১২. ভীম-শল্যের গদাযুদ্ধ

১২শ অধ্যায় ভীমশল্যের গদাযুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর শল্য সারথির বিনাশ দর্শনে সত্বর লৌহময় গদা গ্রহণপূর্ব্বক অচলের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন তাঁহাকে প্রদীপ্ত কালাগ্নির ন্যায়, পাশধারী কৃতান্তের ন্যায়, সশৃঙ্গ কৈলাসপৰ্ব্বতের ন্যায়, বজ্ৰপাণি বাসবের ন্যায়, শূলহস্ত মহাদেবের ন্যায় এবং বনমধ্যস্থিত মত্তমাতঙ্গের ন্যায় অবস্থান করিতে অবলোকন করিয়া স্বীয় ভীষণ গদা। সমুদ্যত করিয়া মহাবেগে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। ঐ সময় চতুর্দ্দিকে বীরজনের হর্ষবর্ধন অসংখ্য শঙ্খনিস্বন, তুৰ্য্যধ্বনি ও সিংহনাদ আরম্ভ হইল। উভয়পক্ষীয় যোধগণ চতুর্দ্দিক হইতে সেই বীরদ্বয়ের বিক্রম দর্শন করিয়া তাঁহাদিগকে সাধুবাদ প্রদানপূর্ব্বক কহিতে লাগিল, ‘মহাবীর মদ্ৰাধিপতি শল্য ও যদুনন্দন বলরাম ভিন্ন আর কেহই বৃকোদরের বেগ ধারণ করিতে সমর্থ নহেন; আর মহাবীর বৃকোদর ব্যতীত অন্য কোন যোদ্ধাই মদ্ৰাধিপতির গদাবেগ নিবারণ করিতে পারেন না।’

“হে মহারাজ! অনন্তর সেই বীরদ্বয় গদাপাণি হইয়া বৃষভদ্বয়ের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া মণ্ডলাকারে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা উভয়েই তুল্যরূপে মণ্ডলাকার গতি প্রদর্শন ও গদাসঞ্চালন করিতে আরম্ভ করিলেন। মদ্ৰাধিপতির অগ্নিজ্বলাসদৃশ বিচিত্র সুবর্ণপট্ট-পরিবেষ্টিত গদা-দর্শনে সকেলরই মনে ভয়সঞ্চার হইল; মহাবীর ভীমসেনের গদাও জলদ-বিরাজিত চপলার ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। অনন্তর মদ্ররাজ ভীমসেনের গদার উপরে গদাঘাত করিলে ভীমের গদা হইতে অগ্নিকণা নির্গত হইল; ভীমের গদাঘাতেও শল্যের গদা হইতে অঙ্গারবৃষ্টি হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। তখন কুঞ্জরদ্বয় যেমন দন্তে দন্তে ও বৃষদ্বয় যেমন শৃঙ্গে শৃঙ্গে যুদ্ধ করে, তদ্রূপ সেই মহাবীরদ্বয় ভীষণ গদাদ্বয়দ্বারা পরস্পরকে প্রহার করি। ক্ষণকালমধ্যে রুধিরাক্তকলেবর হইয়া পুস্পিত কিংশুকদ্বয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। মহাবীর শল্য ভীমসেনের দক্ষিণ ও বামপার্শ্বে গদা প্রহার করিলে বৃকোদর কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না; মদ্ৰাধিপতিও ভীমসেনের গদাপ্রহারে বারংবার নিপীড়িত হইয়াও গজনিভিন্ন [হস্তিকর্ত্তৃক ভগ্ন] মহাগিরির ন্যায় কিছুমাত্র ক্লেশানুভব করিলেন না। ঐ সময় চতুর্দ্দিকে বজ্রনিস্বনের ন্যায় অতি ভীষণ গদানিপাতশব্দ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। অনন্তর সেই মহাবলপরাক্রান্ত অমানুষকৰ্মা [লোকশক্তির অতীত] বীরদ্বয় ক্ষণকাল যুদ্ধে নিবৃত্ত হইয়া পুনরায় গদা উদ্যত করিয়া মণ্ডলাকারে পরিভ্রমণ আরম্ভ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে উভয়ে পরস্পরের বধসাধনার্থ অষ্টপদমাত্র অগ্রসর ও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া মণ্ডলাকারে বিচরণপূর্ব্বক স্ব স্ব শিক্ষানৈপুণ্য প্রদর্শন করিতে লাগিলেন; ভূমিকম্পকালে অচলদ্বয় যেমন শৃঙ্গদ্বারা পরস্পরকে আঘাত করে, তদ্রূপ সেই ঘোরতর গদাদ্বারা পরস্পরকে আঘাত করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর তাহারা পরস্পরের গদাপ্রহারে উভয়েই ক্ষতবিক্ষত ও মর্মপীড়িত হইয়া এককালে ইন্দ্ৰধ্বজদ্বয়ের ন্যায় ভূতলে নিপতিত ও বিমোহিত হইলেন। তদ্দর্শনে উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণই হাহাকার করিতে লাগিল। তখন মহাবলপরাক্রান্ত কৃপাচার্য্য মদ্ৰাধিপতিকে স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া সমরাঙ্গন হইতে অপসৃত হইলেন। ঐ সময় মহাবীর ভীমসেন মত্তের ন্যায় নিমিষমধ্যে পুনরায় উত্থিত হইয়া গদা গ্রহণপূর্ব্বক মদ্ৰাধিপতিকে আহ্বান করিতে লাগিলেন।

সঙ্কুলযুদ্ধে দুর্য্যোধনহস্তে চেকিতান নিহত

“অনন্তর আপনার পক্ষীয় বীরগণ বিবিধ শস্ত্র উদ্যত ও নানা প্রকার বাদ্য বাদিত করিয়া পাণ্ডবসৈন্যগণের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। দুর্য্যোধন প্রভৃতি বীরগণ ভুজদণ্ড ও অস্ত্রশস্ত্র সমুচ্ছ্রিত করিয়া তুমুল কোলাহল সহকারে পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। পাণ্ডবেরাও বিপক্ষগণকে নিরীক্ষণ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক তাহাদিগের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। তখন আপনার আত্মজ দুর্য্যোধন পাণ্ডবসৈন্যগণকে আগমন করিতে দেখিয়া প্রাসদ্বারা চেকিতানের হৃদয়দেশ বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর চেকিতান দুর্য্যোধননিক্ষিপ্ত প্রাসের আঘাতে একান্ত তাড়িত ও রুধিরে অভিষিক্ত হইয়া প্রাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক রথমধ্যে নিপতিত হইলেন। পাণ্ডবগণ চেকিতানকে নিহত নিরীণ করিয়া অনবরত শরনিকর। পরিত্যাগপূর্ব্বক সৰ্ব্বসমক্ষে কৌরবসৈন্য গণমধ্যে নির্ভয়ে বিচরণ করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাবীর কৃপ, কৃতবর্ম্মা ও মহাবলপরাক্রান্ত সুবলনন্দন শকুনি, ইহারা মদ্ররাজ শল্যকে পুরোবর্তী করিয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। রাজা দুর্য্যোধন ভুজবীৰ্য্যসম্পন্ন দ্রোণনিহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। তিনসহস্র রথী রাজা দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে অশ্বত্থামাকে অগ্রবর্তী করিয়া বিজয়লাভাভিলাষে প্রাণপণে ধনঞ্জয়ের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। এইরূপে উভয়পক্ষে পরস্পর বধাভিলাষে বীরগণের প্রতিবর্ধন ভীষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। ঐ সময় বায়ুসহযোগে ধূলিপটল উড্ডীন হইয়া সমরাঙ্গন সমাচ্ছাদিত করিল। তৎকালে আমরা বীরগণের নাম শ্রবণ করিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে, যোদ্ধারা নির্ভয়ে যুদ্ধ করিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই ধূলিজাল রুধিরপ্রবাহে প্রশমিত হওয়াতে দিঙ্মণ্ডল সুনিৰ্ম্মল হইল।

“এইরূপে সেই ভীরুজনভয়াবহ ঘোর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে উভয়পক্ষের কোন বীরই সমপরাঙ্মুখ হইলেন না। তাঁহারা স্ব স্ব প্রভুর ঋণ-পরিশোধ, জয়লাভও স্বর্গলাভে কৃতনিশ্চয় হইয়া তুমুল যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহারথগণ স্পর্ধাসহকারে বিবিধ শস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক পরস্পরকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎকালে উভয় পক্ষীয় বলমধ্যেই বিনাশ কর, বিদ্ধ কর, আক্রমণ কর, প্রহার কর ও ছেদন কর, কেবল এই সকল বাক্য শ্রবণগোচর হইতে লাগিল।

শল্যযুধিষ্ঠির যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরপরাজয়

“ঐ সময় মহাবীর শল্য ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের বিনাশবাসনায় তাঁহাকে নিশিতশরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহারাজ ধৰ্ম্মরাজ শল্যের শরাঘাতে ক্রুদ্ধ হইয়া অবলীলাক্রমে তাঁহার মর্মস্থলে চতুর্দশ নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাযশস্বী মদ্ৰাধিপতি যুধিষ্ঠিরের বিনাশবাসনায় ক্রোধভরে তাঁহার উপর কঙ্কপত্রভূষিত অসংখ্য শর নিক্ষেপপূর্ব্বক সমস্ত সৈন্যসমক্ষে পুনরায় তাঁহার বক্ষঃস্থলে এক আনতপৰ্ব্ব শর প্রহার করিলেন। মহাযশস্বী ধৰ্ম্মরাজ শল্যের শরাঘাতে মহা ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে কঙ্কপত্রভূষিত শরনিকরে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার সারথিকে নয় এবং চক্ররক্ষক চন্দ্রসেনকে সপ্ততি ও দ্রুমসেনকে চতুঃষষ্টিশরে বিনাশ করিলেন। এইরূপে চক্ররক্ষকদ্বয় নিহত হইলে মদ্ৰাধিপতি শল্য ক্রোধভরে চেদিদেশীয় পঞ্চবিংশতি বীরকে বিনাশপূর্ব্বক সাত্যকিকে পঞ্চবিংশতি, ভীমসেনকে সাত এবং যমজ নকুল ও সহদেবকে একশত শরে বিদ্ধ করিয়া সমরাঙ্গনে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর যুধিষ্ঠির আশীবিষসদৃশ শরনিকর পরিত্যাগপূর্ব্বক এক ভল্লে মদ্ৰাধিপতির গিরিশৃঙ্গসদৃশ ধ্বজদণ্ড ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মদ্ৰাধিপতি শল্য ধ্বজযষ্ঠি নিপতিত ও জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবকে সম্মুখে অবস্থিত অবলোকন করিয়া ক্রোধভরে বারিধারাবর্ষী পর্জ্জন্যের ন্যায় ক্ষত্রিয়গণের উপর শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং সাত্যকি, ভীমসেন, নকুল ও সহদেবকে পাঁচ-পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে শরনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মদ্ৰাধিপতির জলদজালসদৃশ শরজালে ধর্মরাজের বক্ষঃস্থল সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। পরিশেষে মহাবীর শল্য একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সন্নতপৰ্ব্ব শরনিকরে এককালে যুধিষ্ঠিরের দশদিক সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। ধৰ্ম্মরাজ শল্যনির্মুক্ত শরজালে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া পুরন্দর বিদলিত জম্ভাসুরের ন্যায় হতপরাক্রম হইলেন।”