১.১ তিন নম্বর ফৌজদারি আদালত

গডফাদার (ভলিউম-১) – মারিয়ো পুজো
রূপান্তর: শেখ আবদুল হাকিম

প্রথম পর্ব

০১.

নিউইয়র্ক। তিন নম্বর ফৌজদারি আদালত। বসে আছে আমেরিগো বনাসেরা। মনে আশা, সুবিচার পাবে সে। তার মেয়ের ওপর যারা অমানুষিক নির্যাতন করেছে, যারা বেচারীর ইজ্জত লুঠ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে, আইনের মাধ্যমে তাদের উপর প্রতিশোধ নেয়া যাবে।

থমথম করছে বিচারকের মুখ। কালো পোশাকের আস্তিন গোটালেন তিনি, যুবক দুজনকে নিজের হাতেই যেন কষে ধোলাই দেবেন। ঘৃণাভরে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।

তবু কেমন যেন একটা সন্দেহ জাগছে নাসেরার মনে। সঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না, কিন্তু খুঁতখুঁত করছে মনটা: এসবের মধ্যে কোথায় যেন একটা ছলচাতুরি আছে।

তোমরা নরাধম! জঘন্য অপরাধ করেছ। রাগে কেঁপে উঠলেন বিচারক।

চকচক করছে ছোট করে ছাঁটা দুই যুবকের চুল! লাবণ্যের প্রলেপ মাখা পরিচ্ছা মুখ। অনুতাপে মিয়মান। মাথা হেঁট।

বুনো জন্তুর মত আচরণ করেছ তোমরা, কর্কশ গলায় রায় ঘোষণা করছেন বিচারক। সে বেচারীর সতীত্ব নষ্ট করতে পারোনি, এ তোমাদের সৌভাগ্যতা যদি করতে, তোমাদের প্রত্যেককে বিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হত। থামলেন তিনি। তাঁর অদ্ভুত ঘন ভুক্ত জোড়া দেখে শ্রদ্ধা জাগে মনে। ভুরুর নিচে চকচক করছে দুটো চোখ। চোখের পাতা কুঁচকে তাকালেন তিনি। চকিতে বনাসেরার রক্তশূন্য মুখটা দেখে নিলেন একবার। টেবিলের উপর ফিরে এলো দৃষ্টি। কাগজপত্রের স্তূপ দেখলেন। মৃদু কুঞ্চিত হলো ভুরু জোড়া, কাঁধ ঝাঁকালেন। ভাবটা যেন, আর কোন উপায় নেই, তাই নিজের স্বাভাবিক ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তাকে।

 তোমাদেরকে আমি তিন বছরের কারাদণ্ড দিলাম, আবার শুরু করলেন বিচারক। কিন্তু তোমাদের বয়স কম। এ ধরনের অপরাধ আগে কখনও করোনি। অভিজাত পরিবারের ছেলে তোমরা। এবং আইনের অপার মহিমা তাই কখনও সে প্রতিশোধ গ্রহণ করে না। এই সব বিবেচনা করে তোমাদের এই দণ্ড মওকুফ করা হলো।

হতাশা আর ঘৃণায় স্তম্ভিত হয়ে গেল বনাসেরা। মেয়েটি এখনও হাসপাতালে, তার দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে-ভাঙা চোয়াল। কুকুর দুটো বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। ভাবছে সে, বেঈমানী করা হলো তার সাথে। ঠকানো হলো। এর নাম বিচার নয়, প্রহসন।

ছেলে দুটোর মা-বাবার দিকে তাকালসে! পরম আদরে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ছেলেদের। কত খুশি সবাই! হাসি আর আনন্দের প্লাবন বয়ে যাচ্ছে।

 গলা দিয়ে টক টক একটা ভাব উঠে এলো আমেরিগোর। বমি পাচ্ছে তার। সাদা একটা রুমালে চেপে ধরুল মুখ।

দুপাশে বসাব বেঞ্চ, মাঝখানে অপ্রশস্ত পথ। লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে ছেলে দুটো। অনড় দাঁড়িয়ে থাকল নাসেরা। নড়ার শক্তি নেই। ছেলে দুটোর মুখে আনন্দের হাসি। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার দিকে ভুলেও একবার তাকাল না।

ইতিমধ্যে ওদের মা-বাবারাও কাছে এসে পড়েছে। দুজন মহিলা, দুজন পুরুষ। সবাই ওর কাছাকাছি বয়সের পোশাক-আশাক, ওর চেয়ে একটু বেশি মার্কিনী। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে চারজন। একটু যেন ইতস্তত ভাব রয়েছে সবর মধ্যে, কিন্তু চোখেমুখে বিজয়ের অদ্ভুত একটা বেপরোয়া ভাবও রয়েছে, দৃষ্টি এড়াল না বনাসেরার।

এতক্ষণ বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিল সে। হঠাৎ সংযমের বাঁধ ধসে পড়ল। সামনের দিকে ঝুঁকে বিকৃত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সে, আমার মত তোমাদেরকেও কাঁদতে হবে। সে ব্যবস্থা আমি করব। চোখের উপর রুমাল চেপে ধরুল বনাসেরা। পানি মুছছে।

ঠিক পিছনেই রয়েছে বিপক্ষের উকিলরা, মক্কেলদের একধারে সরিয়ে নিয়ে একটা দল পাকিয়ে ফেলল তারা। মা-বাবাদের নিরাপজ নিশ্চিত করার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ছেলে দুটো, দলের সঙ্গে যোগ দিল তারাও। তাড়াতাড়ি ছুটে এলো একজন বেলিফ। নাসেরার বেরিয়ে আসার পথ বন্ধ করে দিল সে। তবে এসবের কোন প্রয়োজন ছিল না।

আমেরিকার আইন শৃঙ্খলার উপর কখনও আস্থা হারায়নি বসেরা সেজন্যেই বৈষয়িক উন্নতি করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘৃণায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে তার সারা শরীরে। ছেলে দুটোকে কুকুরের মত গুলি করে খুন করার ইচ্ছে হচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে স্ত্রীর দিকে ডাকাল সে। স্ত্রী বেচারী কিছুই বোঝেনি তখনও। বোকা বানিয়েছে ওরা আমাদের, বলল সে। তার মাথার ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল সে। যা থাকে কপালে, ডন কর্লিয়নির কাছেই যাব আমি। কেঁদে পড়ব তার কাছে। ন্যায্য বিচার চাই আমি।

.

লস এঞ্জেলস। প্রকাণ্ড এক হোটেলের সুইট। লাল একটা কাউচে শুয়ে রয়েছে জনি ফন্টেন। হাতে স্কচ হুইস্কির বোতল। বার বার বোতল কাত করে মুখে মদ ঢালছে সে। ঢোঁক গিলছে। পাশেই একটা কাঁচের পাত্র, তাতে পানি আর বরফের কুচি রয়েছে। ঢোঁক গিলেই ঠাণ্ডা পানি মুখে নিয়ে মদের তেতো স্বাদটা ধুয়ে ফেলছে সে।

ভোর রাত। চারটে বাজে। মাতাল জনি মতলব আঁটছে, কলঙ্কিনী স্ত্রী আজ বাড়ি ফিরলে হয়, খুন করে ফেলবে তাকে। কিন্তু বাড়ি যদি ফেরে, তবেই। প্রথমা স্ত্রীকে ফোনে ডেকে মেয়ে দুটোর খবর নেবে নাকি? নাহ, সময় নেই এখন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। বন্ধুদের কাউকে ডাকলে কেমন হয়? উঁহু, মন সায় দিচ্ছে না। কে কি ভাববে কে জানে! সুখ্যাতি আর সাফল্যের সেই চূড়ায় এখন আর নেই সে। ধাপে ধাপে নামতে নামতে অনেক নিচে নেমে গেছে। এমন একদিন ছিল, ভোর চারটে কেন, যখন ইচ্ছা ডাকলেই পোষা কুকুরের মত লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে আসত সবাই। সেদিন আর নেই। এখন ওরা তার ডাক পেলে বিরক্তি বোধ করে। আপন মনে হাসল জনি ফন্টেন। মনে পড়ে যাচ্ছে, যখন নাম ডাক ছিল, হলিউডের সেরা তারকারাও ওর ব্যক্তিগত সুবিধে অসুবিধের কথা শোনার জন্যে ব্যর্থ হয়ে থাকত।

বোতল কাত করে হুইস্কি ঢেলেছে মুখে, এমন সময় শব্দ হলো। দরজার তালায় চাবি ঢোকাবার শব্দ। কলঙ্কিনী স্ত্রী আসছে, বুঝতে পেরেও উঠছে না জনি। গলায় মদ ঢালছে।

কামরায় ঢুকল মেয়েটা। জনির সামনে এসে দাঁড়াল।

জনির চোখে কি অপূর্ব সুন্দর এই মেয়ে। চোখ দুটো বেগুনি, সাগরের গভীরতা সেখানে। দেবীর মত অম্লান মুখ। নিখুঁত, একহারা, কোমল শরীর। সিনেমার পর্দায় ওর রূপ আরও কয়েকশো গুণ বেড়ে যায়। দুনিয়ার দশ কোটি পুরুষ মার্গট অ্যাশটনের প্রেমে অন্ধ। গাঁটের পয়সা খরচ করে ওকে দেখতে যায় তারা।

কোন চুলোয় যাওয়া হয়েছিল? জানতে চাইল জনি।

কোথায় আবার, একটু ঢলাঢলি করতে বেরিয়েছিলাম।

মাতাল জনি তার উপর কতটা রেগে আছে, বুঝতে পারেনি মার্গট। লাফ দিয়ে ককটেল টেবিলটা টপকাল জনি, মার্গটের গলা টিপে ধরল। কিন্তু বেগুনি চোখের এত কাছে এসে কেমন যেন হয়ে গেল জনি। মূহুর্তে পানি হয়ে গেল তার রাগ। এই সময় একটু ভুল করে বসল মার্গট। ঠোঁট বাঁকা করে ব্যঙ্গের হাসি হাসল সে। এক পলকে আবার মাথায় রক্ত চড়ে গেল জনির। মারবে বলে ঘুষি তুলল সে।

না-না, জনি, চেঁচিয়ে উঠল মার্গট। মুখে মেরো না। আমি এখন ছবি করছি যে! হাসছে সে।

পেটে এক ঘুষি মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিল জনি। পরমুহর্তে ডাইভ দিয়ে পড়ল তার শরীরের উপর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মার্গটের। হাঁসফাস করছে। তার কনুইয়ে ঘুষি মারছে জনি। চাপড় মেরে পাঁচ অঙুলের দাগ বসিয়ে দিচ্ছে রোদে পোড়া উরুতে।

কিশোর বয়সে হেলস কিচেন, নিউ ইয়র্কের গুণ্ডাপাড়ায় ছোট ছোট ছেলেদের ধরে উত্তম-মধ্যম দিত জনি, ঠিক সেই রকম করে মারছে তার স্ত্রীকে। ব্যথা কোথাও কম লাগছে না, তবে একটা দাঁত নড়ে বা নাক ভেঙে রূপের স্থায়ী কোন ক্ষতি হচ্ছে না।

খুব যে জোরে মারছে জনি, তা নয়। আসলে হাতে জোর পাচ্ছে না সে। মার খাচ্ছে, কিন্তু ফিক ফিক করে হাসছে মার্গট। হাই-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে মেঝেতে, উপর দিকে উঠে গেছে গাউন, কিন্তু সি থামছে না তার। আর সেই সাথে কথার হুল ফোটাচ্ছে, এসো, জনি, এসো। কাজ সারো..আসলে তাই তো চাইছ।

উঠে পড়ল জনি।

গড়িয়ে সরে গেল মার্গট, নৃত্য-পটিয়সীর মত লাফ দিয়ে উঠে জনির মুখোমুখি দাঁড়াল। ছোট্ট মেয়ের মত নাচছে, নাচতে নাচতে সুর করে বলছে, মারেনি, মারেনি! জনি আমাকে মারেনি! হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল তার চেহারা, নাচ থামাল মর্গট। গাম্ভীর্য ফুটে উঠল চোখেমুখে, তাও নয়ন ভরে দেখার মত সুন্দর! বলল, বোকা, জনি, তুমি চিরকেলে বোকা। আহাম্মক, হাতে-পায়ে খিল ধরিয়ে দিলে আমার। কিভাবে প্রেম করতে হয় তাও তুমি জানো না। আনাড়ী খোকা। এখনও তুমি ভাবো ন্যাকামি ঢংয়ে যেভাবে গান গাইতে, মেয়েদের সাথে সেভাবে প্রেম করতে হয়! মাথা নাড়ছে মার্গট। বেচারা! তোমাকে আমি করুণা:করি, জনি। গুড বাই, জনি। শোবার ঘরে চলে গেল সে। শব্দ শুনে জনি বুঝল ভিতর থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়া হলো।

মেঝেতে বসল জনি। মুখ ঢাকল দুহাতে। অদ্ভুত একটা গ্লানি অনুভব করছে সে। অপমানে, নৈরাশ্যে অস্থির হয়ে উঠছে মন। নিঃসম্বল হাতে ছেলেদেরও প্রাণশক্তির কিছুটা জোর থাকে, সেই জোর খাঁটিয়ে ফোন তুলল জনি। একটা ট্যাক্সি ডাকল। এয়ারপোর্ট যাবে। ফিরে যাবে নিউইয়র্কে। ক্ষমতা দরকার এর দরকার বিচক্ষণ পরামর্শ। ভালবাসা দরকার, দরকার আত্মবিশ্বাস। এসব তাকে মাত্র একজনই দিতে পারেন। পৃথিবীতে একমাত্র তার কাছেই এসব চাইতে পারে জনি। তার কাছেই যাচ্ছে সে। তিনি ওর ধর্মপিতা। গড ফাদার

ডন কর্লিয়নি।

.

রুটিওয়ালা নাজোরিনি। প্রকাণ্ড একটা ইটালিয়ান রুটির মতই চেহারাটা। ফাপা ফোলা। একবার স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছে, একবার যুবতী মেয়ের দিকে, তারপর চট করে দেখে নিচ্ছে সহকারী এমজোকে। তার ভুরু, জোড়া কোঁচকানো। সারা গায়ে ময়দা মেখে সাদা ভূত হয়ে আছে।

পোশাক পাল্টে, গায়ে যুদ্ধবন্দীর উর্দি চড়িয়েছে এনজো। জামার আস্তিনে। একটা ব্যাণ্ড, তাতে সবুজ সংখ্যা লেখা। গভর্নর্স আইল্যাণ্ডে হাজিরা দিতে দেরি হয়ে গেলে বারোটা বাজবে তার, এই ভয়ে আধমরা হয়ে আছে। হাজার হাজার ইটালিয়ান যুদ্ধবন্দীকে প্রতিদিন পেরোলে মুক্তি দেয়া হয়, আমেরিকার অর্থনীতিকে মোটা তাজা করার কাজে যাতে সাহায্য করতে পারে, তারা। এনজোর ভয়, সুযোগটা যদি কেড়ে নেয়া হয়। তাই আজকের এই ব্যাপারটা তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ঝাঁঝের সাথে জানতে চাইল নাজোরিনি, মেয়ের ইজ্জৎ নিয়ে প্রশ্ন। আমি জানতে চাই, তুমি কি ওর ধর্ম নষ্ট করেছ? স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ছোট কোনো পোটলা ওকে উপহার দিয়েছ? যুদ্ধ থেমে গেছে, আমেরিকা এখন তোমাকে.পোদে লাথি মেরে তাড়াবে। সিসিলির সেই অজ গায়ে ফেরত পাঠানো হবে তোমাকে।

খুব চওড়া শরীর এনজোর। ভাঁজ করে হাত দুটো বুকে রাখল সে। চেহারা কাদো কাদো। দেখুন, যীশু-মাতার কিরে, আপনার মেয়ে.•ওকে আমি ভালবাসি। ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। কিন্তু একবার যদি ওরা আমাকে ইটালিতে ফেরত পাঠায়, জীবনে কখনও আর এখানে ফেরা হবে না আমার। আর ফিরতে না পারলে ক্যাথারিনকে হারাতে হবে, চিরতরে।

ঢং কোরো না! ধমকের সুরে বলল ফিলোমিনা, তারপর ফিরল স্বামীর দিকে। এখন কি করতে হবে তা তোমার অজানা নয়। থেকে যাবে এনজো। লং আইল্যাণ্ডে আমাদের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে, তাদের কাছে ওকে লুকিয়ে রাখো।

কাঁদছে ক্যাথারিন। এরই মধ্যে গায়ে মেদ জমতে শুরু করেছে তার। মুখটা সাদামাঠা, মিহি গোঁফের রেখা ঠোঁটের ওপর। তার চোখে সুদর্শন পুরুষ এনজো, তার মনে হয়, শ্রদ্ধা মেশানো প্রেমের সাথে তার শরীরের গোপন জায়গাগুলোয় যেভাবে হাত দেয় সেভাবে আর কোন পুরুষ হাত দেবে না। শালিক পাখির মত চেঁচামেচি জুড়ে দিল সে।

ঠিক আছে, ইটালিতে গিয়েই থাকব আমি, বলল ক্যাথারিন। তোমরা এনজোকে এখানে রাখার কোন ব্যবস্থা যদি না করো, আমাকেও পালিয়ে যেতে হবে।

আড়চোখে তার দিকে তাস্কাল নাজারিনি। বহুত ঘোড়েল তার এই মেয়েটা। নজর এড়ায়নি তার, তন্দুর থেকে গরম রুটি বের করে খদ্দেরদের টেবিলের দিকে এগোলেই ক্যাথারিন তার সুগঠিত নিতম্ব এনজোর গায়ে ঘষে দেয়। একটা ব্যাপারে এখন নাজোরিনির মনে কোন সন্দেহ নেই: সময় থাকতে একটা সমাধান বের করতে না পারলে ছোকরার গরম রুটি মেয়েটার তন্দুরে উঠবে।

আমেরিকায় স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে এনজোকে। মাত্র একজন ভদ্রলোক আছেন, যিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। তিনি গড় ফাদার। ওর ধর্মপিতা। ডন কর্লিয়নি।

.

উনিশ শো পঁয়তাল্লিশ সাল। আগস্ট মাসের শেষ শনিবার। আরও অনেকের সাথে এই কজনও মিস কনস্ট্যানসিয়া কর্লিয়নির বিয়ে উপলক্ষে এনগ্রেভ করা নিমন্ত্রণপত্র পেল।

কনের বাপ ডন ভিটো কর্লিয়নি আজকাল লং আইল্যাণ্ডের প্রকাণ্ড একটা বাড়িতে থাকেন, কিন্তু পুরানো বন্ধু-বান্ধব কিংবা প্রতিবেশীদের কথা কখনও তিনি, ভুলে যান না। যাদেরকে তিনি চেনেন, যারা তার বন্ধু ছিল এককালে, যারা তার প্রতিবেশী হবার গৌরবের অধিকারী তাদের সবাইকে তিনি মনে রেখেছেন, নিমন্ত্রণ করতেও ভোলেননি।

বিয়ের আয়োজন লং আইল্যান্ডের এই বাড়িটিতেই করা হয়েছে। সারাদিন ধরে এখানে চলবে তুমুল আমোদ-আলাদ। জাপানীদের সাথে যুদ্ধ থেমেছে মাত্র, কারও ছেলে যুদ্ধ করছে না, সুতরাং আনন্দফুর্তি উপভোগ করতে অসুবিধে নেই কারও। উদ্দাম আনন্দ প্রকাশ করার জন্যে বিয়েবাড়ির উৎসবের মত পরিবেশ আর আছে নাকি।

শনিবারের সকাল।

নিউ ইয়র্ক শহর থেকে বিশাল জনমোত বেরিয়ে আসছে। গন্তব্যস্থান লং আইল্যাণ্ড। এরা সবাই ডন কর্লিয়নির বন্ধু-বান্ধব। গড ফাদারের দাওয়াত পেয়ে প্রত্যেকে গর্বিত, কৃতজ্ঞ এবং ধন্য। ধর্মপিতার প্রাপ্য সম্মান দিতে দলে দলে চলেছে তারা। চেক নয়, ঘিয়ে-রঙা এনভেলাপে ভরে নগদ টাকা নিয়ে এসেছে সবাই, বর কনেকে উপহার দেবার জন্যে। সবার এনভেলাপে একটা করে কার্ড আছে, সেই কার্ডে দাতার পরিচয় এবং গড ফাদারের প্রতি তার ভক্তি ও শ্রদ্ধার মাত্রাও উল্লেখ করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, তাদের এই সীমাহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা পাবার যোগ্যতা গড ফাদার ডন ভিটো কর্লিয়নির আছে।

সাহায্যের জন্যে এসে ডন কর্লিয়নির কাছ থেকে কখনও খালি হাতে ফিরে যায় কেউ। কাউকে তিনি বিমুখ করতে জানেন না। প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করেন তিনি, কাউকে কখনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেন না। তার চেয়েও শক্তিশালী কোন পক্ষের কাছে তার হাত পা বাধা, এ ধরনের কাপুরুষোচিত অজুহাত কখনও দেখান না তিনি। তাঁর সাথে যে-কেউ বন্ধুত্ব করতে পারে, সবার বন্ধু হবার জন্যে তিনি সব সময় প্রস্তুত হয়ে আছেন। সাহায্য পেতে হলে তার সাথে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে, এমন কোন শর্তও নেই। ঋণ শোধ করার সঙ্গতি নেই যার তাকেও তিনি সাহায্য করেন, বিনিময়ে তার কাছ থেকে কিছুই চান না। মাঝখানে কথা আছে মাত্র একটা; সাহায্য যে পেতে চায় তাকে যেচে পড়ে তার কাছে আসতে হবে, বন্ধুত্ব পাতাতে হবে। ব্যস, শুধু এইটুকু।

সাহায্য প্রার্থী সর্বহারা হোক, দুর্বল হোক, কিছু এসে যায় না তার সমস্ত সমস্যা; বিপদ, দুশ্চিন্তা নিজের কাঁধে তুলে নেবেন ডন কর্লিয়নি। তার বিপদকে নিজের বিপদ হিসেবে গ্রহণ করবেন। তাকে বিপদ মুক্ত করার জন্যে, তার দুঃখ দূর করার জন্যে দরকার হলে সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করবেন তিনি, শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়বেন। সামনে যত বাধাই আসুক, মানবেন না। কিন্তু বিনিময়ে? এর বিনিময়ে কিছুই কি চান না তিনি?

চান। বন্ধুত্ব চান। চান মর্যাদার প্রতীক ডন হিসেবে স্বীকৃতি। কখনও বা আরও মধুর সশ্রদ্ধ সম্বোধন-গড় ফাদার। এবং এর সাথে হয়তো নগদ প্রাপ্তি হিসেবে নয়, শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ ঘরে তৈরি এক গ্যালন মদ, কিংবা যত্ন করে বেক করা এক ঝুড়ি ঝাল নিমকি পেলে খুশি হন। তাছাড়া, ব্যাপারটা যদিও সামান্য লৌকিকতা ছাড়া কিছু নয়, তবে সকলেরই জানা আছে যে সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে বলতে হবে, তাঁর কাছে তুমি কৃতজ্ঞ এবং ঋণী, প্রয়োজনে নগণ্য কোন কাজ করে দিয়ে সে ঋণের প্রতিদান চাওয়ার অধিকার তাঁর থাকল।

বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন ডন ভিটো কর্লিয়নি। অতিথিরা সবাই তার পরিচিত, সবাইকে তিনি বিশ্বাস করেন। এদের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যা প্রচুর যারা তাদের সমস্ত জীবনের সাফল্যের জন্যে তার কাছে চিরঋণী হয়ে আছে। আজকের এই শুভ অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাকে তারা প্রকাশ্যে গড। ফাদার বলে ডাকতেও সাহস পাচ্ছে। বাড়িতে কাজকর্ম করছে যারা তারাও সবাই তাঁর বন্ধু বান্ধব। টেবিলে মদের পাত্র সাজাবার দায়িত্ব নিয়েছে যে, সে-ও তার একজন পুরানো বন্ধু, বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসেবে যত মদ লাগছে, সবই যোগান দিচ্ছে সে। তার ছেলেদের বন্ধুরা দায়িত্ব নিয়েছে পরিবেশনের। বাগানে ফেলা হয়েছে পিকনিক টেবিলগুলো। ডনের স্ত্রী আর তার বান্ধবীদের রান্না করা উপাদেয় খাবারগুলো সেখানে সাজানো হয়েছে। কনের তরুণী বান্ধবীরা রঙ বেরঙের মালা দিয়ে সাজিয়েছে বাগানের এক একর জায়গা।

ধনী হোক বা গরীব, ক্ষমতাশালী হোক বা দুর্বল, আচরণে কারও প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে না, সমান আন্তরিক প্রীতির সাথে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছেন ডন কর্লিয়নি। কাউকে তিনি অনাদর করছেন না। তাঁর স্বভাবই এই। মেহমানরাও বিগলিত বিনয়ে বারবার স্বীকার করছে, কালো সান্ধ্য পোশাকে তাকে ভারি সুন্দর মানিয়েছে–অজ্ঞ যে কোন লোক তাকে দেখে ভাববে তিনিই বুঝি ভাগ্যবান বর।

তিন ছেলের মধ্যে দুজন বাপের সাথে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ছেলে সানতিনা, বাবা ছাড়া আর সবাই তাকে সনি বলে ডাকে।

সনির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে বয়স্ক ইটালিয়ান ভদ্রলোকেরা। তাকিয়ে আছে যুবকরাও, তাদের চোখে শ্রদ্ধামাখা দৃষ্টি। এক পুরুষ ধরে ইটালিতে বসবাসরত মা বাপের ছেলেরা সনির মত এতটা লম্বা হয় না। প্রায় ছফুট। এলোমেলো কোঁকড়া চুল মাথায়, ফলে তাকে আরও বেশি লম্বা মনে হয়। মুখটা দেখতে খানিকটা স্থল, কিউপিডের মত। নিখুঁত নাক চোখ! ঠোঁট দুটো পুরু এবং ধনুকের মত বাকা, যা দেখে তাকে ইন্দ্রিয়াসক্ত বলে চেনা যায় সহজেই। ঠোঁটের নিচেই টোল খাওয়া থুতনিতে অদ্ভুত একটা, অশ্লীলতার লক্ষণ রয়েছে।

শক্তিশালী ষাঁড়ের মত শরীর সনির। সবাই বলে প্রকৃতি নাকি ওকে এমন উদার হস্তে দান করেছে যে অতীতে অবিশ্বাসীরা ব্ল্যাক নামের যন্ত্রটাকে যে রকম ভয় করত, ওর নির্যাতিতা স্ত্রী বেচারীও ওর যন্ত্রটাকে সে-রকম ভয় পায়। গুজবে প্রকাশ, মাত্র কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছেটে তখন সনি, বারবনিতা পল্লীর সবচেয়ে ডাকসাইটে দুর্ধর্ষ মেয়েগুলোও নাকি ওর বিশাল যন্ত্রটা দেখা মাত্র প্রচলিত দরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দরহেঁকে বসত।

আজকের এই বিয়ে বাড়িতে চওড়া নিতম্ব নিয়ে কমবয়েসী কজন গিন্নী এসেছে, মুখে গাভীর্য অটুট রেখে চোখা দৃষ্টিতে তারা মাপ নিচ্ছে সনি কর্লিয়নির। তবে আজ ওদের বরাত খারাপ, কৌনো আশা নেই। কারণ, অনুষ্ঠানে স্ত্রী এবং বাচ্চা-কাচ্চারা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও লুসি ম্যানচিনিকে নিয়ে অন্য মতল রয়েছে সনির। বোনের বান্ধবী লুসি, উৎসবের গোলাপী পোশাক পরে এসেছে। মাথায় কালো, চকচকে চুলের উপর শোভা পাচ্ছে ফুলের মুকুট। বাগিচায় একটা টেবিলের কাছে বসে আছে; সনির মতলব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনসে।

গত এক হপ্তা ধরে চলেছে বিয়ের আয়োজন, লুসি ম্যানচিনি দীর্ঘ সাতদিন সময় পেয়েছে সনির সাথে ভাব জমাবার। আজ সকালেও এক কাণ্ড করেছে সে, বিয়ের একটা খণ্ড অনুষ্ঠানে সুযোগ পেয়েই হাত চেপে ধরেছিল সনির। কুমারী সে, এর চাইতে বেশি আর কতদূর এগোতে পারে?

সনি কর্লিয়নি তার বাপডন কর্লিয়নির মত একজন মহাপুরুষ হয়ে উঠবে না, কিন্তু সে ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা নেই লুসি ম্যানচিনির। গায়ে জোর আর বুকে বল আছে; সনির। হৃদয়ে উদারতার কোন অভাব নেই তার। তবে বাপ যেমন বিনয়ী, ছেলে তার ধারে কাছেও যেতে পারে না। চট করে রেগে ওঠে সনি, আর রেগে গেলেই বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। একথা ঠিক যে ব্যবসায় তার বাপকে সর্ব রকম সাহায্য করে সে, কিন্তু তবু এই সনিই তার উত্তরাধিকারী হবে কিনা সে বিষয়ে জোর করে কিছুই বলা যায় না।

ফ্রেড বা ফ্রিডো বলে ডাকে সবাই মেজ ছেলেকে, নাম ফ্রেডারিকো। এমন একটা ছেলের জন্যেই প্রার্থনা করে থাকে সব ইটালিয়ান মা বাপেরা। ফ্রেড যেমন কর্তব্যপরায়ণ, তেমনি বিশ্বাসী। বাপের হুকুম পাবার জন্যে সদা সর্বদা একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। ত্রিশ বছর বয়সেও মা বাপের সাথে বসবাস করছে সে। একটু বেঁটে, গড়নটাও বেশ ভারি, ঠিক সুপুরুষ বলা যায় না তাকে। কর্লিয়নি পরিবারের চেহারাগত বৈশিষ্ট্যগুলো ওর মধ্যে উপস্থিত: গোল মুখ, কিউপিডের মাথার উপর কোঁকড়া চুলের মুকুট, ঠোঁট ধনুকের মত বাঁকা। ঠোঁট বাকা হলেও সনির সাথে তফাৎ এই যে ফ্রেঙের ঠোঁটে কামুকতার চিহ্ন নেই, গ্র্যানাইট পাথরে খোদাই করা বলে মনে হয়।

চেহারা এবং আচার-ব্যবহারে শক্ত নীরস একটা ভাব আছে ফ্রেডের। তবু সেই তো বাপের একমাত্র অবলম্বন, কখনও মুখের উপর তর্ক করে না বা মেয়ে ঘটিত ব্যাপারে ঝামেলায় পড়ে তার অপমান করে না। এই ধরনের যথেষ্ট গুণ থাকলেও ফ্রেডের চরিত্রে সেই প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব নেই যা মানুষকে আকর্ষণ করে, নেই সেই বুনো জন্তুর মত প্রবল প্রাণশক্তি-জননেতা হতে চাইলে যা না থাকলেই নয়। বাপের উত্তরাধিকারী হবার সম্ভবনা তারও নেই বললেই চলে।

ছোট ছেলে মাইকেল।

বাবা আর ভাইদের সাথে সদর দরজায় না দাঁড়িয়ে বাগানের নির্জনএক কোণে একটা টেবিলের কিনারায় বসে আছে মাইকেল কর্লিয়নি। সযত্নে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করলেও আত্মীয় স্বজনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে।

ডনের ছোট ছেলে মাইকেল, প্রবল প্রতাপশালী জন্মদাতার শাসন একমাত্র সেই মেনে চলতে রাজি নয়। ভাইদের সাথে কোথাও তেমন কোন মিল নেই মাইকেলের। কিউপিডের মত ভারি নয় তার মুখ, চুলগুলো কুচকুচে কালো, কিন্তু কোঁকড়া নয়। গায়ের চামড়া চকচকে সোনা রঙ মেশানো বাদামী, সাধারণত রূপসী মেয়েদের গায়ের রঙও এমন সুন্দর হতে দেখা যায় না। কোমল একটা রূপ আছে মাইকেলের। একটা সময় গেছে যখন ছেলের পুরুষত্ব সম্পর্কে চিন্তিত ছিলেন জুন। সতেরো বছরে পৌঁছে বাগের মিথ্যে দুর্ভাবনা অবশ্য দূর করে দিয়েছিল মাইকেল।

ভিড় থেকে মাইকেলের দূরে সরে বসার কারণ হলো, বাপ এবং আর সকলের কাছ থেকে নিজেকে যে সে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন করেছে সেটাকে প্রকট ভাবে প্রকাশ করা। পাশে বসে আছে যে মেয়েটি সে ইটালিয়ান নয়, আমেরিকান। সবাই শুনেছে এর কথা, কিন্তু চোখে এই প্রথম দেখছে। মাইকেল অবশ্য ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে মেয়েটার, তাদের মধ্যে পরিবারের কেউ বাদ পড়েনি।

কেউই মেয়েটাকে দেখে খুব একটা মুগ্ধ হয়নি। একটু বেশি রোগা, বেশি ফর্সা, চেহারাটা মেয়েমানুষের পক্ষে একটু বেশি তীক্ষ্ণ, চোখমুখে সপ্রতিভ ভাবও একটু বেশি, বিশেষ করে কুমারী মেয়ের চেহারায় এতটা চালাক চতুর ভাব না থাকলেই যেন তারা খুশি হত। কে অ্যাডামস-ওর নামটাও একটু বেশি অপরিচিত আর কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল ওদের কানে। গত দুশো বছর ধরে ওরা বসবাস করছে আমেরিকায় এবং ওর পদবীটা অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয়, মেয়েটা যদি একথা বলে তাহলেও ব্যাপারটাকে তারা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারবে না, কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশের সুযোগটাকে সাথে সাথে কাজে লাগাবে। এ নাম ওদের পছন্দ নয়।

 মেহমানদের সকলের দৃষ্টি জুনের দিকে। ডন কি করছেন না করছেন সেদিকে সবার গভীর মনোযোগ। জন যে তার ছোট ছেলের দিকে বিশেষ খেয়াল দিচ্ছেন না। এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না কারও।

যুদ্ধের আগে পর্যন্ত মাইকেলই ছিল ডনের সবচাইতে প্রিয় সন্তান, তখনই না গিয়েছিল যে উপযুক্ত সময়ে তারকাঁধেই পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনার সম্মানজনক দায়িত্ব তুলে দেয়া হবে। মহাপুরুষ বাপের মৌন শক্তি আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সবটুকু পেয়েছে ও, তারই সাথে যোগ হয়েছে এমনভাবে চলবার একটা জন্মগত ক্ষমতা, যার ফলে কোন মানুষেরই ওকে বন্ধ না করে উপায় নেই।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হতেই একটা পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করুন মাইকেল। মেরিন কোরে নাম লিখিয়ে যুদ্ধে যোগ দিল সে। ডন কর্লিয়নি ছেলেকে বিশেষভাবে নিষেধ করলেন। কিন্তু মাইকেল কর্লিয়নি বাপের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার প্রয়োজনবোধ করল না।

ডন কর্লিয়নি আমেরিকাকে একটা বিদেশী শক্তি হিসেবে ধরতেন, সেই শক্তির সেবা করতে গিয়ে তাঁর ছোটো ছেলে খুন হবে, এ তিনি চাননি। ঘুষ হিসেবে টাকা পয়সা যা লাগে ডাক্তারকে সেসব দেয়া হয়ে গিয়েছিল, গোপন আর সব ব্যবস্থাও মেরে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল মাইকেলের বয়স। একুশ পেরিয়ে গেছে তখন ও। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করা গেল না। মেরিন কোরে নাম লিখিয়ে যুদ্ধ করতে চলে গেল সে প্রশান্ত মহাসাগরে।

পদক পেল মাইকেল, ক্যাপটেন হলো। ১৯৪৪ সালে ওর কৃতিত্বের সচিত্র বিবরণী ছাপা হলো লাইফ ম্যাগাজিনে, ওর ছবিও ছাপা হলো। বাড়ির লোকজনদের কারও সাহস হয়নি পত্রিকাটা নিয়ে এসে দেখায় ডনকে। তবে ডনের একজন বন্ধু পত্রিকাটা একদিন দেখাল ডনকে। সবটুকু পড়ে দেখে ডন তাচ্ছিল্যের সাথে একটা শব্দ করলেন, বললেন, এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটাচ্ছে ও বিদেশীদের জন্যে।

১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে সামরিক বিভাগ থেকে মুক্তি দেয়া হলো মাইকেল কর্লিয়নিকে। আহত ও অক্ষম অবস্থা থেকে যাতে ও সুস্থ হয়ে উঠতে পারে সেজন্যে ডন কর্লিয়নিই ছেলের এই মুক্তির ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু মাইকেল এ সম্পর্কে কিছুই জানত না। চুপচাপ কয়েক হপ্তা বাড়িতে বসে থাকল ও। তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে ভর্তি হয়ে গেল হ্যাঁনোভারের ডার্টমান্য কলেজে। অর্থাৎ অবার সে বাপের বাড়ি ছেড়ে সরে গেল দূরে।

বোনের বিয়ে উপলক্ষে এতদিন পর আবার বাড়ি ফিরেছে মাইকেল। ফেরার আরেকটা উদ্দেশ্য হলো: ভাবী স্ত্রীকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।

মেহমানদের মধ্যে যাদের চাকচিক্য একটু বেশি তাদের সম্পর্কে দুএকটা মজার মজার গল্প বলে ভাবী স্ত্রী কে অ্যাডমসকে হাসাতে চেষ্টা করছে মাইকেল। কে হাসির মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না, বরং মাইকেল যাদের কথা বলছে সেই সব লোককে আশ্চর্য রোমাঞ্চকর বলে মনে হচ্ছে তার। বেশ মজা লাগছে মাইকেলেরও। যা কিছু নতুন, যা কিছু ওর অভিজ্ঞতার বাইরে তাতেই যত কৌতূহল কে-র, এটা লক্ষ করে সত্যিই মুগ্ধ হচ্ছে ও।

ঘরে তৈরি মদে ভরা একটা পিপের চারদিকে ছোটখাটো ভিড় জমেছে একটা। একসময় সেদিকে চোখ পড়ল কে অ্যাডামসের। এরা হলো আমেরিগো বনাসেরা, রুটিওয়ালা নাজোরিনি, এ্যান্টনি কপোলা এবং লুকাব্রাসি। লোক চারজনকে অখুশি দেখাচ্ছে, সচেতন দৃষ্টি এবং ওর স্বাভাবিক বৃদ্ধির সাহায্যে তা ধরে ফেলল কে।

মৃদু হাসল মাইকেল। তুমি ঠিকই ধরেছ। ওরা অপেক্ষা করছে বাবার সাথে দেখা করবে বলে। প্রত্যেকের কিছু না কিছু চাওয়ার আছে। কথাটা ঠিক। ডন যেদিকেই যাচ্ছেন, চারজোড়া চোখ তাকে সারাক্ষণ অনুসরণ করছে।

 অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন ডন কর্লিয়নি। এমন সময় শানবাঁধানো উঠানের উল্টো দিকে এসে থামল একটা কালো শেভ্রলে গাড়ি। সামনের সীটে দুজন লোক। কোটের পকেট থেকে নোট বই বের করে উঠানের চারদিকে দাঁড়ানো গাড়িগুলোর নম্বর টুকছে।

ব্যাটারা নির্ঘাৎ পুলিশ, বাপের দিকে তাকাল সনি।

কাঁধ ঝাঁকালেন ডন কর্লিয়নি। রাস্তাটার মালিক তো আর আমি নই। যা খুশি তাই করতে পারে ওরা।

রাগে লাল হয়ে উঠেছে সনির মুখ শালা কুত্তার বাচ্চারা! একটা শুভ কাজের ওপরও কি ওদের শ্রদ্ধা থাকতে নেই? বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে যাচ্ছে সনি। উঠান পেরিয়ে গাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিচু হয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাতেই লোকটা নির্বিকার চিত্তে ওয়ালেট খুলে সবুজ রঙের পরিচয় পত্রটা দেখিয়ে দিল। কথা বলল না সনি, শুধু পিছু হঠে এসে থোঃ করে একগাল থুথু ছুঁড়ল। সেটা পড়ল গিয়ে গাড়ির পিছনের দরজার উপর।

ফিরে আসছে সনি। আশা করছে, ড্রাইভার নিচে নেমে ওকে তাড়া করে উঠানে উঠে আসবে। কিন্তু না। বাপের কাছে ফিরে এসে সনি বলল, এফ-বি আই, কুকুরগুলো সব গাড়ির নম্বর টুকছে।

দেখেই ওদের পরিচয় অনুমান করতে পেরেছেন ডন কর্লিয়নি। ওরা আসবে, এও তিনি জানতেন। সেজন্যে তার ঘনিষ্ঠ সব বন্ধুদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে, বিয়ে বাড়িতে কেউ যেন নিজের গাড়ি নিয়ে না আসে। সনির এই নির্বোধের মত রেগে ওঠার পিছনে তার কোন সমর্থন না থাকলেও, তিনি বুঝলেন এতে একটু ভাল ফল দেবে। অবাঞ্ছিত আগন্তুকরা এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে তাদের আগমনটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, এর জন্যে কোন প্রস্তুতি নেয়া হয়নি।

রাগের কোন প্রকাশ জনের নিজের মধ্যে একেবারেই দেখা গেল না। তার কারণ অনেক দিনের অভিজ্ঞতায় তিনি একটি মূল্যবান শিক্ষা অর্জন করেছেন, তা হলো: সমাজ কোন মানুষকে যত ভয়ঙ্কর ভাবেই অপমান করুক না কেন, তা মুখটি বুজে সহ্য করতে হয় এই আশায় বুক বেঁধে যে এ দুনিয়ায় চোখ কান খোলা রাখলে এমন দিনও আসে যখন তুমি যত দূর্বলই হও না কেন, অতিক্ষমতাবানের উপরও প্রতিশোধ নিতে পারবে। এই জ্ঞানটি আছে বলেই তিনি কখনও তার সবিনয় ভাবটি বিসর্জন দেন না।

মেহমানরা সবাই পৌঁছে গেছে। বাড়ির পিছন দিকের বাগানে এই সময় চার বাজনাদারের ব্যাণ্ড শোনা গেল। অবাঞ্ছিতদের চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে বিয়ের ভোজে শরিক হতে যাচ্ছেন ডন কর্লিয়নি। সাথে দুই ছেলে।

প্রকাণ্ড বাগান। ইতিমধ্যে কয়েকশো মেহমান জড়ো হয়েছে সেখানে। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে কাঠের মঞ্চ, তাতে চড়ে কেউ কেউ নাচতে আরম্ভ করেছে। টেবিলগুলো লম্বা, সুস্বাদু মশলা দিয়ে রান্না করা উপাদেয় খাবার-দাবারের পাহাড় জমে উঠেছে সেগুলোয়। ঘরে তৈরি করা কালো মদ সরবরাহ করা হয়েছে। এক একটা জগে এক গ্যালন করে মদ ধরে। টেবিলগুলোর সামনে বসে আছে। মেহমানরা। সবচেয়ে উঁচু টেবিলে বসে আছে জমকালো পোশাক পরা বিয়ের কনে, কনি কর্লিয়নি। পাশে তার বর। ওদেরকে সঙ্গ দিচ্ছেন কনে ও বরের বন্ধু-বান্ধবীরা। সেকেলে ইতালীয় পাড়াগেঁয়ে রীতিতে বিবাহ উৎসবের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি কনি কর্লিয়নির, শুধু বাবাকে খুশি করার জন্যেই এমন সুল আয়োজনে রাজি হয়েছে সে। এ ধরনের ছোটখাটো ব্যাপারে জেদ ধরে বাবার অসন্তোষ বাড়াতে চায়নি, এমনিতেই স্বামী বাছাই করার ব্যাপারে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট করেছে তাকে।

বর কার্লো রিটসি। দো-আঁশলা। মা ইটালির উত্তর দিকের মেয়ে, বাবা সিসিলির। মায়ের কাছ থেকে কালো সোনালী চুল আর নীল চোখ পেয়েছে। নেভাড়ায় থাকে ওরা, আইন কানুনের সাথে তেমন বনিবনা না হওয়ায় সে-রাজ্য ছেড়ে চলে এসেছে কার্লো। সনি কর্লিয়নির সাথে নিউইয়র্কেই পরিচয়, সেই সূত্রে পরিচয় কনি কর্লিয়নির সাথে। নেভাড়ায় বিশ্বস্ত বন্ধু পাঠিয়ে ডন কর্লিয়নি অবশ্য খবর নিয়ে জেনেছেন পুলিশের সাথে ঝামেলাটা যে একটা বন্দুক নিয়ে, অর্থাৎ ব্যাপারটার কোন গুরুত্ব নেই। পাত্রকে নিখুঁত করার স্বার্থে খাত থেকে সহজেই ব্যাপারটা মুছে ফেলা যায়। বন্ধুরা ফিরে এসে সেই সুথে তাকে আরও জানিয়েছিল যে আইনের অনুমতি নিয়ে ধূমসে জুয়া খেলা চাল রয়েছে নেভাডায়। কৌতূহল বোধ করেছিলেন ডন কর্লিয়নি, এবং ব্যাপারটা নিয়ে এখনও ভাবনাচিন্তা করছেন। তাঁর বড় হওয়ার আরেকটা কারণ হলো, সবকিছু থেকেই তিনি লাভবান হতে পছন্দ করেন।

খুব একটা সুন্দরী কনি কর্লিয়নিকে বলা চলে না। বেশ রোগা। নার্ভাস টাইপের মেয়ে। একটু বয়স হলেই এরা খিটখিটে মেজাজের হয়ে ওঠে। কিন্তু আজকের কথা আলাদা। নারীর সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ কুমারীত্ব দান করার ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে কনির চেহারায়, মনে মনে নিজেকে নিয়ে আজ ও ব্যক্তিগত উৎসবে মেতে উঠেছে। বিয়ের সাদা পোশাকে মানিয়েছে খুব, চোখে মুখে এমন এক উজ্জ্বলতা, যে এক রকম সুন্দরীই দেখাচ্ছে তাকে। একটা হাত টেবিলের নিচে দিয়ে স্বামীর পৈশীবহুল উরুর উপর রেখেছে। ধনুকের মত আঁকা ঠোঁট দিয়ে স্বামীকে চুমোয় চুমোয় ব্যতিব্যস্ত করে তোলার জন্যে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে।

কনির চোখে কার্লো আশ্চর্য এক সুদর্শন পুরুষ। বয়স যখন কম ছিল মরুভূমির খোলা বাতাসে কঠিন পরিশ্রমের কাজ করেছে কালো। বিশাল শক্তিশালী ষাড়ের মত কাঁধ তার, পেশীর চাপে সৌখিন কোটের দুটো দিক উঁচু হয়ে আছে। শ্রদ্ধা, প্রশংসা আর ভালবাসার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে কনি। গর্বে আরও ফুলে উঠছে কার্লোর বুক। স্ত্রীর গেলাসে মদ ঢেলে দিচ্ছে। কিন্তু কনির ডান কাঁধে ঝোলানো রেশমী ব্যাগটার দিক থেকে বেশিক্ষণ চোখ সরিয়ে রাখতে পারছে না সে। ব্যাগে রয়েছে অসংখ্য খাম, খামগুলো ভলারে ঠাসা। অনুমান করার চেষ্টা করছে কালো, কত ডলার ধরতে পারে ওই ব্যাগে? পঞ্চাশ হাজার? এক লাখ? তৃপ্তির মুচকি হাসি ফুটছে, তার ঠোর্টে। এই তো সবে শুরু, এখন শুধু আসতেই থাকবে টাকা, আসতেই থাকবে। বলতে গেলে মন্তু এক রাজার জামাই হয়েছে সে। এখন ওকে খাতির করতেওরা বাধ্য।

মেহমানদের মধ্যে রয়েছে ভেল চকচকে মাথাওয়ালা চালিয়াত ছোকরা পলি গাটো।মেন বদ মতলবে নয়, যে অভ্যাসের বশে ভাবছে টাকায় ফুলে ওঠা ওই ব্যাগটা কিভাবে হাইজ্যাক করা যায়। ভেবে খুব মজা পাচ্ছে পলি। জানে, খেলনা বন্দুক দিয়ে বাচ্চারা ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দেবার যে স্বপ্ন দেখে, তার কল্পনাটাও সেই রকম অলস দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।

ওর ওপরওয়ালাকে লক্ষ্য করছে পলি। ভারি মোটা, আধাবয়েসী পিটার ক্লেমেনজো। কাঠের মঞ্চের উপর উঠে ছুকরী বয়েসী টসটসে মেয়েদের সাথে ধুমধাড়াক্কা-সর্বস্ব ট্যারান্টেলা নাচছে। যেমন অস্বাভাবিক লম্বা তেমনি চওড়া তার শরীর, অথচ আশ্চর্য বেপরোয়া দক্ষতার সাথে নাচছে সে। মেয়েগুলো বেঁটে বলেই হোক বা ক্লেমেনজোর শক্ত ভুড়িটা প্রতিটা লাফের সাথে সাথে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে বলেই হোক, মেয়েগুলোর ফুলে থাকা বুকের সাথে অশ্লীলভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। তাই দেখে মেহমানদের কি উল্লাস! এরপর ওর পার্টনার হবার জন্যে একটু বয়স্ক মেয়েরা এগিয়ে এসে ছেকে ধরল ওকে, ওর হাত ধরে টানাহেঁচড়া শুরু করে দিল। ম্যাণ্ডোলিনের উদ্দাম তালের সাথে মিল রেখে হাততালি দিচ্ছে ছোকরাগুলো। এক সময় হাঁপ ধরে গেল ক্লেমেনজোর। যে চেয়ারটায় বসল, সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেল সেটা। তাড়াহুড়ো করে এক গ্লাস মদ এনে দিল.ওকে পলি গাটো। রেশমী রুমাল দিয়ে. ওর বিশাল কপালের ঘাম মুছে দিল। তিমি মাছের মত হাঁসফাঁস করছে ক্লেমেনজো, গলায় মদ ঢালছে। ধন্যবাদ দেয়া তো দূরের কথা, চাছাছোলা গলায় বলল, শোনো, নাচের সমঝদার হবার দরকার নেই। কাজ করোগে। সব ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে এসো ঘুরে।

সুড়ুৎ করে ভিড়ের ভিতর ঢুকে গেল পলি।

টিফিনের জন্যে একটু থামল ব্যাণ্ড রাদকরা। পড়ে থাকা একটা ম্যাণ্ডোলিন তুলে নিল এক ছোকরা। নিমো ভ্যালেন্টি। চেয়ারের উপর বাঁ পা তুলে দিয়ে খানিকটা অশ্লীল ধাচের একটা সিসিলীয় প্রেমের গান গাইতে শুরু করল। সুদর্শন চেহারা, কিন্তু মদ খেয়ে ফুলে গেছে মুখটা। আজও এরই মধ্যে নেশা করেছে সে। অশ্লীল পদগুলো জিভ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে গাইছে নিনো, মেয়েদের দিকে কামাতুর, ঢুলু ঢুলু চোখে তাকাচ্ছে। আর মেয়েগুলো আমোদে আপ্লুত হয়ে চেঁচাচ্ছে। প্রত্যেক চরণের শেষ শব্দটা নিনোর সাথে গলা ফাটিয়ে আওড়াচ্ছে ছেলেরা।

এসব ব্যাপারে গোড়া বলে যথেষ্ট অখ্যাতি আছে ডন কর্লিয়নির। দেখলেন সবার সাথে মেতে উঠে তার মেদবহুল মোটা গিন্নীটিও উল্লাসে চেঁচাচ্ছে। বুদ্ধি করে তিনি বাড়ির ভিতর পালিয়ে গেলেন।

ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কনের টেবিলের দিকে এগোল সনি কর্লিয়নি বসল লুনি ম্যানচিনির পাশে। এখন কোন বাধা নেই। পরিবেশনের আগে বিয়ের কেকট্রাতে শেষ সাজ দেবার জন্যে ওর স্ত্রীও গেছে হেঁসেলে।

তরুণী লুসির কানে কানে কিছু বলল সনি। লুসি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল সাথে সাথে। কিন্তু টেবিল ছেড়ে নড়ার কোন লক্ষণ সনির মধ্যে দেখা গেল না। কয়েকটা মুহূর্তকে বয়ে যেতে দিল সে। তারপর উঠল। অনুসরণ করল লুসিকে। ভিড়ের ভিতর দিয়ে যাবার সময় এখানে সেখানে থেমে এর তার সাথে দুটো কথাও বলল, যেন ওর কোন তাড়া নেই বা নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই হাতে।

কিন্তু আসল ব্যাপারটা কারও দৃষ্টি এড়াল না। ওদের দুজনের উদ্দেশ্য সবাই জানে। সবাই বুঝল নির্জন কোথাও যাচ্ছে ওরা। কেন যাচ্ছে, তাও জানতে বাকি নেই কারও।

তিন বছর কলেজে পড়ে পুরো আমেরিকান বনে গেছে লুসি ম্যানচিনি। পাকা টসটসে ফলের মত দেখতে মেয়েটা, সবার আলোচনার পাত্রী। বিয়ের তোড়জোর চলার সময় খুব জমিয়ে ছিল সনি কর্লিয়নির সাথে। প্রচুর ঠাট্টা তামাশা করে, খানিকটা মিঠেকড়া ব্যঙ্গের মিশেল দিয়ে চটিয়ে পুরোপুরি খেপিয়ে তুলেছিল সনিকে। ওর ধারণা যেহেতু ও নীত-কনে আর সনি নীত-বর তাই এসবের মধ্যে দোষের কিছু নেই।

পরনের পোলাপী গাউনটা মাটি থেকে একটু তুলে ধরেছে লুসি, মুখে লক্ষ্মী মেয়ের কৃত্রিম হাসি। চঞ্চল পায়ে বাড়ির ভিতর ঢুকল সে। সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে গেল দোতলায়। এদিক-ওদিক তাকাল। উত্তেজিত দেখাচ্ছে। আপনাআপনি লাল হয়ে উঠেছে চেহারা। হাঁপাচ্ছে। খানিক পরই ব্যাপারটা ঘটবে। আসছে সনি। ওকে আজ নেবে সে। আশ্চর্য এক উষ্ণতা অনুভব করছে লুসি তার শরীরে। শিহরিত বুকে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। কয়েক মিনিট পর বেরিয়েই দেখতে পেল সনিকে। উপরের ল্যাণ্ডিঙে দাঁড়িয়ে ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে। ইশারায় ওকে ডাকলসনি। ঢোক গিলল লুসি। সারা শরীরে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ।

ডন কর্লিয়নির অফিস রূমটা এক কোণায়, সেটা তৈরি করা হয়েছে একটু উঁচু করে। জানালাগুলো বন্ধ, তারই একটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে টমাস হেগেন। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে সুসজ্জিত বাগান আর উৎসবমুখর মেহমানদের দেখছে সে। তার পিছনের দেয়ালটা ঢাকা পড়ে আছে বুক শেলফে সেগুলোয় মোটা মোটা সব আইনের বই ঠাসা। টমাস হেগেন একাধারে ডন কর্লিয়নির উকিল এবং কার্যকরী কনসিলিয়রি অর্থাৎ মন্ত্রণাদাতা। কর্লিয়নি পরিবারের ব্যাপারে যারা খাটছে, যারা অধঃস্তন কর্মচারী, তাদের কাছে এই পদের গুরুত্ব অপরিসীম।

ডনের সাথে এই অফিসরুমে বসেই জটিল সব সমস্যা আলোচনা করে হেগেন। ডন উৎসবমুখর বাগান ছেড়ে বাড়িতে ঢুকছেন দেখেই সে বুঝল, আজও তিনি কাজে বসবেন। এরপরই তার নজরে ধরা পড়ল সনি। লুসির কানে কানে কি যেন বলছে সে। গোটা প্রহসনটাই মনোযোগ দিয়ে দেখল হেগেন। গম্ভীর হয়ে একটু ভাবল ডনের কানে কথাটা তুলরে কিনা।

না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ডেস্কের কাছে এসে দাঁড়াল হেগেন। ডনের সাথে আজ যারা গোপনে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পেয়েছে তাদের তালিকাটা তুলে নিল ডেস্ক থেকে। এমন সময় অফিসে ঢুকলেন ডন। সাথে সাথে হেগেন তার হাতে তুলে দিল নামের তালিকাটা।

নামগুলোর উপর একবার চোখ বুলালেন ডন। সম্মতি জানাবার ভঙ্গিতে মাথা কাত করলেন। বললেন, আমেরিগো বনানেরাকে সবার শেষে ডেকো।

লম্বা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল হেগেন। সোজা বাগানে। মদের পিপের চারপাশে সাক্ষাৎপ্রার্থীরা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সবাই ওর দিকে তাকাল। রুটিওয়ালা নাজোরিনির দিকে তর্জনী তুলল হেগেন।

বুকে জড়িয়ে ধরে রুটিওয়ালাকে অভ্যর্থনা জানালেন ডন কর্লিয়নি। অনেক দিন, আগেরকত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার: বন্ধু ছিলেন তারা, একসাথে খেলাধুলো করেছেন, একসাথে বড় হয়েছেন। ইটালির সেইসব দিনের কথা কি ভোলা যায়। প্রতি বছর ঈস্টারের সময় সদ্য বেক করা পাই পৌঁছে যেত ডন কর্লিয়নির বাড়িতে। সে-পাইয়ের আকার প্রকাণ্ড ট্রাকের চাকার মত, তাজা হনা আর সুজি দিয়ে তৈরি, মুরগীর ডিমের হলুদ কুসুম দিয়ে সোনালী রঙ করা বড় দিন, বাড়ির কারও জন্মদিন, অথবা অন্য কোন উত্সবের দিন হলে আর কথা ছিল না, ক্ষীর দিয়ে ভরাট করা উপাদেয় মিষ্টির ঝুড়ি উপহার হিসেবে, নাজোরিনিদের শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে পৌঁছে যেত। বয়স হতে ডন একটা বেকারি সমিতি গঠন করেছিলেন, সেই সমিতির চাঁদা সুদিন দুর্দিনে বছরের পর বছর খুশি মনে নিয়মিত দিয়ে এসেছে নাজোরিনি। যুদ্ধের সময় কিছু কালোবাজারি চিনির কুপন ছাড়া আর কোন ব্যাপারে কখনও সে ডনের কাছে সাহায্যের জন্যে হাত পাতেনি। বিশ্বাসী বন্ধু সে, এখন বিপদে পড়ে সাহায্য চাইতে এসেছে। আনন্দের সঙ্গে তার উপকার করবেন ডন কর্লিয়নি। তার উপকার করার সুযোগের অপেক্ষাতেই তিনি আছেন।

এক গ্লাস স্টেগা মদ খেতে দিলেন বন্ধুকে ডন কর্লিয়নি। তারপর একটা ডি নোবিলি চুরুট দিলেন। উৎসাহ যোগানোর জন্যে একটা হাত রাখলেন তার কাঁধে। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ডন কর্লিয়নি জানেন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের কাছে অনুগ্রহ চাওয়া কত কঠিন, কতটা সাহসের দরকার হয়।

তাঁকে নিজের মেয়ে এবং এনজার কথা বলল রুটিওয়ালা। ইতালির খা এক ছেলে, বাড়ি নিসিলীতে। যুদ্ধবন্দী হিসেবে পাঠানো হয়েছে আমেরিকাতে। বর্তমানে প্যারোলে মুক্ত। ওর মেয়ে ক্যাথারিন এই যুদ্ধবন্দীর প্রেমে পাগলিনী হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ এখন থেমে যাওয়ায় এনজোকে আর সব যুদ্ধবন্দীর সাথে ফেরত পাঠানো হবে ইটালিতে। এখানেই হয়েছে মুশকিল। এনজো চলে গেলে ওর মেয়ের মন ভেঙে যাবে, সে বাঁচবে না। বলাই বাহুল্য, ওদের দুজনের মধ্যে এই প্রেমটা যেমন কড়া তেমনি পবিত্র। এখন, একমাত্র গড ফাদারই পারেন এই অভাগা অভাগিনীকে সাহায্য করতে। তার হাতেই নির্ভর করছে ওদের জীবন মৃত্যু।

বন্ধুকে সাথে নিয়ে পায়চারি করছেন ডন কর্লিয়নি। একটা হাত তুলে দিয়েছেন তার কাঁধে। সহানুভূতির সাথে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, বন্ধু যাতে উৎসাহ হারিয়ে না ফেলে। সব শুনে মৃদু হাসলেন তিনি। বললেন, আমি থাকতে তোমার কোন চিন্তা নেই।

কি কি করতে হবে সব তিনি অত্যন্ত সাবধানে বুঝিয়ে দিলেন। ওই এলাকার কংগ্রেস সদস্যের কাছে আবেদন করলে তিনি একটা বিশেষ বিলের প্রস্তাব তুলবেন, প্রস্তাবটা পাসও হয়ে যাবে, এবং পাস হয়ে গেলেই মার্কিন মুল্লুকের নাগরিক হবার অনুমতি মিলবে এনজোর। না-না, কংগ্রেসে বিলটা পাস হবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ করার কিছুই নেই। পরস্পরের জন্যে এটুকু উপকার সবাই করে থাকে।

কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হলো নাজোরিনি। তার চোখে পানি এসে গেছে। দরজা পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দিলেন ডন কর্লিয়নি। বিদায় নেবার আগে রুটিওয়ালা মহান বন্ধুকে আলিঙ্গন করল।

ডনের দিকে তাকিয়ে হাসল হেগেন। নাজোরিনির জন্যে চমৎকার একটা বিনিয়োগ এটা। মাত্র দুহাজার ডলার খরচ করতে হবে তাকে, বিনিময়ে একটা কৃতজ্ঞ জামাই অর্থাৎ রুটির দোকানের নামমাত্র বেতনে সারাজীবন কাজ করার জন্যে একজন লোক পেয়ে গেল। একটু বিরতি নিয়ে জানতে চাইল সে, কাজটা কাকে দেব?

ভুরু কুঁচকে একটু ভাবলেন ডন কর্লিয়নি। আমাদের দলের কাউকে না। পাশের পাড়ার ইহুদিটাকে দিতে পারো! ঠিকানা ইত্যাদি সব বদলে দিতে হবে। যুদ্ধ থেমে গেছে, এ ধরনের সমস্যা আরও দেখা দেবে। আমাদের আরও কিছু লোক ওয়াশিংটনে থাকা দরকার, যারা বাড়তি কাজগুলো করবে, কিন্তু বাড়তি দর হাকবে না। নোট বুকে টুকছে হেগেন। কংগ্রেস সদস্য লুটেকার কাজ নয় এটা। ফিশারকে ধরো।

এরপর অ্যান্টনি কপোলাকে নিয়ে এল হেগেন। যৌবনে রেল ইয়ার্ডে কাজ করেছেন ডন কর্লিয়নি, তখনকার একজন সহকর্মীর ছেলে। একটা পাইয়ের দোকান দিতে চায় কপোলা, সেজন্যে পাঁচশো ডলার লাগবে তার। পকেট হাতড়ে এক গোছা টাকা বের করে গুনলেন ডন কর্লিয়নি। পাঁচশো ডলার হচ্ছে না দেখে হেগেনকে বললেন, একশো ডলার ধার দিতে পারো? সোমবারে ব্যাঙ্ক থেকে এনে। ফেরত দেব।

চারশো দিলেই কাজ চলবে, আর লাগবে না, সলজ্জভাবে বলছে কপোলা। কুণ্ঠিতভাবে হাসলেন ডন কর্লিয়নি। কপোলার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন, তাই কি হয়। আমার পকেট খালি সেতো এই শখের বিয়ের জন্যেই, হেগেনের বাড়িয়ে ধরা হাত থেকে টাকাটা নিয়ে নিজেরগুলোর সাথে কপোলার হাতে গুঁজে দিলেন।

সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হেগেন। সে জানে, ডনের শিক্ষা হলো, কিছু দিতে হলে সেটাকে ব্যক্তিগত দান হিসেবেই দিতে হয়। ডনের মত একজন। মহাপুরুষ টাকা ধার করে তাকে দান করলেন, এতে অ্যান্টনি কপোলার মর্যাদা এক পলকে কতটা বেড়ে গেল। ডন একজন কোটিপতি, কপোলা তা জানে। কিন্তু গরীব বন্ধুর ছেলেকে সাহায্য করার জন্যে কজন কোটিপতি এ-ধরনের ঝামেলাকে হাসিমুখে নেয়?

মাথা তুলে তাকালেন ডন। দৃষ্টিতে প্রশ্ন।

হেগেন বলল, তালিকায় নাম নেই লুকা, ব্রাসির। কিন্তু তবু একবার দেখা করতে চাইছে সে। প্রকাশ্যে ব্যাপারটা হতে পারে না, এ কথা সে বুঝতেই পারছে না, ব্যক্তিগত ভাবে আপনার সাথে দেখা করে অভিনন্দন জানাবে।

এই প্রথম অপ্রসন্ন দেখাল ডনকে। তবে সরাসরি তিনি আপত্তি প্রকাশ করলেন না। বললেন, কোন দরকার আছে কি?

আপনি তাকে আমার চেয়ে ভাল চেনেন, কাঁধ ঝাঁকাল হেগেন। বিয়েতে দাওয়াত করা হয়েছে, সেজন্যে আশ্চর্য এবং কৃতজ্ঞ বোধ করছে। এতটা আশা করেনি। বোধ হয়…

ইঙ্গিত পেয়ে থেমে গেল হেগেন। লুকা ব্রাসিকে নিয়ে আসতে বলছেন ডন।

বাগানে বসে লুকা ব্রাসির মুখে বুনো একটা হিংস্রতার ছাপ লক্ষ্য করে কে অ্যাডামস তার বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করছে। কে-কে বিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসার পিছনে মাইকেলের একটা উদ্দেশ্য আছে। ও চাইছে কে একটু একটু করে এবং মোটেও খুব বেশি স্তম্ভিত না হয়ে,ওর বাবার বিষয়ে সব প্রকৃত সত্য যেন জেনে নেয়। কিন্তু, দেখেশুনে ওর মনে হচ্ছে, সামান্য দুর্নীতিপরায়ণ একজন ব্যবসায়ী ছাড়া কে ডন কর্লিয়নিকে আর কিছু ভাবছে না এখনও। মাইকেল ঠিক করল, পরোক্ষ ভাবে ও চেষ্টা করবে আসল ব্যাপারগুলো জানিয়ে দিতে। তাই বুঝিয়ে বলল যে পূবদিকে যত লোক গোপনে আইন লঙ্ঘন করে তাদের মধ্যে লুকা ব্রাসির মত ভয়ঙ্কর, নির্মম পিশাচতুল্য চরিত্র আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওর সবচেয়ে বড় প্রতিভা হলো, কারও সাহায্য না নিয়ে, একাকী, এমন নিখুঁত ভাবে খুন-টুন করতে পারে যে ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। মাইকেল মুখ বিকৃত করল, বলল, এর মধ্যে সত্য মিথ্যা কতটা জানি না। তবে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বেরই, বলতে পারো।

এই প্রথম চোখ খুলে গেল কে-র। তার কণ্ঠে অবিশ্বাস, এমন ভয়ঙ্কর লোক ও? তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাই না যে এরকম একজন লোককে তোমার বাবা চাকরিতে রেখেছেন?

দুত্তোরি ছাই! ভাবল মাইকেল। সরাসরি বলল, শোনো তাহলে। পনেরো বছর আগের কথা। কয়েকজন লোক বাবার জলপাই তেলের ব্যবসাটা হাত করে। নেবার মতলব এটেছিল। ওদের উদ্দেশ্য ছিল বারাকে খুন করা। খুন প্রায় করে ফেলেছিল। কিন্তু সময় থাকতেই ওদের পিছনে লাগানো হলো ওকে, ওই লুকা ব্রাসিকে। সত্য মিথ্যা জানি না, গুজব হলো, হপ্তা দুয়ের মধ্যে এক এক করে ছয়জনকেই শেষ করেছিল লুকা। বিখ্যাত জলপাই তেল যুদ্ধের সমাপ্তি ওখানেই। হাসল মাইকেল, কথাগুলো যেন কতই না মজার।

শিউরে উঠল মেয়েটা। তোমার বাবাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল?

অনেক আগের কথা। পনেরো বছর আগেই সব ঠাণ্ডা মেরে গেছে। ভয় হচ্ছে মাইকেলের, খুব বেশি বলে ফেলেনি তো!

হঠাৎ হাসল কে। মাইকেলের পাজরে মৃদু একটা কনুইয়ের তো মেরে বলল, ভারি চালাক! আসলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছ! চাও না যে তোমাকে আমি বিয়ে করি?

আমি চাই তুমি গোটা ব্যাপারটা ভালভাবে ভেবেচিন্তে দেখো, বলল মাইকেল।

ভুরু কুঁচকে কে জানতে চাইল, ছয় জনকে মেরে ফেলেছে, সত্যি?

প্রমাণ হয়নি কিছু। কিন্তু কাগজে তাই লিখেছিল। ওর সম্বন্ধে আরেকটা নাকি গল্প আছে, কিন্তু সেই গল্পের কথা কেউ কাউকে বলে না। সে নাকি সাংঘাতিক একটা ব্যাপার, বাবাও কখনও মুখে আনেন না। মাত্র কয়েকজন জানে গল্পটা, তার মধ্যে টম হেগেন একজন। কিন্তু কিছুতেই বলবে না। একবার শোনার জন্যে জেদ ধরায় সে আমাকে কি বলেছিল, জানো?।

বলেছিল, তোমার বয়স একশো বছর হলে গল্পটা শোনার উপযুক্ত হবে তুমি। নিশ্চয়ই গল্পের মত গল্প! না শুনেই কেমন যেন গা ছমছম করে আমার, শুনলে না জানি কেমন হবে?

লুকা ব্রাসি। নরকের সম্রাট স্বয়ং শয়নও বুঝি এই নাম শুনে আঁতকে ওঠে। বেঁটে, গাঁট্টাগোট্টা, মাথার খুলিটা প্রকাণ্ড, কাছে এলেই বিপদের হিম-শীতল ঢেউ জাগে শরীরে। মুখ নয়, নির্মম হিংস্রতার পুরু মুখোশ যেন। মুখোশের কোথাও প্রাণের সজীবতা থাকে না, ওর মুখেও তা নেই। গায়ের রঙটা কেমন উৎকট বাদামী।

হিংসাত্মক কাজে লুকা ৰাসির সমকক্ষ কেউ নেই, তেমনি ডন কর্লিয়নির প্রতি তার আন্তরিক, অন্ধ ভক্তির ব্যাপারটাও কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ডন কর্লিয়নির বিশাল শক্তিশালী দুর্গের ভিত্তিমূলে গাঁথা প্রকাণ্ড একটা স্তম্ভ এই লুকা ব্রাসি। সারা দুনিয়া খুঁজেও এরকম আরেকটা মানুষ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

পুলিশকে ভয় নেই সূকা ব্রাসির, ভয় নেই সমাজকে। সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করে না। সে, ভয় করে না নরকযন্ত্রণার সম্ভাবনাকে। মানুষকে? না, মানুষকে সে ভয় করে না, তাকে সে ভালও বাসে না। শুধু একজনকে ছাড়া। স্বেচ্ছায়, যেচে পড়ে, ভালবাসে সে ডন কর্লিয়নিকে, ভয় করে। এইমাত্র নিয়ে আসা হয়েছে ওকে ডন কর্লিয়নির সামনে। ভয়ঙ্কর, হিংস্র মানুষটাকে এখন চেনার কোন উপায়ই নেই। ভক্তি আর শ্রদ্ধায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কথা বলবে, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। মুখ খুলল বটে, কিন্তু তোতলাচ্ছে। এর আগেও এরকম হয়েছে। ডনের সামনে কথা বলতে গেলেই তোতলাতে উরু করে। কোনরকমে তার মনের কথা জানাল সে: প্রথমেই গড ফাদার যেন নাতির মুখ দেখেন।

সাথে করে নব-দম্পতির জন্যে উপহার নিয়ে এসেছে লুকা ব্রাসি। টাকা ভর্তি একটা খাম। কাঁপা হাতে সেটা সে ডন কর্লিয়নির দিকে বাড়িয়ে ধরল।

ডন কর্লিয়নির মধ্যে একটা পরিবর্তন চোখ এড়াল না হেগেনের। রাজাকে খুশি করার জন্যে কোন প্রজা যখন কোন মহৎ কাজ করে, রাজা তখন সেই প্রজাকে যেভাবে অভ্যর্থনা করেন, খুব ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতার সাথে নয়, বরং গাম্ভীর্যপূর্ণ রাজোচিত সম্মানের সাথে, ঠিক সেইভাবে ডন কর্লিয়নি অভ্যর্থনা করছেন লুকা ব্রাসিকে। তার প্রতিটি ভঙ্গির সাহায্যে, প্রতিটি বাক্যের সাহায্যে ডন কর্লিয়নি বুঝিয়ে দিলেন তাঁর কাছে লুকা ব্রাসি একটা অমূল্য সম্পদ। তিনি তাকে আর সবার চেয়ে বেশি মূল্য দেন। নিজের হাতে উপহারটি তাঁকে দেবার জন্যে তিনি মোটেও বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। সবই তিনি বুঝলেন। তিনিও শব্দের মণি মুক্তো দিয়ে তৈরি করা ভাষায় ৪ন্যবাদ জানিয়ে সামান্য এই আনাড়িপনাটুকু মাফ করে দিলেন।

হেগেন লক্ষ করছে, মুহূর্তে হিংস্র মুখোশটা খসে পড়ল লুকা ব্রাসির চেহারা থেকে, গর্ব আর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মুখ। এগিয়ে গেল হেগেন, দরজা খুলে দিয়ে অপেক্ষা করছে সে। লুকা ব্রাসি গড ফাদারের হাতে চুমো খাচ্ছে।

লুকা ব্রাসি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, বুদ্ধি করে হেগেন তার দিকে ফিরে ভেট হিসেবে বন্ধুত্বের হাসি উপহার দিল একটা। কিন্তু ব্রাসিকে সে হাসতে দেখল না। নীরস রবারের মত ঠোঁট দুটো একটু লম্বা হলো শুধু। হেগেনের জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট।

লুকা ব্রাসি বিদায় হতেই আপনা-আপনি বুকের ভিতর থেকে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ডন কর্লিয়নির। পৃথিবীর কোন লোককে সামান্যতম ভয়ও যদি তিনি করেন, তো সে এই লুকা ব্রাসি। এ লোক প্রচণ্ড একটা প্রাকৃতিক শক্তি, একে সংযত রাখা আসলেই সম্ভব নয়। লোকটাকে ডিনামাইট মনে করে খুব সাবধানে ঘাটেন তিনি। আপন মনে মৃদু কাঁধ ঝাঁকালেন ডন। ভাবলেন, প্রয়োজনে নিরাপদ বিস্ফোরণ তত ডিনামাইটেরও ঘটানো যায়। তারপর দৃষ্টিতে প্রশ্ন নিয়ে হেগেনের দিকে তাকালেন।

গড ফাদারের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে হেগেন বলল, জ্বী, আর শুধু আমেরিগো বনাসেরা বাকি আছে।

ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবলেন ডন কর্লিয়নি। তারপর বললেন, তার আগে সান্তিনোকে ডাকো। এসব কিছু কিছু তারও শেখা দরকার।

বাগানে বেরিয়ে এসেছে হেগেন। ব্যস্তভাবে এখানে সেখানে খুঁজে বেড়াচ্ছে সনিকে। বনাসেরার সাথে দেখা হয়ে গেল। তাকে একটু ধৈর্য ধরার উপদেশ খয়রাত করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল মাইকেল কর্লিয়নি আর তার বান্ধবীর দিকে।

সনিকে দেখেছ নাকি, মাইকেল?

 মাথা নাড়ল মাইকেল।

শঙ্কিত হয়ে উঠল হেগেন। সনি কি তাহলে এখন সেই মেয়েটার সাথে রঙ তামাশায় মেতে আছে? একটা গোল না বাধিয়ে ছাড়বে না দেখছি! কেমন আক্কেল বাপু তোমার বৌ রয়েছে, ছুঁডীটার বাড়ির লোকজন রয়েছে, সব জানাজানি হয়ে গেলে সর্বনাশ হতে কিছু বাকি থাকবে? ভাবতে ভাবতে সদর দরজার দিকে হন হন করেএগোচ্ছে হেগেন। প্রায় আধঘন্টা আগে সনিকে ওদিকে যেতে দেখা গেছে।

হেগেন বাড়ির ভিতর ঢুকছে, তাই দেখে কে অ্যাডামস জানতে চাইল, আসলে কে ও? ভাই বলে পরিচয় তো করিয়ে দিলে, কিন্তু নামে মিল নেই, চেহারা দেখেও তো ঠিক ইতালীয় বলে মনে হচ্ছে না।

মাইকেল জানাল, ওর সেই বারো বছর বয়স থেকে এখানে আছে। মা-বাপ মরে গেল কিনা, কি আর করে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তাই দেখে সনি এক রাতে ওকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই থেকে আছে। কোন আশ্রয় ছিল না, বিয়ের আগে পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থাকত।

ঘটনাটা রোমাঞ্চকর লাগছে কে অ্যাডামসের। ঠিক যেন গল্প শুনছি। তোমার বাবার এত দয়া? নিজেরই এতগুলো ছেলেপিলে, তার ওপর আরেকজনকে পুষ্যি নিলেন?

চার সন্তানের পরিবারকে বহিরাগত ইতালীয়রা বড় পরিবার বলে মনে করে না, কিন্তু তা কেকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করল না মাইক। বলল, বাবা ওকে পুষ্যি নিয়েছেন, এ কথা আমি বলেছি? আমাদের সাথে এমনি থাকত।

ও, আচ্ছা, বলল কে। কিন্তু কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে সাথে সাথে আবার প্রশ্ন করল সে, কিন্তু পুষ্যিই বা নিলেম না কেন?

একটু হাসল মাইকেল। পুষ্যি নিলে তো নাম বদলাতে হয়, সেটা বাবা চাননি। তাতে ওর বাবা-মার প্রতি অসম্মান দেখানো হয়ে যায়।

হেগেন আর সনিকে দেখতে পাচ্ছে এখন ওরা। লম্বা কাঁচের দরজা দিয়ে ঠেলে ডনের অফিসে সনিকে ভিতরে ঢুকিয়ে আঙুল বাকিয়ে ডাকছে হেগেন আমেরিগো বনাসেরাকে।

আচ্ছা, জানতে চাইছে কে, এমন দিনে ওরা তোমার বাবাকে কাজের মধ্যে টেনে না আনলেই তো পারত!

আবার একটু হাসল মাইকেল। মজার একটা কারণ আছে এর মধ্যে।

 কি? কৌতূহল উপচে পড়ছে কে-র দুচোখে।

ওরা জানে মেয়ের বিয়ের দিনটা এমন এক দিন, এই দিনে প্রার্থীকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না। এটা হলো একটা সিসিলীয় রীতি। কিছু চাওয়ার এমন সুযোগ সিসিলীর লোকেরা ছাড়ে কিভাবে, বলো?

.

গোলাপী গাউনটা মাটি থেকে একটু তুলে নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে লুসি ম্যানচিনি। একটু আগে দেখা সনি কর্লিয়নির কিউপিডের মত ভারি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মদ খেয়ে বিচ্ছিরী লাল করে ফেলেছে মুখটাকে, তার উপর উগ্র লালসার সীল মোহর পড়েছে। শিউরে উঠল লুসি,.ভয়ই করছে তার। কিন্তু, একথাও ভাবছে, এখন আর ভয় পেলে চলবে কেন গো মেয়ে! এই মজার আশাতেই না তুমি সারাটা হপ্তা ষাঁড়টাকে জ্বালাতন করে খেপিয়ে তুলেছ। এখন তার শিং দেখে ডরাও ক্যান?

এর আগে কলেজে দুটো প্রেমের স্বাদ পাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল লুসির। কোনটা থেকেই মিষ্টি কিছু পায়নি। এক হপ্তার বেশি টেকেনি-কোনটা। দ্বিতীয় প্রেমিকটা ঝগড়ার মধ্যে নিচু গলায় বলতে চেয়েছিল বা বলেই ফেলেছিল যে ওর ওইটা নাকি সাংঘাতিক প্রশস্ত। অর্থটা ঠিকই ধরতে পেরেছিল লুসি, এবং তারপর থেকে ওভাবে আর কারও সাথে মিশতে রাজি হয়নি সে।

বান্ধবী কনি কর্লিয়নির বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল, এই উপলক্ষ্যে লুসি কদিনের জন্যে থেকেই গিয়েছিল এবাড়িতে। এই সময়ই সনি কর্নিয়নি সম্পর্কে নানারকম অবিশ্বাস্য, রোমাঞ্চকর কানাঘুষো কানে গেছে তার। এক রোববার দুপুরে সনির বউ সাণ্ডা দিল খুলে গল্প করছিল। বউটা হয়তো একটু স্থূল, কিন্তুমনটা সাদা জন্মেছে ইটালিতে, তবে অল্প বয়সেই নিয়ে আসা হয়েছে আমেরিকায়। দশাসই শরীর, বুক দুটোর ওজন কম করেও সের পাঁচেক, পাঁচ বছরে তিন ছেলেমেয়ে বিইয়ে বসে আছে। সে, এবং আর সব বিবাহিতা মেয়েরা, ফুলশয্যা রাতে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটবে তা নিয়ে কনিকে ঠাট্টাচ্ছলে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে।

ফিক ফিক করে হাসছে সাণ্ডা। বলছে, আই বাপ! সনির ওই মুগুর দেখে আমার তো… কথা শেষ করতে পারে না সে, হেসেই গড়িয়ে পড়ে। …যখন বুঝলাম ওই মুগুর আমাকে নিতেই হবে, অমনি এমন তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম-হি হি হি-হি-হি… হাসি থামতে আবার বলল, বছর খানেকের মধ্যে আমার ওখানের কি অবস্থা হলো–যেন এক ঘণ্টা ধরে ম্যাকারনি সেদ্ধ করা হচ্ছে, গলে ছাতুর মত থেলথসে। তারপর যেই শুনলাম অন্য মেয়েদের দিকে ওর নেক নজর পড়েছে, অমনি গির্জায় ছুটে গেলাম। মোমবাতি জ্বেলে ধন্যবাদ দিয়ে এলাম যীশুর মাকে।

সাণ্ডার কথা শুনে মুখে হাত চাপা দিয়ে সে কি চাপা হাসি সবার। কিন্তু লুসি হাসেনি। কথাগুলো শোনেনি সে, গোগ্রাসে গিলেছিল। দুই পায়ের মাঝখানে শরীর শিরশির করে উঠেছিল তার।– রোমাঞ্চকর ভীতিবোধটাকে উপভোগ করছে লুসি। সিঁড়ি বেয়ে সনির কাছে ছুটে যাবার সময় শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে দাউ দাউ কামনার আগুন। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছতেই ওর হাত চেপে ধরে হলঘরের পাশের একটা শোবার ঘরে টেনে নিয়ে গেল ওকে সনি। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে বুঝতে পেরেই পায়ের সবটুকু জোর হারিয়ে ফেলল লুসি। নিজের ঠোঁটে সনির ঠোঁট অনুভব করছে। সনির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা বাতাসে তামাকের কটু গন্ধ। লুসি মুখ খুলল। গাডনের নিচে সনির হাত, অনুভব করছে। খানিকটা ছিঁড়ে গেল রেশমী কাপড়। দুই হাত তুলে সনির গলা জড়িয়ে ধরল লুসি। ব্যস্ত হয়ে পোশাক খুলছে সনি।

তারপর লুসির নিতম্বের নিচে দুটো হাত রেখে উপর দিকে তাকে তুলে ধরল সনি। শূন্যে লাফ দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে থাকল লুসি। সনির জিভ লুসির মুখের ভিতর, ললিপপের মত চুষছে লুসি। সনি তাকে সামনের দিকে ঠেলে দিতেই দরজায় ঠুকে গেল লুসির মাথা। গনগনে আগুনের ছোঁয়া অনুভব করছে লুসি। মিলনের সীমাহীন আনন্দে দম. আটকে যাচ্ছে তার। জীবনে এই প্রথমবারের মত পূর্ণ তৃপ্তি লাভ করল সে। হাঁপিয়ে গেছে দুজনেই, পরস্পরের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শব্দটা বুঝি কিছুক্ষণ ধরেই হচ্ছে, খেয়াল করেনি ওরা। হঠাৎ শুনল কে যেন ধীরে ধীরে টোকা দিচ্ছে দরজায়। দ্রুত দরজার গায়ে শরীর ঠেকিয়ে কাপড় চোপড় পরে নিল সনি। ঝটপট তৈরি হয়ে গেছে লুসিও, ব্যস্ত, হাতে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে গোলাপী গাউনটা।

বাইরে থেকে নিচু গলা ভেসে এলো টম হেগেনের, আছ নাকি, সনি?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে লুসির দিকে তাকান সনি, চোখ মটকাল। কি ব্যাপার, টম?

গলা আরও খাদে নামিয়ে হেগেন জানাল, ডনের অফিসে। এক্ষুণি! হেগেনের পায়ের আওয়াজ দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে।

দেরি করল না সনি, দরজা খুলে অনুসরণ করল হেগেনকে।

চুলে চিরুনি চালাচ্ছে লুসি। কাপড়-চোপড় ঠিক আছে কিনা দেখে নিল আরেকবার, সোজা করল মোজার গার্টার, তারপর দরজা খুলে ধীর স্থির পায়ে সিঁড়ি, ভেঙে সোজা বাগানে নেমে এল। কনির পাশে, কনের টেবিলে বসল সে। মৃদু বিরক্তির সুরে কনে তাকে বলল, কোথায় যাওয়া হয়েছিল রে? নেশা করেছিস মনে হচ্ছে? খবরদার, আমাকে ছেড়ে নড়বি না কোথাও।

লুসির জন্যে গ্লাসে মদ ঢালছে বর। এক মাথা সোনালী চুল নেড়ে সবজান্তার ভঙ্গিতে হাসল সে। এসবে কিছুই এসে গেল না লুসির। গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে সে। শরীরের কাপুনিটা এখনও একটু একটু আছে। ঠোঁটে গ্লাস তুলে ইতিউতি তাকাচ্ছে, দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে সনি কর্লিয়নিকে। আর কেউ ওকে আকর্ষণ করতে পারছে না। কনির কানের কাছে মুখ নিয়ে চালাকি করে বলল সে, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, নিজেই টের পাবে ব্যাপারটা।

নিঃশব্দে হেসে ফেলল কনি।

.

টম হেগেনের পিছু পিছু কোণার ঘরে ঢুকে আমেরিগো বনাসেরা দেখতে পাচ্ছে বিরাট এক ডেস্কের পিছনে বসে আছেন ডন কর্লিয়নি। ঘরে সনি কর্লিয়নিও রয়েছে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বাগানের দিকে।

আজ এই প্রথম কেমন যেন উদাসীন আচরণ করলেন ডন কর্লিয়নি। প্রার্থীকে আলিঙ্গন, তো করলেনই না, তার সাথে করমর্দনও করলেন না। প্রার্থী আমেরিগো বনাসেরাকে রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। সে একজন আণ্ডারটেকার; তার ব্যবসা হলো মৃতদেহ সমাধিস্থ করার আয়োজন এবং শবাধার তৈরি করা। ডনের স্ত্রীর সাথে তার স্ত্রীর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব, সেকারণেই নিমন্ত্রণ পাবার উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছে সে। এমনিতে ডন কর্লিয়নি এই লোকের উপর অত্যন্ত চটে আছেন।

চাতুর্যের সাথে তার অনুরোধ পেশ করতে শুরু করেছে বনাসেরা। আপনার স্ত্রীর ধর্ম-কন্যা, আমার মেয়ে এখানে এসে আজ আপনাদের পরিবারকে শ্রদ্ধা জানাতে পারল না, সেজন্যে তাকে আপনি ক্ষমা করবেন। হাসপাতালের বিছানায় এখন শুয়ে আছে সে। সনি কর্লিয়নি এবং টম হেগেনের দিকে তাকাল বনাসেরা। আশা করছে সে যে এদের সামনে কথাটা পাড়তে চাইছে না তা ডন কর্লিয়নি বুঝবেন। ডন সবই বুঝলেন। কিন্তু তাঁর দয়া হলো না।

তিনি বলেন, মেয়েটার দুর্ভাগ্যের কথা আমরা জানি। তার কোন সাহায্য আমার পক্ষে করা সম্ভব বলে মনে করলে, বলল। আর যাই হোক, আমার স্ত্রী তার ধর্ম-মা, সুতরাং আমার কাছে তার সম্মান কম নয়, এবং এই সম্মানের কথা আমি কখনও ভুলি না। ডনের এই কথাগুলোর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে বনাসেরার প্রতি তীব্র তিরস্কার। ডন কর্লিয়নিকে বনাসেরা আজ পর্যন্ত কখনও ধর্ম-পিতা বলে, সম্বোধন করেনি। অর্থাৎ প্রথম থেকেই একটা অবশ্য পালনীয় রীতি লঙ্ঘন করে আসছে বনাসেরা।

ডনের কথা শুনে কাগজের মত সাদা হয়ে গেল নাসেরার মুখ। দমে গিয়ে বলল, আপনার সাথে নির্জনে কথা বলার সৌভাগ্য হবে কি?

মাথা নাড়লেন ডন কর্লিয়নি। এদেরকে আমি নিজের মতই বিশ্বাস করি। এরা দুজন আমার দুটো হাত। এখান থেকে ওদেরকে যেতে বলা মানে ওদেরকে অপমান করা। তা আমি পারব না।

চোখ বুজে কি এক ধাক্কা সামলাল যেন বনাসেরা। তারপর চোখ খুলে, যেন মৃত ব্যক্তির আত্মীয়কে সান্তনা দিচ্ছে, রপ্ত করা নরম আর শান্ত গলায় কথা বলা শুরু করল।

মেয়েকে আমি আমেরিকান স্টাইলে মানুষ করেছি। তার কারণ, আমেরিকার ওপর আমার আস্থা আছে। এর মধ্যে যতটুকু সাফল্য অর্জন করেছি আমি, তা আমেরিকারই দান। মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছি সত্যি, তার সাথে এ-শিক্ষাও দিয়েছি যে কখনও যেন নিজেদের পরিবারকে কলঙ্কের মধ্যে না জড়ায়। একজন বয়-ফ্রেণ্ড, ইতালীয় নয়, তার সাথে সিনেমা টিনেমায় যেত ও। কিন্তু ছেলেটি কখনও আমার বা আমার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হবার জন্যে বাড়িতে আসেনি। কোন প্রতিবাদ না করে এ সবই আমি মেনে নিয়েছিলাম। এখানেই ভুল হয় আমার। যাই হোক, মাস দুই আগে ছেলেটা ওকে গাড়িতে করে বেড়াতে বেরিয়েছিল। সাথে ছিল আরেক ছোকরা। এরা দুজন মিলে জোরজার করে ওকে হুইস্কি খাইয়ে ওর চরিত্র নষ্ট করার চেষ্টা করে। ও রাজি হয়নি, বাধা দিয়েছিল। এবং নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। তখনই ওকে মার খেতে হয়। খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, মেয়েকে নিতে পারি না। দুচোখে কালসিটে। নাক ভেঙে গেছে। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে চোয়ালের হাড়। জোড়া লাগাবার জন্যে তার দিয়ে বাঁধতে হয়েছে। কথার মধ্যে কোন আবেগ না থাকলেও কথা শেষ হতেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল বনাসেরা।

অভদ্রতা দেখানো হয়ে যায় তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুহূর্তের জন্যে চেহারায় ক্ষীণ একটু সমবেদনার ভাব ফোঁটালেন ডন কর্লিয়নি।

বেদনায় নীল হয়ে গেছে বনাসেরার চেহারা। ও আমার একমাত্র মেয়ে, আমার চোখের আলো। ভারি সুন্দর দেখতে ছিল। সেই রূপ আর কখনও ফিরে পাবে না। বড় বেশি বিশ্বাস করত মানুষকে, আর কখনও করবে না। থরথর করে কাঁপছে শরীরটা।

ভাল মানুষ একজন আমেরিকান যা করে, আমিও তাই করলাম। পুলিশের কাছে গেলাম। পুলিশ ছেলে দুটোকে গ্রেফতার করল। কোর্ট তাদের বিচার করল। এত সাক্ষ্য, অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। অপরাধ স্বীকার করল ওরা। জজ ওদের সাজা দিলেন। তিন বছরের জেল। সাথে সাথে সাজা মাফও করে দিলেন। তখুনি ওরা ছাড়া পেয়ে গেল। বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। দুই হারামজাদা, তাদের মা বাবারা আমার দিকে ফিরে হাসতে লাগল। তখন আমার স্ত্রীকে জানালাম, সুবিচার পেতে হলে ডম কর্লিয়নির কাছে যেতে হবে।

লোকটার দুঃখের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে মাথাটা একটু নত করলেন ডন কর্লিয়নি। কিন্তু তার আত্মমর্যাদা যে আহত হয়েছে তা বোঝা গেল ঠাণ্ডা হিম কণ্ঠস্বর থেকে! কেন? পুলিশের কাছে যাওয়া হয়েছিল কেন? শুরুতেই আমার কাছে আসোনি কি মনে করে?

বিড় বিড় করে কি যেন বলল বনাসেরা, কেউই তা ভাল করে শুনতে পেল না। গলায় জোর এনে তারপর বলল, আপনি যা চান তাই দেব। আপনার ইচ্ছাটা শুধু আমাকে জানতে সুযোগ দিন। কিন্তু আমার আরজিটা গ্রহণ করুন-দয়া করে। কথাগুলো প্রায় ঔদ্ধত্যের মত শোনাল।

গম্ভীর হলেন ডন কর্লিয়নি। আরজিটা কি?

হেগেন আর সনির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল নাসেরা। ডেস্কের উপর হাতের ভর রেখে প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে পড়লেন ডন। একটু ইতস্তত করল বনাসেরা, তারপর নিচু হয়ে ডনের নোমশ কানের এত কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে গেল যে প্রায় ছোঁয়া লেগে যায় আর কি। এই মুহূর্তে গির্জার পাদ্রীর মত লাগছে ডনকে, গভীর মনোযোগে কোন পাপীর স্বীকারোক্তি গুনছেন যেন। তাকিয়ে আছেন যেন বহুদূরে, চোখে উদাস দৃষ্টি। দীর্ঘ এক মিনিট পর কথা শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল বনাসেরা। ডন ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। গভীর। মুখটা লাল হয়ে উঠল বটে, কিন্তু ভয় পেল না বনাসেরা। সেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডনের চোখের দিকে।

না, শেষ পর্যন্ত মুখ খুললেন ডন। এমন কাজ আমি করতে চাই না। তু আবেগে অন্ধ হয়ে গেছ।

গলায় জোর এনে, স্পষ্ট স্বরে বনাসেরা বলল, যত টাকা লাগে দেব।

কথাটা শুনেই হেগেনের শরীর শক্ত কাঠ হয়ে গেল। কপালের কাছে দপ দপ করছে একটা শিরা। বুকের উপর দুটো হাত ভাঁজ করে রেখে দাঁড়িয়ে আছে সাল, মুখে মৃদু ব্যঙ্গের হাসি। ঘরের ভিতর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে, পাত্তাই দেয়নি সে এতোক্ষণ। এখন মনোযোগ না দিয়ে পারছে না।

চেয়ার ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন ডন কর্লিয়নি। মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। তুমি আর আমি, পরস্পরকে অনেক দিন থেকে চিনি আমরা। কিন্তু এতদিন হয়ে গেল, পরামর্শ বা সাহায্যের জন্যে কখনও তুমি আমার কাছে আসার প্রয়োজন বোধ করোনি। কই, মনে তো পড়ছে না শেষ কবে তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে কফি খেতে ডেকেছ। অথচ, আমার স্ত্রী তোমার মেয়ের ধর্ম-মা। শোনো, স্পষ্ট করেই বলি। পাছে আমার কাছে ঋণী হও, এই তোমার ভয়। তাই আমার বাড়িয়ে দেয়া বন্ধুত্বের হাত ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছ তুমি।

অস্পষ্ট গলায় বলল বনাসেরা, কোন গোলমালে নিজেকে জড়াতে চাইনি আমি…

কথা বলতে নিষেধ করার ভঙ্গিতে একটা হাত তুললেন ডন। চুপ! তুমি মনে করেছ আমেরিকা একটা স্বর্গ। চুটিয়ে ব্যবসা করছ, দুহাতে লুটছ টাকা, ভাবছ দুনিয়াটা কি মজার, কি নিরাপদ জায়গা–এখানে যা মন চায় তাই করা যায়। খাঁটি একজন বন্ধুর সাহায্য দরকার আছে বলে মনে করোনি, তাকে দিয়ে নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করোনি। ভেবেছ, এসব গোলমেলে ব্যাপার, নিজেকে খামোকা জড়িয়ে ফায়দা নেই। ভেবেছ, তোমাকে পাহারা দেবার জন্যে পুলিশ আছে, ন্যায় বিচারের জন্যে আদালত আছে। ভেবেছ, ডন কর্লিয়নির সাহায্য তোমার দরকার নেই। বেশ। মনে দুঃখ পেয়েছিলাম আমি, কিন্তু আমার বন্ধুত্বের মূল্যই যে দেয়, যে আমাকে অতি সামান্য বলে মনে করে, জোর জবরদস্তি করে তার ঘাড়ে আমার বন্ধুত্ব চাপাব আমি কি সেই বান্দা? কক্ষনো নই!

ভদ্রভাবে কাষ্ঠ হাসলেন, তারপর বললেন, অথচ লেজে পা পড়ায় এখন আবার আমার কাছে ছুটে এসেছ, বলছ, ডন, কর্লিয়নি, আমি সুবিচার চাই। তাও পরিবেশের পবিত্রতার মুখ চেয়ে কিছু শ্রদ্ধার সাথে বলছ না। এটা আমার বাড়ি, আজ আমার মেয়ের বিয়ে আর তুমি আমার কাছে এসে আমাকে বলছ খুন করতে, বনাসেরার কণ্ঠস্বর নকল করে ঘৃণার সাথে ডন কর্লিয়নি বললেন, বলছ, যত টাকা চান দেব, না-না, আমি রাগ করিনি। কিন্তু বলো তো, কি অপরাধ করেছি তোমার কাছে আমি, যার প্রতিশোধ নিচ্ছ, এত অসম্মান করছ আমাকে?

আতঙ্কের একটা যন্ত্রণা আছে, বনাসেরা সেই যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাচ্ছে। দিশেহারার মত বলতে লাগল, আমেরিকা আমার কত উপকার করেছে। ভাল নাগরিক হতে চেয়েছিলাম আমি। চেয়েছিলাম আমার মেয়ে হবে আমেরিকান মেয়ে…

হাত তালি দিয়ে দৃঢ় সমর্থন জানালেন ডন কর্লিয়নি। চমৎকার, খাসা বলেছ। তাহলে তো আর নালিশ করার কিছু থাকলই না। রায় দিয়েছেন জজ সাহেব। রায়। দিয়েছেন আমেরিকা সাহেব। ফুল আর এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে যেয়ো হাসপাতালে, তাতেই তোমার মেয়ে সান্তনা পাবে। তেমন কোন গুরুতরব্যাপার তো আর নয়, ওদের বয়স কম, উত্তেজনার পরিমাণ একটু বেশি, আবার শুনছি একজন নাকি প্রভাবশালী রাজনীতিকের ছেলে। না, ভাই আমেরিগো, তুমি অসৎ এ অপবাদ কখনও আমি দিতে পারব না। সতোর প্রতি তোমার শ্রদ্ধা, হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে। আমার বন্ধুত্ব উপেক্ষা করেছ, সেটা তেমন কিছু নয়, তবু অন্য কোন মানুষের চাইতে তোমার কথায় আমার আস্থা আছে। তাই কথা দাও, এসব পাগলামি ছাড়বে তুমি। আবেগের বশে যা চাইছ, কাজটা ঠিক আমেরিকান নয়। ওদেরকে মাফ করে দাও। ভুলে যাও। মেনে নাও, এমন কি আমেরিকাতেও দুর্ঘটনা ঘটে। 

নির্মম অবহেলা, ব্যঙ্গ আর তাচ্ছিল্যের সাথে কথাগুলো বলে গেলেন ডন কর্লিয়নি। বনাসেরা কাঁপছে। তবু সাহস সঞ্চয় করে পুনরাবৃত্তি করল সে, সুবিচার আমি আপনার কাছে চাই।

সুবিচার আদালত দেয়নি তোমাকে?

একগুয়ে ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল নাসেরা। না। সুবিচার ওরা পেয়েছে। আমি পাইনি।

উপর নিচে মাথা নেড়ে এই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ অনুমোদন করলেন ডন কর্লিয়নি। কি চাও তুমি?

চোখের বদলে চোখ, অস্ফুটে বলল বনাসেরা। চোখ দুটো জ্বলে উঠল তার।

আরও বেশি চাইছিলে, ডন বললেন। তোমার মেয়ে তো মরেনি।

নিরাশ হলো বনাসেরা। দাবির পরিমাণ কমিয়ে বলল, তাহলে ওরাও যেন ওর মত কষ্ট পায়। বানাসেরা আরও কিছু বলবে, এই আশায় অপেক্ষা করে আছেন ডন কর্লিয়নি। সবটুকু সাহস দিয়ে বুক বেঁধে বসে বলল, কত টাকা দেব আপনাকে? হতাশ আর্তনাদের মত শোনাল কথাটা।

ঘুরে দাঁড়ালেন ডন কর্লিয়নি। এর অর্থ দূর হও তুমি! কিন্তু বাসেরা নড়ল না।

মনটা বড় তাল ডন কলিয়নির, দিকভ্রষ্ট বন্ধর উপর কতক্ষণই বা তিনি রাগ করে থাকতে পারেন? অবশেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, তারপর আবার ফিরলেন। ইতিমধ্যে বেঁচে থেকেও মরার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বনাসেরার চেহারা।

ধৈর্যের সাথে, কোমল গলায় বললেন ডন কর্লিয়নি, প্রথম থেকেই লক্ষ করেছি, আমাকে বিশ্বাস করতে ভয় পাও তুমি। আইনের কাছে সুবিচারের আশায় মাসের পর মাস অপেক্ষা করো তুমি। উকিলের পিছনে বস্তা বস্তা টাকা ঢালো। অথচ, সবাই জানে তোমাকে কেমন ঠকানো হবে। সুবিচারের জন্যে এমন জজের ওপর বিশ্বাস রাখো তুমি যে রাস্তায় রাস্তায় খদ্দের খুঁজে বেড়ানো বেশ্যার মত নিজেকে বেচে দেয়। একবার তুমি সর্বনেশে সুদের বিনিময়ে টাকা ধার করতে গিয়েছিলে ব্যাঙ্কে, দীন-হীন ফকিরের মত ওখানে গিয়ে বসে থাকতে হত তোমাকে দিনের পর দিন, ওরা তোমার পিছনটা কে গন্ধ নিয়ে বুঝতে চাইত টাকা শোধ করার ক্ষমতা তুমি রাখো কিনা!

 কেন, আমার কাছে আসতে পারোনি? যদি আসতে টাকায় ঠাসা আমার থলি তোমার হয়ে যেত। যদি সুবিচার চাইতে, তোমার মেয়ের এই দুর্ভোগের জন্যে যারা দায়ী তাদের চোখ দিয়ে নোনা পানি ঝরত। তোমার সাথে কেউ যদি শত্রুতা করত, তাদেরকে আমার শত্রু বলে মনে করে উচিত সাজা দিতাম। বনাসেরার দিকে তনী খাড়া করলেন ডন কর্লিয়নি, তাহলে, বিশ্বাস করো, আমাকে যেমন ভয় করে, তোমাকেও তেমনি ভয় পেত সবাই।

চোখ নামিয়ে নিল বনাসেরা। চিবুক প্রায় বুক ছোঁয় ছোঁয়। রুদ্ধ গলায় বলল, সব মেনে নিলাম। আমি আপনার বন্ধুত্ব চাই।

দুর্ভাগা লোকটার কাঁধে একটা হাত রাখলেন ডন কর্লিয়নি। ঠিক আছে। পাবে, তুমি সুবিচার। হয়তো সেদিন কখনোই আসবে না, তবুবলে রাখছি, একদিন হয়তো তোমার কাছে যাব আমি বলব এর বদলে আমার একটা কাজ করে দাও। তার আগে পর্যন্ত ভেব এই সুবিচার তোমার মেয়ের ধর্ম-মায়ের তরফ থেকে ছোট্ট একটা দান।

কৃতজ্ঞতায় অভিভূত বনাসেরার মুখ দিয়ে কথা সরল না। আনন্দে বিহ্বল লোকটা চলে গেলে দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল হেগেন। ডন কর্লিয়নি বললেন, কাজটা ক্লেমেঞ্জাকে দাও। রক্তের গন্ধ পেয়ে খেপে উঠবে না এমন লোককে দিয়ে সারতে বলবে। মড়াপোতা ব্যাটার মাথায় যত পাগলামিই গিজ গিজ করুক, আমরা তো আর খুনে নই। বিরক্তির সাথে লক্ষ করলেন তাঁর শক্তিশালী পুরুষসিংহ জ্যেষ্ঠ পুত্রধন জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাগানের উৎসব উপভোগ করছে। নাহ, ওর হবে না, ভাবলেন তিনি। শেখারই যদি আগ্রহ না থাকে, পারিবারিক ব্যবসাটা চালানো ওর কম্ম নয়। ডন ও কোনোদিনই হতে পারবে না। আর কাউকে বেছে নিতে হবে। এবং তাড়াতাড়ি। তিনি নিজে তো আর অমর হয়ে জন্মাননি।

হঠাৎ করে বাগান থেকে একটা আনন্দ কোলাহল ভেসে আসতে তিনজনই চমকে উঠল। একমুখ হাসি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সনি, ছুটল দরজার দিকে। জনি, জনি–বিয়েতে জনি এসেছে। কি, বলিনি আমি?

জানালার কাছে গেল হেগেন। বলল, হ্যাঁ, আপনার ধর্ম-পুত্র এসে পৌঁছেছে। নিয়ে আসব এখানে?

না, বললেন ডন। ওর ইচ্ছে হলে আমার কাছে আসবে। হাসলেন তিনি। ছেলেটা আমার কেমন ভাল, দেখলে তো!

একটু ঈর্ষা হলো হেগেনের। গলাটা একটু পড়ে গেল তার, কম দিন তো হলো না, দুবছর! আবার হয়তো কোন ঝামেলা বাধিয়ে বসেছে, সাহায্য চায়।

তাই যদি হয়, প্রশ্ন করলেন ডন কর্লিয়নি, সাহায্যের জন্যে ওর ধর্ম-বাপ ছাড়া আর কার কাছে যাবে শুনি?

.

 বিয়ের কনের যে একটা আলাদা মর্যাদা আছে, জনিকে দেখে তা আর মনেই থাকল না কনির। জনি-ই-ই! চেঁচিয়ে উঠে পাখনা মেলা পাখির মত উড়ে গিয়ে ওর বাড়িয়ে দেয়া দুই বাহুর মধ্যে সেঁধিয়ে গেল।

কনির মুখে চুমো খেলে জনি। সাদর অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে সবাই যখন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে ওকে, কনিকে তখনও জাপটে ধরে রেখেছে ও। সবাই এরা পুরানো বন্ধু-বান্ধব ওর, এদের সাথেই ওয়েস্ট সাইডে বড় হয়েছে জনি।

কনি ওকে টেনে নিয়ে গেল ওর সদ্য বিবাহিত স্বামীর কাছে। আজকের প্রধান ভূমিকা থেকে পদচ্যুত হয়ে ছোকরার মুখ ভার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব মজা লাগছে জনির। তাই তার সাথে হ্যাণ্ডশেক করে তাকে মোহিত করতে লেগে গেল ও। গ্লাস ভর্তি মদ খেয়ে শুভেচ্ছা জানাল।

ব্যাণ্ড বাদকদের উঁচু মঞ্চ থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এবার একটা গান ধরতে পারলে হত না, জনি?

ঝট করে তাকাল জনি। দেখল ওর দিকে চেয়ে আছে নিনো। নিনো ভ্যালেন্টি। হাসছে। এক সময় গলায় গলায় ভাব ছিল দুজনের, একসাথে গাইত, মেয়েদের নিয়ে একসাথে হুল্লোড় করত। তখন রেডিওতে গাইতে শুরু করেনি জনি, নাম কিনতে শুরু করেনি। ছবি করতে জনি যখন হলিউডে চলে গেল, প্রথমদিকে বার দুয়েক ফোন করেছিল নিনোকে, তখন কথা দিয়েছিল ক্লাবে ও নিনোকে গাইবার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু সে-কথা আর রাখা হয়নি। এখন নিনোর খুশির, ব্যঙ্গ মেশানো মদ খাওয়া হাসি দেখে অন্তরে চাপা পড়ে থাকা ভালবাসাটা ধড়মড় করে জেগে উঠল।

ম্যাণ্ডোলিনে নিনো একটু টুংটাং করতে না করতে জনি ফন্টেন তার কাঁধে হাত রেখে বলল, এ গান শুধু বিয়ের কনের জন্যে! বলেই পা ঠুকে পুরানো একটা সিসিলীয় অশ্লীল প্রেমের গান ধরল। আর যায় কোথা, নিনোও গানের সুরের সাথে তাল রেখে অঙ্গভঙ্গি করতে শুরু করে দিল।

কুনের মুখ রাঙা হয়ে উঠছে গর্বে। মেহমানরা চিৎকার করে জয়ধ্বনি ছুঁড়ছে। গান শেষ হবার আগে উঠে পড়ল সবাই, প্রতি চরণের শেষের চতুর দ্ব্যর্থ ব্যঞ্জক পদটি সমস্বরে গর্জন করে গাইতে শুরু করে দিল পা ঠুকে। গান তো এক সময় থামল, কিন্তু কার সাধ্যি করতালি থামায়। আরেকটা গান ধরল জনি।

ওকে নিয়ে কত গর্ব ওদের। ওদেরই একজন আপনজন ছিল ও, এখন না হয় বিখ্যাত হয়েছে, চিত্রজগতের মস্ত তারকা হয়েছে, দুনিয়ার সেরা সব লোভনীয় মেয়ে মানুষদের সাথে শোয়। কিন্তু, হ্যাঁ, ধর্ম-বাপকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে ভুল করেনি, বিয়ের দাওয়াত পেয়ে তিন হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে চলে এসেছে এখনও ও নিনো ভ্যালেন্টির মত পুরানো বন্ধুকে ভালবাসে। ওদের ছেলেবেলায় ওরা দুজন একসাথে গান করত, তা কে না দেখেছে। ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি কেউ জনি একদিন তার হাতের মুঠোয় পাঁচ কোটি মারীর হৃদয় ধরে রাখবে।

হাত বাড়িয়ে কনেকেও মঞ্চে তুলে নিল জনি। জনি আর নিনোর মাঝখানে দাঁড়াল কনি। ম্যাণ্ডোলিনের তার থেকে কয়েকটা কর্কশ পদ বের করল নিনো। এটা পুরানো একটা রুটিন ওদের-নকল যুদ্ধ, এবং প্রেম বিনিময়। তরোয়ালের মত তীক্ষ্ণ ধার কণ্ঠস্বরে, একেকজন পালা করে গান ধরছে। সূক্ষ্ম সৌজন্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিনোর কণ্ঠকে নিজের গলার উপরে ছাপিয়ে উঠতে দিল জনি, কনেকে হরণ করে নিতে দিল ওর হাত থেকে বিজয়ীর শেষ চরণটি গাইতে দিল নিনোকেই, আস্তে আস্তে বহুদূরে মিলিয়ে গেল জনির গলা। গান শেষে বিয়ে বাড়িতে উদ্দাম আনন্দের ঢেউ আর উচ্ছ্বসিত জয়ধ্বনি শুরু হলো। শেষদিকে ওরা তিনজন আলিঙ্গন করছে পরস্পরকে। ওদিকে আরেকটা গানের দাবিতে মেহমানদের চিৎকার শুরু হয়েছে।

শুধু ডন কর্লিয়নি, কোণার ঘরটার দরজার কাছে একা দাঁড়িয়ে সন্দেহ করছিলেন, কোথায় যেন গোলমাল আছে একটা। প্রফুল্ল মুখে অমায়িক হেসে, মেহমানদের কারও মনে দুঃখ না দিয়ে, সবাইকে ডেকে তিনি বললেন, আমার ধর্ম পুত্র, আমাদেরকে সম্মান দেখানোর জন্যে এতদূর থেকে এসেছে, গলা ভেজাবার জন্যে ওকে কিছু দেবার কথা কারও মনে পড়ল না? কথাটা শেষ হতে যা দেরি, সাথে সাথে দশ বারোটা মদ ভর্তি গ্লাস জনির দিকে এগিয়ে দেয়া হলো। সব গ্লাসে একটা করে চুমুক দিল জনি, তারপর ছুটল ধর্ম-বাপকে আলিঙ্গন করতে।

ধর্ম-বাপকে বুকে চেপে ধরে এক কে তার কানে কানে কিছু বলল জনি। তিনি আর তাকে হাতছাড়া করলেন না, সাথে করে বাড়ির ভিতর নিয়ে চলে গেলেন।

জনি ফন্টেনকে ঘরে ঢুকতে দেখেই করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল টম হেগেন। কেমন আছ? করমর্দন করল বটে জনি, কিন্তু সবাই জনির যে উষ্ণ, গভীর অন্তরঙ্গতার প্রশংসা করে তার কোন প্রকাশ ঘটল না। ডন কর্লিয়নির যাবতীয় অপ্রিয় কাজ যাকে করতে হয়, এইটুকু শাস্তি তাকে তো নিতেই হবে মাথা পেতে।

নিমন্ত্রণ পেয়েই ভাবলাম, যাক, ধর্ম-বাপের রাগ হলে পানি হয়ে গেছে, ডনকে বলছে জনি। বউকে ডিভোর্স করার পর ফোন করেছিলাম আপনাকে পাঁচবার, টমের গলায় শুনেছি হয় আপনি বেরিয়ে গেছেন, নয় এই মুহূর্তে সাংঘাতিক ব্যস্ত। বুঝতে অসুবিধে হয়নি রেগে কাঁই হয়ে আছেন আমার ওপর।

হলুদ বোতল থেকে মদ ঢেলে গ্লাস ভরে দিলেন ডন। আচ্ছা, থাক, হয়েছে। এখন ওসব মনে নেই। এখনও কিছু করতে পারি নাকি তোমার জন্যে? এত বড়লোক হয়ে যাওনি, এত নাম কিনে ফেলোনি তো যে তোমার জন্যে আমার আর কিছুই করার নেই?

তরল অনলের মত মদটুকু গিলে নিয়ে আবার গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল জনি। গলার স্বরে বানোয়াট একটা স্ফূর্তির ভাব আনতে চেষ্টা করে বলল, এখন তো আর আমি বড়লোক নই, গড ফাদার! পতন শুরু হয়ে গেছে আমার। আপনার কথাই ফললো। কি কুক্ষণে চরিত্রহীনা মেয়েটাকে বিয়ে করলাম, তার জন্যে, স্ত্রী আর মেয়েদেরকে পর করে দিয়ে ভাল করিনি আমি। এখন বুঝি, আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আপনি অন্যায় কিছু করেননি।

শ্রাগ করলেন ডন। আর যাই হোক, তুমি আমার ধর্ম-পুত্র তো, তোমার জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল-এই আর কি।

অস্থির হয়ে উঠে ঘরের মেঝেতে পায়চারি শুরু করে দিল জনি। পাজী, শয়তান মেয়েমানুষটার জন্যে বদ্ধ পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। হলিউডের আকাশে সবচেয়ে দামী তারকা, পরীর মত দেখতে। জানেন, শুটিং শেষ হলে কি করে? মেকআপম্যানের কাজ যদি মনের মত হয়, দেহ দেয় তাকে। ক্যামেরাম্যান যদি যত্ন করে ছবি তোলে, নিজের ড্রেসিংরুমে ডেকে এনে তাকে দিয়ে কাপড় খোলায়। কাউকে খুশি করার জন্যে আমি যেমন পকেট থেকে খুচরো পয়সা দিই বকশিশ হিসেবে, তেমনি ও দেয় নিজের শরীরটাকে। বেশ্যা।

ছোট্ট করে জানতে চাইলেন ডন, তোমার স্ত্রী আর মেয়েরা কেমন আছে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জনি। আদালত যা দিতে বলেছে তার চেয়ে বেশিই দিচ্ছি। প্রত্যেক হপ্তায় দেখা করতে যাই। ওদের কথা মনে পড়লে শান্তি পাই না। মাঝে মাঝে ভাবি, বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। আবার একবার গ্লাসে মদ ভরে নিল সে। আমার দ্বিতীয়পক্ষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে আজকাল। আমি নাকি সেকেলে, আমি নাকি আনাড়ি, আমার গান নিয়ে ব্যঙ্গ করে। কষে মারধোর করে এসেছি। ছবি করছে, তাই মুখে মারলাম না। সিগারেট ধরাল সে। এত কথা বলে আপনাকে আসলে বোঝাতে চাইছি, ধর্ম-বাপ, বেঁচে থাকার যে সুখ তা এখন আর আমার নেই। আমি অসুখী।

ডনের কণ্ঠে সরলতা প্রকাশ পেল, এসব ব্যাপারে তোমাকে যে সাহায্য করব তার কোন উপায়ই নেই। থামলেন তিনি, তারপর জানতে চাইলেন, গলায় কি হয়েছে?

সবটুকু আত্মবিশ্বাস, মাধুর্য নিমেষে চেহারা থেকে উবে গেল জনির। কণ্ঠস্বরে একটা হাহাকার ফুটে উঠল তার, গড ফাদার, গড ফাদার, আমার গলায় কিছু হয়েছে, ডাক্তাররা ধরতে পারছে না! গড ফাদার, আমি আর গাইতে পারি না।

জনিকে এভাবে হঠাৎ ভেঙে পড়তে দেখে ডনের সাথে সাথে হেগেনও চমকে উঠল।

দুটো ছবি করে অনেক টাকা কামিয়েছিলাম, বলে চলেছে জনি। বিরাট স্টার বনে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন ওরা আমাকে তাড়াতে চাইছে। স্টুডিওর মালিক ব্যাটা প্রথম থেকেই আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না, সুযোগ বুঝে বদলা নিচ্ছে।

ধর্ম-পুত্রের সামনে দাঁড়ালেন ডন কর্লিয়নি। তার ভারি কণ্ঠস্বর গম গম করে উঠল, কেন সে তোমাকে দুচোখে দেখতে পারে না?

ওই যে, প্রগতি সংস্থার হয়ে গান করতাম, যা আপনিও ভাল চোখে দেখতেন না, সেটাই আমার ওপর তার যত আক্রোশের কারণ, বুঝলেন? আপনার মত জ্যাক ওলট-ও এসব পছন্দ করে না। তার ধারণা, আমি নাকি কমিউনিস্ট, কিন্তু প্রমাণ করতে পারেনি কিছুই। আরও কারণ আছে। নিজের জন্যে ব্যাটা এক মেয়ে শিকার করেছিল, শিকারীর মুখ থেকে সেটাকে ছিনিয়ে নিলাম আমি। না-না, তেমন সিরিয়াস কিছু না, মাত্র এক রাতের ব্যাপার-তাও, আমি নই, মেয়েটাই ধাওয়া করছিল আমাকে। কি করতে পারি আমি? তারপর বেশ্যা দ্বিতীয় বউটা আঁটা মেরে খেদিয়ে দিন আমাকে। আমি এখন কি করি? গড ফাদার, এখন আমার কি গতি হবে? মেয়েরা জায়গা দেবে না আমাকে, এক যদি না হামাগুড়ি দিয়ে, নাকে খত্ দিয়ে ওদের কাছে গিয়ে মাফ চাই। এদিকে, গাইতেও পারছি না আর। গড ফাদার, আপনার কাছে এসেছি, বলে দিন এখন আমি কি করব।

জমাট বরফ হয়ে গেছে ডন কর্লিয়নির মুখ। সেখানে সহানুভূতির লেশমাত্র নেই। তার কণ্ঠস্বরে প্রকট হয়ে উঠল তাচ্ছিল্য, মেয়েমানুষ, তুমি একটা মেয়েমানুষ! রাগে বিকৃত হয়ে উঠল তার চেহারা। প্রথমে পুরুষমানুষের মত আচরণ করতে পারো! জনিকে একেবারেই কিছু বুঝতে না দিয়ে ডেস্কের উপর ঝুঁকে পড়ে খপ করে তার চুল ধরে ফেললেন মুঠো করে। ফর গডস সেক, এও কি বিশ্বাস করতে হবে আমাকে যে এতকাল আমার কাছে কাটিয়েও এর বেশি কিছু হতে পারোনি তুমি? চিত্র-জগতের একটা নষ্টা মেয়ে তুমি, হাপুস নয়নে কাঁদছ আর দয়া ভিক্ষা করছ-এখন আমি কি করব! এখন আমি কি করব!

জনির স্বর ভঙ্গিটা হুবহু, নিখুঁত নকল করলেন ডন, এবং তা এমনই অপ্রত্যাশিতভাবে যে চমকে উঠে হেসে ফেলল হেগেন আর জনি। খুশি হলেন তিনি। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল কত গভীরভাবে ভালবাসেন ধর্ম-পুত্রকে। এভাবে যাচ্ছে তাই বলে শাসন করলে কি প্রতিক্রিয়া হত তাঁর নিজের সন্তানদের? মুখ হাঁড়ি করে থাকত সান্তিনো, দিনের পর দিন কথা বলত না ভাল করে। কেঁচো বনে যেত ফ্রিডো। বরফের মত ঠাণ্ডা এক চিলতে হেসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত মাইকেল, কয়েক মাস তার আর কোন সন্ধানই পাওয়া যেত না। অখুচ জনি! বাহ, কেমন লক্ষ্মী ছেলে, হাসতে পারছে এরই মধ্যে! তা হাসবে না, ধর্মবাপের মতলবটা যে ঠিক ধরে ফেলেছে।

মালিকের মেয়েমানুষ ভাগিয়ে আনলে, তার ক্ষমতা তোমার চেয়ে বেশি জেনেও, তারপর আবার অভিযোগ করছ কেন সে তোমাকে সাহায্য করছে না। সংসার, স্ত্রী, মেয়েদেরকে শ্রাগ করলে কেন? না, একটা বেশ্যাকে বিয়ে করার জন্যে। তারপর এই ভেবে কাঁদছ কেন ওরা তোমাকে দুবাই বাড়িয়ে আদর করে ডেকে নিচ্ছে না! বেশ্যাটা ছবি করছে কিনা, তাই তার মুখে মারোনি-অথচ ব্যঙ্গ করেছে বলে বিস্ময় প্রকাশ করছ। তুমি কি থেকে কি হয়েছ, জানো? এই নির্বোধ, জানোতা? নির্বোধের জায়গা নরকেও নেই, বুঝলে?

ঝাল মিটিয়ে নিয়েছেন ডন কর্লিয়নি। এবার তিনি শান্ত হলেন। একেবারে ভিন্ন সুরে, কোমল সহায়তার সাথে জানতে চাইলেন, এবার থেকে আমার কথা মত চলবে তো?

কাঁধ ঝাঁকাল জনি। জিনিকে আবার বিয়ে করব তা সম্ভব নয়। ওর মনের মত স্বামী কোনদিনই হতে পারব না আমি। জুয়া, মদ, আচ্ছা–এইসব নিয়ে চলছিল আমার, তরতাজা মেয়েমানুষরা আমার পিছু নিত, লোভ আমি কক্ষনো সামলাতে পারিনি। এই সব করে ফিরে যেতাম জিনির কাছে, তখন মনের গ্লানিতে মরে যেতে ইচ্ছে করত আমার। না, গড ফাদার, সেই অবস্থায় আবার আমি ফিরে যেতে পারব না।

ডন কর্লিয়নি কালেভদ্রে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেন, এমন কি হেগেনও আজ অনেকদিন পর তাঁকে অসহিষ্ণু হতে দেখল। আবার জিনিকে বিয়ে করো একথা তোমাকে বলেছি আমি? যা মন চাইছে করতে তাই করো। বাপ হয়ে সন্তানদের ভাল করতে চাইছ, খুব ভাল কথা। সন্তানদের যত্ন নেয় না যে সে তো পূরুষ মানুষই নয়। তবে, তা করতে চাইলে ওদের মায়ের কাছেও কিন্তু তোমাকে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। রোজ ওদের কাছে যেতে পারবে না, কে বলেছে তোমাকে? কে নিষেধ। করেছে ওদের সাথে এক বাড়িতে বাস করতে পারবে না? কে আপত্তি করেছে যেভাবে তুমি চাও সেভাবে জীবন কাটাতে পারবে না?

হাসল জনি ফন্টেন। গড ফাদার, সেকেলে ইতালীয় স্ত্রীদের মত নয় জিনি। ও সব সহ্য করবে না সে।

ডন কর্লিয়নি এবার বিদ্রূপ করে বললেন, তার কারণ তোমার নাটুকে আচরণ। আদালত যা দিতে বলল, তার চেয়ে বেশি দিলে তুমি, ওইখানেই প্রকাশ পেল তোমার বিচ্ছিরী নাটুকেপনা। দ্বিতীয় স্ত্রীকে মারতে পারোমি, কি করেই বা মারতে পারো, ছবি করছে যে! ভেড়া! তাও আবার মেয়েমানুষের! আরে, এখনও শিখলে না, ওরা গুড ফর নাথিং! দুনিয়ার কাজ চালাবে সে ক্ষমতা ওদের একেবারেই নেই। তবে হ্যাঁ, স্বর্গে গিয়ে নির্ঘাৎ ওরাই সেন্ট বনে যাবে, আমরা যত পুরুষ মানুষ নরকে

হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে যেতে গম্ভীর হলেন ডন কর্লিয়নি। ধর্মপুত্র, তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব হয়, তুমি অত্যন্ত সৎ ছেলে আমার, আমার ওপর শ্রদ্ধার অভাব কখনোই তোমার মধ্যে দেখিনি। কিন্তু তোমার বন্ধুদের জন্যে কি করেছ? সেই, ইতালীয় ছেলেটার কথাই ধরা, হাসির ছবি করত, যেই তাকে দুর্ভাগ্য একটু টেনে নামাল অমনি তুমি চুপটি করে কেটে পড়লে তার পাশ থেকে। কারণ তখন প্রচুর নামডাক তোমার। আরও পুরানো বন্ধুর কথা ধরো, স্কুলে পড়েছ যার সাথে, গলায় গলায় দোস্তি ছিল যার সাথে? নিনো? জানো, হতাশ হয়ে মদ ধরেছে. ছেলেটা? তোমার বিরুদ্ধে তবু একটা কথা বলে না। জানো, কি কাজ করে সে? আমাদের কাকরের ট্রাক চালাচ্ছে-গাধার মত খাটে। শনি-রবিবারে কিছু উপরি আয় করে গান গেয়ে। নিনোই না তোমার গানের পার্টনার ছিল? ভুলে গেছ? পারো না ওকে একটু সাহায্য করতে? কেন পারো না? গান তো ভালই গায়, অস্বীকার করতে পারবে?

ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে জনিকে। তবু ধৈর্যের সাথে বলল, গড ফাদার, আসল কথা হলো যথেষ্ট প্রতিভা নেই যে ওর। ভাল, অস্বীকার করি না, কিন্তু তেমন সাফল্য ও কোনদিনই অর্জন করতে পারবে না।

পাতা দুটো নেমে এসে চোখ প্রায় বুজে এলো ডন কর্লিয়নির। বলেন, আর এখন তোমার, ধর্ম-পুত্র? যথেষ্ট প্রতিভা তোমারও তো নেই। তাহলে নিনোর সঙ্গেই কাকরের ট্রাকে তোমাকেও একটা কাজ যোগাড় করে দিই, কি বলো?

জনি কথা বলছে না দেখে ডন বলে চললেন, ধর্মপুত্র, বন্ধুত্বই সব। প্রতিভাও বন্ধুত্বের কাছে কিছু না। সরকারের চেয়েও বড় বন্ধুত্ব। প্রায় পরিবারের সমান, এই বন্ধুত্ব। আমার এই কথাটা কখনও ভুলো না। বন্ধুত্বের একটা প্রাচীর যদি গড়ে তুলতে পারতে, আজ তাহলে তোমাকে আমার কাছে সাহায্যের জন্যে হাত পাততে হত না। এবার বলো দিকি, গাইতে না পারার কারণ কি? বাগানে বেশ গাইলে, শুনলাম তো। প্রায় নিনোর মতই ভাল।

ডনের এই সূক্ষ্ম খোঁচা উপভোগ করে জনি এবং হেগেন দুজনেই হাসল।

গলার জোর হারিয়ে ফেলেছি, বলল জনি। দুএকটা গান করার পর বুজে আসে গলা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাইতে পারি না আর। মাঝে মধ্যে এমনও হয় দিনের পর দিন গাইতে পারি না। রিহার্সল থাকে, কয়েক বার করে রেকর্ড করতে হয়, কিন্তু পারি না। সাংঘাতিক কোন রোগ হয়েছে আমার গলায়।

মেয়েমানুষ নিয়ে সমস্যা। গলায় লোগ। হুঁ। এবার বলো, হলিউডের সেই কর্তা, তার সাথে ঝগড়াটা কিসের? হেগেন বুঝল, এতক্ষণে হাতে কলমে কাজে নামছেন ডন।

আপনার যে-কোন কাপ্তানের চেয়ে তার ক্ষমতা অনেক বেশি, বলল জনি। সে-ই স্টুডিওটার মালিক। সিনেমার মাধ্যমে যুদ্ধের যত প্রপাগাণ্ডা হয়েছে, তার মূলে ছিল এই লোক। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ছিল সে-ই। মাসখানেক আগে চলতি বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের চিত্রত্ব খরিদ করেছে সে। বইটা বেস্ট সেলার। বইয়ের নায়ক হুবহু আমার চরিত্র, অবিকল আমার মত। অভিনয় করার দরকারই পড়বে না আমার, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করলেই খাপে খাপে মিলে যাবে। একটা গান পর্যন্ত গাইতে হবে না। সবাই স্বীকার করছে চরিত্রটা শুধু আমাকেই মানাবে, আবার সুনাম হবে আমার। এবার অভিনয় করে। কিন্তু ওই শালা হারামজাদা জ্যাক ওলটস কিছুতেই চরিত্রটাতে অভিনয় করতে নেবে না আমাকে। পণ করে বসে আছে সে, নেবেই না। ঘোষণা করে দিয়েছে, স্টুডিওর কমিনারিতে গিয়ে সবার সামনে যদি ওর পাছায় চুমু খাই, ব্যাপারটা ভেবে দেখতে রাজি হবে।

হাত নেড়ে ডন কর্লিয়নি এমন একটা ইঙ্গিত করলেন যার অর্থ দাঁড়ায়, আরে থামো, অমন কত দেখা আছেধর্মপুত্রের কাঁধ চাপড়ে আশ্বাস দিলেন তিনি। তুমি দেখছি একেবারেই ভেঙে পড়েছ। ভেবেছ কারও কোনরকম সাহায্য করার নেই তোমাকে? রোগাও হয়ে গেছ দেখছি। মদ খাচ্ছ বুঝি খুব? ঘুমের জন্যে বোধহয় ট্যাবলেট খাও? এসবে যে তার সমর্থন নেই মাথা নেড়ে তা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন তিনি।

বললেন, এখন থেকে তুমি আমার হুকুম মেনে চলল, এই আমি চাই। এক মাস থাকো আমার কাছে। খাও দাও ঘুমাও। তোমার সঙ্গ আমার ভালই লাগবে। আর তোমার ধর্ম-বাপের কাছ থেকে তুমিও হয়তো দুনিয়াদারি সম্পর্কে এমন কিছু শিখতে পারো যেটা তোমাদের ওই বোকার স্বর্গ হলিউডেও কাজে লেগে যেতে পারে। কিন্তু গান গাইতে পারবে না, মদ খেতে পারবে না, মেয়েমানুষের ছায়া পর্যন্ত। মাড়াতে পারবে না। আজ থেকে ঠিক এক মাস পর হলিউডে ফিরে যাবে তুমি, গিয়ে দেখবে তোমার সেই .৯০ ক্যালিবারের কাপ্তান সাহেব তার ছবিতে তোমাকে নেবার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। রাজি?

ডন কর্লিয়নির এত ক্ষমতা আছে, ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না জনি ফন্টেনের। কিন্তু যে কাজ তার দ্বারা হবে না,সে কাজ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি কখনও কাউকে দেন না, গড ফাদার সম্পর্কে এই কথাটাও জানা আছে তার। ব্যাটাচ্ছেলে কিন্তু যা তা লোক নয়। জে এডগার হভারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সামনে দাঁড়িয়ে সাহস করে কথাই বলা যায় না।

মুচকি একটু হাসলেন ডন কর্লিয়নি। ধর্মপুত্রের সংশয় টের পেয়েছেন তিনি। বললেন, সেতো একজন ব্যবসায়ী। তার লাভ হবে এমন প্রস্তাবই তাকে দেব।

এখন আর সময় নেই, বলল জনি। সবাইকে দিয়ে কন্ট্রাক্ট সই করানো হয়ে গেছে। আগামী হপ্তায় শুটিং। তোমার কিছুই করার নেই এ ব্যাপারে, গড ফাদার।

সব দায়িত্ব আমি নিলাম, এরপর আবার কথা কিসের? জনিকে ঠেলে বের করে দিলেন তিনি ঘর থেকে তোমার জন্যে ওরা সবাই অপেক্ষা করছে, যাও, হৈ হন্না করোগে।

ডেস্কের পিছনে বসে সব নোট করে নিয়েছে হেগেন। আর কিছু আছে নাকি? তাকে প্রশ্ন করলেন ডন।

ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকিয়ে হেগেন বলল, ভার্সিল সোযোকে তো আর এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এই হপ্তার ভেতরই আপনার সাথে দেখা করতে চাইছে সে।

শ্রাগ করলেন ডন। বিয়েটা চুকে গেল, এখন যেদিন বলো তুমি।

উত্তরটা শুনে দুটো জিনিস বুঝল হেগেন। এক, এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,-ভার্সিল সলোযোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হবে। দুই, বিয়ের আগে আলোচনায় না বসার অর্থ ডন কর্লিয়নি ভাবছেন এর ফলে কিছু গোলমাল হতে পারে।

সাবধানের মার নেই, এই কথা ভেবে সে বলল, ক্লেমেঞ্জা কে এ-বাড়িতে কিছু লোক এনে রাখতে বলব?

কেন? ডনকে অসহিষ্ণু দেখাল। বিয়ের মত একটা বিশেষ দিনে দূরের আকাশেও এতটুকু মেঘ দেখা যাক তা আমি চাইনি, তাই কথা বলিনি ওর সাথে। তাছাড়া কি বিষয়ে কথা বলতে চায় ও, সেটাও জানা বাকি ছিল আমার। এখন জানি বড় জঘন্য একটা প্রস্তাব করবে।

সত্যি তাহলে ওকে প্রত্যাখ্যান করবেন?

উপর-নিচে মাথা দোলালেন ডন।

পরিবারের সবাই একসাথে বসে ভাল করে আলোচনা করে তারপর উত্তর দিলে হত।

সেই রকম ইচ্ছা বুঝি তোমার? মৃদু হাসলেন ডন কর্লিয়নি। বেশ, কাল তুমি ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফিরে এলে আলোচনাই করা যাবে। প্লেনে করে গিয়ে আগে মিটিয়ে দিয়ে এসো জনির ব্যাপারটা। চিত্র জগতের ফেরেশতাটিকে রাজি করাও। আর কিছু?

ফোন এসেছিল হাসপাতাল থেকে, নীরস গলায় গভীরভাবে বলল হেগেন। কনসিলিয়রি আবানদাণ্ডের রাত কাটবে না। শেষবার দেখার জন্যে ওর বাড়ির লোকদের যেতে বলা হয়েছে।

ডন কর্লিয়ন্ত্রি মন্ত্রণাদাতা অর্থাৎ কনসিলিয়রি গেনকো আবানদাণ্ডোর ক্যান্সার হয়েছে, তাই গত এক বছর থেকে এই পদে টম হেগেনকেই অস্থায়ীভাবে বহাল করা হয়েছে। হেগেন অপেক্ষা করছে ডন কবে তাকে বলবেন পদটা তোমার স্থায়ী হলো। ডনের এ কথা না বলারই সম্ভাবনা বেশি। যাদের মা-বাপ দুজনেই ইতালীয় কেবল তাদেরকেই এতোবড় পদটা দেয়া হয়। তাই, এমন কি অস্থায়ীভাবে কাজ চালাবার জন্য হেগেনকে বেছে নেয়ায় কিছু প্রতিবাদও হয়েছে। তার বয়সও এক্ষেত্রে একটা বাধা। মাত্র পঁয়ত্রিশ। কনসিলিয়রির কাজ সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে সাফল্য অর্জন করার জন্যে যে অভিজ্ঞতা আর চার্য প্রয়োজন এত অল্প বয়সে কারও মধ্যে তা থাকে না, এই রকম ধারণা সবার।

হেগেনকে ডন কর্লিয়নি কিন্তু কোন উৎসাহই দিলেন না। প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইলেন। আমার মেয়ে-জামাইয়ের রওনা হবার সময় ঠিক হয়েছে?

রিস্টওয়াচ দেখল হেগেন। এই তো কেক কাটরে, তারপর আর আধঘন্টা। এই কথার সূত্র ধরে তার আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল। জামাই বাবাজীকে কি পারিবারিক ব্যবসায় বড় কোন পদ দেয়া…।

কক্ষনো না। ডনের অস্বাভাবিক দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল হেগেন। টেবিলে চাপড় মেরে ডন আবার বললেন, প্রশ্নই ওঠে না। খাওয়া পরা চলে, হ্যাঁ, সে-ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কখনও যেন আমাদের পারিবারিক ব্যবসার কথা না, জানে। সনি, ফ্রিডো, ক্লেমেঞ্জা-সবাইকে বলে দিয়ে কথাটা।

একটু হাসলেন ডন, তারপর বললেন, ছেলেগুলোকে বলো; তিনজনকেই, আমার সাথে হাসপাতালে যেতে হবে ওদেরকে। আমি চাই গেনকো বেচারিকে ওরা শেষ শ্রদ্ধা জানাবে। বড় গাড়িটা চালাতে বলবে ফ্রিডোকে, আর. জনি যাবে কিনা জেনে নাও। বলবে, ও গেলে আমি খুশি হব।

চোখে প্রশ্ন নিয়ে ডনের দিকে তাকিয়ে আছে টম হেগেন।

আজ রাতেই ক্যালিফোর্নিয়ায় যাচ্ছ তুমি, তাহলে আর গেনকোর সাথে কখন দেখা করবে? কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে কিছু কথা যদি বলতে চাই, এখানে যেন পাই তোমাকে।

আচ্ছা। ফ্রেড গাড়ি নিয়ে কখন আসবে?

মেহমানরা আগে বিদায় হোক। চিন্তা কোরো না, আমার জন্যে অপেক্ষা করবে গেনকো, হেগেন ডন কর্লিয়নির কথাটার অর্থ করল, তিনি বলতে চাইছেন, গেনকে! আবানদাণ্ডো তার সাথে দেখা না করে মরবে না।

সিনেটর নিজে আসতে পারেননি বলে ফোন করে ক্ষমা চেয়েছেন, বলল হেগেন। বললেন, কথাটা আপনি বুঝবেন। এফ. বি. আই-এর লোক দুজনের কথা ইঙ্গিত করলেন বলে মনে হলো। লোক মারফত প্রেজেন্টেশন পাঠাতে অবশ্য ভুল করেননি।

উপহারটা কেমন, ভাল? সিনেটরকে তিনি বারণ করেছিলেন আসতে, একথা আর বললেন না ডন।

খাঁটি ইতালীয় ভঙ্গিতে সমর্থন সূচক মুখভঙ্গি করল হেগেন, তবে তার আধা আইরিশ আধা-জার্মান চেহারায় সেটা তেমন মানাল না,। রূপোর প্রাচীন জিনিস, মেলা দাম দিয়ে কিনেছেন সিনেটর। হাজার ডলারের কম নয়। প্রচুর সময় খরচ হয়েছে সিনেটরের উপযুক্ত জিনিসটা খুঁজে বের করতে।

খুশি হলেন ডন কর্লিয়নি। লুকা ব্রাসির মত তার ক্ষমতার প্রাসাদের আরেক শুভ এই সিনেটর ভদ্রলোক। এই উপহার পাঠিয়ে তিনিও ডন কর্লিয়নির বশ্যতা স্বীকার করলেন নতুন করে।

.

সাংঘাতিক আশ্চর্য হয়ে গেল কে অ্যাডমস। এ তোমার অন্যায়, মাইক! জনি ফন্টেনকে তোমরা চেনো একথা আগে বলোনি কেন? এখন আর কোন দ্বিধা নেই, বিয়ে আমি তোমাকেই করব।

ওর সাথে কথা বলবে?

এখন? না। জানো, ক্যাপিটালে যখনই গাহত ও, নিউইয়র্কে এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলতাম আমি। কি যে ভাল লাগে ওকে, তিন বছর ওকে ছাড়া আর কোন পুরুষকে তো ভাবতেই পারতাম না।

গান শেষ হলো জনির।ডন কর্লিয়নির সাথে তাকে বাড়ির ভিতর যেতে দেখল কে অ্যাডামস। মাইকেলের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সে বলল, কি ব্যাপার? তোমার বাবার সাথে গেল যে জনি ফন্টেন? ওকেও তোমার বাবার অনুগ্রহ চাইতে হয়, নিশ্চয়ই একথা বলবে না তুমি? কে ভাবছে, খুব ব্যঙ্গ করতে পেরেছে মাইকেলকে।

 জনি বাবার ধর্মপুত্র, বলল মাইকেল। ওর এত বড় ফিল্ম স্টার হবার পেছনে বাবারই বেশি দান রয়েছে।

সত্যি? আনন্দে হেসে উঠল কে। তোমার একথার মধ্যেও কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি আমি।

এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে মাইকেল। তোমার না শোনাই ভাল।

আমাকে বিশ্বাস করো না?

অগত্যা বলল মাইকেল। গল্পটা হাস্যকর শোনাল না। গর্বের সাথেও বলল না। মাইকেল। ব্যাখ্যা দেবার ঝামেলায় না গিয়ে জানাল, বছর সাত-আট আগে এখনকার তুলনায় আরও খেয়াল খুশি মাফিক চলতেন ওর বাবা, এবং ঘটনার সাথে তার ধর্মপুত্র জড়িত থাকায় নিজের আত্মসম্মানের ব্যাপার বলে ধরে নিয়েছিলেন সেটাকে। সংক্ষেপে বলে গেল মাইকেল:

সাত আট বছর আগের কথা। জনি ফন্টেন গায়ক হিসেবে নাম করে জনপ্রিয় ড্যান্স ব্যাণ্ডের সাথে গান গায়। কিছু দিনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হয়ে ওঠে সে রেডিওর। কিন্তু ব্যাপার্টির কর্তা লেস হ্যাঁলি পাঁচ বছরের একটা চুক্তি সই করিয়ে নিয়েছিল জনিকে দিয়ে। এই চুক্তি অনুযায়ী এখানে, সেখানে জনিকে গাধার খাটুনি খাঁটিয়ে মুনাফার বিস্তর টাকা নিজের পকেটে ভরার অধিকার ছিল লেস হ্যাঁলির। এই নিয়েই লাগল গণ্ডগোল। একটা আপোস রফার চেষ্টা করলেন ডন কর্লিয়নি। চুক্তিটা যদি লেস হ্যাঁলি বাতিল করে, তাকে তিনি এককালীন বিশ হাজার ডলার দেবেন। কিন্তু রাজি হলো না, লেস হ্যাঁলি। সে দাবি করছিল জনির মোট আয়ের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। হেসেছিলেন ডন। প্রস্তাবটা বদলালেন। নতুন প্রস্তাবে বললেন, বিশ নয়, দশ হাজার ডলার দেবেন তিনি লেস হ্যাঁলিকে। সে লোকটা দুনিয়ার কোন খবর রাখত না। সুতরাং টাকার অঙ্ক কমে যাবার কি অর্থ তা তার মাথায় ঢুকলই না। বলাই বাহুল্য, এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল সে।

ডন কর্লিয়নি নিজে দেখা করলেন লোকটার সাথে। সাথে গেল তার সবচাইতে অন্তরঙ্গ দুজন বন্ধু। একজন তার মন্ত্রণাদাতা, গেনকো আবানদাণ্ডো, অপরজন লুকা ব্রাসি। সেখানে আর কেউ ছিল না। ডন কর্লিয়নি একটা দলিলে সই নিলেন লেস হ্যাঁলির। দশ হাজার ডলার পেল সে, আগের চুক্তিটা বাতিল হয়ে গেল।

কিভাবে! এই তো বললে লেস হ্যাঁলি রাজি হয়নি?

বাবা তার কপালে পিস্তল ধরে বলেছিলেন, এক মিনিটের মধ্যে হয় সই করো, না হয় দলিলে তোমার মাথার ঘিলু পড়বে!

ঘাবড়ে গেছে কে। ভুরু কুঁচকে চিন্তিতভাবে বলল, তোমার বাবা দেখছি আধুনিক রবিন হুড। ভোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে অন্যের জন্যে কিছু না কিছু সবসময় তিনি করছেন। ঠোঁট বাঁকা করে ব্যঙ্গের হাসি হাসল সে। ওঁর পদ্ধতিগুলো আইনসম্মত নয়, এই যা।

যাই শোনাক না কেন, একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল মাইকেল, আসল ব্যাপারটা হলো: মেরু অভিযাত্রীদের কথা তো শুনেছ তুমি? যারা যাবার পথে এখানে ওখানে লুকিয়ে রেখে যায় খাবার, বিপদের পুঁজি, ফেরার পথে যদি দরকার হয়, মনে করে? বাবার উপকার আর অনুগ্রহগুলো ঠিক সেই খাবারের পুঁজির মত, প্রয়োজনের সময় সবার বাড়িতে গিয়ে ফেরত চাইবেন, তখন না দিলেই বিপদ।

মেহমানদের বিদায় নিতে নিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাস্তায় এখন একটাই মাত্র গাড়ি দেখা যাচ্ছে। কালো লম্বা ক্যাডিলাক। ড্রাইভিং সীটে বসে আছে ফ্রিডো। তার পাশে বসলেন ডন কর্লিয়নি। পিছনের সীটে সনি, মাইকেল আর জনি ফন্টেন।

তোমার বান্ধবীর কথা বলছি, ডন কর্লিয়নি তার কনিষ্ঠ পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, একা শহরে ফিরতে পারবে সে?

টম ব্যবস্থা করবে বলেছে।

মনে মনে মন্ত্রণাদাতার যোগ্যতায় খুশি হলেন ডন। সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা নাড়লেন তিনি।

পেট্রলের রেশন থাকায় ম্যানহাটনের দিকে যাবার সময় বেল্ট পার্কওয়েতে যানবাহন একেবারে নেই বললেই চলে। ফ্রেঞ্চ হাসপাতালে পৌঁছতে পুরো এক ঘন্টাও লাগল না। পথে দুএকটা কথা হলো। ডন কর্লিয়নি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকেই দ্বিতীয় প্রশ্নটি করলেন, পড়াশোনা ঠিকমত চলছে তো?

মাথা ঝাঁকাল শুধু মাইকেল।

সনি বলল, জনির ব্যাপারটা তুমি মিটিয়ে দিচ্ছ শুনলাম? চাও আমি গিয়ে সাহায্য করি?

সামান্য ব্যাপার, সংক্ষেপে বললেন ডন।

ঠিক উল্টো ধারণা জনির, হাসল সনি। সেজন্যেই মনে করলাম তুমি হয়তো আমাকে পাঠাবে।

মাথা ঘুরিয়ে পিছনে বসা জনির দিকে তাকালেন ডন। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না কেন তুমি? করব বলেছি অথচ করিনি এমন কোন উদাহরণ দেখাতে পারো? শুনেছ কোনদিনকেই আমাকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে?

কেঁচো হয়ে গেল জনি ফন্টেন। ভয়ে ভয়ে বলল, গড ফাদার, ও ব্যাটা একটা ৯০ ক্যালিবারের শয়তান। কিছুতেই ওর কথার নড়চড় হয় না। সবচেয়ে ভয় পাচ্ছি; লোকটা ঘৃণা করে আমাকে। আমার মাথায় ঢুকছে না কি করে আপনি এর ফয়সালা করবেন…

সস্নেহে কৌতুক করলেন ডন। বললেন, কথা যখন দিয়েছি, ফয়সালা তো যেভাবে হোক করে দিতেই হবে। দেখি! কনিষ্ঠ পুত্র মাইকেলের পাজরে খোঁচা মারলেন তিনি। আর যাই হোক, তুমি আমার ধর্মপুত্র, তোমাকে তো আ, দুর্দশায় ফেলতে পারি না, কি বলো, মাইকেল?

জীবনে কখনও এক সেকেণ্ডের জন্যেও বাবাকে অবিশ্বাস করেনি মাইকেল। সায় দেবার ভঙ্গিতে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল সে।

হাসপাতালের ফটক দিয়ে ঢোকার সময় মাইকেলের কনুইয়ের উপরটা ধরলেন ডন কর্লিয়নি। কাজেই ওদেরকে ওখানে রেখে এগিয়ে গেল বাকি সবাই। লেখাপড়ার পাট চুকলে, ছোট ছেলেকে বললেন তিনি, আমার কাছে এসো একবার কথা আছে। তোমার ভাল লাগবে এমন কিছু পরিকল্পনা করেছি আমি।

মাইকেল চুপ করে থাকল। তাই দেখে বেজার হয়ে ভারি গলায় ডন বললেন, তোমাকে আমি চিনি। এমন কিছু করতে বলব না যা তোমার পছন্দ হবে না। জেনে রেখো, সাধারণ কোন ব্যাপার নয়-বড় তত হয়েছ, যা ভাল বোঝো করো। কিন্তু বইগুলো গেলা শেষ করে, আর সব ছেলে যেমন করে, আমার কাছে তুমিও একবার এসো।

চওড়া বারান্দার সাদা টালি বসানো মেঝেতে এক ঝাক মোটাতাজা কালো কাক বসে আছে, যেন। ওরা সবাই গেনকো আবানদাণ্ডের পরিবারের লোকজন। গেনকোর তিন মেয়ে আর তার স্ত্রী, শোকের প্রতীক কালো পোশাক পরে এসেছে সবাই।

এলিভেটর থেকে নামলেন ডন কর্লিয়নি। তাকে দেখেই ডানা ঝাপটে সবাই ছুটে এল পরম আশ্রয়ের জন্যে। দশাসই চেহারা মায়ের, মেয়েগুলো সাধারণ, মোটাসোটা। ডনের গলা ছুঁয়ে বিলাপ জুড়ে দিল গেনকোর স্ত্রী, দেবতার চেয়ে কম কিসে তুমি, ছুটে এসেছ নিজের মেয়ের বিয়ে ফেলে।

এসব প্রশংসা গায়ে না মেখে ডন কর্লিয়নি বললেন, গেনকো আমার শরীরের একটা অংশের মত, আজ বিশ বছর ধরে। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আমি আসব না তো কে আসবে?গেনকোর স্ত্রীর কল্পনাতেও নেই যে আজ রাতে তার স্বামী মারা যাবে, একথা বুঝতে দেরি হয়নি ডন কর্লিয়নির।

ক্যান্সারের শিকার গেনকো আবানদাণ্ডো আজ প্রায় এক বছর ধরে এই হাসপাতালে শুয়ে আছে। সে যে দ্রুত মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে একথা ভাল করে বোঝেনি তার স্ত্রী। স্বামীর অসুখটাকে স্বাভাবিক জীবন যাত্রার একটা অংশ বলে ধরে নিয়েছে সে। ভেবেছে, আরেকটা সঙ্কটকাল হাজির হয়েছে আজ রাতে, তার বেশি কিছু না। একনাগাড়ে কথা বলে চলেছে সে, ভিতরে গিয়ে দেখে এসো ওকে। ডাকছিল তোমাকে। জানো, খুব ইচ্ছে ছিল বেচারির তোমার মেয়ের বিয়েতে গিয়ে আশীর্বাদ করার, কিন্তু ডাক্তার একেবারেই ছাড়তে চাইল না। ও-ই আবার বলল, দেখো, উনি আজকের দিনে আমাকে দেখতে আসবেন। সত্যি বলছি, আমি তো ভাবতেই পারিনি। বন্ধুত্বের মেয়েরা কি বোঝে, বলো? সুতরাং আমার দোষ দিতে পারো না। বন্ধুত্বের মূল্য তোমরা, পুরুষরা দিতে জানো। যাও, খুব খুশি হবে তোমাকে দেখে।

নার্স আর ডাক্তার বেরিয়ে এল বারান্দায়। ডাক্তারটি অল্প বয়েসী, গভীর। হাব, ভাব দেখে মনে হয় হুকুম চালাবার জন্যেই দয়া করে এই দুনিয়ার মাটিতে পা রেখেছে, চাল-চলনে বড়লোকি ভাবটা প্রকট। গেনকোর মেয়েদের একজন খুব সাবধানে দয়া ভিক্ষার সুরে জানতে চাইল, এখন বাবাকে দেখতে যাব, ডা. কেনেডি?

রাজ্যের বিরক্তি ফুটে উঠল ডা. কেনেডির চেহারায়। কেবিনের রুগী মরতে যাচ্ছে তা কি এরা সত্যি বুঝতে পারছে না? লোকটাকে শান্তিতে মরতে দিলেই কি ভাল করত না? ওর বাড়ির লোকজন ছাড়া একজনও কেবিনে ঢুকবেন না, বলল সে।

কিন্তু পরমুহূর্তে সে দেখল ভারিক্কী চেহারার খাটো এক লোকের দিকে সবাই ফিরে দাঁড়াল, যেন তাঁর ইচ্ছাতেই সব হবে। লোকটাকে তেমন কিছু মনে হলো না ডাক্তার কেনেডির! একেবারে আনাড়ি লোক, কিভাবে সান্ধ্য পোশাক পরতে হয় তাই জানা নেই। তার দিকে তাকিয়ে লোকটা একটা প্রশ্ন করল, উনি কি আজই মারা যাবেন, ডাক্তার সাহেব? কণ্ঠস্বরে ক্ষীণ ইতালীয় টান।

হ্যাঁ, গভীরভাবে জবাব দিল ডাক্তার।

আপনারা তাহলে কাঁধ থেকে দায়িত্ব নামান, বললেন ডন কর্লিয়নি। এখন থেকে আমরা ভার নেব। ওঁকে সান্তনা দেয়া, ওঁর চোখ বন্ধ করা-সব আমরা, করব। ওঁকে মাটিতে শোয়ার সময় আমরাই ফেলব চোখের পানি। তারপর, ওর স্ত্রী-কন্যাদের ভরণ পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সেটাও নেব আমরা।

ডন কর্লিয়নিকে এমন স্পষ্টভাবে কথা বলতে শুনে সব বুঝে ফেলল গেনকোর স্ত্রী। কাঁদতে শুরু করল সে।

কাঁধ ঝাঁকাল ডাক্তার কেনেডি। গেঁয়ো ভুতদের সাথে কথা বলতে যাওয়াই ঝকমারি! তবে লোকটার কথার মধ্যে যে যুক্তি আছে তাও স্বীকার করতে হলো তাকে। সাদা কোট উড়িয়ে লম্বা বারান্দা ধরে হন হন করে চলে গেল সে।

আবার কেবিনে ফিরে গেল নার্স। একটু পর আবার বেরিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, উনি প্রলাপ বকছেন। খুব জ্বর, খুব ব্যথা। বেশি কথা বলবেন না। ওঁর স্ত্রী ছাড়া আর কারও দুএক মিনিটের বেশি ওখানে থাকা চলবে না। চলে যাবার আগের মুহূর্তে নার্স হঠাৎ জনি ফন্টেনকে দেখে চিনতে পারল। বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে চোখ দুটো বিস্ফারিত হলো তার। জনি ফন্টেন তাকে স্বীকৃতি দিয়ে হাসছে দেখে পুলকিত হয়ে উঠল মেয়েটা। যখন খুশি এলেই আমাকে পেতে পারো, চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে এই দাওয়াত দিয়ে রাখতে ভুল করল না সে।

ভবিষ্যতে প্রয়োজন লাগতে পারে ভেবে মেয়েটার কথা মনে গেঁথে রাখল জনি, তারপর সবার শেষে কেবিনে ঢুকল।

দৌড় প্রতিযোগিতায় মৃত্যুর সাথে হেরে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে খাটে শুয়ে আছে গেনকো আবানদাণ্ডো। মাংসহীন কঙ্কাল একটা। মাথা ভর্তি কালো চুলের নাম নিশানাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাকানো নোংরা দড়ির মত হয়ে গেছে সেগুলো।

গলার স্বরে খুশির ভাব এনে ডন কর্লিয়নি বললেন, এই দেখো, গেনকো ভাই, আমার সাথে কারা এসেছে। ওরা তোমাকে ওদের শ্রদ্ধা জানাতে চায়। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আর একজন কে এসেছে দেখো। জনিরও ইচ্ছা তোমাকে সে তার শুভেচ্ছা আর শ্রদ্ধা জানাবে।

মুমূর্ষ গেনকো চোখ মেলে সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল ডন কর্লিয়নির দিকে। ছেলেরা সবাই তার পাটখড়ির মত সরু হাতটাকে ধরল। খাটের পাশে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওর স্ত্রী আর মেয়েরা। তারা সবাই গেনকোর গালে চুমো খেলো। তারপর তার অপর হাতটা ধরুল।

বিশ্বস্ত পুরানো বন্ধুর হাত ডন কর্লিয়নিও ধরলেন। খুব আন্তরিকতার সাথে তিনি বললেন, এবার তুমি সেরে উঠলেই, বুঝলে ভায়া, আর কেউ না, শুধু তুমি-আমি গিয়ে ইতালির আমাদের সেই গ্রামে একবার বেড়িয়ে আসব। বক্কিখেলার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার? মদের দোকানের সামনে বাবারা সেই যে খেলতেন? ঠিক করেছি, ছেলেমানুষের মত স্ফূর্তি অনুভব করছেন ডন কর্লিয়নি। গ্রামে গিয়ে ওই মদের দোকানের সামনে আমরা দুজন আবার,বক্কি খেলব।

মেনকো একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অতি কষ্টে সেটা তুলে ইশারা করল। সবাই বুঝল ঈশারাটা। ডনের ছেলেরা, গেনকোর স্ত্রী এবং মেয়েরা নিঃশব্দে সরে গেল। সরু হাতটা দিয়ে ডন কর্লিয়নিকে আঁকড়ে ধরে কথা বলতে চেষ্টা করছে গেনকো। খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসলেন ডন। ওদের ছেলেবেলার কথা যা মনে আসছে, বক বক করে যাচ্ছে গেনকো আবানদাণ্ডো। তার কালো নিষ্প্রভ চোখ দুটোয় চাতুর্য চিকচিক করে উল। অস্ফুটে কি বলল, শোনা গেল না, আরেকটু নিচু হলেন ডন। একটু দূরে কেবিনে আর যারা রয়েছে তারা এই করুণ দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত। মাথা নাড়ছেন ডন কর্লিয়নি। তাঁর গাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে চোখের পানি।

কাঁপা গলায় আরও জোর পেল গেনকো। সবাই শুনতে পাচ্ছে এখন তার কথা। প্রাণপণ চেষ্টা করে, হাঁপাতে হাঁপাতে বালিশ থেকে মাথাটাকে তুলে ফেলল সে। রোগা হাতের একটা কাঠির মত আঙুল ডনের দিকে খাড়া করল, বলল, গড ফাদার, তোমার দুটো পায়ে পড়ি, তুমি আমাকে মরে যেতে দিয়ো না। গড় ফাদার, হাড়ে আমার দাউ দাউ আগুন জ্বলছে, পোকায় মগজ খাচ্ছে–এর যে কি কষ্ট সব আমি টের পাচ্ছি। গড ফাদার, ও গড ফাদার, তোমার কতটুকু ক্ষমতা সে আমি জানি। তুমি পারো! গড ফাদার, তুমি আমাকে ইচ্ছে করলেই ভাল করে দিতে পারো! মনে, নেই, ছোটবেলায় কর্লিয়নিতে আমরা একসাথে খেলেছি, একসাথে বড় হয়েছি? আমাদের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, এ সম্পর্ক কোন কালে নষ্ট হবার নয়তবু তুমি আমাকে মরে যেতে দেবে? না, গড ফাদার, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। পাপ করেছি, কিন্তু তোমার সাথে যতক্ষণ আছি কাউকে ডরাই না। নরক আমার কাছে ভীষণ ভীতিকর। তুমি যেভাবে হোক আমাকে বাঁচিয়ে দাও, গড় ফাদার, আমি মরতে চাই না।

শান্ত কিন্তু গম্ভীর গলায়, স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে শুরু করলেন ডন কর্লিয়নি। অবিশ্বাসীর ভুল ভেঙে দেবার জন্যে তিনি চাইছেন তার প্রক্রিট শব্দ যেন গেনকো এবানদাণ্ডের কান হয়ে মগজে পৌঁছায়। ভাই গেনকো, সে ক্ষমতা যদি আমার থাকত, বিশ্বাস করো, সৃষ্টিকর্তার চেয়েও বেশি দয়া দেখাতাম তোমাকে। না, ভাই, নরকের কথা ভেবে তুমি নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। কথা দিচ্ছি, প্রতিদিন দুবেলা উপাসনার আয়োজন করব আমি, যাতে তোমার আত্মা, শান্তি পায়। তোমার পরিবারের সবাই তোমার আত্মার কল্যাণের জন্যে প্রার্থনা করবে। আমরা সবাই এতগুলো মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে ধরনা দেব, তারপরও তিনি তোমাকে সাজা দেবেন এ হতে পারে না।

কঙ্কালের মুখে বিশ্রী একটা ধূর্ত ভাব ফুটে উঠল। সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে তাহলে?

কঠিন সান্ত্বনাহীন শোনাল ডনের উত্তরটা, অবিশ্বাসীর মত প্রলাপ বোকো না। মেনে নাও, আত্মসমর্পণ করো।

ঝপ করে পড়ে গেল বালিশের উপর মাথাটা। দপ্ করে নিভে গেল চোখ থেকে উন্মত্ত আশার আলোটা। কেবিনে ব্যস্তভাবে ঢুকল নার্স, সবাইকে জোরজার করে কেবিন থেকে বের করে দিচ্ছে সে? ডনও উঠে দাঁড়ালেন।

তার দিকে হাত বাড়িয়ে অসহায় গেনকো আবানদাণ্ডো করুণ আবেদনের সুরে বলল, গড ফাদার, আমাকে ফেলে চলে যেয়ো না। কাছে থেকে তুমি আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে অন্তত সাহায্য করো। তোমাকে দেখে হয়তো ভয় পেয়ে যাবে সে, আমার শান্তি ভঙ্গ করতে সাহস পাবে না। বুঝিয়ে শুনিয়ে ভয় দেখিয়ে যেভাবে হোক একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারো হয়তো, কি বলো? বিবর্ণ ঠোটু বাকা করে কথা বলছে গেনকো আবানদাণ্ডো, উনকে এখন যেন সে বিদ্রূপ করছে। হাজার হোক তোমাদের রক্তের সম্পর্ক, সেটা তো আর তুমি অৰীকার করতে পারো না? ডন রাগ করবেন ভেবে এবার ভয় হলো তার, তাড়াতাড়ি তার হাতটা ধরে ফেলল। আমি তোমার হাতটা ধরে আছি, তুমি আমার কাছে থাকো। দুজন একসাথে অমন কত লোককে আমরা নতি স্বীকার করিয়েছি, আর এ ব্যাটাকে জব্দ করতে পারব না? থাকো, গড ফাদার, ভয় লাগছে, দয়া করে আমার কাছে থাকো।

ইশারা করে সবাইকে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন ডন কর্লিয়নি। শুকিয়ে ছোট হয়ে যাওয়া গেনকো আবানদাণ্ডোর হাতটা নিজের দুই মস্ত হাতে তুলে নিলেন। মৃত্যু আসবে, তারই অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধুর পাশে। কোমল স্বরে কত রকমের আশ্বাস দিচ্ছেন বন্ধুকে ডন।

.

.

আজকের দিনটা কনি কর্লিয়নির ভাল ভাবেই কাটল। স্বামী হিসেবে বিয়ের প্রথম রাতের কর্তব্য অত্যন্ত দক্ষতা এবং বলিষ্ঠতার সাথে পালন করল কার্লো রিটসি। উপহার হিসেবে পাওয়া টাকার কথা সারাক্ষণ মনে থাকায় কর্তব্য পালনে সাংঘাতিক উৎসাহ দেখিয়েছে সে। কুড়ি হাজার ডলার, কম নয়। কনি অবশ্য যে ব্যগ্রতার সাথে। তার কুমারীত্ব বর্জন করল, টাকাগুলো হাতছাড়া করার সময় সেরকম ব্যগ্র তাকে হতে দেখা গেল না। কালো কিন্তু ভারি চালাক, সারারাত স্ত্রীকে জাগিয়ে রেখে তার এমন যত্ন নিল যে কনির চোখে কালসিটে পড়ে গেল।

ওদিকে সনি কর্লিয়নি কখন টেলিফোন করবে এই আশায় বাড়িতে বসে ছটফট করছে লুসি ম্যানচিনি। তার বিশ্বাস সনি আবার যোগাযোগ না করেই পারে না। শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে সে-ই ফোন করল অপর প্রান্তে এক মহিলার গলা শুনে সাথে সাথে রিসিভাব ক্রাডলে নামিয়ে রাখল সে। তার জানার কথা নয় যে তাকে নিয়ে সনি আধঘণ্টার জন্যে আড়ালে গিয়ে কি করেছে তা নিয়ে কানাকানি হয়েছে বিয়ে বাড়ির চারদিকে, সবাই বলাবলি করেছে:আরেকটা শিকার বালিয়েছে সান কর্লিয়নি।

ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছে আমেরিগো বনাসেরা। দেখেছে ডন কর্লিয়নিকে। কার্নিস ভোলা টুপি, ওভার অল আর দস্তানা পরে আছেন তিনি। তার দোকানের সামনেই কয়েকটা লাশ নামাচ্ছেন তিনি, সব কটা বুলেটে ঝাঁঝরা। চোখ পাকিয়ে বলছেন, খবরদার, টু-শব্দটি নয়। তাড়াতাড়ি মাটিতে পুঁতে দাও লাশগুলো।

ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে গোঙাচ্ছে বনাসেরা। কেমন মানুষ গো তুমি, একপেট বিয়ে খেয়ে এসে দুঃস্বপ্ন দেখো। তার স্ত্রী ধাক্কা দিয়ে বনাসেরার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বলল।

নিউ ইয়র্ক সিটির হোটেলে কে অ্যাডামসকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে ক্লেমেঞ্জা আর পলি গাটো। প্রকাণ্ড গাড়িটা চালাচ্ছে গাটো। সম্মান দেখিয়ে সামনের বাকি.সীটটায় কে অ্যাডামসকে বসতে দিয়ে পিছনে বসেছে ক্লেমেঞ্জা। কে অ্যাডামসের দৃষ্টিতে এরা দুজনেই সাংঘাতিক রোমাঞ্চকর চরিত্র। ব্রুকলিনের কথা খইয়ের মত ফুটছে ওদের মুখে। ওকে অতিরিক্ত সমীহ দেখাচ্ছে। দুএক কথায় গল্প জমে উঠল। মাইকেলের প্রতি ওদের দ্বিধাহীন স্নেহ আর অপার শ্রদ্ধা প্রকাশ পেতে দেখে বিস্মিত হলো কে। বিস্ময়ের কারণ, মাইকেলের কাছ থেকে শুনে অনেকদিন থেকেই তার ধারণা বাপের বাড়িতে সে একজন বহিরাগতের মত। কিন্তু ক্লেমেঞ্জা ঠিক তার উল্টো কথা বলছে। ডন কর্লিয়নি নাকি মনে করেন তার ছেলেদের মধ্যে সবার সেরা মাইকেল। পারিবারিক ব্যবসার হাল নাকি তাকেই ধরতে হবে ভবিষ্যতে।

সেটা কিসের ব্যবসা? জানতে চাইল কে।

 স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে পলি গাটো, চট করে কে-র দিকে তাকাল, একবার সে।

মাইক জানায়নি? ব্যাক সীট থেকে আশ্চর্য হয়ে বলল ক্লেমেঞ্জা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ইটালিয়ান জলপাই তেলের আমদানীকারক উনি, ডন কর্লিয়নি। যুদ্ধ থেমেছে, ওদের ব্যবসা এখন-ফেঁপে উঠবে। ব্যবসাতে এখন মাইকের মত মেধাবী ছেলেরই দরকার।

হোটেলে পৌঁছে দরকার নেই বলা সত্ত্বেও জোর করে ভেস্ক পর্যন্ত এল কেমো। কে-র আপত্তির উত্তরে সে জানাল, কর্তার নির্দেশ আপনি নিরাপদে পৌঁছলেন কিনা দেখে যেতে হবে। সুতরাং দেখে যেতেই হবে।

কে-কে এলিভেটর পর্যন্ত পৌঁছে দিল ক্লেমেঞ্জা। প্রসন্ন হেসে বিদায় দিল তাকে। তারপর ফিরে এসে হাতের সবুজ কাগজের লিটা ডেস্কের উপর দিয়ে ক্লার্কের দিকে গড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইল, কার নামে রুম ভাড়া নিয়েছেন উনি?

গোল পাকানো টাকাটা তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে পকেটে চালান করে দিল ক্লার্ক। বলল, মি. এবং মিসেস মাইকেল কর্লিয়নি।

গাড়িতে ফিরে এল ক্লেমেঞ্জা। পলি গাটো বলল, বেশ ভাল মেয়ে।

মাইক ওর সাথে শোয়, হেড়ে গলায় বলল কুমো। এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। হেগেন একটা কাজ দিচ্ছে, তাড়াতাড়ি সারতে হবে সেটা। খুব সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ো আমার।

.

টম হেগেনের নানান কাজের ঝামেলা চুকতে অনেক দেরি হয়ে গেল। স্ত্রীকে চুমো খেয়ে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটল সে, তখন অনেক রাত। পেন্টাগনের একজন স্টাফ জেনারেল অফিসার তার কৃতজ্ঞতার নমুনা হিসেবে যে টপ প্রায়োরিটি ইমার্জেন্সী ছাড়পত্রটি দিয়েছিল তাকে সেটি সাথে থাকায় লস এঞ্জেলেসের বিমানে সীট পেতে মোটেও বেগ পেতে হলো না।

দিনটা ক্লান্তিকর, কিন্তু ফলপ্রসূ বটে, ভাবছে হেগেন। গেনকো আবানদাণ্ডো মারা গেছে, ভোর তিনটেয়। হাসপাতাল থেকে ফিরেই ডন কর্লিয়নি তাকে জানিয়েছেন যে আজ থেকে পরিবারের অফিশিয়াল কনসিলিয়রি সে-ই। অফিশিয়াল অর্থাৎ স্থায়ী মন্ত্রণাদাতা পদটি পাওয়ার তাৎপর্য হলো হেগেন নিঃসন্দেহে এবার অগাধ ধন সম্পদের মালিক বনে যাবে, তার ক্ষমতার পরিধিও সেই সাথে অনেক বড় হবে।

এক্ষেত্রে একটা অতি পুরাতন এবং প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করলেন ডন কর্লিয়নি। খাট একজন সিসিলীয় ছাড়া আজ পর্যন্ত কনসিলিয়রির মত এত বড় পদ আর কাউকে দেয়া হয়নি। ডন কর্লিয়নির পরিবারে টম হৈগেনও একজন হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেটাই সব নয়। প্রশ্নটা রক্ত নিয়ে। প্রচলিত বিশ্বাস হলো যন্ত্রণাদাতার মত সাংঘাতিক গুরুপূর্ণ পদের জন্যে শুধুমাত্র একজন সিসিলীয়কেই বিশ্বাস করা যেতে পারে, তার কারণ, ওমোর, অর্থাৎ মুখ বন্ধ রাখার নিয়ম শুধু তারই জানা থাকে।

বাড়ির কর্তা ডন কর্লিয়নি দ্বার উপরে আছেন, সমস্ত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ আসে তাঁর কাছ থেকেই। অনেক নিচের স্তরে একদল লোক রয়েছে তারা ডনের আদেশ বাস্তবায়িত করার জন্যে হাতে কলমে কাজ করে। এই দুই প্রান্তের মাঝখানে রয়েছে তিনটে স্তর, এই স্তরগুলোয় কর্মীরা সব সময় মিডিয়া হিসেবে থাকে। এর সুবিধের দিকটা হলো, কোন কাজের সূত্র ধরে উপরের প্রান্ত পর্যন্ত কখনোই পৌঁছানো সম্ভব নয়। সম্ভব, যদি কনসিলিয়রি বেঈমানী করে।

বনাসেরার মেয়েকে যারা মেরেছে তাদেরকে কি সাজা দেয়া হবে তার বিস্তারিত বিধান দিয়েছেন ডন, কিন্তু আদেশটি তিনি কারও সামনে দেননি। হেগেনও তৃতীয় কারও অনুপস্থিতিতে আদেশটা জানিয়েছিল ক্লেমেঞ্জাকে। ক্লেমেঞ্জ কাজটা সারতে বলল পলি গাটোকে।

পলি গাটো এবার লোক সংগ্রহ করবে। এ কাজ কেন করতে বলা হলো, গোড়ায় কে আদেশটা দিয়েছে, এসব সে বা তার লোকেরা জানবে না। কোন কাজের জন্যে ডন কর্লিয়নিকে যদি জড়াতে হয়, প্রত্যেক স্তরের কর্মীকে অর্থাৎ শিকলের প্রতিটি গিটকে, বেঈমানী করতে হবে। মাফিয়া পরিবারগুলোর দীর্ঘ ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এ-ধরনের কিছু ঘটতে পারে না। ঘটার সম্ভাবনা সব সময়ই আছে। সেই মহামারীর সঠিক ওষুধটিও সবার জানা, শিকলের মাত্র একটা গিটকে কেটে বাদ দিলেই বিপদ শেষ।

কনসিলিয়রি হলো ভনের দ্বিতীয় মগজ। সে ডনের ডান হাত হিসেবে কাজ করে, ডনকে বুদ্ধি পরামর্শ যোগান দেয়। ডনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী, অন্তরঙ্গ সুহৃদ বলতে কনসিলিয়রিকেই বোঝায়। গুরুত্বপূর্ণ যাত্রায় সে ডনের গাড়ি চালায়। জরুরী বৈঠক চলাকালে সেই খাবার, পানীয়, নতুন চুরুট হাতের কাছে এগিয়ে দেয়।

কোন বিষয়ে ডন যতটা জানেন, কনসিলিয়রি ততটা না জানলেও, তাঁর কাছাকাছি জানে। কোন শক্তির উৎস কোথায়, রহস্য কি সব সে বোঝে। ডনের ক্ষতি করার সাধ্য দুনিয়ায় যদি কারও থাকে, তো সে এই কনসিলিয়রির। অবশ্য আজ পর্যন্ত কোন কনসিলিয়রি তার ডনের সাথে বেঈমানী করেছে বলে শোনা যায়নি। বিশ্বাসঘাতকতা করার কথা কনসিলিয়রিদের মনে কখনও স্থান না পাবার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। বিশ্বাস রক্ষা করলে কনসিলিয়রি পার্থিব জগতের সমস্ত লোভনীয় উপকরণই হাতের মুঠোয় পেয়ে থাকে। অঢেল টাকা, অগাধ ক্ষমতা, দুষ্প্রাপ্য মর্যাদা-সবই সে পাবে।

ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি আছে নিরাপত্তার নিশ্চিত আয়োজন। তেমন দুর্ঘটনা যদি কখনও ঘটে, সে বেঁচে থাকতে তার স্ত্রী তথা পরিবার যে আরাম আয়েশ এবং সচ্ছলতার মধ্যে দিন কাটায়, সে মরে গেলেও তেমনি ভাবে বাকি জীবন কাটাতে পারবে। তার অনুপস্থিতিতে তাদের আশ্রয় এবং যত্নের মধ্যে কোন হেরফের হবে না। শর্ত একটাই: তাকে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস রক্ষা করে চলতে হবে।

ক্ষেত্র বিশেষে প্রকাশ্যে এবং সরাসরি ডনের প্রভাব প্রয়োগ করার জন্যে, প্রতিনিধিত্ব করতে হয় কনসিলিয়রিকে, কিন্তু তাকে কোন অবস্থাতেই ব্যাপারটার সাথে জড়ানো চলে না। সেই রকম একটা উদ্দেশ্য নিয়েই প্লেনে চড়ে আজ ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছে হেগেন। কনসিলিয়রি হিসেবে তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নির্ভর করছে হাতের এই কাজটার সাফল্যের উপর এটুকু পরিষ্কার বুঝেছে সে। ডনের পারিবারিক ব্যবসার লাভ-লোকসানের দিক থেকে বিচার করলে ছায়াছবিটিতে জনি ফন্টেন তার শখের অভিনয় করার সুযোগ পেল কি পেল মা তাতে কিছু এসে যায় না। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ব্যাপারটা নিতান্তই তুচ্ছ, কোন গুরুত্ব বহন করে না। গুরুত্বপূর্ণ হলো আগামী শুক্রবারে ভার্সিল সলোযোর সাথে আলোচনাটা। কিন্তু দুটো ব্যাপারের মধ্যে আকাশপাতাল ব্যবধান থাকলেও, ডনের কাছে একটার চেয়ে আরেকটার গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। এটুকু পরিষ্কার বোঝে বলেই শ্রেষ্ঠ কনসিলিয়রিদের মধ্যে একজন হবার উপযুক্ততা রয়েছে হেগেনের।

টম হেগেনের উদ্বেগ প্লেনের ঝাঁকুনিতে আরও যেন বেড়ে গেল। এয়ার, হোস্টেসকে ডেকে একটা মার্টিনি চাইল সে। প্রযোজক জ্যাক ওলটসের কথা ভাবতে চেষ্টা করছে। লোকটা কি রকম শয়তান তা বোঝাতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি জনি ফন্টেন। উনও তাকে কিছু জ্ঞান দান করেছেন। জনির মুখ থেকে সব শোনার পর তার বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, ওলটসকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো তার কর্ম নয়। কিন্তু সেই সাথে এ-ও জানে যে জনিকে কথা দিয়েছেন যখন, সে কথা ডন যে কোনভাবেই হোক রক্ষা করবেন। সুতরাং, তার ঘাড়ে মধ্যস্থতা এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চেপেছে।

ওলটসের ডোশিয়ার তৈরি হতে খুব বেশি দেরি হয়নি। ফাইলটা সাথে করে নিয়েও এসেছে হেগেন। সীটে হেলান দিয়ে সেটার উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে সে এখন। প্রথম শ্রেণীর মাত্র তিনজন, প্রযোজকের মধ্যে একজন ওলটস। নিজেরই একটা স্টুডিও আছে তার। কন্ট্রাক্ট সই করিয়ে শয়ে শয়ে তারকাকে সে নিজের পকেটে ভরে রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সামরিক তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টাদের মধ্যে সে একজন। লোকটা প্রায়ই ডিনার খেতে যায় হোয়াইট হাউজে। হলিউডে ওর বাড়িতে অতিথি হিসেবে যারা যান তাদের মধ্যে জে এডগার হুভারের মত স্বনামধন্য ব্যক্তি রয়েছেন। শুনতে এব যতটা ডারিকী আর গুরুতপূর্ণ লাগে, আসলে ব্যাপারটা সেরকম কিছু নয়। বড় বড় লোকদের সাথে তার উঠাবসা আছে ঠিকই, কিন্তু সবই সরকারী সম্পর্ক। সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়াশীল লোক, সেজন্যেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব বলতে গেলে কিছুই নেই। খুব অহঙ্কারী। উন্মাদের মত নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে অভ্যস্ত। ব্যাঙের ছাতার মত। অগুনতি শত্রু গজিয়ে আছে তার চারদিকে, কিন্তু সে-ব্যাপারে লোকটার কোন খেয়ালই নেই।

মনটা দমে গেল হেগেনের। পরিষ্কার বুঝতে পারছে, যুক্তিতে কান দেবার লোক ওলটস নয়। ফাইলটা রেখে দিয়ে ব্রীফকেস থেকে ব্যবসা সংক্রান্ত কাগজপত্র বের করে লেখাপড়ার কাজে মন দিল সে। কিন্তু শরীরটা বেঁকে বসতে চাইছে। খুব ধকল গেছে আজ। আরেকটা মার্টিনি চেয়ে নিল সে। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। নিজের কথা ভাবছে।

কোন খেদ, কোন অপূর্ণতা নেই ওর জীবনে। ভাগ্যটা আশাতীত ভাল। দশ বছর আগে বেছে নেয়া এই কর্ম জীবনটা ওর উপযুক্তই হয়েছে, ওকে বিমুখ করেনি। হিসাব ধরলে সাফল্যের অনেক সিঁড়ির ধাপই সেটপকে আসতে পেরেছে। পরিণত একজন পুরুষের পক্ষে যতটা সুখী হওয়া সম্ভব, তার চেয়ে কম সুখী নয় সে। তার উপর, বর্তমান জীবনটা ওর কাছে সাংঘাতিক রোমাঞ্চকর, বড় চিত্তাকর্ষক।

দীর্ঘদেহী, আমেরিকান স্টাইলে ছোট করে ছাঁটা চুল মাথায়, ছিপের মত একহারা, টম গেহেনের বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ। চেহারায় তেমন কোন বৈশিষ্ট্য নেই। উকিল হিসেবে তিন বছর প্র্যাকটিস করলেও, এখন আর ডনের পারিবারিক ব্যবসার আইনগত দিকটা হাতে-কলমে করতে হয় না তাকে।

সনি কর্লিয়নি আর টম হেগেন সমবয়েসী, এগারো বছর বয়সে পরস্পরের খেলার সাথী ছিল ওরা। অন্ধ হয়ে গিয়ে হেগেনের মা ছেলের দৃশ বছর পূর্ণ হতেই মারা গেল, বাপও তারপর থেকে একেবারে বেহেড মাতাল হয়ে গেল। কাঠ মিস্ত্রী নোকটা খুব খাটতে পারত। কিন্তু মদ খেয়ে লিভার পচিয়ে শেষ পর্যন্ত সে-ও মরে গেল।

এতিম টম রাস্তায় রাস্তায় নেড়ি কুকুরের মত ঘুরে বেড়ায়, রাতে লোকের বাড়ির সামনে ঘুমায়। মায়ের মত তারও চোখের ব্যারাম, সবাই রোগটাকে ছোঁয়াচে মনে করে ভয় পায়, নিজেদের ছেলেগুলোকে ওর ধারেকাছে ঘেঁষতে নিষেধ করে দেয়, কাছে পিঠে ওকে দেখলে দূর হ দূর হ করে ঝাড়ু, হাতে ছুটে আসে।

সনি কর্লিয়নি সেই এগারো বছর বয়সেই দারুণ একগুঁয়ে, বন্ধুর দুর্দশা দেখে মনে তার অদ্ভুত করুণার উদ্রেক হলো। একদিন তাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে এসে আবদার জুড়ে দিল সে, এ-বাড়িতেই ওর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এক পেয়ালা টমেটো সসের গরম স্প্যাগেটি আনা হলো টমের সামনে। সেই স্প্যাগেটির স্বাদ চিরকাল জিভে লেগে থাকবে তার।

ছেলের আবদার সম্পর্কে হা-না কিছুই বলেননি ডন কর্লিয়নি। টমকেও কিছু বলেননি। তাঁর মৌনতা লক্ষ করে সবাই বুঝে নিল, টম হেগেনকে আশ্রয় দিতে তার কোন আপত্তি নেই। তারপর তিনি নিজেই তাকে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়ে চোখের অসুখটা সারালেন, ভর্তি করে দিলেন স্কুলে। টম তার ছেলেদের সাথেই বড় হতে লাগল। একদিন সে কলেজে ভর্তি হয়ে আইন,পড়তে শুরু করল।

ডন কর্লিয়নির আচরণে কোনদিনই টমের প্রতি স্নেহের কোন প্রকাশ ছিল না। টমের বাবার স্থান দখল না করে তিনি অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্নেহ ভালবাসার প্রকাশ ছিল না, কিন্তু তিনি তাঁর ছেলেদের চেয়ে তাকেই বেশি সৌজন্য দেখাতেন, এবং কোন সময়ই শাসন করতেন না। টমের কোন সিদ্ধান্ত কখনও তিনি বাতিল করেননি। আইন পড়ার সিদ্ধান্তটা টমের নিজেরই। তবে, ডন একবার কাকে যেন বলেছিলেন অস্ত্রধারী একদল ডাকাতের চেয়ে ব্রীফকেসধারী একজন মাত্র উকিল অনেক বেশি টাকা লুট করতে পারে। কথাটা ভোলেনি টম হেগেন।

ওদিকে সনি আর ফ্রেডির পড়াশোনা বেশিদূর এগোল না। হাই স্কুল থেকে বেরিয়েই পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকে পড়ল দুজন। কিন্তু মাইক কলেজে পড়তে গেল। এরপরই ঘটল পার্ল হারবারের দুর্ঘটনা, অমনি কলেজ ছেড়ে মেরিনসে নাম লেখাল সে।

আইন পড়া শেষ করে বিয়ে করল হেগেন। ইতালিরই মেয়ে, নিউ জার্সিতে থাকে, সে-ও গ্র্যাজুয়েট,-বেশ হাসিখুশি টাইপের মেয়ে। বিয়েটা ডন কর্লিয়নির বাড়িতেই হলো। ডন বললেন, এখন টম যেখানে ইচ্ছা নিজের ব্যবসা দাঁড় করাবার চেষ্টা করতে পারে, উনি তাকে সাহায্য করবেন, মক্কেল যোগাড় করে দেবেন, অফিস গোছগাছ করে দেবেন।

আমি আপনার কোন কাজে লাগতে চাই, অবনত মস্তকে মৃদু কণ্ঠে নিজের আন্তরিক ইচ্ছা জানিয়েছিল হেগেন।

অবাক হলেন ডন। খুশিও কম হৃলেন না। কিন্তু প্রশ্ন করলেন, তুমি জানো, আমি কি?

মাখাটা একদিকে কাত করে হেগেন বোঝাতে চেষ্টা করল, সে জানে।

আসলে ডন কর্লিয়নির ক্ষমতার পরিধি সম্পর্কে তখনও কিছু জানা ছিল না হেগেনের। তারপর আরও দশ বছর কাটল, এই দীর্ঘ সময়েও সবটুকু জানা সম্ভব হয়নি। গেনকো আবানদণ্ডা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে অস্থায়ীভাবে কনসিলিয়রির পদে নির্বাচিত করা হলো, এরপরই সে গোটা পরিধিটা আঁচ করতে পারল।

অতি ক্ষুদ্র, অতি নগণ্য অবস্থা থেকে মহাপুরুষের মহিমা অর্জন করার মূলে যে ক্ষমতার দরকার, মানুষের মন বোঝার সেই অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ডন কর্লিয়নির। সেই ক্ষমতার সাহায্যে টম হেগেনের মন জেনে নিতে পেরেছিলেন তিনি। এবং সেই প্রথম হেগেনকে তিনি বাপের মত অকুণ্ঠচিত্তে স্নেহ করলেন, তাকে দুহাত দিয়ে টেনে নিজের বুকের মধ্যে আনলেন। এরপর থেকেই তিনি ওর সাথে এমন ব্যবহার করতে শুরু করলেন, বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যেত না যে হেগেন তাঁর সন্তান নন।

কিন্তু প্রায়ই তিনি টমকে মনে করিয়ে দিয়ে বলতেন, দেখো টম, বাপ-মায়ের চেয়ে কেউ বড় নয়। ওদের কথা কখনও ভুলে যেয়ো না। আসলে শুধু টমকে নয়, কথাটা তিনি নিজেকেও মনে করিয়ে দিতেন।

ডনের নির্দেশে পারিবারিক ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ কর্ম দেখাশোনা করার মধ্যেই তিনটে বছর আইন-ব্যবসা চালাল হেগেন। আইন-ব্যবসার এই অভিজ্ঞতা পরে খুব কাজে দেয়। এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত ফৌজদারী উকিলদের প্রতিষ্ঠানে ডনের কিছু প্রভাব থাকায় এরপর সেখানে দুবছর প্রশিক্ষণ নিতেও কোন অসুবিধে হয়নি টমের।

কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল, আইনের বিশেষ এই দিকে হেগেন একটা প্রতিভা। কর্লিয়নিদের পারিবারিক ব্যবসার একজন ফুল-টাইম কর্মচারী হবার পর থেকে ছয় বছরের মধ্যে আইনগত ব্যাপারে তার উপর অসন্তুষ্ট বা বিরক্ত হবার কোন কারণ দেখতে পাননি ডন কর্লিয়নি।

হেগেনকে অস্থায়ীভাবে কনসিলিয়রির পদে নিযুক্ত করায় প্রভাবশালী সিসিলীয় পরিবারগুলো কর্লিয়নিদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করতে কসুর করেনি। আইরিশ দঙ্গল এই নাম রেখেছে সবাই কর্লিয়নিদেয়। কথাটা মনে পড়লেই হাসি পায় হেগেনের। কিন্তু সেই সাথে এটাও হৃদয়ঙ্গম করে যে ডন কর্লিয়নির অবর্তমানে এই পরিবারের ব্যবসার উপর কর্তৃত্ব করার আশা তার না রাখাই ভাল।

কিন্তু তবু টম হেগেন অসন্তুষ্ট নয়। ডন কর্লিয়নিকে ভালবাসে সে, ভালবাসে ডনের স্ত্রীকে, ভালবাসে ডনের ছেলে-মেয়েদের-গোটা পরিবারের সাথেই ওর ভালবাসার সম্পর্ক। এই পরিবারের ঋণ রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে কোন ভাবেই শোধ করার নয়। সেজন্যে নিজেকে কখনও লাগাম ছাড়া উচ্চাশার শিকার হতে দেয় না সে, দেবে না কখমও। সে ধরনের উচ্চাশা পোষণ করার একটাই অর্থ হয়: পরম উপকারীর অসম্মান করা। জীবন থাকতে তা করতে পারবে না টম হেগেন।

.

লস অ্যাঞ্জেলসে যখন পৌঁছল হেগেন, ভোর হয়নি তখনও। হোটেলে শাওয়ার সারুল সে, শেভ করল। জানালার সামনে একটা চেয়ারে বসে গুটি গুটি পায়ে কিভাবে তোর আসে তাই দেখছে। খানিক পর ব্রেকফাস্ট আর সংবাদপত্রের অর্ডার দিয়ে বিছানায় শুলো একটু আরাম করার জন্যে।

আগের দিনই ডনের নির্দেশে ফোন করেছিল সে বিলি গফ নামে এক লোককে। চলচ্চিত্র শ্রমিক সংঘে খুবই প্রভাব আছে বিলি গফের। জ্যাক ওলটসের সাথে হেগেনের দেখা করার ব্যবস্থা এই লোকই করেছে। ওলটসকে বিলি গফ আভাস ইঙ্গিতে জানিয়ে দিতে ভুল করেনি যে হেগেনকে অসন্তুষ্ট করলে স্টুডিওর শ্রমিকরা বিনা নোটিশে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে বসতে পারে।

এক ঘণ্টা পর ফোন পেয়েছিল হেগেন। বিলি গফ তাকে জানিয়েছে আজ বেলা দশটার সময় তার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছে ওলটস। কিন্তু বিলি গফ হেগেনকে একথাও বলেছে, ধর্মঘটের হুমকিটাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি ওলটস। স্টুডিওতে শেষ পর্যন্ত যদি গোলমাল পাকাতেই হয়, তার আগে দুটো কথা বলে নেব আমি ডনের সাথে।

কোনরকম প্রতিশ্রুতি দেয়া এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে হেগেন তাকে বলেছে, সেক্ষেত্রে ডনও কথা বলতে চাইবেন।

কর্লিয়নিদের ক্ষমতা নিউ ইয়র্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও শ্রমিক নেতাদের সাথে নিজস্ব পদ্ধতিতে যোগাযোগ করে নিউ ইয়র্কের বাইরেও ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছেন ডন কর্লিয়নি। এটুকু জানা আছে বলেই ডনের ইচ্ছাটাকে গফু এত বেশি মর্যাদা দিচ্ছে দেখে আশ্চর্য হয়নি হেগেন। অন্যান্য শ্রমিক নেতাদের মত বিলি গফও ডনের কাছে কোন না কোনভাবে ঋণী, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

কিন্তু বেলা দশটায় সাক্ষাৎ! লক্ষণটা ভাল লাগছে না হেগেনের। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সবার আগে তার সাথে দেখা করবে ওলটস অর্থাৎ তাকে লাঞ্চ খাওয়াবার কোন ইচ্ছা ওর নেই। তার মানে গফ যথেষ্ট ভয় দেখায়নি, তাই তাকে যথেষ্ট মূল্য দিচ্ছে না ওলটস। বলা যায় না; গফ হয়তো ওর কাছ থেকে ঘুষ খায়।

একটু ক্ষোভ দেখা দিল হেগেনের মনে। ডনের এই একটা অভ্যাস, সব সময় নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে রাখা। এতে পারিবারিক ব্যবসার ক্ষতি হয়। বাইরের লোক তাকে চেনে না, তার ক্ষমতা সম্পর্কে জানার সুযোগ পায় না। ফলে ডনের কোন গুরুত্বই দেয় না অজ্ঞরা। ( ঠিক সময়ে পৌঁছল হেগেন। সীটিং রূমটা বিলাসবহুল আসবাব পত্রে সাজানো। মখমলের গদি দিয়ে মোড়া চেয়ার। আরাম করে বসে আছে হেগেন। ওর বিশ্লেষণটাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেছে, অথচ এখনও ওলটসের খাস কামরা থেকে ডাক আসেনি।

সামনের একটা সোফায় স্বল্পবয়েসী একটা মেয়ে বসে আছে। বড়জোর বারো, তার বেশি বয়স হবে না। মেয়েটা পরমাসুন্দরী। অতটুকুন মেয়ে, কিন্তু মূল্যবান সাজসজ্জায় বয়স্কা মহিলার মত দেখাচ্ছে তাকে। সোনালী আঁশের মত চকচক করছে মাথার চুল, টানা দুটো চোখে আশ্চর্য এক মায়াবী গভীরতা, তাজা রাস্পবেরীর মত ঠোঁট। সাথের হাফ-বুড়িটা মেয়েটাকে আগলে রেখেছে। নিশ্চয়ই মা হবে, ভাবল হেগেন। মহিলা বারবার কটমট করে তাকাচ্ছে হেগেনের দিকে। হেগেনের অপরাধ, মাঝে মাঝেই মেয়েটার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

দামী পোশাক পরা এক মোটা মহিলা এসে উদ্ধার করল হেগেনকে। অনেকগুলো অফিস কামরার ভিতর দিয়ে পথ দেখিয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে সে। কামরাগুলোয় আশ্চর্য সুন্দরী সব মেয়েরা কাজ করছে দেখে আপন মনে একটু হাসল হেগেন। এরা সবাই বুদ্ধিমতী মেয়ে, চলচ্চিত্র অফিসে কেরানীর চাকরি করাটা এদের কারুরই উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য অভিনয় করার সুযোগ বের করে নেয়া। চাকচিক্যের এই জগতটায় ঢোকার কৌশল হিসাবে চাকরি নিয়েছে এরা। দুঃখ বোধ করল হেগেন। কেননা, ওরা জানে না ওদের বেশির ভাগেরই বাকি জীবনটা এই কেরানীর চাকরি করেই কেটে যাবে, অভিনয় করার সুযোগ আসবে না।

জ্যাক ওলটস দীর্ঘদেহী, শক্তসমর্থ, ভুড়িটা বিরাট হলেও সুটটা এমন নিখুঁতভাবে তৈরি করা যে সেটাকে প্রায় ঢেকেই রেখেছে। ওলটসের অতীত ইতিহাস কিছুই অজানা নেই হেগেনের। খুব ছোটবেলা থেকে রোজগার করছে সে। দশ বছর বয়সে ঠেলাগাড়ি আর খালি মদের পিপে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গড়িয়ে নিয়ে যেত বাপের একটা পোশাক তৈরির দোকান ছিল, বিশ বছর বয়সে সেই দোকানের কর্মচারীদের উপর অত্যাচার আর শোষণ চালাত। ফাইভ সেন্ট থিয়েটারে টাকা খাটাতে শুরু করে ত্রিশ বছর বয়সে। তার বয়স যখন আটচল্লিশ, হলিউডের রথী মহারথীদের মধ্যে অন্যতম একজন হয়ে উঠেছে সে। বড় হয়েছে, কিন্তু স্বভাব আগের মতই আছে। এখনও সে কামাতুর, কর্কশভাষী, হিংস্র নেকড়ের মত হবু তারকাদের ওপর অত্যাচার চালায়

নিজেকে গড়ে পিটে নিতে অবশ্য ভুল করেনি লোকটা। মার্জিত ভাষায় কথা বলতেও শিখেছে, সাজ-পোশাক কিভাবে করতে হয় তাও একজন ইংরেজ ভ্যালের কাছ থেকে শিখে নিয়েছে, আরেকজন ইংরেজ বাটলারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে সামাজিক আচরণের নিয়ম-কানুন। প্রথমা স্ত্রী গত হবার পর পৃথিবী বিখ্যাত সুন্দরী আরেক মেয়েকে বিয়ে করেছে সে। ওলটস এখন ষাট বছরের বুড়ো। এখন তার শখ একালের বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি সংগ্রহ করা। বর্তমানে সে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য। চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নতির জন্যে একটা স্থায়ী তহবিল গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নিজেই সে কয়েক কোটি ডলার চাঁদ দিয়ে বিস্তর সুনাম এবং প্রচুর হাততালি কুড়িয়েছে। ওর মেয়েকে বিয়ে করেছে এক ইংরেজ লর্ড। আর ছেলেটা বিয়ে করেছে এক ইটালিয়ান রাজকুমারীকে।

মার্কিন মুলুকের সমস্ত সিনে-ম্যাগাজিনগুলোর রিপোর্টারদের মতে ওলটসের সবচেয়ে শখের বস্তু হলো তার ঘোড়ার আস্তাবল। তার ঘোড়াগুলো দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়। গত বছর এই ঘোড়ার পিছনেই সে নাকি খরচ করেছে দশ লক্ষ ডলার। এই তো কিছুদিন আগে ছয় লক্ষ ডলার দিয়ে নামকরা ইংলিশ রেসিং ঘোড়া খার্তুম-কে কিনল। কিনেই সে ঘোষণা করল, খার্তুম আর দৌড়াবে না, আস্তাবলের শোভা বর্ধন করবে। তাজ্জব বনে গিয়েছিল সবাই, দৈনিক সব সংবাদপত্রে বড় বড় হেডিংয়ে বেরিয়েছিল খবরটা।

হেগেনকে অভ্যর্থনা জানাবার সময় ভদ্রতার কার্পণ্য দেখাল না সে। চাঁছাছোলা, ক্লীন-শেভ মুখ, হঠাৎ সেটা বিকৃত হয়ে উঠল-হেগেনকে বুঝে নিতে হলো, এই ভেংচিটাই ওলটসের হাসি। সাংঘাতিক আরামে আছে, ওর শরীর এবং চেহারার যত্ন নেয়বিশেষজ্ঞেরা, তাতেও বয়স লুকিয়ে রাখতে পারেনি। সেলাই করে একসঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে মুখের পেশীগুলো, মনে হলো হেগেনের। তবে, নড়াচড়ার মধ্যে অদ্ভুত এক প্রাণশক্তির প্রাচুর্য টের পাওয়া যাচ্ছে। প্রভুত্ব করার সহজাত গুণ রয়েছে লোকটার মধ্যে, পরিবেশটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেই।

ভূমিকা না করে কাজের কথা পাড়ল হেগেন। জানাল, জনি ফন্টেনের তরফ থেকে নয়, তার এক বিশিষ্ট বন্ধুর প্রতিনিধিত্ব করছে সে। প্রসঙ্গক্রমে জানাল, জনি ফন্টেনের এই বন্ধুটি প্রচণ্ড প্রভাব এবং ক্ষমতাশালী মানুষ, এবং মি, ওলটস যদি তার ছোট্ট একটা উপকার করেন, তিনি কৃতজ্ঞ বোধ করবেন এবং কৃতজ্ঞতার নিদর্শন, স্বরূপ চিরস্থায়ী বন্ধ হবার প্রতিশ্রুতি দেকেন। উপকারটি কি? নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিল হেগেন, মি. ওলটসের স্টুডিওতে একটা যুদ্ধের ছবি শুরু হবে আগামী হপ্তায়, তাতে একটা বিশেষ ভূমিকা দিতে হবে জনি ফন্টেনকে।

কোন ভাবান্তর নেই ওলটসের চেহারায়। হাসি হাসি, ভদ্র ভাব মুখে। তার কথার মধ্যে কৌতুকের সুর, সেই সাথে একটু প্রশ্রয় দেয়ার ভাব ফুটে উঠল। তার প্রচণ্ড ক্ষমতা এবং প্রভাব আমার কি উপকারে আসবে?.

এই ধরুন, সবিনয়ে জানাল হেগেন, আপনার স্টুডিওতে শ্রমিকরা গোলমাল বাধালে আমার বন্ধু কথা দিচ্ছেন, সেটা তিনি মিটিয়ে দেবেন। তারপর, খুব নামকরা আপনাদের একজন নায়ক, ইদানীং মারিজুয়ানা ছেড়ে হেরোইন ধরেছে আমার বন্ধু কথা দিচ্ছেন, কোনভাবেই সে আর হেরোইন যোগাড় করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও যে কোন ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিলে আপনি যদি শুধু একটা ফোন করে জানান, সাথে সাথে সব মিটে যাবে।

ছোট ছেলের বড়াই করা শুনছে, এই রকম একটা হাসি হাসি ভাব নিয়ে হেগেনের কথা শুনল ওলটস। কিন্তু কণ্ঠস্বর রূঢ় শোনাল, আমাকে ভয় দেখাচ্ছ নাকি?

সবিনয়ে বলল হেগেন, ছি-ছি, এ আপনি কি বলছেন। আমার বন্ধু আপনার কাছ থেকে অনুগ্রহ ভিক্ষা চান। আমার মাধ্যমে তিনি আপনাকে জানাচ্ছেন, ভিক্ষাটা দিলে আপনার কোন ক্ষতি হবে না, উপকার হবে।

রাগে মুখটা কালচে হয়ে উঠল ওলটসের। ভুরুজৈাড়া কুঁচকে নেমে এল নিচে, জ্বলজ্বলে চোখের উপর ঘন, কালো, পুরু একটা রেখার মত দেখাচ্ছে সেটাকে। ডেস্কের উপর, হেগেনের দিকে ঝুঁকে পড়ল সে, একটা গাল দিয়ে বলল, বেকুব। তোমার বন্ধু বা মনিব, যেই হোক সে, তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দাওগে, আমি বেঁচে থাকতে অভিনয় করা তো দুরের কথা, ছবিটায় জনি ফন্টেন ছায়া পর্যন্ত ফেলার সুযোগ পাবে না। অসভ্য, জংলী মাফিয়া গুণ্ডাদেরকে আমি ডরাই না। চেয়ারের একদিকের হাতলে কনুই রেখে শরীরের ভর চাপাল সে, ঠোঁট বাঁকা করে হাসল, বলল, একেবারে খালি হাতে ফিরে যাও তা চাই না, সাথে করে একটু জ্ঞানও নিয়ে যাও–এডগার ভার, ব্যঙ্গের হাসিটা আরও বিত্তত হলো মুখে, আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। তার কানে যদি যায় যে তোমরা আমাকে বিরক্ত করছ, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা করে ছাড়বে সে তোমাদের।

বাইরে শান্ত দেখালেও মনে মনে রীতিমত বিস্ময়বোধ করছে হেগেন। এ কেমন বোকা লোক, যে নিজের বিপদ টের পায় না? এই হাঁদা কোটি কোটি টাকার একটা ব্যবসার মালিক হলো কিভাবে? ভাবনার খোরাক রয়েছে এর মধ্যে। নতুন ব্যবসা খুঁজছেন ডন, চলচ্চিত্রে টাকা খাটালেই তো হয়। এই সব গাধারা যদি ওখান থেকে আয় করতে পারে, ডনের যা বুদ্ধি, তিনি তো চোখ বুজে লুটপাট করবেন। ওলটসের গালি-গালাজ গায়ে মাখল না হেগেন। কাজ-কারবারে সব কিছু গায়ে না মেখে মাথা ঠাণ্ডা রাখাটাই সাফল্যের মূল কথা, এ মন্ত্র স্বয়ং ডন তাকে শিখিয়েছেন। ডন বলেন, না, রাগ দেখাবে না। ভয় তো দেখাবেই না। শুধু যুক্তি দিয়ে বোঝাবে। অপমান বা ভীতি-প্রদর্শন গ্রাহ্য করতে নিষেধ করেন ডন। মহান যীশুর পথ অবলম্বন করার পরামর্শ দেন তিনি। একবারের একটা ঘটনার কথা কখনও ভুলবে না হেগেন। কুখ্যাত, আত্মম্ভরি মরণ বাড় বেড়ে ওঠা এক গুণ্ডার সাথে আলোচনায় বসেছেন ডন। লোকটা নানাভাবে অপমান করছিল ডনকে। তিনি হাসি মুখে সব সহ্য করছিলেন। লোকটা যাতে তার স্বভাব বদলায় তার জন্যে শান্তভাবে যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন তাকে। এক দুঘণ্টা নয়, ঝাড়া আট ঘণ্টা ধরে এই চলল। শেষ পর্যন্ত হতাশার ভাব ফুটে উঠল ডনের চেহারায়। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত দুটো শূন্যে তুলে আর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, বোঝা গেল, এ লোকের সাথে যুক্তি চলে না। কথা শেষ করে দ্রুত কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সাথে সাথে দূত পাঠিয়ে তখুনি ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল ডনকে। সমস্যার সমাধানও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুমাস পর লোকটাকে তার পাওনা ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ডন। নাপিতের দোকানে ঢুকে কে যেন গুলি করে মেরে ফেলেছিল লোকটাকে।

ডনের শিক্ষার কথা মনে রেখে হেগেন তাই আবার নতুন করে শুরু করল, আমার কার্ড তো আপনি দেখেছেন, আমি একজন উকিল, তাই না? নিজেকে বিপন্ন করার মত কাজ আমি কিভাবে করি, বলুন? আচ্ছা, আপনাকে ভয় দেখাবার মত একটা কথাও কি বলেছি আমি? আমরা আপনার সব শর্ত মেনে নেব, আপনার সব, কথায় আমরা রাজি, এতসবের বিনিময়ে ছোট একটা অনুরোধ যদি রাখেন, আমরা ধন্য হয়ে যাব। বিশ্বাস করুন, তাতে আপনারও মস্ত লাভ। সামান্য একটা দানের বিনিময়ে আপনার যাতে প্রচুর লাভ হয় সেজন্যে ইতিমধ্যেই অনেকগুলো লোভনীয় প্রস্তাব দেয়া হয়েছে আপনাকে। একটু বিরতি নিয়ে সবিনয়ে হাসল হেগেন, তারপর আবার বলল, জনিকে আপনি নিজেই বলেছেন ওই ভূমিকায় তাকেই সবচেয়ে ভাল মানায়। আপনি যদি মনে করতেন, জনিকে মানাবে না, তাহলে অনুরোধটা করাই ইত না আপনাকে পুঁজির অভাব থাকলে, তাও আমার মক্কেল যোগান দিতে রাজি আছেন। ওলটস কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হাত তুলে তাকে থামাল, বলল, সব কথা আমাকে খুলে বলতে দিন, প্লীজ। ধরে নিচ্ছি, একবার যখন না বলেছেন, এরপর প্রতিবারই না বলবেন আপনি, এটাই আপনার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এ কথা তো ঠিক, আপনার ওপর জোর খাটাবার অধিকার কারও নেই, সে চেষ্টা কেউ করছেও না মি. হতার যে আপনার ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু, তাও আমরা জানি। এবং বিশ্বাস করুন, এই সম্পর্কটার জন্যে আমার মনিব শ্রদ্ধাও করেন আপনাকে। বরাবর তিনি এ ধরনের সম্পর্কের মূল্য দিয়ে থাকেন।

লাল পালকের ঝুঁটিওয়ালা কলম দিয়ে কাগজে হিজিবিজি কাটছে ওলটস। টাকার কথা শুনে চোখের কোণে ঝিলিক দিয়ে উঠল কৌতূহল। থেমে গেছে হাতটা। বলল, ছবিটা করতে কত টাকা লাগবে জানো? পঞ্চাশ লক্ষ ডলার।

আঁতকে ওঠার কৃত্রিম ভান করল হেগেন। তারপর খুব নরম সুরে বলল, আমার মনিবের অনেক জাদরেল বন্ধু আছে, তারা ওঁর কথায় মরে ওর কথায় বাঁচে।

এই প্রথম গোটা ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথে নিল ওলটস। হেগেনের কার্ডটা আরেকবার ভাল করে দেখল সে। না, এর আগে তোমার নামই শুনিনি আমি। নিউ ইয়র্কে যারা নাম করা উকিল তাদের সবাইকে চিনি আমি। তুমি কোন চুলো থেকে এসেছ শুনি?

নিউ ইয়র্কের অভিজাত আইন-উপদেষ্টা সংস্থাগুলোর একটা আমার, মৃদু গলায় বলল হেগেন। উঠি তাহলে।

করমর্দন সেরে দরজার দিকে রওনা দিল হেগেন, দুপা এগিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আবার, বলল, এমন সব লোকের সাথে চলাফেরা করেন আপনি যারা নিজেদেরকে অনেক বড় করে জাহির করে। আমার বেলা কিন্তু তার উল্টোটি ঘটছে। ইচ্ছা করলেই খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে আপনি সব জানতে পারবেন। মত-যদি বদলায়, হোটেলে ফোন করতে ভুলবেন না। একটু থেমে আবার বলল, শুনে হয়তো আপনার মনে হবে পবিত্র একটা ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা করছি, কিন্তু কথাটার মধ্যে এতটুকু অতিরঞ্জন নেই–আমি যার প্রতিনিধিত্ব করছি তিনি এমন অনেক কাজও করে দিতে পারেন যা খোদ মি. হুভারেরও সাধ্যের অতীত।

ওলটসের চোখ দুটো ছোট হয়ে আসছে দেখে হেগেন ভাবল, এতক্ষণে বোধহয় টনক নড়ছে। যথাসম্ভব তোষামোদের সুরে বলল, আরে, বলতে ভুলেই গেছি…আমার মনিব বলে পাঠিয়েছেন, আপনার তৈরি ছবিগুলো সব সত্যি অপূর্ব, প্রশংসা না করে পারা যায় না। এসব ভাল কাজ, আশা করি চালিয়ে যেতে পারবেন। দেশে এসবের দরকার আছে।

সেদিনই সন্ধ্যায় ওলটসের সেক্রেটারি ফোন করল হেগেনকে জানাল, এক ঘণ্টা পর একটা গাড়ি তুলে নেবে হেগেনকে, শহরের বাইরে ওলটসের বাড়িতে তার জন্যে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। মাত্র ঘণ্টা তিনেকের পথ, পানীয় বা নাস্তার জন্যে বার আছে গাড়িতেই, সুতরাং কোন অসুবিধে হবে না। 

কিন্তু হেগেন ভাবছে অন্য কথা। নিজের প্লেনে আসা যাওয়া করে ওলটস, আজ প্লেন বাদ দিয়ে গাড়ি কেন?

হেগেনের চিন্তায় বাধা দিয়ে সেক্রেটারি আবার বলল, টুকটাক দরকারী জিনিস, সাথে নিতে পারেন, রাতটা ইচ্ছে করলে ওখানে কাটাতে পারবেন অনায়াসে, কাল সকালে মি. ওলটস আপনাকে এয়ারপোের্ট পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবেন।

ঠিক আছে, বলল বটে হেগেন, কিন্তু সেক্রেটারির শেষ কথাটায় ভাবনার আরেকটা খোরাক পেয়ে গেল সে। কাল সকালের প্লেনে নিউ ইয়র্কে ফিরবে সে, এ কথা জানল কিভাবে ওলটস? এর একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্য হলো, ওর পিছনে টিকটিকি লাগিয়েছে ওলটসে। তাই যদি হয়ে থাকে, সে যে ডনের প্রতিনিধি এ কথাও নিশ্চয় জানা হয়ে গেছে ওলটসের। এবার যদি কাজ হয়, ভাবল হেগেন, তবে ডনকে যদি ওলটস প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে ভুল না করে, তবেই।

প্রাসাদোপম বাড়ি ওলটসের। বাড়ির চারদিকে প্রশস্ত মাঠ, তাতে ঘোড়া দৌড়ায়, তাই কালো মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। বিশাল একটা ঘাস-জমি লালন করা হচ্ছে ঘোড়া চরাবার জন্যে। চিত্রতারকারা যত্ন করে যেভাবে তাদের নখ পরিষ্কার রাখে ওলটসের কর্মচারীরা, সেভাবে পরিষ্কার করে রেখেছে বাড়ি, বাগান, লতা ঝোঁপ, মাঠ এবং রাস্তাটা।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা কাঁচ মোড়া বারান্দায় হেগেনকে অভ্যর্থনা জানাল ওলটস। বুক ভোলা নীল রঙের রেশমী শার্ট, হলুদাভ সবুজ রঙের স্ন্যাকস এবং কোমল চামড়ার স্যান্ডেল পরে রয়েছে সে। দামী এবং রঙচঙে পোশাক তার কর্কশ চেহারার সাথে বেমানান লাগছে। হেগেনকে এক গ্লাস মার্টিনি দিয়ে নিজেও ট্রে থেকে একটা তুলে নিল সে। চেহারা এবং আচরণে আগের চেয়ে অনেক বেশি সহনশীলতার ছাপ লক্ষ করার মত। হেগেনের কাঁধে একটা হাত তুলে দিয়ে বলল সে, ডিনারে বসার আগে চলো আমার ঘোড়াগুলো দেখে আসি।

আস্তাবলের দিকে রওনা হলো ওরা। তোমার সম্পর্কে খবর নিয়েছি, বুঝলে? তুমি ডন কর্লিয়নির প্রতিনিধিত্ব করছ একথা আমাকে আগে বলা উচিত ছিল। আমাকে ধাপ্পা দেবার জন্যে থার্ড ক্লাস একজন গুণ্ডাকে পাঠিয়েছে জনি, এই ভেবে নিয়েছিলাম আমি। কি জানো, ধাপ্পাবাজিতে বিশ্বাস নেই আমার। তা সে যাই হোক, ডিনারের পর কাজের কথা হবে।

মেহমানকে আনন্দ দানের মনোবৃত্তি এবং আয়োজন, কোনটারই অভাব নেই ওলটসের। গোটা আমেরিকায় তার আস্তাবলটা যাতে সবচেয়ে নামকরা এবং অত্যাধুনিক হয়ে ওঠে সেজন্যে কি সব নতুন পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনা কাজে লাগিয়েছে তার একটা ফিরিস্তি দিল সে। প্রতিটি আস্তাবল ফায়ার-ফ, পয়ঃপ্রণালী, পানি নিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্য রক্ষা ব্যবস্থা ত্রুটিহীন। একটা ইনভেষ্টিগেশন কার্ম ঘোড়া এবং আস্তাবলগুলোকে পাহারা দেয়। সবশেষে হেগেনকে ওলটস একটা স্টলে নিয়ে গেল, সেটার দেয়ালে প্রকাণ্ড একটা তামার ফলক ঝুলছে, তাতে ওলটসের প্রিয় ঘোড়ার নাম লেখা, খাম।

ঘোড়া সম্পর্কে কিছু না জানলেও খামকে দেখে মুগ্ধ হলো হেগেন। গায়ের রঙটা চকচকে কালো। কপালে সাদা একটা রুহিতন আঁকা। সোনার তৈরি আপেলের মত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। রেসের সবচেয়ে দামী ঘোড়া, গর্বের সাথে বলল ওলটস। রাশিয়ার জাররাও ঘোড়ার পিছনে এত টাকা কখনও খরচ করেনি, ছয় লাখ ডলার দিয়ে কিনেছি ওকে আমি। কিন্তু ওকে রেসের মাঠে নিয়ে যাব না। বাচ্চা পয়দার কাজে লাগাব। আস্তাবলটাকে আমি এমন ভাবে গড়ে তুলব, দেশের লোকের যেন তাক লেগে যায়। হেগেনের দিকে ফিরে বলল, পঞ্চাশ পেরোবার পর প্রথম ষোড়ায় চড়তে শিখি আমি, কিন্তু সবাই আমাকে একজন ওস্তাদ ঘোড়সওয়ার বলে জানে। চোখ মটকে হাসল সে, বলা যায় না, কোন কসাক হয়তো আমার দাদী বা নানীকে ধর্ষণ করেছিল রাশিয়ায়, সেই শালার রক্ত রয়েছে আমার গায়ে। প্রিয় ঘোড়র পেটে সুড়সুড়ি দিচ্ছে সে। ব্যাটার যন্ত্রটা দেখেছ? আমারটা যদি ওর মত হত!

একজন বাটলার এবং তিনজন ওয়েইটার পরিবেশন করল ডিনার। প্লেট, কাঁটা চামচ সব রূপোর। খাওয়া শেষ করে দুটো চুরুট ধরাল ওরা। কাজটা তাহলে পাচ্ছে না জনি? প্রশ্ন করল হেগেন।

সম্ভব হলো না। কন্ট্রাক্ট সই হয়ে গেছে সব, আজ বাদে কাল থেকে শুটিং শুরু হবে। এখন আর কোনমতে, সভব নয়।

আপনার ইচ্ছার ওপর জোর নেই, বলল হেগেন। চুরুটে ঘন ঘন টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ল সে। আমার মনিবকে বলব এ কথা। নাকি অন্য কিছু ভাবছেন আপনি?

শ্রমিকরা একটু গোলমাল করবে, বুঝতে পারছি। প্রতি বছর এক লাখ ডলার ঘুষ খায়, অথচ এ-বিষয়ে আভাস দিতে সাহস পেল গফ ব্যাটা। কি জানো, ছবি তৈরির টাকার জন্যে কারও কাছে হাত পাততে হচ্ছে না আমাকে, যথেষ্ট আছে আমার। তোমার বসকে বলল, তার অন্য যেকোন অনুরোধ রাখতে চেষ্টা করব। জনি ফন্টেনকে দুচোখে দেখতে পারি না আমি।

হেগেন ভাবছে, নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে হারামজাদার, তা নাহলে এতদূর টেনে নিয়ে আসত না তাকে। ঠাণ্ডা গলায় বলল সে, মনে হচ্ছে অবস্থাটা বোঝেননি আপনি। মি. কর্লিয়নির সাথে জনির সম্পর্কের মধ্যে আশ্চর্য একটা পবিত্রতা রয়েছে, তিনি ওর ধর্মপিতা। ধর্মের প্রসঙ্গ উঠতে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করল ওলটস। আপনাকে জানানো কর্তব্য বলে মনে করছি, আমার মালিকের মনটা খুবই স্পর্শকাতর, দ্বিতীয়বার কোন অনুরোধ করার আগে তিনি স্মরণ করেন তাঁর প্রথম অনুরোধটা রক্ষা করা হয়েছিল কিনা।

কাঁধ ঝাঁকাল ওলটস। সত্যি, খুবই দুঃখিত। উপায় নেই, তাই কিছু করতে পারলাম না। কিন্তু তুমি যখন সামনে রয়েছ, এসো না, সম্ভাব্য শ্রমিক অসন্তোষের ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলি। কত টাকা? ক্যাশ দেব। এখুনি।

ডনকে তোয়াক্কা করছে না ওলটস, জনিকে সুযোগ না দেবার ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে সে বুঝতে পেরেও মাথা ঠাণ্ডা রাখল হেগেন। ভাবছে, বিস্তর টাকার মালিক লোকটা, এফ, বি, আই-এর কর্তার সাথে বন্ধুত্ব, অনেক রাজনৈতিক নেতা তার পৃষ্ঠপোষকতায় চলে, ছায়াছবির জগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এই রকম একজন নোক কোন দুঃখে ভয় পাবে ডন কর্লিয়নিকে? নিজের প্রতিষ্ঠা পরিমাপ করে যে-কোন বুদ্ধিমান লোককে স্বীকার করতেই হবে, সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে ওলটস। তবে, এই বিশ্লেষণে একটা কিন্তু রয়েছে। ডন কর্লিয়নি জনিকে কথা দিয়েছেন ভূমিকাটা তাকে পাইয়ে দেবেন। হেগেন জানে, কথা রাখার জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করে থাকেন তিনি।

শান্তভাবে বলল হেগেন, আপনি আমাকে ইচ্ছা করে ভুল বুঝছেন। আমার মালিক কথা দিচ্ছেন, বন্ধুত্বের বিনিময়ে সম্ভাব্য শ্রমিক অসন্তোষ ঠেকাবেন তিনি, বিনিময়ে আপনি তার ধর্মপুত্রকে কাজটা দেবেন। সে যাই হোক, বোঝাই যাচ্ছে, আপনি মন স্থির করে ফেলেছেন। তবে আমি বলব, মস্ত ভুল করতে যাচ্ছেন আপনি।

রেগে ওঠার এই সুযোগটা হাতছাড়া করল না ওলটস মাফিয়াদের পুরানো কায়দায় ভয় দেখাচ্ছ আমাকে, এই তো? এতে কাজ হবে না, যাও। চরিত্রটা জনির জন্যে সবচেয়ে মানানসই, আমি জানি, কিন্তু ধড়ে প্রাণ থাকতে ওই ভূমিকায় অভিনয় করতে দেব না ওকে আমি। তার কারণটাও জেনে রাখো। আমার পোষ মানানো একটা মেয়ের সর্বনাশ করেছে ও। পাঁচ বছর ধরে লাখ লাখ ডলার খরচ করে তাকে আমি নাচ গান অভিনয় শিখিয়েছিলাম, অমন সুন্দরী মেয়ে, অমন নিতম্বিনী কোটিতে গুটিকয়েক দেখা যায়। পুরুষমানুষকে শুষে নিয়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলার আশ্চর্য একটা ক্ষমতা ছিল তার। এই রকম মেয়েকে কিনা আমার কাছ থেকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল শালা, রীতিমত বোকা বনে গেলাম আমি। আমার যা পজিশন, তাতে কারও চোখে বোকা প্রতিপন্ন হওয়া চলে না, মি. হেগেন। জনিকে আমি শিক্ষা দিতে চাই।

স্তম্ভিত হয়ে গেল হেগেন। সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন লোক মেয়েমানুষের মত তুচ্ছ একটা ব্যাপারে কিভাবে নিজের স্বার্থবুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিতে পারে তা সে ভেবেই পেল না। হেগেন তথা কর্লিয়নিদের জগতে মেয়েমানুষ মানেই তা ব্যক্তিগত ব্যাপার, বৈষয়িক বিষয়ের সাথে তার সম্পর্ক নেই। তবে বিয়ে, অথবা পারিবারিক সম্মানের কথা আলাদা।

শেষ একটা চেষ্টা করে দেখছে হেগেন। বলল, আমি শুধু বলতে চাই, অতীতে কি ঘটেছে না ঘটেছে সে কথা মনে রেখে ঝুঁকি নেয়া কি ঠিক হচ্ছে আপনার? আমার মালিক ছোট্ট একটা অনুরোধ করেছেন আপনার কাছে, তার কাছে এটার অনেক মূল্য, এই আসল কথাটাই আপনি বুঝতে পারছেন না।

সোফা ছেড়ে ঝট করে উঠে দাঁড়াল ওলটস। কাকে ভয় দেখাচ্ছ তোমরা! এক্ষুণি যদি ফোন করি আজ রাতটা হাজতে কাটাতে হবে তোমাকে, তা জানো? খুনে গুণ্ডাদের আমি ভয় পাই না, তারাই আমাকে ভয় করে চলে। শোনো, দরকার হলে হোয়াইট হাউসে যাব আমি, এবং এমন ব্যবস্থা করব যে তোমার ওই রংবাজ গুণ্ডা সর্দার টেরও পাবে না কোত্থেকে কে তাকে ঘায়েল করে গৈল।

এমন নির্বোধ নোক তো দেখিনি, ভাবছে হেগেন। এত বড় একটা আহাম্মক। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় স্টুডিওর মালিক, প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হলো কিভাবে? কোন সন্দেহ নেই এই ব্যবসাতে নেমে পড়া উচিত ডনের।

সময়টা বড় আনন্দে কাটল, সেজন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, বলল হেগেন। রাতটা আর এখানে কাটাব না। ঠাণ্ডা ভাবে একটু হাসল সে। মি. কর্লিয়নি আবার অবিলম্বে দুঃসংবাদ শুনতে ভালবাসেন।

বাইরে বেরিয়ে এসে হেগেন দেখল, সেই বারো বছরের অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি আর তার মা লম্বা একটা লিমুসিন গাড়িতে চড়ছে। এদেরকেই ওলটসের অফিসে আজ সকালে দেখেছিল সে। চেহারা এরই মধ্যে আশ্চর্য-বিকৃত হয়ে গেছে মেয়েটার, গোলাপী মাংসের একটা পিণ্ডের মত দেখাচ্ছে মুখটাকে। লম্বা পা দুটো ঠিকমত ফেলতে পারছে না সে, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। মা কানে কানে কি যেন বলল, সাথে সাথে ঘাড় ফিরিয়ে হেগেনের দিকে তাকাল মেয়েটা। তার চোখে উকট একটা উল্লাস লক্ষ করল হেগেন। মাকে অনুসরণ করে মেয়েটা এবার উঠে পড়ল গাড়িতে।

এতক্ষণে বুঝতে পারলহেগেন, প্লেনে করে কেন তাকে নিয়ে আসা হয়নি। এই মা আর মেয়েকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল ওলটস। ডিনার খাবার আগে এই কচি মেয়েটার সাথে ফুর্তি করার দরকার ছিল তার। হায় কপাল, ভাবল হেগেন, অথচ এই নরকেই বাস করতে চাইছে জনি!

.

কাজে তাড়াহুড়ো পছন্দ করে না পলি গাটো। আজকের এই কাজটা একটা সহজ কাজ হলেও, কেউ যদি কোথাও একটু ভুল করে ফেলে, তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। তাই আজ সে আরও সতর্ক হয়ে আছে। বারে বসে বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে, আর ফাঁক বুঝে আড়চোখে দেখে নিচ্ছে পাজি দুই ছোকরাকে। মেয়েমানুষ দুটোকে নিয়ে তারা একেবারে মেতে উঠেছে।

ছেলে দুটো সম্পর্কে সব জানা আছে পলির। দুজনেরই বছর কুড়ি বয়স, নাম জেরি ওয়াগনার আর কেভিন মুনান। দুজনই স্বাস্থ্যবান, লম্বা, মাথায় বাদামী রঙের চুল। ছুটির মধ্যে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে, কদিন পর চলে যাবে আবার। হারামীর হাড় শালারা, ভাবছে পলি, গভীর রাত পর্যন্ত বারে বসে মদ গেলা আর বেশ্যাগুলোর পিছু লাগা, এই ওদের কাজ।

খিলখিল করে হেসে উঠল একটা মেয়ে। পলি শুনতে পাচ্ছে তার কথা। রক্ষে করো, জেরি! তোমার সাথে এক গাড়িতে যাব আমি? তারপর তুমি আমাকে ওই বেচারীর মত হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও!

আমেরিগো বনাসেরার কথা ভেবে দুঃখ হলো পলির। মেয়ের সর্বনাশ দেখতে হয় যাকে, তার মত অভাগা আর কে! গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়ল সে, বার থেকে বেরিয়ে এল অন্ধকার রাস্তায়।

দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে গেছে, এলাকার আর একটা মাত্র বারে আলো জ্বলতে দেখছে পলি। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে ক্লেমেঞ্জা। রেডিওর ডাক না পেলে এদিকে ভুলেও আসবে না পুলিশ। শ্ৰেভলে সিডান গাড়িটার দরজায় হেলান দিল পলি। পিছনের সীটে প্রকাণ্ডদেহী দুজন লোক বসে আছে, কিন্তু অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না তাদেরকে। নিচু গলায় তাদেরকে বলল পলি, বেরুলেই শুরু করে দেবে।

খানিক পর বার থেকে বেরিয়ে এল ওরা। মেয়ে দুটো যাচ্ছে তাই বলে বিদ্রূপ করেছে ওদেরকে, তাই মেজাজ খুব খারাপ।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে বিশালদেহীরা।

গাড়ির ফোরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পলি, ছোকরাদেরকে উদ্দেশ্য করে বাঁকা হাসল সে, বলল, কি হে, মেয়েরা বুঝি পাত্তা দিল না?

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওরা। বেঁটে, বেজিমুখো পলির চালিয়াতি ভঙ্গি দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেল ওদের। নিমেষে পলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা। কিন্তু সেই মুহূর্তে ওদের গায়ের উপর এসে পড়ল বিশালদেহীরা। দুজনের হাত ধরে ফেলল তারা, টেনে সরিয়ে আনল ছোকরাদেরকে পলির কাছ থেকে।

এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল পলি। দ্রুত লোহার কাটা বসানো নাকুল ডাস্টার হাতে পরে নিল সে, চরকির মত আধপাক ঘুরেই ওয়াগনার ছোকরার নাকে প্রচণ্ড একটা আঘাত করল সে। প্রকাণ্ডদেহীদের একজন ওয়াগনারকে এবার দুহাত দিয়ে ধরে তুলে ফেলল শূন্যে! নাগালের মধ্যে তার কুঁচকিটা পেয়ে হাত ঘুরিয়ে একটা আপার কাট চালান এবার পলি। নিঃশব্দে দড়ির মত ঝুলে পড়ল ওয়াগনার। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে মাত্র ছয় সেকেণ্ড আগে।

লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিল পলি। ওদিকে তার লোকেরা ধুমসে পেটাচ্ছে কেভিন মুনানকে। কোন তাড়াহুড়ো নেই ওদের মধ্যে, হাতে যেন অঢেল সময় রয়ে গেছে। এলোপাতাড়ি মারছে না ওরা, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ধীরেসুস্থে একের পর এক ঘুসি চালাচ্ছে। ওদের ওপর নির্দেশ আছে, মাথায় বা পিছনে শিরাড়ার উপর মারা চলবে না। তার মানে ছোকরাদের মৃত্যু চাওয়া হয়নি। তবে সেই সাথে সাবধানের সুরে একথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে ছোকরা দুজন যদি হাসপাতাল থেকে মাসখানেকের আগে ছাড়া পায়, ওদেরকে আবার সেই ট্রাক চালাবার কাজে ফেরত পাঠানো হবে। দুজনেই এককালে মুষ্টিযোদ্ধা ছিল ওরা। টাকা কর্জ দেয়ার এমন ব্যবসা এদেরকে শিখিয়ে দিয়েছে সনি কর্লিয়নি যে রীতিমত আরাম আয়েশের সাথে জীবন কাটাতে পারছে। তাই ছোটখাটো এই কাজটা অত্যন্ত উৎসাহ আর আগ্রহের সাথে করে দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার এই মন্ত সুযোগ ওরা ছাড়েনি।

যেখানেই আঘাত লাগছে সেখানেই চামড়া ফেটে যাচ্ছে কেভিন মুনানের। চেহারাটা চেনা যাচ্ছে না এখন তার। তাকে ছেড়ে দিয়ে প্রাক্তন মুষ্টিযোদ্ধারা আবার ফিরল ওয়াগনারের দিকে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, সেই সাথে হেলপ, হেলপ করে চেঁচামেচি করছে।

একজন কাঁধে ঘুসি মেরে বসিয়ে দিল তাকে, অপরজন তার হাতটা মুচড়ে ধরে পিঠে প্রচণ্ড এক লাথি মারল। মট করে শব্দ হলো, পাজরের একটা হাড় বোধহয় ভেঙে গেল।

বার থেকে একজন লোক বেরিয়ে আসছে দেখে কাজের গতি দ্রুত করুল ওরা। ওয়াগনার চেঁচাচ্ছে, শব্দের আকৃষ্ট হয়ে ঝটপট খুলে যাচ্ছে বাড়িগুলোর জানালা। আরও লোকজন বেরিয়ে আসছে বার থেকে। কিন্তু কেউ ওদের কাছাকাছি আসছে না বা কিছু বলছে না।

ওয়াগনারের মাথাটা স্থির রাখার জন্যে দুহাত দিয়ে সেটা চেপে ধরুল একজন, দ্বিতীয় লোকটা লক্ষ্য স্থির করে ধই করে ঘুসি মারুল মুখের উপর। যথেষ্ট হয়েছে, চেঁচিয়ে বলল পলি গাটো। চলে এসো এবার।

দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়ল প্রকাণ্ডদেহীরা, সাথে সাথে গাড়ি ছেড়ে দিল পলি। অনেকেই দেখেছে গাড়িটা, নাম্বারও টুকে রাখতে ভুল করেনি, মুচকি হেসে ভাবছে সে, কিছু এসে যায় না তাতে–চুরি করা ক্যালিফোর্নিয়ার নাম্বার প্লেট এটা। তাছাড়া, এক লাখের উপর শেভ্রলে সিডান আছে নিউ ইয়র্ক শহরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *