৩৯. সপ্তসারস্বত-তীর্থ বর্ণন

৩৯তম অধ্যায় – সপ্তসারস্বততীর্থ বর্ণন

জনমেজয় কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মণ! সপ্তসারস্বত-তীর্থ কিরূপে উৎপন্ন হইল? মঙ্কণক মুনি কে! কিরূপে তিনি সিদ্ধ হইয়াছিলেন? তাঁহার কিরূপ নিয়ম ছিল এবং তিনি কোন বংশে জন্মগ্রহণ ও কি কি অধ্যয়ন করিয়াছিলেন? আমি তৎসমুদয় আনুপূর্বিক শ্রবণ করিতে বাঞ্ছা করি।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, “হে মহারাজ! সরস্বতীর সাত শাখায় এই জগৎ পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে। তেজস্বিগণ সরস্বতীকে যে যে স্থানে আহ্বান করিয়াছিলেন, তিনি সেই সেই স্থানেই আবির্ভূত হয়েন। তন্নিবন্ধন তাঁহার সুপ্রভা, কাঞ্চনাক্ষী, বিশালা, মনোরমা, ওধবতী, সুরেণু ও বিমলোদকা নামে সাত শাখা বিখ্যাত হইয়াছে। পুষ্কর-তীর্থে সৰ্ব্বলোক-পিতামহ ব্রহ্মার মহাযজ্ঞ উপস্থিত হইলে সেই বিস্তৃত যজ্ঞস্থলে দ্বিজগণ পবিত্র বেদপাঠে নিযুক্ত ও দেবগণ নানা কাৰ্য্যে ব্যগ্র হইলেন। ঐ যজ্ঞে ধৰ্মার্থকুশল ব্যক্তিগণ চিন্তা করিবামাত্র ব্রাহ্মণগণের নিকট বিবিধ দ্রব্যজাত উপস্থিত হইতে লাগিল। গন্ধৰ্ব্বেরা গান ও অপ্সরাগণ নৃত্য করিতে আরম্ভ করিলেন। সুমধুর বাদিত্র-সকল বাদিত হইতে লাগিল। মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, দেবতারাও সেই সৰ্ব্বকামসম্পন্ন যজ্ঞ দেখিয়া পরিতুষ্ট ও বিস্ময়াপন্ন হইলেন।

হে মহারাজ! পিতামহ এইরূপে সেই মহাযজ্ঞে দীক্ষিত ও পরম পরিতুষ্ট হইলে মহর্ষিগণ কহিলেন যে, ‘এই যজ্ঞে সরিদ্বারা [নদীশ্রেষ্ঠা] সরস্বতীর আবির্ভাব নাই, অতএব ইহা মহাগুণ বলিয়া নির্দিষ্ট হইতে পারে না।’ তখন ভগবান ব্রহ্মা তাঁহাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া প্রীতমনে সরস্বতীকে স্মরণ করিলেন। সরস্বতী যজ্ঞদীক্ষিত পিতামহ কর্ত্তৃক পুষ্করতীর্থে আহূত হইয়া তথা সমাগত হইলেন। মহর্ষিগণ তথায় সরস্বতীকে দর্শন করিয়া পুলকিতচিত্তে পিতামহকে ধনবাদন প্রদান ও তাঁহার যজ্ঞের যথেষ্ট প্রশংসা করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সরিদ্বরা সরস্বতী পিতামহ কর্ত্তৃক আহূত হইয়া মুনিগণের সন্তোষাৰ্থ পুষ্কর-তীর্থে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। ঐ স্থানে তিনি সুপ্রভা নামে অভিহিত হইয়া থাকেন।

নৈমিষারণ্যে অনেক স্বাধ্যায়নিরত তপস্বীর বাসস্থান ছিল। তাঁহারা সকলে একত্র সমবেত হইয়া দেববিষয়ক নানাবিধ বিচিত্র কথার আন্দোলন করিতেন। সেই মহর্ষিগণ যজ্ঞকালে সরস্বতীকে স্মরণ করাতে তিনি তাঁহাদের সাহায্যার্থ নৈমিষারণ্যে আগমন করেন। ঐ স্থানে সরস্বতীর নাম কাঞ্চনাক্ষী বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছে।

গয় নামে ভূপতি গয়া-তীর্থে মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক সরস্বতীকে আহ্বান করাতে তিনি তথায় আগমন করেন। গয়ের যজ্ঞকাৰ্য্যে দীক্ষিত মুনিগণ সরস্বতীকে তথায় সমাগত দেখিয়া বিশালা নামে প্রথিত করিয়াছেন। মহর্ষি ঔদ্দালকি কোশলার উত্তরভাগে এক যজ্ঞ করিয়াছিলেন। ঐ যজ্ঞে বহুসংখ্যক মহর্ষি আগমন করেন। ঔদ্দালকি যজ্ঞকালে সরস্বতীকে স্মরণ করাতে তিনি তাঁহার অভিলাষ সার্থক করিবার উদ্দেশ্যে হিমালয়ের পার্শ্বদেশ হইতে তথায় সমাগত হয়েন। বল্কলাজিনবাসাঃ [বৃক্ষবল্কল ও মৃগচর্মধারী–গাছের বাকল ও মৃগচর্ম পরিহিত] ঋষিগণ তাঁহাকে ঐ স্থানে মনোরমা নামে প্রসিদ্ধ করিয়াছেন।

কুরুরাজ কুরুক্ষেত্রে যজ্ঞ করিয়াছিলেন। ঐ যজ্ঞে সরস্বতী মহর্ষি বশিষ্ঠ কর্ত্তৃক সমাহূত হইয়া, সেই পবিত্র স্থানে আগমনপূর্ব্বক ওঘবতী নাম ধারণ করিয়াছেন।

সরস্বতী যজ্ঞনিরত দক্ষ কর্ত্তৃক গঙ্গাদ্বারে সমানীত হইয়া সুরেণু নামে বিখ্যাত হন।

হিমালয়ে বিরিঞ্চির [নৈষ্টিক–যাহারা গৃহী হয় না] কাৰ্য্যসাধনার্থ সমাগত হইয়া সরস্বতী বিমলোদকা নামে বিখ্যাত হইয়াছেন।

হে মহারাজ! যে স্থানে ঐ সাত নদী একত্র মিলিত হইয়াছে, তাহার নাম সপ্তসারস্বত তীর্থ। আমি সেই সরস্বতীর সাত শাখার নাম ও পবিত্র সপ্তসারস্বত-তীর্থের বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলাম।

মঙ্কণক মুনির উপাখ্যান

হে মহারাজ! এক্ষণে কৌমার-ব্রহ্মণচারী মহর্ষি মঙ্কণকের বৃত্তান্ত শ্রবণ করুন। একদা ঐ মহর্ষি সরস্বতীজলে অবগাহন করিয়া তথায় এক সৰ্ব্বসুন্দরী নারীকে অবলোকন করিলেন। তৎকালে ঐ নারী দিগম্বরী হইয়া সরস্বতীর নির্মল সলিলে স্নান করিতেছিল। তাহাকে দর্শন করিবামাত্র সেই সরস্বতী জলে মহর্ষির রেতঃ স্বলিত হইল। তখন তিনি এক কুম্ভমধ্যে সেই রেতঃ অবস্থাপন করিলেন। মঙ্কণকের রেতঃ কলসমধ্যে অবস্থাপিত হইবামাত্র সপ্তধা বিভক্ত হইল। বায়ুবেগ, বায়ুবল, বায়ুহা, বায়ুমণ্ডল, বায়ুজাল, বায়ুরে ও বায়ুচক্র নামক সাতজন মহর্ষি সেই রেতঃপ্রভাবে ঐ কলসে জন্মগ্রহণ করেন। ঐ সাতজন মহর্ষি হইতেই বায়ু-সকল উৎপন্ন হইয়াছেন।

মঙ্কণকমহাদেব সংবাদ

হে মহারাজ! এক্ষণে আপনি মহর্ষি মঙ্কণকের আরও একটি ত্রিলোকবিশ্রুত অতি বিচিত্র চরিত্র শ্রবণ করুন। এইরূপ এক কিংবদন্তী আছে যে, একদা কুশাগ্র দ্বারা ঐ মহর্ষির হস্তে ক্ষত হইয়াছিল। মহর্ষি সেই ক্ষত হইতে শাকরস নিঃসৃত হইতে দেখিয়া মহা আহ্লাদে নৃত্য করিতে লাগিলেন। তাহার নৃত্যপ্রভাবে স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় বস্তু বিমোহিত ও একান্ত বিচলিত হইয়া উঠিল। তখন ব্রহ্মাদি দেবগণ তপোধনগণ সমভিব্যাহারে দেবাদিদেব মহাদেবের নিকট গমন করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্‌ মহর্ষি মঙ্কণক যাহাতে আর নৃত্য না করেন, আপনি তাহার উপায়বিধান করুন।”

ভগবান্ রুদ্র দেবগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাদের কাৰ্য্যসাধনাৰ্থে ব্রাহ্মণবেশে মহর্ষি মঙ্কণকের সমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে একান্ত হৃষ্ট দেখিয়া কহিলেন, “হে ধর্মপরায়ণ তপোধন। তুমি এক্ষণে কি নিমিত্ত নৃত্য করিতেছ? তোমার এরূপ হর্ষের কারণ কি?” মহর্ষি কহিলেন, “হে ব্রহ্মণ! এই দেখুন, আমার হস্ত হইতে শাকরস নিঃসৃত হইতেছে। আমি এই নিমিত্তই প্রফুল্লমনে নৃত্য করিতেছি।” তখন মহাদেব হাস্য করিয়া সেই একান্ত পুলকিত তপোধনকে কহিলেন, “হে বিপ্র! এরূপ ঘটনা উপস্থিত হইলে আমি কদাচ বিস্মিত হইয়া না, বরং তুমি তাহা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ কর।” ভগবান শূলপাণি এই বলিয়া নখাগ্র দ্বারা অঙ্গুষ্ঠে আঘাত করিবামাত্র উহা হইতে তুষারধবল ভস্ম নির্গত হইতে লাগিল। মহর্ষি মঙ্কণক তদ্দর্শনে নিতান্ত লজ্জিত হইলেন এবং তাঁহাকে দেবাদিদেব মহাদেব জ্ঞান করিয়া তাঁহার পদতলে নিপতিত হইয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে কহিলেন, “হে ভগবন! আমি রুদ্র অপেক্ষা অন্য কোন দেবতাকেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করি না। আপনি এই চরাচর বিশ্বের একমাত্র গতি। পণ্ডিতেরা কহিয়া থাকেন, আপনিই এই বিশ্ব সৃষ্টি করিয়াছেন এবং প্রলয়কালে সমস্ত বস্তু আপনাতেই প্রবেশ করিবে। হে ভগবন! আমার কথা দূরে থাকুক, দেবগণও আপনাকে বিদিত হইতে সমর্থ নহেন। জগতে যে সমস্ত পদার্থ আছে, তৎসমুদয় আপনাতে নিরীক্ষিত হইয়া থাকে। আপনি বরদাতা, ব্রহ্মাদি দেবগণ আপনারই আরাধনা করেন। আপনি দেবগণের সৃষ্টিকর্তা; তাঁহারা আপনারই আদেশে কাৰ্যানুষ্ঠান এবং আপনারই অনুগ্রহে অকুতোভয়ে আমোদপ্রমোদে কালযাপন করিয়া থাকেন।” মহর্ষি মঙ্কণক এইরূপে মহাদেবকে স্তব করিয়া পুনরায় কহিলেন, “হে দেব! আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হউন; আমি ক্ষত হইতে শাকরস নিঃসৃত দেখিয়া যে গৰ্ব্ব ও চপলতা প্রকাশ করিয়াছিলাম, সেই দোষে যেন আমার তপঃক্ষয় না হয়।”

হে মহারাজ! তখন রুদ্রদেব ঋষির বাক্য-শ্রবণে প্রীত হইয়া কহিলেন, “হে ব্রহ্মণ! আমার প্রসাদে তোমার তপস্যা সহস্র গুণ পরিবর্ধিত হইবে, আমি এক্ষণে তোমার সহিত নিরন্তর এই আশ্রমে অবস্থান করিব। যে মনুষ্য এই সপ্তসারস্বত-তীর্থে আমার অর্চনা করিবে, তাহার উভয় লোকে কোন বস্তুই দুর্লভ থাকিবে না এবং সে সারস্বতলোকলাভে সমর্থ হইবে সন্দেহ নাই।” হে মহারাজ! পবনের ঔরসে সুকন্যার গর্ভে সমুৎপন্ন মহর্ষি মঙ্কণকের চরিত্র আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিল।