৩.০৩ পাঁচ পরিবার একজোট

০৩.

পাঁচ পরিবার একজোট হয়ে যুদ্ধ করছে কর্লিয়নি পরিবারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের খেসারত কোন পক্ষকেই কম দিতে হচ্ছে না। পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে পুলিশ বিভাগ। ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কি খুন হওয়ায় ক্ষেপে গেছে তারা, লাগাম টেনে ধরেও সামলানো যাচ্ছে না তাদেরকে। প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে তারা, এই হত্যাকাণ্ডের একটা সুরাহা করে দিতে হবে। যা খুশি তাই বোঝালে চলবে না, সমাধানটা গোটা পুলিশ বিভাগের মনঃপূত, পছন্দসই হতে হবে। এ-কথার একটাই মানে, ওদের হাতে তুলে দিতে হবে খুনীকে। এ-প্রসঙ্গে অবধারিত ভাবে এসে পড়ে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক নেতাদের কথা। এইসব নেতা সব ধরনের জুয়া-জোচ্চুরী আর বেআইনী ব্যবসাকে প্রশ্রয় দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে। এদের রাজনৈতিক ক্ষমতা খুব বেশি। যদি চয়, পুলিশ বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের চাকুরিও খেয়ে দিতে পারে। এরা যে-সব জুয়ার আড্ডা আর বেআইনী ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতা করে সেসব জায়গায় হানা দেবার সাহস প্রথম সারির পুলিশ অফিসারদেরও নেই। কিন্তু খেপে ওঠা সিপাইদের মধ্যে লুটপাট, হত্যা আর ধর্ষণ প্রবণতা মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়লে তাদের বিভাগীয় কমাণ্ডিং অফিসাররা নিরুপায় হয়েই উপরওয়ালাদের হুকুম অমান্য করতে বাধ্য হয়, এবং সেক্ষেত্রে উপরওয়ালাদের অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না–এক্ষেত্রে, এই বিশেষ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদেরও সেই রকম অবস্থা হয়েছে, অসহায় বোধ করা ছাড়া করার। কিছু খুঁজে পাচ্ছে না তারা।

নেতাদের প্রশ্রয় আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কর্লিয়নি পরিবারের ক্ষতি হচ্ছে বিস্তর, কিন্তু ওদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে প্রতিপক্ষদের। কর্লিয়নিদের সিংহভাগ আয়ের মূল উৎস জুয়া খেলা। খবরের কাগজে নানা ধরনের বিচিত্র বিজ্ঞাপন বের হয়, তাতে কি সব আবোলতাবোল সংখ্যা ছাপা থাকে, সেই সংখ্যার আসল রহস্য আর কেউ বুঝুক বা না বুঝুক, জুয়াড়ীরা ঠিকই বোঝে। তারা সেই সংখ্যা ধরে লটারী খেলে! অত্যন্ত লাভজনক একটা জুয়া খেলা এটা। এই খেলার নাম নম্বর। পলিসি নামে আরেকটা খেলা আছে কর্লিয়নিদের। এই খেলা থেকেও বিস্তর টাকা রোজগার হয় তাদের। এটাও এক ধরনের লটারী খেলা, প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয়। এই দুটো খেলাই প্রচণ্ড মার খাচ্ছে কর্লিয়নিদের। ওদের অসংখ্য কর্মী আর চর আছে, যারা এই খেলা দুটো পরিচালনা করে, তারা পুলিশের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাকে। হাজতে পাঠাবার আগে কষে মারধোরও করা হচ্ছে এদেরকে। পুলিশ এদের কাছ থেকে একটা কথাই জানতে চায়–ক্যাপটেন ম্যাকক্কাস্কিকে কে খুন করেছে? কিন্তু, শত মারধোর করেও কোন লাভ হচ্ছে না। কর্লিয়নি পরিবারের কমী আর চররা আর যাই করুক, পুলিশের কাছে কখনও মুখ খোলে না : লটারী পরিচালনার সাথে জড়িত ব্যাংক বা জুয়ার আচ্ছাগুলো খুঁজে বের করছে সাধারণ পুলিশ অফিসাররা, সে সব জায়গায় হানা। দিয়ে যাকে পাচ্ছে তারই কোমরে দড়ি বেধে তুলে নিচ্ছে গাড়িতে, সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে বস্তা ভর্তি টাকা। এক কথায়, চারদিক থেকে শুধু লোকসান আর হাঙ্গামার খবর এসে পৌঁছাচ্ছে কর্লিয়নি পরিবারের কানে।

অসংখ্য ব্যাংকারের কাছ থেকে নালিশ আসছে ক্যাপোরেজিমিদের কাছে, তারা আবার কর্লিয়নি পরিবারের আলোচনা বৈঠকে উত্থাপন করছে অভিযোগগুলো। কিন্তু করার আছেই বা কি? ব্যবসা বন্ধ করে দেবার পরামর্শ দেয়া। হচ্ছে ব্যাংকারদেরকে। সবচেয়ে বেশি টাকা আসে নিগ্রো পাড়া হার্লেম থেকে, আপাতত সেখানকার হাত-পা-ঝাড়া স্থানীয় লোকজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। ব্যবসার সমস্ত দায়-দায়িত্ব। এই লোকগুলো যেখানে সেখানে ইচ্ছা বারবার জায়গা বদল করে কাজ করে, তাই মালামাল এবং প্রমাণসহ হাতেনাতে এদেরকে ধরা পুলিশের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন কাজ।

ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কি খুন হবার পর পরই অনেকগুলো খবরের কাগজ সলোযোর দুষ্কর্মের সাথে তাকে জড়িয়ে নানান বিবৃতি আর কাহিনী ছেপেছে। ওই সব কাহিনী থেকে নিচ্ছিদ্র প্রমাণ পাওয়া গেল মৃত্যুর অল্প কদিন আগে কোথাও থেকে বেশ মোটা অঙ্কের নগদ টাকা পেয়েছিল ক্যাপটেন। পুলিশ বিভাগের জানার কথা নয় ওই বিবৃতি আর কাহিনীগুলো টম হেগেন নিজেই তৈরি করেছে। কিন্তু কাহিনীর তথ্যগুলো মিথ্যে নয়, সবই সত্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেগুলো সংগ্রহ করতে হয়েছে কর্লিয়নি পরিবারের কনসিলিয়রিকে। পুলিশ বিভাগ এইসব কাহিনীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ তোলেনি, আবার সায় বা সমর্থনও দেয়নি। তবে তাদের এই মৌনব্রত অবলম্বনেরও বিশেষ তাৎপর্য আছে।

যেসব ইনফর্মার আর পুলিশ কর্মচারী কর্লিয়নিদের টাকা খায় তারাও এই জটিল, গুরুতর পরিস্থিতিতে কাজ দিচ্ছে। তাদের রিপোর্টে তারা পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছে ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কি একজন নীতিভ্রষ্ট অফিসার ছিল। টাকা খাওয়া অথবা সাফ ঘাস খাওয়া, এ তো খুবই সাধারণ আর স্বাভাবিক ব্যাপার, সেটা তেমন কোন অপরাধ বা নিন্দাযযাগ্য কাজ বলে গণ্য করে না কেউ। ক্যাপটেন ম্যাকক্কাস্কি আর সব অফিসারের মত এ-ধরনের অল্প নোংরা টা খেত, তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু কর্লিয়নিদের বেতনভুক ইনফর্মার আর পুলিশ কর্মচারীদের রিপোর্টে উল্লেখ করা হলো, নোংরা টাকার মধ্যে সবচেয়ে যেটা মলিন সেই টাকাটাও গোগ্রাসে গিলে ফেলত ক্যাপটেন ম্যাককুাস্কি। তার মানে খুনীর কাছ থেকে টাকা খেয়ে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মিথ্যে রিপোর্ট লিখত সে, আর ড্রাগ ব্যবসায়ীদেরকে ব্যবসা চালাবার সুবিধে করে দেবার বিনিময়ে টাকা খেত। এ দেশের গোটা পুলিশ জাত কয়েকটা ব্যাপারে কঠোর নীতি মেনে চলে, সেই নীতি অনুযায়ী খুনের বা ড্রাগ-ব্যবসার টাকা খাওয়া ভয়ঙ্কর অপরাধ, সে-অপরাধের কোন ক্ষমা নেই।

পুলিশের লোকেরা আশ্চর্য সরলতার সাথে আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলে, এটা জানা আছে টম হেগেনের। জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত ওরা, এবং জনসাধারণের চেয়ে অনেক বেশি আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলে। আইন-শৃঙ্খলা তো একটা যাদু, আর এই যাদুই তো ওদের সমস্ত ক্ষমতার উৎস। প্রত্যেকটি পুলিশ এই ক্ষমতাটাকে তার নিজের ব্যক্তিগত ক্ষমতা বলে মনে করে। কারণ ব্যক্তিগত ক্ষমতা দুনিয়ার প্রায় সব পুরুষ মানুষই কামনা করে।

অথচ, যাদের সেবায় নিয়োজিত ওরা, সেই জনসাধারণের উপর সব সময় তুষের আগুনের মত একটা চাপা আক্রোশ রয়েছে ওদের মনে। ওরা মানুষের অধিকারের রক্ষক যেমন, তেমনি ভক্ষকও বটে নাগরিকদেরকে রক্ষা করে ওরা, অথচ এতটুকু কৃতজ্ঞতবোধ নেই তাদের, শুধু গাল দেয়, শুধু কুৎসা রটায়। বাপের চাকর বলে মনে করে ওদেরকে, শুধু ফরমাস করে, শুধু দাবি জানায়। কিন্তু একটু ছিলতে গেলে, একটু শোষণ করতে গেলে বা একটু শান্তি দিতে গেলে ধরা দেবে না ওরা, পিছলে বেরিয়ে যাবে। সাঙ্ঘাতিক চতুর আর বিপজ্জনক ওরা, কতরকম ছল চাতুরী যে জানে তার হিসেব নেই। যদি বা একজনকে নিজেদের খপ্পরে আনতে পারে পুলিশ, সাথে সাথে ফেসমাজকে তারা রক্ষা করে আসছে সেই সমাজই তার সমস্ত কৌশল আর ক্ষমতা প্রয়োগ করে এত কষ্টে ধরা শিকারটিকে তাদের হাত থেকে ছো মেরে কেড়ে নিতে চায়। রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতিপরায়ণ বেআইনী ব্যবসায়ীকে বাঁচাবার জন্যে নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে। কুখ্যাত গুণ্ডা বদমায়েশকে লঘু সাজা দেয় জজ সাহেবরা, তারপর সে-সাজাও আবার রদ করে দেয়। পুলিশদের বিশ্বাস, দুষ্কর্ম করার আগেই দুষ্কৃতকারীদেরকে খালাস করার ব্যবস্থা উকিল সাহেবরা যদি করতে না পারতেন, তাহলে গভর্নর মহোদয়রা আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং অপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্রেফ মাফ করে দেবার আইন জারি করতেন।

সময় বয়ে যাবার সাথে সাথে পুলিশরাও বুঝতে শিখল, তাদেরও চোখ খুলতে শুরু করল। গুণ্ডা আর দুর্নীতিবাজরা টাকা সাধে, সে টাকা না নিয়ে কেন তারা ঠকতে যাবে? টাকার দরকার পুলিশদেরই তো সবচেয়ে বেশি। তারাই তো সেবা দেয়, বিনিময়ে কেন তাদের ছেলেমেয়েরা ভাল খেতে-পরতে পাবে না? কেন তাদের ছেলেমেয়েরা ভাল স্কুল-কলেজে গিয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষ হবার সুযোগ পাবে না? তাদের স্ত্রীরা অভিজাত সুপারমার্কেটে গিয়ে কেন দামী দামী বিলাস আর শখের জিনিস কিনতে পারবে না? তারা নিজেরাই বা কেন ছুটিছাটার সময় ফ্লোরিডার সাগরসৈকতে গিয়ে মিষ্টি রোদ পোহাবে না? এসবের বিরুদ্ধে যে যাই বলুক, এ-কথা তো ঠিক যে ওরা নিজেদের প্রাণের উপর ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে। সেটা কি ছেলেখেলা ব্যাপার? চাট্টিখানি কথা? সুতরাং কেন তারা ঘুস না। খেয়ে নিজেদের আর স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের বঞ্চিত করবে?

তবে, সাধারণভাবে প্রায় সব পুলিশই নোংরার মধ্যে সবচেয়ে মলিন টাকা খেতে আপত্তি করে। গোপন জুয়ার আড্ডাখানার মালিকদের কাছ থেকে টাকা খায় ওরা, বিনিময়ে তারা যাতে নির্বিমে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে সেদিকে নজর রাখে। ড্রাইভাররা পার্কিং এলাকার বাইরে কোথাও গাড়ি রেখে অথবা বেঁধে দেয়া স্পীড লিমিটের চেয়ে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালিয়ে ধরা পড়লে টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ছেড়ে দিতে আপত্তি নেই ওদের। পকেটে কিছু এলে খারাপ মেয়েমানুষ আর বেশ্যাদেরকেও ব্যবসা চালিয়ে যেতে দেয়। এ-ধরনের নগণ্য দুর্নীতি করা তো মানুষের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ডাগ-বিজনেস, সশস্ত্র ডাকাতি বা রাহাজানি, ধর্ষণ, খুন এবং এই জাতের বিকৃত-বীভৎস আর সব অপরাধকে নগণ্য অপরাধ বলে মনে করে না ওরা, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত টাকা খেতে রাজী হয় না। তার কারণ, ওদের বিশ্বাস, এই জাতের সাঙ্ঘাতিক অপরাধগুলো ওদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার একেবারে উৎসমূলে গিয়ে আঘাত হানে। এগুলোকে মেনে নিলে ওদের ক্ষমতার উৎস ধ্বংস হয়ে যাবার ভয় রয়েছে, তাই এই ধরনের অপরাধ সহ্য করতে রাজী নয় ওরা।

পুলিশকে খুন করা আর সরকারপ্রধান বা রাজাকে খুন করা একই কথা। এই হত্যাকাণ্ডের নায়কের ক্ষমা নেই। কিন্তু যেই রটে গেল যে খুন হবার সময় ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কির সাথে তার বন্ধু হিসেবে পরিচিত কুখ্যাত ড্রাগ-ব্যবসায়ী ছিল, তাছাড়া কাউকে কাউকে খুন করার ষড়যন্ত্রের সাথে সে-ও জড়িত ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, অমনি প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছাটা ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করল পুলিশের মন থেকে। তাছাড়া, এত কড়াকড়িভাবে আইন প্রয়োগ করে সব বেআইনী কাজ অচল করে দিলে তাদের নিজেদের উপায়টা কি হবে? যে-যাই বলুক, বাড়ি করার জন্যে বাংক থেকে লোন নিতে হয়েছে, প্রতি মাসে সুদসহ কিস্তির টাকাটা তো মেটাতে হবে। ছেলেমেয়েদের ভাল খাওয়া-পরার ব্যবস্থা তো করতে হবে, তাদেরকে পুঁজি দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ তো করে দিতে হবে। বেআইনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এতদিন নিয়মিত যে টাকাটা পেয়ে এসেছে তা হঠাৎ যদি অনির্দিষ্ট কালের জন্যে না পায়, পুলিশদের সংসারই বা চলে কি করে? যে-সব হকার আর ফেরিওয়ালাদের লাইসেন্স নেই তাদের কাছ থেকে দুপুরের খাওয়ার পয়সাটা জুটে যায়। অজায়গায় গাড়ি রাখে যারা তারা কয়েক ডলার জরিমানা দেয়া আর আনুষঙ্গিক ঝামেলা এড়াবার জন্যে খুচরো পাঁচ-দশ সেন্ট ওদের হাতে গুঁজে দিয়ে রেহাই পেয়ে যায়। সমকাম, মারামারি বা কোন সন্দেহজনক আচরণের জন্যে যাদেরকে থানায় নিয়ে আসা হয় তাদের কাছ থেকেও বেশ কিছু আদায় হয়। কিন্তু ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কি খুন হবার পর থেকে এ ধরনের সব রোজগারের রাস্তা একেবারে বন্ধ। একজন বজ্জাত, নীতিচ্যুত অফিসারের জন্যে তারা সবাই কেন দুর্ভোগ পোহাবে? কেন বঞ্চিত হবে? একটা অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছে ক্রমশ পুলিশদের মধ্যে।

শেষ পর্যন্ত উপরওয়ালাদের মন গলল। দয়া হলো। ঘুসের রেট বাড়িয়ে দিয়ে মাফিয়া পরিবারগুলোকে তাদের ব্যবসা চালাবার অনুমতি দিলেন তারা।

থানায় তৈরি হলো আবার নতুন চাদা আদায়ের তালিকা, চাদার কই ভাগ কে পাবে তাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো। এতে করে সবকিছু আগের মত স্বাভাবিক আর পরিবেশটা ঠাণ্ডা হয়ে এল, তা নয়। তবে সামাজিক শৃঙ্খলা বেশ খানিকটা ফিরে এল।

.

টম হেগেনের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালে ডন কর্লিয়নি যে কামরাটিতে রয়েছেন সেটি পাহারা দিচ্ছে একটা প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা। তবে শুধু এদের। উপরই সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়নি ওরা। গোটা হাসপাতালটাকে কড়া প্রহরার মধ্যে রেখেছে টেসিওর দলের জবরদস্ত সৈনিকরা। কিন্তু এত কিছুর পরও সন্তুষ্ট হতে পারছে না সনি। তার ইচ্ছাতেই ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সম্পূর্ণ নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে আসা হলো ডনকে।

অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে নিজের বাড়িতে এলেন ডন। ইতিমধ্যে কিছু সংস্কার করা হয়েছে বাড়িটার। হাসপাতালের একটা কামরার মত দেখতে হয়েছে তার শোবার ঘরটা। তার শরীরের অবস্থা হঠাৎ যদি আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে, তখন চিকিৎসা সংক্রান্ত যা কিছু দরকার হতে পারে তার সবই যোগাড় করে এই ঘরে রাখা হয়েছে। বাছাই করা কয়েকজন নার্সের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তার সেবা এষা করার, এদের জন্মের ইতিহাস থেকে শুরু করে জীবনের সমস্ত ঘটনার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে তবে বহাল করা হয়েছে চাকরিতে। ডনের কখন কি দরকার হয়, সেজন্যে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা তার মাথার পিছনে এবং খাটের দুপাশে পালা করে দাঁড়িয়ে থাকে এরা। মোটা টাকা ফি দিয়ে এই ব্যক্তিগত হাসপাতাল-ঘরটার আবাসিক চিকিৎসক হতে রাজী করানো হয়েছে ড. কেনেডিকে।

নতুন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের পর উঠানটা এখন একেবারে দুর্ভেদ্য একটা দুর্গ হয়ে উঠেছে। বাড়তি বাড়িগুলো এখন আর খালি নেই, সশস্ত্র সৈনিকদেরকে নিয়ে এসে রাখা হয়েছে সেগুলোয়। এই বাড়িগুলোয় এর আগে পর্যন্ত যারা বসবাস করছিল। তাদেরকে সমস্ত খরচপত্র ছাড়াও আরও কিছু বেশি টাকা দিয়ে ইটালীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা যে যার গ্রামে গিয়ে ছুটি কাটাচ্ছে এখন।

শরীর আর মন সুস্থ করার জন্যে লাস ভেগাসে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ফ্রেডিকে। সেখানে সৌখিন হোটেল আর জুয়া খেলার ক্যাসিনো তৈরি করছে কর্লিয়নি পরিবার। স্বাস্থ্য উদ্ধারের সাথে সাথে ব্যবসাও দেখাশোনা করবে ফ্রেডি। লাস ভেগাস পশ্চিম তীরের মাফিয়া সামাজ্যের একটা অংশ, ওই সামাজ্যের অধিপতিরা কেউ নিউ ইয়র্কের ছয় পরিবারের যুদ্ধে নাক গলায়নি। ওখানকার ডন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি জীবিত থাকতে ফ্রেডির কোন বিপদ হবে না।

নিউ ইয়র্কের পাঁচটা পরিবার ফ্রেডি কোথায় আছে জানার পরও তার দিকে হাত বাড়াল না। যুদ্ধে কর্লিয়নিদের পক্ষে ফ্রেডির কোন অবদান নেই, তাকে খতম করে কোনদিক থেকে কোন লাভ নেই, বরং লোকসান। কেননা ফ্রেডিকে যারা আশ্রয় দিয়েছে তারা পচ পরিবারের নতুন শত্রু হিসেবে উদয় হবে। নিউ ইয়র্কের ঝামেলা সামলাতেই তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, দূরে শত্রু সৃষ্টি করে ঝামেলা আর বাড়াতে চায় না কেউ।

কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন ড. কেনেডি, ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও আলোচনা ডনের সাথে বা তার সামনে করা চলবে না। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হচ্ছে সেই নিষেধ। সকলের আপত্তি কানে না তুলে নিজের ইচ্ছায় তার কামরায় বৈঠক বসিয়েছেন ডন। হাসপাতাল থেকে প্রথম যেদিন বাড়ি ফিরলেন, সেই রাতেই সবাইকে ডেকে পাঠালেন তিনি। সনি, টম হেগেন, পীট ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও তার কামরায় এসে জড়ো হলো।

এখনও খুব দুর্বল ডন, বেশি কথা বলতে পারছেন না। কিন্তু তবু তার একান্ত ইচ্ছা যা কিছু ঘটেছে সব তিনি শুনবেন এবং চরম সিদ্ধান্ত তিনি নিজে নৈবেন। ক্যাসিনোর জুয়া খেলা ব্যবসা শেখার জন্যে লাস ভেগাসে পাঠানো হয়েছে ফ্রেডিকে, এ-কথা শুনে মাথা দুলিয়ে কাজটাকে সমর্থন এবং ওদের এই সিদ্ধান্তটাকে অনুমোদন করলেন ডন। তারপর তাকে জানানো হলো, কর্লিয়নিদের সৈনিকরা। ব্রুনো টাটাগ্লিয়াকে মেরে ফেলেছে। এদিক-ওদিক মাথা দুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। সলোযো আর ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কিকে খুন করেছে মাইকেল, লুকিয়ে থাকার জন্যে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সিসিলিতে, কথাটা শোনামাত্র আশ্চর্য একটা বিচলিত ভাব দেখা গেল ডনের চেহারায়, কেউ কখনও দেখেনি। খবরটা কানে ঢোকামাত্র ইশারায় সবাইকে তিনি তার কামরা থেকে চলে যেতে বললেন।

নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ওরা সবাই। কোণার কামরাটা একটা লাইব্রেরী, এখানে সব আইনের বই রাখা হয়, কথাবার্তা বলার জন্যে এই লাইব্রেরীতে এসে বসল ওরা। ডেস্কের পিছনে প্রকাণ্ড একটা রিভলভিং চেয়ার, লম্বা-চওড়া ব্রিট শরীর নিয়ে সেটায় হেলান দিয়ে বল সনি, হাত দুটো রাখল হাতলে, লম্বা করে দিল পা দুটো।

বলল, হপ্তা দুই বিশ্রাম করতে দেয়া উচিত বাবাকে। তার আগে ডাক্তার বোধহয় তাকে কাজ করার অনুমতি দেবে না।

সনি আরও কিছু বলবে ধরে নিয়ে চুপ করে আছে সবাই।

আমি চাই, কয়েক সেকেণ্ড পর আবার বলল সনি, বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই আবার কাজকর্ম শুরু করা হোক। পুলিশ তো ইঙ্গিতে জানিয়েই দিয়েছে আবার ব্যবসা শুরু করতে পারি আমরা। হারলেমের পলিসি ব্যাংকগুলোর কি হবে, এটা প্রথম প্রশ্ন। এতদিন চুটিয়ে মজা লুটেছে কার্লো ছোকরাগুলো, ওদেরকে হটিয়ে দিয়ে এবার আমরা নিজেদের জায়গা দখল করব। সমস্ত ব্যাপার যত পারা যায় অগোছাল করে রেখেছে ব্যাটারা, যে-কোন কাজে হাত দিলেই এই রকম বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেয়াই স্বভাবওদের। জুয়ায় যারা জেতে, ওদের চররা তাদেরকে টাকা দেয় না। ক্যাডিলাক গাড়িতে চেপে মক্কেলদের কাছে যায়, গিয়ে বলে জিৎ-এর টাকা পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। নয়তো পাওনা টাকার অর্ধেক দেয়, বাকিটা মেরে খায়। চরেরা খুব পয়সাওয়ালা লোক, মক্কেলরা এটা টের পাক, তা আমি চাই না। চাই না পাওনাদাররা তাদের পাওনা থেকে এক বিন্দু বঞ্চিত হোক। চরেরা ঘন ঘন দামী সট বদল করে ঘুরে বেড়াবে, বা নতুন মডেলের গাড়ি চেপে বেড়াবে, এসব আমি একেবারেই পছন্দ করি না। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের ব্যবসাতে ফ্রি-ল্যান্সারদের রাখতে চাই না আমি। ওদের কোন দায় দায়িত্ববোধ নেই, ওদেরকে দিয়ে কাজ করালে বদনামের ভাগীদার হওয়া ছাড়া আর কোন লাভ নেই। টম, এর একটা বিহিত-ব্যবস্থা এখুনি শুরু করে দাও তুমি। পুলিশের তরফ থেকে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছে, এ-খবর তোমার কাছ থেকে পেলেই এবার আমরা কি করতে যাচ্ছি তা ওরা সাথে সাথে টের পেয়ে যাবে, লেজ তুলে কেটে পড়বে সবাই, রাতারাতি আবার সব ফিরে পাব আমরা।

কিন্তু হারলেমে কিছু দুর্দান্ত টাইপের ছোকরা আছে, বলল টম হেগেন, টাকার স্বাদ পেয়ে সাঙ্ঘাতিক লোভী হয়ে উঠেছে তারা। এখন কি আর তারা চর অথবা সাব-ব্যাংকারের কম ঘসার কাজ করতেখাজী হবে?

মস্ত কাঁধ ঝাঁকাল সনি। বলল, রাজী না হলে ওদের নামগুলো জানিয়ে দিয়ে ক্লেমেঞ্জাকে। এসব সমস্যার সমাধান করা তো ওর দায়িত্ব।

হেগেনের দিকে ফিরল ক্লেমেঞ্জা। আশ্বাস দিয়ে বলল, চিন্তার কিছু নেই, ব্যাপারটা আমি মিটিয়ে ফেলব

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জরুরী সমস্যার কথাটা তুলল টেসিও। কিন্তু আমরা কাজ শুরু করলেই একসাথে হামলা আরম্ভ করবে পচ পরিবার। হারলেমে আমাদের ব্যাংকারদের উপর, ইস্ট সাইডে আমাদের বুক মেকারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ওরা। আমাদের ব্যবস্থাপনায় রেডিমেড কাপড়ের ব্যবসাগুলো চলছে, সেখানেও হানা দিতে ছাড়বে না শয়তানের বাচ্চারা। ওদেরকে ঠেকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে তবে ব্যবসায় হাত দিতে হবে আমাদেরকে কিন্তু তাতে প্রচুর টাকা বেরিয়ে যাবে।

এতটা বাড়াবাড়ি করার সাহস বোধহয় হবে না ওদের, বলল সনি। ওরা জানে, গায়ে আঁচড় লাগলে আমরাও ছেড়ে দেব না, উল্টো মার দেব। শান্তি-প্রস্তাব দিয়ে সবার কাছেই তো দূত পাঠিয়েছি আমি। আশা করছি, ব্রুনো টাটাগ্লিয়ার জন্যে কিছু ক্ষতিপূরণ দিলে মিটমাট করে ফেলবে ওরা।

না, বলল হেগেন। আমার কাছে খবর এসেছে, তোমার প্রস্তাবকে ওরা আমলই দিচ্ছে না। গত কমাসে যে বিরাট অঙ্কের টাকা লোকসান দিতে হয়েছে ওদের, তার জন্যে আমাদেরকে দায়ী করছে ওরা। আসল কথা, ওদের ড্রাগ ব্যবসায় আমাদের সহযোগিতা চাইছে। আমাদের রাজনৈতিক প্রভাব আছে, সেটা ওদের অনুকূলে খাটালেই নির্বিঘ্নে ব্যবসাটায় হাত দিতে পারে। তার মানে, ওরা চাইছে, সলোযো নেই ভালই হয়েছে, কিন্তু সলোযোর প্রস্তাবটা আমরা যেন মেনে নিই। কিন্তু আরও খানিক যুদ্ধ করে আগে আমাদেরকে আরও কিছুটা দুর্বল করে নিতে চাইছে, তারপর প্রস্তাবটা নতুন করে তুলবে। ওদের বিশ্বাস, লোকসান দিয়ে আর নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমরা যখন নরম হব, তখন নিশ্চয়ই মেনে নেব প্রস্তাবটা।

কঠিন সুরে বলল সনি, অসম্ভব! ড্রাগ নিয়ে ব্যবসা হতে পারে না। বাবা না বলেছেন, সুতরাং তার মতের পরিবর্তন না হলে জবাবটা নাই থাকল।

দ্রুত বলল হেগেন, একটা বাস্তব অসুবিধেও দেখতে পাচ্ছি আমি। বুকমেকিং অথবা পলিসি ব্যবসাতে খোলাখুলি খাটছে আমাদের টাকা। ওখানে আমাদের ক্ষতি করা মোটেও কঠিন নয়। কিন্তু টাটাগ্লিয়াদের এমন কোন ব্যবসা নেই যেখানে ওরা আমাদের মত খোনাখুলি টাকা খাটাচ্ছে। ডক ইউনিয়নগুলোর কাছ থেকে পয়সা খায় ওরা, পয়সা খায় বেশ্যা পাড়াগুলো থেকে। ওদের এইসব রোজগারের ওপর কিভাবে মার দেয়া যায়? আর সব পরিবার কিছু কিছু জুয়া ব্যবসা চালায় বটে, তবে বাড়ি তৈরির ব্যবসাতে টাকা খাটানো, শ্রমিকদের সংঘ পরিচালনা করা, সরকারী কন্ট্রাক্ট যোগাড় করা–বেশিরভাগ এই সমস্ত ব্যাপারেই জড়িত ওরা। নিরীহ, সৎ লোকদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার চালিয়েও বেশ কিছু রোজগার হয় ওদের। তার মানে, আমি বলতে চাইছি, ওদের টাকা রাস্তাঘাটে ছড়ানো থাকে না, কিন্তু আমাদের থাকে। হ্যাঁ, একটা নাইট ক্লাব আছে বটে টাটাগ্লিয়াদের, কিন্তু এত বেশি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে সেটা যে ওটাকে ছুঁতে গেলে নিজেদের বোকামিই প্রমাণ করব আমরা, আমাদের দুর্নামে ছেয়ে যাবে দেশটা। মনে রাখতে হবে, ডন যতদিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মাঠে নামতে না পারছেন ততদিন আমাদের রাজনৈতিক। প্রতিপত্তি ওদের চেয়ে বেশি নয়। তাই বলছি, এখানে একটা বড় সমস্যা রয়েছে। আমাদের।

সমস্যাটা আমার, টম, বলল সনি। এর সমাধানও আমি খুঁজে বের করব। ওদের সাথে কথাবার্তা যেমন হচ্ছে হোক, সেই সাথে কাজের কাজগুলোও শুরু করে দাও। ব্যবসা আবার আমাদেরকে শুরু করতেই হবে, করবও তাই, তারপর দেখা যাবে কি হয় না হয়। আগে অবস্থাটা তো বুঝি। অবস্থা বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যাবে। ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওর দলে সৈনিক তো আর কম নেই। তাছাড়া, ওই পাঁচ পরিবারের হাতে মোট যত অস্ত্র আর গোলাবারুদ আছে, তার চেয়ে বেশি আছে আমাদের হাতে। সত্যি যদি বাড়াবাড়ি করেই, আমরাও না হয় তোশক নেব।

স্বাধীনভাবে চলাফেরায় অভ্যস্ত হারলেমের নিগ্রো ব্যাংকারদের হটিয়ে দিতে কোন সমস্যাই পোহাতে হলো না। কর্লিয়নিরা কাউকে পাঠাল না পর্যন্ত, শুধু একটা খবর পৌঁছে দিল পুলিশকে। পুলিশই হানা দিল আস্তানায় প্রচণ্ড আঘাতে সব তছনছ করে দিল রাতারাতি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যে কোন পুলিশ কর্তাকে বা কোন রাজনৈতিক নেতাকে ঘুষ দেয়া এখনও যুক্তরাষ্ট্রে একজন নিগ্রো। পক্ষে অসম্ভব কল্পনা। কারণ, নিগ্রোদের উপর গোটা জাতির বিদ্বেষ আর অনাস্থা রয়েছে, ওদেরকে কেউ সহ্যই করতে পারে না। তবে, কর্লিয়নিরা সব সময়ই ছোট্ট একটা সমস্যা বলে মনে করে এসেছে হারলেমকে সমাধানটা যে সহজেই হয়ে যাবে সে-ব্যাপারে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না।

কিন্তু পাঁচ পরিবার আঘাত করল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আরেক দিক থেকে। রেডিমেড পোশাক কারখানার দুই প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা খুন হয়ে গেল। এরা কর্লিয়নি পরিবারের লোক ছিল। কর্লিয়নিদের মহাজনরা জাহাজ ঘাটে যাবার পথে বাধা পাচ্ছে, একই সমস্যায় পড়ছে ওদের বুক মেকাররা জাহাজ ঘাটের ডক শ্রমিকদের সংঘগুলো পরিচালনা করে কর্লিয়নিরা, তারা রাতারাতি দল শ্রাগ করে যোগ দিল পাঁচ পরিবারের সাথে। শহরের সব জায়গা থেকে প্রতি মুহূর্তে খবর এসে পৌচাচ্ছে নিজেদের দলে যোগ দিতে রাজী করাবার জন্যে পাঁচ পরিবারের গুণ্ডাপাণ্ডারা নানা ভাবে ভয় দেখাচ্ছে কর্লিয়নি বুকমেকারদের। কর্লিয়নিদের একজন পুরানো বন্ধু এবং সমর্থক আছে হারলেমে। বিখ্যাত নাম্বার্স ব্যাংকার সে। নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হলো তাকে। তার মানে, সত্যি বাড়াবাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাঁচ পরিবার আর কোন উপায় নেই! ক্যাপোরেজিমিদের তোশক নিতে বলল সনি।

দুটো ফ্ল্যাটের দখল নেয়া হলো শহরে তোশক পেতে দেয়া হল সশস্ত্র সৈনিকদের শোবার জন্যে খাবারদাবার রাখার জন্যে একটা করে রেফ্রিজারেটর নিয়ে আসা হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে বুলেট, বিস্ফোরক আর আগ্নেয়াস্ত্র তো আছেই। ফ্ল্যাট দুটোয় ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওর সৈনিকরা আলাদা আলাদা ভাবে রয়েছে ওদিকে শহরের প্রত্যেক বুক-মেকারকে একজন করে বডিগার্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু হারলেমের পলিসি ব্যাংকাররা বিরোধী দলে যোগ দেয়ায় তাদের জন্যে কিছু করার দরকার পড়ছে না এখনই। এসব দিক সামাল দিতে গিয়ে খরস্রোতা নদীর সোতের মত বেরিয়ে যাচ্ছে কর্লিয়নিদের টাকা, অথচ ঘরে একটা পয়সাও আসছে না।

আরও কয়েক মাস কেটে গেছে, এখন আরও কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার ধরা পড়ছে চোখে! তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আশঙ্কাজনক ব্যাপার…পাঁচ পরিবার কর্নিয়নিদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

এর পিছনে কারণও রয়েছে অনেক। ব্যবসা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে অংশগ্রহণ করার মত শারীরিক সুস্থতা এখনও ফিরে পাননি ডন কর্লিয়নি। ফলে কর্লিয়নি পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না, বেশিরভাগই অকর্মণ্য হয়ে আছে। আরেকটা.কারণ, গত এক যুগ শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় দুই ক্যাপোরেজিমির আগের সেই যুদ্ধ করার শক্তিতে ঘুণ আর ক্ষয় ধরেছে। ঘাতক আর ব্যবস্থাপক হিসেবে এখনও সক্রিয় রয়েছে বটে ক্লেমেঞ্জা, কিন্তু সশস্ত্র সৈনিকদের নেতা হবার সেই প্রচণ্ড উৎসাহ বা অদম্য প্রাণশক্তি এখন আর নেই তার মধ্যে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক নরম হয়ে গেছে টেসিও-ও, যথেষ্ট নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয়া তার পক্ষেও এখন সম্ভব নয়। নানা তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষমতা হাতে থাকা সওে যুদ্ধকালীন উপদেষ্টা হবার যোগ্যতা টম হেগেনেরও নেই। একজন সিসিলীয় নয়, এটাই ওর প্রধান দোষ।

যুদ্ধের জন্যে শক্তিবিন্যাস করার সময় পরিবারের এই সব ত্রুটি-বিচ্যুতি আর দুর্বলতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন হয়ে উঠল সনি, কিন্তু এই সব দোষ-দুর্বলতা দূর করে পরিবারটিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাবার কোন উপায় নেই ওর হাতে। পরিবারের কর্তা তো আর সে নয়, ক্যাপোরেজিমি বা কনসিলিয়রি বদল করার ক্ষমতা একমাত্র ডনেরই থাকে। তাছাড়া নতুন করে পা ভাগ-বাটোয়ারা করলেই যে সব সমস্যা মিটে যাবে ব্যাপারটা তাও তো নয়, তাতে বরং কাউকে কাউকে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্যে প্ররোচনা দেয়া হয়ে যাবে। বিপদের উপর বিপদ ডেকে আনার কোন ইচ্ছা এই পরিস্থিতিতে সম্ভবত ডনেরও হত না।

প্রথম দিকে মনে মনে ঠিক করেছিল সনি, ডন সুস্থ হয়ে আবার নেতৃত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত যেমন চলছে চলুক সব, চরন কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির চেহারায় আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা সে করবে না। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার নতুন করে ঘটতে শুরু করায় চিন্তিত হয়ে উঠেছে সে। পলিসি ব্যাংকাররা ঝাঁকে ঝাকে দল ছেড়ে চলে যাচ্ছে, গিয়ে হাত মেলাচ্ছে পাঁচ পরিবারের সাথে। শত্রুপ ভয় দেখাচ্ছে, জুলুম করছে বুক-মেকারদের। মানুষের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে কর্লিয়নি পরিবার। মান-মর্যাদা আর সম্মান কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। সনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। পাল্টা আঘাত হানবে সে।

বুদ্ধিটা ভালই পাকাল সনি। ঠিক করল, পাঁচ পরিবারের একেবারে ধূলে আঘাত করবে সে। মোক্ষম একটা মাত্র চাল চালবে, পাঁচ পরিবারের পাঁচ কর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবে।

উদ্দেশ্যটা ভয়ঙ্কর। তাই আঁটঘাট বেঁধে কাজটায় হাত দিল সনি। জটিল, অতি গোপনীয় একটা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ফেঁদে পাঁচ পরিবারের পাঁচ কর্তার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে সে।

বুদ্ধিটা ভাল, কিন্তু ধোপে টিকল না। প্রাথমিক আয়োজ্বন শুরু করেছে সনি, এক হপ্তাও কাটেনি, অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে পাঁচ পরিবারের পাঁচ কর্তা এমনভাবে গা ঢাকা দিলেন যে কোথাও তাদের ছায়া পর্যন্ত দেখা গেল না আর।

দুই পক্ষ এখন সমান সতর্ক। এটাই সামগ্রিক যুদ্ধ শুরু হবার পূর্ব-মূহূর্ত। পাঁচ পরিবার আর কর্লিয়নি সামাজ্যের মধ্যে এবার চালমাৎ অবস্থা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *