০৯. সঙ্কুলযুদ্ধে উভয়পক্ষের বহু লোকক্ষয়

ম অধ্যায় – সঙ্কুলযুদ্ধে উভয়পক্ষের বহু লোকক্ষয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে উভয়পক্ষে দেবাসুরসংগ্রামতুল্য ভয়ানক যুদ্ধ উপস্থিত হইলে সহস্র সহস্র পরাক্রান্ত হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতি পরস্পর মিলিত হইতে লাগিল। ধাবমান ভীষণাকার মাতঙ্গগণের বৃংহিতধ্বনি বর্ষাকালীন জলপটলের গভীর গর্জনের ন্যায় শ্রুতিগোচর হইল। কোন কোন রথী ধাবমান মদোন্মত্ত কুঞ্জরগণের আঘাতে রথের সহিত ভূতলে নিপতিত হইয়া বেগে পলায়ন করিতে লাগিলেন। অশ্বসকল ও পাদরক্ষকগণ সুশিক্ষিত রথীগণের শরাঘাতে পরলোকে প্রস্থান করিল। সুশিক্ষিত অশ্বারোহিগণ মহারথগণকে পরিবেষ্টন করিয়া প্রাস, শক্তি ও ঋষ্টির আঘাত করিয়া ভ্রমণ করিতে লাগিল। ধনুর্ধারী বীরসকল সমবেত হইয়া মহারথগণকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক এক এক জনকে শমনভবনে প্রেরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। মহারথগণ ধাবমান মাতঙ্গকে পরিবেষ্টন করিয়া বিনাশ করিতে লাগিলেন। কুঞ্জরগণও ক্রোধাবিষ্ট অসংখ্য শরবষী রথীবরকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক বিনাশ করিতে লাগিল। গজারোহী গজারোহীকে ও রথী রথীকে আক্রমণপূর্ব্বক শক্তি, তোমর ও নারাচদ্বারা নিহত করিতে আরম্ভ করিল। হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয় পদাতিগণকে বিমর্দিত করাতে সমরস্থল অতি সমাকুল হইয়া উঠিল। চামরবিরাজিত অশ্বগণ হিমালয়প্রস্থস্থিত হংসসমুদয়ের ন্যায় ধাবমান হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, উহারা বসুন্ধরা গ্রাস করিতে উদ্যত হইয়াছে। বসুমতী সেইসকল অশ্বগণের পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হইয়া নখচিহ্নাঙ্কিত কামিনীর ন্যায় শোভা ধারণ করিল এবং নির্ঘাত শব্দের ন্যায় অশ্বগণের খুরশব্দ, রথনেমির ঘর্ঘরনির্ঘোষ, পদাতিগণের কোলাহল, গজগণের বৃংহিতধ্বনি, শঙ্খের নিস্বন ও বাদিত্র-সমুদয়ের বিবিধ শব্দে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ঐ সময় শরাসনের ভীষণ টঙ্কার এবং দেদীপ্যমান খড়্গ ও কবচের প্রভায় আর কিছুই বিদিত হইল না। করিশুণ্ডাকার ছিন্নবাহুসকল মহাবেগে কখন উদ্বেষ্টন [উর্ধ্ব আবরণ] ও কখন বিচেষ্টন করিতে লাগিল। পরিপক্ক তালফল পতিত হইলে যেরূপ শব্দ হয়, বীরগণের মস্তকপতনেও সেইরূপ শব্দ হইতে আরম্ভ হইল। উদ্ধৃত্তনেত্র মস্তকসকল চতুর্দ্দিকে নিপতিত থাকাতে সমরভূমি বিকসিত পুণ্ডরীকসমূহে সমাচ্ছন্ন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। কেয়ূরসমলঙ্কৃত চন্দনচর্চিত বাহুসকল শক্ৰধ্বজের ন্যায় বসুধাতলে শোভমান হইল। সমরাঙ্গন নরেন্দ্রগণের করিশুণ্ডোপম নিকৃত্ত উরুদণ্ডসমুদয়ে আকীর্ণ হইয়া গেল এবং শত শত কবন্ধে সঙ্কীর্ণ ও রাশি রাশি ছত্রচামরে সঙ্কুল হইয়া কুসুমসমূহ-সুশোভিত কাননের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। যোধগণ শোণিতলিপ্ত-কলেবরে ও নির্ভয়ে বিচরণ করিয়া পুস্পিত কিংশুকবৃক্ষের ন্যায় নিরীক্ষিত হইতে লাগিলেন। মাতঙ্গগণ শর-তোমর-নিপীড়িত হইয়া বায়ুসঞ্চালিত জলদজালের ন্যায় ছিন্নভিন্ন ও বেগে প্রধাবিত এবং প্রলয়ালীন কুলিশবিদলিত [বজ্রবিদীর্ণ] অচলের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। সাদিগণের সহিত নিপতিত অশ্বগণের পৰ্ব্বতাকার স্তূপসকল ইতস্ততঃ দৃষ্ট হইতে লাগিল। ঐ সময় শূরগণের হর্ষজনন ও ভীরুজনের ভয়বর্ধন শোণিততরঙ্গিণী সমরাঙ্গনে প্রবাহিত হইল। রুধির উহার সলিল; রথসমুদয় আবর্ত; ধ্বজপতাকাসকল বৃক্ষ ও অস্থিনিচয় কর্কর; বাহুসমূহ নক্র [কুম্ভীর]; শরাসনসকল স্রোত; হস্তিসমুদয় শৈল; অশ্বসকল উপল; মেদ ও মজ্জা কৰ্ম্ম; ছত্রসমুদয় হংস; গদাসমূহ ভেলা ও চক্ৰসমুদয় চক্ৰবাকের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। উহা কবচ, উষ্ণীষ, ত্রিবেণু ও দণ্ডদ্বারা সমাকীর্ণ হইল। পরিঘাকার ভুজদণ্ডসম্পন্ন বীরগণ বাহনরূপ নৌকাদ্বারা সেই যমলোকাভিমুখে প্রবহমান ভয়ঙ্কর শোণিতনদী উত্তীর্ণ হইতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে সেই চতুরঙ্গ-বলক্ষয়কর দেবাসুর সংগ্রামসদৃশ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ প্রবর্তিত হইলে কোন কোন বীর ভয়ে বান্ধবগণকে আহ্বান করাতে বান্ধবেরা তাঁহাদিগকে ভয়ার্ত দেখিয়া চীৎকার করিয়া নিবৃত্ত করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় ও ভীমসেন স্বীয় বলবীর্য্যে বিপক্ষগণকে বিমোহিত করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন যোষিদগণ যেমন মদভরে জ্ঞানশূন্য হয়, তদ্রূপ সেই কৌরবপক্ষীয় সেনাগণ অৰ্জ্জুন ও ভীমসেনকর্ত্তৃক নিহন্যমান হইয়া হতজ্ঞান হইতে লাগিল।

“এইরূপে মহাবীর বৃকোদর ও অর্জ্জুন বিপক্ষ-সৈন্যগণকে বিমোহিত করিয়া শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডী সেই সিংহনাদ শ্রবণ করিবামাত্র ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সমভিব্যাহারে লইয়া মদ্ৰাধিপতি শল্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! বীরগণ শল্যের সম্মুখে সমাগত ও বিভক্ত হইয়া যেরূপ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন, তদ্দর্শনে আমরা সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইলাম। অনন্তর শিক্ষিতাস্ত্র যুদ্ধদুৰ্ম্মদ মাদ্রীতনয় নকুল ও সহদেব জিগীষাপরবশ হইয়া সত্বর আপনার সৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। সৈন্যগণ পাণ্ডবগণের শরপ্রহারে ছিন্নভিন্ন ও যুদ্ধে নিবৃত্ত হইয়া আপনার পুত্রগণের সমক্ষেই পলায়ন করিতে লাগিল। তদ্দর্শনে যোদ্ধারা সকলে হাহাকার শব্দ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। পাণ্ডবেরাও মুক্তকণ্ঠে ‘রণস্থলে অবস্থান কর’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। জয়াভিলাষী ক্ষত্রিয়গণ বারংবার কৌরবসৈন্যগণকে স্থির করিতে চেষ্টা পাইলেন; কিন্তু তাহারা তাঁহাদের সমক্ষেই সমরে পরাঙ্মুখ হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। অনেক যোদ্ধা প্রিয়তম পুত্র, ভ্রাতা, মাতুল, পিতামহ, ভাগিনেয়, সম্বন্ধী ও অন্যান্য বান্ধবগণকে পরিত্যাগ করিয়া আত্মরক্ষার নিমিত্ত অশ্ব ও হস্তীদিগকে দ্রুতবেগে সঞ্চালন করিয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন।”