২৪. শকুনির পুনঃ যুদ্ধ–উভয়পক্ষীয় লোকক্ষয়

২৪তম অধ্যায়শকুনির পুনঃ যুদ্ধউভয়পক্ষীয় লোকক্ষয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! তখন শোণিতলিপ্তকলেবর পাণ্ডবসেনাগণও অবশিষ্ট ছয় সহস্র অশ্ব লইয়া তথা হইতে গমন করিতে লাগিল। তখন জীবিত-নিরপেক্ষ, রক্তাক্তদেহ, পাণ্ডব পক্ষীয় অশ্বারোহিগণ কহিল, ‘হে বীরগণ! এখানে মহাগজের কথা দূরে থাকুক, রথ লইয়া যুদ্ধ করাও সাধ্যায়ত্ত নহে; অতএব রথীগণ রথীদিগের প্রতি এবং কুঞ্জরসকল কুঞ্জরগণের অভিমুখে গমন করুক। সুবলনন্দন শকুনি পলায়নপূর্ব্বক স্বীয় সৈন্যমধ্যে অবস্থান করিতেছে, আর যুদ্ধ করিতে আগমন করিবে না।

“অশ্বারোহিগণ এই কথা বলিলে দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র ও করিসৈন্যগণ পাঞ্চালবংশোদ্ভব মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্নের নিকট গমন করিল। সহদেবও একাকী রাজা যুধিষ্ঠিরের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। এইরূপে সৈন্যসকল অপসৃত হইলে শকুনি পুনরায় সংগ্রামে আগমনপূর্ব্বক একপার্শ্ব হইতে ধৃষ্টদ্যুম্নের সৈন্যগণকে প্রহার করিতে লাগিলেন। তখন উভয়পক্ষীয় বীরগণ পুনরায় প্রাণপণে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ করিল। যোধগণ পরস্পর পরস্পরকে লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইলেন। মস্তকসকল খড়াঘাতে ছিন্ন হইয়া নিপতিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, তালফল নিপতিত হইতেছে। ছিন্নভিন্ন কলেবর, ঊরু ও অস্ত্রযুক্ত বাহুনিচয় নিপতিত হওয়াতে ঘোরতর চটাচট শব্দ সমুত্থিত হইল। যোধগণ শাণিত শস্ত্রসমূহে ভ্রাতা, পিতা ও পুত্রগণকে নিপীড়িত করিয়া আমিষলোলুপ বিহঙ্গমকুলের ন্যায় বিচরণ করিতে লাগিলেন। ক্রোধাবিষ্ট বীরগণ ‘আমি পূৰ্ব্বে প্রহার করিব’, ‘আমি পুৰ্ব্বে প্রহার করিব’ বলিয়া ধাবমান হইয়া সহস্র সহস্র যোদ্ধাকে নিপাত করিলেন। গতাসু নিপতমান অশ্বারোহিগণের সঙ্ঘর্ষণে শত শত বীর ভূতলে নিপাতিত হইল। নিতান্ত পিষ্ট চঞ্চল অশ্বগণের হ্রেষারব এবং সন্নদ্ধগাত্র পরমর্মবিদারপোদ্যত [শত্রুগণের মর্মস্থলচ্ছেদনে উদযুক্ত] মনুষ্যগণের চীৎকার ও অস্ত্রশব্দে রণস্থল তুমুল হইয়া উঠিল। ঐ সময় কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ শ্রান্ত, পিপাসার্ত ও নিশিতশরনিকরে ক্ষতবিক্ষত হইতে লাগিল। তাহাদিগের বাহনগণ নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইল। বীরগণ রুধিরগন্ধে মত্ত ও বিচেতনপ্রায় হইয়া কি স্বকীয়, কি পরকীয় যোধগণকে প্রাপ্তিমাত্রেই বিনাশ করিতে লাগিলেন। কতকগুলি ক্ষত্রিয় জিগীষাপরবশ হইয়া বিপক্ষের শরনিকরে প্রাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইলেন। হে মহারাজ। আপনার পুত্রের সমক্ষেই এইরূপ ঘোরতর সৈন্যক্ষয় হইতে লাগিল। তখন বৃক, গৃধ্র ও শৃগালগণের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। সমরভূমি মনুষ্য ও অশ্বগণের দেহে সমাচ্ছন্ন ও রুধিরপ্রবাহে সমাকুল হইয়া ভীরুজনের নিতান্ত ভয়াবহ হইল। উভয়পক্ষীয় বীরগণ অসি, পট্টিশ ও শূল প্রভৃতি অস্ত্রে বারংবার ক্ষতবিক্ষত হইয়াও সমরে নিবৃত্ত হইলেন না; যতক্ষণ জীবিত রহিলেন, স্ব স্ব শক্তি অনুসারে প্রহার করিতে লাগিলেন। অনেক যোদ্ধা অরাতিগণের অস্ত্রে আহত হইয়া রুধির ক্ষরণপূর্ব্বক, নিপতিত হইল। কবন্ধগণ সমথিত হইয়া যোধগণের কেশাকর্ষণপূর্ব্বক শোণিতলিপ্ত অসি সমুদ্যত করিতে লাগিল। অসংখ্য যোদ্ধা রুধিরগন্ধে মোহপ্রাপ্ত হইল।

“হে মহারাজ! ঐ সময় সমরশব্দ তিরোহিতপ্রায় হইলে সুবলনন্দন শকুনি অম্লাবশিষ্ট অশ্বারোহী সমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের বহুসংখ্যক সৈন্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। জয়াভিলাষী পাণ্ডবগণও অতি সত্বর শকুনির অভিমুখে গমন করিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় উদ্যতাস্ত্র গজারোহী, অশ্বারোহী ও পদাতিগণ সমরসাগর সমুত্তীর্ণ হইবার মানসে চতুর্দ্দিক হইতে শকুনিকে পরিবেষ্টন করিয়া বিবিধ শরনিকরে তাহাকে নিপীড়িত করিতে লাগিল। তখন কৌরবপক্ষীয় হস্তী, অশ্ব ও পদাতিগণ পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যগণকে চতুর্দ্দিক হইতে আগমন করিতে দেখিয়া তাহাদিগের প্রতি ধাবমান হইল। অস্ত্রহীন পদাতিগণ কেহ কেহ পদদ্বারা ও কেহ কেহ মুষ্টিদ্বারা পরস্পরকে নিহত করিয়া ভূতলে নিপাতিত করিল। পূণ্যক্ষয় হইলে সিদ্ধগণ যেমন বিমান হইতে ভূতলে নিপতিত হয়েন, তদ্রূপ রথীগণ রথ হইতে এবং গজারোহিগণ গজ হইতে ভূতলে পতিত হইতে লাগিল। এইরূপে সেই প্রাস, অসি ও শরসঙ্কুল ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইলে যোধগণ পরস্পর মিলিত হইয়া কেহ কেহ পিতা, কেহ কেহ ভ্রাতা, কেহ কেহ বন্ধু, কেহ কেহ পুত্রগণকে বিনাশ করাতে সংগ্রাম অতি অব্যবস্থিত হইয়া পড়িল।”