৩৭. ত্রিত ঋষিকৃত উদপান তীর্থ

৩৭তম অধ্যায় – ত্রিত ঋষিকৃত উদপান তীর্থ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! হলায়ুধ বলদেব মহাযশাঃ মহর্ষি ত্রিতের উদপান তীর্থ প্রাপ্ত হইয়া তথায় স্নান, বিবিধ ধনদান ও দ্বিজগণের পূজা করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। ধর্মপরায়ণ মহাতপাঃ ত্রিত ঐ তীর্থে অবস্থান করিতেন। তিনি ঐ কূপে অবস্থানপূর্ব্বক সোমরস পান করিয়াছিলেন। তাঁহার ভ্রাতৃদ্বয় তাঁহাকে ঐ কূপে পরিত্যাগ করিয়া আপনাদের আবাসে প্রস্থান করিলে মুনিবর ত্রিত তাঁহাদিগকে অভিশাপ প্রদান করেন।

জনমেজয় কহিলেন, হে ব্রাহ্মন উদপান-তীর্থ কিরূপে উৎপন্ন হইল? মহাতপা ত্রিত কি নিমিত্ত কূপমধ্যে পতিত হইয়াছিলেন? কি নিমিত্ত তাঁহার ভ্রাতৃদ্বয় তাঁহাকে কূপমধ্যে পরিত্যাগ করিয়া গৃহে গমন করিয়াছিলেন? আর কিরূপেই বা মহর্ষি ত্রিত যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক সোমরস পান করিয়াছিলেন? যদি এই সমস্ত কথা শ্রোতব্য হয়, তাহা হইলে কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পূৰ্ব্বযুগে সূৰ্য্যের ন্যায় তেজস্বী মহাতপাঃ একত, দ্বিত ও ত্রিত নামে তিন সহোদর ছিলেন। তাঁহাদের তিনজনকেই প্রজাপতির ন্যায় বোধ হইত। তাঁহারা কেহই প্রজাবিহীন ছিলেন না। তাঁহারা বেদাধ্যয়ন ও তপোবলে ব্রহ্মণলোক জয় করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের পিতা ধর্মপরায়ণ ভগবান গৌতম পুত্রগণের তপস্যা, নিয়ম ও দমগুণে [ইন্দ্রিয়সংযম] পরম প্রীত হইয়াছিলেন। তিনি সুদীর্ঘ কাল সুপুত্রদিগের সৎকাৰ্যজনিত আনন্দ অনুভব করিয়া সুরপুরে প্রস্থান করেন।

ঋষিশ্রেষ্ঠ গৌতম কলেবর পরিত্যাগ করিলে তাঁহার যজমানগণ তাঁহার পুত্রগণকে পূজা করিতে লাগিলেন। গৌতমের পুত্রয়ের মধ্যে মহাত্মা ত্রিত কৰ্ম্ম ও অধ্যয়নের গুণে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। মহাভাগ মহর্ষিগণ ত্রিতের গুণগ্রাম-দর্শনে মহাত্মা গৌতমের ন্যায় তাঁহাকে পূজা করিতে লাগিলেন।

একদিন একত ও দ্বিত উভয়ে যজ্ঞানুষ্ঠান ও ধনলাভের নিমিত্ত চিন্তাকুল হইয়া পরামর্শ করিলেন, ‘আমরা ত্রিতকে সমভিব্যাহারে লইয়া যজমানদিগের নিকট বিবিধ পশু পরিগ্রহ করিয়া মহাফল যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক পরমানন্দে সোমরস পান করিব।’ তাঁহারা এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া ত্রিতকে সমভিব্যাহারে লইয়া যজমানগণের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং বিধানানুসারে তাঁহাদিগের যজ্ঞ সমাধানপূর্ব্বক অসংখ্য পশু প্রতিগ্ৰহ করিয়া পূৰ্ব্বদিকে যাত্রা করিলেন! ত্রিত আনন্দিতচিত্তে সকলের দিকে অগ্রসর হইলেন এবং একত ও দ্বিত পশুগণকে সঞ্চালন করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। ক্রমে রজনী সমুপস্থিত হইল। তখন একত ও দ্বিত সেই প্রভূত পশু দর্শনে লোভপরবশ হইয়া ‘কিরূপে এই সমস্ত গাভী আমরা উভয়ে প্রাপ্ত হইব’ ইহাই চিন্তা করিতে আরম্ভ করিলেন। পরিশেষে সেই পাপরায়ণ ভ্রাতৃদ্বয় পরস্পর যুক্তি স্থির করিয়া কহিলেন, ‘দেখ, ত্রিত যজ্ঞকুশল ও বেদপারগ! সে আমাদের অপেক্ষা অনেক গাভী লাভ করিতে পারিবে; অতএব চল, আমরা গো সঞ্চালনপূর্ব্বক প্রস্থান করি। ত্রিত যথা ইচ্ছা গমন করুক।’

হে মহারাজ! এইরূপে তাঁহারা তিনজন গমন করিতেছেন, এমন সময় একটা বৃক তাঁহাদের সমীপে সমুপস্থিত হইল। গৌতমতনয়গণ যে পথ দিয়া গমন করিতেছিলেন, উহার অনতিদূরে সরস্বতীর তটে একটা বৃহৎ কূপ ছিল। মহাত্মা ত্রিত পথিমধ্যে বৃকদর্শনে ভীত হইয়া পলায়নকরতঃ সেই সৰ্ব্বভুতভয়ঙ্কর ঘোরতর কূপে নিপতিত হইলেন। তিনি সেই কূপমধ্যে আর্তনাদ করিলে উহা তাঁহার ভ্রাতৃদ্বয়ের শ্রুতিগোচর হইয়াছিল; কিন্তু তাঁহারা ত্রিতকে কূপে নিপতিত জানিতে পারিয়াও বৃকভয়ে ও পশুলোভে তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। মহাতপস্বী ত্রিত এইরূপে ভ্রাতৃগণ কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া আপনাকে নরকে নিপতিত দুষ্কৃতীর ন্যায় সেই তৃণলতা পরিবেষ্টিত ধূলিসমাচ্ছন্ন নির্জ্জন কূপে নিপতিত অবলোকন করিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, ‘আমি এই কূপে থাকিয়া কিরূপে সোমরস পান করি?’ মহাত্মা ত্রিত এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে দেখিলেন, এক লতা সেই কূপমধ্যে লম্বমান রহিয়াছে। তখন তিনি ক্ষণকাল ধ্যান করিয়া সেই ধূলিসমাবৃত কূপ খননপূর্ব্বক জল উত্তোলন ও বহ্নি স্থাপন করিলেন এবং আপনাকে হোতা, সেই লম্বমান লতাকে সোমলতা, প্রস্তরখণ্ডকে শর্করা এবং জলকে আজ্য কল্পনা করিয়া ঋক, যজু ও সামবেদ চিন্তা করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎপরে তিনি দেবগণের নিমিত্ত সোমরসের ভাগ কল্পনা করিয়া তুমূল শব্দে তাঁহাদিগকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। তথন মহামুনি ত্রিতের সেই শব্দ স্বর্গমধ্যে প্রবেশ করিলে এবং তাহাতে দেবগণের মনেও ভয়সঞ্চার হইয়াছিল; কিন্তু তাঁহারা উহার কিছুমাত্র কারণ অনুসন্ধান করিতে পারিলেন না। তখন দেবপুরোহিত বৃহস্পতি সেই তুমুল শব্দ শ্রবণে সমস্ত দেবগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মুরগণ! মহাতপস্বী ত্রিত যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি ক্রুদ্ধ হইলে অন্যান্য দেবগণের সৃষ্টি করিতে পারেন, অতএব আমাদিগকে তথায় গমন করিতে হইবে।’ দেবগণ বৃহস্পতির বাক্য-শ্রবণে পরস্পর সমবেত হইয়া তেজঃপুঞ্জকলেবর মহাত্মা ত্রিতের যজ্ঞস্থলে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে সেই কূপমধ্যে যজ্ঞকাৰ্য্যে দীক্ষিত দেখিয়া কহিলেন, ‘মহাভাগ! আমরা যজ্ঞভাগগ্রহণার্থ উপস্থিত হইয়াছি।” তখন মহর্ষি ত্রিত দেবগণকে, ‘এই দেখুন। আমি অতি ভীষণ কৃপে নিপতিত হইয়াছি,’ এই বলিয়া যথাবিধি মন্ত্রপূত ভাগ প্রদান করিলেন। দেবগণও প্রীতিমনে স্ব স্ব ভাগ গ্রহণ করিয়া ত্রিতকে অভিলাষানুরূপ বরপ্রদানে উদ্যত হইলেন। তখন মহাত্মা ত্রিত কহিলেন, “হে দেবগণ! আমাকে এই কূপ হইতে উদ্ধার করুন। আর যিনি এই কূপোদক স্পর্শ করিবেন, তিনি যেন আপনাদের বরে সোমরসপায়ীর সঙ্গতিলাভে সমর্থ হয়েন।’

দেবগণ তাঁহার বাক্যশ্রবণে তথাস্তু বলিয়া তাঁহাকে অভিলষিত বর প্রদান করিলেন। দেবগণ বর প্রদান করিবামাত্র কূপমধ্যে তরঙ্গমালাসঙ্কুল সরস্বতী নদীর আবির্ভাব হইল। তখন মহর্ষি ত্রিত ঐ নদীপ্রভাবে উর্ধে উৎক্ষিপ্ত হইয়া দেবগণকে অভিবাদন করিলে দেবগণ স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন; মহর্ষি ত্রিতও মহা আহ্লাদে গৃহাভিমূখে ধাবমান হইলেন। তিনি গৃহে উপস্থিত হইয়া ভ্রাতৃদ্বয়কে অবলোকনপূর্ব্বক রোষাবিষ্টচিত্তে কহিলেন যে, ‘তোমরা পশুলোভে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছিলে; অতএব আমার শাপভাবে দংষ্ট্রায়ুধ ভীষণ বৃকরূপ ধারণ করিয়া ইতস্ততঃ বিচরণ কর। তোমাদিগের সন্তান সন্ততিও গোলাঙ্গুল [হনুমানের মত কৃষ্ণবর্ণ মুখবিশিষ্ট বানর], ভল্লুক ও বানর হইবে।’ মহর্ষি ত্রিত এই বলিবামাত্র তাঁহার সত্যবাদিতাপ্রভাবে সেই তাপসদ্বয় তৎক্ষণাৎ বৃকরূপী হইলেন। হে মহারাজ! অমিতপরাক্রম বলরাম সেই পুণ্যতীর্থে কূপ দর্শনপূর্ব্বক তাহার সলিল স্পর্শ ও বারংবার প্রশংসা করিয়া ব্রাহ্মণগণকে বিবিধ ধন দান করিবেন।