০২. শিবাজীর অভ্যুদয়

দ্বিতীয় অধ্যায় – শিবাজীর অভ্যুদয়

ভোঁশলে বংশ

শিবাজীর অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিক মারাঠাদের জাতীয় জীবন-প্রভাত। তিনিই দেশের শক্তিহীন, খ্যাতিহীন বিক্ষিপ্ত মানুষ-গুলিকে একত্র করিয়া, শক্তি দিয়া রাষ্ট্রসঙ্ঘে গাঁথিয়া, হিন্দুর ইতিহাসে এক নবীন সৃষ্টি রচনা করেন। এটি যে তাঁহারা ব্যক্তিগত কীর্ত্তি তাহার প্রমাণ পাই– যখন আমরা তাঁহার আদি-পুরুষদের ইতিহাস এবং তাঁহার পৈত্রিক পুঁজিপাটা খুঁজিয়া দেখি। বিশাল বেগবতী স্রোতস্বতীর মত তাঁহার উদ্ভব অতি ক্ষুদ্র স্থান হইতে, প্রায় অজ্ঞাত তমসাচ্ছন্ন।

মারাঠা নামক জাতের যে শাখায় শিবাজীর জন্ম, তাহার উপাধি “ভোঁশলে”। এই ভোঁশলে পরিবার দাক্ষিণাত্যে অনেকস্থলে ছড়াইয়া আছে, কিন্তু তাহারা রাজপুতদের বংশশাখার মত এক রক্তের টানে বাঁধা ছিল না, অথবা কোনো একজন দলপতির আজ্ঞায় চালিত হইত না। প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিবার লইয়া নিজ গ্রামে থাকিত, কোন সাধারণ গোষ্ঠীপতিকে মানিত না, বা জাতের মিলনে কখনও সমবেত হইত না। জমি চাষ ও পশুপালনই তাহাদের জাতিগত ব্যবসা ছিল, যদিও মারাঠা জাতের দুই-চারিজন ধনী ও ক্ষমতাশালী প্রধান বা জমিদারের নাম মধ্যযুগের ইতিহাসে পাওয়া যায়। কিন্তু খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমে বহমানী– সাম্রাজ্য ভাঙিবার সময় এবং তাহার শতবর্ষ পরে আহমদনগরের নিজামশাহী রাজবংশের দ্রুত অবনতির বিপ্লবে, মারাঠারা এক মহাসুযোগ পাইল। দেশের রাজনৈতিক অবস্থার ফলে মারাঠা কৃষক-বংশের অনেক বলিষ্ঠ, চতুর ও তেজী লোক হাল ছাড়িয়া অসি ধরিল, সৈনিকের ব্যবসা আরম্ভ করিয়া পরে জমিদার ও রাজা হইতে লাগিল। কিরূপে কৃষকপুত্র ক্রমে ক্রমে দস্যুর সর্দ্দার, ভাড়াটে সৈন্যের দলপতি, রাজ-দরবারের সম্ভ্রান্ত সামন্ত, এবং অবশেষে স্বাধীন নরপতির পদে উঠিতে পারিত তাহার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত– শিবাজী।

শিবাজীর পূর্ব্বপুরুষ

খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাবাজী ভোঁশলে পুণা জেলার হিঙ্গনী এবং দেবলগাঁও নামক দুইটি গ্রামের পাটেল (অর্থাৎ মণ্ডল)-এর কাজ করিতেন। গ্রামের অন্য কৃষকগণের ক্ষেত্রের উৎপন্ন শস্যের এক অংশ পাটেল-পদের বেতনস্বরূপ তাঁহার প্রাপ্য ছিল; ইহা ছাড়া তিনি নিজের কিছু ক্ষেতও চাষ করিতেন। এই দুই উপায়ে তাঁহার সংসার চলিত। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার দুই পুত্র মালোজী ও বিঠোজী প্রতিবেশীদের সহিত বনিবনা না হওয়ায় সপরিবারে গ্রাম ছাড়িয়া এলোরা পর্ব্বতের পাদদেশে বিরুল গ্রামে চলিয়া গেলেন। এখানে চাষবাসে আয় বড় কম দেখিয়া তাঁহারা সিন্ধখেড়ের জমিদার এবং আহমদনগর রাজ্যের সেনাপতি লজী যাদব রাও-এর নিকট গিয়া সাধারণ অশ্বারোহী (বার-গীর্) সৈন্যের চাকরি লইলেন। প্রত্যেকের বেতন হইল মাসিক কুড়ি টাকা।

শাহজী ও জীজা বাঈ

যাদব রাও ভোঁশলেদেরই মত জাতে মারাঠা। মালোজীর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহজী দেখিতে বড় সুশ্রী ছিলেন, যাদব রাও এই বালকটিকে সোহাগ করিতেন এবং সঙ্গে করিয়া অন্তঃপুরে লইয়া যাইতেন। একদিন হোলীর সময় যাদব রাও নিজ বৈঠকখানায় বসিয়া বন্ধুবান্ধব অনুচরগণ লইয়া নাচ-গান উপভোগ করিতেছিলেন। পাঁচ বৎসরের বালক শাহজীকে এক কোলে এবং নিজের তিন বছরের কন্যা জীজা বাঈকে অপর কোলে বসাইয়া তাহাদের হাতে আবীর দিলেন এবং শিশু দুটির হোলী খেলা দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ভগবান মেয়েটিকে কি সুন্দর করিয়াই গড়িয়াছেন! আর শাহজীও রূপে ইহারই সামিল। ঈশ্বর যেন যোগ্যে যোগ্যে মিলন ঘটান!”

যাদব রাও হাসির ভাবে একথা বলিলেন, কিন্তু মালোজী অমনি দাঁড়াইয়া উচ্চস্বরে কহিলেন, “আপনারা সকলে সাক্ষী, যাদব রাও আজ তাঁহার কন্যাকে আমার ছেলের সঙ্গে বাগদত্তা করিলেন।” একথা শুনিয়া যাদব রাও ক্ষুণ্নমনে মেয়ের হাত ধরিয়া অন্তঃপুরে চলিয়া গেলেন; অন্যদিনের মত শাহজীকে সঙ্গে লইলেন না।

যাদব রাও-এর পত্নী গিরিজা বাঈ অতি বুদ্ধিমতী ও তেজস্বী বীর রমণী। (১৬৩০ সালে যখন নিজাম শাহ বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া দরবার মধ্যে হঠাৎ তাঁহার স্বামীকে খুন করেন, তখন গিরিজা বাঈ এই দুঃসংবাদে অভিভূত না হইয়া তৎক্ষণাৎ পরিবারবর্গ অনুচর ও ধন-সম্পত্তি লইয়া অশ্বপৃষ্ঠে রাজধানী হইতে বাহির হইলেন এবং দলবদ্ধভাবে কুচ করিতে করিতে নিরাপদ স্থানে পৌঁছিলেন। শত্রুপক্ষ তাঁহাকে বন্দী করিতে অথবা তাঁহাদের সম্পত্তি লুঠিতে পারিল না। মুসলমান ইতিহাস-লেখকেরা ঐ সময়ে তাঁহার স্থিরবুদ্ধি ও সাহসের খুব প্রশংসা করিয়াছেন)।

হোলীয় মজলিসে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল সমস্ত শুনিয়া গিরিজা বাঈ রাগিয়া স্বামীকে বলিলেন, “কি! এই গরিব ভবঘুরে সামান্য ঘোড়সওয়ারের ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের সম্বন্ধ? বিবাহ সমান সমান ঘরেই সম্ভব। তুমি কি অবিবেচনার কাজই করিয়াছ! কেন উহাদের এই অন্যায় কথার উপযুক্ত জবাব দিলে না, এবং ধমকাইলে না?”

মালোজীর সংসারে উন্নতি

যাদব রাও পরদিনই দুই ভাইকে তাহাদের বেতন চুকাইয়া দিয়া চাকরি হইতে বরখাস্ত করিলেন। মালোজী ও বিঠোজী অগত্যা বিরুল গ্রামে ফিরিয়ে আবার চাষ করিতে লাগিলেন। একদিন রাত্রে মালোজী ক্ষেতের শস্য পাহারা দিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন, এক গর্ভ হইতে একটি বড় সাপ বাহির হইল, আবার তথায় ঢুকিল। মাটির তলে গুপ্তধন প্রাচীন সাপে রক্ষা করে এই বিশ্বাস সেকাল হইতে অনেক দেশে চলিয়া আসিতেছে। মালোজী ঐ গৰ্ত্ত খুঁড়িয়া সেখানে সাতটি লোহার কড়াই-ভরা মোহর পাইলেন।[১]

এতদিনে মালোজীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুরাইবার উপায় জুটিল। ঐ গুপ্তধন চামারগুণ্ডা গ্রামের একজন বিশ্বাসী মহাজনের জিম্মায় রাখিয়া, তাহার কিছু খরচ করিয়া ঘোড়া, জীন ও তাম্বু কিনিয়া তিনি এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সজ্জিত করিলেন, এবং তাহাদের নেতা হইয়া ফলটন গ্রামের নিম্বলকর-বংশীয় জমিদারের সহিত যোগ দিয়া লুটপাট আরম্ভ করিয়া দিলেন। অল্পদিনেই তাঁহার ক্ষমতা ও খ্যাতি এত বাড়িয়া গেল যে, অবসন্নপ্রায় নিজামশাহী-রাজা তাঁহাকে সরকারী সৈন্যমধ্যে ভর্তি করিয়া সেনাপাতি উপাধি দিলেন। মালোজী আর সাধারণ ঘোড়সোয়ার বা চাষী নহেন, তিনি এখন ওমরা- যাদব রাও-এর সমপদস্থ। তখন যাদব রাও নিজ কন্যার সহিত শাহজীর বিবাহ দিলেন (সম্ভবতঃ ১৬০৪ খৃষ্টাব্দে)।

ধনবৃদ্ধির সঙ্গে মালোজী অনেক জনহিতকর কাজ ও দানধর্ম্ম করিলেন। মন্দির-নির্ম্মাণ, ব্রাহ্মণ-ভোজন ছাড়া, সাতারা জেলার উত্তর অংশে মহাদেব পর্ব্বতের শিখরে শম্ভু-মন্দিরে চৈত্র মাসে সমবেত লক্ষ লক্ষ যাত্রীর জলকষ্ট নিবারণের জন্য তথায় পাথর কাটিয়া একটি বড় পুস্করিণী খুঁড়িলেন। মহাদেব তুষ্ট হইয়া স্বপ্নে তাঁহাকে বর দিলেন, “আমি তোমার বংশে অবতীর্ণ হইয়া দেরদ্বিজকে রক্ষা করিব, দক্ষিণ দেশের রাজ্য তোমায় দিব। “

ধনে মানে বাড়িয়া কালক্রমে মালোজী মারা গেলেন, তাহার পর তাঁহার জমিদারী ও সৈন্যদল তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিঠোজী চালাইলেন। বিঠোজীর মৃত্যুর পর (অনুমান ১৬২৩ খৃষ্টাব্দে) শাহজী পৈত্রিক সম্পত্তির ভার পাইলেন, এবং ভোঁশলে বংশের সেনাদলের নেতা হইলেন। এই দল এতদিনে বাড়িয়া দু হাজার আড়াই হাজার লোক হইয়াছিল।

শাহজীর অভ্যুদয়

১৬২৬ সালে নিজামশাহী রাজ্যের সুদক্ষ মন্ত্রী, মালিক অম্বর আশী বৎসর বয়সে মারা গেলেন এবং তাঁহার পুত্র ফতে খাঁ উজীর হইলেন। ইহার এক বৎসরের মধ্যেই দিল্লীর বাদশাহ জাহাঙ্গীর এবং বিজাপুরের সুলতান ইব্রাহিম আদিল শাহও প্রাণত্যাগ করিলেন। দাক্ষিণাত্যে ভীষণ গোলমাল ও যুদ্ধ বাধিয়া গেল।

শাহজীর কাজের উল্লেখ ইতিহাসে ১৬২৮ সালে প্রথম পাওয়া যায়। সেই বৎসর তিনি ফতে খাঁর আজ্ঞায় সসৈন্য মুঘল-রাজ্যের পূর্ব্ব-খান্দে প্রদেশ লুঠ করিতে যান, কিন্তু স্থানীয় মুঘল-সেনানীর হাতে বাধা পাইয়া ফিরিতে বাধ্য হন। ১৬৩০ খৃষ্টাব্দে আহমদনগর-রাজ্যে শেষ-ভাঙ্গন ধরিল। দরবারে দলাদলি, যুদ্ধ ও খুন, শাসনে বিশৃঙ্খলা ও রাজ্যে অরাজকতা নিত্য ঘটিতে লাগিল। শাহজী এই সুযোগে নিজের জন্য রাজ্য জয় করিতে শুরু করিলেন। কখন-বা তিনি মুঘলদের সঙ্গে যোগ দেন, কখন-বা বিজাপুর-রাজ আদিল শাহের সহিত; আমার কখনও বা নিজাম শাহের চাকরিতে ফিরিয়া আসেন। মুঘলেরা শেষ নিজামশাহ রাজধানী দৌলতাবাদ জয় করিয়া সুলতানকে বন্দী করিল (১৬৩৩)।

তখন শাহজী ঐ বংশের একজন বালককে নিজাম শাহ’ বলিয়া মুকুট পরাইয়া, নিজে সৰ্ব্বেসৰ্ব্বা হইয়া তিন বৎসর ধরিয়া পুণা-দৌলতাবাদ অঞ্চলে রাজ্য- পরিচালন করিতে লাগিলেন। কিন্তু ১৬৩৬ সালে মুঘলদের সহিত যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া সব ছাড়িয়া দিয়া বিজাপুর সরকারের চাকরি লইতে বাধ্য হইলেন।

শিবাজীর জন্ম ও বাল্যকাল

জীজা বাঈ-এর গর্ভে তাঁহার দুই পুত্র হয়,– শম্ভুজী[২] (১৬২৩) এবং শিবাজী (১৬২৭)। দ্বিতীয় পুত্রের জন্মের পূর্ব্বে জীজাবাঈ জুন্নর শহরের নিকটস্থ শিবনের গিরিদুর্গে বাস করিতেছিলেন; দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী “শিবা-ভবানীর” নিকট তিনি ভাবী সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। এই জন্য পুত্রের নাম রাখিলেন “শিব” (দাক্ষিণাত্যের উচ্চারণ “শিবা”)।

১৬৩০ হইতে ১৬৩৯ পৰ্য্যন্ত শাহজী নানা যুদ্ধবিগ্রহ, বিপদ ও অবস্থা পরিবর্তনের মধ্যে কাটান। এজন্য তাঁহাকে নানা স্থানে ঘুরিতে হয়। তাঁহার স্ত্রী ও পুত্রদ্বয় শিবনের-দূর্গে আশ্রয় লইয়াছিল। তাহার পর ১৬৩৬ সালে মুঘলদের সঙ্গে তাঁহার যুদ্ধ মিটিল, এবং তিনি বিজাপুর-রাজসরকারে কার্য লইলেন বটে, কিন্তু মহারাষ্ট্রে আর রহিলেন না, মহীশূর প্রদেশে নূতন জাগীর স্থাপন করিতে চলিয়া গেলেন। সেখানে তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তুকা বাঈ মোহিতে তাঁহার গর্ভজাত পুত্র ব্যঙ্কোজীকে (ওরফে একোজী) লইয়া বাস করিতে লাগিলেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও দ্বিতীয় পুত্র যেন ত্যাজ্য হইল; তাহাদের বাসের জন্য পুণা গ্রাম এবং ভরণপোষণের ব্যয়ের জন্য ঐ জেলার ক্ষুদ্র জাগীরটি দিয়া গেলেন। জীজা বাঈ এখন প্রৌঢ়া, তাঁহার বয়স ৪১ বৎসর। তরুণবয়স্কা সুন্দরী সপত্নীর আগমনে তিনি স্বামী-সোহাগ হইতে বঞ্চিত হইলেন। জন্মের পর দশ বৎসর পর্য্যন্ত শিবাজী পিতাকে খুব কম সময় দেখিতে পাইয়াছিলেন, আর তাহার পর দুজনে সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া গেলেন ।

শিবাজীর মাতৃভক্তি ও ধৰ্ম্মশিক্ষা

স্বামীর অবহেলার ফলে জীজা বাঈ-এর মন ধর্ম্মে একনিষ্ঠ হইল। আগেও তিনি ধৰ্ম্মপ্রাণা ছিলেন, এখন একেবারে সন্ন্যাসিনীর মত জীবন যাপন করিতে লাগিলেন– যদিও উপযুক্ত সময়ে জমিদারীর আবশ্যক কাজকর্ম্ম দেখিতেন। মাতার এই ধর্ম্মভাব পুত্রের তরুণ হৃদয় অধিকার করিল। শিবাজী নিৰ্জ্জনে বাড়িতে লাগিলেন; সঙ্গীহীন বালক, ভাই নাই, বোন নাই, পিতা নাই, এই নিঃসঙ্গ জীবনের ফলে মাতা ও পুত্র আরও ঘনিষ্ঠ হইলেন; শিবাজীর স্বাভাবিক মাতৃভক্তি শেষে দেবোপাসনার মত ঐকান্তিক হইয়া দাঁড়াইল।

শিবাজী বাল্যকাল হইতে নিজের কাজ নিজে করিতে শিখিলেন– অন্য কাহারও নিকট আদেশ বা বুদ্ধি লইবার জন্য তাঁহাকে অপেক্ষা করিতে হইত না। এইরূপে জীবন-প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দায়িত্ব-জ্ঞান ও কর্তৃত্বে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিলেন। বিখ্যাত পাঠান-রাজা শের শাহের বাল্যজীবনও ঠিক শিবাজীর মত; দুজনেই সামান্য জাগীরদারের পুত্র হইয়া জন্মান, বিমাতার প্রেমে মুগ্ধ পিতার অবহেলার মধ্যে বাড়িয়া উঠেন, বনজঙ্গল ঘুরিয়া, কৃষক ডাকাত প্রভৃতির সহিত মিশিয়া দেশ ও মানুষ সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেন, চরিত্রের দৃঢ়তা, শ্রমশীলতা ও স্বাবলম্বন নিজ হইতে শিক্ষা করেন, পৈত্রিক জাগীরের কাজ চালাইয়া নিজকে ভবিষ্যৎ রাজ্যশাসন কাজের উপযোগী করিয়া গড়িয়া তোলেন। দুজনেরই চরিত্র ও প্রতিভা একরূপ, দুজনেই ঠিক একশ্রেণীর ঘটনার মধ্য দিয়া বর্দ্ধিত হন।

পুণার অবস্থা

আজ পুণা শহর বম্বে প্রদেশের দ্বিতীয় রাজধানী, মারাঠাদের শিক্ষা, সভ্যতা ও আকাঙ্ক্ষার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। কিন্তু ১৬৩৭ সালে যখন বালক শিবাজী এখানে বাস করিতে আসিলেন, তখন পুণা একটি গণ্ডগ্রাম– অতি শোচনীয় দশায় উপস্থিত। ছয় বৎসর ধরিয়া যুদ্ধে দেশ ছারখার হইয়া গিয়াছিল, বার বার নানা আক্রমণকারী আসিয়া গ্রাম লুঠ করিয়া পুড়াইয়া দিয়া চলিয়া যাইত, তাহার পর অরাজকতার সুযোগে আশপাশের ডাকাত সর্দ্দারেরা নিজ আধিপত্য স্থাপন করিত। এই অঞ্চলটি ভূতের লীলাক্ষেত্ৰ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।

মানুষের মধ্যে যুদ্ধ, অশান্তি ও লোকক্ষয়ের ফলে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলে নেকড়ে-বাঘের বংশ খুব বাড়িয়া গিয়াছিল; তাহাদের উৎপাতে পুণা জেলার গ্রামগুলিতে ভেড়া বাছুর এবং ছেলেপিলে নিরাপদ ছিল না; ভয়ে চাষবাস প্রায় বন্ধ হইল ।

দাদাজী কোল্ডদেব, অভিভাবক

১৬৩৭ সালে, শাহজী বিজাপুরের চাকরি লইয়া মহীশ্বর প্রদেশে চলিয়া যাইবার সময় দাদাজী কোণ্ডদেব নামক এক বিচক্ষণ সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণকে পুণা জাগীরের কার্য্যকর্তা নিযুক্ত করিয়া তাহাকে বলিলেন, “আমার প্রথম স্ত্রী ও পুত্র শিবাজী শিবনের দুর্গে আছে। তাহাদের পুণায় আনিয়া রক্ষণাবেক্ষণ কর।” তাহাই করা হইল।[৩]

এই পুণা জাগীরের খাজনা কাগজে চল্লিশ হাজার হোণ (অর্থাৎ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা) ছিল, কিন্তু আদায় হইত অনেক কম। দাদাজী কোণ্ডদেব জমিদারী কাজে সুপরিপক্ক। তিনি সহ্যাদ্রি শ্রেণীর পাহাড়ী লোকদিগকে পুরস্কার দিয়া সেখানকার নেকড়ের দল নির্ব্বংশ করিলেন; ঐ লোকদের হাত করিয়া প্রথমে জমির খাজনা খুব কম, পরে ধীরে ধীরে বর্দ্ধনশীল নিরিখে ধার্য্য করিয়া, তাহাদিগকে সমতল ভূমিতে আসিতে ও চাষ করিতে রাজি করাইলেন। এইরূপে দেশে লোকের বসতি ও কৃষিকার্য্য দ্রুত বাড়িতে লাগিল।

শান্তিরক্ষার জন্য তিনি কতকগুলি স্থানীয় সৈন্য, অর্থাৎ বর্ক-আন্দাজ নিযুক্ত করিয়া জায়গায় জায়গায় থানা বসাইলেন। দাদাজীর দৃঢ়-শাসন ও ন্যায় বিচারে দস্যু ও অত্যাচারীর নাম পর্য্যন্ত দেশ হইতে লোপ পাইল। তাঁহার নিয়মপালনের একটি গল্প আছে। তিনি “শাহজী বাগ” নাম দিয়া একটি ফলের বাগান করেন। তাঁহার কড়া আদেশ ছিল, কেহ গাছের পাতাটি পর্য্যন্ত লইলে শাস্তি পাইবে। একদিন ভুলিয়া তিনি নিজেই একটি আম পাড়িলেন। নিয়মের কথা মনে পড়িলে নিজের উপর দণ্ড দিবার জন্য তিনি অপরাধী নিজ হাত কাটিয়া ফেলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময় সকলে ধরিয়া তাঁহাকে থামাইল। ইহার পর হইতে তিনি অপরাধের চিহ্নস্বরূপ একটি লোহার শিকল গলায় পরিয়া থাকিতেন।

শিবাজী লিখিতে পড়িতে জানিতেন না, কিন্তু তাহাতে তাঁহার ক্ষতি হয় নাই। আকবর, হাইদর আলী, রণজিৎ সিংহ– ভারতের এই তিনজন কর্মীশ্রেষ্ঠ রাজাও নিরক্ষর ছিলেন। সে সময়টা মধ্যযুগ, অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত; তখনকার দিনে এই পুঁথিগত বিদ্যার অভাব তাঁহার মনকে অন্ধকার অকর্ম্মণ্য করিয়া রাখে নাই, অথবা তাঁহার কার্যদক্ষতা হ্রাস করে নাই। কারণ, শিবাজী রামায়ণ মহাভারতের গল্প এবং পুরাণ-পাঠ ও কীর্ত্তন শুনিয়া শুনিয়া প্রাচীন ভারতের জ্ঞান ধর্ম্ম কত কাব্য-কাহিনীর আস্বাদ পান, রাজনীতি, ধর্ম্মনীতি, রণ-কৌশল ও শাসন- বিধান শেখেন। যেখানে কীৰ্ত্তন হইত সেখানে তিনি যাইতেন এবং তন্ময় হইয়া শুনিতেন; কোন হিন্দু-সন্ন্যাসী বা মুসলমান পীরের আগমন হইলে তিনি তাঁহার কাছে গিয়া ভক্তি দেখাইতেন এবং ধর্ম্মের উপদেশ লইতেন। কাজেই শিক্ষার প্রকৃত ফল তাঁহাতে সম্পূর্ণভাবে ফলিয়াছিল।

মাব্‌লে জাতি

পুণা জেলার পশ্চিম প্রান্তে সহ্যাদ্রি পর্ব্বতের গা বাহিয়া ৯০ মাইল লম্বা এবং ১২ হইতে ২৪ মাইল প্রশস্ত যে ভূমিখণ্ড আছে, তাহার নাম ‘মালব”[৪] অর্থাৎ সূর্যাস্তের দেশ বা পশ্চিম। এই অঞ্চলটি অত্যন্ত অসমান, অধিত্যকার পর অধিত্যকা, আর তাহাদের ধারগুলি খাড়া হইয়া নামিয়াছে; নীচে আঁকা-বাঁকা গভীর উপত্যকা। এই নীচের সমভূমি হইতে ছোট-বড় অনেক পাহাড় স্তরে স্তরে উঠিয়াছে, তাহাদের উঁচু গায়ে কাল কষ্টিপাথরের বড় বড় বোল্ডার ছড়ান। স্থানে স্থানে পৰ্ব্বত-গাত্র বনে আবৃত, গাছের তলায় ঘন গাছড়া ও লতাপাতা চলিবার পথ বন্ধ করিয়াছে।

এই মাব্‌লে প্রদেশের উত্তরাংশে কোলী নামক এক প্রাচীন অসভ্য দস্যুজাতির বাস, আর দক্ষিণাংশে মারাঠা কৃষক। মালের মারাঠাদের শরীরে কিছু পাহাড়ী জাতির রক্ত মিশ্রিত আছে; তাহাদের আকৃতি কাল সরু, কিন্তু মাংসপেশী-বহুল ও কর্ম্মঠ। এদেশের বাতাস শুষ্ক ও হালকা, এবং দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য স্থান হইতে কম গরম । মালের জলবায়ু শরীরে বল বৃদ্ধি করে।

শিবাজীর মাব্‌লে বন্ধুগণ

দাদাজী মাবলদেশ নিজের অধীনে আনিলেন। অনেকে গ্রামের তহসিলদারকে (দেশপাণ্ডে) হাত করিলেন। যাহারা অবাধ্য হইল তাহাদের যুদ্ধে বিনাশ করিলেন। এইরূপে সেই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থাপিত হইল এবং মাব্‌লে গ্রামগুলি পুণা জেলার অধিকারীর পক্ষে অর্থ ও লোকবলের কারণ হইয়া দাঁড়াইল। এই মাব্‌লে দেশ হইতে শিবাজীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পদাতিক সৈন্য আসিল; এখানে তাঁহার বাল্যবন্ধু ও অত্যন্ত অনুগত কর্ম্মচারিগণ পাওয়া গিয়াছিল। ইহাদের সঙ্গে বালক শিবাজী পশ্চিমঘাটের বন-জঙ্গল ও পর্ব্বতে, নদীতীরে ও উপত্যকায় ঘুরিয়া বেড়াইতেন। তিনি ক্রমেই কষ্টসহিষ্ণু ও অক্লান্তশ্রমী হইয়া উঠিলেন এবং দেশ ও দেশবাসীদের বিশেষ ঘনিষ্ঠভাবে চিনিলেন। শিবাজীর উত্থানে মাল-জমিদার ও বলিষ্ঠ কৃষকদের পক্ষে সমস্ত দাক্ষিণাত্য ব্যাপিয়া কাৰ্য্যক্ষেত্রের পরিসর বাড়িয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে অর্থ, ক্ষমতা ও খ্যাতিলাভের মহাসুযোগ জুটিল। শিবাজীর যুদ্ধ ও লুণ্ঠনে সহকারী হইয়াই এই কোণঠাসা গরীব গ্রাম্যলোকেরা সেনাপতি ও সম্ভ্রান্ত পুরুষের পদে উঠিতে পারিল। সুতরাং তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁহার রাজ্যাভিলাষের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা হইল। তিনি খোলাখুলিভাবে মিশিয়া তাহাদের ভাইবন্ধুর সামিল হইলেন। ফরাসী-সৈন্যদের চক্ষে নেপোলিয়ন যেমন একাধারে বন্ধু নেতা ও দেবতার সমান ছিলেন, মাবলদের নিকট শিবাজীও তাহাই হইলেন।

শিবাজী স্বাধীন জীবন চান

দাদাজী ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ যে রামায়ণ, মহাভারত ও শাস্ত্র পাঠ করিতেন তাহা শুনিয়া শুনিয়া শিবাজীর তরুণ হৃদয় গঠিত হইল। সন্ন্যাসিনীতুল্য মাতার দৃষ্টান্ত দেখিয়া এবং তাঁহার উপদেশ পাইয়া শিবাজীর মনে সাত্ত্বিক ভাব, দৃঢ়তা ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা জন্মিল। স্বাধীন জীবনের জন্য তাঁহার মন ব্যাকুল হইল; কোন মুসলমান-রাজার অধীনে সেনাপতি হইয়া অর্থ ও সুখ আকাঙ্ক্ষা করাকে তিনি দাসত্ব বলিয়া ঘৃণা করিতে শিখিলেন। স্বাধীন রাজা হওয়া তাঁহার জীবন-প্রভাতের একমাত্র ইচ্ছা ছিল, সমগ্র হিন্দুজাতিকে উদ্ধার বা রক্ষা করার ইচ্ছা অনেক পরে তাঁহার মনে স্থান পায় ।

শিবাজী বড় হইলে কোন্ পথে চলিবেন– এই প্রশ্ন লইয়া অভিভাবকের সঙ্গে তাঁহার মতের অমিল হইল। দাদাজী কোণ্ডদেব বিচক্ষণ জমিদারী দেওয়ান ও ধার্ম্মিক গৃহস্থ; তাঁহার কোন উচ্চ আকাঙ্ক্ষা, মহৎ আদর্শ বা দূর ভবিষ্যতে দৃষ্টি ছিল না। তিনি শিবাজীকে বার বার বলিতে লাগিলেন যে, পিতৃ-পিতামহের মত কোন মুসলমান-রাজার মনসবদার হইয়া সৈন্য লইয়া তাঁহার আজ্ঞা পালনের দ্বারা জাগীর, অর্থ ও উপাধি লাভ করাই ভাল; বনজঙ্গলে ঘুরিয়া ডাকাতদের সঙ্গে মিশিলে, ইচ্ছা করিয়া বিপদ ও গোলমালের মধ্যে গেলে, অথবা স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের চেষ্টা করিলে, পরিণাম শোচনীয় হইবে। শিবাজী শুনিলেন না; শাহজীর নিকট দাদাজী নালিশ করিলেন, কিন্তু পিতার নিষেধে কোনই ফল হইল না। দুশ্চিন্তায় ও মনঃকষ্টে বৃদ্ধ দাদাজী প্রাণত্যাগ করিলেন (১৬৪৭) এবং বিশ বৎসর বয়সে শিবাজী নিজেই নিজের কর্তা হইলেন।

যুবক শিবাজীর প্রথম স্বাধীন কাজ

ইতিমধ্যে শিবাজী যুদ্ধবিদ্যা এবং জমিদারী-চালান সম্পূর্ণরূপে শিখিয়াছিলেন, এবং ঐ প্রদেশের প্রজা ও সৈন্যগণের সহিত বিশেষভাবে পরিচিত হইয়াছিলেন। নিজের বুদ্ধিতে কাজ করিতে এবং লোককে অধীনে রাখিতে ও খাটাইতে তাঁহার অভ্যাস হইয়াছিল। তাঁহার বর্তমান কর্ম্মচারিগুলি বিশ্বস্ত ও কার্য্যদক্ষ, শ্যামরাজ নীলকণ্ঠ রাকের ছিলেন পেশোয়া বা দেওয়ান, বালকৃষ্ণ দীক্ষিত ছিলেন মজমুয়াদার (হিসাব-লেখক), সোণাজী পন্ত দবীর (বা পত্রলেখক) এবং রঘুনাথ বল্লাল কোডে সবনীস্ অর্থাৎ সৈন্যদের বেতন-কর্তা। ইঁহাদের শাহজী আগে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।

১৬৪৬ সালে বিজাপুর রাজ্যে দুর্দিন দেখা দিল। রাজা মুহম্মদ আদিল শাহ অনেককাল গৌরবে রাজ্যশাসন এবং দেশবিজয় করিবার পর শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন। তাঁহার জীবনসংশয় হইল। তিনি ইহার পর আরও দশ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন বটে, কিন্তু তাহা অৰ্দ্ধমৃত জড় অবস্থায়। সাধারণ লোকেরা বলিত যে, সাধু ফকীর শাহ হাসিম উলুবী মন্ত্রবলে নিজ জীবনের দশ বৎসর পরমায়ু রাজাকে দান করেন, সেই ধার-করা প্রাণ লইয়া রাজা এই দশ বৎসর কোনক্রমে বাঁচিয়া ছিলেন। এই কয় বৎসর রাজা অচল, পুতুলের মত; রাণী বড়ি সাহিবা শাসনকাৰ্য্য চালাইতে লাগিলেন, রাজ্যের কেন্দ্রে জীবনী-শক্তি রহিল না।

ইহাই ত শিবাজীর পরম সুযোগ! এই বৎসর তিনি বাজী পাসলকর যেসাজী কঙ্ক এবং তানাজী মালুসরেকে কতকগুলি মারলে পদাতিকের সহিত পাঠাইয়া বিজাপুর-রাজার পক্ষের কিলাদারকে (দুর্গস্বামী) ভুলাইয়া তোরণা[৫] দুর্গ দখল করিলেন। এখানে দুই লক্ষ হোণ রাজার খাজনা জমা হইয়াছিল, তাহা শিবাজীর হাতে পড়িল। তোরণার পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব্বে ঐ পর্ব্বতের অপর এক চূড়ায় তিনি রাজগড় নামক একটি নূতন দুর্গ গড়িলেন, এবং তাহার নীচে ক্রমান্বয়ে তিনটি স্থানে জমি সমান করিয়া দেওয়াল দিয়া ঘিরিয়া ‘মাচী’, অর্থাৎ রক্ষিত গ্রাম নির্ম্মাণ করিলেন।

প্রথম রাজ্য বিস্তার

দাদাজী কোওদেবের মৃত্যুর পর (১৬৪৭) শিবাজী সর্ব্বপ্রথমে পিতার ঐ প্রদেশস্থ সমস্ত জাগীর হস্তগত করিয়া একটি সংলগ্ন একচ্ছত্র রাজ্যস্থাপন করিতে চেষ্টা করিলেন। পুণার ১৮ মাইল উত্তরে চাকন দুর্গের অধ্যক্ষ ফিরল্জী নরুসালা শিবাজীকে প্রভু বলিয়া স্বীকার করিলেন; বারামতী ও ইন্দাপুর নামক দক্ষিণ- পূর্ব্বদিকের দুইটি ছোট থানার কর্ম্মচারিগণও শিবাজীর অধীনে আসিল।

তাহার পর শিবাজী বিজাপুর-রাজ্য হইতে দেশ কাড়িয়া লইয়া নিজ অধিকার- সীমা বাড়াইতে লাগিলেন। পুণার ১১ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কোণ্ডানা দুর্গ বিজাপুর- রাজার ছিল; ইহার কিলাদার ঘুষ লইয়া দুর্গটি শিবাজীর হাতে ছাড়িয়া দিল।

শাহজী বিজাপুরে বন্দী

১৬৪৮ সালের মাঝামাঝি শিবাজী এতদূর পর্য্যন্ত অধিকার বিস্তার করিয়া ফেলিলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময় এক নূতন বিপদ আসিয়া তাঁহাকে বাধা দিল। ২৫-এ জুলাই তাঁহার পিতা শাহজী বিজাপুর-সেনাপতি মুস্তাফা খাঁর আজ্ঞায় জিঞ্জি দুর্গের বাহিরে কারাবদ্ধ হইলেন; তাঁহার সম্পত্তি ও সৈন্য রাজসরকারে জব্‌ত করা হইল। অনেক পরে রচিত ইতিহাসে এই ঘটনার কারণ মিথ্যা করিয়া লেখা হইয়াছে যে, বিজাপুরের সুলতান শিবাজীকে দমন করিবার জন্য শাহজীকে কয়েদ করেন, এবং শিবাজী বশ না মানিলে শাহজীর কারাদ্বার ইট গাঁথিয়া বন্ধ করিয়া তাঁহাকে জীবন্ত গোর দেওয়া হইবে, এরূপ শাসান। কিন্তু সম-সাময়িক সরকারী ফারসী-ইতিহাস (জহুর বিন্ জহুরীকৃত মহম্মদ আদিল শাহের রাজত্ব-বিবরণ) হইতে জানা যায়, বিজাপুরী সৈন্যগণ যখন বহুদিন যুদ্ধ করিয়াও জিঞ্জি দুর্গ লইতে পারিল না, তাহাদের অন্নকষ্ট উপস্থিত হইল, তখন শাহজী প্রধান সেনাপতির নিষেধ অগ্রাহ্য করিয়া সসৈন্য রণত্যাগ করিয়া নিজ জাগীরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। সর্ব্বোচ্চ সেনাধ্যক্ষ নবাব মুস্তাফা খাঁ দেখিলেন, দুর্গ-অবরোধ ত একেবারে পণ্ড হইয়া যায়, অথচ শাহজীর পলায়নে বাধা দিলে নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি আরম্ভ হইবে। তখন তিনি বুদ্ধি করিয়া বিনাযুদ্ধে শাহজীকে বন্দী করিলেন; তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি জত করিলেন, — এক কণামাত্র গোলমালে লুঠ হইতে পারিল না।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত মারাঠী গ্রন্থে প্রকাশ মুদ্‌হোল গ্রামের জাগীরদার বাজী রাও ঘোরপড়ে মুস্তাফা খাঁর ইঙ্গিতে নিমন্ত্রিত শাহজীকে নিজ শিবিরে আনিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাঁহাকে কয়েদ করেন। এই অপরাধের প্রতিশোধ লইবার জন্য কয়েক বৎসর পরে শাহজী শিবাজীকে আজ্ঞা দিয়া এই মুদহোলের ঘোরপড়ে বংশ প্রায় উচ্ছেদ করান। কিন্তু বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য ফারসী-ইতিহাস “বুসাতীন্-ই সলাতীন্” হইতে আমরা জানিতে পারি যে গল্পটি সত্য নহে; শাহজীকে কয়েদ করিবার প্রণালী এইরূপ– “শাহজীর অবাধ্যতায় নবাব মুস্তাফা খাঁ তাঁহাকে গেরোর করা স্থির করিয়া, একদিন বাজী রাও ঘোরপড়ে ও যশোবন্ত রাও (আসস্থানী)-কে নিজ নিজ সৈন্য সজ্জিত করিয়া অতি প্রত্যূষে শাহজীর শিবিরের দিকে পাঠাইলেন। শাহজী সারা রাত্রি নাচগান উপভোগ করিয়া ভোরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। এই দুই রাও-এর আগমন ও উদ্দেশ্য জানিতে পারিয়া হতভম্ব হইয়া ঘোড়ায় চড়িয়া শিবির হইতে একাকী পলাইতে লাগিলেন। বাজী রাও পিছু পিছু ঘোড়া ছুটাইয়া তাঁহাকে বন্দী করিয়া নবাবের সম্মুখে হাজির করিলেন।…আদিল শাহ সংবাদ পাইয়া বন্দীকে রাজধানীতে আনিবার জন্য আজল খাঁকে, এবং তাঁহার সম্পত্তি বুঝিয়া লইবার জন্য একজন খোঁজাকে জিঞ্জিতে পাঠাইলেন।” বিজাপুরে শাহজীকে আনিয়া কিছুদিন সেনাপতি আহমদ খাঁর বাড়ীতে কারাবদ্ধ রাখা হইল ।

শাহজীর কারামুক্তি

শিবাজী মহা বিপদে পড়িলেন; পিতাকে বাঁচাইতে হইলে তাঁহাকে বিজাপুর সুলতানের বাধ্যতা স্বীকার করিতে হইবে, আর এই বশ্যতার ফলে নূতন জয়-করা সমস্ত রাজ্য ফিরাইয়া দিতে হইবে,– এত পরিশ্রম সব পণ্ড হইবে। সুতরাং দুইদিক রক্ষা করিবার জন্য তিনি রাজনীতির কূট চাল চালিলেন। প্রবল পরাক্রমশালী মুঘল-সম্রাট বিজাপুরের শত্রু, বিজাপুররাজ তাঁহার আজ্ঞা অমান্য করিতে সাহস করেন না। অতএব শিবাজী নিকটবর্ত্তী মুঘল-শাসনাধীন দাক্ষিণাত্য- প্রদেশের শাসনকর্তা যুবরাজ মুরাদ বখ্শকে দরখাস্ত করিলেন যে, যদি বাদশাহ শাহজীর পূর্ব্ব অপরাধ (অর্থাৎ ১৬৩৩-৩৬ পর্যন্ত বাদশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা) ক্ষমা করেন এবং ভবিষ্যতে শাহজী ও তাঁহার পুত্রগণকে রক্ষা করিতে সম্মত হন, তবে যুবরাজ অভয়-পত্র পাঠাইলে শিবাজী গিয়া মুঘল-সৈন্যদলে চাকরি করিবেন। কয়েক-মাস ধরিয়া চিঠি লেখালেখি এবং দূত প্রেরণের পর ১৬৪৯ সালের ৩০-এ নভেম্বর মুরাদ শিবাজীকে জানাইলেন যে, তিনি শীঘ্রই বাদশাহর নিকট যাইবেন এবং তথায় সাক্ষাতে শিবাজীর প্রার্থনা নিবেদন করিয়া সম্রাটের হুকুম লইবেন। এইরূপে এক বৎসর নষ্ট হইল। ইতিহাস হইতে বোঝা যায় যে, বাদশাহ শিবাজীর প্রার্থনায় কর্ণপাত করেন নাই। বিজাপুর-রাজ্যের সেনাপতি আহমদ খাঁর অনুরোধে এবং বাঙ্গালোর, কোণ্ডানা ও কন্দর্পী এই তিনটি দুর্গ সমর্পণ করিবার ফলস্বরূপ আদিল শাহ শাহজীকে মুক্ত করিলেন (১৬৪৯ সালের শেষে)। তাহার পর কিছুকাল তিনি মহীশূরের বিদ্রোহী জমিদারগণের (পলিগর) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া তাহাদের পুনরায় বিজাপুরের অধীনে আনেন এবং তথায় ও মাদ্রাজ অঞ্চলে বিজাপুরের ওমরা-স্বরূপ জাগীর পান।

শাহজী জামিনে খালাস পান; সুতরাং পিতা পাছে আবার বিপদে পড়েন, এই ভাবিয়া শিবাজী ১৬৫০ হইতে ১৬৫৫ পর্যন্ত শান্তভাবে কাটান, বিজাপুর সরকারকে কোনমতে ক্ষুণ্ণ করেন নাই।

কিন্তু এই সময়ে তিনি পুরন্দর দুর্গ হস্তগত করেন। এটি “নীলকণ্ঠ নায়ক” উপাধিকারী এক ব্রাহ্মণ-পরিবারের জাগীর ছিল। এ সময়ে নীলোজী, শঙ্করাজী ও পিলাজী নামক তিন ভাই একান্নভুক্ত শরিকরূপে উহার মালিক ছিলেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা নীলোজী বড় কৃপণ ও স্বার্থপর, তিনি অপর দুই ভাইকে তাহাদের ন্যায্য প্রাপ্য আয় ও ক্ষমতা দিতেন না। পৈত্রিক সম্পত্তি বিভাগ করিয়া দিবার জন্য তাহারা মনের দুঃখে শিবাজীকে ধরিয়া পড়িল। শিবাজীর সহিত এই পরিবারের দুই-তিন পুরুষের হৃদ্যতা ছিল, এবং পুরন্দর পুণা হইতে মাত্র নয় ক্রোশ দূর। শিবাজী দেওয়ালীর সময় অতিথিরূপে দুর্গে প্রবেশ করিলেন। তৃতীয় দিবসে কনিষ্ঠ দুই ভাই রাত্রে জ্যেষ্ঠকে বাঁধিয়া শিবাজীর নিকট আনিল, আর শিবাজী তিনজনকেই বন্দী করিয়া দুর্গটি নিজে দখল করিলেন ও তথায় মালে-সৈন্য বসাইলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে তাহাদের ভরণপোষণের জন্য চাম্‌লী নামক গ্রাম দান করিলেন, এবং পিলাজীকে নিজ সৈন্যদলে চাকরি দিলেন।

শিবাজীর জাবলী-অধিকার

সাতারা জেলার উত্তর-পশ্চিম কোণে বিখ্যাত মহাবালেশ্বর পর্ব্বতের পাঁচ-ছয় মাইল পশ্চিমে জাবলী গ্রাম। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমে মোরে নামক এক মারাঠা- বংশ বিজাপুরের প্রথম সুলতানের নিকট হইতে জাবলী পরগণা জাগীর স্বরূপ পান এবং ক্রমে পাশের জমি দখল করিয়া প্রায় সমগ্র সাতারা জেলা এবং কোঁকনের কিছু কিছু অংশে নিজ রাজ্য স্থাপন করেন। প্রথম মোরে স্বহস্তে বাঘ বধ করায় বিজাপুররাজ তাঁহার বীরত্বের জন্য “চন্দ্ররাও” উপাধি দেন; এই উপাধি পুরুষানুক্রমে মোরেদের জ্যেষ্ঠপুত্র ভোগ করিতেন। কনিষ্ঠ ভাইগণকে নিকটবর্ত্তী গ্রাম দেওয়া হইত।

আট পুরুষ ধরিয়া যুদ্ধ ও লুঠ করিবার ফলে মোরেদের ভাণ্ডারে অনেক ধনরত্ন সঞ্চিত হইয়াছিল। তাঁহাদের অধীনে বারো হাজার পদাতিক সৈন্য ছিল, ইহারা মালদের জাতভাই, বলবান সাহসী পাৰ্ব্বতীয় সেনা। ফলতঃ তখন জাবলী-রাজ্য বলিতে প্রায় সমস্ত সাতারা জেলা বুঝাইত। ইহার পশ্চিম দিকে খাড়া সহ্যাদ্রি পৰ্ব্বত, সমুদ্র হইতে ৪,০০০ ফিট উঁচু, তাহার পূর্ব্ব পাশের উপত্যকাগুলি ঘন বনজঙ্গল ও বিক্ষিপ্ত পাথরে আচ্ছন্ন; এই বৃক্ষ-প্রস্তরময় প্রদেশ পশ্চিমে ৬০ মাইল বিস্তৃত, তাহা ভেদ করিয়া ওধারে কোঁকনে যাইবার পথে আটটি গিরিসঙ্কট আছে; দুইটি এমন প্রশস্ত যে তাহা দিয়া গরুর গাড়ী চলিতে পারে।

এই জাবলী দেশ দক্ষিণে ও দক্ষিণ-পশ্চিমে শিবাজীর রাজ্য-বিস্তারের পথ বন্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। তিনি রঘুনাথ বল্লাল কোরডেকে বলিলেন, “চন্দ্রারাওকে না মারিলে রাজ্যলাভ হইবে না। তুমি ভিন্ন একাজ আর কেহ করিতে পারিবে না। আমি তোমাকে দূতরূপে তাঁহার নিকট পাঠাইতেছি।” রঘুনাথ সম্মত হইলেন এবং শিবাজীর পক্ষ হইতে সন্ধি-প্রস্তাব বহনের ভাণ করিয়া ১২৫ জন বাছা বাছা সৈন্যসহ জাবলী গেলেন।

ইহার তিন-চারি বৎসর আগে কৃষ্ণাজী মোরে, চন্দ্ররাও উপাধি লইয়া রাজা হইয়াছিলেন। রঘুনাথ প্রথম দিন সাধারণ ভদ্রতা ও আলাপের পর বাসায় ফিরিয়া আসিলেন, এবং চন্দ্ররাও-এর অসতর্ক অবস্থা বর্ণনা করিয়া নিজ প্রভুকে সৈন্য লইয়া জাবলীর কাছে উপস্থিত থাকিতে লিখিলেন, যেন খুনের পরে জাবলী আক্রমণ করিতে বিলম্ব না হয়। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ গোপন-গৃহে হইল; রঘুনাথ আলোচনা আরম্ভ করিয়া দিয়া, হঠাৎ ছোরা খুলিয়া চন্দ্ররাও এবং তাঁহার ভাই সূর্য্য রাওকে হত্যা করিয়া ছুটিরা ফটক দিয়া বাহির হইলেন; দ্বারপালগণ ভীত ও হতভম্ব হইয়া বাধা দিতে পারিল না; সৈন্যদের যাহারা তাড়া করিল তাহারা পরাস্ত হইয়া ফিরিয়া আসিল। রঘুনাথ বনে একটি নির্দিষ্টস্থানে আসিয়া লুকাইলেন।

শিবাজী কাছেই ছিলেন। মোরেদের হত্যার সংবাদ পাইবামাত্র তিনি জাবলী আক্রমণ করিলেন। নেতাহীন সৈন্যগণ ছয় ঘণ্টা ধরিয়া সাহসের সহিত যুদ্ধ করিয়া অবশেষে দুর্গ ছাড়িয়া দিল (১৫ জানুয়ারী, ১৬৫৬)। চন্দ্ররাও-এর দুই পুত্র ও পরিবারবর্গ বন্দী হইল। কিন্তু তাঁহার আত্মীয় ও কার্য্যাধ্যক্ষ হনুমন্ত রাও মোরে ঐ বংশের অনুচরদের একত্র করিয়া নিকটবর্ত্তী একটি গ্রামে আত্মরক্ষা করিতে লাগিলেন। শিবাজী দেখিলেন, “হনুমন্তকে হত্যা না করিলে জাবলীর কণ্টক দূর হইবে না।” তিনি শম্ভুজী কাবজী নামক এক মারাঠা-যোদ্ধাকে দৌত্যের ভাণ করিয়া হনুমন্তের নিকট পাঠাইলেন। কাবজী সাক্ষাতের সময় হনুমন্তকে খুন করিল। এইরূপে সমস্ত জাবলী–প্রদেশ শিরাজীর করতলগত হইল। তিনি এইবার দক্ষিণে কোলাপুর ও পশ্চিমে রত্নগিরি জেলা অধিকার করিবার সুযোগ পাইলেন। তাঁহার আরও এই একটি লাভ হইল যে, মারলে সৈন্য জুটাইবার ক্ষেত্র দ্বিগুণ বিস্ত ত হইল, কারণ এখন সাতারার পশ্চিম প্রান্তে ৬০ মাইল ব্যাপী পৰ্ব্বত ও উপত্যকা তাঁহার অধিকারে আসিল। মোরেদের সমস্ত সৈন্যসামন্ত এবং আট পুরুষের সঞ্চিত অগাধ ধনরত্ন তাঁহার হাতে পড়িল।

মোর বংশের কয়েকজন লোক ধরা পড়েন নাই, শিবাজীর উপর প্রতিশোধ লইবার জন্য তাঁহারা ১৬৬৫ সালে জয়সিংহের সহিত যোগ দিয়াছিলেন।

শিবাজীর নূতন দুর্গ

জাবলী গ্রামের দুই মাইল পশ্চিমে শিবাজী প্রতাপগড় নামে একটি দুর্গ নিৰ্ম্মাণ করিয়া তথায় ভবানী-মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিলেন। কারণ, আদি ভবানী দেবীর মন্দির ছিল তুলজাপুরে, বিজাপুর-রাজ্যের মধ্যে। এই প্রতাপগড়ের ভবানীই শিবাজীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হইলেন, তথায় তিনি অনেকবার তীর্থযাত্রা করেন এবং বহুমূল্য ধনরত্ন দান করেন।

জাবলী-জয়ের পর শিবাজী রায়গড়ের বিশাল গিরিদুর্গ মোরের হাত হইতে কাড়িয়া লইলেন (এপ্রিল, ১৬৫৬); ইহা পরে তাঁহার রাজধানী হয়। ২৪-এ সেপ্টেম্বর তিনি বৈমাত্রেয় মাতুল শম্ভুজী মোহিতের নিকট দশহরা পর্ব্বের প্রীতিউপহার চাহিবার ভাণ করিয়া গিয়া, তাঁহাকে হঠাৎ বন্দী করিলেন। শম্ভুজী শাহজীর আজ্ঞায় সুপে পরগণার শাসনকর্তা ছিলেন; তিনি শিবাজীর অধীনে কার্য্য করিতে অস্বীকার করায় শিবাজী তাঁহাকে পিতার নিকট পাঠাইয়া দিয়া সুপে পরগণা দখল করিলেন।

৪ঠা নভেম্বর ১৬৫৬, বিজাপুরের সুলতান মুহম্মদ আদিল শাহর মৃত্যুতে যে বিপ্লবের আরম্ভ হইল, তাহা শিবাজীর পক্ষে মহা লাভের কারণ হইয়া দাঁড়াইল।

তথ্যনির্দেশ

১. পরে লোকের মুখে ঘটনাটি এই আকার ধারণ করে- “মালোজী বড় দেব-দেবীভক্ত গৃহস্থ। একদিন মাঘ মাসের রাত্রে ক্ষেতে পাহারা দিতে দিতে তিনি দেখিলেন যে, মাটির তল হইতে শ্রীদেবী (অর্থাৎ শিবানী) অবিভূত হইলেন এবং নিজ জ্যোতির্ম্ময় অলঙ্কার-মণ্ডিত হাত তাঁহার মুখ ও পিঠে বুলাইয়া দিয়া বলিলেন, “বৎস! আশীর্ব্বাদ করিতেছি। এই গৰ্ত্তটি খুঁড়িলে সাত কড়াই-ভরা মোহর পাইবে। উহা আমি তোমাকে দান করিলাম। তোমার বংশে ২৭ পুরুষ পর্য্যস্ত রাজপদ চলিবে। তোমাদের সব বাঞ্ছা পূর্ণ হইবে।”

২. এই শম্ভুজী যৌবনে কনকগিরি দুর্গ আক্রমণ করিতে গিয়া মারা যান। ইতিহাস তাঁহার সম্বন্ধে নীরব

৩. দুই বৎসর পরে (১৬৪৯) জীজা বাঈ ও শিবাজী দাদাজীর সহিত শাহজীর নিকট বাঙ্গালোরে গেলেন। কিন্তু তিনি তাঁহাদের পুণায় ফিরিয়া পাঠাইয়া দিলেন।

8. মারাঠী ভাষায় ‘মাবলনো (infinitive) ক্রিয়াপদ, অর্থ অস্ত যাওয়া’। পর্ব্বতগাত্রের এই দেশকে উত্তরে (অর্থাৎ বগলানায়) ‘ডাঙ্গ’, মধ্যভাগে (অর্থাৎ নিজ মহারাষ্ট্রে) ‘মাবল’ এবং দক্ষিণ অর্থাৎ কর্ণাটকে ‘মল্লাড়’ বলা হয়!

৫. পুণা হইতে ২৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *