১৩. শল্য-সমরে সমস্ত পাণ্ডবপরাজয়

১৩শ অধ্যায় – শল্যসমরে সমস্ত পাণ্ডবপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহাত্মা ধৰ্ম্মরাজ মদ্ররাজের শরজালে নিপীড়িত হইলে মহাবীর সাত্যকি, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব শল্যকে রথসমুদয়ে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাবীর মদ্ররাজ একাকী অসংখ্য মহারথের শরনিকরে নিপীড়িত হইলে চতুর্দ্দিকে মহান সাধুবাদ সমুচ্ছ্রিত হইল, সিদ্ধগণ আনন্দিত হইলেন ও মহর্ষিগণ মিলিত হইয়া বিস্ময়সূচক বাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন মহাবলপরাক্রান্ত শল্যকে প্রথমতঃ এক বাণে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সাত বাণে নিপীড়িত করিলেন। সাত্যকি ধৰ্ম্মরাজকে মুক্ত করিবার অভিলাষে শল্যকে সাত বাণে সমাচ্ছন্ন করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। নকুল মদ্ররাজকে পাঁচ শরে বিদ্ধ করিলেন এবং সহদেব তাহাকে সাত বাণে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় পাঁচ বাণে নিপীড়িত করিলেন।

“সমরনিপুণ মহাবীর মদ্ররাজ এইরূপে সেই মহারথগণকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইয়া ভারসহ ভীষণ শরাসন আকর্ষণ করিয়া পঞ্চবিংশতি শরে সাত্যকিকে, ত্রিসপ্ততি শরে ভীমসেনকে ও সাত বাণে নকুলকে বিদ্ধ করিয়া ভল্লদ্বারা ধনুর্দ্ধর সহদেবের সশরশরাসন ছেদনপূর্ব্বক ত্রিসপ্ততি শরে তাহাকে নিপীড়িত করিলেন। তখন মহাবীর সহদেব সত্বর অন্য শরাসন জ্যাযুক্ত করিয়া মহাতেজাঃ মদ্ররাজের উপর প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় ও ভীষণ ভুজঙ্গের ন্যায় পাঁচ বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক আনতপৰ্ব্ব এক বাণে তাঁহার সারথিকে ও তিন বাণে পুনরায় তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। ঐ সময় মহাবীর ভীমসেন সপ্ততি, সাত্যকি নয় ও ধৰ্ম্মরাজ ষষ্টি শরে শল্যের শরীর ভেদ করিলেন।

“এইরূপে মহাবীর মদ্ররাজ সেই মহারথগণকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইয়া গৈরিকধাতু ধারাস্রাবী অচলের ন্যায় শোণিতধারা ক্ষরণ করিতে লাগিলেন এবং পাঁচ-পাঁচ বাণে সেই মহাধনুর্দ্ধর বীরগণকে বিদ্ধ করিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। অনন্তর মহারথ শল্য অন্য এক ভল্লদ্বারা ধৰ্ম্মরাজের জ্যাসংযুক্ত শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহারথ যুধিষ্ঠির সত্বর অন্য শরাসনগ্রহণপূর্ব্বক শরনিকরে শল্যকে অশ্ব, সারথি, রথ ও ধ্বজের সহিত সমাচ্ছন্ন করিলেন। মহাবীর মদ্ররাজ যুধিষ্ঠিরের শরজালে সমাকীর্ণ হইয়া অবিলম্বে সুশাণিত দশবাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি একান্ত কোপাবিষ্ট হইয়া শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক মদ্ৰাধিপতিকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে মহাবীর শল্য ক্ষুরপ্রদ্বারা সত্বর সাত্যকির শরাসন ছেদন করিয়া ভীমসেনপ্রমুখ বীরগণকে তিন-তিন বাণে নিপীড়িত করিলেন। তখন সত্যবিক্রম সাত্যকি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার প্রতি এক সুবর্ণদণ্ড ভীষণ তোমর নিক্ষেপ করিলেন। ঐ সময় মহাবীর ভীমসেন এক প্রজ্বলিত পন্নগসদৃশ নারাচ, নকুল ভীষণ শক্তি, সহদেব গদা ও ধৰ্ম্মরাজ শতঘ্নী প্রয়োগ করিয়া মদ্ররাজকে সংহার করিতে সচেষ্ট হইলেন। মহাবীর মদ্ররাজ তদ্দর্শনে অবিলম্বে ভল্লসমূহদ্বারা সাত্যকির তোমর ও ভীমনিক্ষিপ্ত কনকভূষণ নারাচ ছেদন এবং শরনিকরে নকুলপরিত্যক্ত হেমদণ্ডভূষিত ভীষণ শক্তি ও সহদেবপ্রেরিত গদা নিবারণপক দুইবাণে যুধিষ্ঠিরের শতঘ্নী ছেদন করিয়া পাণ্ডবগণের সমক্ষে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। শত্রুনিসূদন সাত্যকি অরাতির জয়লাভ সহ্য করিতে না পারিয়া ক্রোধভরে অন্য শরাসনগ্রহণপূর্ব্বক দুইবাণে শল্যকে ও তিনয়বাণে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মদ্ররাজও অঙ্কুশতাড়িত মহাগজের ন্যায় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দশবাণে সেই সাত্যকিপ্রমুখ পাঁচ মহাবীরকে বিদ্ধ করিলেন। শত্রুসূদন মহারথগণ শল্যশরে নিবারিত হইয়া কোনক্রমেই সমরে অবস্থান করিতে সমর্থ হইলেন না। ঐ সময় রাজা দুর্য্যোধন শল্যের পরাক্রম অবলোকন করিয়া পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে নিহত বোধ করিলেন।

“অনন্তর মহাপ্রতাপশালী মহাবাহু ভীমসেন প্রাণপণে পুনরায় শুল্যের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবীর নকুল, সহদেব ও সাত্যকি ইঁহারাও মদ্ররাজকে পরিবেষ্টন করিয়া শরজালে সমাচ্ছন্ন করিলেন। প্রতাপান্বিত শল্য এইরূপে সেই চারি মহারথকর্ত্তৃক পরিবেষ্টিত হইয়া অনন্যমনে তাঁহাদের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ অবসরে ধৰ্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠির ক্ষুরপ্ৰদ্বারা তাঁহার চক্ররক্ষকের প্রাণ সংহার করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত শল্য স্বীয় চক্ররক্ষককে নিহত দেখিয়া ক্রোধভরে শরনিকরে যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সৈনিকদিগকে শল্যশরে পরিবৃত দেখিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘এক্ষণে কিরূপে বাসুদেবের ঐ মহাবাক্য সত্য হইবে, কিরূপে ক্রুদ্ধ মদ্ররাজের হস্ত হইতে আমার সৈন্যগণ পরিত্রাণ পাইবে।’

“হে মহারাজ! অনন্তর পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ অশ্ব, রথ ও নাগসমূহে পরিবৃত হইয়া চতুর্দ্দিক হইতে শল্যকে নিপীড়িত করিয়া তাঁহার সম্মুখীন হইলেন। তখন মহাবীর মদ্ররাজ পবন যেমন মহামেঘ ছিন্নভিন্ন করে, তদ্রূপ তাঁহাদের শস্ত্রজাল নিরাকৃত করিলেন। ঐ সময় আমরা আকাশপথে শলভশ্রেণীর ন্যায় ও বিহগাবলির ন্যায় শল্যনিক্ষিপ্ত শরজাল অবলোকন করিতে লাগিলাম। শল্যচাপমুক্ত সুবর্ণভূষণ শরনিকরে গগনমার্গ পরিব্যাপ্ত ও সমরভূমি তিমিরাবৃত হইলে কি পাণ্ডবপক্ষীয় কি কৌরবপক্ষীয়, কোন ব্যক্তিই আর আমাদের দৃষ্টিগোচর হইল না। দেব, দানব ও গন্ধৰ্ব্বগণ মদ্ররাজের শরজালে পাণ্ডবসৈন্যগণকে বিলোড়িত দেখিয়া নিতান্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন। এইরূপে মহাবীর শল্য শরনিকরে পাণ্ডবসৈন্যগণকে নিপীড়িত করিয়া ও ধৰ্ম্মরাজকে সায়কসমাচ্ছন্ন করিয়া বারংবার সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ শল্যের শরে সমাচ্ছন্ন হইয়া তাঁহার অভিমুখীন হইতে সমর্থ হইলেন না; কিন্তু ধর্মরাজের অগ্রবর্তী ভীমসেনপ্রমুখ মহাবীরগণ সমরনিপুণ মহাবলপরাক্রান্ত মদ্ররাজকে পরিত্যাগপূর্ব্বক স্থানান্তরে গমন করিলেন না।”