০৬. শিবাজী ও আওরংজীবের সাক্ষাৎ

ষষ্ঠ অধ্যায় – শিবাজী ও আওরংজীবের সাক্ষাৎ

শিবাজীর আগ্রা যাইবার উদ্দেশ্য

পুরন্দরের সন্ধিতে (জুন, ১৬৬৫) শিবাজী এই একটি শর্ত্ত করিয়াছিলেন যে, অনান্য করদ-রাজার মত তাঁহাকে স্বয়ং গিয়া বাদশাহর দরবারে উপস্থিত থাকিতে হইবে না। তবে দাক্ষিণাত্যে কোন যুদ্ধ বাধিলে তিনি বাদশাহী পক্ষকে সসৈন্য সাহায্য করিবেন। কিন্তু বিজাপুর-আক্রমণের পর (জানুয়ারি, ১৬৬৬) জয়সিংহ নানা যুক্তি দেখাইয়া শিবাজীকে বুঝাইলেন যে, বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলে তাঁহার অনেক প্রকার লাভ হইবে। ফন্দিবাজ রাজপুত-রাজা শিবাজীর খুব প্রশংসা করিয়া বলিলেন যে, এরূপ চতুর ও কর্ম্মক্ষম বীরের সঙ্গে আলাপ করিলে তাঁহার গুণে মোহিত হইয়া বাদশাহ হয়ত তাঁহাকে সৈন্য ও অর্থ দিয়া বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা বিজয়ে নিযুক্ত করিবেন এবং এই অবসরে শিবাজী নিজামশাহী অর্থাৎ‍ আহমদ-নগরের লুপ্ত রাজ্যের বাকী প্রদেশগুলি দখল করিয়া তথায় তাঁহার অধিকার নিষ্কণ্টক ও স্থায়ী করিতে পারিবেন। এ পর্য্যন্ত কোন মুঘল সেনাপতিই বিজাপুরকে কাবু করিতে পারেন নাই, এমন কি স্বয়ং আওরংজীব যখন যুবরাজ, তখন তিনিও বিফল হইয়াছিলেন। এ কাজ কেবল শিবাজীর পক্ষেই সম্ভব।

শিবাজীরও কয়েকটি প্রার্থনা ছিল; বাদশাহের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে হাত করিতে না পারিলে তাহা পূর্ণ হইবার সম্ভাবনা নাই। যেমন, জঞ্জিরার জলবেষ্টিত দুর্গ দখলে না আসিলে শিবাজীর কোঁকন-রাজ্য সম্পূর্ণ সুরক্ষিত হয় না; অথচ উহার হাবশী মালিক সিদ্দি শিবাজীর হস্তে দুর্গটি সমর্পণ করিতে একেবারে অসম্মত; শিবাজীও তাহা অধিকার করিতে গিয়া বার-বার পরাস্ত হইয়াছেন। সিদ্দি এখন বাদশাহর অধীন হইয়াছে, তাঁহার ভয়-ভরসা রাখে; সুতরাং বাদশাহর হুকুম পাইলে সে ঐ দুর্গ শিবাজীকে দিতে বাধ্য হইবে। এ বিষয়ে দিল্লীতে দরখাস্ত পাঠাইয়া শিবাজী কোনই ফল পান নাই। স্বয়ং সাক্ষাৎ করিলে কার্য্যসিদ্ধির সম্ভাবনা।

কিন্তু দিল্লীতে যাইবার কথায় প্রথমে শিবাজীর ও তাঁহার আত্মীয়-স্বজনের মনে মহা ভাবনা উপস্থিত হইল। একে ত তিনি বনজঙ্গলে ও গ্রামে প্রতিপালিত ও বর্দ্ধিত, কখন নগর বা রাজসভা দেখেন নাই। তাহার উপর, তাঁহাদের চক্ষে যবন বাদশাহ রাবণের অবতার, হাতে পাইয়া আওরংজীব যদি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া শিবাজীকে বন্দী করেন বা মারিয়া ফেলিবার হুকুম দেন, তখন কি হইবে? কিন্তু জয়সিংহ কঠিন শপথ করিয়া বলিলেন যে, বাদশাহ সত্যবাদী এবং আশ্বাস দিলেন যে, তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার রামসিংহ দরবারে থাকিয়া শিবাজীর রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন। শিবাজী দেখিলেন, দিল্লীতে গেলে মোটের উপর ভয় অপেক্ষা লাভের আশাই বেশী।

শিবাজীর আগ্রাযাত্রা– দেশে বন্দোবস্ত ও পথের কথা

যাহা হউক, পাছে মুঘল রাজধানীতে যাইবার পর কোন বিপদ ঘটে, এই আশঙ্কায় শিবাজী রাজ্যরক্ষা ও শাসনকার্য্যের এমন সুন্দর বন্দোবস্ত করিয়া গেলেন যে, স্বদেশে তাঁহার অনুপস্থিতির সময়েও মারাঠাদের কোন ক্ষতি হইবে না; সৰ্ব্বত্রই তাঁহার কর্ম্মচারিগণ তাঁহার নির্দিষ্ট প্রণালী অনুসারে কাজ চালাইবে, অভ্যস্ত নিয়ম- মত রাজ্যরক্ষা করিবে,– কোনও বিষয়ে নূতন হুকুমের প্রতীক্ষায় প্রভুর মুখ চাহিয়া অসহায় অবস্থায় বসিয়া থাকিতে হইবে না। শিবাজীর মাতা জীজা বাঈ রাজপ্রতিনিধি হইয়া সকলের উপরে রহিলেন। তাঁহার সহকারী হইলেন তিনজন– মোরেশ্বর ত্র্যম্বক পিংলে পেশোয়া অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রী, নিলো সোনদেব মজমুয়াদার অর্থাৎ হিসাব পরীক্ষক এবং নেতাজী পালকর সেনাপতি। রাজ্যের সর্ব্বত্র ঘুরিয়া, প্রত্যেক দুর্গ পরীক্ষা করিয়া, সর্ব্বত্র রক্ষার সুবন্দোবস্ত করিয়া, কৰ্ম্মচারিগণকে দিবারাত্র সতর্ক ও কার্য্যতৎপর থাকিতে এবং তাঁহার নিয়মাবলী পুর্ণমাত্রায় পালন করিতে বার-বার বলিয়া দিয়া, শিবাজী ৫ই মার্চ ১৬৬৩ তারিখে মাতা ও পরিজনবর্গের নিকট বিদায় লইয়া রাজগড় হইতে রওনা হইলেন। সঙ্গে চলিল– পুত্র শম্ভুজী, কয়েকজন বিশ্বস্ত মন্ত্রী এবং হাজার শরীর-রক্ষী সৈন্য। তাঁহার পথ- খরচের জন্য দাক্ষিণাত্যের রাজকোষ হইতে একলক্ষ টাকা অগ্রিম দেওয়া হইল। ইহার আগেই শিবাজীর দূত-স্বরূপ রঘুনাথ বল্লাল কোডে এবং সোনাজী পন্ত দবীর বাদশাহর দরবারে যাত্রা করিয়াছিলেন।

উত্তর-ভারতে যাইবার পথে শিবাজী প্রথমে আওরঙ্গাবাদ শহরে পৌঁছিলেন। তাঁহার খ্যাতি এবং সৈন্যদের জাঁকজমকপূর্ণ সাজসজ্জার কথা শুনিয়া নগরবাসীরা অগ্রসর হইয়া তাঁহাদের দর্শনলাভের প্রতীক্ষা করিতেছিল। কিন্তু স্থানীয় মুঘল শাসনকর্তা সশিকন্ খাঁ ভাবিলেন যে, শিবাজী সামান্য জমিদার এবং বুনো মারাঠামাত্র; তিনি অতিথিকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য স্বয়ং অগ্রসর না হইয়া ভ্রাতুষ্পুত্রকে পাঠাইয়া দিয়া জানাইলেন যে শিবাজী যেন তাঁহার কাছারীতে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। এই অপমানসূচক ব্যবহারে শিবাজী অত্যন্ত রাগিয়া, সফ্‌শিকন্ খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের কথায় একেবারেই কাণ না দিয়া, সোজা শহরের মধ্যে নিজের জন্য নির্দ্দিষ্ট বাসাবাড়ীতে উপস্থিত হইলেন; ভাবটা দেখাইলেন যেন ঐ শহরের শাসনকর্তা মানুষ বলিয়া গণ্য হইবার উপযুক্ত নয়। সশিকন্ বুঝিলেন, এ বড় শক্ত লোক; তিনি অমনি নরম হইয়া সরকারী কর্মচারীদের সহিত গিয়া শিবাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন। এইরূপে নিজ মর্য্যাদা সকলের সামনে রক্ষা করিবার পর, শিবাজীর আর রাগ রহিল না। তিনি পরদিন গিয়া সশিকনের আগমনের প্রতিদান এবং মুঘল কর্ম্মচারিদিগকে ভদ্রতার জন্য আপ্যায়িত করিলেন।

কয়েক দিন তথায় থাকিয়া, শিবাজী আবার উত্তর-মুখে চলিলেন। বাদশাহর হুকুম অনুসারে পথে স্থানীয় কর্মচারীরা তাঁহাকে রসদ ও নানা উপহার আনিয়া দিল। এইরূপে তিনি ৯ই মে আগ্রার নিকট পৌঁছিলেন। বাদশাহ তখন আগ্রা শহরে বাস করিতেছেন। যে আট বৎসর শাহজাহান আগ্রা-দুর্গে বন্দীভাবে ছিলেন, আওরংজীব আগ্রায় কখন নিজ মুখ দেখান নাই,–দিল্লীতেই থাকিতেন। ১৬৬৬ সালে ২২-এ জানুয়ারি শাহজাহানের মৃত্যুর পরেই তিনি আগ্রার রাজবাড়ীতে প্রথম-বার আসিয়া তথায় সমারোহে অভিষেক-ক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

আওরংজীবের সহিত শিবাজীর সাক্ষাৎ

শিবাজী আগ্রায় পৌঁছিবার তিনদিন পরেই চান্দ্র বৎসরের হিসাবে বাদশাহর পঞ্চাশত্তম জন্মদিন; স্থির হইল, জন্মদিনের উৎসব ও আড়ম্বরের মধ্যে শিবাজী বাদশাহকে দর্শন করিবেন, কারণ সেকালে শুভ দিনক্ষণ না দেখিয়া কোন কাজই করা হইত না।

আগ্রা-দুর্গের মধ্যে সারি সারি স্তম্ভ-গঠিত দরবার-গৃহ দেওয়ান-ই-আম, আজ জন্মদিনের উৎসবে পরিপাটিরূপে সাজান হইয়াছে। দেওয়াল ও থামগুলি বহুমূল্য রঙীন কিংখাব ও শালে জড়ান, মেঝেতে উৎকৃষ্ট গালিচা বিছান। এখানে সব উচ্চশ্রেণীর আমীরওম্রা ও রাজারা খুব জমকাল পোষাক পরিয়া নিজ নিজ নিৰ্দ্দিষ্ট শ্রেণীতে দাঁড়াইয়া আছেন। দেওয়ান-ই-আমের সামনে ও দুইপাশে ঘাসে ঢাকা নীচু আঙ্গিনায় লাল শালু-মোড়া কাঠের ডাণ্ডার সাহায্যে শামিয়ানা টাঙ্গান হইয়াছে। সারা আঙ্গিনাটি শতরঞ্জ ও চাদর দিয়া ঢাকা– এখানে নিম্নশ্রেণীর হাজার হাজার মনসবদার ও সাধারণ অনুচর দাঁড়াইবার স্থান পাইয়াছে। দেওয়ান-ই-আম গৃহের সম্মুখভাগ ও দুই পাশ খোলা, পিছন দিকটায় দুর্গমধ্যস্থ অন্তঃপুরের দেওয়াল। এই দেওয়ালের মাঝখানে মানুষের চেয়ে উঁচু একটি ছোট বারান্দা বাহির হইয়াছে; তাহাতে বাদশাহর সিংহাসন, পশ্চাতে অন্তঃপুর হইতে আসিবার দরজা– পর্দ্দা দিয়া ঢাকা। আর তাঁহার সামনে দরবার-গৃহের মেঝেতে থাম হইতে থামে রেলিং দিয়া ঘিরিয়া তিনটি কাটরা বা প্রকোষ্ঠ করা হইয়াছে। প্রথমেই সোনার রেলিং, এখানে মাত্র সর্ব্বোচ্চ শ্রেণীর ওমরার প্রবেশের অধিকার; তাহার পিছনে রূপার রেলিং, এখানে মধ্যম শ্রেণীর মনসবদারদের স্থান; সর্ব্ব-পশ্চাতে রং করা কাঠের রেলিং, তাহার মধ্যে সামান্য কর্ম্মচারীদের দাঁড়াইবার ব্যবস্থা। প্রত্যেক কাটরায় একটি স্থানে রেলিং খুলিয়া লোকের যাতায়াতের পথ করা ছিল। হিন্দী-কবি ভূষণ সত্যই বলিয়াছেন, এই জন্মদিন-উৎসবের দরবারে অমরাপুরীতে জ্যোতিৰ্ম্ময় দেবগণ-বেষ্টিত ইন্দ্রের মত আওরংজীব বিরাজ করিতেছিলেন।

রাজসভা লোকে গগম্ করিতেছে। সভাসদগণের নানাবর্ণের পোষাক- পরিচ্ছদ এবং বিস্তৃত গালিচা ও কিংখাব দেখিয়া স্থানটাকে রঙ্গীন ফুলের বাগান বলিয়া ভ্রম হয়। চারিদিকে ওমরা ও করদ-রাজাদের গা হইতে হীরা মোতি ও নানাপ্রকার মণির আলো ছড়াইয়া পড়িতেছে। বাদশাহ সিংহাসনে বসিয়াছেন।

রামসিংহ এহেন সভায় শিবাজী ও তাঁহার দশজন প্রধান কর্মচারীকে উপস্থিত করিলেন। মারাঠা-রাজার পক্ষ হইতে বাদশাহর পায়ের নিকট থালায় করিয়া দেড় হাজার মোহর নজর এবং ছয় হাজার টাকা নিসার[১] স্বরূপ উপহার দেওয়া হইল। আওরংজীব সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “আও, শিবাজী রাজা!” শিবাজীকে হাত ধরিয়া বাদশাহর সামনে লইয়া যাওয়া হইল। তিনি তিনবার সালাম করিলেন, বাদশাহ তাহার প্রতিদান করিলেন। তাহার পর বাদশাহর ইঙ্গিতে শিবাজীকে তাঁহার জন্য নিৰ্দ্দিষ্ট স্থানে লইয়া গিয়া দাঁড় করান হইল। দরবারের কাজ চলিতে লাগিল, যেন সকলেই শিবাজীর কথা ভুলিয়া গেল।

কত আদর-অভ্যর্থনার আশা বুকে ধরিয়া শিবাজী আগ্রা আসিয়াছিলেন, ইহাই কি তাহার পরিণাম? দরবারে আসিবার আগে হইতেই তাঁহার মনে দুঃখ ও সন্দেহের সঞ্চার হইয়াছিল। প্রথমতঃ, আগ্রার বাহিরে গিয়া কোন বড় ওমরা তাঁহাকে অভ্যর্থনা করেন নাই, কেবল রামসিংহ (আড়াই হাজারী) এবং মুখলিস্ খাঁ (দেড় হাজারী)-র মত দুইজন মধ্যম শ্রেণীর ওমরা কিছুদূর অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া রাজধানীতে আনেন। আর, আজ বাদশাহর দর্শন মিলিবার পর তাঁহার কোন উচ্চ উপাধি, বা মূল্যবান উপহার, এমন কি প্রশংসা বাক্যও লাভ হইল না। শিবাজী দেখিলেন, যেখানে তিনি দাঁড়াইয়া আছেন সেখান হইতে বাদশাহ অনেক দূরে– সম্মুখে সারির পর সারি ওমরার দল দাঁড়াইয়া। তিনি রামসিংহকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন যে তাঁহার স্থানটি পাঁচ হাজারী মনসবদারদের মধ্যে। তখন তিনি উচ্চ স্বরে বলিয়া উঠিলেন– “কি? আমার সাত বৎসরের বালক পুত্র শম্ভুজী দরবারে না আসিয়াই পাঁচ হাজারী হইয়াছিল। আমার চাকর নেতাজীও পাঁচ হাজারী। আর আমি, এত বিজয়-গৌরবের পর স্বয়ং আগ্রায় আসিয়া শেষে কেবলমাত্র সেই পাঁচ হাজারীই হইলাম!”

তাহার পর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন– তাঁহার সামনের ওমরাটি কে? রামসিংহ উত্তর দিলেন- ‘মহারাজা যশোবন্ত সিংহ।’ শুনিয়া শিবাজী রাগে চেঁচাইয়া উঠিলেন, “যশোবন্ত! যাহার পিঠ আমার সৈন্যেরা কতবার রণক্ষেত্রে দেখিয়াছে! আমার স্থান তাহারও নীচে? ইহার অর্থ কি?”

সকলের সামনে এইরূপ তীব্র অপমানে জ্বলিয়া উঠিয়া শিবাজী উঁচু গলায় রামসিংহের সঙ্গে তর্ক করিতে লাগিলেন; বলিলেন– “তরবারি দাও, আমি আত্মহত্যা করিব। এ অপমান সহ্য করা যায় না।” শিবাজীর কড়া কথা এবং উত্তেজিত অঙ্গভঙ্গীতে রাজসভায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইল; রামসিংহ মহা ভাবনায় পড়িয়া তাঁহাকে ঠাণ্ডা করিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনই ফল হইল না। চারিদিকেই বিদেশী ও অজানা মুখ, কোন বন্ধু বা স্বজন নাই– রুদ্ধ রোষে ফুলিতে ফুলিতে শিবাজী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। দরবারে একটা হৈ চৈ পড়িয়া গেল। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, ব্যাপার কি? চতুর রামসিংহ উত্তর দিলেন,– “বাঘ জঙ্গলী জানোয়ার। তার এখানে গরম লাগিয়া অসুখ হইয়াছে।” পরে বলিলেন,–“মারাঠা-রাজা দক্ষিণী লোক, বাদশাহী সভার আদব-কায়দা জানেন না।

সদয় আওরংজীব হুকুম দিলেন, পীড়িত রাজাকে পাশের ঘরে ল‍ইয়া গিয়া মুখে গোলাপজল ছিটাইয়া দেওয়া হউক; জ্ঞান হইলে তিনি বাসাবাড়ীতে চলিয়া যাইবেন,– দরবার শেষ হইবার জন্য অপেক্ষা করিতে হইবে না।

শিবাজী আগ্রায় নজরবন্দী হইলেন

বাসায় ফিরিয়া আসিয়া শিবাজী প্রকাশ্যভাবে বলিতে শুরু করিলেন যে, বাদশাহ নিজ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছেন; ইহা অপেক্ষা তিনি বরং শিবাজীকে মারিয়া ফেলুন। চরের সাহায্যে সব কথাই আওরংজীবের কানে পৌঁছিল; শুনিয়া তাঁহার রাগ ও সন্দেহ বৃদ্ধি পাইল। তিনি রামসিংহকে হুকুম দিলেন যে, আগ্রা শহরের দেওয়ালের বাহিরে, জয়পুর-রাজের জমিতে (অর্থাৎ দুর্গ হইতে তাজমহলে যাইবার পথের ডান পাশে) শিবাজীকে রাখা হউক এবং যাহাতে তিনি পলাইতে না পারেন, সেজন্য রামসিংহকে দায়ী থাকিতে হইবে। বাদশাহর অসন্তোষের চিহ্নস্বরূপ শিবাজীকে পুনরায় দরবারে আসিতে নিষেধ করা হইল; তবে বালক শম্ভুজীকে মাঝে মাঝে আসিতে অনুমতি দেওয়া হইল ।

শিবাজীর সঙ্গীগণ তাঁহাকে পরামর্শ দিল যে, বাদশাহকে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয় করিয়া দিবার লোভ দেখাইয়া তিনি নিজে মুক্তিলাভের চেষ্টা দেখুন। সেই-মত দরখাস্ত করা হইল; কিন্তু পড়িয়া বাদশাহ উত্তর দিলেন– “অপেক্ষা কর, তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করিব।” তাহার পর শিবাজী প্রার্থনা করিলেন যে, বাদশাহ যদি তাঁহাকে গোপনে সাক্ষাৎ করিতে দেন তবে রাজ্য-জয়ের একটি সুন্দর উপায় বলিয়া দিবেন। একথা শুনিয়া প্রধান মন্ত্রী জাফর খাঁ (শায়েস্তা খাঁর ভগ্নীপতি) বলিলেন,– “হুজুর, সর্ব্বনাশ। এমন কাজ করিবেন না। শিবাজী পাকা যাদুকর, আকাশে লাফ দিয়া চল্লিশ গজ জমি পার হইয়া শায়েস্তা খাঁর শিবিরে ঢুকিয়াছিল। এখানেও সেইরূপ দাঘাবাজী করিবে।” শিবাজীর আর বাদশাহর সঙ্গে দেখা হইল না।

শিবাজী তখন জাফর খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দাক্ষিণাত্যেজয়ের বন্দোবস্তে র আলোচনা করিলেন। প্রধান মন্ত্রী বলিলেন, “বেশ ভাল!” কিন্তু তাঁহার স্ত্রী (শায়েস্তা খাঁর ভগিনী) অন্তঃপুর হইতে গোপনে বলিয়া পাঠাইলেন, –“শিবাজী আফজল খাঁকে হত্যা করিয়াছে, শায়েস্তা খাঁর আঙ্গুল কাটিয়া দিয়াছে, তোমাকেও বধ করিবে। শীঘ্র তাহাকে বিদায় কর।” মন্ত্রী তখন “আচ্ছা, আচ্ছা, বাদশাহকে বলিয়া সব সরঞ্জাম দিব”– এই বলিয়া তাড়াতাড়ি কথাবার্তা শেষ করিলেন। শিবাজী বুঝিলেন, তিনি কিছুই করিবেন না।

পরদিন বাদশাহর হুকুমে আগ্রার কোতোয়াল ফুলাদ খাঁ শিবাজীর বাসার চারিদিকে পাহারা ও তোপ বসাইল; মারাঠারাজ সত্য সত্যই বন্দী হইলেন; তাঁহার বাসা হইতে বাহির হওয়া পর্য্যন্ত বন্ধ হইল ।

শিবাজী পলায়নের অদ্ভূত পথ বাহির করিলেন

সব আশায় জলাঞ্জলি দিয়া শিবাজী পুত্রকে বুকে ধরিয়া কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন। তাঁহার সঙ্গীরা সান্ত্বনা দিবার অনেক চেষ্টা করিল।

কিন্তু বেশীদিন এইভাবে গেল না। শিবাজীর অদম্য সাহস ও প্রখর বুদ্ধি শীঘ্রই প্রকাশ পাইল। তিনি নিজের মুক্তির পথ নিজেই বাহির করিলেন। প্রথমতঃ, তিনি সকলের কাছে লোক পাঠাইয়া জানাইতে লাগিলেন যে, তিনি বাদশাহর ভক্ত প্রজা, তাঁহার অসন্তোষের ভয়ে কাঁপিতেছেন। অপরাধ-মার্জ্জনালাভের আশায়, বাদশাহর নিকট সুপারিশ করিবার জন্য শিবাজী দরবারের অনেক সভাসদকে অনুরোধ করিলেন। ইতিমধ্যে তিনি নিজ রক্ষী-সৈন্যদলকে দেশে পাঠাইবার জন্য অনুমতি চাহিলেন; বাদশাহ ভাবিলেন, ভালই ত, আগ্রায় যত শত্রু কমে! সৈন্যেরা মহারাষ্ট্রে গেল, সেই সঙ্গে শিবাজীর সঙ্গীরাও অনেকে দেশে ফিরিল। শিবাজী এখন একা– তিনি নিজের পলায়নের পথ নিজেই দেখিলেন।

অসুখের ভাণ করিয়া তিনি শয্যায় আশ্রয় লইলেন; ঘর হইতে আর বাহির হন না। ব্যাধি দূর করিবার জন্য ব্রাহ্মণ সাধুসজ্জন ও সভাস্দদিগের মধ্যে তিনি প্রত্যহ বড় বড় ঝুড়ি ভরিয়া ফল ও মিঠাই বিতরণ করিতে সুরু করিলেন। প্রত্যেক ঝুড়ি বাঁশের বাঁকে ঝুলাইয়া দুইজন করিয়া বাহক বৈকালে বাসাবাড়ী হইতে বাহিরে লইয়া যাইত। কোতোয়ালের প্রহরীরা প্রথমে দিনকতক ঝুড়ি পরীক্ষা করিয়া দেখিত, তাহার পর বিনা পরীক্ষায় যাইতে দিতে লাগিল।

শিবাজী এই সুযোগেরই অপেক্ষা করিতেছিলেন। ১৯-এ আগষ্ট বৈকালে তিনি প্রহরীদের বলিয়া পাঠাইলেন যে, তাঁহার অসুখ বাড়িয়াছে, তাহারা যেন তাঁহাকে বিরক্ত না করে। এদিকে ঘরের মধ্যে তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা (শাহজীর দাসীপুত্র) হিরাজী ফজন্দ, দেখিতে কতকটা শিবাজীর মতই– শিবাজীর খাঁটিয়ায় শুইয়া, চাদরে গা-মুখ ঢাকিয়া, শুধু ডান হাত বাহির করিয়া রাখিলেন; তাঁহার এই হাতে শিবাজীর সোনার বালা দেখা যাইতেছিল। আর সন্ধ্যার সময় শিবাজী ও শম্ভুজী দুইটি ঝুড়ির মধ্যে জড়সড় হইয়া শুইয়া রহিলেন, তাঁহাদের উপর বেশ করিয়া পাতা ঢাকা দেওয়া হইল; আর তাঁহাদের বাঁকের সামনে ও পিছনে কয়েক ঝুঁড়ি সত্যকার ফল মিঠাই ভরিয়া সারিবন্দী হইয়া বাহকগণ বাসা হইতে বাহির হইল; বাদশাহর প্রহরীরা কোনই উচ্চবাচ্চ্য করিল না, –কেন না ইহা ত নিত্যকার ঘটনা!

আগ্রা শহরের বাহিরে পৌঁছিয়া একটি নির্জ্জন স্থানে ঝুড়ি নামাইয়া বাহকগণ মজুরি লইয়া চলিয়া গেল। তাহার পর শিবাজী ও শম্ভুজী ঝুড়ি হইতে বাহির হইয়া সঙ্গে যে দুইটি মারাঠা-অনুচর আসিয়াছিল তাহাদের সাহায্যে তিন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া একটি ছোট গ্রামে প্রবেশ করিলেন। সেখানে তাঁহার ন্যায়াধীশ নিরাজী রাবজী ঘোড়া লইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। এখানে মারাঠাদের দল দুই ভাগে বিভক্ত হইল। পুত্র শম্ভুজী, নিরাজী, দত্তাজী ত্র্যম্বক (ওয়াকিয়ানবিস্) ও রাঘবমিত্রকে সঙ্গে লইয়া শিবাজী সন্ন্যাসীর বেশ ধরিয়া সারা অঙ্গে ছাই মাখিয়া মথুরার দিকে অগ্রসর হইলেন, বাকী সকলে দাক্ষিণাত্যের পথ ধরিল।

আগ্রায় শিবাজীর পলায়ন প্রকাশ হইল

এদিকে আগ্রায় ১৯-এ আগষ্টের সারারাত্রি এবং পরদিন তিন প্রহর বেলা পৰ্য্যন্ত হিরাজী শিবাজীর বিছানায় শুইয়া রহিলেন। প্রাতে প্রহরীরা আসিয়া জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল,–সোনার বালা পরিয়া বন্দী শুইয়া আছেন, চাকরেরা তাঁহার পা টিপিতেছে। বৈকাল তিনটার সময় হিরাজী উঠিয়া নিজ বেশ পরিয়া চাকরটিকে সঙ্গে লইয়া বাসা হইতে বাহির হইয়া গেলেন; দরজায় প্রহরীদের বলিলেন, “শিবাজীর মাথার বেদনা; কাহাকেও তাঁহার ঘরে যাইতে দিও না, আমি ঔষধ আনিতে যাইতেছি।” এইরূপে দুই-তিন ঘণ্টা কাটিয়া গেল। তাহার পর প্রহরীরা দেখিল, বাড়ীটা যেন কেমন খালি খালি ঠেকিতেছে; ভিতরে কোন সাড়াশব্দ নাই, কোন নড়াচড়ার চিহ্ন দেখা যাইতেছে না; অন্যদিনের মত বাহিরের লোকজনও কেহ দেখা করিতে আসিতেছে না। ক্রমে তাহাদের সন্দেহ বাড়িল, তাহারা ঘরে ঢুকিল। ঢুকিয়া যাহা দেখিল তাহাতে তাহাদের চক্ষুস্থির, –পাখী উড়িয়াছে, ঘরে জনমানব নাই!!!

তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। তাহারা ছুটিয়া গিয়া কোতোয়ালকে সংবাদ দিল। ফুলাদ খাঁ কয়েদীর বাসায় খোঁজ করিয়া দেখিয়া বাদশাহকে জানাইল, –“হুজুর! শিবাজী পলাইয়াছে, কিন্তু ইহার জন্য আমাদের কোনই দোষ নাই। রাজা কুঠুরীর মধ্যেই ছিলেন। আমরা ঠিক মত গিয়া দেখিতেছিলাম; তথাপি একেলা অদৃশ্য হইয়া গিয়াছেন। তিনি মাটির মধ্যে ঢুকিলেন, অথবা আকাশে উড়িয়া গেলেন, বা হাঁটিয়া পলাইলেন তাহা জানা গেল না। আমরা কাছেই ছিলাম; দেখিতে দেখিতে তিনি আর নাই। কি যাদুবিদ্যায় এমনটা হইল বলিতে পারি না।”

কিন্তু আওরংজীব এসব বাজে কথায় ভুলিবার পাত্র নহেন। অমনি চারিদিকে “ধর ধর” শব্দ উঠিল, রাজ্যমধ্যে পথঘাটের সব চৌকি, পার-ঘাট এবং পর্ব্বতের ঘাটিয়া হুকুম পাঠান হইল যেন দাক্ষিণাত্য-যাত্রীদের সকলকে ধরিয়া দেখা হয় তাহাদের মধ্যে শিবাজী আছে কি না। এই হুকুম লইয়া দক্ষিণ দিকে কত সওয়ার ছুটিল। আর আগ্রা বা তাহার নিকটে শিবাজীর যত অনুচর ছিল (যেমন ত্র্যম্বক সেনাদেব দবীর এবং রঘুনাথ বল্লাল (কোডে), তাহাদের ধরিয়া কয়েদ করা হইল। মারের চোটে তাহারা বলিল যে, রামসিংহের সাহায্যে শিবাজী পলাইয়াছেন! বাদশাহ রাগিয়া রামসিংহের দরবারে আসা বন্ধ করিলেন এবং তাঁহার মনসব ও বেতন কাড়িয়া লইলেন।

শিবাজীর পলায়নের সময়ের নানা আশ্চৰ্য ঘটনা

চতুর-চূড়ামণি শিবাজী দেখিলেন, আগ্রা হইতে মহারাষ্ট্রের পথ দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে গিয়াছে, সুতরাং সেদিকে সর্ব্বত্রই শত্রু সজাগ হইয়া পাহারা দিবে। কিন্তু উত্তর- পূর্ব্ব দিকের পথে কোন পথিকের উপরই সন্দেহ করিবার কারণ থাকিবে না। সেইজন্য তিনি আগ্রা হইতে বাহির হইয়া প্রথমে উত্তরে, পরে পূর্ব্বদিকে– অর্থাৎ ক্রমেই মহারাষ্ট্র হইতে অধিক দূরে চলিতে লাগিলেন। প্রথম রাত্রিতে ঘোড়া ছুটাইয়া তাঁহারা দ্রুতগতিতে মথুরায় পৌঁছিলেন, কিন্তু দেখিলেন যে বালক শম্ভুজী অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে; পথ চলিতে একেবারে অক্ষম। অথচ আগ্রার এত নিকটে থাকা শিবাজীর পক্ষে বিশেষ বিপজ্জনক। নিরাজী পণ্ডিত তখন পেশোয়ার শ্যালক তিনজ মথুরাবাসী মারাঠা ব্রাহ্মণকে শিবাজীর আগমন ও দুর্দ্দশার কথা জানাইয়া, সাহায্য ভিক্ষা করিলেন। তাঁহারও দেশ ও ধর্ম্মের নামে বাদশাহর শাস্তির ভয় তুচ্ছ করিয়া শম্ভুজীকে নিজ পরিবারমধ্যে আশ্রয় দিতে সম্মত হইলেন। আর তাঁহাদের এক ভাই শিবাজীকে সঙ্গে লইয়া কাশী পৰ্য্যন্ত পথ দেখাইয়া চলিলেন।

এই দীর্ঘপথের খরচের জন্য শিবাজী প্রস্তুত হইলেন। সন্ন্যাসীর লাঠির মধ্যে ফুটা করিয়া, তাহা মণি ও মোহর দিয়া পুরিয়া মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন; জুতার মধ্যে কিছু টাকা রাখিলেন, আর একটা মহুমূল্য হীরক এবং অনেকগুলি পদ্মরাগমণি মোম দিয়া ঢাকিয়া তাঁহার অনুচরদের জামার ভিতরে সেলাই করিয়া দিলেন, কিছু কিছু তাহারা মুখে পুরিয়া রাখিল।

মথুরায় পৌঁছিয়া দাড়ি-গোঁফ কামাইয়া, গায়ে ছাই মাখিয়া, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে শিবাজী পথ চলিতে লাগিলেন। নিরাজী ভাল হিন্দী বলিতে পারিতেন। তিনি মোহান্ত সাজিয়া দলের আগে আগে যাইতে লাগিলেন। তিনিই পথের লোকজনের উত্তর দেন, শিবাজী সামান্য চেলা হইয়া নীরবে তাঁহার পিছু পিছু চলেন। তাঁহারা প্রায়ই রাত্রে পথ চলেন, দিনে নির্জ্জন স্থানে বিশ্রাম করেন, প্রত্যহই এক ছদ্মবেশ বদলাইয়া আর এক রকম বেশ ধরেন। তাঁহার চল্লিশ পঞ্চাশজন অনুচর তিনটি পৃথক দলে বিভক্ত হইয়া দূরে দূরে পশ্চাতে আসিতে লাগিল, প্রত্যেক দলেরই ভিন্ন ভিন্ন বেশ।

একবার তিনি ধরা পাড়িয়াছিলেন। আলী কুলী নামে বাদশাহর এক ফৌজদার সরকারী হুকুম পাইবার আগেই আগ্রা হইতে নিজ সংবাদ-লেখকের পত্রে শিবাজীর পলায়নের সংবাদ পাইয়া তাহার সীমানার মধ্যে সমস্ত পথিকদের ধরিয়া তল্লাস আরম্ভ করিয়া দিল। শিবাজীও সদলে আটক হইলেন। তিনি দুপুর রাত্রে গোপনে ফৌজদারের কাছে গিয়া বলিলেন, –“আমাকে ছাড়িয়া দাও, তোমাকে এখনি লক্ষ টাকা দামের হীরা ও মণি দিব। আর যদি আমাকে বাদশাহর নিকট ধরাইয়া দাও, তবে এসব রত্ন তিনি পাইবেন, –তোমার কোনই লাভ হইবে না।” ফৌজদার এই ঘুষ লইয়া তখনি তাঁহাদের ছাড়িয়া দিল।

তারপর গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম — এলাহাবাদের পুণ্যক্ষেত্রে স্নান করিয়া সন্ন্যাসীর বেশে শিবাজী কাশীধামে পৌঁছিলেন। অতি প্রত্যূষে গঙ্গাস্নান, কেশচ্ছেদ প্রভৃতি তীর্থের ক্রিয়াকলাপ শেষ করিয়া তাড়াতাড়ি শহর হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। তাঁহার রওনা হইবার পরই আগ্রা হইতে অশ্বারোহী দূত আসিয়া শিবাজীকে ধরিবার জন্য বাদশাহর আদেশ চারিদিকে প্রচার করিল। অনেক বৎসর পরে সুরতের নাভাজী নামে এক গুজরাতী ব্রাহ্মণ কবিরাজ গল্প করিতেন,– “কাশীতে পাঠ্যাবস্থায় আমি এক ব্রাহ্মণের শিষ্য ছিলাম, গুরু আমাকে বড়ই খাবার কষ্ট দিতেন। একদিন ভোরে অন্ধকার থাকিতে থাকিতেই অন্যদিনের মত নদীর ঘাটে গিয়াছি, এমন সময় একজন লোক আমার হাতের মধ্যে মোহর ও মণি গুঁজিয়া দিয়া বলিল, ‘মুঠি খুলিও না, কিন্তু আমার স্নানাদি তীর্থক্রিয়া যত শীঘ্র পার শেষ করাইয়া দাও।’ আমি তাহার মাথা মুড়াইয়া স্নান করাইয়া দিয়া মন্ত্ৰ পড়িতে লাগিলাম; এমন সময় একদিকে শোরগোল উঠিল যে, পলাতক শিবাজীর খোঁজে আগ্রা হইতে বাদশাহী পুলিশ আসিয়া ঢোল পিটিয়া দিতেছে। তাহার পর পূজার কাজে মন দিয়া যাত্রীটির দিকে ফিরিতেই দেখি, সে ইতিমধ্যে অন্তর্ধান করিয়াছে। মুঠির মধ্যে নয়টি মোহর, নয়টি হোণ ও নয়টি মণি পাইলাম। গুরুকে কিছু না বলিয়া সটান দেশে ফিরিলাম। ঐ টাকা দিয়া এই বড় বাড়ী কিনিয়াছি।”

কাশী হইতে গয়া পূৰ্ব্বদিকে; এই তীর্থ করিয়া শিবাজী দক্ষিণ মুখে চলিলেন। পরে গোওওয়ানা ও গোলকুণ্ডা-রাজ্য পার হইয়া পশ্চিম দিকে ফিরিয়া, বিজাপুরের মধ্য দিয়া নিজ দেশে আসিয়া পৌঁছিলেন। দীর্ঘ পথ হাঁটিতে হাঁটিতে ক্লান্ত হইয়া তিনি একটি টাট্টু (ছোট ঘোড়া) কিনিলেন; দাম দিবার সময় দেখেন, রূপার টাকা নাই, তখন ঘোড়াওয়ালাকে একটি মোহর দিলেন। সে বলিল- “তুমি বুঝি শিবাজী, নহিলে এই টাট্টুর জন্য এত বেশী দাম দিতেছ কেন?” শিবাজী থলি খালি করিয়া সব মোহরগুলি তাহাকে দিয়া বলিলেন, –“চুপ! কথাটি কহিও না।” আর ঘোড়ায় চাপিয়া তাড়াতাড়ি সেখান হইতে সরিয়া পড়িলেন।

পলাতক শিবাজী স্বদেশে পৌঁছিলেন

ক্রমে দাক্ষিণাত্য গোদাবরী-তীরে ইন্দুর প্রদেশ পার হইয়া এই সন্ন্যাসীর দল মহারাষ্ট্রের সীমানার কাছে এক গ্রামে সন্ধ্যার সময় আসিয়া পৌঁছিল। তাহারা গাঁয়ের মোড়লের স্ত্রীর (পাটলিন্) বাড়ীতে রাত্রির জন্য আশ্রয় চাহিল। ইহার কিছুদিন আগেই আনন্দ রাও-এর অধীনে শিবাজীর সৈন্যেরা আসিয়া এই গ্রামের সব শস্য ও ধন লুট করিয়া লইয়া গিয়াছিল। পাটেলিন্ উত্তর করিল, –“বাড়ী খালি পড়িয়া আছে। শিবাজীর সওয়ার আসিয়া সব শস্য লইয়া গিয়াছে। শিবাজী কয়েদ আছে। সেইখানেই পচিয়া মরুক,” এবং তাঁহার উদ্দেশে কত অভিসম্পাত করিতে লাগল। শিবাজী হাসিয়া নিরাজীকে ঐ গ্রামের ও তাহার পাটেলিনের নাম লিখিয়া লইতে বলিলেন। নিজ রাজধানীতে পৌঁছিবার পর পাটেলিনকে ডাকাইয়া, লুটে যাহা ক্ষতি হইয়াছিল তাহার বহুগণ অধিক ধন দান করিলেন।

ক্রমে ভীমা নদী পার হইয়া, আগ্রা হইতে রওনা হইবার পূর্ণ তিনমাস পরে, নিজ রাজধানী রাজগড়ে পৌঁছিলেন (২০-এ নবেম্বর)। দুর্গের দ্বারে গিয়া জীজা বাঈকে সংবাদ পাঠাইলেন যে, উত্তর দেশ হইতে একদল বৈরাগী আসিয়াছে– তাহারা সাক্ষাৎ করিতে চায়। জীজা বাঈ অনুমতি দিলেন। অগ্রগামী মোহন্ত (অর্থাৎ নিরাজী) হাত তুলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন, কিন্তু পশ্চাতের চেলা বৈরাগীটি জীজা বাঈ-এর পায়ের উপর মাথা রাখিল। তিনি আশ্চর্য্য হইলেন, সন্ন্যাসী কেন তাঁহাকে প্রণাম করে? তখন ছদ্মবেশী শিবাজী টুপি খুলিয়া নিজ মাথা মাতার কোলে রাখিলেন, এতদিনের হারাধনকে মাতা চিনিতে পারিলেন। অমনি চারিদিকে আনন্দের রোল উঠিল, বাজনা বাজিতে লাগিল, দুর্গ হইতে তোপধ্বনি হইল । মহা হর্ষে সমগ্র মহারাষ্ট্র জানিল– দেশের রাজা নিরাপদে দেশে ফিরিয়াছেন।

শিবাজী দেশে ফিরিলেন, কিন্তু সঙ্গে পুত্রটি নাই। তিনি রটাইয়া দিলেন যে, পথে শম্ভুজীর মৃত্যু হইয়াছে। এইরূপে দাক্ষিণাত্যের পথের যত মুঘল-প্রহরীদের মন নিশ্চিন্ত হইলে, তিনি গোপনে মথুরার সেই তিন ব্রাহ্মণকে পত্র লিখিলেন। তাহারা পরিবারবর্গ লইয়া শম্ভুজীকে ব্রাহ্মণের বেশ পরাইয়া, কুটুম্ব বলিয়া পরিচয় দিয়া, মহারাষ্ট্রে আসিয়া উপস্থিত হইল। পথে এক মুঘল-কর্মচারী তাহাদের গেরেফ্ফার করে, কিন্তু ব্রাহ্মণগণ তাহার সন্দেহ-ভঞ্জনার্থ শম্ভুজীর সহিত এক পংক্তিতে বসিয়া ভোজন করিল,– যেন শম্ভুজী শূদ্র নহেন, তাহাদের স্বশ্রেণীর ব্রাহ্মণ! কৃষ্ণাজী ও বিশাজী– এই তিন ভাইকে শিবাজী “বিশ্বাস রাও” উপাধি, এক লক্ষ মোহর এবং বার্ষিক পঞ্চাশ হাজার টাকার জাগীর পুরস্কার দিলেন।

শিবাজীর পলায়নে আওরংজীবের মনে আমরণ আপশোষ হইয়াছিল। তিনি ৯১ বৎসর বয়সে মৃত্যুর সময় নিজ উইলে লিখিয়াছিলেন, “শাসনের প্রধান স্তম্ভ রাজ্যে যাহা ঘটে তাহার খবর রাখা; এক মুহূর্তের অবহেলা দীর্ঘকাল লজ্জার কারণ হয়। এই দেখ, হতভাগা শিবাজী আমার কর্মচারীদের অসাবধানতায় পলাইয়া গেল, আর তাহার জন্য আমাকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই-সব কষ্টকর যুদ্ধে লাগিয়া থাকিতে হইল।”

শিবাজী সম্বন্ধে আওরংজীব এবং জয়সিংহের মনের অভিপ্রায় কি?

জয়সিংহের পত্রাবলী হইতে শিবাজীর বন্দী-দশায় মুঘল-রাজনীতির হেরফের অতি স্পষ্ট বুঝা যায়। বাদশাহর প্রথমে অভিপ্রায় ছিল, প্রথম দিন দর্শনের পর শিবাজীকে একটি হাতী, খেলাৎ এবং কিছু মণি-মুক্তা উপহার দিবেন। কিন্তু দরবারে শিবাজীর অসভ্য ব্যবহারে চটিয়া গিয়া তিনি এই দান স্থগিত রাখিলেন। এদিকে শিবাজী বাসায় ফিরিয়া বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন যে, মুঘল-রাজসরকার তাঁহার সম্বন্ধে নিজ প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন নাই। তখন আওরংজীব জয়সিংহকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন, তিনি বাদশাহর পক্ষ হইতে শিবাজীকে কি কি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন। উত্তরে জয়সিংহ পুবন্দর-সন্ধির শর্তগুলি লিখিয়া পাঠাইলেন এবং জানাইলেন যে, শিবাজীকে ইহার অতিরিক্ত কোন কথা দেওয়া হয় নাই।

এদিকে আগ্রায় যখন শিবাজী কঠোরভাবে নজরবন্দী হইলেন, জয়সিংহ তখন মহাসঙ্কটে পড়িলেন। একদিকে দাক্ষিণাত্যের আশু বিপদ লাঘব করিবার জন্য শিবাজীকে উত্তর-ভারতে সরাইয়া দিয়াছেন; অপরদিকে তিনি ধৰ্ম্ম-শপথ করিয়াছেন যে, আগ্রায় গেলে শিবাজীর কোন অনিষ্ট বা স্বাধীনতা-লোপ হইবে না। তিনি আওরংজীবের প্রকৃত অভিসন্ধি বুঝিতে পারিলেন না, ক্রমাগত বাদশাহকে লিখিতে লাগিলেন যে শিবাজীকে বন্দী বা বধ করিলে কোন লাভই হইবে না কারণ তিনি স্বদেশে এমন সুবন্দোবস্ত করিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার অনুপস্থিতিতে মারাঠারা পূর্ব্বের মতই রাজ্য চালাইতে থাকিবে; আর শিবাজী যদি নিরাপদে দেশে ফিরিতে না পারেন তবে ভবিষ্যতে কেহই বাদশাহী ওমরাদের কথা বিশ্বাস করিবে না। জয়সিংহ সেইসঙ্গে পুত্র রামসিংহকে বার বার লিখিলেন,–“দেখিও, শিবাজীর রক্ষার জন্য তোমার ও আমার আশ্বাস-বাণী যেন কোনমতে মিথ্যা না হয়, আমরা যেন প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দুর্নামে না পড়ি।”

এদিকে শিবাজীকে লইয়া কি করিবেন তাহা আওরংজীব ভাল বুঝিতে পারিলেন না, তাঁহার কোনই একটা নীতি স্থির হইল না। প্রথমে ভাবিয়াছিলেন, জয়সিংহ বিজাপুর-রাজকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করিলে দাক্ষিণাত্য-সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়া শিবাজীকে ছাড়িয়া দিবেন। কিন্তু সে জয়ের আশা ক্রমেই ক্ষীণ হইয়া আসিল। তখন বাদশাহ একবার বলিলেন যে, রামসিংহ শিবাজীর দায়িত্ব লইয়া আগ্রার থাকুক, তিনি স্বয়ং দাক্ষিণাত্যে যাইবেন। আবার বলিলেন, শিবাজীকে আফঘানিস্থানে মুঘল-সৈন্যের সহিত কাজ করিতে পাঠাইবেন; নেতাজীকে এবং পরে যশোবন্ত কেও এইরূপ আফঘানিস্থানে পাঠান হইয়াছিল, –ইহা একপ্রকার দ্বীপান্তর দেওয়া। কিন্তু এ দুটির কিছুই হইল না। জয়সিংহ ও তাঁহার পুত্র একবাক্যে শিবাজীকে আগ্রায় রাখিবার ভার লইতে অস্বীকার করিলেন। অবশেষে শিবাজী একমাত্র কোতোয়াল ফুলাদ খাঁর জিম্মার রহিলেন।

সেই অবস্থায় শিবাজী পলাইলেন। তাঁহার পলায়নের তিন মাসকাল এবং দেশে ফিরিবার পর প্রথম কিছুদিন ধরিয়া জয়সিংহের ভয় ও দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। তিনি চারিদিকে অন্ধকার দেখিলেন। একে তাঁহার বিজাপুর-আক্রমণ ব্যর্থ হইয়াছে; তাহাতে বাদশাহর এবং নিজের অগাধ টাকা নষ্ট হইয়াছে, তাঁহার উদ্ধারের সম্ভাবনা ছিল না। ইহার উপর রুষ্ট শিবাজী দেশে ফিরিয়া না জানি মুঘলদের উপর কি প্রতিহিংসা লন। এ সকলের উপর, নিজের বংশের আশা- ভরসা কুমার রামসিংহ বাদশাহর সন্দেহে পড়িয়া অপমানিত ও দণ্ডিত হইয়া আছেন। জয়সিংহের প্রথমবারকার এত যুদ্ধজয়, সরকারী কাজে নিজ লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়, দীর্ঘজীবন ধরিয়া রাজসেবায় রক্তপাত,– সবই বিফল হইল। তাঁহার দাক্ষিণাত্য-শাসন, চারিদিকে পরাজয় ও লজ্জায় পরিসমাপ্ত হইল। বাদশাহ তাঁহাকে ঐ পদ হইতে সরাইয়া ডাকিয়া পাঠাইলেন। শ্রম, ক্ষতি, চিন্তা ও অপমানে জর্জরিত বৃদ্ধ রাজপুতবীর পথে বুহানপুর নগরে মরিয়া সকল যন্ত্রণার হাত হইতে মুক্তি পাইলেন (২রা জুলাই, ১৬৬৭)।

বাদশাহ অবাধ্য পলাতক শিবাজীকে শাস্তি দিবার অবসর পাইলেন না। ১৬৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমেই পারস্যরাজের আক্রমণের ভয়ে একদল প্রবল মুঘল-সৈন্য পঞ্জাবে পাঠান হইল, আর তাহার পর বৎসর মার্চ মাসে পেশোয়ার প্রদেশে যে ইউসুফজাই-জাতির বিদ্রোহ বাধিল তাহাতে বাদশাহর সমস্ত শক্তি বহুদিন ধরিয়া সেখানে আবদ্ধ রহিল।

বাদশাহ ও শিবাজীর মধ্যে আবার সন্ধি হইল কেন?

দেশে ফিরিয়া, শিবাজীও মুঘলদের সঙ্গে বিবাদ করিতে চাহিলেন না; তিন বৎসর পর্য্যন্ত শান্তভাবে রহিলেন, নিজ রাজ্যের শাসনপ্রণালী-গঠন এবং সুচারুরূপে জমির বন্দোবস্ত করিলেন; কোঁকন-প্রদেশে নিজ অধিকার বিস্তৃত করিতে লাগিলেন।

এ অবস্থায় বাদশাহর সঙ্গে সন্ধি করায় তাঁহার লাভ। তিনি মহারাজা যশোবন্ত সিংহকে লিখিলেন,– “বাদশাহ আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। নচেৎ আমার ইচ্ছা ছিল, তাঁহার অনুমতি লইয়া নিজবলে কান্দাহার দুর্গ কাড়িয়া লইয়া তাঁহাকে দিই। আমি শুধু প্রাণের ভয়ে আগ্রা হইতে পলাইয়াছি। মির্জা রাজা জয়সিংহ আমার মুরুব্বি ছিলেন, তিনি আর নাই। এখন আপনার মধ্যস্থতায় যদি আমি বাদশাহর ক্ষমা লাভ করি, তবে আমি আমার পুত্রের সহিত সৈন্যদলকে দাক্ষিণাত্যের শাসকর্তা মুয়জ্জমের অধীনে কাজ করিতে পাঠাইয়া দিতে পারি।”

যুবরাজ ও যশোবস্ত এই প্রস্তাব বিশেষভাবে সমর্থন করিয়া বাদশাহকে লিখিলেন। আওরংজীব সম্মত হইয়া শিবাজীর ‘রাজা’ উপাধি মঞ্জুর করিলেন। ১৬৬৭ সালের ৪ঠা নবেম্বর শম্ভুজী আসিয়া আওরঙ্গাবাদে যুবরাজ মুয়জ্জমের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। পরবর্ত্তী আগষ্ট মাসে প্রতাপরাও (নূতন সেনাপতি) এবং নিরাজীর অধীনে শিবাজীর একদল সৈন্য আসিয়া বাদশাহর কাজ করিতে লাগিল। তজ্জন্য শম্ভুজীকে পাঁচ হাজারী মনসবের উপযুক্ত জাগীর বেরার প্রদেশে দেওয়া হইল। এইরূপে “দুই বৎসর পর্য্যন্ত মারাঠা সৈন্য মুঘল-রাজ্যের জমি হইতে পেট ভরাইল, শাহজাদাকে বন্ধু করিল।” [সভাসদ]

১৬৬৭, ১৬৬৮, ১৬৬৯ এই তিন বৎসর শিবাজী শান্তিতে কাটাইলেন, –বিজাপুর বা মুঘল-রাজ্যে কোন উপদ্রব করিলেন না। তাহার পর ১৬৭০ সালের প্রথমেই আবার বাদশাহর সঙ্গে যুদ্ধ বাধিল। ইহার কারণ নানা লোকে নানা রকম বলে। এক গ্রন্থে আছে, নিন্দুকেরা আওরংজীবকে জানাইল যে শাহজাদা মুয়জ্জম শিবাজীর সহিত গাঢ় বন্ধুত্ব করিয়া তাঁহার সাহায্যে স্বাধীন হইবার চেষ্টায় আছেন এবং এই কথা শুনিয়া বাদশাহ শিবাজীর পুত্র ও সেনাপতিদের হঠাৎ বন্দী করিবার জন্য মুয়জ্জমকে হুকুম পাঠাইলেন; কিন্তু কুমার বিশ্বাসঘাতকতা না করিয়া গোপনে মারাঠাদের ইঙ্গিত করিলেন, তাহারা আওরঙ্গাবাদ হইতে দলবল লইয়া রাত্রে পলাইয়া গেল।

অপর এক বিবরণ এই যে, বাদশাহ ১৬৬৬ সালে আগ্রা যাইবার জন্য শিবাজীকে যে একলক্ষ টাকা অগ্রিম দেন, এখন আয়বৃদ্ধি করিবার চেষ্টায় তাহা তাঁহার বেরারের নূতন জাগীর জৎ করিয়া আদায় করিতে হুকুম দিলেন। তাহাতে শিবাজী চটিয়া বিদ্ৰোহী হইলেন।

আসল কথা, এই তিন বৎসরে শিবাজী বলবৃদ্ধি এবং রাজ্যের বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন; এখন দেখিতে চাহিলেন যুদ্ধ করিলে কত লাভ হয়।

তথ্য নির্দেশ

১. বাদশাহর দেহ হইতে অশুভ দৃষ্টির প্রভাব দূর করিবার জন্য যে টাকা বা রত্ন থালায় করিয়া তাঁহার মাথার চারিদিকে ঘুরাইয়া পরে লোকজনদের মধ্যে ছড়াইয়া দেওয়া হইত, তাহার নাম ছিল নিসার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *