০১. পরাজিত দুৰ্য্যোধনানুষ্ঠেয় বিষয়ে প্রশ্নোত্তর

১ম অধ্যায় – পরাজিত দুৰ্য্যোধনানুষ্ঠেয় বিষয়ে প্রশ্নোত্তর

নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।

জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! এইরূপে মহাবীর সূতপুত্র ধনঞ্জয়ের হস্তে নিহত হইলে অল্পমাত্রাবশিষ্ট কৌরবগণ কি করিলেন? আর মহারাজ দুৰ্য্যোধনই বা পাণ্ডবগণের প্রভাবে আপনার প্রভূত সৈন্য বিনষ্ট নিরীক্ষণ করিয়া কি কার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন? হে ব্রহ্মণ! এই সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে আমার একান্ত কৌতূহল উপস্থিত হইয়াছে, অতএব আপনি ইহা কীৰ্ত্তন করুন। পূৰ্ব্বপুরুষগণের বিচিত্র চরিত্র শ্রবণ করিয়া আমার কিছুতেই তৃপ্তিলাভ হইতেছে না।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন মহারথ সূতপুত্রের নিধনদর্শনে শোকসাগরে একান্ত নিমগ্ন ও নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ‘হা কর্ণ! হা কর্ণ!’ বলিয়া বারংবার বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া হতাবশিষ্ট ভূপালগণের সহিত অতিকষ্টে স্বশিবিরে প্রবেশ করিলেন। তথায় ভূমিপতিগণ শাস্ত্রবিহিত যুক্তি অনুসারে কুরুরাজকে নিরন্তর আশ্বাসিত করিতে লাগিলেন; কিন্তু তিনি কর্ণের নিধনচিন্তা করিয়া কিছুতেই সুখলাভ করিতে সমর্থ হইলেন না। পরিশেষে তিনি দৈব ও ভবিতব্যকেই বলবান বিবেচনাপূৰ্ব্বক সংগ্রামে কৃতনিশ্চয় হইয়া মহাবীর শল্যকে সেনাপতিপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া হতাবশিষ্ট ভূপালগণের সহিত অবিলম্বে যুদ্ধার্থে গমন করিলেন। তখন কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যগণের সুরাসুর-সংগ্রামসদৃশ ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। ঐ যুদ্ধে মহাবীর শল্য ভয়ঙ্কর সমরকাৰ্য্য সমাধান ও অসংখ্য শত্রুসৈন্য ক্ষয় করিয়া পরিশেষে হতসৈন্য হইয়া মধ্যাহ্নকালে ধৰ্ম্মরাজের হস্তে নিহত হইলেন। তখন রাজা দুৰ্য্যোধন বন্ধু বান্ধবের নিধন-দর্শনে শত্রুভয়ে নিতান্ত ভীত ও সমরাঙ্গন হইতে অপসৃত হইয়া এক ভয়ঙ্কর হ্রদমধ্যে প্রবেশ করিলেন। মহাবীর বৃকোদর ঐ বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া ঐ দিন অপরাহ্নসময়ে মহারথগণের সহিত সমবেত হইয়া দুৰ্য্যোধনকে আহ্বানপূৰ্ব্বক হ্রদ হইতে উত্থাপিত ও বলপ্রকাশপূৰ্ব্বক নিপাতিত করিলেন। অনন্তর হতাবশিষ্ট কৌরবপক্ষীয় তিনজন মহারথ ঐ দিন রজনীযোগে রোষভরে পাঞ্চালসৈন্যগণকে নিপাতিত করিলেন। পরদিন পূৰ্ব্বাহ্নে মহামতি সঞ্জয় শিবির হইতে আগমন করিয়া শোকাকুলিতচিত্তে দুঃখিতমনে পুরমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তিনি পুরপ্রবেশপূৰ্ব্বক বাহুযুগল উদ্যত করিয়া দীনভাবে কম্পিত কলেবরে ধৃতরাষ্ট্রের আবাসে প্রবেশ করিয়া ‘হা মহারাজ! হা মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধনের নিধনে আমরা সকলেই বিনষ্ট হইলাম, বলবান কালের কি বিষম গতি! হায়! আমাদের পক্ষীয় বীরগণ দেবরাজতুল্য মহাবলপরাক্রান্ত হইয়াও পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হইলেন’ এই বলিয়া অনবরত রোদন করিতে লাগিলেন। তৎকালে সেই পুরমধ্যে আবালবৃদ্ধ সকল লোকেই সঞ্জয়কে ক্লেশে নিতান্ত অভিভূত নিরীক্ষণ করিয়া উদ্বিগ্নমনে হা মহারাজ! হা মহারাজ! বলিয়া মুক্তকণ্ঠে ক্রন্দন ও আর্তনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। মহারাজ দুৰ্য্যোধন নিহত হইয়াছে শ্রবণ করিয়া তত্রত্য যাবতীয় স্ত্রীপুরুষ শোকে একান্ত নিপীড়িত, নষ্টচিত্ত ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া ধাবমান হইতে আরম্ভ করিল।

ধৃতরাষ্ট্রসমীপে সঞ্জয়ের সমর-সংবাদ

হে মহারাজ! অনন্তর সঞ্জয় শোকে নিতান্ত বিহুল হইয়া প্রজ্ঞাচক্ষু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে প্রবেশপূৰ্ব্বক তাহাকে গান্ধারী, বিদুর এবং অন্যান্য সুহৃদ্বর্গ, হিতানুষ্ঠাননিরত জ্ঞাতিসমুদয় ও পুত্রবধূগণকর্ত্তৃক পরিবৃত এবং কর্ণের বধানুধ্যানে [মৃত্যুচিন্তায়] নিতান্ত বিষণ্ণ নিরীক্ষণ করিলেন। তখন তিনি বাষ্পকুললোচনে অনতিহৃষ্টমনে গদবচনে বৃদ্ধ ভূপতিকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমি সঞ্জয়, আপনাকে নমস্কার করিতেছি। মদ্ররাজ শল্য, সুবলনন্দন শকুনি, উল্ক ও কৈতব্য, ইঁহারা সমরাঙ্গনে শয়ন করিয়াছেন। সংশপ্তক, শক, কাম্বোজ, ম্লেচ্ছ, পাৰ্ব্বতীয় যবন, প্রাচ্য, দাক্ষিণাত্য, উদীচ্য ও প্রতীচ্যগণ নিহত হইয়াছে। সমুদয় রাজা ও রাজপুত্রগণ শমনসদনে আতিথ্য স্বীকার করিয়াছেন। মহাবীর ভীমসেন স্বীয় প্রতিজ্ঞানুসারে রাজা দুৰ্য্যোধনের বধসাধন করিয়াছেন। কুরুরাজ এক্ষণে ভগ্নোরু [ভগ্ন-উরু] ও শোণিতরাগরঞ্জিত [শোণিতে লোহিত বর্ণময় দেহ] হইয়া ধূলিশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। পাণ্ডবপক্ষীয় মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ও নিতান্ত দুর্জয় শিখণ্ডী, উত্তমৌজা ও যুধামন্যু এবং প্রভদ্রক, পাঞ্চাল ও চেদিগণ নিহত হইয়াছেন। আপনার পুত্রেরা, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র ও কর্ণাত্মজ বৃষসেন শমনসদনে গমন করিয়াছেন, উভয়পক্ষীয় প্রায় সমুদয় বীর এবং যাবতীয় হস্তী, রথী ও অশ্বসকল সমরে নিহত ও নিপতিত হইয়াছে। এক্ষণে আপনাদিগের শিবিরমধ্যে অতি অল্পমাত্র বীর অবশিষ্ট আছে। হে মহারাজ! কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়াতে সমস্ত জগৎ কালবশে বিমোহিত হইয়া প্রায় স্ত্রীলোকমাত্রাবশিষ্ট হইল। এক্ষণে আপনাদের উভয়পক্ষীয় অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনার মধ্যে পাণ্ডবপক্ষে পঞ্চপাণ্ডব, বাসুদেব ও সাত্যকি–এই সাতজন এবং কৌরবপক্ষে কৃপ, কৃতবর্ম্মা ও অশ্বত্থামা–এই তিনজন মাত্র অবশিষ্ট আছেন। অন্যান্য সকলেই কালকবলে নিপতিত হইয়াছেন। হে মহারাজ! কাল দুৰ্য্যোধনকে উপলক্ষ্য করিয়া সমরানল প্রজ্বলিত করিয়া এই সমুদয় জগৎ বিনষ্ট করিলেন।”

পুনরনারীসহ ধৃতরাষ্ট্রগান্ধারীর বিলাপ

হে মহারাজ জনমেজয়! রাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয় মুখে এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র বিচেতন হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। যশস্বী বিদুর এবং রাজমহিষী গান্ধারী ও অন্যান্য কৌরব-মহিলাগণ সেই কঠোর বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন সমগ্র রাজমণ্ডল চিত্রাপিতের ন্যায় সংজ্ঞাশূন্য হইয়া ধরাশয্যা গ্রহণ করিলেন এবং সকলেই ‘হা হতোহস্মি!’ বলিয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। অনন্তর পুত্ৰবিনাশদুঃথে নিতান্ত দুঃখিত মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অতিকষ্টে সংজ্ঞা লাভ করিয়া দীনমনে কম্পিতকলেবরে চতুর্দ্দিক অবলোকনপূৰ্ব্বক বিদুরকে কহিলেন, ‘হে বিদুর! আমি পুত্রহীন ও অনাথ। এক্ষণে তুমিই আমার একমাত্র আশ্রয়।’ এই বলিয়া ধৃতরাষ্ট্র পুনরায় জ্ঞানশূন্য হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণ তাঁহাকে তদবস্থাপন্ন অবলোকন করিয়া সুশীতল সলিল-সেচন ও তালবৃন্ত-সঞ্চালনদ্বারা তাঁহার শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। অনন্তর রাজা ধৃতরাষ্ট্র বহুবিলম্বে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূৰ্ব্বক কুম্ভমধ্যে নিক্ষিপ্ত ভুজঙ্গের ন্যায় ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন। সঞ্জয় এবং যশস্বিনী গান্ধারী ও অন্যান্য নারীগণ মহীপালকে পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর নিরীক্ষণ করিয়া রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন।

অনন্তর রাজা ধৃতরাষ্ট্র মুহুর্মুহুঃ মোহে অভিভূত হইয়া বিন্দুরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে বিদুর! আমার অন্তঃকরণ অতিশয় চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে, অতএব এক্ষণে গান্ধারী ও অন্যান্য রমণী এবং বন্ধু বান্ধবগণ এ স্থান হইতে প্রস্থান করুন।” তথন মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর ও রাজার আদেশানুসারে সেই সকল মহিলাদিগকে গমনে আদেশ করিলেন। কামিনীগণ এবং বন্ধুবান্ধবসমুদয় মহীপালকে পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর নিরীক্ষণ করিয়া কম্পিতকলেবরে তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। অনন্তর সঞ্জয় দীননয়নে লন্ধসংজ্ঞ নৃপতিকে শোকাবেগে অনর্গল অশ্রুজল বিসর্জন ও ঘন ঘন নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে দেখি কৃতাঞ্জলিপুটে মধুরবাক্যে আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন।