০৩. পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাইরে বাইরে

মা বাবা ভাইবোন আত্মীয় পরিজন সবাইকে ছেড়ে এসেছি প্রায় পাঁচ বছর। পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ালাম যার মধ্যে দুবছর। দিনের পর দিন কিছু খাওয়া জোটেনি, চান হয়নি, ঘুম হয়নি। কখনও বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের অপরাধে চেকারে ধরে নিয়ে গেছে, কখনও রেল পুলিশ চোর বলে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে দিয়েছে। এক দুবার দুর্ঘটনায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একদিন একটা পাউরুটি চুরি করে নিয়েছিলাম এক দোকান থেকে। প্রখর রোদের তাপে ঝলসে গেছে শরীর, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে কোথাও কোন ছাউনি না পেয়ে। শীতের কামড়ে কেঁপেছি আর কেঁদেছিসারারাত। এভাবেই চিনেছিহৃদয়হীন পৃথিবীটাকে। কে যেন বলে গেছেন পৃথিবীটা গোল। এর যেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যাক অনবরত চলতে থাকলে একদিন সেইখানে এসে যাত্রা শেষ হবে যেখান থেকে একদিন শুরু করা হয়েছিল। আমিও তো এই নিয়মের অধীন। তাই একদিন স্পর্শ পেলাম পায়ের পাতায়–চেনা মাটির। গায়ে এসে লাগল সেই চেনা ফুরফুরে হাওয়া। কানে এসে বাজল আমরি বাংলা ভাষা।

.

আমি যেদিন কলকাতায় ফিরে এলাম সেটা ছিল ১৯৬৯ সালের গ্রীষ্মকালের সকাল। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে শিয়ালদহ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে এই পথটুকুর ট্রামভাড়া ছিল আট নয়া পয়সা, বাসভাড়া দশ নয়া পয়সা। পাঁচ বছরের চেষ্টার পরেও আমার পকেটে ওইটুকু পয়সাও ছিল না। যেদিন গিয়েছিলাম তখনও ছিল খালি হাত, যখন ফিরলাম তখনও তাই।

শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে চেপেছিলাম ঘোলা দোতলায় যাব বলে, ট্রেনের মধ্যেই দেখা হয়ে গেল একজন চেনা লোকের সাথে। সে ঘোলা দোতলার ক্যাম্পেই থাকে। তার মুখে খবর পেলাম আমার বাবা আর সেখানে থাকেন না। তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে যাদবপুরে এসে উঠেছেন। যাদবপুর কোন ছোট জায়গা নয়। বিশাল এই জনারণ্যে কোথায় আছে তারা, কী করে খুঁজে পাবো তাদের! তবু আশায় আশায় নেমে পড়ি ট্রেন থেকে যাদবপুর স্টেশনে। এখানে না নেমে আর যাবই বা কোথায়!

অনেকদিন এই শহরে বৃষ্টিপাত হয়নি। সারা শহর যেন সূর্যের দারুণ দহনে জ্বলে যাচ্ছে। সেই নিদারুণ প্রকৃতির রোষের সাথে পাল্লা দিয়ে সমান তালে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপও। পায়ে পায়ে সাতের দশক যে এগিয়ে আসছে। এই দশকেই তো তাজা বুকের গরম রক্ত দিয়ে লেখা হবে রাজনৈতিক ইতিহাসের সেই অধ্যায়। যা আগে মানুষ কখনও দেখেনি, আগে কখনও শোনেনি, আগে কখনও জানেনি।

আমি সেই ১৯৬৭ সালে শিলিগুড়িতে বসেই শুনেছিলাম নকশালবাড়ির নাম। যেখানে চিরকালের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে আদিবাসী, কৃষক, ক্ষেত মজুররা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তারা জমিদার জোতদারদের ধানের গোলা দখল করে নিচ্ছে, দখল করে নিচ্ছে চাষের জমি, ক্ষেতের ফসল। তাদের এক কথা, লাঙল যার জমি তার। যে জমিতে কৃষকদের শ্রমে ঘামে ফসল ফলে, অথচ উৎপাদিত ফসলে কোন অধিকার থাকে না, সে আইন তারা মানবে না। কিন্তু শোষক শ্রেণি যাদের লেজুরবৃত্তিকারী রঙবেরঙের শাসক দল, পুলিশ মিলিটারি–তারা মানুষের এই দাবি মেনে নেবে কেন! তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র জনতার উপর। শিশু বৃদ্ধা মহিলা কাউকে রেয়াত করছেনা। ক্রমে বড় হচ্ছে লাশের পাহাড়। আর মানুষ সেই পাহাড় অতিক্রম করে সামিল হচ্ছে প্রতিরোধ আন্দোলনে।

সেই নকশালবাড়ির লাল আগুন এখন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। তরাইয়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যে বেজে ওঠা “বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ” এখন শোনা যাচ্ছে নানান দিকে, ক্ষেতে খামারে পাহাড়ে জঙ্গলে। কলকাতায় এসে দেখি, সারা শহর দখল করে নিয়েছে ওই নাম–নকশালবাড়ি।

.

খোঁজার মত খুঁজলে নাকি খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সঁচও খুঁজে পাওয়া যায়। তবে তার জন্য কত দিন মাস বছর লাগে তার কোন হিসাব কেউ বলে যায়নি। আমি এই মহানগরে কোথায় আর খুঁজবো আমার প্রিয়জনদের। চিনি শুধু বাঘাযতীন মোড়, যেখানে আমার বাবা ঝুড়ি কোদাল নিয়ে বসে থাকতেন সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। যদি বাবার দেখা মেলে। কিন্তু দেখা মেলে না। তিনি আর ওখানে যান না। যখন যাদবপুরে নেমে ছিলাম এই শহরে আশ্রয় পাবার মতো আমার কোন স্থান ছিল না। সেদিন আমার আশ্রয় হয়েছিল এই রেল স্টেশন। আজও আমার আবাস আশ্রয় ঠিকানা হল সে-ই। আর কোন চা দোকান হোটেলে গিয়ে কাজ নেবার মত মনের ইচ্ছা ছিল না। বড়ও তো হয়ে গেছি একটু। এখন আমি প্রাপ্ত বয়স্ক-যুবক। এখন আমি স্টেশনে মোট বই। ভারী মোট। আর রাত হলে ওভার ব্রিজের সিঁড়ির উপর শুয়ে ঘুমাই।

একদিন ভোর বেলায় ক্যানিং ট্রেনের যাত্রী এক মাছ ব্যাপারীর মাছের চাকন পাল বাজারে পৌঁছে দিয়ে পঞ্চাশ পয়সা মজুরি নিয়ে ফেরবার সময় লেভেল ক্রশিংয়ের কাছে দেখা হয়ে গেল আমার দিদিমার সাথে। শুনলাম তিনি এক বাড়িতে কাজ করেন। রান্না, বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাঁচা। এর জন্য দু বেলা খাওয়া আর মাসে বারোটা টাকা বেতন মেলে। দিদিমার কাছে খবর পাই, পরিবারের সবাই এখন কোথায় থাকে। আমার মা দুই বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করেন। দু বাড়ির মাইনে মিলিয়ে ষোলটাকা হয়। মেজভাই চিত্ত এক চা দোকানে গেলাস ধোয় সে পায় মাসে দশটাকা। বাবার শরীরটা এখন আগের তুলনায় একটু ভাল। তিনি কার কাছ থেকে যেন জেনে নিয়েছেন খাবার সোডা খেলে পেট ব্যথা কমে যায়। এখন পেট চিনচিন করে উঠলেই একমুঠো সোড়া জল দিয়ে গিলে নেন। সাথে সাথে উপশম। তিনি এখন সেই আগের মত জনমজুর খাটতে পারছেন। যদিও খাটবার ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তবে এখন আর বাঘাযতীন মোড়ে যেতে হয় না। যেখানে থাকেন, সেখানকার পাড়াতেই কাজ পেয়ে যান।

কোথায় থাকেন। থাকেন শ্যামা কলোনিতে। এখন যেখানে সুকান্ত সেতু তখন সেখানে একটা খাল ছিল। ঠিক তার উল্টোদিকে। শ্যামা কলোনিতে ঢোকবার মুখে বা দিকে যে বিশাল বিল্ডিং, এখানে তখন বিল্ডিং ছিল না। ছিল একটা ফাঁকা মাঠ। আর জায়গাটি দখল করে রাখার প্রমাণ স্বরূপ মাঠের এককোণে একখানা ছোট দরমার ঘর। না পায়খানা বাথরুম, না জলের কল শুধু মাত্র একখানা ঘর। এই প্লটখানা যিনি দখল করে রেখেছেন, অন্য এক কলোনিতেও তার প্লট দখল করা আছে। ফলে এখানেথাকতে পারল ন্য। থাকেন সেখানে। দাম বাড়লে, পরে তিনি এই প্লটখানা বিক্রি করে দেবেন। শ্যামা কলোনির উল্টোদিকে রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, যেখানে কুলদা কর্মকার নামে এক ভদ্রলোক থাকেন। তিনি বাবাকে এই ঘরে থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

এই প্লটের পূর্বদিকে যে প্লট, যেটায় এখন একটা ব্যাঙ্ক সেই প্লটে তখন বাড়িটার থেমে থেমে নির্মাণ কার্য চলছিল। বাবার কাজ ছিল এই প্লটে থেকে সেই প্লটের ইট, বালি পাথর সিমেন্ট বাঁশকাঠ সব পাহারা দিয়ে রাখা। এর জন্য তাকে মাসে পনের টাকা দেওয়া হতো।

আমি যখন আসামে গিয়েছিলাম সেটা ১৯৬৮ সাল। তখনই সেখানে “বাঙাল খেদাও” আন্দোলনের অঙ্কুরোদগম হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝেই নানাস্থানে বিক্ষিপ্তভাবে আসামবাসী ও বাংলাভাষীদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছিল। যা থেকে অনুমান করা কঠিন ছিল না যে একটা রক্তক্ষয়ী লড়াই আসন্ন। তখন, আর বোধ হয় আসামে থাকা যাবে না, এই আশঙ্কা করে আসামের জোরহাট নিবাসী এক বিত্তবান বাঙালী ভদ্রলোক কলকাতায় বাড়ি বানিয়ে চলে আসার কথা ভাবেন।

আগেই বলা হয়েছে যে, সেই সময়ে এখানে বহুলোকই একাধিক কলোনিতে একাধিক প্লট দখল করে রেখেছিল। তারা তাদের পছন্দ মতো একদুটো নিজের দখলে রেখে বাকিগুলো উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দিতে থাকে। আসামবাসী ভদ্রলোক দালাল মারফত যোগাযোগ করে ওই প্লটখানা কিনে নিয়ে এই বাড়িটার নির্মাণ করাচ্ছিলেন। পরে অবশ্য আসামের গণ্ডগোল থেমে যাওয়ায় আর তিনি আসাম ছেড়ে এই বাড়িতে বাস করতে আসেননি। ব্যাঙ্ককে ভাড়ায় দিয়ে দেন।

যেদিন আমি সেই বাসায় গেলাম তখন দুপুর বেলায় রান্না করছিলেন আমার মা। একটা হঁটের উনুনে বাঁশের টুকরো কাঠের কুচির জালে একটা কালো হাড়িতে ফুটছিল আটাগোলা। আটা জ্বাল হয়ে গেলে নুন দিয়ে বার্লির মত চুমুক দিয়ে খাবে বলে মায়ের কাছে বসেছিল আমার ভাই নিরু আর বোন অঞ্জু। বাবা তখন বাসায় ছিলেন না। পাশের রেশন দোকানের একটা চালের বস্তা নিয়ে নারকেল বাগান কলোনিতে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন পঞ্চাশ পয়সা মজুরির বিনিময়ে। যেদিন বাবার মজুরের কাজ হয়না ওই দোকানে গিয়ে বসে থাকেন। এতে এক আধটাকা হয়ে যায়। আমার ভাইবোন অধীর আগ্রহেইটের পাঁজা হেলান দিয়ে মায়ের রান্নাকরা দেখছিল। আটার মধ্যে ভেসে ভেসে উঠছিল ওদের কুড়িয়ে আনা কিছু সজির টুকরো। মা ভাইবোন সবারই চোখে মুখে বুকে পেটে শরীরের সর্বত্র জেগেছিল যেন যুগ যুগান্তের প্রবল ক্ষুধা।

আমাকে দেখে ভাইবোন প্রথমে চিনতে পারেনি। চিনেছিল মা। আর ভাইবোন যখন চিনল চক্ করে উঠল তাদের ছোট ঘোট দুজোড়া চোখ। বোনটা এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে–দাদা এ্যাতোদিন আসোস নাই ক্যান! কই আছিলি? আমাগো জইন্য কী আনছোস?

জন্ম মুহূর্তের এক অভিশাপ জর্জরিত মানুষ আমি, দুহাত ভরে শূন্যতা ছাড়া আর কী আনতে পারি! মাথা নাড়ি আমি কিছুই আনতে পারিনি। এই দেশ, সময়, মানুষ, খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে। সবাই ঠকিয়েছে যার যেমন সাধ্য। মা কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করে-এতগুলান বছর কই আছিলি? কোথায় যে ছিলাম মাকে তা কী করে বোঝাই! ছিলাম তোনরকে, নরক যন্ত্রণা ভোগ করার জন্যে। এই পৃথিবীর মধ্যে যে বজ্রকন্টকশাল্মলী নরক রয়েছে যেখানে কৃমিকীটের মত মানুষ মানুষকে খুবলে খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়, আমি সেই নরকের বাসিন্দা হয়েছিলাম। সেই কষ্টের কথা মাকে কী করে বলি! বলে হবেই বা কী? তাই কিছুই বলতে পারি না আমি। একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। গ্রীষ্মের রাগীবোদ আমার শরীর জুড়ে ছোবল মারতে থাকে। দরদর ঘামে গায়ের গেঞ্জি ভিজে ওঠে। ভিজে ওঠে আমার চোখের পাতাও।

এ সময়ে বাবা ফিরে আসেন, পাঁচ বছরে তার বয়স যেন পনের বছর বেড়ে গেছে, হাতের ছেঁড়া ময়লা গামছাটা দিয়ে মুখ চোখ মুছে যেন ভূত দেখছেন এমনভাবে আমাকে দ্যাখেন। তারপর গর্জে ওঠেন–”কী করতে আইলি! আমরা মরছি কীনা দ্যাখতে আইলি বুঝি? মরি নাই। আমরা। মরলে তহন আইস্যা পোড়াইয়া যাইস”। আমার মৌনতায় তিনি আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন–”পোলা জন্মাইলে বাপের বুকে হাতির বল হয়। ভাবে, পোলায় বড় হইলে আর আমার কষ্ট দুঃখ এত থাকবো না। পোলায় সে বোঝা কিছু হাল্কা করবো। কিন্তু পোড়া কপাল আমাগো। পোলায় যেই বড় হইছে, পাখনা গজাইয়া গেল তার। যেদিক মোন লয়, ওড়তে আছে। আমরা আছি না গেছি হেতে তার কিছু যায় আসে না।”

বাবার বাক্যের প্রতিটা শব্দের মধ্য দিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে তার জীবন যন্ত্রণার তীব্র গরল। যা সে পান করেছে সারাটা জীবন। যা তাকে দিয়েছে এই সমাজ সে তা-ই দিচ্ছে সন্তানকে। যার সঞ্চয়ে যা আছে সে তো তাই দিতে পারে, যা নেই তা দেবে কী করে? বাবার কথাগুলো যেন আমার বুকের পাঁজরে দাগ কেটে বসে যাচ্ছে। বাবার কী দোষ! গ্রামবাংলার সরলসোজা মানুষ। সে জানেনা ওই দেশকালে তার ছোট্ট ছেলেটা কতখানি অক্ষম–অসহায়। তার দুর্বল বাহুতে নিজের ন্যায্য পাওনাটুকু আদায় করে নেবার মত শক্তি সামর্থ এখনও আসেনি। তাই প্রতি দরজা থেকে ধাক্কা খেয়ে বঞ্চনা কুড়িয়ে ফিরে আসতে হয়।

যেভাবে মাথা নিচু করে ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, মাথা নিচু করে আবার ফিরে চললাম পথের দিকে। একদিন আমি সেচ্ছায় ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, আজ ঘর আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে। এখন মাথার উপরে মহাশূন্য ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।

.

একদিন আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সেই বাঘাযতীন মোড়ে। যেখানে আমার অকালে বুড়ো হয়ে যাওয়া বাপ কাজ পাবার আশায় এসে বসে থাকতেন। এখন সেখানে সমস্ত তীর্থস্থানে যেমন ভিক্ষা পাবার আশায় ভিখিরিরা বসে থাকে, সামনে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে বসে আছে শতশত মজুর শ্রেণির মানুষ। সবাই কাজ চায়। কাজের শেষে চায় মজুরী। তাদের পুত্রকন্যা খিদেয় কাঁদছে। তাদের জন্য চাল কিনে বাসায় ফিরতে হবে।

মোড়ের মাথায় গিজগিজ করছে কর্মপ্রত্যাশী মানুষ। মিস্তিরিরা আসছে বাবু লোকেরা আসছে, গরুর বাজারে যেমনভাবে লোক গরুর শিং দাঁত লেজ নাড়িয়ে দেখে গরু কেনে, সেইভাবে তারা এখান থেকে বাছাই করে মজুর কাজে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম এই মানুষ কেনাবেচা। এ-ও যেন সেই প্রাচীনকালের বাঁদিবান্দা বেচাকেনার বাজার। তফাত শুধু এই, সারা জীবনের জন্য নয়, এখানে মানুষটাকে কেনা হচ্ছে একদিনের জন্য। ক্রীতদাস পোর চাইতে এতে খরচ অনেক কম পড়ে।

।আমি এখানে কাজ পাবার জন্য আসিনি। আমি তো স্টেশনে মোট বই। এসেছিলাম বাঘাযতীন বাজারে মাছের ঝুড়ি নিয়ে। কিছু ছোট ব্যাপারী খরচা কম পড়ে বলে রিকশায় মাল না চাপিয়ে আমাদের দিয়ে বওয়ায়। ঝুড়ি ফেলে যাওয়ার সময় কী মনে করে যেন দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। তখনই হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল একজন লোক। মাথায় সরসের তেল চপচপে লম্বা চুল, খালি পা, গায়ে হাতওয়ালা সাদা গেঞ্জি, গলায় পৈতা। আমাকে বলে সে “এ্যাই কামে যাবি”? কাজ! কী কাজ? জানায় সে “বিয়া বাড়ির কাম।” জল ভরতে হবে, মশলা করতে হবে, পাতা গেলাস ধুতে হবে, এটো পাতা ফেলতে হবে। এর জন্য মজুরি পাওয়া যাবে সাড়ে তিন টাকা, আর তার সাথে বিয়ে বাড়ির উপাদেয় খাবার একপেট ঠেসে যতটা ধরে।

আমি সেই জনগোষ্ঠীর মানুষ যারা উপাদেয় তো দুরের কথা, পেট ভরেই খেতে পায় না। স্টেশনের কিছু গরিব গুরবো দীন দুঃখী মানুষ বিয়ের সিজনে ডাস্টবিনে ফেলা এটোপাতা–খুঁজে খাদ্য নিয়ে আসে। ওদের মুখে শুনি সেই সব খাদ্যদ্রব্যের নাম। যা আমার বাপ ঠাকুরদাও কোনদিন শোনেনি, চোখে দেখেনি। আমি কাজে গেলে তা চোখে দেখতে পারব। রাজি হয়ে যাই। যামু কামে।

আমি বর্ণব্যবস্থার সর্বনিম্ন ধাপে অবস্থানকারীনমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। জল-অচল, অচ্ছুত, অস্পৃশ্য। উঁচু জাতের হেঁসেলে গিয়ে ঢুকলে সেটা অপরাধ। যে আমাকে কাজে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে, তার নাম মেঘা দাস, জাতিতে জেলে। অনেক খুঁজে মেঘা এক গুরুদেবকে পেয়েছে যার শিষ্য হলে পৈতা পাওয়া যায়। মেঘা তার শিষ্য হয়ে উপবীত পেয়ে পেশাগত দিকে কিছু নির্ভরতা পেয়েছে। গলায় পৈতে থাকায় আর কেউ জাত জানতে চায় না।

বলে সে–কী নাম তোর? নাম শোনার পর বলে, কেউ জিগাইলে ওই নাম কবি না। জাইত কবি কাইস্থ, কাম কইরা পয়সা নিয়া চইল্যা তাইলে জাইত যাউক সোগা মারাইতে।

এই জগতের এ এক বিচ্ছিরি নিয়ম এক জনের খারাপ না হলে আর একজনের ভালো হয়না। এই জন্যে বলে কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষমাস। জামাই এসেছে শ্বশুরবাড়ি, শাশুড়ির সে কী আনন্দ। ওদিকে প্রাণ গেল কঁচি পাঠাটার। লাখ খানেক ডিম পেটে নিয়ে মারা পড়ল বেচারা ইলিশ মাছ।

আমরা যে বাড়ি রান্নার কাজে গিয়েছিলাম আয়োজন ছিল চারশো জনের। রান্নাবান্না যখন শেষ হঠাৎই শহর কাঁপিয়ে নেমেছিল কালবৈশাখির ঝড়-জল। বড় বড় গাছের ডাল ভেঙে পড়েছিল মড়মড় করে রাস্তার ওপরে। বিকট শব্দে বাজ পড়ছিল চারধারে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিল বিদ্যুৎ ও পরিবহণ ব্যবস্থা। অবশ্য ঘন্টা দেড়েক পরে সেই ঝড় জল থেমেও গিয়েছিল। কিন্তু তখনকার বিক্রমগড়ের পথঘাট এমন ঝা চকচকে তো ছিল না। ইট বিছানো সে রাস্তায় ছিল বড় বড় গর্ত। আর এ রাস্তায় তখন একমাত্র রিকশা ছাড়া অন্য কোন বাহনও ঢুকত না। এখন সেই সব গর্তে জল জমে গেছে। অন্ধকারে চোখ চলে না। চাকা ভাঙার ভয়ে বেশি ভাড়া দিলেও রিকশা আসতে চাইছে না। এই অবস্থায় নিমন্ত্রিত আত্মীয় স্বজন যারা দূরে থাকে–আসে কী করে। তা ছাড়া এই অঞ্চলে এখন রাত নামলেই বোমা গুলি চলা শুরু হয়ে যায়। রাত গম্ভীর হয়ে গেলে তারা ফিরে যাবে কী করে। ফলে চারশো নিমন্ত্রিতের মধ্যে মাত্র দুই আড়াই শ এসেছে। এখন বেঁচে যাওয়া এত খাবার দাবারের কী উপায় হবে?

অন্যান্য মজুরের তুলনায় রান্নার কাজের মজুরদের দ্বিগুণ সময় বেশি খাটতে হয়। সকাল থেকে রাত দুপুর। কিন্তু এর জন্যে মজুরি মেলে না। তার বদলে মেলে দুবেলা খাবার। এরা দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেয়। রাতের খাবার না খেয়ে পোটলা বেধে বাসায় নিয়ে যায়। গরিব পরিবারের মানুষ এরফলে একটু সুস্বাদু খাদ্যের স্বাদ পায়। সেদিন নিয়মমত সবাই যখন গামছার উপর কলাপাতা পেতে যে যার মজুরির খাদ্যে নেবে বলে প্রস্তুত, দুঃখী গৃহকর্তা একটা হাতা ঠকাস করে আমাদের সামনে ফেলে দিলেন–কী আর দেব, যার যা লাগে নিয়ে যাও? এসব আর কী হবে, সব তত ফেলা যাবে। যা পারো নিয়ে কমাও।

আমরা পাঁচ ছয়জন ছিলাম। যার গামছায় যতটা ধরে বেধে নিয়েছিলাম মাংস আর ভাত। শুধু আমাদের যে মাথা সেই নরেশ ঠাকুর কোন খাবার নেয়নি। খেয়েছিল দই আর মিষ্টি।

সেদিন রাত দুপুরে বাসায় ফিরে এসেছিলাম আমি। ঘুমন্ত মা বাবা ভাইবোন সবাইকে ডেকে তুলে বসিয়ে ছিলাম সরুচালের ভাত আর পাঠার মাংসের সামনে। বড় তৃপ্তি করে সেদিন খেয়েছিল সবাই আমার জীবনের প্রথম রোজগারের অন্ন।…..আমাদের দেশ মুনি ঋষিদের দেশ, তারা বলে গেছেন লোভ লালসাকে পরিত্যাগ করতে, কারণ লোভে পাপ হয়, পাপ করলে নরক গমন ঘটে, নরকে অশেষ যন্ত্রণা অপমান। কিন্তু মানুষ কবে আর মহাপুরুষদের কথা মেনে চলেছে। আমিও তো মানুষই। আমার লোভ হয়ে গেল, সুস্বাদু খাদ্যের লোভ। নেশা হয়ে গেল, রান্নার কাজে যাবার নেশা। যে আমাদের আসল রাধুনি ছিল তার নাম নরেশ ঠাকুর। সে বাল্যকালে মায়ের সাথে বর্ধমান থেকে কলকাতায় এসেছিল। তারপর আর কোনদিন বর্ধমানে যায়নি। লোকে তার মায়ের নামে সেখানে নাকি যাতা বলে। সে সব কথা শুনতে চায়নি।

নরেশ ঠাকুরের মাসি কিভাবে কেমন করে যেন পৌঁছে গিয়েছিল শেঠ বাগান লেনে। এখানে এক “হাইকোর্টের উকিল” তার ‘বাধাবাবু” হয়ে যায়। উকিল সাহেবের বউ বাচ্চা ছিল না। সে তার সমস্ত রোজগার দিয়ে মাসির নামে বেশ বড় একটা বাড়ি কিনে দেয়। তিনতলা এই বাড়িটায় নিজেদের ব্যবহারের জন্য দু তিনখানা কামরা রেখে বাকি ঘরগুলো দিনচুক্তিতে ভাড়া চলত। মাসির নিজের কোন সন্তান ছিল না। তাই তিনি তার ছোটবোন এবং তার দুই শিশু পুত্রকে এখানে এনে রাখেন। এসব গল্প নরেশ ঠাকুর নিজে আমাকে বলেছিল। আমাকে খুব ভালোবাসত বিশ্বাস করত। তবে তার মা এই পেশা গ্রহণ করেছিল কিনা তা কোনদিন বলেনি। সে নিজে থেকে যা বলেছে তার বাইরে অন্যকিছু আমার জানবার আগ্রহও ছিল না।

মেশো আগেই মারা গিয়েছিলেন, মাসি মারা যাবার সময়ে নরেশ ঠাকুর এবং তার দাদার নামে উইল করে বাড়িটা লিখে দিয়ে যান। এই বাড়িতে কমপক্ষে কুড়ি বাইশটি মেয়ে থাকে। তারা যে ভাড়া দেয়, একটু হিসেব করে চললে পুলিশ এবং পাড়ার মাস্তান, রাজনেতা সবাইকে দিয়েথুয়ে দুভাইয়ের সংসার চলে যাবার কথা। কিন্তু নরেশ ঠাকুরের দাদার খরচ ছিল হিসেব ছাড়া। মদ জুয়া বাইরের মেয়ে মানুষ সব নেশাই ছিল ষোল আনা। সে নিয়ে দুই ভাইয়ে ঝগড়া বচসা। এরপর শুরু হল দু ভাইয়ে পুরো বাড়িটা একা দখল নেবার চেষ্টা। চলল মামলা মোকদ্দমা। মামলার খরচা যোগাড় করা হোত সুদে টাকা ধার করে। শেষে একদিন বাড়িটাই চলে গেল দেনাদারের গর্ভে। দুই ভাই সপরিবারে নেমে এল পথে।

নরেশ ঠাকুরের তখন স্ত্রী মারা গেছে দুই ছেলে দুই মেয়ে রেখে। এরপর আর কী–এখানে দু দিন ওখানে দু মাস এইভাবে পথে পথে, ভাড়া বাসায়, ফুটপাতে দিন কাটানো। লেখাপড়া বিশেষ জানে না, কোন হাতের কাজও শেখেনি, শরীরও কোন শ্রমদায়ক কাজের উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার অবকাশ পায়নি। এখন বাঁচবে কীভাবে। কিছুদিন পরে একে একে ছেলেমেয়ে সবাই তাকে ফেলে চলে যায়।

যখন আমার সঙ্গে নরেশ ঠাকুরের পরিচয় হয়, তখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তার বড় ছেলে গনেশটকির কাছে এক প্লাস্টিক কারখানার কাজ করে। বিয়ে করেছে। দুটো বাচ্চা সহ পাতি পুকুরে ঘর ভাড়ায় থাকে। বড় মেয়ে যে ব্যাগের কারখানায় কাজ করত সেই কারখানার সুপার ভাইজারই তাকে বিয়ে করেছে। তারও দুটো বাচ্চা, মা মাসির অতীতে তাকে ধাওয়া করেনি। সে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে আছে। ছোট মেয়ে মা মাসির পদানুসরণ করে পৌঁছে গেছে রাইচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের এক কক্ষে। সেখানেই কামায় ও খায়। আর ছোট ছেলে এসে গেছে সেই শেঠ বাগান লেনে। সে এখন এই গলির এক গুণ্ডা। তোলা তোলে, মদ খায়, মারপিট করে, জেলে যায়।

নরেশ ঠাকুরের সাথে আমি তার ছেলেমেয়ের কাছে অনেকবার গেছি। ছোট ছেলে–যার ডাক নাম বুড়ো সে আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। বুড়োর সাথে গিয়ে পতিতা পল্লীতে মুখে রং মেখে পথের দিকে তাকিয়ে থাকা দুঃখী মেয়েদের যেসব জীবন কাহিনী জানতে পেরেছিলাম তারপর তাদের আর অনেকের মত ঘৃণা করতে পারিনি।

নরেশ ঠাকুর আমাকে ছেলের মতো ভালবাসত। বিশ্বাস করত, তার একলা জীবনের বিপদ বিঘ্নে আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াব। কিন্তু সে আমি পারিনি। আমি তখন নিজের বিপন্ন জীবন নিয়ে কোথায় না কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। সেই সময় সে কী এক রোগে বিনা চিকিৎসায় রামকৃষ্ণ পল্লী মঙ্গল সমিতির বারান্দায় শুয়ে মরে যায় ও নিক্ষিপ্ত হয় বেওয়ারিস লাশ গাদায়।

সে অনেক পরের কথা। এখন আগের কথা বলি। আমার তখন রান্নার কাজে যাওয়ার ছয় সাত মাস হয়ে গেছে। সবদিন তো আর এ কাজ হয় না–মাসে দু চারবার। তবে যখনই কাজে যাই কড়াইয়ের আশেপাশে থাকি আর মন দিয়ে কাজটা শিখি। এ আমার দায়। একটা কিছু করে তো সারা জীবন খেতে হবে। দায়ে পড়ে নরেশ ঠাকুরও এইকাজ শিখেছে। তাইবেঁচে আছে। আমাকেও বাঁচতে হবে।

একদিন উত্তর চব্বিশ পরগণার এক জায়গা থেকে অন্নপ্রাশনের একটা কাজ এল। তিনশো লোকের আয়োজন। কাজটা ধরে নিল নরেশ ঠাকুর। কিছু অগ্রিম পেয়ে গেল। এর নাম বায়না। এসব কাজের এই নিয়ম। এতে দু পক্ষ দুপক্ষের কাছে বাধাপড়া থাকে।

তখনকার দিনে আজকালের মত এত ক্যাটারিং ব্যবসার রমরমা ছিল না। তখন গৃহকর্তা নিজে বাজার হাট করে, রান্নার লোক দিয়ে রাধিয়ে, নিজের আস্থাভাজন লোক দ্বারা পরিবেশন করিয়ে অতিথি অভ্যাগতদের ভুরিভোজন করাতেন।

আমি যে বাড়ির কথা বলতে যাচ্ছি সেই গৃহকর্তার বড় মেয়ের বিবাহ হয়েছে এই যাদবপুরে। মেয়ের বৌভাতে এসে নরেশ ঠাকুরের হাতের রান্না খেয়ে সেইদিনই তিনি মনঃস্থির করে বসেন, নাতির অন্নপ্রাশনে কলকাতার এই ঠাকুরকে দিয়ে রান্না করিয়ে সবাইকে খাইয়ে তাক লাগিয়ে দেবেন। তাই এই বায়না। পারিশ্রমিক বেশ ভালো রকম পাবার লোভে নরেশ ঠাকুর তখন কাজটা তো নিয়ে বসেছিল, কদিন পরে যে ওই একই তারিখে তার একটা বড় কাজ এসে যাবে তা কে জানত। সেটা অন্য অপর কেউ নয়, যে ডেকরেটর্স থেকে বারোমাস কাজ মেলে সেই ডেকরেটর্স মালিকের বাড়ির কাজ। বলে দিয়েছেন মালিক, আমার বাড়ির কাজ তোমাকেই করতে হবে নরেশ। আজেবাজে দুচারটে লোক পাঠিয়ে দেবে, তারা পাতে দেওয়া যায় না এমন রান্না করবে সে কিন্তু হবে না। তাহলে তোমার আমার সব সম্পর্ক শেষ, এই বলে দিলাম।

এখন কী হবে? অগত্যা আমার উপর দায়িত্ব দেওয়া হল উত্তর চব্বিশ পরগনার সেই কাজ সুসম্পন্ন করে আসবার। ভরসা ছিল নরেশ ঠাকুরের–আমি পারব। আমার সাথে যোগাড়ে হয়ে গেল বেতবেড়িয়া গ্রামের দুঃখে। বলে দিল নরেশ ঠাকুর, গিয়ে পার্টিকে বলবি আমার শরীর খুব খারাপ। হঠাৎকরে জ্বর এসে গেছে তাই যেতে পারিনি। কাজ শেষ করে আসার সময় চল্লিশ টাকা চেয়ে নিবি। দশ টাকা বায়না দিয়ে গেছে। এই মোট পঞ্চাশ।

আজ যাব বিকেলে, কাজ কাল, ফিরব পরশু সকালে। দুদিন হাফ একদিন ফুল, আমি ঠাকুর তাই মজুরি পাব ষোল টাকা। এবার আমি পনের টাকায় মাকে একখানা কাপড় কিনে দেব। মা সেই মশারির টুকরো জড়িয়ে কতদিন কাটিয়েছেন অন্ধকার ঘরের কোণে তা আমি জানি না। তাকে দিনের আলোয় আনবার জন্য কর্মকারের বউ একখানা বাতিল কাপড় বাবার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তখন কর্মকার বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। বাবা মজুরের কাজ করছিলেন। এখন সেখানাও ন্যাকড়া।

তখন বিকেল শেষ হয়ে সবে সন্ধ্যে নেমেছে। আমরা দুজন পৌঁছে গেছি সেই ঠিকানায়। সে সময়ে বাড়িটা সাজানো চলছে। গেটের সামনে কয়েকজন মজুর বাঁশের খুটি পুতছে। কাল এতে ফুলের গোছা বাঁধা হবে। একজন চার পাঁচ খানা হ্যাঁজাকে তেল ভরছে, ম্যান্টেল বাধছে। এ অঞ্চলে এখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছয়নি। আর বাড়ির গোবরলেপা পরিষ্কার উঠোনে এক আমগাছের তলে ইজিচেয়ার পেতে বসে আছেন এই গৃহের বড়কর্তা। তার পরনে ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো পরা একখানা দামি ধুতি। গায়ে কিছু নেই এবং হাতে একখানা তালপাতার পাখা। গলায় ধবধবে একগাছা পৈতা। তার সামনে মাটিতে শীতলপাটি বিছানো যার উপরে শায়িত সেই শিশু। যার কাল মুখেভাত। হাজার হাজার টাকা ব্যয়। সোনার বরণ সে শিশুর সারা শরীর সোনায় মোড়া। গলা হাত বাহু কোমর কোথাও খালি নেই। বড়ই ভাগ্যবান এই শিশু জন্ম নিয়েই দশভরি সোনার মালিক।

আমরা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই আমাদের হাতে হাতা খুন্তি দেখে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি-নরেশ আসেনি? বলি আমি–তার শরীরটা। তিনি আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন–খুব খারাপ তাইনা? হঠাৎ করে আজ জ্বর এসে গেছে এই বলবি তো? একটু সময় চুপ করে থেকে জানতে চান তিনি-তোদের দুজনের মধ্যে ঠাকুর কে? আমি আঙুল তুলে দুঃখেকে দেখাই। সে দেখায় আমাকে। হুকুম দেন গৃহকর্তা-~ও দিকে তাকা। তাকাই সেই দিকে। একজন মজুর কুড়ুল দিয়ে কাঠ “চেলা” করছে। এই “চেলায়” কাল রান্না হবে। উনি সেই “চেলা” দেখিয়ে বলেন–কে রান্না করবি আমার জানার দরকার নেই। যদি রান্না খারাপ হয় ওর একখানা পিঠে পড়বে মনে থাকে যেন।

সন্ধ্যে গড়িয়ে গিয়ে রাত নামল। সে বড় ভয়ের রাত। চারিদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। মাঠের ঘাসের মধ্যে ঝিঁঝি পোকারা তান ধরেছে। সামনের পাটক্ষেতের মধ্যে সাপে ব্যাঙ ধরেছে। বড়ই করুণ স্বরে কো কো করে কাতরাচ্ছে মৃত্যুপথযাত্রী ছোট্ট জীবটা। যেখানে কাল রান্না হবে সেখানে আমরা দুটো উনুন বানিয়েছি। তারপরে এদের দেওয়া খাবার খেয়ে পাকশালেই শুয়ে পড়েছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। আমার নিজের উপর আস্থা আছে। জানি, রান্না আমি ভালোই করব। এমন কিছু ঘটবে না। যে পিঠে চেলা কাঠ পড়ে। কিন্তু দুঃখের বুক কাঁপছে ভয়ে। সে আমার উপর ঠিক ভরসা রাখতে পারছেনা। রাত আর একটু ঘন আর একটু শুনশান, নিস্তব্ধ হয়ে যাবার পর আমাকে চুপিচুপি বলে সে–”চল এ্যাখোন আমরা পেলিয়ে চলে যাই।” আন্না বান্নার কথা কিছু বলা যায় নে। এই ভালো তো এই খারাপ। এরা লোক ভালো নয়। যেদি আন্নায় কোন দোষঘাট হয় বড় ঠ্যাঙাবে। আমি এটা জানি যে এখন পালিয়ে চলে যাওয়া খুবই খারাপ কাজ হবে। তখন এরা যাদবপুরে গিয়েও পিটিয়ে আসতে পারে। জন সমর্থন পাবে। বলা যায় না আমরা চলে গেলে রেগেমেগে আমাদের নামে একটা চুরির কেসও চাপিয়ে দিতে পারে সে কথাই বলি দুঃখেকে। সাহস দিই–ভয় পাইসনা দুঃখে দা, দেখবি আমি ভালোই রানমু।

আমার কথা সত্যি হয়েছিল। নিমন্ত্রিত লোকজন খেয়ে রান্নার খুব প্রশংসাও করেছিল। কিন্তু আমাদের সগুণ দোষে পরিণত হয়ে গেল যখন জাতি পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ল।

এই বাড়ির সেই জামাই যে যাদবপুরে থাকে, সে কোন সাধারণ লোক নয়। নামকরা এক মাস্তান। সে এতক্ষণ পাশের কলাবাগানে বসে পাঠার মেটুলি দিয়ে “বাংলা” খাচ্ছিল। একা নয়, সাথে শ্যালক ছিল। পানপর্ব শেষ করে এসে সে দুঃখেকে দেখেই চিনে ফেললো। এ্যাই, তুই সেদিন আমাদের পাড়ায় পানাপুকুর সাফ করেছিলি না? নরেশ তোকে পাঠিয়েছে রান্না করতে।

এটা তো সত্যি যে রান্নার কাজ সবদিন হবার নয়। কিন্তু পেটের খিদে যে সবদিনের। তাই দুঃখে অন্য কাজ যখন যা পায় করে। তা না করলে সংসার চলে না। আমিও তো স্টেশনে মোট বই। তাই দুঃখে একদিন করেছিল কোন এক পানা পুকুরের পানা তোলার কাজ। সেটাই দেখেছিল মাস্তান জামাই এবং তার মুখটা মনে করে রেখেছিল।

এবার সেই জামাই আর তার শ্যালক দুজনে চেপে ধরল আমাদের। বল তোদের কী নাম, কী জাত। জেরায় প্রকাশ হয়ে গেল–একজন দক্ষিণবঙ্গের কাওড়া আর একজন পূর্ববঙ্গের নমঃশুদ্র। দুটোই জল অচল–অচ্ছুত। এরপর দুই মদ্যপজাত লুকিয়ে বামুনের হেঁসেলে ঢোকার অপরাধে আমাদের ধরে নিয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে, কলা বাগানের মধ্যে। কান ধরে ওঠবস নাকে খত এই সব করালো আমাদের দিয়ে। এটা ওদের কাছে ছিল হয়ত একটা মজা পাবার বিষয়। কিন্তু আমাদের কাছে ছিল চরম অবমাননাকর একটা ঘটনা। যা কোনদিন ভুলে যাবার মত নয়।

পরের দিন সকালে কাউকে কিছু না বলে দিনের আলো ফোটবার আগে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে চলে এসেছিলাম আমরা। এক হীনমন্যতা গ্রাস করে নিয়েছিল আমাদের। সাহস করে যে পারিশ্রমিকের টাকাটা চেয়ে নেব, তাও পারিনি।

.

রামকৃষ্ণ উপনিবেশ কলোনিতে থাকে একজন ছেলেধরা। এই লোকটার নাম প্রণব চক্রবর্তী। এক পার্টির আঞ্চলিক নেতা। ফরসা লম্বা ভদ্রশিক্ষিত এই লোকটি সবসময় খুঁজে বেড়ায় কাকে ধরবে। উঠতি বয়সের ছেলে তার ভারী পছন্দ। আমাকেও ধরবে বলে তাক করে আছে। মাঝে মাঝে সে ডেকে আমাকে চায়ের দোকানে নিয়ে বসায়। নিজের পয়সায় বড় চা নিয়ে দুভাগ করে।

তিনি একদিন বলেছিলেন–”এই পৃথিবীর যা কিছু মহান যা কিছু শ্রেষ্ঠ যত কিছু সম্পদ সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা। তাই পৃথিবীর সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ সবচেয়ে মহান মানুষ হচ্ছে মেহনতি মানুষ, শ্রমিক ও কৃষক।”

আমার কিন্তু শ্রম জীবনের প্রতি কোন আকর্ষণ কোন মোহশ্রদ্ধা আর অবশিষ্ট নেই। কোথাও কোন কাজে যেতে মনের সায় পাইনা। রান্নার কাজে যাবার কথা বললে রাগে সারা শরীর যেন জ্বলতে থাকে। তাই কাজ কর্ম ছেড়ে চুপচাপ ঘরে বসে থাকি।

.

আমার মেজভাই চিত্তর পায়ের উপর গরম জলের কেটলি উল্টে পড়ে গেছে। তাই বাসায় চলে এসেছে সে। পায়ের ফোস্কা সেরে যাবার পর সে একটা অন্য কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। যে মালিক এমন বিপদের সময় শুধুমাত্র ফোস্কার উপর বার্নল লাগিয়ে দায় মুক্ত হয়ে যায়, কোন খোঁজ নেয় না তার কাছে কাজ করার ইচ্ছা নেই আমার ভাই চিত্তর। সে তাই তখন বাসায় বসেছিল।

আমরা শ্যামাকলোনি নামের যে পাড়ায় থাকি, রাজা সুবোধ মল্লিক রোড় পার হয়ে তার এপাশের কলোনির নাম রামকৃষ্ণ উপনিবেশ। সেখানে থাকে অনিল, বিলু আর বাসক-নামগুলো আসল নয় একটু বদলে দিলাম। এরাতিনবন্ধু। অনিলেরা চারপাঁচ ভাই। তাদের যাদবপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে বড়কাপড়ের দোকান।বিলু আর বাসক সুলেখা কালির কারখানার কর্মী। এবং এক রাজনৈতিক দলের সদস্য। পূর্বদিকে রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, পশ্চিমদিকে টিবি হাসপাতাল। এর মাঝখান থেকে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সোজা চলে গেছে যে বড় জল নিকাশি নালা, বাসকের মা এই নালায় জমা জলে ডজন খানেক হাঁস পোষে। একদিন ওরা তিনবন্ধু এসে ধরে নিয়ে গেল আমার ভাই চিত্তকে। তাদের অভিযোগ যে সে নাকি হাঁস চুরি করেছে। আমার ভাই চুরি করেছে সেটা কেউ দেখেনি। তবে কে একজন তাকে ওই নোংরা জল নিকাশি নালার কাছে সন্ধ্যে বেলায় ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। তারপরই হাঁস নিখোঁজ। এতেই প্রমাণিত সে ছাড়া আর কেউ নেয়নি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া হাঁসটা।

আমরা যে বাসায় থাকি তাতে কোন পায়খানা নেই। ফলে পায়খানা পেলে আমাদের ওই নালার পাশের ঢোলকমলির জঙ্গলেই যেতে হয়। সাপ আছে জোক আছে বিছে আছে জেনেও আমরা নিরুপায়। এবং আমাদের সবচেয়ে পছন্দের সময় সন্ধ্যার সূর্য ডোবার পরে আর সকালে সূর্য ওঠার আগে। সন্ধ্যার সময় আমার ভাই সেখানে হয়ত গিয়েছিল। তাই শুধু মাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তারা ওকে ধরে নিয়ে গেল। এখানে আমাদের আপনজন কেউ নেই। আমরা এখানকার লোকও নই। এখানে থাকি একজনের অনুগ্রহ আর একজনের বাসায়। আমরা শিক্ষাদীক্ষাহীন–গরিব মানুষ। জাতিতেও নিচু। আমাদের হয়ে এখানে কে কথা বলবে। কেন বলবে? বললে একমাত্র বলতে পারতেন প্রণব চক্রবর্তী, আমার প্রণব দা। কেন কে জানে তিনি ধারে কাছে আসেননি। সেটা কী অনিল তারই সংগঠনের ছেলে বলে? আমি জানি না!

যারা আমার ভাইকে নিয়ে গেছে তাদের যুক্তি অতি চমৎকার–এত বছরে এখানে কারও কোনও কিছু চুরি যায়নি। আমরা আসার পরই হাঁস গেল। এর মানে একটাই–আমরাই চোর। এবং সেই সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎকাল নিয়েও উৎকণ্ঠা, আজ হাঁস চুরি করেছে কাল কার দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সব মাল হাতিয়ে নেবে তার কি ঠিক। অতএব আজই এমন শিক্ষা দিতে হবে, যেন চুরির নাম ভুলে যায়। সেই শিক্ষা দেবার জন্য শুরু হয়ে গেল বেধরক মার।

আমার বাবা তখনও কাজ থেকে ফেরেননি। সারাদিনের কঠিন পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে ক্রন্দনরতা মায়ের মুখে সবকথা শুনে আর বিশ্রাম নিতে পারলেন না, পাগলের মত ছুটে গেলেন তিনি। হাত জোর করে কেঁদে ফেললেন বাবুদের দয়ার দরজায় “–বাবুগো অরে আপনেরা আর মাইরেন না। পোলায় আমার সারাদিন কিছু খায় নাই। আর মারলে মইরা যাইব।” বাবার স্বীকারোক্তির মধ্যেই তারা মারবার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি খুঁজে পেয়ে গেল। মানুষ চুরি করে কেন? করে স্বভাবে আর না হয় অভাবে। সারাদিন খায়নি, একেবারে সোজা অংক–সেই জন্যই হাঁস চুরি করেছে। হয় ওটা বিক্রি করে চালটাল কিনে আনবে বা এনেছে, নয় কেটে খেয়ে নিয়েছে বা খাবে। ঠিক কী করেছে সেটা যতক্ষণ না বলছে মার চলছে মার চলবে।

বাপের সামনে ছেলেকে মারা হলে কোন বাপের পক্ষেই তা সহ্য করা কঠিন। আর একপ্রস্থ মার শুরু হতেই বাবা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার ভাইয়ের বুকের উপর। দুর্বল শরীরের আড়াল দিয়ে রক্ষা করতে চেষ্টা করলেন সারাদিনের অভুক্ত পুত্রকে বিভৎস অত্যাচার থেকে। তার তখন ঠোঁট কেটে নাক ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। সারা শরীর পথের ধুলোয় লতপত। এই মারকুটে ছেলেদের প্রধান অনিল সাহা। সে বাবাকে টেনে তুলল চিত্তর বুকের উপর থেকে। পল্লীমঙ্গল সমিতির ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করা বলশালী হাতে বাবাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাকা রাস্তার উপর–যাও সরে যাও এখান থেকে নাহলে তোমাকেও বানানো হবে। সব চোর কাহাকা।

আছড়ে পড়া বাবার শরীরে যে আঘাত লেগেছিল, মনে লেগেছিল তার বহুগুণ বেশি। সারা জীবন তার মনে একটা ধারণা ছিল সে সৎ মানুষ, কঠোর পরিশ্রমী, কখনও কারও অনিষ্ট করেন না। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এই সব সদগুণের কারণে শ্যামাকলোনি ও রামকৃষ্ণ উপনিবেশের মানুষ তাকে ভালবাসে। এইখানে যে তাকে এত অপমানিত হতে হবে সে তার দুরতম কল্পনাতেও ছিল না। এই অপমানিত জীবন রেখে আর কী হবে? মাটি থেকে উঠে বাবা ছুট দিল রেল লাইনের দিকে। আত্মহত্যা করে তিনি সব অপমানের জ্বালা থেকে চিরমুক্তি নেবেন।

আমি তখন যাদবপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছিলাম। রাত তখন প্রায় নটা, বাসায় ফেরবার সময় দেখতে পাই কাঁদতে কাঁদতে টালমাটাল পায়ে আমার বাবা সামনের দিকে ছুটে আসছেন। তাকে ধরে ফেলে থামিয়ে সব শুনলাম। আর তখন সেই অবমাননাময় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে–চিরমঙ্গলময় ঈশ্বরকে অস্বীকার করলাম আমি। হে ঈশ্বর তুমি যখন তোমার এক অন্ধভক্তকে বিপদের দিনে বাঁচাতে এলে না–তোমাকে আমার আর কোন দরকার নেই। আজ থেকে আমার উপাস্য তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী–শয়তান। মনে মনে ডাকলাম হে শয়তান, আমাকে সাহস দাও শক্তি দাও। যে হাত দিয়ে অনিল আমার বাবাকে মেরেছে সেই হাতটা কাধ করে নামিয়ে দেব–সেই সাধনায় সিদ্ধি দাও।

সন্ধ্যের মুখে ওরা আমার ভাইকে নিয়ে গিয়েছিল, আর ছেড়েছিল রাত প্রায় সাড়ে নটায়। এত দীর্ঘ সময়-আশেপাশের মানুষ তামাশা দেখেছে। কিন্তু এক জনের মনেও শুভবুদ্ধির উদয় হল না। কেউ গিয়ে বলল না, কেন, তোমরা ছেলেটাকে এভাবে মারছো।ও যে চুরি করেছে তার প্রমাণ কী?

সেদিন যা জেনেছিলাম, বুঝেছিলাম আমার সেই জানাবোঝার এত বছর পরেও এতটুকু টোল পড়েনি। দীন দুর্বল অসহায় মানুষের উপর অত্যাচার করতে সবল শক্তিমানের কোন প্রমাণ দরকার পড়ে না। তার ইচ্ছাই যথেষ্ট। এখানে আর একটা কথা বলে রাখি-আমি অনিলের হাত কেটে ফেলতে পারিনি। সেটা আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ। কারণ যতদিনে আমি নিজেকে সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হই, ততদিনে সে তার নব বিবাহিত বধূকে রেখে ব্রেন টিউমারে মরে যায়।

আর একটা কথা, শেষ পর্যন্ত সেই হাঁসটা পাওয়া গিয়েছিল। কেন কে জানে সে ড্রেনের পাশের ঢোলকলমির জঙ্গলে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসেছিল। অনেক রাতে ভয় পেয়ে প্যাক প্যাক করে ডেকে উঠলে বাসকের ভাই গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে আসে।

.

আমার ছোট ভাইয়ের নাম নিরঞ্জন। তাকে আমরা ডাকি নিরু বলে। মাথাটা ছোট পেটটা বড়, মায়ের মত মুখ মায়ের মত গায়ের রঙ। এই ভাইটাকে আমি খুবই ভালোবাসি। ছোটবেলায় আমার কোন খেলবার উপকরণ ছিল না। বাবার সে ক্ষমতা ছিল না যে খেলনা কিনে দেবেন। আমি আমার সেই বাল্যের অতৃপ্তি তৃপ্ত করতে চাইতাম নিরুর মধ্যে দিয়ে। আমার কোন ঘুড়ি লাটাই লাট্টু কাঁচের গুলি ছিল না। কিন্তু নিরুর ছিল। আমি তাকে সেসব কিনে দিয়েছিলাম।ও খেলত আর আমি বসে বসে দেখতাম। যেখানে আমরা থাকতাম আমাদের চারপাশের সবাই ছিল স্বচ্ছল শিক্ষিত ভদ্রলোকের দল। যারা কায়িক শ্রমে জীবননির্বাহকারী মানুষকে ইতর ছোটলোক বলে মনে করে। ফলে ওরা আমাদের সাথে মিশত না। খুব দরকার না পড়লে কথা বলত না। আমাদের দারিদ্র্য এবং জাতিগত ভিন্নতা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল আঞ্চলিক সমাজ জীবন থেকে।

আমরা যে ভবনটির নির্মাণ সামগ্রীর পাহারাদার নিযুক্ত হয়েছিলাম সেটির নির্মাণ তখন বেশ কিছুদিন বন্ধ পড়েছিল। তখন আর ইট বালি এসব না আসায় আমাদের ঘরের সামনের মাঠটুকু ফাঁকা পড়েছিল। আমার ছোটভাই নিরু ছোটবোন অঞ্জু ওই জায়গাটুকুর মধ্যে সারাদিন ঘোরাঘুরি করত, খেলত। এই জায়গায় কোন কোনদিন এ পাড়ার বাচ্চারাও খেলতে আসত। তখন ওরা আমার ভাইবোনকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দিত। নোংরা আর ছেঁড়া জামা কাপড় কালো কালো চেহারা তেলহীন রুক্ষ মাথার চুল, খড়িওঠা গা–গতর এসব দেখেই সেইসব বাচ্চারা বুঝে গিয়েছিল, আমরা ওদের মত “ভদ্রলোক” নই। তাই তাদের আমাদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে থাকাই প্রচলিত নিয়ম।

সেটা সম্ভবতঃ ১৯৮১-৮২ সালের কথা। আমি তখন রিকশা চালাই। এইট বি বাসস্ট্যান্ড থেকে স্কুল ফেরতা দুটি বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম নর্থরোডে। সাত আট বছরের ফুলের মত সুন্দর বাচ্চা দুটি নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল হাসছিল। সেই পবিত্র নির্মল প্রাণখোলা হাসিতে আমার মনটাও হাসছিল “গাধা ঘোড়া গরু” তুল্য জীবনের কষ্ট অপমান ভুলে। রিকশা চালাতে চালাতে তাদের সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করছিলাম আমি, কি নাম তোমার খুকুমণি। কোন ইস্কুলে পড়ো…। আর নর্থরোডে পৌঁছে সুদৃশ্য বাড়ির দরজায় রিকশা থামিয়ে বিগলিত আত্মীয় ভাবনায় বলে বসেছিলাম, খুকুমণি আমাগো বাড়ি যাইবা? আর তখন সেই ফুলের মত শিশুর চোখে মুখে সেদিন যে ঘৃণার চালচিত্র ফুটে উঠেছিল তা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না। ছোট্ট ঠোঁট বাঁকিয়ে সেই শিশু চরম তাচ্ছিল্যের শব্দে বলেছিল–”তোমাদের বাড়ি কেউ যাবে না। তোমরা রিকশা চালাও।”

ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায়–বঙ্গভূমির বাঙালী মননে, বিশেষ করে কলকাতা মহানগরীর মধ্যবিত্ত ভাবনায়, ছোটজাত, ছোটলোক, কায়িকশ্রম এই তিনটি শব্দ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যারা ছোটজাত তারাই ছোটলোক। তারাই রিকশা চালায় মজুর খাটে, ঠেলা চালায়, বাসন মাজে এবং নানারকম কায়িকশ্রমে পেটের খাবার সংগ্রহ করে। আর যারা ভদ্রলোক তারা ভালো খায়, ভালোবাড়িতে থাকে, ভালো চাকরি করে যাতে কোন ঘাম ঝরে না শ্রম লাগে না। এই ভাবাশ্রয়ী পরাবৃত্তের মধ্যেই তাদের সব অভিগমন। যার দ্বারা পারিবারিক পরিবেশগত কারণে শিশুরাও সংক্রামিত হয়ে পড়ে শিশু বয়েসেই।ওদেরও কচি মনে দাগ কেটে বসে যায় ওরা আমরা এই শ্রেণি বিভাজন। দুয়ের কোন বিন্দুতে সম্মিলন সম্ভব নয়। এই ভাবনা উঁচু থেকে নিচুতে, গাছের মগডাল থেকে শেকড়ে চারিয়ে গেছে। কোন গরিব আর নিজেকে ভদ্রলোক বলে ভাবতে পারে না। ভয় পায়, লজ্জাও পায়।

একবার আমি বাইপাশ পার হয়ে রাধা হাউসিংয়ের কাছে একজন লোককে খুঁজতে গেছি। তিনি বলেছিলেন, হাউসিংয়ের পিছনেই ওনার বাড়ি। তিনি ভ্যান রিকশা চালান। দুপুর বেলা সেখানে গিয়ে দেখি ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর। এর ঠিক কোনটায় তিনি থাকেন বুঝতে পারি না। শেষে এক ঘরের সামনে একটি মেয়েকে দাঁড়ানো দেখে জিজ্ঞাসা করি–আচ্ছা বলতে পারেন এখানে এক ভদ্রলোক থাকেন, ভ্যান রিকশা চালান। তার বাড়িটা কোথায়? আমার কথা শুনে মেয়েটা বড় ভাবনায় পড়ে গিয়ে বলে–এখানে যারা ভদ্রলোক সব তো হাউসিংয়ে থাকে। তারা সব চাকরি করে। কেউ ভ্যান চালায় না। ভ্যান রিকশা চালায় আমার বাবা কিন্তু সে ত… মেয়েটির বয়স বছর চব্বিশ। অল্প লেখাপড়াও জানে। দেবী শেঠির হাসপাতালে কাজ করে। পুরাতন অভ্যাসে সেও অন্যদের মত তার ভ্যান রিকশা চালক বাবাকে ভদ্রলোক বলে ভাবতে পারছে না। তার ভাবনাকেও বিকৃত করে দিয়েছে এই দুষিতকরণ প্রক্রিয়া।

সেদিনে আমাদের ঘরের সামনের মাঠে ’পাঁচ-ছটা’ ভদ্রলোকের সন্তান ব্যাটবল নিয়ে ক্রিকেট খেলতে এল। এটা সত্যি যে এ পাড়ায় বাচ্চাদের খেলবার মতো কোন ফাঁকা জায়গা নেই। তারা এসে আমার ভাইবোনকে তাড়িয়ে দিয়ে জায়গাটার দখল নিল। মা বাবা দুজনে কাজে গেছেন। মেজ ভাইও ঘরে নেই। আমি কি এক দরকারে যেন কোথায় গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি আমার ভাই নিরু কাঁদছে। কাঁদছে কেননা ও পাড়ার বাচ্চারা তার কাঁচের গুলি সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। যার দুটো সে খুঁজে পাচ্ছে না।

মাথাটা ধাঁ করে উঠল আমার। আমরা এখানে থাকি। আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। যতদিন আমরা আছি আমাদের অধিকার সবার আগে। আমার ভাইয়ের গুলি ফেলে দেয় এত স্পর্ধা কার! আমি ছুটে গিয়ে ওদের উইকেট তুলে ফেলে দিই–যা! এখানে কোন খেলা ফেলা হবে না। তারা গিয়ে তাদের দাদাদের সে কথা জানাল। খেলতে দিচ্ছে না। উইকেট তুলে ফেলে দিয়েছে। এরপর দাদারা দৌড়ে এল। এক দাদা যে আমার চেয়ে বছর সাত আট বড় দশ-বারো ইঞ্চি বেশি লম্বা সে ঠাস করে এক চড় হাঁকাল আমার বাঁ গালে। বাঞ্চোৎ, এত সাহস তোর! আমাদের পাড়ায় থাকিস আবার আমাদের উপর মস্তানি দেখাস! আন, এনে যেখানের উইকেট সেখানে পুতে দে!

আগে আমি এদের হাতে অনেকবার মার খেয়েছি। এই দাদাও একবার মেরেছিল। কিন্তু এখন আমি অন্য মানুষ। যার একমাত্র উপাস্য শয়তান। যে আমাকে শিখিয়েছে কোন ভয়ভীতির সামনে নত না হতে। মানুষ একবারই মরে, কাপুরুষ মরে বারবার। যে মানুষ মরতে ভয় পায়, তাকে সবাই ভয় করে। আমিও চড়ের বদলে এক চড় বসিয়ে দিলাম তার ডান গালে। ওই চড় যেন মৌচাকে ঢিল মেরে দিয়েছে। পাঁচ-সাত জন একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। কিল চড় লাথি ঘুসি-মুহূর্তে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল আমার শরীরের উপর দিয়ে। তারা যখন ক্লান্ত হয়ে থামল তখন আমার নাকমুখ থেকে গলগল করে রক্তের ঢল নেমে বুকপেট সব ভাসিয়ে দিচ্ছে।

কলকাতা শহরে এসে এ আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। আমাদের ক্যাম্পে দেখেছি দুজনে ঝগড়া মারামারি হলে দশজনে এগিয়ে এসে তাদের থামিয়ে দেয়। এখানে একজনের উপর দশজন মিলে হামলে পড়লে অন্য সবাই দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। এক বিভৎস আনন্দে অবগাহন করে। কেউ কাছে আসে না। এখানকার নীতি যে আক্রান্ত সে যদি পারে আত্মরক্ষা করুক, না পারলে মরুক।

“জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।” মানব মনোবৃত্তি সম্বন্ধে এই যে জ্ঞান তা আমারও একদিন কাজে লাগবে। যেদিন আমিও মারতে শিখে যাব। কিন্তু আমি এখন কী করব।ওরা অনেক আমি একা, তাবলে মার খেয়ে মাটিতে পড়ে থাকব। ওরা যখন আমাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ফিরে যাবার পথ ধরেছে ধুলো ঝেড়ে উঠে বঁছালাম। আমার আরাধ্য দেবতা শয়তানের শরণাপন্ন হলাম আমি। হে দেবতা আমাকে সাহস দাও শক্তি দাও। সারা জীবনে অনেক মার খেয়েছি। অনেক রকমভাবে মেরেছে মানুষ। হয় আমাকে ভয় জয় করে উঠে দাঁড়িয়ে মারতে শেখাও, নয় তো মৃত্যু দাও।

ঘরে আমাদের একখানা ছোট কুড়ুল ছিল। বাবা এই কুড়ুলের সাহসে একা চলে যেতেন কাঠ কাটতে গভীর জঙ্গলে। সেই কুড়ুলখানা আজ আমার হাতে। এ যেন সেই পরশুরামের কুঠার। যা দুর্বিনীত অহংকারী অত্যাচারী ক্ষত্রিয়কুলকে একুশবার ধ্বংস করেছিল। সেই কুড়ুলখানা তুলে ধাওয়া করলাম ওদের। তখন, ওরা অনেক আমি একা, ওরা বলবান আমি বলহীন, ওরা উচ্চবর্ণ আমি নিঃস্ব, এদেশের আইন ধনবানের রক্ষক, ধনহীনের ভক্ষক, এ সব কোন কিছু আর মনে রইলনা। মনের মধ্যে তখন জেগে উঠেছে এক এতকালের ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি। মার কা বদলা মার চাই। খুন কা বদলা খুন।

ওরা আমার দিক থেকে প্রত্যাঘাত আশা করেনি। কাঁদব, নালিশ করব, কপাল চাপড়াব, আমাদের জাত গোত্র শ্রেণির মানুষ চিরকাল যা করে থাকে। সেই চিরকালের বিধান নিয়ম উল্টে দিয়ে নিজেই বিচারকের আসনে বসে বিচার করে নিজের হাতে অপরাধীর শাস্তি দেব সেটা ছিল তাদের কল্পনারও অতীত। তাদের একজনের ঘাড়ে কুড়ুল পড়তেই বাকি সবাই প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে যে যেদিকে পারে ছুট মারল। সেদিন সেই সময় অন্ততঃপক্ষে দশ পনের মিনিট আমার চারপাশে কোন মানুষ হিম্মত করে এসে দাঁড়াতে পারেনি। পাড়ার গলিতে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলাম একা আমি। যাকে এই কিছুক্ষণ আগে মনে হয়েছিল একটা চক্রব্যুহ, ভোতা এক কুড়ুলের দাপটে তা পরিণত হয়ে গিয়েছিল একটা মুক্তাঞ্চলে।

এর কিছুক্ষণ পরে পাড়ার মাতব্বর গোছের মানুষরা বের হয়ে এসেছিলেন। তাদেরই একজন আমার হাত থেকে কুড়ুল ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। পথে যেতে যেতে যে পুলিশ ভ্যানখানা দাঁড়িয়ে পড়েছিল গণ্ডগোল দেখে, তুলে দিয়েছিলেন সেই ভ্যানে। তবে কেন কে জানে তারা আমাকে থানায় নিয়ে কোন কেস না দিয়ে একদিন এক রাত আটকে রেখে দু চার ঘা মেরেই ছেড়ে দিয়েছিল।

আমি শয়তানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। বিনিময়ে শয়তান কী আমাকে রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দিল? না তা দিল না। দিল এক অদ্ভুত মানসিক আরাম দিল সেই সুমহান আত্মশক্তি, যা প্রবল ঝড় ঝঞ্জার মধ্যে এক শিশুবৃক্ষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে শেখায়।

আমরা যেখানে থাকি তার পাশের কলোনি আনন্দপল্লীর দুই উঠতি মাস্তান কাজল আর পনু, এরাই আমার কাছেশয়তানের অবতার। আমার কথা তাদের কানে পৌঁছেগিয়েছিল। বুঝে ফেলেছিল তারা, আমার মধ্যে উপাদান আছে। কাঠে আগুন আছে পাথরে আগুন আছে। সে আগুন বের হয় তখন, যখন দুটো কাঠকে ঘর্ষণ করা হয়, দুটো পাথরকে ঠোকা হয়। আমাকে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে ঠেলে দিলে আমিও আগুন হয়ে উঠব। ওরা আমাকে তাদের সঙ্গী করে নিল। আগে আমি ছিলাম এক আমার পিছনে দুই আসায় বারো হয়ে গেলাম। ওরা আমাকে শিখিয়ে দিল কেমন করে বোমা বানাতে হয়, কেমন করে তা ছুঁড়তে হয়। এবার আবার আমি পুলিশের দৃষ্টিপথে এসে গেলাম। এখন আর আমাকে ধরলে কেস না দিয়ে ছেড়ে দেবে না। আচ্ছামত “বায়নট” করে চালান দেবে।

রামকৃষ্ণ উপনিবেশের মাঝখানে একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি। বাড়ির চার দিকে উঁচু দেওয়াল। এই বাড়ির মালিকদের লাইসেন্স বন্দুক এবং দেশে প্রচুর জমি জায়গা। এরা কি করে এক জবরদখল কলোনির প্লট পায় সে এক রহস্য। এরা তো পূর্ববঙ্গের লোকই নয়। সব সেই প্লট কেনাবেচার রহস্যময় মোড়কে লুকানো।

স্বনামধন্য সাহিত্যিক “যাযাবর” লিখেছেন তার “দৃষ্টিপাত” উপন্যাসে–বাঙালী যেখানে যায় সবার আগে গড়ে একটা কালীমন্দির। সেই নিয়মে ভাদুড়ি বাড়ির ডানপাশে–টিবি হাসপাতালের পচাখাল ঘেসে এ কলোনির লোক একটা কালীমন্দির বানিয়েছে। সেখানকার ভগ্নমন্দিরে এক গরিব কালীর পূজা হয়। একদিন সেই কালীমন্দিরের পিছনে বসে রামকৃষ্ণ উপনিবেশের “আলু স্বপনের” সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন সারা দেশে নকশাল বাড়ির লাল আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। সে আগুন থেকে যাদবপুরও রক্ষা পায়নি। ফলে আমাদের কথপোকথনে বারবার উঠে আসছিল ওই নাম। আমি শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম, তাই নকশাল, কানু সান্যাল জঙ্গল সাওতাল তাদের বিষয়ে বক্তা ছিলাম আমি, স্বপন শ্রোতা।

এক সময়ে আমাদের আড্ডা শেষ হল। আমি যখন ঘরের পথে পা দিয়েছি স্বপন হঠাৎ কি মনে করে কে জানে কালীমন্দিরের সামনে পড়ে থাকা হোমের একখানা পোড়াকয়লার টুকরো তুলে এগিয়ে গেল ভাদুড়িদের দেওয়ালের সামনে। চুনকাম করা সাদা দেওয়াল, যার এককোণে লেখা ইংরাজি বর্ণমালার তিনটি অক্ষর–সি.পি.এম। স্বপন তার পাশে অহেতুক একটা ‘এল’ অক্ষর বসিয়ে দিল। এই দেওয়াল দখল ছিল সি.পি.এম দলের। দখলচ্যুত হয়ে তা সি.পি.এম.এল–অর্থাৎ নকশালদের হয়ে গেল। তখন সেই পথে হেঁটে যাচ্ছিল সুলেখা কারখানার কর্মী সিটু ইউনিয়নের নেতা দেবদাস। সে এইশিল্পকর্ম এবং শিল্পীদের প্রত্যক্ষ করে গেল। তারপর দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর যা কাজ–সে খবরটা লোকাল পার্টি অফিসে পৌঁছে দিল।

সেদিন সি.পি.এম. পার্টির যুব সংগঠন ডি.ওয়াই.এফয়ের একটা মিছিল ছিল। সে মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জঙ্গি নেতা পিন্টু সেন। নানা পথ ঘুরে লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই শ্লোগান দিয়ে সে মিছিল এসে শেষ হয় “মেজদার” চা দোকানের সামনে। যেখানে আমি বসেছিলাম। ওরা ধরে নিয়ে গেল আমাকে।

সুন্দরবন নয় এটা, তবু এমন একটা অঞ্চল যেখানে বাঘেরা বাস করে। যে বাঘের নাম সি.পি.এম. এখানকার আশেপাশের কোন কলোনিতে অন্যকোন পার্টির নামগন্ধ নেই। সব বাঘেরা খেয়ে নিয়েছে। সেই বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! সি.পি.এম পার্টির বড় শত্রু নকশাল অনুপ্রবেশ! এর এখনই একটা প্রতিষেধক ব্যবস্থা না নিলেই নয়।

পিন্টু সেনবাবু একজন বিচক্ষণ নেতা। তিনি মন দিয়ে “কি করিতে হইবে” সেই বইখানা পড়েছিলেন। “আলু” স্বপন এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। সে ভালো ফুটবল খেলে, যে কারণে যুবজনের প্রিয়। এ ছাড়া তারা চার পাঁচ ভাই। বাপের পাইকারি আলুর কারবার। জাতিতে কায়স্থ। ওকে কিছু করলে এলাকায় তার একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ওর সাথে থাকা অন্য যে ছেলেটা কি যেন নাম, ওর বাপ মজুর ঘাটে মা করে ঝিগিরি। ওরা এই অঞ্চলের কেউ নয়। জাতিতেও নিচু। এছাড়া তার নামের পিছনে কিছুটা বদনামও আছে, ওকে ধরে মারায় কোন ঝামেলাই নেই।

সর্বহারা পার্টির নেতা সেনবাবুর এক সর্বহারাকে ঝাড় দিতে মনটা একটু কাতর হয়েছিল, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার উপায় ছিল না। এটা একটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। ঝিকে মেরে বউকে বোঝাও এটা আমাদের প্রাচীন পদ্ধতি। এই জন্য ওকে একটা দৃষ্টান্তমূলক মার দিতে হবে। সেই মার দেখে যেন অঞ্চলের যুবজনের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে যায়। দেখ নকশাল করলে তার কী হাল হয়। ভয়ে যেন কেউ নকশাল নাম পর্যন্ত মুখে না আনে।

আমাকে নিয়ে গিয়ে উপনিবেশের সি ব্লকের পার্টি অফিসের সামনের লাইট পোস্টে বাঁধা হল। লড়াই লড়াই লড়াই চাই, শ্লোগানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গরান কাঠের যে ঝান্ডাবাঁধা ডাণ্ডা তা দিয়ে খুব মেপে আমার হাটুতে হিট করলেন সেনবাবু–বল তোদের বোমা পাইপগান কোথায় আছে? কতজনকে খুন করেছিস? তোদের দলে আর কে আছে? কতদিন ধরে নকশাল করিস? একটা করে প্রশ্ন একবার করে হিট। ওরা জানে আমার কাছে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। আমিও জানি উত্তর নেই, তাই শুধু বাবাগো মাগো করি। জবাব দেবার মত প্রশ্ন আসে একটা, বল দেওয়ালে কেন লিখেছিস? বলি, মুই লেহি নাই। মুই তো ল্যাখতে জানি না। সে কথা কোন ঘাস জল খায় না। মার চলতে থাকে।

ঘন্টা দুয়েক ধরে আমাকে দুরমুশ, থেঁতো, গুড়ো করার পর শেষে একটা রিকশা ডেকে তুলে দেওয়া হল তার পাদানিতে। যা এটাকে শ্যামাকলোনির মোড়ে ফেলে রেখে আয়।

সেদিন সারারাত গাঠের যন্ত্রণায় কাতরেছিলাম আমি। জ্বর এসে গিয়েছিল। তখন ভীষণ ভয়ও করছিল আমার, আর বোধহয় কোনদিন পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে পারব না। পঙ্গু হয়ে যাব। এখন আমার দরকার চিকিৎসার। চিকিৎসা করাতে যে টাকা লাগে, সে আমরা কোথায় পাব! তাইবিনা চিকিৎসায় পড়েছিলাম আট-দশদিন।কাজল পনু যাদের উপর আমার ভরসা ছিল তারাও এ সময়ে কেউ আমার কোন খোঁজ নিল না। ওরা টের পেয়ে গেছে, সময় বদলে যাচ্ছে। এখন মস্তানি গুন্ডামি চালিয়ে যেতে হলে পার্টির ছত্রছায়া ছাড়া গতি নেই। ওরা শক্তিমান, আমাকে দেখতে এসে তাদের বিষ নজরে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। খবর পেলাম “আলু স্বপন” তার বাবাকে সাথে নিয়ে সেনবাবুর কাছে সারেন্ডার করে এসেছে, যা করেছি ভুল করেছি। এখন থেকে আপনি যা বলবেন তাই করব।

সেনবাবু আমাকে মেরে অবশ্যই কিছু লাভবান হয়েছিলেন। তবে সব ক্রিয়ার একটা সমানুপাতিক প্রতিক্রিয়া থাকে, নিউটনের সেই সূত্র অনুসারে আমারও কিছু লাভ হয়েছিল। চারিদিকে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে গিয়েছিল।

একদিন সকালে যখন আমি কিছুটা সুস্থ সচল হয়েছি, আমাদের ঘরের সামনে মেজদার চা দোকানে গিয়ে একটু বসেছি। তখন সেখানে চা খেতে এল সেলিমপুর রেল কলোনির টিউবওয়েল মিস্ত্রি নকুল আর গোষ্ট। চা দোকানদার মেজদাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল ওদের সাথে। আর তখন মুখ নিচু করে চাপা গলায় বলে গোষ্ট, আমরা তোর খোঁজে এসেছি। আশুদা তোকে দেখা করতে বলেছে।

আশুদা মানে নকশাল নেতা আশু মজুমদার। তখনকার যাদবপুরে এক মহা সংগ্রামের মহানায়ক হিসাবে এই মানুষটি প্রতিষ্ঠিত। তিনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন। নিজের অবস্থানে আমার পক্ষে অটল থাকা আর সম্ভব হল না। ওদের পিছু পিছু হাঁটা দিলাম আমি। যেন আমাকে আমার অদেখা ভবিতব্য হটিয়ে নিয়ে গেল গরফায়।

সারা শহর–শুধু শহর কেন পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম নগর সব, কেউ কেউ তো এমনও বলে যে সমস্ত ভারতবর্ষ এখন স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক ভাগে আছে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণি ও তাদের দালালরা। যাদের পিছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ. এই ভাগে রয়েছে ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণি এবং রাষ্ট্রের আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বিশাল পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনী। আছে মুখে দরিদ্র জনগণের কথা বলা রঙবেরঙের পতাকাধারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। যাদের পিছনে টাকার থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধনিক শ্রেণি।

অপরদিকে রয়েছে আদর্শের প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছাত্র যুব শ্রমিক কৃষক। এক কথায় বিপ্লবী জনগণ। এই কঠিন সময়ে কেউ নিরপেক্ষ নয়। যে নিরপেক্ষ সে আসলে শোষক শ্রেণির শোষণ দমন পীড়নেরই মৌন সমর্থক হয়ে রয়েছে অজ্ঞাতসারে। এই সময় আমাকে ডাক দিয়েছে আমার মানবিক, সামাজিক দায়িত্ব পালন করবার জন্য। আশু মজুমদার কোন এক ব্যক্তি নয়, এই সময়ের মুখপাত্র। সময়ের দাবি মেনে নিয়ে অবশ্যই আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে কোন এক পক্ষে। কোন পক্ষে যাব আমি?

যদি যেতে হয় আমাকে সেই পক্ষে যেতে হবে যেখানে আমার মত সর্বহারা মানুষরা রয়েছে। যেখানে আশু মজুমদার রয়েছে। আশু মজুমদারের মতো নিঃস্বার্থতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আর কে বা আছে? ভোট চায়না গদি চায়না সুখভোগ বিলাসব্যাসন কিছুই চায়না তারা। চায় একটা শোষণমুক্ত শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণ করতে। যে সমাজে সব মানুষ সমান সব মানুষ সমান সম্মানীয়। সবার জন্য থাকবে খাদ্যবস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা।

এই অবস্থা এমনি এমনি আসবে না। একে স্থাপন করতে হলে হাজার বছরের পচা পুরাতন জীর্ণ এই সমাজ কাঠামো, রাষ্ট্র ব্যবস্থাটা ভেঙে চুরে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এই ধ্বংসের পরে যে নব নির্মাণ তারই নাম বিপ্লব। বিপ্লব এক উগ্র বলপ্রয়োগ দ্বারাই সফল হয়। কারণ কোথাও কোন শাসক স্বেচ্ছায় ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে সরে দাঁড়ায় না। উগ্র বলপ্রয়োগ দ্বারা তাকে উৎপাটন করতে হয়। এর জন্য প্রচুর প্রাণহানি প্রাণ বলিদান আত্মত্যাগ করতে হয়। আশু মজুমদারের দল সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।বিপ্লবী যুবারা বুকের গরম তাজা রক্ত ঢালছে। নির্ভয়ে বুক পেতে বুলেট নিয়ে আত্মত্যাগের এক সুমহান ইতিহাস রচনা করছে। যে জল বিন্দু একা থাকে রোদ তাকে শুকিয়ে দেয়, মাটি তাকে শুষে নেয়। সে যদি কোনভাবে সাগরে গিয়ে পৌঁছাতে পারে সাগর হয়ে যায়। আমি সাগরে পৌঁছে গেছি। আমি ইতিহাসের পাতার উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছি। সেই স্পার্টাকাস থেকে শুরু করে সিধু কানু বীরসা বীর নারায়ণ তিলকা মাঝি আর এই নকশাল আন্দোলনের বীর শহীদ বাবুলাল বিশ্বকর্মা এদের বুক থেকে ঝরে পরা রক্তের মহাসাগর, আমি সেইরক্ত স্রোতের উত্তরসুরি। আমি এইমাত্র আমাকে চিনেছি। তাই আর ফিরে যাওয়া হল না।

আমি গরফায় যেদিন আসি তার ঘন্টা দুয়েক পরে এখানে পুলিশ এসেছিল। এটা তাদের রুটিন কাজ। কখনও পুলিশ কখনও সিপিএম মাঝে মাঝে নকশালদের এই ঘাটিটার ওপরে হামলা চালাত। ওদের সম্মিলিত প্রয়াস ছিল যেভাবেই পারে এই ঘাটিটাকে চূর্ণ করে দেবে। এই দুপক্ষের স্বার্থের সামনে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এই ঘাটির কিছু অকুতোভয় যুবা। তাই এই আক্রমণ। তো সেদিন আমি আমার অক্ষম অচল শরীর নিয়ে ঘটনাক্রমে সেই অসমযুদ্ধের শরিক হয়ে গিয়েছিলাম। একদিকে মারাত্মক মারণাস্ত্র সজ্জিত একদল হায়নাতুল্য হিংস্র পুলিশ আর একদিকে আদর্শের বলে বলীয়ান একদল আগুনখোর যুবক। যাদের কাছে গোটা কয়েক হাত বোমা আর রেল লাইনের খোয়া ছাড়া অন্যকোন অস্ত্র ছিল না। তবু সেই দৃঢ় প্রতিরোধের সামনে থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী ভয়, সেদিন নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এটা যখন একটা যুদ্ধ, ক্ষয়ক্ষতি যে দুপক্ষেরই হবে সেটা তো স্বাভাবিক। ওপক্ষের কতটা কী হয়েছিল তা আমি জানি না। তবে এ পক্ষের কাতু নামের মধ্যবিত্ত ঘরের একটা ছেলের হাত উড়ে গিয়েছিল। পাল বাজারের পিছনে যে কাঠগোলা, হাওয়াই চটি পায়ে, হাতে বোমা নিয়ে পেছল কাঠের উপর দিয়ে দৌড়াতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে যায় সে। তখন হাতের বোমা হাতেই ফেটে যায়।

আর সেদিন, চিরদিনের নিপীড়িত নির্যাতিত দরিদ্র দুর্বল এক মানুষ আমি, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে সেদিন আমার মনে হয়েছিল আমি লেলিন আমি মাওসেতুং, আমিই সেই মহান বিপ্লবী চেগুয়েভারা।

আমি লেখা পড়া জানি না বটে তবে এদের নাম জানি। এদের ইতিহাসও জানি। সে সব আমাকে বলেছিলেন রামকৃষ্ণ উপনিবেশের আর.এস.পি নেতা “ছেলেধরা” প্রণব চক্রবর্তী। কে জানে যদি আমাকে সি.পি.এমরা না মারত, যদি আমার বাবাকে মারা অনিল, তার দলের সাথে যুক্ত না থাকত, আমি প্রণবদার সাথেই থাকতাম কী থাকতাম না। আর এখন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড় এবং বাসন্তীর ঘটনার পরেও আর.এস.পির লালবাড়ির নেশায় পড়া নেতা মন্ত্রিদের নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি দেখে দল ছেড়ে বসে গিয়ে প্রণবদার মত নষ্ট করা চল্লিশ বছরের জন্য মাথার চুল ছিড়তাম কী না!

গরফায় আমার থাকা ও কাজের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল সেলিমপুর রেল কলোনি। নকুল গোষ্ঠ মন্টু হারু মাধাই রতন নিতাই এবং রাজাপুরের ননীদা যে আমারই মতো নিজের পাড়া ছেড়ে এখানে এসে থাকে, এরাই সব সাথী হল আমার। একমাত্র ননীদা মধ্যবিত্ত বাড়ির সন্তান। এছাড়া আর যারা, সবাই গরিব। এদের কেউ আগে রিকশা চালাত, কেউ স্টেশনে মোট বইত, কেউ বেঁচত উনুন ধরাবার কুঁচো কাঠ, কেউ ছিল টিউবওয়েল মিস্ত্রি। এদের মধ্যে মন্টু রতন হারু অন্য পাড়া থেকে এসেছে নকুল গোষ্ট মাধাই নিতাই এই রেল কলোনিতে থাকে। বিপ্লবী সাজা এদের কাছে বাবুঘরের বিপ্লব বিলাসিতা নয়। ভীষণ জরুরি সুস্থ সুন্দর স্বপ্ন, প্রাণধারণের পক্ষে এক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যা প্রাপ্ত করার জন্য শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়াই আবশ্যক।

কিছু মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিত ছেলে পড়াশোনা চাকরি বাকরি ভবিষ্যত সুখ সব জলাঞ্জলি দিয়ে এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। তবে তাদের চাইতে আমার এই বস্তির ছেলেদের সাথে স্বাচ্ছন্দ হতো বেশি। শিক্ষিত ছেলেদের বইয়ের ভাষার চাইতে আমি এদের ভাষা সহজে বুঝতে পারতাম। এরা বলত গ্রামদেশের অত্যাচারী জোতদার মহাজন মাতব্বরদের কথা। কী ভাবে এদের সর্বসান্ত করে দিয়েছে সেইসব কথা।

এদের সাথে আমার দিনরাত কাটে। রাত এবং দিনের প্রতিটা মুহূর্তই শঙ্কা সংকট দিয়ে ঘেরা। সশব্দ ও রক্তাক্ত। আক্রমণ প্রতি আক্রমণে রক্ত দু পক্ষেরই ঝরছে। যাদবপুর স্টেশনের পূর্বদিকে কামার পাড়া। ওটা সি.পি.এম পার্টির একটা বড় ঘাঁটি। পশ্চিম দিকে পালবাজার, গরফা এটা নকশালদের শক্ত ঘাঁটি। স্টেশনকে মাঝখানে রেখে দু দলের যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে যায় দু পাশে। গুলি চলে বোমা চলে রক্ত ঝরে। বেশ কিছুদিন এই লড়াই চালাবার পর আমি ক্লান্তিবোধ করি। মনে প্রশ্নও জাগে। ওদিক থেকে-যারা লড়ছে তারাও তো আমাদের মতোই গরিব। আমরা এক গরিব আর এক গরিবকে মারছি, পুলিশ আমাদের দুদলকে মারছে, ধরে নিয়ে জেলে ভরে দিচ্ছে, বড়লোকের তো কারও কিছু হচ্ছে না। তবে এত রক্তপাতের সার্থকতা কোথায়!

গরফায় ঢোকবার যে কয়টা রাস্তা সেগুলো দিয়ে পুলিশ যাতে ঢুকতে না পারে আমরা দিনরাত পাহারা দিতাম। এক রাতে রেল লাইনের দিকটা পাহারা দিচ্ছিলাম আমি আর নিতাই। পাহারা দিতে দিতে কখন যে আমাদের ঘুম এসে গেছে আর আমরা রেল লাইনের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি তা জানি না। ওদিকে ভোর চারটের ডাইমন্ড হারবার ট্রেন যাদবপুর স্টেশন থেকে ভো বাজিয়ে রওনা দিয়েছে ঢাকুরিয়া স্টেশনের দিকে। ঠিক সেই সময় রেল কলোনির একজন লোক প্রস্রাব করতে বেরিয়ে আমাদের দেখে ডেকে শোয়া থেকে তুলে দেয়। সে যাত্রা বেঁচে যাই আমরা দুজন। আর তার দিন দশেক পরে একই ভুল করে ঘুমন্ত মাধাই রেলে কেটে মারা যায়। ওকে কেউ ঘুম থেকে ডেকে দেয়নি।

এভাবেই এসে গেল ১৯৭১ সাল। এই সময় শুরু হয়ে গেল পূর্বপাকিস্থানের তথাকথিত মুক্তি যুদ্ধ। একদিকে আওয়ামী লিগ আর অপরদিকে খানসেনা-রাজাকার। লেগে গেল দুপক্ষের ঘোরতর লড়াই। আওয়ামী লিগের পিছনে যাবতীয় যুদ্ধ সম্ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইন্দিরাগান্ধীর সরকার। ভারতবর্ষ দেশটা পাকিস্তানের শাসকদের কাছে চিরদিনই এক শত্রু রাষ্ট্র। যা বিধর্মী কাফেরদের আবাস। যেহেতু ভারতমুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, সেই রাগে খানসেনারা আর তাদের সহযোগী রাজকার বাহিনী আওয়ামী লিগের সাথে ওদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর শুরু করে দিল ব্যাপক খুন জখম বলাকার লুটপাট। ফলে তখন পর্যন্ত যে সব হিন্দু পরিবার ওপার বাংলার রয়ে গিয়েছিল এবার তারা প্রাণ ভয়ে পলায়ন শুরু করে দিল। আবার একবার বাংলার সীমান্তে ভিড় জমল বাস্তুহারা মানুষের। এখন আর এদের নাম রিফিউজি নয়–শরণার্থী।

সেই ১৯৫৮ সালের ভারত সরকারের দণ্ডকারণ্য প্রকল্প তখনও বন্ধ হয়নি।এতগুলো দাঙ্গার পরেও–সব রকম সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওই অঞ্চলে আশানুরূপ জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়নি। কিছু কিছু রিফিউজিদের নানান ক্যাম্প থেকে নানান কায়দায় ওখানে পাঠানো হয়েছিল বটে কিন্তু তার বড় অংশটাই সেখানে থাকতে পারেনি। পালিয়ে এসে মিশে গেছে পশ্চিমবঙ্গের জন সমুদ্রের মধ্যে। যার ফলে দণ্ডকারণ্যের বিশাল বনাঞ্চলে মজুরের অভাবে কোটি কোটি টাকার বন সম্পদ বনে পড়ে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংগ্রহ সম্ভব হয়ে উঠছে না।

এবার চালাক সরকার আর আগের ভুলের ফাঁদে পা দিলেন না। কোন ক্যাম্পে না রেখে শরণার্থীদের টাকি থেকে সোজা–সরাসরি পাঠিয়ে দিতে লাগলেন মধ্য প্রদেশের মানা ক্যাম্পসহ দণ্ডকারণ্যের নানা অঞ্চলে। অংক একেবারে সরল, যতদিন এরা এখানে থাকতে চায়, থাকুক। যুদ্ধ শেষ হলে যদি সে দেশে ফিরে যেতে চায় তাতেও কোন আপত্তি নেই। যদি না যায় পুরাতন রিফিউজি পরিবারের স্থলে এদেরই সেই ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি জমির মালিকানা দিয়ে দেওয়ায় কোন অসুবিধা নেই।

আমার বাবারা আট ভাই। তিন ভাই মারা গেছে। একভাই সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। এক ভাই পূর্ববঙ্গে থেকে গিয়েছিল। এবার সেই ভাই বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন এপার বাংলায়। পরিবারের সবাইকে টাকির অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে রেখে তিনি দেখা করতে এলেন বহু বছরের বিচ্ছিন্ন নিজের ভাইদের সাথে। প্রথমে গিয়েছিলেন ঘোলা-দোলতলার ক্যাম্পে। সেখান থেকে সংবাদ জেনে যাদবপুরে এলেন আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে। আমরা তখন শ্যামা কলোনির যে ঘরে আগে ছিলাম আমি গরফায় চলে যাবার পর এবং সে কথা গোপন না থাকায় কিছু লোক বাবাকে আর সেখানে থাকতে দেয়নি। তারা তখন রেল কলোনির এক ঝুপড়িতে থাকছিল। আমার এক জ্যেঠামশায় ও সেই কাকা দুজনে বাবাকে খুঁজে পেয়ে দেশের সমাচার পরিবার পরিজনের কুশল বিনিময়ের পর জানতে চান, রঞ্জনকে দেহি না ক্যান। হে কই? আবার পলাইছে নাকি বিদ্যাশে? তখন বাবা আমার বিষয়ে আদ্যপান্ত সব খুলে বলেন ভাইদের কাছে। “হেয়ারে মোনে কয় আর বাঁচাইতে পারমুনা। এইখানে রোজ মানুষ খুন হয়। কবে শুনমু ও মইরা পইড়া আছে।”

তখন কাকা আর জ্যেঠা দুজনে বুদ্ধি বিবেচনা করে বাবাকে পরামর্শ দেন আমরা সব যাইতে আছি দণ্ডকারণ্যে। এত বছর এইখানে রইলাম, ভালো কিছু তো হইল না। কই কী, তুমিও আমাগো লগে চইল্যা চলল। হেইখানে গেলে আর কিছু না হউক পোলার পরান তো বাঁচবে।

যে বিপিন ব্যাপারী একদিন দণ্ডকারণ্যের নামে কেঁপে উঠতেন এখন পুত্রের প্রাণ রক্ষার্থে সেই গভীর বনে যেতে রাজি হয়ে গেলেন। এই হয়। যদি কারও পিছনে বাঘ তাড়া করে, লোকটার সামনে যদি নদী থাকে, সাঁতার না জানলেও সে নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার জীবন রক্ষার্থে এক বিপন্ন বাপ শেষকালে অরণ্যকেই পরিত্রাতা হিসাবে গ্রহণ করে নিতে বাধ্য হলেন। সে যে কী অরণ্য তা বুঝতে পেরেছিলেন সেখানে যাবার পর। সেখানকার বনের বাঘ মানুষ খায় না। মানুষই মানুষকে খেয়ে নেয়।

আমার মেজভাই চিত্ত সেই ভয়াবহ দিনে চারদিকে চলা গুলি-বোমার মধ্যে গরফায় গিয়ে আমাকে খুঁজে বের করে সব কথা বিস্তারিত জানাল। কিন্তু আমি এখন কি করি? যাদের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি, যারা নিজের প্রাণ বিপন্ন করে দু তিনবার আমাকে নিশ্চিন্ত মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছে, তাদের ফেলে নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাব?

ওদিকে, মা বাবার প্রতি সন্তানের যে কর্তব্য, জীবনে আমি তার কিছু মাত্র পালন করতে পারিনি। বাবার শরীরের যে অবস্থা কদিন আর বাঁচবেন বলা মুশকিল। সে মৃত্যুও আসবে তার বড় বেদনার সঙ্গে। আমার চিন্তায় তখন প্রাণটা ছটফট করবে। বারবার দরজার দিকে তাকাবেন। এই বোধহয় মুখে জল দেবে বলে বড় ছেলে এল। কারও পায়ের শব্দে চমকে উঠে মাকে জিজ্ঞাসা করবেন–অ খোকার মা, বড়খোকায় কি ঘরে আইলো? অবশেষে এক ব্যর্থ আশা বুকে নিয়ে চির ঘুমে ঘুমিয়ে পড়বেন তিনি। ধর্মবিশ্বাসী সব বাবার যা কামনা মৃত্যুর পরে মুখে আগুন, আমার হাতে তাও তিনি পাবেন না।

এর চেয়েও বড় কথা তারপরও যারা বেঁচে থাকবে, আমাদের সেই পরিবার যাদের সরকারি কোন কাগজে নাম নেই, এদেশের এক অবাঞ্ছিত উদ্বৃত্ত মানুষ ভোটার লিস্টে নাম ওঠেনি রেশ্বন কার্ড পাওয়া যায়নি, কোন নাগরিক অধিকার নেই। এদের কী হবে? যারা অকারণে আমার জন্য বিপদে পড়তে পারে।

আমার সবচেয়ে ভয় ভাই চিত্তকে নিয়ে।বিজয়গড়ের এক কংগ্রেস নেতার নাম ভজন নাগ। তাকে নাগালে না পেয়ে তার শত্রুপক্ষ তার এক ভাই পূজন নাগ, যে তিনফুট উচ্চতার এক বামন–তাকে গলা কেটে মেরে দিয়েছে। আমি এখন এক নিরাপত্তার বলয়ের মধ্যে আছি। আমার নাগাল না পেয়ে আমার শত্রুরা যদি চিত্তকে মেরে দেয়। অনেক ভেবে চিন্তে শেষে সিদ্ধান্ত নিই, যে যা বলে বলুক যে যা ভাবে ভাবুক, আমার এখন প্রধান কাজ পরিবারের সবাইকে যদি একটা আতঙ্ক মুক্ত পরিবেশে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলবার সুযোগ করে দিতে পারি সেই চেষ্টা করা। এটা ঠিক যে তারা যদি আমাকে রেখে একলাই সেখানে চলে যান নির্ভয়ে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু এই ভয়ংকর যুদ্ধের পরে–যদি তখনও আমি বেঁচে থাকি, সেই অরণ্য থেকে খুঁজে বের করব কী করে তাদের।

ভাইকে বলি–কবে তোরা যাবি? আমি শিয়ালদায় গিয়া খাড়াইয়া থাকুম।

অবশেষে বন্ধুদের কাছে বিল্টুদায় নিয়ে পরের দিন পরিবারের সাথে গিয়ে পৌঁছালাম টাকি রেল স্টেশনে। কাকার কাছে বর্ডার পার হয়ে এপারে আসার প্রমাণপত্র ছিল। সেই কাগজ দেখিয়ে–”মোরা পূর্ববাংলার থিকা আইছি” বলে অফিসের খাতায় নাম লিখিয়ে ঢুকে পড়লাম অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরের তাবুর মধ্যে।

এবার আমাদের এখানে থাকতে হল দিন পনের। তারপর যাবার “ডাক” এল। আমরা শিয়ালদহে এসে দাঁড়িয়ে থাকা একখানা ট্রেন, যার নাম রিফিউজি স্পেশাল তাতে উঠে পড়লাম। সেই ট্রেন আউট লাইন দিয়ে ঘুরে ঘুরে যে পথ সাধারণ ট্রেন বারো ঘন্টায় পার হয়, তিনদিন সময় নিয়ে পৌঁছাল জগদ্দলপুর। জগদ্দলপুর আদিবাসী জেলা বস্তারের সবচেয়ে বড় শহর। এখান থেকে ট্রাক ভরে কিছু পরিবারকে নিয়ে যাওয়া হল উড়িষ্যার মালকানগিরি, উমরকোট আর কিছু পাঠানো হল বস্তার জেলার পারালকোটে। পারালকোটে সর্বমোট ১৩৩টা বাঙালী গ্রাম আছে। কোন নাম নেই, শুধু নাম্বার। নাম্বার দিয়ে তাদের পরিচয়। পারালকোট ভিলেজ সংক্ষেপে পি.ভি.। আমাদের রাখা হল পি.ভি. ৯৮তে। যেখান থেকে নিকটস্থবাজার, পঁচিশ মাইল দূরে। বাসস্ট্যান্ডও সেখানেই। যেখান থেকে রেল স্টেশনের দূরত্ব দুশো মাইল। চারদিকে ঘন গভীর জঙ্গল। কোথাও কোন জন মানবের চিহ্ন নেই। সেই জঙ্গলের খানিকটা সাফ করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এই গ্রামটা, এ এমন এক গ্রাম যদি বিশ্বযুদ্ধও হয়ে যায় এখানকার মানুষ টের পাবে না। যদি এই গ্রামটা কোন কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, বিশ্ববাসী জানতে পারবে না।

আমরা এখানে আসবার আগে পঁচিশটি পরিবার ছিল, এবার আমাদের পঁয়ত্রিশ পরিবার মিলে মোট ষাট হয়ে গেল। কয়েকদিন পরে অবশ্য দশ পরিবার এখান থেকে সরিয়ে পিভি ৫৬তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই দশ পরিবারের চার পরিবার আমরা এবং আমার কাকা জ্যেঠা।

সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের ইচ্ছা ছিল প্রতি ভিলেজে ১০০ পরিবার এনে রেখে দেবার। কিন্তু সেই ৫৮ সাল থেকে ৬৪ সাল পর্যন্ত বহু চেষ্টার পরেও টার্গেট পুরো করা যায়নি। কোন ভিলেজে পঞ্চাশ কোনটায় তারও কম। আর ৬৪ সালের পর থেকে তো পলায়ন পর্ব চলছে। মোড়ে মোড়ে পাহারা “নাকা” বসিয়েও যে পলায়ন ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ফলে বহু ভিলেজে বহু ঘর খালি পড়ে আছে। কোন ভিলেজে কতঘর ফাঁকা সেই হিসাবে এখন লোক এনে ভরাট করা হচ্ছে।

চারদিকে মোটা মাটির দেওয়াল। উপরে টিনের ছাউনি। লম্বায় আঠেরো হাত, চওড়ায় বারো হাত। এমন ঘর পূর্ববঙ্গের শতকড়া আটানব্বই জন নমঃ পোদ জেলে কামার কুমোর ঘরামির কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার। সেই ঘর ফেলে মানুষ কেন যে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে রেল লাইন, খালধার, ফুটপাতে থাকে সেটা তখন আমার কাছেও এক অবোধ্য ব্যাপার ছিল। যা পরে আর অবোধ্য থাকেনি।

এখানে আসবার পর আমাদের সরকারি অফিস থেকে কিছু জামাকাপড় কিছু হাড়িকুড়ি আর শাবল কোদাল, গাইতি কুড়ুল এসব দেওয়া হল। দেওয়া হল কিছু চাল ডাল নগদ টাকা। চাল ডালের পরিমাণটা কত ছিল মনে নেই। তবে টাকা মনে হয় মাসে পঁচাত্তর দিত। সেই চাল টাকা যাকে শিরোমণিপুরে বলা হোত ডোল এখন বলা হয় সাবসিডি, তা দিয়ে আমাদের পাঁচজন প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক সর্বমোট সাতজনের পরিবার, অনেক মেপে, অংক কষে, হিসেব করে, আধপেট খেয়ে দিন পনেরোর বেশি চলত না।

চলবে না সে ওরা-ও জানে। এটা ওদের তো অংক কষে হিসেব করে বার করা। সেই বাকি পনের দিন খাবার জন্য মজুর খাটতে যেতে হবে। আর নাম মাত্র মজুরি দিয়ে আমাদের খাঁটিয়ে নেওয়া যাবে। রিফিউজিদের এখানে আনাইতো হয়েছে সেই জন্যে। এবং একদিন নিয়ে যাওয়া হল এক ঠিকাদারের অধীনে এক জঙ্গলে, জঙ্গল সাফ করাবার জন্য। জঙ্গল তো এখানে সর্বত্র। কোথাও ঘন কোথাও পাতলা। সেই জঙ্গল একটু একটু সাফ করে বসানো হয়েছে ভিলেজ, বের করা হয়েছে চাষের জন্য জমি, এখন আমাদের সেখানে আনা হয়েছে এই জঙ্গল সাফ করে যে জমি বের হবে তা আমাদের পরে কৃষিকার্যের জন্য দেওয়া হবে। এই জঙ্গলের পরিচয় এখন আর জঙ্গল নয় ল্যানডম্যাপে কৃষিকর্মের উপযোগী ভূমি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

আমরা সেখানে গিয়ে দেখি জমি জুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অগনন বৃক্ষ। ঠিকাদার ফিতে মেপে গাছের গায়ে দাগ মেরে দিয়ে বললেন–এই হচ্ছে এক একর। প্রথমে গাছগুলো কাটতে হবে। তারপর গোড়া খুঁড়ে শেকড় সহ তুলে ফেলতে হবে। এর জন্য মজুরি মিলবে দেড়শো টাকা। সেই এক একর জমি” সাফ করতে আমি, আমার ভাই চিত্ত এবং বাবা তিনজনের বাইশ দিন সময় লেগে গেল। তিন একর জমি সাফ করতে গাইতি কোদাল সব ক্ষয়ে গিয়েছিল। এখানকার মাটি তো মাটি নয়, পাথর। গাইতি দিয়ে মাটিতে কোপ মারলে ঠন করে শব্দ হয়, আগুন ঠিকরে ওঠে।

গাছ কাটার পর বাঁশ কাটা, মাটি কাটা, পাথর ভাঙা, বিড়ির পাতা তোলা এক ঠিকাদার থেকে আর এক ঠিকেদারের অধীনে এভাবেই কাজ চলতে রইল। এবং যে কাজই হোক যত পরিশ্রমই করি মজুরি তার দিনে দুই আড়াই টাকার চেয়ে বেশি পড়ে না। একদিন আমি আর আমার বাবা আর ভাই গেছি খ্যারকাটা নামের এক জায়গায় মাটি কাটার কাজে। আমাদের নিয়ে গেছে এক ঠিকাদার তার ট্রাকে করে। খ্যারকাটায় বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তায় বিশাল একটা বাঁধের নির্মাণকার্য চলছে। যা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৫৮ সালে। যথেষ্ট মজুর না পাওয়ায় যা আজও সম্পূর্ণ করা যায়নি। এবার প্রচুর শরণার্থী আসায় পূর্ণউদ্যমে শুরু করা হচ্ছে বাঁধ নির্মাণের কাজ। বাঁধের কাজ সম্পূর্ণ হলে রিফিউজিরা জমিতে চাষের জন্য কতটা জল পাবে, পারাল কোটের কতটা উন্নয়ন হবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছেনা। তবে কন্ট্রাকটার, মজুর যোগানদার, কিছু মন্ত্রী নেতা যে কোটিপতি হয়ে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

খ্যারকাটা ড্যামের সব কাজই ফুরনে চলে। যত কাজ তত পয়সা। দশ ফুট লম্বা দশ ফুট চওড়া এক ফুট গভীর, মাটির মাপে যা একশো, এইটুকু মাটি কাটার মজুরি পচাত্তর টাকা শুনে আনন্দে আমরা লাফিয়ে গিয়ে ট্রাকে উঠেছিলাম। নিজেদের শ্রমক্ষমতার উপর আমাদের আস্থা আছে। ভেবেছিলাম শুয়ে বসে জিরিয়ে আমি আর ভাই দুজনে একশো মাটি নিশ্চয় কেটে ফেলব। বাবার হাত লাগাবার দরকারই পড়বে না। কাজের কাছে গিয়ে মাটি দেখে বুক কেঁপে গেল। যা কাটতে হবে তা মাটি নয় চুনের মত নরম আঠালো এক ধরনের পাথর। এ মাটিতে গাইতি চলে না কোদাল বসেনা। ছেনি হাতুড়ি দিয়ে খুঁচে খুঁচে তুলতে হবে। এ কাজে অতি বড় পরিশ্রমীও দুটাকা মজুরি তুলতে পারবে না।

সে সময়টা আবার মে-জুন মাস। এটা বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়। বাতাসে তখন বইছে। বস্তার জেলার সেই কুখ্যাত-লু! যা গায়ে লাগলে চামড়া পুড়ে ফোঁসকা পড়ে যায়। বেলা আটটা-নটাতেই মাটি যেন রুটি সেকা চাটুর মতো তেতে ওঠে। আমাদের পায়ে চপ্পল গায়ে জামা নেই। রাগীরোদ তার ইচ্ছামত আমাদের উদ্যোমশরীরে ছোবল মারে। বাংলার নরম জল হাওয়ায় গঠিত এই দেহ বস্তার জেলার পরিবর্তিত প্রকৃতির দাপট সহ্য করতে পারল না। অসুস্থ হয়ে পড়লাম আমি। আবার সেই বাল্যবেলার রোগ-আমাশা আমাকে চেপে ধরল। এবার তা আগের চেয়ে তীব্র। এবার হাসপাতাল ছিল। সারারাত চলল স্যালাইন, ওষুধ,ইনজেকসান। দিন ছয়-সাত লেগেছিল রোগমুক্ত হতে।

এরপর ভিলেজে ফিরে এসে ভাঙাচোরা মন আর অর্ধেক সুস্থ শরীর নিয়ে কাজে যাবার ক্ষমতা ছিল না। বসে রইলাম ঘরে। আমি কাজে যেতে পারছি না, বাবারও শরীর ভালো নয়। একা চিত্ত কী কাজ করবে।ক পয়সা পাওয়া যায় তাতে?তখন এমন হল যে সাবসিডির চালে যে কয়দিন চলে তারপর আর চাল কেনা যায় না। ফলে যে ভয় আমাদের সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায়, যে কষ্ট বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকে সেই না খাওয়া দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা এই গ্রহের এমন এক অভাগা জীব যে কিছুতেই অনাহার আমাদের পিছন ছাড়ে না। এই আমাদের মতো মানুষদের জন্যই বোধহয় এমন কথার উদ্ভব–আমি যাই বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে। ধনধান্যে ভরা বাংলাতেই আমাদের অন্ন জোটেনি। আর এতো বস্তার। এখানকার আদিবাসী মানুষরাই ভাতের বদলে কেঁদো কুটকি মান্ডিয়া এই সব ঘাসের দানা খেয়ে বাঁচে। তরকারি বানায়। কচি বাঁশের ডগা দিয়ে। এবার খিদের জ্বালায় আমরাও ওই সব খেতে বাধ্য হলাম।

এদিকে সরকার থেকে বলা হয়েছিল, এখানে আমাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে জমি জায়গা দেওয়া হবে। যদি তা পাওয়া যেত একবার চেষ্টা করে দেখা যেত কিছু করা যায় কিনা। বছর ঘুরে গেল কিন্তু সে বিষয়ে সরকারের তরফে কোন উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না। কবে যে তারা ঘুমভেঙে জেগে উঠবে তা কে জানে।

মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে আমার। নিজের উপর নিজের ধিক্কার আসে। বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, আদিবাসী অধ্যুষিত এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে এভাবে খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করে কী হবে। এভাবে বেঁচে থাকাটাই তো কষ্টের। যত বেশি দিন বাঁচা হবে ততটাই বেশি কষ্ট। মনে মনে স্থির করি–পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যাব। সেখানে গিয়ে যা হয় হোক, তবু এখানে আর নয়।

আমার মেজভাই চিত্তকে বলি সে কথা–এখন একসাথে সবার পশ্চিমবঙ্গে যাওয়াটা ঠিক হবে না। গিয়ে থাকব কোথায়। কী কাজ করব। খাব কী? আগে আমি একা যাই। পশ্চিমবঙ্গ অনেক বড় জায়গা। শুধু তো যাদবপুর না। কোথাও একটু মাথা গোঁজার ঠাই করে তারপর সবাইকে নিয়ে যাব। ওরও এখানে মন টিকছিল না তাই মত দিল সে–যা, গিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারিস আমাদের নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। মরণ এইখানে, মরণ সেইখানে। তয় বাংলার মানুষ বাংলায় গিয়া মরি।

আমার কাছে তখন পথখরচা বলতে আছে মাত্র পাঁচটা টাকা। এখান থেকে নিকটস্থ রেল স্টেশন রায়পুর দুশো মাইল দূরে। যার বাসভাড়া সাড়ে দশ টাকা। রেলে বিনা টিকিটে যাওয়া যায়, বাসে যায় না। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম আর একটা রেল স্টেশন আছে দল্লী-রাজহারায়। কখন যেন সেখান থেকে এক আধটা যাত্রী ট্রেন কোথায় যেন যায়। তখন আর আমার ভাবনা চিন্তা করবার অবকাশ ছিল না। একদিন কাপসী থেকে একটাকা দশ পয়সার টিকিট কেটে চেপে বসলাম দল্লী যাবার বাসে। সকালে বাসে চেপে ছিলাম দুঘন্টা পরে বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম দল্লী।

দল্লীকে আমি চিনি না । দল্লীও আমাকে চেনে না। কিন্তু একদিন এই দল্লী শহরকে আমি চিনবো। সেদিন এই ছোট্ট শহরটা অনেক বড়, অনেক প্রিয় হয়ে উঠবে। এই দল্লী আমাকে দেবে প্রাণের আরাম-বেঁচে থাকার অবলম্বন আর এক মহত্তম পরিচয়। তবে সে অনেক পরে ঘটবে। এখন সবে ৭২/৭৩ সাল। এখনও শংকর গুহ নিয়োগী দল্লী এসে পৌঁছাননি। উনি আসবেন ৭৭ সালে। ইতিহাস গড়বেন, তবে তো আমি সেই ইতিহাসে যুক্ত হবো।

দল্লী স্টেশনে এসে শুনি আমি এখানে আসবার দু ঘন্টা আগে–বেলা নটার ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে। যার যাত্রা ভিলাই পর্যন্ত। সেই ট্রেন আবার রাত আটটায় ফিরে আসবে। না যাবার না আসবার আর কোন ট্রেন নেই। কী আর করি, সারাটা দিন এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিই। বাজার দেখি, বাস দেখি, পাহাড় দেখি, খাদানে কাজ করে ফেরা মানুষ দেখি, লাল পতাকা ওড়া একটা ইউনিয়ন অফিস দেখি। আর রাত হয়ে গেলে মুড়ি ভোলা খেয়ে স্টেশনের পাশে এক মন্দিরের চাতালে শুয়ে থাকি। এখন এই মন্দিরটা খুব ছোট। কুড়ি পঁচিশ বছর পরে আবার যখন আসব বিরাট বড় হয়ে যাবে। ইউনিয়ন অফিসটা বড়, ওটা তখন আর থাকবে না। মজুররা ঝান্ডার রঙ বদলে নেবে। সি.পি.আই ছেড়ে সব ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চায় যোগ দেবে।

পরের দিন ট্রেনে চেপে এসে পৌঁছাই ভিলাই। ভিলাই থেকেও হাওড়া যাবার ট্রেন ধরা যায় সেটা তখন আমার জানা ছিল না। তাই সেখান থেকে আর একটা ট্রেনে চেপে এসে নামলাম রায়পুর। শুনলাম, ঘন্টা খানেক পরেই এখানে আসছে বম্বে টু হাওড়া মেল। বসে থাকি সেই ট্রেনে চাপবার আশায়। এমনিতে স্টেশনটা বেশ ফাঁকাই ছিল, স্টেশনে ট্রেন ঢোকবার মিনিট দশেক আগে কোথা থেকে কে জানে শত শত পুলিশ, চেকার এসে সারা প্লাটফর্মে ছড়িয়ে গেল। পুলিশ লাঠি উঁচু করে স্টেশনের যত ভিখারি ভবঘুরে মুটে হকার সব খেদিয়ে এক নাম্বার প্লাটফরম থেকে দুরে সরিয়ে দিল। তাড়া খেয়ে আমিও রেল ব্রিজের উপর দিয়ে দু নাম্বার প্লাটফর্মে এসে পড়ি। দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে এই আশা নিয়ে, ওই ট্রেন এলে উল্টো দিক থেকে রেল লাইন টপকে ছুটে গিয়ে ট্রেনে চেপে বসব। দুনাম্বার প্লাটফর্মের এক গেটের চেকার আমার অভিসন্ধি বোধ হয় বুঝে গিয়ে থাকবে। সে এসে আমাকে ধরল। টিকিট নেই জেনে গেটের বাইরে বের করে দিল। বাইরে এসে লোহার রেলিংয়ে থুতনি ঠেকিয়ে বড় কাতর চোখে দেখলাম সেই ট্রেনখানা স্টেশনে প্রবেশ করল।

এটা কোন সাধারণ ট্রেন নয়। এ হচ্ছে বম্বে টু হাওড়া উইকলি স্পেশাল। এর ভাড়া বেশি। যাত্রীদের সুখ সুবিধাও বেশি। চলে দ্রুত, থামে খুবই কম স্টেশনে। মিনিট পাঁচেক থেমে থাকার পর সিটি দিয়ে সে রওনা দিল হাওড়া উদ্দেশ্যে। এখন আমি কী করি! আমাকে না নিয়ে আমার স্বপ্নের গাড়ি চলে যাচ্ছে। চলে যাবে এত সহজ নাকি? মাথা গরম হয়ে গেল আমার। গেটে চেকার, যে যেতে দেবে না আমাকে। না দিক, আমি আমার জন্য অন্যপথ খুঁজে নেব। সারাটা জীবনই তো আমি অন্যপথের পথিক। উঠে পড়লাম রেলিংয়ের উপর। তারপর লাফিয়ে পড়লাম দু নাম্বার প্ল্যাটফর্মের মধ্যে। তাড়া ছিল বলে অবতরণ সঠিক হল না। আছাড় খেয়ে পড়লাম কংক্রিটের মেঝেয়। হাটুর মালাইচাকি ছড়ে গেল। সেদিকে তখন আর দেখার সময় নেই। আমি দেখছি ট্রেন, যার ক্রমে গতি বেড়ে যাচ্ছে। আর দেরি নয়। ছুটে গিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়লাম নিচে, রেল লাইনের উপরে। তারপর আর একটু ছুটে ধরে ফেললাম চলন্ত ট্রেনের দরজার পাশের হাতল। ঝুলে পড়লাম হাতল ধরে। তখন সারা প্লাটফর্মে লোক ভয়ে চিৎকার করছে এ্যাই রে। গেল বুঝি। গেলাম, তবে চাকার তলে নয়, কামরার মধ্যে। এক হাতে হাতল ধরে রেখে অন্য হাতে দরজার লক খুলে অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ ঘটল আমার। এই ট্রেনে আমার মত দৈনদশার-চেহারা পোষাকের আর একজন যাত্রী পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে–আমার মত যাত্রীর জন্য ঈশ্বর দ্বারা নির্ধারিত যে স্থান-দরজার পাশে পায়খানা বাথরুমের সামনে বসে পড়ি।

আমি যখন এই ট্রেনে চেপেছিলাম তখন বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামছে। এখন কামরার মধ্যে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। বোধহয় আধঘন্টা চলেছে ট্রেন। এমন সময় এলো এক চেকার। কী অদ্ভুত চোখ তার। আমাকে দেখেই সে বুঝে গেছে আমি কোন শ্রেণির যাত্রী। শ্রেণি তো মাত্র দুটো এই কামরায়-হ্যাব আর হ্যাঁব নটস। যাদের টিকিট আছে আর যাদের টিকিট নেই। আমি শেষ দলের। সে তার বেয়নেটের মত তর্জনি আমার দিকে উঁচিয়ে হুকুম দিল–”দো ডাব্বা ছোড়কে আগে নিকল যা।” এই দুটো কামরার দায়িত্বে তিনি আছেন। তিনি তার দায়িত্বের এলাকা থেকে আমাকে স্রেফ আবর্জনার যত অন্যের এলাকায় নিক্ষেপ করে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু যার এলাকায় আমি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সে বা আমাকে সহ্য করবে কেন। আধঘন্টা পরে সে এসে অনুরূপ আদেশ দেয়–দো কামরা ছোড়কে ট্রেনে উঠেছিলাম মনে হয় পাঁচটায়, সেই থেকে কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারলাম না। রাত দুটো আড়াইটা পর্যন্ত এভাবে কুকুর খেদা চলতে রইল।

এবার যে কামরাটায় গিয়ে পৌঁছালাম তার প্লাটফর্মের উল্টোদিকের দরজাটা হাট করে খোলা। খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে মধ্যরাতের ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। আমি আর দেরি না করে গামছা বিছিয়ে সেখানে শুয়ে পড়লাম। যতক্ষণ পারা যায় একটু ঘুমিয়ে নিই। এবং তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে। কতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা। হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ হল। বিকট শব্দের সাথে একটা ভারী কিছু আছড়ে পড়ল আমার মাথার উপরে। মনে হল মাথাটা বুঝি চুরমার হয়ে গেল। কিসের আঘাত এটা? তবে কী দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা এই ট্রেনখানা লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে গেল হাজার ফুট নিচে কোন গিরিখাদে। তারই ফলে মাথায় এই আঘাত। সেই আঘাতে মাথাটা খানিক সময় ঝনঝন করে শেষে অবশ হয়ে গেল। অন্ধকার ঘনিয়ে এল চারিদিকে। কিছু সময় পরে সম্বিত ফিরলে চোখ মেলে দেখি–ঠিক আমার মাথার উপরে উঁচু হয়ে আছে একটা বুটসহ পা। আঘাতটা এসেছে ওই বুট থেকে। বুটের মালিক একটা লাথি মারবার পর আর একটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। লোকটা একজন চেকার। এই কামরা যার দায়িত্বে সে চেহারা, পোষাক, আর ধুলি শয্যা দেখে বুঝে গেছে আমার কোন টিকিট নেই। ফলে এই কামরায় আমি অনধিকার প্রবেশকারী। যা লাথি খাবার উপযুক্ত অন্যায়-অপরাধ। তাই বিনা দ্বিধায় সে সেটা করে দিয়েছে।

লাথি খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। উঠে দাঁড়াল আমার মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সেই শয়তানটাও। চারদিকে তাকালাম। রাত এখন গভীর। কেউ কোথাও জেগে নেই। সব মানুষ যেন মরে পড়ে আছে। তাকালাম খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার পৃথিবীটার দিকে। যার মধ্য দিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটে চলছে এই নৈশ্যযানখানা। এই সময় দরকার মাত্র একটা আচমকা ধাক্কা। পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের রোগা চেকারটা সেই ধাক্কায় খোলা দরজা দিয়ে শোলার মত উড়ে চলে যাবে। এখন আমাকে তাই করতে হবে। ওকে উড়িয়ে দিতে হবে।

এসব কথা লিখতে সময় লেগে গেল দশ মিনিট ভাবতে সময় লেগেছিল দশ সেকেন্ড। তারপর আমার সেই কালো হাত যা থেকে এখনও আমি রক্তের গন্ধ পাই, সেই খুনি হাত তুলে চেকারের দিকে এগিয়ে গেলাম।

আমি এগিয়ে ছিলাম মাত্র এক পা। কিন্তু সে আমার চোখ মুখ চেহারায় ফুটে ওঠা পরিবর্তনের অর্থটা বুঝে ফেলেছে। বুঝে ফেলেছে, এই রাত আঁধারে তাকে খুন করা হবে। তাই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তারপর কুকুরের মত লেজ তুলে ছুটে পালিয়ে চলে গেল। সারারাতে আর আমার ত্রিসীমানায় এল না।

রাত শেষ হয়ে পরের দিন সকাল সাতটা নাগাদ নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনে। তাকালাম প্লাটফর্ম থেকে বাইরে যাবার পথের দিকে। পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কতগুলো পাষাণ হৃদয় পাহারাদার।ওদের হাতে হয় টিকিট নয় ঘুষ দাও, তবেইমিলবে মুক্ত দুনিয়ায় পৌঁছাবার ছাড়পত্র। আমার যে কিছুই নেই। না তির না তুণীর, খালি হাতেই আমাকে এই ব্যুহচক্র ভেদ করতে হবে।

জীবন তো একটা যুদ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকেরা সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে এগোয়। দূর থেকে লক্ষ্য করে দেখলাম বাইরে যাবার গেটের সামনে যে অবরোধক চক্র, তার একটায় তালা মেরে গেট কিপার কোথায় যেন গেছে। একটু ভানদিক ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে সেই চক্রের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লাম নিচে। তারপর বুকে হেঁটে চক্রের তলা থেকে বের হয়ে গেলাম বাইরে। এরপর হাঁটতে শুরু করলাম শিয়ালদহের দিকে।মনে হয় তখন হাওড়া থেকে শিয়ালদহের বাসভাড়া বেড়ে কুড়ি পয়সা হয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমার কাছে কুড়ি পয়সাও ছিল না। পুঁজির পাঁচটাকা রায়পুরে পৌঁছাবার আগেই খরচ হয়ে গিয়েছিল। কাল বিকেল থেকে পেটে জল ছাড়া আর কিছু পড়েনি। খিদেয়, পথশ্রমে, মানসিক ধকলে আমার শরীর আর শরীর নেই–একটা বোঝা হয়ে গেছে। এই বোঝা নিয়ে কোথায় যে যাব তা বুঝে উঠতে পারি না।

অবশেষে স্থির করি সেই পুরাতন জায়গা যাদবপুরেই যাব। গরফায় আমার বন্ধুরা আছে। যদি কিছু সহায়তা পাওয়া যায়–যা আমার এখন একান্ত দরকার, তা এদের কাছেই পাওয়া যেতে পারে। না হলে আর তো কেউ নেই।

মনে হয় বেলা বারোটায় এসে পৌঁছেছিলাম যাদবপুর স্টেশনে। ওখানে দেখা হয়ে গেল আমার এক পূর্ব পরিচিতর সাথে। তার মুখে খবর পেলাম বাহাত্তরের ইলেকশনের দিন আশু মজুমদার মিলিটারির সাথে এক মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা গেছেন। গরফা সেলিমপুরে এখন আর নকশালরা নেই। কিছু মারা গেছে, কিছু পালিয়ে গেছে, কিছু ধরা পড়ে জেলখানায় পচছে। আর কিছু যাদের রাজনৈতিক সচেতনার অভাব ছিল তারা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে কংগ্রেসের ঝাণ্ডার নিচে। গরফা জুড়ে এখন দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে কংগ্রেসি গুণ্ডা হাতকাটা জীতেন এর দলবল। শুধু কামারপাড়া বাদে সমস্ত যাদবপুর কংগ্রেসের দখলে।

তাহলে আমি এখন কী করব। কোথায় যাব! সামান্য মাত্র কয়মাসে এই শহরটা আমার কাছে এমন নির্বান্ধব হয়ে যাবে এমন অনাত্মীয় শহর হয়ে যাবে কল্পনা করতে পারিনি। এখানে কার কাছে গিয়ে কি সাহায্য চাইব। আমি কোন সাধারণ মানুষের মতো নই। কে কোন গলিতে আমার জন্য ভোলা চাকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা কে জানে। এই শহরে আজকাল মারপিট বোমাবাজি আগের তুলনায় কম হয়, তবে লাশ পড়ে বেশি। সব রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মারপিটের সেই পুরাতন ছক বদলে ফেলেছে। এখন একদল তক্কে তক্কে থেকে আর একদলের কর্মীকে ধরে সোজা গলার নলিটা কেটে দেয়।

আমার তখন দিনটা তো নানাভাবে কেটে যায় মুশকিল হয় রাত কাটানো। শোবার কোন জায়গা ছিল না তাই কোনদিন স্টেশনের ওভার ব্রিজের সিঁড়ির নিচের অন্ধকারে, কোনদিন টিকিট কাউন্টারের সামনের বটগাছের আড়ালে কোনদিন রিকশা লাইনে তালামারা কোন রিকশার উপর এভাবেই রাত কাটে। এই অবস্থায় কাটিয়ে ছিলাম তিন-চার দিন। এই কদিন বলতে গেলে কিছুই খেতে পাইনি। চান করিনি ঘুমও হয়নি। সেদিন রাতে আমি ঘুমিয়েছিলাম গুঁড়িসুড়ি মেরে এক রিকশার উপরে। তখনও সূর্যের আলো ঠিকমত ফুটে ওঠেনি। একটা ছাই ছাই অন্ধকার পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে চারদিকে। সময় তখন মনে হয় ভোর ছয়টা কী সাড়ে ছয়টা। রিকশা লাইনের সামনের চা দোকানে কয়লার উনুনে সবে আগুন জ্বেলেছে। সাদা ধোয়ায় ভরে গেছে এলাকাটা। স্টেশনে রাত কাটানো কিছু রিকশাঅলা ঘুম চোখে এসে রিকশার তালা খুলে লাইনে লাগাচ্ছে। ভাড়া তোলবার সময় হল। বিহারি হোটেলঅলা ছেচন সাউ কানে পৈতা জড়িয়ে লোটায় জল নিয়ে রেল লাইনের পাশে প্রাতঃকৃত সারতে যাচ্ছে। খবরের কাগজের হকাররা যে যার সাইকেলে কাগজের বান্ডিল বাধছে। রোজকার এই স্বাভাবিক ছন্দে হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটে গেল। পরপর শোনা গেল এক ঝক কান ফাটানো গুলির শব্দ। সে শব্দে ভয় পেয়ে ডানা ঝাঁপটিয়ে সামনের বটগাছ থেকে উড়ে পালাল এক ঝাঁক পাখি। টিকিট কাউন্টার আর টি স্টলের মধ্যে দিয়ে স্টেশন থেকে বাইরে আসবার যে পথ, সেদিকে তাকিয়ে মনে হল যেন কোন সামুদ্রিক ঝড় আছড়ে পড়েছে, বাঘ তাড়া করেছে। কোন। তখন ক্যানিং থেকে আসা একটা ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকেছিল। সেই ট্রেন থেকে নামা যাত্রীরা প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সামনের দিকে ছুটে পালাচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে আসা বাবুবাড়ির কাজের মাসি ছুটতে গিয়ে কাপড়ে পা জড়িয়ে নিচে আছড়ে পড়ে হাত পা কেটে রক্তাক্ত। কেউ তাকে তুলছে না। মাড়িয়ে ডিঙিয়ে সবাই চলে যাচ্ছে। একজন মজুর খাটা লোকের কাধ থেকে ধাক্কা লেগে ছিটকে গেল কোদাল ঝুড়ি। এক মাছঅলার মাছের চাকন উল্টে গিয়ে জলে আর মাছে পথ একেবারে ছয়লাপ। এরই মধ্যে স্টেশনের সুইপার বিজয় পেটে গুলি খেয়ে রক্তপ্লুত অবস্থায় ছিটকে এসে পড়ল রিকশা লাইনের সামনে। কিছুক্ষণ কাটা ছাগলের মত হাত পা ছুঁড়ে শেষে চুপ হয়ে গেল। রিকশার উপর থেকে নেমে আসতেই কে একজন ছুটতে ছুটতে বলে গেল–পালাও। স্টেশনের পুলিশ ক্যাম্পে নকশালরা হামলা করে অস্ত্রশস্ত্র সব নিয়ে গেছে। দু তিনজন মার্ডার।

কিছুক্ষণ পরে জানতে পারলাম ফুটবল খেলবার ছলে দশবারো জনের একটা দল আক্রমণ করে পুলিশ ক্যাম্পে। দরজায় একজন রাইফেলধারী পুলিশ পাহারায় ছিল, অন্যরা ছিল ভিতরে শোয়া। সেইসময় ওরা অতর্কিত হামলা করে তিনখানা রাইফেল একটা রিভালবার নিয়ে পালিয়েছে। যারা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল সব আহত, নিহত।

যখন এইসব ব্যাপার ঘটছিল তখন সোনারপুর জি.আর.পির চার কনস্টেবল পেট্রোল ডিউটি সেরে ট্রেন ধরে সোনারপুরে ফিরে যাবে বলে এসে বসেছিল দু নাম্বার প্লাটফর্মে। তাদের চোখে পড়ে একদল ছেলে রাইফেল নিয়ে পালাচ্ছে। তারা তখন এলোপাথারি গুলি চালিয়ে বাধা দেবার একটা চেষ্টা করে। তবে সফল হতে পারেনি। তাদের ছোঁড়া একটু এসে লেগেছে নিরীহ বিজয়ের পেটে।

এরপর যা হবে তা কারও অজানা নয়। একটা বিশাল পুলিশ বাহিনী আসবে। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে হৃত অস্ত্রের সন্ধানে শুরু হবে চিরুনি তল্লাশি। হবে ব্যাপক ধরপাকড়। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই চালিয়ে দেবে গুলি। কত যে মরবে কত যে আধমরা হবে তা কে জানে। ইতিমধ্যেই যাদবপুর থানা থেকে কিছু পুলিশ এখানে পৌঁছে গেছে। তারা তাদের সীমিত ক্ষমতায় সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছে। প্রথম ধাক্কায় সন্ধ্যা বাজারের “রাতকানা জ্যোতে” শেষ। রেল লাইনে পাড়ে ঢোলকমলি ঝোপে পায়খানায় বসেছিল। পুলিশের মনে হয় লুকানো নকশাল। তাই গুলি চালায়। এতক্ষণ আমি রিকশার আড়ালে, বটগাছের পিছনে, জলের ট্যাঙ্কের পাশে নানাভাবে নিজেকে রক্ষা করেছি। বড় বাহিনী এসে গেলে আর তা পারা যাবে না। এখনই এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কোনদিকে পালাব তার কোন দিশা যে নেই। এক পালানো যায় পালবাজার সেলিমপুরের দিকে। কিন্তু নকশাল ছেলেরা সব সেইদিকে গেছে। পুলিশ তো ওইদিকে ধাওয়া করবে। আর এক যাওয়া যায় সন্তোষপুরের দিকে। কিন্তু সেদিকে যাব কেমন করে। একটা পুলিশ বাহিনী ওদিকে গিয়ে গুলি চালাচ্ছে। জ্যোতের পরে রাজাপুরের তপন শেষ। আর একটা পথ আছে স্টেশন রোড ধরে যাদবপুর মোড়ে গিয়ে বিজয়গড়ে ঢুকে পড়া। কিন্তু এখনই যদি সেই বড় বাহিনী আসে, আসবে তো ওইদিক থেকেই। যদি সামনে পড়ে যাই, যদি চিনে ফেলে, যদি কেউ আমাকে চিনিয়ে দেয়, তখন কী হবে?

আর একটা পথ আছে, টিবি হাসপাতালের যে দেওয়াল, স্টেশনের দিকে তার কিছুটা ভাঙা। সেই ফোকর গলে হাসপাতালের মধ্যে ঢুকে পড়া। এরপর হাসপাতালের সেকেন্ড গেট থেকে বের হয়ে রাজা সুবোধ মল্লিক রোড় পার হয়ে সেন্ট্রাল রোডে গিয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকা।

এই পরিকল্পনা করে ঢুকেছিলাম হাসপাতালের মধ্যে। কিন্তু সেকেন্ড গেটে আর পৌঁছাতে পারলাম না। হাসপাতালের মেইন গেট থেকে শুরু হয়ে কামারপাড়া পর্যন্ত পৌঁছানোর যে রাস্তা সেটা পার হয়ে এপারে এসে সেকেন্ড গেটের দিকে বাঁক নিতেই হুংকার-হল্ট। হাত উপরে তোল। পালাবার চেষ্টা করেছিস কী মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। একজন বলেছিল কামারপাড়া ছাড়া আর কোথাও কোন সি.পি.এম নেই। আমার বোঝা উচিৎ ছিল যে তারা মাঝে মাঝে গুহা ছেড়ে শিকারে বের হয়।

মেইনগেট থেকে আসা আর সেকেন্ড গেটে যাওয়ার সংযোগস্থলের বাঁদিকে একটা ক্যান্টিন, তার পাশে আছে হাসপাতাল কর্মচারী ইউনিয়ন অফিস। আর আছে কিছু আম কদম সেগুন গাছ। কিছু আকন্দ ঝোঁপ ঢোলকমলি আর ঝাটি গাছের ঝোঁপঝাড়। সেই ঝোঁপের আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছে দু দুটো মূর্তি। যাদের দেখে পা দুটো অবশ হয়ে গেল আমার, গেথে গেল মাটিতে। ওরা এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়াল। তখন পিঠের উপর অনুভূত হল একটা ধাতব নলের কঠিন স্পর্শ। ওই রকম আর একটা কুঁচকুচে কালো নল ঠেকে গেল বুকে। যার ছয়টা ছিদ্র থেকে উঁকি দিচ্ছে ছয়টা বিষাক্ত দাঁত। যা এক তর্জনির ইশারায় যে কোন মুহূর্তে দংশন করে দেবে আমার বুকের হাড়মাংসে।

এই দুই মুর্তি আমার চেনা। এর একজন তাতা দত্ত আর একজন নানু দাস। এরা দুজনও আমাকে চেনে। সে চেনা শব্দের, আগুন বারুদ আর রক্তের। এরা রণসাজে সেজে আসত স্টেশনের এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে, আমরা আসতাম দুনাম্বারে। রেল লাইনকে মাঝখানে রেখে দুদিকে দাঁড়িয়ে আমরা একে অপরকে অকথ্য গালাগালি দিতাম, বোমাগুলি ছুড়তাম। এবং দু পক্ষই ভাবতাম বিপ্লব করছি।

তাতা দত্ত আমার পিছনে রিভলবারের গুতো দিয়ে হুকুম দিল, কামারপাড়ায় চল।

কামারপাড়া। এ কোন একটি পাড়ার নাম নয়। একটা ঘাটি, একটা বিশেষ ধরনের লোকদের দ্বারা পরিপূর্ণ স্থান। একটা পরিকল্পিত কার্যক্রম। এ এমন এক নাম যা অতি বড় সাহসীর বুকেও কাঁপন ধরিয়ে দেয়। সারা অঞ্চল দখল করে নিয়েছে তবু এত পুলিশ সি.আর.পি নিয়েও কংগ্রেসিরা এ পাড়ায় ত্রিসীমানায় আসার চেষ্টা করেনি। প্রবাদ আছে, কামারপাড়ায় যে আসে হেঁটে ফিরে যায় খাটে। এখন আমাকে সেই পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

টিবি হাসপাতাল থেকে কামারপাড়ার কার্লভাট মাত্র এক কিলোমিটার পথ। এই পথটা কী আমি সেদিন হেঁটে যেতে পেরেছিলাম? যে হেঁটে গিয়েছিল সে কী আমি? অনেক দিনের অনাহারী অর্ধমৃত অবশ অচৈতন্য একটা দেহ যেন ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে পার হয়ে এসেছিল জীবনের সব চেয়ে দুর্গম কঠিন পথ। যেভাবে ভোর বেলায় কসাইখানার পথে হেঁটে যেতে দেখা যায় বুড়ো, আধমরা জীর্ণশীর্ণ গরুর পাল। ধুলিধূসর দেহকে অতিকষ্টে টেনে টেনে সামনে আগায়। প্রতি পদক্ষেপে যার ঝরে ঝরে পড়ে সীমাহীন ক্লান্তি-অবসাদ। যার প্রতিটা পদক্ষেপে জীবন থেকে খসে খসে যায় বেঁচে থাকার মেয়াদ।কতরাত কতদিন যে সে এইভাবে কত পথ পার হয়ে এসেছে, কতপথ আর যে বাকি সে তার কোন হিসেব জানে না। ঘোলা চোখে চারদিকে তাকায় আর কেবল হাঁটে। অবসন্ন শরীরটা পথের ধুলোর উপর লুটিয়ে পড়তে চায়। পা যেন আর শরীরের ভার বইতে পারছে না। তবু উপায় নেই, হাঁটতেই হয়। চলার গতি সামান্য শ্লথ হলেই পিঠের উপর আঘাত হানে ক্রুদ্ধ কসাইয়ের নিমর্ম লাঠিচল্ চল্ হেট হেটু। গরুর মুখ থেকে গাঁজলা গালের কষ বেয়ে গড়িয়ে নামে। জল আর পিচুটি ভরা চোখের কোণ খোঁচায় ডাশ মাছি। শরীরের ক্ষত খোবলায় আঁড়িপাতাকাক। লেজ তুলে সেকাউকে ঝাঁপটাও মারতে পারেনা–শরীর এতশক্তিহীন। তবু হাঁটতে হয়। নিজের জীবনকে নিজে বয়ে নিয়ে যেতে হয় বধ্যভূমির দিকে।

আমি এখন এক এক পা টেনে এগিয়ে চলেছি, মাথায় কাটার মুকুট কাঁধে ক্রুশকাঠ নিয়ে হেঁটে চলা যিশুখৃষ্টের মতো। চারদিক তাকিয়ে কাতর চোখে দেখে নিচ্ছি আকাশ সূর্য রোদ মাটি মানুষ। যা আর কোনদিন দেখার সুযোগ পাবো না। এই পৃথিবী নিষ্ঠুর নির্দয় পৃথিবী অনাহার অপমান অত্যাচার ছাড়া আমাকে আর কিছুই দেয়নি। তবু একে ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে। এই পৃথিবীর এককোণে বাস করে আমার বাবা মা ভাই বোন। যাদের প্রতি আমার অনেক দায়িত্ব কর্তব্য ছিল। তার কিছুই পালন করা হলো না।

কামারপাড়ার কার্লভাটের উপর এখন গিজগিজ করছে তোক। তাদের সংখ্যা অনেক। কেউই তারা স্থির নয়, উত্তেজনায় সব ছটফট করছে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে–দেড় দুশো গুলির আওয়াজ। নানা এলাকা থেকে যা তাদের টেনে নিয়ে এসেছে মূল ঘাটিতে। এত গুলিগোলা চলছে কেন। তবে কী জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূলঘাটি, দক্ষিণবঙ্গের লেলিনগ্রাদ, কামারপাড়া বিপন্ন। প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেস দ্বারা আক্রান্ত! সব এখন রণসাজে সজ্জিত। তেমন হলে শেষ সংগ্রাম হবে এই মাটিতে। শত্রুপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে–এ মাটি দুর্জয়ঘাটি। এখানে দাঁত বসাতে গেলে দাঁত ভেঙে যাবে।

খবর এসে গেছে এই কিছুক্ষণ আগে। না, সে সব কিছু নয়। এতে আমাদের খুব একটা ভয়ের কিছু নেই। এটা হচ্ছে নকশাল আর পুলিশের ব্যাপার। আমরা নিরাপদ। তবে পাশের ঘরে আগুন লাগলে একটু তাপ তো লাগেই। সেই জন্য সতর্কতার প্রয়োজন আছে।

আমাকে দেখে এখন এখানকার বেশ কয়েকজনের চোখ ছানাবড়া। ওরা যে আমাকে চেনে। সেই চিনে ফেলাটাই আর লক্ষে বড় বিপদের। আরে তুই। বস বস ওইখানে।

কালর্ভাটের পাশে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। জ্বলছে কয়লার উনুন। দোকানদারের ভাবলেশহীন পাথর পাথর মুখ। সে জল ঢেলে চায়ের গেলাস ধুচ্ছে। গেলাসে চিনি দিচ্ছে। ছাঁকনিতে গুড়ো চা পাতা ফেলে তার উপর গরম জল ঢালছে। তারপর এক হাতে চায়ের গেলাস খদ্দেরের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য হাতে উনুনের পাশে রাখা ডজন খানেক থ্রি নট থ্রি বুলেট নেড়েচেড়ে গরম করছে। এ সব অতি স্বাভাবিক, রুটিন মাফিক ব্যাপার। দোকানদার পার্টির জঙ্গি কমরেড়। তার কাছে রুটি কাটা আর গলা কাটায় কোন প্রভেদ নেই। দুটোতেই সে সমান দক্ষ।

যারা আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে, তাদের কাজ শেষ। পুলিশ অপরাধীকে ধরে কোর্টে নিয়ে এসেছে। এখন যা করার তা বিচারপতি করবে। জহাদ করবে। তাতা দত্ত আর নানু দাস দু জনে এখন পরম নিশ্চিন্তে বসে লেবু চা খাচ্ছে। তারা বসে আছে রাস্তার ওপারে এক বিল্ডিংয়ের ছায়ায়। আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে চচঁড়ে রোদে এপারের চা দোকানের বেঞ্চিতে। আমার সামনে পিছনে সচেতন জনগণের জমায়েত। আমি এক যুদ্ধপরাধী। আমার সাজা কী হবে সে মোটামুটি সবারই জানা। এ বিষয়ে বিচারক, জুরি, এবং জনগণের কোন মতভেদ নেই। মতভেদ হচ্ছে দণ্ড কার্যকর করবার পদ্ধতির বিষয়ে। এখানে মারা হবে না অন্য কোনখানে নিয়ে, এখন মারা হবে, না, রাতে, গলার নলিকাটা হবে না কী গুলি করা হবে, ছোট ছোট ভাগ হয়ে তারা সেই আলোচনা করছে।

কে কী বলছে আমার শোনার কথা নয়। শুনে বা আমি কী করতে পারি। মাংসের দোকানের খুঁটীতে বাঁধা পাঠা তো দেখে, পাঠাকে কী করা হয়। তাকে কী করা হবে। সব জেনে বুঝে তার কী বা করার থাকে? আমি তো যখনই ধরা পড়েছি তখনই বুঝে গেছি কামারপাড়ায় আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কি করার ছিল আমার? একে তো আমাশায় আক্রান্ত অসুস্থ শরীর। তার উপর অনাহারে দুর্বল। শস্ত্রধারী দুজন সবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কী করে লড়াই করে জয় পেতাম।

এখন আমার ভয় করছে। সারা বুক জুড়ে হিমশীতল এক আতঙ্কের নিঃশব্দ চলাচল। ওরা যদি এতক্ষণ আমাকে চড় ঘুষি লাঠি চালাত তাহলে শরীরের কষ্ট হোত কিন্তু ভয় করত না। ওই সব ক্রিয়ার দ্বারা ওদের ক্রোধ খানিকটা নির্গত হয়ে গেলে আমার বেঁচে যাবার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল। ওরা তা করছে না। সব ক্রোধ রাগ আগলে রেখে দিয়েছে মোক্ষম মার দেবে বলে। এটাই ভয়ের। খুবই ভয়ের। যার অপরাধ অতি অল্প তাকে মেরে মেরে আধমরা করে দেওয়া হয়। যার অপরাধ বিশিষ্ট শ্রেণির তাকে মারা হয় অতি বিশিষ্ট মার–মৃত্যু।

এক একজন এসে আমার আগাপস্তলা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছে না, কিছু জিজ্ঞাসা করছে না। শুধু নির্মম নির্নিমেষ দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখে চলে যাচ্ছে।

কত দেরি? কে যেন কাকে জিজ্ঞাসা করে। জবাব দেয় সেখোকা দা এসে গেলেই। আবার প্রশ্ন–কখন আসবে? জবাব–খবর তো অনেকক্ষণ আগে পাঠানো হয়েছে।

তাহলে আর কিছুক্ষণ থেকে দেখেই যাই কী বল?

খোকাদা মানে খোকা দাস। কামারপাড়ায় সেনাদলের সর্বাধিনায়ক। লোকে বলে সে নাকি এককুড়ি খুন করেছে। আঙ্গুলিমাল-এর মত সে যাকে মারে, প্রাণেই মারে। মানুষ মারা তার প্রিয় খেলা। ছুরিচাকু নাকি তার হাতে শিল্পীর তুলির মতো সাবলীলভাবে চলে। চোখের পলক পরার আগে পেট চিরে দ্যায়, নলি কেটে দ্যায়। সে এলেই আমার হয়ে যাবে। যতক্ষণ সে না আসে আমার পরমায়ু ততক্ষণ। আঃ। বেঁচে থাকার এমন অতলান্তিক আনন্দ এমন অনিঃশেষ স্বাদ, এক একটা নিঃশ্বাস যে এত মূল্যবান, আরাম দেয়, আগে কোনদিন এমনভাবে জানা হয়নি। এর জন্য এখন খুব মায়া হচ্ছে।

দম এখন যেন বন্ধ হয়ে আসছে আমার। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। চোখ ঘোলা ঘোলা হয়ে আসছে, ঝাপসা দেখাচ্ছে চারদিক। ঘুরপাক খাওয়া মানুষদের কেমন যেন প্রেতপুরির ছায়া মানুষ বলে মনে হচ্ছে। কান আর মাথার মধ্যে আঁ আঁ করছে। যেন বেসুরে ভেপু বাজাচ্ছে কেউ। চারপাশের লোকজন, মাথার উপরের নীল আকাশ উজ্জ্বল রোদ, সবুজ গাছপালা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি যেন কোন দ্বীপে পৌঁছে গেছি। আমার চারপাশে বৃত্ত করে বসে আছে হায়না চিতা সাপ বাঘ। এখানে আমার আপনজন কেউ নেই।

এক সময় মনে হয় আমি মারা গেছি। জাগতিক যাবতীয় হিসাব নিকাশ–সব চাওয়া পাওয়া বন্ধুত্ব বৈরিতা নিচে ফেলে দেহমুক্ত আত্মা এখন মহাশূন্যে উড়ে গেছে। নিচে যে আমি বসে আছে সে বহুকাল আগে মরে যাওয়া “আমির” মৃত শরীরটাকে মমি করে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

একজন একটা দোনলা বন্দুকেদুটো এল.জি.কার্তুজ ভরে সেটা রাস্তার ওপাশে এক গ্যারাজের লোহার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে। তাহলে কী আমাকে গুলি করে মারবার সিদ্ধান্ত হয়েছে? বর্তমান দুর্মুল্যের বাজারে এক একটা গুলির কত দাম। ওরা কী আমার প্রতি এতটা সদয় উদার হবে? যদি হয়, সেটা খুবই উত্তম। গলা কাটা, পেট চিরে ফেলা, সাপের মত পিটিয়ে পিটিয়ে মারা, ইট দিয়ে থেত করা–এসবের চাইতে সেটা উভয় পক্ষেরই আরামদায়ক। এতে সময় এবং শ্রম দুটোরই সাশ্রয় হবে।

–এ্যাই ছোঁকড়া কী যেন নাম তোর। চা খাবি? বড় নরম বড় মোলায়েম গলায় একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, খাবি চা? লোকটার দিকে এক অবুঝ চোখে তাকিয়ে থাকি আমি। আমাকে চা খাওয়াবে। কিন্তু কেন? আমি তো তার কোন পূর্ব পরিচিত কেউ নই। তবে?

লোকটার পরিধানে পরিষ্কার ধুতি, পাঞ্জাবি। বয়স বছর চল্লিশ। ফরসা গোলগাল, কাপড়ের দোকানের মালিকের মতো চেহারা। আমি মাথা নাড়ি-না। সে নাছোড়–চা খাবি না! বেশ, তবে এক গেলাস দুধজল খা। তা-ও খাবি না! তবে কী খাবি? ডাব এনে দিই একটা?

এই লোকটার নাম ধরে নিচ্ছি বেনু সেন। একজন এসে তাকে থামাতে চায়-আঃ বেনুদা কেন ফালতু ওকে ডিসটার্ব করছ। হাসে বেনু নামের নোকটা–না মানে, ওকে একটু জলটল খাওয়াতাম। আফটার অল আমরা তো হিন্দু। শাস্ত্রে আছে মৃত্যুপথযাত্রীকে জলদান খুবই পুণ্যের কাজ। বলে সেইজন–তুমি এ সব মানো! জোর দিয়ে বলে বেনু সেন–নিশ্চয়! হাজার হাজার বছর এসব রয়েছে। তন্ত্র শাস্ত্র বলে একটা জিনিস আছে। জানিস তন্ত্রের কী অসীম শক্তি? যদি পারিস শনি কিংবা মঙ্গলবারে অপঘাতে মরা চণ্ডালের বুকের একখানা হাড় নিয়ে আয়। তারপর দেখবি।

আজ কি বার! শনি না মঙ্গল! তাহলে আর কোনভাবে আমার অপমৃত্যু রোধ করা যাবে না। আমি নমঃশূদ্র, যাদের আগে চণ্ডাল বলা হোত। আমার বুকের হাড় যে বহুমূল্য বস্তু।

মোহিত বর্মন এসেছে এখন। মোহিত বর্মন খোকা দাসের ঘনিষ্ট সহযোগী। সহযোগী, নাকি ওই “কুড়িকাণ্ডের” রেকর্ড ভেঙে দেবার প্রবল প্রতিযোগী। এ যেন ব্র্যাডম্যান আর ও শচীন তেন্ডুলকার। ও বলে আমি গ্রেটেস্ট এ বলে আমি।

মোহিত বর্মনের হাতে একগোছা ইলেকট্রিকের সরু তার। যার একমাথায় ঝুলছেডিটোনেটর। সে একবার আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নেয়। দৃষ্টিতে কোন দাহ দ্বেষ নেই, আছে সুমহান কর্তব্যের কঠিন দৃঢ়তা। দয়া মায়া স্নেহভালোবাসা এসব বড় কোমল অনুভূতি। পাছে কোন কোমলতা তাকে ছুঁয়ে দ্যায়, দুর্বল মনের বলে বদনাম রটে যায় তাই নিজের চারপাশে তৈরি করে রেখেছে একটা বিভৎসতার অদৃশ্য বলয়। যে কারণে মানুষ মারতে প্রচলিত অস্ত্রের ব্যবহার সে খুব একটা পছন্দ করে না। শোনা যায় কাকে যেন বস্তায় ঢুকিয়ে প্রচুর সময় নিয়ে ইট দিয়ে থেঁতলে মেরেছিল। কার যেন মাথার তালুতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আস্ত একটা গুজাল। কার যেন গলার নলি দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়েছিল।

মোহিত বর্মনের চোখ দুটো এখন আলোহীন-আধবোজা-ইসমাইল কসাইয়ের চোখের মত। যে সকাল বেলা খোয়াড় খুলে ভেড়া ছাগল গুলোর দিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর একটাকে টেনে এনে গলার নলিতে চাকুর পোঁচ মারে। এটা তার নিত্যকর্ম। এবং সে জানে এটা কোনমতেই হত্যা নয়। আল্লাহ তাকে এই কাজ করবার জন্যই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যার যা কাজ সেটা করাই আল্লার কাজ করা।

নিজের কাজ করবার জন্য মোহিত বর্মনের আর তর সইছে না। বলে-ফালতু ফালতু দেরি করে কী হচ্ছে। এটাকে নিয়ে নারকেল গাছে বাধা ডিটোনেটরটা পেটে বেধে বাস্ট করে দিই। একজন বলে–খোকাদাকে খবর দেওয়া হয়েছে। সে না এলে। মোহিত বর্মন বিরক্ত–তোরা পারিসও। সব কথা খোকার কানে দেবার কী দরকার। নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে শেখ। ফালতু দেরি হয়ে যাচ্ছে। স্টেশনে রাইফেল ছিনতাই হয়ে গেছে। এদিকেও পুলিশ রেড করতে পারে। তখন লাশ লুকানো সমস্যা হবে।

রোদ বাড়ছে। সুর্য প্রায় মাথার উপরে উঠে গেছে। সারা শরীর রোদের তাপে জ্বলে যাচ্ছে আমার। শরীরের প্রতিটা লোমকুপ থেকে কলের জলের মত ঘাম গড়াচ্ছে। গায়ের ময়লা ছেঁড়া গেঞ্জিটা ভিজে জবজবে। নাক মুখ থেকে ছুটছে গরম হলকা। চারপাশের দৃশ্যপট দুলছে। বুকের ভিতর যেন হাতুড়ি পড়ার শব্দ–টিপ টিপ টিপ টিপ। যেন পাথর ভাঙছে কেউ। নিম্নাঙ্গ কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে। চোখ দুটো জ্বালা জ্বালা করছে। একটা মরা গাছের ডালে বসে একটা কাক বড় কর্কশ গলায় ডাকছে খাঃ খাঃ খাঃ খাঃ খাঃ। ওরা নাকি মৃতের ঘ্রাণ পায়। তবে কী খবর পেয়ে গেছে এখানে একটা মহাভোজের আয়োজন চলছে।

এখন আমার চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠছেনিহত বন্ধুদের মুখগুলো।কত তাদের নাম। সব নাম এখন মনেও আসে না। কী যেন নাম তার যাকে কুচিকুচি করে কেটে বস্তায় ভরে হোগলা বনে কারা যেন ফেলে এসেছিল। সকাল হবার আগে অর্ধেকটা শেয়ালে খেয়ে যায়। অনেকদিন আগে অপরিণত আবেগে মনে একবার মৃত্যু বাসনা জেগেছিল। দুইপক্ষে ঘোরযুদ্ধ হবে। বুকে গুলি এসে লাগবে। দুই মিনিটে সব যন্ত্রণার উপশম। বন্ধুরা আমাকে কাঁধে করে বয়ে ঘাটিতে নিয়ে আসবে। আমার মৃতদেহ ছুঁয়ে শপথ নেবে-কমরেড আমরা তোমার রক্তের ঋণ রক্ত দিয়ে সোধ করর। কোথাও আমার একটা শহীদ বেদী হবে। জমায়েত জনতা শ্লোগান দেবে–অমর শহীদ লাল সেলাম। সে মৃত্যু কত না মহান। তখন মৃত্যুর এমন বিভৎসকদাকার, কষ্টদায়ক রূপ আমার দুরতম কল্পনাতেও ছিল না। আমাকে শেয়ালে শকুনে খাবে।

এখন আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল অনুভূতি ঢেউয়ের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে। নাভিকুন্ডলি, পায়ের পাতা, হাতের তালুতে অদ্ভুত একটা শিরশিরানি। উঁচু বাড়ির খোলা ছাদে দাঁড়ালে যেমন হয়। বুক বোঝাই আমার এখন এক মরুভূমির পিপাসা। আঃ আর কোনদিন আমার মা বাবা ভাই বোন কারও সাথে দেখা হবেনা। তারা নিশ্চয় আমার শেষ পরিণতির খবরটাও পাবে না। সেটা মন্দের ভালো। অকারণে তাদের কাঁদিয়ে কোন দরকার নেই। মা, মাগো। আমাকে ক্ষমা কোরো মা। তোমাদের কাছে অনেক ঋণী রয়ে গেলাম। দুধের ঋণ অনেক বড় ঋণ। তার বিনিময়ে কিছুই করা হল না।

সেই লোকটা আবার এসেছে। কী যেন নাম? বেনু সেন। যে এক মৃত্যু পথযাত্রীকে পানীয় পরিবেশ করে নিজের পরকালের ঝোলায় কিছু পুণ্য সঞ্চয় করে রাখতে চায়। বলে সে, এই যে, কোন কিছু চাই তো সময় থাকতে বল। মনে কোন শেষ আশা! খোকা এসে গেলে আর বলার সময় পাবি না। বলি, একটা বিড়ি দিবার পারেন! বিড়ি! বিড়ি তো আমি খাই না। দাঁড়া, তোকে একটা সিগারেট খাইয়ে দিই। বলে সে একটা চারমিনার এনে নিজের হাতে দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে দিয়ে আমার পাশে বসে বলে–বাড়িতে কে কে আছে? সে প্রশ্নের উত্তর শোনার পর জানতে চান, তুই বড়? বলি হ্যাঁ। আবার প্রশ্ন–বাবা কী করে? সে প্রশ্নের উত্তর শুনে নিদারুন বেদনায় মাথা ঝাঁকান তিনি-ছিঃ ছিঃ। এমন বোকার মত কাজ কেউ করে। বাপের বড় ছেলে তুই। কোথায় খেটেখুটে এনে মা বাপকে খাওয়াবি। তা না করে গেলি পাটি করতে!–ছিঃ গরিব লোকের কী এসব করা সাজে! রাজনীতি মানে রাজার নীতি। রাজ্য চালাবার নীতি। বুঝলি কিছু। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফের বলেন তিনি, যাকগে যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আর আপশোষ করে কী করবি। ভগবানকে ডাক। সে-ই সবার মালিক।

লোকটা ভালো ভালো কথা বলছে তবু তাকে ভালো লাগছে না। তার উপদেশ সব আমার কাছে এখন অনাবশ্যক–অর্থহীন কথার কচকচানি। লোকটাকে আমার সাপের মত খল, শেয়ালের মত ধুর্ত বলে মনে হয়। আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখা জোড়া জোড়া ঠান্ডা চোখগুলো থেকে তার চোখ দুটোকে কিছু অন্যরকম বলে মনে হয়। সে যেন আয়োজিত এই নরমেধ যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত। সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রে তার অনুতাপরহিত নির্বিকার উপস্থিতি।

অবশেষে সবার সব প্রতিক্ষার অবসান, এসে গেল সেই চরমক্ষণ। চারিদিকের জনসমুদায় চঞ্চল হয়ে উঠল। জনকণ্ঠে ধ্বনিত হল প্রবল উচ্ছ্বাস-খোকাদা আসছে। হাত পা সব শিথিল হয়ে গেল আমার। মাথার মধ্যে লাট্রর বনবন ঘূর্ণি। আর আমার কোন বোধশক্তি নেই। চেতনা অসাড়-নিষ্ক্রিয়। শিরা উপশিরা, ধমনিতে কোথাও কোন স্পন্দন নেই। সব যেন একসাথে হরতাল করে দিয়েছে। শব্দ, স্রেফ একটা শব্দের আঘাতে আমার মন-মস্তিষ্কের কোষে কোষে ধ্বস নেমে গেছে।

খোকাদা আসছে।

এখন আমি আমার ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহটা অগ্রিম দেখে নিতে পারছি। বাঁচবার অদম্য আকাঙ্খয় শেষ সময়ে আঁকড়ে ধরেছিলাম ঘাসমাটি। আমার দুই হাতের দশনখের মধ্যে এখন ঘাস রক্তের কাদা। শুকিয়ে কালচে মেরে যাওয়া রক্তের মধ্যে উল্টে পড়ে থাকা শরীরটা মাছিতে চাটছে। কাক খোবলাচ্ছে। আমার ঠেলে বের হওয়া চোখ দুটো শেষ দৃশ্য দেখবার পরেও, আরও কিছু দেখবে বলে বিস্ফারিত হয়ে আছে।

খোকাদা এসে গেলেন।  

এখন আমি অবাক। এ কোন খোকাদা! এই খোকাদা তো কামারপাড়ার সেই কুড়ি কান্ডের মহানায়ক নন! এই খোকাদা খোকা চক্রবর্তী বিজয়গড়ে থাকেন। বর্তমানে পাড়া থেকে পলাতক। আছে কামারপাড়ার সেন্টারে। ইনি সি.পি.এম পার্টির এক উঁচুদরের নেতা। শোনা ছিল আমার, এই খোকাদা কামারপাড়ার খোকার মত নিষ্ঠুর প্রকৃতির নয়। এনার একটা নরম কোমল দরদিমন আছে। আছে কী?তাহলে একবার একটা শেষ চেষ্টা করে দেখাই যাক। বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। খোকা চক্রবর্তী আমার কাছে আসবে তার আগেই আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম তার সামনে–”খোকাদা আমারে বাঁচান। আমারে মাইরা ফালাবে বইল্যা ধইরা নিয়া আইছে।” থোকা চক্রবর্তী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুপা পিছনে সরে গেলেন–”এ্যাই, এ্যাই, কেডারে তুই”!–আইজ্ঞা আমি এ্যাক টিবি রুগী। রোগ চিকিচ্ছার জইন্য হাসপাতালে আইছিলাম। এনারা আমারে ধরছে।

খোকা চক্রবর্তী বেশ মনোযোগ সহকারে আগাপাস্তালা দেখলেন আমাকে। গায়ে আমার ময়লা একটা ছেঁড়া গেঞ্জি। নিচে আন্ডারওয়ারের উপর জড়ানো একটা গামছা। মাথায় তেলহীন রুক্ষ চুল। খালি পা। চোখের কোণে পিচুটি। অনাহারী পেট। অতিকষ্টে নিঃশ্বাসটানা, হাড় বের করা নির্জীব বুকের খাঁচা।

কী করিস তুই। কাগজ কুড়াইস নাকি?

আমার চেহারা পোষাক সব সেই রকমই। তাই তার জিজ্ঞাসার জবাবে বলি-এহন আর কুড়াইতে পারি না। সব্ব সোমায় জ্বর জ্বর ভাব। বুকে ব্যথা। কাশলে দলাদলা রক্ত বাইরায়। সেই জন্য।

খোকা চক্রবর্তীর মন ভিজে যায়। তিনি ভিড়ের দিকে প্রশ্ন ছোড়েন–এই, এডারে কোড়া আনছে রে?তাতা দত্ত মাথা নিচু করে সামনে এসে দাঁড়ায়। তার দিকে তাকিয়ে প্রখর গলায় বলেন। তিনি–তুই! তুমি হালায় কাউয়া কোন কামের না। হাসপাতালের বেড থিকা এট্যা রুগী তুইল্যা নিয়া আইয়া পড়ছ। মিনমিন করে বলে তাতা দত্ত-কী করে জানবো যে–। তখন তো কিছু বলেনি। আগে তো একটা জিনিস ছিল। হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করতে দেখে আমি ভাবলাম। এবার আমাকে তাড়া দেন খোকা চক্রবর্তী–এ্যাই, যাঃ, ভাগ! এতক্ষণে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল আমার। মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত বন্দী মুক্তির আদেশ পেয়েছে। তবে সত্যি সত্যি পেল কী? মনের সন্দেহ যে যাচ্ছে না। আবার তাড়া দেন তিনি, পালা, পালা। কিন্তু কী করে পালাব। পায়ের উপরে যে পাহাড়। এখনও যথাস্থানে রয়েছে সেই গুলিভরা বন্দুক। আমি হাঁটা দিলেই যদি কেউ পিছন থেকে গুলি চালিয়ে দেয়। এমনভাবে তোক মারা হয়েছে। এখন যে হবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে!

এই যে খোকা চক্রবর্তী–যিনি আজ আমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন, মাত্র এক মাসের মধ্যে পুলিশ ওনাকে ধরে লায়েলকার মাঠে নিয়ে গিয়ে এইভাবে পিছন থেকে গুলি করে মারবে। আর কে কদবে তা জানি না। আমি সেদিন কাঁদব এই মানুষটার জন্য।

এখন আবার বলেন খোকা চক্রবর্তী-কামারপাড়ার খোকা এসে পড়বার আগে পালিয়ে যা। ও ওসব রুগী ফুগি মানে না। কথা বলারই সময় পাবি না, পালা পালা।

পালিয়ে তোত যেতে চাই, কিন্তু পালাই কোন পথে। আছে উপায়? একটা আছে। সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই স্বপন–আলু স্বপন। যে দেওয়ালে “এল” লিখে ছিল। আমি মার খাবার পরে যে গিয়ে সি.পি.এম চলে নাম লিখিয়েছে এখন এই দলের এক মূল্যবান সম্পদ। নারকেল বাগানে এ্যাকশনে গিয়ে পেটে কংগ্রেসিদের গুলি খেয়ে ছয়মাস হাসপাতালে ছিল। তাকে কাছে ডাকি আমি। জড়িয়ে ধরি বুকের মধ্যে।–”ভাইরে, কতদিন তোরে দেহিনা, চল তোর লগে দুইটা সুখদুঃখের কথা কই।” আমার গায়ে ঘামের বোটকা গন্ধ। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে। আমি ছাড়ি না। ধৃতরাষ্ট্রর বাঁধনে বুকে বেঁধে ওকে টেনে নিয়ে যাই আমার সাথে। মনে এবার সাহস ফিরে আসে। আর এখন বন্দুক ব্যবহার করা চলবে না। যতবড় দক্ষ নিশানাবাদ হোক নিজের লোককে জখম করার ঝুঁকি নিতে চাইবে না। ওকে টেনে প্রায় একশো গজ দুরে জমাদার কোয়ার্টারের কাছে নিয়ে গিয়ে বলি–তোর মনে আছে স্বপন, ভাদুড়িগো দেওয়ালে নকশাল লিখিছিলি? বলে সে–সে আমি তারপরদিনই জলপোচড়া দিয়ে পুছে দিয়েছি।

সে তো দেখতেই আছি। বলি আমি–তোরা লেখতেও পারোস পোছতেও পারোস। আমরা না জানি লেখতে, না পারি পোছতে।

জমাদার কোয়াটার বন্দুকের রেঞ্জের বাইরে। বলি স্বপনকে–এবার তুই যাঃ গিয়া। এরপর সামনে পা বাড়াই আমি। যখন আমার মনে হয় বিপদসীমার বাইরে এসে গেছি, আর কোন ভয় নেই, এবার নিরাপদে ফিরে যাওয়া যাবে তখনই পিছন থেকে আবার হুংকার–দাঁড়া। দেখি, যার কোমরে মেডইন চায়না সেই তাতা দত্ত এগিয়ে আসছে। তবে কী বানিয়ে বলা রোগের গল্পটা বুঝে ফেলেছে।

এখন এই মুহূর্তে বাঁচবার মাত্র একটা পথ খোলা আছে, জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ব্যবধান আছে পঞ্চাশ কি ষাট গজ, সময় আছে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আর দু চার সেকেন্ডের মধ্যে তাতা দত্ত আমাকে রিভালবারের রেঞ্জের মধ্যে পেয়ে যাবে। দৌড়, এখন প্রাণপনে একটা দৌড় দিতে পারলে প্রাণটা বেঁচে যাবে। কিন্তু দৌড় দিতে গিয়ে আর দেওয়া গেল না। সামনের দিক থেকে একটা বিশাল পুলিশ বাহিনী এদিকে এগিয়ে আসছে। সহকর্মীর শোকে উন্মত্ত পুলিশের রাইফেল থেকে মুহুর্মুহু গুলি ছুটছে। ওরা আজ লাশগাদায় মানুষের স্তূপ দেখতে চায়। অপরাধ নিরপরাধ ওদের বিচার্য বিষয় নয়, শুধু চায় সংখ্যা। একের বদলে দশ।

তাতা দত্ত এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। এ হাত আগের মত কঠোর কঠিন নয়। নরম কোমল মোলায়েম। বললেন–শিগগির পিছন দিকে পালিয়ে চল।

পুলিশ দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওদের সামনে একটা চেনবাধা কালো কুকুর। কুকুরই মানুষকে টেনে নিয়ে আসছে। আমরা পিছন দিকে ছুটতে শুরু করি। যেখান থেকে ভয় পেয়ে পালাতে চেয়েছিলাম, পরিস্থিতি আবার সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এরপর আমি তাতা দত্ত নানু আর স্বপন এ গলি সে গলি ধরে পৌঁছে যাই রাজাপুর খালধারে। সেখান থেকে ঢোলকমলি, কচুগাছ পার্থেনিয়াম জঙ্গল হোগলাবন সব ঠেলে গিয়ে আমি আনন্দ পরমানিকের ভেরির পাড়ে। এখানে একটা প্রাচীন বটবৃক্ষ আছে, চারজনে বসে পড়ি তার তলে।

.

এটা যাদবপুর বা কলকাতা নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গ এখন এক গভীর সংকট জনক সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো একটা ঘটনা এসে আছড়ে পড়ছে আর একটা ঘটনার উপর। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আর একটা। প্রথম ঘটনার ভয়ংকর অবস্থা চাপা পড়ে যাচ্ছে পরের ভয়াবহতার নিচে। রোজ খবরের কাগজ খুলে মানুষ দেখছে কোথাও পুলিশ নকশালদের খুন করেছে কোথাও নকশালরা পুলিশকে। কোথাও সি.পি.এম মেরেছে কংগ্রেসকে কোথাও কংগ্রেস সিপিএমকে। জেল ভেঙে নকশালরা পালাচ্ছে, আবার পালাতে না পারলে কারারক্ষীরা তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলছে। যতদূর মনে পড়ে এটা বোধহয় সেই সময় যখন ডায়মন্ডহারবারে পাওয়া গিয়েছিল এক জায়গায় বারোটা লাশ। বরাহনগর কাশীপুরে হয়েছিল গণ সংহার।

এই রকম অস্থির সময়ে কি মানুষ আর কি পুলিশ কদিন আর যাদবপুর স্টেশনের ঘটনা মনে করে মুহ্যমান হয়ে থাকবে। থাকেনি। দিন দশেকের মধ্যে স্টেশন ফিরে গিয়েছিল স্বাভাবিক ছন্দে। স্টেশন ঘিরে গড়ে ওঠা চোলাই মদের ঠেকগুলোয় সন্ধ্যের পরে আবার শুরু হয়েছিল খদ্দেরের জমজমাট ভিড়। রেল সাইডিংয়ে, গোডাউনের আড়ালে আবার বসতে শুরু করেছিল তাসের জুয়া। রেল বস্তির কামিনী কমলারা আবার মনোমত সঙ্গী নিয়ে যাওয়া আরম্ভ করেছিল মালগাড়ির খালি বগিতে।

যা কোনদিন এর আগে ঘটেনি–কামারপাড়া থেকে ফিরে এসেছি। যা অনেকের কাছে। আমার পুনর্জন্ম। এরপর “ঠেক” নিয়েছি রেল স্টেশনে। কিন্তু আমি এখন করব কী? কিছু একটা করে তো পেটের অন্ন যোগাড় করতে হবে। পরামর্শ দিল তাতা দত্ত-রিকশা চালা।রিকশা চালাব। গাধা মোট বয়, গরু ঘোড়া গাড়ি টানে, মানুষ পালকি বয়, রিকশা চালায়। ধনতান্ত্রিক এই ব্যবস্থা মানুষকে নামিয়ে এনেছে গরু গাধার পর্যায়ে। এই ব্যবস্থা এত আটোসাটো মজবুত যে হাজার হাজার মানুষের আপ্রাণ চেষ্টায়ও এর গায়ে আঁচড় কাটা গেল না। আর যে কিছু করা যাবে সে প্রত্যয় একটু একটু করে পিছু হটছে।

রিকশাঅলা! শহরের বাবুশ্রেণির কাছে যারা মদ খায়, জুয়া খেলে, ঘন ঘন বউ বদলায়, সুযোগ পেলে ঠকিয়ে ভাড়া বেশি নেয়, বেপরোয়া রিকশা চালিয়ে পথচারীর পায়ে চাকা তুলে দেয়, যখন মানুষের রিকশা চাপার খুব প্রয়োজন, তখন যাব না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে বসে থাকে। যে কারণে এরা অভদ্র অসভ্য পিটুনিযোগ্য জীব হিসাবে চিহ্নিত।

জীবন আমাকে বাধ্য করছে সেই জীব হতে। তাতা দত্তের বেশ কটা রিকশা আছে। তারই একটা দিনে আড়াই টাকা ভাড়ায় আমাকে চালাতে দেয়। সে এখন জেনে গেছে আমি টিবি রোগী নই। আমাকে দিয়ে তার অনেক কাজ হতে পারে।

একমাত্র হাঁস, যে সারাদিন জলে থাকে তবু গায়ে জল লাগে না। এই জন্য রামকৃষ্ণদেব মানুষকে বলেছেন হাঁসের মত হতে। মানুষ কি তা পারে? পারে না। এই মানুষই বনে গিয়ে দীর্ঘদিন থাকলে বনমানুষ হয়ে যায়। পবিত্র গঙ্গাজল নর্দমায় ঢাললে নর্দমা গঙ্গা হয় না, গঙ্গা নদৰ্ম হয়ে যায়। সোনাকে কয়লার মধ্যে রেখে দিলে, সোনা কয়লা যদিনাও হয় তার ঔজ্জ্বল্য ঢেকে যায় কয়লার কালিমায়।

আমি কী কোনদিন মানুষ ছিলাম পবিত্র ছিলাম সোনা ছিলাম? কোন সদগুণ কী আমার ছিল? আমি জানি না। কোনদিন খোঁজ করিনি। এখন পরিবেশ পরিস্থিতি আমাকে পুরোপুরি গিলে নেয়। আমি রিকশাঅলা হই। মদ খাই, মাতলামো করি। মারামারি করি। মনের মধ্যে তখন কী এক ক্রোধ যেন গনগন করে। কতগুলো সোনার টুকরো ছেলে এই দেশটার জন্য, মানুষের জীবন সুখময় করার চেষ্টায় প্রাণ দিয়ে গেল। আর মানুষ–সেইমানুষ, বাজার করছে, বউ নিয়ে সিনেমায় যাচ্ছে, রাতে বাচ্চা পয়দা করছে, চায়ের দোকানে, রকে গুলতানি মারছে। তাদের আত্মত্যাগ মনেও রাখছে না। আমি এই মানুষ নই। ইমানুষ আমার কেউ নয়। শত্রু সব শত্রু।

স্টেশনে সারাদিন প্রায় পাগলের মত ঘুরি। মদ খেয়ে ঘুরি, মদ না খেয়ে ঘুরি। ঘুরি আর খুঁজি কাকে মারা যায়। মানুষকে মেরে মনের আক্রোশ যদি কিছুটা কমে।যদি কোন চোর, কোন পকেটমার, নারী পাচারকারী, শিশু পাচারকারী নাগালে পেয়ে যাই, যদি কোন রঙিন মেজাজের রোমিও সেজেগুজে গরিব মেয়েদের বিরক্ত করতে স্টেশনে আসে, ধরতে পারলে বেধরক ঠ্যাঙাই। যে কারণে স্টেশন এলাকায় বদমাশ শ্রেণির লোকের কাছে আমি ত্রাস হয়ে উঠি। আবার উল্টোদিকের কিছুলোক আমাকে ত্রাণকারীও ভাবতে থাকে। বিশেষ করে বাবুদের বাসায় বাসন মাজতে আসা গ্রাম বাংলার গরিব মেয়েরা। এই সময়ে নানা কারণে ট্রেন চলাচলে খুবই বিঘ্ন হোত, বৃষ্টিতে লাইনে জল জমে গেলেওভারহেডের তার ছিঁড়ে গেলে, তার চুরি করে নিলে আর ট্রেন চলতে পারত না। তখন এই সব মেয়েদের স্টেশনে রাত কাটাতে হতো। সেই বিপন্ন সময়ে ওরা আমাকে খুঁজত। কম বয়েসের মেয়েদের বিপদ তো শুধু দুষ্কৃতীদের কাছ থেকে নয়, স্টেশনের পুলিশের দিক থেকেও আসে। পুলিশের হাতে আগেও প্রচুর ক্ষমতা ছিল এখনও আছে পরেও থাকবে। ওরা জিজ্ঞাসাবাদের নামে বলাৎকার করলে সেটা অপরাধ হয় না।

এদের ভয়ে মেয়েদের কোন নিরাপদ স্থানে নিয়ে রাখি। রাত জেগে পাহারা দিই। স্টেশনের কিছু ছেলে, যার মধ্যে কেউ রিকশা চালায় কেউ মদের দোকানে কাজ করে কেউ কাগজ কুড়ায়, বাজারের মাছের আঁশ ছাড়ায় এরা সব সাথী হয় আমার। এক বাড়িতে একটা কাজের মেয়েকে রেপ করে, গলা টিপে মেরে, ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়। রেলবস্তির মেয়েদের নিয়ে গিয়ে আমরা সেই বাড়িতে ইট পাটকেল ছুঁড়ে আসি। রাজনীতি সম্বন্ধে গভীর কোন জ্ঞান নেই, যদিও তাতা দত্ত আমাকে জ্ঞানবান করার চেষ্টায়, সঞ্চয় পুততুণ্ডু নামে এক নেতার পলিটিক্যাল ক্লাশে মাঝে মাঝে ধরে নিয়ে যায় তবু আমার কিছু শেখা হয় না। এক সময় অল্প কিছুদিন এক উগ্রবাম দলের সঙ্গে ছিলাম। এখন আর তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। আছে শুধু তাদের কাছ থেকে পাওয়া উগ্রতাটা। সেই উগ্রতা দিয়ে যা করি তা শুধু আমার বদনামই বাড়িয়ে দেয়।

স্টেশনের সবচেয়ে পুরানো রিকশা চালক হরেন ঘোষ। যার মাথার চুল সব সাদা, মুখে একটাও দাঁত নেই, গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে। আমরা সবাই তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলি। সে রিকশা ইউনিয়নের লাইন সেক্রেটারী।

রাখালের যে রাজা সে তো রাখালই। আদিবাসীর রাজা আদিবাসী। রিকশাঅলার সেক্রেটারি রিকশাঅলা। রিকশাঅলা মানে-ছোটলোক। কবে কোন ছোট লোককে বাবুশ্রেণির লোক সম্মান দিয়ে কথা বলে? এখানেও তার ব্যতিক্রম হবার নয়। ফলে এক যাত্রী–যা তাদের চিরকালের অভ্যাস–যে ভাষায় তার পূর্ব পুরুষ তাকে বলতে শিখিয়েছে তাই বলে–এ্যাই রিকশো, যাবি নাকি রে? আমরা যখন শ্যামা কলোনিতে থাকতাম, রামকৃষ্ণ উপনিবেশের জনৈক কেষ্টবাবু আমার বাবাকেও ঠিক এই ভাষায় সম্বোধন করতেন।তখন আমি ছোট ছিলাম। কানে খুব খারাপ লাগলেও কিছু বলতে পারিনি। এখন পারলাম। আসলে মানুষের এক সময় এমন একটা বয়স আসে যখন তাকে বাবা বাবা মনে হয়। অন্য কারও হয় কিনা তা জানি না। তবে আমার হয়। যে কোন বুড়ো লোককে দেখলেই আমার বাবার মুখটা মনে পড়ে। এখন হরেন ঘোষ নয়, মনে হল যেন আমার বাবাকেই আর একবার অপমান করা হচ্ছে। আমি তার পাশের রিকশায় বসেছিলাম। আমার উচিত ছিল লোকটাকে বলা–মহাশয়, অনুগ্রহ করে আপনি আপনার ভাষাটা সংশোধন করে নিন। উনি বয়স্ক মানুষ। বলতে গেলে আপনার বাবার বয়েসী। ওনাকে তুই তোকারি করাটা ঠিক নয়। কিন্তু ওই যে রাজনৈতিক বিচ্যুতি–যার মূলে আছে অশিক্ষা, সে আমাকে দিয়ে অন্যকথা বলিয়ে নিল–এ্যাই, কোথায় যাবি রে তুই?

এই শব্দ বাবুর গায়ে যেন লঙ্কাবাটা লেপে দিল–কী কী বললি তুই?

-–ঠিক যা তুই শুনেছিস। আমার দুবির্নীত জবাব।

–মারব এক চড়।

–মারা তো অনেক দূর, গায়ে আঙুল ঠেকালে হাত ভেঙে দেব।–ব্যস এরপর তর্কাতর্কির পর একটা মারামারি হয়েই যায়। পরে জানতে পারি উনি এক নেতার দাদা। তখন গা ঢাকা দিতে হয় আমাকে। আর রিকশা চালাতে পারি না। বালিগঞ্জ-কসবায় এই রকম “বাবুদের গায়ে হাতে তোলা” এক রিকশাঅলাকে প্যাসেঞ্জার সেজে নিয়ে গিয়ে কারা যেন কেটে রাজডাঙার খালে ফেলে দিয়েছিল। যাদবপুরে অবশ্য এতবড় ঘটনা এখনও ঘটেনি। তবে মদের বোতল ভেঙে গলায় চালিয়ে দেওয়া, পিঠে খুঁর মারা এসব হয়ে গেছে। তাই একটু ভয় পাই! এইসব নানা কারণে সেভাবে রিকশা চালানো হয় না। হাতে টাকা পয়সা জমে না। মা বাবাকে কিছু পাঠাতে পারি না।

এবার আমি যখন স্টেশনে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলাম আমার চোখে পড়েছিল লোকটা। যার নাম গোলাম গাঁজি। যে দুনাম্বার প্লাটফরমে বসেনানা রকম মাদুলি কবচ পাথর গাছ গাছড়া বিক্রি করে। আমি জানি, এসব মাদুলি কবচ একটা লোক ঠকানো ব্যবসা, কিন্তু জানতাম না, এটা আসলে তার একটা ভেক। তার সত্যিকারের পরিচয় সে একটা ছেলে পাচার চক্রের চাই। এই সব বিক্রির বাহানায় সে কোন রেল স্টেশনে গিয়ে কিছুদিন ঘাঁটি গাড়ে তারপর সুযোগ বুঝে বাচ্চা নিয়ে পালায়।

আরব দেশের যারা তৈলকুবের তাদের প্রধান শখ দুটো অনেকগুলো বিবি রাখা আর উট দৌড় করানো। এই দৌড়ে একটা ছোট বাচ্চাকে উটের পেটের কাছে না গলায়, কোথায় যেন বেঁধে দেওয়া হয়। উট দৌড় শুরু করলে সেই বাচ্চা ভয়ে-ঝাঁকুনিতে, ব্যথায় যত কাঁদে-চেঁচায়, উট তত জোরে ছোটে।দীর্ঘদৌড় শেষ করে উট যখন থামে কোন বাচ্চা মরে যায় কোন বাচ্চা পঙ্গু হয়ে পড়ে চিরদিনের মতো। তখন সেই বাচ্চাকে মক্কার পথে পথে নিযুক্ত করা হয় ভিক্ষাবৃত্তিতে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে হজ যাত্রার মতো পুণ্যকর্ম আর কিছু নেই। হজযাত্রার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং অবশ্য পালনীয় কর্মের নাম জাকাত। সে সারা জীবনে যত ধন সম্পদ সঞ্চয় করেছে। তার ছয়ভাগের এক ভাগ দান করে দিতে হয়। এইসব অভাগা বালক সেই দান সংগ্রহ করে নিয়ে জমা করে নির্দিষ্ট স্থানে। এর বিনিময়ে সেদুবেলা দুমুঠো আহার আর আশ্রয় পায়। একটা পিতৃমাতৃহীন বালক বিনা অপরাধে একদল নরপশুর ক্রীতদাস হয়ে সেই দূর বিদেশে এই রকম নারকীয় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়।

তখনকার সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর এত সুলভ প্রাপ্তির সুযোগ ছিল না। ফলে রেল স্টেশনে জারজ, অবৈধ, পরিত্যক্ত বা গৃহ পলাতক গাদা গাদা বেওয়ারিস বাচ্চা ঘুরে বেড়াত, ভিক্ষা করত। যাদের হারিয়ে গেলে খোঁজবার মরে গেলে কাঁদবার মতো কোন লোক ছিল না। এই রকম একটা দুটো বাচ্চা স্টেশন থেকে মাঝে মাঝে কেউ কিছু বোঝবার আগে নিঃশব্দে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছিল। এখান থেকে সর্বশেষ যে বাচ্চাটা হারিয়ে গেল তার নাম যাদব। এই নাম তাকে দিয়েছিল স্টেশন কেন্দ্রিক জীবন যাপক মুটে মজুর হকার রিকশঅলা মানু্ষ।

একাত্তরের যুদ্ধের সময় ওর মা ওকে কোলে নিয়ে এসে পৌঁছায় এপার বাংলায়। তারপর নানাঘাটে জল খেতে খেতে একদিন এসে যায় যাদবপুরে। আশ্রয় নেয় দু-নাম্বার প্লাটফর্মের সিঁড়ির নিচে। তারপর একদিন এখানকার জল খেয়ে ভেদ বমি হয়ে মরে পড়ে থাকে। সেই মৃতদেহ রাস্তায় পেতে রেখে রেল কলোনির ভজার দলবল এত দান পায় যে তা দিয়ে দেহটি কালীঘাটে নিয়ে দাহ করবার পর যে টাকা বেঁচে যায় তাতে পাঠার নাড়িভুঁড়ির চচ্চড়ি সহ চোলাই খেতে অসুবিধা হয় না। তখন এই ছোট্ট ছেলেটাকে পালন পোষণের দায়িত্ব নেয় স্টেশনের সেইসব মানুষ, যাদের নিজেদেরই ঠিকমত খাওয়া জোটে না।

স্টেশনের রিকশা লাইনের পাশে বিহারের আরা জেলার বাসিন্দা ছেচন সাউয়ের হোটেল। এখানে যে সব মুটে মজুর রিকশাঅলা খেতে আসে, ডাল তরকারি ভাতের একটাকা দশ পয়সার প্রথম প্লেট নেবার পর পঁচিশ পয়সার একটা পরের ভাত’ চেয়ে নেয়। একা না পারলে দুজনে, তিন বা চারজনে। সেটা ওই যাদবের জন্যে।

মাঝে মাঝে ওকে গোলাম গাঁজিও খাওয়াতে নিয়ে যেত। এটা সেটা কিনে দিত। তখন সেটা কারও মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক করেনি। হঠাৎ একদিন স্টেশন থেকে যাদব উধাও হয়ে গেল। কেতাকে নিয়ে গেছে কেউ কোনদিন জানতেই পারতনা যদিতাকে রেলকলোনির এক কামানেখানে বালা’ মেয়ে-ঘুটিয়ারি শরিফের পনের টাকা ভাড়ার ভাঙা ঘরের জানালা দিয়ে দেখে না ফেলত। তখনই তার একটা সন্দেহ হয়েছিল। কাপড় চোপড় পরে বাবুর কাছ থেকে পারিশ্রমিক বুঝে নিয়ে যখন সে ঘর থেকে বের হতে পারল–পাখি পালিয়ে গেছে।

গোলামগাঁজি জানত যে যাদব কোন সাধারণ বাচ্চানয়।এ বাচ্চা নিখোঁজ হলে স্টেশন তোলপাড় হবে। তাই দুর থেকে পুরো পরিস্থিতির উপর নজর রাখছিল। যে দু-চারটি মুসলমান মেয়ে ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে যাদবপুরে কাজে আসে তাদের মাধ্যমে খবর নিচ্ছিল। ফলে সে জেনে যায়–অনেকে তাকে খুঁজছে। এখন যাদবপুরে গেলে বিপদ আছে। তাই সে ট্রেন থেকে যাদবপুরে নামত না। ভেন্ডার কামরার এককোণে মুখ লুকিয়ে চলে যেত পার্কসার্কাস। আবার লাস্ট ট্রেনে ওই কামরায় ফিরত ঘুটিয়ারি শরিফে। আজ তাকে দেখে ফেলেছে যাদবপুর স্টেশনের লোক আর টেনে নামিয়েছে ট্রেন থেকে।

খবর পেয়ে দেখতে গেলাম। তখন তাকে রেল সাইডিংয়ে স্টোন চিপসের গাদার আড়ালের অন্ধকারে নিয়ে বসানো হয়েছে। মুখ দেখে বোঝা যায় যে খুব গভীর জলের মাছ। সোজা আঙুলে এর পেট থেকে কথা বের করা মুশকিল। তখন বাধ্য হয়ে আঙুল বাঁকানো শুরু করা হল। একটা আমি একটা গণেশ দুই গোপাল দুটো একটা কালিয়া, দশ আঙুল বাঁকাবার আগেই সে স্বীকার করল–দাদারে, আল্লার কিরে আগের বাচ্চাগুলোর কথা আমি কিছু জানিনে। তবে এরে আমি নে গেছি। ফুলের মতোন বাচ্চা আস্তায় আস্তায় ঘোরে, তেমন কোন যত্ন পায়নে। তা দেখে মোনে বড় কষ্টে হয়েছেল। তাই ওরে নেগে বৃন্দাবন বাবুর বাড়ি দে এসেছি! বাবুর পাকা বাড়ি। নেই নেই করে একশো বিঘে জল জমি, পাঁচ পাঁচটা পোনা পুকুর। তবে ওই–আল্লা দশদিকে দে এ্যাকদিকে খালি করে রেখেছে। বউটা বাঁজা। বারো বচ্ছর বে হয়েছে তেবু ছাবাল পান হয়নি। আমার কতা বিশ্বেস করো, বাচ্চাটা সেখেনে সুখেই মানুষ হবে।

যে কটা আঙুল এখনও বাঁকা হয়নি আমরা সেদিকে হাত বাড়াতে কবুল করে গোলামগাঁজি–না সে যাদবকে ঠিক বিক্রি বলতে যা বোঝায় তা করেনি। বাবু খুশি হয়ে বারোশো টাকা দিয়েছে।

রাত দশটা সাড়ে দশটায় গোলামগাঁজিকে ধরা হয়। দেড় দু-ঘণ্টার চেষ্টায় তার মনের গোপন গহুর থেকে সব কথা বের করা সম্ভব হয়। জানা যায় বেন্দাবন বাবু নয়, শেখ আনোয়ার নামে একজনকে দিয়েছে বাচ্চা। সে এতদিনে তাকে নিয়ে বোম্বাই চলে গেছে। সেখান থেকে অন্য কেউ সাগর পার করে আরবে নিয়ে যাবে। তার আর কোনভাবে ফিরে আসবার উপায় নেই।

এখন গোলামগাঁজিকে কী করা যায়! এতবড় অপরাধের সাজা কে দেবে! আমি জানি, পুলিশে দিলে কোন লাভ হবে না। তারা ঘুষ খেয়ে কোন হালকা কেস দিয়ে ওকে ছেড়ে দেবে। তখন সবাই পরামর্শ করে ঠিক করা হয়–গোলামগাঁজি যখন এক মুসলমান, আমাদের সাথী জলিল যা বলবে তাই হবে। জলিল জানায় যে কোরানের নির্দেশ দাঁতের বদলে দাঁত চোখের বদলে চোখ। তখন ধরে নেওয়া হল যে উটের দৌড়ের পরে যাদব মারা যাবে না, পঙ্গু হবে। তাই শরিয়তি বিধান মেনে গোলাম গাঁজির পায়ের নিচে ইট দিয়ে শাবল চালিয়ে তাকেও পঙ্গু বানানো হল।

এরই মাসখানেক পরে আমাকে আর একবার কামারপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হল। যে কামারপাড়ায় যেতে হয় হেঁটে, ফিরতে হয় খাটে। যে কারণে কিছু লোকের মনে সন্দেহ হয়–এর পিছনে গোলাম গাঁজির নিশ্চয় বেশ কিছু টাকার গোপন যোগান আছে।

এক মাস্তানের নাম কার্তিক। সে থাকে কামারপাড়ার সামনে, রেল লাইনের এপারে তালতলা রেলকলোনিতে। আগে সে চুরি ছিনতাই এইসব করত। পরে পার্টিতে ঢুকে খোকা দাসের ডানহাত হয়ে যায়। হাত তার দশটা, তবে ডানহাত চারটে। চান্দু, ভাইয়া, বিশু আর এই কার্তিক।

এখন এই সময়ে কামারপাড়া একেবারে ফাঁকা। পার্টির নির্দেশে যত নেতাকর্মী-এ্যাকশানার সব আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেছে। কামারপাড়ার তাত্ত্বিক নেতা শিবু রায় চৌধুরি এবং মোহিত বর্মন পাড়া ছেড়ে শিয়ালদহ গিয়ে পুরানো জামা কাপড় বেঁচছে। রামঠাকুর আশ্রমের যতীন বিক্রি করে কলা। তাতা দত্ত আর হাতকাটা ভাইয়া পালিয়েছে আসামে। খোকা দাস কোথায় গেছে কে জানে।

এই সময় কংগ্রেস আর পুলিশের যৌথ আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। যে কারণে কামারপাড়া একেবারে বীরশূন্য হয়ে পড়েছিল। এই সময় এক দেড় বছর জেল খেটে কার্তিক সেখানে ফিরে এল। এবং ফাঁকা মাঠে গোল বলে যে বাংলায় একটা কথা আছে সেটা চরিতার্থ করার জন্য নিজস্ব একটা দল গড়ে ফিরে গেল পুরানো চুরি ডাকাতির পথে। চোলাই মদঅলা ছোট ছোট হকার দোকানদারের কাছ থেকে তোলাও তোলে। যে কারণে সি.পি.এম পার্টি তাকে ঘোষণা করে–আউট অব কন্ট্রোল।

ধর্মে অছে–যদি কেউ গঙ্গা স্নান করে নেয়, তার সব পাপ ধুয়ে যায়। যে হেতু জেলখানার আর এক নাম সংশোধনাগার, পুলিশ মনে করে যদি কেউ একবার জেল খেটে আসে সেসংশোধিত হয়ে যায়। যতক্ষণ তার নামে আর একটা লিখিত অভিযোগ জমা না পড়ে তার দিকে কুদৃষ্টি দেয়না। তাই কার্তিক নিরাপদে পাড়ায় ছিল।

লেখক আর মাস্তানদের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল আছে। তাহল অনবরত তাদের কিছু না কিছু করে যেতে হবে। যদি কর্মে কিছু ছেদ পড়ে আলস্য আসে মানুষ তাকে ভুলে মেরে দেয়। কার্তিক কিছুদিন জেলে চলে গিয়েছিল, অর্থাৎকর্মে ছেদ পড়ে গিয়েছিল। এখন পুলিশের ভয়ে “পাবলিকের” সাথে “ধমাকাদার” কিছু করারও সুযোগ পাচ্ছিল না। যার ফলে কামাই তেমন একটা হচ্ছিল না। সেই কবে জেলে যাবার আগে কী করেছিল এখন আর মানুষ তাতে ভয় পাবে কেন! সে চাইছিল একটা কিছু করে দেখাবার।

ঠিক এই সময় আমার কেসটা তার কাছে যায়। অংক কষে বুঝতে পারে আমি অতীব নিরাপদ এক শিকার। ঘরবাড়ি নেই, হোটেলে খাই আর স্টেশনে ঘুমাই। পুলিশ আর পাবলিকের চোখে আমি এক ক্রিমিনালও বটে। কোন পার্টিরও সাথে কোন যোগ নেই। এমন মানুষকেটসকে দেওয়ার কোন অসুবিধা নেই। বিশেষ করে তার জন্য যখন মজুরি পাওয়া যাচ্ছে।

এক জুন মাসের আগুন দুপুরে এক নাম্বার প্লাটফর্মের পূর্বপ্রান্তে ওরা তিনজনে ঘিরে ধরল আমাকে, কামারপাড়ায় একটু চল তো। কথা আছে। এদের সাথে আমার কখনও কোন শত্রুতা ছিল না। তাই ওদের কথায় একটু আশ্চর্য বোধ করি। এরা আমাকে নিয়ে যেতে চায় কেন! জানতে চাই–কী কথা?

-গোপন কথা। এখানে বলায় অসুবিধা আছে। চল, দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবি। ভয় পাচ্ছিস নাকি?

-ভয় কেন পামু! তোমাগো লগে আমার তো কোন বিরোধ নাই।

-তবে চল।

জুনমাসের নিদাঘ দুপুর। ঠিক মাথার উপর জ্বলছে রাগী সূর্য, যেন দশগুণ দহনতেজ নিয়ে। রোদে শরীরে চামড়া যেন ঝলসে যেতে যায়। আমি হাঁটি ওদের সাথে। জীবন আমাকে অনেকবার অনেক রকম পরীক্ষায় ফেলেছে। এবার আর একটা পরীক্ষার সময় সমাগত। এখন অবশ্য এক ছুটে পালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু পালিয়ে চলে গেলে পিছনে কী ফেলে গেলাম আর তা জানবার কোন উপায় থাকবে না। ওরা হয়ত সত্যিই কোন গোপন কথা বলতে চায়। বন্ধু হতে চায় আমার। বন্ধুর অভ্যর্থনার জন্য কিছু রাখা আছে কামারপাড়ায়। কী আছে সেখানে না গেলে জানব কেমন করে?

ওরা তিনজন। কার্তিক মণি আর শিবশংকর। চলতে চলতে চোখে ইশারায় ওরা কিছু কথা সেরে নেয়। আমি তার মানে ধরতে পারি না। সবার সামনে কার্তিক। তার পিছনে আমি। আমার পিছনে অন্য দুজন। ওদের চোখ লাল, পা টলোমলো, মনে হয় আমাকে ধরবার আগে খানিকটা মদ গিলেছিল। রোদের তাপে মদ পেটের মধ্যে ফুটছে। নেশার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

যেখানে এসে আমাদের চলা থামে সেটা একটা তেমাথার মোড়। সামনে একটা তিনতলা বাড়ি। বাড়িটা পুরনো, তবে এখন তাতে লোক থাকে না। কিছু মেরামতির কাজ চলতে চলতে বন্ধ আছে। দুপুরের রোদে ক্লান্ত এই মধ্যবিত্ত অঞ্চলটা এখন দরজা জানালা বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে আছে। পথে কোন লোকজন নেই। এখন ওদের গলার আওয়াজ বদলে গেছে। কঠিন গলায় আমাকে বলে কার্তিক-বাড়ির ভিতর ঢোক। নির্দেশমত ভিতরে ঢুকি আমি। বাড়িটার নিচের তলায় তিনচার খানা ঘর। যার কোনটায় দরজা জানলা নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার বাপাশে বড় বাথরুম। এরও কোন দরজা নেই। আমার প্রতি কুম হয়–বাথরুমে ঢোকবার। আমি আগে ঢুকি। আমার পিছনে ঢোকে কার্তিক। মণি দাঁড়িয়ে যায় বাথরুমের দরজার কাছে। শিবশংকর বাড়িতে ঢোকবার প্রধান দরজার সামনে। এবার কার্তিক মণির দিকে হাত বাড়ায়–দে। মণি কোমর থেকে কানপুরি বের করে তার হাতে দেয়। চাকু বের করতে দেখে আমি সত্যিই অবাক। আমাকে চাকু মারবে! কিন্তু কেন? মনে ভাবি হয়ত আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। এটা যে মজার নয় বুঝলাম তখন, যখন সে চাকুটা আমার বা কাঁধে গেথে দিল। যেভাবে চাকুটা এসেছিল এক আঘাতে আমার মারা যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। কণ্ঠার হাড় আর গলার মাঝে যে খোদল ওখান থেকে চাকু ঢুকে হৃদপিন্ড ফুটো করে দিলে মানুষ বাঁচে না।

আবার চাকু চালাল সে। এবার আড়াআড়ি। মাথাটা চকিতে একপাশে সরিয়ে গলার নলিটা বাঁচালাম আমি। ফের চাকু চালাল, লক্ষ্য সেই গলার নলি। আমার পিছনে পিছোবার কোন জায়গা নেই, পিঠ বাথরুমের দেওয়ালে ঠেকে গেছে। অগত্যা বাঁ হাত উঁচু করে গলা আড়াল করলাম। চাকু এসে বিঁধে গেল বাঁহাতের কনুইয়ের কিছু নিচে। ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল মেঝেয়।

তিনবারের ব্যর্থ চেষ্টার পর কার্তিক এবার একটু পিছনে সরে ফের চাকু উঁচু করল। এবার তার লক্ষ্য আমার পেট।

মনের মধ্যে এখন আমার উথাল পাথাল–মরে যাব! মেরে ফেলবে ওরা এইভাবে? না না মরব না। আমি লড়ব এবং বাঁচব। এখনও সময় আছে। চেষ্টা করলে নিশ্চয় বাঁচা যায়। দরজা জানলা বন্ধ আক্রান্ত বেড়ালের মত আমার মধ্যে জন্ম নেয় আক্রমণাত্মক মনোভাব। হতে পারে কার্তিক অনেক খুন করেছে। কিন্তু সে কোন অতি মানব তো নয়। তার বুকের বাঁদিকে চাকুর চোট পড়লে সেও লাশ হয়ে যাবে। আমার চেয়ে কার্তিক শারীরিক সক্ষমতায় অনেক কম। শুধু হাতে চাকু থাকায় কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওর পেটের মাদক তরল তো ওকে টলোমলো করে দিয়েছে। এটা আমার পক্ষে মস্ত সুবিধার। এক ঝটকায় যদি চাকুটা কেড়ে নিতে পারি, মুহূর্তে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি বদলে দেওয়া যাবে। দেওয়ালে পিঠ রেখে আমি প্রস্তুত হই–এসো।

কার্তিক আমার মনোভূমির এই শক্তিপুঞ্জের বিস্ফোরন অনুধাবন করে উঠতে পারেনি। তার মস্তিষ্কের মাদক প্রভাব তাকে বোধহীন করে দিয়েছে। সে এলোমেলো হাতে আমার পেটে চাকু চালিয়ে দিল। বিদ্যুৎ বেগে বাঁদিকে বেঁকে গেলাম আমি। চাকুর ধারালো ডগা পেটের চামড়ায় হাল্কা আঁচড় কেটে গেল। সাথে সাথে সেই হাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এক মোচড়ে ওর হাত থেকে চাকু আমার হাতে চলে এল। আর দেরি করা ঠিক নয়, চাকু ঘুরিয়ে চালিয়ে দিলাম ওর পেটে। বাপরে। বলে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এ কোন প্রিয় আলিঙ্গন নয়। এখনই বাধনমুক্ত করা দরকার, না হলে মনি এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই বাঁ হাত দিয়ে ওকে বুকে চেপে রেখে ডানহাতে ওর পিঠের উপর মারতে রইলাম চাকুর খোঁচা। প্রতি খোঁচায় আধ ইঞ্চি এক ইঞ্চি গর্ত হচ্ছে–রক্ত ঝরছে।

পাশার দান এখন উল্টো পড়ছে। অতি দ্রুত ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় মণি হত বিহ্বল। শেষে কী করতে হবে বুঝতে না পেরে একটা ইট তুলে আমার দিকে ছুঁড়ে মারে। সেটা আমার নয়, লাগে কার্তিকের মাথার পিছনে। আমার যা করার ছিল মণি করে দ্যায়। কার্তিক গড়িয়ে পড়ে মেঝেয়। এবার আমি খোলা চাকু নিয়ে মনির দিকে ধাওয়া করে যাই। পাঁচিল টপকে সে পালায়। শিবশংকর ছোটে গলি ধরে। ওর পিছন পিছন দৌড়ে কামারপাড়ার সেই কালভার্ট পর্যন্ত আসি। আর আমার ধাওয়া করার দরকার নেই। জমাদার কোয়ার্টার বাঁদিকে রেখে টিবি হাসপাতালের খাল পার ধরে সুবোধ মল্লিক রোডের দিকে ছুটি।

ভারতীয় সংবিধানে যে কোন মানুষের আত্মরক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমি যা করেছি সেটা নিজের প্রাণরক্ষার প্রয়োজনে। কিন্তু সে সাফাই দেবার জন্য আমার বিচারব্যবস্থার সামনে যাবার পথ খোলা নেই। পুলিশের খাতায় আমি কোন সুনাগরিক নই। আমার পরিচয়–আমি এক সমাজবিরোধী। তাই থানায় যাওয়া হল না।

লোকে বলে কার্তিকের নাকি কচ্ছপের প্রাণ। কেটে টুকরো করলেও মরে না। না হলে ওই ভাবে কোপ খেয়ে কেউ বাঁচে! বহুদিন, তা বোধহয় মাস তিনেক হাসপাতালের চিকিৎসার পরে সেরে উঠেছিল সে। তবে মাস্তানি আর করতে পারেনি। শরীরেও মনের সে জোর আর ছিল না।

এরপর সে একটা চোলাই মদের ঠেক খুলেছিল। মদ খেতে খেতে লিভার পচে একদু বছরের পরে বীরগতি প্রাপ্ত হয় তার।

কার্তিকের ঘটনা সে সময়ে জনমানসে একটা ব্যাপক আলোড়ন যে ফেলেছিল সে কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। কামারপাড়ার মধ্যে ঢুকে কাউকে মেরে অক্ষত বের হয়ে আসা এটাই ছিল জনগণের কাছে আশ্চর্য এক আলোচ্য বিষয়। তবে এই ঘটনায় সিপিএমের নেতা বা কর্মী আমার উপর বিশেষ বিরূপ হয়নি। অনেকে তো এমনও বলেছে বেশ করেছিস। খুব বাড় বেড়েছিল। এটা যে সময়ের কথা তখন এই দল ক্ষমতায় আসেনি। দূষণ ঘটেনি। ফলে তখন ওই দলে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন সত্যিকারে কিছু ভালো সংবেদনশীল মনের মানুষ ছিল। এখন যাদের বয়েস পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে সেই নবীন প্রজন্ম অবশ্য আমার কথা মানতে চাইবে না, আজকে এই দলের কার্যকলাপ দেখে ধারণাও করতে পারবে না। এই পার্টির কিছু লোক আমার বিরাট ক্ষতি করে দিয়েছে, ওদের জন্যই আমার জীবন তছনছ হয়ে গেছে, এক সামাজিক মানুষ থেকে অসামাজিক জীবে পরিণত হয়ে গেছি। তবু আমাকে বলতে হবে, এক সময় এইদলে ভালো মানুষ ছিল। যদি এরা কোনদিন ক্ষমতার কেন্দ্রে না পৌঁছাত আজও জনগণের বড় বন্ধু হয়ে থাকত। ক্ষমতার লোভই এদের অধঃপতিত করেছে। হয়ত বিলুপ্ত করে দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *