১২. বামফ্রন্ট নির্বাচনী কার্যক্রম

বামফ্রন্ট এবার নির্বাচনী কার্যক্রম সমাধা করতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় হাজার হাজার ভুয়ো ভোটারের নাম কাটা যাচ্ছে। বড়সাহেব প্রায় চল্লিশ বছর ধরে রাজনীতি করেন। মাত্র একবার ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতায় ফেরার কালে বহু কষ্টে তিনি জয় পেয়ে মন্ত্রী হন। সারা পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের দাপট। মুখের ব্রনের মতো দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কিছু সিটে বিরোধী দল জেতে। এটা সহ্য হয়নি সিপিএম নেতাদের। তাই যাদবপুর থেকে খুন জখম মারপিটে সিদ্ধ হস্ত বড় সাহেবকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই এলাকায়। বেশ কয়েক বছর পুলিশ আর দলীয় কর্মীদের সহায়তায় কী নির্মম হত্যালীলা চালিয়ে উনি যে ওই সব এলাকায় বিরোধী শক্তি হ্রাস করেঝিল্পসংহারের শ্যা দেখে নিরুপণ করা যায়।

এবার বামফ্রন্ট যদি না জেতে মন্ত্রীত্ব হারাবেন। এম.এল.এ. সিটটাও থাকবে না। থাকবে না আরো অনেক কিছুই।

গতবার জয় পেয়েছিলেন মাত্র গুটিকয়েক ভোটের ব্যবধানে। সেই ভোট কটা এবার বিপক্ষ বাক্সে সরে গেলে যা হবে ভাবলে গায়ে জ্বর আসে। তাই এবার ভাটের ঢাকে কাটি পড়ার সাথে শহরের বিলাস বৈভব বিসর্জন দিয়ে সদলবলে গিয়ে পড়ে আছেন সাপ, জোঁক, মশা, বাঘ, কুমির, নোনামাটির দেশে ওনার বিধানসভা এলাকায়।

আমার কথা যেদিন আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তারিখটা ছিল ৩রা এপ্রিল ২০০৬। তখন নির্বাচনী প্রচার তুঙ্গে। এত বিপন্নতার মধ্যেও তার চোখ এড়ায়নি যে তারই স্কুলের রাধুনির ছবি কথা এক বিখ্যাত সংবাদপত্রের সিকি পাতা জুড়ে ছাপা হয়েছে। কিন্তু কোথাও এক লাইন তার কথা লেখা নেই। কেন নেই? এটা তো ঠিক নয়। বধির স্কুল কলকাতা শহর থেকে সামান্য দূরে। সকাল সাতটার মধ্যে এখানে পত্রিকা পৌঁছে যায়। সাতটা দশে আমি জেনে গেছি–খবর হয়ে গেছি। সাতটা চল্লিশে ফোন এল আমার কাছে।

অন্যদিন যদি কেউ আমাকে ফোন করে দারোয়ান বলে দেয়–সে কাজে আছে, ডাকা যাবে না। কিন্তু আজ তা বলতে পারল না ডেকে দিল আমাকে–বড় সাহেবের ফোন। এটা এক মন্ত্রীর আমার কাছে আসা জীবনের প্রথম ফোন। না, কোন অভিনন্দন-প্রশংসা-শুভবার্তা নয়। ফোনে ভেসে এল তার ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ রাগান্বিত গলা–তোর কথা পেপারে দেখলাম। এতে আমার কোনো কথা নেই কেন? কিছু বলিসনি?

বলেছি। সত্যি আমি বড় সাহেব সম্বন্ধে পঞ্চ পাণ্ডব সম্বন্ধে, অনেক কিছু বলেছিলাম। বড় সাহেব আমাকে দিয়ে কোনো কারণে ঘাস ছেঁড়ান, রায়দা কোন্ কারণে বলে, কুঁজোর চিৎ হয়ে শোবার চেষ্টা, কোন্ রাগে ওয়ার্ডেন আমার বিছানা থেকে আমার বউকে তুলে অন্যত্র সরিয়ে দেয়–সব বলেছিলাম আমি। দুরদর্শী সাংবাদিক ঋজু বসু বুঝেছিলেন, রাগের মাথায় আমি যা বলছি যদি তিনি হুবহু লিখে দেন, আমার বিপদ হবে। তাই যাতে আমার কোন ক্ষতি না হয়, স্কুলেরও কোন বদনাম না হয়, দু’কুল বাঁচিয়ে সংবাদটি পরিবেশন করেছিলেন তিনি।

এখন বড়সাহেবের জিজ্ঞাসার জবাবে কাঁদো কাঁদো গলায় অভিনেতার মতো বলি–আমি আপনার কথা বলেছিলাম। খুব ভালো ভালো কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম যে আপনি চাকরি না দিলে না খেয়ে মরে যেতাম। তাহলে আর লেখক হওয়া যেত না। আমি আজ যা হয়েছি সব আপনার দয়ায়। ওরা সে সব না লিখলে আমি কী করব।

আমার প্রথম বই বৃক্সে শেষপর্ব বের হবার পর বইমেলায় এক সাহিত্যপ্রেমী পুলিশ অফিসারের সাথে পরিচয় হয়। আমি কেমন করে লেখক হলাম, তার এই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম–আপনাদের দয়ায়। আপনারা ধরে মেরে জেল খানায় পাঠালেন বলেই তো দু লাইন লিখতে পারছি।

এই কথাটা সত্য, যে কোন খারাপই পুরোপুরি খারাপ হয় না। তার পিছনে কোনো না কোনো ভালো অবশ্যই থাকে। যেমন ভালোর পিছনে থাকে কোন না কোন খারাপ। মানুষ শুধু তাৎক্ষণিক ভালো বা মন্দটা দেখতে পায়। কিন্তু দেখতে পায়না বহুদুরের যে কোন ভালোর পিছনের মন্দ এবং মন্দের পিছনে লুকানো মঙ্গলটাকে।

আমি আজ যদি চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করি তাহলে এই সিদ্ধান্ততে আসি যে, এই দেশ–এই সময় সমাজ মানুষ যে দমনপীড়ার অত্যাচার চালিয়েছে তা না চালালে আমি কোনদিন লেখক হতে পারতাম না। ঘোড়ার পিঠে চাবুক পড়ে বলেই সে ছোটে-ওদের কষাঘাত আমাকে এগিয়ে দিয়েছে লেখক হবার দিকে। যে ধরনের কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে আমার জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, কাজের শেষে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে শরীর বিশ্রাম চায়। তখন আমাকে লেখার টেবিলের কাছে টেনে নিয়ে যায় ওদের কাছ থেকে পাওয়া অপমান অত্যাচারের জ্বালা। সে বলে, লেখ–তোকে লিখতেই হবে। ওরা তোর কলম থামিয়ে দিতে চায়, তা করতে পারলে ওরা জিতে যাবে। ওদের জিততে দিস না। ওদের জয় মানে তোর পরাজয়। হেরে যাবি তুই? না হারিস না। আরো শক্ত হাতে কলমটা আঁকড়ে ধর। লেখ তুই লিখে যা। তোর হাতের ওই কলমটা ছাড়া আর যে কিছুই নেই।

এই বোধ, এই তীব্র অপমান অত্যাচার-অমানবিকতা আমার লেখনিতেশক্তি জোগায়-সমৃদ্ধ করে, আক্রমক করে। চোখা চোখা তীক্ষ্ম এবং নিডর বাক্য উঠে আসেআমার কলমের ডগায় যা হয়ে যায় আমার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। দেখবার চোখ হয় বাজপাখির মতো প্রখর, ভাষা হয় আগুন আর অশ্রুর সংমিশ্রণে দাহক এবং ধারালো। প্রচলিত যা কিছু মহান, যা কিছু শ্রদ্ধার আমি তাকে দেখি, আমার লেখনিতে তা হয়ে যায় কার্টুন–তির্যক আর ব্যাঙ্গের বিষয়।

এই সব কিছুই আমার হয়ে ওঠার পিছনের কার্যকারণ। এবং হয়ে ওঠার পরে আমি আজ অবশ্যই উচ্চারণ করতে পারি যে দরিদ্র, তুমি মোরে করেছে মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান।

তাই আমি বড় সাহেবের কাছে কোন মিথ্যা বলিনি। যা হয়েছি সব ওনাদের জন্য। আমাদের এই স্কুলের কর্মচারি, সিপিএম পার্টি, বর্ণবাদী ধনবাদী ব্যবস্থা–সবাই আমার জীবন অতিষ্ট না করে তুললে আমি আজ যা হয়েছি হতে পারতাম না।

কিন্তু আমার সেই স্তোকে ঝানু রাজনীতিবিদের মন ভেজেনা। অনেকবার টিভিতে দেখিয়েছে ওনাকে হাজার বার নাম উঠেছে পেপারে, তাতে কী? এবার তো ওঠেনি। এটা কেন বাদ যাবে?

বলেন তিনি-পত্রিকায় একটা প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়ে দে। আমি বুঝে উঠতে পারি না এখানে প্রতিবাদপত্র লেখার যুক্তি কী? কেন আপনারা বড়সাহেবের নামে খুব সুন্দর সুন্দর কিছু লিখলেন না এই ভাবে কী কোনো সাংবাদিককে লিখতে বাধ্য করা যায়? সবাই জানে যে, যে সংবাদ ছাপা হয়েছে তার মধ্যে তথ্য-বিকৃতি ভুল বা মিথ্যা কিছু থাকলে তবেই তার প্রতিবাদ করা যায়। সে চিঠি ওরা ছাপে। বাবুর নাম নেই কেন? সে চিঠি ওরা কেন ছাপবে?

বাবুযখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন–আমার কথা নেই কেন?তখন আমার মুখে পাল্টা প্রশ্ন এসে গিয়েছিল কেন থাকবে? বলতে ইচ্ছা করেছিল এমন কী করেছেন আপনি আমার জন্য যে গদগদ হয়ে আপনার কথা বলব। তা বলতে পারিনি। ক্ষমতাবান লোক পাশবিক ক্ষমতা। এদের ক্ষতি করার অভিপ্সা বড় প্রবল যে। উনি আমাকে চাকরি দিয়েছেন, স্বীকার করেছি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো উপকার করেননি। আমার দরকার ছিল একটা কাজ আর ওনার দরকার ছিল একটা কাজের লোক। চাকরি দিয়ে উনি যদি আমার উপকার করে থাকেন, কাজ করে আমি তো ওনার উপকার করেছি। বারোজনের কাজ করছি দুজনে।

একটা গরুকে লোকে ঘাস জল দেয়। উপকার করে? তার দুধটা তো দুইয়ে নেয়, গাড়ি টানায়, হালে জুড়ে দেয়। তবে? ওসব না করতে পারলে দেবে ঘাস জল? না, বেচবে কসাইয়ের কাছে? দয়ার

তাই এখানে আমরা কেউ কারো প্রতি কৃতজ্ঞ নই। যে যার স্বার্থের খুঁটিতে বাধা।

আমার দুটো সত্তা। একটা পেটের কারণে পরের গোলাম। অন্যটা স্বাধীন–তার মালিক সে নিজে। তাকে দাসানুদাস বানানো বড় কঠিন। সে নিজেরে ছাড়া করে না কাহারে কুর্নিশ।

“যদি ভাবো চিনছো আমায়–
ভুল করেছো
আমি নয়, আমার মুখোশ
চিনছো তুমি
যদি ভাবো, কিনছো আমায়
ভুল করেছো
আমি নয়, আমার আপোস
কিনছো তুমি!”

স্কুলে আমার শত্রুপক্ষ এরপর মুখর হতে শুরু করে দেয়। বুঝতে পারি, বেলা যত বাড়বে শিক্ষক শিক্ষিকা অফিসস্টাফরা আসবে, ঝড় তত তীব্র হবে। কী বেইমান দেখেছে। বড় সাহেবের অন্ন খায়, তবু একবার তার নাম নিলোনা। একদিন এই নিয়ে সেই খাস খবর হবার সময়ে আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিল বাবুর এক অনুগামী। সে এই স্কুলের পিওন। সারাদিনে যার কাজ একবার মাত্র পোস্টাপিস, ব্যাঙ্কে গিয়ে চিঠি-চেক ফেলে আসা। আর বাকি সময় আড্ডামারা। বলেছিলাম তখন ওই কথা–মনোরঞ্জন নামের যে রাঁধুনি সে এই স্কুলের প্রতি কিছু কিঞ্চিৎকৃতজ্ঞ হলেও হতে পারে। কিন্তু লেখক মনোরঞ্জন তা নয়। সে যা হয়েছে কারো দয়া দান অনুকম্পায় হয়নি। বড় কষ্ট করে সে যা অর্জন করেছে সেই সফলতার জন্য সে কেন কারো মিথ্যা তাবকতা করবে?

সেই স্টাফ চিৎকার করে বলেছিল, বড় সাহেব আপনাকে চাকরি দেয়নি?

আমি কী একবারও বলেছি যে দেয়নি? সেটা আমার উপকারের জন্য নয়। বোবা বাচ্চাগুলোর জন্য। ওদের রান্না করার জন্য কাউকে না কাউকে তো চাকরি দিতেইহতো। এটা তার বাধ্যবাধকতা কাল যদি আর রান্না করতে না পারি তখন কী উনি আমাকে রাখবেন? যদি রাখেন তখন বলব উপকার করলেন। এখন কোনো উপকারের গল্প নেই।

সেদিন একটু বেশি মাত্রায় বাঁচাল হয়ে গিয়ে বলেছিলাম আমি–যারা রাজনীতি করে–ভোটের রাজনীতি, তাদের কাছে কবি শিল্পী সাহিত্যিক এদের খুব একটা মূল্য নেই। মূল্য আছে তাদের যারা ভোটের বাকসো ভরাতে পারে। আমার সে ক্ষমতা নেই। তাই তোমাদের কাছে যেমন আমার দাম নেই, আমার কাছে তোমাদেরও কোনো দাম নেই।

বলেছিলাম, বড় সাহেব উপকার করেছে তোমাদের। আসছো যাচ্ছো মাইনে পাচ্ছ কোনো কাজ করতে হয় না। বলো না আমাকে এই রকম একটা কাজ দিতে! যে দারোয়ান রাতে এসে ঘুমিয়ে সকালে বাড়ি চলে যায় দেবে সেই কাজটা? তাহলে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

এই ধরনের কথা তো রাজদ্রোহিতার নামান্তর। রাজার কানে গেলে বিপদ হয়, তবে সে কথা রাজার কানে দেবার আগেই রাজা তার চোখ অপারেশন করতে রুবি হাসপাতালে ভর্তি হন। অপারেশনের পরে চোখে ইনফেকশান হয়ে যায়। ফলে ওনাকে চেন্নাই যেতে হয়। দুমাসের মতো ভোগেন তিনি। একটা চোখ চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। যখন তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন, সে পুরানো কথা বলতে ভুলে গেছে।

এটা পুরানো নয়, টাটকা, আজকের ঘটনা। বড় সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন, কেন করেছিলেন বারোয়ান দাস জানে। ফলে তা বাতাসের বেগে সারা ইস্কুলে ছড়িয়ে যায়। রাজা যত বলে, পরিষদ দলে বলে তার শত গুণ। তাপদগ্ধ এপ্রিলের দুপুরে গনগন করে আগুন জ্বলে ওঠে। সে আগুন আমাকে বৃত্ত করে।

.

এবারের নির্বাচন চুকে গেল। ফলাফল হল দুপক্ষকেই চমকে দেবার মতো। যে দল হেরে যাবে বলে সবাই ধারণা করেছিল তারা আশাতীত ভালো ফল করল। ২৩৪। আর যে দল জিতবে ভেবেছিল, পেল মাত্র ৩৫সিট। জ্যোতিবাবু অবসর গ্রহণ করেছেন। খুব বদনাম হয়ে গিয়েছিল তার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সামনে রেখে এই সাফল্য এল। গঠিত হল সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। হাটে বাজারে পথে বাসে ট্রেনে চা দোকানে ভোটের আগে দশজন একত্র হলে ছয়জন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে কথা বলত। তারা ভোটও দিয়েছিল। তাদের সে ভোট কোন্ কৌশলে কোন্ বাকসে চলে গেল তা কে জানে।

তবে ভোট একটা যুদ্ধ। এখানে ছলে বলে কৌশলে যেভাবে হোক, প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করায় কোনো পাপ নেই। এটা মহাভারতের কাল থেকে স্বীকৃত। বড় সাহেবও জিতে গেলেন। স্বস্তির নিঃ শ্বাস পড়ল তার সমর্থকদের। আগামী পাঁচ বছরের জন্য আর কোনো চিন্তা নেই। আনন্দের জোয়ারে ভাসল সবাই। বস্তা বস্তা আবির উড়ল বাতাসে। এবার বড় সাহেব মন্ত্রী হলেন। কথায় বলে, গানেও আছে, কপালে সবার বুঝি সুখ সয়না। এত মহানন্দের মহাপ্লাবনের মধ্যে অল্প কয়েকদিন পরেই নেমে এল এক নিদারুণ শোকের ছায়া। তার স্ত্রী আত্মহত্যা করে বসলেন।

কেন আত্মহত্যা করলেন তার স্ত্রী? সেকি এক পথভ্রষ্ট স্বামী না আদর্শচ্যুত এক নেতার উপর মোহভঙ্গ হবার দুঃখে, সেটা কেউ জানেনা। জানলেও কেউ মুখ খোলেনি।

তবে তার শোকে বধির বিদ্যালয় দশদিন মুহ্যমান হয়ে রইল। দশদিন পরে এই স্কুলকেই বেছে নিলেন বড়সাহেব। তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানের জন্য। এর একটা সুবিধা হল এই যে, অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন সবই স্কুলের কর্মীদের দ্বারা সেরে নেওয়া গেল। বড় সাহেব প্রতি বছর তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানও এখানে করেন। এতে অনেক কম খরচে সারা হয়ে যায়।

তবে বড় ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান এখানে করতে পারেননি। কয়েক হাজার লোকের নিমন্ত্রণ ছিল। এত লোকের এখানে সংকুলান হতো না। সেই অনুষ্ঠানে স্কুলের সবাই গিয়েছিল। ছোট বড় সবাই, শুধু আমি একা বাদ। আমার কোনো নিমন্ত্রণ ছিল না।

আর এবারও, সব কর্মচারির কাছে তার স্ত্রীর শ্রদ্ধা বাসরে যোগদানের অনুরোধ সম্বলিত ছাপাননা পত্র পৌঁছে গেছে। শুধু আমার নামে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। তবে এখানে থাকতে হবে। আমার ডিউটি যে।

অনেকদিন তা প্রায় বছর পাঁচেক আগে এক বিকালে এই স্কুলে এসেছিলেন বড়সাহেব। তখনো তিনি এম.এল.এ. হয়নি মন্ত্রী হননি। তাই খুব বেশি একটা কাজের চাপ ছিল না। তখন মাছ মারা, আড্ডা, দুপুরে ঘুমাবার মতো অবকাশ পেতেন। মাছ মারার জন্য এখানে বড় পুকুর আছে, আড্ডা দিতে চাইলে ফোনে লোক ডেকে নিতেন। ঘুমের জন্য এসি বসানো নিজস্ব কামরা আছে। এই এসি আমাদের বেতন কেটে লাগানো হয়েছিল। আমার বেতন থেকে নেওয়া হয়েছিল সাড়ে আটশো টাকা। সেদিন সেই এসি লাগানো ঘরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে, যারা রান্না করে তাদের নাগালে থাকে মাংস মাছ ডিম। ফলে তারা খুব খায়। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে এর একেবারে বিপরীত। তারা খায় না, খেতে পারে না।

আমি অবশ্য খেতাম। কিছুতেই আমার মাথায় আসেনি যে সেটা কোনো অন্যায়। সকাল ছটা সাড়ে ছটা তখন কাজে আসতাম, যেতে যেতে সেই সাড়ে এগারো-বারোটা। এত সময় খিদে সহ্য করা যায় না, তাই মুড়ি খেয়ে নিতাম ডাল বা ঝোল দিয়ে। রবিবার লুচি হয়। তাও খেয়ে নিতাম দু চারখানা। সেটাই কেউ ওনার কানে দিয়েছে।

বড় সাহেবের একটা অসাধারণ গুণ আছে, যখন তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করেন, আসলে তখন ওনার ভিতরটা থাকে একদম ঠাণ্ডা। আর যখন উপরটা ঠাণ্ডা দেখায়, ভিতরটা থাকে গনগনে গরম।

সেদিন সেই সময়, যখন উনি ধীর স্থির শান্ত। আমাকে দেখে নরম গলায় বলেন তিনি তোমরা এখানে চাকরি করে। তার জন্য বেতন পাও। বাকি পাওনা? তা হলে বাচ্চাদের খাবার কেন খাও? খাবে না। আজকের পরে আমি যেন কোনো দিন না শুনি।

আগে যখন অনু আসেনি, আমি এখানে থাকতাম। তখন সেই ডাল মাছ ডিম যা সবাই খায়, আমিও খেতাম। সেটা কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। অনেকেই জানত। যেটা অনেকে জানে না তা হল এর জন্য আমার কাছ থেকে দাম কাটা হয়েছে। বাবুর কাছে কোন সূত্রে প্রথম খবরটা পৌঁছেছিল। পরের খবরটা পৌঁছায়নি। তাই তার মাথায় চেপে বসেছিল সেই খবরটা আমি খাই। তবে তখন সেটা অপরাধ হলেও ক্ষমার যোগ্য ছিল, কারণ বেতন পেতাম না। এখন আর ক্ষমা করার মতো নেই কারণ এখন বেতন পাই।

বড় সাহেব এখানকার প্রতিদিনের খবর পেয়ে থাকেন। সে ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তাই কেরানি রায় কী করে না করে তা ডানহাত তার কানে দেয়, সে কী করে বলে আসে বাল্যবন্ধু। তার খবর দিয়ে আসে মাদার, আমি কী করি না করি তার দিকে তো অনেকেরই তীক্ষ্ম নজর।

যারা কথা বলতে পারে আর যারা পারে না দুপক্ষের মধ্যে সংবাদ আদান প্রদানের একটা মস্ত অসুবিধা ভাষার। বোবারা চা আর কফি, পানীয় জল আর শরবত, ইলিশ, আর তেলাপিয়া, দুটোর পার্থক্য আলাদা করে বুঝিয়ে বলতে পারে না। যত সময় ধরে বুঝিয়ে বলবে সাধারণ মানুষ বোঝাবার সময় দেবে না।

বোবারা, যাদের অনেক ক্ষোভ-অনেকঅভিযোগ, সুযোগ পেলেই কিছু বলতে চায়, তাদের সামনে নিজের ডান হাতের চারটে আঙুল মুখের কাছে এনে ইশারায় আমার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন বড় সাহেব–এখনও খায় নাকি রে? বোবারা ঘাড় কাত করে জানিয়েছে-খায়। তবে ডালে ভেজানো মুড়ি আর ভাতের যে মৌলিক পার্থক্য, বোঝাতে পারেনি। ফলে বাবুর মাথা গরম। সব খেয়ে নিল রে।

যাইহোক, সেদিনের খিচুনি খাবার পর থেকে আর এখানকার কোনো খাদ্যদ্রব্যের দিকে ফিরেও তাকাই না। কত অনুষ্ঠান হয়, কত রকমারি মেনু। কত কত লোক খায়। সব আনন্দ উৎসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখি নিজেকে। ‘ওরা’ আমাকে খেতে বলে না আমিও খাই না। মনে দুঃখ পাই, তখন মনকে বোঝাই ওরা এই রকমই সিপিএম যেরকম হয়।

একদিন স্কুলে কী যেন একটা অনুষ্ঠান ছিল–যতদূর মনে পড়ে সরস্বতী পূজো। যাতে প্রতি বছরের ন্যায় সে বছরও আমার দেড়শো টাকা চাঁদা কাটা হয়েছিল। সেদিন আমার ছেলে মানিক, তার বয়েস তখন দশ কি বারো, বাবার স্কুলের পূজো দেখতে এসে পাড়ার অনেক বাচ্চার সাথে নিমন্ত্রিতদের মাঝে খিচুড়ি ল্যাবড়া খেতে বসে গিয়েছিল। কাউকে কিছু বলেনি কেরানি রায়, শুধু আমার ছেলেকে চিনতে পেরে ঘর ভর্তি লোক, আর স্কুলের একগাদা কর্মচারির চোখের উপর, আমাকে ধমকে দিয়েছিলেন–এটা কী বিয়ে বাড়ি নাকি যাকে ইচ্ছা ডেকে এনে খেতে বসিয়ে দেবেন।

সেদিন লজ্জা অপমানে মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম আমি। সবাই বড় মজা পেয়ে মুখ টিপে হাসছিল। একমাত্র প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল ‘ছোটজাত’সমপাল। সে এই স্কুলের জমাদার-এ্যাই, ইরোকাম বোলবিনা, বোলবি নাই-ই রকম। আমাদের সোব্বার বাচ্চা আছে, এ্যাকজনকে বোলছিস, সোব্বার গায়ে লাগছে।

এই ঘটনা নিয়ে স্কুলে পরে তুলকালাম হয়েছিল, যাতে রায়কে ক্ষমা চাইতে হয়। সেটা সে স্বেচ্ছায় নয়, চেয়েছিল চাপে পড়ে। তাই সে রাগ আজও রয়ে গেছে। একটা মেয়ের অপমান হলে সেটা যেমন সমগ্র নারী জাতির অপমান, একটা বাবুশ্রেণির লোকের মান গেলে অপমান বোধহয় সব বাবু সমাজের। রায়ের ক্ষমা যাচনায় তারই সমমনস্ক আর এক বাবুর বুকে বড় লেগেছিল। যার ধারণায় ক্ষমা চাওয়ানোটা একটু বাড়াবাড়ি। রায়দার মুখের ভাষাটা একটু ঠিক নয়, তাবলে সে যা বলেছে, কথাটা তো ভুল না। স্কুল একটা প্রাইভেট সেক্টর। যে ইচ্ছা ঢুকে গেল, যার ইচ্ছা খেতে বসে গেল–এই নিয়ম চলে না।

যে রায় স্কুলের সামান্য খিচুড়ি খাওয়ায় একদিন জ্বলে উঠেছিল, সেই তিনি একদিন লক্ষ লক্ষ শোনা যায় দশ লাখ, খেয়ে ধরা পড়ে গিয়ে এখন বড় মনমরা জীবন কাটাচ্ছেন।

তবে তখন, বড় সাহেবের ওই আদেশের বলে, ওয়ার্ডেন আমার উপর রায়ের অপমানের একটা বদলা নেবার অস্ত্র পেয়ে গিয়েছিল পেট টিপে পরীক্ষা-মুখ গুঁকে গন্ধ পরীক্ষা, এই সব শুরু করেছিল। আসুন আসুন–এদিকে আসুন। কী ব্যাপার, পেটটা এত মোটা কেন! এতেকী ঢোকালেন? মুখে ভাজা মাছের গন্ধ মনে হচ্ছে।

সে যাইহোক, সেদিনের শ্রদ্ধানুষ্ঠান গণ্যমান্য অতিথিদের উপস্থিতিতে সুসম্পন্ন হয়ে গেল। যাদের শোক খুব বেশি তারা ভাত ফাত না খেয়ে এক প্লেট মিষ্টি, কিছু কাজু বাদাম এইসব খেয়ে চলে গেলেন। সেদিন বাবু আমাকে বার দশেক দেখেও না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন। উনি চলে যাবার পর আমার মনে হল, এত শোকের নীচে সম্ভবত সেই আনন্দবাজার জনিত ছোট্ট শোকটা চাপা পড়ে গেল। কিন্তু তা যে যায়নি টের পেলাম দিন পনের পরে।

সেদিন কিছু উদারমনা প্রতিবন্ধী দরদী গণ্যমান্য লোককে নিয়ে তিনি বোবাদের স্কুল পরিদর্শন করাতে নিয়ে এলেন। তারা মানব সেবার এমন মহৎ কর্ম চর্মচক্ষে অবলোকন করে কত টাকার চেকে সই করলেন তা কে জানে। তবে তারা বিল্টুদায় হবার পর বড় সাহেব ধরলেন আমাকে প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছিলেন?

বলি–নিজে গিয়ে দিয়ে এসেছিলাম।

ছাপা হয়নি তো! কার কাছে দিয়েছিলে? আমি খোঁজ নেব।

এখন কী বলি আমি কার ঘাড়ে দোষ চাপাই? এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলি–ঋজু বসু ছিলেন না, কোথায় যেন গিয়েছিলেন। রিসেপশান কাউন্টারে যে মহিলা ছিলেন, তিনি বললেন–চিঠি লেটার বক্সে ফেলে দিন। তাই করেছিলাম।

কী লিখেছিলে চিঠিতে কপি আছে?

আমি জানতাম, এমন একটা সমস্যা আসতে পারে। প্রস্তুত হয়েই আছি। একটা চিঠি লিখে আসলটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে তার জেরক্সটা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম ব্যাগে।এখন সেটা বার করি–এই যে।

পড়।

পড়ি সেই চিঠি। মাননীয় সম্পাদক মহাশয়, আপনাদের পত্রিকায় গত ৩ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে ঋজুবসুর প্রতিবেদন–মহীরুহনয়, লড়াকুবটের চারাই তার প্রেরণা–বিষয়ে এইপত্রের অবতারণা। একজন অতি সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম নিয়ে যে দরদ যে আন্তরিকতায় শ্রী বসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন, তার জন্য ওনাকে কোন্ ভাষায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব তা আমার জানা নেই। তবে আর একটু ভালো হতো, যদি বড় সাহেবের বিষয়ে কিছু কথা থাকত। ওনার অনুগ্রহ না পেলে আশ্রয় এবং অন্ন সমস্যার সমাধান হতো না। আর তা না হলে এমন নিশ্চিন্তে সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন থাকতে পারতাম না। আশা করি আমার এই চিঠিখানি প্রকাশ করে এই ভুলের সংশোধন করবার একটা ব্যবস্থা নেবেন।

নীচে আমার সই এবং তারিখ। চিঠির বয়ানে উনি কী সন্তুষ্ট, নাকি চিঠি ছাপা না হবার জন্য ক্রুদ্ধ, মুখ দেখে বোঝা গেল না। আমি কিছু বুঝিবা না বুঝি, যারা বোঝার তারা বুঝে গেল, আমার দ্বারা একটা গর্হিত অপরাধ হয়ে গেছে। যেটায় বড় সাহেব মনে বড় ব্যথা পেয়েছেন। যে খরগোশ বাঘের মনে কষ্ট দেয় তাকে শেয়ালে মারলে তার উপর বাঘ খুশি বই অসন্তুষ্ট হয় না। যারা আমার প্রতি নানা কারণে ক্রুদ্ধ তারা এবার বুঝে নেয় এবার মনের ঝাল ঝাড়ায় আর বাধা রইল না।

আমার পিছনে কোনো দাদা, মামার খুটির জোর নেই, যা তাদের আছে। তবু আমি মাথা নত করি না, এ কী সহ্য হয় কারো!

তবে রাগে তারা একেবারে অন্ধ বা দিশেহারা হয়ে যায় না। অনেকটা দুর তারা দেখতে পায়। আমি তাদের বলে দিয়েছি, আমার চাকরি চলে গেলে, ছাড়িয়ে দিলে, আমি কী করব বলে দিয়েছি, আমার আদর্শ মুম্বাইনগর পালিকার বরখাস্ত কর্মী খেরনার। যে একা একটা আন্দোলন হয়ে উঠেছিল। তখন জনগণের চাপে বাধ্য হয়ে তাকে পুনঃবহাল করতে হয়েছিল। আমি তাই করব। টিভিতে, পত্রিকাতে যেভাবে আমার কথা লেখা, বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সহানুভূতির কেন্দ্রে পোঁছে গেছি। এটাই আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তাদের কাছে বিচার চাইতে যাব। তখন কী হবে?

ওরা বোঝে–আমি শহিদ শঙ্কর গুহ নিয়োগীর আন্দোলনে ছিলাম। ফলে পশ্চিমবঙ্গের গণসংগঠনগুলোর আমার প্রতি একটা টান থাকা স্বাভাবিক। গল্প লিখি। লিখতে এসেছি একেবারে নীচের তলা থেকে। ফলে নীচের তলের মানুষ আমাকে নিজেদের লোক মনে করতে পারে। আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলে জনমানসে শহিদের মর্যাদা পেয়ে যাব। সেটা সঠিক হবে না।

জনগণ, এ এক বড় বিচ্ছিরি জীবের নাম। এরা কখন যে কী করে বসে জ্যোতিষের বাপের সাধ্য নেই বলে দেবে। মানুষ নামের এই জীবরা খেপে গেলে ক্ষমতাবানকে এক মুহূর্তে ক্ষমতার চূড়া থেকে টান মেরে মাটিতে ফেলে দিতে পারে। ফলে তারা ফুঁ দিয়ে দিয়ে চা খাওয়ার পথ পদ্ধতি নেয়। ধীরে ধীরে তারা এগুতে থাকে একটা সুনিয়োজিত পরিকল্পনা অনুসারে। তারা এমন একটা পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় আমিও যেন সন্দীপবাবুর মতো কাউকে কিছু না বলে রাতের অন্ধকারে কেটে পড়ি।

.

রমা এক মহিলা, এসেছিল হোস্টেলের মেয়েদের দেখাশুনো করার কাজে। সে বড়ই সাহসী আর স্বাভিমানী ছিল। কাউকে বিশেষ পাত্তা দিত না। মাদার চাইত পদানত করবে, সে চাইত স্বাধীন থাকবে, এই নিয়ে একটা শীত-যুদ্ধ শুরু হল দুজনার মধ্যে। রমার ছিল মানসিক শক্তি আর মাদারের পিছনে ছিল সুপার ও ওয়ার্ডেন। হঠাৎ একদিন দেখা গেল চারদিকে কানাঘুসো হচ্ছে। কী ব্যাপার? না, রমার স্বভাব ভালো নয়। রমার স্বামী থাকে দেশে, সে এখানে থাকে একা দোতলার লেডিস হোস্টেলে। রাতকালে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চুপচাপ সে নাকি নীচে নেমে যায়। কোথায় যায়? যায় এক দ্বারোয়ান-যার বউ বিহারে রয়েছে, সে এখানে থাকে একা, তার কাছে। প্রমাণ স্বরূপ এখানে ওখানে ব্যবহৃত নিরোধ পাওয়া গেল বেশ কদিন ধরে বেশ কয়েকটা। সেই খবর একদিন কেঁদে ঝাঁকিয়ে বড় সাহেবের কানে দিয়ে এল মাদার ফলে এখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন বড়সাহেব। লজ্জা অপমানে মাথা নীচু করে চলে গেল সে।

মাঝে আর একটা মেয়ে এসেছিল সুপ্তি নামে। সেও মাদারের মনোমত না হওয়ায় চোখের জলে নাকের জলে হয়ে চলে যায়। এরপর আসে কানন। সে বেচারার বিয়ে হয়নি। আর হবেও না। জগতে তার তেমন আপন কেউ নেই। এখানে একটা কাজ পেয়ে ভেবেছিল জীবনটা এই সব মেয়েদের সাথে কেটে যাবে। খুব ঠাণ্ডা খুব নরম, সাত চড়ে রা কাড়েনা, হাঁটলে মাটি টের পায় না–এমন শান্ত মহিলা। কেন কে জানে তার পিছনেও লেগে গেল মাদার। রোজ ঝগড়া, নোংরা ভাষায় কদর্য গালাগালি দিয়ে তাকে অতিষ্ট করে তুলল। শেষে সেও কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।

এবার এই মাদারকে উসকানি দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হল আমার পিছনে।তিন তিনবার সফলতার কারণে মনোবল তার তুঙ্গে। মাছ চুরি ধরা, দুধ নেওয়া নানাবিধ কারণে সে আমার উপর ক্ষিপ্ত তো ছিলই। বলে না–একে মা মনসা, তার উপর ধুনোর গন্ধ। পিছনে খুঁটির জোর পেয়ে সে হামলে পড়ল তার গালাগালি অস্ত্র নিয়ে।

একদিন–সেদিন তখনো বাচ্চাদের টিফিন দেওয়া হয়নি, মাপের মুড়ি-বাতাসা থেকে ইচ্ছেমতো বাতাসা ভরে নিচ্ছল একটা ঠোঙায়। অত একা নেবেন না। আমার সবাইকে দিতে হবে। বাধা দিলাম আমি। তখন একটু ঝগড়া মতো হয়ে গেল। একটু ঝগড়া, তাতেই তুই তোকারি। যে ভাষায় উনি বললেন আমিও জবাব দিলাম সেই ভাষায়। আমি তখনো অসহায় এক মহিলা-কাননের উপর অত্যাচারের কথা ভুলতে পারিনি। তাই বয়স্ক বলে সম্মান দেবার ব্যাপারটা মাথায় ছিল না।

তখনকার মতো ব্যাপারটা থেমে গেল। তখন সময় সকাল সাতটা। তিন ঘন্টা পরে ওয়ার্ডেন এল তার বাচ্চা গোনা ডিউটিতে। তখন ফুঁসতে ফুঁসতে মাদার ছুটে এল তার সামনে নালিশ নিয়ে বাবা, এই কুত্তার বাচ্চাকে বারণ করে দাও, আমার সাথে যেন লাগতে না আসে।

কুত্তার বাচ্চা। ছোট্ট দুটো শব্দ। মাথার মধ্যে যেন দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। ভুলে গেলাম কোথায় আছি। আমার সামনে পিছনে ডানে বামে কারা দাঁড়িয়ে আছে। ছুটে গেলাম তার দিকে শুয়োরের বাচ্চা, আর একবার বল কি বললি, তোর পেটের উপর পা তুলে দিয়ে জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব। আমাকে কানন পেয়েছিস নাকি। মারব শালী, দাঁতফাঁত সব পেটে ঢুকে যাবে।

পাল্টা আক্রমণ এত তীব্র হবে সে বুঝতে পারেনি। একটু মিইয়ে গেল। তবে ফোঁস করতে ছাড়ল না–আমি রজতকে বলব। রজত মানে বর্ধমানের সাইবাড়ি খুনে কেসের এক আসামি।

চিৎকার করে জবাব দিই আমি বোলো, যাকে ইচ্ছা বোলো, কী করবে আমাকে? খুন করবে? আসতে বোলো।

বলার দরকার নেই, এটা নিয়ে পরে একটা ঝড় উঠেছিল। দু-একটা শুকনো পাতা উড়েছিল। তবে তা আমার কাছে তেমন কিছু নয়।

এর কিছুদিন পরে, ময়দানে নামলেন বাল্যবন্ধু। এ যেন সেই কুরুক্ষেত্রের মহারণ। এক সেনাপতির পতন হলে তার জায়গা নিচ্ছে অন্য আর একজন। সেদিন রাত আটটা নাগাদ লোডশেডিং হয়ে গিয়েছিল। স্কুলে জেনারেটর আছে।বললে যে চালাতে জানে, সে চালিয়ে দেয়। আমি চালাতে জানি না। শিখিনি।

আমি আর আমার সহকারি দুজনে রান্না ঘরে ছিলাম। এমন সময় ঝুপ করে অন্ধকার। একটা ফেজ গেছে, তাই রান্নাঘর অন্ধকারে ডুবে গেলেও অন্য বিল্ডিং-এ আলো আছে। আমি অন্ধকার হাতড়ে বাইরে এসে ‘ডানহাত’-কে সামনে পেয়ে বললাম তাকে, জেনারেটর চালাতে হবে। সে আবার ফোনে কাকে যেন নির্দেশ দিল–জেনারেটর চালাও। অন্ধকার, আমি এখন কী করব? যতক্ষণ আলো না জ্বলে কাজ করা যাবে না। তাই বলে পড়লাম একটা পাতানো চেয়ারে–বাইরের আলোয়।

এই সময় কী করতে যেন রান্নাঘরে যাচ্ছিল বাল্যবন্ধু। অন্ধকারে বাধা পেয়ে ফিরে এসে দেখে, আমি বসে আছি। বড় সাহেবের বন্ধু, গলায় তার সেই দর্প দম্ভ অহঙ্কার অধিকার। সেই অধিকার এখন বর্ধিত হয় আমার উপর। তুমি এইখানে ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং দিয়া বইসা আছে, একজোন ওইখানে একলা ভূতের নাহান বইয়া আছে। কোন চিন্তা নাই তোমার।

বলি-আমি তো দাদাকে বলেছি।

কী কইছো?

জেনারেটার চালাতে।

সে জেনারেটার চালায়?

উনি কাকে যেন চালাতে বললেন।

কারে?

আমি ঠিক জানি না।

তেড়ে এলেন উনি আমার দিকে, ওঠো, দেখো গিয়া। কে চালায়।

আমি উঠি না, চেয়ারে বসেই থাকি। বসে বসেই বলি, যাকে বলার বলেছি, উনি কাকে যেন বলছেন। পাঁচ দশ মিনিট দেখি।

কইলেই হইয়া গেল। ওঠো চেয়ার থিকা।

তবু আমি উঠি না। ওনার হম্বিতম্বিকে আমলই দেই না। এটা ওনার বড় সম্মানে লেগে যায়। আর তাই এক ধাক্কায় আমাকে চেয়ার থেকে নীচে ফেলে দেন। উনি লোককে মারতে বড় ভালোবাসেন। প্রতিবন্ধী মালি, নাইট গার্ড সাহা, দু-চারটে বোবা বাচ্চা একবার তো মাস্টার দাসকে পেটে বুকে দুমদাম ঘুষি মেরে দিয়েছিলেন। যারা এই বাবুর হাতে মার খায় তাদের বলার মতো কোনো জায়গা নেই। শোনাবার মতো কোনো লোক নেই। সেই মনোবলে আজ আমাকেও মেরে বসেছেন।

কিন্তু আমি আমি তো সেই মানুষ, যে, শ্রদ্ধেয়দের শ্রাদ্ধ করার সুযোগ পেলে আর ছাড়তে পারি না। এখানে যে তেমন কেউ আছে তা তাদের আচার আচরণে বোঝাই যায় না।

এরা শক্তিমান। শক্তির উৎস, একটি রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা এবং ডাণ্ডা। তবে সম্মানীয় কেউ নয়। অন্ততঃ আমার কাছে। তাই আমাকে মেরে আজ তিনি পার পেলেন না। মাটি থেকে উঠে সজোরে আমিও দিয়ে দিলাম এক ধাক্কা। বোঁটা কাটা কুমড়োর মতো বিশাল ওজোনদার দেহ নিয়ে পতিত হলেন মাটিতে।

তারপর আর তিনি এই স্কুলে কারো গায়ে হাত দেননি। পুরো অহিংস।

.

একদিন মণ্ডল পদবির একটা ছেলের সাথে মারামারি হয়ে গেল। মারামারি নয়–মার। এক চড় জমিয়ে দিলাম তার গালে। গ্রাম থেকে আসা মাথা মোটা ছেলে। কেউ তাকে বাড় খাইয়েছিল। তাই তার ধারণা হয়েছিল–আমি একটি অপমানযোগ্য প্রাণী। হাঁটুর বয়েসী তবু তুই তোকারি করে কথা বলত। কেউ তাকে উস্কে দিয়েছিল। বারণ করলে আরো বেশি করত। বেশ মজা পেয়ে গিয়েছিল।

এই স্কুলের কেউ নয়–আশ্রিত। যাদের ভয়ে সে পাড়া ছেড়ে পালিয়ে এসেছে তারা সিপিএম। যারা তাকে আশ্রয় দিয়েছে, তারাও সব সিপিএম। একেই বলে রাজনীতি। সেই যে, সেবার যার পরিচিতি… ডাক্তার বলে, সে মার্ডার হয়। সেই কেসের কার্য-কারণ অনুসন্ধানে অঞ্চলের অনেকের সন্দেহের তির বড় সাহেবের দিকে গিয়েছিল।… ডাক্তার সিপিএম নেতা, যারা তাকে খুন করে তারাও সব ওই পার্টির লোক। হতে পারে কেউ তাদের বুঝিয়েছিল, ডাক্তার লোকটা ঠিক নয়। গোপনে দল বিরোধী কাজ করছে। ওকে সরিয়ে দাও। সেই কেউ, ওদের তিন লক্ষ টাকাও দিয়েছিল বলে জানা যায়। জানা যায় না তার পরিচয়।

এই খুনিদের দলে মণ্ডল ছিল। যখন … ডাক্তার তার ডাক্তারখানা বন্ধ করে ভ্যান রিকশা চেপে বাড়ি ফিরছিল, মাঠের মধ্যে তাকে খুনিরা গুলি করে, চপার দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে। অকুস্থলে সে ছিল না। ছিল একটু দুরে। খুনিরা পালিয়ে যাবার সময়ে তার কাছে তিরিশ হাজার টাকা আর তাদের সাইকেল রেখে যায়।

গোটা দলটা ধরা পড়ার পর সে রাজসাক্ষী হয়ে যায়। তাকে থানা থেকে মুক্ত করা, এখানে এনে রাখা, কোর্টে নিয়ে গিয়ে সাক্ষী দেওয়ানো, এই পুরো প্রক্রিয়াটা বড় সাহেবের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। খুনিদের চারজনের যাবজ্জীবন সাজা হয়। আর বড় সাহেব তার ভূমিকার জন্য যেটুকু যা বদনাম হয়েছিল তা মুছে যায়। যে… ডাক্তারের খুনিদের প্রতি এত নির্মম, তার নামে… ডাক্তারের হত্যার দায় চাপানো একটা হিমালয় তুল্য ভুল।

সেই থেকে মণ্ডল সপরিবারে এই স্কুলে আছে। বড় সাহেবের অনেকটা বাড়ি। সেইসব বাড়ির বাগানটাগানগুলোর দেখাশুনো করে। রাজার বাড়ির কুকুর রাজার এঁটো খায়, তাই তার মধ্যে প্রকাশ পায় রাজকীয় দম্ভ। বড় সাহেবের আগে পিছে ঘুরঘুর করে তার ধারণা জন্মে গেছে সে আমাকে অপমান করতে পারে। সেও একজন কেউকেটা–তাই তুই তোকারি।

আমি যখন রিকশা চালাতাম, তখনই কেউ ওই ভাষায় কথা বললে তাকে ছাড়তাম না। এখন কেন ছাড়বো।

বলি তাকে পাঁচিলের মধ্যে আছি তাই ওইসব কথা বলে পার পেয়ে যাও। এখানে আমার হাত পা বাঁধা। যদি হিম্মত থাকে একবার গেটের বাইরে গিয়ে তুই তোকারি করে দেখাও।

সে ছুটে গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়, কী করবি কর, বান্ডিল করে দেয় রে।

আমি আর কী করি? মদন হয়ে যাই এক মুহূর্তের জন্যে। সেই বাইশ চব্বিশ বছরের মদন। হাত চালিয়ে দিই।

.

আর একদিন, সেদিন–

না, কোন মারপিট হয়নি। তবে হতে পারত। যেভাবে গায়ের কাছে ধেয়ে ধেয়ে আসছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম, আগে ও আমার গায়ে হাত দিক। আর তা দিলে আমি জানিনা, কী হয়ে যেত। একটা ধারালো বঁটি ছিল আমার নাগালে।

ব্যাপারটা আর কিছু নয়–ইগো। আমি তোমার ‘অফিসার”। আমি বলছি, সেটা ভুল হোক ঠিক হোক, মানতে হবে। মানাবো তোমাকে দিয়ে।

রান্নাঘরের জন্য একটা নতুন ওভেন আনা হয়েছে। দুটো ছিল এখন তিনটে হল। এবার থেকে তিনটে বড় ওভেনে রান্না হবে। তোক বেড়ে গেছে খাবার। প্রায় ষাটটা মেয়ে এসেছে নার্সিং ট্রেনিং নিতে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে। তারাও এখানে খাবে।

এখানে এটা হয়, এক বধির স্কুলের রন্ধন শালায় দশটা অন্য সংস্থার রান্না খাওয়া হয়। এনার্জি পার্ক, সম্মিলনী প্রেস, রুবীর কাছে কেকের দোকান মনজিনিশ, বিগ বাজারে কাছে এক এক অসুধের দোকান, এখানকার বি.এড, কলেজ, কোথাকার এক এস.টি.ডি.বুথ পাশের এক সেলাই কারখানা–কত জায়গার লোক যে এখানে খায় কে জানে। তারা মাস গেলে টাকা দেয়। কে নেয়, তা কে জানে!

রান্নাঘরে রান্না আমরা করি, কোনদিকে ওভেনটা বসালে আমাদের কাজে সুবিধা হবে, সেটা আমরা বুঝি। কিন্তু না, সেখানে বসাতে দেবে না। বসাতে হবে ওয়ার্ডেনের পছন্দমতো জায়গায়। আমাদের অসুবিধা হলেও। আর সে তাই চায়। বিকৃত মানসিকতার মানুষ, মানুষকে বিপদে ফেলে কষ্ট দিয়ে অসুবিধা ঘটিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পায়। রুনু গুহ নিয়োগী মহিলা বন্দীদের যোনীতে গরম ডিম সেদ্ধ ঢুকিয়ে দিত। এ তারই ভক্ত।

ফলে যা হবার তাই ঝগড়া। ছুঁড়ে মারা ভাষার আর কোনো যা বাপ থাকে না। আসলে এতে কোনো সাধারণ ঝগড়া নয়, এক দলকশ্রেণির বিরুদ্ধে এক দলিতের প্রতিবাদ। একটা হার্মাদ পার্টির হার্মাদ সরকারের হার্মাদ সদস্যের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের নিজস্ব ভঙ্গি।

.

এই সময় মমতা ব্যানার্জী সিপিএম-এর আশ্রিত ডাকাত, গুণ্ডা, ধর্ষক, প্রমোটার, ঠিকাদার সবকিছুর সম্মিলিত বাহিনীকে একটা নতুন নাম দিয়েছেন-হার্মাদ। এর আগে বলতেন ভৈরব বাহিনী। ভৈরব শিবের আর এক নাম। শিব সারল্য-সাহস-ন্যায়নিষ্ঠ-স্মরণাগত রক্ষক, নির্লোভ এক দেব। তারই বাহিনীর নাম ভৈরব বাহিনী। সিপিএম দুবৃত্তদের এই নাম যথোপযুক্ত নয়। সেটা কানা ছেলেকে পদ্মলোচন বলা। তাই হার্মাদ। যা একটা বিদেশি, দস্যু লুঠেরা দলের নাম। সিপিএমের পক্ষে যথার্থ নাম।

 এই সময় ছোট আঙারিয়ার হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়ে গেছে। সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাত, জ্যোতি বসু, বিনয় চৌধুরী নয়–দলের সম্পদ হিসাবে সামনের সারিতে চলে আসছেতপন-সুকুর, মজিদ মাস্টার এইসবনাম। যে সিপিএম একদা বলেছিল টাটা বিড়লারা শোষক-দেশের জনগণের শত্রু। তারা এখন মনোভাব বদলে টাটাকে কমরেড় বানিয়ে নিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছেন “টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেবনা।” যেতা করতে চাইবে–”মাথা ভেঙে দেব”। যে সালেম একদিন ইন্দোনেশিয়ায় লক্ষ লক্ষ কমিউনিস্টদের হত্যা করেছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এক সিপিএম নেতা, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের লুঠ করায় খোলা ছুট দিয়ে আনন্দে গদ গদ চিত্তে মৌ চুক্তি স্বাক্ষর করে বলে উঠলেন এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন।

যেদিন তিনি প্রথম পার্টি মেম্বার হলেন–সেদিন নয়, যেদিন প্রথম বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল সেদিন নয়, যেদিন তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলেন সেদিনও নয়, সর্বাপেক্ষা আনন্দের দিন সেদিন, যেদিন দেশের কৃষকদের সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করার পথে প্রথম পা রাখলেন। এত দিনে বোঝা গেল সিপিএম দলটাকে রাজনৈতিক এইচআইভি-র জীবাণু পুরোপুরি কবজা করে নিয়েছে। শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্রের বদলে পুঁজিবাদী সমাজতন্ত্রের যে পথে তারা হাঁটা দিয়েছে ওই পথ আমেরিকার বড় পছন্দের।

এক সময় শুনতাম মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান। আর আমরা সেটা বিশ্বাসও করতাম। এখন দেখেছি সব ‘বাদ’-এর চেয়ে শক্তিমান–পুঁজিবাদ। পুঁজির এত ক্ষমতা যে, আগমার্কা মার্কসবাদীকেও রূপোর জুতোর তলে পিষে দিতে পারে। যে কারণে যে কমিউনিস্ট পার্টি একদিন বলতে টাটা বিড়লা গোয়েঙ্কা ডালমিয়া–এই সব বৃহৎ পুঁজিপতিরা এ দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু, কিছুকাল পরে সেই দলেরই এক নয়া নেতা হুঙ্কার দেয়-কাউকে টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেব না। সর্ব শক্তিমান পুঁজির কী মহিমা!

কমিউনিস্ট পার্টি ও তার গণ সংগঠন ইস্পাতের মতো দৃঢ় আর মজবুত হয়। বাইরে থেকে একে যত আঘাত করা হোক কিছুতে কোন ক্ষতি করা যাবে না। বরং যত আঘাত পড়বে তা আরো মজবুত হবে, শক্তিবৃদ্ধি ঘটবে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ-নকশালবাড়িকে সামনে রেখে গড়ে ওঠা আন্দোলন। শাসক শ্রেণি তাকে তীব্র আক্রমণ চালিয়ে সত্তর দশকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। কিন্তু ধ্বংস হয়েছে কী? তারা আবার নবরূপে নিজেদের সংগঠিত করেছে, শক্তি বৃদ্ধি করেছে। যা ছিল একটা ছোট জেলার আন্দোলন–এখন আঠারোটা প্রদেশকে কবজা করে ফেলেছে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও স্বীকার করতে হচ্ছে এই বিপদের কথা।

এটা পুঁজিপতিরাও জানে। অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা জেনেছে এবং নতুন কৌশল আবিষ্কার করে নিয়েছে।

আমরা সবাই জানি এইডস্ এক মারাত্মক মারণ রোগ। এর কোন ওষুধ নেই। রক্তের সঙ্গে বীজাণুবাহী রক্তের সংমিশ্রণে এই রোগ হয়ে থাকে। মানব দেহের শিরা-উপশিরায় যে প্রবহমান রক্তস্রোত, এর মধ্যে শ্বেত কণিকা নামের একটি ক্ষুদ্র প্রাণ আছে। যারা বাইরে থেকে কোন জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে আক্রমণ করে মেরে ফেলে। সাধারণ কোন অসুস্থতায় ওষুধ না খেয়েও আমরা সেরে উঠি।

কিন্তু এইচ আই ভি-র ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটে অন্যরকম। এই জীবাণুগুলো খুব চালাক। তারা জানে যে, শ্বেত কণিকা দিরামোফোব। তাই শরীরে প্রবেশ করার তিন-চার দিনের মধ্যে এরা এদের আকৃতি বদলে নেয়। ধারণ করে নেয় শ্বেত কণিকার মতো আদল। ফলে, আসল শ্বেত কণিকা ধোঁকা খেয়ে যায়। আপন জন স্বজাতি ভেবে আক্রমণ করে না আর। আসল শ্বেত কণিকার মধ্যে মিশে রয়ে যায় ওই নকল শ্বেত কণিকা। এরপর সে তার বংশবৃদ্ধি শুরু করে। আসল শ্বেত কণিকা যদি মিনিটে একটা করে সংখ্যা বৃদ্ধি করে, সে করে দশটা-বিশটা। এর ফলে একদিন আসল কোণঠাসা হয়ে পড়ে নকলের চাপে।

এরপর যখন মানব শরীরে কোন রোগ-যক্ষ্মা টাইফয়েড ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে, আসল শ্বেত কণিকা হলে সেতাকে আক্রমণ করত–কিন্তু নকল তা করে না। ফলে, বিনা প্রতিরোধে সেই রোগ মানুষকে মেরে ফেলতে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয় না।

কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করার জন্য বুর্জোয়া শ্রেণি এখন এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছে। তাদের বেতনবোগী কিছু লোককেঢুকিয়ে দিচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যারা পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশ করে আসল কমিউনিস্টদের চেয়ে বড় বড় আদর্শের বুলি কপচে, আর নিজের চারপাশে তারই মতো নকল কমিউনিস্টদের ভিড় করে সংখ্যাধিক্যের সমর্থনে দখল করে নেয় সর্বোচ্চ ক্ষমতা। তারপর ভেতর থেকে ক্ষইয়ে ধ্বংস করে দেয় সংগঠন।

এই পদ্ধতির দ্বারা তারা সোভিয়েত রাশিয়াকে সতেরো টুকরো করে দিয়েছে। নির্জীব হীনবল করে দিয়েছে অতবড় একটা শক্তিশালী দেশকে। যা আকাশ থেকে পরমাণু বোমা ফেলেও করতে পারত না বিশ্ব পুঁজিবাদীদের প্রভু আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীরা।

আমাদের এই দেশ আমার ধারণায় ছয়ের দশক থেকে বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের বেতনভোগি-তাবেদার একটা গোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিয়েছে কমিউনিস্ট দলগুলোর মধ্যে। যে সব দল এখনো সংগ্রামের মধ্যে আছে তাদের পক্ষে ওইসব লোককে শনাক্ত করা সহজ। কিন্তু যে দল সংগ্রাম বিমুখ, সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে পা দিয়ে নিজেকে আটকে ফেলেছে ক্ষমতার চিটেগুড়ে, তারা কী করে ভেজাল লোকদের চালুনি ছাটা করবে? লড়াই, আন্দোলন, সংগ্রাম–যা দিয়ে কে কতটা মার্কসবাদী জনদরদী পরখ করার যে বাস্তববাদী পদ্ধতি সে তো আর নেই। আসল নকল সব নেতা-ই নাদুস ভূঁড়ি নিয়ে শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে জনসেবা সারছে।

ফলে, ধীরে ধীরে জনগণ এদের উপর বিরূপ হয়ে গেছে। নকল কমিউনিস্টরা তো এটাই চায়। তারা এমন সব কাজ করে এবং করায়, মানুষ যেন ওই নাম, ওই দলের পতাকা দেখলে ঘৃণায় থুতু ফেলে। পশ্চিমবঙ্গে সেটা তারা খুব সুচারুভাবে করে দিতে পেরেছে। এখন এই বাংলায় আর কাউকে চোর-ডাকাত-খুনে-ধর্ষক বলে গাল দেবার দরকার পড়ছে না, শুধু একটা শব্দ বললেই সবটা বলা হয়ে যাবে। মমতা ব্যানার্জী যার নতুন নাম দিয়েছে হার্মাদ। এই হার্মাদ বিশ্লেষণ থেকে মার্কসবাদের আত্মা আমার ধারণায় আর কোনদিন মুক্তি পাবে না। ঘটনাচক্রে আমি এই রকম একদল লোকের মধ্যে এসে পড়েছি। চেষ্টা তো বহুবার করেছি এখান থেকে বের হয়ে যাবার। কিন্তু কোথায় যাব, কে দেবে আহার আর আশ্রয়, সেই ভাবনায় রয়ে গেছি এতগুলো বছর। এতগুলো বছরের মধ্যে এমন একজনও কাউকে পাইনি যে আমার পাশে দাঁড়াবে।

যে মানুষগুলোর মধ্যে থাকি এদের বাবা কাকা দাদা মামা সব তো একদিন সত্যিকারের জনদরদী ছিল। মানুষকে ভালোবেসে একদিন তোতারা বহু দুঃখকষ্ট স্বীকার করেছে। সেই মানুষগুলো আজ এত বদলে গেল কীভাবে।

এখন দোষারোপ করা হয় নিচের তলার কর্মীদের দিকে। আসলে প্রথমে পতন পচন দূষণ বিচ্যুতি–সব কিছু শুরু হয়েছিল ওপরতলার নেতাদের মধ্যে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার ফলে, ক্ষমতার মোহ-দর্প-দম্ভ-অহঙ্কার এবং আরো দীর্ঘকাল ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার যে সব ঘৃণ্য অপচেষ্টা–তা ক্রমে ক্রমে উপর থেকে চুঁইয়ে নেমে এসেছেনিচে। যা এখন চারিয়ে গেছে সংগঠনের শাখা প্রশাখা থেকে শেকড়ে বাকড়ে। সংগঠনের নেতা কর্মী সদস্য সমর্থক কেউ আর মুক্ত থাকতে পারেনি ওইমরণ ভাইরাস থেকে। যার ফলে মাত্র চৌত্রিশ বছরে মরে গেল সে, যার শত শত বছর বেঁচে থাকা উচিত ছিল।

তখন সিঙ্গুরের জমিহারাদের প্রবল আন্দোলন চলছে। একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে, চাষিদের পিটিয়ে, রাজকুমার ভুলকে খুন করে, তাপসী মালিককে ধর্ষণ এবং পুড়িয়ে মেরে তাদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা পূর্ণ উদ্যমে চলছে। ২০০৬ সালে মোটামুটি সিঙ্গুরকে কিছুটা শান্ত করে ২০০৭ সালে সিপিএম-এর পুলিশের পোষাক পরা ক্যাডার আর ক্যাডারের ভূমিকা পালন করা পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়েছে নন্দীগ্রামের নিরীহ মানুষদের উপর–খুন আর ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর অপহরণ নির্বিচারে চলছে।

আমার পরিচয় তখন আর কারো অজানা নেই–আমি মহাশ্বেতা দেবীর বাড়ি যাই। সে কথা সবাই জানে। মহাশ্বেতা দেবীর কলমে তখন আগুন ঝরছে, সূর্য সমান অনল আর অনির্বাণ তেজে লড়ে যাচ্ছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক কলম কা সিপাহি।

যখন মমতা ব্যানার্জী ধর্মতলায় অনশন বসেছিলেন, সেখানে এসেছিলেন মেধা পাটেকর। আমি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। চারিদিকে তখন বহু টিভি ক্যামেরা চলছিল। কোনো এক ক্যামেরায় কে জানে উঠে যায় আমার ছবি যখন আমি মেধা পাটেকরের সাথে কথা বলছিলাম। এক ঝলক–সেই ছবি দেখে যে আমাকে চেনার চিনে নেয়।

তখন এই স্কুলে কে যেন একখানা দামি টেলিভিশন দান করেছে। সেখানা বসানো হয়েছে আমাদের নতুন রান্নাঘরের কাছে একটা দরজার ওপাশে একটা বড় কামরায়। সন্ধের পরে ওয়ার্ডেন আর বেশ কিছু সিপিএমের কট্টর সমর্থক বসে বসে টিভি দেখে। আর যখনই নন্দীগ্রামে সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীর হাতে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কোনো পরাজয় ঘটে–পিছু হটে, কেউ গুলিবিদ্ধ হয়–সেই খবর দেখে এরা এমনভাবে চিৎকার করে ওঠে-যেন খেলার মাঠে সৌরভ কোনো ছক্কা মেরেছে। চিৎকার করে এমনভাবে যেন আমার কানে যায়। মন পোড়ে।

পোড়ে, খুব মন পোড়ে আমার। তখন ইচ্ছা করে তাপসী মালিক, রাধারানী আড়ি, নর্মদা শীটকে যারা ধর্ষণ করেছে। এরা সেই ধর্ষক। এদের একটাকে….।

রাতে যখন সেই বহিরাগত বোবা স্কুলে আশ্রয় প্রাপ্ত লোকজন খেতে আসে ওয়ার্ডেন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের বলে–শুধু বাটাম দেওয়া দরকার। আর কিছু না ভালো মতো বাটাম পড়লে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। মরিচঝাঁপির মালগুলোকে যেরকম দেওয়া হয়েছিল–চারদিক থেকে ঘিরে সেই রকম বানালে আর মাথা তুলতে পারবে না।

এই মানসিকতার লোক আমার কাছে একটা ঘৃণিত নর্দমার পোকা। ফলে যে কোনো বিষয় নিয়ে সে কথা বলুক ঝগড়া তর্কাতর্কি বেধে যাবেই। তবে সেদিন সে ঝগড়া ছিল আগের চেয়ে অনেক বিষ বাক্যে ভরা। যার পরেই খুনোখুনি হতে পারত।

ঝগড়া কোন পর্যায়ে যাবে, তা নির্ভর করে বিবদমান দুজনের মনে কতখানি বিষবাষ্প আছে তার উপর। তখন কথার উপর কথা, কথার উপর কথা চাপাতে গিয়ে দুজনেই ভুলে যায় আসলে ঝগড়াটা কী নিয়ে শুরু হয়েছিল। তাই এক সময় সে যখন বলে, আপনাদের মতো মানুষের সাথে আমার ভদ্রভাবে কথা বলাই উচিত না, আমার জবাব থাকে, যে, আপনি চাইলেও পারবেন না। ভদ্রতা কাকে বলে আপনি জানেনই না।

সে বলে আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেবেন না। আমার ভদ্রতাকে আমার দুর্বলতা ভাববেন না, তাহলে ভুল করবেন।

আমার জবাব, ভদ্র ব্যবহার যেমন দুর্বলতা নয়, অভদ্র ব্যবহারকেও সবলতা বলে না। আপনার কোনো ধমকিতে আমি ভয় পাচ্ছি না। হোন অধৈর্য, আমি দেখি।

সে বলে-রিক্সা চালাতেন, ভদ্রলোকের সাথে মেশেননি। কী ভাবে কথা বলতে হয় কিছুই জানেন না। একবার দুবার টিভি পেপারে নাম উঠলে কিছু হয় না।

আমার জবাব–আমি যাদের সাথে মিশি, এ জনমে তো তাদের সাথে মিশতে পারবেন না। চেষ্টা করে দেখুন যদি পর জনমে কিছু হয়। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, আপনার দৌড় ওই বড় সাহেব পর্যন্ত। লেজ নড়ে হাতির জোরে। যেদিন হাতি ফঁদে পড়বে লেজ কোথায় যাবে।

সে বলে-ছোট বেলা থেকে মারধোর খেয়ে বড় হয়েছেন। ওই ভাষা ছাড়া আপনারা ভালো কথা বোঝেন না।

আমার জবাব–শুধু মার খাইনি, কতো লোককে চিৎও করে দিয়েছি। তেমন হলে এখনো পারি। কামারপাড়ার কার্তিককে শুইয়ে দিয়েছিলাম। জানেন? এখন পারি।

সে বলে-পারুন দেখি, কেমন পারেন।

আমি বলি, আগে আপনি কতটা যেতে পারেন গিয়ে দেখান। তবে তো। এই সেই বর্ডার লাইন–যার ওপাশে ধারালো বটি। তবে সে পর্যন্ত যাবার আগে ঝগড়া থেমে যায় সেদিন। পিছু হটে এক দাম্ভিক রুনুর চেলা হার্মাদ।

.

এক মহিলার নাম আদুরি গোঁসাই। তার কাজ দুপুরে কয়েক কাপ চা বানানো, বিকালে কৌটো মেপে বাচ্চাদের একটু মুড়ি দিয়ে দেওয়া। সে জানে এত আরামের সরকারি চাকরি করতে হলে তার জন্য কিছু ত্যাগ অবশ্যই থাকা দরকার। তাই বেশ কিছু ছোট ছোট বাটি কিনে রেখেছে। আদুরি গোঁসাই জানে হৃদয়ের রাস্তা শুরু হয় পাকস্থলি থেকে। তাই রোজ ডিউটিতে আসার সময়ে ওইসব বাটিতে কিছু না কিছু ভরে নিয়ে আসে। এবং যারা স্কুলে প্রভাবশালী–ইচ্ছা করলে ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। তাদের টিফিন টেবিলে যথা সময়ে পৌঁছে দেয়। সে কারণে পঞ্চ পাণ্ডব তার উপর ভীষণ প্রীত। আদুরি গোঁসাইকে রায় আর বড়দি খুব ভালোবাসে। আদুরিও ওই দুজনকে ভগবান ভাবে। যাদের মুখের যে কোন বাক্য তার কাছে বেদ বাক্য।

সেই যেবার আমার টিচার ইনচার্জের সাথে বচসা হয়, তার দিন কয়েক পড়ে সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে আমার সহকারি কোমরে চোট পেয়ে কিছুদিন কাজে আসতে পারে না। বাচ্চাদের রান্না খাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে সে সময় সকালের দিকে একটু আদুরি গোঁসাইকে পাঠানো হয়, আমাকে সাহায্যের জন্য।

তখন তিনতলার ছাদে রান্না হত। আর তরিতরকারি কাটার পর খোসাগুলো একটা আলুর বস্তায় ভরে রাখা হতো। বস্তাটা ভরে গেলে আমি ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিলে পৌরসভার সাফাই কর্মীরা নিয়ে যেত।

একদিন রোজকার মতো বস্তা ফেলছি। তখনই মনে হল রোজকার মতো নয়–বস্তা কিছু ভারি। ছুটে নীচে গিয়ে বস্তা খুলে দেখি খোসার মধ্যে একগাদা আলু। বুঝতে পারি এটা আদুরির কীর্তি। আমাকে সাবার জন্য পাতা একটা ফঁদ। সেই দিন গেটে ডিউটি দিচ্ছে সাহা, যে রায় এবং বড়দির আর এক বিশ্বস্ত। যে মাঝে মাঝে আমার ব্যাগ চেক করে, যদি কিছু পায়। যেই বস্তা নিয়ে পৌরসভার লোক রওনা দেবে, সাহা গিয়ে বস্তা চেক করবে। প্রমাণ হয়ে যাবে পৌরসভার লোকের সাথে সাঁটগাট করে এভাবেই আমি চাল ডাল আলু সব পাচার করি।

সে পরিকল্পনা ফেল মেরে গেল কারণ মালটা আমি ধরেছি। তখন ব্যাপারটা এইভাবে চাপা দেওয়া হল আদুরিদি বুড়ো মানুষ। বুঝতে পারেনি মনে হয়। বস্তায় আলু আছে। খোসা ভেবে ভরে দিয়েছে।

হতে পারে। সেটাও হতে পারে। তবে আমার সন্দেহ ভুলে নয়, ওটা করা হয়েছিল পরিকল্পনা অনুসারেই।

পঞ্চপাণ্ডব পাঁচ ভাই, কিন্তু মাতা তো দুই। সৎ ভাইয়ের সাথে সৎ ভাইয়ের কিছু মনোমালিন্য তো থাকেই। এখানেও আছে। টিচার ইনচার্জ আর কেরানি রায় একদিকে, অন্যদিকে বাকি তিন। এই গ্রুপ সেই গ্রুপকে সব সময় বিপাকে ফেলার চেষ্টা করে।

তখন একদিন টিচার ইনচার্জের সাথে হোস্টেল সুপার-এর খুব ঝগড়া হয়ে গেছে। আমার সাথে ঝগড়া তো রোজ চলে। তাই একদিন আমাকে ডেকে সুপরামর্শ দিয়েছিলেন বড়দি, এক গামলা ভাত তরকারি বেঁধে জমাদারের ড্রামে ঢেলে নষ্ট করে দিন। হোস্টেলে থাকেনা, বাচ্চাদের দেখেনা, সুপারকে আমি একটু টাইট দিই। আচ্ছা করে কড়কানি দিয়ে দেব। পারবেন?

না, আমি পারিনি। আমি মনে করি খাদ্য নষ্ট করা একটা সামাজিক অপরাধ। খাবার নষ্ট করলে বাচ্চাদেরও ধমক দিই। অভ্যাস বসে একবার তো আমার সেই ভাই-গণেশের মেয়ের বিয়েতে এক নিমন্ত্রিত পাতে প্রায় গোটা পঁচিশ তিরিশ রসগোল্লা নিয়ে ফেলে চলে যাচ্ছিল বলে–তাকেও ধমকে দিয়েছিলাম। “ও রিক্সা চালায়। বহু কষ্টে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। তোমাকে নিমন্ত্রণ করে ও কী কোনো ভুল করেছে? এইভাবে ওর ক্ষতি করছো? খাও ওগুলো, খেয়ে তারপর ওঠো।”

এই কারণে আমার ধারণা হয়, আদুরি টিচার ইনচার্জের গোপন নির্দেশে বস্তায় আলু ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমিও সুযোগের সন্ধানে থাকি কবে মওকা পাই।

আর একবার এসে গেল সরস্বতী পূজা। এবারও আমার নামে দেড়শো টাকা চাঁদা। তখনো মাইনে হয়নি, হাত ছিল একেবারে খালি। দয়া করে স্কুল দিয়ে দিল, পরে বেতন থেকে কেটে নেবে। এমনিতে আমি নাস্তিক–সে জন্য নয়, স্কুলের পূজো হোক বা কোনো অনুষ্ঠান আমার ভালো লাগে না। কষ্ট হয়, কারণ কাজের চাপ বেড়ে যায়। এমনিতে রোজ প্রায় দেড়শো লোক খায়। সরস্বতী পূজায় তাদের বাড়ির লোক স্কুলের স্টাফ, বড় সাহেবের কিছু নিমন্ত্রিত সব মিলিয়ে প্রায় চারশো লোকের রান্না করতে হয় সেদিন। স্কুল ছুটি থাকে, সবাই পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘোরে আর খেটে মরি আমি। এটাতেই সবচেয়ে কষ্ট!

সেদিন প্রতিবারের মতো ফল প্রসাদ কাটার ভার পড়েছিল আদুরি গোঁসাই ও মাদারের উপর। প্রতি বারের মতো সেদিনও ফল কাটার ফাঁকে ফাঁকে একটা দুটো করে আপেল, কলা, কমলা সরিয়ে ব্যাগে ঢোকাচ্ছিল। যা পরে দুজনে ভাগ করে নেবে।

এরপর বড় সাহেবের আপ্যায়নে আসা অতিথি অভ্যাগতদের জন্য আনা ‘আশীর্বাদের’ মিষ্টি, কাজু, চিপস, বিস্কুক থেকেও যা সটকানো গেছে, সবার পাতে দুটো করে দেবার পর যে কটা রসগোল্লা রয়ে গেছে, নিজের জন্য এক বালতি খিচুড়ি আধ বালতি পায়েস, সবটা মিলিয়ে যা বোঝা হয়ে গেল, তা একা আদুরি গোঁসাইয়ের পক্ষে বয়ে নেওয়া কঠিন। এরপর আবার আছে, রান্নার পরে যা বেঁচে গেছে সেই চাল ডাল নুন মশলা আলু আরো কত কী!

খিচুড়ি পায়েস পর্যন্ত আমার সহন ক্ষমতার মধ্যে ছিল। এরপর আর থাকলো না। এই চাল ডাল তেল নুন কেনার পিছনে আমারও কষ্টে টাকা আছে। আমার ছেলে একটু খিচুড়ি খেলে আজেবাজে কথা বলা হয়, তাহলে এই কঁচা মাল সব আদুরি নিয়ে যায় কোন্ অধিকারে?

তাই রিক্সার হ্যান্ডেল চেপে ধরলাম, চাল ডাল যাবে না।

টিচার ইনচার্জ আর কেরানি রায় আদুরিকে বাঁচাবার চেষ্টা বলে, যেতে দিন। এর একটা দাম ধরে নেব। সেই টাকা পরের বছরের পূজার চাঁদার সাথে যোগ করে নেব।

আমি বলি, তবে নিলাম হোক। যে বেশি দাম দেবে সেই নেবে। কিন্তু আমার প্রস্তাব কারো মনোমত না হওয়ায় অবশেষে সেই বাড়তি চাল ডাল গুদামে জমা করে দেওয়া হয়। পরে একদিন বোবা বাচ্চাদের তা দিয়ে খিচুড়ি খাওয়ানো হয়।

.

এটা সেই সময়–এটা সেই ভয়ঙ্কর সময় যখন সিঙ্গুর ব্লকের জমি অধিগ্রহণ সমাপ্তি হয়ে গিয়েছিল। জমির চারদিকে উঁচু পাঁচিল ঘিরে জমির দখল নিয়েছিল টাটা বাবুরা। নন্দীগ্রাম জ্বলছে। মানুষকে ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এক বর্বর সরকার।

এটা সেইভীষণ কাল–যখন জিন্দাল নামক এক বহুজাতিক কোম্পানির কাছে জঙ্গল মহলকে বিক্রি করে দেবার চক্রান্তের অঙ্গ হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি চলে যাওয়া পথের উপর পটকা ফাটানো হয়েছে একটা। কেউ মরেনি কেউ আহত হয়নি, শুধু শব্দ, তাও মুখ্যমন্ত্রী চলে যাবার মিনিট দশেক পরে। আর এই ঘটনাকে শিখণ্ডি করে সারা জঙ্গলমহল জুড়ে পৈশাচিকতাণ্ডব চালাচ্ছে সিপিএমের পুলিশ। গড়ে উঠেছে জনসাধারণের মধ্য থেকে একটা গণ প্রতিরোধ কমিটি। এই কমিটিতে এমন বহু মানুষ এসেছে যারা আগে সিপিএম করত।বহু মানুষ আসেনি–দলেইআছেকিন্তু তারা সিপিএমের এই তাণ্ডবের পক্ষে নয়। কে বা কাহারা যেন রাতের অন্ধকারে পাইকারি হারে এদের খুন করছে। খুনের পরে পাশে ফেলে যাচ্ছে একটা পোেস্টার। মাওবাদ জিন্দাবাদ।

এই প্রসঙ্গে আমার একটি গল্প মনে পড়ছে। গল্পটা শোনা, কাজেই কিছু তথ্যের ভুল থাকতে পারে। একবার নাকি হিটলারের সে দেশে বেড়ে ওঠা কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিকেশ করার শখ চাগাড় দেয়। তাই তার লোক এক জেলখানায় চলে যায়। গিয়ে যেখানে বন্দী কিছু কুখ্যাত অপরাধীকে বলে তোমাদের একটা কাজ করতে হবে। যদি তোমরা তা করো জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে, কিছু টাকাও দেওয়া হবে। তোমাদের জীবন সুখে কেটে যাবে। তবে কাজটার বিষয় কাউকে কিছু বলা চলবে না।

কী কাজ? না রাইখস্ট্যাগ নামের একটা জায়গা আগুন দিয়ে পোড়াতে হবে। তারা রাজি হয়ে যায়। এরপর তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ-নির্দেশ দিয়ে রেডগার্ডের পোষাক পরিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাইখস্ট্যাগে। আর সাদা পোষাকে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয় সেখানে, যাদের প্রতি আদেশ থাকে যদি কেউ কোনো ধ্বংসাত্মক কার্য করে, গুলি করে মারবে। একটাও যেন বেঁচে না যায়।

অপরাধীরা এত রাজনীতি জানবে কী করে। তারা সরকারের সহযোগিতা করছি এই ভেবে মনের আনন্দে সরকারি-বেসরকারি ভবনে আগুন ধরায়। আর তারপর পুলিশের গুলিতে মারা পড়ে। সেই মৃতদেহ দেখিয়ে হিটলার প্রচার করে এটা কমিউনিস্টদের কাজ। আর তার কমিউনিস্ট নিধন জেলে পোরার কোনো বাধা থাকে না।

কে বলতে পারে বুদ্ধবাবুর পটকার পিছনে এমন কোনো চক্রান্ত নেই? তা না হলে মাসাধিক কাল ধরে হাজার হাজার পুলিশ-গোয়েন্দা-কুকুর, পার্টি ক্যাডার–সব দিয়ে তন্ন তন্ন তল্লাশির পরও কারো চোখে পড়ল না এক ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া তিন মাইল লম্বা সেই তারটা? যা পটকার সাথে যুক্ত?

জিন্দালের দরকার হাজার হাজার একর জমি। এর জন্য উচ্ছেদ করতে হবে আদিবাসীদের। এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা ঘরবাড়ি ফেলে জলের দরে জমি জায়গা বেচে পালাতে বাধ্য হয়। তাই ও পটকা মাওবাদীরা ফাটিয়েছে, এই অঞ্চলে মাওবাদী আছে এই অজুহাতে আদিবাসীদের উপর হামলে পড়ল প্রশাসন। শুরু হয়ে গেল খুন আর ধর্ষণের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। তবে এটা ঠিক যে ও তরফ থেকেও মাঝে মাঝে পাল্টা মার দেওয়া হতে লাগল।

সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠল এই সব ঘটনায়। ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, গায়ক, অভিনেতা, চিত্র পরিচালক, সমাজের সর্বস্তরে শোনা গেল ধিক্কার ধ্বনি–ছিঃ মুখ্যমন্ত্রী ছিঃ!

এখন সারা দেশে আগুন জ্বলছে সর্বত্র জমছে লাশের গাদা। দীর্ঘ তিরিশ বত্রিশ বছরে সিপিএম দলটাকে এমন বিপদের সামনে কোনদিন পড়তে হয়নি এখন তারা ক্ষমতাকে ধরে রাখার চেষ্টায়, এমন সুখের সাম্রাজ্য চলে যাবার আশঙ্কায় মরিয়া ক্ষিপ্ত-উন্মাদ। যেখানে দেখছে সামান্য বিরোধ চরম আঘাত হানছে। তৃণমূল, কংগ্রেস, এস.ইউ.সি এমনকি আর.এস.পি, ফরোয়ার্ড ব্লক–কেউ রেহাই পাচ্ছে না। আর জঙ্গলমহল? শ্মশান হয়ে যাচ্ছে।

বধির স্কুলের তিরিশ পঁয়ত্রিশ জন কর্মী। সবাই সিপিএম। বাইরের আগুনের তাপে তারাও উত্তপ্ত। মনোভাব এমন যেন হাতে বন্দুক দিলে এখনই একটা তৃণমূল বা মাওবাদী মেরে আসবে।

আমি যেন এখানে ওই দুই দলের প্রতিনিধি। চালাও আক্রমণ।

পঞ্চপাণ্ডব আমার উপর রেগে তো ছিলই তার সাথে যোগ দিয়েছে বাল্যবন্ধু, মাদার, আদুরি গোঁসাই আর মণ্ডল।

পঞ্চ পাণ্ডব অফিসিয়াল ব্যাপারে তাদের যা ক্ষমতা তা দিয়ে আমাকে জব্দ করতে চায়। অন্য তিন জন সাথে দুতিনজন আশ্রিতকে নিয়ে আমার রান্না করা খাবারে সুযোগ পেলে নুন-বালি মিশিয়ে দিয়ে বোবা বাচ্চাদের আমার উপর খেপিয়ে তোলে। আর মাথা মোটা, খুনের কেসের রাজসাক্ষী, সে চেষ্টা চালায় গ্যাস সিলিন্ডারের ক্ষতি করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আমাকে পুড়িয়ে দিতে, উড়িয়ে দিতে।

আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই যে সে-ই ওসব করছে। কিন্তু সে ছাড়া আর কে বা এত দুঃ সাহসী আছে যে এত মাথা মোটার মতো কাজ করবে? হতে পারে সে, হতে পারে অন্য কেউ, আমি জানি না। তবে কে বা কারা যেন একদিন ওভেন আর গ্যাস পাইপের সংযোগ স্থলের নাট রেঞ্জ দিয়ে আলদা করে রেখে দেয়। আমি যখন গ্যাস ওভেন জ্বালাই আমার ডান হাতে একটা শিকের মাথায় ন্যাকড়া জড়ানো কেরোসিন তেলে ভেজানো মশাল থাকে। সেটা ওভেনে চেপে রেখে বাঁ হাতে সিলিন্ডারের মুখের চাবি ঘোরাই!

এবার এই নাট খুলে রাখার কারণে গ্যাস ওভেনে পৌঁছাবে না। বের হবে সেই খোলা জায়গা থেকে যা আমার শরীর থেকে এক ফুট দূরে। বড় ওভেনে তার খুলে রাখা পাইপ থেকে গলগল করে বের হয়ে আসা গ্যাসে আমার হাতের মশাল থেকে মুহূর্তে আগুন ধরে যাবে। লেগে যাবে আমার লুঙ্গিতে–পুড়ে যাব আমি। অনেক হিসেব কষে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের ফলে কোনো এক মাথা থেকে এই বুদ্ধি বেরিয়েছে। তবে আমার সৌভাগ্য, এটা করা হয়েছিল দুপুরে আমি বাড়ি চলে যাবার পর রান্না ঘর ফাঁকা পেয়ে। বিকালে কী এক কারণে যেন আমি কাজে আসতে পারিনি। ফলে আমার জায়গায় রান্না করতে গিয়ে আমার সহকারি বিপদে পড়ে। আগুন ঠিকই জ্বলে ছিল, সে কোনোক্রমে ছিটকে গিয়ে বেঁচে যায়।

এরপরে আবার সেই গ্যাস সিলিন্ডারে কারিকুরি করা হল দিন কয়েক পরে দুপুরে আমি না থাকা সেই অবসরে। সকালে ওভেন ভালোই ছিল–রান্নাও করেছিলাম সেই ওভেনে। বিকালে ওভেন জ্বালাতে গিয়ে দেখি এবার কে যেন ওভেন আর রেগুলেটারের মধ্যেকার গোল যে চাকতি যা গ্যাস চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে সেটা খুলে বের করে ফেলে দিয়েছে। এখন আমি সেই চাবি ঘোরাবো, গলগল করে বের হওয়া সেই গ্যাস সন্নিকটে জ্বলতে থাকা আর একটা ছোট ওভেন-যেটায় ডাল সেদ্ধ বসিয়ে আমার বড় ওভেন জ্বালানোর কথা তা থেকে সিলিন্ডারের মুখে আগুন ধরে যাবার সম্ভাবনা আছে। এতে গ্যাস ভরা সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়েও যেতে পারে। তখন আর আমি একা মরব না। অন্য কেউও যেতে পারে। আমার সহকারিও হতে পারে।

কিন্তু সে সব কথা তখন ভাববার মতো মানসিক অবস্থা আমার শত্রুদের ছিল না। তবে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সেবারও আমি বেঁচে যাই। আগুন ধরার আগে দ্রুত যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে চাবি ঘুরিয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিতে সক্ষম হই।

আবার একবার ক্ষতি করা হয় গ্যাস ওভেনের। ওভেনের একেবারে নীচে যে সরু তামার পাইপ সেটা সাঁড়াশি দিয়ে চেপে দেওয়া হয়। ভর্তি সিলিন্ডারে প্রচণ্ড গ্যাসের চাপ থাকে। সেই চাপে ধীরে ধীরে গরম আর নরম হয়ে যাওয়া পাইপ কোনো এক সময় ফেটে যেতে পারে। আমি দুর্ঘটনায় পড়তে পারি সেই আশায় এটা করা হয় এবং এটা যে কোনো মানুষের দ্বারা কৃত সেটা বলে–ওভেন মিস্ত্রি বাবু দাস। যার গ্যাস ওভেন সারাইয়ের দোকান আছে।

এরপর আমি আমার কর্মস্থলের অবস্থার কথা জানিয়ে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কাছে একখানা চিঠি দিয়ে রাখি। জানি কিছু হবে না, তবুও। কিছু হয়নি।

আমি একখানা মোবাইল কিনেছি। বাড়ি আমার অনেক দূরে–পথও দুর্গম। এক পশলা বৃষ্টি হলে এক হাঁটু কাদা। ওই পথে ট্রাক চলে বলে বড় বড় গর্ত হয়ে যায় বর্ষাকালে। দরকার পড়লে বন্ধুরা যেতে পারে না। স্কুলে এলে সহজে আমাকে ডেকে দেয় না। ফোন করলে বলে সে এখন কাজে আছে। আসতে পারবে না। তাই নিতে হল মোবাইল। সরল বিশ্বাসে স্কুলের সবাইকে নম্বর দিয়ে ছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি কী ভুলটা করে ফেললাম। মোবাইলটা যে যম যন্ত্রণার কারণ হয়ে যাবে, কে তা জানত। আসতে আরম্ভ করল প্রায় তিরিশ বত্রিশটা মোবাইল, তিরিশ বত্রিশটা ল্যান্ড ফোন থেকেমিস্, হুমকি, ধমকি, অকথ্য গালাগালি। আমার মাকে পর্যন্ত ধর্ষণের গালাগালি দেওয়া হয়।

আমার তখন খানিকটা নামটাম হয়ে গেছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে যায় লোকে। অনুষ্ঠান চলাকালেও মোবাইলে কাঁচা কাঁচা খিস্তি ছুটে আসে। আমি তাদের অনুরোধ করি এখন রেহাই দাও, মঞ্চে আছি, একটা অনুষ্ঠানে, ওদিক থেকে ভেসে আসে কী বালের অনুষ্ঠান রে গাণ্ডু! একবার এক সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি, ট্রেনে পা দেবার পর এল একটা ফোন–যাচ্ছিস? যাঃ এটাই তোর শেষ যাত্রা। আমি যাচ্ছি তোর বাড়ি! খুব স্বাভাবিক কারণেই এক ক্ষিপ্ত তিক্ত বিষাক্ত মন নিয়ে পৌঁছেছিলাম দিল্লি। চারদিন ছিলাম ওখানে চারদিনই মনের উপর চেপে বসেছিল এক নিদারুণ ক্রোধ।

ফলে, যখন দিল্লির এক নামি পত্রিকা, কথাদেশ, যার সারা ভারতে পাঠক–তারা আমার সাক্ষাৎকার নিতে এল সিপিএম সম্বন্ধে একটাও ভালো কথা বলতে পারলাম না। সব বিষ উগরে দিলাম পত্রিকার পাতায়। ২০০৮-এর সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, এই দুই সংখ্যায় প্রকাশিত হয় আমার বক্তব্য। এতে আমার ‘রীবাজ’ গল্পের হিন্দি অনুবাদও থাকে।

খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এইসব ফোন যে সব মোবাইল থেকে আসে, তারা সব কোন না কোনভাবে এই স্কুলের সাথে যুক্ত। মজার ব্যাপার এতে এমন কিছু মাস্টারও আছে যারা চাকরিতে ঢুকেছে ২০০৮ সালে। যারা অনেকে আমার নামও জানেনা। অথচ তাদের মধ্যে কী অদ্ভুদ বোঝাঁপড়া। সবাই মিলে এক সাথে লড়ছে। এ এক সর্বাত্মক লড়াই। এক মাস্টার বাইক নিয়ে ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা থেকে রাত গভীর পর্যন্ত বুথ থেকে ফোন করে গাল দিতে থাকে।

আমি নালিশ করে কোন লাভ হবে না। তবু একখানা দরখাস্ত লিখি টিচার ইনচার্জের কাছে। অন্তত একটা অভিযোগ তো লিখিত থাক।

.

কথায় বলে বাঘ পঙ্গু হয়ে গেলেও হালুম ভোলে না। দত্তদা কোমর ভেঙে শুয়ে আছে বিছানায়, ডাক্তার কোমরে একটা প্লাস্টার মেরে দিয়েছে, বেশি নড়াচড়া, সিঁড়ি দিয়ে নামা বারণ, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে বুদ্ধি ভাজছে, দাঁতের ফাঁকে ঢুকে পড়া মাছের কাটা কোন কৌশলে তুলে ফেলা যায়।

।একদিন একটা ফোন এল আমার মোবাইলে–একটু আয়, খুব দরকার। তাই যেতে হল তার বাড়ি। আমাকে দেখে দত্ত তার বউকে বললেন-মদনকে এককাপ চা দাও। এক গেলাস ফ্রিজের জলও দিও। যা গরম!

জল-চা খাবার পর বলেন তিনি, বল মদন, আমি তোর উপকার করেছি কিনা? বাংলা ছেড়ে কোথায় কোন্ জঙ্গলে গিয়ে পড়েছিলি। বল ছিলিনা? সেখান থেকে ফিরিয়ে এনেছি। যেমন হোক, একটা চাকরি দিয়েছি। কাজের জায়গায় কিছু সমস্যা আছে। সে আর কোথায় না থাকে। তবে মোটামুটি তো ভালোই আছিস। আর কিছু না হোক একটা বাড়ি করেছিস। এখন যদি রিক্সাও চালিয়ে খাস, আগের চেয়ে ভালোই থাকবি। বল থাকবি না? যদি তুই মনে করিস এই সব কিছু আমার জন্য হয়েছে, তাহলে তোকে আমার জন্য একটা কাজ করতে হবে। কিছু না। কিছুনা, এমন কিছু কঠিন কাজ না তোর পক্ষে। আমি জানি তুই এটা পারবি। জীবনে কত সাহসের কাজ করেছিস, আর সামান্য এইটা পারবি না। বল করবি?

কী কাজ?

যে খাটে তিনি শোয় হাত বাড়িয়ে তার স্কুল থেকে একটা পোটলা বের করলেন। এখন দুপুর। পথঘাট একেবারে ফাঁকা। সাইকেল চালিয়ে সন্তোষপুর লেকের সামনে দিয়ে যাবি। যেতে যেতে ছুঁড়ে এটা লোকের জালে ফেলে দিবি। ব্যাস এইটুকু।

কী আছে এতে?

দত্ত দেওয়ালে ঠেক দিয়ে একটু সোজা হলেন–দেখ মদন, তুই তো জানিস, আমি কোনো চাকরি বাকরি করি না, এই একটু কটা পুকুরে মাছ চাষ করি। এতেই আমার পেট চলে। এখন সেই পেটের উপর লাথি মেরে দিয়েছে রে।

কে!

আবার কে! যাদের জন্য সারা জীবনটা বরবাদ করে দিয়েছি সেই পার্টি। এখন বুঝতে পারছি, তুই যা বলতি–ঠিকই বলতি। একেবারে দয়ামায়াহীন জহ্রদ। জানিস, ওই লেকটায় আমি সেই সাতাত্তর সাল থেকে মাছ চাষ করি। এবারও আশি হাজার টাকার মাছ ছেড়েছি। সেই লেকটা ওরা কেড়ে নিয়ে মহিলা সমিতিকে দিয়ে দিয়েছে। একবার আমার কথা ভাবল না। এখন লেকের পাড় দিয়ে গেলে আমার কান্না পায়। আমার লেক আমার টাকা আমার মাছ, খাবে ওরা। এ কী সহ্য হয়। বল সহ্য হয়?

একটু থেমে আবার বলেন দত্ত–সব মাছ মেরে দেব। আমার কোমর না ভেঙে গেলে তোকে বলতাম না। তুই আমার এই উপকারটা কর।

বলি–আমি লেকে বিষ দিই, কিংবা অন্য কেউ, দোষ তো আপনার উপরই আসবে। সবাই তো বুঝে যাবে যে আপনার কাজ এটা।ওরা লেক নিয়ে নিয়েছে বলে আপনি মাছ মেরে দিয়েছেন।

বুঝুক। আমি চাই সবাই বুঝুক। বুঝে কী করবে আমার! সে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। তুই শুধু কাজটা কর। পরে যা হবে আমি বুঝে নেব।

অনেকক্ষণ ধরে মনের সব ক্ষোভ উগরে দেন সেই পার্টির বিরুদ্ধে যাদের সঙ্গে উনি বহু বছর আছেন–এখন মহিলা সমিতি মারাচ্ছে–“ওরাও দু টাকা পাক”। কোথায় ছিল এই সব মহিলারা, যখন আমরা লড়াই করে পাটিটাকে ক্ষমতায় এনেছিলাম? গাছ পোতর সময় কাউকে পাওয়া যায়নি। এখন ফল খাওয়ার সময় সব হাজির। কত লোক তো প্রমোটারি, জমির দালালি, কনট্রাকটারি করে লাখ লাখ কামাচ্ছে। পারবে তাদের ভাগ থেকে মহিলা সমিতির জন্য কিছু আদায় করতে? মহিলাদের জন্য কেন এত দরদ বুঝিনা কী আর! সব বুঝি!

‘পরম উপকারি’ দত্তদার কাঁদো-কঁদো মুখ দেখে আর না বলতে পারি না। বিষ মাখানো মাটির পোটলা হাতে তুলে নিই। যে তার ক্ষতি করেছে আমি তার ক্ষতি করে দেব। আর সেটা দেওয়াই উচিত। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন-কৃতঘ্ন হয়ো না। এর চেয়ে বড় পাপ আর কিছু হয় না। আমি কী দত্তদার উপকার ভুলে যাব।

কিন্তু সাইকেল নিয়ে পথে আসতে আসতে মাথায় আসে অন্য এক ভাবনা যাকে অকৃতজ্ঞ বলে। হয়তো লেকটা ওরা জোর করে নেয়নি। নিয়েছে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। দত্তদা তুমি তো শত শত পুকুর ঝিল নিয়ে রেখেছ, এই একটা ছেড়ে দাও। গোটা চল্লিশ মেয়ে বাঁচুক। তাই দিয়েছে। এখন এটাকেই গল্প বানাচ্ছে কেড়ে নিয়েছে। অস্ত্র বানাচ্ছে।

কেড়েই নিক বা নিজে ছেড়ে দিক কিছু ক্ষতি তার হয়েছে। তবে আরো বড় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে আমার দিক থেকে। যে অন্যায় অত্যাচার আমার উপর বধির স্কুলে লোকজন চালাচ্ছে, যদি আমি ক্ষেপে গিয়ে স্কুল বিষয়ে যা জানি সেসব কোনো কাগজে লিখে দিই, সমূহ সর্বনাশ হয়ে যাবে। তখন সবার সব রাগ গিয়ে পড়বে দত্তের উপরে। কারণ সেই আমাকে এখানে ঢুকিয়েছে। কেউ কেউ তো এমনও সন্দেহ করতে পারে আমাকে দিয়ে সেই এসব করিয়েছে। তখন একটা লেক গেছে বাকিগুলোও আর থাকবে না।

তাহলে উপায়?

উপায় এটাই–যা সে এখন করাচ্ছে। আমার এখন মনে পড়ে যায়, রাইখস্ট্যাগের সেই গল্প। আমি যেই বিষের পোটলা নিয়ে রওনা দিয়েছি সেই দত্ত ফোন করে দিয়েছে তার আগেভাগে প্রস্তুত করে রাখা লোকজনকে–সে যাচ্ছে। তার সেই লোকজন লুকিয়ে পজিসন নিয়েছে লেকের চারদিকে। যেই আমি বিষ পোটলা জলে ছুঁড়ে ফেলব, সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা আমাকে ধরে ফেলবে। আর তারপর গণধোলাই। পুকুরে বিষ দেওয়া একটা অমার্জনীয় অপরাধ। শত শত লোক চান করে এই লেকে। তখন তারা পিটিয়ে পিটিয়ে আমাকে মেরে ফেললেও ফেলতে পারে। কত লোক এভাবে মারা গেছে। জনগণ মহাশক্তিমান-এরা যা করুক, কোনো সাজা হয়। আঠারোজন সন্ন্যাসীকে জনগণ প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মেরেছিল, কারো কিছু হয়নি।

একান্তই যদি আমাকে মেরে নাও ফেলে, হাড়গোড় ভেঙে পুলিশে দেবে। তখন আইন অনুসারে স্কুল আমাকে সাসপেন্ড করে দেবে। তারপর কেস লড়ে যদি নির্দোষ প্রমাণ হই তবে পুনঃ বহাল হতে পারব। না পারলে গেল। যে ঘৃণ্য অপরাধে অপরাধী তার কোনো কথাই আর লোকে বিশ্বাস করবে না। এইসব ভাবনা, মাথায় চেপে বসার ফলে আমার সাইকেল আর লেক মুখো হতে পারলনা।এ গলি সে গলি ঘুরে পৌঁছে গেল নিজের বাড়ি ক্ষুদিরাবাদে। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে আবার একটা ফোন এল আমার মোবাইলে

কী রে, তুই কোথায়?

বলি–আমি বাড়িতে এসে গেছি।

ওটা ফেলিস নি?

ফেলেছি তো। ইয়ুথ ক্লাবের পিছন থেকে একেবারে মাঝখানে। বুজ বুজ করে ওটা ডুবে গেল দেখে আমি বাড়ি এসেছি। দেখবেন সকালের মধ্যে সব মাছ মরে ভেসে উঠবে

পরের দিন বেলা আটটা নাগাদ আবার ফোন এল ক্রোধ আর কঁচা কাঁচা খিস্তি সহকারে। বলি আমি আমাকে অকারণে গালাগালি দিচ্ছেন। আপনি যে দিব্যি নিতে বলবেন, তাই নিয়ে বলব ওটা আমি ফেলেছি। তবে মাছ যদি না মরে আমি কী করব! আপনি একটু বিষের দোকানে খোঁজ নিয়ে দেখেন–নকল মাল দেয়নি তো!

জবাবে আবার খিস্তি।

কয়েকদিন পরে ২৮.৮.০৭ তারিখে রাত ১০টায় একটা চিঠি লিখি তার নামে। সেটা ফেলে আসি তার ডাক বাক্সে। দত্তদার সাথে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।

‘শ্রদ্ধেয় দত্তদা,

আপনার সাথে আমার এক সুদীর্ঘ কালের পরিচয়। মত পথের কোন মিল কোনদিনই ছিল। তবু গোঁজামিল দিয়ে সেই ১৯৭১ থেকে এই ২০০৭ পর্যন্ত চালিয়ে আসা গেল। এবার মনে হচ্ছে আমাদের ছাড়াছাড়ি হবার সময় এসে গেছে। এই প্রায় বৃদ্ধ বয়েসে আর নিজের সঙ্গে নিজের প্রতারণা পোষায় না। এখন আপনার এবং আমার নিজের স্বার্থেই আলাদা হয়ে যে যার পথে হেঁটে যাবার সময় এসে গেছে। এতকাল আপনার যে আদর্শবাদী রাজনৈতিক কর্মীর ছবিটা আমি বুকে লালন করতাম তা এক নিমিষে ভেঙে চুরে খান খান হয়ে গেছে। সেদিন আমি আপনার মনের যে কুৎসিত কদাকার রূপটা দেখলাম, তারপর আর আপনাকে সাধারণের চেয়ে অন্য কিছু ভাবতে পারছি না। সেই লোভ সেই ঈর্ষা হিংসা স্বার্থপরতা সেই প্রতিশোধপরায়ণতা, যা কোন মার্কসবাদীর পক্ষে একেবারে বেমানান। এরপর আর আপনার সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মনের সায় পাচ্ছি না।

আমি একজন লেখক। এটাই আমার একমাত্র পরিচয়। সারা দেশ আমাকে লেখক বলেই চেনে জানে সম্মান দেয়। এই সম্মান আমার বহু শ্রমে ঘামে চোখের জলে বুকের রক্তে অর্জন করা সম্পদ। আমি এই সম্মান নিয়ে বেঁচে আছি এই সম্মান নিয়েই মরতে চাই। এর উপর কোনো কালি পড়ুক আমি তা কখনো চাইতে পারবো না। কিন্তু আপনার কাছে এ সবের কোনো মূল্যই নেই। সেই কবে আমি রিক্সা চালাতাম, মদ খেতাম, মারপিট করতাম আপনার ধারণায় আমি আজো সেই গুণ্ডাই আছি! তাই আমাকে দিয়ে সেই কাজ করাতে চাইছিলেন, যা একটা ঘৃণ্য সামাজিক অপরাধ। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে যার শাস্তি জেল এবং জরিমানা দুটোই। আপনি ভুলে গিয়েছিলেন আমার বর্তমান অবস্থা অবস্থান এবং মানসিকতার কথা। সাতখানা উপন্যাস আছে আমার প্রায় একশো গল্প। কম পক্ষে দশবার টিভিতে দেখিয়েছে আমাকে। আনন্দবাজার সহ পাঁচটা প্রথম শ্রেণির পত্রিকায় আমার কথা লেখা হয়েছে। সে সব আপনার মনে কোনো দাগ কাটেনি। আপনি ভুলে গিয়েছিলেন যে রত্নাকর বাল্মিকী হবার সাধনারত, সে আর যাই করুক কোনদিন ফেলে আসা পথের দিকে ফিরবে না। আগাবে সামনেই।

আপনি আমাকে একদিন বড় সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। যেভাবে আর যে কারণেই হোক একটা কাজ পেয়েছি। দুবেলা দুমুঠো খেতে পাচ্ছি। এর জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

সেই কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম আমি কোনদিন আপনার অবাধ্য হবে না। যা বলবেন তা করবো। দশ বছর ধরে করে গেছি তা, একটা ফোন করে যখন যা বলেছেন। “ভোর চারটেয় লেকের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াস”। দাঁড়িয়েছি। এর জন্য কোনদিন কোনো মূল্যও দাবি করিনি। প্রয়োজন আপনার, তবু আপনি একটাকা খরচ করে সেটা আমাকে জানাতে চাননি, মিস কল মেরে দিয়েছেন আমি আমার পয়সা খরচ করে কি দরকার জেনে কুকুরের মতো আপনার বাড়ি ছুটে ছুটে গেছি। করেছি আরো অনেক কিছুই সেতো আমি আর আপনি-দুজনে জানি। ওই পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কিন্তু কি করে এক পুকুরে যেখানে হাজার হাজার লোক চান করে, হাজার হাজার টাকার মাছ ছাড়া আছে তাতে বিষ ঢেলে দিতে বললেন, আমি ভাবতে পারছি না। কি করে মনে করলেন যে এত হীন নীচ জঘন্য কাজ আমি বিনা দ্বিধায় করে দেবো? এ কাজ কি আমার মত একজন মানুষ যে লেখে, যে মার্কসবাদের ছাত্র করতে পারে?

আমি আবারও বলছি, আপনি যা বলবেন তাই করব। তবে শর্ত একটাই সেটা যেন সময় সমাজ মানুষের মঙ্গলের জন্য হয়। সেটা করতে গিয়ে আমি মারা গেলে যেন লোকে শহিদ বলে। বেদী বানায়, মালা দেয়। কিন্তু ওটা? যা করার জন্য আপনি চাপ দিচ্ছিলেন, এতে মানষু সমাজের কি মঙ্গল হবে? কারো কোনো মঙ্গল তো হবেই না, উল্টে আপনার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে আমি যদি ধরা পড়ে যাই জনগণ কুকুরের মতো পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য জল, মহিলা সমিতির স্বনিযুক্তি প্রকল্পের মাছ মারার শাস্তি হাতে হাতে পেয়ে যাব।

যদি মারা নাও যাই যেতে হবে জেল গারদে। চাকরিটাও আর থাকবে না। এরপর আরো আছে। লেখকমনোরঞ্জন ব্যাপারী সামাজিক অপরাধ করে ধরা পড়েছে সে খবর পত্রিকায় টিভিতে থাকবেনা তা কি করে সঙ্গবফলে সারা দেশজেনে যাবে আমার চুড়ান্ত নৈতিক অধঃপতন। সারা জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমে যেটুকু বা মান সম্মান অর্জন করেছি সব ধুলোর সাথে মিশে যাবে। আর কোনদিন কারো সামনে মাথা উঁচু করতে পারব না, সবাই ছিঃ ছিঃ করবে। সব সাধ, স্বপ্ন, সাধনার অপমৃত্যু হয়ে যাবে। আপনি কি করে ভাবলেন যে এই রকম আহাম্মুখির কাজ আপনি বলবেন আর আমি করে দেবো! আমি কি এতই নির্বোধ!

আপনি সেদিন আমাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন-“তুই ভীত হয়ে পড়েছিস!” সত্যিই আমি ভীত হয়ে পড়েছি। সে ভয় মান-সম্মান হারাবার ভয়। ওইটুকু ছাড়া আর আমার কি আছে? দশজন গুণী মানুষ চেনে, দশটা অনুষ্ঠানে মঞ্চে বসি, যে মঞ্চে খ্যাতনামা সব মহান মানুষেরা থাকে।ওইটুকু হারাবার ভয় যে কি বিষম ভয় সে একমাত্র তারাই জানে, যাদের আছে। আর জানে তারা, যারা হারিয়েছে।

ধরা যাক আমি স্পটে ধরা পড়লাম না। সফল এ্যাকশানের পর অক্ষত শরীরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়ে গেলাম, তারপরও কি মনে করেন বেঁচে যাব? না বাঁচবো না। তখন মহিলা সমিতি আর সাথে স্থানীয় নেতা-জনতা যাবে থানায়। কেস করবে। করবেই। পুকুর আগে আপনার ছিল, আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ সবার আগে আপনাকে সন্দেহ করবে। কারও না–অন্য কারো চাইতে আপনার রাগ বেশি থাকা স্বাভাবিক। সেটা বুঝেনিতে অপরাধ তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করা পুলিশ অফিসারদের বেশি বিলম্ব হবে না। কত বড় বড় কেস ওরা ধরে ফেলে। সে তুলনায় এতো জলভাত। চব্বিশ ঘন্টা সময় যাবে না ওরা আপনাকে তুলে নেবে। তখন কি হবে? পারবেন পুলিশের মার আর জেরার সামনে মুখ বন্ধ রাখতে? পারবেন না। কথা বের করার ওদের শতেক রকম কায়দা আছে। সে কায়দার সামনে কত বাঘা বাঘা লোক কাত হয়ে যায়। আর আপনার তো ওই শরীর।

ধরে নিচ্ছি আপনি আমার নাম বলবেন না। কিন্তু আপনার বউ মেয়ে? ওরা তো জানে কাকে দিয়ে আপনি এ সব কুকর্ম করিয়েছেন। তারা যখন দেখবে আপনি ফেঁসে গেছেন কেঁদে কেটে আমার নাম বলে আপনার অপরাধ লাঘব করে দিয়ে আপনাকে বাঁচাতে চাইবে। এটা দোষের কিছু নয়, সব মেয়ে মহিলারা এই করে। যদি আমি ধরা পড়ি আমার মেয়ে বউও তাই করবে।

তখন আমার কি হবে দত্তদা। যদি সুযোগ পাই বউ ছেলে মেয়ের হাত ধরে সাজানো সংসার ফেলে আমাকে পলায়ন করতে হবে। আমার এত বছরের চেষ্টায় গড়ে তোলা ঘর দুয়ার সব ছারখার হয়ে যাবে। তখন আবার সেইনা খেয়ে না দেয়ে গাছতলা ফুটপাত স্টেশনে পড়ে থাকতে হবে। আর যদি পালাবার সুযোগ না পাই, হাড়গোড় ভাঙা দেহ নিয়ে পচে মরতে যেতে হবে জেলখানার কালো কুঠুরিতে। অথবা ঘটে যাবে এর চেয়ে মর্মান্তিক ভয়াবহ বিভৎস সেই ঘটনা। আপনি বা আমি কেউই আর ধরাধামে রইলাম না। কথায় বলে পাবলিকের মার দুনিয়ার বার। যে পাবলিকের পিছনে একটা সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল আছে, যে দল শাসন ক্ষমতায় তারা না পারে এমন কোনো কাজ নেই। একথা আপনার চেয়ে বেশি আর কে জানে? শত হলেও চল্লিশ বছর আছেন ওই দলে।

একজন কমুনিস্ট পার্টির কর্মীর দলের প্রতি থাকতে হবে অন্ধআনুগত্য, আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা নেতৃত্বের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্বস্ততা। পার্টির প্রত্যেকটা নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। পার্টির স্বার্থকে স্থান দিতে হবে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে। এসব কথা বহুবার বহুজনের মুখে শুনেছি। তাহলে আজ কেন আপনি পার্টির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধতা করে গুপ্ত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দলের মহিলা শাখার আর্থিক ক্ষতি করতে বদ্ধপরিকর?কি করেছে পার্টি? আপনি একা বহু বছর ধরে যে সর্বসাধারণের পুকুরে মাছ চাষ করতেন সেটা সমিতির মাধ্যমে অনেক ক’জন মহিলাকে মৎস পালনের জন্য দিয়ে দিয়েছে। অনেকগুলো পুকুর আপনার, তার মধ্যে একটা বেদখল হয়ে যাওয়ায় এত বছরের আনুগত্য ভুলে অন্তর্ঘাতে নেমে পড়লেন, এটা ঠিক আদর্শবান কমুনিস্ট পার্টির কর্মীর যথার্থ পরিচয় নয়।

দত্তদা, এই সমাজে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে আপনার মূল্য কানাকড়িও নয় যা কিছু প্রভাব প্রতিপত্তি সব ওই পার্টির সাথে জুড়ে আছেন বলে। যদি আপনার এই সব চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যায়, যদি পার্টি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে আপনাকে আলাদা করে দেয় এক মিনিটে শূন্য হয়ে যাবেন। এটুকুও কি বোঝার মতো বুদ্ধি আপনার নেই? কেন যে ডালে বসে আছেন তাতে কুড়ুল মারতে যাচ্ছেন? এতে শুধু আপনি একা মরবেন না, আপনার বউ মেয়ে ওরাও সবার চোখে হেয় হয়ে যাবে।

আপনাকে এত কথা বলার দরকার ছিল না। আপনি যদি আগুন খান গাল আপনারই পুড়বে। তবু এই জন্য বলছি, এক সঙ্গে অনেকগুলো বছর ছিলাম তো, আপনার ক্ষতি হলে সেটা আমার ভালো লাগবে না তাই বুঝিয়ে বলা। এ সব ধ্বংসাত্মক ভাবনা, আত্মহননের পথ পরিত্যাগ করুন। আপনার যা বয়েস এ সব ছেলে মানুষি আপনাকে মানায় না। যদি আমার কথা না মানেন যা ইচ্ছা করুন আর কি বলব।

.

কি যে করবে কিছুতে বুঝে উঠতে পারছে না ওয়ার্ডেন। একটার পর একটা লেখা ছাপা হয়েই আছে। কিছুতেই থামিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না লোকটার কলম। প্রতি পুজোয় বের হচ্ছে একটা উপন্যাস, মাসে কমপক্ষে একটা গল্প। এত কাজের চাপ, এরপর লেখে কখন! কখন লেখার সময় পায়! উপন্যাসে কত পাতা! কী করে পারে লোকটা এইসব করতে।

সাধারণতঃ স্কুলের চাকরির মতো আরামের চাকরি আর একটাও নেই। এগারোটা থেকে চারটে মাত্র পাঁচঘন্টা ডিউটি। তার উপর এর জন্মদিন ওর মৃত্যুদিন, স্বাধীনতা, প্রজাতন্ত্র-সব মিলিয়ে যে কত ছুটি। আছে পুজোর ছুটি গরমের ছুটি। তবে এইসব ছুটি শুধু শিক্ষক এবং দু’চারজন শিক্ষাকর্মীর জন্য। দারোয়ান, সুইপার, রাঁধুনি–এরা বাদ। আমরা রাঁধুনিরা, ছুটি পাই যদি হোস্টেলে কোনো বাচ্চা না থাকে।

সব ছুটিতে সব বাচ্চা বাড়ি যায় না। অনেকের বাড়ির আর্থিক স্থিতি ভালো নয়, বাচ্চাকে ঠিকমতো খেতে দিতে পারে না, অনেকের বাড়ি দুরে। সেই মা বাবা বাচ্চাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চায় না। অভাগা বাপ-মায়ের সেই অভাগা বাচ্চাগুলো এখানে পড়ে থাকে। ওদের কারণে আমরা পড়ে থাকি। ছুটি পাইনা। আমরা না এলে ওরা খাবে কী। বাচ্চাদের জন্য রান্নাটা করতে আমাদের আসতে হয়–সে একটা দুটো যাই-ই হোক সেইসাথে রান্না করতে হয় বহিরাগত এখানে শেল্টার পাওয়া অন্য চল্লিশ পঞ্চাশ জনেরও। নানাবিধ কারণে যারা পাড়া ছাড়া বা বাড়িতে যেতে পারে না। আমরা না এলে এদের নিজে বেঁধে খেতে হয়!

এদের সবাইকে যে পুলিশ বা বিরোধী দলের লোকেরা খুঁজছে তা নয় কেউ কেউ এমনও আছে যে কলকাতায় কোথাও চাকরি করে। কেউ চাকরি পাবার উপযুক্ত হবার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে শহরের কোন সংস্থায়। কেউ পড়াশোনা করছে কোনো কলেজে। সবারই বাড়ি বহু দুরে আর এদের বাবা কাকা দাদা মামা—কেউ না। কেউ অবশ্যই সিপিএম দলের স্থানীয় নেতা।

আমি মোটামুটি ভাবে গ্রীষ্মের ছুটির আর পুজোর ছুটির সময়টাকে বেছে রাখি কোনো একটা বড় লেখার জন্য। গ্রীষ্মের ছুটিতে যেটা লিখি সেটা পুজোর সময় ছাপা হয়, আর পুজোয় যেটা লিখি ছাপা হয় বইমেলায়। আমার কর্মস্থলের প্রায় সবাই সেটা জানে। জানে ওয়ার্ডেনও।

সে এবার স্থির করে নেয় এই গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাকে লিখতে দেবে না। আসছে পুজোয় ছাপতে দেবে না আমার উপন্যাস। তাতে অবশ্য খুব বেশি ক্ষতি করা হবে না তবু একেবারে কিছু না হওয়ার চাইতে সামান্য কিছু হলেও বা মন্দ কী!

এখন দারুণ দাবদাহ চলছে। তাপমাত্রা ওঠা নামা করছে চল্লিশ ডিগ্রির আশেপাশে। চারদিক যেন জ্বলে যাচ্ছে তার প্রবাহে। সেই প্রখর রোদ রান্নাঘরের টিনের চালে পড়ছে। ঘরের ভেতরটা যেন ফার্নেশের মতো তেতে উঠছে। যেখানে আবার জ্বলছে বড় বড় দু’খানা উনুন। তারই সামনে দাঁড়িয়ে ঘামে নেয়ে চুপচুপে হয়ে লোকটা রান্না করছে, ভাবতেই দেহমনে শিহরণ খেলে যায় ওয়ার্ডেনের! কী দারুণ একটা মজার ব্যাপার। ছুটির ছুটিও গেল উপন্যাসও লেখা হল না। বাড়তি পাওনা–দহন। মন পুড়বে লিখতে না পারার জন্য, শরীর পুড়বে আগুনের তাপে। আহঃ কী বিভৎস মজা! ওকে এই কষ্টে ফেলে সেই মজা উপভোগ করতে হবে।

ওয়ার্ডেন অতীব চালাক লোক। তার হাতে আছে একগাদা বোবা বাচ্চা। এদের চাল হিসাবে ব্যবহার করতে শিখন্ডি দাঁড় করাতে কোনো অসুবিধা নেই। সুস্থ-সামাজিক মানুষের সমস্ত সহানুভূতির কেন্দ্রে আছে এরা। এদের সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার যথেষ্ট সুযোগ।

একটি ছেলে এসেছে এখানে নাম সৌমেন্দু প্রধান। বাড়ি বহু দূর সুন্দরবনের এক অজ গাঁয়ে। যেখানে এখনও পাকা সড়ক হয়নি, বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। সৌমেন্দুর বাবা বড় গরিব। অনেক কষ্টে কোনমতে ছেলেটাকে এখানে ভর্তি করাতে পেরে যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। আর কিছু না হোক ছেলেটা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে, গায়ে গতরে বাড়ছে-এই যথেষ্ট। বাড়িতে থাকলে তো খেতেই পেত না। ওর বাপ ওকে রেখে চলে যাবার পর অন্য বাপের মতো মাসে মাসে এসে ছেলেকে দেখে যাওয়া কি লাগবে না লাগবে খোঁজ নেওয়া সেসব পারে না। পেরে ওঠে না আর্থিক অনটনের জন্য। পথ খরচ যে জোগাড় হওয়াই কঠিন। তার উপর একটা দিন কাজ কামাই দিলে সংসারেও টান পড়ে। সেই জন্য সে আসে বছরে চার বার। গরম আর পূজোর ছুটিতে সৌমেন্দুকে নিয়ে এবং দিয়ে যাবার জন্য। পুজোর ছুটিতে সৌমেন্দু বাড়ি যায় খুশি মনে। সেটা একটা আনন্দ উৎসবের সময়। চারদিকে কত হৈচৈ। তখন একা একা হোস্টেলে পড়ে থাকতে কার ভালো লাগে। আর গরমের ছুটিতে বাড়ি যায় বাধ্য হয়ে–ভারাক্রান্ত মনে। বাড়িতে এখানকার মতো পাখার হাওয়া, পাকা ঘর, খাট সে সব কিছুই নেই। পেট ভরে খাবারও জোটে না। বড় কষ্ট।

ওয়ার্ডেন খুঁজছিল একটা মোক্ষম অজুহাত। যেটা দেখিয়ে আমার গ্রীষ্মের ছুটিটা রদ করা যায়। তার নজর গেল সৌমেন্দুর দিকে। ছেলেটার অনেক দিন ধরে একটা রোগ আছে সেটা হাইড্রোসিল। এমনিতেই এইসব বাচ্চাদের প্রতি মানুষের দয়ামায়ার ভাণ্ড উপচে পড়ে, তার উপর রুগী। একে সামনে রেখে পিছনে বসে যেকোনো বদ উদ্দেশ্য সফল করতে খুব বেশী সমস্যা হবার নয়।

তাই করে সে। কী? না ওর হাইড্রোসিল অপারেশন হবে। ওকে এখানেই রাখা হবে, বাড়ি পাঠানো যাবে না।

 হোস্টেলে রয়ে গেল সৌমেন্দু প্রধান। সে বা তার বাবা বেঁচে গেল ফালতু নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসার ঝামেলা থেকে। আর পুরো গ্রীষ্মের কুড়ি বাইশ দিন ছুটি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলাম আমি। লেখা হল না যে উপন্যাসটা লিখব বলে অপেক্ষা করে ছিলাম।

সে গ্রীষ্মে সৌমেন্দুর অপারেশন হয়নি। হবে না যে সে তো ওয়ার্ডেন জানত। অপারেশন হয়েছিল শীতকালে। তবু তাকে হোস্টেলে রেখে খুব বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমাকে দারুণ দাবদাহে তার সাথে অন্য চল্লিশ জন লোকের রান্না করতে বাধ্য করা হয়েছিল শুধু এই কারণে, আমি যেন লিখতে না পারি।

ঠিক মনে করতে পারছি না কবে কোথায় যেন একটা কবিতা পড়েছিলাম। যার লাইনগুলো ছিল এই রকম–

আমাকে তোমার এত ভয়।
কেন কমরেড?
সেকি শুধু ঘুরে দাঁড়িয়েছি বলে
তাতেই ভয়?
এখনও তত জ্বালিনি আগুন
শ্মশানের ধুলো ওড়াইনি
ধিনিকি ধিনিকি নাচনে
এখনও নামিনি পথে
বৃষভ বাহনে
তবু ভয় পেলে কমরেড?

আমি যখন একা প্রবল পরাক্রান্ত বিরুদ্ধ শক্তির বুহ্যে বসে সাহিত্যচর্চা করে চলেছিলাম যে কোনো মুহূর্তে যা কিছু হয়ে যেতে পারে সেই ভয় বুকে নিয়ে, তখন কিন্তু জেলখানার মতো পাঁচিল ঘেরা স্কুলের জগৎটার বাইরে একটু একটু করে মানুষের ভয় ভাঙছিল। প্রতিবাদী জন বিবেক জাগ্রত হচ্ছিল ধীরে ধীরে। এর প্রথম সূর্যকিরণ দেখা গিয়েছিল হুগলী জেলার সিঙ্গুর ব্লকে ২০০৬ সালে। যে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ ওখানে জ্বলে উঠেছিল তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা পশ্চিমবাংলার জনগণের মনে বুকে আত্মায়। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ শাসকদল সে আগুনের আঁচ অনুমান করতে পারেনি। বুঝে উঠতে পারেনি সাধের লঙ্কা পুড়ে ছারখার হতে বসেছে।

তাই, সিঙ্গুরের আঠারো হাজার পরিবারকে গায়ের জোরে উচ্ছেদ করে তাদের তিন ফসলি চাষের জমি কেড়ে নিয়ে শিল্পপতি রতন টাটাকে উপঢৌকন স্বরূপ দিয়ে ছিল বর্তমান সরকার, যে নাকি শ্রমিক কৃষকের সবচেয়ে বড় বন্ধু।

কুড়ি কাঠায় এক বিঘে, তিন বিঘেয় এক একর, তারই ৯৯৭ একর। জমির পরিমাণ শুনে মাথা ঘুরে যাবার দশা আমার। আমি সারা জীবনে চেষ্টায় সোনারপুর থানার পথঘাট জল বিদ্যুৎবিহীন একদার জলাজমির মাত্র দু’কাঠার মালিক। তাও খাস জমির। কে যে এর আসল মালিক তা কে জানে। সিপিএমের লোকেরা দখলে রেখেছিল। দশ টাকার কোর্ট পেপার লিখে তারাই বেচল। আমার মতো অনেকে কিনে ঘরদোর বানিয়ে বসেছে। মাঝে মাঝে হুঙ্কার আসছে আজকাল, এখানে চিড়িয়াখানা হবে। তবে সেটা খুব একটা মসৃণ পথে হবে না। উচ্ছেদ হলে মানুষ মরণ কামড় দেবে।

যেমন দিয়েছে সিঙ্গুর। কৃষক ক্ষেতমজুররা ভিটে মাটি থেকে উৎখাত এর বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছিল তীব্র বিক্ষোভে। তাদের দমন করতে একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে হাজার হাজার পুলিশ, হাজার হাজার লাঠিয়াল নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা লাঠি, গুলি, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট যা ইচ্ছা তা করার অনুমোদন পেয়ে নেমে পড়েছিল কৃষক জনতার সব প্রতিরোধ আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে।

এরপর যা হয় সে ইতিহাস আজ আর কারও অজনা নয়। সেই ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে রয়ে গেছে তাপসী মালিক আর রাজকুমার ভুলের নাম। এরই প্রতিবাদে পথে নামল লক্ষ জনতার স্বতঃ স্ফুর্তমিছিল। পথে নামলেন অশীতিপর বৃদ্ধা সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। ধর্মতলায় অনশনে বসলেন অগ্নিকন্যা মমতা ব্যানার্জী।

প্রবল বিরোধ তবু সিঙ্গুর ব্লকের জমি অধিগ্রহণ স্থগিত রাখেনি দাম্ভিক সরকারের দাম্ভিক প্রধান। অধিগৃহীত জমির চার দিক ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছিল উঁচু পাঁচিল। হাজার হাজার রাজ্য পুলিশের তখন একটাই কাজ, পাঁচিল পাহারা দেওয়া। জনরোষ আছড়ে পড়ে বারবার ভেঙে দিচ্ছিল, পুলিশ পাহারায় বার বার বসানো হচ্ছিল ওই পাঁচিল।

সিঙ্গুর দখল মোটামুটি সম্পন্ন হবার ফলে জমির ক্ষুধা বেড়ে গেল শিল্পপতিদের তাদের বন্ধু সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর। এবার তার শেন্য দৃষ্টি গেল পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের দিকে। এবার সেখানকার মানুষকে উচ্ছেদ করে সে জমি সালেম নামক এক শিল্পপতির হাতে তুলে দেবার প্রক্রিয়া চালানো হল। পুলিশের পোষাক পরা ক্যাডার, আর ক্যাডারের ভূমিকা পালন করা পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হল নন্দীগ্রামের দিকে। যাও দখল করো। চল্লিশ হাজার একর জমি চাই ওখানে। শুরু হয়ে গেল আবার খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুঠপাট।

মানুষ তো শেষ পর্যন্ত সবকিছুর পরেও মানুষই হয়। সে বেঁকে যেতে যেতে সোজা হয়। মার খেতে খেতে মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাইনন্দীগ্রামের মানুষ রুখে দাঁড়াল। রুখে দিল সেই দলকে এক সময় যে দলকে তারাই বলবৃদ্ধি করেছিল, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের বাল্যের মাতৃক্রোড় শৈশবের ক্রীড়াভূমি, যৌবনের প্রেম, বার্ধক্যের বারাণসী–নিশ্চিন্তে মরবার মাটি মায়ের অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আগুন হয়ে জ্বলে উঠল তারা।

তাদের ভেঙে চুরে নতন বাধা বিনীত করে ফেলার একটাই অস্ত্র-সব দেশের সব স্বৈরাচারি শাসক যা করে থাকে, যার পোষাকি নাম–আইন শৃঙ্খলা রক্ষা। এই একটি মাত্র শব্দের আড়ালে মহিলা যোনীতে শাবল ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, দুধের বাচ্চা দু’পা ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা চলে, মৃত স্বামীর গুলিবিদ্ধ দেহের সামনে ক্রন্দরতা ভীত শোকাহত শরীরকে পিটিয়ে শুইয়ে দেওয়ায় বাধা নেই, এইসবই ঘটানো হয় নন্দীগ্রামে। সিপিএম দল একদিন ক্ষমতায় এসে মরিচঝাঁপিতে যে ধর্ষণ, সংস্কৃতির সূচনা করেছিল, নন্দীগ্রামে তারই বন্ধুহীন প্রয়োগ করে সংগ্রামী মানুষের মনোবল চুর্ণ করার জন্য। রাধারাণী আড়িকে সামান্য দিন ব্যবধানে দু’দুবার গণধর্ষণ করানো হয়। এক ১৪ মার্চ, ২০০৯, ১৪ জন মানুষকে খুন করা হয়। এই সবই করা হয় সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা চুলের সাহিত্য সংস্কৃতির বড় প্রবক্তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাধের শিল্পায়নের জন্যে।

সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে এই ঘটনায় ছাত্র যুবক শিক্ষক কবি লেখক গায়ক অভিনেতা শিল্পী সাহিত্যক-সমাজের সর্বস্তরে শোনা গেল একই ধিক্কার ধ্বনি–ছিঃ। ছিঃ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সাদা পোষাকের নীচে তোমার এই নরখাদক হিংস্র রূপটা লুকানো ছিল, সে আমরা আগে জানতাম না। ধিক্কার তোমাকে, শত ধিক্কার।

এই অন্যায়–রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পথে নামল মানুষ। আবাল বৃদ্ধ শিশু নারী, কেউ বাদ গেল না। লাখো লাখো মানুষের প্রতিবাদী মিছিল বন্যার মতো আছড়ে পড়তে লাগল মহানগরীর বুকের উপর। যারা মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ–সেই সব কবি শিল্পী সাহিত্যিক অভিনেতা সংবেদী মানুষ, একের পর এক বিষ্ঠাবৎ পরিত্যাগ করতে লাগলেন খুনি সরকারের দেওয়া পদ, পুরস্কার, খেতাব। প্রতিবাদী মানুষের সমর্থনে ছুটে এলেন নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটেকর, আদিবাসী মানুষের জল জঙ্গল জমিন নিয়ে অক্লান্ত লড়ে যাওয়া ভারত জনআন্দোলনের নেতা ড. ব্রহ্মদেও শর্মা, হাজার হাজার বন্ধক মানুষের মুক্তি এবং পুনর্বাসনের দাবিতে সড়ক সে সুপ্রিম কোর্ট’ পর্যন্ত লড়ে যাওয়া সন্ন্যাসী স্বামী অগ্নিবেশ। কলম থেকে আগুন উগরে দিতে লাগলেন মহাশ্বেতা দেবী। কত মানুষ, কত যে নাম তা গুনে শেষ করা যাবে না। বিগত চৌত্রিশ বছর কালে এই দেশ–এই পশ্চিমবঙ্গে এমন জনজোয়ার কোনোদিন দেখেনি।

যে চারজনের নাম উল্লেখ করেছি চারজনই আমার পরিচিত। শেষ জনের সঙ্গে তো সেই ১৯৮০ সাল থেকে চেনাজানা। অন্য তিন জনের সাথে স্বল্প সময়ের পরিচয় হলেও তাদের আন্দোলনে অংশ নিতে মিছিলে হেঁটেছি এক সাথে এক দু’পা।

তাকিয়ে দেখি, যে সব পত্র পত্রিকায় আমি লিখি, যাদের সাথে উঠি বসি, নন্দন চত্বরে কফি হাউসে আড্ডা দিই, যারা আমাকে শঙ্কর গুহ নিয়োগীর লোক বলে ভালোবাসে, সেই যে পুর্ণেন্দু বোস, যার সাথে খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত অসুস্থতায় পড়েছিলাম এক নদীর পাড়ে সেই ছত্তিশগড়ের পারালকোটে, সাথে আরও ছিল কুশল দেবনাথ, চঞ্চল মুনশি–সব সৎ দরদী নিঃস্বার্থ মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে ওই লড়াকু কৃষক জনগণের পিছনে।

রণপা পরা নাচের পা আমার, রণবাদ্য শুনলে আর স্থির থাকতে পারে না, নাচতে চায়। টের পাই বুকের মধ্যে মাদলের দ্রিমিদ্রিমি? ওই মাঠ মাটি অকুতো মানুষ আমাকে ডাকে আয় আয়। এই তোর পথ। এই পথই তোর। এখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়। এটা যুগ সন্ধিক্ষণ। এই সময় তোর সময়।

তবু আমি সে ডাকে সাড়া দিতে পারি না। এগিয়ে যেতে পারি না। যার সবার আগে যাবার কথা তার অগ্রগমণ রোধ করে দাঁড়ায় অসহ্য পেটের খিদে। যেদিন আমি ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ব, ওরা, আমাকে ঘিরে রাখা হার্মাদ দস্যুরা, দুধ থেকে তুলে ফেলা মাছির মতো কাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তখন খাব কী! বাঁচব কী ভাবে? তাই রয়ে যাই পেটের গোলাম হয়ে মানবতার সব চেয়ে বড় শত্রুদের শিবিরে–না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে। মোটবওয়া ধোপার গাধার মতো।

এই সময় তীব্র যন্ত্রণায় একটা কবিতা লিখেছিলাম মেধা পাটেকরকে মনে রেখে সেটা লেখার লোভ সামলানো গেল না। সেটি পরে ১৪১৭ শরৎ সংখ্যা ‘নতুন পথ এই সময়’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়।

অক্ষমতা

অনেক দূর থেকে
অনেক পথ পার হয়ে
তুমি এসেছিলে–আমার জন্যে
আমাদের সবার জন্যে
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে
তুমি একা হেঁটেছিলে
দস্যুর হাতে লুঠ হয়ে যাওয়া
সোনালী ধান ক্ষেত, আলপথ ধরে
তুমি একা…।
তোমার পিছনে পিছনে হেঁটে গিয়েছিল
রুক্ষ শুষ্ক বিবর্ণ তবুও আত্মদীপ্ত
সুদীর্ঘ সহস্র মানুষের মিছিল।

সবাই গিয়েছিল, সবাই–
শুধু আমি একমাত্র আমিই
যার সবার আগে যাবার কথা,
–যেতে পারিনি
পথ তো অচেনা ছিল না
পথ তো অপ্রিয় ছিল না
তবু, তবুও…।
তুমি একাই হেঁটেছিল–
তোমার পিছনে হেঁটে গিয়েছিল
যে শিশু ভূমিষ্ট হবে আজ রাতে
তার অনাগত ভবিষ্যতের উদ্বোধন গীত
আমি পারিনি
শুধু আমিই পারিনি
আমার নিজের জন্য
এক পা এগিয়ে যেতে
পথ অচেনা ছিল না অপ্রিয়ও নয়
তবু, তবু…।

এই সময় একদিন দুপুরে গেছি মহাশ্বেতা দেবীর বাড়িতে। উনি তখন গলফগ্রিনে থাকতেন। সাথে করে নিয়ে গেছি আমার সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘চণ্ডাল জীবন’। উনি এই বইয়ের জন্য ভূমিকা লিখেছিলেন। বইখানা ওনাকে দিয়ে প্রণাম করলাম। আমার দুটো চোখের জল ঝরে পড়ল ওনার পায়ের পাতায়। যেন হাজার বঞ্চনার, অভাব অভিযোগের অত্যাচারের গোপন ইতিহাস লুকানো আছে ওই চোখের জলের মধ্যে। যেন সেই জল বলছে, দেখ, আমাকে দেখ। একদিন যে ছোট প্রদীপটা তুমি আমার বুকের মধ্যে জ্বালিয়ে দিয়েছিলে, হাজার ঝড় ঝাঁপটায় আমি তাকে নিভে যেতে দিইনি। প্রাণের মতো, শ্বাস প্রশ্বাসের মতো আমার দুর্বল দুটো হাতের আড়াল দিয়ে অনির্বাণ রেখেছি। আর বহন করে নিয়ে চলেছি পতাকার মতো।

আমি কোন ভয়ের কাছে নত হইনি, প্রলোভনে বিকিয়ে যাইনি, মাথা উঁচু করে শিরদাঁড়া সোজা রেখে সাহসের সাথে উচ্চারণ করেছি অমল সত্য। এই বই বহন করছে তারই সাক্ষ্য।

উনি কোনো কথা বললেন না, আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় দিলেন তিনটি স্নেহ চুম্বন। ছল ছল করে উঠল ওনার দুচোখ। বাইরে কোনো প্রকাশ নেই, তবু মনে হয় এক পশলা বৃষ্টিপাত হয়ে গেল বুকের মরুভূমিতে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবেগঘন গলায় বললেন বুঝতে পারিনি, যে তুই এত লম্বা রেসের ঘোড়া, তোকে সত্যিই সেদিন আমি চিনতে পারিনি।

উনি সেই ১৯৮০ সালে জ্যোতিষ রায় কলেজে পড়াতেন। থাকতেন বালিগঞ্জ রোডে জ্যোতির্ময় বোসের বাড়ি ভাড়ায়। কলেজে আসা যাওয়া করতেন বাসে-রিক্সায়।

সেদিন ছিল এক শনিবার। কলেজের সামনে থেকে উনি উঠেছিলেন এক রিকশায়, যেমন তিনি রোজ ওঠেন। রোজ এইট বি স্ট্যান্ডে গিয়ে নেমে যান। উনিও ভুলে যান রিকশা অলার কথা, রিকশাঅলাও ভুলে যায় ওনাকে।

কিন্তু সেদিন ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ঘটে গিয়েছিল। সেদিন সেই রিকশাঅলা দু’একটা কথা বলেছিল। যাতে বোঝা গিয়েছিল–এ একটু অন্যরকম। অন্যসব রিকশাওলার মতো নয়। বই টই পড়ে, দেশের নানা বিষয়ে কিছু খোঁজখবর রাখে।

উনি তখন একটি পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেছিলেন, যার নাম বর্তিকা। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মনীষ ঘটক। যিনি মহাশ্বেতা দেবীর বাবা। এখন এর দায় দায়িত্ব ওনার উপর বর্তেছে। উনি সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে পত্রিকাটিকে একটি নতুন রূপ দেবার চেষ্টা করেন, গল্প, উপন্যাস কবিতা নয়, সাধারণ মানুষের সত্যনিষ্ঠ গ্রাম সমীক্ষার বাস্তব চিত্র দিয়ে ভরিয়ে তুলতে থাকেন পত্রিকার পাতা।

ইতিপূর্বে বর্তিকায় ক্ষেতমজুর, বর্গাদার, ছোট কৃষক, ইটভাটার মজুর, জুতো কারখানার কর্মী, এমন ধরনের অনেক লিখেছে, লেখেনি কোনো রিকশা শ্রমিক। ওনার তখন মনে হল যে, একটা লেখা এইরিকশাওলাকে দিয়ে লেখানো যেতে পারে। শহর কলকাতায় এদের জীবন বহুবিধ সমস্যা, সেই সমস্যা নিয়ে লিখলে বর্তিকার পাঠকরা একটু ভাবনা চিন্তার খোরাক পাবে।

তাই তিনি সেই রিকশাওলাকে দিয়ে লেখালেন। সেটা ১৯৮১ জানুয়ারি সংখ্যা–বর্তিকায় প্রকাশিত হল। এক কিছুদিন পরে তিনি সেই রিকশাওলার কথা ভুলে গেলেন। রোজ কোন না কোন রিকশায় চাপেন, কত মুখ মনে রাখবেন। রোজ কত না কত জন বর্তিকায় লেখে, কার নাম মনে রাখবেন। মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে সেই কক্ষ যার কিছু পুরাতনকে জায়গা করে দিলে নতুন কিছু রাখার স্থান সংকুলান হয় না।

একবার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি সুন্দরবনের বাসন্তীতে গিয়েছিলেন। তখন এক চায়ের দোকানের বাচ্চা চাকরকে দেখে কী ভাবে কে জানে কাছে ডেকে একটু আদর করে দেন। তারপর ফিরে যান দিল্লিতে। সবাই ভেবেছিল বাচ্চার বোধহয় ভাগ্য ফিরে গেল। কিছুই ফেরেনি, দিল্লি গিয়ে হাজার কাজের চাপে সে বাচ্চার কথা মনে থাকেনি ইন্দিরা গান্ধির। আজও সে বাচ্চা চায়ের গেলাস ধোয়। তবু তার মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেছে সেই দিনটা।

ছত্তিশগড়েন একজন এম.এল.এ. বিল ক্লিন্টনের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এক মাস সে সেই হাতে কোনো কাজ করেনি, ধোয়নি। আর ক্লিন্টন? সে সম্ভবতঃ কীটনাশক সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে নিয়েছিল নিজের হাত।

মহাশ্বেতা দেবীর কাছে সেটা বড় কোনো ঘটনা হবার নয় যেটা সেই রিকশা চালকের জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা, জীবনের এক যুগ সন্ধিক্ষণ। চুম্বক যেমন জানে না, তারই স্পর্শে লোহাও চুম্বক হয়ে যায়, ওনার সামান্য ছোঁয়া পেয়ে সেই রিকশা চালকের মনে জন্ম নিয়েছে আশার একটা ছোট্ট চারাগাছ-আমি লেখক হবো।

সেই আশার বাতি বুকে আঠাশটা বছর শত রকম দুঃখ কষ্ট জীবন যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এক পা এক পা করে হেঁটে, কারও কোনো সহায়তা ছাড়া, হাজার লেখকের ভিড়ে, নিজের একটা স্থান বানিয়ে নেওয়া–এটা কোনো গল্প উপন্যাসের চেয়ে কম নয়।

এখন কী ওনার মনে কোনো কষ্ট হচ্ছে? ছেলেটার জন্য একটু কিছু করা দরকার ছিল। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে, একটু সামান্য সাহায্য পেলে ও অনেকটা এগিয়ে যেতে পারত। তাহলে আজ একলব্যের গুরু দ্রোণের যে স্থান আগামী ইতিহাসে ওনার সে স্থান হতো না, হতো কুরুক্ষেত্র বিজয়ী বীর সব্যসাচীর গুরু দ্রোণাচার্যের সমান স্থান, সম্মান।

তাই কী আক্ষেপ এখন ওনার গলায় আমি সেদিন বুঝতে পারিনি রে। কত লোকের লেখা বর্তিকায় ছেপেছি, একজনও তোর মতন হতে পারল না।

আমি যা হয়েছি তা শখে হইনি, অন্য কিছু হবার কোন পথ ছিল না, তাই হয়েছি। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল হতে পড়াশোনা লাগে, নেতা অভিনেতা খেলায়াড় হতে প্রতিভা থাকা দরকার, যার পড়াশোনা নেই প্রতিভা নেই সে অন্য কিছু কী করে হবে?

আমার বাবার কাছে একটা রূপোর টাকা ছিল। বাবা তাকে বলতেন ষোল আনা। আমার কাছে ষোল আনা আছে, সেটাই ছিল তার গর্ব–পথে যেতে যেতে সেটা তিনি কবে যেন কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। সারা জীবনে শত অভাব অভিযোগের মধ্যেও উনি সে টাকাটা কোনদিন ভাঙাননি। আগলে রেখেছিলেন যক্ষের ধনের মতো। পরে অবশ্য তার সেই পথে পাওয়া টাকা পথেই হারিয়ে যায়।

আমার যা, তা এখনও হারায়নি। হারিয়ে যেতে দেব না, এই পণ করে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছি দুটাকা দামের ছোট কলমটা। এটাই আমার গর্ব অহঙ্কার–ষোল আনা। আমি শিল্পী, আমি স্রষ্টা আমি ঈশ্বরের মতো মহান।

গল্প শুনেছি, কোনো এক রাজা নাকি একবার এক হাড় কাঁপানো শীতের রাতে খেলাচ্ছলে বলে বসেন, ওই পুকুরের জলে যে সারারাত গলা পর্যন্ত ডুবে থাকবে আমি তাকে এক হাজার টাকা দেব। আর একজন লোক সারারাত সেই জলে ডুবে বসে থাকেন। পরদিন রাজা যখন তাকে জিজ্ঞেস, করলেন, কী করে পারলে? এই ভীষণ শীতে লেপ কাথার নীচে মানুষ যখন বরফ হয়ে জমে যাচ্ছে, কী করে এমন অসাধ্য সাধন করলে? সে জবাবে বলে ওই যে দুরের জানালাটা, ওখান থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিল–সেদিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। রাত কেটে গেছে।

আমার সামনেও একটা আশার আলোর ক্ষীণ রেখা ছিল। একদিন এই গভীর অন্ধকার–এই দুর্যোগের কালো মেঘ সরে যাবে। ঝলমল করে সূর্য–রোদ উঠবে। আমার জীবন আলোকিত হবে। সেই দুরাশায় পার হয়ে আসতে পেরেছি সব দুর্যোগের দিন। পার হয়ে আসতে পেরেছি বিপদ সংকুল বাধার পাহাড়-সাগর-অরণ্য-মরু।

বইখানা ওনাকে দিয়ে আর একবার প্রণাম করে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নীচে। যে উচ্চতায় উঠেছিলাম সেখান থেকে পথে। যে পথে রিকশা চলছে, কাগজ কুড়াচ্ছে এক দরিদ্র বালক, সন্তান কোলে বাসি রুটি চেয়ে কাতরাচ্ছে এক ভিখারি মা, সেই পথের উপর। যে পথ আমার পথ।

এই পথে হেঁটে হেঁটে আমাকে পৌঁছাতে হবে আমার গন্তব্যে। কেউ আমার সহযাত্রী নেই, পথ চিনিয়ে দেবে না কেউ, আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে হাত ধরে তুলে দেবে না কেউ। তবু আমাকে হাঁটতে হবে। থামা চলবে না। থামা মানে ইতি–অবসান, মৃত্যু।

আমি মরতে চাই না।

.

খড়ের গাদায় খুঁজলে নাকি হারানো সঁচও খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু কে খোঁজে? যখন এক টাকায় একটা সঁচ কিনতে পারা যায়। তবু যদি কেউ খড়ের গাদায় সঁচ খোঁজে তাকে পাগল ছাড়া অন্য কিছু কী বলা চলে? এমনই একজন পাগল লোক সেই ১৯৮১ সাল থেকে প্রায় তিরিশ বছর আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। বর্তিকা পত্রিকায় আমার লেখাটি পড়বার পরই তার মাথার পোকারা নড়ে ওঠে-খোঁজো এই রিকশাওলাকে খুঁজে বের করো। খোঁজো এবং ধরো এবং যুক্ত করো।

তিনি প্রথম খোঁজ নিলেন বর্তিকার দপ্তরে। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। শুনলেন সেখানে আর সে যায় না। আর এই সব মানুষের তো কোনো ঠিকানা থাকে না। বর্তমানে কোথায় থাকে–তারা জানে না। তবে যাদবপুরে রিকশা চালায়, আছে হয়তো ওখানকার কোনো রিকশা লাইনে।

যাদবপুরে খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, না, এখানেও সে নেই। চলে গেছে এখান থেকে। ওই নরেন্দ্রপুরের দিকে কোথায় যেন থাকে। যেখানে সন্ধান করে জানালেন, না, তার ঝড়ে উড়ে বেড়ানো শুকনো পাতা জীবন এখানেও তিষ্ঠোতে দেয়নি। ঠেলে দিয়েছে বহু দূর ছত্তিশগড়ে। সেখানে দল্লীতে শ্রমিক নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সংগঠনে যোগ দিয়ে সাংগঠনিক কাজ করছে।

উনি গেলেন ছত্তিশগড়। তবে সেই রিকশাওলাকে দেখতে নয়। শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে দেখা করতে। আশা অবশ্য একটা ছিল, যে, এবার হয়তো তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানলেন, সে থাকে দল্লী থেকে দুশো মাইল দুরে বস্তার জেলার পারালকোটে। তবে মাঝে মাঝে দল্লীতে আসে। এই তো গত সপ্তাহে এসে চার পাঁচদিন থেকে ফিরে গেছেবস্তারের গভীর বনাঞ্চলে।

উনি দল্লীতে ছিলেন প্রায় এক সপ্তাহ। এর মধ্যে সে আসেনি তাই সেবারও দেখা হল না। এইভাবে কেটে গেছে অনেক কটা বছর, নিয়োগীজি মারা গেছেন, আর তারপর সে যে আবার পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছে, উনি জানতেন না। হঠাৎ একদিন খবর পেলেন গড়িয়ার পৌন্ড্রক্ষত্রিয় ভবনে বঙ্গীয় দলিত সাহিত্য সংস্থার এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যে অনুষ্ঠানের উদ্বোধকের নাম সেই রিকশা চালকেরই নামে। এই কী সেই, যাকে আমি খ্যাপার মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি? গেলেন উনি সেই অনুষ্ঠানে, আর তারপর যা হয়, পরিচয় হবার পর টেনে নিলেন বুকের ভিতর–মশাই আপনি তো সাংঘাতিক লোক, কোথায় না কোথায় আপনাকে খুঁজে বেড়িয়েছি, আর আপনি কীনা…!

এই লোকটির নাম অনন্ত আচার্য। সত্যিই অনন্ত। একটা টিউবওয়েল–যার আড়াই ফুট থাকে উপরে একশো ফুট থাকে মাটির গভীরে। অনন্তদার শেকড় যে সমাজ জীবনের কত গভীরে চারিয়ে দিয়েছেন আমি তার অন্ত পাইনি। মানুষ নয় উনি আমার কাছে এক অনন্ত বিস্ময়।

আমি একজন দলিত শ্রেণির মানুষ। হিন্দুধর্মের চতুবর্ণ ব্যবস্থায় ১৯১১ সালের আগে আমাদের চণ্ডাল বলে উচ্চবর্ণের লোকেরা অপমান, ঘৃণা করত এড়িয়ে চলত। কারও উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালে গোবর জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করত উঠোন। ছোঁয়া লেগে গেলে চান করে দেহ পবিত্র করত। মানুষকে শুধুমাত্র জন্ম-জনিত কারণে অপরাধী বলে একদল বর্বর মানুষ অপমান অবজ্ঞা অত্যাচার করে আনন্দ পেত।

সে অমানুষিক কুপ্রথা এখনও আছে, বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তবে তা এই বাংলায়–বিহার বা উত্তর প্রদেশের মতো অতো উদোম উলঙ্গতায় নয়। সেখানে যদি কোনো তৃষ্ণার্ত দলিত উচ্চবর্ণের কোনো কুয়ো থেকে জল তুলে খায়, সেই অপরাধে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। এমনটা পশ্চিবঙ্গে হয় না। কারণ এক সময় এখানে কমিউনিস্ট আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠার ফলে, তেঁতো ওষুধকে যেমন মিষ্টি ক্যাপসুলের মধ্যে ঢাকা দিয়ে রাখা হয়–শ্রেণিঘৃণা নামক বায়বীয় বস্তু দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল বর্ণঘৃণাকে।

এখন যখন শোষিতদের পক্ষে লড়াই করছি নাটক করে, একদল বর্ণপ্রভু শোষিত থেকে শোয়ক, শাসিত থেকে শাসক হয়ে গেছে, আর সেই শ্রেণি সংগ্রামের গল্প নয়–এখন ফেরি করে বেড়াচ্ছে শ্রেণি সহবস্থানের তত্ত্ব। তাই এখন আবার সেই বর্ণঘৃণার বিষবৃক্ষ ফলে ফুলে পল্লবিত হয়ে উঠছে। এত দীর্ঘকাল বঙ্গের বাম শাসনের পরও তথাকথিত উঁচু জাতের লোক তথাকথিত নীচু জাতের হাতে রান্না করা মিড-ডে-মিলের খাবার পর্যন্ত ছোট ছোট স্কুলের বাচ্চাদের খেতে দিচ্ছে না।

এই যে আমি যে স্কুলে কাজ করি-সেখানে যে-সব মানুষ আমাকে অনবরত বিপদাপন্ন করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সবাই কী শুধু রাজনৈতিক মত পার্থক্যের জন্য। তা নয়, একটা বৃহৎ অংশের বুক জ্বলে আমার জাতি পরিচিতির জন্য। ব্যাপারী না হয়ে যদি ব্যানার্জী হতাম আক্রমণ এতটা সর্বাত্মক হতো না। কেউনা কেউ পাশে দাঁড়াত।জাতি ব্যাপারটা বঙ্গমানসে এমনভাবে গেড়ে বসে আছে, যে, যিনি ঘৃণা করছেন নিজেও তা বুঝতে পারেন না অনেক সময়। চুরি চামারির চোটে দেশটা রসাতলে গেল। যেমন পচা কাঁঠাল তেমন মুচি খদ্দের।কী সব কাওরা মার্কা কথাবার্তা। বাক্যে যারা এইসব শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন, কী বলছেন, কতজনে তা জেনে বুঝে করেন?

এই যে যুগ যুগ ধরে মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করার হীন প্রবৃত্তি এর বিরুদ্ধে শুধু নিম্নবর্ন সমাজ থেকে প্রতিবাদ ওঠেনি, সমানভাবে প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন উচ্চবর্ণেরও কিছু বিদগ্ধ মানুষ। এই তালিকায় শিবরাম চক্রবর্তী, সুকুমারী ভট্টাচার্য, শিবনাথ শাস্ত্রী, রণজিৎ গুহ, গৌতম রায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সবার শীর্ষে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁরা মনে প্রাণে ওই অন্যায় অবস্থার অবসান কামনায় সড়ক থেকে সাহিত্য অঙ্গনের অন্দরেও তুমুল বিরোধ প্রগঠিত করে চলেছেন। আমার দেখা উচ্চবর্ণ সচেতনদের মধ্যে বর্তমানে সবার আগে আছেন–এই অনন্ত আচার্য। সত্যি বলতে কী প্রথম যেদিন আমি ওনাকে দেখি উলুখাগড়া চুল, আগাছা দাড়ি, আকাঁচা জামা-প্যান্ট। ছেঁড়া জুতো, বই বোঝাই কাঁধের ভারি ঝোলা–এসব কিছুই দেখিনি, দেখেছিলাম শুধু দুটো ফাটাচটা পরিব্রাজক পা। ওই পা দেখেই আমার বহুদেখা চোখ মুহূর্তে বুঝেছিল হাজার মাইল না হাঁটলে কোন পা এমন হয় না। আর শুনেছিলাম তার কথা– । কথায় কোনো বুদ্ধিজীবীতুল্য পালিশ দেবার প্রয়াস ছিল না, তত্ত্বের কচকচানি, জ্ঞানের মেদের সর্বস্তরে দাপট ছিল অনুপস্থিত। অতি সাদামাটা শব্দে যা তিনি বলেছিলেন তাতে বুঝেছিলাম–ইনি যে কাজকে ব্রত করেছেন তাতে কোনো খাদ নেই। কোনো নিজ স্বার্থ নেই। নেই নেতা হয়ে ওঠার নকল নাটক। মনেপ্রাণে চান বর্ণবৈষম্যের বিলুপ্তি! ভালো লেগে গেল ওনাকে আমার। আর আমি যুক্ত হয়ে পড়লাম ওনার সঙ্গে। মাঝে মাঝে দেখা হতে থাকল, কথা হতে রইল এবং কিছু কাজও।

অনন্তদা যে সংগঠনের দায়িত্বে আছেন তার নাম ‘ডাফোড্যাম’ এটি সম্পূর্ণ একটি সামাজিক সংগঠন। যেমন ‘এপিডিআর’, ‘পিইইউসিএল, জন চেতনা মঞ্চ’, ‘ভারত জন আন্দোলন। যাদের একটাই স্লোগান–”হর জোর জুলুম কা বিরোধ মে সংঘর্ষ হামারা নাড়া হ্যায়”।

ডাফোড্যামের মুখপত্র ‘চেতনা লহর’। আমি হয়ে গেলাম এই পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক। হাতে ছিল হাটে বাজারে পত্রিকা এবার আর একখানা পত্রিকা পেলাম যেখানে স্বাধীনভাবে লিখতে পারি। সম্পাদক আমার লেখায় কাঁচি চালায় না।

একদিন অনন্তদা এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে যেমন মাঝে মাঝে আসেন। সেদিন ওনার সাথে একজন অন্য লোকও এসেছেন আমাকে দেখবেন বলে। আজকাল এমন সব লোকের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। যারা শুধু দেখতে নয়, আমাকে পরীক্ষা করতে আসে। বিবিধ প্রশ্নে বিদ্ধ করে। সত্যি আপনি কোন স্কুলে যাননি? ঢপ দিচ্ছেন না তো? কেউ বলে–আপনাকে ঠিক লেখকের মতো দেখায় না, সত্যিই এগুলো আপনি লিখেছেন? অনন্তদাই একদিন বলেছেন বিদেশে নাকি কী এক সাহিত্যের ব্যাপক চল হয়েছে, কোনো নামি লেখক নাম গোপন করে, খুনি, ডাকাত, এমনকী বারবণিতা সেজে বই লেখে। যা নাকি পাঠকেরা খুব খায়। কেউ কেউ আমাকে বাজিয়ে দেখে–আমি নকল মাল নই তো।

যে লোকটি এসেছেন ঠিক অনন্তদার মতোই। যাকে ঠিক প্রচলিত ভদ্রলোক অর্থাৎ পরিপাটি পোষাক, পালিশ মারা চেহারা, এই পর্যায়ে ফেলা যাবে না। রঙটা কোনো এককালে ফরসাই ছিল। এখন রোদে জলে তামাটে। তিনি খুবই রোগা এবং বুড়ো। বৃদ্ধ নয়, বেশ বুড়োই। ঠিকমতো হাঁটতে চলতেও পারেন না। কথা বললে শব্দরা গলার মধ্যে আটকে গিয়ে এমন একটা ফাঁস ফাঁস আওয়াজ বের হয় যে মর্মার্থ উদ্ধার করা অতীব কঠিন। তাই তিনি কী বলছেন তা অনুবাদ করে দিচ্ছেন অনন্তদা।

জানলাম–ইনি উত্তরবঙ্গে থাকেন। কলকাতায় এসেছেন দুটো তীব্র জরুরি কাজ নিয়ে। প্রথমটা চিকিৎসা। শরীরটা ওনার অসুস্থ। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে একবার মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে দেখে যাওয়া। যখন খোঁজ পাওয়া গেছে যে কলকাতায় আছে। আর উনিও যখন কলকাতায় আসছেন এক সাথে দুটো কাজ সেরে নেবার ইচ্ছা।

আমরা বসেছি বাস রাস্তার ধারে এক চায়ের দোকানে। উনি প্রশ্ন করছেন–আমি জবাব দিচ্ছি। এইভাবে এগিয়ে চলল সময়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক কেটে গেল। এবার উনি ফিরে যাবেন। আমি তখন অনন্তদাকে বলি, বহু কথা তো হল, কিন্তু আসল কথাটাই তো জেনে নেওয়া হয়নি ওনার নামটা!

বলেন অনন্তদা—এনার নাম খোকন মজুমদার।

সেই সাতষট্টি সালে শিলিগুড়িতে থাকার সময় এই নামটা আমি বার বার শুনেছি। নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া–এইসব অঞ্চলে সেই কৃষক অভ্যুত্থান সংগঠিত করার পিছনে যে পাঁচ-ছয়জন নেতার নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়–তারই অন্যতম নাম খোকন মজুমদার। তবে কী ইনিই তিনি? না, তা কি করে হবে। তিনি কত বড় মাপের এক নেতা। তিনি আসবেন এক অতি তুচ্ছ লেখকের সাথে দেখা করতে। ধেস তা হয় নাকি। এ অন্য কেউ।

বলি অনন্তদাকে–এই নামটা আমার বহুবার শোনা।

হতে পারে। বলেন অনন্তদা–একই নামে কত মানুষ থাকে। তবে ইনি কোনো বিখ্যাত কেউ নন। আপনার আমার মতো সাধারণ।

কথাবার্তা শেষ। এবার ওনাদের যেতে হবে। বাসে তুলে দেবার সময় আমার সাথে করমর্দন করলেন খোকনবাবু। বললেন–আবার দেখা হবে। তারপর ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা প্যাকেট।কী আছে এতে? বললেন-একটা বই। আপনার জন্য এনেছি। আমিও কোনদিন কোনো স্কুলে পড়িনি। পড়ে দেখবেন কেমন লিখেছি।

প্যাকেট আর তখন খোলা হল না। ব্যাগে রেখে দিলাম। বাস এলে ওনারা উঠে গেলেন। বাড়ি এসে সেই প্যাকেট ছিঁড়ে বইখানা বের করে আমি যেন একটা হাজার ভোল্টেজ বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে ছিটকে পড়লাম কোথায় না কোথায়। কী আশ্চর্য। উনি এলেন, এত সময় রইলেন কত কথা বললেন, আর আমি চিনতে পারলাম না?

ইনি সেই খোকন মজুমদার। এই নামেই সারা ভারত ওনাকে চেনে। সেই সত্তরের দশকে এখান থেকে একটা সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী প্রতিনিধি দল চিনে গিয়েছিল। দেখা করেছিল মাও-সে-তুংয়ের সাথে। সেই দলের এক সদ্য ছিলেন খোকন মজুমদার। ভারতবর্ষের ইনি সেই প্রথম মানুষ যিনি বিপ্লবী জনগণের পক্ষ থেকে এগিয়ে এসে করমর্দন করেছিলেন মহান সেই নেতার সাথে। আমি সেই হাত ছুঁয়েছি, তবু চিনতে পারলাম না। এই বইখানা লেখা হয়েছে সেই চিন যাত্রার অভিজ্ঞতার বিষয় নিয়ে কী ভাবে সীমান্ত রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে, কোনো কোনো সময় বোকা বানিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কি ভাবে পৌঁছে গিয়েছিলেন চিনের রাজধানীতে। কতখানি উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন সেদেশের মানুষের কাছে। অতি প্রাঞ্জল ভাষায় সে সব লিখেছেন খোকনদা তার ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’ বইয়ে।

এখন ওনার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, থেমে গেছে সেই উত্তাল সত্তর দশকের বিপ্লবী সংগ্রাম। তবু উনি সেই বিশ্বাস বুকে নিয়ে আজও পথ হাঁটছেন সংগ্রাম কখনো ফুরায় না, শেষ হয় না। সে আছে সে থাকবে।

.

এই পৃথিবী কত না বৈচিত্র্যে ভরা, কত বিচিত্র রকমের মানুষ এখানে। প্রত্যেকে বাঁচার জন্য খুঁজে নিয়েছে এক একটা অবলম্বন। খুঁজে নিয়েছে এক একটা আনন্দের উপকরণ। সে আনন্দের জন্য কেউ কেউ হাজার হাজার মাইল পথ হাঁটছেন, মানুষের কথা গলায় রক্ত তুলে বলে বেড়াচ্ছেন। জেলে পচছেন, গুলিও খাচ্ছেন বুকে মাথায়। আবার কেউ ব্রত নিয়েছে মানব জীবনের অহিত করার, মানব সমাজের অনিষ্টকরার। এতেই সেখুঁজে পচ্ছে একটা পৈশাচিক আনন্দ। তবে এদের বা ওদের কারও কারও বাছাই করে নেওয়া কর্ম কর্তব্যের প্রতি যে নিষ্ঠা তা দেখলে অবাক না হয়ে উপায় নেই।

ওই যে বললাম আনন্দ, একদল লোক আছে যারা দিন মাস বছরের শেষে দুঃস্থ দরিদ্র অসহায় মানুষকে অন্নদান করে আনন্দ পান অযথা পাপের বোঝা কিছুটা হালকা করে নেন। এ আমি জেলে থাকাকালীন সময়েও দেখেছি। এক একটা বিশেষ দিনে কিছু লোক ঝুড়ি ভরে লুচি হালুয়া নিয়ে পৌঁছে যেত জেলখানায়। বন্দীদের খাইয়ে খুবই আত্মসন্তোষ অনুভব করত।

এমনটা এই বোবা স্কুলেও হয়। মায়ের শ্রাদ্ধ, পুত্রের জন্মদিন বা কোনো বিশেষ কারণে কেউ কেউ ভোজ দেয়। দুতিনবার মুকাভিনয় শিল্পী যোগেশ দত্তও এমন অনুষ্ঠান করে গেছেন।

সেবার–ঠিক মনে নেই, কে যেন এমন একটা আয়োজনের ব্যয়ভার বহন করেছিলেন। হতে পারে কোনো জমি বেচা-কেনার দালাল, কোনো প্রমোটার বা কন্টাক্টার। যে হয়তো বড় সাহেবের কোনো কৃপা করুণায় পেয়ে গেছে কোনো বড় মুনাফা বলেছেন বড় সাহেব বাদবাকি যা সে পরে, আগে বাচ্চাদের একদিন একটু ভালোমন্দ খাইয়ে দে। এখানে জয়া না বিজয়া নামে এক নেতা আছে, যার স্থান বড় সাহেবের এক ধাপ নীচে। সিপিএম পার্টি করে একেবারে সভাবে-স্রেফ জমি কেনাবেচা করে সে কয়েক কুবেরের ধনের মালিক হয়ে গেছে। সে মাঝে মাঝে বোবাদের ভোজন দিয়ে নাম কামায় আর পাপ কমায়।

সেদিন এমন একজনের অনুদানে এই স্কুলে নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যের রান্নাবান্না হচ্ছিল। বোবা ছাড়াও বাইরের কিছু লোক খাবে। সব মিলিয়ে প্রায় চারশো। কেনাকাটা সব কালই হয়ে গেছে আজ সকাল থেকেই আমরা নেমে পড়েছি রান্না বান্নার কাজে। রবিবার বলে বড় বড় কটা বোবা ছেলেও আমাদের সহযোগিতা করছে।

আজ বড় আনন্দের দিন। সবাই হাসছে নাচছে গান গাইছে। আর এমনই আনন্দ যজ্ঞের মাঝে হঠাৎ দুঃসংবাদ, ওয়ার্ডেনের বড়দার হার্ট অ্যাটাক। যে রোগে তার এখন প্রাণ যাবে। প্রাণ তো পরে যাবে, তার আগে চিকিৎসাটা তো হবে। পয়সার তো কোনো কম নেই, পাঁচ ভাই দশ হাতে কামাচ্ছে। তাই তাকে এনে ভর্তি করা হল এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যয়বহুল শেঠির হাসপাতালে। বেলা আটটা থেকে এগোরাটা–তিনঘন্টা লেগে গেল প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সারতে–এরপর হবে বাইপাশ সার্জারি। ছয় আট ঘন্টা ধরে চলবে অপারেশন। ভাইকে ও.টি-তে ঢুকিয়ে দিয়েই আত্মাধিকার এল ওয়ার্ডেনের মনে–ছিঃ ছিঃ আমি এত স্বার্থপর, নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সম্বন্ধে এত অসচেতন–ছিঃ। “আজ স্কুলে অনুষ্ঠান, কত উপাদেয় রান্নাবান্না, কত লোক আসবে খাবে। আর আমি কিনা পড়ে আছিহাসপাতালে।”খেতে সে খুব ভালোবাসে তবে আজ খাবে না। লোভ সম্বরণ করে রাখতেই হবে। যার ভাই হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়–সে পাঠার ঠ্যাং চিবোতে বসলে লোকে কী বলবে। সেই যে বলে না, পারিতে করিনা কাজ, সদা ভয় সদা লাজ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে পাছে লোকে কিছু বলে। এই লোক লজ্জার কারণেই কতবার বঞ্চিত করতে হয় নিজেকে সুস্বাদু প্রাপ্তি থেকে।

নিজের আনন্দ দশজনকে ভাগ করে দিলে তা যেমন বাড়ে, নিজের দুঃখতে দশজনকে জড়িয়ে নিতে পারলে তার ভার কিছু কমে। আমার যদি ঘর না থাকে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজি, রোদে শুকাই, লোকে ঘরের জানালা দিয়ে আমাকে কৃপাদৃষ্টিতে দেখবে–আহা উহ করবে, হাসবে, সে বড় অসহ্য। এতে আমার মনোকষ্ট শতগুণ বেড়ে যাবে। আর যদি কারুর মাথার উপর আচ্ছাদন না থাকে যদি সবাই একসাথে বসে থাকি খোলা আকাশের নীচে, রোদে পুড়ি, শীতে কপি, বৃষ্টিতে চুপচুপে হই—কে কাকে দেখে করুণার পাত্র ভেবে মুচকে হাসবে? কে নিজেকে ভাববে ভাগ্যবান সুখি, অন্যকে মন্দ ভাগ্য? ওয়ার্ডেন বড় ভাইকে মৃত্যুশয্যায় রেখে তাই একছুটে চলে এলেন স্কুলে, আধ ঘন্টার জন্য। ঘুরে ঘুরে দেখলো সব। সবাইকে দিল দাদার সংবাদ শেঠি হাসপাতালে ভর্তি করেছি। অপারেশন চলছে, আমি থাকতে পারব না। এক্ষুনি যেতে হবে।

আর তারপর–চলে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে আমাকে ডেকে নীচু কিন্তু নীরস গলায় বললেন-আপনি কিন্তু খাবেন না। আমি তার চোখের মধ্যে দেখতে পেলাম ছাই চাপা আগুনের মতো জান্তব এক জিঘাংসার প্রকাশ-আপনি হয়তো বুঝবেন না, হয়তো খেতে বসে যাবেন, তাই বারণ করছি। আপনি কিন্তু নিমন্ত্রিত নন। এসব কিছুর আয়োজন একমাত্র নিমন্ত্রিত আর যারা এখানে রোজ খায়—তাদের জন্য। কথা কটা বলে দ্রুত তিনি চলে গেলেন। দাঁড়াবার উপায় নেই–ভাই মরে যাচ্ছে। অন্য অপর কেউ নয় মায়ের পেটের আপন বড় ভাই। তবু এই বিপন্ন সময়েও তিনি বুদ্ধিভ্রষ্ট হননি, স্বধর্মচ্যুত হননি, ছুটে এসে স্বকর্ম করে গেলেন, দেখে আমি বিস্মিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *