১১. বৃত্তের শেষ পর্ব

বৃত্তের শেষ পর্ব এটি একটি ব্যাকরণ বহির্ভূত নাম। বৃত্তের কোন শেষ বা শুরু হয় না। বহু বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের ব্যাখার পরেও আমি ওই নামটা এই জন্যে বাছাই করেছিলাম এই কথা ভেবে যে–জন্ম থেকে মৃত্যু এটা তো একটা বৃত্ত। যার জন্ম হয়েছে অথচ মৃত্যু হয়নি সে তো অসম্পূর্ণ। জন্মে যার শুরু মৃত্যুতে তার শেষ।

কিন্তু সত্যিই শেষ কী? না মৃত্যুর সাথে জীবনের সব শেষ হয়ে যায় না। তার কৃতকর্ম থাকে। খ্যাতি অখ্যাতি যশ অপযশ সব পড়ে থাকে। আর কিছু যদি নাও বা থাকে মৃত মানুষের শরীর পড়ে থাকে। দাহ হলে ছাই পড়ে থাকে। আত্মীয় স্বজনদের পরলৌকিক ক্রিয়াকর্ম পড়ে থাকে।

সেটাই তো আর এক পর্ব। বৃত্তের শেষ পর্ব। একটা জীবন-যার শুরু হয়েছিলনিরক্ষর মা-বাবার নিরক্ষর সন্তান হিসাবে। নিরক্ষর থেকে সাক্ষর হয়ে ওঠা এটা একটা বৃত্ত। এখন সেই সাক্ষরতাকে সৃজনশীলতার সঠিক দিশায় এগিয়ে নিয়ে চলা–আমার ধারণায়, সেটাই বৃত্তের অন্তিম পর্ব।

বৃত্তের শেষ পর্ব তো আসলে বৃত্ত ভেঙে দেবারও গল্প। যা লেখা হয়েছে প্রচলিত “বৃত্তের” বাইরের এক ক্ষুব্ধ ক্ষুধার্ত মানুষের কলম থেকে তার নিজের ভাষায় নিজের ভাবনায়। এতকাল উঁচু তলার মানুষেরা নিচুতলার মানুষকে নিয়ে সাহিত্য করতেন। যার শুরু হয়েছিল সেই শৈলজানন্দের ‘কয়লা কুঠি’ গল্প দিয়ে। তারপর কল্লোল যুগের কলমকাররা তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এক বিশেষ ভাবনায় জারিত হয়ে। বৃত্তের শেষ পর্বের লেখক সেই ধারা প্রবাহেরই আর এক ঢেউ। তবে এর বিশেষত্ব বলা যায় বিশেষ বিশেষত্ব, এই বইয়ের লেখক নিচুতলা থেকে উঁচুতলার মানুষগুলোকে দেখার এবং দেখানোর চেষ্টা করেছে।

বৃত্তের শেষ পর্বে সর্বমোট বাইশটা গল্প ছিল। এর প্রথম গল্প ‘খাঁচার পাখিরাও গান গায়। এটি এক জেলবন্দীর আত্মকথন। সে অনুভব করে যে আসল সুখ যদি কোথাও থাকে তবে তা জেলখানাতেই আছে। বাইরে না খেয়ে মরে গেলেও কেউ ফিরেও তাকাবে না, অথচ এখানে দুবেলা গরম খাবার পাওয়া যায়। এখানে থাকবার জন্যে মাথার ওপর পাকা ছাদ আছে, অসুখ হলে চিকিৎসা মেলে। বাইরে যা তার মত গরিব মানুষের ভাগ্যে সহজে জোটে না।

পরের গল্প-নেশা। এ নেশা মদের নেশা নয়–ভাতের নেশা। এক অসুস্থ এবং ক্ষুধার্ত রিকশা চালক সওয়ারি নিয়ে যেতে যেতে মাথা ঘুরে পথের উপর পড়ে যায়। পথচলা মানুষ মনে করে রিকশাঅলা নেশা করেছে তাই তার পতন ও মূচ্ছ। কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথা ভাবে না। শেষ পর্যন্ত পথে পড়ে মরে যায় রিকশা চালক।

তৃতীয় গল্প-স্বাধীনতা–একজন মুটে যে রেশন দোকানের মোট বয়ে যা মজুরি পায় তা দিয়ে কোনক্রমে পেট চালায়। একদিন সে মোট বয়ে চাল কিনে ঘরে নিয়ে যাবার আশায় রেশন দোকানে এসে দেখতে পায় দোকানে তালাবন্ধ। কেন না আজ পনেরই আগস্ট–স্বাধীনতা দিবস।

এই বইয়ের আর একটা গল্প ভাতের রাজা। একজন খেতে দিতে না পেরে রাগে দুঃখে তার ক্ষুধার্ত ছেলেকে মেরে ফেলে শেষে নিজে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায়। এরপর সেই কেসে বিচারে তার দশ বছর জেল হয়। জেলে এসে কাজ পায় ভাত ঘরের পাহারায়। পাঁচ সাত হাজার লোকের খাদ্য, পাহাড় প্রমাণ ভাতের স্তূপের সামনে বসে কেঁদে ওঠে সেবাপকে তোরা ভাত না পেয়ে মরে গেলি। দ্যাখ আজ আমার কাছে কতো ভাত।

বইটা পড়ে কেউ কেউ বলল-মর্মান্তিক, কেউ নাক সিঁটকালো না খাওয়া মানুষের পাঁচালী বলে। কেউ কেউ তারিফ করল লেখকের লেখার মুনশিয়ানার। পুস্তক সমালোচক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অনীক’পত্রিকার জুন ২০০০ সংখ্যায় লিখলেন–মনোরঞ্জন গল্প লিখেছেন। আসলে তিনি কোন না কোনভাবে নিজের জীবন কাহিনীই বলে গেছেন। এই সংকলনের প্রতিটি রচনায় মিশে আছে মনোরঞ্জনের জীবন–তার যাপিত জীবনের স্বেদরক্ত। তার প্রতিটি গল্পেই পাওয়া যাবে একটি আখ্যান–বেঁচে থাকার সংগ্রাম।দরদী মন নিয়ে তিনি অপরের সংগ্রামের কথা লিখছেন

, লিখছেন সেই সংগ্রামের কথা, যার ভিতর দিয়ে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে এগিয়ে চলেছে তার নিজেরই জীবন। এ রকম গল্প পড়া তাই এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। এরকম গল্প পড়ার সুযোগ আমরা এর আগে খুবই কম পেয়েছি। যে ধরনের আখ্যান পাঠে আমরা অভ্যস্ত মনোরঞ্জন তাকেই লেখেন বিপরীত দিক থেকে।…..সে তো হল, যেটা আসল কাজ, কাজের কাজ তার তো কিছু হল না।বই যে মোটেই বিক্রি হয় না। এটাও ঠিক যে আমার বই তাক্‌-এ সাজিয়ে রাখার মত সুন্দর মোটেই নয়।

সেটা ২০০০ সাল। আর কিছুদিন পরে শুরু হব বইমেলা। নিজে আমার কোন স্টল দিতে পারার মত আর্থিক সঙ্গতি নেই। বিজ্ঞাপনে ব্যয় করি তা-ও ক্ষমতার বাইরে। কীভাবে বইমেলাকে ব্যবহার করি! বইয়ের এত বড় বাজার আমার হাত ছাড়া হয়ে যাবে। ভাবি আর ভাবি, কিন্তু কোন কুল পাইনা।

এটা বিজ্ঞাপনের যুগ। এই সময় প্রচারের জোরে অনেক অচল মালও বাজারে চলে যায়। আর প্রচারের অভাবে বহু প্রতিভা শেষ হয়ে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। যদি একটা ভালো প্রচার পাওয়া যেত, এই বইমেলা আমার বড় কাজে আসত। কী যে করি!

আমার মাথায় একটা পোকা আছে। সেটা মাঝেমাঝে নড়ে ওঠে। যখন নড়ে ওঠে আমি যে কী করে বসব তা আমি নিজেও জানি না। সে নড়লে অসম্ভব-কঠিন, এই শব্দগুলোকে আমি মোটেই সমীহ বা সম্মান দিতে পারি না। মাথায় এখন সেই পোকা নড়ছে, অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। যে ভাবে তোক নিজেকে প্রচারের আলোয় নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে। না হলে বই বিক্রি হবে না। পনের হাজার টাকা আটকে গেছে, তোলা যাবে না। মুদি দোকানে সব টাকা দিইনি। তার ধার শোধ না করলে বাকি দেওয়া বন্ধ করে দেবে। না খেয়ে মরব সবাই।

তখন টিভি-র অসম্ভব জনপ্রিয় প্রোগ্রাম ছিল-খাস খবর। সন্ধে ছটায় সেই প্রোগ্রাম শুরু হলে শহর কলকাতার পথঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে যেত। যে যেখানে থাকুক ছুটে গিয়ে টিভির সামনে বসে পড়ত। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম–এদের অফিস নবীনা সিনেমা হলের দোতলায়। তারপর আর কী! একদিন হামলা করে দিলাম আত্মঘাতী জঙ্গির মত খাস খবরের অফিসে। ঠিক এই রকম হামলা আর একবার করেছিলাম ১৯৮৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে। তখন “কলকাতার কড়চা” বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন নিখিল সরকার যার আর এক নাম শ্রীপান্থ।

একগলা চোলাই গিলে সোজা গিয়ে পৌঁছেছিলাম শ্রীপাস্থের সামনে। সেদিনের আনন্দবাজার খানা ওনার সামনে মেলে ধরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম–এতে কে একজন বাস কন্ডাক্টার বাঁশি বাজায় তার কথা আছে, একজন তরকারি বেচে, তবলা বাজায়, তার কথা আছে, একজন ড্রাইভারি করে, অভিনয় করে, তারও কথা আছে। কিন্তু আমার কথা নেই, কেন?

কতবড় সম্মানীয় মানুষ। উনি কী কোনদিন ভাবতে পেরেছিলেন কেউ এসে ওনার সাথে এইভাবে কথা বলবে। তিনি অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন–তুমি কে? আমার চটের ব্যাগ আমি উবুর করে দিয়েছিলাম ওনার সামনে। সাত বছর ধরে যা লিখছি সব রক্ষিত ছিল এই ব্যাগে–আমি এক রিকশাঅলা, আর এই আমার লেখা। এই যোগ্যতা আমি অর্জন করেছি আমার নিজের চেষ্টায়। তবু আমার কথা কোনদিন আনন্দবাজার লেখেনি। কেন? এর ফলে ওই বছরই ২৮শে মার্চ বাংলা ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকার পাতায় লেখা হয় আমার কথা।

সত্যি কথা এটাই যে-কুয়ো কখনও তৃষ্ণার্তের কাছে যায় না। যে তৃষ্ণার্ত তাকেই আসতে হবে কুয়োর কাছে। আর মহাসত্যি এটাই যে মদঅলা অন্ধকারে বসে থাকলেও মদখোর তাকে খুঁজে বের করবে, দুধঅলাকে তার দুধভান্ড নিয়ে যেতে হবে মানুষের দরজায়।

যারা নিজের মুখে নিজের গুণ গায়-প্রচার বিমুখ যোগেনদা তাদের সহ্য করতে পারে না। বলে—’মানুষের এক বিচ্ছিরি প্রবণতা, সে নিজের ঢাক নিজে বাজায়।’ উনি তো আমার মত জীবন যাপন করেননি। আমিও নই তার মতন। তাহলে তার যে জীবন দর্শন তা আমি গ্রহণ করব কী করে? আমি জানি, আমার একটা ছোট্ট ছেঁড়াফাটা ঢাক আছে। বড় এবং সুন্দর ঢাক ফেলে আমার সে ঢাক বাজাতে কেউ আগ্রহী হবে না। তাই আমার নিজের ঢাক নিজেকেই বাজাতে হবে। কথায় তো বলে ভাগ্যবানের ঢাক ভগবান বাজায়। ভাগ্যহীনদের ঢাক নিজেই বয়ে নিয়ে যেতে হয়, বাজাতে হয়। আমি তো আমি–এমন যে বার্নাডশ, একদিন সে তার নিজের বই বিক্রি করার জন্য কত রকম না ছল চাতুরির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর আমি তো এক মদন।

এখন যে খোঁজ-খবর খ্যাত টাক মাথার দিব্যজ্যোতি বসু–তিনিই তখন ছিলেন একমাথা কালো চুল নিয়ে খাস খবরের প্রধান। তিন চার দিনের অক্লান্ত চেষ্টার পর অবশেষে একদিন পৌঁছতে পারা গেল ওনার টেবিলের সামনে। কিন্তু একী! যেই আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছি অমনি উনি আমাকে থামিয়ে দিলেন–আপনি আর একদিন আসুন। সেদিন মদ খাবেন না। তখন আপনার যা বলার সব শুনব।

হায় আমার পোড়া কপাল। মদ তো খেয়েছিলাম সেই আনন্দবাজার ‘আক্রমণে’র দিন। আজ তো জল ছাড়া আর কিছু খাইনি। তাহলে ইনি আমাকে মদখোর কেন ভাবছেন? আসলে আমার চেহারাটাই এমন যে, আমাকে নিয়ে কেউ ভালো কিছু ভাবতেই পারে না।

এইকদিন আগের কথা।নন্দনের সামনে থেকে গড়িয়ার মিনিবাসে চেপেছি। ছিলাম একেবারে পেছন দিকে। যাদবপুর থানা পার হবার পর ভিড় ঠেলে গেটের দিকে আগাবার সময় বিপত্তি। আমার কাঁধের সাইড ব্যাগটি আটকে গেল দুই ভদ্রলোকের চাপে। আমি এগিয়ে গেছি কিন্তু ব্যাগ বেঁধে রয়েছে। যেই সেই ব্যাগ ছাড়াবার জন্য হাত বাড়িয়েছি আর এক বিপত্তি। একটি বাইশ চব্বিশ বছরের ছেলে হাত চেপে ধরল আমার–প্যাকেটে হাত দিলেন কেন? আমি তাকে যত বোঝাতে চাই-যে পকেটমার নই, ব্যাগটা নিচ্ছিলাম। পাবলিকও খেপে যায়, পকেটমার নন তবে ব্যাগ (মানে মানি ব্যাগ আর কি) নিচ্ছেন কেন? সেদিন পকেট না মেরেও যা হেনস্তা হয়েছিলাম সে আর বলার নয়।

তবে এখন জোর প্রতিবাদ করি–আমি মদ খাইনি। আগে খেতাম, এখন ছেড়ে দিয়েছি।

সত্যিই এখন ছেড়ে দিয়েছি। যেদিন নিয়োগীজির মৃতদেহ দাহ করে ফিরে আসছিলাম আমার সাথে ছিলেন কাঁকেরের বাঙালী উকিল বিষ্ণুপ্ৰসাদ চক্রবর্তী। তিনি বলেছিলেন নিয়োগীজি আমাদের প্রিয় নেতা। তাকে হত্যা করেছে মদ্য মাফিয়ারা। উনি এক দিনে কুড়ি হাজার মজুরকে মদ্যবর্জনকরিয়েছিলেন। তারই অনুগামী হয়ে আমাদের মদ খাওয়া উচিৎনয়।ওনার প্রতি আমাদের এই হোক শ্রদ্ধাঞ্জলি-আর মদ স্পর্শ করব না। সেই দিন থেকে আমি আর ওই দ্রব্য মুখে তুলিনা।

কিন্তু দিব্যজ্যোতি বসু মানলেন না। বলে উঠলেন-আমি আপনার মুখে গন্ধ পেয়েছি। গন্ধ! ও হরি। ধনেপাতার কাঁচা লঙ্কা টমেটো আর রসুনের চাটনি দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছি। শালা রসুন আমার মুখে গন্ধ হয়ে বদনাম ছড়াচ্ছে। দিব্যজ্যোতি বসুকে বলি সেই কথা র-সুন। রবীন্দ্রনাথ সুকান্ত নজরুল, এই তিন মহান মানুষের নামের অদ্যাক্ষরই তার বিভ্রান্তির কারণ। এরপর উনি মন দিয়ে শুনলেন আমার জীবন ও সাহিত্য চর্চার কথা। তারপর একদিন রিপোর্টার আর ক্যামেরা ম্যান পাঠালেন আমার বাসায়। দিন দুয়েক পরে এক সন্ধ্যায় প্রচারিত হল টিভির পর্দায় “বৃত্তের শেষ পর্ব” আর তার লেখকের কথা। তাতে লেখকের মানব জীবন আবাদ হল না, তবে বইমেলায় বইখানির ব্যাপক বিক্রি হল। স্টল তো ছিল না, খবরের কাগজ পেতে ঘাসের উপর ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। তবু তিনদিনে প্রায় দুশো কপি উড়ে গিয়েছিল।

আমার কর্মস্থলে এতদিন তো গোপন করে রেখেছিলাম, আমি কে আমি কী। কিন্তু এখন আর কারো জানতে বাকি নেই। আমি আসলে এক লেখক। কী লিখি কেমন লিখি কেন লিখি–সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা আমাকে টিভির পর্দায় দেখা গেছে। তারা লেখক বলেছে।

মানুষের মতো বুদ্ধিমান যেমন জগতে কেউ নেই, বোকাও বোধ হয় দুটো পাওয়া যাবে না। বোকা বাক্সের পাল্লায় পড়ে মানুষ আরো বোকা হয়ে গেছে। তা না হলে এই সময়ের এক নামী গল্পকার, যার সাথে কতবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আমার বইখানাকে একবার হাতে ধরেও দেখেননি, সেই তিনি খাস খবরে আমাকে দেখার ফলে দাম দিয়ে দুখানা বই কিনে নিয়ে গেছেন। একখানা তিনি রাখবেন, একখানা বোনকে দেবেন।

বর্তমানে সমাজ জীবনে টিভির প্রভাব বড় সাংঘাতিক। শ্রবণ মাধ্যমের চেয়ে দৃশ্য মাধ্যম অধিক শক্তিশালী। এদের দাপটে সরকার বদলে যায়, এক অনামী অখ্যাত হয়ে যায় আলোচিত বিখ্যাত।

কাল পর্যন্ত আমি ছিলাম এক অতি সাধারণ মানুষ। টিভির কল্যাণে এখন লক্ষ লোক আমার মুখ চেনে–নাম জানে। দলে দলে তারা আমাকে দেখতে আসে আমার কর্মস্থলে। এতেই আমার সহকর্মীদের শরীর জ্বলে ঈর্ষায়, মন পোড়ে। লোকে বলে যার একবার নাম ফাটে তার….ফাটে। এবার এসে গেল আমার পেছন ফাটার কাল। শুরু হয়ে গেল ব্যঙ্গ বিদ্রূপ–টিকা টিপ্পনি।

তবে এই পর্বে সবটাই কী নিরানন্দ আর নিরাশার অন্ধকারাচ্ছন্ন কাল। না তা নয়, নব রসের অন্যতম–একটা হাস্যরসের ঘটনাও ঘটেছিল এই সময়ে। সেই করুণ আর হাস্যরসের বিষয় নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম সবুজ আঙিনা পত্রিকার পাতায়। সেটা না বলে পারছি না। তারই কিছু অংশ তুলে দিলাম এখানে।

.

‘গত বইমেলার সময়ে আমার একখানা ছোট গল্পের বই অতিকষ্টে, ধার দেনা করে নিজেই ছাপিয়েছিলাম। পাঁচশো কপির খান পাঁচেক মাত্র বিক্রী হয়, তাও বাকিতে। কিছু বই নিজে ব্যাগে বয়ে পৌঁছে দিয়েছিলাম বিভিন্ন পত্র পত্রিকার দপ্তরে। সাথে সকাতর অনুরোধ–দাদা, দয়া করে রিভিয়্যু করবেন।’ কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। বই পৌঁছে দিয়েছিলাম বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের ঠিকানায়। বলেছিলাম পড়ে কেমন হয়েছে যদি দু-লাইন লিখে দেন শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করবো। কেউ লিখে দেয়নি। লিখতে হলে পড়তে হবে। সেই ভয়ে সবাই পিছিয়ে গেছে।

বন্ধু-বান্ধব যারা আমার পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিয়েছিল তাদের কাছে জানতে চাই, কেমন হয়েছে আমার গল্পগুলো? উত্তর পাইনা ভাই, এখনও সময় করে উঠতে পারিনি। পড়বো পড়বো। অত তাড়া দিও না। সময় পেলে ঠিক পড়ে নেবো। ওই একই প্রশ্ন করেছিলাম এক প্রখ্যাত পুস্তক সমালোচককে, তিনি আমাকে এইমারেন তো সেই মারেন। অভিযোগ, তার অমূল্য সময় আমার ওই অখাদ্য বইয়ের জন্য বরবাদ করে দিয়েছি।

যাইহোক কেমন করে এক টিভি সাংবাদিকের মনে হয় যে এমন একটা উদ্ভট গল্পকারকে টিভি দর্শকদের দেখিয়ে বেশ একটা কৌতুকময় ব্যাপার সৃষ্টি করা যায়। সেই পরিকল্পনা মত সে একদিন সদলবলে আমার উপর জঙ্গী হামলা চালায়। বসিয়ে, দাঁড় করিয়ে হাঁটিয়ে ছুটিয়ে লিখিয়ে কথা বলিয়ে আরও নানান ভাবে নানা কসরত করিয়ে সেসব দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে নিয়ে যায়। যথা সময়ে তা দুর দর্শনের জনপ্রিয় প্রোগ্রাম খাস খবরে দেখানো হয়। আমি কি করে জানবো যে এই সংবাদ আমার কপালে কী দুর্ভোগ নিয়ে আসছে।

যেদিন টিভির পর্দায় সংবাদটি পরিবেশন হয় সেদিন একবাড়িতে বসে সান্ধ্য সংবাদ দেখছিলেন এক অসাধারণ স্বামী আর তার রাগী স্ত্রী। স্বামী বেচারার চিরদিনকার অভ্যাস সূর্য ডুবে যাবার আগেই আকণ্ঠ মদে ডুবে যাওয়া। মদ্যপের ধর্ম হচ্ছে কারণ অকারণে অকথ্য বকবককরাধর্মানুসারে সে তা করে যাচ্ছিল। সংবাদের শুরুতেই টিভির পর্দায় ভেসে উঠল মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর সহাস্য মুখ। তিনি নন্দনে ফিল্ম ফেস্টিভালের উদ্বোধন করছেন মোমবাতি জ্বালিয়ে। আশা আছে যে কটি ফিল্ম প্রদর্শিত হবে জ্বালিয়ে দেবে। সে রকমই জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেই স্বামী ভদ্রলোক ভয়াবহ চিৎকার করে উঠলেন, চিনি চিনি একে চিনি। এর নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নাটক ফাটকও লেখে টেখে। আগে–

–তোমার সাথে এক ঠেকে মাল খেতো?

–আগে আমার কথা শোন।

–কোন কথা নয়। রাগী স্ত্রী স্বামীকে শাসন করে, ‘একদম চুপচাপ বসে থাকো। মাতলামো করোনা। খবরটা দেখতে দাও।’

পরের দৃশ্যে টিভির পর্দায় এলেন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টীমের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। সে শুধু ব্যাটে বল ঠুকতেই দক্ষ নয় তলোয়ার চালাতেও সিদ্ধ হস্ত। এবং এই ক্ষমতা অর্জন করেছেন এক বিশেষ কোম্পানীতে প্রস্তুত বিশেষ দ্রব্যর কারণে। সেটাই বললেন তিনি। স্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে আবার গর্জে উঠল স্বামী, চিনি চিনি। একে চিনি। এর নাম মহারাজা। বেহালায় বাড়ি। এর সাথে আমি

–ডাংগুলি খেলেছিলে? এবার একটু জোরে স্বামীকে ধমক দেয় রাগী স্ত্রী–চুপ করবে? চুপ করে বসতে না পারলে রাস্তায় চলে যাও। মদখোরের জ্বালায় জীবনটা জ্বলে গেল। সারাদিন পরে সন্ধ্যেবেলায় একটু টিভি দেখারও জো নেই। খানিক গিলে এসে বকর বকর। ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বার করে দিই, আর না হয় নিজে বার হয়ে যাই।

স্ত্রীর ধমক স্বামী ভদ্রলোকের মন মস্তিষ্কের উপর বিশেষ কোন প্রভাব ফেলতে পারল না। যতবারই টিভির পর্দায় কারও না কারও মুখ ভেসে ওঠে ততবার সে চিৎকার করে ওঠে–চিনি, চিনি একে। তার চেনবার তালিকা থেকে কবিসভা আলো করে বসে থাকা জয় গোস্বামী, হাজতে বসে থাকা শেখ বিনোদ কেউ বাদ গেল না। মন্ত্রী সান্ত্ৰী কবি কষাই খেলোয়াড় লাথখোর সাধারণ অসাধারণ এত মানুষকে চেনা সোজা কথা নয়। মদ সত্যিই মহান পানীয়। মুহূর্তে মানুষকে মহাজ্ঞানী করে দেয়। কিন্তু রাগী স্ত্রী স্বামীর এই প্রতিভাকে স্রেফ মাতালের প্রলাপ ভেবে কোন সম্মান তো দিলইনা উল্টে যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করতে লাগল। রাগ শুধু অন্ধই নয় অজ্ঞও বটে। সম্ভবত রাগী মহিলা হবার কারণে তার এই মতিভ্রম, অধঃপতন।

এক সময় পর্দায় এল আমার ছবি। এবারও স্বামী যথারীতি গর্জে উঠল চিনি, চিনি একে। এ রোজ রাতে স্টেশনের বইয়ের দোকানের সামনে ধর্না দিয়ে বসে থাকে। একে তাকে বই গছাবার চেষ্টা করে।

এবার আর স্ত্রীর ধৈর্যের বাঁধ অটুট রইলো না। বালির বাঁধের মত ভেঙে গেল। তারপরই প্রচণ্ড হুংকার-কী! কী পেয়েছো তুমি এঁ। মোটে যে বারণ শুনছে না! তখন থেকে বলে যাচ্ছি কথা বোলো না। মুখটা বন্ধ রাখো। গু গোবর গিলে কোন কথা মানছোনা যে। তখন থেকে খালি চিনি চিনি। সব তোমার চেনা? সব্বাই চেনা? কেমন করে চেনো? সবাই বুঝি তোমার সাথে এক ঠেকে বসে মদ খায়? মাতাল বাচাল কোথাকার!

এ কথায় স্বামীর অহংবোধ আহত হয়। মদ জনিত কারণে আবেগাতুর হয়ে ওঠা অনুভূতিতে ধাক্কা লাগে। কী কী বললে তুমি? আমি মাতাল? আমি বাঁচাল? এত বড় কথা তুমি বলতে পারলে! জেনে রাখো, হা জেনে রাখো, যে কথা বারো বছরে জানতে পারোনি আজ জানিয়ে দিচ্ছি, আমি মদ খেতে পারি তা বলে মাতাল নই। আমার বাপ কোনদিন ই মিথ্যা কথা ইক্‌ বলেনি। আমিও কোনদিন ই বলিনা। আমি বলছি তো–বলিনা।ও কে চিনি। ওই লেখকটাকে। বিশ্বাস না করলে বললো, আমি প্রমাণ দেবো। বলছি তো প্রমাণ করে দেবো। চাও প্রমাণ? এক্ষুণি মালটাকে ধরে নিয়ে আসবো।

–ফের? তুমি ও কে ধরে নিয়ে আসবে?

–বললাম তো, ধরেই নিয়ে আসবো।

–চোপ। একদম চুপ। আর একটা কথা বললে ধাক্কা মেরে বাড়ির বাইরে।

–আমি বলছি তো।

–চোপ।

স্ত্রীর দাবড়ানি অসহ্য হয়ে উঠল ভদ্রলোকের। তবে রে। নিকুচি করেছে বাড়ির। থাকবো না বাড়িতে। চল্লাম। যদি লোকটাকে ধরে আনতে পারি সেদিন ফিরবো। তার আগে আসছি না। বলে সে ছুটলো রেল স্টেশনের দিকে। আমাকে ধরবে। বইয়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো আমি এক বন্ধুর কাছে গেছি। ফিরবো রাত দশটা নাগাদ। যত রাতই হোক এই পথটাই আমার বাড়ি ফেরার পথ জেনে পরম নিশ্চিন্তে সে পাহারায় বসে গেল। তবে নির্জন নির্জলতায় নয়, মাঝে মাঝে সে বটগাছের ঘন অন্ধকারে মাসিমার মালের ঠেক থেকে চুক চুক চুমুক মেরে আসতে থাকল।

এক সময় পেয়ে গেল আমাকে। ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে আমার উপর পড়ে, জড়িয়ে ধরে উৎকট গন্ধ ভরা মুখ মস্তকটা কাঁধে রেখে খানিকক্ষণ কাঁদল হাউ হাউ করে। ওহঃ সে কী কান্না। মনে হচ্ছে কোন মাতৃহারা সদ্য শ্মশানের কাজ সমাপ্ত করে ফিরে কোন সমশোকাতুরকে সামনে পেয়ে আপ্লুত হয়ে উঠেছে। অনেকক্ষণ পরে বলে–দাদা, আপনি আমাকে বাঁচান। আমার মান সম্মান সব গেছে। মান ছাড়া মানি মণিহারা ফণী সমান। লজ্জা অপমানে মরে গেছি আমি। সব আপনার জন্য। আপনার–সব আপনারই জন্য। হয় আপনি আমার হারানো মান সম্মান ফিরিয়ে আনুন আর না হয় হাত পা বেধে আমাকে রেল লাইনে ফেলে দিন। যেটুকু যা বেঁচে আছি সেইটুকুও মেরে ফেলুন। কথা দিচ্ছি কাউকে আপনার নাম বলবো না।

লেখকরা সব পারে। এক আধটা মানুষ মেরে ফেলা তাদের কাছে কোন ব্যাপার না। বিশেষ করে সে যখন কারও কাছে নাম প্রকাশ করবে না। একান্তই মারতে না চাইলে বাঁচাতে হবে। তাও পুরোপুরি নয়, মানহারা হয়ে যেটুকু মরো মরো মাত্র সেটুক। কিন্তু সেটুকু কেমন করে করবো বুঝতে পারি না। বুঝিয়ে বলে সে–দয়া করে একবার আমার বাড়ি চলুন। সাথে প্রলোভনও জুড়ে দেয়-চা খেতে বলবো না, রাত্রে থাকতে হবে না। যাবেন আর চলে আসবেন।

–সে না হয় গেলাম। কিন্তু কেন যেতে হবে সেটা না জানলে।

-–আমার বউকে দেখাবো। শালি—

–আহঃ গালাগালি করবেন না।

–গালাগালি দিচ্ছি না। ওই শালি–মানে শালিনী।

লোকটার স্ত্রী ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত না হয়ে উপায় নেই। বউয়ের মধ্যে শালি সুখও পাচ্ছে। বলে সে আমি জীবনে অনেক রকম অপমানিত হয়েছি। কিন্তু আজ যা হলাম সে আর কারও কাছে বলার নয়। শালি কী বলে জানেন? আমি নাকি আপনাকে চিনি না। চলুন একবার। ওকে দেখিয়ে দেবো চেনা না অচেনা।

শুধু এই কারণ। মনটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আমার। বলি, রাত অনেক হয়ে গেছে, আজ থাক। কাল না হয় সকালে।

লোকটা ঝপ দিয়ে আমার পায়ের উপর পড়ে, জীবনে আমি কারও পা ধরিনি। বিশ্বাস করুন কারও ধরিনি। আপনি আর কী এমন, কত নাম করা মানুষ রাস্তায় দেখি, কাউকে পাত্তা দিইনি। বিপদে পড়ে আজ, কথায় বলে না বিপদে পড়লে গাধাকে বাপ ডাকতে হয়। আমার এখন সেই দশা। পায়ে ধরছি আপনার। বল্লে দশবার ধরবো, তবু একটু চলুন। লেখকরা মানি লোক। মানি লোকরা জানে মান হারাবার কী যন্ত্রণা। আপনি একটু চেষ্টা করুন। চেষ্টা করলেই বুঝবেন কত কষ্টে আছি। না বলবেন না, চলুন। আপনি না গেলে আমি নিজেই লাইনে গলা দেবো। মরার আগে সবাইকে বলে যাবো আমার মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী। প্লিজ একবার চলুন।

এত কথার মধ্যে এই প্রথম ইংরাজী শব্দের প্রয়োগ। দুশো বছর ইংরেজের গোলাম। কত ইংরেজের বুটের লাথি কপালে পড়ছে গোনা গাঁথা নেই। বড় সমীহ করি ওই ভাষাকে। সকালে কানে গুড মর্নিং দিয়ে দিন শুরু হয় গুড নাইট দিয়ে শেষ। জুতোর স্মৃতি বুকে নিয়ে আমরা আগাপাশতলা ঐতিহ্যের প্রতি সমর্পিত প্রাণা। এখন ইংরাজী শব্দ শুনে মনটা বড় নরম হয়ে যায় আমার। মনের আর কি দোষ, সে তো সন্ধেবেলায় টিভির পর্দায় নিজেকে দেখার পর থেকে এরকম কোমল হয়েই ছিল। কত লোক খাস খবরের শেষ খবরে আমাকে দেখেছে। আমি কি সেই আমি আছি, “জলে-গল” হয়ে গেছি। এমন দিনে কারও মনে কষ্ট দিতে নেই। স্বামী লোকটা মারা গেলে স্ত্রী বেচারার না জানি কত কষ্ট হবে। সেই ভেবে বলি–ঠিক আছে, এত করে বলছেন যখন আমি যাবো।

চকাস করে লোকটা আমার গালে একটা চুমু দিয়ে দেয়–তাহলে চলুন।

–কিন্তু যাবো কি করে। হেঁটে?

–ছিঃ। জিভ কামড়ায় সে–আপনি লেখক মানুষ। হেঁটে গেলে লোকে কি বলবে। ট্যাক্সি তো এখন পাওয়া যাবে না। কি আর করা যাবে, চলুন রিকশায় যাওয়া যাক।

কথা শেষ করে সে সামনে দাঁড়ানো একটা রিকশায় চেপে বসে আমাকে ডাকে, আসুন। আমি উঠতেই রিকশা সামনে গড়ায়। তখন আবার স্বামী লোকটি বলে, আমার স্ত্রীর ঘুমের কোন প্রবলেম নেই। একবার ঘুমিয়ে পড়লে যেন মরা। সকাল আটটার আগে ভাঙে না। কাল-না-কাল, নয়-পরশু। পরশু ফিরতে একটু দেরী হয়েছিল। তার ঘুম ভাঙেনি। কি করবো, সারা রাত বাইরে বসেছিলাম। একটু খাইটাই তো। খেলে ঘড়ির কথা খেয়াল থাকে না। তাড়াতাড়ি ফেরা হয় না। সারাদিন খাটাখাটুনির পর স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝেই বাইরে। সে জন্য আমার কোন অসুবিধা হয়না। রাতের বাতাস শরীরের পক্ষে খুব উপকারী তো। ঠিক কিনা বলুন।

সারাটা পথ সে বক বক করে চলে। বাধ্য হয়ে আমাকে শুনে যেতে হয়। না শুনে উপায় বা কি! বধির যে নই। বধিরদের এই কারণে ভাগ্যবান বলা চলে, বক বক বক্তৃতা বাণী উপদেশ শুনতে হয় না। যদিও নাম চারটে কিন্তু চরিত্রগত দিকে দিয়ে সব সমান। যা মানুষের কান ঝালা পালা করা ছাড়া আর কোন উপকার করে না।

মিনিট দশ পনেরো চলবার পর এক অন্ধকার গলির সামনে রিকশা থামে। সে আগে নেমে বলে, নামুন। যেই রিকশা থেকে নিচে নেমেছি বলে সে-কিছু মনে করবেন না, ভাড়াটা দিয়ে দিন। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই। সমস্যা তার, গুনাগার যাবে আমার! এ কী বিড়ম্বনা। আবার বলে সে, মাত্র আটটাকার ব্যাপার তো, দিয়ে দিন। আমার কাছে থাকলে আপনাকে বলতাম না। আট টাকার জন্য ছোটোলোকামি কে করে বলুন। পকেট ফকেট খালি বলে। সন্ধে থেকে আপনার জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যা ছিল সব উড়ে গেছে।

এই সময় আমার কাছে সম্বল মাত্র আট টাকা। বাড়ি ফেরার পথ খরচ। যাদবপুর স্টেশন থেকে বাসে মুকুন্দপুর তিনটাকা সেখান থেকে রিকশায় দাস পাড়া পাঁচ টাকা। তারপর আর বাস রিকশা নেই। আধঘন্টা পায়ে হেঁটে আমার নিবাস। বাস আর রিকশা ভাড়া বাবদ কোনক্রমে আটটা টাকা বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। এখন সেটা দিয়ে দিতে হয়। যেহেতু আটটাকার জন্য ছোটোলোকামি ঠিক নয়, মদ্যপানও করিনি। চক্ষু লজ্জায় পকেট খালি বলতে পারি না। পরে যা হবার ভেবে রিকশা ভাড়া মেটাই। তারপর হাঁটতে শুরু করি তার পিছনে পিছনে।

গলিটা সরু অন্ধকার আকাবাকা উবর খাবর। কোন এককালে পিচ খোয়া দেওয়া হয়েছিল। মেরামতির অভাবে এই দশা। বোঝা যায় এই গলিতে কোন নেতার নিবাস নেই। তাই তেমন আলোর ব্যবস্থাও নেই। সারা পাড়া এসময়ে ঘুম ঘোরে কাতর। হোঁচট খেতে খেতে সামনে এগিয়ে লোকটা একটা একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। দরজা স্বাভাবিক নিয়মে ভিতর থেকে বন্ধ থাকার কথা। তাই আছে। স্বামী সেই বন্ধ দরজার কড়া ধরে বার কয়েক নাড়িয়ে কোন সাড়া না পেয়ে রাগে গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে ওঠে, এ্যাই শালি খোল, দরজা খোল–দ্যাখ তোর সেই লোককে ধরে নিয়ে এসেছি। কী বলেছিলাম তখন? বের হয়ে দ্যাখ মালটাকে চিনি কিনা। কথার সাথে সমানে সে কড়া নাড়তে থাকে। তার চিৎকারে গৃহকর্তীর হৃদয় তো গলে না কিন্তু আশেপাশের বাড়ি দু চারটে জানালা খুলে যায়। জানালায় দেখা যায় কিছু কৌতূহলী মুখ। আশংকা হয়। এক্ষুনি মাথার উপর ঢিল পোঁচড়া পচা ডিম কিছু একটা পড়বে। আমার তটস্থতা দেখে সে সাহস জোগায়, ভয় পাবেন না। কেউ কিছু বলবে না।

কিছু বলবে না। কেন বলবে না। তাহলে কি এ পাড়ার সবাই মদখোর। রাত হলে সবাই সমান চিৎকার করে। চিৎ হয়, চিৎকরে। আমার অমূলক সন্দেহ নিরসন করতে বলে সে, পনেরো বচ্ছর এই পাড়ায় আছি তো। রোজ রাতে শুনে শুনে সবার অভ্যাস হয়ে গেছে। ওরা জানে আধ ঘন্টার তো ব্যাপার। ঝগড়া হলে তার চেয়ে কত বেশিক্ষণ লাগবে। বোঝে সবাই।

আধঘন্টা নয় মিনিট পনেরোর চিৎকার আর দরজা ধাক্কার পর শুনতে পাই ছিটকিনি খোলার আওয়াজ। দরজা সামান্য ফাঁক হয়। সেই ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই একটি অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রী, কপালে জ্বলছে সিঁদুরের বড় টিপ! তার নিচে পদ্ম দিঘির মত দুটো কাজল কালো চোখ। দেখতে পাই কমল কোয়ার মত দুটো রসালো ঠোঁট। বাঁশির মত টিকালো নাক। নাকে সোনার সরু নথ। সব মিলিয়ে মুখটা এমন চোখ ফেরানো যায়না। মনে হয় এমন রূপ দেখার জন্য আটটাকা অনেক কম খরচ। মনে হয় এইরাতে এভাবে এসে আমি কোন ভুল করিনি। ইচ্ছা করলে এখন আমি একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারি। গান গেয়ে ওঠাও কোন কঠিন নয়। দরজা আর একটু ফাঁক হলে দেখতে পাই একটা রঙ বেরঙের চুড়ি পরা নরম কোমল হাত যে হাতকে কবির ভাষায় করকমল বলে। দরজার ফাঁকা থেকে বাইরে বের হয়ে আসে সেই সুন্দরী রমণীর সুন্দর হাতখানা। হাতে ধরা আছে একখানি বিশুদ্ধ সম্মার্জনী। গোদা বাংলায় যার নাম আঁটা। এরপর সেই সুন্দরীর সুন্দর মুখ থেকে ছুটে আসে মধুর সংলাপ, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। দরজায় দাঁড়িয়ে ষাঁড়ের মত চেল্লালে দুই মদখোরকে আঁটা দিয়ে ধুনে নেশা ছুটিয়ে দেব।

স্বামী বড় কাতর গলায় বলে, শালি একে দ্যাখো। চেনো, কাকে এনেছি।

–চলো চুপচাপ ঘরে ঢোকে। আমাকে নয়, শালিনীর নির্দেশ মদ্যপ স্বামীকে, আর একটা কথা বলবে না। রোজ রোজ এক নাটক। চলো।

স্বামী আমার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে, দেখছেন তো কী রকম বাজে মেয়ে ছেলে–লেখক চেনেনা। একদম আনকালচার। সেই জন্য আপনাকেও ইয়ে ভাবছে। দরজায় একটা লেখক দাঁড়িয়ে আছে। কীভাবে লেখকদের সম্মান দিতে হয় কিছু শেখেনি। একটু কঁদার চেষ্টা করে স্বামী, ফের বলে, এমন মেয়েছেলের হাতে পড়ে জীবনটা ঝাঁঝড়া হয়ে গেল মশাই। কান্নায় কান না দিয়ে রাগী স্ত্রী গজরায়, কী হল, ঘরে ঢুকবে নাকি আমি বাইরে বের হবো? ঝটা দোলায় সে–দেখছো এটা কী? মনে আছে পরশুর কথা?

শেষবারের মত স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টায় বলে স্বামী–শালি বিশ্বাস করো এ সেই লোক যাকে সন্ধেবেলা টিভিতে দেখেছো? যার উত্তরে গলায় চরম অবিশ্বাস জড়ো করে জবাব দেয় সে, ঠেকে গিয়ে আর দুচার গেলাস গিলতে বলো, একেবারে কবিগুরু হয়ে যাবে।

স্বামী ভদ্রলোক আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে, দেখলেন তো কিছুতে বিশ্বাস করছে না। ওর বা কী দোষ। আপনার চেহারা পোষাক কিছুই তো লেখকের মত না। কী আর করবেন সবই আপনার কপাল। আমি আর কী বলব। যান আপনি আমিও যাই। পরে আবার দেখা হবে। গুড নাইট।

স্বামী ঘরে ঢুকে গেলে সশব্দে দরজা বন্ধ করলেন রাগী স্ত্রী। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম বন্ধ দরজার সামনে। তারপর হাঁটা দিলাম বাড়ির দিকে। রাজা সুবোধ মল্লিক রোড পিছনে ফেলে সুকান্ত সেতু পার হয়ে সন্তোষপুরের মধ্য দিয়ে মুকুন্দপুর দাসপাড়া রুমঝুম মাঠ সব শেষে গোপাল নগর। বড় দীর্ঘ একক যাত্রা। পথে পাগলা কুকুরে কামড়াতে পারে, কোন ছিনতাই বাজ কেড়ে নিতে পারে হাত ঘড়িটা, চোর ভেবে পাহারাদার ধরতে পারে, সে সব ভয় এখন আমার কাছে তুচ্ছ। আমি ভয় পাচ্ছি ঘরের দরজায় রাত দুপুরে ধাক্কা দিলে আমার স্ত্রী বিরক্ত হয়ে ঝাঁটা হাতে দাঁড়ালে তখন কী হবে?

.

আমার বিরুদ্ধে একটা চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে আমার কর্মস্থলে, সেই যেমন হয়েছিল সন্দীপ মাস্টারের বেলায়। তাকে আমি দেখিনি। তবে নিলয় নামের লোকটাকে আমি দেখেছি। নিলয় এখানে চাকরি করতে এসেছিল। তবে তার সব চেয়ে যেটা বড় গুণ, ভালো দাবা খেলত। সে ভারতবর্ষের বহু প্রদেশ থেকে পুরস্কার জিতে এনেছিল। বিদেশেও গেছে কয়েকবার দাবা খেলতে। পেয়েছে ইন্টার ন্যাশনাল রেটেড প্লেয়ারের সম্মান। প্রথম হয়েছে ইংল্যান্ডে ক্রিসমাস মর্নিং চ্যাম্পিয়নশিপে। ব্লিটস চেজ টুর্ণামেন্টে তৃতীয় স্থান পেয়েছে। তার এই খ্যাতি শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াল কর্মক্ষেত্রে। এখানকার দুষ্ট চক্র তাকে দেখলেই দল বেঁধে এমন ব্যঙ্গ বিদ্রূপ শুরু করে দিত যে শেষে সে আর মানসিক ভারসাম্য রাখতে পারছিল না। দাবা তো ধীর স্থির মস্তিষ্কের কাজ। তাই বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে চলে গেল সে।

দাবা একটা খেলা। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হলেও আসলে তো খেলাই। এই খেলায় যতই হাতি ঘোড়া মারা হোক-প্রকৃতপক্ষে কারও অহিত তো হয় না। কিন্তু লেখা তো তা নয়। কলম সে তো কখনও কখনও তরবারির চেয়ে ধারালো হয়ে ওঠে। আমার কলমের ধার মুখে জমে আছে জীবনের যন্ত্রণার তীব্র গরল। পুঁজিবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদ আমার প্রতিপক্ষ। যাদের কাটছে তারা আমাকে ছাড়বে কেন। তারা চায় আমি যেন লিখতে না পারি। সেই যে যারা একদিন গান গাইত–শিল্পী সংগ্রামী পল রবনসন আমরা তোমারই গান গাই–ওরা চায় না। আজ তারাই চায় না, এক জন শ্রমজীবি মানুষ সত্যকথা বলুক।

রোজ সকাল সাড়ে ছটা সাতটায় আমার ডিউটির শুরু। বাসন মাজা তরকারি কাটা ধোয়া, মাছ ধোয়া, মশলা করা, রান্না করা, পরিবেশন, রান্না ঘর খাবার জায়গার সাফ সাফাই। আর একবার এই সব কাজ করতে হবে রাতে। তখন আবার গোডাউন থেকে পরের দিনের জন্য চাল, ডাল, তেল, মশলা মেপে মেপে বের করে নিতে হবে। এই সব সম্পন্ন করতে হবে আমাকে একজন অথর্ব মহিলাকে সাথে নিয়ে। সকালের খাবার পরিবেশন করতে হবে সাড়ে নয়টার সময়ে। ভাত ডাল আলু ভাজা মাছ বা ডিম থাকবে মেনুতে। রবিবার সকালের টিফিনে লুচি আলুর তরকারি যুক্ত হবে। মাছের ডিমের বদলে হবে মাংস। রাতে দুরকমের তরকারি ডাল আর ভাত। খাবার সময় সাড়ে আটটা। যদি ঝড় জল বন্যা হয়ে যায় যদি আমার সহকারি নাও আসে যা সে প্রায়ই করে–ওই নিয়মের কোনো অন্যথা হবে না। হলেই ভাগ্যে জুটবে অকথ্য খিচুনি। ধমকি–‘শোকজ করে দেব’।

এই সব কিছুর পিছনে কাঁকড়া বাঙালিদের রয়েছে একটা উদ্দেশ্য আমাকে চাপে রাখা। যেন আমি লেখার সময় না পাই। কথা ছিল আমাদের পঞ্চাশজন লোকের রান্না করার। এখন যা বেড়ে বেড়ে প্রায় দেড়শত। খাবার লোক বেড়েছে কাজের লোক বাড়ানো হচ্ছে না। দুজন লোকে দেড়শো গরুর ঘাস দিতে পারে না। আর এরা তো মানুষ। কী করে দুজনে খাওয়াবো? কাজে কিছু না কিছু ত্রুটি থেকে যায়, বাচ্চারা খেপে যায় আমার উপর।

উদ্দেশ্য যা থাক এইসব সমস্যার তবু মোকাবিলা করা যায়, করা যায় না সেইসব সমস্যার যা শুধু আমাকে বিবৃত বিপদাপন্ন করে দেবার জন্য পরিকল্পিত ভাবে করা হয়ে থাকে। কোনো ভাবে কষ্টেসৃষ্টে হয়ত রান্নাটা সেরেছি, আমার কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে কেউ ভাতে এক মুঠো ধুলো মিশিয়ে দিয়ে চলে গেল। এটা একবার মাদার করেছিল। কেউ হয়ত তরকারিতে খানিকটা নুন ঢেলে দিল। এটা করেছিল বড় সাহেবের বাল্যবন্ধু। দুপুরে বাড়ি গেছি খেতে বলা হয়নি, তখন আর আমি এখানে খাই না, বড় সাহেবের কঠোর হুকুম বাচ্চাদের কোনো খাবার মুখে তুলবি না। সেটা বেআইনি। কারণ এখন তোরা মাইনে পাস। সে যা হোক বিকালে রান্না করতে এসে দেখব। আমার অবর্তমানে কেউ ক্ষতি করে রেখে দিয়েছে গ্যাস ওভেনের। এতে একটা দুর্ঘটনা যদি ঘটে তাদের মনে শান্তি আসে। যদি তা না হয় একটা বিশৃঙ্খলা তো হবেই। যথা সময়ে রান্না নামানো যাবে না। ক্ষুধার্ত বোবা বাচ্চারা ক্ষেপে উঠবে। এই ওদের লাভ এই ওদের আনন্দ।

আমার একখানা সাইকেল আছে। যা চেপে আমি ডিউটিতে আসি। আমার যেখানে বাড়ি সেখানে কোনো অন্য বাহন চলে না। রাতের রান্না শেষ করে খাইয়ে দাইয়ে বাড়ি যাবার জন্য সাইকেলের কাছে গিয়ে দেখব কেউ টিউব থেকে নজেলটা খুলে দিয়ে চলে গেছে বা চাকায় মেরে দিয়েছে পিন, টায়ার কেটে দিয়েছে ব্লেড মেরে। তখন সেই রাত সাড়ে দশ এগারোটায় আর সাইকেল সারাইয়ের দোকান ভোলা পাওয়া যাবে না। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে বাড়ি। পরদিন ভোরে আবার কাজে আসতে হবে হেঁটে হেঁটে।

শুধু এই নয়, আমার একখানা মোবাইল ফোন আছে। বাড়ি বহুদুরে পথ অতি দুর্গম। কেউ যদি আমাকে খোঁজে কী করে পৌঁছবে আমার ঠিকানায়। এখানে পিওনও চিঠি দিতে আসে কালভদ্রে। তাই নিতে হয়েছে একখানা মোবাইল। এখন সেই মোবাইলে রাতদিন মিসকল আসছে। যদি ফোন রিসিভ করি মা বোন তুলে নোংরা গালাগালি।

আমি আর কী করতে পারি। বাধ্য হয়ে ফোন নম্বরগুলো একটা কাগজে লিখে নিয়ে বড় সাহেবের কাছে দিয়ে আসি। সাথে থাকে একখানা দরখাস্ত।

লিখি–আমি আপনার বধির স্কুলের রন্ধনশালার একজন কর্মী। আমাকে কেন কে জানে কিছু লোক ভীষণ মানসিক উৎপীড়ন করে চলেছে। যারা পঁচিশ তিরিশখানা ফোন থেকে অনবরত মিসকল এবং ফোন ধরলে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে থাকে। আমি জানিনা এরা কারা এবং কী উদ্দেশ্যে এসব করে। কোথা থেকে কী ভাবে এরা আমার ফোন নাম্বার পেয়েছে তাও আমার অজানা। আমার ধারণায় এরা সব কোনো না কোনোভাবে আমাদের স্কুলের সাথে যুক্ত। তাই বিষয়টি আপনার গোচরে আনলাম। এবং সমস্যাটি সমাধানের প্রার্থনা জানালাম।

এদের জ্বালায় আমি রাতে ঘুমাতে পারি না, দিনে ঠিকমতো কাজকর্ম করতে পারি না। যখন তখন ফোনে এরা বিরক্ত করে। যে কারণে খুবই মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। আমি এমন একটা কাজের সাথে যুক্ত যার কারণে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন মানুষ আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখে। ফলে হুট করে যে নাম্বার বদলে ফেল্লব সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। আপনি উদ্যোগ নিলে সমস্যার অবশ্যই সমাধান সম্ভব।

তারা ফোন করা তত বন্ধ করেছিল বন্ধ করেনি অন্য উৎপাত যা আমি আগে লিখেছি। বাধ্য হয়ে টিচার ইনচার্জের কাছে একটা লিখিত অভিযোগ জমা দিই।

.

বৃত্তের শেষ পর্ব বইখানা ছাপাবার পিছনে যে ইতিহাস দেবাবু আর বিশ্বাস বাবুর যে অমানবিক দোহন, আমাকে নিংড়ে ছিবড়ে বানিয়ে দেওয়া, সেসব চুপচাপ মনের মধ্যে মেরে ফেলতে পারিনি। মনের ক্ষোভ জ্বালা মিশিয়ে বলে ফেলেছিলাম কখনো কখনো কাউকে কাউকে। সেটাই কেউ তুলে দেয় ওনার কানে। এতে নিদারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। দে বাবু প্রতিবন্ধী সংগঠনের সচিব। আঠারোটা জেলার ছড়িয়ে আছে এই সংগঠনের কর্মকাণ্ড! বিশাল দায়িত্ব ওনার বিশাল ক্ষমতা সম্মান অর্থ প্রভাব প্রতিপত্তি। উনি যা করবেন সবাইকে নত মস্তকে তা মেনে নিতে হবে এটাই তো এক অলিখিত নিয়ম। মুখ বুজে সয়ে যেতে হবে সব কিছু।

আর আমি কী না তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ক্রোধ উন্মা প্রকাশ করছি। লোকের কাছে যা তা বলে সম্মানহানি ঘটাচ্ছি তার। এ কী সহ্য হয়? কোনো ক্ষমতাবান কী দুর্বলের দাপাদাপি সহ্য করে?

তাই একদিন উনি এলেন বধির বিদ্যালয়ে। ডাকলেন আমাকে তারপর বললেন তুই এসব লোকের কাছে কী বলে বেড়াচ্ছিস রে? তোকে আমরা পাঁঠার মতো কেটেছি? আখের মতো ছিবড়ে করেছি?

আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। কী বলব কোনো কথা খুঁজে পাই না।

হঠাৎ একেবারে শান্ত হয়ে গেল ওনার গলা। তারপর যেন কোনো বিজ্ঞ কোনো অবোধ বাচ্চাকে বোঝাচ্ছেন এমন ভাবে বলেন–বড় দোকানে চা খেয়েছিস কোনো সময়? একশো টাকা এক কাপ। একটু রাস্তাটা পার হয়ে সামনে চলে যা, দুটাকা কাপ। তাহলে কী লোককে তারা ঠকাচ্ছে? মোটেই না। যার যা রেট। বুঝলি কিছু?

মাথা নাড়ি আমি–বুঝলাম।

দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বস।

আমি বসলাম।

দে, একটু খইনি দে।

খইনি দিলাম।

খইনি মুখে দিয়ে বলেন তিনি, আমি খবর পেলাম তুই নাকি জেলে ছিলি! কী ছিলি?

ছিলাম।

আগে বলিস নি তো! কোন্ জেলে ছিলি? কী কেস? সব কিছু খুলে বল। পুলিশ দিয়ে ভেরিফিকেশন করাতে হবে। দেখবে হবে জেলখাটা আসামি সরকারি চাকরিতে কী ভাবে ঢুকে গেল।

এবার আমি সত্যি সত্যি একটু ভয় পাচ্ছি। টের পাই কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভাস। এই সময়টা বড় বিপদজনক সময়। চারদিক মাওবাদীদের নামেই কাঁপুনি শুরু হয়ে যাচ্ছে। কটা বাচ্চা ছেলে নন্দনে লিফলেট ছড়াচ্ছিল তাদের ধরে পুলিশ মাওবাদী বলে চালান করে দিয়েছে। আমার আগেকার রেকর্ড ভালো নয়। ইচ্ছা করলে তাকে খুঁচিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে দিলে আমি কী করব।

কবে দিবি?

কী।

তোর পুরো বায়োডাটা। কটা খুন করেছিস, তার মধ্যে পুলিশ কটা, সিপিএম কটা, সব লিখবি। কেসগুলোর কী হয়েছে না হয়েছে, সব-সব।

আরো অনেক কথা সেদিন বলেছিলেন দে বাবু। কান-মাথা ঝা ঝা করছিল বলে সে সব কথা কানে গেল বটে তবে মাথায় রইল না। বুঝতে পারলাম আজ থেকে আমার চাকরির ঘড়ির কাটা উল্টোদিকে ঘোরা শুরু হয়ে গেল। এবার যেতে হবে। দে বাবু আমার চাকরির মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেবেন।

সেদিন কাজ থেকে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু মনে কোনো শান্তি নেই। না পারলাম ভালো করে খেতে না পারলাম রাতে ঘুমাতে। চৌকির উপর আমার ছেলে মেয়ে ঘুমাচ্ছে চৌকির নীচে আমার স্ত্রী অনু। বড় নিরুদ্বেগ ঘুমে তলিয়ে আছে সবাই! কারো মুখে কোন চিন্তা ভাবনার লেশ মাত্র চিহ্ন নেই! ওরা কেউ জানেনা কী ভীষণ বিপর্যয় নেমে আসছে আমাদের জীবন ঘিরে। চাকরি নামক ছোট এক খাঁচায় চার চারটে প্রাণির যে আশা স্বপ্ন বন্ধ করে রাখা আছে, কাল পরশু কিংবা তার পরের দিন সে খাঁচাটা থাকবে না। আবার আমাদের উড়ান দিতে হবে অজানা আকাশ পথে কোনো এক নিরুদ্দেশের দিকে।

এর মধ্যে একদিন যোগেনদার সাথে দেখা করাতে গেছি সোদপুরের ঠিকানায়। যোগেনদা আমাকে নিয়ে গেলেন সল্টলেকের ড. ইলিনা সেনের এক আস্তানায়। ইলিনা সে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডাক্তার বিনায়ক সেনের সহধর্মিনী। এবং মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধায় মহাত্মা গান্ধি অন্তরাষ্ট্রীয় হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা।

এক সময় বিনায়ক সেন আর দল্লীর শ্রমিক নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগীর মধ্যে গভীর সংযোগ ছিল। এই দুজনার সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠেছিল ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সেই ঐতিহাসিক জনস্বাস্থ্য চেতনার প্রথম প্রকল্প শহিদ হাসপাতাল।

চা খাওয়া এবং নানাবিধ কথপোকথনের মধ্য দিয়ে যখন ইলিনা সেন জানতে পারলেন আমি ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চারই লোক এবং ঠিক কি কী কারণে দণ্ডকারণ্য থেকে চলে এসে কলকাতার এক স্কুলে কী ভাবে একদল হিংস্র জন্তু জানোয়ারের খাঁচায় ঢুকে পড়েছি উনি তা শুনে তুরি মেরে হেসে উঠলেন। বললেন-“ওদের সামনে রাতদিন ভয়ে ভয়ে কখন কী হয় সেই আতঙ্ক নিয়ে কেন পড়ে আছেন। বের হয়ে আসুন। আপনার যেটা সঠিক জায়গা–মানুষের মাঝে মানুষের কাজে সেখানে পৌঁছে যান। যাবেন রায়পুর? রায়পুরে বিনায়ক কী ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত আছেন সে তো আপনার জানা। চলে যান রায়পুরে।”

কথা দেই না ইলিনা সেনকে, আবার একেবারে নাও বলি না। ফিরে এসে অপেক্ষায় থাকি, কখন দে বাবুর সেই মারণাস্ত্রটা আমার দিকে ছুঁড়ে মারেন। এদিকে চাকরি যাবে ওদিকে আমার ফোন যাবে–আমি আসছি দিদি।

মাস খানেক বা তার চেয়ে দু’চারদিন পরে ভেসে এল একটা দুঃসংবাদ। সে সংবাদের জন্য আমি কেন–কেউই প্রস্তুত ছিল না। দে বাবু মারা গেছেন। প্রতিবন্ধী অফিস থেকে সে খবর বধির বিদ্যালয়ে এসে পৌঁছাতে নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারলাম না। এও কী সম্ভব। এ কী করে সম্ভব?

দে বাবু মারা গেছেন!–গেছেন?

দিব্যি সুস্থ সবল তরতাজা মানুষ। বলতে গেলে কাল কালকেও উনি প্রতিবন্ধী অফিসে গিয়ে বসেছেন। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছেন। লাল চা খেয়েছেন, খইনি খেয়েছেন। কারো পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, কাউকে ধমক দিয়েছেন। রোজকার দিন চর্যায় কোথাও কোনো ঘাটতি ছিল না। হঠাৎ ইন্দ্র পতন।

কাল রাত প্রায় দুটোর সময় হঠাৎ তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। দে বাবুর ছেলেও ডাক্তার। ভালো ডাক্তার। সে তার সাধ্যমতো বাবার যন্ত্রণা কমাবার চেষ্টা করে। যন্ত্রণা কমে না, বেড়ে চলে উত্তরোত্তর। তখন তাকে ভর্তি করা হয় শহর কলকাতার সবচেয়ে ব্যয়বহুল এক বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু পাঁচজন ডাক্তারের প্যানেল পাঁচ ঘন্টা ধরে অবিরাম চেষ্টার পরেও সামান্য মাথার যন্ত্রণার উপশম দিতে পারে না।

একে কী বলব! ভাগ্য?নাকি বড় লোকের বড় রোগ? যে মাথার যন্ত্রণা গরিব লোকের একটা ডিসপ্রিনে পালাবার পথ পায় না, তাই একজন বিত্তবানকে পেড়ে ফেলেছে বিছানায়। পাঁচজন আর এক ছয়জন ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে অসহায় হয়ে। উন্নত চিকিৎ জ্ঞানের সব নিদান ব্যর্থ চলে গেছে!

আজ বেলা দশটায় প্রিয়জনকে চোখের জলে ভাসিয়ে চির বিল্টুদায় নিয়ে সাধনোচিত ধামের দিকে যাত্রা করে গেছেন তিনি। খবরটা পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল আমার বুক থেকে। তবে সেটা স্বস্তির না বেদনার তা আমি কখনো কোনোদিন ভেবে দেখেনি।

আমরা ভারতীয়। ভারতীয় সাংস্কৃতিতে কোনো মৃত মানুষের নামে মন্দ কথা বলার অনুমোদন নেই। সেটাকে অনুচিত এবং মৃতের আত্মার প্রতি অবজ্ঞা বলে মনে করা হয়। মৃত মানুষ মানে সব সমালোচনার উর্ধ্বে। তাই একদা যে দে বাবু আমার পশ্চাৎদেশে ঢোকাবার জন্য একখানি উত্তম বাঁশের সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন তারই মৃত্যুতে শোকাহত মুহ্যমান হয়ে পড়ি আমি।

এখন আর এই স্কুলে কারো জানতে বাকি নেই যে আমি আসলে এক লেখক। এখন শোকাচ্ছন্ন স্কুলের পক্ষ থেকে শোকে মুহ্যমান আমার কাছে একটা অনুরোধ আসে দাদার ডেডবডিতে মাল্যদান এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য আমাদের এখানেও আনা হবে।নানান জায়গায় অনুষ্ঠান চলবে তো। এখানে বডি পৌঁছাতে রাত আটটা ন’টা বেজে যাবে। এর মধ্যে তুমি দাদার জন্য একখানা কবিতা লিখে ফেলো। বেশ জম্পেশ করে লিখবে, যেন লোকের চোখে জল এসে যায়।

কবিতা দিয়ে চোখে জল। সামনে শায়িত মৃতদেহখানি দেখেও যে চোখে জল আসে না, কবিতার খোঁচা দিয়ে সেই চোখ থেকে জল ঝরাবো, কবিতা কী লঙ্কার গুঁড়ো না, পেঁয়াজের ঝাঁঝ। নাকি খাঁটি সরষের তেল? যা কবিরও চোখ থেকে জল ঝরায়। ঘরে এসে আমি তখন আঁতিপাঁতি করে পুরাতন ডায়েরি, খাতাপত্র সব খুঁজি। যদি কোথাও কোনো এমন মাল পড়ে থাকে যাকে একটু ঘসে মেজে দিলে যুগপোযোগী সময়োপযোগী হয়ে যায়। কোথায় যেন শুনেছিলাম কে এক কৃষ্ণভক্ত দায়ে পড়ে খ্রিস্টান হয়েছিল। তারপর আগে যে ভজন গাইত ভজ কৃষ্ট কহ কৃষ্ট লহ কৃষ্ট নাম হে, যে জনা কৃষ্ট ভজে সে হয় আমার প্রাণ রে। সেই গানকে ক–এর জায়গায় খ বসিয়ে দিয়েছিল। সেই রকম আর কী! শোকে দুঃখে আবেগ আতিথ্যে কত সময় তো কত কিছু লিখেছি। তার একটাও কী পড়ে নেই যে আজকের সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে?

আছে, বেশি খুঁজতে হয়নি। গত বছরের ডায়েরির পাতায় পেয়ে যাই একখানা খাপে খাপ রেডিমেড মাল। কবিতাটার নাম ‘বৃক্ষ জীবন’।

আমার বউয়ের এক বান্ধবীর নাম পলি দাস। সে আগে মিস্তিরি পাড়ায় থাকত, এখন থাকে নয়াবাদের ভগত সিং কলোনিতে। সে দেবী শেঠি হাসপাতালে আয়ার কাজ করে। সেই পলি দাস একদিন আমাকে ধরেছিল, আমাদের সুরারভাইজার ম্যাডাম চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বিয়ে হচ্ছে কীনা। বর বাইরে চাকরি করে। খুবই ভালো লোক ছিলেন তিনি। আমাদের সব মেয়েকে নিজের বোনের মতো ভালো বাসতেন সবার বিপদে আপদে পাশে থাকতেন। ওনাকে আমরা একটা বিল্টুদায় সংবর্ধনা দেব। তুমি আমাদের জন্য একটা কবিতা লিখে দেবে? আমরা আর্টিস্ট দিয়ে একটা সুন্দর ছবি আঁকিয়ে, পাশে তোমার কবিতাটা লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে ম্যাডামকে দেব।

পরিবর্তন অনেক এসেছে, চুলের একটা দুটোয় রূপালি রঙ। তবু সে আজো কিশোরীদের মত উজ্জ্বল-দুর্বার। তার অনুরোধ আমার পক্ষে আজো এড়ানো কঠিন। তাই কাগজ কলম নিয়ে বসে যাই, সাইকেল চালক হয়ে মোটর সাইকেল চালাতে। আমি কঠিন কঠোর গদ্য জগতের লোক, ওটা পারি। পদ্য পারি না! শুরু হয় ভীষণ যুদ্ধ। লিখে ফেলি বৃক্ষ জীবন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা পলির কাজে লাগে না। বলে সে, মেয়েরা বলছে কবিতা দিয়ে দরকার নেই। সেই টাকায় আমরা অন্য একটা কিছু ভালো দেখে কিনে দেব। এই কানের দুলটুল আর কী!

এখন আমি কবিতার কী করি? এ এমন এক লেখা যা কেউ মারা গেলে, চির বিদায় নিয়ে চলে গেলে তবেই তাকে উৎসর্গ করা যাবে। কোনো জীবিতের কাজে লাগবে না। আজ বিপদতারণ হয়ে আমার হাতে উঠে এল সেই বৃক্ষ জীবন।

বৃক্ষ জীবন

সমাগত হয়ে এল বিল্টুদায়ের বেলা।
চলে যায় সেই মহাবৃক্ষ। যার মাথা ছুঁয়েছে আকাশ।
শেকড় চারিয়ে গেছে মাটির গভীরে।
যার ছায়ায় দাঁড়ানো যায় রৌদ্রদগ্ধ শ্রান্ত দুপুরে।

চলে যায়, হায় সবকিছু চলে যায় কাল স্রোতে
রয়ে যায় সময়ের শরীর জুড়ে
স্মৃতি মেদুর যন্ত্রণার দাগ

যদি বলা যেত যেওনা গো। দাঁড়াও
একবার পিছনে তাকাও, দেখো–
তোমার বিচ্ছেদের বেদনায় নীল
শোকাহত ম্লান মুখ, মানুষ, মিছিল
যেওনা গো, ফেরো, ফিরে এসো।
–বলা গেলে বড় ভালো হতো।

হে বৃক্ষ হে মহান মহীরুহ
যাবে বললেই কী যেতে পারা যায়?
মাটির গভীরে ছড়ানো যার অজস্র শেকড়
আদিগন্ত আকাশে অসংখ্য প্রশাখা
নিঃশ্বাস, বিশ্বাস, আনন্দিত আত্মার স্পন্দন
সব কিছু মুছে যাওয়া এত কী সহজ
এত অনায়াস!
নদী যেমন যায় সাগরের দিকে–
শুরুকেও সব বন্ধন ছিঁড়ে ছুঁড়ে
চলে তো যেতেই হয় মহান এক সমাপ্তির কাছে।

আকাশ কালো করে মেঘ হবে না
আমরা ঝর ঝর নামবো না
শ্রাবণের অঝোর ধারায়
বিদায়ের বিষাদক্ষণে
ডাকব না পিছু ফেরার ডাক
সাময়িক শোকাহত স্তব্ধতার পরে
ফের আমরা খুঁজে দেব
মাটি চাপা মনের কন্দরে
আয়ুর্বেদ সঞ্জীবন শেকড়ের ঘ্রাণ
তোমার অমৃত বাণী–
স্নেহের সেই দান।

হে বৃক্ষ, হে প্রাচীন মহাবোধী, মহীরুহ
যাবার আগে–একবার বলে যাও
সেই মন্ত্র সেই ত্যাগ এবং তপস্যা
যা দিয়ে মানুষ–
একমাত্র মানুষই হয়ে যেতে পারে
এক মহা বৃক্ষ।

রাত তখন আটটা বেজে গেছে। দাদার মরদেহ তখনো এসে পৌঁছায়নি। আকাশে মেঘ জমেছে। আর কিছু সময় পরে যে মুষলধারে নামবে তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে কড় কড় বাজ আর বিদ্যুতের ঝলকানিতে। বাতাসের দাপটে আশে পাশের গাছ গাছালি দুলছে। খসে খসে পড়ছে গাছের শুকনো পাতা।

এতরাত অবধি শিক্ষক শিক্ষিকাদের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাদের আবার কালকে ছাত্র পড়াতে আসতে হবে। ছাত্র পড়ানো ঠাণ্ডা মাথার কাজ। মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য ঘুম অতি জরুরি জিনিস। বিকেল চারটেয় ছুটি হয়ে যায়। তবু বাড়ি গিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে এত রাত হয়ে যায় যে পরের দিন সময় মতো ঘুম ভাঙে না। ফলে প্রায় দিনই স্কুলে আসতে লেট। এখন অধিক রাত করে বাড়ি গেলে কাল আর আসা যাবে কী না বলা বড় শক্ত। যিনি গেছেন তিনি গেছেন। যারা যায়নি তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। একটা দিন পড়া কামাই হলে তাদের কত ক্ষতি।

তবে একজন মাস্টার আছে। যে মাস্টার হিসাবে যত না সফল তার চেয়ে অনেক বেশি সফল এক ফটোগ্রাফার হিসাবে। টিচার ইনচার্জ তাকে এই বিশেষ গুণটার জন্য খুবই নেক নজরে দেখে থাকেন। সে জানে কোন এ্যাঙ্গেল থেকে ক্যামেরা ক্লিক করলে ছবি ভালো আসে। যখন স্কুলে রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী এসেছিল এমনভাবে ছবি তুলেছে যেন সব ছবিতে বড়দিকে পাওয়া যায়।

এই মাস্টারের আর একটা গুণ সে কবিতা লেখে। তাকে এখন আমার লেখাটা দেখাই। দেখুন তো কেমন হয়েছে। কবিতায় পড়ে বলেন তিনি, কী বলব বলুন দেখি। কলম দিয়ে নয়, এ একেবারে হৃদয় দিয়ে লেখা। শোকে একেবারে ওকে কী বলে অভিভূত হয়ে না গেলে এই মাল বের হতো না। আমি হলফ করে বলতে পারি দাদার প্রতি এমন ইয়ে মানে আকুলতা আর কারো বুকে নেই। মাস্টার যা বলেছে তার বাইরে রয়ে গেল অনেক না বলা কথা। কারণ সে দাদাকে খুব ভালো চেনে।

আমি খানিকটা পরের কথা তাকে বলে ফেলেছি।

লোকে বলে যার একবার নাম ফেটে যায়, পরে তার অনেক কিছু ফাটে। সে ফাটা মোটই সুখকর নয়–কষ্টদায়ক। খাস খবরের কারণে আমার নাম তো খানিকটা ফেটেছে এবার আমার পেছন ফাটার পালা। স্কুলে যারা আমার উপর আগুন হয়ে ছিল তখন তারা যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠেছে। দেখো কাণ্ডখানা, এসেছে রান্না করতে, এখন বই লেখা ধরেছে। কী দরকার তোর এসব করার? আরে চেঁকি স্বর্গে গেলেও লাথি খায় আর ধান ভানে। কী ভাবছিস তুই, টিভিতে মুখ দেখালেই সে কেউকেটা হয়ে যায়?

এরা সব সিপিএম পার্টির নেতা মন্ত্রী, এল. সি. এম.-এর ভাইপো, ভাগনে। কর্মস্থলই নয়–সারা পশ্চিমবঙ্গে এদের অসীম ক্ষমতা। তার উপর এখানে আছে ঢাল হিসাবে প্রতিবন্ধী বাচ্চা। দরদী সমাজের সব সহানুভূতি যাদের দিকে। এই বাচ্চাদের শিখণ্ডি করে পেছন থেকে তির মারার মস্ত সুবিধা। ওয়ার্ডেন একদিন বলে, এই যে শোনেন মনোরঞ্জনদা, গল্প লিখছেন, লেখক হচ্ছেন, ভালো কথা, কিন্তু যে কাজটার জন্য মাইনে নিচ্ছেন সেটা ঠিকমতো করবেন তো। রোজ বাচ্চারা কমপ্লেন করছে ভাতে কাকর। একটু চাল ডালগুলো বেছে নেবেন। ছাদে একটা কিছু বিছিয়ে বেছে নিতে কতক্ষণ লাগে? এই রকম নানা অজুহাতে তারা কাজের চাপ বাড়িয়ে চলে। লেখ এবার, দেখি কেমন লিখতে পারিস।

হঠাৎ একদিন হুকুম হল আর ভাত নয়। এবার থেকে রোজ রাতে বাচ্চারা রুটি খাবে।

যখন আমরা প্রথমে কাজে আসি তখন বলা হয়েছিল দুজনের পঞ্চাশটা বাচ্চার রান্না করতে হবে। বেড়ে বেড়ে সে সংখ্যা বর্তমানে প্রায় দেড়শো। এখন লেডিস হোস্টেলও চালু হয়ে গেছে। এত লোকের দুবেলা বাসন মাজা তরকারী কাটা রান্না করা পরিবেশন করা, এতেই দম বেরিয়ে যায় দুজনের। এখন আবার রুটি। কতো সময় লাগে এত লোকের রুটির আটা মাখতে বেলতে ভাজতে? আবার সেই রুটির আটা, সেও গম থেকে ভাঙিয়ে আটা বানিয়ে আনতে আমাকেই যেতে হবে। রেশন দোকান থেকে গম–সেও গিয়ে আমাকেই আনতে হবে।

এত কাজ পারা যায় না। একদিন বলি টিচার ইনচার্জকে খাবার লোক এত বেড়ে গেছে এবার এক দুজন কাজের লোক বাড়ান।

লোক কোথায়! লোক নেই। সরকার আর তোক দেবে না।

বলি–তাহলে যাদের সরকার দিয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ নেই, বসে থাকে তাদের পাঠান না।

কে, কে বসে থাকে, নাম বলুন।

বসে তো অনেকেই থাকে। যেমন আদুরি গোঁসাই।

আদুরিদি বসে থাকে। কিছু করে না?

করে! ওই দুপুরে একটু চা, বিকালে বাচ্চাদের মেপে এক কৌটো মুড়ি। বাকি সময় ঘুম, টিভি।

সব নাম বাদ দিয়ে একা তার নাম কেন।

অন্যরা তো পুরুষ। তারা রান্নার কাজ পারবে কী পারবে না সেই ভেবে বলিনি। উনি তো মেয়েছেলে। দুটো রুটি বেলে দিলে দুটো আলু কেটে দিলে আমাদের চাপটা একটু কমে।

আচ্ছা যান, আমি দেখছি।

দেখলেন টিচার ইনচার্জ। স্কুল ছুটির পর বাড়ি যাবার আগে দারোয়ানের কাছে একটা চিঠি রেখে গেলেন আমার নামে। এবার থেকে বিকালের টিফিন সেটাও আমাদের দায়িত্ব। আদুরি গোঁসাই দেবে না।

যখন এ কাহিনি লিখছি, রুটিটা বন্ধ হয়েছে। আমাদের জব্দ করার বাসনায় বড়দির ইচ্ছার যুপকাষ্ঠে বোবা বাচ্চারা নিজেদের জব্দ করতে রাজি হয়নি, এক বছর পরে সব রুটি বয়কট করে অনাহারে থাকা শুরু করে দেয়। আর এখন পুনরায় বিকালের টিফিন আদুরির কাঁধে চেপেছে। শুধু দশ কাপ চা বানিয়ে চলে যাওয়া খারাপ দেখায়।

.

এই সময় আমার দ্বারা একটা খুব খারাপ কাজ হয়ে গেল। যে খারাপ কাজ সেই খাস খবরের বেলা হয়েছিল। কত কথা বলেছি, কিন্তু একবারও বড় সাহেব বা বোবা স্কুলের নাম সকৃতজ্ঞতার সাথে মুখে আনিনি।

একদিন স্থানীয় এক কেবল টিভি আমাকে নিয়ে একটা আধাঘন্টার প্রোগ্রাম করতে সদলবলে এসে পড়ল স্কুলে। তাদের দেখে তাদের বদ উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে টিচার ইনচার্জ গর্জালেন, একে নিয়ে যা করতে চান করুন, কিন্তু রান্না ঘরে ঢুকবেন না। কোনো ছবি টবি তুলবেন না। বড়দির মুখ চোখ ভাষা বর্ষণ সব দেখে টিভি চ্যানেলের লোকেরা বুঝে ফেলেছেন এরা আমার উপর অসন্তুষ্ট। বলেন টিভি চ্যানেলের দলপতি–দ্যাটস অল। চলুন আপনার বাসায় যাই।

ক্যামেরা চালু হতেই প্রথম প্রশ্ন, কেন লেখেন।

আমার জবাব না লিখে পারি না। যেমন শ্বাস না নিয়ে পারি না।

কী লেখেন? গল্প কবিতা উপন্যাস?

জীবন লিখি। আমার লেখার প্রতিপাদ্য হার-না-মানা মানুষ।

মানুষ ছাড়া আর কিছু নিয়ে লেখেন না? যেমন ফুল, পাখি, পাহাড়, নদী?

না, শুধু মানুষ। একমাত্র মানুষ। আমার প্রথম এবং শেষ প্রণামের কেন্দ্রে আছে মানুষ। প্রতিবাদী, প্রতিরোধী মানুষ।

সুকান্ত স্যাটেলাইট নামের সেই কেবল চ্যানেলের লাখখানেক উপভোক্তা আছে যাদবপুর অঞ্চলে। যেদিন এই প্রোগ্রাম টেলিকাস্ট হল, যারা যাদবপুরে থাকে তারাই তা দেখতে পেল। বড়দি, রায়দা এরা দেখেননি। ওয়ার্ডেন সহ এক দুজন তাই পরের দিন ছুটে গেল টিচার ইনচার্জের কাছে, দেখেছেন বড়দি কী বেইমান। আধঘন্টার মধ্যে একবারও বড় সাহেব, আপনি, স্কুলের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করল না।

আমি বুঝতে পারি সমস্ত পরিবেশ আমার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। স্কুলের কেউ আর আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। কিছু জানতে চাইলে বাঁকা উত্তর দেয়। টিটকারি মারে। তারা বুঝে গেছে এসব করলে বড়দি, সুপার, ওয়ার্ডেন এরা খুশি হয়। ক্ষমতাবানদের খুশি রাখলে পরে সুফল মেলে।

কিন্তু আমি যে অক্ষম। কী করতে পারি। আমি সেই কাক-কবে কতদিন আগে একটা কাক তার ডানায় খুঁজে নিয়েছিল একটা ময়ূর পালক। দিনে দিনে সে পালক প্রবেশ করে গেছে অস্থি মজ্জায়। আর মনে হয় না, পালকটা আমার নয়। লোকে হাসছে, লোকে রেগে যাচ্ছে। কিন্তু অস্থি মজ্জা ভেদ করে সে পালক এখন প্রবেশ করে গেছে হৃদয়ের গভীরে। তাকে কাটতে গেলে লাগে, ছিঁড়তে গেলে লাগে। রক্তপাত হয়।

জীবনের এক ব্যর্থ বঞ্চিত মানুষ আমি, যাকে ধরে বেড়ে ওঠা যায় হাতের কাছে তেমন কিছুই তো ছিল না। সময় আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে অতি সস্তা কলম। তাকেই অকুল দরিয়ায় ছোট্ট ডিঙি নৌকার মতো, অন্ধকার রাতের প্রদীপের মতো, অন্ধ মানুষের ষষ্টির মতো আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। জিজীবিষা শব্দের সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে চাই। হাতের কলমটা যদি না থাকে, আমার থাকা আর না থাকা সমান। যেদিন আর লিখতে পারব না যে ভীষণ মানসিক মৃত্যু হবে, তার আগে আত্মহত্যা করে নেব।

এই সময় এই প্রতিকূল সময় আমার হাত চেপে ধরেছে। আর লিখতে দেবে না। চারপাশে ষড়যন্ত্র দেওয়াল তুলেছে কলম কেড়ে নেবে। মহা ভারতের কালে একলব্যের আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছিল। আধুনিককালে এভোয়ার (মহাশ্বেতা দেবীর গল্প) ওই দশা হয়েছে। আমি কী করব। কীভাবে বাঁচব?

কেউ যদি কারো নাক মুখ সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরে, মেরে ফেলতে চায় তখন কে কী করে? চেপে ধরা হাতের ফাঁক থেকে প্রাণপণে শ্বাস টেনে বেঁচে থাকতে চায়। বাতাস কী আসে? আসে না। তবু সে সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্র করে শ্বাস টানে। যদি আর এক দু-সেকেণ্ড বেঁচে থাকা যায়। অনন্তকালের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায় মাত্র এক দু সেকেণ্ড।

আমার এই লেখালেখি এতো কোনো সময় কাটানোর উপকরণ নয়। কোনদিনই তা ছিল না। এটা আমার কাছে বেঁচে থাকার অবলম্বন; জিজীবিষা। এটা আমার কাছে সমাজ বদলের হাতিয়ার, শোষণ বঞ্চনা অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটা দ্রোহ। কে যেন বলেছেন সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়। কিন্তু কোন কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। আমার কাছে লেখাটাই সত্য লেখাটাই শিব এবং সুন্দর। কোনো কিছুর জন্য একে ত্যাগ করা যাবে না।

বধির স্কুলের মাননীয় সভাপতি মনে মনে স্বীকার করেন অন্য যে কোন স্কুল থেকে তার প্রতিষ্ঠ করা এই স্কুলের বিরাট প্রভেদ আছে। এখানকার শিক্ষার মান-পরিবেশ এত উন্নত যে একজন তুচ্ছ রাধুনি সেও লেখক হয়ে যায়। যদি রাধুনি গল্প লেখে বুঝে দেখুন মাস্টাররা তাহলে কী?

আজকাল স্কুলে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি এলে অবশ্যই একবার রান্নাঘর থেকে ডেকে তাদের সামনে আমাকে নিয়ে দাঁড় করান। রবীন দেব, মীরা ভট্টাচার্য, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, আজিজুল হক এমনি বহু জনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই আমি। তাদের দেখান বড় সাহেব–এই যে। আমাদের এখানে রান্না করে। বই লেখে। কই রে তোর একটা বই দে ওনাকে। পড়ে দেখবেন কী লেখার হাত। জানেন ও আমার কাছে এল। বলল লেখে। কী করব দিলাম একটা কাজ। বললাম-লেখ, মানুষের কথা লেখ। লিখছে, মানুষের কথাই লিখছে।

মানুষ বড়লোক হয়ে গেলে তখন তাদের বিচিত্র সব শখ চাগাড় দেয়। কেউ দামি কুকুর পোশে, বাঘ পোষে, কেউ কেউ এ্যাকোরিয়ামে মাছ পোষে। বড় সাহেবের ধারণায় উনি ওনার খাঁচায় পুরে একটা আস্ত লেখক পুষছেন! সেই আনন্দ–যে আনন্দ নিয়ে বাবা মা বাচ্চাকে চিড়িয়াখানা দেখায়–উনি অতিথি অভ্যাগতদের একটা জ্যান্ত লেখক দেখান। দেখুন দেখুন কেমন পোষ মেনে গেছে।

প্রায় কুড়ি পঁচিশ জনকে এভাবে দর্শন এবং একটা করে দুই দান করে করে মনটা বিষিয়ে ওঠে আমার। এক একখান বই ছাপানোর খরচ পড়ে গেছে প্রায় চল্লিশ টাকা। এতে বড় সাহেবের লাভ হতে পারে কিন্তু আমার কী লাভ? মন্ত্রী এম.এল.এ জেলাশাসক স্কুল থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর কেউ আমার কথা মনে রাখে না। বইটা হয়ত ফেলে দেয় বাজে কাগজের ঝুড়িতে। ফলে বই বিলোনোয় অনীহা আসে আমার। আগে মনে আশা জাগত হয়ত এরা আমার বই পড়ে, আমার বিষয়ে একটু ভাববে। তার ফলে জীবনে একটা পরিবর্তন আসবে। কষ্টকর কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে একটু বেশি লেখার সুযোগ পাবো। কিন্তু কোথায় কী! যথা পূর্বং তথা পরং।

যে মেয়েকে বারবার পাত্রপক্ষের সামনে সেজে গুঁজে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, কিন্তু বিয়ে হয় না, তার যেমন শেষ পর্যন্ত আর সাজার ইচ্ছা থাকে না, প্রশ্নের জবাবও হেলাফেলায় দেয়, আমি এখন তাই করি।

এই যে ও এখানে রান্না করে। কিন্তু বই লেখে। এই তোর একখানা বই নিয়ে আয় তো।

মাথা নেড়ে জানিয়ে দিই আমি, আর বই নেই।

বড় সাহেব বোকা নন। বোকা হলে এত লোককে হারিয়ে মাড়িয়ে ছাড়িয়ে এত উঁচুতে উঠতে পারতেন না। যে উচ্চতা থেকে হাত বাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়া যায়।

উনি আমাকে দেখাচ্ছিলেন। একটা অহংবোধ তৃপ্ত হচ্ছিল। এই যে দেখো কোনো হোস্টেলে এমন রাধুনি পাবে না যে গল্প লেখে। কিন্তু এখন লোক দেখানোর মধ্যে সে আনন্দ নেই। প্রমাণ কই? লেখক বললেই তো লোকে বিশ্বাস করবে না। বই দেখাতে হবে। বই যে আর নেই।

তাই আমাকে দেখানোর উৎসাহটাই মরে গেল তার।

.

অনেকদিন দত্তদার সাথে আমার দেখা হয়নি তিনি খবর পাঠিয়েছেন খুব দরকার একবার আমার বাড়ি আয়, তাই গেলাম দেখা করতে। অজন্তা রোডে তার বাড়ি, আগেও বেশ কবার গেছি, আজ সে বাড়িতে গিয়ে যেন একটু বাড়তি আদর পেলাম। বউদি নারকেল নাড়ু আর ফ্রিজের জল এনে দিলেন। বলেন তোমাকে টিভিতে দেখেছি। তারপর পাশের ঘর থেকে মেয়েকে ডাকেন–আয় বৌ দেখে যা কে এসেছে।

মেয়ে এসে আমাকে দেখে আহ্লাদে গলে যায়-মদনকাকু। কখন এলে? আগে আমাদের বাড়ি কতো আসতে। টিভিতে দেখাবার পর মোটে আসো না। আমরা সব সময় তোমার কতো কথা বলি।

সেই কথাটা বল! মা তাগাদা দেয়।

কোন কথাটা।

আরে সেই টিভির কথা।

ওঃ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একটু থেমে বলে মৌ–মদন কাকু, কতোক্ষণ ধরে টিভিতে কতো কথা বললে, একবার বাবুর নামটা বললে কী হতো। যদি বলতে বাবু তোমাকে চাকরি করে দিয়েছে, ওরা নিশ্চয় ফটোটটো নিয়ে যেত। কী ভালো হতো! কেন বললে না?

মুখ দেখে মনে হয় মৌ-এর মুখ থেকে দত্তদা-ই এসব কথা বলাচ্ছে। কিন্তু এখন এই কথার আমি কোনো জবাব দিতে পারি না।

কিছুক্ষণ পরে বলে দত্তদা–আমি একটা কাজের কথা ভাবছি। খুব বড় একটা কাজ। সেটা তুইই করতে পারবি, আর কেউ পারবে না। ওটা করলে বড় সাহেবের চোখে তোর গুরুত্ব বেড়ে যাবে, আমারও তাই হলেনিয়ার এর তাই হবে।

কী কাজ?

তোর জীবনী লিখতে হবে।

আমার জীবনী। জীবনই নেই আমার।

তোর না, তোর লিখতে হবে, বড় সাহেবের জীবনী।

উনি বলেছেন। মানে আমাকে দিয়ে ওনার জীবনী লেখাবেন, এই কথা কী উনি আপনাকে বলেছেন?

উনি বলেননি। আমি বলছি।

কী করে লিখব। আমি কী ওনার জীবনের কথা জানি নাকি?

কিছুটা আমি তোকে বলে দিতে পারব। সেই জরুরি অবস্থায় এলাকা ছেড়ে পালিয়ে ওনার সাথে অনেকদিন ছিলাম তো, তখন উনি বলেছেন। বাকিটা তোর জেনে নিতে হবে।

কার কাছ থেকে জানবো?

আর কারো কাছ থেকে নয়, সরাসরি বড় সাহেবের মুখ থেকে। তোকে তো চেনে। জানে তো তুই লিখিস। ওনার বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে বলবি যে, আমার এবং দত্তদার দুজনের খুব ইচ্ছা যে আপনার জীবনী লেখা হোক। পারবি তো বলতে? কী বলবি? দত্তদা এবং আমার ইচ্ছা আপনার জীবনী ছাপা হোক। কত আন্দোলন কত লড়াই করেছেন, তবেই আজ বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছে। এখনকার মানুষ সে সব তো জানে না। সেই ইতিহাস মানুষকে জানানো দরকার। তাই আমার আর দত্তদার ইচ্ছা যেভাবে বলছি সে ভাবে বলবি–দত্তদা এবং আমার ইচ্ছা। তুই খালি কথাটা পেড়ে রেখে আয়, পরে আমি গিয়ে বাকি কথা বলে নেব। দেখবি তখন নিজের কথা নিজের মুখে সব বলবে।

সব বলবে। পারবে সব বলতে?

বাংলা সাহিত্যে প্রচুর জীবনী লেখা হয়েছে। জীবন নির্ভর সেই সব আখ্যানে পথ নির্দেশ, অনুপ্রেরণা, সাহিত্য রস, সব কিছু পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান। তাই তা শুধু মাত্র একজনের জীবন কাহিনি না হয়ে হয়ে গেছে সময়ের দলিল। ইতিহাসের অঙ্গ।

সাধারণতঃ যার জীবনী লেখা হয়ে থাকে, যে তা লেখে, তার থাকে সামাজিক দায়বদ্ধতার সাথে উক্ত ব্যক্তির প্রতি এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধাবোধ। সেই শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসার প্রকাশ ভঙ্গি পরিমিতি বোধের সীমা অতিক্রম করে গেলে হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তি পূজা, নির্লজ্জ চটুকারিতা। ওটা যেমন অতি মাত্রায় থাকাটা খুব খারাপ, একেবারে না থাকা আরো খারাপ। যার নেই সে লিখতে পারবে না। জোর করে যদি লেখে দায়সারা সে কর্মে কোনো প্রাণ থাকবে না।

অক্ষরের, শব্দের, বাক্যের, এমনকী দাড়ি, কমা তারও প্রাণ হয়। অনেক বলা কথার মধ্যে লুকানো থাকে অনেক না বলা কথা। অনেক না বলা কথার মধ্যে প্রকাশ করা যায় বহু বার বলা সংলাপ। এই কলায় সবাই নয়, কেউ কেউ সিদ্ধহস্ত।

এখন আমি মনের মধ্যে ডুবুরি নামিয়ে আঁতিপাঁতি অনুসন্ধান করি সেই শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা। সন্ধান মেলে না, যা দিয়ে নিষ্প্রাণ বর্ণমালাকে জীবন্ত করা যায়। বরং উল্টে মনের মধ্যে চাপা বিবমিষা জাগে এমন একটা, যা শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসার বিপ্রতীপ মেরুর।

ওই লোকটার মধ্যে একজন কৌশলী আগ্রাসক, আক্রমণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া আর কোনো মানবিক গুণ চোখে পড়ে না। এই লোকটা যে একদিন তোর বাবার মৃতদেহ দাহ করে কালীঘাট শ্মশান থেকে হেঁটে বাড়ি এসেছিল, বাস ভাড়া ছিল না বলে। সে আজ হাতে লাল ঝাণ্ডা নিয়ে মুখে শ্রমিক কৃষকের কথা বলে চল্লিশ পঞ্চাশ বছরে কত হাজার কোটি টাকার সম্পদ জমা করে ফেলেছে, সেটা একটা বিস্ময়।

তবু না বলতে পারি না। চটাতে চাইনা দত্তকে। ইদানিং স্কুলে আমাকে চটিয়ে দেবার একটা চক্রান্ত চলছে। একদিন কানমলে দিয়েছে আমার ওয়ার্ডেন। কী! না, ইয়ার্কি! একদিন গেটে দাঁড় করিয়ে ব্যাগ পকেট চেক করেছে আমার। এটাও ইয়ার্কি। এই সব ইয়ার্কি দিয়ে সে আমার ধৈৰ্য্যচুতি ঘটাতে চায়। যাতে রেগে গিয়ে আমি এমন একটা কিছু করে বসি, যা শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সাজার যোগ্য। টিচার ইনচার্জ তো কাগজ কলম নিয়ে বসে আছে সুযোগ পেলেই চিঠি ধরাবে। শোকজ।

এই অবস্থায় আবার যদি দত্ত রেগে যায়, আমি যাব কোন চুলোয়।

লোকে বলে পৃথিবীটা নাকি স্বার্থপরে ছেয়ে গেছে। তাহলে এই যে দত্ত এখন বড় সাহেবের জীবনী লেখাবার জন্য এত উদগ্রীব এর পিছনে তার কী স্বার্থ? তার স্বার্থ একেবারে নির্মল এবং পবিত্র। যা সেই রামচন্দ্রের সেতু বন্ধনে কাঠ বেড়ালির মত তুচ্ছ, নগণ্য। কিন্তু সেটা অনেক বড় বড় ব্যাপারের চেয়েও মহিমাময়। দত্ত আমাকে দিয়ে লেখাবেন সেই পলাতক পর্বের কথা। পুলিশের তাড়া খেয়ে বনে বন্দরে পালাতে পালাতে দত্ত বড় সাহেবের জন্য কত কষ্ট করেছেন। দু টাকার ছাতু কিনে ভাগ করেছেন দুজনে। বড় সাহেব এখন এত উচ্চে উঠে গেছেন যেখান থেকে মানুষ তো ছাড় শহিদমিনারকেও গরু বাধার খোটার মতো ছোট দেখায়। এই সময় তাকে মনে করিয়ে দেবেন~ দেশ শুদ্ধ মানুষকে জানিয়ে দেবেন–”যখন তোমার কেউ ছিল না, তখন ছিলাম আমি। এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি।” না পর হয়েছি লেখাটা খারাপ, লিখবে হবে পর কোরো না। সেই পুরাতন দিনের কথা মনে রেখো। তোমার একফেঁটা স্নেহ যদি আমার উপর ঝরে পড়ে, যা পড়া উচিতও, সাত পুরুষ পায়ের উপর পা দিয়ে জীবন চলে যাবে।

একদিন গেলাম বড় সাহেবের বাড়ি। এ বড় কঠিন সময়, এই সময় সিপিএম পার্টির সব বড় বড় নেতাকে দেশের মাথা গরম গরিব-গুরবো মানুষের ভয়ে পুলিশের আশ্রয়ে থাকতে হচ্ছে। বড় সাহেবের বাড়ির সামনে পুলিশ ক্যাম্প। বন্দুকধারী পুলিশ আমাকে আটকাল। অনেক রকম প্রশ্নের পর যখন তারা বুঝল আমার কোনো খুনোখুনি করার মতলব নেই, তখন তারা বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি দিল।

বেশ বড় বেশ সুন্দর বহু অর্থ ব্যয়ে নির্মিত এই বাড়ি। যা যা না থাকলে জীবন অপূর্ণ মনে হয়, সব কিছু আছে এই বাড়িতে। আমি গিয়ে বসা মাত্র এককাপ চা এসে গেল। চা খেলে মুখটা কেমন টক হয়ে যায় আমার। তখন একটু খইনি লাগে। নিজের অভিজ্ঞতায় জানি, যারা খইনিখোর চায়ের পরে সবার মুখ টক হয়। বড় সাহেবও খইনিখোর। বধির স্কুলে গেলে চায়ের পর অনেকদিন আমার কাছ থেকে খইনি চেয়ে খেয়েছেন। উনি নিজে চাননি, কাউকে পাঠিয়ে আনিয়েছেন।

এখন উনিও চা খেয়েছেন। ধরে নিই ওনার মুখও টক হয়েছে। তাই দুজনার মতো খইনি ডলা শুরু করে দেই। সামনেই ডলি ওনার। আমার মনেই হয় না এতে ওনার সম্মানহানি হচ্ছে। সেই সত্তর দশক থেকে বামপন্থী নেতা-কর্মীদের সাথে মিশি। তারা আমাদের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে নিতেন। আমরা তাদের সামনেই বিড়ি খেতাম। এত তুচ্ছ কারণে তাদের সম্মান যেত না।

একবার মহাশ্বেতা দেবীর সাথে পুরুলিয়ায় লোথা উৎসবে যাচ্ছিলাম। ট্রেনে ওনার সামনে ওনার ছেলে বাপ্পাদাও সিগারেট টানছিল, আমিও বিড়ি ফুঁকছিলাম। যারা আমার শঙ্কর গুহ নিয়োগী বিষয়ক লেখাটা প্রতিক্ষণে পড়েছেন, সবাই জানেন, প্রথম সাক্ষাতে আমি ওনাকে বিড়ি দিয়েছিলাম, উনি দিয়েছিলেন দেশলাই। আর যেদিন নাগপুর থেকে রায়পুর পর্যন্ত স্বামী অগ্নিবেশজির সাথে মোটরকারে যাত্রা করেছিলাম, সেদিনও সারা পথে বিড়ি ফুঁকেছিলাম সম্মানে বড় সাহেব এনাদের চেয়ে কোনোভাবে বড় নন। তবে খইনি ডলতে বাধা কোথায়? বাধা আছে, কারণ সময় যে বদলে গেছে। এখন আর বড় সাহেব সেই আগের মানুষ নেই, জীবনে প্রথমবার এম.এল.এ. ভোটে জিতে মন্ত্রী হয়ে গেছেন। তাই আমার খইনি ডলায় বিরক্ত হচ্ছিলেন তিনি। রাগে ফুঁসছিলেন। একটা কিছু বলবার সুযোগ খুঁজছিলেন।

সুযোগ পেলেন তখন যখন আমি আমার খইনি সহ ডান হাতখানা ওনার দিকে এগিয়ে দিলাম–নিন। চরম বিরক্তিতে বলে উঠলেন তিনি, এইভাবে দেয় নাকি। আমি অবাক। বুঝতে পারি না কোথায় ভুল। বলি, কোনভাবে দেয়! উনি নিজের ডান হাতের কনুইয়ে বাঁ হাত ঠেকালেন।তর্পণের ভঙ্গিতে হাতটা সামনে এগিয়ে দেখালেন, এইভাবে সম্মানীয় মানুষকে দিতে হয়।

এইভাবে যে অনেকে দেয় সেটা জানি। আর এ-ও জানি যে এটা হচ্ছে পুরাতন ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি। আভূমি প্রণত প্রণাম। প্রণাম করে পায়ের ধুলো মাথায় জিভে দেওয়া, পাদোদক পান এই সবই একদল বৰ্বর পুরোহিত শ্রেণী, অন্য এক শ্রেণির মানুষকে হেয় হীন নীচ বানাবার বদ উদ্দেশ্যে প্রচলন করেছিল। সে সব তো এখন এক অন্ধকার যুগের অতীত অধ্যায়। শিক্ষা দীক্ষায় মানুষ তো অনেক এগিয়ে গেছে। সচেতন মানুষের কাছে এই প্রথা অচল।

তাছাড়া যারা বামপন্থী সেই কবে কতকাল আগে তারা আমাকে বলেছিল–সব মানুষ সমান, সব মানুষ সমান সম্মানীয়। তাহলে আজ উল্টো কথা বলে কেন? আমার কাছে আজ যে সম্মান দাবি করছে, যেভাবে খইনি দিতে বলছে, উনি আমাকে কী সেই ভাবে দেবেন? কেন দেবেন না? উনি মন্ত্রী হলে আমিও তো লেখক। লেখা একটা শিল্প, লেখক একজন শিল্পী, লেখা একটা সৃষ্টি লেখক একজন স্রষ্টা।

হতে পারে উনি আমাকে একটা চাকরি দিয়েছেন, চাকরির আর একনাম সেবা। আমি জনগণের একজন। জনগণ ওনাকেও ভোট দিয়েছে। উনি জনগণকে সেবা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেবক।

এই সব ভাবনা তখন মুহূর্তের মধ্যে তরঙ্গের মতো মনের তটে আছড়ে পড়েছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল, আমার সামনে যে বসে আছে, যে কমিউনিস্ট নয়, একজন কুলিন ব্রাহ্মণ। মার্কসবাদীও নয়, বিশাল পুঁজির মালিক, তাই মার্কসবাদ পুঁজির মালিককে যা বলেছে, উনি সেটাই।

আমি একজন দলিত, আমি একজন শ্রমিক। পুরোহিত তন্ত্র এবং পুঁজিবাদের পক্ষে মানুষদের সাথেই আমাদের লড়াই। এ লড়াই চলছে চলবে।

তখন বলে বসি আমি, আপনি তো কমিউনিস্ট পার্টি করেন, আমি ভেবে ছিলাম, হয়ত এই সংস্কৃতির পক্ষে নন।

আমার কথায় বড় সাহেব খুশি হননি। খসখসে গলায় বলেন তিনি, খইনিটা একটা কাগজে মুড়ে টেবিলে রেখে দাও।

একটু পরে জানতে চান তিনি, এখানে কেন এসেছ। কী দরকার?

বলি–দত্তদা পাঠিয়েছেন। উনি বললেন যে আপনার জীবনী লিখতে হবে। আমি তো আপনার জীবনের বিশেষ কিছু জানি না। যদি আপনি বলতে থাকেন, আমি লিখে নেব। উনি আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। শেষে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখন এখানে বসে আছে, রান্না কে করছে? বাচ্চারা কী খাবে?

বলি–এখন তো পূজার ছুটি পড়ে গেছে। বাচ্চারা বাড়ি চলে গেছে।

অন্য যারা, তারা কী খায়?

তারা নিজেরা রান্না করে নেয়।

তাহলে তোমার আর রান্না করতে হচ্ছে না?

না।

কতদিন ছুটি?

আছে। এখনো দিন পনের আছে।

এবার মোড়ক খুলে খানিকটা খইনিমুখে দিয়ে চোখ বুজে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন কাল থেকে ডিউটিতে আসবে। বাচ্চাদের খেলার মাঠটায় এই বর্ষায় প্রচুর দুব্বো ঘাস গজিয়ে গেছে। ওগুলো সব সাফ করবে। পনের দিনে মাঠ যেন পরিষ্কার হয়ে যায়।

হায় আমার কপাল। আমি বড় সাহেবের বাড়ি এসেছিলাম এক লেখকের অহং নিয়ে। ফিরে যাচ্ছি ঘাস ছেঁড়ার আদেশ পেয়ে। আমার মতো লেখকের এক ভোট ব্যবসায়ীর কাছে কানা কড়ি মূল্য নেই। ওনার কাছে মুল্যবান তারাই যারা ভোটের বাকসো ভরাতে জানে।

এখন সারা স্কুলের সবাই ছুটি ভোগ করবে। আর একা আমি দুব্বোঘাস ছিঁড়ব।

.

আমি বড় সাহেবের বাড়ি গিয়েছিলাম। কেন গিয়েছিলাম? কারো নামে কিছু চুকলি করতে? বাবুকে পটিয়ে কোনো কাজ বাগাতে? নানা রকম শঙ্কা দেখা দিয়েছে আমার ওই যাওয়া নিয়ে। বড় সাহেবের অনেকগুলো গাড়ি। এগুলো নানা জায়গায় ভাড়া খাটে। একটা দুটো বাবুকে বহন করে। গাড়ি অনেক কিন্তু গ্যারাজ তো অনেক নেই। সব রাখা হয় এই স্কুলে। এক ড্রাইভার আমাকে ওখানে দেখেছিল। সে এসে বলেছে এখানে। আর তাই জল্পনা সন্দেহ শঙ্কার ঝড়।

শুধু একা আমারই নয়, সারা স্কুলেরই এখন চলছে অবিশ্বাস সন্দেহ আর আক্রমণ। কারো সাথে কারো কোনো মিল মিশ নেই। সবারই ধারণা যে আমার সাথে সামনে হেসে কথা বলছে পিছনে সেই আমাকে মারবার জন্য চাকু শান দিচ্ছে। আর এটা এই সময় সিপিএম পার্টির মধ্যেও হচ্ছে। যেখানে সেখানে দশজন সিপিএম কর্মী একত্র হচ্ছে সেখানেই হচ্ছে।

যে যাদবপুর কেন্দ্রে এখন সাংসদ সুজন চক্রবর্তী, তাকে যারা জিতেয়েছে, এই যাদবপুরের সেই পার্টি কর্মীরা আগের ভোটে বড় সাহেবকে হারিয়ে দিয়েছে। যে ভীষণ হৃদয় বিল্টুদারক ঘটনার মুখোমুখি বড় সাহেব হয়েছিলেন, ২০১১তে সব সিপিএম নেতা হবেন। তাদের খেয়ে তাদের অতি বিশ্বস্ত লোকজন দলে দলে চুপচাপ জোড়া ফুলে ছাপ দিয়ে দেবে। মহাশক্তিশালী রোম সাম্রাজ্য যেভাবে তাদের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল বামফ্রন্টও মুখ থুবড়ে পড়বে।

এই সময় বধির স্কুলে একটা পরিবর্তন হয়ে গেল। চারতলা থেকে রান্না ঘর দক্ষিণ প্রান্তে এক নব নির্মিত ভবনের নীচের তলায় নেমে এল। এটা বেশ বড়সড় জায়গা। জায়গাও বেশ ভালো। এই ভবনের নির্মাণের ইট বালি রড সিমেন্ট দরজা জানলা চেয়ার টেবিল পাখা লাইট নানাবিধ দ্রব্যের কেনাকাটা নিয়ে স্কুলের প্রভাবশালী লোকেদের মধ্যে যে ক্ষোভ ক্রোধ তার কিছু কিছু আমার কানেও এল। বড় সাহেবের এক বিশেষ স্নেহধন্য যে আবার ‘ডানহাত’ ইট বালি-র ব্যাপারটা সে দেখা শোনা করে। চেয়ার টেবিল জানালা দরজা কেরানি রায়। হোস্টেলের চাল ডাল তেল নুন সুপার আর ওয়ার্ডেন। টিচার ইনচার্জ কিছু কেনা বেচা করেন না,শুধু চেকে সই করেন। সবাই এই পাঁচজনকে বলে পঞ্চ পাণ্ডব। অন্যদের কার কী হয়েছে তা জানিনা টিচার ইনচার্জ নতুন গাড়ি কিনেছেন। বেশ বড় গাড়ি।

.

আমার এক বন্ধুর নাম রাজু দাস এয়ারপোর্টে চাকরি করে দমদমে থাকে। সে নাটক লেখে, অভিনয় করে, একটা নাটকের দল আছে তার। যাদের আগে চণ্ডাল বলা হতো, এখন নমঃশূদ্র বলা হয়, রাজু দাস সেই জাতির মানুষ এবং তার লেখা নাটকে ওই বর্ণবাদী ব্যবস্থার প্রতি আক্রোশ অবশ্যই থাকে।

সে এসে আমাকে বলে, তোমার একটা লেখা দিতে হবে।

কী লেখা?

তোমার জীবন সংগ্রামের কাহিনি। বলে সে অমুক বিশ্বাস নামটা কি শোনা আছে? সে একটা পত্রিকা বের করে। এবার যে সংখ্যাটা করতে চাইছে, তার ইচ্ছা ওই পত্রিকায় একজন দলিত লেখকের, নিজের লেখায় নিজের কথা রাখবে। আমার সাথে তার কথা হয়েছে, তোমাকে দিয়ে এর সূচনা হোক। এই সংখ্যায় তুমি লেখপরের সংখ্যায় আমি লিখব, তার পরের সংখ্যায় অন্য আর কেউ।

আমি কী দলিত লেখক? অদল বদল পত্রিকা সম্পাদক বিমল বিশ্বাস, যে ওই পত্রিকাখানা। একক প্রয়াসেকুড়ি বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশ করছেন, তিনি বলেছেন-”দলিতদের দ্বারা, দলিতদের জন্য, দলিত বিষয়ক যে রচনা তাকে দলিত সাহিত্য বলে।”আমি যদিও জন্মসুত্রে দলিত কিন্তু বিমল বিশ্বাস কথিত দলিত সংজ্ঞায়, আমার লেখা তো দলিত সাহিত্যের পর্যায়ভূক্ত হবে না। রীবাজ, অতিথি সেবা, আর এখন ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকা–জীবন চণ্ডাল, এই তিনটি লেখাকে বাদ দিয়ে এত বছর ধরে যা কিছু লিখেছি, সেইসব লেখায় সমাজের নীচের তলার মানুষের জীবনের ক্রোধ প্রেম প্রতিবাদতীব্রতার সাথে থাকলেও বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা শব্দও নেই। তাই ওগুলোকে ‘দলিত সাহিত্য’ বলা যাবে না। কাজেই আমি দলিত লেখক নই।

বলে রাজু দাস-তুমি দলিত লেখক। অবশ্যই তুমি দলিত লেখক। তুমি যে নীচের তলার মানুষের জীবন যন্ত্রণা নিয়ে লিখেছো তারা কারা? বামপন্থীরা বলবে–শ্রমিক কৃষক খেটে খাওয়া মানুষ। আমি বলব কাওরা বাগদি নমঃশুদ্র। তথা কথিত ভদ্রলোকেদের ভাষায় ছোট লোক ছোট জাত। এই দেশে একমাত্র তারাই শ্রমজীবী, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পেটের ভাত জোগাড় করে, শোষিত বঞ্চিত অত্যাচারিত হয়, সব ওই কাওরা বাগদি নমো। তুমি তাদের কথাই লিখেছ। তাই তুমি দলিত লেখকই। কে কী বলছে ওসব ছেড়ে দাও। আমি বলছি তুমি একটা লেখা দেবে। প্রশ্নমালা তৈরি করাই আছে, তুমি খালি উত্তরগুলো লিখবে? এটা আমার দাবি বলো তো দাবি, অনুরোধ বলো তো অনুরোধ।

আমার বাবা লেখাপড়া জানতেন না, তবু প্রচুর জ্ঞান ছিল তার। তিনি একদিন আমাকে বলেছিলেন–“যদি কেউ তোকে আদর করে ডেকে পান্তাভাত খেতে দেয় পরমান্ন মনে করে খাবি। আর যদি অনাদরে ডেকে পরমান্নও খেতে দেয়, ফেলে চলে যাস। অনাদরের পরমান্নের চেয়ে আদরের পান্তা হাজার গুণে ভালো। অনাদরের অমৃতও পাকস্থলিতে গিয়ে বিষের ক্রিয়া করে।”

কী আমার ভাগ্য। আজ সেই অনাদরের অন্ন, অপমানের অন্ন রোজ খেতে হচ্ছে আমাকে। ছেড়ে ছুঁড়ে যে বেরিয়ে আসব, তা পারছি না ছেলে মেয়ের ভবিষ্যতের কারণে। রবি শ্রীবাস্তবের দেওয়া চাকরি ছেড়ে এসে যে বিপদে পড়েছিলাম সে অনুভূতিটাও ভুলতে পারিনি।

ওই পত্রিকার জন্য একটা লেখা দিতে হবে, লিখতে হবে নিজের কথা নিজের কলমে।

এটা আমার জীবনের সেই সময়–এই রকম এক একটা সময় হয়ত সব মানুষের জীবনেই আসে–যখন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উপর চেপে বসে পড়ে দুঃসহ অন্ধ ক্রোধ, যখন তার নিজের উপর আর নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন সে যা করে বসে সেটা আত্মহত্যারই নামান্তর।

আমি এখন যেখানে কাজ করি কর্মস্থলের অমানবিক পরিবেশ আমাকে এমন তিক্ত ক্ষিপ্ত উত্যক্ত করে তুলেছে যে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে আমার। বলার সময় ঠিক করতে পারি না কতটুকু বলা উচিত আর কতটুকু অনুচিত।

আর লেখার বেলা? আমি আমার সরল অংকের হিসাবে দেখি, যারা আজ আমার জীবনটা যন্ত্রণায় ভরে দিচ্ছে তারা সব সিপিএম প্রশ্রয়পুষ্ট। এর একটাই অর্থ সিপিএম একটি বিষবৃক্ষ। যার ডালপালা ফুল ফল এই কারণে এমন বিষাক্ত।

এরা একদিন বলেছিল লাঙল যার জমি তার। আর ক্ষমতা হাতে পেয়ে এরাই সেই মানুষগুলোকে মেরে ফেলেছিল যারা জোতদারের জমি, গোলার ধানের দখল নিয়েছিল। সেই সময়ের কথা লিখতে গিয়ে আমি লিখে বসি “ সেটা সেই সময় যখন নকশালবাড়ি জ্বলছে। পল্লী কবি গান বাঁধছে–তরাই জ্বলছে রে, জ্বলছে আমার হিয়া, নকশাল বাড়ির মাঠ জ্বলে, সপ্তকন্যার লাইগা। এই সাতকন্যা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল তাদের রাইফেলে, যারা একদিন গলার শিরা ফুলিয়ে শ্রমিক কৃষকদের পক্ষে শ্লোগান দিতো। সিংহাসনের কি অপূর্ব মহিমা। যে বসে সেই নবরক্ত পিপাসু হয়ে যায়।”

আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে দেশভাগ, রিফিউজি ক্যাম্প, দণ্ডকারণ্য মরিচঝাঁপি। রিফিউজি এবংকমিউনিস্ট আন্দোলন প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে আমি লিখে বসি–“সেই সময় কিছু লোক লাল পতাকা নিয়ে রিফিউজিদের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু আন্দোলন আন্দোলন খেলা খেলেছিল। তবে সে খেলা যে নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, তা তখন বোঝা যায়নি। বোঝা গেল অনেক বছর পর, যখন তারা মসনদে আসীন হতে পেরেছেন। (তখন) যে নারকীয় তাণ্ডব তারা মরিচ ঝাপির দীন দুর্বল মানুষগুলোর উপর চালিয়েছে, তা নাৎসি বাহিনীর ইহুদি নিধনকেও হার মানিয়ে দেয়। ফ্যাসিস্ট আর কমিউনিস্ট এক্ষেত্রে এক কী করে হয় কে জানে।”

সিপিএম সরকার প্রাথমিক স্কুল থেকে ইংরাজি তুলে দিয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা ভিতর থেকে এমন অন্তঃসার শূন্য করে দিয়েছে যে আর কেউ ‘শিক্ষিত’ হতে পারবে না। হবে অশিক্ষিত দলদাস সুবিধাভোগী বুদ্ধি বিবেক বর্জিত মানব।

এককালে যারা রাজনীতি করত প্রচুর পড়াশোনা করতে হতো। তখন নিয়মিত পার্টির ক্লাস হতো। সে কাল আর নেই। ফলে সিপিএমের কর্মীরা আর বইপত্র খুব একটা ছোঁয় না। বই পড়ার প্রয়োজন কখন হয়? যখন কিছু জানা বোঝার দরকার হয়। যার জন্ম থেকেই সবকিছু জানা তার আর বই পত্রের কী দরকার?

একজন হিন্দু ঘরে জন্ম দেওয়া শিশু যেমন বাল্যবস্থায় জেনে যায় ভগবান আছেন–তিনি সর্ব শক্তিমান, একটি মুসলমান ঘরে ভূমিষ্ট হওয়া শিশু যেমন দুপায়ে দাঁড়িয়েই টের পায় আল্লা আছেন, আল্লা ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই। তেমনই সিপিএম জমানায় জন্ম দিয়ে যে কোনো শিশু বুঝে যায় সিপিএম পার্টি সর্বশক্তিমান। এই পার্টি না করলে রেহাই নাই। আর একটু গুছিয়ে করতে পারলে পোমাটারি ঠিকেদারি তোলাবাজি-বিবিধ সুযোগ।

তবে সেই সম্পাদক তেমন নন উনি পড়েন। কিন্তু কেন কে জানে আমার লেখাটায় চোখ বোলাতে পারেননি। অথবা বোলাননি। ভেবেছিলেন আমি যখন বড় সাহেবের স্কুলে কাজ করি যা-ই লিখি সিপিএম পার্টির বিরুদ্ধে কী আর কিছু লিখব। তাড়াহুড়ো করে উনি হয়ত এই বিশ্বাসেই লেখাটা প্রেসে পাঠিয়ে দেন। কম্পোজিটার কম্পোজ করে প্রুফ রিডার প্রুফ দেখে প্রকাশক লেখাটির প্রকাশ করে দেয় ওই একই ভরসায়–দাদা যখন দিয়েছেন, পড়ে, জেনে বুঝে তবেই তো দিয়েছেন। আমরা আর কী দেখব।

মরিচঝাঁপির ঘটনায় যে মানুষগুলোর ঘর পুড়েছিল, আহত, নিহত, ধর্ষিত হয়েছিল তাদের একটা বড় অংশ নমঃশূদ্র। উত্তর এবং দক্ষিণ দুই চব্বিশ পরগণা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই সম্প্রদায়ের বহু মানুষ। এদের আবার অনেকে মতুয়া ধর্মে বিশ্বাসী। এরা তাদের ভোটদান ক্ষমতার বলে বহু বিধানসভা লোকসভার সিটে হারানো জেতানোর ক্ষমতা রাখে।

সিপিএমের চালাক রাজনেতা বিশেষ করে রাজনীতির চাণক্য অনিল বিশ্বাস সেটা অনুধাবন করেছিলেন, যে, এক দেশ, স্বজাতির মানুষ হবার কারণে মরিচঝাঁপির মানুষের হত্যালীলায়, তাদের বুকে একটা ক্ষত থাকা অতি স্বাভাবিক। এই ক্ষতে মলম না লাগালে সিপিএম পার্টির বিপদ আছে।

তাই, দলিত আন্দোলনের নেতারা যাকে বলেন চামচা, সিপিএম পার্টি নমঃশুদ্র শ্রেণির মধ্যে সেই চামচা খোঁজার কাজ শুরু করে দেয়। এই রকম কিছু লোককে পেয়েও যায়। যারা পরবর্তীকালে প্রমাণ করতে সক্ষম হয় যে তারা চামচা নয়–বেলচা বেলচাবৃত্তি দিয়ে সিপিএম পার্টির কাছে থেকে অর্জন করে সেই বিশ্বাস-উনি আমাদেরই লোক।

তাই ২০০৪ সালের বইমেলায় যখন সেই পত্রিকাখানি প্রকাশিত হয় ত্রিপুরার সিপিএম সরকারের আর একজন ‘আমাদের লোক’ পাইয়ে দেন ‘অদ্বৈত মল্লবর্মন পুরষ্কার’। পত্রিকার লেখকসূচিতে উপদেষ্টামণ্ডলীতে একঝাক সিপিএম নেতার নাম আছে, একটা পত্রিকার পুরষ্কার পাবার জন্য আর কী যোগ্যতা দরকার?

তারপরে কোন এক সময়ে সম্পাদকের চোখে পড়ে কোন এক ভুলের ফাঁক ফোকর গলে পত্রিকার ঐক্য বিঘ্নকারি একটা লেখা স্থান পেয়ে গেছে। তখন তিনি আর পোস্টাপিসের উপর আস্থা না রেখে লোক মারফত একখানা পত্রিকা বধির স্কুলে পাঠিয়ে দেন। দেখুন কী মাল আমাদের মধ্যে ঢুকে বসে আছে।

আর বাকি সব পত্রিকার বাঁধাই খুলে আমার লেখাটিকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে বাঁধাই করে তবে সেই পত্রিকা গ্রাহকদের দেওয়া হয়। পাঠানো হয় বুকস্টল এবং পত্রিকা বিক্রেতাদের কাছে।

ফুল ফুটলে নাকি তার গন্ধে সবাই টের পায় ফুল ফুটেছে। তবে মজা হচ্ছে ফুলের গন্ধে যদি কারো মন মোহিত না ও বা হয় ইঁদুর পচা গন্ধে বিরক্তি অবশ্যই আসবে তা সে চাক বা না চাক, গন্ধ ধাওয়া করে গিয়ে জানিয়ে দেবে–এই যে আমি।

আমি লিখি সে গন্ধ যাদের নাকে যায়নি, আমার পচনটা গেল। শালা এতদিন সিপিএমের অন্নজল খেয়ে সিপিএমের লোকজনের সাথে মিশে সিপিএম সমর্থক কাগজে সিপিএমের বিরুদ্ধে এইসব লিখেছে? ডাক বাঞ্চোদকে।

দত্তদার একটা ফোন এল–এক্ষুনি একবার আয়।

আমি যাবার পর টেবিল থেকে একখানা পত্রিকা তুলে সজোরে আমার গায়ে ছুঁড়ে মারলেন–কী লিখেছিস এতে। তোর এত সাহস কী করে হয়?

বলি–আমি তো সত্যি কথাই লিখেছি।

খেপে উঠলেন দত্ত–তুই তো বালের এক লেখক তোর মতো কত গা মায়ের ভোগে চলে গেছে। বালস্য বাল তুমি এসেছো সত্যি কথা মারাতে। সত্যি? ছাই হয়ে যাবি তা জানিস?

উত্তেজনায় সারা শরীর কাঁপছে তার, কপালে বিনবিনে ঘাম। বলেন তিনি এর আগে এক বাঞ্চোৎকে বড় সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে দুখানা মাল নিয়ে পালিয়ে গিয়ে সেই মাল দিয়ে ডাকাতি করে ধরা পড়ে। গাঁঢ়ে বাঁশ চলে যায় আমার। ভেবেছিলাম তুই আমার সেই দোষ খানিকটা ঢেকে দিতে পারবি। এখন তো দেখছি তুই যা করেছিস আর একটা বাঁশ যাবে আমার গাঁঢ়ে। আর আমি কোন্ মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব।

বউদি এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে–চা খাবে? চিৎকার করে ওঠে দত্তদানা, চা দেবে না ওকে। জলও দেবেনা। শালা উঁচ হয়ে ঢুকে এখন ফাল হয়ে বের হচ্ছে। তারপর আগুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন–একদিন তোকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম। বেঁচে গেছিস। জানিনা এতদিন পরে আবার তোকে গুলি করতে হবে কিনা। আমি পার্টির সদস্য। পার্টি আমাকে যা বলবে করতেই হবে, আমি পার্টির আদেশ অমান্য করতে পারব না। আমার কাছে পার্টি ছাড়া আর কেউ আপন নয়। একটু যেন আক্ষেপ শোনা যায় দত্তের গলায় পার্টি ছাড়া আর কী আছে আমার? সারা জীবন পার্টির আশ্রয়ে আছি। ভুল হোক ঠিক হোক আমাকে এই ছাতার তলায় থাকতে হবে। এই বয়েসে আর কোথায় যাব আবি। যদি কোনদিন তোর বুকে গুলি চালাই-যেন দুঃখ করিসনা। সুযোগ দিয়েছিলাম, তা কাজে লাগালি না। বলেছিলাম বড় সাহেবের জীবনী লেখ। লিখলি না।

বলি, উনিতো আমার কথার কোনো দামই দেননি। ঘাস ছিঁড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

তা বলে তুই এইসব লিখবি? ভয় করেনি? এখন যদি পার্টির ছেলেরা ধরে তোকে তেলে দেয়, কী করবি? তোর মতো একটা লোক মারা আর রাস্তার একটা কুকুর মারা সমান তা জানিস?

আমি কী তখন আমাতে ছিলাম, নাকি সেই মৃত্যু বিলাসী পতঙ্গ হয়ে গিয়ে ছিলাম যে আগুন দেখলে মরবে বলে ঝপায়।

সেই পত্রিকাখানা হাতে তুলে নিয়ে বলি–দত্তদা এটা সোমেন চন্দ সংখ্যা। সোমেন চন্দ বহু বছর আগে ঢাকার রাজপথে ফ্যাসিবাদ বিরোধী এক মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেই তাপরাধে তাকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরেছিল। কারা, তা জানেন? কারা তার মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে নেচেছিল, চোখ খুবলে নিয়েছিল? আর.এস.পি. আর ফরওয়ার্ড ব্লকের লোকেরা। সেদিন সে যে দলের মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল আর যাকে তারা খুন করেছিল সব মিলে আজ বামফ্রন্ট।কমিউনিস্ট আর কমিউনিস্ট নিধনকারি–মিলে মিশে একাকার। দেখতে গেলে সোমেন চন্দের মৃত্যু ব্যর্থ হয়ে গেছে। কিন্তু যায়নি–কিছু মানুষের মননে চিন্তনে ইতিহাস চর্চায় সে বেঁচে আছে, অমর হয়ে আছে। আমি যদি ওইভাবে মরি–পত্রপত্রিকা টিভিতে ছেয়ে যাব। অমর হয়ে যাব। অমরত্ব কেনা চায়।

আমার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে বলেন তিনি, আচ্ছা তুই এবার যা, কেটে পড়।

আমি তখন বুঝিনি এখন বুঝি যে মানুষ নয়, মানুষকে অমর আর মহান বানায় সময়। সময়ই এক অত্যাচারি ঘৃণিত নবাবকে দেশপ্রেমী বানিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতাকামী মানুষের অন্তরে সিরাজ হয়ে উঠেছিল একটা প্রতীক। মদ্যপ চরিত্রহীন বেশ্যাগৃহগামী মঙ্গল পাণ্ডে হয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের এক মহান নায়ক। সবই সময়ের দয়া এবং দান।

সময়ই ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত করেছে মহামতি লেনিনকে এক মহানায়ক হিসাবে। সময়ই তার মূর্তি মিশিয়ে দিয়েছে ধুলোয়।

.

সারা বিকেলটা লোডশেডিং ছিল। অসহ্য গরমে প্রাণ আইঢাই করছিল সবার। এখন অবশ্য বিদ্যুৎ এসে গেছে, পাখা ঘুরছে। তবে পাখার সে বাতাসে গরম হলকা। আজ আমি ডিউটিতে যাইনি। এখন আমার হাতে সি.এল. নামক একটা ব্রহ্মাস্ত্র এসে গেছে। বছরে চৌদ্দ দিন ছুটি করতে পারি। তাই আজ বিকালের পরে বউকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হই। ইচ্ছা, আজ ওকে একটা মনের মতো জিনিস কিনে দেব। ছানার জিলাপি খেতে অনুখুব ভালোবাসে, ছানার জিলাপি খাওয়াব।

অনু আমাকে একজন রসকষহীন রাগী প্রকৃতির মানুষ বলে মনে করে। এত বছর পরে আজ আমার এমন রোমান্টিক মুড দেখে অবাক হয়ে বলে সে-কী ব্যাপার বলো তো! সূর্য আজ কোন্ দিকে উঠেছে যে মরুভূমিতে বন্যা হচ্ছে!

বলি–কিছু না, এমনি।

এমনি এমনি তো কিছু হয় না। একটা কার্য কারণ থাকে।

হেসে বলি–মনে হল একটু আধটু এসব করারও দরকার আছে।

যখন দরকার ছিল তখনই কিছু করোনি। এখন আর এসব করে কী বা হবে। সেই বয়স সেই আর কী ফিরে আসবে?

বলি আমি–একজন বিখ্যাত মানুষ বলেছেন–জব জাগা তবহি সাবেরা। ঘুম কখনই ভাঙবে সেটাই সকাল।

সূর্য মাথার উপর থাকলেও?

সূর্য ডুবে গেলেও।

এখন আমার মনে পড়ে যায় সেই গল্পটা–একজন লোক তার বউকে সাজাবে বলে জঙ্গলে ফুল তুলতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে পথ খুঁজে পেয়ে যেদিন যে বাড়ি ফিরতে পারে বিশ বছর পার হয়ে গেছে। বুড়ি হয়ে গেছে সুন্দরী বউ। এই গল্প মনে পড়ায় আমাকে সেই বিড়ম্বিত কথা নায়কের মতো মনে হয়, যার হাতের আঙুল গলে চলে গেছে সময়।

ঘুরতে ঘুরতে অনুকে নিয়ে চলে আসি যাদবপুর। সেই জায়গাটায় দাঁড়াই যেখানে অনুকে প্রথম দেখেছিলাম। সেই বাস রাস্তার দিকের পাঁচিলটা আর নেই। পাঁচিল ভেঙে রাস্তা চওড়া করা হয়েছে।

হকার মার্কেট থেকে অনুর জন্য কটা শাড়ি কিনি। ছেলে মেয়ের জন্য জামা প্যান্ট। অনু বলে-তোমার জন্য কিছু কেনো।

বলি–আমি এখন কিছু কিনব না। আমার আছে।

কোথায় আছে? একটা প্যান্ট একটা মাত্র শার্ট।

ওই এখন চলুক। পরে দেখা যাবে। মনে মনে বলি, বেঁচে থাকলে তো প্যান্ট শার্ট পরবো। না বাঁচলে ওসব কী কাজে লাগবে।

যখন কেনাকাটা শেষ করে ঘরের দিকে ফিরব বলে অনু, আমাকে একজোড়া শাঁখা কিনে দেবে? দেখো না, সেই কবে থেকে হাতটা খালি। এঁয়োতির হাত খালি থাকলে ভালো দেখায় না। সেই বিয়ের সময়কার শাঁখা, কতদিন টিকবে। আজ যখন এত কিছু কিনলে এক জোড়া শাখা কিনে দাও।

বলি ওকে, শাঁখা ফাঁকা পরা এসব এক কুসংস্কার। শাঁখা পরার দরকার নেই। একটা ঠুনকো জিনিস, একটু টোকা লাগল কি গেল। ফালতু কতগুলো টাকা নষ্ট। এর চেয়ে ওই টাকায় তুমি অন্য কিছু নাও না!

কী নেব?

ইয়ে–মশারি কিনি একখানা কী বল। বেশ ঘুমানো যাবে।

এরপর একখানা মশারি আর অনুর জন্য দুটো সাদা চুড়ি কিনে বাসায় আসি। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত জাগি আমি আর অনু। রাত যখন খুব গভীর তখন বলি-আমাদের স্কুলে ব্যাঙ্কের এক কর্মচারি এসেছিল বেশ কিছুদিন আগে। তারা লোন দেয়। তা স্কুলের সবাই তার মারফত ব্যাঙ্ক লোনের দরখাস্ত দেয়। আমিও দিয়েছিলাম পঁয়ষট্টি হাজার টাকা পাওয়া গেছে। এই টাকা পাঁচ বছরে শোধ করতে হবে। এখনো তুলিনি, তবে কাল পরশু তুলে নেব। আমি ভাবছি ওই টাকায় ক্ষুদেরাবাদ, গোপালনগর এসব দিকে কোথাও দুই কাঠা জায়গা নেব। বহু লোক নিচ্ছে। খাস জমি সিপিএমের লোকেরা বেচছে। পনের কুড়ি হাজার টাকা কাঠা। যদি ওখানে একটা ছোট ঘর বানিয়ে নিই মাসে মাসে ঘর ভাড়াটা বেঁচে যাবে। যদি আমি মরে ফরে যাই, বাচ্চাদুটো নিয়ে থাকতে পারবে।

বলে সে জায়গা নেবে, সে ভালো কথা। মরার কথা আসছে কেন?

বলি, মানুষের জীবনের কী কোনো ঠিক আছে। আজ আছে কাল নেই। রোজ পেপারে দেখি গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে কেউ না কেউ মরে গেছে। আমিও তো দুটো বড় ওভেন দুটো ছোট ওভেনের সামনে গ্যাস নিয়ে কাজ করি। কখন কী হবে, কিছু কী বলা যায়। কিছু হয়ে গেলে তোমরা তো পথে ভাসবে।

তুমি থামবে। আমাকে ধমক দেয় অনু।

তবে কদিন পরে সত্যিই আমি দুকাঠা জায়গা কিনে ফেলি সাতাশ হাজার টাকা দিয়ে ক্ষুদেরাবাদে। কিনি অনুরই নামে। ব্যাঙ্কের টাকা নিতে এলে একজন গ্যারেন্টর লাগে। আমার চাকরি আমার গ্যারেন্টার। চাকরি যদি থাকে টাকা পাবে। চাকরি না থাকলে আমি উধাও। জায়গা অনুর নামে, কী করে নেবে টাকা।

সবাই বলে, সরকারি চাকরি পাওয়া যত কঠিন যাওয়া আরো কঠিন। আমি কেন এই স্কুলের সবাই জানে, যে চাকরি আমরা পেয়েছি তা সরকারের কম, সিপিএমের বেশি। তাদের ইচ্ছা হলে চাকরি থাকবে, ইচ্ছা না হলে থাকবেনা।রাত দশটায় আমার কানে রিভালভার ঠেকিয়ে রেজিগনেশন। লেটারে সই করিয়ে নিলে আমি কী করতে পারব! যদি গেটে পাঁচটা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে আর আমাকে স্কুলে ঢুকতেইনা দেয়–যদিবা ঢুকি টিচার ইনচার্জ হাজিরা খাতায় সই না করতে দেয় যদি ছয় মাস অনুপস্থিত দেখিয়ে বরখাস্ত করে দেয়, তখন বা আমার কী করবার থাকবে? থানায় যাবো; থানা কোনো ডায়েরি নেবে না, তখন কী উপায়?

সিপিএম পার্টি সর্বশক্তিমান পার্টি। ওরা না পারে এমন কোনো কাজ নেই। ওদের ভয় না পায় এমন কোনো লোক নেই।

বাড়ি হয়ে যাবার পরে অনুকে বলি, আমি যা রোজগার করি সে তো আছে। যদি তুমি কোনো একটা কাজ করো–দুটো পয়সা জমে। অনু কদিন পরে রুবি হাসপাতালের কাছে এক বিখ্যাত জুতো কারখানায় একটা কাজ খুঁজে নেয়। ফুরনের কাজ, যাতে মাসে দেড় দুহাজার হয়ে যায়।

বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে আমার। এবার রণক্ষেত্রে ঘটোৎকচের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়াই। এসো হুঙ্কার, এসো ধমক, বিপদ, একাঘী বান আমি এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

দত্তের ফোন এল কদিন পরে–আমার বাড়ি আয়, কথা আছে।

আমি জানতাম ডাক আসবে। প্রস্তুত ছিলাম।

আমি যাবার পরে বলেন তিনি–মঙ্গলবার তোর ছুটির দিন তো? ওইদিন তোকে আমার সাথে একটু যেতে হবে।

কোথায়?

সিঙ্গেশ্বর।

আমি আগে একবার ওখানে দত্তের সাথে গেছি তাই জায়গাটা আমার চেনা। যাদবপুর থেকে ট্রেনে ঘন্টা খানেক লাগে তালদিতে যেতে। তালদি থেকে ভ্যান রিক্সায় যেতে হবে আরো ঘন্টাখানেক। তারপর পায়ে হেঁটে আর আধঘন্টা। তবে যাওয়া যাবে সিঙ্গেশ্বর। ধুধু মাঠের মাঝখানে এই ছোট্ট গ্রাম। তিরিশ চল্লিশ ঘর দরিদ্র মুসলমান পরিবারের বসবাস এই গ্রামে।

দত্ত জীবনে কোনোদিন চাকরি ব্যবসা কিছু করেননি। পার্টি করেছেন। পার্টির ক্ষমতায় যাদবপুর এবং বহু জায়গায় তার পুকুর নেওয়া আছে। যাতে মাছ চাষ হয়। সিঙ্গেশ্বরে আছে বিরাট মাছের ঘেরী। যে ঘেরীর এপাড় থেকে ও পাড় ধুধু দেখায়। তবে উনি একা নন, স্থানীয় আরো কুড়ি পঁচিশ জন সিপিএম নেতা কর্মীরও অংশ আছে এতে।

সবাই না হলেও বহু লোক জানে–ঘেরী পত্তনের কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই ঘেরীর দখল রাখা নিয়ে কত রক্তের নদী বয়ে গেছে। মানুষের দাম এখানে মাছের চেয়েও কম। যারা এইসব ঘেরীতে পাহারা দেয় সব কুখ্যাত খুনি ডাকাত। মানুষ মারা যাদের কাছে জলভাত। যারা, মাছ চুরি করতে এসে ধরা পড়া চোরকে কেটে কুচি কুচি করে মাছকে খাইয়ে দেয়।

আগে যখন ওখানে গিয়েছিলাম তখন বুক কাঁপেনি। এখন বুক কেঁপে গেল। পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী দত্ত। পার্টির নির্দেশের চেয়ে তার কাছে আর বড় কিছু নেই। কোন প্রশ্ন নয়–তার কাজ অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ পালন করা। কী নির্দেশ এসেছে দত্তের কাছে তা কে বলতে পারে। চারদিকে লাশ পড়ছে। খবরের কাগজের পাতা মানুষের রক্তে লাল। মৃত্যু আর কোনো বেদনাদায়ক ঘটনা নয়, এখন একটা খবর মাত্র। রুটিন কার্যক্রম।

কে বলতে পারে উপর মহল থেকে আমাকে টপকে দেবার আদেশ এসেছে কিনা। মালটা আমাদের অনেক গোপন খবর জেনে ফেলেছে। চাকরি থেকে বের করে দিলে পথে পথে চেঁচাব। লিখবে কাগজে কাগজে। তার চেয়ে হাপিশ করে দেওয়ায় ঝামেলা কম।

এদের যা ক্ষমতা, চাইলে রাতে, যখন আমি সাইকেল চালিয়ে ক্ষুদেরাবাদে ফিরি, সুনসান রাস্তায় অন্ধকারে আমার কাম তামাম করে দিতে পারে। তবে এখন চারদিকে জনবসতি গড়ে উঠেছে, তাই লাশ লুকাতে পারবে না।

মনে সন্দেহ জাগে আমার–এর সম্ভবত কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। কেন তা নেবে? যখন ইচ্ছা করলে শিকারকে পছন্দমতো জায়গায় নিয়ে যেতে বাধা নেই। তারপর সারারাত ধরে ছোট ছোট কুঁচি করে পুকুরে ফেলে দিতে অসুবিধাও নেই। হাইব্রিড মাগুর এক রাক্ষুসে মাছ। জলে নামিয়ে দিলে জ্যান্ত মানুষকে খেয়ে নেয়। আর আমি তোমরা। এক রাতে কোথায় হাপিস হয়ে যাব কোনো হদিশ থাকবে না।

আমি সব বুঝতে পারছি। তবু না বলার উপায় নেই। তাই বাড়ি ফিরে বিধ্বস্ত মন নিয়ে প্রতিক্ষায় থাকি আগামী মঙ্গলবারের। যে মঙ্গল আমার জীবনে এক চরম অমঙ্গল নিয়ে আসছে।

এতদিন অনু একটু একটু করে আমার মুখে শুনে শুনে আমার প্রতি সিপিএম দলের মনোভাব সব জেনে ফেলেছে। তাই আশঙ্কা আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়ে বলে সে, তুমি যাবে না। সবাই জানে দত্তদা তোমাকে দণ্ডকারণ্য থেকে ফিরিয়ে এনেছে। চাকরি দিয়েছে। সে তোমার পরম উপকারি। তুমি নিজেও কত জায়গায় লিখেছ এই সব কথা। এখন সে তোমাকে মেরে দিলে কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারবে না। তোমার লেখাই ওকে বাঁচিয়ে দেবে। ওর পক্ষে তোমাকে মেরে ফেলা সব চেয়ে সহজ। তুমি একদম যাবে না।

বলি–যেতে তো আমাকে হবেই। না গিয়ে যে কোনো উপায় নেই। যদি ওরা সত্যি সত্যি মেরে ফেলবে বলে স্থির করে থাকে এই পরিকল্পনা সফল না হলে অন্য পথ নেবে। ছাড়বে না ওরা। ক্ষতি করতে পারে এমন কাউকেই ওরা ছাড়ে না।

কী করে মারবে তুমি না গেলে?

পাঠাবে ওরা। পাঠাবেই। আমি ওদের কর্মচারী তো–। ওরা যা বলবে আমাকে করতে হবে। বলো হবে কিনা? তা ধরো, ওদের একটা প্রেস আছে। যদি সেই প্রেস থেকে কিছু পোস্টার টোস্টার ছাপিয়ে আমাকে দিয়ে বলে–এগুলো সব বড় সাহেবের বিধানসভা কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসো। আমাকে তো যেতেই হবে। আমি যাচ্ছি–পথে কোন ফাঁকা জায়গায় কেউ আমাকে গুলি করে পালিয়ে গেল। তখন ওরা আমার মৃতদেহ নিয়ে মিছিল করবে। বলবে–এই দেখো পোস্টার, এ হচ্ছে আমাদের লোক, বধির স্কুলে কাজ করে। একে তৃণমূল এবং এস.ইউ.সি. মেরে ফেলেছে। মরি তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু আমার মৃতদেহ নিয়ে সিপিএম ফয়দা তুলবে সেটায় আমার খুব কষ্ট হবে।

.

আজ সোমবার। রাত পোহালেই মঙ্গল। আমাদের দুজনার কারো চোখে ঘুম নেই। সকাল বেলায় যেতে হবে দত্তের বাড়ি। সেখান থেকে সিঙ্গেশ্বর। এই দুশ্চিন্তা চেপে বসে আছে আমাদের মনে–কী হবে। কী যে হবে!

মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত বন্দীর যেমন মনে হয় ঘড়ির কাটা বনবন করে ঘুরছে। আমাদেরও মনে হয় রাত বড় বেশি দ্রুত ফুরাচ্ছে। তখনই আমার শঙ্কর গুহ নিয়োগীর কথা মনে পড়ে যায়। তাকে যে খুন করা হবে, কারা কারা আর কেন তাকে খুন করা হবে সব সবিস্তারে একটা ডায়েরির পাতায় লিখে রেখে দেন, নিজের গলায় ক্যাসেটও করেন সব বক্তব্য। ফলে তার মৃত্যুর পর সব সত্য দেশবাসীর সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে।

আমাকেও তাই করতে হবে। অতএব কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ি। কোথায় যাচ্ছি, কেনিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে, মারা হলে তা কেন? সব কিছু লিখে অনুর কাছে দিয়ে বলি–আমি যদি কালকের মধ্যে না ফিরে আসি জেরক্স করে এই চিঠির একটা করে কপি সব দৈনিক পত্রিকায় পাঠাবে। ডায়েরিতে ঠিকানা লেখা আছে, একটা পাঠাবে মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রের ঠিকানায়। মহাশ্বেতা দেবীকে অবশ্যই একটা দেবে।

সারারাত ধরে এইসব করে, সকালবেলায় অনুকে কাদিয়ে বাচ্চা দুটোর গালে চুমুটুমু দিয়ে আমার ভাঙা সাইকেল নিয়ে রওনা দিলাম দত্তের বাড়ির দিকে। যা আছে ভাগ্যে হয়ে যাক।

অজন্তা রোডে সেই তিনতলা বাড়িতে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে দেখি দত্ত একটা চৌকিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। চোখ বোজা, ডান হাতখানা কপালের উপর আড়াআড়ি রাখা। ঘুম নয়, চোখ বুজে কাতরাচ্ছেন তিনি।

কী ব্যাপার দাদা?

উহঃ আহঃ করে বলে দত্ত–কাল বিকালে পা পিছলে বাথরুমে পড়ে গেছি, কোমরে চোট পেয়েছি। হাঁটতে পারছি না বসতে পারছি না। ডাক্তার বলেছে চুপচাপ শুয়ে থাকতে। কবে সারবে, সারবে কী না সারবে তা কে জানে।

দারুণ সুখবর। আমি এখন নেচে উঠব কিনা, বুঝে উঠতে পারি না। তিরের মতো সাইকেল চালিয়ে বাড়ি এসে, অনুকে খবরটা দিয়ে প্রাণ খুলে দুজনে খুব হেসে নিই এক চোট।

দিন দুতিন পরে আর একটা সুখবর পাই, বড় সাহেবের বিধানসভা এলাকার এক সিপিএম নেতা খুন হয়ে গেছে। সেই নেতা অঞ্চলের বড় সাহেবের বিরোধী গোষ্ঠীর লোক হিসাবে পরিচিত। যে কারণে তার খুন হওয়াটা কিছু লোকের ধারণায় সিপিএম-এর অন্তর্কলহের পরিণতি। কেউ কেউ তো এমনও সন্দেহ করছে এতে বড় সাহেবের পরোক্ষ মদত আছে। সে কারণে তিনি খানিকটা বেকায়দায় পড়ে গেছেন।

ফলে, আমার ব্যাপারে যদি তার মনে কোনো রাগ দ্বেষ থেকেও থাকে আর সেদিকে তাকাবার ফুরসত রইল না। ওই ঝামেলা কীভাবে মেটাবেন সেই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

সময়, সর্বশক্তিমান সময়। সময়ের ঘাত প্রতিঘাতে সেই পত্রিকার লেখার উপর পলি পড়ে গেল তখনকার মতো।

তারপর? তারপর অনুকে নিয়ে গেলাম শাখার দোকানে। আশি টাকা দিয়ে এক জোড়া শাখা কিনে দিলাম। শাঁখা যদি ভেঙে যায়, সেটা অপচয় কখনো নয়। অপচয়, অসময়ে ভেঙে ফেলতে হলে। এখন সে সম্ভাবনা কিছু দুরে গেছে বলে মনে হল। হোক কুসংস্কার, তবু অনু শাঁখা পরুক। ওটাই আমার বেঁচে থাকার প্রমাণ।

.

রামকৃষ্ণ উপনিবেশের প্রণব চক্রবর্তী যাকে আমি আগে ছেলেধরা বলে উল্লেখ করেছিলাম, উনি এখন বর্ধমানের বাসিন্দা। চাকরি নিয়ে চলে গিয়ে পাকাপাকিভাবে ওখানেই বসবাস করছেন। বিশেষ একটা কলকাতার দিকে আসেন না। এখন আর তার আরএসপি পার্টির সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। সেদিন মায়ের শরীর খারাপ শুনে দেখা করতে রামকৃষ্ণ উপনিবেশে এসেছিলেন। খবর পেয়ে আমি গিয়েছিলাম। কথায় কথায় উনি জানালেন যে, বামপন্থা থেকে বিচ্যুত হয়ে যে দল পুঁজিবাদীদের সেবাদাস হয়ে গেছে, আরএসপি নেতারা শুধু ক্ষমতার লোভে সেই দলের লেজুড়বৃত্তি করে চলেছে। সেই কারণে উনি দলত্যাগ করেছেন। বর্তমানে তিনি হাটেবাজারে পত্রিকা ও আটুল বাঁটুল নামে দুটি পত্রিকা চালান। সেই নিয়ে আছেন এবং থাকতে চান।

ওনার হাটেবাজারে পত্রিকা সাপ্তাহিক। চারপাতার বছরভর চলা এই পত্রিকার পুজো সংখ্যাটা হয় চোখে পড়ার মতো, যা অনেক নামী-দামী পত্রিকার ভীড়েও জ্বলজ্বল করে ওঠে–হারিয়ে যায় না।

ওনার সাথে দেখা হওয়ার পরে আমি আমার ঝুলি থেকে একখানা বৃত্তের শেষ পর্ব’ ওনাকে দিলাম। আমি যে লেখাপড়া শিখে গেছি এবং লিখেটিখে লেখার জগতে একটু নামটাম করে ফেলেছি, তা উনি প্রথম জানলেন। জানবেনই বা কি করে? উনি যাকে চেনেন, সে তো নিরক্ষর মদন’। মনোরঞ্জন আর মদন যে একই ব্যক্তি, এখনও বহু লোক তা জানে না। সেই নিরক্ষর মদন সাক্ষর হয়ে একটা গোটা বই লিখে ফেলবে কোনোদিন সে তার ধারণায় আসবে কি করে?

বই দিয়ে ওনাকে বললাম একটু পড়ে দেখবেন। আপনার মতামত পেলে আমার খুব উপকার

উনি বই নিয়ে বর্ধমানে চলে গেলেন।

মাঝখানে বেশ কয়েকমাস কোনও সংবাদ নেই। হঠাৎ একদিন আমার কর্মস্থলে ফোন বেজে উঠল। ওপারে প্রণবদার গলা–হাটেবাজারে পত্রিকার জন্য একটা লেখা পাঠা।

প্রথমে ওই পত্রিকায় আমার অনুপ্রবেশ ঘটে একটি ছোট গল্প দিয়ে। সাপ্তাহিক হাটেবাজারে পত্রিকা দেখেছি, দেখা হয়নি শারদ সংখ্যা। জানতাম না তার আকার-আয়তন কেমন। সেটা জানবার পরই স্থির করি, পরের সংখ্যায় আমি উপন্যাস দেব।

বাংলাভাষায় যাঁরা লেখেন, তুলনামূলকভাবে কবিতার লেখক খুব বেশি। লেখাও যায় অল্প আয়াসে।সকালে-দুপুরে-সন্ধ্যায়-রাতে অভিধান দেখে গুটিকয়েক দুর্বোধ্য জটিল শব্দবসিয়ে চারখানা মাল নামিয়ে ফেলা কোনও ব্যাপার নয়। পত্রিকার সম্পাদকরাও কবিদের প্রতি একটু বেশি সদয়। একপাতায় চারজনকে ধরিয়ে দিতে পারে যে। তাই ফটাফট ছেপে দেয়। কবিতাটা কবিতা হলো কি না, কি হলে কথারা কবিতা পদবাচ্য হয়–কে বা ওসব নিয়ে মাথা ঘামায়।

কবিতার পরে ছোট গল্প। গল্প যদি ছোট হয় এবং গল্প হয়, তাহলেও কোনো পত্রিকার পাতায় একটুখানি স্থান পেতে পারে। বহু পত্রিকাই একটা ‘ভাল লেখার’ জন্য হা-হুতাশ করে মরে। তবে উপন্যাসের বেলায় ব্যাপারটা হয় উল্টো। যদি কোনও ভাল লেখাও হয়, বহু পত্রিকার সেটা ছাপার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় না। যাঁদের সাধ্য আছে, সেইসব বড় পত্রিকা তো কোনও অনামা-অখ্যাত লেখকের লেখা পড়েও দেখে না। অত সময় কোথায় তাদের?

হাটেবাজারে পত্রিকা এখন আমার কাছে সাত রাজার ধন এক মানিক। আমার উপন্যাসসমুহ এখানেই ছাপা হয়। এই পত্রিকা আমার পত্রিকা। আমিই প্রকাশক প্রণব চক্রবর্তী (সম্পাদক মিতা চক্রবর্তী)। প্রকাশক ‘আমি’ লেখক আমার উপর কঠোর শর্ত আরোপ করি, লেখা তোমার যত বড় হোক আপত্তি নেই, তবে সেটা যেন উৎকর্ষতায় উৎরোয়। তা না হলে সেটা হাওড়া ব্রীজ থেকে গঙ্গায় ফেলে দিও। ট্রেনে চাপিয়ে বর্ধমানে আর পাঠিও না। না হলে আমাকে আবার ফেলতে যেতে হবে দামোদর নদে।

পরের বছরের জন্য সারা বছর ধরে একপাতা একপাতা করে দুটো উপন্যাস লিখি। ছন্নছাড়া ও বাতাসে বারুদের গন্ধ’ ছন্নছাড়া’ একদল অনিকেত দরিদ্র-দুর্বল স্টেশন আবাসিক মানুষের জীবন সংগ্রামের উপরে লিখিত। ‘ছন্নছাড়া’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নব’, যার অতীত বলে কিছু নেই, ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। আছে শুধু অস্তিত্বের সংকটে দীর্ণ, বিকট হাঁ-মুখ মেলা বর্তমান। এই উপন্যাসে সেইসব মানুরের কথা বলা হয়েছে, যারা রেল ষ্টেশনে জন্ম নেয়, রেল ষ্টেশনে বাঁচে আর মরে। এইসব প্রান্তিক মানুষের আশা-স্বপ্ন-ভালোবাসা-প্রেম-প্রতিহিংসার আলেখ্য–ছন্নছাড়া। আর বাতাসে বারুদের গন্ধ। একদল জেল বন্দী–যাদের মধ্যে নকশাল বন্দীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি–তাদের মতাদর্শ কেন্দ্রীক সংগ্রাম, নির্ভিকতা, আত্মত্যাগ–এই উপন্যাসের উপজীব্য। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে একজন চোর। যে স্বেচ্ছায় নকশাল বন্দীদের জেল পলায়ন কর্মসুচীর অংশীদার হয়ে শুধু এই আশায় মৃত্যুবরণ করে নেয়, যেন আর কেউ কোনদিন তার ছেলেকে চোরের ছেলে বলতে না পারে, বলবে এক বিপ্লবীর ছেলে।

আমি প্রথম লেখাটাই পছন্দ করি হাটেবাজারে পত্রিকার জন্য। সেটা পড়ে প্রণবদার পছন্দ হয়ে যায়। তিনি কম্পোজ করে ফেলেন। তখন একদিন তাকে আমি আমার দ্বিতীয় লেখাটির কথা বলি। বলি যে, কোথায় যে এটা পাঠাবো, কে যে ছাপবে!

বলেন তিনি–পাঠিয়ে দে।

কোথায়?

আমার কাছে।

আপনি কি করবেন?

বর্ধমানে কত কাগজ, দেব কাউকে। তুই পাঠিয়ে দে।

অগত্যা সেটাও প্রণবদার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই। আর মাঝে মাঝে ফোন করে জানতে চাই, কি হলো লেখাটার ভবিষ্যৎ?

বলেন প্রণবদা-ছাপা হচ্ছে।

কোন পত্রিকায়?

পরে দেখিস।

দেখলাম পরে। ১৪১১ উৎসব সংখ্যায় হাটেবাজারে পত্রিকায় সেই দুটো লেখাই প্রকাশিত হয়েছে। ‘ছন্নছাড়া’, লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’–লেখক মদন দত্ত। দেখে বিস্ময়ে আর আনন্দে নেচে উঠলাম আমি। এটা কেন? বলেন প্রণবদা, ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’ আগে পেলে ওটাই ছাপতাম। ছন্নছাড়া কম্পোজ হয়ে গিয়েছিল তাই সেটা বাদ দেওয়া গেল না। আর ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’-এর মতো একটা লেখা নিজে হাতে করে অন্য পত্রিকায় দিতে মন সায় দিল না। বাধ্য হয়ে দুটোকেই রাখতে হল।

প্রণবদা যে এমন একটা কাণ্ড করবেন, আগেভাগে তার কিছুই বলেননি। সেই থেকে প্রণবদার সাথে আবার নতুন করে যোগসূত্র স্থাপিত হল আমার, নতুনভাবে। উনি সম্পাদক, আর আমি তার পত্রিকার নিয়মিত লেখক।

পরের বছর এই কাগজে প্রকাশিত হল আমার আর একটা উপন্যাস ‘অমানুষিক’। প্রচলিত অন্ধ বিচার ব্যবস্থার অন্যায় বিচারে এক নিরপরাধ বন্দীকে কিভাবে ফঁসী দিয়ে মেরে ফেলা হয়। কেন মেরে ফেলা হয়, এই মৃত্যুতে কার কি স্বর্থ জড়িত-এটা তারই কাহিনী। এই প্রথম আমি আমার ব্যক্তিগত ক্রোধকে পরিণত করি সামাজিক ক্রোধে। স্কুলের গুটিকয়েক সিপিএম-এর অত্যাচারে ক্ষিপ্ত ক্ষুব্ধ এক লেখক আঘাত করে গোটা শাসন ব্যবস্থাটার গোড়ায়। ড্রেন থেকে যেমন ডেঙ্গুবাহি মশা ছড়ালে ড্রেনে ওষুধ স্প্রে করতে হয়, আমি আমার আক্রমণের বর্শামুখ ধাবিত করি আলিমুদ্দিন ভায়া রাইটার্সের দিকে। একজন দুঃস্থ হতভাগা মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবার জন্য কীভাবে তারা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, হত্যাকে পরিণত করেছিল একটা মহোৎসবে, যা দেখে রাগে-ঘৃণায় দেহমন পুড়ে গিয়েছিল আমার। ভীষণ আক্ষেপ হচ্ছিল–এরা কারা আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে গেছে। সেই যে একজন দাঁড়িওয়ালা বুড়ো বলেছিল, ‘দণ্ডদাতা কাঁদে যবে দণ্ডিতের সাথে, সে বিচার সর্বশ্রেষ্ঠ বিচার’। আমরা তো এতদিন এদের তাই ভেবে বসেছিলাম। এ তো দেখছি যাত্রা মঞ্চে যোগী সাজা জাদ। এই উপন্যাসে তখনই আমি লিখেছিলাম একটা নির্মম রাষ্ট্রীয় হত্যা হয়ে গেল। কিন্তু সমাজের সচেতন অংশ–কবি শিল্পী সাহিত্যিক কেউ কিছু করলেন না। কোনই প্রতিবাদ হল না। আমাদের এই প্রতিবাদহীনতা রাষ্ট্র পরিচালকদের আগামীদিনে আরও বড় কোন হত্যা মহোৎসব করতে যে উৎসাহিত করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তারা বুঝে গেছে, মানুষ এক মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ প্রাণীতে পরিণত হয়ে গেছে। আর মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারবে না। এটাই দেশের পক্ষে আগামী দিনে অশুভ হয়ে দেখা দেবে।’

হাটেবাজারে পত্রিকার লেখাটি প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালের শারদ সংখ্যায়। আমার ভবিষ্যত্বাণী যে কত সঠিক ছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নেতাই-এর পরে আর নিশ্চয়ই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি সেদিন মানুষ সচেতন হতো, সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ জানাতো তাহলে অনেকগুলো প্রাণ রক্ষা পেয়ে যেত অকাল মৃত্যু থেকে।

যে রাতে ধনঞ্জয়ের ফাসী হয় সারা রাত ঘুমোতে পারি নি। আমার বন্ধুরা মোমবাতি মিছিল করেছিল, আর আমি রাতভর লিখেছিলাম খাতার পাতায় নিজেকে এই হতভাগ্যের জায়গায় রেখে একটা খসড়া। পরে সেটাই উপন্যাসের রূপ নিই।

এর পরের বছর প্রকাশ হয় সংলাপ নির্ভর উপন্যাস ‘জনযুদ্ধ’। তখনও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন শুরু হয়নি। আমি আমার মতো করে এই ব্যাপক জনসাধারণকে উচ্ছেদ আর ব্যাঙের ছাতার মতো দিকে দিকে গজিয়ে ওঠা নানাবিধ শিল্পদ্যোগ এবং জনজীবনে তার দুষ্প্রভাব-সেই নিয়ে লিখেছিলাম সংলাপ-নির্ভর এই উপন্যাস। জনযুদ্ধ’-জনবিরোধী শিল্পায়নের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধযাত্রার কাহিনী।

এরপর প্রকাশিত হয় আমার উপন্যাস ‘বিবর্ণ শব্দেরা। দণ্ডকারণ্যে বসবাসকারী একদল মানুষ, যাদের দেখে করুণার চাইতে বেশি হয় হাসির উদ্রেক, তাদের নিয়ে এটি লেখা।

এরপর আবার পর পর দু’ বছরে প্রকাশিত হয় চণ্ডাল জীবন।

হাটেবাজারে পত্রিকার বাৎসরিক উপন্যাস ছাড়াও প্রণবদার আটুল বাঁটুল পত্রিকায় প্রায় প্রতিমাসে আমার ছোটগল্প ছাপা হচ্ছিল। যে কারণে কলকাতার চেয়ে বর্ধমানে আমার পাঠকসংখ্যা বেশি হয়েছে। লিখে যাচ্ছিলাম কলকাতার আরও অনেক কটা কাগজে। যেমন বর্তিকা, ভাষাবন্ধন, অদল বদল, চতুর্থ দুনিয়া, জলাভূমি, দ্বীপবাংলা ইত্যাদি।

এর মাঝে আটুল বাঁটুল পত্রিকার উদ্যোগে আয়োজিত উমাপদ দত্তরায় ও নীহারবালা দেবী স্মৃতি গল্প প্রতিযোগিতায় ২০০৩ সালে পেয়ে গিয়েছিলাম প্রথম পুরস্কার হিসেবে মানপত্র ও কিছু নগদ অর্থ। এর আগে অদল বদল পত্রিকার একটি প্রতিযোগিতায় পেয়েছিলাম দ্বিতীয় পুরস্কার। পুরস্কার দ্বিতীয় হলেও প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বড়-ই ছিল। লেখার জন্য এর আগে টাকা পেয়েছি মাত্র দু’বার। একবার দিয়েছিল মনোরম পত্রিকা-সাড়ে চারশো আর প্রতিক্ষণ পত্রিকা দেড়শো টাকা।

একটি লেখা সংগ্রহের প্রয়োজনে প্রতিক্ষণ অফিসে গিয়ে দেখলাম, ওরা আট বছর ধরে লেখকের পারিশ্রমিক বাবদ প্রাপ্য দেড়শো টাকা যক্ষের ধনের মতো আগলে বসে আছেন। সে যাই

হোক, এরপর প্রণবদা ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত আমার গল্পগুলো নিয়ে প্রকাশ করলেন আমার দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘জিজীবিষার গল্প’। এতে স্থান পেল বাইশটা গল্প, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮৮।

এরপর থেকে প্রতি বছর শারদ সংখ্যার জন্যে আমার একটা উপন্যাসের স্থান পাকা হয়ে যায় হাটেবাজারে পত্রিকায়। ১৪১১ থেকে ১৪১৯ দশখানা উপন্যাস প্রকাশিত হয় এই পত্রিকায়।

‘চণ্ডাল জীবন’ উপন্যাসটি প্রথমে যখন হাটেবাজারে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, পাঠক সাধারণের প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। তার ফলে এটাকে পুস্তকাকারে মুদ্রিত করার একটা বাসনা মনের মধ্যে তুমুল তোলপাড় তোলে। কিছু টাকা পয়সা ধারদেনা করে অবশেষে সেটা সম্ভব হয়। ২০০৯ সালে কলকাতা বইমেলায় বইটির প্রকাশ হয়।

.

এই সময় আর একজন মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। ইনি প্রিয়শিল্প পত্রিকা ও প্রিয়শিল্প প্রকাশন সংস্থার কর্ণধার মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায়। ওনার সহধর্মিনী কবি নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবিমন পত্রিকা।

আমি কবিতা লিখি না। ব্যাপারটা এমন নয়। আসলে আমি কবিতা লিখতে পারি না। এই রকমই একনা লিখতে পারা কবিতা স্থান পেয়ে গিয়েছিল ‘কবিমন’-এর পাতায়। সেই সূত্রে আলাপ পরিচয়।তখন আমি মনোজদাকে বলেছিলাম–ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়–আমি পদ্যের লোক নই। আগাপস্তলা গদ্যের লেখক। তাকে একখানা পাণ্ডুলিপি পড়তে দিয়েছিলাম। এটা আমার ছত্তিশগড় বাসকালে দেখা এক জনজাতির ক্ষুদ্র গোষ্ঠির জীবন সমাজ সংস্কার নিয়ে লেখা একটি উপন্যাস। কিন্তু আমার হাতে লেখা দেখে মনোজদা সে পাণ্ডুলিপি পড়বার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তাই মাস ছয়েক পড়ে থাকে পাণ্ডুলিপি স্পর্শরহিত হয়ে। ধুলো জমে যায় পাতার উপর। আমার মনে এ বিশ্বাস দৃঢ় ছিল যে যদি একবার পড়ে ফেলে, না ছেপে ফেরত দিতে পারবেনা। কিন্তু তাকে দিয়ে পড়াব কি করে। একমাস দুমাস পরে পরে যাই, জানতে চাই–পড়েছেন? জবাব পাই এখনও পড়ে উঠতে পারিনি। ভীষণ কাজের চাপ।

শেষে একদিন ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম-ওটা দিয়ে দিন নিয়ে যাই। এখানে পড়ে থেকে তো কোন লাভ নেই, আমি অন্য চেষ্টা করে দেখি। মনোজদা পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে দিলেন। খেদ প্রকাশ করলেন–না পড়তে পাবার জন্য।একবারও বললেন না–মশাই এইহাতের লেখা কী পড়া যায়? বললেন–চা আনাই, একটু চা খান।

চা খেতে খেতে বলি–যদি একটু সময় দ্যান তো দুটো পাতা আমি একটু পড়ে শোনাই। ভদ্রলোক মুখের উপর না বলতে পারলেন না। সম্মতি দিলেন–পড়ুন। আমি পড়া শুরু করলাম। বলেছিলাম দু পাতা পড়ব-ভদ্রলোক তো নই, শর্ত না মেনে দশ পাতা পড়ে গেলাম। তারপর থামলাম। আমি থেমে যেতেই উনি তাড়া দিলেন–থামলেন কেন। আর কিছুটা পড়ুন। পড়লাম এবার আরও দশবারো পাতা।তারপর পাণ্ডুলিপিমুড়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। বললাম চলি, মনোজদার মুখ চোখের ভাষা তখন বদলে গেছে, এক ভালোলাগার ছবি যেন। বলেন তিনি-মনোরঞ্জনদা, যদি কিছু মনে না করেন পাণ্ডুলিপিটা আপনি রেখে যান। আমি কথা দিচ্ছি–আগামী বইমেলায় আপনার বই বের করব।

তাই করেছিলেন তিনি তবে সেবছরুনয়, তারপরের বছরসূ৬ সালের বই মেলায় বের হল আমার পুস্তকাকারে প্রথম উপন্যাস অন্যভুবন।

আমার দুজন প্রকাশকই আর্থির সঙ্গতিতে অনেকটা দুর্বল। এরা যে আমার উপর বেশ কিছু টাকা লগ্নি করেছেন তার পিছনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যের চেয়েও বড় ছিল অনামী কিন্তু সম্ভাবনাময় এক লেখককে উৎসারিত করা। কিন্তু আমারও তো একটা দায়দায়িত্ব থেকে যায়। যদি এঁরা ব্যয়ের অংশ পুনরুদ্ধার করতে না পারে, পরে আর আমার বই ছাপাতে চাইবে না। এই ভাবনা থেকে দুপুর বেলা আমার কাজের শেষে ব্যাগে বই ভরে পৌঁছে যেতে লাগলাম বিভিন্ন স্কুল কলেজে। খাস খবর এবং অন্যান্য কারণে আমার একটা পরিচিতি তো ছিলই। যে কারণে দু চারটে বই বিক্রি হয়ে যেত। তবে তা শ্রমের তুলনায় বা পথ খরচের তুলনায় বিশেষ কিছু নয়। বৃত্তের শেষ পর্বের বেলায় দিব্যজ্যোতি বসুর সহায়তায় একটা জোয়ার পেয়েছিলাম–যাদবপুর ইউনির্ভাসিটিতে দুতিন ঘন্টায় তিরিশ পঁয়ত্রিশ খানা বই বিক্রি হয়েছিল, এবার পাঁচের উপর উঠল না। মাথার সেই পোকাটা নড়ে উঠল–জোয়ার আনতে হবে। বিজ্ঞাপন দেবার ক্ষমতা নেই। এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে দিতে হবে যে আপনা আপনি বিজ্ঞাপন হয়ে যায়।

আচ্ছা, একটা লোক হাওড়া ব্রিজের সবচেয়ে উঁচুতে উঠে বসেছিল, ব্যাপক প্রচার পেয়েছে, আমি যদি বই নিয়ে ওখানে চড়ে বসি? একটা লোক বাঘের গলায় মালা দিয়েছিল সে-ও খুব প্রচার পেয়েছে। তবে লোকটা মারা গেছে এই যা। আমি যদি মারা না যাই? এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের বোকামিতে আমি নিজে হেসে ফেলি। আরে, বাঘের সামনে যাবার চেয়ে কঠিন আর সাহসের-হাওড়া ব্রিজের চেয়ে উঁচু আর একটা জায়গা তো আছে। যেখানে গেলে আর কোথাও যাবার প্রয়োজনই পড়বে না। সব প্রচার এসে হামাগুড়ি দেবে দরজার কাছে। তাই এক দুপুরে আমার ছেঁড়া ঢাকটা কাঁধে করে রওনা দিলাম আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসের দিকে। বঙ্গভূমিতে ওই একটি মাত্র পত্রিকা যা পনের কুড়ি লাখ বিক্রি হয় আর এক দুকোটি লোক পড়ে। এ এমন এক পত্রিকা যা ভালোবাসলেও পড়তে হবে আর মন্দ ভালোবাসলেও অনেক রকম পত্রিকা আছে। সব পড়বার পরেও মনে হয়–দেখি তো ওরা কি লিখেছে।

পত্রিকা অফিসের রিশেপসনের এক সুন্দরী মহিলা বসেছিলেন। রত্নাকরের মত তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই আমি। খরে গলায় জানতে চাই–আমি একটা খবর নিয়ে এসেছি। কার সঙ্গে দেখা করলে সেটা পত্রিকার পাতায় স্থান পাবে যদি একটু বলে দেন। ভদ্রমহিলা যথার্থইভদ্র এবং উপকারী। বলেন তিনি। রিপোর্টার ঋজু বসুর সঙ্গে কথা বলুন।

–কীভাবে বলব?

–ফোন করুন।

–নাম্বার দিন।

কোন রকম বিরক্তি না দেখিয়ে নাম্বার দিলেন তিনি। নাম্বার টিপে পেয়ে গেলাম শ্রদ্ধেয় জগন্নাথ বসুর সুযোগ্য পুত্র ঋজু বসুকে–হ্যালো, আমি আপনার সাথে দুমিনিট কথা বলতে চাই।

–কি বিষয়ে বলুন।

–আমি একজন লেখক। দুটো বই নিয়ে এসেছি। আপনাকে দেব।

–রিশেপসানে জমা দিয়ে যান। আমি পেয়ে যাব।

–রিশেপসানে জমা দিলে হবে না। এর একটা ইতিহাস আছে। সেটা আমি আপনাকে বলতে চাই।

আমার গলার স্বরে জেদ ছিল সাহস ছিল জোর ছিল প্রবল জিগীষা ছিল। যা তাকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে এল বাইরে–দাঁড়ান আমি আসছি। এর কিছু সময় পরে উনি নিচে নেমে এলেন। উনি কয়ধাপ নেমেছিলেন, খুব বেশি হলে দশ বিশ। আর আমি? আমি উঠে গেলাম সপ্ত আকাশ ভেদকরে অনেক উপরে। যেখানে পৌঁছাবার চেষ্টায় আমার মত কত হতভাগ্য আজন্ম মাথা খুঁড়ে চলেছে। এক মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই সারা ভারতবর্ষে যেখানে বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে সর্বত্র পৌঁছে গেল আমার নাম ও জীবন সংগ্রামের কাহিনি।

সেই দুপুরের তপ্তরোধে ঋজু বসু নিজে গিয়েছিলেন আমার ছোট্ট ঝুপড়িতে। সাথে ছিলেন ক্যামেরাম্যান রাজীব বসু। দুজনে দু ঘন্টা ছিলেন। দুঘন্টা ধরে অনবরত বকে গিয়েছিলাম আমি। এত বড় বিশাল মাপের ব্যক্তিত্বের সামনে একটুও সংকুচিত না হয়ে বললাম সেইবাল্যবেলা থেকে আজ পর্যন্ত সব। অবশেষে ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকার প্রায় সিকি পাতা জুড়ে আমার ছবি সহ প্রকাশিত হল ঋজু বসুর প্রতিবেদন–মহীরুহনয়, লড়াকুবটের চারাইতার প্রেরণা।

“নাম সই করতে শেখার ঢের আগে পেটের জ্বালায় বোমাবাজি পাইপগান চালানোয় হাত পাকিয়েছিলেন তিনি।নীরস সিমেন্টে মাথা তোলাবটের চারার মত বেঁচে থাকার জেদ সেই জীবনটাই বদলে ছিল।

সত্তর দশকের গোড়ায় আলিপুর জেলের ধুলোয় কাঠি দিয়ে আকিবুকিতে হাতে খড়ি হয় মনোরঞ্জন ব্যাপারির। মারপিটের অভিযোগে ধরা পড়ে জেল খাটার হতাশায় ভেঙে পড়া সদ্য যুবককে সেদিন আলো দেখিয়ে ছিলেন আর এক অখ্যাত কয়েদি। জেল কুঠুরির জানালা থেকে জাতীয় গ্রন্থাগারের কার্নিশে লতপত করা চারাটা দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন–ওই বটের চারার মতো হও। জীবনের যে কোন অবস্থা থেকে রস নিঙরে নিতে শেখ।

ওই কথাগুলো আজ পঞ্চাশ পেরিয়েও বহন করে চলেছেন তিনি। অবশ্য ঠিক তার বয়েস কত তা তিনি নিজেও জানেন না। উদ্বাস্তু ঘরের জনমজুরের ছেলে একদিনও স্কুলে না যাওয়া মনোরঞ্জন শেষ পর্যন্ত গল্পের বইয়ের লেখক হয়ে উঠেছেন। জেলে অক্ষর চেনার মধ্য দিয়ে বইয়ের যে আশ্চর্য জগত খুলে গিয়েছিল জীবন যুদ্ধের যাবতীয় টানা পোড়েনেও তাকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন বটের চারার মতোই। ছোট বড় পত্রিকায় আড়াই দশক ধরে মাঝে মধ্যেই ছাপা হয়েছে তার গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ। যাদবপুরের ফুটপাত বা দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু মহল্লায়, রিকশা চালক সাফাইকর্মী বা মধ্যপ্রদেশের শ্মশানে ডোমের ভূমিকায়, চোলাই মহুয়ার নেশায়, চারপাশে জীবনের অপচয়ের মধ্যেও ধরে রেখেছেন লেখালেখির অভ্যেস। আর তার দেখা জীবন, মাদকাসক্ত রিকশা চালকের ঘুরে দাঁড়ানো বা কারখানার কাজ করা আইবুড়ো মেয়ের চোরা পথের বাঁকে তলিয়ে যাবার গল্প ক্রমাগত ছাপার অক্ষরের রূপ নিয়ে চলেছে….!”

আমি আগে মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কথা বলেছি। বলা হয়নি যে আমাকে মনোজদার কাছে নিয়ে গিয়েছিল সেই নরেন ভট্টাচার্যের কথা।

আমার প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিল বর্তিকা পত্রিকায় একাশি সালে। সমীক্ষা লিখে আমার মন ভর ছিল না। চাইছিলাম গল্প লিখব। লেখক হবো। সেই আশায় চার পাঁচটা ছোট গল্প লিখেও ফেলি। কিন্তু বর্তিকা তখন পর্যন্ত গল্প কবিতা এসব ছাপাত না।

ভাবি–এগুলো অন্য কোন কাগজে পাঠাব। এও ভাবি–যারা পত্র পত্রিকার সাথে যুক্ত তারা প্রায় সবাই জানে যে এক রিকশাঅলা লেখে–যার নাম মদন দত্ত। যাকে মহাশ্বেতা দেবী স্নেহ করেন। তারা হয়ত মাত্র মহাশ্বেতা দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য লেখাগুলো ছেপে দেবে। আর তাহলে–আমি যে লিখতে পারি তার কোন পরীক্ষা তো হবে না। কীভাবে হবে পরীক্ষা?

তখন জিজীবিষা–এই ছদ্মনামে চারটে কাগজে চারটে গল্প পাঠিয়ে দিই। রানার, হাতিয়ার, সিসৃক্ষা, লোক বিজ্ঞান, পরে আর একটা পাঠাই বঙ্গবার্তা কাগজে। সব কটা লেখাই ছাপা হয়ে যায়। পরীক্ষায় পাশ করি আমি। আমিও পারি, আমিও পারব। মনোবল বেড়ে যায় আমার।

আমরা আগে যেখানে থাকতাম সেই শ্যামা কলোনীতে থাকত নরেন ভট্টাচার্য। ও তখন খুবই ছোট। তবে সাহিত্য সংস্কৃতির দিকে দারুণ ঝোঁক ছিল ওর। ওই বয়েসেই নরেন একটা পত্রিকা বের করেছিল–নাম উদাহরণ। সেই পত্রিকায় এরপরে আমি “রানারের নূপুর”নামে একটা গল্প লিখি। পরের সংখ্যার জন্য একটা কবিতা দিই। তবে সেকবিতা আর প্রকাশ হয়নি। পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। নরেন চলে যায় অভিনয় জগতে। একটা নিজস্ব নাটকের দল গড়ে তোলে, তার নামও দেয় উদাহরণ।

যে কবিতাটা নরেনকে দিয়েছিলাম আমার কাছে তার কোন কপি রাখা ছিল না। লেখা যে কপি রেখে দিতে হয় আমি তা জানতাম না। এই বোধ এল অনেক পরে–যখন আমার প্রায় তিনশো পাতার–পথ হারা পথিক’ নামের একটা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলে ছিল ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকার সম্পাদক আফিফ ফুয়াদ। সাতষট্টি সালে একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে ফারাক্কা নিউ জলপাইগুড়ি দার্জিলিং গৌহাটি হয়ে–লক্ষ্মেী পর্যন্ত গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ বিনা খরচায়। একটা নয়া পয়সা কাছে ছিল না। সেই বিচিত্র ভ্রমণ কাহিনি দিয়ে সাজিয়ে ছিলাম ওই উপন্যাসের অঙ্গ। স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে সেই ভ্রমণ কাহিনীর অল্প কিছু আমার অনেক পরে লেখা চণ্ডাল জীবন’ উপন্যাসে রেখেছি।

প্রায় কুড়ি বছর পরে একদিন দেখা হল নরেনের সাথে আমি ওকে চিনতে পারিনি, নরেনই চিনল আমাকে। নরেন আমাকে খাস খবরে দেখেছে। জেনেছে সেই কবেকার হাতে তুলে নেওয়া কলমটা, বহু ঝড় ঝাঁপটার পরেও–আজো আমি ছাড়িনি–ধরে রেখেছি।

তখন সে উদাহরণ পত্রিকার কথা বলে! জানতে চায় সেই কবিতাটা আমি পরে অন্য কোন কাগজে দিয়েছি কিনা। আমার সে কবিতার কথা কিছু মনে নেই। কিন্তু দেখি সেইনা ছাপা কবিতার একটা লাইন আজো মনে করে রেখে দিয়েছে নরেন–তুমি হাসতে পারলে, আমি পারতাম আত্মহত্যা করতে।

এরপর নরেনের সাথে যাদবপুর কফি হাউসে গিয়ে দেখি সেখানে আড্ডা মারা তরুণ লেখক কবি অভিনেতা সবাই এই না ছাপা কবিতার কবির নাম জানে জানে তার অদ্ভুত জীবনের বহু বিচিত্র–বর্ণময় কথা ও কাহিনি। বলেছে-নরেনই। বুঝতে পারি শারীরিক ভাবে আমি এখানে না থাকলেও উদাহরণ উপকথার কেন্দ্রে অবশ্যই ছিলাম।

এই নরেনই একদিন বিজয়গড়ের নিরঞ্জন সদনে–উদাহরণ নাট্য গোষ্ঠিরনাট্য উৎসবে ২০০৭ সালে সম্বর্ধনা-মানপত্র দেয়।

পরে রানাভুতিয়া–কাটিপোতা নামে এক গ্রামের আর একজন যুবকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়–তার নাম উত্তম পাঁজা। তাদের পাড়ায় প্রতি বছর খুব ধুমধাম করে জগদ্ধাত্রী পূজা হয়। পূজা উপলক্ষে মেলা–কুড়িদিন ধরে নাট্য প্রতিযোগিতা হয়। জলাভূমি নামে একটা পত্রিকাও প্রকাশ করে তারা। উত্তম পাঁজা প্রতি বছরই আমাকে ধরে নিয়ে মঞ্চে বসিয়ে মালা মানপত্র স্মারক দেয়।

কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়, অজিত পাণ্ডে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, নবনীতা দেবসেন এদের মতো স্বক্ষেত্রে মহান মানুষদের পাশে বসার সৌভাগ্য হয় এই মঞ্চে।

আমার প্রথম বই বৃত্তের শেষ পর্ব’ বের হয়েছিল ২০০০ সালের বই মেলায়। তার ছয় বছরের মাথায়–এবারের বই মেলায় এক সাথে বের হল দুটো বই। ‘জিজীবিষার গল্প’ আর ‘অন্য ভুবন’।

অন্য ভুবন উপন্যাস কী ভাবে প্রকাশিত হয় সে আমি আগে বলে দিয়েছি। একটু জিজীবিষার গল্পের কথা বলি। এতেও বাইশটা গল্প আছে। এই সংকলনের একটা গল্পের নাম ফোটোজনিক। যার মুখ্য চরিত্র এক ভিখারিনী মা। ঠিক জানা যায়না যে সেই অল্প বয়েসী মায়ের মাতৃত্ব সামাজিক বিচারের বৈধ না অবৈধ। তবে তার কোলে যে হাড়গিলে শিশুটি, তাকে দেখতে মানুষের বাচ্চার মতোই। যার পেট আছে, সে পেটে খিদে আছে। বাচ্চাটা খিদের জ্বালায় কাঁদলে মা তার মুখে গুঁজে দেয় উদোম একটা স্তন। যে স্তন কামুক পুরুষকে বড় পীড়া দেয়, উত্তেজিত করে।

ঠিক সেই সময় সেখানে উপস্থিত এক ফোটোগ্রাফার অতীব পেশাদারি দক্ষতায় সেই দুর্লভ ছবিখানি ক্যামেরা বন্দী করে নেয়। যে ভিখারিনীকে কেউ একটাকা দেবে না, তারই ছবি একদিন বিক্রি হয়ে যায় অনেক দামে। যেদিন ফোটোগ্রাফার অনেক টাকা পুরস্কার নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে, সেইদিনই না খেয়ে পথে পড়ে মরে যায় ভিখারিনী মা।

একটা গল্পের নাম–রীবাজ, এ এমন এক অরাজক অন্ধকার প্রদেশের গল্প, সেখানে উচ্চবর্ণ দ্বারা নিম্নবর্ণের মানুষকে নিপীড়নের হাজার রকম পন্থা চলে আসছে অনেক বছর ধরে। যার একটা-যদি কোন নিম্নবর্ণ বিয়ে করে বউ নিয়ে আসে, বউকে প্রথম তিনরাত উচ্চবর্ণের গৃহে পাঠিয়ে শুদ্ধ করে আনতে হবে।

একবার জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে শহরে যাওয়া এক ট্রাকে সওয়ার হয়ে বসেছিল একটা ছেলে। কয়েক বছর সেখানে কাটিয়ে সে বুঝে যায় যে শুদ্ধিকরণ আসলে একটা ভাঁওতা দিয়ে নিম্নবর্ণের বউদের ভোগ করা।

সে গ্রামে ফিরে এই প্রথার বিরোধ করে। নিজের বউকে কিছুতেই পাঠাতে রাজি হয়না ব্রাহ্মণ পূজারির কাছে। সে একা ছিল এবং দুর্বল। বুঝতে পারে তার পক্ষে এই অন্যায় বন্ধ করা অসম্ভব। তাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় বউ নিয়ে। যাবার আগে খুন করে যায় বাওন দেওতাকে।

আর একটা গল্পের নাম–মানুষের মুখ। একজন তোক শহরে পঁচিশ বছর ধরে রিকশা চালিয়েছে। তখন কতো মানুষকে সে রিকশায় চাপিয়েছে কতো বাচ্চাকে নিয়মিত পৌঁছে দিয়েছে স্কুলে। যাদের কেউ কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উকিল অফিসার কত কি হয়ে গেছে। সেই নিয়ে তার গর্ব–অহঙ্কার।

একদিন এক দুর্ঘটনায় একটা পা ভেঙে গেল তার। পঙ্গু হয়ে গেল সে চিরদিনের মতো। সেদিন সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল–কেউ তার খোঁজ নিচ্ছে না, কেউ মনে রাখেনি তাকে। সে এতকাল এক মিথ্যে অহঙ্কারের হাওয়া ভরা বেলুনে ভেসে যাচ্ছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতেই স্বার্থপর দুনিয়া তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

একটি গল্পের নাম কলমকার। এই গল্পের নায়ক একজন ঝাড়ুদারসে স্কুল ম্যাগাজিনে একটা গল্প ছাপতে দেয়। যখন দেখা যায় তার লেখাটা স্কুলের সব শিক্ষক বা অফিসস্টাফের চাইতে ভালো লেখা হয়ে গেছে, সবাই মিলে পিছনে লাগতে থাকে তার শত্রুতা করা শুরু করে দেয়। তাদের একটাই রাগ-ঝাড়ুদার মাস্টারদের চেয়ে এত ভালো কেন লিখবে, যাতে তাদের অপমান হয়।

একটা আছে যুদ্ধ বিরোধী গল্প, যার নাম–নিছক মোরগ লড়াই। মানুষ দুটো নিরীহ মোরগকে নানারকম ট্রেনিং দিয়ে হিংস্র করে তোলে। আর তার পায়ে ধারালো চাকু বেঁধে নামিয়ে দেয় লড়াইয়ের ময়দানে। তখন সে তারইমতো আর একটা মোরগকে মারে যার সাথে তার কোনকালে কোন শত্রুতা ছিল না। এই মরা আর মারার খেলায় তাদের কারো কোন লাভ নেই।

এই রকম গল্প ঘিরে সাজানো থাকে একশো নব্বই পাতার বই–জিজীবিষার গল্প। এই সময় একদিন পথেই পরিচয় হয়ে গেল একজন অসাধারণ–বাউলমন, লেখক মানিক মণ্ডলের সাথে। সে এমন এক মানুষ যে দিনের পর দিন চান করে না, খায় না ঘুমায় না। পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। মাথার চুল-দাড়ির চেহারা দেখলে পাগল বলে মনে হয়। তবে মানুষটা বড়ই গুণী। রাজা থেকে ফকির সবার সাথে তার চেনা।

যেদিন তার সাথে তার বাসায় গেছি, আমার সব কথা শুনে বলে সে, দাঁড়াও তোমার একটা টি.ভি.র প্রোগ্রাম করিয়ে দিই। আর তখনই কাকে যেন ফোন করে। এর আধঘন্টা পরে এসে গেল তার এক বন্ধু যার নাম অমিত ঘোষ। কথা বলল আমার সাথে। এরই দিন কয়েক পরে একটা পুরো ইউনিট লাইট ক্যামেরা নিয়ে চলে এল আমার বাড়ি। তিন চারদিন ধরে চলল শুটিং। কিছু কথা আমাকে দিয়ে বলানো হল, কিছু কথা আমার চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা বলল। প্রায় দশবারো জন অভিনয় করে নানা চরিত্রে। তৈরি হয়ে গেল একটা তথ্যচিত্র যার নাম সাধারণ-অসাধারণ।

আধ ঘন্টার এই প্রোগ্রাম এরপর আকাশ বাংলা চ্যানেলে পরপর তিনবার দেখানো হল কিছুদিন পরে। এরপর তো বলতে গেলে আমার বাড়ির দরজায় টিভি সাংবাদিকদের ভিড় লেগে গেল। অনন্যা নামের এক সাংবাদিকের দ্বারা তারা নিউজ চ্যানেল থেকে “তারার নজর” নামে আধ ঘন্টার আবার একটা প্রোগ্রাম হল। এল আকাশ বার্তার অধীর নামে এক সাংবাদিক, দিশারী কেবল চ্যানেল থেকে এলদীপান্বিতা নামের এক মহিলা সাংবাদিক।ই.টি.ভি থেকে মনিরুল নামে আর এক সাংবাদিক।

আর কিছুদিন পরে আবার এলেন–নিজে এলেন না, লোক পাঠালেন সেই দিব্যজ্যোতি বসু। তখন তিনি আকাশ বাংলা চ্যানেলে নতুন একটা প্রোগ্রাম করছেন যার নাম খোঁজ খবর। এই সময়–যত আমাকে নিয়ে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা–কৌতূহল বাড়ছিল, ততই আমার স্কুলের সহকর্মী–প্রভাবশালী লোকদের গাত্রদাহ বেড়ে যাচ্ছিল। তখন আমার মনে হতো যারা আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে–নরমাংস ভোজী চিতা হায়নার পাল। সুযোগ পেলেই যারা আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে নেবে। এত নাম কেন হবে আমার। কেন বার বার আমাকে টিভিতে দেখাবে। এতেই তাদের ক্রোধ বাড়ে।

এই রকম একদিন সাহিত্য আকাদেমি থেকে আঞ্চলিক সচিব রাম কুমার মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষর সম্বলিত একখানা চিঠি এসে পৌঁছালো আমার নামে–বিদ্যালয়ের ঠিকানায়। যাতে লেখা—’সাহিত্য আকদেমি’ জীবনতারা ভবনের নিজস্ব সভাঘরে একটি অস্মিতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এই অনুষ্ঠানে আপনি ছোট গল্প/কবিতা পাঠ করলে আমরা বাধিত হবো।

নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও যারা সাহিত্য চর্চা করছেন এবং যাদের রচনার মধ্যে নিজস্বতার ছাপ আছে তাদের রচনা শোনার জন্যই আমাদের অস্মিতা অনুষ্ঠানের আয়োজন।

আমরা আশা করবো আপনি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্মত হবেন।…আপনার সম্মতি পত্রযোগে বা দূরভাষে জানিয়ে ধন্য করবেন।”

এমন অনুষ্ঠানে যাবে না তা কী করে হয়? কিন্তু সম্মতি জানাব কী করে। সে চিঠি হাতে পাবো–পড়ব তবে তো। সে চিঠিস্কুলের ঠিকানায় কুরিয়ার মারফত পৌঁছাবার পর স্কুলের দায়িত্ববান অধিকারী শুধু সাহিত্য আকাদেমি নাম দেখেই যা বোঝার তা বুঝে ফেলেছে। তাই একটা সই করে স্ট্যাম্প মেরে চিঠি রাখতে অস্বীকার করে। আমি তখন দুপুর বেলায় বাড়ি চলে গিয়েছিলাম, ফলে চিঠি ফেরত চলে যায়।

সাহিত্য আকাদেমি চিঠি আসবে একটা তুচ্ছ রাধুনির নামে। কেন? আর কী কোন লোক ছিল না? এটা কী শিক্ষিত মানুষদের পরোক্ষে একটা অপমান নয়?

সি.এস.সি অফিসের এক কর্মচারি যাকে আমি দাদা বলে ডাকি, সেই অমরদার সাথে রামকুমার বাবুর ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। অমরদার মাধ্যমে আমার ঠিকানা পান তিনি। তখন অমরদার কাছে জানতে পারি আমার নামে যে চিঠি এসেছিল ফেরত গেছে।

অমরদার কাছ থেকে রামকুমার বাবুর ফোন নাম্বার নিয়ে ওনাকে ফোনে জানাই, কেন চিঠি পাইনি। জানাই আমি যাবো। অবশ্যই যাবো। আনন্দবাজার পত্রিকার মাধ্যমে জানালাম ওখানে কবি বিনোদ বেরা গদ্যকার আব্দুল জব্বার গল্পকার আনসারুদ্দিন থাকবে। আমি থাকব কিনা কেউ জানল না। আমার সম্মতির আগে পত্রিকার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পৌঁছে গিয়েছিল।

পরের দিনই অনুষ্ঠান। দুপুরে ফোন করে স্কুলকে জানাই, আমার জ্বর যেতে পারছি না কাজে। তারপর বের হয়ে পড়ি তারাতলার জীবনতারা ভবনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রতিকূলতা বলে কাকে। বাসস্ট্যান্ডে এসে শুনি বাস ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে আজ বাস মালিক ইউনিয়ন ধর্মঘট করে বসে আছে। ট্যাক্সি অবশ্য চলছে, কিন্তু আমার কাছে এত টাকা নেই।

হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল একটা মোটর সাইকেল। ছেলেটাকে আমি তেমন একটা চিনি না। তবে সে আমাকে চেনে। এদের টিভির দোকান আছে। ফলে অনেকবার ছবি দেখেছে আমার।

আমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি কোথায় যেতে চাই জানবার পর সে আমাকে পিছনে বসিয়ে নিল। চালিয়ে দিল মোটর সাইকেল তারাতলার দিকে। যখন জীবন তারা ভবনে পৌঁছালাম অনুষ্ঠান শুরুর মুখে। উদ্বিগ্ন অমরদা তাকিয়ে আছে আমার পথের দিকে। আমি পৌঁছাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল তার।

‘অস্মিতা’ সাহিত্য আকাদেমি অনুষ্ঠানটির এই নাম রেখেছেন। যাতে আমন্ত্রিত লেখকরা কত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সাহিত্য কর্মে ব্যাপৃত আছেন তারই কিছু উদাহরণ তুলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন সঞ্চালক রামকুমার মুখোপাধ্যায় খানিকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন আমার বিষয়ে।কতখানি অসুবিধার মধ্যে আমাকে লিখতে হয়। আর কেন আমি অনুষ্ঠানের চিঠি পাইনি।

আমার সঠিক বয়স কত আমি তা জানি না। পঞ্চাশ বা তারও বেশি যা-ই হোক মনের বয়স, কিন্তু বাড়তে দিইনি। সেটা আটকে আছে সকাল সাড়ে আটটা নটায়। যে বয়সে বুকে দাপায় সাহস আর প্রতিবাদ। যে বয়স কোন অন্যায় মেনে নিতে পারে না। সেই যে একজন দাড়িঅলা বুড়ো বলেছিল–অপরাধ যে করে আর অপরাধ যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে। এই কথা যে বয়সকে খোঁচায়-খেপায়।

আর যে এমন করে খুব স্বাভাবিক নিয়মে অন্যায়কারী দুর্বৃত্তরা তার উপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ শানাবেই। এটা শুধু যে পশ্চিমবঙ্গে হয় তা নয়–রাম রাজত্বেও হয়।

জায়গা বদল তো কম হল না জীবনে। জীবন আমাকে নিয়ে গেছে শতেক জায়গায় শত রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। হাজার লোকের সঙ্গে পরিচয়, হাজার রকম ঘটনায় জীবন পেয়েছে এমন অনেক অমূল্য রতন, যা না পেলে জীবন একটা অজ্ঞতার অন্ধকুপ হয়ে রয়ে যায়। এই পাওয়াটা যার যত তীব্র-গভীর তার ঝুলি ততোখানি পূর্ণ।

কে যেন একজন বলেছেন–এই পৃথিবী-এর পাহাড় নদী অরণ্য মরুভূমি এর জনপদ নগর বন্দর, এর জীব জগত সব কিছুকে মনে করো একটা আগাছা বোঝাই চারণ ক্ষেত্র। যে লেখক হতে উৎসুক, সে এই আগাছার মধ্যে গরুর মতো চড়ে বেড়াবে। চিনে চিনে–বেছে বেছে কচি ঘাসটি খাবে। হজম করবে, তারপর যা বর্জ গোবর বানিয়ে ফেলে দেবে। যেটি মূল পদার্থ সেটি রেখে দেবে নিজের সঞ্চয়ে। তারপর তা পবিনত হবে দুধে। দান করবে মানুষের কল্যাণে।

লেখক আর কিছু নয়–একটা গরু। সে নিজে খাবে যা সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ঘাস, আর দেবে যা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সেই দুধ।

আমার মনে হয়–আমি যেখানে চড়ছি–সেটা মাঠ, ক্ষেত, বনভূমি নয়, সেখানে ঘাসের মধ্যে একটা দুটো চিনে জোঁক একটা দুটো সাপ বিছে থাকে। এটা একটা বাঘ ভাল্লুকমুন্ড শিকারীদের বিচরণভূমি।

জীবন এক বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতার নাম। জীবন এক যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে পথ চলার নাম। যে জীবন আমি যাপন করেছি, করে চলেছি, মনে হয় যেন জীবন্ত চিতার আগুনে পোড়ানো হচ্ছে আমাকে। কোথাও কোন আলো নেই, পথের দিশা নেই। কেউ এমন নেই যার হাত ধরে দুপা হাঁটতে পারি। পড়ে গেলে যে আমাকে ঠেলে তুলবে। এগিয়ে দেবে একটু সামনে।

এটা সেই সময় যখন কালীঘাটের এক সাধারণ ঘরের অতি সাধারণ মেয়ের দৌরাত্মে পাকা মাথার ঝানু রাজনীতিবিদদের রাতের ঘুম দিনের খাওয়া উড়ে গেছে। ছয় ছয়বার চোখ বুজে নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া বামফ্রন্ট সাতবারের বেলা বুঝি ডুবেই যায়। বাসে ট্রামে ট্রেনে, হাটে বাজারে চৌরাস্তায় সবার মুখে গেল গেল রব। আর বোধহয় জেতা যাবে না। রেডিও টেলিভিশন পত্র পত্রিকা সবাই বলছে–এবার বদলে যাবে সরকার। আর পলিটব্যুরো থেকে পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত ছোট বড় মাঝারি সব নেতার বুককাঁপছে–মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষকে বোঝাচ্ছেন–চুপচাপ ফুলে ছাপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *