৩.০৪ আমেরিগো বনাসেরার ব্যবসা

০৪.

আমেরিগো বনাসেরার ব্যবসা হলো মৃতদেহ সাজানো এবং সমাধিস্থ করা। সে একজন আণ্ডারটেকার। তার প্রতিষ্ঠানটা মালবেরী স্ট্রীটে, বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তাই রোজই বৈকালিক নাস্তা খেতে বাড়ি আসে সে। তারপর আবার কাজের জায়গায় ফিরে যায়। সেখানে গভীর, বিষণ্ণ পরিবেশে সাজিয়ে রাখা হয় লাশগুলো। তাদের আত্মীয়-বন্ধুরা শোক প্রকাশ করার জন্যে আসে, শোক-বিফল মানুষগুলোকে সঙ্গ দেয় বনাসেরা।

ওর ব্যবসা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি নানা অতি গুরুত্বপূর্ণ আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান সম্পর্কে কেউ ঠাট্টা তামাশা করলে সাঙ্ঘাতিক বিরক্ত হয় বনাসেরা। অবশ্য ওর বাড়ির কেউ, আত্মীয় বা প্রতিবেশীরা এ বিষয়ে কখশোই তামাশা করে না। শত শত বছর ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পেটের রুটি যোগাড় করে যারা, তারা কোন পেশাকেই অশ্রদ্ধার চোখে দেখে না।

নিরেট, মজবুত আসবাব-পত্র দিয়ে সাজানো বনাসেরার বাড়িটা। স্ত্রীর সাথে সাপার খেতে বসেছে সে। পাশেই খাবার রাখার র‍্যাকে গিলটি করা কুমারী মেরীর মূর্তির সামনে লাল কাঁচের গম্বুজের ভিতর মোমবাতির শিখা কাঁপছে। একটা ক্যামেল সিগারেট ধরিয়ে, এক গ্লাস আমেরিকান হুইস্কি হাতে নিয়ে আরাম করে বসে আছে সে। দুপ্লেট ধুমায়িত গরম সুপ এনে টেবিলে রাখল স্ত্রী। বাড়িতে এখন ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়েকে বোস্টনে তার খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে সেই দুই দত্তের হাতে পড়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আর আঘাতের কথা ভুলতে পারে। বদমাশ দুটোকে অবশ্য ডন কর্লিয়নি উপযুক্ত সাজাই দিয়েছিলেন।

সুপ খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল স্ত্রী, আজ আবার কাজে যাচ্ছ নাকি গো?

আমেরিগো বনাসের উপর-নিচে মাথা দোলাল। স্ত্রী ওর কাজকে শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও, এই কাজের মাহাত্ম সে ঠিক বুঝে ওঠে না। স্বামীর কাজের কারিগরি দিকটার গুরুত্ব সব চাইতে কম, এটা তার মাথায় ঢোকে না। আর সব লোকের মত তারও ধারণা লোকে ওকে টাকা দেয়, কারণ ওর হাতের কৌশল এতটাই নিপুণ যে কফিনে শোয়া মৃতদেহগুলোকে একেবারে জ্যান্ত বলে মনে হয়। সন্দেহ নেই, এ-বিষয়ে ওর দক্ষতা অপরিসীম। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও জরুরী ব্যাপার, মৃতের জন্যে নিশিপালনে ওর ব্যক্তিগত উপস্থিতি। রাতেপ্রিয়জনের কফিনের পাশে আত্মীয়-বন্ধুদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য শোকাহত পরিবারটি এসে পৌঁছায়, তখন আমেরিগো বনাসেরাকে ছাড়া তাদের চলে না।

শোকাহত পরিবারের কাছে কর্তব্যনিষ্ঠ অভিভাবক সে। মুখ আশ্চর্য গাভীর্য, অথচ কত শক্তি যোগায়, কত সান্ত্বনা দেয়। কণ্ঠস্বর অবিচলিত, অথচ নিচু পর্দায় নামানো। শোক-প্রকাশ অনুষ্ঠানের সেই তো পরিচালক। অশোডন শোকোচ্ছাস শান্ত করতে পারে সে, উন্মাদ ছেলেমেয়েদের শান্ত করতে মা-বাপের মনের জোরে না কুলোলে বনাসেরা তাদের শাসন করে। সমবেদনা জানাতে গিয়ে কখনও সে বাড়াবাড়ি করে না, আবার কোন সময় অবহেলাও দেখায় না। একবার প্রিয়জনের শেষ-পরিচর্যার জন্যে যারা বনাসেরার কাছে এসেছে, বারবার তারা ফিরে আসে তার কাছে! বনাসেরাও পৃথিবীর মাটির উপর সেই শেষ ভয়ঙ্কর রাতে ওদের কাউকে পরিশ্রাগ বা অনাদর করে না।

খাবার পর সাধারণত একটা ঘুম দেয় বনাসেরা। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে, আরেকবার দাড়ি কামিয়ে, প্রচুর পাউডার মেখে দাড়ির ঘন বাড় গোপন করে রাখে। সুগন্ধি ওষুধ দিয়ে কুলকুচি করা তার একটা অভ্যাস। শ্রদ্ধা প্রকাশ করার জন্য পরিষ্কার গেঞ্জি, ধবধবে সাদা শার্ট কার্লো টাই, গাঢ় রঙের নতুন ইস্ত্রি করা স্যুট, মান কার্লো জুতো, কার্লো মোজা পরে। তার এই বেশভূষা দর্শকদের মনে সান্তনা এনে দেয়। কলপ দিয়ে চুল কার্লো করে রাখে বনাসেরা, যদিও ওর সমবয়সী ইতালীয় পুরুষদের কারও মধ্যে এান চপলতা দেখা যায় না। তবে এটা কোন সৌখিনতা নয় বনাসেরার। এখানে-সেখানে পেকে গিয়ে বিচ্ছিরি কাঁচা-পাকা চেহারা হয়েছে ওর চুলের। ওর ধারণা, চুলের এই দুরকম রঙ ওর পেশার জন্যে শোডন নয়।

সুপ খাওয়া শেষ হতে সামনে মাংসের ছোট একটা স্টেক এনে রাখল ওর স্ত্রী, সেই সাথে কয়েক চামচ সবুজ পালং শাক, তেল গড়াচ্ছে তা থেকে। অল্প খাওয়া দাওয়া করে বনাসেরা। সবশেষে এক পেয়ালা গরম কফি হাতে নিয়ে একটা ক্যামেল সিগারেট ধরাল। অভাগিনী মেয়েটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আর কখনও আগের চেহারা ফিরে পাবে না বেচারী। বাইরের চেহারা মোটামুটি ফিরিয়ে আনা গেছে, কিন্তু চোখে আহত পশুর মত এমন একটা ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব এসে গেছে যে মেয়ের দিকে তাকাতে পারে না বনাসেরা। আপাতত তাকে বোস্টনে পাঠিয়ে দেবার সেটাও একটা কারণ। সময়ে ক্ষতগুলো ঠিকই সেরে যাবে, ব্যথা আর ভয়ের চেহারা তো আর মৃত্যুর মত স্থায়ী নয়। মৃতদেহ নাড়াচাড়া করাই পেশা ওর, সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানে, ভয় আর আঘাতের ধাক্কা ঠিকই কাটিয়ে উঠবে তার মেয়ে।

কফি খাওয়া সবে শেষ হয়েছে, এই সময় বৈঠকখানার টেলিফোনটা ঝনঝন। শব্দে বেজে উঠল। স্বামী বাড়িতে থাকলে স্ত্রী কখনও ফোন ধরে না, তাই উঠে দাঁড়াল বনাসেরা। ফোনের দিকে এগোচ্ছে সে, সেই সাথে টাই আর শার্টের বোতাম খুলছে। এবার একটু ঘুম দেব, ভাবছে সে। রিসিভার তুলে সবিনয়ে জানতে চাইল, হ্যালো?

আমি টম হেগেন, অপরপ্রান্ত থেকে কর্কশ, বেসুরো কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ডন কর্লিয়নির অনুরোধে তার তরফ থেকে আপনার সাথে কথা বলছি।

মাখাটা ঘুরে উঠল আমেরিগো বনাসের। পেটের ভিতর পাক খেয়ে উপর দিকে উঠে আসতে চাইছে কফিটা। অতি কষ্টে বমি বমি ভাবটা দমন করছে সে। তার মেয়ে যাদের হাতে সম্মান খুইয়েছিল তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে ডন তাকে ঋণী করে রেখেছেন, সে যে ঋণী হয়ে থাকল তা সে ডনের কাছে স্বীকারও করেছিল। বিনিময়ে, যদি কখনও প্রয়োজন হয়, সেই দেনার পরিবর্তে একটা উপকার চাইতে পারেন বলে তাকে জানিয়ে রেখেছিলেন ডন। যারা তার মেয়ের সর্বনাশ করেছিল তাদের রক্তমাখা মুখ দেখে তখন বনাসেরার মনে হয়েছিল ডনের জনো পারে না এমন কোন কাজ নেই দুনিয়ায়। কিন্তু ডনের কাছে ঋণ স্বীকার করার পর এক বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। সময় বয়ে যাবার সাথে সাথে রূপের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষয় হয় কৃতজ্ঞতাবোধ হঠাৎ সামনে সর্বনাশ দেখলে মানুষের। মন যেমন বিষিয়ে ওঠে বনাসেরারও তাই হলো একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করে উত্তর দিল সে, কিন্তু গলার কম্পনটা তাতে চাপা দেয়া গেল না। হ্যাঁ। বুঝেছি বলুন। শুনছি।

হেগেনের কণ্ঠস্বরে ঠাণ্ডা হিম একটা ভাব লক্ষ করে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে বনাসেরা। কনসিলিয়রি ইতালীয় নয় বটে, কিন্তু তার ব্যবহারে ভদ্রতার অভাব কখনও দেখেনি সে। কি এমন হয়েছে যে এখন এমন চাছাছোলা, অমার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলছে? কোন কারণই অনুমান করতে পারছে না বনাসেরা।

আপনার কাছে একটা উপকার পাওনা আছে ডন কর্লিয়নির। আপনি তার কাছে ঋণী। আপনার সেই ঋণ শোধ করার সময় হয়েছে। আপনি তা শোধ করবেন; এ-বিষয়ে তার মনে কোন সন্দেহ নেই। দেনা শোধ করার এই সুযোগটা পেয়ে আপনি খুশি হবেন, তাও তিনি জানেন। এখন থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে, তার আগে নয়, একটু দেরি হতে পারে, তিনি আপনার প্রতিষ্ঠানে আসছেন। পাওনা। উপকারটা নেবেন বনে এত কথা বলছে হেগেন, অথচ কেমন যেন অপরিচিত লাগছে তার কণ্ঠস্বর। এমন ঠাণ্ডা কিন্তু কঠিন ভঙ্গিতে তাকে কখনও কথা বলতে শোনেনি বনাসেরা। তাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে আপনাকে উপস্থিত থাকতে হবে। কর্মচরীরা কেউ ওখানে থাকতে পারবে না। ছুটি দিয়ে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। এতে যদি কোন আপত্তি বা অসুবিধে থাকে আপনার, এখুনি বলুন। আমি আপনার আপত্তির কথা তাকে নিয়ে দিচ্ছি। আরও অনেক বন্ধু আছে তার, এ কাজটা করে দিতে পারবে তারা।

বিষম ভয় পেয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল বনালেরা, আপনি এ কি বলছেন? গড় ফাদারের আদেশ মানব না, তা আপনি ভাবতে পারছেন কিভাবে? তার যে কোন হুকুম পালন করে আমি তার কাছে আমি ঋণী, সে-কথা কি করে ভুলে যাই? এখুনি আমি রওনা হয়ে যাচ্ছি আমার কাজের জায়গায়।

আগের চেয়ে একটু কোমল শোনাল হেগেনের কণ্ঠ, ধন্যবাদ ও প্রশ্নটা আমার আপনি যে ঋন শোধ করবেন সে-ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই ডনের মনে! আজ তাঁর এই উপকারটা আপনি করুন, পরে যে-কোন বিপদে আমার কাছে এলে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব পাবেন আপনি।

কথাটা শুনে আরও ঘাবড়ে গেল বনাসের। তোতলাচ্ছে সে, আ-আজ রাতে ডন নি-নিজে আসবেন আ-আমার কাছে?

হ্যাঁ।

উনি যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন সেজন্যে তাহলে যীশুকে ধন্যবাদ দিই। প্রশ্নের মত শোনাল নাসেরার কথাটা।

ফোনের অপরপ্রান্তে কয়েক সেকেও কোন শব্দ নেই, তারপর আশ্চর্য নিচু গলায় বলল হেগেন, হ্যাঁ। কট করে কেটে গেল ফোনের কানেকশন।

দর দর করে ঘামছে নাসেরা। শোবার ঘরে এসে শার্ট বদলাল, চোখে-মুখে পানি ছিটাল, কুলকুচি করল। কিন্তু দাড়ি কামাল না, গলায় নতুন টাইও বাধল না। টেলিফোন করল সহকারীকে। জানাল, সামনের সীটিংরুমে যে শোকবিহ্বল পরিবারটি রয়েছে তাদেরকে ছেড়ে কোন অবস্থাতেই কোথাও যেন না যায় সে। বসেবা মনে মনে ঠিক করেছে বাড়ির যে অংশে ল্যাবরেটরির কাজ হয় সেখানে থাকবে সে নিজে। সহকারকে কোন প্রশ্ন করার অবকাশ না দিয়ে বলল তার নির্দেশ যেন অমান্য করা না হয়।

এখনও খাওয়া শেষ হয়নি ওর স্ত্রীর। গায়ে কোটটা চাপিয়ে এঘরে বসেরা আসতেই অবাক চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকল সে।

বাইরে আমার কাজ আছে, বলল বনাসেরা! স্বামীর চেহারা দেখে কোন প্রশ্ন করতে সাহস পেল না স্ত্রী দ্রুত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল নাসেরা। ফিউনারেল পার্লারে পৌঁছুল সে পায়ে হেঁটে।

বাড়িটা বিরাট, সাদা রেইলিং দিয়ে ঘেরা। বড় রাস্তা থেকে সরু একটা গলি চলে গেছে সেটার পিছন দিকে। গলিটা এতই সরু যে কোএকমে একটা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারে। গেট খুলল নাসেরা, সেটাকে খোলা রেখেই সরু গলিটা ধরে বাড়ির পিছন দিকে চলে এল। পিছনের দরজাটা বেশ চওড়া। ভিতরে ঢোকার সময় দেখল শোকে মুষড়ে পড়া আত্মীয়-স্বজনরা তাদের সদ্যমৃত প্রিয়জনকে শেষবারের মত দেখার জন্যে সামনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছে।

বেশ অনেক বছর আগে আরেকজন আণ্ডারটেকারের কাছ থেকে এই বাড়িটা কিনেছে বনাসেরা। তখন বাড়ির ভিতর ঢুকতে হলে দশ প্রস্থ সিঁড়ি ভাঙতে হত বিকট একটা সমস্যা ছিল সেটা। বয়োবৃদ্ধ কিংবা শোকে মুহ্যমান আপনজনেরা তাদের প্রিয় মৃত ব্যক্তিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে আবিষ্কার করত দশটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার শক্তি এখন নেই তাদের। তখনকার মালিক অবশ্য এইসব লোককে মাল তোলার একটি লিফট ব্যবহার করতে দিত! বাড়ির পাশেই ছিল সেটা, ছোট একটা মঞ্চের মত উপরে উঠে যেত। সাধারণত কফিন আর লাশ তোলার কাজেই ব্যবহার করা হত লিফটটাকে। মাটির নিচে নেমে যেত প্রথমে, তারপর উঠত গিয়ে একেবারে বৈঠকখানায়। কফিন রাখার জায়গার পাশেই চোরা একটা দরজা আছে, সেটা খুলতে হলে শোকে কাতর লোকজনদেরকে তাদের চেয়ার সরিয়ে নিতে হত। এই চোরা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হত দুর্বল বুড়োদের।

ব্যাপারটা অশোডন আর কৃপণতার পরিচয় বলে মনে হয়েছি বনাসেরার। ভাই বাড়িটার সামনের দিকটা আমূল সংস্কার করেছে সে।প্রবেশ পথটা সিঁড়িসহ তুলে ফেলে দিয়ে সে-জায়গায় অল্প ঢালু একটা পথ তৈরি করে নিয়েছে, কফিন-বাক্স আর লাশ তোলার জন্যে লিফটটাও আছে।

বাড়ির একেবারে ভিতর দিকে, কয়েকটা বসার ঘরের পিছনে সাউণ্ডপ্রুফ কামরাটা আণ্ডারটেকারের সেরেস্তা, সেটা আবার কয়েক ভাগে ভাগ করা। মেডিসিন দিয়ে মৃতদেহ তাজা রাখার ব্যবস্থা করতে হয়, তার জন্যে আলাদা ঘর। কফিন রাখার জন্যে আরেকটা কামরা, সেখানে বড় তালা মারা ছোট্ট একটা খুপরিতে রাখা হয় রাসায়নিক দ্রব্যাদি আর বিদঘুঁটে চেহারার নানা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। অফিস রুমে ঢুকে ডেস্কের পিছনে আরাম কেদারায় বসল বনাসেরা। এবাড়িতে যতক্ষণ থাকে, সিগারেট প্রায় খায় না বললেই চলে, কিন্তু নিজের অজান্তে একটা ক্যামেল সিগারেট ধরাল সে। এখন তার অপেক্ষার পালা। ভাগ্যে কি আছে, জানে না। মাথার ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তিনি আসছেন। ডন কর্লিয়নি।

অপেক্ষার প্রতিটি সেকেণ্ড অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে কাটছে তার। ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে না জানলেও কি কাজ করতে বলা হবে তাকে সে ব্যাপারে কোন ভুল ধারণা বা এতটুকু সন্দেহ নেই তার মনে। নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবার গত প্রায় এক বছর ধরে যুদ্ধ করছে কর্লিয়নিদের সাথে যুদ্ধে হতাহতের খবর প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে খবরের কাগজে। শুধু ছাপা হচ্ছে বলে কিছুই বলা হয় না, প্রতিটি খবরের কাগজ ওদের খুন-খারাবির খবরেই ভরাট হয়ে থাকে। দুপক্ষই অগুনতি লোকজন হারাচ্ছে। বনাসেরার ধারণা, কর্লিয়নি নিশ্চয়ই এখন এমন কাউকে খুন করেছে যার লাশ আবিষ্কার হতে দেয়া যায় না, নিশ্চয়ই সেই লোকটা প্রতিপক্ষের কর্তা ব্যক্তিদের একজন হবে। সেজন্যেই নাশটাকে গুম করতে চাইছে কর্লিয়নিরা, একেবারে নেই করে দিতে চাইছে। তা করতে হলে একজন রেজিস্টার্ড সমাধি ব্যবসায়ীর সাহায্য একান্ত দরকার ওদের। সেই পারে আইন এবং বিধিমতে একটা লাশকে কবর দিতে। এর চেয়ে উত্তম, উৎকৃষ্ট আর নিরাপদ উপায় আর কি হতে পারে?

এই কাজটা করতে গিয়ে নিজের জন্যে কি ধরনের বিপদ ডেকে আনছে সে ব্যাপারেও কোন ভুল ধারণা নেই বনাসেরার। ডন কর্লিয়নির আদেশ মেনে নেয়ার অর্থ হবে খুন গোপন করতে খুনীকে সাহায্য করা। খুনের সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে তাকে। ব্যাপারটা অবশ্য জানাজানি হওয়া না হওয়ার উপর নির্ভর করবে। জানাজানি হয়ে গেলে বছরের পর বছর জেলের ঘানি টানতে হবে তাকে। ধূলোয় লুটাবে তার পারিবারিক সম্মান। তার মেয়ে আর স্ত্রীর দিকে লোকে আঙুল তুলে বলবে, ওদের বাড়ির কর্তা হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করার জন্যে জেলে গেছে। শুধু তাই নয়, মাফিয়াদের একজন চর বলে মনে করা হবে তাকে। জীবনে যে কখনও অন্যায়ভাবে একটা পয়সা কামায়নি, যে সারাটা জীবন চেষ্টা করেছে সং থাকার, তাকে দেশের সবাই জানবে কুখ্যাত মাফিয়াদের নোক বলে।

শরীরটা ঢিল করে দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাল নাসেরা। আরও অনেক বিপদের কা ভাবছে সে। কর্লিয়নিদেরকে সাহায্য করলে অন্য মাফিয়া পরিবারগুলো কি অবস্থা করবে তার? কথাটা যদি তাদের কানে যায়, তাকে শত্রু বলে ধরে নেরে ওরা। মাফিয়ারা শত্রুদের সাথে কি আচরণ করে জানা আছে বনাসেরার। কোন সতর্কবাণী নয়, কিছু নয়, স্রেফ খুন করে ফেলবে তাকে। এখন ভাবছে, কি ভীমরতি ধরেছিল তাকে, কি কুক্ষণে সে গড ফাদারের কাছে মেয়ের সম্মান বাঁচাবার জন্যে প্রতিশোধ ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিল। ওর স্ত্রীর সাথে ডন কর্লিয়নির স্ত্রীর পরিচয় হয়েছিল যেদিন সেই দিনটাকে অভিশাপ দিচ্ছে সে। অভিশাপ দিচ্ছে নিজেকে, মেয়েকে, স্ত্রীকে! মনে মনে গালাগালি করছে আমেরিকাকে, নিজের সাফল্যকে। কিন্তু, খানিক পর আরেকটা কথা মনে পড়ে যেতে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেল সে। ভাবছে, আসলে হয়তো সব নিরাপদেই চুকে বুকে যাবে, কোন বিপদ-আপদ ঘটবে না। ক্ষুরধার বুদ্ধি রাখেন ডন কর্লিয়নি, কাঁচা কাজ করার পাত্র তিনি নন, নিশ্চয়ই গোটা ব্যাপারটা গোপন করার পাকা ব্যবস্থা করবেন তিনি। বনাসেরা অনুভব করছে, যেকোন ভাবে হোক নিজের মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে হবে তাকে, এমন কিছু করা বা বলা চলবে না যাতে তার ভয়টা প্রকাশ হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় বিপদ, কোন সন্দেহ নেই, ডন কর্লিয়নির তরফ থেকে আসারই সম্ভাবনা তার, তার স্ত্রীর, তার মেয়ের, এমন কি গোটা জগৎসংসারের চরম সর্বনাশ হয়ে গেলেও ডন কর্লিয়নি, গড ফাদারকে অসন্তুষ্ট করা চলবে না।

কাঁকর বিছানো রাস্তায় গাড়ির চাকার শব্দ। বুকটা ধড়াস করে উঠল বনাসেরার। ঢোক গিলে গলাটাকে স্বাভাবিক করে রাখার চেষ্টা করছে সে। ওদিকে কান দুটো সজাগ হয়ে আছে। সরু গলিটা দিয়ে এসে পিছনের উঠানে থেমেছে। একটা গাড়ি। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে, পা দুটো কাঁপছে একটু একটু। দরজাটা খুলে দিল সে। প্রথমে ভিতরে ঢুকল প্রকাণ্ডদেহী ভোতা চেহারার পাট ক্লেমেঞ্জা। তার পিছনে হিংস্র বুনো জানোয়ারের মত চেহারা নিয়ে দুই যুবক। তিনজনের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, পাথরের মূর্তির মত নিষ্প্রাণ, কিন্তু। গভীর থম থম করছে। তার দিকে ভাল করে তাকাল না পর্যন্ত, একটা কথা বলল না। প্রত্যেকটা কামরা, বাথরুম, গলি-খুঁজি, স্টোররুম-বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি তন্ন তন্ন করে সার্চ করল ওরা। সার্চ করা শেষ হতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল ক্লেমেঞ্জা। বুনো চেহারার যুবকেরা রয়ে গেল বনাসেরার সাথে, তাকে যেন পাহারা দিচ্ছে।

অপেক্ষা করছে ওরা। কিন্তু কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। ওদেরকে কোন প্রশ্ন করার কোন ইচ্ছা বা সাহস কোনটাই নেই বনাসেরার, তার ভয় ওরা।

তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। কয়েক মিনিট কেটে গেল। হঠাৎ সরু গলি থেকে ভেসে এল আবার একটা গাড়ি আসার শব্দ। শব্দটা ভারী, শুনেই বুঝতে পারল নাসেরা, একটা অ্যাম্বুলেন্স আসছে।

আবার তার বিশাল শরীর নিয়ে উদয় হলো ক্লেমেঞ্জা। তার পিছনে দুজন লোক। তারা একটা স্ট্রেচার বয়ে নিয়ে এল যে দুঃস্বপ্নটা এতক্ষণ ধরে দেখছিল বনাসেরা, সেটা এবার কঠোর বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে ছাই রঙের কম্বল দিয়ে মোড়া একটা লাশ শোয়ানো রয়েছে স্ট্রেচারে। লাশের হলদেটে পা দুটো খালি, কম্বলের বাইরে একটু বেরিয়ে আছে।

নিঃশব্দে ইশারা করল ক্লেমেঞ্জা। স্ট্রেচারটাকে মেডিসিন রুমে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। উঠানে গাঢ় অন্ধকার, সেখান থেকে আরেকজন এসে ঢুকল আলোকিত অফিসরুমে। তিনি গড ফাদার। ডন কর্লিয়নি।

অসুস্থতার জন্যে আগের চেয়ে অনেক হালকা হয়ে গেছেন, হাঁটছেনও একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। টুপিটা হাতে ধরে রেখেছেন, প্রকাণ্ড করোটির উপর চুলগুলোকে আশ্চর্য পাতলা লাগছে। মেয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়ে সেই শেষ দেখেছিল তাকে বনাসেরা, তারপর আবার আজ দেখা। এক বছরের কিছু বেশি হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে যেন বিশ বছর বয়স বেড়ে গেছে তার। সেই লাবণ্যও নেই চেহারায়, নো একটা ভাব দেখা যাচ্ছে। নিজের বুকের উপর টুপিটা চেপে ধরলেন গড ফাদার। বনানেরাকে বললেন, এই যে, পুরানো বন্ধু, উপকারটা করে দিতে তৈরি আছ তো?

মুখে কথা যোগাল না বনাসেরার, শুধু উপর-নিচে মাথা দোলাল সে। স্ট্রেচারের পিছু পিছু মেডিসিন রুমে ঢুকছেন ডন, ধীর পায়ে তাকে অনুসরণ করছে। বনাসেরা। প্রতিটি টেবিলের দুপাশে নালি রয়েছে। একটা টেবিলে কম্বল মোড়া লাশটা নামানো হলো। টুপি নেড়ে ইঙ্গিত করলেন ডন। সাথে সাথে কামরা থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল সবাই।

কি করতে হবে আমাকে? ফিস ফিস করে জানতে চাইল নাসেরা।

নির্নিমেষ দৃষ্টিতে টেবিলটার দিকে তাকিয়ে আছেন ডন কর্লিয়নি। তমার সমস্ত সাধ্য, সমস্ত নিপুণতা, সারা জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করতে বলছি। ওর মা ওকে এভাবে দেখুন তা আমি চাই না। ধীর পায়ে এগোচ্ছেন ডন। টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। হাত বাড়ালেন ছাই রঙের কলটার দিকে। এক সেকেণ্ড শূন্যে স্থির হয়ে থাকল তার হাতটা। তারপর আস্তে করে লাশের উপর থেকে সরিয়ে নিলেন কম্বলটা। বহু বছরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও নিজের অজান্তে আতঙ্কিত একটা শব্দ বেরিয়ে এল বনাসেরার গলা থেকে। প্রচণ্ড ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল তার শরীর। অবিশ্বাসে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখের মণি দুটো।

বুলেটের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে মুখটা। টেবিলে শুয়ে আছে সনি কর্লিয়নির লাশ। বা চোখটা ভরাট হয়ে আছে রক্তে, মণিটা ফেটে চৌচির। নাকের সেতু ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, বা দিকের চোয়াল বিধ্বস্ত।

এক সেকেণ্ডের তিন ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্যে বনাসেরার কাঁধে একটা হাত রেখে নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে সামলে নিলেন ডন কর্লিয়নি দেখে, আমার ছেলেকে কি বিশ্রী ভাবে মেরেছে ওরা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *