১০. চাকরির নিয়োগপত্র

পাক্কা এক বছর কেটে গেল আমার আশায় আশায় এই বুঝি চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পাব। মাঝে মাঝে বস্তার থেকে অনুর চিঠি আসে–তুমি কী করছো, কেমন আছো? আমি যে আর সংসার চালাতে পারছি না। জিনিসপত্রের দাম-ছেলে মেয়ের পড়ার খরচ বেড়ে গেছে। আমার এই সামান্য পয়সায় কী চলে!

জবাবে আমি লিখি–অনেক কষ্ট করেছে, আর কয়েকটা মাস ধৈর্য ধরো। জুন মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত দেখব। তার মধ্যে কিছু না হলে আমি বস্তারে ফিরে যাব। তারপর যা হয় হবে।

জুন নয় এপ্রিলেই নিয়োগপত্র পেয়ে গেলাম। অর্থাৎ চাকরিটা হয়ে গেল আমার। চাকরি তো হল, কিন্তু বেতন আর হয় না। শেষে প্রায় পাক্কা এক বছর পরে মাসে আড়াই হাজার টাকা হিসাবে পুরো মাইনে পেয়ে গেলাম।

প্রথম বছর–ওটার কোনো হিসেব নেই। ওটা গেছে স্বেচ্ছাশ্রম। পরের বছরের তিরিশ হাজারের বাইশ হাজার কেটে নেওয়া হল দান হিসাবে। আমার একার নয় প্রত্যেক কর্মচারির কারো বিশ কারো পঁচিশ হাজার এইভাবে কাটা হয়েছে চাকরি দানের প্রতিদানে। সবার মতো আমিও বধির বিদ্যালয়-এর সভাপতির সই করা একখানা বিল পেলাম সংগ্রহে রাখার মতো।

দান করতে হবেই এটা তার নির্দেশ। সে নির্দেশ অমান্য করবে এই স্কুলে এমন বুকের পাটা কার? এবং কে কত স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে দান করবে সে উনি নামে নামে লিস্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শুধু এই নয় এরপর থেকে যখনই বেতন হবে বধির বিদ্যালয়ের উন্নয়ন, মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল, নির্বাচনী তহবিল–যখন যে কাজে যত টাকা দানের দরকার উনি নির্দ্বিধায় লিখে দেবেন আর সবাই হাসিমুখে দান করে যাবে।

বাইশ বাদ দিয়ে আমার আর যে আট হাজার থাকে তা থেকে কিছু গেল প্রভিডেন্ট ফান্ডে কিছু গেল প্রফেশনাল ট্যাক্সে আর কিছু কেটে নেওয়া হল আমি যে এতদিন এখানে খেয়েছি তার মূল্য বাবদ। দীর্ঘ প্রায় দু বছর বাদে পারিশ্রমিক পেলাম মাত্র দু হাজার টাকা।

এক হাজার নিজের কাছে রেখে এক হাজার পাঠিয়ে দিলাম অনুকে মানিঅর্ডার করে পরের দিন দুপুরে। আর রাতের বেলায় গোটা ছয়েক বোবা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্ডেন এল আমার কাছে।

আমার এই দীর্ঘ জীবনে বহু মানুষ দেখেছি। জেলে ছিলাম তাই চোর ডাকাত খুনিও কম দেখিনি। কিন্তু এই ওয়ার্ডেনের মতো খল ধূর্ত নিষ্ঠুর মানুষ একজনও দেখিনি। আর সবচেয়ে যেটা মজার যে মানুষটা মানুষের অনিষ্ট ছাড়া কোনদিন কিছু ভাবলো না, সে এক কমিউনিস্ট দলের সদস্য। এই যদি কমিউনিস্ট দল হয়, এর চেয়ে ফ্যাসিস্ট মনে হয় ঢের ভালো। তারা অন্তত আদর্শের দোহাই তো দেয়না।

তখন আমার রান্নাঘরের পাশের ছাদটায় অন্ধকার। ওয়ার্ডেনের হাসি হাসি মুখের ধূর্ত রেখাগুলো দেখা যাচ্ছে না। বলে, তাহলে এতদিন পরে সব প্রতীক্ষার অবসান, কী বলেন? এবার মাসে মাসে মাইনে পাবেন। আজ আপনার খুব আনন্দের দিন। তাই কীনা? আমরা এই বাচ্চাদের নিয়ে থাকি। এদের জন্যই আমাদের চাকরি। বাচ্চাগুলো ধরেছে, যেটা কোনো অন্যায়ও নয়, বলছে, ওদের একদিন একটু ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম। আমি কেন বলব? ওদের কথা ওরাই আপনাকে বলুক!

ওয়ার্ডেন একা নয় সাথে হাউ হাউ করে বাচ্চারাও বলছে তাদের দাবির কথা। আগে ভাগে তাদের যথেষ্ট পরিমাণে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা হয়েছে যে। আর ওয়ার্ডেন মাঝে মাঝে এটাও বলতে ভুলছে না যে বড় সাহেব বাচ্চাদের খাওয়াতে বলেছেন। না খাওয়ালে তিনি রাগ করবেন। বড় সাহেবের রাগ যে কী ভীষণ তা সেই জানে যার উপর তিনি অতীতে রেগেছেন।

বুঝতে পারলাম এই লোকটা একবার যখন পিছনে পড়ে গেছে–রেহাই দেবে না। তার সামনে এখন ঢাল হয়ে আছে বোবা বাচ্চাদের একটা বড় সড় দল।

কিছুদিন আগে সম্ভবত ধ্রুবপদ পত্রিকায়, একটা লেখা পড়েছিলাম। লিখেছেন একমাস্টারমশাই। যিনি তিরিশ বছর কোনো এক বোবাদের স্কুলে চাকরি করেছেন। তিনি তার চল্লিশ পঞ্চাশ পৃষ্ঠা লেখার মধ্যে একটা লাইনও এমন লেখেননি যাকে প্রশংসাসূচক বাক্য’ বলা যায়। তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, পড়ে মনে হতে পারে এরা অতি হিংস্র নির্দয় স্বার্থপর আক্ৰামক একতাবদ্ধ এক অদ্ভুত প্রজাতির জীব। যারা কথা বলে, তাদের কথা বলা হাসা তাকানো সব কিছুকে এরা সন্দেহের চোখে দেখে এবং তাদের শত্রুপক্ষ মনে করে। সেইদিন যেদিন এদের আমি নিজের পয়সায় খাওয়াতে গিয়েছিলাম টের পেয়েছিলাম দুর্বুদ্ধিতে এরা কারো চেয়ে কম নয়, বরং কিছুটা বেশি।

কথা হয়েছিল আমি পরোটা আর ডিমের কারি খাওয়াব। তখন স্কুলে ছোট বড় মিলিয়ে গোটা সত্তর বাচ্চা। আমার হিসেব মতো দশ কিলো ময়দা আর গোটা আশি ডিম কিলো দশ বারো আলু যথেষ্ট। এর সাথে কিলো তিনেক ডালডা আর কিছু তেল মশলা। সব জোগাড় করে এনেছিলাম আমি। ডিমের কারি তো আগে তৈরি করা হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল লুচি ভাজা। রাত আটটায় স্কুলের ছাদে খেতে বসল প্রথম জনা তিরিশ বাচ্চা। তখন আমি লুচি ভাজছি আর লুচি বেলে দিচ্ছে আমার জোগাড়ে। পরিবেশন করতে থাকে বাচ্চারাই, নিজেরা। কিন্তু এ কী? লুচি ভাজছি তো ভাজছি, ভাজছি তো ভাজছি, প্রথম ব্যাচ আর ওঠে না। বার বার তাগাদা আসছে লুচি, লুচি কই? আমি তো কড়াইয়ের কাছে বসে আছি, ওদিকে কী খেলা চলছে কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। যখন প্রথম ব্যাচের খাওয়া শেষ হল ময়দার তিনভাগ উড়ে গেছে। ডিমের কারিতে ডিম আর নেই পড়ে আছে শুধু কারি। তাই ব্যাগ নিয়ে আর একবার দৌড়ালাম দোকানে।

জীবন তো আসলে এক অভিজ্ঞতার আঁধার। এই জীবনে যে কত কিছু শিখলাম কতভাবে মানুষকে চিনলাম। যদি জীবনে সবচেয়ে কাউকে ভালোবেসে থাকি তা বেসেছি মানুষকে। পাহাড় নয় নদী নয়, সোনালি ফসল ভরা ক্ষেত নয়, পাখির সুমধুর গান নয়, সবুজ অরণ্য, সুমিষ্ট ফলভারে নত বৃক্ষ নয় শুধু মানুষ আর মানুষের যা কিছু প্রিয় এবং প্রয়োজনীয়। মানুষের চেয়ে মূল্যবান আমার কাছে আর কিছু নেই। আবার সবচেয়ে যদি কারো ব্যবহার আমাকে ব্যথিত পীড়িত ক্রুদ্ধ করে থাকে যদি কাউকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত দুষ্ট ধূর্ত মনে হয় সেও ওই মানুষকেই হয়েছে।

আমি সেই বাপের সন্তান যে মাসের পর মাস না খেয়ে কাটিয়েছে। তবু ঘরে যেদিন উনুন জ্বলত আর কিছু ভালোমন্দ রান্না হতো, রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত কোনো একজন অতিথির আশায়। মানুষকে খাইয়ে সে এত আনন্দ পেত যা নিজে খেয়ে পেত না। সেই আমি সেদিন একদল মানুষের বক রাক্ষুসে খাওয়া, আর খাদ্যের অপচয় দেখে জীবনে কোনোদিন উচ্চারণ করার মানসিক সাহস ও শান্তি পাই না যে, অতিথি দেবঃ ভবঃ।

পরের সেই ব্যাচও আগের ব্যাচের মতই খেয়েছিল। যতটা খেয়েছিল তার চেয়ে নষ্ট করেছিল ঢের বেশি। কিছু পাচার করেছিল আমার নজর বাঁচিয়ে নীচে ওদের শোবার খাটের তলে, পরের দিন খাবে বলে। আর যেটা সবচেয়ে জঘন্য সবচেয়ে নিন্দনীয় ছাদ থেকে গোছা গোছ লুচি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল নীচে, স্কুলের পিছনের এক পচা ডোবায়। পরের দিন সকালে আলো ফোঁটার পর সে দৃশ্য দেখে কেন কে জানে বুকটা মুচড়ে উঠেছিল আমার। দিনের পর দিন মাসের পর মাস খেতে পাইনি। খাদ্য আমার কাছে ভগবান। তার এত অনাদর?

সমস্যাটার এখানেই শেষ হল না। লুকিয়ে রাখা সেই বাসি লুচি খেয়ে পরদিন বিকেল থেকে প্রায় তিরিশ পঁয়ত্রিশটা বাচ্চার শুরু হয়ে গেল বমি পায়খানা। রাত যত বাড়ে তত বাড়ে পায়খানার সামনে লম্বা লাইন। দশ বারোজন তো শুয়ে পড়ল বিছানায়। চারজনের অবস্থা সংকটজনক হয়ে উঠল। নুন চিনির ঘোল খাইয়েও তাদের ঠেকানো গেল না। ডাক্তার ডাকতে হল।

এমনিতে এইসব বোবা বাচ্চারা আমার উপর সন্তুষ্ট নয়। ওরা একটা পেঁয়াজ দুটো কাঁচা লঙ্কা একটু তেল চাইলে দিতে পারি না। কি করে দেব? হোস্টেল সুপার যা মাল মশলা দেয় তা যথেষ্ট কম। সে দিয়ে দিলে রান্না কী করে করব? একজনকে দিলে অন্যরাও চাইবে। যাকে না দেব সে রেগে যাবে। এই কারণেই দিই না।

এবার সেই অসন্তুষ্টির আগুনে খানিকটা ঘি ঢেলে দেয় বাল্যবন্ধু। আরে বোকা বুঝতে পারছিস তোদের পেট খারাপ কেন হল! তোরা বা কি করে জানবি আমি ডাক্তারি লাইনের লোক আমি জানি। তোদের খাবারে খইনি ফেলে দিয়েছে। বড় সাহেব কইছে তগো খাওয়াইতে হইবো। পকেট থিক্যা টেকা যাইতেছে আছে, সেই রাগ।

শাস্ত্রে শব্দকে বলা হয় ব্রহ্ম। যে শব্দ থেকে বঞ্চিত সে ব্রহ্মা থেকে বঞ্চিত। বোবা বাচ্চাগুলো বড় অভাগা। ওরা কোনদিন শোনেনি কোনো মন্ত্র কোনো স্তব কোন কবিতা কোন সঙ্গীতের সুমধুর সুর। মনের সুকুমার প্রবৃত্তির অর্গলমুক্ত করা শ্ৰব্য মাধ্যম থেকে বহুদূর জগতের এই বাসিন্দাদের বুদ্ধি বৃত্তির উপর তাই জমে গেছে একটা পুরু প্রলেপ। যা ভেদ করে কোনো সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে গেছে। সেখানে যা প্রবেশ করে তা অতীব স্থূল কদাকার কিছু বিষয়। আর যা একবার প্রবেশ করে, তাকে নিষ্কাশন কঠিন কর্ম।

এই সহজ সত্যের পথ ধরে বোবা বাচ্চারা বিশ্বাস করে নেয়, আমি খইনি ফেলে দিয়েছি। আমি খইনি খাই, আমার কাছে খইনি থাকে সেটা তো জানে। তাই খেপে যায় তারা আমার উপর।

কৃতজ্ঞতা–এই শব্দটা প্রতিবন্ধী অভিধানে বড় রুগ্ন, অপুষ্টি আক্রান্ত। সে শব্দ এদের মনে কোনো আঁচড় কাটে না। বাবা ভাই বোন পাড়া-প্রতিবেশী সমাজ দেশ রাষ্ট্র সব এদের চোখে প্রতিপক্ষ। শত্রু। যা চেয়েছিল ওয়ার্ডেন যা চেয়েছিল বাল্যবন্ধু এবং আরো অনেকে তাই হয়ে যায়। একমুহূর্ত বদলে গেল পুরো পরিবেশ। মনে হল আমি যেন একঅগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হলাম। চারপাশে দাউ দাউ লেলিহান শিখা। কেউ আমার পাশে নেই, আমি একা পুড়ছি আর পুড়ছি। রাবণের চিতার মতো এ আগুন জ্বলতেই থাকবে। যখনই একটু নিভু নিভু হয়ে আসবে কেউ না কেউ চিতায় একটা কাঠ গুঁজে দেবে।

ভারতবর্ষের পাশের দেশ চীন।দু দেশের মধ্যে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। সীমান্তে কী এক ভুল বোঝাবুঝিতে মাত্র দুটো গুলি চলেছিল দু’দেশের মধ্যে। তাতেই উড়ে গেছে হাজার বছরের বন্ধুত্ব। এরপর পঞ্চাশ-ষাট বছর কেটে গেছে তবু সেই ফাটল আজো জোড়া লাগেনি।

আমার আঠারো-কুড়ি বছর হয়ে গেল বধির বিদ্যালয়ে। সেদিন যারা বমি পায়খানা করেছিল তারা আর কেউ নেই। তবু যারা নতুন এসেছে তারাও কোনো কারণে পেট খারাপ হলে আঙুল তোলে আমার খইনির দিকে।

***

একবার টিচার ইনচার্জ স্কুলে বড় বেইজ্জত হয়েছিলেন। সেটা অবশ্য অন্যসব লোকের ধারণা, যা ঘটেছিল তাতে নাকি তার মানহানি ঘটেছিল। তবে এটা একান্তই ব্যক্তি বিশেষের মানসিক গঠনের উপর নির্ভর করে। যেটাতে একজন অপমান বোধ করে আর একজন নাও করতে পারে। ওয়ার্ডেন বলে, সম্মান কোনো কাঁচের বাসন নয় যে টোকা লাগলে ভেঙে যাবে। সম্মান হচ্ছে লোহা, সম্মান হচ্ছে ইস্পাত যা সহজে নষ্ট হয় না। নষ্ট হয় যদি সে নিজে অপমানিত বোধ করে।

হক কথা, মূল্যবান কথা ওয়ার্ডেনের। এক বদমায়েস বলেছিল–কী বলব দাদা, মারতে মারতে জুতো ছিঁড়ে ফেলেছিল তবু আমি অপমানবোধ করিনি।

আবার কখনো কখনো অপমানও ফিরে আসে মহা সম্মান হয়ে। ঘটনাটা আমার জানা। আমি তখন বস্তারে থাকি। মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলার জেলা শাসক ছিলেন ড. ব্রহ্মদেও শর্মা। এই জেলা তেন্দুপাতা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। যে পাতায় বিড়ি বানানো হয়। এই বিড়ি পাতার মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে ড. শর্মার সঙ্গে তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং-এর সাথে বিরোধ বাধে। অর্জুন সিংয়ের মনে হয় একশো বান্ডিল পাতা ভাঙার মজুরি বারো টাকা দিয়ে ঠিকাদাররা কোনো অন্যায় করছে না। ড. শর্মার মনে হয় ঠিকেদাররা ভোলাভালা আদিবাসী মানুষগুলোর সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকাচ্ছে। দু জনার বিরোধ চরমে উঠলে ব্রহ্মদেও শর্মা চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। এবং বস্তার জেলার আদিবাসীদের সংগঠিত করে গড়ে তোলেন ভারত জন আন্দোলন নামে এক সংগঠন। এই আন্দোলনে অন্য বহু সংগঠন যোগ দেয়। বিশেষ করে ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা ও জনযুদ্ধ গোষ্ঠী। জল জঙ্গল জমিন হো জনতাকে অধীন এই দাবিতে সে আন্দোলন বস্তার ছাড়িয়ে মধ্যপ্রদেশের সব জেলায় বিস্তৃতি লাভ করে। এই আন্দোলনের ফলে তেন্দুপাতার উপর থেকে ঠিকেদারি প্রথা খতম হয় এবং ধাপে ধাপে মজুরি বেড়ে যারো থেকে পঞ্চাশ টাকা হয়ে যায়।

এটা ঠিক যে অর্জুন সিং কংগ্রেস নেতা এবং সে তেন্দুপাতার মজুরি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে। কিন্তু সাথে সাথে এটাও ঠিক যে ঠিকাদাররা কেউই কংগ্রেস নয়, তারা আগে ছিল জনসংঘ এবং এখন বিজেপি। এদের একটা বড় ঘাঁটি আছে। বস্তার জেলার সবচেয়ে বড় শহর জগদ্দলপুরে। এরা বিড়ির পাতার ঠিকেদারি সমাপ্ত হওয়ায় এবং ভারত জন আন্দোলনের মাধ্যমে আদিবাসী মানুষকে সচেতন সংগঠিত করায় ব্রহ্মদেও শর্মার উপর সন্তুষ্ট ছিল না। একদিন এরা নাগালে পেয়ে গেল ড. শর্মাকে। সে ছিল একা এরা ছিল অনেক। তারা ড. শর্মাকে ধরে তার জামা-কাপড় সব ছিঁড়ে গায়ে গোবর জল ঢেলে চোরের মত কোমরে দড়ি বেঁধে সারা শহরময় ঘোরালো। পরের দিন তার নগ্নদেহ সহ ছবি সংবাদ ছাপা হল মধ্যপ্রদেশের সবকটা বড় কাগজে। দিল্লি বসে সে খবর পড়লেন আর্য সমাজি নেতা স্বামী অগ্নিবেশ। তারপরই তিনি চারশো অনুগামী নিয়ে দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ধর্ণায় বসে পড়লেন সংসদ ভবনের সামনে। যে ব্রহ্মদেও শর্মার অপমানে বস্তার জেলার বিজেপি বড় আনন্দ পেয়েছিল সেই বিজেপির সর্বোচ্চ নেতা অটলবিহারী তাদের কর্মীদের অসদাচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন পুনবার এমন ঘটনা না ঘটার। ব্রহ্মদেও শর্মা যে ঘটনায় অপমানিত হয়েছিলেন সেই ঘটনাই তাকে পৌঁছে দিয়েছিল গান্ধীতুল্য সম্মানের আসনে।

“সম্মান কোনো কাঁচের বাসন নয় যে ঠোকর লাগলে ভেঙে যাবে। সম্মান তো একইস্পাতের মুকুট যা নিজে থেকে না ভাঙলে কেউ তাকে ভাঙতে পারে না।” টিচার ইনচার্জ সে সম্মান ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। এটা ঠিক যে তাকে নিয়ে লোকে হাসাহাসি করে নোংরা আলোচনা করে। তাতে কি যায় আসে? দুনিয়াকে হামাম মে হাম সব নাঙ্গা হ্যায়। পৃথিবীর স্নান ঘরে সব মানুষই ন্যাংটা। তফাৎ এই যে, যার চাল ঝড়ে উড়ে গেছে তাকে কেউ কেউ দেখে ফেলেছে। তবে তার চিন্তার কারণ অন্য, স্কুলের বোবা বাচ্চারা যাদের বয়েস কুড়ি বাইশ বা তার বেশি তারা যেন কেমন এক বিচ্ছিরি নজরে আজকাল তাকে দেখে। মনে হচ্ছে, অতো যে ভয় পেতো সম্মান দিতো কোথায় যেন একটা ফাটল ধরেছে। মনে হচ্ছে ওরা বোধহয় কথা বলা লোকদের মানসিক অসুখে সংক্রামিত হয়ে পড়েছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়–কয়েক দিন আগে এক সেভেন পড়া ছাত্রকে সেভেন পড়া বাচ্চা’ ভেবে পড়া না পারার জন্য চড় মেরেছিলেন তিনি। তখন তার মনে ছিল না যে সে অনেক দিন আগে কুড়ি পার করে দিয়েছে। চড় খেয়ে সে আগে যা করেনি সেদিন তাই করল। এমন ঝটকা দিল বড়দির হাতে যে সেই হাত ঘুরে নিজের গালে লাগলো। চোখ থেকে আটশো টাকা দামের চশমা পড়ে খান খান। আর কুড়ি নয় কিছু কম বয়েসের অন্য একটা ছেলে একদিন যা করল সে তো এর চেয়ে খারাপ, চিন্তার অতীত নিন্দার অতীত।

এখানে যেসব ছেলেমেয়ে থাকে সেই সব প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্য কোনো কোনো ব্যক্তি সংস্থা সেবা প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের খেলনা, খাবার দাবার, জামা কাপড়, কম্বল এসব দিয়ে যায়। দান ভারতীয় সংস্কৃতিতে একটা পুণ্যের কাজ। কিন্তু দাতাদের অনেকের জানা নেই, এখানকার সব বাচ্চা গরিব নয়। কেউ কেউ তো এমন ঘরের সন্তান, যে ঘরের সদস্যদের চোখে দান দাতাই এত দুঃস্থ যে সেই দান পাবার যোগ্য। কিন্তু তাদের সন্তান এখানে সে ধনাত্তপ দর্শাতে পারে না। থাকে হীন দীন বালকদের মতই। দীন হীনদের মতই অপরের অনুগ্রহ হাত পেতে নেয়। আর সবাই যে এমন তুচ্ছ নগণ্য কমদামি দান দিয়ে বড় সাহেবের নেক নজরে থাকতে চায় তা নয় কেউ কেউ বিশেষ করে বিদেশি কিছু সংস্থা যে সব খেলনা খাবার শ্রবণযন্ত্র দিয়ে যায়, তা সত্যিই খুব দামি। তারা এগুলো বড়দির কাছে জমা দিয়ে আশা করে যে সময়মতো বধির বাচ্চাদের কাছে ঠিক পৌঁছে যাবে। পৌঁছে যায়, তবে সবটা নয়, কিছু কিছু। আর বাকিটা টিচার ইনচার্জ তার পছন্দের কিছু কিছু শিক্ষক শিক্ষাকর্মীকে ভাগ করে দেন। কিছুটা ব্যাগে ভরে স্বদেশে নিয়ে যান দান করবেন বলে। এটা তার রুটিন কাজ। সবদিনই তিনি এটা করে থাকেন। স্কুল মাস্টারির চাকরিতে কি বা এমন মাইনে? যা কিছু দু পয়সা তা এই পথে আসে। কানে শোনার একটা মেশিন ছয় সাত হাজার টাকা দাম। প্রতি মাসে গোটা চার ছয় নিয়ে গিয়ে ধরা দোকানে বেচতে পারলে মোটামুটি পুশিয়ে যায়। সদ্য সদ্য উনি একটা গাড়ি নিয়েছেন, তার মেনটেন্টে খরচা কি কম! এ সব না করলে তা আসবে কোথা থেকে?

অভ্যাস মত সেদিন তিনি ছুটির পরে নিজের অফিস ঘরের দরজা ভেজিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন। অফিসে বড় বড় চার ছটা আলমারি আছে। যে যা দান করে যায় তা ওই সব আলমারিতে সযত্নে রক্ষিত থাকে। তা থেকে কিছু কিছু ব্যাগে ভরে নেন। অনেক দুরে বাড়ি ওনার বাস তারপর ট্রেন তারপর আবার বাস বাসে ট্রেনে আজকাল খুব ভিড়। খুব বেশি ভারি ব্যাগ বহন করা কষ্টকর, তাই অল্প অল্প বহন করেন। এতে কষ্টটা কম হয়ে যায়, নরম কোমল মহিলা দেহ ধকল পায়না। কিন্তু সেদিন বোধহয় ব্যাগটা একটু বেশি ভারি হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বস্ত দারোয়ান বিহারির দরকার পড়েছিল ব্যাগটা বাসে তুলে দিয়ে আসার জন্য। কে জানে সেই বিশ্বস্ত দারোয়ানই বেইমানি করলো, নাকি বোবা বাচ্চাদের বদমায়েশি। একটু পিছিয়ে পড়ে ছিলেন টিচার ইনচার্জ আগে যাচ্ছিল বিহারি। হঠাৎ বড় গেটের সামনে তার পথ আটকে দাঁড়ালো কটা বোবা ছেলে। কি সাহস! বিহারির বার বার ‘মেরা নেহি এ বড় দিদিমণি কা ব্যাগ’ বলা সত্ত্বেও খুলে ফেললো সেই ব্যাগের চেন। তখন বড় লজ্জায় পড়ে যেতে হল স্কুল টিচার ইনচার্জকে। ওরা শুধু বোবাই তা নয়, বোকাও। কিছুতে এদের বোঝানো গেল না যে এটা চুরি নয়। তবে স্কুলের কর্মচারিদের সেটা বোঝাতে পেরেছিলেন।

চুরি কাকে বলে? চুরি হচ্ছে পরের দ্রব্য না বলিয়া নেওয়া। লক্ষ্য করার বিষয় এখানে পরের দ্রব্য বলা হয়েছে। কিন্তু যে দ্রব্য নিজের তা নিয়ে যাওয়াকে কোনমতে চুরি বলে না। আর বলতে চাইলে বা কাকে বলবেন, উনিই তো সর্বেসর্বা, তাহলে তো নিজের কানে নিজেই বলতে হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে উনি নিজের দ্রব্য নিজে নিয়ে যা করেছেন সেটাকে আর যা বলা হোক, বাচ্চারা যা বলছে তা নয়। খুব বেশি হলে এটা বলা যেতে পারে যে স্কুলের বাচ্চাদের না দিয়ে উনি অন্য কাউকে এসব দিতে চেয়েছিলেন। সেটা প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটা ভুল হতে পারে কিন্তু চুরি কি করে হবে? ভুল আর চুরি কি এক? ভুল কার না হয়? এবং এই স্কুলে তো সবারই ভুল হয়। যার যেমন ক্ষমতা সে সেই অনুসারে ভুল করে থাকে। যার উপর সবজি বাগানের ভার সে ভুল করে লাউটা মুলোটা হোস্টেলের রান্না ঘরে না পাঠিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। যার উপর বাজার করার ভার বারোটাকা কিলোর চাল কিনে ভুল করে ষোল টাকা লিখছে। যার উপর স্কুলের পাখা, লাইট, চেয়ার-টেবিল কেনার বা মেরামতির ভার সে তত ভুল পাহাড়ের উপর বসে আছে। ভুল বাদ দিলে এখানে মানুষই খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে একা আমার ভুল কোথায়? একথায় সবাই ম্যাডাম কি বলছেন তা বুঝে নেয় এবং খুব হাসে। তবে মুখ টিপে।

এখন সেই টিচার ইনচার্জের ঘরে যেতে হল আমাকে। বড় গুরুতর অভিযোগ আমার নামে। বাচ্চাদের অসুস্থ করে দিয়েছি। সে ঘরে ম্যাডাম ছাড়া আর একজন আছে। তার বাড়ি ওই বড়দির পাশের গ্রামে। ছেলেটার সবচেয়ে বড় গুণ গান গায় আর দারুণ হাসে। ছবিও আঁকতে জানে। সব মিলিয়ে একজন শিল্পী মানুষ। একে ম্যাডাম নিয়ে এসেছেন বাচ্চাদের অংকন শেখাবার জন্য। গান তো আর শেখাতে পারবে না। কি আর করবে, আঁকাই শেখাক। মুকাভিনয় শেখাবার জন্য একজন, নাচ শেখাবার জন্য একজন, আগে এই দুজনকে আনা হয়েছে। যদিও মুকাভিনয়ের মাস্টার ছাত্রদের চাইতেনাচের দিদিমণিকে মুকাভিনয়ে মুগ্ধ করার জন্য এবং নাচের দিদিমণি মুকাভিনয়ের মাস্টারকে নৃত্যকলায় বস করার জন্য শিক্ষক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলেছে। তবু এটা সত্যি স্কুলের কিছু ছেলে কিছু মেয়ে ওই দুটো কলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এবার অংকন কলায় পারদর্শী হোক। সপ্তাহে দু দিন সে ওই শিক্ষা দিয়ে যায়। সেই দুদিন সে ম্যাডামের সাথেই বাড়ি ফেরে। লোকের সামনে ম্যাডামকে বড়দি বললেও, আসলে সে দুর সম্পর্কের বউদি। এখন দেওর বউদির হাস্য পরিহাস নয়, অত্যন্ত গুরুগম্ভীর একটা আলোচনা চলছিল। সেটা হচ্ছে, যদি তুলি বড় বাজার থেকে না এনে বারুইপুর থেকে আনা হয় তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়। এটা লিচুর সময়। বারুইপুরের লিচুর খুব নাম ডাক। রংয়ের বিলে লিচুর দামটা ঢুকিয়ে দিলে কেনাটা বেশ আরামদায়ক হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় দরজায় গিয়ে বলি, আসবো বড়দি?

এসো। বড়দি অংকন মাস্টারের দিক থেকে আমার দিকে ফিরলেন তারপর বললেন–তুমি এককালে নাকি বিপ্লব করতে গিয়ে জেলে গিয়ে ছিলে যার বুকে মানুষের জন্য দরদ নেই, ভালোবাসা নেই আন্তরিকতা নেই, সে কি করে বিপ্লব করতে পারে!

বলি, আপনি কি বিশ্বাস করেন বাচ্চাদের খাবারে আমি খইনি ফেলে দিয়েছি?

ফেলে যে দিয়েছো সেটা বলছি না। পড়ে যেতে পারে। পড়ে যাওয়াটাও কোনো বড় ঘটনা নয়। কিন্তু আসল হল দরদ। যার বুকে দরদ থাকবে তার হাত থেকে যদি তেতো খাবার পরিবেশন হয় তা ওই হাতের ছোঁয়ায় মিষ্টি হয়ে যায়। আগে যা হয়েছে তা হয়েছে। তখন বেতন পেতে না, যেমন ইচ্ছা কাজ করেছো, আমার বলার কিছু ছিল না। কিন্তু এখন যদি কাজে কোনো ফঁকি দাও বা অযত্ন করো আমি কিন্তু স্টেপ নিতে বাধ্য হবো। সোজা সাসপেন্ড করে দেবো।

আমি ম্যাডামের প্রবচন শুনে ছাদের দিকে তাকাই। ভয় হয়, ঘরের ছাদ না খসে পড়ে। শুনেছি কবে কোথায় নাকি একটা প্লেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আকাশ ছিল পরিষ্কার, প্লেনে কোনো যান্ত্রিক গোলযোগও হয়নি। তবে এ দুর্ঘটনার কারণ কি? পরে প্লেনের ধ্বংসস্তূপ থেকে ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পেয়ে যাত্রীদের কথপোকথন রেকর্ড করা টেপ থেকে যা জানা গেল, তা হচ্ছে পাশাপাশি বসা এক সুদখোর আর এক কষাই ধর্ম মানবতা অহিংসা জীবসেবা এসব নিয়ে আলোচনা করছিল। এতেই শান্ত আবহাওয়া বিরূপ হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় পড়ে যাত্রীবোঝাই প্লেন। কেন কে জানে, আমার ধারণা হয়, ম্যাডামের মুখে এই সব অশোভন বাক্য প্রকৃতি সহ্য করবে না। ভূমিকম্প হয়ে যেতে পারে।

***

এক হাজার টাকা অনুকে পাঠিয়েছিলাম। টাকা হাতে পেয়েই সে আট দশ বছরের বনবাস পর্ব থেকে একটু মুক্তির আশায় তার আই.সি.ডি.এস.-এর চাকরি থেকে এক মাস ছুটি নিয়ে এসে পড়েছে কলকাতায়, আমার ঠিকানায়। তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছে সেই কেনারাম। এটা তার কোনো নিঃস্বার্থ সেবা নয়, পুরো গাড়ি ভাড়া সহ পথ খরচা সব হিসেব কষে আদায় করেছে। অনুকে আমার স্কুলের সামনে এনে আমার সাথে দেখা করিয়ে দিয়েই সে ফিরতি বাস ধরেছে। সে কাপসীতে একটা রেডিমেড বস্ত্রের দোকান দিয়েছে। এখন বড় বাজার থেকে কিছু মাল কিনে রাতের ট্রেন ধরে ফিরে যাবে। তাই আমার অনুরোধও থাকতে রাজি হল না। অবশ্য সে রাজি হলে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো আমাকে। ফলে যা হলো সেটা আমার পক্ষে খুব একটা মন্দ নয়।

অনু যখন আমার স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তখন বেলা দশটা মতো বাজে। একজনের মুখে খবর পেয়ে ছাদ থেকে নীচে নেমে আসি। কেনাকে বিল্টুদায় দিয়ে তাকে নিয়ে স্কুলে ঢুকতে যাব, পথ আটকায় দাস। ইনি সেই লোক যিনি বোজ চারখানা পত্রিকা পড়েন। মানুষের একটা দোষ বা গুণ। যে পড়াশুনো করে সে বিদ্বান হয়ে যায়। আর কোন বিদ্বান নির্বোধের মত কোনো কাজ করে না। যা করে তা দশদিক দেখে, ভেবে, তবেই করে।

একজন লোক এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে, আমি তৃষ্ণার্ত, এক গেলাস জল দাও। যে বোকা, সটান জল ভরা গেলাস, হাতে ধরিয়ে দেবে। আর যে বিদ্বান, বিচার বিবেচনা করবে। যে জল চাইছে সত্যি তৃষ্ণার্ত তো?নাকি জল খাবার ছুতোয় উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে চাইছে ঘরে এই সময় ক’জন লোক থাকে, আলমারিটা কোন দিকে, কোন যুবতী আছে কী না! সত্যিই যদি তৃষ্ণার্ত হয়, জানতে হবে, এত ঘর ফেলে সে আমারই দরজায় এল কেন? এর পিছনে কোনো চক্রান্ত নেই তো! বুঝতে হবে আজ জল দিলে কাল পরশু আবার আসবে কী না। ভেবে দেখতে হবে, জল দিলে আমার মন নরম ভেবে আবার বাতাসা চেয়ে বসবে কী না!

এত সব বিষয় আগেভাগে অতি অল্প সময়ে যে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাকেই বলে বিদ্বান-বিচক্ষণ-বুদ্ধিমান। দ্বারোয়ান দাস তাই।

বলে সে, রঞ্জনদা একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না। আপনি তো এখানকার সব নিয়ম জানেননা। বড়দির অর্ডার, কোনো বাইরের লোক উইদাউট পারমিশন, স্কুলে ঢুকবে না। আপনার এসিস্টানের বর কী ঝামেলা বাঁধিয়েছিল মনে আছে তো! এখন যদি আপনার সাথে বউদিকে স্কুলে ঢুকতে দেই, যদি আমাকে বড়দি চাপ দেয়, কার অর্ডারে তুমি এদের যেতে দিয়েছে, আমি কোনো জবাব দিতে পারব না। তাই আমি বলি কি বউদি বাচ্চারা এখানে একটু বসুক। বড়দি হোক কী সুপার কেউ একজন এসে গেলে–আসবার সময় তো হয়ে গেছে, তাদের কারো পারমিশন নিয়ে তখন বউদিকে ভিতরে নিয়ে যাবেন। আর যদি আপনি নিজের দায়িত্বে নিয়ে যেতে চান, যেতে পারেন। তখন যদি বড়দি কিছু বলে আমি কিন্তু বলব যে, আমি বারণ করেছিলাম। তখন সব দায়িত্ব কিন্তু আপনার। এখন ভেবে দেখেন কী করবেন। আমার যা বলার আমি বলে দিলাম।

একটা পুরো দিন, একটা পুরো রাত ওরা বাসে রিকশায় ট্রেনে, ফের বাসে চেপে কয়েকশো মাইল পথ পার হয়ে এখানে এসেছে। অনু, আর সাথে আমার দুটো বাচ্চা। এখন ওদের চান খাওয়া বিশ্রাম দরকার। কিন্তু তার কোনো উপায় নেই। অগত্যা তাদের বসিয়ে রেখে আসি সেই বটগাছের গোড়ায়। তবে বড়দি–মানে টিচার ইনচার্জ এলে তাকে বলে ওদের ভিতরে নেওয়া গেল।

বললেন তিনি, এমনিতে কোনো বাইরের লোক থাকতে দিতে পারি না। তবে ওনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন, আজকের দিনটা রাখুন। কাল কিন্তু অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে নেবেন।

সে আমি করব। ওনার বলার দরকার ছিল না। আমার শাশুড়ি এখন তালদিতে আছেন। ভাড়ার ঘর। সেখানেই পৌঁছে দেব।

অনুকে নিয়ে এসে ছাদের যাবার সিঁড়িতে বসার ব্যবস্থা করে দিলাম। ছাদেই জল আছে, স্নান করা যায়। হোস্টেল সুপারের কাছে অনুরোধ করে ওদের খাবার ব্যবস্থাটা করা গেল।

দুপুরে বাচ্চাদের ক্লাস থাকে। তবে ক্লাস না থাকলেও তারা ছাদের দিকে আসে না। আসবার আদেশ নেই। শুধু খাবার সময় আদেশ কিছু শিথিল করা হয়। দুপুরে সিঁড়িতে, আর রাতে বৃষ্টি বাদল না থাকলে ছাদে ওরা খায়। নীচে রান্না খাবার ঘর নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একদুবছর এই অবস্থা আরো চলবে।

রাতের খাওয়া শেষ হলে বাচ্চাদের হোস্টেল রুমের গেটে তালা পড়ে যায়। ফলে ছাদ একেবারে ফাঁকা। আমি এই ছাদেই থাকি। আমার হেল্পার সকালে এসে কাজকর্ম সেরে দুপুরে বাড়ি চলে যায়। আবার আসে বিকেলে বাড়ি যায় রাত দশটা সাড়ে দশটায়। দুপুরে বা রাতে আমার লেখাপড়া সেও এই ছাদে বা সিঁড়িতে বসে চলে।

প্রাথমিক সমস্যা মিটে যাবার পর বউ বাচ্চাদের দিকে একটু ভালো করে তাকাবার ফুরসত পেলাম। দীর্ঘ দু-বছরের অদর্শনের পর আমি যেন আমার সন্তানদের কাছেই কেমন অচেনা হয়ে গেছি। তারা সর্বক্ষণ কাছে পেয়েছে মাকে, তাকেই গভীর ভাবে চেনে। তাই মায়ের গা ঘেসে শুয়ে বসে থাকছে, আমার কাছে আসছে না। বস্তার জেলার চারদিকে তারা এত ভিড় এত দোর দালান গাড়ির মিছিল দেখেনি। সেখানে সবদিকে পাহাড়, ঘন বনে শাল, সেগুন, বীজা, মহুয়া এই সবের আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষ। এখন এত লোকজন হৈ চৈ দেখে তারা কিছুটা ভীত কিছুটা বিহ্বল।

সেদিন দুপুরটা বেশ আনন্দে কেটে গেল আমার। এতদিন পর পরিবার পরিজনকে কাছে পেয়ে মনটা খুশিতে ভরে গেছে। খুশি মনেই রাতের রান্না শেষ করে বোবা বাচ্চাদের খাইয়ে দিলাম। তারা চলে গেল ঘুমাতে আমার হেল্পারও বাড়ি চলে গেল। এরপর আমরাও খেয়ে নিলাম। এবার আমরাও ঘুমাব।

কোথায় ঘুমাব আমরা? অনুর প্রশ্নের জবাবে বলি–এতবড় ছাদ। যেখানে হোক শুয়ে পড়লেই হল। তখন আমার মনে ছিল না যে এখানে একজন ইতর প্রজাতির অসভ্য প্রাণী আছে। যে তার ক্ষমতার মদমত্ততায় শ্রীল অশ্লীল সব সীমা পার করে যেতে পারে।

ব্যাপারটা তার মাথায় সারাদিনে একবারও আসেনি, নাকি একেবারে শেষ সময়ে ওস্তাদ খেলোয়াড় যে রকম তুরুপের তাসটা দেখায় সেই ভেবে চুপ করে ছিল তা কে জানে। তখন সে শেষ বিল্টুদায় জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেও গিয়েছিল। দু’দশ ধাপ নেমে আবার উঠে এল ছাদে।

… আর একটু পরে সারা স্কুল নিঝুম হয়ে যাবে। শুধু স্কুলই কেন বিশ্বচরাচর ঢলে পড়বে ঘুমের ঘোরে। আকাশে এখন চাঁদ উঠেছে। আজ বা কাল হয়তো পুর্ণিমা, তাই চাঁদ এখন পূর্ণাবয়ব। মধ্যরাতে আধা গ্রাম আধা শহর এই অঞ্চলের মাঠপাথার ভেসে যাচ্ছে রূপপাগলা উজ্জ্বল জোছনায়। দক্ষিণ দিকে থেকে বইছে মৃদুমন্দ বাতাস। দিনের দাবদাহ শেষে দক্ষিণা বাতাসে শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এখন বড় মন কেমন করা পরিবেশ। এই রকম পরিবেশে দীর্ঘ বিরহের পর প্রিয় সান্নিধ্য পেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। শরীরে শোনিতে শ্বেত কণিকায় বিদ্যুৎ প্রবাহ দৌড়ায়।

আমারও এমন হবে। অনুরও হবে। প্রায় দুবছর কাল দুজন দুজনকে ফেলে দুরে আছি। আজ এতদিন পরে নিরালা এক অবসরে দুজন দুজনকে কাছে পাবো। এই অবস্থায় আমি যে রকম–অনুর মনেও নিশ্চয় শতেক কল্পনার ফানুস উড়েছে রামধনুর সাত রঙ মেখে। সঙ্গ সুখ কামনায় শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে বার বার।

সেই সুখের কল্পনার ফানুসটাকে ফাটিয়ে দিতে হবে। ফাটিয়ে দেবার মধ্যে একটা বিভৎস আনন্দ রসের সন্ধান পেয়েছে ওয়ার্ডেন। তাই ছুটে এসেছে ছাদে। আহঃ উপোসি স্বামী উপপসি স্ত্রী দুজন দুজনকে যখন একান্তভাবে চাইছেবিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে দুজনকে। এক বিছানায় স্বামী আর এক বিছানায় বউ। দুজন দুদিকের বিছানায় শুয়ে ছটফট করবে। পেটে এক আকাশের খিদে, খাবার আছে হাতের নাগালে, অথচ খেতে পারছে না, সেই আক্ষেপে শরীর মন পুড়বে, ঘুম আসবে না কারো চোখে, সে যে কী নিদারুণ মজা।

তখন আমি রান্নাঘর থেকে সবে ছাদের এক কোণে–যেখানে অনু ছেলে মেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়েছে সেদিকে পা বাড়িয়েছি আমাকে ডাকে ওয়ার্ডেন–শোনেন। একটা কথা শুনে যান।

বলেন।

বউদি কোথায় ঘুমাবে?

ওই তো বিছানা বিছিয়ে শুয়েছে। একটা রাত তো, কেটে যাবে।

না, এখানে শোয়াবেন না। আপনি যেমন থাকেন–ছাদে থাকুন। বউদিকে হোস্টেল রুমে পাঠিয়ে দিন। অনেক খাট খালি আছে, তার একটায় গিয়ে শুয়ে পড়ুক।

তার গলার সুর নরম কিন্তু তাতে যেন মেশানো আছে ধারালো লোহার গলানো ছুরি। অন্ধকারেও তার চোখ দুটো জ্বলছে। যে চোখের দৃষ্টিতে ফুটে আছে হিম শীতল সর্পিল বক্রতা। এই চোখ আমি চিনি। আর চিনি বলেই তার দুরভিসন্ধিতে রাগে শরীর জ্বলে আমার।

তার দাদারা নেতা। দাদাদের ক্ষমতায় সে ক্ষমতাবান। তাবলে সে সব কিছুতে ক্ষমতার দাপট দেখাবে? এটা তো সরাসরি অন্যায়, ইচ্ছাকৃত দমন পীড়ন অত্যাচার। হতে পারে সে আমার বস, তবু আমাকে আমার স্ত্রী বাচ্চার সাথে থাকতে দেবে না, এত অধিকার তার কী আছে? আছে, কারণ সে বড় সাহেবের প্রিয়পাত্র। এর সব অধিকার আছে।

তবু বলি, কেন? আমার বউ নীচে যাবে কেন? সে যদি এখানে থাকে আপনাদের কী অসুবিধা?

সেই সাতাত্তর সালে যখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে, তখনও সে হাফ প্যান্ট ছাড়েনি। তখনই এলাকায় তার ভাইয়েদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল। যত সে বড় হয়েছে চারপাশে দেখেছে একদল নত ন্যুজ ভীত মানুষ। যাদের মারলে দাঁড়িয়ে মার খায়, ধমকালে চুপ করে শোনে। তাই এদের যে সমীহ করতে হবে, সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে তা কখনো তার মনে হয়নি। বলতে বলতে এখন বলাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। কী বলছে কী তার অর্থ বোঝার মতো বিবেচনা শক্তিও আর নেই।

তাই এখন সে আমার প্রশ্নের জবাবে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে–হোস্টেলে বড় বড় ছেলেরা থাকে। ওরা কথা বলতে পারে না, কিন্তু বোঝে তো সব। সব বোঝে সব জানে। আপনি আর বউদি ছাদে থাকলে তার কী মানে সে ওদের কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। এতে ওদের স্বভাব চরিত্র খারাপ হয়ে যেতে পারে।

টের পাই আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। সে আগুন আর আমার আয়ত্বে থাকতে চাইছে না।

বলি–এত বড় বড় বাচ্চা, ওরা সব জানে সব বোঝে। তা ওদের তো বাপ মা আছে, ছোট ছোট ভাইবোনও আছে। ভাই বোন কেমন করে জন্মাচ্ছে সে নিজে কী কার্য কারণে জন্মেছে তাও তো জানে বোঝে। এতে তাদের স্বভাব চরিত্র খারাপ হয়ে যায় না? আমি ছাদে বউ নিয়ে ঘুমালে নীচের তলায় থাকা বাচ্চা খারাপ হয়ে যাবে?

এক মুহূর্ত থমকে থাকে ওয়ার্ডেন, সে এখানে যুক্তি পালটা যুক্তি এসব শুনতে তো আসেনি। এসেছে আমাকে একটা মানসিক বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে তার জিঘাংসু প্রবৃত্তির খোরাক সংগ্রহ করতে। এসেছে তার নগ্ন তামশ মনোবৃত্তির কদর্য বহিঃপ্রকাশ দ্বারা অপমান করতে।

বলে–আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। যা বলছি তা করুন। এটা হোস্টেল–হোটেল না। হোটেলে যা চলে হোস্টেলে চলে না। বউদিকে নীচে পাঠিয়ে দিন।

অনুবড় বিব্রত। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যায় না, তবে বুঝতে পারি যে বিষয় নিয়ে বাদানুবাদ হচ্ছে তা তার কাছে শ্রুতিমধুর নয়। কথা যাই হোক তার অন্তর্নিহিত অর্থটা তোত অশ্লীলই। স্বাভাবিক কারণে এক অনাধুনিক মানসিকতার গ্রাম্য সংস্কারে লালিত নারীর মনন চিন্তনে তা কটু এবং অপ্রিয়। সে চায় আমি আর এই বিষয়ে একটাও কথা না বলি। অনেক রাত তো গেছে, এ রাত না হয় এমনি চলে যাক।

কথা আর আমিও বলি না। বলে কী লাভ? এখন যে লোকটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কথা বলছে, সে তো একা কথা বলছে না। তার সাথে কথা বলছে তার সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থান। তার শিক্ষা, সংস্কৃতি, রক্তের গ্রুপ, বংশগতি সব কিছু। একে যে ভাষায় বলে বোঝানো যাবে সে ভাষা আমার নেই।

কী আর করি, অনুকে নিয়ে হোস্টেলের একটা খাটে শুইয়ে দিই। আমি জানি তিরিশ চল্লিশটা বড় বড় ছেলের মধ্যে একজন মহিলাকে এভাবে ঘুমাতে পাঠানো অন্যায় অশোভন। ঘুমের ঘোরে তার শরীরের কাপড় সরে যেতে পারে, ধ্রুবপদের লেখক লিখেছে–বোবাদের কাম চেতনা ভীষণ প্রবল। কেউ তার শরীর ছুঁতে পারে। তবু বাধ্য হই এক অন্যায় দাবির কাছে মাথা নত করতে। বুকের মধ্যে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে আমার। এ আগুন অপমানের আগুন। চির অপমানিত অক্ষম মানুষের মনের মধ্যে অহর্নিশি যে আগুন জ্বলে, তা কোন না কোনো একদিন দাবানল হয়ে যেতে পারে। দর্পী দম্ভী অহঙ্কারিরা তা জানে না।

এখন এই মধ্যরাতে ছাদে দাঁড়িয়ে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার সেই প্রাজ্ঞ-মহাগুরুর মুখটা মনে পড়ল।যিনি বলেছিলেন–এখানে ওখানে সাবধানে, এদেশে ওদেশে পৃথিবীর সর্বত্র শক্তিমানদের হাতে নির্বল, ধনবানদের হাতে নির্ধন, ক্ষমতাবানদের হাতে সাধারণ মানুষ নিগৃহীত অপমানিত অত্যাচারিত হচ্ছে। অতীতে দিনে হয়েছে, আজ হচ্ছে আগামী দিনেও হতে থাকবে। কোনদিন এর বিনাশ নির্মূল হবে না।

শাস্ত্রে বলে, যখন পৃথিবী পাপে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, অর্ধামিকের দ্বারা ধার্মিক লাঞ্ছিত হয়, ভগবান অবতার রূপে পৃথিবীতে আসেন এবং পাপীদের বিনাশ করে পুনঃ শান্তিস্থাপন করেন, ধর্মরাজ্য প্রবর্তন করেন। বারবার আসতে হয় তাকে, বার বার কারণ পাপ আর পাপীকে স্বয়ং ভগবানও সম্পূর্ণ বিনাশ করতে পারে না। তার বীজ কোথাও না কোথাও গুপ্ত রয়ে যায়। যা আবার কিছুকাল পরে পল্লবিত হয়ে ওঠে। পৃথিবীকে মানুষের অ-বাসযোগ্য করে ফেলে।

এই জন্যই ভগবান এক পরশুরাম অবতারে একুশবার ক্ষমতায় মদমত্ত ক্ষত্রিয়কুলকে নিধন করে পৃথিবীকে ক্ষাত্রমুক্ত করেছিলেন। একুশবার কেন? একবার কেন নয়? ডাইনোমোরাস আর জন্মাবে না কারণ তার বীজ বিলুপ্ত। অত্যাচারি বার বার জন্মাবে কারণ বীজ মজুত আছে। তাই, বাঁচতে হলে মানুষকে বার বার কুঠার তুলতে হবে। পরশুরাম হতে হবে, ভগবান হতে হবে। এই মহা সংগ্রাম নিরন্তর চলবে। চালাতে হবে।

আমি এক অতি সাধারণ মানুষ। আমি দেখিনি তবে শুনেছি, এই দেশে নাকি এক সময় ইংরেজ শাসন ছিল। তারা নাকি ভীষণ অত্যাচারি ছিল। সেই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারা চলে গেল। তাদের শূন্য আসনে যারা গিয়ে বসল, কালে কালে তারাও সব একই রকম অত্যাচারি হয়ে উঠল। সত্তরের দশকের সেই কালো দিন আমি নিজের চোখে দেখেছি।

আবার তাদের সরিয়ে মানুষ নিয়ে এল আর এক নতুন শাসক। ক্ষমতা হাতে পাবার সাথে সাথে মরিচঝাঁপির নৃশংস নর সংহার-ধর্ষণের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের পথ চলা। হাজার হাজার নিরন্ন-প্রতিবাদী মানুষের মৃত দেহ মাড়িয়ে নেতাই পর্যন্ত গিয়ে থামবে তাদের স্বৈরাচারের রথ–! থামাবে সেই মানুষই।

তারপর আসবে অন্য কেউ। কে আসবে, কেমন হবে সেই শাসক তা এখনো অজানা। জানিনা তখন মানুষ তার কুঠারখানা বর্জন করতে পারবে কী পারবে না। সে বলবে সময়।

আমি সে সময় থেকে অনেক দূরে, দশ বারো বছর পিছনে দাঁড়িয়ে আছি এক খোলা আকাশের নীচে। আমার হাতে কুঠার নেই আছে ছোট একটা দু টাকা দামের কলম।

***

অনু এখন তার মায়ের কাছে আছে। একমাস থাকবে। আমি মাঝে মাঝে তালদিতে যাই। তালদিতে মাছের বড় বাজার। জ্ঞান হবার পর এই প্রথম আমার ছেলে মেয়ে ইলিশ মাছের স্বাদ পেল। বস্তারে যা পাওয়া সম্ভব নয়।

একদিন অনু এসেছে স্কুলে। আমরা যাবো সোদপুর। যোগেন সেনগুপ্ত এই সময়ে সেখানে থাকেন। তিনি অনুকে শুধু যে চেনেন তা নয়–ভালোও বাসেন। তিনি কলকাতায় আছেন জেনে অনু একবার দেখা করতে চায়। বহুকাল তার সাথে দেখা নেই তাই আমারও ইচ্ছা দেখা করার। “বহতা নদী আর রমতা যোগী” জীবন যোগেনদার। কখন যে কোথায় থাকে তা সে নিজেও জানেনা। মনে ভাবি, আমরা যে যাচ্ছি সোদপুরে তার বাড়িতে, সেটা একবার ফোন করে জানিয়ে দেওয়া দরকার। ফোন স্কুলে আছে বেশ কয়েকটা। সব কর্মচারিই দরকারে এখান থেকে ফোন করে থাকে। বাল্যবন্ধু তো একটা ফোন রোজ সকালে সাতটা থেকে নটা দশটা পর্যন্ত একাই কজা করে বসে থাকে। কথার পরে কথা-যেন গোটা উপন্যাস পড়ে যায়। আবার সন্ধে থেকে অনেক রাত পর্যন্ত চলে এই পাঠ। মাদার অবশ্য একবারে এত কথা বলে না, তবে দিনে পাঁচ দশবার তারও দরকার পড়ে ফোন করার। সে তা করে থাকে। তাই আমার মনে হয় একটা ফোন আমিও করতে পারি।

তখন বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা। টিচার অফিসস্টাফ সব এসে গেছে। টিচার ইনচার্জ এসে বসে পড়েছেন তার কক্ষে। এসব ফোনে এখন ফোন করায় সমস্যা। তাই দারোয়ান দাসকে বলি, কী যে করি। একটা ফোন করা খুব দরকার। কিন্তু কোন ফোন থেকে করব। বড়দির ঘরে বড়দি বসে আছে। অফিস ঘরে রায়দা আর সবাই কাজ করছে।

রায় সোনারপুর অঞ্চলের এক সিপিএম নেতা। পার্টির খুব গুরু দায়িত্ব পালন করেন তাই সেই কাজে প্রচুর সময় দিতে হয় বলে স্কুলে আসার সময় যদিও একটু বের করতে পারেন, বেশি সময় থাকতে পারেন না। এই এসেছেন এক্ষুনি চলে যাবেন। তবে যে এক আধঘন্টা সে এখানে থাকবে পুরো স্কুল কঁপবে। তখন বোঝা মুশকিল হবে ইনি অফিসের কেরানিবাবুনা স্কুল শিক্ষামন্ত্রী।

ইনি সব সিপিএম কর্মী নেতাদের মতোই এক কৃতকর্মা পুরুষ। যে কেরানির চাকরি করে লোকে সংসার চালাতে হিমসিম খায়, উনি যে সময় এই কাহিনি লিখছি বাড়ি গাড়ি সহ অনেক কিছুর মালিক হয়ে গেছেন। মাঝে কিছু টাকা পয়সার হিসেবে গরমিল করে বড় সাহেবের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, তখন মনে হয়েছিল বোধহয় চাকরিটা আর থাকবে না। জেলও হতে পারে। সে ঝামেলা মিটে গেছে এখন। গরমিলের টাকা তার মাইনে থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে।

এখন বলে দাস, যখন ফোন করা খুবই দরকার বড় সাহেবের ঘরে চলে যান। ওখান থেকে করে নিন।

কেউ কিছু বলবে না তো।

কে বলবে। সবাই তো করে। আমি বলছি আপনি যান না।

যাবো?

হ্যাঁ যান।

দাসের কথায় ভরসা করে বড় সাহেবের অফিস কক্ষে ঢুকে পড়ি। উনি সবদিন আসেন না। আসেন দশ পনের দিনে একবার। তখন এই কক্ষে বসেন। ইচ্ছা করলে শুতেও পারেন। কামরার একদিকে খাট বিছানা পেতে রাখা আছে। আছে এ.সি. আছে পত্র-পত্রিকা রঙিন টিভি।

সেই কামরায় ঢুকে এক মিনিট কথা বলেছি, হঠাৎ চিৎকার। পাশের কামরা থেকে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে ধেয়ে এল টিচার ইনচার্জ। ওয়ার্ডেন এবং রায় দুইজনে গিয়ে উত্তেজিত করে দিয়েছে, একী বড়দি, আপনি আছেন। আপনি না থাকলে তখন আলাদা ব্যাপার। আপনি থাকতে আপনার কোন অনুমতি না নিয়ে সোজা সভাপতির ঘরে ঢুকে ফোন করছে, এতো আপনাকে অপমান করা।

এটা খুবই তাতানো কথা। তাই তেতে গেছে বনেদি বাড়ির বিদুষী বউ। কেন তাতবে না? যখন এর জন্য তার কোনো ব্যক্তিগত ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

ইনি এক অপমানিত মানবী। অপমানিতের মরম বেদনায় তিনি মর্মাহত। আর তাই যে অপমান তিনি অমানবিক মানব সমাজ থেকে পেয়ে থাকেন, সেটাই সহস্রগুণ বৃদ্ধি করে ফিরিয়ে দেন সামাজিক মানুষকে, যারা তার নিম্নে আছেন। ইনি টিচার ইনচার্জ এবং পদাধিকার বলে স্কুল পরিচালন সমিতির সেক্রেটারিও বটে। এখন আর সেই বাবু সেক্রেটারি নেই যিনি আগে ছিলেন।

সরকারি আইন মোতাবেক স্কুলের সকল কর্মচারি তার আদেশ মানতে বাধ্য। মানুষকে বাধ্য পোষ্য অবনত আজ্ঞাবহকরায় যে কী আনন্দ সে একমাত্র সেই জানে যে এই আনন্দধারায় অবগাহনের সুযোগ পেয়েছেন। তিনি সেই আনন্দ অবগাহনে নিমজ্জিত থাকেন। প্রতি মুহূর্তে অধস্তন–বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের চমকাতে থাকেন।

এমনিতে তাঁর বাসস্থান এক মফঃস্বল শহর। ওনার পড়াশোনা সব সেই শহরে। তবে কলকাতায় যে মজা তা কি ওই ছোট্ট শহরে আছে? এখানে কত দর্শনীয় স্থান। নিকোপার্ক, নলবন, সায়েন্স সিটি, বোটানিকাল গার্ডেন, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা। স্কুল ছুটির পর উনি বেরিয়ে পড়েন ভ্রমণে। গাইড হিসাবে সাথে নেন এই স্কুলেরই এক মাস্টারকে। সারা কলকাতার দর্শনীয় স্থান সমূহ দর্শনের পর উনি চলে যান তার বাড়িতে। না গিয়ে বা কী করবেন। অতরাতে তো নিজগৃহে যাবার ট্রেন থাকে না। আর কোন ভদ্রঘরের মেয়ে বা বউয়ের তো হোটলে থাকা মানুষ ভালো মনে নেয় না।

তবে কোনো অসুবিধা হয়না। মাস্টার মশায়ের বাড়িটা বড় এবং সে এখনো বিয়ে থা করেনি। সেখানে বড়দি নিজের পয়সায়াম্ৰকখানা ক্লিাল বৃঙিন টিভি কিনে রেখে দিয়েছে। সিডি, ডিভিডি মাস্টারের কেনা। ফলে ইচ্ছা হলে সেখানে বসে বিদেশি বা দেশী অ্যাকশন বেশি সংলাপ কম সিনেমা দেখার সুখ পেতেও বাধা নেই।

এইভাবে বেশ সুখেই তার কাটছিল দিন। কিন্তু সেই সুখের ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিল এই স্কুলেরই আর এক শিক্ষিকা। সে মাষ্টারকে আরো দূরে-দীঘা, পুরীর দ্রষ্টব্য স্থান সমূহ দর্শনের নিমিত্তে গাইড হিসাবে নির্বাচিত করে বসল। আর তখনই একদিন মহাধুন্দুমার। সেদিন টিচার ইনচার্জ আর মাস্টারের মধ্যে যে অঙ্গভঙ্গিতে যে বাক্য বিন্যাসে ঝগড়া শুরু হল তা শুনে যে কেউ ধারণা করে বসবে–এটা বিদ্যাদেবী সরস্বতীর অঙ্গন নয়–হয় কোনো মাছের বাজার, নয় ঝি ট্রেনের কোনো কামরা বা সোনাগাছির কোনো গলি। অথবা এক সাথে তিনটেই। তখন মাস্টারের লাগামহীন মুখ দিয়ে যে মধুর বচন বের হল তাতেই জানা গেল টিভি ডিভিডির গল্প।

এরপর যা হয়–স্কুল পরিচালন সমিতির একটা জরুরি মিটিং বসল। তাতে একটা আদেশ একটা নির্দেশ একটা উপদেশ দেওয়া হল শিক্ষক মশাইকে। এক, সে আর ক্লাস করতে পারবে না। পুনরাদেশ না হওয়া পর্যন্ত এগারোটা থেকে চারটে–একা টিচারর্স রুমে বসে থাকবে। দুই, সোনি কোম্পানির ওই দামি টিভিটা ফিরিয়ে দিতে হবে। তিন, এটা উপদেশ, দিলেন প্রাক্তন সেক্রেটারি, বিয়ে করে নাও। চারদিকে যা রোগ শুনি, এ্যাকবার হইলে আর বাঁচবা না।

সে অনেকদিন আগের ব্যাপার। কিন্তু শরীর পুড়ে যাক বা কেটে যাক, তার ক্ষত তো শুকিয়ে যায়-দাগ যায় না। মানুষের মনে সে দাগ তখনো আছে, বিশেষ করে ওই চতুর্থ শ্রেণির অশিক্ষিত অসভ্য কর্মচারিদের। তারা আর বড়দিকে সেই চোখে দেখে না সেই সম্মান করে না যা তার পদাধিকার বলে প্রাপ্য। তারা আড়ালে আবডালে বড়দিকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে যেসব কথা বলে, তা কোনো ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বলাটা খুবই খারাপ।

আর যেটা আরো খারাপ সেটা হল, যখন তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হয় তারাই একজনের নামে আর একজন চুকলি করে যায়-জানেন বড়দি ও বলে আপনি নাকি…। বড়দি যা বোঝেন তা হল–সব শালাই হারামির বাচ্চা। তাই মওকা পেলে দুজনকেই ধেসে দেন। এতে খানিকটা হলেও গাত্রদাহ-অপমান-অসম্মানের জ্বালা মেটে। যেটা অনেকের মতে মশা মারতে কামান দাগা।

এই হয়, এটা হওয়াই স্বাভাবিক নিয়ম। স্নেহের মতো ক্রোধও নিম্নগামী। যে আমার উপরে বা সমকক্ষ তাকে যখন কিছু বলতে পারি না, নীচের জনকে মারি! লোকে বউ কেন পেটায়? পেটের সন্তানকে কেন পেটায়? এইভাবে নির্গত হয় আক্রোশ।

এখন টিচার ইনচার্জ আমার উপর আক্রোশ ঝাড়লেন–আপনি এখান থেকে ফোন করছেন কেন?

এখানে চাকরিতে ঢোকার পর অনুকে প্রথম যে চিঠিখানা লিখেছিলাম তাতে বলেছিলাম, অনেক ঘাটের জল খাবার পর জীবনতরী এতদিনে সঠিক তীরে এসে ভিড়েছে। বিদ্যালয় হচ্ছে সরস্বতীর মন্দির। এখানে সব বিদ্বান মানুষ থাকেন। যাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। আশা করছি একদিন এরা আমার পরিচয় পাবে। সেদিন নিশ্চয় আমার সাধনার একটা স্বীকৃতি আসবে। সবাই ভালোবাসবে আমাকে।

এখন সেই অনুর সামনে আমার উপর বড়দি এক ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেখে বিব্রত আমি আহতঙ্গায়রদি-আমিও তো এই স্কুলের কী। সবাই ফোন করে আর আমি একটা দরকারি ফোন করতে পারব না?

পারবেন। তবে সে জন্য আমার পারমিশন নিতে হবে। নিয়েছেন?

দাসদাকে তো বলেছি। তিনি তো পারমিশন দিয়েছেন। কী দাসদা আপনি বলেননি ফোন করতে। ভুল হলে সে তো দাসদার। উনি বলতেন যে আপনার পারমিশন লাগবে। নিতাম পারমিশন।

এ কথায় টিচার ইনচার্জের কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। কী এক কারণে যেন উনি স্থির করে নিয়েছেন আমাকে আমার বউয়ের সামনে যতখানি অপমান করা যায় আজ উনি তা করেই ছাড়বেন।

আমি এর আগে অল্প কিছুদিনের জন্য এক স্কুলে কাজ করেছিলাম। সেখানে দেখেছি স্কুলের কেউ কোনো অন্যায় করলে হেড মাস্টার তাকে নিজের কামরায় ডেকে নিতেন। তারপর ছোট ছোট শব্দে যা বলতেন তা অনেক বড় বড় বাক্যেরও বাপ।

আসলে এটাই তো হয়, আসল রাজা আর রঙ্গমঞ্চেল্প রাজা সাজা রাজা দুজনের এই প্রভেদ। আসল রাজাকে কোনো বন্দীর প্রাণদানের আদেশ গলা ফাটিয়ে গর্জন করে বলতে হয় না। তার দরকার পড়ে না। হাতের বুড়ো আঙুল কাত করলেই হয়ে যায়। কিন্তু মঞ্চের রাজাকে দৌড়াতে হয় দাপাতে হয় হাঁফাতে হয়।

এই হেড তো আসল হেড নয়। ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া একটা পুতুল মাত্র। যার টিকিটা ধরে আছে অন্য কেউ; যাকে দেখা যায় না। সে যেমন নাচায় উনি তেমনই নাচেন। সকলি হয় তাহারই ইচ্ছায়–উনি নিমিত্ত মাত্র। তবে

তবে কখনো কখনো রথ পথ মূর্তি নিজেকে দেব ভাবে। একজন দাড়িঅলা বুড়ো বলে গেছে। ওনারও সেই ভ্রম হয়েছে। অ্যাই এ্যাম হেড অব দি ইনস্টিটিউশন।

.

এই চেয়ার-উনি যেটায় বসে থাকেন, সেই চেয়ারে আগে অন্য একজন বসত। আমি তাকে দেখিনি, শুনেছি তার নাম ছিল সন্দীপ মাস্টার। তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ন্যায় নিষ্ঠাবান আদর্শপরায়ণ একজন শিক্ষক। যখন তখন তাকে যে কোনো কাগজ এগিয়ে দিলে চোখ বুজে সই করে দিতেন না। কী এবং কেন, সত্য তথ্যের অনুসন্ধান নিতেন। প্রশ্নের জবাবে অযুক্তি কুযুক্তি দৃষ্ট হলে আর কোনভাবে তার না কে হা করানো যেত না।

এটা একটা সমস্যা। ফলে কোনো এক অদৃশ্য আঙুলের ইশারায় এই স্কুলের একটা চক্র সক্রিয় করে তোলা হল সন্দীপ মাস্টারের বিরুদ্ধে। আমি ঠিক জানিনা সেই চক্রের পিছনে এই স্কুলের যারা সর্বময় কর্তা, কেউ ছিলেন কিনা। আমার পক্ষে এটাও বলা সম্ভব নয় যে সেই সময় কর্তাদের কেউ রাজভবন কেউ আলিমুদ্দিনে থাকেন কিনা? সে জানতেন সন্দীপ মাস্টার। কিন্তু তিনি মুখই খোলেননি। কী এক ভয়ে চুপচাপ পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে নিরুদ্দেশে চলে গেছেন। আর জীবনে কোনদিন এই স্কুলের ত্রিসীমানায় আসেননি।

এখন টিচার ইনচার্জ তার অস্ত্র পরিবর্তন করে। শেল, শুল, গদা, ধনুক বিবিধ মারণাস্ত্র তার অস্ত্রশালায়। ঠিক আছে, মানছি দাসদা বলেছে। আপনি গিয়ে ফোন করতেন। বউদিকে কেন সাথে করে নিয়ে গেছেন? আপনি স্টাফ কিন্তু উনি কে? এটা কী পাবলিক বুথ নাকি যে যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়ে যাবেন। এটা অফিস, এখানে একটা ডিসিপ্লিন আছে। যা ইচ্ছা তা করা যায় না, এটা মনে রাখবেন। কথা শেষ করে বীর দর্পে তিনি যেমন এসেছিলেন তেমনই ফিরে নিজের অফিস ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

তার ব্যবহারে এখন দারোয়ান দাস ভীষণ বিপন্ন। বলে সে, মনোরঞ্জনদা, আমি একদম বুঝতে পারিনি দাদা যে বড়দি এইরকম খেপে উঠবে। বুঝলে কক্ষনো আপনাকে ও ঘরে ফোন করতে পাঠাতাম না। সবাই করে তাই আমি ভাবলাম।

বলি–আমার যদি দোষ বলেন তো দোষ, আর গুণ বলেন তো গুণ। ছোট বেলা থেকেই আমার অভ্যাস, আমি কারো ধার বাকি কিছু রাখিনা। যে আমাকে অপমান করে সে অপমান সময় সুযোগ এলে সুদে আসলে ফিরিয়ে দিই। উনি আজ আমাকে দিলেন, সব আমার কাছে জমা রইল। দুদিন আগে আর দুদিন পরে–একদিন এ দান আমি ফিরিয়ে দেব। ঋণ রাখব না।

রামকৃষ্ণদেব বলেছেন–যে সয় সে রয়, যে না সয় সে নাশ হয়। আমার জিনগত ত্রুটি হল মোটে সইতে পারি না। তাই রইতে পারি না কোথাও। বার বার স্থান অস্থান বদলে বদলে যায় জীবনের।

অপমানটা অনুর বুকেও নিদারুণ ভাবে বেজেছে। বলে সেচলো আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। আমি মায়ের ওখানে যাব। যখন তোমার সময় হবে তালদি যেও। না পারলে না যেও। কিন্তু আমাকে আর কোনোদিন তোমাদের এই স্কুলে আসতে বোলো না। এর চেয়ে তো আমাদের জঙ্গলের গোণ্ড আদিবাসীরা অনেক ভদ্র অনেক ভালো। মানুষকে সম্মান দিতে জানে। ছিঃ

আদিবাসীরা ভালো, কারণ তারা রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, মার্কস পড়ে না। যেদিন তা পড়বে ওরাও এই রকম জংলি হয়ে যাবে। এটা রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের দোষ নয়। বিদ্বান হয়ে যাওয়ার দোষ। এই বিদ্যাকে সঠিক চিনেছিলেন চারু মজুমদার। তাই বোধহয় বলেছিলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যে যত পড়ে, সে তত মুখ হয়।

.

জীবন এক যন্ত্রণার নাম। জীবন এক ভারবাহী পশুর মতো পথের পাথরে হোঁচটে ঠোক্করে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে এগিয়ে চলার নাম। জীবন এক যুদ্ধ। ফিরে দাঁড়ানো, প্রত্যাখ্যান করা সেও জীবনের ধর্ম। জীবন এক নির্মম অভিজ্ঞতার নাম। পথের বাঁকে বাঁকে কুড়িয়ে নেওয়া নুড়িতে শূন্য ঝুলি পূর্ণ করে নেওয়া। কে বলতে পারে কোন নুড়ির বুকে কী রঙ গোপন আছে। কোন পাথরটা–পরশ পাথর।

আমি কী কোনোদিন জানতাম যে জেলখানার উঁচু দেওয়ালটা একদিন কঠোর থেকে কঠোরতর মনে হয়েছিল, আজ সেই জেলবাসের পুঁজি ভাঙিয়ে লেখক হয়ে যাব।

তাই এখন আমার মনে হয় এই যে লাঞ্ছনা এ-ও ব্যর্থ যাবে না। যে বিষ আমি আজ পান করছি একদিন অমৃত হয়ে উঠে আসবে কলমের ডগায়। একদিন…।

.

একজন লোকের নাম–পালদা। এই স্কুলে সে দারোয়ানের কাজ করে। খুব ছোটবেলায় তার পোলিও হয়েছিল। এই রোগে শরীরের একটা দিক সম্পূর্ণ অসাড় অবশ হয়ে গেছে। হুইল চেয়ার তো লাগে না, তবে হাঁটতে তার খুবই কষ্ট হয়। বেঁকে বেঁকে ফেন পা খোঁড়া, কোনো কাঁধে জোয়াল চাপানো জন্তুর মতো অতি কষ্টে শরীরটাকে টেনে টেনে সামনে আগায়।

লোকটা অতি শান্ত সংযত অতি নিপাট একজন ভালো মানুষ। কারও কোনো ঝামেলায় থাকে না। আসে ডিউটি করে বাড়ি চলে যায়। নিপীড়ক ওয়ার্ডেন এই লোকটাকেও ছাড়ে না। কোনো মানবিকতা, দয়া-দরদ দেখায় না, সুযোগ পেলেই তাকে পীড়ন করে। সুযোগ না পেলে সুযোগ বানিয়ে নেয়। সে হাজিরা দিতে আসে সাইকেলে। যে পথে আসে হাজার একটা পান বিড়ি সিগারেটের দোকান। ইচ্ছা করলেই সাইকেল থামিয়ে সে কোনো দোকান থেকে সিগারেট কিনে নিতে পারে। কোনোদিন কেনে না। ডিউটিতে এসে গেটে সাইকেল দাঁড় করিয়েই পকেট থেকে কিছু খুচরো পয়সা বের করে কেউ একজনকে বলবে–একটা ফ্লেগ নিয়ে এসো।

.

সিগারেট সে খুব ঘন ঘন খায় কিন্তু একবারে এক প্যাকেট কোনোদিন কিনবে না। নেশা চাগাড় দিলেই একজনকে ফের দোকানে পাঠাবে আর একটা কিনে আনতে। তার যুক্তি, পকেটে থাকলে বেশি খরচা হয়ে যায়। দিনের মধ্যে দুঘন্টা ডিউটি করে, এই দু ঘন্টায় কমপক্ষে চার বার কাউকে না কাউকে ছুটতে হয় তার নেশার খোরাক আনতে। এক আধবার আমার ভাগেও এই কর্মের ভার পড়ে। তার একটু সাইকেল থামানোর কষ্ট, দুটো মিনিট সময়ের অপচয় বাঁচাতে আমি তিনতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নামি, সিঁড়ি ভেঙে উঠি-আধ মাইল পায়ে হাঁটি। আমার কষ্ট তার কাছে কোনো কষ্ট নয়, তার সাইকেল থেকে নামাটাই বড় কষ্ট।

আগে এমন ছিল না, তখন মানুষ মানুষের দুঃখ কষ্ট বুঝত। সেই সংবেদনশীল মনটা কী করে যে মরে গেল! এখন পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র একদল আধা জন্তু আধা দানবের বড় দাপাদাপি চলছে।

এক একটা সময় এমন আসে, যাকে ইতিহাসে কালোদিন অন্ধকার যুগ এই সব অভিধায় অভিহিত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন সেই অরাজক অন্ধকার পর্ব চলছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেওয়া দুর্বৃত্তায়নের নীচে দমচাপা মানুষ বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদ করছে। কে কাকে বাঁচাবে? সব মানুষই এখন ভীত ত্রস্ত বাকহারা।

সেটা ছিল পৌষ কী মাঘ মাসের রাত্রির আটটা সাড়ে আটটা। সারাদিন থম মেরে–শেষে বিকেল থেকে বৃষ্টি নেমেছিল ঝিরঝির করে। সেই সাথে কনকনে বাতাস। শীতে সারা অঞ্চল কুঁকড়ে গিয়েছিল সেদিন। বৃষ্টির সেই বরফ জল গায়ে লাগলে যেন লোমকুপ থেকে শরীরের মধ্যে ঢুকে কামড় বসাচ্ছিল হাড়ে। হাত পায়ের আঙুল বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় সাইকেল চালিয়ে গেটে এসে থামল ওয়ার্ডেন। অভ্যাস মতো পকেট হাতড়ে বের করল পয়সা। উঃ রে বাপ, ঠাণ্ডায় যেন জমে গেলাম। আনো তো পালদা একটা ফ্লেগ। সিগারেট না টানলে আর চলবে না। বলে এগিয়ে দিল পয়সা ধরা হাত পালের দিকে।

ওয়ার্ডেনের দেহ রেন কোটে ঢাকা। বাড়ি থেকে বেরই হয়েছে বৃষ্টির মধ্যে। পাল যখন এসেছে তখন আকাশ ছিল পরিষ্কার, ছাতা, রেনকোট আনবার দরকার ছিল না। এখন এই বৃষ্টিতে ভিজে সেই বাসরাস্তায় অচল অক্ষম শরীরটা শামুকের মতো টেনেটেনে সিগারেট আনতে যাবার কথায় তার দুটো চোখে এক অসহায় আর্তনাদের ছবি ফুটে উঠল। এমনভাবে তাকাতে লাগল, যেন সে বিশ্বপিতার কাছে কাকুতি করছে দয়া কর প্রভু।

দয়া, ওয়ার্ডেন লোকটার অভিধানে দয়া বলে কোনো কথা নেই। কষাই কোনো ছাগ শিশুকে না কেটে দয়া করে ছেড়ে দিতে পারে, সে ছাড়বে না। সেই যেমন নড়াচড়া করলে কাঁকড়া আরও জোরে কামড়ে ধরা ঠ্যাংয়ের জোর বাড়িয়ে দেয়, তাতে নিজের ঠ্যাং যদি ভেঙে যায় তাও যাক। সেই রকম কোনো কাজ পারব না পারছি না বললে ওয়ার্ডেন আরও চাপ বাড়ায়–সেই কাজ তাকে দিয়ে করিয়েই রেহাই দেয়। আমি যখন বলেছি যদি মরে যাও তবু সেটা করতেই হবে। এমন সেনা কমান্ডার তুল্য অনমনীয় সে।

আজ তাই বেচারা পাল, এক পা টেনে টেনে খুঁড়িয়ে হাঁটা একজন প্রতিবন্ধী মানুষ না বলতে পারল না। সেই প্রবল শীতে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ভিজে একটা ভারবাহী পশুর মতো হাঁটা দিল সামনে সিগারেট দোকানের দিকে। তার ডিউটি শেষ হতে এখনও ঘন্টা দুয়েক বাকি। এই সাত স্যাঁতে জামা কাপড় গায়ে রাত দশটা পর্যন্ত থাকতে হবে তাকে। ওয়ার্ডেনও সেটা জানে। জানে বলেই এক পৈশাচিক আনন্দ তার চোখে মুখে ঢেউ খেলছে। গেটে দাঁড়িয়ে আশ মিটিয়ে সে দেখছে পালের হেঁটে যাওয়া।

আমিও তাকে দেখি। মনে হয় যেন পাল নয়, পা টেনে টেনে যে হেঁটে যাচ্ছে সে আমি, আমারই খণ্ডিত সত্ত্বা, দুর্বল অসহায়…। বুকটা কী এক বেদনায় যেন মুচড়ে ওঠে। কী এক ক্রোধে যেন বুকের কোনও নিভৃত কক্ষে আগুন জ্বলে ওঠে। সেই কবে কতযুগ আগে একটা সিনেমা দেখেছিলাম–ছবির নাম দিবার’,নায়ক অমিতাভ বচ্চন। মনে পড়ে যায় সেইছবির একটা সংলাপ। আগলে হপ্তা আউর এক আদমি ইনকার করে গা।

একটা কারখানা-মজুর বিজয় যেখানে সদ্য কাজে যোগ দিয়েছে। সে মাইনে পাবার দিন দেখে যত মজুর মাইনে নিচ্ছে প্রত্যেকের মজুরি থেকে একটা অংশ কিছু গুণ্ডার দাদা সেলামি বাবদ জোর করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তার শ্রমে ঘামের মূল্য লুঠ হয়ে যাচ্ছে।

একজন বৃদ্ধ মজুর পারিবারিক কিছু অসুবিধার কারণে সেদিন দাদা সেলামি দিতে আপত্তি জানায়, গুণ্ডাদের দয়া চায়। তখন গুণ্ডারা তাকে বেদম মারধোর করে টাকা কেড়ে নেয়। সব মজুর দাঁড়িয়ে দেখে, কেউ গুণ্ডাদের বাধা দেয় না।

সমাজে সর্বত্র তো এই চলছে। অন্যায়কারিরা সংখ্যায় খুব কম, তবু তারা দৌরাত্ম করে যেতে পারে। কারণ মানুষ এগিয়ে এসে বাধার পাহাড় হয়ে সামনে দাঁড়ায় না। সেনা দাঁড়াক, তবে আজ আমি দাঁড়াব। যেন জগতের সব দুর্বল অসহায় মানুষের প্রতিনিধি আমি। আর সব অত্যাচারী মানুষের প্রতিনিধি ওই ওয়ার্ডেন। মনে মনে বলি, আগলে বার এক আদমি ইনকার করেগা।

.

বড় সাহেব বেশিরভাগ দিনই সন্ধের পর এখানে আসে। সে আসা মাত্র হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কে কত তৎপর প্রদর্শন বাতিক চেগে ওঠে। তার মুখ থেকে হাঁ বের হওয়া মাত্র লোকে হাওয়া ধরতে ছুট মারে। ওয়ার্ডেনও জনগণের কাছে সেই সেবা সেই মনোযোগ দাবি করে। কিছু মানুষও তো তেমন আছে যারা ক্ষমতাবানদের তোষামোদ, লেজুরবৃত্তি করতে ভালোবাসে। ফলে কিছু পরিমাণে সেও সেবাযত্ন পায় বইকি। ওয়ার্ডেনও স্কুলে এলে কিছু লোক তটস্থ হয়ে ওঠে। কীভাবে দাদাকে তুষ্ট করবে সেই ভাবনায় অস্থির হয়ে ওঠে। সে গেটে পা রাখা মাত্র ব্যস্ত সমস্ত হয়ে কেউ না কেউ ছাদের দিকে মুখ করে চিৎকার ছোঁড়েরঞ্জনদা, চা বসাও।… দা এসে গেছে। যেন এক মিনিট দেরি হলে চা বিহনে দাদার প্রাণ চলে যাবে।

একদিন চা পান শেষ করেই অভ্যাসবশে খুচরো পয়সা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দেয় হাতটা–যান চট করে একটা ফ্লেগ নিয়ে আসুন।

আজ আমি সে পয়সা তুলে নিয়ে ছুট মারি না। দাঁড়িয়ে থাকি রণক্ষেত্রে ঘটোৎকচের মতো। আসুক একাঘ্নীবান, বুক পেতে নেব।

বলি–আমি এখন যেতে পারব না।

যেতে পারবেন না মানে!

উনুনে ভাত বসানো আছে। গলে যাবে।

যাবেন আর আসবেন। কত সময় লাগবে। যান এক ছুটে গিয়ে নিয়ে আসুন। সিগারেট না খেলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।

বলি–এত যদি নেশা আসার পথে একটা নিয়ে এলেন না কেন? পথের দুধারে তো কত দোকান।

ওয়ার্ডেন আমার মুখে দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

বলি আমি–কথায় বলে নিত্য মরাকে কে দেয় কাঠ আর নিত্য উপোসীরে কে দেয় অন্ন। এক আধদিন হলে সে ঠিক আছে। রোজ কে আপনার জন্য হাতের কাজ ফেলে দোকানে দৌড়বে। সে যে যায় যাক। আমি যাব না। আমাকে আর কোনোদিন বলবেন না।

আপনি আমার আন্ডারে কাজ করেন?

করি।

তাহলে আমি যা বলব আপনি শুনতে বাধ্য।

না, মোটেই বাধ্য নই। আপনি বলবেন তাল গাছের মাথায় চড়ে যাও আর আমি চড়ে যাব। একদম নয়। তাছাড়া এটা আপনার ব্যক্তিগত কাজ, স্কুলের কিছু না। আপনি আমাকে ওই কাজে লাগাতে পারেন না। সেটা বেআইনি।

যেন ভূত দেখার মতো আমাকে দেখে ওয়ার্ডেন। দেখে তাকে ঘিরে থাকা স্তাবকের দলও। মানুষের জীবনে এমন এক একটা সময় আসে যখন ঘুরে দাঁড়াতে হয়। প্রত্যাঘাত করতে হয়। লাভের চেয়ে তাতে ক্ষতি হয়তো বেশিই হয়, তবু মনের কাছে নিজের মাথাটা অনেক উঁচু দেখায়। নিজের কাছে নিজের সম্মান বেড়ে যায়।

এখন আমার মনে হয় ছোট হোক–তবু একটা আঘাত তো দিতে পারলাম এক দাম্ভিককে। এটাই অনেক।

***

আজকে আবার আর একবার বাল্যবন্ধুর সাথে আমার ঝগড়া হয়ে গেল। সেই চুরির কেসের পর থেকে উনি সর্বদাই আমার উপর রেগে আছেন। ছুতোনাতায় ছোট বড় কথা বলেই চলেছেন। তবে আজকের ঝগড়াটা বেধেছে আমারই দোষে। আজকে সত্যিই আমার দোষ।

আজ তিনি চলে এসেছিলেন ছাদে স্নান করবেন বলে। শীতকাল হলে আলাদা কথা। তখন। উনি ক্কচিৎ কদাচিৎ স্নান করেন। জল গরম করিয়ে নেন। তবে এটা তো গরম কাল। এখন স্নান করায় কোনো দোষ নেই কষ্টও নেই।

ছাদে একটা জলের কল আছে যেখানে বাসনপত্তর মাজা ধোয়াও হয়। স্নান করার শখ হলে উনি এখানে চলে আসেন। বাল্যবন্ধুর স্কুল, উনি যেখানে যা ইচ্ছা তা করবেন বাধা কে দেবে? ওনার রোজ দুতিন ঘন্টা ফোন করা নিয়ে টিচার ইনচার্জ একদিন কিছু একটু বলেছিলেন। উনি তাকে এমন ঝাড় দেন যে পালাতে পারলে বাঁচেন।

উনি যে ঘরে থাকেন গ্রাম দেশের কয়েকটা দরিদ্র কিন্তু মেধাবি ছেলে থাকে। বাবা মায়ের সে ক্ষমতা ছিল না পড়াবে। বড় সাহেবের হাতে পায়ে ধরে ব্যবস্থা করেছে এখানে থাকা খাওয়া পড়ার। তারা কলকাতার নানান কলেজে পড়ে। হয়ত তারা রাত জেগে পরীক্ষার পড়া তৈরি করছে তখনই বাল্যবন্ধুর শখ হল একটু দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবেন। টেপ রেকর্ডার ক্যাসেট সব আছে ওনার। ব্যস ফুল ভলিউমে চালিয়ে দিলেন–আকাশ ভরা সূর্য তারা…। তখন পড়ুয়া ছেলেদের সামনে দুটো পথ খোলা থাকে–হয় বই বন্ধ করে গান শোনা, নয়তো বই বগলে নিয়ে চলে যাওয়া অন্য কোনোখানে। নালিশ করবে। কার কাছে করবে নালিশ? টিচার ইনচার্জ?

সে একদিন এমন ঝাড় খেয়েছে যে নিজের নালিশ নিয়ে বড় সাহেবের কাছে ছুটছে। সেদিন বেশ সাবান টাবান দিয়ে ছাদে বসে চান করেন সারেন বাবু। তারপর লুঙ্গি গামছা আন্ডারওয়ার সব গামলায় ফেলে হেলে দুলে নেমে যান নীচে, নিজেদের ঘরে। যাবার আগে আমাকে হুকুম দিয়ে যান–ওগুলো ভালো করে ধুয়ে ছাদে মেলে দিও। শুকিয়ে গেলে আমার ঘরে দিয়ে এসো।

কথাটা শুনি কিন্তু মাথায় থাকে না। আমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান থেকে বের হয়ে যায়। গামছা আন্ডারওয়ার যেমনকে তেমন জলের গামলায় পড়ে থাকে। বিকালে হাতের কাছে গামছা না পেয়ে ছাদে এসে দেখেন বাল্যবন্ধু তখনও গামছা গামলায় ভাসছে।

মনোরঞ্জন।

বলুন।

আমার লুঙ্গি গামছা কই?

যেখানে রেখে ছিলেন সেখানেই আছে।

ধোওনি, কেন?

আন্ডারওয়ার ধুতে ঘেন্না করে।

ঘেন্না করে। বাবু অবাক এবং ক্রুদ্ধ। চোখে যেন আগুন জ্বলে ওঠে তার। গলায় গরম ভাপ–আমি চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ।

জানি তো।

কী? কী জানো?

আপনি চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ। তাতে কী হল? আপনার আন্ডারওয়ার তো আর তা না। ও আমি ধুতে পারব না। আমি রাধুনি, ও সব ধধাওয়া আমার কাজ নয়।

এরপরই বেধে গেল তুমুল ঝগড়া। বাবু সে ঝগড়ার ইতি করলেন শেষ কথা বলে–আমি কেস্টোরে কমু। তোমার বহুত ত্যাল হইছে। যারে যা না কওনের তা কইতে আছে। পাইছো কী তুমি।

আর একটা ঝগড়া হয়ে গেল টিচার ইনচার্জের সাথে। তখন বেলা প্রায় আড়াইটা বাজে। সেই সময় চান করে খেয়ে সিঁড়ির উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। বিশ্রাম বলতে একটু পড়া একটু লেখা। এখন নব উদ্যমে আবার লেখা শুরু করেছি। ‘অদল বদল’ মাসিক পত্রিকায় প্রতি মাসেই একটা করে গল্প ছাপা হচ্ছে, এ ছাড়া সাপ্তাহিক ‘বহুজন নায়ক’ পত্রিকায় ধারাবাহিক জীবন চণ্ডাল উপন্যাসটাও আছে। দিতে হচ্ছে কিছু অন্য পত্রিকার জন্যও নতুন লেখা। এই সময়টাতেই অনেক পত্রিকায় লিখেছিলাম কিছু লেখা।

এখানে এক বিখ্যাত টিভি সিরিয়াল নির্মাতার একটা প্রাসাদোপম বাড়ি আছে। সে মাঝে মাঝে তার শুটিং করতে পুরো ইউনিট নিয়ে স্কুলে চলে আসে। বড় সাহেবের অনুমতি আছে। ফলে সেদিন পুরো স্কুল একটা স্টুডিও হয়ে যায়। এখানেই সেই পরিচালকের সাথে কেরানী রায়ের আলাপ পরিচয়। একদিন তাকে পাকড়াও করে, আপনার সিরিয়ালে আমাকে একটা পার্ট দিন।

অভিনয় করেছেন কখনো? জানতে চায় পরিচালক।

করিনি। তবে অনেক নাটক সিনেমা দেখেছি। একটা চান্স দিয়ে দেখুন আমি ঠিক পিরবো।

অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না পরিচালক মহাশয়। সেই দিনই উনি তার সিরিয়ালে একটা পার্ট দিলেন কেরানী রায়কে। সেটা একটা ডাক্তারের রোল। চেহারাটা রায়ের ঠিক ডাক্তারের মত বানাতে মেকআপম্যান প্রায় দেড় ঘন্টা সময় নিয়েছিল। সেজেগুজে রায় বসে রইল আরো প্রায় এক ঘন্টা। তারপর এল সেই শট নেবার মহেন্দ্রক্ষণ। খুশি খুশি মনে সে পৌঁছাল শুটিং স্পটে। একটা লোক চিৎপাত হয়ে ঘাসের উপর পড়ে আছে। রায় ওরফে ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে তার নাড়ি দেখল। তারপর কার উদ্দেশ্যে যেন বলল–হি ইজ ডেড। সাথে সাথে পরিচালকের গলাকাট। তারপর শট ওকে। জীবনে সেই প্রথম আর সেই শেষ অভিনয়। এই অভিনয়েই তার নতুন নাম হয়ে গেল ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। তবে সবটা আর লোকে বলে না। বলে শুধু, ডাক্তার রায়।

আমি যে একটু লেখাপড়া নিয়ে আছি সেটা অনেকের ঠিক পছন্দ ছিল না। যার মধ্যে অন্যতম অফিসের কেরানিবাবু ডাক্তার রায়। ওনারই সেই বিখ্যাত উক্তি কুঁজোর চিৎ হয়ে শোবার শখ। যে উক্তিকে পরবর্তীকালে আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় অমর করে দেবেন সাংবাদিক ঋজু বসু।

ডাক্তার রায়-এর বিবেচনায় আমি এইভাবে সময়ের অপচয় না করে সেই সময়টা স্কুলের কাজে খরচ করি, যদি তার বা টিচার ইনচার্জের ফাইফরমাস খার্টি, সেটা যথার্থ হয়। ফাইফরমাস বলতে একটু চা ফা বানানো, বোতলে বোতলে জল ভরে বাবুদের বিশ্রামাগারে পৌঁছে দেওয়া, বাজারে দোকানে গিয়ে টিফিনটা, পান সিগারেটটা কিনে আনা। চতুর্থ শ্রেণির সব কর্মী এসব করে। কেউ না বলে না, শুধু আমি বলি। তাই আমার উপর ডাক্তার রায়ের রাগ। সেই রাগ প্রকাশ হয় ব্যঙ্গ বিদ্রূপ উপহাসের মাধ্যমে।

সে জানে না, তার জানার কথাও নয় যে চেষ্টা থাকলে কুঁজোও চিৎ হয়ে শুতে পারে। আমি ইতিমধ্যে চিৎ হয়ে গেছি চেষ্টার দ্বারা। সমাজ যাদের সম্মান করে সেই সব সম্মানীয় মানুষদের অনেকে আমার জীবন সংগ্রাম এবং লেখার প্রয়াসকে সাধুবাদ দেয়।

এই সবের ফলে আমার একটা ক্ষতি হয়ে গেছে। আত্মসম্মান বোধ বড় প্রবল হয়ে গেছে। আমি স্রষ্টা আমি শিল্পী, আমি শোষিত বঞ্চিত দলিত অত্যাচারিত প্রতিবাদী মানুষের মুখপাত্র। আমি যা লিখি–লেখার মধ্যেকার সেই প্রতিবাদমুখিনতা সঞ্চারিত হয়ে গেছে ব্যক্তি জীবনেও। সৃষ্টি এবং স্রষ্টা এক অবচেতন সময়ে মিলে মিশে একাত্ম হয়ে গেছে।

সেদিন দুপুরে সিঁড়িতে বসে একটা গল্প লিখছিলাম। এমন সময় ডাক্তার রায় আমাকে খুঁজতে এসে সেই অবস্থায় দেখে চোখ কুঁচকে বাঁকা হাসি হাসে। জানতে চায়–এটা কী হচ্ছে?

বলি, গল্প লিখছি।

ডাক্তার রায়ের জিভে যেন করাতের ধার–গল্প লিখে কী করবে? লেখক হবে! লেখক!

যদি হই আপনার কোনো আপত্তি আছে?

মুখ বেঁকিয়ে বলে ডাক্তার রায়, নিজের নাম লিখতে গাঢ় ফেটে যায়, সে হবে লেখক। পোঙায় নাই চাম–হরিকিষ্ট নাম। যান গিয়া কাপ দশেক চা বসান। বড়দির বাড়ি থেইক্যা লোক আইছে। আগে জল টল দেন। লিখন পড়ন ছাড়েন।

এতক্ষণ চোখে পড়েনি পিছনে আর একজন আছে। ডাক্তার রায়ের কথা শুনে হাসছে সে। শরীর জ্বলে আমার।

বলি, বড়দিকে গিয়ে বলেদিন, আমি এখন চা বানাতে পারব না। এটা আমার বিশ্রামের সময়। সকালের ডিউটি শেষ হয়ে গেছে। বিকালের ডিউটি শুরু হবে যখন তার কথা শুনব।

যা বলেছি, যেভাবে যে ভাষায় বলেছি সেটা তো রাজদ্রোহতুল্য অপরাধ। ডাক্তার রায় দ্রুত নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে নীচে।নালিশ করার একটা মস্ত সুযোগ ছাড়বে কেন? আর এটা তো আমার জানা কথা–যা বলেছি শুনলে সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। উঠলেনও তাই। তিনিও তার বাড়ির লোকের সামনে নিজের প্রতাপ দেখাবার এমন সুযোগ ছাড়বেন কেন?

ছাদের সিঁড়িতে বসেই তার গর্জন শুনি–কেউ ওকে ডাকো তো।

ডাকতে এল বিহারি দারোয়ান। টিচার ইনচার্জ ডাক্তার রায়ের একান্ত অনুগত সে। স্কুলের কে কোথায় কী করছে, কী বলছে সব তার মাধ্যমে তারা পেয়ে থাকেন। বিহারি বর্তমানে সর্বক্ষণ স্কুলেই থাকছে। কিছুদিন পরে অন্যত্র থাকবে। সে জানে চাকরির প্রধান শর্ত বসের নেক নজরে থাকা। এখানে কাজ করা বা না করার কোনো গুরুত্বই নেই। বস খুশ তো সব খুশ।

এখন আমাকে টিচার ইনচার্জের সামনে যেতেই হয়। তার ঘরে ঢুকে দেখি আরো অনেক লোক। একজন তার মেয়ে, অন্যজন, যে তার জামাই হবে। আর একজন তার ছোট ভাই ছিল সম্ভবত।

রাগে গড়গড় করে বলেন তিনি, রায়দা আপনাকে চা বানাতে বলেছে। আপনি বলেছেন পারব না। বলেছেন?

বলেছি। ভয় পাচ্ছি না আমি, গলা বুক কাঁপছে না আমার। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ–এই দর্শনের উপর সুদৃঢ় আস্থায় শ্রম শ্রমিক মুনাফা মালিক নিয়ে আমি যদি কোন গল্প উপন্যাস লিখি, একজন শ্রমিক প্রতিনিধি মালিকের প্রতিনিধির সামনে যে যুক্তির অবতারণা করবে, এখন তাই করি। বড়দি যেরকম তার বাড়ির লোকেদের সামনে নিজের প্রতাপ প্রভাব দেখাবেন বলে আমাকে ডাকিয়ে এনেছেন, আমিও তো আমার শ্রেণির পক্ষ থেকে সচেতন সাহসী প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিচ্ছবি দেখাতে ইচ্ছুক।

বলি–সকালে সেই আধা অন্ধকার সময় থেকে দুপুর দেড়টা দুটো–প্রায় ছয় সাত ঘন্টা আগুনের সামনে ঝলসেছি। বিকেল থেকে রাত দুপুর, ছয় সাত ঘন্টা আবার খাটতে হবে। মাত্র দুপুরের কয়েক ঘন্টা আমার চান খাওয়া বিশ্রামের সময় থাকে। সেই সময় টুকুতেও যদি বিশ্রাম না দেন তাহলে কী করে পারা যায়।

রেগে ছিলেন দত্ত বাড়ির বউ। এখন আরো রেগে যান। বলেন–ওই সব বলবেন না। বলে কোনো লাভ হবে না। যারা রান্না করে তাদের চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি। আপনি তো জেনে বুঝেই এই চাকরি করতে এসেছেন। যখন যা বলা হবে তখন তা করতে হবে।

কে আপনাকে বলেছে যে যারা রান্না করে চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি তাদের? কোন কেতাবে লেখা আছে এমন অন্যায় কথা, দেখাতে পারবেন?

আমি বলছি।

ভুল বলছেন। ভারতবর্ষের কোথাও আর কারো আট ঘন্টার বেশি ডিউটি করাবার কোনো আইন নেই।

আপনাদের ইমারজেন্সি ডিউটি। অন্য ডিপার্টমেন্টের নিয়ম এখানে চলবে না।

হাসপাতাল, দমকল, পুলিশ, সেনাবাহিনী এইসব কটাই ইমারজেন্সি ডিপার্টমেন্ট। চব্বিশ ঘন্টা চালু। মনে রাখবেন ডিপার্টমেন্টটা ইমারজেন্সি। কিন্তু স্টাফ তা নয়। সবার আট ঘন্টা ডিউটি। কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে যদি কোনো কর্মচারিকে আট ঘন্টার অধিক সময় কাজ করতে হয় তার জন্য অধিক পারিশ্রমিক দিতে হয়। আমি এমনিতেই তো প্রতিদিন তিন চার পাঁচ ঘন্টা বেশি খাটছি। এর বেশি আর পারা যাবে না।

পারতে হবে। এখানে থাকতে হলে পারতে হবে। না পারলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যান।

চলে তো যাবোই। বার বার বলার দরকার নেই। না পারলে তো চলে যেতেই হবে। তবে যখন আপনারা বলবেন–এসো, আসব, যখন বলবেন যাও, চলে যাব, ব্যাপারটা এত সহজ হবে না।

বড়দি এখন বাক্যহারা। কী করবেন আর কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তখন আমি বলি, আপনার বোধহয় মনে নেই, অনেক বছর আগে আমেরিকা নামের এক দেশে শিকাগো নামের এক শহরে একদল শ্রমিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে লড়াই করেছিল। সেই আন্দোলন দমন করতে পুলিশ গুলি চালায়। আর বেশ কিছু শ্রমিক মারা যায়। তখন আন্দোলনরত অন্য শ্রমিকরা তাদের শহিদ সাথীদের রক্ত মাখা জামা কাপড় লাঠির মাথায় বেঁধে ফের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বহু ক্ষয়ক্ষতির পরে তাদের আন্দোলন জয়যুক্ত হয়। সেই থেকে সারা পৃথিবীতে ওই আট ঘন্টা কাজের নিয়ম–আইন চলছে।

বড়দির বাড়িতে একজন রান্নার লোক আছে, তার চেনা জানা বহু লোকের বাড়িতেও রান্নার লোক দেখেছেন। তারা স্বভাব ভীরু, সাত চড়ে রা না কাড়া এক বিরল প্রজাতির জীব। কিন্তু এ তিনি কী দেখছেন। এক রান্নার ঠাকুর রাজনীতির কথা বলছে। আমেরিকা ফামেরিকার গল্প শোনাচ্ছে।

আমি তখনও বলে চলেছি–পরবর্তীকালে যখন শ্রমিক শ্রেণির পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি গঠন হয়, তখন সেই রক্তমাখা জামার অনুকরণে পার্টির পতাকার রঙ লাল রাখে। পশ্চিমবঙ্গে সেই লাল পতাকা বাহক এক পার্টির নেতা বড় সাহেব। তার দ্বারা এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা। সেই স্কুলের প্রধান হয়ে আপনি আমাকে বলছেন আমার চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি? বড় আশ্চর্য কথা তো।

একটু দম নিয়ে আবার বলি–এটা একটা আবাসিক স্কুল। সরকারি নিয়ম অনুসারে আপনি, আমি, হোস্টেল সুপার, দারোয়ান, সুইপার, ওয়ার্ডেন এই ছয় জন চব্বিশ ঘন্টা এখানে থাকব। পুলিশ মিলিটারি যেমন ব্যারাকে থাকে সেই রকম। যেন দরকার পড়লেই পাওয়া যায়। তবে ডিউটি হবে ওই আট ঘন্টাই। আপনার জন্য একটা ছাড় আছে। আপনি ম্যানেজিং কমিটির অনুমতি ক্রমে অন্যত্র থাকতে পারেন কিন্তু তা যেন কোনক্রমে এই স্কুল থেকে তিন কিলোমিটারের চেয়ে অধিক দূরত্বে না হয়।

মুচকে হাসি আমি–অথচ দেখেন বড়দি, আপনি জয়নগর থেকে আসা যাওয়া করছেন। জয়নগর কত দূর। তবু কেউ কিছু বলছে না। ছাড় দিয়েছে।

এবার বড়দি ধৈর্য হারান–এসব আপনি পেলেন কোথায়। কে বলেছে?

বই। বই বলেছে। আপনাকে কেউ বলেনি, আমি বই পড়ি। শুধু পড়ি না লিখিও। লিখতে গেলে তো পড়া লাগে।

আমি যে লিখি সেটা এখনো কারো তেমন একটা বিশ্বাস হয় না। হতে পারে যে অন্য কেউ এমন একজন আছে যার নাম আমার নামে। হতে পারে আমি কারো লেখা নিজের বলে চালাচ্ছি। হতে পারে–কী ছাই যে হতে পারে মাথা মুন্ডু কিছু বোঝার উপায় নেই। ফল মার্কশিট দেখিয়ে চাকরি করছি। হাতের লেখা কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং, ছুটির দরখাস্তে ইনচার্জ বানানের জায়গায় ইনচার্য লিখি, আমি লেখক হলে চামচিকেও পাখি।

টিচার ইনচার্জ ফরসা মানুষ। মেয়ে জামাইয়ের সামনে অপমানে সে মুখ লাল। তর্কে না পেরে সেই ব্রহ্মাস্ত্র ছোঁড়েন তিনি, যে অস্ত্রে আমার মতো সব ছোট কর্মী ঘায়েল।

আমি কিন্তু বড় সাহেব এলে তাকে জানাব। উনি বলে গেছেন এই স্কুলে কোনো ঘড়ি ঘন্টা দেখে কাজ করা চলবে না।

বলি–নিশ্চয় তাকে বলবেন। বলা তো দরকার। কারণ স্কুলটা তো তার। তিনি যা বলবেন তাই তো হবে। আমরা সবাই তো তার চাকর। কেউ কম বেতনের ছোট চাকর কেউ বেশি বেতনের বড় চাকর। মালিক কেউ নই। উনি তো এও বলেছিলেন, সবাইকে সব কাজ করতে হবে। করে সবাই সব কাজ? যে এত বড় নেতা হয়ে নিজে মাথায় করে মাটির ঝুড়ি বয়ে নেন, তার দয়ায় চাকরি পাওয়া লোক এক কাপ চা ঢেলে খেতে চায়না, ওতে নাকি তার সম্মান চলে যায়। বলবেন আপনি যা বলার, আমিও বলব।

কথা শেষ করে আমি আমার ছাদে যাবার সিঁড়িতে সবে পা দিয়েছি, ছুটে এসে আড়ালে টেনে নিয়ে গেল দারোয়ান দাস–কই ছিলেন ঋণ রাখিনা। এত তাড়াতাড়ি ঋণ সুইধ্যা দিবেন ভাবতে পারি নাই।

এই বোধহয় বস্তুবাদী দর্শনের ব্যাখ্যায় ঐক্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবার দ্বন্দ্বের মধ্যে ঐক্য। কোনো এক সময় দাসদা বড়দির কাছে ঝাড় খেয়েছিল। সে কিছু করতে পারেনি। এখন তারই মতো আর এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীর কাছে বড়দিকে অপদস্ত হতে দেখে সে আনন্দিত। এখন আমি তার মিত্র। আর শত্রু নেই। পুরানো শোক ম্লান।

তবে কিছুক্ষণ পরে তার হাসি মুখ কালো হয়ে যায়। বলে–তবু আমার মনে হয় বড়দিকে এইভাবে বলাটা ঠিক হয় নাই। ওনার পোস্টটাতো বড়। তার একটা সম্মান আছে।

বলি–আপনার সেই ইঁদুরের গল্পটা কী জানা আছে?

আছে আছে। বলে দাস, একটা ইঁদুর বিড়ালের তাড়া খেয়ে এক মুনির কোলে গিয়ে লুকায়। তখন মুনি তাকে বিড়াল বানিয়ে দেয়। একদিন বিড়ালটাকে কুকুরে তাড়া করে তা দেখে মুনি বিড়ালটাকে কুকুর বানায়। এইভাবে একদিন কুকুরকে বাঘ বানিয়ে দেয় মুনি। তারপর বাঘ একদিন মুনিকেই খেতে যায়, সেই গল্প তো?

বলি–সেই গল্প তবে একটু ভিন্ন। এখানে একমুনি একপাল ইঁদুরকে কাউকে বেড়াল কাউকে বাঘ এইসব বানিয়ে রেখেছে। আসলে সবাই ইঁদুর–কিন্তু তারা নিজের যোগ্যতায় নয়, মুনির দয়ায় এই সব হয়েছে। যাদের কাছে তারা রোয়াব ঝাড়তে চায়, ঝাড়ুক, আমরা যারা তাদের জন্ম ইতিহাস জানি, আমাদের কাছে কেন? ওরা আমাদের চেয়ে এই জন্য বড় হয়ে গেছে কারণ ওদের অনেক টাকা ছিল। আর কিছু নয়-স্রেফ টাকা। আমাদেরও যদি পাঁচ দশ লাখ খরচ করার দম থাকত, এইট নয়, এম.এ. পাশের সার্টিফিকেট কিনে আনতাম। কে বলতে পারে তখন আমি ওই চেয়ারে বসতাম কী না, যেখানে এখন উনি বসে আছেন।

চমকে ওঠে দাস–চুপ করেন। বিপদে পইড়া যাইবেন।

***

আরাম আয়েশের জায়গা, মাদার কিলার নামে খ্যাত মহিলার এটা সত্যিই বড় আরাম আয়েসেরই জায়গা। বাবু বাড়ির বাসন মেজে রান্না করে করে হাড় কালি হয়ে যাচ্ছিল। এতদিনে সুখ এসেছে কপালে। এই জন্যে লোকে বলে–ভগবানের রাজ্যে দেরি আছে অন্ধকার নেই। ভগবানকা দুয়রমে দের হ্যায় অন্ধেরা নেহী। সে যা হোক, দেরি হলেও পেয়েছেন তো। সেটাই আসল। এখন শেষপাতে পায়েসের মতো সব সুখ চেটে পুটে খাচ্ছেন।

তবে মনে সামান্য একটু কষ্ট-লোকে আড়ালে তাকে মাদার কিলার বলে–সামনে মাসিমা। কিলার মানে যে খুনি আগে সেটা জানতেন না। এখন জানেন। আগে ভাবতেন মাদার টেরেসার মাদার আর হেলেন কেলারের কেলার–এই দুই মহীয়সীর নাম জুড়ে বুঝি তাকে কেউ সম্মান দিয়েছে। সে ভুল ভেঙে দিয়েছে একটি গ্রাম থেকে আসা কলেজে পড়া ছেলে–সম্মান নয়, ওরা আপনাকে অপমান করে। আপনি তো বাচ্চাদের মারেন তাই।

এটা ঠিক যে বাচ্চাদের প্রতি উনি একটু কঠোর। তা বলে একেবারে খুনি। বাচ্চা হচ্ছে একখণ্ড নিরেট পাথর। তাকে হাম্বর মেরে ভাঙতে হয় তারপর ছেনি হাতুড়ি দিয়ে ছাটতে হয়। তবেই তার মূর্তি নির্মিত হয়। বিগ্রহ রূপে মন্দিরে স্থান পায়, পূজিত হয়। এর কোন স্তরে দয়ামায়া দেখাবার প্রশ্নই নেই। সে করলে পাথর মুর্তি হবে না, বাচ্চারা মানুষ হবে না। তাই উনি বাচ্চাদের প্রতি এত নির্দয়, যা নিয়ে লোকে বলে–উনি তো বাচ্চার মা হতে পারেননি, সে কারণে বাচ্চাদের দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায়।

শুধু বাচ্চা নয়–এইমহিলার আবিশ্বের সবকিছুর প্রতি অসম্ভব আক্রোশ। গাছপালা, পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ, মানুষ তো বটেই সব কিছুর উপর সর্বক্ষণ ক্ষেপে আছে। যৌনসুখ থেকে বঞ্চিত বিধবা এই মহিলা যেন বেঁচেই আছে তার অতৃপ্তির চরম প্রতিশোধ নেবার জন্য। কারও কোনো কাজ, কোন কথা, হাঁটা, হাসা, হোস্টেলের মেয়েদের সাজগোজ–এদিক ওদিক তাকানো, ছেলেদের দেখা–সবকিছুতে তার রাগ বেড়ে যায়। তখন চিৎকার করে যাচ্ছেতাই গাল পাড়ে, মেরেও বসে কাউকে কাউকে। আর যদি কারও সাথে ঝগড়া বাধে সে পুরুষ হোক কী মহিলা-তাহলে তো তার মুখের লাগাম থাকে না। কুকুরের বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা তো জলভাত–এমন সব ভাষার প্রয়োগ শুরু হয় যা লেখার অযোগ্য।

কথায় বলে–যার একটা অঙ্গ অকেজো হয়ে যায় তার অন্য কোনো অঙ্গ অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মহিলার গর্ভাশয় অক্ষম-অনুর্বরা-উৎপাদনহীন হয়ে যাওয়ায় পাকস্থলির কার্যক্ষমতা যেন দশ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। সারাটা দিন সে পাগলের মতো রান্নাঘর ঘিরে পাক খায়-কোন্টা নেব কোন্টা খাব এই ধান্ধায়। যা দেখে আমার কাছে রাগত গলায় বলেছিল একজন–মাগীর পেটে ঝ্যান হজম মেশিন বসানো আছে। ইট, পাথর যা ঢোকাবে সব গলে গোবর হয়ে যাবে। আর বাগানের এক মালি বলে–বুড়ি বিষ খায় না মরবার ভয়ে, গু খায় না গন্ধ বলে, নালি সব খায়। একে দেখে আমার মনে হতো–ভগবান বলে যদি কেউ থেকে থাকে তিনি বড়ই বিবেচক। সেই জন্য এর কোনো সন্তান দেননি। যদি এর ছেলে থাকত–ইনি যা হিংস্র এবং আক্রামক-একটা বধু পোড়ানোর ঘটনা অবশ্যই ঘটত। অকালে প্রাণ হারাত কোনো বেচারা।

পৃথিবী বড় বিচিত্র জায়গা। এখানকার নিয়ম বড় অদ্ভুত। এখানে কারও ক্ষতি না করলে কারও উপকার হয় না। কারও উপকার হলে তাতে কারও না কারও ক্ষতি অনিবার্য হবে। রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ রোধ করেছিলেন। তিনি কী জানতেন যে এর ফলে সমাজে বিরাট সংখ্যক যৌনসুখ বঞ্চিত নারীর বৃদ্ধি হবে। তারা তাদের বিকৃত মানসিক অসুখ নিয়ে যখন মানুষের উপর আক্রমণে নামবে, তখন কী সমস্যার সৃষ্টি হবে। মাদার কিলারের সেই আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে একের পর এক পাঁচজন আয়া কাজ ছেড়ে চলে গেছে। যারা বড় গরিব, এই চাকরিটা যাদের জীবন ধারণের জন্য ধরে রাখা জরুরি ছিল।

মাদার…যে বাড়িতে কাজ করত, সেই বাড়িতে বর্তমান সময়ে যারা নেতা মন্ত্রী এক সময়ে তাদের খুব যাওয়া আসা ছিল, সেই সূত্রে তার সবার সাথে চেনা জানা। কিন্তু সে চেনা কোনও কাজে আসেনি। কাজে লাগাবার মতো কোনো ইচ্ছা উদ্যম কিছুই ছিল না তার। সে শুধু সেই বিখ্যাত কুলীন কমরেডের বাড়ির রান্নাঘর, ভাড়ার ঘর, ফ্রিজের রকমারি খাবার আর সে বাড়ির অন্যসব কাজের লোকের উপর নেতাগিরি–এই করে এতটা বছর কাটিয়ে দিল। এই নিয়েই সে সন্তুষ্ট হয়েছিল।

লোকের উপর খবরদারি করা, পীড়ন করা এটা একটা নেশা। এ নেশা যার ধরেছে সব নেশাকে ছাপিয়ে গেছে। জেলখানায় একদল লোককে আর একদল লোকের উপর অত্যাচারের খোলাছুট দিয়ে তাদের কেমন বছরের পর বছর আজ্ঞাবহ বানিয়ে রেখে দেয় জেল কর্তৃপক্ষ।

আমি আমার জাত গোপন করিনি। সেই একবার জাত গোপন করে বামুন বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকে যে অপমান অত্যাচার সইতে হয়েছিল তার পর থেকে আর নিজেকে শুধু নমোশুদ্দুর বলেই থেমে থাকিনা, এও বলে দিই আগে আমাদেরই চণ্ডাল বলা হত।

আমাদের নমঃশূদ্রদের প্রায় সবাই, সে কথা মনে করতে চায় না। মনে পড়লে কষ্ট পায়। একটু পয়সাঅলা হয়ে গেলেই অনেকে নাম-পদবি বদলে নেয়। ছিল মিস্তিরি হয়ে গেছে মিত্তির। ছিল হালদার হয়ে গেল হাওলাদার। ব্যাপারী থেকে ইচ্ছা করলে ব্যানার্জী বলা যায় না এমন নয়, যদি চেহারায় চাকচিক্য আর এক গাদা টাকা থাকে।

আমাদের মাদার…ইনিও এমন কোনো কুলীন কুলবালা নন। তবে বড়লোক বাড়ির ননী মাখনে চেহারায় একটা বাবু বাবু জেল্লা আছে। আর মানসিকতায় তো বামুনের চেয়ে বড় বামনি, সে নমঃশূদ্রদের ঘৃণা করে মুসলমানদের মতোই।

সে যেমন আমাকে ঘৃণা করে, আমিও সমানঘৃণা করি তাকে। সেই যে বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিলেন যদি খারাপ লোকের সাথে ভালো ব্যবহার করি, তাহলে ভালো লোকের সাথে কী করব! আমিও খারাপ লোকের সামনে বুদ্ধের প্রেমবাণী দিতে পারি না।

রবীন্দ্র সদনের সামনে থেকে মিনিবাসে চেপেছি। বেশ ফাঁকাই বাসটা। ড্রাইভারের পিছনের দিকে সিটের কাছে একটি বছর কুড়ির মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবু ঘরের নয়, খেটে খাওয়া ঘরের মেয়ে। আর একটা গুণ্ডা গোছের লোক তাকে ঠেলছে। টাল খেতে খেতে মেয়েটা একেবারে কোনায় সেঁটে গেছে আর কাতরাচ্ছে–একটু সরে দাঁড়ান না। কঁহা হটেগা। জাগা কাহা, বলে সেই দুবৃত্ত গোছের লোকটা।

মেয়েটার দিকে দেখি, বিরক্তিতে তার কুঁচকে যাওয়া কপালে বিন বিনে ঘাম, চোখে ভয়। যাত্রীদের দেখি, রাত এখনও ন’টা বাজেনি এর মধ্যে অর্ধেক যাত্রী কী সুন্দর সিটে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকি অর্ধেক জানালা দিয়ে রাতের কলকাতার অপূর্ব আলোকমালা অবলোকন করে চলেছে।

বয়স আমার কোনকালে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে, সেইকাল কবে পিছনে ফেলে চলে এসেছি–হাতে অস্ত্র দাও আর সামনে দাও শত্ৰু তারপর আমাকে দেখো। যখন লোকে বলত–মদনের পেটে এক পাইট মদ আর হাতে চপার থাকলে একাই একশো।

বারবার এমন হয় না। সে হয়েছিল মাত্র একবারই। যেটা আজও ভোলেনি যাদবপুর স্টেশন রোডের লোক। সেদিন পেটে মদ ছিল হাতে চপার ছিল। তখন পুলিশ খুঁজতো আমাকে। কিছু পুরানো শত্রু আমাকে ধরে চেন দিয়ে বেঁধে ফেলেছিল। খবর দিয়েছিল পুলিশে–আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। তখন মত্ত মস্তিষ্ক আমার বুঝে ফেলেছিল আসন্ন বিপদ। আর তাতে ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে উঠেছিল আমার ভেতরের বন্য বরাহ। এক ঝটকায় শেকল ভেঙে ছুটে গিয়ে তুলে নিয়েছিলাম মাংসের দোকান থেকে একখানা চপার। তখন কত লোক ঘিরে ছিল আমাকে? একশো দুশো। জানিনা, তবে কাছে কেউ আসার সাহস পায়নি, দুর থেকে ইট পাথর ছুড়ছিল আমার দিকে। রক্তাক্ত করছিল আমাকে। আর আমি ওদের আক্রমণ প্রতিহত করে ভেঙে দিয়েছিলাম পাঁচখানা দোকান, ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির মোটর কার, আর সেক্রেটারির চেপে আসা রিক্সা।

ডান হাতে আমার চপার ছিল বাঁহাতে বাঁধা লম্বা লোহার চেন। সেই চেনটা ঘোরাচ্ছিলাম বনবন করে। সেটা একটা পোস্টে প্যাঁচ খেয়ে গেলে–আর পালাতে পারি না। ধরা পড়ে যাই।

বোকামো করে জীবনে বহুবার বিপদে পড়েছি। সারা শরীর পুড়িয়েছি, বেড়ে গেছে শরীরে কাটা ছেঁড়া দাগ। যা মানুষেরই দান। তবু আজও শিক্ষা হয়নি। মাঝে মাঝে ভুলে যাই বয়স, ভুলে যাই স্থান কাল পাত্র। ভুলে যাই মৃত্যুর কথা।

সেটা এক মহালয়ার দিনের বেলা বারোটা। স্কুলের কাজ শেষে বাড়ির পথ ধরেছি। যখন গলি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় পড়েছি, খেয়াল করিনি একটা মোটর সাইকেল আসছে। চালক সেও মত্ত যে পিছনে বসে আছে সেও তাই। দুজনই যুবক। মোটর সাইকেল আমার সাইকেলকে পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। চালক খেঁকিয়ে উঠল, __ মাদারচোদ অন্ধ্যা হ্যায়। দিখতা নেহী?

চারদিকে তাকাই, কাছে পিঠে চেনাজানা কেউ নেই। কেউ যখন দেখছে না, দুটো গালিতে আর কী হবে? যা বাবা, চলে যা, সরি। আমি ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলি। কিন্তু ওরা এত অল্পে থামবে না। মোটর বাইক নিয়ে আমার পিছনে পিছনে গাল দিতে দিতে আসতে থাকে। অসহ্য লাগে আমার। সাইকেল থামিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ি। ওরা চলে যাক। পরে আমি যাব।

না, ওরা গেল না, দাঁড়িয়ে পড়ল, ক্যা করেগা বে! সাইকল বরাক দিয়া! ক্যা কর লেগা তু? আর পারা যায় না, এগিয়ে গিয়ে চালকের সামনে দাঁড়ালাম–গালি কাহে দেতা বে? সে খপ করে আমার কলার ধরলখিচকে শালে তেরেকো পুলিশ পাড়া লেযায়েগা। দেখলাম–সামনের কাঠগোলাটা ভোলা। সাজানো আছে চেলা করা পিস কাঠ। একটা তুলে নিলে দুজনকে পেড়ে ফেলতে দুই মিনিট। কিছু বোঝার আগে শুয়ে পড়বে, তবে আর কেন! এক চড় জমিয়ে দিলাম চালকের গালে–শালে বটি বটি কর দুঙ্গা। রোক দু মিনিট। এক চড়েই তার নেশা হাওয়া। আভি আতা বলে পালিয়ে গেল মোটর বাইক চালিয়ে।

দুজনে ঘুরে দাঁড়ালে সেদিন কী হতো কে জানে। সাময়িক উত্তেজনা কেটে গেলে বুঝতে পারি–একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। সেই বাড়াবাড়ি সেদিন ওই মিনি বাসেও হয়ে গেল। মেয়েটাকে দেখে মনে হল এ আমার মেয়ে। হাসপাতালে সেবিকার ডিউটি করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। এই বাসে আমি ওর বাপ। ওকে বিড়ম্বনা থেকে আমি বাঁচাব। বাপের কর্তব্য করব। যে ঘুমাচ্ছে ঘুমাক–আমি জেগে আছি।

এগিয়ে গেলাম লোকটার সামনে। টের পেলাম তার মুখে সস্তা মদের তীব্র গন্ধ। বললাম-বাসে তো অনেক জায়গা, ওদিকে সরে যাও না। লেডিস সিটের সামনে কেন দাঁড়িয়ে আছো!

লাল ঢুলু ঢুলু চোখে সে আমাকে দেখল, পাত্তা দিল না। কহাঁ জায়েগা! জাগা কঁহা!

এবার লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম–এই যে জায়গা।

তখন উড়াল পুলের কাজ চলছে। রাস্তা জ্যাম। লর্ড সিনহা স্টপে এসে বাস দাঁড়িয়ে পড়েছে। আর আগাচ্ছে না। লোকটা বাস থেকে নীচে নেমে কোমর থেকে একটা ক্ষুর বের করল। আয়, এ্যাই বুড়া চোদ্দা, লিচ্চে লেবে আয়। শালে–।

আমাকে ডাকছে।বড় আদরের ডাক। আমি নেমেই যাচ্ছিলাম। পথ রোধ করল সেই মেয়ে, জেই যাবেন না–ক্ষুর মেরে দেবে। তাই নামা হয় না। যতক্ষণ বাস দাঁড়িয়ে থাকে সে সমানে গাল দিয়ে যায়। তবে বাসে ওঠে না।

বাস ছাড়ার পর ঘুমন্ত লোকেরা জেগে ওঠে। ঝপায় আমার উপর। কী দরকার মশাই ফালতু ঝামেলার। যদি ও ক্ষুরটা নলিতে টেনে দিত কী করতেন। এত সাহস দেখাবেন না। বিপদে পড়ে যাবেন।

একজন বলে–এগুলোর যা বাড় বেড়েছে। এদের সাইজ করার জন্য দরকার একজন মোদির। সব এদের তেল দেয় ভোটের জন্য। বাপের ব্যাটা একমাত্র নরেন্দ্র মোদি।

মোদি কেন একমাত্র বাপের ব্যাটা, আমি তা জানি না। মোদি যদি এদের সাইজ করে যোবা স্কুলের হার্মাদদের কে সাইজ করবে। একদিন সরল সোজা মানুষ বোতল খুলে যে দৈত্যকে মুক্ত করেছিল, কে তাকে আবার বোতলবন্দী করবে?

এখনও তার কোন লক্ষণ নেই। এটা শূন্য দশক যে। চারদিকে শুধু শুন্য। হাসপাতালের চিকিৎসাশূন্য, শিক্ষা ব্যবস্থা শুন্য, পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতাশূন্য, পথঘাট, জল বিদ্যুৎ, পরিবহন শূন্য, বিপিএল কার্ড, একশো দিনের কাজ শূন্য। বন্ধ কলকারখানা খোলার চেষ্টা শূন্য। সমস্ত শূন্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় শূন্য সর্বার্থে শূন্য একটা সরকার। দু’লক্ষ কোটি দেনা করে শুধু ক্যাডার পোষা ছাড়া যার ঝুলিতে আর কোনো কৃতিত্ব নেই।

এই দল আর দলের নেতাদের সংস্পর্শে যার বেঁচে বেড়ে ওঠা সে বা তারা মানবিক গুণ পাবে কোথা থেকে। যেদিন থেকে জ্যোতি বসু তার ছেলে চন্দন বোসকে হাজার হাজার কোটি টাকার অন্যায় অসৎ উপার্জনের অনুমোদন দিয়েছিলেন সেদিন থেকে দলের নেতাকর্মী বুঝে গেছে–আমাদের “কী করিতে হইবে।”উহাই একমাত্র সঠিক পথ সুচেতনা, এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।

***

একদিন মাদার কিলার ছোট ওভেনের একটায় তার মাপ মতো ভাত নিয়ে সেদ্ধ বসিয়েছে। আর একটা ফোঁটাচ্ছে ডাল, মাছের ঝোল। এইভাবে জাত বাঁচাচ্ছে। এখন আমার সাথে তার সম্পর্ক মেঘ রোদের। এই আকাশ কালো, এই রোদ ঝলমল।

তখন বলি তাকে–একটা গল্প শুনবেন? এই গল্পে আপনার জীবনের খুব মিল আছে। শুনবেন?

চশমার উপর দিয়ে বাঁকা চোখে তাকায় মাদার–বলো। দেখি কী মিল আছে আমার সাথে।

একজন লোক বারো বছর হিমালয়ের গুহায় বসে কঠোর তপস্যা করেছে।

আমি তপস্যা করেছি।

আগে সবটা শোনেন। তপস্যায় তার এমন ক্ষমতা অর্জন হয়েছে যা সাধারণ মানুষ পারে না। সে তার ক্ষমতার প্রমাণ দেবার জন্য একদিন সমতলে নেমে এল।

তারপর? তারপর এক গ্রামে গিয়ে লোকজনকে ডেকে বলল–আমি এক যোগী পুরুষ। যোগ বলে আমি অসাধ্য সাধন করতে পারি। তোমরা কী তার প্রমাণ চাও? বারো বছরের সাধনায়

আমি এমন ক্ষমতা পেয়েছি যে যোগবলে শুকনো বিচালিতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারি।

আর কী পারেন? বোকা ধরনের একজন লোক বলে–এর চেয়ে বড় ধরনের কিছু পারেন কী?

যোগীরাজ কুদ্ধ–যোগবলে আগুন জ্বালানো এটা কম বড় কাজ। কেউ পারে?

বোকা লোকটা বোকা বোকা গলায় বলে–বারো বছর নষ্ট করে এই সামান্য ক্ষমতা! কেউ সে চেষ্টাই করবে না।

তার মানে!

একটা পয়সা দিলে এক বাকসো দেশলাই কাঠি মিলে যায়। এক মাস অনায়াসে আগুন জ্বালানো চলে। মাত্র একটা পয়সা বাঁচাবে বলে জীবনের মহামূল্য বারোটা বছর নষ্ট করে দিলে! তোমার মতো বোকারাম আর কেউ আছে?

গল্প শুনে মাদারের মুখ হাঁ হয়ে যায়। বলে–এই গল্পের সাথে আমার জীবনের মিল আছে বললে। সেটা কোথায়?

মিল আছে, বলি আমি–যে বাড়িতে জীবন কাটালেন, পশ্চিমবঙ্গের কত নামকরা বাড়ি। সেখানে কত নামি-দামি লোকজনের যাওয়া আসা ছিল। বলেন ছিল না?

জ্যোতি বসুর সাথে তো ওখানেই চেনা। উনি তখন বিধান সভার বিরোধী দলনেতা। খুব যেতেন ওই বাড়িতে। কত চা যে বানিয়ে খাইয়েছি তখন। জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার, প্রমোদ দাশগুপ্ত কে আমার হাতের বানানো চা খায়নি!

বলি–যদি তাদের কাছ থেকে কিছু শিখে নিতে পারতেন তাহলে আজ আপনি একজন মহিলা নেত্রী হতে পারতেন। কিছুই শিখলেন না। শুধু রান্নাঘর আর ভঁড়ার ঘর আগলে জীবন কাটিয়ে দিলেন।

আমাদের যেখানে স্কুল এখানে একজন নেতা থাকে তার নাম চোর বাপ্পা। পার্টিতে ঢোকার আগে চুরি করত বলে ওই নাম। কয়েকবার তাকে সিপিএমের লোকরাও পিটিয়েছে। শেষে এক নেতা তাকে পার্টি অফিস ঝাড়ু দেওয়া, চা ফা বানানো এই সব একটা কাজ দেয়। কিছু মাইনেও দেয়। সেখানে থাকতে থাকতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দপ্তরে চাপরাশি হয়ে যায়। আর যখন এই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠে এখানে এসে হয়ে যায় নেতা। বাজারে যার হোটেল আছে-বাগে ফেলে সেই অমূল্য মাঝির দোতলা দখল করে নেয়। এখন বড় ভালো আছে বাপ্পাদা, আর কেউ চোর বাপ্পা বলে না, বলে কমরেড বাপ্পা। লোকে বুঝে গেছে কমরেড বললে আর কিছু বলার দরকার পড়ে না।

আমার কথায় মাদারের শরীর জ্বলে। বলে-উপদেশের চেয়ে উদাহরণ ভালো। কে কী করেছে আর করেনি সে সব না বলে পারলে নিজে কিছু করে দেখাও।

বলি–করছি।

কী করছো হাতি না ঘোড়া?

দেখবেন একদিন। ফুল ফুটলে তার গন্ধ তো চাপা থাকে না।

ইঁদুর পচা গন্ধ এখন পাচ্ছি।

ঠিক। একদম ঠিক বলেছেমাদার…। আমি একদল লোকের কাছে পচে গেছি। স্বভাব পরিবর্তন ঘটে গেছে আমার। নিম্নবর্গ নিম্নবর্ণ সেই প্রথাগত মানসিকতার মধ্যে বাইরের সচেতন বাতাস ঢুকে পড়েছে। আমার শিক্ষাই এই সর্বনাশ করে ফেলেছে। এই শিক্ষা প্রথাবিরোধী প্রতিষ্ঠান বিরোধী। প্রথা বিরোধী শিক্ষার তিনটি স্তর। এক–এর কোনো বাঁধা পাঠক্রম, পাঠ্য পুস্তক বা প্রতিষ্ঠান থাকে না। দুই, কোনো পরীক্ষা, পাশফেল, ডিপ্লোমা ডিগ্রির সার্টিফিকেট পকেটে থাকে না। তিন, চাকরি-বাকরি বা সামাজিক মান মর্যাদার ক্ষেত্রে এর কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই। আমি যা শিখেছি তা একান্তই নিজের জানার জগৎটাকে আরও বিস্তৃত করার জন্য। সেই জগত আমাকে বিচ্ছিন্নতা থেকে সমগ্রতার সাথে যুক্ত করেছে। নিজের দুঃখকষ্ট যন্ত্রণার সাথে সমস্ত দরিদ্র দলিত মানুষের যন্ত্রণাকে এক করে দেখতে শিখেছি। এই শিক্ষায় আমার কোনো শিক্ষক নেই। আমার জীবনই আমার বড় শিক্ষক। তাই আমি আর কারও আজ্ঞাবহ-দাসানুদাস হতে পারি না। শুধু বুদ্ধি বিদ্যা বিবেকের দাসত্ব করি। যেটা সাধারণত চাকর-বাকর ঝি-রাঁধুনিদের থাকাটা জরুরি। না থাকাটা ঔদ্ধত্য। এরা চায়–আমরা সবাই পুরাতন ভৃত্য কেষ্টা হয়ে জীবন কাটাই। তা করছি না বলে এদের এত রাগ আমার উপরে।

তবে তাদের দশা এখন সেই সাপের ছুঁচো গেলার মতো। না পারছে গিলে নিতে না পারছে উগরে ফেলতে। বড় সাহেব আমাকে এনেছে। তাকে কে গিয়ে বলবে ওকে বের করে দিন। উনি কী তা করবেন? তাহলে এত বাচ্চার রান্না খাওয়ার কী হবে? পথ একটাই–অত্যাচার তীব্র করা। যেন আমি নিজেই পালাই। এভাবে সাপ মরে যাবে লাঠিও ভাঙবে না। দোষ পড়বে না কারও ঘাড়ে।

এই কাজে মাদার তাদের প্রথম পছন্দের। তাকে সবাই উস্কে দেয়। আর সে সুযোগ পেলেই হামলে পড়ে। সেই যে সে একবার বড় সাহেবকেরাখি বেঁধেছিল–সেই সম্পর্কের জোরে ভাইয়ের স্কুলের মালিক মনোভাবে সবার কাছে যেমন মূর্তিমতি ত্রাস–আমাকেও ত্রাসিত করে তুলতে চায়।

***

আমি আমার পেট চালাবার জন্য রান্নার যে কাজটা করি তাতে লেখালেখি করার মত সময় বের করা খুবই মুশকিল। রোজ সকাল ছটা-সাড়ে ছটায় শুরু করতে হয় কাজ। দুখানা বড় দুখানা ছোট চারখানা উনুন জ্বলে আমার চারপাশে। বাইরে যখন বিয়াল্লিশ ডিগ্রি গরম রান্নাঘরের কি অবস্থা সহজে অনুমেয়। এই অবস্থায় বেলা এগারটা বারোটা, স্কুল ছুটির দিন দুটো আড়াইটা পর্যন্ত লেগে যাবে দুপুরের খাওয়ার সব কাজ মেটাতে। আবার রাতের খাবারের জন্যে কাজ শুরু করতে হবে সন্ধে ছটা থেকে রাত দশটা-সাড়ে দশটা পর্যন্ত। এর মধ্যে লেখার সময় বলতে দুপুরের কিছু সময় আর রাতের কিছু সময়। কাজ শেষ করার পরে ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ত। শ্রান্ত শরীর আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইত না। দুপুরে চান করে খাবার পর শরীর চাইত বিশ্রাম। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত আমার। তখন নিজেকে বোঝাতাম আমি, এটাই লড়াই। লড়াই শুধু মাঠেময়দানে হয়না-লড়াই সর্বত্র। এই লড়াই তোকে জিততে হবে। হেরে গেলে চিরতরে হারিয়ে যাবি। তুমি লুডো খেলছো না, গল্প লিখছো। এটাও একটা যুদ্ধ। তোমার একটা প্রতিপক্ষ আছে। যাদের দিকে অস্ত্র ছুঁড়ছো তুমি। তারা তোমাকে সাহায্য সহযোগিতা দেবে, সহানুভূতি দেখাবে তা হয় নাকি। তারা উল্টো করবে। পদে পদে বাধার সৃষ্টি করবে যাতে তুমি লিখতে না পারো। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে তোমাকে নিরস্ত্র করবার চেষ্টা চালাবে। তোমার সহজ কাজটাকে জটিল করে দিয়ে মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করবার প্রয়াস চালাবে। দুপুরের বিশ্রামের সময়টা কী ভাবে কমিয়ে আনা যায় সেই বুদ্ধি খাটাবে। যদি তাতে সফল না হয় তখন তারা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে। তোমার কাজে খুঁত খুঁজবে–যদি তরকারিতে একটু নুন বেশি হয়ে যায় তিন চারজন এমনভাবে আঁপিয়ে পড়বে–যেন তুমি মানুষ খুন করার চেষ্টা করেছে। যত তোমার যশ খ্যাতি পরিচিতি বাড়বে আক্রমণ তত তীব্র হবে।

এইসব সয়ে যদি তুমি লিখে যেতে পারো তবেই জয়ী হবে। এদেশ সেই দেশ যেখানে জ্ঞান চর্চার অপরাধে রাম শম্বুক ঋষিকে হত্যা করেছিলেন। মহাগুরু কেটে নিয়েছিলেন একলব্যের আঙ্গুল। এ দেশের মধ্যে বহুকাল ধরে আছে ”ওরা” আর “আমরা” এই বিভাজন। যে জ্ঞান, বিদ্যা, দক্ষতা “আমরা”দের বিপক্ষে যায় তা সহ্য করে না। উৎপাটন করে।

আমার চারপাশের মানুষ, যত তারা দাঁত নখ বের করছিল, আমার জেদ তত বেড়ে যাচ্ছিল। একটা কিছু করতে হবে, এমন একটা কিছু যাতে প্রতিপন্ন হয়ে যায় ওই দাঁত নখের ভয়ে আমি ভীত নই। এমন একটা কিছু করতে হবে যেটা হয়ে ওদের মুখের মত জবাব। সারা পশ্চিমবঙ্গ আমার পাশে এসে দাঁড়াবে।

আমি নিজেকে যতটা জানি, তাতে জানি যে–যে কাজ আমি প্রেমে পারি না, ক্রোধে পারি। তাই আজ আমি ওই মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ওরা যদি প্রতিনিয়ত আমার ক্রোধের বারুদে আগুন দেবার কাজটা না করে যেত আজ আমি এখানে পৌঁছতে পারতাম না। প্রদীপ যখন নিভু নিভু হয়ে আসে একটা কাঠি দিয়ে পলতেটাকে ঠেলে উপরের দিকে তুলে দিতে হয়। ওরা সেই কাঠিবাজিটা নিষ্ঠার সাথে নিয়মানুবর্তিতার সাথে করে গেছে। যাতে পরোক্ষে আমার উপকারই হয়েছে। আমার ঝিমিয়ে পরা প্রতিজ্ঞা ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে উঠেছে। হ্যাঁ, আমার এই সাহিত্যচর্চা, এই সৃজন, এসব আমার ক্রোধেরই সন্তান। দশ-বার খানা উপন্যাস শতাধিক গল্প যা লিখেছি এতদিন ধরে আমি, সবই উৎপন্ন হয়েছে এক ক্রুদ্ধ লেখকের লেখনি থেকে। প্রায়শঃই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে–আমি কেন কোন প্রেমের গল্প লিখিনি। মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসার গল্প লিখিনি, কারণ লিখতে পারিনি। কী করে লিখব? আমার জীবনে যে কোন প্রেম নেই। যা আমার ভাগ্যেই নেই তা আমি মানুষের সাথে ভাগ করব কী করে? যার জীবন জুড়ে শুধু আকাল আর আকাল। ধ্বংস-রক্ত-চোখের জল, অভিশাপ আর অবমাননা সে কী করে লিখতে পারে হাতে হাত চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন সাগরে ভেসে যাবার আখ্যান। আমার সঞ্চয়ের ঝুলিতে যা

আছে তাই-ই তো বিলোতে পারি সবাইকে। যা কেউ আমাকে দেয়নি, আমি কাউকে কী ভাবে দেব? আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই সেই কিশোরকে যার খেলবার জন্য একটা কাঁচের গুলিও নেই। নেই পড়বার জন্য দুআনা দায়ের একখানা বাল্যশিক্ষা। পেছন ভেঁড়া প্যান্ট পরে যে দুহাতে পেছনে রেখে ঢাকতে চায় লজ্জা-হীনমন্যতা। যে খিদে ভুলতে পশুর মত দুর্বাঘাসের মাথি তুলে চিবোয়। আমি দেখি সেই বালককে যে জনহীন জঙ্গলে হিংস্র শেয়ালের আক্রমণের ভয়ে কুঁকড়ে যেতে যেতে ছাগল চড়ায়। সকাল সন্ধ্যায় তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয় জল বওয়া বাঁক। বাঁক বইতে বইতে কাঁধের মাংস জোয়াল বওয়া গরুর কাঁধের মত খরখরে হয়ে যায়। উপর থেকে চাপের ফলে শরীরটা বাড়তে না পেরে খর্বকায়–বনসাই আকার নেয়। দেখি এক বালকের গেলাস প্লেট ধুতে ধুতে হাজায় পচে যাওয়া হাতের আঙ্গুল-পায়ের পাতা।

একদিন তাকে দেখি ডাস্টবিন ঘাটতে, দেখি কুকুরের মুখ থেকে রুটি কেড়ে নিতে। এক অমৃতস্যঃ পুত্রার এমন কুকুরোচিত ব্যবহারে সেই কুকুরটির দুচোখ জুড়ে ফুটে ওঠা বিস্ময়, সেও দেখি আমি।

এই সব দেখি আমি। আমার সারাটা জীবন সিনেমার পর্দার মত–চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন আর মনটাকে বলতে পারি না–ওরে, একটু ভালোভাষায় ভালোবাসার কথা বল। তখন আমি তাকে বলি–বিদ্রোহ কর। ভাঙ, সব কিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দেবার রাগ প্রধান গান–ভৈরব বাহার ভীন-কানাড়া হাম্বীর আর সিংহেন্দ্র মধ্যম গা। মীরার ভজন তোর জন্য নয়। আগুন দুভাবে নেভানো যায়–জল ঢেলে বা কেরোসিন ঢেলে। তোর কাছে যেটা অনায়াস লভ্য সেটাই ঢাল। ছাইয়ের মধ্য থেকে আবার নতুন প্রাণ জাগবে।

তাই রান্না ঘরের এক কোণে কাগজ কলম নিয়ে বসি। উনুনে রান্না চাপিয়ে দিয়ে দু লাইন লিখি। রান্না নামিয়ে দু লাইন লিখি। বাচ্চাদের খেতে আসতে দশ মিনিট দেরি আছে-সেই ফাঁকে দু লাইন লিখি। আমার অবস্থা তখন ফাঁসির দড়ি গলায় চেপে বসা বন্দীর মত। শ্বাস নিতে পারছে, তবু প্রাণপণে শ্বাস টানছে যদি দু সেকেণ্ড বাঁচা যায়। ওরা আমাকে লিখতে দিতে চায় না, সেই ফাঁস ক্রমে এঁটে আনছে আর আমি প্রাণপণে চাইছি দু কলম লিখতে। আমি যে তখন নিরুপায়। কাগজ কলম ছাড়া তখন তো আর আমার কোন অবলম্বন নেই। কী নিয়ে বাঁচব। আর মিছিলে হাঁটতে পারব না। কার পিছনে হাঁটব? জেলে যেতে পারব না। শরীর পোক্ত নেই। গলা কাটতে পারব না। মনে সে জোর নেই। আছে শুধু কলম। তাই মনে প্রাণে যাদের মৃত্যু কামনা করি, আমার গল্পে তাকে মেরে ফেলি। এতেই পাই মানসিক তৃপ্তি আর বেঁচে থাকার রসন। এইভাবেই পদক্ষেপ আনোয়ান, অদলবদল, বহুজন নায়ক, রবিশস্য এই সব পত্রিকার জন্য লেখাগুলো তৈরি করেছিলাম। একদিন আনন্দবাজার পত্রিকার (২৪.৪.৯৯) পাতা খুলে দেখি পুস্তক সমালোচনা বিভাগে পুস্তক সমালোচক শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত রবিশস্য পত্রিকায় প্রকাশিত আমার “অভিশপ্ত অতীত অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে দু লাইন লিখেছেন। কী লিখেছেন চোখ বোলাতে বোলাতে আমার মনে হল ছোট করে হলেও কিছু মানুষের কাছে এই বার্তা দেওয়া গেল যে রাঁধে যে চুলও বাঁধে।

উনি লিখেছেন..”পূর্বাঞ্চলের দেশভাগের এই মানব ইতিহাস এখনও সে ভাবে লেখা হয়নি…..। যত তাড়াতাড়ি লেখা যায় ততই ভালো…। আজ পাঁচ দশক পরে যখন সেই মারনাগ্নির বিবরণ পড়ি তখন একটাই প্রশ্ন কুড়ে কুড়ে খায়–কেন? উত্তরে অনেক কারণ দেওয়া যেতে পারে। তবে মূল কারণটি ব্যাখ্যা করেছেন বরিশালের নমঃশূদ্র, খেটে খাওয়া বিতাড়িত মনোরঞ্জন ব্যাপারী। তার অনবদ্য স্মৃতি কথা শেষ হয়েছে এইভাবে–সেই কিশোর বয়েসে সেই একটি মাত্র ঘটনা আমাকে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার মূল রহস্য বুঝিয়ে দেয়। যে মানুষ কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে আর একজন মানুষের কাছেঘৃণার পাত্র বলে বিবেচিত হয়, সে তাকে শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে এ হতে পারে না। হওয়া সম্ভব নয়। ঘটনাটি হল–মুসলমান অতিথিকে পায়েস খাওয়ানোর পর রাতে থালা ধুয়ে চান করে আসার ভাবটা ছিল আমার (মনোরঞ্জনের) উপর। হ্যাঁ জায়গাটা গোবর দিয়ে ঝট দেবার কাজটাও আমাকে করতে হয়। এই অভ্রান্ত সাবঅন্টনি বিশ্লেষকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ।”

.

রবিশস্য পত্রিকার সম্পাদকের নাম ধীরাজ বোস। এই পত্রিকাটা প্রকাশিত হয় বাঘাযতীন কাজিপাড়া থেকে। একদিন আমার একটু বাঘাযতীন যেতে হয়েছিল। তখন ভাবলাম–একবার সম্পাদক মহাশয়ের সঙ্গে দেখাই করে যাই। ইনি সেই সম্পাদক যার দরজায় কুকুর বাঁধা থাকে না, ঘর আর মনের দরজা হাট করে খোলা। সম্পাদকের সামনে গিয়ে আমি তো অবাক। ধীরাজ বোস আর কেউ নয়, এ আমার সেই সত্তরের দশকের সাথী নেতা, বাবলাদা। অবাক বাবলাদা, তার পত্রিকায় যার লেখা বের হয়েছে সেই মনোরঞ্জন তার চেনা মদন। প্রায় পঁচিশ বছর পরে দুজনের সাথে দুজনের পরিচয় ঘটল নতুন নামে নতুন এক ভূমিকায়। এরপর এই কাগজে প্রকাশিত হল আমার একটা বড় লেখা শমনসকাশে তিন দিন। তারপরে লাথখোর’আর পথ যেখানে পৌঁছলো। তারপর, সব কথা রাত জানে।

আমরা যখন কলকাতা ছেড়ে দণ্ডকারণ্যে চলে যাই আমার ছেলে মেয়ে সব ছিল ছোট ছোট। ওরা বিশেষ কিছু বুঝত না। এখন বড় হয়ে গেছে বুঝতে শিখেছে দণ্ডকারণ্যের পাহাড় পাথর বন জঙ্গলের সাথে বাংলাদেশের জল মাটি আবহাওয়া খাদ্যদ্রব্যের কী পার্থক্য। ওদের এখন মন কাঁদে বাংলার মাটি মানুষের জন্য।

অনু যে ভাবনায় যে আশায় দণ্ডকারণ্য গিয়েছিল সে এখন নিভে গেছে। ওখানকার রুক্ষ্ম জীবন এখন অসহ্য মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে গরম কড়াই থেকে বাঁচতে সে যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেটা জ্বলন্ত উনুন। তাই বার বার চিঠি লিখছে সে-আমরা আর এখানে থাকব না। তোমার ওখানে যাব।

আমার মাইনে অনিয়মিত মেলে। আটমাসের মাথায় সেবার বেতন পেলাম। বেতন পেয়েই সর্বপ্রথম একখানা ঘর ভাড়া করে ফেললাম আমি। চারদিকে দরমার বেড়া, উপরে টালি, মেঝে কাঁচা–ভাড়া মাসে চারশো। এরপর অনুকে চিঠি লিখলাম–চলে এসো। ওরা তো আসবে বলে প্রস্তুত হয়েই ছিল। চিঠি পাবার সাতদিনের মধ্যে পৌঁছে গেল হাওড়ায়। ফোন পেয়ে আমি গিয়ে নিয়ে এলাম সেই ভাড়া করা বাসায়। ঘরটা খুবই ছোট। এত ছোট যে একখানা চৌকি পাতবার পর আর কোন জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে কয়েকটা ইট দিয়ে চৌকি বেশ কিছুটা উঁচু করে নীচে যে জায়গা পাওয়া গেল আমাদের স্বামী স্ত্রী রাতে ঘুমানো যায়। বাচ্চা দুটো চৌকিতে কুলিয়ে যেত। রান্না খাওয়ার জন্য এক চিলতে বারান্দা আছে। এই হল আমার নতুন করে পাতা সংসার।

এবার আমার মাথায় কিলবিল করে উঠল একটা গুবরে পোকা। আট মাস পরে একসাথে অনেক কটা টাকা পেয়ে গেছি, তাই তাকে টাকার গরমও বলা যায়। এই টাকা এখন যদি ফালতু ফালতু উড়িয়ে দিই আগামী আটমাস সংসার কী করে চলবে?না সে সমস্যা হবেনা। স্কুলের পাশে যে মুদি দোকান সে কথা দিয়েছে আট কেন পুরো এক বছর চাল ডাল নুন তেল সব বাকিতে দেবে। শর্ত একটাই, মাইনে পাবার সাথে সাথে সব বাকি শোধ করে দিতে হবে। আজ শোধ দাও, কাল থেকে আবার নাও।

তখন ভাবলাম–সেই উনিশশো একাশি থেকে নিরানব্বই প্রায় উনিশ বছর ধরে আমি লিখছি, এখনো আমার নিজের কোন বই নেই। একখানা বই ছাপাতে হবে। যার নিজের কোন বই থাকে না লেখকদের সমাজে সে বড়ই করুণার পাত্র বলে চিহ্নিত হয়ে যায়।

তা ছাড়া বহুকাল যাযাবর জীবন কাটাতে হয়েছে। ভারি বোঝা বয়ে বেড়ানোয় অসুবিধা বলে প্রকাশিত লেখাগুলো সব পত্রিকার পাতা থেকে ছিঁড়ে রেখেছিলাম। তার কিছু পোকায়, কিছু ইঁদুরে কেটে নষ্ট করে দিয়েছে। কিছু ছিঁড়ে ফেটে গেছে। এখন এগুলোকে সংরক্ষণের একটা ব্যবস্থা না করলে সব চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর আমাকে যদি বই ছাপাতে হয়, তবে তা করতে হবে সম্পূর্ণ নিজের গাঁটের টাকায়। আমি এমন কোন নামী লেখক নই যে প্রকাশক তার টাকায় আমার বই ছাপাবে। তারা সেই লেখকের পিছনে টাকা ঢালে যে টাকা দশ বিশগুন বেশি হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। এই অবস্থায় আমার নিজের বই নিজে না ছেপে আর কী উপায়? আমি যে সংস্থার অধীন সেই সংস্থার একটা নিজস্ব প্রেস আছে, তাই একদিন অফিসে গিয়ে ওই সংস্থার যিনি সর্বময় কর্তা তার সাথে দেখা করি।

বলি–দাদা, আপনাদের প্রেস থেকে আমার একটা বই ছেপে দেবেন?

–বই! দাদা আকাশ থেকে পড়েন তোর বই! কী বই?

–গল্পের বই।

–তুই গল্প লিখিস নাকি! লেখক?

মহাশয়ের গলা থেকে ঝলকে ঝলকে নামে কৌতুক। বড় অদ্ভুত ব্যাপার তো। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে সেটা উনি জানেন। কিন্তু সে যে গল্প লেখে–কোনদিন শোনেন নি।

আমি বুঝতে পারি একটা মহাভুল হয়ে গেছে। সামলে নেবার জন্য বলি–না, মানে আমি গল্পটল্প লিখি না। আমার এক চেনাজানা-মদন দত্ত নাম, সে লেখে। সে বলল যে তোদের ওখানে তো প্রেস আছে, আমার একটা বই ওখান থেকে ছাপিয়ে দে। তাই–ধরে নিন আমারই বই। টাকা পয়সা সব আমি দেব।

ওঃ এই ব্যাপার! তা আমার কাছে কেন এসেছিল। বিশ্বাস বাবুর সঙ্গে কথা বল। প্রেসের সব কাজ উনি দেখেন। রেট ফেট যা সব উনি বলবেন।

–কথা বলেছি।

–কী বলল।

–আপনার সাথে দেখা করতে বলল।

–কেন!

–আমি এখন সব টাকা দিতে পারব না। পাঁচ হাজার দেব। বাকি আর যা থাকবে সেটা দেব বই ছাপা হয়ে গেলে বিক্রি করে, ধীরে ধীরে।

হেসে উঠলেন উনি–বই বিক্রি করে দিবি পাগল ছাড়া আজকাল আর কেউ বই কেনে না। ও বই বিক্রি হবে না।

–তা না হোক আমার মাইনে থেকে মাসে মাসে কিছু কিছু কাটিয়ে দেব।

–ঠিক তো?

-–একদম ঠিক।

–কত বই হবে?

–কত আর, এই ধরুন শ পাঁচেক।

-–ঠিক আছে যা। গিয়ে বিশ্বাস বাবুর কাছে পাঁচ হাজার জমা করে দে। আমি তাকে বলে দেব। কথা দিলাম বই হয়ে যাবে। যা।

আমি এখন এক অভাগা মানুষ, সবদিনই এমন হয়েছে যে সুযোগ পেয়েছে আমাকে আখ পেষার মতো পিষে সব রস নিঙরে নিয়েছে। এবারই বা তার ব্যতিক্রম কেন হবে? বাগে পেয়ে এবারও মানুষ জোঁকের মতো সব রক্ত রস শুষে নিল। বড় রস তোর। বই ছাপাবি, লেখক হবি। বের করছি রস।

লোকটার কী যে নাম জানি না। সবাই বিশ্বাস বাবু বলে ডাকে। তা বলে সে যে সবার বিশ্বাসী হবে তা কী করে হয়। এখানেই একটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার। নাম যাই হোক নামের শেষে বিশ্বাস আছে দেখে ভেবে বলেছিলাম–আমারই স্বজাতি যখন একে বিশ্বাস করা যায়। এই লোকটা অন্ততঃ আমার গলা কাটবে না।

এই সময়কালে আমার খুব গভীর এবং নিবিড় একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে যারা মহারাষ্ট্রের দলিত নেতা ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের মতাদর্শ অনুসরণে দলিতদের সংগঠন গড়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশভাগী হবার জন্য সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

আমি নিজেও দলিত শ্রেণির মানুষ। ফলে স্বজাতির স্বশ্রেণির লোকের প্রতি এমন একটা দুবর্লতা জন্মে গিয়েছিল যে এরা আর যাইহোক উচ্চবর্ণ উচ্চবর্গের মতো কখনোই নয়। আমার তখন মনে ছিল না যে জাতি ধর্ম ভাষা কোনকিছুই মানুষকে মানবিক করে না, সহানুভূতিশীল বা দরদী বানায় না। তা যদি বানাত শিয়া-সুন্নি এক মুসলমান আর এক মুসলমানের গলা কাটত না, ধর্ম হাত চেপে ধরত। পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের বিতাড়ন এখনো চলছে। চলত না, ভাষা এসে পথ আটকাত। সাঁওতালরা লোধাদের মারত না, নিম্নবর্ণ ঐক্য বাধা দিত।

এক ভদ্রলোক বাপ ঠাকুর্দার জমিদারির কল্যাণে বড় সুখে জীবন কাটিয়েছেন। বড় শান্তির নিকেতনে বসে কাব্যসুন্দরীর সেবা করেছেন সারা জীবন। মানুষ এসেছে তার দরজায় গুরুদেব বলে পদধূলি নিতে। তাকে কোনদিন গিয়ে দাঁড়াতে হয়নি মানুষের দুয়ারে। তাই বাতায়নে বসে দক্ষিণা বাতাসে লিখতে পেরেছিলেন–মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।

যদি উনি কোন বাড়িতে রান্নার কাজে যেতেন, কাজের শেষে মজুরি না দিয়ে চোর বলে মেরে তাড়াত, যদি কোন গয়লার দুধের ড্রাম মাথায় বয়ে নিয়ে যাবার অতি কষ্টে জমানো পারিশ্রমিকের টাকা, তারাই হাতিয়ে নিত, যদি রিকশা চালাতেন, প্রবল গরমে-ঘামে নেয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া যাত্রী ভাড়া না দিয়ে “দাঁড়া আসছি” বলে হাওয়া হয়ে যেত, তাহলে আর ওই বাণী বের হতো না। টের পেতেন বিশ্বাসের মা মারা গেছে বহু বছর আগে। তাই যে মানুষকে বিশ্বাস করা যায় তারা আর পয়দাই হচ্ছে না। এ আমার অভিজ্ঞতা লব্ধ একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব।

আমি সেদিন এসে দেখা করলাম প্রেসের ম্যানেজার বিশ্বাসবাবুর সাথে। লম্বা রোগা ফাঁসফেসে গলায় কথা বলা সত্তর বাহাত্তর বছর বয়সের বুড়ো, তিনি আমার মুখে সব কথা শুনে চশমার নিচে চোখ কুঁচকে হেসে বলেন–তাহলে আর কী, আমার তো আর কিছুই বলার মতো নেই। তুমি তো একেবারে আসল লোকের অর্ডার নিয়ে এসেছে। যাও পাণ্ডুলিপি আর পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে এসো। পাঁচ হাজার আগাম দেবে বলেছো তো? সেটা জমা করে দাও, আমরা কাজ শুরু করে দিই।

একটু রেটটা বলবেন। পাঁচশো বইয়ে কী রকম কী পড়বে।

বলেন তিনি–আমার উপর বিশ্বাস আছে কী? বিশ্বাস রেখো তোমার কাছ থেকে এক টাকাও বেশী নেব না। পারলে দু টাকা কম নেব। কেন বেশী নেব? নিয়ে আমার কী লাভ? এই টাকা আমার পকেটে তো আর যাবে না। তবে? তা ছাড়া তুমি তো আমাদের লোক। ঠিক কিনা। তা, কবে জমা দিচ্ছ টাকা, পাণ্ডুলিপি?

পাণ্ডুলিপি ও পাঁচ হাজার টাকা সেদিনই জমা করে দিলাম। খুঁজে পেতে বাইশটা গল্পই পাওয়া গেছে। কথা দিলেন বিশ্বাস বাবু, দুর্গাপুজার আগেই বই পেয়ে যাবে। পূজার তখনও তিন চার মাস বাকি।

দুর্গাপূজা বাঙালি জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। যারা চাকরি করে এই সময় তাদের হাতে খরচ করার মতো বাড়তি কিছু টাকা থাকে। বোনাস পায় বেতন পায়। এই সময় প্রচুর পত্র পত্রিকা শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ হয়। বিক্রিও হয়।

বর্তমানে এই শহরে আমার বিস্তর চেনা জানা লোক। প্রচুর লোক আমাকে ভালোবাসে। তারা এই সময়ে অবশ্যই আমার বই কিনবে। আমি বই নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কেউ না বলবে না। আর নিজের বই নিজে বেচা এটা কোন অন্যায় নয়। লজ্জার বিষয়ও নয়। বামপন্থী কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়ও নিজের বই নিজে বেচতেন। বেচে থাকেন আরো অনেকেই।

পুজোর সময় আমার স্কুলের সব বাচ্চা বাড়ি চলে যায়। প্রায় কুড়ি বাইশ দিন রান্না করতে হবে না। ফলে ঘুরে ঘুরে বই বেচতে পারব। বড় আশায় বুক বেঁধে বসে থাকি আমি। কিন্তু কোথায় কী! দিন দুই তিনেক ধরে মাত্র কয়েক পাতা কম্পোজ করে সেই যে ফেলে রেখে দিল পাণ্ডুলিপিতে আর হাত পড়ল না। একটা বড় কাজ এসে গেছে, সেই কাজ নিয়ে মেতে উঠল পুরো প্রেসকর্মী। দেখতে দেখতে দুর্গাপুজো পার হয়ে গেল।

রোজ খোঁজ নিই কবে আমার কাজটা শুরু হবে। বলেন বিশ্বাস বাবু, আর কোন কাজ হাতে নেব না। বড় কাজটা শেষ হয়ে গেলেই তোমারটা ধরব। ভাইফেঁটার পর ধরলেন “আমারটা”। কিন্তু দিন দশেক ধরে আবার আমারটা ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা ধরে নিলেন।

একদিন অধৈর্য হয়ে বলি-কী হল বিশ্বাস বাবু? বলেছিলেন পুজোর মধ্যেই বইটা দিয়ে দেবেন। পুজো তো গেল। বইমেলা আসছে, তার আগে ছাপিয়ে দিন।

বিশ্বাস বাবু চশমার নিচে সেই চোখ কুঁচকে হাসলেন। খোঁচা খোঁচা মুখ ভর্তি দাড়িতে খেলে গেল ধূর্ত ঢেউ–তুমিও দাও।

–কী?

–টাকা।

–পাঁচ হাজার তো দিয়েছি।

সে টাকার কাজ তো পাঁচ দিনে হয়ে গেছে। টাকা না পেলে কাজ হবে কী করে?কর্মচারীদের বেতন, ইলেকট্রিক, ফোন, কত খরচা। সব দায় তো আমার। আমি হিসেব করে দেখেছি এখন পর্যন্ত তোমার যা কাজ হয়েছে সাড়ে বারো হাজার। পাঁচ বাদ গেলে থাকে সাড়ে সাত। এত তো বাকি রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব।

বলি–আমার তো দাদার সাথে এই রকম কথা হয়েছিল, প্রথমে পাঁচ হাজার দেব। এরপর বাকিটা দেব বই হয়ে যাবার পরে–ধীরে ধীরে।

–এই রকম কথা হয়েছিল বুঝি!

–আপনাকে বলেনি?

–না তো! তোমার সাথে কী কথা হয়েছে তা আমি জানি না। আমি আমার কথা বললাম। প্রেসটা তো আমি চালাই। আমার এক কথা, টাকা যদি পাই কাজ এগুবে। না পেলে আর এগুবে না। যেমনকে তেমন পড়ে থাকবে। পুজো গেছে, বই মেলাও যাবে।

আমি এখন কী করব। আমার কাছে তো টাকা নেই আর। কবে মাইনে হবে তা-ও তো কিছু জানি না।

–তুমি এক কাজ করো। পরামর্শ দেন বিশ্বাস বাবু–দাদার কাছে চলে যাও। গিয়ে তোমার সমস্যাটা বুঝিয়ে বলো। বলা যায় না হয়ত উনি নিজের পকেট থেকে ওই পরিমাণ টাকা ধারও দিয়ে দিতে পারেন।

বিশ্বাসবাবু কথা শেষ করে অন্যদিকে চলে গেলেন। আমি সেখানে বসে আর কী করি, গেলাম দাদার কাছে। বললাম, একী হল দাদা। যেমন কথা ছিল আমি তো তেমনই করেছি। পাঁচ হাজার দিয়েছি। এখন আর টাকা কোথায় পাব? এদিকে বিশ্বাস বাবু বলছেন টাকা না দিলে হবে না। আপনি একটু বলে দিন, বইটা ছেপে দিক। আমি তো আর কাজ ছেড়ে চলে যাব না। যা বাকি থাকবে দিয়ে দেব ধীরে ধীরে।

হাসেন দাদা–বিশ্বাস বাবু ভীষণ ত্যাড়া লোক। কারো কথা মানে না। অনিল বিশ্বাসের জাত তো, যখন বলেছে টাকা না পেলে কাজ করবে না, আমি কেন, আলিমুদ্দিন কলিমুদ্দিন বললেও করবে না।

–তাহলে আমি এখন কী করি। আমার কাছে এক টাকাও নেই।

–শিশুর মতো সরলয়োস্থবলেন গঙ্গা-তুই এত উতলা হচ্ছিস কেন। যার বই তাকে বল। বই ছাপা হচ্ছে তার। পুরস্কার পাবে সে, টাকা পাবে সে, নাম হবে তার। ফালতু তুই হেঁদিয়ে মরছিস। তাকে বল টাকা না পেলে প্রেস বই ছাপছে না, দেখ কী করে।

–তার কাছে আর নেই। যা ছিল সব দিয়ে দিয়েছে। খুবই গরিব তো। রিকশা চালায়, ভাড়া বাসায় থাকে রিকশাটাও ভাড়ার।

হেসে হেসে বলেন দাদা–গরিবের এসব ঘোড়া রোগ কেন! এই সব ছাইপাশ না ছেপে একটা রিকশা কিনে নিত। পাঁচ হাজারে নতুন রিকশা হয়ে যেত না একখানা?

–সে হতো। বলি আমি-রুমঝুম মাঠে পার্টির লোকেরা চার হাজার টাকায় দুকাঠা করে প্লট দিচ্ছে খাস জমিতে। একটা প্লট নিলে আর ভাড়া ঘরে থাকতে হতো না। কিন্তু ওর যে সে সব ইচ্ছা হয়নি। বই ছাপার বাই উঠেছে।

–তবে টাকা জোগাড় করুক।

এ প্রসঙ্গে দাদার সব কথা বলা হয়ে গেছে। হাতের পেন দুবার টেবিলে ঠুকে বলেন, চা খাবি? খা একটু চা। ওই মোড়ের কাছে দোকানে গিয়ে দুটো লাল চা নিয়ে আয়। তুই কী বিস্কুট খাবি? খেলে একটা আনিস।

চা খেয়ে আমার দিতে হাত বাড়ান তিনি–দে একটু খইনি দে। খইনি খেয়ে বলেন–তোর কাজ কর্ম কেমন চলছে? মন দিয়ে রান্না বান্নাটা করিস। রোড রিপোর্ট পাচ্ছি খাবার নিয়ে। ভালো হচ্ছে না কেন? কী প্রবলেম?

এই সব শুনতে এখানে আসিনি। আমার যা কাজ একাজে কাউকে সন্তুষ্ট করা যায় না। যেমন পারে না বাসের চালক কন্ডাক্টার। জোরে চালালে দোষ, ধীরে চালালে আরো দোষ। থামালে দোষ না থামালে আরো দোষ।

আবার কাজটাও এই রকম। কেউ বলবে নুন কম কেউ বলবে নুন বেশি। কেউ বলবে ঝাল কম কেউ বলবে ঝাল বেশি। কেউ বলবে ভাত গলে গেছে কেউ বলবে শক্ত আছে। মোট কথা সুনাম পাবার কোন পথ নেই। একশো পরিবার থেকে আসা একশো রকম মানুষের একশো রকম রান্না খাওয়া জিভ। সবার মন জয় করা আমি কেন, কেউই পারবে না। সে বলে আর কী হবে।

আমি বলতে এবং শুনতে চাই আমার বইখানা ছাপা হবে কী হবে না।

দাদা একটু থামতেই সেই ফাঁকে আমার কথা গুঁজে দেই–কী হবে! তাহলে আমার বইটা কী হবে না?

–হবে। বিশ্বাস বাবু তো বলেই দিয়েছে, টাকা দিলেই হবে। কী করব বল, লোকটা মহা ইয়ে। কারো কথা মানে না। সেটা যেন তার পৈত্রিক সম্পত্তি। একটা কথা বললে যদি সেটা না রাখে আর বলতে ইচ্ছা করে, তুই-ই বল। আমি তোকে পাঠিয়েছি সে তো জানে, তবু এই রকম করছে। কোন মানে হয়?

একটু দম নিয়ে আবার বলেন তিনি–আমি বলি কী, সেই তো তুই টাকা দিবি। তাহলে ফালতু দেরি করে কী হবে, আগেই দিয়ে দে।

–পাবো কোথায়?

–জোগাড় কর। ধারনে কারো কাছ থেকে।

যদি কেউ দিতে পারে–সে আপনি। আপনি দেন না কিছু টাকা ধার দেবেন?

আবার হাসেন তিনি—বই বের হবে তার? ওহঃ তোর না, রিকশাঅলা মদনের। আর গচ্চা যাবে আমার? বাহঃ বেশ বলেছিস তো। একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে ফের বলেন তিনি আমাকে তোর কী বলে মনে হয়? বোকা? মাথা মোটা? না, গৌরি সেন? বল বল, আমি কিছু মনে করব না। বলে ফ্যাল।

বলি–আমি তো আপনাকে এই সব বলিনি। খালি কিছু ধারের কথা বলেছি। আগে আপনার সাথে যে রকম কথা হয়েছিল সেই রকম হলে আর তো ধারের কথা বলতেই হত না। আমার মনে হয় আপনি একবার বিশ্বাস বাবুকে বলে দিলে সব ঝামেলা মিটে যাবে। বিশ্বাস বাবু আপনার কথা মেনে নেবেন।

এবার দাদা রেগে গেলেন-কী তখন থেকে প্যানর কচ্ছিস! বিশ্বাসকে তুই আমার চেয়ে বেশি চিনিস? সে একবার বলেছে–টাকা ছাড়া হবে না তার মানে-হবে না। আমি কেন ব্রহ্ম বিষ্ণু মহেশ্বর গিয়ে বললেও হবে না। কথা না বলে, গিয়ে টাকার ব্যবস্থা কর। আমার কাছে নেই। এক দুশো হলে দেখতাম। এখন তুই যা, আমাকে আমার কাজ করতে দে।

গলায় আমার একরাশ হতাশা এসে জমা হয়। বলি–বইটা তাহলে আর হবে না। কী আর করব, যা হয়েছে ওই পর্যন্ত থাক। যায় যাক আমার পাঁচ হাজার টাকা গচ্চা। অন্য কোন উপায় নেই।

এখন মনে হয় বড় ভুল হয়ে গেছে। এর চেয়ে রুমঝুম মাঠে চার হাজার টাকায় দুকাঠার একটা প্লট নিলে অনেক ভালো করতাম। স্কুল থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে গড়ে উঠেছে নতুন জনবসতি। শত শত লোক খাস জমিতে বাড়ি বানাচ্ছে। বইয়ের পিছনে যদি টাকা না ঢেলে ওখানে ঢালতাম আর ভাড়া ঘরে চৌকির নিচে কুকুর কুণ্ডলি পাকিয়ে শুতে হতো না। সেদ্ধ হতে হতো না গরমে। পাখা একটা আছে, কিন্তু তার হাওয়া চৌকি ভেদ করে নিচে কী করে পৌঁছবে।

সারাদিন উনুনের সামনে তারপর গরমে রাতের পর রাত ঘুম নেই, একটু ভুল না করলে ওই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যেতাম। আক্ষেপে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে আমার।

কিন্তু আক্ষেপের আমার তখন সবে তো শুরু। যে সাপ একবার ব্যাঙের পা ধরে তাকে পুরোপুরি গিলে নেয়। তার আগে নিস্তার মেলে না। আমার ওরা পা ধরেছে, কেন নিস্তার দেবে?

আবার সেই হাসি ফিরে এসেছে দাদার মুখে। আগের রাগ আর নেই। হেসে হেসে বলে–এই জন্য লোকে বলে ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। তোর আগে ভেবে পথে নামা উচিৎ ছিল। পরের জন্য ফালতু ফেঁসে গেছিস।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের বলে-তুই আসার একটু আগে বিশ্বাস বাবু আমাকে ফোন করে সব বলেছে। সাড়ে বারো হাজার টাকার কাজ হয়ে গেছে। এখন বই নিস আর না নিস, ছাপাস আর না ছাপাস সে তোর ব্যাপার। কিন্তু যে টাকার কাজ হয়ে গেছে সেইটুকু টাকা তো তোর দিতেই হবে। এখন দিতে না পারিস, কোন কথা নেই। যখন বেতন পাবিকাটিয়ে দিস! না দিলে ওরা স্কুলে জানাবে, তোর রেকর্ড খারাপ হয়ে যাবে। টাকা তো না দিয়ে পার পাবি না। মাঝখান থেকে একটা ব্যাড রেকর্ড।

আমাকে বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখার জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল দুমাস। কারণ হিসেব মতো আমার মাইনে পেতে দুমাস দেরি আছে। এরপর বিশ্বাস বাবু স্কুলে জানাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিই, শুধু সাড়ে সাত কেন–আর যা দু-এক হাজার লাগবে সেটাও দিয়ে বইটা বানিয়েই নেব। তাতে আর কিছু না হোক আমার একটা বই তো হবে।

এবার ছয় মাস নয়, মাইনে এসে গেল পাঁচ মাসেই। ভাগ্য ভালো ছিল হয়ত। সেই মাইনে থেকে সাত হাজার তুলে দিলাম বিশ্বাস বাবুর হাতে। আগের পাঁচ এই সাত সব মিলে বারো হল। হিসেব কষে বুঝিয়ে দিলেন বিশ্বাস বাবু–আরো হাজার তিনেক টাকা লাগবে বই বের করতে। কম্পোজ প্রুফ রিডিং প্রিন্টিং বাঁধাই সব এখানে হবে। শুধু কভারটা হবে না। সেটা আমাকে অন্য জায়গা থেকে ছেপে এনে দিতে হবে।

মাইনের সাত হাজার এখানে দিয়ে যে টাকা কটা ছিল কোন মতে মুদির দেনা অল্পকিছু শোধ দেওয়া গেল। কিন্তু তারপরেও যে আরো টাকা লাগবে। বাধ্য হয়ে আমার সেই সোদপুরের যোগেনদার কাছে হাত পাতলাম। উনি দিলেন দুহাজার। অন্য এক দুবন্ধু দুশো পাঁচশো করে দিয়ে পূর্ণ করে দিল আমার ঝুলি। ‘অদল বদল’ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় আমার একটা গল্প ‘একটি দেবী স্থানের পত্তন কাহিনী’ প্রকাশ করেছিল। তাতে একটা ছোট পুরস্কার পাই অল্প কিছু টাকা-আর একখানা মানপত্র।

সে যাইহোক সেই কভার ছাপিয়ে আনবার প্রয়োজনে প্রেসে প্রেসে চক্কর দিতে দিতে জ্ঞান-চক্ষু উন্মেলিত হয়ে গেল আমার। দেখলাম আমি শুধু বোকাই নয় আস্ত একটা বোকা পাঠা। যে পাঠাকে কোন পুজো ছাড়াই হাড়িকাঠে পেলে ইচ্ছে মতো কেটেছে জনৈক বিশ্বাস।

যে কাগজের রীমের দাম অন্য জায়গায় তিন হাজার, ওরা দাম ধরেছে সাড়ে চার হাজার টাকা। ষোল-পাতায় এক ফর্মা, যার কম্পোজের রেট তিনশো টাকা ফর্মা। ওরা তার জন্য নিয়েছে সাড়ে আটশো করে। যে বই বাঁধাইয়ের দাম বাইরে প্রতিপিস দু টাকা ওরা তার জন্য নিয়েছে পাঁচ টাকা পিস।

তখন হিসেব করে দেখি একশো চুরাশি পৃষ্ঠার চারশো আটানব্বই খানা বই ছাপাতে এরা যে পনের ষোল হাজার টাকা নিয়েছে ওই টাকায় পুরো একটা সংস্করণ–এগারো শশা বই ছাপা হয়ে যেত। কায়দায় ফেলে ওরা আমাকে ইচ্ছামত জবাই করে দিয়েছে।

সবচেয়ে বাজে কাগজ, সবচেয়ে বাজে বাঁধাই, বিচ্ছিরি ছাপা।তবু ২০০০ সালের বই মেলায় প্রকাশিত হল আমার প্রথম বই ‘বৃত্তের শেষ পর্ব’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *