৩.১০ জুলসের সোনালি চুলভর্তি মাথা

১০.

জুলসের সোনালি চুলভর্তি মাথা কোলে নিয়ে সুইমিং পুলের ধারে বসে রয়েছে নুসি! জুলসের উপর গভীর স্নেহে অভিভূত হয়েউঠেছে ওর মন। কামনায় উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ওর শরীর। নিজের অজ্ঞাতে জুলসের গলায় হাত বুলাচ্ছে। জুলস ঘুমাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ওর, ভাবছে টের পাচ্ছে না কিছুই। গায়ের সাথে গায়ের ছোঁয়া লাগতেই উত্তেজিত হয়ে উঠছে ও। হঠাৎ ওর কোল থেকে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল জুস, হাত ধরে দাঁড় করাল ওকে। ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে সিমেন্ট বাধানো পথের উপর নিয়ে এল ওকে। নমী মেয়ের মত ওর পিছন পিছন আসছে ও। একটি কটেজে থাকে জুলস, ওর সাথে সেই কটেজে এল লুসি। ভিতরে ঢুকে দুজনের জন্যে দুটো লম্বা, গ্লাসে পানীয় ঢালল জুলস। বাইরের চোখ ঝলসানো রোদ আর নিজের যৌনকামনাময় বাসনার গায়ে পানীয়টুকু যেন আগুন জেলে দিল। মাথা ঘুরছে ওর। ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল জুলস, সাতারের পোশাক পরা প্রায় অনাবৃত শরীরের সাথে শরীর সংলগ্ন হলো। নিচু গলায় বলল লুলি, না.! প্লীজ, না। কিন্তু গলার সুরে তেমন জোর নেই, কান দিল না জুলস। তাড়াতাড়ি ওর অন্তর্বাস খুলে ফেলে ওর বুকে আদর করছে সে, সাঁতারের পোশাক ছাড়িয়ে ওর সারা শরীরে, সুডৌল উদরে, উরুতে চুমু খাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে এবার নিজের সুইম স্যুট ছেড়ে ওকে জড়িয়ে ধরল জুলস। তারপর মিলিত হলো ওরা। এতটুকু স্পর্শ লাগতে না লাগতেই লুসির শরীরে চরম মুহূর্ত উপস্থিত। পরমুহূর্তে জুলসের ভাব-ভঙ্গি থেকে বোঝা গেল, ভারি আশ্চর্য হয়ে গেছে সে! সনিকে পাবার পূর্ব মুহূর্তের সেই লজ্জা আর হীনম্মন্যতা আবার গ্রাস করল লুসিকে। কিন্তু জুলস ওর শরীরটাকে খাটের কিনারায় বিচিত্র কায়দায় ঝুলিয়ে নিয়ে আবার মিলন ঘটাল। ওকে অনেকক্ষণ ধরে চুমো খেলো জুলস। এবার সে-ও পরম তৃপ্তি পেয়েছে।

শরীরের উপর থেকে জুলস নেমে যেতেই খাটের আরেক প্রান্তে সরে গিয়ে শরীরটাকে ছোট করে কাঁদছে লুসি। এ কি বিষম লজ্জা তার। পরমুহূর্তে চমকে উঠল। মৃদু শব্দে হাসছে জুলস। বলল, ওরে বোকা ইতালীয় মেয়ে, এইজন্যেই তাহলে এতদিন অৰীকার করেছ আমাকে! হাঁদা কোথাকার! সস্নেহে হাদা ডাক শুনে ওর দিকে ফিরল নি। ওর নগ্ন শরীর জড়িয়ে ধরে জুলস বলল, স্রেফ সেকেলে, একেবারে মধ্যযুগীয়। ওর কণ্ঠস্বরে গভীর সান্ত্বনা রয়েছে, রয়েছে আশ্বাস, কাঁদতে কাঁদতে সেটা অনুভব করছে লুসি।

একটা সিগারেট ধরাল জুলস, সেটা লুসির ঠোঁটে গুঁজে দিল। ধোয়া খেয়ে কেশে উঠল লুসি, অগত্যা থামাতে হলে কান্নাটাকে। এবার আমার কথা শোনো, বলল জুলস। তুমি যদি আরেকটু আধুনিক হতে, বিংশ শতাব্দীর শিক্ষাদীক্ষা পেতে, তাহলে তোমার এই সমস্যা কোনকালে মিটে যেত। তোমার অসুবিধেটা কোথায়, বুঝিয়ে দিচ্ছি, শোনো। তুমি কুৎসিত, তোমার চামড়া কর্কশ কিংবা তোমার চোখ ট্যারা–এসব তোমার সমস্যা নয়। এসব ত্রুটি পান্টিক সার্জারি দিয়েও সম্পূর্ণ সারানো যায় না। তোমার সমস্যাটা বরং থুতনিতে একটা আঁচিল অথবা মুখের কোথাও একটা জল থাকার মত। কিংবা কানের গঠনে ত্রুটি থাকার মত। এটা একটা খুদে যৌন সমস্যা। দুশ্চিন্তা ছাড়ো। যদি ভেবে থাকো তোমার নিতম্বের আকার বেশি বড় বলে কোন পুরুষ তোমার সাথে সঙ্গমে সুখ পায় না, তাহলে মস্ত ভুল করেছ। গঠনে খানিকটা দোষ যে নেই তা নয়, ডাক্তাররা যাকে বলে নিতম্বের নিচেকার ত্রুটি। সাধারণত সন্তান প্রসবের পর ওরকম হয়ে থাকে, এমনিতে হাড়ের আকৃতির দোষেও হয়। কত মেয়েরই তো অমন থাকে। মহা অসুখী অবস্থায় জীবন কাটায় তারা। অথচ সামান্য একটা অপারেশন করিয়ে নিলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়। জানো তুমি, অনেকে এর জন্যে এমন কি আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। কি বোকা! তোমার এমন আশ্চর্য সুন্দর গড়ন, অথচ তোমারও যে এই সমস্যা থাকতে পারে তা আমি ভাবতেও পারিনি। ভেবেছিলাম, মানসিক কোন ব্যারাম বাধিয়ে বসে আছ। তোমার কাহিনী তো আমার জানা আছে–সনির সাথে সাঙ্ঘাতিকভাবে জড়িয়ে ছিলে। তোমার মুখেও সে-গল্প অনেকবার শুনেছি। এখন যখন সমস্যাটা জানা গেছে, চিন্তার কিছুই নেই তোমার। একবার যদি তোমার শরীরটাকে ভাল করে পরীক্ষা করতে দাও আমাকে, কোথায় কতটা কি করার দরকার হবে তা আমি সাথে সাথে বলে দিতে পারব। এবার যাও, শাওয়ারটা সেরে ফেলো।

শাওয়ার সেরে ফিরে এলো লুসি। আড়ষ্ট ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কোনমতে। রাজ্যের কুণ্ঠা, লজ্জা এসে জড়সড় করে ফেলছে ওকে। জুলস ওর দিকে এগিয়ে আসছে দেখে দ্রুত মাথা নাড়ল ও। বলল, না!

কিন্তু ওর কথায় কান দিল না ডাক্তার। তাই বলে ধমক-ধামক মেরে আরও সন্ত্রস্ত করে তুলল না ওকে। ধৈর্যের সাথে বোঝাল খানিকক্ষণ, তারপর ওর পা দুটো আলগা করে শুইয়ে দিল খাটের উপর। কামরায় একটা অতিরিক্ত ডাক্তারী ব্যাগ রয়েছে। খাটের পাশে রয়েছে কাঁচ দিয়ে ঘেরা ছোট একটা টেবিল, এটার উপরেও কিছু যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তে পেশাদার ডাক্তার বনে গেল জুলস। পরীক্ষা। করছে লুসিকে। ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। ওদিকে লুসির অবস্থা গুরতর, লজ্জায় দম আটকে মারা যায় আর কি। টের পেয়ে ওর নাভির ওপর চুমু খেলো জুলস, আদর করে বলল, কাজ করে এই প্রথম আনন্দ পেলাম আমিই। এরপর আবার পরীক্ষা করল লুসিকে, এবার ওকে উপুড় করে শুইয়ে নিল। মল নিষ্কাশনের ফুটোটা পরীক্ষা করার সময় সির শরীরটা শিউরে শিউরে উঠছে। তাই দেখে রেগে কাই হয়ে গেল জুলস। খুব একচোট বকাবকি করেও যখন কাজ হলো না, তখন আবার সেই আগের পন্থায় ফিরে এলো সে, আদর করতে শুরু করল। সস্নেহে ওর গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

পরীক্ষা শেষ হতে বসিকে আবার সোজা করে শুইয়ে দিল জুলস। ওর ঠোঁটে হালকা চুমু খেয়ে বলল, সোনা মানিক, তুমি দেখো, তোমার এই শরীরটাকে একেবারে নতুন করে গড়ে দেব আমি। তারপর আবার পরীক্ষা করে দেখব–আমি নিজেই। এ-বিষয়ে এটা আমার এই প্রথম ডাক্তারী প্রচেষ্টা। ফলাফল যদি ভাল হয়, ডাক্তারী পত্রিকায় তথ্যবহুল একটা প্রবন্ধ লিখতে পারব।

ইতিমধ্যে কুণ্ঠা আর লজ্জার কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই লুসির মধ্যে। এর জন্যে দায়ী জুলসের সরুল সস্নেহ ব্যবহার। যা কিছু করল আর বলল তার মধ্যে পেশাদারী একটা কর্তব্যের ভাব ছিল, আন্তরিক ভালবাসা ছিল কিন্তু নোংরা কৌতূহল বা যৌনবিকৃতির লক্ষণ ছিল না।

এখন জুলস শেলফ থেকে মোটা একটা বই নামিয়ে লুসির মত আরেকটা কেসের বিবৃতি পড়ে শোনাচ্ছে। এতে অপারেশনের কথাও লেখা রয়েছে। শুনতে শুনতে হঠাৎ আবিষ্কার করুল লুসি, সে-ও ভীষণ কৌতূহলে আক্রান্ত হয়েছে।

শুধু বেঢপ আকৃতি শুধরে নেয়ার জন্যে নয়, বলল জুলস, স্বাস্থ্যের জন্যেও প্রয়োজন রয়েছে এটা। সময় থাকতে ত্রুটিটা সারিয়ে না নিলে পরে তোমার শরীরের সমস্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থায় গোলযোগ দেখা দিতে পারে। অপারেশন করে শুধরে নিতে যত দেরি করা হবে জায়গাটা ততই দুর্বল হয়ে পড়বে। দুঃখের কথা কি জানো? এই ধরনের রোগের চিকিৎসা করা তো দূরের কথা, অনেক ডাক্তার সেকেলে লজ্জা-শরমের জন্যে আসল গলদটা কোথায় তাই ধরতে পারে না। এই একই কারণে বেশির ভাগ মেয়েরাও মুখ ফুটে কিছু বলে না।

এবার তুমি থামবে? মুখটা লাল হয়ে আছে লুসির দোহাই লাগে, অন্য কিছু বলো তুমি।

বুঝতে পারছে জুলস, নিজের বিশ্রী বিকৃতির কথা ভেবে এখনও স্বাভাবিক হতে পারছে না লুসি। ডাক্তারী প্রশিক্ষণ পেয়েছে জুলস, তার কাছে ব্যাপারটা স্রেফ বোকামি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু মনটা তার কোমল, বিরক্ত বোধ করলেও লুসির প্রতি আশ্চর্য একটা সহানুভূতি অনুভব করছে সে। আর এই সহানুভূতিটাই লুসির মন ভাল করে দেবার জন্যে সবচেয়ে বেশি দরকার এখন।

যাই হোক, হাসতে হাসতে বলল জুলস, তোমার গোপন কথাটা জানা হয়ে গেছে আমার। ইচ্ছা হলে আমারটাও এখন শুনতে পারো তুমি।

চুপ করে আছে লুসি, কিন্তু চোখ দুটো কৌতূহলে চিক চিক করছে।

তোমার মুখে তো একটা প্রশ্ন লেগেই আছে, বলল জুলস, আমার মত কম বয়েসী একজন প্রতিভাবান ডাক্তার এই বাজ-পড়া শহরে কেন মরতে এসেছি? নিজের সম্পর্কে খবরের কাগজে প্রকাশিত কয়েকটা বিবৃতি নিয়ে ব্যঙ্গ করল জুলস। তোমার কাছে কিছুই লুকাবার নেই আমার। শোনো তাহলে, আমি একজন গর্ভপাত বিশেষজ্ঞ। কাজটাকে তুমি খারাপ বলতে পারো না, একটু হাসল জুলস। কিন্তু কপাল মন্দ, আমি ধরা পড়ে গেলাম। আমার এক বন্ধু আছে, সেও একজন ডাক্তার, নাম কেনেডি। হাসপাতালে একসাথে চাকরি করতাম আমরা। ঘনিষ্ট বন্ধু কিনা, আমার বিপদ দেখে কথা দিল, কোন না কোন ভাবে সাহায্য করবে আমাকে। যতদূর জানা আছে আমার, টম হেগেন তাকে বলেছিল, কর্লিয়নি.পরিবার তার কাছে ঋণী, কখনও যদি কোন সাহায্যের দরকার হয়, সে যেন ওকে স্মরণ করে। সেই সূত্রেই টম হেগেনের সাথে আমার ব্যাপারে কথা বলল কেনেডি এই ঘটনার পরই শুনলাম, আমার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ তুলে নেয়া হয়েছে কিন্তু। শুধু মেডিকেল এসোসিয়েশন আর পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ আমার নামটা ব্ল্যাকলিস্ট থেকে বাতিল করল না। তার মানে, ওরা আমার খুব একটা উপকার করতে পারল না। তাই শেষ পর্যন্ত, কর্লিয়নি পরিবার এই চাকরিটা দিল আমাকে। খুব ভাল রোজগার করি আমি এখানে। শো-বিজনেসের এইসব বোকা মেয়েগুলো পা পিছলে ফ্যাসাদে পড়ে যায়–সময় মত আমার কাছে এলে ওদের গর্ভপাত ঘটাতে একটুও বেগ পেতে হয় না আমার। চেছে একেবারে কিউরেট করে দিই সব তুমি জানো, ওই ফ্রেডি কর্লিয়নিটি কি রকম সাঙ্ঘাতিক? আমি এখানে আসার পর গোটা পনেরো খেয়েকে বিপদে ফেলেছে ও। তার আগে কি করেছে না করেছে বুঝে নাও। ভাবছি, ওর সাথে একদিন কথা বলতে হবে আমাকে। কিছু জ্ঞান দেব, যা বাপের কালেও শোনননি ও। ভাবতে পারো, তিনবার গনোরিয়া আর একবার সিফিলিস বাধিয়ে আমার কাছে এসেছে চিকিৎসার জন্যে? এমন লম্পট ছোকরা দ্বিতীয়টি দেখিনি আমি।

থামল জুলস। ইচ্ছা করেই গোপন সব কথা ফাস করে দিচ্ছে ও। অথচ কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলা অভ্যাস নয় ওর। কারও দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়াটাকে এক ধরনের অপরাধ বলেই মনে করে ও কিন্তু লুসির মনটাকে হালকা করার জন্যে এই ছোট্ট অপরাধটা করতে হলো ওকে। ওর ইচ্ছা, লুসিও জানুক যে অন্যদেরও এমন কি ফ্রেডি কর্লিয়নির মত লোক, যাদেরকে লুসি শ্রদ্ধা আর ভয় করে, তাদেরও অনেক গোপন, লজ্জাকর ব্যাপার থাকে।

মনে করো তোমার শরীরের একটুকরো ইলাসটিক ঢিলে হয়ে গেছে, বলল জুলস, ওটার খানিকটা কেটে বাদ দিলেই আঁটো হয়ে যাবে আবার।

ঠিক আছে, কি করব না করব ভেবে দেখা যাবে পরে, বলল নৃসি. অপারেশন করাবেই, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ও। ওর মনে জুলস সম্পর্কে অগাধ বিশ্বাস জন্মে গেছে। কিন্তু হঠাৎ আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল ওর। জানতে চাইল, কি রকম খরচ পড়বে?

এ-ধরনের অপারেশন করার মত যন্ত্রপাতি তো এখানে নেই, ভুরু কুঁচকে, চিন্তিতভাবে বলল জুলস, তাছাড়া এ-বিষয়ে বিশেষজ্ঞও নই আমি। তবে আমার এক বন্ধু আছে লস এঞ্জেলেসে, ঠিক এই বিষয়েই একজন বিশেষজ্ঞ সে। ওখানকার সবচেয়ে ভাল হাসপাতালে ভর্তিও করে দিতে পারবে তোমাকে। সমস্ত চিত্রতারকাদের শরীর ওই তত আঁটসাট করে দেয়। মুখের আর বুকের চামড়া টেনে তুলে সেলাই করিয়ে নেবার পরও এই সব মহিলারা যখন দেখেন যে পুরুষরা তাদেরকে যথেষ্ট ভালবাসছে না তখন তারা আমার ওই বন্ধুর কাছে আসে। অপারেশনে দারুণ হাত তার, সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি একেবারে নিখুঁতভাবে সারিয়ে দেয়। কোন একটা ব্যাপারে আমার কাছে একটু ঋণী ও••• তোমার কাছে স্বীকার করতে আপত্তি নেই, ওর গর্ভপাতের কেসগুলো আমিই করে দিই। দেখো, লুসি, নীতির বাধা না থাকলে তোমাকে এমন বেশ কয়েকজন চিত্র-সম্রাজ্ঞীর কথা এই মুহূর্তে বাতে পারতাম যারা এই অপারেশন করিয়েছে।

আমাকে তুমি অনায়াসে বলতে পারো, মেয়েলি কৌতূহলে চিকচিক করে, উঠল লুসির চোখ দুটো। আমি কি আর কাউকে বলতে যাচ্ছি! জুলসের সামনে একটু না হয় পরচর্চা করা যেতে পারে, ভাবছে লুসি, তাই নিয়ে ও তো আর ব্যঙ্গ করবে না।

বলতে পারি, মৃদু হেসে বলল জুলস, একশর্তে।

 কি শর্ত?

ডিনার খেয়ে আজ রাতটা আমার সাথে কাটাবে তুমি, বলল জুল তোমার বোকামির জন্যে অনেকদিন ধরে আমরা বঞ্চিত হয়েছি অনেক দুঃখ আর ক্ষোভ জমা হয়ে আছে তোমার শরীর আর মনে, সেগুলো পূরণ হওয়া দরকার। এমন আশ্চর্য সহানুভূতি আর আন্তরিকতার সাথে কথাগুলো বলল জুলস যে নিমেষে অভিভূত হয়ে পড়ল লুসি।

একটা ঢোক গিলল লুসি, কোনমতে বলল, অনেক দোষ-ত্রুটি আছে আমার, তুমি মোটেও আনন্দ পাবে না।

কি বোকা মেয়ে রে বাবা! হেসে ফেলল জলস। প্রেম করার যে আরও কত উপায় আছে তাও জানো না তুমি? আরও প্রাচীন, কিন্তু আরও সভ্য?

ও, বুঝতে পারার ভঙ্গিতে ছোট করে মাথা নেড়ে চোখ নামাল লুসি, ওটার কথা বলছ তুমি।

হ্যাঁ, লুসির কণ্ঠস্বর নকল করে ভেঙচাল জুলস, ওটার কথা বলছি আমি। আজকাল ভাল মেয়েরা ওটা করে না, তেজী ঘোড়ার মত পুরুষরাও ওটা পছন্দ করে না–এমন একটা আশ্চর্য পদ্ধতি, যার সমস্ত দিকই ভাল আর বিজ্ঞান-সম্মত, অথচ এই উনিশশো আটচল্লিশ সালেও এর প্রচলন নেই বললেই চলে। কিন্তু আমি এই লাস ভেগাসেরই এক থুড়থুড়ে বুড়ির কাছে নিয়ে যেতে পারি তোমাকে, একসময় এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত বেশ্যাবাড়ির সবচেয়ে কমবয়েসী মানী ছিল সে, ওয়াইল্ড ওয়েস্টের সেই উন্মাদ যুগে, সম্ভবত আঠারোশো আশি সালের দিকে। সে-যুগের গল্প বলতে ভালবাসে বুড়ি। তার গল্প শুনলে বিস্ময়ে মাথা ঘুরে যাবে তোমার জানো, আমাকে কি বলেছে সে? পৌরুষের প্রতীক, আগ্নেয়াস্ত্রধারী, দুঃসাহসী সেই যুগের পুরুষেরা, যাদেরকে কাউ বয় বলি আমরা, তারাও নাকি বেশ্যা পাড়ায় এসে মেয়েদের কাছে এই ফ্রেঞ্চ পদ্ধতির জন্যে অনুরোধ করত। ডাক্তাররা এটাকে ফেলাশিও বলে। তোমার প্রিয় সনির সাথে এসব হয়েছে কখনও?

এই প্রথম জুলসকে বিস্মিত করল লুসি। হঠাৎ হাসল সে, তাই দেখে সর্বশরীর শিহরিত হলো জুলসের। বিদ্যুৎচমকের মত আবিষ্কার এবং উপলব্ধি করল জুলস, হাসিটা হুবহু মোনালিসার ছবির মত। সাথে সাথে জুলসের বিজ্ঞান-সচেতন মন অন্য খাতে বইতে শুরু করল-মোনালিসার হাসির এই কি তবে রহস্য? তবে কি শতাধিক বছরের রহস্য উদঘাটিত হলো আজ?

সনির সাথে? মৃদু, চাপা গলায় বলল লুসি, সনির সাথে সব করেছি আমি। এমন খোলাখুলিভাবে এই প্রথম কারও কাছে কথাটা স্বীকার করল সে।

.

দুই হপ্তা পরের ঘটনা।

লুসির অপারেশন হচ্ছে। ডাক্তার জুলস সীগল উপস্থিত রয়েছে অপারেশন থিয়েটারে। অপারেশন করছেন তার বন্ধু ডাক্তার কেলনার।

ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করার আগে লুসির কানে কানে বলল জুলস, ডাক্তার তোমার চারদিকটা খুব ভাল করে এঁটে দেবে। তুমি আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, সে কথা ওকে বলেছি কিনা। তবে, এরই মধ্যে ঘুম পাড়াবার প্রাথমিক ওষুধ খেয়ে উদ্ৰামত এসে গেছে লুসির, তাই হাসতে পারছে না সে। কিন্তু রসিকতাটায় ভাল কাজ হলো, অপারেশনের ভয় বেশ একটু কমে গেল তার।

নিতম্বের ঝুল কমানোকে ডাক্তারী ভাষায় বলা হয় পেরিন কোরাফি আর যোনির দেয়াল সেলাই করাকে বলা হয় কল্পোরাফি। ডাক্তার কেলনার আত্মপ্রত্যয়ের সাথে ছুরি বসাল। পেশীর ঝুল কমিয়ে যোনি-মুখ সামনের দিকে সরিয়ে আনা, এই দুটো কাজ করতে হয় ডাক্তারকে নিতম্বের তলদেশ শক্ত করার জন্যে। এতে উপর থেকে বেশি চাপ পড়ার সম্ভবনা থাকে না।

লক্ষ করল জুলস, খুব সাবধানে কাজ করছে এখন ডাক্তার। ছুরি চালাবার ঝুঁকিটা হলো, একটু বেশি কাটা হয়ে গেলেই মলদ্বার পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তবে, কেসটা একটুও জটিল নয়। এক্সরে প্লেট আর অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফল দেখেছে জুলস। কোন বিপদ হবার কথা নয়। কিন্তু, সেই সাথে এ-কথাও সত্যি যে কাটাছেঁড়ার ব্যাপারে সব সময়ই আশঙ্কা থাকে। জোর করে কিছুই বলা যায় না।

ডায়াফ্রাম স্লিং-এর উপর কাজ করছে এখন কেলনার। যোনির খোপ ধরা রয়েছে টি-ফসেঁপের সাহায্যে, তাতে পেশী অ্যানি আর ফ্যাসি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এই পেশী দুটোই যোনির খোপ হিসেবে চিহ্নিত। গজ দিয়ে মোড়া ডাক্তার কেলনারের আঙুলগুলো মধ্যবর্তী সংযোগ রক্ষাকারী ঢিলা টিসুগুলো একপাশে সরিয়ে দিচ্ছে। যোনির দেয়ালের উপর চোখ রয়েছে ডাক্তার জুলসের, ওখানে কোন শিরা দেখা গেলেই বুঝতে হবে মলদ্বার আহত, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নিজের কাজে সাঙ্ঘাতিক দক্ষ ডাক্তার কেলনার, কাজে কোথাও এতটুকু খুত নেই তার। নিপুণ দক্ষতার সাথে ছুতোর যেভাবে পেরেক দিয়ে কাঠ জোড়া দেয় ঠিক সেভাবে লুসির শরীরে নতুন অংশ জুড়ে দিচ্ছে সে।

যোনির দেয়ালের বাইরে সমস্ত বাড়তি অংশ ছেটে ফেলে দিচ্ছে কেলনার। কেটে বাদ দেয়া জায়গাটুকু সেলাই করে এমনভাবে জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে পরে যাতে সেখানে খোঁচখাঁচ না গজাতে পারে। যোনির মুখ এখন ছোট হয়ে গেছে। প্রথমে সেটার ভিতরে তিনটে আঙুল ঢোকাবার চেষ্টা চালাল কেলনার। কিন্তু পারল না। এরপর দুটো আঙুল ঢোকাবার চেষ্টা করল সে। আঙুল দুটো কোন মতে ঢুকল ভিতরে! অন্দরমহলটা ভাল করে একবার নেড়েচেড়ে দেখে নিল সে। তারপর মুহূর্তের জন্যে জুলসের দিকে একবার তাকাল, গজ দিয়ে তৈরি মুখোশের উপর নেচে উঠল উজ্জল নীল চোখ দুটো, যেন জুলসের মতামত চাইছে, গর্তটা যথেষ্ট সরু হলো কিনা। পর মূহর্তে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

নির্বিঘ্নে শেষ হলো কাজটা। ট্রলি করে নিয়ে যাওয়া হলো লুসিকে রিকভারি রুমে, এখন থেকে ওখানেই থাকবে সে, যতদিন না সুস্থ হয়ে ওঠে। ডাক্তার কেলনারের সাথে কথা বলছে জুলস। ডাক্তারকে মহা খুশি দেখে বুঝতে পারছে সে, অপারেশন সফল হয়েছে, কোথাও কোন গোলমাল নেই। জুলসকে বলল সে, কোন দুশ্চিন্তা নেই। পানির মত সহজ কেস, ভেতরেও কিছু গজাচ্ছে না শরীরের বাঁধুনিটা চমৎকার, এ-ধরনের কেসে সাধারণত যা দেখা যায় না। মুচকি হাসল কেলনার। ফুর্তি করার এখন আর কোন অসুবিধেই রইল না-বুঝলে, তোমার ভাগ্যকে ঈর্ষা করি আমি। তবে কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু, দেখো, শেষ পর্যন্ত আমার কাজের প্রশংসা না করে পারবে না তুমি।

তুমি একটা পিগমেলিয়ান ডাক্তার, সহাস্যে বলল জুলস। সত্যি জাদু জানো

এ আবার একটা কাজ নাকি? গভীরভাবে বলল ডাক্তার কেলনার। তোমার গর্ভপাতের কেসগুলো যেমন, এটাও সেরকম-পানির মত সহজ ব্যাপার। একটু থেমে আরও গম্ভীর হলো ডাক্তার। সমাজটা যদি আরেকটু আধুনিক হত, এখানের লোকজনের যদি আরেকটু বাস্তব-বুদ্ধি থাকত, হাতুড়েদের জন্যে এসব কাজ ছেড়ে দিয়ে তুমি আর আমি সত্যিকার গুরুত্বপূর্ণ কাজে মন দিতে পারতাম। কাঁধ ঝাঁকাল সে। ওহে শোনো, মনে পড়ে গেছে কথাটা, আগামী হপ্তায় আমার একটা কাজ করে দিতে হবে তোমাকে। একটা মেয়ে পাঠাব। খুব ভাল একটা মেয়ে। জানোই তো, ভাল মেয়েগুলোই শুধু বিপদে পড়ে। ওর সমস্যাটা মিটিয়ে দিলেই আজকের ব্যাপারটা শোধবোধ, কেমন?

ঠিক আছে, ডাক্তার কেলনারের সাথে হ্যান্ডশেক করে জুলস বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ, ডাক্তার। কতবার তো বললাম, কই, এলে তো না আমাদের ওখানে বেড়াতে! একবার এসো না? আসবে? জুয়া খেলা থেকে শুরু করে সব কিছু ফ্রি তোমার জন্যে–আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখব না।

ঠোঁট বাকা করে হাসল ডাক্তার কেলনার। জুয়া তো আমি রোজ খেলি। কিন্তু সে জুয়া খেলতে তোমাদের রুলেত সার্কেল আর ক্রাপ টেবিলের দরকার হয় না। ও-ধরনের জুয়া না খেলেও ভাগ্যের সাথে মাথা ঠোকাঠুকি কম করতে হয় না আমাকে। একটা কথা, জুলস! তুমি ওখানে আসলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছ। আরও দুএকটা বছর গেলে সত্যিকার সার্জারি কাকে বলে তাই ভুলে যাবে তুমি। কথা শেষ করেই বাক নিল ডাক্তার, জলসের জবাব শোনার জন্যে অপেক্ষা পর্যন্ত করল না।

ডাক্তার কেলনারের কথায় অভিযোগ নেই, জানে জুলস। সে শুধু তার শুভানুধ্যায়ী হিসেবে তাকে সাবধান করে দেবার জন্যে কথাগুলো বলল। তাসত্তেও, সাঙ্ঘাতিক খারাপ হয়ে গেল মনটা। কমপক্ষে আরও বারো ঘণ্টা পর রিকভারি রুম থেকে বেরুবে লুসি। অগত্যা গোটা সন্ধ্যাটা হৈচৈ করে কাটাল সে। প্রচুর মদও খেলো। এর কারণ নৈরাশ নয়, আনন্দ। লুসির অপারেশনটা ভালয় ভালয় চুকে গেছে বলে ভীষণ খুশি হয়েছে ডাক্তার জুলস।

.

পরদিন। সকাল।

লুসিকে হাসপাতালে দেখতে এসে আশ্চর্য হয়েগেল জুলস। ফুলে ফুলে ভরে আছে কেবিনটা লুসির বেডের কিনারায় বসে রয়েছে দুজন লোক লুসিও বালিশে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে, উজ্জল হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ।

জুলস জানে, বাড়ির লোকদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে লুসির। তাকে জানিয়েছিল ও, তাদেরকে কোন খবর দেবার দরকার নেই। তবে খুব যদি বিপদ দেখা দেয়, শেষ মুহূর্তে খবর তো দিতেই হবে। যাই হোক, বাড়াবাড়ি কিছু ঘটেনি, তাই লসির বাড়িতেও খবর দেয়া হয়নি। জানার মধ্যে জানে শুধু ফ্রেডি কর্লিয়নি। তাকে বলা হয়েছে, ছোট্ট একটা অপারেশনের জন্যে হাসপালে ভর্তি হয়েছে লুনি ফ্রেডিকেও বলা হত না, যদি না ওদের দুজনেরই ছুটির দরকার হত। কথাটা শুনে ফ্রেডি জানিয়েছে, অপারেশনের যাবতীয় খরচ হোটেলের তহবিল থেকেই মিটিয়ে দেয়া হবে।

লোক দুজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল লুসি। সাথে সাথে একজনকে চিনতে পারল জুলস। লোকটা হলো সেই বিখ্যাত গাইয়ে, ইদানীং যে অভিনয় করে খুব নাম করেছে। জনি ফন্টেন। তার সাথের লোকটা প্রকাণ্ডদেহী, ভোতা চেহারার একজন ইতালীয়। নাম নিনো ভ্যালেন্টি। পরিচয় করিয়ে দেবার সময় ওরা দুজনেই জুলসের করমর্দন করল, কিন্তু পরমুহূর্ত থেকে ওরা আর তার দিকে ফিরেও তাকাল না। লুসির সাথে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছে ওরা। নিউ ইয়র্কে ফেলে আসা পুরানো দিনের গল্প করছে। অজানা-অচেনা ঘটনা আর লোকজন সম্পর্কে কথা বলছে, যার সাথে কোন সম্পর্ক নেই জুলসের।

পরে আসব আমি, লুসিকে বলল জুলস। ডাক্তার কেলনারের সাথে দেখা করার কাজটা সেরে ফেলি আগে।

এতক্ষণে ওর দিকে নজর দিল জনি ফন্টেন। তার আচরণে মাধুর্য ফুটে উঠল এই যে, ভাই, একটু থামুন। পালাবার সময় হয়ে গেছে আমাদের, আপনিই এখন সঙ্গ দেবেন লুসিকে। একটা কথা, বড় আদরের আর পুরানো সাথী ও আমাদের, ওর যত্ন নিতে যেন ভুল করবেন না, ডাক্তার।

জনি ফন্টেনের কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন কর্কশ, কানে বাজল জলসের। গলা ভেঙে গেলে যেমন হয়, অনেকটা সেই রকম। পরমুহূর্তে মনে পড়ে গেল, প্রকাশ্যে এক বছরের উপর গান গায়নি লোকটা। এই বয়সে তবে কি গলা ভেঙেছে লোকটার? কিন্তু তা যদি হয়, খবরের কাগজে ব্যাপারটা নিয়ে লেখালেখি হয়নি কেন? তারা চেপে গেছে? সবাই চেপে গেছে? মনটা খুঁতখত করছে জুলসের। ওর মধ্যে কৌতূহলী একটা স্বভাব আছে, কোথাও কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখলেই কারণ অনুসন্ধানের জন্যে হন্যে হয়ে ওঠে। কান পেতে আছে ও, জনির গলার আওয়াজ গভীর মনোযোগের সাথে শুনছে। আশা, ত্রুটিটা যদি ধরতে পারে। মনে পড়ছে, গান গেয়ে নয়, অভিনয় করে অস্কার পেয়েছে লোকটা! অথচ গানের জন্যে পুরস্কারটা পেলে বেশি মানাত। অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুন গলার এই অবস্থা হতে পারে, ভাবছে জুলস। অথবা প্রচুর ধূমপান আর ধুমসে মদ গিললে এমন করুণ অবস্থা হওয়া বিচিত্র নয়। আবার মেয়েমানুষের শরীর নিয়ে খুব বেশি ঘাটাঘাটিও এর কারণ হতে পারে। গলাটা বসে গেছে, কেমন যেন বিশ্রী একটা কণ্ঠস্বর–আর যাই হোক, লোকটাকে এখন আর কেউ মধুর গাইয়ে বলবে না।

কিছু যদি মনে না করেন, মদু কণ্ঠেবলল জুলস, আপনার কি সর্দি লেগেছে?

ভদ্রতার সাথেই জবাব দিল ফন্টেন, সর্দি? আরে না। স্রেফ অতিরিক্ত খাটাখাটনির ফল, কাল রাতে গাইবার চেষ্টা করেছিলাম কিনা। কি জানেন, গলাটা যে আমার বদলে গেছে তা আমি কোনমতে মেনে নিতে পারছি না। বুড়ো হচ্ছি, গলা তো বদলাবেই। কিছুতেই কিছু এসে যায় না, এই রকম একটা ভঙ্গি করে নিঃশব্দে হাসল জনি।

ডাক্তার দেখিয়েছেন? হালকা সুরে জানতে চাইল জলস। আপনি যা ভাবছেন হয়তো নয়, হয়তো সামান্য একটু অসুখ, সারানো যায়।

জুলসের সাথে এবার আর মিষ্টি ব্যবহার করল না জুনি ফন্টেন। ঠাণ্ডা চোখে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বলল সে, গলাটা যখন ভাঙে, আজ থেকে দুবছর আগে, সবচেয়ে আগে তাই করেছিলাম, কয়েকজন ডাক্তারকেই দেখিয়েছিলাম। তারা সবাই দেশের সেরা ডাক্তার, হাতুড়ে নয়। আমার ব্যক্তিগত ডাক্তারকেও তো সবাই শ্রেষ্ঠ একজন বিশেষজ্ঞ বলে মনে করে। তারা সবাই একবাক্যে জানিয়েছে, বিশ্রাম নিতে হবে। এর জন্যে বয়স দায়ী। বয়স হলে মানুষের কণ্ঠস্বর তো বদলাবেই।

কথা শেষ করে মুখ ফিরিয়ে নিল জনি, দ্বিতীয়বার আর ফিরেও তাকাল না জুলসের দিকে। লুসির দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা মস্করায় মেতে উঠল সে, সব মেয়ের সাথেই যেমন করে। অনর্গল কথা বলছে, আর তার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে নছে জুলস। ভাবছে লোকটার স্বরতন্ত্রীতে নিশ্চয়ই কিছু একটা গজিয়েছে, তা না হয়েই যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশেষজ্ঞরা সেটা ধরতে পারেনি কেন? একটা আশঙ্কা দেখা দিল জুলসের মনে–যা গজিয়েছে সেটা কি তবে ম্যালিগন্যান্ট? অপারেশনের বাইরে? তা যদি হয়ও, তারও তো আরেক ধরনের চিকিৎসা আছে।

লুসির সাথে কথা বলতে মগ্ন হয়ে আছে জনি ফন্টেন, তাকে বাধা দিয়ে বলল জুলস, আপনার গলা শেষবার কবে পরীক্ষা করিয়েছেন?

চেহারা দেখেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, জুলসের উপর মহা বিরক্ত হয়েছে জনি। কিন্তু লুসির বন্ধু জুলস, তাই ভদ্রতা বজায় না রেখেও পারছে না। ঠাণ্ডা গলায় বলল, মাস আঠারো আগে।

আপনার ব্যক্তিগত ডাক্তারকে দিয়ে মাঝে মধ্যে পরীক্ষা করান না? জানতে চাইল জুলস। সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয় সে।

এবার কণ্ঠস্বরে অসন্তোষ প্রকাশ পেল জনি ফন্টেনের। একটু ব্যঙ্গের সুরে বলল সে, করাই বৈকি। প্রত্যেকবার কোডিন স্প্রে লাগিয়ে ভাগিয়ে দেন। কোন প্রশ্ন করলে বলেন, আগেই তো জানিয়েছি, স্বরযুটার বয়স বাড়ছে। তাছাড়া, অতিরিক্ত মদ, সিগারেট এসব তো আছেই। জুলসের দিকে তীব্র দৃষ্টি হানল জনি। আপনি বোধহয় আরও ভাল একজন ডাক্তার, তারচেয়েও বেশি বোঝেন?

তার নামটা জানতে পারি? খোঁচাটা গায়ে না মেখে প্রশ্ন করল জুলস।

টাকার, গর্বের সুরে বলল জনি, ড. জেমস টাকার। তাঁর সম্পর্কে কি ধারণা আপনার?

টাকার নামটা পরিচিত জুলসের। যতসব নামকরা ফিল্ম স্টারদের চিকিৎসা করে, তাছাড়া বিখ্যাত একটা স্যানাটোরিয়ামের সাথে জড়িত। এক গাল হাসল জুলস, বলল, খুব সাজগোজ করেন ভদ্রলোক।

কি বলতে চান আপনি? এবার সত্যি সত্যি খেপে গেছে জনি আপনি কি নিজেকে তার চেয়ে বড় ডাক্তার বলে মনে করেন?

হেসে ফেলে পাল্টা প্রশ্ন করল জুলস, আপনি কি নিজেকে কারমেন লম্বার্ডোর চেয়ে বড় গাইয়ে বলে মনে করেন?

জুলসের প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে উঠে চেয়ারে মাথা ঠুকতে শুরু করল নিনো ভ্যালেন্টি, তাই দেখে জুলস তো অবাক। সে ভাবছে, রসিকতা এমন কিছু ভাল হয়নি। নিনো ভ্যালেন্টির অট্টহাসির সাথে মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে, নাকে ধাক্কা লাগতেই জুলস বুঝল, যে-ই হোক না কেন, এই সাত সকালেই নেশায় প্রায় আধা-বেহুশ হয়ে আছে লোকটা।

এই ব্যাটা, বন্ধুর দিকে ফিরে হাসছে জনি ফন্টেন। তুই তো আমার রসিকতা শুনে হাসবি, ওরটা শুনে হাসছিস কি মনে করে?

হাত বাড়িয়ে ইতিমধ্যে বেডের কাছে জুলসকে টেনে নিয়ে এসেছে লুসি।

জনি আর নিনোকে বলছে সে, দেখতে ডাক্তার যাই হোক, হয়তো আনাড়ি বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বাস করো, ও কিন্তু প্রতিভাবান একজন সার্জেন। বাজে কথা বলার লোক নয়। যদি দাবি করে যে ডাক্তার টাকারের চেয়ে ভাল ও, তাহলে নিশ্চয়ই সেটাই সত্যি কথা, এর মধ্যে বড়াই থাকতে পারে না। জনির দিকে আবেদনের দৃষ্টিতে তাকাল ও। জুলসের কথা একবার শুনেই দেখো না। ও হয়তো তোমার গলার ত্রুটিটা সারিয়ে দিতে পারবে, জনি।

এই সময় কেবিনে একজন নার্স ঢুকে ওদেরকে জানাল, লুসিকে দেখার জন্যে আবাসিক ডাক্তার আসবেন, এবার সবাইকে চলে যেতে হয়। একটা কাণ্ড লক্ষ করে বেদম হাসি পেল জুলসের। জনি ফন্টেন আর নিনো ভ্যালেন্টি চুমো খাচ্ছে লুসিকে, কিন্তু লুসি ঠিক সময় মত এমন ভাবে মুখটা ঘুরিয়ে নিল, যাতে চুমোলো গালে লাগে, ঠোঁটে নয় অবশ্য, দেখে মনে হলো লুসির কাছ থেকে তাই আশা করেছিল তারা। তবে, জুলসকে কিন্তু ঠোঁটেই চুমো খেতে দিল লুসি। বিকেলে কিন্তু আবার আমাকে দেখতে আসতে হবে, ফিসফিস করে জুলসের কানে কানে বলল সে, মনে থাকবে তো?

মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হলো জুলস।

 বাইরের করিডরে বেরিয়ে এল ওরা তিনজন।

কি অপারেশন হয়েছে ওর? জানতে চাইল নিনো ভ্যালেন্টি। জটিল কোন ব্যাপার নাকি, ডাক্তার?

এদিক ওদিকে মাথা নাড়ল জুলস। মেয়েলি ব্যাপার। জটিল কিছু নয়, নিতান্ত সাধারণ একটা অপারেশন। এ-বিষয়ে আপনাদের চেয়ে আমার দুর্ভাবনা বেশি। আশা করছি, লুসিকে আমি বিয়ে করব।

জুলস লক্ষ করল, জনি ফন্টেন আর নিনো ভ্যালেন্টির চোখে সংশয় ফুটে উঠল। লুসি হাসপাতালে তা আপনারা জানলেন কিভাবে?

টেলিফোন করে ফ্রেডি জানিয়েছে আমাদেরকে, বলল জনি। ছোটবেলায় আমরা সবাই এক পাড়াতেই বড় হয়েছি কিনা। ফ্রেডির বোন কনির বিয়েতে নীত কনে হয়েছিল লুসি।

তাই নাকি! বলল জুলস। এসব তথ্য যে নতুন নয় ওর কাছে তা আর প্রকাশ করল না ভাবছে, লুসির সাথে সনির সম্পর্কটা ওরাও হয়তো তার কাছে গোপন করতে চাইছে।

করিডর ধরে হাঁটছে ওরা। এই হাসপাতালে একজন ভিজিটিং ডাক্তারের সুবিধে ভোগ করি আমি, জনি ফন্টেনকে বলল জুলস, কিছু যদি মনে করেন, আপনার গলাটা একবার পরীক্ষা করতে দেবেন আমাকে?

দ্রুত এদিক ওদিক মাথা নাড়ল জনি। বলল, মাফ করবেন, আজ আমার সময় হবে না।

এটা কি সস্তা কোন লোকের গলা? ওই গলার দাম লক্ষকোটি টাকা। দেখাতে যদি হয়ই, আজেবাজে একজন ডাক্তারকে দেখাবে কেন? বলল নিনো। ভ্যালেন্টি। হাসছে সে। তার ওই হাসি দেখেই বুঝে নিল জুলস, লোকটা তার দলে, তাকেই সমর্থন করছে।

ডাক্তার হিসেবে আমি কিন্তু আজেবাজে নই, সহাস্যে বলল জুলস। পুব তীরে আমিই তো একমাত্র প্রতিভাবান সার্জেন ছিলাম। একটা গর্ভপাতের কেসে ধরা পড়ে গিয়েই না আজ আমার এই দশা।

যেমনটি আশা করেছিল জুলস, ঠিক তাই ঘটল। ওর কথার মূল্য দিল জনি ফন্টেন আর নিনো ভ্যালেন্টি। নিজের অপরাধ সাধারণত কেউ স্বীকার করে না। ও করেছে দেখে ওর সম্পর্কে ওদের ধারণা পাল্টে গেল মুহূর্তে! দ্রুত নিজেকে সামলে নিল প্রথমে নিনো ভ্যালেন্টি।

আপনার চিকিৎসা জনি যদি না চায়, বলল নিনো, তাতে আপনার মন খারাপ করার কিছু নেই। আমার এক বান্ধবী আছে, আপনি তাকে একবার দেখুন। তবে, নাটকীয়ভাবে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে তারপর বলল নিনো, গলার দিকটা নয়!

পরীক্ষা করতে কতক্ষণ সময় নেবেন আপনি? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল জনি ফন্টেন।

মিনিট দশেক, মিথ্যে কথা বলল জুলস। এ-ধরনের মিথ্যে কথা হর-হামেশা বলে থাকে ও। ওর বিশ্বাস, ডাক্তারী পেশার সাথে সত্যবাদিতা মানায় না, ও বিশেষ সংকটাপন্ন অবস্থা ছাড়া–এবং তখনও সত্য প্রকাশ করা সাজে কিনা সন্দেহ আছে জুলসের মনে।

ঠিক আছে, চাপা কর্কশ গলায় বলল জনি ফন্টেন। ভয় পেয়েছে সে, তাই আরও খারাপ শোনাল গলাটা।

একজন নার্স আর একটা কনসালটিং রুমের ব্যবস্থা করে ফেলল জুলস। পরীক্ষার জন্যে যা যা দরকার:তার সবগুলো এখানে নেই বটে, কিন্তু যা আছে তা দিয়েও চমৎকার কাজ চলে যাবে। জুলসের সন্দেহই সত্যি প্রমাণিত হলো। জনি ফন্টেনের স্বরতন্ত্রীতে কিছু একটা গজিয়েছে, মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে তা আবিষ্কার করা গেল। পানির মত সহজ একটা কাজ। ওই ব্যাটা টাকারেরই ধরতে পারার কথা, কিন্তু সাজগোজ করে হলিউডি চালচলন রপ্ত করতেই তার সময় বয়ে যায়, রোগীদের পিছনে খরচ করার মত সময় কোথায় তার। মাই গড, ভাবছে জুলস, হারামজাদার হয়তো ডাক্তারী লাইসেন্সই নেই, আর থাকলেও জাল না হয়েই যায় না, সুতরাং অনতিবিলম্বে কেড়ে নেয়া দরকার সেটা। নিনো আর অনির দিকে এখন আর ফিরেও তাকাচ্ছে না জুলস। এই হাসপাতালের গলা বিশেষজ্ঞকে ফোনে ডেকে পাঠাল সে। তারপর ধীরে ধীরে ফিরল নিনো ভ্যালেন্টির দিকে। বল, মি. জনি ফন্টেনকে বেশ কিছুক্ষণ এখানে থাকতে হবে বলে মনে হচ্ছে। আপনি বরং চলে যান।

এক নিমেষে খেপে উঠল জনি। অ্যাই, শয়তানের হাড্ডি! কি ভেবেছ তুমি আমাকে, অ্যাঁ? ভেবেছ আমাকে এখানে আটকে রেখে তুমি আমার গলা ঘাটাঘাটি করবে? এক্সপেরিমেন্ট চালাবে?

জনি ফন্টেনের অপমানকর আচরণেও মুখের হাসি এতটুকু মান হলো না জুলসের। আনন্দে ডগমগ করছে সে এত আনন্দ পাবে, তা সে নিজেও কল্পনা করেনি–পরিষ্কার করে ওকে জানিয়ে দিল, আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে যাচ্ছি না আমি। যা খুশি করতে পারেন আপনি। এখান থেকে আপনি চলে যেতে পারেন, তাতে আমি বাদ সাধব না। যাবার আগে শুধু জেনে যান, আপনার স্বরতন্ত্রীতে কিছু একটা গজিয়েছে। তার মানে, আপনার বাগযন্ত্রে। জিনিসটা কি, ক্যানসার নাকি অন্য কিছু তা জানতে হলে এখানে কিছুক্ষণ থাকতে হবে আপনাকে। ক্যানসার হোক বা না হোক, জিনিসটা সরাবার জন্যে অপারেশনের দরকার নাকি শুধু ওষুধপত্র দিয়ে কাজ হবে, তাও পরিষ্কার জানা যাবে। একটু থেমে আবার বলল জুস, অনেকগুলো রাস্তা খোলা রয়েছে আপনার সামনে, যেকোন একটা বেছে নিতে পারেন আপনি। গরজ থাকলে নিজেকে আমার হাতে ছেড়ে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে, আমেরিকার শ্রেষ্ঠ একজন বিশেষজ্ঞ ডাকা যেতে পারে–যদি আপনি খরচ দেন আর আমি দরকার বলে মনে করি। ভদ্রলোক আমার অনুরোধ পেলে আপনাকে দেখার জন্যে প্লেনে চড়ে এখানে চলে আসবেন। অথবা আপনি এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যেতে পারেন, গিয়ে আপনার সেই ব্যক্তিগত হাতুড়ের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে পারেন। কিংবা, দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আর কাউকে দেখাতে পারেন ওরা হয়তো অক্ষম আর কারও কাছে পাঠাবে। আপনাকে। ওটা যদি সত্যি ক্যানসার হয়, ততদিনে আরও বেড়ে যাবে, তখন ওরা আপনার গোটা বাগযন্ত্রটাই কেটে ফেলে দেবার পরামর্শ দেবে, বলবে, তা নাহলে আপনি মারা যাবেন। আরেক কাজ করতে পারেন আপনি। সোজা বাড়ি ফিরে গিয়ে চুপচাপ বসে স্রেফ দরদর করে ঘামতে পারেন। আমার পরামর্শ যদি শোনেন, দয়া করে এখানেই থেকে যান। কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র। সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কি হয়েছে না হয়েছে নিশ্চিতভাবে জানতে পারবেন। একটু থেমে মৃদু হেসে জানতে চাইল জুলস, কোথাও খুব জরুরী কোন কাজ আছে বুঝি আপনার?

দরকার নেই বাবা আর কোথাও গিয়ে, বলল নিনো, জনি, এত করে যখন বলছেন উনি, পরীক্ষাটা করিয়েই নে, বাবা হলরুম থেকে স্টুডিওতে ফোন করে দিচ্ছি আমি। কাউকে কিছু জানাচ্ছি না, শুধু বলব ফিরতে একটু দেরি হবে আমাদের। জনিকে প্রতিবাদের কোন সুযোগ না দিয়ে দ্রুত চলে গেল নিনো ফোন করতে।

লম্বা দুপুর, কাটতেই চায় না। কিন্তু শেষমেষ কাজ হলো বৈকি। রোগটা কি তা নির্ভুলভাবে ধরতে পারলেন হাসপাতালের গলাবিশেষজ্ঞ এক্সরে, সোয়াব ইত্যাদি বিশ্লেষণ-এর রিপোর্ট দেখে রোগটা সম্পর্কে জুসেরও পরিষ্কার একটা ধারণা জন্মাল।

পরীক্ষার সময় যথেষ্ট অসহযোগিতা করল জনি ফস্টেন। ঠোঁটের কোণ বেয়ে আয়োডিন গড়িয়ে পড়ছে, মুখ ভর্তি গজের রোল, ওয়াক ওয়াক করে বমির আওয়াজ তুলতে তুলতে মাঝপথে উঠে যেতে চাইল সে দুই কাধ চেপে ধরে জোর করে ওকে বসিয়ে রাখল নিনো। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। জনি ফন্টেনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে জুলস, বলল, আঁচিল।

ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতেই পারল না জনি। কয়েকটা আঁচিলের মত হয়েছে, বুঝিয়ে দেবার জন্যে আবার বলল জুলন, বড সসেজের ছাল ছাড়াবার মত করে ওগুলোকে ছাড়িয়ে আনা হবে। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন আপনি। কয়েক মাস সময় লাগবে অবশ্য।

আনন্দে লাফ মারতে শুরু করল নিনো, গলা ছেড়ে চিৎকার করছে সে।

কিন্তু এখনও ভুরু কুঁচকে রয়েছে জনি। জানতে চাইল, আমার গান গাওয়ার কি হবে? আবার আমি গাইতে পারব?।

শ্রাগ করল জুলস। গান গাইতে পারবেন কিনা তা এখনও গ্যারান্টি দিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। গান তো আপনি এখনও গাইতে পারছেন না, ভবিষ্যতেও যদি গাইতে না পারেন–মেনে নিতে হবে ব্যাপারটাকে।

আবার জুলসের উপর চটে গেল জনি ফন্টেন। বিরক্তির সাথে বলল, আজব ছোকরা তো! কি বলছ তা তুমি নিজেই জানো না। তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, আমাকে তুমি কত বড় সুখবরই না দিচ্ছ। অথচ আসলে বলতে চাইছ যে আমি হয়তো আর কোনদিনই গান করতে পারব না। কি? ঠিক এই কথাই বলতে চাইছ তুমি, তাই না? গাইতে পারব না আর কোন দিন? জবাব দাও।

এবার রেগে উঠল জুলসও। একজন আদর্শ ডাক্তারের কর্তব্য পালন করেছে। সে। কাজটা করে যথেষ্ট আনন্দও পেয়েছে। যে-কোন নির্বোধও বুঝবে যে হতভাগা লোকটার মস্ত একটা উপকার করেছে সে, অথচ লোকটার ধারণা সে তার সাঙ্ঘাতিক ক্ষতি করে দিয়েছে।

শুনুন, মি. ফন্টেন, ঠাণ্ডা, চাপা গলায় শুরু করল জুলস, একজন পাস করা ডাক্তার আমি, ছোকরা নই। এবার যখন আমাকে সম্বোধন করবেন, ডাক্তার শব্দটা উচ্চারণ করতে ভুল করবেন না, এবং ছোকরা শব্দটা আর কারও জন্যে মুখের ভিতরেই কোথাও জমা করে রাখবেন। আপনাকে আমি বোক বলতে চাই না, কিন্তু যে-কোন লোককে একবার জিজ্ঞেস করলেই বুঝবেন আপনাকে সত্যিই আমি একটা সুখবর দিয়েছি এখানে আপনাকে নিয়ে আসার সময় কি ভেবেছিলাম, জানেন? ভেবেছিলাম গলায় আপনার নির্ঘাৎ ক্যানসার হয়েছে। তার মানে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আপনার গলার প্রায় সবটা কেটে ফেলে দিতে হবে। তাতে আপনি মারাও যেতে পারতেন। আপনার মৃত্যু অবধারিত; এই কথাটা কিভাবে বলব তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলাম আমি। তাই শুধু আঁচিল শব্দটা উচ্চারণ করার সময় সত্যি ভাষণ আনন্দ হয়েছিল আমার। আনন্দটা শুধু একজন ডাক্তার। হিসেবে নয়, আপনার একজন ভক্ত হিসেবেও উপভোগ করেছিলাম। অকুণ্ঠচিত্তে। স্বীকার করছি, আপনার গান শুনে এক সময় সাঙ্ঘাতিক আনন্দ পেয়েছি। ছাত্র জীবনে তো আপনার গানের জোরেই কত মেয়ে পটিয়েছি। সন্দেহ নেই, আপনি খাঁটি শিল্পী। কিন্তু সেই সাথে একথাও ঠিক যে লাই দিয়ে আপনার মাথাটাও খাওয়া হয়েছে। কি মনে করেন, আপনি জনি ফন্টেন বলে আপনার ক্যানসার হতে পারে না? অথবা আপনার ব্রেনে এমন টিউমার হতে পারে না অপারেশন করে যা বের করে আনার উপায় নেই? হঠাৎ আপনার হাট বন্ধ হয়ে যেতে পারে না? নিজেকে আপনি অমর বলে ধরে নিয়েছেন নাকি? জীবনের সবটাই মধুর সঙ্গীত, এ কথা আপনাকে কে বলেছে? দুঃখ-কষ্ট কাকে বলে তা যদি দেখতে চান, এই হাসপাতালটার ভেতর দিয়ে একবার হেঁটে যান–আঁচিল হয়েছে বলে নিজেকে আপনার মহা-ভাগ্যবান বলে মনে হবে। আঁচিল আপনি কত ভালবাসেন তা রসের গান গেয়ে প্রকাশ করার জন্যে আশ্চর্য একটা অস্থিরতা অনুভব করবেন আপনি। তাই বলছি, ওসব ন্যাকামি বাদ দিয়ে এবার একটু মাটিতে পা রাখতে চেষ্টা করুন। অ্যাডলফ মেনজুর মত দেখতে আপনার ওই ডাক্তারটি যত ভাল সার্জেনই হোক, সে যদি ভুল করেও অপারেশন রুমে ঢোকার চেষ্টা করে, আমার পরামর্শ, ব্যাটাকে ধরে খুনের অভিযোগে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দ্রত কামরা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে জুলস। পিছন থেকে কথা বলে উঠল নিনো।

চমৎকার, অপূর্ব! চেঁচিয়ে উঠল নিনো। দারুণ বলেছেন, ভায়া।

চরকির মত আধ পাক ঘুরে দাঁড়াল জুলস। মি. ভ্যালেন্টি, বোজ বেলা বারোটার আগেই কি মাতাল হয়ে পড়েন আপনি?

নিশ্চয়ই, বলল নিনো। নির্মল সতর্কতার সাথে, দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে সে।

রাগটা পানি হয়ে গেল জুলসের। যতটা রূঢ় ভাবে মন্তব্য করতে যাচ্ছিল তার চেয়ে নরম গলায় বলল, তাহলে আর পাঁচ বছর বাঁচবেন আপনি, তার আগেও শেষ হয়ে যেতে পারেন-কথাটা মনে রাখলে ভাল করবেন।

ছোট ছোট পা ফেলে, প্রায় নাচের ভঙ্গিতে জুলসের দিকে এগিয়ে এল নিনো। ডাক্তারকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল সে। নিঃশ্বাসের সাথে ভুরভুর করে মদের গন্ধ বের হচ্ছে। দিল খোলা হাসি মুখে বলল, পাঁচ বছর? হাসির মাত্রাটা বেড়ে গেল তার। এত বেশি দিন বেঁচে থাকতে হবে, ডাক্তার? তুমি আমাকে এতবড় দুঃসংবাদ দিচ্ছ?

.

এক মাস পরের ঘটনা।

লাস ভেগাস। হোটেল। সুইমিং পুলের কিনারায় বসে রয়েছে লুসি ম্যানচিনি। হাতে একটা ককটেলের গ্লাস। ওর কোলে রয়েছে জুলসের মাথা। আরেক হাত দিয়ে জুলসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে লুসি।

এত ভয় পাবার কোন দরকার নেই, ঠাট্টার সুরে বলল জুলস। তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছ। ঘরে আমাদের জন্যে শ্যাম্পেনের বোতল অপেক্ষা করছে।

তোমার আর ধৈর্য মানছে না, না? বলল লুসি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কিছু করতে গেলে কোন ক্ষতি হবে না তো?

তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি একজন ডাক্তার, বলল জুলস। সময় হয়নি মনে করলে এত তাগাদা দিতাম? কোন ভয় নেই তোমার। আজই আমাদের সেই পরম রজনী। একটা ব্যাপার বুঝতে পারছ, ডার্লিং?

কি?

ডাক্তারি ইতিহাসে আমিই একমাত্র ডাক্তার যে তার নিজের হাতের কাজ নিজেই হাতেকলমে পরীক্ষা করবে। পরীক্ষার আগে, এবং পরীক্ষার পরে। বিষয়টা নিয়ে পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে কি যে মজা লাগবে আমার। সবুর, ব্যাপারটা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। বক্তৃতা দেবার ঢঙে শুরু করুল জুলস, চিকিৎসক তথা গবেষক-সুলভ দক্ষতা এবং হৃদয়গত কারণে যদিও আগের অনুষ্ঠানটি পরম আনন্দদায়ক ছিল, কিন্তু অপারেশনের পরের অনুষ্ঠানটি আগেরটার চেয়ে অবশ্যই অনেক বেশি উপভোগ্য হতে বাধ্য…। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল জুলস, ভীষণ জোরে তার চুল টেনে ধরেছে লুসি।

মাথা নিচু করে আছে লুসি। চোখ দুটো নত। কিন্তু একটু একটু হাসছে ফিস। ফিস করে বলল, আজ যদি ভাল না লাগে, মনে করতে হবে তুমিই দায়ী-তোমারই ব্যর্থতা।

প্রশ্নই ওঠে না ব্যর্থতার, দৃঢ় আস্থার সাথে বলল জুলস। সেন্ট পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিচ্ছি আমি কেলনার ব্যাটাকে হাতের কাজটুকু করতে দিলেও পরিকল্পনাটা তো আমার। এখন একটু বিশ্রাম নেয়া একান্ত কর্তব্য। সারারাত ধরে গবেষণা চলবে আজ।

আজকাল এক সাথেই থাকে ওরা। হাত ধরাধরি করে এক সময় নিজেদের কামরায় ফিরে এল। লুসি আবিষ্কার করল, তাকে চমকে দেবার আয়োজন করে রেখেছে জুলস। দুজন মাত্র মানুষ, কিন্তু বারোজনের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছে সে। শুধু তাই নয়, শ্যাম্পেনের বোতলগুলোর পাশেই দেখা যাচ্ছে একটা বাক্স। দেখেই চিনতে পারল লুসি, ওটা একটা গয়নার বাক্স। সেটা খুলতেই প্রকাণ্ড হীরে বসানো বাগদানের একটা আংটি দেখতে পেল লুসি।

এ থেকেই কি প্রমাণ হয় না, নিজের কাজে আমার কতটা আস্থা? বলল জুলস। আমি তোমাকে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি। বিয়ে করার আগে নিজের বউকে মেরামত করিয়ে নেবার আর কোন ঘটনা আছে কিনা আমার জানা নেই। এখন দেখা যাক, আমার স্ত্রী হবার যোগ্যতা কি পরিমাণে রয়েছে তোমার মধ্যে।

গভীর মমতায় আপ্লুত হয়ে উঠেছে জুলসের মনটা। আশ্চর্য কোমল ব্যবহার করছে সে লুসির সাথে। কিন্তু তবু ভয় ভয় করছে লুসির। গায়ে জুলসের মৃদু একটু ছোঁয়া লাগলেই শিউরে উঠছে, জড়োসড়ো হয়ে পড়ছে। তবে, খানিক পর সমস্ত ভয় কাটিয়ে উঠল সে।

কিভাবে, তা সে নিজেই টের পেল না শুধু অনুভব করল, তার সারা শরীর জুড়ে বিদ্যুতের মত তীব্র কামনার হোত বইতে শুরু করেছে এমন প্রচণ্ডভাবে আর কখনও আক্রান্ত হয়নি সে।

হাতের কাজটা আমার ভালই হয়েছে, বুঝলে? লুসির কানে কানে বলল জুলস। প্রথমবারই পরম তৃপ্তি পেয়েছে সে।

লুসি জবাবে ফিসফিস করে বলল, ভাল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই,•••এত ভাল, এই ভাল, এতটা আমি আশা করিনি।

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে ওরা। তারপর আবার শুরু হলো ওদের একান্ত গোপনীয় খেলা গবেষণার সাফল্য আত্মহারা করে তুলেছে জুলসকে। আর লুসি খুঁজে পেয়েছে তার হারানো মানিক। তার জীবনে আজ আর কোন অপূর্ণতা নেই। যে জিনিস হারালে আর কোন দিন ফিরে পাওয়া যায় না, সেই জিনিস ফিরে পেয়েছে সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *