১৫. বিশ্বমঞ্চে মনোরঞ্জন

২০১১ সোমবার ১৯ নভেম্বর এই সময় পত্রিকার পাঁচের পাতায় প্রকাশিত হয় কৌশিক সরকারের প্রতিবেদন কলমে জীবনের জলছবি এঁকে ‘বিশ্বমঞ্চে মনোরঞ্জন’, বুধবার সন্ধ্যায় আমাকে ডাকলেন বড় সাহেব। ওনার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায় ঋজু বসুর প্রতিবেদন মহীরুহ নয়, লড়াকু বটের চারাই তার প্রেরণা প্রকাশিত হবার পরে। সে প্রায় ছয় বছর আগে। তারপর এক দীর্ঘ নীরবতা। দেখেছেন আমাকে অনেকবার। কথা বলেননি–। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমিও-কী বলব আর না বলব ভেবে চুপ করে থেকেছি। আজ এত বছর বাদে ডেকে পাঠানোতে একটু অবাক হই।

আজকাল উনি প্রায় দিনই মুক বধির বিদ্যালয়ে আসেন। যখন মন্ত্রী ছিলেন সময় পেতেন না। এখন মন্ত্রিত্ব নেই। সময় কাটে না। এখানে এসে কিছুক্ষণ হাঁটেন কিছুক্ষণ বসেন কোনো কোনদিন তাসও খেলেন। এইভাবে পার করেন দুঃসহ সময়। আর কাল গোনেন সুসময়ের। আহা কত সুখের ছিল তিনটি দশক। চারদিক থেকে ঘিরে থাকত চাটুকার জনগণ। কৃপাভিক্ষু প্রমোটার ঠিকেদার, স্তাবক আমলা অফিসার। সে সবদিন আর নেই। বড় একা হয়ে গেছেন, ফাঁকা হয়ে গেছেন।

ডাক পেয়ে ওনার নিজস্বকক্ষে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি মৃদু হাসলেন আমাকে দেখে বুক শিরশির করে উঠল আমার। এই হাসি তত সাধারণ হাসি নয়, এতে রাজনীতি আছে কূটনীতি আছে। এই হাসি আমার অচেনা নয়।

বলেন তিনি–তোর কথা পেপারে পড়ছি।

এ আর নতুন কথা কী! লক্ষ লোকে পড়েছে। উনি তো ___ বৰ্তমানও না পড়ে পার পায়নি। এই সংবাদ শুনে আমি অতটা আশ্চর্য হই না। হই তার পরের বাক্যে। “আমরা এবার তোকে একটা সম্মান জানাবো।”

সেই বহু বছর আগে একবার ঠিক যেভাবে দুম করে আগুপিছু না ভেবে বলে বসেছিলাম তার মুখের সামনে নিজের বিরুদ্ধে বক্তব্য, আজও তাই হয়ে গেল। সামলাতে পারলাম না নিজেকে। বুকের ভিতর থেকে উঠে এল বিয়ারের বোতলের মতো ছিপি খোলা উগ্র উম্মা–“আপনাদের সম্মান চাই না।”

উনি কী চমকে উঠলেন এই অবমানিত ‘না’ এর বিদ্যুৎ ঝটকায়, চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল তার। উনি সম্মান দেবেন, তার জন্য যার ধন্য হয়ে পায়ে লুটিয়ে পড়ার কথা সেই তৃণদপি তুচ্ছ জেহাদ ঘোষণা করছে! নেবনা। খুব সংযত শব্দে সীমিত বাক্যে ছোট্ট একটা মানবিক বোমা ছুঁড়ে দিই আমি যদি পারেন যে অপমান অত্যাচারের আগুনে নিত্য দহন হচ্ছি সেটা একটু সহনশীলতার মধ্যে নামিয়ে আনুন আর কাজের চাপটা একটু কমিয়ে দিন। উত্তরে উনি কী বলবেন শোনার জন্য অপেক্ষা করি না। কথাটা শেষ করে দোর ঠেলে বাইরে বের হয়ে আসি। বুকটা বড় হালকা লাগে আমার, বড় নির্ভার গ্রহণে যে আনন্দ আছে সেটা জানতাম, বর্জনে যে এত আনন্দ সেটা এই প্রথম জানলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন, এই কিছুদিন আগে গাদা গাদা বুদ্ধিজীবী বর্জন করেছেন গাদা গাদা পদক পদ পুরস্কার সম্মাননা। কী সেই আনন্দ আমি আজ বুঝতে পারলাম। এখন নিজেকে মনে হল আলেকজান্ডারের মতো সম্রাট। যিনি পরাজিত পুরুকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তার রাজ্য–অনেক আছে আমার, যা, তোরটা আর নেব না।

আগে আমি যাকে বড় সাহেবের ডানহাত বলে উল্লেখ করেছি সেই হাত এসে আমার সামনে দাঁড়াল–কাজটা ঠিক করলেন না।

কোন্ কাজটা?

বড় সাহেবের মুখের উপর না বলা। উনি এতে অপমানিত হয়েছেন।

উনি তাই বললেন?

বলে কখনও। মুখ দেখে বোঝেননি?

পনেরো বছর দুবেলা চিতার সামনে বসে থাকি, বোঝার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছে আমার।

বুঝলাম ডান হাতও অপমান বোধ করছে, মনে কষ্ট পাচ্ছে। রাত তখন সাড়ে আটটা। বাচ্চাদের খেতে দিতে হবে। আমার কোনো সহকারি নেই। যে একজন ছিল সে তিন চার মাস অসুস্থ। আসছে না আর। শুনলাম নাকি কুষ্ঠ হয়েছে। এই রোগে সবেতন ছুটির নিয়ম আছে। এখন আমি একেবারে একা আমাকে খেতে দিতে হবে প্রায় দেড়শো খাদককে। যদি খাদ্য না পায়, যদি কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি হয়–সবাই মিলে আমাকে খাবে। এই দুঃসময়ে লোকের মান অপমান নিয়ে ভেবে মরার সময় কোথায়!

পরের দিন দুপুরে কাজের শেষে বাড়ি গেছি, একটা ফোন এল আমার মোবাইলে–ওপারে একটি বিশিষ্ট গলা–আমি কি মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সাথে কথা বলছি? তুমি কি আমাকে চেনো? আমি শৈলেনদা, শৈলেন চৌধুরি। আমি তোমার স্কুলে বসে আছি। তুমি কি একটু আসতে পারবে? একটু কথা বলতাম। আসবে ভাই?

চৌধুরিবাবুকে চিনি। কথা বলিনি কোনোদিন। বলার মতো কোনো ব্যাপার ঘটেনি। উনি প্রতিবন্ধী সংগঠনের মস্ত নেতা। দুধ সাদা গাড়ি চেপে যাওয়া আসা করেন। চোখে দেখেন না তবে বড় চাকরি পেয়েছেন। দুজন লোক ওনার পরিচারক, সদা সঙ্গী, যখন আসেন বড় সাহেবের ঘরে বসে বড় বড় লোকদের সাথে বড় বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। স্কুলের যারা ছোট ছোট লোক ওনার সম্বন্ধে কেউই খুব একটা বড় ধারণা পোষণ করে না। তাই আমি কাছে ঘেঁষিনি, দূরত্ব বজায় রেখেছি। আজ উনি ডাকছেন, দুরত্ব ঘোচাতে চাইছেন, কী যে করি?

বলি–আমার তো এক্ষুনি এক জায়গায় যেতে হবে।

কাতর গলা ওনার–বেশি সময় নেব না। মাত্র পাঁচ মিনিট। একটু দেখা করেই চলে যেও।

অগত্যা যেতে হল। উনি সেই বড় সাহেবের ঘরে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগে বড় সাহেবও ছিলেন। মিটিং শেষ করে তিনি চলে গেছেন। রয়ে গেছেন ইনি, অন্ধ চোখে আমাকে দেখবেন বলে। যারা চক্ষুম্মান পনেরো বছর ধরে দিনে দশবারো ঘণ্টা আমাকে দেখে–তারাই দেখল না, আর উনি তো দৃষ্টিহীন। তবে এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন সেই সব ক্ষমতার দম্ভে একদল অন্ধের। যে অন্ধরা অতি কষ্টে দেখে একটা টিউবয়েল, পাম্প করলে জল পড়ে, উচ্চতা আড়াই ফুট। অন্ধত্বের জন্য বুঝতে পারে না এর কতটা প্রোথিত আছে মাটির কত গভীরে, কোন্ নদী, কোন্ সমুদ্র জোগাচ্ছে জলের প্রস্রবন।

বলেন তিনি–শুনলাম তুমি আমাদের স্কুলে রান্না করো লেখো টেখো। আমরা তোমাকে এবার একটা সংবর্ধনা দেব।

বলি–ও সব দিতে হবে না। পারলে একটু কাজের চাপ কমিয়ে দেন, যেন একটু লেখার মতো সময় পাই। সেটা করলেই আমি কৃতার্থ হবো।

বলেন উনি–৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। ওই ব্যাপারটা মিটে যাক তারপর তোমার জন্য কী করা যায় ভেবে দেখব। বড় সাহেবও বলেছেন যাতে তুমি লেখার সময় পাও সেটা উনি দেখবেন।

বলি–আজ থেকে ছয় বছর আগে তারা চ্যানেলের প্রোগ্রাম তারার নজর এর ক্যামেরার সামনে উনি বলেছিলেন আমি যাতে লেখার সময় পাই ব্যবস্থা করে দেবেন। ছয় বছর কেটে গেছে–আজও কিছু করেননি। তখন উনি মন্ত্রী ছিলেন ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। তখন করেননি, এখন আর কী করে করবেন। তাই ওনার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। যদি সত্যিই কিছু করতে চান, হাতে দশদিন সময় আছে এর মধ্যে কিছু করে দেখান। তা না হলে আমি আপনাদের দেওয়া কোনো সম্মান নেব না।

ওনাকে বড় সাহেব দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমাকে রাজি করাবার জন্য। বড় সাহেবের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। আমাকে মঞ্চে তুলে পাশে নিয়ে বসবেন। পত্র পত্রিকার সাংবাদিক টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে গলায় দরদ ফুটিয়ে বলবেন–এই ছেলেটা আমার কাছে এল। বলল, আমি লিখি। দেখলাম লেখার হাতটা খুব ভালো। আমিও তো খুব গরিব ঘর থেকে এসেছি, কাজেই এটা আমার কাছে একটা সফট কর্ণার। তাই একে সাহায্য করলাম। বললাম কিছু করতে হবে না, শুধু লিখে যাও। লেখার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেব। যা দরকার চাইবে। আজ ও একটা জায়গায় পৌঁছেছে। সারা দেশে ওর নাম খ্যাতি হয়েছে। এর জন্য আমি আনন্দিত। এই রকম কথাই উনি বলেছিলেন ছয় বছর আগে, টিভি ক্যামেরার সামনে। আবার এখন বলবেন। মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল, তাই আবার মনে করিয়ে দেবেন যে উনি এক রাস্তার মানুষকে তুলে নিয়ে লেখক বানিয়ে দিয়েছেন।

আমার কথায় শৈলেনবাবু মনে বড় কষ্ট পেলেন। চলে গেলেন তিনি সেই কষ্ট নিয়ে। আগেকার দিন হলে এইসব লোকের মনে কষ্ট দিতে আমি কেন, আচ্ছা আচ্ছা লোক সাহস পেত না। এখন আমি মরিয়া। কী করতে পারে ওঁরা? যেভাবে মুড়ির টিন ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মুড়ি ঢোকায় সেইভাবে কোথায় কোন ফাঁক ফোকর আছে গুঁজে দিয়েছে একটা বাড়তি কাজ। আর কাজের চাপ বাড়িয়ে দেবার সুযোগ নেই। পারবে শুধু কোন্ ছুতো বানিয়ে আমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে। সে তো আমি এমনিতেই আর করতে পারবো না। নিজে থেকেই ছেড়ে পালাতে হবে। সেই যে পিন্টু সেন মেরেছিল, তখন বয়স কম ছিল, মালুম পাইনি, এখন যত বয়স বাড়ছে দুটো হাঁটুতে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। জখম পায়ের উপর আর আট দশ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেই যখন চলে যেতেই হবে বাবুদের তুষ্ট করে কী হবে!

এ্যাপোলো ক্লিনিকের ডাক্তার প্রসেনজিৎ বড়াল আমার হাঁটু পরীক্ষা করে ওষুধ দিয়েছেন ইনজেকশন দিয়েছেন আর দিয়েছেন বিধান–২০ মিনিটের বেশি একটানা দাঁড়ানো বা হাঁটা চলবে না, সাইকেল চালাবেন না। নিয়ম না মানলে যত ওষুধ ইনজেকশান নিন, হাঁটুর ব্যথা সারবে না।

তাই সারছে না। সাইকেল না চালিয়ে না হেঁটে বাড়ি থেকে চারবার–তিন/চারে–বারো মাইল পথ পার হয়ে কর্মস্থলে আসা যাওয়া করব কি ভাবে? অন্য কোনো বাহন যে ওই পথে চলে না। আর দাঁড়িয়ে না থাকলে রান্না করব কি করে? যে কড়াইয়ে একবারে কুড়ি কিলো চাল ফোটে তরকারি রান্না হয়, বসে বসে তাতে রান্না করা অসম্ভব। এর উপর ওই সব ভারি গামলা সেও বহন করে রান্নার জায়গা থেকে খাবার জায়গায় নিয়ে যাবার ব্যাপার আছে। পরিবেশন, সেও বসে বসে করা যাবে না। সবটা মিলিয়ে আট দশ ঘণ্টা দুটো পায়ের উপর না দাঁড়িয়ে থেকে রেহাই নেই।

আর তাই রেহাই নেই পায়ের। সে দিনে দিনে কাহিল হয়ে যাচ্ছে। চলছে একেবারে অন্তিম অবস্থা। আর মেরে কেটে পেন কিলার চার্জ করে ছয় মাস। বড় জোর এক বছর। তারপর বসে যেতে হবে। বিল্টুদায় নিতে হবে কর্মভূমি থেকে। তাহা হইলেই সপ্তদশ রথীর মনোস্কামনা সিদ্ধ হয়।

আমি কবি নই তাই বলতে পারব না, যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো। আমি এক রাঁধুনি। হাজার পাতা লেখার পরেও লেখক হয়ে উঠতে পারিনি। আমার জন্য আছে পল্লী কবির দু-কলি গান–গুরু ভজলি নারে মন, বুঝলি নারে বাঁচাবে কে যখন এসে দাঁড়াবে শমন।

শৈলেনবাবু চলে যাবার পর প্রতিবন্ধী সংগঠনের জনে জনে তিন চারদিন ধরে ক্রমান্বয়ে আমাকে বুঝিয়ে চলল, তারা যে উদ্দেশ্যে যে কাজটা করতে চাইছে সেটা সফল করতে আমার সামান্য উপস্থিতি কতটা সঠিক। যা না করা, বলা চলে–একটা নিমক হারামির মতো ব্যাপার।

দীর্ঘ তিন দশক ধরে প্রবল এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ক্রোধ আর জেদ সম্বল করে অনলস প্রয়াসে আমি আজ যেখানে এসে পৌঁছেছি সে স্থানটা বড় আদরের অহঙ্কারের। এটা একা আমার নয়–গোটা নমঃশূদ্র জাতির গর্ব অহঙ্কার। আমি আজ আমার সমাজের সম্পদ, তাদের আদর আর ভালোবাসার ধন।

মার্কসবাদ পড়ে জেনেছি ঐক্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে, থাকে দ্বন্দ্বের মধ্যে ঐক্য। যেমনভাবে সর্বহারা মানুষদের ছোট ছোট প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, আছে বৃহত্তর স্বার্থে ব্যাপক জনগণের ঐক্য। একে অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই।

সেই রকম বৃহত্তম ভারতীয় দলিত সমাজ-সংগঠনেও ছোট ছোট দ্বন্দ্ব বা গর্ব-হীনমন্যতা রয়ে গেছে, যাকে গভীর নিরীক্ষণে ধরতে পারা যায়। অস্বীকার করা যায় গাজোয়ারি যুক্তি দিয়ে।

আমরা বলে থাকি বাঙালি জাতি আজ যা ভাবে কাল তা ভাবে সারা ভারতবর্ষ। আজ যা করে কাল করে সারা দেশ। এই কথা বুক বাজিয়ে বলতে গিয়ে বাঙালি দলিত সমাজ দেখে–যে, মহারাষ্ট্রে একজন আম্বেদকর আছে, উত্তর প্রদেশে কাশীরাম মায়াবতী আছে, আমাদের তেমন কেউ নেই। তারা যা বলছে, যে পথে আজ চলেছে, আমরা আশা করছি কাল বা পরশু সেই পথে হেঁটেই সারা ভারতে শূদ্ররাজ আসবে। তাহলে আমরা যা আজ বলি কাল তা সারা দেশ বলবে সে কথায় সত্য কোথায় থাকছে। এইখানে কিছু কিঞ্চিত পরিমাণে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে হেরে রয়েছে দলিত বাঙালির আত্ম-অভিমান। আক্রান্ত হচ্ছে হীনমন্যতার দ্বারা।

রাজনীতি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সাহিত্য প্রসঙ্গে আসা যাক। এখানে বাংলা সাহিত্য থেকে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কন্নড়, হিন্দি, তামিল, তেলেগু দলিত সাহিত্য অনেক এগিয়ে রয়েছে। বাংলা ভাষায় যে দলিত সাহিত্য বলে কিছু আছে, অন্য প্রদেশতো দূরের কথা বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও সেটা জানত না। বহু সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর লেখায় রয়ে গেছে তার বহু সাক্ষ্য।

বাংলায় দলিত সাহিত্য আছে এই বক্তব্য প্রমাণ সহ জনৈক মনোরঞ্জন ব্যাপারী ইকনমিক এ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকার মাধ্যমে ভারতবর্ষ শুধু নয় বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। আজ আর কারও ক্ষমতা নেই একে অস্বীকার করে। ঢোক গিলে বলতে হচ্ছে–আছে, ছিল, তবে আমরা জানতাম না।

এটা হল বৃহৎ ব্যাপার। তবে এটা নিয়ে একটা ক্ষুদ্র দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে বাংলা এবং মহারাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে। বাংলার দলিত সমাজ বলছে–মানছি তোমরা দলিত সাহিত্যে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে, কিন্তু আমাদের মনোরঞ্জনের লেখা ইপিড-তে ছাপা হয়েছে। পেরেছো তোমরা এমন মর্যাদাবান কাগজে লেখা ছাপাতে? আমরা পেরেছি।

ওরা জবাব দিয়েছে আছে। আমাদের বামার লেখা তোমাদের চেয়ে আগে ইপিডব্লু ছেপেছিল।

বাংলা জবাব দেয়–বামা ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। সে সামাজিক দিক থেকে দলিত হলেও আর্থিক দিক থেকে কোনো অর্থে দলিত নয়। সর্বার্থে দলিত আমাদের মনোরঞ্জন। কোন ইসকুলে যায়নি, রিকশা চালায়, আর মনোরঞ্জনের লেখা অক্সফোর্ড প্রেসেও ছাপে।

ভারতবর্ষ ঘুরে এই বিতর্ক চলে এসেছে বাংলার দলিত সমাজের বুদ্ধিজীবী মহলে–। এখানে দলিত সমাজের নেতৃত্বে কোন গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের হাতে থাকবে সে নিয়ে নিচু গলায় চলে একটা আন্তর্বিরোধ। চেষ্টা চলে সম্প্রদায়ের সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অন্যে কে কী বলে সে কথা থাক। তবে নমঃশূদ্র সমাজ যে কারণে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে তা হল–অন্যান্য দলিত সমাজের চাইতে তাদের মধ্যে শিক্ষিত-স্বচ্ছল সরকারি চাকুরিজীবীর সংখ্যা অনেক বেশী। তাদের জাতের লোক একদিন নীল বিদ্রোহ করে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকদের শাসনভিত্তির মূল। হিমালয়ের উচ্চতা কত যে মেপে প্রথম বের করেছিল সে এক নমঃশূদ্র। তাদের রয়েছে হরিচাঁদ গুরুষ্টাদের মতো ধর্মগুরু–সমাজ সংস্কারক। রয়েছে যোগেন মণ্ডলের মতো জননেতা, কুমুদ মল্লিকের মতো ব্যারিস্টার, উপেন বিশ্বাসের মতো সিবিআই অফিসার, অচিন্ত্য বিশ্বাসের মতো অধ্যাপক, অনিল সরকারের মতো কবি, অনিলরঞ্জন বিশ্বাসের মতো মনীষী, গৌতম হালদারের মতো অভিনেতা। মোটকথা সমাজের সবকটি শ্রেষ্ঠ আসনের কোনো না কোনো আসন দখল করে স্বমহিমায় বিরাজমান কোনো না কোনো নমঃশূদ্র। কবি বিনয় মজুমদার, কবিয়াল বিজয় সরকার, বিপ্লবী হেমন্ত ব্যাপারী, ডাক্তার হৃষীকেশ মজুমদার, সুনীল ঠাকুর নমঃশূদ্র সমাজের রত্ন।

শুধু একটি ক্ষেত্রে এতকাল পিছিয়ে ছিল এই সমাজ। তাদের কোনো লেখক ছিল না, যে উচ্চবর্ণ সমাজের সঙ্গে সমানে টক্কর দেবে। যে দু-একজন আছে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে না পেরে গুটিয়ে আছে রিকেট রোগী সদৃশ্য দু-একটি দলিত পত্রিকার পাতায়। বাধ্য হয়ে নমঃশূদ্র সমাজ–মালো সম্প্রদায়ের লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণকে আমাদের লোক বলে চালাচ্ছিল এতকাল ধরে। সেই শূন্যতা কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে দিয়ে। যার লেখা ছাপা হয় উচ্চবর্ণদের কাগজে। যে লেখে নিম্নবর্ণ মানুষের জীবন নিয়ে। এবং সে জাতিতে খাঁটি নমোশূদ্র।

দলিত সমাজের এক নেতা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস মৌলালি যুবকেন্দ্রে এক অনুষ্ঠান হলভর্তি দলিত মানুষের সামনে ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বইখানাকে পড়তে উপদেশ দিয়েছেন রবীন্দ্র সাহিত্যেরও আগে। জামশেদপুরের চিত্র পরিচালক বিদ্যার্থী চ্যাটার্জী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন–দলিত জীবন তার সংগ্রাম সম্যক জানতে বুঝতে হলে একটা সিনেমা–জয় ভীম কমরেড দেখা দরকার, পড়া দরকার ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। আর দলিত দরদী অনন্ত আচার্য–সে তো বিভিন্ন দলিত শ্রমিক সংগঠনে বইখানাকে নিয়ে গিয়ে নমাজের শেষে মুসলমান মৌলবী যেভাবে কোরান পাঠ করে নিরক্ষর মানুষকে শোনায়–সে পাঁচ দশ পাতা পড়ে শোনায়–আলোচনা করে।

আজকাল সিপিএম সচেষ্ট হয়েছে দলিত, নমঃশুদ্র, মতুয়াদের তৃণমূল শিবির থেকে টেনে নিজেদের দিকে নিয়ে আসার, যারা বহুকাল দলন-দমন সয়ে সিপিএমের সাথেই ছিল। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে গত ২০১১ সালে। সেই সিপিএমের কমরেডদের কাছে আজ আর অজানা থাকার কথা নয়, নমঃশূদ্রদের কাছে মনোরঞ্জন কতটা প্রিয়, কতটা আপন। একে নিজেদের গোয়ালে ঢোকাতে পারলে–কিছুটা ড্যামেজ কন্ট্রোল তো হয়ই। সেই চাতুরির অঙ্গ এই সম্মান প্রদর্শন। একে মঞ্চে বসিয়ে আমাদের লোক’বলে চালিয়ে দিতে পারলে অনেকটা কাজ সারা হয়ে যায়। যদিআর কিছু নাও হয় বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায় একে এর আপন জনের কাছ থেকে।

উত্তর চব্বিশ পরগণার বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে আমাকে আদর করে নিয়ে গেছে–আমার আপনজনেরা। সেখানে কী বলেছি কী করেছি সূত্র মারফৎ জেনে গেছে যাদের জানার। একদিন তো শিয়ালদহে আমাকে সচেক্ষ দেখে ফেলে সদলবলে এক সিপিএম রাজ্য কমিটির নেতা। তাই এখন এই সব চাতুরি।

এইরকম অবস্থায় যখন হাড়িকাঠে গলা না দেবার পণ করে বসে আছি একটা চিঠি এল আমার নামে। পাঠিয়েছে বড় সাহেবের সই করা সেই চিঠি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী। অনেক কথার মধ্যে লেখা আছে–৩রা ডিসেম্বর ২০১২ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে আপনার সাহিত্য কর্মের জন্য সংবর্ধনা জ্ঞাপন করতে চাই। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ মাননীয় সোমনাথ চ্যাটার্জী মহাশয়। আপনি এই আমন্ত্রণ স্বীকার করে আমাদের গৌরবান্বিত করুন। এখন আমি কী যে করি! রাজার অনুরোধও আদেশ হয়ে যায়। রাজাদেশ না মানার কী ফল সে জানে ভুক্তভোগী। যদি মুখের কথায় ব্যাপারটা মিটে যেত, সমস্যা ছিল না। এখন চিঠি চাপাটি চলছে। যাবো অথবা যাব না জবাব দিতে হবে লিখে। যদি ৩ তারিখ না যাই পরের দিনই সামনা সামনি হতে হবে রাজক্রোধের। ভেবেছিলাম আরও ছয় মাস কী এক বছর টিকে যাব, এক মাস কী ছয় সপ্তাহও টিকতে দেবে না। ওরা অনেক–আমি একেবারে একা। কী করে পারব?

অবশেষে বলি বড় সাহেবের ডান হাতকে–ঠিক আছে আমি যাব। তবে যদি দেখি আমাকে মঞ্চে বসিয়ে গাদা গাদা অসত্য তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে আমি কিন্তু সাথে সাথে ওখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করব। যা সত্য সেটাই প্রকাশ করে দেব। তারপর যা হয় হবে।

বলে সে–আপনি এখানে রান্না করেন সেটা তো বলা যাবে নাকি?

বলা যাবে। তবে এই নয় যে রান্না করতে করতে লেখক হয়েছে। আমরা সব রকম সাহায্য করেছি। সেটা যদি বলে আমি বলব–ভুল। আমি একাশি সাল থেকেই লিখি। ২০.১১.৮১-তে যুগান্তর পত্রিকা আমাকে লেখক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্কুলে কাজে আসি ৯৭ সালে। তার আগেই আমার একটা লেখা প্রতিক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যেটা পরে ইংরাজিতে অনুবাদ হয়ে ফ্রন্টিয়ারে আর হিন্দিতে অনুবাদ হয়ে রাজকমল প্রকাশনার বই ‘সংঘর্ষ আউর নির্মাণ’-এ ছাপা হয়। কাজেই রান্না করে লেখক হয়েছি সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যেটা সবাই প্রচার চালায়। সত্যি এটাই যে, এই ইসকুল এক লেখককে দিয়ে বাসন মাজাচ্ছে, রান্না করাচ্ছে।

মনের মধ্যে জমে থাকা বহুদিনের বিষ একদমে ঝেড়ে দিয়ে থেকে দেখি ‘ডান হাতে’র মুখে আষাঢ়ের মেঘ জমে গেছে। তখন মনটা যেন অনেকটা নির্ভার হয়ে গেল।

কিছু লিখে দিইনি, মুখে বলেছি যাব। তাই গেলাম রাণী রাসমণি রোডে। এক জাউল্যার মাইয়ার’ নামাঙ্কিত রাজপথের অনুষ্ঠানে। আশা ছিল–হয়তো আমাকে মঞ্চে তুলবে না। না তুললে বেঁচে যাই। আমি গিয়ে মঞ্চের পিছনে যেন আত্মগোপন করে বসে রইলাম। কান রইল মাইকের শব্দের দিকে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সেই লোক যে বাহাত্তর সালে বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে এখন এক নেতা। মঞ্চে বসে আছেন সোমনাথ চ্যাটার্জী সহ আরও অনেকে, আমাদের বড় সাহেব তো আছেনই।

বহু সময় পরে আমার ডাক এল। মঞ্চে ওঠার সাথে সাথে আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল এক গোছা ফুল, একখানা মানপত্র আর একটা খাম। খামে একটা চেক। বলা হল–মনোরঞ্জন ব্যাপারী এক দলিত সাহিত্যিক যে আমাদের এক স্কুলে বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ‘একটু সহযোগ’ দিয়ে থাকেন। দাঁড়ালাম ততক্ষণ যতক্ষণ মানপত্রটা পড়া হল। তারপর ওরা নামার পথ দেখিয়ে দিলে আমি নেমে এসেছিলাম। কিছু বলার মতো সুযোগ দিল না, কিছু বললে শোনার মতো লোকও সেখানে ছিল না। অর্ধেক বোবা বধিক অর্ধেক নিজের কষ্টে কাতর অন্ধ পঙ্গু বিকলাঙ্গ। তবে সুযোগ করে মাননীয় সোমনাথ চ্যাটার্জীর হাতে পাঁচখানা পেপার কার্টিং ধরিয়ে দিতে পেরেছিলাম। এই যে আমি। তাতেও কোন ফলপ্রসব করেনি।

কি লেখা আছে সেই মানপত্রে এখানে তুলে দেবার ইচ্ছা দমন করা যাচ্ছে না। তাই তুলে দিলাম–

বিশিষ্ট দলিত সাহিত্য কর্মী মনোরঞ্জন ব্যাপারী মহাশয়ের প্রতি

সুধি,

ঝলমলে চটকদার বিশ্বায়নের শৌখিন পৃথিবীতে এক বিচিত্র জীবনের দুর্লভ আখ্যান নিয়ে সচল ও বহতা আপনার জীবন। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক অভিমানের। তথাপি আমাদের জ্ঞান নারী অভিজ্ঞতা হেমন্তের হলুদ ফসল–এসবই আপনার সৃজনশীল চেতনায় ক্রমশ অন্বিষ্ট। প্রকৃত প্রস্তাবে মেধাবী সৌন্দর্যের একজন কঠিন মানুষ আপনি, যে মানব-জমিনে আকীর্ণ রয়েছে অপরাজেয় মানবশক্তির উষ্ণ অভিজ্ঞান।

শ্রেণি শোষণ ও বর্ণবাদের তিক্ত লেনদেন নিয়ে গড়ে ওঠা অতলস্পর্শী সংস্কার ও অনড় সমাজের আঘাতে বিক্ষত হলেও সৃজনে মগ্ন ছিল আপনার কলম। পূর্ববঙ্গ, ছত্তিশগড়, মুকুন্দপুর হয়ে আজকের সারস্বত সমাজ; ক্ষয়া ইটের প্রতিটি সিঁড়ি আপনাকে পেরোতে হয়েছে থমথমে দুঃ। খের মতো সন্ধ্যা বুকে নিয়ে। তবু ফসলের স্বর্ণ-শস্য হাতে নিয়ে সমৃদ্ধ ও সম্পন্ন করেছেন আমাদের সাহিত্য চেতনাকে।

‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন’–সেইখানে প্রতিবন্ধকতার সেই প্রান্তিকতায় আপনারও অবস্থান ছিল। নিম্নবর্গীয় লোকায়ত জীবনের ব্যাথার্ত সত্য বুকে নিয়ে আপনি যেন আমাদের পরম আত্মীয়। মাল্টিপল চয়েসের এই প্রগলভ সমাজে আপনার সঙ্গে তাই ভাগ করে নিতে চাই আমাদের দুঃখ-বেদনা। আমাদেরই সংগঠনের উদ্যোগে গড়ে ওঠা, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন বিদ্যালয়-এর ছাত্রাবাস কর্মী হিসাবে আপনার পেশাগত জীবন; আর সাহিত্যাঙ্গনে আপনি আমাদের শিক্ষক।

আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের এই মহতী লগ্নে আপনাকে সম্মাননা জ্ঞাপন করতে পেরে আমরা গর্বিত। আশা করে থাকবো, বৈদ্যুতিন কৃৎকৌশলের এই অবিশ্বাস্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে আপনার জীবনের দুর্লভ কাহিনি, ক্রমশ বহতা হবে আপনার লেখনি ভিন্নতর বাস্তবতার বর্ণিল প্রকাশে।

.

আমাদের এই সম্মাননা গ্রহণ করে সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন নিয়ে আপনি এগিয়ে চলুন সৃষ্টির বিচিত্র পথে, গ্রহণ করুন আমাদের অন্তরের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

আমি আর কোনো মন্তব্য করব না। শুধু শেষ কথাটা বলে লেখায় ইতি টানব।

এত কিছুর পরেও–দু’বেলা দহন হচ্ছি আজও–দুমুঠো অন্নের জন্য। প্রবল গ্রীষ্মের দাবদাহেও আমার চারপাশে জ্বলে চারখানা অগ্নিকুণ্ড। দুবেলা রান্না করি আড়াই থেকে তিনশত জনের। কাজ দিন থেকে কেড়ে নেয় দশ বারো ঘণ্টা। এই দেশ এই সময়, এই সমাজ আমাকে আজও দেয়নি দুমুঠো ভাত আর পড়া লেখার সামান্যতম সুযোগ।

আমার অপরাধ আমি যে দলিত। শম্বুক একলব্যর গোত্র। এই অপরাধ বর্ণবাদী ব্যবস্থায় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

ওরা যখন নিজেদের বদলাবে না, আমাদের কলম কামানের নলের মতো চলছে চলবে। এ যুদ্ধ থামবে না।

***

অবশেষে–বলা চলে, বৃত্তটা সম্পূর্ণ হলো। যদিও সময়টা একটু বেশিই লেগে গেল, সে আর কী করা যাবে। তবে ওই, হলো তো। এটা না হলে আমার তো বটেই, মনুষ্য সমাজের বহু মানুষের সেই বদ্ধমূল বিশ্বাসটারই অপমৃত্যু ঘটে যাবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল, যে বিশ্বাসের মূল ছিল–লেগে পড়ে থাকলে–একদিন না একদিন অবশ্যই বিজয় করতলগত হয়, সাফল্য আসে। তখন মানুষ আমাকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করে প্রশ্ন করার সুযোগ পেত–ওইযে লোকটা কী কঠোর পরিশ্রমটাই না করেছিল, কিন্তু কী তার হলো! কী পেল?

এটা ঠিক যে কাল আমি যা ছিলাম ব্যক্তি জীবনে আমি আজও তাই আছি, তবে সমাজ জীবনের অঙ্গ হিসাবে ব্যক্তি জীবনটা আর হেলাফেলার বিষয় নেই, অনেক গর্ব অহংকারের অলঙ্কার হয়ে গেছে। বহু মানুষের বুকটা ফুলে উঠেছে, মাথাটা উঁচু হবার হিম্মত পেয়েছে।

আমি তখন ছিলাম মেরঠে। এক বন্ধু স্থানীয় ডাক্তারের বাড়িতে। গৌতম বিশ্বাস নামে এই ডাক্তার চাঁদসী চিকিৎসক। এখানে বলা রাখা দরকার চাঁদসী চিকিৎসা নামে অর্শ, ভগন্দর, নালী ঘা–এই সব রোগের চিকিৎসার আবিষ্কারক এই নমো সমাজেরই মানুষেরা। যে রোগী সর্বত্র বিফল সেইসব হতাশ রোগীদের ডাক্তার গৌতম বিশ্বাস গ্যারান্টি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিরাময় করে থাকেন। তখনই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সচিব শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ফোনে আমাকে জানালেন–“এই বছরের বাংলা আকাদেমির সুপ্রভা মজুমদার স্মারক পুরস্কারের জন্য আপনাকে নির্বাচন করা হয়েছে।”

সেই যেবার নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়েছিলেন বিশ্বের মানব জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন তা হল–আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে এটা একটা ছোট্ট পদক্ষেপ কিন্তু সমগ্র মানব জাতির পক্ষে এটা একটা বৃহৎ উলম্ফন।

১১ই জানুয়ারি ২০১৪ তারিখ সন্ধেবেলায় বাংলা আকাদেমি মুক্তমঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরস্কারটা হাত পেতে নিতে নিতে আমারও ঠিক ওই রকমটা মনে হচ্ছিল। পুরস্কারের অর্থমূল্য মাত্র পঁচিশ হাজার। তেত্রিশ চৌত্রিশ বছরের অক্লান্ত কমপেশার পক্ষে মূল্যটা বড় কম। কিন্তু সামাজিক সম্মাননার ক্ষেত্রে এর মূল্য অপরিসীম। এই সম্মাননা এসেছে তার হাতে যে কোনোদিন কোনো স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোতে পারেনি।

পুরস্কার ফলকটা আমার হাতে তুলে দিলেন মাননীয় উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু আর বাংলা অকাঁদেমির সভাপতি মাননীয়া শাঁওলী মিত্র। হ্যাঁ দুজনেই অর্পণ করলেন সেই মহার্ঘ্য সম্মাননা। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ষাট লক্ষ নমঃশূদ্র মানুষের মধ্যে আমিই সেই যে বঙ্গসাহিত্যে সর্বপ্রথম এই পুরস্কার পেল। এটা সমগ্র দলিত অবহেলিত নিরন্ন নমঃশূদ্র সমাজের পক্ষে বিরাট একটা সাফল্য।

একটা জাতি–এপার ওপার বাংলা মিলিয়ে যাদের জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটির কাছাকাছি। সমাজের বহু ক্ষেত্রে তাদের বিশিষ্ট অবদান থাকলেও এই একটি ক্ষেত্র–সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা ছিল না। হতে পারে এতে কোনো অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হবার সম্ভাবনা না থাকায় শিক্ষিত নমোরা এদিকে আগ্রহ দেখায়নি। এত কষ্ট করে লেখাপড়া যখন শিখলাম–যাতে দুটো পয়সা পাওয়া যায় বিদ্যে বুদ্ধি সেই কাজে লাগাই। এই হয়তো তাদের মনোভাব। তবে এটাও একান্ত ব্যক্তির মনোভাব। সমাজের অন্দরে কিন্তু ওই শূন্যস্থান পূরণের একটা আর্তি অনুভূত হচ্ছিল। অনুপস্থিতির অভাবটা ব্যথা দিচ্ছিল।

ভারতবর্ষের সবচেয়ে অভাগা যারা বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেন। এখানে যে যত বড় লেখকই হোন, বর্তমান সময়ে শুধু লিখেই সংসার চালাতে পারেন না। প্রত্যেককে কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো চাকরি করতে হয়। এখানে যে কত শত পত্র পত্রিকা বের হয় গুনে বলা মুশকিল। পত্রিকার কর্মকর্তারা কাগজের দাম দেন, কম্পোজিটার, প্রুফ রিডার, বাইন্ডার, পুস্তক বিক্রেতা সবারই পারিশ্রমিক দিতে বাধ্য থাকেন। শুধু বেচারা লেখকের বেলায় কাঁদতে বসেন, আমরা ক্ষুদ্র পত্রিকা, বড় গরিব ইত্যাদি।

এই কারণে বিশেষ করে বুদ্ধিমান শিক্ষিতরা ঘরের খেয়ে সাহিত্যের মোষ তাড়াতে মনের সায় পায়নি।

প্রায়শই একটা অভিযোগ ওঠে যে দলিত লেখকের লেখা নাকি উচ্চবর্ণদের পত্রিকায় ছাপতে চায় না। ধরে নিলাম যে দলিত লেখকদের লেখায় সেই সাহিত্য গুণমান রয়েছে তবু সেই বৈষম্য। তাহলে দলিতদের দ্বারা প্রকাশিত দলিত জীবন নিয়ে লিখিত দলিত লেখকেও ন্যূনতম সম্মান দক্ষিণা থেকে বঞ্চিত করা হয় কেন?

কারণটা ওই–বাংলা ভাষার লেখকরা বড় হতভাগ্য।

আমি লেখক ছিলাম না। একটু পড়তে লিখতে শিখে সেই শিক্ষা দিয়ে আর কিছু করা যায় না বলেই সাদা কাগজকে কালিমালিপ্ত করার খেলায় মেতে উঠেছিলাম। সেই যে বলে না, খেলতে খেলতে খেলোয়াড়, জানতে জানতে কী যেন–তো লিখতে লিখতে লেখক হয়ে গেছি। এখন, কেউ আমাকে বলে দলিত লেখক, কেউ বলে প্রতিবাদী লেখক, কেউ বলে প্রগতিশীল লেখক, এক পত্রিকা লিখেছে শ্রম সংস্কৃতির প্রতিনিধি। এইসব অভিধায় অভিহিত হবার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকায় রয়েছে আমার বই ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। এতে সাহিত্য কতটা আছে সে বিচারের ভার যারা সাহিত্য বোদ্ধা তাদের। তবে মানুষ একে কিছু ভালোবাসা দিয়েছে। যার জন্য মিলেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির স্বীকৃতি।

আর সাধারণ, স্বল্প শিক্ষিত, নমঃশূদ্র মানুষদের আদর ভালোবাসা। এবার তাদের মধ্যে তারা একজন লেখক পেয়েছে, যাকে উচ্চবর্ণ সমাজও সম্মাননা দেয়।

***

এবার ডাক এসেছে আমার লক্ষ্ণৌ শহরে এক অনুষ্ঠানে যাবার। দৈনিক জাগরণ পত্রিকা কয়েক মাস আগে বিহার সরকারের নবরস সংস্থা দ্বারা আয়োজিত বিহার দিবস অনুষ্ঠানের এক অংশীদার হয়েছিল। আমি সেই অনুষ্ঠানের একজন আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। তারা তখন দেখেছে আমাকে। শুনেছে আমার কথা। এইবার এটা তাদের নিজস্ব অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে চায় আমাকে। আমার মুখেই–আমার অবমাননাকর জীবনের কথা শোনাতে চায় লক্ষৌবাসিদের–।

এই সেই লক্ষ্ণৌ। সাতচল্লিশ বছর আগে আর একবার এসেছিলাম এই শহরে। লোকো-রেলের ইঞ্জিন মেরামতির কারখানায় মাসে মাত্র পঞ্চাশ টাকা মাইনেয় এখানে কাজ করতাম। রেল লাইন থেকে ঝুড়ি ভরে ছাই সরাবার কাজ ছিল আমার। সেই দিনে এখান থেকে চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়ে অভিশাপ দিতে দিতে ফিরে গিয়েছিলাম আমি–।

আজ সেই শহর, সেই ছাই ফেলা তুচ্ছ মজুরকে দিচ্ছে এক মর্যাদাময় মঞ্চ। অসংখ্য ক্যামেরায় ফ্লাশ বাশ্বের আলো ঝলসে দেবে তার মুখ। প্রভাতি সংবাদ পত্রের পাতায় থাকবে তার ছবি–খবর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রেষ্ঠ গুণীজন আজ নিশ্চল বসে শুনবে তার কথা।

ঐতিহাসিক কাল খণ্ডে–এটা বার বার দেখা গেছে যে, সময়ের প্রয়োজনে মূক মানবও মুখর হয়ে ওঠে। চির পরাজিত অথব–অশক্তও উঠে দাঁড়ায়। প্রত্যাঘাত করবার জন্য। আজ আমার কাঁধে সেই দায়িত্ব এসে পড়েছে। দলিত-দরিদ্র শ্রমজীবী জনতার সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে আমি এসেছি ভদ্রবাবুদের জমায়েতে আমাদের প্রতি অন্যায় অবিচারের কথা তুলে ধরতে। প্রতিকার চাইতে। সাবধান করে দিতে। সামলে যাও তোমরা। মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা এবং মজুরি দাও। এখনও সময় আছে। তা না হলে মানুষের মনে হাজার বছর ধরে জমে থাকা ক্রোধের বারুদে যদি বিস্ফোরণ ঘটে শাসন শোষণের দাম্ভিক দুর্গ ধুলো হয়ে খুঁড়িয়ে যাবে।

না, আমাকে কেউ এই দায়িত্ব সমপর্ণ করেনি। গণভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেনি কেউ। আমি স্বেচ্ছায় এই দায় ঘাড়ে নিয়েছি এবং আমৃত্যু বহন করে চলব।

এর আগে মুম্বাই ঘুরে এসেছি কদিন আগে। স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ বিনায়ক সেনের সহধর্মিনী ডঃ ইলিনা সেন।–যিনি টাটা সোশ্যাল সায়েন্সের একজন সম্মানীয়া অধ্যাপিকা।ইলিনা দিদির আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম মুম্বাই। সেই সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠানের এক অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তা ছিলাম আমি। ওই মঞ্চে আর যত বক্তা ছিলেন সবাই বক্তব্য রেখেছেন ইংরাজিতে। একমাত্র আমারটা পরিবেশন করেছিলাম রাষ্ট্র ভাষা হিন্দিতে। শ্রোতার আসনে দিল্লি কলকাতা মুম্বাই ভুবনেশ্বর এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক তো ছিলেনই–তবে আমার কাছে যাঁর উপস্থিতি সবচেয়ে বড় তিনি ডঃ বিনায়ক সেন।

মুম্বাইয়ের অনুষ্ঠানের পর সেই দিনই চেপে বসেছিলাম এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে আর দমদমে নেমে এক ঘণ্টা পরে ফের চড়ে বসেছিলাম শিলচরগামী আর এক প্লেনে। সন্ধানী যুব সংঘের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে করিমগঞ্জ যাবার জন্য আমাকে কলকাতা থেকে সাথে করে নিয়ে যাবার জন্য শিলচর থেকে কলকাতায় উড়ে এসেছিলেন করিমগঞ্জের সুযোগ্য সন্তান শিক্ষাবিদ বাণীপ্রস। মিশ্র মহাশয়। উনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত।

বক্তৃতা তো আমার সব জায়গায় প্রায় এক–আমার জীবন, আমার সাহিত্য। অন্য আর কী বলব! সেসব কথা বলার জন্য তো অন্য অনেক লোক আছে। থাকে না তেমন লোক, যে সমাজের সবচেয়ে নীচের ধাপের মানুষের যাপিত জীবনের রক্ত ঘাম চোখের জলের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে। সে সব বলতে হলে তো জানতে হবে। জানতে হলে তো যেতে হবে সেই সব মানুষের কাছে। মিলতে হবে মিশতে হবে–তাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে সেটা পেরে ওঠে না।

আমি সেই কথা বলি। যে সমাজের আমি-। যে সমাজ আমার। আমি আমার ব্যক্তি জীবনের অসহ্য অকথ্য অবস্থা আর সমাজ জীবনের চরম অবহেলা অবমাননার আখ্যান মানুষকে শোনাই। শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে হৃদয়হীন শাসন আর শোষণের নগ্নরূপ তুলে ধরি। বিষ বাক্যে বিদ্ধ করি বর্ণবাদ আর পুঁজিবাদকে।

এই সব সোজা সাপটা কথা শোনার জন্য মানুষজন আমাকে বহু ব্যয় করে দেশের নানা প্রান্তে নিয়ে যায়। আমার বাবা সেই মানুষ যার গায়ে একটা জামা, পায়ে এক জোড়া চপ্পল, পেটে ভাত, মাথায় এক ফোঁটা তেল ছিল না। জীবনে কোনদিন তৃতীয় শ্রেণির ট্রেনের একটা টিকিট কেটে নির্ভয়ে রেল সফর করতে পারেননি। সেই বাপের ছেলে–আমাকে উদ্যোক্তারা নিয়ে যায় এরোপ্লেনে-। ট্রেন হলে প্রথম শ্রেণির শীততাপনিয়ন্ত্রিত কামরায়।

আমি বিভিন্ন শহরে যাই বটে তবে সে শহরকে যে একটু ঘুরে দেখব তেমন সময় সুযোগ পাওয়া যায় না। এয়ারপোর্ট থেকে স্টেশন থেকে উদ্যোক্তারা গাড়ি করে তুলে নিয়ে গিয়ে পুরে দেয় পাঁচতলা দশতলা কোন হোটেলের সুসজ্জিত কক্ষে। সেখান থেকে বের করে নিয়ে যায় অনুষ্ঠান মঞ্চে। মঞ্চ থেকে নামলে আবার হোটেলে। হোটেল থেকে বের করে সোজা স্টেশন না হয় এয়ারপোর্ট। দরকারের বাইরে আর এক মিনিটও সময় দেবে না। সময় এখানে খুবই মূল্যবান। শুনি-এখানকার একদিনের থাকা খাওয়ার হোটেল বিল নাকি আমার মত মানুষের এক মাসের মাইনেও ছাড়িয়ে যায়।

তবে এবার ইলিনা দিদি আমাকে মুম্বাই ঘুরে দেখার জন্য একটু ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গাড়ি ড্রাইভার আর আমার গাইড হিসাবে সাথে পাঠিয়েছিলেন নিজের মেয়েকে। গেট ওয়ে অব ইন্ডিয়া, খাজা বাবার মাজার, লতা মঙ্গেশকরের বাড়ি-আরও অনেক কিছু দেখে নিতে পেরেছিলাম দিদির দয়ায়।

রূপ নগরী মুম্বাই। যে মুম্বাইকে আমরা জানি সিনেমার কল্যাণে অর্থ যশ ভোগ বিলাসের স্বর্গভূমি হিসাবে-কত যে যুবক যুবতী এই শহরের মোহ মদির আকর্ষণে পাগলের মত ছুটে এসে–জীবনের অনেক অমূল্য সময়ের অপচয় করে হতাশ-ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে যায় তার কোন গোনাগাঁথা নেই।

ফেরার দিন মনে হয় রাত আটটায় প্লেনে চেপেছিলাম। দশটা সাড়ে দশটায় দমদমে নামবার কথা ছিল। কথা ছিল–আড়াই নাম্বার গেটে বন্ধু রাজু দাসের বাড়ি রাতটা কাটিয়ে পরের দিন বেলা একটায় শিলচরগামী প্লেনে উঠব। সে আর হল না। প্লেন অধিক কুয়াশার কারণে দমদমে নামতে পারল না। ঘুরিয়ে নাগপুরে নিয়ে চলে গেল। সারারাত সে কী কষ্ট। একে তো প্রবল শীত তার উপর না জল, না খাবার।

পরের দিন আটটায় নাগপুর থেকে ছাড়ল প্লেন। দমদমে পৌঁছাল দশটায়। তখন হাতে মাত্র এক ঘণ্টা সময়। এগারোটায় তো আবার রিপোর্টিং করতে হবে। বাণীপ্রসন্নবাবু তো শিলচর থেকে দুদিন আগে এসে বসে আছেন আমাকে নিয়ে যাবেন বলে। সকালে বাড়ি থেকে আমার স্ত্রীও এসে গেছে, এসেছে আমার পরম মিত্র অনন্ত আচার্য আর বন্ধু রাজু দাস। তার হাতে টিফিনক্যারিয়ার। তাতে খাদ্যদ্রব্য বোঝাই।

এয়ার পোর্টে বসে সেগুলোর সদগতি করতে হল। তারপর রওনা দিলাম শিলচরের দিকে।

এখন আমি বেশ সড় গড় হয়ে গেছি। অনেক সাবলীল অনেক স্বচ্ছন্দ। এই নিয়ে সাতবার হচ্ছে প্লেন যাত্রা। এখন আমি সিট বেল্ট কেমন করে বাঁধতে হয় জানি। কেমন ভাবে পাথর পাথর মুখ করে চারদিকে তাকাতে হয় পারি। একজন সৌদি আরব থেকে ফেরা যাত্রী মোবাইল চালাচ্ছিল, তাকে ধমকে সেটা বন্ধ করিয়ে দিই।

সাতদিন ছিল এবারের ভ্রমণ। সত্যি বলতে কী অনেক মর্যাদাময় অনুষ্ঠানে অনেকবার অতিথি তত হয়েছি, কিন্তু শিলচর করিমগঞ্জ-সুপ্রাকান্দি এই সব জায়গার ছোট বড় প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে যে অকৃত্রিম আন্তরিকতা দেখেছি–তা আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। এক দাদা তার গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ বর্ডার দেখাতে। এপারে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম ওপার আমার সেই জন্মভূমি। সেখান থেকে চলে তো এসেছি সেই শিশুবেলায় আর কোনোদিন যেতে পারিনি। যেতে আর পারব না। আমার যে পাসপোর্ট ভিসা নেই। সে সব পেতে হলে যে সব কাগজ পত্র লাগে তা আমার কাছে নেই।

আমার বাবা ছিলেন লেখাপড়া না জানা মানুষ। কোন কোন কাগজ বানিয়ে রাখতে হয়, গুছিয়ে রাখতে হয় যে সব কাগজের জোরে নিজেকে ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করা যায় তা তিনি জানতেন না।

আমরা এদেশে এসেছি সেই বাহান্ন তেপান্ন সালে। বাঁকুড়ার শিরোমণিপুর নামে যে ক্যাম্পে ছিলাম, তখন সরকার যে সব কাগজ পত্র দিয়েছিল–ডোল বন্ধ হয়ে যাবার পর যে দীর্ঘ সময় এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে সে সব কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ছিল না–ছিল

কোন বাকসো তোরঙ্গ। ন্যাকড়ার পুঁটলিতে বেঁধে খড়ের চালার বাতায় গুঁজে রাখা সে কাগজ কবে যে পচে গলে গেছে তা কে জানে–।

সেই থেকে আমরা নাম পরিচয়হীন এক নেই দেশের নাগরিক। রেশন কার্ড, ভোটার লিস্টে নাম, জমির দলিল কিছুই ছিল না আমাদের। কুট রাজনীতির এক কলমের আঁচড়ে–আমাদের সব কিছু চলে গেছে।

নদীর নামটি সুরমা। ছোট যে নদী চিহ্নিত করেছে দু-দেশের সীমা। নদীর এপারে দাঁড়িয়ে এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে দেখছিলাম ওপারের ঘর বাড়ি মানুষজন। বার বার চোখে জল ভরে আসছিল। কয়েকটা বাচ্চা খেলা করছে। নদীতে কাপড় কাঁচছে, স্নান করছে কয়েকজন। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, চাইলে এক বুক জল সাঁতরে একমিনিটে পৌঁছে যেতে পারি ওপারে। আমার প্রিয় জন্মভূমিতে। সে মাটি নাকি স্বর্গের চেয়ে গরীয়সী। তবে যেতে দেবে না। রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে বসে থাকা বর্ডার সিকিউরিটির লোকেরা সাথে সাথে বুক মাথা সোজা গুলি চালিয়ে দেবে। এই সব পাহারাদারদের একজনও বাঙালি নয়। ওদের কোনদিন দেশ ভাগ হয় নি। দেশ ভাগের কী। যন্ত্রণা ওরা জানে না। জানে না স্বদেশের মাটি মানুষ গাছপালা পশু পাখির কী দুর্বার আকর্ষণ। তাই সেই আবেগ ওদের কাছে অবাস্তব অর্থহীন।

তবে কী ওরা কাউকে ওপারে যেতে দেয় না? আসতে দেয় না এপারে? দেয়। হাজার হাজার লোক আসা যাওয়া করে–সে রাতের আঁধারে ওদের সাথে নগদ লেনদেনের দরদাম চুক্তির ভিত্তিতে। আমি সে ভাবে যেতে চাই না। গিয়ে বা কী করব? ও দেশের মানুষের কাছে আমি যে বিধর্মী-মালাউন-কাফের-হিন্দু। ভাই বলে তারা তো গলা জড়াবে না। সে যদি জড়াত তাহলে তো দেশভাগই হতো না।

দেশ ভাগ কে করেছে, জিন্না না জওহরলাল–আমি সে তর্কে যাব না। তবে দেশ ভাগের ফলে ভারতবর্ষে কারা লাভবান হয়েছে তার কিছুটা বলতে পারি। প্রথম লাভ–সবচেয়ে বড় লাভ পেয়েছে–এ দেশের উচ্চবর্ণ সমাজ। তখন পূর্ববঙ্গের বরিশাল ফরিদপুর খুলনা যশোর জুড়ে হরিচাঁদ পুত্র গুরুচাঁদের নেতৃত্বে নমঃশূদ্রদের মধ্যে বিরাট একটা গণ জাগরণ দেখা দিয়েছে। যারা সবর্ণ সমাজের আধিপত্য ধর্মীয় শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নতুন ধর্মমত মতুয়া ধর্মের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ এক শক্তিশালী জনগোষ্ঠী হিসাবে সামনের সারিতে এগিয়ে আসছে। শিল্প সাহিত্য, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে জোর কদমে ধেয়ে যাচ্ছে।

এই অদ্ভুত অস্পৃশ্য নম জাতির অবিসংবাদী নেতা রূপে সামনের সারিতে চলে এসেছে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। যার সাথে যোগ সূত্র স্থাপিত হয়েছে মহারাষ্ট্রের মাহার নেতা বাবা সাহেব আম্বেদকরের।

তখন সারা ভারতে মহাত্মারূপে পূজিত জন নেতা উচ্চবর্ণ স্বার্থের সবচেয়ে বড় সংরক্ষক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে যার নাম জনচর্চার বিষয়–সে আম্বেদকর। গান্ধী নীতির প্রতি পদে যে তার শানিত যুক্তির অস্ত্র নিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছে। আম্বেদকরকে সামনে রেখে সারা ভারতের মূক দলিত বঞ্চিত মানুষ মুখর হয়ে উঠেছে, দাবি জানাচ্ছে জন সংখ্যার অনুপাতে শাসনকর্মে ভাগীদারির।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নামে যে গালভরা গল্প পরিবেশন করা হয়–তা আসলে একটা মিথ্যের বাতাস ভরা বেলুন। কী সংগ্রাম হয়েছে। ক’টা লোক মারা গেছে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে। হাতের আঙুলের কড় শেষ হবে না, শহীদের তালিকা শেষ হয়ে যাবে।

এত বড় একটা দেশ, যে দেশের জনসংখ্যা তেত্রিশ কোটি, যে দেশের মাটির তলে রয়েছে অপার খনিজ সম্পদ–মাটির উপর শস্যের অপার ভাড়ার। এমন স্বর্ণভূমি সে গোটা কয়েক লোকের ইংরেজ ভারত ছাড়ো শ্লোগান আর গুটি কয়েক আবেগ তাড়িত যুবকের খান কয়েক মশার পিস্তলের কুটুস কুটুস শুনে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল! এরোপ্লেন থেকে বোমা ফেলল না, কামানের গোলা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিল না–তেত্রিশ কোটির দশ কোটিকে লাশ বানিয়ে দিল না, এত শান্ত ভদ্র দয়ালু বৃটিশ সরকার। এই দয়া দিয়ে তারা সূর্য না ডোবা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিল!

আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ঝাড় খাবার পর নিজদেশ পূণর্গঠনের জন্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুশলি ইংরেজদের স্বদেশে ফিরে যাবার তাড়া ছিল। আফ্রিকার এমন দেশও আছে যারা ইংরেজ শাসকদের কাছে কাতর আবেদন করেছিল এখনই আমাদের ছেড়ে যেও না–কটা বছর সময় দাও। আমরা শাসন কার্য সঞ্চালনের মতো দক্ষ হয়ে উঠি তারপর যেও। তবু ইংরেজ শাসকরা সে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।

এই একই কারণে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে। তবে অন্য দেশের ক্ষেত্রে যা করেনি–দেশটাকে টুকরো করে রেখে গেছে। চাইছিল এদেশের লোক–তারা সেটাকে কার্যকর করেছে মাত্র।

স্বাধীন দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে–সেই সংবিধান রচনার জন্য যে কমিটি উচ্চবর্ণ নেতৃবর্গ চায়নি ওই কমিটিতে আম্বেদকর জায়গা পাক! তাই তাকে গভীর এক ষড়যন্ত্র করে নির্বাচনে পরাজিত করে দেওয়া হয়। তখন বড় গর্বভরে উচ্চবর্ণ এক নেতা বলেছিলেন দরজা তো দূর আম্বেদকরের জন্য সংবিধান সভায় অনুপ্রবেশের জানলা পর্যন্ত আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।

মাহার সন্তান দলিত সমাজের নেতা আম্বেদকরকে তখন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল আমন্ত্রণ করে মহারাষ্ট্র থেকে পূর্ববঙ্গ নিয়ে যান। নিজে পদত্যাগ করে সেই কেন্দ্র থেকে পুনঃনির্বাচনের মাধ্যমে আম্বেদকরকে সংবিধান সভায় প্রতিনিধি করে পাঠান। যোগেন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন–দলিত স্বার্থ রক্ষার পক্ষে আমার চেয়ে অনেক যোগ্য ব্যক্তি বাবা সাহেব আম্বেদকর।

এই ঘটনাই উচ্চবর্ণ অহমিকায় পদাঘাত করে। পূর্ববঙ্গে নমঃশূদ্র জাতি তাদের বিষ নজরে পড়ে যায়। তারা ভয় পায় মাহার আর নমঃ ঐক্য যদি গড়ে ওঠে ব্রাহ্মণ্যবাদী ক্ষমতার সামনে বড় বিপদ দেখা দেবে। এই কারণে তারা দেশভাগের সময় বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা যশোর এই সব নমঃশূদ্র অধুষিত জেলাগুলো পূর্ব পাকিস্তানে ঠেলে দেয়।

জাতিগত কারণে দেশভাগ। তাই যদি হয়, ওই চার জেলা থাকা দরকার ভারতে আর মালদা মুর্শিদাবাদ নদীয়া এই মুসলমান প্রধান জেলাগুলো যাওয়া দরকার পাকিস্তানে। তেমন করা হয়নি শুধু এই আক্রোশবশতঃ অন্ধ প্রতিহিংসার কারণে। এর ফলে একটা শক্তিশালী দলিত জনগোষ্ঠি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। কিছু রয়ে গেছে ওপার বাংলায় যাদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। তিন কোটি আছে এপারে। যার কিছু দণ্ডকারণ্যে কিছু মহারাষ্ট্রে কিছু নৈনিতালে কিছু মীরাটে আর কিছু পশ্চিমবঙ্গের রেল লাইনের ধারে, খাল পাড়ে ফুটপাতে। ছিন্নভিন্ন এই জাতিকে দিয়ে আর ভয় পাবার কিছু নেই। ভয়মুক্ত হয়ে গেছে উচ্চবর্ণ স্বার্থ।

আর একটা স্বার্থ সুরক্ষিত হয়েছে এই দেশভাগের ফলে। সেটা প্রদেশিক। দুই বাংলা এক থাকলে তার যা আয়তন–কমপক্ষে একশো পনের কুড়িটা সংসদীয় নির্বাচন ক্ষেত্র থেকে শুধু বাঙালি সাংসদ নির্বাচিত হয়ে দিল্লির সংসদ ভবনে যেত। এত সাংসদ আর কোন প্রদেশ পেত না। আজ যে দল পশ্চিমবঙ্গেশাসন ক্ষমতায় আসে, সব দলের এক অভিযোগ–দিল্লির বিমাতৃ সুলভ আচরণ। তখন এমন হলে বাংলার বঞ্চনার বিরুদ্ধে একশো সাংসদ একযোগে উঠে দাঁড়ালে দিল্লির বড় নেতারা সব কেঁপে যেত। সে ভয় এখন আর নেই। দুই ভাগ ওপারে, এক ভাগ এপারে-এই খণ্ডিত শক্তি নিয়ে বাঙালি আর কোনদিন মাথা উঁচু করতে পারবে না।

পারবে যদি আবার কোনদিন দুই বাংলা এক হয়। বন্দুকের ডগায় ভাগ করে দেওয়া দুই জার্মানি কত বছর পরে আবার এক হয়ে গেছে। তাদের ভাষা খাদ্য পোষাক সংস্কৃতি সব এক–তাই সহজ হয়েছে মিলন। আমাদের ভাষা খাদ্য পোষাক সংস্কৃতি খানিকটা মিল আর মাঝখানে এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়েছে ধর্ম। তাই আমরা মিলতে পারব না। মানুষে মানুষে যত বিভেদ, যত অনৈক্য ধর্ম সৃষ্টি করেছে–আর কিছুতে তা পারেনি।

আমি এক এক সময় ভাবি ইস্রায়েল একটা দেশ বর্তমানে যার জন সংখ্যা মাত্র আশি লক্ষ। ওদেরও এক সময় কোন দেশ ছিল না। উদ্বাস্তু হয়ে তাড়া খেয়ে ফিরেছে পৃথিবীর পথে পথে। জার্মানিতে নাৎসী সমর নায়ক হিটলার ইহুদি মানুষগুলোকে ধরে ধরে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে বিনা দোষে মেরে ফেলেছে। শোনা যায় তাদের সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশী।

আর আমরা নমঃ মানুষ, ওপারে এক কোটি এপারে তিন। চার কোটি মানুষ মিলে এক সাথে উঠে দাঁড়ালে এক কোটি প্রাণের বিনিময়ে কী নিজেদের একটা দেশ গড়ে নিতে পারি না। এপারে আমাদের পরিচয় বাস্তুহারা শরণার্থী অনুপ্রবেশকারী রিফিউজি উদ্বাস্তু আর বাঙ্গাল। ওপারে ওদের পরিচয় বিধর্মী কাফের মালাউন হিঁদু। কোন পার-ই আমাদের আপনজন বলে স্বীকার করে না। তাহলে আমরা কোন পার এর? কোনো পার যখন আমাদের নয়, আমরা আমাদের জন্য একটা নতুন পার কেন গড়ে নিচ্ছি না? আশি লক্ষ যদি পারে, চারকোটি কেন পারে না?

বলছি বটে তবে আমিও জানি পারি না, পারে না; পারব না। কারণ আমরা যে জাতিতে বাঙালি। বলি বটে আমরা বীরের জাতি, কিন্তু ইতিহাস অন্য সাক্ষ্য দেয়।

আমাদের এক রাজা লক্ষণ সেন। দুপুরবেলায় কই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে সবে মুখে তুলেছে। এমন সময় রাজদ্বারে এসে দাঁড়াল আঠারোজন তুর্কী সেনা। আঠারো হাজার নয় আঠারো শত নয় একশো আঠারো নয় শুধু আঠারো। রাজার আর ভাত খাওয়া হল না। কইমাছ পাতে পড়ে রইল। এঁটো হাত নিয়ে রাজা পিছন দরজা দিয়ে ছুট মেরে পালিয়ে গেলেন।

আমাদের এক নেতা এম.এন.রায়, আর এক নেতা রাস বিহারী বোস আর এক নেতা সুভাষ বোস–তারাও পালিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন রাশিয়ার লেনিন, চিনের মাও-সে-তুং, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের হো চি মিন –এরা কিন্তু কেউই দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যান নি। মাছের মধ্যে জলের মত তারা জনগণের সঙ্গে মিশে থেকেছেন জনগণকে সংগঠিত করেছেন লড়াই লড়েছেন। সবশেষে অর্জন করেছেন বিজয়। বাঙালি নেতাদের বেলা উল্টো। রাজার চোখ লাল হবার সাথে সাথে হাওয়া।

এক নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। দেশ ভাগের প্রাক্কালে নমঃশুদ্র মানুষদের বলেছিলেন তিনি, তোমরা কেউ দেশ ছেড়ে যেও না। আমি আছি তোমাদের সহায়। তার ভরসায় নমঃশূদ্ররা বড় সংখ্যায় রয়ে গেল ওপার বাংলায়। তারপর একদিন সেই অসহায় মানুষগুলোকে ফেলে যেভাবে ভেড়ার পালকে হিংস্র ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে ফেলে রাখাল পালায়, তিনি পালিয়ে ভারতে চলে এলেন। নিজের প্রাণ তো বাঁচালেন, মরে গেল লক্ষ লক্ষ অসহায় নমঃ মানুষ। ওপারে থাকার উপায় নেই–এপারে আসার পথ নেই। চোরা পথে যদি বা আসে–আহার নেই আশ্রয় নেই, স্বীকৃতি নেই।

এক নেতা মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ তো ঘোষণা করে দিলেন। তারপর এসে মেহমান হলেন ভারত দেশের। খান সেনা আর রাজাকারদের হাতে মুরগি ছাগলের মত মানুষ কাটা পড়ল। উনি রইলেন রণক্ষেত্র থেকে বহুদূরের নিরাপদ আশ্রয়ে। শেষে ভারত সরকার যুদ্ধ টুদ্ধ করে খানসেনাদের তাড়িয়ে দেশটা দখল করে উপঢৌকন দিল তাকে। তবে সেই পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা বেশী দিন ভোগ করা ভাগ্যে জুটল না। তিনি মানুষের বিপদে পাশে ছিলেন না, তার বিপদেও মানুষকে পাশে পেলেন না। কয়েক জন ঘাতক নির্বিবাদে গুলি চালিয়ে তাকে মেরে চলে গেল ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

আর এক নেতা সতীশ মণ্ডল। এ সেই নেতা যে রাম চ্যাটার্জীর সাথে দণ্ডকারণ্যের বাঙালি এলাকায় ঘুরে ঘুরে প্ররোচনা দিয়েছিল সবাইকে মরিচঝাঁপি আসার জন্য। এক লক্ষ মানুষ এসেছিল তার কথা শুনে। আর যেদিন বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ চল্লিশখানা লঞ্চ দিয়ে চারদিক থেকে দ্বীপকে ঘিরে ধরল, মধু মালাকারকে সাথে নিয়ে নদী সাঁতরে সবার আগে পালিয়ে গেলেন সতীশ মণ্ডল। মধু মালাকার এখন পারাল কোটে থাকে। সতীশ মণ্ডল রায়পুরে। এরা এসেছিল আবার ফিরে গেছে। খোঁজ নেই চার হাজার সাতশত আঠাশ জন মানুষের–কেউ জানে না তাদের কী পরিণতি হয়েছে।

এই লড়াইবিমুখ পলায়নি প্রবৃত্তি আমাদের রক্ত মাংস অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। তাই আমাদের বিষয়ে কেউ ভাবে না। মাত্র পঞ্চাশ লক্ষ গোখা যখন হুংকার দেয় গোখা ল্যান্ড চাই–পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার সব কেঁপে ওঠে। আমাদের ভয়ে কাঁপে না। ওরা জানে হীনধর্মী কাপুরুষ পলায়নী বাঙালি মনোবৃত্তির ধারক বাহক আমরা রাজনেতা গুরু গোঁসাই দেব দেবতার কাছে নত হতে হতে আমাদের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। ধীরে ধীরে চতুষ্পদ হয়ে যাব। লোম গজাবে দেহে। লেজ গজাবে–তারপর একদিন আমরা ফিরে যাব সেই অবস্থায়–যেখান থেকে বানররা যাত্রা শুরু করেছিল মনুষ্যত্বের দিকে।

***

এটাই জগতের নিয়ম। যে আগাতে জানে না তাকে পিছিয়ে যেতে হয়। মাঝামাঝি কোন স্থান নেই। করিমগঞ্জ আসাম প্রদেশের অন্তর্গত হলেও বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশী। কেউ বলে না দিলে আমার পক্ষে এটা বোঝা সম্ভবই ছিল না যে এটা বাংলার অংশ নয়।

এই শহরের চারদিকে অনেকগুলো বড় বড় ব্যানার টাঙানো হয়েছে দেখলাম। সব ব্যানারে আঁকা আছে আমার মুখ। লেখা আছে আমি কে, আমি কী! আহ্বান করা হয়েছে মানুষকে, আসুন দেখে যান এক বিস্ময়কর মানুষকে।

এক সপ্তাহের অধিক সময় ধরে চলবে এদের নানাবিধ অনুষ্ঠান। গান আছে, নাচ আছে, নাটক আছে–একদিন রাখা আছে আমার জন্য। দু আড়াই ঘণ্টা যতক্ষণ লাগে বলতে বাঁধা নেই।

অনুষ্ঠান শুরুর দিন সকালে হাজার মানুষ হাতি নিয়ে এক বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা বের করে সারা শহর পরিক্রমা করেছিল। সেই শোভাযাত্রায় রঙ বেরঙের সাজ সজ্জায় মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। একদল ছেলে ছিল সামরিক পোষাকে। ব্যান্ডের তালে তালে কুচকাওয়াজ করছিল তারা।

সন্ধানী যুব সংঘ গঠিত হয়েছিল নিখোঁজ হয়ে যাওয়া প্রিয় নেতা সুভাষচন্দ্র বোসকে খুঁজে বের করার সংকল্প নিয়ে সেই পঞ্চাশের দশকে। যে যুবকেরা সেদিন সংঘ গড়ে ছিলেন অনেকে। মারা গেছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন সব বৃদ্ধ। সেই বৃদ্ধদের আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার শপথ নিয়ে নব প্রজন্ম সংঘের কার্যভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

সন্ধানী যুব সংঘ নেতাজিকে খুঁজে পায় নি। পাবে কী না তা এখনও অজানা। তবে সেই উদ্দেশ্যে গঠিত সংঘ এখন সমাজ সেবামূলক বহু কর্মে করিমগঞ্জে একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। আর প্রতি বৎসর সাড়ম্বরে পালন করে থাকে নেতাজি জন্ম দিবস।

আজকের এই শোভা যাত্রায় আসামের বাঙালি অসমিয়া সবাই অংশ নিয়েছে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ছাপ-ছবি নিয়ে। কিছু মেয়ে ঐতিহ্যশালী পার্বত্য বেশবাসে তোক নৃত্যের তালে তালে পথ হাঁটছে। বাঙালি বধূরা লাল পাড় সাদা শাড়িতে চলেছে শঙ্খ বাজাতে বাজাতে। ঢাক তাশা আরও নানা ধরনের বাদ্য যন্ত্র বাজছে।

একদল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এসেছে স্কুলের পোষাক পরে। মিছিলের পুরো ভাগে তারা। হাতে স্কুলের নাম লেখা ব্যানার। উচ্ছল পাহাড়ি ঝর্ণার মত হেসে গেয়ে তারা পথ হাঁটছে।

আজ এই শহরের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সব নেমে এসেছে পথে! যারা মিছিলে হাঁটছে তারা তো হাঁটছে, যারা হাঁটতে পারছে না দুধারে দাঁড়িয়ে দেখছে বর্ণাঢ্য মিছিল।

একদল মেয়ে চলছিল ফুল ছড়াতে ছড়াতে। একদল শাঁখ বাজাচ্ছিল। বাজনার তালে তালে আসাম, বাংলার বিবিধ নৃত্য সহযোগে পথ হাঁটছিল লোক শিল্পীদের ছোট ছোট দল।

আসামের ‘আনন্দ বাজার’ যুগ শঙ্খ সাময়িক প্রসঙ্গ পত্রিকা পুরো এক পৃষ্ঠা জুড়ে আমার ছবি সহ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। আর সন্ধানী যুব সংঘ আমার বক্তৃতার সিডি করে বার বার প্রদর্শন করেছিল শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। এখানে আমার জন্য বাণীপ্রসন্ন মিশ্র তো বটেই, সন্ধানী যুব সংঘের সম্পাদক শ্যামলরঞ্জন দেব, রথীশ দেব নামে আরও দুজন মানুষকে পেয়েছিলাম, যাদের উষ্ণ হৃদ্যতা কোনদিন ভোলা যাবে না। পেয়েছিলাম দশ হাজার নগদ টাকা, একটা শাল একটা কম্বল, অনুর জন্য একটা শাড়ি ফুল মালা আর এক সমুদ্র ভালোবাসা।

***

সুর্য যখন উদয় হয় সারা পৃথিবীতে আলো দেয়। তবে সে আলোতে আমার খুব একটা উপকার হয় না। হয় সেই টুকু যা সবার হয়। আমার কাছে সুর্যের চেয়েও বড় প্রিয় বড় আপনার, অনেক বেশী কাজের মাটির সেই ছোট্ট প্রদীপখানি। যা আমার কুড়ে ঘরের অন্ধকার দূর করে। ভীতিকারক কালো তমসাকে দূরে সরিয়ে দেয়।

জীবনের এক এক পর্বের সূর্য সমান তেজবান উজ্জ্বল কিছু ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় যে হয়নি তেমন নয়, তবে তা খুব একটা কাজে আসেনি। এসেছে নামহীন গোত্রহীন অখ্যাত অতি সাধারণ অনেক মানুষ। যাদের ছোট ছোট সহযোগ না পেলে আমি এইখানে পৌঁছাতে পারতাম না হয়

আমি একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, কোন ব্যক্তি মানুষের একক প্রয়াস কখনই সাফল্যমন্ডিত হতে পারে না। সময় আর সমাজের বহু মানুষের নিভৃত সহযোগ থাকে। আপাতঃদৃষ্টিতে তা হয় তো তুচ্ছ, তবে সেটাও যে সেইটুকু সময়ে অতি বড় ভূমিকা নিয়েছিল এটাকে স্বীকার না করলে অন্যায় হয়।

.

রাগ চণ্ডাল–রেগে গেলে যে কোন মানুষের মাথা গরম হয়ে যায়। আর মাথা গরম হলে যে সিদ্ধান্তই নেবে ভুল হতে বাধ্য।

মানুষ রাগলে চণ্ডাল হয় আর আমি জন্মজাত চন্ডাল। চন্ডাল যদি রাগে সে যা হবে বলার মত নয়। রাগ আমি জীবনে বহু বার করেছি, ক্ষয়ক্ষতিও তার জন্য কম হয়নি। তবু শিক্ষা হল কই। এই সেদিন রাগের মাথায় আর একটু হলে বঙ্গসাহিত্যের একটা বড় শিরোপা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। যে শিরোপা পাবার জন্য কত মানুষ কী চেষ্টাটাই না করে চলেছে। আর সেই শিরোপা নিজে হেঁটে এসে আমার দরজা থেকে ফিরে চলে যাচ্ছিল আমার চন্ডাল রাগের গুতোয়।

।এক টিভি সাংবাদিক থাকেন এই মুকুন্দপুরে। চাকরি করেন ২৪ ঘন্টা সংবাদ চ্যানেলে। তার উপরওলা আদেশ দিয়েছে যাও তোমাদের ওদিকে একটা লোক থাকে, লেখে টেখে, ওর একটা ইন্টারভিউ নিয়ে এসো।

কোথায় থাকে সে?

ওই যে বোবা স্কুল ওতে রান্না করে।

রান্না করে। তবে যে বলেন লেখে!

হ্যাঁ, লেখেও রান্নাও করে। শুনেছি তার আগে রিকশাও চালাত। জেলে টেলেও গেছে।

এই লোকের ইন্টারভিউ!

হ্যাঁ, সিইও আমাকে বলেছে, আমি তোমাকে বললাম অন্য কাজ পরে হবে সবার আগে এটা সারো।

সাংবাদিক আমার মোবাইলে ফোন করলেন, ২৪ ঘণ্টা চ্যানেল থেকে বলছি। আমি আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই। তাড়াতাড়ি দরকার। কখন আপনার সময় হবে?

চলে আসুন আজ বিকালে।

একটু ভেবে বলে সে–আজ না, যদি কাল যাই কোন অসুবিধা হবে?

ভালো হবে। কাল আমার ছুটির দিন, কোন তাড়াহুড়ো থাকবে না। সারাদিন বাড়িতে থাকব। যখন খুশি আসতে পারেন।

আপনার কাল ছুটি?

হ্যাঁ, কাল আমার রবিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন।

তাহলে আপনি যে রান্না করেন, সে ছবি কী করে পাবো। ওটা যে চাই।

বলি–তাহলে সকালে নটার আগে আসতে হবে। তারপর হবে না। নটার মধ্যে রান্না শেষ হয়ে যায়। সন্ধেয় ফের শুরু হয় ছ’টায়। যখন আপনারা আসবেন একটা ফোন করে দেবেন। আমি কাজের জায়গায় এসে যাবো।

আমরা সকালে সাড়ে আটটার মধ্যে আসব। আপনি থাকবেন।

আমাকে প্রায় সব বাংলা চ্যানেল এক দুবার ডেকেছে। তারা মাঝারি মাপের। বড়র মধ্যে। এবিপি আনন্দ আর ২৪ ঘণ্টা কোনদিন ডাকেনি। এই প্রথম ২৪ ঘণ্টা এগিয়ে এল তাই একটু আনন্দ একটু বিস্ময়। তবে কী ওরা এতদিনকার কট্টরতা থেকে সরে এল! অচ্ছুৎদের জন্য দরজাটা একটু খুলল!

প্রচার কে না চায়? হতে পারে অনেকে চায় না, আমি চাই। প্রচার না হলে আজ যে হারে আমার বই লোকে কিনছে–পড়ছে, সে কী সম্ভব হতো? আমি সেই ভাগ্যবাণের একজন যে টেলিভিশন পত্র পত্রিকা অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম সবার অকৃপণ সহযোগিতা পেয়েছি। ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই তারা আমাকে ব্যবহার করেছে, তবু তাদের সহযোগিতা না পেলে কে আমার নাম জানত–কে বা চিনত! আমার পাঠক, প্রকাশক আর সেই সাথে ওই সব সংবাদ মাধ্যম–সাংবাদিক অবশ্যই তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার কথা স্বীকার না করে কোন উপায় নেই।

দলিত সাহিত্য সংস্থার তেইশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে গেছি। এই সব লেখক কবিদের অনুষ্ঠানে খুব একটা যেতে চাই না। আমি লিখি তো সেই ৮১ সাল থেকে। বিদ্বান লোকদের কিছু ব্যঙ্গবিদ্রূপ জুটলেও তেমন তীব্রতম আক্রমণ আক্রোশের সামনে কখনও পড়িনি। সেই যে বছর মীনাক্ষী মুখার্জী আমার লেখা ইপি ডরু তে ছাপালেন আর সারা ভারতের কেউ কেউ আমার নামের আগে দলিত সাহিত্যিক বলে দেগে দেওয়া শুরু করল, বাঙালি দলিত সমাজের সেই সব লেখক যারা কেউ শিক্ষক কেউ কোন সরকারি বড় চাকুরে বহু বছর কলম ঘসেও যারা কোন সম্মান পুরস্কার স্বীকৃতি এখনও পাননি, নিজের জমানো টাকায় গাদা গাদা বই ছেপে গোছা গোছা বিলিয়েও রয়ে গেছে অপরিচয়ের অন্ধকারে, তারাই আমার সব থেকে বেশী বিরোধীতায় নেমে পড়ল। মনোরঞ্জন দলিত লেখক। লেখার কী জানে ও দলিতের সংজ্ঞা কী বোঝে! দলিত সাহিত্য কাকে বলে ধারণা আছে! ওকে তো ব্রাহ্মণ্যবাদীরা প্রচার দিয়ে উপরে তুলেছে। আসলে তো হাওয়া ভরা বেলুন, পেটে কোন বিদ্যে নেই।

দলিত বিশেষ করে নমঃশূদ্র সমাজের সেই সব মানুষ আমাকে গভীরভাবে ভালোবাসে, যারা পড়ে এবং ভাবে। যারা লেখে তারা ঈর্ষায় পোড়ে। তাই পারত পক্ষে আমি দলিত লেখকদের ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে চাই না। এটায় এই জন্য যেতে হল—এখানে আজ আমার পরিচিত একজন লোক আসবে। যার সঙ্গে দেখা করাটা খুবই দরকার এবং সে লেখক নয়, পাঠক।

এই মানুষটা একটা অদ্ভুত মানুষ। জাহাজে চাকরি করে। ছয় মাস থাকে জলে ছয় মাস ডাঙায়। কবে কোথায় কে জানে কার মুখে আমার কথা শুনেছিলেন। একদিন মুকুন্দপুরে এসে আমার কাছ থেকে খান কয়েক বই সংগ্রহ করে নিয়ে যান। বলে যান জাহাজ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। ফিরে এসে দেখা করবেন।

প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়। কতরকম প্রতিশ্রুতি দেয়। ফোনও আসে কত অচেনা নম্বর থেকে। সব কী আর মনে থাকে। বয়স বাড়ছে স্মৃতিও আগের মত তত প্রখর নেই। তাই এই লোকটির কী নাম জানতে চাইনি। পরে এসে দেখা করবে সে কথায় অতটা আস্থা রাখিনি। অমন তো সবাই বলে। কে বা পরে আর আসে!

বেশ কিছু দিন পরে একটা ফোন এল অচেনা এক নম্বর থেকে, কী দাদা গলাটা চিনতে পারছেন? মনে আছে আমার কথা? আমি এখন সুয়েজ খাল পার হচ্ছি। শোবার আগে ভাবলাম আপনার বইটা একটু পড়ি, তাই পড়া শুরু করেছিলাম। কী করেছেন মশাই, এইসব কেউ লেখে। এইভাবে কেউ লেখে। ঘুমের বারোটা বেজে গেল। বই মোটে ছাড়তে পারছি না। আমি এসেই আপনার সাথে দেখা করব। অনেক বই নেব। আমার চেনাজানা সবাইকে দেব।

মাঝে তিন চার মাস আর কোন খবর নেই। বিদেশে ফোন করলে অনেক টাকার বিল হয়। আমারও তাই ফোন করা হয়ে ওঠে না। সে কলকাতায় ফিরে নিজেই আমাকে ফোন করে, কেমন আছেন? আমি ফোন করেছিলাম। চিনতে পেরেছেন আমাকে?

না, চিনতে পারিনি। সত্যিই চিনতে পারিনি। আগের দুবার যে যে ফোন করেছে সে নাম্বার অন্য। নাবিক দাদা নামে সে নাম্বার সেভ করা আছে। এটা অন্য নাম্বার। তবু বলি হা হা চিনেছি। বলুন কেমন আছেন?

ভালো আছি। আমি আজ বিকেলে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে যাব। একটু দরকার আছে। আপনি কী ওখানে আসতে পারবেন। এলে দেখা হয়।

যাদবপুর আমার প্রিয় জায়গা। ওখানে কফি হাউস আছে। যেখানে আমার পরিচিত কবি লেখকদের আড্ডা, অনেকদিন যাই না। এই সুযোগে না হয় একবার দেখা সাক্ষাৎ করে নেব।

বলি, ক’টায় আসবেন আপনি?

এই পাঁচটা ছটা। আমি আপনাকে আসার আধঘন্টা আগে ফোন করে দেব। ফোন আসে রাত সাতটা নাগাদ। দাদা একটা জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলাম। এখন আমি আসছি। আমার কলেজ স্ট্রীটে একটা কাজ আছে। আপনি আমার গাড়িতে বসবেন কথা বলতে বলতে যাব। কাজ সেরে আপনাকে যাদবপুরে এনে নামিয়ে দিয়ে যাব।

তখনও মানুষটাকে চিনে উঠতে পারিনি। তাই মনে সন্দেহের দোলাচল। আমি গাড়িতে বসলাম, … গাড়ি যাচ্ছে …… কিছু দূর যাবার পর দুজন লোক উঠে পড়ল আমার দুপাশে দু দরজা দিয়ে। তুলল গাড়ির মালিকই। “আমার চেনা”। তারপর গাড়ি বেঁকে গেল চেনা পথ ছেড়ে অচেনা পথের দিকে। নিরালা নির্জন অন্ধকারের নিঃঝুম পথে। পাশের দুজন আমার পেটের কাছে চেপে ধরেছে ধাতব নল। কোন টু শব্দ করবি না। যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ চল। যদি এমনটা হয়? আমার শত্রুপক্ষ যদি এভাবে কোন ষড়যন্ত্র করে থাকে? নিয়ে গিয়ে যদি মেরে রেললাইনে শুইয়ে দেয়? শঙ্কাটা শুধু আমার নয়–আমার স্ত্রী অনুরও।

বলে সে, যদি তার দরকার আমাদের বাড়ি আসবে। এদিকে সেদিকে ডাকবে কেন? ব্যাপারটা সন্দেহজনক।

তাই ভদ্রলোককে বলতে হয়, না দাদা, রাত হয়ে গেছে। শরীরটাও খুব একটা ভালো নেই। অন্যদিন দেখা হবে। আজ ছেড়ে দিন।

দিন কয়েক পরে আবার ফোন, আবার সেই যাদবপুরে আসিবার জন্য ডাক। সেদিন পাশ কাটাই ডিউটি আছে বলে। দিন দশেক পরে আবার ফোন, আমি আপনাদের মুকুন্দপুরে আসছি। একবার দেখা করতে পারবেন?

জানতে চাই কখন আসবেন?

সন্ধ্যা ছটা সাড়ে ছটা।

এদিন আমার মুকুন্দপুরে আসতে হবে। দৈনিক জাগরণ পত্রিকা এবার লক্ষ্ণৌয় একটা অনুষ্ঠান করবে। আমি সেই অনুষ্ঠানের এক আমন্ত্রিত বক্তা। ওরা ই-মেলে আমার যাবার টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে। এক সাইবার কাফে-এর আই ডি ব্যবহার করতে পারি। সেই টিকিট নিতে আমি যখন মুকুন্দপুরে আসবই দেখা করে নেব। এত যখন তাগিদ আমাকে না দেখে তো ছাড়বে না। তবে আজই হয়ে যাক। অন্য জায়গার চেয়ে মুকুন্দপুর আমার পক্ষে খানিকটা সুবিধাজনক।

বলি আমি যাব। যেখানে অটো স্ট্যান্ড সেই মোড়ের শেডের নীচে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।

শীতকালের সন্ধ্যে। পথে লোকজন অপেক্ষাকৃত কম। একটা হালকা কুয়াশা জড়িয়ে আছে সন্ধ্যার অন্ধকারের গায়ে। নির্দিষ্ট সময়ে সাইকেল বাহনে আমি গিয়ে নামি অটোস্ট্যান্ডের সামনে। তখনই ফোন আপনি কোথায়?

যেখানে থাকব বলেছিলাম। অটো স্ট্যান্ডের ছাউনির নীচে।

ওখানে অনেক লোকজন। কথা বলা যাবে না। আপনি যেখানে ওয়ান-এ বাস স্ট্যান্ড, তার পিছনে যে মাঠ ওখানে চলে আসুন। দেখবেন একটা লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ওটা আমার। বিশাল এই মাঠটার নাম এফ.সি.আই মাঠ। এখন মাঠ একেবারে ফাঁকা। বিকালে যে বাচ্চারা ফুটবল খেলে, যে বয়স্করা হাঁটাহাঁটি করে, যে যবুক যুবতীরা গল্প গুজব করে–সবাই চলে গেছে। মৃদু আলোর মধ্যে শীত কুয়াশায় ডুবে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে লাল গাড়িখানা।

যাব কী যাব না! একটু মানসিক দোলাচল। মাঠের সামনে থেকে একটা রাস্তা নিতাই নগর হয়ে রুবীর দিকে চলে গেছে। এই পথে কোন লোকজন-গাড়ি ঘোড়া নেই। কোন অঘটন ঘটিয়ে গাড়ি এই পথে সরে পড়বে না তো।

যা হয় হোক! সাইকেল চালিয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখনই চিনতে পারি তাকে। আরে! এ আমি কাকে সন্দেহ করে বসেছি। এ তো আমার পাঠক। আমার স্বজাতি।

বলেন তিনি, বই এনেছেন?

না তো।

তাহলে কী করতে এসেছেন! আমি এতদূর থেকে এসে কী আপনাকে দেখে খালি হাতে ফিরে যাব?

বলেন নি তো যে বই লাগবে। যদি ফোনে একবার বলে দিতেন।

হ্যাঁ, আমারই একটু ভুল হয়ে গেছে!

একটু ভেবে বলেন তিনি, আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূর? চলুন, আপনার বাড়ি যাব। সাইকেল এখানে তালা মেরে রেখে দিন। গাড়িতে বসুন। ফিরে এসে সাইকেল নিয়ে যাবেন।

আমার বাড়ির পথ বড় এবরো খেবরো। মিনিট পনের পরে বাড়ি পৌঁছে আমার বেশ কখানা বই নিলেন তিনি। দাম কত হল? হিসেব করে দেখলাম তেরশো চল্লিশ টাকা। তিনি পকেট থেকে একটা বান্ডিল বের করে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে, এটা রাখুন।

কত আছে এতে?

পাঁচ হাজার।

এত কেন?

আপনাকে দিলাম। তেরশো চল্লিশ বাদ দিয়ে যা থাকে আপনার কাজে লাগবে। কাগজ কলম কিনবেন।

এক কাপ চাও খেলেন না আমার বাড়ি। আমাকে পাশে নিয়ে কোন ছবিও তুললেন না। কী নাম, কোথায় বাড়ি কিছুই জানালেন না। নিঃশব্দে নাম ফাটানো থেকে নিবৃত্ত থেকে চুপচাপ চলে গেলেন দরদী মানুষটা। এই মানুষটার নাম নিশীথ সরকার।

পরে অনেকবার ভেবেছি–কী বিরাট একটা ভুল হয়ে যেত আর একটু হলে। যদি মানুষটার সাথে ভয়ে দেখা না করতাম আজীবন কত বড় একটা ভ্রান্তি বয়ে বেড়াতে হতো। বন্ধুর গায়ে লেগে থাকত বৈরীর একটা অমূলক সন্দেহ।

এই বন্ধুটি আজ দলিত সাহিত্য সংস্থার অনুষ্ঠানে আসবে। তারপর ভেসে যাবে সমুদ্র পথে। আবার কবে কতদিন পরে ফিরবে ভারতে–কোন ঠিক নেই। যাবার আগে একবার আমার সাথে দেখা করে যেতে চান। তাই আমার যাওয়া। আমার এক মিত্র অনন্ত আচার্য-সেও যাবে। উল্টোডাঙ্গা থেকে তার সাথে একই বাসে গেলাম। যেতে যেতে বললাম আমি কিন্তু মঞ্চে উঠব না। বক্তৃতা দেব না।

আমি নিজেকে নিয়ে সব সময় বিব্রত। জন্মের সময় আমার মুখে মধু পড়েনি। ফলে মুখের ভাষা মিষ্ট নয়। লিখতে গেলেও কলমের মুখে এসে জমা হয় জীবন যন্ত্রণার তীব্র গরল। বহু মানুষের যেটা ভালো লাগে না। যা লিখি যা বলি–একটা বিতর্ক তৈরী করে। আজ আমার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার মোটে ইচ্ছা নেই।

না, পাশ কাটানো গেল না। দলিত সাহিত্য সংস্থার কল্যাণীর এক কর্মকর্তা মাইকে নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দিল আমার। অগত্যা না গিয়ে উপায় নেই। আর যা হবার তাই হল। আমার বক্তৃতার পর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন এক লেখক।

আমি বলেছিলাম বাংলা দলিত সাহিত্য হিন্দি মারাঠী গুজরাটি কন্নর তামিল তেলেগু ভাষার দলিত সাহিত্যের তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে। বলেছিলাম যে–এর জন্য দেশভাগ অনেকটা দায়ী। বাংলার সবচেয়ে সচেতন সংগঠিতদলিত সম্প্রদায় হচ্ছেনমঃশূদ্র। মাহার বাদে যে জনগোষ্ঠী বাবা সাহেব-ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের পিছনে সবচেয়ে আগে এসে দাঁড়িয়েছিল সে ওই নমরা।–বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত করে পাঠিয়েছিল। দেশভাগজনিত কারণে এই শক্তিশালী জনগোষ্ঠী ছিন্নভিন্ন হয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। তখন তাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দেয় অস্তিত্বের সংকট। থাকব কোথায়, খাব কী-বাঁচব কী ভাবে! সেই সংকট কাটিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পঞ্চাশ ষাট বছর কেটে গেছে। এমন বিপদে ভারতবর্ষের অন্য কোনও দলিত গোষ্ঠীকে পড়তে হয়নি। তাই তারা এগিয়ে গেছে।

লেখক বাবু এই কথায় ক্ষেপে গেলেন। আসল রাগের কারণ তো অন্য। তবে এখন–যখন মওকা একটা পাওয়া গেছে মনোরঞ্জনকে একটু ঠেসে দেওয়া যাক। বলে সে, আমি আমার পত্রিকায় একশো দলিত লেখকের নাম ঠিকানা বইয়ের তালিকা ছেপেছিলাম। কমপক্ষে এক হাজার বই। তবু উচ্চবর্ণরা বলে বাংলায় নাকি দলিত সাহিত্য নেই। আমাদের কিছু লোকও সেই সুরে সুর মেলাচ্ছে। তারা ওই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পক্ষে চলে গেছে।

বলে সেই বাবু লেখক–প্রচার নেই বলে আমাদের বই বিক্রি হয় না। হল-এ তখন শ খানেক লোক। তাদের বলেন–এই ক’জন পাঠক যদি পাই অবহেলায় আমি রবীন্দ্র পুরস্কার ছেড়ে দিতে পারি।

বক্তৃতায় খুব তালি পান লেখক। আমার তখন বলতে ইচ্ছা করছিল–বাপু হে–চরণদাস চোর বলেছিল, সোনার থালায় ভাত খাবে না। হাতিতে চড়বে না, রাণী বিয়ে করবে না, রাজা হবে না। কারণ এই সব প্রাপ্তি সম্ভাবনা তার কল্পনার হাজার মাইলের মধ্যে ছিল না। আপনি বলছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। সেটা যদি খুব বড় প্রতিজ্ঞা হয়–আমি বলছি নোবেল নেব না–বুকার ম্যাগসেসাই নেব না। কী যায় আসে এইসব ফাঁকা আওয়াজে। এতে নির্বোধের হাততালি হয়ত মেলে বুদ্ধিমান হাসে—’আঙুর ফল টক’ বলে।

আমি দলিত সাহিত্য নেই তা বলিনি। বলেছি তেমন উল্লেখযোগ্য কৃতী নেই। বাংলা ভাষা সাহিত্যের মূল ধারায় প্রতিনিধিত্বকারী যে সব কালজয়ী রচনা সম্ভার রয়েছে–অন্ততঃ একশো বইয়ের নাম এক নিঃশ্বাসে বলা যায়–আমাদের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বাদ দিলে আর একখানাও সেই পর্যায়ের উচ্চাঙ্গ রচনা নয়।

ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র–সে বলেও কোন ফল হবে না। আমাদের যে দুর্বলতা তা স্বীকার করতে হবে। পারিনি, তবে হতাশ বা নিরুদ্যম নই। চেষ্টা করছি, শিখছি এবং লিখছি। এভাবে একদিন নিশ্চয় পেয়ে যাব সাহিত্যের সম্মানের সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়ে দিতে। একথা বলতে লজ্জার কী আছে?

হাজার বছর ধরে বিদ্যায়তনের দ্বার আমাদের জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। দরজাটা সবে একটু খুলছে, সামান্য আলো আসছে। ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে দলিত জীবন। আলোচিত হচ্ছে। আমাদের আজীবন ষ্টোয় যেখানে পৌঁছাতে পেরেছি–পরবর্তী প্রজন্ম সেই সিঁড়িতে পা রেখে আরও উচ্চে ওঠার লড়াই চালাবে। আমাদের তো অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হয়েছে। তারা সিমেন্টের সিঁড়ি না পাকা বাঁশের মই তো হাতের কাছে পাবে। ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই সেই আসন দখল করবে যে আসনের আশা আকাঙ্খা আমাদের ছিল।

যা এখনও করায়ত্ব হয়নি তার জন্য উদ্যম থাকুক। সেই পথটা আরও প্রশস্ত করার চেষ্টা করা হোক। তা না করে যদি শুধু অন্যকে দোষারোপ করি, কাথাকথা সেলাই করি লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে রয়ে যাব। কোনদিন শিখর বিজয় হবে না। চাকরীতে সংরক্ষণ আছে শিক্ষক অধ্যাপক বড় বড় পদে চাকরি মিলে যায় সংরক্ষণের সুযোগে। আমার এক দুর্মুখ বন্ধু বলেছিল, আসলে আমাকে অংক কষে বুঝিয়ে ছিল, ধরো কোন একটা চাকরিতে যোগ্যতার মান দরকার একশো। যে উচ্চবর্ণ সন্তানের একশোযোগ্যতা আছে সে অনায়াসে চাকরিটা পেতে পারে। যদি নব্বই হয় কোন দাদা মামা কাকাকে ধরে পেয়ে যেতে পারে। যদি আশি হয় কোন রাজনৈতিক সুপারিশে পেলেও পেতে পারে সত্তর হলে আর পাবে না।

ওই একই চাকরি পাবার ক্ষেত্রে একজন নিম্নবর্ণের যোগ্যতার মাপ মাত্র পঞ্চাশ। চল্লিশ থাকলে দাদা মামা কাকা রাজনেতা ঘুষ দেবার ক্ষমতা এই সব ক্ষমতাকে ব্যবহার করেও পেয়ে যেতে পারে ওই চাকরিটা। তাহলে দেখা যাচ্ছে সত্তর যোগ্যতা নিয়ে উচ্চবর্ণের একজন যে চাকরি পাবার ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে পঞ্চাশ হয়েও একজন পেয়ে যাচ্ছে সেই চাকরি।

এই নিয়ে অবশ্য বহু ক্ষোভ বিক্ষোভ যুক্তি তর্ক আছে। দুপক্ষের কাছেই যুক্তির শানিত অস্ত্র মজুদ। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিরোধী নই। অর্জুনের মাছের চোখ বিদ্ধ করা বিদ্যার চেয়ে একলব্য দ্বারা কুকুরের মুখ বন্ধ করা বাণ অনেক প্রশংসার। অর্জুন উপযুক্ত গুরু সহ অনেক কিছু নাগালে পেয়েছে অস্ত্র শিক্ষার জন্য। একলব্য কিছুই পায়নি। তবু সে যা আয়ত্ব করেছে তা বহু পরিশ্রমের ফসল।

উচ্চবর্ণের একজন সন্তান শিক্ষিত হয়ে ওঠার জন্য যা যা দরকার সহজে পেয়ে যায়। নিম্নবর্ণের একটি সন্তান–হতে পারে তার মা কোন বাবুর বাড়ি বাসন মাজে, বাপ চালায় রিকশা–তাকে লেখাপড়া করতে হয় এর তার কাছে বই চেয়ে কেরোসিন কুপির আলোয়। এই অবস্থায় পঞ্চাশ যোগ্য হয়ে ওঠা পাঁচ শতর সমান।

তবে আমার আপত্তি আছে সংরক্ষণের সুযোগ বিতরণের পদ্ধতি বিষয়ে। একজন নিম্নবর্ণ–যে চাকরি পেয়ে গেছে। আর তো তার ছেলে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করে তোলায় অসুবিধা নেই। তবু কেন সেই ছেলে মেয়েকে ওই সুযোগ দেওয়া হবে? এক বিশ্বাস সিবিআই অফিসার ছিলেন, এক বিশ্বাস ভারত সরকারের বিরাট অফিসার, এক বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ার, এক মল্লিক শিক্ষক, এক বিশ্বাস ব্যাংক অফিসার, এক বিশ্বাস অধ্যাপক, এক বালা শিক্ষক–এমন নাম হাজার হাজার বলা যায়। এদের সন্তান সন্ততি সংরক্ষণের সুযোগ নেবে কিনা, নিয়েছে কিনা আমার জানা নেই, নিয়ে থাকলে সেটা অন্যায়। তার চেয়ে অন্যায় সেই সরকারের, যে দিয়েছে। এতে তেলা মাথায় তেল পড়েছে আর বঞ্চিত হয়ে গেছে দরিদ্র দুঃস্থ সেই বাচ্চাটা যার একটা চাকরি বড় দরকার।

তাই আমার মনে হয় সংরক্ষিত পদে চাকরি দেবার আগে প্রার্থীর নিকট থেকে এই মর্মে হলফনামা নেবার জন্য সংসদে বিল পাশ হোক যে তার পিতা পিতামহ প্রপিতামহ তিনপুরুষের কেউ কোনদিন কোন সরকারি চাকরি পায়নি।

মিথ্যে হলফ নামা দিলে চাকরি থেকে সাথে সাথে বরখাস্ত, জেল এবং জরিমানা।

এমনটা যদি হয় তাহলে বন্ধ হবে তেলা মাথায় তেল পরা আর উপকৃত হবে সমাজের সবচেয়ে নীচের অংশের নিম্নবর্ণ মানুষের বহু কষ্টে লেখাপড়া শেখা ছেলে মেয়েগুলো।

বাবা সাহেব আম্বেদকর, গুরুচাঁদ ঠাকুর পেরিয়ার রামাস্বামী নাইকার মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে এদের প্রত্যেকের আশা এবং উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের পেষণ থেকে নিম্নবর্ণ দলিত মানুষকে রক্ষা করা। সেই লক্ষ্যে তারা আজীবন কঠোর আর আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাদের সংগ্রামের সুফল চেটে পুটে খেয়ে কিছু মানুষ জোঁকের মত ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এই লোকগুলি স্বজাতি দলিত দরিদ্র মানুষদের কোন উপকারে আসে না। এরা মত্ত হয়ে আছে আরও অর্থ আরও সুখভোগ প্রাপ্তির তালাশে। নিজেকে ছাড়া নিজের পুত্র কন্যা পরিজন ছাড়া এরা কাউকে ভালোবাসে না। তাই এই সব লোক দলিত তাস খেলে বার বার সমাজের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেবে এ জিনিস চলতে দেওয়া অন্যায়।

বাবা সাহেব চাকরিতে সংরক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি আশা করেছিলেন–যারা আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে তারা নিম্নবর্ণ মানুষদের উন্নতির জন্য কিছু উদ্যোগ নেবে। তাই তিনি বলেছিলেন–পে ব্যাক টু সসাসাইটি। নিয়েছে তারা অনেক কিন্তু দেয়নি কেউ কিছু। এইসব দেখে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আক্ষেপ ঝরে পড়েছিল তার গলা থেকে–এই সব শিক্ষিত মানুষ আমাকে ঠকিয়েছে সবচেয়ে বেশী।

তাহলে যারা সমাজের জন্য কিছু করবে না, সমাজ তাদের জন্য কিছু করবে কেন!

আজ মনে হয় সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসে গেছে, একদল লোক কবে কোনকালে এক দলিত পরিবারে জন্মেছিল, মাত্র সেই কারণে দলিত সমাজের কোন উপকার না করে–দলিতদের জন্য সংরক্ষিত রাখা সব মধু চেটে পুটে খেয়ে নেবে। এর বিরুদ্ধে দলিত সমাজের মধ্য থেকেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠা। প্রয়োজন মনে করলে তাদের ‘তনখাইয়া’ ঘোষণা করে সামাজিক বয়কট করা।

দলিত সমাজ অন্য অহিতকারীদের সাথে তো লড়ে নেবে সে শক্তি তার আছে। পারবে না যদি নিজের মধ্যের কেউ মুখে এক কর্মে অন্য রকম হয়। এদের চিহ্নিত করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা দরকার। সে যাই হোক, তবে আমাদের এইসব দলিত সাহিত্যিক খ্যাতি প্রত্যাশী বড় বড় সরকারী চাকুরেদের এটাই হয়ে গেছে মহা সমস্যা। সংরক্ষণের দৌলতে যত সহজে সরকারি চাকরি মিলে গেছে অত অনায়াসে সাহিত্যিক স্বীকৃতি মেলে না। সেখানে প্রতিযোগিতা বড় কঠিন। একশোতে তেত্রিশ পেয়ে পাশ এখানে চলে না। একশোতে পূর্ণ মার্কস একশোই চাই। এই একটি ক্ষেত্রে কেউ দয়া কৃপা দেখাবে না। এক ইঞ্চি জমি ছাড়বে না। সম্পূর্ণ যোগ্যতার বলে আসনটি অধিকার করতে হবে।

আমাদের মধ্যের কেউ কেউ সাফাই দেয়–“আমরা এক পুরুষের শিক্ষিত’। এটা কোন কথাই নয়। আপনি ওয়ান থেকে গ্র্যাজুয়েট যে বই পড়ে হয়েছেন, যে স্কুল কলেজের যে সব মাস্টার আপনাকে পড়িয়েছে তাকেও–তাই। তাহলে আপনি তার চেয়ে কম কীসে? কম ওই–আগ্রহের। কম ওই আয়ত্ব-আত্মীকরণের নিষ্ঠা একাগ্রতার। আর বেশী হচ্ছে সবকিছু অতি আয়াশে পেয়ে যাবার প্রবণতা।

এই প্রবণতা আমাদের রক্তের মধ্যে আছে। আমরা এক গুরুর শিষ্য হই। তার পায়ে প্রণতঃ হই আর আশা করি আমার কিছু করতে হবে না–যা কিছু সমস্যা সব গুরু দূর করে দেবে। যে। নিজের সমস্যা দুর করতে পারে না। সে দূর করবে আমার সমস্যা?

আমরা কালী শিব নানান ঠাকুর দেবতাকে লোভ দেখাই যদি আমার একটা চাকরি হয়, লটারিতে লাখ টাকা পাই তোমাকে পাঁচসিকে মানত দেব। ঠাকুর তো একটা হাঁদারাম যে পঁচিশ হাজার টাকা মাস মাইনের চাকরি বা লাখ টাকার লটারী আমাকে দেবে পাঁচসিকে পাবার লোভে!

আমাদের নমশূদ্রদের সবচেয়ে বড় তীর্থ পশ্চিমবঙ্গে ঠাকুরনগর। হরিচাঁদ ঠাকুরের নাতি পুতিরা ওদেশ থেকে পালিয়ে এপার বঙ্গে এসে বেশ ক’বিঘে জমি কিনে ঘর বাড়ি বানিয়েছিল। নীচু জমি উঁচু করার প্রয়োজনে প্রচুর মাটি চাই, তাই খনন করেছিল বড় একটা পুকুর। তার নাম দিয়েছে কামনা সাগর। এই পুকুরে নাকি যা মনস্কামনা নিয়ে ডুব দেওয়া হবে–সব পূর্ণ হয়ে যাবে।

আমাদের লোকজন বহু পথ পার হয়ে গিয়ে সেই পুকুরে ডুব দিচ্ছে। কী তাদের কামনা, পূর্ণ হচ্ছে কী হচ্ছে না, কে জানে? যদি হয় তাহলে আমার পরামর্শ একজন ডুব দিয়ে মনে মনে বলুক ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হবো। একজন বলুক মুকেশ আম্বানী হবো। একজন বলুক অমিতাভ বচ্চন হবো। এইভাবে সমাজের সবকটা শীর্ষ স্থান আমরা পেয়ে যেতে অসুবিধা হবে না।

ওই সাহিত্য শীর্ষে ওঠার জন্য উদগ্রীব লেখককেও বলব–একটা ডুব দিয়ে নিন। আর তা না হলে একাগ্রচিত্তে সাধনা করুন। যত মহৎ সাহিত্য আছে সব পড়ুন। শিখুন কেমন করে লিখতে হয়। সেই যে চশমা পরা খালি গায়ের লাঠিতে ভর দেওয়া বুড়ো–অনেক কথার সাথে তার একমত হওয়া যায় না–সেটা সত্যি। তবে সে যে বলেছে চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কার্য সিদ্ধ হয় না। এটা একশোর মধ্যে একশো দশভাগ সত্যি।

আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই কথাটা আরও বেশী সত্যি।একজন বড় রাজনেতা তার ছেলেমেয়ে বাপের নাম ভাঙিয়ে নেতা হয়ে বসতে পারে। এক ধর্মগুরু–তার ছেলেও হয়ে যেতে পারে ধর্মগুরু। রাজার ছেলে রাজা, জমিদারের ছেলে জমিদার হয়ই। কিন্তু সাহিত্যের অঙ্গন অত সহজলভ্য নয়। তাই কোন বিখ্যাত লেখকের ছেলে সেই সুযোগ পায়নি। যে হয়েছে সে বহু সাধ্য সাধনায় হয়েছে।

এইখানে হেরে যাচ্ছে আমাদের নমশূদ্র লেখকরা। সবাইনয়, অনেকের আপ্রাণ প্রয়াস আছে, তবে অধিকাংশই ফাঁকি দিয়ে আদায় করতে চাইছে ওই আসন। পারছে না, তাই যে বা যারা তাকে ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠছে–ক্ষোভে দুঃখে বিষোদগার করছে।

যাদবপুর ইউনিভাসিটির তুলনামূলক সাহিত্যের এক অধ্যাপক গেছেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এক সাহিত্যের অনুষ্ঠানে।তিনি সেখানে পাঠ করলেন পশ্চিমবঙ্গের জেলখাটা রিকশাঅলার লেখা একটি গল্প। গল্পের নাম রিবাজ।

ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির এক ডেপুটি রেজিস্ট্রারও সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। তিনি চেপে ধরলেন অধ্যাপককে, মশাই আপনি কী আর লেখক পেলেন না। শেষকালে এক রিকশাঅলার লেখা!

বলেন অধ্যাপক, আমি কী করব বলুন রিবাজ গল্পটা যে ওই লোকটার লেখা। আপনি একটা রিবাজ লিখুন, পরে যে অনুষ্ঠানে যাব সেখানে সেটাই পড়ব।

আমি কোন মন্তব্য করব না। সব কথার শেষ কথা তো অধ্যাপক বলে দিয়েছেন। আমি শুধু বাসের পিছনে লিখে রাখা লেখাটা পড়ব। হিংসা কোরো না। চেষ্টা করো, তোমারও হবে।

***

কথা হচ্ছিল ২৪ ঘণ্টা চ্যানেলের বিষয়ে। চলে গেছি বিষয়ান্তরে। সেই কথায় ফিরে আসি।

সেদিন মঙ্গলবার। প্রস্তুত হয়ে আছি ফোন আসবে। ফোন এল সেই সাড়ে আটটায়। তবে তখন তাদের গাড়ি বাইপাস পার হচ্ছে। আপনি কোথায়?

আমি বাড়িতে।

আমরা এসে গেছি। তাড়াতাড়ি আসুন।

দোষটা আমার নয়–তাদের। বিভিন্ন চ্যানেলে বহুবার ইন্টারভিউ দিয়েছি। অভিজ্ঞতায় জানি–কাল আসব বলে আসে তিনদিন পরে। একবার তো এখনই আসছি বলে যে গাড়ি আমার বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিল–মাঝপথ থেকে ঘুরে এক দুর্ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে চলে যায়। তাই ২৪ ঘণ্টার কথায় নেচে উঠিনি। ফোন আসুক তখন যাব। এতেই মুশকিল হয়ে গেল।

তখন আমি সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি। ফোন পেয়ে চা প্লেটে ঢেলে মুখ পুড়িয়ে খেয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হই। আমার সবদিনের বাহন সাইকেল। ভাগ্য ভালো তখনই একটা স্যাটেল ট্যাক্সি পেয়ে যাই। সাইকেলে বিশ মিনিট লাগে ট্যাক্সি পনের মিনিটে পৌঁছায়। মাঝ পথেই একবার আবার সাংবাদিকের ফোন পাই। আপনি কত দূরে? বলি পাঁচ-সাত মিনিটে এসে পড়ব। ট্যাক্সিতে আছি।

বলে সে, আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আসুন আপনি। গলার স্বরটা যেন কেমন কেমন। মোটেই একজন লেখকের প্রতি সম্মান সভ্রম সূচক নয়। যেন অভদ্র ভাষা ~ আয় শালা তোকে মজা দেখাচ্ছি। বুঝতে পারছিলাম–হেনস্থা কপালে আছে। তবু এলাম। শেষটা না দেখে কী করে যাই।

আমি আসা মাত্র ঝাঁঝের সাথে বলে সে–আমরা কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সময়ের দাম নেই! বললাম সাড়ে আটটায় আসব। আপনার থাকা দরকার ছিল। কেন থাকেননি?

বলি আমি, বড়জোর দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছেন। তা আপনারা যখন রওনা দিলেন পোদ্দার কোর্ট থেকে একটা ফোন করে দিতে পারতেন। তাহলে তো দেরি হতো না।

কেন ফোন করব! কাল তো বলে দিয়েছি!

হ্যাঁ কাল বলেছেন। আজ তো আপনাদের অন্য জরুরি কাজ পড়ে যেতে পারে। আমি কি করে বুঝব? আমারও তো শরীর খারাপ বা কোন বিপদ আপদ ঘটে যেতে পারে!

সে এক সম্মানীয় চ্যানেলের সাংবাদিক। কথা বলছে একজন তুচ্ছ রাঁধুনির সাথে, যাদের মুখ টিভির পর্দায় দেখাবার জন্য বিগলিত হয়ে যাওয়া উচিৎ। আর আমি কথা বলছি এক লেখক হিসেবে। দাবি করছি সেই সম্মান। যে লেখকের সংবাদ বিক্রি করে এই সব লোক অনেক অনেক কামায়। ফলে, দুজনের গলার স্বর উচ্চগ্রামে উঠতে থাকে। যাকে রীতিমত ঝগড়া বলে।

তখন বলি তাকে–আপনি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন? না কি আমি কোন দরকারে গেছি আপনার দরজায়? আপনি এভাবে ধমকে কথা বলছেন? আমি কী আপনার কর্মচারি! আপনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন। ইচ্ছা না থাকলে চলে যাবেন। দশ মিনিট আমার জন্য নষ্ট হয়েছে বলে আপনি গরম দেখাচ্ছেন, তাহলে আপনার জন্য আমি দুঘণ্টা কেন নষ্ট করব? যান, ইন্টারভিউ দেব না।

বলেই আমি হাঁটা দিয়েছি সামনের দিকে। এত ইন্টারভিউ হয়েছে। তবু তো জীবনের কিছু বদলাল না। সেই তো খুন্তি নাড়া। আর একটা না হলে কী এমন ক্ষতি হবে?

হেঁটে হেঁটে আমি যখন বেশ কিছুটা চলে গেছি ওরা গাড়ি নিয়ে গিয়ে আমার পথ আটকায়, চলে যাচ্ছেন যে।

যাব না তো কী করব?

আমি চ্যানেলে গিয়ে কী জবাব দেব?

সেটা আপনার ব্যাপার।

না, না, আপনি ইন্টারভিউ দিয়ে যান।

দেব। আগে প্লিজ বলুন।

সাংবাদিকেরও কোন দোষ নেই। তার একটা প্রোগ্রাম বেলা তিনটায় টেলিকাস্ট হবে। এখানের কাজ সেরে ফিরে গিয়ে সেটার এডিটিং করতে হবে। মাথায় রয়েছে সেই চাপ। তাই মাথা গরম।

পরে সে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমার কর্মস্থলের শুটিং সেরে আমার বাড়ি গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাঁদেমির পদক, চারদিকে ছড়ানো অজস্র মানপত্র, ভারতবর্ষের প্রথম শ্রেণির সবকটা পত্রিকায় আমার ছবি-খবর, আমার লেখা বইয়ের গাদা সব দেখে বলে সে, ক্ষমা করবেন। মাথাটা ঠিক ছিল না। আজেবাজে বলেছি। পরে একদিন আমি আবার আসব।

সত্যিই সে এল দিন সাতেক পরে। দিয়ে গেল একটা চিঠি। সোনার বাংলা হোটেলে ১৪২০-র ২৪ ঘণ্টা অনন্য সম্মান অনুষ্ঠানে আমার আমন্ত্রণ। বলে গেল সে–আমি তো যাবই আমার সঙ্গে একজন সঙ্গী নিয়ে যেতে পারি। নির্দিষ্ট দিনে গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে যাবে।

সেদিন গিয়ে জানতে পারলাম–এই বছর আমাকে মনোনীত করা হয়েছে এই সম্মানের জন্য। আরও একজন সাহিত্যিক পাচ্ছেন এই সম্মান তিনি বুদ্ধদেব গুহ।

সেসব তো হল। অনন্য সম্মান তো পেলাম। চ্যানেল দিল পঁচিশ হাজার টাকার চেক, মানপত্র, ট্রফি আর সেনকো গোল্ড দিল একখানা রূপোর স্মারক–নয় দশ ভরি ওজনের।

এখন এক একদিন মনে মনে ভাবি সেদিন যদি ইন্টারভিউ না দিয়ে চন্ডাল রাগের পিঠে সওয়ার হয়ে চলে যেতাম–ওসব তো পেতাম না। টাকা তো খরচ হয়ে গেছে। রয়ে গেছে মানপত্র স্মারক। অন্ততঃ তিন চারবার পুরো প্রোগ্রামটা টেলিকাস্ট হয়েছে।তাইবহু মানুষ জেনেছে আমার কথা। বেশ কিছু বই বিক্রি হয়েছে। পাঠক বেড়েছে আমার বইয়ের। সব ফুস হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে।

একটা প্রাপ্তি হারিয়ে যাচ্ছিল অহেতুক ভয়ে আর একটা চলে যেতো অকারণ ক্রোধে।

#

আমাকে লিখতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তবু লিখি। না লিখে পারি না, তাই লিখি। মহা সমুদ্রে ডুবে যাওয়া একজন মানুষ যেমন বেঁচে থাকার আকুল আকাঙ্খায় হাতের কাছে যা পায় আঁকড়ে ধরে আমি ধরে রেখেছি সস্তা দামের একটা কলম। এবং এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর জন্য কারওর কাছে কোন সহযোগিতা পাব তেমনটা আশা না করাই ভাল। যদি পাই উত্তম, না পেলেও হা হুতাশ করার কিছু নেই। লেখন ক্রিয়া যেহেতু এটি একটি সৃজন নির্মাণ বা আন্দোলন, এর একটা অভিমুখ তো থাকেই।

ণতবে যিনি মিষ্টি মিষ্টি–বাজারের চাহিদা অনুসারে প্রেমের কথা কাহিনী লেখেন তার কথা আলাদা। কিন্তু যিনি সচেতনভাবে কঠিন কঠোর গদ্যের লোক, তার তো নব নির্মাণের প্রয়োজনে যা জীর্ণ যা পুরাতন পচা গলা সেই সমাজ ব্যবস্থাকে অপসারণ উদ্দেশ্যে আঘাত না করে অন্য কোন উপায় থাকে না। ফলে, নিশ্চিন্তরূপে পুঁজিবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদ পুরুষ আধিপত্য এবং শাসন প্রশাসন তার বিরুদ্ধে যাবে। আর অতি স্বাভাবিক নিয়মে কিছু মানুষ সেই লেখা এবং লেখকের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠবে। সেই বিরূপ লোকেদের হাতে যদি থাকে প্রচুর অর্থ–প্রচুর রাজনৈতিক ক্ষমতা, তারা লেখকের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবেই। এই অবস্থা থেকে রেহাই পাবার কোন পথ খোলা নেই।

আমার ভাগ্য আমাকে সেই ভীষণ অবস্থার মধ্যে এনে ফেলেছে। কারও দোষ নেই –দোষ আমার। কারণ, আমি যে নিজেই এই অবস্থা সৃষ্টি করেছি। এখন পরিত্রাণের উপায় আমাকেই খুঁজে নিতে হবে। যদি পারি–বিজয়। যদি না পারি–বিলোপ।

লোকে বলে ভাগ্যবানের বোঝা স্বয়ং ভগবান নাকি বয়ে দেন। আর যে ভাগ্যহীন তাকে তার নিজের বোঝা নিজে উটের কুঁজের মত বয়ে নিয়ে যেতে হয়–নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। আমি শেষ দলের লোক যাকে প্রতিটা সিঁড়ি অতিকষ্টে তৈরি করে এক এক পা এগোতে হচ্ছে সামনে।

আমি মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি বালক, কোথায় পৌঁছাতে চাও তুমি? কেন এই বোঝা বইছো? এইসব লেখা লেখি দিয়ে কী পেতে চাও?

সেই যখন আমার প্রথম বই বৃত্তের শেষ পর্ব প্রকাশিত হয় আমি আমার বই বিক্রি করতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বামপন্থী অতি খ্যাতনাম্নী অধ্যাপিকার কাছে গিয়েছিলাম। বিনীত গলায় বলেছিলাম আমি একজন রিকশা চালক লেখক। একটা বই লিখেছি। একখানা কিনবেন? পড়বেন?

তিনি আমাকে মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দিয়েছিলেন–কে তোমাকে লিখতে বলেছে! সত্যিই তো। কে আমাকে লিখতে বলেছে? যেটা যার কাজ সেটা তো তাকেই মানায়। আমি এক রিকশাঅলা, আমার কাজ তো গরু গাধার মত গাড়ি টানা। লেখালেখি এসব তো শিক্ষিত বিদ্বান লোকের কাজ। আমি শালা সেই শ্রেণীতে নাম লেখাতে চাইছি কেন! কেন লিখি আমি?

আমি কি এই পচাগলা জীর্ণ হাজার বছরের বনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে থাকা রক্তচোষা সমাজ ব্যবস্থাটাকে কলম চালিয়ে বদলে ফেলতে পারব? আমি কি জাত বর্ণের নামে পুরোহিত শ্রেণীর অমানবিক ধর্মীয় বর্বরতাকে বন্ধ করে দিতে পারি! ওই যে শিশু ফুটপাতে প্রবল শীতের কামড়ে কুঁকড়ে গেছে–এনে দিতে পারি একটা শীত বস্ত্র। ওই যে মা সন্তান কোলে কাঁদছে খিদের তাড়নায়–বসিয়ে দিতে পারি তাকে গরম ভাতের থালার সামনে!

পারি না। পারি না।

মানুষ যাক মায়ের ভোগে। আমি কী এই লেখার দ্বারা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে পারি। পেতে পারি সেই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য যেটুকু না পেলে জীবন অচল। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা মেলে।

তাও পারি না। আমি এত শক্তিমান লেখক নই।

তবু লিখে যেতে চাই। দেশ সমাজ মানুষ এবং নিজ কারওঁ নে কাজে আসবে না, তবু লিখে যেতে চাই। কেন বেঁচে আছি তা জানি না, তবু মরতে চাই না–বেঁচে থাকতে চাই। আমি মরে গেলে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না। আমার মত কত লক্ষ কোটি এসেছে চলে গেছে, তবু আমার যেতে মন সায় দেয় না। প্রাজ্ঞ পুরুষ বলে গেছেন–জীবন লম্বা না হয় না থোক, পারলে বড় কর। বড় করতে পারিনি–লম্বা করেছি। তিন কুড়ি পার। তবু বাঁচতে চাই–লিখতে চাই।

কারণ, সেই শেষ লেখাটা যে আজও লেখা হয়নি। কেউ দিব্যি দেয়নি–এ আমার নিজের কাছে নিজের দায়। এই দায় আমাকে আজন্ম বয়ে যেতে হবে। সব অবজ্ঞা অনাদর উপহাস তিরস্কার অপমান অত্যাচার সয়ে। আর লিখতে হবে সেই শেষ লেখাটা।

সেই শিরোমণিপুর ক্যাম্পে শিশুবেলায় আমি তো মরেই গিয়েছিলাম–তারপর আবার যে বেঁচে উঠলাম সেটা ওই অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করে যাব, বোধহয় সেই কারণে।

তাই আমি লিখি, তাই আমাকে লিখতে হবে। ১৯১৪-র শেষ পাদে এসে অশোকজি ৮১ বছর বয়সে মারা গেছেন। তখন বেঁচে ছিলেন। একদিন অশোক সাকসেরিয়ার বাড়ি লর্ড সিনহা রোডে গেছি। বুড়ো মানুষ, শরীরটা একটু সেদিন খারাপ ছিল ওনার। শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। তার পর বালিশের তলা থেকে বের করলেন আঁকা বাঁকা অক্ষরের লেখা একটা বাংলা পাণ্ডুলিপি। বললেন–আমাদের সঙ্গে তো বাংলা প্রকাশকদের খুব একটা চেনা জানা নেই, আপনার আছে। এটা একটা মেয়ের আত্মজীবনী। দেখুন যদি কোথাও ছাপাবার একটু ব্যবস্থা করতে পারেন তো খুব ভালো হয়।

একটা মেয়ে। কে সেই মেয়ে?

মেয়েটির নাম বেবী হালদার। এই পশ্চিমবঙ্গেরই মেয়ে। আমি বা বই পাড়ার প্রকাশক কে জানত যে মাত্র ক্লাশ সিক্সে পড়া বাবুর বাড়ির কাজের মেয়ে বেবী–তার এই আত্মজীবনীর জন্য একদিন পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে যাবে। ছাব্বিশটা ভাষায় ছাপা হবে তার বই। লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা দেবে। বদলে যাবে বেবীর অবহেলিত জীবন।

বেবীর বাবার তিন বিয়ে। প্রথম পক্ষের বউ বেবীর মা তার চার পাঁচ বছর বয়েসের সময় তাকে ফেলে চলে যায়। বেবী বড় হয়ে ওঠে বিমাতাদের অনাদর অত্যাচার সয়ে সয়ে। যখন তার মাত্র তের বছর বয়স বিমাতা আর মদ্যপ বাপ মিলে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় তার দ্বিগুণ বয়সের এক ভ্যানচালকের সাথে। সেও ছিল মদ্যপ এবং অত্যাচারী। সে মদ খেয়ে বেবীকে খুব মারত পেট ভরে খেতে দিত না।

এরপর বেবীর মা যেমন একদিন তার অত্যাচারী স্বামীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল বেবীও তার স্বামীর সংসার ফেলে চলে যায়। নানান পথ ঘুরে সে একদিন পৌঁছায় দিল্লীর গুরগাঁও। এখানে সে কাজ নেয় এক অকৃতদার অধ্যাপকের বাড়িতে রান্না বাসন মাজা কাপড় কাঁচার। বেবীর জানবার কথা নয় যে এই অধ্যাপক হিন্দি সাহিত্য জগতের সম্রাট মুন্সী প্রেমৰ্চাদের নাতি, নাম প্রবোধ কুমার।

একদিন কোন এক অবসরে বৃদ্ধ অধ্যাপকের কাছে কথায় কথায় বেবী তার দেশের বাড়ির কথা বেদনাদায়ক জীবনের কথা বলে বসে। প্রবোধ কুমার সাহিত্যিক। বেবীর কথা শুনে অধ্যাপকের মনে হয় যদি বেবী তার বিড়ম্বিত জীবন গাঁথা অকপটে লিখে ফেলতে পারে একটা অসাধারণ আত্মকাহিনী তৈরী হবে। উনি তখন বলেন–তোমার দুঃখ বেদনার সব কথা লিখে ফেলল। বাল্যকাল থেকে আজ অবধি সব লেখো। এই লেখাই তোমার জীবন বদলে দেবে। লিখতে হলে পড়তে হয়। কি করে লিখতে হবে শেখাবার জন্য কলকাতার বন্ধু অশোকজির মাধ্যমে তসলিমা নাসরিনের মেয়েবেলা আনিয়ে পড়তে দেন। পড়ো। লেখো।

বেবী তাই করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চালিয়ে যায় জীবনী লেখার কাজ। কিছুটা লেখা হলে প্রবোধ কুমারকে পড়ে শোনায়। কোথাও কোন ভুল ভ্রান্তি হলে সংশোধন করে দেন বৃদ্ধ অধ্যাপক। লেখা হয়ে যায় বেবীর জীবনী।

এরপর প্রবোধ কুমার সেই পান্ডুলিপি কলকাতার বন্ধু অশোকজির কাছে পাঠিয়ে দেন প্রকাশনার জন্য।

অশোকজি অনেক খুঁজেছেন। প্রকাশক পাননি। তাই আমাকে দিয়েছেন, যদি কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমি নিজেই তো কোন প্রকাশক নিজের জন্য যোগাড় করতে পারি না। অন্যের জন্য কী করে করব! তবু চেষ্টা করি। প্রায় দু-মাস বই পাড়ায় বিভিন্ন প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরি। কিন্তু কোন প্রকাশকই এক ঝি মেয়ের আঁকাবাঁকা অক্ষরের জীবনী পড়ে দেখার উৎসাহ দেখায় না। তাই একদিন সেই পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে আসি অশোকজির কাছে। ‘আমি পারলাম না দাদাজি’।

একে বোধহয় বলে ভাগ্য। এখন যখন বেবীর বই দুনিয়া কাঁপাচ্ছে, যে সব প্রকাশক পান্ডুলিপি হাতে পেয়েও ছাপালো না–হাত কামড়াচ্ছে। অশোকজি এবং প্রবোধ কুমার দুজনেই ভীষণ জেদি মানুষ। কোন অবস্থায় যারা হার মেনে নেবার পাত্র নয়। কই বাত নেহি, বাংলায় হয়নি তো কী হয়েছে! হিন্দিতে হবে।

এবার প্রবোধ কুমার বেবীর লেখাটা অনুবাদ করে ফেলেন হিন্দিতে। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে পুস্তক প্রকাশনার জগতে অনেকবারই দেখা গেছে যে গুণমানে মূল লেখার চেয়ে অনুবাদ অনেক পোক্ত হয়েছে, মূলকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রবোধ কুমার পরিণত সাহিত্যিক অশোকজিও তাই। ফলে অনুবাদে বেবীর লেখায় যা কিছু খামতি অপূর্ণতা ছিল–ঢেকে গেল। পরে সেই হিন্দি লেখাই ইংরাজীতে অনুবাদ হয়। ইংরাজী থেকে ফিরে আসে বাংলা ভাষায়। ইংরাজি থেকে বিভিন্ন বিদেশী ভাষাতেও অনুবাদ হয়।

কাঁচড়াপাড়ার রোশনাই প্রকাশনার কর্ণধার সঞ্জয় ভারতী সে অশোকজির পরিচিত–স্নেহধন্য। হিন্দি অনুবাদটি তার হাতে দিয়ে বলেন অশোকজি এটা ছাপো সঞ্জয়। তোমার কোন দায় নেই, টাকা পয়সা যা লাগবে–আমরা দেব। এবং তখনই পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে দিলেন। কিছুদিন পরে প্রকাশিত হল বেবী হালদারের বই–আলো আঁধারি।

প্রবোধ কুমার দিল্লিতে থাকেন। দিল্লি ভারতবর্ষের রাজধানী। হাজার হাজার সংবাদ মাধ্যম প্রতিনিধি ওখানে থাকে। সবার সঙ্গেই প্রবোধ কুমারের সুসম্পর্ক। উনি তার ভরপুর সুযোগ নেন। ফলে, অল্প দিনের মধ্যে ভারতবর্ষের সব কটি টিভি চ্যানেলে প্রধান প্রধান সংবাদ পত্রে বেবীর কথা–আলো আঁধারির কথা স্থান পায়।

এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বেবী হালদারের, নাম যশ অর্থ সব তাকে ধাওয়া করে চলে। বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে যায় সে।

আপনারা যাঁরা বেবী হালদারের জীবনী পড়েছেন তাদের কাছে আমার একটি বিনীত প্রশ্ন–এটা ঠিক যে বেবী বহু দুঃখ কষ্ট সয়েছে। সে কী আমার চেয়ে বেশী দুঃখ কষ্ট অপমান অত্যাচার? হাঁটতে হয়েছে আমার মত প্রাণ হাতে করে বিপদ সংকুল রক্তাক্ত পথে? বারবার ফিরে এসেছে নিশ্চিন্ত মরণের মুখ থেকে–আর একবার মরবে বলে! সে কী আমার মত কঠিন পরিবেশে লেখাপড়া শিখেছে! অনাহারের যে কী বিভৎস রূপ তা কত কাছে থেকে দেখেছে! সে কী আমার মত দীর্ঘদিন পেটে গামছা বেঁধে সাহিত্যের সাথে সংপৃক্ত হয়ে রয়েছে। আমার যত গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধ–এ যাবত প্রকাশিত হয়েছে তার কী এর চেয়ে বেশী?

যদি এর সব কটা প্রশ্নের উত্তর না হয়–তবু সময়ের সিদ্ধান্তে বেবী বিজয়িনী। এগিয়ে আছে আমার চেয়ে এক হাজার মাইল আগে। এর একমাত্র কারণ–আমার অনেক কিছু থাকলেও একজন প্রবোধ কুমার ছিল না। একজন প্রবোধ কুমার–অশোক সাকসেরিয়ার বড় দরকার ছিল আমার। যার সর্বশক্তি বেবীর মতো নিয়োজিত হবে আমার জন্যে। তা না থাকায় আমার একক লড়াই সেই অর্থে তেমন কোন সফলতার দ্বার স্পর্শ করতে পারল না।

আমার স্ত্রী অনু আমাকে বলে–দোষারোপ করে–না কাঁদলে মা-ও বাচ্চাকে দুধ দেয় না। তুমি কাঁদতে পারোনি, তাই কিছু পাওনি। যে কেঁদেছে অনেক পেয়ে গেছে। একটু কাঁদতে শেখো–তুমিও পাবে।

এটাই আমার সবচেয়ে বড় দোষ–সত্যিই আমি মোট্টে কাঁদতে পারি না। জীবনভর এত কেঁদেছি যে সব চোখের জল খরচা হয়ে গেছে। অকারণ অপচয়ে ভাঁড়ারে আর জল নেই। জলের প্রস্রবণ শুকিয়ে খটখটে। তাই কাঁদতে পারি না। না হলে মা তো আমারও ছিল। শুধু কাঁদতে না পারার অক্ষমতায়–সেই মমতাময়ী মা আমাকে ‘আহা রে বাছা আমার’ বলে কোলে তুলে নিল না।

সত্যিই আমি সেই বোকা ভিখারি। যে বহু পথ পার হয়ে বহু ক্লেশ সয়ে বহু চেষ্টার পরে রাজদ্বারে তো পৌঁছাতে পেরেছিল কিন্তু সাহস করে রাজভোগ চাইতে পারেনি। ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে বাসি রুটি নিয়ে। কে জানে চাইতে পারলে হয়তো রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব পেয়ে যেত। যা পাবার জন্য হাজার মাইল পথ হাঁটা।

বেবী হালদার অতি দুঃখী-দরিদ্র এবং দলিত সমাজের এক মেয়ে। তার সাফল্যে আমার কোন মনোবেদনা ঈর্ষা দ্বেষ নেই–থাকা উচিৎ নয়। সে যা পেয়েছে নিজের ভাগ্যে পেয়েছে। যার ভাগ্যে যা আছে সেই নিয়ে তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

আমি এটা জানি–বেবীকে যারা উচ্চে তুলেছে, আমার পাশে পিছনে এসে দাঁড়ানোয় খানিকটা অসুবিধা আছে। সে অতি দরিদ্র। অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের দারিদ্রের যে অন্তর্নিহিত কারণ–সেই অমানবিক শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সে একটা লাইনও লেখেনি। ফলে, ধনকুবের গোষ্ঠীর কোন বিষ নজরে পড়েনি। তারা বেবীর প্রতি দরদ দেখিয়ে নিজেদের মানবিক মুখটা উজ্জ্বল করে নেবার সুযোগ পেয়েছে।

বেবী দলিত সম্প্রদায়ের মেয়ে। দলিতদের দলনকারী ব্রাহ্মণ্যবাদ পুরোহিত তন্ত্রের বিরুদ্ধে সে একটা কথাও বলেনি। তাই উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়ও তার উপর খঙ্গ হস্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। দেখো আমরা কত উদার–ছোট জাতদেরও কত স্নেহ করি, এই প্রদর্শন বাতিক থেকে বেবীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে বিবেক দংশন অনুভব করেনি।

আমার লেখা তো তেমন নয়। পুঁজিবাদ পুরোহিত তন্ত্র অন্ধ কুসংস্কার সব কিছুর উপর নির্মম প্রহার থাকে। যে প্রহারে ওরা আহত হয়। তাই তারা আমার পক্ষে এসে দাঁড়াতে পারে না।

কোন রকম বিতর্কে জড়াতে হবে না–বইটা বিক্রি করে বেশ খানিকটা মুনাফাও করা যাবে এই কারণে বই ব্যবসায়ীদের বইটা ছেপে বিক্রি করতেও কোন সমস্যা হয়নি।

বেবীর বই আলো আঁধারিতে–বাপ এবং স্বামীকে সামনে রেখে পুরুষ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে খুবই হালকা কিছু আক্রমণ আছে। এটাই নারীবাদী আন্দোলনের কর্তা-কত্রীদের বেবীর বইকে হাতে নিয়ে সোচ্চার হবার সুযোগ দিয়েছে। মার্কসবাদের যে কোন ছাত্রই জানে–সব সমস্যার সমাধান গোপন আছে অর্থনীতির মধ্যে। সেই সমস্যাকে জিইয়ে রেখে কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নারীকে পুরুষ দমন-দলন করতে পারে, কারণ নারী অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল! সে স্বাবলম্বী নয়। দেখা গেছে যে নারী আর্থিক দিক থেকে সক্ষম হয়ে গেছে, তাকে আর কেউ দলন করতে পারে না। কার এমন ক্ষমতা আছে এদেশে যে ইন্দিরা গান্ধী, জয়ললিতা, মায়াবতী, মমতা ব্যানার্জী, নীতা আম্বানি–সিনেমা লাইনের কারও নাম নাই বা বললাম–এদের দমন দলন করবে?

এমনও দেখা গেছে–অধিক ক্ষমতা ধনের অধিকারী হয়ে অনেক নারীই পুরুষের জীবন স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই কারণে অসম বন্টন ব্যবস্থা কোন সমাজেরই হিত করে না। দরকার অর্থ ক্ষমতার সুসম বন্টন ব্যবস্থা। নারীবাদীরা এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে শুধু পুরুষ আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। বেবী তাদের হাতে একটা অস্ত্র দিয়েছে।

আমার লেখা এদের অপছন্দের কারণ, আমি যা লিখি সেই বিষয় বস্তুতে পুঁজিবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদ রাষ্ট্রীয় শোষণ এদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ থাকে। থাকে গভীরে গিয়ে সমস্যাকে দেখা এবং সমাধান কল্পে বস্তুবাদী মতাদর্শকে প্রাধান্য দেওয়া।

তাই বেবীর পিছনে যারা দাঁড়াবে আমার পিছনে দাঁড়াবার কথা নয়। কে জানে হয়ত এই কারণেই অশোকজি-সঞ্জয় ভারতী আমার অতি পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও আমাকে কোন সাহায্য করেননি। দলিত বেবীর প্রতি তাদের যে দরদ ভালোবাসা তার এককণাও আমার উপর পড়ল না। যে অলকা সারাওগী-তার উপন্যাসে আমার নামে একটা চরিত্র রেখেছেন তিনিও আমার জন্য তেমন কিছু করলেন না।

.

আমি জানি আমার এই লেখাটা পড়ে বহুলোক আমাকে অকৃতজ্ঞ বলবে। আমার এই কটু সত্য তাদের পীড়া দেবে। সে আর কী করা যাবে। আমার নাম মনোরঞ্জন কিন্তু আমার কোন লেখাই তো কারও মনোরঞ্জনের নিমিত্তে লেখা নয়। যে অনাত্মীয় অসহযোগী সমাজে আমার বাস তাকে আগামী কালের মানুষের কাছে লিলিকৃত করে রেখে যাবার ঐকান্তিক প্রয়াস। আর কিছু নয়।

আমার অভিযোগ আরও অনেকেরই বিরুদ্ধে। গৌতম রায় যথার্থ বলেছিলেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী ব্যক্তি থেকে বিষয় হয়ে উঠেছে। এই সমাজে আর কিছু নয় আমি একটা বিষয় মাত্র। আমি লিখি। যে সমাজে যে মানুষদের কথা লিখি আমি, আমার আত্মজীবনীতে যে সব দুঃখ কষ্ট অপমান অত্যাচারের কথা লিখেছি মানুষ সেগুলো পড়ে। কেউ কেউ আহা উঁহু করে। কিন্তু আমার বা আমাদের দলিত দরিদ্র সমাজের মানুষের জীবনের সেই অবস্থাটা পরিবর্তনের জন্য কেউ কোন উদ্যোগ নেয় না।

আমি লিখি, বিষয় বস্তু নয় কেউ কেউ আমার লেখার রীতি-পদ্ধতি ভুল বানান, দাড়ি কমা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কীভাবে লিখলে লেখা আরও মনোগ্রাহি হবে উপদেশ দেয়। সাহিত্য রস কত কম আছে–সমালোচনা করে। শুধু তাদের স্পর্শ করে না কাহিনীর মর্মবাণী–চির বঞ্চিতের আর্তনাদ।

এখন আমাকে লোকে প্লেন ভাড়া দিয়ে নিয়ে যায়। দশতলা হোটেলে রাখে। আলো ঝলমল মঞ্চে বসতে দেয়। সেখানে কেউ আমার সাহিত্য নিয়ে কোন কথা বলে না, সাহিত্য বিষয়ে কোন কথা আমার কাছে শুনতে চায় না। সব প্রশ্নের তির ছুটে আসে আমার ব্যক্তি জীবনের দিকে। সবার মাত্র একটা কৌতূহল এই লোকটা এত বেশী বয়সে লেখাপড়া শিখে এত মোটা বই কী করে লিখে ফেলল। তাদের চোখে আমি মানুষ নয় একটা কাক–যে কোকিলের মত ডাকতে জানে! এটা কী করে পারে–এই এক বিস্ময়।

কাক কোকিলের মত ডাকে ওরা সেই ডাকটা নিয়ে কৌতূহলী, কাকটার জীবন যন্ত্রণা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।

লক্ষৌ দিল্লি মুম্বাই পাটনা কত জায়গা থেকে ডাক আসে। কত সমাদর করে নিয়ে যায়। অনুষ্ঠান মঞ্চ আমার বক্তব্য শুনে হাততালি দেয়, পত্র পত্রিকায় ছবি প্রতিবেদন লেখা হয়। পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তোলে, কতজন অটোগ্রাফ নেয়। অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসি আর কেউ আমার কোন খোঁজ খবর রাখে না। আর কী দরকার, আমাকে যেটুকু ব্যবহার করা যায় সে তো হয়ে গেছে। দেখা যাবে আবার পরের বছর।

লেখালেখির জগতে অনুপ্রবেশ পেয়ে যাবার পরে অনেক বিশিষ্ট অতি বিশিষ্ট স্বনাম ধন্য, সেক্ষেত্রে উজ্জ্বল মানুষজনের সাক্ষাৎ পেয়েছি। এনাদের সাথে পরিচিত হবার পরে যেমন হয় আর কী, আমার মনের মরা নদীতে আশার বাণ ডেকেছে। এত ক্ষমতাবান এরা, হয়তো এবার বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে। তারা তাদের থৈ থৈ দয়া কৃপার পাত্রটা থেকে দুচামচ এই অভাগার পাতে দেবে। অন্যদের কথা বাদ–যেসব নিম্নবর্ণের লোক উচ্চপদে বসে নিচের লোকেদের জন্য কেঁদে কেঁদে পত্র পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখে, যারা নিম্নবর্ণ উন্নয়ন দপ্তরে বড় বড় সরকারি চাকরিতে বহাল, কারও না কারও নেক নজর আমার দিকে পড়বে।

বড় বিচিত্র এই দেশ। অদ্ভুত এ দেশের নিয়ম কানুন। এখানে খেলোয়াড়দের জন্য রেলে সেনাবাহিনীতে ব্যাংক পোস্ট এ্যাণ্ড টেলিগ্রাফে–আরও কত বিভাগে চাকরি দেবার প্রবধান আছে। চোলাই খেয়ে মরে গেলে সরকার টাকা দেয়, মসজিদের ইমামরাও ভাতা পায়–শুধু বেচারা গরিব লেখকদের দেবার মত কিছু নেই, দেখার মত লোক নেই।

কিছু দিন আগে মরে গেলেন একা কুম্ভ বইয়ের লেখক আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত গরিব কথা শিল্পী সদানন্দ পাল। কী তার জীবন, কী ভাবে পেটে গামছা বেঁধে সাহিত্যের সেবা করে গেছেন সব লেখা আছে একা কুম্ভ বইয়ের পাতায় পাতায়।

ক্যানসার হয়েছিল তার। পয়সার অভাবে তেমন চিকিৎসাও করাতে পারেননি। অসহায় অবস্থায় তিলে তিলে মরে গেলেন।

আমি ভয় পাচ্ছি। সত্যিই আমি এখন ভীত হয়ে পড়েছি। টের পাচ্ছি পায়ে পায়ে ওই রকম একটা যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু আমাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। দিনে দিনে হাঁটু দুটো অকেজো হয়ে আসছে–আর সে দেহের ভার বহন করতে পারছে না। হাজার মাইল পথ হেঁটে আর তার চলার শক্তি নেই। তাই ভয় পাচ্ছি। যে দিন বিছানায় শুয়ে পড়ব, গ্রাসাচ্ছদন কী করে চলবে!

তাই বড় ভয় পাচ্ছি এখন। বিছানায় শুয়ে যদি স্ত্রী পুত্রের অনাহার দেখতে হয় সে বড় কষ্টের।

আর আমার কিছু বলার বা লেখার নেই। যতটুকু পেরেছি–বলেছি। যদিও বলা অংশের চেয়ে অনেক বেশী রয়ে গেল না বলা। আমি কেন, কোন মানুষই বোধহয় জীবনে সব কথা অকপটে বলে যেতে পারে না। কিছু কথা মনের মধ্যে গোপন করে রেখে দিতেই হয়। সেই না বলতে পারা কথারা তাকে রক্তাক্ত করে।

***

২৮শে জুলাই ২০১৬ একটা বড় ভয়ংকর কঠিন সময়ে চলে গেলেন সংগ্রামী সাহিত্যিক, আদিবাসী মানুষের বড়ো প্রিয়-বড়ো আপনারজন, মারং দাই __গা___ শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করার এক আপোষহীন সেনাপতি। জীবনের এই এক চরম কঠিন নিয়ম–একে অস্বীকার করবার ক্ষমতা কারওরই নেই। জন্ম যখন হয়েছে–সব কিছুটান পিছে ফেলে, সব বাঁধন বন্ধন ছিঁড়ে ছুঁড়ে, একদিন তো সবাইকে চলে যেতেই হয়। তবে এটা নির্মম ভাবে সত্যি, যে এক একজন মানুষের চলে যাওয়ায় মানব সমাজে তার বিরাট একটা প্রভাব পড়ে, সেই মানুষটার অনুপস্থিতিতে যে বিশাল বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা আর কোনও ভাবে কোনও কিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না। মহাশ্বেতাদেবীর বেলা এই কথাটা আরও বেশি করে সত্য।

আজ সারাদেশ জুড়ে শোনা যাচ্ছে ভয়াল ভয়ংকর একটা অশুভ শক্তির প্রবল পদধ্বনি। বীর বিক্রমে সে ধেয়ে আসছে অপ্রতিহত খেপে ওঠা বুনো শুয়োরের মতো। দেশটাকে একটা সর্বনাশা ধ্বংস অশ্রু রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেবার কদাকার কুৎসিত অভিপ্রায় নিয়ে। তাই দিকে দিকে আজ অতি পরিকল্পিত ভাবে দলিত দরিদ্র আদিবাসী সংখ্যালঘু মানুষের উপর শুরু হয়েছে একটা বর্বর আক্রমণ। সেই যেমন বহু বছর আগে–জার্মানিতে ইহুদি জাতির সব মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রয়াস চালিয়ে ছিল মানব সভ্যতার সব চেয়ে বড় শত্রু–নাৎসি বাহিনী। আজ আবার তাদেরই উত্তরসূরিরা সেই একই রকম তাণ্ডব চালাতে চাইছে ভারতভূমির গ্রাম গঞ্জে নগর শহরে বন্দরে জনপদে। মানুষ মরবে–মানুষ আর্তনাদ করবে–রক্তের নদী বইবে গঙ্গা নর্মদা গোদাবরীর জল লাল হবে মানুষের রক্তে। আর হত্যাকারীরা হা হা রে রে করে জয়ধ্বনি দেবে। যেন সেই রক্ত প্লাবনে–জল্লাদের উল্লাস গর্জনের নীচে চাপা পড়ে যায় সাধারণ মানুষের খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা–স্বাধীনতা আর সামাজিক সম্মানের মতো মৌলিক দাবি দাওয়ার নাগরিক প্রশ্নগুলো। সংগঠিত হতে থাকা সমস্ত প্রতিবাদী আন্দোলন। জল জঙ্গল জমিনের লড়াই সব যেন ঢাকা পড়ে যায় আর্তের কান্নার নীচে।

ওরা জানে–বহু মানুষকে বঞ্চিত না করতে পারলে অল্প কিছু মানুষের প্রাপ্তির ঝুলি ঝোলা ভরে উপছে পড়তে পারে না। তাই শোষণ শাসন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যেখানেই মানুষ মাথা উঁচুকরছে, নানা কৌশলে তাদের উপর নামিয়ে আনা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী কায়দায় বর্বর আক্রমণ। সামান্য ছুতোনাতায় তারা হামলে পড়ছে সাধারণ জনজীবনের উপর। চূর্ণ বিচুর্ণ বিধ্বস্ত করে দিতে চাইছে প্রতিবাদী মানুষের মনোবল। একজন অতি সাধারণ মানুষ, সে কী খাবে, কী পড়বে, তার উপরও চালান হচ্ছে শ্যেন পাহারাদারি। ভীত ত্রস্ত করে মানুষকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে–তোমরা কেউ আমাদের ইচ্ছা বিনা এক পাও চলতে পারবে না। আমাদের অনুমতি বিনা তোমাদের কোন স্বাধীন স্বত্ত্বা থাকতে পারবে না। যুগ যুগ ধরে যেমন থেকেছে–চির পদানত, গোলাম হয়ে বাঁচতে হবে খেটে খাওয়া দরিদ্র সাধারণ মানুষকে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই নিরীহ নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ মানুষের উপর আজ দিকে দিকে নির্মম অত্যাচার চালান হচ্ছে–অতি পরিকল্পিত ভাবে।

মানুষ বিপন্ন মানুষ এখন বড়োই অসহায়। তাদের পাশে পিছনে দরদী সাহসী লড়াকু মানুষের বড়ো অভাব। এই রকম এক নির্বান্ধব সময়ে মহাশ্বেতাদেবীর বড়ো দরকার ছিল। দরকার ছিল তার সচেতন সাহসী শক্তিশালী ধারালো তলোয়ারের মতো সচল লেখনীর। সুর্য সমান অনল অমল অনির্বাণ ক্রোধে, অসম সাহসে–অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যিনি মসিযুদ্ধ জারি রেখেছিলেন। কোনও প্রলোভনে বিকিয়ে যাননি, কোনও ভয়ের সামনে নতজানু হননি। খালি পা খালি গা খালি পেট–যে মানুষ, সেই নিরন্ন নির্ধন মানুষের স্বার্থে আজীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন। সত্তর দশকের ভয়ংকর দিন থেকে শুরু করে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নেতাই–বার বার গর্জে উঠেছেন তিনি। তার অগ্নিবর্ষী ক্রুদ্ধ কলম কামানের নলের মতো গোলার পর গোলা দেগেছে। নরখাদক, হিংস্র–মানব সভ্যতার চরম অনিষ্টকারীদের দুর্ভেদ্য দুর্গ লক্ষ্য করে।

নকশাল বাড়ির সাত কৃষক রমণীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যারা একদিন বীরদর্পে শুরু করেছিল পদযাত্রা, সে যাত্রা শেষ হয়েছিল নেতাইয়ে এসে–আবার সাত রমণীর হত্যাকাণ্ডের পরে। দাম্ভিক অত্যাচারী সেই শাসকদের চলার পথে পড়ে আছে মরিচঝাঁপি সহ পঞ্চান্ন হাজার মানুষের ছিন্নভিন্ন নিষ্প্রাণ দেহ। হাজারের অধিক ধর্ষিত নারীর মলিন মুখ। কেউ কোনও দিন ভাবতে পারেনি মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে কেউ তাদের সামনে তর্জনী তুলে গর্জন করে বলবে–হত্যাকারীরা হুসিয়ার। এবার তোমরা থামো। অনেক হয়েছে–আর নয়। এটাই উনি করেছিলেন। অন্য কোনও লেখক কবি সাহিত্যিক যা পারেনি। তিন দশকেরও অধিককাল বাংলার প্রতিবাদী কলম বোবা বধির অন্ধ হয়ে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল শাসক শোষকদের–পুঁজিবাদীদের প্রতিনিধিদের পদতলে কিছু নগদ প্রাপ্তির লোভে লালসায়। সেই বন্ধ্যা সময়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে একমাত্র উনি পেরেছিলেন।

সেটা বাংলার পক্ষে, গোটা বাঙালি জাতির পক্ষে, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের পক্ষে, বড়ো লজ্জাজনক কাল–বড়ো বেদনাদায়ক সময়। কে যেন বলেছেন–লেখক কলম দিয়ে নয়, লেখে শিরদাঁড়া দিয়ে। বাংলার ‘আগুন ওগরানো’ প্রতিবাদী কলম সে সময় বিকিয়ে দিয়েছিল নিজের শিরদাঁড়া। কুকুরের লেজের মতো বেঁকে গিয়েছিল লাল কালির সব হরফ। বিপ্লবী লেবেল আঁটা বুদ্ধিজীবীরা টাকা আনা পাই দরে ভাড়া খাটাচ্ছিল যে যার জিভ। সেই দিনে–সেই নিবীর্য নির্জীব বন্ধ্যা সময়ে–অতন্দ্র প্রহরীর মতো মানুষের পক্ষে অটল দাঁড়িয়ে ছিলেন রণাঙ্গনে–একা এক ‘কলমকা সিপাহী’ মহাশ্বেতাদেবী। নির্দয় আর ক্ষমাহীন দৃঢ়তায়–যা অন্যায় অনুচিত, যা অমানবিক–তার বিরুদ্ধে। আদিবাসী বনবাসী দলিত দরিদ্র শ্রমজীবী সংখ্যালঘু মানুষদের–ন্যায় সংগ্রামের পক্ষে।

সেদিন বাংলার শাসন ক্ষমতার দখল নেওয়া ‘হীরক রাজা’ গর্জে উঠে বলেছিল–এই চাষা ভুযোরা–তোদের জমিভূমি বাসস্থান, তোদের মন্দির মসজিদ গির্জা, তোদের হাসপাতাল ইস্কুল পুকুর, খেলার মাঠ, তাদের ফলের বাগান, ফুলের বাগিচা, তোদের শ্মশান গোরস্থান, তাদের জল বাতাস আকাশ, সব আমাকে দিয়ে দে। সব দিবি–যা তোর আছে। না দিলে আমার পুলিশ তোকে খুন করবে। আগুন দেবে তোর ঘরে। সেই আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হবে তোর শিশু সন্তানকে। তোর মা মেয়েকে গণধর্ষণ করবে। সেদিন সেই বিপন্ন মানুষের সামনে প্রতিরোধের দেওয়াল তুলে যিনি দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি এই মহাশ্বেতাদেবী।

আজ আবার আর-এক মহালড়াই আসন্ন। দিকে দিকে তারই আগমণ বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে। পালাবার পথ নেই, পরিত্রাণের কোনো উপায় আর নেই। মহা সর্বনাশ থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে পরিবার পরিজন নিয়ে মানুষকে বাঁচতে হলে–ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হলে–দলিত দরিদ্র সংখ্যালঘু সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। রক্ত পিপাসু ঘাতকের উদ্যত অস্ত্রের সামনে আঙ্গুল তুলে বলতে হবে–খবরদার। আর আগাতে চেওনা। আর এক পা আগালে আমরা কিন্তু হত্যাকারীকে নীরব করে দেবার মহামন্ত্র ছুঁড়ে দেবো। আগ্নেয়গিরির মতো সে মন্ত্র তোমাদের ভস্মীভূত করে দেবে। বিলুপ্ত বিলীন–ইতিকথা বানিয়ে দেবে। এই দিনে আমাদের পাশে মহাশ্বেতাদেবীর অভাব বড়ো বেশি অনুভূত হবে। আর তো কেউ এমন একজনও নেই। উনি অদ্বিতীয়, এক এবং একক। ওনার ফেলে রেখে যাওয়া আসন আজ শূন্য। এই দিনে মেহনতি মানুষের ওনাকে বড়ো প্রয়োজন ছিল।

আমরা সেই ভীষণ সময়ে রণাঙ্গনে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মহাশ্বেতা দেবীর জীবন এবং কর্ম আর আগুনের বর্ণমালায় রচনা করে রেখে যাওয়া সুবিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে শক্তি আর সাহস খুঁজে নেব। অনুপ্রেরণা দেবে, আমাদের পথ প্রদর্শক হবে সেই আগুন আঁখর। বীরসা, বসাই টডু, চেট্টি মুণ্ডা, দোপদীর পাশে পিছনে হেঁটে আমরাও পৌঁছে যাব শত্রুর মুখোমুখি মহড়া নেবার জন্য। কোনও ভয়কেই আমরা ভয় পাবে না। ভয়কে ভয় পাইয়ে দেবার শিক্ষা দেবে ওই আগুনের বর্ণমালা।

মহাশ্বেতাদেবীর প্রয়াণে প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন যেমন হারিয়েছে তার এক অনমনীয় আপোষহীন লড়াকু সেনাপতিকে, আর আমি ব্যক্তিগত ভাবে হারিয়েছি–আমার সেই মাকে। যিনি প্রায় ঘৃণিত অভিশপ্ত এক আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে আমাকে সন্ধান দিয়েছেন একটা নতুন জীবনের। গভীর ভাবে বুঝিয়ে ছিলেন ‘জিজীবিষা’ শব্দের যথার্থ অর্থ। বেঁচে তো অনেক রকম ভাবেই থাকা যায়, অনেক রকম ভাবেই বাঁচে মানুষ। কিন্তু সে বাঁচা কেমন বাঁচা–যা মরার পরেই সব ফুরিয়ে যায়। নিঃশেষ হয়ে যায়। আমাকে উনি সেই জীবনের সন্ধান দিয়েছেন যে জীবনের কোনও অন্ত অবশেষ নেই, সমাপ্তি নেই। আমি সেই জীবনের তপস্যা শিখেছি ওনার কাছে বসে। ১৯৮১ থেকে ২০১৬ প্রায় ৩৬ বছর কাল সময়। এত দীর্ঘকাল ধরে বিশাল এক মহীরূহের মতো ব্যাপ্ত হয়েছিলেন তিনি আমার জীবনে। যেখানে যাই, যত দূরেই যাই সে বৃক্ষ আমাকে ছুঁয়ে থেকেছে সর্বক্ষণ। আস্তিকের মন মনন জীবনে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। সে এমন এক বৃক্ষ, শ্রান্ত হলে যার ছায়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যায়। যে সঞ্জিবনী বৃক্ষের স্পর্শ মৃতদেহ অমৃত প্রবাহ বইয়ে দেবার মতো আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে। আমি নাস্তিক, ঘোর নাস্তিক। জাতপাত ধর্মবর্ণ দেবদেবীআল্লাভগবান কোনও কিছুতে আমার এতটুকু আস্থা নেই। পৃথিবীতে এত অন্যায় অত্যাচার রোগ শোক অসাম্য, মানুষে মানুষে এত বিভেদ। সব সে দেখছে। সে ভদ্রলোক নাকি অসীম ক্ষমতার অধীশ্বর, এক তুড়ি মেরে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃজন করেছেন। এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে এর কোনও প্রতিকার করছে না। আর আমাকে তো কী এক আক্রোশে যেন জন্ম থেকেই না খাইয়ে রেখেছে। এমন অবস্থা রাখেনি যে একটা বই নিয়ে এক মুঠো খেয়ে ইস্কুলে যাই। যে বয়সে বাচ্চারা যায় ইস্কুলে, আমাদের পেটের দায়ে যেতে হয়েছে মানুষের ছাগল গোরু চড়াতে। পায়ে চপ্পল, গায়ে একটা জামা, মাথায় এক ফোঁটা তেল, এক কুচো সাবান–যে আমার জন্য সামান্য এইটুকু ব্যবস্থা করে রাখতে পারেনি, উল্টে কিশোরবেলায় আমি যেখানে যেখানে কাজ করেছি–ভগবানের পরম ভক্তরা আমাকে বারো চোদ্দ ঘণ্টা খাঁটিয়ে নিয়ে আমার মজুরি পর্যন্ত দেয়নি–মেরে দিয়েছে। সব তো সে দেখেছে? মানে–চোখ থাকলে তো নিশ্চয় দেখবার কথা। অন্ধ হলে আলাদা ব্যাপার। কোন বইপত্রে যখন পাওয়া যায় না যে–ভগবান অন্ধ, তার মানে সে চোখে দেখে। তাহলে সব দেখে শুনেও যে এমন কানা, সেই কানা ভগবান দিয়ে আমার কি হবে? আমি তাকে না মানলে সে আমার উপর রেগে যাবে। তো যাক না। কে বারন করছে। যা ক্ষতি সে আমার করেছে তার বেশি আর কি করবে? আমি জানি–অনেক বছর আগে একদল না খাওয়া মানুষ এক কালী মন্দিরের দরজা ভেঙ্গে জাগ্রত কালীমাতা নামে পূজিত কালীর সোনার পাতে মোড়ানো জিভ মুচড়ে ভেঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিল। সেদিন সেই জাগ্রত কালী নিজেকেই নিজে রক্ষা করতে পারেনি। সেই দেব দেবতা আমার কি ব্যাক করবে?

তবে আমি সবদিন মেনেছি মানুষকে। মানুষ মানুষ মানুষ, একমাত্র মানুষই আমার উপাস্য আমার সমস্ত বিনম্র প্রনাম বর্ষিত হয়েছে মানব দেবতারই শ্রীপাদপদ্মে। মন্দির মসজিদ গির্জা তীর্থস্থানে কোন দিন যাইনি আমি। কালীঘাট থেকে কামাখ্যা–গয়া থেকে গঙ্গাসাগর, ঘুরেছি তো অনেক জায়গায়। কিন্তু কোথাও ভক্তিতে গদগদ হতে পারিনি। যুক্তির কষ্ঠী পাথরে সব মূর্তি আমার কাছে বাচ্চা ভোলানো পুতুল হয়ে রয়ে গেছে। যত সব নাঙ্গাবাবা সাধু সন্ন্যাসী প্রতিপন্ন হয়েছে অলস কর্মভীরু ঠগ চোর জোচ্চোর বলে। তাই আমি ছুটে গেছি মানুষের কাছে। ছুটে গেছি আমার দেবী–মহাশ্বেতাদেবীর কাছে। তার নিবাস আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে হিন্দুর অমরনাথ, মুসলমানের মক্কা মদীনার মর্যাদায়। মানবী মহাশ্বেতাকে বসিয়েছি বিদ্যার দেবী সরস্বতীর মহান আসনে। আর সেই দেবীর কাছে বসে “একলব্য” একাগ্রতায় পাঠ নিয়েছি মহাশব্দ জিজীবিষার–। জিজীবিষার মানে বেঁচে থাকার ইচ্ছা। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকার নামই–জিজীবিষা। মরার ভয়ে নুয়ে বেঁকে ঘাড় গুঁজে বাঁচা নয়, বীরদর্পে এগিয়ে আসা মৃত্যুর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে প্রতিহত করা–তার নামই জিজীবিষা।

সবাই জানেন, নতুন করে বলার কিছু নেই। আমাকে নিয়ে দেশ বিদেশের নামী দামী পত্র পত্রিকায় শতশত বার লেখা হয়েছে, টেলিভিশনে বারবার দেখানো হয়েছে। লক্ষ লোক আমার আত্মজীবনী পড়েছে। তার ফলে সবাই প্রায় জানে যে আমি কোনো দিন কোনো ইস্কুলে যেতে পারিনি। বাবার সে ক্ষমতা ছিল না যে এক মুঠো খেতে দেয়, একটা বই দিয়ে ইস্কুলে পাঠায়। বাল্যকাল কেটেছে আমার গোরু ছাগল চড়িয়ে, চায়ের দোকানে হোটেলে গেলাস থালা ধুয়ে। একটু বড় হয়ে মুটেমজুর রিকশাঅলা শতেক রকমের শ্রমের কাজ, ডোম সুইপার নাইটগার্ড ট্রাকের খালাসী–আরও কত কি। এই যে জীবন–এ কোন মহৎ জীবন হতে পারে না। একটা পাহাড়ের মাথায় বরফ জমে, সেই জল নালা নদী দিয়ে পৌঁছে যায় সমুদ্রে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু যদি সেই নালা নদীর সামনে একটা বাঁধ পড়ে যায়, সে আর সাগরে যেতে পারেনা। তখন সে দুই পাড়কে প্লাবিত করে দেয়। জন জীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এর জন্য সে দায়ী নয়। দায়ী সেই বাঁধ। বাঁধ ভেঙ্গে দাও–জল চলে যাবে তার আপন বেগে নিজের পথ ধরে। বিপদ কেটে যাবে। বাঁধ থাকলে বাধা প্রাপ্ত জলচ্ছাস বন্যা ডাকবে। রাজপথ জনপদ ভাসাবে ~ ঘর বাড়ি ডোবাবে। আমি সহজ সরল স্বাভাবিক ভাবে বহে যেতে পারিনি–জীবনের চলার পথে নানা ঘাটে পড়ে গেছি নানান নির্দয় বাধার সামনে। প্রতি মুহূর্তে প্রতিহত হয়েছে আমার চলাচল। ফলে যা হয় উল্টোপাল্টা দিকে বয়ে গেছে আমার জীবন। বইতে বইতে একদিন দেখলাম পৌঁছে গেছি জেলখানার কালো কুঠুরিতে।

সেইখানেই একজন অসাধারণ মানুষের দেখা পেয়েছিলাম। বাইরে তো পাইনি–হয়তো এমন মানুষেরা বাইরে থাকতে পারে না। ভালো মানুষের শত্রুরা তাদের ধরে জেলখানায় ভরে দেয়। তাই এইসব মানুষকে খুঁজে পেতে হলে জেলখানায় আসতে হয়। সেখানেই সেই মহান শিক্ষকের সাক্ষাৎ পাই, যিনি আমাকে অসীম ধৈর্য সহকারে জেলখানার মাটিতে কাঠির আঁচড় দিয়ে শেখান বাংলা বর্ণমালার সবকটা অক্ষর। একদিন তিনি আমাকে জেলখানার জানালা দিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরির কার্নিশে লতপত করতে থাকা বিঘৎ খানেক একটা ছোট্ট বটের চারা দেখিয়ে বলেছিলেন–‘ওই নিরেট সিমেন্টের উপর যেখানে কোনও রসকষ নেই, মাটি নেই জল নেই, অত ছোট্ট চারাটা এত প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে আছে কি করে জানিস? বেঁচে আছে, কারণ ও মরতে চায় না। বেঁচে থাকতে চায়। আর যে বাঁচতে চায় কারও ক্ষমতা নেই তাকে মেরে ফেলবার বেঁচে থাকার ইচ্ছা, এর নামই তো জিজীবিষ।

আপনারা তো সে গল্প আগেই পড়ে নিয়েছেন যে কিভাবে আমার সাথে মহাশ্বেতোদেবীর সাক্ষাৎ হয়। সেটা ছিল ১৯৮১ সালের জুন মাসের এক তাপদগ্ধ শনিবার। জেল থেকে বের হয়ে আমি তখন রিকশা চালাই। আমরা সেই মহান দেশের নাগরিক, যেখানে একজন নিরীহ নির্বল ধনহীন মানুষ পথে পড়ে না খেয়ে মরে গেলেও কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। রাস্তায় পড়ে রোদে শরীর পোড়ালে, বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হলেও কেউ মাথার উপর একটা ছাউনি এনে দেবে না। রোগে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের সামনে বসে কাতরালেও কেউ দেবে না এক ফোঁটা ওষুধ। প্রবল শীতে কুঁকড়ে কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকলেও কেউ মমতা করে এসে একটা কম্বল ঢাকা দেবে না। অথচ ভাণ্ডারে অচেল আছে। সরকার চাইলেই দিতে পারে। সে দেবে কখন? যখন সে কারও পেটে, গলার নলিতে চাকুর পোঁচ মেরে জেলখানায় চলে যাবে। তার আগে একদম নয়। সে তখন রাজ অতিথি–তখন সব পাবে সে–যেটুকু আগে পেলে আর জেলে তার আসবার কোনও দরকারই পড়ত না। তখন খেতে না চাইলে সেপাই এসে নাকে নল ঢুকিয়ে জোর করে পেটের মধ্যে খাবার ঢুকিয়ে দেবে।

আমার কপালে যতদিন সে সুখ ছিল, জেলে ছিলাম। একদিন সুখ ফুরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে জেল থেকে বাইরে আসতে হল। তখন তো আর কেউ গরম ভাতের থালা নিয়ে আমার জন্য বসে নেই। বাধ্য হয়ে তাই আমি পেটের প্রয়োজনে রিকশা চালাতে আরম্ভ করলাম। আর সেদিন রিকশায় সওয়ারি পাবার আশায় বসেছিলাম বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজের সামনে। ওখানে রিকশার উপর বসেই একটা বই পড়ছিলাম। নতুন নয়, সব দিনই আমি এই করি। যখনই সময় পাই বই পড়ি।

এটায় আমার তেমন কোনও দোষ নেই। নতুন যে-কোন-জিনিস শেখা যায় তাতে মানুষের উৎসাহ থাকে অনেক বেশি। অন্য তো অন্য–দেখা যায় যে সদ্য সাইকেল চালাতে শিখেছে, সারাক্ষণ চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই। আমার অবস্থা তো তখন সেই রকম। অনেক বেশি বয়সে পড়তে শিখেছি, অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করে। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে আমি পৌঁছে যেতে পারি মহাকাশের গ্রহনক্ষত্রের অনন্ত উচ্চতায়, ডুব দিতে পারি মহাসমুদ্রে বিস্ময়কর অতল গভীরে। নিখরচায় নির্ভয়ে ভ্রমণ করে আসতে পারি শ্বাপদ সঙ্কুল আফ্রিকার গহীন অরণ্যে। অনায়াসে চড়ে যেতে পারি হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়। বই আমাকে দেখায় আমার না দেখা না জানা না চেনা এক অচিন ভুবন। তাই সারাক্ষণ বই পড়ি। মদের চেয়ে মারাত্মক নেশা–বই-এর নেশা। সেই নেশায় কুঁদ হয়ে বসে থাকি।

তখন মনে হয় বেলা দুটো বাজে। আমাদের রিকশা লাইনের কাছে জ্যোতিষ রায় কলেজ সে সময় ছুটি হয়েছে। সব শিক্ষক শিক্ষিকারা যাচ্ছেন বাড়ির পথে। সেই সময় আমার রিকশার সামনে এসে দাঁড়ালেন উনি। বললেন–যাবে চল। আমি রিকশায় তুলেছিলাম সেই প্যাসেঞ্জর। সেই জুন মাসের আগুন জ্বলা দুপুর–বুডবুডে করে করে ফুটতে থাকা পিচ রাস্তার উপর দিয়ে গড়িয়ে চলা রিকশার চাকা।–আমি জানতাম না, কেউ জানত না, সেদিন সেই চাকা যেন ঘুরছিল আমার ভাগ্যের চাকা হয়ে।

যদি সেদিন ওই প্যাসেঞ্জার অন্য কেউ নিয়ে চলে যেত–আমি চলে যেতাম অজ্ঞাত, অন্ধকার, অপরিচিতির কোন গোপন গহ্বরে। কেউ জানতো না আমার কথা। জীবনের যা সঞ্চয় আজ আমার হাত ধরে আমাকে এত দূর পথ হাঁটিয়ে নিয়ে এল, সব পচে গলে মাটি হয়ে যেত। কত লক্ষ লক্ষ মন সোনা তো মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে, কে তার খবর রাখে? মানুষ জানে, কদর করে দাম দেয় সেইটুকুর-যা অলঙ্কার হতে পেরেছে। উঠতে পেরেছে শ্রীঅঙ্গে।

আমার সেই প্যাসেঞ্জার–আমি ওনাকে চিনতাম না শুধু জানতাম উনি একজন শিক্ষিকা। তাই আমি কদিন আগে একটা বই থেকে পাওয়া একটা শব্দের মানে–যা আমার অজানা–তা জানতে চেয়ে বসেছিলাম তার কাছে–দিদি, জিজীবিষা শব্দের মানে কি?

এটা আমার জীবনে একটা অলৌকিক অবিশ্বাস্য অত্যাশ্চর্য ঘটনা। যেমন ঘটনা সেই এক জনের সামনে আপেল ছিঁড়ে পড়বার মত ব্যাপার স্যাপার আর কি। আপেলটা না পড়লে তার কি এত বড় বিজ্ঞানী হওয়া কোনদিন সম্ভব হতো? আপেল আগেও পড়েছে পরেও পড়বে। কেউ কেউ তো সে আপেল ছুলে খেতে খেতে চলে গেছে নিজের কাজে। তার চিন্তা চেতনায় ওটা কোনো আলোড়ন তুলতে পারেনি। কিন্তু সেদিনের সেই পতন ছিল এক বিজ্ঞানীর জীবনের জন্মলগ্নের এক মহান ঘটনা। তেমনই–আমার রিকশায় বহু মানুষ উঠেছেন, সবাইকে তো চেনবার সুযোগ হয়নি। হতে পারে তার মধ্যে কবি লেখক প্রকাশক সাংবাদিক, এমন ধরনের অনেক মানুষ ছিল। মহাশ্বেতা দেবীও তার জীবনে বহুবার বহু রিকশায় চেপেছেন, রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে চলেও গেছেন নিজের পথে। বহু সাধারণ মানুষের লেখাও তিনি উদ্যোগ নিয়ে ছেপেছেন তাঁর বর্তিকায়। কেননা তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল একটা নতুন ধরনের পত্রিকা চালানো। সময়ের স্রোতে তারা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ তার আর কোনও খবর জানেনা। আমার পরে আর এক রিকশাঅলার লেখাও বর্তিকায় ছাপা হয়। সে লেখকের আর কোনদিন কোনও লেখা প্রকাশিত হতে পারেনি। তাই আমার সাথে মহাশ্বেতাদেবীর সাক্ষাৎ সেই দিক থেকে একটা বিরাট বিশাল ঘটনা। আজ আমার যা কিছু খ্যাতি যশ প্রাপ্তি সব সেই সেদিনের পরিনতি। ওনার সাথে দেখা না হলে এটা হওয়া আমার পক্ষে হয়ত কোনও দিন সম্ভবই হত না। যেমন আপেল না পড়লে নিউটন–নিউটনই হতে পারতেন না। অন্যের কথা জানিনা আমি, ওনার সাথে দেখা না হলে আসতেই পারতাম না এই লাইনে।

আমি সে সময় রামায়নে বর্ণিত সেই দন্ডকারন্যের বনে থাকতাম। একদিন আমি আর আমার ভাই দুজনে যাচ্ছি জঙ্গলে কাঠ কাটতে। আমাদের দুজনেরই বিড়ি খাবার নেশা। বিড়ি তো নিয়েছি সাথে কিন্তু বিড়ি খেতে হলে আগুন লাগে সে কোথায় পাবো? তাই একটা ঘুঁটে পুড়িয়ে সাথে নিয়ে নিলাম। বন পথ ধরে আমরা যখন যাচ্ছি, খেয়াল করিনি যে একটা ছোটো টুকরো ছুটে থেকে ভেঙ্গে নিচে পড়ে গেল। ওটা যে ওখানে একটা মারাত্মক ব্যাপার তা আমরা কি করে জানবো? আমাদের বাঙলায় তো এমন কতো বিড়ি সিগারেট আগুন সহ এদিক সেদিক ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। আমরা তো এখানে নতুন। কিছু জানি বুঝি না। তো আমরা যখন ঘন্টা দুয়েক পরে কাঠের বোঝা মাথায় করে ফিরে আসছি–দেখি বিশাল একটা এলাকা জুড়ে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। আর একটু এগিয়ে দেখি–যেখানে আমাদের ভাঙ্গা টুকরোটা পড়ে ছিল সেখান থেকে একটা আগুন এগিয়ে যাবার সরু রেখা। জুন মাসের শুকনো সময়–সে যত সামনে এগিয়েছে। তত শুকনো ঘাস নাগালে পেয়েছে তাই ক্রমে রেখা চওড়া হয়ে গেছে। যত সামনে এগিয়েছে তত ঘাস পাতা কাঠ নাগালে পেয়েছে। এই ভাবে ক্রমে শক্তি বৃদ্ধি করেছে সে। আর এক সময় পুরো জঙ্গলটা গ্রাস করে নিয়েছে। ওই সামান্য আগুন খসে যাওয়ার পরিনতি কি আমরা যেমন জানতাম না, আমার মনে হয় যেদিন আমাকে প্রথম বর্তিকায় লেখার কথা বলেছিলেন–মহাশ্বেতাদেবীও হয়ত কল্পনা করতে পারেন নি যে একদিন আমি আজকের এই জায়গায় আসতে পারব। দাবানল হয়ে যাব। বহু বছর পরে আবার যখন দেখা হয় একদিন–সেদিন তিনি অবাক বিস্ময়ে বলেছিলেন সেই কথাই–তুই যে এত লম্বা রেসের ঘোড়া আমি আগে জানতাম না।

আমার একটা বদ অভ্যাস–আমি যেটা একবার ধরি তার শেষ পরিনতি না দেখে কিছুতেই থামতে পারি না। এটা আমার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। ভাল খারাপ যেকোন কাজ–একদম ছোট্ট তুচ্ছ নগন্য থেকে শুরু করে একেবারে চরম সীমা পর্যন্ত পৌঁছে–তার সব সার নির্যাস নিঙরে পরখ করে তারপরই থামতে পেরেছি। যখন মদ খেতাম ~~ একেবারে গলা পর্যন্ত খেয়ে দেখেছি ওতে কি মজা। যখন বুঝলাম কোন মজা নেই, শুধু পয়সার শ্রাদ্ধ মানুষের নিন্দা মন্দ অবজ্ঞা অপমান, এখানে ওখানে পড়ে থাকা। সেই যে থামলাম একেবারে থেমেই গেলাম। অপরাধ জীবনে অনুপ্রবেশ–যেটা একটা সামান্য অতিতুচ্ছ পাউরুটি চুরি থেকে শুরু–তারপর একেবারে সেই সীমায় গিয়ে থেমেছি–যার এক ইঞ্চি দূরেই লাশ কাটা টেবিল, ফাঁসীর দড়ি।

বই পড়ার বেলাও আমার ওই একই অভ্যাস। কোকশাস্ত্র থেকে কালিদাস, মপাশা থেকে মহাভারত, রবিবারের খবরের কাগজ থেকে রবীন্দ্রনাথ, যা নাগালে পাই বাছ বিচার না করেই সব গোগ্রাসে গিলি। পত্রিকা, হস্তরেখা, বিজ্ঞান, লতাপাতার গুন, খনার বচন, গোপাল ভাড়, কোন কিছুতে অরুচি নেই। সব কিছুই আমার খাদ্য।

এখন লিখতে এসেও আমার সেই রোগ চাগাড় দিল। এর শেষ পর্যন্ত গিয়ে দেখতে হবে আর কি কি তলানিতে পড়ে আছে। তবে সেই বর্তিকা থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম–অক্সফোর্ডের বই, বারাসত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের জার্নাল, পাব্লিক সার্ভিস কমিশনের প্রশ্নপত্র আর বহু কিছুতে আমার লেখা জায়গা করে নেবার পরেও বুঝতে পারছি না আর কতটা গেলে তলানিটা দেখে নিতে পারব। আমার তো মনে হয় চুড়ান্ত পর্যন্ত করতে পেরেছি। যতটুকু আমার ক্ষমতার মধ্যে কুলায়–সেটা করা হয়ে গেছে। নিরক্ষরতা থেকে স্বাক্ষর, আর তারপর লিখতে লিখতে বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, ২৪ ঘন্টা অনন্য সম্মান। সাহিত্য জগতের দুটো বড়ো পুরষ্কার পাবার পর এখন কী বলতে পারি না, সবটা দেখা হয়ে গেছে। আর আমার দেখার মতো তেমন কিছু নেই। দেখাবার মতোও আর কিছু বাকি নেই। এবার বোধহয় থেমে যাওয়া চলে। থেমে গেলে বিরাট কিছু হানি হবার নয়। এমনিতে চেঁকি চন্দন কাঠের হলেও তার ভাগ্যে লাথিই লেখা থাকে। আমি লেখা লেখির জগতে যে হনুই হই না কেন, মুটে মজুর বাপের ছেলে–আমাকে সারাজীবন তাই করেই চাল ডাল জোগাড় করতে হবে। তাহলে আর ওই লেখা ফেকা করে আর কী হবে।

তবে এই যাত্রাটা খুব একটা সহজ ছিল না। সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, আর্থিক অভাব অনটন, এমন বহু বাধার পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আমার চলার পথের উপর। সে সব আমার আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় লেখা আছে, তাই আর এখানে লিখছি না। আমি বরং এখানে পৌঁছাবার পথের কথা বলি। যে পথের উপর আমাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন মহান সাহিত্যিক মহাশ্বেতাদেবী। একটা নগণ্য জঘন্য ঘৃণিত জীবন, রাস্তার কুকুরের চেয়েও অধম। রেল স্টেশন ফুটপাতে শুয়ে থাকলে যাকে বিনা কারণে পুলিশ ডাণ্ডা মেরে তুলে নিয়ে যায়। লাথি মেরে দেয় বিরক্ত পাবলিক। মানুষের সমাজে যার কানাকড়িও মূল্য নেই। কাল পর্যন্ত আমি ছিলাম সেই প্রাণী। মানুষ যাকে অপমান অসম্মান অনাহার উপবাস ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। একটা লেখা ছাপা হবার পর দেখলাম সেই মানুষের কাছে আমি যেন অনেকটা মূল্যবান হয়ে গেছি। তারা আমাকে খুঁজে খুঁজে দেখা করতে আসছে, বেশ খানিকটা সমীহ দিচ্ছে। তাই মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার। মনের মধ্যে পাগলা হাতি দাপাদাপি শুরু করে দিল। একটা লেখায় যদি এত হৈ চৈ, দশটা বিশটা লেখা ছাপা হলে তখন কী হবে। নিশ্চয় মানব সমাজে আমি পেয়ে যাব একটা আদরনীয় স্থান।

কে যেন বলেছেন লেখক হচ্ছেন একটা গোরুর মতো জীব। সে খাবে যা সব চেয়ে নিকৃষ্ট সেই ঘাস, আর দেবে যা সব চেয়ে উৎকৃষ্ট সেই দুধ। জীবন আমাকে ঠেলে গুতিয়ে এমন বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছে। সে সব অভিজ্ঞতা ভরে পড়ে আছে সঞ্চয়ের ঝুলিতে। বই তো আমার অনেক পড়া ছিল, তাই জেনেছি আমার দেখা যে জগত তা অন্য অনেকের দেখার সুযোগ মেলেনি। তাই তারা তা নিয়ে লিখে উঠতে পারেননি। লেখবার কথা ভাবতে পারেননি। একটা বিশাল জন জীবন–অদেখা অজানা ভূখণ্ড পড়ে আছে অনেকের দৃষ্টি সীমার বাইরে। আমি সেই নিয়ে অনায়াসে তো লিখে ফেলতে পারি অনেকগুলো লেখা।

তখন তাই করলাম আমি।লিখলাম চারটে ছোটো গল্প। নিয়ে গেলাম মহাশ্বেতাদেবীর কাছে। উনি দেখলেন সেগুলো। তারপর নিরাসক্ত গলায় বললেন–বর্তিকা তো গল্পের কাগজ নয়, এতে শুধু সমীক্ষা ছাপা হয়। তুমি বরং অন্য কোথাও চেষ্টা করো। এটা সত্যি যে তখন বর্তিকায় শুধু সমীক্ষাই ছাপা হত। অন্য কোন লেখা নয়।

তবে আমি তো তখন নতুন, সাহিত্য জগতের কাউকে তেমন একটা চিনি জানি না। কোথায় কার কাছে নিয়ে গেলে লেখা ছাপা হবে আমার জানা নেই। কিন্তু লেখাগুলোর কিছু একটা না করেও তো মনে শান্তি পাচ্ছি না। শেষে ঠিকানা জোগাড় করে সেগুলো পাঠিয়ে দিলাম চারটে পত্রিকার ঠিকানায়। মনে একটা সন্দেহও ছিল। হয়তো লেখাগুলো তেমন একটা ভালো হয়নি। না হলে ওনার কাছেই তো কত পত্রিকার কত প্রকাশক সম্পাদক আসে। উনিইতো এগুলো নিজে হাতে কাউকে ছাপার জন্য দিতে পারতেন। তাই নামটা বদলে নিলাম লেখাগুলো পাঠালাম জিজীবিষা এই ছদ্মনামে। ছাপা যদি নাও হয় লজ্জায় পড়তে হবে না। দুতিন মাস পরে দেখলাম চারটে লেখাই ছাপা হয়ে গেছে চারটে পত্রিকায়। এতে মনে ভীষণ জোর আর আত্মবিশ্বাস এলো। পাবব–আমিও পারব। কেউ পাশে পিছনে না থাকলেও নিজের লড়াই নিজে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব আমি।

সেদিন আমার লেখা ছাপাবার কোনও উদ্যোগ নেননি বলে মহাশ্বেতাদেবীর উপর মনে মনে খানিকটা অভিমান করেছিলাম। কষ্ট দুঃখ যে পেয়েছিলাম খানিকটা–সেটা আজ আর লুকাব না। অভিমানেই বালিগঞ্জে ওনার বাড়িতে যাওয়া আসা খুব কমিয়ে দিয়েছিলাম। তবে মহাশ্বেতা দেবীর বাড়ি না গেলেও ওনার ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যের বাড়ি যাওয়া আসা ছিল। কারণ তার ছেলে বাউকে আমি রিকশা করে ইস্কুলে পৌঁছে দিতাম। ওনাদের কাছে পাঁচশো টাকা ধার করে আমি একটা রিকশা কিনেছিলাম। বাউকে দুবেলা বহন করার ভাড়া বাবদ মাসে মাসে পঞ্চাশটাকা করে শোধ হয়ে যেতো। এক বছরে সে টাকা পরিশোধ হয়ে যায়। এরপর তো আমি মধ্যপ্রদেশ চলে যাই। ওখানে গিয়ে যোগাযোগ ঘটে ছত্তিশগড়ের শ্রমিক নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সাথে। শঙ্কর গুহ নিয়োগীর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় লেখার সাথে তেমন একটা সম্পর্ক আর থাকে না। বলতে গেলে মহাশ্বেতাদেবীর সাথেও প্রায় সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ফিরি ৯৭ সালে। আততায়ীর গুলিতে শঙ্কর গুহ নিয়োগী নিহত হবার পর। উনি বেঁচে থাকলে আর আমার হয়তো বাঙলায় আসাই হত না, লেখালেখিও আর হত না। হয়তো আমার পরিচিতি হতো একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। উনি না থাকার কারণেই আমাকে ফিরে আসতে হয়। এর মাঝে কেটে গেছে আট বছর। এখানে তখন অন্য কিছু করার মতো নেই বলে আবার নতুন করে লেখালেখিটা শুরু করি। সেই সময় আমাকে সব চেয়ে বেশি সহযোগিতা দেন মীনাক্ষী মুখার্জী। উনিই আমার একটা লেখা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে EPW পত্রিকায় প্রকাশ করার ফলে বাংলা তথা সারা ভারতের লোক আমার বিষয়ে জানতে পারে। এই সময় মনোরঞ্জন ব্যাপারী নামের একটা চরিত্র বানিয়ে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত হিন্দি সাহিত্যিক অলকা সারাওগী একটা উপন্যাসও লিখে ফেলেছেন। তবে তার আগেই আমি লেখার জগতে নিজের জন্য একটা ছোট্ট জায়গা বানিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম।

এরপর মহাশ্বেতাদেবীর সাথে আবার যোগাযোগ ঘটে ২০০০ সাল নাগাদ–আমার ফিরে আসার তিন বছর পরে। এই সময় আমার বেশ কয়েকটি লেখা বর্তিকায় প্রকাশ পায়। সেই থেকে ওনার সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ ঘটে যা শেষদিন পর্যন্ত ছিল। দেখার ব্যাপার–১৯৮১ থেকে ২০১৬ মাঝের কয়েক বছর বাদ দিয়ে বাকি সবটা সময় আমি ওনার কাছে কাছেই ছিলাম। প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমি ওনার কাছে যেতাম। এতো দীর্ঘ সময়ে সেই যুগান্তর থেকে শুরু করে বর্তমান সহ অনেক পত্রিকায় উনি অনেক প্রতিবেদন লিখছেন। কিন্তু উনি রিকশাচালক লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী বিষয়ে কোথাও এক লাইনও লেখেননি। আপনাদের অনেকের মনে আছে যে উনি মারা যাবার মাত্র অল্প কয়েক দিন আগে ২০১৪ সালে এই সময় পত্রিকায় প্রায় গোটা পাতা জুড়ে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উদীয়মান, তরুণ, নবীন, সম্ভাবনাময়, লেখকদের নিয়ে। সেই ৮১ সালে আমরা যারা এক সাথে লেখা শুরু করেছি–অনেকের কথাই সেই লেখায় ছিল। এমনকি–জয় ভদ্র তারও নামে সুলেখক সম্ভাবনাময় লেখা ছিল। ছিলো না শুধু আমার নামে এক লাইন। চাইলে তিনি নিশ্চয় লিখতে পারতেন কারণ আমি তো ততোদিনে বাংলা আকাদেমি পুরষ্কার পেয়ে গেছি। পেয়ে গেছি ২৪ ঘণ্টা অনন্য সম্মান। আমার কথা কোথাও লেখেননি আবার কোনো পত্রিকা সম্পাদককেও কোনো দিন বলেননি আমার কোনো একটা লেখা ছাপাবার জন্য। কোনো প্রকাশককেও কোনোদিন বলেননি আমার কোনও একটা বই প্রকাশ করার জন্য। উনি বলেছিলেন আমার ছেলেকে একটা চাকরি পাইয়ে দেবেন। বলেছিলেন আমি যেখানে ২০০ জন লোকের রান্নার কাজ করি আর লেখার জন্য মোটে সময় পাইনা–বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে বলে আমাকে যাতে কোনও হালকা কাজে বদলি করে দেয় তার ব্যবস্থা করে দেবেন। সেটা উনি পারতেন কারণ মমতা ব্যানার্জি ওনাকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করে। উনি বললে সে কিছুতে না করতে পারত না। তবে এই সব বলেছিলেন বটে তিনি আমাকেও কিন্তু কোনওটাই করেননি।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় মহাশ্বেতাদেবী কঠিন কঠোর নির্দয়। আমারও আগে এই রকম মনে হতো। কিন্তু এখন আর তা মনে হয় না। আসলে উনি অনেক দূরের কথা ভেবেই আমার মঙ্গলের জন্য কিছু করেননি। একজন অভিযাত্রী যে হিমালয়ের শিখর ছুঁতে চায়, সে যখন এক এক পা আগাবার জন্য কঠিন পরিশ্রম করে, এক একটা পা রাখার জন্য তাকে ছেনী হাতুড়ি গাইতি চালিয়ে বরফ পাথর কেটে পা রাখার জায়গা বানিয়ে নিতে হয়, তারপর যখন সে হিমালয়ের শীর্ষ ছোঁয়, তার যে আনন্দ, আর যাকে হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ি ঝুলিয়ে পাহাড় চূড়ায় নামিয়ে দেওয়া হয়, তার যে আনন্দ, দুটো কোনও দিন এক হতে পারে না। নিজের চেষ্টায় পায়ে হেঁটে ওঠা ওই মানুষটাকে সবাই স্বীকৃতি দেবে একজন সফল অভিযাত্রী বলে, কিন্তু যে সিঁড়ি বেয়ে নামবে তাকে তো কেউ সেই সম্মান দেখাবে না। কেউ তার নামে জয়ধ্বনি দেবে না।

উনি আমাকে ভালোবাসতেন–খুবই ভালোবাসতেন। সন্তানসম স্নেহ করতেন। আমাকে নিয়ে অনেক দুরের ভাবনা ভেবে রেখেছিলেন তিনি। জানতেন আমার খুবই কষ্ট হবে তবু চেয়েছেন সবাই আমার নামে জয় জয় বলুক। চেয়েছেন, যত কঠোর কঠিন হোক–আমার চলার পথ যেন নিজেই আমি তৈরি করে নিই। কারও সহযোগ যেন আমার জীবনের সাথে জোঁক এটুলি পোকার মত সেঁটে না যায়। যেন ‘কৃতজ্ঞ’ শব্দটার সামনে আমাকে আজীবন হাঁটু মুড়ে মাথা হেঁট করে বসে থাকতে না হয়। যেন আমি স্বাধীন স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারি। ভাই মনকে দুর্বল হতে দেননি। মনের মাতৃস্নেহ মনেই দমন করে রেখেছেন। তাই পারলেও আমার জন্য কিছু করেননি। এই বই-এর ভূমিকাতে রয়েছে ওনার সেই মনোভাবের চিহ্ন। লিখেছেন তিনি—’মনোরঞ্জন ব্যাপারী একেবারে স্বপরিচয়ে স্বীকৃতি পেতে চান’। বলেননি তিনি যে—’আমি চাই সে স্বপরিচয়ে সমাজে স্বীকৃতি পাক।’

শীত গ্রীষ্ম বর্ষা প্রায় দুশো লোকের রান্না করতে হয় আমাকে। রান্না, বাসন মাজা, সবজি কাটা, পরিবেশন, টেবিল মোছা, তারপর আবার গোডাউন থেকে মালপত্র মেপে মেপে বের করা, সব করতে হয় মাত্র দুজনে। বাইরে যখন বিয়াল্লিশ ডিগ্রি গরম, টিনের ছাউনি দেওয়া রান্না ঘরে, দশ থেকে বারো ঘণ্টা চারখানা উনুনের সামনে রুটি সেঁকার মত শরীর সেঁকার পর যখন আমি লিখতে বসি, আমার কলমের আগায় যে তীব্র তীক্ষ্ণ শব্দ উঠে আসে–যা আমার লেখার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য–নরম আরাম কোমল জীবন পেলে সেই শব্দ তো আমার কলমে আসতো না। শাসন শোষণ অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে ভাষায় আক্রমণ করি, তখন আর হয়তো তা করতে পারতাম না। আমিও হয়তো তখন সধী লেখকদের মত চাঁদ তারা ফুল জোছনা পাহাড় ঝরনা–এই সব নিয়ে লিখতাম। উনি আমার সেই ক্ষতিটা করতে চাননি। আমাকে যে খুবই ভালোবাসতেন। মায়ের মতো ভালোবাসতেন। আর চাননি বলেই আমাকে আমার অবস্থানে থাকতে দিয়েছেন। নাড়িয়ে দেননি আমাকে আমার মাটি শিকড়–রস রসদের শক্তিকেন্দ্র থেকে। উনি সেটা পারতেন। ওনার একটা ফোনে আমার কর্মস্থলটা বদলে দিতে পারতেন। অনেককে দিয়েছেন। খালি আমার বেলা বাদ। কারণ উনি আমাকে আর কিছু নয়–লেখক বানাতে চেয়েছেন। স্বাধীন স্বনির্ভর আর সাহসী লেখক। এই কারণে আমি ওনার প্রতি ভীষণ ভীষণ রকম কৃতজ্ঞ। রোগা হোক, ছোটো আর দুর্বল হোক–দাঁড়িয়ে আছি নিজের পায়ে, কোনও খুঁটি লাঠির ভরকেন্দ্র ছাড়াই। খুঁটি লাঠির সহায়তায় দাঁড়ানো মানুষের অবলম্বনটা কোনও কারণে সরে গেলে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। আমার সে ভয় নেই। আর খুব বেশি উঁচুতে তো উঠিনি, পড়লে খুব একটা বেশি ব্যাথাও লাগবে না। এইখানেই মহাশ্বেতাদেবী অন্যদের চেয়ে অনন্য, অসাধারণ, দূরদর্শী, আর অন্যদের চেয়ে ভীষণ রকম আলাদা। এই কারণেই তার পায়ে শ্রদ্ধায় আমার মাথা আপনা-আপনি নুয়ে আসে।

1 Comment
Collapse Comments
এনায়েত রশীদ April 4, 2022 at 4:50 pm

বইটি এক কথায় অপূর্ব। একজন খেতে খাওয়া মানুষের লক্ষ প্রতিকূলতার মত এত শত বই লিখা পায় অসম্ভব কাজকে তিনি অবিশ্বাস্য ভাবে সম্ভবকরেছেন। তার এজন্য প্রসংশনা অপেক্ষা আরো অনেক বেশী কিছু পাওয়ার দাবী রাখে। তিনি অনেক দিন বাঁচেন এবং এরকম অনেক লেখা লিখে যান। সাগিনা মাহাতো হতে যেয়েন না।
এক কথা যোগ করতে চাই। কষ্ট পেলে ভূল হলে ক্ষমা করবেন।
বাংলাদেশ সমন্ধে ভারতীয় প্রচারের জন্য বা অন্য কোন কারনে আপনার ধারনা সম্ভবত ঠিক নয়। বাঙ্গালীরা ভাগ করে নি। বাংলা ভাগ করেছেন হিন্দু জমিদার ও তাদের দোষররা। একমাত্র নোয়াখালী ছাড়া সারা বাংলার কোথায়ও কোন রায়ট হয়নি। রায়ট হয়েছিল পন্জাবে। সেখান লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছিল। অনেক ধর্ষণ হয়েছিল। সেই নিয়ে ভারতে ও বিদেশে প্রচুর লেখা লেখি হয়েছে। তবে পাকিস্তান সরকার এবং বিহারের রায়ট থেকে আসা মানুষরা রায়ট করা চেষ্টা করে থাকতে পারে তবে বাংলার মানুষের জন্য তেমন ব্যাপক হতে উঠতে পারেনই।
বাঙ্গালীরা সব সময়ই নিরীহ। তারা কখনই শাষক হতে উঠতে পারে নি। কখন বুদ্ধরা কখন হিন্দুরা বাঙ্গালীদের শাষন করেছে। বাংলাদেশ হাজার বছরের বেশী সময়ে বাঙ্গালী শাষিত একমাত্র দেশ। স্বাধীন হওয়ায় যে মুসলমানরা চন্ডালরা হিন্দুদের বাড়ীর কাছাকাছিও যেতে পারতো না তারা ব্যবসা গবেষনা থেকে আরাম্ভ করে এমন কোন পদ নাই এরা
নেই। বাংলাদেশ শিক্ষাসহ আর্থিক ভাবে অভাবিত উন্নতি করেছে।
আপনি একবার বাংলাদেশ দেখে যান। সাংসদ হিসাবে লেখক বক্তা হিসাবে নয় সাধারন মানুষ হিসাবে বাঙ্গালী হিসাবে আসুন। দেখে যান। দেখবেন আপনার শোনা বাংলাদেশে আর বাস্তব বাংলাদেশের মিল খুঁজে পাবেন না। এখানে জাত সাত নাই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *