০১. মহারাষ্ট্র দেশ ও মারাঠা জাতি

প্রথম অধ্যায় – মহারাষ্ট্র দেশ ও মারাঠা জাতি

দেশের বিস্তৃতি

১৯১১ সালের গণনায় দেখা গেল যে, সমগ্র ভারতবর্ষের সাড়ে একত্রিশ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় দুই কোটি নরনারী মারাঠী ভাষা বলে। ইহার মধ্যে এক কোটির কিছু বেশী বোম্বাই প্রদেশে, প্রায় আধ কোটি মধ্য-প্রদেশ ও বেরারে, এবং পঁয়ত্রিশ লক্ষ নিজামের রাজ্যে বাস করে। সিন্ধু বিভাগ বাদ দিলে বোম্বাই প্রদেশের যাহা থাকে তাহার অর্ধেক অধিবাসীর, মধ্য-প্রদেশের এক-তৃতীয়াংশের এবং নিজাম- রাজ্যের সিকি লোকের মাতৃভাষা মারাঠী। এই ভাষার দিন দিন বিস্তৃতি হইতেছে, কারণ ইহার সাহিত্য বৃহৎ এবং বর্দ্ধিষ্ণু, আর মারাঠারা তেজস্বী উন্নতিশীল জাতি।

প্রকৃত মহারাষ্ট্র দেশ বলিলে বুঝাইত দক্ষিণ ভারতের উঁচু জমির পশ্চিম প্রান্তে প্রায় আটাশ হাজার বর্গমাইল স্থান; অর্থাৎ, নাসিক, পুণা ও সাতারা– এই তিন জেলার সমস্তটা, এবং আহমদনগর এবং শোলাপুর জেলার কিছু কিছু, উত্তরে তাপ্তী নদী হইতে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদীর আদি শাখা বর্ণা নদী পর্য্যন্ত, এবং পূর্ব্বে সীনা নদী হইতে পশ্চিম দিকে সহ্যাদ্রি (অর্থাৎ পশ্চিম-ঘাট) পৰ্ব্বতশ্রেণী পৰ্য্যন্ত। আর, ঐ সহ্যাদ্রি পার হইয়া আরব-সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত যে লম্বা ফালি জমি তাহার উত্তরার্দ্ধের নাম কোঁকন, এবং দক্ষিণ ভাগ কানাড়া ও মালবার; এই কোঁকনে থানা, কোলাবা ও রত্নগিরি নামে তিনটি জেলা এবং সংলগ্ন সাবন্ত-বাড়ী নামক দেশী রাজ্য প্রায় দশ হাজার বর্গমাইল ব্যাপিয়া আছে। ইহার অধিকাংশ লোকে এখন মারাঠী বলে, কিন্তু তাহারা সকলেই জাতিতে মারাঠা নহে।

চাষবাস ও জমির অবস্থা

মহারাষ্ট্র দেশে বৃষ্টি বড় কম এবং অনিশ্চিত; এজন্য অল্প শস্য জন্মে, এবং তাহাও অনেক পরিশ্রমের ফলে। কৃষক সারা বৎসর খাঁটিয়া কোনমতে পেট ভরিবার মত ফসল লাভ করে। ইহাও আবার সকল বৎসরে নহে। যে শুষ্ক পাহাড়ে দেশ, তাহাতে ধান হয় না, গম ও যব জন্মে অত্যন্ত কম। এ দেশের প্রধান ফসল এবং সাধারণ লোকের একমাত্র খাদ্য জোয়ারি, বাজ্রী এবং ভুট্টা। মাঝে মাঝে অনাবৃষ্টিতে এইসব গাছের চারা শুকাইয়া যায়, জমির উপরটা পুড়িয়া ধূলার রং হয়, সবুজ কিছুই বাঁচে না, অসংখ্য নরনারী এবং গরু-বাছুর অনাহারে মারা যায়। এইজন্যই আমরা এতবার দাক্ষিণাত্যে দুর্ভিক্ষের কথা শুনিতে পাই ।

পাহাড় বনে ঢাকা অনুব্বর দেশ, কাজেই লোকসংখ্যা বড় কম। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত সহ্যাদ্রি পর্বতশ্রেণী মেঘ পর্য্যন্ত মাথা তুলিয়া সমুদ্রে যাইবার পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, আর এই সহ্যাদ্রি হইতে পূৰ্ব্বদিকে কতকগুলি শাখা বাহির হইয়াছে। এইরূপে দেশটা অনেক ছোট ছোট অংশে বিভক্ত, প্রতি অংশের তিনদিকে পাহাড়ের দেওয়াল আর মাঝখান দিয়া পূৰ্ব্বমুখে প্রবাহিত কোন প্রাচীন বেগবতী নদী। এই খণ্ড- জেলাগুলিতে মারাঠারা নিভৃতি বাস করিত, বাহিরের জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখিত না, কারণ তাহাদের না ছিল ধনধান্য, না ছিল তেমন কিছু শিল্প- বাণিজ্য, না ছিল বণিক, সৈন্য বা পথিককে আকৃষ্ট করিবার মত সমৃদ্ধ রাজধানী তবে ভারতের পশ্চিম সাগরতীরের বন্দরগুলিতে পৌঁছিতে হইলে এই প্রদেশ পার হইয়া যাইতে হইত।

গিরি-দুর্গ

এই নির্জ্জনবাসের ফলে মারাঠা জাতি স্বভাবতঃই স্বাধীনতাপ্রিয় হইল এবং জাতীয় বিশেষত্ব রক্ষা করিতে পারিল। এই দেশে প্রকৃতি-দেবী নিজ হইতে অসংখ্য গিরিদুর্গ গড়িয়া দিয়াছেন, তাহাতে আশ্রয় লইয়া মারাঠারা সহজেই অনেকদিন ধরিয়া আত্মরক্ষা করিতে এবং বহুসংখ্যক আক্রমণকারীকে বাধা দিতে পারিত; অবশেষে শ্রান্ত ক্লান্ত শত্রু অবসন্নমনে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হইত।

পশ্চিমঘাটশ্রেণীর অনেক পর্ব্বতের শিখরদেশ সমতল আর পাশগুলি অনেকদূর পর্য্যন্ত খাড়া, অথচ তাহাদের উপরে অনেক ঝরণা আছে। অতীত যুগে এই পাহাড়ের গা হইতে ট্র্যাপ প্রস্তর গলিয়া পড়িয়া অতি কঠিন ব্যাসল্ট (কষ্টিপাথর) খাড়া দেওয়াল অথবা স্তূপের আকারে বাহির হইয়াছে, তাহা ভাঙ্গা বা খোঁড়া যায় না। পর্ব্বতের চূড়ায় পৌঁছিবার জন্য পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি কাটিলেই এবং পথরোধের জন্য গোটাকয়েক দরজা গাঁথিলেই, এক একটি সম্পূর্ণ দুৰ্গ গঠিত হয়,– বিশেষ কোন পরিশ্রম বা অর্থব্যয়ের প্রয়োজন হয় না। এরূপ গিরিদুর্গে আশ্রয় লইয়া পাঁচশত লোক বিশ হাজার শত্রুকে বহুদিন ঠেকাইয়া রাখিতে পারে। অগণিত গিরিদুর্গ দেশময় ছড়ান থাকায়, বিনা কামানে মহারাষ্ট্র জয় করা অসাধ্য।

যে দেশের অবস্থা এরূপ, সেখানে কেহই অলস থাকিতে পারে না। প্রাচীন মহারাষ্ট্রে কেহই অকৰ্ম্মণ্য ছিল না– কেহই পরের পরিশ্রমের ফলে জীবিকা নির্ব্বাহ করিত না; এমন কি গ্রামের জমিদারও (পাটেল বা প্রধান) শাসনকার্য পরিচালনা করিয়া নিজের অন্ন উপার্জ্জন করিতেন। দেশে ধনীর সংখ্যা খুব কম ছিল, এবং তাহারা ব্যবসায়ী-শ্রেণীর। জমিদারগণেরও যে গৌরব ছিল তাহা ততটা মজুত টাকার জন্য নহে, যতটা শস্য ও সৈন্য-সংগ্রহের জন্য।

এরূপ সমাজে প্রত্যেক স্ত্রী-পুরুষ কায়িক পরিশ্রম করিতে বাধ্য; শৌখিনতা ও কোমলতার স্থান এখানে নাই। প্রকৃতিদেবীর কঠোর শাসনে সকলকেই কোনমতে সাদাসিধে ধরণে সংসার চালাইতে হইত; সুতরাং তাহাদের মধ্যে বিলাসিতা, অনন্যমনে জ্ঞান বা সুকুমার শিল্পের চর্চ্চা, এমন কি ভব্যতা পৰ্য্যন্ত অসম্ভব ছিল। উত্তর-ভারতে মারাঠা-প্রাধান্যের সময় এই বিজেতাদের ব্যবহার দেখিয়া বোধ হইত– তাহারা অহঙ্কারী হঠাৎ বড়লোক, কোমলতা ও ভব্যতাহীন, এমন কি বর্ঝর। তাহাদের প্রধান ব্যক্তিরাও শিল্পকলা, সামাজিকতা, এবং সৌজন্যের দিকে দৃষ্টিপাত করিত না। ভারতের অনেক প্রদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠারা রাজা হইয়াছিল সত্য, কিন্তু তাহারা কোন সুন্দর অট্টালিকা, মনোহর চিত্র বা কারুকার্যময় পুঁথি প্রস্তুত করায় নাই।

মারাঠা চরিত্র

মহারাষ্ট্র দেশ শুষ্ক ও স্বাস্থ্যকর; এরূপ জলবায়ুর গুণও কম নয়। এই কঠিন জীবনের ফলে মারাঠা-চরিত্রে আত্মনির্ভরতা, সাহস, অধ্যবসায়, কঠোর আড়ম্বরশূন্যতা, সাদাসিদে ব্যবহার, সামাজিক সাম্য, এবং প্রত্যেক মানবেরই আত্মসম্মানবোধ এবং স্বাধীনতাপ্রিয়তা,– এই-সব মহাগুণ জন্মিয়াছিল। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চীনা পর্যটক ইউয়ান চুয়াং মারাঠা জাতিকে এইরূপ চক্ষে দেখিয়াছিলেন, –“এই দেশের অধিবাসীরা তেজী ও যুদ্ধপ্রিয়; উপকার করিলে কৃতজ্ঞ থাকে, অপকার করিলে প্রতিহিংসা খোঁজে। কেহ বিপদে পড়িয়া আশ্রয় চাহিলে তাহারা ত্যাগস্বীকার করে, আর অপমান করিলে তাহাকে বধ না করিয়া ছাড়ে না। তাহারা প্রতিহিংসা লইবার আগে শত্রুকে শাসাইয়া দেয়।“

যে সময় এই বৌদ্ধ-পথিক ভারতে আসেন, তখন মারাঠারা দাক্ষিণাত্যের মধ্য অংশে সুবিস্তৃত ও ধনজনপূর্ণ রাজ্যের অধিকারী। তাহার পর চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে মুসলমান- বিজয়ের ফলে স্বরাজ্য হারাইয়া তাহারা দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম প্রান্তে পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় লইল, এবং গরীব অবস্থায় কোণ-ঠাসা হইয়া পড়িল। এই নির্জ্জন দেশে জঙ্গল, অনুর্ব্বরা জমি এবং বন্যজন্তুর সহিত লড়াই করিয়া ক্রমে তাহারা ভব্যতা ও উদারতা অনেকটা হারাইল বটে, কিন্তু অধিকতর সাহসী, চতুর এবং ক্লেশসহিষ্ণু হইয়া উঠিল। মারাঠা-সৈন্যগণ সাহসী, বুদ্ধিমান এবং পরিশ্রমী; রাত্রে নিঃশব্দে আক্রমণ করা, অথবা শত্রুর জন্য ফাঁদ পাতিয়া লুকাইয়া থাকা, সেনাপতির মুখ না চাহিয়া বুদ্ধিবলে নিজকে বিপদ হইতে মুক্ত করা, এবং যুদ্ধের অবস্থা বদলানের সঙ্গে সঙ্গে রণ-প্রণালী বদলানর ক্ষমতা– একাধারে এই গুণগুলি একমাত্র আফগান এবং মারাঠা জাতি ভিন্ন এশিয়া মাহাদেশে অন্য কোন জাতির নাই ।

সামাজিক সাম্যভাব

ধনী এবং সুসভ্য সমাজে যেমন অসংখ্য শ্রেণী-বিভাগ, উচ্চনীচ-ভেদ আছে, ষোড়শ শতাব্দীর সরল গরীব মারাঠাদের মধ্যে সেরূপ ছিল না। সেখানে ধনীর মান ও পদ দরিদ্র হইতে বড় বেশী উঁচু ছিল না, এবং অতি দরিদ্র লোকও যোদ্ধা বা কৃষকের কাজ করিত বলিয়া আদরের পাত্র ছিল; অন্ততঃ তাহারা আগ্রা-দিল্লীর অলস ভিক্ষুকদল বা পরান্নভোজী চাটুকারদের ঘৃণিত জীবন যাপন করা হইতে রক্ষা পাইত, কারণ এদেশে কুঁড়ে পুষিবার মত কোন লোক ছিল না। প্রাচীন প্ৰথা এবং দারিদ্র্যের ফলে মারাঠা-সমাজে স্ত্রীলোকেরা ঘোমটা দিত না, অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকিত না। স্ত্রী-স্বাধীনতার ফলে মহারাষ্ট্রে জাতীয় শক্তি দ্বিগুণ হইল এবং সামাজিক জীবন অধিকতর পবিত্র ও সরস হইল। ঐ দেশের ইতিহাসে অনেক কর্মী ও বীর মহিলার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। শুধু যেসব বংশ ক্ষত্রিয় বলিয়া দাবি করিত, তাহারাই বাড়ীর স্ত্রীলোকদের অবরোধে রাখিত। কিন্তু ব্রাহ্মণ-বংশের স্ত্রী- লোকেরাও অবরোধ-মুক্ত, এমন কি অনেকে অশ্বারোহণে পটু ছিলেন।

দেশের ধর্ম্মও এই সামাজিক সাম্যভাব বাড়াইল। ব্রাহ্মণেরা শাস্ত্রগ্রন্থ নিজহাতে রাখিয়া ধৰ্ম্মজগতে কৰ্ত্তা হইয়া বসিয়াছিলেন বটে, কিন্তু নূতন নূতন জন- ধর্ম্ম উঠিয়া দেশের লক্ষ লক্ষ নরনারীকে শিখাইল যে লোকে চরিত্রের বলেই পবিত্র হয়,– জন্মের জন্য নহে; ক্রিয়াকর্ম্মে মুক্তি হয় না, হয় অন্তরের ভক্তিতে। এই নব ধর্ম্মগুলি ভেদবুদ্ধির মূলে আঘাত করিল। তাহাদের কেন্দ্র ছিল এই দেশের প্রধান তীর্থ পংঢারপুরে। যে-সব সাধু ও সংস্কারক এই ভক্তিমন্ত্রে দেশবাসীকে নবজীবন দান করিলেন, তাঁহারা অনেকেই অব্রাহ্মণ নিরক্ষর, কেহ দর্জি, কেহ ছুতার, কেহ কুমার, মালী, মুদী, নাপিত, এমন কি মেথর। আজিও তাঁহারা মারাঠা দেশে ভক্তহৃদয় অধিকার করিয়া আছে। তীর্থে তীর্থে বাৎসরিক মেলার দিনে অগণিত লোক সম্মিলিত হইয়া মারাঠাদের জাতীয় একতা, হিন্দুজাতির একপ্রাণতা অনুভব করিত; জাতিভেদ ঘুচিল না বটে, কিন্তু গ্রাম ও গ্রামের মধ্যে, প্রদেশ ও প্রদেশের মধ্যে ভেদবৃদ্ধি কমিতে লাগিল।

মারাঠী জন-সাহিত্যও এই জাতীয় একতা-বন্ধনের সহায় হইল। তুকারাম ও রামাদাস, বামন পণ্ডিত ও মোরো পন্ত প্রভৃতি সন্ত-কবির সরল মাতৃভাষায় রচিত গীত ও নীতিবচনগুলি ঘরে ঘরে পৌঁছিল। “দক্ষিণদেশ ও কোঁকনের প্রত্যেক শহর ও গ্রামে, প্রধানতঃ বর্ষাকালে, ধার্ম্মিক মারাঠা-গৃহস্থ পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবর্গ লইয়া শ্রীধর কবির “পোথী” পাঠ শোনে। ভাবাবেশে তাহারা উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে থাকে, মাঝে মাঝে কেহ হাসে, কেহ দুঃখের শ্বাস ফেলে, কেহ বা কাঁদে। যখন চরম করুণ রসের বর্ণনা আসে তখন শ্রোতারা একসঙ্গে দুঃখে কাঁদিয়া উঠে, পাঠকের গলা আর শুনা যায় না।” [একবাৰ্থ]

প্রাচীন মারাঠী কবিতায় সুদীর্ঘ গুরুগম্ভীর পদলালিত্য ছিল না, ভাবোচ্ছ্বাসময় বীণার ঝঙ্কার ছিল না, কথার মারপেঁচ ছিল না। “নিরক্ষর জনসাধারণের প্রিয় পদ্য ছিল ‘পোবাড়া’ অর্থাৎ ‘কথা’ (ব্যালাড্)। ইহাতেই জাতীয় চিত্তের স্ফুরণ হইয়াছে। দাক্ষিণাত্যের সমতলক্ষেত্র, সহ্যাদ্রির গভীর উপত্যকা এবং উচ্চগিরিশ্রেণী– সর্ব্বত্রই গ্রামে গ্রামে দরিদ্র ‘গোন্ধালী’-গণ (অর্থাৎ, চারণেরা) ভ্রমণ করে, এখনও সেই অতীত যুগের ঘটনা লইয়া ‘কথা ও কাহিনী’ গান করে,– যখন তাহাদের পূর্ব্বপুরুষেরা অস্ত্রবলে সমগ্র ভারত জয় করিয়াছিল, কিন্তু অবশেষে সমুদ্রপার হইতে আগত বিদেশীর কাছে আহত বিধ্বস্ত হইয়া দেশে পলাইয়া আসিয়াছিল। গ্রামবাসীরা ভিড় করিযা সেই কাহিনী শুনিতে থাকে, কখন-বা মুগ্ধ, নীরব থাকে, কখন-বা উল্লাসে উন্মত্ত হয়।” [একবাৰ্থ]

মারাঠী জনসাধারণের ভাষা আড়ম্বরশূন্য, কর্কশ, কেবলমাত্র কাজের উপযোগী। ইহাতে উর্দুর কোমলতা, শব্দবিন্যাসের মারপেঁচ, ভাব প্রকাশের বৈচিত্র্য, ভব্যতা ও আমীরি সুর একেবারেই নাই। মারাঠারা যে স্বাধীনতা, সাম্য ও প্রজাতন্ত্রপ্রিয় তাহার প্রমাণ– তাহাদের ভাষায় ‘আপনি’ অর্থাৎ সম্মান-সূচক কোন ডাক ছিল না। সকলেই ‘তুমি’।

এইরূপে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দেখা গেল, মহারাষ্ট্র দেশে ভাষায় ধৰ্ম্মে চিন্তায় জীবনে এক আশ্চর্য্য একতা ও সাম্যের সৃষ্টি হইয়াছে। শুধু রাষ্ট্রীয় একতার অভাব ছিল; তাহাও পূরণ করিলেন– শিবাজী। তিনিই প্রথমে জাতীয় স্বরাজ্য স্থাপন করিলেন; তিনি দিল্লীর আক্রমণকারীকে স্বদেশ হইতে বিতাড়িত করিবার জন্য যে যুদ্ধের সূচনা করেন, তাহা তাঁহার পুত্রপৌত্রগণ চালাইয়া দেহের রক্তদানে মারাঠা-মিলন গাঁথিয়া তুলিল। অবশেষে পেশোয়াগণের রাজত্বকালে সমগ্র ভারতের রাজরাজেশ্বর হইবার চেষ্টার ফলে যে জাতীয় গৌরব-জ্ঞান, জাতীয় সমৃদ্ধি, জাতীয় উৎসাহ জাগিয়া উঠে তাহা শিবাজীর ব্রত সম্পূর্ণ করিয়া দিল, –কয়েকটি জাত (caste) এক ছাঁচে ঢালা হইয়া রাষ্ট্রসঙ্ঘ (nation) গঠিত হইবার পথে অগ্রসর হইল। ভারতের অন্য কোন প্রদেশে ইহা ঘটে নাই।

কৃষক ও সৈনিক জাত

‘মারাঠা’ বলিতে বাহিরের লোক এই নেশন্ বা জনসঙ্ঘ বোঝে। কিন্তু মহারাষ্ট্রে এই শব্দের অর্থ একটি বিশেষ জাত অর্থাৎ বর্ণ, সমগ্র মহারাষ্ট্রবাসী নেশন্ নহে। এই মারাঠা জাত এবং তাহাদের নিকট কুটুম্ব কুন্তী জাতের অধিকাংশ লোকই কৃষক, সৈন্য বা প্রহরীর কাজ করে। ১৯১১ সালে মারাঠা জাত সংখ্যায় পঞ্চাশ লক্ষ এবং কুবীরা পঁচিশ লক্ষ ছিল। এই দুই জাত লইয়া শিবাজীর সৈন্যদল গঠিত হয়– যদিও সেনাপতিদের মধ্যে অনেকেই ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ ছিলেন।

“মারাঠা (অর্থাৎ কৃষক) জাত সরল, খোলামন, স্বাধীনচেতা, উদার ও ভদ্র; সদ্ব্যবহার পাইলে পরকে বিশ্বাস করে; বীর ও বুদ্ধিমান, পূর্ব্বগরিমা স্মরণ করিয়া গর্ব্বোৎফুল্ল। ইহারা মুরগী ও মাংস খায়, মদ ও তাড়ি পান করে (কিন্তু নেশাখোর নহে)। বোম্বাই প্রদেশের রত্নগিরি জেলার মারাঠা জাত হইতে যত লোক সৈন্যদলে ভর্তি হয়, অন্য কোন জাত হইতে তত নহে। অনেকে পুলিস এবং পাইক হরকরা হয়। মারাঠারা কুন্তীর মত শান্ত ভদ্রব্যবহারকারী, মোটেই রাগী নহে, কিন্তু অধিকতর সাহসী ও দয়াদাক্ষিণ্যশালী। তাহারা বেশ মিতব্যয়ী, নম্র, ভদ্র ও ধৰ্ম্মপ্রাণ। কুন্তীরা এখন সকলেই কৃষক হইয়াছে– তাহারা স্থির, শান্ত, শ্রমী, সুশৃঙ্খল, দেবদেবীভক্ত, এবং চুরি-ডাকাতি বা অন্য অপরাধ হইতে মুক্ত। তাহাদের স্ত্রীলোকগণ পুরষের মত বলিষ্ঠ এবং কষ্টসহিষ্ণু। ইহাদের মধ্যে বিধবা- বিবাহ প্রচলিত আছে।” (বম্বে গেজেটিয়র) মারাঠা-চরিত্রের গুণের কথা বলিলাম, এইবার তাহাদের দোষগুলির আলোচনা করা যাক।

মারাঠা চরিত্রের দোষ

মারাঠা-রাজশক্তি বিদেশ-লুণ্ঠনের বলে বাঁচিয়া থাকিত। এরূপ দেশের রাজপুরুষেরা নিজের জন্য লুঠ করিতে, অর্থাৎ ঘুষ লইতে কুণ্ঠিত হয় না। প্রভুর প্রবৃত্তি ভৃত্যে দেখা দেয়। শিবাজীর জীবিতকালেও তাঁহার ব্রাহ্মণ কর্মচারীরা নির্লজ্জভাবে ঘুষ চাহিত ও আদায় করিত।

মারাঠাদের মধ্যে ব্যবসায়-বুদ্ধি বড় কম, ইহার ফলে তাহাদের রাজত্ব বেশীদিন টেকে নাই। এই জাতির মধ্যে একজনও বড় শ্রেষ্ঠী (ব্যাঙ্কার), বণিক, ব্যবসায়-পরিচালক, এমন কি সর্দ্দার ঠিকাদারেরও উদ্ভব হয় নাই। মারাঠা- রাজশক্তির প্রধান ত্রুটি ছিল– অর্থনীতির ক্ষেত্রে অপারগতা। ইহাদের রাজারা সৰ্ব্বদাই ঋণগ্রস্ত, নিয়মিত সময়ে ও সুচারুরূপে রাজ্যের ব্যয়-নির্ব্বাহ এবং শাসন- যন্ত্র ঠিক এবং দ্রুত পরিচালন করা তাঁহাদের সকলের নিকট অসম্ভব ছিল।

কিন্তু বর্তমান মারাঠারা এক অতুলনীয় সম্পদে ধনী। মাত্র তিন পুরুষ আগে তাহাদের জাতি শত শত যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্মুখীন হইয়াছিল, রাজ্যের দৌত্যকার্য্য ও সন্ধির তর্ক এবং ষড়যন্ত্রজালে লিপ্ত হইয়াছিল, রাজস্ব-চালনা আয়ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়াছিল, সাম্রাজ্যের নানা সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা করিতে বাধ্য হইয়াছিল। তাহারা যে-ভারতের ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে, আমরা এখন সেই ভারতেরই অধিবাসী। এই-সব কীর্তির স্মৃতি প্রতি মারাঠার অন্তরে অবর্ণনীয় তেজের সঞ্চার করে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ধীর শ্রমশীলতা, সরল চালচলন, মানব-জীবনের সর্ব্বোচ্চ আদর্শের অনুসরণ করিবার জন্য প্রাণের টান, যাহা উচিত বলিয়া জানি তাহা করিবই– এই দৃঢ়পণ, ত্যাগস্পৃহা, চরিত্রের দৃঢ়তা, এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সাম্যে বিশ্বাস, –এই-সব গুণে মারাঠী মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভারতের অপর কোন জাতি হইতে কম নহে বরং অনেকস্থলে শ্রেষ্ঠ। আহা! সেই সঙ্গে তাহাদের যদি ইংরাজদের মত অনুষ্ঠানগঠনে ও বন্দোবস্তে দক্ষতা, সকলে মিলিয়া-মিশিয়া কাজ করিবার শক্তি, লোককে চালাইবার ও বশ করিবার স্বাভাবিক ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি, এবং অজেয় বিষয়-বুদ্ধি (common sense) থাকিত, তবে ভারতের ইতিহাস আজ অন্যরূপ হইত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *