১০. জীবনের শেষ দুই

দশম অধ্যায় – জীবনের শেষ দুই বৎসর

স্ত্রীলোকের বীরত্ব

পূর্ব্ব-কর্ণাটক বিজয়ের পর শিবাজী মহীশূর পার হইয়া ১৬৭৮ সালের গোড়ায় পশ্চিম কানাড়া বালাঘাট– অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের দক্ষিণে বর্ত্তমান ধারোয়ার জেলায় পৌঁছিলেন। এই অঞ্চলের লক্ষ্মীশ্বর প্রভৃতি নগরে লুঠ ও চৌথ আদায় করিয়া তিনি উহার উত্তরে বেলগাঁও জেলায় ঢুকিলেন। বেলগাঁও দুর্গের ৩০ মাইল দক্ষিণ-পূৰ্ব্বে বেলগাড়ী নামক গ্রামের পাশ দিয়া যাইবার সময় ঐ গ্রামের পাটেলনী (অর্থাৎ জমিদারগণী)– সাবিত্রী বাঈ নামক কায়স্থ বিধবার অনুচরগণ মারাঠা-সৈন্যদের কতকগুলি মালের বলদ কাড়িয়া লইল। ইহাতে শিবাজী রাগিয়া বেলবাড়ীর দুর্গ অবরোধ করিলেন। কিন্তু সাবিত্রী বাঈ সেই মহাবিজয়ী বীর ও তাঁহার অগণিত সৈন্যের বিরুদ্ধে অদম্য সাহসে যুঝিয়া ২৭ দিন পর্য্যন্ত নিজের ছোট মাটির গড়টি রক্ষা করিলেন। শেষে তাঁহার খাদ্য ও বারুদ ফুরাইয়া গেল, মারাঠারা বেলবাড়ী দখল করিল, বীর নারী বন্দী হইলেন। এমন এক ক্ষুদ্র স্থানে এত দীর্ঘকাল বাধা পাওয়ায় শিবাজীর বড় দুর্নাম রটিল। ইংরাজ-কুঠীর সাহেব লিখিতেছেন (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৬৭৮,)–“তাঁহার নিজের লোকেরাই ওখান হইতে আসিয়া বলিতেছে যে বেলবাড়ীতে তাঁহার যত বেশী নাকাল হইয়াছে, নাকাল অতটা তিনি মুঘল বা বিজাপুর সুলতানের হাতেও হন নাই। যিনি এত রাজ্য জয় করিয়াছেন, তিনি কিনা শেষে এক স্ত্রীলোক দেশাইকে হারাইতে পারিতেছেন না।”

বিজাপুর-লাভের চেষ্টা বিফল

ইতিমধ্যে শিবাজী ঘুষ দিয়া বিজাপুর-দূর্গ লাভ করিবার এক ফন্দি আঁটিয়াছিলেন। ঘটনাটা এই,– উজীর বহলোল খাঁর মৃত্যু (২৩ ডিসেম্বর, ১৬৭৭)-র পর তাঁহার ক্রীতদাস জমশেদ খাঁ ঐ দুর্গ ও বালক রাজা সিকন্দর আদিল শাহর ভার পাইয়াছিল; কিন্তু সে দেখিল উহা রক্ষা করিবার মত বল তাহার নাই। তখন ত্রিশ লক্ষ টাকার বদলে রাজা ও রাজধানীকে শিবাজীর হাতে সঁপিয়া দিতে সম্মত হইল। এই সংবাদ পাইয়া আদোনীর নবাব সিদ্দি মাসুদ (মৃত সিদ্দি জৌহরের জামাতা) গোপনে থাকিয়া প্রচার করিয়া দিলেন যে তাঁহার কঠিন অসুখ, অবশেষে নিজের মৃত্যু-সংবাদও রটাইলেন। এমন কি একখানা পালকীতে করিয়া যেন তাঁহারই মৃতদেহ বাক্সে পুরিয়া কয়েক হাজার রক্ষীসহ কবর দিবার জন্য আদোনী পাঠান হইল! তাঁহার অবশিষ্ট সৈন্যদল– চার হাজার অশ্বারোহী, –বিজাপুরে গিয়া জমশেদকে জানাইল, “আমাদের প্রভু মারা যাওয়ায় আমাদের অন্ন জুটিতেছে না; তোমার চাকরিতে আমাদের লও।” সেও তাহাদের ভর্ত্তি করিয়া দুর্গের মধ্যে স্থান দিল। আর, তাহারা দুই দিন পরে জমশেদকে বন্দী করিয়া বিজাপুরের ফটক খুলিয়া দিয়া সিদ্দি মাসুদকে ভিতরে আনিল। মাসুদ উজীর হইলেন (২১-এ ফেব্রুয়ারি)। শিবাজী এই চরম লাভের আশায় বিফল হইবার পর পশ্চিমদিকে বাঁকিয়া নিজদেশে পনহালায় প্রবেশ করিলেন (বোধ হয় ৪ঠা এপ্রিল, ১৬৭৭)।

মারাঠাদের অন্যান্য যুদ্ধ ও দেশজয়

শিবাজী কর্ণাটক-অভিযানে যে পনের মাস নিজদেশ হইতে অনুপস্থিত ছিলেন সেই সময় তাঁহার সৈন্যগণ গোয়া ও দামনের অধীনে পোর্তুগীজদের মহাল আক্রমণ করে, কিন্তু ইহাতে কোনই ফল হয় নাই। সুরত এবং নাসিক জেলায় পেশোয়া এবং পশ্চিম-কানাড়ায় দত্তাজী কিছুদিন ধরিয়া লুঠ করেন, কিন্তু ইহাতে দেশজয় হয় নাই।

১৬৭৮ সালের এপ্রিলের প্রথমভাগে দেশে ফিরিয়া শিবাজী কোপল অঞ্চল- অর্থাৎ বিজয়নগর শহরের উত্তরে তুঙ্গভদ্রা নদীর অপর তীর এবং তাহার পশ্চিমে গদগ মহাল জয় করিতে সৈন্য পাঠাইলেন। হুসেন খাঁ এবং কাসিম খাঁ মিয়ানা দুই ভাই বহলোল খাঁর স্বজাতি। কোপল প্রদেশ এই দুই আফগান ওমরার অধীনে ছিল। শিবাজী ১৬৭৮ সালে গদগ এবং পর বৎসর মার্চ মাসে কোপল অধিকার করিলেন। “কোপল দক্ষিণ দেশের প্রবেশ-দ্বার,” এখান হইতে তুঙ্গভদ্রা নদী পার হইয়া উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়া সহজেই মহীশূরে যাওয়া যায়। এই পথে প্রবেশ করিয়া মারাঠারা ঐ নদীর দক্ষিণে বেলারী ও চিতলদুর্গ জেলার অনেক স্থান অধিকার করিল, পলিগরদের বশে আনিল। এই অঞ্চলের বিজিত দেশগুলি একত্র করিয়া শিবাজীর রাজ্যের একটি নূতন প্রদেশ গঠিত হইল; উহার শাসনকর্তা হইলেন জনার্দন নারায়ণ হনুমন্তে।

শিবাজী দেশে ফিরিবার একমাস পরেই তাঁহার সৈন্যরা আবার শিবনের-দুর্গ রাত্রে আক্রমণ করিল। কিন্তু বাদশাহী কিলাদার আবদুল আজিজ খাঁ সজাগ ছিল– সে আক্রমণকারীদের আবার মারিয়া তাড়াইয়া দিল এবং বন্দী শত্রুদের মুক্তি দিয়া তাহাদের দ্বারা শিবাজীকে বলিয়া পাঠাইল, “যতদিন আমি কিলাদার আছি, ততদিন এ দুর্গ অধিকার করা তোমার কাজ নয়।“

এদিকে বিজাপুরের অবস্থা অতি শোচনীয় হইয়া পড়িল। উজীর সিদ্দি মাসুদই সৰ্ব্বেসৰ্ব্বা- বালক সুলতান তাহার হাতে পুতুলমাত্র। চারিদিকে নানা শত্রুর উৎপাতে উজীর অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন। মৃত বহুলোল খাঁর আফঘানদল তাঁহাকে নিত্য অপমান করে ও ভয় দেখায়; শিবাজী রাজ্যের সর্ব্বত্র অবাধে লুঠ করেন ও মহাল দখল করেন; রাজকোষে টাকা নাই; দলাদলির ফলে রাজশক্তি নিৰ্জ্জীব। আর অল্পদিন আগে যেসব শর্তে মুঘল সেনাপতির সহিত গুলবর্গায় তাঁহার সন্ধি হয়, তাহা বিজাপুর-রাজবংশের পক্ষে অত্যন্ত অপমান ও ক্ষতিজনক বলিয়া সকলে মাসুদকে ধিক্কার দিতে থাকে। চারিদিকে অন্ধকার দেখিয়া হতভম্ব মাসুদ শিবাজীর নিকট সাহায্য চাহিলেন, বলিলেন যে শিবাজীও এই আদিলশাহী বংশের নুন খাইয়াছেন এবং একদেশবাসী; মুঘলেরা তাঁহাদের দুজনেরই শত্রু, দুজনে মিলিত হইয়া মুঘলদের দমন করা উচিত। এই সন্ধির কথাবার্তার সংবাদ পাইয়া দিলির খাঁ রাগিয়া বিজাপুর আক্রমণ করিলেন (১৬৭৮ সালের শেষে)।

শম্ভুজীর পলায়ন ও দিলিরের সঙ্গে যোগদান

শিবাজীর জ্যেষ্ঠপুত্র শম্ভুজী যেন পিতার পাপের ফল হইয়া জন্মিয়া-ছিলেন। এই একুশ বৎসর বয়সেই তিনি উদ্ধত, খামখেয়ালি, নেশাখোর এবং লম্পট হইয়া পড়িয়াছেন। একজন সধবা ব্রাহ্মণীর ধর্ম নষ্ট করিবার ফলে ন্যায়পরায়ণ পিতার আদেশে তাঁহাকে পনহালা দুর্গে আবদ্ধ করিয়া রাখা হয়। সেখান হইতে শম্ভুজী নিজ স্ত্রী যেসু বাঈকে সঙ্গে লইয়া গোপনে পলাইয়া গিয়া দিলির খাঁর সহিত যোগ দিলেন (১৩ই ডিসেম্বর, ১৬৭৮)। শম্ভুজীকে পাইয়া দিলির খাঁর আহ্লাদ ধরে না। “তিনি যেন ইতিমধ্যে সমস্ত দাক্ষিণাত্য জয় করিয়াছেন এরূপ উল্লাস করিতে লাগিলেন এবং বাদশাহকে এই পরম সুখবর দিলেন।” আওরংজীবের পক্ষ হইতে শম্ভুজীকে সাত হাজারী মসর্, রাজা উপাধি এবং একটি হাতী দেওয়া হইল । তাহার পর দুজনে একসঙ্গে বিজাপুর দখল করিতে চলিলেন।

এই বিপদে সিদ্দি মাসুদ শিবাজীর শরণ লইলেন। শিবাজী অমনি ছয় সাত হাজার ভাল অশ্বারোহী বিজাপুর-রক্ষার জন্য পাঠাইলেন। তাহারা আসিয়া রাজধানীর বাহিরে খানাপুরা ও খসরুপুরা গ্রামে আড্ডা করিল এবং বলিয়া পাঠাইল যে বিজাপুর দুর্গের একটা দরজা এবং একটা বুরুজ তাহাদের হাতে ছাড়িয়া দেওয়া হউক। মাসুদ তাহাদের বিশ্বাস করিলেন না। তখন মারাঠারা বিজাপুর দখল করার এক ফন্দি পাকাইল :– কতকগুলি অস্ত্র চাউলের বস্তায় লুকাইয়া, বস্ত াগুলি বলদের পিঠে বোঝাই করিয়া, নিজেদের কতকগুলি সৈন্যকে বলদ-চালকের ছদ্মবেশে বাজারে পাঠাইবার ভাণ করিয়া দুর্গের মধ্যে ঢুকিতে চেষ্টা করিল! কিন্তু ধরা পড়িয়া তাহারা তাড়িত হইল। তাহার পর মারাঠারা এই বন্ধুর গ্রাম লুঠিতে আরম্ভ করিল। মাসুদ বিরক্ত হইয়া দিলির খাঁর সঙ্গে মিটমাট করিয়া ফেলিলেন, বিজাপুরে মুঘল-সৈন্য ডাকিয়া আনিলেন, আর মারাঠাদের তাড়াইয়া দিলেন।

দিলিরের ভূপালগড় জয়

তাহার পর শম্ভুজীকে সঙ্গে লইয়া দিলির খাঁ শিবাজীর ভূপালগড় তোপের জোরে কাড়িয়া লইলেন এবং এখানে প্রচুর শস্য, ধন, মালপত্র এবং অনেক লোককে ধরিলেন। এই সব বন্দীদের কতকগুলির এক হাত কাটিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইল, অবশিষ্ট সকলকে দাস করিয়া বিক্রয় করা হইল (২রা এপ্রিল, ১৬৭৯)। ঐ দুর্গের দেওয়াল ও বুরুজগুলি ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইল। তাহার পর ছোটখাট যুদ্ধ এবং বিজাপুরের দরবারে অশেষ দলাদলি ও ষড়যন্ত্র কয়েক মাস ধরিয়া চলিল; কোনই কিছু নিষ্পত্তি হইল না।

২রা এপ্রিল ১৬৭৯ সালে আওরংজীব হুকুম প্রচার করিলেন যে তাঁহার রাজ্যে সর্বত্র হিন্দুদের মানুষ গণিয়া প্রত্যেকের জন্য বৎসর বৎসর তিন শ্রেণীর আয় অনুসারে ১৩৫০- ৬.৬২ বা ৩৩১ “জজিয়া কর” লওয়া হইবে। বাদশাহর এই নূতন ও অন্যায় প্রজাপীড়নের সংবাদে শিবাজী তাঁহাকে নিম্নের সুন্দর পত্রখানি লেখেন। ইহা সুললিত ফারসী ভাষায় নীল প্রভুর দ্বারা রচিত হয়।

জজিয়া করের বিরুদ্ধে+ আওরংজীবের নামে শিবাজীর পত্র

“বাদশাহ আলমগীর, সালাম। আমি আপনার দৃঢ় এবং চিরহিতৈষী শিবাজী। ঈশ্বরের দয়া এবং বাদশাহর সূর্যকিরণ অপেক্ষাও উজ্জ্বলতার অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ দিয়া নিবেদন করিতেছি যে :-

যদিও এই শুভাকাঙ্ক্ষী দুর্ভাগ্যবশতঃ আপনার মহিমামণ্ডিত সন্নিধি হইতে অনুমতি না লইয়াই আসিতে বাধ্য হয়, তথাপি আমি, যতদূর সম্ভব ও উচিত, ভূত্যের কর্তব্য ও কৃতজ্ঞতার দাবি সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন করিতে সদাই প্রস্তুত আছি।***

এখন শুনিতেছি যে আমার সহিত যুদ্ধের ফলে আপনার ধন ও রাজকোষ শূন্য হইয়াছে এবং এই কারণে আপনি হুকুম দিয়াছেন যে জজিয়া নামক কর হিন্দুদের নিকট আদায় করা হইবে এবং তাহা আপনার অভাব পূরণ করিতে লাগিবে।

বাদশাহ সালাম। এই সাম্রাজ্য-সৌধের নির্মাতা আকবর বাদশাহ পূর্ণ- গৌরবে ৫২ [চান্দ্র] বৎসর রাজত্ব করেন। তিনি সকল ধৰ্ম্ম-সম্প্রদায়– যেমন, খৃষ্টান, ইহুদী, মুসলমান, দাদুপন্থী, নক্ষত্রবাদী [ফলকিয়া = গগন-পূজক?], পরী-পূজক [মালাকিয়া], বিষয়বাদী [আনসরিয়া], নাস্তিক, ব্রাহ্মণ ও শ্বেতাম্বরদিগের প্রতি– সাৰ্ব্বজনীন মৈত্রী [সুল্হ্-ই-কুল=সকলের সহিত শান্তি’র সুনীতি অবলম্বন করেন। তাঁহার উদার হৃদয়ের উদ্দেশ্যে ছিল সকল লোককে রক্ষা ও পোষণ করা। এইজন্যই তিনি “জগৎগুরু” নামে অমর খ্যাতি লাভ করেন।

তাহার পর বাদশাহ জহাঙ্গীর ২২ বৎসর ধরিয়া তাঁহার দয়ার ছায়া জগৎ ও জগৎবাসীর মস্তকের উপর বিস্তার করিলেন। তাঁহার হৃদয় বন্ধুদিগকে এবং হস্ত কার্য্যেতে দিলেন এইরূপে মনের বাসনাগুলি পূর্ণ করিলেন। বাদশাহ শাহাজহানও ৩২ বৎসর রাজত্ব করিয়া সুখী পার্থিব জীবনের ফল-স্বরূপ অমরতা– অর্থাৎ সজ্জনতা এবং সুনাম, অর্জ্জন করেন।

(পদ্য)

যে জন জীবনে সুনাম অর্জ্জন করে
সে অক্ষয় ধন পায়,
কারণ, মৃত্যুর পর তাহার পুণ্য চরিতের কথা তাহার
নাম জীবিত রাখো।।

আকবরের মহতী প্রবৃত্তির এমনি পুণ্য প্রভাব ছিল যে তিনি যেদিকে চাহিতেন, সেদিকেই বিজয় ও সফলতা অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিত। তাঁহার রাজত্বকালে অনেক অনেক দেশ ও দুর্গ জয় হয়। এই সব পূর্ব্ববর্ত্তী সম্রাটদের ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য্য ইহা হইতেই অতি সহজে বুঝা যায় যে আলমগীর বাদশাহ তাঁহাদের রাজনীতি অনুসরণ মাত্র করিতে গিয়া বিফল এবং বিব্রত হইয়া পড়িয়াছেন। তাঁহাদেরও জজিয়া ধার্য্য করিবার শক্তি ছিল। কিন্তু তাঁহারা গোঁড়ামীকে হৃদয়ে স্থান দেন নাই, কারণ তাঁহারা জানিতেন যে উচ্চ নীচ সব মনুষ্যকে ঈশ্বর বিভিন্ন ধর্ম্ম-বিশ্বাস ও প্রবৃত্তির দৃষ্টান্ত দেখাইবার জন্যই সৃষ্টি করিয়াছেন। তাঁহাদের দয়া- দাক্ষিণ্যের খ্যাতি তাঁহাদের স্মৃতিচিহ্নরূপে অনন্তকালের ইতিহাসে লিখিত রহিবে এবং এই তিন পবিত্র-আত্মা [সম্রাটের] জন্য প্রশংসা ও শুভ প্রার্থনা চিরদিন ছোটবড় সমস্ত মানবজাতির কণ্ঠে ও হৃদয়ে বাস করিবে। লোকের প্রাণের আকাঙ্ক্ষার ফলেই সৌভাগ্য দুর্ভাগ্য আসে। অতএব, তাঁহাদের ধনসম্পদ দিন দিন বাড়িয়াছিল, ঈশ্বরের জীবগুলি তাঁহাদের সুশাসনের ফলে শান্তিতে ও নিরাপদের শয্যায় বিরাম করিতে লাগিল এবং তাঁহাদের সর্ব্ব কৰ্ম্মই সফল হইল।

আর আপনার রাজত্বে? অনেক দুর্গ ও প্রদেশ আপনার হাতছাড়া হইয়াছে; এবং বাকীগুলিও শীঘ্রই হইবে, কারণ তাহাদের ধ্বংস ও ছিন্নভিন্ন করিতে আমার পক্ষে চেষ্টার অভাব হইবে না। আপনার রাজ্যে প্রজারা পদদলিত হইতেছে, প্রত্যেক গ্রামের উৎপন্ন দ্রব্য কমিয়াছে, –এক লাখের স্থানে এক হাজার, হাজারের স্থানে দশ টাকা মাত্র আদায় হয়; আর তাহাও মহাকষ্টে। বাদশাহ ও রাজপুত্রদের প্রাসাদে আজ দারিদ্র্য ও ভিক্ষাবৃত্তি স্থায়ী আবাস করিয়াছে; ওমরা ও আমলাদের অবস্থা ত সহজেই কল্পনা করা যাইতে পারে। আপনার রাজত্বকালে সৈন্যগণ অস্থির, বণিকেরা অত্যাচার-পীড়িত, মুসলমানেরা কাঁদিতেছে, হিন্দুরা জ্বলিতেছে, প্রায় সকল প্রজারই রাত্রে রুটি জোটে না এবং দিনে মনস্তাপে করাঘাত করায় গাল রক্তবর্ণ হয়।

এই দুর্দ্দশার মধ্যে প্রজাদের উপর জজিয়ার ভার চাপাইয়া দিতে কি করিয়া আপনার রাজ-হৃদয় আপনাকে প্রণোদিত করিয়াছে? অতি শীঘ্রই পশ্চিম হইতে পূর্ব্বে এই অপযশ ছড়াইয়া পড়িবে যে হিন্দুস্থানের বাদশাহ ভিক্ষুকের থলিয়ার প্রতিলুব্ধ-দৃষ্টি ফেলিয়া, ব্রাহ্মণ-পুরোহিত, জৈন, যতি, যোগী, সন্ন্যাসী, বৈরাগী, দেউলিয়া, ভিখারী, সর্ব্বস্বহীন ও দুর্ভিক্ষ-পীড়িত লোকদের নিকট হইতে জজিয়া কর লইতেছেন! ভিক্ষার ঝুলি লইয়া কাড়াকাড়িতে আপনার বিক্রম প্রকাশ পাইতেছে! আপনি তাইমুর-বংশের সুনাম ও মান ভূমিসাৎ করিয়াছেন!

বাদশাহ, সালাম। যদি আপনি খোদার কেতাব (অর্থাৎ কুরাণ)-এ বিশ্বাস করেন, তবে দেখিবেন লেখা আছে যে ঈশ্বর সর্ব্বজনের প্রভু (বর্-উল-আলমীন্), শুধু মুসলমানের প্রভু (রর্-উল্-মুস্‌লমীন্) নহেন। বস্তুতঃ ইসলাম ও হিন্দু ধৰ্ম্ম দুইটি পার্থক্যব্যঞ্জক শব্দ মাত্র; যেন দুইটি ভিন্ন রং যাহা দিয়া স্বর্গবাসীচিত্রকর রং ফলাইয়া মানবজাতির [নানাবর্ণে রঙ্গীন] চিত্রপট পূর্ণ করিয়াছেন।

মসজিদে তাঁহাকে স্মরণ করিবার জন্যই আজান্ উচ্চারিত হয়। মন্দিরে তাঁহার অন্বেষণে হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশ করিবার জন্যই ঘণ্টা বাজান হয়। অতএব, নিজের ধর্ম্ম ও ক্রিয়াকাণ্ডের জন্য গোঁড়ামী করা ঈশ্বরের গ্রন্থের কথা বদল করিয়া দেওয়া ভিন্ন আর কিছুই নহে। চিত্রের উপর নূতন রেখা টানিলে আমরা দেখাই যে চিত্রকর ভুল আঁকিয়াছিল!

প্রকৃত ধর্ম্ম অনুসারে জজিয়া কোনমতেই ন্যায্য নহে। রাজনীতির দিক হইতে দেখিলে, জজিয়া শুধু সেই যুগেই ন্যায্য হইতে পারে যে-যুগে সুন্দরী স্ত্রীলোক স্বর্ণালঙ্কার পরিয়া নির্ভয়ে এক প্রদেশ হইতে অপর প্রদেশে নিরাপদে যাইতে পারে। কিন্তু, আজকাল আপনার বড় বড় নগর লুঠ হইতেছে, গ্রামের ত কথাই নাই। জজিয়া ত ন্যায়বিরুদ্ধ, তাহা ছাড়া ইহা ভারতে এক নূতন অত্যাচার ও ক্ষতিকারক।

যদি আপনি মনে করেন যে প্রজাদের পীড়ন ও হিন্দুদের ভয়ে দমাইয়া রাখিলে আপনার ধাৰ্ম্মিকতা প্রমাণিত হইবে, তবে প্রথমে হিন্দুদের শীর্ষস্থানীয় মহারাণা রাজসিংহের নিকট হইতে জজিয়া আদায় করুন। তাহার পর আমার নিকট আদায় করা তত কঠিন হইবে না, কারণ আমি ত আপনার সেবার জন্য সদাই প্ৰস্তুত আছি। কিন্তু মাছি ও পিপীলিকাকে পীড়ন করা পৌরুষ নহে।

বুঝিতে পারি না কেন আপনার কর্ম্মচারীরা এমন অদ্ভুত প্রভুভক্ত যে তাহারা আপনাকে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানায় না, কিন্তু জ্বলন্ত আগুনকে খড় চাপা দিয়া লুকাইতে চায় ।

আপনার রাজসূর্য্য গৌরবের গগনে দীপ্তি বিকীর্ণ করিতে থাকুক!”

দিলিরের বিজাপুর আক্রমণ; শিবাজীর আদিল শাহের পক্ষে যোগদান

১৮ই আগষ্ট ১৬৭৯, দিলির খাঁ ভীমা নদী পার হইয়া বিজাপুর রাজ্য আক্রমণ করিলেন। মাসুদ নিরুপায় হইয়া শিবাজীর নিকট হিন্দুরাও নামক দূতের হাত দিয়া এই করুণ নিবেদন পাঠাইলেনঃ– “এই রাজ-সংসারের অবস্থা আপনার নিকট গোপন নহে। আমাদের সৈন্য নাই, টাকা নাই, খাদ্য নাই, দুর্গ-রক্ষার জন্য কোন সহায় নাই। শত্রু মুঘল প্রবল এবং সর্ব্বদা যুদ্ধ করিতে চায়। আপনি এই বংশের দুই পুরুষের চাকর, এই রাজাদের হাতে গৌরব সম্মান লাভ করিয়াছেন। অতএব, এই রাজবংশের জন্য অন্যের অপেক্ষা আপনার বেশী দুঃখ দরদ হওয়া উচিত। আপনার সাহায্য বিনা আমরা এই দেশ ও দুর্গ রক্ষা করিতে পারিব না। নিমকের সম্মান রাখুন; আমাদের দিকে আসুন; যাহা চান তাহাই দিব।”

ইহার উত্তরে শিবাজী বিজাপুর-রক্ষার ভার লইলেন; মাসুদের সাহায্যে দশ হাজার অশ্বারোহী ও দুই হাজার বলদ-বোঝাই রসদ ঐ রাজধানীতে পাঠাইয়া দিলেন এবং নিজ প্রজাদের হুকুম দিলেন, যে যত পারে খাদ্যদ্রব্য বস্ত্র প্রভৃতি বিজাপুরে বিক্রয় করুক। তাঁহার দূত বিসাজী নীলকণ্ঠ আসিয়া মাসুদকে সাহস দিয়া বলিলেন, “আপনি দুর্গ রক্ষা করুন, আমার প্রভু গিয়া দিলিরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিবেন।”

১৫ই সেপ্টেম্বর ভীমার দক্ষিণ তীরে ধূলখেড় গ্রাম হইতে রওনা হইয়া দিলির খাঁ ৭ই অক্টোবর বিজাপুরের ছয় মাইল উত্তরে পৌঁছিলেন। ঐ মাসের শেষে শিবাজী নিজে দশ হাজার সৈন্য লইয়া বিজাপুরের প্রায় পঞ্চাশ মাইল পশ্চিমে সেলগুড নামক স্থানে পৌঁছিলেন। পূর্ব্বে তাঁহার যে দশ হাজার অশ্বারোহী বিজাপুরের কাছে আসিয়াছিল, তাহারা এখানে তাঁহার সঙ্গে মিলিত হইল। সেলগুড হইতে শিবাজী নিজে আট হাজার সওয়ার লইয়া সোজা উত্তর দিকে এবং তাঁহার দ্বিতীয় সেনাপতি আনন্দ রাও দশ হাজার অশ্বারোহী লইয়া উত্তর-পূর্ব্ব দিকে মুঘল-রাজ্য লুঠ ও ভস্ম করিয়া দিবার জন্য ছুটিলেন। তিনি ভাবিলেন যে দিলির নিজ প্রদেশ রক্ষা করিবার জন্য শীঘ্রই বিজাপুর রাজ্য ছাড়িয়া ভীমা পার হইয়া উত্তরে ফিরিবেন। কিন্তু দিলির বিজাপুরী রাজধানী ও রাজাকে দখল করিবার লোভে নিজ প্রভুর রাজ্যের দুর্দ্দশার দিকে তাকাইলেন না।

দিলিরের নিষ্ঠুরতা, শম্ভুজীর পনহালায় ফিরিয়া আসা

বিজাপুরের মত প্রবল এবং বৃহৎ দুর্গ জয় করা দিলিরের কাজ নহে; স্বয়ং জয়সিংহও এখানে বিফল হইয়াছিলেন। একমাস সময় নষ্ট করিয়া ১৪ই নবেম্বর দিলির বিজাপুর শহর হইতে সরিয়া গিয়া তাহার পশ্চিমের ধনশালী নগর ও গ্রামগুলি লুঠিতে আরম্ভ করিলেন। এই অঞ্চল যে মুঘলেরা আক্রমণ করিবে তাহা কেহই ভাবে নাই, কারণ মুঘলদিগের পশ্চাতে রাজধানী তখনও অপরাজিত ছিল। সুতরাং এই দিক হইতে লোকে পলায় নাই, স্ত্রী পুত্র ধন নিরাপদ স্থানে সরায় নাই। এই অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুর হাতে পড়িয়া তাহাদের কঠোর দুর্দ্দশা হইল। “হিন্দু ও মুসলমান স্ত্রীলোকগণ সন্তান বুকে ধরিয়া বাড়ীর কুয়ায় ঝাঁপাইয়া পড়িয়া সতীত্ব রক্ষা করিল। গ্রামকে গ্রাম লুঠে উজাড় হইল। একটি বড় গ্রামে তিন হাজার হিন্দু মুসলমানদের (অনেকে নিকটবর্ত্তী ছোট গ্রামগুলির পলাতক আশ্রয়প্রার্থী) দাসরূপে বিক্রয় করিয়া দেওয়া হইল।”

এই মত অনেক ধ্বংস করিয়া, দিলির বিজাপুরের ৪৩ মাইল পশ্চিমে আীতে পৌঁছিলেন। তিনি এই প্রকাণ্ড ধনজনপূর্ণ বাজার লুঠ করিয়া পুড়াইয়া দিয়া স্থানীয় অধিবাসীদের ক্রীতদাস করিতে চাহিলেন (২০ নবেম্বর)। তাহারা সকলেই হিন্দু। শম্ভুজী এই অত্যাচারে বাধা দিলেন, দিলির তাঁহার নিষেধ শুনিলেন না। সেই রাত্রে শম্ভুজী নিজ স্ত্রীকে পুরুষের বেশ পরাইয়া দুজনে ঘোড়ায় চড়িয়া শুধু দশজন সওয়ার সঙ্গে লইয়া দিলির খাঁর শিবির হইতে গোপনে বাহির হইয়া পড়িলেন এবং পরদিন বিজাপুর পৌঁছিয়া মাসুদের আশ্রয় লইলেন। কিন্তু সেখানে থাকা নিরাপদ নয় বুঝিয়া আবার পলাইলেন, এবং পথে পিতার কতকগুলি সৈন্যের দেখা পাইয়া তাহাদের আশ্রয়ে পনহারালা পৌঁছিলেন (৪ঠা ডিসেম্বর, ১৬৭৯)।

শিবাজীর জালনা লুঠ ও মহাবিপদ হইতে উদ্ধার

ইতিমধ্যে শিবাজী ৪ঠা নবেম্বর সেলগুড হইতে বাহির হইয়া মুঘল-রাজ্যে ঢুকিলেন, দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া পথের দুধারে লুটিয়া পুড়াইয়া দিয়া ছারখার করিয়া চলিতে লাগিলেন। প্রায়দিনই তিনি জানা শহর (আওরঙ্গাবাদের ৪০ মাইল পূর্ব্বে) লুঠ করিলেন। কিন্তু এই জনপূর্ণ বাণিজ্যের কেন্দ্রে তেমন ধন পাওয়া গেল না। তখন জানিতে পারিলেন যে জানার সব মহাজনেরা নিজ নিজ টাকাকড়ি শহরের বাহিরে সৈয়দ জান্ মহম্মদ নামক মুসলমান সাধুর আশ্রয়ে লুকাইয়া রাখিয়াছে, কারণ সকলেই জানিত যে শিবাজী সব মন্দির ও মসজিদ, মঠ ও পীরের আস্তানা মান্য করিয়া চলিতেন, তাহাতে হাত দিতেন না। তখন মারাঠা- সৈন্যগণ ঐ আশ্রমে ঢুকিয়া পলাতকদের টাকা কাড়িয়া লইল, কাহাকেও কাহাকেও জখম করিল। সাধু তাঁহার আশ্রমের শান্তি ভঙ্গ করিতে নিষেধ করায় তাহারা গালি দিল ও মারিতে উদ্যত হইল। তখন ক্রোধে সেই মহাশক্তিমান পুণ্যাত্মা পুরুষ শিবাজীকে অভিসম্পাত করিলেন। ইহার পাঁচমাস পরে শিবাজীর অকাল-মৃত্যু হইল; সকলেই বলিল যে পীরের ক্রোধের ফলেই এরূপ ঘটিয়াছি।

মারাঠা-সৈন্য চারিদিন ধরিয়া জানা নগর এবং তাহার শহরতলীর গ্রাম ও বাগান লুঠ করিয়া দেশের দিকে– অর্থাৎ পশ্চিমে ফিরিল। সঙ্গে অগণিত লুঠের টাকা, মণি, অলঙ্কার, বস্ত্র, হাতী, ঘোড়া ও উট, সেজন্য তাহারা ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। রণমস্ত খাঁ নামে একজন চট্‌পটে সাহসী মুঘল-ফৌজদার এই সময় মারাঠা-সৈন্যদের পশ্চাতে আসিয়া আক্রমণ করিলেন। শিধোজী নিম্বলকর পাঁচ হাজার সৈন্য লইয়া তাঁহার দিকে ফিরিয়া বাধা দিল; তিন দিন ধরিয়া যুদ্ধ হইল, শিধোজী ও তাহার দুই হাজার সৈন্য মারা পড়িল। আর, ইতিমধ্যে মুঘল- দাক্ষিণাত্যের রাজধানী আওরঙ্গাবাদ হইতে অনেক সৈন্য রণমস্ত খাঁর দলপুষ্টি করিবার জন্য আসিতেছিল। তৃতীয় দিন তাহারা যুদ্ধক্ষেত্র হইতে ছয় মাইল দূরে পৌঁছিয়া রাত্রির জন্য থামিল। শিবাজী চারিদিকে ঘেরা হইয়া ধরা পড়েন আর কি! কিন্তু ঐ নূতন সৈন্যগণের সর্দ্দার কেশরী সিংহ গোপনে সেই রাত্রে শিবাজীকে পরামর্শ দিয়া পাঠাইল যে সামনের পথ বন্ধ হইবার আগেই তিনি যেন সৰ্ব্বস্ব ত্যাগ করিয়া তৎক্ষণাৎ দেশে পলাইয়া যান। অবস্থা প্রকৃতই খুব সঙ্কটাপন্ন দেখিয়া শিবাজী লুঠের মাল, নিজের দু-হাজার ঘোড়া ইত্যাদি সব সেখানে ফেলিয়া মাত্ৰ পাঁচশত বাছা বাছা ঘোড়সওয়ার সঙ্গে লইয়া স্বদেশের দিকে রওনা হইলেন। তাঁহার সুদক্ষ প্রধান চর বহিরজী একটি অজানা পথ দেখাইয়া দিয়া তিন দিন তিন রাত্রি ধরিয়া তাঁহাকে অবিরাম কুচ করাইয়া নিরাপদ স্থানে আনিয়া পৌঁছাইয়া দিল। শিবাজীর প্রাণ রক্ষা হইল; কিন্তু, এই যুদ্ধে ও পলায়নে তাঁহার চারি হাজার সৈন্য মারা পড়ে, সেনাপতি হাম্বীর রাও আহত হন এবং অনেক সৈন্য মুঘলদের হাতে বন্দী হয়।

লুঠের জিনিষ সমস্ত ফেলিয়া দিয়া মাত্র পাঁচশত রক্ষীর সহিত শিবাজী অবসন্নদেহে পাট্টা দুর্গে পৌঁছিলেন (২২ নবেম্বর)। ইহা নাসিক শহরের ২০ মাইল দক্ষিণে এবং তলঘাট ষ্টেশনের ২০ মাইল পূর্ব্বে। এখানে কিছু দিন বিশ্রাম করিবার পর আবার তিনি চলিবার শক্তি ফিরিয়া পাইলেন, এজন্য পাট্টাকে “বিশ্রামগড়” নাম দিলেন।

শেষ পারিবারিক বন্দোবস্ত

ইহার পর ডিসেম্বর মাসের প্রথমে তিনি রায়গড়ে গিয়া সেখানে তিন সপ্তাহ কাটাইলেন। শম্ভুজী পনহালাতে ফিরিয়া আসায় (৪ঠা ডিসেম্বর), শিবাজী স্বয়ং সেই দুর্গে জানুয়ারির প্রথমে গেলেন। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহে একদল মারাঠা- সৈন্য খান্দেশে ঢুকিয়ে ধরণগাঁও, চোপ্রা প্রভৃতি বড় বড় বাজার লুঠিয়াছিল।

জ্যেষ্ঠপুত্রের চরিত্র ও বুদ্ধির কথা ভাবিয়া শিবাজী নিজ রাজ্য ও বংশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ হইলেন। তাঁহার নানা উপদেশ ও মিষ্ট কথায় কোন ফল হইল না। শিবাজী পুত্রকে নিজের বিশাল রাজ্যের সমস্ত মহাল দুর্গ ধনভাণ্ডার অশ্ব গজ ও সৈন্যদলের তালিকা দেখাইলেন এবং সৎ ও উচ্চমনা রাজা হইবার জন্য নানা উপদেশ দিলেন। শম্ভুজী পিতার কথা শুধু চুপ করিয়া শুনিয়া উত্তর দিলেন, “আপনার যাহা ইচ্ছা তাহাই হউক।” শিবাজী স্পষ্টই বুঝিলেন তাঁহার মৃত্যুর পর শম্ভুজীর হাতে মহারাষ্ট্র রাজ্যের কি দশা হইবে। এই দুর্ভাবনা ও হতাশা তাঁহার আয়ু হ্রাস করিল। শম্ভুজীকে আবার পনহালা-দুর্গে বন্দী করিয়া রাখা হইল এবং শিবাজী রায়গড়ে ফিরিয়া আসিলেন (ফেব্রুয়ারি ১৬৮০)। তাঁহার দিন ফুরাইয়া আসিয়াছে বুঝিয়া, শিবাজী তাড়াতাড়ি কনিষ্ঠ পুত্র দশ বৎসরের বালক রাজারামের উপবীত ও বিবাহ দিলেন (৭ই ও ১৫ই মার্চ)।

শিবাজীর মৃত্যু

২৩-এ মার্চ শিবাজীর জ্বর ও রক্ত-আমাশয় দেখা দিল। বারো দিন পর্য্যন্ত পীড়ার কোন উপশম হইল না। ক্রমে সব আশা ফুরাইল। তিনিও নিজ দশা বুঝিয়া কর্মচারীদের ডাকিয়া শেষ উপদেশ দিলেন; ক্রন্দনশীল আত্মীয়স্বজন, প্রজা ও সেবকদের বলিলেন, “জীবাত্মা অবিনশ্বর, আমি যুগে যুগে আবার ধরায় আসিব।” তাহার পর চির-যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইয়া অন্তিমের সকল ক্রিয়াকর্ম্ম করাইলেন।

অবশেষে চৈত্র পূর্ণিমার দিন (রবিবার, ৪ঠা এপ্রিল, ১৬৮০) সকালে তাঁহার জ্ঞান লোপ হইল, তিনি যেন ঘুমাইয়া পড়িলেন। দ্বিপ্রহরে তাহা অনন্ত নিদ্ৰায় পরিণত হইল। মারাঠা জাতির নবজীবন-দাতা কর্ম্মক্ষেত্র শূন্য করিয়া বীরদের বাঞ্ছিত অমরধামে চলিয়া গেলেন। তখন তাঁহার বয়স ৫৩ বৎসরের ছয় দিন কম ছিল।

সমস্ত দেশ স্তম্ভিত, বজ্রাহত হইল। হিন্দুর শেষ আশা ডুবিল।

তথ্যনির্দেশ

১. লণ্ডনের রয়েল এসিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত ফারসী হস্তলিপির অনুবাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *