১৭. শল্য-পাণ্ডব যুদ্ধ–বহু বীরক্ষয়

১৭শ অধ্যায়শল্যপাণ্ডব যুদ্ধ–বহু বীরক্ষয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহারথ শল্য অতি সুদৃঢ় বেগবান অন্য এক শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক ধারাবর্ষী জলধরের ন্যায় ক্ষত্রিয়গণের উপর শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন এবং সাত্যকিকে দশ, ভীমসেনকে তিন ও সহদেবকে তিন শরে বিদ্ধ করিয়া যুধিষ্ঠিরকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাধনুর্ধরগণ হস্তিযূথ যেমন উল্কাদ্বারা আহত হয়, তদ্রূপ মদ্ররাজের শরনিকরে সমাহত হইতে লাগিল। অসংখ্য গজ ও গজারোহী, অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং রথ ও রথী তাঁহার শরে নিপীড়িত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। শল্য অনেকের আয়ুধযুক্ত বাহু এবং অনেকের রথধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সমরভূমি নিপাতিত যোধগণে সমাকীর্ণ হইয়া কুশাস্তীর্ণ যজ্ঞবেদির ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।

“হে মহারাজ! ঐ সময় পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সোমকগণ সেই অরাতিসৈন্যনিপাতন কৃতান্ততুল্য মদ্ররাজের পরাক্রম দেখিয়া রোষভরে তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিলেন। মহাবীর সাত্যকি, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব অসাধারণ বলসম্পন্ন মদ্ৰাধিপতিকে যুধিষ্ঠিরের সহিত সমরে প্রবৃত্ত দেখিয়া তাঁহাকে আহ্বান ও পরিবেষ্টনপূর্ব্বক মহাবেগসম্পন্ন শরনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির ভীমসেন, নকুল, সহদেব ও সাত্যকি কর্ত্তৃক পরিরক্ষিত হইয়া মদ্ৰাধিপতির বক্ষঃস্থলে অনবরত শরাঘাত করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় কৌরবপক্ষীয় মহারথগণ শল্যকে শরনিপীড়িত নিরীক্ষণ করিয়া দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে চতুর্দ্দিক হইতে তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর শল্য অতি সত্বর সাতবাণে যুধিষ্ঠিরকে বিদ্ধ করিলে তিনিও তাঁহাকে নয়শরে বিদ্ধ করিলেন। পরে তাঁহারা উভয়ে আকর্ণাকৃষ্ট তৈলধৌত শরনিকরে পরস্পরকে সমাচ্ছাদিত করিয়া পরস্পরের ছিদ্রান্বেষণপূর্ব্বক শরনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। উভয়ের ধনুষ্টঙ্কার ও তলনিনাদ অশনিনির্ঘোষের ন্যায় শ্রুতিগোচর হইল। তাঁহারা নিবিড় অরণ্যমধ্যস্থিত আমিষগৃধূ ব্যাঘ্ৰশাবকদ্বয়ের ন্যায় সমরাঙ্গনে বিচরণ করিয়া বিষাণযুক্ত মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাত্মা মদ্ৰাধিপতি সহসা মহাবলপরাক্রান্ত রাজা যুধিষ্ঠিরের বক্ষঃস্থলে এক সূৰ্য্য ও অনলসদৃশ প্রভাসম্পন্ন শর নিক্ষেপ করিলেন। ধৰ্ম্মরাজ শল্যের শরে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া মহাবেগে তাঁহার উপর শরাঘাত করিয়া তাঁহাকে মূর্ছিত করিয়া যারপরনাই আহ্লাদিত হইলেন। দেবরাজপ্রতিম মহাত্মা মদ্ররাজও মুহূর্তকালমধ্যে পুনরায় সংজ্ঞালাভ করিয়া রোষারুণনেত্রে অতি সত্বর একশতশরে ধৰ্ম্মরাজকে বিদ্ধ করিলেন। তখন ধৰ্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠির ক্রোধভরে নয়বাণে মদ্ররাজের সুবর্ণময় কবচ ছেদন ও বক্ষঃস্থল ভেদ করিয়া ছয়শরে তাঁহাকে নিপীড়িত করিলেন। মহাবীর শল্য যুধিষ্ঠিরের শরে সমাহত হইয়া হৃষ্টমনে শরাসন। আকর্ষণপূর্ব্বক শর নিক্ষেপপূর্ব্বক দুই ক্ষুরাস্ত্রে যুধিষ্ঠিরের কার্ম্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাত্মা ধৰ্ম্মতনয় অন্য এক নূতন শরাসন গ্রহণ করিয়া, দেবরাজ ইন্দ্র যেমন নমুচিকে শরনিকরে বিদ্ধ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ চতুর্দ্দিক হইতে শল্যকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাবীর শল্য নয়শরে ভীম ও রাজা যুধিষ্ঠিরের সুবর্ণময় বর্ম্ম ছেদন করিয়া তাঁহাদিগের ভুজযুগল বিদ্ধ করিলেন; হুতাশন ও সূর্য্যের ন্যায় তেজঃসম্পন্ন ক্ষুরপ্ৰদ্বারা পুনরায় ধৰ্ম্মরাজের শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময় মহাবীর কৃপ ছয়শরে যুধিষ্ঠিরের সারথির শিরচ্ছেদনপূর্ব্বক ভূতলে নিপাতিত করিলেন। তখন মদ্ররাজ চারিশরে ধর্মরাজের চারি অশ্ব বিনাশ করিয়া তাঁহার সৈন্যসংহারে প্রবৃত্ত হইলেন। তদ্দর্শনে মহাবীর বৃকোদর একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া একশরে মদ্ররাজের কোদণ্ড দ্বিখণ্ড করিয়া দুইশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন এবং তৎপরে অন্য একশরে তাঁহার সারথির শিরচ্ছেদন করিয়া সত্বর তাঁহার চারি অশ্বকে বিনাশ করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে মদ্ররাজ অশ্বসারথিবিহীন হইলে ভীমসেন ও মাদ্ৰীতনয় সহদেব উভয়ে সেই ধনুর্ধরাগ্রগণ্য সমরচারী একমাত্র বীরকে শাণিতশরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর বৃকোদর মদ্ররাজকে শরজালে বিমোহিত দেখিয়া পুনরায় শরপ্রয়োগপূর্ব্বক মদ্ররাজের বর্ম্ম ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মদ্ররাজ সহস্রতারকাসম্পন্ন চর্ম ও খড়্গ গ্রহণপূর্ব্বক সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইলেন এবং অবিলম্বে নকুলের রথেষা ছেদনপূর্ব্বক দ্রুতবেগে যুধিষ্ঠিরের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, সাত্যকি ও দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র মদ্ররাজকে যুদ্ধে অন্তকের ন্যায় আগমন করিতে দেখিয়া অবিলম্বে তাঁহার অভিমুখে গমন করিলেন। তখন মহাত্মা বৃকোদর নয়শরে মদ্ররাজের সেই অপ্রতিম চর্ম ও সুনিশিত ভল্লে তাঁহার খড়্গের মুষ্টিদেশ ছেদন করিয়া সৈন্যগণমধ্যে প্রফুল্লমনে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ মহাবীর ভীমের সেই অদ্ভুত কাৰ্য্য নিরীক্ষণপূর্ব্বক হৃষ্টান্তঃকরণে হাস্যবদনে সিংহনাদ পরিত্যাগ ও শশাঙ্কধবল শঙ্খ ধ্বনিত করিতে আরম্ভ করিলেন। নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ সুরক্ষিত কৌরবসৈন্যগণ সেই ভীষণ শব্দে একান্ত ভীত ও বিসংজ্ঞ[অচেতন]প্রায় হইয়া শোণিতসিক্তকলেবরে ইতস্ততঃ ধাবমান হইল।

যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক শল্যসংহার

“ইত্যবসরে মদ্ৰাধিপতি শল্য ভীমপ্রমুখ পাণ্ডবপক্ষীয় যোধগণকর্ত্তৃক শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়াও মৃগবিনাশার্থী সিংহের ন্যায় মহাবেগে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির মদ্ররাজকে আগমন করিতে দেখিয়া রোষপ্রভাবে হুতাশনের ন্যায় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিলেন এবং বাসুদেবের বাক্য স্মরণ করিয়া তৎকালে তাঁহাকে বিনাশ করিতে কৃতনিশ্চয় হইলেন। তখন তিনি শল্যের অদ্ভুত কাৰ্য্য নিরীক্ষণ করিয়া সেই অশ্বসারথিশূন্য রথে অবস্থান করিয়াই এক কনকসঙ্কাশ, মণিখচিত সুবর্ণদণ্ডসম্পন্ন শক্তি গ্রহণ করিলেন এবং ক্রোধপ্রদীপ্ত নেযুগল বিস্ফারিত করিয়া মদ্ররাজকে অবলোকন করিতে লাগিলেন। তৎকালে মদ্ররাজ সেই পবিত্রস্বভাব পাপহীন ধৰ্ম্মরাজকর্ত্তৃক নিরীক্ষিত হইয়া যে ভস্মসাৎ হইলেন না, ইহা দেখিয়া আমরা সকলেই বিস্মিত হইলাম।

“হে মহারাজ! ধর্মরাজ মদ্ররাজের প্রতি নিক্ষেপ করিবার নিমিত্ত যে যমদণ্ডপ্রতিম শক্তি গ্রহণ করিয়াছিলেন, উহা পাশহস্তা [পাশধারিণী] কালরাত্রির ন্যায় যমরাজের উগ্ররূপা ধাত্রীর ন্যায় নিতান্ত ভীষণ; পাণ্ডবগণ গন্ধমাল্য, পান ও ভোজনদ্বারা প্রযত্ন সহকারে নিরন্তর ঐ শক্তির অর্চনা করিতেন; উহা সংবৰ্ত্তক [প্রলয়কালীন অগ্নির] অনলের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত ও অথৰ্ব্ববেদপোক্ত[১] কার্য্যের ন্যায় নিতান্ত উগ্র। পূৰ্ব্বে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ভগবান শঙ্করের নিমিত্ত ঐ শক্তি নিৰ্মাণ করিয়াছিলেন। উহা ভূচর, খেচর ও জলচর প্রভৃতি সমুদয় প্রাণীর বিনাশে সমর্থ। উহার দণ্ড, ঘণ্টা, পতাকা মণিহীরক সমলঙ্কৃত এবং সুবর্ণবৈদূৰ্য্যখচিত। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মদ্ররাজের বিনাশসাধনার্থ সেই অসুরবিনাশক, অব্যর্থ, ব্ৰহ্মদণ্ডসন্নিভ শক্তি মন্ত্রপূত করিয়া প্রযত্ন সহকারে মহাবেগে নিক্ষেপ করিলেন। পূৰ্ব্বে রুদ্রদেব যেমন অন্ধকাসুরের প্রতি শর নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ধৰ্ম্মরাজ এক্ষণে মদ্ররাজের প্রতি সেই প্রাণান্তকর শক্তি প্রয়োগ করিয়া ‘রে পাপ! তুই নিহত হইলি’, এই বলিয়া তর্জ্জনগর্জ্জন করিয়া সুদৃঢ় ভুজদণ্ড প্রসারণপূর্ব্বক ক্রোধভরে যেন নৃত্য করিতে লাগিলেন। তখন মদ্ররাজ হুতাশন যেমন বিধিপূর্ব্বক হুত ঘৃতধারা গ্রহণ করিতে উৎসুক হয়েন, তদ্রূপ সেই যুধিষ্ঠিরপ্রেরিত দুর্নিবার শক্তি গ্রহণ করিবার নিমিত্ত সমুত্থিত হইয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর সেই শক্তি মদ্ররাজের অতি বিশাল শুভ্র বক্ষঃস্থল ও সমুদয় মৰ্ম্ম ভেদপূর্ব্বক ধৰ্ম্মরাজের যশোবিস্তার করিয়া সলিলের ন্যায় অপ্রতিহতবেগে ভূমধ্যে প্রবেশ করিল। তখন মদ্ররাজ নাসা, চক্ষু, কর্ণ ও আস্যদেশ হইতে বিনিঃসৃত রুধিরধারায় সংসিক্তকলেবর হইয়া, কার্তিকেয় নিহত ক্রৌঞ্চপৰ্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন এবং অবিলম্বে বাহু প্রসারণপূর্ব্বক কুলিশদলিত অচলশিখরের ন্যায়, সমুচ্ছ্রিত ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় রথ হইতে ভূতলে নিপতিত হইলেন। বোধ হইতে লাগিল যেন, বসুন্ধরা প্রিয়তম পতির ন্যায় প্রণয়পূর্ব্বক তাঁহাকে প্রত্যুদগমন ও আলিঙ্গন করিতেছে। তিনি যেন বসুন্ধরাকে প্রিয়তমা পত্নীর ন্যায় বহুকাল উপভোগ করিয়া তাঁহাকে গাঢ় আলিঙ্গনপুৰ্ব্বক সুষুপ্তি লাভ করিলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর শল্য ধর্মযুদ্ধে ধৰ্ম্মনন্দনের হস্তে নিহত হইয়া হোমাবসানে প্রশান্ত হুতাশনের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। শক্তিদ্বারা তাঁহার অঙ্গ, আয়ুধ ও হৃদয় বিদীর্ণ হইলেও তিনি কিছুমাত্র শোভাবিহীন হয়েন নাই। অনন্তর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ইন্দ্রধনুপ্রতিম শরাসন গ্রহণ করিয়া খগরাজ যেমন পন্নগগণকে বিমর্দ্দিত করে, তদ্রূপ কৌরপসৈন্যগণকে বিদলিত করিতে লাগিলেন। তাঁহার সুনিশিত ভল্লে ক্ষণকালমধ্যে অসংখ্য কৌরবসেনা বিনষ্ট হইল। অনেকে তাঁহার শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া নিমীলিতলোচনে পরস্পর পরস্পরকে নিপীড়নপূর্ব্বক রুধিরাক্তকলেবরে অস্ত্রশস্ত্রবিহীন ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল।

শল্যানুজ বধকৌরবপলায়ন

“অনন্তর মদ্ররাজের অনুজ ভ্রাতা জ্যেষ্ঠের নিধনে ক্রোধান্বিত হইয়া যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইলেন। ঐ মহাবীর মদ্ররাজের ন্যায় সৰ্ব্বগুণসম্পন্ন। তিনি ভ্রাতৃঋণপরিশোধের নিমিত্ত অসংখ্য নারাচদ্বারা ধৰ্ম্মনন্দনকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির অতি সত্বর ছয়শরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া দুই ক্ষুরাস্ত্রে তাঁহার শাসন ও রথধ্বজ ছেদনপূর্ব্বক এক দেদীপ্যমান সুদৃঢ় ভল্লে তাঁহার শিরচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তাঁহার সেই কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক রথ হইতে নিপতিত হইলে বোধ হইল যেন, কোন স্বর্গবাসী পূণ্যাবসানে স্বর্গ হইতে নিপতিত হইলেন। তৎপরে তাঁহার সেই মস্তকশূন্য রুধিরাক্ত কলেবর ভূমিসাৎ হইল।

“হে মহারাজ! এইরূপে বিচিত্ৰকবচমণ্ডিত মহারথ শল্যানুজ নিহত হইলে কৌরবগণ পাণ্ডবভয়ে ভীত হইয়া জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক ধূলিধূসরিতকলেবরে হাহাকারপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর সাত্যকি সেই ভয়পলায়িত কৌরবগণের প্রতি অনবরত শর বর্ষণপূর্ব্বক ধাবমান হইলেন। মহাবীর কৃতবর্ম্মা তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া নির্ভীকচিত্তে সেই দুর্দ্ধর্ষ মহাধনুর্ধর যুযুধানকে আক্রমণ করিলেন। এইরূপে সেই মার্তণ্ডসদৃশ তেজঃপূজকলেবর সিংহবিক্রান্ত বীরদ্বয় পরস্পর মিলিত হইয়া নিৰ্মলপ্ৰভ শরনিকরে পরস্পরকে আচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের শরাসনচ্যুত শরনিকর নভোমণ্ডলস্থিত পক্ষিগণের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। অনন্তর মহাবীর কৃতবর্ম্মা দশবাণে সাত্যকিকে এবং তিনশরে তাঁহার অশ্বগণকে বিদ্ধ করিয়া এক নতপৰ্ব্ব শরে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাধনুর্দ্ধর সাত্যকি সেই ছিন্ন কামুক পরিত্যাগ ও অবিলম্বে অন্য এক সুদৃঢ় শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক দশবাণে কৃতবর্ম্মার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া ভল্লাস্ত্রে তাঁহার রথ, যুগ ও ঈষা ছেদন এবং অশ্বগণ ও পার্ষ্ণি সারথিদ্বয়কে বিনাশ করিলেন। ঐ সময় মহাবীর কৃপাচার্য্য কৃতবর্ম্মাকে রথবিহীন দেখিয়া সত্বর স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া তথা হইতে অপসৃত হইলেন।

“হে মহারাজ! দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণ মদ্ররাজের নিধনের পূৰ্ব্বেই নিতান্ত ভীত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহারা কৃতবর্ম্মাকে রথবিহীন দেখিয়া অধিকতর শঙ্কিত হইয়া পুনরায় পলায়ন করিতে লাগিল। ঐ সময় সমরাঙ্গন রজোরাশিতে সমাচ্ছন্ন হইলে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। আপনার সৈন্যগণের অধিকাংশই বিনষ্ট হইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই সমুত্থিত রজোরাশি শোণিতনিস্রাবে সিক্ত ও প্রশমিত হইল। তখন রাজা দুর্য্যোধন স্বীয় সৈন্যগণকে পরাঙ্মুখ এবং পাণ্ডবগণ, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে রথারোহণে বেগে সমাগত সন্দর্শন করিয়া একাকীই নিশিত শরনিকরে অরাতিগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মর্ত্তেরা [মর্ত্তলোকের প্রাণীরা] যেমন আসন্ন মৃত্যুকে নিবারণ করিতে পারে না, তদ্রূপ অরাতিগণ কোনক্রমেই দুর্য্যোধনকে নিবারণ করিতে সমর্থ হইলেন না। ঐ সময় মহাবীর কৃতবর্ম্মাও অন্য এক রথে আরোহণ করিয়া শত্রুগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহারথ রাজা যুধিষ্ঠির চারিবাণে কৃতবর্ম্মার অশ্বগণকে নিপাতিত করিয়া ছয় ভল্লে কৃপাচাৰ্য্যকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা কৃতবর্ম্মাকে যুধিষ্ঠিরের শরে অশ্ব ও রথবিহীন দেখি স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া যুধিষ্ঠিরের নিকট হইতে অপসৃত হইলেন। তখন মহাবীর কৃপাচাৰ্য্য যুধিষ্ঠিরকে ছয় ও তাঁহার অশ্বগণকে আটবাণে বিদ্ধ করিলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে আপনার ও আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধনের দুৰ্ম্মন্ত্রণায় অসংখ্য সৈন্য বিনষ্ট হইল। করুপুঙ্গব যুধিষ্ঠির শল্যকে নিহত করাতে পাণ্ডবগণ মহা আহ্লাদে একত্র সমবেত হইয়া, বৃত্রাসুরনিধনান্তে দেবগণ যেমন ইন্দ্রের প্রশংসা করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ধৰ্ম্মরাজকে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদান করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে শঙ্খ ও বিবিধ বাদি বাদনপূর্ব্বক বসুন্ধরা প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিলেন।”