৪২. ধৃতরাষ্ট্রধ্বংসাৰ্থ বক ঋষির অভিচারক্রিয়া কথা

৪২তম অধ্যায়ধৃতরাষ্ট্রধ্বংসাৰ্থ বক ঋষির অভিচারক্রিয়া কথা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপে মহাবল বলদেব বেদধ্বনি-নিনাদিত মহর্ষি বকের আশ্রমে সমুপস্থিত হইলেন। মহর্ষি বক একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ঐ স্থানে অতি কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক আপনার দেহ ক্ষীণ করিয়া হুতাশনে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য আহুতি প্রদান করিয়াছিলেন। পূৰ্ব্বে নৈমিষারণ্যবাসী মহর্ষিগণের দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞানুষ্ঠানকালে বিশ্বজিৎ যজ্ঞাবসানে মুনিগণ পাঞ্চালরাজের নিকট উপস্থিত হইয়া হৃষ্টপুষ্ট বলবান একবিংশতি গোবৎস দক্ষিণা প্রার্থনা করিলেন। ঐ সময় মহর্ষি বক তাঁহাদিগকে পশুর অভাব দেখিয়া কহিলেন, ‘মহর্ষিগণ! তোমরা আমার এই সমস্ত পশু গ্রহণপূর্ব্বক বিভাগ করিয়া লও। আমি ইহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া রাজা ধৃতরাষ্ট্রের নিকট পশু প্রার্থনা করিব।” মহর্ষি বক এই বলিয়া মুনিগণকে পশু প্রদানপূর্ব্বক রাজা ধৃতরাষ্ট্রের নিকট আগমন করিয়া পশু প্রার্থনা করিলেন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মহর্ষির প্রার্থনা-শ্রবণে নিতান্ত রোষাবিষ্ট হইলেন এবং কতকগুলি গাভী যদৃচ্ছাক্রমে নিহত হইয়াছে শ্রবণ করিয়া মহর্ষিকে কহিলেন, “হে ব্রাহ্মণাধম! তুমি ধরায় এই সমস্ত পশু লইয়া প্রস্থান কর।” ধর্মপরায়ণ মহর্ষি বক ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য-শ্রবণে চিন্তা করিলেন, “হায়! রাজা ধৃতরাষ্ট্র সভামধ্যে আমার প্রতি অতি কঠোর বাক্য প্রয়োগ করিল!” মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া রোষাবিষ্টচিত্তে বিচিত্রবীৰ্য্যতনয়ের বিনাশ-সাধনার্থ সমুদ্যত হইলেন এবং সরস্বতী-তীর্থে নিয়ম অবলম্বনপূর্ব্বক অগ্নি প্রজ্বলিত ও সেই সমস্ত মৃত পশুর মাংস গ্রহণ করিয়া ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যক্ষয় করিবার নিমিত্ত হোম করিতে লাগিলেন।

এইরূপে মহর্ষি বক যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলে ক্রমে ক্রমে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যক্ষয় হইতে লাগিল। তখন মহারাজ অম্বিকানন্দন স্বীয়রাজ্য পরশুচ্ছিন্ন নিবিড় কাননের ন্যায় ক্ষীণ হইতে দেখিয়া একান্ত চিন্তাকুল হইলেন। তখন তিনি ব্রাহ্মণগণ সমভিব্যাহারে ঐ দুর্নিমিত্ত শান্তি করিবার নিমিত্ত সবিশেষ যত্ন করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই শ্রেয়োলাভে সমর্থ হইলেন না। তাঁহার রাজ্য প্রতিনিয়তই ক্ষীণ হইতে লাগিল। তখন রাজা ও ব্রাহ্মণগণ সকলেই অতিশয় বিষণ্ণ হইলেন। পরিশেষে রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যরক্ষার উপায়ান্তর না দেখিয়া সভাসদগণকে আহ্বানপূর্ব্বক এই বিষয়ের পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহারা কহিলেন, “মহারাজ! আপনি মহর্ষি বককে মৃতপণ্ড প্রদানপূর্ব্বক প্রতারণা করিয়াছিলেন, তিনি এক্ষণে রোষাবিষ্ট হইয়া আপনার রাজ্যক্ষয়ের নিমিত্ত সেই মৃত পশুর মাংস দ্বারা হোম করিতেছেন। তাঁহার তপঃপ্রভাবেই আপনার এইরূপ রাজ্যক্ষয় হইতেছে অতএব আপনি সত্বর সরস্বতী তীর্থে গমন করিয়া তাহাকে প্রসন্ন করুন।” তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্র সভাসদগণের বাক্যানুসারে সরস্বতী-তীর্থে গমনপূর্ব্বক মহর্ষি বকের চরণে প্রণত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, ‘ভগবন! আমি অতিশয় দীন, লুব্ধ ও মোহান্ধ; অতএব আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া আমার অপরাধ মার্জনা করুন। এক্ষণে আপনিই আমার গতি।” তখন মহর্ষি বক রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে শোকাকুলিতচিত্তে সেইরূপ বিলাপ ও পরিতাপ করিতে দেখিয়া একান্ত দয়াপরবশ হইলেন এবং ক্রোধ সংবরণপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া তাঁহার রাজ্যের উৎপাত-শান্তির নিমিত্ত পুনরায় হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যের বিশান্তি করিয়া তাঁহার নিকট বিবিধ পশু গ্রহণপূর্ব্বক হৃষ্টান্তঃকরণে পুনরায় নৈমিষারণ্যে আগমন করিলেন। ধর্মপরায়ণ রাজা ধৃতরাষ্ট্রও প্রসন্নমনে স্বনগরে সমুপস্থিত হইলেন।

যযাতিযজ্ঞপ্রসূত যাযাততীর্থ হে মহারাজ! ঐ তীর্থে উদার-বুদ্ধিসম্পন্ন সুরগুরু বৃহস্পতি অসুরগণের বিনাশ ও দেবগণের মঙ্গলসাধনার্থ যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক মাংস দ্বারা হোম করিয়াছিলেন। অসুরগণ সেই যজ্ঞের প্রভাবে সংগ্রামে দেবগণের নিকট পরাজিত ও বিনষ্ট হইয়াছে। মহাবল বলদেব ঐ তীর্থে ব্রাহ্মণগণকে বিধানানুসারে হস্তী, অশ্ব, অশ্বতরীযুক্ত রথ, মহামূল্য রত্ন ও প্রভূত ধান্য প্ৰদানপূর্ব্বক যাযাত-তীর্থে গমন করিলেন। ঐ স্থানে সরিদ্বরা সরস্বতী নহুষতনয় রাজা যযাতি-যজ্ঞে প্রাদুর্ভূত হইয়া ব্রাহ্মণগণকে অভিলাষানুরূপ দ্রব্যজাত প্রদান করিয়াছিলেন। ঐ যজ্ঞে ঘৃত ও দুগ্ধের প্রবাহ প্রবাহিত হইয়াছিল। রাজা যযাতি ঐ স্থানে যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া হাষ্টমনে উর্ধ্বে গমন ও সদগতি লাভ করিয়াছিলেন। উদারপ্রকৃতি রাজা যযাতি আর একবার পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে ঐ স্থানে যজ্ঞ আহরণ করেন। স্রোতস্বতী সরস্বতী সেই যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণের যে যে দ্রব্যের অভিলাষ হইয়াছিল, তৎসমুদয়ই প্রদান করিয়াছিলেন। আহূত ব্যক্তিগণ যিনি যে স্থানে অবস্থান করিয়াছিলেন, তিনি সেই স্থানেই সরস্বতীর কৃপায় ষড়রস-সম্পন্ন, সুস্বাদু পানভোজন ও বিবিধ ধন প্রাপ্ত হইয়া, ঐ সমুদয় রাজারই দান অনুমান করিয়া প্রীতমনে তাঁহাকে স্তব ও আশীর্বাদ করিয়াছিলেন। গন্ধৰ্ব্ব, দেবতা ও মনুষ্যগণ যযাতির সেই যজ্ঞব্যাপার নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলেন। হে মহারাজ! অনন্তর দাননিরত মহাবীর বলদেব তথা হইতে তীব্ৰবেগসম্পন্ন বশিষ্ঠাপবাহ তীর্থে গমন করিলেন।