০৭. শিবাজীর স্বাধীন রাজ্য স্থাপন

সপ্তম অধ্যায় – শিবাজীর স্বাধীন রাজ্য স্থাপন

মুঘলদের হাত হইতে দুর্গ-উদ্ধার

আওরংজীবের দরবার হইতে পলাইয়া আসিয়া শিবাজী তিন বৎসর (১৬৬৭- ১৬৬৯) চুপচাপ ছিলেন। তাহার পর, ১৬৭০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমেই আবার যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া দিলেন। দাক্ষিণাত্যে মুঘল-কর্ম্মচারীরা কিছুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। শিবাজী দ্রুতগতিতে চারিদিকে সতেজ আক্রমণ করিয়া গোলমাল সৃষ্টি করায় তাহারা একেবারে বিব্রত হইয়া পড়িল। তাহাদের অধীন কত গ্রাম লুঠ হইল, পুরন্দর-সন্ধিতে পাওয়া সাতাইশটি দুর্গের মধ্যে অনেকগুলি বাদশাহর হাতছাড়া হইল। মুঘল-কর্মচারীদের অনেকে নিজ নিজ দুর্গে বা থানায় যুদ্ধ করিয়া মরিল, অপরে হতাশ হইয়া স্থান ত্যাগ করিয়া সরিয়া পড়িল।

ইহার মধ্যে কোশুনা-জয়ের কাহিনী এখনও মারাঠা-দেশে লোকেরা মুখে মুখে গান করে। শিবাজী তাঁহার মহাকায় মাব্‌লে সেনাপতি ও বাল্যবন্ধু তানাজী মাল্সরেকে এই দুর্গ আক্রমণ করিতে পাঠাইলেন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে তিনশত বাছা বাছা মাব্‌লে পদাতিক লইয়া তানাজী অন্ধকার রাত্রে দড়ির সিঁড়ি লাগাইয়া পর্ব্বতের উত্তর-পশ্চিম গা বাহিয়া উপরে উঠিলেন; অসভ্য কোলী-জাতীয় কয়েকজন স্থানীয় লোক তাঁহাকে গুপ্ত পথ দেখাইয়া দিল। দুর্গপ্রাচীরে পৌঁছিয়াই সেখানকার বাদশাহী প্রহরীদের নিহত করিয়া তাঁহারা ভিতরে ঢুকিলেন। কিলাদার উদয়ভান এবং তাঁহার রাজপুত সেনারা দুর্গ রক্ষা করিতেছিল। ‘শত্রু আসিয়াছে’ এই চীৎকার শুনিয়া তাহারা সেদিকে অগ্রসর হইল। কিন্তু শীতের রাত্রে আফিংখোর রাজপুতরা তাড়াতাড়ি শয্যাত্যাগ করিতে পারিল না। ইতিমধ্যে মারাঠারা দুর্গ-প্রাচীরের এক অংশ বেশ দখল করিয়া বসিয়াছে। যখন রাজপুতগণ আসিয়া পৌঁছিল, মারাঠারা “হর হর মহাদেব” শব্দে তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। উদয়ভান তানাজীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিলেন। পরস্পরের তরবারির আঘাতে দুই সেনানীই মারা গেলেন। কিন্তু তানজীর ভাই সূর্য্যাজী সামনে আসিয়া বলিলেন, “সৈন্যগণ! ভাই মারা পড়িয়াছেন, কিন্তু ভয় নাই। আমি তোমাদের নেতা হইব।” নেতার পতনে রাজপুতেরা কিছুক্ষণ হতভম্ব হইয়া রহিল। আর অমনি মারাঠারা আবার রুখিয়া তাহাদের আক্রমণ করিল। ইতিমধ্যে তাহারা দুর্গের দরজা খুলিয়া দেওয়ায় আরও অনেক মারাঠী সৈন্য নীচ হইতে ভাল পথ দিয়া দুর্গে ঢুকিল। অবশেষে এই নিষ্ফল যুদ্ধে বারো শত রাজপুত মারা পড়িল, অনেকে পাহাড়ের গা বাহিয়া পলাইতে গিয়া নীচে পড়িয়া প্রাণ হারাইল।

বিজয়ী মারাঠারা দুর্গের ভিতরের আস্তাবলের খড়ের ছাদে আগুন ধরাইয়া দিল। পাঁচ ক্রোশ দূরে রাজগড় হইতে সেই আলো দেখিয়া শিবাজী বুঝিলেন যে তাঁহার জয় হইয়াছে। পরদিন যখন সকল সংবাদ পাইলেন, তখন দুঃখ করিয়া বলিলেন, “গড়টা পাইলাম বটে, কিন্তু সিংহকে হারাইলাম।” তিনি কোণ্ডানার নাম বদলাইয়া “সিংহগড়” করিলেন এবং তানাজীর পরিবারকে অনেক পুরস্কার দিলেন।

এইরূপে কোণ্ডানা, পুরন্দর, কল্যাণ-ভিবী, মাহুলী প্রভৃতি অনেক দুর্গ শিবাজীর হাতে আসিল। মুঘল সেনাপতিদের মধ্যে একমাত্র দাউদ খাঁ কুরেশী যুদ্ধ করিয়া কিছু ফললাভ করিলেন, কিন্তু তিনি একলা কত দিক সামলাইবেন?

দাক্ষিণাত্যে মুঘলদিগের গৃহ-বিবাদ

আওরংজীব শিবাজীর নূতন বিদ্রোহের সংবাদ পাইবামাত্র আরও অনেক সৈন্য ও সেনাপতি মহারাষ্ট্রে পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। গৃহবিবাদে মুঘলদের সকল চেষ্টা পণ্ড হইয়া গেল। দাক্ষিণাত্যের সুবাদার কুমার মুয়জ্জম এবং তাঁহার প্রিয়পাত্র যশোবন্ত সিংহের সহিত দাক্ষিণাত্যে সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ মুঘল-বীর ও সেনাপতি দিলির খাঁর মর্মান্তিক শত্রুতা ছিল। তাহার উপর নিন্দুকেরা বাদশাহকে বলিল যে, কুমার নিজকে স্বাধীন করিবার চেষ্টায় আছেন। এ-পক্ষ ও-পক্ষের বিরুদ্ধে বাদশাহর নিকট নালিশ করিতে লাগিল। দিলিরের ভয় হইল, সুবাদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গেলে কুমার তাঁহাকে কয়েদ করিতে পারেন! অবশেষে (আগষ্ট ১৬৭০) গভীর বর্ষার মধ্যে দিলির প্রাণভয়ে মহারাষ্ট্র দেশ ছাড়িয়া উত্তর-ভারতের দিকে পলাইলেন। আর মুয়জ্জম এবং যশোবন্ত তাপ্তী নদী পর্য্যন্ত সৈন্যসহ তাঁহাকে তাড়া করিয়া গেলেন এবং এই অবাধ্য কৰ্ম্মচারীকে দমন করিবার জন্য শিবাজীর সাহায্য চাহিয়া পাঠাইলেন |

ইহার ফলে শিবাজীর জয়জয়কার হইল; কোথাও তাঁহাকে বাধা দিবার কেহ নাই। ইংরাজ-কুঠীর সাহেব লিখিলেন, “শিবাজী আগে চোরের মত গোপনে দ্রুত চলিতেন। কিন্তু এখন আর তাঁহার সে অবস্থা নাই। তিনি প্রবল সৈন্যদল, ত্রিশ হাজার যোদ্ধা লইয়া দেশ জয় করিতে করিতে অগ্রসর হইতেছেন। শাহজাদা যে এত কাছে রহিয়াছেন, সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করেন না।”

এই বৎসর (১৬৭০) ৩রা অক্টোবর শিবাজী আবার সুরত-বন্দর লুঠ করিলেন। একমাস আগে হইতে সকলেই শুনিতেছিল যে, তিনি কল্যাণ শহরে অনেক অশ্বারোহী সৈন্য একত্র করিতেছেন এবং প্রথমেই সুরত আক্রমণ করিবেন। এমন কি ইংরেজরা এই লুঠ সম্বন্ধে এত নিশ্চিত ছিল যে, আগেই তাহাদের সুরত- কুঠী হইতে সব টাকাকড়ি, মালপত্র এবং কার্য্যনির্ব্বাহক সভার লোকজন পর্য্যন্ত সুহায়িলীতে সরাইয়া ফেলিয়াছিল। অথচ সুরতের মুঘল-শাসনকৰ্ত্তা এমন অলস ও অন্ধ যে অত-বড় ধনশালী শহর রক্ষার জন্য সে শুধু তিনশত সৈন্য রাখিয়াছিল।

৩রা অক্টোবর প্রাতে শিবাজী পনের হাজার সৈন্যসহ সুরতে প্রবেশ করিলেন। তাহার পূর্ব্বদিন ও রাত্রে সমস্ত ভারতীয় বণিক– এমন কি সরকারী কর্মচারীরাও শহর ছাড়িয়া দূরে পলাইয়া গিয়াছিল। ১৬৬৪ সালে প্রথম লুঠের পর বাদশাহর আজ্ঞায় সুরতের চারিদিক একটা ইটপাথরের দেওয়াল দিয়া ঘেরা হইয়াছিল, বটে, কিন্তু তাহা এত সামান্য যে শিবাজীর পনের হাজার লোকের সম্মুখে তিনশত মুঘল-চৌকীদার দাঁড়াইতে পারিল না, তাহারা দুর্গের মধ্যে পলাইয়া গেল।

দুইদিন একবেলা ধরিয়া মারাঠারা এই পরিত্যক্ত শহর লুঠ করিল। ডাচ্- কুঠীতে খবর পাঠাইল– “যদি তোমরা চুপচাপ করিয়া থাক তবে তোমাদের কোন অনিষ্ট হইবে না।” তাহারা তাহাই করিল। ফরাসী-কুঠীর সাহবেরা মূল্যবান উপহার দিয়া মারাঠাদের খুশী করিল। সুহায়িলী হইতে আনা পঞ্চাশজন জাহাজী- গোরা (বিখ্যাত ট্রেনস্-হ্যাম মাষ্টারের অধীনে) ইংরাজ-কুঠী রক্ষা করিল; যে মারাঠাদল উহা লুঠ করিতে আসিয়াছিল ইংরাজদের অব্যর্থ বন্দুকের গুলিতে তাহাদের এত লোক মারা গেল যে আর কেহ সেদিকে অগ্রসর হইল না। পারসী ও তুর্কী বণিকদের দুর্গের মত “নূতন সরাই”ও রক্ষা পাইল।

ফরাসী-কুঠীর সামনে “তাতার সরাই”য়ে কাশঘরের পদচ্যুত রাজা আবদুল্লা খাঁ মক্কা হইতে কয়েকদিন আগে ফিরিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। নিকটের কয়েকটি গাছের আড়াল হইতে মারাঠারা প্রথম দিন সরাই-এর ওপর গুলি চালাইতে লাগিল। তাহাতে অতিষ্ঠ হইয়া রাত্রে সকলে ভিতর হইতে পলাইয়া গেল। মারাঠারা রাজার ধনসম্পত্তি, আওরংজীবের দেওয়া সোনার খাট এবং অন্যান্য মূল্যবান উপহার সব দখল করিল।

মারাঠারা অবসর-মত অবাধে বড় বড় বাড়ী লুঠ করিয়া সুরত হইতে ৬৬ লক্ষ টাকার ধনরত্ন লইয়া ৫ই অক্টোবর দুপুর বেলা তাড়াতাড়ি শহর ত্যাগ করিল। লুঠের পর তাহারা এত জায়গায় আগুন লাগাইয়া দিয়াছিল যে প্রায় অর্দ্ধেক শহর পুড়িয়া ছাই হইয়াছিল। প্রথম দিনের আক্রমণে ইংরাজদের গুলিতে অনেক মারাঠা মারা পড়ায় শিবাজীর সৈন্যগণ প্রতিহিংসা লইবার জন্য তৃতীয় দিন ইংরাজ-কুঠীর সামনে আসিয়া “কুঠী পুড়াইব” বলিয়া চেঁচাইতে লাগিল। কিন্তু তাহাদের নেতারা জানিত যে আবার আক্রমণ করিলে আরও লোক মারা যাইবে। শেষে একটা নিষ্পত্তি হইল। দুইজন ইংরাজ-বণিক শহরের বাহিরে শিবাজীর শিবিরে গিয়া কিছু লাল বনাত, তরবারি এবং ছুরি উপহার দিল। রাজা তাহাদের প্রতি বেশ মিষ্ট ব্যবহার করিলেন এবং তাহাদের হাত ধরিয়া বলিলেন, “ইংরাজেরা আমার বন্ধু; আমি তাহাদের কোন অনিষ্ট করিব না। “

সুরতের দুর্দ্দশা

সুরত ছাড়িবার সময় শিবাজী শহরের শাসনকর্তা এবং প্রধান বণিকদের নামে এই মৰ্ম্মে এক চিঠি পাঠাইলেন যে, যদি তাহারা তাঁহাকে বৎসর বৎসর বারো লাখ টাকা কর না দেয়, তবে তিনি আগামী বৎসর আসিয়া শহরের বাকী ঘরগুলিও পুড়াইয়া দিয়া যাইবেন।

যেই মারাঠারা সুরত হইতে বাহির হইল, অমনি শহরের গরিব লোকগুলি (যাহারা পলায় নাই) সব বাড়ীতে ঢুকিয়া যাহা অবশিষ্ট ছিল তাহাও লুঠ করিতে লাগিল। ইংরাজ-কুঠীর জাহাজী-গোরারাও এই কাজে যোগ দিল!

যখন সুরতে তিনদিন ধরিয়া এই লুঠ চলিতেছিল, তখন পাঁচ-ছয় ক্রোশ পশ্চিমে সুহায়িলী বন্দরে ইংরাজদের গুদাম এবং কুঠীতে সুরত-কুঠীর সাহেবগুলি ছাড়া সুরত শহরের শাহ-বন্দর (অর্থাৎ জাহাজী মালের দারোঘা), প্রধান কাজী এবং বড় বড় হিন্দু, মুসলমান ও আরমানী বণিক আশ্রয় লইয়াছিল। মারাঠারা আসিবে আসিবে বলিয়া দুই-একদিন একটা জনরব উঠিয়াছিল; সকলে তাহাতে ভীত ও চঞ্চল হইয়াছিল বটে, কিন্তু ইংরাজেরা জেটীর ধারে আটটা তোপ রাখিয়া বন্দর রক্ষার সুন্দর বন্দোবস্ত করিয়াছিল এবং কোনই বিপদ ঘটে নাই।

এইরূপে জনকতক বিদেশী দোকানদার মারাঠাদের তুচ্ছ করিয়া নিজেদের বল দেখাইল; আর ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরোবা’-র শাসনকর্তা ও সৈন্যগণ ভয়ে পলাইল। এই দৃশ্য দেখিয়া দেশের লোক বিস্মিত হইল। সুরতের শ্রেষ্ঠ ধনী হাজি সাইদ্ বেগ্‌-এর পত্র সুহায়িলীতে আশ্রয় পাইয়া বলিলেন, “আমি সপরিবারে বোম্বাই চলিয়া যাইব– বাদশাহী রাজ্যে আর বাস করিব না।

একটা কথা আছে, বাঘে যাহাকে একবার ঘাল্ করিয়া ছাড়িয়া দেয়, সে লোক পরে বাঁচিলেও মরার সামিল হইয়া থাকে। শিবাজীর দুই-দুইবার লুঠের পরে সুরতেরও সেই দশা হইল। শিবাজী ঐদিকে আসিতেছেন, মারাঠা সৈন্য সুরতের পঞ্চাশ ক্রোশ দক্ষিণে কোলী-দেশে ঢুকিয়াছে– এই সব জনরব ঘন ঘন সুরতে পৌঁছিতে লাগিল। আর অমনি লোকজন শহর ছাড়িয়া পলাইতে সুরু করিল এবং দেখিতে দেখিতে সেই প্রকাণ্ড বন্দর মরুদেশের মত নির্জ্জন নিস্তব্ধ হইয়া পড়িল। ইংরাজ ও অন্যান্য সাহেব-বণিকেরা নিজ কুঠী খালি করিয়া টাকা ও মাল তাড়াতাড়ি সুহায়িলীতে পাঠাইয়া দিলেন।

বৎসরের পর বৎসর এইরূপ ঘটিতে লাগিল। ফলে ভারতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বন্দরের বাণিজ্য ও সমৃদ্ধি একেবারে লোপ পাইল।

ডিণ্ডোরীর যুদ্ধ

৫ই অক্টোবর সুরত ছাড়িয়া শিবাজী দক্ষিণ-পূর্ব্বে বগলানা প্রদেশে প্রবেশ করিলেন এবং মূলের দুর্গের নীচের গ্রামগুলি লুঠিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে শাহজাদা মুয়াজ্জম দিলির খাঁর পিছু লইয়া প্রায় বুর্হানপুর পর্য্যন্ত যাইবার পর বাদশাহর হুকুমে সেখান হইতে সবেমাত্র আওরঙ্গাবাদে ফিরিয়াছেন, এমন সময় তিনি দ্বিতীয়বার সুরত- লুঠের সংবাদ পাইলেন। তিনি অমনি দাউদ খাঁকে মারাঠাদের বিরুদ্ধে পাঠাইলেন। দাউদ খাঁ চান্দোর-দুর্গের কাছে পৌঁছিয়া শুনিলেন যে, সেখান হইতে পাঁচ ক্রোশ পশ্চিমে ঐ লম্বা গিরিশ্রেণীর মধ্যে একটা সরু পথ দিয়া শিবাজী বগলানা হইতে নামিয়া উত্তর-মহারাষ্ট্রে (অর্থাৎ নাসিক জেলায়) ঢুকিবেন। মধ্যরাত্রে মুঘলদের চরেরা আসিয়া পাকা খরব দিল যে, শিবাজী ঐ গিরিসঙ্কট পার হইয়া অর্দ্ধেক সৈন্য লইয়া নাসিকের দিকে দ্রুত অগ্রসর হইতেছেন, আর তাঁহার বাকী অর্দ্ধেক সৈন্য মাল ও পশ্চাৎ রক্ষা করিবার জন্য ঐ গিরিসঙ্কটের মুখে দাঁড়াইয়া আছে।

দাউদ খাঁ তৎক্ষণাৎ আবার অগ্রসর হইলেন। সেদিন কার্ত্তিক শুক্লাচতুৰ্দ্দশী; তৃতীয় প্রহর রাত্রিতে চাঁদ ডুবিল এবং অন্ধকারে মুঘল-সৈন্যগণ শ্রেণী ভাঙ্গিয়া ছড়াইয়া পড়িল। তাহাদের অগ্রগামী বিভাগের নেতা ছিলেন- বিখ্যাত পাঠান-বীর ইখ্লাস খাঁ মিয়ানা। প্রভাত হইলে (১৭ই অক্টোবর) তিনি একটি ছোট পাহাড়ের উপর হইতে দেখিলেন যে, নীচের মাঠে মারাঠারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া তাঁহার দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া আছে। মুঘল-সৈন্যগণ উটের পিঠ হইতে বৰ্ম্ম ও অস্ত্র নামাইয়া সাজ করিতে লাগিল; কিন্তু ইলাস খাঁর বিলম্ব সহিল না, তিনি জনকতক মাত্র লোক লইয়া ঘোড়া ছুটাইয়া শত্রুদের আক্রমণ করিলেন। কিন্তু মারাঠারা সংখ্যায় আট হাজার; তাহাদের বড় বড় নেতা– প্রতাপ রাও (সেনাপতি), আনন্দ রাও প্রভৃতি উপস্থিত।[১] শীঘ্রই ইখ্লাস্ খাঁ আহত হইয়া ঘোড়া হইতে পড়িয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পরে দাউদ খাঁ আসিয়া পৌঁছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আরও সৈন্য পাঠাইয়া দিলেন। প্রাতঃকাল হইতে ছয় সাত ঘণ্টা ধরিয়া ভীষণ কাটাকাটি চলিল। মারাঠা বর্গীরা মুঘলদের চারিদিকে ঘোড়া ছুটাইয়া ঘুরিতে লাগিল, যেন তাহাদের সব পথ রোধ করিবে। দাউদ খাঁর দলের অনেকে মারা গেল, অনেকে আহত হইল। কিন্তু বুন্দেলা রাজপুতদের বন্দুকের ভয়ে মারাঠারা বেশী কাছে আসিল না। অবশেষে দাউদ খাঁ স্বয়ং রণক্ষেত্রে আসিয়া তোপের সাহায্যে শত্রুদের তাড়াইয়া দিলেন এবং নিজপক্ষীয় আহত লোকজনদের উদ্ধার করিলেন।

যখন বেলা দুই প্রহর তখন উভয় পক্ষই ক্লান্ত হইয়া যুদ্ধ স্থগিত রাখিয়া খাইতে গেল। সন্ধ্যার আগে মারাঠারা আবার আক্রমণ করিল, তাহারা আট হাজার, আর দাউদ খাঁর সঙ্গে দু হাজার মাত্র লোক, তথাপি তোপের জোরে বাদশাহী দল রক্ষা পাইল। রাত্রিতে মারাঠারা কোঁকনের দিকে চলিয়া গেল; তাহাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়াছে, একদিন এক রাত্রি মুঘলদের সেখানে থামাইয়া রাখিয়া তাহারা সুরত বগলানার লুঠ নিরাপদে দেশে লইয়া যাইতে পারিল।

ডিণ্ডোরীর যুদ্ধের ফলে ইহার পর এক মাসেরও অধিক কাল মুঘল শক্তি নিস্তে জ হইয়া রহিল। দাউদ খাঁ আহত সৈন্যদের লইয়া নাসিকে এবং পরে আহমদনগরে গিয়া বিশ্রাম করিলেন। কিন্তু এই বৎসরের শেষে (১৬৭০) তাঁহাকে আবার এখানে আসিতে হইল।

প্রথমবার বেরাব ও বগলানা লুঠ

সুরত-লুঠের পর মারাঠারা দেড়মাস নিশ্চেষ্ট ছিল। কিন্তু ১৬৭০ সালের ডিসেম্বরের প্রথমে শিবাজী আবার সসৈন্য বাহির হইলেন; পথে চাণ্ডোর গিরিশ্রেণীতে অহিবন্ত ও অন্যান্য কয়েকটি উঁচু পাহাড়ী দুর্গ জয় করিয়া তিনি বগলানার মধ্য দিয়া দ্রুতবেগে খান্দেশ প্রদেশে ঢুকিলেন এবং তাহার রাজধানী বুহানপুর শহরের বাহিরের গ্রামগুলি লুঠিলেন। তাহার পর হঠাৎ পূর্ব্বদিকে ফিরিয়া উর্ব্বর ও ধনশালী বেরার প্রদেশ আক্রমণ করিলেন। এ পর্য্যন্ত মারাঠারা এতদূর আসে নাই, কাজেই বেরারের কেহই এই বিপদের জন্য প্রস্তুত ছিল না। শিবাজী অবাধে মনের সুখে কারিঞ্জা নামক খুব সমৃদ্ধিশালী শহর হইতে এক কোটি টাকা মূল্যের ধনরত্ন, অলঙ্কার ও মূল্যবান কাপড় লইলেন। লুঠের জিনিস চারি হাজার বলদ ও গাধার পিঠে বোঝাই করিয়া এবং শহরের সমস্ত ধনী লোককে[২] টাকা আদায়ের জন্য বন্দী করিয়া শিবাজী বেরারের অন্যান্য শহরে চলিলেন এবং সেখানে অগাধ ধন লুঠিলেন। সৰ্ব্বত্রই লোকেরা ভয়ে শিবাজীকে লিখিয়া দিল যে, তাহারা বৎসর বৎসর তাঁহাকে চৌথ, অর্থাৎ বাদশাহী খাজানার এক-চতুর্থাংশ, কর দিবে।

মুঘলেরা উপযুক্ত কোনই বাধা দিতে পারিল না। বেরারের বাদশাহী সুবাদার অলস ধীর নবাবী চালে চলেন, আর খান্দেশের সুবাদার এবং কুমার মুয়জ্জমের মধ্যে এমন ঝগড়া ছিল যে যুদ্ধ বাধে আর কি!

শিবাজী স্বয়ং যখন বেরারে যান তখন আর একদল মারাঠা সৈন্য পেশোয়া মোরো ত্র্যম্বকের অধীনে পশ্চিম-খান্দেশ লুঠিতে থাকে। এখন শিবাজী ফিরিয়া আবার বগলানায় আসিলে, এই দল তাঁহার সহিত যোগ দিয়া বিখ্যাত সালের-দুর্গ জয় করিল (৫ই জানুয়ারি, ১৬৭১) এবং মূলের, ধোড়প প্রভৃতি অন্যান্য বড় পাৰ্ব্বত্য দুর্গ অবরোধ করিল, গ্রাম লুঠিল, শস্য চলাচল বন্ধ করিল। ফলতঃ এই অঞ্চলে মুঘলেরা অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল, অথচ তাহাদের আত্মরক্ষার মত বল বা বড় নেতা কেহ নাই।

শিবাজী ও ছত্রশাল বুন্দেলার সাক্ষাৎ

১৬৭০ সালের শেষভাগে যখন এই-সব যুদ্ধ চলিতেছিল, তখন বিখ্যাত বুন্দেলা রাজা চম্পৎ রায়ের পুত্র ছত্রশাল শিবাজীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। ইনিই পরে পান্না-রাজ্য এবং ছত্রপুর শহর প্রতিষ্ঠা করিয়া, দীর্ঘকাল রাজত্বের পর ১৭৩১ সালে মারা যান। কিন্তু এ সময় তিনি তরুণ যুবক মাত্র এবং দাক্ষিণাত্যে মুঘল সৈন্যদলে অল্প বেতনের মনসবদার। এরূপ চাকরিতে অসন্তুষ্ট হইয়া ছত্রশাল একদিন শিকারের ভাণ করিয়া সন্ত্রীকে মুঘল-শিবির হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন এবং ঘোরা পথ দিয়া মহারাষ্ট্রে পৌঁছিয়া শিবাজীর অধীনে বাদশাহর সঙ্গে যুদ্ধ করিবার জন্য সেনাপতির পদ চাহিলেন। কিন্তু শিবাজী দক্ষিণী ভিন্ন ভারতের অন্য প্রদেশের লোককে বিশ্বাস করিতেন না অথবা উচ্চপদ দিতেন না। তিনি ছাত্রশালকে এই বলিয়া ফেরত পাঠাইয়া দিলেন– “বীরবর! যাও, নিজ দেশ অধিকার করিয়া তথায় রাজ্য স্থাপন কর, আর শত্রু জয় কর। তোমার পক্ষে সেখানে গিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করাই শ্রেয়, কারণ তোমার বংশের খ্যাতির জন্য অনেকে তোমার সঙ্গে যোগ দিবে। যদি মুঘলেরা তোমাকে আক্রমণ করিতে আসে, আমি এদিক হইতে তাহাদের উপর গিয়া পড়িব এবং এইরূপে দুই শত্রুর মধ্যে পড়িয়া তাহারা সহজেই পরাস্ত হইবে।” ছত্রশাল ক্ষুণ্নমনে ফিরিয়া আসিলেন।[৩]

শিবাজীর বগলানা অধিকার

সমস্ত ১৬৭০ সাল ধরিয়া শিবাজীর আশ্চর্য্য তেজ ও ক্ষিপ্র গতিবিধি, নানাক্ষেত্রে জয়লাভ এবং অতি দূর দূর প্রদেশ লুঠ করা দেখিয়া বাদশাহ আওরংজীব বড়ই চিন্তিত হইলেন। প্রথমতঃ তিনি মহাবৎ খাঁকে দাক্ষিণাত্যের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করিলেন এবং তাঁহার সঙ্গে দাউদ খাঁকে রাখিয়া দিলেন। নিজ জাতভাই এবং অন্যান্য অনেক রাজপুত-সেনাসহ রাজা অমর সিংহ চন্দাবৎকে বিস্তর টাকা, গোলাবারুদ ও রসদ দিয়া মহারাষ্ট্রে পাঠান হইল।

মহাবৎ খাঁ ১০ই জানুয়ারি, ১৬৭১ আওরঙ্গাবাদে পৌঁছিয়া কিছুদিন পরে চাণ্ডোর জেলায় গেলেন, অমনি কিন্তু সহকারী দাউদ খাঁর সহিত তাঁহার ঝগড়া বাধিয়া গেল। তিন মাসে মুঘলেরা এখানে প্রায় কিছুই করিতে পারিল না। শিবাজী ধোড়প-দুর্গ অবরোধ করিয়া বিফল হইয়াছিলেন বটে (ডিসেম্বরের শেষ), কিন্তু পরের মাসে সালের-দুর্গ জয় করিলেন। মার্চ মাসের প্রথমে দাউদ খাঁ মারাঠাদের হাত হইতে অহিবন্ত গড় কাড়িয়া লইলেন। তাঁহার এই গৌরবে মহাবৎ খাঁ ঈর্ষায় ক্ষেপিয়া গেলেন। তাহার পর আর যুদ্ধ করা হইল না। প্রধান সেনাপতি সৈন্যসহ নাসিক এবং পরে পারনের নগরে ছয় মাস ধরিয়া বিশ্রাম করিতে এবং বাঈজীদের নাচ দেখিতে লাগিল!

এই-সব শুনিয়া বাদশাহ বিরক্ত হইয়া অক্টোবর, ১৬৭১ সালে বাহাদুর খাঁ ও দিলির খাঁকে গুজরাত হইতে মহারাষ্ট্রে পাঠাইলেন। এই দুই বিখ্যাত সেনাপতি সালের-দুর্গ অবরোধ করিবার জন্যই ইখলাস খাঁ মিয়ানা, রাজা অমর সিংহ চন্দাবৎ এবং অন্য কর্ম্মচারীদের রাখিয়া, নিজেরা আহমদনগর হইয়া পুণা জেলা আক্রমণ করিলেন। দিলির খাঁ পুণা দখল করিয়া নয় বৎসরের কম বয়স্ক বালক ছাড়া আর- সব লোককে হত্যা করিলেন (ডিসেম্বর)। কিন্তু ইহার এক মাস পরেই মুঘলদের এক ভীষণ পরাজয় হইল। বগলানায় তাহাদের যে দল সালের-দুর্গ অবরোধ করিয়া বসিয়াছিল, ১৬৭২ জানুয়ারির শেষে প্রধান সেনাপতি প্রতাপ রাও, দ্বিতীয় সোনপতি আনন্দ রাও এবং পেশোয়া মোরো ত্র্যম্বক অসংখ্য সৈন্য লইয়া হঠাৎ আসিয়া সেই মুঘলদলকে আক্রমণ করিলেন; তাহারা প্রাণপণ লড়িল, কিন্তু সংখ্যায় কম বলিয়া পারিয়া উঠিল না। রাজা অমর সিংহ এবং অন্যান্য অনেক সেনাপতি এবং হাজার হাজার সাধারণ সিপাহী মারা গেল, আর অমর সিংহের পুত্র মুহম্ সিংহ, ইখলাস খাঁ এবং ৩০ জন প্রধান কর্ম্মচারী আহত ও বন্দী হইল; তাহাদের সমস্ত মালপত্র ও তোপ মারাঠারা লইয়া গেল।

তাহার পরই পেশোয়া মুলের-দুর্গ জয় করিলেন। ইহার ফলে সমস্ত বগলানা প্রদেশে মারাঠা আধিপত্য নিষ্কণ্টক হইল। বগলানা সুরত যাইবার পথ। চারিদিকে শিবাজীর নাম ছড়াইয়া পড়িল, সকলে ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। মুঘল-সেনাপতি দুইজন (বাহাদুর ও দিলির) যুদ্ধে বিফল হইয়া লজ্জার মাথা হেঁট করিয়া নিজ সীমানায় আহমদনগরে ফিরিয়া আসিলেন। পুণা ও নাসিক জেলা (অর্থাৎ মারাঠাদের দেশ) বাঁচিল।

এদিকে মার্চ মাসে সৎনামী বিদ্রোহ এবং এপ্রিল মাসে খাইবার গিরিসঙ্কটের পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আওরংজীব এত বিব্রত হইলেন যে কিছুদিন ধরিয়া দক্ষিণে আর সৈন্য ও টাকা পাঠান অসম্ভব হইল। জুন মাসে (১৬৭২) শাহজাদা মুয়জ্জমের স্থানে বাহাদুর খাঁ দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত হইলেন। কুমার ও মহাবৎ খাঁ দুজনেরই উত্তর-ভারতে ডাক পড়িল।

কোলী-দেশ অধিকার

তাহার পর শিবাজীর জয়জয়কার। সুরত হইতে দক্ষিণে বম্বের দিকে আসিতে যে পাহাড় ও জঙ্গলপূর্ণ দেশ পার হইতে হয়, তাহাতে কোলী নামক অসভ্য দস্যুজাতির বাস। সে সময় এখানে ইহাদের দুইটি ছোট রাজ্য ছিল;– ধরমপুর (রাজধানী রামনগর, বর্তমান নাম ‘নগর’, সুরতের ৬০ মাইল দক্ষিণে) এবং জওহার (রামনগরের ৪০ মাইল দক্ষিণে)। এই রামনগরের ঠিক পূর্ব্বদিকে সহ্যাদ্রি পৰ্ব্বতশ্রেণী পার হইলে নাসিক জেলা বা উত্তর-মহারাষ্ট্র। ১৬৭২ সালের ৫ই জুন পেশোয়া মোরো ত্র্যম্বক জওহার অধিকার করিলেন। সেখানকার রাজা বিক্রম শাহ মুঘল-রাজ্যে পলাইয়া গেলেন। ইহার অল্পদিন পরে রামনগরও দখল করা হইল, তাহার রাজা সোমসিংহ পোর্তুগীজ শহর দামনে আশ্রয় লইলেন।

মারাঠারা এত কাছে স্থায়ী আড্ডা গাড়াতে সুরত শহর ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। রামনগরে বসিয়া পেশোয়া সুরতের শাসনকর্তা ও প্রধান বণিকদের নামে উপরি উপরি তিনখানা পত্র পাঠাইয়া চারিলক্ষ টাকা কর চাহিলেন এবং বলিলেন যে, এই টাকা না দিলে তিনি সুরত দখল করিবেন। শেষ চিঠিতে শিবাজীর জবানী এইরূপ লেখা ছিল: “আমি তিনবারের বার এই শেষবার তোমাদের বলিতেছি যে, সুরত প্রদেশের খাজনার এক সিকি অর্থাৎ চৌথ আমাকে পাঠাইয়া দাও। তোমাদের বাদশাহ আমাকে নিজ দেশ ও প্রজা রক্ষা করিবার জন্য প্রকাণ্ড সৈন্যদল রাখিতে বাধ্য করিয়াছেন; সুতরাং তাঁহার প্রজারই এই সৈন্যদলের খরচ জোগাইবে। যদি এই টাকা শীঘ্র না পাঠাও, তরে আমার জন্য একটা বড় বাড়ী প্রস্তুত রাখিও, আমি গিয়া সেখানে বসিয়া থাকিব এবং সুরতের খাজনা এবং মালের মাশুল আদায় করিয়া লইব। এখন আমাকে বাধা দিতে পারে এমন লোক তোমাদের মধ্যে কেহ নাই।”

এই পত্র পাইবার পর সুরতে পরামর্শের জন্য সভা বসিল। শহরবাসী এবং আশপাশের গ্রামের প্রধান লোকদিগের উপর তিনলক্ষ টাকা চাঁদা তোলার ভার দেওয়া হইল। কিন্তু অনেক আলোচনার পর লোকেরা কিছুই দিল না, কারণ তাহারা বেশ জানিত যে শহরের মুঘল-শাসনকৰ্ত্তা সব টাকা নিজে খাইয়া ফেলিবে, মারাঠাদের শান্ত করিবার জন্য কিছুই দিবে না।

তাহার পর যতবারই মারাঠারা এদিকে আসিতেছে বলিয়া গুজব উঠিত, ততবারই সুরতবাসীরা পলাইবার পথ খুঁজিত। এই কাণ্ড অনেক বৎসর ধরিয়া চলিল।

১৬৭২, জুলাই মাসে পেশোয়া নাসিক জেলায় ঢুকিয়া লুঠপাঠ আরম্ভ করিলেন। সেখানকার দুইজন মুঘল-থানাদার পরাস্ত হইয়া পলাইল। অক্টোবর-নবেম্বর মাসে মারাঠা অশ্বারোহীরা দ্রুতবেগে বেরার ও তেলিঙ্গানায় প্রবেশ করিয়া রামগির জেলা লুঠ করিতে লাগিল। মুঘল সেনাপতি বাহাদুর খাঁ কিছুতেই তাহাদের ধরিতে পারিলেন না। তাহারা দ্রুতগতি নিজদেশে ফিরিয়া আসিল, কিন্তু মুঘলেরা পিছু পিছু থাকিয়া তাহাদের হাত হইতে অনেক লুঠ করা ঘোড়া ও বণিকদের মাল উদ্ধার করিল। আওরঙ্গাবাদের কাছে একটি ছোট যুদ্ধে মারাঠারা পরাস্ত হইল । ফলতঃ তাহাদের এবারকার বেরার-আক্রমণ প্রায় সম্পূর্ণ নিষ্ফল হইল।

বিজাপুরের সহিত শিবাজীর সন্ধিভঙ্গ

পর বৎসর (১৬৭৩) মহারাষ্ট্রে তেমন কোন বড় যুদ্ধ বা বিশেষ লাভ-লোকসান হইল না। সুবাদার বাহাদুর খাঁ ভীমা নদীর তীরে পেড়গাঁও-এ শিবির স্থাপন করিয়া পথঘাটের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে লাগিলেন।

এই বৎসর শিবাজী নিজ জন্মস্থান শিবনের-দুর্গ অধিকার করিবার এক চেষ্টা করেন। আওরংজীব এই দুর্গটি আবদুল আজিজ খাঁ নামক একজন ব্রাহ্মণ মুসলমানের জিম্মায় রাখিয়াছিলেন। সেই লোকটি যেমন বিশ্বাসী তেমনি চতুর ও কাৰ্য্যদক্ষ। শিবাজী তাহাকে “পৰ্ব্বতপ্রমাণ টাকার স্তূপ” ঘুষ দিতে চাহিলেন, আর সেও সম্মতির ভাণ করিয়া একটা নির্দ্দিষ্ট রাত্রে দুর্গ ছাড়িয়া দিবে বলিয়া স্বীকার করিল। সেই রাত্রে শিবাজীর সাত হাজার সৈন্য দুর্গের কাছে পৌঁছিল। কিন্তু আবদুল আজিজ ইতিমধ্যে বাহাদুর খাঁকে গোপনে খবর দিয়াছিল। মারাঠারা আসিয়া ফাঁদে পড়িল। তাহাদের অনেকে মরিল, অনেকে জখম হইল, বাকী সকলে হতাশ হইয়া ফিরিয়া গেল।

কিন্তু অন্যদিকে শিবাজীর এক মহাসুযোগের পথ খুলিয়া গিয়াছিল। ২৪-এ নবেম্বর (১৬৭২) বিজাপুরের রাজা দ্বিতীয় আলি আদিল শাহ প্রাণত্যাগ করিলেন এবং তাঁহার স্থানে চারি বৎসরের শিশু সিকন্দর রাজা হইলেন। তাঁহার অভিভাবক পদ লইয়া বিজাপুরের বড় বড় ওমরাদের মধ্যে মহা ঝগড়া বাধিয়া গেল। রাজ্যময় গোলমাল ও বিদ্রোহ দেখা দিল। বিজাপুরের নূতন উজীর খাওয়াস্ খাঁর সহিত শিবাজী আর পূর্ব্বের সদ্ভাব বজায় রাখিলেন না, ঐ রাজ্যে উৎপাত সুরু করিয়া দিলেন।

পনহালা-জয়

১৬৭৩, ৬ই মার্চ, কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর রাত্রিতে শিবাজীর সেনাপতি কোণ্ডাজী ফজন্দ ষাটজন বাছা বাছা মাব্‌লে পদাতিক লইয়া নিঃশব্দে পনহালা-দুর্গের উপরে চড়িলেন। তাঁহার সৈন্যগণ হাত ধরাধরি করিয়া পরস্পরকে পাহাড়ের প্রায় খাড়া গা বাহিয়া টানিয়া তুলিল। চূড়ায় পৌঁছিয়া তাহারা চারিদলে ভাগ হইয়া চারিদিক হইতে ভেরী বাজাইয়া দুর্গের মধ্যে ছুটিয়া চলিল। গম্ভীর নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত্রে, বাহিরের সমতলভূমি হইতে নহে, দুর্গের মধ্যে হইতে এই হঠাৎ আক্রমণে দুর্গ- রক্ষকেরা হতভম্ব হইয়া পড়িল। চারিদিকে ছুটাছুটি ও পলায়ন আরম্ভ হইল। কোণ্ডাজী স্বয়ং দুর্গস্বামীকে তরবারি দিয়া কাটিয়া ফেলিলেন। হিসাবের প্রধান কর্মচারী নাগোজী পণ্ডিত গোলমাল শুনিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া একজন প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে?” সে বলিল, “আরে ঠাকুর! জান না মারাঠারা দুর্গ লইয়াছে, আর দুর্গস্বামী মারা পড়িয়াছেন?” অমনি নাগোজী সৰ্ব্বস্ব ছাড়িয়া দ্রুতবেগে পলায়ন করিলেন। ধরা পড়িলে তাঁহাকে মারিয়া টাকাকড়ি আদায় করা হইত ।

তখন নীচ হইতে আর-সব মারাঠা সৈন্য দুর্গে ঢুকিল। ক্রমে প্রভাত হইল। সমস্ত দুর্গ শিবাজীর অধিকারে আসিল।[৪] বিজাপুরী কর্মচারীদের নিজের এবং সরকারী সব ধনসম্পত্তি কোথায় লুকান আছে প্রহারের চোটে জানিয়া লইয়া মারাঠারা তাহা দখল করিল। সংবাদ পাইয়া শিবাজী নিজে শীঘ্র আসিয়া দুর্গটি দেখিলেন এবং সেখানে একমাস থাকিয়া দেওয়াল মজবুত করিয়া, আরও কামান আনাইয়া পনহালাকে নিজের অজেয় আশ্রয়স্থলে পরিণত করিলেন। কিছুদিনের মধ্যে পারলি এবং সাতারা দুর্গও তাঁহার লাভ হইল।

উমরাণীর যুদ্ধ

এতগুলি দুর্গ হাতছাড়া হওয়ায় বিজাপুরের রাজসভায় মহা আন্দোলন পড়িয়া গেল। নূতন উজীর খাওয়াস্ খাঁর অবহেলায় এই সব ক্ষতি হইয়াছে বলিয়া সকলে তাঁহাকে দোষ দিতে লাগিল। বহলোল খাঁকে পনহালা উদ্ধার করিতে পাঠান হইল এবং আর তিনজন বড় সেনাপতিকে দূর দূর প্রদেশ হইতে নিজ সৈন্য সহিত আসিয়া বহলোলকে সাহায্য করিবার জন্য হুকুম গেল।

কিন্তু এই সকল সাহায্য পৌঁছিবার পূর্ব্বেই শিবাজী বহলোলকে আক্রমণ করিলেন। তাঁহার প্রধান সেনাপতি প্রতাপ রাও পনের হাজার অশ্বারোহীসহ দুই রাত্রি গোপনে দ্রুত কুচ করিয়া আসিয়া উমরাণী নামক গ্রামে (বিজাপুর শহরের ১৮ ক্রোশ পশ্চিমে) বহলোকের সৈন্যদলকে একেবারে ঘিরিয়া ফেলিলেন এবং তাহাদের জলাশয়ে যাইবার একমাত্র পথ বন্ধ করিয়া দিলেন (১৫ই এপ্রিল)। পরদিন প্রাতে মারাঠারা দলে দলে ঢেউয়ের মত বার-বার বিজাপুরী-সৈন্যদের আক্রমণ করিল। সারাদিন ধরিয়া যুদ্ধ চলিল; অনেকে মরিল, অনেকে আহত হইল। বহলোলের আফঘান-সৈন্যগণ প্রাণপণে লড়িয়া নিজস্থান রক্ষা করিল। অবশেষে রণক্ষেত্রে সন্ধ্যা নামিল। দুই পক্ষ ক্লান্ত হইয়া নিজ নিজ শিবিরে ফিরিয়া গেল। কিন্তু বিজাপুরীদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এক বিন্দু জল জুটিল না।

তখন বহলোল গোপনে প্রতাপ রাওকে অনেক টাকা ঘুষ পাঠাইয়া দিলেন এবং বলিলেন, “আমাকে পলাইয়া যাইবার জন্য একদিকের পথ ছাড়িয়া দাও। তোমরা আমার শিবিরের সব জিনিস লইও।” তাহাই করা হইল। বহলোল রাতারাতি শত্রুব্যূহের মধ্যে একটি ফাঁক দিয়া কুচ করিয়া বিজাপুরে ফিরিয়া গেলেন। একথা শুনিয়া শিবাজী অত্যন্ত রাগিয়া প্রতাপ রাওকে তিরস্কার করিলেন।

তাহার পর কয়েক মাস ধরিয়া কানাড়া প্রদেশে যুদ্ধ চলিল, কিন্তু কোন পক্ষেই বড় কিছু হইল না। শিবাজী চারিদিকে অবাধগতিতে চলাফেরা ও লুঠ করিতে লাগিলেন। ১০ই অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিন তিনি স্বয়ং কানাড়া আক্রমণ করিতে রওনা হইলেন। কিন্তু দুই মাস পরেই বিজাপুরীরা তাঁহাকে সেখান হইতে ফিরিতে বাধ্য করিল। এবার তাঁহার তেমন কিছু লাভ হইল না।

সেনাপতি প্রতাপ রাও-এর মৃত্যু

এই পরাজয়ের অপমান মুছিয়া ফেলিবার জন্য ১৬৭৪, জানুয়ারি মাসে শিবাজী প্রতাপ রাওকে আবার পাঠাইয়া দিয়া বলিলেন, “বহলোল আমার রাজ্যে বার-বার আসিতেছে। তুমি সৈন্য লইয়া যাও এবং তাহাকে চূড়ান্তরূপে পরাস্ত কর! নচেৎ আর কখন আমাকে মুখ দেখাইও না।”

প্রভুর তিরস্কারে ক্ষুব্ধ হইয়া প্রতাপ রাও বহুলোলের খোঁজে বাহির হইলেন এবং কোলাপুরের ৪৫ মাইল দক্ষিণে ঘাটপ্রভা নদীর কিছু দূরে নেসরী নামক গ্রামে তাঁহাকে পাইলেন। বিজাপুরী-সৈন্য দেখিবামাত্র প্রতাপ রাও দিগ্‌-বিদিক্ জ্ঞান হারাইয়া ঘোড়া ছুটাইয়া তাহাদের উপর গিয়া পড়িলেন। শুধু ছয়জন অনুচর তাঁহার সঙ্গে চলিল, বাকী সৈন্য এই পাগলের কাণ্ড দেখিয়া পিছাইয়া রহিল। কিন্তু প্রতাপ রাও-এর পশ্চাতে দৃষ্টি নাই, কথা শুনিবার সময় নাই। তাঁহার সম্মুখে দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়া একটি সরু পথ, ও-পারে বহলোলের লোক দাঁড়াইয়া। এই পথে ঢুকিয়া শত্ৰুবেষ্টিত প্রতাপ ও তাঁহার ছয়জন সঙ্গী শীঘ্রই নিহত হইলেন। তখন বিজাপুরীরা বিজয় উল্লাসে মারাঠাদের উপর ছুটিয়া আসিয়া অনেককে কাটিয়া ফেলিল, “রক্তের নদী বহিল।” (২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৬৭৪)।

অন্যান্য যুদ্ধ

আনন্দ রাও ছত্রভঙ্গ মারাঠা-সৈন্যগণকে সাহস দিয়া আবার একত্র করিলেন। শিবাজী তাঁহাকে সেনাপতি নিযুক্ত করিয়া লিখির পাঠাইলেন, “শত্রুকে পরাজিত না করিতে পারিলে জীবন্ত ফিরিও না।” তখন আনন্দ রাও তাঁহার অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া বিজাপুর রাজ্যের মধ্যে ঢুকিলেন। দিলির ও বহলোল খাঁ মিলিত হইয়া তাঁহার পথ রোধ করিলেন। কিন্তু আনন্দ রাও প্রত্যহ ৪৫ মাইল করিয়া এত দ্রুত কুচ করিলেন যে দুই খাঁ-ই অপারগ হইয়া পথ হইতে ফিরিয়া গেলেন।

তাহার পর আনন্দ রাও দক্ষিণে ঘুরিয়া কানাড়ায় প্রবেশ করিলেন। সাঁপগাঁও শহরের বাজার (পেঠ) লুঠিয়া সাড়ে সাত লাখ টাকা পাইলেন (২৩ মার্চ)। দশ ক্রোশ দূরে বঙ্কাপুর নগরের কাছে বহলোল ও খিজির খাঁর অধীনে একদল বিজাপুরী-সৈন্য পরাস্ত করিয়া পাঁচ শত ঘোড়া, দুইটি হাতী এবং শত্রুদলের যথাসৰ্ব্বস্ব কাড়িয়া লইলেন। কিন্তু বহলোল শীঘ্রই ফিরিয়া প্রচণ্ড বেগে তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন। মারাঠারা এক হাজার ঘোড়া ও লুঠের মালের কতক ফেলিয়া দিয়া হালকা হইয়া অবশিষ্ট লুট লইয়া নিরাপদে নিজ দেশে ফিরিল।

৮ই এপ্রিল শিবাজী চিপলুন নগরে এই-সব বিজয়ী সৈন্যদের মহলা (রিভিউ) দেখিলেন, তাহাদের অনেক পুরস্কার দিলেন এবং হংসাজী মোহিতেকে “হাম্বীর রাও” উপাধি দিয়া প্রতাপ রাও-এর স্থানে সৰ্ব্বপ্রধান সেনাপতির পদে নিযুক্ত করিলেন।

১৬৭৩ সালের ডিসেম্বর হইতে পর বৎসরের মার্চ মাস পর্যন্ত কোঁকনে ও অন্যত্র যুদ্ধ খুব ঢিলা তালে চলিল। দুই পক্ষেরই সৈন্যেরা ক্লান্ত ও বিরক্ত হইয়া কাজে গা লাগাইল না। তাহাদের নেতারাও যুদ্ধ করিয়া বিবাদ নিষ্পত্তি করা অপেক্ষা লুঠতরাজ অধিক লাভজনক দেখিয়া তাহাতেই মন দিল। এই বৎসর শীতকালে অতিবৃষ্টি হওয়ায় মহারাষ্ট্রে মড়ক দেখা দিল। তাহাতে অনেক ঘোড়া ও মানুষ মরিল।

বাদশাহ ৭ই এপ্রিল (১৬৭৪) দিল্লী হইতে রওনা হইয়া উত্তর-পশ্চিমে আফঘান-সীমানায় গেলেন, কারণ খাইবার পর্ব্বতের আফ্রিদি জাতি ভীষণ বিদ্ৰোহ আরম্ভ করিয়াছিল। দিলির খাঁকে দাক্ষিণাত্য হইতে ফিরাইয়া আনা হইল। সেখানে বাহাদুর খাঁ একা পড়িয়া রহিলেন; তাঁহার পক্ষে এত কম সৈন্য লইয়া কিছু করা অসম্ভব হইল। এই সুযোগে শিবাজী মহা আড়ম্বরে নিজের রাজ্যাভিষেক-ক্রিয়া সম্পন্ন করিলেন।

তথ্যনির্দেশ

১. শিবাজী এই যুদ্ধে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন না, সুতরাং কার্ম্মায়করের আধুনিক ব্রঞ্জ প্যানেল ঐতিহাসিক সত্যের বিরোধী।

২. কিন্তু কারিঞ্জার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ধরা পড়েন নাই। তিনি স্ত্রীলোকের পোষাক পরিয়া নিরাপদে পলাইয়াছিলেন। তিনি জনিতেন যেখানে শিবাজী স্বয়ং উপস্থিত সেখানে কোনো মারাঠা সৈন্য স্ত্রীলোকের উপর হাত তুলিতে সাহস পাইবে না।

৩. তিনি পরে কি করিলেন তাহার বিবরণ আমার History of Aurangzib vol. 5, Ch. 61-এ ও Irvine’s Later Mughals, ii. ch. 8-এ আছে।

8. জেধে শব্দাবলিতে লেখা আছে যে শিবাজী ঘুষ দিয়া (দুর্গের একদিককার রক্ষীদের হাত করিয়া) পনহালা দখল করেন। আমারও তাহাই সত্য বলিয়া মনে হয়, কারণ এমন অজেয় দুর্গ রক্ষা করিবার জন্য তেমন কোন চেষ্টাই হয় নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *