৪৩. বশিষ্ঠাপবাহতীর্থ-বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র শত্রুতা

৪৩তম অধ্যায় – বশিষ্ঠাপবাহতীর্থ-বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র শত্রুতা

জনমেজয় কহিলেন, ভগবান! কি নিমিত্ত বশিষ্ঠাপবাহের প্রবাহ অতি ভীষণ হইয়াছিল, কি কারণে মহানদী সরস্বতী মহর্ষি বশিষ্টকে প্রবাহিত করিলেন, আর কি নিমিত্তই বা বিশ্বামিত্রের সাহিত বশিষ্ঠদেবের বৈরভাব ঘটিয়াছিল, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহর্ষি বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র এই উভয়ের তপঃ-স্পর্ধা[১]বশতঃই সাতিশয় বৈরভাব উপস্থিত হয়। স্থাণুতীর্থের পূর্ব্বভাগে মহর্ষি বশিষ্ঠদেবের আশ্রম ছিল। ঐ তীর্থের পশ্চিমকূলে অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন মহর্ষি বিশ্বামিত্র অবস্থান করিতেন। ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতি কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক সরস্বতীকে পূজা করিয়া ঐ তীর্থ স্থাপন করিয়াছিলেন। এই নিমিত্ত উহার নাম স্থাণুতীর্থ। দেবগণ ঐ তীর্থে কার্তিকেয়কে সেনাপতিপদে অভিষেক করেন। ঐ তীর্থে মহর্ষি বিশ্বামিত্র স্বীয় উগ্র তপঃপ্রভাবে যেরূপে বশিষ্ঠদেবকে আপনার আশ্রমে আনয়ন করিয়াছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।

মহর্ষি বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র উভয়ে নিরন্তর তপঃস্পর্ধা করিতেন। একদা মহামুনি বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের তেজঃপ্রভাবসন্দর্শনে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন যে, “আমি সরিদ্বরা সরস্বতীকে জপনিরত দ্বিজোত্তম বশিষ্ঠ তপোধনকে আমার সমীপে উপনীত করিতে আদেশ করি। সরস্বতী স্বীয় বেগপ্রভাবে বশিষ্ঠকে এ স্থানে আনয়ন করিলে আমি উহাকে বিনাশ করিব।” গাধিনন্দন এইরূপ স্থির করিয়া রোষকষায়িতলোচনে সরস্বতীকে স্মরণ করিলেন। মহানদী সরস্বতী বিশ্বামিত্রকে ক্রোধনস্বভাব ও তেজস্ব বলিয়া অবগত ছিলেন। এক্ষণে তাঁহার স্মরণে পুত্রবিহীনা কামিনীর ন্যায় একান্ত দুঃখিত ও নিতান্ত ব্যাকুলিত হইয়া কম্পিতকলেবরে কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মুনিসত্তম! এক্ষণে আমাকে কি কাৰ্য্য সাধন করিতে হইবে, আদেশ করুন।” তখন মহামুনি বিশ্বামিত্র ক্রোধভরে তাঁহাকে কহিলেন, “সরস্বতী! তুমি অবিলম্বে বশিষ্ঠকে এই স্থানে আনয়ন কর। আমি আজ তাঁহাকে বিনাশ করিব।”

মহানদী সরস্বতী বিশ্বামিত্রের বাক্য শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ভীত ও ব্যথিত হইয়া বাতাহত লতার ন্যায় কম্পিত হইতে লাগিলেন। মহামুনি বিশ্বামিত্র তাঁহাকে তদবস্থাপন্ন অবলোকন করিয়া কহিলেন, “তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে সত্বর বশিষ্ঠকে আমার নিকট উপনীত কর।” তখন সরিদ্বরা সরস্বতী বিশ্বামিত্রের পাপচিকীর্ষা ও বশিষ্ঠদেবের অপ্রতিম প্রভাব চিন্তা করিয়া উভয়ের শাপভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া বশিষ্ঠের নিকট আগমনপূর্ব্বক কম্পিত কলেবরে বিশ্বামিত্রের আদেশ নিবেদন করিলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ মহানদী সরস্বতীকে কৃশ, বিবর্ণ ও চিন্তান্বিত অবলোকন করিয়া কহিলেন, “সরস্বতী! তুমি আর চিন্তা করিও না, অবিলম্বে আমাকে বিশ্বামিত্রের নিকট উপনীত কর। নচেৎ গাধিনন্দন তোমাকে শাপ প্রদান করিবেন।” তখন সরস্বতী কৃপাপরতন্ত্র মহর্ষি বশিষ্ঠের বাক্য শ্রবণ করিয়া চিন্তা করিতে। লাগিলেন, “এক্ষণে কি করি, মহর্ষি বশিষ্ঠ প্রতিনিয়ত আমার প্রতি দয়া প্রকাশ করিয়া  থাকেন; অতএব উহার হিতসাধন করা আমার অবশ্য কর্তব্য।” সরিৎপ্রধানা সরস্বতী এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে স্বীয় কূলে মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে জপকার্য্যে নিরত দেখি এই উত্তম অবসর বিবেচনা করিয়া স্বীয় বেগপ্রভাবে [তরঙ্গ দ্বারা তীর ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতে] কূল বিপাটন-পূর্ব্বক বশিষ্ঠকে তাঁহার সমীপে লইয়া চলিলেন।

মহর্ষি বশিষ্ঠ সরস্বতীর বেগে প্রবাহিত হইয়া তাঁহাকে স্তব করিতে লাগিলেন, ‘হে সরস্বতী! তুমি মানস সরোবর হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছ, তোমার সলিলে চরাচর বিশ্ব ব্যাপ্ত রহিয়াছে। তুমিই আকাশমণ্ডলে অবস্থানপূর্ব্বক মেঘমণ্ডলে জল প্রদান করিয়া থাক; সেই জল পুনরায় তোমাতেই আগমন করে। তুমিই দ্যুতি, তুমিই কীৰ্ত্তি, তুমিই সিদ্ধি, তুমিই বুদ্ধি, তুমিই ঊমা, তুমিই বাণী এবং তুমিই স্বাহা। এই জগৎ তোমারই অধীনে অবস্থান করিতেছে। তুমি সূক্ষা, মধ্যমা, বৈখরী ও পশ্যন্তী [সপ্তস্বরের অন্যতম বৈদিক স্বরচতুষ্টয়] এই চারিরূপে বিভক্ত হইয়া সমস্ত ভূতে বিদ্যমান রহিছ।”

হে মহারাজ! মহর্ষি বশিষ্ঠ এইরূপে স্তব করিলে নদীপ্রধানা সরস্বতী মহাবেগে তাঁহাকে বিশ্বামিত্র সমীপে উপনীত করিয়া গাধিতনয়কে বারংবার বশিষ্ঠের আগমন-বার্তা নির্দেশ করিলেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠকে সমানীত সন্দর্শন করিয়া ক্রোধভরে তাঁহার বিনাশের নিমিত্ত অস্ত্র অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। তখন সরস্বতী গাধিপুত্রকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া ব্রহ্মণহত্যাভয়ে, ভীত হইয়া চিন্তা করিলেন, ‘এক্ষণে বিশ্বামিত্রের বাক্যরক্ষা করা হইয়াছে; অতএব বশিষ্ঠকে লইয়া প্রস্থান করি!” মহানদী মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিয়া বশিষ্ঠকে পুনরায় পূৰ্ব্বস্থলে উপনীত করিলেন। গাধিনন্দন বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠকে অপবাহিত [উল্টাভাবে] ও আপনাকে বঞ্চিত দেখি ক্রোধভরে সরস্বতীকে কহিলেন, ‘সরস্বতী! তুমি আমাকে বঞ্চনা করিলে, অতএব আজ হইতে রাক্ষসগণের আহ্লাদকর শোণিতপ্রবাহ বহন কর।” মহানদী সরস্বতী বিশ্বামিত্র কর্ত্তৃক এইরূপ অভিশপ্ত হইয়া শোণিতমিশ্রিত সলিল বহন করিতে লাগিলেন। দেবতা, ঋষি, গন্ধৰ্ব্ব ও অপ্সরাগণ সরস্বতীর তদ্রূপ দশা-সন্দর্শনে অতিশয় দুঃখিত হইলেন। এক বৎসর পরে সরস্বতী পুনরায় আত্মরূপ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে ঐ তীর্থে মহাত্মা বশিষ্ঠ সরস্বতীর প্রবাহে প্রবাহিত হওয়াতে উহা ভূমণ্ডলে বশিষ্ঠাপবাহ বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছে।