৩৮. বিনশনাদি তীর্থকথা

৩৮তম অধ্যায় – বিনশনাদি তীর্থকথা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর মহাত্মা বলদেব বিনশনতীর্থে উপস্থিত হইলেন। তথায় সরস্বতী শূদ্র ও আভীর[৪]দিগের প্রতি বিদ্বেষবৃদ্ধি নিবন্ধন অন্তর্হিত হইয়াছেন। এই নিমিত্তই মহর্ষিগণ ঐ তীর্থকে বিনশন নামে নির্দেশ করিয়া থাকেন। মহাবল-পরাক্রান্ত বলদেব ঐ তীর্থে স্নান করিয়া সুভূমিকতীর্থে গমন করিলেন। ঐ তীর্থে ব্রাহ্মণগণ সতত অবস্থান ও প্রসন্নবদন অঙ্গরাগণ নিরন্তর বিহার করিয়া থাকেন এবং গন্ধৰ্ব্ব ও দেবগণ প্রতিমাসে সেই স্থানে উপস্থিত হয়েন। দেবতা ও পিতৃগণ তথায় সমবেত ও পবিত্র দিব্য কুসুমসমুদয়ে সমাকীর্ণ হইয়া আমোদ-প্রমোদ করিয়া থাকেন। ঐ তীর্থ অঙ্গরাদিগের আক্রীয়ভূমি [ক্রীড়া-স্থান] বলিয়া সুভূমিক নামে বিখ্যাত হইয়াছে। মহাত্মা বলদেব সেই তীর্থে স্নান, ব্রাহ্মণগণকে ধন দান, বিবিধ গীতবাদ্য শ্রবণ এবং দেব, গন্ধৰ্ব্ব ও রাক্ষসগণের ছায়া দর্শন করিয়া গন্ধৰ্ব্বতীর্থে গমন করিলেন। তথায় বিশ্বাবসু প্রভৃতি তপঃপরায়ণ গন্ধৰ্ব্বগণ মনোহর নৃত্যগীত করিয়া থাকেন। মহাত্মা রোহিণীনন্দন তথায় ব্রাহ্মণগণকে প্রচুর অর্থ, ছাগ, মেষ, গো, খর [গর্দভ], উষ্ট্র, সুবর্ণ ও রৌপ্য প্রদানপূর্ব্বক ভোজন করাইয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। গমনকালে ব্রাহ্মণেরা তাঁহার স্তব করিতে লাগিলেন।

অনন্তর তিনি গর্গস্রোত-তীর্থে গমন করিলেন। তথায় আত্মতত্ত্বজ্ঞ বৃদ্ধ গর্গ জ্ঞান ও কালের গতি, জ্যোতিঃপদার্থ সমূদয়ের ব্যতিক্রম [গ্রহাদির স্থানচ্যুতি স্থানবিপর্যয়] এবং শুভ ও দারুণ [অশুভ] নিমিত্ত-সকল অবগত হইয়াছিলেন। এই নিমিত্ত তাহার নামানুসারেই উহার নাম গর্গস্রোত হইয়াছে। ব্রতপরায়ণ মহর্ষিগণ কালজ্ঞানের নিমিত্ত ঐ তীর্থে প্রতিনিয়ত মহর্থি গর্গের উপাসনা করিয়া থাকেন। শ্বেতচন্দনচর্চিতকলেবর বলদেব তথায় মুনিগণকে ধনদান ও বিপ্রদিগকে নানাবিধ ভোজ্য প্রদানপূর্ব্বক শঙ্খতীর্থে গমন করিলেন। তথায় তিনি সরস্বতীতীরে মহর্ষিগণ নিষেবিত মহাশঙ্খ নামে এক বৃক্ষ নিরীক্ষণ করিলেন। ঐ বৃক্ষ শ্বেতপৰ্ব্বতসন্নিভ ও সুমেরুর ন্যায় সমুন্নত; বিদ্যাধর, রাক্ষস, পিশাচ ও সিদ্ধগণ অন্য প্রকার আহার পরিত্যাগপূর্ব্বক ব্রত ও নিয়মানুষ্ঠান করিয়া নির্দিষ্ট সময়ে উহার ফল ভক্ষণ ও ঐ স্থানে পৃথক পৃথক হইয়া সঞ্চরণ করিয়া থাকেন। মনুষ্যেরা তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ নহে। মহাত্মা বলদেব সেই শঙ্খতীর্থে গাভী, বিবিধ বিচিত্র বস্তু এবং তাম্র ও লৌহময় ভাণ্ড সকল প্রদানপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে অৰ্চনা ও তাঁহাদের পূজা গ্রহণ করিয়া পবিত্র দ্বৈতবনে উপনীত হইলেন। তিনি ঐ তীর্থে নানা বেশধারী মুনিগণকে নিরীক্ষণ করিয়া উহার সলিলে অবগাহনপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে অচনা ও প্রচুর ভোজ্যদ্রব্য দান করিয়া সরস্বতীর দক্ষিণতীরে গমন করিতে লাগিলেন এবং কিয়দ্দূর অতিক্রম করিয়া নাগবর্ত্মনামক তীর্থে উপস্থিত হইলেন। ঐ তীর্থে পন্নগরাজ বাসুকির বাসস্থান আছে। উহা অসংখ্য সর্পে সমাকীর্ণ, কিন্তু উহাতে কিছুমাত্র সর্পভয় নাই। ঐ তীর্থে চতুর্দশ সহস্র মহর্ষি নিরন্তর বাস করিয়া থাকেন। দেবগণ ঐ স্থানে আগমন করিয়া নাগরাজ বাসুকিকে বিধানানুসারে অভিষেক করিয়াছিলেন। মহাত্মা বলদেব ঐ তীর্থে ব্রাহ্মণগণকে বিবিধ রত্ন প্রদানপূর্ব্বক পূৰ্ব্বদিকে গমন করিলেন। তথায় শতসহস্ৰসংখ্যক [বহু শতসহস্র-বহুত্ববাচক] সুবিখ্যাত তীর্থে স্নান, ঋষিগণের আদেশানুসারে উপবাস, সংযম ও প্রভূত ধন দান করিলেন এবং তীর্থবাসী মুনিগণকে অভিবাদনপূর্ব্বক তাঁহাদিগের প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! মহানদী সরস্বতী নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণকে দর্শন করিবার নিমিত্ত ঐ স্থান হইতে বাতাহত [বায়ু দ্বারা বেগে চালিত বর্ষাধারার] বৃষ্টির ন্যায় পূৰ্ব্বভিমূখে ধাবমান হইয়াছেন। মহাত্মা বলদেব সরস্বতীকে তথা হইতে পূৰ্বাভিমুথে প্রবাহিত দেখি যার পর নাই বিস্ময়াপন্ন হইলেন।

সরস্বতী নদীর পূর্ব্ববাহিনীত্ব বর্ণন

জনমেজয় কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! সরস্বতী নদী কি নিমিত্ত তথা হইতে পূর্বাভিমুখী হইয়াছেন এবং কি কারণেই বা বলদেব তথায় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন, তাহা কীর্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পূৰ্ব্বে সত্যযুগে নৈমিষারণ্যে দ্বাদশবর্ষব্যাপী মহাযজ্ঞ আরম্ভ হইলে তত্য অসংখ্য মহর্ষি সেই যজ্ঞে সমুপস্থিত হইলেন এবং দ্বাদশ বৎসর যজ্ঞস্থলে অবস্থান করিয়া যজ্ঞসমাপনান্তে তীর্থদর্শনার্থ সরস্বতীর দক্ষিণ-কূলে আগমন করিলেন। ঋষিগণের সংখ্যাবাহুল্য প্রযুক্ত সরস্বতী নদীর দক্ষিণতীরস্থিত তীর্থসকল নগরসদৃশ হইয়া উঠিল। ব্রাহ্মণগণ তীর্থবাসাভিলাষে সামন্তপঞ্চকের শেষসীমা পর্যন্ত আশ্রয় করিলেন। তাঁহাদিগের আহুতিদান ও বেদাধ্যয়ন-শব্দে দিক সকল পরিপূর্ণ হইয়া গেল। হুতহুতাশন[আহুতিপ্রদত্ত অগ্নি] সৰ্ব্বত্র দেদীপ্যমান হওয়াতে সরস্বতীর অতিচমৎকার শোভা হইল। বালখিল্য [অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ তপস্বী], অশ্বকূট্ট [বানপ্রস্থী –তাঁতাভাঙ্গাবাদিচুর্ণ দ্রব্যভোজী], দন্তোলুথল [উদুখলিতে ফেলিয়া যেমন ধান ভানা হয়, তদ্রূপ দাঁতের মধ্যে ২/১টি মাত্র শস্য ফেলিয়া সেই সামান্যমাত্র ভোজ্যদ্রব্য দন্তে স্পর্শমাত্রে যাহারা জীবন ধারণে সমর্থ, তদ্রূপ তপস্বী], প্রসংখ্যান [প্রকৃষ্ট জ্ঞানী] এবং বায়ুভক্ষণ, জলাহার, পর্ণভোজন [শাদিশয্যায় শ্যন] ও স্থণ্ডিলে শয়ন প্রভৃতি বিবিধ নিয়মধারী অন্যান্য তাপসগণ, দেবগণ যেমন মন্দাকিনীর শোভাসম্পাদন করেন, তদ্রূপ সরস্বতীর শোভা সম্পাদন করিলেন। তৎপরে যজ্ঞনিরত ব্রতধারী অন্যান্য অসংখ্য ঋষি তথায় সমুপস্থিত হইলেন, কিন্তু বিন্দুমাত্র স্থান পাইলেন না। তখন তাঁহারা তীর্থের শেষসীমা হইতে যজ্ঞোপবীতপ্রমাণ [পৈতার সমান মাপে-তত পরিমাণ ভূমি লইয়া তীর্থ নির্ম্মাণপূর্ব্বক হোমাদি বিবিধ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, কিরূপে এই অল্প প্রমাণ স্থানে আমাদের সমুদয় কাৰ্য্য নির্বাহ হইবে? হে মহারাজ! ঐ সময় সরস্বতী মুনিগণকে চিন্তাকুলিতচিত্ত দেখিয়া তাঁহাদের কাৰ্য্যসাধনার্থ তথায় গমন ও দর্শন প্রদান করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সরস্বতী ঋষিগণের আগমন চরিতার্থ করিয়া পুনরায় পশ্চিমাভিমুখে নির্গত হইলেন। সরস্বতীর আগমনে ঐ স্থানে অসংখ্য কুঞ্জ [লতাগৃহ] উৎপন্ন হইল। তৎকালে মহানদী সরস্বতী নৈমিষারণ্যবাসী ব্রাহ্মণগণের হিতার্থে ঐরূপ অদ্ভুত কাৰ্য্য সম্পাদন করাতে সেই সকল কাননময় স্থান নৈমিষীয় বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছে।

হে মহারাজ! সেই স্থানে বহুতর কুঞ্জকানন এবং সরস্বতীর পূর্বাভিমুখে গমন অবলোকন করিয়া বলরামের বিস্ময় উপস্থিত হইল। তখন তিনি সেই তীর্থে যথাবিধি অবগাহনপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে ভক্ষ্য, ভোজ্য ও সুবর্ণাদি বিবিধ ধন দান করিয়া তথা হইতে সপ্তসারস্বত-তীর্থে যাত্রা করিলেন। ঐ তীর্থ বদর [কুল], ইঙ্গুদ[রেডির মত তৈলাক্ত বীজ], কাশ্মৰ্য্য[গাম্ভারী], অশ্বথ, বট, বিভীতক[বহেড়া], কক্কোল[কটফল], পলাশ, করবীর[কবরী], পীলু[আখরোট], করুষক[ফলসা], বিল্ব, আম্রতক[আমড়া] ও ষণ্ড [কদম্ব] প্রভৃতি বিবিধ বৃক্ষে এবং কদলী, পারিজাত ও মাধবীলতাবনে সুশোভিত আছে। জলপায়ী, বায়ুভক্ষক, ফলাহারী, পর্ণাশী, দন্তোলুখল ও অশ্মকুট্ট প্রভৃতি বহুতর মুনিগণ নিরন্তর উহাতে বাস করিতেছেন। ঐ স্থানে সৰ্ব্বদা বেদাধ্যয়ন হইয়া থাকে, উহা হিংসাধর্মশূন্য অসংখ্য লোকের আবাসভূমি। মঙ্কণক নামে একজন সিদ্ধ ঐ বহুমৃগসমাকীর্ণ তীর্থে তপানুষ্ঠান করিয়াছিলেন।