২.৮ ডন ভিটো কর্লিয়নির ছেলেবেলা

০৮.

ডন ভিটো কর্লিয়নির ছেলেবেলা।

মাত্র বারো বছর বয়েস, কিন্তু এরই মধ্যে রীতিমত সাবালক হয়ে উঠেছেন তিনি। মাথা ভর্তি কালো চুল, ছিপছিপে লম্বা শরীর। মরক্কোয় বসবাসরত আরবদের গ্রামের আদলে তৈরি অদ্ভুত একটা গ্রামে জন্ম, নাম ভিটো আন্দোলিনি। ওই বয়সেই বাবাকে হারালেন, একদল আগন্তুক এসে খুন করে গেল তাকে। এর কিছুদিন পর প্রামে একদল অচেনা লোক এসেছে, এবং তাদের উদ্দেশ্য কি জানতে পারার পর ভিটো আন্দোলিনির মা তার ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকায় তাদের পারিবারিক বন্ধু-বান্ধবদের কাছে।

নতুন দেশে এসে জন্মস্থানের সাথে একটা সম্পর্ক জিইয়ে রাখার জন্যে ভিটো নিজের নাম বদলে পদবী হিসেবে বেছে নিলেন কর্লিয়নি শব্দটা। ভাবাবেগের পরিচয় জীবনে তিনি খুব কমই দিয়েছেন, এটা তার একটা।

উনিশ শতকের শেষ ভাগ এটা, দুটো সরকার চালু রয়েছে সিসিলিতে, তার মধ্যে একটা হলো মাফিয়া। রোমের বৈধ সরকারের চেয়ে মাফিয়াদের প্রতাপ আর ক্ষমতা অনেক বেশি, কোন উপায় নেই দেখে রোমের শাসনকর্তারা মাফিয়াদেরকে একরকম মেনেই নিয়েছে। কি একটা ব্যাপারে একজন গ্রামবাসীর সাথে ঝগড়া বাধল ভিটো আন্দোলিনির বাবার, সুবিচার পাবার আশায় তিনি মাফিয়া সরকারের শরণাপন্ন হলেন। মাফিয়া সরকার তাঁকে এমন সব কথা বলল যা তিনি মেনে নিতে পারলেন না, ফলে প্রকাশ্যে একটা মারপিট বেঁধে গেল, এবং এর পরিণতিতে খুন হয়ে গেল মাফিয়া সরকারের নেতাটি। এরপর এক হপ্তাও কাটল না, লুপারা বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা অবস্থায় পাওয়া গেল ভিটোর বাবার মৃতদেহ। এই ঘটনার এক মাস পর সশস্ত্র মাফিয়া গুণ্ডারা ছেলেমানুষ ভিটোকে খুঁজতে এল। হঠাৎ করে যেন তারা বুঝতে পেরেছে, এই ছোকরা কদিন পরই সাবালক হয়ে উঠবে, আর বাপকে খুন করার প্রতিশোধ নিতে ছাড়বে না।

আমেরিকায় এসে আবান্দাণ্ডোর বাড়িতে আশ্রয় নিলেন ভিটো (পরে তিনি ডন হলে এই আবানদাণ্ডোর.ছেলেই তার কনসিলিয়রি হয়েছিল)। নিউ ইয়র্কের হেলস কিচেনের নাইনথ এভিনিউয়ে একটা মুদি দোকান আছে আবানদাণ্ডোর, সেখানেই চাকরি পেলেন তিনি। আঠারো বছর বয়সে বিয়ে করেন তিনি, সদ্য সিসিলি থেকে আসা এক মোড়শীকে। রান্নার হাতটা খুব মিষ্টি তার, ঘরকন্নার কাজ আর কাজকর্মেও খুব পটু। থার্টি-ফিফথ স্ট্রীটের কাছাকাছি টেন এভিনিউয়ে সস্তায় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে ওঁরা সংসার পাতলেন। দুবছর পর প্রথম সন্তানের মুখ দেখলেন ওঁরা। একটা ছেলে। বাপৈর খুব ন্যাওটা, তাই সবাই তাকে সনি বলে ডাকে।

ওদের এই পাড়াতেই ফানুচি নামে এক লোক থাকে। সেও, একজন ইতালীয়, মডের মত শক্তিশালী, চেহারায় অদ্ভুত একটা হিংস্রতার ছাপ। তার সবগুলো সার্টই খুর দামী আর ফিকে রঙের, মাথায় থাকে সব সময় ঘিয়ে রঙের ফিডরা টুপি। সবাই বলে, সে নাকি কালো হাত দলের লোক। কালো হাত মাফিয়াদেরই একটা উপদল, হুমকি দিয়ে, মারধরের ভয় দেখিয়ে গৃহস্থ আর দোকানদারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করাই এদের পেশা। কিন্তু এই অঞ্চলের লোকেরাও বেপরোয়া টাইপের। তারা নিজেরাও নানান হিংসাত্মক কাজ করে। তাই তাদের সাথে লেগে খুব একটা সুবিধে করতে পারে না ফানুচি। কয়েকজন বুড়ো-বুড়ি, যাদের কোন যুবক ছেলে নেই মা-বাপকে রক্ষা করে, এদের উপরই যত অন্যায় অত্যাচার আর চোটপার্ট দেখিয়ে বেড়ায় সে। খামোকা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে ব্যবসার ক্ষতি করতে চায় না বলে দোকানদাররাও সামান্য কিছু টাকা দেয় তাকে। ওদিকে, তার পেশার আরেকটা দিক হলো, চোরের উপর বাটপাডি করা। কিছু লোক বেআইনী ভাবে ইতালীয় লটারীর টিকিট বিক্রি করে, কিছু লোক নিজেদের বাড়িতে জুয়ার আজ্ঞা বসায়, এদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে সে। মুদি দোকানদার আবানদাণ্ডোও সামান্য কিছু টাকা দেয় তাকে, তবে এ-ব্যাপারে তার ছেলে গেনকোর প্রবল আপত্তি আছে। ফানুচিকে একদিন দেখে নেবে সে, প্রায়ই কথাটা শোনায় বাপকে। ছেলেকে এসব ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে নিষেধ করেন আবানদাণ্ডো। আর ভিটো কর্লিয়নি সবই লক্ষ করেন, কিন্তু তার মুখের ভাব দেখে কিছু বোঝা যায় না, কাউকে তিনি কিছু বলেনও না।

এর মধ্যে একদিন হলো কি, গ্রামেরই তিন ছোকরা কি কারণে কে জানে, ঝাঁপিয়ে পড়ল ফানুচির উপর। ফানুচির এ কান থেকে ও-কান পর্যন্ত চিরে দিল ছুরি দিয়ে। ক্ষতটা লম্বা হলো বটে, কিন্তু গম্ভীর হলো না মোটেও। ফানুচি বেঁচে গেল। কিন্তু সাংঘাতিক ভয় পেল সে, রক্তক্ষরণও হলো প্রচুর। আততায়ীদের কাছ থেকে পালাচ্ছে ফানুচি, কাছেপিঠে ছিলেন বলে দৃশ্যটা দেখতে পেলেন ভিটো। দেখলেন, খেচে দৌড়াচ্ছে ফানুচি, বিশেষ রঙের ফিডরা টুপিটা নিজের বুকের কাছে ধরে আছে, যাতে রক্ত লেগে সুটের কোন ক্ষতি না হয় বা লজ্জাস্কর কোন দাগ কোথাও দেখা না যায়। ঝর ঝর করে ঝরছে রক্ত, কিন্তু একটা ফোঁটাও টুপির বাইরে পড়তে দেখলেন না ভিটো। দৃশ্যটা জীবনে কখনও ভুলবেন না তিনি।

হামলার শিকার হলো বটে ফানুচি, কিন্তু ব্যাপারটা তার জন্যে শাপে বর হয়ে দেখা দিল। ছোকরা তিনজন শক্তিশালী বেপরোয়া টাইপের হলেও খুন-খারাবিতে এখনও নাম লেখায়নি। ফানুচিকে.একটু শিক্ষা দেয়া ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না তাদের, ভবিষ্যতে ফানুচি।যাতে চোরের উপর বাটপাড়ি করতে সাহস না পায়। কিন্তু এই হামলার শিকার হয়ে ফানুচির আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ল, সে যে আসলেই একটা খুনী এবার তা প্রমাণিত হয়ে গেল। যে ছেলেটা ওর গালে চুরি চালিয়েছিল, কে যেন তাকে মেরে ফেলল গুলি করে। বাকি ছেলে দুটোর আত্মীয়স্বজনরা ফানুচিকে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে ওদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি চেয়ে নিল। এরপর স্বভাবতই দর্শনীর হার বাড়িয়ে দিল ফানুচি, সেই সাথে একটা জুয়ার আড্ডাখানার অংশীদার বনে গেল। এসবের সাথে কোন ভাবেই কোন সম্পর্ক ছিল না কর্লিয়নির, যা ঘটে গেছে তাতে কিছুই এসে যায় না তার, সুতরাং গোটা ব্যাপারটা সাথে সাথে ভুলে গেলেন তিনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমদানি করা জলপাইতেলের খুব অভাব দেখা দিল আমেরিকায়। বাড়তে বাড়তে অনেক দূর এগিয়েছে ফানুচি, যত দিন যাচ্ছে ততই খাঁই আর লোভ সীমা ছাড়াচ্ছে তার। আবানদাতোর মুদি দোকান থেকে শুধু জলপাই তেল নয়, ইতালী থেকে আমদানি করা সালামি, হ্যাম আর চিজের একটা অংশ নিয়মিত সালামী হিসেবে আদায় করে নিচ্ছে সে! দোকান আর দোকানের মালপত্রের উপর নিজের অধিকার আরও শক্ত করে কায়েম করার জন্যে আরেক কৌশল খাটাল সে, নিজের এক ভাইপোকে নিয়ে এসে বসিয়ে দিল দোকানটায়। ফলে চাকরি হারালেন ভিটো কর্লিয়নি।

ইতিমধ্যে ওদের দ্বিতীয় ছেলে ফ্রেডারিকোরও জন্ম হয়েছে, তার মানে চার চারটে পেট চালাতে হয় ভিটো কর্লিয়নিকে। চিরকালই চুপচাপ, চাপা স্বভাবের মানুষ তিনি, মনের কথা ঠোঁটের বাইরে বের করেন না। তাঁর অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে একজনই, দোকান মালিকের ছেলে গেনকো আবানদাণ্ডো। চাকরি হারিয়ে রাগ, ক্ষোভ আর দুঃখের বশে বাপের অন্যায় সিদ্ধান্তের জন্যে বন্ধুকে দায়ী করলেন ভিটো। তাতে তিনি নিজে এবং বন্ধু গেনকো দুজনেই অপ্রতিভ বোধ করলেন। লজ্জায় লাল হয়ে উঠে গেনকো বন্ধুকে কথা দিল, তার সংসারের পেট চালাবার জন্যে তাকে ভাবতে হবে না, সে-ব্যবস্থা যেভাবে হোক করবে সে। কি ভাবে? সাথে সাথে পানির মত সহজ একটা উপায়ের কথা জানাল গেনকো, বাপের দোকান থেকে খাবার চুরি করে এনে দেবে সে বন্ধুকে। কিন্তু প্রস্তাবটা অত্যন্ত কঠোর ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন ভিটো কর্লিয়নি, ছেলে হয়ে বাপের কাছ থেকে চুরি করবে, এতবড় অন্যায়, লজ্জাস্কর কাজ তিনি করতে দেবেন না।

ইদানীং যার নাম শুনলে লোক ভয় পায়, সেই ফানুচির উপর ঠাণ্ডা হিম একটা বিদ্বেষ জন্মাল তরুণ ভিটো কর্লিয়নির মনে। ভয়ঙ্কর রাগে বিস্ফোরনোন্মুখ হয়ে। আছে তাঁর শরীর, কিন্তু ভাষায় বা চেহারায় কিছুই তিনি প্রকাশ করলেন না, শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। একটা চাকরি পেলেন তিনি রেল পথে, কিন্তু সেটাও কয়েক মাসের বেশি টিকল না। যুদ্ধের শেষে চাকরির বাজার এখন সাংঘাতিক মন্দা, মাসের মধ্যে আজকাল মাত্র কয়েকদিন কাজ হয়, প্রায় পুরো মাসই বেকার বসে থাকেন। যে কদিন কাজ হয়, তাও সুখের সাথে করার উপায় নেই। ফোরম্যানরা বেশিরভাগই হয় আমেরিকান নয়তো আইরিশ, শ্রমিকদেরকে তারা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। ভাবলেশহীন পাথরের মত মুখ করে থাকেন ভিটো, যেন এ-সব গালমন্দের অর্থ কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না। আসলে ইংরেজি বলার মধ্যে একটু টান থাকলেও ভাষাটা তিনি বেশ ভালই বুঝতে পারেন।

একদিন সন্ধ্যাবেলার ঘটনা। স্ত্রী আর ছেলেদের নিয়ে খেতে বসেছেন ভিটো, এই সময় একটা টোকা পড়ল জানালায়। জানালার বাইরে বাতাস চলাচলের জন্যে ছোট্ট একটা প্যাসেজ আছে, প্যাসেজের ওপারে অন্য একটি বাড়ির দেয়াল, দেয়ালের গায়ে একটা জানালা ॥ পর্দা সরিয়ে প্যাসেজে তাকালেন ভিটো, দেখলেন পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে ঘাড়-মাথা বের করে বাইরের দিকে ঝুঁকে রয়েছে যুবক পিটার ক্লেমেঞ্জা, তার হাতে সাদা কাপড়ে মোড়া একটা প্যাকেট দেখা যাচ্ছে, সেটা সে বাড়িয়ে ধরে আছে সামনের দিকে।

এই যে, দেশী ভাই, ভিটোকে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতে দেখেই বলল ক্লেমেঞ্জা, তোমার জিম্মায় রাখতে পারবে এটা, আবার যখন চাইব, ফিরিয়ে দেবে? ধরো, তাড়াতাড়ি করো।

ঝোঁকের মাথায়, ভাল মন্দ কিছু না ভেবেই যন্ত্রচালিতের মত হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিলেন ভিটো। তবে, ক্লেমেঞ্জার চেহারায় উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা দেখতে পেয়েছেন তিনি, তাকে সাহায্য করার ঝোঁকটা সেজন্যেই চাপল। প্যাকেটটা কিচেনে নিয়ে এসে খুললেন তিনি। চুপটি করে শুয়ে রয়েছে কয়েকটি ভাল মানুষের ছা, তেল চকচকে তিনটে পিস্তল। বেডরূমের আলমারিতে তুলে রাখলেন ওগুলো তিনি, এরপর কি হয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছেন। খানিক পরেই জানতে পারলেন, পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে ক্লেমেঞ্জাকে। ভিটো বুঝলেন, ক্লেমেঞ্জা যখন মোড়কটা পাচার করে দিচ্ছিল, নিশ্চয়ই পুলিশ তখন তার দরজায় লাথি মারছিল।

এ-বিষয়ে একটা কথাও বললেন ন ভিটো। আর তাঁর স্ত্রী তো ভয়েই কারও কাছে দুঠোঁট আলগা করেননি, স্বামীকেও যদি ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। দুদিন পরই আবার পাশের বাড়িতে উদয় হলো পিটার ক্লেমেঞ্জা, এ-কথা সে-কথার মাঝখানে সহজ ভাবে একবার জানতে চাইল সে, আমার সেই প্যাকেটটা এখনও রেখেছ তোমার কাছে?

মাথা নাড়লেন ভিটো। কম কথার মানুষ তিনি। ক্লেমেঞ্জাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে তাকে এক গ্লাস মদ খেতে দিলেন। তারপর বেডরূমের আলমারি থেকে প্যাকেটটা বের করে এনে নিঃশব্দে ধরিয়ে দিলেন তার হাতে।

মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে ক্লেমেঞ্জা, মুখের গড়ন, ভারি হলেও, অদ্ভুত একটা ভালমানুষির ছাপ ফুটে আছে চেহারায়, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে প্রখর সতর্কতা-খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছে ভিটো কর্লিয়নিকে। খুলে দেখেছ? সংক্ষেপে জানতে চাইল সে।

চেহারায় গাম্ভীর্য এতটুকু না ভেঙে এদিক ওদিক মাথা দোলালেন ভিটো, বললেন, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি নাক গলাই না।

সন্ধ্যাটা ভিটো কর্লিয়নির সাথে মদ খেয়ে কাটাল ক্লেমেঞ্জা । প্রায় কোন কথাবার্তা ছাড়াই ওদের মধ্যে একটা সদ্ভাব গড়ে উঠল, ভাল লেগে গেল পরস্পরকে। এর একটু পর গল্প শুরু করল ক্লেমেঞ্জা। গল্প বলিয়ে হিসেবে জুড়ি নেই তার। আর কম কথার মানুষ ভিটো কর্লিয়নি ভালবাসেন গল্প শুনতে নিঃশব্দে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল ওদের মধ্যে।

কয়েক দিন পরের কথা, ভিটো কর্লিয়নির স্ত্রীকে ক্লেমেঞ্জা জিজ্ঞেস করল, বৈঠকখানার জন্যে তাদের কোন গালিচা দরকার আছে কিনা। গালিচাটা বয়ে আনতে হবে, একজনের পক্ষে তা সম্ভব নয়, তাই ভিটোকে সাথে যেতে অনুরোধ করল ক্লেমেঞ্জা। ভিটোকে নিয়ে একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে এল সে। বাড়িটার গেটের ভিতর মোটা লম্বা থামগুলো শ্বেত পাথরের তৈরি। চাবি বের করে দরজা খুলল ক্লেমেঞ্জা, ভিট্টোকে নিয়ে সৌখিন ভাবে সাজানো একটা ফ্ল্যাটে ঢুকল সে। ঘরের ওধারে যাও, ভারি গলায় ভিটোকে বলল, গালিচাটা আমি গোটাচ্ছি, তুমি আমাকে সাহায্য করো।

অপূর্ব সুন্দর দামী লাল উলের গালিচা, এ-ধরনের একটা জিনিস ক্লেমোতকৈ দান করতে যাচ্ছে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন ভিটো। তার মনের উদারতা দেখে খুশি হলেন তিনি। গোটানো হয়ে যেতে, গালিচার দুই প্রান্ত দুজন ধরে গেটের দিকে হাঁটা দিয়েছেন, ঠিক এই সময় গেটের কলিংবেল বেজে উঠল।

নিমেষে হাত থেকে গালিচাটা ফেলে দিল ক্লেমেঞ্জা, লাফ দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, পর্দাটা সিকি ইঞ্চি সরিয়ে কি সে দেখল সেই জানে, ঝট করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে ফেলল পিস্তলটা। এতক্ষণে ভিটো কর্লিয়নি বুঝতে পারছেন, ক্লেমেঞ্জা তাকে নিজের জিনিস দান করছে না, তারা অন্য লোকের জিনিস চুরি করছেন।

আবার বেজে উঠল কলিংবেল। ব্যাপারটা কি দেখার জন্যে ক্লেমেঞ্জার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ভিটো, পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেলেন, গেটের সামনে ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তৃতীয় এবং শেষবারের মত কলিংবেল বাজিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে যখন কোন সাড়া পেল না লোকটা, বিরক্তির সাথে কাধ ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে, সাদা মার্বেল-পাথরের সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে গেল।

গভীর, ভারি গলা থেকে ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল ক্লেমেঞ্জার, ভিটো বুঝলেন, শব্দটা আনন্দের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। পুলিশ লোকটা সবে রাস্তার মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এই সময় গালিচাটাকে দুজন। মিলে ধরাধরি করে বয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। আধঘণ্টা পর ভিটো কর্লিয়নির বৈঠকখানার মাপ নিয়ে গালিচাটা কাটতে বসল ক্লেমেঞ্জা। বৈঠকখানার মেঝে ঢাকা পড়ার পরও অনেকটা বেঁচে গেল গালিচা, সেটুকু দিয়ে বেডরূমের মেঝেটাকেও মুড়ে দেয়া গেল। ভিটো কর্লিয়নি আবিষ্কার করলেন, ক্লেমেঞ্জার মত দূরদৃষ্টি সপন্ন আর নিপুণ কারিগর হয় না। লোকটা যত মোটা তার চেয়ে মাপে অনেক বড় কোট পরে, আর সেই কোটের সবগুলো পকেটে গালিচা কাটার যত রকম যন্ত্রপাতি থাকা সম্ভব সবই সে সাথে করে নিয়ে এসেছে।

সময় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অবস্থা ভাল হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অপূর্ব সুন্দর দামী গালিচাটা খেয়ে তো আর কর্লিয়নি পরিবারের পেট ভরবে না। কাজকর্ম নেই এই অবস্থায় যা হবার তাই হচ্ছে, স্ত্রী আর ছেলেদেরকে নিয়ে উপোস থাকতে হয় বাড়ির কর্তাকে। আর কোন উপায় নেই দেখে, অগত্যা বাধ্য হয়ে বন্ধু গেনকোর কাছ থেকে কয়েক প্যাকেট খাবার নিতে হলো। কিন্তু এভাবে আর কদিন। কি করা যায় ভাবছেন ভিটো। কিছু একটা করতেই হয় এবার। কিন্তু কি করবেন তার কোন হদিস খুঁজে পান না তিনি। এমন ভয়াবহ অভাবে পড়েছেন, অথচ অন্যায় পথে টাকা রোজগারের কথা একবারও উঁকি দেয়নি তার মনে। এর মধ্যে একদিন ক্লেমেঞ্জা আবার তার বাড়িতে এসে হাজির, সাথে করে এনেছে পাড়ারই আরেক গুণ্ডা টাইপের ছোকরাকে। এরা দুজনেই তাঁকে ভালমানুষ বলে মনে করে, তার ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করে, সেই সাথে জানে এখন তিনি অভাবের তাড়নায় মরিয়া হয়ে আছেন। একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তারা, ভিটো কর্লিয়নি তাদের দলে যোগ দিলে তারা নিজেদেরকে ভাগ্যবান বলে মনে করবে। একমুহূর্ত দেরি না করে নিজেদের পরিকল্পনার বর্ণনা দিতে শুরু করল তারা। হ্যাঁ বা না, কিছুই বলেননি এখনও ভিটো কর্লিয়নি, তিনি শুধু মন দিয়ে শুনে যাচ্ছেন ওদের কথা। থার্টিফাস্ট স্ট্রীটে রেশমের রেডিমেড পোশাক তৈরির একটা কারখানা আছে, সেখান থেকে চালান যায় ট্রাক ভর্তি পোশাক রাস্তায় ট্রাক থামিয়ে তাদের দলই এই মাল ছিনতাই করে। বিপদের ঝুঁকি বলতে কিছুই নেই। কিসে নিজেদের ভাল হবে সে-ব্যাপারে টনটনে জ্ঞান ট্রাক ড্রাইভারদের, একবার শুধু পিস্তলের চেহারা দেখলে হয়, অমনি লক্ষ্মী ছেলের মত নিঃশব্দে ফুটপাথে নেমে দাঁড়ায়। এরপর ছিনতাইকারীরা ট্রাক নিয়ে সোজা চলে আসে এক বন্ধুর দামে, সেখানেই খালাস করা হয় লুটের মাল।

ব্রঙ্কসের আর্থার এভেনিউ, মালবেরি স্ট্রীট, ম্যানহাটনের চেলসি-এই সব এলাকায় বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করা হয় লুটের মাল। খরিদ্দাররা সবাই গরীব ইতালীয় পরিবারের মেয়ে, সস্তা জিনিসের খোঁজেই থাকে এরা, উচিত মূল্য বা বাজার দর দিয়ে এত ভাল পোশাক কেনবার সামর্থ্য এদের কারও নেই। লুটের মাল এরপরও প্রচুর থেকে যায়। সেগুলো বিক্রি করে দেয়া হয় ইতালীয় পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে।

ভিটো কর্লিয়নিকে কেন তাদের দরকার, এবার সে-প্রসঙ্গে এল তারা। আসলে ট্রাক ড্রাইভারের অভাব পড়েছে তাদের। তারা জানে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত আবানদার্তোর গাড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি দোকানের মাল পৌঁছে দিয়েছেন ভিটো। উনিশশো উনিশ সাল এটা, ট্রেনিং পাওয়া ড্রাইভার জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়, মেলা টাকা দিলেও সব সময় পাওয়া যায় না। তাছাড়া, লোকটাকে তো ভালমানুষ আর বিশ্বস্ত হতে হবে।

নিজের শুভ বুদ্ধির সাথে পরামর্শ করে দেখলেন ভিটো কর্লিয়নি। বুঝলেন, ওদের দলে যোগ দেয়া চলে না, সেটাই সুবুদ্ধির কাজ হবে। কিন্তু, এই প্রথম শুভ বুদ্ধির পরামর্শ অমান্য করে ওদের দলে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। চিন্তা ভাবনা করতে গিয়ে একটা যুক্তির বিরুদ্ধে তিনি কোন সদুত্তর খুঁজে পেলেন না। তা হলো, এই একটা কাজের জন্যে তাঁর হাতে আসবে হাজার ডলার। এত মোটা অঙ্কের টাকা যেচে পড়ে আসতে চাইছে, কোন যুক্তিতে সেটাকে ফিরিয়ে দেবেন। তিনি, বিশেষ করে না খেতে পেয়ে পরিবারের সবাই যখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? কিন্তু তরুণ সঙ্গীদের মধ্যে ক্ষতিকর ছটফটে ভাব লক্ষ করছেন তিনি, কাজের ধারা বড় বেশি এলোমেলো, লুটের মাল বিলি করার পদ্ধতিতে খুব বেশি ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। গোটা পরিকল্পনায় নিপুণ কৌশল আর যত্নের অভাব রয়েছে। এত ত্রুটি-বিচ্যুতি ঠিক মেনে নিতে পারছেন না তিনি। তবে সঙ্গী দুজনকে তাঁর সৎ আর নির্ভরযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। এই অল্প বয়সেই পিটার ক্লেমেঞ্জার চেহারায় রাশভারি একটা ভাব, ভরসা রাখা যায়। আর একহারা, তীক্ষ্ণ চেহারায় টেসিওর আত্মবিশ্বাস দেখে উৎসাহ পাওয়া যায়।

কোন বিঘ্ন ছাড়াই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হলো কাজটা। পিস্তল দেখাতেই টু-শব্দটি করে নিচে নেমে এল ট্রাক ড্রাইভার। এখনও মনের কোথাও ভয়ের একটু ছোঁয়া পর্যন্ত অনুভব করছেন না লক্ষ করে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন ভিটো কর্লিয়নি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সমস্ত কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করল। ওরা ঘাবড়ানো তো দুরের কথা, একটু উত্তেজিত পর্যন্ত হয়নি। কেউ। বরং, হাস্য রসিকতা করে ট্রাক ড্রাইভারকে বলল, সে যদি ভালমানুষ সেজে থাকে তাহলে তার বউকে কয়েক জোড়া পোশাক উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে।

বাড়ি বাড়ি ফেরি করে লুটের পোশাক বিক্রি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ভেবে নিজের ভাগের সবটাই তিনি একজন চোরাকারবারীর হাতে তুলে দিলেন, এতে তার লাভ হলো খুবই কম, মাত্র সাতশো ডলার পেলেন। কিন্তু উনিশশো উনিশ সালে সাতশো ডলার মেলা টাকা।

পরদিনই রাস্তায় তার পথ আটকালো একজন লোক। পরনে ঘিয়ে রঙের সুট, মাথায় সাদা ফিডরা টুপি, চেহারাটা হিংস্র। তার চিবুকের নিচে গলার উপর, এ-কান থেকে ও-কান পর্যন্ত গোল ফঁসের মত সাদা একটা দাগ, সেটা, ঢেকে রাখার কোন চেষ্টাই নেই। চকচকে কালো রঙের ভুরু জোড়া চওড়া আর ঘন! চেহারাটা রুক্ষ, কর্কশ হলেও হাসলে তাকে বিনয়ের অবতার আর সাংঘাতিক অমায়িক বলে মনে হয়। হাসছে ফানুচি। কিন্তু ভিটো কর্লিয়নি চুপচাপ। রাগ, বিস্ময় বা ভয়ের কোন ভাবই দেখা যাচ্ছে না তার চেহারায়,

কথার সুরে খুব বেশি সিসিলীয় টান ফানুচির। আরে থামো থামো, তোমাকেই তো খুঁজছি আমি, লোকমুখে শুনছি তুমি নাকি বিরাট ধনী বনে গেছ। তুমি একা নও, তোমার সাথের মিতারাও নাকি প্রচুর মালপানি কামিয়েছে। কথাটা সত্যি নাকি? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই বলে চলল ফানুচি, তা, তোমার কি মনে হয় না, আমাকে তোমরা ছোটলোকের মত ঠকাচ্ছ? ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছ। আমাকে? জানোই তো, এটা আমার এলাকা, সুতরাং আমাকেও একটু ঠোঁট ভেজাতে দেয়া উচিত ছিল। মাফিয়াদের পূরানো একটা প্রবাদ আওড়াল ফানুচি, কথাটায় পিটসু শব্দটা রয়েছে, মানে হলো ক্যানারি বা ওই জাতের ছোট পাখির ঠোঁট। সোজা কথায় লুটের মালের ভাগ চাইছে ফানুচি।

নিজের স্বভাব বজায় রাখলেন ভিটো, ফানুচি থামতেও কোন উত্তর করলেন না। দাবির ইঙ্গিতটা সাথে সাথেই টের পেয়েছেন কিন্তু স্পষ্ট দাবির জন্যে অপেক্ষা করছেন তিনি।

নিঃশব্দে হাসল ফানুচি, সোনা দিয়ে বাঁধানো সঁতটা বেরিয়ে পড়ল তার, সেই সাথে ফাঁসের মত গলার সাদা দাগটায় টান পড়ল, শুকনো ক্ষতটা তাতে এঁটে বসল মুখের চারদিকে। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছে, হাসছে এখনও, ভিটোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে সুস্থে খুলছে কোটের বোতাম, উদ্দেশ্য ঢিলেঢালা ট্রাউজারের কোমরে গোজা পিস্তলটা দেখানো। আমাকে অপমান করেছ তুমি, তবে সে-কথা আমি ভুলে যাব, আমাকে শুধু পাঁচশো ডলার দিতে হবে। কি জানো, আমার মত মানুষদেরকে আজকালের ছেলেরা শ্রদ্ধা করতে শেখেনি, তাতে নিজেরাই শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়ে যায়। অথচ কিভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হয়, তা যদি একবার শিখে নিতে পারে, সব দিক থেকেই লাভ হয় তাদের, কোন ঝামেলায়, পড়তে হয় না।

এই প্রথম ফানুচির চোখে চোখ রেখে নিঃশব্দে হাসলেন ভিটো কর্লিয়নি। এখনও তিনি অল্পবয়েসী, তরুণ, রক্ত ঝরাতে শেখেননি, কিন্তু তার হাসির মধ্যে এমন একটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা অথচ ভীতিকর ভাব রয়েছে যা দেখে ফানুচির মত খুনীর বুকটাও কেমন যেন দুলে উঠল। আবার মুখ খোলার আগে খানিক ইতস্তত করল সে, তারপর। বলল, টাকা দেয়া না দেয়া তোমার ইচ্ছা। তবে না দিলে তোমার বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে। তোমার স্ত্রী আর ছেলেরা হয়তো বিপাকে পড়বে, পথে দাঁড়াব। তাই চাও তুমি? ভেবে দেখো। অবশ্য তোমার লাভের অংকটা যদি ভুল শুনে থাকি, কথা দিচ্ছি, ঠোঁটটা তাহলে আরও একটু কম ভোবাব। তাই বলে ভেব না তিনশোর কমে রাজি হব আমি। আর, মনে রেখো, কেউ যদি আমাকে ঠকাতে চেষ্টা করে, ভীষণ রেগে যাই আমি।

এই প্রথম মুখ খুললেন, ভিটো কর্লিয়নি। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক, রাগের ছিটেফোঁটাও নেই। সম্মান দেখিয়েই কথা বললেন, ফানুচির মত নাম করা একজন বয়স্ক লোকের সাথে একজন সুবোধ তরুণের যেভাবে কথা বলা শোডন দেখায়। গলার স্বর নরম করে বললেন, আমার ভাগের টাকাটা বন্ধুদের কাছে রয়ে গেছে। ওদের সাথে আগে কথা বলতে হবে আমার।

দুশ্চিন্তা মুক্ত হলো ফানুচি। বেশ তো। কিন্তু সেই সাথে জানিয়ে দিয়ে, ওদের ভাগেও আমাকে যেন ঠোঁট ডোবাতে দেয়, অভয় দানের সুরে আবার বলল সে, কথাটা বলতে ভয় পেয়ো না যেন আবার। ক্লেমেঞ্জাকে ভালভাবে চেনা আছে আমার, এসব ব্যাপার বুঝতে দেরি করে না সে। চালু ছোকরা, ওর কথামত চললে উন্নতি হবে তোমার। অনেক কিছু শিখতে পারবে।

শ্রাগ করলেন ভিটো। একটু আনাড়ী আর কুণ্ঠিত ভাব ফুটিয়ে তুললেন চেহারায়। বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি তো বুঝতেই পারছেন, এসব ব্যাপারে একদম কাঁচা আমি, এখনও কিছু শিখে উঠতে পারিনি। আপনি যে আমার সাথে গুরুজনের মত কথা বলছেন সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ।

কথাগুলো শুনে খুব খুশি হলো ফানুচি। লক্ষ্মী ছেলে তুমি, বলেই লোমশ হাত দিয়ে ভিটোর একটা হাত ধরে আন্তরিক ভাবে ঝাঁকিয়ে দিল। আমারই ভুল হয়েছে, আসলে কিভাবে শ্রদ্ধা দেখাতে হয় তা তুমি অনেকের চেয়ে ভাল জানো। এত কম বয়েসে এই গুণ সবার মধ্যে দেখা যায় না। এর পরের বার কিন্তু তুমিই আমার কাছে গিয়ে প্রথম কথা বলবে, কেমন? আর একটা কথা বলে রাখি, বড়সড় ধরনের কোন দাও-এর খোঁজখবর পেলে আমার সাথে পরামর্শ করে নিয়ে, আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারব।

আজ যে ফানুচির সাথে এমন নরম আর নিখুঁত কৌশলে কথা বললেন ভিটো কর্লিয়নি তার কারণ অনেক বছর পর তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। আসলে সিসিলিতে মাফিয়াদের হাতে তার বদমেজাজী বাবার মৃত্যুর স্মৃতি ভোলেননি তিনি। ফানুচির সাথে কথা বলার সময় শুধুমাত্র একটা অনুভূতি কাজ করেছে তার মধ্যে, ঠাণ্ডা হিম একটা রাগ।

টাকাটা রোজগার করার জন্যে নিজের প্রাণ, নিজের স্বাধীনতা পর্যন্ত বাজি রাখতে হয়েছে তাকে, অথচ স্পর্ধা দেখিয়ে আরেকজন লোক এত কষ্টের টাকাটা তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। কথা বলার সময় ফানুচিকে স্রেফ একটা বদ্ধ পাগল বলে মনে হচ্ছে তার। লোকটা এতবড় আহাম্মক ভেবে অবাক হচ্ছেন তিনি। এর মধ্যে ক্লেমেঞ্জাকে যতটুকু চিনেছেন তিনি, প্রকাণ্ডদেহী ওই সিসিলীয় প্রাণ দিয়ে লড়বে তবু নিজের ভাগ থেকে একটা কণা পর্যন্ত দিতে রাজি হবে না। এই তো সেদিনের কথা, ভোলেননি তিনি, সামান্য একটা গালিচা চুরি করার জন্যে একজন পুলিশের লোককেও খুন করতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল সে। আর একহারা তীক্ষ্ণ চেহারার টেসিওর মধ্যে একরোখা একটা ভাব আছে, বিষধর সাপের মত ভয়ঙ্কর। কারও ভয়ে নতি স্বীকার করার পাত্র সে-ও নয়।

কিন্তু সেদিনই রাত আর একটু গম্ভীর হতে, ক্লেমেঞ্জার বাড়িতে বসে সদ্য শুরু নতুন শিক্ষা জীবনের আরেক পাঠ নিলেন ভিটো কর্লিয়নি। অশ্রাব্য খিস্তি আর অভিশাপ দিতে শুরু করল ক্লেমেঞ্জা, ভুরু কুঁচকে প্রচণ্ড রাগে মুখ বিকৃত হয়ে উঠল টেসিওর, কিন্তু দুজনেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিল দুশো ডলার করে দিলে সন্তুষ্ট করা যাবে কিনা ফানুচিকে।.টেসিওর ধারণা, হয়তো যাবে।

কিন্তু ক্লেমেঞ্জার দৃঢ় বিশ্বাস ফানুচিকে এত কমে রাজি করানো অসম্ভব। উঁহু, বেজন্মা কুত্তাটা নিশ্চয়ই পাইকারদের কাছ থেকে শুনেছে কত টাকার মাল লুট করেছি আমরা, শালাকে তিনশো ডলারেই রাজি করা কঠিন হবে। মান হয়ে গেল তার চেহারা। ওকে টাকা না দিয়ে উপায় নেই আমাদের।

আশ্চর্য হয়ে গেলেন ভিটো কর্লিয়নি, কিন্তু সযত্ন চেষ্টায় মুখের চেহারায় তা প্রকাশ পেতে দিলেন না। মৃদু কণ্ঠে তিনি বললেন, টাকা দিতেই হবে তার কি মানে? আমরা তিনজন, ও একা। ওর চেয়ে আমাদের জোর বেশি। আমাদের পিস্তল আছে। কি করতে পারে আমাদের ও? টাকাটা আমাদের, আমরা খেটে রোজগার করেছি-ওকে কেন দেব?

ভিটো কর্লিয়নি এ-লাইনে নতুন, তাই তার উপর বিরক্ত না হয়ে ধৈর্য ধরে তাকে বোঝাতে শুরু করল ক্লেমেঞ্জা। অনেক বন্ধু আছে ফানুচির, হিংস্র পশু এক একটা। পুলিশও রয়েছে ওর হাতে। আমরা কিভাবে টাকা কামাই সেটা জানাই ওর। আসল উদ্দেশ্য, পুলিশকে কথাটা ফাস করে দিয়ে তাদের মন রাখতে চায়। তাহলে পুলিশও ওর সুবিধে করে দেবে। ওর কাজের ধারাই তো এই রকম। এদিকে কাজ করার জন্যে খোদ মারান জালার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে এসেছে ও।খুব বড় একজন গুণ্ডা মারান জালা, খবরের কাগজে প্রায়ই তার নামে নানান ধরনের অভিযোগ তোলা হয়। শোনা যায়, সে নাকি সুসংগঠিত একটা দুষ্কৃতকারী দলের নেতা। প্রাণের ভয় দেখিয়ে টাকা খসানো, জুয়ার আড্ডা কসানো আর ডাকাতি করা ওদের পেশা।

নিজের তৈরি মদ খাওয়াল ওদেরকে ক্লেমেঞ্জা। ওর বউ টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে গেল এক প্লেট সালামি, জলপাই আর ইতালীয় রুটি। কামরা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় একটা চেয়ার তুলে নিয়ে গেল সে, বাড়ির সামনে বসে বান্ধবীদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। বয়স কম মেয়েটার, এই তো কবছর হলো আমেরিকায় এসেছে, ইংরেজি ভাষাটা এখনও বুঝতে শেখেনি।

দুই বন্ধুর সাথে মদ খাচ্ছেন ভিটো কর্লিয়নি। এই মুহূর্তে যেভাবে বুদ্ধির চর্চা করছেন তিনি, এর আগে আর কখনও সেভাবে চিন্তা করেননি। নিজের চিন্তাশক্তির স্বচ্ছতা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন। প্রথমে তিনি ফানুচি সম্পর্কে যা কিছু জানেন সব স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। সবচেয়ে আগে মনে পড়ল, তার গাল চিরে দেয়ার কথাটা! ঝরে পড়া রক্ত ধরার জন্যে চিবুকের নিচে টুপি নিয়ে ছুটছে ফানুচি, দৃশ্যটা পরিষ্কার ভেসে উঠল চোখের সামনে। এর পরের ঘটনা কি? যে-ছেলেটা তার গালে ছুরি চালিয়েছিল, তাকে গুলি করে মেরে ফেলে সে। কিন্তু বাকি দুই ছোকরা বেঁচে গেল কেন? তারা ফানুচিকে টাকা দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। হঠাৎ বুঝতে পারলেন ভিটো কর্লিয়নি, জবরদস্ত কোন সমর্থক বা ওস্তাদ কখনোই ছিল না ফানুচির, নেই, থাকতে পারে না। যে নোক পুলিশকে তথ্য যোগান দেয়, টাকা খেয়ে প্রাণের শত্রুকে ক্ষমা করে, প্রতিশোধ নেয় না, তার পিছনে বড় কোন শক্তির সমর্থন থাকতে পারে না। ও যদি সত্যি মাফিয়া গুণ্ডা হত, তাহলে বাকি দুজনকেও প্রাণ হারাতে হত। মাফিয়া গুণ্ডারা এ-ধরনের সিরিয়াস ব্যাপারে কখনও আপস করে না। সুযোগ পেয়ে একজনকে খুন করল বটে ফানুচি, কিন্তু সাথে সাথে এও বুঝল যে অন্য দুজন এবার সাবধান হয়ে গেছে, তাদেরকে খুন করা এখন আর সহজ নয়, তাই প্রতিশোধের বদলে টাকা নেয়া ছাড়া উপায় দেখেনি সে। বস্তি এলাকার জুয়ার আড়ালো আর দোকানদারদের কাছ থেকে সেফ গায়ের জোর দেখিয়ে টাকা খায় ও। ভিটো কর্লিয়নির মনে পড়ল, অন্তত একটা জুয়ার আড্ডার কথা জানেন তিনি, যেখান থেকে একটা কানাকড়িও আদায় করতে পারে না ফানুচি। দুএকবার চেষ্টা করে সুবিধে করতে না পেরে আশা ছেড়ে দিয়েছে ও। কিন্তু, কই, সেই জুয়ার আড্ডা তো বন্ধ হয়নি বা আড্ডার মালিকের তো কোন ক্ষতি হয়নি।

এসবের একটাই মানে, কারও সাহায্য বা উৎসাহ পেয়ে নয়, ফানুচি একাই কাজ করে। প্রয়োজনে বড়জোর নগদ টাকা দিয়ে পিস্তলধারী ভাড়া করে ও, এবং ওই পর্যন্তই ওর দৌড়। এটুকু পরিষ্কার বোঝার পর ভিটো কর্লিয়নিকে এবার জীবনের সবচেয়ে কঠিন আর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে মনে মনে তৈরি হতে হলো।

আজকের এই অভিজ্ঞতার ফলেই তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা মাত্র নিয়তি আছে। কথাটা তিনি তার পরবর্তী জীবনে অসংখ্যবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। আজ রাতে ফানুচির দাবি মেনে নিয়ে আবার তিনি মুদি দোকানের একজন অতি সাধারণ কেরানী হয়ে যেতে পারেন, দূর ভবিষ্যতে একদিন হয়তো তার নিজেরও একটা দোকান হবে। কিন্তু নিয়তির অমোঘ নির্দেশে তাঁকে একজন ডন হতে হবে। সেজন্যেই তার জীবনে ফানুচির আগমন, সে এসেই তাকে তার নির্দিষ্ট পথে দাঁড় করিয়ে দিল।

নিঃশব্দে মদের গ্লাসটা খালি করলেন ভিটো কৃর্লিয়নি। তারপর অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ওদেরকে বললেন, তোমরা প্রত্যেকে দুশো ডলারের বেশি দিতে চাইছ না, আবার ভাবছ, এত কম টাকায় রাজি হবে না ফানুচি। বেশ, টাকাগুলো তোমরা বরং আমাকেই দাও, তোমরা যেভাবে চাইছ সেভাবেই সমস্যাটা মিটিয়ে দেব আমি। আমার কাছ থেকে ঠিকই ওই পরিমাণ টাকা নিতে রাজি হবে ফানুচি। অবশ্য নিক বা না নিক সেটা তোমাদের দেখার বিষয় নয়, কিভাবে ওর সাথে আপস করব সেটা আমার ব্যাপার, আমার ওপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দেবে তোমরা।

তীব্র সন্দেহের চোখে তাকাল ক্লেমেঞ্জা। কিন্তু শান্ত কণ্ঠে ভিটো কর্লিয়নি বললেন, যাদেরকে বন্ধু বলে মেনে নিই তাদের কাছে কখনও মিথ্যে কথা বলি না আমি। তুমি কালই ফানুচির সাথে কথা বলে সত্য মিথ্যে জেনে নাও। সত্যি টাকা চেয়েছে কিনা, কত টাকা চেয়েছে, সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু নিজেদের হাতে ওকে তোমরা দিয়ো না টাকা। তাই বলে ঝগড়াঝাটি করতে যেয়ো না আবার। বলবে, টাকাটা জোগাড় করতে একটু সময় লাগবে। তারপর যা দিতে চাইছ আমাকেই দিয়ো, আমি নিজের হাতে ওকে দেব সেটা। কথা বলতে গেলে দেখবে পাঁচশো ডলারের কমে কোনমতে রাজি হচ্ছে না, তাই বলে দর কষাকষি করতে যেয়ো না ভুলেও। যাই দাবি করুক, একটু মনমরা ভাব দেখিয়ে তাতেই রাজি হয়ে যেয়ো। দর কষব আমি। ওর সম্পর্কে তোমরা যা বলছ তা যদি সত্যি হয়, তাহলে মেনে না নিয়ে উপায় নেই যে লোকটা ভয়ঙ্কর, সুতরাং কি দরকার তার সাথে গোলমাল পাকিয়ে? ওকে খেপাবার কোন মানেই হয় না। দাবি মিটিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলাই সবদিক থেকে ভাল।

ভেবেচিন্তে দেখে শেষ পর্যন্ত ভিটো কর্লিয়নির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ওরা। পরদিনই ফানুচির সাথে কথা বলে যাচাই করে নিল ক্লেমেঞ্জা, ভিটো যে মিথ্যে বলেননি সে-ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হলো সে। খানিক পর ভিটোর বাড়িতে এসে দুশো ডলার তুলে দিল তার হাতে। টাকাটা দেবার সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভিটোকে লক্ষ করছে সে! জানতে চাইল, কথা বলে যা বুঝলাম, তিনশো ডলারের কমে ফানুচিকে রাজি করা অসম্ভব, তুমি কমাবে কিভাবে?

সহজ সরল ভঙ্গিতে বললেন ভিটো কর্লিয়নি, তা জেনে তোমার কি দরকার। শুধু মনে রেখো, আমি তোমার একটা উপকার করলাম।

আরও অনেক পরে এল টেসিও। ক্লেমেঞ্জার তুলনায় অনেক বেশি চালাক চতুর, ধারাল, আর চাপা স্বভাবের, কিন্তু শক্তির প্রচণ্ডতা অনেক কম। অনুভূতি দিয়ে ঠিকই আঁচ করতে পেরেছে সে, কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে। মনটা খুঁতখুত করছে তার, একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ও শালা কালো হাত দলের লোক, যা করার সাবধানে করবে, গভীর ভাবে বুদ্ধি ধার দিচ্ছে সে ভিটো কর্লিয়নিকে। হারামীর হাড়, শিয়ালের চেয়ে ধূর্তটাকাটা দেবার সময় একজন সাক্ষী থাকলে ভাল হয়, তুমি বললে আমি তোমার সাথে যেতে পারি।

শুধু মাথা নাড়লেন ভিটো কর্লিয়নি। উত্তরে কিছু বলার কষ্টটুকু পর্যন্ত স্বীকার করলেন না। একটু পর টেসিওকে বললেন, টাকাটা নেবার জন্যে আজ রাত নটার সময় এখানে আসতে হবে, ফানুচিকে শুধু এই কথাটা জানিয়ে দিয়ে। একটু মদ খাইয়ে, রসের গল্প করে, মন গলাবার চেষ্টা করব ওর, তারপর বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠিক রাজি করে ফেলব কম টাকায়।

অসম্ভব! এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে বলল টেসিও। নিজেকে অতবড় ভাগ্যবান মনে কোরো না। ফানুচি তার দাবি থেকে একচুল পিছু হটেছে বলে শুনিনি কখনও।

যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করব, বললেন ভিটো কর্লিয়নি। পরবর্তী জীবনে এই কথাটা তার মুখে এত বেশি বার শোনা গেছে যে শুধু বিখ্যাত নয়, এর নির্দিষ্ট আলাদা একটা অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। নিষ্ঠুর, মর্মান্তিক, চরম আঘাতের আগে এটা ছিল শেষ সতর্কবাণীর মত, তার মানে বিষধর সাপ ফণা তুলেছে, এখন শুধু ছোবল মারার অপেক্ষা, যে-কোন মুহূর্তে তা মারা হতে পারে। ভিটো কর্লিয়নি ডন হবার পর প্রতিপক্ষদের সাথে আলোচনায় বসে যখন এই কথাটা বলতেন, সাথে সাথে বুঝে নিত তারা রক্তপাত আর খুন-খারাবি বাদ দিয়ে আপস করার এটাই শেষ সুযোগ দিচ্ছেন তিনি।

স্ত্রীকে ডেকে ভিটো কর্লিয়নি বললেন, খাওয়ার পাট চুকলে ছেলেদুটোকে পাড়ারই অন্য কারও বাড়িতে যেন রেখে আসে সে। তার অনুমতি ছাড়া ওদেরকে যেন ফিরিয়ে আনা না হয়। ছেলেদেরকে পৌঁছে দিয়ে এসে স্ত্রীকে ফিরে আসতে হবে, তার কাজ হবে বাড়ির দরজায় বসে পাহারা দেয়া। কারণ হিসেবে জানালেন, খুব গুরুত্বপূর্ণ আর অত্যন্ত গোপনীয় কিছু পরামর্শ আছে ফানুচির সাথে তার, সে সময় কোন রকম বাধা পড়লে চলবে না। স্ত্রীর চেহারায় ভয় ফুটে উঠতে দেখে বিরক্তির সাথে কিন্তু নিচু গলায় বললেন, আমাকে মি বোকা মনে করো?

তাঁর স্ত্রী কোন উত্তর দেয়নি, উত্তর দেননি ভয়ে। ভয় তার ফানুচিকে নয়, ভয় নিজের স্বামীকে। একসাথে ঘর-সংসার করছেন, স্বামীর পরিবর্তন ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন তিনি। প্রতি ঘন্টায় বদলে যাচ্ছেন তিনি। কোথা থেকে যেন অতি ভয়ঙ্কর একটা শক্তি এসে ভর করেছে তার উপর, তাঁর গা থেকে সেই শক্তির আলো আর উত্তাপের আঁচ আসছে। স্বামী তার চিরকালই চুপচাপ স্বভাবের মানুষ, কথা বলেন কম, প্রকৃতিটা মাটির মত শান্ত, কখনও কোন অন্যায় করেন না, সব সময় যুক্তি মেনে চলেন-এমন দেবতার মত স্বামী পেয়ে নিজেকে তিনি মহাভাগ্যবতী বলে মনে করেন। কমবয়েসী সিসিলীয় তরুণরা এমন হয় না। দুনিয়ার যত খারাপ কাজ করে বেড়ানোই তো এই বয়েসী তরুণদের স্বভাব।

স্বামীকে বদলে যেতে দেখছেন বটে, কিন্তু কি থেকে কি হচ্ছেন তিনি তা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। নিরাপত্তার খাতিরে এতদিন নিরীহ ভালমানুষের খোলস পরে ছিলেন তিনি, এখন তার আর প্রয়োজন নেই বুঝতে পারার সাথে সাথে ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছেন। বয়েস হয়েছে পঁচিশ, শুরুটা একটু দেরিতেই হয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু আড়ম্বর আর সমারোহের সাথেই শুরু করছেন।

খুব সহজেই সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছেন ভিটো কর্লিয়নি। ফানুচিকে তিনি খুন করবেন। তাতে সরাসরি বাড়তি সাতশো ডলার ব্যাঙ্কে জমা পড়বে তার নামে। ক্লেমেঞ্জার দুশো, টেসিওর দুশো আর নিজের তিনশো, এই মোটা সাতশো ডলার দেবার কথা ফানুচিকে। তাকে যদি বেঁচে থাকতে দেন তিনি, এই সাতশো ডলার হাতছাড়া হয়ে যাবে। ফানুচিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে এত টাকা খরচ করতে তিনি রাজি নন। কঠিন ব্যারামে পড়ে ফানুচি আজ যদি হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর অপারেশন করার জন্যে তার যদি সাতশো ডলার দরকার হয়, তিনি কি টাকাটা নিজের পকেট থেকে তাকে দেবেন? না। কোন কারণে তিনি কি ফানুচির কাছে ঋণী? না। তার সাথে ওর কি কোন রক্তের সম্পর্ক আছে? না। তিনি কি তাকে ভালবাসেন? না। তাহলে কেন তাকে দিতে যাবেন সাতশো ডলার? দেবার কোন কারণই তো দেখতে পাচ্ছেন না। সুতরাং দেবেন না।

কিন্তু দেবেন না বললেই তো আর হলো না, ফানুচি জোর করে টাকাটা আদায় করার চেষ্টা করবে। তাহলে, ভাবলেন ভিটো কর্লিয়নি, তাকে আরেকটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হয়। যে-লোক তাঁর কাছ থেকে সাতশো ডলার কেড়ে নিতে চায় তাকে কেন তিনি মেরে ফেলবেন না?

সেই সাথে একথাও ভাবলেন, ফানুচিকে খুন করার বিরুদ্ধে কিছু যুক্তিও অবশ্য রয়েছে। সন্দেহ নেই, তার মত লোক না থাকলেও দুনিয়ার কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু বলা তো যায় না, ফানুচির হয়তো কিছু শক্তিশালী বন্ধু আছে। তারা প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করবে। তাছাড়া, ফানুচি নিজেও সাংঘাতিক সতর্ক আর শক্তিশালী লাক, ওকে খতম করা খুব সহজ কাজ হবে না। পুলিশের কথা মনে রাখতে হবে, মনে রাখতে হবে ইলেকট্রিক চেয়ারের কথা।

তারপর আবার ফানুচিকে খুন করার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে শুরু করলেন ভিটো কর্লিয়নি। নিজেকে প্রশ্ন করলেন, বিপদের কথা ভাবছেন কেন তিনি? বারো বছর বয়েস থেকেই কি তিনি বিপদের মধ্যে বাস করছেন না? বাবার সাথে কি তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি? বাবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা হয়ে গেছে, তারটা এখনও হয়নি, পার্থক্য তো এইটুকুই। ব্যাপারটা তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? বিপদের মধ্যেই বাস করছেন তিনি, সুতরাং এই প্রথম বিপদের ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন মনে করার কোন কারণ নেই। সমুদ্রেই যার শয়ন, শিশিরে তার কিসের ভয়? বারো বছর বয়েস থেকে আততায়ীরা যাতে নাগাল না পায় সেজন্যে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অচেনা বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে এসে ছদ্মনাম নিয়ে আত্মগোপন করে আছেন। একটানা অনেক বছর নিঃশব্দে দুনিয়াদারির হালচাল পর্যবেক্ষণ করে তার মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে তার বুদ্ধি আর সাহস আর সব লোকের তুলনায় অনেক বেশি, আজ পর্যন্ত সেই গুণগুলো কাজে লাগাবার সুযোগ পাননি তিনি এই যা।

তবু, নিয়তির পথে প্রথম পা ফেলার আগে তার আচরণের মধ্যে খানিকটা ইতস্তত ভাব দেখা গেল। এমন কি, ট্রাউজারের পকেটে সাতশো ডলার ভরে রাখলেন তিনি। আর ডান পকেটে রাখলেন পিস্তলটা, ট্রাক থেকে রেশমের পোশাক লুট করার সময় এটা তাকে দিয়েছিল ক্লেমেজা।

ঠিক সময়ে, নটা বাজতে না বাজতে এসে হাজির হলো ফানুচি! ক্লেমেঞ্জার উপহার দেয়া ঘরে তৈরি এক বোতল মদ টেবিলের উপর রাখলেন ভিটো কর্লিয়নি। মাথা থেকে খুলে সাদা ফিডরা টুপিটা মদের বোতলের পাশে রাখল ফানুচি। একটু আরাম পাবার জন্যে ফুল-কাটা রঙচঙে চওড়া টাইয়ের নটটা ঢিলে করে নিল সে, আরাম করে বসল। গ্রীষ্মের রাত, আজ আবার অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি গরম পড়েছে। ক্ষীণ, আবছা আলো বিলি করছে গ্যাসের বাতি। বাড়িটা নিস্তব্ধ, কোথাও কোন শব্দ নেই। এই প্রচণ্ড গরমেও, আশ্চর্য, ঠাণ্ডা বরফ হয়ে আছে ভিটো কর্লিয়নির শরীর। সতোর নমুনা দেখাবার জন্যে ট্রাউজারের পকেট থেকে সাতশো ডলারের তোড়াটা বের করলেন তিনি, সেটা ফানুচির বাড়িয়ে দেয়া হাতে ধরিয়ে দিলেন। তার চোখে সতর্ক দৃষ্টি ফুটে উঠেছে, ফানুচি টাকাগুলো গুণছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। গোণা শেষ করে পকেট থেকে মস্ত একটা চামড়ার ওয়ালেট বের করল ফানুচি, নোটের হোড়াটা তার ভিতর রেখে দিল সে। তারপর ধীরেসূন্থে মদের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, আরও দুশো ডলার পাওনা থাকল আমার।

বিনয়ের সাথে, অনুগ্রহ চাওয়ার ভঙ্গিতে ভিটো কর্লিয়নি বলেন, চাকরি-বাকরি নেই, আমার এখন হাত একটু টান যাচ্ছে। দয়া করে কয়েকটা হপ্তা আমাকে আপনার কাছে ঋণী থাকতে দিন।

কৌশলটা টিকে যেতে পারে, বেশিরভাগ টাকা তো পেয়েই গেছে ফানুচি। ভিটো ভাবলেন, অপেক্ষা করতে বলায় ফানুচি রেগে উঠবে বলে মনে হয় না, আর হাতে সময় পেলে তিনি হয়তো অনুনয় বিনয় করে বাকি টাকা না দেবার আর্জিও পেশ করতে পারবেন। বলা যায় না, ফানুচি হয়তো সে-আর্জি মঞ্জুরও করতে পারে।

মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে ফানুচি। তুমি দেখছি দারুণ চালাক ছেলে, বলল সে। এতদিন তুমি আমার চোখে পড়োনি কেন বলো তো? শোনো এমন গা ঢাকা দিয়ে আর চুপচাপ থাকলে নিজের সুবিধে করা যায় না, বুঝলে? আমার সাথে যোগাযোগ রেখো; এমন সব কাজ পাইয়ে দেব, প্রচুর রোজগার করতে পারবে।

সবিনয় ভদ্রতার সাথে মাথা কাত করে উৎসাহ আর আগ্রহ দেখালেন ভিটা কর্লিয়নি। ফানুচির মদের গ্লাস্টা আবার ভরে দিলেন তিনি। কি যেন বলতে যাচ্ছে সে, কিন্তু কি মনে করে শেষ মুহূর্তে ক্ষান্ত হলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে পঁড়াল সে, ভিটোর বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল, বলল, কিছু মনে করোনি তো? হোমার কোন কাজ করে দিতে পারব বলে মনে করলে আমাকে শুধু একটা ব্বর দিয়ো। আজ আমার সাথে ভাল ব্যবহার করেছ, তাতে তোমারই অনেক সুবিধে হবে, দেখো।?

অপেক্ষা করছেন ভিটো কর্লিয়নি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে ফানুচি, ধীরে ধীরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। প্রচুর লোকজন রয়েছে রাস্তায়, তারা সবাই দেখল বহাল তবিয়তে ভিটোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ফানুচি। তারমানে, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর কোন অভাব হবে না (অবশ্য আদৌ যদি সাক্ষী দেবার কোন দরকার পড়ে)।

জানালা দিয়ে দেখলেন ভিটো, ইলেভেনথু স্ট্রীটের দিকে বাঁক নিচ্ছে ফানুচি। বুঝলেন, বাড়িতেই ফিরছে সে। আদায় করা টাকা বাড়িতে তুলে রেখে আবার হয়তো বেরোবে, নতুন দাও-এর সন্ধানে টহল দিয়ে বেড়াবে রাস্তায় রাস্তায়। পিস্তলটাও হয়তো রেখে দেবে বাড়িতে।

নিজের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলেন ভিটো কর্লিয়নি। চৌকো ছাদগুলো একটার পর একটা নিঃশব্দ পায়ে দৌড়ে পেরিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একটা গুদামঘরের ছাদে পৌঁছে থামলেন, চারদিকে চোখ বুলিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলেন কেউ তাকে লক্ষ করছে কিনা। রাতের অন্ধকারে কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না, তারমানে তাকেও দেখতে পাচ্ছে না কেউ। লোহার সিঁড়ি বেয়ে একটা বাড়িতে নামলেন। পা দিয়ে এক ধাক্কায় গুদাম ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। সস্তাদরের একটা ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকে ফানুচি, রাস্তার ওপারেই দেখা যাচ্ছে সেটা। এদিকে সারি সারি গুদামঘর ছাড়া আর কিছুই নেই, মরুভূমির মত খা খা করছে, মাঝখানে শুধু একটা বাড়ি, সেটাতেই থাকে ফানুচি। বাড়ির ভাড়াটেরা বেশিরভাগই রেললাইনের শ্রমিক আর সস্তাদরের নোংরা বেশ্যা। কাজ থেকে ফিরে এরা সবাই বিয়ারের দোকানে মদ গিলতে চলে যায়, ভদ্র ইতালীয়দের মত রাস্তায় বসে গল্প করার ধাত নয় এদের। গোটা ইলেভেনথ এভিনিউ মরা সাপের মত পড়ে আছে, ফাঁকা, নির্জন। কারও চোখে না পড়েই রাস্তাটা পার হলেন ভিটো। ফু্যাট বাড়ির হলরুমে ঢুকে পিস্তলটা বের করলেন। জিনিসটার দিকে ভাল করে তাকাবেন না, কিভাবে গুলি করবেন সে ব্যাপারেও মাথা ঘামাচ্ছেন না। অথচ এটা তিনি এখনও ব্যবহারই করেননি।

কাঁচের দরজা দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে, জানেন, টেন এভিনিউ-এর দিক থেকে আসবে ফানুচি। ক্লেমেঞ্জা তাকে আনাড়ী ভেবেই পিস্তলটা দেবার সময় এটা ব্যবহার করার পদ্ধতি দেখিয়ে দিয়েছিল। তার অবশ্য জানা থাকার কথা নয় যে একেবারে ছোটবেলায় বাবার সাথে প্রায়ই শিকারে বের হতেন তিনি, মাত্র নবছর বয়সেই ভারি লুপারা শটগান ছুঁড়তে পারতেন। অত কম বয়েসে লুপারা ছোঁড়ায় তাঁর নৈপুণ্য দেখেই বাপকে খুন করার পর হত্যাকারীরা তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।

অন্ধকার হলরূমে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হঠাৎ একটা সাদাটে অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পেলেন। দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ, চিনতে পারছেন আবছা মূর্তিটাকে। ফানুচি।

পিছু হটলেন ভিটো, ভিতরের সিঁড়ির দিকে এগোবার দরজার কাছে পৌঁছে থামলেন। দরজার গায়ে হেলান দিয়ে অনায়াস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন হাতে কোন কাজ নেই, চুপচাপ সময় কাটাচ্ছেন। অবশ্য, হাতটা বাড়িয়ে রেখেছেন সামনের দিকে, সময় হয়েছে বলে মনে করলেই যাতে গুলি করতে পারেন। বাইরের দরজাটা একেবারে কাছেই, বাড়িয়ে ধরা পিস্তলটা থেকে বড়জোর তিন হাত। দরজার কবাট দুটো খুলে যাচ্ছে। চৌকো একটা আলো পড়ল সামনে, সেটার উপর ফানুচির ছায়া পড়ছে, ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আলোটা { একটা গন্ধ ঢুকল নাকে, ফানুচির গায়ের গন্ধ। চৌকো আলোটা সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যেতে গুলি করলেন ভিটো।

দরজাটা খোলা থাকলেও গুলির আওয়াজ বাইরের রাস্তায় খুব সামান্যই পৌঁছুল, কিন্তু প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল গোটা বাড়ি। দরজারদুদিকের মোটা কাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে ফানুচি, পিস্তলটা বের করার জন্যে পকেটের মুখ হাতড়াচ্ছে। গুলি লেগে কোর্টের বোতাম ছিঁড়ে গেছে তার, হাঁ হয়ে গেছে সেটা। তার পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে পিস্তলটা, দেখতে পাচ্ছেন ভিটো। সাদা শার্টে লাল মাকড়সার জালের মত একটা নকশা ফুটে উঠেছে। অত্যন্ত সাবধানে, কোনরকম তাড়াহুড়ো না করে, যেন অতি যত্নের সাথে সুচ দিয়ে শিরা ফুটো করে কাউকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছেন, লাল মাকড়সার জালটার ঠিক মাঝখানে, লক্ষ্য স্থির করলেন তিনি। তারপর দ্বিতীয়বার গুলি করলেন। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল ফানুচি, তার শরীরের ধাক্কা খেয়ে পুরোপুরি খুলে গেল দরজাটা। ভয়ঙ্কর একটা গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে আসছে গলার ভিতর থেকে, অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণায় মানুষ যেমন বিকট আর্তনাদ ছাড়ে, অথচ অদ্ভুত হাস্যকর শোনায় কানে। তার সেই গোঙানির শব্দ থামেনি, ভিটো কর্লিয়নির পরে মনে পড়েছিল অন্তত বার তিনেক আর্তনাদটা কানে ঢুকেছিল তার।

চর্বি ভরা প্রকাণ্ড মুখটা ঘামে চক চক করছে ফানুচির। পিস্তলের নলটা তার কপালে ঠেকালেন ভিটো। নলটা একটু বাঁকা করে গুলি করলেন, যাতে মগজে ঠিকমত গিয়ে ঢেকে বুলেটটা। বসা অবস্থা থেকে শুয়ে পড়ল ফানুচি, খোলা, দরজাটার উপর একটা নিষ্প্রাণ জড় পদার্থের স্থাপ-এর মত দেখাচ্ছে। দুই সেকেণ্ড আগেই মারা গেছে সে। প্রথম গুলি করার পর মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পেরিয়েছে।

ফানুচির পকেট থেকে সাবধানে ওয়ালেটটা বের করে নিজের পকেটে ভরলেন ভিটো কর্লিয়নি। রাস্তাটা পেরোবার সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার দেখে নিলেন চারদিক। রাস্তার দুই দিকই ফাঁকা, নির্জন। গুদামঘর পেরিয়ে উঠানে বেরিয়ে এলেন, সেখান থেকে লোহার সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলেন। উঁকি দিয়ে আরেকবার দেখে নিলেন নিচের রাস্তাটা। দরজার উপর এখনও পড়ে আছে ফানুচি, কেউ নেই তার ধারে কাছে। শুধু দুটো জানালা খুলে গেছে ফ্যাট-বাড়ির, কয়েকটা কালো রঙের মাথা উঁকি দিচ্ছে বাইরের দিকে। ওদের কারও মুখ দেখতে পাচ্ছেন না ভিটো, তার মানে, তিনি ধরে নিলেন, ওরাও তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না। আর দেখতে পেলেই বা কি? এরা অন্য জাতের লোক, কখনও পুলিশে খবর দেয় না। ওই দরজার উপর ফানূচি সম্ভবত সারারাত পড়ে থাকবে, তবে টহলে বেরিয়ে এদিকে যদি আসে তাহলে কোন পুলিশ.ধাক্কা খেতে পারে লাশটার সাথে। যেচে পড়ে এ-বাড়ির একজন লোকও পুলিশকে কিছু জানাতে যাবে না। জিজ্ঞেস করলে সবাই একই কথা বলবে, কেউ কিছু দেখেনি, কেউ কিছু শোনেনি।

তাড়াহুড়ো করার কোন কারণই দেখছেন না ভিটো কর্লিয়নি। শান্ত, অনুত্তেজিতভাবে একটা একটা করে ছাদগুলো পেরোলেন তিনি, নিজেদের বাড়ির ছাদে এসে দরজাটা খুললেন, তারপর নেমে এলেন নিচে। ফ্ল্যাটের দরজার তালা খুলে ভিতরে ঢুকে ভিতর থেকে আবার তালা মেরে দিলেন। নিহত ফানুচির ওয়ালেটটা খুলে দেখলেন তার দেয়া সাতশো ডলার ছাড়া আর একটা মাত্র পাঁচ ডলারের নোট রয়েছে। খুঁজতে গিয়ে গোপন একটা খোপ পেয়ে গেলেন তিনি, তাতে একটা স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে, পাঁচ ডলারের। ভিটো কর্লিয়নি ভাবলেন, ফানুচি পয়সাওয়ালা গুণ্ডা ছিল না, নয়তো সাথে টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াবার অভ্যাস ছিল না তার। যাই হোক, ওয়ালেটের হাল-অবস্থা দেখে তার পুরানো কয়েকটা সন্দেহ সমর্থন লাভ করুল।

ওয়ালেট আর পিস্তলটা যে গায়েব করে দিতে হবে তা তিনি জানেন, সেই সাথে এও বুঝলেন যে ওয়ালেটের ভিতর স্বর্ণমুদ্রাটাও রেখে দেয়া দরকার। সিঁড়ি বেয়ে আবার উঠলেন তিনি, কয়েকটা ছাদ আর পাঁচিল পেরোলেন। তারপর একটা বাতাস চলাচলের জায়গায় ফেলে দিলেন ওয়ালেটটা। বাকি বুলেটগুলো বের করলেন পিস্তল থেকে, কিন্তু পাচিলে আছাড় মেরেও ভাঙতে পারলেন না মলটাকে। শেষ পর্যন্ত উল্টো করে ধরে একটা চিমনির গায়ে প্রচণ্ড শক্তিতে কয়েকটা বাড়ি মারতে দুভাগ হয়ে গেল সেটা। নল আর হাতল আলাদা করার জন্যে আরও কয়েকটা শক্ত বাড়ি মারতে হলো। প্রতিটি অংশ আলাদাভাবে একেকটা এয়ার শাফটের ভিতর ফেলে দিলেন। পাঁচতলা থেকে সোজা নিচে, মাটিতে পড়ার সময় কোথাও ঘষা খেয়ে বা ধাক্কা লেগে একটু শক্ত হলো না। সবগুলো টুকরো আবর্জনা স্তূপে পড়ে একেবারে ডুবে গেল। সকালেই সবগুলো জানালা থেকে আরও আবর্জনা ফেলা হবে, তখন ওগুলো পুরোপুরি চাপা পড়ে যাবে। এরপর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এলেন ভিটো।

মৃদু একটু কাঁপছে শরীরটা, কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আছেন তিনি। পোশাক ছাড়ার সময় ভাবলেন নিজের অজান্তে কাপড়-চোপড়ের কোথাও দুএক ফোঁটা রক্ত লেগে থাকতে পারে। কাপড় কাঁচার সোডা আর মেটে রঙের সাবান একটা ধাতব গামলায় ফেলে কাপড়গুলোকে ভিজিয়ে রাখলেন কিছুক্ষণ, তারপর বাসনকোসন ধোবার সিঙ্কের শক্ত ধাতব পাতের উপর ফেলে ভাল করে রগড়ালেন সেগুলো। সবশেষে সোডা সাবান দিয়ে মেজে ঘষে সাফ করলেন গামলা আর সিঙ্কটা। স্ত্রীর সদ্য ধোয়া একগাদা কাপড়চোপড় শোবার ঘরে আগেই দেখে এসেছেন, সেগুলোর সাথে নিজেরগুলো মিলিয়ে রাখলেন তিনি। নতুন, পরিষ্কার শার্ট আর ট্রাউজার পরে ধীরেসুস্থে হেঁটে চলে এলেন বাড়ির সামনের দিকে, ছেলেদেরকে নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করছেন সেখানে তার স্ত্রী।

এত সাবধানতা অবলম্বনের আসলে কোন দরকার ছিল না। পরদিন ভোরে আবিষ্কার হলো ফানুচির লাশ, পুলিশই প্রথম দেখতে পেল। কিন্তু এ-ব্যাপারে কোন প্রশ্নই করা হলো না ভিটো কর্লিয়নিকে। ফামুচি খুন হবার রাতে ফানুচি যে তার বাড়িতে এসেছিল এ-কথাটা পর্যন্ত কানে যায়নি পুলিশের। বেশ আশ্চর্যই হলেন ভিটো। পুলিশের কানে কথাটা গেলে কিছু এসে যেত না তার, বহাল তবিয়তে ক্ষানুচিকে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে অনেক লোক, এই সব লোকের সাক্ষ্য থেকেই প্রমাণিত হয়ে যাবে খুনটার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। ঘটনাটা ঘটে যাবার অনেকদিন পর ভিটো শুনেছিলেন, পুলিশ ফানুচির খুনীকে ধরার কোন চেষ্টাই করেনি, ফানুচি খুন হওয়াতে তারা বরং খুশিই হয়েছিল। গুণ্ডা-গোষ্ঠীদের নিজেদের ব্যাপার এটা, রেষারেষির আরেকটা ফল, এই ধরে নিয়েছে তারা। একেবারে কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়া হয় বলে চোরাকারবারের সাথে জড়িত কিছু গুণ্ডাপাণ্ডাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল বটে, কিন্তু কাউকে আটক করার ঝামেলা পোহাতে গেল না পুলিশ। সবাই জানে ভিটো কর্লিয়নি কখনও কোন গোলমালে পড়েননি, শান্ত আর ভালমানুষ হিসেবে তার সুখ্যাতি আছে, তাই ব্যাপারটার সাথে কেউ তাকে জড়ায়নি।

তাই বলে সবার চোখে ধুলো দিতে পারেননি ভিটো কর্লিয়নি। পুলিশ কিছুই টের পেল না, কিন্তু সঙ্গীরা? ঘটনাটা ঘটার দিন থেকে আজ প্রায় হপ্তা দুই তাঁকে এড়িয়ে চলছে ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও। তারপর, অনেকটা আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে, তার সাথে দেখা করার জন্যে এক সন্ধ্যায় তার বাড়িতে এসে হাজির হলো ওরা। শ্রদ্ধা, জানাবার জন্যে মনস্থির করেই এসেছে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলছে না। ওরা যে প্রকাশ্যে তাকে সম্মান জানাতে এসেছে তা ভিটো কর্লিয়নি বুঝতে পারছেন ওদের চেহারা দেখে; চোখের দৃষ্টিতে সবিনয় আত্মসমর্পণের ভাব দেখে। তিনি নিজেও কিছু বলতে গেলেন না, এমন কি কিছু বলতে হবে কিনা সে-ব্যাপারে মাথা পর্যন্ত ঘামালেন না। মুখের চেহারা ভাবলেশহীন, কিন্তু নির্বিকার সৌজন্যের সাথে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন তিনি, যত্নের সাথে মদ পরিবেশন করলেন।

দুজনের মধ্যে আগে মুখ খুলল ক্লেমেঞ্জা । মৃদু কণ্ঠে বলল, একটা কথা। নাইনথ এভেনিউয়ের দোকান মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা নিচ্ছে না কেউ। একই অবস্থা জুয়ার আড্ডাগুলোর, ওদের কাছ থেকেও টাকা নেবার কেউ নেই।

একদৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন ভিটো কর্লিয়নি। শুনলেন। কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছেন না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখল ওরা, কিন্তু এরপরও যখন ভিটো কর্লিয়নি চুপ করে থাকলেন, আবার কথা বলতে হলো ওদেরকে। এবার বলল টেসিও, ফানুচির ভূমিকাটা তো আমরা নিতে পারি। যাদের কাছ থেকে টাকা নিত ও, তারা আমাদেরকেও টাকা দেবে। 

পাথরের মত স্থির হয়ে বসে আছেন ভিটো কর্লিয়নি। হঠাৎ কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। বললেন, আমার কাছে কেন এসেছ? এসব ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই।

হাসল ক্লেমেঞ্জা। এই অল্প বয়সেও, বিরাট ভূড়ি বাগাবার আগেই, একটু হাসলেই প্রকাণ্ড মুখটা আরও বড় দেখায় তার, যেন সাংঘাতিক একজন মোটাসোটা মানুষ হাসছে। হাসিটা মুখে ধরে রেখেই এতক্ষণে একটা প্রশ্ন করল সে ভিটো কর্লিয়নিকে, তোমাকে একটা পিস্তল দিয়েছিলাম। কোথায় সেটা? ওটা যখন আর দরকার নেই তোমার, আমাকে ফিরিয়ে দিলেই পারো।

অত্যন্ত ধীর এবং নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সাইড পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করলেন ভিটা, কর্লিয়নি, গুণে পাঁচটা নোট আলাদা করলেন, তারপর বাড়িয়ে ধরলেন সেগুলো ক্লেমেঞ্জার দিকে। নাও, এটা তোমার পিস্তলের দাম। ট্রাক লুট করার পর ফেলে দিয়েছিলাম ওটা। দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছেন তিনি।

এই জিনিসটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কর্লিয়নির, কিন্তু আজও তিনি নিজে এই হাসির ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া টের পান না। ভয় দেখাবার কোন চেষ্টা নেই, তবে ঠাণ্ডা হিম একটা ভাব আছে তাতে। ভঙ্গিটা এমন, যেন কি একটা ভারি মজার কৌতুক মনে পড়ে গেছে, যার তাৎপর্য এবং রস তিনি ছাড়া আর কেউ উপভোগ করতে পারছেন না। সাংঘাতিক কোন পরিস্থিতি ছাড়া এই হাসি দেখা যায় না তার মুখে, আর যেহেতু মজার কৌতুকটা মোটেই গোপনীয় বা ব্যক্তিগত কিছু নয়, তার উপর তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হলো তিনি যুক্তি মেনে চলেন, কথা বলেন কম, এবং সেই মুহূর্তে তার চোখ দুটো কখনও হাসে না, তাই অকস্মাৎ ওই হাসির ভিতর দিয়ে তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়লেই হ্যাঁৎ করে ওঠে বুক, যেন ঝপি থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে ফণা তুলে ছোবল মারতে উদ্যত হয়েছে বিষধর গোক্ষুর। কিন্তু তার সেই হাসিতে কোন ফোঁস-ফোসানি নেই, ব্যঙ্গ নেই, নেই কোনরকম চেষ্টাকৃত ভাবের প্রলেপ।

মাথা নেড়ে ক্লেমেঞ্জা বলল, টাকার আমার দরকার নেই।

নিঃশব্দে টাকাগুলো পকেটে ভরে রাখলেন ভিটো। অপেক্ষা করছেন তিনি। ওঁরা তিনজন পরস্পরকে পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। সবচেয়ে বড় কথা মনের মিল খুঁজে পাচ্ছেন ওঁরা। ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও জানে, ভিটো খুন করেছেন ফানুচিকে। যদিও দুজনের কেউই কথাটা মুখে আনেননি। বাইরের কারও সামনে তো নয়ই, এমন কি ভিটো কর্লিয়নির সামনেও নয়। তবু কিছুদিনের মধ্যেই পাড়াসুদ্ধ সবাই জেনে গেল ব্যাপারটা। ব্যস, আর যায় কোথা, একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসেবে সবাই ভিটো কর্লিয়নিকে খাতির করতে শুরু করে দিল। কিন্তু, ভিটো কর্লিয়নি ফানুচির বেআইনী ব্যবসা আর টাকা আদায়ের সুযোগগুলোর একটাও হস্তগত করার কোন চেষ্টা করলেন না। ব্যাপারটা কি বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে গেল সবাই।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা ঘটবার তাই ঘটল।

তখন রাত। ভিটো কর্লিয়নিকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই তার স্ত্রী প্রতিবেশিনী এক বিধবাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে এলেন। মহিলা ইতালীয়, চরিত্রে কোন খুঁত নেই। বাপহারা ছেলেপুলেদের মানুষ করার জন্যে হাড়ভাঙা খাটতে হয় তাকে। বড় ছেলেটির বয়েস মোনলা, ফেলে আসাদেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী মাস শেষে বেতনের টাকার সবটাই মায়ের হাতে তুলে দেয়। আর মেয়েটির বয়েস সতেরো, কাজ করে। একটা দর্জির দোকানে। ভাইয়ের মত সেও বেতনের টাকা নিজের কাছে রাখে না। ওদের পরিবারের সবাই বাড়তি কিছু আয়ের জন্যে রাত জেগে কার্ডের উপর বোতাম সেলাই করে। খাটনির তুলনায় এই কাজের পারিশ্রমিক এত কম যে এই কাজ করার জন্যে লোকই পাওয়া যায় না। যাদের আর কোন উপায় নেই শুধু তারাই কাজটা করে। এই পরিবারটি সেই দলের। মহিলার নাম সিনিয়রা কলম্বো।

সিনিয়রা তোমার কাছ থেকে একটা উপকার চাইতে এসেছেন, ভিটোকে বললেন তার স্ত্রী। বলছেন, ইচ্ছা করলে ওর সমস্যাটা মিটিয়ে দিতে পারো তুমি।

ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই টাকা চাইবেন, ভাবছেন ভিটো কর্লিয়নি, টাকা দেবার জন্যে মনে মনে তৈরিও হয়ে গেলেন। কিন্তু তার কথা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন তিনি। মহিলার সমস্যা টাকা নয়, একটা কুকুর। তার ছোট ছেলের ভারি প্রিয় ওটা। কিন্তু বাড়িওয়ালার কানে নালিশ গেছে রাতে নাকি কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে। তাতে খুব রাগ হয়েছে বাড়িওয়ালার, সাথে সাথে হুকুম দিয়েছে কুকুরটাকে যেন বিদায় করে দেয়া হয়। মহিলাও পরে এমন ভাব দেখিয়েছেন যেন কুকুরটাকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু একটা জ্যান্ত কুকুরকে তো আর দিনের পর দিন গোপন করে রাখা যায় না, রাখতে চাইলেই বা সে থাকতে রাজি হবে কেন! যাই হোক, বাড়িওয়ালা বুঝল, তাকে ঠকানো হয়েছে। তাতে আরও বেশি রেগে গেল সে, চরম পত্র দিয়ে মহিলাকে জানিয়ে দিল, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে তাদেরকে। ব্যাপারটা এতদূর গড়াবার পর মহিলা বুঝলেন কুকুরটাকে সত্যি এবার বিদায় করে দিতে হবে, দিলেনও তাই। কিন্তু বদরাগী বাড়িওয়ালা এখন আর কোন কথা শুনতে রাজি নয়, বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ প্রত্যাহার করছে না সে। হুমকি দিয়ে বলেছে, ভালয় ভালয় যদি বাড়ি ছেড়ে দেয়া না হয়, পুলিশ ডেকে বের করে দেয়া হবে। এদিকে, কুকুরটাকে দেখতে পাচ্ছে না বলে ছোট ছেলেটা এমন কান্নাকাটি করছে যে পরিবারের সবাই তার জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কুকুরটা তো গেছেই, সেই সাথে শুধু শুধু বাড়িটাও ছাড়তে হচ্ছে।

মৃদু গলায় জানতে চাইলেন ভিটো কর্লিয়নি, কিন্তু এ-ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব তা আপনার মনে হলো কেন?

সিনিয়রা কলম্বো ভিটোর স্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, উনিই তো বললেন কথাটা আপনার কানে তুললে আপনি একটী ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।

আশ্চর্য হয়ে গেলেন ভিটো। ফানুচিকে খুন করার রাতে তিনি কাপড় কেচেছিলেন, কিন্তু সে-ব্যাপারে তাকে কোন প্রশ্ন করেননি তাঁর স্ত্রী। চাকরি-বাকরি নেই অথচ কখনও জানতে চাননি এত টাকা আসে কোত্থেকে। এখন, এই মুহূর্তেও তিনি স্ত্রীর চেহারায় কোন ভাবের প্রকাশ দেখছেন না। স্ত্রীর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সিনিয়রার দিকে তাকালেন তিনি, বললেন, বাড়ি বদল করা খরচের ব্যাপার, আপনি চাইলে এই খরচটা আমি দিয়ে দিতে পারি।

দ্রুত এদিক ওদিক মাথা দোলালেন মহিলা, চোখে তার পানি এসে গেছে। নিজেকে সামলে নিতে নিতে বললেন, আমার সব বন্ধু আর আপনজনেরা এই এলাকায় থাকে, দেশে এদের সাথেই মানুষ হয়েছি আমি। এদেরকে ছেড়ে অন্য পাড়ায় অচেনা লোকদের সাথে থাকতে একেবারেই মন বসবে না আমার। বাড়িওয়ালাকে বলে এখানেই যাতে থাকতে পারি, তার একটা ব্যবস্থা করে দিন আপনি। 

ঘাড় কাত করে ভিটো কর্লিয়নি বললেন, সমাধান তাহলে হয়েই গেল। বাড়ি আপনি ছাড়তে চাইছেন না, তার পিছনে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। অন্য কোথাও যাবার দরকার নেই আপনার। সকালে আমি কথা বলব বাড়িওয়ালার সাথে।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন মিসেস ভিটো। কিছু বললেন না ভিটো কর্লিয়নি, তার চেহারা দেখেও বোঝা গেল না কিছু, কিন্তু মনে মনে তিনি খুশি হলেন। সিনিয়রার দিকে তাকালেন তিনি, মনে হলো এখনও পুরোপুরি নিশ্চয়তাবোধ করছে না সে।

কিন্তু…লোকটা, মানে বাড়িওয়ালার কথা বলছি, তাকে আপনি সত্যি রাজি করাতে পারবেন তো?

সিনিয়র রবার্টো? অবাক হয়ে বললেন ভিটো। সে কি, রাজি হবেন না কেন? সব ভালমানুষই যুক্তি মেনে চলে, উনিও তো একজন ভালমানুষ। আপনার অসুবিধেটা একবার যদি তাকে ভালভাবে বুঝিয়ে বলতে পারি, নিশ্চয় আপনার ওপর দয়া হবে তার। এত দুশ্চিন্তা করবেন না তো। দুশ্চিন্তা করলে শরীর খারাপ হয়। ছেলেমেয়েদের ভালর কথা ভেবেই নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখবেন।

এই পাড়াতেই পাঁচটা কম ভাড়ার ফুাট-বাড়ি আছে সিনিয়র রবার্টোর, রোজ একবার করে সেগুলো দেখতে আসে সে।এক সময় লোকটা আদম বেপারী ছিল, ইতালীয় শ্রমিকরা জাহাজ থেকে নামতে যা দেরি, সাথে সাথে তাদেরকে সে বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর কাছে বিক্রি করে দিত। এই আদম ব্যবসাতে প্রচুর টাকা কামিয়েছে সে, সেই টাকা দিয়েই কিনেছে এই বাড়িগুলো। জন্ম উত্তর ইতালিতে, লেখাপড়াও শিখেছে, কিন্তু দক্ষিণের সিসিলি আর নেপলস থেকে আমদানি এই সব নিরক্ষর লোকগুলোকে দুচোখে দেখতে পারে না সে। তার বাড়িতে নোংরা পোকার মত কিলবিল করে এরা, বাতাস চলাচলের জায়গায় আবর্জনা ফেলে, ঘরের দেয়াল আরশোলা আর ইঁদুর খুবলে খেলেও নিজেদের সম্পত্তি নয় বলে এসব ক্ষতি দেখে একটা আঙুল পর্যন্ত তোলে না। মানুষ হিসেবে মন্দ বলা যাবে না রবার্টোকে। বাপ হিসেবে ভাল, স্বামী হিসেবে সৎ। রাত দিন টাকা বাড়াবার ফিকির খোঁজা যদি দোষের হয়, তবে এই একটা দোষ খুব বেশি পরিমাণেই আছে তার। কোথায় কত টাকা খাটছে, লাভ হলো না লোকসান হলো, আরও লাভ কোন পথে আসবে, হিসাব-পত্র নির্ভুল হচ্ছে কিনা-এইসব নিয়েই চব্বিশ ঘণ্টা মাথা ঘামাচ্ছে সে। ফলে মেজাজটা তার সবসময় খিঁচড়ে থাকে। একটা বিষয়ে আলাপ করার জন্যে ভিটো কলিয়নি তাকে যখন পথে দাঁড় করাল, দ্রুত এবং সংক্ষেপে কথা বলল সে। রেগেমেগে অভদ্র ব্যবহারই করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভেবেচিন্তে নিজেকে সংযত করে রাখল। ছোকরাকে অতি ভালমানুষ আর নিরীহ দেখালেও, এইসব দক্ষিণ দেশীয়দের। একটুও বিশ্বাস করা যায় না, খারাপ ব্যবহার করলে, কোন নিশ্চয়তা নেই, ঘ্যাচ করে, হয়তো ছোরা সেঁধিয়ে দেবে পেটে।

সিনিয়র রবার্টো, অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে বললেন ভিটো কর্লিয়নি, আমার গিন্নীর বান্ধবী একজন গরীব বিধবা, তার ওপর না আছে স্বামী, না আছে কোন পুরুষ অভিভাবক। শুনলাম তাকে নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। সেই থেকে বেচারি তো একেবারে ভেঙে পড়েছেন হতাশায়। তাই তাকে বলেছি, আপনার সাথে কথা বলে দেখব আমি। বলেছি, সিনিয়র রবার্টো তো আর অন্যান্য কিছু করতে পারেন না, তিনি হয়তো কিছু ভুল বুঝেছেন! যত গণ্ডগোলের মূল লতা ওই জানোয়ারটা, সেটাকে যখন বিদায় করেই দিয়েছে, এখন আর থেকে যেতে অসুবিধে কোথায়। ঠিক কিনা? আমি একজন ইতালীয়, আপনিও তাই। দয়া করে আপনি আমার এই উপকারটা করুন।

সামনে দাঁড়ানো যুবকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবার্টো।দেখছে, ছোকরা লম্বায় মাঝারি, কিন্তু গড়নটা বলিষ্ঠ। সম্ভবত গেঁয়ো ভূত, গোটা একটা চাষা। তবে গুণ্ডা, খুনে বা ডাকাত যে নয় সে-ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই। অন্তত হাবভাব, চেহারা-সুরত দেখে তা মনে হচ্ছে না। তবে, ছোকরার স্পর্ধা আছে বলতে হবে, হাস্যকর দুঃসাহস দেখাচ্ছে কেমন!-ব্যাটা নাকি একজন ইতালীয়।

শ্রাগ করল রবার্টো। বলল, অন্য ভাড়াটে ঠিক করে ফেলেছি আমি। তারা আরও বেশি ভাড়া দেবে তোমার লোকের জন্যে তাদেরকে আমি নিরাশ করতে পারি না।

এমন ভাবে মাথা নাড়লেন ভিটো কর্লিয়নি দেখে মনে হলো রবার্টোর যুক্তিটা তিনি মেনে নিলেন। জানতে চাইলেন, কত বেড়েছে ভাড়া?

পাঁচ ডলার, মিথ্যে কথা বলল রবার্টো। রেল লাইনের পাশে ফ্ল্যাট, চারটে অন্ধকার ঘুপচি, এর জন্যে সিনিয়রা কলম্বো দেয় বারো ডলার, নতুন ভাড়াটেকেও এরচেয়ে বেশি দিতে রাজি করাতে পারেনি রবার্টো।

পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করে তা থেকে দশ ডলারের তিনটে নোট খুলে নিয়ে ভিটো কর্লিয়নি বললেন, এই নিন, ছমাসের অ্যাডভান্স। সিনিয়রাকে দয়া করে কিছু বলবেন না, খুব বেশি আত্মসম্মানবোধ তার, ব্যাপারটা জানতে পারলে লজ্জা এবং দুঃখ পাবেন। আবার আপনি আমার সাথে ছমাস পর দেখা করবেন। আর একটা কথা কুকুরটাকে অবশ্যই ওদের কাছে থাকতে দেবেন।

কচু দেব! খেপে গিয়ে প্রায় ভেংচে উঠল রবার্টো। কোথাকার লাটসাহেব হে তুমি এত বড় স্পর্ধা, আমার উপর হুকুম চালাচ্ছ। ফের যদি একটা বাজে কথা মুখে আনো, এ্যায়সা এক লাথি মারব, বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে ঋবে।

বিশুদ্ধ বিস্ময়ে ভিটো কর্লিয়নির হাত দুটো আপনাআপনি শরীরের পাশ থেকে উপর দিকে উঠে এল। কয়েক সেকেণ্ড অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, আপনার কাছে শুধু একটু দয়া ভিক্ষা চাইছি আমি, আর তো কিছু নয়। বন্ধুর সাহায্য কখন কার দরকার হয়, কে বলতে পারে, বলুন? টাকাটা নিন, মনে করুন এটা আমার সদিচ্ছার নমুনা, তারপর ভেবেচিন্তে দেখে মনস্থির করুন। আপনার ইচ্ছার উপর তো আর জোর নেই আমার। রবার্টোর হাতে নোটগুলো খুঁজে দিলেন ভিটো ৫ টাকাটা নিলেই মনে করব আপনি আমার একটা উপকার করলেন। তারপর যা স্থির করবেন, তাই হবে। কাল সকালে এটা যদি ফিরিয়ে দিতে চান, তাই দেবেন। সিনিয়রা কলম্বোকে আপনি যদি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন, দেবেন, আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিই বা আমার করার আছে, বলুন! বাড়িটা তো আর আমার নয়, ওটা আপনার সম্পত্তি। আপনার কথা মতই তো চলবে সব। কুকুর রাখতে দিতে চান না, কারণটা বুঝি। আমি নিজেও জন্তু-জানোয়ার ভালবাসি না। হাত তুলে রবার্টোর কাঁধ চাপড়ে দিয়ে আবার বলতেন তিটো, দয়া করে আমার এই উপকারটুকু করুন আপনি, কেমন? চিরকাল মনে রাখব। এদিকে আপনার যারা বন্ধু-বান্ধব আছে, তাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। সবাই আপনাকে জানাবে, কেউ উপকার করলে আমি তার প্রতিদান দিতে ভালবাসি। আমি যে অকৃতজ্ঞ নই, এটুকু আপনার জানা হয়ে যাবে।

চোখ ফুটতে খুব বেশি সময় লাগল না রবার্টোর। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই ভিটো কর্লিয়নি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করল সে। আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করল না। ভিটো কর্লিয়নির দরজায় টোকা পড়ল সেই রাতেই। এত বেশি রাত করে আসার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে ভিটোর স্ত্রীর হাত থেকে এক গ্লাস মদ গ্রহণ করল। রবার্টো। লজ্জিত ভঙ্গিতে ভিটো কর্লিয়নিকেবলল, গোটা ব্যাপারটাই ভুল বুঝেছিল সে। কে বলেছে সিনিয়রা কলম্বো তার বাড়িতে থাকতে পারবেন না? একশো বার থাকতে পারবেন। থাকবেন তো বটেই, কুকুরটাকেও ফিরিয়ে নিয়ে এসে নিজেদের সাথে রাখবেন। আর সব ভাড়াটেরা, যারা অত কম ভাড়া দেয়, রাতে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে বলে তাদেরই বা নালিশ করার কি অধিকার আছে? কথা শেষ করে নিঃশব্দে টেবিলের উপর তিরিশটা ডলার রেখে দিল রবার্টো, তারপর আবার আন্তরিকতার সাথে বলল, আপনি মহৎ পুরুষ, সেজন্যেই এই বিধবা মহিলাকে এভাবে সাহায্য করছেন। বিশ্বাস করুন, নিজের আচরণে ভীষণ লজ্জা পেয়েছি। আমি। তবে, আমিও দেখাতে চাই যে খৃস্টান সূলভ কিছু সদগুণ আমার মধ্যেও আছে। সিনিয়রার ভাড়া বাড়ানো হলো না।

ছোট্ট একটা প্রহসন, কিন্তু যে যার ভূমিকায় আশ্চর্য সুন্দর ভাবে অভিনয় করে গেল। নিজের হাতে মদ ঢেলে পরিবেশন করলেন ভিটো, ফরমায়েশ দিয়ে কেক আনালেন, খুশি মনে রবার্টোর হ্যাণ্ডশেক করে তার সহৃদয়তার প্রশংসা করতেও ভুল করলেন না। রাবার্টোও একটা খুব বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃঢ় কণ্ঠে জানাল, ভিটো কর্লিয়নির মত একজন মানুষের সাথে পরিচয় ঘটায় মানবজাতির উপর তার বিশ্বাস ফিরে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *