০৫. সন্ধিকার্য্যে দুর্য্যোধনের সযৌক্তিক অনিচ্ছা

পঞ্চম অধ্যায় – সন্ধিকার্য্যে দুৰ্য্যোধনের সযৌক্তিক অনিচ্ছা

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাত্মা কৃপাচার্য্য এইরূপ কহিলে রাজা দুর্য্যোধন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া ক্ষণকাল তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূৰ্ব্বক চিন্তা করিয়া কহিলেন, ‘আচার্য্য আপনি অমিতপরাক্রম পাণ্ডবগণের সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়াছেন এবং এক্ষণেও বন্ধুজনোচিত বাক্য প্রয়োগ করিলেন। আপনি যেসকল কথা কহিলেন, সে সমস্তই হেতুগর্ভ, উৎকৃষ্ট ও হিতকর; কিন্তু মুমূর্ষু ব্যক্তির যেমন ঔষধে অভিরুচি হয় না, তদ্রূপ আপনার ঐ সকল বাক্যে আমার অভিরুচি হইতেছে না। দেখুন, যে মহাবল নরপতিকে আমি রাজ্য হইতে নিরাকৃত করিয়াছি, যে ব্যক্তি আমার নিকট দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হইয়াছে, সে কিরূপে আমাদিগের বাক্যে বিশ্বাস করিবে; আর মহামতি বাসুদেব তৎকালে পাণ্ডবগণের হিতসাধনে তৎপর হইয়া তাহাদিগের দৌত্যকাৰ্য্য [দূতের কাৰ্য্য] স্বীকার করিয়াছিলেন, তৎকালে আমরা তাঁহাকে প্রতারণা করিয়া নিতান্ত অবিবেচকের কাৰ্য্য করিয়াছি। এক্ষণে তিনি কিরূপে আমাদিগের বাক্য গ্রাহ্য করিবেন? বিশেষতঃ সভাস্থলে দ্রৌপদীর রোদন এবং পাণ্ডবদিগের রাজ্যহরণ তাঁহার নিতান্ত অসহ্য হইয়াছে। হে ব্রহ্মণ! পূৰ্ব্বে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন অভিন্নাত্মা এবং পরস্পর নিতান্ত অনুরক্ত, ইহা শ্রবণ করিয়াছিলাম, আজ তাহা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিলাম। মহাত্মা বাসুদেব অভিমন্যুর বিনাশবার্তা শ্রবণাবধি নিতান্ত দুঃখে কালযাপন করিতেছেন। আমরা তাহার নিকট অপরাধী হইয়াছি। তিনি কিরূপে আমাদিগকে ক্ষমা প্রদর্শন করিবেন? মহাবীর অর্জ্জুনও অভিমন্যুর বিনাশে নিতান্ত অসুখী হইয়া আছে, প্রার্থনা করিলে কিরূপে যে আমাদিগের হিতসাধনে যত্নবান হইবে? মহাবলপরাক্রান্ত মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন অতি উগ্ৰস্বভাব, বিশেষতঃ সে ঘোরতর প্রতিজ্ঞা করিয়াছে; এক্ষণে বরং স্বয়ং বিনষ্ট হইবে, তথাপি প্রতিজ্ঞা লঙ্নপূৰ্ব্বক শান্তিলাভ করিবে না। সন্নদ্ধ- কবচ[ধর্মধারী], বদ্ধপরিকর কালান্তক যমোপম, যমজ নকুল ও সহদেব এবং মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডী আমাদিগের সহিত বৈরাচরণ করিয়াছে, তাহারা কিরূপে আমাদিগের হিতসাধনে যত্ন করিবে? দুঃশাসন সভামধ্যে সৰ্ব্বলোকসমক্ষে একবস্ত্রা রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে বিবস্ত্রা করিয়া ক্লেশ প্রদান করিয়াছিল, পাণ্ডবগণ অদ্যাপি তাহা বিস্মৃত হয় নাই। অতএব আপনি কখনই তাহাদিগকে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইবেন না। দ্রৌপদী আমাদের নিকট অপমানিত হইয়া অবধি আমাদিগের বিনাশ ও ভর্তৃগণের অর্থসিদ্ধির নিমিত্ত নিত্য স্থণ্ডিলে [ভূতলস্থ তৃণাদি শয্যায] শয়ন করিয়া অতি কঠোর তপশ্চরণ করিতেছে। কৃষ্ণসহোদরা সুভদ্রা স্বীয় মানমর্যাদায় জলাঞ্জলি প্রদানপূৰ্ব্বক দাসীর ন্যায় নিয়ত তাহার শুশ্রূষায় নিযুক্ত রহিয়াছে। হে প্রভো! এইরূপে দ্রৌপদীর অপমান ও অভিমন্যুর বিনাশনিবন্ধন পাণ্ডবপক্ষীয় সকলেরই রোষানল প্রজ্বলিত হইয়া রহিয়াছে, কখনই নিৰ্ব্বাণ হইবে না; সুতরাং সন্ধিস্থাপন কখনই সুসাধ্য নহে। আর দেখুন, আমি এই সাগরাম্বরা ধরিত্রী উপভোগ করিয়া এক্ষণে কিরূপে পাণ্ডবগণের অনুগ্রহে রাজ্যভোগ করিব? পূৰ্ব্বে আমি দিবাকরের ন্যায় সমস্তু নরপালগণের উপর তেজ প্ৰকাশ করিয়াছি, এক্ষণে কিরূপে দাসের ন্যায় যুধিষ্ঠিরের অনুগমন করিব এবং কিরূপেই বা চিরকাল বিবিধ সুখভোগে কালযাপন ও বিপুল ধন দান করিয়া এক্ষণে দীনজনের সহিত দীনভাবে অবস্থান করিব?

‘হে আচাৰ্য্য! এক্ষণে আপনি স্নেহপ্রযুক্ত যাহা কহিলেন, আমি সেই হিতকর বাক্যে অসূ্য়া প্রদর্শন করিতেছি না, কিন্তু পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন করা এক্ষণে সমুচিত নহে, যুদ্ধ করাই শ্রেয়স্কর বোধ হইতেছে। দেখুন, আমি বহুবিধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান, ব্রাহ্মণগণকে প্রভূত দক্ষিণা দান, বেদাধ্যয়ন ও বিপক্ষগণের মস্তকে অবস্থান করিয়াছি। আমার সমুদয় অভিলষিত দ্রব্যই লাভ হইয়াছে। আমার ভৃত্যবর্গেরা উত্তমরূপে প্রতিপালিত হইতেছে। আমি দুঃখিত ব্যক্তিদিগের দুঃখ দূর, পররাষ্ট্র-পরাজয়, স্বরাজ্য-প্ৰতিপালন, বিবিধ ভোগ্যদ্রব্য উপভোগ এবং ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামের সেবা করিয়াছি। ক্ষত্রিয়ধর্ম ও পিতৃগণের ঋণজাল হইতে আমার মুক্তিলাভ হইয়াছে। অতএব পাণ্ডবগণের নিকট সন্ধি প্রার্থনা করা আমার কদাপি বিধেয় নহে। হে ব্রহ্মণ! এই পৃথিবীতে কিছুতেই সুখ নাই। এই ধরাতলে কেবল কীৰ্ত্তিস্থাপন করাই লোকের কর্ত্তব্য; কিন্তু উহা যুদ্ধ ব্যতিরেকে আর কিছুতেই হইবার সম্ভাবনা নাই। ক্ষত্রিয়দিগের গৃহে মৃত্যু নিতান্ত নিন্দনীয় ও অধৰ্ম্ম। যে ক্ষত্রিয় বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক অরণ্যে বা সংগ্রামে কলেবর পরিত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই মহিমা লাভ করিয়া থাকেন। আর যে ক্ষত্রিয় জরাজীর্ণ হইয়া রোদনপরায়ণ জ্ঞাতিগণমধ্যে দীনভাবে বিলাপ ও পরিতাপপূৰ্ব্বক মানবলীলা সংবরণ করেন, তিনি কদাপি পুরুষমধ্যে পরিগণিত হইতে পারেন না। অতএব আমি এক্ষণে বিবিধ বিষয়োপভোগ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক যুদ্ধদ্বারা দেবলোক লাভ করিতে অভিলাষ করিয়াছি। সমরে অপরাঙ্মুখ, সত্যসন্ধ, যজ্ঞানুষ্ঠায়ী, শস্ত্রাবভৃতপূত আৰ্য্যবৃত্ত বীরপুরুষগণের স্বর্গে গতিলাভ হইয়া থাকে। অপ্সরাগণ যুদ্ধকালে পরম কুতুহল সহকারে তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণ করে। পিতৃগণ সংগ্রামনিহিত বীরবর্গকে সুরসমাজে পূজিত ও অঙ্গরাদিগের সহিত আমোদ-প্রমোদে অবস্থিত অবলোকন করিয়া থাকেন। এক্ষণে সমরে অপরাঙ্মুখ, নিহত পিতামহ ভীষ্ম, আচাৰ্য্য দ্রোণ, মহাবীর জয়দ্ৰথ, কর্ণ ও দুঃশাসন প্রভৃতি বীরগণের ও দেবগণের উৎকৃষ্টগতি লাভ করিতে আমার একান্ত বাসনা হইছে। হে আচাৰ্য্য উত্তমাস্ত্রবেত্তা অবনীপালগণ আমার নিমিত্ত যুদ্ধে সমুদ্যত, শরনিকরে ক্ষত-বিক্ষত ও নিহত হইয়া শোণিতলিপ্ত কলেবরে সমর-শয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। ঐ সমুদয় মহাবীর ইন্দ্রসভায় গমন করিয়া দেবলোকে গমনের পথ প্ৰস্তুত করিয়া দিয়াছেন। সদগতিলাভার্থী মহাবেগে গমনোদ্যত বীরবর্গে পুনৰ্ব্বার উহা নিতান্ত দুর্গম হইয়া উঠিবে। এক্ষণে যে সকল বীরেরা আমার নিমিত্ত নিহত হইয়াছেন, তাঁহাদিগকে কৃতজ্ঞতাপ্রদর্শন ও তাঁহাদের ঋণজাল হইতে মুক্তিলাভ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে; রাজ্যে কিছুতেই মনোনিবেশ হইতেছে না। যদি এক্ষণে আমি বয়স্য ও ভ্রাতৃগণ এবং পিতামহকে মৃত্যুমুখে নিপাতিত করিয়া আপনার জীবন রক্ষা করি, তাহা হইলে লোকে নিশ্চয়ই আমার নিন্দা করিবে। হে আচাৰ্য্য! এক্ষণে আমি বন্ধুবান্ধববিহীন হইয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রণিপাতপূৰ্ব্বক রাজয়লাভ করিলে উহা কিরূপে আমার প্রীতিকর হইবে? দেখুন, আমা হইতে সমুদয় জগতের পরাভব হইয়াছে, অতএব এক্ষণে ধৰ্ম্মানুসারে সমরকাৰ্য্য সমাধানপূর্ব্বক স্বর্গলাভ করাই আমার শ্রেয়ঃ বোধ হইতেছে রাজয়লাভ কোনক্রমেই অভিরুচি হইতেছে না।

“হে মহারাজ অম্বিকানন্দন! কুরুরাজ দুর্য্যোধন এই কথা কহিলে ক্ষত্রিয়গণ ‘সাধু সাধু’ বলিয়া বারংবার তাঁহার প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তৎকালে পরাজয়ের নিমিত্ত তাঁহাদিগের মনোমধ্যে কিছুমাত্র অনুতাপ উপস্থিত হইল না; প্রত্যুত তাঁহারা বিক্রমপ্রকাশে স্থিরনিশ্চয় হইয়া যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইলেন। অনন্তর কৌরবগণ অশ্বগণের শ্ৰমাপনোদন করিয়া সংগ্রামস্থলের ঈষদুন [কিছু কম] দ্বিযোজন অন্তরে অবস্থান করিতে লাগিলেন এবং হিমাচলের প্রস্থদেশে অরুণবর্ণ স্রোতস্বতী সরস্বতী সন্দর্শন করিয়া উহার জলে অবগাহন ও উহার জল পান করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে ক্ষত্রিয়গণ রাজা দুৰ্য্যোধনের বাক্যে উত্তেজিত ও কালপ্রেরিত হইয়া তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন।”