৩২. হ্রদস্থ দুর্য্যোধনবধে কৃষ্ণের উপদেশ

৩২তম অধ্যায় হ্রদস্থ দুর্য্যোধনবধে কৃষ্ণের উপদেশ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে সেই কৃপ প্রভৃতি তিনজন রথী প্রস্থান করিলে পাণ্ডবগণ সেই হ্রদের কূলে সমুপস্থিত হইলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির সেই দ্বৈপায়নহ্রদ দুৰ্য্যোধনের মায়াপ্রভাবে স্তম্ভিত দেখি বাসুদেবকে কহিলেন, ‘কৃষ্ণ! ঐ দেখ, দুর্য্যোধন মায়াবলে জলস্তম্ভ করিয়া হ্রদমধ্যে অবস্থান করিতেছে। মনুষ্য হইতে উহার কিছুমাত্র ভয় নাই। যাহা হউক, আমি ঐ মায়াবীকে কদাচ জীবিতাবস্থায় পরিত্যাগ করিব না। যদি দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং উহার সহায়তা করেন, তথাপি লোকে ইহাকে সংগ্রামে নিহত দর্শন করিবে।’

“বাসুদেব কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনি মায়াবলে ঐ মায়াবীর মায়া বিনষ্ট করুন। মাহাপ্রভাবে মায়াকে বিনষ্ট করা কর্তব্য। অতএব আপনি উপায় দ্বারা ঐ দুরাত্মাকে বিনষ্ট করুন। দেবরাজ উপায় দ্বারাই অসংখ্য দানবকে নিহত করিয়াছেন। কৌশলপ্রভাবেই বলি রাজা বদ্ধ এবং হিরণ্যাক্ষ, হিরণ্যকশিপুর ও বৃত্রাসুরের বধসাধন হইয়াছে; শ্রীরাম উপায়প্রভাবেই রাক্ষসরাজ রাবণকে সবংশে ধ্বংস করিয়াছেন। আমার উপায় প্রভাবেই মহাবল-পরাক্রান্ত বিচিও ও তারকাসুর নিপাতিত হইয়াছে। উপায়প্রভাবেই বাতাপি, ইল্বল, ত্রিশিরা, সুন্দ ও উপসুন্দ নিহত হইয়াছে এবং দেবরাজ ইন্দ্র উপায়বলেই স্বর্গরাজ্য ভোগ করিতেছেন। হে মহারাজ! উপায় সৰ্ব্বাপেক্ষা বলবান। উপায় প্রভাবেই দানব, রাক্ষস ও ভূপালগণ নিহত হইয়াছে। অতএব আপনি উপায় অবলম্বন করিয়া বিক্রম প্রকাশ করুন।

হ্রদতীরস্থ যুধিষ্ঠিরের দুৰ্য্যোধনাহ্বান

“হে মহারাজ! মহামতি বাসুদেব এইরূপ কহিলে কুন্তীতনয় যুধিষ্ঠির ঈষৎ হাস্য করিয়া জলমধ্যস্থিত মহাবলপরাক্রান্ত দুর্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘কুরুরাজ! তুমি সমস্ত ক্ষত্রিয় ও আপনার বংশ বিনষ্ট করিয়া কি নিমিত্ত আজ আপনার জীবনরক্ষার্থে জলাশয়ে প্রবেশ করিয়াছ? অচিরাৎ জলমধ্য হইতে গাত্রোত্থান করিয়া আমাদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। হে পুরুষোত্তম! আজ তোমার সে দর্প ও অভিমান কোথায়! সভামধ্যে সকলেই তোমাকে বীরপুরুষ বলিয়া কীৰ্ত্তন করে; কিন্তু আজ তুমি প্রাণভয়ে সলিলমধ্যে প্রবেশ করাতে উহা বৃথা বোধ হইতেছে। তুমি ক্ষত্রিয়বংশে বিশেষতঃ কৌরবকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, যুদ্ধে ভীত হইয়া সলিলমধ্যে অবস্থান করা তোমার নিতান্ত অকর্তব্য। সমরপরাঙ্মুখ হইয়া অবস্থান করা ক্ষত্রিয়গণের ধর্ম নহে; অসাধু লোকেরাই সমরাঙ্গন হইতে পলায়ন করিয়া থাকে। তুমি সমরসাগর সমুত্তীর্ণ না হইয়া কি নিমিত্ত জীবনরক্ষার বাসনা করিতেছ? এক্ষণে ভ্রাতা, পুত্র, বয়স্য, গুরুজন ও বন্ধুবান্ধবগণকে নিপাতিত করিয়া কি এই হ্রদমধ্যে বাস করা তোমার কর্তব্য হইতেছে? হে দুৰ্ব্বদ্ধে! তুমি সর্ব্বলোকসমক্ষে আপনাকে বীর বলি যে পরিচয় প্রদান করিতে, তাহা নিতান্ত নিরর্থক। বীরপুরুষেরা প্রাণান্তে শত্ৰু-সন্দর্শনে পলায়ন করেন না। তুমি কি মনে করি সমর পরিত্যাগ করিয়াছ, তাহা প্রকাশ কর এবং শঙ্কা পরিত্যাগপূর্ব্বক জলমধ্য হইতে উত্থিত হইয়া সমরে প্রবৃত্ত হও। সমস্ত সৈন্য ও ভ্রাতৃগণকে নিপাতিত করিয়া এক্ষণে জীবনরক্ষার বাসনা করা ক্ষাত্রধর্মানুসারে তোমার নিতান্ত অকর্তব্য হইতেছে। তুমি মোহবশতঃ কর্ণ ও শকুনিকে আশ্রয়পূর্ব্বক আপনাকে অমর জ্ঞান করিয়া যে পাপাচারণ করিয়াছিলে, এক্ষণে তাহার ফল ভোগ কর। তোমার ন্যায় বীরপুরুষেরা কখনই সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করেন না। এক্ষণে তোমার সে পৌরুষ, সে ক্ষত্রিয়াভিমান, সে বিক্রম, সে তর্জ্জন-গর্জ্জন ও সে অস্ত্রশিক্ষা কোথায় রহিল? তুমি কি নিমিত্ত জলাশযে শয়ান রহিলে? অচিরাৎ গাত্রোত্থানপূর্ব্বক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া হয় আমাদিগকে পরাজিত করিয়া এই পৃথিবী ভোগ কর, না হয় আমাদিগের হস্তে নিহত হইয়া ভূতলশায়ী হও। বিধাতা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধই পরম ধর্ম নির্দেশ করিয়াছেন। তুমি সেই ধর্মের অনুষ্ঠান করিয়া রাজত্ব লাভ কর।’

হ্রদস্থ দুর্য্যোধন ও তীরস্থ যুধিষ্ঠিরের উক্তিপ্রত্যুক্তি

“হে মহারাজ! ধীমান্ ধৰ্ম্মনন্দন এইরূপ কহিলে আপনার পুত্র দুর্য্যোধন জলমধ্য হইতে যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! প্রাণীদিগের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হওয়া বিচিত্র নহে। কিন্তু আমি প্রাণভয়ে পলায়ন করি নাই। সংগ্রামস্থলে আমার রথ ও তণীর বিনষ্ট এবং সমৃদ্য সৈন্যসামন্ত ও পৃষ্ঠরক্ষক নিহত হওয়াতে আমি একাকী নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া বিশ্রামার্থ সলিলমধ্যে প্রবেশ করিয়াছি; প্রাণভয়ে বা বিষাদ প্রযুক্ত এই কার্য্যের অনুষ্ঠান করি নাই। হে কুন্তীনন্দন! এক্ষণে অনুচরগণের সহিত তুমি কিয়ৎকাল বিশ্রাম কর। আমি অবিলম্বেই সলিল হইতে সমুত্থিত হইয়া তোমাদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইব।

যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘হে দুর্য্যোধন! আমরা শ্রমাপনোদন করিয়াছি; এক্ষণে বহুক্ষণের পর তোমার অনুসন্ধান পাইলাম, অতএব তুমি অবিলম্বে হ্রদমধ্য হইতে উত্থিত ও আমাদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হই, হয় রণস্থলে আমাদিগকে বিনাশপূর্ব্বক অতি সমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ কর, না হয় আমাদিগের হস্তে নিহত হইয়া বীরলোক প্রাপ্ত হও।’ তখন দুর্য্যোধন কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি যাহাদিগের নিমিত্ত রাজয়লাভের অভিলাষ করিতেছিলাম, আমার সেই সমস্ত ভ্রাতা পরলোকগমন করিয়াছে, পৃথিবীও রত্নহীন ও ক্ষত্রিয়শূন্য হইয়াছে; সুতরাং বিধবা রমণীর ন্যায় এই অবনীকে উপভোগ করিতে আমার আর স্পৃহা নাই। হে যুধিষ্ঠির! আমি এখনও পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে ভগ্নোৎসাহ করিয়া তোমাকে পরাজিত করিতে পারি; কিন্তু মহাবীর দ্রোণ, কর্ণ ও পিতামহ ভীষ্ম নিহত হওয়াতে আমার আর যুদ্ধ করিতে ইচ্ছা নাই। অতএব এক্ষণে তুমিই এই হস্তী ও অশ্বশূন্য বন্ধুবান্ধববিহীন পৃথিবী ভোগ কর। আমার সদৃশ কোন রাজ সহায়হীন রাজ্য শাসন করিতে বাসনা করে? বিশেষতঃ তাদৃশ সুহৃৎ, পুত্র ও ভ্রাতৃগণকে নিহত এবং শত্রু কর্ত্তৃক রাজ্য অপহৃত হওয়াতে আমার জীবন ধারণ করিতে অভিলাষ নাই। আমি এক্ষণে মৃগচর্ম পরিধানপূর্ব্বক বনে গমন করিব। রাজ্যভোগে আমার আর কিছুতেই স্পৃহা হইতেছে না।’

“হে মহারাজ! মহাযশস্বী যুধিষ্ঠির রাজা দুৰ্য্যোধনের সে করুণ বাক্য শ্রবণ করি। কহিলেন, “হে দুর্য্যোধন! তুমি সলিলমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক আর এইরূপ পরিতাপ করিও না। শকুনির ন্যায় তোমার ঐ সকল আৰ্ত্ত-প্রলাপে [পীড়িতের কাতর বাক্যে] আমার মনে কিছুমাত্র দয়াসঞ্চার হইতেছে না। তুমি কথঞ্চিৎ রাজ্যদানে সম্মত হইতে পার; কিন্তু আমি কিছুতেই তোমার প্রদত্ত রাজ্য শাসন করিতে সম্মত নহি। প্রতিগ্রহ ক্ষত্রিয়ের পক্ষে নিতান্ত অধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দিষ্ট আছে; অতএব তুমি সমগ্র পৃথিবী দান করিলেও আমি অধর্মাচরণপূর্ব্বক কদাচ প্রতিগ্ৰহ করিব না। আমি তোমাকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া এই পৃথিবী ভোগ করিব। হে দুর্য্যোধন! পূৰ্ব্বে আমরা পুররক্ষার্থ ধর্মানুসারে রাজ্য প্রার্থনা করিয়াছিলাম, তৎকালে তুমি কি নিমিত্ত উহা আমাদিগকে প্রদান কর নাই? তুমি প্রথমে মহাবল-পরাক্রান্ত বাসুদেবকে প্রত্যাখ্যান করিয়া এক্ষণেই বা কি নিমিত্ত রাজ্যদানে অভিলাষী হইয়াছ? হা! তোমার কি ভ্রান্তি! কোন রাজা শত্রু কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া রাজ্যদানে ইচ্ছা করিয়া থাকে? আর এক্ষণে তোমার এই রাজ্য বলপূর্ব্বক গ্রহণ বা দান করিবার ক্ষমতা নাই, সুতরাং তুমি কিরূপে আমাকে দান করিবে? হে দুর্য্যোধন! এক্ষণে তুমি আমাকে পরাজিত করিয়া এই পৃথিবী প্রতিপালন কর। পূৰ্ব্বে তুমি আমাকে সূচ্যগ্র-পরিমিত ভূমি প্রদান করিতে অভিলাষী হও নাই; এক্ষণে কিরূপে সমগ্র পৃথিবী প্রদান করিবে? কোন্ মূর্খ অতুল ঐশ্বৰ্য্য ভোগ ও রাজ্য শাসন করিয়া শত্রুকে বসুন্ধরাদানে অধ্যবসায় করিয়া থাকে? তুমি কেবল মোহপ্রভাবেই উহা অবগত হইতে সমর্থ হইতেছ না। হে কুরুরাজ! তুমি রাজ্যদানে অভিলাষী হইলেও আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করিব না। অতএব এক্ষণে হয়ে তুমি আমাদিগকে জয় করিয়া রাজ্য শাসন কর, নতুবা আমাদিগের হস্তে নিহত হইয়া অত্যুৎকৃষ্ট ব্রহ্মণলোক প্রাপ্ত হও। তুমি ও আমি আমরা দুইজনেই জীবিত থাকিলে লোকে আমাদের জয়-পরাজয়ে সন্দেহ করিবে। হে দুর্বুদ্ধে! এক্ষণে তোমার জীবন আমার অধীন হইয়াছে, আমি মনে করিলে তোমার প্রাণ রক্ষা করিতে পারি; কিন্তু তুমি স্বয়ং কখনই আত্মপরিত্রাণে সমর্থ হইবে না। পূৰ্ব্বে তুমি গৃহদাহ ও বিষপ্রয়োগ প্রভৃতি বিবিধ উপায় দ্বারা আমাদিগকে বিনাশ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলে এবং রাজ্যাপহরণ, দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ ও অপ্রিয়বাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক বারংবার আমাদিগকে কষ্ট প্রদান করিয়াছ। সেই সমুদয় কারণবশতঃ তুমি নিশ্চয়ই বিনষ্ট হইবে; এক্ষণে জলমধ্য হইতে উত্থিত হইয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও; যুদ্ধই তোমার পক্ষে শ্রেয়ঃ।’ হে মহারাজ! ধৰ্ম্মনন্দন এই কথা কহিলে অন্যান্য পাণ্ডবগণ দুর্য্যোধনকে লক্ষ্য করিয়া বারংবার সেইরূপ বাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিলেন।”

হ্রদপ্রবেশপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত