০২. শিয়ালদহ রেল স্টেশন

শিয়ালদহ রেল স্টেশন। নামের অভিধানিক অর্থ খুঁজতে গেলে মনে হয় কোন এক কালে এখানে কোন জলাশয় ছিল যাতে শেয়াল পড়ে গিয়ে থাকবে। নানা পথ ঘুরে ঘুরে এখানে এসে পৌঁছেছে বিপন্ন সময়ের গর্তে পা পিছলে পড়া এক কিশোর। যার নাম জীবন। অজানিত এক ভয় তাড়া করে নিয়ে ফিরছে তাকে। মনে হচ্ছে যেন একপাল হিংস্র হায়না ধাওয়া করে আসছে। নাগালে পেলে ধারালো দাঁতে ফালা ফালা করে ফেলবে। কত বা বয়স এখন জীবনের! সেই নাবালক বয়সের তুলনায় অন্যায়েরকার বিশাল ও শিয়ালদহ রেল স্টেশন। শুধু এই রেল স্টেশনই নয়, সব রেল স্টেশনেরই একটা বিমূর্ত কিন্তু সংবেদী সত্তা আছে। যাকে দেখতে বা বুঝতে হলে মনটাকে খানিকটা দার্শনিক ভাবালুতার শিকড়ে নিয়ে বসাতে হয়। গোপন প্রবাহিত সেই ফতার আদিম অনাবিল শেকড়ে আছে জাতিধর্ম বর্ণের উর্ধ্বে এক চিরায়ত মানবাত্মার সুগভীর মেল বন্ধন। হাজার হাজার মানুষ, নানা বয়সের নানা পোষাকের নানা ভাষার। কেউ কারও পরিচিত নয়, কিন্তু কোন দক্ষ মালাকার যেন এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছে সব ফুলের এক অদৃশ্য মালা।

সকালবেলায় যখন দিনের প্রথম ট্রেনখানা এসে প্লাটফর্মে থামে সেই যন্ত্রযানের গর্ভ থেকে একইভাবে পিলপিল করে প্রসব হয় মানুষ। তারপর একই রকম, ধেয়ে চলা মিছিলের মতো সামনে ছোটে। প্রতিটি পায়ের চলায় ফুটে ওঠে একই রকম ছন্দ তাল ধ্বনি। ফুটে ওঠে দায়িত্ব কর্তব্যের সাথে নিখুঁত শ্রম জীবনের বার্তা। আবার দুপুরে বিকালে রাতে ফিরতি এই পাগুলোয় জড়িয়ে থাকে শ্রান্তি ক্লান্তি অবসাদ। মনে জড়িয়ে থাকে ঘরে ফেরার তাড়ার সাথে কিছু উৎকণ্ঠা। যদি ট্রেন না আসে! যদি ট্রেন না ছাড়ে! যদি মাঝপথে গিয়ে থেমে যায়! ট্রেনের আজকাল হাজার বিপদ। বর্ষায় লাইনে জল জমে যেতে পারে। ওভার হেড তার ছিঁড়ে যেতে পারে। কেটে নিয়ে যেতে পারে কোন চোর। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকতে পারে। হঠাৎ কোন নাগরিক বা রাজনৈতিক অবরোধে বন্ধ। তখন আর ট্রেন চলবে না। ট্রেন না চললে সব মানুষের মুখ একই দুশ্চিন্তায় কালো হবে। বুকে জমবে একই রকম মেঘ বাদল যা বৃষ্টি হয়ে ঝরাও বিচিত্র নয়। সবার ঘরের মানুষ একই রকম আশংকায় পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে একই কামনা নিয়ে। ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে আসুক ঘরের মানুষ। কারো সাথে কারো দেখা সাক্ষাৎ চেনা জানা পরিচয় পরিচিতি নেই, তবু একই রকম দীর্ঘশ্বাস পড়বে সবার একই দুর্ভাবনায়। জীবন দার্শনিক নয়। দর্শনের গভীর তথ্যে বিচরণের পক্ষে ষোল সতের বছর বয়েসটা বড় কম। সে এই স্টেশনে বলতে গেলে আত্মগোপন করে আছে স্কুল এক জৈবিক তাড়নায়। স্টেশনে সে একা নয়, তার মত ভবঘুরে ভিখারি পাগল গৃহহারা বহু মানুষের বসবাস। এর মধ্যে আর একটা নতুন বাড়তি বালক বিশেষ কারো শিরঃ পীড়ার কারণ ঘটায় না।

সেদিন দুপুরবেলা স্টেশনময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল জীবন। এ সময়ে স্টেশনে খুব একটা ভিড় থাকে না। লাল জামা পড়া রেলের কুলিরা এখানে সেখানে শুয়ে পড়েছে গামছা বিছিয়ে। কেউ কেউ বসে গেছে তাস নিয়ে। শহর কলকাতার অরাজকতা এখানে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারে নি। স্টেশনের প্লাটফর্মের বাইরে ইটের উনুনে কাঠপাতার জ্বালে কালো কালো হাড়িতে ভাত রান্না করছেন কয়েকজন মহিলা। তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে বোগা, উদোম কিছু বালক বালিকা। মানুষের হাড়ি কুড়ি সংসারের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে কতগুলো ছাল ওঠা নেড়ি কুকুর। তারা বর্তমান সময়ের মানুষের মতই মারামারি কামড়া কামড়ি করছে।

বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরার পর ক্লান্ত হয়ে খানিকটা কলের জল খেয়ে একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে পড়ে জীবন। এমন সময়ে পাশে এসে বসল ওর চেয়ে দু-তিন বছরের বড় একটা ছেলে। একটু লম্বাটে ধরনের চেহারা। গায়ের রঙটা কালো। মাথায় উস্কোখুস্কো লম্বা চুল। পরিধানে একটা বেমানান ফুল প্যান্ট। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর মুখে জ্বলন্ত বিড়ি। ছেলেটা এখানে নতুন আমদানি। জীবন আগে কখনো দেখেনি তাকে। পাশে বসে সে জীবনকে অতি পরিচিতের মত বলে, এই তোর নাম কি রে?

–মোর নামে তোমার কি কাম?

–নাম না জানলে তোকে কি বলে ডাকবো।

–আমায় ডাকবা ক্যান?

–এক সাথ এক জায়গায় থাকলে ডাকা লাগবে না। মানুষ মানুষের কত সময় কত দরকারে লাগে। আমি কটা দিন তোদের এখানে থাকব ভাবছি তো। সেই জন্য নামটা জানতে চাইলাম।

ছেলেটার গলার স্বরে সারল্য এবং সত্যের সংমিশ্রণ। মনে হয় জীবনের একে নিজের নাম পরিচয় দেওয়ায় কোন সমস্যা হবে না। বলে, মোর নাম জীবন।

বলে সে, আমার কী নাম জানিস? শুনলে চমকে যাবি। রাজা, আমার নাম রাজা। তোর চেয়ে বয়সে চার পাঁচ বছরের বড়ো হব আমি। তবে তোকে দাদা ফাদা বলে ডাকতে হবে না। নাম ধরেই ডাকিস।

তাকে রাজা বলে মেনে নিতে কোন আপত্তিকরে না জীবন। কষাইয়ের নাম যদি দয়াময় হতে পারে তাহলে এক পথ বালকের নাম রাজা মহারাজা সম্রাট কেন হতে পারে না।

জীবন চা দোকানে রেল স্টেশন ফুটপাতে অনেক দিন কাটাচ্ছে। লোকমুখে গল্পকথায় জেনেছে কোন কোন সময় রাজারাও রাজত্ব হারিয়ে ভিখারি হয়ে যায়। যেমন হরিশচন্দ্র যেমন নবাব সিরাজ। আবার কোন কোন সময় নিজেরাই ভিখারি ফকির সন্ন্যাসী সেজে বের হয়ে পড়ে ভ্রমণে। এই রাজাটি কোন কারণে এখানে এসেছে সেটা এখনো জানা যায়নি। এক গাল হেসে সেই খবরটাই পরিবেশন করে সে–আমি আসামে যাবো। বলতে পারিস, আমার হচ্ছে আসামে যাওয়া আসার কারবার। বছরে একবার যাই একবার আসি। আমার এক বন্ধু এবার আমার সাথে যাবে বলেছে। সে যতক্ষণ বাড়ি থেকে পালিয়ে না আসতে পারছে আমাকে এইখানে অপেক্ষা করতে হবে। তারই জন্য বসে আছি। না হলে কি আর আমাকে এখানে দেখতে পেতিস। কবে ফুরুত হয়ে উড়ে যেতাম। অনেক দূরের পথ তো। কেউ একজন সাথে থাকলে গল্প গাছা করতে করতে যাওয়া যায়। একা একা বোকা হয়ে ঠিক ভালো লাগে না।

আসাম নাম জীবনের অজানা নয়। যাদবপুর স্টেশনে একজন লোক মাদুলি বেচতে আসে। মাটিতে শুইয়ে সে একটা ছেলেকে মন্ত্রের সাহায্যে মাটি থেকে শুন্যে তুলে দেয়। একটাকা হাতের তালুতে নিয়ে দশটাকা বানাতে পারে। তার এসব মন্ত্র নাকি আসাম গিয়ে শেখা। আসাম হচ্ছে পাহাড় জঙ্গল ঘেরা অতি দুর্গম একটা স্থান। যেখানে আছে দেবী কামাক্ষ্যার মন্দির। সেখানে নাকি কোন পুরুষ লোক সহসা যেতে পারে না। যদি যায় সেখানকার জাদুকরী মেয়েরা তাকে ধরে জাদুমন্ত্র বলে ভেড়া বানিয়ে ফেলে।

কিন্তু রাজা নামের এই ছেলেটা এ নাকি অনেক বার আসাম গেছে। তবু এ ভেড়া না হয়ে ফিরে এল কেমন করে? বলছে আবার নাকি যাবে। ধাপ্পা দিচ্ছেনা তো?কিছু বিশ্বাস কিছু অবিশ্বাস নিয়ে জানতে চায় জীবন, তুমি কামরূপ কামাক্ষ্যার মন্দিরে গেছো?

অনেক বার।

সত্যি কইতে আছো?

তোর কাছে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ?

মাইনষে যে কয় ওইখানে কেউ যাইতে পারে না। গেলে মাইয়ারা ধইয়া ভেড়া বানাইয়া দেয়।

গুল দেয়। বলে রাজা—সব মিথ্যা কথা। এই তো আমি তোর সামনে বসে আছি। বললাম না অনেকবার আসাম গেছি, তা আমি কি ভেড়া হয়েছি? দেখাচ্ছে আমাকে ভেড়ার মতো?

মোনে কয় ওরা তোমারে দেখতে পায় নাই।

বলিস কি। আমার এত বড় শরীরটা দেখতে পায়নি। দেখা কি রে, কত জনার সাথে কথাও বলছি। এক জনের হাত ধরেছি।

সেই হাত ধরার পুরাতন স্মৃতি মনের দরজায় ধাক্কা মারায় কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে যায় রাজা। তারপরে বলে ওই দেশের মেয়েগুলোকে কে জানে ভগবান কি দিয়ে তৈরি করেছে, যদি একবার ছুঁয়ে দেয়, সারা শরীর অবশ হয়ে যাবে। জাদু যদি বলিস, তবে তা ওদের আছে। যদি কোন বাঙালীর ভাগ্যে ও রকম একটা মেয়ে জুটে যায়, ভেড়া কি রে! একেবারে পায়ের জুতো হয়ে যাবে।

মেয়ে বিষয়ক গল্প বেশিদূর এগোয় না। একা রাজা কতক্ষণ বা বলবে! জীবন এখনো এতটা সাবলীল হয়ে ওঠেনি। মেয়ে দেখতে তার ভালোই লাগে, তবে তা আড়চোখে। সরাসরি কারও চোখে চোখ পড়লে কেন কে জানে পা থেকে মাথা অবধি কেঁপে ওঠে। একে শিহরণ বলে।

কিছুক্ষণ পরে জীবনের কাছে জানতে চায়–বিড়ি খাবি?

মুই বিড়ি খাইনা। বলে জীবন।

অবাক হয় রাজা। এ কী করে সম্ভব! স্টেশনবাসি এই বয়সের সব ছেলেরাই মদ, গাঁজা কত কী নেশা করে। আর এই ছেলেটা নিরীহ বিড়িতেই বিমুখ? এত নিরামিষভাবে স্টেশনে টিকে আছে কেমন করে!

তাহলে তুই কি খাস? কীসের নেশা তোর!

আমি ভাত খাই। আমার একটাই নেশা। ভাত। ভাত ছাড়া আর কোনো নেশা নাই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে রাজা–আগে আমারও ওই নেশা ছিল। একমুঠো ভাত সারা দিনে একবার না হলে চলতো না। এখন আর সে নেশা নেই। পেলে খাই না পেলেও কোন দুঃখ করি না। দুঃখ করেই বা কি করবো। না খেয়ে আছি বলে কেউ তো আর ভাতের থালা সামনে এগিয়ে দেবে না।

জীবনকে প্রশ্ন করে রাজা–আচ্ছা কতদিন তুই কিছু না খেয়ে থাকতে পারিস?

একদিনও পারি না। বলে জীবন–না খাইয়া থাকলে হাত পা কাপে, চক্ষু ঘোলা হইয়া যায়। কথা কান দিয়া বাইরায়।

বলে রাজা, না খেয়ে থাকা কোন ব্যাপারই না, শিখলে সব পারা যায়। বেঞ্চির পিছন দিকে শরীর হেলিয়ে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে ফের বলে সে–বলতো উট কতদিন জল না খেয়ে থাকতে পারে? এক মাস। মরুভূমি কত গরম জানিস? সেখানে এক মাস জল না খেয়ে থাকা কি সোজা কথা! কেউ পারবে?

মাথা নাড়ে জীবন–পারবে না।

আচ্ছা বলতো সাপ কতদিন না খেয়ে থাকতে পারে?

জানি না।

পাক্কা তিনমাস। শীত পড়া শুরু করলে একবার খেয়ে সেই যে গর্তে ঢোকে পুরো শীতকাল আর বের হয় না, কিছু খায়ও না। তাহলে বল ওরা যদি এসব পারে মানুষ কেন পারবে না।

ফের বলে রাজা—আমার এক মামা আছে তারে আমি কোনদিন ভাত রুটি কিছু খেতে দেখিনি। রোজ সকালে একমগ লাল চা দুটো নেড়ো বিস্কুট, বিকালেও তাই। কিন্তু কোনদিন কোন বিয়ে বাড়ি, যদি খাবার টাবার বেঁচে যায় আর মামাকে ডেকে নিয়ে যায় তখন দেখা যায় খাওয়া কাকে বলে। সেই মামার কাছে থেকে আমি না খেয়ে থাকার কায়দা জেনে নিয়েছি।

কী কায়দা?

একদম খিদের কথা মনে না করা। চেষ্টা করে দেখ, তুইও পারবি। সব সময় মনে করবি–এইমাত্র খেয়ে উঠেছি, পেট ভরা আছে। দেখবি মোটেই খিদে লাগবে না।

মানুষকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা বলার জন্য পণ্ডিত হতে হবে এ নিয়ম সর্বদা খাটে না। কখনো কোন মূর্খ নির্বোধ নিরক্ষর মানুষের মুখ থেকে বের হয়ে যেতে পারে এমন কোন শব্দ যা সর্বকালের পণ্ডিতদেরও জ্ঞানের অতীত। সেই কবে কত সহস্র বছর আগে একজন মানুষ যে সূর্য পৃথিবীর চেয়ে বড় না ছোট, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, না পৃথিবী, তা জানত না। জানত না গাছ থেকে আপেল মাটিতে কেন পড়ে, আকাশে কেন উড়ে যায় না। সেই আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলো ওখানে ঈশ্বর থাকেন। তারই কথা হাজার হাজার পণ্ডিত হাজার হাজার বছর বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

রাজা নামের ছেলেটা জানে না সে আজ নিজের অজান্তে অষ্টম মার্গের শেষ এবং পরম মার্গের শেষ কথা বলে ফেলেছে। বহু সাধক মুনিতপস্বী যার নাম দিয়েছে নিবৃত্তিমার্গ। এই মার্গের পথিকের বিষয় সম্পদ ভোগ বিলাস কোন কিছুতে আসক্তি থাকে না। তারা বলে গেছেন–আসক্তি অর্থাৎ কামনা বাসনাই হচ্ছে সর্বপ্রকার দুঃখের মূল কারণ। মন থেকে যদি আসক্তিকে উৎপাটন করে ফেলে তাকে জড় নির্জীব নির্বিকার করে দেওয়া যায় সেটাই হবে মোক্ষ। এই মোক্ষ প্রাপ্তি ঘটে গেলে তখন আর জীবের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আনন্দ বেদনা প্রেম বিরহ কোন কিছুই অবশেষ থাকে না। সব কিছুর অবসান ঘটে যায় এবং বন্ধন দশা থেকে চিরমুক্তি পায় জীব। তখন আর তার সৎ আর শঠে পুরুষ আর নারীতে পায়েস আর পান্তায় কোন প্রভেদ থাকে না। তখন সেই মুক্ত পুরুষ নেংটি পরে খালি পেটে গাছতলায় শুয়ে মিলিয়ন ডলারের মালিকের চেয়ে নিজেকে বড় ভাবতে পারে।

হাজার বছর ধরে হাজার মহাপুরুষ মানব সমাজকে সেই মোক্ষের পথে নিয়ে যাবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কোরাণ পুরাণ বেদ বাইবেল, মঠ মন্দির মসজিদ গির্জার সমবেত প্রচেষ্টায় আংশিক সফলতা এসে গেছে।কিছুমানুষকেবোঝানো গেছে। বাকি মানুষটাকে বোঝাতে পারলেই ধরণীর ধূলিতে আকাশের স্বর্গ নেমে আসবে। দ্বেষ কলুষতা হিংসা ঈর্ষামুক্ত হয়ে মানুষ মহাসুখে বসবাস করবে।

অনেকক্ষণ পরে বলে জীবন, একটা কথা কমু? তোমাগো লগে তোমরা আমারে আসাম নিয়ে যাবা?

তুই যাবি আমার সাথে!

নিয়া গেলে যাইতাম।

নিয়া যাবো কিরে, তুই কি বাচ্চা নাকি যে কোলে করে নেবো। তুই যাবি তোর পায়ে হেঁটে। তুই যদি যাস আমি আর বন্ধুর জন্য দেরি করব না। তাহলে আজই রওনা দিই কি বল?

একটু বিমর্ষ হয়ে বলে জীবন–আমার কাছেও তো টাকা পয়সা নেই।

যাবো তো ট্রেনে, বিনা টিকিটে। টাকা কি হবে?

ভাড়া না লাগুক কিন্তু পথে খাওয়া দাওয়া–

খাওয়া দাওয়ার নামে খেপে ওঠে রাজা। এই হচ্ছে তোদের দোষ। এই জন্য তোদের কোন উন্নতি হবে না। এখানে দিব্যি দিনের পর দিন না খেয়ে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিচ্ছিস, তখন খিদের নাম মুখে আসে না। যেই এক জায়গায় যাবার কথা হল অমনি খাই খাই জুড়ে দিলি। আচ্ছা ঠিক আছে, কথা দিলাম পথে তোকে একবার গরম ভাত খাইয়ে তবেই আসাম নিয়ে যাবো। এবার আর আপত্তি নেই তো?

মানে। আমতা আমতা করে বলে জীবন—তোমার কাছে তো কইলা টাকা নাই, তয় কেমুন কইরা খাওয়াইবা। ভাত খাইতে তো টাকা লাগে।

আমার লাগে না।

কেমনে?

কেমনে? আরে মাথা মোটা পথে কি একবারও চেকারে ধরবেন না? যদি না ধরে নিজেরা গিয়ে ধরা দেবো। জেলে নিয়ে গেলে খাওয়ার কি ভাবনা। দু-দশদিন খেয়ে দেয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নিয়ে ফের রওনা দেবো।

বাল্যের সেই জেল ভীতি উঁকি দেয় জীবনের মনে। ওর বাবাকে ধরে জেলের বদলে কুড়ি পঁচিশ মাইল দুরে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এবারেও যদি সে রকম কিছু হয়? যদি চেকাররা কুড়ি পঁচিশ স্টেশন সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়? তখন এই না খাওয়া দুর্বল দেহ নিয়ে কি করবে জীবন। মরে যাবে যে। জীবনের আশংকা এক ফুয়ে উড়িয়ে দেয় রাজা। পঁচিশ স্টেশন আগে নিয়ে যাবে? যাক না। যতদূরই নিয়ে নামাক আসামের ওপারে তো নিয়ে যেতে পারবে না। রেল লাইনই নেই। তাছাড়া আসাম বর্ডার পার হলেই তো অন্য দেশ।

না, আর কোনো দ্বিধা সংকোচ ভয় ভীতি নয়, যা হবার তা হবে। মনঃস্থির করে বলে জীবন, তাইলে চলো।

মাঝ পথে গিয়ে কাদাকাটি জুড়বি না তো? মা’র জন্য মন কেমন করছে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আয়। তাহলে আমি কিন্তু তোকে ফেলেই চলে যাবো। তখন কিন্তু বলতে পারবি না রাজাটা বেইমান। ভেবে দেখ। যাবি?

যাবো।

বেশ তবে চল।

.

তখন বিকেল হয়ে গেছে। শুরু হল দুই আধ পাগলের এক অবিশ্বাস্য যাত্রা। যাত্রা না বলে একে অভিযান বলাই বোধ হয় বেশি যুক্তিযুক্ত। কাছে কারও একটা পয়সা নেই সেই অবস্থায় রওনা দিয়েছে আসাম। সে দেশে কেউ চেনা নেই জানা নেই কোথায় থাকবে কি বিপদে পড়বে সবটাই অজানা। তবু শুধু মাত্র আশার ছলনে ভুলি পরবাসের পথে হাঁটা দিয়েছে দুই উন্মাদ বালক।

তখনো ফারাক্কায় ব্রিজ নির্মাণ হয়নি। হাওড়া থেকে ট্রেন এসে থামাতো এক বড় নদীর কিনারে ফারাক্কায়। তারপর লঞ্চ ধরে আসতে হত এই পারে। খেজুরিয়া ঘাটে। সেই স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে আসতে হবে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে পাওয়া যাবে গৌহাটি মেল। পথে কোন বিঘ্ন না ঘটলে এটা পঞ্চাশ ষাট ঘণ্টার যাত্রা পথ। যা সমাপ্ত করতে হবে একেবারে নিখরচায়। এটা এ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে কোনও অংশে কম রোমাঞ্চক, কষ্টকর, সাহসিকতাপূর্ণ তো নয়ই, বলা চলে কিছু বেশিই।

শিয়ালদহ স্টেশনের গেটে কোন গেট কীপার ছিলো না। ওরা সহজেই গেট পার হয়ে বাইরে এসে হাঁটা দিলো হাওড়ার দিকে। তখন হাওড়া থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ট্রামের ভাড়া মাত্র আট নয়া পয়সা। সেইটুকুও কারও কাছে নেই। ধীর কিন্তু দৃঢ় পায়ে ওরা হাঁটা দেয় ওদের সামনের দিকে যা দিকের বিচারে পশ্চিম। যেদিক থেকে সূর্য ওঠে না, ডুবে যায়। যখন ওরা হাওড়ায় পৌঁছায় তার আগে সূর্য ডুবে গেছে।

রাজা জানে কোন প্লাটফর্ম থেকে ফরাক্কার ট্রেন ছাড়বে। যার সময়ও খুব একটা বাকি নেই। কিন্তু সমস্যা বিনা টিকিটে কেমন করে ভিতরে ঢোকে! এখানে শিয়ালদহের মত গেট ফাঁকা নেই। সব গেটে দু’তিন জন গেট কীপার। তার উপর গেটের সামনে একটা চাকার মত অবরোধক। যা একজন একজন করে ঠেলে ঠেলে যেতে হয়।

অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর চোখে পড়ে রাজার একটা গেটে কোন গেট কীপার নেই। অবরোধক চক্রে তালা দিয়ে সে কোথায় যেন গেছে। সাথে সাথে তার সামনে শুয়ে পড়ে রাজা। তারপর যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন ভাবে সৈনিকেরা বুকে হেঁটে আগায় সেই ভাবে চাকার নিচে থেকে ঢুকে যায় প্লাটফর্মের ভিতরে। ডাকে, চলে আয় জীবন, শিগগির। ওই একইভাবে জীবনও ঢুকে পড়ে। তারপর ছোটে ট্রেনের দিকে। তখন গার্ড সাহেব তার হাতের নীল আলো দুলিয়ে ট্রেন ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। ওরা ছুটে গিয়ে উঠে পড়ে সেই ট্রেনের এক কামরায়।

এ কামরায় বিশেষ একটা ভিড় নেই। যাত্রীরা বেশ আরামে বসে যেতে পারছে। সিট দু’চারটে খালি ছিল ইচ্ছা করলে ওরাও বসতে পারত কিন্তু তা করল না। একে টিকিট নেই তার ওপর সিট দখল, সেটা টিকিট চেকার এবং বৈধযাত্রী দুজনের কাছে গর্হিত অপরাধ। ওরা গিয়ে বসলো উল্টো দিকের দরজায়, দুপাশে দুজন। সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে। এদিকে প্লাটফর্ম পড়বে না। বেশ হাওয়া খেতে খেতে বাইরেটা দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। সামান্য কিছু সময়ের মধ্যে আলোয় আলোয় উজ্জ্বল শহর পার হয়ে ট্রেনখানা প্রবেশ করল রাত্রির নিকষ অন্ধকার গর্ভের ভিতর। যত সে চলে ধীরে ধীরে দূরে সরে যায় হাওড়া ব্রিজের বাতিস্তম্ভ।

জীবন কলকাতা ছেড়ে এর আগে এতদুর যাত্রায় কখনো যায় নি। ট্রেন যত সামনে আগায় যত একটু একটু করে দুরে সরে যায় কলকাতা শহর, তত তার বুকটা কি এক বেদনায় যেন ভরে ওঠে। অনেকগুলো দিন কেটে গেছে এইশহরের পথে পথে। অনেক অপমান অন্যায় অত্যাচার দিয়েছে। এই শহর দিনের পর দিন অনাহারেও রেখেছে। তবু আজ কেন কে জানে ছেড়ে যেতে বড় মায়া হচ্ছে। এই শহরের এক কোণে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে কাজের আশায় হা পিত্যেশ করে বসে থাকত তার অসময়ে বুড়ো হয়ে যাওয়া বাপ। বাপের ফেরবার পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত তার অনাহারী ভাই, বোন। ভাই বোনের কাতর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে অসহায় মা। এ শহর তাদের কোন কষ্ট বোঝেনি। তাই তারা কোনদিন পেট ভরে দুটো ভাত খেতে পায়নি। অসুখে বিসুখে পায় নি একটু ওষুধ। বর্ষা নামলে ভাঙা ঘরের খড়পচা জল ভিজিয়ে দিতে চার ছয় জন অভাগা মানুষের শীর্ণ শরীর। শীতকাল এলে তারা শীতের কামড়ে কুই কুই করে কঁপে আর কাঁদে। মায়াটা কি ওই অসহায় মানুষগুলোর জন্য না এই নির্দয় শহরের জন্য, সেটা এখন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না জীবন। কিন্তু তার চোখে জল ভরে আসে। মনে মনে বলে–মা মাগো, আমি তোমার এক অধম সন্তান। ক্ষমা করো। আমি আমার দায়িত্ব কর্তব্য কিছুই পালন করতে পারি নি। তাই তোমাকে ফেলে চোরের মত পালিয়ে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি তা জানি না। কী পাবো সেখানে গিয়ে তাও আমার অজানা। তবু যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি তা আর কেউ না জানুক না বুঝুক তুমি নিশ্চয় জানো বোঝো। যদি কোন অন্যায় করে থাকি ক্ষমা কোরো।

রাতের ট্রেনের চলার ছন্দে এক অদ্ভুত মাদকতার মিশ্রণ আছে। এক মনে অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে ছুটে চলা বেগবান ট্রেনের চাকার সাথে লাইনের ঘর্ষণের যে শব্দ, ইঞ্জিনের ফোঁস ফোঁস গর্জন, সব মিলে যে মধুর বাদ্যধ্বনি তা শুনে যেন নেশায় চোখ বুজে আসে। তারপরে বহু সময়ের একই ধরনের যন্ত্রসঙ্গীতের পর, কোন এক স্টেশনে যখন ট্রেন থামে, হকারদের সম্মিলিত কলতান, কুলিদের হাঁকাহাকি ছোটাছুটি সব মিলিয়ে যেন কোন মৃত নগরীর হঠাৎ কোন যাদুকাঠির ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়ে জেগে ওঠার উল্লাস উৎসব আর আনন্দ আমেজ ফুটে ওঠে।

জীবন এখন সান্ধ্য শোক বিস্মৃত হয়ে রাত্রি গভীরের অনির্বচনীয় মাদক আমেজে ডুবে যায়। রাত যত বেড়ে চলে তত তার নেশা গাঢ়তর হয়। তখন চা অলার দ্বিমাত্রিক বাঁশচেড়া গলার গর্জনে, পাকোড়া ফল্লিদানা বিক্রেতার আনুনাসিক শব্দে, তার সাথে মিলে মিশে আসা আরও নানাবিধ জটিল এলোমেলো ধ্বনি তরঙ্গের মধ্যে একটা কাব্যিক সুষমা খুঁজে পায়। খুঁজে পায় নিশুতি রাতের শরীরময় এক আবহ সঙ্গীতের বর্ণময় রেশ।

জীবন নামক এক বালকের জীবনে এমন রাত আগে আর আসেনি। এ যেন জীবনকে সমৃদ্ধ করা নতুন রাগে রূপে উপস্থাপিত অন্যতর এক রাত। ফলে তার সারা শরীর মনে বহে যায় অদ্ভুত এক শিহরণ। এক ভালো লাগা ঢেউ। অনাস্বাদিত রোমাঞ্চের অগুনতি সেই ঢেউ দোলায় দুলে যায় প্রাণের ছোট তরণীখানি।

বেলা আট কি সাড়ে আটটার সময় ট্রেন পৌঁছে গেল ফরাক্কা স্টেশনে। এ স্টেশন হাওড়া শিয়ালদহের মত রেলিং গেট শেড দিয়ে অত ঘেরা ঘোরা নয়। চারদিকে অত পথঘাট যান বাহন বড় ছোট গাড়ির মিছিলও নেই। নেই উঁচু উঁচু বাড়ি গিজগিজে লোকের ভিড়। এখান থেকে এক দেড় মাইল দুরে ফেরীঘাট। ট্রেন থেকে নামা সব যাত্রীর পা সেই দিকে সচল। সবার পিছু পিছু রাজা আর জীবনও হাটা দেয় সেই পথ বেয়ে।

ফেরীঘাটে এসে দেখতে পায় সেখানে দাঁড়িয়ে আছে জলে গা ভাসিয়ে দু-তিনখানা স্টীমার। যারা অকারণে অথবা যাত্রী ডাকার জন্য মাঝে মাঝে ভেঁপু বাজাচ্ছে। আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় বেশ কিছু পণ্যবাহী নৌকা। যাতে মাল ওঠা নামা চলছে। রয়েছে কতগুলো মাছ ধরা ছোট নৌকাও। মালকোচা মারা খালি গায়ের কালো কালো কিছু মৎস্যজীবী ঝুড়ি ভরে ভরে নামাচ্ছে নানা জাতের নদীর মাছ। এই ফেরী ঘাট ঘিরে অসংখ্য হোটেল রেস্টুরেন্ট। সবই দরমা টিনের। সেগুলোয় এখন উপছে পড়া ভিড়।

যে স্টীমারটা প্রথম ছেড়ে যাবে তাতে যাত্রী বোঝাই করা হচ্ছে। কাঠের একটা পাটাতন বেয়ে মালপত্র নিয়ে ধীরে ধীরে তাতে চড়ছে মানুষ। পাটাতনের শেষ মাথায় স্টীমারের দরজায় রোগা কালো লুঙ্গি পড়া দুতিন জন চেকার যাত্রীদের টিকিট চেক করে তবেই ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। রাজা জীবনের টিকিট নেই। তাদের পক্ষে এই স্টীমারে চড়া অসম্ভব। সে কথা বুঝে রাজার দিকে তাকিয়ে বলে জীবন, কী হবে রাজা। আমরা ও পারে যামু কেমনে?

জীবনের কাতরতাকে কোন আমল দেয় না রাজা। দৃপ্ত গলায় বলে, আমরা ওপারে যাবো আর স্টীমারেই যাবো। একটু ধৈর্য্য ধরে দেখ।

স্টীমার তো ছাড়ে ছাড়ে।

ছাড়ুক না। এটাই কী শেষ নাকি! এরপর আরো কত আছে, আধ ঘণ্টা পরপর। একটা না একটায় চান্স পাবো।

আর একবার স্টীমার ভোঁ বাজালো। এটাই শেষ ভো। এর আগে দুবার বাজানো হয়ে গেছে। যারা যাবার সব উঠে পড়েছে। এবার লুঙ্গি পড়া চেকার ক’জন মুখের বিড়ি জলে ছুঁড়ে ফেলে প্রস্তুত হল পাটাতন সরিয়ে দেবার জন্য। ঠিক সেই সময় এক মহিলা মাথায় একটা বড় মোট আর এক দঙ্গল ছেলে পুলে নিয়ে ছুটে এল স্টীমারের দিকে। এখানকার অধিকাংশ দোকানদার স্টীমার লঞ্চের কর্মচারী সম্ভবতঃ সবাই ভালোমত তাকে চেনে। কারণ তাকে দেখেই হেসে নানা দোকান থেকে নানা মন্তব্য ছুটে আসতে লাগল। মহিলা তাদের অকথ্য ভাষায় গাল দিতে দিতে গাদা গুচ্ছের বাচ্চা নিয়ে পাটাতন বেয়ে স্টীমারে উঠার মুখে বোধ হয় কোন নতুন কর্মচারী তার কাছে টিকিট দেখতে চেয়ে থাকবে। সাথে সাথে সে জুড়ে দিল চিল চিৎকার কান্না ঝগড়া গালাগালি–টিকিট! কেন–ঘরে তোর মা নেই, বোন নেই! তার টিকিট দেখতে পারিস না। টিকিট দেখবি তো চল আমার সাথে, চল তোকে দেখাবো টিকিট! মহিলার কথ্য ভাষার সাথে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি দেখে সে গোবেচারা চেকার ভয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ায় আর মহিলা সদলবলে প্রবিষ্ট হল জলযানের অন্দর মহলে। প্রায় সাথে সাথে পিছন পিছন দৌড়ে যায় রাজা, বিড়ি ফোঁকা বোকা বোকা চেকারের সামনে দুটো হাত জোড় করে তুলে ধরে বলে বাবু, রাগ করবেন না বাবু। মা-টার আমার মাথার ঠিক নেই তো। একে বাবু শব্দ, তার উপর জোড় হাত–এই দুই ধাক্কায় চেকার কাত। তারা ধাতস্ত হবার আগেই জীবনের হাত টেনে ধরে স্টীমারের গিজ গিজ ভিড়ের মধ্যে রাজা উধাও।

বলে রাজা–যা বাবা চড়া তো হলো। এবার যা পারে হোক। রাজার স্বস্তিতে জীবন স্বস্তি পায় না। বলে–এখন যদি ওরা এসে আমাদের ধরে?

ধরলে ধরবে। বলে রাজা–ধরে আর কি করবে। হয় এপারে নয় ওপারে এক পারে তো নামাবে। ধাক্কা মেরে জলে তো ফেলে দিতে পারবে না।

ওরা ওঠবার প্রায় সাথে সাথে চলতে শুরু করে দিয়েছে সেই জলযান। জলের রঙ ঘোলা লাল মাটির মতো। যার উপর খেলছে ছোট ছোট ঢেউ। কিছুক্ষণ সেটা চলার পর ডানদিকে দূরে দেখা যায় একটা ছোট গ্রামের আম, জাম, নারকেল সুপারির সবুজ বাগান। ঠিক তারই সামনে জলে মাছ ধরছে কিছু নৌকা চড়া মৎস্যজীবী মানুষ।

আধঘণ্টা চলবার পর এপার খেজুরিয়া ঘাটে এসে থামল জলযানখানা। এখানে গেটে কোন পাহারাদার নেই। নিরাপদে ওরা নামল দুজন। বালির উপর রেল লাইন পেতে নদীর একেবারে কাছাকাছি এনে বানানো হয়েছে এই স্টেশন। যে কেউ দেখে এক নিমেষে বুঝে যাবে এ স্টেশন স্থায়ী নির্মাণ নয়।নদীর জল বাড়লেই একে তুলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে পিছনে। দোকানগুলোও তাই। সবই অস্থায়ী। হোগলা দরমার ঘেরা বেড়া দিয়ে বালির উপর বানানো হয়েছে চা দোকান হোটেল। একখানা ট্রেন তখন দাঁড়িয়ে রয়েছে লাইনের উপর। বগিগুলো টেনে নেওয়া ইঞ্জিনটা যেন ঘুমাচ্ছে। দৌড় শুরু করার আগে তার যে ফোঁস ফোঁস তেজ গর্জন নরম নিশ্বাস তা এখন নেই। গাড়ি টানা আলসে গরু যেরকম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জাবর কাটে আর ঘন ঘন মূত্র ত্যাগ করে ইঞ্জিনটা তাই করছে।

বলে রাজা, গাড়ি ছাড়তে এখনো অনেক দেরি আছে বলে মনে হচ্ছে। চল দেখি কোথা থেকে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

ট্রেনের সামনে সোজা লম্বা হয়ে বসেছে বাজার। গ্রামের সাধারণ চাষীবাসী মানুষ নানারকম ক্ষেতের ফসল, যার মধ্যে পাকা আমই সব চেয়ে বেশি, তা নিয়ে এসে বিক্রি করছে বাজারে। চার কি পাঁচটায় এক কিলো হবে এমন আমের দাম একটা এক আনা। এক টাকার কিনলে ষোলটার বদলে আঠারো কেউ কেউ কুড়িটাও দিচ্ছে। রাজা এক বুড়ো মত চাষীর ঝুড়ির সামনে গিয়ে জানতে চায়–আম মিষ্টি হবে তো? নাকি টক? বুড়ো লোকটা কথার জবাব দেয় হাত দিয়ে–একটা কাটা আমের ফালি এগিয়ে ধরে। এক কামড় রাজা খেয়ে বাকিটা জীবনের দিকে এগিয়ে দেয়। দেখ তো।

এভাবে একে একে সারা বাজারের সব আমের ঝুড়ির কাটা টুকরো চাখা হয়ে যায় দুজনার। এ সেই ঝাটি ফুলের মধু চোষা, ধান ক্ষেতের কচি ধানের শীষ ছিঁড়ে দাঁতে চেপে দুধ বের করে খাওয়ার মতো ব্যাপার। খিতে এতে মিটবে না শুধু মনকে প্রবোধ দেবার কাজ চলবে।

বলে রাজা–এবার আমের ফলন খুব একটা ভালো হয় নি মনে হচ্ছে। না হলে আরো লোক আম নিয়ে আসত। আমাদের পেট ভরে যেত। যা একেবারে না হবার চেয়ে কিছু তো হল। সারা দিনে আর না পেলেও চলে যাবে কি বল!

দশটা কি সাড়ে দশটা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল সেই ট্রেন। সব কামরাই এখন কঁকা ফাঁকা। কোনটায় পাঁচ কোনটায় দশজন এইরকম যাত্রী নিয়ে বালির উপর পাতা লাইনের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ট্রেন। রাজা জীবন দুজনে সেই প্রিয় পুরাতন স্থান একটা দরজার দুপাশ দখল করে বসে পড়ে। চোখ বিছিয়ে রাখে রোদ্দুর ধোয়া মাঠ ধান ক্ষেত জলাশয় ফলফলাদির বাগান মাঠে চড়তে থাকা গরু দূরের ছুটন্ত গ্রাম, গ্রামের মানুষের উপরে।

এইসব কি নতুন কিছু! আগে কখনো দেখেনি! দেখেছে খুব দেখেছে। কিন্তু এই রকম পরিবেশ পরিস্থিতি এই রকম মানসিক অবস্থায় একবারও আর দেখা হয়ে ওঠেনি।

ট্রেন এক এক স্টেশন করে পিছনে ফেলে আর একটু একটু করে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ে। তবে সারা দিনে কখনো তেমন ভিড় হল না যাকে চামকাটাকাটি ভিড় বলে। পুরো দিন অবিরাম চলার পর সন্ধ্যে বেলায় নির্বিঘ্নে সে ট্রেন পৌঁছে গেল নিউ জলপাইগুড়ি। আজ আর আসামে যাবার মতো কোন ট্রেন নেই। সে পাওয়া যাবে কাল সকালে।

এখন জীবনের খিদের চোটে মুখে ফেনা উঠে গেছে। হাত পা সব তির তির করে কাঁপছে। কথা বলতে গেলে তা বের হচ্ছে কান দিয়ে। পেটের নাড়ি ভুড়িগুলো মনে হচ্ছে কেউ দু-হাতে টেনে ছিঁড়ে নিতে চাইছে। বুকের খাঁচায় পোষা প্রাণ পাখি আর বাঁচার মধ্যে বদ্ধ থাকতে চাইছে না। যেন এক্ষুণি খাঁচা ফেলে উড়ে যাবে কোন দিকে।

খিদে রাজারও লেগেছ। তবে তা জীবনের মত কষ্টে নয়, বদলে গেল রাগে। ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে বলে সে, শালাদের কাণ্ডটা দেখলি জীবন। কোন মানে হয়। সেই কলকাতা থেকে হাজার মাইল পথ এলাম। এক শালা চেকারকে দেখতে পেলি। ডাং ডাং করে বিনা টিকিটে দুদুটো লোক যাচ্ছে যেন তাদের বাপের ট্রেন। ধরার কেউ নেই। সব বাঞ্চোৎ অকস্মা। শালারা মাইনে নেয় আর ঘরে গিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমায়। বলতো এখন আমরা কি করি।

চেকারের উপর এক বিনা টিকিটের যাত্রীর কেন এত দ্বগ স্ত্রী এখন জীবন ঠিক ঠাক বুঝে উঠতে পারে না। খিদেয় তার বোধ বুদ্ধি লুপ্ত হয়ে গেছে। তখন তাকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বোঝায় রাজা–আরে যদি চেকার থাকত আর যদি আমাদের ধরে জেলে পাঠাত কটা দিন আরামে খেয়ে দেয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা বানিয়ে আনতে পারতাম। আমার নিজের জন্য বলছি না। তোর কথা ভেবেই বলছি। মুখ টুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। খিয়ে পেয়েছে না?

এ্যাঃ। কি কইলা?

ঠিক পেয়েছে। নিশ্চয় কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। সেই জন্য কথা শুনতে পাচ্ছিস না। চল দেখি তোর জন্য কোথা থেকে কিছু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।

তখন সন্ধ্যা বেশ ঘন হয়ে এসে গেছে। যদিও চারদিকে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে লাইট পোস্টে লাগানো বৈদ্যুতিক আলোগুলো তবু সে আলোয় তত জোর নেই যা গা ছমছম করা অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেয়। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে দূর পর্বত চূড়ায় অবস্থিত শৈল শহর দার্জিলিংকে। সেখানকার পথ ঘাট ঘর বাড়ি দোকান বাজারে সদ্য জ্বলে ওঠা আলোগুলোকে দেখাচ্ছে আকাশ থেকে খসে পড়া চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়া একরাশ তারার মতো। মনে হচ্ছে কোন ঘন সবুজ বনের বৃক্ষ। বৃক্ষের ডালে ডালে আটকা পড়া তারারা জ্বল জ্বল করে জ্বলছে নিভছে আর জ্বলছে।

রেল স্টেশন থেকে বাইরে বের হয়ে ওরা সেই দিকে মুখ করে হাটে।

এখানে একটু শীত শীত ভাব আছে এ সময়ের আবহাওয়ায়। পথে কোন লোকজন নেই। একদম ফাঁকা। যারা ট্রেন থেকে নেমেছিল তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কুড়ি পঁচিশজন হবে হয়ত। এতক্ষণে তারা চলে গেছে যে যার গন্তব্যে। কলকাতার আলো লোকজন গাড়ি ঘোড়া দেখা চোখে এখানকার নির্জনতা, পাহাড়, জঙ্গল, পুরো পরিবেশটাই এখন বড় ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে। সেই ভয় থেকেই জীবন বাঁহাত দিয়ে রাজার ডানহাত চেপে ধরে। বিদেশ বিভুয়ে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে বন্ধু হয়ে ওঠা একটা হাতের স্পর্শ মানুষকে যে কতখানি নিরাপত্তা কতখানি সাহস জোগাতে পারে তা জীবন জীবন থেকে অনুভব করে।

প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট হাটবার সামনে পড়ল একটা তেমাথার মোড়। সেখানে একটা বটগাছ। গাছের গোড়াটা গোল করে বাঁধানো। ডানদিকের রাস্তায় পর পর কয়েকটা দোকান। প্রথমটা মিষ্টির পরেরটা হোটেল। একটার মালিক বাঙালী। অন্যটার নেপালি।

বলে রাজা–চল তো দোকানগুলোর দিকে।

পয়সা নাই খাবার দোকানে কি কাম।

চারদিক দেখে নিয়ে বলে রাজা–দুটো পথ আছে, যা মন চায় পেট ভরে খেয়ে দেয়ে দৌড় মেরে পালানো। পারবি?

ধরা পড়লে খুব মারবে।

খুব মারবে না। দু-চারটে চড় ঘুষি মারতে পারে।

আমি মাইর খাইতে পারি না, ব্যথা লাগে।

তাহলে আর একটা উপায় আছে। গিয়ে বলা আমরা কাজ করব। যদি কাজ দেয় খেতেও দেবে। করবি কাজ? দু-চারদিন কাজ করে খেয়ে দেয়ে জিড়িয়ে যেতর আসামের দিকে রওনা দেবো।

এইটা ঠিক হইবে।

রাজা মিষ্টির দোকানের সামনে গিয়ে সহজ সপ্রতিভ গলায় দোকান মালিককে বলে, দেখুন, আমরা দুজন কলকাতায় থাকি। আপনাদের এখানটা ঘুরে দেখতে এসেছি। কটা দিন এখানে থাকার ইচ্ছা। আপনার দোকানে কোন কাজ টাজ পাওয়া যাবে? একটু বিড়ির নেশা আছে আমার। দু’একটা দিলে ভালো না দিলেও কোন কথা নেই। বাঙালী দোকান মালিক তার পাশের নেপালি মালিককে ডেকে আনে। দু’জনে প্রাণভরে খানিকক্ষণ হেসে সোৎসাহে বলে–নিশ্চয় কাজ পাবে। কাজের লোকের জন্য আমরা কবে থেকে পথ চেয়ে বসে আছি। কাজের লোকের অভাবে কত কাজ পড়ে আছে। এসো এসো তোমরা। যতদিন মন চায় থাকো, খাও দাও, দেশ দেখো।

রাজা নেপালির হোটেলে আর জীবন বাঙালীর মিষ্টির দোকানে তৎক্ষণাৎ বহাল হয়ে গেল। দুই দোকানের গোপন গুদাম থেকে এবার বের হল বিশাল বিশাল কড়াই গামলা বাথটব হাতা খুন্তি আরও কত কী। তারা সেই ছোট খাটো পাহাড় দেখিয়ে বলল–আজকে তোমরা ক্লান্ত, অনেক দূর থেকে এসেছো বলে এর বেশি আর কিছু দিলাম না। ভালো করে এগুলো মেজে ধুয়ে চকচকে করে ফ্যালো তো দেখি। মালিক দুজন মুখ নয়। তারা বুঝে গেছে এরা আজ আছে কালকে কোথায় তা কে জানে। প্রথম দিন আজ যখন তারা একবার এদের খাপে পেয়ে গেছে যতটা পারে খাঁটিয়ে নেবে সেটায় তার আশ্চর্য কি!

দুই দোকানের মাঝে একটা বাঁশের বেড়া। এপারের কলতলায় জীবন ওপারের কলতলায় রাজা। দুজনার সামনে বাসনের পাহাড়। যা মনে হয় বহু বছর ধরে মাজা ধোয়া হয়নি। ছাই দেওয়া হয়েছে সোড়া দেওয়া হয়েছে আর বলে দেওয়া হয়েছে—কাজ শেষ হবার পরই খেতে দেওয়া হবে গরম গরম ভাত। ভাতের লোভে দুই ক্ষুধার্ত বালকের শুরু হল বাসনের সাথে দুই তিন ঘণ্টার কঠিন কুস্তি। শেষে গামলা কড়াই মেজে ধুয়ে নিয়ে চলে যাবার আগে জীবনকে বলে যায় রাজা সকালেই কিন্তু পালাবো। সাতটার সময় আসাম যাবার ট্রেন, মনে থাকে যেন। না পালালে শালারা আমাদের খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে মেরে ফেলবে।

যেমন কথা তেমন কাজ। সকাল বেলা রাজা চলে গেল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। সে যে যাবে তা জানা ছিল জীবনের। যাবার কথা ছিল তারও। কিন্তু কথা থাকলেই কি সব কাজ সময় মত করে ওঠা যায়? রাতের খাওয়া দাওয়ার পর রাজাকে শুতে দেওয়া হয়েছিল বাইরে হোটেলের বারান্দায়। যেখান থেকে সটকে পড়া সহজ। আর জীবন ছিলো কাঠের দোতলার তালাবদ্ধ এক ঘরে। যার তালা বাইরে থেকে না খুলে দিলে বের হওয়া অসম্ভব। তাছাড়া বিগত চব্বিশ ঘন্টার পথ ক্লেশ তাকে সঠিক সময়ে জেগেও উঠতে দেয়নি। যখন তার ঘুম ভাঙল বাইরে তখন নেপালি ভাষায় চিৎকার গালি গালাজ–চোর শালে, চোরিসে ভাগ গিয়া।

চোরিসে ভাগ গিয়া, আর চোরি করকে ভাগ গিয়া দুটো কথার মধ্যে ব্যবধান আকাশ পাতালের। কিন্তু সে ব্যবধান স্থান কাল পাত্র অনুসারে বিবেচিত হয়। এক দুর্বল দরিদ্র দূর দেশের বাচ্চার জন্য কে কবে এত বিচার বিবেচনার ধারে কাছে গেছে। জীবনকে চুলের মুঠি ধরে দোকানের বাইরে বের করে আনলো একজন। ঠাস করে চড় হাঁকাল গালে। যাঃ শালা চোর। ভাগ।

এই বিদেশ বিভুয়ে বান্ধবহীন জীবন এখন কোথায় যাবে। চড়ের ব্যথায় নয়, কেঁদে ফেলল নিজের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে। সে যেন এখন হাত পা বাঁধা কুয়োয় পড়া মানুষ। যার আর রক্ষা নেই। নিশ্চিত মৃত্যু এসে যেন শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে পড়েছে। চিলের মত ছোঁ মেরে এখনই তুলে নেবে ধারালো নখে।  

দোকানের সামনে থেকে সরে এসে তেমাথার মোড়ে বাঁধানো বটের গোড়ায় বসে পড়ল জীবন। সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে চারদিকে তাকাল। তেমন কাউকে চোখ পড়ল না যার সামনে গিয়ে অঞ্জলি পেতে দাঁড়িয়ে বলা যায় আমি বড় বিপদগ্রস্থ। আমাকে বাঁচান।

কত সময় সেই নির্বান্ধব গাছতলায় একা একা বসেছিল জীবন তা সে নিজেও জানে না। কখন চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে তা টেরও পায়নি। তখন জীবন মন শক্ত লক্ষ্যস্থির করে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে হাঁটা দেয় সামনে। কয়েক পা হাঁটবার পর মনে হয়, হ্যাঁ পারব। কারও কোন সহায়তা ছাড়াই সে একা হেঁটে যেতে পারবে।

.

পথ কোন আঁকা বাঁকা নেই, একেবারে ধনুকের ছিলার মত সোজা। সেই সোজা পথ ধরে হেঁটে জীবন পৌঁছে গেল রেল স্টেশনে। কাল যে স্টেশন থেকে রাজার হাত ধরে হেঁটে গিয়েছিল। এখন স্টেশন কালকের মত অত ফাঁকা নেই। কিছু লোকজন আছে। সেই কিছু লোকজনের মধ্যে একা একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়ে জীবন।

সকাল সাতটার যে ট্রেন তা সকাল সাতটাতেই ছেড়ে গেছে। সেই ট্রেন ধরে চলে গেছে রাজা। এরপর আসাম ট্রেন আবার আছে বেলা বারোটায়। ফের বিকেল চারটেয়। সময় এখন দশটার বেশি নয়। দু’ঘণ্টা কি করে কাটায় জীবন। কিছুক্ষণ বসার পর সে স্টেশন দেখতে বের হল। এক নাম্বার প্লাটফর্ম ঘুরে গিয়ে উঠল দু’নাম্বার প্লাটফর্মে। কিন্তু তার চোখ প্লাটফর্মের সেই চেনা চিহ্ন কিছুতেই খুঁজে পেল না। এখানে সেই উনুন নেই যা ঘিরে বসে থাকে ভিখারি মায়ের হাড় গিলগিলে সন্তানরা। রেলিংয়ের গায়ে ছেঁড়া ময়লা কথা শুকোতে দেওয়া নেই। কেউ মাতলামো করছে না। তাসের জুয়া খেলছে না রেলের কুলিরা দল বেঁধে। ঝগড়া মারামারি করছে না কেউ। বড় শান্ত বড়ই নিরুপদ্রব পরিবেশ এখানে।

এই সব দেখে অথবা কিছুই না দেখে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিল জীবন। এক সময় ঘড়িতে বারোটা বাজলো। কারশেড থেকে এবার একখানা ট্রেন এসে ঢুকল প্লাটফর্মে। যারা যাবার ছিলো সব ধীরে সুস্থে উঠে পড়ল কামরায়। জীবনকেও যেতে হবে। সে বা বসে থাকে কেন? ট্রেনে উঠে দরজার কাছে সেই পুরাতন ভঙ্গিতে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল সে।

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে এক সময় ট্রেন এসে পৌঁছাল শিলিগুড়ি স্টেশন। ট্রেনে ওঠার জন্য এখানে বড় বড় বেডিং ট্র্যাঙ্ক স্যুটকেশ নিয়ে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার যাত্রী। ট্রেন থামা মাত্র হুড়মুড় করে তারা সব উঠে পড়তে লাগল কামরায়। চিৎকার চেঁচামেচি হৈ হট্টগোলে সমস্ত স্টেশন এক মুহূর্তে যেন রণভূমি হয়ে গেল। কে কার পা মাড়িয়ে কে কার বুকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে কে কাকে ঠেলে ফেলে আগে গিয়ে পছন্দের সিট দখল করবে তারই প্রতিযোগিতা শুরু হল। সে সব থামলে যাকে গত কয়েকদিন তপস্যা করেও দর্শন মেলেনি সেই অপ্রত্যাশিত অবয়ব আচমকা সামনে এসে দাঁড়াল। তিনি কালো কোর্ট পড়া বিশালদেহী এক চেকার। টিকিট! মাথা এবং হাত দুটো এক সাথে নেড়ে জানাল জীবন–নেই। চেকারের আর কিছু শোনবার দরকার ছিল না। বাজপাখি যেমন ছোঁ মেরে ইঁদুর ছানা তুলে নেয় সে তার বিশাল থাবায় ঠিক সেই ভাবে ধরে ফেলল জীবনকে। তারপর যেমনভাবে ঘোড়ায় বেঁধে যুদ্ধবন্দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় সেইভাবে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল স্টেশন থেকে বাইরে যাবার গেটের কাছে। শেষে সজোর এক ধাক্কা যাঃ–!

জীবনের পরিধানে একটা হাফ প্যান্ট গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি জড়ানো গামছা আর খালি পা দেখে চেকার বুঝে গেছে এরকম লোকের ফাইন দেবার ক্ষমতা, ঘুষ দেবার যোগ্যতা থাকে না। বিনা টিকিটে চড়া এমন কোন গর্হিত কাজ নয়। গর্হিত ওই দুটোর কোন একটা না থাকা। তেমন লোক ধাক্কা খাবারই যোগ্য। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পদে পদে এরা ধাক্কাই খায়। সেটাই দিয়েছে সে।

গেটের এপারে টিকিট কাউন্টার। তার পাশে একটা ফাঁকা কাঠের বেঞ্চি। সেটায় বসে ফের ভালো করে স্টেশন আর আসামগামী ট্রেনটার দিকে তাকায় জীবন। ট্রেন ঘিরে স্টেশনের চারদিকে থিকথিক করছে কালো কোর্ট আর খাকি জামা। এত পুলিশ এত চেকার হাওড়া শিয়ালদায়ও দেখা যায় নি। এত চোখ ফাঁকি দিয়ে কী করে ট্রেনে চড়া যায় সে জীবন জানে না। যে জানত সে রাজা আর নেই।

কী করা যায় এখন। ট্রেনে চড়া যাবে না, তাহলে কী একা এই পরদেশে ভয়ে ভাবনায় ক্ষুধা তৃষ্ণায় মরে পড়ে থাকবে। মরতেই যদি হয় তবে এতদূর দেশে আসতে গেল কেন! কলকাতায় কি মৃত্যুর কোন অভাব ছিল। এসেছে বাঁচতে। সে এখনও বেঁচে থাকতে চায়। সবাইকে বাঁচাবার জন্যই তার বাঁচাটা দরকারী। সবাইকে বাঁচাতে হলে আসাম যাওয়াও দরকার। যার পথে পথে পড়ে থাকে টাকা। যে টাকায় কেনা যায় বেঁচে থাকার উপকরণ।

আসাম যেতে হবে। না গিয়ে কোনও উপায় নেই। ঝিমুনি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় জীবন। টিকিট কাউন্টারের সামনে একটা বড় স্টল। শো কেসে সাজানো নানা রকম খাবার। উনুনে ভাজা হচ্ছে কচুরি সিঙ্গারা আরও কত কী! বানানো হচ্ছে দুধের ঘন চা। দোকানের সামনে গিয়ে রাজার মত গলায় বলে সে, আপনেগো দোকানে কামে লোক লাগবে নাকি? আমি কাজের তালাশে কইলকাতা থিকা আইছি।

দোকানের মালিকের মাথায় লম্বা চুল দাড়িগোঁফ সব কামানো একেবারে সখি সখি চেহারা। গলায় বৈষ্ণব পদাবলীর মধুর সুর এনে বলে সে–দেশ কোথায় ছিল?

আইজ্ঞা পূর্ব পাকিস্থানের বরিশাল জেলায়।

আমরা ঢাকা জেলার লোক। বলে না বিদ্যা বুদ্ধি টাকা সব হচ্ছে ঢাকা। সেই ঢাকার। কি নাম তোর?

জীবন। আইজ্ঞা জীবন কৃষ্ণ দত্ত।

বড় ভালো নাম, কায়স্থ। হ্যাঁ, লোক তো আমার লাগবে।

মাইনা কত দিবেন।

মাইনে! হাসেন তিনি, আগে কাজে তো লাগ। এক দুমাস কাজ কর। সব কাজ শেখ তবে তো মাইনের কথা। কেমন কাজ করিস না করিস কিছু দেখলাম না, শুনলাম না–আগেই মাইনের কথা কি করে বলবো! এক দেশের লোক তুই, এক জাতের। আমরা সাহা। তোকে কি আর আমি ঠকাবো?

না, তবু আপনে কিছু এক্ট কন। আমার খুউব টাকার দরকার। আমি গেলাস ধুইতে, চা বানাইতে পারি।

ঠিক আছে। বলছিস যখন, প্রথম মাসের পর থেকে মাসে চল্লিশ করে নিস।

মাত্র ষাট দিন পরে পাওয়া যাবে চল্লিশ টাকা। মাত্র ষাটটা দিন। তারপরই জোগাড় হয়ে যাবে ট্রেন ভাড়া। এই কটা দিন পরে জীবন পেয়ে যাবে সেই জাদু নগরীর গেট পাশ। যেখানে পৌঁছাতে পারা মাত্র জীবনের নাগালে এসে যাবে কাঙ্খিত সুখ।

জীবন যখন তাড়া খাওয়া কুকুরের মত এখানে সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল ঠিক সেই সময় তারা অজান্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা পালাবদল ঘটে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে যে দল পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় অটল বসেছিল তারা টলে গেল। তাদের দলের এক প্রভাবশালী নেতা অজয় মুখার্জী তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ডিগবাজী খাওয়ায় কংগ্রেস দল শাসন ক্ষমতা হারাল। পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় বসল চৌদ্দ দলের জোট যুক্তফ্রন্ট। অজয় মুখার্জী হল সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আর উপমুখ্যমন্ত্রী হল সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু। পুলিশ বিভাগ রইল তাঁরই হাতে। এর ফলে গ্রাম বাংলার শ্রমিক কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার হল। শ্রমিকরা ভাবল শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির নেতার হাতে যখন পুলিশ বিভাগ তখন সেই পুলিশ দিয়ে মালিক শ্রেণি আর শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার আন্দোলন দমন করতে পারবে না। আর কৃষক, যারা এতকাল শুনে এসেছে লাঙল যার জমির প্রকৃত মালিকই সেই। মাটিতে যাদের ঠেকেনা চরণ মাটির মালিক তাহারাই হন–সেই পুরানো অন্যায় আইন এবার বদলে যাবে। এই আশায় টগবগ করে ফুটতে লাগল।

সেটা উনিশশো সাতষট্টি সাল। হেমন্তকাল গিয়ে শীতকাল এল বীর বিক্রমে। বস্ত্রহীন মানুষের হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের শীষে সোনার রঙ ধরল। সে এক সময় বিল্টুদায় নিল। এসে গেল বসন্তকাল। বসন্তকালকে বলা হয় প্রেমের ঋতু। কিন্তু এবার সমগ্র উত্তরবঙ্গের জন্য তা নিয়েএল এক বিদ্রোহী বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ।

স্টেশনের এক চা দোকান, যেখানে নানা জায়গার লোক আসে তাদের মুখের টুকরো টুকরো কথায় জীবনও বুঝে যায় এই বসন্ত এই শহরের সুখী শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে কোন শুভবার্তা নিয়ে আসেনি। সর্বত্র কি যেন এক গুঞ্জন ত্রস্তভাব। সব যেন ভয়ের জ্বরে কাঁপছে। কয়েকদিন পরে দেখতে পেল জীবন, স্টেশন বাজার শহর সারা শিলিগুড়ি যেন খাকি রঙে ঢেকে গেল। জেলা পুলিশের সদর দপ্তর এখানেই। ট্রাক ভ্যান জীপ ভরে রাইফেল স্টেনগান এস, এল, আর নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ সেখানে এল, এরা সব সি.আর.পি। আবার ঝাঁকে ঝাঁকে তারা গাড়ি ছুটিয়ে চলে গেল। এদের আসা যাওয়ায় ফুটে উঠলএকটা রণংদেহী ভাব। যা দেখে মনে হল এরা যেন সেই বাষট্টি সালে চিনের হাতে জুতো খাওয়ার বদলা নিতে যাচ্ছে আজ।

ইচ্ছা করে জীবনের কোথায় সেই নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি একবার গিয়ে দেখে আসতে। সাওতাল গরিব চাষী ক্ষেতমজুর কেমন করে লড়ছে এক সাহসিক লড়াই। ওদের নেতার নাম জঙ্গল সাওতাল। তারই নেতৃত্বে শোষণ বঞ্চনা অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে কৃষক জনতা। এলড়াই মনে হয় যেন তারও লড়াই। হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছে জীবন। সে দাঙ্গার ছিটেফোঁটা রক্ত তার হাতেও লেগে আছে। যে রক্তের ঘ্রাণ এখনো তাকে বিচলিত করে দেয়। সে লড়াইকে কখনো সঠিক লড়াই, নিজের লড়াই বলে মনে হয় নি। কিন্তু এই লড়াই যেন তার নিজেরই লড়াই এমনই মনে হয়।

কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও তার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সে রয়ে যায় সেই চা দোকানের এঁঠো থালা গেলাস প্লেট কাপের ডাই করা স্তূপের পাশে। এ ভাবেই কেটে যায় আট দশ মাস। কথা ছিল সাহাবাবু প্রথম মাসের মাইনে দেবেন না। পরের মাস থেকে দেবেন। সে মাস শেষ হতেই জীবন হাত পেতে দাঁড়ায় মালিকের সামনে—বাবু মোর মোর মাইনা দ্যান।

তেল চকচকে বকনা বাছুরের মত চেহারার সখি মুখে সাহাবাবু জীবনের কথা শুনে একটু নিরীহ হাসি দিলেন–মাইনে? কেন দেব না। নিশ্চয় দেব, একশো বার দেব। তবে এখন তো নেই। সামনের মাসে নিয়ে নিস।

মাইনে না পাওয়ায় মনটা একটু খারাপ হলেও সেটা সামলে নেয় জীবন। দুমাস তো গেছে আর একটা মাস গেলে বা কি হয়েছে। তাতে বরং ভালোই হবে। কিছু বেশি টাকা হাতে থাকবে। আসাম গিয়ে দু পাঁচদিন খেয়ে দেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে একটা মনের মত কাজ খোঁজা যাবে। কিন্তু হায় হতভাগা! পরের মাসে সে যেই মাইনে চাইল বিনোদ সাহার অতি বিনীত জবাব নেই রে। পরের মাসে নিস। এভাবে পরের মাস পরের মাস করে ছয় সাত মাস কেটে গেল।

একদিন একটু ক্ষোভ রাগ গলায় এনে বলে জীবন পেত্যেক বার আপনে কন সামনের মাসে দিমু। ছয় সাত মাস হইয়া গেছে একটাও পয়সা দ্যান নাই। এইবার আমার মাইনা দ্যান। দ্যাখেন আমার গামছা গেঞ্জিও ছিইড়া গেছে। নতুন কেনা লাগবো।

বলিস কি! এর মধ্যে ছয় মাস হয়ে গেল! ঠিক গুনেছিস?

আপনে গুইন্যা দেখেন। কার্তিক মাসে কামে লাগছি, এইডা বৈশাখ।

বাব্বা একেবারে ক্যালেন্ডার। তো ঠিক আছে, ছয় মাসইতে হয়েছে, ছয় বছর তো আর হয় নি। চার ছয় চব্বিশ, দুশো চব্বিশ টাকা আছে আমার কাছে তোর পাওনা। থাক না আরো ছয় মাস। একেবারে সব হিসেব করে দিয়ে দেব। একবারে টাকাটা পেলে তোরও কাজে লাগবে।

এবার বড় কাতর হয়ে পড়ে জীবন। কান্না এসে জমা হয় তার গলায়। বলে, বাবু মোরা বড় গরিব। বাড়িতে ছোড ছোড় ভাই বইন। অরা খাইতে পায় না। মোর বাপের প্যাডে ব্যথা। অষুধ পায় না। সেই লইগ্যা কামে বাইরাইছি। মোর টাকা কয়ডা মোরে দিয়া দ্যান বাবু। বাড়িতে পাড়াইয়া দিই।

সাহাবাবু বিষম বিরক্ত–তুই তো দেখছি কাবুলিওয়ালারও বাপ। বলছি এখন নেই তবু প্যানর প্যানর করছিস। এই রকম করবি জানলে কোনদিন তোকে কাজে রাখতাম না। দেখে মায়া হয়েছিল বলে রেখেছিলাম। কথায় বলে না উপকারীকে বাঘে খায়। আমার এখন সেই দশা। বড় ভুল করে ফেলেছি। বলছি পরের মাসে দিয়ে দেব। আরে ভগবান আমাকে অনেক দিয়েছে, অনেক দেবে। তোর ওই কটা টাকা মেরে আমার কি হবে।

বলে জীবন, বাবুমুই অনেকদিন ঘর ছাড়া। মার লইগ্যা মোন কেমন কেমন করে। তারা বাঁইচা আছে না বেবাকে মইরা গেছে তা কে জানে। সামনের মাসে মোর টাকা মিটাইয়া দিবেন। মুই বাড়ি যামু।

দরাজ গলায় বলেন সাহাবাবু–নিশ্চয় দেবো। দু’দশটাকা বেশিই দেবো। যা এখন মন দিয়ে কাজ কর।

পরের মাসেও বিনোদ সাহার সেই এক গৎ–নেই রে। হাতে একদম টাকা পয়সা নেই। ঠিক আছে, এতদিন যখন গেছে আর একটা মাস যাক। সামনের মাসে ঠিক দিয়ে দেব। কথা দিলাম। পরের মাসেও টাকা দেয় না বিনোদ সাহা, কথা দেয়। পাকা কথা পরের মাসে।

ত্রিকোণ পার্কে একটা বাড়িতে কাজ করত বিহারের একটা ছেলে। সে এক রাতে বাড়ির মালিকের গলা কেটে দিয়ে সোনাদানা টাকা পয়সা সব নিয়ে পালিয়ে চলে যায়। জীবনের মনের মধ্যে এখন একটা সেই ইচ্ছা দাপাদাপি করে। কিন্তু কিছুই পারে না সে, গোপনে চোখের জল ফেলা ছাড়া। সে কান্নায় একটা গাছের পাতা খসে পড়ে না। কে যেন কবে বলেছিল–মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। বিশ্বাস করতে করতে দশ মাস কেটে গেল। শেষে আর বিশ্বাস রইল না মানুষের ওপর। এবার জীবনের নিজের উপর, দেশ সমাজ মানুষের উপর রাগ হতে থাকে। একদিন বিনোদ সাহাকে বলে সে–আপনি আমারে খালি দিনই দিবেন। টাকা আর দিবেন না। আমি আপনেরে বুইঝা ফালাইছি। আমি আর কাম করমু না।

মিষ্টি করে হেসে, একটুও না রেগে বলেন তিনি কাজ করা না করা সবটা তোর ইচ্ছা। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক তার উপর তো জোর খাটানো চলবে না। পারি, ইচ্ছা করলে তোকে যতক্ষণ আর একজন লোক না পাই আটকে রাখতে পারি। সে আমি করব না। তবে আমার ওই এক কথা–সামনের মাসে।

সামনের মাসে আমি কইলকাতা থিকা টাকা নিতে কেমনে আমু?

আসতে হবে না। ঠিকানা রেখে দিয়ে যা, মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দেব। জীবনে কারও এক পয়সা মারি নাই, তোরও মারবো না।

জীবন আর কোন কথা বলতে পারে না। কেন কে জানে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে নামে। চোখের জল, যা এ সময়ের সব চেয়ে সস্তা সব চেয়ে ফালতু একটা জিনিস। নীরব ঝাঁপশা চোখে সে সামনে আগায়। নির্বান্ধব এক ছোট শহর শিলিগুড়ির পথে পথে খালি পায়ে ঘুরে খালি পেটে ঘুমিয়ে এক নিঃস্ব কিশোরের কেটে গেল কয়েকটা দিন কয়েকটা রাত। প্রথমে সে ভেবেছিল কলকাতার দিকে ফিরে যাবে। শিলিগুড়ি থেকে ট্রেনে যদিনা চাপা যায় রেল লাইন ধরে হেঁটে এক স্টেশন পেছনে পিছিয়ে আসবে, কিন্তু তখনই তার চোখে পড়েছিল নিজের দুটো নিঃস্ব হাত। অনবরত কাপ প্লেট ধোবার ফলে জলে ভিজে হাজা মজা পচা সে হাতে মা বাবা ভাই বোনকে দেবার মতো কোন সঞ্চয় ছিল না। ছিল নিঃসীম শূন্যতার বিপ। সে হাত যেন বলে উঠেছিল হেরো হেরো। তুই এক হেরে যাওয়া ব্যর্থ মানুষ। তোর মা বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর মত মুখ আর নেই। তখনই জীবনের ছোট্ট বুকটায় তোলপাড় হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে জনমদুঃখী জননীর আশাহত ছলো ছলো মুখটা। সে যেন বলছে, জীবন রে কি আনলি তোর না খাওয়া ছোট ছোট ভাই বোনদের জন্য? এতদিনে একসের চালও জোগাড় করতে পারলি না!

তখনই এক অসহায় জীবন কাঁদে। মাকে তার বলতে ইচ্ছা করে, মা-মাগো, আমাদের বড় অভিশাপময় জীবন। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে আমাদের জন্য কোথাও আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আমাদের জন্মের বহু আগেই জগতের যত কিছু সম্পদ, যা কিছু ভালো যা কিছু বেঁচে থাকার জন্য জরুরি, সব–সব দখল হয়ে গেছে। যারা তা দখল করে বসে আছে তা থেকে তিলপরিমাণও আর আমাদের জন্য ছেড়ে দিতে রাজি নয়। এরা বুক থেকে উঠে আসা গরম নিশ্বাস চোখ থেকে ঝরে পড়া নোনা জলের মূল্য দেয় না। শরীর থেকে বেয়ে পড়া ঘামকে কত কম দামে কিনতে পারে তারই কৌশল করে। দয়া ধর্ম ন্যায় এসব এদের কাছে অর্থহীন মূল্যহীন অবজ্ঞার বিষয়। কত পথ পার হলাম, কোথায় না কোথায় ঘুরলাম, কত মানুষ দেখে এলাম–সর্বত্র, সবার কাছে আমরা সমান উপেক্ষিত। এক উদ্বৃত্ত জীব মাত্র। যার দাম এই সমাজে কুকুর ছাগলের চেয়েও কম।

একদিন জীবনের আবার মনে পড়ে গেল আসামের কথা। মনে পড়ে গেল রাজার কথা। রাজা আসামের অনেক গল্প করেছিল। একবারও তার মুখ থেকে আসামের কোন নিন্দা বের হয় নি। যা বলেছে তার সবটা প্রশংসা। তাহলে এটা তো প্রমাণিত যে আসাম অন্য সব জায়গা থেকে আলাদা। সেখানকার মানুষ এখানকার মত অমানুষ দয়া মায়া শূন্য নয়।

তখনই জীবনের মাথায় আসে, এক স্টেশন পিছিয়ে গিয়ে যদি কলকাতামুখি ট্রেনে চাপা যায় তাহলে এক স্টেশন এগিয়ে গিয়ে আসাম ট্রেনে ওঠাও তো কঠিন নয়। এখন মনে হল তার, ছিঃ ছিঃ এই সহজ কথাটা এত দিন কেন মনে আসে নি। যতদিন শিলিগুড়ির পথে পথে ঘুরছি। ঘুরে ঘুরে মরছি, রেল লাইন ধরে হাঁটতে থাকলে হয়ত আসামেই পৌঁছে যেতাম। সে আর কাল বিলম্ব করে না। হাটা দেয় রেল লাইন ধরে।

সময় এখন সকাল সাত কি সাড়ে সাতটা। যত দূরই হোক বেলা বারোটা নাগাদ কি সামনের স্টেশনে পৌঁছে যেতে পারবে না। নিশ্চয়ই পারবে। এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশন কত দুরে দুরে হয় সে তো তার জানা। তবে আর চিন্তা কীসের! শহর পার হয়ে আসবার পর সামনে পড়ল একটা কুয়ো। কিছু মহিলা সেখানে বালতি কলসিতে জল ভরছে। এক জনের কাছ থেকে চেয়ে অঞ্জলি ভরে খানিকটা জল খেয়ে নেয়। পথে আর কোন পানীয় জল পাওয়া যাবে কিনা তা কে জানে। খালি পেটে জল পড়ায়, পেটটা কন কন করে ওঠে। হাটার সময় খল খল করে। কিন্তু এত তুচ্ছ ব্যাপারে এখন জীবনের নজর দেবার সময় নেই। সে হাঁটতে থাকে।

দু’তিন কিলোমিটার চলার পর দেখে রেল লাইন দুদিকে বেঁকে গেছে। একটা বা দিকে অন্যটা ডানে। বা দিকে লাইনটা সরু। ওই লাইনে যে ট্রেন চলে তা ট্রামের চেয়ে সামান্য বড়। এর নাম ন্যারোগেজ। এ ট্রেন যায় দার্জিলিং। জীবন ডান দিকের বড় রেললাইন ধরে। এটাই আসাম যাবার পথ।

আরো কিছুক্ষণ হাঁটবার পর ঘর বাড়ি দোর দালান গাড়ি ঘোড়া লোক জন সব চিহ্ন মুছে যায়। শুরু হয় ঘন গভীর বন। রেল লাইনের পাশেই একবুক উঁচু জংলা আগাছা আর পিছনে আকাশ ছোঁয়া উঁচু উঁচু বৃক্ষ। যে বৃক্ষের ডালে ডালে দোল খাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে শাখামৃগ। প্রচুর নানাবর্ণের পাখিও দেখা যাচ্ছে। সব কিচির মিচির করছে। ডালে ডালে দোল খাওয়া বানরগুলো বিস্ময় মাখা চোখে জীবনকে দেখছে আর মুখ দিয়ে বিচিত্র সব শব্দ করছে। বাঁকুড়ার জঙ্গল দেখেছে জীবন। একা একা সে জঙ্গলে অনেক ঘুরেছে। কিন্তু সে জঙ্গলের সাথে এ জঙ্গলের কোন মিল নেই। তাই কেমন যেন একটু ভয় ভয় করে জীবনের। প্রতিটা জঙ্গলের একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। সেই গন্ধের মধ্যে গোপন থাকে তার চরিত্র। সে জানে যারা অভিজ্ঞ। জীবন এ জঙ্গলের স্বভাব চরিত্র জানে না। তাই একা এই পথে হেঁটে যেতে পারছে। জানলে কোনদিন পারত না। এ জঙ্গলে বাঘ আছে, তার চেয়ে মারাত্মক পাহাড়ি চিতা। আকারে কিছু ছোট অসম্ভব ক্ষিপ্র এই জীবেরা ক’দিন আগে এখানেই একটা গরু মেরেছে।

দু’আড়াই ঘণ্টা হাটবার পর অবশেষে জীবন পৌঁছে গেল সেই কাঙ্খিত স্টেশনে। কিন্তু এ কী! ঘন জঙ্গলের মধ্যে সে স্টেশনে একজনও লোক নেই। এমনকি যাদের না হলে ট্রেন চলে না সেই স্টেশন মাস্টার পোর্টার সিগন্যাল ম্যান কারো কোনো কোনো আত্তা পাতা নেই। স্টেশনটাকে দেখে মনে হয় বন জঙ্গলের মধ্যে বহু বছর আগে একে পরিত্যাগ করে চলে গেছে কেউ। সেই থেকে যেন অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। আর এখানে ঝক মক ধাতব শব্দ তুলে কোন ট্রেন এসে পৌঁছায় না। হৈ চৈ সোরগোল তুলে মানুষ ট্রেনে ওঠা নামা করে না। তাই স্টেশনের ঘুম ভাঙে না চেতনা ফেরে না। স্টেশন স্থাপনের প্রয়োজনে যেটুকু জঙ্গল সাফ করা হয়েছে তার ওপাশে গাছ পালা ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে কোনও গ্রাম নগর লোকালয় আছে কিনা কিছু বোঝা যায় না। তবে যেটুকু চোখে পড়ছে বৈশাখের প্রখর রোদে জ্বলা সেই সীমার মধ্যে কোন জীবিত প্রাণী আছে তেমন বিশ্বাস হয় না।

মনে মনে বুঝে যায় জীবন এ স্টেশনে অন্য ট্রেন যদি বা থামে মেল ট্রেন কিছুতে থামবে না। মেল ট্রেন থামার জন্য যত বড় স্টেশন চাই, এটা তা নয়। গৌহাটি মেল আসবে বারোটায়। হাতে এখনো তিনঘণ্টা সময়। ইচ্ছা করলে এই সময়ের মধ্যে সামনের স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া কঠিন হবে না। আর তা করতেই হবে আসাম যেতে হলে। সে আবার সামনে হাটা দেয়। এবার জঙ্গল আরো ঘন আরো গভীর। আরো ভীতিকারক। গত কয়েক দিনের উপোস আর গত কয়েক ঘন্টার অনবরত হাটায় কিছুটা ঘায়েল তবু মনের জোরে এগিয়ে চলে। কে যেন কবে কোন পর্বতের গুহায় বসে বহু সাধনার জ্ঞান ব্যক্ত করেছিলেন–চরৈবেতি চরৈবেতি চরৈবেতি। এগিয়ে চলো এগিয়ে চলো। বিশ্ব চরাচর জল স্থল অন্তরীক্ষে, সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে এই এক নাদ ধ্বনি, চলো চলো–চলার নামই জীবন। যে সচল একমাত্র সেই জীবিত। যার চলা থেমে গেছে তার মৃত্যু ঘটে গেছে। জীবন এখন অন্তরাত্মার মধ্যে সেই মহান বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করে। এই জঙ্গলের মধ্যে না চলে বসে পড়লে দুচার দিন যাও বাঁচা যেত তাও যাবে না। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত অক্ষম অসমর্থ দেহ রাত নামার সাথে সাথে কোন বন্যপ্রাণী মেরে খেয়ে নেবে।

কে জানে, জীবনের চলার গতি কমে গেছে, নাকি পরবর্তী স্টেশনের দুরত্ব অনেক বেশি অথবা ঘড়ির কাটা জোরে ছুটছে বলে সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে। চুলের সিঁথির মত জঙ্গলের মধ্যের রেলপথের উপর দারুণ আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রোদ। জীবনের শরীর জ্বলছে। পায়ের পাতা পুড়ে যাচ্ছে গরমে। জল তেষ্টাও পাচ্ছে খুব। কিন্তু ঘাম নেই শরীরে।

স্টেশনে তখনো পৌঁছাতে পারে নি জীবন, তা রয়েছে এখনো বেশ কয়েক কিলোমিটার দুরে। ঠিক সেই সময় শিলিগুড়ির দিক থেকে ছুটে এল সেই বেলা বারোটার গৌহাটি মেল। শব্দ শুনে পিছন ফিরে ট্রেনকে দেখে পাশের বুক সমান ঘাস জঙ্গলের মধ্যে নেমে দাঁড়ালো সে। মাটি কাঁপয়ে জঙ্গল কাঁপিয়ে শুকনো পাতা উড়িয়ে পাখিদের ভয় ধরিয়ে যেন জীবনের বুকের উপর দিয়ে সে ট্রেন ছুটে গেল আসামের দিকে। কি আর করে জীবন, ফের রেল লাইনের উপর উঠে কিছুক্ষণ হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। কিন্তু কতক্ষণ দাঁড়াবে! দাঁড়িয়ে তো কোন সুরাহা হবে না, বোঝে সে, স্টেশনে তো পৌঁছাতেই হবে। এর কোন বিকল্পই যে নেই।

সে আবার হাঁটা দেয়। দুর্বল পায়ের উপর যে অক্ষম শরীর তার উপর ঝিম ঝিম করা বোধহীন যে ফালতু মাথা সে সব টেনে টেনে যেন সামনে আগায়। আরো দেড় দু ঘন্টা চলার পর পৌঁছায়। আর এক স্টেশনে। সে স্টেশনে পৌঁছে জীবন অবাক। মনের ভুলে যেখানে লাইন থেকে নিচে নেমেছিল সেখান থেকে উল্টো দিকে হেঁটে চলে যায় নি তো। না হলে এখানেও সেই জনশুন্য মৃত নগরীর পুনরাবৃত্তি হল কেন? সেই রোদে জ্বলা খাঃ আঃ করা স্টেশন। যেখানে মানুষ তো বহুদূর, একটা কাক কুকুরও নেই।

এবার কি করবে জীবন? করার আর কিছু নেই চলা ছাড়া। যে করে হোক এখন একটা রেল স্টেশনে পৌঁছাতেই হবে যেখানে লোক জন আছে। যেখানে মেল ট্রেন যাত্রী তোলা নামানোর জন্য থামে। যেখানে ঘর বাড়ি দোকান পাট লোক জন কিছুই নেই সেখানে অপেক্ষা করা চরম মুখামি। তাই চালাকের মতো জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সোজা এগিয়ে যাওয়া রেল লাইন ধরে ধুঁকতে ধুঁকতে হাঁটে। হাটুর মালাইচাকি কন কন করছে, বুকে দাপাচ্ছে তৃষ্ণা, পেটে জ্বলছে আগুন, শরীর জ্বলছে রোদে, সব কিছু অস্বীকার করে সে উন্মাদের মত হেঁটে চলে। জঙ্গলের বানরগুলো অবাক হয়ে ওকে দেখে নিজেদের মধ্যে যেন কি বলাবলি করে। সে ভাষা অনুবাদ করতে পারলে জীবন হয়ত মানুষ সম্বন্ধে ওদের ধারণা জেনে মরমে মরে যেত।

সে যাই হোক শরীর তখন আর চলছে না। নিজের শরীর নিজের কাছে একটা বোঝা হয়ে গেছে। সেই বোঝা টেনে পরের স্টেশন গুলমায় পৌঁছাতে পারল, তখন ওর সামনে থেকে তির বেগে বের হয়ে গেল সেই চারটের আসাম মেল। সে ট্রেনও ওই স্টেশনকে যোগ্য বলে মনে করে নি এক মিনিট থেমে যাবার উপযুক্ত ভেবে।

ট্রেন চলে যাবার পর এই প্রথম একজন লোকের সাক্ষাৎ পেল জীবন। সে দু হাতে দুটো পতাকা যার একটা লাল একটা নীল, নিয়ে প্লাটফর্মে ধরে হেঁটে এসে জীবনের সামনে দাঁড়াল। ডানদিকে রেলের অফিস, সেদিকেই যাবে সে। ওদিকে গিয়েছিল ট্রেন পাশ করাতে। পতাকা নাড়িয়ে ট্রেনকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেওয়া তার কাজ।

জীনকে দেখে তার চোখে মুখে সারা শরীরে ঘনিয়ে উঠল চরম বিস্ময়। ঘন ঘোর জঙ্গল কুঁড়ে যে আসছে সে কে!

বলে সে–এ বাচ্চা, কাহা যায়েগা?

জীবন সরল গলায় জবাব দেয়–হাম আসাম যায়েগা।

তো পয়দল কিউ?

বলে জীবন–আমার কাছে তো গাড়ি ভাড়া নেই। তাই–

পতাকাবাহী লোকটার বিস্ময় আর সীমার মধ্যে থাকে না। একি পাগল নাকি। বারো, চোদ্দ ঘন্টার ট্রেন পথ আসাম। সেই আসামে যাচ্ছে পায়ে হেঁটে। পরের স্টেশনে পৌঁছাবার আগেই পথে রাত নামবে। জঙ্গল থেকে বের হবে শিকার সন্ধানী জন্তু জানোয়ার। তাদের সামনে পড়লে আর কি বাঁচবে?

বলে সে–আভি শিলিগুড়ি নেবালা ট্রেন হ্যায়। উসমে বইঠকে বাপস চলা যা। মরে গা কেয়া? আসাম বহুত দূর হ্যায় কেইসে যায়েগা পয়দল? আর বেশি কথা না বাড়িয়ে সে নিজের কক্ষে গিয়ে ঢোকে।

না, আর চলার ক্ষমতা নেই জীবনের। আজ আর আসাম যাবার কোন ট্রেনও নেই। এ স্টেশনের এখনই যা ভয়াবহ অবস্থা রাত নামলে কেমন হবে তার অনুমান করতে পেরে জীবন ভয়ে মুষড়ে পড়ে। এখন ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

ফিরে গেলে শিলিগুড়িতে আবার চেকারে ধরতে পারে। এক আধটা ধাক্কা কি চড় চাপড় দিতে পারে। জেলেও নিয়ে যেতে পারে। সে যা হয় তোক। এই ভেবে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে এসে বসে সে।

ট্রেন এল সন্ধ্যে ঘোর করে। জীবন তখন আগপাছ না ভেবে উঠে পড়ল সেই ফিরতি ট্রেনে। সবকটা স্টেশনে থেমে থেমে সে ট্রেন পৌঁছাল শিলিগুড়ি। জীবন ট্রেন থেকে নেমে অগুনতি চেকার, পুলিশের সামনে থেকে হেঁটে ওভার ব্রিজের উপর গিয়ে ওঠে। এখন তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে জীবনের। সে বসে পড়ে ব্রিজের উপর। তারপর গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে এবং এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ তাকে বিরক্ত করে না। নিরুপদ্রবে রাতটা কেটে যায়। ব্রিজের উপর চিৎ শোয়া জীবন ঘুম ভেঙে চোখ মুছে প্রথমে আকাশ দেখতে পেল। একখানা কালো মেঘ উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কোথায় গিয়ে মাটির টানে নিজেকে ঢেলে রৌদ্র তাপে ফুটিফাটা মাটিকে নরম কোমল করে দেবে তা কে জানে। এ বছর এখনো বৃষ্টি হয় নি। তবে হবে। মেঘে মেঘে তারই বজ্রগর্ভ সঞ্চার। জল পেয়ে জমিতে জাগবেশস্যের সম্ভাবনা।শস্য জাগাবে মানুষের আশা আকাঙ্খ আর বেঁচে থাকার সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতি। মানুষ বাঁচলে বাঁচবে মানুষের সমাজ সভ্যতা আর মানুষের যা কিছু নির্মাণ শিল্প সৃজন।

কিন্তু সময়ের গতি প্রবাহ ধারা সব এখন উল্টো দিকে ছুটছে। প্রাকৃতিক নিয়মকে বদলে দিয়েছে মানুষ। মানুষ তার চতুর কৌশলে খরা বন্যা মহামারী মন্বন্তর বানাতে পারে। পারে কৃত্রিম অভাব বানিয়ে মানুষের জীবনকে কষ্টকর মরণ যন্ত্রণার আকর বানিয়ে দিতে, জীবন নামক এক কিশোরের জীবন এখন সেই পাহাড় সমান যন্ত্রণার নিচে চাপা পড়ে ছটফট করছে।

চিৎ থেকে কাত হয়ে দেখতে পায় সে স্টেশনের উপরে যে মিষ্টির দোকান তার ঘাড়ে গর্দানে মালিক একঝুড়ি গতকালের অবিক্রিত সিঙ্গারা, নিমকি, কচুরি প্ল্যাটফর্মের বাইরে একটা একটা করে ছুঁড়ছে, আর মুখে আঃ আঃ করে কাক ডাকছে। তা দেখে জীবনের পেটের খিদে গন গন করে। কষ্ট পায়, কান্না আসে। সে জানে ওরা মানুষ না খেয়ে মরে গেলেও তাকে খাবারগুলো দেবে না। কাক কুকুরকে এইজন্য দেবে, কারণ, তারা মানুষ নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নাকি এই রকমই। এই ব্যবস্থায় মানুষের প্রতি মানুষের নাকি দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রেম–এসব আবেগ প্রকাশের বিশেষ কোন ভূমিকা নেই। যা আছে তা লেনদেনের হিসেবী সম্পর্ক। কিছু দেবার আগে সেই অংক দিয়ে হিসেব নিকেশ করে দেখে নেবে। যা দেওয়া হবে তা লাভজনক হয়ে ফিরে আসবে কিনা।

এই গণিতের কারণে জীবন এখন একটা ফালতু মানুষ। তাকে কেন কেউ কিছু দেবে! তাই জীবনকে, তার মত হাজার হাজার মানুষকে, না খেয়ে থাকতে হবে।

জীবন এখন শোয়া থেকে উঠে বসে। উঠে বসতে বাধ্য হয়। এক থেমে যাওয়া ট্রেনের এক ব্যস্তযাত্রীর পায়ের বুটে তার হাতের আঙুল চেপে যাবার জন্য। তাকিয়ে দেখে সূর্য মাটি ছেড়ে আট দশ ফুট উপরে উঠে গেছে। যা এক বড় গাছের আড়ালে আছে বলে ব্রিজের উপর বিশেষ রোদ ফেলতে পারে নি। তখনই জীবন এক জনের কাছে জানতে চায়–ওইটা কোন গাড়ি? যাইবো কই? চলে যেতে যেতে বলে যায় সে, গৌহাটি মেল।

গৌহাটি মেল! থেমে থাকা ওই ট্রেনখানা সেই ট্রেন যে আসাম যাচ্ছে! জীবন ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে চারিদিকে তাকায়। আছে, একটা সুযোগ আছে। ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে দৌড়ে সামনের ওই ফাঁকা কামরায় উঠে পড়ায় কোন অসুবিধা হবেনা। চেকার পুলিশ সব প্লাটফর্মের উপর। একবার চলন্ত ট্রেনে উঠে গেলে ওরা আর কি করবে? যেই মত ভাবা, সেই মতো কাজ। একটু পরেই গার্ড সাহেব তার হাতের নীল পতাকা উড়িয়ে মুখের বাঁশি বাজিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল গাড়ি ছাড়ার। ড্রাইভার ইঞ্জিনের হুইসেল বাজিয়ে হুকুম মতো গাড়িকে চালাবার প্রস্তুতি নিল। জীবন ছুটে গিয়ে উঠে পড়ল একটা কামরায়। গাড়ির চলা শুরু হল। তখন সে তার সেই নিজস্ব স্থান উল্টোদিকের দরজায় গিয়ে বসে পড়ল। এ ট্রেন বড় অহংকারী। ছোটখাটো স্টেশনে থামে না। প্রায় আধঘন্টা চলার পর যেখানে থামে, সেসব জমজমাট স্টেশন, জংশন।

এভাবে প্রায় দুই তিন ঘন্টা চলবার পরে পৌঁছাল এক জংশনে। এখানে ইঞ্জিন জল ভরছে বা ইঞ্জিন বদল হচ্ছে সেই কারণে ট্রেন ছাড়তে বৈশ বিলম্ব হচ্ছে। বেলা এখন দশটা কি সাড়ে দশটা। এটা লোকেদের টিফিনের সময়। জীবন উল্টো দিকের দরজায় বাইরের দিকে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ তার চোখ গেল সামনের জানলার দিকে। জানলা থেকে একটা মোটা লোমশ হাত বাইরে বের হল। সে হাতে শাল পাতার একটা ঠোঙা। হাতটা বড় অবহেলায় সেই ঠোঙাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ওপাশের রেল লাইনের উপর। সেটা উঁচু থেকে নিচে পড়ার সাথে সাথে খুলে গেল। তখন দেখতে পেল জীবন, ওর মধ্যে রয়েছে মোটা মোেটা দেড়খানা আটার লালরুটি, সাথে কিছু ভাজাভুজি।

রুটি দেখেই মনে পড়ল জীবনের সে অনেকদিন কিছু খায়নি। এবং যেগুলো কেউ অবহেলায় বিসর্জন দিয়েছে, তা একটা খাদ্য। সেই মুহূর্তে জীবন তার আত্মা পরমাত্মাকে গলা টিপে হত্যা করে দিল। আর সে যা কোনদিন করেনি কোনও দিন করতে হবে বলে ভাবে নি তাই করে বসল। তড়াক করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল রেল লাইনের উপর। তারপর ছুটে গিয়ে সেই ঠোঙাটা যেন কোনও বহুমুল্য ধন, এমনভাবে তুলেনিল। রুটি দেখে কটা ছাল ওঠা নেড়ি কুত্তাও সেটা অধিকার করবার আশায় ছুটে এসেছিলো। ওরা এই স্টেশনে থাকে, তাই জানে পৃথিবীতে এখনও এমন বহু মানুষ আছে যাদের কাছে ছুঁড়ে ফেলার মত প্রচুর ভাত রুটি থাকে। এখানে ট্রেন থামলেই তারা কিছু না কিছু ফেলে দিয়ে যায়। কুকুরেরা তাই ট্রেন এলেই লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে বেড়ায়। ট্রেনের দরজায় জানালায় তাকায় কুঁই কুঁই করে। তারা এতদিন জানত যে মানুষ আর যাইহোক কুকুরের মতো হবে না কোন দিন। কিন্তু এখন দেখতে পেল মানুষের সমাজে মানুষের ছদ্মবেশে তাদের মত একজন কেউ লুকিয়ে আছে যে তাদের মুখের খাবার কেড়ে নিচ্ছে। মানুষ থেকে কুকুর হয়ে কুকুরদের বঞ্চিত করছে তাদের কুকুরিক অধিকার থেকে।

জীবনের এমন অমানবিক অন্যায় ব্যবহার দেখে এক যোগে ঘেউ ঘেউ করে প্রতিবাদ জানাল তারা। তেড়ে এল রুটির ঠোঙা কেড়ে নেবার জন্য। জীবন একা ওরা অনেক। জীবন নিরীহ নিরস্ত্র ক্ষুধার্ত কিন্তু ওরা আক্রমণে অভ্যস্ত। দাঁতে অনেক ধার আছে ওদের। সে পিছন ফিরে ছুট মেরে পালায়। পালিয়ে কিছু দুরে গিয়ে আর এক কামরায় উঠে পড়ে। বসে পড়ে আবার দরজায় পা ঝুলিয়ে। তারপর আস্ত মোটা লাল গমের রুটিখানা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ সোকে। মনে হচ্ছে যেন ঘিয়ে ভাজা। তবে আজকের নয় কাল কিংবা পরশুর। ভাজাভুজিও অতটাই পুরানো। তাই ইটের মত শক্ত আর পুরাতন ভাজাভুজি থেকে মিলে মিশে পাওয়া যাচ্ছে কেমন একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণে যেন মানুষকে মানুষ থেকে কুকুরের পর্যায়ে নামিয়ে এনে অন্ততঃ একটা দিন কঠোর জঠর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার প্রলোভন আছে। সেই প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করে জীবন।

রুটি খেয়ে পেট ভরে জল খাবার পর তখন আসে সেই আত্মগ্লানী যা আগে আসে নি। কে যেন তখন বুকের ভিতর কেঁদে ওঠে। ছিঃ ছিঃ করে, ধিক্কার দেয়। শেষকালে তোর এত অধঃ পতন। কুকুরের মুখের খাবার কেড়ে খেলি! নিজেকে আর কত নিচে নামাবি জীবন? কিন্তু অসহায় জীবন এখন এ কথার কি জবাব দেবে? দেবার মতো জবাব কি তার এখন আছে? সে কোন জবাব দিতে পারে না। হয়ত এ দেশের হাজার হাজার মানুষ এই যন্ত্রণায় ডাস্টবিন ঘেঁটে খাবার খোঁজে।

যে কামরায় উঠেছে জীবন সেটা বেশ ফাঁকাই। যার হারাবার মত কোন সম্পদ নেই কোনকিছু পাবার আশা, পথ, সম্ভাবনা নেই, জীবনের সব চাওয়া পাওয়া যার ফুরিয়ে গেছে, কোন রকম শোক, দুঃখ ব্যথা বেদনা যাকে আর বিচলিত করে না, সে ঈশ্বরের পায়ে ভবিষ্যতের হাতে নিজেকে সমর্পন করে, যা হবার তা হোক বলে বসে আছে, সেই সাধক তপস্বী বা নিরাশ হতাশ মানুষের মত জীবন দরজায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। ট্রেন চলা শুরু করলে গায়ে এসে লাগে গ্রাম বাংলার মাঠ মাটি জলাভূমি জঙ্গলের ফুরফুরে হাওয়া।

জীবনের এখন ঘুম পায়। সে দরজার ডান দিকে গামছা পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ থাকায় জীবন এখন দেখতে পাচ্ছে না এখানকার প্রকৃতি পরিবেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য। সামনে কিছু পাতলা গাছ গাছালির ওপারে দাঁড়িয়ে আছে যুগযুগান্তরের ঘুমন্ত পাহাড়। যার ন্যাড়া মাথায় সূর্যের আলো পড়ে আয়নার মত ঠিকরে যাচ্ছে। সেই পাহাড়কে যেন কেউ কোন অদৃশ্য নদীর উপর বসিয়ে দিয়েছে। যে নদীতাকে ভাটার টানে ছোট নৌকার মতো মোহনার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ট্রেন যত সামনে আগায় সে তত পিছনে ছোটে।

ট্রেনখানা কিছুক্ষণ চলার পর শুরু হয় আরো ঘন আরো গভীর বন। এক আদিম অনাবিল সবুজ অন্ধকার ঢেকে ফেলল এই অতিকায় যন্ত্রনখানাকে। শুধু জঙ্গলই নয় এরই সাথে রয়েছে ছোট খাটো পাহাড়। পাহাড় কেটে কোথাও কোথাও বানানো হয়েছে রেল যাত্রার লৌহ পথ। সেই পথে ঝমঝম বাজনা বাজিয়ে ছুটতে থাকে গৌহাটি মেল। আর জীবন চিন্তারহিত এক নির্বিকল্প সমাধিতে সমর্পিত হয়ে দরজার কাছে টানটান হয়ে শুয়ে থাকে। ঘুম নয় ওর যা আসে তা ঝিমুনি, তা যেন চোখ বুজে কোন পরিণতির জন্য প্রতীক্ষা।

যখন ওর ঝিমুনি কেটে গেল তখন বেলা একটু হেলে গেছে। দু’তিন ঘন্টা আগে পেটের এক সমুদ্র খিদের মধ্যে যে দেড়খানা রুটি পড়েছিল, তা কখন যেন গলে জল হয়ে গেছে। এখন আবার সেই পেট মোচড়ান শুরু হয়ে গেছে। আবার সেই চোখ কেমন ঘোলাটে হচ্ছে আর কান ঝা ঝাঁ করা ধরেছে। মানুষ তো অভ্যাসের দাস। আগে না খেতে খেতে সেটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন সে অভ্যাস নিজের দোষে নষ্ট করে ফেলেছে জীবন। জিভের এখন লোভ বেড়ে গেছে। সে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারছে না।

হঠাৎ যেন জীবনের মনোকষ্টের কথা বুঝতে পেরে তার সামনে ঈশ্বরের প্রেরিত কোন মহান মানবের মত এসে দাঁড়াল একজন লোক। লোকটা মাঝবয়সী মাথায় কাঁচা পাকা চুল। মুখে মৃদু হাসি। দুটো চোখে যেন উপছে পড়ছে স্বর্গীয় মমত্ব। যা মানুষের সমাজে আজকে বড় দুর্লভ। গলায় তার গভীর আদর স্নেহ দরদ, এই বাচ্চা তুই কোথায় যাবি রে বাবা?

গ্রাম দেশের পাঠশালার মাষ্টার মশাইয়ের মত চেহারার এই লোকটার কথা শুনে, চোখ তুলে তাকাল জীবন। গলায় জোর ছিল না তার। রোগীর কাতরানোর মত জবাব দিল সে, এই টেরেন যেইখান যাবে, সেইখানে যামু আমি।

কোথায় যাবে এই ট্রেন তা জানিস?

মাথা নেড়ে জানায় জীবন, সে জানে। তারপর বলে আমি কামের তালাশে বাইর হইছি। যাইতে আছি আসাম। দেখি হেইখানে গিয়া যদি কোন কাম কাজ পাই।

কোথায় তোর বাড়ি?

বাড়ি নাই আমাগো। বাপ মা ক্যাম্পে থাকে।

ঘনিষ্ট হয়ে দয়াবান লোকটা জীবনের কাছ থেকে একে একে তার সব কথা জেনে নেয়। গাঠের পয়সা খরচ করে জীবনকে চা পাউরুটি মিশন খাওয়ায়।

মানুষ জীবন তার ছোট জীবনে অনেক দেখছে। কিন্তু এমন মানবিক ব্যবহার আর দেখে নি। কেউ তার সাথে এত দরদ ভরা আত্মীয় ভাষায় কথা বলে নি। তার নোংরা পোষাক অপরিচর্চা অনাকর্ষক চেহারা, তার দুরবস্থা সর্বদাই মানুষের ঘৃণা কখনো কখনো নামমাত্র অনুকম্পা জুটিয়েছে। কিন্তু এই গ্রাম্য শিক্ষক গোছের লোকটা যেন একটু অন্য ধরনের। সে যেন জীবনকে, তার অসহনিয় অবস্থাকে সম্যক উপলব্ধি করে সেই কর্তব্য করছেন যা প্রকৃত পক্ষে একজন দরদী মানুষই করতে পারে। তাই জীবন কৃতার্থ বোধ করে।

লোকটা কি এক বেদনায় কিছুক্ষণ মৌন হয়ে থাকেন। শেষে আবার বলেন–কাল থেকে কিছু খাসনি। আহারে! সামনের স্টেশনে আমি নামব। চল তুই আমার বাড়ি। কটা দিন আমার বাড়ি থেকে খেয়ে তারপর যদি আসাম যেতে চাস তো যাস। পথ খরচার কটা টাকা সে না হয় বাবার মত আমার কাছ থেকে নিয়ে নিবি। লোকটার কথায় প্রলোভন ছিল, সম্মোহন ছিল, দরদ ছিল যা এড়াতে পারে না জীবন। পরে স্টেশনে ট্রেন থামলে সে তার পিছন পিছন হেঁটে যায়। হেঁটে যায় জীবন আর এক অভিজ্ঞার দিকে। জীবন তো নিত্য নতুন এক যাত্রার মধ্য দিয়ে বিশ্ব জগতটাকে চিনে নেবার আর এক নাম। হোঁচট ঠোকরে ক্ষত বিক্ষত হয়ে পথে পথে রক্ত ছড়িয়ে যাবার নাম।

স্টেশনটা খুব বড় নয়, তবে একেবারে ছোটও বলা যাবে না। প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে দক্ষিণমুখো ইট বিছানো রাস্তা। রাস্তার পাশে বেশ কিছু গাছ গাছালিতে ঘেরা ছায়াদার পরিবেশ। সেখানে বৈকালিন বাজারের আয়োজন। স্থানীয় চাষীরা তাদের ক্ষেত্রের নানাবিধ ফসল নিয়ে এসেছে বেচতে। সে সব ছাড়িয়ে সামনে আগালে কিছু জামা কাপড় শাড়ি সায়ার দোকান। দরিদ্র অঞ্চলের দরিদ্র দোকান। দোকানদারও তত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জাত ব্যবসায়ী শ্রেণির নয়।

দোকানে ঢুকে লোকটা দোকানদারকে বলে, ভাল দেখে শাড়ি দেখাও তো দুটো নেবো। আর আমার এই ছেলেটার জন্য একটা প্যান্ট একটা জামা। দামী জামা প্যান্ট জীবনের অঙ্গে কখনো ওঠেনি। জামা প্যান্টের রঙ দেখে দাম শুনে সে আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠে। কিন্তু হাতে নেবার আগেই বলে লোকটা, তুই এক কাজ কর, আগে চুলটা কেটে নে। আমি ততক্ষণে তোর মায়ের জন্য শাড়ি দেখি।

সেলুন রাস্তার ও পাশে। জীবনকে সেখানে বসিয়ে দিয়ে এসে ফের শাড়ি বাছাই করে লোকটা। দাম নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। ভালো জিনিসের তো ভাল দাম হবেই। চিন্তা একটাই, বউয়ের পছন্দ হবে কিনা। অনেক বেছে অনেক ভেবে শেষে বলে সে–এক কাজ করো ভাই, যদি কোন অসুবিধা না হয় গোটা চার পাঁচ শাড়ি আমাকে দিয়ে দাও। এই তো পাশেই আমার বাড়ি, যেতে পাঁচ মিনিট আসতে পাঁচ মিনিট। দু-তিনটে যা বউ পছন্দ করবে রেখে দেব। ছেলেটার চুল কাটা হয়ে গেলে এখানে বসতে বোলো।

দোকানদার সরল সোজা মানুষ। অনেক কটা শাড়ি বিক্রির লোভে সে আহ্লাদিত। তা ছাড়া যার ছেলে এখানে থাকছে তাকে অবিশ্বাস কীসের। সে লোকটাকে যেতে দেয়।

এ সব কথা জীবন সেলুনে থাকার জন্য শুনতে পায় নি। তাকে শোনাবার জন্য তো বলা হয়নি। শুনলে স্রেফ শব্দ, বাক্য থেকে নিহিত মর্মার্থকী বুঝতে পারত। যে বয়স মানব চরিত্রের এই অনাবিষ্কৃত রহস্য অনুধাবন করায় সে ক্ষমতা তার কি তখনো হয়েছে। সে বুঝতে অল্প কিছু সময় বাকি ছিলো। জীবন সেলুন থেকে বের হবার পর কাপড় দোকানদার ডাকে–এই ছেলে এখানে এসো বসো। তোমার বাবা এক্ষুণি আসবে। সেলুন অলাকেও বলে দেয় সে–একটু পরে এর বাবা এসে পয়সা দেবে। তার এই

জীবনের আর কি করার আছে অপেক্ষা করা ছাড়া? এক ঘন্টা দু’ঘন্টা করে সময় কেটে যায়। বিকেল ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা ঘনায়। সে আর আসে না। সে ফেরেনা বলে দোকানদারও জীবনকে দোকান ছেড়ে নড়তে চড়তে দেয় না। বলে তোর বাপ না এলে তোকে ছাড়ব না। কোথায় কত দুরে বাড়ি তোদের? বাজারের চারদিকে খবর ছড়ায়। বহুলোক ভিড় করে জীবনকে ঘিরে। চলে জিজ্ঞাসাবাদ চলে চড় চাপড়। চোর চিটিংবাজের যা সাজা। এক প্রস্ত সাধারণ মারের পর তাকে চালান করা হয় বাজার কমিটির দপ্তরে। শুরু হয় অসাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ। সে যত বলে আমি লোকটাকে চিনি না, ট্রেনে আলাপ, কেউ সে কথা বিশ্বাস করে না। যত বিশ্বাস করে না তত “সত্য” জানবার চেষ্টায় নির্দয় হয়ে ওঠে কমিটির মানুষ। কার যেন একটা জোরালো ঘুষি এসে পড়ে জীবনের বুকে, বল তোর দলের লোক কোথায় গেছে? অনাহারে দুর্বল ক্লান্ত জীবনের ছোট্ট শরীর সে সজোর ঘুষির ধকল সহ্য করতে পারে না। মাটিতে আছড়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জীবন তার এই অল্প পরিধির জীবনে অনেকবার মার খেয়েছে কিন্তু অজ্ঞান কখনো হয় নি। অজ্ঞান হবার একটা মস্ত সুবিধা যে তারপর মারলে আর কষ্ট হয় না।

যখন তার জ্ঞান ফেরে দেখে মাথা মুখ সব ভেজা।এ সব জ্ঞান ফেরাবার জন্য সাধারণ জনতার সাধারণ উপাচার। জীবন অজ্ঞান হবার পর শালা নাটক করছে ভেবে আর দু এক ঘা দেবার পরও যখন সে নড়ে না, তখন তারা চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়েছে। মরে ফরে গেলে মহা হ্যাপা হবে ভেবে দোকানদার জীবনের জ্ঞান ফেরার পর তাকে গরম দুধ খাইয়ে, নিজের অদৃষ্টকে যথেচ্ছা গালাগালি দিয়ে, যা ক্ষতি হয়েছে মেনে নিয়ে, আর না ক্ষতি হোক সেই কারণে ওকে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে তুলে দেয়। সে ট্রেন গৌহাটি যাবে। যে ট্রেন বিকেল চারটেয় নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছেড়ে রাত দশটায় এখানে পৌঁছেছে। মার খেয়ে যতটা কষ্ট হয়েছিল তার খানিকটা কমে গেল আসাম যাবার ট্রেনের কামরায় উঠে। ওরা বলাবলি করছিল পুলিশে দিয়ে দেবে, জেল খাটাবে। তা যখন করে নি সেটাকে জীবন নিজের পরম ভাগ্য বলে মন করল এখন। এই রাত আঁধারে ওরা মেরে রেল লাইনে শুইয়ে দিলেই বা তার কি করার ছিলো। তাও বলে ছিল ওরা। তোর দলের আর একজন কোথায় থাকে বলে দে। না হলে মেরে লাইনে শুইয়ে দেবো।

রাত দশটায় ট্রেনে উঠেছিল জীবন। একরাশ দুশ্চিন্তা আর এক পাহাড় শারীরিক কষ্ট নিয়ে সে এখন পায়খানা বাথরুমে যাবার গলির মধ্যে থুতু ধুলো বিড়ির টুকরো বাদাম খোলা লেবুর খোসা শাল পাতা, ছেঁড়া কাগজের টুকরো ইত্যাকার আবর্জনার মধ্যে শুয়ে পড়ে। যা ভাগ্যে আছে এর বাইরে সে আর কিছু ভাবতে পারে না। ভাবতে চায় ও না।

… ঝমঝম করে চলছে রাতের ট্রেন। এখন ট্রেনে সেই দিনের মত চেঁচামেচি নেই। এক আধঘন্টা নাগাড়ে চলবার পর কোথাও গিয়ে ট্রেন থামে। তখন একদল নেমে যায় আর একদল ওঠে। তাদের ছেড়ে যাওয়া স্থান দখল করে। জীবনের সে সব দিকে কোন খেয়াল দেবার দরকার পড়ে না। সে শুয়ে থাকে সেই অনারোগ্য রোগের রোগীর মত যাকে ডাক্তার বলে দিয়েছে কোন আশা নেই। ভগবানকে ডাকো, যা কিছু করার সেই করতে পারে। সবটা এখন তারই হাতে।

নিজের জন্য জীবনের যা যা করার ছিল সবটা সাধ্যমত করেছে। এর মধ্যে কোন ফাঁকি চালাকি নেই। আর তার করার মত কিছু নেই। এবার যা হবার তা হোক। তার আর কোন ভয় ভাবনা চঞ্চলতা উত্তেজনা কিছুই থাকে না। চুপচাপ কুকুর কুণ্ডলি পাকিয়ে মরার মতো পড়ে থাকে। লোকেরা তাকে ডিঙিয়ে পায়খানা বাথরুমে আসা যাওয়া করে। রাত বাড়ে।

টিকিট।

চোখ কচলে তাকায় জীবন শব্দ লক্ষ্য করে। সামনের আলো আঁধারিতে দণ্ডায়মান কালো কোট পড়া গুফো ষণ্ডা চেহারার এক চেকার। শুয়ে শুয়ে হাত নাড়ে জীবন–নেই।

উতার যা!

কোথায় কোন এক অন্ধকার স্টেশনে দাঁড়িয়েছে ট্রেন। বাধ্য ছেলের মত সেখানে নেমে পড়ে জীবন। দু’চার বগি পার হয়ে গিয়ে ফের একটা কামরায় উঠে আবার সেই একই ভাবে একই জায়গায় গিয়ে শয্যা নেয়। কিছুক্ষণ ট্রেন চলার পর আবার এক অন্য চেকারে তাকে নামিয়ে দেয়। যথারীতি জীবনও আর এক কামরায় গিয়ে ওঠে। এভাবেই সকাল হয়।

বেলা দশ কী এগারোটায় ট্রেন এসে পৌঁছাল সেই কাঙ্খিত ধাম। আসাম এর এক শহর গৌহাটিতে। এসময়ে প্লাটফর্ম বেশ কঁকাই। সামান্য কিছু লোক এদিক সেদিক ঘুরছে, জটলা করছে। স্টেশনের স্টলগুলোয় তেমন একটা খদ্দরের ভিড় নেই। সব যেন জাবর কাটছে এমন অলসতা ছেয়ে আছে। সেগুলোকে বৃত্ত করে একজন নীল প্যান্ট নীল জামা পড়া বুড়ো ঝাড়ুদার লাঠির ডগায় বাধা ঝাটা দিয়ে প্লাটফর্ম ঝাট দিচ্ছে। স্টেশনটা বেশ সাফসুতরো। পাগল মাতাল জুয়াড়ি ভিখারি দেখা যাচ্ছেনা এখানে। জীবন মন্থর পায়ে প্লাটফর্ম থেকে বাইরে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ায়। রোদ এখন বেশ কড়া হয়ে নামছে। সে রোদে যেন খা খা করছে চারদিক। দূরে দেখা যাচ্ছে আকাশের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সার সার ছোট বড় পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে সবুজ পত্রসার বৃক্ষ। কিন্তু এখন প্রকৃতির এসব দৃশ্যপট মুগ্ধ হয়ে দেখবার সময় নয়। এখন মাথার উপর যেমন সুর্য জ্বলছে পেটে জ্বলছে ক্ষুধার আগুন। জঠরাগ্নি নির্বাপণের জন্য এখন একটু খাদ্য দরকার। কিন্তু সে তো কেউ এমনি এমনি দেবে না। রাজা বলেছিলো, এখানে নাকি পথে ঘাটে পয়সার ছড়াছড়ি। স্টেশনের বাইরের জগতটা দেখে তার কথার উপর কেন কে জানে ভরসা থাকে না জীবনের।মনে কুডাক ডেকে ওঠে। এস্থানও কলকাতা নিউ জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ির চেয়ে আলাদা কিছু নয়। পথ ঘাট ঘর বাড়ি দোকানপসার মানুষ জন সবই তো সেই এক রকম। মনে হয় জীবনের যে আশায় বুক বেঁধে সে বহু ক্লেশ সয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে সে আশা আশাই রয়ে যাবে। কোন সার্থকতার সংবাদ বহন করে আনবে এখনো তেমন প্রত্যয় হয় না।

সে যা হোক এখন জীবনের এক মুঠো খাদ্য দরকার। বাদবাকি ভাবনা তার পরে। এখনই শরীর ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছে। আজকেও কিছু খেতে না পেলে কাল আরো দুর্বল হয়ে যাবে। পরশু নিজেকে আর দুপায়ের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। তারপরের দিন শুয়ে পড়তে হবে। এ সব জীবন জানে, তাই এখনই শরীর আরো বেশি অক্ষম হয়ে যাবার আগে যে করে হোক একটু কিছু খাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

এখানে তার সহজ পথ কি? পথ একটাই কোন হোটেলে রেস্টুরেন্টে চা দোকানে যা সে পারে সেই থালাগেলাস ধোবার কাজে লেগে পড়া। মোট কথা এখন একটা কাজ চাই। যা হোক আর যেমন হোক দুটো খেতে পেলেই চলবে। যদি মাইনে ফাইনে না পাওয়া যায় সে আর কি করা যাবে। সে সেই আশায় বড় রাস্তা ধরে হেঁটে সামনে আগায়।

আপনে গো কামের লোক লাগবে?

রাস্তার বা পাশে এক পাঞ্জাবির বড় দোকান। চা মিষ্টি নোনতা শো কেসে সাজানো রকমারি খাবার। খদ্দের যেন উপছে পড়ছে। পাঁচ ছয় জন কর্মচারী ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। সেই দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দোকানদার ওকে ভিখারি ভেবে কুকুর খেদা দেয়, যা! ভাগ। নেহী তো বদনপে গরম পানী ডাল দেগা। তখন বলে জীবন, মুই ভিখারি না, কামের তলাশে আইছি। আগে এক মিষ্টির দোকানে কাম করেছি। বেবাক কাম জানি।

হিন্দিতে জানতে চায় মাথায় পাগড়ি মুখে দাড়ি হাতে বালা পড়া মধ্যম বয়সি দোকানদার–কোথায় কাজ করেছিস?

শিলিগুড়ি।

শিলিগুড়ি থেকে সোজা আসাম!

চব্বিশ ঘণ্টার ট্রেন যাত্রা করে এতপথ পাড়ি দিয়ে মিষ্টির দোকানে কাজ করতে আসায় দোকানদার বিস্মিত–শিলিগুড়িতে আর দোকান নেই?

ফালতু কথায় নষ্ট করবার মতো সময় আমার হাতে নাই। আপনে কাম দিলে কন। মাইনা ফাইনা লাগবে না, শুধু খাওয়া। নইলে আমি যাই।

এখানে তোক কে চেনে?

ক্যামনে চেনবে আইজই তো আইছি।

তাহলে কাজ হবে না। চুরি ফুরি করে পালালে তখন কি করব। যাও রাস্তা মাগো, আগে বাড়ো।

সময়টা সেই সময় যখন আসামের ভাগ্যাকাশে দেখা দিয়েছে একখণ্ড কালো মেঘ। যা অচিরেই বঙ্গাল খেদাও নামক এক সুপার সাইক্লোন হয়ে আছড়ে পড়বে আসামের সর্বত্র। ডিগবয় ডিব্ৰুগড় তিনসুকিয়া জোড়হাট গৌহাটি জুড়ে এক বিধ্বংসী তাণ্ডব চলবে প্রায় এক দশক ধরে। ঘর বাড়ি পুড়বে, দোকান লুঠপাট হবে, মানুষ মরবে। ইতিমধ্যেই তার কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ হতে শুরু করেছে। কদিন আগে এখানে অহমিয়া আর বঙ্গালে তুমুল এক সংঘর্ষ হয়ে গেছে। পথে পথে এখনো পড়ে আছে ইটের টুকরো সোডার বোতলের ভাঙা কাঁচ। সেই পথ মাড়িয়ে বেঁচে থাকার এক আদিম অভীপ্সায় সামনে আগায় এক অনাহারী বালক।

কাজ একটা চাই। আসামে যখন পৌঁছানো গেছে কটা দিন এখানে থাকার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। তারপর খুঁজতে হবে কামরূপ কামাক্ষার সেই মন্দির। যার চারদিকে নাকি ঘিরে আছে ফণীমনসার দুর্ভেদ্য জঙ্গল। যে জঙ্গল পার হওয়া মানুষের পক্ষে অতীব কঠিন। সেই মন্দিরকে নাকি পাহারা দেয় সুন্দরী সুসজ্জিত প্রমিলা বাহিনী। যারা যাদু মন্ত্র জানে। তারা নাকি নাগালের মধ্যে কোন পুরুষ লোককে পেলেই মন্ত্র শক্তিতে ভেড়া বানিয়ে রাখে। এত বাধা বিপত্তি ঠেলে যদি কোন সাহসী মানুষ সেখানে পৌঁছে যেতে পারে আর কোনভাবে শিখে নিতে পারে কিছু মন্ত্র, তখন সারা পৃথিবী তার হাতের মুঠোয় চলে আসে। এ সব গল্প ছোট বেলা থেকে বহুবার শুনেছে জীবন। এই জীবনের আর কি দাম? কুকুরের মুখ থেকে খাবার কেড়ে খেয়ে কুকুর গোত্র তো হয়েই গেছে। এখন যদি তাকে কেউ ভেড়া বানিয়ে দেয় তো দিক না। ভেড়া এমন কী খারাপ জীব। ভেড়ারা আর যাই হোক না খেয়ে তো থাকে না।

রাস্তা ধরে এই সব ভাবে আর সামনের দিকে হাঁটে এবং কোন হোটেল রেস্টুরেন্ট মিষ্টির দোকান দেখলে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জানতে চায়, আপনের দোকানে কামে লোক লাগবে?

আমি বড় দুঃখী গো বাবু। বড় গরিব। কেউ আমাকে রাখো না কোনও কাজে। আমার বাবা এক বস্তা ধান একা মাথায় তুলে দুক্রোশ পথ বয়ে নিয়ে যেতে পারত। সেই বাপের ছেলে আমি। খুব খাটতে পারি। আগে যেখানে কাজ করেছি আমার পরিশ্রম দেখে সবাই ধন্য ধন্য করেছে। নেবে আমাকে কেউ?

কে নেবে। কেন নেবে? সময় বড় সংক্রামক বড় সন্দেহজনক। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। কে জানে যদি সুযোগ পেলে সব কিছু ফাঁকা করে পালিয়ে যায়। যারা সৎ যারা সাবধানী তারা অচেনা অজানা লোক বিষয়ে বড় ভীত। জানতে চায়, কে তোমাকে চেনে! কে গ্যারান্টি নেবে তোমার সতোর!

নেই তেমন কেউ জীবনের জন্য সারা আসামে, শুধু আসাম কেন সারা ভারতে সারা পৃথিবীতে নেই। কেউ বলবে না, একে আমি পরিপূর্ণভাবে চিনি, কেবল চিনি না, এর সততা সম্বন্ধে একশো ভাগ নিঃসন্দেহ।

তাই সৎ সাবধান ভীত লোকেরা এমন উটকো লোককে কাজে রাখবে না। তবু হাল ছাড়তে পারে না জীবন। হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বিদেশের পথে বসে পড়ায় সমস্যার কোন সমাধান হবে না। সেটুকু বোঝে সে। তাই স্রেফ আশা আঁকড়ে আবার সামনে আগায়।

সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর। তার শরীর গলে গলে যেন আগুন হয়ে নিচে নামছে। সে আগুনে জীবনের সারা দেহ জ্বলে যাচ্ছে। আগুন তো জীবনের পেটেও। নাড়ি ভুড়িগুলো যেন আগুনে পোড়া অজগরের মত মোচরাচ্ছে। আর যেন দেহটা দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। যেন এখনই গোড়া কাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়বে। সেই শরীরটাকে শামুকের খোলের মতো টেনে এনে দাঁড় করায় ভাঙা চোরা একটা দোকানের সামনে। এটা এক বিহারির চা দোকান।

এখানে চা হয় বটে তবে তার আসল ব্যবসা দুধের। জাতে যাদব। লোকটা দোকান দোকানে দিয়ে অবশিষ্ট যা দুধ থাকে তা দিয়ে দুই পাতে। দইয়ে লস্যি হয়। এই দোকানে বলা মাত্র কাজ পেয়ে যায় জীবন। হ্যাঁ হ্যাঁ কামমে তো আমি চাহিয়ে।

লোকটার উৎসাহ দেখে জীবন বলে–মাইনা দিবেন?

জরুর জরুর কিউ নেহি দেগা!

কত দিবেন?

কিতনা লেগা?

না, আপনে কন কত দিবেন?

দোটাইম খানা এক টাইম নাস্তা আউর মহিনামে বিশ দেনে সে চলেগা?

চলেগা কি দৌড়েগা। মনে মনে ভাবে জীবন-কাজ যা হোক আর যেমনই হোক মাইনেটা মাসে মাসে পেলে আর কোন কথাই নেই। যদি কেউ তাকে ঠকাতে চায় এক মাসের বেশি ঠকাতে পারবে না তাহলে। আর কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায় না। বিশ্বাস কথাটা যেন মরে পচে ফালতু হয়ে গেছে ওর অভিধানে। কুকুর তুল্য জীবন ওকে শিক্ষা দিয়েছে মানুষের সমাজে তার মত মানুষের জন্য কোন সমবেদনা সহানুভূতি দায় দরদ আর অবশিষ্ট নেই। সে এই সময় সমাজের কাছে অবাঞ্ছিত অনভিপ্রেত একজীব। তাকে যে যতটুকু পারবে সুযোগ পেলে ঠকাতেই থাকবে। তাই এখন সময়টা একটু অনুকূল বিবেচনায় সে নিজের দুর্বলতা গোপন রেখে শর্ত চাপায়-মাহিনা কিন্তু মাসে মাসে নিমু।

দরাজ গলায় গ্রাম দেশের যাত্রা দলের শকুনি মামার মত চেহারার রোগা ছুঁচলো কাঁচা পাকা মোটা গোঁফের মালিক লুঙ্গি ফতুয়া পড়া বিহারি দোকানদার বলে–লে লেনা মাহিনা মাহিনামে। ইসমে মেরাহি আচ্ছা হ্যায়। জাদা বোঝ নেহী পড়ে গা।

কাজে নিযুক্ত হল জীবন। কাজ বলতে দুধের ড্রাম মাথায় করে লোকটার পিছন পিছন হাঁটা। আড়াই মোন ধানের বস্তা বওয়া বাপের ছেলে কুড়ি কিলো ওজনে ঘায়েল হয় না। কিন্তু ঘায়েল হয়ে যায় দুপুরে রাতে খাবার পাতে বসে। গোয়ালা লোকটার দেশে বউ মেয়ে সব আছে। এখানে সে থাকে তার দুই ছেলেকে নিয়ে। ছেলে দুটো মোষ চড়াতে মোষ দুইতেই ওস্তাদ নয়, লাঠি চালানো কুস্তি এসবেও সমান দক্ষ। সারা শরাবভাট্টি অঞ্চলে তাদের সমকক্ষ পালোয়ান আর একজনও নেই। রোজ সকালে তারা নিয়ম করে বুকডন ডনবৈঠক মারে। আর বিকালে যায় কুস্তির আখরায়। ধোবিপাট খেয়ে থোবিপাট দিয়ে তারা যখন ঘরে ফিরে খেতে বসে প্রায় দিনই ভুলে যায় যে খাবার লোক একজন বেড়ে গেছে। যার জন্য কিছু ফেলে রাখার দরকার আছে। বিহারিরা বাঙালীদের মতো ভাতের ভক্ত নয়, ছাতু রুটি তাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু জীবনের ভাতের জন্য বড় প্রাণ আনচান করে। সে কষ্ট যদি বা ভোলা যায়, না খাওয়ার কষ্ট ভোলে কি করে! বিশেষতঃ যখন দুটাইম খেতে দেবার কড়ারে তাকে দিয়ে শহরময় বোঝা বওয়ানো হয়।

আরো একটা কারণে সে বড় কাতর হয়, সেটা কামাখ্যা দেবীর মন্দিরদর্শন করে ফেরত আসা তীর্থযাত্রীদের কথপোকথনে। কোথায় জাদু মন্তর বাপ! কোন কালে তা থাকলেও থাকতে পারে। এখন ওসব কিছু আর নেই টেই।

একটু একটু করে জীবনের কিশোর চৈতন্য বাস্তবতার কঠোর আঘাতে অলীক উড়ান থেকে যথার্থতার ধরাতলে নেমে আসে। চারদিকে তাকায়। স্টেশন থেকে এই শরাবভাট্টির চৌমাথা পর্যন্ত। চারপাশে অসংখ্য অনাহার অভাবজনিত নত নজ মানুষ। তথাকথিত জাদুর দেশে বাস করেও যাদের আজো সেই জাদুকাঠির সন্ধান জানা হয় নি, যা জানলে জীবন সুন্দর হয় সম্পন্ন হয়। পেট পিঠের সাথে সেঁটে যাওয়া, বুকের হাড় দাঁত বের করে ভেংচি কাটা সেইসব মানুষের স্বপ্নহারা দুচোখ জুড়ে শুধু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো ছায়ার নাচন। মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা কথা বলেছে রাজা। কোথায় এখানে পথে পথে পড়ে থাকা সেই তামার টুকরো, যাকে পয়সা বলে! যা দিয়ে পেটের ভাত পরনের ন্যাতা পাওয়া যায়? নেই, এখানেও ওসব নেই। নেই বলেই এখানেও মানুষ অভাবে আছে। অনাহারে আছে।

তবে আর আসামে থেকে কি হবে! চিনির বলদ যেমন সারা জন্ম চিনির বোঝা বয় কিন্তু এক দানা চিনি খেতে পায় না। বড় দুধের ড্রাম মাথায় করে বওয়া জীবন জানেনা দুধের স্বাদ কেমন। যে মানুষ কিলো কিলো দুধের যোগানদার সে নিজেই এক ফোঁটা দুধ মুখে তোলেনা, আর জীবন তো সাধারণ এক চাকর মাত্র। কেন তার পেছনে হিসেবি মালিক অপচয় করবে সেই দ্রব্য যা দামে বিক্রি হবে।

মানুষের সমাজে এক বিচিত্র নিয়ম আছে। যে ময়রা মিষ্টান্ন তৈয়ারি করে সেমিষ্টি খায় না।সে ছোটে তেল মশলা ঝাল কোন খাবারের দিকে। যে দোকানদার তেলেভাজা ভাজে, সে বড় আয়েশ করে মুড়কি বাদাম ছাপা খায়, তেলেভাজা মুখে তুলতে রাজি হয় না। সেই নিয়মে কিনা কে জানে। এই দুধওলা কোনদিন দুধ খায় না। সে সন্ধ্যে হলে ছোটে দেশী মদের দোকানে। আর মদ খেয়ে একটু নেশা হয়ে গেলে সে কবে কোন কালে একবার কলকাতা গিয়ে কিছু কাল ছিল তখন বাঙালিরা তার সাথে কি দুর্ব্যবহার করেছে সেই কথা তার মনে পড়ে যায়। আর তখন অকারণেই জীবনকে স্রেফ বাঙালী হবার অপরাধে যাচ্ছেতাই গালাগাল দেয়। বাঙালী নামক এই জাতটার যে এতদোষ তা আগে জীবন জানত না। এই জাতটার মেয়েদের সতীত্ব বলে কোন জিনিস নেই। তাগড়া পুরুষ পেলেই নাকি তার কাছে শুয়ে পড়ে। খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে কোন বাছ বিচার নেই। মাছ তা সে যে কয়মাসের পচা হোক, খেয়ে নেয়। এমনিতে দুর্বল, কিন্তু ঝগড়া কোন্দল পেলে নাওয়া খাওয়া ভুলে তাতে মেতে থাকে। আর মিথ্যা ছাড়া সত্যি কোন দিন বলে না। যার খায় তার দেয় না। এমন যে দুধ, তার দাম পর্যন্ত মেরে দেয়। প্রায় রোজই এত বাঙলী নিন্দা শুনতে শুনতে কান যেন ঝালাপালা হয়ে যায় জীবনের।

অন্য কেউ হলে হয়তো কবে পালিয়ে যেত। কিন্তু জীবন পালাই পালাই মন নিয়েও পাঁচ মাস টিকে যায়। কারণ একটাই। লোকটা মাসের দশবারো তারিখ হলেই জীবনকে তার মাস মাইনের টাকা ধরিয়ে দিত। যক্ষের ধনের মত জীবন তার সেই কষ্টার্জিত টাকা শোবার বালিশের মধ্যে লুকিয়ে রাখত। মা বাবার কাছে পোস্টাপিস মারফত টাকা পাঠাবার কায়দা তখন তার জানা ছিল না। ভয় করত টাকাটা হয়ত পৌঁছাবে না ঠিকানা পর্যন্ত। পথেই মার পড়ে যাবে। তাই ভাবনায় ছিল আর সামান্য কিছু জমে গেলে বাসায় গিয়ে মায়ের হাতে দিয়ে আসবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হল না। যত সাবধানে গোপনে টাকাটা সে লুকিয়ে রাখুক, তা আসলে গোপন ছিল না। যাদের সঙ্গে তার সারাদিন কাটে তারা জানতো। কিছু টাকা জীবন এটা সেটা কিনে, খেয়ে খরচ করে ফেলেছিল। রাখা ছিল নীল রঙের একটা একশো টাকার নোট। এক সকালে দুধ বওয়ার কাজ শেষ করে দোকানে ফিরে এসে দেখে বালিশের মধ্যে থেকে টাকা উধাও হয়ে গেছে। তখন দোকানে ছিল দোকানদারের ছোট ছেলে। এত কষ্টের ধন চুরি চলে যাওয়ায় জীবনের আর মাথার ঠিক ছিল না। সে সরাসরি ছোট ছেলের দিকে আঙুল তুললো–তুমি নেছো। আর কেউ না, তুমি। যাওনের আগে আমি দেইখ্যা গেছি, হেয়ার পর ঘরে আর কেউ ছেলে না। আমার টাকা ফেরত দাও।

চুরি ততটা লজ্জার নয়, যতটা চোর বদনামে। মাথা গরম হয়ে গেল আখড়ায় কুস্তি লড়া ছোট পহেলবানের। “শালা হামারা খাতা হ্যায় হামারা পিতা হ্যায় আউর হামিকো চোরবোলতা হ্যায়।” জীবনকে সে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাস্তায়-যা শালে কুত্তা, ভাগ, নেহি তো মারকে তবিয়ত বিগাড় দেগা। ভেবেছিল জীবন, আশে পাশের মানুষ, বিশেষ করে দুপাঁচজন বাঙালী যারা আছে তারা ওর পাশে এসে দাঁড়াবে। কেউ অন্ততঃ বলবে, এটা অন্যায়। গরিব বেচারার টাকাটা দিয়ে দাও। কিন্তু তেমনটা ঘটলো না। দূরে দাঁড়িয়ে অনেকে জীবনের কান্না দেখে মজা করল। কেউ কষ্টও পেতে পারে। তবে সামনে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করল না। আবার আর একবার পাঁচ ছয় মাসের নিষ্ফল প্রচেষ্টার পর কপর্দকশূন্য অবস্থায় পথে পড়ল জীবন।

এখন বেলা প্রায় তিনটে বাজে। পথঘাট একেবারে ফাঁকা। এমনিতে এ অঞ্চলের জনবসতি ততটা ঘিঞ্জি নয়। শহর কলকাতার ভিড় দেখা চোখে এখানকার ভিড় শিশু। ভগ্ন মনে একরাশ শূন্যতা নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে স্টেশনে আসে জীবন। কোথায় যাবে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। এমন একটা মানুষের মুখ চোখে পড়ে না, যার কাছে গিয়ে কেঁদে পড়া যায়। বলা যায় নিজের দুঃখের সাতকাহন। আশা করা যায়, সে এমন একটা কাজ কথা উপদেশ দেবে যাতে জীবনের এই হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া তরণীখানি একটু কুল ছোঁয়। একটু মাটি পায়। যে মাটিতে শিকড় চারিয়ে বেঁচে থাকে ছোট বনস্পতি।

পৃথিবীর কাছে জীবনের আর কোন আশা নেই, দাবি নেই। শুধু দুবেলা দুমুঠো অন্ন, এক টুকরো মোটা কাপড়, মাথার উপর একটু ছাউনি–সেটুকুই যে কৃপণ পৃথিবীর কাছে অনেক বড় দান। কিছুতেই সে মুঠি আলগা করতে রাজি নয়। বাবা বলত ক্ষুধা দিয়েছেন যিনি আহার জোগাবেন তিনি। কাঠের মধ্যে ঘুন পোকা থাকে ঈশ্বর তাকেও অভুক্ত রাখেন না। তাকে বলেছিল তার বাবা। তোতা রটনের মতো দুখ কষ্ট অভাব অনটনের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে, বিনা অসুখে পেটের ব্যথায় কাটা ছাগলের মত ছটফট করতে করতে, অনাহারে মরে যাওয়া শিশু কন্যার মৃতদেহের সামনে বসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে, নিবস্ত্র স্ত্রীর লজ্জা নিবারণের জন্য এক খণ্ড ন্যাকড়া জোগাড় করবার অক্ষমতায় হাহুতাশ করতে করতে, কোন বিশ্বাসে নিজের কাছে এসব বলেছিল তা এক জব্বর ধাঁধাঁ। জীবন যে ধাঁধার অর্থ আজো জানে না। কোথা সেই মঙ্গলময়ের মঙ্গল বাসনা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। সে কোনদিন কারো কাছে বলতে পারবে না, ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করে থাকেন।

কিছুক্ষণ গৌহাটি স্টেশন বসে কিছু সময় কাটিয়ে শেষে যে ট্রেনখানা তখন ছাড়ছে সেটায় উঠে বসে। কেন উঠে বসে কোথায় যাবে কেন যাবে তার কোন উত্তর জীবনের কাছে নেই।

এ ট্রেনে অসম্ভব ভিড়! কামরার মধ্যে গাদাগাদি মেরে গেছে যাত্রীতে। এত ভিড় ট্রেনে চেকার ওঠে না। কত ধাক্কা সহ্য করবে! একদিন দুদিন তো নয় রোজকার কর্ম। জীবন কোথাও বসার জায়গা পায় না। দরজার সামনে অনেকের সাথে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের পোষাক আষাক দেখে বোঝা যায় এরা মজুরশ্রেণীর লোক। কোথায় যেন কাজে চলেছে। হায় হতভাগা! জীবন যে আসামে এসেছিল এক বুক আশা নিয়ে, সেই আসাম থেকে একদল মানুষ চলেছে আলিপুর দুয়ার নামক এক স্থানে কাজের সন্ধানে।

এক সময় জীবন একটু বসার জায়গা পায়। সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে সে। দুতিন ঘণ্টা ট্রেন চলার পর ভিড় একটু কমলে শুয়েও পড়তে পারে। ধীরে ধীরে ঘুম এসে যায় তার। ভোর চারটেয় ট্রেন এসে থামে শিলিগুড়ি। কি ভেবে কে জানে, সেখানে নেমে পড়ে জীবন। অনেকগুলো মাস এখানে কেটেছে। সেই প্রাণের টানেই কি? কিন্তু তা বা কি করে হয়। শিলিগুড়ি তাকে যা দিয়েছে সে তো বিশ্বাসঘাতকতা। আস্থা হনন। তবু এখানে নামে। জীবনের বহু অকারণ অবিবেচক সিদ্ধান্তের এটা আর একটা।

রাত শেষ হতে খুব বেশি বাকি ছিল না। সব রাতের শেষ আছে। এটা প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম। শুধু সেই রাত সেই অন্ধকার শেষ হয় না যা মানুষের নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি করে, পরিপুষ্ট করে। যেসব অন্ধকার মানুষ বুকের মধ্যে লালন করে। নিজের সৃষ্টি করা লালন করা অন্ধকারে বাস করতে করতে সেই মানুষই নিজে একদিন কালো কুৎসিত প্রেতাত্মার মতো অবয়ব শূন্য আদর্শ শূন্য এমন এক প্রাণী হয়ে যায়, যার আরাধ্য উপাস্য পূজ্য শুধু অন্ধকার অন্ধকার অন্ধকার। সেই অন্ধকারের জঠর থেকে জন্ম নেয় আরো অন্ধকারে। যা অনন্ত অসীম …।

প্রকৃতির অন্ধকার এখন একটা পাতলা চাদরের মতো বিছানো রয়েছে দিগন্ত জুড়ে। সেই চাদর সরিয়ে পুর্বাকাশে দেখা দিচ্ছে হালকা একটা বেগুনি রেখা। গাছ গাছালির ডালে ডালে খড় কুটোর বাসায় আড়মোড়া ভাঙছে পাখ পাখালির ঝক। কিচির মিচির শোনা যাচ্ছে তাদের গলায়। কত সুখী ওরা! ছোট্ট দুটো ডানা আছে। সেই ক্ষুদ্র কিন্তু স্বাধীন ডানায় সারা আকাশ দখল করে নেয়। যতদিন জীব জন্তু পাখিদের জীবনের দিকে লোভি মানুষের কালো হাতের ছায়া না পড়ে ওরা বড় সুখেই থাকে।

জীবন আনমনে রেল লাইন ধরে হাঁটে। কেন হাঁটে, চঞ্চল পা কিসের সন্ধানে ব্যাকুল, তা কি সে জানে? স্টেশনের আলোকিত অঞ্চলের বাইরে যে বিশাল অঞ্চল তার চোখে এখনও প্রভাতি ঘুমের আঠা লেগে আছে। রাতের আঁধার যত ফিকে হয়ে যাচ্ছে তত পরিদৃশ্য হচ্ছে হালকা ধোয়ার মতো সামান্য কুয়াশা। যা দুরের গাছপালা, পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে আছে। কি ভেবে যেন কিছুক্ষণ জনহীন সেই মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে জীবন। নিজেকে এখন তার জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলা সেই রাখাল বালকের মতো মনে হয়। যার সামনে কোনও পথের নিশানা নেই। মনে হয় চোরাবালিতে পা বসে যাওয়া সেই হরিণ শাবকের মত, যে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে এরপর কি ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু পরিত্রাণের কোন পথই নেই।

বেলা তখন মাটি ছেড়ে এক হাত উপরে উঠেছে। সকাল বেলার সেই সোনালি রঙ ঝেড়ে ফেলে রোদ এখন রক্তচক্ষু। উবর খাবর মাটি মাঠ পাথর টিলা পাহাড় গাছ পালার ফাঁক থেকে তার তিরের ফলার মতো দৃষ্টি এসে বিদ্ধ করছে জীবনের চারপাশ। সেই সময় দেখতে পায় জীবন তার সামনের রেল লাইনের উপর এসে দাঁড়ায় ট্রেনের চেয়ে ছোট ট্রামের চেয়ে বড় তিন চার বগির একখানা অদ্ভুত যান। ইঞ্জিনখানাও সেইরকম ছোট। কিছু পরে দেখে জীবন সেই যানখানা যার নাম ন্যাড়ো গেজ, তাতে এসে চড়তে থাকে একদল সুবেশ সুন্দর বড় বড় মানুষ। লোকের কথোপকথন থেকে শুনে নেয় সে এই যানখানা যাবে দার্জিলিং।

সকাল বেলায় ঝকঝকে রোদে এখান থেকে পাহাড়ের মাথায় আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই শহরে দেশলাই বাক্সের মতো দালান কোঠা ঘর বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে। যেন এক সবুজ নিথর সমুদ্রের মধ্যে নোঙর ফেলা ছোট ছোট খেলনা রাংতার নৌকা। যা রোদের আলোয় ঝিকমিক ঝিকমিক করছে।

সকাল দেখলে বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। এটা পুরাতন প্রবাদ। জীবনও তা জানে। আজকের দিনটাও যে তার জন্য কোন শুভবার্তা নিয়ে আসেনি, তার আভাস পাওয়া হয়ে গেছে। সেই এক বুক নিরাশা বঞ্চনা এক পেট বুভুক্ষা নিয়ে পথে পথে ঘোরা। এর যখন কোন ব্যাত্যয় নেই তখন ঘুরতে ঘুরতে দার্জিলিং চলে গেলে ক্ষতি কি! কে যেন দার্জিলিংকে অলকাপুরী বলেছে। অলকাপুরী মানে ধন দেবতা কুবেরের পুরী। যে রাস্তায় ছাইয়ের ট্রাক, বালি, চালের ট্রাক যায়, উড়ে ঝরে একটু আধটু রাস্তায় পড়ে। ক্ষুদ্র মানুষ জীবন তার চাহিদাও ক্ষুদ্র। কুবেরের নগর থেকে কুড়িয়ে খুটে কিছু কি এমন পেতে পারে না যে সেই ছোট্ট চাহিদাটুকু মিটে যায়? সেটা পরখ করতে হলে সেই নগরে না গিয়ে উপায় নেই।

যাবে জীবন! ভালো কিছু হবার আশা যখন নেই সব চেয়ে খারাপ যা হতে পারে তা যখন জানা, শিলিগুড়িতে পড়ে মরার চেয়ে দার্জিলিং গিয়ে মরায় কি এমন ক্ষতি! তাতে অন্ততঃ মরার আগে মনে সান্ত্বনা থাকবে, আঙুর ফল টক জেনেও লাফালাফি করেছিলাম, নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকিনি।

সামনে ইঞ্জিন, তার পরের কামরা মালপত্রের, তার পরে ফার্স্ট ক্লাস, তার পিছনে সেকেন্ড ক্লাস এবং সবার পিছনে গার্ড সাহেবের কামরা। ছোট্ট ট্রেন এবং লোকজনের ভিড়ও খুব কম। যারা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যায় বেশির ভাগ লোক ট্রেনের চেয়ে জিপ বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে জিপের সামনের সিট। পিছন থেকে তার ভাড়াও কিছু বেশি। জিপ ট্রেনের চেয়ে সময় নেয় কম আর দেয় নৈসর্গকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবার রোমাঞ্চ। কিন্তু জিপে বিনা ভাড়ায় যাওয়া যাবে না। ট্রেনে তা যায়। শুধু যে তিন চারজন চেকার ট্রেন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওদের চোখ এড়িয়ে কামরায় চড়তে পারলেই হল।

জীবনের কাছে কোন পয়সা কড়ি নেই। কিন্তু ট্রেনে তো চাপতেই হবে। সেইঞ্জিনের সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কখন ট্রেন ছাড়বে। এই ট্রেন ধীরে ধীরে চলে। চলন্ত ট্রেনে ওর পক্ষে উঠে পড়া খুব কঠিন কাজ নয়। চেকার পিছনে ফেলে ট্রেন সামান্য সামনে এগিয়ে এলে সেই কাজটা সম্পন্ন করবে। সেটা করতে পারলেই দার্জিলিং যাত্রার প্রথম ধাপ পার হওয়া যাবে।

ট্রেন যেখানে দণ্ডায়মান সেখানে কোনও প্লাটফর্ম নেই। চারদিক খোলা মাঠ। মাথার উপর সুনীল আকাশ। আকাশে ডানা মেলা এক ঝাক পরিযায়ী পাখি। হিমালয় পার হয়ে কোথায় কোন দূর দেশ থেকে ওরা উড়ে আসছে। তিন চার মাস এখানে কাটিয়ে ফেব্রুয়ারীর দিকে ওরা আবার ফিরে যাবে। এটা অক্টোবর, আর কয়েকদিন পরে হিন্দুধর্মের শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গা এই হিমালয় থেকে পুত্র কন্যাসহ সমতলে পূজা নিতে আসবে। এখনই বাতাসে খুব সামান্য শীত শীত ভাব। যেন সেই ভাবের সাথে মিশে আছে পূজো পূজো গন্ধ। তাতে অবশ্য জীবনের কিছু যায় আসে না। ওর তো পেট বোঝাই আগুন, দহন। সে আগুনে দহনে সব উৎসব ছাই হয়ে গিয়ে যা পড়ে আছে। তার রূপ বড়ই কদাকার। সেখানে কোন প্রফুল্লতা স্থায়ী হয় না।

এতক্ষণ ইঞ্জিন থেকে গর্ভবতী রমণীর মতো আলস্যময়, একটা মন্থর ধোঁয়া চিমনি বেয়ে আকাশের দিকে উঠছিল। এবার তার আলস্য কেটে গেল। বয়লারের কয়লা মারার ফলে ভলকে ভলকে সাদা ধোয়া উঠে আকাশ ঢেকে দিল। দুবার কুকু করে সিটি বাজাল। বোঝা গেল দৌড় শুরু হবার জন্য সে প্রস্তুত হয়েছে।

জীবনও প্রস্তুত। স্টার্ট হলো ইঞ্জিন। সো সো ছ্যাক ছ্যাক করে সে তার চাকা গড়ানো লিভারের উপর বাষ্পের চাপ দিয়ে শুরু করল সামনের দিকে যাত্রা। এক দুই তিন চার। চার পাক চাকা ঘোরার পর কালো কোর্ট পড়া চার চেকার পিছনে ফিরল। ওরা স্টেশনের কেবিনে যাবে। আর অপেক্ষার দরকার নেই। জীবন ছুটল ট্রেনের দিকে। ট্রেন তখন একটু বেগবান হয়ে গেছে। সে তুলনায় জীবনের শরীর একটু বেসামাল, পা একটু নড়বড়ে, হাত শক্তিহীন। তবু কোন মতে ধরে ফেলল দরজার হাতল। যাত্রীরা ওর রকম সকম দেখে আঁতকে উঠল। বিপদাশঙ্কায় কেঁপে চোখ বন্ধ করল কেউ কেউ। গেল, গেল বুঝি। কিন্তু গেল না। না প্রাণ, না হাত পা। সে উঠে পড়ল সাধারণ কামরায়। দাঁড়িয়ে পড়ল দরজার সামনে। দু’এক জন যাত্রী যাদের আশঙ্কা হচ্ছিল কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ট্রেন থেমে যাবে। যাত্রায় বিলম্ব ঘটবে। তারা ওকে দুচারটে সাধারণ খিচুনি দেবার পর মনোনিবেশ করল প্রকৃতির দৃশ্যপট দেখার দিকে।

শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন ছেড়ে প্রথমে যে স্টেশনে এসে থামল তার নাম সুকনা। এখান থেকেই ট্রেন পাহাড়ে চড়া শুরু করল। পাহাড়ের গায়ে নানা ধরনের বৃক্ষের ঘনগভীর জঙ্গল। তবে সে সব একটু দুর দুরে। এই সময় থেকে একটু শীত শীত করতে শুরু করল জীবনের। ট্রেনের যাত্রীদের দেখা গেল গায়ে শাল সোয়েটার কোর্ট চাপাচ্ছে। জীবনের কাছে গামছা গেঞ্জি ছাড়া আর কিছু নেই। সেগুলোই সে গায়ে জড়িয়ে নেয়।

এরপর ট্রেন যত সামনে আগায় শীত বেড়ে চলে। কিন্তু তখন শীতের কামড়ে জীবন ততটা কাতর হয় না। সে অবাক হয়ে প্রকৃতির অনুপম সৃষ্টি ছোট বড় মাঝারি পর্বতশ্রেণীর শৈলচূড়া দেখতে থাকে। যেন কেউ একখানা ঢেউ খেলানো বিশাল সবুজ চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে সব কিছু। সে চাদরের উপর নানা রকম ফুলের কেয়ারি করা। দুরে দেখা যাচ্ছে একপাল ভেড়া চড়ছে। সবুজের উপর ঘিয়ে রঙের জীবনগুলো ফুটে আছে আর এক সৌন্দৰ্য্য হয়ে।

পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেন সোজা চলতে পারে না। তাকে পাহাড়ের গায়ে পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠতে হয়। কত কঠিন পরিশ্রমে বিশ্বকর্মার বরপুত্ররা এ পথের নির্মাণ করেছে ভেবে অবাক হয় জীবন। চেষ্টা করলে মানুষ কত কি না করতে পারে। যারা পাহাড় ফাটিয়ে ছেনি হাতুড়ি চালিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এমন অনবদ্য শিল্প সৃষ্টি করেছে, কে তাদের কথা জানে? কে জানে

তারাও সব একদিন এক বস্তা ধান মাথায় একা তোলা গরিব দাসের দশা প্রাপ্ত হয়েছে কিনা!

অতিকায় এক কেন্নোর মত টিকিস টিকিস করে ট্রেনখানা যে পাহাড়ের গা বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠছে তার একদিকে গভীর খাঁই। সেদিকে একবার ট্রেন হেলে গেলে গড়িয়ে কোথায় গিয়ে পড়বে তা কে জানে! অন্য দিকে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে একেবারে ট্রেনের প্রায় গা ঘেসে। সেই পাহাড়ের গায়ে ফুটে আছে লাল সাদা হলুদ নীল নানারঙের অজস্র জংলা ফুল। যা দেখে মনে হয় কেউ যেন সেসব সুন্দর ভাবে লাগিয়ে রেখে গেছে। কোন এক স্টেশন থেকে যেন পাঁচ ছয়জন জীবনের বয়েসী নেপালি ছেলে উঠেছে ট্রেনে। তারাও সব ভিড় করে রয়েছে দরজার কাছে। প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর সেই সব তরুণরা হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নিচ্ছে। তারপর পথ চলা কোন তরুণী যুবতী দেখলে ছুঁড়ে দিচ্ছে তার দিকে। যাদের দিকে ছুঁড়ছে তারাও সব হাত নেড়ে হেসে ছুঁড়ে দিচ্ছে ভালোবাসার প্রত্যুত্তর। যে একটু বেশি সাহসী সে ছুঁড়ছে উড়ন্ত চুম্বন।

যে পথে রেল চলেছে তারই সাথে সাথে পাশে পাশে কখনো বা শঙ্খ লাগা সাপের মত জড়িয়ে পেঁচিয়ে চলেছে একটা পিচ ঢালা পথ। যে পথে যাত্রী নিয়ে আসা যাওয়া করছে প্রচুর জিপ গাড়ি। খুশির জোয়ারে গা ভাসিয়ে জিপের আরোহীরাও মেতে উঠেছে সীমিত উশৃঙ্খলতায়। স্থান কালের কারণে বৈসাদৃশ্য লাগছে না কারোরই। ট্রেনের প্রায় সব যাত্রী আনন্দে হাসছে হা হা করে। মনে হয় সারা পৃথিবীতে একমাত্র হাসি এবং কান্নার যে ভাষা তা বিনা অনুবাদে সবাই বুঝে নিতে সক্ষম। জন থেকে জনে জনে সংক্রামিত হয়ে যাচ্ছে সেইহাসিখুশি আনন্দ আহাদের মলয় মদিরতা। এই আনন্দে মূর্তিমান নিরানন্দ একমাত্র জীবন নামের এক না কিশোর না যুবক না জীবিত না মৃত মানুষ। সে তার ছোট্ট গামছায় শরীর ঢেকে শীত বাতাসের ছোবল খেয়ে একপাশে সরে থেকে সুখী মানুষ দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

ট্রেন চলছে আর চলছে। কখনো ইঞ্জিন সামনে টানে কখনো পিছনের দিকে ঠেলে পাহাড় চড়ছে। কখনো দেখা যায় রেল লাইন মাথার উপরে কখনো সোজা পায়ের নিচে। এই ঘুরপাক খাওয়া পথের নাম লুপ। সুকনা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত নাকি আঠারোটা লুপ আছে। দুরন্ত দামাল নেপালি ছেলেগুলোর এই পথের বাঁক মোচর সব নখ দর্পণে। ওরা এক একটা বাঁকে এসে চলন্ত ট্রেন থেকেজিপচলা পথের উপর নেমে পড়ে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে চা জল খেয়ে গোছাখানেক ফুল ছিঁড়ে পাহাড়ি চড়াই বেয়ে হেঁটে এসে আর এক বাঁকে বসে থাকে। যেখানে মানুষ পৌঁছে যাবার বিশ মিনিট বাদে পৌঁছাচ্ছে ট্রেন। আবার ওরা ট্রেনে উঠে শুরু করে দেয় হুল্লোড়। যার নাম যৌবন জল তরঙ্গ। কয়েক ঘণ্টা ওরা এসব করার পর কোন এক স্টেশনে যেন নেমে যায়। কে একজন বলে এ স্টেশনের নাম ঘুম। সেখানে ট্রেনের ক্রশিং হল। যে ট্রেন দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি যাচ্ছে ওরা সব সেই ট্রেনে গিয়ে উঠল। এবার ওরা হুল্লোড় করতে করতে নিচে নামবে।

এখন মনে হয় বেলা একটা হবে। ইঞ্জিনে এখানে জল ভরা হল। যাত্রীদের সুযোগ দেওয়া হল দুপুরের ভোজন সেরে নেবার। তারপর মন্থর পায়ে আবার রওনা দিল ট্রেন। এখন শীত আগের চেয়ে ঢের বেড়ে গেছে। জীবনের ছোট্ট গামছা গেঞ্জিতে সে শীত বাধা মানতে চাইছে না। এ ট্রেনে ওর মতো উদোম যাত্রী আর কেউ নেই। সব প্যান্ট কোর্ট টুপি মাফলারে ঢাকা। কিছু যাত্রী এমন আছে দেখে বোঝা যায় তারা গরিব কেননা তাদের প্যান্ট কোট মলিন ছেঁড়াকোরা। কিন্তু সে যেমনই হোক শীত তো মানছে। জীবনের তো তাও নেই।

এরপর বেশ কয়েকঘণ্টা ট্রেন চলে অনেকগুলো স্টেশনে পিছনে ফেলে ট্রেন পৌঁছাল কার্শিয়াং। তখন ঘড়ির কাঁটায় সময় মনে হয় পাঁচটা হবে। উঁচু একটা পাহাড়ের মাথায় জোরালো সার্চলাইটের মতো জ্বলছে বিল্টুদায়ী সূর্য। আর পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে সে পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবে। সমতলের ঢের আগে এখানে দিবাবসান ঘটবে।

ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী এখানে নেমে গেছে। কামরায় আর সাত আট জন অবশিষ্ট মাত্র। সেই নিয়ে আবার চলা শুরু করল ট্রেন। জীবন এখন একটা বসার জায়গা পেয়ে হাঁটু মুড়ে ছোট হয়ে বসে পড়ে। এখানে হাওয়া একটু কম তাই শীতও কম। কিছুক্ষণ পরে উঁচু নিচু পৰ্বত শ্রেণীর মাথায় মাথায় যেখানে যেখানে লোকালয় আছে জ্বলে ওঠা আলোকমালা দেখতে পায়। পাহাড়ি নৈঃশব্দতার মধ্য দিয়ে ছুটে চলা ট্রেনখানাকে তখন মনে হয় যেন নক্ষত্র রাজ্যের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা কোন মহাকাশ যান। জীবন বসেছে ট্রেনের ডানদিকে। ওর ডানদিকে গভীর গিরি খাদ, মাথা উঁচু পাইন দেবদারুর বন। তার ও পাশে আকাশের গায়ে ঘুমন্ত পাহাড় পর্বত গিরিশৃঙ্গ।

এখন জীবনের এসব দৃশ্যে মুগ্ধ হবার সময় নেই। সে ভাবছে আর কতক্ষণ পরে ট্রেন দার্জিলিং পৌঁছাবে। সেখানে এরপর কি ঘটবে। কি বিস্ময় বিপদ ঘটনা দুর্ঘটনা অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে। এখনই শীতকামড়ে শরীর কাতর। রাত যত বাড়বে শীতও বাড়বে। কোথাও একটু মাথা গোঁজার গরম জায়গা না পেলে তখন কি হবে! এখন আবার মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। এ সেই সমতলের আষাঢ়স্য ধারা নয়। এ উড়ে চলা পরিব্রাজক মেঘ। যা উড়তে উড়তে কোথাও থেমে গিয়ে ঝির ঝির করে খানিকক্ষণ ঝরে যায়। তাই এই বোদ তো এই বৃষ্টি। পাহাড় জুড়ে এমন লুকোচুরি খেলা চলতেই থাকে এই সময়টায়। জলের ছিটে গায়ে পড়তে মনে হল যেন সুচের মত লোমকুপ থেকে চামড়া ভেদ করে হাড়ে গিয়ে বিধছে। এত ঠাণ্ডা। সরাসরি পর্বতের মাথায় জমে থাকা বরফ জল হয়ে নামছে বোধ হয়।

রাত তখন আটটা কি সাড়ে আটটা ঝিরি ঝিরি বরফ জলে ভিজতে ভিজতে ট্রেন এসে পৌঁছাল দার্জিলিং স্টেশনে। একেবারে সুনসান চারধার। এক গণ্ডা পৌষ মাঘ যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে এখানকার সব তাপ উত্তাপ প্রাণের স্পন্দন ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। চারদিকে ছেয়ে আছে কেমন একটা গা ছমছমে অচেনা অন্ধকার। যে কজন যাত্রী ট্রেন থেকে নেমেছে সবাই কুলির মাথায়, না, কুলিরা এখানে মাথায় মাল বয় না, বয় দড়ির ঝোলায়, পিঠে। সেভাবে মালপত্র নিয়ে চলে যায় ভিজতে ভিজতে যে যার গন্তব্যে। জীবন ট্রেন থেকে নিচে নেমে চারপাশ দেখে বড় মুষড়ে পড়ে। কেমন যেন বুকের মধ্যে একটা ভয়ের অস্তিত্ব টের পায়। মনে হয় তার কোথায় কি যেন একটা হিসেবে ভুল হয়ে গেছে।

বাঁকুড়ায় থাকতে একবার জীবন একা হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলো বিষ্ণুপুর। লালবাঁধ আর রাণীবাঁধ নামে ওখানে দুটো বিশাল দিঘি আছে। প্রজাদের জল কষ্ট নিবারণের জন্য মল্লরাজারা এ দিঘির খনন করিয়েছিলেন। এখন পরিচর্যার অভাবে যার জল পানের অযোগ্য হয়ে গেছে। লাল বাঁধের তীরে পৌঁছে দেখেছিল জীবন দিঘির মাঝখানে প্রচুর শাপলা ফুল ফুটে আছে। শাপলা এমন এক জলজ উদ্ভিদ যা সেদ্ধ করে খেলে খিদে মেটে। খিদের কারণে আগপাছ বিচার না করেই সেই ভরদুপুরে দিঘির পাড়ে প্যান্ট খুলে রেখে নেমে পড়েছিল জলে। সেদিন কোন বিশ্বাসে কোন সাহসে জনহীন মনুষ্যহীন লালবাঁধের জলে একা নেমে পড়েছিল জীবন কে জানে। সাঁতরে মাঝখানে চলেও গিয়েছিল। বেশ কিছু শাপলা তুলেও ফেলেছিল। কিন্তু শাপলা নিয়ে ফেরবার সময় বুঝতে পারল এভাবে একা একা আসাটা একদম ঠিক হয়নি। যেভাবে তোক সে এসে তো পড়েছে কিন্তু ফেরার পথে জলজ উদ্ভিদেরা বিছিয়ে দিয়েছে অজস্র লতা পাতার বাধা। সাঁতার কাটতে গেলে যা পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। কোনভাবে যদি এক সাথে দু পা লতায় পেঁচিয়ে যায় আর বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। এমনিতে দিঘির গভীরতা খুব বেশি নয়। তবে এত কমও নয় যে একটা বাচ্চাকে ডুবিয়ে মারতে পারবে না।

যখন সাঁতার কাটতে কাটতে হাত পা খিল ধরে আসছিল মনের মধ্যে মাথা চাড়া দিচ্ছিল ডুবে মরার নিদারুণ ভয়, তখনই কার যেন গলা শুনেছিল, যে গলা বিপদে আপদের সময় বারবার শুনেছে–সাহস হারাস না জীবন। মরার ভয়ে যেন মরে বসিস না। আশে পাশে কেউ কোথাও নেই, কারও কোনও সহায়তা পাবার আশা কোরো না। কেউ তোমাকে এই মাঠের মাঝখানে, দিঘির জলে বাঁচাতে আসবে না। বাঁচতে হলে নিজের চেষ্টায় বাঁচতে হবে। সেই চেষ্টা কর। কথায় বলে, ডুবন্ত মানুষ হাতের কাছে খড়কুটো যা পায় আঁকড়ে ধরে। জীবনের সামনে খড়কুটো ছিল না। থাকার মধ্যে ছিল এক আঁটি শাপলা। যা সে জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। তখন সেই শাপলা ধরে জলের উপর শরীর ভাসিয়ে কিছুক্ষণ দম নেয় সে। তারপর আবার সাঁতরায় আবার দম নেয়। এভাবেই সেই লতাগুল্মর জঙ্গল থেকে এক সময় পাড়ে এসে পৌঁছায়। সেদিন সে মনে শপথ নিয়েছিল, এমন ভুল আর কোনদিন করবে না।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই একই ভুল আর একবার হয়ে গেছে। অন্ধকার এক দিক দিশা কুলহীন সমুদ্রের বরফ জল পড়ে গেছে সে। এখানে কেউ তার বন্ধু আপনজন বিপদতারণ নেই।

স্টেশনের উপর একজন লোক একটা কালো কম্বল জড়িয়ে সামনে একটা কয়লার উনুন নিয়ে বসে বসে আগুন সেঁকছে। তার কাছে গিয়ে জানতে চায় জীবন–এইখানে রাইতটা একটু কোথাও কাটানো যায় কিনা কন দেখি।

লোকটা মনে হয় স্টেশনস্থ খাবার দোকানের কর্মী। সে যে চোখে জীবনের দিকে তাকায় তাতে কোন কৌতূহল বিস্ময় বাৎসল্য আতিশয্য নেই। আছে বিরক্তি, ফালতু বাক্যালাপের অনিচ্ছুকতা।

বলে সে–কই হোটেল মে চলা যাও।

আমার কাছে তো টাকা নেই। আচ্ছা এইখানে কি ইস্টাশনে থাকা যায় না?

আগের চেয়েও বেশি বিরক্তি ঝরে লোকটার গলা থেকে–ইহা তো টেসনমে পুলিশ মচ্ছর তক রহনে নেহি দেতা, কেইসে রহো গে।

জীবন তার ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া হাত দুটো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু উনুনে সেঁকে নেয়। তখন আবার বলে লোকটা–কাহা রহতা হ্যায়?

বেশি দূর বলা ঠিক হবে না ভেবে নিকটস্থ স্থানের নাম নেয় জীবন। শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ির বর্ধমান রোড, সেইখানে আমাগো বাড়ি।

তো ইহা ক্যা করনে আয়া?

কামের তালাশে আইছি।

কাম! লোকটা ঠোঁট ওল্টায়। এ কাম কাঁহা। এহাকে লোক কাম কী তালাশমে নিচে যাতা হ্যায় আউর তুম নিচেসে উপর আয়া!

লোকটার কথায় জীবনের মনের মধ্যে কল্পনায় গড়ে তোলা কুবের মহলের স্বর্ণসৌধটা চুর চুর হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়। পাহাড়কে লোগ খুদ ভুখ পিয়াস গরিবীমে মর রহা। দূর সে পাহাড়কো বহুত সুন্দর দিখতা হ্যায়। নজদিক আনেসে মালুম পড়তা হ্যায় কিতনা খাই গড়া হ্যায়।

হতাশায় বলে জীবন–তাইলে হাম এখন কি করো?

ক্যা করেগা?মর। মরনেকে লিয়ে তো আয়া। কথা তার শেষ। লোকটা উনুন নিয়ে সামনের দোকানে ঢুকে দরজা বন্ধ করে নেয়। কে কোথাকার একটা উটকো লোক তার জন্য সে কেন মাথা ব্যথা করবে। বর্তমান সময় বড়ই আত্মকেন্দ্রিক। এত সময় কার আছে যে, এক অচেনা আপদের বিষয়ে দুর্ভাবনায় ডুববে। কিন্তু জীবন এখন কি করবে? কী করবে জীবন? যেমন বলল লোকটা, মরে যাবে?

মরে তো যাবেই। সে চাক বা না চাক। শীত যেরকম হামলে পড়েছে সারারাত যদি সে শরীর ছোবলায় প্রাণ দেহ ছেড়ে পালাবে। কোনভাবে তাকে আটকে রাখা যাবে না দেহের চোর কুঠরির মধ্যে। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে জীবন যখন অনাগত ভব্যিতের জন্য একরকম প্রায় প্রস্তুত তখনই ট্রেনের হুইসেল তীক্ষ্ণভাবে বৃষ্টি ভেজা রাতের বাতাস কাঁপিয়ে বেজে উঠল। কি ব্যাপার? ট্রেনের চাকাও যে পিছন দিকে গড়াতে শুরু করেছে একটু একটু করে। কেউ বলেনি তবু বুঝতে পারল, ট্রেন এবার ফিরে যাবে। এ সময়ে জীবনের বোধ বুদ্ধিতে যা এল তাই করল সে। আবার উঠে পড়ল ট্রেনে।ফিরে যাবে। ফিরেই যাবে জীবন। না ফিরে গিয়ে আর তার কি বা করার আছে। অলকাপুরী তার জন্য কোন শুভ সংবাদ নিয়ে অপেক্ষা করে নি।

বলতে গেলে প্রায় ফাঁকা ট্রেন ঘণ্টা দেড়েক চলার পর পৌঁছে গেল কার্শিয়াং। যাবার বেলা এর ডবল সময় লেগেছিল। সেটা চড়াই, এটা উতরাই। জগতের সব জিনিসের ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম। উঠতে লাগে বহু সময় বহু কষ্ট বহু দৃঢ়তা কিন্তু নামতে হলে কোন প্রয়াসই লাগে না। একটা অপপ্রয়াসই যথেষ্ট।

রাত তখন দশ কি সাড়ে দশটা। শীতার্ত রাতের পাহাড়ি স্টেশন কার্শিয়াংয়ে এসে সেই যে ট্রেন থামল, একেবারেই থেমেই গেল। নট নড়ন চড়ন। কামরাগুলো প্লাটফর্মে ফেলে ড্রাইভার গার্ড উধাও হল। আজকের মত তাদের ডিউটি শেষ। ট্রেন চলার ইতি আজকের মত। আবার চলবে কাল। সকাল সাতটায়। কার্শিয়াং দার্জিলিংয়ের চেয়ে উঁচুতে। ফলে সেখানে শীতও বেশি বৃষ্টিও বেশি। জীবনের ক্ষেত্রে এ যেন গরম কড়াই থেকে রক্ষা পেতে আগুনে ঝাপানোর সামিল হল। কি আর করে জীবন, ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নেমে চারদিকে কাতর চোখে তাকায় সে। যদি কোথাও কোন আশার আলোর সন্ধান মেলে, যদি পাওয়া যায় প্রাণ বাঁচানো প্রাণের উত্তাপ নেই। চারদিকে অন্ধকার। লোডশেডিং নয়। এমনিতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে তবে সে আলোয় এত উজ্জ্বলতা নেই যাতে জীবন আলোকিত হয়। মনে হয় পরিবেশ বিরূপ নয়, ভয়ংকর বিরূপ।

প্লাটফর্ম একদম ফাঁকা। এটা অফ সিজন। এ সময়ে ভ্রমণার্থী মানুষেরা এখানে আসা তেমন একটা পছন্দ করে না। তাছাড়া আজ বৃষ্টিটা একটু বেশি হচ্ছে। সবটা মিলিয়ে সঠিক সময়ের অনেক আগে, বলা চলে প্রায় সূর্য ডোবার সাথে সাথে মানুষজন, যারা পথে ছিল সবকে সব ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এক পা দু-পা করে হেঁটে জীবন একটু সামনের দিকে যেখানে জিপ স্ট্যান্ড সেদিকে চলে গিয়েছিল। গোটা কয়েক জিপ যেখানে দাঁড় করানো যার উপর বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। কিন্তু কোনও লোকজন দেখা গেল না। আছে হয়তো জিপের ড্রাইভাররা জিপের মধ্যে বসে শুয়ে। অকারণে কেন বৃষ্টিতে ভিজবে!

সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ট্রেনের দিকে তাকাতেই বুকটা কেঁপে যায় জীবনের। একজন রেলের কর্মচারী রেল কেবিন থেকে বেড়িয়ে এসে ট্রেনের প্রতিটা কামরায় লক লাগিয়ে দিচ্ছে। চাবি তার কাছে থাকছে। যা ঘুরিয়ে সে কাল দরজা খুলে দিলে যাত্রীরা উঠতে নামতে পারবে। কিন্তু জীবন এখন কী করবে! কোথায় বসে কাটাবে হিম তুহিন ভয়াবহ রাত! ট্রেনের কামরায় স্থান পেলে তবু একটা কথা ছিল। খোলা প্লাটফর্মে থাকতে হলে যা ঘটবে, সে কথা ভেবে বুকের কি দোষ সেতো কেঁপে যাবেই। কোন মানুষের এমন বুকের পাটা, যে মৃত্যু ভয়ে কাঁপে না।

আর কি! হয়ে গেল হিসেব নিকেশ। এই রাত জীবনের শেষ রাত। জমে বরফ হয়ে মরে পড়ে থাকার রাত। তার আর এমন কি বিলম্ব। এক ঘণ্টা দু-ঘণ্টা তিন-ঘন্টা। নশ্বর এই কায়াটা কতক্ষণ সইতে পারবে এমন বাঘের মত হাড় কাঁপানো শীতের কামড়!

বৃষ্টি ঝরা রাত, সাথে সাথে হাড় হিম করা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। কোথাও কোন মাথা গোঁজার ঠাই নেই। এই অবস্থায় বাঁচবার কোন পথ কি থাকে! মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি, ফাঁসির দড়ি গলায় চেপে বসার পরেও একবার প্রাণপণে শেষ নিঃশ্বাস টানে। যদি এক সেকেন্ডও বেঁচে থাকা যায়। বেঁচে থাকার এই আকুতি, অদম্য অভীপ্সা, মরণান্তিক প্রয়াস–এর নাম জীবন সংগ্রাম। হার জিত বড় কথা নয়, বড় কথা মরার আগে না মরা। শেষ নিঃশ্বাস পড়ার আগের নিঃশ্বাস পড়া পর্যন্ত লড়ে যাওয়া, ভীষণ ভাবে বেঁচে থাকা।

কান পাতে জীবন, যেন অন্ধকার সমুদ্রের ওপার আকাশ ছোঁয়া দুর্গম পর্বতের কোন এক গুহা থেকে মেঘে ঢাকা নভোমণ্ডলের ওপাশের কোনও নাম না জানা নক্ষত্র থেকে ভেসে আসে সেই মৃত্যুঞ্জয় মহামন্ত্র, চরৈবেতি চরৈবেতি চরৈবেতি। জীবন এগিয়ে চল। এগিয়ে চল জীবন। মরার আগে মরে বসিস না। ডোবার আগে হাল ছাড়িস না। বড় পরিচিত, প্রিয় এই কণ্ঠস্বর। এ রব নাদ শব্দ ধ্বনি জীবনের বড়ই চেনা।

এগিয়ে যায় জীবন। প্ল্যাটফর্ম থেকে নিচে নেমে ট্রেনের অপর পার্শ্বে গিয়ে চারদিক দেখে নেয়। চোখে একেবারে তার আজ রাতচারা শিকারী জন্তুর চাউনি। না কেউ তাকে দেখছে না। এসময়ে যে কোনও দুষ্কর্ম করা যায়। সে ট্রেনের কাছে গিয়ে একটা দরজার গায়ে ধাক্কা দেয়। যা ভেবেছে ঠিক তাই, খুলে যায় দরজা। রেলের কর্মচারী, সব সরকারি কর্মচারীর যা স্বভাব ধর্ম তার বাইরে যেতে পারেনি। প্ল্যাটফর্মের দিকের ট্রেনের দরজা কটায় লক করে পিছনেরগুলো খোলা রেখে অর্ধেক শ্রম বাঁচিয়ে নিয়েছে।

জীবন খোলা দরজা দিয়ে কামরার মধ্যে উঠে বুকের সঙ্গে হাঁটু ঠেকিয়ে গোল হয়ে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ে। বাইরে থেকে এখানে বেশ ঠাণ্ডা বেশ খানিকটা খুব স্বাভাবিক কারণেই কম। মনে হয় জীবনের, কষ্ট হবে, তবে এভাবে এই রাতটা কাটিয়ে দেওয়া কঠিন হবে না। অন্ততঃ মরণকে ফাঁকি দিয়ে এ যাত্রা বেঁচে থাকা গেল।

রাত তখন কত হবে তা কে জানে, সারা পাহাড় জুড়ে ছেয়ে গিয়েছিল কোন মায়াবী জাদুকরের জাদুকাঠির নির্দেশে নেমে আসা মায়া ঘুমে। পাহাড়, গাছপালা, ঘর-বাড়ি, পথ-ঘাট, যানবাহন সব ডুবে গিয়েছিল সুপ্তির অতল গহ্বরে। কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া ছিল না। শুধু দমকা বাতাস আর বৃষ্টির জল ঝরার মৃদু আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না কোথাও। লাইট পোস্ট আর প্ল্যাটফর্মের শেডে ঝোলানো আলোগুলো জ্বলছিল কোনও ক্লান্ত দৈত্যের সহস্র লোচনের মত ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে। কিছু আলো চুঁইয়ে রেল কামরার জালিকাটা জানালা দিয়ে জীবনের চারপাশেও এসে পড়েছিল। তবে তাতে কামরার অন্ধকার দূর হয়নি। কিছু পাতলা হয়ে গিয়েছিল মাত্র। একসময় কামরার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক শব্দ হল। একটু ঘুম ঘুম এসেছিল জীবনের। সেই শব্দে চোখ খুলে গেল তার। টের পেল সারা কামরাটা চোলাই মদের কটু গন্ধে ভরে গেছে। চোখে পড়ল, আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে কান মাথা মুখ ঢাকা হাঁটু পর্যন্ত কোট পড়া একজন মাতাল মানুষ। তার পা টলছে আর গলা দিয়ে বার হচ্ছে গর গর ইঁদুর ধরার আগে বিড়ালের স্বর।

কি করে সে টের পেয়েছে যে, এই দুর্যোগময় রাতে ট্রেনের কামরায় একটি অরক্ষিত অভিভাবকহীন দুঃস্থ বালক আছে তা কে জানে! সে তার টলোমলো পায়ে এগিয়ে এল জীবনের দিকে। গামছা সরিয়ে মুখ দেখল, একে নেশা তায় কামরায় অপ্রতুল আলোয় দাড়ি গোঁফ শূন্য জীবনের কিশোর মুখটা কোন যুবতীর বলে ভ্রম হল। এই আততায়ী অন্ধকারে যাকে ধর্ষণ করলে রক্ষা করার কেউ নেই। সে তার মাতাল মানসিকতায় টালমাটাল পায়ে এগিয়ে এসে জীবনের প্যান্টের বোতামে হাত দেয়। তর সয় না তার, বোম খোলায় দেরি হলে টেনে ছিঁড়েই ফেলবে।

এমন আকস্মিক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না জীবন। ভয়ে, আত্মরক্ষার তাড়নায়, ঘৃণায় ক্রোধে তার ডান পাটা ছুটে গেল। সেটা যেখানে গিয়ে লাগল দুর্ভাগ্যবশতঃ সেখানেই লোকটার অণ্ডকোষ ঝুলছিল। পুরুষশরীরের এটা এমন এক দুর্বলতম স্থান যেখানে লাথি তো অনেক বড়ো জিনিস, সামান্য টোকা পড়লেও অতিবড় পালোয়ান বাপ বলে শুয়ে পড়ে। ছিটকে পড়ল লোকটা। তার গলা থেকে তখন যে আওয়াজ বের হল তাকে কাতরানো, আর্তনাদ গোঙানী যা হোক একটার সাথে তুলনা করা যায়। সেই আওয়াজ না জীবনের ভারাক্রান্ত কান্না কে জানে, কি শুনে যেন প্লাটফর্মের পাশের জিপ স্ট্যান্ডে থেকে দুজন লোক ছুটে এল। কোন পাশের দরজা খোলা থাকে তা তারা মনে হয় জানে। সেই দরজা দিয়ে সোজা ট্রেনের কামরায় ঢুকে পড়ল। মাতাল লোকটা ওদের হয়তো চেনে, পরিচয় জানে। সে চেনা হয়তো সুখদায়ক কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে হয়নি। সে-ক্যা শালে! ফির সে? মাত্র এইটুকু শুনে শরীরের কষ্ট শরীরে বয়ে ছুটে পালাল।

এরা সব জিপ গাড়ির চালক। যে পালিয়েছে এবং যারা দাঁড়িয়ে আছে তিনজনই হিন্দিভাষী। নাক ছোট চোখ গোল চেহারাও নেপালিদের মতো ফর্সা নয়। একজন জীবনের দিকে তাকিয়ে পালিশহীন গলায় বলে, কৌন হ্যায় রে তু?

জীবন এখনো যথেষ্ট ভীত। সেই ভীতি জড়ানো, ক্ষুধায় আধবোজা গলায় সে তার এখানে আসার কার্যকারণ সংক্ষেপে বলে দেয়। দুজনার মধ্যে যার চেহারা একটু লম্বা, বয়েস ত্রিশ বত্রিশ সে খসখসে গলায় যেন আদেশ করে, চল।

কোথায়?

মেরে সাথ।

কেন?

নেহী তো জার মে মর জায়েগা।

জিপ চালক লোকটা জীবনকে নিয়ে গিয়ে তার জিপের পিছনের সিটে শুইয়ে দেয়। গায়ে দেবার জন্য দেয় একটা ছেঁড়া কোট। বলে, সুবে হোতে হি বাপস চলা যা। এহা কুছ নেহী মিলনে বালা। একদম ফালতু আয়া। তারপর সামনের সিটে শুয়ে পড়ে। পাহাড় অঞ্চলে বাস করা মানুষ। এখন তো শীত এমন কিছু নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ভোস ভেঁস করে নাক ডাকা শুরু হল। কিন্তু জীবনের ঘুম আসে না। অজানা পরিবেশের অনিশ্চিত অবস্থা। পেটের খিদে, তার উপর হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার মনের উপর চাপ, ওকে ঘুমাতে দেয় না। এপাশ ওপাশ করে রাত কেটে যায়।

তখন সূর্য উঠেছে উঁচু পাহাড়টার মাথায়। বৃষ্টি ধোয়া সবুজ চা বাগানে দেবদারু পাইন সেগুণ গাছের ডালে পাতায় প্রভাতী রোদ হাসছে কিশোরী মেয়ের মত। মানুষজন অল্প স্বল্প ইতিমধ্যে বেড়িয়ে পড়েছে পথে। দোকান বাজার খুলে গেছে। দিনশুরু হয়ে গেছে ছোট্ট পার্বত্য শহর কার্শিয়াংয়ে। জিপ চালক ঘুম থেকে উঠে জীবনকে নিয়ে যায় এক দোকানে। পনেরো পয়সায় এক কাপ চা দশ পয়সায় দুই স্লাইজ রুটি কিনে দেয়। বলে খা লে–আউর আভি টেরেন ছুটনে বালা হ্যায়। উসমে বইঠকে বাপস চলা যা। ফির কোভি নেহি আনা।

এক গলা কৃতজ্ঞতায় ডুবে যায় জীবন জিপ চালকের বদান্যতায়। এই প্রথম, এর আগে আর কেউ কোনওদিন প্রতিদানের আশা না রেখে তার জন্য এক পয়সাও খরচ করেনি। বলে সে–যো আপনে বলা ওহি করে গা। ফিরত যায়ে গা!

বেলা তখন দুটো আড়াইটে। যে ট্রেনখানা কাল এখান থেকে চলে গিয়েছিল, আজ এখন ফিরে এসেছে। সেই ট্রেনে চেপে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে এক ব্যর্থ বিষণ্ণ পরাভূত মানব সন্তান। যার নাম জীবন। ফিরে এল দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়িতে। পাহাড় থেকে সমতলে, আকাশ ছোঁয়া উচ্চতা থেকে, কল্পনায় গড়ে তোলা স্বর্ণপুরী থেকে, বাস্তবতার কঠিন ধরাতলে। সেই চেনা আকাশ মাটি মানুষের মাঝে। এখানকার আবহাওয়া এখনো শরীরের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠবার সময় কালের ঋতুচক্রে আবর্তিত হয় নি। বাতাসের সেই সূঁচ ফোঁটানো তীক্ষ্ণ কামড় অনুপস্থিত। রাতও এখানকার কম অন্ধকার কম ভীতিকারক। ফলে, দশ বারো ঘণ্টা এখানে আরো বিনা কারণে কাটিয়ে দিতে জীবনের কোন অসুবিধা হল না। কোন আশায় এখানে পড়েছিল, মনের অতলে আঁতিপাতি করে তার বিশ্বাসযোগ্য, বাস্তবতাসম্মত, যুক্তিগ্রাহ্য কোন উত্তর খুঁজে কোনওদিন পাবে না। এর একটাই কারণ ছিল তা হচ্ছে মনঃস্থির করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না জীবন। এইসময় তার পক্ষে যা করার ছিল সবচেয়ে সহজ পথ তা হল আর একটা কোনও দোকানের সামনে গিয়ে কাজে রাখার আবেদন জানানো। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে মনের মধ্যে কাটার মত খচ খচ বিঁধছিল একটা ভয় সন্দেহ অবিশ্বাস। সেও যদি গাধার মতো খাঁটিয়ে নিয়ে মজুরি না দেয়। মজুরির যে খুব দরকার। সেই কারণে কোন মনঃস্থির করতে না পেরে স্টেশনের আশে পাশে পাক খেতে খেতে কেটে যায় সারাদিন এবং প্রায় সারা রাত।

রাত যখন প্রায় শেষতখনই শিলিগুড়ি স্টেশনে এসে ঢুকল লক্ষ্ণৌ মেল। এসেছে সেই জীবনের ফেলে আসা জাদু নগরী আসামের গৌহাটি থেকে। তখন মনে মনে ভাবে জীবন, লক্ষ্ণৌ মানে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ মানে দিল্লী, ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লী। দেশের মাথা মাথা লোকের বাস সেখানে। একবার সেখানে গিয়ে দেখলে খুব একটা খারাপ হয় না। খারাপ হবার মতো তার আর আছে বা কি! চরম-চরমতম খারাপ যাকে ঘিরে আছে তার আর নতুন খারাপ থেকে ভয় পাবার কিছু নাই। তবে যদি কোন অঘটন ঘটে, যদি তিলার্ধ পরিমাণ কোন ভালো শুভ মঙ্গল বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো তার ভাগ্যে জুটে যায়। এতকালের গতানুগতিক নিরস নির্মম জীবনযাত্রায় একটা কিছু পরিবর্তন এলেও আসতে পারে। অন্ততঃ তেমন একটা আশা করে এক দান জুয়া খেলায় অন্যায় বা ভুল কিছু হবে না।

ঘোলাদোলতলায় থাকতে একবার জীবন একটা ভাঙা ছাতার শিক কুড়িয়ে পেয়ে তাকে পাথরে ঘষে ধার দিয়ে একটা বাঁশের লাঠির মাথায় বেঁধে মাছ মারা কোচ বানিয়েছিল। এর আগে সে কোনদিন কোচ বানায়নি, মাছও মারে নি। সে বিষয়ে বলতে গেলে কোন অভিজ্ঞতাই ছিলো না। শুধু তার এক দু’বার দেখাছিল কেমন করে লোকে ওটা বানায় ও মাছ মারে। সে শিক্ষা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে সাইকেল চালাতে দেখা বা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে সাঁতার শেখার মতো শিক্ষা। তাই কোচ নিয়ে সারা দিন খালপাড় ধানক্ষেত ঘুরে বেড়িয়েও কোন ফল হল না। একটা মাছও গেঁথে তুলতে পারল না কোচে। মনের দুঃখ মনে চেপে ঘরে ফেরার সময় এ কোচ দিয়ে আর কি হবে’ ভেবে রাগে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ধান ক্ষেতের দিকে। কিন্তু তখনই ঘটে গিয়েছিল এই আশ্চর্য ঘটনা। শত চেষ্টায় যা সে পারেনি, বিনা চেষ্টায় তাই ঘটেছিল। একটা শোল মাছের বাচ্চার পিঠে গেঁথে গিয়েছিল কোচের চোখা সিক। সে মাছের বাচ্চার বয়স চার পাঁচ দিনের বেশি নয়, লম্বা ইঞ্চি দেড়েক মাত্র। মনে হয় ঈশ্বর তার ভাগ্যে ওই রকমই মুক্তি নির্ধারিত করে রেখেছিল বলেই ওভাবে মারা পড়ল নাহলে তার মৃত্যুর আর কোনও ব্যাখ্যা হয় না।

.

আকাশের দিকে মুখ করে তীর ছুঁড়লে তা শিকারের গায়ে গিয়ে বেঁধে, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়লে তা সঠিক স্থানে গিয়ে পড়ে, সে সব কখন? যখন কপাল ভালো থাকে। সবার নয় কারো কারো এভাবে কপাল ফিরেছে। জীবন এসব গভীর ভাবে ভেবে বুঝে অথবা কিছুই না ভেবে না বুঝে উঠে পড়ে লক্ষ্ণৌ মেলের তৃতীয় শ্রেণীর চামকাটা ভিড় কামরায়। শুরু হয় জীবনের খালি পেটে শুন্য ট্যাকে আড়াইদিন ব্যাপী আপাতঃ দৃষ্টিতে অনর্থক উদ্দেশ্যহীন আশা আশ্বাস ছাড়া এক দীর্ঘ রেল যাত্রা। চান নেই খাওয়া নেই ঘুম নেই শুধু চলা আর চলা। দিনের বেলা ট্রেনে তেমন একটা ভিড় থাকে না। রাত যত বাড়তে থাকে তত ভিড় গাদা মেরে যায়। কোন এক স্টেশনে যেন ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে জল খেতে গিয়ে ভিড়ের কারণে কামরায় আর উঠতে পারল না। জীবন একা নয় তার মত অনেকেই পা রাখার জায়গা পায়নি কোথাও। তখন সবাই মিলে প্রাণ হাতে করে গিয়ে বসেছিল দুটো কামরাকে পরস্পরের সাথে জুড়ে রাখা লোহার শিকলের উপর। কয়লাচালিত ইঞ্জিন থেকে ভকভক ধোঁয়ার সাথে গরম কয়লার কুচি, আগুনের ফুলকি উড়ে উড়ে এসে পড়ছিল মুখে মাথায় চুলে। ধুলো মাখা জট বাধা চুলে সে কুচি আটকে যাচ্ছিল। পোড়াচ্ছিল চামড়া! উপায় ছিল না পোড়া থেকে নিস্তারের। হাত দিয়ে আগুন আটকাতে গেলে সার্কাসের তারের মত শিকল থেকে নিচের রেল লাইনের উপর পড়ে যাবার ভয় ছিল।

এই দীর্ঘ যাত্রা পথে একবার টিকিট চেকারের সামনে পড়ে জীবন। বেলা তখন নয় কী দশটা। দাড়িওলা বৃদ্ধ এক চেকার কোথায় কোন স্টেশন থেকে যেন উঠে পড়ে ট্রেনের কামরায়। একদিক থেকে টিকিট পরীক্ষা করতে করতে এসে যায় জীবনের সামনে। তারপর হাত বাড়ায়–টিকিট। এই প্রশ্নের একটাই জবাব জানা আছে জীবনের–নেই। তখন চেকার লোকটি নরম গলায় জানতে যায়–কাহা যায়ে গা?

জীবন যেখানে যাবে বলে ট্রেনে চেপেছে সে নামটা তো জানে। কিন্তু এখন সে নাম না বলে শুধু বলে–যায়েগা বহুতদূর। বৃদ্ধ চেকার কানে একটু কম শোনে। ট্রেনের আওয়াজ তা ছাড়া জীবনের না খাওয়া গলায় ফ্যাঁস ফ্যাসে আওয়াজে অন্য কিছু শোনে–ক্যা বোলা? কাহা যায়ে গা? গোরক্ষপুর? গোরক্ষপুর বহুদূর।

লোকটাকে দেখে মনে হয় জীবনের এর একটু দয়া মায়া থাকলেও থাকতে পারে। নিজের কষ্টের কথা একে বলে একটু সাহায্য ভিক্ষা করা যেতে পারে। অনেকগুলো দিন পেটে কিছু পড়েনি। খিদেয় শরীর কাহিল। একে বললে এ নিশ্চয় তাকে দিন কয়েকের জন্য জেলে নিয়ে যেতে পারবে। বলে গেছে রাজা জেলখানায় খাবার পাওয়া যায়। কিছু খেতে হলে এখন জেলে যাওয়াটা জরুরি। লক্ষ্ণৌ এখনো কত পথ তা কে জানে। আর গেলেই যে কেউ খাবারের থালা এগিয়ে দেবে তাও তো নয়। যদি এখানে খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায় দু’চারদিন বিশ্রাম নিয়ে ফের যাত্রা শুরু করায় খুব একটা ক্ষতির কিছু নেই।

সে একটু এগিয়ে যাওয়া চেকারের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে–আমার টিকিট নাই। মানে হাম বেটিকিট।

ঘাড় ঘুরিয়ে জীবনকে দেখে বলে চেকার–ও তো পহেলে বোল দিয়া ক্যা! ফির ক্যা?

হাম এহি বোলতা হ্যায় যে আপনি কী আমাকে ধরে নিয়ে যাইতে পারতা হ্যায়।

কিউ?

এতক্ষণের বৃদ্ধ নরম চেহারার চেকার লোকটার চোখ লাল চেহারা রাগী রাগী হয়ে ওঠে। সেই রাগ গলায় ঢেলে বলে সে–যাঃ ওই কোণায় গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। ধরে নিয়ে যাব! শালা যাদের ক্ষমতা আছে টিকিট কাটার তারাই কাটে না। তাদের ধরতে পারি না, একা কী করব। সাথ ফোর্স দিক। তা তত দেবে না। মরব নাকি ডিউটি করতে গিয়ে? তুই তো বেচারা গরিব। দেখলেই বোঝা যায়, খাওয়া জোটে না। তোকে ধরে কি হবে। ধরব না! যা বস গিয়ে ওদিকে।

জীবনের সবিনয় নিবেদনে নরম লোকটা রেগে তো গেছে কিন্তু এমন রাগ নয় যাতে জীবনের লাভ হয়। পরের স্টেশনে চেকার নেমে যাবার আগে জীবনকে আশ্বস্ত করে যায়–মেরা ডিউটি গোরক্ষপুর তক। যা বেটা কোই ডর নেহী।

সেদিন সারা দিন সারা রাত আর কোন চেকার পুলিশ কারো সাথেই তার দেখা সাক্ষাৎ হলো না। নিঝঞ্ঝাটে অবশেষ শেষ হলে বাংলা থেকে বিহারের মধ্যে দিয়ে উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত পৌঁছাবার নিখরচার দীর্ঘ যাত্রা। ট্রেন এসে থামল লক্ষ্ণৌয়ের চার বাগ স্টেশনে। সময় তখন সকাল সাতটা। বাতাসে একটু শীত শীত ভাব। ট্রেন থেকে নেমে শতশত যাত্রীর সাথে মিশে যেন মিছিল করে গেটের দিকে আগাল জীবন। গেট পার হতে পারলেই পাওয়া যাবে স্বাধীনতা, ভয় থেকে মুক্তি। গেটের ও পারেই আছে উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌ শহরের মাটি, পথ মানুষ। লক্ষ্ণৌ সেই অতীত কালের নবাব বাদশা গজল ঠুংরি বাইজি নর্তকী প্রসাদ ইমারতের শহর। শরীরের অবস্থা বিশেষ সুবিধার নয়। একে আর দানাপানী না দিয়ে বেশি দূর টেনে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাই কটা দিন এখানে থাকতে হবে জীবনের। কিছু খাবারের জোগাড় করতে হবে। তারপর আবার যাত্রা শুরু করবে।

গেটের দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে কালো কোট পড়া দুজন চেকার। তারা একে একে যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করে যেতে দিচ্ছে গেটের বাইরে। জীবনের টিকিট নেই। কিন্তু সে নিয়ে কোন ভাবনাও নাই তার। কি করবে চেকার! কী করারই ক্ষমতা আছে তার? হয় সে ধরবে নয় ধরবে না। ধরলে হয় জেলে দেবে নয় ছেড়ে দেবে। এদের যেটাই করার জীবনের তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। সে সহজ পায়ে সামনের দিকে আগায়।

কিন্তু সেদিকে আর যেতে পারল না। গেট তখনো কুড়ি পঁচিশ ফুট দুর। কর্কশ গম্ভীর এক গলার আওয়াজে পা থেমে গেল–এই রোখ, চেকার নয় তাকে ধরে ফেলেছে জি.আর.পিবিভাগের এক হাবিলদার। মাঝবয়েসী, মোটা গোঁফ মোটা শরীর চোখে কালো চশমা হাতে বেতের লাঠি খাকি হাফ প্যান্ট পায়ে বুট। তবে গায়ে সাদা জামা। লোকটাকে দেখে জীবনের বুনো শুয়োর উপমাটা মনে পড়ে যায়। পথ আগলে দাঁড়িয়ে ঘোঁত ঘোত করে বলে সে–কাহা যায়েগা?

বড় লালের দোকানে অনেক দিন থাকার কারণে হিন্দিটা বুঝতে ওর বিশেষ অসুবিধা হয় না। অসুবিধা হয় বলার বেলায়। জীবন তার বাঙাল টান যুক্ত হিন্দিতে হাবিলদারের কথার জবাবে বলে–ওই দিক যায়েগা। গেটের বাইরের দিক।

কাহা সে আয়া?

কলকাতা, অতদূর বলাটা কি ঠিক হবে! অতদুর থেকে বিনা টিকিটে এসেছে তা নিজেই স্বীকার করে নিলে জেল জরিমানাও তো সেই রকম হবে। তার চেয়ে একটু কম বলা যাক। দিন ছয় সাত যাতে জেল হয়। বলে জীবন, গোরখপুর থিকা আয়া।

গোরখপুর মানে লক্ষ্ণৌ থেকে কুড়ি বাইশ ঘণ্টার পথ। তাই শুনে হাবিলদার চমকে যায়। এ কাহা আয়া মালুম হ্যায়?

হাঁ হয়, এ লক্ষ্ণৌ।

কিউ আয়া?

কিউ মানে কেন। কেন জীবন গোরক্ষপুর থেকে লক্ষৌ এসেছে তা জানতে চায় হাবিলদার। বুঝতে চায় কোনও অপকর্ম করে পালিয়েছে কিনা। কিন্তু এখন জীবন কি বলে। কি বলে পুলিশ লোকটাকে বিশ্বাস করাবে সে সত্য বলেছে। সদা সত্য কথা বলিবে। সতমেব জয়তে। এ সব কথা বলতে বা শুনতে যতটা মধুর হোক আসলে তা মোটেই মধুর নয়। বাস্তব সত্য এই যে, সব সময় সত্য কথা চলে না। সময় বিশেষে সত্যটাই চরম মিথ্যা হয়ে যায়। সেটা জীবন এই ছোট্টবয়েসে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছ। যদি সে বিনোদ সাহাকে কলকাতার কথা না বলে নিউ জলপাইগুড়ি বা আশেপাশের কোন ঠিকানা বলতে পারতো তবে কী ওরকম নির্ভয়ে টাকাগুলো মেরে দেবার সাহস পেতো?

তবে সে যা হোক, এখন এই চরম সন্ধিক্ষণে হাবিলদারকে যদি বলে জীবন–আমি খুব গরিব তাই বিশ্বের বৃহত্তমের তালিকায় নাম থাকা শহর কলকাতা থেকে লক্ষ্ণৌ শহরের এক দোকানে কাজ করতে এসেছি–সেটা আর যার কাছে হোক বা না হোক দিন রাত চোর ছ্যাচোর ধরা এক পুলিশের কাছে সত্য হবে না। তাই বাধ্য হয়ে জীবন এখন একটা সত্যকে বিনির্মাণ করে। সব কিছুর মতো সত্যকেও নির্মাণ ও প্রাণ দান করা যায়। রবারের মতো বিস্তার সংকোচনও করা চলে। সেই জন্যই তো একজন পুরুলেছেন–রায়ে জন্মভূমি অযযাধ্যার চেয়ে কবির মনোভূমি অনেক বড়।কবি হোক বা কথকতার উপস্থাপনাটাই হচ্ছে আসল জিনিস। তার রচনাকৃত কৌশলে মিথ্যাটা সত্যি সত্যিটা মহা সত্যি হয়ে যায়।

চোখে এক ফোঁটা জল এনে বলে জীবন, “হামলোক রিফুজি। পূর্ব পাকিস্তানে যে রায়ট হইলো তাই তে আমরা ঘরবাড়ি, জমি জাগা গোলা ভরা ধান পুকুর ভরা মাছ বেবাক ফালাইয়া এই পারে পরাণ লইয়া পালাইয়া আইছি। সরকার আমাগো থাকতে দিছিলো ক্যাম্পে। সেইখান থিকা টেরেনে কইরা নিয়া যাইতে আছিলো দণ্ডকারণ্য। বাপ মায় ভাই বইন তাগো লগে আমিও যাইতে আছিলাম। পথে এক ইস্টাশনে টেরেন থামলে মায় আমারে কয়, খোকা এটু খাবার জল নিয়া আয়। মার কথায় আমি গেছি জল আনতে। এদিকে টেরেন ছাইড়া দেছে। আমি আর উঠতে পারলাম না। মায় বাপ ভাই বোন সব হারাইয়া গেল।”

হাতের চেটোয় চোখ মুছে বলে জীবন–”হাম তো নেহি জানতে হ্যায় দণ্ডাকারণ্য কোন দিকে। একজন বলা হ্যায়, সেটা নাকি লক্ষৌয়ের কাছে। সেই শুইনা মায় বাপরে খোঁজতে হাম হিয়াপর আয়া। আপনি কি কইতে পারেন দণ্ডকারণ্য কোথায়?”

মাথা নাড়ে হাবিলদার। সে জানে না। দুশ্চিন্তায় কালো হয় জীবনের কাঁদো কাঁদো মুখ, “আপনি জানেন না কেউ জানেনা, তাইলে আমি তাগো কেমন খুইজা পামু। এখন আমি বিদ্যাশ বিভুয়ে কি করমু। কি খাইয়া বাচমু! আচ্ছা আপনেরে দেইখ্যা তো ভালো মানুষ বইল্যা মোনে হয়। আমার এটা উপকার কইরা দিবেন। কোনো জাগায় আমারে এটা কামে লাগাইয়া দিবেন। আমি খুব কাম করতে পারি।

খানা বানানে আতা হ্যায়?

আতা হ্যায়। বলে জীবন, আমি সব রান্না পারি।

চল মেরা সাথ।

যার ক্যানসার রোগ হয় তার অন্যরোগ হবার দরকার নেই। যাকে পুলিশে ধরে ফেলেছে, চেকারে কি করবে! গেট ছেড়ে সরে দাঁড়ায় গেট কীপার দু’জন। জীবনের হাত শক্ত করে ধরে তাকে নিয়ে একটা রিকশায় তোলে হাবিলদার। পঞ্চাশ পয়সা ভাড়া পথ পার হয়ে মিনিট কুড়ি বাদেশহরের শেষ সীমায়–যার ও পাশে মাঠ রেল লাইন সেখানে এক রেল কোয়াটারের সামনে এসে রিকশা থামে। হাবিলদার রিকশা থেকে নেমে পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খোলে। কোয়াটারে আর অন্য কোনও লোক থাকে কিনা তার কোন চিহ্ন নেই। আসবাব পত্র তেমন কিছু নেই ঘরে। দুঘরে দুটো দড়ির খাঁটিয়া। টাঙানো দড়িতে গামছা লুঙ্গি আর দু’তিনটে পুলিশের পোষাক। একটা টিনে কিছু আটা। মেঝেয় গড়াচ্ছে কটা আলু পেঁয়াজ। একটা শিশিতে সরসের তেল, কিছু মশলা। ঘরের এক কোণে কটা থালা। দুটো বালতি। আর বারান্দায় একটা কয়লার উনুন, যার সামনে কিছু কাঠ কুঁচো কয়লা। একটা বড় ড্রাম।

বলে হাবিলদার, “চুল্লা জ্বালানে আঁতা?”

“আঁতা।” বলে জীবন।

“তো চুল্লা জ্বালাকে আটা সান।”

হাবিলদার জামা প্যান্ট খুলে আণ্ডার ওয়ার পরা অবস্থায় একটা দড়ির খাঁটিয়ায় বসে পড়ে। হাত পা বুক সব লোমশ। বুকের এক পাশে উল্কিতে হনুমান আঁকা। গায়ে ঘাম। যা থেকে ছড়াচ্ছে। একটা বোটকা গন্ধ। যেমন গন্ধ বুড়ো পাঠার গায়ে থাকে। তাই

জীবন রান্না করতে জানে। গৌহাটিতে খুব বানিয়েছে। সে আটা মেখে রুটি বানায়। আলু চচ্চড়ি, আর রসুন ফোড়ন দিয়ে অড়হর ডাল রাঁধে।কটা রুটি কতটা ডাল রান্না হবে তা মেপে দেয় হাবিলদার। রান্না শেষ হবার পর জীবনকে বলে সে, “কাটোরামে থোরা তেল লে আ এবং সে বারান্দার এক পাশে হাত পা ছড়িয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে। তেল নিয়ে যাবার পর জীবনকে বলে–চল আব মালিশ লাগা।”

পেটে এক সমুদ্র খিদে। নাকে এসে ধাক্কা মারছে রসুন ডালের হত্যাকারী গন্ধ। পেটের শুকনো সমুদ্রে সাইক্লোন উঠছে উত্তাল হয়ে। এ বড় ভয়ংকর সময়। এ সময়ে অবাধ্য হওয়া চলে না। জীবন মালিশ শুরু করে দেয়। প্রথমে হাত তার পর পা তারপর পিঠ তারপর মাথা তারপর আর যা যা বাকি থাকে, সব হায়া বর্জন করে সর্বত্র ছোঁড়া হাতের নরম মালিশ গ্রহণ করে হাবিলদার। আ হা কি আরাম, কি আনন্দ। নরম আঙুল স্পর্শে শরীর যেন শিউরে উঠছিল। প্রায় দেড় দু’ঘন্টা ধরে প্রায় পঞ্চাশ গ্রাম তেল দিয়ে সারা শরীর মালিশ করানোয় এখন শরীরটা বেশ ঝরঝরে হয়ে গেছে হাবিলদারের। এবার চান করতে হবে। তাই জীবনকে এর পরের কাজটা বলে।

“রাস্তামে নিকালকে সোজা বায়ে তরফ যানা। সামনে কুঁয়া মিলেগা। উহাসে পানী লা।” কুয়া থেকে বালতি ভরে জল এনে একটা ড্রামে ভরে জীবন। তিনবারে আনা ছয় বালতি জলে ড্রাম ভর্তি হয়ে যায়। তখন সেই জলে অনেকক্ষণ ধরে চান করে চুল আঁচড়ে খেতে বসে হাবিলদার। আটা সে মেপে দিয়েছিল। কটা রুটি হয়েছে তা তার জানা। চারটে নিজে খেয়ে দুটো জীবনের জন্য রেখে মুখ হাত ধুয়ে খাঁটিয়ায় গিয়ে বসে খইনি ডলে। খইনি মুখে রেখে থুতু ফেলে বলে জীবনকে–যা নাহাকে রুটি খালে। জলদি কর।

জল কিছুটা ড্রামে ছিলো। সেটুকু গায়ে ঢেলে রুটি ডাল আলু চচ্চড়ি যতটুকু তারজন্য রাখা হয়েছিল খেয়ে বাসন পত্র সব মেজে ধুয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয় জীবন। তখন বড় দুটো পেতলের তালা দরজায় লাগিয়ে পোষাক পড়ে ডিউটিতে চলে যায় হাবিলদার। বলে যায়–বারান্দায় বসে থাকিস। আমি আটটার মধ্যে এসে পড়ব।

বেশ কয়েকদিন চান খাওয়া ঘুম কিছুই ছিল না। আজ চান করে যা হোক একটু পেটে দেওয়ার শরীর এলিয়ে আসে জীবনের। বারান্দায় ঝাট দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে এমন ঘুম কোথা দিয়ে যে সারা দিন কেটে যায় টেরই পায় না। ঘুম ভাঙে সন্ধেবেলায় বাচ্চাদের কিচির মিচির শব্দে। এই জায়গাটা রেলের। তার কর্মচারীদের থাকার জন্য পঞ্চাশ ষাটটা কোয়াটার বানিয়ে রেখেছে রেল কোম্পানী। একটা ছোট মাঠের চারপাশ ঘিরে এ সব কোয়াটার। যার সামনে ছয় সাত ফুট উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের গেটে লোহার দরজা। এখন সব কোয়াটারের সব লোহার দরজা খুলে মাঠে নেমে এসেছে বাচ্চারা। ঘুম থেকে উঠে হাবিলদারের দরজার সামনে বসে বাচ্চাদের হাসি খেলা হুল্লোড় দেখে মনটা ভরে ওঠে জীবনের। ভরে ওঠে বেদনার অশ্রু জলে। তারও একটা বাল্যকাল ছিল। কথা ছিল তারও এমনি খেলায় মেতে ওঠার, হেসে ওঠার। কিন্তু তা পারেনি। তার হাসি আনন্দ খেলা কাদের যেন চক্রান্তে চুরি হয়ে গিয়েছিল। এই সব শিশুদের বাপ দাদা কেউ না কেউ সরকারি কর্মচারী। সরকার দায়িত্ব নিয়েছে তাদের অন্নবস্ত্র সুখসুবিধার।তাই তাদের সন্তানরা হেসে খেলে খেয়ে মেখে বড় হচ্ছে। সরকারি কর্মচারী মানে সরকারের পোষ্য পুত্র। বেতন পাবে ঘুষও খাবে, ইচ্ছা না হলে কাজও করার দরকার নেই। বড় সুখের চাকরি, বড় সুখের জীবন। তাদের শিশুরাও সুখের রোজগারে সুখে মানুষ হচ্ছে। ওরা হাসবে না তো কারা হাসবে।

বাচ্চাদের খেলা শেষ হয়। দূরের এক মসজিদ থেকে মাইক মারফত ভেসে আসে আজানের সুর। সেই পবিত্র প্রদোষকালের পিছন পিছন এসে যায় অমাবস্যার আলকাতরা কালো ভয়ানক নিশিতপ্রিয় পিশাচরাত।

রাত আটটাতেই ফিরে এসেছে হাবিলদার। জীবনকে দেখে একটু হাসি খেলে যায় তার মুখে আছিস! তালা খুলে ঘর থেকে আবার আটা ডাল আলু বের করে দেয় সে, খানা বানা। ও বেলার মত এ বেলাও রুটি ডাল আলু চচ্চরি বানায় জীবন। হাবিলদার নিজে হাতে খাবার নিয়ে যায়। যা সে রেখে দেয়, খায় জীবন। ততক্ষণে দশটা সাড়ে দশটা বেজে গেছে। একটা হাবিলদারের দেওয়া চাদর পেতে বারান্দায় শুয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে শুয়ে পড়ে হাবিলদার। শুয়ে পড়ে কিন্তু তার ঘুম আসে না। তারই ঘরের বারান্দায় তারই কবজায় এই রাত আঁধারে শুয়ে আছে একটা ষোল সতের বছরের তরতাজা ‘লোণ্ডা’। তাহলে কেমন করে তার ঘুম আসবে। বেশ কিছুক্ষণ উস পাশ করে দরজা খুলে বারান্দায় আসে। কোথায় কোন গাছের ডালে বাধা পাখির বাসায় ঘুমন্ত পাখি ছানার উপর ছোঃ মেরেছে আর কোন এক রাতচরা শিকারী পাখি। ভয়ে দুঃখে পাখি মা ডানা ঝাঁপটাচ্ছে, কর্কশ চিৎকারে কাঁদছে। রাত্রির নৈশব্দতা ছিঁড়ে তার কান্না কাতর আর্তনাদ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারধারে।

সে রাত বড় বিভৎস কালো কদাকার রাত। পৃথিবী মনে হয় তার আবর্তন গতি পথ বদলে ফেলেছিল। বিবর্তন হাটা দিয়ে ছিল উল্টো মুখো। প্রকৃতির সব নিয়ম নীতি, বহু কষ্টে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানব সভ্যতা, কৃষ্টি সংস্কৃতি সব বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষ হয়ে ওঠার গর্ব করা এক জানোয়ার পৌঁছে গিয়েছিল সেই ভূমিকায় যা দেখে জানোয়ারও ঘৃণায় থুতু ফেলে।

হাবিলদার জীবনকে দেখে। তাকে ঘিরে আছে ঘন অন্ধকার। অন্ধকার যা আলোর বিপরীতে অবস্থান করে। আলো মানে দীপ্তি প্রভা জ্যোতি কিরণ। আলো মানে সূর্য আলো মানে সত্য। আর অন্ধকারের অর্থ শুধু অন্ধকার। ঘন কালো নিস্তব্ধ। সে অন্ধকারের গর্ভগৃহে বাস করে পাপ অন্যায় অবিচার ব্যাভিচার অত্যাচার। যে অন্ধকার ঢেকে রাখতে পারে শয়তানদের আসল অবয়ব। বড়ই সুবর্ণ সুযোগ এখন। হাবিলদার এক ক্ষুধার্ত হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে নধর হরিণ শাবক তুল্য নিরাশ্রয় নিঃসহায় জীবনের উপর। সে বাধা দিতে পারে না, শরীরে তত শক্তি নেই। চিৎকার করতে পারে না, কারণ গলার উপর একটা সবল হাত। সাথে ধমক, মাত চিল্লানা। নেহী তো গলা ঘোট দুঙ্গা। বাধ্য হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে হাবিলদারের গলগল করে ঢেলে দেওয়া আঠালো অপমান অনাচার অত্যাচার মাখে শরীর ময়। শিবপুরের মেসে, কার্শিয়াংয়ের ট্রেনের কামরায় নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল জীবন। কিন্তু এখন যাদের হাতে দেশের আইন শৃঙ্খলা নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষার ভার, সেই রক্ষকের তমঃপ্রবৃত্তি থেকে সে নিজেকে বাঁচাতে পারল না। মানব ধর্ম থেকে, পুরুষ ধর্ম থেকে, পুলিশ ধর্ম থেকে বিচ্যুত এক পাষণ্ড ধর্ষণ করল তাকে। তার আত্মা স্বাভিমান অস্মিতাকে।

কতক্ষণ চলে ছিল পায়ুদেশে সেই রবার পিষ্টকের ওঠা নামা। কত কষ্ট হয়েছিল জীবনের। ক ফোঁটা রক্ত ঝরে ছিল শরীর থেকে। সারা জীবন যত কষ্ট যত অপমান সয়েছে জীবন সে তুলনায় এ আর কতটুকু। কিন্তু মনে হয় জীবনের আজকের এই ঘটনা, এই গ্লানি অসম্মান, এর চেয়ে বড় আগে আর কিছু ঘটে নি। পরেও ঘটবে না। এই ঘটনা, যদি সে বেঁচে থাকে, সারা জীবন মনন চিন্তনকে প্রভাবিত করে দেবে। মানুষ আর তার মানসিকতা সম্বন্ধে অন্য কিছু ভাবতে শেখাবে।

ধর্ষণ এমন একটা বিভৎস ক্রিয়া যা শোনা মাত্র যে কোন সাধারণ মানুষ বিচলিত হয়ে ওঠে। ধর্ষণ এমন একটা পাশবিক ঘটনা, যা যার উপর তা ঘটে যায়, নিজের কাছে সমাজের কাছে তার মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। জীবন তখন মৃত্যুর চেয়ে ভারী, কষ্টদায়ক হয়ে যায়। প্রচলিত ধারণায় ধর্ষণ ব্যাপারটা সব সময় সংঘটিত হয় কামুক পুরুষ দ্বারা কোন দুর্বল অসুরক্ষিত মহিলার উপর।কিন্তু মহিলা দ্বারা পুরুষ, মহিলা দ্বারা মহিলা, পুরুষ দ্বারা পুরুষ ধর্ষণের ঘটনা সাধারণের ধারণায় তত পরিষ্কার উদ্বেগ উদ্রেককারী কোন বিরাট বিষয় নয়। এ সব বিশ্বাস করে নিতেও তাদের কষ্ট হবে। কিন্তু সত্য ঘটনা হচ্ছে সমকামী বিকৃতকামী দ্বারা সমাজে এসব ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে। মানুষ তো তুচ্ছ, মানুষ কুকুর গরুকেও রেহাই দেয় না।

মনে আছে জীবনের এমন একটা ঘটনার কথা। যা সংঘটিত হয়েছিল শিবপুর পুলিশ লাইনে। ফুটবল খেলা, প্যারেড করা ফাঁকা মাঠে রাত আটটা নটার সময়ে এক যুবতী কুকুর দেখে কাম মোহিত হয়ে একজন তাকে ধর্ষণ করে দিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা গোপন থাকে নি। কেউ একজন দেখে সেটা প্রকাশ করে দেয়। সেটা বহুদিন মানুষের কাছে একটা আলোচনার বিষয় হয়েছিল মাত্র তার বেশি আর কিছু নয়।

যদি কোন পুরুষ দ্বারা কোন মহিলা ধর্ষিত হয় ধর্ষকের প্রতি মানুষ ফেটে পড়ে ক্রোধে, আর ধর্ষিতার প্রতি সহানুভূতিতে। কিন্তু যদি কোন বালক বা কিশোর ধর্ষিত হয়, তার ভাগ্যে জোটে সামাজিক উপহাস। কেউ উপহাসের পাত্র হতে চায় না। তাই অধিকাংশ ঘটনা থেকে যায় অপ্রকাশিত গোপন গুপ্ত। জীবনও আশা করছে না কারও কোন সাহায্য সহানুভূতি পাবার। এ বড় বিপন্ন সময়। এ সময়ে কে কার? কে যাবে এক ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা আজব এক জীবের জন্য পুলিশ হাবিলদারের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভাগে নালিশ জানিয়ে পুলিশের ক্রোধের কারণ হতে? কেন যাবে?

এক সময় সকাল হয়। হাবিলদারের কোয়াটার পশ্চিম মুখো। তার উঠোনে রোদ একটু বিলম্বে আসে। ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল জীবন। ঘুম থেকে উঠে দেখে হাবিলদার নেই। সে তার রোজকার রুটিন মর্নিং ওয়াকে গেছে। যে ওয়াক সারবার সময়ে জীবন তার সামনে পড়ে যায়।

জীবনের এখন নিজেকে ভীষণ ঘৃণা হয়। কান্না পায় তার। নিজেকে যেন অশুচি অপবিত্র নোংরা নদৰ্মার মতো মনে হয়। যে নর্দমায় লোকে প্রস্রাব করে। মনে হয় যেন তার সারা শরীর বেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা পোকা। জ্যান্ত জীবনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যেমন ভাবে লাশ গাদায় পড়ে থাকা বেওয়ারিশ লাশ খায়। মনে হয় যেন পাঁচিলের ও পারের সব মানুষ জেনে গেছে তার চূড়ান্ত হেনস্তার কথা। গেট খুলে বাইরে গেলেই সব চোখ কুঁচকে মুখ বাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হেসে উঠবে–পোদু, ওই দ্যাখ যাচ্ছে, শালা একটা পোদু। হাবিলদার ওর পোদ মেরেছে।

শরীর জ্বলে যায় জীবনের। মনের মধ্যে মাথা নাড়ায় পোষ না মানা একটা বুনো মোষ। চোখা সিং দিয়ে গেঁথে দিতে চায় হারামী হাবিলদারটাকে। রক্তের লোহিত কণিকায় সেই পার্ক সার্কাস রাতের তুফান টের পায়। হাতটা নিস পিস করে তার। যে হাত শুঁকলে এখনো রক্তের ঘ্রাণ পায়। মানুষের রক্তের ঘ্রাণ।

ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। কিন্তু জীবন এত অন্ধ হয় নি যে তার বর্তমান অবস্থা অবস্থান বিস্মৃত হয়ে যায়। পরিণতি দেখতে না পায়।

আশি পঁচাশি কিলো ওজনের, ছয় ফুটের চেয়ে কিছু বেশি, মারপিট শেখা শরীর চর্চা করা সরকারি চাকুরে, যার সামনে পিছনে পাহাড়ের মত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহাশক্তিধর ভারত রাষ্ট্রের তাবত আইন কানুন বিচার ব্যবস্থা। সব তাকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করবে। অন্য দিকে জন্ম জনিত কারণে অপরাধী দুঃস্থ দুর্বল এক সহায়হীন কিশোর। কি তার ক্ষমতা রাষ্ট্রীক এবং সামাজিক সুরক্ষা বর্ম ভেদ করে অপরাধীর কাছে পর্যন্ত পৌঁছায় এবং তার অপরাধের যোগ্য শাস্তি দেয়?

ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড নামে, একখানা পুস্তকে লেখা আছে, যদি কোন পুরুষ দ্বারা কোন নারী ধর্ষিত হয়, ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ধর্ষকের সর্বোচ্চ সাত বছর কারাবাস হতে পারে। আর যদি কোন পুরুষ কোন বালক বা কিশোরকে ধর্ষণ করে তার সাজা যাবজ্জীবন জেল। এ দেশে প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে এক জন নারী ধর্ষিত হয়। অত না হলেও বালক কিশোর ধর্ষণের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। নারী ধর্ষকদের কালে ভদ্রে এক আধজনার সাজার কথা শোনা গেলেও বালক কিশোর এমন কি পশু ধর্ষক এক জনেরও কোন সাজা হয়েছে এমন কোন উদাহরণ নেই।

তাই এখন জীবন যতই মাথা খুড়ুক তার কোন ন্যায় বিচার হবে না। কে করবে সেই বিচার? যার গরু ধান খায় তার কাছে ক্ষেতের মালিক ন্যায় কি করে পাবে? কেউ কি পেয়েছে?

একটাই কাজ পারে জীবন। সেটা নিজের প্রতি ঘটা অপরাধের নিজে বিচার করে তার সাজা দেওয়া। রাতে হাবিলদার ঘুমিয়ে পড়লে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়া। খড়ের গাদায় সঁচ খুঁজলে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু বিশাল এই দেশের কোটি কোটি জনগণের মধ্যে থেকে নাম পরিচয় হীন এক বালককে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। মনে যে আগুন এখন জ্বলছে জীবনের, তাতে হাবিলদারকে পুড়িয়ে মারা তার পক্ষে কোন কঠিন কাজ নয়। তবে কঠিন সেটা করার জন্য দশ বিশ লিটার পেট্রোল বা কেরোসিন সংগ্রহ করা। এটা খড়ের ঘরতো নয় যে ফুলকিতে জতুগৃহ হয়ে যাবে।

তাহলে কি করা হবে। ছেড়ে দেওয়া হবে বদমাইশটাকে। এতবড় অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে? ভাবতে ভাবতে একটা পথ পেয়ে যায় জীবন। সেটা সস্তা নির্ভরযোগ্য এবং মোক্ষম। বারান্দার এক দিকে একটা তাক। যার উপর রাখা একটা ছোট আয়না যার পাশে একটা রেজার গোটা কয়েক নতুন ব্লেড। খুবই সাধারণ উপকরণ। এখানে হাবিলদার চান করে, মাথা আঁচড়ায়। দাড়ি কামায়। এখানকার একটা ধারালো ব্লেড জীবনের কাজে লাগতে পারে। মাত্র একটা পোঁচ পুরুষাঙ্গের গোড়ায়। একটা মাত্র পোঁচ।

জীবন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কাল রাতের ঘটনা যা মনের উপর এতক্ষণ জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল তা নেমে যায়। যেন কিছু ঘটে নি। যা ঘটেছে তা এমন কিছু নয়। একটা আগাম প্রস্তুতির অভাব জনিত ভুল বোঝাবুঝি মাত্র। কিছুক্ষণ পরে হাবিলদার ফিরে আসে। সহজভাবে জীবন যা কাল করেছে সেই সব কাজ সম্পন্ন করে। উনুন ধরায় আটা মাখে রুটি বানায় চানের জল বয়ে আনে তেল মালিশ করে হাবিলদারের সারা অঙ্গে। কাল তেল মাখা হাত যেখানে যেতে থমকে যাচ্ছিল আজ অবলীলায় পৌঁছে যায়। হাবিলদার তৃপ্ত হয়। এই তো চাই। লৌণ্ডা ঠিক লাইনে এসে গেছে। লৌণ্ডা হিন্দিতে বহুল প্রচলিত একটা শব্দ। যার বাংলা অর্থ পোE। যার কাজ পায়ু মৈথুন করানো।

খুশি মনে হাবিলদার খেয়ে দেয়ে চলে যায়। আর জীবন একটা ব্লেড নিয়ে প্রতিক্ষায় বসে থাকে মধ্যরাতের।

ডান আর বা, সঠিক আর বেঠিক বলে কোন কিছু হয় না। যদি কেউ পর পর দুবার বা দিকে ঘোরে নিজের অজান্তে তার একটা ডান দিকের যাত্রা হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো ছিল তাই সেদিন হাবিলদারের একটা সঠিক যাত্রা হয়ে গেল। স্টেশনস্থ জি.আর.পি. অফিসে গ্রামের বাড়ি থেকে খবর এসে পৌঁছাল, জলদি ঘর আ যা বেটা। সে ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা ছিল না হাবিলদারের। কারণ তার ছোট ভাই মেরে তার বাবার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। পুলিশের লোক, মারপিট খুন দাঙ্গায় খুব একটা বিচলিত হয় না। তবে এখানে ব্যাপারটা পারিবারিক বলে একটু যা কষ্টদায়ক হয়ে গেছে। তখুনি সে গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যায়। তবে যাবার আগে জীবনকে রেলের ইঞ্জিন মেরামতির কারখানায় একটা কাজে লাগিয়ে রেখে যায়।

হাবিলদারের কোয়াটার থেকে স্টেশনের দিকে আসবার পথের ডান দিকে এই লোকো ওয়ার্কশপ। এই ঠিকেদারের অধীনে আরো কুড়ি পঁচিশজন মজুরের সাথে মিলে রেল লাইন থেকে ছাই সরিয়ে নিয়ে গাদায় গিয়ে ফেলা এই হচ্ছে কাজ। মাইনে তার মাসে পঞ্চাশ টাকা। যেদিন বাজে না যাবে মাইনে কাটা। নো ওয়ার্ক, নো পে। মাসে পঞ্চাশ অর্থাৎ দিনে এক টাকা দশ আনা। এত কম মজুরিতে কাজের লোক পাবার কথা নয়। পেয়ে যায় কারণ কাজের শেষে সব মজুর এক ঝুড়ি করে পোড়া কয়লা নিয়ে যেতে পারে। দয়া পরবশ হয়ে হাবিলদার তার জন্য উনুন চাটু তাওয়া বারান্দায় রেখে গেছে। বলে গেছে ঠিকেদারকে, দু একটাকা চাইলে যেন দেয়। হাবিলদার এক সপ্তাহের জন্য গ্রামে চলে গেল। অক্ষত রয়ে গেল তার পুরুষাঙ্গটি।

সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে ছটা অবধি কাজ। একজন বেলচায় করে ছাই দিয়ে ঝুড়ি ভরে তুলে দেয় জীবনের মাথায়। সে নিয়ে গিয়ে দূরে ফেলে আসে। সন্ধ্যায় কয়লার ঝুড়ি পাড়ার দিকে নিয়ে যায়। কয়লা কেনার লোক প্রচুর। কয়লা বেচে পয়সা নিয়ে বাজার করে। নিজে রান্না করে। নিজে খায়। জীবনে পেট ভরে খাবার, আনন্দে থাকার সুযোগ খুব কম আসে। ভবিষ্যৎ কোন রূপ নিয়ে আসছে তা কে জানে। সাতটা দিন যখন পাওয়া গেল তাকে উপভোগ করে নেওয়া যাক। এমনই ভাবে জীবন।

সাত নয়, দশ দিন পরে পারিবারিক সমস্যা মিটিয়ে ফিরে এল হাবিলদার। তবে একা নয় এবার সাথে এসেছে তার বউ, মেয়ে। তারা এখানেই থাকবে এখন থেকে।

কে যেন বলেছে জীবনটা একটা নাটক পৃথিবীটা একটা রঙ্গমঞ্চ। হাবিলদার এখন পশুত্বকে লুকিয়ে রেখে ভাজা মাছ উল্টে খেতে না জানা পরম নিষ্ঠাবান পতিধর্ম নির্বাহ শুরু করল। তবে জীবনের জীবন যাত্রার কোন পরিবর্তন ঘটল না। নিজের বাজার নিজে করে নিজে খাওয়া চালু থাকল। হাবিলদার ঘরনির রাতের রান্না শেষ হলে সেই উনুনে কয়লা ঢেলে নিজের দুবেলার রান্না সেরে নেয় জীবন। তারপর রাতটুকুর জন্য পড়ে থাকে বারান্দার এক কোণে।

একদিক ভোলা ছোট্ট বারান্দা। উত্তর প্রদেশ হিমালয়ের কাছে বলে শীত এখানে বাংলার চেয়ে আগে আসে। একটু একটু শীত পড়া শুরু হয়ে গেছে। ভোরের দিকে হাত পা কালা হয়ে যায়। সে যা হোক আর যেমন হোক তবু একটা আস্তানা তো। নিয়মমত তার একটা ভাড়া নিশ্চয় হয়। জীবনের ভাড়া দেবার ক্ষমতা নেই। তাই হাবিলদারের হিসেবি স্ত্রী ভাড়ার বদলে বাসন মাজানো রান্না চানের জল বওয়ালে কাপ ছোপানো এসব ঘরের কাজ বিনা দ্বিধায় করিয়ে নেয়।

এইভাবে কেটে যায় এক মাস। এসে যায় বেতন পাবার দিন। মজুরদের সবার মনে উল্লাস। জীবনও ভাসছে আনন্দের জোয়ারে। আর কিছুক্ষণ পরে হাতে পাবে নগদ পঞ্চাশ টাকা। এতটাকা। সে, এমন কি তার বাপ ও এক সাথে কোনদিন হাতে ধরে দেখে নি। গামছাটা ছিঁড়ে ফর্দাফাই হয়ে গেছে। একটা নতুন গামছা কিনবে। অনেক দিন ভাত খায় নি। ভাত রান্নার কোন হাড়ি নেই। হোটেলে গিয়ে আজ ভাত খাবে। চারবাগের স্টেশনের কাছে একটা বাঙালী হোটেল আছে। বড় আশা বুকে নিয়ে বসে থাকে জীবন।

ঠিক চারটের সময় মাইনে দেওয়া শুরু হয়। একে একে সবার ডাক আসে। সবাই টাকা পেয়ে যায়। শুধু একা জীবনের ডাক আসে না। বিস্মিত জীবন ঠিকাদারকে বলে–কই সায়েব আমাকে তো টাকা দিলেন না।

ফরসা গোল মুখ মুসলমান ঠিকাদার। দেখে মনে হয় নবাব বাদশার রক্ত শরীরে আছে। শহরের মাঝখানে বিশাল বাড়ি। দু তিনটে বউ, সর্ব কনিষ্ঠ বউটার বয়েস নাকি বাইশ। বছর খানেক আগে বিয়ে করেছে।

বলে সে–তোমার টাকা তো তোমার হাতে দেওয়া যাবে না। হাবিলদার বারণ করে দিয়ে গেছে। তুমি তার বাসায় থাকো খাও। তোমার সাথে তার কি কথাবার্তা হিসাব নিকাশ আমি তো কিছুই জানি না। সে তোমাকে কাজে লাগিয়ে গেছে। বলতে গেলে তুমি তারই কাজ করছে। যা বলার তাকে বোলো।

বলে জীবন–তার বাসায় খাই সে খাবার আমি নিজে কিনে আনি, থাকি একটু তার জন্য বাসার সব কাজ করিয়ে নেয়। আপনারা যে কয়লা দ্যান মাঝে মাঝে তারও এক দু ঝুড়ি দিয়ে দিই।

সে তো আমি বলতে পারব না। তোমার আর তার ব্যাপার। আমি কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইনা।

ইঁদুর কলে পড়ে গেছে জীবন। তাকে বিনাশ করার জন্য যেন বিশ্বজোড়া ফঁদ পাতা রয়েছে, অদৃশ্য সেই মাকড়শার জাল কেটে কোনভাবে বের হতে পারছে না। কেউ তাকে ত্রাণ দিতে অবতার হয়ে আসবে না। এখন কি করে সে? কি করে জীবন নামের এক হতভাগ্য?

বোঝে সে, এখানে কাজ করতে হলে থাকার জন্য হাবিলদারের বাসায় না গিয়ে কোন উপায় নেই। আর গেলেই তার মালিশ জল ভোলা বাসন মাজা, সব কাজ সিন্ধবাদের বোঝার মত ঘাড়ে চেপে বসবে। তার পর মাস গেলে নিজের মেহনতের মজুরিও হাতে পাবে না। হাবিলদারের মত নরাধমের কাছে কোন দয়া কৃপা পাবার আশা করা মানে মুখের স্বর্গে বাস। দেখে মনে হয় এই সব পাষণ্ডতে পৃথিবীটা ভরে গেছে। যারা গলা টিপে ধরে আছে জীবনদের মতো জীবনের।

বলে ঠিকেদার, আমি বুঝি না তেমন নয়। তুমি গরিব ঘরের ছেলে। দুটো পয়সার জন্য খাটতে এসেছ। কিন্তু আমার কিছু করার উপায় নেই। হাত পা বাধা। জলে বাস করে কি কুমীরের সাথে বিবাদ করে পারা যায়। তুমি তো জানো কাজের মজুরি বাবদ মজুররা কিছু পোড়া কয়লা নিয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কি, সেটা আইনসম্মত নয়। আইন হচ্ছে ওয়ার্কসপের ধুলোও নাইরে যাবে না। যদি আমি হাবিলদারের কথা না মানি, সে রেগে যাবে। আর তখন কয়লা নিয়ে যেতে দেবে না। সব বাজেয়াপ্ত করে নেবে। আগে কয়েকবার এমন হয়েছে। তাহলে মজুররা সব না খেয়ে মরবে। কাজ বন্ধ হয়ে গেলে আমার কি হবে বলো।

বিদায় নবাব বাদশা বাইজি নর্তকী আমীর ওমরাহ গলজ ঠুংরির স্বনামধন্য শহর লক্ষ্ণৌ। কত ইতিহাস ইতিকথা কত গল্প গাথা কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে তোমার পথে পথে ধুলিকণায়। ক্ষুধার্ত এক কিশোরের তার কিছুই শোনা হল না। দেখা হল না। চলে যেতে হবে এবার এখান থেকে।

মনের মধ্যে যখন বিল্টুদায়ের ঘন্টা বাজতে শুরু করেছে তখন সেই ঘন্টায় একটা নাড়া দিয়ে দেয় ঠিকেদার, তোমার অবস্থা বুঝে, সবদিক ভেবে দেখে বলছি, তোমার এখান থেকে চলে যাওয়াই উচিৎ হবে। তবে হ্যাঁ, যদি কানপুরে যাও, ওখানেও আমার ঠিকা নেওয়া আছে। সেখানে কাজে লাগিয়ে দিতে পারি। তাহলে আর তোমার পয়সা হাবিলদার নিয়ে নিতে পারবে না। যাবে?

রাতটা ঠিকেদারের বাড়ির নিচের তলায় একটা ঘরে কাটিয়ে সূর্য ওঠার আগেই রওনা দিল কানপুর। কানপুরের কাজ দেখা শোনা করা মুনশি এসেছিল পেমেন্ট নিয়ে যাবার জন্য। সকাল আটটার আগে পৌঁছে তাকে মজুর কাজে লাগাতে হবে। তাই তাড়াহুড়ো।

কানপুর লক্ষ্ণৌ থেকে খুব একটা দুর নয়। দেড় দুঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া গেল লোকো শেডে। এটা খুবই ছোট কারখানা। কাজও কম মজুরও কম। কিন্তু সেখানেও কি টিকতে পারল জীবন। এতো সেই জীবন যার পায়ের তলের ভূমি পিচ্ছল। অনবরত পিছলে পিছলে যায়। সে ভূমিতে স্থির দাঁড়াবে কি করে?

এখানে রান্না করে খাবার কোনো সুবিধা নেই। খেতে হবে হোটেলে। পঞ্চাশ টাকা মাস মাইনের লোক সারা মাস হোটেলে খেলে হাতে আর পয়সা থাকে কই? দু বেলা, মাত্র দু বেলা তাও কি পেট ভরে খাওয়া যায়? চারটে রুটি যার দাম আট আনা সাথে দু আনার ডাল, রাতটা তো দশ আনায় চলে যায় কিন্তু দুপুর এক টাকায় চলে না। কম পক্ষে আটটা রুটি চার আনার তরকারি দরকার।

ইঞ্জিন থেকে যে ছাই ঢালা হয় তাতে আগুন থাকে। আগুন নেভাবার জন্য ঢালা হয় জল। সেই জলে ভেজা ছাই এক ঝুড়ির ওজন চল্লিশ পঞ্চাশ কিলোর কম নয়। সারা দিন ধরে সেই ঝুড়ি মাথায় করে বয়ে পেটে যেন আগুন জ্বলে। সেই আগুনে পাতলা আটটা দশটা রুটি দহন হতে কতক্ষণ। লক্ষ্ণৌয়ে যে পোড়া কলার উপরি রোজগার ছিল এখানে তা নেই। অন্য মজুরদের বাড়ির লোকরা তা আগে ভাগে বেছে নিয়ে চলে যায়। ঝুড়ি বওয়া থেকে ফুরসত মিললে তবে তো জীবন তা বাছাই করবে। তার আগেই তো সব হাওয়া।

লক্ষ্ণৌয়ের সহকর্মীরা বাচ্চা বলে জীবনকে কিছু রাহত দিত। কিন্তু কানপুরের সঙ্গীরা তেমন নয়। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসা জীবনকে ঠিকেদারের চামচা ভেবে ঝুড়িতে যথেচ্ছো বোঝ চাপিয়ে তুলে দেয় তার মাথায়। ছাইয়ে ঢালা জল বেলচা করে তুলে দেয় ঝুড়িতে। সে জল চুঁইয়ে গায়ে মাথায় পড়ে জীবনের। ভিজে ভূত হয়ে যায়। কতদিন সে এই অত্যাচার সয়ে টিকতে পারে? যেন সেই পরীক্ষায় মেতে ওঠে সাত সহকর্মী মজুর ভাই।

এক মাস টেকে জীবন। তবে তার জন্য সহকর্মীদের ব্যবহারই একমাত্র দায়ী নয়। শীতও বেশ কিছু দায়ী। প্রকৃতির নিয়মানুসারে সে তখন বেশ জাঁকিয়ে নেমেছে। উত্তর প্রদেশকে ভালোমত কাঁপিয়ে প্রতিবছরের মত শীতেদুদশজনকে মেরে বাংলার দিকে যাবে। লক্ষ্ণৌয়ের মত কানপুরে জীবনের থাকার কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই। তেমন কোন বিষয় ঠিকেদারের হাজার রকম চিন্তা করা মাথায় আসে নি। বড় মানুষের বড় ভাবনা থাকে। সেখানে এত তুচ্ছ জিনিস স্থান পায় না। প্রথম প্রথম দিন কয়েক কারখানায় একটা চালায় রাত কাটাতে খুব একটা অসুবিধা হয় নি। শীত বাড়ার সাথে সাথে অসুবিধা ঘটল। চারদিক ভোলা সে স্থান আর শীতের দাপটে বাসের উপযুক্ত রইল না।

তাই কাজ ছেড়ে আবার হাঁটা দেয় জীবন। তবে এবার আর তার আর্থিক ক্ষতি বিশেষ একটা হয়নি। পারিশ্রমিকের সবটা পেয়ে গিয়েছিলো। এবং তা খরচও হয়ে গিয়েছিলো সবটা।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *