সম্মান ও আত্মসম্মান

সম্মান ও আত্মসম্মান

০১.

পৃথিবীতে উন্নতি করিবার পথ দুইটি একটি আত্মশক্তি, আরেকটি চালিয়াতি। চালিয়াতিও একপ্রকার শক্তি বটে, তবে তাহা ধীরে ধীরে আত্মাকে ক্ষুদ্র ও নির্বীর্য করিয়া চারিত্রিক অধোগতি সাধন করে বলিয়া সর্বদা নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য।

যাহারা আত্মশক্তির সাধনা করে, তাহাদের বড় হইতে সময় লাগে, অথবা তাহাদের কেহ কেহ কোনো সময়ে বড় হইতেই পারে না। তবু তাহাদের জীবন সার্থক এইজন্য যে, তাহারা একটি বড় রকমের আদর্শ দিয়া পৃথিবীকে ঋণী করিয়া যায়। সার্থক হইলে তো কথাই নাই, না হইলেও সাধনার একটা মূল্য আছেই। ভিতরের দিক হইতে দেখিতে গেলে তাহা আত্মশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিয়া মানুষকে সৃজনধর্মী করিয়া তুলে, আর বাহিরের দিক হইতে দেখিতে গেলে তাহা মানুষকে প্রাত্যহিক জীবনের গ্লানি ও নীচতা হইতে রক্ষা করে।

সার্থকতা সকল সময় সকলের ভাগ্যে ঘটে না। কারণ তাহা শুধু চেষ্টার উপর নির্ভর না করিয়া বিধাত-দত্ত শক্তির উপর নির্ভর করিতেছে। সে-শক্তির তারতম্য আছে। তাহার জন্য আমরা দায়ী নহি, দায়ী স্বয়ং বিধাতা। শক্তির অভাবের জন্য লজ্জাবোধ করিবার কিছুই। নাই। সাধনার অভাবেই আমাদের লজ্জা। আমি চেষ্টা করিলেই রবীন্দ্রনাথ হইতে পারি না। কারণ রবীন্দ্রনাথের শক্তিতে আর আমার শক্তিতে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। কিন্তু সাধনায় তাহার সমকক্ষ হওয়া অসম্ভব নহে। না হইলে বিধাতার অপরাধ হইবে না, হইবে আমাদেরই।

একজন একশ টাকার মূলধন লইয়া কারবার শুরু করিল, আরেকজনের মূলধন মাত্র পঁচিশ টাকা। পঁচিশ টাকা মূলধনওয়ালার কাছে একশ টাকার মূলধনের লাভ প্রত্যাশা করা বাতুলতা; তবু সমীকরণ পদ্ধতির দ্বারা দেখা যাইতে পারে–উভয়ের মধ্যে লাভের সমতা আছে কি-না। না-থাকিলে বুঝিতে হইবে সাধনায় গলদ, উপযুক্ত চেষ্টা হয় নাই। অতএব, ফলের দিকে না তাকাইয়া আমাদের সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করিয়া যাওয়া উচিত। সফল হইলে তো ভালোই, না হইলে ঊর্ধ্বে অঙ্গুলিসঙ্কেত করিয়া অট্টহাস্য করিয়া বলিতে পারিব– আমার কী দোষ? আমার চেষ্টা তো আমি করিলাম। দোষ ঐ যাহাকে ধরিতে ছুঁইতে পাওয়া যায় না, সেই ব্যক্তির। কিন্তু সাধনা না করিয়া বিনাচেষ্টায় কিছুতেই নিজেকে অকৃতকার্যতার গ্লানি হইতে মুক্ত করিতে পারি না।

.

০২.

চালিয়াতির সহগামী তোষামোদ, তোষামোদ আত্মার পক্ষে ব্যভিচার। ভান ও অভিনয়ের উপর নির্ভরশীল বলিয়া তোষামোদ তলে তলে আত্মাকে কলুষিত করিয়া তোলে। শ্রদ্ধা না থাকিলেও কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য শ্রদ্ধার ভান করিতে করিতে চরিত্র কপট ও দুর্বল হইয়া পড়ে, এবং পরিণামে ভালো-মন্দ বিচার করিবার ক্ষমতাই নষ্ট হইয়া যায়। এই অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ, কারণ তখন বুঝিতেই পারা যায় না যে, নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করা হইতেছে।

তোষামোদকারী ও বারবণিতা প্রায় সমপর্যায়ভুক্ত। যৌন সম্বন্ধ নিজে ভালো কি মন্দ, কিছুই নয়। তাহার সঙ্গে মানসিকতার যোগেই তাহা ভালো কি মন্দ হইয়া থাকে। প্রেম ব্যতীত প্রেমের ভান যেখানে সেখানেই তাহা পাপ, অন্যত্র নহে। শ্রদ্ধা ও প্রেম আত্মরই প্রকাশ ইহা মানিয়া নিলে এ-কথা বলিতে পারা যায় যে, বারবণিতা ও তোষামোদকারী উভয়ে আত্মবমাননাকারী বলিয়াই পাপী, অন্য কারণে নহে।

অথচ বারবর্ণিত ও বারবণিতা সম্পর্কিত ব্যক্তিকে দেখিলে আমরা ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করি, তোষামোদকারীকে দেখিলে ডাকিয়া আনিয়া শ্রেষ্ঠ আসন দিতেও কুণ্ঠা বোধ করি না। ইহা হইতেই বুঝা যায়, আমাদের পাপ-পুণ্যের ধারণা কত অগভীর। যুক্তিযুক্ততার উপর নির্ভরশীল না হইয়া তাহা একটি সংস্কারের উপর নির্ভর করিয়া আছে। যাহা পাপ মনে করিতেছি, তাহা কেন পাপ হইল একবারও ভাবিয়া দেখিতেছি না। দশজনে যখন মনে করিতেছে তখন আমিও মনে করিতেছি দশজনে মনে না করলে আমিও বিরত থাকিতাম–ইহাই আমাদের মনোভাব। এই মনোভাব হইতে মুক্তিলাভ না করিলে আত্মিক মৃত্যু অনিবার্য। যে শিক্ষায় তাহা সম্ভব হইবে, তাহার গোড়ার কথা হইবে আত্মনিষ্ঠা বা আত্মসম্মান, তথাকথিত সম্মান নয়। আর লক্ষ্য হইবে জীবনের বিকাশ, সফলতা নয়। সফলতা লাভ করিলে তো ভালোই, না করিলেও বিশেষ ক্ষতি নাই। সফলতার জন্য বিকাশকে বর্জন করা আর আত্মহত্যা করা সমান।

.

০৩.

সম্মান আর আত্মসম্মানে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। উভয় ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিমার পার্থক্য বিস্তর। আত্মসম্মানীর দৃষ্টি অন্তর্মুখী; আর সম্মানীর দৃষ্টি বহির্মুখী। আত্মসম্মানীর সম্মান সে নিজে ছাড়া অন্য কেহ নষ্ট করিতে পারে না। সম্মানীর সম্মান অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তনশীল–সামান্য ধুলা লাগিলেও তাহা নষ্ট হইয়া যায়। আজ তুমি লক্ষ টাকার মালিক বলিয়া যে সম্মানের অধিকারী, কাল লক্ষ টাকা ফুরাইয়া গেলে আর সে সম্মান থাকিবে না, তুমি নিতান্ত অসহায় ও কৃপার পাত্র হইয়া পড়িবে। তাই কখন কী হয় মনে করিয়া তোমাকে সতত ভীত ও ত্রস্ত থাকিতে হয়। আত্মসম্মান কিন্তু এই ভীতি ও ত্রস্ত হইতে মুক্ত ভয়ার্ততার পাপ হইতে সে রক্ষা পাইয়াছে।

সম্মানীকে লোক বুঝিয়া কথা বলিতে হয়, সময় বুঝিয়া বাহির হইতে হয়, স্থান বুঝিয়া পদার্পণ করিতে হয়, আর স্বার্থ বুঝিয়া ভাব করিতে হয়। নইলে তাহার সম্মান বজায় রাখা ভার হইয়া ওঠে। সে মুক্ত নয়, সে বন্দী–সতত সন্দেহ দোলায় দোদুল্যমান বলিয়া তাহার চিত্তের স্থৈর্য নাই।

আত্মসম্মানী কিন্তু এইসব বালাই হইতে মুক্ত। সে নিজের ভিতরে এমন এক শ্রেষ্ঠ সম্পদের সাক্ষাৎ পাইয়াছে, যাহার মৃত্যু নাই–যাহা অজর, অমর, অক্ষয়, যাহা আগুনে পোড়ে না, জলে বিনষ্ট হয় না, দুর্যোগে ভাঙিয়া পড়ে না; শত শত বিপদপাতের মধ্য দিয়া গিয়াও যাহা ধ্বংস না হইয়া উজ্জ্বল হইয়া ওঠে। এই পরম বস্তুটি লাভ করিয়াছে বলিয়াই সে সর্বত্র স্বচ্ছন্দগতি, সদানন্দচিত্ত–তাহাকে ভীরুর মতো আগপাছ ভাবিয়া গণিয়া গণিয়া পা ফেলিয়া চলিতে হয় না। সে ভাবনামুক্ত।

সম্মানীর ভয়ের কারণ এইখানে যে, সে জানে সে ফাঁকি দিয়া বড় হইয়াছে, এবং সেহেতু যে-কোনো সময়ে যে কোনো অজুহাতে সেই বড়ত্ব হইতে বঞ্চিত হওয়া তাহার পক্ষে অসম্ভব নয়। সেইজন্যই সে ভীরুর মতো সন্দেহপ্রবণ ও স্বল্পপ্রাণ বলিয়াই নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী। সে মনে করে সমস্ত জগৎ তাহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সুতরাং সকলকে টুটি টিপিয়া না মারিলে তাহার পক্ষে তিষ্ঠানো মুশকিল। তাহার অনেক কাজই সাহসের বলিয়া ভ্রম হয়, কিন্তু আসলে তাহা সাহসের ভান, দুর্বলচিত্তের ছটফটানি ছাড়া আর কিছুই নয়। নিজের অযোগ্যতা ঢাকিবার জন্য সে পারিপার্শ্বিক জগতকে সন্ত্রস্ত করিয়া রাখিতে চায়। যতই সে সাবধান হয় ততই তাহাকে বিসদৃশ ঠেকে–ততই তাহার ভিতরের কদর্যতা বাহির হইয়া পড়ে। অযোগ্য ভূঁইফোড়ের আগমনে এইজন্য যুদ্ধ ও পারিবারিক কলহ অবশ্যম্ভাবী হইয়া ওঠে।

আত্মনিষ্ঠার শ্রেষ্ঠতা এইখানে যে, আত্মনিষ্ঠাই আমাদের বহু পাপ ও অন্যায় হইতে রক্ষা করিতে পারে–বাইরের নীতি অথবা তথাকথিত সংযমের আদর্শ নয়। প্রবৃত্তির প্রাবল্যের কাছে বাইরের নীতি তো তৃণবৎ তুচ্ছ, আর আত্মনিষ্ঠা ব্যতীত সংযম-সাধনার চেষ্টা বালুকার উপর অট্টালিকা নির্মাণের মতোই নিরর্থক। আত্মনিষ্ঠা মানুষকে সৌভাগ্যে প্রমত্ত দুর্ভাগ্যে অস্থির ও বিপদে অধীর হইতে দেয় না। কারণ আত্মাই শ্রেষ্ঠ, তাহা হইতে বড় কিছুই হইতে পারে না, এই উপলব্ধির মধ্যে একটা বড় রকমের আশ্রয় লাভ করিয়া সে গভীরত্ব লাভ করে। আত্মনিষ্ঠা নাই বলিয়াই তোষামোদকারী বিশ্রী ও প্রগম্ভ। তাহার মাথা ও হাত প্রতাপশালীর পায়ে। আর পা দুর্বলের ঘাড়ে। নিজের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা না থাকার দরুন সে অপরের আত্মাকেও অপমান করিতে দ্বিধাবোধ করে না। থাকিলে লজ্জায় অধোবদন হইত।

.

০৪.

সাধকের প্রিয় হইতেছে আত্মসম্মান নিজের আত্মার প্রতি নিজের অপরিসীম শ্রদ্ধা। আর তোষামোদকারীর প্রিয় সম্মান। প্রথমটি ভিতর হইতে লাভ করিতে হয়, আর দ্বিতীয়টি বাহির হইতে। সাধক সৃজনধর্মী আর তোষামোদকারী সঞ্চয়ধর্মী (possessive)। তোষামোদকারী কী করিয়া সম্মান লাভ করে, তাহার একটা কাল্পনিক চিত্র অঙ্কন করা যাক।

সম্মান নির্ভর করিতেছে সার্থকতার উপর। সার্থক না হইলে যত বড় কাজেই হাত দাও না কেন, সম্মান নাই। কবিতা লিখিতেছ? ক্ষতি কী? রবীন্দ্রনাথ না হইলে আমরা কেয়ার করিব না।– ছবি আঁকিতেছ? বেশ তো। অবনীন্দ্রনাথ না হইলে আমরা ফিরিয়াও তাকাইব না। বিজ্ঞানচর্চা করিতেছ? ভালো কথা। জগদীশ বসু না হইয়া আসিলে তোমার স্থান নাই।–তাহার চাইতে যাহারা সঁতারে প্রথম হইল, ফুটবল খেলায় কেল্লাফতে করিল, অথবা ঘোড়দৌড়ে ঘোড়া ছুটাইয়া সকলের আগে আসিল, তাহাদিগকেই আমরা বরমাল্য প্রদান করিব। কোন্ বিষয়ে কী হইল, অথবা কীভাবে হইল, তাহা দেখিতে চাহিব না। দেখিব শুধু প্রথম হইল কিনা। তাহা হইলেই আমাদের বাস্। আমরা ‘ফিলিস্টাইন’; আমাদের কাছে মুড়ি-মুড়কির একদর।

সার্থকতা লাভের সহজ উপায় তোষামোদ ও চালিয়াতি। উভয়ে মাসতুতো ভাই–সর্বদা একসঙ্গে হাত ধরাধরি করিয়া চলে। একটিকে ছাড়া অন্যটি অথর্ব হইয়া পড়ে। সুতরাং উভয়কেই একসঙ্গে গ্রহণ করিতে হয়। নইলে সার্থকতা সহজলভ্য হয় না। সাধনার দ্বারাও সার্থকতা লাভ করা যায়। কিন্তু সাধনার পথ দুরূহ বলিয়া তোষামোদ ও চালিয়াতিকেই একান্তভাবে গ্রহণ করিতে হয়।

তুমি বড় হইয়াছ ও উচ্চপদবি লাভ করিয়াছ। তোমার দরবারে আসা-যাওয়া শুরু করিলাম। তোমার মনটি জয় করিতে তোমার শত্রু রহিমের বিরুদ্ধে অযথা নানা কথা বলিতে লাগিলাম, মাঝে মাঝে কারণে-অকারণে বোকার মতো তোমার প্রশংসা করিতে লাগিলাম, আর বোকার মতো তুমিও তাহা বিশ্বাস করিয়া খুশি হইতে লাগিলে। ফলে তোমার মনের কোণে আমার জন্য একটি স্থান রচিত হইল। আমি ধীরে ধীরে তোমার প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলাম।

তারপর? তারপর লোকসমাজে আমার বেশ কদর বাড়িয়া গেল। যাহারা তোমার নিকট আসিতে সাহস করে না; তাহারা তোমার কাছে সুপারিশ করিবার জন্য আমাকে ধরিতে লাগিল। আমিও সুযোগ ও সুবিধা বুঝিয়া তাহাদের তোষামোদ ও স্তুতিতে স্ফীত হইতে লাগিলাম। ক্রমে ক্রমে খোদার মর্জিতে ও লোকের কৃপায় পকেটও ভারী হইতে লাগিল। তারপর একটু চাল খাটাইয়া সামান্য তোষামোদকারীর পদ হইতে একেবারে তোমার মন্ত্রিত্বের পদে উন্নীত হইলাম। বাস, আর আমাকে পায় কে? এখন তুমি আর আমি প্রায় সমান। তুমি আরো উপরের পদে উন্নীত হইলে আমিও তোমার পরিত্যক্তপদে উঠিয়া আসিলাম। এতদিন তোমাকে ও তোমার মতো অন্যান্য বড়লোককে নতজানু হইয়া সেলাম ঠুকিতে ঠুকিতে কোমর বাকিয়া গিয়াছিল, এখন অন্যের কোমর বাকাইতে লাগিলাম। নইলে তোমাদেরই যে প্রিয়-শিষ্য তাহা প্রমাণ করিব কী করিয়া তোষামোদল উন্নতি ও সম্মানের এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

কিন্তু তোষামোদের শুধু এই রূপ নয়, অন্য রূপও আছে। জনপ্রিয় হইবার জন্য প্রচলিত ও সামাজিক মতবাদের সমর্থন, কবি ও সাহিত্যিক হইবার জন্য বড় লেখকের অনুভূতি ও ভাব চুরি করিয়া রচনা লিখিবার চেষ্টা ইত্যাদি একপ্রকার তোষামোদ। অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলিয়া সূক্ষ্মদর্শী ব্যতীত অন্য কেহ তাহা উপলব্ধি করিতে পারে না। আধুনিকদের মধ্যেই এই পাপ অত্যন্ত বেশি। কারণ আধুনিকরাই একটা কিছু হইতে চায়, কিন্তু হইবার যথার্থ সাধনা করে। তাহারা লেখে, কিন্তু কবিতার অনুভূতির প্রতি সত্যিকার কোনো দরদ রাখে না। মত প্রচার করে কিন্তু মতবাদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল হয় না। মত তাহাদের গায়ের কোট, গায়ের চামড়া নয়। সুবিধানুযায়ী পরে আবার খুলিয়া রাখে। ভণ্ডামি ও চালিয়াতিতে ইহাদের জীবন ক্লিন্ন। বেশ বুদ্ধিলিপ্ত হইয়া জীবনযাপন করিলেও ভিতরে ভিতরে এদের আত্মা মরিয়া আসে, অন্তরের সত্যোপলব্ধি নষ্ট হইয়া যায়। কবি ও সাহিত্যিকের স্বাভাবিক আত্মমর্যাদা জ্ঞান হইতে বঞ্চিত বলিয়া ইহারা অত্যন্ত সুবিধাবাদী হইয়া পড়ে। বড়লোকের কেদারায় বসিতে পারিলে তাহারা নিজেকে সরফরাজ মনে করে, এক রাত্রি ইষ্টক নির্মিত গৃহে ঘুমাইতে পারিলে নিজের জীবন ধন্য মনে না করিয়া পারে না। ইহারা অশ্লীল ও কদর্য। দেখা তো দূরের কথা, ইহাদের নাম শুনিলেও চিত্তের শান্তি নষ্ট হইয়া যায়।

.

০৫.

আসলে বিচারপূর্ণভাবে দেখিতে গেলে, তোষামোদ ও চালিয়াতির দ্বারা উন্নতি লাভ করা যায় না। তাহাতে উন্নীত হওয়া যায়, কিন্তু উন্নত হওয়া যায় না। উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যে চারিত্রিক ও মানসিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, চালিয়াত ও তোষামোদকারীদের জীবনে তাহা অনুপস্থিত। সে যে-কেসে অবস্থাতেই থাকিয়া যায়। শুধু বাহিরের পোশাকি পরিবর্তন ঘটে মাত্র। সে পদকে মর্যাদা দান করে না, পদ তাহাকে মর্যাদা দান করে। তাহার পদে তাহাকে কেমন যেন মানায় না–গম্ভীর হইলে মনে হয় অতিরিক্ত গম্ভীর হইয়া পড়িয়াছে। যেন ধরা পড়িবার ভয়ে সতত অতিরিক্ত সাবধান।

উন্নতির একমাত্র পন্থা সাধনা। সাধনা ব্যতীত জীবনে লাবণ্য ফোটে না। উন্নীত না হইলেও তাহাতে লাভ। যতটুকু সাধনা করিলাম ততটুকু অগ্রসর হইলাম, ততটুকু চরিত্রের বিকাশ সাধন হইল। বাস্ তাহাতেই তৃপ্তি তাহাতেই আনন্দ। ভিতরে ভিতরে আমি বাড়িলাম, integrated হইলাম, ইহার চাইতে বড় কথা আর কী হইতে পারে? কিন্তু গভীর না হইলে তাহা উপলব্ধি করা যায় না, সূক্ষ্মদর্শী না হইলে তাহা প্রত্যক্ষ করা অসম্ভব। কারণ তাহা বাহিরের বস্তু নয়, তাহা চরিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়া আছে।

সাধককে ভবিষ্যতের ভাবনা ভুলিয়া, লাভ-লোকসানের মায়া কাটাইয়া কেবল সৃষ্টির আনন্দে কাজ করিতে হয়। সাধনাকে বড় না করিয়া সিদ্ধিকে বড় করিয়া দেখিলে সাধকের চলার শক্তি মন্দীভূত হইয়া আসে, তাহার ভিতরের তেজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। আর তাড়াতাড়ি লক্ষ্যে পৌঁছিতে গিয়া সে মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করিয়া বসে। লক্ষ্যে সে পৌঁছে আর উন্নতিও সে লাভ করে বটে, তবে তাহাই তাহার চিন্তাভাবনার একমাত্র কারণ হইয়া ওঠে না, হইলে সাধনার গতি স্তব্ধ হইয়া যায়চিত্ত অস্থির হইয়া পড়ে। মনে হয়, সাধক মাত্রই ক্ষণবাদী। ক্ষণগুলির যথার্থ ব্যবহারই তাহাদের একমাত্র কাজ। তবে লক্ষ্যের প্রতি একটুখানি দৃষ্টি না রাখিলে সাধনার ধারা এলোমেলো হইতে পারে বলিয়া তাহার প্রতি মাঝে মাঝে একটু দৃষ্টি রাখা সাধকের পক্ষে প্রয়োজন হইয়া পড়ে।

সঞ্চয়শীলতা সাধকের ধর্ম নহে। সঞ্চয়ের জালে বন্দী হইলে সাধনায় অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হইয়া পড়ে। শুধু বাহিরের বস্তুই নয়, তাহার সৃষ্টির চাইতে সে নিজেই বড় বলিয়া তাহাকে নিজের সৃষ্ট বস্তুর মায়া কাটাইয়াও চলিতে হয়।

সাধকের মর্মবাণী :

হায়রে হৃদয়–তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু
 পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

প্রান্তের চাইতে অপ্রান্তই তাহাকে বেশি করিয়া টানে। তাহার সাধনা আত্মা বধূর নব নব রূপ দেখিবার সাধনা। সঞ্চয়ের প্রতি লোভ থাকিলে উদার ও সুন্দর জীবনযাপন করা মুশকিল হইয়া ওঠে–চিত্তের প্রশান্তি নষ্ট হইয়া যায় বলিয়া বিক্ষিপ্ততা অরাজকতার মূর্তি নিয়া দেখা দেয়। রাসেলের উক্তিই এ-সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন :

“….. not even the most purity defensive forms of possessiveness are in themselves admirable; indeed as soon as they are strong, they become hostile to the creative impulses.”Take no thought, saying what shall we eat? or what shall we drink, or wherewithal shall we be clothed?” “ Whoever has known a strong creative impulse has known the value of this precept in its exact and literal sense. It is preoccupation with possession more than anything else, that prevents men from living freely and nobly?”

সাধক সাধনার দ্বারা যাহা দান করিয়া যায়, তম্মধ্যে তাহার ব্যক্তিত্বই প্রধান। ইহা খণ্ড-সৃষ্টি নয়, সম্পূর্ণ সত্তা। সমস্ত খণ্ড-সৃষ্টি ইহার মধ্যে বিধৃত। এই ব্যক্তিত্ব সে শুধু তাহার পুত্র-কন্যাকে দান করিয়া যায় না, সমস্ত মানব-সম্প্রদায়ই তাহার উত্তরাধিকারী; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাহার পুত্র-কন্যাই তাহা হইতে বিশেষভাবে বঞ্চিত হয়। অত্যন্ত নিকট হইতে দেখে বলিয়া অনেক সময় তাহারা তাহার সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব উপলব্ধি করিতে পারে না।

সাধকের চিন্তা ও কর্ম যেখানে সকলের, সেখানে সে নৈর্ব্যক্তিক। চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে সাধক যতই নৈর্ব্যক্তিক হইতে থাকে, ততই তাহার ক্ষুদ্র ‘আমি’ ক্ষুদ্রতম হইয়া, বৃহৎ ‘আমি’ বৃহত্তর হইতে থাকে। নৈর্ব্যক্তিক হইবার সহায়ক বলিয়াই আল্লাহর আরাধনা মানবচিত্তের পক্ষে এত কল্যাণকর। তিনি অনন্ত, অসীম ও প্রেমময়। সকলকে লইয়াই তিনি জাগিতেছেন কিন্তু সকলকে অতিক্রম করিয়াও আছেন, তিনি অবিনশ্বর আর সকলে নম্বর। এই মনোভাব মানুষকে যতটা ঔদার্য ও বিশালতা দান করিতে পারে, আর কোনো মনোভাব ততটা পারে না। এইখানেই ঈশ্বরের ধারণার শ্রেষ্ঠতা। ডিমোক্রেসি বলো, এনার্কিজম বলো, কোনোকিছুতেই তুমি এতবড় সার্থকতা লাভ করিতে পারো না, এমন বিপুলভাবে পরিপূর্ণ হইতে পারো না। কিন্তু যেখানে এই চারিত্রিক প্রভাব নাই, সেখানে তাহার আরাধনা শুধুই নাম-পূজা, শুধু অভিনয়। তোমার গুণ গাহিলাম, কিন্তু গুণে গুণান্বিত হইলাম না; তোমার নাম করিলাম, কিন্তু চরিত্রের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইলাম না ইহার মতো বড় রকমের ঠাট্টা আর কী হইতে পারে, ধারণা করা কঠিন। আল্লাহ যদি সবাক হইতেন তবে নিশ্চয়ই চিৎকার করিয়া বলিতেন বন্ধ করো তোমার পূজা, শুনিতে চাই না ঐ অনুপযুক্ত মুখে আমার নাম গান। কিন্তু তিনি নীরব বলিয়াই ভঁহাকে ফাঁকি দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হইতেছে।

অনেকে ব্যক্তিত্বকে প্রভুত্বের সঙ্গে এক করিয়া দেখে প্রতাপশালীকে ব্যক্তিত্বশালী বলিয়া ভুল করে। কিন্তু বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে দেখা যাইবে, সে অত্যন্ত সাধারণ, তাহার কোনো বিকাশ নাই, সুতরাং ব্যক্তিত্বও নাই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোথাও তাহার তিলমাত্র প্রভেদ নাই। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আসলে সেবার সম্পর্কই বেশি। সেবার ভাব না আসিলে নৈর্ব্যক্তিক হওয়া যায় না, আর নৈর্ব্যক্তিক না হইলে ব্যক্তিত্ব বিশাল ও গম্ভীর হয় না। সেবার ভাব না জাগিলে শুধু ‘আমি’র কারাগারে বন্দী থাকিতে হয় বলিয়া জীবনের পরিপূর্ণ আস্বাদ লাভ করা অসম্ভব হইয়া পড়ে।

তোষামোদকারীর নৈর্ব্যক্তিক সাধনা নাই বলিয়া তাহার ব্যক্তিত্বও নাই। তাহার প্রতাপ থাকিতে পারে, কিন্তু প্রভাব নাই। যেটুকু থাকে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাহা শেষ হইয়া যায়। সাধকের ব্যক্তিত্ব কিন্তু তাহার মৃত্যুর পরেও বহু বৎসর বাঁচিয়া থাকিয়া তাহাকে পৃথিবীতে অমর করিয়া রাখে। নৈসর্গিক দ্রব্যের মতো ব্যবহারে লাগাইয়া মানুষ তাহা হইতে প্রচুর উপকার লাভ করিতে পারে। তবে এ কথা সত্য যে, মৃত্যুর পরে বাঁচিয়া থাকিবার জন্যই সাধক সাধনা করে না, কীর্তিমান হইবার জন্যই কীর্তি গড়া তাহার উদ্দেশ্য নয়। এই সাধনাতেই তাহার আনন্দ ও তৃপ্তি বলিয়া সে তাহা করিয়া যায়। ফাল্গুনীর যুবকের ভাষায় সাধকের মর্মবাণী : “কীর্তি? নদী কি নিজের ফেনাকে গ্রাহ্য করে? কীর্তি তো আমাদের ফেনা–ছড়াতে ছড়াতে চলে যাব। ফিরে তাকাব না।”

.

০৬.

সাধকের প্রথম ও প্রধান শত্রু লোভ–চাকচিক্যময় জীবনের প্রতি টান। দ্বিতীয় শত্রু প্রতিযোগিতা। উভয়ের সম্মিলিত অত্যাচারে তাহার জীবন দুর্বিষহ হইয়া ওঠে। লোভ ও প্রতিযোগিতা প্রথমে তাহার ভিতর হইতে জাগে না, অন্যে জাগাইয়া দেয়। তাহাকে সাবধান করিয়া দিয়া তাহার শুভানুধ্যায়ী বন্ধুগণ যে তাহার অপকারই করে, তাহা তাহারা বুঝিতে পারে না। পারে না বলিয়াই ক্ষমার পাত্র। নইলে তাহাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা সাধনের অভিযোগ আনা সহজ হইত। সাধককে তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সচেতন করিলে তাহার ভিতরের আনন্দের উৎসটি নষ্ট করিয়া দেওয়া হয়। তখন সে অথর্ব ও পঙ্গু হইয়া পড়ে। ইচ্ছাবৃত্তির দ্বারা সৃজনাবেগকে ধ্বংস করিতে করিতে সে ক্রমাগত তিক্ত ও বিরক্ত হইয়া ওঠে, তাহার জীবনের পূর্ণতা ও চরিত্রের অটুটভাব নষ্ট হইয়া যায়। রাসেল এ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা এখানে উল্লেখযোগ্য :

The worst things are those to which will assents. Often, chiefly from the failure of self-knowledge, a man’s will is on lower level than his impulse; his impulse is towards some kind of creation, while his will is towards a conventional career, with a sufficient income and the respect of his contemporaries. …Because the impulse is deep and dumb, because what is called commonsense is often against it, because a young man can only follow it if he is willing to set-up his own obscure feeling against the wisdom and prudent maxims of elders and friends. It happens in ninety-nine cases of a hundred that a creative impulse, out of which a free and vigorous life might have sprung, is checked and thwarted at the very outset : the young man consents to become a tool, not on independent workman, a mere means to the fulfilment of others, not the artificer of what his own nature feels to be good. In the moment when he makes this act of consent something dies within him. He can never again become a whole man, never again have the undamaged self-respect, the upright pride, which might have kept him happy in his soul inspite of all outward troubles and difficulties……

বলা হইয়াছে, অন্তরের সহজ প্রবৃত্তি নষ্ট হওয়ার দরুন সাধক ক্ৰমে তিক্ত ও বিরক্ত হইয়া ওঠে। তিক্ততা ধীরে ধীরে নৃশংসতায় পরিণত হয়, আর সেই নৃশংসতাকে সে কখনো সাহস, কখনো নৈতিকতার ছদ্মবেশ পরাইয়া চালাইতে থাকে। ক্রমে প্রতিযোগিতার ইচ্ছা বলবতী হয়, অর্থাৎ নিজের সুখ-সৃষ্টির চাইতে পরের দুঃখ-সৃষ্টির স্পৃহা প্রবল হইয়া দেখা দেয়। নিজের ভিতরের কাজ করিবার প্রেরণা স্তব্ধ হইয়া আসে, অন্যকে জব্দ করিবার জন্যই তাহাকে সবকিছু করিতে হয়। জীবনের বিকাশের আর আনন্দ পায় না বলিয়া যে-কোনো ক্ষেত্রে যে কোনো উপায়ে সার্থকতা লাভকেই সে বড় করিয়া দেখিতে শুরু করে। সার্থকতা লাভের জন্য সে এত ব্যস্ত হইয়া ওঠে যে, আত্মার বৈশিষ্ট্য নষ্ট করিয়া নিতান্ত সাধারণ হইয়া পড়িতেও তাহার কুণ্ঠাবোধ হয় না। এইরূপে success-এর bitch goddess-এর আরাধনা চিত্তের সৌকুমার্য নষ্ট করিয়া তাহাকে একেবারে অনুভূতিহীন পশুতে পরিণত করে।

সাধকের জীবন কীভাবে লোভ ও প্রতিযোগিতার বশবর্তী হইয়া নষ্ট হইয়া যায়, তাহার একটা কাল্পনিক চিত্র অঙ্কন করা যাক। ধরা যাক, ‘ক’ নামক একটি লোক সহজ প্রেরণার বশবর্তী হইয়া শিল্পচর্চাকেই তাহার সাধনার বিষয় করিয়া তুলিল। (এখানে বলা দরকার, প্রত্যেক সাধককেই সহজ প্রেরণার বশবর্তী হইয়া চলিতে হয়। নইলে তাহার পথচলা সহজ ও আনন্দদায়ক হয় না।) শিল্পে কী করিয়া নতুনত্ব সৃষ্টি করা যায়, সেই দিকেই তাহার ঝোঁক। একলা ঘরে বসিয়া অথচ বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হইয়া তাহার দিন কাটে বেশ। জীবিকা অর্জনের চাইতে জীবনার্জনের দিকেই তাহার নজর বেশি। সে অনুভব করে তাহার চিত্তে স্পর্শমণির মতো এমন এক দুর্লভ বস্তু আছে যাহার স্পর্শে সামান্য ধূলিবালিও সোনা হইয়া ওঠে, নিতান্ত সাধারণ জিনিসও অসাধারণত্ব লাভ করে। সেই স্পর্শমণির স্পর্শ লাভ করিবার জন্য কীট-পতঙ্গ, তৃণলতা সমস্ত কিছু লইয়া বিশ্ব-সংসার তাহার মনের দুয়ারে অতিথি। আনন্দের অফুরন্ত ভাণ্ডার বলিয়া সে তাহার আত্মার প্রতি সতত শ্রদ্ধাশীল। কস্তুরী-মৃগের মতো সে আপনার গন্ধে আপনি পাগল। কিন্তু তাহার এই তন্ময়তার অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাহার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন তাহার শিল্পচর্চায় খুশি না থাকিয়া তাহাকে বাস্তবজগতে উন্নতি করিবার জন্য উপদেশ দিতে থাকে। তাহার মা তাহার বাল্যবন্ধু খ-র নজির দেখাইয়া তাহাকে বড়লোক হইতে বলে।’খ’ নাকি পাটের ব্যবসায় করিয়া অজস্র টাকা করিয়াছে; আর এক প্রাসাদতুল্য বাড়ি নির্মাণ করিয়াছে। প্রথম প্রথম তাহাদের কথায় তাহার মন বিরক্ত হইয়া ওঠে, মনে হয়, তাহাকে আত্মহত্যা করিবার জন্য উপদেশ দেওয়া হইতেছে।

কিন্তু ক্রমে সন্দেহ শয়তান তাহার হৃদয় জুড়িয়া বসিয়া তাহার ভিতরের দেবতার সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। সন্দেহ ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিতে থাকে–ফেলে রাখো তোমার শিল্পচর্চা। ওসব দিয়ে কী হয়? পারো তো খ-র মতো একখানা অট্টালিকা নির্মাণ করো, আর লোকের আভূমি-প্রণত সেলাম গ্রহণ করো। দেবতা তিরস্কারের সুরে বলে : ছি ছি এ কী তোমার মতিগতি? শেষে কাঞ্চন ফেলে কাঁচ গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইলে? আত্মার বিকাশেই তোমার তৃপ্তি; কেন ওসব বাইরের আবর্জনার প্রতি নজর দাও? পরিণামে বহু যুঝাযুঝির পর দেবতা পরাজয় লাভ করে। সন্দেহ জয়ী হইয়া তাহাকে বাস্তক-জগতে উন্নতি-সংগ্রামে প্রবৃত্ত করে। ক্রমে প্রতিযোগিতার স্পৃহা জাগে এবং তাহার আনুষঙ্গিক পাপও অন্তর-রাজ্য দখল করিয়া বসে। সে আত্মহত্যা করে। শিল্পচর্চা ছাড়িয়া দিয়া সে ছবির ব্যবসায় শুরু করে এবং অল্প কয়েক বছরের মধ্যে তাহাতে প্রচুর অর্থ উপার্জন করিয়া ‘খ’কে জব্দ করিবার জন্য এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করে। চারিদিকে তাহার জয়জয়কার পড়িয়া যায়। তাহার উন্নতি ও সম্মান দেখিয়া তাহার মা তাহাকে স্নেহ-আশীর্বাদ জানায়, পিতা যোগ্য পুত্র বলিয়া অভিনন্দন করে, আর শুভানুধ্যায়ী বন্ধু-বান্ধব, এতদিনে সে মিথ্যা কল্পনা পরিহার করিয়া নিরেট খাঁটি মানুষ হইয়াছে বলিয়া করমর্দন করে।

কিন্তু পূর্বেকার প্রশান্তি আর তাহার নাই। একলা ঘরে বসিয়া থাকিতে এখন আর তাহার ভালো লাগে না। মনে হয়, কী যেন হারাইয়া গিয়াছে কিসের বিরহে যেন মন উতলা হইয়া উঠে, চোখ বাম্পায়মান হইয়া আসে। ব্যথা ভুলিতে সে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে হুল্লোড় করিয়া বেড়ায় পাগলের মতো ছুটাছুটি করিয়া সময় কাটায়। তবু আনন্দ করায়ত্ত হয় না।’খ, ‘খ, ‘খ’ ‘খ’-র ভূতে তাহাকে পাইয়াছে, ‘খ ছাড়া দুনিয়াতে সে এখন আর কাহাকেও দেখিতে পায় না। তাহার নিজের অস্তিত্বের চাইতেও খ-র অস্তিত্ব তাহার কাছে এখন সত্যতর। আনন্দ তাহার নিকট হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিয়াছে। সমস্ত পৃথিবী টুড়িয়াও সে একবিন্দু আনন্দ লাভ করিতে পারে না। যাহা তাহার জন্য আকাশ আলোর মতো অজস্র ছিল, যাহা নিজে উপভোগ করিয়া অন্যকে বিলাইয়াও উদ্বৃত্ত থাকিত, তাহা এমন দুর্লভ হইল কী করিয়া, শত চিন্তা করিয়াও সে তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারে না। শুধু মনে হয়, কী যেন পৃথিবী হইতে পলাইয়া গিয়াছে, কী যেন নাই। যে সন্ধ্যাতারা প্রতি সন্ধ্যায় তাহার জন্য আনন্দবার্তা বহন করিয়া আনিত, তাহা যেন এখন বিদ্রূপবার্তা নিয়া আসে। তাহার মুখে হাসি নাই, আছে ব্যঙ্গ।

সে জানে না যে সে আত্মহত্যা করিয়াছে–তাহার পিতামাতাও না, বন্ধু বান্ধবও জানে না। যেসব ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি আত্ম-আত্মা করিয়া অস্থির, তাহারাও না। আত্মসম্মানের প্রতি আমাদের নজর নাই, বাহিরের সম্মান পাইলেই ব্যস। সম্মানের জন্য আত্মাকে বিক্রি করিতেও আমরা প্রস্তুত। তবু আমরা ধার্মিক। ধর্ম ব্যাপারে পান হইতে চুন খসিলে অস্থির হইয়া পড়ি। হায় রে, ধর্মের খাঁচাটি লইয়া আমরা সানন্দে নৃত্য করিতেছি, পাখিটি কবে উড়িয়া গিয়াছে, সেদিকে কাহারো লক্ষ্যই নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *