২৩. শকুনি-পাণ্ডব মহাসমর–শকুনি-পরাজয়

২৩তম অধ্যায় – শকুনিপাণ্ডব মহাসমর–শকুনিপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে সেই তুমুল সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে আপনার সৈন্যগণ সমপরাঙ্মুখ ও ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। তখন মহারাজ দুর্য্যোধন পরম প্রযত্নসহকারে তাঁহাদিগকে নিবারণ করিয়া পাণ্ডব-সৈন্যগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। যোদ্ধারা সকলেই প্রত্যাগত হইয়া রাজা দুৰ্য্যোধনের বিজয়লাভাভিলাষে সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। তখন উভয়পক্ষে সুরাসুরসংগ্রামসদৃশ ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। তৎকালে উভয়পক্ষে কোন সৈন্যই আর সমপরাঙ্মুখ হইল না। সকলেই অনুমান দ্বারা পরস্পরের নাম নির্দেশপূর্ব্বক যুদ্ধ করিতে লাগিল। ঐ সময়ে রণস্থলেও অসংখ্য সৈন্য বিনষ্ট হইয়াছিল।

“অনন্তর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অন্যান্য ভূপালবৰ্গসমভিব্যাহারে বিপক্ষগণকে পরাজিত করিবার নিমিত্ত নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সুশাণিত তিন শরে কৃপাচাৰ্য্যকে বিদ্ধ করিয়া চারি নারাচে কৃতবর্ম্মার অশ্বগণকে সংহার করিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা কৃতবর্ম্মাকে অশ্ববিহীন দেখিয়া তাঁহাকে লইয়া রণস্থল হইতে অপসৃত হইলেন। অনন্তর কৃপাচার্য্য আট শরে যুধিষ্ঠিরকে বিদ্ধ করিলেন। রাজা দুর্য্যোধন তাঁহার অভিমুখে সাতশত রথী প্রেরণ করিলেন। রথীগণ মহাবেগে ধৰ্ম্মরাজের রথাভিমুখে অশ্বসঞ্চালন করিতে লাগিলেন এবং জলদজাল যেমন দিবাকরকে তিরোহিত করে, তদ্রূপ শরনিকরে ধৰ্ম্মরাজকে অদৃশ্য করিয়া ফেলিলেন। শিখণ্ডিপ্রমুখ মহারথগণ যুধিষ্ঠিরের সেইরূপ অবস্থা দর্শনে উহা নিতান্ত অসহ্য জ্ঞান করিয়া ক্রোধভরে তাঁহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত কিঙ্কিণীজালজড়িত অশ্বসংযুক্ত রথে আরোহণপূর্ব্বক সত্বর গমন করিলেন।

“অনন্তর উভয়পক্ষে যমরাষ্ট্রবিবর্ধন ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। পাঞ্চালদিগের সহিত মিলিত পাণ্ডবগণ কৌরবপক্ষীয় সাতশত রথীকে বিনাশ করিয়া অন্যান্য বীরগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন রাজা দুৰ্য্যোধনের সহিত পাণ্ডবগণের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। ঐরুপ যুদ্ধ আমরা কখন দর্শন বা শ্রবণও করি নাই। ঐ সময় চতুর্দ্দিকে অব্যবস্থিত, যুদ্ধপ্রবর্তিত ও উভয়পক্ষীয় অসংখ্য বীর পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলে সমরাঙ্গনে অনবরত শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ হইতে লাগিল। যোদ্ধারা শরনিকরে পরস্পরের মর্ম ছেদনপূর্ব্বক জয়লাভাভিলাষে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সেই বহুসংখ্যক মহিলাগণের কেশসংস্কারনিবারক, শোকজনক, ভীষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে ভূতল ও নভোমণ্ডলে অতি ভয়ঙ্কর দুর্নিমিত্ত সমুদয় প্রাদুর্ভুত হইল। পৰ্ব্বতবনসমাকীর্ণ পৃথিবী ঘোরতর শব্দ করিয়া বিকশিত হইয়া উঠিল। দণ্ড ও উল্মূকযুক্ত[দগ্ধ অঙ্গার-সমন্বিত] উল্কাসকল সূৰ্য্যমণ্ডল সমাহত করিয়া নভোমণ্ডল হইতে নিপতিত হইতে লাগিল। প্রবল বায়ু প্রাদুর্ভূত হইয়া কর্কররাশি বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল এবং করিনিকর কম্পিতকলেবর হইয়া অজস্র অশ্রুবর্ষণ করিতে লাগিল। ক্ষত্রিয়গণ এই সমস্ত দুর্নিমিত্তদর্শনে কিছুমাত্র ভীত হইয়া স্বর্গলাভাভিলাষে সেই পুণ্যক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর গান্ধাররাজতনয় শকুনি যোদ্ধাদিগকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন, “হে যোধাগণ! তোমরা সম্মুখে যুদ্ধ কর, আমি পশ্চাদ্ভাগে থাকিয়া পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিতেছি। মদ্রদেশীয় যোদ্ধা ও অন্যান্য বীরগণ সুবলনন্দনের বাক্য-শ্রবণে যার পর নাই আহ্লাদিত হইয়া তুমুল কোলাহল করিতে লাগিলেন। ঐ সময় বিপক্ষেরা শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক আমাদিগের প্রতি অনবরত শরনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে, মদ্ররাজের সৈন্যগণ বিনষ্ট হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে মহারাজ দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণ নিতান্ত ভীত হইয়া পুনরায় সমরপরাঙ্মুখ হইল। তখন মহাবল-পরাক্রান্ত শকুনি তাহাদিগকে বলিলেন, ‘সৈন্যগণ! তোমরা প্রতিনিবৃত্ত হইয়া পুনরায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। পলায়নপূর্ব্বক অধৰ্ম্মানুষ্ঠান করা তোমাদিগের নিতান্ত অকর্তব্য।’

“হে মহারাজ! ঐ সময় গান্ধাররাজ শকুনিরও দশ সহস্র প্রাসধারী অশ্বারোহী ছিল; তিনি পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান করিয়া সেই সমস্ত সৈন্য লইয়া বিক্ৰম প্ৰকাশপূর্ব্বক নিশিতশরনিকরে পাণ্ডবগণকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ডবসৈন্যগণ বায়ুসঞ্চালিত অভ্রজালের ন্যায় ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আপনার সমক্ষে সৈন্যগণকে ছিন্নভিন্ন দেখিয়া অক্ষুব্ধ চিত্তে মহাবল সহদেবকে কহিলেন, “হে সহদেব! ঐ দেখ, দুৰ্ম্মতি সুবলনন্দন আমাদিগের পশ্চাদ্ভাগে সৈন্যগণকে বিনাশ করিতেছে, অতএব তুমি অবিলম্বে উহার সম্মুখীন হইয়া উহাকে সংহার কর। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, তিন সহস্র পদাতি এবং হস্তী ও অশ্বগণ তোমার সমভিব্যাহারে গমন করুক। আমি পাঞ্চালগণ সমভিব্যাহারে শরানলে রথীদিগকে দগ্ধ করিতেছি। মহাবল পরাক্রান্ত সহদেব ধর্ম্মরাজ কর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া অবিলম্বে আরোহিসমবেত সাত শত হস্তী, পাঁচ সহস্র অশ্ব ও তিন সহস্র পদাতি এবং দ্রৌপদীর আত্মজগণকে সমভিব্যাহারে লইয়া সমরদুর্ম্মদ শকুনির প্রতি ধাবমান হইলেন এবং শকুনিকে অতিক্রম করিয়া জয়াভিলাষে পশ্চাদ্ভাগে অবস্থানপূর্ব্বক তাঁহার সৈন্যগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অশ্বারোহী সৈন্যগণ ক্রোধভরে রথীদিগকে অতিক্রমপূর্ব্বক শকুনির সৈন্যগণমধ্যে প্রবেশ করিয়া তাঁহাদিগের প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। অনন্তর সহদেবের সৈন্যগণের সহিত শকুনির ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। রথীসকল শরবর্ষণে বিরত হইয়া তাঁহাদের সংগ্রাম দর্শন করিতে লাগিলেন। তৎকালে কে আত্মপক্ষ, আর কে-ই বা পরপক্ষ, তাহা বোধগম্য হইল না, কৌরব ও পাণ্ডবগণ নক্ষত্রপাতের ন্যায় শূরগণবিসৃষ্ট শক্তিসম্পাত নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। নভোমণ্ডল নিৰ্ম্মল ঋষ্টি দ্বারা সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। প্রাস-সমুদয় শলভশ্রেণীর ন্যায় নভোমণ্ডলে বিরাজিত হইল। অসংখ্য অশ্ব শরবিদ্ধ ও রুধিরলিপ্তকলেবর হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল এবং কতকগুলি পরস্পর পরিপেষিত ও ক্ষতবিক্ষত হইয়া অনবরত রুধির বমন করিতে আরম্ভ করিল।

‘অনন্তর রণস্থল সৈন্যসমুত্থিত ধূলিজালে সমাচ্ছন্ন হইলে ঘোরতর অন্ধকার প্রাদুর্ভূত হইল। তখন অসংখ্য অশ্ব ও মনুষ্য তথা হইতে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। কতকগুলি সৈন্য ভূতলে নিপতিত হইয়া রুধির বমন করিতে লাগিল। কেহ কেহ পরস্পরের কেশ গ্রহণপূর্ব্বক নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল এবং কেহ কেহ পরস্পরকে অশ্বপৃষ্ঠ হইতে আকর্ষণপূর্ব্বক মল্লের ন্যায় পরস্পর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া নিহত হইল। কোন কোন বীর অশ্বপৃষ্ঠে নিহত হইলে অরো তাঁহাদিগকে লইয়া ধাবমান হইল এবং কেহ কেহ গতাসু হইয়া অশ্বপৃষ্ঠ হইতে নিপতিত হইতে লাগিল। ঐ সময় রুধিরোক্ষিত শস্ত্রখণ্ডিত ভুজদণ্ড, ছিন্ন কেশপাশ, বিবিধ অস্ত্র শস্ত্র, নিহত অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং শোণিতসিক্ত বর্ম্মধারী পরস্পরবধাভিলাষী উদ্যতায়ুধ সৈন্যগণে সমরাঙ্গন সমাচ্ছন্ন হইলে কেহই আর অশ্বারোহণপূর্ব্বক দূরে গমন করিতে সমর্থ হইল না। তখন মহাবলপরাক্রান্ত সুবলনন্দন মুহূর্তকাল যুদ্ধ করিয়া হতাবশিষ্ট ছয় সহস্র অশ্বসৈন্যের সহিত তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।”