১৩. কৃষ্টি-সংস্কৃতি সৌজন্য সভ্যতা

কৃষ্টি-সংস্কৃতি সৌজন্য সভ্যতা এর কোনো নির্দিষ্ট মাপদণ্ড নেই। স্থান ভেদে পাত্র ভেদে কাল ভেদে নির্ণয় হয়। আমি যে সমাজে মানুষ, সেই দরিদ্র নমঃশূদ্র মানুষকে একত্র একটা বড় সংখ্যায় বসবাস করতে দেখেছি দণ্ডকারণ্যে। পূর্ববাংলার বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা থেকে যদিও তারা এসেছে, সেখানকার দেশাচার লোকাঁচার লোকধৰ্ম লৌকিকতা কিছুই বর্জন করে আসেনি।ঝিনুকের বুকের মুক্তোর মতো সব আগলে রেখে দিয়েছে। কেউ কেউ যাকে কুসংস্কার কুপ্রথা এসব বলতেই পারেন।

এই সমাজে নিয়ম আছে–যার বাড়িতে অনুষ্ঠান–সে বিয়ে, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন যাই হোক, রান্না হয়ে যাবার পর নিমন্ত্রিতকে তার বাড়ি গিয়ে ডেকে আনতে হবে–“চলেন, রান্না হইয়া গ্যাছে, দুইটা অন্ন সেবা করবেন।” সেই কবে কতদিন আগে একবার বলা হয়েছিল, আর আজ সব এসে পাত পেতে বসে যাবে–এমন হবে না। সেটাতে তারা অপমানিত বোধ করবেন। শাস্ত্রে বলা আছে, অতিথি নারায়ণ। এখন আমি নারায়ণ। তবে আমাকে সেই সম্মান দাও। না হলে যাব না। থাক তোমার খাবার তোমার হাঁড়িতে। আমি খাব না।

আমি এই সংস্কারের ক্রোড়ে লালিত। আমার আজন্ম অনাহারি তবু আত্মসম্মান সচেতন বাবা আমাকে বলে গেছেন–যদি কেউ আদর করে ডেকে পান্তা খেতে দেয়–পরমান্ন ভেবে খাস, যদি কেউ অনাদরে পরমান্ন দেয়–বিষ্টাবৎ বর্জন করে আসিস!

এখানকার খাদ্যদ্রব্যকে আমি ওই মনে করি। ঘৃণা করে আমার মুখে তুলতে। রান্নার সময়ে নুন ঝাল পরীক্ষা করতে একটু জিভে ছোঁয়াতেও আমার অন্তরাত্মা রি রি করে ওঠে। তবু সেইবিষ্ঠা এক একদিন গলাধঃকরণ না করে উপায় থাকে না।

একদিন টিচার ইনচার্জ তার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে যারা সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেনি তাদের জন্য এখানে একটা ভোজ দিয়েছিলেন। যথারীতি রান্নাবান্না করে সবাইকে খাইয়ে আমি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। পরের দিন কেউ একজন কথাটা তার কানে দিয়ে দেয়–রঞ্জনদা খায়নি। উনি সেদিন আমাকে ডেকে বেজায় ধমকান। কেন খাননি? এটা তো আমাকে অপমান।

বলি-আমার তো নিমন্ত্রণ ছিল না।

ছিল না মানে! সবার নিমন্ত্রণ ছিল। আলাদা আলাদা করে কাউকে বলিনি। সুপারকে বলে গিয়েছিলাম–সবাই যেন যায়।

সে কথা উনি তো আমাকে কিছু বলেননি। আমি কী করে জানব! রোজ যে রকম রান্না করে চলে যাই। কালকেও গেছি।

তার মানে কোনদিনই আপনি খান না?

মাথা নাড়ি আমি–না।

কেন?

বড় সাহেবের বারণ আছে যে।

কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে–শেষে কেন কে জানে মানবিক হয়ে উঠলেন তিনি সে ঠিক আছে। অন্যদিন না খান না খাবেন, কিন্তু যেদিন কোনো অনুষ্ঠান হবে খেয়ে যাবেন। আমার অর্ডার রইল। এ কী কথা! সবাই খাবে আর যে রান্না করবে সে খাবে না। হয় নাকি!

সেই কারণে কোনো কোনোদিন বিশেষ নিষেধ না থাকলে খেয়ে নিতে হতো। সবটা নির্ভর করে যিনি খরচপাতি করছেন তার উপরে। তার জিনিস তিনি কাকে দেবেন না দেবেন সবই তার মর্জি। সেই যেবার বড় সাহেবের বড় ছেলের বিয়ে হল–কয়েক হাজার লোক খেয়েছিল, একমাত্র আমি ছিলাম অনিমন্ত্রিত। অবশ্য সে রান্না করেছিল অন্য রাঁধুনিরা।

আজকের যিনি উদ্যোক্তা, হতে পারে তিনি বড় সাহেবের পদাঙ্ক অনুসারি। তাই আমি তার নাপসন্দ। তবে সেই নির্দেশ কার্যকর করতে ভাইকে মৃত্যু শয্যায় রেখে ওয়ার্ডেনের উন্মাদ প্রায় ছুটে আসা–নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে এমন সচেতন আমি আগে আর কাউকে দেখিনি।

আগে হোস্টেলে চা হতো, ওরা খেত। আমি ওদের জন্য বানাতাম তাই আমিও খেয়ে নিতাম। দুধ ছাড়া লাল চা আর একটু চিনি। এতে কত বা খরচ। তবু বুক টনটন করে উঠল ওয়ার্ডেনের। খাচ্ছে তো! খেয়ে নিল তো। সর্বনাশ।

তাই সুপারের কানে সুপরামর্শ দিয়ে চা চিনি কেনা বন্ধ করিয়েছে সে। না, একেবারে বন্ধ করেনি। তা এখন রাখা থাকে মাদার কিলারের জিম্মায়। চা এখন সে-ই বানায়। সুপার, ওয়ার্ডেন, মাদার-তিনজন খায়।

ব্যাপারটা অতি তুচ্ছ। তবে এই রকমের তুচ্ছ তুচ্ছ ঘটনা দিয়ে একজন মানুষের স্বরূপ কিছুটা বুঝতে পারা যায় বলে এসব লেখা। এগুলো তো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাও নয়। আমার প্রতি

মনের মধ্যে গুপ্ত থাকা অগ্নিকুণ্ডের ছোট ছোট ফুলকি।

আর যখন আমি এর কার্যকারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হই মনে হয় যেন আমি এক ভুল মানুষ, ভুল করে ভুল জায়গায় এসে পড়েছি।

আমিও মানুষ, আমারও দুঃখ হয় কষ্ট হয় রাগ হয়। তবে কী বা করতে পারি আমি? কী বা করার আছে আমার? আমি পারি দুই চার লাইন লিখতে। এই সময় এছাড়া আমার আর কোনো অবলম্বন নেই। লিখে যাই অনাগত কালের মানুষদের জন্য আমার কষ্টকর অবমানিত মরম বেদনার কথা। আর আশা করি, একদিন তা এক বিশাল দীর্ঘশ্বাস হয়ে চারিয়ে যাবে হাজার হাজার বুকে। যে বুক থেকে একটা প্রবল ধিক্কারের সাথে এক দলা থুথু ছুটে যাবে সেই সব মানুষের দিকে।

সেই সময় একটা গল্প লিখেছিলাম এই সময় নামে। বর্ণনা করেছিলাম অসহনীয় মানসিক অবস্থা। তুলে দিচ্ছি সেই গল্পটা।

নব গোয়ালকে বলেছিল তার বাপ প্রবীণ গোয়ালা–”যদি পারিস বাপ আমার তবে যেন গরু হোস।” আমি তোকে সেই আশীর্বাদ করি।

সবাই যখন সন্তানকে ‘মানুষ’ করে গড়ে তোলাবার আপ্রাণ চেষ্টায় কালঘাম ছোটায় তখন প্রবীণ গোয়ালার এরকম উদ্ভট কামনা কেন তা বোঝা বেশ কঠিন ব্যাপার। যার নামই গরু। অপদার্থ জীবদের মধ্যে যার গণনা সবার আগে, এক মানব পুত্রকে সেই জীবতুল্য হতে বলা আশীর্বাদ না অভিশাপ।

একদিন ছেলেকে বলেছিল বুড়ো বাপ-গোয়ালা আছিস গোয়ালাই থাকিস। মানুষ হবার দরকার নেই। মানুষের বড় লোভ, বড় আত্মস্বার্থ চিন্তা, পরশ্রীকাতরতা, সবাইকে পিছনে ফেলে নিজে এগিয়ে যাবার চেষ্টা। মানুষের মত মানুষ আর কজনা। সে পথে বাধাও বিস্তর। তার চেয়ে তুই গরু হোস। গরুশান্ত নির্বিরোধ পরোপকারী সারাটা জীবন অন্যের জন্য খাটে। অন্যের জন্যই কোনো টুশব্দ না করে কসাইয়ের ছুরির সামনে গলাটা বাড়ায়। মৃত্যুর পরও শরীরের চামড়া দিয়ে অন্যের শরীর রক্ষা করে। আরও বলেছিল বুড়ো গরু কী খায় জানিস তো বাপ, যা পৃথিবীর সব চেয়ে তুচ্ছ নিকৃষ্ট আর কম দামী। আর যা দেয় সেই দুধ হচ্ছে পৃথিবীর সব চেয়ে পবিত্র পুষ্টিকর এবং তুলনাহীন সামগ্রী। সেই জন্যই গরু হচ্ছে জগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সব চেয়ে মহান জীব। তোর জীবনের পরমার্থ সাধন হোক–সত্যিকারের গো-জীবন।

গোয়ালার জীবন জীবিকার সর্বপ্রধান শর্ত বা অঙ্গ-গো-পালন এবং দুগ্ধ সংগ্রহণ। সংগৃহীত দুগ্ধ যারা বিক্রয় দ্বারা ধনোপার্জন করে তাদের কথা নয়, যারা বিতরণ করে তাদের কর্ম কল্পনা স্বপ্ন ভালোবাসা সব কিছুতেই মাখামাখি হয়ে থাকে দুধ দই ঘি মাখনের সুবাস সুগন্ধ। গল্প গান কবিতা হাসি আহ্লাদে উপচে ওঠে, এক ফেনিল উষ্ণ শুভ্রতা।

নব সেই রকম গোয়ালা। যার বাপ তাকে বলেছিল, দুধের কোন দাম হয় না বাপ। দুধ অমূল্য। যে বিক্রয় করে–পাষণ্ড, যে দাম দেবার ধৃষ্টতা দেখায়–মূর্খ। তুই দুধ দান করিস বাপ। শিশু, রুগ্ন, দুর্বল ভয় স্বাস্থ্য যে চাইবে তাকেই দিস।

তাহলে আমার চলবে কী করে?

যৎ সামান্য যে যা দেবে প্রতিদানে। বলেছিল বুড়ো, বেচা-কেনা নয়, সেটা দানের প্রতিদান।

আর একদিন বলেছিল বুড়ো, যে মদ বিক্রি করে সে কারও কাছে যায় না। কাউকে খোঁজে না। অন্ধকার ঘরে বসে থাকলেও মদখোর তাকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু গোয়ালাকে তার সামগ্রী মানুষের দুয়ারে বয়ে নিয়ে যেতে হয়। কার প্রয়োজন খুঁজে ফিরতে হয়।

সময় সময় এমন ধরনের অনেক কথা বলতে প্রদীপ গোয়ালা। সব কথার সঠিক অর্থ নব গোয়ালার বোধগম্য হতো না। তবে তা নিয়ে তেমন চিন্তিত ছিল না বৃদ্ধ। কেননা, সময় সবচেয়ে বড় শিক্ষক। পরিণতি পাবার আগে বেদতুল্য বাক্যও মানুষের কাছে স্রেফ কতগুলো দুর্বোধ্য শব্দ।

বাবা দেহ রাখার পর স্বাভাবিক নিয়েমেই গোপালনের সমস্ত দায়দায়িত্ব নব গোয়ালার কাঁধে বর্তায়। ফলে সারাদিন মাঠে মাঠে বাশুরি বাজিয়ে গোচারণের পর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ক্লান্ত ঘুম। এই করেই সময় তার বেশ কেটে যায়। এর বাইরে যে অন্য কোন জীবন থাকতে পারে তা সে জানে না। জানতে চায় না।

নব গোয়ালা যে প্রদেশের বাসিন্দা সেখানে সবাই গোয়ালা। প্রত্যেকের রয়েছে বিশাল বিশাল গরুর পাল। ফলে গোচারণ-ভূমির বড় অকুলান। গো-বৎসরা যে কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘাস বিচালি খেতে পায় না। ফলে তাদের স্বাস্থ্য বা দেয় দুধে তেমন বাড় বাড়ন্ত হতে পারে না।

সে কারণে নব গোয়াল খুবই চিন্তিত। গরু যার জীবন, যে মানুষ গরুর পালের দ্বারা ঘিরে থাকে জলের মধ্যেকার মাছের মত। যার স্বপ্ন-সাধন একমাত্র গরুতুল্য হওয়া, গোধন কুলের শ্রী এবং সৌন্দর্যতে যার জীবন সৌন্দর্যমণ্ডিত, সে যে এর ফলে চিন্তাকুল হবে তাতে আর আশ্চর্য কী।

ফলে একদিন উপযুক্ত গোচারণ ভূমির সন্ধানে নব তার অতি চেনা বিচরণ ক্ষেত্র ত্যাগ করে অজানা অচেনা অঞ্চলের দিকে রওনা দিল। সাথে রইল সামান্য কিছু পাথেয় আর প্রিয় গরুর পাল।

অনেক পাহাড়, জঙ্গল, পথ পার হয়ে অনেক দিন পর সে এমন এক অঞ্চলে এসে পৌঁছলো যেখানে নদীতে রয়েছে পান করার মত প্রচুর স্বচ্ছ সুমিষ্ট জল। আর মাঠ ভর্তি অঢেল সতেজ সবুজ ঘাস। কারণ এখানকার কেউ গরু পোষে না। গরু যে পোষবার মত একটা প্রাণী, দুধ যে পান করার মত একটা পদার্থ কেউ তা কখনও শোনেনি।

এখানকার প্রত্যেকটি মানুষ যে শিশু কিশোর যুবা যাই হোক, সব নেশাগ্রস্ত। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটুকু পথ, তা সে স্বল্প কিংবা দীর্ঘ সরল কিংবা আঁকা-বাঁকা, এরা পার হয়ে চলে আচ্ছন্ন এক নেশার খেয়ালে। এখানে নব জাতকের মুখে কেউ মধু দেয় না, মাতৃবক্ষ থেকে উথলে ওঠা সুধার সমুদ্র উপচে পড়ে না সন্তানের ওষ্ঠে বা অধরে। এখানে মৃত্যু পথযাত্রীকে কেউ হরিনাম শোনায় না, পান করায় না পবিত্র গঙ্গা বারি। শোকে বা আনন্দে উৎসব বা উত্তেজনায় বলতে গেলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এদের অবলম্বন একমাত্র নেশা।

নব গোয়ালা এইরকম অঞ্চলে এসে গরু গোয়াল গোয়ালা নেই দেখে মনে মনে দারুণ পুলকিত। এতবড় বিশাল অঞ্চল, এত মানুষজন আর দুধওয়ালা বলতে সে মাত্র একা। না জানি কতশত লোক তার কাছে আসবে, কদর করবে।কিন্তু এখানে কেন যে কোন গোয়ালা নেই তা সে কী করে বুঝতে পারবে। এ সব গুহ্য রহস্য বুঝতে পারার মত বুদ্ধি তার নেই। কথায় তো বলে যে, গোয়ালাদের বুদ্ধির বিকাশ হয় চোখে তুলসী পাতা দেবার কয়েকঘন্টা আগে।

সে সময় আসতে নব গোয়ালার ঢের বাকি। তবে তার বাপ বুড়ো গোয়ালা সেই চরম মুহূর্তে বলে গিয়েছিল প্রিয় পুত্রকে মাতালের পাড়ায় দুধওয়ালার কী দরকার। ভুলেও যেন যাসনা বাপ৷ গেলে মান পাবি না। মদের উপর দুধ শাস্ত্র মতে বিরুদ্ধ ভোজন। এদের কী ঠিক, লোভে কিংবা স্বাদে নেশা কিংবা কৌতূহলে যদি খেয়ে ফেলে, হজম হবে না। তাতে দুধের অপমান হবে। গোয়ালার অবমাননা হবে। তার চেয়ে দুরে দুরে থাকিস, বাপ। অমৃতও অপাত্রে রাখলে গরল হয়ে যায়।

নব গোয়ালা নদীর কিনারে সবুজ শ্যামল মাঠের পাশে অল্প কিছুকাল বাস করার ফলে শীর্ণকায় গরুগুলো প্রাণভরে পেট পুরে কচিকচি নরম ঘাস খেতে পেয়ে বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠল। গাভীগুলোর দুধ দেবার ক্ষমতাও বেশ বেড়ে গেল। যা কিছু ভাণ্ড পাত্র, সব টইটম্বুর। তখন একদিন পিতৃবাক্য বেমালুম বিস্মৃত হয়ে সেই পূর্ণভাণ্ড মাথায় বয়ে পৌঁছে গেল সেই পাড়ায়। যেখানে লোক কারণ ছাড়া পান করে না। যেন পরিশুদ্ধ জলও পান করা অকারণ।

সে পাড়ার চারদিকে বড় বিচিত্র দৃশ্য। যে লোকটি আসলে জন্ম থেকেই অন্ধ, চোখের তারায় জ্বলেনি কখনও কোন আলো, সে এমন এক গভীরে নেশায় আকণ্ঠ ডুবু ডুবু যেন একমাত্র সেই জানে কেমন করে সমুদ্রের তলদেশ থেকে সোনার থালার মত উঠে আসে সকালের সূর্য। আর কেমন করে গলানো সোনার মতো রোদ ছড়িয়ে আকাশ পেরিয়ে পশ্চিম পাহাড়ের পিছে ডুবে যায় বিকেলবেলায়।

আসলে যে বোবা যার মুখ থেকে কখনও উচ্চারিত হতে পারবে না কোন স্তব কোন প্রিয় শব্দ বা কোন মাঙ্গলিক মন্ত্র, অহংকারী নেশা তাকে দিয়েছে এক হিমালয় ভ্রম। যেন তার মুখ নিঃ সৃত প্রতিটি শব্দ মহার্ঘ বা মহান। যেন জগতের যা কিছু শ্রেষ্ঠ বাক্যবাণী উপদেশ সব ভুয়ো ভ্রান্ত, চিরসত্য তারই অসংবদ্ধ অসংলগ্ন অর্থহীন প্রলাপ। যে আসলে চির বধির, কোনদিন শোনেনি কোন শিশুর মুখের নির্মল হাসি, কোন পাখির কুহুতান। আধো অন্ধকারে অস্ফুট কোন নিবেদন কিংবা সমুদ্রের অক্লান্ত গর্জন। মস্তিষ্কের কোষে কোষে পুঞ্জিভূত মাদক ধারণা তাকে দিয়েছে এমন এক দম্ভ যেন জগতের যা কিছু সুন্দর স্বরযুক্ত রাগ কাব্যিক ব্যঞ্জনা তার মত আস্বাদন আর কারও জীবনে জোটেনি। সবাই ব্যর্থ অপূর্ণ। একমাত্র তারই টলোমলো পায়ের নীচে আছাড় খাচ্ছে সকল পুর্ণতা।

এমনই অসহ্য অস্বাভাবিক দৃশ্য ও ঘটনার মধ্যে দিয়ে গোয়ালা তার অমৃতসম্ভার মাথায় বয়ে পথ হেঁটে চলে। আতুর আবেদনে হেঁকে চলে, কে নেবে গো দুধ।

দুধ। সে আবার কী পদার্থ রে বাবা? থমকে দাঁড়ায় এক নেশাগ্রস্ত। নামাও দেখি ভাণ্ড তোমার। জিনিসটা কেমন একটু দেখি।

আরও দু’চারজন জড়ো হয়ে গেল আশেপাশে। তাদের চোখে মুখে বিস্ময়। এর নাম বুঝি দুধ। খায় নাকি। খেলে নেশা হয়?

একজন হাতের কোষে করে অল্প মুখে ঢেলে বলে বাহঃ, খেতে তো মন্দ নয়। কিন্তু খেলে শরীর টরির খারাপ হবে নাতো?

এ পাড়ার যে সবচেয়ে বিচক্ষণ বলে সে, এই রকম একটা সাদা জিনিষ শীতকালে খেজুরগাছে গরম কালে তালগাছে হয়। খেতেও বেশ আর নেশাও হয়।

আর এক বুদ্ধিমান বলে, এটা সেটা নয়। এই রকম জিনিস, তবে কিছুটা ঘন। যেটা পানের সাথে অল্প পরিমাণে খায়। বেশি হলে মুখ পোড়ে।

নানা সেটা নয়।

এটাও নয় ওটাও নয় তাহলে বস্তুটা কী? যে পণ্ডিত সে বলে-সেটা জানবার সহজ উপায় কিছুটা খেয়ে নেওয়া।

মদের চেয়ে দুধের দাম সর্বকালে কম। এবং পান করাও কম কষ্টকর। লোকগুলো সস্তায় পানীয় পেয়ে বেশ কয়েক গ্লাস করেই পান করে বসে। কেউ কৌতূহলে আর কেউ বা নেশার খেয়ালে। কিন্তু দুধের মত পবিত্র শক্তিবর্ধক সহজপাচ্য এবং সুলভ পদার্থও তাদের সহ্য হয় না। পেটের মধ্যে পড়ে থাকা যুগ যুগান্তরের মাদক তরলে পতিত পবিত্র গোরসও বিষাক্ত হয়ে ওঠে। ফলে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কারও বমি শুরু হয়ে যায়। কারও পাতলা দাস্ত আর কারও বা দুটোই।

খবরটা বাতাসের বেগে দিকে দিকে ছড়িয়ে যায়। একটা লোক মারাত্মক বিপজ্জনক, বিষবাহক। রে রে করে ছুটে আসে সবাই।

মানুষ হয়তো মানুষ বলেই মানুষকে বাঁচাবার চাইতে মারবার ব্যাপারে অধিক উৎসাহী। জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশাল অংশ ব্যয় হয় মারণ গবেষণায়। কত শত শ্রেষ্ঠ মানবসন্তান নিভৃত গবেষণায় ব্যাপ্ত কত সহজে মানবকুলকে ধ্বংস করা যায় সেই মারণাস্ত্র উদ্ভাবনে।

যে লোকগুলো শুড়িখানার সংরক্ষক ও সঞ্চালক তারা হামলে পড়ে নব গোয়ালার উপর। তাদের ক্রোধই যেন সর্বাধিক। কেন না তারা, একমাত্র তারাই দুধের অপকার উপকার সব চেয়ে বেশি জানে।

সেই অদ্ভুত অঞ্চলের অদ্ভুত লোকরা গোয়ালার মুখে থুথু ছেটায়, অশ্রাব্য বাক্যবাণে বিদ্ধ করে। অপমানিত অবসন্ন নব গোয়ালা আত্মগ্লানিতে মরে যেতে অনুধাবন করতে পারে বুড়ো বাপের শেষ সতর্ক বার্তা–বাপরে, মাতালের পাড়ায় যাস না। ওখানে দুধওয়ালার মান থাকে না।

.

বড় সাহেবকে আর বাঁচানো গেল না। ভারতবর্ষের এক প্ৰথমশ্রেণির চিকিৎসা কেন্দ্রের দুষ্প্রাপ্য চিকিৎসকদের দুর্মূল্য চিকিৎসার পরেও একটা চোখ তার নষ্ট হয়ে গেল। ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! একদা এই এরাই একদিন কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষকে একটা চোখ অন্ধ থাকার কারণে নাম দিয়েছিল কানা অতুল্য, কানা বেগুন।

অতুল্য ঘোষ একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তার চোখটা নষ্ট হয়েছিল ইংরেজ পুলিশের লাঠির আঘাতে। এই কারণে দেশবাসীর তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। তা তো নয়, উল্টে এই ধরনের রাজনেতারা তাদের কর্মী সমর্থকদের শিখিয়েছিল তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ অপমান করতে। সম্মানীয়কে অপমান, মর্যাদাবানদের মর্যাদা নাশ,কীর্তিবানদের নামে কুৎসা ভারতীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে অস্বীকার–এই সব অপকর্মকে হাতিয়ার করে কীভাবেবঙ্গের মাটিতে বিদেশি ভাবধারার শেকড় বসানো যায় তারই প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে এরা জন্মলগ্ন থেকে। স্বদেশের সবকিছু বাতিল বর্জ নিন্দনীয় আর রাশিয়া চিনের সবকিছু মহান এবং শ্রেয় এই রকম একটা জনভাবনা নির্মাণে এদের ভূমিকা ছিল অতি উগ্র বিবেকানন্দ তাই অচল। নেতাজিতাই তোজোর কুকুর, সাম্রাজ্যবাদের দালাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুর্জোয়া কবি, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, রামমোহন কেউ নমস্য নয়?

যাঁরা শ্রদ্ধেয় সম্মানীয় পূজনীয় তাদের অবজ্ঞা অস্বীকার অপমানকারী যে রাজনীতির অতি সুচতুর ভাবে আমদানি করা হয়েছিল এদেশে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির মূলোচ্ছেদের অপপ্রয়াসে, অতি ধূর্ত সেই একদল মানুষের পিছনে কোনো বিদেশি চক্রের ইন্ধন ছিল, সুদূর প্রসারি পরিকল্পনার চক্রান্ত জাল ছিল, যা এখন মহীরুহ হয়ে উঠেছে। একটা গোটা জাতি যে জাতি আজ যা ভাবে, কাল তা ভাবে সারা ভারত, তার নীতি নৈতিকতার চুড়ান্ত অধঃপতন ঘটিয়ে দেওয়া গেছে। আর যে তার বাঁকা কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে দেশকে পথ দেখাবে-প্রত্যয় হয় না। প্রতিবাদ প্রতিরোধের সেই দৃঢ় দৃপ্ত চেতনাকে ভোগবাদের সপ্ততল নরকের দিকে চালিত করতে পেরে এখন সুখ নিদ্রা দিতে পারছে দেশকে শুষে ছিবড়ে বানিয়ে দেওয়া বেনিয়া বুর্জোয়া শ্রেণির মানুষ। আর তাদের শোষণ সাম্রাজ্যকে আতঙ্কে প্রহর গুনতে হবে না। যুগ যুগ জিন্দাবাদ হয়ে থাকবে সর্বশক্তিমান পুঁজিবাদ।

যে কোন গণ-আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকে দেশের ছাত্র-যুব সম্প্রদায়। সেই যুব ছাত্রদের মন যদি দেশের সবকিছুর প্রতি শ্রদ্ধাহীন-নীতি নৈতিকতাহীন–আত্মসুখ সর্বস্ব ‘বিশ্ব নাগরিক বানিয়ে দেওয়া হয় তার কাছ থেকে দেশ, দেশের মানুষ, মহৎ কিছু পাবার আশা করতে পারে না। আজকের যুব সমাজ তাই এমন সমাজ বিমুখ। এত উচ্ছৃঙ্খল-উদ্দাম।

অতি দুঃখের বিষয়, বঙ্গে এই জিনিসের আমদানি ঘটিয়েছে তারা যাদের প্রতিশ্রুতি ছিল মানুষকে বিচ্ছিন্ন না রেখে সমাজের সার্বিক কল্যাণে যুক্ত করে পরিপূর্ণ সামাজিক মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার। তাদেরই আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বেপথু যুব জনতা প্রমোটারি, জমির দালালি, সাপ্লাই, সিন্ডিকেট এইসব করে গাদাগুচ্ছের অন্যায় উপার্জনের অর্থ খরচা করছে আরও কোন অন্যায় উদ্দেশ্যে। এইযুবকদের ব্যবহার করছে সিপিএম দল তাদের শাসনক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার কুপ্রয়াসে।

এটা বড় অন্ধকার সময়, অরাজক অন্ধকার। যে সময় দুর্বলের গলার আওয়াজ, কান্নার শব্দ চাপা পড়ে যায়, শাষকের সবল বুটের আওয়াজের নীচে। সেই যে এক কবি বলেছিলেন–শাসক আর শশাষকের নিষ্ঠুর সংহতি–যাতে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তবু মানুষ প্রতিবাদে পথে নামতে সাহস পায় না। বুক জুড়ে দাপায় নিদারুণ এক ভয়। সেই সাতাত্তর সাল থেকে দুহাজার এগারো–এতগুলো বছর ধরে মানুষ আর্তনাদ করছিল আর কামনা করছিল-একজন কেউ একজন ভয়কে জয় করে সামনে এসে দাঁড়াক। সাহসের মন্ত্রে সঞ্জীবিত করুক মৃতপ্রায় মানুষকে। আমরা এগিয়ে যাই তার পিছনে দুঃসহ রাত্রির বুকে সূর্য জ্বেলে দিতে। তিমির রাত্রির অবসানে নতুন দিন আসুক।

তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে, গ্রাম বাংলার অতি পুরানো প্রবাদ। যেন সেই প্রবাদকে সত্যি করে–ঐতিহাসিক প্রয়োজনে, অতি সন্তর্পণে শহর কলকাতার এক খালপাড়ে বস্তিতে বেড়ে উঠছিল এক মেয়ে। সেটা সেই অঞ্চল যেখানে কাল অবসানের দেবী কালিকার মন্দির। সেই মেয়ে যে রূপে ইন্দিরা গান্ধির মতো নয়, সুভাষ বসুর মতো নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করেনি, জন্ম হয়নি কোনো অভিজাত ধনী পরিবারে, নেই কোনো ক্ষমতাশালী দাদা-মামা-কাকা। অতি সাধারণ ঘরের এক আটপৌরে বাঙালি মেয়ে। যাকে দেখলে আমাদের ঘরের মেয়ে বলে মনে হয়, এমন সাদাসিধা বেশবাস। কে জানত যে সে এমন উল্কার মতো, আলো আগুন নিয়ে ধেয়ে এসে আছড়ে পড়বে বঙ্গের রাজনীতিতে। মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ মিছিল করে দাঁড়াবে তার পিছনে। একশো কুড়ি বছরের সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস, সত্তর পঁচাত্তর বছরের কমিউনিস্ট পার্টির হাজার হাজার নেতা কর্মী মুখ থুবড়ে পড়বে তার প্রতাপের সামনে। অর্থের পাহাড়, অস্ত্রের ভাণ্ডার ভেঁতা করে, শুধু মানুষকে সাথে নিয়ে গলা টিপে ধরবে সব জুলুম অন্যায় অত্যাচারের। কে জানত যে বার বার হেরে যাওয়া মানুষ, শ্রমিক কৃষক খেটে খাওয়া মানুষ, লাথি মেরে চূর্ণ করে দেবে স্বৈরাচারী শাসকের দম্ভ-দুর্গ। বিজয় কেতন তুলে ধরবে মা মাটি মানুষের। সেই অসম্ভব সম্ভব হল ২০১১ সালের ১৩ মার্চ। অবসান ঘটল একটা ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের। অহমিকার মিনারে বসে মানুষকে অপমান অবহেলার চরম প্রতিশোধ নিল মানুষ। ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে বিতাড়িত হল কমিউনিস্ট নামধারি মানবতার শত্রুরা। সেই যে মরিচঝাঁপি দ্বীপে হত্যা, ধর্ষণ, লুঠপাটের মধ্য দিয়ে, হাজার হাজার মৃতদেহের উপর দিয়ে, যাদের স্বৈরাচারের রথ নেতাই পর্যন্ত পৌঁছেছিল–দলিত দমিত নিপীড়িত মানুষ তাকে গতিরুদ্ধ করে দাঁড়াল। অনেক হয়েছে–আর না।

তবে লড়াই এখনও শেষ হয়নি, শুরু হয়েছে মাত্র। বোতলের দৈত্যকে বোতলে ঢুকিয়ে গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ না না করলে সে কোনদিন কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে আবার মানুষের জীবন সম্পত্তি সম্ভ্রমের উপর হামলে পড়তে পারে। ওরা সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে। প্রতিক্ষণ তাই সতর্ক থাকা জরুরি।

.

একটা চৌরাস্তার মোড়। সেখানে আছে একটা বাস স্ট্যান্ড।বহু লোকের যাতায়াত এই পথে। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে স্কুলে যায়। দোকান, বাজার, অফিসে যায় শত শত লোক। কিন্তু সেখানে কোনো ছায়া নেই। গ্রীষ্মকালে রোদের তাপে সবার বড় কষ্ট হয়।

মোড় থেকে কিছুদূরে থাকেন একজন মানুষ। সেই যে যাদের মাথায় অনবরত উকুনে কামড়ায়–কিসে মানুষের মঙ্গল হবে–সেই রকম একজন মানুষ। তিনি একদিন একটা বটের চারা এনে পুতে দিলেন মোড়ের মাথায়। সার দিলেন, জল দিলেন, চারাগাছের চারদিকে ঘেড়া দিলেন যেন গরু ছাগলে মুড়িয়ে খেয়ে না যায়।

দিনে দিনে গাছটা বড় হতে লাগল। আকাশে ছড়িয়ে দিল শাখা প্রশাখা।তিরিশ চল্লিশ বছরে সেই ছোট্ট চারা মহীরুহ হয়ে উঠল। একদিন দেখা গেল সেই গাছের গোয় একটা দেবদেবীর মন্দির গড়ে উঠেছে। সেইসব দেবদেবী মানুষের কোনো মঙ্গল করল তা কে জানে। তবে মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটা আখড়া জমে গেল গঞ্জিকা সেবীদের। গাঁজার ধোঁয়ার কটু গন্ধে পথচলা মানুষের নাক জ্বালা শুরু হয়ে গেল।

কিছুদিন পরে শুরু হল আর এক নতুন উপসর্গ। কোথা থেকে কে জানে একঝক শকুন এসে বাসা বাঁধল তার ডালে ডালে। দিনরাত তাদের ঝাঁপটা ঝাঁপটি ডাকাডাকি কামড়াকামড়িতে পরিবেশটা বিচ্ছিরি হয়ে উঠল। তার উপর শকুনের গায়ের গন্ধ, ঠোঁটে করে ভাগাড় থেকে নিয়ে আসা পচা গলা মাংস–এদিক সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ায় মানুষের পথচলা দুঃসাধ্য হয়ে গেল।

সেই যে মানুষটা–যিনি একদিন গাছটা পুতে ছিলেন, যখন গাছটা একটু একটু করে বড় হচ্ছিল দেখে মনটা ভরে গিয়েছিল তার। যখন সেই গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শ্রান্ত পথিক বিশ্রাম নিত, ভাবতেন তিনি, জীবনে একটা কাজের মতো কাজ করেছি। বটবৃক্ষ অমর। আমি যেদিন থাকব না, গাছটা থাকবে। সেদিনও সে পরিশ্রান্ত পথিককে শীতল ছায়া দেবে।

কিন্তু আজ সেই গাছটাকে দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। দীর্ঘদিনের সযত্নে লালিত স্বপ্ন-বাসনা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এ আমি কী করেছি! আত্মগ্লানিতে মন মুচড়ে উঠল তার। এমনটা যে হবে সে তো কোনোদিন ভাবেনি। পুরো পরিবেশটা যে পূর্তিগন্ধময় নরক হয়ে যাচ্ছে। বটবৃক্ষ যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে বিষবৃক্ষে। এখন মানুষকে, সমাজকে, পরিবেশকে কী করে রক্ষা করা যাবে?

ভাবলেন তিনি গাছটাকে গোড়া থেকে কেটে ফেলবেন। তখনই মনে পড়ল সেটা বর্তমান আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। জেল খাটতে হতে পারে। শকুনগুলোকেও মেরে ফেলা যাবে না, আইনে ওটাও অপরাধ। মন্দিরটাকেও ভেঙে ফেলা চলবে না, সেটা ধর্মবিশ্বাসীদের আঘাত দেবে। সংবিধান ঘোষণা করে রেখেছে, কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিলে সেটাকে শান্তিযোগ্য অপরাধ বলে মানা হবে। তাহলে এখন উপায়? জনসাধারণের স্বার্থে কাউকে দরকার, কাউকে না কাউকে ওটাকে মারার দায়িত্ব নিতে হবে।

কে নেবে সে দায়িত্ব? ভাবে লোকটা–আমি। আমাকেই সেই সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমার কৃতকর্মের অপরাধ আমাকেই স্খলন করতে হবে।

যে কাজ গোপনে—লোক চক্ষুর আড়ালে করা হয় সে কর্মের কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে লজ্জায় মুখ লুকাতে হয়–লোকটা জানত, সেটাই অপকর্ম। তাহলে ভোটদান সেটা কি? সেটাও তো লোকচক্ষুর আড়ালে অতি সঙ্গোপনে সেরে নিতে হয়। যে গোপন ক্ষমতার বলে বদলে ফেলা যায় শাসককেও এই গোপন কর্মটি যখন অপকর্ম নয়, তখন অন্য দু-একটা কাজও নিশ্চয় গোপনে করায় বাধা নেই, যদি তা জনহিতে করা হয়।

মানুষের সবচেয়ে প্রবল প্রতিপক্ষ সে নিজে। তাকে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় ফেলে তার মন। মনের কাছে জবাবদিহি করতে হয় সবচেয়ে বেশি। যখন সে মনের কাছে মাথা উঁচু রাখার যুক্তি নাগালে পেয়ে গেল, এক গভীর রাতে ঘর থেকে কাটারি হাতে বেরিয়ে গিয়ে গাছটার চারদিকের মোটা ছাল চেঁছে তুলে নিল গোল করে। এতে কোনো শব্দ হলো না। কেউ টের পেল না। ফলে গাছ আর মাটি থেকে যথেষ্ট পরিমাণে রস শোষণ করতে না পারায় ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরে গেল।

এরপর যা হয়–শকুনগুলো উড়ে পালাল অন্য কোন দিকে। গাঁজাখোরেরা সরে গেল অন্য কোনো ছায়ার সন্ধানে। মন্দির ভেঙে পড়ল সংরক্ষণের অভাবে। গাছটাকে আবর্তন করে যা যা জমে উঠেছিল সেসব আর কিছুই রইল না। আর একদিন শুকনো গাছটাকে কারা যেন কেটেকুটে নিয়ে চলে গেল। পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল পুরো পরিবেশ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পথ চলা মানুষ।

গাছটা মারা গিয়েছিল গত বছর ঠিক সেই সময়, যখন ভোটে বামফ্রন্ট সরকারের বিচ্ছিরিভাবে পরাজয় ঘটে। এই এক বছর সিপিএম দলটা বড় ম্রিয়মান হয়ে বসেছিল মণিহারা ফণীর মতো। সেই যে মোগল সাম্রাজ্যের কালে কিছু ক্ষমতালোভি তখৎ ইয়া তাবুদ বলে মেতে উঠেছিল মরণপণ দন্দ্বে, সিপিএম দলও এখন মেতে উঠেছে। যে কোনো কৌশলে আবার রাইটার্স দখল করতে হবে। কোনো নীতি নয়, আদর্শ নয় পাখির চোখের মতো তাদের একমাত্র লক্ষ্য আবার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা। যদি কোনভাবে তাতে একবার সফল হয়, আগামী পঞ্চাশ বছরে আর তাদের কেউ ভোটে হারাতে পারবে না।

প্রথমত, এখানে বিরোধী দল বলে আর কিছু থাকবেইনা। থাকবে, যেমন ভিলাই শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। কথিত শ্রমিক নেতাকে আগে গিয়ে মালিকের সঙ্গে দেখা করে কোন বিষয়ে আন্দোলন করা হবে জানিয়ে তার অনুমোদন নিতে হয়। গোডাউনে মাল জমে গেলে নেতাকে মালিক হুকুম দেয়-সাতদিনের জন্য ধর্মঘট করে দাও।তখন মিছিল মিটিং আগুন ছেটানো বক্তৃতা হয়। আন্দোলন হয়, তার আগে নয়।

সেই যে মমতা ব্যানার্জী যাদের বলেছিলেন তরমুজ, তারাই গণতন্ত্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে বিরোধীর ভূমিকা পালন করবে। যারা তরমুজ হবে না, নিখোঁজ হয়ে গিয়ে সুশান্ত কোন কর্মীর দ্বারা উপরে নুন নীচে নুন নিয়ে কবরে গিয়ে ঘুমাবে। পচবে জেলে, পালাতে হবে রাজ্যের বাইরে। তখন পাড়ায় পাড়ায় ওয়াচকমিটি হবে। সিপিএমের লোকেরা নজর রাখবে, কোন লোকটা আমাদের বিরুদ্ধে কী কথা বলছে। কে গণশক্তি কিনছে না, পার্টিকে খুশি মনে চাদা দিচ্ছে না, মিছিল মিটিংয়ে যাচ্ছে না। হাড়গোড় ভাঙা হবে তার কোনো ছুতো পেলেই। ছুতো না পেলে ছুতো তৈরি করে নেবে। ওরা পারে না এমন কোন অপকর্ম পৃথিবীতে নেই। নৃশংসতায় এরা তালিবানেরও বাপ, নাৎসিদের জ্যাঠামশাই।

মাত্র এক বছর পরে তাই আবার সিপিএম মরিয়া চেষ্টা শুরু করেছে নতুন সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য। আবার সেই মরা গাছের গোড়া থেকে লতপত করে বেড়ে উঠছে একটা সরু ডগা। এই বর্ষার জল পেয়ে অসীম স্পর্ধায় আকাশের দিকে মাথা উঁচু করছে। এখনই ওটাকে নির্মূল করা দরকার। না হলে দেরি হয়ে যাবে।

.

আমার বাড়ির সামনে একখানা গাড়ি এসে থেমেছে। কেন এই গাড়ি তা বলতে হলে আমাকে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।

সেটা ২০০৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সকাল বেলা আনন্দবাজার পত্রিকার পাতা খুলে চোখ আটকে গেল একটা সংবাদে। আজ সন্ধে ৬টায় অক্সফোর্ড বুকস্টোরে অলকা সারাওগীর উপন্যাস শেষ কাদম্বরীর ইংরাজি–বাংলা, ইতালী অনুবাদ প্রকাশ অনুষ্ঠান। প্রকাশ করবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উপস্থিত থাকবেন ইতালির আন্তোনিয়ো সিলভি।

আর কী আমি থাকতে পারি? মন উতলা হয়ে উঠছে আমার। চোখে জল এসে যাচ্ছে। এই সেই বই যাতে আমার নামের একটা চরিত্র আছে। তাই জলভরা চোখে ছুটে যাই টিচার ইনচার্জের টেবিলের সামনে–বড়দি। বড় দুঃসংবাদ, আমাকে ও বেলা ছুটি দিতে হবে তালদিতে আমার শাশুড়ির মরণাপন্ন অবস্থা, আমার যেতেই হবে।

ছুটি নিয়েই ছুটে যাই পার্কস্ট্রিটে–অক্সফোর্ড বুক স্টোরের সামনে। যে ভবনে বই প্রকাশ অনুষ্ঠান তা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস। যার উপর ষাট সত্তর দিন আগে মুসলিম জেহাদিরা হামলে পড়েছিল ক্ষুধার্ত হায়নার মতো। এখন ওসামা বিন লাদেনের অনুগামিদের একটাই কর্মসূচি–আমেরিকানদের মারো।

ইতালি আমেরিকার একটা মিত্র দেশ। এই কদিন আগে আমেরিকা ইতালি আর বৃটেন মিলে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইরাককে। আজ এই ভবনে ইতালি দূতাবাসের কিছু লোক আসবে। বলা যায় না, তাদের উপর আছড়ে পড়তে পারে কোন মানব বোমা। সুরক্ষার ব্যবস্থা তাই খুবই কড়া।

এক সময় আমি ধীরে ধীরে বুক স্টোরের প্রধান প্রবেশ পথের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দ্বার আগলে দুজন দীর্ঘদেহী দারোয়ান–একজন প্রশ্ন করে–হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট। আমি একথার মানে বুঝি না, বোকার মতো মাথা নাড়াই। তারপর নিজের মাতৃভাষায় বলি–এখানে যে অনুষ্ঠান হচ্ছে–আমি যাব।

কার্ড প্লিজ। অর্থাৎ আমন্ত্রণ পত্র দেখতে চাইছে। কত লোক যাচ্ছে, কারো কাছে চায়নি। শুধু আমার কাছে। আমার চেহারা পোষাক এই ভবনের উপযুক্ত যে নয়। বলি–নেই। সে আঙুল তুলে বলে–গো এ্যাওয়ে। আমার কানে তা আসে–গেট আউট হয়ে।

কী আর করি! এক বুক নিরাশা নিয়ে গেট ছেড়ে ফুটপাতে নেমে দাঁড়াই। চারদিকে তাকাই যদি কোন চেনা কাউকে পাই।

ভাগ্য আমার ভালো, কিছুক্ষণ পরে দেখি–গাড়ি থেকে আমার সামনে অলকা দিদি এসে নামলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কখন এসেছেন? বলি–এই তো সবে।

চলুন ভিতরে যাই।

চলুন।

দারোয়ান অলকা দিদিকে চেনে। তার সাথে যেতে দেখে এখন সে আর আমার পথ আটকাল। সভা ঘরে ঢুকে আমার ভীষণ ভয় ভয় করছিল। চারদিকে ফরসা দামি দামি জামাপ্যান্ট পড়া ইংরাজিতে অনর্গল কথাবলা লোকজন এখানে আমার মত একজনও নেই।

না, আছে। আমার মত গায়ের রঙ একজন আছে। যদিও তিনিই আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। মঞ্চ আলো করে বসে আছেন। আহা, কালোর কী অপরূপ আলো! তিনি আর কেউ নয়, কবি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা শেষ কাদম্বরীর প্রকাশ হল তাঁরই হাত দিয়ে।

সে যাই হোক, অনুষ্ঠান শেষে যখন নীচে নেমে এসেছি, অলকা দিদি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এক সুশ্রী বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে। ইনি হায়দারাবাদে থাকেন, নাম মীনাক্ষী মুখাজী। ইনিই হিন্দি থেকে বাংলায় শেষ কাদম্বরীর অনুবাদ করেছেন। বলেন অলকাদিদি, এই যে–এই হচ্ছে মনোরঞ্জন ব্যাপারী। মীনাক্ষী দিদিবইয়ের পাতায় বার বার এইনাম দেখেছেন। সেই নামের একজন রক্তমাংসের মানুষ দেখে বিস্মিত হন তিনি–আমি তো ভেবেছিলাম চরিত্রটি কাল্পনিক। আশ্চর্য তো!

আমি তখন বলি–অলকা দিদি তার বইয়ে আমার নামে চরিত্র রেখেছেন। এবার আমি আমার বইয়ে অলকা দিদির নামে একটা চরিত্র রাখবো।

এবার মীনাক্ষী দিদি আর একবার অবাক হলেন। কারণ বইয়ে যে মনোরঞ্জন সে অনেক কিছু করেছে তা সত্য, কিন্তু সে লেখেলিখতে পারে, তেমন কোন ইঙ্গিত তো নেই। তাই বিস্মিত গলায় জানতে চান–তুমি লেখো? মাথা নাড়ি আমি, লিখি। একাশি সাল থেকে লিখছি। আমার লেখা হিন্দি ইংরাজিতেও অনুবাদ হয়েছে। তারপর আমার দুটো উপন্যাস-ছন্নছাড়া ও বাতাসে বারুদের গন্ধ পড়তে দেই তাকে। কিছুক্ষণ পরে উনি জানতে চান–বাংলায় দলিত সাহিত্য বলে কি কিছু আছে?

দলিত। বাংলায় এই শব্দটার এত ব্যাপক প্রচলন নেই। এখানে দলিত অচ্ছুত অস্পৃশ্য এ সব বোঝাতে ছোটজাত ছোটলোক এই সব শব্দের প্রয়োগ হয়। কেউ কেউ একে একটু ভদ্রোচিত করে ইংরাজি মোড়কে মুড়ে বলে থাকেন সিডিউল কাস্ট বা সিডিউল ট্রাইব। যাদের সামাজিক সম্মান থেকে বঞ্চিত বা দলন করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে একদল বুদ্ধিজীবী আছেন–অবশ্যই তারা বর্ণবাদী ব্যবস্থার উপর দিকের বাসিন্দা, তারা বলেন থাকেন যে–যা সাহিত্য তা সবার পক্ষে হিতকারক। সাহিত্যের কখনও দলিত–অদলিত এমন শ্রেণি বিভাগ হয়না। আর কিছু বিশ্বাস মন্ডল বাগ এমন পদবিধারী বুদ্ধিজীবী মানুষ বলে থাকেন যে-হয়। সাহিত্যেরও শ্রেণি বিভাগ হয়। বৈষ্ণব সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্য, মার্কসীয় সাহিত্য, প্রগতিশীল সাহিত্য–এই সব শব্দের মধ্য দিয়ে যেমন একটা বিশেষ ধারা বা মতবাদ বা বিশিষ্টতার প্রকাশ ঘটে–যা সাহিত্যের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও সাহিত্য ধারাকেই পরিপুষ্ট করে–তেমনই জন্ম জনিত কারণে অপরাধী ঘোষিত মানুষেরা তাদের জীবনযন্ত্রণা প্রেম দ্রোহ প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ নিয়ে যা রচনা করে তাকে অবশ্যই দলিত সাহিত্য বলা যাবে।

এখানে তারা একটি শর্ত দিয়েছেন–দলিত জীবন নিয়ে যে কেউ লিখলেই সেটা দলিত সাহিত্য হবে না। অবশ্যই রচনাকারকে হতে হবে জন্মসূত্রে দলিত পরিবারের সন্তান। আর–ওই, লিখতে হবে দলিত জীবনের ব্যথা বেদনা অনাহার অপমান বিষয়ে। যে কারণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি দলিত সাহিত্য নয়, আর রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত বিনয় মজুমদার নন-দলিত কবি। তার কবিতায় কোন দলিত যন্ত্রণা নেই। আর পদ্মানদীর মাঝিতে যে দলিত জীবন, তা দলিতের মর্যাদা বাড়ায় না।

দলিত বুদ্ধিজীবীদের স্বপক্ষে এটা বলা যায় যে–অদলিত কথাশিল্পীদের কলম থেকে নিম্নবর্নের মানুষের জীবন নিয়ে অনেক উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা হয়েছে, কিন্তু নিম্নবর্গের মানুষকে নিয়ে সেভাবে বিশেষ লেখা হয়নি। এটা একদিক থেকে মন্দের ভালো। কারণ তারা যা রচনা করতেন তাতে দলিত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি দেখা যেত। এমন কি যথার্থ তো নয়ই তার উল্টোটা মনে হতো। পদ্মানদীর মাঝির একটি চরিত্রকেও মহৎ করে গড়তে পারেননি মানিকবাবু। সেকী তিনি সচেতন ভাবে করেছেন? নাকি তার মনের মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা বর্ণবাদী চিন্তা তাকে দিয়ে এসব করিয়ে নিয়েছে? অ-দলিত লেখক এমন ভুল করেই ফেলবেন।

একটি বিশিষ্ট দৈনিক পত্রিকা আমি পড়ি। তাতে মাঝে মাঝে একটা শব্দ দেখি, চুরি চামারি। চুরি চামারির চোটে দেশটা উচ্ছন্নে গেল। প্রায়শই মানুষের মুখে শুনি। তা চুরি তো একটা বাজে কাজ সেটা সবাই মানে। কিন্তু চামারি কাজটা বাজে হল কেন? একজন মানুষ পেটের জ্বালায় চামড়া ছেলে, সেটা কী তার অপরাধ! এমন অপরাধ যা চোরের সমতুল? এই শব্দ অ-দলিত বুদ্ধিজীবীর কলম থেকে বের হয়ে যাবে। কিন্তু কোন দলিত লিখতে পারবে না। একটা বিশাল জনগোষ্ঠিকে অপমান করতে তার দলিত চেতনা তাকে বাধা দেবে।

এই প্রসঙ্গে মুনশি প্রেমাদের কথা বলা যায়। দলিত জীবন নিয়ে উনি যত লিখেছেন ভারতীয় ভাষা সাহিত্যের আর কেউ লিখেছে বলে আমার জানা নেই। ওনার কফন একটি অসাধারণ গল্প। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজে কায়স্থ-দলিত নন, তাই ঘিসু আর মাধব এই দুই পিতা পুত্রের কুৎসিত কদাকার চরিত্রের এমন এক ছবি বানাতে পারলেন। তারা তাদের এক নিকট আত্মীয়ের মৃতদেহ ঢাকবার জন্য কাপড় (কফন) কেনার টাকা যা তারা চেয়েচিন্তে যোগাড় করেছিল, মদ খেয়ে উড়িয়ে দিল। দলিতেরা এমন নিষ্ঠুর অমানবিক হৃদয়হীন নরাধম?

যদি কোন দলিত লেখককে ওই কাহিনী দ্বিতীয়বার লিখতে বলা হয়, সে কোন দিন ওইভাবে কাহিনী শেষ করতে পারবে না। হাত কেঁপে যাবে তার। কারণ দলিত জীবনের যথার্থতা সে নিজের জীবন থেকে জানে। সে লিখবে মাধব আর ঘিসু কফন কিনতে গিয়ে হোটেলের টগবগে ফোঁটা ভাতের গন্ধে বিহ্বল হয়ে পড়ে। মনে পড়ে যাবে তাদের, যে, বহুকাল তারা ভাত পায়নি। তখন একজন আর একজনকে বলবে যে মরে গেছে সে তো গেছে। আয় আমরা একটা দিন বাঁচি। ভাত খাই।

এইজন্য দলিত লেখকেরা অ-দলিত লেখকদের দলিত জীবন বিষয়ক লেখাকে বলে থাকেন সহানুভূতি সাহিত্য। যা সমান অনুভূতি বা দলিত সাহিত্য নয়। মীনাক্ষী দিদি আমাকে সেই সাহিত্যের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন, যা দলিতদের দ্বারা রচিত ও দলিত জীবনের দুঃখ বেদনা সমাজ সংস্কৃতির উপর বিন্যস্ত।

বলি তাকে আমি–আছে। মূলস্রোত থেকে সরে অন্তঃশীলা সে সাহিত্য খুব ধীর গতিতে প্রবহমান। অদ্বৈত মল্লবর্মনের পরে এই সমাজে তেমন কোন শক্তিমান লেখক এখনও আসেনি, গুণমান উৎকর্ষতায় যা বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ স্থান দখল করে নিতে পারে। সেটা পারলে তো আপনি আজ আমাকে এই প্রশ্ন করতেন না। তবে আছে।

বলেন তিনি–এই বিষয়ে তুমি একটা লেখা দিতে পারবে? একটা ভালো কাগজে দেব লেখাটা। পারলে লেখো৷

আমি এর আগে কোনদিন প্রবন্ধ লিখিনি। আত্মকথা লিখেছি গল্প উপন্যাস লিখেছি। একটা দুটো কবিতা ছড়াও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। কিন্তু প্রবন্ধ কখনও নয়। কারণ এতে মৌলিক কিছুতো থাকে না। এখান থেকে খানিকটা ওখান থেকে খানিকটা এনে জুড়ে জুড়ে দেওয়া। আমার কেন জানি না একে কুম্ভীলক বৃত্তি বলে মনে হয়। অপরের শ্রমের ফসল আত্মসাৎ বলে মনে হয়। প্রবন্ধ লিখতে গেলে হীনমন্যতা এসে হাত চেপে ধরে। তাই বলি–চেষ্টা করব। এরপর আমি যারা দলিত বুদ্ধিজীবী তাদের দুতিন জনের সাথে যোগাযোগ করে বলি–এই বিষয়ে একটা লেখা দিন, খুব বড় কাগজে ছাপা হবে। কিন্তু তারা আমার কথার উপর ভরসা রাখতে পারে না।

এইসব দলিত লেখক কবি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আমার পরিচয় অল্পদিনের। আসলে আমি তো এই ফ্রন্টে কোনদিন কাজ করিনি। আমার গল্পের মধ্যে রীবাজ অতিথি সেবা আর উপন্যাসের মধ্যে চন্ডাল জীবন ছাড়া অন্যকোন রচনাকে তো দলিত সাহিত্য বলে ছাপও মারা যাবে না। আমি এতকাল যে ফ্রন্টে কাজ করেছি সে এদের কাছে এক অন্ধকার মহাদেশ। তার বিষয়ে এরা কোন খোঁজ খবর রাখে না, আম্বেদকর জ্যোতিবা ফুলে পেরিয়ার হয়ে কাশীরাম মায়াবতী এই এদের জানার জগত। এরা আমাকে জানে এক গরিব রিকশাঅলা–একটু লেখে টেখে। এদের যদি বলি যে, রাষ্ট্রসংঘের দলিত দাসতা নিধির তিন বছরের জন্য সম্মাননীয় অধ্যক্ষ স্বামী অগ্নিবেশ আমার পরিচিত, তাহলে সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যা বলে ভাববে। এরা তো আমার অতীত জানে না। তাই বিশ্বাস করে না।

এখানে আর একটা কথা বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, কাষ্ট এর মধ্যে ক্লাশ আছে, আবার ক্লাশের মধ্যে কাষ্ট আছে। একদলের কাছে যদি আমি চল বা নমঃশুদ্র বলে ঘৃণার পাত্র হই তবে আর একদল ঘৃণা আর উপেক্ষা দেয় শিক্ষাদীক্ষা হীন গরিব রিকশাঅলা বলে। এই জন্যে দুই দলের কাছেই আমি সমান ব্রাত্য। আমাকে তারাই ভালোবাসে যারা কোন দলের বন্ধনে আবদ্ধ নয়।

তারা যখন কেউ লিখলেন না তখন আমাকেই নেমে পড়তে হল কুম্ভীলকবৃত্তিতে। আট নয় মাস ধরে চেষ্টা করি আমি। প্রচুর বইপত্র ঘেটে প্রায় পঞ্চাশ ষাট পাতার একটা লেখা তৈরি করি। সেটি মীনাক্ষী দিদির হায়দারাবাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলে উনি নিজস্ব একটি ভূমিকার সাথে কেটে ছেটে দশ পনের পাতা ইংরাজিতে অনুবাদ করে পাঠিয়ে যেন বিখ্যাত ইংরাজি পত্রিকা, ইকনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে।

এরপর সেটি অক্টোবরের তের তারিখ দুহাজার সাত এ প্রকাশিত হয়। একটি আমার দ্বিতীয় লেখা যা ইংরাজিতে প্রকাশ হল। পরে সম্পূর্ণ লেখাটি বর্তিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২০১০ উৎসব সংখ্যায়।

এই লেখাটির জন্য কোন পারিশ্রমিক পাইনি। মীনাক্ষী দিদি বলেছিলেন কিছু টাকা দেবেন। জানিনা ই.পি.ডব্লু ওনাকে কিছু দিয়েছিল কীনা। এখন তো মীনাক্ষী দিদি মারা গেছেন। আর কিছু জানাও যাবে না। তবেই.পি.ডব্লুতে লেখাটি প্রকাশিত হবার পর সারা ভারতবর্ষের দৃষ্টি পথে এসে যায় মনোরঞ্জন ব্যাপারীর নাম। দিল্লি হায়দরাবাদ মহারাষ্ট্র বিভিন্ন জায়গা থেকে বুদ্ধিজীবী মানুষের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ আসতে থাকে যোগ দেবার জন্য।

সুদুর কানাডায় বসে ইন্টারনেটে লেখাটি পড়ে কলকাতায় এসে গরু খোঁজার মত আমাকে খুঁজে বের করেন কল্পনা বর্ধন। ইনি সেই কল্পনা বর্ধন যিনি বাংলার এক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্ল বর্মনের শ্রেষ্ঠ রচনাকৃতি–তিতাস একটি নদীর নাম,ইংরাজিতে অনুবাদ করে পৌঁছে দিয়েছেন পৃথিবীর বহু পাঠকের কাছে। তিনি জানান যে–তিনি অক্সফোর্ড প্রেসের পক্ষ থেকে বাংলা সাহিত্য সংকলনের একটা দায়িত্ব পেয়েছেন। তাতে আমার ওই লেখাটি–lts there Dalit writing in Bangla? সন্নিহিত করতে চান। আমি এতে সম্মত আছি কিনা? এ যেন কোন বুভুক্ষকে প্রশ্ন করা সে পোলাও খেতে চায় কীনা। এক মুহূর্ত দেরি করিনি। লিখিত অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। আর সেটি প্রকাশিত হয়ে গেছে।

.

মহাভারতে পড়েছি মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য স্বর্গ থেকে একখানা রথ নেমে এসেছিল পৃথিবীতে। কেমন ছিল সে রথখানা! আমি জানি না। আজ আমার ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়ালো একখানা দুধ সাদা গাড়ি। যেমন গাড়ি চেপে একদিন বস্তার জেলার ঘন জঙ্গল থেকে যাত্রা করেছিলাম দল্লীর দিকে। ভারতবর্ষের উথাল পাথাল এক রাজনৈতিক ইতিবৃত্তের অংশভাগী হতে। আজ আবার সেইরকম আর একখানা গাড়ি এসেছে আমাকে মাটি থেকে মহাকাশে নিয়ে যাবার জন্যে।

।গাড়ি থেকে নেমে এলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সায়ন্তন দাশগুপ্ত। উনি একটি বার্তা নিয়ে এসেছেন হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রধান ডঃ টুটুনমুখার্জীর কাছ থেকে। যিনি পরে আমাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, যে বাংলায় দলিত সাহিত্য বলে যে কিছু আছে তা উনি এই প্রথম আমার লেখার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। তাই তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলা দলিত সাহিত্যের একটি সংকলন প্রস্তুত করবেন। যা ইংরাজিতে অনুদিত হয়ে অক্সফোর্ড প্রেস দ্বারা প্রকাশিত হবে। এবং উনি না বললেও এটা বোঝা যায় সেটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে। তাই আমার সহযোগিতা চাই।

প্রত্যেকটা মানুষ একদিন মারা যাবে। মারা আমিও যাবো। কিন্তু মৃত্যুর পরও বহু বহু বছর বেঁচে থাকবে আমার কীর্তি। একেই তো অমর হওয়া বলে। এ লোভ আমি পরিত্যাগ করতে পারি? তাই বলে দিই ওনাকে, এই কাজের জন্য আমার সর্বতো সহযোগিতা থাকবে। এ আমার প্রাণের বড় আরামের কাজ।

এরপর উনি আমাকে কোঅর্ডিনেটর হিসাবে যুক্ত করে নিলেন ওই কাজে। যে আমি জীবনে কখনও স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোইনি–আকাট মূর্খ, সেই আমাকে যাদবপুর, দিল্লি, আসাম এর শিলচর, আর হায়দরাবাদ চার বিশ্ব বিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের চার অধ্যাপক, এদের নিয়ে গড়া এক কমিটিতে সমমর্যাদায় স্থান দেওয়া হল। আমার উপর ভার রইল বাংলা দলিত সাহিত্য সংকলনটির।

একজন তুচ্ছ নগণ্য মানুষ। সে কী কোনদিন ভাবতে পেরেছিল তার জীবদ্দশায় কোনদিন এতবড় প্রাপ্তি ঘটবে। এই সম্মান–এই প্রাপ্তি, আমার তো মনে হয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান এক পুরস্কার। এর চেয়ে বড় আর কী হয় তা আমার জানা নেই।

.

এবার একটি ছোট্ট গল্প। গল্পটি মহাভারতের। পঞ্চ পান্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া ধরেছে বালক বব্ৰুবাহন। সেই নিয়ে তার ও অর্জুনের মধ্যে মহাযুদ্ধ। অর্জুন বাণ নিক্ষেপ করল বব্ৰুবাহনের রথে। বাণের ধাক্কায় সে রথ ছিটকে গিয়ে পড়ল চল্লিশ যোজন দুরে। কী আর করে বালক বব্ৰুবাহন। সে ধীরে ধীরে ফিরে এল রণভূমিতে। এবার সে একটা বান ছুড়ল অর্জুনের রথে। রথ তিন পা পিছনে সরে গেল। শ্রীকৃষ্ণ হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করলেন বালককে–সাবাশ বীর।

তখন অর্জুন ক্ষুণ্ণ মনে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন–আমি ওর রথ চল্লিশ যোজন দূরে ফেলেছিলাম, আমাকে ধন্যবাদ দাওনি। ও আমার রথ মাত্র তিন পা সরিয়েছে, ওকে ধন্যবাদ দিলে।

তখন বলেন শ্রীকৃষ্ণ–ওর রথে কে আছে আর কী আছে! ওই রথ চল্লিশ কেন চারশো যোজন দূরে ফেলাও কোন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু যে রথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব ভার নিয়ে আমি বসে আছি, এই রথকে এক চুল নাড়ানো সহজ নয়। এ তিন পা সরিয়েছে। ধন্য বালকের অস্ত্র শিক্ষা।

যারা বিদ্বান, বিদ্যার্জনের জন্যে পান অফুরন্ত অবসর, তারা তো উন্নত উৎকৃষ্ট মহৎ আর অজস্র রচনা করবেনই। তা না করাটাই তো আশ্চর্যের, কিন্তু কিছু না শিখে না জেনে বাইরে যখন অসহ্য উত্তাপ, সেই উত্তাপকে আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলে আমার কর্মস্থলের আগুন সেই অবস্থায় যতটুকু যা করেছি একটা হাততালি কী আমি পেতে পারি না? ওই হাততালির মূল্য আমার কাছে অনেক বড়।

আমার একখানি উপন্যাস যা আমাকে সবচেয়ে খ্যাতি সম্মান ও লেখক পরিচিতি দিয়েছে–তার নাম চন্ডাল জীবন। এটি এক সময় বহুজন নায়ক পত্রিকায় জীবন চন্ডাল শিরোনামে কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাখানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাকি অংশ অপ্রকাশিত পড়ে থাকে বহু বছর।

শেষে একদিন ছুটে যাই তার কাছে, যার কাছে যাওয়া যায়। ইনি আমার প্রণবদা। হাটে বাজারে পত্রিকার সম্পাদক। যে চন্ডালের কথা আমি লিখেছি–মাত্র তার চব্বিশ পঁচিশ বছরের বিচ্ছিরি বিড়ম্বনাময় ঘটনা দুর্ঘটনা বহুল জীবন কথার পাণ্ডুলিপি দেখে মুষড়ে পড়েন প্রনবদা। এটা ছাপালে পত্রিকায় অন্য লেখকদের লেখা রাখার জায়গা থাকবে না। কিন্তু আমার আবদার–অনুরোধ–দাবি–সেটাও তার পক্ষে এড়ানো কঠিন–সেই যে স্নেহ ভালোবাসা বলে কী সব আছে! সেটা আমার প্রতি প্রণবদার ভান্ডারে অনেক বেশি।

তাই পরামর্শ দেন তিনি–খন্ড খন্ড করে ফ্যাল। প্রতি খন্ড এমন ভাবে শেষ কর, যেন তাতে একটা সুন্দর সমাপ্তি থাকে। এরপর কী? পাঠকের কৌতূহল থাকুক, কিন্তু কোনভাবে যেন বোঝা না যায়-অসমাপ্ত হয়ে গেছে।

তাই করি আমি। একটাকে ভেঙে চারটে বানাই। তারপর চার বছরের চারটে হাটে বাজারে পত্রিকার পূজা সংখ্যায়-চন্ডাল জীবন, আবার চন্ডাল জীবন, এই জীবন সেই জীবন, এবং নরকের এক জীবন, নামে প্রকাশিত হয়ে যায়।

এরপর আর সেই চন্ডালের জীবন কাহিনী লেখার কোন দরকার নেই। নরকের যে জীবন সে স্বর্গের দিকে, মুক্ত মানুষের বাসভূমি থেকে প্রাচীর ঘেরা জেলখানার দিকে যাত্রা করে গেছে। যখন সে জেলখানা থেকে বাইরে আসবে আর চন্ডাল নয়। এখানে রাগ শব্দের অর্থ চন্ডাল ধরা হচ্ছে। এরপর সে তত শুধু জীবন। যার কাহিনী রত্নাকরের মৃতদেহের মধ্যে থেকে বাল্মিকীর বেঁচে ওঠার কাহিনী। যা আমি এই কাহিনীর মধ্যে লিখে ফেলেছি।

ওটি উপন্যাস–এটি আত্মকথন। দুটি কাহিনীর মর্মবস্তুতে মিল থাকলেও গরমিল আছে উপস্থাপনায় বর্ণনায়। উপন্যাসকে উপন্যাস বানাবার প্রয়োজনে যেটুকু কারিকুরি দরকার তা করা হয়েছে। ফলে আগের কথা পরে-পরের কথা আগে এমন হয়েছে। তবে সব কথার সার কথা–এ দুটোতে সাহিত্য কতটা আছে তা কে জানে, কিন্তু সত্য আছে। উলঙ্গ নির্ভেজাল কঠিন সত্য।

হাটেবাজারে পত্রিকায় চন্ডাল জীবন প্রকাশিত হবার পরে, পাঠকদের মধ্যে একটা প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হল এটাকে পুস্তকাকারে প্রকাশ করতে পারলে খুব ভালো হয়। কিন্তু এই ব্যয়বহুল দায়িত্ব কে নেবে। তখনই মনে পড়ল মনোজদার কথা। মনোজদা মানে প্রিয়শিল্প প্রকাশন-এর কর্ণধার মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি আমার ‘অন্য ভুবন’ উপন্যাসখানি ছেপেছিলেন।

অল্প কিছু টাকা যোগাড় করে সেটা নিয়ে শরণাপন্ন হই মনোজদার–চন্ডাল জীবন-এর প্রথম ভাগটা আপনাকে ছাপতে হবে। যতটুকু পেরেছি দিলাম আর এখন কোনো টাকা দিতে পারব না সে দেব বই বিক্রি করে।

দাবি মেনে নেন উনি। এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দেন–আর কেউ নয় সাহিত্য জগতের হিমালয় প্রতিম সাহিত্যিক-মহাশ্বেতা দেবী। উনি লেখেন, লেখেন–উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক-অশ্রুকুমার সিকদার, বাংলাদেশের বিতর্কিত লেখক সালাম আজাদ আর লেখেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাস। অচিন্ত্য বিশ্বাস শুধু লেখকই নন, একজন সমালোচকও।

চণ্ডাল, এই কথাটির অর্থ ভারতীয় বর্ণ ব্যবস্থায় সর্বনিম্নে অবস্থিত সেই মানুষ, যাকে সমাজ-ধর্ম ঘোষণা করেছে অচ্ছুত অস্পৃশ্য ঘৃণা করার যোগ্য এক মানবেতর জীব বলে।

চণ্ডাল শব্দের আর একটি অর্থ–ভয়ংকর রাগ। বলাই তো হয়ে থাকে রাগ-চণ্ডাল। তাহলে চণ্ডাল জীবন কথার অর্থ দাঁড়াচ্ছে–একটা অচ্ছুত অস্পৃশ্যের গোটা জিয়কাল, অথবা একটা রাগী মানুষের জীবনযাপন প্রণালী।

চণ্ডাল জীবন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র একাধারে দুই-ই। সে জন্ম জনিত কারণে অচ্ছুত অস্পৃশ্য ও স্বভাবজাত কারণে ভীষণ রকম ক্রোধী। যে ক্রোধের কারণও হয়তো সুপ্ত রয়েছে এই অমানবিক সমাজের অন্দরে। সেটা খুঁজে দেখবেন বিবেচক পাঠক। হয়তো প্রতিকারের বিষয়ও। কেউ ভাববেন।

জীবন দাস কোনও কল্প কাহিনীর নায়ক নয়। সে এই দেশ সমাজ সময়ের এক জিয়ন্ত জীবন্ত মানুষ ছিলো। ছিলো বলছি, কারণ সে এখন আর নেই। যাকে আমি চিনতাম। এবং যাকে আমার মতো গভীরভাবে অন্য কেউ চেনেনা। এই দাবি আমিই করতে পারি। যদিতাকে পাঠকের দরবারে বিচারার্থে যথাযথ উপস্থাপন না করতে পেরে থাকি সে আমার দুর্বল লেখনি, আমার ক্রটি।

আমার মুখে শুনে শুনে আকাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিতা সাহিত্যিক অলকা সারাওগী তার বিখ্যাত হিন্দি উপন্যাস “কোই বাত নেহী” তে জীবন চণ্ডালের জীবনের কিছু খণ্ড ছবি এঁকেছিলেন। আমার ইচ্ছা এই অদ্ভুত রকমের বিচিত্র মানুষটির পূর্ণাঙ্গ জীবনকাহিনী লিপিবদ্ধ করে রেখে যাবার, সে বেঁচে ছিল শুধুমাত্র মরে যাবার উদগ্র কামনা বুকে নিয়ে। এবং যে মরে গেছে বেঁচে থাকার ভীষণ অভীপ্সায়।

.

২০১১ সালের ২৭ শে নভেম্বর, রাত তখন মনে হয় আট কি সাড়ে আটটা। ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল আমার মোবাইল। ফোন তুলে জানলাম যিনি ওপারে আছেন তিনি মনোহর মৌলি বিশ্বাস।

বলেন তিনি–মনোরঞ্জন, আগামী ২৯ ও ৩০ তারিখে যাদবপুরের ইন্দুমতী সভাগৃহে যে সর্ব ভারতীয় দলিত সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে–তুমি কী তার আমন্ত্রণ পত্র পেয়েছো?

বলি না তো। আমি তো জানিই না যে ওখানে কিছু হবে।

সায়ন্তন বাবু তোমাকে বলেননি! উনি তো একটা পেপার পড়বেন যাতে তোমার লেখা নিয়ে ঐ সম্মেলনে আলোচনা হবে।

একটু ভেবে বলি–হয়ত বলবেন। এখনও তো সময় আছে।

বলেন তিনি–তুমি যখন জানো না একটু বুঝিয়ে বলি, এটা যাদবপুর হলেও, সম্মেলনটা করছে যোগেশ চন্দ্র চৌধুরি কলেজের ইংরাজী বিভাগ আর পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য সংস্থা। এর ব্যয়ভার বহন করছে ইউ.জি.সি। মানে ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন। বলতে গেলে এটা খুব বড় মাপের প্রোগ্রাম। দলিত সাহিত্য নিয়ে এরকম প্রোগ্রাম পশ্চিমবঙ্গে আগে আর হয়নি। তুমি কী ওইদিন যেতে পারবে? যদি যাও আমার কাছে আমন্ত্রণ পত্র আছে। আমি তোমাকে একটা দুটো দিতে পারব। সকাল সাড়ে নটা থেকে অনুষ্ঠান। ওখানে গিয়ে আমাকে একটা ফোন কোরো, আমি গেটে আমন্ত্রণ পত্র দিয়ে আসব। গেট পাশ না থাকলে ঢোকা যাবে না।

আজ রবিবার। অর্থাৎ ঊনত্রিশ তারিখ পড়বে মঙ্গলবার। ওইদিন আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অন্য কোন দিন হলে যেতে পারতাম কী না কে জানে তবে ছুটির দিন যখন, যাওয়া যায়। এই তো কাছেই। বাসে পাঁচ টাকা ভাড়া মাত্র।

কিছুক্ষণ পরে কী ভেবে কে জানে, ফোন করলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক সায়ন্তন দাশগুপ্তকে–দাদা, খবর পেলাম যাদবপুরের ইন্দুমতী সভাগৃহে একটা সর্বভারতীয় দলিত সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। মনোহরদা ফোন করেছিলেন।

ধীর গলায় বলেন তিনি–আপনি যাচ্ছেন নাকি?

-–ভাবছি যাব। শুনলাম আপনি নাকি একটা পেপার পড়বেন।

–হ্যাঁ, পড়ব।

–ওটাই শোনবার জন্য যাব। যেতে পারতাম না, মঙ্গলবার হওয়ায় পারব।

বলেন তিনি–আমি আপনাকে বলতাম।বলিনি, কারণ পুরো প্রোগ্রামটা তো হবে ইংরাজিতে। আপনি তো…হয়ত বোর হয়ে যাবেন।

বলি–কিছু বুঝি আর না বুঝি–তবু যাব। আপনি যখন পেপার পড়বেন শ্রোতাদের কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটা তো দেখতে পারব।

যথারীতি ২৯শে নভেম্বর সকালে দাড়িটারি কেটে চানটান করে গিয়ে পৌঁছালাম যাদবপুরের সেই সভাগৃহের সামনে। আমার কোন আমন্ত্রণ নেই, সম্পূর্ণ অনাহুত, গেটের সামনে যেতে একটু সংকোচ হচ্ছে। একটু ভয় ভয়। এটা নতুন নয়, সবদিনই শিক্ষিত-বিদ্বান লোকদের সামনে যেতে আমার হাত পা গলা বুক সব কঁপে। বিশেষ করে যারা অধিক ইংরাজি জ্ঞান সম্পন্ন তাদের ডরাই বাঘের চেয়ে বেশি।

ফোন করি মনোহর মৌলি বিশ্বাসকে–দাদা আমি এসে গেছি। গেটে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে নিয়ে যান।

বলেন তিনি আমার যেতে হবে না, তুমি সোজা চলে এসো।

–যদি গেটে আটকায়?

–আটকাবে না। বলবে, অনুষ্ঠানে যাব। দলিত সাহিত্য সংস্থার সদস্য।

–তবু–যদি যেতে না দেয়।

–তখন আমাকে ফোন কোরো।

আটকাল না। তবে জিজ্ঞাসা করল–কোথায় যাব। আর আমার যা ভয়, সেই কটমটে ইংরাজি ভাষায়। ভাষার কিছু বুঝিনি, ভাবনার বুঝেছি। তাই জবাব হয়েছিল শুদ্ধ ভেজালবিহীন বাংলা ভাষায়–এই অনুষ্ঠানে যাব।

গেট থেকে একটা অল্পবয়সী মেয়ে–মনে হয় ছাত্রী, আমার আগে আগে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছে বসবার আসন দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। সেই যেমন বহুকাল আগে বিনাটিকিটে ট্রেনে চেপে কাচুমাচু মুখ নিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসতাম, সেভাবেই নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম ভিড়ের মধ্যে।

খুবই ভিড় হয়েছে সভাগৃহে। হিন্দিতে যাকে বলে–খচাখচ ভরা–একেবারে তাই। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে মোমবাতি জ্বালানো রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সম্মানীয়দের বরণের পরে শুরু হয়ে গেল মূল অনুষ্ঠান। যার সঞ্চালক এবং মুখ্য উদ্যোক্তা যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী কলেজের ইংরাজীর অধ্যাপক জয়দীপ ষড়ঙ্গী। সর্বপ্রথম বলতে উঠলেন তিনি। জানতাম বক্তৃতার একবর্ণও আমি বুঝব না। আমার অবস্থা এখানে–মধু রাখা কাঁচের বয়মের উপর বসে থাকা মাছির মতন। তবু তাকিয়ে ছিলাম মঞ্চের দিকে। উকর্ণ হয়েছিলাম–যদি কোন প্রিয়–পরিচিত শব্দ ভেসে আসে।

এল। এল একেবারে অনুষ্ঠান শুরুতেই, যা আমার দূরতম কষ্ট কল্পনাতেও ছিল না। যা আমার কাছে একেবারে বারুদ আর বাঁশরির শব্দ আর সুরের সংমিশ্রণে সৃষ্ট এমন এক বিদ্যুৎ চমক যে পা থেকে মাথা পর্যন্ত গোটা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল আমার।

কী বললেন অধ্যাপক ষড়ঙ্গী, আমরা কেউ আগে জানতাম না যে পশ্চিমবঙ্গে দলিত সাহিত্য আছে। মহারাষ্ট্রে গুজরাটে আছে–জানতাম। বাংলায় আছে–জানতাম না। গত ১৩ই অক্টোবর ২০০৭ ই.পি. ডব্লিউতে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর একটা লেখা প্রকাশিত হয়, যার অনুবাদ করেছেন অধ্যাপিকা মীনাক্ষী মুখার্জী। সেটা পড়বার পরে জানলাম যে আছে। বাংলাতেও দলিত সাহিত্য আছে। তার ফলেই বাংলা দলিত সাহিত্য বিষয়ে একটা সম্মেলন করার ভাবনা মাথায় আসে। বাংলা এবং অন্যান্য ভারতীয় দলিত সাহিত্য। যার ফলশ্রুতিতে আজকের এই সম্মেলন। এটাই কী বলেছিলেন?

আমি জানি না। কারণ পুরো বক্তৃতাটা তো ছিল ইংরাজিতে–যা আমার কাছে ‘গোণ্ডি বুলি’-র চেয়েও দুর্বোধ্য। তবে মনোরঞ্জন, মীনাক্ষী মুখার্জী আর ইপিডব্লিউ এই তিনটে কথা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। যার ফলে উনি কী বলতে পারেন সেটাও অনুমান করে নিতে অসুবিধা কোথায়?

যখন জয়দীপ ষড়ঙ্গী মঞ্চ থেকে নিচে নামলেন আমি সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম–দাদা, এই যে আমি। মনোরঞ্জন ব্যাপারী।

ওনার চোখে মুখে বিপন্ন বিস্ময়–আপনি মনোরঞ্জন ব্যাপারী।

–আমিই—

–মীনাক্ষী মুখার্জী আর আপনি মিলে ওই কাজটা করেছিলেন?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা করেছিলাম।

আমি করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে ছিলাম। উনি আমাকেই বুকে টেনে নিলেন। জড়িয়ে ধরলেন–আপনার সাথে যোগাযোগ থাকবে। আরো অনেক কাজ করতে হবে। সবে তত পথ চলা শুরু।

আমি আবার গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লাম। দেখলাম–জয়দীপ ষড়ঙ্গী দূর থেকে জনে জনে–আমাকে দেখাচ্ছেন–ওই যে। মনোরঞ্জন ব্যাপারী।

প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান শেষ হল। হঠাৎ আমার পিছন থেকে একটি সুরেলা কণ্ঠের সংকোচপূর্ণ মৃদু জিজ্ঞাসা–আপনি মনোরঞ্জন ব্যাপারী?

পরে জেনেছি ওই কণ্ঠের মালিকের নাম–অঙ্গনা দত্ত।

মাথা নাড়ি আমি–হ্যাঁ-আমি।

বলে সে–আজই সকালে আপনার কথা হচ্ছিল। স্যার বলছিলেন।

পাশ থেকে এবার-আবার একটি পুরুষ কণ্ঠ ওই একই প্রশ্ন করেন–আপনি মনোরঞ্জন ব্যাপারী? আবার মাথা নাড়ি আমি, হ্যাঁ আমিই সেই। বলেন তিনি–আমার নাম সঞ্জয় কুমার, দিল্লি থেকে আসছি। একটু থেমে ফের বলেন–আমি আপনার ‘রীবাজ’ গল্পটা হিন্দিতে অনুবাদ করেছিলাম। কথাদেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

বলি-হা মনে পড়েছে, এক দুবার ফোনেও আপনার সাথে কথা হয়েছিল। চাক্ষুষ দেখা এই প্রথম।

বলেন তিনি–আমি আপনার চণ্ডাল জীবন হিন্দিতে অনুবাদ করতে চাই। বইখানা কোথায় পাবো। এখানে কী আছে?

বলি–আমি আপনাকে এনে দেব।

দ্বিতীয় পর্বে চারজন পেপার পড়বেন। সবার শেষে সায়ন্তন দাশগুপ্ত। আর কী আশ্চর্য উনি পড়বেন সেই ‘রীবাজ’সহ আর এক দুটি আমার লেখা বিষয়ে। উনি রীবাজ গল্পের ইংরাজি অনুবাদ করেছেন, অক্সফোর্ড প্রকাশনার দলিত সাহিত্য সংকলনে দেবেন বলে।

কী তিনি পড়লেন আর কী তিনি বললেন সে আমি কী করে বুঝব! বুঝেছেন সঞ্জয় কুমার। উনিও যে লেখাটা অনেকবার পড়েছেন। পেপার পড়বার পরে যখন শুরু হল প্রশ্ন-উত্তর পর্ব, সঞ্জয় কুমার আর সায়ন্তন দাশগুপ্ত দুজনের বেশ অনেকক্ষণ ধরে তা নিয়ে চলল কথপোকথন। শব্দ ছোঁড়াছুড়ি। মজার ব্যাপার সমগ্র অনুষ্ঠানে আমি একটা বিরাট জায়গা জুড়ে ছিলাম। অথচ আমি ছিলাম না। থাকার কথাই ছিল না আমার। আমার কোন আমন্ত্রণই তো ছিল না।

এরপর অনুষ্ঠান শেষ হলে একটা ফাইল পেলাম। আর ফাইলে কিছু ছাপানো কাগজপত্র। অতিথি যারা আগে পেয়ে গেছে ফাইল–অনাহুত আমি পরে। আমি অন্ধ দেখতে পাইনা। যারা চক্ষুষ্মন সেই কাগজপত্রে চোখ বুলিয়ে অনেক জায়গায় লেখা পেয়ে গেল আমার নাম।

অনুষ্ঠান শেষ হবার পর হেঁটে হেঁটে এসে দাঁড়ালাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে–যেখানে একদিন আমি রিকশা চালাতাম।

সেই রিকশা লাইনটা আজও আছে। শুধু আমি আর নেই। এখান থেকেই আমার যে রিকশার চাকা গড়াতে শুরু করেছিল তা আজ গড়িয়ে গড়িয়ে পৌঁছে গেছে ইন্দুমতী সভাগৃহে। আরো অনেক পথ যেতে হবে।

***

দুহাজার দশ সালের মাঝামাঝি থেকে দুহাজার এগারোর মাঝামাঝি এই সময়কালটা মোটেই ভালো যাচ্ছিল না। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি না, আমি আমার নিজের কথা বলছি। পশ্চিমবঙ্গ তো তখন যেন রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছিল এক নতুন ভবিষ্যকাল প্রসবের দিকে। সেই যন্ত্রণা তাকে তো মেনে নিতেই হবে। সমস্ত নব জনমের এটাই আগমন পূর্ব–শর্ত। একে এড়িয়ে যাবার কোন পথ প্রকৃতি খোলা রাখেনি।

“মানুষকে কখনও অবজ্ঞা করতে নেই”। মানুষের ক্ষমতাকে কখনও ছোট করে দেখতে নেই। পেটে ভাত, পায়ে চপ্পল, গায়ে জামা, মাথায় তেল না থাকা তৃণাদপি’ এই যে মানুষ–এরা একতাবদ্ধ হয়ে ভয়কে জয় করে উঠে দাঁড়ালে পৃথিবীর সব ইতিহাস ওলোট পালট করে দিতে পারে, রাজপ্রাসাদ থেকে হিড়হিড় করে টেনে এনে পথের ধুলোয় গুড়ো করে মিশিয়ে দিতে পারে স্বৈরাচারী দাম্ভিকদের। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার ফলে সেটা ভুলে গিয়েছিল লাল পার্টির লোকজন। মুখ অহম জিরাফ হয়ে উঠেছিল মনে–উত্তরের পাহাড় থেকে দক্ষিণে সাগর–সব আমার গোলাম। আমি যদি বলি দাঁড়িয়ে থাক–দাঁড়িয়ে থাকবে, যদি বলি বসে পড়–বসে পড়বে। এই সীমাহীন ঔদ্ধত্যে তারা আয়লাঝড়ের মতো গিয়ে আছড়ে পড়েছিল গ্রামবাংলার গরিব জনজীবনের উপর। তোর ওই জমি মন্দির মসজিদ খেলার মাঠ স্কুল হাসপাতাল পুকুর, তোর সভ্যতা, সংস্কৃতি নিরাপদ জীবন, স্বাধীনসত্তা–সব আমাকে দিয়ে দে। একদম কাঁদবি না, মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বল–হীরকের রাজা ভগবান, তিনি যা করেন সব আমার মঙ্গলের জন্য। যদি তা না করিস তোর মেয়েকে, তোর বউকে, তোর মাকে–জানিস তো, প্রণাম করে দেব। প্রণাম বুঝিস? আমাদের শক্তিশালী প্রণব ব্রিগেড আট থেকে আশি কাউকে ছাড়ে না।

সেই ভয়কে জয় করে যেদিন মানুষ উঠে দাঁড়াল, শাসনক্ষমতার অলিন্দ থেকে চোখ মুছতে মুছতে বিল্টুদায় হয়ে গেল আবর্জনা সমতুল্য অপশাসনের আমদানি কারি চৌত্রিশ বছরের শাসকদল, সেই ইতিহাস তো সবারই জানা। জানা নেই তাদের সরিয়ে দিয়ে আজ যাদের হাতে নিজের শুভাশুভের ভার সমর্পণ করা হল তার ভূমিকা কী হবে। তবে এটা ঠিক যে মানুষ যদি এদের উপর তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ না রেখে আবার শীত ঘুমে চলে যায়–ক্ষমতার যা ধর্ম, এদেরও দূষিত করে দেবে। ঘুম শেষে চোখ মেলে দেখবে মানুষ আর এক দৈত্যে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তারা যাদের প্রতিশ্রুতি ছিল মা মাটি মানুষের মঙ্গলের।

কী হবে না হবে সেটা ভোলা থাক ভবিষ্যৎ কালের জন্য। আমি আমার কথা বলি।

ওই দু হাজার দশের মাঝামাঝি থেকে এগারোর মাঝামাঝি বারো মাসে তিনবার তিন তিনটি শারীরিক অসুবিধায় পড়ি। প্রথমবার আমার একটি চোখের ছানি অপারেশন করাতে হয়। পরের বার হয়ে যায় জলবাহিত রোগ জন্ডিস। আর তার পরেরবার আমার কর্মস্থলে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মারাত্মক ভাবে পুড়ে যাই।বুক পেট গরম জলে ঝলসে যায় আমার। সেই বছর তিরিশ পঁয়ত্রিশ আগে একবার পুড়েছিল শরীরের ডান দিক, এবার গেল বাঁদিক। দু’দুবার জীবন্ত দগ্ধ হলাম জীবনে।

তবে যারা আমার জীবনী পড়েছেন নিশ্চয় জেনে গেছেন আমার জীবনের সব দুঃ সময়-পরবর্তীকালে বদলে গেছে সুন্দর সময়ে কিছুই ছাড়িনি আমি সব দুঃখ কষ্টঅপমান অত্যাচার যা জীবনকে একদা দুর্বিষহ নরকতুল্য বানিয়ে দিয়েছিল, তাকে নিংড়ে আদায় করে নিয়েছি যথার্থ মূল্য। আজ আর আমার বিগত দিনের প্রতি কোন ক্ষোভ দ্বেষ নেই। যে জীবন যাপন করেছি, যে দুঃখ কষ্ট অপমান সইতে হয়েছে তা আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এসেছে অনেক অনেক রসদ। তা না হলে আমি কী লেখক হতে পারতাম?

পশ্চিমবঙ্গে আমার এমন কোনো আত্মীয় নেই যাদের সাথে কোনো রক্তের সম্পর্ক আছে। তবে আমি আত্মজন বিহীন আত্মীয়তা হীন মোটেই নই। এখানে রয়েছে অগণন আপনজন, যাদের সঙ্গে আমার আত্মার এবং আদর্শের সম্পর্ক যা রক্তের স্পর্কের চেয়ে অনেক গুণ মজবুত। যে কারণে যারা আমার প্রতিপক্ষ–শত্রু ভাবাপন্ন, বিশেষ একটা ক্ষতি এখনও করে উঠতে পারেনি। অজস্র সৎ সাহসী সমাজ-সচেতন মানুষ নিজেরা এগিয়ে এসে আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে বন্ধুত্বের হাত। জড়িয়ে ধরেছে বুকে উষ্ণ আলিঙ্গনে। যাদের কাছে আমি চিন্তা চেতনা শিক্ষাদীক্ষা আর্থ সামাজিক ও আভিজাত্যে তৃণদপি তুচ্ছ। তবু সেই মানুষরা আমাকে স্নেহ করেন, ভালোবাসেন। এটা আমার একটা পরম প্রাপ্তি।

এইরকম এক বন্ধুর নাম জয়ন্ত ঘোষাল। থাকেন ব্যারাকপুরে। উনি শূন্যদশক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সুলেখক।

উনি একদিন অসম্ভব উৎপীড়ন শুরু করে দিলেন আমার উপর। কী? না আপনার আত্মজীবনীটা লিখে ফেলুন।

জয়ন্তদা ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ। উনি ওনার বিশেষ পরিচিত একনামি প্রকাশকের বিশ্বাস পদবি দেখে বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন যে আমার জীবনী সে ছাপবে। কথা যখন দিয়েছে।

আমিও এক বিশ্বাসকে বিশ্বাস করে যে ভুল করেছিলাম সেই একই ভুল জয়ন্তদাও করে বসলেন। আর আমাকে তাগাদার পর তাগাদা দিয়ে অস্থির করে তুললেন–লিখুন। যত তাড়াতাড়ি পারেন লিখে শেষ করুন।

বহুকাল আগে পৃথিবীতে এসেছি। সেই যখন অষ্টগ্রহ নামে কী এক বিঘটন ঘটেছিল সৌরমন্ডলে। শোনা গিয়েছিল সেইদিনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আজব ব্যাপার–সব আশঙ্কা ব্যর্থ করে পৃথিবী বেঁচে গেছে। আমিও সব সম্ভাবনা ব্যর্থ চলে যাওয়ায় আজও বেঁচে রয়েছি। অনাবশ্যক–অনেক বছর।

আর এই বেকার বর্ধিত আয়ুর কারণে জীবনের সাথে যুক্ত হয়ে গেছেকত যে কাহিনি উপাখ্যান ঘটনা দুর্ঘটনা। সে সব কী এত তাড়াতাড়ি লিখে ফেলা যায়! সব কথা কী অকপটে বলা চলে? আমার লেখা শব্দরা আমার বিরুদ্ধে সাপের মতো ফণা তুলে দাঁড়ালে তখন কী হবে? তা ছাড়া তেমন বিশদ ও বিস্তারিত লিখব যে, আমার জীবনে এত সময় কই!

কে যেন বলেছেন-যদি তুমি কোন কিছু আন্তরিকভাবে চাও, সমস্ত মহাবিশ্ব সেটি তোমার কাছে পৌঁছে দিতে সক্রিয় হয়ে উঠবে। ঠিক জানিনা আমি আন্তরিক ভাবে একটু লেখার সময় সুযোগ চেয়েছিলাম কিনা, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম মহাবিশ্ব সক্রিয় হয়ে উঠেছে সেটি আমার নাগালে এনে দিতে। হঠাৎ আমার জন্ডিস হয়ে গেল। এরই নাম ভাগ্য। সারা জীবনে কত অখাদ্য কুখাদ্য পচা বাসি খেয়েছি, কোনোদিন কিছু হয়নি। সেদিন এক গেলাস জল খেয়ে শুয়ে পড়তে হল বিছানায়।

জন্ডিস এত অতি তুচ্ছ রোগ। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের ক্যাম্পে কারও জন্ডিস হলে ওঝা একটা মালা পরিয়ে রুগীকে শুইয়ে রাখে, দিন কয়েক পরে সে ভালো হয়ে যায়। এই প্রথম। শুনলাম যে এটি একটি এমন রোগ যে, ধরলে আর রক্ষা নেই।

এমনিতে আমি নিজেকে যথেষ্ট সাহসী বলে মনে করি। কিন্তু যারা আমাকে ভালোবাসে জীবিত দেখতে চায়, তাদের চোখে মুখে, চাল চলনে, কথাবার্তায়, তৎপরতায় ভীষণ ভীতি কামড়ে ধরেছিল আমার সাহসের ভিত্তিমুল। মনে হচ্ছিল এবার আমি যাচ্ছি।

একদিন এক সকালে একটা ফোন এল আমার মোবাইলে ফোন করেছেন জয়ন্তদা-কী হল মনোরঞ্জনদা? আপনাকে যে বলেছিলাম জীবনীটা লিখে ফেলুন কতদূর কী করলেন?

জবাবে বলেছিলাম–দাদা, এখনও ওটায় হাত দিতে পারিনি। শরীরটা একটু খারাপ। সেরে উঠেই লেখাটা নিয়ে পড়ব।

কী হয়েছে?

কিছু না। এই একটু জন্ডিস।

চমকে উঠলেন তিনি কী বললেন। একটু জন্ডিস? যার নাম জন্ডিস সেটা একটু হয় কী করে! খুব সাবধান, একদম হেলাফেলা করবেন না। রোগটা কিন্তু মারাত্মক।

এরপর যা হল সে আর বলার নয়, জয়ন্তদা থেকে মধুময় পাল, মধুময় পাল থেকে বাবলাদা, বাবলা দা থেকে সন্দীপদা, সন্দীপদা থেকে যোগেন দা, যোগেনদা থেকে অলকাদিদি, অশোকজি, কাজলদাসের পুরো টীম খবর পেয়ে গেল মনোরঞ্জন মারাত্মক অসুস্থ। আর যায় কোথায়, সবাই প্রায় পাগলের মতো ছুটে আসতে লাগল–দূর দুর্গম পথ পেরিয়ে ক্ষুদেরাবাদে –আমার বাসায়, আর্থিক সহায়তা নিয়ে। তাদের কষ্ট দেখে আমারই কষ্ট হতে লাগল অসুখের কষ্টের চেয়ে অধিক। প্রায় পঁচাশি ছিয়াশি বছরের বৃদ্ধ অসুস্থ অশোকজি তিনিও এসেছেন আমাকে দেখতে। মনটা কৃতজ্ঞতায় নুয়ে গেল আমার

আমাদের এলাকায় কোনো ভালো ডাক্তার নেই। সবাই হাতুড়ে, আমার শুভানুধ্যায়ী-আত্মজনদের আশঙ্কা এই চিকিৎসায় সেরে ওঠা কঠিন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিৎ। প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে বটে এতে কাজের কাজ হচ্ছে না।

আমি ঠিক জানি না কে যেন আমার খবর ফোন করে মহাশ্বেতা দেবীকে জানিয়ে দেয়। তিনি ফোন করেন আমাকে–কী তোর জন্ডিস হয়েছে নাকি! দেবপ্রিয় মল্লিককে ফোন কর। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যা।

যে ফোন নাম্বার তিনি দিয়েছিলেন সেটায় ফোন করে পেয়ে গেলাম ডাক্তার দেবপ্রিয় মল্লিককে। বলেন তিনি, পিজিতে চলে যাও। তারপর দেখছি।

ওনার কথামত পরের দিন সকালে পিজি হাসপাতালে পৌঁছে আবার ফোন করলাম ডাক্তার মল্লিককে–পৌঁছে গেছি। তিনি অন্য এক ডাক্তারের নাম বলে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম-বলতে পারেন অমুক ডাক্তারকে পাবো কোথায়?

বলেন তিনি–সে তো আসেনি। তার কাছে কী দরকার?

বলি–ডাক্তার দেবপ্রিয় মল্লিক দেখা করতে বলেছেন। সেই অচেনা ভদ্রলোক–ডাক্তারই হবেন হয়তো নিজেই আমাকে নিয়ে গেলেন আর এক ডাক্তারের কাছে, পরে জেনেছি উনি ডাক্তার জয়ন্ত দাশগুপ্ত। সেই অচেনা ডাক্তার বলেন ডাক্তার জয়ন্ত দাশগুপ্তকে, একে ডাক্তার দেবপ্রিয় মল্লিক পাঠিয়েছে, একটু দেখুন।

কে দেবপ্রিয় মল্লিক!

জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ভাই।

আমি তাকে চিনি?

খুব ভালো করেই চেনেন।

এবার ডাক্তার জয়ন্ত দাশগুপ্ত আমাকে জিজ্ঞাসা করেন উনি আপনাকে কী করে চেনেন?

বলি–আমি ওনাকে ঠিক চিনি না। মহাশ্বেতা দেবীর চেনা। মহাশ্বেতা দেবী আমার চেনা।

ডাক্তার মল্লিক যেন গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলেন। কে তো তিনি বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না, যে, আমার মতো খসখসে চোয়াড়ে চেহারার লোককে নিয়ে তার পরিচিত এক ডাক্তার এমন ব্যক্তিগত উদ্যোগ কেন নিচ্ছেন। যা হোক, খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলেন যে একভাই রাজনেতা একভাই ডাক্তার এমন একটা ঘটনাক্রমের সাথে আমার কোন যোগসূত্র আছে। সেটাই তার মনোযোগ আকর্ষণের কারণ। কিন্তু এখন যা শুনলেন তা যেন কোন কিছুর সাথে মিল খাচ্ছে না। মেলানো যাচ্ছে না।

বলেন–মহাশ্বেতা দেবী আপনার চেনা। কী করে চেনেন ওনাকে?

বলি–আমি ওনার পত্রিকা ‘বর্তিকা’-য় লিখি।

আপনি লেখক।

ওই আর কী! একটু আধটু লিখি।

কী লেখেন?

গল্প উপন্যাস।

বর্তিকাতেই লেখেন, নাকি…।

বর্তিকা দিয়েই লেখার শুরু, তবে পরে আরও বহু পত্র-পত্রিকাতে লিখেছি। চারখানা বইও বের হয়েছে আমার।

এরপর তিনি আমাকে পরীক্ষা করলেন, ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে ডায়গনোসিস বলে। তারপর আমার স্ত্রীর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন–ব্লাড টেস্ট করতে হবে। আর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন–ভর্তি হবেন? ভর্তি হলেই ভালো হবে।

দেবপ্রিয়বাবু ভর্তির কথাই বলেছিলেন। তাই সায় দিলাম আমি। অল্প সময়ে সে পর্ব মিটে গেল। তারপর কী যে একটা ঘটল আজ আর তা মনে নেই-সম্ভবত রক্ত পরীক্ষা। আগে বার পাঁচেক রক্ত পরীক্ষা হয়ে গেছে। গাদা গুচ্ছের টাকা গেছে তার পিছনে। ফের রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন পড়বে–একগাদা টাকা লাগবে, এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমরা। কাছে টাকা ছিল না।

আমাদের অসহায়তার কথা শুনলেন ডাক্তার জয়ন্ত দাশগুপ্ত। বুঝলেন এক দরিদ্র কলমকারের অক্ষমতা। আর সেই সদ্য চেনা ডাক্তার শোনা যায় ডাক্তারেরা রোগী দেখেন ফিস্ এর জন্য, উনি এক রোগীকে ফিস্ দিলেন। পাঁচশো টাকা।

পরে সে টাকা ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলাম। উনি নেননি। বাধ্য হয়ে কটা বই দিয়েছিলাম আমার লেখা না কোনো ঠুনকো কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওই মানুষটির মহত্বকে ছোট করব না। এই সব মানুষ আছে বলেই আমি আমরা বেঁচে আছি এইহিংস্র মানব সমাজে।না হলে কবেই ‘ছিলাম’ হয়ে যেতাম।

এই রোগটির ফলে প্রায় দেড় দুমাস পড়ে ছিলাম বিছানায়। এই সুযোগে আমার লেখাটাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম। সেটাই আমার একটা বড় কাজ হয়ে গেল।

এরই কিছুদিন পরে আমার ডান চোখে সমস্যা দেখা দিল। চশমা তো দশ বছর আগে ধারণ করেছি, মনে হল চোখটা একবার পরীক্ষা করিয়ে চশমাটা বদলে নিলে সমস্যাটা কেটে যাবে। আমার স্ত্রী অনু সেক্টর ফাইভে শঙ্কর নেত্রালয়ে তখন কাজ করত এক ঠিকেদার সংস্থার অধীনে।

তখন ওর নাম শঙ্কর নেত্রালয়ই ছিল। শঙ্কর নারায়ণ নেত্রালয়। পরে নারায়ণ ওখানে রয়ে যায় শঙ্কর চলে আসে মুকুন্দপুরে।

অনু বলল–এই শঙ্কর নারায়ণ নেত্রালয়ে গিয়ে চক্ষু পরীক্ষা করাতে। সে সাথে নিয়ে যাবে সাথে নিয়ে আসবে। চক্ষু পরীক্ষা আর ডিউটি একসাথে হয়ে যাবে। তাই গেলাম সেখানে।

অনু ওখানে কাজ করে। কোন্ ডাক্তার কেমন সে তা জানে। বলে সে, ভিনিত স্যারকে দিয়ে চোখটা দেখিয়ে নেব। একজন দু’জন নয়, দশজন পুরানো রোগী বলল-ভিনিত ডাক্তার মানুষ নয়-ভগবান। যদিঅন্ধকে ছুঁয়ে দেয় তো চক্ষুস্মান হয়ে যায়। পৃথিবীতে এমন ডাক্তার দু’দশজনের বেশি নেই।

তীর্থস্থানে গেছি, মন্দিরে গেছি। কোনদিন ভগবান দেখিনি। কী করে দেখব! উনি যে শঙ্কর নারায়ণ নেত্রালয়ে এসে বসে আছেন। ভগবান আমার চক্ষু পরীক্ষা করে বলে দিলেন–ছানি পড়েছে। অপারেশন করতে হবে এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব?বললেন তিনি–আমি আগামী মাসে ক্যালিফোর্ণিয়া চলে যাব। তাই কাল অথবা পরশু করিয়ে নাও।

অনু এই হাসপাতালের কর্মী। খোঁজ নিয়ে কথা বলে জানল সে–অন্য কেউ হলে যত কম হোক হাজার তিরিশ লাগবে। তার বেলা সেটা কমে পনের হাজার হতে পারে। এর কমে কিছুতে হবে না।

দুদিন কেটে যেতে তৃতীয় দিন ডাক্তার ভিনিত লোক পাঠিয়ে আমার স্ত্রীকে ডাকিয়ে আনলেন–কী হল ‘বেটা’। অপারেশনটা করিয়ে নিলে না! আই হেল্থ তো ভালো নেই।

বলে অনু, কী করে করব স্যার। হাসপাতাল যে টাকা চায়।

তোমার কাছে টাকা চেয়েছে!

হ্যাঁ স্যার।

কত?

পনের হাজার। এত টাকা কোথায় পাবো!

কিছুক্ষণ ভেবে নিজের পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে অনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন তিনি–এটা কাউন্টারে জমা করে দিয়ে বলবে, আমি আর দিতে পারব না। ওরা কী বলে আমাকে এসে জানাও।

একটু দ্বিধা নিয়ে বলে অনু–আপনার টাকা নেব না স্যার। আপনি কেন দেবেন! যদি পারেন একটু ওদের বলে দিন। কিছু কম করুক। ডাক্তার স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের বলেন-কাল পেসেন্ট নিয়ে এসে নাম লিখিয়ে দাও। অন্য যা আমি বুঝে নেব।

পরের দিন গিয়ে ভর্তি হলাম শঙ্কর নারায়ণ নেত্রালয়ে। দুপুর দুটো নাগাদ অপারেশন হয়ে গেল। ও.টি-তে যেসব আয়া কাজ করে আমাদের পরিচিত। বলে তারা ভিনিত স্যার কী যত্ন নিয়ে যে অপারেশনটা করল কী বলব। শুনলাম, যে লেন্সটা লাগানো হয়েছে আমার চোখে, ওটার দাম বারো হাজার। কিন্তু কী কারণে জানি না আমাদের একটাও পয়সা লাগল না।

কয়েকদিন পরে আবার আর একবার গিয়ে চক্ষুর ব্যান্ডেজ খুলিয়ে চক্ষু পরীক্ষা করিয়ে আসতে হল। পরীক্ষা ওই ভিনিতস্যারই করলেন। বললেন–ও,কে। তারপর পাঠালেন আর এক অন্য ডাক্তারের কাছে। তিনি চক্ষু পরীক্ষা করে চশমার পাওয়ার দিলেন। সেই কাগজখানা আমাদের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন ভিনিত স্যার আর অনুকে বললেন–চশমা হাম লেকে রাখেংগে, তোম হামসে লে জানা বেটা।

দিন কয়েক পরে সেই চশমা অনু নিয়ে আসে। অপারেশন ওষুধ চশমা—সব ব্যাপারটাই হয়ে গেল বিনামুল্যে—ভগবানের দয়ায়। সেই ভগবানের নাম ভিনিত স্যার।

চোখ অপারেশন হয়ে বাড়ি এসে শুয়ে বসে সময় কাটানো–এই সময়কালটার মেয়াদ এক মাসের কিছু বেশি। ডান চোখে পট্টি কিন্তু বাঁ চোখ তত ভালো। সেই চোখে পুরাতন চশমা বেঁধে লিখতে শুরু করি আত্মজীবনী। যেখানে থেমে গেছিল সেইখান থেকে। অনু চেঁচায়–কঁচা চোখ। ঘাড় গুঁজে লিখছো, চোখে রক্ত উঠে যাবে।কানা হয়ে যাবে তুমি। সারা জীবন তো লিখছো। ওসব ছাইপাঁশ লিখে কী হয়েছে। চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। কিচ্ছু হবে না তোমার ওই খুন্তি নাড়া ছাড়া। চোখ গেলে সেও পারবে না। সব মরব না খেয়ে।

কিছু হবে না সে আমিও জানি। একটা গাছ কত বড় হবে সে তো তার বীজের মধ্যে গুপ্ত হয়ে থাকে। হাজার চেষ্টা করেও বেগুন চারাকে কী বটবৃক্ষ বানানো সম্ভব! তবু মনকে যে কিছুতে বোঝাতে পারি না। কিছুতেই যে সে পাগল বুঝ মানতে চায় না। বলে শুয়োপোকা যদি প্রজাপতি হয় আমি কেন পারব না আমার পা-কে পাখনা বানিয়ে উড়ে যেতে।

ভাবি, যে কাজ করি সে আর খুব বেশিদিন পেরে উঠব না। আমার শত্রুপক্ষের তাড়াতে হবে, এমনিতে শরীর অচল অক্ষম হয়ে পড়বে। তখন তো ভিক্ষে ছাড়া গতি নেই। যায় যদি তো যাক–সাধারণ ভিখারির চেয়ে অন্ধ খঞ্জ মানুষের দয়া বেশি পায়। তবু লেখাটা শেষ করি। একজন প্রকাশক যখন পাওয়া গেছে। মানুষ তো মানুষই হয়, আজ যে উৎসাহ দেখাচ্ছে কাল যদি মতিগতি বদলে যায়। সেই যে মেয়েটা যে একজনকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল-বাবু তোমাকে আমি প্রেমিকের মতো ভালোবাসি, সে পরে আর একদিন তার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে অন্য বাবুকে ঘরে বসিয়ে নেয় না। তাই দ্রুত হাত চালাই। মোহ কেটে যাবার আগে লেখা শেষ করে দিয়ে অন্ধ হবার আগে বইটা দেখতে চাই।

২০১১ সালের জুন মাসে যেদিন প্রথম বর্ষার আগমন ঘটল, দারুণ দাবদাহের পর নামল শান্তির বারিধারা–সেদিনই পা পিছলে পড়ে গেলাম আমি। আমার কর্মস্থলে রান্না ঘরের তিনদিক খোলা। একটু বৃষ্টি সাথে একটু হাওয়া থাকলে আর কথা নেই, জলে ভিজে চুপচুপে। তাই পা হড়কে গেল, আর পড়বি তো পড় উনুনের পাশে। ধাক্কা লেগে কড়াই উল্টে গেল। ডিম সেদ্ধ হচ্ছিল শ দেড়েক। সব গরম জল ছলকে পড়ে গেল পেটের উপর। ফুট খানেক লম্বা ফুট খানেক চওড়া জায়গার চামড়া সেদ্ধ হয়ে খসে গেল। ফলে ভর্তি হতে হল মেডিকা হাসপাতালে।

এমনিতে আমার কর্মস্থলের যা লোকজন, এত ব্যয়বহুল চিকিৎসালয়ে আমাকে নিয়ে আসার কথা নয়। যতটুকু তাদের জানি, কোনো সরকারি হাসপাতালে নিয়ে ফেলে আসার কথা। কিন্তু তখন পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি বড় ভয়াবহ। চারদিকে পরিলক্ষিত হচ্ছে একটা পরিবর্তন। লোকসভার ভোটে পরিবর্তনপন্থীদের বিরাট বিজয় ঘটে গেছে। সেই পরিবর্তনের পক্ষের বহু বিদ্বৎজন–গণসংগঠন আমাকে চেনে, জানে। অনেকে এটাও জানে যে আমার বিরুদ্ধবাদীরা আমার ক্ষতি করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। এই অবস্থায় আমি মারা গেলে একটা ঝড় উঠবে। সে ঝড় সামলানো মুশকিল। আমার যারা বিরুদ্ধ পক্ষ–তারা বোকা নয়। তারা সবটা না জানলেও এটা জানে–আমার শেকড় অনেক শক্ত। তাই তারা ধাক্কা মেরে তাড়িয়ে দিতে পারেনি।

আর তাই ওই আতঙ্ক থেকেই মেডিকায় ভর্তি করে দেয়। প্রতিদিনকার চিকিৎসায় ব্যয় যেখানে প্রায় দশ হাজার। নয় দিন থাকতে হয় আমাকে ওখানে।

এরপর বাড়ি এসে আরও দেড় মাস। এই দেড় মাসকেও কাজে লাগাই আমি। লেখা সম্পূর্ণ হয়ে যায় আমার আত্মজীবনী পৃষ্ঠার সংখ্যা দাঁড়ায় সাত আটশো। ফোন করে সেই প্রকাশককে জানাই–দাদা লেখাটা শেষ করে ফেলেছি। ভেবেছিলাম সংবাদটা জেনে উনি আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবেন, হল উল্টো। একেবারে নিরাসক্ত নিস্পৃহ গলায় জবাব দিলেন–দেখছি কী করা যায়। আমি যেদিন বলব পাণ্ডুলিপি দিয়ে যাবেন। পড়ে আপনাকে জানাব।

দিন যায় মাস যায় তিনি কোনো উদ্যোগ নেন না। মাঝে মাঝে ফোন করি, একই জবাব পাই, কবে পাণ্ডুলিপি দিয়ে যাবেন আমি আপনাকে বলব। লেখাটা লিখেছি জয়ন্তদার কথায়, ওনাকে ফোন করি–কী হবে দাদা, লেখাটা কী ছাপা হবে না? কুণ্ঠিত গলায় বলেন তিনি–উনি তো আর আগের মতো ‘অধীর’ নেই। বিশ্বাস হচ্ছে না যে ছাপবেন।

জয়ন্তদার কথায় আমার এতদিনকার সব আশা যেন ‘গাঙচিল’ হয়ে উড়ে পালায়।

.

পাঁচ ছয় মাস কেটে গেল-বিশ্বাসী প্রকাশকের কোনো সাড়া না পাওয়ায় মনটা ভেঙেচুরে খানখান হয়ে গেল। জীবনের প্রতি পদে মানুষের বিশ্বাসহীনতা অসহযোগ দেখে দেখে মনে যে ধারণা গড়ে উঠেছিল আর একবার যেন সেটাই প্রমাণিত হল–মানুষকে বিশ্বাস করা পাপ যদি নাও বা হয়–অবশ্যই বোকামো।

মানুষ আমাকে সহযোগিতা দেবে না, সাহায্য করবে না এগিয়ে যেতে, তাহলে আমি কী করব? বসে বসে কাঁদব? ছিঁড়ব মাথার চুল? না, এসব করলে তো হেরে গেলাম। আমার যুদ্ধ তো এই সামাজিক অবজ্ঞা অসহযোগিতা–এই সবের বিরুদ্ধেই। হারা আমার চলবে না।

আবার আগুন হলাম আমি–নিশ্চিন্ত পরাজয়ের বিরুদ্ধে। যেভাবেই হোক আগামী বইমেলায় অবশ্যই প্রকাশিত হবে ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। আমার আত্মজীবনী। এখন এটাই আমার লড়াই। এক মাত্র লড়াই। সামনে আছে তিরিশ চল্লিশ দিন। এর মধ্যে সব কিছু করে ফেলতে হবে….।

আমার তিনখানা বই যিনি ছেপেছেন কথা বললাম সেই প্রিয়শিল্প প্রকাশনার মনোজদার সাথে। বলেন তিনি পারি, পারব। অবশ্যই বইমেলায় বই বের হবে। তবে আর্থিক দিক থেকে আমি খুব দুর্বল, টাকার দায়ভার আপনাকেই বহন করতে হবে। যা পাণ্ডুলিপি হিসাব করে দেখলাম কমপক্ষে পঞ্চাশ ষাট হাজার দরকার। এত টাকা যোগাড় করা কঠিন। তাই লেখাটাকে দুভাগ করে ফেললাম। জন্ম থেকে নানান পথ ঘুরে বহু ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে দুহাজার সালের দোরগোড়ায় অর্থাৎ শেষবার ছত্তিশগড় ঘুরে এসে প্রতিবন্ধী স্কুলের কাজে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্ত–এইটুকু থাকে প্রথম ভাগে।

মূল বিষয় ওটা-তবে শেষ ভাগ থেকে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু তথ্য বক্তব্যও ওতে রেখে দেওয়া হয়। ভয় ছিল প্রথম ভাগ কোনোভাবে কষ্টেসৃষ্টে বের হবার পর যদি আর শেষভাগ বেরই না হয়। মানুষের জীবন অনিশ্চিত, কত কী ঘটে যেতে পারে। যদি আমার কিছু হয়ে যায়।

ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন, আমার লেখা আমারই জীবনী বটে তবে বইটি প্রকাশিত হবার পর আর আমার থাকেনি। এটা যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজের অধ্যাপক জয়দীপ ষড়ঙ্গী, চেতনা লহর পত্রিকা সম্পাদক অনন্ত আচার্য আর আমার বন্ধু বাপ্পাদিত্য ভট্টাচার্য এদের হয়ে যায়। বইটির শুভাশুভ বিষয়ক সব দায় দায়িত্ব এই তিনজন ভাগ করে নেয়।

জয়দীপবাবু নিয়ে নেন প্রচারের দায়িত্ব। ওনারই উদ্যোগে ইংরেজি স্টেটসম্যান, টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, হিন্দি পত্রিকা প্রভাত খবর ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ এবং তার লেখককে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে বিশালাকারে। টিভি চ্যানেল এন.ই. বাংলা স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে আধ ঘন্টার এক অনুষ্ঠান করে।

আর অনন্ত আচার্য এই বইকে ব্যাগে ভরে কাঁধে করে পৌঁছে দিতে থাকেন ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। আনন্দবাজার পত্রিকার গৌতম রায়ের কাছে তিনি বই পৌঁছে দেন। তার ফলে গৌতমবাবুর লেখা “চণ্ডালের চোখে চণ্ডাল জীবন” প্রতিবেদন লেখা হয়। ওনারই প্রচেষ্টায় দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে যায় আমার জীবন কাহিনী।

বন্ধু বাপ্পা দায়িত্ব নেয় শহর কলকাতায়। কলেজ ষ্ট্রীট বই পাড়ায় ওঁর অনেক দিনের আসা যাওয়া, দে বুক স্টোরের মাধ্যমে কলকাতার পাঠকদের কাছে বই পৌঁছে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে।

সেবার কত বই ছেপেছিলেন মনোজদা? উনি নিজেই বলেছেন–“প্রকাশকরা কোনদিন সত্যি কথা বলে না, একটু এদিক সেদিক করেই থাকে।” অতি সৎ এবং সাহসী উচ্চারণ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে যদি কোনদিন এই সৎ সাহস নিয়ে সঠিক সংখ্যা বলে, জানা যাবে এই বই বিক্রির ধারে কাছে বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত বেস্ট সেলারও ঘেঁসতে পারেনি।

বইখানা পাঠক সমাজে যে এতখানি সমাদৃত হবে প্রিয় শিল্প প্রকাশনের কর্ণধার মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায় আগে বুঝে উঠতে পারেনি। সেটা বুঝলেন বই প্রকাশ হবার কয়েক দিনের মাথায় তিনশো কপি উড়ে যাবার পর। আগে জানলে একবারে কয়েক হাজার ছাপিয়ে ফেলত নিশ্চয়। তাতে খরচ অনেক কম পড়ল। বই প্রতি বেশি লাভ ঘরে আসত।

প্রথমবার বই ছাপা হয়েছিল মাত্র তিনশো। কুড়ি হাজার টাকা ধার দেনা করে প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়েছিলাম আমি। কথা ছিল আর যে টাকা বাকি রইল বই পাবার পর বিক্রি করে সেই টাকা শোধ করে দেব। এক কথায় এই বই ব্যাপারে প্রকাশকের কোনো দায় দায়িত্ব থাকবে না। লাভ লোকসান সব আমার। সে পাবে শুধু তার ছাপাই বাঁধাই বাবদ ধার্য পারিশ্রমিক। আর কাগজের দাম কভারের খরচ।

প্রিয় শিল্প প্রকাশনার মনোজদা নিপাট ভদ্রলোক। কখনও রাগ করেন না। ভেবে চিন্তে ধীরে ধীরে হিসেব করে কথা বলেন। তা ছাড়া তিনি একজন সৎ মানুষ। তার একটা বড় গুণ-তিনি যে সৎ, সেটা গোপন করে রাখেন না। পাছে লোকে তার সততায় সন্দেহ করে বড় বড় অক্ষরে পোস্টার মেরে রেখেছেন প্রকাশনালয়ের দেওয়ালে–“অসৎ পথে হয়তো অর্থ উপার্জন করা সম্ভব, কিন্তু শ্ৰদ্ধা সম্মান অর্জন করা যায় না। সেই যে ব্যবসাদাররা দোকানে লিখে রাখে–সততাই মূলধন। যাতে কেউ তাকে অসৎ মনে না করে।

মনোজদা সৎ-চিরকাল তা-ই থাকতেন। তবে মানুষ তো মানুষইহয়। স্বর্গের দেব দেবতার পর্যন্ত বিচ্যুতি ঘটে যায় মানুষের ঘটবে এতে আর তেমন দোষ কোথায়? আসলে দোষ বা গুণ, সৎ বা অসৎ ভালো বা মন্দ এইভাবে মানুষকে চিহ্নিত করা দেগে দেওয়া যায় না। সব কিছু ঘটায় বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি। পরিস্থিতির কারণে কাল যে মানুষ রত্নাকর আজ সে বাল্মীকি। কাল যে দানবীয় সুদীপ্ত আজ সে সিঁদকাটা সারদা প্রসাদ। মোজদার পা পিছলে যাবার পিছনেও রয়েছে। সেই বিশেষ পরিস্থিতি। যার সৃষ্টিকর্তা গৌতম রায়। তিনি যদি আনন্দ বাজার পত্রিকায় চণ্ডালের চোখে চণ্ডাল জীবন প্রতিবেদন না লিখতেন–এই অবস্থা আসত না।

সর্ব প্রথমে বইটা নিয়ে স্টেটস্‌ম্যান পত্রিকা প্রায় আধপাতা জুড়ে আমার বেশ বড় ছবি সহ প্রতিবেদন ছাপে, তারপর ছাপে টাইমস অফ ইন্ডিয়া। তবে তাতে বাঙালি পাঠক বিশেষ হেলদোল দেখায়নি। দেখালো আনন্দবাজারে প্রতিবেদন প্রকাশ হবার পর। বাপরে বনে যেন আগুন লেগে গেল। চারদিক থেকে ফোন আসতে লাগল আমার কাছে। বই চাই বই। পাঠক তো বটেই বই বিক্রেতাদেরও ফোনের বিরাম ছিল না।

এর আগে আমার যে কটা বই বের হয়েছে সব কটার যত্ন করে নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছিলাম। যদি কেউ চিঠি দেয়, ফোন করে। বইটা কেমন লেগেছে যদি বলে। ফোন বা কোন চিঠি আসেনি। কিছু কেউ বলেনি। তাই এবার রাগ করে কোন ঠিকানা কোন নাম্বার ইচ্ছে করেই রাখিনি। আর কি আশ্চর্য এবারেই অগুনতি ফোন। কী করে যে তারা আমার নাম্বার পাচ্ছে কে জানে। আমি যখন শত শত–যার নাম ঠিকানা বইয়ের পাতায় জ্বলজ্বল করে সে তাহলে কত শত ফোন পেয়েছে? দার্শনিকরা যেমন বোঝেন ধোঁয়া যখন দেখা যাচ্ছে আগুন নিশ্চয় আছে, প্রকাশক ফোনের তাণ্ডবে এমন নয় যে বুঝতে পারেনি জোয়ার আসছে।

বইখানা প্রথম প্রকাশ হয় ২০১২ বইমেলায়। মেলার প্রায় শেষ দিকে বই এবং বইয়ের লেখককে নিয়ে একটা ছোট্ট সংবাদ করে চ্যানেল টেন। তাতেই খান চল্লিশ বই হাওয়া। প্রিয় শিল্প বই মেলায় স্টল দেয় তাদের কী খবর আমি জানিনা। আমাকে তারা জানায়নি। ট্রেড সিক্রেট বলে কী একটা ব্যাপার আছে যে।

বই মেলা শেষ হবার অল্প ক’দিন পরে বোমাটা ফাটালেন সেই গৌতম রায়। অল্প কিছু বই ছিল আমার কাছে। সেক’খানা উড়ে যেতেই ছুটে গেলাম প্রকাশকের কাছে আমার বাকিবইগুলো দিয়ে দিন। সে তখন ঝড়ের আঁচ পেয়ে গেছে, আর কী দেয়? মিষ্টি করে হেসে ভদ্রভাষায় বলে–গোটা কুড়ি আছে আর তো নেই। নেই মানে বাইন্ডিং হয়নি। দিন সাতেক পরে আসুন। পেয়ে যাবেন।

এই সাত দিনের মধ্যে একদিন আমি আর আমার বন্ধু বাপ্পা কলেজ স্ট্রিটে গেছি–সে বুক স্টোরে বই দিতে। ফোনের পরে ফোন করছিল তারা–বই দাও বই দাও। দে বুক স্টোর থেকে এক একদিনে তিরিশ পঁয়ত্রিশ খানা বই বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল। বই পৌঁছে দিতে দিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি আর বাপ্পা। তারা আগাম টাকা দিয়ে দিচ্ছিল। ফোন আসছিল বুকমার্ক থেকেও।

দে বুক স্টোর থেকে বেরিয়ে আমরা দুজন একটু ঢুঁ মারলাম দেজ-এ। বাপ্পার কী সব দু-একটা বই কেনার দরকার ছিল। দেজ-এ ঢুকে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। টাল মারা রয়েছে ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। মনে হয় পাঁচশোর কম হবে না। এত বই। কোথা থেকে এল?

দিন সাতেক পরে আবার গেলাম প্রিয়শিল্পতে। আবার সেই মিষ্টি হাসি সাথে মিষ্টি চা নোনতা বিস্কুট। বই পেলাম খান চল্লিশ। সাথে কোন এক কামচোর কর্মচারীর প্রতি অনুযোগ–এগুলোর যা অবস্থা আর বলবেন না। একদিন কাজে আসে তিনদিন আসে না। আরও তিন চারখানা বই পড়ে আছে। বাইন্ডিং হচ্ছে না। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারছি না।

বললাম–দেজ-এ গিয়েছিলাম। দেখলাম ওখানে বই আছে।

তাড়াতাড়ি বলে মনোজদা–ওদের কটা বই দিয়েছি। ফোন করে চাইলেন। ওখান থেকে লাইব্রেরি পারচেজিং হয়। অনেক দূরে দূরে বই যায়।

আজকাল আমি দু-দশটা ইংরাজি শব্দের মানে জানি। প্রয়োজনে বলতেও পারি। তবে বলি, লজ্জা করে। লোকে কী না কী ভাববে। পারচেজিং মানে বিক্রি বোধহয়।

বলে মনোজদা দিন কয়েক পরে আসুন–বাকি বই পেয়ে যাবেন।

দিন কয়েক পরে আবার গেলাম। আরও গোটা কয়েক বই দিলেন। হিসেব করে দেখলাম সর্বমোট একশো বত্রিশখানা বই নেওয়া হয়েছে আমার। খান দশবারো বিতরণে গেছে বটে তবে বাকি বই বিক্রি করে যে কুড়ি হাজার ধার করেছিলাম শোধ দিয়ে অল্প কিছু লাভও পেয়েছি। বুকমার্ক আর দে বুক স্টোরকে তিরিশ শতাংশ কমিশন দিতে হয়েছে তবে আমি বা বাপ্পা আর অনন্তদা বিক্রি করেছি দুশো টাকা করে। এতেই টাকাটা উঠেছে।

ধরে নিচ্ছি দেজ পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স-এ আমরা কোন বইয়ের পাহাড় দেখিনি, ধরে নিচ্ছি মাঝে আর কোন বই ছাপা হয়নি। ছাপা হয়েছে মাত্র তিনশো–যা আগে কথা ছিল। তাহলে একশো বত্রিশোনা আমি নিলে বাকি একশো আটষট্টি খানা কোথায়?

খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে দেয় মনোজদা–ভবানী ভবন ন্যাশন্যাল লাইব্রেরী আর কোথায় না কোথায় আইন অনুসারে বই পাঠাতে হয়। খান তিরিশ এতে চলে গেছে। বাকি যা বই ছিল সেগুলো বিক্রি করে শোধ হয়ে গেছে সেই দেনা–যেটা আমার প্রকাশকের কাছে ছিল। মোটকথা–লাভ লোকসান সব সমান সমান। আমি তার কাছে আর কিছু পাব না, সেও পাবে না কিছু আমার কাছে। হিসাব বরাব্বর। লাখ টাকা লাখ টাকা দু কুড়ি দশ টাকা। এক কুড়ি তোর এক কুড়ি মোর, দশ গেল দশখাতে, না কিছু হাতে না কিছু পাতে।

কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের হাহাকার তখনও চলছে। ফোনের পরে ফোন তখনও আসছে। বলি মনোজদাকে তাহলে তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় সংস্করণ করে ফেলেন। প্রথম সংস্করণে বেশ কিছু বানান ভুল আছে। আছে দু একটা তথ্যে ভুল, সেটুকু সংশোধন করে।

বলে মনোজদা–এখন দ্বিতীয় সংস্করণ করার মতো সময় নেই। প্লেট, কভার সব রেডি আছে, যা ভুলটুল আছে–থাকুক। ওইভাবে কিছুবই ছেপেচাহিদার সামাল দেওয়া হোক। আগামী বই মেলার সময় বোর্ড বাইন্ডিং দ্বিতীয় সংস্করণ করা হবে।

ঠিক আছে, তাই হোক–

বই তো ছাপা হয়ে চলেছে, বিক্রিও হচ্ছে। লভ্যাংশ যা আসবার আসছে। বহু মানুষ আমার বই পড়ছে। শিলিগুড়ি ইন্দোর দিল্লি থেকে ফোন আসছে। পত্র পত্রিকায় আমার কথা লেখা হচ্ছে। টিভিতে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এতেই আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত ছিল। বই ছাপা ব্যাপারটা প্রকাশকের উপর ছেড়ে দিয়ে আমার এখন লেখায় মনসংযোগ করে থাকলে ভালো হতো। সে সব না করে দ্বিতীয় সংস্করণ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। কী বিচ্ছিরি কাণ্ড!

বলে মনোজদা–দ্বিতীয় মুদ্রণ করার মত টাকা আমার কাছে নেই। একটা ফ্যালাট নিয়েছি সেখানে একগাদা টাকা গেছে। আমার শাশুড়ির অপারেশন হল। কী বলব। হাত একেবারে খালি। যদি আপনি কিছু টাকা দেন তাহলে পারি, নাহলে তো…।

আমার বন্ধু বাপ্পা, বন্ধু অন্তপ্রাণ। বলে সে, কত টাকা লাগবে আমি দেব। কত বই ছাপতে চান?

কম্পোজ, প্লেট সব তো করাই ছিল। হিসেব করে বলে মনোজদা কুড়ি হাজার হলে সাড়ে তিনশো বই হয়ে যাবে।

দে বুক স্টোর, আমি আর বাপ্পা এই কটা বিক্রি করে ফেলতে কোনো অসুবিধা হবে না, বুঝে বাপ্পা চেক লিখে দিয়ে জানতে চায় বই কবে নাগাদ পাবো?

বলে মনোজদা সপ্তাহখানেক লাগবে।

এরপর শুরু হল বাপ্পা আর আমার প্যারেড। পরের সপ্তাহে গিয়ে শুনি, বই হয়নি। বাইন্ডারের ঘর রিপেয়ারিং শুরু হয়েছে সেটা শেষ না হলে তো কাজ হবে না। পরের সপ্তাহে আসুন। পরের সপ্তাহে গেলে আবার সেই পরের সপ্তাহ। কাতর গলায় বলি তাকে–কী যে করি, লোকে বই বই করে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। সৎ উপদেশ দেয় মনোজদা-ওদের বলুন যেন দেজ থেকে বই নিয়ে নেয়। দেজে তো বই আছে।

দেজে বই আছে। কী করে? আমি ন্যাকা সাজি।

বলে মনোজদা–সেই যে দিয়েছিলাম না, সেই বই। কী মনোজদার হাতের জাদু! সেই কবে দুমাস আগে নাকি একশো মতো বই দিয়েছিল যা এখনও আছে। আর অনামা অখ্যাত বগুলার রেল স্টেশনের এক বই বিক্রেতা একাই নাকি চল্লিশ পঞ্চাশখানা বই দেজ থেকে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে।

আমি আর বাপ্পা একদিন গিয়ে দেখি দেজের সেইবই পাহাড়–এখনও বিরাজমান। ব্যাপারটা কী? ব্যাপার হচ্ছে এই যে বই বাঁধাই হচ্ছে। সেখান থেকে সোজা এসে যাচ্ছে দেজ-এ। এখান থেকে চলে যাচ্ছে সর্বত্র। অনন্তদা খবর দিল শিলিগুড়ির সবচেয়ে বড় বইঘরে এখনও খান চল্লিশ বই শোভমান।

প্রায় দু আড়াই মাস ঘুরিয়ে শেষে একদিন ফোন করল মনোজদা নিয়ে যান বই। আপনার সব বই রেডি।

রাজনীতি ধর্ম সমাজ–সব কিছুতে জোয়ার ভাটা আছে। সলমান রুশদি-তসলিমার বই নিয়ে পাঠক মহলে কী উন্মাদনা হয়েছিল। এখন আর তো নেই। মানুষের স্মৃতি যেমন দুর্বল–মনও অস্থির। একটা বিষয় নিয়ে বেশিদিন ভাবতে পারে না–আটকে থাকে না। আমার বই নিয়ে যে উন্মাদনা এসেছিল সেটা এখন কিছুটা নিম্নমুখি। সেই ব্যাপক বেচাকেনায় একটু ভাটার টান। দু আড়াই মাস ধরে যে ঝড় চলেছে সেই ঝড়ের সব আম একা কুড়িয়ে ঝুলি ভরে নিয়েছে। এখন আমাকে বই দেওয়ায় বিশেষ অসুবিধা নেই। কুড়িয়ে কুড়িয়ে বই বেচে আসলটা হয়তো ঘরে আসবে লাভের গুড়ে বালি।

অতএব গুনে গুনে সাড়ে তিনশো বই দিয়ে দিল আমাদের। আর বই নেই? প্রশ্নের জবাবে হেসে সভাবে জানান–দু দশ খানা আছে। এটা তো সব প্রকাশকই করে..। আপনার সাড়ে তিনশো পেয়ে গেছেন তো! আমার কাছে কী আছে কী নেই সে দিয়ে আপনি কি করবেন!

ঠিকই তো। গৃহকর্তা রাখালকে গরু চরাতে দেয় মাস শেষে মাইনে দেবার চুক্তিতে। সে সারাদিন গরুকে ঘাস জল খাইয়ে দিনের শেষে গোয়ালে তুলে দিয়ে যাবার আগে মাঠের এক কোণে বসে খানিকটা দুধ যদি দুয়ে নেয় এতে অন্যায় হয় নাকি। যেমন গরু নিয়ে গেছে তেমনই তো ফেরত দিয়ে গেল। তবে ওই যে–জানলে গৃহকর্তার মনে কষ্ট হয়। পারলে রাখাল বদলে দেয়।

আমি আর বাপ্পা কলেজ স্ট্রীটে যাই–দেজ-এ বইয়ের গাদা দেখি আর অগুনতি পাঠকের ফোনে জানতে পারি রোজ বেশ কিছু বই বেচাকেনা হচ্ছে যার সিংহভাগ দেজ থেকে–যা আমাদের কাছে গোপন করে একা সব মধু খেয়ে নিচ্ছে মনোজদা। তখন আমরাও ভাবনা চিন্তা করতে থাকি কি করে তার হাত থেকে ওই সুযোগটা কেড়ে নেওয়া যায়।

এর একমাত্র উপায় সুন্দর শোভন স্বল্প দামে নির্ভুল একটা দ্বিতীয় সংস্করণ করে ফেলা। তাহলে প্রথম সংস্করণ আর এত বিক্রি হবে না যা এখন হয়ে চলেছে। এই বই নিয়ে চারদিকে যা মাতামাতি হয়েছে প্রকাশক পেতে আর কোনো অসুবিধা হবে না। আর এবার আমাদের টাকাও দিতে হবে না। পুঁজি লাগাবে প্রকাশক, লাভ ঘরে তুলবে সে। আমি পাবো শুধু রয়ালটি।

সেইভাবে চুক্তি করে দ্বিতীয় সংস্করণ করার ভার কলকাতা প্রকাশনকে দেওয়া হয়।ওরা বই ছাপে আর দেশ পত্রিকা আনন্দবাজার সহ নানা কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। ফলে নিম্নগামী বই বিক্রি আবার কিছু উর্ধমুখী হয়। বাংলাদেশ থেকেও বইয়ের অর্ডার আসে। যে দেজ পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স-এর সঙ্গে মনোজদার সুসম্পর্ক–সেই দেজ ফোন করে কলকাতা প্রকাশনের মানিক ফকিরকে বইয়ের অর্ডার দেয়।

সেই সময় একদিন মনোজদার স্ত্রী নন্দিতাদির ফোন এল আমার কাছে। এই সেই নন্দিতাদি–যার নামে ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবনের পাতায় পাতায় সুখ্যাতি করেছি আমি। উৎসর্গেও তার নাম রয়েছে।

রাগত গলায় বলে সে-কাজটা কি ভালো করলেন মনোরঞ্জনদা।

–কোন্ কাজটা! অবাক গলা আমার।

–বইটা আমাদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে অন্যকে দিয়ে দেওয়া?

বলি–আমি তো দিতে চাইনি। মনোজদা ছাপলেন না বলেই তো অন্য প্রকাশক খুঁজতে হল।

সে কি ছাপবে না বলেছিল?

না, তো বলেনি। বলেছিল টাকা দিলে ছাপবে। এখন যে বই এত ব্যাপক বিক্রি হল–সেই বই যদি এবারও লেখককে টাকা দিয়ে ছাপতে হয়–যখন বহু প্রকাশক বিনা টাকায় ছেপে দিতে উদ্গ্রীব–আমি কি করব বলেন তো? আবার দেনা করব?

গলায় একরাশ বেদনা ফুটে ওঠে। বলে নন্দিতাদি–আজ আপনার যে নাম খ্যাতি যশ–সে সব তো আমাদের জন্য। কুড়ি হাজার আপনি দিয়েছিলেন–কত টাকা আমরা বাকি রেখেছিলাম বলেন। যদি আমরা এই বই না ছাপতাম–কে আপনাকে চিনত। হাজার হাজার বই আপনার আমরা বিক্রি করে দিয়েছি। সে সব আপনি মনে রাখলেন না।

বেশ কৌতুক লাগে আমার। শোকে দুঃখে আনন্দে মানুষ প্রগলভ হয়ে ওঠে। বাক্ সংযম থাকে না। পেটের গোপন কথা বমি করে দেয়। যেমন এখন নন্দিতাদি দিলেন।

বলি তাকে–কুড়ি নয়, দু খেপে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়েছি আমরা। আর হাজার হাজার নয়–আপনারা বই বিক্রি করেছেন একশোর কিছু বেশি–দেড়শোর কিছু কম।

কী বলছেন আপনি মাত্র দেড়শো!

মনোজদার হিসাবে তো তাই হয়। প্রথমে যে তিনশো ছাপা হয়েছিল তার একশো বত্রিশখানা আমাকে দিয়েছেন। পরের সাড়ে তিনশো তো সবটা আমরা নিয়ে আসি। ওনার কাছে বই থাকে হিসেব মতে একশো আটষট্টি খানা। তা থেকে কিছু যদি বিনা পয়সায় চলে যায় বাকি আর কত থাকে।

ট্রেড সিক্রেট বলে একটা কথা আছে। ব্যবসায়ীর সব গোপন কথা বউকেও বলে না। তাই হয়তো মনোজদা সব কথা নন্দিতাদিকে বলনি সাবধান করে দিলে ভালো করত। তা না করায় এখন গলগল করে সে যা বলে দিল–এতে ব্যবসার ওকে কি বলে–রেপুটেশান খারাপ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সততা শব্দটার উপর ভুযোকালি পড়ে যায়।

মনোজদা পাশেই ছিলেন। তিনি নন্দিতাদির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে আমাকে বলেন–পরের সব বই আপনারা নিয়ে গেছিলেন! আমার তো মনে হয় কিছু ছিল।

কত ছিল?

হিসেব করলে বলতে পারব।

বলি–আপনার হিসাব আপনার কাছে, আমার হিসাব আমার কাছে। দুই হিসাব কোনোদিন মিলবে না। আর এই অমিল হিসাব নিয়েই তো পৃথিবী জুড়ে এত সমস্যা। এই হিসাব নিকাশ নিয়েই তো আমার লেখালেখি।

ফোন কেটে গেল।

***

একটি সুবেশ যুবক একখানা দামি গাড়ি চেপে এক বিকেলে এসে উপস্থিত আমার কর্মস্থল–মুকুন্দপুরে। আসবে সেটা জানতাম। ফোনে কথা হয়েছিল। তাই কাজের সময়ের দুঘন্টা আগে বেলা চারটেয়, আমার ভাঙা সাইকেল চালিয়ে আমিও চলে এসেছি। বলেছিল কী যেন একটা পত্রিকা চালায়। লেখা চায়। এমনতো আজকাল কতই আসে। আর একজন আসবে–আসুক। লেখা একটা নেবে–দিয়ে দেব। তখন ঠিক জানতাম না–যে আসছে সে এত সুন্দর, এত দামি গাড়িতে চেপে এমন রাজবেশে আসবে। সরস্বতীর সাধক যে এমন লক্ষ্মীর বরপুত্র ভাবতে পারিনি।

এখন আমি তাকে নিয়ে বিষম বিব্রত, কোথায় বসতে দেব। আছে, আমার কর্মস্থলে সম্মানীয় মানুষদের বসার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা আছে। গদি আঁটা চেয়ার, বনবন পাখা, ঠাণ্ডা জল, গরম চা সব কিছু আছে তবে তা ওই যে “সম্মানীয় অতিথিদের জন্য।” আমার অতিথি যে সেই মাপে ফিট বসে না। আম্বেদকর হতে পারে ডক্টরেট–তবু মাহার তো! তার যে আত্মীয়-অভ্যাগত সে আর কী হবে ছোট কোনো জাত ছাড়া? বর্ণবাদী দেশে এই যে মনোবৃত্তি আজও তার পরিবর্তন ঘটেনি। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝি এ মনোবৃত্তির বদল-মোলায়েম সাহিত্য দিয়ে হবে না। বর্ণবাদের কোমর ভাঙা মাওবাদী লাথি মারা দরকার। সে আর কে মারবে। বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্যের মতো মার্কসবাদ লেনিনবাদকেও ব্রাহ্মণ্যবাদগিলে নিয়েছে। ফলে–ওই! অকারণ কান্না, হা-হুঁতাশ, আর ঘাড়গুঁজে কলম পেষা।

তা সেই মহাপণ্ডিত আম্বেদকর যখন রেহাই পায়নি শ্লেষ ঘৃণা বিদ্রূপ-বিরোধ থেকে আমি আর কোনো ক্ষেতের মুলো! না হয় লিখি দু-এক লাইন, তবে জাতে তো চাড়াল–ওই যাদের নমঃ বলে। আর করি তো রান্না বাসন মাজার কাজ। এসব মানুষ আবার মনুষ্য পদবাচ্য হয় নাকি। তাই অতিথিকে নিয়ে বড় সমস্যায় পড়ে যাই। কোথায় বসাবো।

আগে দু একবার দু একজন আমার অতিথিকে নিয়ে কর্মস্থলের মধ্যে কোথাও একটা কোণ খুঁজে নিরিবিলিতে বসেছি কোনো দরকারি কথা সেরে নেবার জন্য, আর তখনই কেউ একজন মোবাইল কানে দিয়ে উচ্চনাদে বার্তালাপ করতে করতে আমাদের পাশে পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়বে। আর আমাদের অস্তিত্ব উপেক্ষা করে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটির সাথে খিস্তি খামারি শুরু করে দেবেন। সেই বচন কে শুনছে না শুনছে, ফোনের অপর প্রান্তে কেউ আছে কি না আছে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ–তবে আমরা তো শুনি। কান ঝালাপালা করে বিরক্তি ধরে, আলোচনায় মনঃসংযোগ করতে পারি না। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, অতিথির সামনে লজ্জা লাগে।

আমি বলছি না যে ওরা পরিকল্পিতভাবে ঐসব করে। কেন করবে! করে কী লাভ। হতে পারে অকারণে আমি সন্দেহ করছি। তবে করে এবং সেটা ক্লান্তিহীন নিরবচ্ছিন্নভাবে। যেমন আমার সাইকেলের টায়ারে ব্লেড চলে পিন ফোটে, নজেল খুলে কোথায় চলে যায়। জলের বোতলটা হাত পা হয়ে হেঁটে চলে যায়। বাড়ি থেকে যে জামা প্যান্ট পরে এসেছি খুলে রেখে অন্য পোষাক পরে কাজে লেগেছি–সেই খুলে রাখা পোষাক হলুদ তেলে মাখামাখি হয়ে যায়। এই রকম কত কিছু যে হয় একটু চোখের আড়াল হলে।

তাই সেই সুবেশ তরুণকে বলি, কোথায় তোমাকে বসাবো ভাই। চলো গাড়ির মধ্যে বসেই কথা বলি।

বলে যে–আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূর? বাড়ি যাওয়া যায় না? বাড়িটাও একটু দেখার ইচ্ছা ছিল।

আমার সাইকেল সেখানে রেখে চেপে বসি তার মোটরকারে। মুকুন্দপুর থেকে আমার বাড়ি মাইল তিনেক দূরে। পথ বড় উবর খাবর। বর্ষায় এই পথের বড় বড় গর্তে জল জমে। বৃষ্টির সময় রাত সাড়ে দশটায় কাজ থেকে ফেরার পথে কতবার যে আছাড় খাই। তবে এক আধদিন লাভও হয়, একটা দুটো কইমাছ পাওয়া যায়। পাশের খাল থেকে কানে হেঁটে উঠে আসে রাস্তার মাঝের পুকুর ডোবায়।

এখন গর্ত আছে জল নেই। সেই শুকনো গর্ত ডিঙ্গিয়ে দুরমুশ করে গাড়িখানা কাতরে কাতরে পৌঁছাল আমার বাসস্থানে। বসতে দিলাম সেই কোর্টপ্যান্ট নাদুস তরুণ সম্পাদককে। পথে আসতে আসতে নাম জেনে নিয়েছি–রাতুল। বাড়ি তার বর্ধমানে।

বলে সে, মলয় চৌধুরির নাম শুনেছেন? দিল্লিতে থাকেন, উনি একটা টেকনিক্যাল কলেজ চালান। ভারতবর্ষে আঠারোটা কলেজ আছে বিভিন্ন প্রদেশে। এখানকার সল্টলেকেও আছে একটা। সম্প্রতি উনি একটি পত্রিকা বের করেছেন, যা দুই মেদিনীপুরে এখন বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। পোস্টারের মতো লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেওয়ালে। মূলত গ্রামীণ এলাকার পত্রিকা। আপনাকে লিখতে হবে এই পত্রিকার জন্য। এর জন্য কিছু পারিশ্রমিকও পাবেন।

কথায় কথায় সে জানায়–মলয় চৌধুরী টি একজন সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। তিনি সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরিকে তার সাহিত্যকৃতির জন্য এক কোটি টাকা পুরস্কার দিয়েছেন। আফগানিস্থানের কোন এক লেখককে দিয়েছেন ছাব্বিশ লক্ষ টাকা আর মণিপুরের লৌহ মানবী শর্মিলা চানুকে দিয়েছেন একান্ন লক্ষ টাকা। জানাল রাতুল-স্বনামধন্য বিশাল বিত্তবান মলয় চৌধুরির পুত্রের নাম অরিন্দম চৌধুরি, যার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ইংরাজি ম্যাগাজিন সানডে টাইমস।

কিছুক্ষণ পরে জানতে চায় সে, বর্তমানে আপনি কি কাজ করেন? বলি–সেটা তো আমার ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বইয়ে লেখা আছে।

অক্ষম গলায় জানায় রাতুল–বইটা আমি এখনও পাড়তে পারিনি, স্যার পড়েছেন। স্যারই আমাকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পাঠিয়েছেন। আমি কালকেই দিল্লি থেকে ফিরেছি। উনি বলেছেন এইটা আর্জেন্ট তাই।

স্যার কে? মলয় চৌধুরী, না অরিন্দম চৌধুরী?

বাবা ছেলে দুজনের আলাদা আলাদা ব্যবসা। আমি মলয় চৌধুরীর প্রাইভেট সেক্রেটারি। ওনার সব কাজ আমিই দেখাশোনা করি। তাছাড়া উনি আমার মামা হন।

বইটা ওনার হাতে পৌঁছাল কী করে!

সে তো আমি বলতে পারব না। তবে ওনার খুব ভালো লেগেছে আপনার লেখা। উনিই চাইছেন আপনি আমাদের সাথে যুক্ত হোন।

বলি–আমি এক বোবাদের আবাসিক স্কুলে রান্নার কাজ করি। সকাল ছ’টায় কাজে যাই ফিরতে ফিরতে কোনো কোনোদিন দুপুর দুটো হয়ে যায়। আবার যাই সন্ধে ছ’টায়–ফিরতে কোনোদিন সাড়ে দশটা কোনদিন এগারোটা।

অবাক হয়ে বলে সে, তাহলে লেখেন কখন?

হেসে হেসে বলি–শিব্রাম চক্রবর্তীকে একবার এক সাংবাদিক ঠিক এই প্রশ্ন করেছিল। সকাল নটায় ঘুম থেকে উঠে শিব্রাম ভাত খাচ্ছেন দেখে বলে সাংবাদিক এত সকালে খাচ্ছেন? জবাবে বলে শিব্রাম সারারাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খিদে লেগে গেছে। জানতে চায় সাংবাদিক খেয়ে কী করবেন? বলে শিব্রাম–খেয়ে ক্লান্ত হয়ে যাব তত তাই ঘুমিয়ে পড়ব। বলে সাংবাদিক ঘুমিয়ে উঠে খাওয়া–খেয়ে উঠে আবার ঘুম, সারাদিন যদি এই করেন তো লেখেন কখন? বলে শিব্রাম তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে–কেন! তার পরদিন। আমারও সেই জবাব–লিখি পরের দিন।

আমি হাসাতে চেয়েছিলাম রাতুল হাসে না। এদের হাসতে নেই। এরা ইংরাজি যে সব স্কুলে পড়াশোনা করেছে সেখানে শুনি হাঁটা, হাসা, কথাবলা এমনকি জামা প্যান্ট পরা, চুল আঁচড়ানো সব শেখায়। মানুষকে একটা নিয়মনিষ্ঠ মেশিনী জীবনশৈলীতে অভ্যস্ত করে দেয়। চেয়ার টেবিল কাটা চামচ ছাড়া খায় না, চায়ে চুমুক দিলে শব্দ হবে না, হাসলে যেন দাঁত না দেখা যায়। কাঁদলে যেন চোখের জল গড়িয়ে না নামে।

বলে সে আপনাকে লিখতে হবে। ওখানে মাইনে কত পান? আপনি ওই কাজ ছেড়ে দিন। আমাদের পত্রিকায় যোগ দিন। এখন যা মাইনে পাচ্ছেন সেই মাইনেটা আমরা আপনাকে দেব! রাজি আছেন?

বলি–মাইনে হাজার পনের ষোল পাই।

মাত্র পনের হাজার। কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে বলে রাতুল–বেশ, এখন আমরা আপনাকে ওই মাইনেই দেব। পরে দেখব কতটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়। কাল থেকে আপনি আমাদের অফিসে আসুন। কালকেই আমরা আপনার নামে এক লক্ষ টাকা সিকিউরিটি মানি জমা করে দেব। যদি আপনি আমাদের চাকরি ছেড়ে দেন তাহলে ওই এক লক্ষ টাকা আপনাকে ফেরত দিয়ে দিতে হবে। আর আমরা যদি আপনাকে ছাড়িয়ে দিই ছয় মাসের একটা নোটিশ দেব এবং আরও এক লক্ষ টাকা দেব। বলুন কী বলছেন?

বুক লাফাচ্ছে আমার। এতকাল ধরে তো এমনই একটা সুযোগের জন্য হা পিত্যেশ করে বসেছিলাম। আমি আর কিছু চাই না, শুধু দুবেলা পেট ভরে খেতে চাই, পরতে চাই দুএকটা সস্তার জামা কাপড়, আর চাই অসুখ হলে একটু সাধারণ চিকিচ্ছার মতো কিছু পয়সা। যে কাজ এখন করি এতে এসব হয়ে যায়। তবে কাজটা আর করতে পারছি না। শরীর আর দুবেলা অত আগুন তাপ কাজের চাপ নিতে পারছে না। অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাঁটু দুটো বড় বেগ দিচ্ছে। আট দশ ঘন্টা দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। ব্যথায় হাঁটু বেঁকে আসে। সারারাত কনকন করে।

সবচেয়ে বড় কষ্ট লিখতে পারি না। মোটেই সময় পাই না। দুপুরে ঘন্টা খানেক রাতে ঘন্টা খানেক–এই মাত্র সময়। কোনো একটা লেখা শুরু করেছি কথারা মনে মাথায় গজগজ করছে। খাতার পাতায় নামার জন্য প্রসব বেদনায় ছটফট করছে–সেই সময় কলম নামিয়ে রেখে দৌড় মারতে হয় কর্মস্থলের দিকে। আগুনে ঝলসে পরিশ্রমে বিধ্বস্ত, বসের বাক্যবাণে বিদ্ধ ঈর্ষাতুর সহকর্মীদের নানাবিধ আক্রমণে আহত দেহ মন নিয়ে বাড়ি ফিরে তালাশ করে দেখি–সেইমনের মধ্যের কথারা মরে গেছে। কিছুতেই সেই ভাব-ভাবনা আসছে না, যা না এলে লেখাটায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে না।

সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে গেছে। লক্ষ্মী সরস্বতী দু-বোন এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। ডাকছে আমাকে–আয় বাছা আয়। তোকে দত্তক নিলাম। আর তোর কোনো চিন্তা নেই।সব চিন্তা আমাদের। তুই শুধু লিখে যা নিশ্চিত মনে।

মনের আবেগ সংযত রেখে বলি রাতুলকে–আমাকে একটু ভেবে দেখতে সময় দাও ভাই। কয়েকটা দিন পরে তোমাকে জানাব।

পরের দিন দেখতে গেলাম ওদের অফিস। রুবি হাসপাতালের কাছে একটা অফিস–এটা ছোট, এখান থেকে পত্রিকা সংক্রান্ত সব কাজ করা হয়। দোতলার একটা ঘর দেখিয়ে আমাকে বলা হল–যেদিন যেদিন আপনি অফিসে আসবেন এইখানে বসবেন। এটা আপনার রুম।

যেদিন যেদিন আসব মানে! রোজ আসতে হবে না?

নিরাসক্ত গলায় বলে রাতুল–রোজ আসার কী দরকার! আপনি তো লিখবেন! বাড়ি বসেও লিখতে পারেন। লেখা শেষ হলে দিয়ে যাবেন। অসুবিধা থাকলে ফোন করে দেবেন, ড্রাইভার গিয়ে নিয়ে আসবে।

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করি–কত লিখতে হবে মাসে?

বলে রাতুল–মাসিক পত্রিকা, মাসে একটা লেখা দেবেন। বিষয় আপনি নির্বাচন করবেন। তবে শব্দ সংখ্যা যেন পাঁচ ছশোর বেশি না হয়।

আমি কী এখন ধেই ধেই করে নাচব। মাসে মাত্র পাঁচশো শব্দ। এক একটা শব্দের দাম তিরিশ টাকা। তিরিশ টাকা। পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। এমন জোরে চিৎকার করতে মন চাইছে যেন জীবনের সব ব্যর্থতা-উপহাস-অবজ্ঞার কানে তালা লেগে যায়। বোবা বধির হয়ে যায়। রাতুল আমাকে গাড়ি করে নিয়ে গেল সেক্টর ফাইভে ওদের সেই আই. আই. পি. এম. কলেজে। বিশাল এলাকা জুড়ে এগারোতলা ভবনের সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাল। এতবড় প্রতিষ্ঠানের সম্মানীয় কর্মচারী হতে যাচ্ছি। ভেবে মনে দারুন গর্বের ঢেউ লাগল। আজ আমি এক রন্ধনশালার তুচ্ছ কর্মী। কেউ যাকে সাধারণ সৌজন্যটুকু পর্যন্ত দেখায় না। কাল থেকে আর তা থাকব না। আমিও হয়ে উঠব সম্মান আর সমাদরের পাত্র। গায়ে চিমটি দিলাম যা দেখছি যা শুনছি স্বপ্ন নয় তো!

বাড়ি ফিরে এসে সেদিন আমার সে কী উত্তেজনা। আনন্দে মনে হয় বুক ফেটে যাবে। নাহ? আর পিছনে ফিরে তাকাব না। চুলোয় যাক স্কুলের চাকরি পেনশন গ্র্যাচুইটি। সাতদিনের মধ্যে ইস্তফা দিয়ে দেব।

পরের দিন আমার এক দাদা শঙ্কর রায়কে বললাম যা যা ঘটেছে। সব শুনে সে বলে–দাঁড়াও চন্দ্রশেখরকে ফোন করি। চন্দ্রশেখরকে মলয় চৌধুরী ছেলের মতো ভালোবাসে। সব সে বলতে পারবে।

জানা গেল ইতিবৃত্তেচণ্ডাল জীবন বইখানা চন্দ্রশেখরকে দিয়েছে আমার বন্ধু বাপ্পা। চন্দ্রশেখরই সেখানা পৌঁছে দিয়েছে মলয় চৌধুরির কাছে। তার ভাবনায় ছিল মলয় চৌধুরি সাহিত্যের সমঝদার পাঠক। যদি বইখানাকে কোনো ছোটখাটো একটা পুরস্কার দিয়ে দেন লেখকের কষ্টকর জীবনের কিছু পরিবর্তন আসে। লোকটা বেঁচে যায়। বড় মানুষের ছোটটাও ছোট মানুষদের কাছে বিরাট বিশাল। জানত না চন্দ্রশেখর যে, পুরস্কার নয়, লেখককে চাকরি করতে বলবে সে।

বলে চন্দ্রশেখর–কালকেই মলয় চৌধুরি ফোন করেছিলেন আমাকে। বললেন–চন্দ্রশেখর তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে আমাকে তুমি এত ভালো একখানা বই পড়ালে। আমার লোক গতকালই দিল্লি থেকে কলকাতার দিকে রওনা দিয়েছে। সে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সাথে যোগাযোগ করবে। তারপর দেখা যাক কি করা যায়।

পরিশেষে বলে সে–আমার মনে হয় ওখানে চাকরি করাটা তোমার ঠিক হবে না। মলয় চৌধুরী ভীষণ মুডি লোক। কখন যে কী করবেন কোনো কিছু বোঝা যায় না। আজ যাকে কাছে টানছেন কালকে দূর করে দিচ্ছেন। আমিই ওনার চাকরি করতে পারলাম না। ধর এখন ওখানে ঢুকলে–যদি ছয়মাস পরে চাকরি চলে যায়–তখন কী করবে? দু লাখ টাকায় কদিন খাবে?

এক বুড়ি ছিল। যে মাঠের মধ্যে ঘর বেঁধে একা থাকত। খুঁটে বানিয়ে পেটের অন্ন জোগাড় করত। দম্ভ করে বলত সে, আমি চোর ডাকাত ভূতের ভয় পাই না, ভয় খালি টাপুর টুপুরের। ঘরের চালে খড় ছিল না তাই ওইভয়। সেইরকম আমিও ওবামা আলকায়দা ভূত ভগবান কিছুতেই চমকাই না। খালি বুক কেঁপে যায় অনাহারে থাকার ভয়ে। সে যে কী কষ্ট তা আমি জানি। যার পেটে পোড়া অজগরের মতো মোচড় মারে নাড়িভুঁড়ি তার কাছে নীতি নৈতিকতা ন্যায় অন্যায় সব সীমান্ত মুছে যায়। কাব্য সাহিত্য জ্ঞানবাণী সব মনে হয় অকারণ।

তাই পরের দিন গিয়ে রাতুলকে বলি-না ভাই এখনই আমি তোমাদের চাকরিটা নেব না। ছয় মাস তোমরা আমাকে দেখো, ছয়মাস আমি তোমাদের দেখি। যদি তখন মনে হয় একসাথে কাজ করা যাবে এই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে যুক্ত হয়ে যাব তোমাদের সাথে। তোমরা বললে লেখা আমি দেব তবে এখন কোনো পয়সা নেব না।

বলে রাতুল–ঠিক আছে, তাই হবে। তবে একটা লেখা দিন।

সেটা ছিল বিবেকানন্দ জন্ম সার্ধশতবর্ষ। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত হবে পত্রিকাখানি। জীবনভর কত বাণী দিয়েছেন বিবেকানন্দ। হিন্দুধর্মকে বিদেশে গিয়ে কী উচ্চতায় তুলে দিয়ে এসেছেন। হিন্দু দেবদেবীমুনিঋষি মনীষী নিয়ে কী সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছেন। আমার তখন সেসব কিছুই মনে পড়ল না। মনে পড়ল সেই পেটের মধ্যে মোচড় মারা অজগর। অমনি লিখে ফেললাম বিবেকানন্দের জ্ঞানযোগ থেকে একটা কোটেশান। সেই যে তিনি বলেছেন, যারা না খেয়ে থাকে কষ্টে থাকে তারা ভরপেটা চর্বচোষ্য লেহ্য পেয় খাওয়া সুখি মানুষকে বলে–আমরা না খেয়ে আছি, দুঃখে আছি, তোমাদেরও সুখে শান্তিতে থাকতে দেব না। টেনে নীচে নামাব, আমাদের সমান বানিয়ে দেব। সেই কথাকে মূল বিষয় রেখে ধনবানদের নমনীয় মানবিক হবার উপদেশ দিই।

লেখাটা রাতুলকে দিলে সে পড়ে। ইমেল করে দিল্লিতে পাঠায় স্যারকে পড়াবার জন্য। দিন কয়েক পরে জানায় সে আপনার লেখা খুব ভালো হয়েছে। স্যারের খুব ভালো লেগেছে। তবে ওটা ছাপা যাবে না।

বুঝলাম–আমি টেস্টেই ফেল হয়ে গেছি। ফাইনাল পরীক্ষায় আর বসা হবে না। এতে আমার কোনো দোষ নেই। দোষ আমার ভাগ্যের। ভাগ্য আমাকে যে জীবনযাপন করতে বাধ্য করেছে মনে এত বিষবাষ্প জমে গেছে কিছু লিখতে বসলেই কলমের মুখ থেকে সেই বিষ বের হয়ে আসে। পুঁজিবাদ বর্ণবাদকে বিনাশ করার ‘অসৎ অভিপ্রায়’ আর গোপন থাকে না।

মলয় চৌধুরী একজন বিত্তবান। সরস্বতীর সম্পদ বিক্রি করে তিনি লক্ষ্মীর বরপুত্র হয়েছেন। হয়েছেন সৎপথে সততার উপার্জনে। সে না হলে তো আয়কর বিভাগ সিবিআই পেড়ে ফেলত। আর এদেশে তো অর্থ উপার্জন কোনো অন্যায়ও নয়। তা সে যেভাবেই হোক। উনি তো তবু সেই উপার্জন থেকে কিছু কিছু সমাজের নানা কাজে ব্যয় করেন। শোনা যায় শ্রমজীবী হাসপাতালকে কটা দামি মেশিনও দান করেছেন।

সেসব ঠিক আছে। তবে কিনা উনি মাইনে দিয়ে লোক রাখবেন আর সে–উনি যে গাছের ছায়ায় বসে আছেন তারই গোড়ায় কুড়ুল কোপাবে সেটা কী করে পারেন?

তাই রাতুলও আমাকে ডাকেনি। আমারও যাওয়া হয়নি।

ছেঁড়া বস্তা কাঁধে নিয়ে পথে পথে কাগজ কুড়াই। একদিন কুড়িয়ে পেলাম একটা লটারির টিকিট। একজন দেখে বলল–রেখে দে, খেলা বাকি আছে। খেলা হয়ে গেলে, নাম্বার মিলিয়ে দেখলাম, কোনো পুরস্কার ওঠেনি। কাল পর্যন্ত যে টিকিট ছিল লাখ টাকার আশা, আজ তা আবার ছেঁড়া কাগজ। চালান করে দিলাম ছেঁড়া বস্তায়।

আমার বস্তা আছে এটা তো কোথাও যাবে না।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *