২.৯ একজন শ্রদ্ধেয় মাতবর

০৯.

একজন শ্রদ্ধেয় মাতবর হিসেবে পাড়ার সবাই আজকাল মেনে চলে ভিটো কর্লিয়নিকে। ভিটো কর্লিয়নি কাউকে কিছু বলতে যাননি, তাঁর বন্ধুরাও কিছু রটায়নি, কিন্তু তবু সবাই বলাবলি করে, তিনি নাকি সিসিলীয় মাফিয়া সংগঠনের একজন সদস্য। ফার্নিশ করা একটা কামরা ভাড়া নিয়ে জুয়ার আড্ডা বসায় এক লোক, প্রতি হপ্তায় যেচে পড়ে আসে সে, প্রতিবার, বিশটা করে ডলার দিয়ে যায় ভিটোকে, বিনিময়ে তিনি যেন তার বন্ধ থাকেন। বন্ধুত্বটা প্রকাশ করার জন্যে লোকটার আচ্ছায় হপ্তায় দুএকবার ঘুরে আসতে হয় তাকে, সবাই যাতে বুঝতে পারে লোকটা তার প্রশ্রয় পাচ্ছে।

দোকানদাররাও আসে তার কাছে। ছোকরা কিছু গুণ্ডা তাদেরকে জালাতন করে, ওরা এসে তার কাছে বিচার দাবি করে। বিচার মানে। দোকান এলাকায় মাঝে মধ্যে যেতে হবে তাকে, তাতেই কেটে পড়বে ছোকরাগুলো। নাছোড়বান্দা এই সব দোকানদারদের অনুরোধও ফেলতে পারেন না ভিটো, অগত্যা যেতে হয় তাঁকে, বিনিময়ে উপযুক্ত সম্মানীও নিতে হয়। এই সময় আর এই জায়গার তুলনায় রাতিমত মোটা অঙ্কের টাকা রোজগার হচ্ছে তাঁর, হপ্তায় একশো ডলারের কম নয়। বন্ধু আর শিষ্য বলতে সেই দুজন, ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও। এদেরকেও ভাগ দেন তিনি। চায়া কখনও, তবু নিজে থেকেই দেন। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আশ্রয়দাতা আবানদাণ্ডোর ছেলে অর্থাৎ তার কৈশোরের বন্ধু গেনকো আবানদাড়োকে জলপাই-তেল আমদানির ব্যবসায়ে নামাবেন। সম্পূর্ণ ব্যবসাটা সামলাবে গেনকো, তার মানে, ন্যায্য দাম দিয়ে ইতালি থেকে কিনে জলপাই-তেল আমদানি করবে সে, নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করবে তার বাবার গুদামে। কারবারের এই সব দিক সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা আছে, ভিটো কর্লিয়নি তার সেই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে চান। আর তেল বিক্রি করার দায়িত্ব নেবে তাঁর দুই শিষ্য, ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও। প্রথমে ম্যানহাটান, তারপর ব্রুকলিন, সবশেষে ব্রঙ্কসের সবগুলো ইতালীয় দোকানে যাবে ওরা দোকানদারদেরকে গেনকোর বিশুদ্ধ জলপাই তেল কিনতে রাজি করাবার চেষ্টা করবে। সবিনয় সরলতার সাথে তিনি জানালেন এই ব্যবসার সাথে তার নাম কোন ভাবেই জড়ানো হবে না। অবশ্যই কারবারের মালিক থাকবেন তিনি, কারণ, পুঁজির প্রায় সবটুকু তিনিই যোগাবেন। ঠিক হলো, যে-সব ক্ষেত্রে দোকানদাররা ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওর অনুরোধ সত্ত্বেও তাদের মাল কিনতে রাজি হবেনা, সে-সব ক্ষেত্রে তিনি নিজে যাবেন। এ-ধরনের সমস্যায় তার শারীরিক উপস্থিতিই যে যথেষ্ট সে-ব্যাপারে কারও মনে কোন সন্দেহ নেই। তাতেও যদি কাজ না হয় তখন তিনি নিজের পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ হাসিল করবেন।

পরবর্তী কটা বছর ছোট একজন ব্যবসায়ী হিসেবে যথেষ্ট উন্নতি করলেন ভিটো কর্লিয়নি। ক্রমশ ব্যবসার আয়তন বাড়ছে তাঁর, নিজের সবটুকু শক্তি আর মেধা এর পিছনে ব্যয় করছেন তিনি। ছেলেদের একজন কর্তব্যপরায়ণ বাবা, স্ত্রীর একজন দায়িত্বশীল স্বামী হওয়া সত্তেও হাতে তার এত বেশি কাজের চাপ থাকে যে এদের দিকে নজর রাখার জন্যে খুব বেশি সময় তিনি দিতে পারেন না। বিশুদ্ধ গেনকোর জলপাই তেল ক্রমশ আমেরিকার সবচেয়ে নাম করা আর জনপ্রিয় তেল হয়ে উঠেছে, আর সেই সাথে ব্যবসা থেকে অগাধ টাকা কামাচ্ছেন ভিটো কর্লিয়নি। বুদ্ধিমান যে-কোন একজন ব্যবসায়ীর মত ধারে ধীরে তিনিও বুঝলেন, ব্যবসা বড় করতে হলে বাজার দরের চেয়ে জিনিসের দাম একটু কম রাখতে হয়। অন্য কোম্পানীর মাল দোকানে একেবারে না রাখতে বা খুব কম করে রাখতে দোকানদারদেরকে রাজি করিয়ে প্রতিযোগীদেরকে ব্যবসা থেকে হটিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে হয়। যে-কোন উচ্চাভিলাষী এবং মেধাবী ব্যবসায়ীর মত তারও ইচ্ছা প্রতিযোগীদের ব্যবসায় লাল বাতি জ্বালিয়ে অথবা তার কাছে তাদের সবার ব্যবসা বিক্রি করে দিতে রাজি করিয়ে, ক্রমশ একটা একচেটিয়া ব্যবসার মালিক বনে যাওয়া।

তাঁর ব্যবসার ধরন অন্য ব্যবসায়ীদের চেয়ে একটু আলাদা, তার কারণ খুব অল্প টাকা নিয়ে প্রায় অসহায় অবস্থায় শুরু করেছেন তিনি। বিজ্ঞাপন দেয়াতেও বিশ্বাস নেই তার। বিক্রি বাড়াবার কৌশল হিসেবে নির্ভর করেন মুখের কথার উপর। তাছাড়া, সত্যি কথা হলো, প্রতিযোগীদের তুলনায় তার কোম্পানীর জলপাই তেলটা কোন দিক থেকেই সরেস নয়। তাই সাধারণ ব্যবসায়ীদের মামুলি কৌশলগুলো ব্যবহার করার সুযোগ নেই তাঁর। তিনি নির্ভর করেন নিজের ব্যক্তিত্বের উপর, শ্রদ্ধেয় মাতবর হিসেবে তার একটা বিস্ময়কর খ্যাতি আছে, তিনি সেটাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন।

এখনও অল্প বয়েস, কিন্তু এরই মধ্যে ভিটো কর্লিয়নিকে একজন তীক্ষ্ণবিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বলে চিনে নিয়েছে সবাই। তার ধৈর্য লক্ষ করে অবাক হয়ে যায় সবাই। হুমকি দেয়া তো দূরের কথা, কাউকে কখনও ধমক পর্যন্ত মারেন না। কেউ বলতে পারবে না, আজ পর্যন্ত কাউকে তিনি শাসিয়েছেন। তাঁর নিয়মই হলো সব সময় যুক্তি দেখিয়ে কথা বলা। আর তার যুক্তিগুলোও এমন বলিষ্ঠ যে সেগুলো অস্বীকার বা খণ্ডন করার জো থাকে না কারও। কেউ যাতে না ঠকে, সবাই যাতে লাভের ন্যায্য ভাগ পায়, সেদিকেও তার তীক্ষ্ণ নজর। কেউ কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক বা ব্যবসায় লোকসান দিক তা তিনি চান না। তাঁর এই নীতির কথা তিনি সংশ্লিষ্টদের কাছে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যাও করে থাকেন। প্রতিযোগীদেরকে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন, হয় একচেটিয়া ব্যবসা করো, নয়তো কেটে পড়ো, পাততাড়ি গোটাও। মুক্ত প্রতিযোগিতায় লাভ কম, ঝামেলাও পোহাতে হয় অনেক বেশি। আসল মজা হলো একচেটিয়া ব্যবসাতে। একজন প্রতিভাবান ব্যবসায়ী বলেই ব্যাপারটা শুধু বুঝতে পেরেই ক্ষান্ত হননি তিনি, প্রতিযোগীদেরকে সময় থাকতে ভরাডুবি এড়াবার উপায় বাতলে দিয়ে, স্রেফ উপকার করার উদ্দেশ্যে, এক এক করে কিনে নিতে শুরু করেছেন তাদের ব্যবসাগুলো। অর্থাৎ ব্যবসা থেকে আসল মজা পেতে চান তিনি, নিজের জগতে হতে চান একচ্ছত্র অধিপতি। এটা তার একটা স্বপ্ন। স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দেবার সাধনাই তিনি করছেন।

কিন্তু নানা দিক থেকে বাধাও আসছে বৈকি।

কয়েকজন পাইকারী তেল ব্যবসায়ী আছে ব্রুকলিনে, খুব বদমেজাজী তারা, সাংঘাতিক গোঁয়ার, যুক্তির ধারেকাছে আসতে রাজি নয়। ভিটো কর্লিয়নির যে একটা স্বপ্ন আছে, শত চেষ্টা করেও সে-কথা তাদেরকে বোঝানো যায় না। অথচ প্রচুর ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে সমস্ত খুঁটিনাটিসহ গোটা ব্যাপারটা তাদেরকে তিনি নিজে, বুঝাবার চেষ্টা করেছেন। শেষ পর্যন্ত এদের ব্যাপারে হতাশই হতে হলো তাকে। অসহায় ভঙ্গিতে, অনেকটা আত্মসমর্পণের কায়দায় শরীরের পাশ থেকে হাত দুটো তুলে নৈরাশ্য প্রকাশ করলেন তিনি।

ফিরে এসে টেসিওকে রুকলিনে পাঠালেন তিনি। তার উপর নির্দেশ থাকল ওখানে একটা আস্তানা গাড়তে হবে, এবং সমস্যাটার একটা সমাধান বের করতে হবে। টেসিওঁর জন্যে কাজটা কঠিন তো নয়ই, বরং পানির চেয়েও সহজ হলো। কারণ সমাধানটা কি হবে সে ব্যাপারেও স্বচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন ভিটো কর্লিয়নি।

এরপর একের পর এক পুড়তে শুরু করল ব্রুকলিনের গুদামগুলো! রাস্তার উপর টন টন জলপাই তেলের পুকুর তৈরি হলো। এমন অবস্থা কেউ কখনও দেখেনি, এমন কি স্বপ্নে পর্যন্ত ভাবেলি-সারা দিনরাত গুদাম এলাকায় বিশাল ধোয়ার স্তম্ভ আর আগুনের লকলকে শিখা দেখা যায়। এই সব চলছে, এর মধ্যে ঘটল আরেক ঘটনা। ঘটনার যে নায়ক, তার কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছুই নেই। বাড়ি ছিল মিলানে, নিজের সম্পর্কে তার ধারণা সব সময়ই খুব উঁচু, এমন দাম্ভিক লোক খুব কমই দেখেছেন ভিটো কর্লিয়নি। সেন্টরা যীশুর উপর যতটা বিশ্বাস রাখে, পুলিশের উপর এই লোকের তার চেয়েও বেশি বিশ্বাস। কি সম্পর্ধা লোকটার, সত্যি সত্যি দেশীভাইদের নামে নালিশ করার জন্যে থানায় গেল সে। সেই সাথে দশ দশটা শতকের পুরানো ওমের্তো অর্থাৎ ঠোঁট না খোলার নিয়ম পর্যন্ত ভাঙতে ইতস্তত বোধ করল না। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারল বেচারা। ব্যাপারটা তো বেশি দূর গড়াতে দেয়া যায় না। তাই তাকে গায়েব হয়ে যেতে হলো। তারপর থেকে কারও চোখে পড়েনি সে। সবাই শুধু জানল লোকটা বাতাসে মিলিয়ে গেছে, তবে নিজের ইচ্ছায় নয়। ধরে নেয়া হলো সতী স্ত্রীটি বিধবা, আর ছেলেমেয়ে তিনটে বাপহারা হয়েছে। তবে যীশুর দয়ায় ছেলেমেয়েগুলোর বয়স একেবারে কম নয়, বাপের ব্যবসা চালাবার দায়িত্ব নিতে পারল তারা। বাপের চেয়ে বরং বেশিই বুদ্ধি রাখে ছেলেগুলো, কোন ঝামেলায় না গিয়ে নিজেরাই যেচে পড়ে গেনকোর বিশুদ্ধ জলপাই তেল কোম্পানীর সাথে আপস মীমাংসা করে নিল।

মায়ের পেট থেকে মহান ব্যক্তি হয়ে জন্মায় না কেউ! যারা মহান আর মহৎ ই, নিজেদের চেষ্টায় আর কর্মফলে একটু একটু করে হয়ে ওঠেন। সব মহান বাক্তির বেলাতে এই একই নিয়ম। এই নিয়মে ভিটো কর্লিয়নিও তাই হয়ে উঠেছেন।

এর মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত দ্রব্যের তালিকায় মদও পড়ে গেল, বন্ধ করে দেয়া হলো মদ বেচাকেনার ব্যবসাগুলোকে। ঠিক এই সময় চরম পদক্ষেপ নিলেন ভিটো কর্লিয়নি, অর্থাৎ নিয়তির পথে আরও এক ধাপ এগোলেন। এতদিন ছিলেন একজন সাধারণ ব্যবসায়ী, ব্যবসাটাকে বড় করার জন্যে ছোটখাট এক-আধটু নির্মমতার পরিচয় কখনও দিতেন, এই যা। কিন্তু এবার তিনি ঢুকলেন পুরোপুরি বেআইনী ব্যবসার জগতে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিলেন সাধারণ একজন ব্যবসায়ী মানুষ, সেই পদ থেকে উঠে এলেন ডন বা নেতার পদে। একদিন বা একবছরে সম্ভব হয়নি এটা। মদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির মেয়াদ যখন শেষ হয়ে আসছে আঁর আমেরিকা জুড়ে ইতিহাসখ্যাত ব্যবসায়িক মন্দা যখন শুরু হতে যাচ্ছে, তার আগেই ভিটো কর্লিয়নি মহাপরাক্রমশালী একজন অধিপতি হয়ে উঠেছেন। হয়ে উঠেছেন গড়ফাদার। ডন। ডন কর্লিয়নি।

শুরুটা সহজ আর স্বাভাবিক ভাবেই হলো।

গেনকোর বিশুদ্ধ তেল কোম্পানির মাল আনা নেয়া করার জন্যে ছটা ট্রাক কেনা হয়েছে। হঠাৎ, প্রায় রাতারাতি, অন্য কাজে লাগিয়ে দেয়া হলো সেগুলোকে।

চোরা পথে বেআইনীভাবে মদ, আনায় এমন একদল লোক একদিন দেখা করতে এল ভিটো কর্লিয়নির সাথে, ক্লেমেঞ্জাই নিয়ে নিল তাদেরকে। কানাডা থেকে অ্যালকোহল আর হুইস্কি নিয়ে আসে তারা। এখন তারা নিউ ইয়র্কেও এগুলো সরবরাহ করতে চাইছে, সেজন্যে তাদের কম আর ট্রাক দরকার। সাধারণ লোকজন হলে চলবে না, তাদেরকে বিচক্ষণ, নির্ভরযোগ্য আর সৎ হতে হবে, থাকতে হবে গায়ের আর মনের জোর। লোক আর ট্রাকের জন্যে ভিটো কর্লিয়নিকে মোটা টাকা দিতে রাজি আছে তারা। ভাড়ার অঙ্ক শুনে খুশি হলেন ভিটো কর্লিয়নি। এত খুশি হলেন যে তার তেলের ব্যবসা বেশ একটু খাটো করে এনে প্রায় সারাক্ষণের জন্যে ট্রাকগুলোকে বেআইনী মদ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিলেন। অথচ লোকগুলোর প্রস্তাবের মধ্যে মোলায়েম একটা শাসানি ছিল, তারা ভিটো কর্লিয়নিকে প্রচ্ছন্ন ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের দুর্বলতার কোন রকম সুযোগ নিতে চেষ্টা করলে বা অন্য কোন ধরনের চালাকি করার চেষ্টা করলে পরিণতি ভাল হবে না। তা সত্ত্বেও ওদেরকে সাহায্য করলেন ভিটো। এই অল্প বয়সেও তার বুদ্ধি এতটা হয়ে উঠেছে যে দুএকটা হুমকি, শাসানি, আর অল্প স্বল্প চোখ রাঙানিতে তিনি অপমান বোধ করেন না। রাগ করে কোন লাভজনক প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া তার স্বভাব নয়। অবশ্যই তিনি চোরাকারবারীদের শাসানিটা যাচাই করে দেখে নিলেন, তাতে কোন সার-পদার্থ আছে বলে মনে হয়নি। তবে নতুন সহকর্মীদের যোগ্যতা সম্পর্কে তার বিশ্বাস একটু কমে গেল। এমন নির্বোধ ব্যাটারা, ভাবলেন তিনি, শাসাবার কোন দরকার নেই যেখানে, শুধু শুধু সেখানেও শাসায়। মনে মনে ঠিক করে রাখলেন, বিষয়টা নিয়ে তাকে আরও কিছু ভাবনা চিন্তা করতে হবে।

নতুন কর্মক্ষেত্রেও সাফল্য অর্জন করলেন ভিটো। তিনি নিজে অবশ্য সাফল্যটাকে খুব বড় করে দেখলেন না। খানিকটা জ্ঞান, কিছু যোগাযোগ আর একটু অভিজ্ঞতা–এগুলোকেই ৭ড় গাওয়া বলে মনে করলেন তিনি। ব্যাংকাররা যেমন জামিনের দলিল-পত্র আর টাকা জমা রাখে, ভিটো কর্লিয়নিও সেই রকম সৎকর্ম সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন। উপকার করো, উপকার পাও, তাঁর নিজের জীবন দর্শনের একটা পরিচ্ছেদের সারমর্ম এটাই। উপকার কেউ চাইলে তাকে তিনি ফিরিয়ে দিতে পারেন না। আরও কটা বছর কেটে গেল। সেই সাথে প্রমাণিত হয়ে গো একজন আশ্চর্য গুণী ব্যক্তিই শুধু নন ভিটো কর্লিয়নি, নিজের ক্ষেত্রে অসাধারণ একটা প্রতিভাও বটেন।

অসংখ্য ইতালীয় পরিবার তাদের বাড়িতে ছোট ছোট মদের আড্ডা বসায়। অবিবাহিত শ্রমিকরা এই সব আড্ডার খদ্দের, একগ্লাস মদ কিনতে পনেরো সেন্ট খরচ হয় তাদের। এই সব খদ্দের আর আড্ডাগুলোর রক্ষাকর্তা হয়ে উঠলেন ভিটো কর্লিয়নি। সিনিয়রা কলম্বোর ছোট ছেলেটা যখন গির্জায় বিশ্বাস আনল, তিনি তার ধর্মবাপ হলেন, তাকে একটা বিশ ডলারের স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিলেন। ওদিকে মাঝে মধ্যে পুলিশ যেতার দুটো একটা ট্রাক আটক করবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে, এমন তো হবেই। তাই গেনকে আবানাতো আগেই একজন তুখোড় ওস্তাদ উকিল ভাড়া করে রেখেছে। এই উকিলের আবার যত কড়া মেজাজের পুলিশ অফিসার অ.কোটের জজসাহেবের সাথে খুব খাতির আর দোস্তি। তারা যাতে দয়া করে টাকা নিতে রাজি হয় তার ব্যবস্থা করা হলো। দেখতে দেখতে দয়া করে টাকা খাওয়ার দল সংখ্যায় বিস্ময়করভাবে বেড়ে যেতে শুরু করল। ফলে বিরাট একটা তালিকা তৈরি করার প্রয়োজন দেখা দিল কলিয়নি পরিবারের। প্রতি মাসে টাকা যত বেশি দিতে হয় ততই খুশি হন ভিটো কর্লিয়নি, ততই ফুলে-ফেঁপে ওঠে তার ব্যবসা। এখনও টাকা দেবার দরকার মেই এমন লোকদের নাম তালিকা থেকে কেটে দিতে চাইল উকিল, কিন্তু ভিটো বললেন, না, না, সবার নাম থাকুক। গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ যদি থাকে তাদের নামও টুকে রাখো। এদের কাছ থেকে এখনি হয়তো কাজ পাব না আমরা, তবু নামগুলো থাকুক। শুধু বন্ধুতেই বিশ্বাস রাখি। আমি, আর আমি যে তাদের বন্ধুত্ব চাই সেটা আমার তরফ থেকেই প্রথম প্রকাশ পাক।

যত দিন যাচ্ছে, আরও বিরাট বিশাল হয়ে উঠছে কর্লিয়নি সামাজ্য। আরও অনেক ট্রাক কেনা হয়েছে, দয়া করে টাকা খাওয়ার দল সংখ্যায় আরও বেড়েছে। আগে ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও যত লোক নিয়ে কাজ করত তাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে উঠেছে। ব্যবসার আয়তন আর কর্মচাঞ্চল্য এত বেশি ব্যাপক হয়ে উঠল যে গোটা ব্যাপারটা সামাল দেয়া মুশকিল। সময় হয়েছে বলে মনে হতেই সংগঠনটাকে একটা সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেললেন ভিটো কর্লিয়নি।

ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওর আনুষ্ঠানিক পদোন্নতি ঘটল, কাপ্তান বা ক্যাপোরেজিমি উপাধি পেল ওরা। এদের নিয়ে যারা কাজ করছে তারা সবাই সৈনিক। নিজের কনসিলিয়রি হিসেবে বেছে নিলেন গেনকো আনদাণ্ডোকে, অর্থাৎ সে হলো তাঁর উপদেষ্টা। তার নিজের আর প্রত্যক্ষ কর্ম-তৎপরতা ও ক্রিয়াকলাপের মাঝখানে আরও অনেক নিরাপত্তার কঠিন পাচিল তৈরি করে রাখলেন, যাতে আইন বা আর কারও পক্ষে তাকে ছোঁয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। আদেশ বা হুকুম করলে গেনকো অথবা ক্যাপোরেজিমিদের কাউকে করেন, তখন সেখানে আর কারও উপস্থিতি সম্ভব নয়। অনেক সময় বিশেষ কোন আদেশ শুধু বিশেষ একজনকেই দেন, তৃতীয় আর কারও কানে সে-কথা যায় না। তার মানে কোন সাক্ষী রেখে কোন হুকুম দেন না তিনি।

 এরপর সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়া হলো টেসিওর দলকে, তার উপর ছেড়ে দেয়া হলো ব্রুকলিনের দায়িত্ব। এর অন্যতম কারণ, আসলে ক্লেমেঞ্জার কাছ থেকে টেসিওকে দূরে সরিয়ে দিলেন তিনি। সময় বয়ে যাবার সাথে সাথে আভাসে ইঙ্গিতে তিনি ওদেরকে বুঝিয়ে দিলেন যে ওরা দুজন খুব বেশি মেলামেশা করে সেটা তাঁর পছন্দ নয়। এমন কি, একান্ত দরকার না পড়লে, সামাজিক জীবনেও নয়। বুদ্ধি চিরকালই একটু বেশি টোসওর, তাই কথাটা,শোনা মাত্র সে এর অন্তর্নিহিত কারণটা বুঝে নিল। কারণ হিসেবে ভিটো কর্লিয়নি অবশ্য বললেন, আইনের চোখে যাতে পড়তে না হয় সেজন্যেই এটা চাইছেন তিনি। কিন্তু আসল কারণ ঠিকই ধরতে পেরেছে টেসিও, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার কোন সুযোগ ক্যাপোরেজিমিদের দিতে চাইছেন না ভিটো কর্লিয়নি।

কথাটা বুঝতে পেরে মন খারাপ হয়নি টেসিওর, এর মধ্যে যে আসলে কোন, আক্রোশ, ভয় বা সন্দেহ নেই তাও বুঝতে পেরেছে সে। এটা হলো, নিরাপত্তা বিধানের বিচক্ষণ ব্যবস্থা। বিপদ ঘটে যাবার আগে সাবধানতা অবলম্বন করা। এতে দোষের কিছু নেই। দূরে সরিয়ে দেবার বিনিময়ে ব্রুকলিনে অনেকটা স্বাধীনতা দিলেন ভিটো টেওিকে। কিন্তু ক্লেমেঞ্জার ব্রঙ্কসের জায়গীরটা নিজের মুঠোর ভিতর রাখলেন। টেসিও কেন, অনেকের চেয়ে অনেক বেশি সাহসী ক্লেমেঞ্জা, মানুষ হিসেবে বেপরোয়া, কাউকে কেয়ার করা ওর ধাতে নেই। বাইরে থেকে যতই হাসিখুশি দেখাক তাকে, তার নিষ্ঠুরতাও বিস্ময়কর। তাই তাকে একটু শক্ত বাধনে রাখতে চান ভিটো কর্লিয়নি।

ত্রিশ দশকের মন্দাও এল, সেই সাথে হু হু করে বেড়ে যেতে লাগল ভিরে কর্লিয়নিদের ক্ষমতা। ঠিক এই সময় থেকেই সবাই তাকে ডন বলে সম্বোধন কর শুরু করল। ডন। ডন কর্লিয়নি। ডন ভিটো কর্লিয়নি।

সৎ আর ভালমানুষ লোকেরা খামোকা শহর চষে জুতোর সুকলা খুইয়ে ফেলে সৎ একটা চাকরির খোঁজে, বাজার মন্দা বলে কেউ তারা কোথাও সুবিধে করতে পারে না। এদের মধ্যে কিছু লোক, যাদের এক ধরনের গর্ব আর ন্ত আছে, তারাও বাধ্য হয়ে অপমান হজম করে, নিজের আর পরিবারের মাথা হেঁট করে সরকারী লঙ্গরখানা থেকে ভিক্ষার দান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ডন কর্লিয়নির লোকেরা? তারা ফিটফাট বাবুসাহেব হয়ে বেরোয়, বুক উঁচিয়ে হাঁটে, তাদের সবগুলো পকেট টাকায় ভর্তি হয়ে ফুলে থাকে। চাকরি হারাতে হবে, এদের কারও মনে সে-ভয় নেই। এসব দেখেশুনে এমন কি ডন ভিটো কর্লিয়নির মত একজন বিনয়ী মহান পুরুষও একটু একটু গর্ব অনুভব করেন। নিজের এলাকা আর নিজের লোকদের জন্যে যতটা করা সম্ভব তার চেয়ে বেশি করেন তিনি। তার উপর নির্ভর করে যারা, কাজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, তাকে উৎসর্গ করে দিয়েছে নিজেদের জীবন আর ভাগ্য, তাদেরকে তিনি ডুবিয়ে দেন না। যদি বা কখনও তার কোন লোক অ্যারেস্ট হয়ে জেলে যায়, তার পিরবারের কথা ভেবে মুষড়ে পড়তে হয় না তাকে, কারণ সে জানে, তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বুড়ো মা-বাপ-পিরবারের সবাই ভাল খেয়ে, ভূল পরে দিন কাটাবে, যতদিন না সে আবার বেরুতে পারছে জেল থেকে। এই এ ধরনের হতভাগাদের পরিবারকে দয়া করে, বাধ্য হয়ে সামান্য খুঁদকুড়ো দেয়া হয়, ব্যাপারটা মোর্টেও সে-রকম নয়। মুক্ত অবস্থায় লোকটা যা বেতন পেত তার সবটাই দেয়া হয়।

এর পিছনে সবটাই সৎ খৃস্টান সুলভ বদান্যতা আছে, ব্যাপারটা তাও নয়। ডনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, অন্তরঙ্গ বন্ধুরাও তাকে বেহেশতের ফেরেশতা বলে মনে করে না। এই দয়া-দাক্ষিণ্যের মধ্যে কিছুটা স্বার্থও আছে বৈকি। কোন বুদ্ধিমান মানুষ, সে মহান হোক বা নিকৃষ্ট হোক, তার প্রতিটি কাজে স্বার্থ থাকতে হবে, একজন সাধারণ মানুষের বেলাতেও এই কথা সত্যি। ডন ভিটো কর্লিয়নির যে সব লোকেরা জেলে যায় তারা জানে, যত জেরাই করা হোক, মুখ ভোলা চলবে না। শুধু মুখ বুজে থাকলেই তার পরিবারের সবাই আগের মতই সুখে-শান্তিতে থাকবে। ডনের প্রতি শ্রদ্ধা আর সততা বজায় রাখলে জেল থেকে বেরুলে রাজকীয় অভ্যর্থনা জুটবে তার কপালে। তার বাড়িতে বিরাট খানাপিনার ব্যবস্থা করবেন ডন। আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুরা আসবে সেই উৎসবে, সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। তারপর, উৎসবের শেষে রাত যখন অনেক গভীর, তখন তার কাছে আসবে কনসিলিয়রি গেনকৈা আবানদাণ্ডো, কিম্বা হয়তো এমন কি স্বয়ং ডন নিজেই। তার সাহস আর সতোর প্রশংসা করে যাবেন তারা। তাকে সম্মান দেখিয়ে তিনি হয়তো তার বাড়িতে তৈরি একগ্লাস মদ নিয়ে দুচুমুক খাবেন, আর ফেরার সময় তাকে দিয়ে যাবেন প্রচুর টাকা, উপহার হিসেবে। সে যাতে তার দৈনন্দিন কাজে আবার যোগ দেবার আগে সপরিবারে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে বা কয়েকটা দিন মামোদ ফুর্তি করে বেড়াতে পারে। এই রকম অপার ভালবাসা, সহানুভূতি আর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে থাকেন ডন কর্লিয়নি।

বৃহত্তর জগৎ যারা পরিচালনা করে তারা তার উন্নতির পথে বাধা তো বটেই, তাদেরকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। কিন্তু এক সময় উপলব্ধি করলেন, তাদের তুলনায় নিজের আয়ত্তাধীন এলাকাটা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালভাবে পরিচালনা করেন নিজে। পাড়ার গরীব লোকেরা সাহায্যের জন্যে তার কাছে বারবার এসে ধারণাটাকে আরও দৃঢ় করে তোলে। তাদের কি না উপকারে লাগছেন তিনি। সরকারী সাহায্য পাবার জন্যে, অল্পবয়েসী ছেলেকে একটা চাকরি পাইয়ে দেবার জন্যে, এই সাংঘাতিক দুর্দিনে কিছু টাকা ধার পেতে, বিপদে পড়লে দয়া ভিক্ষা করতে, ফ্যাসাদে পড়লে মধ্যস্থতা করে দেবার অনুরোধ জানাবার জন্যে সবাই আসছে তার কাছে– তিনি ছাড়া এসব ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করার আর আছেইবা কে?

কাউকে প্রত্যাখ্যান করেন না তিনি সবাইকে সাহায্য করেন। শুধু দয়া দেখাবার জন্যে নয়, বড়লোকি ফলাবার জন্যে নয়, সাহায্য তিনি খুশি মনে, যে উপকার করার জন্যে করেন। শুধু তাই নয়, সেই সাথে দুটো উৎসাহের কথাও শোনান, ভিক্ষা গ্রহণের তিক্ত স্বাদটা যাতে ভুলে যায় তারা। তাই, রাজ্যের আইনসভায়, পৌর সংস্থায় অথবা কংগ্রেসে এই সব ইতালীয় লোকেরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে কাকে সেব্যাপারে পরামর্শ নেবার জন্যে ডন কর্লিয়নির কাছে ছুটে আসবে না তো কার কাছে ছুটে যাবে? আর তাদেরকে পরামর্শ দেবার সময় নিজের স্বার্থটা যে দেখবেন তিনি, এতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে? এইভাবে ধারে ধীরে রাজনীতির একজন নেপথ্য নায়ক হয়ে উঠলেন তিনি। বাস্তব বুদ্ধি আছে এমন সব দলীয় নেতারা তাঁর কাছে আসে, কি করলে তাদের ভাল হবে সে-ব্যাপারে উপদেশ পরামর্শ চায়। এই অবস্থা ডন কর্লিয়নির হাতে আরও ব্যাপক এবং প্রচুর ক্ষমতা এনে দিল, এবং একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনীতিবিদের প্রতিভা নিয়ে তিনি অনায়াসেই তাঁর এই নতুন পাওয়া প্রচণ্ড ক্ষমতাটাকে কাজে লাগিয়ে আরও বিশাল এবং দুর্ভেদ্য হয়ে উঠলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তার দূরদৃষ্টি সম্পর্কে প্রশংসা না করে পারে না। গরীবের ছেলে, অথচ মাথাটা ভাল, এই ধরনের সবাইকে তিনি লেখাপড়া শেখান নিজের খরচে। এই সব ইতালীয় ছেলেরা কলেজ থেকে বেরিয়ে উকিল হয়, আঞ্চলিক সহকারী অ্যাটর্নি হয়, এমন কি কেউ কেউ কোর্টের বিচারক পর্যন্ত হয়ে বসে। এরা সবাই ডন কর্লিয়নির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। একজন মহান জাতীয় নেতা যেভাবে তার সামাজ্যের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেন, ডন কর্লিয়নিও ঠিক সেভাবে তার সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রচনা করেন।

কিন্তু মদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যেতেই ডনের এই সাম্রাজ্য প্রচণ্ড এক আঘাত খেয়ে টলমল করে উঠল। তবে, এক্ষেত্রেও তাঁর দূরদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া গেল। এই ধরনের কিছু একটা ঘটতে পারে, তা তিনি আগেই অনুমান করতে পেরে প্রতিকারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ম্যানহাটনের সমস্ত জুয়া খেলা পরিচালনা করে যে লোকটা, তার কাছে প্রতিনিধি পাঠালেন তিনি। লোকটার নাম সালভাতোরি মারানজানো। ডকের ক্রাপ খেলা থেকে শুরু করে, ঘোড় দৌড়ের বাজি, বেআইনী পোকার খেলা, পলিসি আর নম্বর নিয়ে যত রকম জালিয়াতি আছে সব তার হাতের মুঠোয়। নিউ ইয়র্কের গোটা অপরাধ জগতের সবাই তাকে যমের মত ভয় করে। সেৎসোনোভান্তি, নব্বই ক্যালিবার অর্থাৎ সর্দার বলে একবাক্যে স্বীকার করে। ডন কর্লিয়নির প্রতিনিধিরা সরাসরি প্রস্তাব করল, ব্যবসা এবং লাভের বা আধাআধি থোক, তাতে দুপক্ষেরই সুবিধা হবে। কর্লিয়নিদের আছে দৃঢ় মজবুত সংগঠন, পুলিশ আর রাজনীতিকদের প্রশ্রয়! এসবের সাহায্যে ডন কর্লিয়নি মারানজানোদের সমস্ত তৎপরতার উপর একটা বিপদ নিবারক নিচ্ছিদ্র ছাতা ধরতে পারবেন। তাছাড়া, ইচ্ছা করলে তারা ব্রুকলিন এবং ব্রঙ্কস পর্যন্ত নিজেদের কর্মতৎপরতার বিস্তৃতি ঘটাতে পারবে, সেজন্যে সব ধরনের ক্ষমতা ধার দেবেন ডন কর্লিয়নি। কিন্তু, মুশকিল হলো, মারানর্সানো লোকটার দূরদৃষ্টি বলতে গেলে কিছুই নেই, নিজের কিসে ভাল হবে তা ভেবে না দেখেই ডন কর্লিয়নির প্রস্তাব ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করল সে।

বিখ্যাত আল ক্যাপনি হলো মারানজানোর বন্ধু, তাছাড়া তার নিজেরও রয়েছে একটা সংগঠন, রয়েছে প্রচুর গোলাবারুদ। শক্তিতে কারও চেয়ে নিজেকে সে কম মনে করবে কেন? ডন কর্লিয়নিকে একজন ভূঁইফোড় ছাড়া আর কি ভাবতে পারে সে? তার তো ধারণা, অপরাধ জগতে না এসে লোকটার পার্লামেন্টের সদস্য হওয়া উচিত ছিল, তর্ক আর যুক্তি দিয়ে নোকটা দুনিয়া জয় করতে চায়। পাগল আর কি!

কিন্তু, ডন কর্নিয়নিকে চিনতে ভুল করল মারানজানো। ডন কর্লিয়নির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার ফলেই তোত বেঁধে গেল উনিশশো তেত্রিশ সালের বিখ্যাত দলীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলে নিউ ইয়র্ক শহরে অপরাধ জগতের গঠন প্রণালী আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ বদলে গেল।

যুদ্ধের শুরুতে মনে হলো দুপক্ষের শক্তি এক নয়। সালভাতোরি মারানজানোর সংগঠনটা খুব শক্তিশালী। তার দলের গুণ্ডারা যেমন নিষ্ঠুর তেমনি বেপরোয়া। তাছাড়া শিকাগোর আল ক্যাপনি তার বন্ধু, সেখান থেকে সৈনিক এবং অন্য সব ধরনের সাহায্য আনতে পারে সে। এদিকে তার সদ্ভাব রয়েছে টাটাগ্রিয়া পরিবারের সাথে, যাদের হাতে রয়েছে শহরের বেশ্যা ব্যবসার সবটুকু আর এখনও অবশিষ্ট কিছুটা মাদক দ্রব্যের কারবার। এসব ছাড়াও ব্যবসায়ী সমিতির প্রভাবশালী কিছু নেতাদের সাথে যোগাযোগ আছে মারাজানোর। তারা ওর কাছ থেকে গুণ্ডা ভাড়া নিয়ে অত্যাচার চালায় রেডিমেড পোশাক তৈরির শ্রমিক-সংঘের সদস্যদের উপর আর ইমারত তৈরি ব্যবসার ইতালীয় নৈরাজ্যবাদী সংঘের উপর।

মারানজানোর এই ব্যাপক শক্তির বিরুদ্ধে ডন কর্লিয়নি মাত্র দুটো ছোট ছোট দল-নামাতে পারেন। সংখ্যায় মাত্র দুটো আর আকারে ছোট হলেও দল দুটো ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওর দক্ষ নেতৃত্বে নিখুঁতভাবে সুসংগঠিত, একটা সুশিক্ষিত সেনাদলের মত। ডন কর্লিয়নি পুলিশ আর রাজনীতিকদের প্রশ্রয় পাবেন বটে, কিন্তু মারানজানোর রয়েছে বণিক সমিতির সমর্থন। এক্ষেত্রে, ডনের ক্ষমতা মারাজানোর তুলনায় কিছুই নয়, ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তবে ডনের মস্ত একটা সুবিধে হলো এই যে তাঁর সংগঠন সম্পর্কে কোন খবরই জানা নেই শত্রুপক্ষের। তার একটা সেনাদল থাকতে পারে, অনুমান করত অনেকেই, কিন্তু সেই দলের প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে কারও কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। তাছাড়া, সবাই মনে করত ব্রুকলিনের টেসিওর দলটার সাথে ডনের কোন সম্পর্ক নেই, সেটা টেপিওর নিজস্ব একটা দল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দুদলের শক্তি সমান নয়। ডন কলিয়ান তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট আর দুর্বল, যুদ্ধে তার কোন আশা নেই। তবে বিরোধী দলের মত শুধু শক্তির উপর ভরসা করে নেই তিনি। প্রথম দিকে মার খেয়ে মার হজম করতে হলো তাকে। কিন্তু তা খুব বেশি দিন নয়। আশ্চর্য এক মোক্ষম আর নিপুণ চালে সমস্ত বিজোড় সংখ্যাগুলোকে জোড় সংখ্যায় পরিণত করলেন তিনি, শক্তির অসাম্য সৃষ্টি করলেন।

ওদের ভাষায় ভুঁইফোড় ডন কর্লিয়নিকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যে ক্যাপনির কাছ থেকে লক্ষ্যভেদে অব্যর্থ দুজন পিস্তলধারীকে চেয়ে পাঠাল মারানজানো। কর্লিয়নি পরিবারের লোকজন, বন্ধু-বান্ধব আর গুপ্তচর শিকাগোতেও আছে, তারা যথাসময়ে খবর পাঠাল পিস্তলধারীরা ট্রেনে করে রওনা হয়েছে। ওদের একটা ব্যবস্থা করার জন্যে ডন কর্লিয়নি একজন লোককে পাঠালেন। তার নাম লুকা ব্রাসি। উনার সাম্রাজ্যের অন্যতম স্তম্ভতে এমন সব নির্দেশ দিলেন, যা শুনে এই বিস্ময়কর প্রাণীটির মনের সবচেয়ে নৃশংস পৈশাচিক দিকের দরজাটা খুলে গেল।

চারজন লোককে সাথে নিল বাসি। শিকাগো থেকে মেহমান আসছে, মাসি আর তার দল রেলস্টেশনে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে। তার একজন লোককে সি একটা ট্যাক্সিতে ড্রাইভার সেজে বসে থাকতে বলেছে। স্টেশনের কুলি মজুররাও ব্রাসির লোক, তারা মেহমানদের ব্যাগ-ব্যাগেজগুলো বয়ে নিয়ে লি, ভুলল ওই ট্যাক্সিটাতেই। মেহমানরাও উঠল গাড়িতে, ব্রাসির লোকেরাও পিছু পিছু উঠে পড়ল। মেহমানরাতো আর এ-ধরনের কোন ঘটনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তাই সির দল পিস্তল দেখাতেই তারা গাড়ির ভিতর পা রাখার জায়গায় শুয়ে পড়া ছাড়া উপায় দেখল না। আগে থেকেই ভকের কাছে একটা মাল-গুদাম ঠিক করা আছে ব্রাসির, ঝড় তুলে সেখানেই পৌঁছুল ট্যাক্সি।

আল ক্যাপনির নোক দুজনের হাত-পা বেঁধে ফেলা হলো প্রথমে, তারপর তাদের মুখের ভিতর গুঁজে দেয়া হলো দুটো তোয়ালে। এখন তারা যত ইচ্ছা চেঁচাতে পারে, কোন শব্দ বেরুবে না!

দেয়ালের গায়ে দাঁড় করানো রয়েছে একটা কুড়াল, এগিয়ে গিয়ে সেটা নিয়ে এল ব্রাসি। শক্ত কাঠ চেরার জন্যে যতটা গায়ের জোরে কাঠরেরা কুড়াল চালায় ব্রাসিও সেই রকম জোরের সাথে মেহমানদের একজনকে কোপাতে শুরু করে দিল। তবে, এলোপাতাড়ি ভাবে কোন কাজ করতে পছন্দ করে না বালি, প্রথমে সে লোকটার পায়ের পাতা দুটো কেটে নিল। তারপর আলাদা করুল হাঁটুর কাছ থেকে পা দুটোকে। কুচকির একটু নিচে থেকে উরু দুটো কেটে ফেলতেও খুব বেশি সময় নিল না বাসি। গায়ে তার প্রচণ্ড শক্তি, তবে অনেক বার কুড়াল দিয়ে কোপ মারতে হলো তাকে।একটা কাজ শুরু করলে সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কার বাপের সাধ্যি তাকে থামায়। এর মধ্যে কখন মরে ভূত হয়ে গেছে লোকটা, কিন্তু বাসি সেই মৃতদেহের উপর আরও কিছুক্ষণ কোপ মারল। মাল-গুদামের পুরো মেঝেতে রক্ত মাংসের ছড়াছড়ি, পা ফেলতে ভয় হয়, এমন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। এরপর দ্বিতীয় মেহমানের দিকে ফিরল ব্রাসি। তাকে দেখেই বুবলি, কষ্ট করার আর কোন দরকারই নেই। তোয়ালে গিলে ব্রাসির কাজটা নিজেই সেরে ফেলেছে লোকটা। ইচ্ছা করে, নাকি নিজের অজান্তে তোয়ালেটা গিলেছে তা আর এখন জানার কোন উপায় নেই। শুধু একটা ব্যাপার বোঝা যায়, লোকটা ভয় পেয়েছিল। পুলিশের ডাক্তার ময়নাতদন্ত করার সময় ওই তোয়ালেটা পেটের ভিতর থেকে পেল।

কয়েকদিন কেটে গেল। নতুন আর কিছুই, ঘটছে না। কেমন যেন থমথম করছে বাতাস। কিছু যদি ঘটে, শিকাগোর আল ক্যাপনি ভাবছে, ডনের তরফ থেকেই ঘটবার সম্ভাবনা। ঘটলও তাই। ডন কর্লিয়নির কাছ থেকে একটা চিঠি পেল সে।

ডন কর্লিয়নির চিঠিতে বলা হয়েছে।

এখন তো আর তোমার অজানা নেই, শত্রুর সাথে কি ধরনের আচরণ করি আমি। আচ্ছা, দুজন সিসিলিয়ানের মধ্যে যদি বিরোধ বাধে তার মধ্যে একজন নিয়াপলিটান নাক গলাতে আসে কেন? তবে তোমরা যদি আমাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করতে চাও, সেটা আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে আমি তোমাদের কাছে ঋণী হয়ে থাকব, এবং যখনই তোমরা দাবি করবে তখনই সে ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করব। তুমি বোকা। একথা আমি স্বীকার করি না-সুতরাং তুমি নিশ্চয় বুঝবে যে এমন বন্ধু থাকা কি রকম লাভজনক যে তোমার কাছ থেকে কোন রকম সাহায্য চাইবে না, নিজের ঝামেলা নিজেই সামলাবে, অথচ তুমি কখনও যদি বিপদে পড়া, সব রকম সাহায্য নিয়েসে তোমার পাশে দাঁড়াবে। এসব কথার মানে কোরো না যে আমার বন্ধুত্ব তোমাকে চাইতেই হবে! না চাও, সেও ভাল কথা। তবে, সেক্ষেত্রে তোমাকে আমি না জানিয়ে পারি না যে আমাদের এদিকের আবহাওয়া, বড় বেশি সঁতসেঁতে, নিয়াপলিটানদের স্বাস্থ্যের জন্যে মোটেও.অনুকূল নয়। এত কথা বলে তোমাকে আমি ঠিক কি পরামর্শ দিতে চাইছি তা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ? হ্যাঁ এখানে কখনও এসে না।

চিঠির সুরে একটু দম্ভ রয়েছে, সেটা ইচ্ছাকৃত। ক্যাপনিরা প্রকাশ্যে গলাকাটা খুনে, নির্বোধ, সেজন্যে ওদেরকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেন ভুন। নিজের স্বাভাবিক বুদ্ধির সাহায্যে বুঝতে পেরেছেন প্রকাশ্যে খুব বেশি. সর্দারী ফলাতে গিয়ে আর বেআইনী পথে রোজগার করার টাকার গরমে বেসামাল হয়ে পড়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলেছে ক্যাপনি। ডন জানেন, নিশ্চিতভাবেই জানেন, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং তার সাথে একটা নিরীহটাইপের সামাজিক ছদ্মবেশ নেই যার, অর্থাৎ ক্যাপনি অথবা তার মত আর সবার জগতকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া সম্ভব। তিনি বুঝতে পারছেন, ধ্বংসের পথ ধরে নামতে শুরু করেছে ক্যাপনি। তাঁর কাছে খবর আছে শিকাগোর শহর এলাকায় ক্যাপনির ক্ষমতা যতই ভয়াবহ আর বিস্তৃত হোক না কেন, শহরের বাইরে তার কোন মূল্য নেই।

ডন যা আশা করেছিলেন তাই হলো। শত্রুপক্ষ নত হলো তার হিংস্রতার নমুনা দেখে নয়, তার বিদ্যুৎ গতি সম্পন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে। শর্করা বুঝল, কর্লিয়নিদের গুপ্তচর বিভাগ অত্যন্ত দক্ষ, তাদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আর একটা কিছু করতে গেলে এবারের আঘাতটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে আসবে। ঝুঁকি নিয়ে দরকার নেই, ভাবল তারা, তার চেয়ে অনেক ভাল ভনের বন্ধুত্বের প্রস্তাব মেনে নিয়ে তার দেয়া সুবিধেগুলো গ্রহণ করা। চিঠির জবাবে ক্যাপনি জানাল, সে আর নাক গলাবে না।

দুপক্ষের হাতের তাস এবার সমান সমান হলো। ক্যাপনি নতি স্বীকার করায় সারা যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ জগতে ডন কর্লিয়নির নাম ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ল, সব ধরনের অপরাধীর কাছে তিনি একজন শ্রদ্ধেয়, সম্মানী ব্যক্তি হয়ে উঠলেন। কিন্তু। মানজানোর সাথে যুদ্ধ তাতে থামল না। যুদ্ধ চলছে, তবে মারানজানোদের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে কর্লিয়নিরাই। একটানা ছমাস ওদেরকে নাকানিচোবানি খাওয়ালেন ডন। মারানজানোর ক্রাপ খেলার আজ্ঞায় হানা দিয়ে সব তছনছ করে দেয়া হলো। হারলেমে তার প্রধান পলিসি ব্যাংকারকে খুঁজে বের করা হলো, তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো একদিনের সমস্ত খেলার ফল, শুধু টাকাগুলো নয়, সেই সাথে, নথিপত্রগুলোও।

ডন কর্লিয়নি খুঁজে পেতে নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র আবিষ্কার করছেন। তাঁর ইচ্ছা, একবার যখন তাঁকে নামানো হয়েছে, শত্রুর জড় পর্যন্ত উপড়ে ফেলবেন তিনি। যেখানে শত্রু সেখানেই তিনি না দিচ্ছেন, মুখোমুখি হচ্ছেন তাদের। ক্লেমেঞ্জাকে পাঠালন রেডিমেড পোশাক তৈরি কারখানাগুলোর শ্রমিক সংঘের পক্ষ নিয়ে মারানজানো আর মালিকদের ভাড়াটে গুণ্ডাদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কার্নিয়মিদের রণ-কৌশল তুলনামূলক ভাবে অনেক ভাল, সবখানেই জিতছে তারা। ক্লেমেঞ্জার মাংসল মুখে ছড়িয়ে আছে সদয় হাসি কিন্তু মনে তার চরম হিংসতা, সেটাকে অতি সুকৌশলে কাজে লাগাচ্ছেন ডন। দ্রুত যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাচ্ছে তার ফলে। সবশেষে তিনি সযত্নে আলাদা করে রাখা টেসিওর দলকে পাঠালেন স্বয়ং মারানজানোর উদ্দেশ্যে।

এর মধ্যে শান্তি প্রার্থনা করে বিশেষ দূত পাঠাতে শুরু করেছে মারানজানো। কিন্তু তাদের সাথে দেখা করেননি ডন। নানা অজুহাত দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। ওদিকে মারানজানোকে ফেলে পালাতে শুরু করেছে তার দলের লোকেরা। চলতি যুদ্ধে মারানজানোর পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। সবার জানা হয়ে গেছে ব্যাপারটা, এরপরও কোন্ বোকা তার জন্যে বেহুদা সড়ে প্রাণ দিতে যাবে? মারানজানোর বুকমেকার আর মহাজনেরা কর্লিয়নিদের প্রশ্রয় আর সমর্থন পাবার জন্যে টাকা দিতে শুরু করেছে। বলতে গেলে এক রকম শেষই হয়ে গেছে।

অবশেষে, উনিশশো তেত্রিশ সালের বর্ষা শুরুর আগের রাত এসে পড়ল। এর আগেই মারানজানোর সুরক্ষিত এলাকার ভিতর ঢুকে পড়েছে টেসিওর দল। ডনের নির্দেশ অনুযায়ী একটা প্রস্তাব প্লাঠাল টেসিও, মারানজানোর কাছে নয়, তার লেফটেন্যান্টদের কাছে। তারা আপস করার জন্যে একপায়ে খাড়া হয়ে আছে। জানে, মিটমাট না হলে তাদের একজনের প্রাণও বাঁচবে না। যে-কোন শর্তে শান্তি চায় তারা। হ্যাঁ, নেতার সাথে বেঈমানী পর্যন্ত করতে রাজি আছে। এখন নিজেদের প্রাণ বাঁচাবার তাগিদ ছাড়া আর কিছুই অনুভব করছে না তারা।

লেফটেন্যান্টরাই মারানজানোকে জানাল, আপস-মীমাংসায় বসার জন্যে ব্রুকলিনের একটা রেস্তোরাঁ নির্বাচন করা হয়েছে। বডিগার্ড হিসেবে তারাও এল সেখানে মারানজানোর সাথে। মারানজানোকে একটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে তারা। একটুকরো রুটি নিয়ে সেটা চিবাচ্ছে মারানজানো, চেহারায় বিমর্ষ ভাব। এই সময় চারজন লোক ঢুকল রেস্তোরাঁয়, সাথে টেসিও। এদেরকে দেখেই যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল বডিগার্ডরা। শান্তি দিতে কখনও দেরি করে না টেসিও। আধা চিবানো পাউরুটি এখনও রয়েছে মুখের ভিতর, কিন্তু অসংখ্য বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে মারানজানোর শরীর। মারানজানো খতম, সেই সাথে যুদ্ধেরও পরিসমাপ্তি।

বলাই বাহুল্য, এরপর আপনাআপনি মারানজানো সাম্রাজ্যে কর্লিয়নি সংগঠনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। চাঁদা বা খাজনা, যাই বলা হোক, নিজের নিয়মে সেগুলো সংগ্রহের ব্যবস্থা করলেন ডন কর্লিয়নি। বুকমেকিং আর পলিসি জালিয়াতির কাজে যারা আগে ছিল, তাদেরকে স্ব স্ব পদে বহাল রাখলেন তিনি। অনেক লাভের মধ্যে একটা হলো, রেডিমেড পোশাক তৈরির শ্রমিক সংঘে একটা পা ফেলার জায়গা পাওয়া গেল–ভবিষ্যতে এই ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

ব্যবসা সংক্রান্ত ঝামেলা তো মিটল, কিন্তু ডন দেখলেন বাড়িতে অশান্তির সূচনা হয়েছে।

সনি, সান্তিনো কর্লিয়নি মাত্র ষোলো বছরে পা দিয়েছে। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে লম্বায় ছয় ফুট, মস্ত চওড়া দুই কাঁধ, মুখটা প্রকাণ্ড আর ভারি, দেখেই মনে হয় ইন্দ্রিয়পরায়ণ, প্রচণ্ড কামুক। শক্তিশালী বঁড় একটা। মেজ ছেলেটা শান্ত আর বোকা টাইপ। মাইকেল তো সবে হাঁটতে শিখেছে। যত গণ্ডগোল ওই সনিকে নিয়েই। যার তার সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে, স্কুল ফাঁকি দেয়। একদিন একটা অভিযোগ নিয়ে এল ক্লেমেঞ্জা। সনির ধর্মবাপ সেই, অভিযোগ করা তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

ক্লেমেঞ্জার মুখ থেকে ডন শুনলেন, সনি একটা সশস্ত্র ডাকাতির সাথে জড়িয়েছে নিজেকে। এর চেয়ে বোকার মত কাজ আর হতে পারে না ভাগ্য ভাল, ব্যাপারটা ঘটাতে গিয়ে কোন বিপদে জড়িয়ে পড়েনি, তা নাহলে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াতে পারত। অনুমানেই বোঝা যায়, সনিই পালের গোদা, বাকি ছেলে দুটো তারই শিষ্য।

রাগের বিস্ফোরণ কদাচ দেখা যায় জুনের মধ্যে, সেদিন তিনি বিস্ফোরিত হলেন। টম হেগেন এ-বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে আজ বছর তিনেক হলো, তিনি ক্লেমেঞ্জাকে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন সেই এতিম ছেলেটাও এই ডাকাতির সাথে জড়িত কি না। ক্লেমেঞ্জা এদিক ওদিক মাথা নাড়ল।

সনিকে ডেকে পাঠালেন তিনি। এলো সে, বাপের সামনে ছয় ফুট উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দশাসই ছেলেকে সিলিীয় ভাষায় গাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিতে শুরু করলেন ডন। ক্রোধ প্রকাশ আর গালমন্দ করার জন্যে সিসিলীয় ভাষার তুলনা হয় না। সবশেষে একটা প্রশ্ন করলেন তিনি, এ-ধরনের কাজ করার অধিকার তুমি পেলে কোথায়? এমন কুমতি তোমার হলোই বা কেন?

মাথা একটু নিচু হয়ে গেছে সনির। বাবার প্রশ্নের কোন জবাব দিল না সে।

তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন ডন, আর বুদ্ধির কি নমুনা! একটা রাত খেটে পেলে কত? মাথা পিছু পঞ্চাশ ডলার? নাকি আরও কম, বিশ ডলার? বিশটা ডলারের জন্যে নিজের প্রাণের ওপর ঝুঁকি নিলে? আঁ?

বাবার কথা যেন কানেই যায়নি, হুট করে অন্য এক প্রসঙ্গ তুলল সে, যা ডনের কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত। উদ্ধত, একটা ভঙ্গি দেখা গেল, তার চেহারায়, উঁচু গলায় বলল, মনে করেছ আমি কিছু জানি না, কিন্তু নিজের চোখে সব দেখেছি আমি-ফানুচিকে খুন করেছিলে তুমি!

ও! বললেন ডন। আচ্ছা! কথাটা বলে চেয়ারে হেলান দিলেন, ছেলে আর কি বলে শোনার অপেক্ষায় রয়েছেন।

বিদায় নিয়ে ফানুচি বাড়ি থেকে চলে যাবার পর মা বলল, এবার আমি বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারি। বাড়িতে ঢুকে দেখি, তুমি ছাদে চড়ছ। তোমার পিছু পিছু আমিও গেলাম। যা যা করেছিলে সব দেখেছি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডন বললেন, তাহলে তো কিছু বলার নেই তোমাকে আমার। কিন্তু, তুমি কি পড়াশোনাটা শেষ করতে চাইছ না, তোমার কি উকিল হবার সত্যি কোন ইচ্ছা নেই? বন্দুকধারী এক হাজার ডাকাত যত টাকা লুট করতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা ছিনতাই করতে পারে একজন ব্রীফকেসধারী উকিল।

চতুর একটু হেসে সনি বলল, পারিবারিক ব্যবসাতে ঢুকতে চাই আমি। কিন্তু বাবার মুখে ভাবের কোন পরিবর্তন দেখল না সে, তার রসিকতা শুনেও তিনি হাসলেন না, তাই দেখে তাড়াতাড়ি আবার বলল, সে, আমাকে তুমি জলপাই তেল বিক্রি করতে শেখাতে পারো।

তবু কোন উত্তর দিলেন না ডন। অনেকক্ষণ কেটে গেল। অবশেষে বললেন তিনি, প্রত্যেক মানুষের একটা নিয়তি থাকে। তারপর কাঁধ ঝাঁকালেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বললেন না, তা হলো, ফানুচির হত্যাকাণ্ড দেখার সাথে সাথে তাঁর বড় ছেলের নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে শুধু অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলেন মুখটা, বললেন, কাল সকালে এসো। নটার সময়। কি করতে হবে গেমকো জানাবে তোমাকে।

ডন আসলে কি চাইছেন তা উপযুক্ত কনসিলিয়রির গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে পরিষ্কার বুঝতে পারল. গেনকো আবাদাণ্ডা। সনিকে প্রধানত ডনের বডিগার্ডের কাজে বহাল করল সে। এতে করে বাপের কাজকর্মের ধরন, পদ্ধতি, কৌশল ইত্যাদি দেখে ভবিষ্যৎ ডন হবার শিক্ষা পেতে শুরু করবে সনি। আর ডন ভিটো কর্লিয়নির বিরাট একটা লাভ হলো এই যে তিনি একটা মাস্টারি পেয়ে গেলেন। ছেলেকে হাতে কলমে শিক্ষা দেবার এই সুযোগটাকে তিনি সদ্ব্যবহার করতে ছাড়লেন না। সাফল্য লাভ করতে হলে কি ভাবে কি করতে হয়, এই বিষয়ে প্রায়ই তিনি বক্তৃতা দেন। বড় ছেলের নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, তা জানার পরও সনির ব্যাপারে দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারেন না তিনি। কারণে অকারণে রেগে ওঠা স্বভাব সনির। সেজন্যে ছেলেকে তিনি তিরস্কারও কম করেন না। বলেন, এবং কথাটা তিনি নিজে মনে প্রাণে বিশ্বাসও করেন, সবচেয়ে বোকার মত নিজের দুর্বলতা প্রকাশের উপায় হলো কাউকে শাসানো। দুর্বলতা প্রকাশের এর চেয়ে মৃঢ়তম পথ আর হতে পারে না। খামোকা রাগ দেখানো একজন মানুষের সবচেয়ে বিপজ্জনক অভ্যাস। ডন সরাসরি ভয় দেখাচ্ছেন কাউকে, এমন ঘটনা কেউ কখনও দেখেনি বা শোনেনি। সংযম হারিয়েছেন তিনি, তার সম্পর্কে কেউ বলতে পারবে না এ-কথা। নিজের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাগুলো সনিকে তিনি শেখাবার চেষ্টা করেন। বলেন, শত্রুরা যদি তোমার দোষগুলোকে বড় করে দেখে, এর চেয়ে ভাল পরিস্থিতি জীবনে আর আসতে পারে না। আর, মনে রেখো তোমার গুণগুলোকে তোমার বন্ধুরা যদি ছোট করে দেখে, এর চেয়ে খারাপ অবস্থা জীবনে আর আসতে পারে না।

এদিকে সনির ধর্মবাপ, ক্যাপোরেজিমি ক্লেমেঞ্জা তাকে গুলি ছুঁড়তে, ফাস পরাতে শেখাচ্ছে। ওই ইতালীয় নিয়মে দড়ির ফাস লাগানো পছন্দ করে না সনি। স্বভাবটা একটু বেশি মার্কিনী ওর। সাদামাঠা, সহজ অ্যাংলোস্যাক্সন আগ্নেয়াস্ত্র পছন্দ করে ও। এসর দেখে মনে মনে দুঃখ পায় ক্লেমেঞ্জা।

ক্রমশ বাপের নিত্য সহচর হয়ে উঠছে সনি। বাবার গাড়ি চালায় এটা সেটা নানা কাজে সাহায্য করে। পরবর্তী দুবছর দুজনের ঘনিষ্ঠতা দেখে মনে হতে লাগল বাপের কাছ থেকে ব্যবসার অন্ধিসন্ধি সব শিখে নিচ্ছে ছেলে। কিন্তু বুদ্ধির ধার খুব বেশি নয় ওর, শেখার আগ্রহও তেমন জোরাল নয়, বাপের সাথে সাথে থাকার চাকরিটাই যেন দরকার ওর, সেটা পেয়েই সন্তুষ্ট হয়ে আছে।

ওদিকে সনির কৈশোরের বন্ধু, টম হেগেন ওদের আশ্রয়ে থেকে কলেজের পড়া মন দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। ফ্রিডো এখনও হাই স্কুল ছাড়াতে পারেনি। আর ছোট ভাই মাইকেল পড়ছে গ্রামার স্কুলে। সবার ছোট একমাত্র বোন কনি, মাত্র চার বছরের। বেশ কিছুদিন হয়েছে ব্রঙ্কসের একটা ভাড়া করা বাড়িতে উঠে এসেছেন উন, লং আইল্যান্ডে একটা বাড়ি কেনার কথাও ভাবছেন তিনি। কিন্তু আরও অনেক পরিকল্পনা আছে তার। বাড়ি কেনার আগে সেগুলোর একটা বিহিত করে নিতে চান।

প্রখর দূর দৃষ্টিসম্পন্ন একজন মানুষ ভিটো কর্লিয়নি। গোটা আমেরিকা জুড়ে বেআইনী ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে মারামারি ঝগড়াঝাটি করে বিষিয়ে তুলছে সমস্ত পরিবেশটাকে। এর একটা বিহিত করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন জটিল পর্যায়ে চলে গেছে, সমাধান চাইলেই তা পাওয়া সম্ভব নয়। দেশের সব জায়গায় গেরিলা যুদ্ধের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, অপরাধীরা পরস্পরের রক্ত পান করার জন্যে যেন ব্যথ-ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। উচ্চাভিলাষী গুণ্ডারা সবাই চাইছে প্রত্যেকে একটা করে নিজস্ব সামাজ্য গড়ে তুলতে। এদিকে, ডন কর্লিয়নির মত ব্যবসায়ীরা নিজেদের সীমানা আর অবৈধ ব্যবসা সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, টিকে থাকার জন্যে বড় বেশি পরিশ্রম আর সময় দিতে হচ্ছে। সরকার আর সংবাদপত্রগুলো নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে অপরাধ জগতের এই সব খুন-খারাবীগুলো পুঁজি করে ক্রমশ আরও কড়া আইন প্রণয়ন করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে, পুলিশ যাতে আরও কঠোর শাস্তি দানের অধিকার পায় তারজন্যে উঁচু মহল থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। আর কেউ এসব ব্যাপার লক্ষ না করলেও, ডন কর্লিয়নির চোখে সবই ধরা পড়ছিল। সময় থাকতেই বুঝতে পারলেন তিনি, জনসাধারণ খেপে উঠলে শেষ পর্যন্ত হয়তো অনেক গণতান্ত্রিক অধিকার লোপ পাবে দেশ থেকে, তাতে, সাধারণ মানুষ যত না ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার চেয়ে কোটিণ্ডণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেআইনী ব্যবসায়ী আর অপরাধ জগতের বাসিন্দারা। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা তার আর তার কর্মীদের সর্বনাশ হতে কিছু আর বাকি থাকবে না। এখনও তার নিজের সামাজ্যের নিরাপত্তা অটুট আছে, অবশ্য কতটা সুরক্ষিত অবস্থায় আছে তা বাইরের কেউ জানে না। কিন্তু, গোটা দেশ জুড়ে অপরাধ জগতে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তা যদি এভাবে চলতেই থাকে, যত শক্তিশালীই হোক তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাসের ঘরের মত সব ভেঙে পড়তে খুব বেশি দিন সময় নেবে না। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে শহর নিউ ইয়র্কের মধ্যে, তারপর সমস্ত দেশে শান্তি কায়েম করবেন তিনি। তা করতে হলে যুদ্ধে মেতে আছে যে দলগুলো প্রথমে তাদেরকে যুদ্ধ বিরতিতে রাজি রাতে হবে। কাজটা কঠিন, বুঝলেন তিনি, কিন্তু অসম্ভব বলে মনে হলো না তার কাছে।

উদ্যোগী হয়ে এ-ধবনের কিছু করতে গেলে তাতে যে বড় ধরনের একটা ঝুঁকি আছে তাও তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন। সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেই কাজে হাত দিলেন।

প্রথম বছরটা নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন ধরনের বেআইনী কাজের হোতাদের সাথে আলোচনা, জমি ভাগ এবং নিষ্কণ্টক করা, অপরাধ জগতের নেতাদের বাজিয়ে দেখা, এই সব কাজে ব্যয় হয়ে গেল। তার প্রস্তাব হলো, সবাই একসাথে বসে একটা সিদ্ধন্ত নিয়ে যার যার ক্ষমতার এলাকা আলাদা করে নিক ক্ষমতার এলাকা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেলে নিজেদের মধ্যে, গোলযোগের আর কোন কারণ থাকবে না। দলগুলো একটা শিথিল নিয়মে আবদ্ধ থাকবে, গড়ে নেবে একটা মিত্র-সংঘ। এবং সবাই তাকে মেনে চলবে।

কিন্তু শান্তি প্রচেষ্টার শুরুতেই দেখা গেল স্বার্থের সংঘর্ষ বড় বেশি, বড় বেশি দলাদলি! কারও সাথেই একমত হওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত এ-ধরনের পরিস্থিতিতে ইতিহাস-খ্যাত বহু সুনামধন্য শাসনকর্তা আর আইন প্রবর্তকরা যে পথ অবলম্বন করেছিলেন ডন কর্লিয়নিও সেই পথ ধরবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্যের সংখ্যা কমিয়ে মাত্র কয়েকটার মধ্যে আনা না গেলে শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপন করা সম্ভব নয়।

কয়েকটা পরিবার আছে, সংখ্যায় পাঁচ ছয়টা, এদেরকে উৎখাত করা অসম্ভব। এরা প্রত্যেকেই প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু অন্যান্যরা, যেমন কালো হাত সন্ত্রাসবাদী দল, স্বাবলম্বী মহাজন গোষ্ঠী, রেসের বেয়াড়া বুকমেকার বাহিনী, যারা অবৈধ ব্যবসার কোন মালিকের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়েই নিজেদের আয়ের পথ করে নিয়েছে, এদের সবাইকে উচ্ছেদ করা যায় এবং তা না করে উপায়ও নেই। এ কাজটাও কঠিন, কিন্তু সবদিক বিবেচনা করে, আঁটঘাট বেঁধেই নামলেন ডন কর্লিয়নি। এদের বিরুদ্ধে রীতিমত একটা মহা-যুদ্ধ, দস্তুরমত প্রায় একটা ঔপনিবেশিক অভিযান শুরু করে দিলেন তিনি। আর এই নির্মূল অভিযানে তাঁকে তাঁর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হলো।

তিনটে বছর লেগে গেল শুধু নিউ ইয়র্ককে ঠাণ্ডা করতে। ডন যতটুকু আশা করেছিলেন তার চেয়ে বেশি, কিছু অপ্রত্যাশিত লাভও পাওয়া গেল। তবে, একেবারে প্রথম দিকেই কার্নিয়নি পরিবারের সামাজ্যকে প্রায় টলিয়ে দিল বিপক্ষ দল। কয়েকটা শোচনীয় ঘটনাও ঘটে গেল। ডনের পরিকল্পনা একদল খ্যাপাটে আইরিশ লুটেরার দলকে নির্মূল করবেন, কাজটায় হাতও দিলেন। কিন্তু গায়ে হ্যাঁকা লাগা মাত্র ব্যাটারা তাদের মরকত দ্বীপের বেপরোয়া সাহস আর বীরত্ব দেখিয়ে আর একটু হলেই যুদ্ধে প্রায় জিতেই যাচ্ছিল। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে অকস্মাৎ আইরিশ লুটেরাদের একজন পিস্তলধারী ডনের নিরাপত্তা প্রহরার প্রায় নিচ্ছিদ্র প্রাচীর ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। শুধু তাই নয়, গুলি চালাতেও সমর্থ হলো সে, এবং সে গুলি লাগল ডনের বুকে। সাথে সাথে অসংখ্য বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল আততায়ীর শরীর। কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। ডন ভিটো কর্লিয়নি শয্যা নিতে বাধ্য হলেন।

এতে অবশ্য লাভ হলো সান্তিনো কর্লিয়নির, কাজ দেখাবার একটা সুযোগ পেয়ে গেল সে। একটা দলের নেতৃত্ব নিয়ে, এরা সবাই তার নিজের সেনাদলের বাছাই করা লোক, তরুণ একজন অখ্যাত নেপোলিয়নের মত মেতে উঠল যুদ্ধে। এই নগর যুদ্ধে বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিল বটে সনি, কিন্তু সেই সাথে নিষ্ঠুরতাও সীমা ছাড়িয়ে গেল। বিজয়ী কর হিসাবে বিচার করতে গেলে দেখা যাবে ডনের মধ্যে এই জিনিসটারই অভাব রয়েছে, এই নিষ্ঠুরতার।

উনিশশো পঁয়ত্রিশ থেকে উনিশশো সাঁইত্রিশ সালের মধ্যে অপরাধীদের জুগতে সবচেয়ে হৃদয়হীন পাষাণ বলতে একমাত্র সনি কর্লিয়নিকেই বোঝাত। তার এই খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেফ ভয়াবহতায় তাকে ছাড়িয়ে যায় লুকা ব্রাসি নামে সাংঘাতিক মানুষটা।

বাকি আইরিশ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে লাগল এই লুকা ব্রাসি। কারও সাহায্য লাগল না, অমন ভয়ঙ্কর বেপরোয়া দলটাকে সে একাই নিশ্চিহ্ন করে দিল। আগাছার মত এই সব দলগুলোকে শক্তি যোগাবার জন্যে ছয় বড় পরিবারের এক পরিবার উদ্যোগী হলো, তারমানে কর্লিয়নি পরিবারের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করল নিজেদেরকে। কাউকে কিছু বলতে হলো না, অন্যান্য পরিবারগুলোকে সাবধান করে দেবার জন্যে একাই রওনা হয়ে গেল লুকা ব্রাসি। বিশ্বাসঘাতক ওই পরিবারটির কর্তাকে খুন করে, নিজের গায়ে আঁচড়টিও না লাগিয়ে নিরাপদে সেখান থেকে বেরিয়ে এল সে।

নিউ ইয়র্ক শহরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো উনিশশো সাঁইত্রিশ সালের মধ্যে। অবশ্য, এরপরও ছোটোখাটো দুর্ঘটনা, এক-আধটু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় বৈকি। মাঝে মধ্যে এসবের পরিণাম মর্মান্তিক হয়েও ওঠে। প্রাচীন নগর শাসনকর্তারা ঠিক যেভাবে শহর প্রাচীরের বাইরের বর্বর জাতিগুলোর উপর সতর্ক নজর রাখতেন, তেমনি সজাগ দৃষ্টি রাখেন ডন কর্লিয়নি তার জগতের বাইরে যারা রয়েছে তাদের তৎপরতার উপর। কিভাবে এল হিটলার, স্পেনের পতন, জার্মানী কেমন করে মিউনিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল ব্রিটেনকেএসবই তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করলেন। বাইরের জগতে নজর আছে বলেই চোখের সামনে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, একটা বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত এগিয়ে আসছে। এই যুদ্ধ কি ফলাফল বয়ে আনবে তাও তিনি আঁচ করতে পারছেন। আগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্ভেদ্য হয়ে উঠবে তাঁর নিজের দুনিয়া। সুযোগ সন্ধানী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা যুদ্ধের এই সুযোগে অঢেল ধনসম্পদ সংগ্রহ করে নিতে পারবে। কিন্তু সেই সাথে এটুকুও বুঝলেন তিনি যে অত্যাসন্ন সুবর্ণ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হলে সবচেয়ে আগে তাঁর নিজের এলাকায় শান্তি আনা দরকার।

যুক্তরাষ্ট্রের সবখানে তার বিশেষ বার্তা পাঠালেন ডন কর্লিয়নি! সানফ্রান্সিসকো, লস এঞ্জেলস, শিকাগো, ক্লীভল্যাণ্ড, ফিলাডেলফিয়া, বোস্টন, মায়ামী, যেখানে তাঁর যত দেশী ভাই আছে সবার সাথে আলাপ-আলোচনা করছেন তিনি। অপরাধ জগতের শান্তির দূত হিসেবে স্বীকৃতি দিল সবাই তাঁকে। উনিশশো ঊনচল্লিশ সালের মধ্যে এমন কি রোমের পোপের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন তিনি। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সেরা অপরাধী দলের সংগঠনগুলোর মধ্যে একটা মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলো। দেশের শাসনতন্ত্রের আদলে তৈরি হলে এই সব মাফিয়া সংগঠনের নীতিমালা। ঠিক হলো যে যার নিজের রাজ্যে বা, শহরে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, কেউ কারও জগতে নাক গলাতে পারবে না। চুক্তিতে বলা হলো, কে কোথায় ক্ষমতা পাবে, কার কতটা সীমানা, কোন কোন এলাকায় কার কি ধরনের ব্যবসা চালাবার অধিকার সংরক্ষিত থাকবে, ইত্যাদি। এবং, সবাই ওয়াদা করল, অপরাধ জগতে তারা শান্তি বজায় রাখবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো উনিশশো উনচল্লিশ সালে, তারপর উনিশশো একচল্লিশ সালে, সে-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল আমেরিকা। দুনিয়াময় অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু ডন কর্লিয়নির জগতে অশান্তির কোন চিহ্নমাত্র নেই। আমেরিকার একদিকের বাজার আচমকা গরম হয়ে উঠল, সোনালী ফসল ঘরে তোলার জন্যে সবাই তৈরি হয়েই আছে। ব্ল্যাকমার্কেট থেকে খাদ্যদ্রব্যের ও. পি. এ. টিকেট, পেট্রলের কুপন এমন কি যাতায়াতে অনুমতি পত্র সংগ্রহ করা পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারে হাত আছে কর্লিয়নি পরিবারের। ঠিকাদাররা ওদের কাছে এসে ধরনা দিয়ে বসে থাকে, কন্ট্রাক্ট পেতে হলে কর্লিয়নিদের কাছে না এসে উপায় নেই। রেডিমেড পোশাক তৈরির কারখানাগুলো চাহিদা অনুযায়ী প্রচুর কাঁচামাল জোগাড় করতে পারে না, কারণ তারা সরকারী আনুকূল্য পায়নি, এদেরকে কালোবাজার থেকে মাল কিনতে সাহায্য করে কর্লিয়নি পরিবার, সেজন্যে পোশাক ব্যবসায়ীরা কৃতজ্ঞ, বোধ না করে পারে না। কর্লিয়নি পরিবারে যারা কাজ করে, এবং আমেরিকার আইন অনুযায়ী যাদেরকে যুদ্ধে যেতেই হবে, না গেলে শাস্তি পেতে হবে, বিদেশীদের যুদ্ধে এইসব ইতালীয় যুবকদেরকে যাতেযোগ দিতে না হয় তার ব্যবস্থা করতে একটুও বেগ পেতে হয় না কর্লিয়নিকে। ডাক্তারদের সাহায্য নিয়ে কাজটা করেন তিনি। শারীরিক পরীক্ষা নেবার আগে কি কি খেয়ে যেতে হবে তা তারা বলে দেয়। অথবা ছেলেগুলোকে কোন সামরিক কারখানায় চাকরি জুটিয়ে দেন ডন, ওই সব কারখানাগুলো থেকে যুদ্ধের জন্যে লোক সংগ্রহ করা হয় না।

নিজের সাম্রাজ্যে শান্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পেরে ডন কর্লিয়নি একটু গর্বও অনুভব করেন। তাঁর শিষ্য যারা, যারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে, যারা তাকে শ্রদ্ধা আর সম্মান করে, তার জগতে তারা সবাই সম্পূর্ণ নিরাপদ, শুধু সুখে নেই, রাজার হালে আছে। বাকিরা যারা আইন, শৃঙ্খলা, সরকার, নীতি, আদর্শ ইত্যাদি মেনে চলে, তারা লাখে লাখে পটল তুলছে। এরপরও যারা বেঁচে থাকছে তারা খেতে পাচ্ছে না, বেঁচে থাকার কোন আনন্দই নেই তাদের জীবনে।

ডন কর্লিয়নির সুখী হবার পথে একটা মাত্র বাধা হলো তাঁর ছোট ছেলে মাইকেল কর্লিয়নি। বাবার নির্দেশ, সাহায্যের প্রস্তাব, অনুরোধ-সব কিছু প্রত্যাখ্যান করে নিজের ইচ্ছায় দেশ রক্ষায় যোগ দেবার জন্যে নাম লেখাল সে। তার সংগঠনের আরও কয়েকজন যুবকও এই কর্ম করায় আশ্চর্য হয়ে গেলেন ডন কর্লিয়নি। এদের মধ্যে একজন তার ক্যাপোরিজিমিকে বলল, এই দেশ, এই আমেরিকা আমার সাথে যে বড় ভাল ব্যবহার করেছে! ডনের কানে যখন কথাটা পৌঁছুল, তিনি রেগে উঠে বললেন, হুঁ, আমিও ওর সাথে বড্ড ভাল ব্যবহার করে ফেলেছি। যুদ্ধে যারা নাম লেখাল তারা সবাই হয়তো ভীষণ বিপদে পড়ে যেত, কিন্তু ডন কর্লিয়নি যখন নিজের ছেলেকে ক্ষমা করতে পারলেন, তখন বাকি সবাইকেও ক্ষমা করতে হলো। কিন্তু ডন ধরে নিলেন, তার প্রতি এদের কোন কর্তব্য-জ্ঞানই নেই, নিজেদের প্রতি তো নেইই।

তাঁর জগতের চেহারা পাল্টাতে হবে আরার, যুদ্ধের শেষে ব্যাপারটা উপলব্ধি করলেন ডন কর্লিয়নি। বাইরের বৃহত্তর জগতের সাথে আরও যাতে অনায়াসে নিজের সংগঠনকে খাপ খাইয়ে নেয়া যায় তার ব্যবস্থা করা কার। তার বিশ্বাস, মুনাফার হার না কমিয়েও সেটা করা যেতে পারে।

তাঁর এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে তার নিজের অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে ব্যক্তিগত দুটো ঘটনা ঘটে যাবার ফলে এই ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত হলেন তিনি।

প্রথম ঘটনাটা অনেক দিন আগের, তাঁর কর্মজীবনের শুরুর দিকের ব্যাপার।

বয়স কম নাজোরিনির, একজন রুটিওয়ালার সহকারী হিসেবে কাজ করে, এদিকে আবার খুব ইচ্ছা বিয়ে করে। একদিন সে ভিটো কর্লিয়নির কাছে এল একটা সমস্যা নিয়ে। কি ব্যাপার? ব্যাপার হলো, নাজোরিনি যাকে বিয়ে করবে, তার হবু স্ত্রী, অত্যন্ত সুলক্ষণা এক ইতালীয় মেয়ে। বিয়ের পর ঘর-বাড়ি সাজাতে হবে বলে দুজন মিলে টাকা জমিয়েছে তারা। সেই টাকা আসবাবপত্রের একজন পাইকারি ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিয়েছে। অনেকগুলো টাকা, তিনশো ডলার। ব্যবসায়ী ওদেরকে তার মালগুদামে নিয়ে গিয়ে পছন্দসই আসবাবপত্র বেছে নিতে বলল। দুজন মিলে প্রায় সারাদিন ধরে বাছাই করল নিজেদের মনের মত জিনিস। তিনশো ডলার নিজের পকেটে ভরে ব্যবসায়ী জানাল, এক হপ্তার মধ্যেই তাদের নতুন ভাড়া করা ফ্ল্যাটে সব ফার্নিচার পাঠিয়ে দেয়া হবে।

কিন্তু হপ্তা পেরোবার আগেই লালবাতি জ্বালল কোম্পানিটা। আসবাব ভর্তি প্রকাশ্য গুদামে তালা মেরে সীল করে দেয়া হলো। ওদিকে সমস্ত পাওনাদারকে বোকা বানিয়ে ব্যবসায়ী গায়েব হয়ে গেছে। পাওনাদারদেরু মধ্যে নাজোরিনিও একজন, সে একজন উকিলের কাছে গেল পরামর্শ করার জন্যে। উকিল জানান, কোর্টে মামলা শেষ হতে সময় লাগবে, তবে শেষ হলে পাওনাদাররা তাদের টাকা ফেরত পাবে। তার আগে করার কিছুই নেই। কত সময় লাগবে? বলা যায় না, তিন বছরও লাগতে পারে। আর প্রাপ্য পাবার সময় নাজোরিনি যদি প্রতি ডলারে এক সেন্ট করে পায়, তার ভাগ্য ভালই বলতে হবে।

কাহিনীটা শোনার সময় হাসছেন ভিটো কর্লিয়নি, হাসিটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাসের। জোরিনি এসব কি বলছে? আইন কি এতবড় একটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারে? আসবাবপত্রের ওই পাইকারি ব্যবসায়ী বিরাট একজন ধনী মানুষ, প্রাসাদতুল্য একটা বাড়ি আছে তার, লং আইল্যান্ডে বিরাট সয়-সম্পত্তি, দামী একটা মোটর গাড়ি আছে, নিজের ছেলেদের কলেজে পড়ায়-এমন একজন লোক কী নাজোরিনির মত গরীব মানুষের তিনশো ডলার মেরে দেবে? এ যে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। তবু, পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে গেনকোর বিশুদ্ধ তেল কোম্পানির উকিলকে দিয়ে সমস্ত খবর আনিয়ে নিলেন ডন।

নাজোরিনির কথাই সত্যি। ব্যবসায়ীর সমস্ত সম্পত্তি তার স্ত্রীর নামে, সেখানে হাত দেবার ক্ষমতা কারও নেই। দেউলিয়া হতে যাচ্ছে জেনেও নাজোরিনির টাকাটা নেয়া ভুল হয়েছে তার, কিন্তু এমন তো অনেকেই করে থাকে। আইন তত আর কিছু করতে পারবে না তার।

খুব সহজেই মিটে গেল ব্যাপারটা। ডন কর্লিয়নি তাঁর কনসিলিয়রি গেনকো আবানদাণ্ডোকে সেই ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করতে পাঠালেন। চতুর ব্যবসায়ী পরিস্থিতিটা সাথে সাথে বুঝে নিয়ে নামজারিনি যাতে তার আসবাব পায় সে ব্যবস্থা করে দিল। ভিটো কর্লিয়নি এই ছোট ঘটনাটা থেকে অনেক কিছুই শিখে নিতে পারলেন।

উনিশশো ঊনচল্লিশ সালের দ্বিতীয় ঘটনাটার প্রতিক্রিয়া হলো আরও সুদূর প্রসারী। সপরিবারে শহরের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডন কর্লিয়নি। যে কোন আদর্শ বাবার মত তারও ইচ্ছা, তার ছেলেরা ভাল স্কুলে লেখাপড়া শিখুক, অল সঙ্গী সাথীদের সাথে মেলামেশা করুক। ব্যক্তিগত কারণেও শহরতলিতে অজ্ঞাতবাস করতে চান তিনি, সেখানে থাকলে তাঁর সম্পর্কে বাইরের লোক বেশি কিছু জানতে পারবে না। প্রকাণ্ড উঠানসহ সেজন্যেই লং বীচের এই বাড়িটা কিনেছেন তিনি। উঠানের চারদিকে চারটে মাত্র বাড়ি, কিন্তু আরও বাড়ি করার জন্যে প্রচুর জায়গা খালি পড়ে আছে। ইতিমধ্যে সাণ্ডার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সনির। আর খুব বেশি দেরিও নেই, ওদের জন্যে একটা আলাদা বাড়ির দরকার। একটাতে থাকবে সপরিবারে গেনকে। আরেকটাতে ডন নিজে। অবশিষ্ট বাড়িটা খালি রাখা হবে।

ঘটনাটা ঘটল নতুন বাড়িতে উঠে আসার এক হপ্তা পর। ভাল মানুষ চেহারার তিন জন লোক একটা ট্রাক নিয়ে ওদের বাড়িতে এসে হাজির। নিজেদের পরিচয় দিল, তারা শহরের ফার্নেস ইন্সপেক্টর। ডন কর্লিয়নির কম বয়সী বডিগার্ডদের একজন বেসমেন্টের ফার্নেস দেখাবার জন্যে নিয়ে গেল তাদেরকে। স্ত্রী আর সনির সাথে বাগানে হাওয়া খাচ্ছেন তখন ডন।

এই সময় বডিগার্ডদের একজন এসে জানাল, ইন্সপেক্টররা বাড়ির মালিককে ডাকছে। ভীষণ বিরক্তবোধ করলেন তিনি। গিয়ে দেখলেন, ইন্সপেক্টররা তিনজনই লম্বা চওড়া, ফার্নেসটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। দলের নেতা লোকটাকে খুব গভীর আর রগচটা মনে হলো। কর্কশ গলায় সে ডনকে বলল, আপনার ফার্নেসের অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়ে আছে। আপনি বললে এটাকে সারাতে পারি, আবার জোড়া লাগিয়ে দিতে পারি, কিন্তু খাটাখাটনি আর স্পেয়ার পার্টসের জন্যে টাকা লাগবে, দেড়শো ডলার। কথা শেষ করে লোকটা ডনকে একটা লাল কাগজের লেবেল দেখাল, তারপর আবার বলল, এই সীলটা যদি লাগিয়ে দিয়ে যাই, আর কেউ কখনও এ-ব্যাপারে আপনাকে বিরক্ত করবে না।

খুব মজা লাগল ডনের। গোটা হপ্তাটা কেটেছে একঘেয়ে ভাবে! নতুন বাড়িতে উঠে এলে যা হয়, ঘর-গৃহস্থালি গোছগাছ কতেই সময়টা কেটে গেছে। উচ্চারণ ভঙ্গিতে সামান্য একটু টান ছাড়া ইংরেজী বলায় কোন খুঁত নেই ডনের। তিনি জানতে চাইলেন, যদি টাকা না দিই? কি অবস্থা হবে আমার কানেসের?

ইন্সপেক্টরের মাথা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, যা যেখানে যে-অবস্থায় আছে, সব সেভাবে ফেলে রেখে চলে যাব আমরা। কথা শেষ করে ঘরময় ছড়ানো বিচ্ছিন্ন ফার্নেসের পার্টসগুলো হাত-ইশারায় দেখাল সে।

ম্লানমুখে বললেন উন, ঠিক আছে, কি আর করা, টাকা যখন দিতেই হবেড়ান, নিয়ে আসছি।

বাগানে ফিরে এলেন ডন। সনিকে বললেন, শোনো, কয়েকজন কারিগর আমাদের ফার্নেস দেখতে এসেছে। কি বলতে চায়, আমি ঠিক বুঝলাম না। তুমি গিয়ে দেখো তো, ব্যাপারটা কি। সনিকে একটা পরীক্ষায় ফেলতে চাইছেন ডন, এর মধ্যে সবটাই ঠাট্টা নয়। নিজের সহকারী করে নেবার জন্যে সনির কথা গুরুত্বের সাথে ভাবছেন তিনি। এই ধরনের পদ পেতে হলে এমন অনেক পরীক্ষায় পাস করতে হয়।

সমস্যার সমাধান ঠিকই, করল সনি, কিন্তু তার পদ্ধতিটা দেখে মোটেই খুশি হতে পারলেন না উন! বড় বেশি খোলাখুলি সমাধান, বিখ্যাত সেই সিসিলীয় সূক্ষ্মতার অভাব প্রকট। তলোয়ারের কোপ নয়, এ যেন মুগুরের ঘা। কারিগরদের দাবি শুনেই পিস্তল বের করল সনি, তাদেরকে কোণঠাসা করে বডিগার্ডদের ডেকে পাঠাল। প্রথমে তিনজনকেই ধরে খুব মারধর করাল, তারপর ফার্নেস মেরামত করিয়ে নিয়ে বেসমেন্টের কামরাটা ভাল করে সাফ করিয়ে নিল। সবশেষে ওদেরকে সার্চ করে দেখল, আসলেই ওরা একটা গৃহ সংস্কার সংস্থার কর্মী, ওদের হেডকোয়ার্টার সাফক কাউন্টিতে। কোম্পানির মালিকের নাম জেনে নিয়ে ওদেরকে বলল সনি, লং বীচে আবার যদি তোমাদের কাউকে দেখি, গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেব। লাথি মারতে মারতে তিনজনকে ট্রাকের কাছে পৌঁছে দিল সে।

 বয়স এখনও কম সনির, প্রচণ্ড রাগ এখনও আছর করেনি ওর উপর, কিন্তু যেখানে ও বসবাস করে সেখানে আর সবার রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে ওর মধ্যে। সেই গৃহ সংস্কার সংস্থার কর্তার সাথে যোগাযোগ করে। সত্যিই সে সাবধান করে দিল, ডেকে পাঠানোনা হলে কেউ যেন লং বীচে পায়ের ধুলো ফেলতে না আসে।

 এরপর তো পুলিশের সাথে কর্লিয়নি পরিবারের স্থায়ী যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। যত রকম অভিযোগ কর্লিয়নিরা পুলিশকেই জানায় এখন। পেশাদার অপরাধীরা যদি কিছু করে, তান্যান্য আইন ভঙ্গকারী দল, যদি ওদের এলাকায় দু মারতে চেষ্টা করে, সাথে সাথে খবর পেয়ে যায় পুলিশ। এক বছরও কাটল না, ওই আকারের সমস্তু শহরের মধ্যে লং বীচ হয়ে উঠল একেবারে অপরাধ মুক্ত, আদর্শ এলাকা। এই শহরে যাতে ব্যবসা না চালায় তার জন্যে পেশাদার লুটেরাদেরকে একবার মাত্র সতর্ক করে দেয়া হলো। গুণ্ডাপাণ্ডাদেরকেও চলে যেতে বলা হলো শহর ছেড়ে। এরপরও কেউ যদি কোন অপরাধ করে বসে, প্রথমবার ক্ষমা করা হয় তাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বার অপরাধ করলে ক্ষমা করা হয় না। তারা কোথায় যেন। অদৃশ্য হয়ে যায়। ভুয়া যত গুহ সংস্কার সংস্থার লোক আর সমস্ত ধাপ্পাবাজদেরকে, যারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে অন্যায় দাবির মাধ্যমে টাকা আদায় করার চেষ্টা করে, তাদেরকে ডেকে ভদ্রভাবে জানিয়ে দেয়া হলো, লং বীচে কেউ তাদেরকে চায় না। এরপরও চিটিংবাজ কেউ যদি দুঃসাহস দেখিয়ে তাদের স্বভাব না বদলায়, পাকড়াও করে এ্যায়সা প্যাদানি দেয় সনি, সেফ মাটিতে কিছুকাল শুয়ে না থেকে উপায় থাকে না তার। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কিছু ছোকরা আছে যারা আইনও মানে না, প্রকৃত ক্ষমতাবান কর্তৃপক্ষকেও মানতে রাজি নয়।. ডন কর্লিয়নি নিজে ডেকে তাদেরকে বাপের মত স্নেহের সাথে উপদেশ দেন, আর দেরি না করে তারা যেন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই ভাবে একটা আদর্শ শহর হয়ে উঠল লং বীচ।

গৃহ সংস্কার, সম্পত্তি বিনিময়, ইত্যাদি হাজার রকম বেচাকেনা ব্যবসার দিকটা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করল ডন ভিটো কর্লিয়নিকে। আইনের চোখকে অনায়াসে উঁকি দিয়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে লোকেরা। এককালে তিনি সৎ, নীতিপরায়ণ, আদর্শ যুবক ছিলেন, তখন যে আলাদা জগতে তার প্রবেশাধিকার ছিল না, তিনি দেখতে পেলেন এখন সেখানে তার মৃত গুণী লোকের জন্যে খুব ভাল আর যথেষ্ট জায়গা আছে। সেই নতুন জগতে প্রবেশ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেন ডন ভিটো কর্লিয়নি।

লং বীচের উঠানে সুখ আর শান্তির সাথে বাস করছেন তিনি। তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিদিনই একটু একটু করে বিস্তার লাভ করছে। ক্রমশ দুর্জয় হয়ে উঠছেন তিনি। তারপর শেষ হলো একদিন যুদ্ধ। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো পরিবারগুলোর মধ্যে ডন ভিটো কর্লিয়নি যা চেয়েছিলেন তাই পেয়েছেন, নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবারের সবচেয়ে শক্তিশালী পরিবারটির কর্তা তিনি আজ।

কিন্তু হঠাৎ সব ওলটপালট হয়ে গেল। সর্বনাশের সূচনা করল ভার্সিল সলোযো, শান্তি ভঙ্গ করল সে। ডন ভিটো কর্লিয়নিকে গুলি করে বসল। শয্যা নিলেন ডন।

কিন্তু এর পরিণাম যে কি ভয়াবহ হতে পারে তা সলোযো বা তার সমর্থকরা একবার ভেবেও দেখেনি। ডন কর্লিয়নি মারা গেলেন না, এটা তাদের জন্য সবচয়ে বড় দূর্ভাগ্য।  আসলে, ডনকে গুলি করে নিজেদের জন্যে স্বহস্তে কবর খুঁড়ল ওরা। কর্লিয়নি পরিবারে আর একজন আছে, যাকে ওরা গোণার মধ্যেই ধরে না, সময় হতেই সবাইকে ভীষণভাবে চমকে দিয়ে সে-ই এমন এক চাল চালল, ওই এক চালেই মাত্ হয়ে গেল বাজি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *