০৪. কার্তিকের ব্যাপারটা

কার্তিকের ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশও খুব একটা তৎপর হয়নি। হলে আমাকে ধরে ফেলা তাদের কাছে কঠিন কিছু ছিল না। আমি তো এই যাদবপুরেই ছিলাম। হয় স্টেশন, নয় টিবি হাসপাতাল। আমি তখন টিবি হাসপাতালেই বেশি সময় কাটাতাম। টিবি হাসপাতালের পূর্বদিকে একেবারে শেষ মাথায় ময়লা পোড়ানো চুল্লি। চুল্লির সামনে থেকে একটা সরু রাস্তা যার বাঁদিকে একটা পুকুর, এতে নানু মাছ চাষ করে, আর ডান দিকে একটা ডোবা, এতে হাসপাতালের যত নোংরা জল এসে পড়ে। ফলে ডোবায় বিজবিজ করে নানারকম পোকা, সাপ, ব্যাঙ। ডোবার মধ্যে কিছু হোগলা বনও আছে, কিছু গানাও।

এই পুকুর আর ডোবার মাঝখান থেকে সরু পথটা গিয়ে মিশেছে রাজা সুবোধ মল্লিক রোডের পাশ থেকে যে বড় জল নিকাশি নালা কামারপাড়া থেকে ধাপার দিকে চলে গেছে সেই নালার পাড়ে। যার ওপারেই সেই রামকৃষ্ণ উপনিবেশের কালী মন্দির। যে মন্দিরের যজ্ঞের কাঠ আমার কপাল পুড়িয়ে ছিল।

এই ডোবার পাশে, নালার ধারে ঢোল কমলিসহ নানা আগাছা পূর্ণ। পাশে আছে একটা জমাদার বস্তি। তারা শুয়োর পোষে, কুকুর পোষে, মদ খায়, ঝগড়া মারামারি করে। পরিবেশটা সবদিক থেকে নোংরা, প্ৰদূষিত। ফলে মানুষ এই দিকটায় পারতপক্ষে আসতে চায় না। আমি আসি। অন্য জায়গার চাইতে আমার এই জায়গাটা সবদিক থেকে নিরাপদ মনে হয়। নানু তো আছেই, এ ছাড়া আমার আর কয়েকজন বন্ধু হয়েছে, যারা হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় সুইপার। ওয়ার্ডবয় বন্ধুরা রোগীদের জন্য খাবার ঘর থেকে যে খাবার নিয়ে আসে, রোগীদের মুখে রুচি থাকে না বলে তা প্রায়দিনই অল্পসল্প বেঁচে যায়। যা ফেলে দেবার নিয়ম। ওরা কায়দা করে আমার পাতে ফেলে দেয়। নানুর চোলাই মদের ঠেক আছে। সেখান থেকে এক আধ গেলাস আমাকে দেয়। গণেশ গোপাল জলিল মাঝে মধ্যে পাঁচদশ পয়সা উঁদা তুলে আট আনা এক টাকা আমাকে সাহায্য করে। দিন আমার এভাবে কাটে। রাত কাটে আগে যে ঘরে মৃতদেহ রাখা হোত, এখন নানুর মদের ঠেক সেই লাশ ঘরের ভিতরে বা ছাদে।

টিবি হাসপাতালের পিছন থেকে যে নোংরা নালাটা রাজা সুবোধ মল্লিক রোডে গিয়ে মিশেছে, সেটা ধরে যাদবপুরের দিকে এসে বাঁদিকে যে পাড়া আগে এখানে বেশ কিছু মিস্ত্রি বাস করত। যে কারণে এর নাম হয়েছিল মিস্ত্রি পাড়া। এখন সেখানে বাবুশ্রেণির কিছুলোক বড়বড় বিল্ডিং করেছে। তারা মিস্ত্রি পাড়ায় থাকি বলতে খুবই বিব্রত বোধ করে। তারা এর নাম দিয়েছে কালীবাড়ি লেন। এই একই কারণে শ্যামা কলোনির লোকও পাড়ার নাম বদলে শ্যামাপল্লী করে নিয়েছে। তো সেই মিস্ত্রি পাড়ায় থাকে একটা ছেলে যার নাম বাবলু। ফরসা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বাবলু আগে টিউবয়েল মিস্ত্রির কাজ করত। কীভাবে কে জানে ও সিপিএম পার্টিতে ভিড়ে যায়। বড় মাপের দু-তিনখানা কেস চাপে ওর নামে। যার ফলে এখন পুলিশ আর কংগ্রেস ওকে হন্যে হয়ে খোঁজে। সিপিএম পার্টির নেতাকর্মী যারা আর্থিক দিক থেকে সবল তারা তো সব এলাকা ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু যাদের কোথাও গিয়ে থাকা খাওয়ার জায়গা নেই প্রাণ হাতে করে রয়ে গেছে পাড়ায়। নানু, বাবলু এবং কার্তিক সেই রকম লোক।

বাবলু সারাদিন কোথায় লুকিয়ে থাকত তা জানি না। তবে বিকেল হলে সে চলে আসত টিবি হাসপাতালের ময়লা পোড়ানো চুল্লির কাছে। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে আমাদের আড্ডা চলত। আড্ডায় প্রায়ই বাবলু আক্ষেপ করে বলত–শালা পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়েস হয়ে গেল। এখনও একটা মেয়ের শরীর কেমন তা জানা হল না। পুলিশের হিট লিস্টে আছি। আজ যদি বুকে একটা গুলি লাগে আর কোনদিন জানা হবে না।

যদিও তখন আমরা বাবলুকে নানারকম ঠাট্টা তামাশা করতাম। বলতাম মরার পরে ভগবানকে বলিস তোকে যেন পরের জন্মে মোরগ বানায়। তাহলে এ জীবনে যা পাওয়া বাকি রইল মোরগ জনমে একশোগুণ বেশি পেয়ে যাবি। কিন্তু সত্যি এটাই যে ওই আক্ষেপ আমাদের মনেও ছিল। টের পেতাম আমার বুকেও তৃষ্ণা, প্রবল তৃষ্ণা আছে। কেউ আমাকে ভালোবাসুক, আমি কাউকে ভালোবাসি। সে আমাকে তার সবকিছু দিক। আমার সব কিছু চেয়ে কেড়ে নিক। তখন চারদিকে পাইকারি হারে মানুষ খুন হচ্ছিল। মনের মধ্যে তখন এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গিয়েছিল আমিও খুব বেশিদিন বাঁচব না। খুব বেশি হলে এই দশক। জীবনটা, যৌবনটা নারী শরীরের স্বাদ থেকে বঞ্চিত রয়ে যাবে। এই ধারণা–ওই তৃষ্ণা, তীব্রতর হয়ে উঠেছিল বাবলু বুকে গুলি লেগে মরে যাবার পর। মনের সেই দুর্বলতার ফোঁকর গলে সেই সময় আমার জীবনে অনুপ্রবেশ করে গেল একটা মেয়ে। না মেয়ে নয়–এক মহিলা। গোলাবাড়ি থানার গোলক সরদারের পরিত্যক্ত স্ত্রী, বারুইপুর থানার পাগলা সরদারের মেয়ে। যে বয়সে আমার চেয়ে দু-তিন বছরের বড় মনের দিক থেকে অনেক পরিণত এবং সাহসী।

সেদিন জমাদার বস্তিতে কী যেন এক পরব ছিল। শুয়োর মারা হয়েছিল। নানুর ঠেকে খুব মদ বিক্রি হচ্ছিল, চলছিল তাসের জুয়া। একজন আশি টাকা জিতেছিল। যা থেকে মুড়ি চানাচুর খাবার জন্য আমাদের দু-চার টাকা দিয়েছিল। একটা খবরের কাগজের উপর মুড়িমাখিয়ে আমরা খাচ্ছিলাম। আমরা বসেছিলাম চুল্লির সামনে সেই ডোবা আর পুকুরের মাঝের সরু পথটার উপরে। তখন সন্ধ্যে ঘনাচ্ছিল। চারদিকে ছেয়ে গিয়েছিল একটা আবছা অন্ধকার। চেনা মুখগুলোকে অচেনা বলে মনে হচ্ছিল। আর অচেনা মানুষগুলোকে চেনা। সেই সময় যাদবপুর থানার ওসি ছিলেন জনৈক পালবাবু। শোনা যায় উনি নাকি একশো গজ দূর থেকে গুলি করে মাটিতে রাখা আধুলি উড়িয়ে দিতে পারেন। লোকাল ইনফর্মারের মাধ্যমে খবর পাওয়া মাত্র একটা জিপে চার জন সাদা পোষাকের সঙ্গী নিয়ে পৌঁছে গেলেন টিবি হাসপাতালের গেটে। সেখানে জিপ থেকে নেমে আবছা অন্ধকারে গা ঢেকে হেঁটে হেঁটে গিয়ে থামলেন চুল্লির এপাশে। আমাদের একেবারে একশো গজের মধ্যে।

আমি বসেছিলাম রাজা সুবোধ মল্লিক রোডের দিকে পিঠ রেখে কামারপাড়ার দিকে তাকিয়ে। ওদিকে আমার ভয়। কার্তিকের ভাই, মণি, শিবশংকর এলে ওদিক থেকে আসতে পারে। বাবলুর পিঠ ছিল কামারপাড়ার দিকে। চোখ খাল যেখানে গিয়ে রাজা সুবোধ মল্লিক রোডে মিশেছে। ওর ভয় ছিল বিজয়গড়ের ছেলেরা ওদিক থেকে আসতে পারে। নানুর পিঠ রামকৃষ্ণ উপনিবেশের কালী মন্দিরের দিকে। চোখ চুল্লির ওপাশে যেখানে লাশঘর সেদিকে। নানুর চোলাইঠেকে খদ্দের যাচ্ছে, আসছে। মাল বিক্রি করছে বাচ্চা দিলীপ। কেউ কোন ঝামেলা পাকাচ্ছে কিনা সেটা নজর রাখছে সে। যেদিকে কারও দৃষ্টি ছিল না, বিপদ এসেছে সেইদিক থেকে।

বাবলুর পরিধানে লুঙ্গি আর গায়ে গলাবন্ধ সাদা গেঞ্জি। যে গেঞ্জি অন্ধকারে চর্চ করে। ফলে পাল বাবুর নিশানা করতে কোন অসুবিধা হয়নি। বাবলুর চওড়া বুকে একশো গজ দূর থেকে নির্ভুলভাবে গেঁথে দিতে পেরেছেন থ্রি এইট ক্যালিভার রিভালবারের এক গুলি। গুলি খেয়ে ওহঃ আওয়াজ করে বাবলু উল্টে গেল পোনাপুকুরের নীল জলে। পালবাবু একটু এগিয়ে আর একটা গুলি চালালেন। নীল জল লাল করে বাবলু তলিয়ে গেল জলের তলায়।

আমি মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম আমার পিছনের সেই পুঁজ রক্ত পায়খানা প্রস্রাব পোকামাকড় পানা হোগলা বোঝাই ডোবায়। পচাপাকে শরীর ডুবে গেল আমার। তবে পালবাবুর খতম তালিকায় আমার নাম ছিল না। তাই আমার দিকে কোন গুলি ছোড়েনি। ধরবারও চেষ্টা করেনি। গুলির আওয়াজ শুনে মেনগেটে থেমে থাকা জিপ দ্রুত চলে এল চুল্লির কাছে। যাকে মারার টার্গেট ছিল মারা হয়ে গেছে, পালবাবুরা জিপে চেপে ফিরে চলে গেলেন। চারঘন্টা মরার মত পড়েছিলাম সেই পুতিগন্ধময় নরকে। লাশ কাটা ঘরের বেওয়ারিস লাশের মত পোকা কুরে কুরে খেয়েছিল আমাকে। জোঁক লেগেছিল গায়ে পনের কুড়িটা। জীবিত অবস্থায় যেন সেদিন। লাশ হয়ে গিয়েছিলাম।

পরের দিন সকালে নানু পালিয়ে চলে গিয়েছিল তার বোনর বাড়ি মেদিনীপুরে। প্রায় ছয়মাস সে আর যাদবপুরের দিকে আসেনি। পালাতে তো আমাকেও হবে। যার সব চেয়ে বড় ভরসায় হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেইনানু নেই। আমি কী করে থাকি। একজন লোকের সহায়তায় এবার আমি “ঠেক” নিলাম শিয়ালদহে।

আমার পদবি ব্যাপারী। কিন্তু আমি তো আমি, আমার বাপ পর্যন্ত কোনদিন ব্যবসা করেনি এবার আমি ব্যবসায় নামলাম। পুঁজি মাত্র কুড়ি টাকা। এই কুড়ি টাকা দিয়ে কোলে মার্কেট থেকে কুড়িটা নারকেল কিনে এনে গির্জার সামনে ফুটপাতে বিক্রি করি। যা দু-এক টাকা লাভ হয় তা দিয়ে কোনদিন মুড়ি আলুর দম কোনদিন ঘুগনি রুটি খেয়ে ওই ফুটপাতে গামছা বিছিয়ে শুয়ে থাকি। এই সময়ই এখানে আমার সাথে দেখা হয় শিবু রায়চৌধুরি, মোহিত বর্মন, যতীনের। আর দেখা হয় সেইসব কিছু মেয়ের যারা আগে যাদবপুরে বাবুদের বাসায় কাজ করত। এখন কুখ্যাত “হাড়কাটা” গলিতে মুখে পাউডার হাতে কাঁচের চুড়ি পরে সন্ধ্যা বেলায় লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লেখক সুবোধ দাস এই সব যৌনকর্মীদের যন্ত্রণা লাঞ্ছনা নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। কিন্তু উনি যাদের দেখেছেন তারা সেইসব মেয়ে যারা একরাতের পারিশ্রমিক দিয়ে ফ্রিজ-কালার টিভি কিনতে পারে। উনি দেখেননি সেই অভাগা মেয়েগুলোকে যারা বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গলিতে দাঁড়িয়ে থেকে আমার কাছে এসে কাঁদত–দাদারে, আজ বউনি হয়নি, একটা পাউরুটি কিনে দিবি? কে লিখবে তাদের কথা?

একদিন বিকেলে সবে নারকেল এনে ফুটপাতে সাজিয়ে বসেছি এমন সময় পেটটা চিনচিন করে উঠল। গতরাতে যে আলুর তরকারি রুটি খেয়েছি এ তারই অ্যাকশান। তখন পাশের এক সবজিঅলাকে বলি–ভাই আমার মালটা একটু দেখো। আমি পায়খানা করে আসি। পায়খানা কোলে মার্কেটের মধ্যে। সে এমন নোংরা যে গা ঘিন ঘিন করে। যাতে সর্বদা পড়ে থাকে লম্বা লাইন। লাইন দিয়ে তিনচার জনার পরে যখন ক্লেশমুক্ত হয়ে ফিরে এলাম, দেখলাম, ফুটপাতে বহু মালপত্র ছড়ানো ছিটানো, আর আমার নারকেল কটা নেই। সে সব “হল্লাগাড়ি” এসে তুলে নিয়ে চলে গেছে। আমার পাশের দোকানদার তার নিজের ঝুড়ি মাথায় তুলে ছুটে পালিয়েছিল। তবু সবটা রক্ষা করতে পারেনি। আমারটা সামলাবে কী করে? এখন মুচিপাড়া থানায় গিয়ে গোটা পনের টাকা ঘুষ দিয়ে ওগুলো ছাড়িয়ে আনা যায়, না হলে সব বাজেয়াপ্ত। কিন্তু আমার কাছে তখন যে পনের পয়সাও নেই। তাই শেষ হয়ে গেল ব্যবসা। বেকার হয়ে গেলাম আবার।

.

এবার আবার আমার এখানে ওখানে শুরু হল পুকুরের পানার মতো ভেসে বেড়ানো। ভাসতে ভাসতে একদিন পৌঁছে গেলাম গড়িয়ার বোড়াল রোডে। এখানে একটা পাম্পে বহু ট্রাক থাকে। যারা ইট বালি মাটির ট্রিপ মারে। কিছু ট্রাক ট্রান্সপোর্টে খাটে। ট্রাকে কাজ করা এক চেনাজানা বন্ধু যে আগে রিকশা চালাত তার মাধ্যমে আমিও একটা ট্রাকে খালাসির কাজ পেয়ে গেলাম। এই গাড়ির মালিকের নাম কাল্টু মুখার্জী। গাড়ির নাম্বার ডব্লু.এম.কে ৪৮১০। এই গাড়ি ট্রান্সপোর্টের মাল বয়। আসামে যায় মাল নিয়ে ফেরে মাল নিয়ে।

একদিন চলেছি আসাম। পোস্তা থেকে রওনা দিয়ে বেলা দুটো নাগাদ পৌঁছেছি আমডাঙার পেট্রলপাম্পে।হঠাৎ মনে পড়ে গেল ড্রাইভারেরমস্ত ভুল হয়ে গেছে। আসামের যে রোড পারমিট সেটি বাড়িতে রেখেই চলে এসেছে। এই কাগজ কাছে না থাকলে আসামে ঢোকাই যাবে না। তখন সে আমাকে বলে–গাড়ি পাম্পে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি। তুই গিয়ে কাগজটা নিয়ে আয়।

তখন বিকেল। আমডাঙা থেকে চেপে বসলাম একবাসে। কোথা থেকে কীভাবে কলকাতায় পৌঁছানো যাবে। সে সব বলে দিয়েছে ড্রাইভার। তার নির্দেশমত একটা মোড়ে এসে বাস থেকে নেমে পড়লাম। এখান থেকে অন্য বাস ধরতে হবে। এখানে একটা ধাবা আছে যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দশবারোটা পাট বোঝাই ট্রাক। যখন এখানে পৌঁছেছি সন্ধ্যা উত্তরে গিয়েছিল। বাতাসে একটু শীত শীত ভাব। কিন্তু অপেক্ষায় থেকে থেকে রাত বেড়ে গেল। কলকাতা যাবার মতো কোন বাস এল না। ফলে রুটি তরকা খেয়ে বাবার এক খাঁটিয়ায় পড়ে রইলাম সারা রাত।

যখন ভোর তিনটে তখন দেখি একটা পাটবোঝাই ট্রাক রওনা দিচ্ছে কলকাতার দিকে। তখন ড্রাইভারকে বলি–আমি গাড়ির খালাসি। কলকাতায় যাব। আমাকে একটু নিয়ে যাবে? গাড়ির লাইনে পারস্পরিক সহযোগিতার ভাবনা বড় প্রবল! সব শুনে সে রাজি হয়ে গেল। আমি গিয়ে বসলাম ড্রাইভার কেবিনের বাঁদিকের দরজার কাছে। সারারাত ঘুমাইনি। একটু ঘুম ঘুম পেয়ে গেল যখন চোখ খুললাম তখন দেখি ট্রাক কলকাতা পৌঁছে গেছে। এখন পার হচ্ছে গিরিশ পার্ক। আমি জানি, এখান থেকে এইট বি বাস ধরা যাবে। এটা ধরে যাদবপুর যাওয়া যাবে। সেখান থেকে অন্য কোন বাস ধরে গড়িয়া পৌঁছাতে পারব। তাই চিৎকার করে উঠলাম–থামো থামো। আমি নামব।

তখনও ভোরের আলো ঠিকমত ফোটেনি। চারদিকে জমে আছে একটা ছাইছাই পাতলা অন্ধকার। যার উপর আবার কুয়াশার হালকা আস্তরণ। সকাল বেলার হিম বাতাসে ড্রাইভারের চোখেও হয়ত একটু ঘুমের ঘোর লেগে গিয়ে থাকবে। সেই ঘোরে সে ব্রেকের উপর পা তুলে দিল। গাড়ি পুরো থামাবার দরকার ছিল না। একটু গতি কমে যেতেই আমি লাফিয়ে নিচে নেমে গেলাম। সাথে সাথেই ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে দিল।

গিরিশ পার্ক পার হয়ে ট্রাক যেখানে থেমেছিল সেটা একটা চৌরাস্তার সংযোগস্থল। আমরা যাচ্ছিলাম পশ্চিম থেকে পূর্বে। আর আমাদের দক্ষিণদিকের রাস্তা ধরে উত্তরে যাচ্ছিল একটা ট্রাম। ট্রামের চালক ট্রাকের গতি কমে যেতে দেখে মনে করেছে এটা বোধহয় থেমে যাবে। তাই সে ট্রামের গতি হ্রাস বা থেমে যাবার প্রয়োজন আছে মনে না করে দ্রুত পার হয়ে যাবার চেষ্টা করল রাস্তাটা। পার হয়ে প্রায় চলেও গিয়েছিল কিন্তু শেষরক্ষা হল না। তার আগেই ট্রাকটা গিয়ে ঠুকে দিল ট্রামের পিছনে। খুবই ছোট ধাক্কা দিয়ে ট্রাকের চালক একটু ডানদিকে কাটিয়ে সামনে ছুটে চলে গেল।

ভোরবেলার ফাঁকা ট্রাম। এ ধাক্কায় তার বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। শুধু লাইনচ্যুত হয়ে গড়িয়ে গেল সামনে-ডানদিকে কিছুটা। এ সময় উত্তরদিকের রাস্তা ধরে দ্রুত ছুটে আসছিল একটা বারো সি বাস। যার পেটে ঠাসা ছিল বহু যাত্রী। এরা সবাই বস্ত্র ব্যবসায়ী। সব যাচ্ছিল মঙ্গলার হাটে যে যার সম্ভার নিয়ে বিকিকিনি করবে বলে। কে জানে, যে ভুল ট্রামের চালক করেছিল, সম্ভবতঃ একই ভুল বাস চালকও করে থাকবে। ভেবে থাকবে ট্রাক থেমে গেছে। কুয়াশা আর আবছা আলোয় দৃষ্টি বিভ্রম ঘটে গিয়ে থাকবে তার। ভেবে থাকবে এই ফাঁকে পার হয়ে যেতে পারবে পথটা। তাই গতিবেগ না কমিয়ে দ্রুত ছুটে এসেছিল। কিন্তু তখন তার পথ আটকে দিয়েছে লাইনচ্যুত ট্রাম। সে গড়িয়ে গিয়ে গুতো মেরে দিল বাসের পেটে। দুবার পাক খেয়ে বাসটা উল্টে গিয়ে পড়ল বাদিকের ফুটপাতে, একটা লাইট পোস্টের উপরে। সেটা বেঁকে নুয়ে পড়ল। মুহূর্তে উগ্র ডিজেলের গন্ধের সাথে মানুষের রক্তের ঢল নামল রাস্তার উপর। বাসের ছাঁদে রাখা কাপড়ের গাঠরি, কন্ডাক্টরের ব্যাগের রেজগি টাকায় ছড়াছড়ি। আহত মানুষের আর্ত চিৎকার। পথচারী মানুষের ছোটাছুটি। চোখের পলকে সকাল বেলায় শান্ত পরিবেশ ছিন্নভিন্ন বিদ্ধস্ত।

কী বিভৎস জীবন আমার। আমি চাই না। তবু রক্ত ধ্বংস চোখের জল মৃত্যু এসব যেন আমার পিছনে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যা থেকে মুক্তি নেই। বিপদাপন্ন মানুষের সম্মিলিত কান্না গোঙানি, সাহায্য প্রার্থনার সেই অশুভ সকাল, অনেককটা মৃত্যু বেশ কিছু মানুষের পঙ্গুত্বের দায়ভার আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে গেল বিনা কারণে।

.

গাড়ির লাইনে দুর্ঘটনা, মৃত্যু এসব তো দৈনন্দিন ঘটনা, এছাড়া আছে চোর ডাকাত। হাইরোডে চলাচল করলে এসব ঝুঁকি নিয়েই চলতে হবে। দিন কয়েক আগে লালি নামের এক ডাকাত চার চারজন লোককে খুন করে এক গাড়ি চা পাতা ডাকাতি করে ধরা পড়ে গেছে। একগাড়ি চা পাতার দাম দেড় লক্ষ টাকা। সেই ৭৩-৭৪ সালে এটাকা অনেক টাকা। সে তুলনায় এক ড্রাইভার আর এক খালাসির জীবনের দাম আর কতটুকু। ওরা দুজনকেই মারবে ভেবেছিল সেই ভেবেই গাড়িটা ধরেছিল। জানত না, আর একটা দুর্ঘটনায় পড়া গাড়ির চালক ও মালিক মাঝপথে এই গাড়িতে উঠে পড়েছে। বাধ্য হয়েই চারজনকে।

আসাম যাবার পথে এক জায়গায় তিরিশ কিলোমিটার লম্বা ঘন জঙ্গল পড়ে। যতদূর মনে আছে খুব সম্ভব হাতিমারা বা হাসিমারা নামে। রাত আট-নটার পরে সেই জঙ্গলের পথে কারও একা যাবার সাহস হয় না। এখানে কত যে গাড়ি উল্টে দিয়ে ডাকাতরা সব মাল নিয়ে চলে গেছে তার কোন হিসেব নেই। আমাদের গাড়িতেও আসাম থেকে চা পাতা আসে। যে কোন সময়ে কোন লালি পথরোধ করে দাঁড়াতে পারে। এত ভয় এত বিপদ মাথায় নিয়ে মাত্র পচাত্তর টাকা মাইনে আর ছয়টাকা খোরাকিতে কাজ করছিলাম। যে কাজে চব্বিশ ঘণ্টা নিযুক্ত থাকতে হয়, সারারাতে তিনচার ঘণ্টার বেশি বিশ্রাম মেলে না। আশা করেছিলাম কোনমতে ড্রাইভারিটা শিখে যদি একটা লাইসেন্স বানিয়ে নিতে পারি তাহলে হয়ত আগামী দিনগুলো একটু ভালোভাবে কাটবে। এ গাড়িতে সে সুযোগ মেলে না। কিন্তু এ জন্যে ড্রাইভারকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। কলকাতা থেকে আটটন মাল ভর্তি করে ট্রাক আসামে যায়, ফেরেও আটটন নিয়ে। ভর্তি গাড়িতে এক নতুন শিক্ষার্থীর ট্রেনিং কী করে দেবে? সেটায় বেশ ঝুঁকি। তাই সে বলে একদিন–ড্রাইভারি শিখতে চাইলে তোকে লাইনের গাড়ি ছেড়ে লোকাল গাড়িতে উঠতে হবে। এতে সুযোগ পাবি। যাবে মাল নিয়ে আসবে খালি, তখন।

এবার সে গাড়ি ছেড়ে যে গাড়িতে উঠলাম সেটা বেডফোর্ড কম্পানির পুরানো জে. সিক্স মডেলের একটা লরঝরে গাড়ি। এই গাড়িতে বেশির ভাগ দিন সিঙ্গুর তারকেশ্বর থেকে বালি আসে। বালি নিয়ে বাবুঘাটে দাঁড়িয়ে থাকলে যার দরকার দরদাম করে কিনে নিয়ে যায়। এ গাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। রোজ বালি নিয়ে ফেরার সময় পথে একবার চাকা লিক হবে, না হয় স্টার্ট নেবে না। ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে কেনা এই গাড়ি নতুন অবস্থায় যতট্রিপ মেরেছে, সব দুহাতে খরচ করেছে গাড়ির মালিক। এখন আর গাড়ি মেরামত করবার পয়সা নেই। তাই এই দশা।

একবার এই গাড়ি ভাড়ায় নিয়ে কিছু সবজি ব্যাপারী–এখন আর নামটা মনে নেই, সেই হাটে গেছে সবজি কিনতে। ওখানে পাইকারি বাজারে সবজি খুবই সস্তা। যাবার সময়ে গেছি বেশ ভালো কিন্তু ফেরবার সময়ে এসে গেল এক মহাসমস্যা।

রাত তখন মনে হয় প্রায় দশটা-এগারোটা। উত্তর চব্বিশ পরগণার সেই হাট থেকে রওনা দিয়ে আমরা পৌঁছেছি দমদমে। তখন সবাই স্থির করল পরে কোন হোটেল পাওয়া যাবে কী যাবে না, এখানেই খেয়েদেয়ে নেওয়া যাক। হোটেল একটা সামনেই ছিল। আমরা যখন খেয়েদেয়ে গাড়িতে উঠেছি, গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ছয় আট জনের একটা দল। তাদের দাবি একশো টাকা দিতে হবে। কীসের চাঁদা ভাই? ”রাম” বাবুর পূজা! আমাদের গাড়ির চালকের নাম বৈশাখু। সে সাদাসিধা লোক বলে কুড়ি টাকা দিতে পারি। এর বেশি আমার কাছে নেই। কিন্তু তারা মানবে না। এতলোক আমরা কুড়ি টাকায় কী হবে। এক সময়ে তাদের সাথে আমার তর্কাতর্কি বেধে গেল আর তখন তারা আমার গেঞ্জি ধরে টেনে আমাকে কেবিন থেকে নিচে নামাতে চাইল।

আমি বসে আছি ড্রাইভারের বাঁদিকে। আমার পায়ের কাছে সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় প্রস্তুত রাখা রয়েছে জ্যাক তোলা রডখানা। আমি সেটা নিয়ে নিচে নামি। আর সামনের জনের ঘাড়ে বসিয়ে দেই সজোরে। একজন পড়ে যেতেই বাকিরা ছুটে পালায়। আমি তখন চিৎকার করে ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট করতে বলি। কিন্তু হায় আমার কপাল, সেলফ স্টার্টর তখন ফেল মেরে গেছে। আর স্টার্ট নিচ্ছে না। যতবার ড্রাইভার চাবি ঘোরায় খরর খর খরর খর করে থেমে যায়।

পালিয়ে গিয়েছিল যারা, দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখে তাদের মনে সাহস ফিরে এল। আর তারা তখন হাতের কাছে লাঠিসোটা যে যা পায় নিয়ে ফিরে আসে। নিচে তো আমি একা, গাড়ির আরোহীরা সব হুডের উপরে বসে কাঁপছে। কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না। ওরা প্রবল উৎসাহে একযোগে আমার উপর হামলা করে দেয়। আমি একা ওদের সাথে পেরে উঠি না। লাঠির একটা আঘাত লেগে আমার ডান হাতের মাঝের আঙুলটা ফেটে যায়। হাতের রডটা ছিটকে যায়। আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে না পেরে আমি পেছোতে পেছোতে গাড়ি থেকে বেশ খানিকটা পিছন দিকে সরে যাই। আর তখনই গাড়ি স্টার্ট হয়ে গেল। এবং সেই রাতের অন্ধকারে শুনশান সড়কে একদল মারমুখি লোকের সামনে আমাকে একা ফেলে তারা উধাও হয়ে গেল।

এখন আমি কী করি। তখন আমার একটাই করার মত ছিল–দৌড়। তাই করি আমি। পিছন দিকে দৌড় মারি। ওরা ধর ধর চোর চোর বলে পিছনে ধাওয়া করে। তবে আমার নাগাল পায় না। আমি দৌড়ে দৌড়ে নানা পথ ঘুরে শেষে রেল স্টেশনে গিয়ে উঠি। সারারাত সেখানে বসে থেকে ভোরবেলা এসে নামি শিয়ালদহে। ফের সাউথ সেকশানে এসে ট্রেন ধরে গিয়ে নামি গড়িয়া স্টেশনে। তারপর হেঁটে হেঁটে গিয়ে পৌঁছাই গড়িয়ার পেট্রল পাম্পে। যেখানে আমাদের গাড়ি থাকে।

তখন খবর পেয়ে গাড়ির মালিক এসে গেছেন। থানায় যাবার তোড়জোর করছেন। সেটা তো তাকে করতেই হবে। এমন সময় সশরীরে আমাকে উপস্থিত হতে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। সবার মুখে যা শুনেছেন তাতে তার ধারণা হয়েছিল যে আমি এতক্ষণে হাড়গোড় ভেঙে ‘দ’ হয়ে কোথাও পড়ে আছি। একটু ধাতস্থ হবার পরে বলেন তিনি আমার সাথে থানায় চল। একটা ডায়েরি করে রেখে আসি। এটা খুব দরকার।

থানা মানে সোনারপুর থানা। এখন সময়টা বদলে গেছে। যে শ্যামাকলোনির দাদা আমাকে মেরেছিল, নকশাল আমলের সেই প্রবল মত্ততার দিনে যাকে আমি বাগে পেয়ে পেটে চাকু ঠেকিয়ে পুরাতন অপরাধের জন্য ক্ষমা যাচনা এবং প্রাণভিক্ষা চাইতে বাধ্য করেছিলেম, শুনেছি, সে এখন চাকরি পেয়ে সোনারপুর থানার এ.এস.আই। এখন তার হাতে প্রচুর ক্ষমতা। যদি সে এখন থানায় থাকে যে সম্ভাবনা বড় প্রবল, আমাকে নাগালে পেয়ে আর যদি না ছাড়ে? এই কেসে না হোক অন্য কোন কেসে নিশ্চয় জুড়ে দিয়ে জেলে পাঠাবে। এ সব পুলিশেরা করে থাকে। তার আগে গায়ের ঝাল মেটাতে খানিকক্ষণ প্রাণভরে পিটিয়ে নেবে।

এইসব কথা ভাবছিলাম মালিকের সাথে থানার দিকে যেতে যেতে। ফলে থানা থেকে কিছুটা দূরে পা থমকে গেল আমার। বলি–আমি থানায় যাব না। কেন রে? মালিকের অবোধ জিজ্ঞাসার জবাবে আমি বলি–অসুবিধা আছে! কী অসুবিধা? বলা যাবে না। তারপরই এক ছুটে মিশে গেলাম পথচলা জনতার ভিড়ে। মালিক অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল পলায়নপর আমার দিকে। শেষ হয়ে গেল আমার ট্রাক চালক হবার সব সম্ভাবনা।

এবার আমার ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?

এটা সেই সময়ের কথা। তখনও বাবলু মারা যায়নি। এক সন্ধ্যায় প্রচুর মদ খেয়েছিলাম। আসছিলাম স্টেশনের দিক থেকে। তখনই দেখা হয়ে গিয়েছিল সেই মহিলার সাথে। ও নব নগরে দুই তিন বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে। টিবি হাসপাতালের সেকেন্ড গেট থেকে ঢুকে ওপাশের ভাঙা পাঁচিল গলে স্টেশনে পৌঁছাবার ইচ্ছা ছিল তার। তখনই আমার সাথে দেখা হাসপাতালের ক্যান্টিনের সামনে। যারা রোজ গ্রাম থেকে শহরে আসে রোজ ফিরে যায় সেই ট্রেন যাত্রী কমবেশি সবাই আমাকে চেনে। তাদের কোন সমস্যা হলে আমাকে বলে। সাধ্যমত তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। তবে পুরুষের তুলনায় মেয়েদের সমস্যা বেশি বলে তাদের সাথে আমার নৈকট্যও বেশি। এই মহিলার মাসি একদিন এসেছিল আমার কাছে তার স্বামীকে একটু সাইজ করার জন্য। যে তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা মাগি নিয়ে এই যাদবপুরে ঘরভাড়ায় রয়েছে। সেদিন মাসির সাথে এ-ও ছিল। তখন থেকে চেনা। মাঝে মাঝে একটা দুটো কথাবার্তা।

এখন দেখা হতেই বলে সে তোমার সাতে আমার এটা গোপন কথা ছেলো। বলি, বলো কী কথা?–এখেনে নয়, এটু ফাঁকার দিকে চলো। সেখেনে গে বলবো।

তখন সন্ধ্যা হচ্ছে। এই সময়ে আর তেমন ফাঁকা কোথায়? সে আছে এক সেই বড় নালার পাড়ে। সেখানেই নিয়ে বসাই তাকে। বলল কি বলবা? তখন একটু লাজুক হেসে চোখে কটাক্ষ হেনে বলে সে–আমি ঠিক করিচি এট্যা লাবমেরেজ করবো। একটা কেন সে দশটা করতে পারে। তবে তার কপালে সিঁদুর হাতে শাখার বদলে সস্তার সাদা চুড়ি। যা বিবাহিত হিন্দু রমণীর চিহ্ন। তাই বলি–তোমার তো বিয়া হইয়া গ্যাছে। আবার বিয়া?

মুখ বাঁকিয়ে বলে সে–যা হয়েছে তারে বে বলে নাকি! এ্যাক মাসও সোমসার করিনি। খানকির ছাবাল পেলিয়েছে।

এটা সে মিথ্যা বলেনি। সত্যিসত্যি তার বিবাহিত জীবনের সময়কাল একমাসের বেশি নয়। এর বাপ পাগলা সরদার প্রতিবছর চাষের সময় দুমাস যে বাড়িতে চাষের কাজ করে সেই বাড়িতে বারোমেসে ছিল গোলাবাড়ির গোলক সরদার। পাগলা সরদারের চেয়ে গোলক সরদার বয়েসে কিছু ছোট হলেও দুজনের ছিল গভীর বন্ধুত্ব। রোজ কাজের পরে একসাথে বসে তাড়ি খায় আর সুখ দুঃখের কথা বলে। তখন একদিন গোলকের মনে হয় তাদের এই বন্ধুত্বকে একটা চিরস্থায়ী রূপ দেওয়া দরকার। তাই বলে সে-পাগলা দা, আজ থেকে তোরে আর দাদা বলবুনি। বাপ বলবো। যদি তুই মত দিস, এ্যাক পয়সা পন নিবুনি, তোর মেয়েরে আমি বে করবো। পাছে নেশা কেটে গেলে বেঁকে বসে তাই তখনই তাড়ি অলাকে সাক্ষী রেখে পাকা কথা হয়ে যায়। আর সেই রাতেই পাড়ার পাঁচজনকে ডেকে মা মনসার থানে গিয়ে এর মাথায় সিঁদুর তুলে দেয় গোলক। আইবুড়ো নাম ঘুচে যায় ওর। নরক ভোগের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায় এক কন্যাদায়গ্রস্থ বাপ।

যখন এর বিয়ে হয়, বয়েস চৌদ্দ পনেরোর বেশি নয়। একটু লম্বা বেশ রোগা এই মেয়ের কাছে পুরুষ এক ভীতিজনক জীব। সে যা করে তা অত্যাচার। ফলে সে মাঝরাতে কান্না চিৎকার জুড়ে দিত। ঘর থেকে ছুটে পালাত। আর তখন ঘরের সামনে লোক জড়ো হয়ে যেত। তারা মাঝবয়সী, কামুক ধৈয্যহীন গোলককে যা-তা বলত। একরাতে তো এমন হল পাগলা সরদার বাঁশ নিয়ে জামাইকে পেটাতে ছুটে গেল। পরদিন সকালে কাউকে কিছু না বলে গোলাবাড়িতে পালিয়ে চলে গেল গোলক।

এ প্রায় ছয় সাত বছর আগের ঘটনা। এখন সেই ছোট্ট মেয়ে শরীর মনে পরিণত হয়ে উঠেছে। বুঝতে শিখেছে পুরুষের এই পেষনের মধ্যে লুকানো আছে অনেক আনন্দ। যা না পেলে নারীর দেহমন যৌবন অতৃপ্ত অপূর্ণ উষর হয়ে থাকে। এখন তার দেহমন আত্মা একটা সবল পুরুষের জন্য আকুল হয়। যা হোক আর যেমন তোক খেটে না খাওয়াতে পারে, না পারুক, আমি এখন যেমন খেটে খাচ্ছি তখনও খাব, তবু কেউ একজন আসুক। যে সুখ আমি পেয়ে হারিয়েছি সেই সুখে সিক্ত করুক।

চেষ্টা সে খুব করেছে। কিন্তু তেমন কাউকে জোটাতে পারেনি। কেন কে জানে তার মনে হয়েছে এই কাজের পক্ষে আমি উপযুক্ত লোক। তাই এখন ধরে ফেলেছে আমাকে। আমি তার মনোভাব বুঝতে না পেরে যখন বলি, লাভমেরেজ করতে চাও, কইরা ফালাও। তয় এই কামে আমি কোন সাহায্য করতে পারমুনা। ঘটকালি ক্যামনে করে আমি জানি না। তখন বলে সে–আমি তোমার সাতে লাবমেরেজ করবো।

বলি আমি–তুমি জানো না আমি কী? মাইনষে আমারে গুন্ডা কয়!

তার সপাট জবাব–গুন্ডা বলে কি মানুষ না!

–তা, তোমারে নিয়া রাখমু কই। আমার তো ঘরদুয়ার নাই।

–মোনের মানুষ কাঁচে থাকলি বোনে গে থাকায়ও সুখ। তুমি আমারে যেখেনে নে রাখবে, গাছ তলায়, ফুটপাতে, আমি সিখেনে থাকবো।

এ এক মহা সমস্যায় পড়ে গেছি আমি। আমি তাকে যত আমার অক্ষমতা বোঝাতে চাই, সে বুঝতে চায় না। আমি যত পিছলে যেতে চাই সে চেপে ধরে। মনের সাথে যুদ্ধ করে করে আমিও তখন পর্যদস্ত হয়ে পড়ি।

যাদবপুর স্টেশনের আসা যাওয়া করা গোটা চল্লিশ মেয়ে আমার চেনা। তাদের কাউকে কাউকে আমার ভালোলাগে। ভালোবেসে ঘর বাধতেও ইচ্ছা করে। কিন্তু পদ্মপাতায় জলের মত টলটলায়মান যে জীবন, সাহস হয়নি কাউকে সেই জীবনে যুক্ত করি। যাদের এক দু জনকে পরে আমি হাড়কাটা গলিতে দেখেছি। অন্ততঃ একটা মেয়েকে সেই ঘৃণ্য জীবন থেকে বাঁচাতে পারতাম, যদি আমার তেমন ক্ষমতা থাকত। এখন এ সেই অস্থির জীবনের অংশ হতে চাইছে। মরণ ডেকে আনছে। যে নিজে মরতে চায় তাকে কে বাঁচাতে পারে।–মর। আমি আর কদিন? তখন ভোগ নিজের কর্মফল।

বলি–এখন বাড়ি যাও গিয়া। দুই দশদিন আমারে এ্যু সোমায় দাও। তারপর যা হোউক একটা ব্যবস্থা করমু।

–আমার সাতে লাবমেরেজ করবে?

–কইলাম তো করমু। যাও?

তখন বলে–তালি আমি কবে আসবো?

–দশদিন পর।

এরই মধ্যে ঘটে গেছে বাবলু হত্যাকান্ড। আর তার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ ঘটেনি। দেখা হয়ে গেল আজ প্রায় তিনচার মাস বাদে। সেই সোনারপুর থানার সামনে থেকে ছুট মেরে পালিয়ে আসবার পর আট-দশদিন ধরে ঘুরে ঘুরে দিন কাটছিল আমার। খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম এমন একটা জায়গা যেখানে থিতু হয়ে দাঁড়ানো যায়, একটা কোন কাজকর্ম পাওয়া যায়। আমার কাছে দুশো মত টাকা আছে। যা দিয়ে লাইসেন্স করব ভেবেছিলাম। এখন ভাবছি যদি এই টাকায় একটা ব্যবসা করা যায়। পুরনো নারকেলের ব্যবসা করবার আশায় কোলে মার্কেটেও গিয়েছিলাম। আমার সেই জায়গা আর খালি নেই। অন্য লোক দখল করে নিয়েছে। অন্য কোন ফুটপাতে গিয়ে বসব, সেখানে কেউ চেনা জানা নেই। যার পরিচয়ে এখানে “ঠেক” পেয়েছিলাম সে এক সবজিওয়ালিকে ফুসলিয়ে কোথায় নিয়ে গিয়ে কী সব করেছে যে কারণে সবজিওয়ালির স্বামী তাকে খুঁজছে। সে আর এখানে আসে না।

এইরকম বিপন্ন বিব্রত সময়ে এসে বসেছিলাম এক স্টেশনে। তখনই দেখা হয়ে গেল তার সাথে। সে কাজ করে যাদবপুর থেকে ফিরছিল। মনে হয় আমার ভাগ্যই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। না হলে হবে কেন? সে আমাকে দেখতে পেয়েই সামনে এসে দাঁড়াল–কোতায় পেলিয়ে ছেলে এ্যাতোদিন? আমি তোমারে খুঁজে খুঁজে হাল্লাক। এখেনে বসে রয়েছে কার খোঁজে শুনি।

যখন কোন মানুষ ডুবে যেতে থাকে হাতের কাছে যা পায় তা সে খড়কুটো যা-ই হোক আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। মানুষ যখন প্রবল ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে পঁচা বাসি এটো যা পায় গোগ্রাসে গেলে। মানুষের যখন নিদারুণ তৃষ্ণায় ছাতি ফাটে মরীচিকা দেখে জল ভেবে সেদিকে ছোটে।

আমি এখন জানি না ঠিক কোন উপমাটা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কালের জন্য সুপ্রযোজ্য হবে। তবে এটা সত্যি যে এই অনাত্মীয়-নিবন্ধিব, একাকীত্বময় মানসিক বিপর্যয়ের সময়ে ওকে বলে বসেছিলাম–তোমারে খোঁজ করতে আইছি।

চলো চলো আমাগার বাড়ি চলো। গেরামের সবাইরে তোমার কতা বলে দিইচি। তারা তোমারে দেখতি চাচ্ছে।

স্টেশন থেকে ওদের গ্রাম মাইল সাতেক দুরে। মাইল চার বাসে আসা যেত তারপর খাল পাড়ের চা পথ ধরে বাকিটা হাঁটা। আমরা সবটাই হেঁটে গিয়েছিলাম। ওরা সবদিনই হেঁটে যাওয়া আসা করে। বাসে যেতে পঁচিশ পয়সা আসতে পঁচিশ পয়সা, মাসে যদি সাড়ে সাতটাকা এতে চলে যায় তাহলে আর হাতে কী থাকে সারামাস কাজ করে? যা দুপয়সা চোখে দেখা যায় সে তো ওই বাসভাড়া বাঁচিয়ে ট্রেনভাড়া না দিয়ে।

যখন আমরা ওদের গ্রামে পৌঁছালাম চারদিকে নেমেছে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। সেই অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মত দেখাচ্ছে সেই গ্রামটাকে। এখানে গোটা তিরিশ পরিবারের বাস। এরা জাতিগত পরিচয়ে কাওড়া। মাছ ধরা, পালকি বওয়া, আর ঢোল বাজানো এদের পুরাতন পেশা। তবে এখন খাল বিল সব হেঁজে মজে গেছে, মাছ আর মেলে না। পালকির স্থান দখল করে নিয়েছে মোটরকার আর ঢোলের জায়গা নিয়ে নিয়েছে মাইক। তাই পুরুষেরা খাটে জন মজুর আর মেয়েরা কেউ মাজে বাসন কেউ শাকপাতা যা পায় বাজারে গিয়ে বেঁচে আসে। কারও কোন জমি নেই। শুধু বসতবাড়ি।

গ্রামে পৌঁছে প্রথম আমার কিছুটা ভয় ভয় করছিল। যার সাথে আমি এসেছি তার সাথে আমার কোন বৈধ সম্পর্ক নেই। সমাজের চোখে এটা অপরাধ। এটা তো কোন উচ্চ শিক্ষিত উচ্চবিত্তের “লিভ টুগেদার”-এর সমাজ নয়। পিছিয়ে পড়া গোড়ামিপূর্ণ সমাজ। তবে কিছুক্ষণ পরে সে ভয় আমার কেটে গেল। পাগলা সরদারের মেয়ের ভেসে বেড়ানো পানসি যে মাটির নাগাল পেয়েছে এতে তারা খুশি। পাগলা সরদারের মাথায় ছিট আছে তাই কী বলতে কী বলে বসে, একবার তার দোষে মেয়েটার কপাল পুড়েছে, আর যেন না পোড়ে সেই কারণে সে বিশেষ কথা বলে না। তবে তার স্ত্রী যে যাদবপুরে ঘুঁটে বিক্রি করতে যায় এবং আমাকে চেনে, বলে সে, দুজনা খেটেপিটে খাও আর “ভাইবনির” মত মিলেমিশে থাক এই আমরা চাই।

এখানে সবঘরে সবদিন উনুন জ্বলে না। যে ঘরে উনুন জ্বলে ভাত যদি বা হয় সবদিন তরকারি হয় না। পাগলা সরদারের ঘর তার ব্যতিক্রম নয়।তবে আজ তার উনুন জ্বলেছে। ওদের তরকারিও হয়েছে। বাড়ির সামনের খালধারে সরকারি খাস জায়গা সবারই একটু একটু দখল করা আছে। সেখানেই ওল লাগিয়েছিল পাগলা সরদার। সেই ওল বেঁচে চাল আর দু আনার কুচো চিংড়ি এসেছে।

খাওয়া দাওয়ার পর আমার শোবার জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে পাশের দাওয়ায়। অনেকদিন পরে আজ নিশ্চিন্তে একটু ঘুমোবার সুযোগ পেয়েছি। এখানে মশাও নেই। শোবার অল্প কিছু সময় পরে তলিয়ে গেছি ঘুমের অতলে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম তা জানি না। ঘুম ভেঙে গেল একটু মৃদু ধাক্কায়। অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না, শোনা গেল একটা নরম গলা–সরে শোও। আমারে এটু জায়গা দাও। তারপর বিনা দ্বিধায় যে আমার পাশে শুয়ে পড়ল সে আর কেউ নয়-সে-ই। আমি সেদিন সেই রাত আঁধারে–চরাচর যখন নিঝুম নিস্তব্ধ, এক আকুলি বিকুলি দেহের দাবিকে শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। আত্মসমর্পণ করে বসেছিলাম কী হবে তা না ভেবে।

আমার তখন চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠেছিল মৃত বাবলুর আক্ষেপ মাখা দুটো চোখ। সে দুদিন আগে মারা গেছে, দুদিন পরে আমারও ওই অবস্থা হবে। গোনাগুনতি যে কটা নিঃশ্বাস এখনও পড়া বাকি আছে সেই সামান্য সময়ে সীমিত সামর্থের মধ্যে যদি জীবন আমাকে কিছু দিতে চায়, নিয়ে নিলে আর মরার সময় শূন্যপাত্রের বেদনা বুকে নিয়ে মরতে হবে না। যেভাবে অভাগা বাবলু মরে গেছে।

এসো জীবন, এসো গরলপাত্রের অমৃত, আমি তোমাকে পান করি।

তার নাম মেঘনাদ। তাকে আমি চিনতাম। এখন মনে হচ্ছে ভুল। মানুষ চেনা অত সহজ নয়। ডাবের ঝুড়ি নিয়ে ট্রেন থেকে স্টেশনে নামে, রিকশায় ঝুড়ি চাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে নিয়ে যায় এই চেনার বাইরে তার আর একটা অচেনা আন্তঃদেশ আছে যা আফ্রিকার গহন অরণ্যের মত অনালোকিত। আজ সে আমার কাছে পরম বিশ্বাসে সেই অজানা ইতিহাসের পাতা মেলে ধরেছিল।

গ্রামবাংলায় চিরদিনই অন্নের বড় আকাল। যা আর একবার তীব্র হয়ে উঠেছিল ১৯৫৯ সালে। খাদ্যের দাবিতে সেই সময় মিছিল বের করা মানুষের উপর হামলে পড়েছিল পুলিশ। লাঠিপেটা করেই বহু মানুষকে মেরে ফেলেছিল তারা। সেই দিনে মেঘনাদের বাবা খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে এক জোতদারের ধানের গোলা থেকে চুরি করে নিয়েছিল আধবস্তা ধান। সে ধান যখন মেঘনাদের মা কেঁকিতে ফেলে কুটছিল, তেঁকির আওয়াজ পৌঁছে গিয়েছিল জোতদারের কানে। তারা তো চারদিকে চর লাগিয়ে রেখেছিল কে ধান চুরি করেছে ধরবার জন্য। আধবস্তা ধান নিতে তো দিল্লীর লোক আসেনি। মেঘনাদের এক জ্ঞাতি, পিঠোপিছি ঘর, সে গিয়ে সব বলে আসে। ফলে সে ধানের ভাত আর পেটে যায় না, ধরা পড়ে যায় মেঘনাদের বাবা। তাকে নিয়ে আসা হয় জোতদারের খামারে। তারপর কামারশালার হাম্বর দিয়ে কুঁচোকুঁচো করা হয় দু-হাতের হাড়। আর যেন সে কোনদিন চুরি করতে না পারে। গ্রামদেশের অভাবি মানুষ যেন তাকে দেখে চুরির নাম নিতে কেঁপে যায়।

মেঘনাদ তখন খুবই ছোট। ওর বাপ ভাঙা হাত নিয়ে বিছানায় পড়ে থেকে হেগেমুতে একসা হয়। আর ওর মা–যেখানে লোকে তাকে চোরের বউ বলে চেনে না তেমন কোন দুরগাঁয়ে গিয়ে ভিক্ষা চায়। এই দেখতে দেখতে বড় হয় সে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে টাকার গরমে পুরকায়েতরা তার বাপের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে, মাকে ভিখিরি’বানিয়ে ছেড়েছে একদিন তা কেড়ে নিয়ে ওদেরও ভিখিরি বানিয়ে ছাড়বে।

ডাব কাটতে হলে দাঁ যোগাড় করা দরকার। দাঁয়ে ধার দেওয়া দরকার। বাঘ মারতে হলে বন্দুক যোগাড় করা দরকার, বনের নাড়িনক্ষত্র জানা দরকার। যুদ্ধ করতে হলে ট্রেনিং নেওয়া দরকার। এখন মেঘনাদ সেই মোক্ষম আঘাতটা হানবার জন্য ট্রেনিংস্কুলে ঢুকেছে। শিক্ষকের নাম ধরে নেওয়া যাক–আহবালি।

এই অঞ্চলে বেশ কিছুদিন আগে এম. সি. সি দলের তিনজন কর্মী এসেছিল যার একজনের নাম চন্দ্রশেখর, ডাক নাম দাদু। তারা তখনও কোন এ্যাকশান করেনি শুধু সংগঠন বানাচ্ছিল। এতেইজোতদাররা ভয় পেয়ে যায়। আর একরাতে একটা মিটিংকরার সময়ে জোতদারের লোকেরা তাদের ধরে ডাকাত বলে পিটিয়ে মারে। তারা তিনজন তো মরে যায় কিন্তু যারা সেই মিটিংয়ে ছিল তাদেরও ছাড়া হয় না। যাদের বাড়িতে তারা থাকত-খেত, যাদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল সবাইকে চালান করা হয় থানা থেকে জেলে। এই দলে আহবালিও ছিল। বেচারার সেটাই ছিল প্রথম পলিটিক্যাল ক্লাশ।

এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব কটা জেলই নকশাল বন্দিতে পূর্ণ। তবে উঁচু ধরনের তাত্ত্বিক যত নেতা সব আছে প্রেসিডেন্সি জেলে। কিছু আছে দমদম কিছু বহরমপুরে। ও যে জেলে ছিল সেই সাবজেলে যাদের সে কাছে পায় তারা কর্মী হিসাবে যেমন হোক শিক্ষক হিসাবে দুর্বল। ফলে আহবালি তাদের কাছ থেকে সঠিক সুরে জাগো জাগো সর্বহারা গানটা গাইতে শেখে, শিখতে পারে না শ্রেণি সংগ্রাম কৃষি বিপ্লব এসব কথার সঠিক মানে। শ্রেণিঘৃণা, সে তো তার ভিতরে বহুপূর্ব থেকে মজুত–যা তাকে চন্দ্রশেখরের মিটিংয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। অসম্পূর্ণ শিক্ষার ফলে তা সঠিক দিশায় চালিত হয়নি। এক দেড় বছর পরে জেল থেকে বের হয়ে সে যে সংগঠন গড়েছে আর যা সে করছে তার সাথে রঘু ডাকাতের কর্মকাণ্ডের কিছু মিল পেলেও চন্দ্রশেখরের কাজের কোন মিল পাওয়া মুশকিল। মেঘনাদ এখন তার কাছে নাড়া বেঁধেছে।

এতসব কথা আমি তখন জানতাম না। এ সব বলেছে পরে। যাদবপুরের চেনা। তাই আলাপ করে এখন কোথায় কী কাজে লেগেছে জানতে চেয়েছিলাম। যদি সম্ভব হয় আমাকেও লাগাতে পারে কিনা! আমি যখন গড়িয়ার কাজ ছেড়ে আসি আমার কাছে যে শদুয়েক টাকা ছিল এখন তা সব শেষ। যাদের সাথে আমি থাকি ওরা ছয়জন আর আমি, যত কম হোক দুকিলো চালের কমে দিন চলে না। সাথে একটু আলু, ডাল। এর জন্য দিনে দশ টাকা আমি দেই বাকিটা ওদের যায়। নিজেরও আমার এক আধ টাকা হাত খরচ। ফলে এখন ট্যাক একদম খালি। কিছু একটা কাজকর্ম না করতে পারলে আর চলবে না।

মেঘনাদ আমার সব খবর রাখে। আমার অতীত জানে। তার ধারণা আমিও তার বিষয়ে জানি। আসলে তো আমি কিছুই জানি না। তাই আমি কাজে যেতে ইচ্ছুক শুনে বলে সে–আহবালি ভাইকে না জিজ্ঞাসা করে বলা যাবে না। আমি তারে তোমার কথা বলব। সে যদি মত দেয় তখন!

–আহবালি কে?

–আমি যার সাথে কাজে যাই। আমার মোনে হয় না সে তোমার কথা শুনলি না বলবে। নসকাল সকালে এট্যা টান থাকে না। নিশ্চয় দলে নেবে।

আমি সেই সময় ছিলাম এক “অসম্পূর্ণ শিক্ষার শিকার” মাথার ঘায়ে কুকুর-পাগলা মানুষ। প্রতিটা পদক্ষেপ ভুলের পাকে জড়িয়ে যাচ্ছিল আমার। কোন শক্ত “সঠিক অবলম্বন” হাতের নাগালে না থাকায় আমি ডুবে যাচ্ছিলাম দিশাহীন অন্ধকূপে। অনেকদিন পরে বিখ্যাত শ্রমিক নেতা শংকর গুহ নিয়োগীর মুখে বার বার এই কথাটা শুনেছি, যা তিনি আমার আত্মানুসন্ধান অনুশোচনা পর্বে বলতেন–”যে গরিব তার কাছে কোন নীতি নৈতিকতার আশা করা যায় না।”–সত্যিই যায় না।

খিদে এমন এক মহা ঘাতক যে মানুষের মন-বুদ্ধি-বিবেক-দয়া-মায়া-স্নেহ-প্রেম-মনুষ্যত্ব সব খেয়ে নেয়। কে দেখেছে তা জানি না, আমি দেখেছি খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বাপ তার মেয়েকে বেশ্যার দালালের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। স্বামী তার স্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে খদ্দেরের সামনে। মা তার শিশু সন্তানকে বিলিয়ে দিচ্ছে চালের বদলে। ছুঁড়ে ফেলছে কুঁয়োর মধ্যে।

এই কঠিন সময়ে আমি স্থির প্রতিজ্ঞ এমন কোন হরিদাস যে সত্য আর ন্যায়ের পথে পেটে গামছা বেঁধে অটল দাঁড়িয়ে থাকতে পারব আজীবন! আর মাত্র দু একদিন, তারপর হা হা করা আকাল আমাকে গ্রাস করে নেবে। তখন মাথা ঘুরবে, চোখ ঘোলা হয়ে যাবে, হাত পা কাপবে। দু পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো যাবে না। তখন কোথায় যাব আমি? কেমন করে বাঁচব?

রেল স্টেশনে এক সাধু থাকে। যদি গেরুয়া পোষাক আর মুখে দাড়ি মাথায় জটা থাকলে সাধু হওয়া যায় তবে সে মুখে মদের গন্ধ নিয়েও সাধু। সে বলে আমি আমার শিষ্যদের চোর হবার শিক্ষা দেই না যাতে সে চোরের সর্দার হয় সেই শিক্ষা দেই।

একদিন বলেছিল সে-জগতে যত রকম পাপ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে। অনাহারী থাকা। অনাহারে থাকলে আত্মা কষ্ট পায়। আত্মার মধ্যে বাস করেন পরমাত্মা, তিনি কষ্ট পান। যে পরমাত্মাকে কষ্ট দেয় সে মহাপাতকী। তার জিয়ন্তে কুম্ভীপাক নরক বাস হয়।

জীবনে অনেক পাপ করেছি। তখন আমি দুর্বল ছিলাম অক্ষম ছিলাম। আর আমি পাপ করতে পারব না। পরমাত্মাকে কষ্ট দিতে পারব না। কুম্ভীপাকনরক যে কী তা আমি জানি। আর সেই নরকে নিমজ্জিত হব না।

তাই যেদিন মেঘনাদ আহবালির ডাক এল–সময় হয়ে গেছে, এবার কাজে চলো, আমি আর পিছন ফিরে তাকাবার অবকাশ পেলাম না। রওনা দিলাম ওদের সাথে। রওনা দিলাম এতকাল ধরে আগলে রাখা মূল্যবোধ মাড়িয়ে অন্ধকার পথের দিকে।

আমরা চলেছি আজ বর্ধমান। এই ভ্রমণের প্রোগ্রামটা পুরোপুরি আহবালির। ট্রেনের টিকিট সে কেটেছে, চাফা সে খাওয়াচ্ছে। এসব হিসেব করে পরে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নেবে। আমি এদের সাথে নতুন, তাই জানি না। ওরা কী ভাবে কোথায় যেতে হবে–সব জানে। এক আশ্চর্য কৌশলে বন্দুক দুখানা খুলে ফেলেছে আহবালি। ফের জোড়া লাগানো হবে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে। কুঁদো দুটো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা বড় ব্যাগের পেটে। নলি দুটো জড়িয়ে নেওয়া হয়েছে সদ্য কিনে আনা একটা মাদুরে। আর একটা ব্যাগে খান কয়েক টর্চ নতুন ব্যাটারি। একটা ব্যাগে খান চার পাঁচ পাইপগান। লোক সংখ্যা আমাদের সাত। আর যেভাবে যে পোষাকে আমরা চলেছি যে কেউ দেখে মনকুবেবুঝি গ্রাম থেকে কলুষত্যু শহরে খাটতে আসা একদল মিস্ত্রি মজুর। যারা মাস দুমাস পরে এখন বাড়ি ফিরে চলেছে। বর্ধমান থেকে একজন আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে বলে এসেছে। কীভাবে পুরো পথটা নিরাপদে পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে সেই দায়িত্ব তার। আমরা ফিরে আসবার সময়ে এই লোকটাই বর্ধমান পর্যন্ত এসে আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে যাবে।

হাওড়া থেকে বর্ধমান ট্রেনে দুই আড়াই ঘণ্টার পথ। এরপর বাসে গেল আর ঘন্টা খানেক। তারপর এক ভ্যান রিকশায় মাথা পিছু একটাকা ভাড়ায় পার হওয়া গেল আরও মাইল পাঁচ ছয়। ভ্যান থেকে নেমে এক পায়ে হাঁটা পথে আবার মাইল তিন চার। সব মিলিয়ে গন্তব্য গ্রামে পৌঁছাতে লেগে গেল আট দশ ঘণ্টা। সকাল নটায় হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপেছিলাম আর সন্ধ্যে ছটায় পৌঁছাতে পারলাম এখানে।

এই জেলাটি ধান উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। হালকা বাতাসে উড়ছে তার সম্ভাবনাময় ডগা। এই দুধারের ধানক্ষেতের মাঝের আলপথ ধরে হেঁটে এসেছি আমরা। এই গ্রামটায় চল্লিশ পঞ্চাশ ঘর বাগদি পরিবারের বাস। এদের কারও কোন জমি নেই। সব ভূমিহীন। ক্ষেত মজুরি করে আর মাছ ধরে দিন গুজরান। যদি কখনও তেমন সুযোগ সুবিধা পায় পাশের কোন গ্রামে গিয়ে কলাটা মুলোটাও হাতিয়ে নিয়ে আসে। মাথা মুড়িয়ে কেটে বস্তা ভরে তুলে আনে পাকা আধপাকা ধান। জালের খেপ মেরে দেয় কোন পোনা পুকুরে। তাই প্রায় প্রতি ঘরের কারও না কারও নাম পুলিশের লাল খাতায় শোভমান। সঙ্গত কারণেই আশেপাশের বামুন কায়েত পাড়ার লোক বাগদি পাড়াটাকে বিষ নজরে দেখে থাকে। তারা বিষ ঝাড়ার সুযোগ পেলে আর ছাড়ে না।

গ্রামের চারিদিকে একহাঁটু জলে ডোবা ধানের ক্ষেত। জলের এক বিঘত উপরে মাথা উঁচু কচি ধানের শিষ। এই ধান মুখে রেখে দাঁতে চাপলে দুধ বের হয়। যা খেতে দারুণ মজা। জিভ ছুলে যাবার যন্ত্রণা ভুলে ক্ষুধায় কাতর রাখাল বালকেরা খুব খায়। এক সময় আমিও খেয়েছি। একদা এইসব জমির মালিকানা এইসব বাগদি পরিবারগুলোর হাতেই ছিল। জঙ্গল হাসিল করে এদেরই পূর্ব পুরুষ এ জমির অধিকার কায়েম করেছিল। নানান কৌশলে যে জমি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন এই জমির মালিকানা দেড় দুই মাইল দূরের কোন রায় সেন ভট্টাচার্জ চক্রবর্তীদের হাতে। নিজেদের জমিতে এখন নিজেরাই মজুর খাটে বাগদি পাড়ার নারী পুরুষ। তাতে যা মজুরি মেলে–পেট ভরে না–মন ভরে না, অভাব মেটে না। তাই সুযোগ পেলে চুরি করে নেয়। পাকা আধপাকা ধান। ছেলে মেয়ে বউ যে যা পারে অন্ধকারে কেটে তুলে নিয়ে আসে। যদি ধরা পড়ে যায় পুরুষ হলে বেদম মার খায়। আর যদি মেয়ে বউ হয়, সম্ভ্রম-সতীত্ব হারায়।

মার খেতে খেতে অপমানিত হতে হতে অনাহার সইতে সইতে এখানকার মানুষ এখন ভীষণ ক্ষিপ্ত। একটা এসপার ওসপার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। আমার ঠিক জানা নেই ওদেরই একজন কীভাবে যেন যোগাযোগ করেছে ভিন জেলার লোক-নসকাল আহবালির সাথে। যে লোকটা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে তার নাম ভুতো। যার অপুষ্টিতে দরকচা মারা দেহ! মাথা আর পেটটা বড়! গড়ন একটু খাটো। বয়েস মনে হয় তিরিশের কোঠায়। তার একটা বোন আছে। গত বৈশাখে যে পনের পার হয়ে গেছে। তবু এখনও কোন পাত্র পাওয়া যায়নি। এ পাড়ার মেয়েদের বর পাওয়া, ঘর পাওয়া খুবই মুশকিল। য়ে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে জেনে নিতে চায়–এই মেয়ে কোন রাতে বাবুদের ক্ষেতের ধান ছিঁড়তে গেছে কী না। কোনবার ধরা পড়েছে কী না।

ভুতোর একটা ভাই আছে, যে রাত নামলেই অন্ধ। তখন আর সে কিছু চোখে দেখতে পায় না। মা নেই। বাবা আছে। তবে কোথায় আছে কেউ জানে না। বছর খানেক আগে খবর পাওয়া গিয়েছিল সে নাকি বর্ধমান শহরের পথে পথে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ভুতে গিয়ে অনেক খুঁজেও তাকে পায়নি। ভুতোর বউ আছে। যে আর মাত্র কয়েকদিন পরে মা হবে।

“কলকাতা” থেকে আসা আমরা সাতজন সন্ধ্যার কিছু পরে ভুতের বাড়ি গিয়ে উঠলাম। বাড়িটা মাটির, কিন্তু দোতলা। এটা ওই পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বড় বাড়ি। বলে ভুতো, কবে নাকি সে কোন মেলা দেখে ফেরবার পথে এক বামুন বউয়ের বিছে হার ছিঁড়ে নিয়ে ছুটে পালাতে পেরেছিল। সেই টাকায় এই ঘরবাড়ি। না হলে আজও সেই কুঁড়ে ঘরই থাকত। আজকের রাত আমাদের ভুতোর দোতলায় বিশ্রাম। যা হবার তা হবে কাল রাত্তিরে, চাঁদ যখন ‘ঘড়ি মারবে।’ আহবালি তার হাতে ধরা ব্যাগ খুলে দুটো ওজনদার পোটলা বের করে ভুতোর হাতে দিয়ে বলে–এগুলো এ্যাখোন রেখে দাও?কাল কাউরি দেমিহিন করে গুড়ো বানিয়ে দিও। এখন আমি বুঝতে পারি ও দুটো হচ্ছে বোমা তৈরির মশলা। অতদুর থেকে তৈরি বোমা বহন করে আনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পথে ফেটে যাবার ভয় আছে। তাই মশলা এসেছে। এইখানে বসে নির্মাণ হবে সেই আওয়াজকারী আয়ুধ। যা মানুষকে ছত্রভঙ্গ আর ভীতত্রস্ত করে দিতে অদ্বিতীয় অস্ত্র।

আমরা যারা এখানে এসেছি, বলতে গেলে সবাই হচ্ছে সহযোগী মাত্র। মূল কাজটা সম্পন্ন করবে এই গ্রামেরই লোকজন। যারা সংখ্যায় অনেক। যাদের শারীরিভাষ্যে প্রকাশ পাচ্ছে, ওরা সেই অত্যাচারী জোতদারটার ঘরে কাল কীসে খাবে সেই কঁসার থালাখানিও রেখে আসবে না। পড়বে সে কাপড়খানাও নিয়ে চলে আসবে। যা ওরা বয়ে আনতে অপারগ হবে, ছিঁড়ে ভেঙে নষ্ট করে দেবে, এত আক্রোশ। ওরা সব দল বেঁধে আমাদের দেখতে এল। এবং আমাদের দেখে দারুণ পুলকিত হল! এক সময় আগুনগোর আসল নকশালদের সাথে ছিলাম। প্রচুর গুলিবোমা ছুঁড়েছি। তার একটাও প্রকৃত শ্রেণিশত্রুর শরীর ছুঁতে পারেনি। সবটাই পর্যবসিত হয়েছে এক নকলযুদ্ধে–অকারণ আত্ম অপচয়ে। আজ মনে হচ্ছে, আজীবন আমার যে তালাশ সেখানে পৌঁছে যাব। আজ আমার ছোঁড়া বোমার প্রিন্টার প্রকৃত এক গণশত্রুর বুকে আঘাত হানবে। একটা দরিদ্র গ্রামের শিশু বৃদ্ধ নারী পুরুষ যে পরিবারটির ধ্বংসের জন্য সর্বস্ব পণ করে বসে আছে তার সামাজিক অবস্থান যা-ই হোক সে সমাজবন্ধু কখনই হতে পারে না।

এমন একটা “ভালকাজের” সাথে যুক্ত হয়ে মনটা এখন ভালো হয়ে গেছে আমার। বলে একজন–দাদারে, কত বচ্ছর ধরে আমরা পেলান করিচি, শালারে নিকেশ করবো। পারিনি। আমাগার কাঁচে তো অস্তর বলতি ত্যামন কিছু নাই। কটা লাঠি বল্লম। এদে কী বন্দুকের মুকাবেলা করা যায়। এখোন আমাগার হাতে য্যাখোন বন্দুক এসে গিছে এবার সব শালারে উচিৎ শিক্ষা দেবো। ওই বুড়ো শালারে আগে ধরে ন্যাংটো করে নারকেল গাছে বাঁধালো। তারপর পেত্যেকে দম ভর খানিকক্ষণ পিট্টে নেবো। তারপর অন্যকথা।

রাত্রে আমাদের কিছু খাওয়া দাওয়া দরকার। ভুতোর ঘরে এত মানুষের চাল কোথায়। মুষ্টিভিক্ষায় সারাগ্রাম সহযোগ দিল। কেউ একমুঠো চাল কেউ দুটো আলু কেউ এক ফালি কুমড়ো। সারাটা গ্রামে আজ যেন উৎসবের দিন, শিকার পরব। ভাত আর কুমভোর ঘ্যাট রান্না হল। সবাই একসাথে, কলাপাতায় সে খাদ্য খাওয়া হল।

একজন বলল–আমরা কেউ রেতে ঘরে থাকিনে। বাঁশ বাগান কলাবাগান এখেনে সেখেনে ঘুমাই। তবে তোমরা ভুতোর এখেনেই থাকো। কোন ভয়নি, আমরা পাহারায় থাকবো। তা ছাড়া আমাগার পোষা কুকুর আছে। অচেনা কেউ সামনে এলি কামড়ে টুটি ছিঁড়ে নেবে। পুলিশ তোক আর যে তোক এত সহজে কেউ আমাগার গেরামের ধারে কাছে ঘেসতি পারবেনে। তোমরা ঘুমোও।

চারদিকে জল আর ধানক্ষেতের মধ্যে গাছগাছালিপূর্ণ এই গ্রামখানা যেন একটা দ্বীপভূমির মত সুরক্ষিত। এ গ্রামে আসা যাওয়ার জন্য মাত্র একটাই সরু মাটির পথ। সে পথে কোন যানবাহন চলার মতো নয়। জল আর কাদায় থকথকে সে পথে চলতে গেলে মানুষ পেছল খায়। কেউ এলে, দিনের বেলায় দু-মাইল দূর থেকে দেখা যায়। এই গ্রামের প্রায় প্রত্যেক পুরুষের নামে পুলিশি কেস আছে। চুরি ডাকাতি ছিনতাই। তবে সহজে তাদের ধরতে পারে না। এত কষ্টের চলাচল মাস মাইনের সুরক্ষা কর্মীদের কাছে বড়ই বিরক্তিকর। তাই গ্রামবাংলার দাপুটে লোকজন বর্ষাকালে বাগদি পাড়ার সামনে বড় অসহায়। প্রকৃতি সহায় তাই এখন বাগদি পাড়ার দরিদ্র দুর্বল লোকেদের বুকে দাপাচ্ছে সাহস আর এক প্রতিশোেধী চেতনা। আমাদের মা বোনের অসম্মান আর অত্যাচারের বদলা এবার নেবই।

পরের দিন মুখ হাত ধুয়ে মুড়ি পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা চেবোবার পর আমাকে বলে আহবালি–তোমার উপরে ভার। মশলা রেডি হয়ে গ্যাছে। বসে বসে যে কটা মাল হয় বেঁধে ফ্যালো।

আমি বড় অবাক। আহবালি কী করে জানে, আমি বোমা বাঁধতে পারি। তবে কী কোন সময় মেঘনাদকে বলে ফেলেছিলাম? সে দিয়েছে আহবালির কানে! ব্যাপারটা তাহলে এই হয়েছে। বোমাবাধায় বিশেষ পারদর্শী বলেই আমাকে যুক্ত করা হয়েছে ওদের দলে! তা না হলে আর কেন। ওদের যে “কাজ” আমি তো সে বিষয়ে একেবারে অজ্ঞ। একজন ট্রাকের ড্রাইভার একজন ট্রামের। ড্রাইভার তো দুজনেই, পথও এক। তবু একজন আর একজনের কাজ করতে অক্ষম। এটা একমাত্র অপরাধ বিজ্ঞানীরা ভালো জানে।

বলি–যা মশলার পরিমাণ, গোটা কুড়ি নিশ্চয় হবে। এতে আমি একা কী করে পারব।

কাতর গলায় বলে সে–একটু কষ্ট করে বেনিয়ে ফ্যালো। তুমি ছাড়া আর তো কেউ নেই। কারে বলবো! এ যা ঝামেলার কাজ বোমা না হলি চলবেনে। হাজার দেড় দুই “মাছি ভনভন” করতি পারে। মাছি উড়িয়ে দিতি হলি আওয়াজ খুব কাজে আসে।

বলি–তোমরা তোকইছিলা লোকটা বদমাইশ। সারা অঞ্চলের লোক তার বিপক্ষ, কেউ তার হইয়া আগাইবে না।

আসবে না! এরকম লোকের জন্যি কেউ বিপদে ঝপায় না। বলে আহবালি–তোমারে কী বোঝাবো, তুমি তো নতুন। আমরা দেখেছি। তার কত নাম ডাক, লোক সব সোমায় আগে পিছে ঘোরে। আমরা যেখন গে দরজায় দেড়িয়ে পড়ি, আর কারও টিকির নাগাল পাওয়া যায়নে। সব দূরে দেড়িয়ে চেঁচায়। খুব বেশি হলি এট্টা দুটো ইটপাটকেল ছোড়ে। আমি বলতিচি দেখে নিও এদের জন্যিও কেউ আসবে না। তবে সে বলে তো আমাগার হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলে না। পেরান একটা। সে গেলি তো আর পাওয়া যাবেন। তাই সাবধান থাকা লাগে। আমি ধরে নিচ্ছি, ওই গেরামের সবলোক আমাগার পথ আটকাবে। কিছু অন্তর পাতি থাকলিও থাকতি পারে। সেই জন্য আমাগার তরফে কোন খামতি রাখতি চাচ্ছি নে। পঞ্চাশটা কার্টিশ আছে আর এই কুড়িখানা বোমা। এতে পাঁচ হাজার লোকে মহড়া নেওয়া যাবে। একটু পরে আবার বলে সে, আমি আগে এ্যাকবার ঘুরে সব দেখে গিছি। বাড়ির বউ কটার গায়ে যা গহনা, যদি সে কটা ঠিকমত গুছিয়ে নিতি পারি, কমপক্ষে এ্যাককিলো।

ভুতের বোন বেটেছে বোমার মশলা। ভুতো তাকে ছেঁড়া মশারির টুকরোয় চেলেছে। আর গোয়াল ঘরের এককোণে ভুতোর বউ পরিপাটি পেতে দিয়েছে বসবার আসন। ভুতোর পুরো পরিবার-শুধু পরিবার কেন ভুতোদের সারা গ্রামটাই এখন ধাবিত হচ্ছে একটা বিশেষ লক্ষ্যের দিকে। এরা কেউ-ই পুথি পুস্তক পড়া, একনিষ্ঠ মতাদশের প্রতি নিবেদিত প্রাণ, কোন রাজনৈতিক কর্মী নয়। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো, আর শ্রেণি শত্রু খতমের যে বিপ্লবী তত্ত্ব সে বিষয়েও বিশেষ জানে না। তবে ওটা জানে, যে, যারা ছলছুতো পেলে আমার বউ বোন মেয়েকে ন্যাংটো করে হাতড়ায়, যারা কেড়ে নিয়েছে আমার সোনা ফলানো মা মাটি, শালারা নিপাত যাক। নকশালদের সাথে যে কারণে শ্রেণিঘৃণার ক্ষেত্রে কোথায় যেন একটা গোপন মিল।

এখন আমার আর কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব সংশয় কুণ্ঠা কিছু নেই। এত মানুষের জন্য যদি অন্যায় অপরাধ কিছু হয়ে থেকে থাকে–হোক। এমন অন্যায় আমি বারবার করতে চাই। বসে যাই আমি মশলার থালা নিয়ে বোমা বাঁধতে। একদল গ্রামবাসী গোয়াল ঘরের খড়ের গাদার উপর বসে দেখছে সেই নির্মাণ। একটা সাদা একটা একটু মেটে লাল, দুটো নিরীহ পদার্থের সংমিশ্রণে কেমন করে প্রস্তুত হচ্ছে একটা ভয়ংকর মারণাস্ত্র। দেখতে অতি সাধারণ, সুতলির গোলার মতো একটা জিনিস। যা ছুঁড়ে ফেলার পরে বাজ গর্জনে প্রবল প্রতিপক্ষকে পরাস্ত ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

কলাইকরা কানা উঁচু একটা বড় থালায় ঢেলে মাখানো হয়েছে সব মশালাটা। যেখান থেকে পরিমাপ মতো অল্প কিছুটা মশলা নিয়ে তাতে কাঁচের টুকরো জালের কাঠি বেয়ারিংবল এসব দিয়ে বানানো হচ্ছে বোমা। যা দেখে বাগদি পাড়ার মানুষের মনে তৈরি হচ্ছে রণ উন্মাদনা। দেখে নেব শালাদের। অনেকদিনের অনেক হিসাব বাকি পড়ে আছে। শালা, কেটে ছিলাম এককাদি কলা। সারারাত ধরে পিটিয়েছে। আবার জেলেও দিল। দু দুটো বচ্ছর পচেছি। না খেতে পেয়ে বউটা আমার পালিয়ে গেল। সব শোধ নেবো আজ।

কথার মধ্যে প্রবল উত্তেজনায় সে হঠাৎ দেশলাই কাঠি ঠুকে বসল। বিড়ি ধরাবে। কেমন করে যেন দেশলাই কাঠির আগুনের ফুলকি ছিটকে এসে পড়ল কলাই করা থালার মশলার স্তূপে। সাথে সাথে দপ করে বিশাল একটা আগুনের গোলা একরাশ সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে উঠে গেল আকাশের দিকে। গোয়াল ঘরের খড়ের চালে জ্বলে উঠল দাউদাউ আগুন। তার লাল, লেলিহান শিখা ছুটল উপর দিকে। সেই সাথে খড় পোড়া কুণ্ডলী পাকানো সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল চারদিক। আমার হাতে যে অর্ধ-নির্মিত বোমাটি ছিল হস্তচ্যুত হয়ে নিচে পড়ে ফেটে গেল বিকট শব্দে। প্রিন্টার ছুটল সব দিকে। যারা বসে বোমা বাধার কলাকৌশল দেখছিল আহত হল তারা দুচারজন। আহত তারা অল্পই তবে আতঙ্কিত অনেক বেশি। পূর্বে যে নয়খানা বোমা তৈরি হয়ে গরুর জাবনা দেওয়া মেঝলায় রাখা আছে যদি সেগুলো ফেটে যায় গোয়াল উড়ে যাবে। মরে যাবে সবাই। তারা প্রাণভয়ে ছুটল যে যেদিকে পারে। মুহূর্তের মধ্যে একটা হুলুস্থুলু কাণ্ড।

আমি দৌড়ে অতিকষ্টে গোয়াল ঘরের বাইরে এসে উঠোনে পড়ে গেলাম। মশলার থালা যেদিকে ছিল সেই ডানদিকটা সম্পূর্ণ ঝলসে গেছে। হাত পা মুখ থেকে এক পরত চামড়া খুলে ঝুলে পড়েছে। পোড়া চামড়ায় বারুদের কটু ঘ্রাণ। ছেঁড়া চামড়ার ফাঁক থেকে উঁকি দিচ্ছে ডিমের মত সাদা মাংস।

গোয়াল ঘরের লোকজনদের আতঙ্কিত চিৎকার এবং বোমা ফাটার আওয়াজে বড় ঘর থেকে ছুটে এলো ভুতো মেঘনাদ আহবালিরা। তাদের তখন আমার দিকে দেখবার মতো সময় কোথায়! তারা হাতের কাছে যে যা পেল নিয়ে ছুটে গেল জল নিয়ে আসতে। পুকুর পাশেই ছিল। গোয়ালের আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে নেভানো গেল। আমি তখন যন্ত্রণায় সারা উঠোন জুড়ে পোড়া সাপের মতো গড়াচ্ছি। উঃ মরে গেলাম, আঃ মরে গেলাম। তখন ওরা আমাকে তুলে পাশের বড় ঘরে নিয়ে গেল। যে মাদুরে শুয়ে তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল তাতে আমাকে শুইয়ে দিল।

মদ! মদ নিয়ে আয়। একজন ছুটে গিয়ে তার ঘর থেকে নিয়ে এল একঘটি চোলাই মদ। খেয়ে নাও। যন্ত্রণা কমে যাবে। মুখের কাছে ধরতেই চো চো করে পুরো একঘটি-র চোলাই টেনে নিলাম আমি। তখনকার মত যন্ত্রণাটা সত্যি সত্যি কমে গেল। কারণ দশ মিনিটের মধ্যে জ্ঞান হারাল আমার। থেমে গেল এতক্ষণের উঃ আঃ।

মশলা পুড়ে গেছে। বোমা ফেটেছে। আওয়াজ কতদূরে গেছে তা কে জানে। বামুন কায়েত পাড়া হয়ে সে আওয়াজ থানার দিকে যে চলে যায়নি, তার কী প্রমাণ। শুভ কাজে বিঘ্ন ঘটে গেছে। এখন বেশ কিছুদিনের মধ্যে পরিকল্পনাকে আর বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না। আর এখানে অপেক্ষা করে কী লাভ! আহবালি মেঘনাদ এখন এখান থেকে সরে পড়তে পারলে বেঁচে যায়। এরা তো কেউ আমার আত্মীয় বন্ধু আপনজন নয় নয় সেইসচেতন রাজনৈতিক সহকর্মী কমরেড। যারা বন্ধুর বিপদকে নিজের বিপদ মনে করে বুক দিয়ে আগলে বসে থাকে। এদের কাছে নিজের প্রাণ ছাড়া নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু প্রিয় নয়। তেমন কোন শিক্ষা এরা পায়নি তো কী করবে! আমি বুঝতে পারছি এরা একবার কোনভাবে এখান থেকে সরে পড়তে পারলে আমি মরে গেলেও এরা আর আসবে না। কিন্তু আমি ওদের যাওয়া আটকাব কী করে!

ভুতোকে বলে আহবালি–আর আমরা এখেনে থেকে কী করবো? যা হোক করে এরে তোমরা দুটোদিন লুকিয়ে রেখে দাও। কলকেতা গে এটা গাড়ির বেবস্তা করে এসে নে যাবো।

সন্ধ্যে ঘনাবার আগেই ওরা চলে গেল। তবে যাবার আগে ভুতোর কাছে কিছু টাকা রেখে গেল–এই দিয়ে যাহোক কিছু ওষুধপত্তর কোরো। তারপর তো আমরা আসতিচি।

জীবনে বহুবার বহুরকম বিপদে পড়েছি। কিন্তু সে সময়ে শরীর সক্ষম এবং মস্তিষ্ক সক্রিয় ছিল। এখন আমি যে বড় অক্ষম-অসহায়। বলতে গেলে এটা আমার কাছে বিদেশ বিভুই। মানুষগুলো সব অনাত্মীয়। যে আত্মীয়তা আত্মার সাথে আত্মার মেলবন্ধনে গড়ে ওঠে সে এক দীর্ঘসুত্রীয় কার্যক্রম। আসিলাম বসিলাম আর হয়ে গেল, ব্যাপারটা এমত সরল নয়। সে যা হোক, এখন আমি কী করি? বুঝতে পারছি আমাকে ঘিরে এক চরম বিপদ বৃত্ত করে আসছে। অনাত্মীয়–অন্নের চিন্তায় কাতর একদল মানুষ, যাদের অনবরত পুলিশ খুঁজে বেড়ায়। প্রিয় শয্যায় সঙ্গিনীকে পাশে নিয়ে কেউ রাতে ঘরে ঘুমাতে পারে না। এই রকম আধপোড়া একটা মানুষ তাদের কাছে একটা বোঝা-মস্ত বড় সমস্যা।

আবার আর একবার জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিল আমার। অনেক রাতে যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখলাম, ভুতোর বউ বোন অন্ধ ভাই তিনজনে তিনখানা তালপাতার পাখায় অনবরত আমাকে হাওয়া করে চলেছে। পরিশ্রমে তাদের শরীর বেয়ে নামছে দরদর ঘাম। হাওয়ায় পোড়ার জ্বালা কম হয়। কিন্তু কত কম! যার ডানদিকের অঙ্গের পুরো এক পরত চামড়া খুলে গেছে, শুধু হাওয়ায় তার কী হবে। একটু পরে অবশ্য কে যেন একটা বার্নল কিনে নিয়ে এল। অষুধের দোকান অনেক দূরে। তাই তার আসা যাওয়ায় দিন গড়িয়ে গিয়ে রাত নেমে গেছে। কিন্তু যা পোড়া একটা বার্নলে কুলাবার নয়। একটু একটু করে লাগিয়ে সবটা শেষ।

যখন অজ্ঞান হয়েছিলাম তখন বিশেষ কিছু টের পাইনি। এখন জ্ঞান হবার পর সারা শরীর জুড়ে টের পাচ্ছি যন্ত্রণার এক মহাসমুদ্র। যেন চিতার আগুনে জীবন্ত দাহ করা হচ্ছে আমার দেহ। কিন্তু আমার কিচ্ছুটি করবার কোন উপায় নেই জ্বলন সয়ে যাওয়া ছাড়া। আজ আমি বড় বিপন্ন–অসহায়। একটু যে পাশ ফিরে শোব সেই সামান্য শক্তিটুকুও আর নেই আমার।

জল, একটু জল দাও। ভুতোর বোন সুধা–মাত্র পনের বছরের মেয়ে সুধা, পুরো পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাবার জন্য যার মনোকষ্ট সবচেয়ে বেশি। সে জল এনে আমার মুখের কাছে ধরে মায়াময় গলায় বলে-খাও দাদা, জল খাও।

গ্রামের ভাবনাকাতর সব মানুষেরা এখন উঠোনে বসা। তাদের গলার স্বর বড় নিচু আর নরম। বুঝতে পারি কোন গোপন শলাপরামর্শ হচ্ছে। আমার চেতন আর অর্ধচেতন শরীরের সাথে যুক্ত শ্রবণেন্দ্রিয় যথাযথ সব শব্দ ধরতে পারছে না। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সবাই সর্বসম্মতিক্রমে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার চেষ্টা করছে। যেটা আমার পক্ষে ভালো কিছু নয়। শুনতে পাই একজনের মৃদু গলা-ভেবে দ্যাখ ভুতো, এছাড়া এ্যাখোন আমাগার আর কোন উপায় নাই।শালা, আমাগার কপালই খারাব।নালি ওরাম বেভুলি বিড়ি ধরাতি যাব ক্যান! এ্যাখোন আর কী করবি বল! বোমা ফাটার ব্যাপার বাবু পাড়ার লোক জেনে গে থাকলি, এ্যাতক্ষণে থানায় পৌঁছে গেছে। পুলিশ এসে পড়ল বলে। এই অবোস্তায় এরে আমরা কোতায় নুইকে রাখবো বল? নিরঘাত ধরা পড়ে যাবে। পুলুশের মার জানিস তো? ত্যাখোনও আমাগার নামধাম সব বলে দেবে। আর এটা কেস চেপে যাবে নামে নামে। তাই বলতিছি।

আর একজন বলে–এ্যাখোন বরষাকাল। নদীতে ভরা জল আর সেই রকম টান। ফ্যালার সাতে সাতে ভেসে কোথায় না কোথায় চলে যাবে। কেউ নাগাল পাবে নে।

তখন বলে ভুতো–ভাই, তোমরা যা বলতেছো, দশদিক ভেবে দেখে নিচ্চয় বলতেচো। তেবু কেন জানিনা সে কতায় মোন সায় দিতি চাচ্ছে নে। এ্যাট্রানোক, এ্যাখোনও পেরান আছে। তারে নদীতি ফেলে দেবো? যার কোন দোষ নাই। এই অবোস্থা হয়েছে আমাগার জন্যি! না ভাই, সে আমি পারবো না।

–ভুতো খুব নরম মোনের মানুষ। ওর দয়া মায়া বেশি।

–মদ নিয়ে আয়। মদ খেলি মোনের দুব্বলতা কেটে যাবে। যা নিয়ে আয়। একটু পরে কে যেন আবার বলে–মোন খারাব করে আর কী করবি বল ভুতো! এছাড়া আর কোন পথ নেই রে।

মদ এসে গেছে। মনের সাহস বাড়াবার জন্য শুরু হয় পানপর্ব। লোকগুলো একেবারে নির্দয় নয়। এখন অবস্থা বিপাকে এমন নির্দয় নিষ্ঠুর হতে হচ্ছে তাদের। ভূতত একবার ঘরে এসে আমাকে দেখেও যায়। দাঁতে দাঁত চেপে মরার মত পড়ে থাকি আমি। কোন শব্দ করি না। যদি জেনে যায় আমি সজাগ আছি তাহলে ওদের গলার স্বর আরও নিচু হয়ে যাবে। তখন পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াচ্ছে কিছু বোঝা যাব্দেনীবুঝকৈপালে আর কিছু না হোক অন্তত প্রস্তুত থাকা যাবে।

মদে ভুতোর নেশা হচ্ছে না। তারই জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। সে যা বলবে–তাই হবে। তার একটা হা, না, এর উপর ঝুলছে একটা জীবন। এখন তার মুখের একটা বাক্য বন্দুকের গুলির সমান। যা একবার ছুটে গেলে আর ফেরানো যাবে না। সারা জীবন ভুলোকে সেই বাক্যের দায় ভার বহন করে যেতে হবে। আমাকে সে নিয়ে এসেছে, তার দায়িত্ব ছিল ফিরিয়ে রেখে আসার। এখন সে সেই মিত্রের মৃত্যুর কারণ কেমন করে হয়। আমি কোন কথা বলি না। শরীরময় যে যন্ত্রণা হচ্ছে–মাগো বাবাগো ছাড়া আর কিছুমুখ থেকে বের হতে চায় না। তবু যদি কিছু বলার চেষ্টা করি তাতে কোন লাভ হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিচারে আমি এখন এক মৃত মানুষ। আমার মতামত-মৃত মতামত যা জীবিতের কাছে মূল্যহীন।

এখন ভুতোর বেশ উত্তেজিত গলা-দ্যাখো ভাই, তোমরা যে সব পেলান করতিছো সেডা ঠিক পেলান নয়। ওরা বলে গিছে গাড়ি নিয়ে দুদিনের মধ্য আসবে। আসুক আর না আসুক সেই দুটোদিন দেখা দরকার। যেদি আসে–এসে যেদিবলে আমাগার নোক কই? আমরা তার কী জবাব দেবো?

–কিন্তু তারই মধ্যি যেদি পুলুশ এসে পড়ে?

–যেদি না আসে?

–যেদি না আসে সে তো গেরামের সবার পক্ষে মঙ্গল। কিন্তু যেদি আসে?

সব নিশ্চুপ। আর কোন শব্দ নেই। জলাভূমির উপর দিয়ে ছুটছে রাত্রির শনশন বাতাস। বাতাস নয়, যেন হাজার বুক ঠেলে বের হওয়া দীর্ঘশ্বাস। জলের উপর মাথা উঁচুধানের শিষগুলো সাপের ফণার মতো দুলছে। যেন কোন বিষম ভয়ে আমূল নড়ে যাচ্ছে মহাবিশ্ব! এই সব কিছুর উপর ছেয়ে আছে আলকাতরার মতো গাঢ় অন্ধকার। কোন বাচ্চা কাঁদছে না, কোন বুড়ো কাশছ না, কোন কুকুর ডাকছে না। কোথাও এখন কোন প্রাণ আছে, বোঝা যাচ্ছে না। গাছগাছালি ঘেরা দরিদ্র এই গ্রামটায় সন্ধ্যে নামবার সাথে সাথে আজ সব প্রাণ মারা গেছে। এখন যারা ভুতোর উঠোনে বসে ফিসফাস করছে-সব যেন প্রেতাত্মা।

আবার কিছু সময় পরে শোনা গেল ভুতোর অসহিষ্ণু গলা, ক্যানো ভাই তোমরা সব অবুঝ হচ্ছো! বলো তোমরা, য্যাখোন তারা এসে বলবে, সে কই? আমি তার কী জবাব দেবো?

-বলবি, মরে গেছে। মরার উপর আর কী কত? মরা তো রাখা যায়নে তাই ফেলে দিইচি। করো এ্যাখোন কী করবে।

-তালি আর আমি কী বইলবো। সব্বাই যা ভালো বোঝো, তাই করো। ভুতো এতক্ষণ পরে সম্মিলিত চাপের সামনে মাথা নত করে দেয়, চলো। ফেলে দিয়ে আসি।

কিছু সময় পরে একজন লোক একটা বাঁশের মাচা নিয়ে ঘরে এসে ঢোকে। সুধা আর তার বউদি পাখা চালনা বন্ধ করে কাতর মুখে এক পাশে সরে দাঁড়ায়। শুধু অন্ধ বুধো যে অন্ধ বলেই যেন অনেক কিছু স্পষ্ট দেখতে পায়। বুঝতে পারে যা ঘটতে চলেছে তার ঔচিত্য, অনঔচিত্য। তার মুখ থেকে তখন যে শব্দ বের হয় তাকে একটা হাহাকার বলে মনে হয় আমার, এরে কোথায় নে যাচ্ছিস! যা আসলে এই সময়ের কাছে এখন একটা অর্থহীন শব্দ মাত্র।

মাচা পাতা লোকটা–যাকে এই অপ্রিয় কাজটা করতে হচ্ছে, মুখ দেখে মনে হয় সে এটা না করতে হলে সবচেয়ে খুঙ্গিক অপরাধবোহাকু পীড়া দিচ্ছে। তারই ভুলে বারুদ পুড়েছিল। সে কাতর গলায় বলে–দাদা, ওদাদা, শুনতি পাচ্ছো! ওঠো। উঠে এই মাচায় শোও। তোমারে অন্যদিকে নে যাব। ভালো জায়গায়।

আমি জানি, অনুনয় বিনয় আবেদন নিবেদন প্রাণভিক্ষার আর্তি, এসব এখন কোন কাজে আসবে না। আমার পক্ষে পরিস্থিতি বড় প্রতিকুল। আমার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এর কোন পুনর্বিচার হবে না। এখন আমি এদের সাথে অসহযোগিতা করলে পেটের মধ্যের মদ ওদের ক্ষিপ্ত করে তুলবে। তখন টেনে হিঁচড়ে মাচায় নিয়ে ফেলবে। কষে বেধে দেবে মাঁচার সাথে। চিৎকার যদি করি গলা টিপে ধরাও অসম্ভব নয়। মানুষ অনেক সময় সাহসে যে কাজ করতে না পারে ভয় পেয়ে করে দেয়। ওরা এখন ভীষণ রকম বিপন্নতা বোধের দ্বারা আক্রান্ত। তাই অনেক কিছুই করে ফেলতে পারে। এখন আমার বাঁচার কোন আশা না করাই উচিৎ। আশা করা উচিৎ, মৃত্যুটা যেন সহজ হয়। তাই গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে মাচায় উঠি–চলো ভাই।

চারজন চারকোণে কাঁধ দেয়। এ এক বড় আশ্চর্য শবযাত্রা। যে প্রাণ এখনও ধুকপুক করছে, একটু পরিচর্যা পেলে বেঁচে উঠতে পারে, তাকেই মৃত ঘোষণা করে দিয়েছে এই সময়। আর তাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারজন মরা-ভয়ে মরা। কারও মুখে কোন বোলহরি ধ্বনি নেই, পথে কেউ খইছেটাচ্ছে না। ফুল ধুপ অগুরু চন্দন নেই। কারও মুখে নেই শোকাতুর কান্না। শুধুচারজোড়া পায়ের জল ছপ ছপ শব্দের মধ্যে দিয়ে ফুরাচ্ছে একটা জীবনের সব পথ। সব চলাচল।

চিৎশোয়া আমি আকাশ দেখি। কালো ছাতার মত আকাশটার গায়ে পোকা কাটা হাজার ছিদ্র। ছোটছোট সেই ছিদ্রে উজ্জ্বল আলোর আভাস।ওটা কী কালপুরুষ! ওটা কী সপ্তর্ষি! শুনেছি আকাশে নাকি ধ্রুবতারা থাকে। সেটা কোনটা? না, আর কোনদিন তা জানা হবে না। জীবনের অনেক অজানার মধ্যে এটাও রয়ে গেল। তবে যা জেনেছি সেটা কী কম! চারকাঁধের মৃত্যুদোলায় চেপে উদার আকাশ দেখা-মানব জীবনের এক অতুল অভিজ্ঞতা। এমন আর কে দেখতে পেয়েছে, যা এখন আমি দেখছি!

এর জন্য আমি কী এখন জীবনকে ধন্যবাদ জানাব? কৃতজ্ঞ হবো, এমন জীবন যে দিয়েছে তার প্রতি?

এখনও আমার বুকের বাঁদিক ঢিপঢিপ করে বলছে–আমি বেঁচে আছি। কিন্তু সে এখন মাত্র একটা কথার কথা। পরিবেশ পরিস্থিতি সে কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলবে তুমি বিগত। তুমি অতীত। তুমি মৃত। ওই আকাশ আর তারা, এই ফুরফুরে হাওয়া সব নিরর্থক। তোমার হাতে গোনা মাত্র কটা নিঃশ্বাস বাকি, তারপর সব শেষ। ঝপাং করে একটা শব্দ হবে, দেহটা তলিয়ে যাবে অতল জলের তলায়। জলচর প্রাণীরা খুবলে খাবে।

নদী যখন, জলে নিশ্চয় খুব স্রোত। আমি ভাল সাঁতার জানতাম। শিরোমণিপুরে একবার জলে ডুবে গিয়েছিলাম। আর যাতে না ডুবি বাবা শিখিয়েছিলেন। এখন আর সে শিক্ষা কোন কাজে আসবে না। আগুন আর বারুদের ছোবলে সারা অঙ্গ অসাড়। হাত পা চলবে না। এত যত্নে বাবার দেওয়া বিদ্যা-সব ব্যর্থ।

একটু যেন ঘুমঘুম পাচ্ছে। ছোটবেলায় মায়ের কোলে এই রকম দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়তাম। মা আমাকে কোলে নিয়ে গান গাইত ছোট্ট সোনা চাঁদের কণা ….., এখন আমার বড় মায়ের কথা মনে পড়ছে। সে যেন তার সেই ছোট্ট শিশু সন্তানকে ডাকছে ফিরে আয় বাপ আমার যাসনে। ফিরে আয়।

ফিরে আয় বললেই কী ফেরা যায় মা? পায়ে পায়ে বহুদুর চলে এসেছি। এখন ফিরে যাবার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আর কোনদিন আমার ফিরে আসা হবে না। বিল্টুদায়।

বর্ষার ভরা দামোদর নদীর ক্রুদ্ধ গর্জন এখন কানে আসছে আমার। পাগলা খ্যাপা ঢেউ ছুটছে। পাড় ভেঙে। তারই ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। বুক থেকে ঠেলে উঠছে একটা বোবাকান্না। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে নামছে নোনা জলের ধারা। বুকের বাঁদিকটা প্রবলভাবে লাফাচ্ছে। আর মাত্র কয়েক পা। তারপরই ঝপাং। সব শেষ। সময় না পায়ের শব্দ তা জানি না শুনতে শুরু করি আমি এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়। হঠাৎ যেন মাঠপাথার কাঁপয়ে–সমস্ত অন্ধকার ছিঁড়ে, আছড়ে পড়ে বিকট একটা গর্জন–ভুউউউতো রে এএএ। থা আআম। থেমে-যা।

–কে! কে?

–আমি বুধো।

–কী হয়েছে?

–দাঁড়া।

অন্ধকার রাতের জল জঙ্গল সাঁতরে ছুটে এসেছে অন্ধ বুধ। কেন! কেন? তার পিছনে আরও দুই মূর্তি। একজন পাঁচ মাসের গর্ভবতী ভুতোর বউ অন্যজন এক নাবালিকা “নারী” সুধা।

ভুতো আমার বাঁ পায়ের দিকে। বুধোর গলার শব্দে সে যেন শক্ত খোটার মতো মাটিতে গেঁথে গেছে। যে খোটা অন্য তিনজনে মিলে উপড়ে ফেলতে পারবে না। তারাও দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা অবিশ্বাস্য–অলৌকিক কিছু ঘটে যাক, মনে প্রাণে চাইছিল সে। থেমে যাক এই মরণযাত্রা। অন্ধভাইয়ের রূপ ধরে যেন সেই পার্থিব এগিয়ে আসছে।

বুধো ছুটে গিয়ে সবার সামনে আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর যেন আকাশ মাটি জল হাওয়া মাঠ অন্ধকার সব কিছুর দিকে–মচাকাঁধে দাঁড়িয়ে থাকা চারজনের দিকে অন্ধচোখে আগুন জ্বেলে চিৎকার করে ওঠে–শালা খানকির ছাবালরা–তোরা কী মানষির জন্ম! নাকি কুকুর শেয়ালের পেটে হইচিস! নিজিগার ব্যগ্র ক্ষত্রিয় বলিস। বালের ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়ের অক্ত কী আছে তোগার শরীলি! যে বাবু পাড়ার নোক তোগার মা বোনির কাছে শুয়ে গেল তাগার কোনদিন এট্যা বালও ছিড়তি পারিসনি। আর এই মানুষটা সেই কঁহা মুল্লুক থিকে পেরান হাতে নে এয়েচে তোগার উবগার করতি, বেপদে পড়েছে যে তোগার জন্যি। আর তারে নে চলেছিস নদীতি ফেলতি? ছিঃ ছিঃ!

শুধু বুধো নয়, আমার মনে হয় ভুতোর বউয়ের পেটে যে বাচ্চা সেও প্রতিধ্বনি করছে–ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

কে যেন মিনমিন করে বলে–কিন্তুক যা ওর অবোস্তা এতো বাঁচবে না। কাল না হয় পরশু তো মরেই যাবে।

গর্জে ওঠে বুধো–তুই কী চের জীবন বাঁচবি! এ বচ্ছর নয় ও বচ্ছর যোম তোরে নেবে। তেবু পরান নে ইদিক সিদিক পালাচ্ছিস ক্যান! কতায় বলে য্যাতক্ষণ শ্বাস ত্যাতক্ষণ আশ। যার শ্বাস নাই তার আশ নাই। মানুষটার এ্যাখোনও ঘাস চলতিছে।

–ভয় তো এ্যাটাই–যেদি পুলুশে ধরে নে যায়।

–সে তো উত্তম কতা। সেখেনে চিকিচ্ছেডা পাবে। বেঁচে যাবে।

–যদি আমাগার নাম বলে দ্যায়!

তাতে কার কী বাল ছেঁড়া যাবে? পাঁচটা কেসে এ্যাখোন পুলুশে খোঁজে, ত্যাখন ছটায় খুঁজবে। এর বেশি আর কী হবে!

ভুতো আর কোন কথা বলে না, কথা শোনেনা। পাঁক মেরে মাঁচার মুখ ঘুরিয়ে দ্যায়। যে পথে ওরা চারজনে হেঁটে এসেছিল সেই পথে এখন ফিরে চলে সাত জোড়া পা। যাবার বেলা যাদের বুক জুড়ে দাপাচ্ছিল ভয়, এখন দৌড়ে বেড়াচ্ছে সাহস। সাপ জোঁক ঝিনুক শামুক পিষে যাচ্ছে ওদের দৃঢ় পায়ের তলে। তাকিয়ে দেখি পূর্বাকাশে তখন দেখা যাচ্ছে হালকা আলোর একটা রেখা। মনে হয় কিছুক্ষণ পরে সূর্য উঠবে।

এ আমার নবজীবনের সূর্যও।

.

অবশেষে অনেকবারের মত আর একবার ফিরে আসতে পেরেছি নিশ্চিন্ত মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে। আমাকে ঢুকিয়ে রাখা হল সেই ঘরে যে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নদীবক্ষে বিসর্জনের জন্য। ঘরের দরজায় একটা বল্লম নিয়ে পাহারায় বসে গেল বুধধা। তার চোখে এখন আর কোন অন্ধকার নেই। সে এমন অনড় হয়ে বসে রইল যে দেখে মনে হচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ তো তুচ্ছ, ভারত সরকারের সেনা বাহিনীরও ক্ষমতা হবে না, তাকে ঠেলে এই ঘরে প্রবেশ করে। সুধা আর তার বউদি মমতাময়ী দুই বঙ্গললনা লেগে গেল অসুস্থের শুশ্রূষায়। কিন্তু শুধু শুশ্রূষায় তো আর দেহের দগ্ধক্ষত নিরাময় হবার নয়। এর জন্য চাই চিকিৎসক, চাই ওষুধ। আহবালিরা মনে হয় গোটা পঞ্চাশ টাকা ভুতোর কাছে দিয়ে গিয়েছিল সেই সম্বল নিয়ে ভুতো খুঁজতে বের হল এক ডাক্তার।

সেদিন ছিল হাটবার। হাটবার না হয়ে অন্যকোন বার হলে নিঃসন্দেহে আমার সমস্যা অনেক বেড়ে যেত। সেই হাটে ভুতো গরু খোঁজার মত খুঁজে বেড়াচ্ছিল এমন একজনকে যে এই মহা বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে। সে শুধু ডাক্তার হলেই তো হবে না যেন বিশ্বস্তও হয়। যেন গোপন কথা পাঁচকান করে না বসে। এটাই ছিল ভুতোর কাছে একটা ঘোর সমস্যা। ডাক্তার তো অনেক পাওয়া যাচ্ছিল, পাওয়া যাচ্ছিল না বিশ্বস্ত কাউকে। যাদের পেয়েছিল তারা কেউ ডাক্তার নয়।

ঘরে পোড়া রুগী। তাকে তো বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা যায় না। তাই সে নিরুপায় হয়ে এমন একজনকে ধরে নিয়ে এলো যে এক ডাক্তারের ভাই।

অল্প কিছু পড়াশোনা জানা, মধ্যম চাষীর ছেলে, সেই কোয়াক ডাক্তারের এই ভাইয়ের আশা “বড়” হয়ে সে একটা বিরাট কিছু হবে। কিন্তু কী যে হবে সেই বিষয়ে এখনও ভাবনা চিন্তা করে যাচ্ছে। ভাবনা চিন্তার মত কঠিন কাজ লোকজনের ভিড়ে হয় না। এর জন্য একটা নিরিবিলি স্থান। দরকার। তেমন নিরিবিলি স্থান আজকাল আর কোথায় মেলে? তাই বেচারা বাধ্য হয়ে একটা মাছমারা ছিপ নিয়ে চলে যায় কোন জলাশয়ের পাড়ে। জলে ছিপ পেলে ফাতনায় চোখ রেখে দিনভর নানা রকম পরিকল্পনা করে। কিন্তু তার মা বাবা এসব গুঢ় বিষয় বোঝে না। তারা বলে–লেখাপড়া শিখলি না, চাষের কাজও পারিস না। মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু জানিস নে। আমরা মরে গেলে কী যে হবে তোর।

কী হবে? আর যদি কিছু করতে না পারে, ডাক্তারি করবে। তার দাদা বলে ডাক্তারি করতে হলে সেটা তো শেখা লাগবে। শেখা? সে আর এমন কী। দেখে দেখে শেখা তো হয়েই রয়েছে। সে যে সব শিখে বসে আছে, সেই প্রমাণও একদিন দিয়ে দেবে। যদি নাগালে কোনদিন তেমন কোন কঠিন রুগী পেয়ে যায় তাকে সারিয়ে। নিয়ে যাবে তাকে দাদার সামনে–দ্যাখ দাদা আমিও পারি।

ভগবান এতদিনে তার প্রতি সদয় হয়েছে। পেয়ে গেছে এমন এক রোগী যার অর্ধেক শরীর পোড়া। এবার চলবে চিকিৎসা। গিনিপিগের উপর যেমন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে। যদি রোগী বেঁচে যায় নবীন এক ডাক্তারের নামে জয় জয়কার হবে। যদি মরে যায়, কোন ভয় নাই। নদীতে ঢের জল। ভুতো বুখোরা নিজেদের জ্বালায় লাশ নিয়ে নদীতে ফেলে আসবে। কেউ ডাক্তারের নামে দোষ চাপাবার সুযোগ পাবে না।

হাট থেকে ডাক্তার ভুতোর সাথে আমাকে দেখতে এসেছিল। দেখে সে তখনকার মত চলে গেল। ফের এল ঘণ্টা দুয়েক পরে, হাতে ছিপ আর লুঙ্গির কোঁচড়ে কিছু ওষুধপত্র নিয়ে। আগেই সে বলে গিয়েছিল–সে ডাক্তার নয়, ডাক্তারের ভাই। তবে কোন রোগে কী ওষুধ সেটা সে জানে। যদি চিকিৎসায় কোন জটিলতা দেখা দেয় সে তার দাদার পরামর্শ নেবে।

এখন সে আমাকে দুটি ইনজেকশান দেবে। একটি টিটেনাস একটি পেনিসিলিন। পোড়াস্থানে লাগাবে সোফ্রামাইসিন। আমি আর কী করব তখন। নিজেকে সমপর্ণ করে দিলাম এই শিক্ষানবিশের হাতে। যার জীবনের প্রথম রোগী আমি। হয় রোগ, নয় চিকিৎসা এতেই তো মানুষ মরে। আমি শুনেছি, সারা পৃথিবীতে নাকি যতলোক রোগে মরে তার অর্ধেক বিনা চিকিৎসায়, অর্ধেক ভুল চিকিৎসায়। যারা সেরে ওঠে সব বরাত জোরে, নয় ট্যাকের জোরে। আমার সামনে এখন দুটো পথ খোলা, হয় ডাক্তারের হাতে খুন হওয়া, না হয় ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া।

প্রথমদিনের ওষুধে ভূতোর চল্লিশ টাকা শেষ। তাহলে কাল কী হবে? পরশু? একটা পাঠাছাগল ছিল ভুতোর। সেটা বিক্রি করে দিল একশো কুড়ি টাকায়। ষাট টাকা নিজের সংসারের জন্য রেখে বাকি ষাট টাকায় আরও দুদিন চলে গেল। এখন রোজ দুটো করে ইনজেকশান আর পোড়াতে পাউডার অষুধ লাগানো হচ্ছে।তিন দিন পার হয়ে গেল, আহবালিরা কেউ এল না। আসবে না যে সে আমার মন জেনেছিল। বোঝেনি বোকা ভুতো।

ডাক্তারের তখন চিকিৎসার নেশা ধরে গেছে। নতুন গাড়ি চালানো শিখলে যেমন হয়। সব সময় মনে হয় চালাই, চালাই। সে তার দাদার ডিসপেনসারি থেকে লুকিয়ে লুঙ্গির কোচড়ে ওষুধ এনে দুদিন চিকিৎসা চালিয়ে তিনদিনের বেলা ধরা পড়ে গেল। তখন কী উপায়? যে লোকটা বিড়ি ধরাবার চেষ্টায় দেশলাই জ্বেলেছিল, গ্রামের সবাই–বিশেষ করে বুধো চাপ দিল তাকে–কেরাম মানুষ তুই! মানষির রক্ত শরীলি আছে? না, নেই? তোরি জন্যি লোকটা মরতিছে আর তুই মোট্টে হাত উপুর করলি না? সে গরিব, খুবই গরবি। তার সম্বল বলতে একখানা ভাঙা সাইকেল। যা সে প্রায় বছরখানেক আগে চুরি করে এনেছিল। বহু অভাব অনটনেও সেটা বিক্রি করেনি। কঠিন চাপের সামনে পড়ে এবার সেটা তিনশো টাকায় বিক্রি করে দিল। তবে তা থেকে সে ভূতোকে দেড়শোর বেশি কিছুতে দিল না। এইভাবে “এদিক সেদিক” করে প্রায় পনেরদিন চিকিৎসা চলার পর লাঠিতে ভর দিয়ে পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে পারলাম। যেদিন সকালে প্রথম ঘরের বাইরে এসে সূর্যোদয় দেখলাম, মনে হল পৃথিবীটা কী সুন্দর। ধানের শিষে পড়া সোনা রোদ যেন শিশুর মত হাসছে। মিষ্টি মিষ্টি স্বতন্ত্র স্বাসফেদুল গায়ে বুলিয়ে দেওয়া মায়ের কোমল হাত।

আমাকে দু পায়ের উপর দাঁড়াতে দেখে ভুতো বুধো সুধা তার বউদির মুখে যে কী অনাবিল হাসি! তবে সব হাসিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল নবীন ডাক্তারের সাফল্যের হাসি। যেন সে আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেয়ে গেছে। পঞ্চাশ ষাট টাকার ওষুধ তার নিজের ট্যাক থেকে এসেছে, পনের দিনের পরিশ্রমও গেছে। সে নিয়ে তার মনে এখন কোন শোকতাপ নেই। সে যেদিন পারে দেবে ভুতো। এখন তার সফলতার সুখ উপভোগ করার দিন। বলে সে–আজ রাতে আমি তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। তোমার পোড়ার জায়গাগুলো আমার দাদাকে দেখাবে।

আশুদা, আমাকে ক্ষমা কোরো, নকশাল বাড়ি আন্দোলনের অসংখ্য শহিদ, আমাকে ক্ষমা কোরো। আমি জানতাম না, গ্রামবাংলার মানুষ তোমাদের এত ভালোবাসে। তোমাদের নাম এত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে। আমি কিছুদিন তোমাদের সাথে ছিলাম। তোমাদের মতো ছিলাম না। বিপ্লবী রাজনীতির বিন্দুবিসর্গ তখন বুঝতাম না। এখনও যে বুঝি এমন দাবি করতে পারব না। তবু সেদিন তোমাদের সঙ্গে যে ছিলাম এক সময়, সেই পরিচয়টুকুতে আমি প্রিয় হয়ে গিয়েছিলাম কিছু মানুষের কাছে।

একজন শ্রমিক যে উৎপাদনমুখি শ্রমের সাথে যুক্ত। একজন কৃষক, যে সন্তান স্নেহে যত্নে জমিতে ফসল ফলায়।শ্রমজীবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগের ফলে তারা শোষণবাদী ব্যবস্থার স্বরূপ জানে। ফলে তার ব্যবস্থার প্রতি সঙ্গত ক্ষোভ জন্মে। সে ওই ব্যবস্থার ধ্বংস সাধনে পুঁথি পড়া রাজনৈতিক কর্মীর তুলনায় অনেক সময় অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষে যে ছোটবড় প্রায় দুশো আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে তারা তো কেউ দাস ক্যাপিটাল বা রেডবুক পড়া মানুষ ছিল না। তাদের বাস্তব জ্ঞান তাদের বাধ্য করেছিল বিদ্রোহ করতে।

আমি তো শ্রমিক নই কৃষক নই। আমার কোন দেশ নেই। যে অবস্থা এবং ব্যবস্থার মধ্যে আমার বাস, সেখানেও জীবন কোন শেকড় বসাতে পারেনি। যে গভীর অধ্যয়ন থাকলে সবকিছুর পরেও একজন ভালো রাজনৈতিক কর্মী হওয়া যায় নিরক্ষরতার জন্য আমি সেও পারিনি। তবু সেদিন আমার সব অযোগ্যতা অপূর্ণতা অজ্ঞতা চাপা পড়ে গিয়েছিল বারুদে পোড়া দাগের নিচে।

সন্ধ্যে ঘোর হয়ে গেলে ডাক্তার একজন বলবান যুবাকে নিয়ে হাজির হয়েছিল ভুতোর বাড়ি। সেই যুবক বি. এ. পাশ করে এখন বেকার হয়ে বসে আছে। যে আমাকে কাঁধে করে প্রায় মাইল তিনচারেকধান ক্ষেতের জলকাদার মধ্যে দিয়ে, নিয়ে এসেছিল ডাক্তারের বাড়ি। তারপর নিঃশব্দে পিছন দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ঘরে। আমিও চাইছিলাম ভুতের বাড়ি থেকে চলে আসতে। এই চৌদ্দ পনের দিনের সবকটা রাত কেটেছে ভয়ে ভয়ে-এই বুঝি পুলিশ আসে। সকালে সে ভয় আরও বেড়ে গিয়েছিল, তীরে এসে তরী ডোবে এই উপমাটা মনে পড়ায়।এতদিন বিছানায় পড়েছিলাম, তখন কিছু হলে করার কিছু থাকত না। কিন্তু এখন হলে, সেবড় আক্ষেপের। তাই ডাক্তার বলা মাত্র রাজি হয়েছিলাম। তা ছাড়া ডাক্তারের বাড়ির সামনে পাকা রাস্তা। এ রাস্তায় ভ্যান রিকশা চলে। ভোর বেলা সেই ভ্যানে চেপেই বাস রাস্তায় যেতে হবে।

ডাক্তার আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল তার দাদাকে দেখাবে বলে। পরে অবশ্য সে মত পাল্টে ফেলেছিল। না থাক। যদি কিছু হয়। পরের দিন সে আমাকে, যেভাবে লুকিয়ে তার ঘরে ঢুকিয়ে ছিল, সেইভাবে সবার নজর বাঁচিয়ে ভ্যানে এনে তুলে বাস রাস্তায় নিয়ে এসেছিল। পথে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল–কী করে পুড়েছে? আমার হয়ে জবাব দিয়েছিল ডাক্তার–স্টোভ ফেটে। বলেছে–আমি তাদের চাষের কাজের লোক। বাসে সে আমার সাথে বর্ধমান পর্যন্ত গিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল।

সে কবেকার কথা। আজও আমি সেই প্রাণরক্ষাকারী ভুতো বুধো সুধা তার বৌদি, ডাক্তার, এবং সেই কাঁধে বয়ে নিয়ে আসা যুবক কারও কথা ভুলতে পারিনি। উচিৎ ছিল একবার গিয়ে সবার সাথে দেখা করে আসা। নানা কারণে সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আর এখন তো সে গ্রামের নাম, যাবার পথ, সব ভুলে গেছি। জানি না এই লেখা তাদের কারও চোখে পড়বে কী না। ভুতোরা লেখাপড়া জানত না। কিন্তু ডাক্তার আর সেই যুবক তো জানে। ওরা বুঝবে কেন আমি যেতে পারিনি। তখন নিশ্চয় আমার না যাওয়ার অপরাধ ক্ষমা করে দেবে।

শহাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে বাসে উঠলাম। তখনও ঠিক করতে পারছিলাম না এই শরীর নিয়ে কোথায় যাব। শিয়ালদহ স্টেশনে এসে বহুক্ষণ বসে একে একে মনে করছিলাম সব চেনা মুখ। যার কাছে গেলে এই সময়ে সাহায্য পাবো। মেঘনাদ আহবালিদের বাড়ি চিনি না। ওরা চেনায় নি। সবার সাথে সবার দেখা হয়, বারুইপুর রেল ব্রিজের পাশে এক চায়ের দোকানে। সেও আগে ভাগে বলা কওয়া থাকলে। আজ সন্ধ্যায় ওরা সেখানে আসবে কী আসবে না তা কে জানে। একবার মনে হল, পাগলা সরদারের বাড়ি যাবার কথা। কিন্তু তারা এত দুঃস্থ যে নিজের পেটের ভাতই যোগাড় করতে পারে না। আমাকে খাওয়াবে কী? কম পক্ষে আট দশদিন আমার সুস্থ হবার জন্য সময় দরকার।

শরীরের যে সব অংশ পুড়ে গিয়েছিল তার ঘা তো শুকিয়ে গেছে। রয়ে গেছে পোড়ার দাগ। যা আগে ডিমের মত সাদা দেখাচ্ছিল–এখন কয়লার মত কালো। জামা আর লুঙ্গির নিচে সে দাগ ঢাকা পড়ে আছে। বাইরে থেকে দেখা যায় না। দেখা যায় মুখের ডানদিকের পোড়া দাগটা। মাথায় গামছা বেধে গামছার একটা প্রান্ত ঝুলিয়ে দিয়ে সে দিকটাও ঢেকে নিয়েছি যতটা পারি। তবে ঢাকা যায়নি ডানপায়ের জোড়ের উপরকার পোড়া। শরীরে সবচেয়ে বেশি পুড়েছিল এই জায়গাটা। এখানকার চামড়া খুলে ঝুলছিল। যা আমি তখনই টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। এখনও সেই ঘাটা কিছু রয়ে গেছে। যা কড়কড় করছে। হাঁটতে গেলে টান ধরে আর মনে হয় বুঝি ছিঁড়ে গেল। পায়ের কারণেই আমার হাঁটায় বড় অসুবিধা হচ্ছে। এই পা নিয়ে আমি কোথায় যাব!

যাদবপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতে সাহস হল না। ওখানে গণেশ গোপালরা থাকে। ওদের কাছে কিছু সাহায্য পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু তার আগে যদি কোন শত্রুর সামনে পড়ে যাই নিজেকে রক্ষা করতে পারব না। কার্তিক হাসপাতাল থেকে এসে গেছে। যদিও তার শরীর এখন অক্ষম কিন্তু তার ভাই, মণি ও শিবশংকর তো সক্ষম সুস্থ। তাই ট্রেনের ভিড়ে মুখ লুকিয়ে গিয়ে নামলাম বাঘাযতীন স্টেশনে। আর সারাদিন সেখানে শুয়ে বসে থেকে সন্ধ্যের কিছু পরে একটা রিকশায় পঞ্চাশ পয়সা ভাড়া দিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম বাস রাস্তার মোড়ে সেই ডেকরেটার্সে-কাজ না থাকলে কাজ পাবার আশায় যেখানে নরেশ ঠাকুর বসে থাকে। এখন এই লোকটাই আমার সবচেয়ে বড় ভরসার।

নরেশ ঠাকুর আমাকে ভালোবাসে সেটা জানতাম। জানতাম না কতটা ভালবাসে আর সে জন্যে কতদূর আগাতে পারে। ঝুঁকি নিতে পারে। এমনিতে মানুষটা যথেষ্ট বিপন্ন। তার মুখটা দেখলে খুবই মায়া হোত। তাই আমিও চাইতাম না যে তার সাথে কোন গভীর যোগাযোগ রাখি। তাহলে হয়ত “সঙ্গদোষের” কারণে সে আমার শত্রুপক্ষের নিশানায় এসে যাবে। মানুষ তো এই সময় পাগলা কুকুরের চেয়ে খারাপ। সব সময় দাঁত বের করে ঘুরছে কাকে কামড়াবে। কিছুদিন আগে সেই বিভৎস কাশীপুর বরাহনগর গণসংহার হয়ে গেছে। যাকে খুঁজছে তাকে না পেয়ে তার ভাই বন্ধু যাকে পেয়েছে খুন করে দিয়েছে খুনিরা। তাই গরফায় চলে যাবার পর তার সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখিনি। এমন কী দণ্ডকারণ্য থেকে ফিরে এসে চার পাঁচদিন না খেয়েছিলাম, আমি জানতাম তার কাছে যেতে পারলে সে যা খেত তার থেকে একভাগ নিশ্চয় আমাকে দিত। তবে তখন সে যেখানে থাকত যাওয়া যেত কিনা সে আমার পক্ষে একটা ভাবনার বিষয়।

এরপর আবার তার সাথে যোগাযোগ হয়েছিল আমি রিকশা চালানো শুরু করার পর। তখন নরেশ ঠাকুর কোথাও কাজে গেলে সেখান থেকে খাবারটি পরিপাটি করে গুছিয়ে আমার জন্য নিয়ে আসত। এবং যত রাত হোক পোটলাটি স্টেশনে আমার হাতে তুলে দিয়ে যেত। কোন কোনদিন কাজের জায়গা থেকে আমি তাকে রিকশায় তুলে নিয়ে আসতাম।

এরপর আবার কার্তিকের ঘটনার পর তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সে তখন আনন্দপল্লীতে ঘর ভাড়ায় থাকত। ওই পাড়ার কিছু লোকের সাথে কামারপাড়ার একটা সম্পর্ক আছে। আমার একটা ভয় ছিল, যদি তারা আমাকে বন্ধুর শত্ৰু অতএব আমার শত্রু। এবং শত্রুর বন্ধু সেও আমার শত্রু এই মনে করে নরেশ ঠাকুরকে নিগ্রহ করে।

কিন্তু আজ আমি বড় নিরুপায়। পৃথিবীর সব দরজা এখন আমার জন্য বন্ধ বলে মনে হচ্ছে। থাকে যদি সে ওই ছোট্ট ঘুলঘুলি, ওই নরেশ ঠাকুর। আশা করেছিলাম, দেখা পাব। দেখা পেয়ে গেলাম। সেদিন তার কাজ ছিল না। ডেকে নিয়ে বলি তাকে বড় বিপদে পড়েছি। আমার শরীর পুইড়া গেছে। কী করে? তার প্রশ্নের জবাব বলি–বারুদে। বলি, একবাজির কারখানায় কাজ করি। কালী পটকা দোদমা বানায় না? সেই কারখানায়। দিন পনের সবে লেগেছি। তা আমি তো জানি না যে ওই কারখানায় বিড়ি খাওয়া বারণ। ভুল করে যেই বিড়ি ধরিয়েছি, বারুদে আগুন ধরে গিয়ে।”ওরা কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি।” দিয়েছে, দিয়েছে। সেই টাকায় তো চিকিৎসা করে পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে পেরেছি। তবে তাদের খুব বেশি চাপ দিতে পারিনি। দোষটা তো আমার। প্রচুর টাকার বাজি পুড়ে গেছে। আর বাজির কারখানায় কাজ করব না। অন্য একটা কাজ দেখেছি। তবে শরীরটা ঠিক না হলে তো। এর জন্য দশ বারোটা দিন দরকার। কোথায় থাকি, কী খাই?

নরেশ ঠাকুর সরল সোজা মানুষ। খুব একটা চালাক চতুর নয়। তা হলে কী অত বড় বাড়িটা ওভাবে চলে যায়। তবে এত বোকাও নয় যে আমার চালাকিটা ধরতে পারছে না। সে নিয়ে একটাও কথা বলল না।বলে অন্য কথা–আমি ওইশ্রীকলোনির ওদিকে ঘরভাড়া নিয়েছি।ওদিকে তোকে কেউ চেনে নাকি?

চেনে! তবে সে কথা নরেশ ঠাকুরকে বলি না। শ্রী কলোনির এক কংগ্রেস নেতা আমাকে চেনে। এই লোকটা আগে নকশাল পার্টি করত। বেশ কিছুদিন আগে কে বা কাহারা যেন বোমা পাইপ নিয়ে এক তুমুল বর্ষার রাতে শ্রী কলোনির নকশাল ছেলেদের ডেরায় হামলা চালায়। তারা তাকে তো পায় না পেয়ে যায় তার পাঁচ সঙ্গীকে। যাদের পরের দিন সকালে নলিকাটা অবস্থায় লায়েলকার মাঠে জলকাদার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

শ্রী কলোনির পাশের পাড়া বিজয়গড়। সেখানে তখন সি আর পি-র ক্যাম্পবসেছে। যাদের সাহস এবং সহায়তায় পাড়া ছাড়া কংগ্রেসিরা পাড়ায় ফিরে এসে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হচ্ছে সি.পি.এম উৎখাত করবার জন্যে। সে গিয়ে সেই দলের সাথে হাত মেলায়। যার ফলে তার নাম হয় কংসাল। এবং সে-যে আমার ছেলেদের মেরেছে তাদের নিকেশ করে দেবব্রত নিয়ে আশেপাশের পাড়ায় হামলা শুরু করে দেয়। এরই ফলে একটা বিরাট এলাকা এখন সিপিএম মুক্ত।

একান্তে সে একদিন আমাকে বলেছে–এই যা দেখছিস, এতো আমার ছদ্মবেশ। উপায় ছিল না তাই ধারণ করতে হয়েছে। আসলে আমি তা-ই আছি, আগে যা ছিলাম। চলে আয় আমার কাছে।

তার সেন্টারে চলে যেতে মনের সায় পাইনি। ওরা তো আমাকে বসিয়ে খাওয়াবে না। হাতে বোমা দিয়ে ছুঁড়তে পাঠাবে। সে ছুঁড়বো তো কার দিকে ছুঁড়বো? এদিক কিংবা ওদিক, সার বেধে যারা দাঁড়িয়ে আছে সব তো নকল শত্রু। আসল শত্রু তো নাগালের বাইরে। আমি তখন এই সত্যটা বুঝে ফেলেছি। কার্তিক যদি আবার আমার উপর আক্রমণ করে, আমি হয়ত তার পেট সোজা আবার চাকু চালাবো। কিন্তু তাতে আনন্দ হবে না, কষ্ট হবে। তাই যাওয়া হয়নি তার আশ্রয়ে। তবে এটা জানি আমার পূর্ব পরিচিতির কারণে সে আমার কোন ক্ষতি করবে না। ছোটখাটো বিপদ এলে বাঁচাবে।

বলে নরেশ ঠাকুর–বাজিতে পুড়েছিস বলবি না। বলবি, আমার সাথে কাজে গেছিলি। উনুন ভেঙে লুচির কড়াই উল্টে গিয়েছিল। সেই আগুনে পুড়েছিস। তাই বলেছিলাম আমি।

এরপর বেশ কটা দিন ছোট ছোট কটা সমস্যা ছোট ছোট কটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। আমি এখন লাঠি ছাড়া চলতে পারি। তখন মনে হল, নরেশ ঠাকুর আমাকে একটু স্নেহ করে, সেই দাবিতে তার ঘাড় ভেঙে এত কষ্টের অন্ন ধ্বংস করা ঠিক হচ্ছে না। এবার আমাকেও কিছু একটা কাজকর্ম খুঁজে নিতে হবে। মা বাবা ভাই বোন সে তো ছিলই, তারপর আবার ঘটনাচক্রে এক মহিলার দায়দায়িত্ব আমার উপর এসে গেছে। নরেশ ঠাকুরও আশা করছে আমি তার শেষ জীবনের আশ্রয় হবে। তাই একদিন পথ খুঁজতে পথে বের হয়ে পড়লাম।

জন্ম মুহূর্তে মধু বঞ্চিত এক অভিশপ্ত মানুষ আমি। জীবন আমার জন্য সব কটা সোজা পথ, সাধারণ আর স্বাভাবিক চলার পথ বন্ধ করে রেখেছে। আমার চলার জন্য ভোলা আছে অন্ধকার আঁকাবাঁকা রক্তপেছল পথ। যে পথ গিয়ে শেষ হয় কোন হাসপাতালের লাশ কাটা টেবিলে। কোন অন্ধকার জেলখানার কালো কুঠুরিতে। কোন নুন বোঝাই গর্তে। কোন শেয়াল শকুনের পেটে। এই সব কটা পথের মধ্যে একমাত্র জেলখানার কালো কুঠুরিটাই কিছু কম নৃশংস। কারণ সেখানে প্রাণটা বেঁচে থাকে। আশা রাখা চলে হয়ত শেষ পর্যন্ত থাকবে।

একদিন দেখলাম আমি হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছি সেই কালো কুঠুরিতে।

এই সময় অর্থাৎনরেশ ঠাকুরের বাসা থেকে বের হয়ে জেলখানায় পৌঁছানো পর্যন্তকিছুদিনের কথা আমি ইচ্ছা করেই বলা থেকে বিরত থাকছি। সে এত রক্তপাত আর ভয়ংকরতা পূর্ণ তা লিখতে যেমন ভালো লাগছে না হয়ত পড়তেও কারও ভালো লাগবে না। তাই…।

বারুইপুর স্টেশনকে পিছনে ফেলে বাদিকের বাস চলা রাস্তা ধরে মাইল সাত আট আর চম্পাহাটি রেল স্টেশন পিছনে ফেলে বারুইপুরের দিকে মাইল চারেক হাটলে পাওয়া যাবে একটা নোনাজলের খাল। এই খালপাড়ের পথ ধরে মাইল তিনেক হেঁটে এলে যে গ্রাম এখানেই পাগলা সরদারের বাড়ি। হাতে কিছু টাকা এসে যাওয়ায় আশি টাকার এক কাহন খড়, চল্লিশ টাকায় আটখানা বাঁশ, দড়িদড়া পেরেক আরো গোটা কুড়ি টাকা, তিরিশ টাকার মতো মিস্ত্রি মজুরে ব্যয় করে এই খাল পারে একখানা ঝুপড়ি বানিয়েছি আমি। এই ঘরের কোন দরজা নেই। দরজার সামনে একটা বস্তা কেটে ঝুলিয়ে রাখদমজরুজাতে তাদের দরকার যাদের ঘরে দামি কোন মালপত্র থাকে। এই ঘরে এমন কিছু নেই যা চোরের পছন্দ হবে। একটা খেজুর পাতার ছেঁড়া মাদুর, মাটির একটা কলসি একটা কালো বেড়ানো ভাতের হাড়ি, একটা ভাঙা কড়াই, দুটো এ্যালমুনিয়ামের থালা।

তবে এই ঘরে একজন মানুষ থাকে। সে বর্তমান শাসক সম্প্রদায়ের কাছে খুবই মূল্যবান এক জীব। সে কী নিজে কোনদিন জানতো যে তার মতো একজন তুচ্ছ মানুষ এই দেশকালের কাছে এত দামি হয়ে উঠবে? যে, তাকে নিয়ে যাবার জন্য খোদ লালবাজার থেকে একজন উচ্চ শিক্ষিত উচ্চ বেতনে চাকুরিরত অফিসার, রাতের ঘুম নষ্ট করে জনা পনেরো কুড়ি অস্ত্র সজ্জিত পুলিশ নিয়ে বৃষ্টি ভেজা পথে পেছল খেতে খেতে সূর্য ওঠার ঢের আগে এখানে পৌঁছে যাবে।

কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। তখন দুরের পথটার দিকে একবার তাকালে দেখে নিতে পারত বাস রাস্তায় ভ্যান রেখে হেঁটে আসা দলটাকে। ভোরের আধো আলোয় খাল পার হয়ে ও পারের জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে পড়লে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হতো।কিন্তু ভাগ্য খারাপ, ওদিকটায় চোখ যায়নি। প্রস্রাব করে ঘরে ঢুকে ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে আর একটু ঘুমিয়ে নেবে ভেবেছিল। সে ঘুম ভেঙে গেল সদ্য চাকুরি পাওয়া এক যুবকের গলার আওয়াজে, এই ওঠ। তার হাতে চকচক করছে একটা গুলি ভরা রিভালবার। যা সেই সময় তাক করা ছিল আমার দিকে। সে তো কোন পুলিশি পোষাকে ছিল না, তবে তার পিছনে দাঁড়ানো দুজনের হাতে রাইফেল-পরিধানে খাকি পোষাক ছিল। তাদের সাথে ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে দেখতে পেলাম, ঝুপড়িকে চারিদিক থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে দশ বারো জন আরো পুলিশ।

এবার যে পথে এসেছিল তারা, আমাকে নিয়ে ফিরে চলল সেই পথে। হাতে হাত কড়া পড়িয়ে দিয়েছে। কোমরে বেধে দিয়েছে মোটা দড়ি। দড়ির এক প্রান্ত ধরে রেখেছে সাদা পোশাকের একজন সেপাই। সেইভাবে এসে উঠলাম বাস রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা একখানা জাল ঢাকা কালো ভ্যানে। সে ভ্যান দক্ষিণবঙ্গের ধানক্ষেত পেয়ারা বাগান পুকুর স্কুল হাসপাতাল গোরুর পাল দেখতে দেখতে ছুটে চলল লালবাজারে দিকে। লালবাজার–এটা শুধু মাত্র একটা নাম, একটা সরকারি অফিস বা কোন বিকিকিনির বাজার নয়–রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বাপেক্ষা শক্তিকেন্দ্রের একটি।

ভ্যান থেকে নামিয়ে প্রথমে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল এক বিল্ডিংয়ের দোতলাকী তিনতলায়। দেখলাম সেখানে গ্রাম শহরের নানা জায়গায় রাতভর তল্লাশি চালিয়ে আমার মত আরো জনা তিরিশকে ধরে আনা হয়েছে। আমি এদের কাউকে চিনি না। এরাও আমাকে চেনে না। আমি মাত্র একজনকেই চিনি। যাকে একবার আমার ঝুপড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। যে কারণে সে এখন আমাকে ধরিয়ে দিতে পেরেছে। গতকাল সকাল সাতটায় সে ধরা পড়েছিল। বেলা দুটো থেকে বেলা চারটে দু ঘন্টার মারে তার পেটের সব খবর পুলিশ বের করে নিয়েছে। কবে, কোথায়, কার কার সাথে মিশে কি কী করেছে, সব বলে দিয়েছে। সে বলেছে একজনের নাম, সেইজন বলেছে আর দু জনার নাম, সব মিলিয়ে এই এত জন। এর কিছু পুলিশই বেলা হলে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেবে। কিছু কোর্ট থেকে আজকালের মধ্যে জামিন পেয়ে যাবে। কিছু জামিন পাবে নব্বই দিন পরে। আর আমি? আমাকে এখন থাকতে হবে। সেটা পুলিশের কোন দোষ নয়, আমারই অক্ষমতা। জামিন করে ছাড়া পেতে হলে টাকা লাগে। আমার তা ছিল না যে।

যে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে তার মুখে আমার বিষয়ে শুনে পুলিশের একটা ধারণা হয়েছিল কোন রাঘব বোয়াল। কিন্তু আমার ঘর তল্লাশি করে যখন বোমা বন্দুক কিছুই পাওয়া গেল না, আর এখন যখন “জিজ্ঞাসাবাদ” করে জানা গেল যে–আমি রেডবুক পড়িনি, দেশব্রতী পড়িনি। কোন “খতম” বা রাইফেল ছিনতাইয়ের সাথে যুক্ত নই, এমন কি আমার চেহারাটাও কোন রাজনৈতিক নেতার মত নয়, স্টেশনের কুলির মত, তখন তারা খুবই হতাশ হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল এতো মাইল পথ ছুটে গিয়ে আমাকে তুলে আনায় খুব একটা লাভ হয়নি। এতে কোন রিওয়ার্ড পাবার সম্ভাবনা নেই। যে সি.পি.আই এম.এল দলের রাজ্য সম্পাদকের নাম পর্যন্ত জানে না, তাকেনকশাল বলে চালানো হাস্যকর। আর খুন ডাকাতি রেপ চুরি এসব কেস দিতে হলে যা সাক্ষ্য প্রমাণ লাগে, তা-ই বা কই। তবে আনা যখন হয়েছে কেস তো একটা দিতেই হবে। জিজ্ঞাসাবাদও করতে হবে, কোন উপায় নেই এটা ডিউটি। কথায় তো বলে-যেখানে দেখবি ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, মিলিলেও মিলিতে পারে অমূল্য রতন। পি.সি. এনে পিটিয়ে দেখতে হবে যদি কিছু বের হয়।

আমি আজো সঠিক ভাবে জানি না বিপিন পাল রোড়টা কোথায়। তবে এটা জানি যে বিপিন পাল একজন বিরাট বড় নেতা ছিলেন। লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক আর এই বিপিন পাল–এরা সেই ইংরেজ শাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। যে কারণে তখন তিনটে নাম এইভাবে বলা হোত লাল বাল পাল। তো পুলিশ আমাকে সেই মহান নেতার নামাঙ্কিত বিপিন পাল রোডের মারপিট অর্থাৎ তিনশো সাত ধারায় একটা কেস দিয়েছিল। সাথে একটা উপধারা ছিল তিন বাই পাঁচ। এই শেষ উপধারাটা যদি থ্রি প্লাস ফাইভ না হয়ে টুয়েন্টি ফাইভ বাই টুয়েন্টি ফাইভ দিত-মিসা হয়ে যেত। তখন মিসা হয়নি বলে যতটা খুশি হয়ে ছিলাম এখন ততোটা কষ্ট পাচ্ছি। যারা সে সময় মিসা খেটেছিল সব এখন পেনশন পাচ্ছে। তিন বছরের ত্যাগ বাকি জীবনটা সুখি করে দিয়েছে। তবু পুলিশ বিভাগের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে তারা আমাকে জেলে পাঠিয়ে ছিল বলে এই জীবনী লিখতে পারছি। যদি ওই ছোট ধারাটা লাগিয়ে দিত, সারা জীবনের আমার চাল ডালের সমস্যাটা মিটে যেত, বড়ো ভালো হত। আরো অনেক বেশি কৃতজ্ঞ হতে পারতাম।

জীবন আমাকে অনেকবার অনেক পরীক্ষায় ফেলেছে, নিয়ে গেছে অনেক অচেনা অজানা জায়গায়। জল জঙ্গল পাহাড়। যে কারণে অকাঁদেমি পুরস্কার বিজেতা হিন্দি সাহিত্যিক অলকা সারাওগীবলেছেন–এক জীবনের মধ্যে দশটা জীবন। সেই দশ জীবনের এক জীবন এই জেলখানার জীবন। আমি যেদিন জেলে এলাম তারই অল্প কয়েকদিন পরে সারা দেশে ঘোষণা করা হল অভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা। বাথরুমের মধ্যে মানুষ উদোম উলঙ্গ হয়। কেন তা পারে? কারণ তার চারিদিকে দেওয়াল থাকে। কেউ কিছু দেখতে পায় না।

জেলখানার চারিদিকেও নিচ্ছিদ্র দুর্ভেদ্য কঠিন দেওয়াল। ফলে সেই দেওয়ালের আড়ালে জরুরি অবস্থার যে নগ্ন নির্লজ্জ পৈশাচিকতার আত্মপ্রকাশ ঘটবে এতে আর আশ্চর্য কী? তাই তখনকার জেলখানার পরিবেশ মোটেই সংশোধনাগার ছিল না। ছিল পিশাচদের ক্রুর বিভৎস বধ্যভূমি।

কেউ কেউ বলে থাকেন জেলখানা নাকি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে জীবনের যে পাঠ মেলে সে নাকি আর কোথাও পাওয়া যায় না। কী কারণে তারা একথা বলে থাকেন সে আমার জানবার কথা নয়। তবে আমার পক্ষে একথা বলা মোটেই অসমীচীন হবে না যে, সেই বধ্যভূমি সেদিন অধ্যয়নের পক্ষে মোটেই অনুকূল স্থান ছিল না।

পি.সি খেটে, গাটে গাটে থার্ড ডিগ্রির বিষ বেদনা নিয়ে প্রথম যেদিন জেলখানায় এসেছিলাম, দোতলার জানলা দিয়ে যে আকাশটুকু দেখা যায় সেদিকে তাকিয়ে খুব কাঁদছিলাম। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছিল আমার। হতে পারে, বিবাহের পরে পিত্রালয় ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাবার সময়ে বহু মেয়ে কাঁদে না। কিন্তু মুক্ত মানুষের বাসভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জেলখানায় এসে না কাঁদে এমন শক্ত মনের মানুষ খুব একটা পাওয়া যায় না। জেলখানা তো কোন মনোরম ভ্রমণের স্থান নয়। এটা যেন হিংস্র শ্বাপদ সংকুল কোন দ্বীপ। কে যে কখন ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কোন ঠিক নেই। ফলে বুক তো ধরফর করবেই। চোখে তো জল আসবেই।

আমি কাঁদছিলাম গোপনে–নিঃশব্দে। কোর্ট লকআপে বসেই শুনে এসেছি জেলখানায় জোরে জোরে কাঁদলে, তা যারা বছরের পর বছর আত্মীয় স্বজন থেকে বহুদুরের এক জগতে, অসহনীয় অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে তাদের চেপে রাখা মনঃকষ্টউথলে ওঠে। আত্ম পরিজনের জন্য তাদেরও কান্না পায়। চোখের জল বড় সংক্রামক যে। ফলে তারা রেগে গিয়ে আমাকে মারধর করা শুরু করে দিতে পারে।

আমি যে ঘনঘন চোখ মুছছি সেটা একজন মানুষের নজর এড়ায়নি। পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের মত বয়সী মানুষটা আমাদের এই দোতলা ওয়ার্ডের দক্ষিণ দিকের বড় জানালার উপর উঠে বসে দূরের বড় রাস্তা, বাস ট্যাক্সি, লোকজনের চলাচল, দেখছিলেন। মুখময় খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কিছুটা রোগা, গ্রামবাংলার কোন পাঠশালার গরিব মাস্টারের মত চেহারার সেই লোকটা আমাকে কাছে ডাকলেন–এই ছেলে এদিকে আয়। আমি কাছে গেলে জানতে চাইলেন–কী কেস?

বলি–পুলিশেরা কইছে, আমার দশ বছর থাকা লাগবে। সেই কেস!

–দশ বছর! ধারা কত?

–সে তো আমি কইতে পারি না।

–হিস্ট্রি টিকিটে তো লেখা আছে। পড়।

–আমি তো লেখাপড়া জানিনা।

উনি একচোখে দুর্বাসা ক্রোধ আর এক চোখে বুদ্ধের দয়া দিয়ে আমাকে দেখলেন। তারপর হাত বাড়ালেন আমার দিকে–টিকিটটা দে, দেখি।

এই কিছুক্ষণ আগে আমাকে রেশন কার্ডের মত একখানা মোটা কাগজ দেওয়া হয়েছে ’কেস টেবিল’ থেকে। এর নাম হিস্ট্রি টিকিট। এতে বন্দীর নাম ঠিকানা বয়স উচ্চতা ওজন, শনাক্ত করনের জন্য শরীরের একটা বিশেষ চিহ্ন, কী কেসে ধরা হয়েছে তার ধারা, পরবর্তী কোর্টে যাবার দিন, সব লেখা আছে। সেটা আমার হাতে ধরা ছিল। আর ছিল সদ্য পাওয়া একটা থালা, একখানা কম্বল। কার্ডখানা ওনার দিকে এগিয়ে দেই। উনি সেটা দেখে হুম করে একটু শব্দ ছেড়ে বলেন–বাইরে কে কে আছে?

বাইরে আমার সব আছে। কিন্তু তারা থেকেও না থাকারই মত। তাই বলি–কেউ নাই।

–একেবারে একা।

–একেবারে একা।

চিন্তিত দেখায় ওনার মুখ, তাহলে উকিল দেওয়া, জামিন নেওয়া, কেস লড়া এসব কে করবে?

–ত্যামোন তো আমার কেউ নাই।

কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে ফের  বলেন তিনি–তাহলে তো খুবই মুশকিল। পুলিশ এক তরফা কেস সাজাবে। তোর হয়ে যদি কেউ ডিফেন্স না করে–সমস্যা আছে। ওনার গায়ে একটা খাদির পাঞ্জাবি। তার পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে একজনের কাছ থেকে আগুন চেয়ে সেটা জ্বালিয়ে দুটান মেরে আবার বলেন–ক্রিমিনাল কেস জিনিসটা কী রকম জানিস? যেমন ধর রাজমিস্ত্রির কাজ। ধর তোর হাত পা বেধে মাঝখানে বসিয়ে রেখে মিস্তিরি চারপাশে দেওয়াল তুলছে। তখন তোর তো কিছু করার ক্ষমতা নেই। তখন তোর পক্ষ নিয়ে একজন লোক এগিয়ে এল। এক ধাক্কা দিয়ে দেওয়ালটা ফেলে দিল। তুই বেঁচে গেলি। সরকারি যে উকিল সে হল মিস্ত্রি আর পুলিশ হল তার যোগাড়ে। আর ধাক্কা মারা লোকটা হল তোর উকিল। তা তুই যদি সেই উকিলই না দিতে পারিস তো!

ভয়ে ভয়ে জানতে চাই–তাহলে কী আমার দশ বচ্ছরের আগে ছাড়ান পাওনের কোন উপায় নেই?

সেটা এখনই বলা যাবে না। বলেন তিনি–পুলিশ কীভাবে কেসটা সাজায়, কিকী সাক্ষ্যপ্রমাণ তাদের কাছে আছে, সাক্ষীরা ক জন আসে আর না আসে, কি বলে আর কী না বলে, মেজিস্ট্রেটের মুড কেমন থাকে, অনেক ব্যাপার আছে।

বলি–তা আমার বিচার হবে কবে? কবে জানতে পারমু আমার কপালে কতখানি দুর্ভোগ লেখা আছে?

সেও এখন বলা মুশকিল। কোর্টে হাজার হাজার কেস জমে আছে। যেটা নিয়ে নাড়াচাড়া পড়ে সেটা উপরে ওঠে। যেটা নিয়ে নাড়াচাড়া না পড়ে–ফাইল চাপা পড়ে থাকে নিচে। চার পাঁচ বছর ধরে বিনা বিচারে কত লোক পড়ে আছে তার কোন ঠিক নেই। আমারই তো দু বছর।

একটু পরে আবার বলেন তিনি–যা তোর কেস, যদি পুলিশ কেসটা নিয়ে খাটে উপরে দশ নিচে পাঁচ-এর মধ্যে সাজা হতে পারে। তার মধ্য থেকে যতদিন বিনা বিচারে জেলে থাকবি সেটা বাদ চলে যাবে। আর বাকি বছর কটা–বছর হবে নয় মাসে। চোখ বুজে পড়ে থাক। ঠিক কেটে যাবে।

পুলিশ কাস্টডি থেকে জেল কাস্টডিতে এসেছি এখনও চব্বিশ ঘন্টা হয়নি। এখন এক এক ঘন্টাকে মনে হচ্ছে একশো বছরের মত দীর্ঘ আর কষ্টকর। বুকটা ব্যথায় দুমড়ে মুচড়ে আসছে। চোখ থেকে নামছে অকাল বর্ষণ। আশেপাশে আপনজন কেউ নেই। আমি একা, একেবারে একা। এই অবস্থায় পাঁচ সাত বছর একা কী করে কাটাব। এ আমি পারব না। নির্ঘাত মরে যাব। আত্মীয় স্বজন কারও সাথে আর কোনদিন দেখা সাক্ষাৎ হবে না। আর এ জীবনে পা রাখা সম্ভব হবে না মুক্ত মানুষের দুনিয়ায়।

আমার চোখ থেকে জল গড়াতে দেখে বলেন তিনি, কাঁদছিস কেন?

–আমি আর বাঁচব না।

মুখটা বেঁকে গেল তার, বিদ্রূপ, বাঁচবি না তো কী করবি? এখানে যে আত্মহত্যা করবি সে সুযোগও পাবি না। সেলেবন্ধ কঁসির আসামিদের দেখেছিস? বছর বছর পড়ে আছে। সব সময় প্রাণে ভয় আজ মরি না কাল মরি। ওরা আত্মহত্যা করার সুযোগ খোঁজে। রোজ তিলে তিলে মরবার চেয়ে আগেভাগে নিষ্কৃতি নিয়ে নিতে চায়। পারে? এখানে মরাটাও তোর হাতে নেই। ও সব বাজে ভাবনা ছেড়ে দিয়ে ভাব, কী করে এই অবস্থার মধ্যেও ভালোভাবে বাঁচা যায়।

উনি একমনে কিছুক্ষ বিড়ি টেনে শেষে আবার বলেন–আঁম কাছে এদিকে সরে আয়। তোকে একটা জিনিস দেখাই। ওনার ডাকে সরে গেলাম জানালার কাছে। জানালা দিয়ে দখিনা বাতাস আসছে। ভেসে আসছে পথে চলা মোটরকারের হর্নের আওয়াজ। দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপারে কতগুলো বড় বড় গাছ, কটা বড় বড় দালান। বলেন উনি, ওদিকে দ্যাখ তো কিছু চোখে পড়ে কীনা। আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাই। কিন্তু কিছু চোখে পড়ে না।

কিছু দেখতে পাচ্ছিস? ভালো করে ন্যাশন্যাল লাইব্রেরির কার্নিশটা দ্যাখ। দেখতে পাচ্ছিস একটা ছোট্ট বটের চারা। এবার বল দেখি, ওখানে এই বটের চারাটা বেঁচে আছেকী করে? সিমেন্টের নিরেট কার্নিশ, ওখানে রস কোথায়? রসদ কোথায়?

আমি কোন জবাব দিতে পারছি না দেখে জবাব উনিই দেন–ওখানেও রস-রসদ আছে, চারাটার বেঁচে থাকাটাই এ কথার বড় প্রমাণ। তা না হলেও তো মরে যেত। আপাতঃদৃষ্টিতে যা নীরস কঠিন কঠোর ও সেখানে রস পেল কী করে? পেয়েছে, কারণ, সে খুঁজেছে। খুঁজেছে, কারণ সে বেঁচে থাকতে চায়। তাহলে এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য–যে খোঁজে সে পায়, যে খোঁজে না সে পায় না।

ওনার চোখ দুটো এখন প্রাজ্ঞ ঋষির মত অর্ধ নিমীলিত। যেন কোন আত্মজ্ঞানের অতল গভীরে ডুবে বসে আছেন। খোঁজ, খুঁজে দ্যাখ এখানেও আনন্দের উপাদান, রস রসদের ক্ষেত্রবসুধা আছে। না হলে মানুষ এখানে বহু বছর ধরে বেঁচে থাকে কী করে? খুঁজতে থাক, খুঁজলে ঠিক পেয়ে যাবি। এবং এখন তোর সেটাই একমাত্র কাজ। এখানে কেঁদে কোন লাভ হবে না। যতই কাদিস আর মাথা খুড়িস তোকে ছেড়ে দেবে না। যা তাদের করার তা করবেই। যেদিন থেকে জেলগারদের সৃষ্টি হয়েছে লক্ষ লক্ষ লোক এখানে এসেছে। যারা কেঁদেছে, কেঁদে কেঁদে শেষ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত টিকেছিল তারা, যারা কান্না দমন করতে পেরেছিল। আর যারা হাসতে পেরেছিল তারা ইতিহাস হয়ে গেছে।

মুগ্ধচোখে আমি ওনার দিকে তাকাই। কথা শুনে বুঝতে পারি উনি বিদ্বান মানুষ। বিদ্বান এই শব্দের সাথে বিদ্যাভবন পুঁথিপুস্তকের একটা নিবিড় সংযোগ। আমি এখান থেকে বড় রাস্তার ওপারে বিশ্বের এক বৃহত্তম বাচনালয়-ন্যাশন্যাল লাইব্রেরিটা দেখতে পাচ্ছি। শুনেছি, এই পাঠ্যকেন্দ্রে জ্ঞান তপস্বী মানুষেরা পুঁথির পাতায় নিমগ্ন থেকে আহরণ করে নিয়ে যেতে পারে সেই মহাজ্ঞান, যা দিয়ে জীবন ধন্য সার্থক আর পূর্ণ হয়। তবে সে দিয়ে আমার কোন লাভ হবার নয়। আমি কোনদিন ওখানে প্রবেশ পাব না। আমি যে অক্ষরজ্ঞানহীন। ওপার আমার জন্য নয়। আমি এপারের জীব। জেলখানার বাসিন্দা। যে বয়সে বাচ্চারা পাঠশালায় গিয়ে বাল্যশিক্ষা মুখস্থ করে, জীবন আমাকে নিয়ে গেছে গরু ছাগল চড়াতে। বড় সাধ ছিল পড়াশোনা শিখে আমি বড় মানুষ হব। সে সাধ পূরণ হয়নি। আর কোনদিন হবারও নয়।

একদিন সন্ধ্যায়, যখন সূর্য ডুবে গিয়ে চারদিকে নেমেছিল এক বিষণ্ণ আবছায়া আমি একা আমাদের তাবুতে ফিরে আসছিলাম। আর তখন বন্ধ হয়ে যাওয়া, পথের পাশের প্রাথমিক স্কুলটার কাছে এসে কেন কে জানে পাদুটো ভারী হয়ে গিয়েছিল আমার। মনের মধ্যে কে যেন বড় হাহাকার করে কেঁদে উঠেছিল। সে কান্না কী এমন অনাদরে ফেলে চলে যাওয়া বিদ্যাভবনের জন্য। নাকি আমার বিদ্যাবঞ্চিত ব্যর্থ জীবনটার জন্য, তা আমি জানি না। কী এক অমোঘ আকর্ষণ যেন আমাকে টেনে নিয়ে গেল সেই স্কুলবাড়িটার মধ্যে। উপরে টিনের চালা, নিচে সিমেন্টের মেঝে, ঘর মাত্র দুখানা। যে ঘরের মেঝের উপর এখন ধুলোর পুরু আস্তরণ। কোণে কোণে মাটি লেপা বেড়ার এখানে সেখানে মাকড়সার জাল। আমি তখন সেই ধুলো মাকড়সার জাল আর স্কুলের মধ্যে অন্ধকার ঘরের এককোণে বসা দেখলাম তাকে একা–যার আশীর্বাদে মহামুখ কালিদাস এক মহাপণ্ডিত হয়েছিল। যে গল্প আমাকে বলেছেন আমার বাবা। সেই বিদ্যার দেবীমাতা, হংসবাহিনী সরস্বতাঁকে।

আমার তখন মনে হল, তার মুখে চোখে যেন আমার জন্য মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে এক ধবল, দুগ্ধফেননিভ মাতৃমমত্ব। যা কোন হারিয়ে যাওয়া সন্তান বহুদিন পরে ঘরে ফিরে এলে মায়ের মুখে ফুটে ওঠে। আমি ঠিক জানি না, তখন আমি কী করেছিলাম আর কেন করেছিলাম। শুধু জানি আমি একটা ঘোরের মধ্যে ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিলাম সেই মাতৃমূর্তির সামনে। মনে হচ্ছিল–উনি আমাকে ডাকছেন-আয় বাছা, কাছে আয় আমার। সে সময়ে সেখানে আর কেউ ছিল না। আমি আর আমার মা। তখন খুব সন্তর্পণে মায়ের পীনোন্নত স্তনে রেখেছিলাম আমার তৃষ্ণার্ত দুটো ঠোঁট। আর আকণ্ঠ পীযূষ পানে যেন শীতল করেছিলাম দগ্ধ জীবন। একটি শিশুমন এভাবেই সেদিন বিদ্যারদেবীকে বরণ করেছিল মাতৃপদে, জানিয়েছিল তার ভালোবাসা।

কিন্তু সেই মাটির মূর্তিতে আমার হৃদয়াবেগ প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। মাটির মা মাটি হয়ে রয়ে গেছে। তাই তার আশীর্বাদ আমার ভাগ্যে জোটেনি। আমি আজও নিরক্ষর।

.

সেই প্রাজ্ঞ পুরুষ জানালার উপর থেকে এখন নিচে নেমে আসেন। তার নিজের পাশে কম্বল পেতে আমার জন্য জায়গা রাখেন। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার কী কে?

হাসলেন তিনি–আমি শিকার করি।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষন আইনে শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা আমার জানা। তবে অনেক চোরা শিকারি বাঘ হরিণ গণ্ডার মেরে তার চামড়া বিক্রি করে। বলি–এখন পর্যন্ত কয়টা বাঘ মারছেন?

–আমি পশু পাখি মারি না। মানুষ মারি। শিকারি বলেই ওনাকে বিশ্বাস করা শক্ত। এখন আবার বলছে মানুষ মারে। লোকটার চেহারা মোটেই খুনির মতো নয়। অবিকল একজন দরদি শিক্ষকের মতো।

একটু হেসে আবার বলেন তিনি-আমার দুটো শখ। একটা হচ্ছে দাবা খেলা। আর একটা শিকার। দুটোই বুদ্ধির খেলা। খুব মগজ খাটাতে লাগে বলে আমার খুব প্রিয়। দাবায় যেমন প্রতিপক্ষ ভালো খেলোয়াড় হলে খেলে খুব মজা পাওয়া যায়, মানুষ শিকারের সময় যে মানুষ খুব চালাক-অন্যকে শিকার করে বেড়ায় তাকে শিকার করে খুব আনন্দ পাই।

এক মুহূর্ত থেমে কী যেন ভেবে আবার বলেন তিনি–আনন্দ, এই কথাটা কে বলেছে জানিস? গৌতম বুদ্ধ। ইহকাল পরকাল, পরজন্ম পূর্বজন্ম স্বর্গ নরক বলেনি। সুখ, ভোগ, বিলাস বলেনি। বলেছে আনন্দের কথা। অমৃতের পরশে অমরত্ব প্রাপ্তি হয়। যাহা আনন্দ তাহাই অমৃত। আনন্দের মধ্যে মানুষের জন্ম। সেই জন্য মানুষকে বলে অমৃতের সন্তান। আনন্দ জিনিসটা কী? মনের একটা অবস্থা এই তো? সেই অবস্থা বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। কারও ব্রহ্মচর্যে আনন্দ কারও বহু গমনে। কারও গ্রহণে আনন্দ কারও বর্জনে। গৌতম বুদ্ধ আনন্দের সন্ধানে রাজত্ব ছেড়ে দিয়ে বৃক্ষের তলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আলেকজান্ডার রাজ্যের পর রাজ্য জয় করেছে ওই আনন্দেরই জন্য। সেই রকম আমার আনন্দ চালাক চতুর লোককে বোকা বানানোয়।

যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছে সেখানে আরও সত্তর আশিজন লোক আছে। তবে ওনার মত বয়স্ক আর কেউ নেই। সব পঁচিশ তিরিশ। তারা বড় গোলমাল করছে। কাউকে দেখে এখন বোঝবার উপায় নেই যে জেল খাটছে। সে দুঃখ বেদনা চেপে রাখার চেষ্টায় তারা তাস নিয়ে খেলতে বসে গেছে। কেউ লুডো কেউ ষোলগুটি নিয়ে সময় কাটাবার খেলায় চেঁচাচ্ছে। অনাবশ্যক পায়চারি করছে দু চার জন। এই হৈ চৈয়ের মধ্যে ওয়ার্ডের এক কোণে এক “নকশাল বন্দি” বইয়ের পাতায় চোখ রেখে স্থির। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে।

প্রাজ্ঞ পুরুষ তখন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছেন। চোখ দুটো ছাঁদের কড়িবরগায় নিবদ্ধ। মন যেন চলে গেছে এই ঘর এই পরিবেশ, লোহার দরজা, কড়া পাহারা, উঁচু দেওয়াল সব কিছু ছাড়িয়ে মহাকাশের কোন নাম না জানা গ্রন্থে। যেখানে আলো নেই অন্ধকার নেই জল নেই তৃষ্ণা নেই, জীবন নেই মৃত্যু নেই। বহু সময় সেই মহাকাশ ভ্রমণের পর আবার তিনি মাটিতে নেমে এলেন। আমাকে দেখলেন। কেন কে জানে একটা হাত আমার পিঠে রাখলেন। তারপর সিদ্ধান্তমূলক অন্তর্মুখী স্বরে বলেন–কোন কিছু অধিক হওয়ার ফল কখনও ভালো হয় না। অধিক ধন অধিক ক্ষমতা অধিক জ্ঞান-হ্যাঁ জ্ঞানও, অধিক জ্ঞানও মানুষকে বিপথে চালিত করতে পারে। পৃথিবীর দুঃখের কারণ কোন মুখ নয়, জ্ঞানীরাই।

বোধহয় একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি–আমার বেলা এটাই হয়েছে। যা জ্ঞান অর্জন করেছিলাম তাদিয়ে অনায়াসে সমাজে একটা উঁচু স্থান পেয়ে যেতে পারতাম। কী থেকে যে কী হয়ে গেল। উনি চিৎ থেকে আমার দিকে কাত হলেন তারপর যেন গলায় নির্বেদসন্তাপ ভরে বললেন–চারশো বিশধারায় কেস আমার।

জেলখানায় সবচেয়ে সম্মানীয় কেস তিনশো দুই। সবাই তাকে সমীহ করে চলে। এখন অবশ্য মার্ডার কেসের আসামির আর আগের মতো সম্মান নেই। তাদের তুচ্ছ করে দিয়েছে রাজবন্দিরা। বিশেষ করে নকশাল বন্দিরা। আর সবচেয়ে অসম্মানজনক কেস রেপ। কয়েদিরা বলে–চামড়া চুরি। এই কেসের আসামিকে সবাই ঘৃণা করে। চিটিংবাজি কেসটা রয়েছে এই দুয়ের মাঝে। বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার সাথে বেইমানি করা এটাকে কেউ সুনজরে দেখে না। তবে লোকটা যে খুব বুদ্ধিধর সেটা সবাই মানে অনেকে এমনও বলে মার্ডার মাথা মোটা লোকের কাজ। কিন্তু চিটিং করতে হলে চিকন বুদ্ধি লাগে।

আমার এই মাস্টার মশাই, একজন শিক্ষিত মানুষ।রাজনীতি সমাজনীতি অর্থশাস্ত্র ধর্মসংস্কৃতি ক্রীড়া সর্ববিষয়ে ওনার অগাধ জ্ঞান। যে কোন মানুষের সঙ্গে দশ মিনিট কথা বলে তাকে বশীভূত করবার ক্ষমতা রাখেন। এটাই তাকে নিয়ে এসেছে জেলখানার গারদের মধ্যে।

খানিকক্ষণ পরে জেল গেটের পেটা ঘন্টায় ঢংঢং করে এগারটা শব্দ হল। এগারটা থেকে সাড়ে বারোটা এই দেড় ঘন্টা চান খাওয়ার জন্য বরাদ্দ। এই সময় টুকু এখন ওয়ার্ডের বাইরে থাকা যাবে।

আমাদের ওয়ার্ডের সামনে একটা উঠোন মতো জায়গা রেখে চারদিক লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। এমন ঘেরা সব ওয়ার্ডে। এতে এক ওয়ার্ড থেকে আর এক ওয়ার্ডকে আলাদা করে রাখা গেছে। সেই রেলিংয়ের গেটের কাছে খাবার নিয়ে বসে আছে “চৌকা খাটুনির” লোক। যারা মেপে মেপে থালায় খাবার ঢেলে দেয়। কয়েদিরা লাইন দিয়ে খাবার নেয়।

এটা কোন নিমন্ত্রণ বাড়ি নয়–জেলখানা। খাদ্যদ্রব্যের অবস্থা বর্ণনা না করাই ভালো। আর তার পরিমাণ এত কম যে পেটের এক কোণাও ভরে না। কেউ কেউ তো খিদের জ্বালায় চৌকা থেকে ড্রেন বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া ভাতের ফ্যান তুলে চুমুক মারে।

মাপের খাবার খেয়ে মাস্টার মশাইয়ের পিছন পিছন ওয়ার্ডে ফিরে আসি। লোহার দরজায় তালা পড়ে যায়। এ তালা আবার খোলা হবে বিকের চারটেয়। তখন আবার দু ঘন্টা বাইরের উঠোনে থাকা যাবে। এখন ওয়ার্ডে সবাই শুয়ে পড়েছে। আমিও ওনার পাশে শুয়ে পড়ে ঘুমোবার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘুম আসে না। আমার শরীর সুস্থ নয়। পি.সি. খেটে এসেছি। চার রাত দু জন কনস্টেবল শরীরকে কাদার মত ছেনেছিল। পরের সাতদিন মেরেছে কম, ভয় দেখিয়েছে বেশি। ওরা কত কী যে আমার কাছে জানতে চাইছিল। সেই জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়ার যন্ত্রণা এখনও আমার শরীরময় ছড়িয়ে আছে।

তখন শুয়ে শুয়ে মাস্টার মশাইয়ের সাথে গল্প করি। বলি–আমার সেই বাল্যকাল থেকে কী ভাবে বড় হয়েছি, সেই সব কথা। এও বলি আমার খুব লেখা পড়া শেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পারিনি। আমার সব কথা গভীর মনোযোগ সহকারে শুনে বলেন তিনি–এখানে দু বেলা গরম খাবার পাবি। যেমন তুই বললি–সে রকম একেবারে না খেয়ে থাকতে হবে না। যদি অসুখ হয়, একেবারে বিনা চিকিৎসায় মরবি না। কম হোক বেশি হোক কিছু চিকিৎসা পাবি। মাথার উপর পাকা ছাদ আছে। তাহলে রোদে পুড়বি না জলেও ভিজবিনা। আর সব চেয়ে যেটা বড় কথা, যে আতঙ্ক নিয়ে বাইরে ছিলি, এখানে তা নেই। কোন শত্রু তোকে মারতে পারবে না। সব চিন্তা থেকে তুই মুক্ত। এখন তোর হাতে অখণ্ড অবসর। যত কমই হোক তিন-চার বছরের আগে বিচার শুরু হবে না। এই সময়টাকে কাজে লাগা।

–কী ভাবে?

–লেখাপড়া শেখ। ওদিকে দ্যাখ।

মাস্টার মশাইয়ের চোখের ইশারায় ওয়ার্ডের উত্তর কোণে তাকাই। অনেকক্ষণ আগে ওখানে যাকে চিৎশোয়া হয়ে বই পড়তে দেখেছিলাম, খেয়ে এসে সে আবার বই নিয়ে বসেছে। আবার বলেন তিনি–কঠিন কেসে পড়েছে। কেসে কী হবে সে চিন্তা নেই, পরীক্ষার পড়া পড়ছে। একে বলে ইচ্ছা শক্তি। এই রকম ডুবে যেতে পারলে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে।

নিজের নিরক্ষরতার জন্য একটা বিরাট কষ্ট আমার বুকে আছে এটা সত্যি। কিন্তু শেখার যে বয়স সে তো বহু পিছনে ফেলে এসেছি। তা ছাড়া এখনও বাইরে রেখে আসা প্রিয় পরিচিত মানুষের জন্য মন কাঁদছে। কিছুতে তাদের কথা ভুলে এই হৈচৈ করা ভিড়ের একজন হয়ে যেতে পারছি না। মনের মধ্যে বিধছে গোপন ব্যথার কাঁটা। রক্ত ঝড়ছে। এ সময়ে পড়াশোনা শেখার মত “মননশীল” বিষয়ে মন দেব কেমন করে?

আমার মুখমন্ডলে কী মনের কোন ছায়া পড়েছে? তা না হলে উনি আমার মনের কথা জেনে গেলেন কী ভাবে? বলেন তিনি–বাইরের কথা ভুলে যা। মনে কর তুই যখন একবার এসে গেছিস-এসেই গেছিস। আর কোথাও যাবার ব্যাপার নেই। যত তাড়াতাড়ি বাইরের কথা ভুলে যেতে পারবি, তোর পক্ষে মঙ্গল। তো এখানে যখন অনেক দিন থাকতেই হবে একটা ভাল কিছু শিখে নে। যা বাইরে গেলে উপকারে লাগবে।

ম্লান গলায় বলি–বয়স বেড়ে গেছে। এই বয়সে কী আর কিছু শেখা যায়।

–যায়! জোর দিয়ে বলেন তিনি, শেখবার কোন বয়স নেই। হিন্দিতে একটা কথা আছে, যব জাগা তবহি সবেরা। যখনই ঘুম ভাঙবে সেটাই সকাল। তুই ভাববি কেন তোর বয়স বেশি। মনে কর না, ছয় আট দশ। মনে করতে বাধা কোথায়?

দিন আসে দিন যায়। রাত আসে রাত যায়। মানুষের যত কষ্ট হোক, যত মনে হোক এদিন বুঝি আর কাটবে না, দিন তার নিজস্ব নিয়মে কেটেই যায়। ভোর পাঁচটায় আমাদের দিন শুরু হয় প্রথম গুনতি দিয়ে। জেল কর্তৃপক্ষ মিলিয়ে দেখে রাত্রির অন্ধকারে কেউ পালিয়ে গেছে কী না। এরপর আর একটা গুনতি হয় ছটায়। যারা ওয়ার্ডে আছে আর যারা ওয়ার্ড থেকে বিভিন্ন জায়গায় “লেবার” দিতে গেছে সব মিলিয়ে আগের গুনতির সাথে সঠিক সংখ্যার মিল হচ্ছে কী না। এই গুনতির পর আমরা ওয়ার্ড থেকে বাইরে আসবার সুযোগ পাই, পায়খানা, মুখহাত ধোবার জন্য। তখন টিফিন পাওয়া যায়। কোনদিন ছোলা, কোনদিন মটর সেদ্ধ। এক আধদিন চিড়ে গুড়। আটটা পর্যন্ত এসময়ে উঠোনে থাকা যায়। আবার একটা গুনতি হয় দুপুরের খাওয়ার পর। ফের বিকেল চারটেয়। চারটে থেকে সন্ধ্যা ছটা এই দু ঘন্টা বাইরে থেকে খাবার খেয়ে ওয়ার্ডে ঢুকতে হয়। এই ভাবে কম খানা জাদা গোনর মধ্যে দিয়ে বেশ কটা দিন কেটে যায়। এর মধ্যে একদিন কোর্টে গিয়ে সারাদিন কোর্ট লকআপে কাটিয়ে বিচারকের মুখ না দেখেই, জেলে ফিরে আসি।

তখন একদিন রাত্রিতে শুয়ে শুয়ে বলেন মাস্টার মশাই–জেলখানায় শুধু খাওয়া আর ঘুম ঘুম আর খাওয়া, এই করে করে কত যে মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেল তার কোন হিসাব পাওয়া যাবে না। যদি সে একটু বুদ্ধি করে এই সময়টাকে কাজে লাগাতে পারত, জীবনের গতিপথটাই বদলে যেত। বলা যায় না, সে হয়ত অমরও হয়ে যেত।

–অমর? আমি অবাক হয়ে বলি।

–এটা একটা কথার কথা। জীব মাত্রেই মরণশীল। তবে এটাও ঠিক যে কোন কোন মানুষ। তার কাজের মধ্যে দিয়ে অমর হয়ে যায়। এবং এটা একমাত্র মানুষই পারে। আমার গুরুদেবের কী নাম জানিস?–সক্রেটিস। তারও শখ ছিল বুদ্ধিমানকে বোকা, পণ্ডিতকেমুখ বানানোর। পৃথিবীতে কেউ কোনদিন তার নাম ভুলবে না। তাহলে সে অমর হলো, কী, না?

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আমাকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি–কীরে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?

বলি আমি–ঘুম আসছে না।

উনি বলেন–হয়, এরকম হয়। এক আধ মাস ঘুম আসবে না। পরে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ অভ্যাসের দাস। পুরানো অভ্যাস ভুলে নতুন অভ্যাস রপ্ত করতে একটু সময় নেবে। তবে হয়ে যাবে। আমারও প্রথম প্রথম কিছুদিন ও রকম হয়েছিল। আর এটা তো রপ্ত করে নিতেই হবে। পরিবেশের সাথে মানিয়ে না নিতে পারলে পাগলখানায় স্থান পাবে। এ ছাড়া অন্য কিছু উপায় নেই। তবে মানুষের বিশেষত্ব এটাই যে সে সব পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। পারে বলেই বেঁচে থাকে। মরুভূমিতে কী ভীষণ গরম, মেরু অঞ্চলেকী ভীষণ ঠান্ডা, মানুষ কোথায় নেই?

উনি কথা বলেন অদ্ভুত এক সম্মোহনী স্বরে। যা ধীরে ধীরে মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। মনের উপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না, যেন অবশ হয়ে আসে। বুঝতে পারি এই স্বরক্ষেপণ, শব্দ জাদুতে মানুষকে ঘায়েল করে ফেলার ক্ষমতা আছে বলেই তারা শিকার হয়ে যায়।

একদিন আমি ওনাকে বলি–আপনে যে আমার লেহাপড়া শেখনের কথা কন, তয় এইখানে তা করতে হইলে যা যা লাগে হেই বই পত্তর, শেলেট পেনসিল কই পামু?

বলেন তিনি–ইচ্ছা থাকলে সব যোগাড় হয়ে যাবে। একটু সময় থেমে থেকে আবার বলেন তিনি–ভাব, খুব ভাল করে ভেবে সামনে আগাস! লোকে কিন্তু হাসবে, নানা রকম ঠাট্টা টিটকারি দেবে। যদি সে সব সয়ে ঘাড় গুঁজে নিজের কাজ করে যেতে পারিস, তাহলেই সফল হতে পারবি। আমাদের শাস্ত্রে কী বলে জানিস? যার মাঝপথে তপস্যা ভঙ্গ হয়, তার নরকবাস ঘটে। একে তো এতদিনের সব শ্রম ব্যর্থ গেল তার উপর লোকের উপহাস–এই তো নরক। সেই জন্য তপস্যায় বসার আগে মনঃস্থির করে নে। যদি শেষ পর্যন্ত যাবার মানসিকতা না থাকে শুরুই করিস না। মনঃ স্থির হলে বলিস, যা যা লাগে আমি এনে দেব।

ভাবি আমি, বেশ কয়েকদিন ধরে খুব ভাবি। শেষে একদিন জিজ্ঞাসা করি, আইচ্ছা আপনে আমারে পড়াশোনা শেখানোর লাইগ্যা এত ব্যাকুল ক্যান! এইতে আপনের কী লাভ?

উনি কী আমার কথায় মনে কোন আঘাত পেলেন? কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে শেষে বলেন–তুই একটা ডিম। সেই জন্য। আমি কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। সেই কারণে আবার বলেন–একটা ডিমে তা দিলে সেটা ফুটে বাচ্চা বের হয়। কেন বের হয়? কারণ ডিমের মধ্যে সেই উপাদান মজুদ আছে যা একটু তাপ পেলে প্রাণ হয়। যাতে সেই উপাদান নেই, যতই চেষ্টা করি-হবে না। আমি তো মানুষ চিনি। মানুষ নিয়েই যে আমার কারবার। সেদিন তুই তোর কথা আমাকে সব বলেছিস। লেখাপড়া না জানার জন্য তোর একটু দুঃখবোধ আছে সেটাও জেনেছি। তোর মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছে, যদি তোর পিছনে একটু শ্রম দিই, সেটা ব্যর্থ যাবে না। এমনিতে আমারও তো সময় কাটে না এইভাবে সময়টাও কেটে যাবে। কথা থামিয়ে উনি কিছুক্ষণ হাঃ হাঃ করে হেসে নিয়ে কথা শেষ করলেন–বীজের মধ্য দিয়ে গাছ, পুত্রের মধ্য দিয়ে পিতা, শিষ্যের মধ্য দিয়ে গুরু বেঁচে থাকে। আমি তোর মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকব।

ওয়ার্ডের সবলোক গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়েছে এ সময়। খানিকক্ষণ আগে যে শোরগোল ছিল, এখন আর তা নেই। যে ছেলেটা সব সময় বই পড়ে সেও এখন ঘুমে কাদা। জানালা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো এসে পড়েছে আমাদের ওয়ার্ডের মধ্যে। তবে সে শুভ্রতা খেয়ে নিচ্ছে জেলখানার বৈদ্যুতিক আলো। তখন আবার কথা বলে ওঠেন সেই ভুয়োদর্শী। কথা নয়, যেন আবেগ-আক্ষেপ–অতপর্ণ-দ্যাখ, পৃথিবীতে কোন মানুষই একেবারে নিখাদ হয় না। তার কিছুটা কালো কিছুটা আলো। আমি দেখেছি যার মধ্যে একশোটা ভালোগুণ আছে তার একটা এমন দোষ যা জঘন্য থেকে জঘন্য। আবার সবচেয়ে খারাপ লোকটার মধ্যে এমন একটা গুণ আছে যা তুই কোন মহানের মধ্যেও খুঁজে পাবি না। আমি জানি আমার বহু দোষ। কারও প্রতি আমি কোন সুবিচার করতে পারিনি। আমার স্ত্রী যে কারণে আমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখে না। ছেলে মেয়ে বাবা বলে আমার পরিচয় দেয় না। এতদিন তারা আমাকে একবার দেখতে পর্যন্ত আসেনি। কিন্তু আমারও কিছু ভালোগুণ ছিল রে। কী ছিল কাউকে দেখাতে পারলাম না। কত কিছু শিখেছিলাম, সে শিক্ষা কোন ভাল কাজে লাগাতে পারলাম না।

আবার সাময়িক নীরবতা। মাস্টার মশাই যেন ডুবে গেছে। একদিশেহারা কুটিল কৃষ্ণগহ্বরে। কোথাও কোন পাড়ের কিনারা পাচ্ছেন না। যে ভয়াল অন্ধকার ওনাকে পরিত্রাণহীন অতলবিতলে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উনি কিছুই করতে পারছেন না। বড় দেরি করে ফেলেছেন যে। এখন আর ঘুরে দাঁড়াবার মত, ফিরে আসার মত হাতে খুব বেশি সময় নেই। হঠাৎ একটা ঝড় উঠল। কোথা থেকে কেমনভাবে যেন একটা শুকনো ডাল ভেঙে এসে পড়ল সামনে। উনি তাকে বিরাট অবলম্বন ভেবে দু হাতে চেপে ধরলেন। নিভু নিভু মনের আদিম সবুজতা দিয়ে সেই মরা ডালটাকে সতেজ প্রাণবন্ত করবার বাসনায় কেঁদে উঠলেন, তুই আমার মনের আশ্রয় হ। বেঁচে ওঠ আর বাঁচিয়ে রাখ।

বলে যেতে থাকেন উনি–একজন বিপ্লবী, সে যদি বিপ্লবী না হতে পারত, তাহলে অবশ্যই ডাকাত হতো। তার ক্রোধ তাকে কিছুতে স্থির থাকতে দিত না। একজন কবি যদি কবি না হতে পারত হয় পাগল হয়ে পথে পথে ঘুরত আর না হয় মদ খেয়ে শুয়ে থাকত কোন শুড়িখানায়। একজন সৈনিক যদি সৈনিক না হতে পারত, একটা গুন্ডা খুনি হোত। কবির যন্ত্রণা সৃষ্টিশীলতার পথ না পেয়ে তাকে যেমন বিক্ষিপ্ত বা সুরাসক্ত করে দেয়, সেপাই তার শক্তিমত্তার প্রয়োগের জন্য বেছে নিত আইন বিরুদ্ধ সমাজ বিরুদ্ধ পথ। আমার বেলায় সেটাই হয়ে গেছে। প্রচুর পড়াশোনা করেছিলাম যে কারণে আমার মনে একটা গর্ব-অহংকার জন্মে গিয়েছিল, আমি বিদ্বান, কোন সাধারণ নই। বাবার কিছু জমি জায়গা ছিল যে কারণে খাওয়া দাওয়ার কোন সমস্যা ছিল না। বিদ্যার্জনের পথে কোন বাধা ছিল না। কিন্তু এই বিদ্যা দিয়ে আমি কী করব তার কোন পরিকল্পনাও ছিল না।

এক সময় বাবা মারা গেলেন। তখন ভাইয়েরা আলাদা হয়ে গেল। ভাগ হয়ে গেল জমি জায়গা। আমার ভাগে যেটুকু পড়েছিল তাতে তখন আর সংসার চলে না। নিজের জমিতে নিজে খাটতে পারলে চলত। কিন্তু খাটতে পারি না। অভ্যাস নেই যে। এরপর একটা পথ ছিল কারও কাছে মাস মাইনের কাজ করা। করেছিলাম কিছু দিন। দেখলাম কতগুলো মুখের হুকুম আমাকে মানতে হয়, তাদের মুখতাপূর্ণ কথায় মাথা নাড়তে হয়। এতে আত্মগ্লানি আসত আমার। তাই পরের কাজ আর করা হল না। কিন্তু কাজ না করলে চলবে কী করে?

আমাদের শাস্ত্রে বলে, মন্ত্রশক্তিতে পাহাড় টলে যায়, পাথর গলে যায়। মন্ত্র আসলে কী? কতগুলো কথা বই তো আর কিছু নয়। দেখলাম, আমার ভান্ডারে সেই কথা প্রচুর পড়ে আছে। ব্যাস, পা পিছলে গেল আমার। কঠিন শ্রমে আয়ত্ত করা বিদ্যা নিয়ে নেমে গেলাম অবিদ্যার পথে।

সব মানুষই নিজেকে চালাক ভাবে। পরিশ্রমের চাইতে কৌশলে আজ আদায় করে নিতে চায়। অন্য তো অন্য–ভগবানের সাথেও ছলচাতুরি করে। রেকাবিতে দুটো বাতাসা সাজিয়ে দিয়ে বলে–আমাকে কোটিপতি করে দাও ঠাকুর। ভাবে ঠাকুর খুব বোকা, বাতাসায় ভুলে যাবে। কিন্তু সে জানে না, ঠাকুর নয়, ঠকছে সে নিজে। তার দেওয়া বাতাসা হয় পিঁপড়ে নয় পূজারির পেটে যাচ্ছে।

আমি সেই পূজারির ভূমিকা নিলাম। কী চাই, মদের দোকানের লাইসেন্স? উপর মহলে চেনাজানা আছে। আমি এনে দেব। হংকং ছাপ মারা সোনার বিস্কুট আছে সস্তায় বেঁচব। জমানো টাকা আছে? আমাকে দাও–ডবল করে দেব। আমি এক সর্বশক্তিমান। মন্ত্রশক্তি আছে আমার। মানুষ বিশ্বাস করে, আমি পারি। আর আমি তাদের মনের আনন্দে শিকার করি।

কথা শেষ করে চোখ বুজলেন তিনি। আমি তখনও জেগে আছি। একজন বিখ্যাত দার্শনিক বলেছেন–জেলখানা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। আকাশ ছোঁয়া উঁচু দুর্ভেদ্য দেওয়ালের এপারেই নাকি আলিবাবার গুপ্তগুহার মতো সসাগরা জ্ঞান স্তূপাকার। এই রত্নভাণ্ডার একমাত্র সে-ই লুঠ করে নিয়ে যেতে সক্ষম–যার থাকবে রত্নাকর অভীপ্সা।

আমি ঠিক জানি না, আমার ভাগ্য আমাকে এই কঠিন দেওয়ালের এপারে নিয়ে আসার পিছনের গভীর গোপন উদ্দেশ্যটা কী! কী সে করাতে চাইছে আমাকে দিয়ে। কোন পথে এরপর ধাবিত হবে আমার অর্থহীন জীবন।

একদিন সকালে–সবদিনের মতো মাস্টার মশাই উঠে বসেছিলেন তার সারা ওয়ার্ডের মধ্যে প্রিয় এবং পছন্দের সেই জানালার উপর। চোখ মেলে রেখেছিলেন অল্প কিছু দূরের–গোপালনগরের দিক থেকে এসে চিড়িয়াখানার ওদিকে চলে যাওয়া বড় রাস্তাটার উপর। এই পথে এ সময়ে প্রচুর লোকজন গাড়ি চলাচল করছে।

জেলখানায় একদল লোক থাকে যাদের বাইরে কোন লোক নেই। অথবা থাকলেও এত গরিব যে গাড়ি ভাড়া যোগাড় করে মানুষটাকে দেখতে আসা, একটু চিড়ে গুড় দুটো বিড়ি কিনে দেওয়া সে সব পারে না। এখন ওই লোকটা কি করে? যা খাবার পায় পেট তো ভরে না। বিড়ির নেশার জন্য মন আনচান করে। জেল কর্তৃপক্ষ এই সব বন্দীর মধ্যে থেকে কিছু লোককে জেলের ভিতরে নানান কাজে লাগায়। যার জন্য ডবল খাবার আর কটা বিড়ি পায়। বিচারাধীন এ সব বন্দির জেলখানার নাম ফালতু। আমিও একদিন চলে গেলাম ফালতুর কাজে।

এই জেলের সেলে চারজন নকশাল বন্দি থাকে। যার একজন আমার পূর্ব পরিচিত। সেলের সামনের রাস্তা ধরে পায়খানায় যাবার সময়ে তাকে দেখি। কিন্তু কথা বলতে পারি না। সাধারণ বন্দিদের সেলের বন্দির সাথে কথা বলা বারণ। বারণ না মানলে সেল ডিউটির সেপাই ছুটে এসে পিঠে ডান্ডা মারবে।

আমি এক সাধারণ বন্দি। নকশালদের সাথে আমার কোন যোগাযোগ আছে পুলিশের কাছে তার কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। আমিও তা বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পারিনি। রেড বুক পড়িনি, সি.পি.আই.এম.এল. এই কথাটার সম্পূর্ণ মানে জানি না, দেশব্রতী চোখে দেখিনি, আমি কি করে নকশাল হব। তাই আমার কেস ক্রিমিন্যাল কেস। ১৪৮/১৪৯/৩০৭, ৩/৫ ধারা।

আজ যখন সেলের জন্য একজন ফালতু কাজের লোকের দরকার আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমার কাজ ওই সব বন্দির কুঁজোয় পানীয় জল ভরে আনা। হাসপাতালে গিয়ে তাদের ওষুধ, মেডিকেল ডায়েড এসব নিয়ে আসা। সকালে আর বিকালে দুবার চৌকায় গিয়ে তাদের জন্য চা বানিয়ে আনা। এর জন্য ডবল ভাত তরকারি আর আটটা বিড়ি পাবো। তার চেয়ে বড় কথা বন্ধুর সঙ্গ পাবো।

একদিন হাসপাতাল থেকে দুধ আনতে গেছি। হাসপাতালের পাশে পাগলা গারদ, গিয়ে দাঁড়িয়েছি তার সামনে। এখানে দুরকম পাগল আছে। একদল যারা কোন অপরাধ করে জেলখানায় এসে শোকে দুঃখে অনুশোচনায় আতঙ্কে পাগল হয়ে গেছে, এবং তার কারণে সহবন্দীরা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আর একদল যারা কোন মানসিক কারণে উন্মাদ হয়ে কোন অন্যায় কাজ করে এখানে এসেছে। এই শেষদলের প্রতি জেল কিছু সদয়। সুস্থ হবার লক্ষণ দেখা গেলে এরা বেশ কিছুটা স্বাধীনতা পায়। গারদের বাইরে থাকতে পারে।

এই জেলের ঠিক মাঝখানে একটা বড় পুকুর আছে। যার পূর্ব প্রান্তে আমাদের ওয়ার্ড, পশ্চিমে হাসপাতাল। উত্তরে রন্ধনশালাদক্ষিণে সেল। সেলের বাদিকে পায়খানা ডানদিকে আমদানি ওয়ার্ড আর কেস টেবিল। কেস টেবিলকে ডানদিকে রেখে কিছুটা গেলে বাঁদিকে জেলখানার প্রধান ফটক। ঠিক তার উল্টো দিকে বড় মাঠ। আগে এই মাঠে বন্দীরা ফুটবল খেলতে পারত। একবার মাঠের পাশের দেওয়ালে মুই লাগিয়ে নকশাল বন্দীরা পালাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় আট জন মারা যায়, যার অন্যতম পঞ্চাননতলার পরিতোষ ব্যানার্জী। তারপর থেকে খেলা বন্ধ আছে।

এখন আমার হাসপাতালের সামনের পুকুর ঘাটে চোখ গেলে দেখতে পাই সেখানে বসে কাপড়চোপড় কাঁচছে এক জন যুবক। খুব ফর্সা, বেশ লম্বা বছর পঁচিশ বয়সের সুদর্শনকান্তির যুবাকে দেখে মনে হল সুশিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কিন্তু এ এখানে কেন! প্রথমতঃ জেলখানার এই ক্রিমিনালদের ভিড়ে একে একদম মানাচ্ছে না। মুখ চোখ তার সে রকম নয়। তবু মেনে নেওয়া যেত, যদি সাত নাম্বার ওয়ার্ডে নকশালবন্দীদের সাথে থাকত। অথবা সেলের কোন কক্ষে। সেলে এই রকম বাংলা সিনেমার নায়কের মত একজন আছে। কিন্তু এ রয়েছে পাগলা গারদে। তার চেহারা আচার আচরণে কোন পাগলামোর চিহ্নমাত্র নেই। একেবারে সুস্থ। বিষয়টা জানবার জন্য আমি ভিতরে ভিতরে উগ্রীব হয়ে উঠি। এবং তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু বড় বিব্রত হই। কিভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করি–এই যে ভাই তুমি কী পাগল? সেটা যে কখনই শোভন নয়। আমি পড়াশোনা জানি না সেটা ঠিক, তবে পড়াশোনা জানা লোকের সাথে তো মিশেছি। শিষ্টাচার বলে যে একটা কিছু আছে, সেটা তো জানি।

অনেক ভেবে শেষে বলি, এখানকার পরিবেশের সাথে আপনেরে মানায় না। আপনে জেলে ক্যান? কাপড় কাঁচা বন্ধ রেখে সে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। বড় মায়াবী দুটো কালো চোখ। সে চোখের চাউনিতে লুকানো আছে একটা গভীর বেদনা। তারপর ক্লান্ত গলায় বলে আমার মা আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে।

মা! মা ধরিয়ে দিয়েছে। আমি যেন হাজার ভোল্টেজের একটা বিদ্যুতের শক খেলাম। মা? মা ধরিয়ে দিয়েছে ছেলেকে। সারাদেশে জরুরি অবস্থা চলছে। জেলখানা এখন আর জেল নয়, যেন জল্লাদের উল্লাসভূমি। এই সময়ে একজন বন্দী আর একটা লাশের মধ্যে ব্যবধান মাত্র একটা ঘন্টার। যার নাম পাগলাঘন্টি। জেল গেটে ওই ঘন্টি বেজে ওঠার সাথে সাথে “পাঁচহাতিয়া” নিয়ে পাগলা ষাড়ের মতো ছুটে আসবে একদল কারারক্ষী। তারপর সজোরে সেই পাঁচ হাত লম্বা লাঠি চালাবে অসহায় বন্দীদের মাথা ঘাড় লক্ষ্য করে। মাথা ফেটে ঘিলু ছিটকে পড়বে। রক্তের ঢল নামবে। মানুষকে দলাদলা মাংসের তাল বানিয়ে নাচবে কসাই, ঘাতক খুনি বাহিনী।

এইভাবে, এই তো প্রায় সেদিন আট আটটা ছেলেকে পিটিয়ে মেরেছে এরা। এখন এক ভয়ানক দুঃসময়, অরাজক অন্ধকার সময়। পশ্চিমবঙ্গের বাহান্নটা জেলের কোনটায় কখন যে নকশালবন্দীদের শেষ করার জন্য সাইরেন ঘন্টি বেজে উঠবে তা কেউ জানে না। সে জানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের গোপন ফাইল। যখন পুলিশ গুলি চালাবে সেটা যে সঠিক টার্গেটে লাগবে, এমন কোন কথা নেই। যে কেউ মরতে পারে। এই সময়ে যদি কোন সন্তান জেলে থাকে তার মায়ের চোখ থেকে ঘুম উড়ে যাবে, দরদর করে নামবে দু গাল বেয়ে নোনা জলের ধারা। তখন সে যে কোন মুল্যে কামনা করে ছেলেটা আমার ঘরে ফিরে আসুক। আর এই যুবকের মা, নিজের সন্তানকে তুলে দিয়েছে কসাইদের হাতে। মরতে পাঠিয়েছে এই মৃত্যুপুরিতে। সে কী মা? মা, না রাক্ষসি? এক মুহূর্তে মনের মধ্যে হানা দেয় আমার এমন কিছু ভাবনা, যা মা, এই প্রিয় পবিত্র শব্দটার উপর সুবিচার করে না। ঘৃণা মিশ্রিত বিবমিষার উদ্রেক করে। কেন সেই মহিলা একে পাগল সাজিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে? নিঃসন্দেহে তার স্বভাব চরিত্র ভালো নয়। যার ছেলে এত রূপবান, তার মা রূপসী না হয়ে পারে না। নিশ্চয় তার রূপের আগুনে পুড়তে পঙ্গপাল আসে। সম্ভবতঃ ছেলে সেই পোড়াপুড়ির মাঝখানে একটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সেই দুশ্চরিত্র মহিলা যোগসাজশ করে একে পাগল প্রতিপন্ন করে পাঠিয়ে দিয়েছে দূরে–বহুদুরে।

বেশ কিছু সময় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে থাকি। শেষে বড় সংকোচ নিয়ে এক অভব্য প্রশ্ন করে ফেল-আপনার মা আপনাকে কেন জেলে পাঠাল আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আপনে কী করছেলেন?

বলে সে–আমি ঘরের কিছু দামি আসবাব ভেঙে চুরে ফেলেছিলাম।

–ক্যান। নিজের ঘরের জিনিস।

এতক্ষণে যুবক তার পাগলা গারদে থাকার আসল কারণ ব্যক্ত করে, আমার মাথাটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

আমি কোনদিন কোন নেতাকে নিজের মুখে স্বীকার করতে শুনিনি যে সে এক চোর, কোন ধর্মগুরুকে স্বীকার করতে শুনিনি—ঠগ জোচ্চোর। কোন মদখোরকে স্বীকার করাতে পারিনি–সে মাতাল। এরা বরং উল্টোটাই বলে। কিন্তু আজ এক পাগল নিজের মুখে বলছে–সে পাগল। এও আমি আগে কোনদিন শুনিনি।

জানতে চাই, আপনার মাথা যে খারাপ হয়ে গিয়েছিল আপনি সেটা বুঝতে পারেন?

বিষণ্ণ হেসে বলে সে-যখন সেটা বুঝতে পারি তখন আমি সুস্থ। যখন বুঝতে পারি না, পাগল তো তখন।

আর একটা প্রশ্ন, যে প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে লুকনো আছে সব প্রশ্নের সব উত্তর। এবার সেটাই করে বসি তাকে, কারণ ছাড়া তো কোন কার্য হয় না, তাহলে আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবার কারণ কী?

একটু থেমে বলে সে–একটা বই পড়ে।

–সেকি। চমকে উঠি আমি তার কথায়। জানি যে ধুতরোর বীজ খেলে মানুষ পাগল হয়। পরিমাণে বেশি হলে মানুষ মারাও যায়। কিন্তু একটা নিরীহ বইয়ে এত বিষ! সে কি করে হয়? জানতে চাই–কি বই?

বলে সে, শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন। ওই বইখানা পড়েই আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

কথাটা যেমন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, তেমনই ওই ছেলেটাকে অস্তৃতভাষণকারী বলে ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল। কেন সে মিথা বলবে। বলে তার কি লাভ! কিন্তু বই? এটা বা কী করে হয়? সেদিন ওয়ার্ডে ফিরে এসেই মাস্টার মশাইকে বলেছিলাম সব কথা। আমার কথার শেষে একটা বড় বিস্ময় সূচক চিহ্ন ছিল–এটা কেমন করে হয়!

তখন ধীরে ধীরে বলেন তিনি–হয়, এমনটা হওয়া কোন আশ্চর্য নয়। শরৎচন্দ্র তো খুব জীবননিষ্ঠ কথাশিল্পী। উনি ওনার এই উপন্যাসে যে সব চরিত্র বা ঘটনার সমাহার ঘটিয়েছেন, তার সাথে ওই ছেলেটার জীবনের গভীর কোন মিল আছে। আমাদের মস্তিষ্কের যেখান থেকে ভাবনা চিন্তাগুলোর জন্ম নেয় সেখানকার তন্তুকোষগুলো খুবই সূক্ষ্ম। ছেলেটার মনমস্তিষ্কে বইয়ের ঘটনা এমনভাবে আঘাত করেছে যে মস্তিষ্ক সেই আঘাত সামলে নিতে পারেনি। যে কারণে ছেলেটা উন্মাদ হয়ে উঠেছে।

একটু পরে আবার বলেন তিনি, যারা বই পড়ে, কমবেশি সবাই পাগল।নকশাল ছেলেদের দ্যাখ। ওরাও তো এক একটা আস্ত পাগল। সব পাগল হয়ে গেছে মাওসেতুংয়ের বই পড়ে পড়ে। বিশাল এই দেশ, দেশের সরকারের কী বিশাল ক্ষমতা। কত পুলিশ কত মিলিটারি আর কত অস্ত্রশস্ত্র। রেডবুক পড়ে ওরা কটা হাতবোমা নিয়ে সেই রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। বদ্ধ পাগল ছাড়া আর কেউ পারে?

এখন ওনার গলার স্বর বড় নরম। তবে এই সব পাগলদের প্রতিই কিন্তু মানুষ শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। নিজের জন্য তো সব মানুষ বাঁচে, পরের জন্য কে বাঁচে? কে মরে? ওরা মরছে।

.

আমাদের এই ওয়ার্ডের ইনচার্জ লোকটা খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির। কারণে অকারণে সে মানুষের উপর অত্যাচার করে আনন্দ পায়। এখনও তার বিচার পর্ব শুরু হয়নি। শোনা যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে যা সাক্ষী সাবুদ, সাজা না হয়ে কোন রেহাই নেই। তিনশো দুই বাই চৌত্রিশ ধারায় চার্জ। সাজা হলে, হয় কঁসি নয় যাবজ্জীবন। আমাদের এক সহবন্দী দু বেলা তাকে অভিশাপ দেয়–শালা মরুক। ফাঁসিই হোক ওর। আমার কেন জানিনা মনে হয় কঁসি হয়ে গেলে অল্পকষ্টে রেহাই হয়ে গেল। এর চেয়ে কষ্টকর সারাজীবন জেলখানায় পড়ে পচা। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে যাবজ্জীবন মানে বুঝি চৌদ্দ বছর। তা কিন্তু নয়। যাবজ্জীবন মানে যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকবে। তবে কেউ কেউ চৌদ্দ বছরে ছাড়া পেয়ে যেতে পারে। তার পিছনে অনেকগুলো শর্ত কাজ করে। যে সেই শর্ত পূরণ করতে না পারে–সে সারাজীবনই জেলে কাটায়।

একদিন মাস্টার মশাইয়ের কাছে জানতে চাই–আইচ্ছা, ফাঁসি হওন ভালো না, যাবজ্জীবন? আপনে কী কন?

উনি বলেন–একেবারে মরে যাবার চেয়ে, যত কষ্টই হোক বেঁচে থাকা ভালো। বলা তো যায় না, বেঁচে থাকলে কোনদিন তার কাছে এমন একটা সুযোগ হয়ত এসে যাবে, সে এমন একটা কিছু করে ফেলবে যে মানুষ তার সব দোষ ক্ষমা করে দেবে। জয় বলবে তার নামে।

উনি শোয়া ছিলেন উঠে বসলেন–একটা গল্প বলি শোন। গল্পটা বিদেশের। এক বার কী হয়েছে জানিস, একজন সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়িতে কি এক অনুষ্ঠানে সমাজের সব মাথা মাথা লোকেরা একত্র হয়েছে। ডাক্তার উকিল বিচারপতি কবি সাহিত্যিক সব ছিল। তখন এক সময় এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেল, ফাঁসি-মানে মৃত্যুদন্ড ভালো না যাবজ্জীবন। তা যা হয়, একদল বলছে মৃত্যুদন্ড, আর একদল যাবজ্জীবন। যারা যাবজ্জীবনের পক্ষে তাদের বক্তব্য হল–মরে গেলে সব শেষ কিন্তু যদি বেঁচে থাকে, সে যদি যাবজ্জীবন জেলও হয়, ওই সময়টা কাজে লাগাবার সুযোগ পেলে সে তার জীবন সার্থক করে ফেলতে পারে। গৃহকর্তী বেশ ধনবান লোক তিনি ছিলেন ফাঁসির পক্ষে। তার যুক্তি যাবজ্জীবন ফাঁসির চেয়ে কষ্টকর। তিনি বলে ওঠেন যে, বলা খুব সহজ, কিন্তু যাবজ্জীবনমোটামুটি যা কুড়ি বছর–এতবছর জেলে কাটানো সহজ নয়। যারা যাবজ্জীবনের

পক্ষে বলছে তাদের মধ্যে এমন কেউ কী আছে যে কুড়ি বছর বন্দী থাকতে পারে? যদি কেউ পারে আমি তাকে কুড়ি লক্ষ ডলার দেব। আছে কেউ এমন?

একজন তোক উঠে দাঁড়ায়–আমি আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। আমি কাটাব বন্দীদশায় কুড়ি বছর। বলেন গৃহস্বামী–একটা ঘরে আপনাকে একা রাখা হবে। কারও সাথে কথা বলা চলবে না। আমার একজন কর্মচারী আপনাকে খাবার দাবার দিয়ে আসবে। সময় কাটাবার জন্য যা যা দরকার একটা চিরকুটে লিখে দেবেন। আমি তা সংগ্রহ করে পাঠাব। ঠিক আছে? যদি কুড়ি বছর পূর্ণ হবার আগে ঘর থেকে বের হয়ে যান কিছু পাবেন না।

যারা ওখানে উপস্থিত ছিল। ব্যাপারটায় সবার বেশ মজা লাগছিল। তারা ভেবেছিল এটা দু দশদিনের একটা খেলা। একঘরে একা আর কদিন থাকতে পারবে। তো তারা রীতিমত শর্তনামা লিখে দুজনকে স্বাক্ষর করিয়ে নিল। আগামী কোন এক নির্দিষ্ট দিন থেকে শুরু হবে লোকটার বন্দীজীবন।

লোকটা বিবাহিত। স্ত্রী তার স্বামীকে নিরস্ত করবার চেষ্টায় বলে–এ কী করতে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তোমাকে তো হেরেই যেতে হবে। কুড়ি বছর কোনভাবে বন্দি হয়ে থাকতে পারবেনা। মাঝখান থেকে কতগুলো দিন অকারণে নষ্ট হবে। কিন্তু লোকটা নিজের সিদ্ধান্তে অটল হয়ে রইল। স্ত্রীকে সে বোঝাল, দ্যাখো, আমি তো বলতে গেলে তেমন কিছু রোজগার করতে পারি না। সংসার তোমাকেই চালাতে হয়। এই অবস্থায় আমি যদি না থাকি তোমার খুব একটা অসুবিধা হবে না। আর আমি জীবনে তো তোমাকে কোন সুখ দিতেও পারিনি। কোনদিন তা পারব বলে মনে হয় না। তবে যদি আমি কুড়িটা বছর কাটিয়ে আসতে পারি বাকি জীবনটা সুখে কাটবে। তুমি আমাকে বাধা দিওনা।

যথারীতি নির্দিষ্ট দিনে তিনি গিয়ে প্রবেশ করলেন এক বাগান বাড়ির নির্জন কক্ষে। বাইরে থেকে লাগিয়ে দেওয়া হল বড় একটা তালা। দিন কাটতে লাগল তার একা সেই কক্ষে। প্রথমদিকে কিছুদিন সে খুব দামি মদ সুস্বাদু খাদ্য–যা সে আগে খেতে পায়নি, সে সব চিরকুটে লিখে আনাতে লাগল। দেখল, এসব ইন্দ্রিয়আসক্তি উগ্র করে। তাই বর্জন করে দিল সব, গ্রহণ করতে লাগল সাদামাটা সাত্ত্বিক আহার। আর চিত্ত চাঞ্চল্য স্ববশে রাখার জন্য চেয়ে পাঠাতে লাগল ধর্মপুস্তক। কিছুদিন পরে চাইল পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষা শিক্ষার বই। যখন ভাষা রপ্ত হয়ে গেল তখন যে ভাষায় যত রকম দুমুল্য-দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যায় সে সব চাইতে লাগল আর পড়ে যেতে লাগল। এখন আর সে অন্যকিছু চায় না–শুধু বই আর বই।

গৃহস্বামী বিশাল বিত্তবান লোক। এ সব চাহিদা পূরণ করা তার পক্ষে কঠিন কিছু নয়। তা ছাড়া সে ভেবেছিল, কিছুদিন পরে বন্দী হাঁপিয়ে উঠবে। শেষে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে মুক্তি ভিক্ষা চাইবে। কিন্তু বন্দী তার কিছুই করল না। সে মহানন্দে ডুবে গেল জ্ঞানসাগরের মধ্যে। এভাবেই দিন কেটে চলল। এক সময় মানুষ ভুলে গেল বন্দীর কথা। নির্জন সেই কক্ষে সে বেঁচে আছে না মারা গেছে কারও তা মনে রইল না। এক সময় ধীরে ধীরে ফুরিয়ে গেল মেয়াদের কাল। পূর্ণ হয়ে গেল শর্তের কুড়ি বছর। আর মাত্র একটা রাত, তারপর মুক্তি পাবে বন্দী। কাল তাকে দিতে হবে বাজিধরা কুড়িলক্ষ ডলার। তখন গৃহস্বামীর আর আগের মত অবস্থা নেই। বড় আর্থিক মন্দা চলছে। এখন তার পক্ষে অতটাকা দেওয়া এক কঠিন ব্যাপার। দেউলিয়া হয়ে যেতে হবে তার। সেই চিন্তায় তখন গৃহস্বামীর পাগল পাগল দশা।

মানুষ তো মানুষই হয়। তার মধ্যে একাধারে দেবতা ও শয়তানের বাস।কখন যে মানুষ কার দ্বারা সঞ্চালিত হবে, কেউ জানে না। গৃহকর্তা তখন কী ভাবে টাকা না দিয়ে পার পাওয়া যায় সেই চিন্তায় অস্থির। তখন ভাবে, বন্দী লোকটাকে রাতের অন্ধকারে খুন করে লাশ গুম করে দেব। এখন আর তার কথা কারও মনে নেই। যদি কেউ কোনদিন তার কথা জানতে চায়, বলে দিলেই হবে, সে বহুদিন আগেই পালিয়ে চলে গেছে।

এই ভেবে গৃহকর্তা গভীররাতে একটা ধারালো অস্ত্র নিয়ে পৌঁছে গেল বন্দী নিবাসে। চাবি ঘুরিয়ে বহুকালের জংধরা তালাটা খুললেন। নিঃশব্দ ঘরের ভিতর ঢুকে দেখলেন, টেবিলের এককোণে একটা মোমবাতি জ্বলছে। চেয়ারে বসে কিছু লিখতে লিখতে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে বন্দী লোকটি। কুড়ি বছর আগে যেমন দেখেছিলেন এখনকার চেহারায় তার কোন মিল নেই। শীর্ণকায়, পক্ককেশ অকালেবৃদ্ধ হয়ে যাওয়া বিস্মৃত মানুষ।

গৃহস্বামী টেবিলের উপর থেকে সেই লেখা খাতাটা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন এতে বন্দী মানুষটা কী লিখেছে, অবাক হলেন তিনি, এটা তারই উদ্দেশ্যে লেখা একটা চিঠি। বন্দী লিখেছে, প্রিয় বন্ধু, আমি জানি আজ তুমি আসবে ও আমাকে হত্যা করতে চাইবে। কারণ তোমার আর্থিক স্থিতি এখন ভালো নয়। এতগুলো ডলার দেওয়া বর্তমানে তোমার পক্ষে অসম্ভব! আমি তোমাকে পরামর্শ দেব, তবু আমাকে হত্যা কোরো না। এতে তোমার ধরা পড়ে যাবার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। তাতে সাজা এবং লোকনিন্দা দুটোই তোমার ভাগ্যে জুটবে। আমি তা চাই না। আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। তোমার অনুগ্রহে আমি যে সব বহুমুল্য পুস্তক অধ্যায়ন করবার সুযোগ পেয়েছি নিজের চেষ্টায় কখনই পারতাম না। তাই তোমাকে বিব্রত না হতে হয়, সূর্যোদয়ের পূর্বে আমি বন্দীশালা থেকে বাইরে বের হয়ে যাব। দরজাটা খোলা রেখে দিও। আর সে তাই করেছিল। বিশ লক্ষ ডলারের মোহ দু পায়ে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিল বন্দীশালার বাইরে।

গল্প শেষ করে আমার দিকে তাকালেন মাস্টার মশাই। এটা একটা গল্প। তবে এই গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে বন্দিত্ব যতই কঠোর বা কষ্টকর হোক মনের জোর, শেখার আগ্রহ থাকলে তাকে হারিয়ে দিয়ে জয়ী হওয়া যায়।

রাত তখন গভীর। বিশ্ব চরাচর নিঝুম। কেউ কোথাও জেগে নেই। জেগে আছি আমরা দুজন। এক জ্ঞানবৃক্ষের নিচে এক রাখাল বালক। রাত একটু একটু করে ভোরের দিকে এগিয়ে চলেছে। তখন আমার মনে হচ্ছিল যেন বহুদূর কোন পাহাড়ের গুহায় বসে কোন ঋতবাক পুরুষ জগতবাসীর উদ্দেশ্যে শোনাচ্ছেন অভয় মন্ত্র–কোন অন্ধকারই ধ্রুব নয়। ধ্রুব হচ্ছে আলোকপতি অংশুমালী। তাকে আহবান জানাও অন্ধকার সরে যাবে।

আজ আবার সকাল হয়েছে। আজকের সকাল অন্যদিনের মতো নয়। কালরাতে যে ঘনমেঘ আকাশ ঢেকে রেখেছিল তা এখন আর নেই। সকাল বেলার সুর্য উঠেছে পুবাকাশ লাল করে। জানালা দিয়ে সে আলো এসে পড়েছে আমাদের ওয়ার্ডে। দেওয়ালের ওপারে একটা বিশাল বৃক্ষ। যার ডালে ডালে নেচে বেড়াচ্ছে লাল ঠোঁট সবুজ পাখনা হলুদ লেজ এক ঝাঁক পাখি। মনটা এখন একেবারে হালকা নির্ভার। বুকের উপর যে দেওয়াল সর্বক্ষণ চেপে বসে থাকে সে নেমে গেছে। এখন যেন আমি উড়ে যেতে পারি মহাকাশের মহাউচ্চতায়। যেখান থেকে জেলখানার উঁচু দেওয়ালকে অবলীলায় অস্বীকার করা যায়। আমি যেন প্রজ্ঞার সেই পাঠ পেয়ে গেছি।

পাঁচটার গুনতির পর আজ আর আমি ‘ফালতু’ হয়ে যাই না। মুখ হাত ধুয়ে এসে মাস্টারমশাইয়ের পায়ের কাছে নত হয়ে বসে পড়ি। উনি অবাক হয়ে জানতে চান কী ব্যাপার রে? বলি, আমি লেখাপড়া শিখমু। আপনে আমারে শেখান। উনি নির্নিমেষে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখে নেন। তারপর কোন কথা না বলে সোজা উঠে চলে যান। আবার ফিরে আসেন অল্প কিছু সময় পরে। ওনার হাতে একটা ছোট্ট কাঠি। সেটা আমার দিকে এগিয়ে দেন–নে ধর। এটা কী? এটা তোর কলম। আর এই উঠোন এটা তোর লেখার কাগজ। আর বই? নিজের বুকে হাত রাখেন তিনি–আমি তোর বই। আজ বৃহস্পতিবার–গুরুবার। খুব ভালোদিন। চল হাতেখড়িটা দিয়ে দিই।

মাস্টার মশাই সেইকাঠিখানা দিয়েশ্নটির উপুর মিষ্টির দোকানের নিমকির মত তিনকোনা একটা দাগ টেনে বললেন, কি ভাবে টানলাম আঁকটা দেখলি? পুব থেকে তেরছা করে উত্তরে, উত্তর থেকে পশ্চিমে তারপর সোজা আবার পুবে। এবার একটা বরশি মোচড়। এই হল ক। লেখ। এবার নিজে নিজে। দেখি পারিস কিনা। পারলাম। তবে অক্ষরটা ওনার মত সুন্দর হল না। শুরু হল আমার নিরক্ষরতার অন্ধকার মহাসমুদ্র পার হয়ে সাক্ষরতার উপকুলে পৌঁছাবার এক কঠিন সংগ্রাম। এ মহাসংগ্রাম নিজের সাথে নিজের। এ লড়াই জিততেই হবে। মাস্টার মশাই জারি করলেন তার অমোঘ আদেশ, ব্যঞ্জনবর্ণের চৌত্রিশটা অক্ষর। বেশি নয়, রোজ পাঁচটা করে লিখতে শিখতে হবে। যে পিছনে পড়ে যায় তাকে জোরে ছুটতে হয়। তুই কুড়ি বছর পিছনে পড়ে গেছিস। রোজ ষোলো আঠারো ঘন্টা শিখবি। বলে না, মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন। আজ থেকে তোর সেই পণ হোক।

মাস্টার মশাইয়ের কথা শুধুমাত্র কথার কথা নয়। মনের মধ্যে গেঁথে রেখে দেবার মত বাক্য বাণী জ্ঞান। মনে মনে প্রণাম করি ওনাকে। বরণ করে নিই যার স্থান ঠিক জন্মদাতা মাতা পিতার পরে সেই গুরুদেবের আসনে। এই তো সেই মহাগুরু, সেই মহান শিল্পকার–যার কুশলী হাতের স্পর্শে খড়কুটো মাটি প্রাণ পায়, প্রতিমা হয়। আমাদের ধর্ম বলেছে গুরু যদ্যপি করে বেশ্যালয় গমন, তথাপি জানিবে গুরু পতিত পাবন। হোক চিটিংবাজ ঠগ জালিয়াত প্রতারক। তবু উনি আমার গুরু, আমার প্রণম্য।

এখন আমার বাবার কথা মনে পড়ে। তিনি নিজে লেখাপড়া জানতেন না, তবু বিদ্বান মানুষদের প্রতি তার ছিল গভীর শ্রদ্ধা। অজস্র ছোট গল্প ছিল তার স্মৃতিতে। লোকশিক্ষার জন্য তৎক্ষণাৎ একটা গল্প বলে দিতে পারতেন। একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন মুখ কালিদাসের গল্প। কালিদাস মহামূর্খ, তাই তার বিদুষী স্ত্রী পদে পদে তাকে লাঞ্ছনা গঞ্জনা দেয়। তাই একদিন তিনি মনের দুঃখে জলে ডুবে আত্মহত্যা করবেন বলে চলে গেলেন দিঘির ঘাটে। সেখানে এসে দেখেন পুরনারীরা জলঘাটে জল ভরছে। তারা চলে না গেলে তো ডুবে মারা যাবে না, তাই বসে রইলেন এক গাছতলায়, কখন ঘাট খালি হবে সেই অপেক্ষায়। যখন ঘাট ফাঁকা হল কাছে এসে দেখলেন পুরনারীরা দিঘি থেকে জল তুলে এনে পাথর বাধানো ঘাটের সিঁড়ির যে জায়গায় রাখে, মাটির কলসির ঘষায় ঘষায় সেখানে একটা গর্ত হয়ে গেছে। তখনই তার গভীর জ্ঞানের উদয় হল–মাটির কলস, যা অতি ক্ষীণজীবী বস্তু যা অতি পলকা, তার অবিরাম ঘর্ষণে কঠিন পাথরও যদি ক্ষয়ে যেতে পারে, আমি মুখ কালিদাস নিরন্তর চেষ্টায় কেন পন্ডিত হতে পারব না। পারব, আমিও পারব। আমাকে পারতেই হবে। এই প্রতিজ্ঞা করে ফিরে এলেন তিনি। আর একদিন মহাকবি হলেন।

আমাদের ওয়ার্ডের বাইরে থাকার মেয়াদ সকালে দু ঘন্টা বিকালে দু ঘন্টা। এই চার ঘন্টা আমার নাগালে থাকে মাটি। যতক্ষণ মাটি পাই কাঠি দিয়ে মাটির গায়ে আখর ফোঁটাই, কখগঘ। যখন ওয়ার্ডের মধ্যে বন্ধ থাকি ভেজা আঙুল দিয়ে সিমেন্টের মেঝেতে অক্ষর আঁকি, ভাত খেতে খেতে ভাতের থালার ডালের দাগের মধ্যে এঠো তর্জনী দিয়ে লিখতে চেষ্টা করি বর্ণমালা। যখন হাতের কাছে কিছু থাকে না। মনে মনে লিখি, মনে মনে পড়ি। এখন আমি আমার চারদিকে অক্ষর ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনা। এক একটা মানুষের মুখ, তাদের হাঁটা হাসা হাত নাড়ানো সব আমার কাছে অক্ষরের মতো মনে হয়। যে লোকটা আমাদের ভাত দেয়, হাতের মুদ্রায় দন্তন্য লিখছে, যে ডাল দেয় যেভাবে ড্যাগ থেকে হাতা ঘুরিয়ে ডাল তুলে থালায় ঢালে, মনে হয় একটা বড় আকারের ত হয়ে যায়। ক-এর আকশিটা না থাকলে সেটা হয়ে যায়। ব-এর পেট থেকে একটা দাগ টেনে নিচে নামিয়ে আবার খানিকটা উপরে ঠেলে দিলে সেটা ঝ। ব-এর নিচে একটা পুটলি দিয়ে দিলে সেটা র। কয়ের আকশিটা উপরে ঘুরিয়ে দিলে ওমনি সেটা ধ। ক এর উপর দিকটা একটু ফাঁকা রাখলে সেটা ফ। ময়ের সামনের পুটলিটা না দিলে সেটা অন্তয্য, পুটলির জায়গাটা টেনে লম্বা করে দিলে দন্তস্য। পেটটা কেটে দিলে মূর্ধণ্য-ষ। ঢায়ের মাথায় একটা টিকি লাগিয়ে দিলে সেটা ট হয়ে যায়। সারাটা দিন ধরে আমি মনে মনে এই খেলা খেলি।

একদিন বসে বসে মাটির গায়ে আঁচড় কাটছি। সেটা সকাল বেলার টিফিন খাবার পরে। অক্ষরের যক্ষপুরীতে এমন হারিয়ে গিয়েছি যে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত বলা চলে। এর মধ্যে কখন যে দুবার “চলো, ফাইল” বলা হয়ে গেছে, টেরই পাইনি। এরপর আর ওয়ার্ডের বাইরে থাকার নিয়ম নেই। ওয়ার্ডে ঢুকে “লকআপ”হবার নিয়ম। নিয়ম না মানলে আর কোন কথা নেই পিঠে ডান্ডা। নিয়ম ভঙ্গ আমার হয়েই গেছে। আর উঠোনে কেউ নেই। সবাই চলে গেছে লকআপ হতে। মাস্টার মশাইয়ের আজ শরীরটা ভালো নেই। নাস্তা নিয়েই ওয়ার্ডে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। উনি কাছে থাকলে আমাকে ডেকে তুলতেন। ছিলেন না বলেই জেলাকোডের শাস্তি যোগ্য একটা অপরাধ করে ফেলেছি। টের পেলাম আমার অপরাধের শাস্তি দেবার জন্য পিঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যার মুখ খুব কম চলে–ডান্ডা চলে বেশি, সেই ভুবন সেপাই।

কীরে, কী করছিস রে? কি করছি তা আমার আর বলার দরকার পড়ে না। তার চোখেই পড়ে যায়, জেলখানার মাটিতে ফুটে থাকা আঁকা বাঁকা বর্ণমালা। যে রাগ কিছুক্ষণ আগে তার চোখ মুখ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছিল তা এখন নিভে যায়। হাতের লাঠি তার হাতে থেকে যায়। শূন্যে উঠে আমার পিঠে আছড়ে পড়ে না। ধীর গলায় বলে সে, সময় শেষ। আবার বিকালে লিখিস। যা, লকআপ হ গিয়ে।

মানুষ চেনা সত্যিই কঠিন, কে যে কী কিছু বোঝবার উপায় নেই। যে ভুবন সেপাই সারা জেলে নির্দয় মারকুটে বলে খ্যাত, যে জেলকোডের নিয়ম বিরুদ্ধ কোন কাজ করে না, যদি কেউ তা করে, তাকে ছাড়ে না, সে আজ সম্পূর্ণ বেআইনি একটা ঘটনা ঘটিয়ে বসে। এক সপ্তাহ তার ডিউটি ছিল আমাদের ওয়ার্ডে। সাতদিন সে আমার মাটি খোঁড়া দেখছে। তারই ফলে এই ভূমিকায়। ডিউটিতে এসে সে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে এক বাকসো চক পেনসিল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে–তোর সাধনায় আমার অল্প একটা সহযোগ থাক। কেউ যেন না দেখে। লুকিয়ে রাখ। এভাবে বাইরের কোন জিনিস গোপনে জেলের মধ্যে নিয়ে আসা বেআইনি কাজ।

স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ তো মাটি আর লাঠির কল্যাণে শেখা হয়ে গিয়েছিল। এবার চক দিয়ে সিমেন্টের মেঝের উপর শেখা শুরু হল আ কার ইকার। মাস্টার মশাইয়ের এখন জানালার উপর বসে মুক্ত বিশ্বাবলোকন ছুটে গেছে, সারাক্ষণ উনি আমাকে দেখছেন। আমাকে দেখাচ্ছেন। কেমন করে অক্ষরের পিছনে অক্ষর বসিয়ে একটা শব্দ হয়। কেমন করে শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে বাক্য হয়। কেমন করে বাক্যের সাথে বাক্য জুড়ে মনের ভাব সম্পূর্ণ প্রকাশ করা যায়। লেখ, অয় আকারে আ, ময় আকারে মা, রেফরয়ের র,–আমার, নয় আকারে না, আর ম নাম, আমার নাম–। লেখ, প আর থয় রশ্মিকার, পথি, আর ক পথিক।

-কিন্তু আমার নাম তো..

যে পথ চলে তারই নাম পথিক। তুই এখন চলেছিস। কোথায় চলেছিস বলতো? অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। এক এক পা করে এগিয়ে চলেছিস সূর্যোদয়ের দেশের দিকে। খুব দ্রুত তোর উন্নতি হচ্ছে। লেখ লেখ লিখে যা, থামিস না। অদ্ভুত এক মোহে আমি মগ্ন হয়ে গেছি, অদ্ভুত এক তপশ্চর্যা। এক রাতে স্বপ্ন দেখলাম আমি, কে এক দিব্যকান্তি পুরুষ আমাকে বলছে জেলখানার মেঝেতে তুই অক্ষর নয়, জীবন লিখছিস। তোর অনাগত ভবিষ্যৎ লিখছিস। বর্ণময় শব্দে সজ্জিত গর্বিত জীবন। এগিয়ে চল। চরৈবেতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *