১৪. ব্যক্তি থেকে বিষয়

প্রতিবেদক গৌতম রায় একবার আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছিলেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী এখন ব্যক্তি থেকে বিষয় হয়ে গেছে। পড়েছি বটে লেখাটা কিন্তু মানেটা বুঝতে পারিনি। সেটা বুঝেছি অনেক দিন পরে।

আমি একটা বিষয়, এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে গল্প উপন্যাস লেখা যায়। পত্র পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখা যায়। যেটা দর্শক খেয়ে মজা পায়। তথ্যচিত্র বানাবার জন্য ওকে কী বলে–ফিনান্সার পাওয়া যায়। তাতে তথ্যচিত্র নির্মাতার দুটো পয়সা আসে।

যেভাবে পত্রিকা এবং টিভি সাংবাদিকরা আমাকে নিয়ে হুড়োহুড়ি করত আমি ভাবতাম যে অসম লড়াইটা আমি লড়ছি তার প্রতি একটা সহমর্মিতা থেকে এঁরা আসেন। এখন বুঝি আমরা যেরকম জঙ্গলে গিয়ে আমলকি হরিতকি বহেড়া মহুয়া ফুল কুড়িয়ে আনতাম, কারণ তার একটা বাজার মূল্য আছে। বেচে চাল ডাল কেনা যায়, এদের কাছে আমিও তেমনই একটা বিক্রয়জাত পণ্য। ঠিকঠাক বেচতে পারলে ওয়াইন আপেল খাওয়া যায়।

সবাই হয়তো আপেল ওয়াইনের জন্য নয়–বসের হুকুমে চাকরির জন্য আসে। তারা তাদের কাজটাকে ভালোবাসে। তাই যে আন্তরিকতায় আমার কথা শোনে ছবি তোলে সেই একই আন্তরিকতায় সাপ বাঘ হাতি ঘোড়ার ছবি তোলে, গর্জন রেকর্ড করে। কেউ কেউ নিপুণ দক্ষতায় শব্দ সাজিয়ে লেখে।

আজকের সমাজ কেউ কেউ যাকে বলে বৈশ্য সমাজ, এই সমাজে যে বেচতে জানে সবকিছু বেচতে পারে–হাসি কান্না রাগ দুঃখ দরিদ্রতা–সব। একবার আমি আর আমার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু দাঁড়িয়ে ছিলাম এক রেল স্টেশনে। এক ভিখারিণী বাচ্চা কোলে ভিক্ষে চেয়ে বেড়াচ্ছিল। “সারাদিন খাইনি দশটা পয়সা দাও বাবু”। কেউ তার কান্নায় কান দেয়নি।

এক সময় সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল মুত্রালয়ের পাশে দেওয়াল ঘেষে। তারপর সে তার ক্ষুধার্ত বাচ্চার মুখে গুঁজে দিল স্তনের বোটা। ঠিক সেই মুহূর্তে বন্ধুর ক্যামেরা ক্লিক করে উঠল। এক ভিখারি মা তৎক্ষণাৎ হয়ে গেল একটা শিল্প। একটা বিক্রয়জাত পণ্য।

কিছুদিন পরে এক পত্রিকায় সেই অনবদ্য চিত্রশিল্প দিয়ে বন্ধুটি পেয়ে গেল অনেক টাকা। যা সেই ভিখারির কল্পনায়ও আসবে না।

আমিও আজ একটা পণ্য, তাই কেউ আমাকে উপন্যাসের চরিত্র করে। কেউ পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখে আর কেউ ফোটো তোলে, হাঁটায় বসায় কথা বলায়। তাদের যেটুকু কাজ–সারা হয়ে গেলে আর আমার কোনো সংবাদ রাখে না। ধাওয়া করে অন্য আর একটা বিষয়ের দিকে।

অমিত ঘোষ নামের এক চিত্র পরিচালক যে আমাকে নিয়ে “সাধারণ অসাধারণ” নামে একটা আধঘন্টার তথ্যচিত্র করেছিল সেটা পরপর কয়েকবার আকাশ বাংলা চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। সে আবার ফোনে জানাল আর একটা তথ্যচিত্র করতে চায়। এটা হবে দুঘন্টার। দেখানো হবে ফেস্টিভ্যালে।

যেবার সাধারণ অসাধারণ হয় চারদিন শুটিং হয়েছিল। দুদিন আউটডোর দুদিন আমার বাড়িতে। চারদিন কাজে কামাই হয়েছিল আমার। বাড়িতে বড় বড় আলো আর ক্যামেরা সব চলেছিল আমার কারেন্ট পুড়িয়ে। ওরাই বলেছিল দুতিনশো টাকার বিল বাড়বে। দশ বারোজন লোকের বার বার চা বিস্কুট সব খরচ ছিল আমার। মনে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল তাই এসব নিয়ে কোনো মাথা ঘামাইনি।

শুটিং শেষ হল, বললাম ওদের–আর কিছু নয় আমাকে একটা সিডি করে দেবেন। কথা দিল তারা–দেব। প্রোগ্রাম টেলিকাস্ট হয়ে যাক। দু-তিনদিন পরে চ্যানেলে যাবেন। দিয়ে দেব। টেলিকাস্ট হয়ে যাবার দুদিন পরে গেলাম চ্যানেল এইট-এ। সেটা ওই মধ্য কলকাতায়। বলল তারা আজ তো হবে না, কাল আসুন। গেলাম পরের দিন। বলে আজকেও হবে না। দিন তিনেক পরে আসুন। তিনদিন পরে বলল–এক সপ্তাহ পরে পাবেন। এক সপ্তাহ পরে-একমাস। একমাস পরে বলল–চ্যানেল থেকে সিডি দেবার কোনো নিয়ম নেই। ওটা দেওয়া যাবে না।

লোকে বলে–তুমি একবার ঠকতে পারো। যদি দুবার ঠকে তবে বুঝতে হবে তুমি আস্ত বোকা। দশবার ঠকেছি, তবু আমার শিক্ষা হয়নি। এবারও তাই সেই অমিত ঘোষকে মুখের উপর না বলতে পারলাম না।

এবার প্রথমে তো বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আমার উপর যেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যা আমি ভবিষ্যৎকালের জন্য গুছিয়ে রেখেছি–সেই ফাইলটা চেয়েছিল–পড়ে দেখবে বলে। ভরসা। করে দিতে পারিনি। যদি হারিয়ে ফেলে। ওর তো কিছু যাবে না। সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার। তাই সেগুলো ফোটোকপি করে দিয়েছিলাম। এই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বুদ্ধিমানের মতো। কারণ সেগুলো আর ফেরত দেয়নি। তাতে খরচ গেল পঁচাত্তর টাকা। দুখানা ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বই চেয়ে নিয়েছিল পরে দাম দেবে বলে। দাম দেয়নি। তাতেও গেল কিছু টাকা। আর শুটিং চলাকালে পুরো ইউনিট সারাদিন ধরে চা বিস্কুট যা খেল এছাড়া একদিন দুপুরে ভাত, মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, ঝিঙে পোস্ত, আর রুই মাছের ঝোল দ্বারা ভোজন সারল আমার ঘাড় ভেঙে। তারপর তারা গেল–। গেল যে গেলই–।  আর কোনো খবর নেই। কোনো ফোনও করে না। আমি ফোন করলে দেখি সুইচ অফ।

এই কারণে আর আমি তথ্যচিত্রের নামে আগের মতো আনন্দে উদবেল হতে পারি না। যথেষ্ট হয়েছে আর না। তবে ওই যে বললাম–আমার শিক্ষা হয়নি। আমার মতো বোকা পাঁঠার জন্যই যে কিছু লোকের নাম চালাক চতুর। মালের ঠেকে বসে আমাদের জন্যই দাঁত বের করে বলতে পারে–গাণ্ডুকে যা একখানা টুপি দিয়েছি না। একদম ধরতে পারেনি।

এবার এলেন আর এক ঘোষ। এক ঘোষ আমাকে দুয়ে গেছে এবার ইনি দোহন করবেন। ইনি সেই জয়দীপ ঘোষ যে মায়া বাজার’ সিনেমাটা করেছিল এন এফ ডি সি-র অর্থানুকূল্যে। বইটা তেমন ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। নামি পরিচালক দেখে মাথা ঘুরে গেল আমার মনেও রইল না আবার মুরগি হবো। আমাকে বধ করে ভরে নেবে একজন প্রাপ্তির ঝুলি থলি বস্তা।

আবার শুরু হল সেই হাঁকাহাঁকি–সাইলেন্ট, লাইট, সাউন্ড, এ্যাকশান। যার আর এক নাম শুটিং। আমার বাড়ি, কর্মস্থল, জয়দীপ ঘোষের বাড়ি, শিয়ালদহ স্টেশন, যাদবপুরের নানা স্থান, গঙ্গার ঘাট, প্রেসিডেন্সি জেলের ভিতরে আরো বহু জায়গায় মাসাধিক কাল চলল সেই শুটিং। পঞ্চাশ ষাট জন অভিনেতা, সহ-অভিনেতা আর অন্যসব লোকজন নিয়ে সে এক মহা যুদ্ধ। এইসব শেষ করে যাওয়া হল ছত্তিশগড়। তিনচার দিনের শুটিং চলল–ভিলাই দল্লী-রাজহারা আর কাকেরে।

সব কিছু শেষ হবার পরে হিসেব করি কতটা গেল আর বিনিময়ে কী এল। দেখলাম সারা বছরের সব সি.এল., মেডিকেল লিভ আমার খতম। দু তিন দিনের পুরো ইউনিটের চা টিফিন সে খরচা আর অনুর কয়েক দিনের হাড়ভাঙা খাটুনি সেটা হল আসলের সাথে ফাউ। বিনিময়ে পাওয়া গেল পরিচালক জয়দীপ ঘোষের-থ্যাংক ইউ। শালা–একজন জুনিয়র আর্টিস্ট সারাদিনে মাত্র একটা শট দিয়ে দুটো সংলাপ বলে পাঁচশো টাকা পকেটে গুঁজে হাসতে হাসতে চলে যায়, একটি মেয়ে আমার বই দেখে বিভিন্ন চরিত্রের মুখের সংলাপগুলো খাতায় লিখেছিল–সে পেয়ে যায়। পাঁচ হাজার। আর আমার হাতে পাঁচটা পয়সাও কেউ ঠেকায় না–মুখ ফুটে একদিন বলে বসি জয়দীপ ঘোষকে–কী দাদা আমাকে কিছু দেবেন না? জবাব দেয় তার এক সহকারি–আমাদের বইয়ে যে প্রথম হিরো হয় সে আমাদের টাকা দেয়, এই বইয়ের হিরো তো আপনি। আপনার উচিত আমাদের কিছু টাকা দেওয়া। ছোট দেখে একটা চেক দিন না।

আমি আর কোনো জবাব খুঁজে পাই না।

কারও দোষ নয়, দোষ আমার এই চার আঙুল নসিবের। শালা এমন কিসমত নিয়ে পয়দা হয়েছি যে–যে পারে সে ইচ্ছেমতো আমাকে জবাই করে ফুটে যায়।

তবে একটা লাভ আমার হয়েছিল সেটা হচ্ছে–এই ছুতোয় একবার মধ্যপ্রদেশের এক টুকরো ছত্তিশগড়ে ঘোরা হয়ে গেল। তা না হলে আর হয়তো কে যাওয়া হতো না। কার টানে যাব? সে রামও নেই আর সে অযোধ্যাও নেই।

আমরা দ্রুগ স্টেশনের সন্নিকটে এক সরকারি বিশ্রামাগারে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। জয়দীপ ঘোষ ‘উঁচা পঁচবালা আদমি’। সে তার যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে এই ব্যবস্থা করেছিল। সেখান থেকে ভাড়া করা জিপে প্রথম দিন পৌঁছেছিলাম দল্লী-রাজহারায়। শহিদ হাসপাতাল তখন আকারে প্রকারে বিরাট হয়ে গেছে। নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে বসেছে দামি দামি যন্ত্রপাতি। চিকিৎসা কর্মীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেড়েছে রুগির সংখ্যাও। স্বল্প ব্যয়ে সুচিকিৎসা পেতে দূর দূরান্ত থেকে রোগী আসছে। সেসব তো ঠিক আছে, কিন্তু সেই প্রাণচাঞ্চল্য কই! ইউনিয়ন অফিসে সর্বক্ষণ গমগম করত লোকে, সেসব আর নেই। যেন এক পরিত্যক্ত নগরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে খাঁ খাঁ দালান। সামনের মাঠটা–যাকে মজুররা নাম দিয়েছিল লাল ময়দান–সেটা একবুক রিক্ততা নিয়ে পড়ে আছে। যেন প্রিয়জনকে দাহ করে চলে যাওয়া নিস্তব্ধ শ্মশান।

ইউনিয়ন সচিব সহদেব সাউ এখনও আছে। সে যেন এই মহাশ্মশানের নিঃসঙ্গ পাহারাদার। কাছে পিঠে আর কেউ নেই। আছে স্মৃতি আছে শূন্যতা! সাতাত্তর থেকে দুহাজার তেরচল্লিশ বছরের এক বোবা ইতিহাস বহনকারী এক জীবন্ত লাশের মতো পড়ে আছে সে। ইউনিয়ন অফিসের দলিল দস্তাবেজ চেয়ার টেবিল জুড়ে।

সে একদিন স্বচক্ষে দেখেছে সমুদ্র তরঙ্গের মতো ফুঁসে ওঠা শ্রমিক আন্দোলন। দেখেছে হাতুড়ি শাবল গাঁইতি ধরা-বজ্রগর্ভ মুষ্টিবদ্ধ হাত। সে হাত যেন আকাশ থেকে সূর্যকে ছিঁড়ে আনবার অসীম স্পর্ধায় উত্তোলিত হচ্ছে। ভেঙে ফেলে দিতে চাইছে শোষণ আর শাসনের বুহ্যচক্র। ইনকিলাব হুঙ্কারে কেঁপে যাচ্ছে ছত্তিশগড়ের পাহাড় অরণ্যং ভয়ে কাঁপছে শ্রেণিশত্রুদের সুরক্ষিত দূর্গ। বুঝি শেষের সেদিন সমাগত।

সব আজ স্তব্ধ। আর ইউনিয়ন অফিসের সামনের রাস্তা ধরে খাদানের দিকে মিছিল করে যেতে দেখা যায় না মজদুর নারী পুরুষকে। যাদের কাঁধের শাবল গাইতিতে পড়ে ঠিকরে যেত সকাল বেলার রোদ। পেশিবহুল পায়ের আঘাতে উড়তে ধুলো, থরথর করতো মেদিনী। সব নিঃ ঝুম হয়ে গেছে খুনি মালিক শ্রেণির দেশী কাট্টা’র একটা গুলিতে। শঙ্কর গুহ নিয়োগীর ঝাঁঝরা বুকের মতো ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে সংগঠন। এখন ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা একটা নিভে যাওয়া মশাল। ধোঁয়া একটু আছে বটে কিন্তু সেই দাউ দাউ দীপ্তি আর নেই।

নিয়োগীজি মারা যাবার সময়ে তার দু মেয়ে এক ছেলে ছিল ছোট ছোট। শুনলাম বড় মেয়ে ক্রান্তি নাকি এল.এল.বি পাশ করে এখন রায়পুর কোর্টে প্র্যাকটিশ করছে। ছোট মেয়ে মুক্তি দল্লী নগর পালিকা পরিষদের অধ্যক্ষ হয়েছে। তারই উদ্যোগে নিয়োগীজি এবং সাতাত্তরের এগারজন শহিদের শহিদ বেদী ঘিরে নির্মিত হয়েছে উঁচু প্রাচীর, লোহার গেট। লাগানো হয়েছে নানাবিধ ফুলের গাছ। একজন কর্মী রাখা হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।

ছোট ছিল মুক্তি তবু আমাকে চিনতে পারল। আর তাই মনের ক্ষোভ উগরে দিল আমার সামনে। ‘হামনে পর্ষদ চুনাবমে খাড়ে হোনেকে লিয়ে মুক্তি মোর্চা সে টিকট মাঙা থা। নেহি দিয়া। কংগ্রেসকো পাতা চলা, হাম চুনাম লড়না চাহতে হ্যায়, তো উনহোনে কহা, হাম দেতে হ্যায় টিকিট–তোম লড়ো। লড়া আউর জিত গ্যায়া। উনহোনে হামে অধ্যক্ষ বনা দিয়া। দেখতে হ্যায়–আগে ক্যায় হোতা হ্যায়।’

আশা দিদিও চিনল আমাকে। চিনল ফাগুরাম যাদব, জনক লাল ঠাকুর, ছবিলাল সাউ। ডাঃ শৈবাল জানা সে তো চিনবেই। সবাই স্মৃতিচারণ করল অতীত দিনের। বলল সেই আন্দোলনে আমার কী ভূমিকা ছিল। ভূমিকা তো সেই রামচন্দ্রের সেতুবন্ধে কাঠবেড়ালির। দেখলাম সেইটুকুও তারা আজও মনে রেখেছে।

এরপর গেলাম কাঁকেরে। কাঁকের শহরটা এখন দৈর্ঘ্য প্রস্থে চারগুণ বেড়ে গেছে। দল্লী যদি আমার হৃদয় হয় কাঁকের আমার ফুসফুস। এই শহরের গলি-মহল্লা-পথের বাঁকে বাঁকে পড়ে আছে। অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন। আমি ভালোবাসতাম দল্লীকে, এই শহর ভালোবাসতো আমাকে। ছোট্ট প্রাণবন্ত কাকের শহরের নৈঃসর্গ অকৃত্রিম সৌন্দর্য আমার কাছে যেন সেই অঞ্চল যা দেখে মুখ থেকে বের হয়ে আসে–আহঃ স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এইখানেই। এইখানে, এইখানে।

কাঁকেরে এককালে চেনা তো আমার অনেক ছিল, তবে তাদের খোঁজার মতো অবকাশ ছিল। সূর্য ডুবে যাচ্ছে আলো কমে আসছে, তখন ক্যামেরা ব্যবহারে লাভ হবে না। তাই একমাত্র নাজিব কুরেশি আর কাঁকেরে এলে যে হোটেলে রাত কাটাতাম কখনও কখনও, সেই পাঞ্জাব হোটেলের মালিক নাজিব এবং আমারও বন্ধু সরোজ–এই দুজনের বাইট নেওয়া হল। “বাঙালি দাদা মনোরঞ্জন বেপারির” বিষয়ে কিছু স্মৃতির জাবর কাটল তারা।

পরের দিন পাকড়াও করলাম বাঙালি উকিল বিষ্ণুপ্রসাদ চক্রবর্তীকে। সেও খানিক বকলেন। খুব বেশি নয়, তবে অল্প স্বল্প আমিও তো মানুষ চিনি। শারীরি ভাষ্য কিছুটা বুঝি। এদের মুখের কথা, এতকাল পরে আমাকে দেখতে পাবার আনন্দ আর সেই কতকাল আগে তাদের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, সব এখনও দরদের সাথে বুকের মধ্যে ধরে রেখেছে দেখে মনটা ভরে গেল আমার।

বুঝলাম–শারীরিক ভাবে আমি এখানে না থাকলেও এদের অলস আলোচনায় আমি আছি, আমি বহুকাল থাকব। ছত্তিশগড় ভ্রমণের এটা একটা বড় প্রাপ্তি।

.

আমার বাড়ির পাশের এক মার্কসবাদী পার্টির আঞ্চলিক নেতা মারা গেছে। খুব দাপুটে নেতা ছিলেন তিনি। মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান। প্রথম জীবনে বড় অভাব অনটনে দিন কাটিয়েছেন। নিজের মুখে বলেছেন তিনি তখন কচু ঘেঁচু খেয়ে বেঁচেছি। শেষ জীবনটা তার পার্টির দয়ায় বেশ সুখে কেটেছে। আগে পিছে দশজন চেলা ঘুরত। তাদের সব খরচা উনি চালাতেন। শুনি, দুপুর রাতে শুধু মদ্যপানেই হাজার বারোশো খরচ হতো।

ছয় ছেলে তার। মোটামুটি সবার জীবন সচ্ছল ভাবে ব্যয় করার পোক্ত ব্যবস্থা তিনি করে রেখে গেছেন। সব ভাইয়ের পাকা বাড়ি আর নানা ধরনের লাভদায়কলগ্নিকারী ব্যবসা। পুত্রবধূদের গা ভর্তি গহনা।

তিনি মারা যাবার পর প্রায় গোটা পঞ্চাশ গাড়ির মিছিল হয়েছিল। লাল কাপড়ে ঢেকে পার্টি অফিসে আনা হয়েছিল মৃতদেহ। লাল সেলাম দিয়েছিল কমরেডরা। আর বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে সমাধা হয়েছিল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। রাতের দিকে শোকগীতির আসর বসেছিল। ডজনখানেক মাইকে–এলাকার জনগণকে শোনাবার ব্যবস্থা হয়েছিল সেই গীত।

এলাকার এক সুগায়ক–ভক্ত বাউল যে প্রায়দিন সূর্য উদিত হবার সাথে সাথে দাস পাড়ার ব্রীজের সামনে চোলাই পান করে ধুলোমাটি মেখে ‘গড়াতে’ থাকে, সে বড় দরদী গলায় গাইছিল বারে বারে আর আসা হবে না। হে মানব, চুরাশি কোটি যোনীভেদ করে সর্বশেষে এই দুর্লভ মনুষ্য জন্ম পেয়েছে। এই জনম আর পাবে না। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ হয়, চোখের পলক, নাকের নিঃশ্বাস পড়ে–কিছু সুকর্ম করো। না হলে মরে যাবার পর হা হুতাশ করে কোনো ফল হবে না।

এই গান আমি বহু বছর ধরে বহুবার বহুজনের গলায় শুনেছি। শুধু এই গান কেন আমাদের সব ভক্তিগীতিতেই সর্বদা মানুষকে ভীত করে তোলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মোটমাট সব কথার এক কথা–শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর। বেঁচে থেকে আর কী এমন যন্ত্রণা পেয়েছে, পাবে মরে যাবার পরে। রামকৃষ্ণদেবও বলেছেন–মরণটাকে মনে রেখ।

এক একটা কথা এক একজন মানুষের উপর এক এক রকমের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সেই যে পরমহংস বলেছেন-টাকা মাটি মাটি টাকা। সেই শুনে কেউ টাকাকে মাটি (ময়লা) মনে করে ফেলে ছড়িয়ে পথের ভিখারি হয়ে যেতে পারে, আবার কেউ মাটিকে টাকা ভেবে জমি–অর্থাৎ মাটি কিনে ইটভাটা বসিয়ে মাটিকে অনেক টাকায় বদলে ফেলতে পারে।

মহাভারত পাঠের শেষে দাদু নাতনিকে জিজ্ঞাসা করলেন–বলো এই মহাকাব্য থেকে কি শিক্ষা পেলে? নাতনি বলল–দেখা যাচ্ছে একটা মেয়ে পাঁচটা পতি নিয়েও সতী থাকতে পারে। এতে কোনো অন্যায় হয় না। ওই একই প্রশ্ন নাতিকে করার পর সে জবাব দিল–রাজত্ব অধিকার করার জন্য আত্মীয়স্বজন যদি বাধার সৃষ্টি করে যুদ্ধ করা–প্রয়োজনে হত্যা করায় কোনো পাপ হয় না। না আমার উপর–বারে বারে আর আসা হবে না–কথাটা অন্য কোনো রকম অর্থে নয়, সরাসরি ওই ভাবেই আঘাত করে–আর আসা হবে না। দিনে দিনে গোনা দিন তো হল অবসান। আর–সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল সকলি ফুরায়ে যায়।

তেমন কোনো বড় আশা কি আমার কোনদিন ছিল? পেট ভরে দুটো খেতে চাওয়া, মাথার উপর একটা ছাউনি, সস্তার এক দুটো বস্ত্র, অসুখে একটু চিকিৎসা আর অবমাননামুক্ত একটু জীবন। এ যদি কোনো বড় চাওয়া হয়–হতে পারে।

ইদানিং মানুষের দরবারে আমার খানিকটা কদর বেড়েছে। ব্যক্তি থেকে বিষয় হয়ে গেছি যে। ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে বিদ্বজ্জন আমাকে আদর করে নিয়ে যাচ্ছে–কাক কেমন করে কোকিলের ডাক ডাকে–দেখার জন্য। দিল্লি, মহারাষ্ট্র, হায়দ্রাবাদ ঘুরে এসেছি। শুনেছি বাংলাদেশ আর অস্ট্রেলিয়াও আমাকে ডাকবে। তবে যাওয়া যাবে না হয়তো, আমার যে পাসপোর্ট নেই।

সে যা হয় হবে–তবে ইদানিং মনের মধ্যে বড় সাধ আঁকুপাঁকু হচ্ছে একবার জীবনে অন্তত একটা বার এরোপ্লেনে চড়বার। একবার আকাশে ওড়বার। আমি নিঃস্ব, আমার নিজের ক্ষমতায় এই বিলাস কখনই সম্ভব হবার নয়। কিন্তু যারা আমাকে হেতা হোত নিয়ে যায় তারা তো মর্তের কুবের। টাকার পাহাড়ে বসে আছে, তাদের কাছে একটা প্লেনের টিকিট-সে তো হাতির মুখে জিরে। তাই এবার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করি–এবার যদি কেউ বাংলার বাইরে কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায়–প্লেনে নিয়ে গেলে যাব। নচেৎ নট।

আমার এক দাদা–যার সঙ্গে পথেই পরিচয় সে এসে একদিন বলে–এবার আপনার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। ব্যাঙ্গালোর থেকে একটা আমন্ত্রণ এসেছে। আপনাকে সেখানে যেতে হবে।

নেচে উঠি আমি–প্লেনে যাব?

না, ট্রেনে।

যাব না।

আগে পুরো ব্যাপারটা তো শুনুন।

বলুন।

ব্যাঙ্গালোর থেকে আর একটা অনুষ্ঠানে যাব। সেটা হবে দিল্লিতে। জে.এন.ইউতে আর একটা অনুষ্ঠান আছে।

ব্যাঙ্গালোর থেকে দিল্লি নিশ্চয় প্লেনে যাব?

না, ওটাও ট্রেনে যেতে হবে।

তাহলে আমার আশা পূরণ কোথায় হবে?

দিল্লি থেকে কলকাতা ফেরার সময়। এটাই হবে প্লেনের যাত্রা। সব কথা ফাইন্যাল হয়ে গেছে। যাবার জন্য রেডি হোন।

তার কথায় বিশ্বাস করে বুকের গনগনে আশায় বৈশাখের ঘূর্ণি বাতাস লাগে। কাজের জায়গা থেকে দিন সাতেকের ছুটি নিই। বাড়িতে পাড়াতে কর্মস্থানে সবাইকে ডেকে বলি সুসংবাদের বার্তা–-শোন হে মানুষজন এবার বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে।

কাছে কোনো টাকা পয়সা ছিল না। এক বন্ধুর কাছে কিছু টাকা ধার করে কিনে আনলাম একটা বড় ব্যাগ। সাত আট দিনের যাত্রা, যেমন তেমন ব্যাগ হলে তো চলবে না। সাত-আট দিনের জামা প্যান্ট তো আটা চাই। সাড়ে বারোশো সেই ব্যাগে গচ্চা গেল। কিনতে হল কয়েকটা পাজামা পাঞ্জাবি গেঞ্জি জাঙ্গিয়া তোয়ালে আর দাড়ি কামাবার সাজসরঞ্জাম। পথে যদি শরীর খারাপ হয় সে জন্য কিছু ওষুধ। অনু বড় হিসেবি–সে হিসেব করে তেল সাবান শ্যাম্পু যা যা লাগবে বলে তার ধারণা–সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরে দিল।

যেদিন যাব তার দুদিন আগে থেকে শুরু হয়েছিল গোছগাছ। সে কি গোছগাছ! যেন যুদ্ধ যাত্রা। আমাদের পাড়ায় কোনো জুতো সরাইয়ের লোক নেই। অনু দশ আর দশ কুড়ি টাকা শাল ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে দু ঘন্টা সময় নষ্ট করে মুকুন্দপুরে গিয়ে ছেঁড়া জুতো সারিয়ে পালিশ করে নিয়ে এল। তার কঠোর নির্দেশ–যখন প্যান্ট পরব তখন যেন বুট পায়ে দিই। পায়জামা পাঞ্জাবির বেলা চটি।

অনু যখন ছত্তিশগড় থেকে কলকাতা চলে আসে শিলনোড়া পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এসেছিল। মুড়ো আঁটাখানাও ফেলে আসেনি। যদি জানত ব্যাঙ্গালোর দিল্লি গিয়ে রান্না করে খেতে হবে আমার ব্যাগে হয়তো শিল নোড়া দা বটি সব ভরে দিত। তবু একটা ছোট, একটা বড় দুটো ব্যাগে যা মাল ভরেছে ওজন বারো চৌদ্দ কিলোর কম নয়। সব গুছিয়ে নির্দিষ্ট দিনে বসে থাকি সেই দাদার একটা ফোনের অপেক্ষায় ফোন আসবে–আমি রওনা দেব হাওড়ার উদ্দেশ্যে। গিয়ে দাঁড়াব বড় ঘড়ির নীচে। দাদা এবং তার সাথে আসবে অন্য একজন তিনজনে গিয়ে চাপবো ব্যাঙ্গালোরগামী ট্রেনে।

কিন্তু কোথায় সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন। সকাল গড়িয়ে দুপুর–দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বিকেল গিয়ে নামল রাত। ফোন আর এল না। সেদিন, তারপরের দিন–তারও পরের দিন–কোনো খবর নেই। কী হল লোকটার তা কে জানে!

তার সম্বন্ধে সবিশেষ কিছু জানি না। বাড়ির ঠিকানা, সন্তান সন্ততি কে কী করে, তিনি কী করেন–সংসার কী করে চলে কোনোদিন কিছু বলেননি তিনি। আমার অভ্যাস কারও কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপারে কৌতূহল না প্রকাশ করা। যে কারণে তার সাথে আমার পরিচয় শুধু সেই ব্যাপারটায় সব প্রশ্ন উত্তর সীমাবদ্ধ রাখা। যদি সে কোনো সময় নিজের কথা বলে–শুনব। আগ বাড়িয়ে জানতে চাইব না।

তাই সেই দাদা বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানি না। একটি অনুষ্ঠানে পরিচয়। তখন থেকে সে আমার বাড়ি আসে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। চা খায় সিগারেট খায় গল্প করে। গল্প দেশ নিয়ে–সমাজ সাহিত্য রাজনীতি নিয়ে।

যেমন সে হঠাৎ করে এসেছিল, আবার নিখোঁজ হয়ে গেল হঠাৎ করে। আগে ভেবেছিলাম কোনো বিপদ হয়েছে। বার বার ফোন করছিলাম আমার মোবাইল থেকে। রিং হয়ে যাচ্ছিল কেউ সে ফোন রিসিভ করেনি। যখন আমার স্ত্রী অনুর মোবাইল থেকে ফোন করলাম সে ফোন রিসিভ করলেন। গলা শুনে বুঝলাম সুস্থ আছেন। তবে আমি কিছু বলার চেষ্টা করতেই ফোনটা কেটে গেল।

একটা মানুষ একটা দমকা হাওয়ার মতো জীবনে এসেছিল। মাত্র কয়েকদিন–তারপর কোনো দাগ চিহ্ন না রেখে মিলিয়ে গেল হাওয়ারই মতো। না, দাগ একটা বোধ হয় একটা থেকেই গেল যা কোনোদিন মুছে যাবার নয়। হতে পারে কোনো এক মহল থেকে চাপ এসেছিল–যেন আমাকে নিয়ে যাওয়া না হয়। সে চাপ তার পক্ষে না মেনে কোনো উপায় নেই। এমন তো সব মানুষের বেলাই হতে পারে। তাহলে উনি যদি একটা ছোট্ট ফোন করে আমাকে বলে দিতেন–”না দাদা, আপনাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না, কিছু অসুবিধা ঘটে গেছে। শেষ মুহূর্তে উদ্যোক্তারা কেন কে জানে বেঁকে বসেছে। কারণটা ঠিক যে কি আমি জানি না।” এক ফোনে সব ব্যাপারটা মিটে যেত।

আমি তো জানি–শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা ভারতবর্ষে আমার অগণন বিরুদ্ধপক্ষ গজিয়ে উঠেছে। লক্ষণটা খুব একটা খারাপ নয়। এটা নিউটনের সূত্র–বন্ধুর সংখ্যা যত বেড়ে যাবে–সমান অনুপাতে শত্রুর সংখ্যাও বাড়বে। এখন শত্রুর ভয়ে যদি বন্ধু বৃদ্ধির পথে পাথর ফেলে দিই সেটা অনুচিত হবে। তাই বন্ধুর মতো শত্রুও স্বাগতম, এসো শত্ৰু হানো আঘাত আমি বুক পেতে দিয়েছি।

কেন উনি ফোন করলেন না? তবে কী ওনার নিজেরই মোহভঙ্গ ঘটে গেছে আমার বিষয়ে। এই দুদিনে চিড় ধরেছে কোনো পুরানো ধ্যান ধারণায়। কাল আমাকে যা ভেবেছিলেন আমি আজ আর সেই মানুষ নেই? পদস্খলন ঘটে গেছে আমার। বের হয়ে পড়েছে কোনো গোপন দোষ।

হয় এমনটা হয়। যে ছেলেটা যে মেয়েটাকে পাগলের মতো ফটো দেখে ভালোবাসত, পরিচয় হবার কয়েক দিন পরে সে প্রেম ধুয়ে যায়। তখন সে সেই মেয়ের মুখোমুখি হবার ভয়ে পালাতে থাকে।

বিহারের পাটনার বুড়োনাথ তলার বসাক কুটীর ঠিকানা থেকে বর্ণালী বসাক নামে একটি মেয়ে আমাকে চিঠি লিখত। প্রতি সপ্তাহে একটা দীর্ঘ চিঠি। আবেগ আর আন্তরিকতায় মাখামাখি সে চিঠি–বহুকাল আমার মনের শান্তি ও প্রাণের আরাম–গর্বিত হবার রসদ জুগিয়েছে।

একদিন একটা ভুল করে ফেললাম। সেই যেবার ডাক্তার পিটিয়ে জেলে যাই–সেটা আমার ছবিসহ অমৃত সন্দেশ পত্রিকায় সংবাদ হয়েছিল। সেই পেপার কাটিংতাকে পাঠিয়ে দিই। ভাবনাটায় আমার ছেলেমানুষি ছিল। আমি চেয়েছিলাম সে জানুক, আমি কত সাহসী, সমাজ সেবক। কিন্তু সে দেখল এক মাঝবয়সী জেল ফেরত আসামির অনাকর্ষক চেহারা। চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল বর্ণালী বসাক নামের সেই কবি কল্পনায় গড়া মানসী প্রতিমার।

হতে পারে আমার উপর কোনো কারণে মোহভঙ্গ ঘটে গেছে তার। সে তো হতেই পারে। তবে সেটায় এমন মোটা দাগের নিষ্পত্তি না ঘটিয়ে একটা শিল্পীসুলভ তুলির টানে ইতি টানতে পারতেন। সেটা যে তিনি পারতেন না তেমন না, তাতে শ্যাম কুল দুটোই রক্ষা পেত।

কেন সেটা করলেন না, কোথায় তার অনীহার উৎস?

দিল্লিতে থাকেন এক ভদ্রলোক। নাম বজরঙ বিহারী তিওয়ারি। ইনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং লেখক। লেখার বিষয় দলিত সমাজ এবং সাহিত্য। এঁরই একটা লেখা দিল্লির কথাদেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার ফলে সারা ভারতের হিন্দি পাঠক আমার বিষয়ে অবগত হয়েছেন। একদিন সেই বজরঙ বিহারির ফোন এল–ব্যাপারীজি নমস্তে। কেইসে হ্যায় আপ?

বলি–ব্যাস্—চলারহা__

বলে সে–বিহার মে বিহার সরকার দৈনিক জাগরণ পত্রিকা আউরভি কুছ সংস্থায়ে মিলকর বিহার দিবস নাম সে এক কারিক্রম মানানে জা রহা। উনমে পাটনা লিটারেচর ফ্যাস্টিবল নাম কা এক কারিক্রম রাক্ষা গয়া। তিন দিন চলনে বালা উস প্রোগ্রামমে দিল্লি বিহার কলকাতা–প্রায় দেশকে সভি প্রদেশসে ডেলিগেট আয়েঙ্গে। আয়েঙ্গে পাকিস্তান সে ভি।

বলি–বহুত বড়া কারিক্রম।

হ্যা বহুত বড়া। বলে সে–উনহোনে মেরে উপর এক জিম্মেদারি সোপা হ্যায়। ম্যায় সারা দেশ মে সে স্রেফ এক দলিত লেখক কো চুন সকতা। ম্যায় তো দুবিধা মে পড় গয়া থা–কিসকো চুনু।

হেসে হেসে বলি আমি–কিউ! সারা দেশমে দলিত লেখক মে সে কিসিকো উস কারিক্রম কা যোগ্য মিল নেহি রহা?

বলে সে–মিল তো বহুত রহা, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, দিল্লি মেভি বহুত বড়া বড়া দলিত রাইটার ভরা পড়া হ্যায়। লেকিন–

বলিয়ে!

মেরে হিসাব সে ইনমে কোঈ ভি সহি মাইনেমে দলিত সমাজকা প্রতিনিধিত্ব নেহি কর রহা। এ লোক সব কোঈ অধ্যাপক, কোঈ বড়া সরকারি নোকর ভুখ-দলন জানতাই নেহি। মেরে কহনেকা মতলব এ লোগ সামাজিক রূপ মে দলিত জরুর লেকিন আর্থিক রূপ মে বহুতহিসচ্ছম। হ্যাঁ আগার দশ কো চুননেকা মওকা হোতা তো জরুর ম্যায় ইনমেসে চুনকো লিয়ে মজবুর হো যাতা। লেকিন চুন না থা এক-তো ম্যায় আপকো চুনা। না নেহি বোলিয়ে গা। ম্যায় আপকা নাম প্রস্তাব করা চুকা। ও লোক আপকো ফোন করে গা, এ মেরা ইজ্জত কা সওয়াল।

না, আর কিছু বলার মতো নেই। বজরঙ বিহারির চয়নের যে যুক্তি সেটা অকাট্য। আর্থিক এবং সামাজিক দিক থেকে দলিত লেখক-আর কেউ নেই। এটা তো দলিত বুদ্ধিজীবী কবি লেখক শিক্ষক সমাজ সেবক সবারও একটা সমস্যা। যে লোকটা ইসকুলে গেল না, বড় হল গরু চরিয়ে, এখন বাসন মাজে রান্না করে–তার এসব লেখালেখির কি দরকার ছিল। তা আবার এমন লেখা যা ই.পি.ডব্লু. ছাপে! সুযোগ পেয়ে তখন বলি বজরঙ বিহারিকে–যাব। না বলব না। তবে আমাকে প্লেনে নিয়ে যেতে হবে। ফেরবার সময় না হয় ট্রেনে ফিরব। জীবনে কখনও প্লেনে চড়িনি। আপনার সৌজন্যে একবার চড়ে দেখতে চাই।

শর্ত মেনে নিল তারা। আর তাই একবার পাখি হয়ে উড়ে নিচের ঘর বাড়ি পাহাড় নদী মানুষ কেমন দেখায়–দেখে নিতে পারলাম! বলেছিলাম ডান দিকে জানালার পাশে সিট চাই। সেই সিটই পেয়েছিলাম। আকাশে মেঘ থাকায় হিমালয় দেখতে পাইনি। খুব ইচ্ছে ছিল দেখার।

আমি প্লেনে চড়ব এটা আমার পরিবারের কাছে যেমন, দরিদ্র গ্রাম ক্ষুদিরাবাদের কাছেও একটা আশ্চর্য ঘটনা। পাশের বাড়ির অজিত দলুইয়ের বুড়ি মায়ের ভয়ে বুক কাঁপছে। সে এসে আমার বউকে বলে–ছেলেরে মানা কর বউমা অত উপর দিয়ে যাবে যদি পড়ে যায় তেখন কী হবে!

সত্যি বলতে কী প্লেন উঁচুতে ওঠার পর মৃত্যুভয় আমার যে আসেনি তা কিন্তু নয়। ভয়ের সাথে কিছু আশাও এসেছিল। অহো, এই মৃত্যু কত না মহান যদি আসে তো আসুক না। যার বাস লরি চাপা পড়ে মরার কথা, যার চাকু বোমা গুলি খেয়ে মরার কথা, যার কিছু না খেয়ে মরার কথা সে যদি প্লেন দুর্ঘটনায় মরে—সে মৃত্যু জগন্নাথের রথের চাকায় পিষে মরার মতো পুণ্যের মরণ। বউ বাচ্চার জন্য কিছু করে রাখতে পারিনি। কাল না হয় কদিন পরে তারা পেয়ে যাবে বীমা কোম্পানির দশ না পনের লক্ষ টাকা। খেয়ে পরে বাঁচবে। তবে তা চাইলেইকী পাওয়া যায়?শালা এমন একটা ছিঁবড়ে জীবন আমার ভালোভাবে যে বাঁচবো সেও পারব না, ভালো ভাবে যে মরব সেও ভাগ্যে নেই।

আমাদের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড আসার মতো কোনো বাহনের চলাচল নেই বাধ্য হয়ে একটা ট্যাক্সি নিতে হল। সঙ্গের দুটো ব্যাগ বেজায় ভারি। আমার স্ত্রী আর পাশের বাড়ির এক মহিলা সাবিত্রী দলুই দুজনে গেল সেই ভয়াবহ শেষ দৃশ্যের সাক্ষী থাকবে বলে।

আগে আমি যখন দুবৃত্ত ছিলাম তখন দেখেছি সত্যের চেয়ে মিথ্যার শক্তি শতেক গুণ বেশি। এখন সু-বৃত্তে এসে জেনেছি সত্যতে ঝামেলা অনেক কম। হ্যাঁ, সাহিত্য করতে হলে ভুরি ভুরি মিথ্যের মালা গাঁথতে হয়। যা হয় না হবে না, সেই হয় হবের গাথা গাইতে হয়। মানুষকে পশুত্বে অবনমন থেকে রক্ষা করতে সত্য শিব সুন্দর এসব বলতে হয়। সে সব অনেক উচ্চাঙ্গ ব্যাপার। তবে সাধারণ মানুষকে সাধারণ জীবন যাপন করতে হলে সত্য পথ ধরে চলায় প্রেসার সুগার এইসব ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি মিলে যায়।

তাই গাড়ি যেখানে থেমেছে ব্যাগ কাঁধে করে পৌঁছাই গেটের কাছে। বলা হয়েছিল দুঘন্টা আগে আসতে। কী সব চেকিং ফেকিং হয়। তবে অনুমতি মেলে প্লেনে চাপবার। আমি ঘড়ি ধরে দুঘন্টা আগে এসেছি গেটের সামনে। তার আগে আধঘন্টা বসেছিলাম অন্যখানে।

এবার বউ থেকে বিচ্ছেদ। সে ছল ছল চোখে বিল্টুদায় জানায়। সেই বুহ্যচক্রে প্রবেশের আগে যাত্রা দলের অভিমন্যু গান গায়–বিদায় দাও গো প্রাণেশ্বরী যেন যুদ্ধতে জয় করতে পারি গো। আমিও মনে মনে বলি–সারা ভারতের বিশিষ্ট বিদ্বানরা আসবে, সেই মঞ্চে আমি একা এক দরিদ্র দলিত। যেন ছাপ ছেড়ে আসতে পারি। যেন যতবার বিহার দিবস পালন হবে–সব অনুষ্ঠানে অনুভূত হয় আমার অনুপস্থিতি।

গেটের সামনে এক সিকিউরিটি গার্ড। প্লেনের টিকিট আর ভোটার আই কার্ড দেখাই তাকে–বলি বিশেষ পড়ালেখা জানি না।ইংরাজি তো একদম না। এই প্রথম প্লেনে যাচ্ছি। কোথায় যেতে হবে কী করতে হবে বলে দিন।

সত্যমেব জয়তে হয়। সে বলে দেয়–সোজা গিয়ে ডান দিকে ঘুরবেন। দেখবেন কাউন্টার। কাউকে জিজ্ঞাসা করলে বলে দেবে–জেট এয়ার লাইনস্ কাউন্টারে টিকিট দেবেন। এরপর কী করতে হবে ওরা বলে দেবে।

বলে দেয় তারা–ওখানে গিয়ে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করুন। সেখানে বড় ব্যাগটা জমা করে নেয়। মেশিন দ্বারা আমার শরীরে তল্লাশি চালায়। শেষে দেখিয়ে দেয় আর একটা গেট। ওখান দিয়ে ভিতরে যান। সেই গেটে আর একজন সিকিউরিটি। সেও কিছু পরীক্ষা পর্বের পরে পৌঁছাতে দেয় প্রতিক্ষালয়ে।

এইসব করতে ঘন্টা দুয়েক কেটে গেছে। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর এক বাসে তুলে নিয়ে গেল প্লেনের কাছে। ছোট প্লেন তার সিঁড়িটাও ছোট। তবু সেই সিঁড়ি বেয়ে প্লেনে চড়ার সময় সাদা শরীর শিহরিত হল আমার। এ বুঝি সেই সিঁড়ি যা রাবণ বানাতে চেয়েছিল। যে সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গে পৌঁছানো যায়। রাবণ যা পারেনি, বিজ্ঞানীরা পেরেছে। এই তো আমি স্বর্গে পৌঁছে যাচ্ছি।

মনটা এখন কেমন যেন করছে, বাবার মুখটা মনে পড়ছে। সারা জীবনে কোনদিন সে রেলের তৃতীয় শ্রেণির বগিতে টিকিট কেটে চেয়ারে বসে যেতে পারেনি। আমি কতবার জুন মাসের দুপুরে দুটো দশটা ডিউটি করার জন্য রাজডাঙ্গা খাল পার থেকে হেঁটে হিন্দুস্থান পার্কের জ্যোতি বসুর বাড়ির কাছে ভারত টিভি কোম্পানিতে গেছি মাত্র পঁচিশ পয়সা পকেটে না থাকায়। সেই আমি আজ এরোপ্লেনে চাপব। মেঘের উপর দিয়ে উড়ব। যেখান থেকে হাত বাড়িয়ে চাঁদ তারা ছুঁয়ে ফেলা যায়। আমি ধন্য। বজরঙবাবু তোমাকে ধন্যবাদ।

প্লেনে বসার পর ঘোষণা হল–এবার প্লেন উড়বে। কোমরে সিট বেল্ট বেঁধে নিন মোবাইলের সুইচ অফ করে দিন। এরপর প্লেন রওনা দিল, প্রথমে সোজা দক্ষিণ থেকে উত্তরে গেল কিছু পথ, বাসের মত গড় গড়িয়ে একটু গতি কমিয়ে ডান দিকে ঘুরল ফের ছুটল দক্ষিণ দিকে। জোরে–আরও জোরে। তারপর এক ঝকিদুঝুঁকি তিন ঝুঁকি দিয়ে মাটি ছেড়ে ক্রমে উঁচু থেকে আরও উচ্চে উঠে পড়ল। একবার বাঁ দিকে কাত হল একবার ডান দিকে কাত হল-ফের বাম ফের ডান উচ্চ থেকে উচ্চতর হল প্লেনের অবস্থান।

প্লেনে বসার আসন পেয়েছি ডানদিকের জানলার ধারে। আমার বাঁদিকের একটা সিট। সেটা খালি। কেউ বসেনি। কেন বসেনি। আমার গায়ে ঘামের গন্ধ? চেহারাটা খসখসে অ-বাবু? বসেনি তো বয়েই গেল আমার, আমি তো বসেছি। সারা দেহ মন রোমাঞ্চিত হচ্ছে আমার। সারাটা জীবন মাটি কাদায় পাঁকে পা দিয়ে কেটেছে। আমার ভাগ্য আজ আমাকে দুটো ডানা দিয়েছে। শঙ্খ চিল বানিয়ে দিয়েছে, সেই আনন্দে হাবুডুবু খাচ্ছি আমি। কেন আমার পাশের সিট খালি সে দিয়ে আমার কী দরকার।

একটু অস্বস্তি যে হচ্ছে না, তা নয়। এখানে আমি যেন বাঘের পালে এক শেয়াল শাবক। চারপাশে যে লোকজন তাদের পোষাক আষাক, চালচলন, কথা বার্তা সব কিছুতে বোঝা যাচ্ছে এরা কেউ আমার গোত্রের নয়–সব ধনবান। সেই দাপট যেন ফুটে ফুটে বের হচ্ছে। তাই তাদের দিকে না তাকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাই। নিচে দেখা যাচ্ছে কলকাতা মহানগরটাকে। বিশাল বিশাল দালানগুলো যেন এক একটা দেশলাই খোলের মতো ছোট আর ক্ষুদ্র। চোখে পড়ল ইন্ডোর স্টেডিয়াম, শহিদ মিনার। কতবার ভেবেছি একদিন ওই মিনারের মাথায় চড়ে কলকাতা শহরটা কেমন দেখায়–দেখব। যারা চড়েছে সবাই বলেছে–চড়তে পারবে না খুব উঁচু। পা ধরে যাবে। সেই শহিদ মিনারকে এখন দেখাচ্ছে যেন আমারই বুড়ো আঙুলের মতো ছোট। তুচ্ছ মনে হচ্ছে তার অহঙ্কারি উচ্চতাকে–আমার অহঙ্কারের তুলনায়। তার উঁচু মস্তক এখন আমার পায়ের অনেক নিচে।

শহর শেষ হলে শুরু হল সেই আদিগন্ত গ্রামীণ ভারত। সব সবুজ আর সবুজ। যার মাঝে মাঝে না চিনতে পারা কোনো লম্বা নদী, নদী আর পাহাড় শ্রেণির নীচে যে সমতল–সব চৌকা মাপের। যেমন ভাবে বালকেরা দাড়িয়াবান্ধা খেলার খোপ কাটে অনেকটা সেই রকম। ওই এক একটা খোপ বুঝি এক একটা জেলার সীমানা!

সেই কবে কতকাল আগে যাযাবরের বই দৃষ্টিপাত-এ পড়েছিলাম বিমান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ, সেদিন সে কথার মর্ম বুঝিনি–আজ বুঝলাম। প্লেনে উঠলাম সময় লাগল এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট–হুঁস করে চলে এলাম কলকাতা থেকে পাটনা। এতে সেই ভালো লাগা কোথায়? যেমন ট্রেন বা বাস যাত্রায় থাকে। এটাই হচ্ছে মাটি ছুঁয়ে থাকার মজা–স্বাদ-আনন্দ। এক এক স্টেশনে দীর্ঘ দৌড় শেষ করে ট্রেন এসে থামে। চা-অলা ফল্লি অলা সবার সমবেত কোরাসে যেন আবহ সঙ্গীতের সুরধ্বনি শোনা যায়। যেন সেই স্বর সুর শব্দে প্রাণ ফিরে পায় রাত গভীরে-মৃত কোন নগরী প্রাণে প্রবাহিত হয় নব, নবতম জীবনী শক্তি। কত বড় এই দেশ, কত রকমের ভাষা–পোষাক পরিচ্ছদ সমাজ সংস্কৃতি, ট্রেন বাসের যাত্রায় অল্প হলেও সব কিছু ছুঁয়ে যাওয়া যায়। প্লেনে সে আনন্দ পাওয়া যাবে না।

অবশেষে এসে নামলাম পাটনার হাওয়াই আড্ডায়। সময় লেগেছে মাত্র এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট। আমার বাড়ি থেকে যাদবপুর স্টেশনে যেতে এর চেয়ে সময় বেশি বই কম লাগে না। আমার সামনে চলমান যাত্রীদের মিছিল। তাদের পিছু পিছু হেঁটে আমিও বাইরে বের হয়ে আসি। দেখি একটা টেবিল পেতে তার উপর ফুলের তোড়া জলের বোতল নিয়ে বসে আছে একজন লোক। তার হাতে একটা প্ল্যাকার্ড মনোরঞ্জন ব্যাপারী ওয়েলকাম। তার সামনে যেতেই সে আমার হাতে একটা ফুলের তোড়া জলের বোতল ধরিয়ে দেয়। অন্য একজন পথ দেখায়, আইয়ে–গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একখানা গাড়ি। সেটার দরজা খুলে বলে যাইয়ে। সে গিয়ে বসে ড্রাইভারের পাশে। আমি এক কেউকেটা লোক, আমার পাশে বসার মতো যোগ্যতা তার কোথায়!

গাড়ির দরজা খোলার সময় চোখে মুখে যে ঠাণ্ডা বাতাস লেগেছিল তাতেই বুঝেছিলাম–যা তা গাড়ি নয়। এখন ভিতরে ঢুকে সারা শরীর শীতল হয়ে গেল। এসি চলছে। পাটনা শহরের আজ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ ডিগ্রি তাপমান এই গাড়ির মধ্যে ঢুকতে পারছে না।

যারা এই রকম গাড়িতে চড়ে এই রকম শীতল বাড়িতে থাকে তাদের কী যায় আসে বিশ্বের তাপ বাড়ছে না কমছে সেই হিসেব দিয়ে। তারা অক্লেশে হাজার মাইল অরণ্য ধ্বংস করে দিতে পারে নিজস্ব প্রয়োজনে।

গাড়ি মিনিট কুড়ি পরে পৌঁছাল অতিথিশালার দরজায়। এখানেও আমার জন্য প্রস্তুত আছে সাদর অভ্যর্থনা। এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিহার সরকারের কয়েকজন পদস্থ অফিসার। যাদের চেহারা পোষাক, চলন বলন সব কিছুতে শিক্ষা এবং সচ্ছলতার সাথে পদমর্যাদার প্রভাব বেশ স্পষ্ট। বাড়িটা ক’তলা গুনে দেখেনি তবে আমাকে রাখা হল দশতলার সুসজ্জিত সর্ব সুবিধাযুক্ত একটা রুমে। আমি গেছি ২২ মার্চ ২০১৩। সেই দিনই বজরঙ বিহারি এসে গেলেন দিল্লি থেকে। আমার পাশের কামরায় রইলেন তিনি।

এখানে আমার পরিচিত আর কেউ নেই। এই একজন মাত্র। খানিকক্ষণ বিশ্রাম করে মুখ হাত ধুয়ে চা ফা খেয়ে আমরা গেলাম স্থানীয় তারামণ্ডল সভাগৃহে–যেখানে বিহার সরকারের কলা এবং সাংস্কৃতিক বিভাগ নিবরস’ এবং দৈনিক জাগরণ পত্রিকার যৌথ প্রয়াসে শুরু হয়েছে। সাহিত্য মহোৎসব। পাটনা লিটরেচার ফেস্টিভ্যাল। তারামণ্ডলের বিশাল হল এখন পরিপূর্ণ সারা ভারত থেকে আগত তারকা সমাবেশে। আছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও। এই বিদ্বজ্জনের মাঝে আমারও একটা পরিচয় আছে-দৈনিক জাগরণ লিখেছিল–”শ্রমশীল সংস্কৃতিকে লিয়ে ভারত কা নির্মাণ করনেবালো কা প্রতিনিধি মনোরঞ্জন ব্যাপারী।”

আজ ঠিক মনে নেই, কোথায় যেন পড়েছিলাম কোনো এক কবিতার একটা লাইন-”যদি জ্বল জ্বল করো, লোক হাসাতে সভায় যেও না।” ২২ আর ২৩শে মার্চ দুদিন আমি ছিলাম নিষ্প্রভ। শ্রোতা দর্শকের ভিড়ে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা একজন সাধারণ মানুষ। বিহারের কেউ যাকে চেনে না। ২৪শে মার্চ সকাল সাড়ে নটায় থেকে সাড়ে দশটা তারপর আর অপরিচিত ছিলাম না। দৈনিক জাগরণ হিন্দুস্থান টাইমস প্রভাত খ, আপনা বিহার পত্রিকা আর বহু টিভি চ্যানেল আমাকে নিয়ে যা ক্ষেপে উঠেছিল–আর অপরিচিত থাকার উপায় ছিল না। জ্বল জ্বলে হয়ে উঠেছিলাম আমি। আমার নাম প্রস্তাব করা বজরঙ বিহারি অনুষ্ঠানে শেষে শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়ায় সন্তুষ্ট হয়ে বহুবার শোনা সেই শোলে সিনেমার সঞ্জীব কুমারের সংলাপ আবার বলেছিলেন–বাঙাল সে আপকো বিহার বুলাকার হামনে কোঈ গলতি নেহি কি।

২৪শে মার্চ ২০১৩, টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটায় এগিয়ে চলেছে সময়। স্নান টান করে আমি প্রস্তুত–যেতে হবে যুদ্ধভূমিতে। নির্ধারিত সময় ৯.৩০। দুদিন ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছি প্রতিপক্ষ সেনাদলের গতিবিধি আর অস্ত্র ভাণ্ডার। চারু মজুমদার বলেছিলেন–সঠিক তদন্তই একটা সফল অ্যাকশনের প্রাণ। তাই দুদিন ধরে জেনে বুঝে নিয়েছি কী ধরনের মারণাস্ত্র আমার দিকে ধেয়ে আসতে পারে–তখন আত্মরক্ষা কোন্ অস্ত্রে সম্ভব হবে।

এই অনুষ্ঠান অংশের সঞ্চালক বজরঙ বিহারি তিওয়ারি। বসেছিলাম দর্শকাসনে, তিনি নাম ধরে ডাকতে দৃঢ় পায়ে হেঁটে উঠলাম মঞ্চে। ইংরাজিতে যাকে এরিনা বলে-বুনো মোষকে ছেড়ে দিয়ে চারদিক থেকে লোকে যাকে খোঁচায়, খেপায়, রক্তপাত ঘটিয়ে আনন্দ পায়। তাকালাম সামনের অক্ষৌহিনী নারায়ণ সেনার দিকে। “আমি এক অঙ্গহীন অস্ত্রহীন” একা-একলব্য।” যদি ওই বাহিনীকে বিধ্বস্ত করতে পারি সসম্মানে চক্রব্যুহ থেকে বের হয়ে যেতে পারব। যদি না পারি ওরা পেড়ে ফেলবে। নাচবে আমার মৃত দেহের উপর। বলবে–যোগ্যতমের জয়। এরা অযোগ্য তাই নিম্নে পড়ে আছে। যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তবু হেরে ভূত। অতএব–প্রমাণিত হল এরা পারে না, পারবে না। কী দরকার তোদের এসব সাহিত্য ফাহিত্য করে। যা, গিয়ে চাষ কর রিকশা চালা মোট ব। যা তোরা পারিস।

আমার আগে এক বক্তা সুপ্রসিদ্ধ লেখক অসগর বজাহত। আজ নিয়ে তিনদিন উনি মঞ্চে বসলেন। প্রতিদিনই ওনার কিছু না কিছু প্রোগ্রাম রেখেছে সঞ্চালন সমিতি। যা যা বলার সম্ভবত গত দুদিনে বলে দিয়েছেন তাই আজ বেশি সময় নিলেন না। মিনিট পাঁচেকে সেরে দিলেন শেষ কথা বলে–দলিতদের শুধু আত্মজীবনী লিখলে চলবে না, গল্প উপন্যাস কবিতা–সব লিখতে হবে।

এইবার আমার পালা। নিয়ম অনুসারে সঞ্চালক আমাকে প্রশ্ন করলেন বা সূত্র ধরিয়ে দিলেন একটা, কোন খাতে তিনি আলোচনাকে প্রবাহিত করতে চান। আমি কি সেই বান্দা যে ওনার গয়ে গাইব। আমি সবদিন যা করেছি নিজের গতি পথ নিজে বানিয়ে নিয়েছি, আজও তাই করার উদ্দেশ্যে তার কথা কানের এক ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক ছিদ্র দিয়ে বের করে দিই। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বিহার সরকার দৈনিক জাগরণ পত্রিকা, উপস্থিত জনতা সবাইকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে শুরু করি আমার নিজস্ব ঘরানার আলাপ।

সুধী সজ্জন, বজরঙজিকা সওয়ালকা জবাব হাম কুছ বাদমে দেঙ্গে। পহেলে আপলোগ সে কুছ বাত করেঙ্গে। ফির এক লেখ পড়েঙ্গে। ফির বজরঙজি আউর আপ সবকা সওয়ালকা জবাব দেঙ্গে।

হিন্দি মোটামুটি খুব একটা খারাপ বলি না। বলে চলি সেই ভাষায়। আমি যা বলতে চাই বলার জন্য একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শুরু করব। গল্পটা হচ্ছে একবার সংসদে কোনো একটা বিষয় নিয়ে জোরদার কোনো বিতর্ক চলছে। তখন এক সাংসদের কোনো একটা মন্তব্যে অধ্যক্ষ মহোদয় কিছু বিরক্ত হয়েছেন, অপমান বোধ করেছেন। তখন তিনি সাংসদকে বলেন–আপনি নিশ্চয় জানেন, আমি কে? জবাব দেয় সাংসদ–জানি তত আপনি কে। তাহলে এটাও জানেন বোধহয় যে আপনার সাথে আমার কী পার্থক্য? বলে সাংসদ সেটাও জানি। তাহলে বলুন তো কী সেই পার্থক্য! হেসে জবাব দেয় সাংসদ, পার্থক্য একটাই–ব্যাস মাত্র একটাই পার্থক্য, আপনি ওখানে বসে আছেন আর আমি এখানে বসে আছি।

শ্রোতার আসনে উপবিষ্ট সুধী সজ্জন, আপনাদের সঙ্গেও আমার এইটুকু মাত্র তফাৎ–আপনারা ওখানে বসে আছেন, আমি এখানে বসে আছি। আমি জানি-যারা ওখানে বসে আছেন যে কেউ মঞ্চে উঠে আমার চেয়ারে বসে পড়ার মতো যোগ্যতা রাখেন। শিল্প সাহিত্য বিষয়ে তিনি আমার চেয়ে অনেক ভালো জানেন–বলতে পারেন।

তবে একটা তফাৎ আছে আপনার সাথে আমার। সেটা হচ্ছে ওই চেয়ার থেকে এই মঞ্চে আসতে আপনার সময় লাগবে মাত্র কয়েক মিনিট। আর আমার সময় লেগে গেল–তেত্রিশ বছর। যাদবপুর রেল স্টেশনে গামছা বিছিয়ে ইট মাথায় দিয়ে শূন্য পেটে শুয়ে থাকতাম। সেই অবস্থায় ১৯৮১ সালে বর্তিকা পত্রিকার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিলাম–এই সম্মানীয় মঞ্চের দিকে। আজ এসে পৌঁছেছি।

তালি তালি তালি তালি। বুঝতে পারলাম না এ তালি কীসের জন্য। শ্রোতার সামনে বসে থাকা বিদগ্ধ-বিদ্বৎ সমাজ তবে কী স্বীকার করে নিল আমাকে। ঘায়েল হয়ে পড়ল আমার শব্দ-শরে! সেই কবে যেন শুনেছিলাম যেটা যার দুর্বলতা সেটাই তার অস্ত্র। আমার কর্মস্থলে তিন ফুট এক মাংসপিন্ড বিশেষ কর্মচারি আছে। সে যাকে তাকে যখন তখন যাতা বলে গাল দেয়, মেরে বসে। সে অক্ষম দুর্বল প্রতিবন্ধী। সেটাই তার সাহসের উৎস। কেউ তাকে কিছু করতে পারবে না। তাহলে জন-ভাবাবেগ আইন সব তার পিছনে দাঁড়িয়ে পড়বে।

আমার শক্তির উৎস–আমার থেতলানো জীবন। পড়ে আছি একদম নিচের সিঁড়িতে। আর নিচে কে নামাবে! হারাবার কিছু নেই তাই আমি নির্ভয়। বলি তাদের –ওপার বাংলা থেকে আসা দলিত-দরিদ্র-সরকারি সহায়তা বঞ্চিত এক রিফিউজি পরিবারের সন্তান আমি। বাল্যকাল কেটেছে গরু ছাগল চরিয়ে। একটু বড় হয়ে চা দোকানের টেবিল বয়। আর একটু বড় হয়ে মুটে মজুর রিকশা চালক ডোম সুইপার ট্রাকের খালাসি নাইট গার্ড আরও কত কিছু পেশা–খিদের জ্বালায় পেটের মধ্যে নাড়িভুঁড়িগুলো পোড়া অজগরের মত মোচড় মারা যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চুরি ছিনতাইও করেছিদুচারবার। জীবন আমাকেইসকুলে যাবার সুযোগ দেয়নি, নিয়ে গেছে জেলখানার কালো কুঠুরিতে। সেই জেলখানার মাটিতে কাঠির আঁচড়ে শিখেছি বাংলা বর্ণমালা। তারপর ঘটনাচক্রে লেখক হয়েছি। দশ বারোখানা উপন্যাস শ’খানেক গল্প বিশ পঁচিশখানা প্রবন্ধ গোটা পাঁচ সাত কবিতা প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। তবে সবচেয়ে খ্যাতি পেয়েছি আমার আত্মজীবনী-ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন প্রকাশিত হবার পরে। সাহিত্য এতে কতটা আছে জানি না–তবে সত্য আছে। বড় নির্মম নিষ্ঠুর কদাকার সত্য।

তালি তালি–আবার তালি।

শুনেছি মণিরাজ নামে কোনো গাছ আছে, যার শেকড় সামনে নিয়ে গেলে ফণীরাজ নত হয়ে পড়ে। তেমন হয় কিনা আমি জানি না। তবে এখন আমি জনগণেশকে বশ করে ফেলেছি। কালীয় নাগের মাথায় মৃত্যরত বালক কৃষ্ণের মতো নাচছি। নাচাচ্ছি।

কী যেন একটা সিনেমা দেখেছিলাম।এক কংফু কিং একটা বিষধর শঙ্খচুড়কে চোখের চাউনিতে মাথার নড়াচড়ায় বাধ্য করেছিল তারই ইচ্ছানুরূপ সাপকেও মাথা নাড়াতে বেঁকে যেতে।

আমি সেই কুংফু কিং হয়ে গেছি। আমার বক্তব্য আমি শ্রোতাদের শুনতে বাধ্য করছি। এরা ততোক্ষণ শুনবে–যতক্ষণ আমি বলব। শুনছে আমার ইচ্ছায়-ভাবছে ইচ্ছাটা তার। চালাকিটা বুঝতে পারছে না আমার। মাঝে মাঝে কথা থামিয়ে শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করছি আমার কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আপনাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো? বলুন তাহলে থেমে যাই। শ্রোতারা সমস্বরে গর্জায়–নেহি নেহি। আপ বোলিয়ে।

বলি তাদের, দশ-বারোটা উপন্যাস প্রায় একশো গল্প-র একটাও আমার কষ্ট কল্পিত আখ্যান নয়। সব আমারই জীবন গাথা। সব কাহিনির মধ্যে খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে আছে আমারই বিড়ম্বিত জীবন। ওই যে ছেঁড়া বস্তা কাঁধে পথে পথে খাদ্য খুঁজছে যে ছেলেটা ওই যে ডাষ্টবিন ঘেঁটে আলিবাবার গুপ্ত গুহার দ্বার খুঁজছে যে ছেলেটা, যাকে লাইট পোস্টে পিছমোড়া বেঁধে পেটানো হচ্ছে চোর বলে–কারণ সে পাউরুটি চুরি করে ধরা পড়েছে, ওই যে লোকটা হোটেলে খেয়ে পয়সা না দিয়ে পালাচ্ছে আর জনতা ডাকাত ডাকাত বলে তার পিছনে ধাওয়া করছে, কোটা পূরণ করার জন্য, ওই যে লোকটাকে পুলিশ ওয়াগন ব্রেকার বলে জেলে চালান করছে–সব আমি। এসবই আমার বহুধা বিভক্ত-সত্ত্বা। এরাই আমার কাহিনীর চরিত্র।

উদ্যোক্তারা সংকেত পাঠাচ্ছে বজরঙ বার বার ঘড়ি দেখছে। সময় হুহু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কথা ছিল এক ঘন্টার–এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান শেষ করা যাচ্ছে না। যেই আমি। একটু থেমেছি সেই ফাঁকে ছুটে এল একগাদা প্রশ্ন–আপনি কী করে লেখক হলেন? দলিত সাহিত্য বলতে কী বোঝায়? বাংলায় দলিত আন্দোলন নেই কেন? আগামীর পরিকল্পনা কি? বর্তমানে কি করেন? সংসার কি ভাবে চলে? প্রেম করে ছিলেন কিনা? কত যে প্রশ্ন! প্রশ্নের তোড়ে যেন ভেসে যাব।

এসব প্রশ্নের উত্তর আমার বইয়ে লেখা আছে। সংক্ষেপে কিছু জবাব দিই। এখন বলে বজরঙ বিহারি-আপ লোগোকো উবলা দেখকে সমঝ আতা কী, সওয়াল জবাব সে জি নেহি ভরা। লেকিন হাম মজবুর হ্যায় ইস করিক্রম সমাপ্ত করনেকে লিয়ে।সিড়ল টাইম–পাছে আউরভি কারিক্রম হ্যায়। উনকা লিয়ে মঞ্চ খালি করনা হোগা। আগর আপলোগ বাত করনা চাহতে হ্যায় তো মনোরঞ্জন ব্যাপারী কো লেকে বাহার জাইয়ে। বহা ভি বইঠনে কে লিয়ে সারি প্রবন্ধ হ্যায়।

মঞ্চ থেকে নেমে বাইরে আসি। আমার পিছনে আসে জন-জোয়ার। অটোগ্রাফ-রিপোর্টারদের প্রশ্নের জবাব ক্যামেরার সামনে পোজ দেওয়া। আর আমি অখ্যাত, অবজ্ঞাত নই–হয়ে গেছি সারা দেশের দলিত-দরিদ্র-মুক মানুষের মুখর কণ্ঠ। বিহার বিজয় হয়ে গেছে আমার।

সেদিনের বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে আপনা বিহার পত্রিকার প্রতিবেদক নবল কিশোর লিখেছে–”মনোরঞ্জন ব্যাপারীনে কার্যক্রম ‘অন্য কা লেখন’ কী সার্থক বনা দিয়া”। শুরুটা করেছিলেন এইভাবে–দোস্তো, পটনা লিটেরচর ফেস্টিবল ব্যক্তিগত স্তরে আমার কাছে এর কোনো মহত্ব ছিল না। কেন? কেন? এত বড় একটা ফেস্টিভ্যালের তার কাছে গুরুত্বহীন হবার কারণ?

কারণ সে এক দলিত। বিহারে সবর্ণরা কুয়ো থেকে জল তুলে খেলে যে সব দলিতদের হাতে রড পুড়িয়ে ছ্যাকা দেয়। হতে পারে এটা সরকারি অনুষ্ঠান, কিন্তু কর্তৃত্ব তো দুবে চৌবে মিশ্র তিওয়ারিদের। তারা বেছে বেছে সবর্ণ সমাজের লেখক কবি নাট্যকার চিত্র পরিচালকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। শুধু নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে দু-চার পিস মুসলমান আর এক গাছা দলিত। একা সে কী করবে? তার কণ্ঠ ঢাকা পড়ে যাবে উচ্চবর্ণ–উচ্চনিনাদে। তাই তার কাছে এই অনুষ্ঠান একটা ঢকোসলা মাত্র। সদিচ্ছাবর্জিত নোটাক্কি।

অনুষ্ঠানে অনিচ্ছাকৃত অংশ গ্রহণের শেষে তার অনুভবের বাখান–”সবর্ণ কী ভীড় মে এক মেট ময়লা কৃর্তা-পাজামা পহনে ব্যক্তি নে ব্রাহ্মণ্যবাদী আউর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কী চুল্লে হিলা দি থী।”

সত্যই তাই। সেদিন ভীষণ আক্রামক আর দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলাম আমি। প্রতিপক্ষ শিবির লক্ষ্য করে তাদের প্রাসাদের দিকে দাগা গোলার মতো শব্দ দেগেছিলাম আমি। একজন প্রশ্ন করেছিল কেন লেখেন? আমার গলা কাঁপেনি–বলেছিলাম খুন করতে পারি না বলে লিখি। যদি খুন করার মতো শরীরে শক্তি থাকত, আর লিখতাম না। খুন করতাম।

ইচ্ছে করেই খুন বলেছি খতম বলিনি। অবশ্য দৈনিক জাগরণ সেটা লিখেছে মন হোতা হ্যায় কল কর। খুন খতম কতল বধ হত্যা হনন–মেরে ফেলা, সবগুলোই এক তবে তার নানা অর্থ। সেইক্ষণে আমার কথার কে কী মানে বুঝেছিল কে জানে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল সভাগৃহ। সে যে কী নীরবতা–যেন পিন পড়লে শব্দ শোনা যাবে।

বলি আমি–যারা ধর্মের নামে মায়ের পেট চিরে বাচ্চা বের করে মারে আমার তাদের খুন করতে ইচ্ছা করে। দুপুরের তীব্র রোদ্দুরে একজন মানুষ যাচ্ছিল পথে, সহ্য করতে পারেনি তৃষ্ণা। পথের পাশে কুঁয়ো ছিল একটু জল তুলে খেয়েছে। জাতের নামে যারা তার হাতে শিক পুড়িয়ে ছ্যাকা দেয়, আমার খুন করতে ইচ্ছা করে। ঘরে তিন চার পাঁচ বছরের শিশু কন্যা রেখে মা গেছে কাজে। ঘরের ভাঙা বেড়ার ফোকর গলে যে এসে সেই শিশুকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে, এক গরিব চাষি–সামান্য মাত্র জমিতে যার সংসার প্রতিপালন যে তাকে মেরে ধরে উচ্ছেদ করে শিল্পায়নের অজুহাতে জমিটা গ্রাস করে, এক সরল সোজা আদিবাসী–যার এই সভ্য সমাজের কাছে কোনো দাবি নেই সে শুধু বলে হে সভ্যতা আমাকে আমার সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে আমার মতো বাঁচতে দাও। এই জল জমি জঙ্গল আমার। আমি এ দেশের মূল নিবাসী। এখান থেকে তোমার আগ্রাসী থাবা সরিয়ে নাও। সেই অপরাধে যারা তার ঘর পোড়ায়, বউ মেয়ের ইজ্জত নেয় হত্যা করে-সেই ঘাতকদের আমার খুন করতে হাত নিশপিশ করে।

পারি না তো! শরীরে আর সে শক্তি নেই। তাই লিখি। আমি একদল নির্মম খুনি তৈরি করতে চাই। আমি চাই, যারা আমার লেখা পড়বে তাদের মনে যেন হনন অভিপ্রায় জন্ম নেয়। আমি যা পারিনি তারা যেন তাই করে।

এইসব কারণে আমাকে হিন্দুস্থান টাইমস প্রথম পাতায় ছবি দিয়ে সংবাদ প্রকাশিত করে। করে প্রভাত খবর পত্রিকায় সাংবাদিক প্রভাতরঞ্জন।

.

আমরা যা করার ছিল, করা হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান এখনও চলবে। আমি থাকতে পারি না থাকলেও ক্ষতি নেই। ফিরব কাল বেলা বারোটায়। কথা ছিল একবার প্লেন একবার ট্রেনের। এক উদ্যোক্তা গদগদ হয়ে বলে গেল, এক নেহি, দোবার আপকো হাওয়াই সফর করা দেঙ্গে। প্লেনমেই আপ বাপস যায়েঙ্গে।

হাতে আমার বেশ খানিকটা অবসর। চাইলে নিজের কাজে খরচ করতে বাধা নেই। তখনই টের পাই বুকের বাঁদিকে চিনচিনে ব্যথা। ব্যথাটা বহু পুরানো কিছুতে সারছে না। আমার কাছে কিছু ওষুধ আছে। সে ওষুধ কোনো কাজে আসবে না। কী যে করি। ব্যথাটা ক্রমে বাড়ছে।

নিরুপায় হয়ে ছুটে যাই আমার জন্য বরাদ্দ গাড়ির ড্রাইভারের কাছে। বলি, তুমি তো গাড়ি নিয়ে চারদিকে ঘোরো। জানলেও জানতে পারো। এখানে বুড়োনাথতলাটা কোথায়?

মাথা নাড়িয়ে বলে সে, পুরো ঠিকানাটা কী?

বর্ণালী বসাক, বসাক কুটীর, বুড়োনাথতলা রোড, পাটনা, বিহার এই তো চিঠিতে লেখা থাকত বলে মনে আছে। আর কিছু তো জানা নেই।

বলে সে–আমি তো জানি না এই ঠিকানা কোথায়!

কে জানতে পারে বলো তো?

পোস্টাপিসে খোঁজ নিলে তারা বলতে পারবে।

খোঁজ নিয়ে আমাকে সেখানে একবার নিয়ে যাবে?

ওখানে কে থাকে আপনার?

কে থাকে আমার। সত্যি তো কে থাকে আমার। ব্যথার ওষুধ থাকে?বুঝতে পারি না কিছুই। বুঝতে পারি না মনের মধ্যে কিসের অনুসন্ধান।

বলি–কেউ থাকে না।

তবে কেন যাবেন!

কেন যাবো? বলি–এমনি।

এমনি এমনি নিয়ে যেতে ড্রাইভার উৎসাহ পায়নি। আমারও আর যাওয়া হয়নি–উপশমের ঠিকানায়। ব্যথাটা আছে থাক।

***

আমি দলিত সমাজের মানুষ এই কথা বললে আমার পরিচয় সম্পূর্ণ হবে না। দলিতদের মধ্যেও বহু ভাগ-বিভাগ। শুনি, সেই সংখ্যাটা নাকি প্রায় ছয় হাজার। সেই যে বিভেদ করে শাসন করো, এইনীতিটা ইংরেজ আসার বহু পূর্ব থেকে এদেশে বিদ্যমান। তবে ইংরেজরা একে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছে এই কারণে দোষের দায়ভার তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়। এই চতুবর্ণ প্রথা তো তারা সাথে করে নিয়ে আসেনি। এই প্রথা তো এদেশীয় ব্রাহ্মণ বুদ্ধিমানদের অবদান।

সে যাইহোক, আমি সেই ছয় হাজার ভাগের এক ভাগ নমঃ জাতির সন্তান। নমোদের মধ্যেও দু-ভাগ। একভাগ মাছ ধরে বিক্রি করে। আর এক ভাগ খায়। যারা খায় আর যারা বিক্রি করে দুদলের মধ্যে কোনো বৈবাহিক সম্বন্ধ হয় না। যেমন হয় না কাওরাদের সাথে বাগদির, বাগদির সাথে পৌ ক্ষত্রিয়ের।

এরপর আছে কিছু গুরু গোঁসাই, তারা আবার এই বিভাজনের মধ্যে কিছু ছোট ছোট নিজস্ব বিভাজন বানিয়ে ফেলেছে। আমার জ্যাঠতুতো এক ভাই কেশব ব্যাপারী। সে অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য হয়ে জাতে উঠে গেছে। গুরু তার গলায় পৈতে ঝুলিয়ে দিয়েছে। বামুন তো হয়নি তবে নমঃ আর নেই। সে এখন আর আমাদের রান্না খায় না।

নিম্নবর্ণের কিছু মানুষের মধ্যে পৈতে পাবার কী হাস্যকর প্রয়াস। আমার যেখানে বাড়ি সেটা গত বারো চৌদ্দ বছরে গড়ে ওঠা একটা গরিব জনবসতি অঞ্চল। এখানে মজুর খাটতে প্রতি বছর সুন্দরবনের দিক থেকে লোক আসে। গ্রীষ্ম-শীত এখানে থাকে বর্ষায় ফিরে যায়। এক শীতকালে ভোর বেলায় হুম হাম শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে বাইরে বেরিয়ে দেখি লরি করে নিয়ে এসে ফেলে যাওয়া মাটি বইছে ঝুড়িতে তুলে পাঁচ ছয় জন মজুর। সূর্য তখন সবে উঁকি দিচ্ছে, বাতাসে কনকনে ঠান্ডা। সেই ঠান্ডায় সবার উধ্বাঙ্গ উদোম। আর একটু লক্ষ্য করে দেখি সবার গলায় ধবধবে পৈতে। মাটি বওয়া লোকের জামা গেঞ্জি যেমন মেটে রঙের হয় তেমন নয়–একেবারে চকচকে। যেন কালো মেয়ের মুখে শ্বেতীর দাগের মতো পৈতে বিদ্রুপের হাসি হাসছে। দেখে মনে হয় এই পৈতে কাঁধে উঠেছে সদ্য সদ্য। পৈতেধারীর দেহের উপর মানানসই হয়ে সেঁটে বসার সময় পায়নি।

প্রথমে তো আমি চমকাই, ধাঁধায় পড়ে যাই। এতগুলো বামুন মাটি বইছে! তবে তো ওদের শ্রম বিমুখ পরস্ব অপহরণকারী এসব অপবাদ ঘুচে গেল। এখন থেকে তো শ্রমজীবী শ্ৰমপুত্র এইসব অভিধায় অভিহিত হবে।

পাশে একটা চায়ের দোকান। সবে উনুনে জল বসিয়েছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি লোকগুলোকে। কালো কালো দুর্ভিক্ষপীড়িত চেহারা। তবে পৈতে বিষয়ে ব্যাপক সচেতন, ওটা যেন সাত রাজার ধন। আমার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ধরা পড়ে ওরা মাত্র গলার পৈতেটা দেখনদারি করে রাখার কারণে এই শীতে অঙ্গটি উদোম করে রেখেছে। ওইসুতো ক’গাছার দৌলতে বোঝাতে করুণ প্রয়াস করছে আমরা এক ধাপ উপরের জীব।

কাছে যাই তাদের, কথা বলি। তখনই জানতে পারি এটি এক গুরুর। তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেই মিলে যাচ্ছে মন্ত্রপুত ব্রহ্মসূত’! শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। সেই আমি প্রথম জানাম–ব্রহ্মসূত মানে পৈতা।

কথায় কথায় আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছি। কথা হচ্ছিল নমো নিয়ে। এমনিতে তো সিপিএম কংগ্রেস তৃণমূল বিজেপি এসব ভাগ আছে, যে দলের এখানে একটা পঞ্চায়েত সিটও দখলে নেই সেই বিএসপি দলেও কিছু লোক যুক্ত। আছে মায়াবতী বিরোধী বি.এস.পিও। তারা আম্বেদকর কাশীরামের নামে জয় দেয়। সহ্য করতে পারে না মায়াবতীর পাঁচ কোটির গলার মালা–ব্রাহ্মণ তোষণ।

তবে সোজা লম্বালম্বি ভাবে নমোদের যদি দুটো ভাগ করা হয় তবে এক ভাগ মতুয়া আর এক ভাগ মতুয়া নয়। মতুয়াদের আড়াআড়ি দুভাগ করলে এক ভাগ ঠাকুরনগরপন্থী আর একভাগ বিরোধী। একদল বলে যা করবে ঠাকুর নগরের ঠাকুরেরা তাতেই আমাদের মঙ্গল হবে। আর একদল বলে–কী করেছ আমাদের জন্য ঠাকুর নগরের ঠাকুর। সব তো নিজেদের সেবায়।

আমি নমো কিন্তু মতুয়া নই। গুরুর কাছে দীক্ষা নিইনি। আমার যা রোজগার ছেলে মেয়েকে ভালোমতো রাখতে পারিনা গুরু পুষবো কী করে। একটা গুরু পোষা তত কম খরচ না, হাতি পোষার সমান। আজ টাকা দাও গুরু তীর্থে যাবে, কাল টাকা দাও মহোৎসব হবে। এত খরচা পোষাবে না।

এমনিতে আমি নিজেকে নমো না বলে–শুধু মানুষ বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আমি বললে কী হবে ওরা তো আমাকে মানুষ ভেবে মানবিকতা দেখাবে না। সেই যে একটা গল্পে আছে-এক মাঠে এক স্কুলের চারটে বাচ্চা ঘোড়া ঘোড়া খেলে। একজন বামুন একজন বদ্যি একজন কায়েত একজন শূদ্র। ওদের খেলা যে দেখে সেই বলে বাহঃ কী সুন্দর মিলমিশ। কোনো ছুয়াছুত ছোটজাত উঁচু জাত নেই। সে সব যে আছে জানে শূদ্র ছেলেটা। কারণ প্রতিবার তাকেই ঘোড়া হতে হয়। বইতে হয় তিনজনকে পিঠে করে। কোনোদিন সওয়ার হতে পারে না। কেউ তাকে পিঠে তোলে না।

ওরা এই রকম। মুখে সাম্যবাদ সমাজতন্ত্র–জাতপাত বিরোধী কত কিছু বলবে। শুধু স্বীকার করবে না শূদ্রকে সমকক্ষ বলে। মিলবে মিশবে সে ওইঘোড়া গাধা বানাবার জন্য। এর সব চেয়ে বড় উদাহরণ আমি। এই বর্ণবাদী সমাজ আমাকে দিয়ে আজও বাসন মাজায় তরকারি কাটায় রান্না করায়। আর একই কর্মস্থলে একই চতুর্থ শ্রেণির উচ্চবর্ণ কর্মী? বলার কী দরকার ইচ্ছে হলে দেখে যাক যে কেউ। কী আরামের চাকরি তাদের।

এই কারণে আমি নিজেকে নমো বলে পরিচয় করাব। বলতে দ্বিধা নেই এই জাতের একদল মানুষকে আমি ঘৃণা করি ব্রাহ্মণদের চেয়ে বেশি। আমার প্রতিবেশী যে আমাকে ঠকিয়ে নিতে পারে অনিষ্টকারী হতে পারে, পারে অকৃতজ্ঞ হতে। তাবলে আমার ভাই হবে?যদিহয়, প্রতিবেশীকে পরে দেখব আগে দেখে নেব নিজের ভাইকে। তার জন্য কোনো দয়া ক্ষমা নেই।

গুরুচাঁদ ঠাকুর ভেবেছিলেন স্বজাতির মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আম্বেদকর ভেবেছিলেন–নিম্নবর্ণ মানুষকে চাকরি পাইয়ে দিতে হবে। দুজনের আশা ছিল–এইসব শিক্ষিত সচ্ছল মানুষরা দরদীর ভূমিকা নেবে। সমাজটাকে টেনে উপরে তুলবে। তাদের দয়ার দানে পরিপুষ্ট হয়ে কিছু লোক তো একেবারে তাদের নাম সমাজের কথা ভুলে গেছে। সে এখন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অনুকরণে আরও অর্থ আরও প্রতিপত্তির পিছনে পাগলের মতো ছুটছে।

যে দল মনে রেখেছে তারা মাঝে মাঝে গুরুচাঁদ ঠাকুরের অবদানের কথা বলে, আম্বেদকরের জন্মদিবস মৃত্যুদিবস পালন করে। গল্প কবিতা লেখে। তীব্র ভাষায় সভা সেমিনারে মনুসংহিতার ব্রাহ্মণ্যবাদের মুণ্ডপাত করে। সব করে এরা। করে না, যেটা করা তীব্র জরুরি। নন্দীগ্রাম নেতাই নোনাডাঙা তো বহুদূর–বাড়ির পাশের বিপন্ন জাতভাইয়ের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দেয় না। বাবাসাহেব যে বলেছিলেন পে ব্যাক টু সোসাইটি। সেটা আর মনে নেই।

আমি একটা লড়াই লড়ছি। লড়াই দলিত-দরিদ্র মানুষের জন্য। লড়ছি পুঁজিবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, সমতা আর সম্মানের পক্ষে। বহু কষ্টে একটা ধাপ অতিক্রম করেছি। আমি ভেবেছিলাম ২০০০ সালে খাস খবর হবার পরে–আমাদের সমাজে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার রাজনেতা ব্যবসায়ী প্রভাবশালী এসব তো কম নেই, কত জনের নাম পত্রিকায় পড়ি। টিভিতে দেখি–এবার নিশ্চয় আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। একটু টেনে তুলবে। কিন্তু আশা অপূর্ণ রয়ে গেছে। কেউ আসেনি।

এরপর থেকে তো বিরামহীন পত্র-পত্রিকায় আমার কথা লিখে গেছে। টিভিতে কতবার যে আমাকে দেখিয়েছে। উচ্চবর্ণ সমাজ থেকে বহু সংবেদনশীল মানুষ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, আসেনি শুধু নমঃশূদ্রদের কেউ। অন্য কেউ না আসুক যারা লেখে তারা তো আসতে পারত।

আসবে না। বলেছিল রিকশাচালক-নাট্যকার রাজু দাস। ওরা তোমাকে ভয় পায়। ওদের কেউ শিক্ষক কেউ অধ্যাপক কেউ বড় অফিসার। তাদের লেখা কেউ ছাপে না, তুমি লিখতে পারলে পড়ে থাকে না। ওরা সেই ভয়ে কাতর। পাছে ছাড়িয়ে চলে যাও। উচ্চবর্ণের সে ভয় নেই। তারা বসে আছে একশো ধাপ উপরে। তারা জানে তুমি সারা জীবনের চেষ্টায় ওই উচ্চতা ছুঁতে পারবে না। তাই হাত ধরে টানছে। যদি পাঁচ ধাপ যেতে পারো ওদের কী ক্ষতি। ওদের আসন তো সুরক্ষিত। আর আমাদের বিদ্বানরা সব পড়ে আছে সিঁড়ির শেষ ধাপে। উপরে ওঠার জন্য যে ধৈৰ্য্য নিষ্ঠা অধ্যাবসায় দরকার তা নেই। চাকরিতে সংরক্ষণ আছে, ঘুষ চলে। যত সহজে সেটা মেলে সাহিত্য খ্যাতি মেলে না। সেটা ওরা বোঝে না। যদি বুঝত ভাবত আমি ভালো চাকরি করি, ভালো বাড়িতে থাকি, ভালো খাই ভালো পরি–পেটে বিদ্যা আছে তবু ভালো কেন লিখতে পারি না। এটা বৈশ্য ব্যবস্থা চলছে। ব্যবসায়ীরা যদি মদ বেচে লাভ পায় মদ বেচে। যদি দুধ বেচে লাভ পায় দুধ বেচে। যদি তুমি তেমন লিখতে পারো যা পাঠক পয়সা দিয়ে কিনে পড়বে-প্রকাশকের অভাব হবে না। সে চেষ্টা না করে দিনরাত ভয়ে কাঁপছে। এই বুঝি অমুক আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেল। যে যাবার সে যাবেই। কেউ সাহায্য করুক আর না করুক।

বারো বছর কেটে গেল। বারো বছর পরে দূরভাষে প্রথম পেলাম এক স্বজনের আন্তরিক গলার স্বর। ফোন এসেছে উত্তর ২৪ পরগণার বগুলা থেকে হরিগুরুচাঁদ আম্বেদকর চেতনা মঞ্চের পক্ষ থেকে। ফোন আসতে রইল বগুলা বিরাটি হৃদয়পুর বহু জায়গা থেকে। আমন্ত্রণ আসা আরম্ভ হল নানা অনুষ্ঠানে অতিথি হবার। মালা-মানপত্র-সাম্মানিক দিয়ে দুহাত ভরে দিল প্রিয়জনেরা। এইসব প্রাপ্তি ইতিবৃত্তে চাল জীবনের জন্য একখানা বই–একখানা বইয়ের কারণে বাংলার পাঠক–আর নমঃশূদ্র মানুষের বুকের ভিতর স্থান হয়ে গেল আমার।

এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা–বর্ধমান বইমেলার অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ। যে মঞ্চের সঞ্চালক বড় আবেগঘন গলায় বার বার ঘোষণা করেছিল আমাদের সৌভাগ্য আমরা এক মঞ্চে গুরু এবং শিষ্যকে পেয়েছি এক সাথে। হ্যাঁ, ওই অনুষ্ঠানে মহাশ্বেতা দেবী প্রধান অতিথি ছিলেন, উনি জানতেন না আমিও এক অতিথি। বিশিষ্ট অতিথি। পাশাপাশি বসেছিলাম দুজন। একটু অস্বস্তিও লাগছিল। আমি যেন হিমালয়ের পাশে এক উই টিপি। তবে সেটা আমার জীবনেতিহাসে একটা স্মরণীয় ঘটনা তো বটে। একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছিল। মহাশ্বেতা দেবীর জীবনী যে লিখবে এই দিনের কথা না লিখে কি পারবে।

এরই কয়েক দিন পরে একটা আমন্ত্রণ এল বজবজের মাঝের হাট থেকে। অমলেন্দু সমাদ্দার নামে এক ভদ্রলোক ফোনেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমার এটাই বাজে স্বভাব যে ডাকে চলে যাই। সেই যে বলে না পাগলা ভাত খাবি?হাত ধোব কীসে? আমার সেই দশা। কেউ তো কোনোদিন আদর করে কাছে ডাকেনি। সবাই দূর দূর করেছে। তাই এখন কেউ ডাকলেই পড়ি মরি করে ছুটে যাই। আগপাছ না ভেবে।

এক বিরক্ত বন্ধু বিকৃত গলায় বলেছিল–যে ডাকে অমনি চলে যাও, কেন? তুমি কি কুকুর নাকি! কুকুরেরাই অমন ‘আতু’ করলে দৌড়ে যায়–।

বলেছিলাম–হ্যাঁ, আমি কুকুর। আমি আমার দরিদ্র দলিত ও সর্বহারা শ্রমজীবী মানুষের পাহারাদার। যদি কেউ সেই শ্রেণীর ক্ষতি করতে চেষ্টা করে, আমি তার দিকে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে যাব। তেমন মনে করলে কামড়ে গলার নলিও ছিঁড়ে দিতে পারি।

.

একদিন একটা ফোন এল দুর্গানগরের এক ডাক্তারের যার মোবাইল নম্বর ৯১৮৬২১০০১৫২২ বলল–রায়পুরের বিধায়িকা ‘মায়াবতীর বোন’ কলকাতায় আসছে। আপনি আসুন। আমাদের লোকজন থাকবে। পরিচয় করিয়ে দেব। আর কিছু বই নিয়ে আসবেন বেচে দেব।

কোথায় যাব?

এয়ারপোর্টে আসুন। সাড়ে বারোটায় মায়াবতীর বোন’ প্লেন থেকে নামবে। ওখান থেকে আপনাকে গাড়ি করে নিয়ে যাব।

একদিন কাজ কামাই করে দশখানা বই ব্যাগে ভরে পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। সাড়ে বারোটায় নয়, মায়াবতীর বোন এল পরের ফ্লাইটে বেলা দুটোয়। উদ্যোক্তারা তোক এসেছে জনা কুড়ি। এখন ফেরার সময় গাড়ি মাত্র দুটো। যে গাড়িতে মায়াবতীর বোন চাপল হুড়োহুড়ি করে জন আটেক উঠে পড়ল সেই গাড়িতে। বাকি সব কজন পরের গাড়িতে। আমার কোনো বসার জায়গা নেই। আমি কীভাবে যাব সেদিকে কেউ দেখছে না। যে ফোন করে নিয়ে গেছে সে তো সবার আগে গিয়ে মায়াবতীর বোনের পাশের সিট দখল করেছে। সেখান থেকে ফোন করে একজনকে বলে–লেখককে তুলে নিস।

তুলবে তো তুলবে কোথায়। বলে সে আপনে আমার কোলে বসেন। তাই করি কোলেই বসি। সে এক কঠিন পরিস্থিতি, মাথা সোজা হচ্ছে না। ছাদে ঠেকে যাচ্ছে। বসতে হল বেঁকে আধশোয়া অবস্থায়। এইভাবে ঘন্টাখানেক চলে পৌঁছলাম বিরাটি। যে গাড়িতে মায়াবতীর বোন সেটা গিয়ে থামল এক তিনতলা বাড়ির সামনে। সেখানে তিনি ভোজন করবেন, একটু বিশ্রাম নেবেন। তারপর আসবেন আর এক তিনতলা বাড়িতে যেখানে মিটিং হবে।

আমাদের গাড়ি এসে থামল সোজা মিটিং স্থলের সামনে। নামলাম গাড়ি থেকে, উঠলাম তিনতলায়, কাঁধে সেই বইয়ের ব্যাগ। এখানে কেউ আমাকে চেনে না। যে চেনে সে মায়াবতীর বোনের সাথে। সকালে টিফিন করে বের হয়েছি এখন খিদেয় পেট চিনচিন করছে। ভাত তো বহুদূর জল এক গেলাসও কেউ দিল না।

চারটে নাগাদ মায়াবতীর বোন এল। এসেই শুরু করে দিল বক্তৃতা। আমাকে যে নিয়ে গেছে বক্তৃতায় এমন মশগুল হয়ে গেছে আমার কথা তার মনে নেই।

ঘন্টা দেড়েক বক্তৃতা দিয়ে থামল সে। মিটিং শেষ। আর আমি কী করব এখানে বসে। নেমে এলাম নিচে। হাঁটা দিলাম রেল স্টেশনের দিকে। একটা ফোনে সারাটা দিনের রোজগার গেল উপবাস গেল একফেঁটা তৃষ্ণার জলও মিলল না। এই যে মানুষ এরাই দলিত সমাজের হিত করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে, সেই বিশ্বাসে অটল থাকা খুব কঠিন। তবে ওই যে–দুর্জনের কারণে যদি দুয়ার এঁটে দিই যদি কোনো সুজন আসে-প্রবেশ করবে কোন্ পথে? তাই মনের দরজা বন্ধ করতে পারি না।

তাই অমলেন্দু সমাদ্দারের ফোন পেয়ে আনন্দে উদবেল হয়ে না উঠতে পারলেও না বলতে পারি না। পরে জেনেছি উনি রাজার হাটের বিডিও। আমাকে ওনার গাড়িতে বাইপাশ থেকে তুলে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে।

গিয়ে দেখি একবাড়ির ছাদে চট কাপড় ঘিরে বানানো হয়েছে অনুষ্ঠান মঞ্চ। কী অনুষ্ঠান? সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সম্মাননা। সে বড় নিষ্প্রভ অনুষ্ঠান। কোনো চাকচিক্য আলোর ঝিকিমিকি নেই। নেই মাইক, ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক। খান পঞ্চাশেক চেয়ারের অর্ধেক দখল করে বসে আছে কিছু বালক বালিকা আর তাদের মায়েরা। পুরুষ আছেন দশ বারোজন, সব বয়স্ক। অবসরপ্রাপ্ত।

আমার আগে দুজন বক্তা ছিলেন শেষ বক্তা আমি।বলার বিষয় আমার জীবন এবং সাহিত্য। বক্তৃতা শেষ করার পর অমলেন্দুবাবু আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা খাম। বললেন–আপনার সাহিত্য সাধনায় আমাদের ছোট্ট একটা সহযোগ থাকল। ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবনের দ্বিতীয় খণ্ড যাতে সত্বর প্রকাশ হয়। কত ছোট সহযোগ? কুড়ি হাজার। টাকার খামটা ছুঁয়ে চোখে জল এসে গেল আমার। লিখে টাকা পাই না, এখন লেখবার জন্য টাকা। টাকা নয়–এটা একটা তাগাদা আমার উপর চাপ সৃষ্টি করা। এরা আমার পাঠক–প্রথম খণ্ড পড়ে মন ভরেনি তাই জানতে চায় আরও কী আছে জীবন চণ্ডালের জীবনের পরতে পরতে। লেখাতে চায় তাই দ্বিতীয় খণ্ড। লেখ লেখ–আর তোমার বই ছাপাবার ভাবনা ভাবতে হবে না। সে দায় আমাদের। এই নাও আগাম–বলো বই কবে দেবে। একটা খামে এত ভালোবাসা ভরা থাকে আগে জানতাম না।

এই অনুষ্ঠানে পরিচয় হল হিমাংশু বিশ্বাস নামে একজন দরদী মানুষের সাথে।ইনি ব্যবসায়ী মানুষ। পয়সা কড়ি খুব একটা কম নেই। তিনি আমাকে খান কয়েক বই দিলেন, যার একখানা, তারক সরকার লিখিত হরি লীলামৃত। বইটা দিয়ে বলেন তিনি, হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন কাহিনি এতে যেমন লেখা আছে তা ভাববাদ আশ্রিত একটা অবাস্তব কল্পনা বিলাস। যদি সম্ভব হয় এটা পড়ে একটা উপন্যাস লিখুন। যাতে হরিচাঁদকে মানুষ বলে চেনা যায়। দলিত মানুষের মধ্যে যিনি কাজ করেছেন তাদের সঠিক দিশায় চালিত করবেন বলে।

পরিচয় হলো সুরেশ বিশ্বাস নামে একজন সমাজদরদীর সাথে। তারও ইচ্ছা তাই। আর সেই আবেদন আমাকে বাধ্য করেছে ‘মতুয়া এক মুক্তি সেনা’ উপন্যাসটি লিখতে। যেটি বর্ধমান থেকে প্রকাশিত হাটেবাজারে পত্রিকা-র ১৪২০ শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। তারপরে পুস্তকাকারে প্রকাশ হয়েছে ২০১৪ বইমেলায়। প্রকাশক কলকাতা প্রকাশন। সেটি খুব একটা খারাপ লিখিনি বলে আমার বিশ্বাস। কিছু পাঠক ফোন করে জানিয়েছে–ভালো লেগেছে।

এরপর ইচ্ছা আছে অনুরূপ একটা উপন্যাস হরিচাঁদ পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে নিয়ে লেখার।

***

সমসাময়িক পত্রিকাটির আবির্ভাব ২০১২ সালে। আত্মপ্রকাশের প্রায় সাথে সাথে সায়নদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এটি পাঠক মহলে একটি বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করেছে বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং উপস্থাপনার নিজস্ব শৈলির কারণে। এই পত্রিকা আমার কাছে যে কারণে আরও বেশি বৈশিষ্ট্যতার দাবিদার–সেটা হচ্ছে এরা আমার লেখার যে একটা বাজারমূল্য আছে সেইটের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমার পাঁচ পাতা একটা লেখার জন্য পারিশ্রমিক ধার্য করেছে এক হাজার টাকা। প্রতিক্ষণ দিয়েছিল দেড়শো, মনোরমা সাড়ে চারশো এরা হাজার। দাম একটু বেড়েছে আমার।

সমসাময়িক পত্রিকার পক্ষ থেকে ২০১২ বইমেলায় আমাকে একটা সংবর্ধনাও দেয় শাল ফুলের তোড়া মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে। বলতে গেলে কলকাতা বইমেলা আর আমার লেখক জীবনের বয়স প্রায় সমান। কলকাতার বাইরে যে কবছর ছিলাম সে ক বছর বাদে প্রতি বছরই মেলায় যাই। সে শুধু পরিচিত লেখক বন্ধুদের সাথে বাৎসরিক সাক্ষাৎকারের জন্য। বই কেনবার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ ছিল না।

তবে এবার কিছু বই কিনতে পেরেছি। মহাশ্বেতা দেবীর রচনা সমগ্রের পুরো সেট ছয় হাজারে, হাজার দুয়েক টাকার অন্য বই। এত টাকা পাগলের মতো খরচ করায় পরে অবশ্য সংসার চালাতে কিছু অসুবিধা হয়েছিল, মুদিখানায় ধার বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমনটা যে হবে তা তখন তো বুঝিনি। সে সময় তো আমি হাওয়ায় ভাসছি। এই প্রথম কলকাতা বইমেলায় সম্মাননা পরিচিতি পেলাম। সে কি কম আনন্দজনক ব্যাপার। কতবার মনে ভেবেছি সবাই পায়–আমি কবে পাবো মেলার নেক নজর। ছোট হোক তবু পেলাম তো! সেটা ঘটল এই সমসাময়িক পত্রিকার সৌজন্যে।

বায়োর পরে এল দুহাজার তের। শিক্ষিত লোকেরা বলে আনলাকি থার্টিন। তবে এই আনলাকি বছর এল আমার জীবনে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে। এই বছরের মাঝামাঝি জুন মাসের ছাব্বিশ তারিখটা লিখিত হল স্বর্ণাক্ষরে–মাইল ফলক হিসাবে, জীবনের যাত্রাপথের পাশে।

***

একজনের সঙ্গে বহুদিন পরে দেখা। গলায় গরম ভাপ তুলে বিকৃত স্বরে জিজ্ঞেস করে সে-কীরে! কেমন আছিস?

বুক টান-মাথা উঁচু করে স্বগর্বে বলি ভালো আছি। তার চোখে কুঞ্চন মুখে বিরক্তি–ভালো আছিস! কী করে ভালো আছিস রে! আমি তো তোর ভালো থাকার পথে হাজার কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছি। পেট ভরে খেতে দিইনি, অপমান অত্যাচারে জর্জর করেছি জীবন। তবু বলছিস ভালো আছিস।

বলি, শুধু ভালো নয়–খুব ভালো আছি। যে জীবনকে তুমি অক্ষম অথর্ব পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল আমি তাকে সফল আর সার্থক বানিয়ে দিয়েছি। আমার দুর্বলতাকে আমি বানিয়েছি আমার অস্ত্র।

মুখে তাচ্ছিল্য এনে বলে সে তার মানে তুই বলতে চাইছিস আমি তোর কাছে পরাজিত? পরাজিত-পদদলিত-হেরে ভূত।

বলে সে শ্লেষের হাসি হেসে, তুই বোকা তাই জানিস না আমাকে কেউ হারাতে পারবে না, শেষ পর্যন্ত আমারই জয় হয়।

বলি আমি–তুমি বোকা তাই জানো না শেষ পর্যন্ত জয় আমারই হবে। আমার জয়গান গাইবে সবাই। তোমাকে চিহ্নিত করবে খলনায়ক হিসাবে। মহাভারতের বীর বালক অভিমন্যু সপ্তরথী ঘিরে তাকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু হারাতে পারেনি। তুমি বড় জোর আমার বিনাশ করে দিতে পারো, হারিয়ে দিতে পারবে না। বহু বহু বছর মানুষের গল্প গাথায় স্মৃতিকথায় উঠে আসবে

আমার সংগ্রাম কাহিনি। সেটাই আমার জীবনের চরম এবং পরম সার্থকতা।

বলতে ভুলে গেছি তার নাম ভাগ্য। আমার সবচেয়ে বড় যে শত্রু। মূর্খ জানে না আজই আমি একখানা চিঠি পেয়েছি। যে চিঠি পাবার পর ভাগ্যের মাথায় মুখে সজোর পদাঘাত করে বলে দেওয়া যায় জীবনের সব পরাভবকে লাথি মেরে আজ আমি জয়ী হয়েছি।

চিঠিখানা এসেছে সাহিত্য সংস্কৃতির সর্বমান্য প্রতিষ্ঠান বাংলা আকাদেমির পক্ষ থেকে। তাদের অনুষ্ঠানে আমার লেখা থেকে পাঠ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে। অনুষ্ঠানের নাম আত্ম/আখ্যান/সময়ের সন্ধানে। গদ্যের গল্পসল্প। উপস্থিত থাকবেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি শাঁওলী মিত্র। এই সম্মানীয় মঞ্চে স্থান পাওয়ার অর্থ পশ্চিমবঙ্গের নয় কোটি জনগণের মতদানে নির্বাচিত সরকারের লেখক হিসাবে স্বীকার করা–মান্যতা দেওয়া। খুবই ছোট তবু একটা খিড়কি খুলে যাওয়া।

গেলাম নির্ধারিত দিনে সেই অনুষ্ঠানে। আমি জানতাম আমার দুপাশে দুজন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক থাকবেন। একজন সুনন্দা শিকদার যিনি বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার তার “দয়াময়ীর কথা” বইয়ের জন্য, আর একজন সদানন্দ পাল–যিনি তার “এক মাটিমাখা কুমোরের আত্মকথা” বইয়ের জন্য পেয়েছেন আকাদেমি পুরস্কার। এই নিরিখে আমি নিম্নশ্রেণির লেখক–যে কোনো পুরস্কার পায়নি।

হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রধান টুটুন মুখার্জি আমার সবিশেষ পরিচিত। যিনি বলেন–মনোরঞ্জন তুমি আমার ভাই, আমি তোমার দিদি।

একদিন দিদির ফোন এল–মনোরঞ্জন, আমি কালকে কলকাতা যাচ্ছি, তুমি একটু মহাশ্বেতা দেবীর বাড়ি থেকো-ওখানেই যাবো আমি। একটু কথা আছে।

বলেন তিনি, মহাশ্বেতা দেবীকে রামারাও ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। ওরা আমাকেই ভার দিয়েছিল বাংলা থেকে লেখক বাছাই করার। তা আমি তো মহাশ্বেতা দেবী ছাড়া আর কোনো নাম খুঁজে পেলাম না।

হেসে উঠে বলি আমি–উপযুক্ত আর কাউকে পেলেন না। কেউ এমন ছিল না।

পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি, তুমি বলো কে ছিল?

বলি, মহাশ্বেতা দেবী সমুদ্র। ওই এক গেলাস জল তাতে ঢাললে সে জলের কোনো চিহ্ন থাকবে? যদি কোনো তৃষ্ণার্তকে দিতেন চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকত আপনার কাছে।

একটু হেসে বলেন তিনি–তোমার কথা বুঝেছি মনোরঞ্জন। তবে কী জানো–লেখার মান যতই উন্নত হোক, ওতে পুরস্কার পাওয়া যায় না। পুরস্কার পেতে হলে আরও অনেক কিছু লাগে–সেটা তুমি বুঝবে না।

এটাই আমার পক্ষে একটা সমস্যা–”আরো অনেক কিছু নেই।” যেদিন সেটা যোগাড় হয়ে যাবে পুরস্কার হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে আসবে আমার কাছে। সেই অনেক কিছুর একটা হচ্ছে লিখিত বইখানি প্রকাশকের উদ্যোগে পুরস্কার কমিটির দপ্তরে পৌঁছে যাওয়া। শুনেছি বঙ্কিম পুরস্কারের দাবি পেশ করতে এগারোখানা বই দিতে হয়। এইটে প্রথম সংস্করণে তিনশো বই ছাপানো ছোট প্রকাশক পারে না। দশ জায়গায় চেষ্টা চালালে এক জায়গার মাছ বঁড়শিতে লাগে। কিন্তু দশ ঘরে বই পাঠাবার দম কোথায়!

অগত্যা মঞ্চে উঠে এক পাশে বড় কুণ্ঠা নিয়ে বসে পড়ি আমি। তাকাই সামনের দিকে–হল একেবারে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তবে এরা আমার লোক–আমার পাঠক। তাই বুক কাঁপে না, গলা শুকায় না। অল্প কিছু অচেনা লোক আছে বটে সে সিন্ধুতে বিন্দুর সমান।

আমার এক দাদা-চেতনা লহর পত্রিকা সম্পাদক অনন্ত আচার্য একবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন একটা অনুষ্ঠান করবেন। আকাদেমি হল ভাড়া করে। পাঠকের মুখোমুখি মনোরঞ্জন ব্যাপারী। নানা কারণে সেটা হতে পারেনি। সেদিন তিনি যখন বললেন–বাংলা আকাদেমির নিজস্ব কোননা অনুষ্ঠানে তেমন একটা লোক হয় না। হলের তিন ভাগ ফাঁকা পড়ে থাকে। তখন তাকে বলি আমি, আপনারা তো ওই হলে আমাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন। সেটা এবার করে দিন। মঞ্চটা ওদের, ব্যবহার করে নিন আপনারা।

কথাটা মনে ধরে তার। আর তার ফলে ফেসবুকে একটা প্রচার চালায়, মোবাইলে মেসেজ পাঠায় জনে জনে এবং যেসব গণসংগঠনের সঙ্গে অনন্তদার চেনাজানা–সবাইকে জানিয়ে দেয় সংবাদ আমাদের মনোরঞ্জন বাংলা আকাদেমির মঞ্চে ছাব্বিশে জুন। ওই মঞ্চে যেসব বক্তা বসেন-তাদের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শোনবার জন্য খুব স্বাভাবিক নিয়মে শ্রোতাও হয় ধোপদুরস্ত শিক্ষিত জনেরা। কিন্তু এইবার নোনাডাঙা বস্তি থেকে এসেছিল একদল ময়লা পোষাক হাওয়াই চটি পরা সেই সব মানুষ, যাদের কেউ রিকশা চালায়, কেউ জনমজুর খাটে কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করে। যেসব মানুষের জীবন সংগ্রাম হাসি কান্না প্রেম প্রতিবাদ নিয়ে আমার সাহিত্যকর্ম। সব যেন বইয়ের পাতা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গিয়েছিল শিল্প সাহিত্যের পীঠস্থানে।

যাদবপুর কফি হাউস–যে হাউসের সামনে একদা আমি রিকশা চালাতাম। সেই কফি হাউসে এখন যারা বসেন তার মধ্যে আজ আছেন একদল আমার পাঠক। যেসব পাঠক পাওয়া যে কোনো লেখকের গর্বের বিষয়। কারণ তারা সেইসব ব্যক্তিত্ব–যাদের লেখা পড়বার জন্য কথা শোনবার জন্য হাজার লোক হাঁ করে থাকে।

আমি সাধারণত বুদ্ধিজীবী সংস্পর্শ এড়িয়ে চলি। এদের সামনে এলে নিজের খর্বতা বড় বেশি অনুভূত হয়। আমি কত কম জানি–জেনে কষ্ট পাই। আগে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে এক একদিন যেতাম। তখন চারদিক থেকে ঘিরে ধরত বিদ্যার জাহাজরা-প্রশ্নের পর প্রশ্নের বাণে বিদ্ধ করত। হবসম পড়েছ? দেরিদার নাম শুনেছো? নোয়াম চমস্কির কথা জানো? এ্যাঃ বাবা ফুঁকো পড়নি? নিজের অজ্ঞতা আড়াল করতে বর্জন করেছিলাম কফি হাউসের ব্ল্যাক কফি আর বিদ্বান সংস্রব।

যাদবপুর কফি হাউসে এক রকম জোর করে ধরে নিয়ে এল আমার বন্ধু বাপ্পা। আমি এখানে পৌঁছবার আগে পৌঁছে গিয়েছিল ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। ফলে আমি আসা মাত্র পেয়েছিলাম উষ্ণ অভ্যর্থনা আর একদল বন্ধু।

এখানেই একদিন দেখা হয়ে গেল গৌতম ভদ্রের সাথে। পরিচয় পাওয়া মাত্র বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কত বড় মাপের মানুষ তিনি। শুনি, ওনার ‘ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়’-বইখানার দাম আঠারোশো টাকা। সে বইয়ে এমন কী আছে যে, লোকে এত দাম দিয়ে কিনে পড়ছে। ওনার স্পর্শে আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়ি আমি। বলি–দাদা! আপনি আমার বইটা পড়েছেন!! চোখে ভালো লাগা আলো ছড়িয়ে বলেন তিনি–না, পড়িনি। মুখস্থ করেছি! চারবার।

বিজ্ঞানী সুজয় বসু লেখক শঙ্কর রায় তপন বন্দ্যোপাধ্যায়–জানলাম এনারাও আমার পাঠক। শঙ্করদা তপনদা তত আমার সঙ্গে পরিচয় হবার অনেক আগে–যখন সেই যুগ পরিবর্তন পত্রিকায় প্রতিবেদন লিখতাম সেই লেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন বিভিন্ন ইংরাজি পত্রিকায়–যার মধ্যে অন্যতম-ফ্রন্টিয়ার পত্রিকা।

আমার অনেক লেখায় যেসব উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্তদের বিরুদ্ধে বহু বিষোদ্গার করেছি–তারা যে আমাকে এত আপন করে নেবে, আগে জানতাম না। কেন কে জানে বন্ধু বাপ্পার কথাই এখন সত্যি বলে মনে হয়–”শ্রেণি নয় বর্ণ নয়, ধর্ম নয়–পৃথিবীতে মাত্র দু রকম মানুষ হয়–ভালো মানুষ আর মন্দ মানুষ।”

সে যাইহোক–এই কফিহাউসের কিছু বন্ধুও দায়িত্ব নিয়েছিল সেদিন হলের ফাঁকা চেয়ারগুলো ভরে দেবার।

কথা ছিল উত্তর ২৪ পরগণার নমঃশূদ্র সমাজ থেকে একটা বড় ‘মিছিল’ আসবে। শেষ মুহূর্তে তারা আর আসতে পারেনি। কামদুনির ঘটনার প্রতিবাদে ট্রেন অবরোধে আটকে যায়। তবে বজবজের মাঝের হাট থেকে হিমাংশু বিশ্বাসের উদ্যোগে কিছু লোক এসেছিল। সবটা মিলিয়ে হল ছিল “কানায় কানায় ভরা”। আকাদেমির সচিব শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ও স্বীকার করেছিলেন–এমন ভিড় আগে কখনও হয়নি।

অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা আমি। সবার আগে বলেছেন সুনন্দা শিকদার। ওনার জীবন-গাথা-যা লেখা আছে দয়াময়ীর কথায়–কিছুটা শোনালেন শ্রোতাদের। তারপর বললেন সদানন্দ পাল, ওনার মাটি মাখা কুমোরের আত্মকথা থেকে। এরপর এল আমার পালা।

আমি এখন রণাঙ্গণে। আমার সামনে কোনো শ্রোতা নেই। আছে প্রতিপক্ষ সেনা। যে কোনো যুদ্ধের নিয়ম সেনাপতিকে ঘায়েল করে দেওয়া সেটা করতে পারলেই বিজয় অনিবার্য। ছোট খাটো সৈন্য মেরে কী হবে, প্রধানকে টার্গেট করি! প্রধান তো এখানে শাঁওলি মিত্র। বাংলা আকাদেমির বর্তমান সভাপতি। আমি তুলে নিই শক্তিশালী শব্দাস্ত্র।

অনেকদিন–তা প্রায় বছর তিরিশ আগে যাদবপুরের এক রিকশাঅলা অতি কষ্টের সারাদিনের রোজগার পনের টাকা দিয়ে টিকিট কেটে এই পাশের আকাদেমি মঞ্চে একটা নাটক দেখতে এসেছিল সেই নাটকের নাম ছিল—’নাথবতী অনাথবৎ’।

তাকিয়ে দেখি আমার শব্দাঘাতে শাঁওলি মিত্র চেয়ারের উপর নড়ে উঠলেন। তার শিল্প একজন সাধারণ মানুষকে কতখানি মোহিত করেছিল শোনবার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠলেন।

বলি, চেয়ার থেকে দেড়ঘণ্টায় আমি নড়তে পারিনি। আমাকে যিনি চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন সেই শাঁওলি মিত্র মহাশয়া এখানে উপস্থিত আছেন–আমি এখন ওনাকে প্রণাম ছাড়া আর কি বা দিতে পারি।

তালি তালি। মঞ্চে যখন প্রথম উঠেছিলাম তালি দিয়ে অভিনন্দিত করেছিল মানুষেরা। এখন আবার তালি পড়ল। তবে আগের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে। তালি দিলেন শাঁওলি দিদিও।

বলি–আমি আজ সেদিনের বদলা নেব। উনি আমাকে দেড়ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিলেন, আজ আমি ওনাকে বসিয়ে রাখব। সেদিন আমি ওনার নাটক দেখেছি আজ আমার নাটক উনি দেখবেন।

আবার করতালি। আমার বন্ধু-পাঠক-স্বজাতি-স্বশ্রেণির লোকসব উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। কিছুক্ষণ আগের সেই ঝিমিয়ে থাকা হলঘর যেন ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে উঠেছে। তখন উপস্থিত সব দর্শক শ্রোতাকে সম্মোহিত করে ফেলেছি। এখন তাদের একটাই কাজ মাঝে মাঝে তালি বাজানো। কারণ মঞ্চে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে তারা নিজেরাই যারা দলিত-দরিদ্র চিরবঞ্চিত, মানহারা মানব, যেভাবে ফুটবল সম্রাট পেলের এক একটা লাথি–যেমনভাবে মহম্মদ আলির এক একটা ঘুষি বিশ্বের সব কালো মানুষের ক্রোধ-ঘৃণার প্রকাশ হয়ে যায়, এখন মঞ্চে আমার উপস্থিতি ঘোষণা করছে শ্রম-সংস্কৃতির জয়।

আমি সেই মানুষ যা কাল ছিলাম। কাল যা বলেছি আজও আমার বলার কথা সেই একই। সময় বদলে গেছেমঞ্চ বদলে গেছে সে আমি কি করতে পারি। তাই বিহারের পাটনা লিটারেচারে ফেস্টিভ্যালে–সংসদ আর অধ্যক্ষর যে গল্প বলেছিলাম সেটা আর একবার বলে জনতাকে সম্মান জানাই। আমি একটু উঁচু জায়গায় বসে আছি বলে এটা ভাববার কোনো কারণ নেই যে কেউ-কেটা হয়ে গেছি। আমিও আপনাদের মতো সাধারণ মানুষ। বলি মহাভারতের সেই অর্জুন আর বব্ৰুবাহনের যুদ্ধের গল্প। যে যুদ্ধে অর্জুন বব্ৰুবাহনের রথ চল্লিশ যোজন দুরে ছুঁড়ে ফেলেছিল এক বাণ মেরে আর বব্ৰুবাহন সরিয়েছিল অজুনের রথ মাত্র তিন পা।তবু অর্জুনকে সাবাশি দেয়নি শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছিল বীর বব্ৰুবাহনকে।

এসব গল্প-কথার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতিটা কিছু নিজের অনুকূলে এনে তৃণ থেকে বের করি তীক্ষ্ণ শর। বন্ধুগণ আপনারা ভালো বাড়িতে থাকেন, ভালো জামা কাপড় পরেন, খান ভালোমন্দ, লেখাপড়া শিখেছেন ভালোভালো স্কুলে। আপনারা তো ভালো লিখবেনই। সেটা না করতে পারা আপনাদের ব্যর্থতা। আমি ভালো লিখতে পারব না, কী করে লিখব? যে বয়সে আপনি স্কুলে গেছেন আমি গেছি পাঁচনবারি হাতে গরু চরাতে। যখন আপনি কলেজে পড়ছেন আমি জেলখানার মাটিতে কাঠির আঁচড়ে বর্ণমালা শিখেছি। আপনি আমার চেয়ে এগিয়ে আছেন–এক হাজার মাইল, আর এক হাজার বইয়ে। তবু যদি আমার লেখায় সাহিত্যের রথ এক পাও এগিয়ে থাকে আপনার একটা তালি পাবার হকদার। আপনার সেই তালি আমার কাছে শ্রীকৃষ্ণের তালি। সব পুরস্কারের চেয়ে বড় পুরস্কার।

তালি সেদিন খুব পড়েছিল, আবেগ উচ্ছ্বাস আর সহর্ষ অভিনন্দনে যেন ছোট হল ঘরটা গমগম করছিল। আমি সব মুখের প্রশান্তি সব হাতের উজ্জ্বলতা তো দেখিনি–শুধু দেখেছিলাম একজন মানুষকে যিনি শাঁওলি মিত্র। সারা শরীর থেকে ঝরে পড়ছিল তার স্নেহমাখা ভালোলাগার অনুভূতি। সেই অনুভূতিতে ভিজে যাচ্ছিল আমার হৃদয়-মন।

পেয়েছি আমি পেয়েছি, পেরেছি, আমি পেরেছি সাহিত্য সংস্কৃতির পীঠস্থানের মহানায়িকার আশীর্বাদ আদায় করে নিতে। বিজয় সম্পূর্ণ হয়েছে আমার। সার্থক হয়েছে কলমের যুদ্ধ। মঞ্চ থেকে নিচে নামবার পর চেনা-অচেনা অজস্র মানুষের অভিনন্দনে পূর্ণ হয়ে গেল জীবনের শূন্য ঝুলি। যে অবমানিত জীবনের বোঝা এতকাল বয়ে বেড়াচ্ছিলাম–সমুদ্র ঢেউয়ের মতো একটা জন উচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে ধুয়ে দিয়ে গেল সব গ্লানি।

***

সবাই বলে তের নাকি একটা অশুভ সংখ্যা। হবে হয়তো। তবে সেটা আমার জন্য নয়। আমার কাছে এই বছরটা সারা জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বৎসর। এই বছর আমাকে যা দিয়েছে কোনো বৎসর তা দেয়নি।

একটি অল্পবয়স্ক ছেলে–নাম রাজদীপ, সে এসে ধরল আমাকে–দাদা, আমরা শিল্পী সাহিত্যিকদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদে স্টুডেন্ট হলে একটা সভা ডেকেছি। বক্তা হিসাবে আপনাকে চাই।

তার চোখে মুখে এমন আকুতি ছিল যে আর বলতে পারলাম না। তবে শর্ত রাখলাম–আমি যাব কিন্তু আমার নামটা বক্তার তালিকায় যেন রেখ না।

নির্দিষ্ট দিনে সভাঘরে গিয়ে সবার পিছনের এক কোণের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। তখন মঞ্চে গান হচ্ছে। কিছু পরে শুরু হল বক্তৃতা। সবাই সুবক্তা এবং দেশ বিদেশের প্রচুর তথ্য জানেন। সব শেষে হঠাৎ উচ্চারিত হল আমার নাম–দলিত সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন। তাকে মঞ্চে আসতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তিনি এসে কিছু বলুন।

রাজদীপ শর্ত ভেঙেছে। এখন কী করি? পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াই মঞ্চে মাইকের সামনে। বলি, আমাকে না ডাকলেই ভালো হতো, এখন আমি কী যে বলি? আমার তো তেমন পড়াশোনা খুব একটা নেই। আছে একটা জীবন। সেই জীবনের শিক্ষা থেকে দু-একটা কথা বলছি।

একবার শঙ্কর গুহ নিয়োগীর কাছে সাফদার হাসমি এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন–কী ব্যাপার বলুন তো নিয়োগীজি, আপনারা যদি কোন মিটিং মিছিল জমায়েত করেন পুলিশ লাঠি গুলি চালিয়ে দেয়! আমরা তো সারা দেশ ঘুরে নাটক করি অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠাই, কই সরকার আমাদের তো কিছু বলে না।

তখন বলেছিলেন নিয়োগীজি–যেদিন আপনার কথা–কাজ এই শোষণ শাসন ব্যবস্থার গায়ে একটা আঁচড় কাটতে পারবে সেদিন আর আপনাকে সরকার ছাড়বে না। যতক্ষণ তা না হচ্ছে আপনি নিরাপদ।

আপনারা সবাই জানেন–কেন কাদের হাতে এরপর সাফদার হাসমি নিহত হন। কেন নিয়োগীজিকে বুকে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলা হয়।

আমি একবার মহারাষ্ট্রে গিয়েছিলাম এক সম্মেলনে। সেখানে বিনায়ক সেনের স্ত্রী ইলিনা সেনও ছিলেন। তখন বিনায়ক সেন জেলে ছিলেন। ফলে সেটা আমার এখনও মনে আছে, সেখানে একটা দেওয়ালে একটা পোস্টারে লেখা ছিল অভিব্যক্তি কা খতরা উঠানাহি হোগা। তাই আমার মনে হয়–যদি আপনি লেখেন সে লেখা যদি এই শাসন শোষণ ব্যবস্থার গায়ে কোনো আঁচড় কাটতে পারে অভিব্যক্তি কা খতরা উঠানাহি হোগা। আপনাকে জেলে যেতে হবে, বুকে গুলি খেতে হবে। যদি সেই সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকি নিতে পারেন তবে লিখুন। তা না পারলে লিখবেন না। নমস্কার।

এই অনুষ্ঠানে পরিচয় হল কবি সব্যসাচী দেব-এর সাথে। উনি আগে থেকে আমাকে চেনেন। চেতনা লহর পত্রিকায় পড়েছেন আমার লেখা। বলেন তিনি–কবি শঙ্খ ঘোষ আপনার পাঠক।

এটা এমন একটা কথা যা বিশ্বাস করা কঠিন। চমকে উঠে বলি আমি–উনি কোন লেখাটা পড়েছেন আমার? ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন?

হ্যাঁ, উনি পড়েই তো আমাকে পড়তে বলেছেন।

কবি সব্যসাচী দেবের কাছ থেকে কবি শঙ্ ঘোষের ফোন নাম্বার নিয়ে পরের দিন ফোন করি কবিকে। দু-চার দিনের মধ্যে আমার একটা গল্প সংকলন প্রকাশিত হবে। খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম কার হাত দিয়ে বইটার প্রকাশ করব। এখন আমার আশা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে–যদি কবি শঙ্খ ঘোষ ওটা করে দেন–এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না।

ভয়ে ভয়ে ফোন করেছিলাম কবির ল্যান্ড ফোনে। ফোন উনিই তুলেছিলেন সে আর আমি কী করে জানব। বলেছিলাম কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।

আওয়াজ এল–বলছি।

গড়গড় করে এক নিঃশ্বাসে বলি আমি–কবি সব্যসাচী দেবের কাছ থেকে নাম্বার পেয়ে আপনাকে ফোন করছি। আমার নাম মনোরঞ্জন ব্যাপারী। আপনার কাছে ফোন করার কারণ–আমার একটা গল্প সংকলন বের হচ্ছে। যদি দয়া করে এটার আপনি একটু প্রকাশ করে দেন, খুব ভালো হয়।

কোথায় হবে প্রকাশ অনুষ্ঠান?

বাংলা আকাদেমিতে।

কবে?

যেদিন আপনি বলবেন। আপনি যেদিন দেবেন সেই দিনই হল বুক করব।

আমি তো আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহের আগে পারব না।

গলা কাঁপছে আমার। এই সময়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি রাজি হয়ে গেছেন আমার বইয়ের প্রকাশ করতে। গলার কী দোষ সে তো কাঁপবেই। বলি–তৃতীয় সপ্তাহের পরেই প্রকাশ হবে।

হেসে বলেন তিনি–এতদিন দেরী করবে! বই বেচবে না? আমি তখন আনন্দে পেঁজা তুলোর মতো আকাশে ভাসছি-বলি কবি শঙ্খ ঘোষ যদি আমার বইকে ছুঁয়ে দেয়-বই ধন্য আমার জীবন ধন্য। সেই সুযোগ আমি ছাড়তে পারি! বই তো বিক্রি হবার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে।

একটু থেমে ধীরে ধীরে বলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। যে কবির পায়ে সব কবির মস্তক প্রণত হয় সেই শ্রেষ্ঠ কবি–আমি কিন্তু তোমার একজন পাঠক।

আহঃ! কী শান্তি! কী তৃপ্তি! মনে হল যেন কেউ এই মাত্র দূরভাষে বলে দিল মনোরঞ্জন তুমি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে গেছ। কবি শঙ্খ ঘোষ তোমার একজন পাঠক। কোনোদিন কী ভাবতে পেরেছিলেন জীবনে এমন মহার্ঘ প্রাপ্তি ঘটবে!

না, কোনোদিন ভাবিনি। এত বড় আশা-স্বপ্ন বুকে লালন করার মতো দুঃসাহস আমার ছিল না। আর আমি কিছু চাই না। কিছু চাই না আর। আর আমাকে কে কী দেবে! যা দেবে তা কী অমৃতের চেয়ে বড়!

কবি শঙ্খ ঘোষ আমার শিল্পকে ছুঁয়েছেন। আমার শিল্প অমর হয়ে গেছে। শিল্পের মধ্যে জড়িয়ে থাকা আমার জীবন–অমর হয়ে গেছে।

***

আজ সাতাশে আগস্ট দুহাজার তের সাল। এই দিনটা এমন একটা দিন যেমন দিন আমার আগে আর কোনদিন আসেনি। এমন মহার্ঘ-মহত্তম দিন জীবনে খুব বেশি আসে না। যা মনের মণিকোঠায় চির ভাস্বর হয়ে রয়ে যায় হয়ে যায়, একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা।

আজ জীবনানন্দ সভাঘরে আমাকে কেন্দ্র করে একটা অনুষ্ঠান। আর সেই অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলংকৃত করে মঞ্চে আসীন এই সময়ে বরিষ্ঠ-সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি মাননীয় শঙ্খ ঘোষ। আর গান গাইবেন সত্তর দশকের পাগল করে দেওয়া গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়, আমার লেখা পাঠ করবেন রূপশ্রী কাহালী। সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঞ্চালন করবেন মিহির চক্রবর্তী।

সকাল থেকেই আকাশ জুড়ে ছিল মেঘের ঘনঘটা। মাঝে মাঝে কেঁপে আসছিল বৃষ্টি-বাতাস। আমার মতো অনুষ্ঠানের আয়োজকদেরও মনে নিদারুণ ভয় দাপাচ্ছিল–শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটা ভালোভাবে হতে পারবেতো! নাকি গত এক মাস ধরে প্রস্তুতির সবটা পর্যবসিত হবে এক অকারণ পণ্ডশ্রমে!তবে শেষ পর্যন্ত বেলা প্রায় দুটো আড়াইটার পর বৃষ্টি বাদল থেমে গেল ঝলমলে রোদে ভরে গেল চারদিক।

সত্যি বলতে কি–এই দিনটায় যেন মূর্ত হয়েছিল একটা প্রতীকি ব্যঞ্জনা, যা যেন আমারই জীবনের এক প্রতিরূপ। প্রথম দিকটা কর্ম-কদাকার-দুর্যোগপূর্ণ জলময়। আর শেষটা …..অন্তত আজ কাল ……? একটু কি ঝলমল আলোকিত হয়ে ওঠেনি?

সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক আমার দুই প্রকাশক–বইওয়ালা এবং কলকাতা প্রকাশন। প্রথম জন প্রস্তুত করেছে আমার একটা গল্প সংকলন—’মনোরঞ্জন ব্যাপারীরর গল্প সমগ্র ১’, আর পরের জন একটা উপন্যাস ‘অমানুষিক’। এই বই দুখানার প্রকাশ হবে আজ। জীবনানন্দ সভাঘরটা খুবই ছোট। তাই আগত দর্শক-শ্রোতা–সবাই বসবার আসন পাননি। যত বসে আছেন, দাঁড়িয়ে আছেন তার চেয়ে ঢের বেশি। এরা সব আমার পাঠক, আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। বসার জায়গা পাননি তা বলে কোনো অসন্তুষ্টি নেই, অভিযোগ নেই কারও। এদের দিকে দেখে কেন কে জানে বুকটায় মোচড় মারছে আমার। এরা সবাই এসেছে আমার জন্য। সব কাজ ফেলে পকেটের পয়সা খরচ করে, ট্রেনে বাসে ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে বনগা বারাসাত বজবজ যাদবপুর নোনাডাঙ্গা সব জায়গা থেকে মানুষ এসেছে, এসেছে শুধু আমাকে ভালোবেসে। এসেছে আমাকে দেখবে বলে, আমার কথা শুনবে বলে। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজের অধ্যাপক জয়দীপ ষড়ঙ্গী, সাংবাদিক চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য, নাট্য ব্যক্তিত্ব তীর্থঙ্কর চন্দ এনারা এসেছেন আমার জীবন এবং সাহিত্য বিষয়ে বলবেন বলে। এই সবকিছু সংঘটিত হচ্ছে আমার মতো একজন এই সময়ের কাছে মূল্যহীন মানুষকে কেন্দ্র করে।

সময়! সব কিছু মান-মূল্য নিয়ামক হচ্ছে সময়। সময় কাউকে মূল্যবান মনে করে মাথায় তুলে নাচে। আবার সময় কাউকে মাথার উপর থেকে আছড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। সময়ের চেয়ে শক্তিমান জগতে আর কিছু নেই।

একজন লোককে দেখেছি সকাল সন্ধে যার বাড়ির দরজায় দর্শনপ্রার্থী মানুষের মহা ভিড়। মানুষ তাকে দেখতে চায়, পা ছুঁতে চায়, দুটো কথা বলে বুকটা হাল্কা করতে চায়। মানুষটা সেই একই আছে, বদলে গেছে সময়। এখন আর দরজায় দর্শনপ্রার্থীর সে ভিড় নেই। একবুক রিক্ততা নিয়ে খাঁ খাঁ করছে দরজার সামনেটা। তিনি রাস্তায় একা হেঁটে যান কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। যদি বা তাকায়, সম্ভ্রম নয় চোখে ঝিলিক মারে কিঞ্চিৎ করুণা। এই সেই পথ যে পথে একদা তিনি হাঁটলে স্তাবক চাটুকার কৃপাভিক্ষু শতেক মানুষ পিছে হাঁটত, সময় তাদের সরিয়ে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অন্য কোনো দরজায়। এখন তিনি একা ভীষণ আর বিষম একা।

কে জানে কাল কী হবে। সময় আমার জন্য কী অর্ঘ সাজিয়ে রেখেছে কে জানে। হতে পারে সময়ের আস্তাকুড়ে বিসর্জিত হয়ে যাব আগামীর দৃশ্যপটে। তাই সেই অমানিশা আসার আগে আজকের বৃষ্টি বাদলের পরে, ভাগ্যে পাওয়া গোধূলি রোদটুকু প্রাণভরে শরীরে মেখে নিই। অন্তত এইক্ষণে হেসে উঠি কী পাইনি সে কথা ভুলে–যা পেয়েছি সেই প্রাপ্তি সুখের উল্লাস-উৎসবে।

***

সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় শুরু হল অনুষ্ঠান, সভাপতি বরণ, বই প্রকাশ, গান, লেখ্যপাঠ সেসব তো হল, কিন্তু আর যেটা হল সেটা আমার তো বটেই, উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের কাছেও চরম বিস্ময়ের বিষয়। কবি শঙ্খ ঘোষ সভা সমিতি সমাবেশে আজকার আর কোন বক্তব্য রাখেন না। অনেক অনুষ্ঠানে তো মঞ্চেও ওঠেন না। বসে থাকেন দর্শক আসনে। আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করার আগে উনি সেই শর্ত রেখেছিলেন–আমি কিন্তু কিছু বলব না। বলেছিলাম আমি–সে জন্য আপনাকে কোনো জোর করব না। শুধু আপনার উপস্থিতিটাই আমাকে ধন্য করবে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মিহির চক্রবর্তী সে শর্তের কথা জানতেন না, তাই এক সময় তিনি কবি শঙ্খ ঘোষকে অনুরোধ করে বসলেন দু-কথা বলার জন্য। আর সেই মহান কবি–নিজের শর্ত ভেঙে নিজেই মাইক হাতে উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে বললেন মাত্র দুটো কথা। কথা মাত্র দুটোই তবে তা দু লক্ষ কোটি কথার চেয়েও ভারি। অন্ততঃ আমার জীবনে তো বটেই।

শান্ত ধীর গলায় বললেন তিনি উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের দিকে তাকিয়ে–আপনারা কী কেউ এমন আছেন যিনি ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন পড়েননি! আমার মাত্র একটাই কথা বলার আছে–এই বইখানা সমস্ত বাঙালির পাঠ করা দরকার।

আর কিছু বলবার ওনার দরকার ছিল না। এর চেয়ে বড় আর কোনো কথা হয় না। আমার মতো একজন লেখকের এর চেয়ে বড় শংসাপত্র আর কী হতে পারে!

নাট্য ব্যক্তিত্ব তীর্থঙ্কর চন্দ তার বক্তৃতায় অনেক কথার মধ্যে বললেন সেই কথাটা যা শুনে অবশ্যই নিজেকে নিজে ধন্য বলতে পারি। বললেন তিনি বহু হাজার মাইলের দূরত্ব–তবু মনোরঞ্জন ব্যাপারী তার লেখার মধ্য দিয়ে গোর্কি এবং জ্যাক লণ্ডনের সমকক্ষ সাহিত্য রচনা করে আমাদের বিস্মিত করেছেন।

যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজের অধ্যাপক জয়দীপ ষড়ঙ্গী তার বক্তৃতার মধ্যে আমার জীবন এবং সাহিত্য নিয়ে আবেগঘন গলায় আক্ষেপ করে বললেন–আমাদের দুভাগ্য মনোরঞ্জনদাকে এই দেশ তার যোগ্য মর্যাদা দেয়নি। এখনও তাকে বারো চোদ্দঘন্টা আগুনের সামনে কাজ করতে হয়। তারপরে লেখেন–সরকারের উচিত তার লেখা স্কুল পাঠ্য-পুস্তকে স্থান দেওয়া।

আর সাংবাদিক চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য তিনি তো তার বক্তৃতায় মহাভারতের অনুষঙ্গ–মহারাজ যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করছেন সে যজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন কুরুকুলের স্বনামধন্য সমস্ত শ্রেষ্ঠ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ। সেই সভায় যুধিষ্ঠির অন্য কাউকে নয়–পদার্থ দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণকে। “আজ আমি এই সভায় একজন ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও সভার অনুমতি নিয়ে এক চণ্ডালের পায়ে প্রণাম করবো। যুধিষ্ঠির যেমন সেদিন সবার চেয়ে যোচ্য শ্রীকৃষ্ণকে মনে করেছিলেন–আমি মনে করি এই সময়ে প্রণাম পাবার একজন যোগ্য মানুষ–মনোরঞ্জন ব্যাপারী। আমার মনোরঞ্জনদা।” বলেই সে সত্যি সত্যিই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসলো।

দুখানি বই আজ যার প্রকাশ অনুষ্ঠান সে নিয়ে কেউ খুব একটা বিশেষ কিছু বলেনি। বলছিল ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন আর তাঁর লেখক বিষয়ে। এই সব দেখে মনে হচ্ছিল–সেই সীমা আমি ছুঁতে পেরেছি–যে সীমা ছুঁয়ে ফেলার সাধনা আমার ছিল।

***

সেটা সেই উনিশশো আশি সালের কথা। খাস খবর’ আমাকে খবর করেছিল। সেই প্রথম টিভির পর্দায় দেখা গিয়েছিল আমার মুখ। বাংলার মানুষ শুনেছিল আমার কথা। তখন সেই সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিল–আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

বলেছিলাম আমি–আর কিছু নয়, শুধু ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর মতো কালজয়ী একখানা বই লিখে যাওয়া। যেটা পারলে মনে করব কলম পেশা সার্থক।

সেটা পেরেছি কিনা বলবে সময়। সময়ের চেয়ে বড় বিচারক আর কেউ নেই।

***

২০ জুলাই ২০১৩ আমার জীবনের আর একটি স্মরণীয় দিন। এইদিন ভারত সভা হলে দেখা হয়ে গেল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডাক্তার বিনায়ক সেনের সঙ্গে। আজ্ঞে হ্যাঁ ইনিই সেই মহান ডাক্তার যিনি দল্লী রাজহরায় শ্রমজীবী মানুষের দানে শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা শ্রমিক নেতাশঙ্কর গুহ নিয়োগীর সহযোগিতায় গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন এক আধুনিক চিকিৎসালয়–শহিদ হাসপাতাল। যে হাসপাতাল আজ দ্রুগ আর বস্তার জেলার দরিদ্র-দলিত আদিবাসী মানুষের সব চেয়ে বড় বান্ধব। প্রাণদায়ী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান।

ইনি সেই বিনায়ক সেন যাকে দরিদ্র দলিত আদিবাসী মানুষের সেবা করার অপরাধে ছত্তিশগড়ের বিজেপি সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কারারুদ্ধ করেছিল। ইচ্ছা ছিল কারাগারের অন্তরালে যাবজ্জীবন অন্তরীণ রেখে তার মনোবল চুর্ণ বিচূর্ণ করে দেবার। সে অসৎ উদ্দেশ্য তাদের সফল হয়নি বিশ্বজনমত গর্জে ওঠার জন্য। শুধু সাধারণ মানুষ নয়–বাইশ জন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব মুখর হয়ে উঠেছিলেন তার মুক্তির দাবিতে। ছিঃ ছিঃ ধ্বনি শোনা গিয়েছিল সর্বত্র। বৃদ্ধ ব্যরিস্টার রাম জেঠমালানি ছুটে গিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টে ডাঃ বিনায়ক সেনকে মুক্ত করার জন্য। কোনো এক মাওবাদী নেতার সঙ্গে সংযোগ–শুধু এই অভিযোগে রাষ্ট্রের এই বর্বর প্রতিহিংসার মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি। তাই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন মানুষের মাঝে মানুষের কাজে।

আমার সঙ্গে ওনার মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। সেটা দল্লীতে–নিয়োগীজির মৃত্যুর দিন সাতেক পরে। সেদিন আমি ছিলাম আর ছিল কাঁকেরের নাজিব কুরেশি। খুব বেশি হলে দশ মিনিট কথা বলেছিলাম। কী বলেছিলাম সেদিন আজ আর মনে নেই। তবে সেদিনের সেই সামান্য সাক্ষাৎকারের স্মৃতি মনের পর্দায় আজও রয়ে গেছে অমলিন হয়ে। ষোল বছর কেটে গেছে তারপর। অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে সময় সমাজ রাজনীতিতে। এত বছর পরে আবার মুখোমুখি হলাম সেই স্মৃতির। সেই কিংবদন্তীর মহা নায়কের।

আচ্ছা এটা কী ঠিক টেলিপ্যাথি বলে একটা কিছু আছে? যে মুহূর্তে কোন নাম কোনো প্রিয়মুখ আমার মনে পড়ছে অনুরূপভাবে তারও মনের মুকুরে প্রতিভাত হবে আমার মুখ। তা না হলে এই কয়েকদিন আগে যখন ডাঃ বিনায়ক সেন এবং তার যোগ্য সহধর্মিনী ইলিনা সেন আমার কথা ভাবছিলেন–তাদের কথা আমার মনে পড়বে কেন?

তারিখটা ঠিক মনে নেই তবে এই জুলাই মাসের প্রথমদিকে স্টুডেন্ট হলে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেই সময় আমার ডাঃ বিনায়ক সেন আর ইলিনা সেনের কথা মনে পড়েছিল। অংকের হিসাবে যে সময় ওনাদের মনের আনাচে কানাচে হেঁটে বেড়াচ্ছিল লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী আর ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন নামক একখানা পুস্তক।

ভারত সভা হলের এই সভার আয়োজক যোগেন মণ্ডল স্মৃতি রক্ষা কমিটি। শুনেছিলাম এখানে কানাডা থেকে দ্বৈপায়ন সেন আসবেন। যিনি প্রথম পরিচয়ে–আমার পাঠক। দ্বিতীয় পরিচয়ে বিনায়ক সেনের ভ্রাতুস্পুত্র। তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করতে উৎসুক। তাই আমার যাওয়া।

গিয়ে দেখি কোনো আগাম আভাস না থাকা সত্ত্বেও মুম্বাই থেকে ডাঃ বিনায়ক সেনও এখানে এসে দর্শকাসনে বসে আছেন। ষোল বছর আগে ওনাকে দেখেছিলাম, মাঝে কোনো যোগাযোগ নেই। ইলিনা সেনকে দেখেছিলাম সেও প্রায় পাঁচ সাত বছর হয়ে গেল। কীভাবে কে জানে আমি গিয়ে বিনায়ক সেনের সামনে দাঁড়ালাম। বললাম ষোল বছর আগে দল্লীতে আপনার সাথে দেখা হয়েছিল। নিয়োগীজির মৃত্যুর কয়েকদিন পর। আমি তখন ছত্তিশগড়ে থাকতাম। ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার কর্মী ছিলাম।

উনি জিজ্ঞাসা করলেন–আপনার নাম?

বলি–মনোরঞ্জন ব্যাপারী।

নাম শুনে উনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আপনার সঙ্গে কথা আছে। বেরিয়ে এলেন ফাঁকা জায়গায়। বললেন–আপনাকে নিয়ে আমি লিখেছি। আমি আর ইলিনা সেন দুজনে।

কোথায় লিখেছেন, আমার গলায় বিস্ময় বিহ্বলতা।

বলেন তিনি–দি উইক পত্রিকায়।

১৫ জুলাই ২০১৩ মাত্র পাঁচদিন আগে যে লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আর আজ ওনার সাথে দেখা। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ‘অলৌকিক’ যুক্তি বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না, এমন একটা বিষয়। একটা জীবনে এত সব ঘটনা, এ কী বাস্তবে সম্ভব!

ডাঃ বিনায়ক সেন, কবি শঙ্খ ঘোষ, নকশাল নেতা খোকন মজুমদার, গৌতম ভদ্র, কবি জয় গোস্বামী, নাট্য বক্তিত্ব শাঁওলী মিত্র এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী, আমার পাঠক একি সত্যিই সম্ভব!

যদি তেমন হয়–যা জীবন তোকে ক্ষমা করে দিলাম। আর তোর উপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই। রাগ নেই ক্রোধ নেই। সার্টিফিকেট দিয়ে দিলাম–যা তুই পরীক্ষায় পাশ। সফল তুই।

.

ঢেঁকি যদি চন্দন কাঠ দ্বারাও নির্মিত হয়ে থাকে তার ভাগ্যে লাথিই বরাদ্দ হয়ে আছে। আমি এক দলিত পরিবারের সন্তান তার উপর দরিদ্র। এক সাথে দু-দুটো অপরাধে অপরাধী। এই কারণে এই দেশ এই সমাজ আমাকে দয়া করে কৃপা করুণার অযোগ্য বলে মনে করে। আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা অন্যায় শুধু নয়–পাপ। আর তাই আমা হেন পাপিষ্ঠকে বিনাশ করে ফেলার সদিচ্ছায় আমার কর্মক্ষেত্র নামক কুরুক্ষেত্রে সপ্তদশ রথীর মতো ঘিরে ধরেছে ক্ষমতাধর সহকর্মীরা। যার হাতে যা অস্ত্র আছে নির্মমভাবে নিক্ষেপ করে চলেছে আমার দিকে। আমাকে ধ্বংস করে ফেলার ক্রুর অভিঙ্গায়।

একজন কেরানিবাবু আছেন, জন্ম প্রতিবন্ধী। দুটো পা চলৎশক্তিহীন। চলাফেরা সব হুইল চেয়ারে। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই অথচ পদাধিকারে তিনি মহা শক্তিমান। আমি ছুটিছাটা নিলে দরখাস্ত তারই কাছে জমা দেবার নিয়ম! শুধু এইটুকু ক্ষমতার বলে তিনি আমাকে সাধ্যমতো বিরক্ত করে থাকেন। চেয়ারে বসে আছেন, হাতে কোনো কাজ নেই তবু দরখাস্ত নেবেন না। এক ঘন্টা পরে আসুন বলে চোখ বুজে থাকবেন। আমি তখন আমার ডিউটি শেষ করেছি। পেটে ছুঁচো ডন মারছে। বাড়ি গিয়ে চান করব খাবো। বিকালে ফের ডিউটি আছে। অকারণে বসে থাকতে হবে খিদে চেপে। উনি তখন সবে ডিউটিতে এসেছেন। বসে আছেন পাখার নিচে। আমার কষ্টে ওনার মুখে তৃপ্তির হাসি খেলছে।

একদিন একটু ক্ষুব্ধ হয়ে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি যে আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন এর কারণ কী? তিনি জোরালো জবাব দিয়েছিলেন—’অন্যের কথা জানি না, আমি আপনার সাথে এই ব্যবহার করি, তার কারণ আপনি তৃণমূল!’

লোকটা সিপিএম পার্টির সদস্য। পা না থাকুক পিছনে পার্টি আছে। শুধু এই শক্তিতে-সাহসে একটা অসত্য অজুহাত দাঁড় করিয়ে অন্ধ আক্রোশের সপক্ষে যুক্তি দিচ্ছে সেটা সেই যুক্তি যা আমেরিকা দিয়েছিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের সময়ে–যে আমাদের পক্ষে নয়, সে ওদের পক্ষে।

আমি সিপিএম নই। সেটা এরা সবাই জানে। আমি এদের মিছিলে যাই না মিটিংয়ে যাই না। পোস্টার মারি না কিন্তু তৃণমূল দলের সঙ্গেও তো নেই; সেটা কিছু নয়, শুধু সিপিএমের পিছনে ঝান্ডা নিয়ে না হাঁটায় আমি এদের বিচারে তৃণমূল।

একটা পুরাতন প্রবাদ আছে। যদি কোনো কুকুরকে মেরে ফেলতে চাও পাগল বলে বদনাম করে দাও। আমি জানতাম না যে আমার কর্মস্থলে দুষ্ট চক্রটি অতি সঙ্গোপনে অনেকদিন ধরে এই কাজটি করে চলেছে। আর তাই অতি সাধারণ সিপিএম সমর্থকও আমার উপর বিরূপ হয়ে উঠেছে। এই গুপ্ত তথ্য আমি আগে জানতাম না। জানলাম সেদিন তুমুল একটা ঝগড়া হবার কারণে। একা সে নয়–দেখলাম অনেকেই বিশ্বাস করে আমি তৃণমূল। আর সেই কারণেই মনে করে আমি কোনো সহানুভূতি সমবেদনা–মানবিক ব্যবহার পাবার অনধিকারি।

এরা তো তৃণমূলভাবে কিন্তু যারা তৃণমূল তাদের চোখে আমি কী?

সবাই জানে যে এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা একজন বড় মাপের সিপিএমের নেতা। শুধু এই স্কুল কেন, গত তিরিশ বত্রিশ বছরে যে কোন সরকারি দপ্তরে যত চাকরি হয়েছে কোথাও সিপিএম পার্টির লোক ছাড়া কেউ চাকরি পায়নি। দেওয়া হয়নি কাউকে সিপিএমের নিজের লোক না হলে। আর এই স্কুল তো স্থাপনাই করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্যে। আমি এখানে চাকরি করি। সবার মনে পেরেকের মতো গেঁখে বসে আছে সেই ধারণা–আরে বাবা সিপিএম নাহলে কী আর চাকরি পায়। কেউ কোথাও পেয়েছে?

আর তাই আমার উপর অন্যায় অবিচারের কথা বলি–লোকের চোখে সেটা সিপিএমের নিজেদের খাওয়াখাওয়ির ব্যাপার। এতে তাদের কী করার আছে?

শেঠির হাসপাতালের উল্টোদিকে একটা হোটেলের বোর্ডে নাম লেখা বৌদির হোটেল।বউদির স্বামীর নাম অমূল্য মাঝি। অমূল্য মাঝি সিপিএম করে। সেই অপরাধে কংগ্রেস দলের লোকেরা মেরে একটা পা ভেঙে দেয়। সে কারণে এখন সে প্রতিবন্ধী। এবং প্রতিবন্ধী সংগঠনের সদস্য। যারা তাকে মেরেছিল পরে সব সিপিএম হয়ে গেছে। সেটা অবশ্য অন্য গল্প। তবে যেটা বলার সেটা হল–এই এলাকার এক সিপিএম নেতা কিছুদিন আগে জোর করে দুকাঠা জমি সহ অমূল্য মাঝির দোতলা বাড়িটা দখল করে নিয়েছে। যে খবর একটি দৈনিক পত্রিকাতেও বের হয়েছিল। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। সবটা চাপা পড়ে গেছে ওই ‘ওদের নিজেদের ব্যাপার’ এর নিচে।

আমি ভেবেছিলাম, বলা চলে খুব আশা করেছিলাম, আগে যে সরকার ছিল, পরিবর্তনের পরে যে সরকার পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা দখল করেছে তারা তাদের মতো হৃদয়হীন অমানবিক হবে না। আমি একজন শ্রমজীবী মানুষ। লিখি, নিশ্চয় একটা কিছু সুব্যবস্থা করবে আমার জন্য। যাতে অন্ত দুবেলা খেতে পারি আর লিখতে পারি নিশ্চিন্ত মনে।

এই যে সরকার মা মাটি মানুষের সরকার, যার নেত্রী মাননীয়া মমতা ব্যানার্জী, তিনি কত তো সমিতি কমিটি গড়ে কত কবি শিল্পী সাহিত্যিক বিদ্বজনকে স্থান করে দিয়েছেন তাতে। তারা ভাতা পাচ্ছেন, পাচ্ছেন অনেক সুযোগ সুবিধা, যা না পেলেও তাদের খুব একটা অসুবিধা হতো না। তিনি তেলা মাথায় যখন তেল দিচ্ছেন এক আধ ফোঁটা এই নেড়া মাথাতেও নিশ্চয় দেবেন, যার খুব দরকার।

উনি নিজে খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে। এক কঠিন লড়াই করে পৌঁছেছেন এই জায়গায়। তিনি নিশ্চয় আর একটা লড়াকু মানুষের দিকে একটুদৃকপাত করবেন, বাড়িয়ে দেবেন সামান্য সাহায্যের হাত। যদি তা করেন লড়াইটা আমার কিছুটা সহজ হয়ে যায়। তাহলে হয়তো লিখে যেতে পারি সেই শেষ লেখাটা যেটা লেখার জন্য আমার জন্ম নেওয়া, লেখক হয়ে ওঠা, আর এত ঝড় ঝাঁপটা সয়ে এতকাল বেঁচে থাকা।

কিন্তু কে আমার কথা পৌঁছে দেবে মমতা ব্যানার্জীর কাছে? কেউ তো তেমন নেই। সবাই যে যার চরকা ঘোরাচ্ছে। কার সময় আছে আমার মতো এক অভাগার বোঝা বইবার। একদিন বড় আশা নিয়ে পৌঁছে গেলাম হরিশ মুখার্জী রোডে। মমতাময়ী মমতা দিদির বাড়ি। মনে হল যেন বহু পথ পার হয়ে বহু কষ্ট সয়ে সেই দেবধামে এসে গেছি, যেখানে আসতে পারলে জীবন সফল হয়ে যায়। পূর্ণ হয়ে যায় শূন্য কুম্ভ। ধন্য হয়ে যায় জীবন।

কালীঘাট ব্রিজের মুখেই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র পুলিশ। পথ আটকালো তারা–কোথায় যাবে?

মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে। তখন সময় সকাল সাতটা। আমি অনেক আগে গেছি। বলল–বসে থাকো। বেলা নটায় যাবে। তার আগে যাওয়া বারণ।

দেখলাম অনেকে বসে আছে। আমিও বসে পড়লাম একধারে। বেলা নটার সময়ই যেতে পারলাম মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দোরগোড়ায়। বসার একটা জায়গা আছে। পাতা আছে চেয়ার। কোন্ পথে কে জানে আমার আগেই শ’খানেক দর্শনপ্রার্থী এসে লাইন দিয়ে রয়েছে। আমি তাদের পিছনে বসি।

প্রায় ঘণ্টা দেড় দুই বাদে আমার ডাক এল। উল্টোদিকের এক ঘরে দেখা হল এক ভদ্রলোকের সাথে। ফরসা, মিষ্টি চেহারা, মাথায় টাক ইনি মুখ্যমন্ত্রীর সচিব। বলেন তিনি, মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আজ দেখা হবে না। যা বলার আমাকে বলুন। যা বলার ছিল বললাম। যা দেখাবার ছিল দেখালাম। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম আনন্দবাজার, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, স্টেটম্যান, প্রভাত খবর পত্রিকা সহ কিছু বই। আমার ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। উনি সব দেখলেন। দেখে অবাক হলেন–আপনি লেখক! দেখে বোঝা যায় না।

বললাম ওনাকে–আমি এখন রান্নার কাজ করি। সারাদিন কেটে যায় সেই কাজে। লেখার সুযোগ পাই না। যদি উনি আমাকে একটু সুযোগ করে দেন চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

উনি কাগজ কলম দিলেন—এই কথাগুলো লিখে দিন। সাথে আপনার ঠিকানা, ফোন নম্বর, স্কুলের নাম লিখে দিলাম সেই সব।উনি যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে সেটা নিলেন। চা-ও খাওয়ালেন এক কাপ। তারপর সেই সব কাগজপত্র আন্তরিকভাবে মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে পৌঁছে দিয়েছিলেন কিনা আমি জানি না। এত বছর কেটে গেছে কোনো পরিবর্তন আসেনি আমার জীবনে।

বই, কাগজপত্র, দরখাস্ত নিয়ে দেখা করেছিলাম এলাকার এম.এল.এ. বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্তের সাথে। সেসব দিয়ে ওই একই অনুরোধ করেছিলাম। দেখা করেছিলাম নাট্য ব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ আর বরো কমিটির চেয়ারম্যান তারকেশ্বর চক্রবর্তীর সাথে। তাদেরও বই-কাগজ দিয়েছি। কোনো লাভ হয়নি। মাঝখান থেকে আমার রক্ত জ্বালানো পয়সায় ছাপানো ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বইগুলো ফালতু চলে গেছে। যা তারা হয়তো কোনো ফেরিওয়ালাকে বেচে দিয়েছে কিলো দরে।

বর্তমানে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বোস, এককালে আমার গভীর চেনা ছিল। ছত্তিশগড়ের বস্তার জেলার পারালকোটে ৫৬ নং ভিলেজের এক নদীর ধারে এক সাথে পড়েছিলাম খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে। বহু বছর পরে আবার দেখা হয়েছিল দু-হাজার এগারো বইমেলায়। আমি আমার বই দিয়েছিলাম ওনাকে। উনি দোলা সেন ও ছাত্র নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডার সাথে পরিচয় করিয়ে ছিলেন এই বলে–যেখানে কেউ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম পর্যন্ত শোনেনি সেই দণ্ডকারণ্য থেকে এসে এ বাংলা জয় করেছে। লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী।

বই দিয়েছি জয় গোস্বামী, কবীর সুমন, ব্রাত্য বসুকে। ব্রাত্য বসুও মন্ত্রী হবার অনেক আগে থেকে আমার চেনা। উনি জানেন–আমি এক রিকশা চালক লেখক। আমাকে নিয়ে উনি আর তথাগত দত্ত কলকাতা টিভির জন্য একটা প্রোগ্রামও শু্যট করেছিলেন।

এমনিভাবে বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী কত লোককে যে বই দিয়েছি গুণে বলতে পারবো না। ভেবেছি–কেউ যদি বইটা পড়ে আমার জন্য কিছু না করে পারবে না। কিইবা এমন করবে? শুধু মুখ্যমন্ত্রীকে একটা ফোন, একটা ছোট্ট অনুরোধ। বইগুলোর কী হয়েছে তা কে জানে? আর আমার জীবন? যা ছিল তাই। পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন এসে গেছে আমি রয়েছি অপরিবর্তিত।

বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়–ওনার পত্রিকা ‘অঙ্গীকারে’ আমি দুবার লেখা দিয়েছি। আনন্দবাজার পত্রিকার কার্টিংও দিয়েছি ওনাকে। হয়তো পড়েছেন লেখাটা। কিন্তু কিছু ভেবেছেন আমার জন্যও প্রমাণ পাইনি।

নিম্নবর্ণের কোনো কেউ উচ্চ হয়ে উঠুক তারা চায় না। তারা এমন কিছু করতে মনের সায় পায় না যাতে তাদের উচ্চতা কোনো প্রতিস্পর্ধার সামনে পড়ে। এটা যে তারা সব সময় সচেতনভাবে করে তা নয়–। অবচেতন মন যান্ত্রিকভাবে অনেক সময় তাদের দিয়ে এসব করিয়ে নেয় যা তারা জানতেও পারে না।

ধরা যাক–শহর কলকাতার কোনো নামি পত্রিকায় দশজন অনামি লেখক একটা করে গল্প জমা দিয়েছে। ওই দশজনের নয়জন স্বাভাবিক কারণেই চ্চাটার্জি মুখার্জি, ব্যানার্জি, চক্রবর্তী, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত, ঘোষ, বোস, মিত্তির হবে। একজন হবে ব্যাপারী বা বাগ বা সর্দার। লেখা বাছাই করার সময় পাঠের জন্য, পত্রিকার উচ্চবর্ণ সম্পাদক ওই নয় জনের মধ্য থেকে এক দুই তিন জনকে পছন্দের তালিকায় রাখবেন। ভুলেও ব্যপারী, বাগ, সর্দারের লেখা ছুঁয়েও দেখবেন না। পড়া তো দূরের ব্যাপার, ছাপা তো আরও দূরত্বের ব্যাপার–। চাকরি বাকরি বা যে-কোনো সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে এই একই নিয়ম চলছে।

এই নিয়মের কারণে আমি ঝাড় খেয়ে গেছি। যদি আমার জন্ম দলিত পরিবারে না হতো, যদি আমার পদবি ব্যাপারী না হয়ে ব্যানার্জি হতো, আমার জন্য তদবির করার লোক জুটে যেত, কারণ আমি জন্মজনিত কারণে এই দেশে অপরাধী।

এই কিছুদিন আগে খবরের কাগজে একটা খবর পড়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল। কী?, একটি পথশিশু, বয়স বছর চৌদ্দ পনের, যে চুরি টুরি করত। পুলিশ তাকে ধরে। কিন্তু জেলে নিয়ে যায়নি। নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছে এক হোস্টেলে সে যেখানে থাকবে লেখা-পড়া শিখবে, মানুষ হবে।

পুলিশ শুধু খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ করে না তার একটা অন্য রূপ আছে, একটা মানবিক মুখ আছে। জেনে বড় ভালো লেগেছিল, সেই ভালো লাগা শুকিয়ে এল একটু পরে–ভাবতে লাগলাম যে দেশের পথে পথে লক্ষ লক্ষ বালক কিশোর পড়ে আছে কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না, ওই একজনের প্রতি এত সদয় কেন ব্যাপারটা কী?তখন দেখলাম–ওই ছেলেটার পদবি চক্রবর্তী। আর কিছু বলার দরকার নেই। আমার সব কথার জবাব গোপন আছে চক্রবর্তী–চক্র ঘিরে।

পুলিশ অফিসার কী খুব সচেতনভাবে সদয় হয়ে উঠেছিলেন উচ্চবর্ণ সন্তানের এমন হীন জীবন-যাপন দেখে। না তা নয়। অন্তরের অন্তঃস্থলে একটা মোচড় দিয়েছিল নিজের অজ্ঞাতে। আহা রে বাছা! যে মোচড় কোনো নমো বাগদির বাচ্চা দেখে আসে না। ওদের কালো কদাকার মুখ দেখে দয়া দৌড়ে পালায়।

আর সেই কালো কালো না খাওয়া ভূত সদৃশ্য মানুষ যখন ভালো খাওয়া ভালো পরা উচ্চবর্ণ ভদ্রলোকদের উচ্চতাকে হারিয়ে দেবার স্পর্ধা দেখায় তখন তাদের রাগে শরীর জ্বলে। মনে পড়ে সেই নিম্নবর্ণের বাচ্চা বুধিয়ার কথা। বারো বছরের বালক বুধিয়া ~ যে দৌড়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা রেস ম্যারাথন। যে রেস শেষ করতে বড় বড় দৌড় বীরের দম বের হয়ে যায়। অনেককে হারিয়ে মাড়িয়ে সেই দৌড় শেষ করেছিল বুধিয়া। তার ছোট্ট পায়ের নিচে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল বর্ণবাদের অহঙ্কার দর্প দম্ভ।

তখন রে রে করে তার দিকে ধেয়ে গিয়েছিল অসংখ্য মানব-দরদীর মুখোশ আটা ব্যক্তি-সংগঠন। সমস্বরে শেয়ালের মতো হুঙ্কার তুলেছিল এ অন্যায়, এ অতি অসামাজিক। এতটুকু বাচ্চাকে এত পথ দৌড় করানো অনুচিত।

বুধিয়ার মা শিশু বুধিয়াকে দুবেলা খেতে দিতে পারত না, হয়তো না খেয়েই সে মরে যেত। তখন কেউ তাকে একমুঠো চাল দিয়ে সাহায্য করেনি। সে আর কী হতো! এমন তো হাজার হাজার মরে। সে মৃত্যু অতি সাধারণ ব্যাপার এবং কোনোমতেই অন্যায় অমানবিক নয়।

বুধিয়ার মা তখন তাকে বিক্রি করে দেয়। বালক বুধিয়াকে মাত্র পাঁচ টাকায় কিনে নেয় বিরিঞ্চি দাস। সে বুধিয়ার ছোট্ট পা দুটো গড়ে তোলে বর্ণপ্রভুদের মুখে লাথি মারার উপযুক্ত করে। এই অপরাধে গুলি করে মেরে ফেলা হয় প্রশিক্ষক বিরিঞ্চি দাসকে। আর নানা আইনি প্রতিবন্ধকতা দিয়ে বুধিয়ার পায়ে পরিয়ে দেয়া হয় বেড়ি। আর সে দৌড়তে পারবে না। পারবে তখন, যখন তার বয়স হবে আঠারো বছর। এতদিন ফেলে রাখলে লোহাতেও মরচে ধরে যায়। কে আর বুধিয়াকে ঘসে মেজে ধারালো করে রাখবে। বিরিঞ্চি দাস তো নেই। হারিয়ে যাবে ‘বিস্ময় বালক’ বুধিয়া। চিন্তামুক্ত হয়ে গেছে বর্ণপ্রভুরা। কেউ তাদের উচ্চতাকে চ্যালেঞ্জ করবে না।

উচ্চবর্ণ সব লোকই যে এমন হিংস্র ক্রুর তা নয়। যেমন সব বিষ নয় প্রাণঘাতী, সব বিষ্ঠা নয় সমান দুর্গন্ধ। গরুর বিষ্ঠায় তো উঠোন নিকানো হয়। যে ব্যক্তি নিজেকে মানুষ হিসাবে প্রতিপন্ন করার চাইতে গর্ব যে কহে হাম হিন্দু হ্যায় মুসলমান হ্যায় কী উচ্চবর্ণ হ্যায় বলে হুঙ্কার ছাড়ে সে সমাজের পক্ষে বিষ বা বিষ্ঠার চেয়ে উচ্চ কিছু নয়। কিছু কিছু উচ্চবর্ণ নিজেদের উচ্চে রেখে মাঝে মাঝে বাণী দেন বর্ণ ব্যবস্থাটা খুবই খারাপ, তবে আমি ওর দ্বারা আচ্ছন্ন নই। পৈতেটা গলায় রাখি, না হলে মা মনে কষ্ট পাবে। পদবিটা বর্জন করতে পারি না কারণ আমি ওটাকে জাত পরিচয় উপনাম মনে করি না। সবার সাথে মিশি সবার হাতে খাই।

এই অপেক্ষাকৃত নরম মনের লোকেরা নিজেরাও জানেন না যে তার কোন কাজ কোন কথা নিম্নবর্ণের পক্ষে অসহ্য অপমানজনক।

জাতপাত অস্বীকারের প্রশ্নে সব চেয়ে এগিয়ে আছে বামপন্থীরা। আমিও এক সময় বামপন্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছি। আজও তাই আছি। তবে বঙ্গে যে বামপন্থার চেহারা চরিত্র দেখেছি এবং দেখছি, এই যদি বামপন্থা হয় আমি ভাই চরম প্রতিক্রিয়াশীল হতে রাজি আছি। এই বামপন্থা নিপাত যাক।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *