০৬. একমাস পরে পত্রিকা বের হল

প্রায় একমাস পরে পত্রিকা বের হল। তারপরই মনে হল হঠাৎই যেন আমার চারপাশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে নিক্ষিপ্ত হচ্ছি ক্রমশ কোন নির্জন নির্বান্ধব দ্বীপে। হিংস্র নির্দয় নরভোজীরা দাঁতনখ নিয়ে ঘিরেছে আমাকে। আর কোন শিক্ষক আমার দিকে সোজা চোখে তাকাচ্ছে না। সবার চোখে কেমন যেন একটা ভয় একটা সন্দেহ। যেন কোন আত্মঘাতী জঙ্গি অনুপ্রবেশ করেছে তাদের সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে যে কোন মুহূর্তে সে সব কিছু বিস্ফোরণে চুরমার করে দেবে।

কদিন পরে রথীনবাবু ডাকলেন আমাকে সত্যি করে বলো তো এই গল্পটা কার লেখা?

বলি–আমি লিখেছি।

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। বলেন তিনি এত ভালো তুমি কী করে লিখতে পার! পত্রিকায় অন্য যে সব লেখা ছাপা হয়েছে এর সামনে সেগুলোকে খুবই জোলো বলে মনে হয়। ওই সব শিক্ষিত মানুষদের চেয়ে তোমার লেখা এত ভালো হয় কী ভাবে? ঠিক করে বলো তো ব্যাপারটা কী?

বলি–অন্য লেখার সাথে আমি কোন তুলনায় যাবো না। তবে এটা আমারই লেখা। এই প্রথম নয়–এর আগেও আমার কুড়ি বাইশটা লেখা ছাপা হয়েছে। মহাশ্বেতা দেবীর বর্তিকাতেও আমার লেখা ছিল।

গলায় ক্ষোভ ফুটিয়ে বলেন রথীন বাবু–সে তুমি যেখানে যা করছিলে সেখানেই তা করতে। এখানকার পত্রিকায় লেখার দুর্বুদ্ধি হল কেন! এখনও তোমার চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়নি। এই সময় মাষ্টার মশাইরা যাতে অপমানিত বোধ করেন এমন কাজ করাটা তোমার পক্ষে মঙ্গলজনক হবে না। একটু থেমে আবার বলেন উনি সুধীর বাবুর ধারণা, এর মধ্যে একটা চক্রান্ত আছে। সুবোধ বাবু তাদের লোকের চোখে হেয় করবার জন্য তোমাকে দিয়ে এ সব করিয়েছে। যার জন্য তোমার নামের পাশে ব্রেকেটে জমাদার লিখে দিয়েছে। এর সোজা মানে–দেখো একটা জমাদার কেমন লিখেছে আর মাষ্টাররা বা কি লিখেছে। আমার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে ফের বলেন উনি তুমি ধরা পড়ে গেছো।

-কী?

–তুমি রীতিমত পড়াশোনা জানা ছেলে। আমার ধারণায় কমপক্ষে মাধ্যমিক এবং অবশ্যই বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত। তোমার লেখা পড়লেই পরিষ্কার সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়।

দিন কয়েক পরে ডাক এল হেডমাষ্টারের কাছ থেকে। সবদিন বিনম্রতা সহকারে দাঁড়িয়ে থাকি আজ বসতে চেয়ার দিলেন–দাঁড়িয়ে কেন বসো বসো। আরে তুমি তো বিরাট গুণী মানুষ হে। তুমি কি অসাধারণ গল্প লিখতে পারো। সত্যি বলতে কি আমি তো গল্পটা পড়ে একেবারে থ হয়ে গেছি। গল্পের ওই জায়গাটা পড়বার সময় আমার গায়ে তো কটা দিচ্ছিল। যখন মৃত্যু শয্যায় শুয়ে মাষ্টার মশাই ছাত্রদের বলছেন–তোমরা শিক্ষিত হও।সচেতন হও। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা ঘটায় বিপ্লব। তোমাদের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসুক। তোমরা পরিবর্তিত হলেই সমাজে পরিবর্তন আসবে।

চোখের চশমা মুছে, হাতের পেনটা টেবিলে ঠুকে আবার বলেন তিনি–আমার একটা ভীষণ অহংকার ছিল যে আমি মানুষ চিনতে কখনও ভুল করি না। সে অহংকার আজ আমার চূর্ণ হয়ে গেছে। যেদিন তুমি প্রথম আমার কাছে এলে, সত্যি বলছি তোমাকে দেখে আমি একদম চিনতে পারিনি। তোমার চেহারা পোষাক এসব দেখে আমি একজন সত্যিকারের জমাদার ভেবেছিলাম। আমার চোখকে যে ফঁকি দিতে পারে স্বীকার করে নিতেই হবে সে অসাধারণ। এক গেলাস জল খেয়ে আবার বলেন তিনি–আমার বাবাও ছিলেন একজন বিপ্লবী। মাষ্টারদার সাথে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। উনি জালালাবাদ পাহাড় থেকে পালিয়ে এসে হুগলি নদীতে মাঝির ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিলেন। কেউ ওনাকে চিনতে পারেনি। শুনেছি একবার নাকি ওনার নৌকায় সেই দারোগা সওয়ার হয়েছিল যে বাবাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। গলা একটু ভার ভার করে কথার মালা গেথে চলেন তিনি, আমি জানি আদর্শের প্রতি গভীর অনুরাগ থাকলে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সে সব কিছু করতে পারে। তোমাকে দেখে বলতে হচ্ছে–যে দল তোমাদের মত একনিষ্ট কর্মী তৈরি করতে পেরেছে তাদের অগ্রগতি কেউ রোধ করতে পারবে না। আমাদের দলের ছেলেগুলোকে দেখো–পায়খানা পরিষ্কার তো বহুদূরের কথা, পোষ্টার মারতেও লজ্জা পায়। এই একটা দিকে আমরা তোমাদের কাছে হেরে যাচ্ছি।

উনি থামবার পর কাঁপা কাঁপা গলায় বলি–আপনি স্যার যা ভাবছেন আমি তা নই। কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আমার কোন সংশ্রব নেই। নিতান্তই গরিব মানুষ, পেটের দায়ে এই কাজ করতে এসেছি। আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। স্যার বহুদিন হয়ে গেল, এত কম মাইনেয় আর সংসার চালাতে পারছি না। এবার দয়া করে আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন স্যার।

হাসলেন উনি বস্তুতঃ উনি এই প্রথমবার হাসলেন। এমন বুক হিম করে দেওয়া বিদ্রুপের হাসির সামনে আগে আর কখনও পড়িনি। হেসে হেসে বলেন তিনি একটা সত্যি কথা শুনবে? শুনলে তোমার কিন্তু ভালো লাগবেনা। তবুবলছি, আমি তোমার মত একজন প্রতিভাবান মানুষকে ঝাটা হাতে দেখতে চাই না। ওই হাতে কলম দেখতে চাই। কামানের নলের মত অগ্নি উক্ষিরণকারী কলম। হাঃ হাঃ। তাই এমন কিছু করতে মনের সায় পাচ্ছি না যাতে মহান একটা প্রতিভা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। কত শক্তিশালী লেখনি তোমার যদি তুমি শুধু লেখা নিয়েই থাকো, আমি বলছি–একদিকে যেমন বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে, অন্যদিকে বাংলার বামপন্থীরা গর্ব করার জন্য খুঁজে পাবে এক বাঙালী গোর্কিকে। আমি তোমার মধ্যে সেই সম্ভাবনা সুপ্তাকারে দেখতে পাচ্ছি। সামান্য মাইনের একটা চাকরির প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে তোমার ও বাংলা সাহিত্যের এত বড় ক্ষতি আমার দ্বারা হবে না। সেটা অন্যায় হবে পাপ হবে। আমার এই নির্ণয় আজ তোমার কাছে অমানবিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একদিন তুমিই বলবে যে আমার এই সিদ্ধান্ত কত নির্ভুল কতটা সঠিক ছিল। তুমি বরং একটা কাজ করো, সুবোধ বাবু স্বদেশবাবু এদের বলো–ওদের তো অনেক পত্র পত্রিকা তার কোন একটায় লেখালেখির কাজ দিয়ে দিক।

কখন হেডস্যারের প্রবচন থেমে গেছে বুঝতে পারিনি। তখন কান মাথা সব আঁ আঁ করছিল আমার। নিদারুণ এক আশঙ্কা–এক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আমার সমগ্র সত্তা বর্তমান ভবিষ্যৎ সব যেন গিলে নিয়েছিল। শোকে দুঃখে তখন যেন মরে গেছি আমি। মরে পচে হেজে গেছি। আমার সারা শরীর বেয়ে দৌড়াচ্ছে নানা সাইজের বিষ্টাকীট। যেমন দৌড়য় লাশ গাদায় ফেলে দেওয়া বেওয়ারিস লাশের শরীরময়। কখন যে চেতনাহীন অবশ অসাড় শরীরটা টেনে কলঘরের পাশের প্রায়ান্ধকার সিঁড়ির নিচে এনে ফেলেছি–জানি না। বসে পড়েছি সিঁড়ির থুতুকফ ধুলো পানের পিকের উপর। মল মূত্রের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগছে। বহু সময় এভাবে বসে থাকবার পর শুনতে পাই স্কুলের ছুটির ঘন্টা।তখন পায়ে পায়ে দাঁড়াই পথের উপর। আমারও ছুটি হয়ে গেছে।

বহুপথ হেঁটে বহু মানুষ দেখে বহু অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হয়ে আবার ফিরে এলাম আমার সেই পুরনো ঠিকানা–যাদবপুর রেল স্টেশনে। স্টেশনের রিকশা লাইনে, আবার রিকশাঅলা হয়ে। তখন মনে হল ঘুড়ি যতই আকাশময় উড়ুক যত ফড়ফড় করুক আর যতই উঁচুতে উঠুক, শেষকালে লাটাইয়ের গোড়ায় ফিরেই আসতে হবে। এটাই তার নিয়তি। আমার জীবনটাও ওই ঘুড়িরইমতোনাকী এক অদৃশ্য সুতো আমাকে বেধে রেখেছে একঅবমাননা অভাব আর অস্বাভাবিক ঘটনা প্রবাহের সাথে। যা থেকে মুক্তি নেই। সরল স্বাভাবিক ছন্দবদ্ধ যে জীবন তা আমার নাগালে কোনদিন আসবে না।

কী আর করা যাবে, যখন গরু গাধা ঘোড়ার মত ভারবাহী পশুতুল্য জীবন যাপন করতেই হবে–রিকশা চালিয়ে বাঁচতে এবং মরতে হবে। দিনের অধিকাংশ সময় যেখানে কাটাতে হবে সেই কর্মভূমিটাকে এবং যে মানুষগুলোর সঙ্গে থাকতে হবে, মরে গেলে যাদের কাঁধে চেপে শ্মশান পর্যন্ত যেতে হবে সেই আমার স্বজন, সবাই মিলে যাতে আর একটু কম কষ্টে থাকা যায় এবার সেই উদ্যোগটা নেওয়া যাক। স্থির করি আমি রিকশা ইউনিয়ন করবো। একেবারে একটা নতুন ধরনের ইউনিয়ন।

এর আগে অনেকবাৰ্বি ইউনি হয়েছে। ইউনিয়নের কর্মকর্তা যারা হয়েছেন কেউ রিকশা চালান না। রিকশা চড়েন। যে ইউনিয়নের সদস্য হবার ফলে রিকশা চালকদের তিনটি বিশেষ কাজ করা ছিল বাধ্যতামূলক। একমাসে মাসে নির্ধারিত চাঁদাটি ঠিকমত দেওয়া। দুই-বিশেষ বিশেষ দিনে মিছিল করে গিয়ে মিটিংয়ে ভিড় বাড়ানো। তিন-ভোটের সময়ে উক্ত ইউনিয়ন নেতার নির্দেশ অনুসারে বিশেষ বিশেষ ভোটারকে বাড়ি থেকে রিকশায় করে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া ও ভোটদানের পরে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া এবং অবশ্যই এর জন্য কোন ভাড়া দাবি না করা।

যাদবপুর স্টেশনে দীর্ঘদিন ধরে যে রিকশা ইউনিয়নটি রয়েছে এর নেতা জনৈক কংগ্রেসি মাস্তান। কংগ্রেস হলেও কী এক কারণে কে জানে এলাকার সিপিএম নেতাদের সাথে তার বড় মধুর সম্পর্ক। প্রতিমাসে দুটাকা করে ইউনিয়ন চাঁদা তো সে আদায় করে নেয়, কেউ জানে না সে টাকা কোথায় কি ভাবে খরচ হয়। রিকশা চালকেরা সাধারণত খুবই গরিব। তাদের কন্যাদায়, মা বাপের শ্রাদ্ধ, পরিবারের কারও অসুখ বিসুখ বা রিকশা চালকের নিজের অসুখ কিংবা দুর্ঘটনা, এসব ক্ষেত্রে তাকে সহজ শর্তে কিছু ঋণদান অবশ্যই ইউনিয়নের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু কোন ইউনিয়নই এখন পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেনি।

আমার ধারণায় একটা কারখানায় যদি ইউনিয়ন হয় আর তার নেতৃত্ব কর্তৃত্ব যদিশ্রমিকদের হাতে না থেকে মালিকদের হাতে থাকে তাতে মালিকদেরই মঙ্গল হবে শ্রমিকদের হবে না। সেই হিসাবে যদি রিকশা ইউনিয়ন যারা রিকশা চালায় তারা না বানিয়ে যারা রিকশায় চড়ে তারা বানায় তাতে রিকশাঅলাদের হিত হবার নয়। রিকশা চালক ভাইদের সাথে এ নিয়ে কথা বললাম। বোঝালাম নিজেদের ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে। আমরা আমাদের ইউনিয়ন নিজেরা বানাবো। এখন যার হাতে ইউনিয়ন সে এক পুরনো মাস্তান, সবাই ভয়ে ভয়ে বলল–সে যদি রেগে যায়! বললাম-বুড়ো বাঘের চেয়ে জোয়ান ষাড় বেশি বলবান। আমরা আমাদের পরিশ্রমের পয়সা অন্যকে দেব না। এতে যদি কারও রাগ হয়–দেখা যাবে। অবশেষে একদিন পুরানো সাইনবোর্ড খুলে ফেলে লাগানো হল নতুন ইউনিয়নের নতুন সাইন বোর্ড রিকশা শ্রমিক সমিতি। সভাপতি হরেন ঘোষ সম্পাদক মদন দে কোষাধ্যক্ষ অভিমুন্য দাস আর গণেশ, দুই গোপাল ও আমি রইলাম সদস্য। কিছুদিন আগে সিপিএম পার্টির সালকিয়া প্লেনাম অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। যাতে কতগুলো নতুন নতুন প্রস্তাব পাশ হয়েছে। আগে এরা বলত ধর্ম হচ্ছে আফিং যা মানুষের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এবার প্রস্তাব নেওয়া হল যে সিপিএম পার্টির কর্মীরাও দুর্গাপূজা কালীপূজায় সক্রিয় অংশ নেবে। মানে চঁদা তুলবে আর কি। এবং আর একটা প্রস্তাবও নেওয়া হয়েছিল যে অসংগঠিত শিল্পে যে সব মজুর আছে তাদেরও সংগঠিত করা হবে। যাতখন তারা বেশ ভালোভাবে শুরুও করে দিয়েছিল। যত হকার, ছোট ছোট দোকানদার, বড় বড় দোকানের কর্মচারী, রেল স্টেশনের মুটে, বাবুবাড়ির কাজের মাসি, দিন মজুরি করা মজুর মোদ্দা কথা সর্বত্র, প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিটা পেশার মানুষকে অক্টোপাশের আটবাহু দিয়ে আঁকড়ে ধরার মত ধরে ফেলা জোর কদমে চলছিল। এবার তাদের নজর পড়ল রিকশা চালকদের দিকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে রিকশা চালকদের নিয়ে বিভিন্ন নেতা ইউনিয়ন গড়েছেন। তবে এত ব্যাপক আয়োজন এর আগে আর হয়নি। সঠিক হিসাব জানা নেই তবে এটা ঠিক সে সময় যাদবপুর অঞ্চলে হাজার খানেক রিকশা নিশ্চয় চলত। সব লাল ছাতার নিচে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। তাদের কঠোর নির্দেশ যে আমাদের ইউনিয়নে আসবে না, এখানে রিকশাই চালাতে দেব না। ফলে তারা প্রায় সফল হয়ে গেছে।

পুরো যাদবপুর কজা করে নিলেও স্টেশনটা বাদ ছিল। সিপিএম নেতা শিবু রায় চৌধুরী আর সেই কংগ্রেসি মাস্তান দুজনে বন্ধু। সন্ধ্যেবেলায় একসাথে বসে মদটদ খায়। চক্ষু লজ্জার কারণে ওটা তার জন্য ছাড় দিয়ে রেখেছিল। এখন সে ইউনিয়ন তার কজা থেকে বের হয়ে গেছে, আর চক্ষুলজ্জার কোন বালাই নেই তাই একদিন সি.পি.এম. পার্টির দু তিনজন যুবনেতা আমার কাছে এল। বলল–এই ইউনিয়ন চলবে না। সবাইকে সিটু অনুমোদিত অল বেঙ্গল রিকশা ইউনিয়নে যোগ দিতে হবে।

আমি জানি, আগের রিকশায় চড়া লোক দ্বারা সঞ্চালিত ইউনিয়ন কেমন ছিল। এটা সব রিকশাঅলাই জানে। এবারও যারা এসেছে সব রিকশায় চড়া দলের লোক। এ ইউনিয়ন যে কেমন হবে তা আমাদের বোঝা আছে। তাই রাজি হতে পারি না। বলি–আমরা কোন দলের সাথে যাবো না। ফলে তারা আমার উপর খুবই রুষ্ট হয়। বলে যায় যাস কী যাস না দেখবো!

দেখতে গেলে এই শহরতলিতে সবচেয়ে বিপন্ন বেওয়ারিস অসুরক্ষিত হস্তসুখ দানযোগ্য দুর্বল প্রাণীটির নাম রিকশাঅলা। তাকে যে কোন সময় যে কোন সুবিধা জনক স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। মেরে নাক ফাটিয়ে দেওয়া যায়। হাজার লোক থাকলেও কেউ কিছু বলবে না। কোন বাবু রিকশাঅলাকে পেটাচ্ছে আর কেউ এসে বাধা দিয়েছে এমন উদাহরণ একটাও নেই। যারা আমার সবকাজের সহায়ক শুধু এই কটাকে সাইজ করে দিলে বাকি যে কটা বুড়ো আধবুড়ো মরা আধমরা থাকে তাদের উঠতে বললে উঠবে বসতে বললে বসবে। তাই তারা পরের দিন থেকে নানান ছলছুতোয় তাদের উপর অত্যাচার শুরু করে দিল। কথায় তো বলে দুষ্টের কখনও ছলের অভাব হয় না। কজন রিকশাঅলা দুপুর বেলা তাস খেলছিল যার মধ্যে কালো গোপালও ছিল। জুয়া খেলছে বলে তাকে পিটিয়ে দিল। জলিলকে মারল মদ খেয়ে আজেবাজে কথা বলেছে এইছুতোয়। গণেশকে মারল ভাড়া বেশি নিয়েছে বলে। আর সব শেষে এক দিন আমাকেও বাঁশপেটা করে দিল আমার বউ বাচ্চার সামনে। আমার অপরাধ তো একটা নয়–অনেক। সেই উনসত্তর সাল থেকে দশ-বারো বছর শুধু অপরাধই অপরাধ। সময়টা একটু বদলে গেছে, নাহলে ওরা আমাকে শেয়াল শকুনের খাদ্য বানিয়ে দিতে পারলে খুশি হতো। তা যখন করা যাচ্ছে না এই সময়, তাই কঠোর আদেশ দেওয়া হল আমাকে–আর যেন তোকে যাদবপুর স্টেশনের ত্রিসীমানায় না দেখি। আর রিকশার হ্যান্ডেল ষ্টুবি না। তোদের মতো ক্রিমিনালদের জন্য যারা সত্যিকারের ভালো লোক সেই সব রিকশাঅলার বদনাম হয়ে যায়। যদি রিকশা চালাস ধাপার মাঠে নিয়ে গিয়ে পুতে দেব।

আবার বেকার হয়ে গেলাম আমি। চলে গেল রিকশা চালানো, চলে গেল আমার প্রিয় যাদবপুর স্টেশন। এরপর আর কোনদিন এখানে ফিরে আসা হয়নি। প্রবহমান সময় আমাকে ঠেলতে ঠেলতে সরিয়ে নিয়ে গেল দূর থেকে দুরে।

এবার আমাকে যাদবপুর থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিলেন আমার শাশুড়ি মাতা। ওনার একজন লোকের সাথে চেনাজানা ছিল, যার মাধ্যমে আমার জন্য যোগাড় করে দিলেন নরেন্দ্রপুরের এক কারখানায় নাইট গার্ভের কাজ। মাইনে মাসে সাড়ে তিনশো। তবে তারা কারখানার মধ্যেই আমাদের থাকার জন্য একটা ছোট্ট ঘর দিলো যে কারণে ঘর ভাড়াটা বেঁচে গেল।

নরেন্দ্রপুরে আমি বছর দুই ছিলাম। এখানে আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্মগ্রহণ করে। যার নাম রাখা হয় মানিক। আর প্রথম সন্তানের নাম তো রাখা হয়েছিল আমার প্রিয় সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর নামে। এবার আর এক প্রিয় পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের লেখকের নামে মিলিয়ে রাখলাম ছেলের নাম।

এই সময় আমার অনেকগুলো লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জীবনে প্রথম লেখার জন্য টাকা পাই। মনোরমা পত্রিকায় প্রকাশিত আমার নেশা গল্পটির জন্য সাড়ে চারশো টাকা (যা তখন আমার একমাসের মাইনের চেয়েও বেশি)-“পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসের ২৮ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকার কলকাতার কড়চায় আমার কথা লেখা হয়। লিখেছিলেন নিখিল সরকার–“আমরা প্রশ্ন করেছিলাম ওকে কেন লেখেন? জবাব ছিল আমার কিছু কথা আছে যা মানুষকে জানানো দরকার আর সে সব কথা জানাতে পারি আমিই।……”

১৯৮৯ সালের এক সকালে আমার বড় অবাক হবার পালা। কেমন করে কে জানে আমার ছোট ভাই নিরু এই এত বছর পরে দণ্ডকারণ্য থেকে কলকাতায় এসে খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মত খুঁজে আমার নরেন্দ্রপুরের ঠিকানায় পৌঁছে গেল। ও এসেছিল কলকাতায় তার দোকানের জন্য কিছু মালপত্র কিনতে। তখন তার মনে হয় একবার দাদাকে খুঁজে দেখা যাক যদি পাওয়া যায়। সে প্রথম আসে সুলেখা কালি কোম্পানির কাছে। সেখান থেকে খবর পায় আমি যাদবপুর স্টেশনে রিকশা চালাই। স্টেশনের রিকশাঅলারা জানায় এখানে নয়, আমি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে থাকি। কেউ একজন এও বলে দেয়-মিশন পার হয়ে ডানদিকে যে বিস্কুট, লোহা, আর কাঠের কারখানা ওখানেই আমার ডেরা।

আর কেউ দিক বা না দিক আমি অন্তত মরিচঝাঁপির নির্মম নরসংহার বলাকার কান্ডের মহানায়ক জ্যোতি বসুকে একটা ধন্যবাদ দেব। উনি যা করেছিলেন সঠিক কাজই করেছিলেন। কারণ যে যত গভীরভাবে ঘুমোয় তাকে তত জোরে ধাক্কা মেরে জাগাতে হয়, দণ্ডকারণ্যবাসী উদ্বাস্তুরা পরম বিশ্বাসে গভীর ঘুমে তলিয়ে স্বপ্ন দেখছিল যে পশ্চিমবঙ্গে তাদের প্রতি দরদি মনের একজন মানুষ আছে, একটা দল আছে। যদি তারা কোনদিন ক্ষমতা পায় আবার তারা স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে। জ্যোতি বসুর পুলিশ আর পার্টিক্যাডারদের পাশবিক হত্যা আর ধর্ষণ তাদের সে স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। তারা এখন বুঝতে পারছে তাদের প্রতি দায় বা দরদ কোনটাই এদের কোনদিন ছিল না। কোন উচ্চবর্ণের নেতা বা দলের তা থাকে না। তারা যখন যা করে সে গলায় জড়ানো বা গলা টেপা-সবটাই নিজেদের স্বার্থে। এই বোধোদয় পরবর্তী সময়ে তাদের প্রভূত উপকারে লেগেছে। নতুন করে ভাবতে এবং বাঁচতে শিখিয়েছে।

যখন মানুষ প্রথম জেলখানায় যায়–বাইরের জন্যে মন কাঁদে। মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করে। যখন বুঝে যায় মুক্তি পাবার কোন আশা আর নেই, সারা জীবন এখানেই কাটাতে হবে তখন তার উতলাভাব ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। সে তখন জেলবাসটা কতটা সহনীয় করে নেওয়া যায় সেই চেষ্টায় মত্ত হয়। কেউ মাটির মুর্তি গড়ে, কেউ ছবি আঁকে, কেউ ফুলের বাগান করে।

উদ্বাস্তুরা যখন বুঝে গেল তারা বাংলার কেউ নয়, বাঙালীর কেউ নয়। তাদের জীবন মরণ লেখা হয়ে গেছে দণ্ডকারণ্যের কাঁকর পাথর মাটির বুকের গোপন আখরে, তখন তারা যে কটা দিন বাঁচি যতটা ভালোভাবে বাঁচা যায় সেই চেষ্টায় যত্নশীল হয়ে উঠল। বাড়ির আশেপাশে পুততে শুরু করল আম কাঁঠাল সহ নানাবিধ ফলের গাছ। কেউ খুড়ে ফেলল জলের কুয়ো। সেই কুয়োর জলে ফলাতে লাগল ফুলকপি বাধাকপি বেগুন মুলো। কেউ উঁচু নীচু জমি কঠিন শ্রমে সমতল করে খরিফ এবং রবি দুটো ফসল উৎপন্ন করে নিতে লাগল বছরে। ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে যাতে চাকরি বাকরি পায় সেই চেষ্টা শুরু করল কেউ কেউ। একদল নেমে গেল ছোটখাটো ব্যবসায়–যার স্থানীয় নাম ধান্দা। যার মধ্যে ব্যবসা কম-ধান্দা বেশি।

নিরুও ধান্দা করে। সাইকেলে চাপিয়ে খইনি তেল সাবান নিয়ে আদিবাসী পাড়ায় গিয়ে বিক্রি করে। ধান্দা মোটামুটি জমে গেছে। এবার এসেছে কলকাতা থেকে চুড়ি দুল চুলের ফিতে এই সব মনোহারি মাল নিয়ে যাবে বলে। এতে দারুণ লাভ।

মানুষ তো আসলে সব কিছুর পরেও মানুষ। তার লোভ আছে ক্রোধ আছে আবেগ আছে। সে তো জানে না কখন তার মনের উপর কোনটা বেশি প্রভাব বিস্তার করে বসবে। আর তখনকার সেই মানসিক দুর্বলতার মুহূর্তে এমন একটা কাজকরে ফেলবে যে সেই ভুলের জন্য সারাটা জীবন তাকে পস্তাতে হবে। আমার ছোট ভাই নিরু এমনিতে দয়ামায়া শূন্য এক কঠোর প্রকৃতির মানুষ। তবে সেদিন দীর্ঘ ষোল সতের বছর পরে দাদাকে দেখে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে সে, আর বলে বসে–দাদা এখানে যখন এই অবস্থা, তখন শুধু শুধু এখানে কেন পড়ে আছে। বাড়ি চলো। সরকারের কাছ থেকে যে জমি জায়গা পেয়েছি একা আমি তা চাষ করে উঠতে পারি না। অর্ধেকের বেশি অনাবাদি পড়ে থাকে। বাবা মরে গেছে মেজদা মরে গেছে। চলো দুই ভাই মিলে মিশে একসাথে থাকব। চাষাবাদ করে খাব। নির্বোধটার তখন মনে ছিল না যে তার দুটো ছেলে আছে। তারা একদিন বড় হবে, বিয়ে থা করবে। এখন জমি চাষ করা যায় না, খাটবার লোক নেই, তখন জমি কম পড়ে যাবে।

নিরুহোতখনকার মত কথাকটি বলে দিয়ে দুদিন আমার বাসায় থেকে তৃতীয় দিন চলে গেল, এদিকে আমার সংসারে লেগে গেল অশান্তির আগুন। আমার স্ত্রী অনুর বা কী দোষ। তার তো তখন ডুবন্ত মানুষের মত অবস্থা, খড় কুটো যা পায় আঁকড়ে ধরে তীরে উঠতে চায়। নিরুর কথায় তার মনের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে আমরা কুল পাবো-বাঁচবো। তাই সে জিদ করতে থাকে, ঝগড়া করতে থাকে, কান্না জুড়ে দেয়–”দেশে চলো।”

অনু এভাবে এখানে থাকতে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। তার চোখের সামনে ভাসছে রাজডাঙার ছয় ছয়টা মৃতদেহ। যেদিন সে রেশন তুলতে হালতুতে গিয়েছিল তারই চোখের সামনে কানা অজিতকে খুন করা হয়। তারই চোখের সামনে তার স্বামীকে রিকশা থেকে নামিয়ে বেধরক মারা হয়। অনাথ আশ্রমের শান্ত নিরুদ্বেগ জীবন কাটিয়ে এসে এসব ভয়াবহতা সহ্য করতে পারছে না। তার আশঙ্কা হচ্ছে আমার শত্রুরা যে কোনদিন তাকে বিধবা বানিয়ে দিতে পারে। তাই তার কান্না কাতরতা দেশে চলো।

এই সময় আমি একদিন চেতলা স্কুলের শিক্ষক-কবি-দাদা সমীর রায়ের সাথে দেখা করে বলেছিলাম-ভাবছি, আমি মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলায় চলে যাব। কলকাতায় আর আসব না। বাকি জীবনটা ওখানেই কাটিয়ে দেব। বন্ধু বান্ধব সবার কাছে বিল্টুদায় ওয়া হয়ে গেছে। শুধু আপনি বাকি ছিলেন।

তখন বলেন উনি–সিদ্ধান্ত যখন নিয়ে ফেলেছে, নিশ্চয় সবদিক খতিয়ে দেখেই নিয়েছে। তবে বস্তারে যখন যাচ্ছো তুমি ওনার সাথে দেখা কোরো। বস্তার থেকে দল্লী খুব বেশি দুর নয়।

কার কথা বলেছিলেন কবি সমীর রামা কে তিনি? উনি ছত্তিশগড়ের শ্রমজীবী জনগণের হৃদয়-সাম্রাজ্যের রাজা শংকর গুহ নিয়োগী। আপামর জনগণের আদর আর ভালোবাসার নিয়োগী ভাইয়া।

এই নাম আমার আগে থেকে জানাছিল। সঠিক মনে নেই সম্ভবত পরিবর্তন পত্রিকার কোন পুরনো সংখ্যা ছেচনের ছেঁড়া কাগজের স্তূপ থেকে বের করে পড়ে জানতে পেরেছিলাম ওনার বিষয়ে। তবে সাক্ষাৎ কোন পরিচয় তো ছিল না তাই জানা ছিল না মানুষটা ব্যবহারিক জীবনে ঠিক কেমন আর জনতার কতটা প্রিয়। মনে এবার আশা জাগলো, বস্তারে গিয়ে অন্তত একবার ওনার সাথে নিশ্চয় দেখা করব।

অবশেষে মাস দুয়েক পরে একদিন প্রয়োজনীয় যা কিছু বেধে ছেদে পৌঁছে গেলাম পারালকোটে। নিরু তখন আর আমাদের পুরনো বাড়ি–পি.ভি৫৬ তে থাকে না। থাকে হারানগড় নামে এক আদিবাসী গ্রামের কাছে নতুন বসত বাড়ি বানিয়ে। এখানে আমাদের বেশ খানিকটা চাষের জমি আছে। একটু ফাঁকা ফাঁকা জায়গা বলে এখানে গরু মোষ হাস মুরগি এসব পালন পোষণের বিশেষ সুবিধা। এখানে নিরুর একটা মুদিখানার দোকানও করেছে। হারানগড়ের সব লোক যে দোকান থেকে দরকারি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যায়।

আমরা পৌঁছেছিবিকালে। তখন নিরুবাড়িতে ছিল না।পি.ভি. ৫৬-এ তাস খেলতে গিয়েছিল। নিরুর ছেলে গিয়ে তাকে খবর দিল। খবর পেয়েও সে তাস ফেলে সন্ধ্যার আগে বাড়িতে এল না, এবং যখন সে এল তার ও তার বউয়ের হাসিহীন কালো মুখ দেখে মনে কুডাক ডেকে উঠল। তখনই বুঝে গেলাম–জীবনের অনেক ভুলের মত আর একটা মস্তবড় ভুল করে বসে আছি। এখানে এভাবে সপরিবারে এসে পড়াটা একদম সঠিক কাজ হয়নি। আমার সেই মা–মায়ের নিরাসক্ত ব্যবহারে বুঝে গেলাম–এক দীর্ঘ অদর্শন তার মনের মধ্যেও দেওয়াল তুলে দিয়েছে। সেখানে আজ আর আমার জন্য কোন স্নেহ মমতা অবশিষ্ট নেই। সে তার ছোটছেলে এবং তার সন্তান সন্ততির স্বার্থ সুখ ছাড়া আর অন্য কিছু চায় না। মা মহাভারতের গল্প জানে। যদি সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ বাধে মহা অনর্থ হকে। মায়ের এখন সেই ভয়ে বুক কঁপছে।

সব বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি তখন কী করব? অচেনা দেশ অচেনা পরিবেশ। যেখানে আমার বন্ধু রলে কেউ নেই। এখানে এসে যেন এক কুয়োর মধ্যে সপরিবারে পড়ে গেছি। ফের যে কলকাতায় ফিরে আসব তার গাড়ি ভাড়াই নেই। এসে যে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকব তার কোন ঘর নেই। নরেন্দ্রপুরে যে ঘরে ছিলাম, আমি চলে আসার পর সেখানে অন্য কাউকে কাজে রেখে ঘরটা তাকেই দিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়। তাহলে এখন উপায়?

একান্ত বাধ্য হয়ে দু তিন মাস থাকতে হল ভাইয়ের বাড়ি। আমরা আমাদের অসহায়তার বিষয়টা জানি, তাই যথাসাধ্য ওদের মন জুগিয়ে চলবার চেষ্টা করি। অনু ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে গোয়াল সাফ করে, ঘরদোর ঝাট দেয় লেপাপোছা করে, জল বয়ে আনে, রান্না করে খেতে দেয়। বাড়িতে এখন এগার বারো জন লোক। তাদের জন্য রান্না হয় মোট তিনবার। সকালে সামান্য কিছু সেদ্ধ ভাত। যা খেয়ে আমরা যে যার কাজে বের হয়ে পড়ি। আমি মাঠে গরু ছেড়ে দিয়ে জঙ্গল থেকে খুটি বাঁশ কেটে আনি। যে বাড়ি এতকাল ঘেরা বেড়া ছাড়া ছিল এখন তার চারদিকে, যা প্রায় এক একর জায়গা, তাকে ঘিরে বেড়া দিই। এখন বাড়ির সবাই সব কাজ আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে হাতপা ছড়িয়ে বসে পড়েছে। চাইছে খাটুনির চোটে আমরা যেন চলে যাই। নিরুর বউ আর টিউবয়েলে গিয়ে চান করতে পারে না। তার পেটে বাচ্চা। সে জন্য তার চানের জল আধ কিলো মিটার দূর থেকে অনুকে বয়ে এনে দিতে হয়। আর সে এক পৈশাচিক আনন্দে দুতিন বালতি জল হড় হড় করে গায়ে ঢালে। এত কিছুর পরেও সে বেচারা পেট ভরে খেতে পায় না। আমি তো আগে খাই ফলে টের পাই না ওর খাবার আছে কি নেই। নিরুর বউ এবং আমার পূজনীয়া মা খেয়ে ছড়িয়ে ভাত নষ্ট করে ওকে উপোসে রাখে। এর ওপর আছে ঝগড়া। মা আর নিরুর বউ তো আছেই, মাঝে মাঝে আমার এক বোন যার বিয়ে হয়ে গেছে, তাকে ঝগড়া করার জন্য ডেকে আনা হয়। আমি যখন জঙ্গলে বা মাঠের কাজে ব্যস্ত থাকি তিন দিক থেকে অনুকে ঘিরে শুরু হয় ওদের আক্রমণ। একদিন তো এমন হল সারাটা দিন কিছু খেতে দেওয়া হল না। আমি যেন কি কাজে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যাবেলা ফিরে দেখলাম আমার পথ চেয়ে পথের পাশে এক গাছ তলায় ছেলে মেয়ে নিয়ে বসে বসে কাঁদছে অনাহারী অনু।

তখুনি আমরা চলে এলাম আমার বাবার সেই পুরনো ঘর পিভি ৫৬তে। সে ঘরের তখন ভগ্ন দশা। চালের খড় পচে ভোলা হয়ে গেছে। বৃষ্টি নামলে এ ঘরে থাকা মুশকিল। এখানে আমার মেজ ভাই চিত্তের বিধবা স্ত্রী থাকে দুটো নাবালক বাচ্চা নিয়ে। নিয়ম মত তার শ্বশুরের জমির একটা ভাগ পাওয়ার কথা। নিরু তাকে সে ভাগও দেয়নি। বেচারা মানুষের বাড়ি বাড়ি ধান কুটে জমিতে খেটে বাচ্চা দুটো নিয়ে বেঁচে আছে।

এখানে বলে রাখি, আমি পরে নিরুর কাছ থেকে তাদের জমির ন্যায্যভাগ আদায় করে দিতে পেরেছিলাম এবং আমার যে ভাগ তা আদায় করে চিত্তর দুই নাবালক ছেলে চন্দন তিলকের নামে লিখে দিয়েছিলাম। তখন নিরু নিশ্চয় বুঝেছিল আমাকে কলকাতা থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া কত বড় ভুল হয়েছে। একে বোধ হয় বলে খাল কেটে কুমির আনা।

যাই হোক, সেই রাতে চন্দনের মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেছিলাম, ভাত রান্না করো, আমরা না খেয়ে আছি।

সে রাত তো সেই ভাবে গেল কিন্তু তার পরের দিনগুলো কি করে যাবে? এখানে তো এমন কেউ নেই যে এক কিলো চাল দিয়ে আমাদের সাহায্য করে। ভাইদা শংকর নামে একটা লোক ছিল সে বলল চলে যাও জঙ্গলে। কেটে ফেড়ে নিয়ে আসো এক সাইকেল কাঠ। বেচো কোনো হোটেলে। কিনে আনো চাল ডাল। খেয়ে বাঁচো বউ বাচ্চা নিয়ে।

কথাটা মনে ধরল আমার। এখানে যারা মজুর খাটায় রোজের পয়সা রোজ দিতে পারে না। সপ্তাহ শেষে হাটবারে ধান পাট তিল সরষে হাঁস মোরগ কিছু একটা বেচে মজুরি শোধ করে। অত দেরি হলে আমার চলবে না। দুপুরেই চাল কিনে ভাত রান্না করতে হবে যে।

এখানে যে কাঠ বিক্রি করে তার কোন সম্মান বলে কিছু থাকে না। সবাই ডিফল্টার বলে। কলকাতা শহরে যারা কাগজ কুড়ায় এখানে যারা কাঠ বেচে দুজন সমান। আমার তখন সম্মান নয় খাদ্য দরকার। দুটো বাচ্চা, বউ। এদের বাঁচানো দরকার।

পি.ভি. ৫৬ নাম্বার থেকে কাপসী বাজার মাইল তিনেক দূরে। বাজারের শেষ মাথায় গোপালের হোটেল। ধরলাম গিয়ে তাকে। দাদা সবাই যে পরিমাণ কাঠ দেয় আমি তার চেয়ে কিছু বেশি দেবো। সবাইকে তুমি যে দাম দাও আমাকে না হয় তার চেয়ে এক টাকা কম দিও। তবু আমার কাছ থেকে কাঠ নাও। আমি বড় বিপদে পড়েছি। কথা হল সে আমাকে প্রতি সাইকেল কাঠের দাম দশ টাকা দেবে।

যেদিন থেকে কাপসী বাজারের পত্তন–সে প্রায় তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর, সেদিন থেকে হোটেল-চা দোকান চলছে। তা ছাড়া আশে পাশের দশ বিশটা গ্রামও আছে। সবারই জ্বালানি কাঠ লাগে। ফলে নিকটস্থ কোন জঙ্গলে শুকনো কাঠ পাওয়া খুব কঠিন। আমায় যেতে হবে কম পক্ষে দশ বারো মাইল দূরে। ১৩০ নাম্বার ভিলেজ পিছনে ফেলে আরো তিন চার মাইল আগের ঘন গভীর জঙ্গলে। যেখানে ভাল্লুক আমাকে আক্রমণ করতে পারে। বস্তার জেলার কুসংস্কার আচ্ছন্ন গোণ্ড আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা আমাকে তাদের নররক্ত প্রিয় দেবতা আঙ্গা দেবকে তুষ্ট করার জন্য ধরে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দিতে পারে। একটা সময় পৃথিবীর সব দেশেই নরবলির প্রথা ছিল। ছিল আমাদের এই ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্র। আমাদের ধর্ম পুস্তক যজুর্বেদ যার আর একনাম বাজনেয়ি সংহিতা এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও নরবলির উল্লেখ আছে।কালিকা পুরানম্‌-য়ে নরবলির সমর্থনে শ্লোক লেখা হয়েছে–

“নরেন বলিনা দেবী তৃপ্তিং সহস্র বৎসরাপি।
বিধিদত্তেন চাপপ্লাতি তৃপ্তিং লক্ষং ত্রিভির্নরে।”

অর্থাৎ বিধি অনুসারে যদি একটি নরকে বলিদান দেওয়া হয়, দেবী এক হাজার বছর, আর তিনটি নরবলি দানে এক লক্ষ বৎসর তৃপ্ত হয়ে থাকেন।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের সম সাময়িক কালেও বঙ্গদেশে যে ব্যাপক নরবলির প্রচলন ছিল, বহু পুঁথি পুস্তকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

শোনা যায় এদেশে ইংরেজশাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও আমাদের কালীঘাটের কালীমন্দিরে এবং চিৎপুরের দেবী চিত্তেশ্বরীর মন্দিরে নরবলি দেওয়া হতো।

সেই প্রাচীনকাল থেকে গোল্ড মাড়িয়া মুড়িয়া হল প্রভৃতি আদিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই বস্তার জেলার বিভিন্ন স্থানে নরবলি প্রথা চলে আসছে। এই জেলার এক নরবলি প্রিয় নরপতির নাম ছিল-ভৈঁরো দেও। ১৮৭৬ সালে তিনি এখানকার রাজা ছিলেন। সেই সময় বস্তার জেলার জগদ্দলপুরের বিখ্যাত দেবী দন্তেশ্বরীর মন্দিরে প্রচুর নরবলি দেওয়া হতো। রাজার লোকেরা পাশের উড়িষ্যা রাজ্য থেকে চুরি করে বা জোর করে মানুষ ধরে নিয়ে আসত।

আগের মতো ঘন জঙ্গল এখন আর নেই। প্রশাসনও সর্তক দৃষ্টি রাখে। ফলে দন্তেশ্বরী মন্দিরে আর নরবলি হয়না। তবে যে সব জায়গায় জঙ্গল এখনও ঘন-গভীর-দুর্গম আদিবাসীদের আর এক দেবতা বা দেবী–আঙ্গার মন্দিরে এখনও মাঝে মধ্যে একটা দুটো বলি হয়েও যায়। যাকে শাসন-প্রশাসন কোনভাবেই রদ করতে পেরে উঠছে না।

আইন হয়েছে বন্যপ্রাণী শিকার করা চলবে না। দ্রুণ হত্যা কঠোর দণ্ডনীয় অপরাধ। সাজার ভয় দেখিয়ে এ সব কী বন্ধ করা গেছে? নরবলিও ঘোর অপরাধ। এই অপরাধে যাবজ্জীবন জেল অথবা ফাঁসি হতে পারে। তবু কুসংস্কার আচ্ছন্ন বস্তার জেলার আদিবাসীরা সুযোগ পেলে নরবলি দিয়েই যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

এছাড়া সাপ কিংবা বিছা কাটতে পারে। তখন আমার আর এ সব ভাববার অবকাশ ছিল না। বাবার সময়কার একখানা ভোতা কুড়ুল ছিল। সেখানায় ধার দিয়ে আর একখানা সাইকেল ভাড়া নিয়ে একা চলে গিয়েছিলাম জঙ্গলে।

এ জঙ্গলে সহজে কেউ আসেনা এখলে প্রচুর শুকনো ১০ নাম্বার ভিলেজের কাছে একটা খাড়া পাহাড়ের উপর দিয়ে রাস্তাটা কাপসী গেছে। সেটা এত খাড়া যে খালি সাইকেলই ঠেলে উপরে তুলতে প্রাণ বের হয়ে যেতে চায়। প্রায় আধ মাইল লম্বা এই বাধার কারণে সম্ভবতঃ কাঠ সংগ্রহ করা লোকেরা এ দিকটা পরিহার করে চলে।

আমি অন্য দিকের জঙ্গল চিনি না। চিনবো হাতে অত এখন সময় নেই। খিদে তাড়া করে আসছে। খুব বেশি হলে আট ঘন্টা, তারপর পেড়ে ফেলবে। তার আগে কিছু একটা করা চাই। তাই এই জঙ্গলটা বেছেছি।

এটা জুন মাস। বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়। বেলা এগারোটার পরে আর কেউ ঘরের বাইরে থাকে না। তখন বাতাসে লু চলে। সেই গরম হাওয়া গায়ে লাগলে চামড়া পুড়ে ফোস্কা পড়ে যায়। সানস্ট্রোকেও বহু মানুষ মারা পড়ে। কাঠ কেটে বয়ে নিয়ে ফিরে আসতে হবে তার আগে। না হলে সূর্য তখন মাটিতে যে আগুন ঢালবে, পাথুরে মাটি সে আগুন দ্বিগুণ করে ফেরাবে।

সেই ঘন গভীর ভয় ধরানো জঙ্গলে গিয়ে ভোতা কুড়ুল দিয়ে যা হোক করে কাঠ তো কাটলাম। সেই কাঠ সাইকেলের ক্যারিয়ারে সাজিয়ে সাইকেলের একটা টিউব দিয়ে এবার বেঁধে ফেলতে হবে। বেলা তখন দশটার মতো হয়ে গেছে। রোদ শরীরে ছোবল দিতে শুরু করেছে আর পেটে শুরু হয়েছে খিদের চিনচিনে কামড়, সাথে প্রবল জল পিপাসা। এ সব অঞ্চলের মানুষ কেউ জল ছাড়া পথে নামে না। সবার সাইকেলে বাধা থাকে জল ভরা ব্যাগ যার নাম–ছাগোল। মাথায় বাধা থাকে গামছা। আর একটু বাবু গোছের লোক হলে চোখে কালো চশমা। আমি একেবারে অজ্ঞ এ সব বিষয়ে, তাই না জল না গামছা জঙ্গলে চলে এসেছি। এখানে কোথাও জলের নাম গন্ধ নেই।

কি আর করার। তাড়াতাড়ি কাঠ গোছাতে শুরু করি সাইকেলে আশা, জঙ্গল পার হয়ে ১৩০ নাম্বার ভিলেজে গিয়ে জল খাবো। আর তখনই বাঁ পায়ের পাতায় কাঁকড়া বিছে ফুটিয়ে দিল হুল। কাঠের বাকলের মধ্যে থাকা কালো রঙের ছোট্ট বিছে আমার নজরে পড়েনি। পা তুলে দিয়েছি পিঠে। পায়ে তো চপ্পল ছিল না ফলে হুল বিধোতে তার কোন বেগ পেতে হয় নি। তখন মনে হল একটা গরম শিক যেন চড়চড় করে পায়ের পাতায় ঢুকে গেল। পুরো পা যেন যন্ত্রণায় অবশ হয়ে যেতে আরম্ভ করল আমার। আর মাঝে মাঝে তার মধ্যে যেন বিদ্যুতের ঝলক আর ঝটকা।

মিনিট দুয়েক পা ধরে বসে পড়েছিলাম। তখন যে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে বুঝতে পারলাম আর কিছু সময় পরে পা খানা পুরোপুরি অক্ষম হয়ে যাবে। তার আগে এই জনহীন জঙ্গল থেকে কোন ভাবে বের হয়ে ১৩০ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। যেখানে কাউকে সাহায্যকারী পাওয়া গেলেও যেতে পারে। এখানে তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। তাই দ্রুত কাঠ সাজাতে আরম্ভ করি সাইকেলে। কাঠ ফেলে যাওয়া চলবে না। যদি তা করি সকাল থেকে এতক্ষণের পরিশ্রম সবটা জলে চলে যাবে। ঘরে বউ বাচ্চা সব না খেয়ে মরবে। সাইকেল ভাড়ার টাকা চেপে যাবে ঘাড়ে। তাই যত কষ্টই হোক কাঠ নিয়ে যেতেই হবে। তাহলে অন্তত আজকের দিনটা ভাত জল খেয়ে সবাই বাঁচব। কাল নিশ্চয় পা ফুলে যাবে। তখন যা হয় হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার প্রিয় কবি নয়। আমি একজন শ্রমজীবী শোষিত মানুষ। যদিও আমি তার সব লেখা পড়িনি তবু যেটুকু পড়েছি তাতে এই শোষণবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হবার কোন উপাদান তাতে খুঁজে পাইনি। দুই বিঘা জমি যার মধ্যে কবিতা কম ছোট গল্পের ভাগ বেশি। সবাই বলে এটা এক মহান সৃষ্টি। আমার কিন্তু রাগ হয় কবি উপেনকে সর্বস্বান্ত করে সাধু বানিয়ে দু বিঘার পরিবর্তে নিখিল বিশ্ব ধরার আনন্দে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন বলে। আমার শ্রেণি ঘৃণা আমাকে বলে উপেনেরুত্ৰকটা রাম দা নিয়ে বাবুর মুখোমুখি হওয়া উচিত ছিল। আমার সেই অপ্রিয় কবির কবিতার একটা লাইন এখন আমাকে শক্তি জোগায়–তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা। কাঠ সাজিয়ে জঙ্গলের মধ্যের এবরো খেবরে পাথুরে পথ ঠেলে কোনক্রমে সাইকেল নিয়ে পৌঁছলাম পাকা রাস্তায়। এবার সাইকেলে চড়তে হবে। কিন্তু সাইকেলের পিছনে বাঁধা কাঠের অনেক ওজোন। কিছুতেই ব্যালেন্স রেখে সিটে উঠতে পারি না। প্যাডেলে পা দিয়ে উঠতে গেলে টাল খেয়ে পড়ে যাবার ভয়।

অবশেষে সাইকেল নিয়ে এসে রাস্তার পাশে একটা গাছের গায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিয়ে এলাম একটা বড় পাথর। সেই পাথরে পা দিয়ে উঠে বসলাম সিটের উপর। কিন্তু যেই না প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাইকেল সামনে আগাবার চেষ্টা করেছি টাল খেয়ে কাঠ সহ সাইকেল নিয়ে উল্টে পড়ে গেলাম। আমার এখন এত ক্ষমতা নেই যে সাইকেল সোজা করি।

তাহলে এখন উপায়? উপায় একটাই, খুলে ফেললাম কাঠ বাঁধা টিউব। কাঠ সরিয়ে সোজা করে দাঁড় করালাম সাইকেল। এখন আমার পায়ের যন্ত্রণা মাথায় উঠে গেছে। কপালের দু পাশের শিরা দপ দপ করছে। বুকের মধ্যে যেন একটা শুকনো সমুদ্র কাতর প্রার্থনা জানাচ্ছে–জল একটু জল। মন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আমার। পিরবো না বোধ হয় আমিহেরেই যাবো। তখনই মনে পড়ল সমরেশ বসুর সেই পাড়ি গল্পটা। সিনেমায় সেখানে এক আনা মাথা পিছু মজুরিতে শুয়োরকে নদী পার করাচ্ছেনাসিরুদ্দিন শাহ আর তার গর্ভবতী স্ত্রী শাবানা আজমি। সাঁতারে ক্লান্ত, নদীর নাব্যতা দেখে ভীত শাবানা যখন বলছে–আমি নদী পার হতে পারব না, তখন নাসিরুদ্দিন বলছেপার হতেই হবে। কারণ ও পাড়েই আছে জীবন। নদী না পার হতে পারলে পয়সা পাবে না, তখন না খেয়ে মরে যাবে।

আমিও তখন বুঝে যাই কাঠ আমাকে নিয়ে যেতেই হবে। এর কোন বিকল্পই নেই।

আবার একখানা একখানা করে কাঠগুলো সাইকেলের পিছনে সাজাই। টিউব দিয়ে বাধি আবার। পাথরে পা দিয়ে উঠি সিটে। শক্ত করে হ্যান্ডেল চেপে ধরে প্যাডেলে চাপ দিই। এবার আর আছাড় খাই না। সাইকেল সামনে গড়ায়। মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে যাই ১৩০ নাম্বার ভিলেজের সামনে। পাকা রাস্তা ছেড়েবাঁদিকের কাঁচা রাস্তায় মিনিট দুয়েক গেলে রিফিউজি মানুষদের ঘর বাড়ি। এখানে এসে চেপে রাখা পিপাসাটা প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু ভয় করছে। বাঁদিকের বালি রাস্তায় বাঁক নিতে গেলে আবার যদি পড়ে যাই। পাকা রাস্তায় সাইকেল রেখে গিয়ে জল খেয়ে ফিরে এসে আর যদি উঠতে না পারি সিটে। সেই ভয়ে আর নামা হয় না। জলের আশা ছেড়ে এগিয়ে চলি সামনে। সামনে এখনো অনেকটা পথ।

আরো পনেরো কুড়ি মিনিট পড়ে পৌঁছাই সেই প্রাণ পাখি উড়ে যাওয়া খাড়া পাহাড়ের সামনে। সেখানে না নেমে কোন উপায় নেই। উল্টে যেতে যেতে কোনো মতে নামলাম সাইকেল থেকে। এবার যে পাহাড়ে খালি সাইকেল ঠেলে তুলতে বুকে হাঁপ ধরে যায়, আমাকে ষাট সত্তর কিলো কাঠ বোঝাই সাইকেল তুলতে হবে। তুলতেই হবে। কারণ পাহাড়ের ও পাড়েই আছে জীবন। এখন এর কোন বিকল্প আর নেই।

কোথা থেকে সেদিন কি এক শক্তি কী ভীষণ মনোবল এল আমার তা আমি জানি না। এর পিছনে কি সেই দাড়িআলা বুড়ো কবি না পাড়ি গল্পের লেখকের অবদান ছিল তা আমার অজানা। অকেজো এক পা, পেটে দুর্ভিক্ষের খিদে, মাথার উপর জুন মাসের রাগী সূর্য, পায়ের নিচে রুটি সেকাঁচাটুর মতো গরম পিচ পথ, পিচগুলো এখন গরমে বুজবুজ করে ফুটছে যার উপর সাইকেলের চাকা পড়লে কামড়ে ধরে চাকা গড়াতে দেয় না, এই সব রকম অসহযোগী সময়ে এক যুদ্ধ জয়ের আশায় এগিয়ে চললাম রণক্ষেত্রের দিকে। জীবন এক যাত্রা, জীবন এক যুদ্ধ। জীবন মরণকে প্রতিহত করে বেঁচে থাকার আর এক নাম।

প্রতি পাঁচ ফুট সাইকেল ঠেলে উপরে তুলতে মনে হচ্ছে বুক বুঝি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। পাঁচ ফুট এগিয়ে যেই একটু দম নিতে যাই সাইকেল গড়িয়ে দু তিন ফুট পিছনে চলে যায়। এই ভাবে কিছুটা এগিয়ে কিছুটা পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত সাফল্য এল। নিচে থেকে পথের সব চেয়ে উঁচুতে পৌঁছতে মনে হয় এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লেগে গেল। তখন ঘড়ির কাটা মনে হয় একটার কাটা পার করে গেছে। পাহাড়ের উপর পৌঁছে মনে হল জীবন ফিরে পেলাম। খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠে পড়লাম সাইকেলের সিটে, এবার প্যাডেলে পা দিয়েই উঠতে পারলাম। এখন আমি ভারী সাইকেলের ব্যালেন্স বুঝে গেছি। এবার আর কোন পরিশ্রমের ব্যাপার ছিল না সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে বসে থাকা ছাড়া। আপনা আপনি সাইকেল গড়িয়ে চলল প্রায় দেড় মাইল। বিনা কষ্টে পৌঁছে গেলাম গোপালের হোটেলে। ওরা আমার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ঘটে যাওয়া বিপর্যয় শুনে নিজেরাই হাতে হাতে কাঠ নামিয়ে নিল। আর দিল দশটা টাকা। দশ টাকা। আমাদের চার জনার একদিন বেঁচে থাকার অবলম্বন।

এই রকম ভয়ংকর দিনে নির্বান্ধব নিঃসহায় বস্তার জেলায় বাস করার সময়ে যে মানুষটার কথা আমার সব চেয়ে বেশি মনে পড়ত তিনি শংকর গুহ নিয়োগী। আমার মন বলছিল যদি একবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি আর আমি আমার পরিচয়–যা অর্জন করেছি অনেক রক্ত ঝরিয়ে অনেক অধ্যবসায় আর কষ্ট স্বীকারের মধ্য দিয়ে, তা প্রকাশ করতে পারি, ওনার সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে না।

আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ। এমন কি বড় জিনিস চাই আমার? চাই এমন একটা ছোট খাটো কাজ যা করে চারটে প্রাণী দু বেলা খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারি। চাই একটা জনমঙ্গল কাজের সঙ্গে যুক্ত হবার মানসিক সুখ। কিন্তু তখন যে আমি দল্লী যাব ওনার সঙ্গে দেখা করতে, আমার কাছে সেই বাস ভাড়া, পথ খরচটুকু ছিল না। তখন আমি দুসাইকেল কাঠ বিক্রি করে যে কুড়ি টাকা পাই তার দশ টাকা চলে যায় চাল ডালে। বাকি দশ টাকার পাঁচ টাকা চলে যায় সাইকেল ভাড়ায়। বাকি যে পাঁচ টাকা থাকে তা দিয়ে মহুয়ার মদগিলি। তখন আমার নিজেকে মনে হতো জীবন যুদ্ধে পরাজিত ব্যর্থ এক ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। পৃথিবী আমাকে পরিত্যাগ করেছে। তার কাছে আর আমার কানাকড়ি মূল্য নেই।

এক সময় আমি লিখতাম। তখন সমাজের কতো সম্মানীয় মানুষের কত সমীহ পেয়েছি। সব হারিয়ে আমি এখন বস্তার জেলার এক কাঠ অলা। যার সম্মান কলকাতার রাস্তায় কাগজ কুড়ানো লোকের সমান। এ জীবনের কি দাম! কি দরকার? তাই মনের কষ্টে মদ গিলি। মানুষের সামনে থেকে মুখ লুকিয়ে জঙ্গলে গিয়ে একা একা বসে থাকি। যখন কাঠ নিয়ে কাপসী আসি মনে হয় মানুষ আমাকে দেখে হাসছে, উপহাস করছে। তাই তাদের কাছ থেকে যত দ্রুত সম্ভব দূরে পালাই। মানুষ এখন আর আমার ভালো লাগে না। ভালো লাগে নির্জনতা। জঙ্গল। বড় কাপসী বলে একটা জায়গা আছে। যেখানে দুদিক থেকে দুটো নদী গিয়ে একটা ত্রিভুজ তৈরি করেছে। সেখানে যেমন কিছু ফাঁকা জায়গা আছে, আছে ঘন জঙ্গল। আমি এখানে একটা কুড়ে ঘর বানিয়েছি জঙ্গলের বাঁশ বল্লি দিয়ে। যাতে ছাউনি দিয়েছি হেতাল পাতা দিয়ে। দু বার কাপসীতে কাঠ নিয়ে যাওয়া ছাড়া সারা দিন আমি এখানে পড়ে থাকি। অনু দুপুরবেলা আমাকে ভাত জল দিয়ে যায়।

সেটা ১৯৮৯ সাল। যেবার অর্জুন সিং রাজীব গান্ধির উপর রাগ করে কংগ্রেস ছেড়ে বের হয়ে এসে কংগ্রেস দলের ভরা তরী ডোবাবার বাসনায় সব বিরোধী দলগুলোকে একত্র করে জনতা দল নামে একটা প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করিয়ে ভোটে নেমে ছিল। চির শত্রু সিপিএম এবং বিজেপিও জড়ো হয়ে ছিল সেই ছাতার তলায় এবং বোফর্স ইস্যু সামনে রেখে ভোট যুদ্ধে নেমেছিল।

আমি তখন অন্ধ হয়ে গেছি। এখানে কোন বাংলা সংবাদপত্র নেই। যা আছে সব হিন্দি। আমি তো তখন হিন্দি পড়তে পারতাম না। পরে অবশ্য বাংলা ভাষার মত নিজের চেষ্টায় হিন্দিও শিখে নিয়েছিলাম। যার ফলে অমৃত সন্দেশ পত্রিকার রিপোর্টারও হয়েছিলাম। সে অনেক পরের ব্যাপার। এখন আমি যা কিছু খবর পাই লোকের মুখে, কিছু পাই রেডিওতে। জানতে পারি আসন্ন নির্বাচনের সারা দেশে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিয়ে জনতা দল ভোট যুদ্ধে নামছে।

আমরা যে লোকসভার অন্তর্গত তার নাম কাঁকের লোকসভা। স্বাধীনতার পর থেকে এই লোক সভায় কংগ্রেস জিতে আসছে। এক মাত্র নারানপুর বিধান সভা বাদে বাকি সবকটা বিধান সভার সিট কংগ্রেসের কবজায়। এবার এখানে জনতা দলের প্রার্থী লম্বোদর বলিহার। ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা-যাদের দল্লীতে বিশাল শ্রমিক সংগঠন, গতবার যাদের প্রার্থী জনকলাল ঠাকুর ডোন্ডি লোহরা বিধানসভা সিটে জয়ী হয়েছিল তারা দাবি করেছিল এই সিটটা তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। বিনিময়ে তারা ছত্তিশগড়ের সব সিটে জনতা দলকে সমর্থন দেবে। কিন্তু জনতা দল রাজি হয়নি। ফলে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চাও এখানে একজন প্রার্থী দিয়েছে যে ওই জনক লাল ঠাকুর। আর কংগ্রেসের রয়েছে বরাবরের জেতা প্রার্থী অরবিন্দ নেতাম।

কাপসী বান্দে পাখান জুর বাঙালী অধ্যুষিত এই পারাল কোটের কিছু ঠিকাদার, বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, জঙ্গলের কাঠ চোর কিছু দুবৃত্ত গোছের লোক, এরা আছে কংগ্রেসের সাথে। এবং সেই সাথে এটাও সত্য যে-সরল সোজা আদিবাসী সমাজ তারাও কংগ্রেসকে ভোট দেয়। বাদবাকি সব সাধারন বাঙালী যারা দেশভাগের জন্য কংগ্রেসকে দায়ী মনে করে, সব আছে বিজেপির সঙ্গে। সিপিএম-এর সঙ্গে এখানে কোন লোক নেই। দণ্ডকারণ্য বাসী বাঙালীদের মনে মরিচঝাঁপির দাগ তখনো বড় দগদগে। সেই হত্যা ধর্ষণ লুটপাট অগ্নি সংযোগ তারা ভুলতে পারেনি এখনো। যারা কংগ্রেস বা বিজেপিতে কল্কে পায়নি এমন আট দশ জন এখানে সিপিএম করে “নেতা গিরি” চালায়। সম্প্রতি বাংলা থেকে পালিয়ে আসা মধু মালাকার নামে একজন এদের সঙ্গে এসে ভেড়ায় এদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটেছে। লোক সংখ্যায় যদিও কম, এরা গলাবাজিতে সবার আগে। হুজ্জতি করার সুযোগ পেলে আর ছাড়ে না।

এখানকার সব সরকারি কর্মচারী ঘুষখোর দুর্নীতিগ্রস্থ। এদের দুহাতে উপার্জন। এরা বাঁ হাতের কামাই থেকে কিছু ভাগ রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা হিসেবে দিয়ে থাকে। এ ভাবে হাতে রাখে আর কি। এখন সিপিএমও একটা ছোট ভাগ পাচ্ছে।

ওই তিনটে দল লোকাল দল। এখানে এবারের নির্বাচনে নতুন এসেছে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা। এদের সব কর্মকর্তা দল্লীর। এখানে এখনো এরা সঙ্গে কোন লোকাল লোক পায়নি। কাপসী পাখানজুর আর বান্দে তিন জায়গায় তিনটে ঘর ভাড়া নিয়ে নির্বাচনী প্রচার অফিস খুলেছে। চার দলেরই প্রচার এখন তুঙ্গে। সিপিএম-বিজেপি যদিও একই প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নেমেছে কিন্তু তাদের প্রচার অফিস আলাদা আলাদা। তাদের দুটো কংগ্রেস আর মুক্তি মোর্চার দুটো, কাপসী বাজারে এই চারটে অফিস বলতে গেলে মুখোমুখি।

সেদিন আমি আমার কাঠের বোঝা নিয়ে দুপুর বেলায় কাপসী বাজারে এসেছি। আজ আমি গিয়েছিলাম খ্যারকাটা জঙ্গলে। এ জঙ্গল ১৩০-এর মত ভয়ংকর নয়। পথও অতি সরল। কাপসী থেকে খ্যারকাটা যদিও দশ কিলোমিটার তবে মজাটা এই, যা কিছু চড়াই সে যাবার বেলা পড়ে। ফেরবার সময় পথ একেবারে ঢালু। ফলে কাঠ নিয়ে আসতে খুব একটা কষ্ট হয় না।

আজ রবিবার।কাপসীর হাটবারের দিন। প্রায় গোটা কুড়ি বাঙালী আর গোটা পঁচিশ আদিবাসী গ্রামের মানুষ এদিন আসে কিছু বেচতে কিছু কিনতে। এর উপর আছে বাইরে থেকে আসা ফড়ে দালাল ব্যাপারী ব্যবসায়ীর দল। সব মিলিয়ে কয়েকহাজার লোকের সমাগমে থিক থিক করে হাটবার। আমাকে হাটের মধ্যে থেকে পথ করে পৌঁছাতে হবে বাজারের পূর্ব প্রান্তে নদীর কিনারে গোপালের হোটেলে। এসে দেখি হাটের মধ্যে সাইকেলে মাইক বেঁধে ঘুরে ঘুরে সিপিএম পার্টির প্রচার চলছে। লাউড স্পিকার হাতে তখন কোন এক সিপিএম নেতা হরিদাস মালাকারের ভাই মধু মালাকার বক্তৃতা দিচ্ছে বন্ধুগণ কোনদিন যা হয়নি এবার তা ভগবানের দয়ায় হয়ে গেছে। সব দল আমরা এক হয়ে গেছি। এবার আমরা ঠিক ভগবানের দয়ায় কংগ্রেসকে হারিয়ে দেবো।

বক্তৃতা নয়, আমার তখন মনে হচ্ছে মানুষের সামনে একটা বেড়াল মিউ মিউ করছে। নাকে কাঁদছে। নামটা যখন কমিউনিস্ট সেই পার্টির কর্মীর গলায় এমন ম্যাড়মেড়ে আওয়াজ কেন! যে আগুন যে তেজ যে আশা স্বপ্ন দ্রোহ মানুষকে উজ্জীবিত করে তা কোথায় এই কাঁদুনে ভাষায়। শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে যে শব্দভেদী বাণ, যা ছুঁড়ে মানুষকে মাতিয়ে দেওয়া যায়, মধু মালাকারের শব্দ ভান্ডারে সেশব্দ কই! সিপিএম বলেনয়, লাল পতাকাবাহী একটা দল যে পতাকা দণ্ডকারণ্যের আগুনখোর দল পিপলস ওয়্যার গ্রুপের সদস্যরা বহন করে শাসক শ্রেণির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, তা নিয়ে দাঁড়িয়ে মধু মালাকারের নাকে কাদায় মনে বড় কষ্ট পাই আমি।

আমার সঙ্গে সিপিএম-এর যে বিরোধ সে আমি পরে বুঝে নেব। এখন লাল পতাকার সম্মান রক্ষার প্রশ্ন। লাল পতাকার লাল আগুন কাপসীবাসীর মনে ছড়িয়ে দেবার প্রশ্ন। এবং মরিচঝাঁপির দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে ওই পতাকা কেড়ে নিয়ে সঠিক মানুষের হাতে ধরিয়ে দেবারও প্রশ্ন। কেউ আমাকে নিয়োগ করেনি, যেন আজ এই বনরাজ্যে সেই ঐতিহাসিক দায়িত্বের গুরুভার আমার কাঁধে ন্যস্ত হয়েছে।

এ সব কি তখন আমি ভেবেছিলাম? না, আমার পেটের মধ্যে টগবগ করে ফোঁটা মহুয়ার মদ তখন আমাকে দিয়ে এসব ভাবাচ্ছিল। আগেই বলেছি মদ এমন একটা জিনিস যে ভীতুকে করে সাহসী আর সাহসীকে দুঃসাহসী। বোকাকে করে বাঁচাল আর বাঁচালকে মহা বাঁচাল। তা না হলে যে আমি জীবনে কোনদিন পাঁচজনের সামনে কথা বলার সাহস করিনি, পাছে লোকে কি না কি ভাবে। সেই আমি মধু মালাকারের হাত থেকে লাউড স্পিকার কি করে কেড়ে নিলাম।

–এই যে দাদা, অনেক বলেছেন এই বার আমাকে দিন।

সঙ্গে থাকা সিপিএম-এর কর্মীরাও মধু মালাকারের ভাষণে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। তাদের অসন্তুষ্টির কারণ অবশ্য অন্য। এখানকার রোদ চড়া, মাটি কঠোর তাই ভাষাও কিছু কঠোরতা দাবি করে। এখানকার যে কোন রাজনৈতিক বক্তৃতা শুরু হয় প্রতিপক্ষের মাকে গালাগালি দিয়ে। শেষও হয় ওই ভাবে। যত গালাগালি তত হাততালি। যে বক্তা মা নামের শব্দটাকে যত বার ধর্ষণ করতে পারে সে তত ভাল বক্তা। মধু মালাকার তার লম্বা বক্তৃতায় একবারও ‘মাদার চোত’ বলেনি। এমন বক্তৃতায় মানুষের মন ভরবে কেন?

আমি কাঠ বিক্রি করি অর্থাৎ সমাজের চোখে এক নিকৃষ্ট জীব। খেয়ে রয়েছি মদ। যা মানুষকে ভালো কথার চেয়ে মন্দ বলায় বেশি। আমাকে দেখে সবার উৎসাহ বেড়ে যায়। মধু মালাকার আমার হাত থেকে লাউড স্পিকার নিয়ে নিতে গেলে সবাই তাকে থামায় থাক থাক, ওকে বলতে দাও। একজন আমাকে বক্তৃতার সুরটা ধরিয়ে দেয় দাও ভাই, কষে চার গাছা গাল দাও তো। তাকে বলি, গালাগালি আমি দেবো না। তবে যা দেবো সে গালাগালির বাবা। বলা বাহুল্য মাইক বাহিত সে শব্দ পাশের কংগ্রেস কার্যালয়েও পৌঁছায়। তারা কান উৎকর্ণ করে। গালাগালির বাবা! সে বস্তুটা কি!

আমি তখন আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছি। মদই আমাকে ফোঁটাচ্ছে। তখন আমাকে মনে হচ্ছে আমার চারপাশের এই যে মানুষ এরা সব শিশু নাবালক অর্বাচীন। আমি সেই প্রাজ্ঞ ঋষি। যার কাছে এরা আজ প্রথম পাঠ নিতে এসেছে। এরা কেউ কিছু জানে না কেউ কিছু এখনো শিখতে পারেনি। সব অজ্ঞ সব মূর্খ। আজ আমি প্রেরিত পুরুষের মতো ওদের শুন্য পাত্রে পরিবেশন করবো জ্ঞান বৃক্ষের স্বাদু ফল। যা খেলে মানুষ চির অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞান মার্গের দিকে, মৃত্যু থেকে মহা মহাজীবনের দিকে অগ্রসর হয়। আমি মহা গুরু। আমি আজ এদের এমন কিছু নতুন কথা শেখাবো যা এর আগে কোনদিন শোনেনি। আমার আগে এদের কাছে কেউ বলেনি।

এ সব ভাবনা-বোধ আমার নয়, আমার পেটের মধ্যে পড়ে থাকা তরল পদার্থের। এবং এটা সত্যি যে এখানকার একশো তেত্রিশটি বাঙালী গ্রামের প্রায় পঁচাত্তর হাজার মানুষের কাছে কেউ কোন দিন বস্তুবাদী দর্শনের কথা বলেনি। এখানকার মানুষ ভূত ভগবান ভাগ্য পরকাল স্বর্গ নরক গুরু গোঁসাই ঝাড় ফুক তাবিজ কবচ আরো শতেক রকম কুসংস্কার অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে পড়ে আছে পাঁচশো বছর আগের সেই চৈতন্য মহাপ্রভুর কালে। এদের কাছে রাজনীতি মানে ভোট দেওয়া আর তার বিনিময়ে কিছু নগদ নারায়ণ হাতিয়ে নেওয়া। এর বেশি আর কিছু নয়।

এই অবস্থা-ব্যবস্থা, রামায়ণ মহাভারত ভূত প্রেত রাজা রানীর গল্পের মধ্যে বলতে হবে অন্য এক গল্প। বলতে হবে ব্রহ্মা নয় এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে সুর্যে এক বিস্ফোরণের ফলে, বলতে হবে আজ আমার এই দুরবস্থার জন্য পূর্বজন্ম নয়, এক দল মানুষই দায়ী। বলতে হবে কোন গুরু গোঁসাই নয়, এ অবস্থা পরিবর্তন করতে পারি আমি এক আপোসহীন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে।

আমার খালি গা খালি পা স্রেফ কোমরে জড়ানো একটা গামছা-মাথার চুল রুক্ষ গায়ের রঙ কালো যা রোদে পুড়ে আরো কালো দেখাচ্ছে। এমন আদিবাসী মার্কা চেহারার লোক এখানে বক্তৃতা করে না, বক্তৃতা শোনে আর হাততালি দেয়। আমার হাতে লাউড স্পিকার দেখে কৌতূহলে বাজারের ভিড় থমকে গেল আমার চারপাশে। আমি শুরু করলাম আমার জীবনের সেই প্রথম বক্তৃতা। যার প্রেরণা কেন্দ্রে অবশ্যই ছিল মদ।

শুরু করলাম বহু দুর কয়েক কোটি বছর আগের সেই মহা বিস্ফোরণ কাল থেকে। বন্ধুগণ, কোন গড় আল্লা ভগবান নয়, এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে সূর্য থেকে। সূর্য হচ্ছে এক অনির্বাণ আগুনের গোলা। পৃথিবী তার অংশ। আমরা সেই পৃথিবীর সন্তান। আমাদের মধ্যেও সুপ্তাকারে আছে সেই আগুন, যা সব অন্যায় অত্যাচারকে দহন করে দিতে পারে। সেই আগুনকে জাগাতে হবে। তার দীপ্তি আর দহনেলিসাদের আগাছার মতো জ্বালিয়ে দিতে হবে…..।

সূর্য গ্রহে বিস্ফোরণ। পৃথিবীর সৃষ্টি। প্রাণের উদ্ভব। বিবর্তন বাদ। আদিম সাম্যবাদী সমাজ। গোষ্ঠি সমাজ। দাস প্রথা। সামন্ততন্ত্র। ধর্ম গুরুদের ভূমিকা। রাজতন্ত্র। সামন্ততন্ত্রের শক্তিক্ষয় এবং পূজির বিকাশ। শ্রমিক শ্রেণির জন্ম। আট ঘন্টার লড়াই। লাল ঝাণ্ডার ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মার্কসের দাস ক্যাপিটাল। প্যারি কমিউন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র। আন্তর্জাতিক ক্যুনিস্ট পার্টি। মানবেন্দ্র নাথ, রজনী পাম দত্ত। সিপিআই। ভারত চিন যুদ্ধ। সিপিএম। নকশাল আন্দোলন। জরুরি অবস্থা। জনতা দল। ভিন্দ্রেনওয়ালা। স্বর্ণমন্দির।ইন্দিরা হত্যা।রাজীব। বোফর্স। আজকের জোট এবং ভোট।

এতদিন ধরে কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছে যা শুনেছি যা শিখেছি সব বলে গেলাম যাত্রা দলের অভিনেতার মতো কখনো গলা খাঁদে নামিয়ে, কখনো চড়া সুরে। তখন আমি যেন লেনিন’ যাত্রা পালার শান্তিগোপাল।

এ গল্প শেষ করে ধরলাম জনসংঘের গল্প। নাম বদলে যে দল এখন ভারতীয় জনতা পার্টি। এর জন্য যেতে হল চার সাড়ে চার হাজার বছর পুরানো ঋক বেদে। বেদের সেই দশম মণ্ডলের পুরুষ সুক্তের বর্ণবাদ সমর্থনকারী শ্লোক যা জার্মানি দেশের কিছু পণ্ডিতের খুব প্রিয় হওয়ায় তারা বেদকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে। পরবর্তী কালে যে বেদ নাৎসিবাদের প্রেরণা যোগায়। নাৎসিবাদ এলে এলো হিটলার। আর্য রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে অনার্য হিংসা। ইহুদি নিধন। বিশ্ব যুদ্ধ। অক্ষশক্তি মিত্র শক্তি। সোভিয়েত সমাজবাদের উপর আক্রমণ। হিটলারের পরাজয়। নাৎসি বাদের “ভুল থেকে শিক্ষা”নিয়ে শুরু গোলওবাকরের রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ গঠন।ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনুরুথানে তথা আর্য প্রাধান্য বিস্তারে নব নাৎসিবাদী প্রয়াস। জনসংঘ, শ্যামাপ্রসাদ এবং সর্বশেষে বিজেপির উত্থান।

বিজেপির কথা শেষ করে এবার কংগ্রেস। কংগ্রেসের ইতিহাসে আসবার জন্য যেতে হল ১৭৫৭ সালের পলাশীতে। পলাশীর যুদ্ধ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন, সিপাহিবিদ্রোহ আদিবাসী সহ ছোট বড় অসংখ্য বিদ্রোহ। যার ফলশ্রুতিতে দেশীয় মানুষদের অভাব অভিযোগ জানাবার জন্য এক ইংরেজ এইচ কে হিউম দ্বারা কংগ্রেস দলের গঠন। দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলন এবং মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। কংগ্রেসের সর্বময় কর্তৃত্ব। ত্রিপুরি কংগ্রেস, গান্ধী এবং সুভাষ। সুভাষ বোসের দেশত্যাগ। বিশ্বযুদ্ধ। দেশ ভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর। নেহেরু পরিবারের পরিবার তন্ত্র। জরুরি অবস্থা। নকশাল নিধন এবং বর্তমান সময়।

মনে হয় একনাগাড়ে দুআড়াই ঘন্টা কথা বলেছিলাম আমি। ঘেমে সারা শরীর ভিজে গিয়েছিল আমার, মুখে উঠে গিয়েছিল ফেনা। কপালের শিরাগুলো দপ দপ করে লাফাচ্ছিল। বক্তৃতা শেষ করেছিলাম এই বলে আপনারা বুদ্ধিমান মানুষ। আশা করি এরপর আমাকে বলে দিতে হবে না কোন দলকে ভোট দেবেন। কে আপনাদের স্বার্থ দেখবে। মনে রাখবেন, আজ যদি ভুল করেন সে ভুলের খেসারত আপনাকেই দিতে হবে। তাই চিন্তা ভাবনা করে ভোট দেবেন এই আমার বলার।

যখন আমি বক্তৃতা শেষ করলাম, দেখলাম সাপ্তাহিক বাজারের সেই মহাভিড় আমার সামনে পেছনে ডান দিকে বাঁ দিকে কেমন যেন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সমাধিস্থ হয়ে গেছে। কোথাও কোন কোলাহল নেই, সব নিগ্রুপ। আমার বক্তৃতা শুরু হবার মিনিট পনেরোর মধ্যে দাঁতের মাজন, দাদের মলম, সুন্দরী বিড়ি কোম্পানী সবার সব মাইক পাবলিক বন্ধ করে দিয়েছিল। বিজেপির মাইক তারা বন্ধ করে ছিল নিজেরাই। কারণ তাদের দলের যে জন্ম ইতিহাস তাদের অজানা তা জেনে নেবার আগ্রহ ছিল কংগ্রেসমাইক বন্ধ করেছিলরেল আমি কি খিস্তি দেবো সেটা শুনে তাদেরও তো নতুন কোন খিস্তির জন্ম দিতে হবে। সিপিএম-এর মাইক সে তো আমার দখলে। আর মুক্তিমোর্চা বন্ধ করে ছিল কারণ তাদের নেতা তাদের শিখিয়েছে কাউকে বিরক্ত কোরো না। যার যা ভাষ্য আছে বলতে দাও।

বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতার পর প্রথম যে শব্দ হল তা আমার বাবা তুলে বিশ্রি গালাগালি। যা দিয়েছে এক বিজেপি সমর্থক–শুয়োরের বাচ্চা। কাঠের চোরা কারবারি সেই সমর্থক তারপর আমার দু পায়ের ফাঁকে মাথা গলিয়ে কাঁধের উপর তুলে নেচে নিল এক পাক ধেই ধেই করে। রাস্তার পাশে অবিনাশের মদের দোকানে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল-শালা শুয়োরের বাচ্চা! তুমি এত জানো! আর শালা কাঠ বেচে চোলাই খেয়ে লাইফটা খারাপ করে দিচ্ছো! এর পর অবিনাশের দিকে হুংকার গুরুকে এক পাইট ইংলিশ দাও।

কবিয়াল বিজয় সরকার একবার গান গাইতে গেছেন কোন এক গ্রামে। গান শুনে এক শ্রোতা এমন মুগ্ধ যে সে তা ভাষায় প্রকাশ করে এমন ক্ষমতা নেই। সে তা প্রকাশ করে নিজের ভাষায়–হালার পো হালারে ধইরা গলাটা কাইট্যা আন, দেখি ওয়ার মইধ্যে কি আছে!

একটা মেয়েকে গণেশ খুব ভালোবাসতো। সে একবার বলেছিল তুমি আমাকে আর ভালোবাসো। রাগে গণেশ তার গালে এমন চড় মেরেছিল যে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গিয়েছিল আর বলবি আমি তোকে ভালোবাসি না! ভালোবাসা এ ভাবেও প্রকাশ করা যায়।

ছেলেটার কথায় তাই আমি রাগ করতে পারি না। ওর কাছে যে ভাষা নেই, তাবলে মনের ভালোলাগা প্রকাশ করবে না? বলে সে মালটা খেয়ে বাড়ি চলে যাও গুরু। রাত্রে এসে আবার একখানা ঘাপান দেবে।

একজন গিয়ে ধরাম করে লাথি মেরে আমার কাঠ বোঝাই সাইকেলটা ফেলে দিল।

–আজ থেকে কাঠ ফাঠ বেচা বন্ধ। তোমার সংসার আমরা চালাবো। ভোটের কদিন আর কোন কাজ নেই। মাল খাও আর ঘাপান দাও।

যুবক ছেলেদের একটা দল চলে গেল চাদা তুলতে। ব্লু ফিল্ম দেখানো ভিডিও হলের মালিক দিল বিশ টাকা। অ্যাবর্সন বিশেষজ্ঞ সতীশ ডাক্তার সে দিল বিশ। মদঅলা অবিনাশ দশ। সারের কালোবাজারি করা মিশ্রা দশ। এ ভাবে সারা বাজার ঘুরে তারা আধ ঘন্টায় পৌনে দুশো টাকা জোগাড় করে এনে আমায় দিল মাল খেয়ে বাজার করে বাড়ি যাও।

টাকা পেয়ে বাজার করে বাসায় এসেছিলাম। অনেকদিন পরে পেটভরে মাছভাত খেয়েছিলাম। কিন্তু মদের নেশা যখন কেটে গেল মাথায় চেপে বসলো এক নিদারুণ ভয়। এটা জঙ্গল এলাকা। এখানকার সব আইন জঙ্গলের আইন। পুলিশ এখানকার সর্বময় কর্তা। অসীম ক্ষমতা তার। কেউ পুলিশের উপর কোন কথা বলতে পারে না। পাগলা ষাড়ের মত যাকে ইচ্ছা তাকে গুতিয়ে দিতে পারে। সমস্ত দণ্ডকারণ্য জুড়ে এখন পিপলস ওয়্যার গ্রুপের সমান্তরাল প্রশাসন চলছে। তাদের দমন করার জন্য পুলিশের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বস্তার জেলার পুলিশ প্রশাসন কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী অরবিন্দ নেতামের কথায় ওঠে বসে। কাপসীতে নেতামের সব থেকে বড় চামচা জীতেন ব্যানার্জী। নেতামের প্রিয় বলে থানা ফরেষ্ট ইরিগেশান ব্যাঙ্ক পোস্টাপিস রেশন সপ সবাই তাকে সমীহ করে চলে। সে যদি পুলিশকে খুঁচিয়ে দেয়–এ লোকটা এখানে নতুন এসেছে। একটু খোঁজ খবর নিন তো এর আসল পরিচয় কি! নকশাল ফকশাল নয় তো? তাহলেই আমি গেছি। ব্যাঙ খুঁজতে সাপ বেড়িয়ে পড়বে।

একটি নকশাল ছেলে যাদবপুর থেকে পালিয়ে এক হোটেলে কাজ নিয়ে লুকিয়ে ছিল। হাবা গোবা চেহারা দেখে কেউ তাকে সন্দেহ করেনি। হঠাৎ একদিন কি হল এক কাস্টমারের ফেলে যাওয়া ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার পাতা উল্টে বসল আর পড়ে ফেললো দুদশ লাইন। ব্যাস আর যায় কোথায়। পড়ে গেল এক আই.বি-র নজরে। ধরা পড়ে শেষে জেল।

আমি এখানে এসেছিলাম কোন ঝামেলায় না জড়িয়ে একটু নিশ্চিন্তে থাকবো বলে। মদের খেয়ালে এ আমি কি করে বসলাম, আমার পরিচয় আর যে লুকানো নেই।

সেদিন বিকালে আর কোথাও বের হলাম না। কে জানে কি বিপদ আসছে। যতটুকু সময় হাতে আছে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে যাই। কে জানে আর দু চার বছরে যদি এ সুযোগ না পাই!

সেদিন রাতে আকাশে কোন চাঁদ ছিল না। চারদিক ঘিরে ছিল ঘনঘোর অন্ধকারে। আমাদের উঠোনে আম জাম নীম আর কাজু বাদাম গাছের পাতার ছায়ায় আরো ঘন আরো নিকষ হয়ে উঠেছিল সেই অন্ধকার। আমি আর আমার স্ত্রী খেজুর পাতার মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিলাম উঠোনের সেই ঘন অন্ধকারে। ঘরে ঘুমাবার উপায় নেই। অসহ্য গরম, বাচ্চা দুটো ছিল আমাদের দু জনার মাঝে। সবে একটু চোখটা বুজে এসেছিল। ডিজেল চালিত জিপ গাড়ির ঘড় ঘড় আওয়াজে চোখ খুলে গেল। দেখলাম বাঘের চোখের মত দুটো হেডলাইট জ্বেলে জিপটা পাকা রাস্তা ছেড়ে আমার বাড়ির রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে। বাড়ি চিনিয়ে নিয়ে আসছে এই গ্রামের ছেলে হারাধন।

তবে কি যা ভেবেছিলাম তাই? বিপদ তাহলে এসেই গেল? অনুরও ঘুম ভেঙে গেছে। তার সারা শরীর থিরথির কাঁপছে। ওর হাতটা আমার হাতের মুঠোয় ধরা। স্পর্শের মধ্যে দিয়ে সে কাপুনি আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে। আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। আমাকে ধরে নিয়ে গেলে এরা বাঁচবে কি করে! কে ওদের দেখবে?

আমার বাসা পর্যন্ত জিপ আসবে না। সে থেমেছে একটু দূরে এ গ্রামের “কোচিয়া” জগোর মুদিখানার সামনে। জগো আজ হাট থেকে যে সব ধান ভুট্টা তিল সরষে আদিবাসীদের কাছ থেকে সস্তায় কিনে এনেছ তা এখন মেপে মেপে বস্তায় ভরা হচ্ছে। যা কাল ট্রাক বোঝাই করে বেশি দামে বেচতে রায়পুর পাঠাবে। জগোর বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। সেই আলোয় দেখতে পাই চার পাঁচ জন কাঠখোট্টা লোক যারা ধুলি ধূসর জিপ থেকে নেমে বড় বড় দু তিনখানা টর্চ জ্বেলে আমার বাসার দিকে আসছে। তারা এসে আমার মাদুর ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে একজন লোককে চিনতে পারি। একটু রোগা কম উচ্চতার চোখে চশমা অনাকর্ষক চেহারার এই লোকটি কাপসীতে আমার সাথে কথা বলেছিল। আমার নাম ধাম জেনে নিয়েছিল। বাঙালী এই লোকটা তবে পুলিশ?

একজন চর্ট ধারী যে একটু লম্বা, চোখে চশমা মুখে দাড়ি আছে আমার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দেয় সে–আমরা সবাই ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার লোক। একটু আপনার সাথে আলাপ করতে এসেছি।

আমি নিয়োগীজির নাম জানতাম। কাপসী এসে ওনার ঠিকানায় দু খানা পোস্ট কার্ডও ছেড়েছিলাম দেখা করার সুযোগ চেয়ে। সে চিঠির কোন জবাব আসেনি। তবে আমি তখনো জানতাম না যে উনি ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার প্রাণপুরুষ–প্রতিষ্ঠাতা।

বলি–বসুন। আর আমার কিছু নেই, এই ছেঁড়া মাদুরেই বসতে হবে।

বসে তারা। এর মধ্যে আছে দু জন বাঙালী, যার একজন দল্লী শহীদ হাসপাতালের ডাক্তার শৈবাল জানা। ইনিই কাপসীতে আমার নাম ঠিকানা জেনে নিয়েছিলেন। অন্যজন–!

ইনি চান না তার নাম প্রকাশ হোক। প্রচার বিমুখ এই লোকটি লোকচক্ষুর অন্তরালে–প্রচারের আলো থেকে দুরে বসে নিঃশব্দে কাজ করে যেতে ভালোবাসেন। তাই বাধ্য হয়ে ওনার নাম গোপন করে যাচ্ছি। এনাকে দিচ্ছি আমার অন্য এক পরিচিত প্রিয় মানুষের নাম–যোগেন। ইনি দিল্লীর চিত্তরঞ্জন পার্কের বাসিন্দা। এনার বাবা ছিলেন ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী। মা কোন এক হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ড।

এই রকম পরিবারের একমাত্র পুত্র যোগেন উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন দিল্লীর নামি দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বন্ধু বান্ধবও জুটেছে সব সম্পন্ন স্বচ্ছল ঘরের ছেলে মেয়ে। তবে এদের একটা বিশেষ বিশেষত্ব ছিল যে এরা শুধু নিজেদের সুখ সাচ্ছন্দ কেরিয়ার এসব নিয়ে ভাবিত ছিল না। দেশের আপামর জনসাধারণের দারিদ্র বঞ্চনা নিয়েও ভাবনা চিন্তা করতো। এরা চাইতো দেশ থেকে অসাম্য দূর হোক। সব মানুষ পাক খাদ্য বস্তু শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা এবং কর্মসংস্থানের সম অধিকার। বলা বাহুল্য এরা মানসিক দিক থেকে কিছুটা নকশালপন্থীদের কাছাকাছি ছিল।

যোগেনের বাবা চাইতেন ছেলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। হাসিল করুক সর্বোচ্চ ডিগ্রি। বিদেশে যাক, নিজের কেরিয়ার গড়ুক। সেই ছেলে “নকশাল পন্থী” হয়ে যাওয়ায় পড়াশোনা মুলতুবী রেখে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়ায় ক্রোধে দিশেহারা হয়ে যোগেনকে ত্যাজ্য পুত্র করে দেন। বঞ্চিত করেন তাকে তার সম্পদ-সম্পত্তি থেকে। এতে অবশ্য যোগেনের জীবনে কোন পরিবর্তন ঘটে না। সে তার পূর্বের ভূমিকায় রয়ে যায়।

এর পর এক সময় উত্তাল সাত-এর দশকের সমাপ্তি ঘটে। দিকে দিকে জেগে ওঠা বিপ্লবী সম্ভাবনা পিছু হটে। হতাশ যোগেনের বন্ধুরা “আর কিছু হবে না” ভেবে দেশে বিদেশে বড় বড় চাকরি নিয়ে বিয়ে থা করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তবে দেশের দরিদ্র মানুষের প্রতি তাদের যে দরদ তা তখনো সবটা মরে যায়নি। তখন সেই সব লোকেরা একত্র হয়ে ঠিক করে যে তারা তাদের বেতনের একটা অংশ দেশের কাজে ব্যয় করবে। এ জন্য সবাই মিলে একটা ফান্ড গঠন করে। এবং এর সব ভার ন্যস্ত হয় যোগেনের উপর। সে চাকরি বাকরি বিয়ে ঘর সংসার কিছুই না করে সন্ন্যাসী তুল্য জীবন কাটাচ্ছে। দেশের প্রায় সব গণ সংগঠন গণ আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ রেখে চলে। এই ফান্ডের অর্থ কোথায় কি ভাবে খরচ করা উচিত সেই সিদ্ধান্ত নেবে যোগেন। এ ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

তারা উপযুক্ত লোককে বাছাই করে উপযুক্ত দায়িত্ব দিয়েছে এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। যে দায়িত্ব যোগেন বহু বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছে। ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় সবার আগে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যে ট্রাক সেখানে পৌঁছায় সে ট্রাকে সাওয়ার থাকে যোগেন। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, মোংগরা বাঁধে মৎস্যজীবীদের আন্দোলন, যেখানেই আন্দোলন যথাসাধ্য সাহায্য নিয়ে পৌঁছে যায় যোগেন এবং নিঃশব্দে নিজের কাজ সেরে ফিরে আসে। মঞ্চে ওঠে না পত্রিকায় ইন্টারভিউ দেয় না টিভিতে মুখ দেখায়না। সব কিছু থেকে দূরে সরে মানুষের কাজ করে যায়।

দিল্লী থেকে এবার দল্লী এসেছে কিছু ওষুধ পত্র নিয়ে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা দ্বারা স্থাপিত শহীদ হাসপাতালকে দেবে বলে। এ সময়ে নির্বাচনী মহাযজ্ঞ চলছে। সেই প্রচার জিপে বসে দল্লী থেকে চলে এসেছে আদিবাসী জেলা বস্তারে। জল জঙ্গল জমিন নিয়ে গড়ে ওঠা এখানকার আদিবাসী আন্দোলন–যা চালাচ্ছে চেতনা মণ্ডল নামে এক সংগঠন–সুযোগ পেলে কাছে গিয়ে সে আন্দোলনও একটু দেখবো।

এই দুজন বাঙালীকে দেখে আমার খুব ভালো লাগল। এদের সঙ্গে রয়েছে দল্লীর লোহা খাদানের শ্রমিক এবং ছত্তিশগড়ের প্রখ্যাত লোকশিল্পী ফাগুরাম যাদব। এক জন ড্রাইভার ও আর একজন মোর্চা কর্মী।

বলেন ডা. জানা–আমরা আপনার বক্তৃতার পুরোটা শুনেছি। যার ফলে মনে হয়েছে আপনি এই এলাকার লোক নয়। এখানে তো এ সবের চর্চা নেই বল্লে চলে। পারাল কোট থেকে প্রচুর রোগী শহীদ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায়। তাদের সাথে কথা বলে রাজনৈতিক সচেতনতার কোন প্রমাণ পাইনি।

এবার আমি বিশ্বাস করে আমার পরিচয় এখানে আসার কারণ বর্তমানের অবস্থা সব বলে ফেলি। সাথে এও বলি যে আমি একজন লেখক। আমার একটি কবিতা নকশালপন্থীদের কাগজ অনীক-এ প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা দেখাই। ডা. জানা কবিতাটি তার ডায়েরিতে লিখে নেন।

সেদিন প্রায় এক ঘন্টা আমরা কথা বলেছিলাম। যার মধ্যে দিয়ে যে যার রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার আদান প্রদান করেছিলাম। সেই রাতেই একখানা জিপ দল্লী ফিরে গিয়েছিল। যে জিপে ডা. জানা ছিলেন। পারাল কোটের নির্বাচনী প্রচার বিষয়ক নানা তথ্যের মাঝে নিয়োগীজিকে তিনি আমার কথা বলেছিলেন। পড়িয়ে ছিলেন আমার সেই কবিতা। বলেছিলেন এই কবিতাটির লেখক আগে রিকশা চালাতে এখন কাঠ বেচে। তখন নাকি নিয়োগীজি বলেছিলেন-একে আমার কাছে নিয়ে আসুন।

দিন কয়েক পরে একদিন পারালকোট অঞ্চলের সব থেকে বড় বাজার পাখান জুড়ে এক নির্বাচনী জনসভার আয়োজন করেছিল ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা। আমাকে সেদিন সেখানে নিয়ে গেলেন যোগেন দা। সভার কাজ শুরু হয়ে যাবার অল্প কিছু সময় পরে আমরা পৌঁছে ছিলাম সভাস্থলে। দেখেছিলাম মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি পায়জামা পড়া একজন ফরসা দীর্ঘদেহী উজ্জ্বল চোখ মানুষ সব মানুষের সাথে মিশে মাঠের ঘাসের উপর বসে আছেন। সবার সঙ্গে মিশে থাকলেও মোটেই তিনি সব মানুষের মতো নন। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। হাসি মাখা অমলিন মুখ। সব মাথা ছাড়িয়ে যায় এমন এক উঁচু মাথা। দেখলেই বুঝে নেওয়া যায় এ মাথা কখনো কোন অন্যায় অত্যাচারের সামনে নত হতে শেখেনি। ভয়ে ভেঙে নুয়ে পড়ে না। অর্থে কেনা যায় না!

আমি নিয়োগীজির সাথে কথা বলেছিলাম মাত্র দশ কি বারো মিনিট। মনে হয়েছিল যেন আমার বহু বছরের চেনা। আপন, পরম আত্মীয়। আর তারপরই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম আজ থেকে আমার এই পরিচয় হোক–আমি শংকর গুহ নিয়োগীর লোক।

আমি আমার ঘামে ভেজা ছেঁড়া জামার পকেট থেকে বিড়ি বের করে ওনার হাতে দিয়েছিলাম। আর উনি আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন দেশলাই। বলেছিলেন–একবার দল্লী আসুন।

আদেশ নয় অনুরোধ নয়, উনি মাত্র তিনটে শব্দে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন আমার সঠিক স্থান। ওই শব্দ কটায় কি জাদু, কি সম্মোহন ছিল কে জানে–আমি ঘাড় কাত করেছিলাম যাবো। নিশ্চয় যাবো।

যেতে তো আমাকে হবেই। আমার ভবিতব্য যে আমার জন্য ওই গন্তব্য নির্ধারণ করে রেখেছে। না গিয়ে উপায় আছে? যে কথা প্রকাশ হয় না, বুকে যেমন দাগ কেটে বসে যে জলকনা সমুদ্রে পৌঁছাতে পারে না, মাটি তাকে শোষে। যদি একবার সে সমুদ্রে পৌঁছে যায় সমাপ্ত হয়ে যায় তার সব ক্ষুদ্রতা। বিশালের অংশ হয়ে সেও বিশাল বিরাট মহান হয়ে যায়। আমাকে সমুদ্র ডাকছে সমুদ্র হবার জন্য। আর আমি যাবো না?

লোকসভার নির্বাচন শেষ হয়ে গেল। এবারও অন্য বারের মতো ভোটে জিতে গেল কংগ্রেস প্রার্থী অরবিন্দ নেতাম। মুক্তি মোর্চার সবাই ফিরে গেল দল্লী। এর পর মাস দুয়েক তাদের আর কোন খবর নেই। নিয়োগীজি আমাকে দল্লী যেতে বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু গাড়ি ভাড়ার টাকা। আমি কিছুতেই যোগাড় করে উঠতে পারি না। যেতে কুড়ি আসতে কুড়ি, দশ টাকা অন্য খরচ, পঞ্চাশ টাকা সব মিলিয়ে। এত টাকা পাবো কোথায়। মনে একটু কষ্ট হচ্ছিল। এত কথা বলে গেল, আর এত দিনে ওরা আমার কোন খোঁজ খবর নিল না!

খবর আমার তারা নিয়েছে। সেটা আমি জানি না। এখন থেকে প্রচুর রোগী শহীদ হাসপাতালে যায়। তাদের কাছ থেকে আমার প্রতি দিনকার জীবন চর‍্যা তারা জেনেছে। কিন্তু নানা ধরনের ব্যস্ততার জন্য আমাকে দল্লী নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। হঠাৎ একদিন আমার ভাঙা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো দুধ সাদা এক অ্যামবাসাডার, যার চালক আমাকে বলল–নিয়োগীজি তুমকো লে জানেকে লিয়ে ভেজা।

এ সেই গাড়ি যা নিয়োগীজি ব্যবহার করেন। এ সেই গাড়ি যা বিশেষ বিশেষ সময়ে সম্মানীয় মানুষকে নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয় বিমান বন্দরে রেল স্টেশনে। এই গাড়িতে চেপেই একদিন দল্লী আসেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, রাম বিলাস পাশোয়ান, জর্জ ফার্নান্ডেজ। এই গাড়ি চেপেই নাগপুর থেকে ভিলাই গিয়েছিলেন আর্য সমাজি নেতা এবং রাষ্ট্র সংঘের “দলিত দাসতানিধি”র তিন বছরের জন্য সম্মানীয় অধ্যক্ষ স্বামী অগ্নিবেশজি। সেদিন অবশ্য তার সহযাত্রী আমিও ছিলাম। অনুপ সিং ছিল।

সেই গাড়ি আজ একশো মাইল পথ পার হয়ে এক কাঠঅলাকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে। আমি কি এই গাড়িতে চড়বার উপযুক্ত মানুষ! যার গায়ের জামা ছেঁড়া, পায়ে একটা দশ টাকা দামের টায়ারের চপ্পল পর্যন্ত নেই! খালি পায়েই গিয়ে উঠে বসলাম সেই গাড়িতে। কি নেই কি আছে সেসব আমার ভাববার অবকাশ কোথায়!

যখন আমরা দল্লী গিয়ে পৌঁছলাম নিয়োগীজি রাজনাদ গাঁও চলে গেছেন। ফিরবেন রাতে। তবে কত রাতে তা কেউ জানে না। এখানে দেখা হল ডা. জানা আর যোগেনদার সাথে। ডা. জানা তো খুব ব্যস্ত মানুষ এত বড় হাসপাতালের সব দায় তার ঘাড়ে। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলেন না তিনি। তবে যোগেনদা রইল সর্বক্ষণ আমরা সাথে সাথে। তার চোখে পড়ল আমার পা খালি। এটা পশ্চিম বাংলার সমতল পথ নয়। এ ছত্তিশগড়ের উবর খাবর পাথরের দাঁত বের করা পথ। খালি পায়ে চলতে গেলে যে কোন সময়ে ঠোক্করে ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত হবার ভয়। যা হয়েছিলও বেশ কবার। এখন যোগেনদা সামনে পেয়ে গেলেন প্রদীপ দাস নামে এক তরুণ ডাক্তারকে। যার পায়ে হাওয়াই চটি। বললেন তাকে, ঘরে নিশ্চয় অন্য চটি আরো আছে। তবে এটা একে দিয়ে দাও। এবং দিয়ে দিল সে।

নিয়োগীজি সেদিন অনেক রাতে ফিরেছিলেন ক্লান্ত হয়ে। মোর্চার অফিসে আমাকে দেখে হেসে বলেছিলেন–আপনি এসে গেছেন। বিশ্রাম করুন অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল কথা হবে।

মোর্চার অফিস ঘরটা বিরাট। দু তিনশো লোক এখানে অনায়াসে ঘুমোতে পারে। সে জন্য যথেষ্ট সতরঞ্চি আছে। অফিস ঘরের সাথে লাগোয়া মোর্চার রান্না ঘর। রোজ সেখানে দু বেলায় চল্লিশ পঞ্চাশ কিলো চাল, দশ বারো কিলো ডাল রান্না হয়। দুর দুরান্ত থেকে আসা মোর্চর কর্মীরা পেট ভরে ডাল ভাত খেয়ে অফিসের মধ্যে ঘুমোয়। সে রাতে আমিও খেয়ে সেখানে ঘুমোলাম।

পরের দিন সকাল বেলায় দেখা করতে গেলাম নিয়োগীজির বাসভবনে। বাসভবন! হায় রে বাসভবন! মাটির দেওয়াল দেওয়া একটা মাত্র বড় ঘর যার দুটো বারান্দা। ঘরটির ছাউনি দেওয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে পোড়া মাটির খাপরেল। ঠিক যেন শ্রমিক বস্তির একখানা ঘর। ঘরে বিশেষ কোন আসবাব নেই। পাশের একটা বারান্দায় রান্না করা হয়। সেই রান্নাঘরে কাঠের উনুনে নিজের হাতে রান্না করেন নিয়োগীজির স্ত্রী যিনি এক আদিবাসী কন্যা আশা গুহ নিয়োগী। তখন মুক্তি মোর্চা থেকে মাসে সাতশো টাকা ভাতা পেয়ে স্ত্রী দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে সংসার প্রতিপালন করা ছত্তিশগড়ের অবিসংবাদী নেতা নড়বড়ে চৌকিতে বসে চা খাচ্ছিলেন। আমি যাওয়া মাত্র আশা দিদি এক কাপ চা আমাকে দিলেন। তখন বলেন নিয়োগীজি, এই প্রথম দল্লী এলেন, দু চার দিন থাকুন। ভালো করে এখানকার মানুষদের সাথে পরিচিত হোন। খাদানে যান, আমাদের স্কুল-ওয়াকশপ সব দেখুন। তারপর কথা হবে।

বলেন তিনি–আমরা একটা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চাইছি। কিন্তু তার পরে কি নির্মাণ করবো তার কোনো মডেল যদি মানুষকে দেখাতে না পারি মানুষ ধ্বংস প্রবণ হবে কেন? এক সময় জয় প্রকাশ নারায়ণ নির্মাণ প্রধান আন্দোলন করেছিলেন, সে আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। এক সময় নকশালপন্থীরা ধ্বংস প্রধান আন্দোলন করেছিল সেটাও কোন সুফল দিতে পারেনি। আমার এর ফলে যেটা মনে হয় যে ধ্বংস এবং নির্মাণ দুটোর মধ্যে একটা সমন্বয় খুবই জরুরি। যে কারণে আমাদের একটা প্রিয় শ্লোগান ধ্বংসের জন্য নির্মাণ, আর নির্মাণের জন্য ধ্বংস। এই ভাবনা মাথায় রেখেই আমরা আমাদের সংগঠনের মধ্য দিয়ে হাসপাতাল স্কুল ছোট ছোট ওয়ার্কশপ, সমবায়, এছাড়া সংস্কৃতি-সাহিত্য এ সবের নির্মাণ এবং পরিচালনার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছি যে আমরা যে সমাজ ব্যবস্থাটা চাই সেটা কেমন হবে। আর একটা কাজ আমরা করে থাকি সেটা হল-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের জন্য আবেদন নিবেদন আন্দোলন মিটিং মিছিল আইন আদালতের যে কটা দরজা এখনো খুলে রেখেছে সেই পথ পদ্ধতির মাধ্যমে যতটুকু যা পারা যায় মানুষের জন্য দাবি আদায় করা এবং তাকে বোঝানো যে এই পথে বিশেষ কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। সেটা পেতে হলে শেষ লড়াই আমাদের লড়তেই হবে।

কিছু পরে আবার বলেন তিনি–দেশে অনেক বড় বড় ট্রেড ইউনিয়ান মুভমেন্ট হয়েছে। কিন্তু সে সব ইউনিয়ন শ্রমিক শ্রেণিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার সংকীর্ণ রাজনীতির মধ্যে আটকে রাখা ছাড়া আর কোন কাজ করেনি। একজন শ্রমিক কারখানা বা খনিতে যেটুকু সময় কাজ করে তার পরে আর যে বাকি সময় সেটাকে কি ভাবে সদুপযোগ করবে সে বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেনি বা করতে পারেনি। সেটা আমরা করেছি। একজন শ্রমিক এবং তার সন্তান সন্ততির জীবনে যাতে সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটে সে দিকেও আমাদের দৃষ্টি আছে। এটাই আমাদের বিশেষত্ব এবং অন্যান্য ইউনিয়ানের সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য।

আমরা শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করেছি। বেতন বেড়েছে। কিন্তু সে তার বাড়তি বেতন খরচ করার জন্য চলে গেছে মদের দোকানে। যে জন্য আমাদের মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে। যা মোটেই কোন ট্রেড ইউনিয়নের কাজ নয়। করেওনি কেউ কোন দিন। কমিউনিস্ট পার্টিতে এ ধরনের কোন কর্মসূচিও নেই। যে কারণে আমাদের এই আন্দোলনের প্রেরণা মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে নিতে হয়েছে। মার্কসবাদ-গান্ধীবাদ লোহিয়াবাদ-আম্বেদকরবাদ, সে সব বাদে যে জনকল্যাণকারী দিক আছে আমরা তার চর্চা করি এবং নিজেদের মতো করে প্রয়োগ করে থাকি। এটাও আমাদের একটা বিশেষত্ব। দু চার দিন এখানে থাকুন। নিজের চোখে দেখুন। জানুন বুঝুন তার পরে আবার কথা হবে।

শ্রমিকতীর্থ দল্লীরাজহারা। এখানেই সর্বপ্রথম শ্রমিক শ্রেণি মালিক তোষক দালাল ট্রেডইউনিয়ান নেতাদের খপ্পর থেকে বের হয়ে এসে তৈরি করেছিল নিজেদের নেতৃত্বে নিজেদের ইউনিয়ান। নিয়োগীজি তখন জেলে ছিলেন। উনি ছিলেন ছত্তিশগড়ে নিবর্তনমূলক আইন-মিসায় প্রথম বন্দী।

শংকর গুহ নিয়োগী পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার লোক। রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ ওখানেই। তখন উনি সিপিআই এমএল পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চারু মজুমদার সহ সিপিআই এম এল-এর অনেক নেতার সঙ্গে পরিচয় ছিল তার। পরে উনি ভিলাই চলে আসেন এবং ভিলাই ইস্পাত কারখানায় চাকরি নেন। চাকরি, সেটাই তো ওনার এক মাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। ছিল একটা জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার ইচ্ছা। সে কাজে উনি কিছুটা সফল হতেই মালিক শ্রেণির কুনজরে পড়ে যান। ছাটাই করে দেওয়া হয় ওনাকে। পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হয় পুলিশ। যার ফলে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।

এই সময় নিয়োগী সমগ্র ছত্তিশগড় পরিভ্রমণ করেন। কখনো ছাগল কেনা বেচা কখনো গ্রামে গিয়ে কাপড় জামা বিক্রি করা এ ভাবে ঘুরে ঘুরে এখানকার মানুষের দুঃখ দুর্দশার সাথে পরিচিত হন। এটা ছত্তিশগড়। ভারতবর্ষের মধ্যে সব থেকে পিছিয়ে থাকা অঞ্চল। এখানে মাটির নিচে রয়েছে লোহা তামা ডিলিমাইট বক্সাইট সব অপার খনিজ সম্পদ। মাটির উপরে রয়েছে শাল সেগুন বীজা বাঁশবল্লী বিড়ির পাতার অফুরন্ত ভান্ডার। এখানকার জমিতে সোনার মত ফসল ফলে। যে কারণে ছত্তিশগড়কে বলা হয়-ধান কি কাটোরা। এত সম্পদ থাকার পরেও এখানকার মূল নিবাসী মানুষ আদিবাসী-বনবাসী মানুষ নিঃস্ব। কারো পেটে ভাত মাথায় তেল পায়ে চপ্পল পরনের কাপড় নেই। এ সবই এক দল বহিরাগত শেঠ বেনিয়া-সাৎকার-শিল্প মাফিয়া এবং রাষ্ট্রীয় শোষণের পরিণাম।

তিনশো কুড়িটা গ্রামের মানুষকে এ সব বোঝান তিনি। এবং সংগঠিত করেন। এই পর্বে ওনার ছদ্মনাম ছিল-মদন। আমার মনে আছে এ তথ্য কলকাতার কোন এক কাগজে যেন “খবর” হয়ে ছিল।

এই সময় নিয়োগীজির সাথে সিপিআই এমএল–এর গণ সংগঠন গড়ার প্রশ্নে মতানৈক্য দেখা দেয়। তারা গণ সংগঠন গড়ার চাইতে গুপ্ত সংগঠন গড়ে শ্রেণি শত্রুর উপর গেরিলা আক্রমণের উপর জোর দিতো। আর নিয়োগীজি চাইতেন গণ সংগঠনের মাধ্যমে ছোট ছোট দাবি দাওয়ার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রচুর মানুষকে একত্র করে ধাপে ধাপে সেই অন্তিম লড়াইয়ের দিকে অগ্রসর হওয়া। মত বিরোধের পরিণামে সিপিআই এমএল ওনাকে বহিষ্কার করে দেয় দল থেকে।

এর পরে উনি চলে যান দানী টোলা পাথর খাদানে। পরিচয় গোপন রেখে এক ঠিকাদারের অধীনে মুনশীর কাজ নেন এবং খাদান মজুরদের সংগঠিত করেন। একদিন উনি লেবার পেমেন্টের টাকা আনবার জন্য ভিলাইয়ে ঠিকাদারের কাছে গিয়ে ছিলেন। পুলিশ তো ওনাকে খুঁজে হয়রান হচ্ছিল। এবার তারা ওনাকে ধরে ফেললো এবং মিসায় জেলে পুরে দিল। তখন উনি সাহস আর সতোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন৷ ছত্রিশগড় ওনাকে চিনে ফেলেছে। তাই দিল্লীর এক শ্রমিক প্রতিনিধিদল জেলখানায় গিয়ে ওনার সাথে দেখা করে এবং আবেদন জানায়–আপনি দল্লীর শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিন। আপনাকে আমরা দল্লীতে নিয়ে যেতে চাই।

তখনো নিয়োগীজির কারাবাস শেষ হতে ছয় মাস বাকি ছিল। উনি বলেছিলেন-জেল মুক্ত হই। নিশ্চয় যাবো দল্লী। আর তারপর যেদিন উনি জেল মুক্ত হলেন, জেল গেটে অপেক্ষামান আট হাজার মানুষ ষোল হাজার হাতে ওনাকে বরণ করে নিয়ে এলেন দল্লী। তারপর একটানা চৌদ্দ বছর শুধু লড়াই আর বিজয়ের ইতিহাস। দীর্ঘ পরাজয়ের গ্লানি ঝেড়ে ফেলে মানুষের হেসে ওঠার গল্প। ১৯৭৭ সালে যে মজুর হাড়ভাঙা খাটুনির পর মজুরি হাতে পেত মাত্র ৭ টাকা, কঠিন লড়াইয়ের ফলে সে ৮০ টাকা মজুরি আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছে। স্বামী স্ত্রী মিলিত মজুরিতে জীবন সচ্ছল হয়েছে। ছেলে মেয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। দৃঢ় সংকল্প, অটুট মনোবল, অসীম সাহস আর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এই ছিল তাদের লড়াই জেতার প্রধান অস্ত্র। কিন্তু এই সব কিছুকে সুপরিকল্পিত ভাবে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যে পরাক্রমী সেনাপতি তার নাম শংকর গুহ নিয়োগী। আপামর জনতার বড় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জন–নিয়োগী ভাইয়া।

কাল যখন এখানে এসেছিলাম রাত হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ কিছু দেখতে পাইনি। এখন পথে পা দিয়ে আমি চমকে উঠলাম। দোকান বাজার রাস্তাঘাট সর্বত্র উড়ছে লাল সবুজ নিশান। যত শ্রমিক পুরুষ সবার গায়ে লাল জামা পরনে সবুজহাফ প্যান্ট। নারীদের গায়ে লাল ব্লাউজ পরিধানে সবুজ শাড়ি। বালক বৃদ্ধ সবাই লাল সবুজে মাখামাখি। চলন্ত ট্রাকে উড়ছে লাল সবুজ পতাকা। জিপ সাইকেল রিকশা কোথাও খালি নেই। গুটি কয়েক বাবু গোছের লোক ছাড়া সবার শরীরে এই দুই রঙ। সবার এ রঙ বড় প্রিয় বড় আপনার। দূরের ওই যে লোহা পাহাড়, পঁচিশ হাজার মজুর সেখানে ঘাম ঝরায় সেই পাহাড়টাও যেন পরম মমতায় শরীরে মেখে নিয়েছে ওই দুই রঙ “লাল হারা”। এই রঙ ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার পতাকার রঙ। এরঙ শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনতার এবং মেহনতি জনতার প্রিয় নেতা শংকর গুহ নিয়োগীর।

এরপর দেখতে গেলাম লোহার খাদান। দেখলাম আত্মবিশ্বাসী আত্ম সম্মান সচেতন একদল কর্মরত নারী পুরুষ। প্রত্যেকের চোখে মুখে দৃঢ় দৃপ্ত প্রত্যয়। শাবল গাইতি কোদাল চালানো হাতে যারা আমাকে সাথী বলে বুকে টেনে নিল। ছত্তিশগড় সাত জেলা নিয়ে গঠিত। ছয় জেলার প্রতিনিধি মুক্তি মোর্চার সঙ্গে আছে। বাকি ছিল বস্তার। আমি বস্তার জেলা থেকে গেছি শুনে আনন্দে উদ্বেল হল তারা।

দেখলাম সেই ১৯৭৭ সালে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর গুলি চালনায় নিহত ১১ জন শহীদ সাথীর স্মৃতি স্তম্ভ। সেদিন রাতে কিছু মজদুর সাথী নিয়ে ইউনিয়নের মাঠের মাঝখানে শুয়েছিলেন নিয়োগীজি। দুখানা ভ্যান বোঝই পুলিশ নিয়ে এক অফিসার হামলে পড়েছিল নিয়োগীজির উপর। যার প্রতি গোপন নির্দেশ ছিল নিয়োগীজিকে “এনকাউন্টার” করে দেবার। ঘুমন্ত মজদুর সাথীরা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে নিয়োগীজিকে ভ্যানে তুলে নিয়ে এসেছিল “বালোদ”-এর ঘন জঙ্গলে। বড় মোলায়েম গলায় বলেছিল ধূর্ত পুলিশ অফিসার–হাম আপকো বহুত রেসপেক্ট করতে হ্যায়। আপকো জেলমে ঠুস দেনা হামে আচছা নেহী লাগেগা। হাম চাহতে হ্যায় আপ ভাগ যাইয়ে বাঙাল। অউর কভি দল্লী মৎ আইয়ে।

নিয়োগীজি বুঝতে পেরেছিলেন ভ্যান থেকে নামা মাত্র ওনাকে গুলি করা হবে। যা কালকের খবরের কাগজে খবর হবে—পুলিশ ভ্যান থেকে পালাতে গিয়ে গুলিতে নকশাল নেতার মৃত্যু। উনি তখন অফিসারকে বলেছিলেন–আমাকে গুলি করতে হলে ভ্যানের মধ্যেই করতে হবে। অন্য কোন সুযোগ আপনি পাবেন না।

সেটা করাও সেই অফিসারের পক্ষে কঠিন ছিল না। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে একটা। নিয়োগীজিকে তুলে নিয়ে প্রথম ভ্যানখানা চলে আসার পর মজুররা বুঝে ফেলেছে তাদের নেতাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাথে সাথে তারা পিছনের ভ্যানখানা ঘিরে ফেলেছিল। এবং ওয়ারলেস মারফত অফিসারকে খবর পাঠিয়ে ছিল, আমাদের নেতার যদি কিছু হয় দশ বারো জন পুলিশের একটাকেও বাঁচিয়ে রাখবো না। যতক্ষণ তাকে আমাদের কাছে পৌঁছে দেবে সব পুলিশ আমাদের বন্ধক থাকবে।

নিরুপায় হয়ে সে আর নিয়োগীজিকে মেরে ফেলতে পারে না। তাকে থানার লক আপে রেখে আরো পুলিশ নিয়ে বন্ধক পুলিশদের মুক্ত করতে এসে গুলি চালায়। বুকে গুলি লেগে ঢলে পড়ে সাত জন মানুষ। কিন্তু তবু মজুরদের মনোবলে চিড় ধরে না। নিহত সাথীদের তারা ঘিরে বসে থাকে, পুলিশদেরও ঘিরে রাখে। রাত কেটে যায়। পরের দিন পুলিশ আসে আরো বেশি সংখ্যায়। আবার গুলি চালায়। এবার মারা যায় আরো চার জন। মোট এগারো জন মানুষ যার মধ্যে বারো বছরের বালক সুদামা, মহিলা অহল্যা বাইও আছে। এদের খুন করে বন্ধক পুলিশদের মুক্ত করে নেয় তারা। মজুররা স্বজন হারানো শোকে পাগল তো হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এত পাগল নয় যে বন্দী পুলিশগুলোকে কেটে কুচি কুচি করে ফেলে। তারা শোকের মধ্যেও মনে রেখেছিল–এরা আমাদের আসল শত্রু নয়। আসল শত্ৰু বিলাসবহুল ভবনে বাস করা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা মালিক শ্রেণি আর তাদের রক্ষাকর্তা নেতা মন্ত্রী-সরকার।

পরের দিন মজুররা খাদানের কাজ বন্ধ করে দেয় শংকর গুহ নিয়োগীর মুক্তি এবং মালিক ও সরকার পক্ষের আলোচনার টেবিলে বসার দাবিতে। আঠারো দিন আন্দোলন চলার ফলে লৌহ আকরের অভাবে ভিলাই ইস্পাত কারখানা বন্ধের মুখে এসে দাঁড়ায়। তখন তারা নিয়োগীজিকে মুক্তি দেয় এবং মজুরদের দাবি মেনে নেয়।

দেখলাম শহীদ হাসপাতাল। শাসক এবং শোষক শ্রেণির মাইনে করা ক্রীতদাসরা প্রভুদের নির্দেশে প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল যে ১১ জন মানুষের তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ এই হাসপাতাল আজ হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষার প্রধান কেন্দ্র। কুসুমি বাই নামে এক লড়াকু মহিলা নেত্রী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে উপযুক্ত অভিজ্ঞ ডাক্তার নার্সের অভাবে মারা গিয়েছিলেন। তখন নিয়োগীজির মাথায় আসে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার ভাবনা। ডাক্তার বিনায়ক সেন আর নিয়োগীজি দুজনে মিলে শ্রমিকদের দানে এবং শ্রমে অবশেষে প্রতিষ্ঠা করেন এই হাসপাতাল। এখন যাকে সঞ্চালন করছেন ডাঃ শৈবাল জানা সহ একদল নিয়ম নিষ্ঠ সেবাব্রতী স্বেচ্ছাসেবী। যে কোন অসুখে ওষুধের তো একটা পরিমাপ থাকে, কিন্তু পরিমাপ নেই এখানকার ডাক্তার নার্স সেবিকাদের সেবা পরিচর্যায়। একজন রোগী বললএখানকার মানুষের ব্যবহারে আমাদের অর্ধেক রোগ বিনা ওষুধে সেরে যায়। ডাক্তার নর্মান বেথুন ডাক্তার কোটনিশ ড্রিংক্রার বিনায়ক সেনদের শিক্ষায় শিক্ষিত এই সব স্বাস্থ্যকর্মী সমাজের প্রকৃত বন্ধু।

চারদিন ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখবার পর নতুনতর এক অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হবার পর দ্বিতীয় বার মুখোমুখি হলাম আবার নিয়োগীজির। বললাম, এবার আমায় যেতে হবে। উনি তখন অর্থবহ হাসি হাসলেন–যেতে পারবেন? তখন মনে মনে আমিও বুঝে গেছিলাম–যেখানে যত দুরেই যাই এ জীবনে আর দল্লী থেকে যাওয়া হবে না। যাওয়া যাবে না।

আশা দিদি আমাকে চা দিয়ে ছিলেন। চা খেয়ে নিয়োগীজি বললেন–আপনি একজন বামপন্থী মানুষ। আমরাও তাই। একই অঞ্চলে আছি। আমার মনে হয় আপনি যে কাজই করুন মানুষের পক্ষেই করবেন। তাই আমরা আপনাকে কিছু সাহায্যের কথা ভেবেছি। দুবেলা কিছু পেট ভরে খাওয়া তো দরকার কি বলেন? তা এ ব্যাপারে আপনি আমাদের কাছে কি ধরনের সাহায্য আশা করেন?

কত কিছু আগে ভেবে রেখেছিলাম বলবো বলে। এখন সে সব কথা আর মনে পড়ে না। নিয়োগীজিকে দেখার পর সব প্রশ্নের অনায়াস পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে। এত বড় একজন নেতার কী কৃচ্ছসাধন, কী সাধারণ জীবন যাপন, হাসি মুখে কী ভীষণ দারিদ্রের মধ্যে সংসার প্রতিপালন। সংগঠন থেকে সাতশো টাকা ভাতা নেন তিনি। মাত্র সাতশো! তেইশ টাকা তেত্রিশ পয়সা রোজ। এর চেয়ে তো আমার রোজগার কম নয়। কোনদিন দু সাইকেল কোনদিন তিন সাইকেল কাঠ বেচি।

অনেক ভেবে শেষে বলি-আমার ভালো কুড়ুল নেই। যদি আপনারা আমাকে একখানা কুড়ুল বানিয়ে দ্যান তত খুব উপকার হয়। তা হলে যেভাবে হোক আমি সংসার চালিয়ে নিতে পারবো।

আমার কথা শুনে নিয়োগীজি হাসলেন। এ হাসির কারণ কি? আমি কি কোন ভুল কিছু বলে ফেলেছি? আমার বাবা আমাকে বলে গেছেন কোন নিমন্ত্রণ বাড়িতে গিয়ে এমন খাবি না যে পরের বার নিমন্ত্রণ করার আগে গৃহকর্তার চিন্তায় পড়তে হয়! আমি তো সামান্য মাত্র পঞ্চাশ টাকার বস্তু চেয়েছি! এর চেয়ে কম আর আমার কোন কাজের।

একটু পরে বলেন তিনি–জঙ্গলে যাবেন, কাঠ কাটবেন বাজারে এনে বেচবেন। সারা দিন তো এতেই শেষ। তাহলে মানুষের জন্য কাজ করবেন কখন?

বলি–দিনের পরে সারা রাত থাকে! এক টাকার কেরোসিন কিনতে পারলে রাত দুপুর পর্যন্ত বসে লেখায় আর কোন সমস্যা থাকবে না।

আচ্ছা এ ব্যাপারটা ছেড়ে দিন। বলেন তিনি–আপনার সংসার কি ভাবে চলবে সে দায়িত্ব আমাদের। কবে কাপসী যাবেন? যাবার আগে ডাক্তার জানার সঙ্গে দেখা করে যাবেন।

একটু সময় থেমে ফের বলেন তিনি দল্লীর খাদান আর খুব বেশি হলে দশ বছর চলবে। এরপর এটা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ভিলাইইস্পাত কারখানাকে সচল রাখতে হলে বস্তারের রাওঘাট খাদান চালু করতে হবে। রাওঘাটে রয়েছে অতি উন্নত মানের লৌহ আকর। এবং এটা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় লোহার খাদান। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে একেসম্পূর্ণ মেকানাইজ মাইন্সে পরিণত করার। বিদেশ থেকে বড় বড় মেশিন আসবে। যা চালনা করার জন্য বাইরে থেকে আনা হবে চার পাঁচশো অপারেটার। এতে অঞ্চলের কতটুকু বিকাশ হবে? আদিবাসীর জঙ্গল যাবে, জমিন যাবে, জল যাবে, তাদের জীবন ধারণ প্রণালী নষ্ট হবে, অস্মিতা এবং সংস্কৃতির উপর বহিরাগতের হামলা হবে। এত কিছু যাবে কিন্তু বিনিময়ে তারা কিছু পাবে না। সেই জন্য আমরা চাইরাওঘাটে মেকানাইজ নয়, ম্যানুয়াল মাইন্স হোক। দল্লীতেও পূর্ণ মেশিনীকরণের প্রয়াস চলেছিল। আন্দোলন করে আমরা সেটা রুখে দিতে পেরেছি। এখানে অর্ধ মেশিনীকরণ হয়েছে। যে কাজ মানুষের পক্ষে অসাধ্য সেটা মেশিন করবে। যদি রানাঘাটেও সেটা করা যায় কম পক্ষে তিরিশ হাজার মানুষ কাজ পাবে। সভ্যতার অগ্রগতিতে লোহার অবদান অসামান্য। লোহা অবশ্যই চাই তবে সেটা বহু সংখ্যক মানুষের ক্ষতি করে নয়।

আমার মনে হয় আপনাদের এটা বস্তারের মানুষকে এখন থেকে বোঝানো শুরু করা দরকার। পারলে আজ থেকে এই কাজটা শুরু করে দিন।

কাপসীতে ফিরে আসবার সময় দেখা করেছিলাম ডাঃ জানার সাথে। যা আমি কল্পনাও করিনি, পাঁচশো টাকা দিয়েছিলেন উনি। বলেছিলেন–আপনার মাসের খরচ। নিয়োগীজির পরিবারে আমার চেয়ে একজন সদস্য বেশি। ছেলে মেয়েরা উঁচু ক্লাশে পড়ে। যে কারণে খরচ বেশি। তাই উনি পান সাতশো টাকা মাসের খরচ। তাহলে আমার জন্য পাঁচশোর বেশি আর কি হবে?

দিল্লীর যোগেন দা আর দল্লীর ডাঃ শৈবাল জানা দুজনের সঙ্গে এই চার দিনে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। কাপসী ফিরে আসার আগে ডাঃ জানাকে হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি–ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার পতাকার দুটো রঙ। শ্রমিকের জন্য লাল কৃষকের জন্য হারা (সবুজ) তাহলে আমার জন্য কি? আমি তো শ্রমিকও নই কৃষকও নই। আমার জীবন কাহিনীর কিছু ডাঃ জানা জানতেন। উনি তখন মজা করে বলেছিলেন, আপনার জন্য আছে ঝান্ডা বাঁধা ওই ডাণ্ডা।

এর কিছুদিন মনে হয় এক দেড় মাস পড়ে এসে গেল বিধান সভার নির্বাচন। নিয়োগীজি আমাকে ডেকে পাঠালেন দল্লী। গিয়ে দেখি আমার আগেই সেখানে গিয়ে বসে আছে চেতনা মন্ডল নামক এক সামাজিক সংস্থার অধ্যক্ষ সুরেশ মোড়ে। মোড়ে আসলে মহারাষ্ট্রের গড় চিরোলির লোক। এখন এসে ঘাঁটি গেড়েছে উত্তর বস্তারে। এ এখানে আদিবাসীদের সংগঠিত করে নানা ধরনের ছোট খাটো আন্দোলন করে। এবং সে ভীষণ রকম বাঙালী বিদ্বেষী। তার সংগঠনে কোন বাঙালীর স্থান নেই। সে বলে বাঙালী এখানে বহিরাগত। যারা জঙ্গল ধ্বংস করছে। জমি হরপ করেছে। চাকরি ব্যবসা সব দখল করে নিয়েছে। আদিবাসীদের সে উস্কানি দেয়–এখান থেকে এদের তাড়াতে হবে।

কংগ্রেস নেতা অরবিন্দ নেতামেরও বাঙালীদের উপর খুব রাগ। কারণ বাঙালীরা তাকে ভোট দেয় না। কাকের লোকসভার অন্তর্গত এই নারায়ণপুর বিধানসভার সিটে বিজেপি জেতে। সে কারণে সুরেশ মোড়ে আর অরবিন্দ নেতামের খুবই দোস্তি।

আর একজন মানুষকে এখানে দেখলাম। ইনি রবিশংকর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রফেসর প্রফুল্ল কুমার ঝ। সম্প্রতি উনি রিটায়ার করেছেন। হাতে বিশেষ কাজ নেই। অবসর সময় কাটে না। তাই মুক্তি মোর্চার সাথে কাজ করে সময় কাটাতে চান।

আমাদের তিন জনকে নিয়ে এক মিটিংয়ে বসে নিয়োগীজি জানালেন যে এবার ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা বিধান সভার নির্বাচনে মোট ১৩টা কেন্দ্রে প্রার্থী দেবার কথা ভাবছে। যার মধ্যে একটা নারায়ণপুর। উনি আমাদের তিন জনের এক কমিটি বানিয়ে ভার দিলেন সর্ব সম্মতি ক্রমে একজন প্রার্থী বাছাই করার। আমি এক নগণ্য মানুষ। সমাজে যার মূল্য এক কানাকড়িও নয়, তাকে এত গুরুত্ব! এ আমার কল্পনারও অতীত।

নারায়ণপুর বিধানসভার আসন আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত। প্রফুল্ল কুমার ঝাঁ এবং সুরেশ মোড়ে প্রস্তাব করলেন চেতনা মণ্ডলের এক নেতা সুরজারাম নরেটির নাম। এমনিতে সুরজারাম লোকটা ভালো। আদিবাসীদের সমর্থনও আছে তার পিছনে। তবে সে অরবিন্দ নেতামের কাছের লোক। নেতাম পরাল কোটির যেখানে টিকবে সুরজারাম মঞ্চে বসে থাকে। আমি সে কথা নিয়োগীজিকে জানাই। সুরজা ভোটে দাঁড়ালে বাঙালীরা তাকে ভোট দেবে না। বহু চেষ্টায় আমি যে মুক্তি মোর্চার ছোট একটা সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছি সব বিরূপ হয়ে দূরে সরে যাবে। আমার যুক্তি মেনে নিয়ে দু দুজন প্রবল সমর্থক থাকা সত্ত্বেও নিয়োগীজি সুরজারামকে বাতিল করেদিলেন। আমি শিক্ষা দীক্ষাহীন এক কাঠ বেচা মানুষ নিয়োগীজির কাছে এত গুরুত্ব পাবো কোনদিন ভাবিনি।

সুরজারাম বাদ গেলে বাছাই করা হয় নারায়ণপুরের এক স্কুল মাস্টার মুরহারাম দেহারীকে। যার প্রচারে ডাঃ জানা তো ছিলেনই, যোগেন দা, তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ থেকে কনোরিয়া জুট মিলের শ্রমিক সংগঠনের নেতা প্রফুল্ল চক্রবর্তী, কুশল দেবনাথ, পূর্ণেন্দু বোস, চঞ্চল মুন্সী সহ আরো দু তিনজন গিয়েছিলেন। কিন্তু তবুমুরহারাম দেহারী হেরে গেলেন। হেরে গিয়েছিলেন মোর্চার প্রার্থী অন্য এগারো জনও। শুধু ডোণ্ডি লোহরা ক্ষেত্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন জনক লাল ঠাকুর।

এরপর যোগেন দা দিল্লী ফিরে যান, কলকাতার লোকজন সব ফিরে যায় কলকাতায়। সেই সময় একদিন দল্লীতে গেছি। এক চা দোকানে বসে চা খাচ্ছিল প্রফুল্ল ঝাঁ। আমার উপর তার রাগ ছিল। আমাকে দেখে সে তার এক সঙ্গীকে বলে–বাঙালীরা সব বেইমান। অসুখ হলে সব দৌড়ে শহীদ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে চলে আসে। আর ভোট দেবার বেলা দেয় সাম্প্রদায়িক দল বিজেপিকে। এবার আমরাও সুরেশ মোড়ের সাথে মিলে বাঙালী খেদাও আন্দোলন শুরু করবো। এটা সে বলেছিল আমাকে রাগাবার জন্য। এবং আমি রেগে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে ছিলাম কাপসী। আর একটা চিঠির দুটো কপি করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম একটা দিল্লী একটা কলকাতায়। যাতে আমার প্রশ্ন ছিল–মোর্চা যদি বাঙালী খেদাও আন্দোলন করে আমরা সে সংগঠনে কেন থাকবো? প্রফুল্ল চক্রবর্তী বাবুরা সে চিঠি নিয়োগীজির কাছে পাঠিয়ে দেয়। এরপর যা হয়–নিয়োগীজি আমাকে ডেকে পাঠান।

আমি জানি অন্য কোন নেতা হলে আমার কৃতকর্মের জন্য আমাকে মেরে তালগোল পাকিয়ে দিত। উনি কিন্তু সে সব করলেন না, ধীর গলায় বললেন আমাদের যদি কোন ভুল ত্রুটি ঘটে যায় আপনি সেটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে যদি দিল্লী কলকাতায় চিঠি লিখে বেড়ান তাহলে আমরা ভুলটা সংশোধন কি করে করবো। এটা আপনি কেন করলেন?

তখন বলেছিলাম আমি আজ হোক বা কাল আমাকে তো কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। যত দিন মোর্চার প্রতি মোহ ছিল ফিরে যাবার কথা মনে পড়েনি। ফিরে গেলে তখন যারা আপনাকে কলকাতায় চেনে সবাই আমাকে দোষ দেবে। বলবে, নিয়োগীজির মত মানুষের সঙ্গে যখন তুমি কাজ করতে পারোনি, তুমি লোকটা ঠিক লোকনও। সেই জন্য চিঠি দিয়ে অবস্থাটা তাদের জানিয়েছি।

তখন উনি ধৈর্য ধরে বিশদভাবে আমাকে বলেন–ছত্তিশগড়মুক্তিমোর্চা সেই অর্থে আটোসাটো কোন রাজনৈতিক দল নয়। এটা ছত্তিশগড়ের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত একটা সামাজিক সংগঠন। শ্রম জীবনের সমস্ত রকম বিকাশের লক্ষ্যে আমাদের রয়েছে বহুমুখীন কার্যক্রম। যেমন ধরা যাক, পর্যাবরণ রক্ষা, মাদক বর্জন আন্দোলন। শিক্ষা বিস্তার এবং লোক সংস্কৃতি-লোক সাহিত্যের প্রচার প্রসার। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিবিধ প্রোগ্রাম। এই রকম আন্দোলন বা কার্যক্রমে বিভিন্ন সংগঠন আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, সময়ে সময়ে আমরাও ওই সব সংগঠন বা ব্যক্তি বিশেষের সহযোগিতা নিয়ে থাকি। এই দেওয়া এবং নেওয়ার সঙ্গে আমাদের মূল রাজনীতি বা সিদ্ধান্তের কোন সম্পর্ক নেই।

আমরা যখন মাদক বর্জন আন্দোলন করেছিলাম, গান্ধীজির এক আত্মীয় সুশীলা নায়ার আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা তাকে সঙ্গে নিয়েছি। এই ভাবে গান্ধীবাদী বাবা আমটের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটকর, পি ইউ সি এল-এর রাজেন্দ্র সায়েল, ভারত জন আন্দোলনের ড, ব্রহ্মদেও শর্মা, বন্ধুয়া মুক্তি মোর্চার স্বামী অগ্নিবেশ যারা কোন না কোন সময়ে মোর্চার আন্দোলনে সামিল হয়েছে। প্রফুল্ল ঝাঁও সেই রকম এক জন। এ মোর্চার কেউ নন। তিনি যা বলেছেন, ঠিক না বেঠিক সে দায় কোন মতে মোর্চার উপর বর্তায় না। মোর্চা প্রফুল্ল আঁকে নিশ্চয় এই মন্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বলবে। আর তা না হলে তাকে দল্লী ছেড়ে চলে যেতে হবে।

এরপর ঠিক ঠিক কি ঘটেছিল আমি জানি না। তবে প্রফুল্ল ঝাঁ দল্লী ছেড়ে রায়পুর চলে যান এবং সেখানে গিয়ে নব ভাস্কর পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের চাকরি নেন। বহুদিন পরে আর একবার তিনি দল্লী এসেছিলেন। সেটা ১৯৯১ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর।

নানা কথা শেষ করে সেদিন নিয়োগীজি জিজ্ঞাসা করেছিলেন–কী করবেন?

–কী করবো!

–কলকাতায় চলে যাবেন?

–না। জোর দিয়ে বলেছিলাম আমি।

–তাহলে আর কোনদিন যেন কোথাও চিঠি লিখবেন না।

একটা ছোট্ট ডোবা গ্রীষ্মের দারুণ দাবদাহে শুকিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ কোথা থেকে যেন উড়ে এল এক খণ্ড মৌসুমি মেঘ। সে অকৃপণ জল ধারা ঢেলে দিল মাটির উপর। মাটির শিরা বেয়ে-উপশিরা বেয়ে সে জল গিয়ে পড়ল শুকনো ডোবায়। যত জলচর প্রাণী জল ছাড়া মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল সব আবার বাঁচার আশ্বাস পেয়ে সজীব হয়ে উঠল।

মনে হয়েছিল বস্তারের জঙ্গলে এসে বুঝি আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো। কিন্তু না, তা হল না। জঙ্গলই এল আমার কাছে মহা মঙ্গল হয়ে।

.

তখন আর আমি অনেকদিন দল্লী যেতে পারিনি। একবার সেই যে পাঁচশো টাকা নিয়ে এসেছিলাম যাতে এক মাস সংসার চলে ছিল, তারপর তো এসে গিয়েছিল বিধানসভার ভোট। সে সময় প্রচুর মুক্তিমোর্চার কর্মী কাপসী এসেছিল যাদের রান্না খাওয়া এখানেই হোত। তাদের খাওয়া দাওয়ার পর যে খাবার বেঁচে যেত আমার পুরো পরিবার খেয়ে শেষ করতে পারত না। এর পর ঘটে সেই চিঠি চাপাটির ঘটনা। যার ফলে আমি কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিলাম। দল্লী গিয়ে যে দাবি করবো সে মনের জোর পাচ্ছিলাম না।

তবে দল্লী যাই বা না যাই আমি যেমন জানতাম আমি মুক্তি মোর্চার সঙ্গেই আছি স্থানীয় মানুষ পুলিশ, ফরেস্ট এবং সব সরকারি কর্মচারী এমন কি কাকেরের এল আই বি শ্রী বাস্তব সেও তাই জানত এবং মাঝে মাঝে এসে আমরা বস্তারে কি করছি তার খোঁজ খবর নিয়ে যেত।

সে সময় আমি অমৃত সন্দেশ নামে এক হিন্দি পত্রিকার স্থানীয় এজেন্ট হয়ে গিয়েছিলাম। এ সব পত্রিকার কোন সংবাদদাতা থাকে না। যারা এজেন্সি নেয় তারাই সংবাদ পাঠায়। বাধ্য হয়ে আমাকে রাত জেগে হিন্দি পড়াটাও শিখে নিতে হল। কাপসীতে তখন অমৃত সন্দেশ তিরিশখানার মতো চলত। যার কমিশন পনেরো টাকা পেয়ে যেতাম। এতে আমাদের চাল আলু কেনা হয়ে যেত। আর একটা সুবিধাও হল, একবেলা সংগঠনের কাজ করার সময় পেয়ে যেতাম।

একদিন পত্রিকা বিলি করতে কাপসী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে গেছি। তখন হাসপাতালেরই এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটা খবর জানালো পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য। বলল যে হাসপাতালের স্টোরে প্রচুর ওষুধ–যা বোকা হাবা আদিবাসীদের নামে প্রেসক্রিপশান করা হয়েছিল–অথচ দেওয়া হয়নি তা জমে জমে এখন পাহাড়। এ সব ওষুধ বাইরে বিক্রির জন্য যে কোন দিন পাচার হবে।

হাসপাতাল থেকে যে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে একটা পাখানজুর একটা ভানু প্রতাপপুর চলে গেছে, তা গেছে কাপসী বাজারের পাশ থেকে। কটা ছেলেকে সেখানে পাহারায় বসিয়ে দিলাম নজর রাখার জন্য। জিপ সাইকেল যাতেই ওষুধ আসুক ধরা হবে। কিন্তু আমাদের এ খবর গোপন রইল না। একটা ছেলে–যে আমাদের সাথে আছে তার এক জামাইবাবু হাসপাতালের কর্মী। জামাইবাবু যাতে বিপদে না পড়ে সে দিদিকে বলে আসে-ওষুধ পাচার হওয়া গাড়িতে সে যেন থাকে। মুক্তি মোর্চার ছেলেরা ধরবে।

এই ওষুধ পাচার চক্রে হাসপাতালের সবাই যুক্ত। যে কারণে সেই জামাইবাবু তার সহকর্মীদের আসন্ন বিপদ থেকে সতর্ক করে দেয়। ফলে স্টোর থেকে ওষুধ আর বাইরে এল না। আমরা তখন গোটা কয়েক দরখাস্ত লিখে থানা বিডিও অফিস তফসিল জেলাশাসককে পাঠিয়ে আবেদন জানালাম হাসপাতালের স্টোর এবং রেজিস্টার চেক করতে। যখন হাসপাতালের কর্মীরা বুঝল একটা সমস্যা আসছে, তারা রাতের অন্ধকারে একটা গর্ত খুঁড়ে সব ওষুধ মাটি চাপা দিয়ে দিল।

সকালবেলা মাঠের মাঝে নতুন খোঁড়া একটা গর্ত দেখে গরু চড়াতে যাওয়া কিছু লোকের সন্দেহ হয় এবং তারা আমাকে খবর দেয়। এরপর যা হল সে আর বলার নয়–কোদাল দিয়ে মাটি সরিয়ে আমার মাথা গরম। সব শুদ্ধ প্রায় এক বস্তা যার দাম নাকি চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা। সেই সব প্রাণদায়ী ওষুধ সব নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

এখানকার মানুষ তো খেপে ছিলই। দরকার ছিল শুধু একটু ইন্ধন। ফলে মানুষ হামলে পড়ল ডাক্তার কম্পাউন্ডার কর্মীদের উপর। বিনা বাছ বিচারে সবাইকে পিটিয়ে দিল। যেহেতু এর সূচনা আমার দ্বারা হয়েছিল পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। কেস দিয়ে দিল মারপিটের। এটা বস্তারে আমার প্রথম জেল যাত্রা। পরে অবশ্য আরো বার কয়েক যেতে হয়। তবে একটা সুবিধা এখানে ছিল। কাকের কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন বিষ্ণু প্ৰসাদ চক্রবর্তী আর ভানু প্রতাপপুরে মুরলি মোহন উপ্ৰেতি এরা দুজন নিয়োগীজির ভক্ত। যারা আমি কোর্টে যাওয়া মাত্র ছাড়াবার চেষ্টা শুরু করে দিতেন। এবং যেদিন ছাড়া পেতাম-সে জেল থেকে হোক বা কোর্ট থেকে, হোটেলে খাইয়ে গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিতেন।

এবার ছাড়া পেতে তিন দিন লেগেছিল। ততক্ষণে অমৃত সন্দেশ পত্রিকা আমার ফোটো সহ সে খবর ছড়িয়ে দিয়েছিল ছত্তিশগড়ের সর্বত্র। সবাই জেনে গিয়েছিল আমার নাম। বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এরপর একটি ছোট্ট আন্দোলন সংগঠিত করেছিলাম তেন্দু পাতা ভাঙার বকেয়া মজুরি আদায়ের দাবিতে। হারানগড়, ডোন্ডি এ দুটো আদিবাসী গ্রাম আর বাঙালী গ্রাম পি ভি ৫৬ নাম্বারের দেড় দুশো লোক নিয়ে ফরেস্টের সব চাইতে খুংখার অফিসার জনসন ক্রাককে তার অফিসের মধ্যে ঘেরাও করে বসেছিলাম দু-ঘণ্টা। যখন সে দুদিনের মধ্যে বকেয়া মজুরি মিটিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ঘেরাও তুলে নিয়েছিলাম এই বলে–যদি দুদিনের মধ্যে টাকা না পাওয়া যায়, আমরা আবার আসবো। সেদিন কিন্তু অহিংস না-ও থাকতে পারি। সে দুদিনের মধ্যে মজুরি মিটিয়ে দেয়।

কিছুদিন পরে একটা মারপিট হয় জীতেন ব্যানার্জীর পরিবারের সাথে। কংগ্রেসের নেতা, নেতামের চামচা, জীতেন ব্যানার্জীরা ছয় ভাই। ছয় ভাইয়ের বারো চোদ্দটা ছেলে। একান্নবর্তী পরিবার। ফলে এদের দাপটে কাপসীর মানুষ অতিষ্ট। কারো কোনদিন সাহস হয়নি এদের কিছু বলবার। জীতেন ব্যানার্জীর ভাই শম্ভ ব্যানার্জী আমাকে চড় মেরেছিল। আমি তারপর তাকে ফেলে পিটিয়েছিলাম।

ওরা থানায় গিয়ে কেস লেখায়। যে পুলিশ অফিসার আমাকে ধরে নিয়ে যেতে আসে সে ব্যানার্জীদের খুশি করার জন্য আমাকে বলে-মাদার চোদ্দ, চল তেরেকো থানে লেকে হাড্ডি তোড়ুঙ্গা।

সেটা ছিল কাপসীর হাটবার। বহু মানুষ, যার মধ্যে কিছু মুক্তি মোর্চার সমর্থকও আমাকে দেখেছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল এখানকার পুলিশ এবং ব্যানার্জী পরিবারের ভয় মানুষের মন থেকে দূর করার জন্য এখনই আমার একটা কিছু করা খুব দরকার। এ ভয় না কাটাতে পারলে তারা আমার সাথে আসবে না। তাই সাহসী গলায় অফিসারকে বলেছিলাম, দেখো সাব, গালি উলি মাৎ দো। দুবারা আগার মা উঠাকে গালি দিয়া তো তুমহারা জবান খিচু লুঙ্গা। তুমহারা বর্দী তুমে ইতনা তাকত নেহী দিয়া কি কিসিকো মা উঠাকে গালি দো। যাহা তক মারনে কা বাত, লক আপমে লেকে মারনা। নেহীতো দো গবাহি লেকে তুমে কোর্টমে ঘসিট দুঙ্গা।

এ ভাষা পুলিশ অফিসার কোনদিন শোনেনি। পারাল কোর্টে শুনবে তা কোনদিন ভাবেও নি। বুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার।

এর কদিন পরে বিজেপির ছোটখাটো এক নেতার সাথে হাতাহাতি হয়ে গিয়েছিল। সেও কেস দেয়। তবে কিছুদিন পরে নিজেই কেস তুলে নেয়। আমাদের ক্ষতি পূরণ বাবদ বারোশো টাকাও দেয়। এ কেসে আমি এবং আমার দুই ভাই আসামি হয়েছিলাম। এরা আমার জেঠতুতো ভাই সুধীর আর অধীর।

.

অনেকদিন পরে আবার আমার ডাক এসেছে দল্লী থেকে। ৫৬ নম্বর ভিলেজের গণেশ মণ্ডল শহীদ হাসপাতালে গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য। তারই কাছে খবর পাঠিয়েছেন ডাঃ জানা। একবার আসুন, দরকারি কথা আছে। আমি যখন এদিক সেদিক চলে যাই আমার স্ত্রী অনু পত্রিকা বিলি করে। এখন অবশ্য তিরিশ থেকে পত্রিকা পনেরোয় নেমে গেছে। হাসপাতালের যারা গ্রাহক ছিল আর পত্রিকা নেয় না। ফরেস্টের অফিসাররাও বন্ধ করে দিয়েছে পত্রিকা নেওয়া। রোজগার আমাদের অর্ধেক কমে গেছে। আমি দল্লী যাবার গাড়ি ভাড়া পাই কোথায়?

বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না। ৫৬ নাম্বার ভিলেজের একটা ছেলের শরীর খারাপ হল। মা আর ছেলের সংসার। মা এসে আমাকে ধরলো-বাবা আমার সাথে তুমি একটু দল্লী চলো। তোমার তো চেনা জানা আছে। বলে দিলে একটু “ভালো”চিকিৎসা হবে। তাই যেতে পেরেছিলাম দল্লী। আর “ভালো” চিকিৎসার কথা বলে ডাক্তার পুণ্যব্রত গুণের কাছে ধমক খেয়েছিলাম আমি।—ভাল চিকিৎসা মানে কি! এর যে রোগ হয়েছে তাতে যে ওষুধ লাগে সেটাই দেওয়া হবে। একে দেওয়া হবে, একজন ভিখারি হলেও বা একজন শিল্পপতি হলেও তাই করা হবে। এখানে ভাল মন্দের কথা আসছে কেন? একে ভাল চিকিৎসা করব তাহলে মন্দ চিকিৎসা কাকে করবো? এর মানে এখানে মুখ চিনে চিনে চিকিৎসা করা হয়। কাউকে ভাল কাউকে মন্দ!

ভাল কথা বলে যে এমন ভালোরকম খিচুনি খাবো আগে জানতাম না। সত্যিই এখানে ভালো মন্দ বলে কিছু নেই। সব কিছু সবার জন্য সমান। যে কারণে এক ভোর বেলায় নিয়োগীজিকে দেখেছিলাম অসুস্থ ছোট মেয়ে মুক্তিকে নিয়ে ডাক্তার দেখাবার জন্য দশ বারো জনের পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। ডেকে পাঠালে ডাক্তার তার বাড়ি দৌড়ে যাবার কথা–কিন্তু উনি তা করেন না। এবং এখানকার সব মানুষই নিয়োগীজির শিক্ষায় শিক্ষিত।

আমি যখন ডা:জানার সঙ্গে দেখা করলাম।বললেন উনি-আমরা একটা পরিকল্পনা করেছি। বাড়ি যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন। সব বুঝিয়ে বলব। পরের দিন সকালে সেটা বুঝিয়ে বললেন তিনি–বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। একদুদিনের মধ্যে রেজাল্ট বের হয়ে যাবে। আমরা দেখছি আপনাদের ওখানে প্রতিটা পাঠ্য পুস্তকের উপর দোকানদাররা দুইতিন টাকা বেশি দাম নেয়। আমরা চাই আপনি ওখানে একটা বইয়ের দোকান করুন। এবং ন্যায্য দামে বই বিক্রি করুন। এতে মানুষের উপকার হবে আর আপনার সংসারও চলে যাবে।

ডা: জানা দু হাজার টাকা দিয়ে বললেন–এটা নিয়ে আপনি কাকের চলে যান। কাকেরে নাজিব কুরেশি থাকে। টাকাটা তাকে দেবেন। নাজিবের বই দোকান আছে–কুরেশি বুক ডিপো। সে আপনাকে একটা দোকানের যা যা বই প্রয়োজন সব দিয়ে দেবে। কথা বলা আছে।

মুক্তি মোর্চার সমর্থক নাজিব কুরেশি আমাকে প্রায় দশ হাজার টাকার বই খাতা পেন কাগজ দিয়েছিল। কাপসীতে একটা ঘর ভাড়া করে খুলেছিলাম ন্যায্য মূল্যের বইয়ের দোকান। যার নাম দিয়েছিলাম–কবি সুকান্ত পুস্তকালয়। বইয়ের দোকানের একটা অংশে তৈরি করেছিলাম পাঠচক্র। যার নাম দিয়েছিলাম পারালকোট পাঠচক্র। চেষ্টা ছিল পারালকোটে বসবাসকারী বাংলা ভুলে যাওয়া বাঙালী সন্তানদের বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাহিত্যের সাথে পরিচিত করানো। বই কেনবার তো সামর্থ্য ছিল না। তাই একখানা আবেদন পত্র ছাপিয়ে বাংলার বিভিন্ন মানুষের কাছে পাঠিয়েছিলাম বই ভিক্ষা চেয়ে। একখানা মহাশ্বেতা দেবীর ঠিকানায়ও পাঠাই। উনি এটাকে সবিশেষ গুরুত্ব দেন এবং বর্তমান পত্রিকার মাধ্যমে বাংলার মানুষের কাছে বইয়ের আবেদন রাখেন। ফলে প্রচুর বই পাওয়া যায়। ঘর ভরে যায় ওনার। যখন সেই বই নিতে আমি ওনার বাসায় যাই তখনই উনি জানতে পারেন আমিই সেই রিকশাঅলা মদন। যার আসল নাম–মনোরঞ্জন।

এখন আমার সংসারের সমস্যা অনেকটা মিটে গেছে। ফলে সংগঠনের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করতে পেরেছি। দোকান অণুর উপর চালানোর ভার দিয়ে একটা সাইকেল-যার পিছনের ক্যারিয়ারে জল কিছু শুকনো খাবার আর একটা কম্বল নিয়ে আদিবাসী পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। ডোন্ডির পুনউ হারানগড়ের নহুরু এদের আগে পেয়েছিলাম, এবার সাথে পেলাম বড়ে গাওয়ের রবি টেইলার মুর ডোঙ্গরির প্রীতম এবং আরো অনেককে। এদের মাধ্যমে নানা জায়গায় আমাদের মজবুত সংগঠন গড়ে উঠল।

এ সময়ে আমাকে প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেবার জন্য মাঝে মাঝে দল্লী যেতে হোত। কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। যেতাম প্রাণের টানে। যেতাম সফলতার সংবাদ দিয়ে আনন্দিত হবার জন্যে।

বহু মানুষের কাছে শংকর গুহ নিয়োগীর বহু রকম রূপ। যে কারণে কেউ কেউ তাকে বলে থাকেন নকশাল। সেটা পুলিশেরও ধারণা যে তিনি তাই। ছত্তিশগড়ে যে ১৩টা গণ সংগঠনকে পুলিশ প্রশাসন নকশালবাদীদের সহযোগী বলে মনে করে, সবার শীর্ষে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার নাম। আবার বাবা আমটে মেধা পাটেকর ব্রহ্মদেও শর্মার মত গান্ধীবাদীরা নিয়োগিজীকে মনে করে গান্ধীবাদী। কেউ কেউ তো তাকে ছত্তিশগড়ের গান্ধীও বলে। একবার আলোচনার সময় নিয়োগীজি আমাকে বলেছিলেন তিনি মার্কসবাদী। সিপিআই অবশ্য তাকে মার্কসবাদী মানতে নারাজ। কারণ ভিলাই ইস্পাত কারখানা–যা ভারত সরকার এবং রাশিয়ানদের মিলিত উদ্যোগ, কখন কখনো নিয়োগীজি তার বিরুদ্ধে শ্রমিক শোষণের অভিযোগ তুলেছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আঙুল তুললে সে কি করে মার্কসবাদী থাকে!

আমার কিন্তু মনে হয় কোন বিশেষ ‘বাদ’-এর গাড়ায় নিয়োগীজিকে আটকে ফেলা কঠিন শুধু নয়–এক অসম্ভব প্রয়াস। উনি সব ‘বাদ’-এর বাদ বিবাদের উর্ধ্বে। এক মহান মানবতাবাদী। যার সঙ্গে একমাত্র তুলনা করা যায় রাজপ্রাসাদ থেকে নেমে এসে দুঃখী মানুষের মাঝে দাঁড়ানো গৌতম বুদ্ধের। তুলনা করা যায় মহান বিপ্লবী চে গুয়েভারার।

একবার দল্লী গিয়েছি নিয়োগীজির সঙ্গে দেখা করতে। শীতের রাত। গিয়ে দেখলাম ইউনিয়ান অফিসে উনি প্রায় পঁচাত্তর আশি বছরের এক বৃদ্ধের সাথে কথা বলছেন। অতি দরিদ্র বৃদ্ধ দূর কোন গ্রাম থেকে এসেছেন। তিনি কিভাবে কোথা থেকে জেনে এসেছেন যেদল্লীতে নিয়োগী নামের এক ডাক্তার আছে যার বিরাট হাসপাতাল; সে হাতপাতালে মরা রোগী গেলেও নাকি জ্যান্ত হয়ে ফিরে যায়। বৃদ্ধ বড় আশা নিয়ে এখানে এসেছেন ওই নিয়োগী ডাক্তারকে একবার তার রোগ জর্জর দেহটা দেখাবেন।

বার্ধক্য যে রোগের নাম তা কোন ওষুধেই সারবার নয়। অন্য কেউ হলে কি করতেন কে জানে, উনি কিন্তু দুঃখী একজন মানুষের দুঃখের কথা দরদ ভরা মন নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে শুনলেন। তারপর সান্ত্বনা দিলেন সব ঠিক হো যায়েগা। আজকের রাতটুকু বিশ্রাম করো। কাল সকালে তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বৃদ্ধের কাছে খাবার পয়সা নেই, শোবার কোন বিছানা নেই। সাথে কোন লোকও আসেনি, নিয়োগীজি জনকলাল ঠাকুরের ছোট ভাইকে ডেকে বললেন–এনাকে মেস থেকে খাবার খাইয়ে আনো। আর হাসপাতাল থেকে দুটো কম্বল এনে একটা ভালো জায়গায় শুইয়ে দাও। এরপর তিনি নানান জায়গা থেকে আসা মোর্চর কর্মীদের সাথে সংগঠন বিষয়ক আলোচনা শুরু করলেন। যে আলোচনা শেষ হল রাত দুটোর সময়। এত কিছু আলোচনার মধ্যেও উনি বৃদ্ধ লোকটির কথা ভোলেননি। ঘরে ফেরবার আগে একবার খোঁজ নিতে গেলেন তার। গিয়ে দেখলেন বৃদ্ধ কম্বল না পেয়ে একটা ছেঁড়া সতরঞ্চি জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে।

সদা প্রশান্ত নিয়োগীজির সেদিন যে ভয়ংকর রুদ্রমূর্তি দেখেছিলাম তা আমার পক্ষে এ জীবনে ভোলবার নয়। বৃদ্ধের ওই অবস্থা দেখার সঙ্গে সঙ্গে ওনার মুখ থেকে চির পরিচিত হাসি মিলিয়ে গিয়ে নিরেট একটা কালো পাথরের আকার ধারণ করল। পরক্ষণে ফেটে পড়লেন তীব্র রাগেও কঁহা! বুলাও উসকো।

জনকলাল ঠাকুরের ভাইমুখকাঁচুমাঁচুকরে সামনে এসে দাঁড়াতেইনিয়োগীজির ক্ষিপ্ত গর্জন-কা বোলা থা তুমকো?ইতনা ছোটাসা এক কাম কর নেহি পায়া তো ক্যা তুম জনতাকে সেবা করোগে?

আমতা আমতা করে বলে সে–হাসপাতালের স্টোরে কোন কম্বল নেই। রোগী খুব বেশি এসে গেছে। তাই তাদের কম্বল পেতে মেঝেতে রাখা হয়েছে।

এটা কোন যুক্তি নয়। যেখান থেকে হোক একে কম্বল এনে দিতে হবে। জনকের ঘরে যাও। ওখানে না পাও সাইকেল নিয়ে আমার ঘরে গিয়ে নিয়ে এসো।

জনকলাল ঠাকুরের ঘর ইউনিয়ন অফিসের কাছেই। তার ঘর থেকে কম্বল আনিয়ে বৃদ্ধকে শুইয়ে তবে সে রাতে নিয়োগীজি ঘরে গিয়েছিলেন। অনাথ অসহায় একজন অচেনা মানুষ, বলা চলে সমাজ সংসার যাকে পরিত্যাগ করে দিয়েছে। পৃথিবীকে দেবার মত যার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তার প্রতি এমন আন্তরিক দরদ। এই দরদ-ই শংকর গুহ নিয়োগীজিকে বানিয়েছে নিয়োগী ভাইয়া। আর বসিয়ে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে।

আমি শংকর গুহ নিয়োগীর লোক। আমার সারা জীবন তার কাছে কৃতজ্ঞতায় অবনত। যে ভয়ংকর দুর্দিনে তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, যদি তিনি সেদিন না দাঁড়াতেন সপরিবারে। কোথায় হারিয়ে যেতাম আমি তা কে জানে! আর শুধু আমি কেন ছত্তিশগড়ের লক্ষ মানুষের ত্রাতা মিত্র বন্ধু সহায়ক হয়ে জীবন বিপন্ন করে বার বার তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো–এটাই ছিল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। যা তাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ছত্তিশগড়ে মানুষের মনে মহাকাব্যের এক মহানায়ক রূপে।

একবার এক সকালে ডাঃ শৈবাল জানা আমাকে বললেন–চলুন ব্যাপারীদা একজন রুগী দেখে আসি। সেই যে বহু বছর আগে এক মানব দরদি ডাক্তার নর্মান বেথুন চিকিৎসার মধ্যে প্রচলন করেছিলেন এক নতুন নিয়ম-গুরুতর অসুস্থ রোগী ডাক্তারের কাছে আসবে না। ডাক্তার যাবে রোগীর কাছে। শহীদ হাসপাতালের সব ডাক্তার এই নিয়ম মেনে চলেন। এদের রয়েছে স্বাস্থ্য-ভ্যান যা চিকিৎসা এবং মানুষকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করার জন্য পৌঁছে যায় দূর-দূরান্তের গ্রামে।

আমরা অবশ্য সেদিন পায়ে হেঁটেই গিয়েছিলাম মাইল দুয়েক দূরে এক শ্রমিক বস্তিতে। দেখেছিলাম শয্যাশায়ী আর এক বৃদ্ধকে। আমাদের দেখে বার্ধক্য ভুলে ধরমর করে বিছানার উপর উঠে বসল সে। ডাঃ জানা তার নাড়ি দেখলেন জিভ দেখলেন তারপর বললেন–আর তোমার কোন শরীর খারাপ নেই। একদম ফিট। ঘরে অন্য কোন লোক নেই। বৃদ্ধ নিজে হাতে আমাদের জন্য হাতল ভাঙা কাপে দুধ ছাড়া চা বানিয়ে নিয়ে এল। চায়ে চুমুক দিয়ে ডাঃ জানা বৃদ্ধকে বললেন–ডোকরা (বুড়ো) হামারা এ সাথী কাপসীসে আয়া হ্যায়। হাম ইনহে বোলা, তোম বহুত আচ্ছা কাহানি বলতে হোসাথীকো এক কাহানি শুনা দো!

নড়ে চড়ে বসল সেই বৃদ্ধ। যেন বহুদিন পরে সে গল্প শোনার লোক পেয়ে মহাখুশি। খুলে। বসল সে তার গল্পের ঝুলি। গল্পটা রামায়ণের। বৃদ্ধ দল্লীর একজন সাধারণ শ্রমিক। ৭৭ সালের সেই মজদুর আন্দোলন সব তার স্বচক্ষে দেখা। স্মৃতির কোঠায় সে কাহিনী এখনো এত সজীব যে রামায়ণ কথকতায় বার বার এসে পড়তে লাগল মজদুর আর মজদুর নেতা শংকর গুহ নিয়োগীর কথা। এক সময় বৃদ্ধের গল্প এসে গেল রাবণ পুত্র মহীরাবণ কর্তৃক রাম লক্ষ্মণ হরণ বৃত্তান্তে। বৃদ্ধ বলে চলে—

রাম কা সাথ রাবণ কা মহারণ ….. মজদুর কা সাথ মালিক লোপোকা। তো রাবণ নে ক্যা কিয়া? আপনা লেড়কা মহীরাবণ-যো কি রসাতল কা রাজা থা–উসকো বুলায়া! কহা, যা বেটা রামকা সাথ যা কর যুদ্ধ কর। উসকো মার আউর হামারা লঙ্কা রাজকো রকসা কর। দেখা নেহী ঠিক উসি প্রকার মালিক লোগছি পুলিকা স্মাণ লিয়া। কন্থা, নিয়োগীকা হাত সে হাম লোগোকো বাঁচাও। হামারা লুঠ খসোটকা ধান্ধা রকসা করো। কহা কি নেহী?–কহা। অভি তো পুলিশ আইন (এল)। আউর মজদুর কো গোলি মারিন। তো মহীরাবণ–যো এক মায়া ভি থা! মায়া সে-মতলব ধোঁকে সে রামজীকো–যেইসে হামারা নিয়োগীজিকো পুলিশ ধোকে সে গ্রেপ্তার কর লিয়া থা।

একজন কাব্যের কল্পিত বীর আর একজন জীবন্ত মানুষ সেদিন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল এক বৃদ্ধের গল্পে। একজন থেকে কিছুতে আর একজনকে আলাদা করা যাচ্ছিল না।

মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস চেটি মুণ্ডা এবং তার তির-এ পড়েছি কেমন করে একজন মানুষ চিরকালের সঙ্গে মিশে হয়ে যায় নদী পাহাড় কিংবদন্তী–অবিনশ্বর। যা একমাত্র মানুষই পারে। শংকর গুহ নিয়োগী তা পেরেছেন। এখন আর এ কথা কোন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।

একবার নিয়োগীজির বাসায় গেছি আমি আর আমার এক বন্ধু রবি টেইলর। গতকাল উনি ভিলাই থেকে বাসায় এসেছেন। কথা যা ছিল আমাদের তা কালই ইউনিয়ন অফিসে বসে সেরে নিয়েছি। আজ শুধু আশা দিদির সাথে দেখা করে নিজস্ব কর্মাঞ্চল বস্তারে ফিরে যাব।

ইউনিয়ন অফিস থেকে এবরো থেবরো রাস্তায় মিনিট পাঁচ সাত এক শ্রমিক মহল্লার মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় ওনার কুঁড়ে ঘরের সামনে। অবাক হবার মত কথা। সত্যি সত্যি একটা ভাঙা চোরা ঘরে বাস করেন লক্ষ লক্ষ মানুষের নেতা শংকর গুহ নিয়োগী। যদি উনি চাইতেন দল্লী শহরের সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার মালিক হতে পারতেন। যদি নিজের অবস্থান থেকে সরে তথা কথিত শ্রমিক নেতাদের মত মালিক তোষক হতেন। উনি তা চাননি। চাননি শ্রমিক স্বার্থ বলি দিয়ে নিজের সুখ কিনতে। তাই সবার সমান জীবন–সবার সুখে সুখী হয়ে প্রবল দারিদ্রতার মধ্যে কাটিয়ে গেছেন সারাটা জীবন।

তখন সবে সকাল হয়েছে। আমি গিয়ে ডাকতেই নিয়োগীজির ছোট মেয়ে মুক্তি এসে দরজা খুলে দিল। তারপর আমাদের বসতে বলে কিছু না বুঝে ঘুম থেকে ডেকে তুলল নিয়োগীজিকে। মুক্তি ভুল করে ফেলেছে। আমরা তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। আশা দিদি অবশ্য কোন দিন কোন রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নেন না। তবু দল্লী এলে তার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যেতে মন চায় না।

আজ যে মানুষটির নামে লক্ষ লক্ষ মানুষ উত্তাল হয়, একদিন সে ছিল একেবারে একা। তার পিছনে পাগলা কুকুরের মত ছুটে বেড়াত পুলিশ। তখন নিয়োগীজি লুকিয়ে থেকেছেন জঙ্গল পাহাড় গুহায়। সেই সব দিনে আমাদের প্রিয় নেতা নিয়োগীজিকে তৃষ্ণার জল, অসুখে ওষুধ পথ্য খিদের অন্ন লুকিয়ে লুকিয়ে দিয়ে এসেছেন এই আদিবাসী ললনা। সেদিন আশা দিদি না পাশে থাকলে নিয়োগীজির কি হতো তা কে জানে! এই কথা মনে রেখে আমি আশা দিদির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে যাই। মুক্তি সেটা না জেনে নিয়োগীজিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। গতরাতে প্রায় দুটো অবধি মিটিং চলেছে। এত সকালে ওনাকে ডাকা মোটেই উচিৎ হয়নি।

কিন্তু ডাকা মাত্র উনি বিছানা থেকে নেমে এসে আমাদের সামনের বেঞ্চিতে বসে পড়লেন। মুখে কোন রাগ বা বিরক্তির চিহ্ন নেই। কথা বলা শুরু করলেন স্বাভাবিক গলায়। অতি সাধারণ কথার মাঝে আশা দিদি চা এনে আমাদের সামনে রাখলেন। রান্না বাসন মাজা জল তোলা সংসারের সব কাজ তিনি নিজের হাতে করেন। এত বড় এক জন নেতার সহধর্মিনীর একজন কাজের লোকও নেই। ভাবা যায়?

চা খেতে খেতে বলেন নিয়োগীজী—”শরীরটা ভাল নেই। কাল রাতে হঠাৎ করে জ্বর এসে গেছে।” হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেমন একটা মোচড় খেল আমার। কি করতে যাচ্ছি বুঝে ওঠার আগেই ওনার গায়ে হাত দিয়ে বসলাম। টের পেলাম প্রচণ্ড তাপ শরীরে বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, এই অবস্থায় উনি উঠে বসে আছেন। আর আমাদের মত অতি সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ কথা শুনছেন।

এটাই ছিল ওনার বৈশিষ্ট্য। কেউ ওনার কাছে সাধারণ নয়। সবাইবিশিষ্ট, সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে মানুষ তার কাছে আসত সবাইকে ভালোবাসতেন সবার কথা শুনতেন। সকাল দুপুর বিকেল রাতের প্রতিটা মুহূর্ত তার উৎসর্গ করা ছিল মানুষের জন্য। এক সমুদ্র সমান ভালোবাসার ভাণ্ডার তিনি নিঃশেষে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন মানুষের জন্যে।

আমি নিজেকে ধন্য মনে করি এমন মানুষের সাথে কাজ করতে পেরেছি বলে। তার শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করতে পেরে।

এর কিছুদিন পরে ১৯৯০ সালে উনি আহ্বান পেলেন ভিলাইয়ের হাজার হাজার অসহায়, মালিক শোষণে জর্জর শ্রমিকদের কাছ থেকে–আপনি আসুন নিয়োগীজি। আমরা আপনার নেতৃত্ব চাই। যেখানে অত্যাচার সেইখানে নিয়োগী। যেখানে নিয়োগী সেখানে প্রতিরোধ। সেখানে বিজয়। মানুষ ডাকছে আর কি করে চুপ থাকেন শংকর গুহ নিয়োগী? উনি যেভাবে একদিন দানী টোলা থেকে দল্লী এসেছিলেন ঠিক সেইভাবে দল্লী থেকে ভিলাই চলে গেলেন। এ সেই ভিলাই যেখান থেকে একদিন পূজিপতি-রাজনৈতিক দলের নানা ইউনিয়ান আর পুলিশের তাড়নায় চলে গিয়েছিলেন একা। আজ যখন বিশ বছর পরে আবার সেই ভিলাইয়ে ফিরে এলেন পথের দুধারে লক্ষ মানুষের আন্দোলিত হাত–স্বাগতম কমরেড।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে–সোভিয়েত সহযোগিতায় ১৯৫৮ সালে এখানে স্থাপন করা হয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম ইস্পাত কারখানা। যে কারখানার অনুসারী শিল্প হিসাবে অন্যান্য আরো ১৫০টি সংস্থা স্থাপন করা হয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশের মালিক পাঁচটি শিল্পপতি পরিবার। যারা ২৫/৩০ বছর ধরে শ্রমিককে শোষণ করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে। সামন্ত মানসিকতার এই সব নব ধনাঢ্য এক একটা গুণ্ডা বিশেষ। যাদের রয়েছে নিজস্ব মাফিয়া সংগঠন। যারা হিংস্রতায় পৃথিবীর যে কোন মাফিয়া সংগঠনের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম।

ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা এই সব শিল্পদ্যোগের একটাতেও শ্রম কানুন যথাযথভাবে পালন করা হয় না। নাম মাত্র মাইনে আর কথায় কথায় ছাঁটাই। প্রতিবাদ করলে মারধোর নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতিকার পাবার কোন উপায় ছিল না এখানে।কারণ এখানকার শ্রমিক নেতারা সব ভয়ে এবং উৎকোচের লোভে পড়েছিল মালিক শ্রেণির পায়ের কাছে।

নিয়োগী এখানে পৌঁছে যাবার পর হাড়কম্পন শুরু হয়ে গেল দালাল ইউনিয়ন আর রক্তচোষা মালিক পক্ষের। তখন মধ্য প্রদেশের শাসন ক্ষমতায় বিজেপি। যার মুখ্যমন্ত্রী সুন্দর লাল পটোয়া। প্রমাদ গুনলো পটোয়ার প্রশাসন। আর বোধহয় রামভক্ত–লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা দেওয়া পুঁজিপতিদের বাঁচানো গেল না।

১৯৯০-এর ২রা অক্টোবর গান্ধী জয়ন্তীর দিন ভিলাইয়ের শ্রমিক শ্রেণির প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন সমস্ত শ্রেণির মানুষকে জমায়েত হবার আহ্বান জানালেন নিয়োগীজি। চেষ্টা হল–সমস্ত মানুষকে সংগঠিত করে শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে একটা দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তোলবার।

ছত্তিশগড়ের যেখানে নিয়োগী আন্দোলন সংগঠিত করে, লাঠি গুলি নিয়ে আন্দোলন দমন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রশাসন। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। ভীত উদ্যোগপতিদের ইশারায় বিজেপি প্রশাসন নিয়োগীজির প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে ভিলাই জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। জারি হল ১৪৪ ধারা। কিন্তু হার মেনে নেবার মানুষ উনি নন। ১৪৪ ধারা ভেঙে উনি পুলিশ প্রশাসনকে শ্রমিকদের উপর আক্রমণের সুযোগ না দিয়ে ৩০/৪০ হাজার মানুষের ওই বিশাল সমাবেশ ভিলাই থেকে রায়পুরে সরিয়ে এনেতাদের খাদ্য দ্রব্য পানীয় জল, অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা সর্বশেষে একটি সফল জনসভা করে প্রশাসনকে মুখের মত জবাব দিলেন। ছত্তিশগড়ে এমন ক্ষমতা একমাত্র ওনারই ছিল। এই ঘটনায় তার সংগঠন শক্তি এবং কর্ম তৎপরতার পরিচয় পেয়ে সমস্ত পত্রপত্রিকা এবং নেতা বুদ্ধিজীবীরা এক বাক্যে স্বীকার করেছিল–নিয়োগীজি এক অসাধারণ নেতা।

উত্তর বস্তার থেকে ছয়খানা ট্রাকে দুশো কার্যকর্তা নিয়ে আমরাও গিয়েছিলাম সেই সমাবেশে। তিন দিন থেকে শুরু হয়েছিল প্রবল বৃষ্টিপাত। এ বৃষ্টি পশ্চিমবঙ্গের নয়, ছত্তিশগড়ের বৃষ্টি। বরফের মত ঠাণ্ডা সে বৃষ্টির ফোঁটা লোমকুপ থেকে ভিতরে ঢুকে হাড়ে গিয়ে কামড় বসায়। এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসছিল শুধু মানুষ আর মানুষ। দিল্লীর সভ্য শিক্ষিত মানুষ যেমন এ সমাবেশে ছিল, তেমনই ছিল বস্তার জেলার গভীর বন “অবুঝ মাড়”-এর মুড়িয়া আদিবাসী। যারা হিন্দি ভাষা বোঝে না ছত্তিশগড়ী ভাষা জানে না, জানে শুধু ভালোবাসার সেই ভাষা যে ভাষায় নিয়োগী ভাইয়া কথা বলে।

বাবুদের শহর রায়পুরে এদের জন্য কোন আশা আশ্বাস আশ্রয় ছিল না। ছিল না সমবেদনা সহানুভূতির কোন লেশমাত্র।এরা কারো সমবেদনা চাইতে আসেওনি। এসেছিল লড়াইয়ের ময়দানে কাঁধে তির ধনুক টাঙ্গি নিয়ে তাদের প্রিয় সেনাপতির আহ্বানে। অনুশাসিত সেই সেনাবাহিনীর তিন লাইনের একটা ছয় মাইল লম্বা মিছিল হয়েছিল। নিয়োগীজি সেদিন একটা ভোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে রেখেছিলেন তার অগ্নিবর্ষী বক্তব্য। সবাই ভিজছিল, বৃষ্টিতে ভিজছিলেন তিনিও। সবাইকে জলে নামিয়ে দিয়ে একা ডাঙায় থাকার মানুষ নিয়োগীজি ছিলেন না। কোন অর্থেই ছিলেন না। তাই সবাই নিয়োগীজিকে এত আপন ভাবত। তার ডাকে এমন ভাবে সাড়া দিত।

এখনো আমার স্বপ্নের মত মনে হয় সেদিনের সেই সভা শুরু হবার দৃশ্য : পায়ের নিচে থকথকে কাদা। বসবার উপায় নেই; সব মানুষ মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে :হঠাৎ মাইকে ভেসে এল পরম শ্রদ্ধেয় নিয়োগীজির গলা–ভাই সব, হামলোগ তো কিষান মজদুর। এহি মিট্টি পানীমেই হামলোগকা জিনা-মরনা। হো সকতা হ্যায় তো আপ সব বইঠ জাইয়ে।

দুবার আর কেউ কিছু শোনবার অপেক্ষা করেনি। নিয়োগী ভাইয়া বসতে বলেছে, মাত্র দু মিনিটের মধ্যে ওই বিশাল জনসমুদ্র নিশ্চপ আসন নিয়ে ছিল সেই কাদার মধ্যে–প্রিয় নেতার বক্তব্য শোনার জন্য। তাকিয়ে দেখেছিলাম আমার সামনে পিছনে ডানে বায়ে সবাই বসে পড়েছে।

নিয়োগীজি তখন পুরোপুরি ভিলাইয়ের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। পরিবারের সবাইকে ওখানে নিয়ে যাবেন এই রকম পরিকল্পনা। তখন উনি আর দল্লী আসবার বিশেষ সময় পান না। আমাদের খুব দেখা করবার দরকার ছিল। তাই একদিন আমি আর নাজিব কুরেশি দুজনে গেলাম ভিলাই। সেক্টর নাইনের যে বাসায় উনি থাকতেন সেখানে তখন উনি ছিলেন না। কি আর করার, আমি আর নাজিব অপেক্ষায় বসে রইলাম সেই ঘরে।

ঘরে কোন লোক নেই। মাত্র এক জন আঠাশ তিরিশ বছরের সুন্দরী মহিলা রান্না করছে। পরে জেনেছিলাম-এর নাম সুধা ভরদ্বাজ। সে এল এল বি পাশ। এবং রায়পুর কোর্টে প্র্যাকটিস করে। আমার মাথা সত্যি সত্যি ঘুরে গিয়েছিল। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ–এ সব মানুষ আমি যা জানি সে হল, রান্না করা বাসন মাজা এ সব শ্রমের কাজকে এড়িয়ে চলে। যারা এগুলো করে তাদের ঘৃণা করে ছোট লোক বলে। কিন্তু সুধা নামের এই মেয়ে উকিল হয়েও রান্না করছে।

এটাই শংকর গুহ নিয়োগীর শিক্ষা। সে শিখিয়েছে, কোন কাজ ছোট নয় কোন কাজ বড় নয়। এই শিক্ষায় শিক্ষিত বলে ডা: শৈবাল জানা সকালবেলা হাসপাতালে রাউন্ড দিতে গিয়ে মেঝের এক জায়গায় জল পড়ে আছে দেখে নিজেই তোয়ালে টেনে মুছতে শুরু করে দেন। কে সাফাই কর্মী, তাকে হুকুম দিয়ে দায় সারেন না।

বেলা তখন প্রায় একটা বেজে গেছে। খিদেয় পেট চো চো করছে আমার। ভাবছি কখন রান্না হবে আর কখন আমাদের খেতে দেবে। মনে খুব আনন্দও হচ্ছে। এত বড় নেতার বাসা, নিশ্চয় ভাল মন্দ কিছু রান্না হচ্ছে। কিন্তু রান্না হয়ে গেলে সুধা নামের সেই মেয়ে আমাদের খেতে দিল না। খাবার দাবার ঢাকা দিয়ে রেখে এক গোছ পেপার নিয়ে পড়তে বসে গেল। নাজিব তখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে খিদের জ্বালায়। আর আমি ঘুমোতে পারছি না সেও ওই খিদের জ্বালায়। খিদে দুজনার উপর দুরকম প্রভাব ফেলেছে। সুধা পেপার পড়ছে আর গুরুত্বপূর্ণ খবর কাচি দিয়ে কেটে ফাইলে রাখছে। এই করতে করতে বেলা তিনটে।

এ সময়ে জিপের আওয়াজ পাওয়া গেল। ঘরের সামনে জিপ থামলে তা থেকে নেমে এলেন। নিয়োগীজি। সাথে আরো তিনজন। এসে আমাদের দেখে বললেন–কখন এসেছেন? এলাকার কি খবর? খিদে লেগেছে, আগে খেয়ে নেওয়া যাক পরে সব শুনবো।

সুধা চলে গেল খাবার পরিবেশনে। নিয়োগীজি লেগে গেলেন পেঁয়াজ কাটতে। অন্য একজন গেলাসে জল ঢালতে। আগে জানা ছিল না দুজন তোক বেড়ে যাবে। রান্না হয়েছিল পাঁচজনার। এখন সেই খাবার সাত ভাগ করে সাত থালায় পরিবেশন করল সুধা। আহা রে! সে কি খাবার, দেখে চোখ ফেটে জল আসতে চায়। আতপ চালের দলা দুলা ভাত আর সাথে না হলুদ না লঙ্কা না কোন ফোড়ন–খানিকটা অরহরের সেদ্ধ ডাল। খাবার টেবিল ছোট। নিয়োগীজি তো বসারও জায়গা পেলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চার গ্রাস ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন।

কাকেরে পরিবর্তন নামে একটা এন.জি.ও আছে। যার প্রধান রত্নেশ্বর নাথ। একবার সেখানে জনকলাল ঠাকুর ও আমার রাতে থাকতে হয়েছিল। রাতের খাবারে মাছ মাংস তো ছিল না তবু ঝাল টকমিষ্টি আঠাশ রকম পদ ছিল সেইনৈশ ভোজে। এত রকম পদ আমি কোন বিয়ে বাড়িতেও দেখিনি। দেখেছিলাম একমাত্র নাগপুর টাইমস পত্রিকার সম্পাদক–যার ভাইনা কে যেন মহারাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী ছিল–সেই বাড়িতে। স্বামী অগ্নিবেশ অনুপ সিং আর আমি খেয়েছিলাম সে বাড়িতে। নাগপুর টাইমসের মালিকের বা সমাজ সেবক রত্নেশ্বর নাথের সাথে তুলনা করছি না, লোহা খাদানের একজন সাধারণ মজুরেরও দুপুরের ভোজনে ডালের সাথে কমপক্ষে একটা ভাজা কিছু থাকে, নিদেন পক্ষে এক কুচি আচার–নিয়োগীজির তাও ছিল না।

এত ত্যাগ এত কৃচ্ছসাধন-দুঃখ কষ্টের স্বেচ্ছাবরণ আমি ঠিক জানিনা ভারতবর্ষের এই মাপের নেতা আর কেউ করেছেন কিনা! আজ আমার মনে হয় ওই ত্যাগ, কৃচ্ছসাধনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে নিয়োগীজির। মানুষের মনে যে শ্রদ্ধার চিরস্থায়ী আসন তিনি পেয়েছেন তা এক অমূল্য অর্জন, মহাপুরুষদের কামনার ধন।

…আজ আবার দেখতে এসেছি আমার পরম শ্রদ্ধেয় কমরেড শংকর গুহ নিয়োগীকে। আজ ১৯৯১ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর! দল্লী শহীদ চকের সামনে ফুল মালায় আবিরে সজ্জিত নিয়োগীজি আজো শুয়ে আছেন। ছেচল্লিশটা বছর বড় কঠিন পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হয়ে চির ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছেন নিপীড়িত জনতার সেই সদা জাগ্রত প্রহরী।

১৯৮৯ সালের ২৬শে জুলাই নিয়োগীজির নেতৃত্বে সর্ব প্রথম একটি আন্দোলন হয় জামুলের সিমেন্ট কারখানায়। গত তিরিশ বছরের মধ্যে এটাই প্রথম আন্দোলন যাতে ভিলাইয়ের শ্রমিক শ্রেণি জয়ের স্বাদ পায়। দীর্ঘ পরাজয়ের পর এই বিজয় শ্রমিকদের মনোবল তুঙ্গে তুলে দেয়। ফলে ভীত উদ্যোগপতিরা সংঘবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়–এই প্রথম এই শেষ। আর কোন আন্দোলনে নিয়োগীকে জিততে দেওয়া যাবে না।

১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরের একত্রিশ তারিখে নিয়োগীজি ভিলাইয়ের পাঁচটি প্রধান শিল্পদ্যোগে আলাদা আলাদা দাবি সনদ পেশ করেন। যার মধ্যে মুখ্য দাবি থাকে বেঁচে থাকার মত মজুরি। যা শ্রম আইন দ্বারা ঘোষিত তা দিতে হবে এবং শিল্প যখন স্থায়ী, ঠিকাদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটিয়ে মজুরদের স্থায়ী করতে হবে। কিন্তু মালিক পক্ষ “লাল হারা” ইউনিয়নের নিয়োগীজির কোন দাবি মানতে রাজি ছিল না।

আন্দোলন শুরু হয়েছিল আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৬ই নভেম্বর ‘৯০ থেকে। মালিক পক্ষ তখন থেকেই মজুরদের উপর গুণ্ডা এবং পুলিশ দিয়ে হামলা চালানো শুরু করে দেয়। কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয় প্রায় সাড়ে চার হাজার মজুরকে মিথ্যা কেসে জেলে ঢোকানো হয় কয়েকশো জনকে। কিন্তু তাতে আন্দোলনে কোন ভাটা পড়ে না।

এই সময় উদ্যোগপতিরা এক ঘৃণ্যচাল চালে নিয়োগীজিকে ফাঁসিয়ে দেবার জন্য। ৬০ লক্ষ টাকার ইনসুরেন্স করার দেড় মাস পরে আর.কে ইন্ডাস্ট্রিজে আগুন লাগিয়ে দোষ চাপানা হয় নিয়োগীজির উপর। কিন্তু তাদের চালাকি সফল হয় না। নিয়োগীজি সত্য প্রকাশের জন্য সি. বি. আই.তদন্ত দাবি করে বসেন। কয়েক দিন পরে ভিলাই টাইমস এর সাহসী সম্পাদক দেবী দাস এই আগুন লাগানো চক্রান্তে কে বা কারা জড়িত তা তথ্য সহকারে জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। ফলে মালিকপক্ষের গুণ্ডারা তার প্রাণনাশের চেষ্টা করে। ছুরিকাহত হয়ে কোন ক্রমে প্রাণে বাঁচেন তিনি।

যখন অগ্নিকাণ্ডে নিয়োগীজিকে কিছু করা গেল না তখন শোষক শাসক মিলে শুরু করল নতুন ষড়যন্ত্র। ১৯৯১ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ৭২টা সাজানো মামলায় নিয়োগীজিকে গ্রেপ্তার করে জেল কুঠুরিতে বন্ধ করা হল। সারা দেশ এই গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মোর্চার পক্ষ থেকে উচ্চ ন্যায়ালয়ে নিয়োগীজির মুক্তির জন্য আবেদন জানানো হয়। উচ্চ ন্যায়ালয়ের ন্যায়াধীশ নিয়োগীজিকে ব্যক্তিগত মুচলেকায় মুক্তি দিতে গিয়ে টিপ্পনি করেন–নিয়োগী একজন প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক নেতা। সে কারণে ন্যায়ালয় তাকে ব্যক্তিগত মুচলেকায় মুক্তি দেবার আদেশ দিচ্ছে। নিয়োগী এমন একজন মান্যগণ্য মজদুর নেতা যে সর্বদাই সমাজের নিচু স্তরের মানুষের হিতে কর্মরত। তাকে জেলে বন্ধ করে রাখা ন্যায়ের পক্ষে কখনো সঠিক নয়।

এবারও ব্যর্থ হল মালিক পক্ষের চক্রান্ত। এবার উদ্যোগপতিগণ ও বিজেপি সরকার আর এক নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করল। মুখ্যমন্ত্রী সুন্দরলাল পটোয়ার নির্দেশে দ্রুগ জেলাশাসক ১৯ দফা কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়ে ১৮ জুলাই ’৯১ নিয়োগীজিকে ‘জেলাবদর’ করার প্রয়াস শুরু করে। সেই ১৯ দফার কয়েক দফা এই রকম–লাগাতার মজুরদের নিয়ে আন্দোলন, আতঙ্ক ছড়ানো, মজদুরদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার ও আদিবাসী কন্যাকে বিবাহ। এই সব অপরাধের জন্য তাকে ছত্রিশগড় ছেড়ে চলে যেতে হবে।

নিয়োগীজি আবার উচ্চন্যায়ালয়ে আপিল করেন। ন্যায়ালয় এই আদেশের বিরুদ্ধেও স্থগিতাদেশ দেয়। সমস্ত পরিকল্পনা এভাবে ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখে ক্ষিপ্ত উদ্যোগপতিরা এবার নিয়োগীজিকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়। নেপালে গিয়ে অস্ত্র এবং মজফরপুর থেকে ভাড়াটে খুনি পল্টন মল্লারকে নিয়ে আসা হয়।

রাজ্য সরকারের কাছে কোন সুবিচার পাবার আশা আর ছিল না তাই ৫০ হাজার মানুষের সাক্ষর সম্বলিত পত্র এবং ৪০০ জন মজদুর প্রতিনিধি নিয়ে ১০ই সেপ্টেম্বর ‘৯১ দিল্লীতে সুবিচার চাইতে গেলেন নিয়োগীজি। ১১ এবং ১২ দু’দিন শ্রমশক্তি ভবনের সামনে ধর্না দিলেন। কিন্তু শ্রম পুত্রদের আবেদন শ্রমশক্তি ভবনের নিরেট দেওয়াল ভেদ করে কুম্ভকর্ণদের নিদ্রা ভাঙাতে অসমর্থ হল। ১৬ই সেপ্টেম্বর বহু কষ্টে দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু ১ লক্ষ মজুরদের প্রতিনিধিদের জন্য মাত্র ২৫ সেকেন্ডের বেশি সময় বরাদ্দ না থাকায় কোন কথা হল না। নিয়োগীজি দেখা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি এবং বিরোধী দলনেতা লালকৃষ্ণ আডবানীর সাথেও। কিন্তু ভিলাইয়ের লাখ খানেক মজুরের জন্য তারা কোন মাথা ঘামায়নি। উনি তাদের বলেছিলেন নিজের প্রাণনাশের আশঙ্কার কথাও। তাতে কোন ফল ফলেনি।

ফেরবার সময় নিয়োগীজি ২২ ও ২৩শে সেপ্টেম্বর ভিলাইয়ে থেকে সুন্দরলাল পটোয়ার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পটোয়া দেখা করেননি। পটোয়ার মন্ত্রীসভার এক মন্ত্রী প্রস্তাব রাখে যদি নিয়োগী ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেয় তাহলে মজদুর সমস্যার কিভাবে সমাধান করা যায়, দেখা হবে। নিয়োগীজি নিজের বিচার ধারা থেকে সরে আসতে রাজি ছিলেন না। মন্ত্রী তখন আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন এর ফল ভালো হবার নয়। এটাই ছিল হত্যার কার্যকারণ।

নিয়োগীজি ভিলাই ফিরে আসবার সাথে সাথে সক্রিয় হয়ে ওঠে খুনি চক্র। উদ্যোগপতিদের অর্থ অস্ত্র বিভিন্ন দলের রাজনেতাদের সমর্থন এবং শাসক পক্ষের আশীর্বাদে সাহসী ঘাতকদের অপেক্ষা থাকে একটা সুযোগের। সে সুযোগ তারা ২৮শে সেপ্টেম্বর ভোর রাতে পেয়েও যায়। ঘরে শুয়ে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নিয়োগীজি। জানালা খোলা ছিল। খোলা জানালা দিয়ে ওনার বুকে গুলি চালায় ভাড়াটে খুনি।

পোস্ট মর্টেমের পর ভিলাই থেকে দল্লী নিয়ে আসা হয়েছে ওনাকে, এখন উনি শুয়ে আছেন একটা খোলা ট্রাকে শহীদ হাসপাতালের সামনের বড় রাস্তায়।

আমি সামনে গিয়ে অভিবাদন করি। অন্য দিনের মত আজ উনি প্রত্যুত্তরে নিজের বদ্ধমুষ্টি আকাশে তোলেন না। মনে হয় যেন গভীর কোন স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছেন। মুখে এখনো লেগে আছে চির চেনা সেই অমলিন হাসির রেশ। যে হাসি ঘাতকের বুলেটে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। ছিনিয়ে নিতে পারে না। মৃত্যুও পারে না সেই স্বপ্নের সমাপ্তি আনতে–সব জমিতে জল, সব শরীরে স্বাস্থ্য। সব মুখে হাসি। সব জীবনে সুখ। সব মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার।

ইচ্ছা করে এখন আমি আকাশ বাতাস মাটি কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠি–উঠুন নিয়োগীজি উঠে পড়ুন ওই ফুলশয্যা ছেড়ে। অসময়ে এ ঘুম আপনার সাজে না। নিয়োগীজি উঠে দেখুন এখনও সুসজ্জিত লক্ষ পদাতিক আপনার নির্দেশের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে যারা জেগে উঠতে শিখেছিল। চিনতে শিখেছিল ধ্রুব তারা। আপনি ঘুমিয়ে থাকলে কে তাদের পথ চিনিয়ে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবে?

এখনো যুদ্ধ জয় হয়নি। শত্রু দুর্গে শেষ আর্তনাদ না শোনার আগে আপনার বিশ্রাম নেই, ছুটি নেই। দেখুন নিয়োগীজি লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। আপনি ঘুমিয়ে থাকলে কে তাদের চোখের জল মুছে দিয়ে আগুন হবার ইতিহাস শোনাবে। কে বলবে–এই তপ্ত অশ্রু হোক শক্তি, শোকের আগুন জ্বলুক দ্বিগুণ হয়ে।

চারদিকে তাকাই আমি। সমস্ত বাতাবরণ কেমন যেন নিশ্চুপ। তারই মাঝে মানুষের কান্না ভেজা শ্লোগান কমরেড শংকর গুহ নিয়োগী অমর রহে। কখন যেন একটু অসাবধান হয়ে পড়েছিলাম। বুকের মধ্যে থেকে একটা প্রবল জলপ্রপাত আছাড় খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আর তখনই মনে পড়ে গেল আমার নেতা নিয়োগীজির শেষ নির্দেশ—”আমাদের উপর অতীতে অনেক বার হামলা হয়েছে। হয়ত আরো হামলা হবে। এমন ঘটনাও ঘটতে পারে যা শুনে তোমাদের লোমকুপ পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠবে…।

সেই দিন উঠে দাঁড়িও বন্ধু। আর তা না পারলে আমাদের বলিদানের কথা মনে করে ফেলো দু ফোঁটা চোখের জল।”

আমি এখন চোখের জল ফেলছি কেন! আমাকে তো নিয়োগীজি এত নরম এত অক্ষম করে গড়েননি। আমাকে তো ঘটোৎকচের মত শত্রুর সামনে পাহাড় হয়ে দাঁড়াতে হবে। দু হাত যদি চোখের জল মুছতে ব্যস্ত থাকে অস্ত্র ধরবো কি করে!

চোখ মুছে সামনে তাকাই। নিয়োগীজিকে নিয়ে এখন বিশাল এক পদাতিক বাহিনী সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। যেমন ভাবে মানুষকে আগাতে দেখেছি রায়পুর ভিলাই এবং এই দল্লী শহরে। আর মনে হয় না, উনি আমাদের মধ্যে নেই। মনে হচ্ছে পাহাড় নদী মিছিল হয়ে, আকাশ বাতাস স্বপ্ন হয়ে–সংগ্রামী মানুষের প্রেরণা বিজয় ভবিষ্যৎ হয়ে মিশে গেছেন।

বাংলার এক কবি লিখেছিলেন–বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন। এখন শ্রেণিশত্রুর প্রতি তীব্র ক্রোধে মনে হয় আমিই শংকর গুহনিয়োগী। তার আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করার দায় ভার আজ আমার কাঁধে।

আমি ঠিক জানি না কখন আমার মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে উঠে যায় এবং সূর্যকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করে–নিয়োগীজি তোমায় লাল সেলাম। তোমার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার ভার আমার। এবং আমাদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *