১. শিখণ্ডী খণ্ড

শিখণ্ডী খণ্ড

“I want to suck your big penis”– চমকাবেন না। ফেসবুকের ইনবক্সে এরকম মেসেজ পাওয়ার এরকম নাছোড় অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেকেরই হয়েছে। ফেসবুকে এরকম অনেক নারীপুরুষ তাঁদের যৌনসঙ্গী খুঁজতে সরাসরি এইভাবে প্রস্তাব রাখে। এরা আদতে সমকামী। পুরুষ খোঁজে পুরুষকে, নারী খোঁজে নারীকে। প্রথমপক্ষ ‘গে’, অপরপক্ষ ‘লেসবিয়ান’। বাজারি নাম ‘হিজড়ে’ বা ‘হিজড়া’ রূপান্তরকামী বা ট্রান্সসেক্সয়ালও বলা হয়ে থাকে। সোজা বাংলায় যৌনপ্রতিবন্ধী বা লিঙ্গ-কবন্ধ জাতক বলা যায়।

হিজড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত একটি পরিভাষা— বিশেষ করে ভারতের ট্রান্সসেক্সয়াল বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকে।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্ম-পরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তাঁরাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের অপর অর্থ হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’, ট্রান্সজেন্ডার বলতে এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থাকে বোঝায় যা দৈহিক বা জেনেটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোনো শ্রেণিতে পড়ে না। প্রকৃতিতে কিছু মানুষ নারী এবং পুরুষের যৌথ বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বাংলা ভাষায় এই ধরনের মানুষগুলো হিজড়া নামে পরিচিত। সমার্থক শব্দে শিখণ্ডী, বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ, উভলিঙ্গ, নপুংসক, ট্রান্সজেন্ডার (ইংরেজি), ইনুখ (হিব্রু), মুখান্নাতুন (আরবি), মাসি, বৌদি, চাচা, তাউ, ওস্তাদ, মাংলিমুখী, কুলিমাদর, ভিলাইমাদর, মামা, পিসি, অজনিকা ষণ্ড, অজনক, সুবিদ, কঞ্চুকী, মহল্লক, ছিন্নমুষ্ক, আক্তা, পুংস্তহীন ইত্যাদি। হরিদ্বারে হিজড়াদের সকলে তাওজি বা পণ্ডিতজি বলে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে হিজড়াদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

হিজড়া, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী– এঁরা না-নারী না-পুরুষদের দলে অন্তর্ভুক্ত হলে এঁদের সূক্ষ্ম মূলগত পার্থক্য আছে। সবাইকে পাইকারি দরে এক পংক্তিতে ফেলা যাবে না। প্রথমে আসি হিজড়া প্রসঙ্গে।

হিজড়া : লিঙ্গ ও অণ্ডকোশ কর্তন করে যাঁরা বাচ্চা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাঁরা হিজড়া বলে পরিচিত। বা যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও অপরিণত বা ত্রুটিপূর্ণ যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাঁদেরও হিজড়া বলা হয়। এঁরা সমকামী হতে পারে আবার নাও হতে পারে। এঁরা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সমকামী : সমকামিতা (Homosexuality) বলতে বোঝায় সমলিঙ্গ ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ ও দুর্বলতা বোধ করে। যৌনতা করতে মন চায়। অর্থাৎ যাবতীয় রোম্যান্টিক আকর্ষণ, যৌন আকর্ষণ ও যৌন আচরণকে বোঝায়। যৌন অভিমুখিতা হিসাবে। সমলিঙ্গ বলতে শারীরিকভাবে পুরুষ শরীরের অধিকারী হয়েও পুরুষ শরীরের প্রতি যৌন আকর্ষণ এবং শারীরিকভাবে নারী শরীরের অধিকারী হয়েও নারী শরীরের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোঝায়। এঁরা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

উভকামী : এঁরাও সমকামী। তবে এঁরা বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে যৌনানন্দ উপভোগ করে। এঁরা বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও সমলিঙ্গের বন্ধু খুঁজে নিয়ে তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে যায়। এঁরা সমাজের মূলস্রোতেই থাকে।

রূপান্তরকামী : রূপান্তরকামিতা (Transsexualism) বলতে বিশেষ একটি প্রবণতা বোঝায় যখন জৈব লিঙ্গ ব্যক্তির জেন্ডারের সঙ্গে প্রভেদ তৈরি করে। রূপান্তরকামী ব্যক্তিরা এমন একটি যৌন পরিচয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেন, যা ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের নির্ধারিত যৌনতার সঙ্গে স্থিতিশীল নয় এবং | নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে সেই লিঙ্গে পরিবর্তন করতে চান। রূপান্তরকামী। মানুষেরা পুরুষ হয়ে (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে) জন্মানো সত্ত্বেও মন-মানসিকতায় নিজেকে নারী ভাবেন এবং নারী হিসাবে জন্মানোর পরও মানসিক জগতে থাকেন পুরুষসুলভ। এঁদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করেন, এই ব্যাপারটিকে বলা হয় ট্রান্সভেস্টিজম বা ক্রসড্রেস। আবার কেউ সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে রূপান্তরিত মানবে (Transexual) পরিণত হন। যেমন সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যাওয়া। এঁরা সকলেই রূপান্তরিত লিঙ্গ নামক বৃহৎ রূপান্তরপ্রবণ সম্প্রদায়ের (Transgender) অংশ হিসেবে বিবেচিত।

মানবসভ্যতার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় লিখিত ইতিহাসের সমগ্র সময়কাল জুড়ে রূপান্তরকামিতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে আমেরিকার পুরুষ রূপান্তরকামী জর্জ জরগেন্সেনের ক্রিস্টিন জরগেন্সেনের রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনি মিডিয়ায় একসময় আলোড়ন তুলেছিলো। এ ছাড়া জোয়ান অব আর্ক, জীববিজ্ঞানী জোয়ান (জনাথন) রাফগার্ডেন, বাস্কেটবল খেলোয়াড় ডেনিস রডম্যান, চক্ষুচিকিৎসক এবং পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় ডঃ রেনি রিচার্ডস, সঙ্গিতজ্ঞ বিলিটিপটন সহ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির মধ্যে রূপান্তর প্রবণতার উল্লেখযোগ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়। ১৯৬০ সালে মনোচিকিৎসক ওয়ালিন্দার রূপান্তরকামীদের উপরে একটি সমীক্ষা চালান। তাঁর এই সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রতি ৩৭,০০০ জনের মধ্যে একজন পুরুষ রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি ১০৩,০০০ জনের মধ্যে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এই সমীক্ষাটি চালিয়ে দেখা গেছে যে, সেখানে প্রতি ৩৪,০০০ জনের মধ্যে একজন পুরুষ রূপান্তরকামী ভূমিষ্ট হচ্ছে, আর অন্যদিকে প্রতি ১০৮,০০০ জনের মধ্যে একজন জন্ম নিচ্ছে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামী। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ২৪,০০০ পুরুষের মধ্যে একজন এবং ১৫০,০০০ নারীর মধ্যে একজন রূপান্তরকামীর জন্ম হয়। এ বিষয়ে আরও পরে বিস্তারিত লিখব।

ধর্মবেত্তারা হিজড়াদের নিয়ে বিপুল শ্রম খরচ করে ভয়ানক ভ্রম সৃষ্টি করে রেখেছেন। ঘৃণা আর অবজ্ঞা ছড়িয়ে রেখেছেন। তা সত্ত্বেও হিজড়ারা কেউ নাস্তিক নয়। তথাকথিত ‘ঈশ্বরের এই বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসনকে মাথায় পেতে নিয়ে নিজেদেরকে ‘অভিশপ্ত’ বলেই গোটা জীবন কাটিয়ে দেন। আসুন দেখি, ধর্মগ্রন্থগুলি কী বলছে জেনে নেওয়া যাক।

.

ইসলাম ধর্মে হিজড়া

হজরত ইব্রাহিমের বংশধরদের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রচারিত ধর্মগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় ইব্রাহিমীয় ধর্ম ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম, ইহুদি ধর্ম— এগুলো সবই ইব্রাহিমীয় ধর্ম। প্রতিটি ইব্রাহিমীয় ধর্ম পুরুষ এবং নারী সৃষ্টির ব্যাপারে আদম এবং হাওয়া (ইভ)-এর গল্প বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ প্রথমে মাটি থেকে তৈরি করেন আদমকে। আদমের বুকের পাঁজর দিয়ে তৈরি করেন বিবি হাওয়াকে। তাহলে আল্লাহ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কিভাবে তৈরি করেন? নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বা হিজড়া কীভাবে সৃষ্টি করা হল, এই বিষয়ে পৃথিবীর কোনো ধর্মেই আলোচনা করা হয়নি।

ইসলামে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের মুখান্নাতুন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবি ভাষায় ‘মুখান্নাতুন’ বলতে মেয়েদের মত আচরণকারী পুরুষদেরকে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু শুধুমাত্র মেল টু ফিমেল ট্রান্সসেক্সয়ালদের বোঝানো হয়, তাই আরবি ‘মুখান্নাতুন’ হিব্রু সারিস বা ইংরেজি ‘ইউনুখ’-এর সমার্থক শব্দ নয়। কোরানে কোথাও মুখান্নাতুন সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু হাদিসে ‘মুখান্নাতুন’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

নবি বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, একজন মুখান্নাতুন’ হচ্ছে সেই পুরুষ, যাঁর চলাফেরায়, চেহারায় এবং কথাবার্তায় নারী আচরণ বহন করে। তাঁরা দু-প্রকারের— প্রথম প্রকারের হচ্ছে তাঁরাই যাঁরা এই ধরনের আচরণ ইচ্ছাকৃতভাবে করে না এবং তাঁদের এই ব্যবহারে কোনো দোষ নেই, কোনো অভিযোগ নেই, কোনো লজ্জা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা কোনো অবৈধ কাজ না করে এবং গণিকাবৃত্তিতে না জড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যক্তি হচ্ছে তাঁরাই যাঁরা অনৈতিক উদ্দেশ্যে মেয়েলি আচরণ করে।

হজরত ইবনে আব্বাস বলেছেন– হিজড়ারা জিনদের সন্তান। এক ব্যক্তি আব্বাসকে প্রশ্ন করেছিলেন– এটা কেমন করে হতে পারে? জবাবে তিনি বলেছিলেন– “আল্লাহ ও রসুল নিযেধ করেছেন যে মানুষ যেন তাঁর স্ত্রীর পিরিয়ড বা মাসিক স্রাব চলাকালে যৌনমিলন না করে”। সুতরাং কোনো মহিলার সঙ্গে তাঁর ঋতুস্রাব হলে শয়তান তাঁর আগে থাকে এবং সেই শয়তান দ্বারা ওই মহিলা গর্ভবতী হয় এবং হিজড়া সন্তান (খুন্নাস) প্রসব করে (সুরা বাণী ইস্রাইল –আর রাহমান-৫৪, ইবনে আবি হাতিম, হাকিম তিরমিজি)।

“তিনিই মহান সত্ত্বা, মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সুরা আলে ইমরান ৬) ইসলামীদের মতে তিনি মানবজাতির কারোকে পুরুষ, কারোকে নারী, আবার তাঁর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ কারোকে বানিয়েছেন একটু ভিন্ন করে। যেন বান্দা তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে তিনি সব বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমনি এর ব্যতিক্রম সৃষ্টি করতেও সক্ষম। আর এমনই এক বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি হল লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া। এঁরা পূর্ণাঙ্গদের মতো সমান মর্যাদার অধিকারী মানবগোষ্ঠী।

ইসলামের দৃষ্টিতে হিজড়া, বিকলাঙ্গ বা পূর্ণাঙ্গ হওয়া মর্যাদা-অমর্যাদার মাপকাঠি নয়। বরং তাকওয়াই হল মানমর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। “আল্লাহতাআলা তোমাদের বাহ্যিক আকার-প্রকৃতি এবং সহায়-সম্পত্তির প্রতি লক্ষ করেন না। বরং তিনি লক্ষ করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৬৭০৮) অতএব ইসলামি মূল্যবোধ ও সুমহান আদর্শের আলোকে এটাই প্রমাণিত হয়, লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের এ পরিমাণ সম্মান ও মর্যাদা আছে, যে পরিমাণ মর্যাদা ও সম্মান আছেএকজন সুস্থ-সবল সাধারণ মুসলিমের। এমনকি ইসলামি শরিয়তে একজন মুমিন-মুত্তাকি, পরহেজগার হিজড়া, শত-সহস্র কাফের-ফাসেক ও মুত্তাকি নয় এমন নরনারী থেকে উত্তম। শরিয়তের পরিভাষায় তাঁকেই হিজড়া বলা হয়, যাঁর পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ উভয়ই আছে। অথবা কোনোটিই নেই, শুধু মূত্রত্যাগের জন্য একটিমাত্র ছিদ্রপথ আছে। সংক্ষেপে একই শরীরে স্ত্রী ও পুরুষচিহ্ন যুক্ত অথবা উভয় চিহ্নবিযুক্ত মানুষই হল লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া (কামুসুল ফিকহ ৩/৩৭৭)। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, কোনো পুরুষ বা নারী নিজ ইচ্ছায় নারী ও পুরুষ হয়নি। তেমনি হিজড়া হওয়ার পিছনেও তাঁদের নিজের ইচ্ছার কোনো ভূমিকা নেই। এটা শুধুমাত্র আল্লাহতালার কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। তিনি নিজের ইচ্ছায় বানিয়েছেন উভলিঙ্গ বা হিজড়া। কোরানের আলোকে বোঝা যায়, এর পিছনে আল্লাহর মহান হেকমত ও নিগূঢ় রহস্য বিরাজমান। ইসলামী দেশগুলির মধ্যে ইরানে সবচেয়ে বেশি রুপান্তরকামী অপারেশন করা হয়। তারা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে যে-কোনো এক লিঙ্গে রুপান্তর হওয়ার সুযোগ দেয়।

.

হিন্দু ধর্মে হিজড়া

দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরকে সাধারণত হিজড়া নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু অঞ্চলভেদে ভাষাভেদে হিজড়াকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এই অঞ্চলে হিজড়াদেরকে সামাজিক ভাবে মূল্যায়িত করা হয়। তারা সমাজ থেকে দূরে বাস করতে বাধ্য হয়। দূরপাল্লা ট্রেনে বা বাজারে ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তিই তাদের প্রধান পেশা।

হিন্দুদর্শনে তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এই শ্রেণিকে ‘তৃতীয় প্রকৃতি’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে এই ধরনের মানুষকে আলাদাভাবে পুরুষ বা নারী হিসাবে বিবেচনা করা হত না। তাদেরকে জন্মসূত্রে তৃতীয় প্রকৃতি হিসেবে গণ্য করা হত। তাদের কাছে সাধারণ নারী-পুরুষের মতো ব্যবহার প্রত্যাশা করা হত না। আরাবানী হিজড়ারা আরাবান দেবতার পুজো করে। অনেক মন্দিরে হিজড়াদের নাচের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন হিজড়াদের আশীর্বাদ করার এবং অভিশাপ দেওয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে।

হিন্দু সংস্কৃতিতে এই মুহূর্তে তিনজন মহাকাব্যিক চরিত্রের কথা মনে পড়ছে–  চিত্রাঙ্গদা, বৃহন্নলা এবং শিখণ্ডী। এঁরা হিজড়া বলেই পরিচিত হয়েছে, যদিও এঁরা কেউই সেই অর্থে হিজড়া নয়। এঁদের কারোরই যৌনাঙ্গের ত্রুটি ছিল না। তবু কেন চিত্রাঙ্গদা, বৃহন্নলা এবং শিখণ্ডীরা ‘হিজড়া’ শব্দের সমর্থক হয়ে উঠল?

চিত্রাঙ্গদা মহাভারত মহাকাব্যের একটি চরিত্র। মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। তা সত্ত্বেও রাজকুলে যখন চিত্রাঙ্গদা নামে কন্যার জন্ম হল, রাজা তাঁকে পুত্ররূপেই পালন করলেন। সেই সূত্রেই রাজকন্যা পুত্রের বেশে ধনুর্বিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা এবং রাজদণ্ডনীতি অনুশীলন করতে থাকলেন। মণিপুররাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তাঁর কন্যার সঙ্গে কেবলমাত্র মহাবীর অর্জুনের বিবাহ দেবেন। অন্যদিকে ইন্দ্রপ্রস্থে অর্জুন মিলনরত অবস্থায় যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীকে দেখে ফেললে তাঁর দ্বাদশ বর্ষ বনবাস হয়। অর্জুন দ্বাদশবর্ষ ব্যাপী ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের সময় ভ্রমণ করতে করতে মণিপুর রাজ্যে। সেই সময়ে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার প্রেমে পড়েন। চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করলেন। তাঁদের মিলনের ফলে অর্জুনের ঔরসে চিত্রাঙ্গদার গর্ভে সন্তান আসে। তাঁদের মিলনজাত পুত্রের নাম বজ্ৰবাহন। কিন্তু চিত্রাঙ্গদার মধ্য ক্রমশ দ্বৈতসত্ত্বার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এজন্যে যে, অর্জুন তাঁকে বাহ্যিক রূপের কারণে ভালোবাসে সেখানে চিত্রাঙ্গদার প্রকৃত অস্তিত্ব অবহেলিত। এর মধ্যে মণিপুর রাজ্যের বিপদের আভাসে একসময় অর্জুন নারীর মমতায় প্রজাবৎসল, সাহসে-শক্তিতে পুরুষের মতো সবল চিত্রাঙ্গদার কথা লোকমুখে জানতে পারে। রবিঠাকুরের ভাষায় –

“শুনি স্নেহে সে নারী বীর্যে সে পুরুষ,
শুনি সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী।”

একজন পুরুষ-মনে একজন রমণীয় সবল নারীকে দেখার উদগ্র বাসনা অর্জুন প্রকাশ করে তাঁর আগ্রহ—

 “আগ্রহ মোর অধীর অতি —
কোথা সে রমণী বীর্যবতী,
কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা–
 দারুণ সে, সুন্দর সে
 উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে,
 নহে সে ভোগীর লোচনলোভা,
ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণ শোভা।”

এমতাবস্থায় চিত্রাঙ্গদা নিজেকে অর্জুনের কাছে প্রকাশ করে এভাবে—

 “আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্ৰনন্দিনী
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিত ব্ৰতে
সহায় হতে,
 পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।

পরিশেষে এটা উপলব্ধি হয় যে, বাহ্যিক রূপের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান মানুষের চারিত্রিক শক্তি এবং এতেই প্রকৃতপক্ষে আত্মার স্থায়ী পরিচয়।

অতএব চিত্রাঙ্গদা যৌনত্রুটি ঘটিত হিজড়া বা রূপান্তরকামী ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি পূর্ণাঙ্গ নারী এবং নিজেকে নারী হিসাবেই পরিচয় দিতেন। নারী হয়েও পুরুষের পোশাক পরতেন ঠিকই এবং পুরুষদের মতো শিক্ষাগ্রহণও করেছিলেন। সেটা করেছিলেন পিতার ইচ্ছাপূরণ করতে। তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যেমন ছিল না, তেমন মানসিক বৈকল্যও ছিল না। কেন যে ‘চিত্রাঙ্গদা’ চলচ্চিত্রের পরিচালক ও অভিনেতা (অভিনেত্রী?) ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেন –“পৌরুষের বদলে রূপলাবণ্য পাওয়ার বাসনাই ঘুরপাক খেয়েছে এই চলচ্চিত্রে।” চিত্রাঙ্গদার ভিতর লৈঙ্গিক বিষয়টা যে অনেক বড়ো আছে, তা নাকি আগে বুঝতে পারেননি ঋতুপর্ণ। চলচ্চিত্র যদি ভাষার মতো হবে, তাহলে সেই ভাষার পথ ধরে ঋতুপর্ণের অবচেতনের ঘরে কে বসত করত, তা সহজেই অনুমেয়। সেই বসতকারী পৌরুষ বিসর্জন দেওয়ার জন্য উদগ্রীব, নারীসুলভ লাবণ্য ঋতুপর্ণের কাম্য। চিত্রাঙ্গদায় ঋতুপর্ণ দেখিয়েছেন, শুদ্ধ বললে ভুল হবে, কারণ তিনি অভিনয়ও করেছেন এক রক্ষণশীল, বিত্তবান পরিবারের নারীসুলভ ছেলের চরিত্রে। যাঁকে প্রায় বাধ্য করা হয় পুরুষ হয়ে উঠতে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ঋতুপর্ণ ঘোষ নিজেই রূপান্তকামী ব্যক্তিত্ব ছিল। তিনি পুরুষ হয়েও মেয়েদের পোশাক পরতেন, মেয়েদের মতো রূপচর্চাও করতেন। অবশেষে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে রূপান্তর হতে গিয়েই নাকি তাঁর অকালমৃত্যু হয়। প্রকৃত ঘটনা হল ১০ বছর ধরে উনি ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস মেটিলাস, টাইপ ২) অসুখে ভুগছিলেন। ৫ বছর ধরে প্যানক্রিটিটিস অসুখে ভুগছিলেন। এছাড়াও তাঁর অনিদ্রার সমস্যা ছিল। ফলে তিনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেতেন। চিকিৎসকদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। আরেকটি প্রেমের গল্প’ চলচ্চিত্রে এক সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তাঁকে এগুলি করাতে হয়েছিল বলে শোনা যায়।

বৃহন্নলা > বৃহৎ + নল + আ। এর অর্থ দীর্ঘ ভুজা বা দীর্ঘ হাত। মহাভারতে অর্জুন অজ্ঞাতবাসের এক বছর নারীরূপে বিচরণ করেছিলেন। তিনি এসময় নিজের প্রকৃত নাম পরিবর্তন করে ‘বৃহন্নলা’ রাখেন। অর্জুনের দীর্ঘ হাত ছিল বলেই এরূপ নামকরণ অর্জুন যেহেতু স্বনামধন্য যোদ্ধার প্রকৃতির ছিলেন, তাই তিনি অন্য কোনো রূপ ধারণ না করে ‘নারী’ রূপ ধারণ করেন। মহাভারতের অর্জুন অজ্ঞাতবাসের প্রয়োজনে বলেছিলেন– আমি তৃতীয়া প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে অন্তরীণ করে রাখব– “তৃতীয়াং প্রকৃতিং গতঃ”। অতএব বৃহন্নলা নামধারী অর্জুনও যৌনত্রুটিগত ‘হিজড়া’ ছিলেন না। শারীরিক ও মানসিকভাবেও সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। অর্জুন ছিলেন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ, নারী-মনের পুরুষ নয়। সাময়িক কার্যসিদ্ধির জন্য অর্জুন নারীর পোশাক পরে নারীর মতো আচরণ করেছিলেন মাত্র। অতএব বৃহন্নলা কখনোই হিজড়ার সমর্থক হতে পারে না। কোনো পুরুষ কোনো কারণে নারীর সাজপোশাক পরলেই রূপান্তরকামী বলা যায় না। অথবা নারী পুরুষের পোশাক পরলেই রূপান্তরকামী বলা যায় না। মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা ও বৃহন্নলা এক ধরনের চরিত্র।

একটা সময় ছিল যখন চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রায় নারীরা সামাজিক অন্তরায় থাকার জন্য অভিনয় করতে আসত না। সে সময় নারীচরিত্রে নারীর পোষাকে পুরুষরা অভিনয় করত। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলালবসুর মতো নটরাও প্রয়োজনে নারীচরিত্রে অভিনয় করত। সেই ধারার শেষের দিককার অন্যতম প্রতিনিধি চপল ভাদুড়ী। অভিনয়ের মঞ্চে নারীরা আসতে শুরু করেন ষাটের দশকের শেষের দিকে। তার আগে পর্যন্ত নারীচরিত্রে অভিনয় পুরুষ অভিনেত্রীরাই। অভিনেত্রী’ চপল ভাদুড়ী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। চপলবাবুর পারিশ্রমিকও ছিল বেশ চড়া।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চপলবাবু বলেন— “১৫ বছর বয়স থেকে নারীচরিত্রে অভিনয় করছি। স্বাভাবিকভাবেই আমার মধ্যে অনেক নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য চলে এসেছে। কিন্তু আমি নারীসজ্জা নিয়েছি কেবল মঞ্চে। ঋতুর মতো জনসমক্ষে শাড়ি-গয়না পরে বের হইনি কখনো।” চপল ভাদুড়ী বায়োলজিক্যাল রূপান্তরকামী ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি সমকামী অপবাদে অপমানিত হয়েছেন। তাঁর ভাষায় –“সমকামিতার ‘অপরাধে’ দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। বঞ্চিত করা হয় প্রাপ্য পারিশ্রমিক থেকেও। আমি অবাক হইনি, সেসময় সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে বলা দূরে থাক, ভাবতও না লোকে।”

সারা পৃথিবী জুড়েই বহুকাল থেকে নারীচরিত্রের ভূমিকায় পুরুষ এবং পুরুষচরিত্রের ভূমিকায় নারীর অভিনয় করার দৃষ্টান্ত আছে। ডাস্টিন হফম্যান ‘টুটসি’ ও রবিন উইলিয়াম ‘মিসেস ডাউটফায়ার’ চলচ্চিত্রে যে চরিত্র করেছেন সেটা তেমনই। কিছু সময়ের জন্য নারী সেজেছেন মাত্র। গল্পের প্রয়োজনেই পুরুষ সেখানে কিছুক্ষণের জন্য নারীর ছদ্মবেশ নিয়েছে। এইরকম ভাবেই “মিসেস ডাউটফায়ার’ অবলম্বনে কমল হাসান করেছিল ‘চাচি ৪২০’। আমির খান, গোবিন্দা ও রীতেশ দেশমুখও এই মুভিতে নারীর ছদ্মবেশ নিয়েছিল। ঠিক যেভাবে ‘মিস প্রিয়ংবদা’ চলচ্চিত্রে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিক সেভাবেই মহাভারতের অর্জুন বৃহন্নলা।

ওয়ালেস বিরি, ফ্যাটি আরবাকল, অ্যালেক গিনেস প্রমুখ অনেকেই নারীচরিত্রে দাপুটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। পরের দিকে জেরি লিউইস, এডি মারফি, টেরি জোন্সের মতো অনেককে নারীচরিত্রে দেখা গেছে। হেয়ার স্পে’ চলচ্চিত্রে নারীচরিত্র করেই ‘গোল্ডেন গ্লোব’ জিতে নেন অভিনেতা জন ট্রাভোল্টা। হাবিব তনবিরের নির্দেশনায় ‘জিস লাহৌর নহি দেখা ওহ জামিয়া নেহি’ নাটকে নারীচরিত্রে পুরুষের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকরা।

ডাক্তার মাসুর গুলাটি। আসল নাম সুনীল গ্রোভারের তুলনায় এই নামেই বেশি জনপ্রিয় এই অভিনেতা। কপিল শর্মার অনুষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে নারীচরিত্রে কমেডিয়ান হিসাবে তাঁর পরিচিতি। জনপ্রিয়তা তুঙ্গে হলেও তাঁর পুরুষসত্ত্বায় কখনো কি আঘাত এনেছে এই চরিত্র? এমন প্রশ্নের উত্তরে তাঁর সাফ কথা– বায়োলজিক্যাল পুরুষ হলেও নারী হতে তাঁর মন্দ লাগে না একফোঁটাও। সুনীল গ্রোভার রূপান্তরকামী নন, উনি একজন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ।

ইরানে মেয়েরা ছেলে সেজে স্টেডিয়ামে খেলা দেখেছেন। প্রিয় দলের খেলা দেখতে পুরুষের সাজে স্টেডিয়ামে এসেছিলেন এসব নারীরা। ইরানের স্টেডিয়ামে নারীদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। অবিকল ছেলেদের সাজ-পোশাক নিয়ে খেলা দেখেছেন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর এই ম্যাচে পেরেসপোলিসের বেশ কিছু নারী সমর্থক নকল দাড়ি আর পরচুলা পরে স্টেডিয়ামে ঢোকেন। নকল এই সাজ-পোশাক এতটাই নিখুঁত ছিল যে, স্টেডিয়ামের নিরাপত্তারক্ষীরা পর্যন্ত ধরতে পারেনি। এই নারীদের রূপান্তরকামী বলা যায় না। উদ্দেশ্য পৃথক হলেও বৃহন্নলা ও চিত্রাঙ্গদাকেও তেমনি রূপান্তরকামী বলা যায় না। তথাকথিত ‘হিজড়া’র প্রতিশব্দও হতে পারে না।

শিখণ্ডী মহাভারতের আর-একটি চরিত্র। দ্রুপদের মেয়ে ও দ্রৌপদীর বড়ো বোন! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর পিতা দ্রুপদ ও ভাই ধৃষ্টদুম্নের সঙ্গে পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। এবং ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন। তাঁর পুত্রের নাম ক্ষত্রদেব। পূর্বজন্মে শিখণ্ডী ছিলেন কাশীরাজের বড়ো মেয়ে অম্বা। হস্তিনাপুরে রাজা বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য ভীষ্ম তাঁর দুই বোন সহ তাঁকে স্বয়ংবর সভা থেকে জয় করে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি সুবলের রাজা শান্বকে ভালোবাসেন জেনে বিচিত্রবীর্য তাঁকে বিয়ে করেননি। শাল্বও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তাঁকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তাঁর দুর্দশার জন্য তিনি ভীষ্মকে দায়ী করেন এবং ভীষ্মের মৃত্যু কামনায় সাধনা করে শিবের বর লাভ করে ‘শিখণ্ডী’ নামে দ্রুপদ রাজার মেয়ে হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন।

শৈশবে শিখণ্ডী রাজপ্রাসাদের ফটকে রাখা একটা মালা গলায় পরে দ্রুপদের কাছে এলে দ্রুপদ বুঝতে পারেন, শিখণ্ডীই অম্বা। কারণ কার্তিকের প্রদত্ত চিরসবুজ পদ্মের মালাটি শুধু অম্বাই পরতে পারে। তখন রাজা ভীষ্মের আক্রমণ এড়ানোর জন্য শিখণ্ডীকে বনে রাখার ব্যবস্থা করেন। সেখানে শিখণ্ডী সাধনা করে স্থণাকর্ণ নামে এক যক্ষের কাছ থেকে পুরুষত্ব লাভ করে। মহাভারতের যুগে সফল ট্রান্সজেন্ডার! অথচ একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সোমনাথ থেকে মানবী হতে কত কসরৎই-না করতে হল। যাই হোক, এরপর শিখণ্ডী বন থেকে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে এবং বিয়ে করে সংসারী হন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পুরুষ-যোদ্ধা হিসাবেই অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ভীষ্ম তাঁকে দ্রুপদের মেয়ে হিসাবে জানতে পেরে অস্ত্র পরিত্যাগ করে শরাক্রান্ত হয়ে শরশয্যায় শায়িত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধের অষ্টাদশ দিনে অশ্বত্থামার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিখণ্ডী মৃত্যুবরণ করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখণ্ডীর জন্মরহস্য জানতেন বলে ভীষ্ম দুর্যোধনকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করবেন না পাণ্ডবরাও তা জানতেন। শিখণ্ডী নিজেও ভালো যোদ্ধা ছিলেন না। তাই শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন ভীষ্মকে বাণহত করে শরশয্যায় শুইয়েছিলেন। এক্ষেত্রে একমাত্র শিখণ্ডীর ক্ষেত্রেই বলা যায়, নারীশরীর থেকে পুরুষত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। শিখণ্ডীকে অবশ্যই রূপান্তরকামী বলা যায়।

হিন্দু পুরাণে এলজিবিটির বিষয়বস্তু বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কয়েকজন দেবদেবী ও যোদ্ধাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা আচরণে স্ত্রী সমকামিতা, পুরুষ সমকামিতা, উভকামিতা বা রূপান্তকামিতা (এককথায় এলজিবিটি) অর্থাৎ বৈশিষ্ট্য ও আচরণে পরিদৃষ্ট হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের চরিত্রে লিঙ্গ পার্থক্য ও অ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তিরও আভাস মেলে। ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু সাহিত্যে সরাসরি সমকামিতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণগুলিতে এবং লোকসাহিত্যে লিঙ্গ পরিবর্তন, সমকামোদ্দীপক (হোমো ইরোটিক) ঘটনা এবং আন্তঃলিঙ্গ ও তৃতীয় লিঙ্গ চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

হিন্দু পুরাণে দেখা যায় দেবদেবীরা লিঙ্গ পরিবর্তন করছেন বা বিভিন্ন সময়ে বিপরীত লিঙ্গের রূপ ধারণ করছে, অথবা একজন দেবতা ও একজন দেবী মিলিত হয়ে একই শরীরে উভলিঙ্গ রূপ ধারণ করেছে। যৌনমিলনের সুবিধার্থে দেবতাদের বিপরীত লিঙ্গের অবতার রূপে অবতীর্ণও দেখা যায়।

হিন্দু পুরাণগুলিতে আমরা বিষ্ণু ও শিবকে নারীরূপে পাই। হিন্দুধর্মে ও ভারতীয় পুরাণে একাধিক দেবদেবীকে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন রূপে পুরুষ ও নারী উভয় সত্ত্বা ধারণ করতে দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার একজন দেবতা ও একজন দেবী একই সময়ে একই মূর্তিতে একাধারে পুরুষ ও নারী রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। এইরকম একটি মূর্তি আমরা পাই শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপ। এই রূপ শিব ও পার্বতীর সম্মিলিত রূপ। শিবের এই মূর্তিটি দ্বৈতসত্ত্বার উৰ্বেস্থিত সামগ্রিকতার প্রতীক। এই মূর্তি নশ্বর জীব ও অমর দেবদেবীর এবং পুরুষ ও নারীসত্ত্বার যোগসূত্র। এই প্রসঙ্গে অ্যালাই ড্যানিলোর মতে– “উভলিঙ্গ, সমকামী ও রূপান্তকামিতার একটি প্রতীকী মূল্য আছে এবং এঁদের সম্মানীয় সত্ত্বা অর্ধনারীশ্বর মূর্তি মনে করা হয়। আর-একটি অনুরূপ মূর্তি হল লক্ষ্মী-নারায়ণ। এই মূর্তিটি সৌন্দর্য ও সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর স্বামী বিষ্ণুর যুগল উভলিঙ্গ মূর্তি।

ভাগবত পুরাণে পাওয়া যায় বিষ্ণু অসুরদের অমৃতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ছলনাকারিণী মোহিনী রূপ গ্রহণ করেছিলেন। শিব মোহিনীকে দেখে আকৃষ্ট হন এবং এর ফলে তাঁর বীর্যস্খলন হয়ে যায়। সেই বীর্য পাথরের উপর পড়ে সোনায় পরিণত হয়। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শিবের পত্নী পার্বতী তাঁর স্বামীকে মোহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখে লজ্জায় মাথা নত করে ফেলেন। কোনো কোনো উপাখ্যানে দেখা যায়, শিব পুনরায় বিষ্ণুকে মোহিনী রূপ ধারণ করতে বলেন, যাতে তিনি প্রকৃত রূপান্তরটি স্বচক্ষে দেখতে পারেন। যেসব উপাখ্যানে শিব মোহিনীর সত্য প্রকৃতিটি জানতেন, সেই উপাখ্যানগুলিকে যৌন-আকর্ষণে লিঙ্গের অনিশ্চয়তার পরিচায়ক হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। মোহিনীর নারীসত্ত্বা হল সত্যের জাগতিক দিক। শিবকে আকর্ষিত করার যে চেষ্টা মোহিনী করেছিলেন, তা শুধুমাত্র শিবকে জাগতিক বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার জন্যেই। পট্টনায়ক একটি উপাখ্যানের উদাহরণ দেখিয়ে বলেছেন যে, কেবলমাত্র বিষ্ণুরই শিবকে ‘মোহিত’ করার ক্ষমতা ছিল।

এক অসুর নারীমূর্তি নারীমূর্তি ধারণ করে শিবকে হত্যা করতে যায় বলে একটি আখ্যান পাওয়া যায়। সে তাঁর নারীমূর্তির যোনিতে তীক্ষ্ণ দাঁত স্থাপন করেছিল। শিব তাঁর ছলনা ধরে ফেলেন এবং নিজের পুরুষত্ব’-এ একটি ‘বজ’ স্থাপন করে ‘রতিক্রিয়া’-র সময় সেই অসুরকে হত্যা করেন। মহাভারত মহাকাব্যের তামিল সংস্করণ অনুসারে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণ মোহিনীমূর্তি ধারণ করে ইরাবানকে বিয়ে করেছিলেন। ইরাবান আত্মবলিদানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে প্রেমের স্পর্শ দান করার জন্য কৃষ্ণ তাঁকে বিয়ে করেন। ইরাবানের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ মোহিনীমূর্তিতেই তাঁর জন্য বিলাপ করতে থাকেন। বার্ষিক তালি অনুষ্ঠানে ইরাবানের বিয়ে ও মৃত্যুর ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। এই অনুষ্ঠানের হিজড়ারা কৃষ্ণ-মোহিনীর ভূমিকায় অভিনয় করে একটি গণবিবাহ অনুষ্ঠানে ইরাবানকে বিয়ে করেন। এই উৎসব ১৮ দিন ধরে চলে। উৎসব শেষ হয় ইরাবানের আনুষ্ঠানের সমাধিদানের মধ্য দিয়ে। এইসময় হিজড়ারা তামিল প্রথা অনুসারে নৃত্য করতে করতে বুক চাপড়ায়, হাতের চুরি ভেঙে ফেলে এবং বৈধব্যের শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে। পদ্মপুরাণ অনুসারে কৃষ্ণের রাসনৃত্যে কেবলমাত্র নারীরই প্রবেশাধিকার ছিল। সেই রাসনৃত্যে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানালে অর্জুন শারীরিকভাবেই নারীতে পরিণত হয়েছিলেন বলে ভিত্তিহীন গল্প ফাঁদা হয়েছে।

আর-একটি উপাখ্যান থেকে জানা যায়, তা হল ইলার কাহিনি। এই কাহিনিটি একাধিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। ইলা ছিলেন এক রাজা। তিনি শিব ও পার্বতীর অভিশাপে এক মাস পুরুষ রূপে এবং পরবর্তী এক মাস নারী রূপে দেহধারণ করে জীবনযাপন করতেন। লিঙ্গ পরিবর্তনের পর ইলা তাঁর পূর্বের লিঙ্গাবস্থার জীবন বিস্মৃত হতেন। এইরকম এক পর্যায়ে ইলা গ্রহদেবতা বুধকে বিয়ে করেন। ইলার লিঙ্গ পরিবর্তনশীলতার কথা বুধ জানতেন। কিন্তু তিনি ‘পুরুষবেশী’ ইলাকে সেটা জানালেন না। ইলাও তাঁর নারীরূপের কথা ভুলে গেলেন। ইলা যখন নারীরূপে থাকতেন, তখনই বুধ ও ইলা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সহবাস করতেন। রামায়ণ অনুসারে বুধের ঔরসে ইলা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। যদিও মহাভারত অনুসারে ইলাকেই সেই পুত্রের মাতা ও পিতা বলা হয়েছে। পুত্রের জন্মের পর ইলার অভিশাপের নিষ্পত্তি হয়। এরপর ইলা পাকাপাকিভাবে পুরুষে পরিণত হয়। এরপর ইলা তাঁর স্ত্রীর কাছে ফিরে যান এবং একাধিক সন্তানের জন্ম দেন।

কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব। শাম্ব নারীর বস্ত্র পরিধান করে মানুষকে উপহাস করতেন এবং বিপথে চালনা করতেন। নারীর বেশ ধারণ করে তিনি সহজেই নারীদের সঙ্গে অবলীলায় পারতেন এবং তাঁদের সঙ্গে সম্ভোগ করতেন। মৌষলপুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শাম্ব একবার নারীর বেশ ধারণ করে কয়েকজন ঋষিকে নিজের নিজের গর্ভধারণ নিয়ে প্রশ্ন করেন। ঋষিরা তখন তাঁকে অভিশাপ দেন– পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি লৌহমুষল প্রসব করবেন।

সুশ্রুতসংহিতায় দুই ধরনের পুরুষ সমকামিতার কথা উল্লেখ আছে। একটি গোষ্ঠীর নাম ‘কুম্ভীক’, যাঁরা পায়ুসঙ্গমে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। অপর গোষ্ঠীর নাম ‘অশ্য’, পায়ুসঙ্গমে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। অগ্নি ও সোম দুজনেই পুরুষ দেবতা। এই দুই পুরুষদেবতার মধ্যে সমকামী সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। এক কাহিনিতে পাচ্ছি অগ্নিদেবতা সোমের বীর্য মুখে ধারণ করছেন। বৈদিক-দেবতা মিত্র ও বরুণের অযোনিজ কামে লিপ্ত হয়ে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। অতএব এখানেও সমকামী সম্পর্কের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রাজা দিলীপের দুই স্ত্রীর মধ্যেও সমকামী সম্পর্ক ছিল। গণেশের নানা ধরনের জন্মবৃত্তান্তের কথা জানা যায়। তার মধ্যে একটি হল পার্বতী ও গজানো রাক্ষসী নামের দুই নারীর যৌনমিলনের ফলে গণেশের জন্ম হয়।

কেবল সমকামীই নয়, রূপান্তরকামিতারও কিছু উল্লেখ পাই। মহাভারতের কাহিনিতে আমরা অর্জুনের এক স্নান করার কথা জেনেছি, সেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে পবিত্র সরোবরে স্নান করতে বলেছিলেন। অর্জুন সেই পবিত্র সরোবরে যেই-না স্নান করলেন, অমনি অপরূপা সুন্দরী এক নারীতে পরিণত হলেন। অর্থাৎ পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তর। সেই রূপান্তরিত নারীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের কামকেলির আখ্যান পাওয়া যায়। কেলি শেষে পুনরায় সরোবরে স্নান সেরে অর্জুন পুরুষজীবনে ফিরে আসে। রূপান্তরকামিতার আরও একটি কাহিনিতে পাচ্ছি রাজা ভগ্নাস্বনকে। রাজা ভগ্নাসন সরোবরে স্নান করে পুরুষ থেকে নারীত্ব লাভ করেন এবং তাপসের স্ত্রী হয়ে পুত্রসন্তানও উৎপাদন করেন। পুরাণগুলিতে রূপান্তরকামীরা সন্তান উৎপাদন করলেও বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান যতটা এগিয়েছে, তাতে কোনো রূপান্তরিত মানুষ গর্ভবতী হতে পারবে ন বা জন্ম দিতে পারবে না। অর্থাৎ কোনো পুরুষ নারীতে রূপান্তরিত হয়ে যেমন গর্ভবতী হতে পারবে না, তেমনি কোনো নারী পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে কোনো নারীকে মা করতে সক্ষম হবে না।

হিন্দুসমাজে তথাকথিত হিজড়ারা ব্রাত্য, ঘৃণ্য, প্রান্তিক। তাঁদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। এঁদের নিয়ে খিল্লি করা যায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা যায়। এঁরা হাসির খোরাক। তাই এঁরা সমাজের মূল্যস্রোতকে এড়িয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে নিজস্ব কমিউনিটিতে। পুরুষদের উৎপাত এড়াতে এঁরা ট্রেনের লেডিস কম্পার্টমেন্টে রেলভ্রমণ করেন। অবশ্য এঁরা নিজেদের মহিলা ভাবেন বলেই স্বভাবত লেডিস কম্পার্টমেন্ট, লেডিস টয়লেট ব্যবহার করেন। তবে যেসব মহিলারা নিজেদেরকে পুরুষ সত্ত্বার (নারী হিজড়া) অধিকারী ভাবেন, তাঁদের কখনো জেন্টস টয়লেট ব্যবহার করতে দেখা যায় না।

হিন্দুসমাজের অনেকেই মনে করে হিজড়াদের প্রথম মুখদর্শন অশুভ, অমঙ্গলের। হিজড়াদের জন্ম অভিশাপের জন্ম বলে মনে করা হয়। বাচ্চা নাচানো হিজড়ারাও তাঁদের গানে ‘আমাদের জীবন অভিশাপের’ বলেন। এই অভিশাপের সূত্রপাত সম্ভবত মহাভারতে। যেখানে উর্বশীর অভিশাপে অর্জুন এক ‘ক্লীব’ বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিতে হয়েছেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, পাণ্ডবদের বর্ষব্যাপী অজ্ঞাতবাসের ক্ষেত্রে এই অসুখ ফলপ্রসূ হবে। আবার অনেক ব্যবসায়ীরা মনে করেন সকাল খুলেই হিজড়া প্রথম কাস্টমার হলেই সেদিন ব্যাবসা ভালো হবে।

.

খ্রিস্টান ধর্মে হিজড়া

গ্রিক Eunochos থেকে Eunuchs শব্দটি এসেছে। খ্রিস্টধর্মের নিউ টেস্টামেন্টে স্পষ্ট করে তৃতীয় লিঙ্গ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যদিও এখানে Eunuchs বলতে নপুংসক ব্যক্তি বোঝানো হয়েছে। বিবাহ এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় জিশু বলেন, কিছু মানুষ জন্ম থেকেই Eunuchs, আবার কিছু মানুষ অন্যদের দ্বারা Eunuchs–এ পরিণত হয় এবং আরও কিছু মানুষ আছে যারা স্বর্গরাজ্যের জন্য নিজদেরকে Eunuchs-এ রূপান্তরিত করে।

২০০০ সালে ক্যাথলিক সম্মেলনের ডকট্রিন অফ ফেইথের উপসংহারে বলা হয়, চার্চের দৃষ্টিতে একজন মানুষ ট্রান্সসেক্সয়াল সার্জিকাল অপারেশনের মাধ্যমে একজন মানুষকে শুধু বাহ্যিকভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। “the transsexual surgical operation is so superficial and external that it does not change the personality. If the person was a male, he remains male. If she was female, she remains female.” খ্রিস্টান ধর্মে একজন ইথিওপিয়ান ইনুখ সম্পর্কে আলোচনার কথা আছে। বিবাহ এবং তালাক নিয়ে উত্তর দেওয়ার সময় জিশু এক পর্যায়ে বলেন, “কিছু মানুষ আছে যারা জন্ম থেকে ইনুখ এবং আরও কিছু মানুষ আছে যাদেরকে অন্যেরা ইমুখ বানিয়েছে এবং আরও এক প্রকৃতির মানুষ আছে যারা স্বর্গরাজ্যের জন্য নিজেদেরকেই ইমুখ বানিয়েছে।”

.

বৌদ্ধ ধর্মে হিজড়া

অধিকাংশ বৌদ্ধলিপিতে ধর্ম প্রতিপালনে কোনো লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন করা হয়নি। নির্বাণ লাভের জন্য কামনাকে এই শাস্ত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। থাই বৌদ্ধধর্মে ‘কতি’ বলে একটি শব্দ আছে। মেয়েদের মতো আচরণকারী পুরুষকে ‘কতি’ বলা হয়। এটা সেখানে পুরুষ সমকামীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। থাইল্যান্ডে কতিদের বিবাহের অনুমতি নেই। তাঁরা কখনোই বিয়ে করতে পারবে না। থাইল্যান্ডে কতিদের নারীতে রূপান্তরিত হওয়া কি পুরুষ বিয়ে করা এখনও আইনত অবৈধ। কিন্তু হিজড়া মহিলারা তাঁদের ইউরোপীয় সঙ্গীকে বিয়ে করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে তাঁকে থাইল্যান্ড ত্যাগ করে তাঁদের সঙ্গীদের দেশে চলে যেতে হবে।

.

ইহুদি ধর্মে হিজড়া

মোজেস বা হজরত মুসার অনুসারীদেরকে বলা হয় ইহুদি। ইহুদি ধর্মে হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডারদের ‘সারিস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হিব্রু ‘সারিস’ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে ‘Eunuch’ অথবা ‘Chamberlain’ নামে। “তনখ’-এ সারিস শব্দটি ৪৫ বার পাওয়া যায়। সারিস বলতে একজন লিঙ্গ নিরপেক্ষ বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি শক্তিমানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ঈশ্বর সারিসদের কাছে এই বলে প্রতিজ্ঞা করছেন, “তারা যদি সাবাথ পালন করে এবং রোজা রাখে তাহলে তাদের জন্য স্বর্গে একটি উত্তম মনুমেন্ট তৈরি করবেন।” (ইসাইয়াহ, ৫৬)। “তোরাহ”-তে ক্রস ড্রেসিং (যেমন পুরুষের নারীর মতো পোশাক পরা) এবং জেনিটাল বা শুক্রাশয় ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। সেজন্য অনেক ইহুদি হিজড়াদের ধর্মের বাইরের মানুষ মনে করেন। কারণ হিজড়ারা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে হিজড়ারা তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী অথবা পুরুষে নিজেদের রূপান্তর করে নিতে পারবেন। ইহুদিধর্মের অনেক শাখা বিজ্ঞানের এই অগ্রগতিকে স্বাগত জানালেও জুদাইজমের সকল ধারা এই রূপান্তরকামিতাকে এখনও সমর্থন করেনি।

.

বাহাই ধর্মে হিজড়া

বাহাই ধর্মবিশ্বাসে হিজড়াদেরকে Sex Reassignment Surgery (SRS) এর মাধ্যমে একটি লিঙ্গ বেছে নিতে হবে এবং শল্যচিকিৎসকের মাধ্যমে লিঙ্গ রূপান্তর করতে হবে। এসআরএসের পরে তাদেরকে রূপান্তরিত বলে গণ্য করা হবে এবং তারা উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচন করে বাহাই মতে বিবাহ করতে পারবে।

প্রধান ধর্মগুলিতে হিজড়াদের অবস্থান সম্বন্ধে মোটামুটি আলোচনা করা গেল যতটুকু জানা গেছে। তবে সমকামীদের ভূগোল-ইতিহাস-বিজ্ঞান সবই দেখে নিতে হবে। না-হলে এই গোষ্ঠীকে সঠিক অনুধাবন করা যাবে না। প্রাচীন যুগে হেরোডোটাস, প্লেটো, অ্যাথেনেউস, জেনোফোন এবং অন্যান্য লেখকদের লেখা থেকে প্রাচীন গ্রিসে সমকামিতা প্রসঙ্গে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায়, প্রাচীন গ্রিসে বহুল প্রচলিত ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সমকামী যৌন সম্পর্কটি ছিল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও সদ্য কিশোর বা পূর্ণকিশোর বালকদের মধ্যেকার যৌন সম্পর্ক (প্রাচীন গ্রিসের বিবাহ প্রথাও ছিল বয়সভিত্তিক; তিরিশ বছর পার করা পুরুষেরা সদ্য কিশোরীদের বিয়ে করত।)। নারীর সমকামিতার বিষয়টি প্রাচীন গ্রিসে ঠিক কী চোখে দেখা হত, তা স্পষ্ট নয়। তবে নারীর সমকামিতাও যে স্যাফোর যুগ থেকে গ্রিসে প্রচলিত ছিল, তা জানা যায়। বিগত শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সমাজে যৌনপ্রবৃত্তিকে যেমন সামাজিক পরিচিতির মাপকাঠি হিসাবে দেখা হলেও, প্রাচীন গ্রিসে তেমনটা হত না। গ্রিক সমাজে যৌন কামনা বা আচরণকে সঙ্গমকারীদের লিঙ্গ অনুযায়ী ভাগ করে দেখা হত না; দেখা হত যৌনক্রিয়ার সময় সঙ্গমকারীরা কে নিজের পুরুষাঙ্গ সঙ্গীর দেহে প্রবেশ করাচ্ছে, বা সঙ্গীর পুরুষাঙ্গ নিজের শরীরে গ্রহণ করছে, তার ভিত্তিতে। এই দাতা/গ্রহীতা বিভেদটি সামাজিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্বকারী ও শাসিতের ভূমিকা নিত। অপরের শরীরে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করানো পৌরুষ, উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ও প্রাপ্তবয়স্কতার প্রতীক ছিল। অপরদিকে অন্যের পুরুষাঙ্গ নিজের শরীরে গ্রহণ করা ছিল নারীত্ব, এঁরা নিম্ন সামাজিক মর্যাদা ও অপ্রাপ্তবয়স্কতার প্রতীক।

প্রাচীন নাগরিক সমাজ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা জন্ম নিয়েছিল গ্রিসে। সেই গ্রিস, যাঁরা কখনো নাগরিকের যৌন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। সমলিঙ্গ যৌন-সংসর্গ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো প্রশ্নচিহ্ন ছিল না কোনোদিন। প্রাচীন গ্রিসের সংস্কৃতিতে প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে গভীর প্রণয় সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায় ইলিয়াড মহাকাব্যে। রচয়িতা হোমার অ্যাকিলিস ও প্যাট্রোক্ল্যাসের সম্পর্কটিকে যৌন-সম্পর্ক বলেননি। চিত্রকলা ও পাত্রচিত্রে প্যাট্রোক্ল্যাসের দাড়ি আঁকা হত। অপরদিকে গ্রিক সমাজে অ্যাকিলিসের স্থান দেবতুল্য হলেও তাঁর চিত্র উলঙ্গই আঁকা হত। এর ফলে কে ‘এরাস্টেস’ এবং কে ‘এরোমেনোস’ ছিলেন, তাই নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। হোমারীয় ঐতিহ্যে প্যাট্রোক্ল্যাস ছিলেন বয়সে বড়ো; কিন্তু অ্যাকিলিস ছিলেন বেশি শক্তিশালী। অন্যান্য প্রাচীন গল্পের মতে, অ্যাকিলিস ও প্যাট্রোক্ল্যাস ছিলেন নিছক বন্ধু। ঐতিহাসিক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ প্রণয়ীযুগলের মধ্যে এথেন্সের পাউসানিয়াস ও ট্র্যাজিক কবি আগাথন বিখ্যাত। আগাথনের বয়স ছিল ত্রিশের বেশি। মহামতি আলেকজান্ডার ও তাঁর বাল্যবন্ধু হেফাস্টনের সম্পর্কও একই ধরনের ছিল বলে মনে করা হয়।

স্যাফো নারী ও বালিকাদের উদ্দেশ্য করে অনেকগুলি কবিতা রচনা করেছিলেন। ইনি লেসবোস দ্বীপের বাসিন্দা। স্যাফো সম্ভবত ১২,০০০ লাইনের কবিতা লিখেছিলেন নারীদের জন্য। তবে তার মধ্যে মাত্র ৬০০ লাইনেরই সন্ধান পাওয়া গেছে। এই মহিলা কবির লেখার পরতে পরতে ছিল নারী-শরীরের বন্দনা। তাই স্যাফো প্রাচীনকালের নারী-সমকামী কবি হিসাবে পরিচিত। তিনি গ্রিক সমাজে ‘থিয়াসোস’ বা অল্পশিক্ষিতা নারী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। সে যুগের সমাজে নারীজাতির মধ্যেও সমকামিতার প্রচলন ছিল। নগররাষ্ট্রের উদ্ভবের পর বিবাহপ্রথা সমাজ ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠে এবং মেয়েরা গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। থিয়াসসাস’-রা হারিয়ে যায়। স্যাফোর জন্মস্থান লেসবস থেকেই তো অভিধানে জায়গা পেয়েছে ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি। সামাজিকভাবে নারীর সমকামিতার কোনো স্থান হয়নি। সাধারণভাবে নারীর সমকামিতার ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য বেশি নেই।

সমকামী বিষয়বস্তু সম্পর্কে দীর্ঘকাল নীরব থাকার পর ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। এরিক বেথে ১৯০৭ সালে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। পরে কে, জিডোভারাও গবেষণা চালিয়ে যান। গবেষণায় জানা গেছে, প্রাচীন গ্রিসে সমকামিতার খোলাখুলি প্রচলন ছিল। এমনকি সরকারি অনুমোদনও ছিল। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকে রোমান যুগ পর্যন্ত এই অবস্থা চলেছিল। কোনো কোনো গবেষকদের মতে সমকামী সম্পর্ক, বিশেষত পেডেরাস্টির প্রচলন ছিল উচ্চবিত্ত সমাজের মধ্যেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রথার প্রচলন খুব একটা ছিল না। ব্রুস থর্নটনের মতে, অ্যারিস্টোফেনিসের কৌতুক নাটকগুলিতে গ্রহীতার স্থান গ্রহণকারী সমকামীদের প্রতি উপহাস করার প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, পুরুষ সমকামিতাকে সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখত না। ভিক্টোরিয়া ওল প্রমুখ অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, এথেন্সে সমকামী সম্পর্ক ছিল ‘গণতন্ত্রের যৌন আদর্শ। এটি উচবিত্ত ও সাধারণ মানুষ— উভয় সমাজেই সমাজভাবে প্রচলিত ছিল। হার্মোডিয়াস ও অ্যারিস্টোগেইটন নামে দুই হত্যাকারীর ঘটনা থেকে তা প্রমাণিত হয়। এমনকি যাঁরা বলেন যে, পেডেরাস্টি উচ্চবিত্ত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাঁরাও মনে করেন যে এটি ছিল ‘নগররাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোর অঙ্গ’।

আধুনিক গ্রিসে এই বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। ২০০২ সালে মহামতি আলেকজান্ডার সম্পর্কিত এক সম্মেলনে তাঁর সমকামিতা নিয়ে বিতর্ক হয়। ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আলেকজান্ডার’ চলচ্চিত্রে আলেকজান্ডারকে উভকামী হিসাবে দেখানোর জন্য ২৫ জন গ্রিক আইনজীবী চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন। তবে ছবির এক আগাম প্রদর্শনীর পর তাঁরা আর মামলা করেননি।

.

সাহিত্য ও সিনেমায় সমকামী

আধুনিক সাহিত্য-সিনেমাতেও বারবার জায়গা করে নিয়েছে সমকামী মানুষের গল্প। অতীত ও বর্তমান কোনোকালেই সমকামিতাকে অস্বীকার করার উপায় না থাকলেও রক্ষণশীল সমাজ ও পরিবারের বাধা তো ছিলই, আজও আছে। তাই সাহিত্যের দিকে তাকালে তার পরিসরের ক্ষেত্রকে খুব সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়েছে। তবু, সাহিত্যে যা নিদর্শন পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না এর অন্তরালে থাকা মনস্তাত্ত্বিক কিছু প্রবৃত্তিকে। এছাড়া শারীরিক কিছু কারণ তো আছেই। ইংরেজি সাহিত্যে ক্রিস্টোফার মার্লোর ‘Edward the Second’ এবং মহেশ দত্তানির ‘Bravely fought the Queen’ নাটক বর্তমান সমাজেও বহু আলোচিত। জগদীশ গুপ্তের গল্পে সমকামিতার আভাস পাওয়া যায় মাত্র। একটি গল্পে রাণুর স্বামীর বদলিজনিত কারণে অন্যত্র যেতে হবে। যাওয়ার আগে কানুর স্ত্রীর ইন্দিরার সঙ্গে রাণু একরাত্রি কাটাতে চায়। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে সেই অমোঘ কথাগুলি– “তুই আর আমি এক হয়ে যাই”। এক পুরুষের শরীরে এক নারীর এক হয়ে যাওয়াটাকে যেমন বিষমকামিতা বলা হয়, তেমনি এক নারীর শরীরের সঙ্গে আর-এক নারীর এক হয়ে যাওয়াটাকে সমকামিতা বলা হয়। মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে রূপ ছাপিয়ে ইন্দিরার অঙ্গসান্নিধ্যে। রূপ নয়, অরূপের মধ্যে দিয়ে নিজেকে স্বামী আর ইন্দিরাকে স্ত্রী ভেবে মিলনেচ্ছায় রাণু বলেই ফেলে সেই ইচ্ছের কথা। ইন্দিরার মুখে শুনি –“যেন স্বামী আর স্ত্রী, সে আর আমি”। কমলকুমার মজুমদারের মল্লিকা বাহার’ কাহিনিতে সমকামিতার আভাস মেলে। মল্লিকার পুরুষ-সঙ্গের অভাব তাঁর যৌন-তাড়নার অভিমুখ বদলে যায়। তাই শোভনাদির সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন থেকেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুই নারীর। লেখকের ভাষায়– “শোভনার চোখে অন্য আলো এসে পড়েছে, তাঁর চোখে-মুখে দেখা যাবে পুরুষালি দীপ্তি, যে-কোনো রমণী যে সে ঘাটের পথে, বাটের পথে চিকের আড়াল হতে দেখুক, ভালো এ দৃষ্টি লাগবেই… শোভনার স্পর্শের মধ্যে কেমন এক দিব্য উষ্ণতা, এ উষ্ণতা বহুকাল বয়সি বহুজন প্রিয়। মল্লিকার এ উষ্ণতা ভালো লেগেছিল, ভারী ভালো লেগেছিল।” মল্লিকার মন সায় দিয়েছিল, তাই অন্তর থেকে সে স্পর্শসুখকাতরতা অনুভব করেছিল। সেই কাতরতা অনুভব করেছিল বলেই শোভনার সঙ্গে সে তাঁদের বাড়ির ছাদে যায় নিভৃতে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে। সেখানে শোভনার আচরণের মধ্যেও পুরুষালি ভাব প্রকট হয়। লেখক বলছেন –“শোভনা আপনার মধ্যে মল্লিকাকে এনেছে, সোহাগ করে মালা পরিয়ে দিয়েছে, সে মালা তাঁর কণ্ঠে বিলম্বিত, চুম্বনে চুম্বনে শোক ভুলিয়ে দিয়েছে।” গল্পের শেষ অংশে পাঠকরা পাচ্ছেন সেইসব সাহসী কথোপকথন। শোভনা বলছে –“কই তুমি আমায় খেলে না? তুমি আমায় ভালোবাসো না?” “বাসি!” মল্লিকা শোভনাকে বিশেষ অপটুতার সঙ্গে গভীরভাবে চুম্বন করলে—

“আগে কাউকে কখনো এমনভাবে …”

“হ্যাঁ … আচ্ছা আপনি?”

 “আমায় তুমি বলো, আমি তোমার কে? বলো?”

“আচ্ছা তুমি?”

“না”, দৃঢ়কণ্ঠে শোভনা বললে। বোধহয় মিথ্যা। হেসে বললে, “আমি তোমার স্বামী, “তুমি”, “বউ”।” লেখক জানাচ্ছেন, “(এই) শুনে শোভনা আবেগে চুম্বন করলে। শোভনার মুখনিঃসৃত লালা মল্লিকার গালে লাগল।”

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘বুটকি ছুটকি’ গল্পেও খুব সংক্ষিপ্তভাবে শেষদিকে এসেছে দুই বোনের স্পর্শজনিত অনুভবের কথা। মাতৃহীন দুই সমবয়সি বোনের জীবনে জীবনে না আছে কোনো আনন্দের কলরব, না আছে কোনো আশার প্রদীপ। ক্রাচ নিয়ে জীবনোপায় অবলম্বন করা দরিদ্র বাবা প্রতাপের বাড়িতে ইলেকট্রিকের আলো কেটে দিয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মে দুই বোন চোদ্দো পনেরোয় যখন পৌঁছোয়, তখন স্বভাবতই পুরুষের দৃষ্টির আওতার বাইরে থাকে না তাঁরা। “বুটকির কোমরের দিকটা সুন্দর। ছুটকির বুকের দিকটা।” টগবগে যৌবনা দুই নারী, দুই বোন পরস্পরের সহমর্মী হয়ে বেঁচে থাকে বাবার ফিরে আসার প্রতীক্ষায়, অনেক গভীর রাত পর্যন্ত। চরম দারিদ্রতা, তাই পরনের অভাবে নিকষ অন্ধকারে তাঁরা নিরাবরণ হয়ে শোয়। এক বোন আর-এক বোনকে দেখে। দেখে নগ্ন শরীর। এক বোন দেখে, “দিদির ঘাড়ের সুন্দর বাঁক। শাঁখের মতন সরু হয়ে নীচের দিকে গড়িয়ে আসা গলা।” অন্য বোন দেখে, “সবুজ আলোটা বল্লমের মতো খোঁচা মেরে ছুটকির সুন্দর উঁচু বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল, পাতলা জামার ছিদ্র দিয়ে উদ্ধত স্তনের চূড়ায়। একটা চূড়া বেরিয়ে এসেছিল। বিশেষত ছুটকি যখন বলে, “রক্ষা করো বাবা, দরকার নেই রাজার ছেলের, বিনা পণে যদি বুড়ো মদন এসে তুলে নিয়ে যায় বাঁচি”, তখন বোঝাই যায় কামনা-বাসনার প্রতি লোভাতুর হয়ে আছে অসহায় নারী। না-হলে রাত্রের অন্ধকারে নিরাবরণ দুই বোন দুটি শরীরকে আশ্রয় করে উষ্ণতা চাইবে কেন!

তিলোত্তমা মজুমদারের ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ উপন্যাসে দেবরূপার শ্রেয়সীর প্রতি সমকামিতার প্রকাশ তাঁকে ক্রমশ বিপন্ন করে তোলে –“শ্রুতি হোমাসেক্সয়াল ঘেন্না করে। শ্রুতি হোমোসেক্সয়াল ভয় পায়।” দেবরূপা শ্রেয়সীর প্রতি আসক্ত, যদিও শ্রেয়সী শুভ্ৰশীলের প্রতি প্রণয়াসক্ত। কিন্তু কাহিনি থেকে জানা যায়, দেবরূপা প্রচণ্ডই পুরুষবিদ্বেষী। তাই সে শ্রেয়সীকে শুভ্ৰশীলের কবল থেকে মুক্ত করতে হয়। আর এই সব কিছুর মূলেই যে তীব্র কামচেতনা তা লেখিকা বুঝিয়েছেন– “তোমাদের মধ্যেও দেখো এই দুই বিভাগ। পীড়ক ও আত্মপীড়ক। কিন্তু দুই-ই স্বাভাবিক। দুই-ই কামবোধের প্রকাশ। দুই-ই প্রকৃতির ইচ্ছা। শুধু বৈচিত্র্য ব্যাপ্ত। নারী নারী, পুরুষ পুরুষ সম্পর্কে ভেদ নেই। কারণ শুধুই মানুষে মানুষে টান সমাজের জন্ম দিয়েছিল। মানুষে মানুষে টান গড়নের জন্ম দেয়।”

বদলেছে মানুষের মানসিকতা, বদলেছে মানুষের প্রান্তিক ধ্যান-ধারণা। তাই পুরস্কৃত হয় স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’। নর-নারীর যৌন সম্পর্ক, সমকামীদের আকাঙ্ক্ষা-যন্ত্রণা, তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের বিস্তৃত বিবরণ উপন্যাসটিকে একটি বৈপ্লবিক মাত্রা সংযোজন। সংযোজন বলাটা ভুল হল বোধহয়, আসলে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের কাহিনিই এতে যোজিত হয়েছে। ‘হলদে গোলাপ’ প্রসঙ্গে মনে পড়ে বিচারপতি কে. এস. রাধাকৃষ্ণণের উক্তি : “তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি কোনো সামাজিক বা চিকিৎসা সংক্রান্ত ইস্যু নয়, মানবাধিকারের প্রশ্ন বলেই বিবেচ্য।” এই উপন্যাসে অনিকেত একজন বেতারকর্মী— যিনি সমকামী, লিঙ্গান্তরকামী কিছু মানুষের কথা তুলে ধরেছেন, বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন হিজড়ে সম্প্রদায়ের অন্ধকারময় জীবনের কথা– যৌনতার বিকৃতিজনিত কিছু অসুস্থতার কথা, যাঁদের বর্তমানে এলজিবিটি বলে চিহ্নিত করা হয় তাঁদের জীবনচিত্র। কিন্সের তত্ত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছেন, “প্রত্যেক মানুষের মধ্যে পুরুষ সত্ত্বা ও নারী সত্ত্বা একসঙ্গে থাকে। সব পুরুষের কম-বেশি সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ আছে।” তবে শুধু পুরুষরা নয়, নারীরাও সমলিঙ্গে আকর্ষণ বোধ করে। বরং বেশিই। লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন– বিষমকাম যেমন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, সমকামও তেমনই। তবে মানুষের হরমোনাল একটা ‘স্কেল থাকে। তার তারতম্যেই আসে ‘এলজিবিটি তত্ত্বটি। সুধীর চক্রবর্তী গ্রন্থটির আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন– “আনকমনদের বেদনার্ত আখ্যান”।

তৌহিদুর রহমানের লেখা ‘নীল যমুনার জলে’ উপন্যাস নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। বইমেলায় প্রকাশিত এই উপন্যাসটি নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল বিভিন্ন গোষ্ঠী তাঁদের মতামত– বইটি নিষিদ্ধ করতে হবে। নীল যমুনার জলে’-র কেন্দ্রীয় চরিত্র সোমা। যিনি একজন কলেজ ছাত্রী। আর-একটি চরিত্র রেহানা। তিনি একজন কলেজের শিক্ষিকা। এই দুই চরিত্র ঘিরেই এগিয়েছে উপন্যাসের কাহিনি। এতে দেখানো হয়েছে দুজন একই প্রকৃতির। তাঁদের দুজনেরই পুরুষের কোনো আকর্ষণ নেই। কোনো পুরুষের প্রতি আকর্ষণ না থাকাটাই স্বাভাবিক। তার মানে যৌনতা নেই, তা কিন্তু নয়। সোমা ও রেহানা উভয় উভয়ের মধ্যে আকর্ষণ খুঁজে পায়। সেই আকর্ষণে থাকে তীব্রতা। কেউ একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারে না। ধীরে ধীরে একসময় দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলে। দুজনে চলার পথে একসময় বুঝতে পারে আর দশটা মানুষের মতো ওদের জীবন নয়। তাই সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা সারাজীবন একসঙ্গে থাকবে। তবে সামাজিক কারণে ওরা একসঙ্গে থাকতে পারে না। একদিন দুজনেই মালাবদল করে গোপনে বিয়ে করে নিলেন। সে বিয়ের কথা কেউ জানতে পারল না। ওরা কারোকে জানাতেও পারে না। এভাবেই বয়ে চলে দুটি জীবন। লেখক বিশ্বাস করেন, “বাংলাদেশে অনেক সমকামী পুরুষ আছেন। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার কারণে সমকামী নারী পুরুষরা এখানে নিজেদের আড়ালে রাখেন। সমকামিতা কোনো প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ নয়, বরং খুব স্বাভাবিক।”

শুধু গল্প-উপন্যাসেই নয়, সমকাম ধরা দিয়েছে কবিতাতেও। এই সময়ের কবি অনুপম মুখোপাধ্যায় লিখছেন –

“আমার খবর জবাব নেই। কুসুমের কাছে
বাগান আমাকে এখানে। এই। নোটিশ দিয়েছে।
বোঁটা জানে, ডাল জানে। মালি নই আমি
বেতন দিয়েছে। শুধু। পরাগ দিল না।
হায়ের বয়স কত। কেউ কি তা জানে
 এতদিন। ছায়া সে তো রোদেই ফেলেছে।
 ধুলোর অনেক কাছে। রেণু। রাখা ছিল
 আমার এলার্জি। তার। ঠিকানা পেল না।
সুগন্ধ এভাবে। বেশ। কেটেই চলেছে
অপর সুগন্ধী। সেই। মনে পড়ে গেল।
 কিছু নেই। খুব জানি। কিছুই তো নেই।”

কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় ‘বান্ধবীবিহার’ কবিতাটিতে লিখছেন –

“ব্যত্যয় নেই কোনও! আমি
জানি, তোকে ভালবাসি, তাই এ-জগত
 মধুময় লাগে। আয়োজনে, যদি কিছু
 বিরোধিতা জাগে! খুনি বোমা বেঁধে
চলে, কোকিল লুকিয়ে কাঁদে
বসন্তগোড়ায়, দুধে-বিষে মিশে গেলে,
 তখন সমাজ, খোলা বাথরুম হয়ে, যায়! … দরোজা দিয়েছি, জানলাও,
আমাদের ঘরে মধুঘুম নামবে, বল
 সখি, মম সঙ্গে লিভ-ইন করবে কি।”

কিছুদিন আগে নিজেকে সমকামী দাবি করে একটি গানও লিখেছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কবীর সুমন।

“পুরুষ হও বা নারী, তুমিই আমার সখা”– ঋগ্বেদের এই উক্তিকে পুঁজি করেই ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল সমকামিতার উপর প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘১০ জুলাই’। এর আগে বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে সমকামিতার আভাস থাকলেও সমকামীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো চলচ্চিত্র এটাই প্রথম। সারা দেশে সমকামী প্রেম যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে পরিচালক রাতুল গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্মিত এই ছবির রিলিজ নিয়ে হইচই তো হবেই। ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিভিন্ন সময়ে বিষয়বস্তু হিসাবে উঠে এসেছে সমকামিতা। বলিউডে সমকামিতা বিষয়ক কিছু ছবি নিয়ে জি নিউজে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিল। বম গে’ (১৯৯৬) সমকামিতার উপর তৈরি ভারতের প্রথম ডকুফ্লিম। যদিও ভারতে মুক্তি পায়নি এই ছবি। কবি আর, রাজ রাওয়ের লেখার উপর, মুম্বাইয়ের গে সংস্কৃতি নিয়ে গে পরিচালক রিয়াদ ভিঞ্চি ওয়াদিয়ার ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রাহুল বসু। ‘ফায়ার’ (১৯৯৭) ভারতে সমকামী চলচ্চিত্র তৈরির পথপ্রদর্শক দিপা মেহতা। তাঁর ট্রিলজির প্রথম ছবি ‘ফায়ার’। বৈবাহিক জীবনের সমস্যায় জর্জরিত দুই মহিলার শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কাহিনি নিয়ে ফায়ার’ ভারত রক্ষণশীল সমাজে আগুন জ্বেলেছিল। বক্স অফিসে মুক্তি রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটি এড়াতে পারেনি। এর ছয় বছর পর ‘ম্যাঙ্গো সুফলে’ (২০০২) চলচ্চিত্রটি বানিয়েছিলেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মহেশ দত্তানি। একাকিত্বে ভোগা গে ফ্যাশন ডিজাইনারের গল্প ব্যঙ্গাত্মক মোড়কে উপস্থাপন করেছিলেন মহেশ। ফায়ারের মতো রক্ষণশীলদের প্রতিবাদের মুখে পড়তে না-হলেও চুপিচুপি মুক্তি পেয়ে চুপিচুপিই প্রেক্ষাগৃহ থেকে চলে গিয়েছিল ম্যাঙ্গো সুফলে।

‘কাল হো না হো’ (২০০৩) চলচ্চিত্র মুম্বাইয়ের মেনস্ট্রিম ধারার সমকামিতাকে ব্যঙ্গাত্মক রূপ দিয়েছিলেন করণ জোহর। তবে শুধু সমকামিতা নয়, সমকামিতার প্রতি সাধারণ মানুষের ভুরু কোঁচকানোও করণ তুলে এনেছিলেন এই চলচ্চিত্রে। শাহরুখ খান ও সইফ আলি খানের গে সম্পর্ক দেখে চমকে ওঠেন ছবির চরিত্র কান্তা বেন। গার্লফ্রেন্ড’ (২০০৪) আর-একটি চলচ্চিত্র। গে সম্পর্ক নিয়ে চলচ্চিত্র বেশ কিছু চলচ্চিত্র তৈরি হলেও লেসবিয়ান সম্পর্ক নিয়ে চলচ্চিত্র ফায়ারের পর হয়েছে গার্লফ্রেন্ড। দুই বন্ধুর মধ্যে একজন লেসবিয়ান, অন্যজন বাই-সেক্সচুয়াল। বন্ধুর সঙ্গে সমকামিতার সম্পর্ক ছাড়াও তাঁর জীবনে ছিল প্রেমও। সমকামিতার সম্পর্ক ও বিষমকামিতা (Heterosexuality) সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, বয়ফ্রেন্ড ও বন্ধুর মধ্যে যৌনহিংসা নিয়ে এগিয়েছে গার্লফ্রেন্ডের গল্প। মাই ব্রাদার নিখিল’ (২০০৫) গে পরিচালক ওনির প্রথম চলচ্চিত্রেই গে সমকামিতাকে দারুণ সফলভাবে নিয়ে এসেছিলেন। ভারতের মতো দেশ থেকে সমকামিতার কারণে একঘরে হয়ে যাওয়া থেকে এইডস নিয়ে বাঁধাধরা ধারণা, সর্বোপরি পরিবারের পাশে দাঁড়ানো সবকিছুই ওনির তুলে ধরেছিলেন। পরে ‘আই অ্যাম’ চলচ্চিত্রেও। হানিমুন ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড’ (২০০৭) চলচ্চিত্রে ছয়জন সদ্যবিবাহিত জুটির হনিমুনের গল্প। এই ছয় জোড়ার মধ্যেই ছিলেন একজন বিবাহিত সমকামী পুরুষ। কীভাবে সেখান থেকেই অন্য সমকামী পুরুষের প্রতি আকর্ষণ ও বৈবাহিক সম্পর্কেও নিজেদের নিজেদের পছন্দের জায়গা বেছে নেন তাঁরা। ফ্যাশন’ চলচ্চিত্রে সমকামিতার অন্য দিক তুলে ধরেন মধুর ভাণ্ডারকর। সমাজের সামনে নিজের সমকামিতা লুকিয়ে রাখতে বন্ধু মুগ্ধা গডসেকে বিয়ে করেন গে ডিজাইনার সমীর সোনি। পাঁচ বছর পর আবার একই বিষয়ে ‘দোস্তানা’ চলচ্চিত্রটি রুপোলি পর্দায় নিয়ে আসেন। করণ জোহর। অভিষেক বচ্চন ও জন আব্রাহামের গে সম্পর্ক বক্স অফিসে প্রথমবারের জন্য কিছুটা হলেও দর্শকদের আনুকূল্য পেয়েছিল। পরে ‘বম্বে টকিজ’ চলচ্চিত্রেও সমকামিতা দেখিয়েছেন করণ জোহর। বস্তুত করণ জোহর নিজেও একজন সমকামী ব্যক্তিত্ব। সেই কারণে সুযোগ পেলেই উনি সমকামিতা বিষয়টাকে তাঁর চলচ্চিত্রে টেনে আনেন। ‘ডোন্ট নো হোয়াই না জানে কিউ’ (২০১০) চলচ্চিত্রকেও সেন্সর বোর্ডের চোখ-রাঙানিতে পড়তে হয় সমকামিতা প্রদর্শনের জন্য। এমনকি সমকামিতার দৃশ্যে অভিনয় করার অভিনেতা যুবরাজ পরাশরকে ত্যাজ্য করেছিল তাঁর পরিবার।

দীপা মেহতার ‘ফায়ার’ বা মধুর ভাণ্ডারকারের ‘পেজ থ্রি’ ছাড়াও সমকালে ভারতীয় সিনেমাতে সমলিঙ্গ প্রেমের প্রচুর উদাহরণ আছে। সদ্যপ্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চিত্রাঙ্গদা’, কিংবা ‘তিনকন্যা’, মৈনাকের ফ্যামিলি অ্যালবাম’, অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’ ‘তাসের দেশ’-এর মতো হাল আমলের নানা বাংলা ছবির গল্পও ঘিরেছে সমকামী সম্পর্ক। লক্ষ করা গেছে, আদিকাল থেকে শিল্প-সাহিত্যে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অভিলাষ সমকামিতার প্রতিফলন। একদা যেটা লুকিয়ে-চুরিয়ে হত আজ তা প্রকাশ্যে এসেছে। সমসাময়িক সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে বারবার জায়গা করে নিয়েছে সমকামী মানুষের গল্প। হেরোডোটাস, প্লেটোর মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদদের লেখায় প্রায়ই পাওয়া যায় সমকামী সম্পর্কের কথা।

তবে সমকামী পুরুষ ও সমকামী নারীরা হলিউডে গুরুত্ব পেলেও বলিউডের চলচ্চিত্রে তাঁদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আর বড়ো বাজেটের চলচ্চিত্রে একদমই দেখা যায় না তাঁদেরকে। মিডিয়ায় সমকামী পুরুষ, সমকামী নারী, উভকামী এবং হিজড়াদের উপস্থিতি এবং তাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ করে ‘গ্লাড’। সংগঠনটির মুখপাত্র উইলসন ক্রুজ জানান, মার্কিন সমাজে এসব চরিত্রের গুরুত্ব থাকলেও হলিউডের বড়ো বাজেটের ছবিতে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে পরিবর্তন জরুরি। সামগ্রিকভাবে হলিউড এবং মার্কিন চলচ্চিত্র তারকারা সমকামীদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হলেও ছবিতে তার প্রতিফলন নেই। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১০১টি বড় বাজেটের ছবির মধ্যে মাত্র ১৪টি পুরুষ বা নারী সমকামী এবং উভকামীদের চরিত্র ছিল।

ইতিহাস বলছে, প্রাচীন পারস্যে সমকামী সম্পর্কের প্রচলন ছিল। এই ভারতবর্ষেও সমকামিতা ছিল এবং আছে। বহু হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্য তো সমকামেরই পরিচয় প্রকট হয়ে আছে। খাজুরাহোর শিল্পকীর্তিতে তো রয়েছে গ্রুপ সেক্সের নিদর্শনও। বাৎসায়নের কামসূত্রেও সমকামিতা নিয়ে আলোচিত হয়েছে, দেখানো হয়েছে যৌন সম্পর্কেরই অন্য এক রূপ। অস্কার ওয়াইল্ডের জীবনী লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত এই সমকামী সাহিত্যিকের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন রিচার্ড এলম্যান।

সমকামীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক ভুলভাল ধারণা আছে। যেমন—

(১) সমকামিতা পাশ্চাত্যের সৃষ্টি। পাশ্চাত্যের উদার সমাজব্যবস্থা এবং ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমকামিতার জন্য দায়ী।

(২) সমকামিতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা।

 (৩) সমকামীদের সুশিক্ষা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

 (৪) সমকামিতা একটা রোগ।

 (৫) প্রকৃতিতে অন্য কোনো জীবজন্তু বা গাছপালার মধ্যে সমকামিতা দেখা যায় না।

(৬) সমকামীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত।

 (৭) জীবজন্তুরা তো অনেক কিছু করে, তাই বলে সেগুলি মানুষেরও করতে হবে নাকি?

উত্তরে বলি— প্রথমত, সমকামিতা মোটেই পাশ্চাত্যের সৃষ্টি নয়। এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা। সমকাম কোনো ফ্যাশন নয় যে, ওখান-এখান থেকে মানুষ গ্রহণ করবে। সমকাম একটি জৈবিক বিষয়, যা শরীর অনুমোদন করে দেশ-কাল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। প্রথমত, আদিমকাল থেকেই সমকামিতা আছে। ইতিহাসের বিভিন্ন অংশে সমকামিতার দৃষ্টান্ত আছে। সমকামিতা কোনো ফ্যাশান নয়, এটি একটি যৌন-সংকট বলা যায়। প্রাচীন বিভিন্ন মহাকাব্য সমকামিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে। মধ্যপ্রাচ্যে সমকামিতার ব্যাপক প্রচলন ছিল এক সময়ে। আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, সক্রেটিস সমকামী ছিলেন। কামসূত্রে সমকামিতার প্রচুর উদাহরণ আছে। অতএব সমকাম কোনো পাশ্চাত্যের তৈরি করা বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত, প্রাণীকুলে সমকামিতার ব্যাপক বিস্তার দেখতে পাওয়া যায়। প্রাণীকুল পাশ্চাত্যের উদার জীবনব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়েছে এটা যাঁরা ভাবে তাঁদের সম্পর্কে বলার কিছু নেই।

দ্বিতীয়ত, সমকামিতা কোনোভাবেই মানসিক বিকৃতি নয়। জীববিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, সমকাম কোনো মানসিক বিকার নয়। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয়। প্রত্যেক জীবের মধ্যে কিছু অংশ অবশ্যই সমকামী হয়ে জন্ম নেবে। তারা বেড়ে উঠবে সমকামী হয়ে, তাদের চালচলনে সমকামী ভাব ফুটে উঠবে। একটা রক্ষণশীল সমাজে সমকামীরা বেঁচে থাকে গোপনে, তাদের যৌনপ্রবৃত্তি তারা উপভোগ করে গোপনে, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধের মাধ্যমে, আর-একটা মুক্তসমাজে সেটা হয় প্রকাশ্যে। প্রকাশ্যে হওয়ার কারণে অপরাধের মাত্রা কমে যায়। মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও সমকামিতার অভিযোগ শোনা যায়। মাদ্রাসার শিক্ষকরা যাঁরা সমকামী, তাঁরা তাঁদের যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটায় অপরাধের মাধ্যমে শিশু ছাত্রদের সঙ্গে। হয়তো তাঁরা একজন নারীর সঙ্গে বিবাহত জীবন পালন করছে, কিন্তু তৃপ্তির অভাবে তাঁরা প্রতিনিয়ত সুযোগ খোঁজে তাঁদের অবদমিত কামনা পুরণের। যার শিকার সব সময় আমাদের দেশের বালক-তরুণরা হয়। অন্যান্য বিদ্যালয়ের সমকামী | শিক্ষক-শিক্ষিকারও যৌনক্ষুধা মিটিয়ে নেয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্য দিয়ে। ব্যাপারটা বেশ গোপনেই চলে। উন্নত বিশ্বে সমকামীরা প্রকাশ্যে বলে যে তাঁরা সমকামী। যার ফলে চিনতে পারা সহজ হয় এবং সমলিঙ্গের Straight মানুষরা সবসময় সতর্ক থাকতে পারে। তার উপর সমকামীরা সমকামী সঙ্গী বেছে নিয়ে স্বাভাবিক বিবাহিত এবং যৌন জীবনযাপন করলে তাঁরা অপরাধের মাধ্যমে তাঁদের যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার প্রয়োজন পড়ে না।

তৃতীয়ত, সমকামীদের নিয়ে যেই মামলাগুলি হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছিল যে সমকামীরা বিকৃতির শিকার কিংবা রোগী বা কিংবা অসুস্থ। কিন্তু মেডিকেল সায়েন্সে বিপরীতকামীদের সঙ্গে সমকামীদের কোনো পার্থক্য আছে, শারীরিক বা মানসিকভাবে, তার কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে সমকামীরা অসুস্থ বা মানসিক বিকৃতির শিকার বা বিকলাঙ্গ তাও বলা যাচ্ছে না।

চতুর্থত, প্রকৃতিতে বিভিন্নভাবে কীভাবে সমকামিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রকৃতির সৃষ্ট প্রায় প্রতিটি প্রাণী এবং বৃক্ষরাজিতে সমকামিতা বিদ্যমান। বেশিরভাগ জীব এবং গাছপালায় সমকামিতার প্রকাশ আছে।

পঞ্চমত, সমকামীদের কেন সামাজিকভাবে বয়কট করার কথা বলা হবে? তাঁরাও রক্তমাংসের মানুষ। একজন সমকামী পুরুষের নারীর প্রতি প্রাকৃতিকভাবে আকর্ষণ বোধ করে না। কোনো নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নারী দেখলে তার লিঙ্গ উত্থিত হয় না। সেই পুরুষের লিঙ্গ উত্থিত হবে কোনো নগ্ন বা অর্ধ নগ্ন পুরুষ দেখলে। একইভাবে নারী সমকামীরও কোনো নগ্ন নারী দেখলে উত্তেজনা আসবে, অপরদিকে পুরুষদের দেখে তাঁকে যৌনসঙ্গী করার কোনো ইচ্ছাই জাগবে না। এই কারণে নিশ্চয়ই একজন মানুষকে একঘরে করে রাখা বা বয়কট করা কোনোমতেই মানবিক আচরণ হতে পারে না। এটা অন্যায্য, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ।

ষষ্ঠত, জীবজন্তুরা এমন অনেক কাজ করে যেটা সভ্য মানুষের করা উচিত নয়, এটা ঠিক। যেমন ধর্ষণ প্রবৃত্তি জীবকুলে বিদ্যমান, পিতামাতার সঙ্গে যৌনতা প্রাণীকুলে বিদ্যমান। একজন সভ্য মানুষ কখনোই এই ধরনের কাজ করতে বা সমর্থন করতে পারে না। কথা হচ্ছে সমকামিতাও কি একই ধরনের ব্যাপার?

বিরোধীরা বলেন, সমকাম প্রবৃত্তি প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং সৃষ্টিশীল নয়। তাই সেটা আইনসংগত করার কোনো মানে হয় না। সমাজে অবক্ষয় আসবে। সমকামিতা না থাকলে সমাজের কী ক্ষতি হবে? সমকাম সমাজের বা প্রকৃতির কোন্ উপকারে লাগবে? ইত্যাদি।

আমি বলি– কে বলল সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ? কোন্ যুক্তিতে? সমকামী মানুষরা কি প্রকৃতি ছাড়াই জন্ম নিয়েছে? নারী ও পুরুষদের মতো সমকামীদেরও এই প্রকৃতি থেকেই জন্ম হয়েছে। নারী ও পুরুষদের মতো সমকামী মানুদের শরীরও তৈরি হয়েছে প্রকৃতির উপাদান দিয়েই। আমরা বিপরীতকামীরা যে উপায়ে যৌনতা করি তার সব ইভেন্টই কি সৃষ্টিশীল? একটা বা দুটো সন্তানের পিতামাতা হওয়া কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়? তাহলে তো প্রকৃতিবিরুদ্ধতার অভিযোগে জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হয়! জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রকৃতিবিরুদ্ধতা নয়?

আদিম যুগে যে সময় বিবাহ প্রথা ছিল না, যখন মানুষ প্রাণীদের মতোই ভোলা আকাশের নীচে যৌনমিলন করেছে, প্রকৃতির কোলে জন্ম নিয়েছে ও মরেছে, সেটা কী প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল? নাকি বিবাহ প্রথাটাই প্রকৃতিবিরুদ্ধ? যেসব নারী বা যেসব পুরুষ বন্ধ্যা হওয়ার কারণে সন্তানের জন্মদানে অক্ষম, তাঁদের যৌনজীবন কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ?

বস্তুত সমকামিতা সমকামীরা নিজে নির্ধারণ করে না। প্রকৃতি তাঁদের ভিতরে সমকামিতার বীজ বপন করে রেখেছে। একজন ধর্ষক ধর্ষণ না-করেও সুস্থ যৌনতার মাধ্যমে নিজের যৌনাকাঙ্ক্ষা পুরণ করতে পারে। একজন ইনসেস্টার বা অজাচারিতা ইনসেস্ট বা অজাচার সম্পর্ক না-করেও সুস্থ যৌনজীবন যাপন করতে পারে। সমকামীরা কীভাবে যৌনজীবন যাপন করবে? এই প্রশ্নটাই মূলত বিপরীতকামীদের মাথার ব্যথার কারণ। যেভাবেই করুক, সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত পরিসরেই করে। সমকামীরা কেন তাঁদের রুচিমতো যৌনতা উপভোগ করতে পারবে না? কেন পারবে না?

হিজড়ে এবং সমকামীরা কি একই সমগোত্রীয়? রূপান্তরকামী সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অন্তহীন অন্তরীণ প্রোষিতভর্তৃকা’ গ্রন্থে বিষয়টা পরিষ্কার করেছেন। তিনি হিজরানী শ্যামলী-মায়ের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন– “এতদিনে মানুষের ধারণা ছিল হিজড়ে বুঝি জন্ম থেকেই হয়। ছোটোবেলাতেই হিজড়ে সন্তান জন্মালে মা-বাবা তাকে হিজড়ে ডেরায় দিয়ে আসে। কেন– এমন গল্প শুনিসনি, হিজড়ে বাচ্ছাকে মা-বাবা আটকে রেখেছিল, পাড়ায় হিজড়েরা তালি দিচ্ছিল, আর সেই তালি শুনে ঘর থেকে বাচ্ছা হিজড়ে তালি দিল। আর সেই তালি শুনে হিজড়েরা বাচ্ছাটাকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল!”

হিজড়া হতে হলে লিকস্ (লিঙ্গ) ছিবড়াতে (কর্তন) হয়। অণ্ডকোশ সমেত পুরুষাঙ্গ কেটে ফেললে তবেই ‘নির্বাণ’ বা প্রকৃত সন্মানিত হিজড়া হওয়া যায়। অবশ্য পুরুষাঙ্গ কর্তন করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পুরুষাঙ্গ নিয়ে যে ধুরানি (বেশ্যা বা যৌনকর্মী) হিজড়া বৃত্তি করবে, তাকে হিজড়ারা ‘আকুয়া’ (বিপরীত সাজসজ্জাকামী ও যৌনপরিবর্তনকামী) বলে।

ওরা ঢোল বাজিয়ের দল, ওরা হিজড়া। ওরা নবজাতকের খোঁজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, ওরা হিজড়া। ওরা এক শ্রেণির অবাঞ্ছিত, অপাঙক্তেয় মানবগোষ্ঠী, ওরা হিজড়া। ওরা যৌন বিকলাঙ্গ– এক প্রতিবন্ধী মানুষ, ওরা হিজড়া। মনুষ্য সমাজে এক অন্তঃসলিলা প্রবাহ, যাঁরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসছে সমাজের উন্থানপতন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে, ওরা হিজড়াই। প্রাণীজগতে আমরা চার প্রকারের ‘হিজড়া’ দেখতে পাই।

(১) প্রকৃত হিজড়া (True Hermaphrolite),

 (২) পুরুষ অপ্রকৃত হিজড়া (Male Pseudo Hermaphrodite),

(৩) স্ত্রী অপ্রকৃত হিজড়া (Female Pseudo Hermaphrodite) এবং

(৪) ফ্ৰিমার্টিন সিনড্রোম (Freemartin Syndrome)।

প্রকৃত হিজড়াদের ক্ষেত্রে একই দেহে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়ের অবস্থান লক্ষ করা যায়। পুরুষ অপ্রকৃত হিজড়াদের শরীরের আপাত বাহ্যিক গঠন মেয়েলি হলেও শুক্রাশয় বর্তমান। স্ত্রী অপ্রকৃত হিজড়াদের দৈহিক গঠনের সঙ্গে সুস্থ পুরুষের আপাত সাদৃশ্য থাকলেও এরকম হিজড়ার দেহে ডিম্বাশয় থাকে।

হিজড়াদের মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়– (১) জন্মগত হিজড়ে এবং (২) ছদ্মবেশী হিজড়া।

(১) জন্মগত হিজড়ে : আমরা আমাদের চারপাশে যেসব হিজড়া দেখি তাঁদের অনেকেই জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী। এঁদের যৌন জনন বৈকল্য বা প্রতিবন্ধকতা একরকম নয়। কারোর যৌনাঙ্গ অপুষ্ট বা অপূর্ণাঙ্গ। কারোর-বা শরীরে নারী ও পুরুষ অপরিপূর্ণ উভয় যৌনাঙ্গের অবস্থান লক্ষ করা যায়। এখন প্রশ্ন কেন প্রতিবন্ধকতা?

নারী-পুরুষ লিঙ্গ নির্ধারণ হয় দুই ধরনের আলাদা আলাদা ক্রোমোজোমের উপস্থিতিতে। সাধারণত প্রতি কোশে এক জোড়া ক্রোমোজোম দেখা যায়, যারা বস্তুত লিঙ্গ নির্ধারক। এই ক্রোমোজোমগুলিই হল Sex Chromosome বা যৌন ক্রোমোজোম। যৌন ক্রোমোজোম দুটিকে X এবং Y দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। বাকি ক্রোমোজোমগুলি জীবের অন্যান্য বৈশিষ্ঠ্যের ধারক। এঁরা। Autosome বা অযৌন ক্রোমোজোম। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে মানুষের দেহকোশের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৬ বা ২৩ জোড়া। এই ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে এক জোড়া ক্রোমোজোম নির্ধারক। অর্থাৎ বাকি ২২ জোড়া অটোজোম। Y ক্রোমোজোমের আকৃতি ও আয়তনে X ক্রোমোজোমের তুলনায় ক্ষুদ্র। স্ত্রী দেহকোশে দুটি X ক্রোমোজোম থাকে। অপরদিকে, পুরুষ দেহকোশে একটি x এবং একটি Y ক্রোমোজোম থাকে। প্রতিটি কন্যা সন্তান মাতাপিতার কাছ থেকে ২২ জোড়া অযৌন ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। এর মধ্যে মায়ের কাছ থেকে একটি X ক্রমোজোম এবং বাবার কাছ থেকে একটি Y ক্রোমোজোম, অর্থাৎ দুটি XX যৌন ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। অপরদিকে পুত্র সন্তানটি ২২ জোড়া অযৌন ক্রোমোজোমের সঙ্গে মায়ের কাছ থেকে একটি x এবং বাবার কাছ থেকে একটি Y ক্রোমোজোম লাভ করে। এটাই স্বাভাবিক হলেও সবসময় তা হয় না। অনেক সময় যৌন ক্রোমোজোমের ত্রুটির ফলে কোনো সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সন্তানটি ছেলে না মেয়ে, সেটা বলা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তখন সে তৃতীয় সেক্সের দলে পড়ে, অর্থাৎ হিজড়া। ক্রোমোজোম ও বাবডির ত্রুটির হিসাবে হিজড়াদের ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন–

(ক) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম (Klinefelter Syndrome): এদের স্ফীত স্তন দেখা যায়। এদের শিশ্ন বা পুংলিঙ্গ থাকে বটে, তবে তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র। শুক্রাশয়ও খুব ছোটো হয়। বগল (বাহুমূল) চুল বা কেশ থাকে না। এঁদের তলপেটের নীচে, অর্থাৎ যৌনাঙ্গের চারপাশে চুল কম হয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ কম হয়। এঁরা সাধারণত উচ্চতায় লম্বা ধরনের হয়ে থাকে। মানসিক জড়তাও থাকতে পারে। এই সমস্ত ব্যক্তিদের দেহকোশে ২২ জোড়া অটোজোম, ২টি x ক্রোমোজোম এবং একটি Y ক্রোমোজোম— মোট ৪৭টি ক্রোমোজোম থাকে। সাধারণ অবস্থায় পুরুষের শরীরে যৌন ক্রোমোজোম থাকে xY এবং মোট ক্রোমোজোমের সংখ্যা হয় ৪৬টি। অতিরিক্ত স্ত্রী যৌন ক্রোমোজোম, অর্থাৎ X এর উপস্থিতির ফলেই ব্যক্তির শরীরে স্ত্রী-বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়।

 (খ) XXX পুরুষ (xxY Male) : এঁদের শরীরের গঠন পুরুষদের মতো হলেও এঁরা পুরোপুরি পুরুষ নয়। এরা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা হয়। এঁদের বুদ্ধিবৃত্তি কম। এঁদের মধ্যে অনেক সময়েই হিংসাত্মক সমাজবিরোধী আচরণের প্রকাশ ঘটে। পুরুষদের মতো লিঙ্গ থাকে। তবে লিঙ্গ থাকলেও মূত্রছিদ্রটি লিঙ্গের স্বাভাবিক স্থানে থাকে না। এঁদের অণ্ডকোশও স্বাভাবিক স্থানে না। থাকে শরীরের অভ্যন্তরে। এঁদের শরীরে ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৭। ৪৪ টি অটোজোম এবং ৩ টি যৌন ক্রোমোজোম। যৌন ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি x এবং দুটি Y ক্রোমোজোম থাকে।

 (গ) XX পুরুষ (xx Male syndrome) : XX-পুরুষদের সঙ্গে ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোমের অনেক মিল আছে। এদের অনেকেরই স্তন থাকে। তবে তা কখনোই সুডৌল এবং স্ফীত নয়। শুক্রাশয় থাকে, তবে তা খুবই ক্ষুদ্র। তবে শুক্রাশয় থাকলেও সেখানে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় না। পুরুষাঙ্গ আকৃতিতে স্বাভাবিক, অথবা স্বাভাবিকের তুলনায় ছোটোও হতে পারে। লিঙ্গের যে স্থানে মূত্রছিদ্রটি থাকার কথা সেখানে থাকে না। XX পুরুষরা উচ্চতায় বেঁটে প্রকৃতির হয়। এই ধরনের XX পুরুষের শরীরে ক্রোমোজোমের মোট সংখ্যা ৪৮। অটোজোম ৪৬ টি এবং দুটি সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। XX সেক্স ক্রোমোজোমের উপস্থিতি থাকলেও ক্রোমোজোমের গঠনের অস্বাভাবিকতার জন্য এঁরা পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠতে পারে না। বিভিন্ন রকম পুরুষালি ভাব প্রকট হয়।

(ঘ) টার্নার সিনড্রোম (Turner Syndrome) : এঁদের ক্রোমোজোমের গঠন ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম ও XX-পুরুষ হিজড়াদের অনুরূপ নয়। আপাতদৃষ্টিতে এঁদের নারী মনে হলেও এরা কিন্তু পুরোপুরি নারী নন। কারণ এদের প্রধান যৌনাঙ্গ এবং অন্যান্য গৌণ যৌনাঙ্গ ত্রুটিযুক্ত। এদের যৌনাঙ্গের সঙ্গে নারীর যৌনাঙ্গের আপাত সাদৃশ্য থাকে। যোনিকেশ খুবই কম দেখা যায়। ডিম্বাশয় থাকে না এবং অপূর্ণাঙ্গ ফেলোপিয়ান টিউব ও জরায়ুর গঠন। এর ফলে রজঃস্বলা বা পিরিয়ড হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদের বুকের ছাতি পুরুষদের মতো প্রশস্ত। তবে এঁদের প্রশস্ত ছাতিতে কৈশোর থেকে স্তনগ্রন্থির প্রকাশ ঘটে। এঁরা অস্বাভাবিক খর্বাকৃতি হয়। গায়ের চামড়া টানলে অনেকটা ঝুলে পড়ে। হাত-পায়ের অত্যন্ত খসখসে হয়। বৌদ্ধিক ক্ষমতা সাধারণের চাইতে কম। এঁদের কোশের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৫ (অটোজোম ৪৪ + x)। বার্বোডি থাকে না। ক্রোমোজোমের এই অস্বাভাবিকতার জন্যেই এঁদের যৌনাঙ্গ ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত হয়। Y ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি যেমন শরীরে পুরুষালি ভাব প্রকাশের অন্তরায় হয়ে শরীরকে নারীসুলভ করে তোলে, ঠিক তেমনই বার্বোডি না-থাকায় নারী শরীরের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। দেহের গঠন আংশিক পুরুষের মতো হয়ে থাকে।

(ঙ) মিশ্র যৌনগ্রন্থির বিকৃতি (Mixed Gonadal Dysgenesis) : আপাতদৃষ্টিতে এঁদের পুরুষ বলেই মনে হয়। গোঁফ-দাড়িও হয়। শুক্রাশয় থাকে, তবে তা থাকে শরীরের অভ্যন্তরে। এই প্রকার হিজড়াদের শুক্রাশয়ের বিভিন্ন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যই পরিণত শুক্রাণুর জন্ম হয় না। এদের শিশ্ন বা লিঙ্গ বর্তমান থাকে। মূত্রছিদ্র লিঙ্গের স্বাভাবিক স্থানেই থাকে। ব্যতিক্রম যেটা, সেটা হল লিঙ্গ থাকা সত্ত্বেও এদের শরীরে যোনি অর্থাৎ স্ত্রীযোনি, জরায়ু এবং ফেলোপিয়ান টিউব থাকে। কৈশোরের এদের শুক্রাশয় থেকে এন্ড্রোজেন নিঃসৃত হয়, ফলে শরীরে পুরুষালি ভাব বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। প্রধানত ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা, অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডের নানারকম ত্রুটি এবং জননকোশের উৎপত্তি স্থানের নানা সূক্ষ্ম জটিলতার ফলেই এমন যৌনবিকলাঙ্গ মানুষের জন্ম হয়। এইসব মানুষদের দেহকোশে ক্রোমোজোমের সংখ্যা সাধারণত ৪৬ (৪৫ + X) হয়। অবশ্য অনেক সময়েই ৪৭ (৪৫ + XY)ও দেখা যায়।

বস্তুত হিজড়াদের দলে জন্মগত যৌন-প্রতিবন্ধীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। সামান্য কিছু ব্যতীত প্রায় সকলেই ছদ্মবেশী হিজড়া। তবে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে এঁরা এত বেশি অসুস্থ যে খোশমেজাজে নেচে-গেয়ে হিজড়াদের দলে থেকে এঁদের জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। নানাবিধ শারীরিক পীড়ায় জর্জরিত এঁরা। আর পাঁচটা অসুস্থ-পঙ্গু মানুষের মতো এরা সংসারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সম্প্রদায়ভুক্ত হিজড়াদের দলে এঁদের ঠাঁই হয় না। এঁদের কাছেও এরা ঝঞ্ঝাট। অন্যভাবে বললে এরা ‘অপ্রকৃত হিজড়া’। প্রসঙ্গত জানাই, যৌন-প্রতিবন্ধী যাঁরা, তাঁদেরকে ‘প্রকৃত হিজড়া’ বলা হয়। প্রকৃত হিজড়াদের সকলকেই পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব না-হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেকেই ত্রুটিমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। যদিও ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা থাকলে তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা যায় না ঠিকই, কিন্তু হাইপোস্পিডিয়াস থাকলে তাঁকে সার্জারির সাহায্যে ভালো করে তোলা সম্ভব হয়েছে। টানার্স সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও অস্ত্রোপচার সম্ভব হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আগামীদিনে জন্মগত হিজড়ে অনেক কমে যাবে বলে অনেকে মনে করেন।

(২) ছদ্মবেশী হিজড়া : ছদ্মবেশী হিজড়াদের চারভাগে ভাগ করলে আলোচনার সুবিধা হবে। যেমন–

(ক) আকুয়া : হিজড়া দলে এক ধরনের পুরুষ থাকে যাঁরা মেয়ে সাজতে চায়, মেয়ে হতে চায়। মেয়ে হিসাবে নিজেকে জাহির করার মধ্যে এঁরা অসম্ভব রকম মানসিক পরিতৃপ্তি বোধ করে। এঁরা পুরুষ হলেও নারী-বেশ ধারণ করতে পছন্দ করে। স্রেফ এক বিশেষ মানসিক তাড়নায় এঁরা মেয়ে সেজে থাকতে চায়। সদ্য শৈশব পেরিয়ে আসা কিশোরদের মধ্যে এরকম ভাব লক্ষ করা যায়। তবে পরিণত বয়সেও কোনো পুরুষের মধ্যেও এ ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এঁদের মানসিকতাকে Transexualism বা লিঙ্গরূপান্তরকামিতা বা যৌন পরিবর্তনকামিতা বলে। নিজেকে পুরোপুরি পালটে মহিলা হিসাবে পরিচিত হতে চায়। যৌন পরিবর্তনকামী মানুষরা নারীত্বের স্বাদ পেতে চায়। পুরুষদের এঁরা প্রেমিকা ভাবে। কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের সদ্য নিযুক্ত মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগে পর্যন্তও ‘আকুয়া’ সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হিসাবে পরিচিত ছিলেন। আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে ‘পুরুষ’ সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে নারী হিসাবে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুনর্জন্ম হয়েছে।

মাঝের ছবিতে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই পাশের দুজনও রূপান্তরকামী
[মাঝের ছবিতে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই পাশের দুজনও রূপান্তরকামী]

এই আকুয়ারা সমবয়সিকে স্রেফ বন্ধু হিসাবে পেতে চায়, যৌনসঙ্গী হিসাবে নয়। কিন্তু পুরুষ হয়েও মেয়েলি স্বভাব ও আচরণের জন্য মেয়েরা তাঁদের মেয়ে হিসাবে মেনে নিতে পারে না। মেয়েলি ভাবের জন্য এঁরা যেমন মেয়েদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়, তেমনি পুরুষদের কাছ থেকেও প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে এদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও অন্তর্মুখীনতা দেখা যায়। দারিদ্র্য, সাংসারিক ও পারিপার্শ্বিক চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা আকুয়ারা একটা সময় হিজড়াদের দলে এসে ভিড়ে যায়। সবার ভাগ্যে তো আর মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঘর ও বর জোটে না!

(খ) জেনানা : জেনানা হল নারীর সাজে সজ্জিত কোনো পুরুষ। তবে এঁদের আকুয়া বলা যাবে না। কারণ জেনানারা কোনো বিশেষ মানসিকতার দ্বারা আক্রান্ত নয়। নারী বেশ ধারণের মধ্য দিয়ে এঁরা কোনো সুখ উপলব্ধি করে না। যৌন-প্রতিবন্ধী হিসাবে পরিচিত হয়ে এঁরা সমাজের কাছ থেকে সর্বপ্রকার বাড়তি সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে চায়। কম খেটে অসদুপায়ে বেশি রোজগারের আশায় জেনানা হিজড়াদের এই ধরনের নারীবেশ ধারণ। হিজড়ার জগতে জেনানাদের দাপটই সবচেয়ে জেনানারা আবার দু-ধরনের হয়। যেমন —

(অ) যৌনক্ষমতাহীন জেনানা : হিজড়া দলের এইসব জেনানারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজের এক্কেবারে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির মানুষ। অস্বাস্থ্যকর ঝুপড়ি বস্তি এলাকা থেকেই এইসব হিজড়ারা সংগৃহীত হয়। এদের কেউ কেউ অনাথ। এঁরা স্বেচ্ছায় হিজড়াদের দলে চলে আসে। দারিদ্র্য, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং অল্প পরিশ্রমে রোজগারের হাতছানি যৌনক্ষমতাহীন ব্যক্তিদের হিজড়াদের ডেরায় ভিড়ে যায়।

(আ) যৌনক্ষমতাসম্পন্ন জেনানা : এঁরা শরীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে পরিপূর্ণ সুস্থ পুরুষ-মানুষ। এঁরা ধান্দাবাজ, ধুরন্ধর। এঁদের অনেকেরই স্ত্রী-সন্তান পরিবার থাকে। কোনো জেনানা যদি হিজড়েদের দলের প্রধান হয় তাহলে তাঁর পক্ষে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকা সম্ভব হয় না। দল পরিচালনার জন্যে তাঁকে হিজড়া-মহল্লাতেই থাকতে হয়। তাই বলে পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নষ্ট হয় না। সেই কারণেই এদেরকে রোজ ভোর হতে না-হতেই ছুটতে হয় হিজড়েদের দুনিয়াতে।

(গ) ছিবড়ি : শুধু পুরুষরাই নয়, হিজড়াদের দলে কিছু মহিলাদেরও দেখা যায়। এইসব হিজড়াদের ছিবড়ি বলা হয়। এঁরা যৌনাঙ্গের ত্রুটিযুক্ত মহিলা নয়, সুস্থ সবল মানুষ এঁরা। নিতান্তই অর্থনৈতিক কারণেই এঁরা হিজড়ের দলে এসে যোগ দেয়। চরমতম আর্থিক সংকটের মধ্যেই দিন গুজরান করে। রুটিরুজির ধান্দায় এঁরা হিজড়াদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। হিজড়াদের সঙ্গে থাকার কারণে হিজড়াদের আদব-কায়দাও শিখে নেয়। রপ্ত করে নেয় হিজড়া সমাজের রীতিনীতি। এঁরা বেশিরভাই বিবাহিতা এবং স্বামী পরিত্যক্তা হন।

(ঘ) ছিন্নি : যে সমস্ত পুরুষ মানুষ লিঙ্গ কর্তন করে ‘খোজা হয়, তাঁদেরকেই ‘ছিন্নি’ বলে। হিজড়াদের গরিষ্ঠাংশই ছিন্নি। আকুয়া থেকে অনেকে হিজরাই স্বেচ্ছায় ছিন্নিতে রূপান্তরিত হয়। যৌন পরির্তনকামী হিজড়ারা নিজেদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে। শরীর থেকে পুরুষাঙ্গ কর্তন করে পরিপূর্ণ নারী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। আধুনিক বা অগ্রসর দেশগুলিতে অত্যাধুনিক প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে যৌন পরিবর্তনকামীরা তাঁদের লিঙ্গ পরিবর্তন করার সুযোগ পেতে পারে। এই জাতীয় অস্ত্রোপচার অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তাই অনেকেরই এই স্বপ্ন অধুরাই থেকে যায়। তবে যাঁরা অসম্ভব রকমের মানসিক টানাপোড়েনকে উপেক্ষা করতে পারেন না, তাঁরা হাতুড়ে চিকিৎসক দিয়ে লিঙ্গ কর্তন করিয়ে নেয়। অবশ্য যৌন পরিবর্তনকামী আকুয়ারা ছাড়াও যৌনক্ষমতাহীন জেনানারাও অনেক সময় তাঁদের লিঙ্গ কর্তন করায়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দালাল মারফত পুরুষ-শিশু, কিশোর এবং যুবকদের হিজড়াদের গোষ্ঠীপতিরা সংগ্রহ করে। এরপর ওদের লিঙ্গ কর্তন খোজা করে ‘পাকা হিজড়া’ বানিয়ে তাঁদের বিভিন্ন রকম রোজগারের কাজে নামানো হয়।

খোজার কথা যখন উঠলই তখন আমরা জেনে নিতে পারি খোজার ইতিহাস। কীভাবে খোজা’ (ক্যাসট্রেশন) করা হয় তাও জানব। খোজাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় মানুষের হাতে গড়া খোজাদের আবির্ভাব হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায়। খোজা প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজকীয় হারেমে বা জেনানামহলে কর্মী ও কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত খোজাকৃত পুরুষ। বিশেষ উদ্দেশ্যে পুরুষদের খোজা করার প্রথা খ্রিস্টপূর্ব আট শতকের গোড়ার দিকেও প্রচলিত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে খোজারা রাজকীয় হারেমের ভৃত্য বা প্রহরী হিসাবে, খেতাবধারী বা বৃত্তিভোগী রানি এবং সরকারের যোদ্ধা ও মন্ত্রীদের পরামর্শদাতা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এ প্রথা বা ব্যবস্থাটি ভারতে প্রবর্তিত হয় সম্ভবত সুলতানি আমলের গোড়ার দিকে। খোজাদের প্রধানত সুলতানদের প্রাসাদে হারেম প্রহরার জন্য নিযুক্ত করা হলেও চিনা খোজাদের মতো সুলতানি আমলের খোজারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা পালন করে। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির (১২৯৬-১৩১৬) অন্যতম বিখ্যাত সেনাপতি ও ওয়াজির মালিক কাফুর একজন খোজা ছিলেন। দিল্লির খোজাদের মতো বাংলার অভিজাতবর্গের খোজারাও প্রশাসনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। বাংলায় হাবশি শাসনামলে (১৪৮৭-১৪৯৩) বস্তত শাসকদের ক্ষমতার উত্থান-পতনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শাহজাদা ওরফে বারবক নামে এক খোজা ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদ দখল করেন। পণ্ডিতদের বিশ্বাস, হাবসি সুলতান শামসউদ্দিন মুজাফফর শাহ (১৪৯০-১৪৯৩) খোজা ছিলেন। সমসাময়িক বাংলায় পর্তুগিজ পরিব্রাজক দুয়ার্তে বারবোসার বিবরণ অনুসারে বাংলার শাসক ও অভিজাতবর্গের হারেমগুলিতে দেশীয় ও বিদেশি বংশোদ্ভূত খোজারা প্রহরায় নিয়োজিত থাকত। কথিত আছে, নওয়াব শুজাউদ্দিন খানের (১৭১৭-১৭৩৯) হারেম প্রহরায় নিয়োজিত ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে সংগৃহীত খোজারা।

ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক নানা গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বহুবিবাহ, উপপত্নী (বাঁদি) ও হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণে খোজা ব্যবস্থারও উদ্ভব ঘটে। হারেমের নারীদের উপর নজর রাখার জন্য খোজাকৃত পুরুষ প্রহরী নিয়োগ করা হত। পুরুষদের খোজা করে দেওয়া হত এই কারণে যে, যাতে এই পুরুষ-প্রহরীরা হারেমের নারীদের সঙ্গে যৌনমিলন না করতে পারে। সাধারণত রণাঙ্গণে বন্দি তরুণ সৈনিকদের খোজা করা হত। এছাড়া দাস-বিক্রেতারা সাধারণত দাস বাজার থেকে ক্রয় করে স্বাস্থ্যবান ও তরুণ বালকদেরও খোজা করত। এরপর শাসক ও অভিজাতবর্গের হারেমে বিক্রি করে দিত। ভারতের প্রাচীন শাসকরা তাঁদের হারেম পাহারা দেওয়ার জন্য হিজড়াদের নিয়োগ করতেন, কখনো তাঁরা খোজা করা কোনো পুরুষকে নিয়োগ করতেন না। অতএব খোজা প্রথা এদেশে প্রবর্তিত হয় বিদেশিদের দ্বারাই।

সভ্যতার একেবারে গোড়ার দিকে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৮১১ থেকে ৮০৮ অব্দের আসিবিয়ার রানিমাতা সামুরামাত নিজ হাতে তার এক ক্রীতদাসকে ‘খোজা’ করেছিলেন। একটি উপকথায় তাঁকে সেমিরা মিস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসিবিয়ার রানিমাতা কেন তাঁর ক্রীতদাসকে ‘খোজা’ করেছিলেন ইতিহাসে তার বিবরণ না-থাকলেও অনেক গবেষক মনে করেন রানির বিকৃত যৌন-লালসা নিবৃত্ত করার জন্য হতভাগ্য ক্রীতদাসকে বিকলাঙ্গ করা হয়েছিল।

এরপর বিভিন্ন দেশে ‘খোজা’ করা হয়েছে। আর এই নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয়েছে শাসক, অভিজাত শ্রেনি এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মহলেও। শুধু যে রাজা-বাদশা বা অভিজাত শ্রেণির মহলে খোজা তৈরি হত তা কিন্তু নয়, ধর্মীয় কারণে অনেকেই খোজাকরণ বরণ করেছে, ইতিহাসে এর প্রমাণও আছে। ওল্ড টেস্টামেন্টে খোজার উল্লেখ আছে। ম্যাথুর প্রবচনে আছে— ‘একদল পুরুষত্বহীন মানুষ আছে যারা মাতৃগর্ভ থেকেই অসম্পূর্ণ অবস্থাতে ভূমিষ্ট হয়েছে। আর একদল আছে যাদের অন্য মানুষ খোজা করেছে। তৃতীয় দলের খোজা যাঁরা তাঁরা স্বর্গের কামনায় স্বেচ্ছায় পুরুষহীন হয়েছে। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতেই বোধহয় একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক ঘোষণা করেছিলেন— একমাত্র কামনাশূন্য খোজার কাছেই স্বর্গের দুয়ার খোলা রয়েছে। কামনা-বাসনা শূন্য হওয়ার জন্য অনেক ধর্মপ্রচারক খোজাদের স্বপক্ষে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কামনাশূন্য সাধনা করার জন্য বিগত খ্রিস্টান সাধু ওরিজেন তার পুরুষত্ব বিসর্জন দিয়েছিলেন। ১৭৭২ সালে রাশিয়ায় একটি গোপন ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল, যাঁরা স্বেচ্ছায় খোজাকরণ বরণ করে নিতেন। এঁদের বিশ্বাস ছিল মানুষের দেহে আদম এবং ইড থেকে যে নিষিদ্ধ ফল যৌন-তাড়না করে বেড়াচ্ছে, খোজাকরণের মাধ্যমে তার অবসান ঘটানো সম্ভব। মানব এবং মানবীর জনক এবং জননী হওয়ার যোগ্যতা এই নিষিদ্ধ অদৃশ্য ফল থেকেই আসে, আর লিঙ্গ ও যোনির ব্যবহারে আর একটি মাত্র সন্তানের জন্ম হয়। এ কারণেই রাশিয়ার ওই গোপন সংগঠনের পুরুষ সদস্যরা স্বেচ্ছায় খোজা এবং নারীরা তাঁদের স্তন কেটে কামনাশূন্য হতে চেয়েছিল।

খ্রিস্টানদের মধ্যে স্বর্গ প্রাপ্তির আশায় শুধু খোজাকরণ বরণ করত, তা কিন্তু নয়। গির্জায় প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য খোজাদের কদর করা হত। সিসটান চ্যাপেলে প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য স্বয়ং পোপ তাঁদের আহ্বান করতেন। খোজাদের আহ্বান করার পিছনে যুক্তি ছিল খোজাদের কণ্ঠস্বর সমান তেজি, সমান গভীর এবং সমান নিখাদ। খ্রিস্ট সম্প্রদায় এই সংগীত আগ্রহভরে শ্রবণ করত, তাঁদের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরকে মুগ্ধ করার জন্য খোজা কণ্ঠের সংগীত অবশ্যই গীত হওয়া প্রয়োজন। এই ধারণা থেকে ইতালির অনেক বিখ্যাত গায়ক স্বেচ্ছায় খোজা হয়ে গিয়েছিলেন।

এখানেই শেষ নয়, হারেমের প্রহরী হিসাবেও খোজারা নির্ভরযোগ্য ছিল। খোজাদের এই বিশ্বস্ততা প্রথম লক্ষ করেন সাইরাস। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ অব্দে ব্যাবিলন দখল করার পর আবিষ্কার করলেন খোজাদের মতো নির্ভরযোগ্য পুরুষ সত্যিই দুর্লভ। তার এই আবিষ্কারের পিছনে যুক্তি ছিল খোজাদের যেহেতু কোনো সংসার নেই, তাই যে তাকে প্রতিপালন করবে খোজারা সুখ-দুঃখে তারই পাশে থাকবে। সাইরাস এও লক্ষ করেছিলেন যে, খোজারা পুরুষত্বহীন বলে কিন্তু তারা হীনবল নয়। সাইরাস এই বিশ্বাস থেকেই রাজ অন্তঃপুরে খোজা প্রহরী নিয়োগ করেছিলেন। এরপর বিভিন্ন দেশের হারেমে খোজা প্রহরীদের নিয়োগের হিড়িক পড়ে যায়।

হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, পারস্যের মানুষরা আইনিয়ানদের দলে দলে বন্দি করে তাঁদের পুরুষত্বের বিনাশ করত এবং এঁদের সুন্দর পোশাক-আশাক পরিয়ে বিভিন্ন দেশের রাজাদের কাছে বিক্রি করে দিত। হেরোডেটাস বলেছেন– সম্রাট জারেজেসের প্রিয় খোজা-পুরুষ ছিলেন হারমোটিয়াস নামে এক ব্যক্তি। শিশুকালে তাঁকে অপহরণ করে দাস বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর দাস-বিক্রেতারা ভালো দাম পেয়ে তাঁকে পানিওনিয়াস নামে এক ধনী ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়। সে ছিল খোজাকরণে দক্ষ। পানিওনিয়াসই বালক হারমোটিয়াসকে খোজা করে বাজারে নিয়ে আসে। এরপর আর-এক ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এইভাবে হাতবদল হতে হতে হারমোটিয়াস একদিন জারকজেসের দরবারে পৌঁছে যায়।

পারসিকরাই মুসলিম শাসিত রাজ্যে প্রথম খোজার আমদানি করেছিল। তুর্কিরা তো খোজার খোঁজই রাখতেন না। অবশ্য পঞ্চদশ শতাব্দীতে খোজার সন্ধান পান তুর্কি শাসকরা। এই আশ্চর্য বিশ্বস্ত এবং শক্তিমান না-নারী না-পুরুষ প্রাণীটি পেয়ে তুর্কিদের মধ্যে এই চেতনার উদয় হল যে, ইচ্ছে করলে তা তাঁরা নিজেরাই খোজা তৈরি করতে পারে।

তুর্কি সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে অসংখ্য যুদ্ধবন্দির মাঝখান থেকে রূপবান এবং শক্তিমান পুরুষদের বেছে বেছে খোজা তৈরির মহরত শুরু করেন সুলতান প্রথম মাহমুদ এবং দ্বিতীয় মুরাদ। খোজাদের প্রথমদিকে বাদশাহ বা সুলতানের মহিষী এবং রক্ষিতাদের পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলেও পরবর্তী সময় সুলতানের হেঁসেল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে তাঁদের নিয়োগ করা হত।

১৮৩৬ সালে মুর্শিদাবাদের এক প্রাসাদে ৬৩ জন খোজার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। এই খোজারা শুধু আজ্ঞাবাহী ভৃত্য হিসাবে নিয়োজিত ছিল না, তাঁরা সম্রাট এবং নবাবের প্রিয়পাত্র হিসাবে কোনো কোনো সময় শাসনকার্যে প্রভাব বিস্তার করত। ইতিহাসে এ রকম একটি ঘটনার কথা জানা যায়, ঘটনাটি ঘটেছিল তুর্কি হারেমে। তুর্কিমহলের খোজা প্রধানকে বলা হত কিসলার আগা। কিসলার আগা উপাধিধারী খোজা শুধু মহলের কুমারীদের প্রধান রক্ষী হিসাবে নিয়োজিত হত। সে নিজে দাস হলে তার অধীনে থাকত চারশো গোলাম-বাঁদি। তার নামে ঘোড়াশালে আলাদা করে রেখে দেয়া হত তিনশো ঘোড়া। পুরুষত্বহীন একজন মানুষের এই বিপুল ক্ষমতা একজন খোজার শুধু অটোমান সাম্রাজ্যেই দেখা যায়নি, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মোগল আমলে অযোধ্যার একজন জনপ্রিয় আঞ্চলিক শাসক ছিল খোজা। স্পষ্টত মুসলিম বিশ্বে প্রেরিত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সব বা অতি উচ্চ অংশকে খোজা করা হয়েছিল, যার কারণে এসব অঞ্চলে তারা উল্লেখযোগ্য বংশধর (ডায়াসপোরা’) রেখে যেতে ব্যর্থ হয়। ইসলামি ক্রীতদাসত্বের নিদারুণ লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়া ইউরোপীয়, ভারতীয়, মধ্য-এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লক্ষ লক্ষ বিধর্মীর ভাগ্যও অনেকটা একইরকম ছিল। ১২৮০-র দশকে মার্কোপোলো ও ১৫০০-র দশকে দুয়ার্ত বার্বোসা স্বচক্ষে ভারতে বিপুল সংখ্যায় খোজাকরণ প্রত্যক্ষ করেছেন। একই প্রক্রিয়া চলে সম্রাট আকবর (মৃত্যু ১৬০৫), জাহাঙ্গীর (মৃত্যু ১৬২৮) ও আওরঙ্গজেবের (মৃত্যু ১৭০৭) শাসনামলে। সুতরাং, ভারতে গোটা মুসলিম শাসনামলে খোজাকরণ ছিল একটা প্রচলিত নিয়ম। সম্ভবত এটা ইতিপূর্বে উল্লেখিত ভারতের জনসংখ্যা ১০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ২০ কোটি থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ১৭ কোটিতে হ্রাসকরণে একটা বড়ো অবদান রেখেছিল।

খোজাদের মধ্যে বুদ্ধিমান এবং স্মৃতিশক্তিধর হিসাবে যাঁদের পাওয়া যেত সুলতান এবং সম্রাটেরা তাঁদের রাজকার্যে নিয়োজিত করতেন। তবে বুদ্ধিমান খোজার সংখ্যা ছিল খুবই কম। খোজাদের নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে অধিকাংশ খোজাই বদমেজাজি, বালসুলভ, প্রতিশোধপরায়ণ, নিষ্ঠুর এবং উদ্ধত। অবশ্য এর বিপরীত স্বভাবের খোজাও রয়েছে। এঁরা সরল, নিরীহ, আমোদপ্রিয় উদার। অবশ্য খোজাদের মেজাজ মর্জি এই বৈপরীত্যের কারণ তাঁদের খোজাকরণের বয়সের উপর নির্ভর করত। কম বয়সে খোজা করার পর ওই খোজা কারও উপর ক্রোধান্বিত হলে এবং সুযোগ পেলে তাঁকে হত্যা করতেও দ্বিধা করত না।

জে. রিচার্ড লিখিত ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়, সাধারণভাবে খোজা বা পুরোপুরি অক্ষম এই কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকলেও খোজারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যৌন-অক্ষম নয়। রিচার্ড একজন বিবাহিত খোজার স্ত্রীর সংগে আলাপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, স্ত্রীলোকটির কথায় মনে হচ্ছিল ওরা পুরোপুরি তৃপ্ত এবং সুখী। চিয়েন লুঙের আমলে একটি ঘটনা থেকে জানা যায়, পিকিংয়ের হারেমের এক খোজা পুরোহিতের কাছে ঔদ্ধত্ব প্রকাশ করে বলেছিল, খোজার উপর পুরোহিতের কোনো এক্তিয়ার নেই। পুরোহিত খোজাকে হেকিমের কাছে নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা করে দেখা গেল তাঁর পৌরুষত্ব ফিরে এসেছে। আসলে সে ছিল এক নকল খোজা।

প্রাচীন চিনে শাসক বা রাজারা রক্ষিতা রাখার ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে ছিল। বিস্তৃত চিনের অবস্থা ছিল যে, যাঁর যত বেশি রক্ষিত নারী আছে সমাজে তাঁর স্ট্যাটাস তত উঁচুতে। সম্রাটদের ক্ষেত্রেও রক্ষিতা রাখার প্রচলন ছিল। কোনো কোনো সম্রাটের হারেমে হাজার হাজার রক্ষিতা থাকত। মিঙ রাজবংশ এই দিক থেকে বিখ্যাত। মিঙ শাসনামলে তাঁদের হারেমে ২০ হাজার ছিল। যেন পালিয়ে না যায় বা ভিতরে কোনো ঝামেলা না করে সে কারণে পাহারাদার রাখা হত। তবে পাহারাদাররা অবশ্যই পুরুষ ছিল। পাছে রক্ষিতাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কগড়ে তোলে, তাই সেইসব যৌনক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হত খোজাকরণের মাধ্যমে। ইংরেজি Eunuch শব্দের প্রতিশব্দ হল খোজা। ইউনাক শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Eunoukhos থেকে, যার অর্থ শয়নকক্ষের পাহারাদার।

খোজাকরণ মূলত তিনটি পদ্ধতিতে করা হত। যেমন– (১) পুরুষাঙ্গ বা লিঙ্গ সমূলে কর্তন করা, (২) অণ্ডকোশ বা শুক্রথলি কর্তন করা এবং (৩) পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোশ উভয়ই কর্তন করা।

প্রাচীন চিনে এই তিনপ্রকার কর্তনই প্রচলন ছিল। এই প্রক্রিয়ায় খুব ধারালো ছুরির সাহায্যে পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোশ উভয়ই কেটে ফেলা হত। চিনে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল। তবে এই প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি অনেক বেশি। এই প্রক্রিয়ায় অসংখ্য পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুহার কমানোর জন্য অবশেষে পুরুষাঙ্গ রেখে শুক্রথলি কেটে খোজা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে চিনের খোজাকরণ প্রক্রিয়া আরও উন্নত করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুহারও কমতে শুরু করে। এই কাজে এতটাই পারদর্শী হয়ে ওঠে যে মৃত্যুহার শূন্য হয়ে যায়। প্রাচীন চৈনিক সাম্রাজ্যে খোজাকরণের কাজটি করা হত মূল প্রাসাদের বাইরে বিচ্ছিন্ন কোনো জায়গায়। রাজপ্রাসাদের চারদিকে দেয়াল-ঘেরা সীমানা থাকত। এই সীমানার কোনো স্থানে ব্যবহৃত হয় না এমন একটি পাহারাকক্ষ ব্যবহার করা হত খোজাকরণের অপারেশনের কক্ষ হিসাবে।

কীভাবে খোজা করা হত? প্রথমে ব্যক্তিটিকে ওই কক্ষে নিয়ে গিয়ে একটি কাঠের পাটাতনে শুইয়ে দেওয়া হত। এরপর হালকা গরম জলে যৌনাঙ্গ ও যৌনাঙ্গের আশেপাশে ধুয়ে নেওয়া হত। তারপর ওই স্থানটুকু অবশ করতে পারে এমন উপাদানের প্রলেপ দিয়ে যৌনাঙ্গকে অবশ করে নেওয়া হত। তখনকার সময়ে অবশকারী উপাদান হিসাবে প্রচণ্ড ঝালযুক্ত লঙ্কা বাটা ব্যবহার করা হত। যিনি খোজাকর্মটি করবেন তিনি হচ্ছেন অপারেশন প্রধান। প্রধানের পাশাপাশি কয়েকজনের সহকারীও থাকত। পুরুষাঙ্গ অবশ করার পর সহযোগীরা পুরুষটিকে কাঠের পাটাতনের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলত। এরপর দুজন সহকারী তাঁর দুই পা ফাঁক করে ধরে থাকত, যেন পুরুষাঙ্গ কর্তনের সময় পায়ের দ্বারা কোনো বাধার সৃষ্টি না হয়। দুইজন সহকারী দুই পা শক্ত করে ধরে রাখতই, তার উপর আরও দুজন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে একজন হাতদুটি বেঁধে চেপে ধরে রাখত। কর্তক ব্যক্তি সুবিধামতো পুরুষটির দুই পায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অণ্ডকোশ ও পুরুষাঙ্গ একসঙ্গে মুঠোর ভিতর ধরে নিত। মুঠোর মধ্যে শায়িত পুরুষটির কাছ থেকে সম্মতি (অসম্মতির কোনো প্রশ্নই নেই, এটা ছিল প্রোটোকল) নেওয়া হত যে, তিনি স্বেচ্ছায় খোজাকরণ করতে দিচ্ছেন। সম্মতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলকেই ধারালো ছুরি দিয়ে একসঙ্গে কর্তন করে দিত পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোশ। পুরুষটি তীব্র যন্ত্রণায় আর্ত চিৎকার করে উঠত। কর্তন প্রক্রিয়া শেষ হলে মূত্রনালিতে একটি প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হত, যাতে মূত্রত্যাগ করতে পারে। নলটি ছিল অনেকটা আজকের যুগের স্যালাইনের পাইপের মতো। আজ রাজা-সম্রাটদের হারেমে হাজার হাজার নারী রাখার প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। পাশাপাশি বিলুপ্ত হয়েছে খোজাকরণের মতো চরম নিষ্ঠুর এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। তবে রাজার আমল না থাকলেও হিজড়াসমাজে আজও খোজাকরণ হয়ে থাকে।

রাজা-সুলতান-বাদশাহদের হারেমের জন্য খোজার প্রয়োজনীয়তার যে কারণগুলি পাওয়া যায়, তা হল –

(১) হারেম ও অন্দরমহলে থাকত হাজার হাজার পত্নী ও উপপত্নী, স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলনের সুযোগ কম পেত। ফলে সেসব নারীর অধিকাংশের যৌনাকাঙ্ক্ষা অতৃপ্ত থেকে যেত। সেই সঙ্গে তাঁদের স্বামীদের বহু নারীর সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত থাকাটা মেনে নিতে বাধ্য হত। এর ফলে ঈর্ষা ও আক্রোশের জন্ম নিত। এ অবস্থায় হারেমে বা অন্দরমহলে পুরুষ ক্রীতদাস রাখা স্বামীর জন্য ছিল উদ্বেগের বিষয়। কারণ যৌন অতৃপ্ত ও ঈর্ষাপূর্ণ ওসব নারীরা পুরুষ ক্রীতদাসদের সঙ্গে সহজেই যৌনমিলনে প্রলুব্ধ হতে পারত। অন্য পুরুষের প্রতি হারেমের নারীদের আকর্ষণ বোধ করা তো আর অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।

 (২) পরিবার বা সন্তান-সন্ততি-পরিবারহীন এসব খোজা পুরুষ মানুষরা অসহায় বৃদ্ধ বয়সে দেখাশোনার জন্য সামান্য সান্নিধ্যের আশায় মালিকের প্রতি চরম আনুগত্য প্রদর্শন করে নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দিত। উপরন্তু যৌন তাড়নাবিহীন খোজাকৃত দাসরা সাধারণ যৌন উন্মাদনাযুক্ত ইসলামি সংস্কৃতিতে সহজেই একাগ্রভাবে কাজে মনসংযোগ করতে পারত।

 (৩) খোজা ক্রীতদাসদের অত্যধিক চাহিদার আর-এক অন্যতম কারণ –শাসক, সেনাধ্যক্ষ ও সম্ভ্রান্তদের সমকামিতার প্রতি মোহাচ্ছন্নতা। ইন্দ্রিয়গত আকাক্ষা চরিতার্থ করার জন্য রাখা হত খোজাদের। সেইসব খোজাদের বলা হত ‘গেলেমান’ বা ‘গিলমান’। তাঁরা উৎকৃষ্ট ও আকর্ষণীয় পোশাকে সজ্জিত থাকত এবং নারীদের মতো তাঁদের শরীরকে সুন্দর করে রাখত। সুগন্ধী সহ প্রসাধনী করত।

.

হিজড়াসমাজে খোজাকরণ

হিজড়াসমাজে সাধারণত দু-রকমভাবে খোজা করা হয়। একটি হল— (১) Castration (Removal of the testicles), অপরটি (২) Penectomy (Penis Removal)। ক্যাসট্রেশন (Castration) হল আসলে পুরুষের ভাসডিফারেন্স বা শুক্রনালীকে কেটে দেওয়া হয়। এই শুক্রনালী শুক্রাণু বহন করে। কাজেই শুক্রাণু বীর্যে আসতে পারে না। কাজেই এই পুরুষের পক্ষে নারীর গর্ভসঞ্চার করানো হয় না। এটি পুরুষের স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা ভেসেকটমি বলে পরিচিত। ভেসেকটমি অপারেশনের পর সেই পুরুষের যৌন-ইচ্ছা, যৌনক্ষমতা, যৌন-আবেদন কোনোটাই হ্রাস পায় না। হারেমের খোজাদের বেশিরভাগেরই এই পদ্ধতিই অবলম্বন করা হত। তবে Penectomy খোজা হল পুরুষের লিঙ্গটাকে কেটে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলা। বাৎসায়নের আগেই কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’-এ এক বিশেষ ধরনের পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন। এরা নপুংসক’। পুরুষাঙ্গ ছেদন করে এদের নপুংসক করা হত। এরা ছিল রাজ-অন্তঃপুরের পাহারাদার। শুধু মহিলারক্ষীদের এই করানো বেশ কঠিন ছিল। আবার পুরুষরক্ষীবাহিনীকে বিশ্বাস করা যেত না। এদের দ্বারা অতঃপুরবাসিনীর শ্লীলতাহানি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিছু পুরুষকে লিঙ্গ কেটে খোজা করে দেওয়া হয়। রাজ-অন্তঃপুরের বা হারেমের মহিলারা এইসব খোজাদের দিয়ে বিকৃতভাবে তাঁদের যৌনক্ষুধা মেটাতো। রাজা বা বাদশাও যাবে কেন? এঁদের অনেকেই পুরুষসঙ্গমে তৃপ্ত হতেন। লিঙ্গ কেটে ফেললে যৌনমিলন একেবারেই অসম্ভব।

হিজড়া-মহলে কীভাবে লিঙ্গ কর্তন খোজা (Penectomy) করা হয় সেটা এবার জানা যেতে পারে। বীভৎস নারকীয় এবং অবৈজ্ঞানিক উপায়ে লিঙ্গ শরীর থেকে কেটে ফেলা হয়। হিজড়া বানানোর জন্য নিয়ে আসা ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ঘরে অন্তরীণ অবস্থায় ১১ দিন থাকতে হয়। সূর্যের আলো পর্যন্ত দর্শন করতে পারবে না সে। প্রথম প্রথম মহল্লার হিজড়ারা এর সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে। চলে আদর আর যত্ন। লিঙ্গচ্ছেদনের জন্য হবু হিজড়ার সম্পত্তি আদায় করে নেয়। যৌন পরিবর্তনকামীরা মত দিলেও অন্যরা মত দিতে রাজি হয় না। রাজি না-হলে চলে দৈহিক আর মানসিক নির্যাতন। এই সময়ে হবু হিজড়াকে প্রচুর পরিমাণে মাদক সেবন করানো হয়। অমানবিক অত্যাচার ও মাদকের প্রভাবে তার স্বাভাবিক চেতনা লুপ্ত হয়। ঠিক ১১ দিন পর অনেক রাতে মহল্লার দলপতি তার অনুগত কয়েকজনকে হিজড়াকে নিয়ে ওই ঘরে ঢোকে। নেশায় আচ্ছন্ন হবু হিজড়াকে উলঙ্গ করে হাত-পা বেঁধে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরা হয়। যাতে চিৎকার করতে না-পারে সেজন্য মুখের ভিতর কাপড় জাতীয় কিছু খুঁজে দেওয়া হয়। এরপর কালো ফিতে দিয়ে লিঙ্গ ও অণ্ডকোশ একসঙ্গে সজোরে বেঁধে দু-দিক থেকে টেনে ধরা হয়। মাথা একদিকে হেলিয়ে কয়েকজন হিজড়া তাকে চেপে ধরে রাখে। এরপর দলপতি অত্যন্ত ধারালো ছুরি বা ক্ষুর দিয়ে ঘ্যাচাং করে লিঙ্গটি কেটে ফেলে। তখন প্রচুর পরিমাণে রক্ত নিঃসরণ হতে থাকে। হিজড়াদের ধারণা এই রক্তপাতের মধ্য দিয়ে শরীরের সমস্ত পুরুষ-রক্ত বেরিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে শরীরে নারী-রক্তের জন্ম হয়। একে ওরা ‘নির্বাণ বলে। নির্বাণের মধ্য দিয়ে হিজড়ার জন্ম হয়।

সে যাই হোক, প্রসঙ্গে আসি। লিঙ্গচ্ছেদনের পর ওই ব্যক্তিকে চিৎ করে শুইয়ে তাঁর ক্ষতস্থানের নীচে একটি পাত্র রাখা হয়। ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত ওই পাত্রে রাখা হয়। কর্তিত লিঙ্গটিও রাখা হয় ওই পাত্রটিতেই। পরদিন সকালে পাত্রটিকে ফুল দিয়ে সাজানো একটি ঝুড়ির মধ্যে নিয়ে হিজড়ারা মিছিল করে চলে কাছেপিঠের কোনো জলাশয়ে। সেখানেই ঝুড়িটি ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ছেদনকার্যের পর নতুন হিজড়াকে ৪৮ ঘণ্টা ঘুমোতে দেওয়া হয় না। ক্ষতস্থান রক্ত বন্ধ করার জন্য ঘুঁটে পোড়া ছাই খয়ের ভিজিয়ে পুরু করে ওই ক্ষতস্থানের ছাইয়ের উপর লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটি প্লাস্টারের মতো শক্ত হয়ে যায়। নির্মাণ হয় এক লিঙ্গ-কবন্ধ হিজড়া।

লিঙ্গ কর্তনের পর আর-একটি প্রধান কাজ হল স্তন-দুটিকে পুষ্ট করা। এটি হিজড়াসমাজের অত্যন্ত গোপনে হয়, যাকে বলে ট্রেড সিক্রেট। লিঙ্গ কর্তনের কয়েকদিন পর নতুন হিজড়া একটু সুস্থ হয়ে উঠলে মহল্লার দলপতি তাকে Lyndiol (চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ট্যাবলেট খাওয়া অনুচিত) নামে এক ধরনের জন্ম নিরোধক ট্যাবলেট খাওয়ায়। বেশ কয়েক মাস ধরে এই ট্যাবলেট সেবন করানো হয় রোজ, নিয়মিত। এই ট্যাবলেটে ইথিলিন অস্ট্রাডাইওলের পরিমাণ একটু বেশি থাকে। ফলে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। হরমোনের কু-প্রভাবে স্তনগ্রন্থিতে স্নেহজাতীয় পদার্থ সঞ্চিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে পুরুষ-বক্ষ থেকে নারী-স্তনের মতো স্ফীত ও পরিপুষ্ট হতে থাকে। নারীদের মতোই স্তনবৃন্তও ফুলে ওঠে।তবে যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে তারা প্ল্যাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে স্তন প্রতিস্থাপন বা সিলিকন ব্রেস্ট করিয়ে নেয়। খুবই ব্যয়সাপেক্ষ এই পদ্ধতি আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে প্রায় অসম্ভব হলেও ধনতান্ত্রিক দেশগুলির হিজড়ারা সিলিকন ব্রেস্ট বানিয়ে নেয়। তবে তারা কিন্তু সকলেই লিঙ্গ কর্তন করে না। নীল ছবির দুনিয়ায় এদের বেশ কদর আছে। এরা ‘shemale’ বা ‘Ladyboy’। তবে সোমনাথ ওরফে মানবী মনে করেন, “মেয়ে হিজড়ে ছেলে হিজড়ে বলে কিছুই নেই। সকলেই সমান হিজড়ে। হিজড়ে দলে দু-রকম মানুষ –আকুয়া আর নির্বাণ। আকুয়ারা পেনিস টেসটিস এখনো কেটে ফেলে দেয়নি, আর নির্বাণ হল তাঁরাই যাঁরা কেটে ফেলে দিয়েছে”।

.

হিজরাদের দেবতা

বহুচেরা মাতা হলেন হিজড়াদের দেবতা। হিন্দু হিজড়াদের এই দেবতার জনপ্রিয় মূর্তিটিতে দেখা যায়, তিনি একটি মোরগের পিঠে বসে আছেন এবং হাতে ধরে আছেন একটি তরবারি, ত্রিশূল ও একটি বই। বহুচারা সংক্রান্ত কাহিনিগুলিতে পুরুষাঙ্গ কর্তন ও শারীরিক যৌন বৈশিষ্ট্যের অন্যান্য পরিবর্তনের বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। এই জন্যে তাঁকে পুরুষের প্রতি অভিশাপদাত্রীর দেবী মনে করা হয়। কথিত আছে, বহুচারা ছিলেন এক নশ্বর নারী। তিনি শহিদ হন। একটি কাহিনিতে দেখা যায়, একদল দস্যু বহুচারাকে ধর্ষণ করার জন্য আক্রমণ করেছিল। সে সময় বহুচারা নিজের তরবারিতেই নিজেরই স্তন দুটি কর্তন করে ফেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয়। অন্য একটি কাহিনিতে জানা যায়, বহুচারার স্বামী যখন একটি উপবনে সমকামী রতিক্রিয়ায় লিপ্ত ছিলেন, তখন বহুচারা তাঁকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। তখন স্বামীর পুরুষাঙ্গ খসে পড়ে এবং তিনি নারীর বেশ ধারণ করতে বাধ্য হন।

বহুচারার উপাখ্যানগুলিতে তাঁর দৈবসত্ত্বা পাওয়ার পর লিঙ্গ পার্থক্যের বিষয়টি লক্ষিত হয়। একটি কিংবদন্তী অনুসারে, এক রাজা বহুচারার কাছে পুত্রসন্তান কামনা করেছিলেন। বহুচারা তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। কিন্তু বড়ো হয়ে রাজকুমার সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হন। এক রাতে বহুচারা রাজকুমারকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং আদেশ করেন যাতে সে পুরুষাঙ্গ কর্তন করে নারীর বেশ ধারণ করেন এবং তাঁর দাসত্ব করেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বহুচারা এরপরও পুরুষত্বহীন পুরুষদের চিহ্নিত করে লিঙ্গ কর্তন করতে আদেশ দিতে থাকেন। যাঁরা সেটা করতে অস্বীকার করে তিনি তাঁদের শাস্তি দেন। ফলে তাঁরা পরবর্তী সাত জন্ম পুরুষত্বহীন হয়ে থাকে। এই কাহিনিটিই বহুচারা কাল্টের উৎস। বহুচারা ভক্তদের নিজেদের পুরুষাঙ্গ কর্তন করে আজীবন “ব্রহ্মচারী’ থাকতে হয়।

বহুচারা মন্দিরে ‘কমলিয়া’ নামে এক বিশেষ হিজড়া সম্প্রদায় আছে। এরা পুরুষ। এরা একই সঙ্গে নিজেদের নারী ও পুরুষ হিসাবে কল্পনা করে। তাই লম্বালম্বিভাবে দেহের এক অংশে পুরুষের পোশাক এবং অপর অংশে নারীর বেশ ধারণ করে। এই ‘কমলিয়া’ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।

.

রূপান্তরকামী

রূপান্তরকামীর উদাহরণ হিসাবে হাতের সামনে জ্বলজ্বল করছে সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি। যিনি আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে পুরুষ শরীর ত্যাগ করে নারী শরীর গ্রহণ করেছেন। সন্তানধারণ করার ক্ষমতা ছাড়া তিনি আজ পূর্ণাঙ্গ নারীতে রূপান্তরিত। তাঁর বর্মান নাম মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। ঈশ্বর তাঁকে এক পুরুষের শরীর দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে মনকেই জিতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে একটি লিঙ্গ পুনর্নির্মাণ সার্জারি করিয়েছিলেন তিনি, তাঁর মনের সঙ্গে শরীরেও বসত করতে লাগল এক মানবী’। এরপর সমাজের বুকে নিজের অস্তিত্বই শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, মানুষের মধ্যে রীতিমতো চর্চিত হতে শুরু করেন মানবী। এরপর ২০০৫ সালে বাংলা সাহিত্যে পিএইডি অর্জনকারী দেশের প্রথম রূপান্তরকামী হলেন এই মানবী। এরপর ২০১৫ সালে তিনি প্রথম রূপান্তরকামী অধ্যক্ষ হিসাবে নিযুক্ত হন কৃষ্ণনগর ওম্যানস কলেজে। বর্তমানে তিনি ঢোসা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের দায়ভার সামলাচ্ছেন। একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে, তাঁর এই মেয়ে জীবনকে তাঁর বাবা কখনোই মেনে নিতে পারেননি। তাঁকে বরাবরই তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু জীবনের লড়াইয়ে পিছিয়ে যাননি মানবী। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম আজ তিনি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন।

[শিল্পীর স্পর্শে রূপান্তরকামী, খোদার উপর খোদগারি]
[শিল্পীর স্পর্শে রূপান্তরকামী, খোদার উপর খোদগারি]

রূপান্তরকামিতা (Transsexualism) বলতে বিশেষ একটি প্রবণতা বোঝায়, যখন সেক্স বা ‘জৈব লিঙ্গ’ ব্যক্তির জেন্ডার বা ‘সাংস্কৃতিক লিঙ্গ’-এর সঙ্গে সংঘর্ষ তৈরি করে। রূপান্তরকামী মানুষরা এমন একটি যৌন-পরিচয়ের (Sex Identity) অভিজ্ঞতা লাভ করেন যা ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের নির্ধারিত যৌনতার সঙ্গে সমঝতা করতে সক্ষম নয় এবং স্থিতিশীলও নয়। অতএব নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে সেই লিঙ্গে পরিবর্তন করতে চান। রূপান্তরকামী মানুষেরা পুরুষ হয়ে (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে) জন্মানো সত্ত্বেও মনমানসিকতায় নিজেকে নারী ভাবেন, পুরুষের প্রতি যৌনাকৃষ্ট হন। অপরদিকে নারী হয়ে জন্মানোর পরও মানসিক জগতে নিজেকে পুরুষ বলে মনে করেন, নারীর প্রতি যৌনাকৃষ্ট হন। এঁদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করেন, এই ব্যাপারটিকে বলা হয় (ট্রান্সভেস্টিজম বা ক্রসড্রেস)। আবার কেউ সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে রূপান্তরিত মানবে (Transexual) পরিণত হন। এরা সকলেই রূপান্তরিত লিঙ্গ নামক বৃহৎ রূপান্তরপ্রবণ সম্প্রদায়ের (Transgender) অংশ হিসেবে বিবেচিত।

শুধু মানুষ নয়, বিজ্ঞানীরা প্রাণিজগতের মধ্যেও রূপান্তরকামিতার উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। প্রাণীবিজ্ঞানীরা উত্তর আমেরিকার সমুদ্রোপকূলে আটলান্টিক স্লিপার শেল (Atlantic slipper shell) নামে পরিচিত ক্রিপিডুলা ফরমিক্যাটা (Crepidula_Fornicata) এবং ল্যাবারিডেস ডিমিডিয়াটাস (Laborides dimidiatus), ইউরোপিয়ান ফ্লে অয়েস্টার (European Flay Oyster) ও অস্ট্রা এডুলিস (Ostrea edulis) প্রজাতির ঝিনুকের মধ্যে রূপান্তরকামিতা এবং লিঙ্গ পরিবর্তনের প্রমাণ পেয়েছেন। যৌনতার পরিবর্তন ঘটে মাছি, কেঁচো, মাকড়শা এবং জলজ ফ্রি ডাফনিয়াদের বিভিন্ন প্রজাতিরে মধ্যেও। লিঙ্গ পরিবর্তনকারী মাছের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রবালের খাঁজে বসবাসকারী গ্রুপার মাছ। এ গ্রুপার মাছ প্রথমে স্ত্রী হিসাবে জন্মগ্রহণ করে ও পরিপক্কতা লাভ করে এবং এক বা একাধিকবার প্রজননে অংশ নেয়। এসব স্ত্রী মাছ পরে লিঙ্গ পরিবর্তন করে পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হয় এবং সক্রিয় পুরুষ মাছ হিসাবে প্রজননে অংশগ্রহণ করে। ক্লাউনফিশও রূপান্তরকামিতার অন্যতম উদাহরণ—

জন্মগতভাবে সকল ক্লাউনফিশ পুরুষ, কিন্তু দলের সবচেয়ে বড়ো আকারের মাছটি নারী মাছে রূপান্তরিত হয়। ভেটকি বা কোরাল মাছও ওইভাবে লিঙ্গ পরিবর্তন করে বলে জানা যায়।

মানবসভ্যতার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় লিখিত ইতিহাসের সমগ্র সময়কাল জুড়ে রূপান্তরকামিতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে আমেরিকার পুরুষ রূপান্তরকামী জর্জ জরগেন্সেনের ক্রিস্টিন জরগেন্সেনের রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনি মিডিয়ায় এক সময় আলোড়ন তুলেছিল। এছাড়া জোয়ান অব আর্ক, জীববিজ্ঞানী জোয়ান (জনাথন) রাফগার্ডেন, বাস্কেটবল খেলোয়াড় ডেনিস রডম্যান, চক্ষুচিকিৎসক এবং পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় ডঃ রেনি রিচার্ডস, সঙ্গীতজ্ঞ বিলিটিপটন সহ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির মধ্যে রূপান্তরপ্রবণতার উল্লেখ ইতিহাসে মেলে। ১৯৬০ সালে মনোচিকিৎসক ওয়ালিন্দার রূপান্তরকামীদের উপরে একটি সমীক্ষা চালান। তার এই সমীক্ষা থেকে জানা যায় প্রতি ৩৭ হাজারে একজন পুরুষ রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। অপরদিকে প্রতি ১০৩,০০০-এ একজন স্ত্রী রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এই সমীক্ষাটি চালিয়ে দেখা গেছে যে সেখানে প্রতি ৩৪ হাজারে একজন পুরুষ রূপান্তরকামী ভূমিষ্ট হচ্ছে, অপরদিকে প্রতি ১০৮,০০০-এ একজন জন্ম নিচ্ছে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামী। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে গবেষণা করে দেখা গেছে সেখানে ২৪ হাজারে পুরুষের মধ্যে একজন এবং ১৫০,০০০ নারীর মধ্যে একজন রূপান্তরকামীর জন্ম হয়।

সমাজবিজ্ঞানী অ্যান ওকলের মতে, জৈবিক লিঙ্গ শারীরিক বৈশিষ্ট্য বহন করে। আর মানসিক লিঙ্গ’ একটি নির্দিষ্ট সমাজে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত বিশিষ্টতা নির্দেশ করে। একজন নারী ও পুরুষের কার কী রকম পোশাক-পরিচ্ছদ হবে; কে কী রকম আচার-আচরণ করবে; আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা কার কী রকম হবে; সমাজের নানা ধরনের কাজে একজন নারী বা একজন পুরুষের ভূমিকা কী হবে এই বিষয়গুলো নির্ধারণ করে জেন্ডার বা লিঙ্গ। অর্থাৎ, ‘জৈবিক লিঙ্গ’ বিষয়টি পুরোপুরি শরীরের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু মানসিক লিঙ্গ নির্ভরশীল সমাজের উপর। যেহেতু নারী বা পুরুষের দায়িত্ব, কাজ ও আচরণ মোটামুটি সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত হয়। তাই সমাজ পরিবর্তন বা সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জেন্ডারের ধারণা বদলে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন কাউকে ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ হিসাবে চিহ্নিত করি, তখন সেখানে ‘জৈবিক লিঙ্গ’ নির্দেশ করাটাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ‘মেয়েলি’ বা ‘পুরুষালি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে জেন্ডার প্রপঞ্চকে যুক্ত করা হয়, যেখানে নারী বা পুরুষের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে স্বভাব আচরণগত ইত্যাদি বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। আর এই কারণে সেক্সকে জৈবলিঙ্গ এবং জেন্ডারকে সামাজিক বা ‘সাংস্কৃতিক লিঙ্গ’ বলে অনেকে অভিহিত করেন। বস্তুত জৈব বৈশিষ্ট্যের বলয় অতিক্রম করে সাংস্কৃতিক বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বাসনার কারণেই মানব সমাজে রূপান্তরকামিতার অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন বা সেক্সচেঞ্জ একটি খুব জটিল প্লাস্টিক সার্জারি অপারেশন। এই অপারেশনে যাঁরা নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন হ্যারি বেঞ্জামিন, স্টিক, আব্রাহাম, জন মানি প্রমুখ। রূপান্তরকামী এবং উভলিঙ্গ মানুষদের চাহিদাকে মূল্য দিয়ে ডাক্তাররা সার্জারির মাধ্যমে সেক্সচেঞ্জ অপারেশন করে থাকেন। যে সকল রূপান্তরকামী একে অসুখ মনে করেন না, তাঁদের ঔষধ প্রয়োগ করে উক্ত মানসিকতাকে বদলে ফেলা সম্ভব হয় না। এঁদের অনেকেই সেক্সচেঞ্জ অপারেশনের মধ্য দিয়ে মানসিক পরিতৃপ্তি পেয়ে থাকেন। পুরুষ রূপান্তরকামী অর্থাৎ যাঁরা পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হতে চায়, তাঁদের জন্য এক ধরনের অপারেশন। আর নারী রূপান্তরকামীদের জন্য ভিন্ন অপারেশন রয়েছে। মুলত শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে চামড়া ও টিস্যু নিয়ে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে যৌনাঙ্গ গঠন করা হয়, হরমোন থেরাপির সাহায্যে স্তন গ্রন্থির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো হয়, সিলিকন টেস্টিকেলের সাহায্যে অণ্ডকোশ তৈরি করা হয়।

ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের আগে লিঙ্গ-পরিবর্তনের প্রবণতা সরকার স্বীকার করেনি। অবশেষে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সরকার লিঙ্গ-পরিবর্তনকারীদের স্বীকার করে নেয় ও তাঁদের শল্যচিকিৎসার অনুমোদন দেয়। ২০০৮ সালের মধ্যে ইরান বিশ্বের অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি এ জাতীয় শল্যচিকিৎসা করে। একমাত্র থাইল্যান্ডই শুধু তাঁদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। যাঁদের সাহায্য প্রয়োজন তাঁদেরকে সরকার অর্ধেক টাকা দেয় শল্যচিকিসাত্র জন্য ও তা জন্ম সনদেই লেখা থাকে। ১৯৬৩ সালে ইরানের আয়াতুল্লাহ রহোল্লাহ খোমেইনি তাঁর লেখা এক গ্রন্থে বলেন যে, লিঙ্গ পরিবর্তন ইসলামবিরোধী নয়। সে সময় আয়াতুল্লাহ ছিলেন যুগান্তকারী, শাহবিরোধী বিপ্লবী এবং তাঁর এই ফতোয়া সে সময়ের রাজকীয় সরকার কোনো আমলে নেয়নি ও তাঁদের এই বিষয়ে কোনো নীতি ছিল না। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরানে নতুন ধর্মীয় সরকার আসে যাঁরা লিঙ্গ-পরিবর্তনকে পুরুষ সমকামী ও স্ত্রী সমকামীদের একই সারিয়ে দাঁড় করিয়ে এটা নিষিদ্ধ করে ও এর জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান ঘোষণা করে। লিঙ্গ পরিবর্তনের স্বপক্ষে প্রথম প্রচারণা চালান ফেরেয়দুন নামের একজন পুরুষ, যিনি মেয়ে হয়ে যান লিঙ্গ-পরিবর্তন করে। নতুন নারী-জীবনে তিনি মারইয়াম হাতুন মোল্কারা নাম ধারণ করে। বিপ্লবের আগে তিনি মেয়ে হয়ে যান, কিন্তু তিনি শল্যচিকিৎসার কোনো চেষ্টা করেননি। পরে তিনি ধর্মীয় অনুমোদন চান। ১৯৭৫ সালে থেকে তিনি আয়াতুল্লাহ কাছে বার বার চিঠি লিখতে থাকেন যিনি ওই বিপ্লবের নেতা ছিলেন ও নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিপ্লবের পর তিনি চাকরিচ্যুত হন ও তাঁকে জোর করে হরমোন ইঞ্জেকশন দেওয়া হতে থাকে। তিনি কারারুদ্ধও হন। পরে তিনি মুক্তি পান তার পরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ও লবিং চালাতে থাকেন নেতাদের কাছে। তিনি খোমেইনির সঙ্গে দেখা করতে যান। তখন তাঁর রক্ষীরা তাঁকে থামান ও মারতে থাকেন। পরে আয়াতুল্লাহ তাঁকে এক চিঠির মাধ্যমে বিষয়টির বৈধতা দান করেন। এ ধরনের শল্যচিকিৎসার পক্ষে ফতোয়া হিসাবে চিঠিটিকে চিহ্নিত করা হয়।

উভলিঙ্গ মানবদের ইংরেজিতে অভিহিত করা হয় হার্মফ্রোডাইট বা ইন্টারসেক্স (আন্তঃলিঙ্গ) হিসাবে। উভলিঙ্গত্বকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়– (১) প্রকৃত উভলিঙ্গত্ব (true-hermaphrodite) এবং (২) অপ্রকৃত উভলিঙ্গত্ব (pseudo-hermaphrodite)। প্রকৃত উভলিঙ্গ হচ্ছে যখন একই শরীরে স্ত্রী এবং পুরুষ যৌনাঙ্গের সহাবস্থান থাকে। তবে প্রকৃতিতে প্রকৃত উভলিঙ্গত্বের সংখ্যা খুবই কম। বেশি দেখা যায় অপ্রকৃত উভলিঙ্গত্ব। যখন কোনো ব্যক্তি এক যৌনতার প্রাইমারি বা প্রাথমিক যৌন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়, কিন্তু অপর যৌনতার সেকেন্ডারি বা গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে, তখন তাকে অপ্রকৃত উভলিঙ্গত্ব বলে। সাধারণত ছয় ধরনের অপ্রকৃত উভলিঙ্গত্ব দৃশ্যমান –(১) কনজেনিটাল এড্রেনাল হাইপারপ্লাসিয়া (CAH), (২) এন্ড্রোজেন ইন্সেন্সিটিভিটি সিনড্রোম (AIS), (৩) গোনাডাল ডিসজেনেসিস, (৪) হাইপোস্পাডিয়াস, (৫) টার্নার সিনড্রোম (xo) এবং (৬) ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম (XXY)। উভলিঙ্গত্বের বিভিন্ন প্রপঞ্চের উদ্ভব বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে।

রূপান্তরকামী পুরুষ এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে জন্মের সময় স্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গ বৈকল্পিক মানুষ (রূপান্তরকামীরা সহ) ট্রান্সজেন্ডার শব্দের অন্তর্ভুক্ত। অনেক রূপান্তরকামী পুরুষ অস্ত্রোপচার বা হরমোন রূপান্তর বা উভয়ভাবেই তাঁদের শরীর এমনভাবে পরিবর্তিত করেন যাতে তাঁদের গঠন তাদের লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে অভিন্ন হয় বা লিঙ্গ অস্বস্তিকে হ্রাস করে।

গবেষণা দেখায় গেছে যে বেশিরভাগ রূপান্তরকামী পুরুষরা বিপরীতকামী হয়ে থাকেন (যার অর্থ তাঁরা নারীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন) মূলত রূপান্তরকামী পুরুষ শব্দটি এমন মহিলা থেকে পুরুষ রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ব্যবহার করা হত, যাঁরা হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা বা লিঙ্গ পুনর্নির্মাণ অস্ত্রোপাচার বা উভয়ই করিয়ে থাকতেন। রূপান্তরের সংজ্ঞাটিকে মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের তত্ত্বগুলি বা স্বগ্রহণযোগ্যতার পদ্ধতিগুলিকে অন্তর্গত করার মাধ্যমে প্রসারিত করা হয়েছে। যাঁরা রূপান্তরকামী হিসাবে চিহ্নিত হন তাদের অনেকে লিঙ্গ অস্বস্তির শিকার হতে পারেন।

কয়েকটি পদক্ষেপগুলিই রূপান্তরের অংশ হতে পারে। যেমন –(১) সামাজিক রূপান্তর: নিজস্ব পছন্দসই নাম এবং সর্বনাম ব্যবহার করা, লিঙ্গ উপযুক্ত পোশাক পরিধান করা, পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সাধারণত কর্মক্ষেত্রে/বিদ্যালয়ে স্বরূপ প্রকাশ। (২) লিঙ্গ পুনর্নির্মাণ চিকিৎসা: হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা (এইচআরটি), অথবা অস্ত্রোপাচার (এসআরএস)। (৩) আইনি বিবৃতি: দলিলগুলিতে নাম এবং (কখনও কখনও) লিঙ্গ চিহ্ন পরিবর্তন করা। অবশ্য কিছু রূপান্তরকামী পুরুষ বিপরীতকামী মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্কে থাকেন, আবার কিছু রূপান্তরকামী পুরুষরা কুইয়ার মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্কে থাকেন। কারণ কুইয়ার মহিলারা বেশিরভাগ সময় অন্তরঙ্গ সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির লিঙ্গ এবং যৌন শারীরবৃত্ত বিষয়ে কম চিন্তিত হন। লেসবিয়ান সম্প্রদায়ের সঙ্গে রূপান্তরকামী পুরুষদের ইতিহাস থাকতে বা বিস্তৃত লিঙ্গ বৈচিত্র্যের গ্রহণযোগ্যতার কারণে তাঁরা এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরও ভালোভাবে মেলামেশা করতে পারেন। কিছু রূপান্তরকামী পুরুষ লেসবিয়ান হিসাবে চিহ্নিত হন, যাদের “বুচ লেসবিয়ান’ বলা হয়। এটা বুঝতে পারার আগে যে তাঁরা আসলে রূপান্তরকামী।

হুবার্ড একজন রূপান্তরকামী মানুষ। হুবার্ড মেয়েদের ৮৭ কেজি সুপার হেভিওয়েট বিভাগে নেমেছিলেন। তাঁর বয়স তখন ৪৩ বছর। তিনিই ছিলেন টোকিও অলিম্পিকের সব চেয়ে বেশি বয়সি প্রতিদ্বন্দ্বী। অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র পেয়েছিলেন হুবার্ড। তারপর তিনি জানিয়েছিলেন, নিউজিল্যান্ডের এত মানুষ তাঁকে সমর্থন করেছেন দেখে তিনি কৃতজ্ঞ ও আপ্লুত। এই রূপান্তরকামী অ্যাথলিট বলেছেন, তিন বছর আগে কমনওয়েলথ গেমসে যখন তাঁর হাত ভেঙেছিল, তখন অনেকেই বলেছিলেন, তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে গেল। কিন্তু মানুষের সমর্থনে তিনি আবার ফিরে আসতে পেরেছেন। রূপান্তরকামী অ্যাথলিটদের জন্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কিছু শর্ত আছে। হুবার্ড সেই সব শর্ত পূরণ করছেন। তিনি ২০১৩ সালে ৩৫ বছর বয়সে লিঙ্গ পরিবর্তন করেন।

নিউজিল্যান্ড অলিম্পিক কমিটির সিইও কেরেয়ন স্মিথ বলেছেন, হুবার্ড অলিম্পিক ও ইন্টারন্যাশনাল ওয়েটলিফটিং ফেডারেশনের সব শর্ত পূরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা স্বীকার করি যে, জেন্ডার আইডেনটিটি হল খুব জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়। এর সঙ্গে মানবাধিকার, সকলের জন্য সমান সুযোগের বিষয়টিও জড়িত। আর নিউজিল্যান্ড টিমে সকলকে নিয়ে চলার, সকলকে শ্রদ্ধা করার ঐতিহ্য আছে।” তবে কিছু নারী অ্যাথলিটের মতে, এর ফলে তাঁদের মেডেল জেতার সুযোগ কমে গেল। বেলজিয়ান ওয়েটলিফটার অ্যানা বলেছেন, হুবার্ডকে টোকিওতে সুযোগ দেওয়া নারী অ্যাথলিটদের কাছে একটা বড়ো প্রহসনের মতো। তাঁর মতে, “রূপান্তরকামীদের জন্য গাইডলাইন তৈরি করাটা কঠিন। কিন্তু যাঁরা এই সর্বোচ্চ পর্যায়ের জন্য নিজেকে তৈরি করেছে, তাঁরা জানেন, হুবার্ডের অন্তর্ভুক্তি কতটা অন্যায়।” হুবার্ড বলেছিলেন, “আমি জানি, সকলে আমাকে সমর্থন করবেন না। কিন্তু আমি আশা করি, মানুষ খোলা মনে বিচার করবেন। আমার এই জায়গায় আসতে অনেক সময় লেগেছে।”

.

সফল রূপান্তরকামী হিজড়া

আমরা এবার দেখব কয়েকজন সফল রূপান্তরকারী হিজড়া, যাঁরা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রথমেই আসব পদ্মীনি প্রকাশের কথায়। আর পাঁচজন রূপান্তরকামীর মতো পদ্মীনিও তাঁর পরিবারের কাছে চরম অবহেলার শিকার হয়েছিলেন। নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করে উঠতে না পেরে ১৩ বছর বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ছোটো থেকে সমস্যা যাঁর নিত্যসঙ্গী সেই পদ্মীনি একদিন ঘুরে দাঁড়ালেন। ২০১৪ সালে তিনি কোয়েম্বাটোরের একটি স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলের প্রথম রূপান্তরকামী প্রাইম টাইম অ্যাঙ্কর হয়েছিলেন।

[পদ্মীনি প্রকাশ]
[পদ্মীনি প্রকাশ]

লক্ষ্মী নারায়ণ ত্রিপাঠি ২০০৮ সালে লক্ষ্মী নারায়ণ ত্রিপাঠি হলেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের এশিয়া প্যাসিফিকের প্রথম রূপান্তকারী ভারতীয় প্রতিনিধি। কিন্তু তাঁর এই রূপান্তরকামিতার জন্য ছেলেবেলা থেকেই তাঁকে অসম্ভব লড়াই করতে হয়েছে। বর্তমানে তিনি একজন সমাজকর্মীও বটে। রূপান্তরিত সম্প্রদায়ের উন্নয়নকল্পে তিনি ২০০৭ সালে ‘অস্তিত্ব’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। তাঁর কথায়, ‘একজন রূপান্তরিত মহিলা হিসাবে তাঁরা যেন পুরুষের হাতের খেলনা। আমাদের শ্লীলতাহানি করা যায়, আমাদের অপমান করা যায়। এমনকী আদালতও বলেছে যে, আমাদের নাকি শ্লীলতাহানি করা যায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে সেই পুরনো গল্প। লোকেরা আমাদের ছক্কা, হিজড়া বিভিন্ন নামেই ডাকতে পারে। আমাদের সম্প্রদায়ে হাজার হাজার নির্ভয়া আছে। আপনাদের কোনো ধারণা নেই আমাদের মধ্যে কতজনকে ধর্ষণ করে খুন করে দেওয়া হয়।”

[লক্ষ্মী নারায়ণ ত্রিপাঠি]
[লক্ষ্মী নারায়ণ ত্রিপাঠি]

কে প্রীতিকা ইয়াশিনি তামিলনাড়ুর প্রথম রূপান্তরকীমা পুলিশ অফিসার। পুলিশবাহিনীতে যোগ দেওয়া নিয়েও রীতিমতো যুদ্ধ করেছিলেন প্রীতিকা। আবেদনপত্রে ‘রূপান্তরকামী’ হিসাবে যোগ দেওয়ার জন্য রীতিমতো আইনি লড়াই লড়েছিলেন তিনি। তবে শেষপর্যন্ত অবশ্য তিনিই জয়ী হলেন। বর্তমানে তিনি চেন্নাইয়ে সাব-ইন্সপেকটার হিসাবে কর্মরত।

[কে প্রীতিকা ইয়াশিনি]
[কে প্রীতিকা ইয়াশিনি]

৬ প্যাক ব্যান্ড ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী মিউজিক ব্যান্ড। ৬ সদস্যের রূপান্তরকামী মহিলার ২০১৬ সালে এই ব্যান্ডটি ‘কানস গ্র্যান্ড প্রিক্স গ্লাস লায়ন’ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।

[কানস গ্র্যান্ড প্রিক্স গ্লাস লায়ন]
[কানস গ্র্যান্ড প্রিক্স গ্লাস লায়ন]

জয়িতা মণ্ডল হলেন ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী বিচারক, যিনি ২০১৭ সালের অক্টোবরে উত্তরবঙ্গের লোক আদালতে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

[জয়িতা মণ্ডল]
[জয়িতা মণ্ডল]

নিতাশা বিশ্বাস হলেন ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী বিউটি কুইন। ২০১৭ সালে | তিনি এই খেতাব অর্জন করেছিলেন।

[নিতাশা বিশ্বাস]
[নিতাশা বিশ্বাস]

ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবি হলেন সত্যাশ্রী শর্মিলা। ২০১৮ সালের জুন মাসে তিনি আইনজীবি হিসাবে কাজ শুরু করেন।

[সত্যাশ্রী শর্মিলা]
[সত্যাশ্রী শর্মিলা]

ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী অপারেশন থিয়েটার টেকনিশিয়ান হলেন জিয়া। ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে তিনি এই কাজে নিযুক্ত।

[জিয়া দাস]
[জিয়া দাস]

ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী মহিলা যাজক এস্থার ভারতী। তিনি বর্তমানে বিয়েও দেন।

হিজড়াসমাজের রীতিনীতি

সামাজিক মূলস্রোত থেকে এই সমাজ সম্পূর্ণই বিচ্ছিন্ন। হিজড়াসমাজের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, ধর্মীয় অনুশাসন সবই আলাদা। প্রত্যেক হিজড়া মহল্লায় একজন দলপতি থাকেন। এরা ‘গুরু-মা’ ‘নান-গুরু মা’ বলে পরিচিত। এই গুরু-মাই দলের অভিভাবক। গুরু-মায়ের তত্ত্বাবধানে হিজড়ারা হল তাঁর শিষ্য, চেলা বা মেয়ে। অবাধ্য হওয়া তো দূরের কথা, শিষ্যেরা গুরু-মাকে খুবই মান্য করে। শিষ্যত্ব সংগ্রহ করা এবং তাঁকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে কাজে পাঠানো গুরু-মায়ের অন্যতম প্রধান কাজ। গুরু-মায়ের তত্ত্বাবধানে শিষ্যরা নাচ-গান বাজনা শিখতে থাকে। শুধু নাচ-গান-বাজনা শিখলেই হয় না, তালি দেওয়া শেখাটাও অত্যন্ত জরুরি। সবাই জানেন, হিজড়াদের তালি বিশেষ ধরনের। দুটি হাতের তালুকে ৯০ ডিগ্রি কোণ করে এই তালি দেওয়া হয়।

হিজড়া দুনিয়ার প্রচলিত রীতি অনুসারে প্রত্যেক গুরু-মায়ের কাজের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা থাকে। এই এলাকায় তিনিই হলেন হিজড়াদের ‘বস’। হিজড়া মহল্লায় একজন গুরু-মায়ের অধীনে কতজন শিষ্য থাকবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে যেসব শিষ্যরা মহল্লায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে তাঁরা হল ‘সাধারণ শিষ্য’। একই গুরু-মায়ের সাধারণ শিষ্যেরা একে অন্যের গুরু-বোন। গুরু-মায়ের অবর্তমানে তাঁর সম্পত্তির সমান অংশ পায় শিষ্যেরা। তবে অনেক সময় মৃত্যুর আগেই গুরু-মা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি কোনো একজন শিষ্যকে উইল করেও দিয়ে যান।

হিজড়াদের জীবনজীবিকা

সাধারণত দেখা যায় গুরু-মার তত্ত্বাবধানে থেকেই সমস্ত হিজড়াদের কাজ করতে হয়। কমন সোসাইটিতে যখন একটা মানুষ হিজড়া হয়ে ওঠার কারণে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে, ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের মধ্যে পড়ে যায়, তখন এই গুরু-মাই যেন সাক্ষাৎ দেবদূত। এই দেবদূতরাই তাঁদের আশ্রয় দেয়, জীবনজীবিকা দেয়, মুক্তি দেয়, রক্ষা করে। গুরু-মার মতো সহনশীল ও দায়িত্ববান মানুষরা যদি না থাকতেন তাহলে সমস্ত তৃতীয় লিঙ্গদের হয়তো আত্মহননের পথ বেছে নিতে হত। যাই হোক, এই হিজড়া সোসাইটিতে নাম লেখানোর পর গুরু-মা তাঁদের জীবনজীবিকার সন্ধান দেন। জীবিকার একটা অংশ গুরু-মাকে দিতে হয়, বাকি অংশ হিজড়ার। হিজড়ার সেই অংশ থেকে একটা অংশ সন্তান হিসাবে বাবা-মাকে পাঠান।

স্বাভাবিক মানুষদের মতো হিজাড়ারাও নানাবিধ পেশায় যুক্ত থাকে, যদিও সীমিত ক্ষেত্র। দেখা যাক— (১) বাচ্চা নাচানোই এদের প্রধান জীবিকা। সাধারণত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে নবজাতকের জন্মের কথা ওরা জানতে পারে। তারপর একদিন দলবল নিয়ে হাজির হয় নবজাতকের বাড়িতে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শুরু হয় নাচা-গানা। বাচ্চা নাচানোর পর ওরা যে টাকাপয়সা ও অন্যান্য দ্রব্য দাবি করে, তা বেশিরভাগ সময়ই জুলুমের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। প্রাপ্য দাবি না-মিটলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি এবং অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে নবজাতকের পরিবারকে হেনস্থা করতে থাকে। এই ঔদ্ধত্য ও দুর্বিনীত আচরণ শেষপর্যন্ত বাক্-বিতণ্ডা এবং হাতাহাতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বাচ্চা নাচিয়ে যে অর্থ উপার্জন হয় তার অর্ধেক গুরু-মা ও অর্ধেক শিষ্যারা পায়। অবশ্য কোনো কোনো অঞ্চলে উপার্জিত অর্থের এক-চতুর্থাংশ শিষ্যেরা পায়। তবে সব হিজড়াই যে জুলুমবাজি করে একথা বলা যায় না। আমার বাচ্চাকে যে হিজড়াদের দল নাচাতে এসেছিল তাঁরা জুলুমবাজি তো দূরের কথা, কোনো দাবি করেনি। সামর্থ্য অনুযায়ী যা দিয়েছিলাম সেটাই নিয়েছিল। (২) গুরু মায়েরা দালাল মারফৎ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সুশ্রী ‘নাগিন’ হিজড়াদের পাঠিয়ে থাকে। দালালরা এদের নিয়ে তোলে ওইসব অঞ্চলের কিছু ব্যক্তির কাছে, যারা মাস্টারজি’ নামে পরিচিত। এই মাস্টারজিদের তত্ত্বাবধানে নাগিনরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দি ফিল্মি দুনিয়ার চিত্তবিনোদক নৃত্য পরিবেশন করে। এইভাবে যে অর্থ উপার্জন হয় তার সিংহভাগই মাস্টারজির পকেটে চলে যায়। গুরু-মায়েরও দালালদের মাধ্যমে এই অর্থের একটা বড় অংশ লাভ করেন। (৩) মূল্য না দিয়ে বাজার থেকে সবজি-তরিতরকারি জোর করে তুলে নেয়। এই ‘তোলা’ তোলা ব্যবস্থা বহু বছর ধরে চলে আসছে। আজকাল দূরপাল্লার ট্রেনে ও বাসেও এঁদের তোলা তুলতে দেখা যায়। সবাই জোর করে তোলা তোলে না। অনেকেই আছেন মানুষ খুশি হয়ে যা দেয় তাতেই আশীর্বাদ করে। (৪) আন্তর্জাতিক চোরাচালানের সঙ্গেও হিজড়ারা যুক্ত থাকে। বিভিন্ন স্মাগলার ডনদের আন্ডারে কিছু গ্যাংলিডার আছে। সেই গ্যাংলিডারদের একটা বড়ো অংশই হিজড়া। (৫) হিজড়াদের একটা অংশ দেহ ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে অর্থ ও যৌনসুখের আশায়। সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষায়, “হিজড়াদের একমাত্র জ্বালা-যন্ত্রণা-প্রতিহিংসার বিষয় হল– নরনারীর ‘স্বাভাবিক জীবন’।” গণিকাপল্লি সত্যিকারের মেয়েদের হারিয়ে ‘পারিক’ হিজড়াদের চাহিদা বেড়েছে। কম বয়সি হিজড়ারা কলগার্ল হিসাবেও যৌনপেশায় লিপ্ত থাকে। হিজড়া মহল্লার বাইরে সমকামী অ্যাকটিভ পুরুষের কাছে হিজড়াদের বেশ চাহিদা আছে। এঁরা নারীর স্থলাভিষিক্ত পুরুষ যৌনকর্মী। মুম্বাই শহরে হিজড়াদের উপর বিশেষ অনুসন্ধান চালিয়ে ডাঃ ঈশ্বর গিলাডা এক সমীক্ষায় বলেছেন –সেখানকার প্রায় ৬০ শতাংশ হিজড়া বেঁচে থাকার তাগিদে বেশ্যাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে হিজড়ারা চায় তাঁরা আর পাঁচজনের কাজ করে জীবন চালায়। মানুষ তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দিক। তাঁদের বক্তব্য– “এখন যে কাজ করি তাতে হয়তো কোর্মা-পোলাও-বিরিয়ানি খেতে পারি। তখন রোজগার অল্প হলেও ডাল-ভাত আলু সেদ্ধ খাব। তবু বুঝব ন্যায্য কামাইয়ে খাই।” বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল বটে। কিন্তু সেই ভাতার টাকা হিজড়া হাতের তালু পর্যন্ত পৌঁছোয়নি।

হিজড়াদের যৌনকর্ম

আমাদের সমাজে লিঙ্গভিত্তিক দুই প্রকারের হিজড়া দেখতে পাই। যেমন– নারী হিজড়া ও পুরুষ হিজড়া। নারী হিজড়ারা পুরুষের সঙ্গেই যৌনকর্ম করতে চায়। একজন সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের অপেক্ষা করে থাকে। সেই স্বপ্নের পুরুষটির সঙ্গে সারাজীবন ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সেই স্বপ্ন সবার পূরণ হয় না। কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষরাই তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করে। ভালোবাসার অভিনয় করে তাঁদের শরীর ভোগ করে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশের আপন নামের জনৈকা মেয়ে হিজড়া দাবি করেন “একজন মেয়ে পুরুষকে যতটা সুখ দিতে আমরা তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি সুখ দিতে পারি”। তিনি বলেন– “আমার শরীরের সব পার্টস ন্যাচারাল। আমার উপরতলা ও নীচতলা কোনোটাই কৃত্রিম নয়। আমার স্তন সিলিকনের নয়, অরিজিনাল। কারণ আমি একজন মেয়ে হিজড়া।” আপন বেশ্যাবৃত্তি করে অর্থ রোজগার করে না। দোকান কালেকশনই তাঁর মূল জীবিকা। ভালোবেসে এক রিকশাচালককে বিয়ে করেছিলেন। সেই রিকশাচালক বেশ কিছুদিন তাঁর সঙ্গে ঘরসংসার করে পালিয়ে যায়। আপন বলেন –“মানুষের যৌন চাহিদা থাকাটা স্বাভাবিক চাহিদা। আমারও আছে। কিন্তু সেই চাহিদা মেটাতে বহুগামিতায় যাব না। মনের মানুষ পেলে তাঁকে আমার সব উজাড় করে দেব।” আপনকে নিয়ে বাংলাদেশের ইউটিউবারদের কৌতূহলের সীমা অন্তহীন। ছবিতে যেমন দেখছেন ঠিক সেইভাবেই ইউটিউবারদের সামনে ক্লিভেজ প্রদর্শন করে বার্তালাপ চালিয়ে যান। এমনভাবে কেন বসেন, পুরুষদের প্রলুব্ধ করতে? এহেন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন– “আমি সবসময় বড়ো গলা ব্লাউজ পরি। তা ছাড়া আমি একটু মোটাসোটা বলে খুব গরম লাগে।”

[মেয়ে হিজড়া আপন]
[মেয়ে হিজড়া আপন]

 ফুলকলি হিজড়াও বাংলাদেশে থাকেন। বিয়ের স্বপ্ন দেখলেও তিনি বাস্তববাদী। উনি জানেন তাঁর বিয়ের স্বপ্ন থাকলেও কোনো পুরুষ কখনোই তাঁকে বিয়ে করবে না। তাঁর বড় কারণ হিজড়ারা কখনোই সন্তান জন্ম দিতে পারে না। সব পুরুষই বাবা হতে চায়। তাই সেক্স ভোগ করি। বিনিময়ে অর্থ নিই। হিজড়া সমাজে থাকলেও নিজের বাড়িতে বাবা-মাকে টাকা পাঠাই। ফুলকলি জানান– “আমি একটি ছেলেকে পছন্দ করতাম। একে অপরকে ভালোবাসতাম। একদিন বিয়ে কথা ভেবে ছেলেটি অভিভাবকদের সঙ্গে কথা তাঁরা জানাল, আমি তো কোনোদিন সন্তান দিতে পারব না। তাহলে কেন ছেলেটার জীবন নষ্ট করব!” জীবন নিয়ে হতাশ ফুলকলি বলেন– “আমার শরীর দেখে কারোর লোভ লাগতেই পারে। কারণ আমার শরীরের মেয়েদের চেয়ে কিছু কম নেই। বাস্তবে তো আমাদের নিয়ে শোয়া আর একটা কলাগাছকে নিয়ে শোয়া একই ব্যাপার। সাধ আছে সাধ্য নেই। আমার ভিতরে আবেগ আছে, বাইরে শরীর আছে। এমন শরীর যা যৌনতা ছাড়া সৃষ্টি করতে পারে না। পুরুষ মানুষদের কাছে আমরা হলাম ‘ওয়ান টাইম ইউজড, টু টাইম ডাস্টবিন। মাঝেমাঝে মনে হয় আমার জীবনে আমি কী পেলাম। মনে হয় গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাই। চাই না এই দুনিয়ায় থাকতে। আল্লাপাক যদি আমাকে পরের জন্মে নারী বা পুরুষ হিসাবে জন্ম দিত তাহলে আমি আল্লাহর কাছে অনেক হ্যাপি হতাম। কিন্তু শুনেছি আত্মহত্যা করা মহাপাপ। আমি এভাবে মরব না। ধুকে ধুকে মরব। যত দিন যাবে আমি তিলে তিলে মরব। আমি প্রতিদিন রাত হলে কাঁদি। আল্লাকে বলি, আল্লা তুমি আমাকে নিয়ে যাও।”

[মেয়ে হিজড়া ফুলকলি]
[মেয়ে হিজড়া ফুলকলি]

তানজিমা বলেন “ছোটোবেলায় ছিলাম একরকম। অর্থাৎ একজন পুরুষ। তাই আমার নাম হয়েছিল নাহিদ। কিন্তু আমি পুরুষ শরীর জন্মালেও আমার মন ছিল একজন নারীর মতো। অর্থাৎ আমি মেয়েদের মতো কাজকাম করতাম। বাড়ির মা-মাসিরা যে ধরনের কাজ করতেন, আমারও সেই কাজ করতে ভালো লাগত। ছোটোবেলায় আমি মেয়েদের মতো পুতুল খেলতাম। মেয়েদের মতো সাজগোজ করতাম। মেয়েদের মতো হাঁটাচলা করতে পছন্দ করতাম। আমার ভালো লাগত। আমার মা বলত– বাবা, এগুলো তোমার কাজ না। এগুলো মেয়েদের কাজ। ছেলেরা যে ধরনের কাজ করে যে ধরনের কাজ করে তুমি সেগুলো করো। কিন্তু আমি অপারগ ছিলাম। আমার বাবা-মা যখন স্কুলে ভর্তি করে দিল, তখন রাস্তায় অনেকে বলত ‘মাইগ্যা হাঁইটা যাচ্ছে। স্কুলে গেলে ছেলেরা বলত, “তুই তো হাফ লেডিজ। মেয়েদের কাছে গিয়ে বস’। মেয়েদের কাছে গিয়ে বসলে মেয়েরা বলত, ‘তুই তো হাফ লেডিজ। ছেলেদের কাছে গিয়ে বস’। আমাকে নিয়ে সবাই হাসি-ঠাট্টা করত। আমার খারাপ লাগত। অনেক মেয়েরা অবশ্য কাছে টেনে নিত। সবাই এরকম বলত না। একদিন রাতে আমার বাবা-মায়ের কয়েকটা কানে এলো। আমার বাবার একটা মুদির দোকান আছে। বাবা মাকে বলছেন, দোকানের লোকেরা এসে বলে ভাই আপনার তো দুটো সন্তান। আপনার বড় ছেলেটা ঠিক আছে। কিন্তু ছোটো ছেলেটা কেমন মেয়েদের মতো। হিজড়াদের মতো চলাফেরা। হিজড়াদের মতো দেখতে। হিজড়াদের মতো কণ্ঠ। এ কথা যখন বাবা মাকে বলছে, তখন দুজনেই কাঁদছিল। আমার বাবা-মায়ের কান্না শুনে আমার খারাপ লেগেছিল। আমি যত বড়ো হচ্ছিলাম আমার ভিতর ততই মেয়েলিপনাটা বেড়ে উঠছিল। আমার প্রতিবেশীরা আমাকে নিয়ে আমার বাবা-মাকে কটুকথা শোনায়। আমার দাদা মামুনকে সবসময় কষ্ট পেত আমার গজন্যে। তাঁর বন্ধুরা বলত, “তোর ভাইকে দেখতে মেয়েদের মতো। তখন আমার দাদা খুব লজ্জা পেত। আমার কাছেও খারাপ লাগত। আজকে আমার জন্যে আমার বাবা-মার চোখে জল। আমার দাদার জন্যে আমার বাবা-মার চোখে জল আসেনি। আমার জন্যে কেন আমার চোখে জল আসবে? হয়তো আমার বাবা-মা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবে। এটা ভেবে দেখলাম আমার এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া উচিত। তখন ওখানকার মুন্নি নামে হিজড়ার কাছে জানতে পারলাম বর্তমান নান গুরু এনজি হুররামের কথা। শুনেছি উনি খুব ভালো। উনি থার্ড জেন্ডারদের আশ্রয় দেন, তাঁদেরকে বাঁচার জন্য ভালো একটা পথ দেখায়। তখন আমি মুন্নি আপার কাছ থেকে নান গুরুর ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখি। পরে যোগাযোগ করে নিই। তিনি আমাকে গ্রহণ করলেন। এক ভোররাতে বাবা মাকে একটা চিঠি লিখে আমি চলে আসি। লিখেছিলাম, ‘আমি চলে গেলাম। ভবিষ্যতে যদি বেঁচে থাকি অবশ্যই কথা হবে দেখা হবে। আমি চাই আমার নান গুরু ওরফে সজীবকে আল্লাহ হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখুক। তাঁর মতো একটা মানুষ আমার জীবনটা পুরোটাই চেঞ্জ করে দিয়েছে। সে না-থাকলে হয়তো আমি আজ এ জায়গায় থাকতাম না। সমাজে আমার একটা পরিচয় হয়েছে ভালোভাবে থাকা ভালোভাবে মানুষের সামনে যাওয়া এটা আমার হত না। সে দুই মাস আমাকে কোনো কাজ করতে দেয়নি নিখরচায় আমার ভরণপোষণ করেছে আমার নতুন জামাকাপড় কিনে দিয়েছে। কোনো ভালো জায়গায় গেলে সে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার দুই বছর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁরা প্রথমে আমাকে চিনতে না পারলও পরে চিনেছে যে আমিই তাঁদের ছোটো সন্তান। কারণ আমার লুকটাই তো বদলে গেছে। বাচ্চা বকসিস ও বিয়েবাড়ি বিনোদন দিয়ে আমি যা রোজগার করি তার একটা অংশ আমার বাবা-মাকে পাঠাই সন্তান হিসাবে।

[হিজড়া তানজিমা]
[হিজড়া তানজিমা]

এবার তানিশা হিজড়ার কথা বলব। তানিশা বাংলাদেশের নাগরিক হলেও সে ভারতে এসে আধুনিক চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে স্তনের বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। তানিশ জানিয়েছেন স্তন তাঁর আগে থেকেই ছিল। তবে কিঞ্চিৎ ছোটো থাকায় একটু বড়ো করিয়ে নিয়েছেন আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য। আকর্ষণ বাড়ানোর দুই চোখে লেন্সও পরেন। তানিশা বলেন, “একটা মেয়ে একটা ছেলেকে যতটা সুখ দিতে পারে আমি তাঁদের চেয়ে ১২ গুণ সুখ দিতে পারি।” জন্ম হয়েছিল পুরুষ হিসাবে। তখন নাম ছিল তানবির। নান গুরুর কাছে শিষ্যা হওয়ার পর নাম হয় তানিশা। উনিশ বর্ষীয়া লাজুক তানিশা নিজেকে মেয়ে হিজড়া বলে দাবি করেন। বাংলাদেশ থেকে দিল্লিতে এসে দেড় বছর থেকে তাঁর স্তন তৈরি করান। এই খরচ তিনি সংগ্রহ করেছেন ভারতের এক নাইট ক্লাবে ডান্স করে। কোনো পুরুষের সঙ্গে সংসার করার স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করে আছেন। একটা মেয়ে যা দিতে পারবে তার চেয়ে অনেক বেশি দিতে পারবেন বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু বাচ্চা দিতে পারবেন না, এটাই আক্ষেপ।

[তানিশা হিজড়া]
[তানিশা হিজড়া]

পুরুষ হিজড়ারা পায়ুকামের (Sodomy) মাধ্যমে যৌনতা করে। দুই সমকামী পুরুষের মধ্যে একজন মেয়েদের মতো Passive বা নিষ্ক্রিয় যৌনসঙ্গী হন। এরা সকলেই পায়ুমিলনে অভ্যস্ত। এই পায়ুপথই (Anal canal) নারীর যৌনাঙ্গের (Vagina) সমতুল মনে করে থার্ড জেন্ডারের মানুষরা। যদিও অনেক কমন জেন্ডার বা বিপরীতকামীদের মধ্যেও পায়ুমৈথুনে অভ্যস্ত। শুধু রোজগারের জন্যই এইসব হিজড়ারা সমকামী কোনো ব্যক্তির সঙ্গে পায়ুমিলনে লিপ্ত হয় না, অবদমিত যৌনক্ষুধাকে তৃপ্ত করার জন্যও এঁরা সমকামে লিপ্ত হয়। মূত্রছিদ্র দিয়ে এক ধরনের রস নিঃসরণের (Urethral Smear) মধ্য দিয়ে এঁদের যৌনসুখের চরম তৃপ্তি বা অর্গাজম অনুভূত হয়।

হিজড়াদের ভোটাধিকার

হিজড়ারা আগেও ভোট দিত, এখনও দেয়। তবে হিজড়া হিসাবে ভোট দেওয়া যায় না। যেহেতু এঁরা নারী-বেশ ধারণ করেন এবং স্ত্রীলিঙ্গে নাম ধারণ করে সেইহেতু ভোটের সময় এঁরা স্ত্রী ভোটার হিসাবেই চিহ্নিত হয়। অথচ রহস্যজনকভাবে এঁরাই আবার জনগণনায় পুরুষ হিসাবে নথিভুক্ত হয়। সর্বভারতীয় হিজড়া কল্যাণ সভার সভাপতি শ্রী খৈরাতিলাল ভোলা হিজড়া ‘হিসাবে’ ভোট দেওয়ার আইনি স্বীকৃতি আদায় করার জন্য ‘Election Commisson of India’-র কাছে আবেদন জানিয়েছেন। আবেদনে সাড়া দিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সমস্ত মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের ভোটার তালিকায় হিজড়াদের ‘হিজড়া’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ পাঠান। সমস্যাটা আর-এক জায়গায়– সমস্ত হিজড়াই নিজেদের ‘স্ত্রীলোক’ হিসাবেই পরিচয় দিতে আগ্রহী। তারা চায় না ভোটার তালিকায় ‘হিজড়া’ হিসাবে নাম থাকুক।

হিজড়াদের সংস্কার

হিজড়া দুনিয়ায় সব সদস্যকেই বেশকিছু নিয়মনীতি মান্য করে চলতে হয়। যেমন –(১) রাস্তায় অপরিচিত কোনো পুরুষের সঙ্গে হালকা চালে কথা বলা এবং অশালীন আচরণ হিজড়াসমাজে গর্হিত অপরাধ। (২) সন্ধ্যার পর হিজড়া মহল্লার সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়। অতি পরিচিত কোনো ব্যক্তি ছাড়া ভিতরে প্রবেশ নিযেধ। অবশ্য ঝুপড়িবাসীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হবে না। (৩) খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বা আমন্ত্রণ না-পেলে কোনো গুরু-মা সাধারণত অপর কোনো গুরু-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান না। (৪) কোনো গুরু-মা মাটিতে বসে থাকলে তা চেলা বা শিষ্যরা খাটে বা উঁচু কোনো জায়গায় বসে না। (৫) কিছু কিছু মহল্লায় হিজড়ারা খুব ভোরে উঠে প্রধান দরজার চৌকাঠে ঝাঁটা বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে। অনেকে আবার মহল্লার মাথায় ছেঁড়া জুতো বেঁধে রাখে। (৬) হিজড়ারা মনে করে সন্তানসম্ভবা কোনো মহিলার উদর বা পেট যদি কোনো হিজড়া বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করে তাহলে গর্ভস্থ সন্তান হিজড়া হয়ে ভূমিষ্ঠ হবে। (৭) হিজড়ারা মনে করে হিজড়াদের লেখা চিঠি যদি কোনো গর্ভবতী মহিলা পাঠ বা স্পর্শ করে তাহলে ভ্রণের ক্ষতি হবে ইত্যাদি। (৮) তাঁরা বিশ্বাস করে, তাঁরা তাঁদের মৃত্যুর কথা আগাম জানতে পারে। (৯) হিজড়ারা মনে করে তাঁদের গুরু-মা দৈব ক্ষমতার ক্ষমতার অধিকারী। | শিষ্যাদের সম্পর্কে সবকিছুই গুরু-মা জানতে পারেন।

হিজড়াদের ঢোল

হিজড়াদের জীবনে ঢোল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বাচ্চা নাচাতে ঢোলের বাজনা অত্যাবশ্যক অনুসঙ্গ। কর্মক্ষেত্র ছাড়া অকারণে গুরু-মায়ের সামনে ঢোল বাজালে বা হাতের তালি দিলে শিষ্যদের ক্ষতি হবে বলে বিশ্বাস। হিজড়াদের বিশ্বাস ঢোল পায়ে লাগা পাপ। সকালে, বিকালে ঢোলকে এঁরা প্রণাম করে। কোনো-কোনো মহল্লায় কাজের শেষে ঢোলগুলিকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। সকালে কাজে বেরনোর আগে যদি কোনো অ-হিজড়া ঢোল স্পর্শ করে তাহলে ঢোলটি অপবিত্র হয়ে যায়। সেদিনের জন্য ওই ঢোল বাতিল, অন্য ঢোল নিয়ে কাজে বেরতে হয়। হাজারো বিপদের মাঝে নিজের জান দিয়ে হলেও ঢোলকে অক্ষত রাখা হিজড়াদের অসীম কর্তব্য। হিজড়াদের বিশ্বাস, এই ঢোল যদি অন্য কেউ কেড়ে নেয় তাহলে মনে করা হয় বিপদ নিকটেই। এছাড়া মহল্লার গুরু-মায়ের সম্মতি ছাড়া ঢোল ক্রয় করা গর্হিত অপরাধ। সমস্ত হিজড়া মহল্লার ঢোল পুজো হয়। ঢোল পুজো হিজড়াদের একটি বাৎসরিক উৎসব। কালীপুজোর রাতে এঁরা ঢোলের আরাধনায় বসে। এদিন কেউ কাজে বেরন না। নিরামিষ খাবে সবাই। ঢোল পুজোর অনুষ্ঠানে বাইরের কেউ প্রবেশাধিকার পায় না। পুরোনো চামড়ার | ঢোল এই পুজোর বাতিল। যাই হোক, পুজোয় বসেন গুরু-মা। কোনো নির্ধারিত মন্ত্র-টন্ত্র নেই এই পুজোয়। গুরু-মা চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে, ধ্যান ভাঙলে পুজো শেষ।

হিজড়াদের ধর্মবিশ্বাস

জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে সমস্ত রকমের ভেদাভেদ ভুলে এক সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তুলেছে হিজড়া সমাজ। যে-কোনো হিজড়া মহল্লায় দেখা মিলবে সব ধর্মের হিজড়া। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এরা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে তুলেছে। ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি বা রক্ষণশীলতা এক্কেবারেই নেই। সব ধর্মের দেব-দেবতাই সকল হিজড়াদের ইষ্টদেবতা।

এঁদের অধিকাংশেরই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মেলে। কিন্তু সামাজিক জীবনযাত্রার উপর ইসলামের প্রভাব বিস্তর। হিজড়াদের অধিকাংশ দলপত্নী বা গুরু-মা ইসলাম ধর্মাবলম্বী হন। তামিল লুনার ক্যালেন্ডার মতে নববর্ষের দিন সারা ভারতের হিজড়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। মাদ্রাজ থেকে প্রায় ২০০ মাইল দক্ষিণে কোষাগাম গ্রামে তাঁরা একসঙ্গে মিলিত। বাংলাদেশের হিজড়ারাও ভারতে আসেন। তাঁরা মনে করেন ভারতের মানুষের কাছ থেকে হিজড়ারা সম্মান পান। ভারতের মানুষরা হিজড়াদের সমীহ করে।

হিজড়াদের মন ও মনন

নারী না-হয়েও হিজড়ারা নিজেদের নারীরূপে ভেবে থাকে। মহিলাদের পোশাক আশাক, মহিলাদের অলংকার-কসমেটিক-শৃঙ্গার এদের পছন্দ অপ্রতিরোধ্য। ট্রেনে-বাসে লেডিস সিট, লেডিস কম্পার্টমেন্ট, লেডিস ট্রেন, লেডিস বাসে চড়ে বা উঠে যাতায়াত করে। ভুলেও এরা জেনারেল আসন বা কম্পার্টমেন্ট ব্যবহার করে না। শেষ মুহূতে ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়লেও পরের স্টপেজে নেমে লেডিস কম্পার্টমেন্টে ওঠে। পুজোর প্যান্ডেলে বা যাত্রার এঁদের মহিলাদের মধ্যেই দেখা যায়। বস্তুত এঁরা নিজেদেরকে অম্বার জাত বা উত্তরসূরী ভাবে। অম্বা মহাভারতের একটি অভিশপ্ত চরিত্র। গল্পটা একটু বলি; ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বয়ংবর সভা থেকে ভীষ্ম অম্বাকে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন। কিন্তু শারাজার প্রতি অনুরাগের কথা শুনে ভীষ্ম অম্বাকে মুক্তি দেন। অপরদিকে শান্বরাজ অম্বাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এহেন ঘটনার অম্বা জোর গলায় ভীষ্মকে অভিযুক্ত করে। এখানেই শেষ নয়, অম্বা ভীষ্মকে ধ্বংস করবে এমন বিধ্বংসী তপস্যায় ব্রতী হলেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে অম্বাকে বর দিলেন। বললেন– এ জন্মে নয়, পরজন্মে নপুংসক ‘শিখণ্ডী’ হয়ে অম্বা জন্মগ্রহণ করবেন এবং ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবে। হিজড়ারা এই কাহিনি জানে, জানে বলেই তারা নিজেদেরকে অম্বার সঙ্গে গভীর একাত্মতা অনুভব করে। হিজড়ারা বিশ্বাস করে তারা নপুংসক শিখণ্ডী– এ জন্মের আগে তাদেরও ছিল স্বাভাবিক জীবন এবং পরের জন্মে আবার নারীজন্ম ফিরে পাবে।

স্বাভাবিক কর্মজীবনে হিজড়াদের ভূমিকা

হিজড়াদের সেই পরিচিত কর্মের বাইরে মূলস্রোতে কর্মরত অবস্থাতেও দেখা যাচ্ছে। কিছু খ্রিস্টান সংঘ হিজড়াদের সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইউনিটারিয়ান একটি উদার ধর্মমত। তাদের মূল খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭৯ সালে তারাই সর্বপ্রথম হিজড়াদের পূর্ণ সদস্য হিসাবে গ্রহণ করে। and the first to open an Office of Bisexual, Gay, Lesbian, and Transgender Concerns in 1973. ১৯৮৮ সালে উইনিটারিয়ান উইনিভার্সালিস্ট অ্যাসোসিয়েশান প্রথম একজন হিজড়া ব্যক্তিকে মনোনীত করে। ২০০২ সালে শ্যন ডেন্নিসন প্রথম হিজড়া ব্যক্তি যিনি ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সালিস্ট মন্ত্রনালয়ে ডাক পান। ২০০৩ সালে ইউনাইটেড চার্চ অফ খ্রিস্ট সকল হিজড়া ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেয়। ২০০৫ সালে ট্রান্সজেন্ডার সারাহ জোনস চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ধর্মযাজক হিসাবে নিয়োগ পান। ২০০৮ সালে ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চ জুডিশিয়াল কাউন্সিল রায় দেন যে ট্রান্সজেন্ডার ড্রিউ ফনিক্স তাঁর পদে বহাল থাকতে পারবেন। ওই একই বছরে মেথোডিস্টদের একটি সাধারণ বৈঠকে একাধিক হিজড়া ক্লারজির বিরুদ্ধে পিটিশন খারিজ করে দেওয়া হয়। ভারতের বিহারে ‘কালী হিজড়া’ পশ্চিম পাটনা কেন্দ্র থেকে ‘জুডিসিয়াল রিফর্মস’ পার্টির প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে পশ্চিমবাংলার টিটাগড় পৌরভোটে ১৪ নং ওয়ার্ড থেকে ‘হিজড়া’ বৈজয়ন্তীমালা মিশ্র ভোটপ্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের লোকসভায় মহারাষ্ট্রের জালনা কেন্দ্র থেকে নির্দল হিজড়া প্রার্থী রমেশ ওরফে মালা ভোটপ্রার্থী হয়েছিলেন।

উত্তর চব্বিশ পরগণার নৈহাটির কারখানা শ্রমিক বাবার মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলে হিসেবে জন্ম হয় সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে কলকাতার একটি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। পড়াশোনা শেষে পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী (ঝাড়গ্রাম) অধ্যুষিত অঞ্চলের এক কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন তিনি। এ সময়েই নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লেখালেখি ও সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পরে ২০০৩ সালে জটিল এক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজেকে নারীতে রূপান্তরিত করেন সোমনাথ, এখন তিনিই মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। ৫১ বছর বয়সি মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় এখন পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। ২০১৫ সালের ৯ জুন থেকে তিনি নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ভারতে প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) একজনকে কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা হয়েছে। এটা তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।সম্প্রতি অনেকে নিশ্চয় লক্ষ করেছেন যে, ভারত সরকারের একটি ট্র্যাফিক সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন হিজড়াদের দিয়ে করানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশে হাসিনা সরকার হিজড়াদেরকে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগানো যায় কি না ভাবছেন।

তবে দৈনিক প্রথম আলোর একটি সংখ্যায় ছাপা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হিজড়া। হিজড়াদের দেওয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে এঁদের সংখ্যা প্রায় ১,৫০,০০০। শুধু ঢাকাতেই বসবাস করে ১৫,০০০ হিজড়া। তবে বেশিরভাগই অন্য জেলা থেকে এসেছে রাজধানীতে রুজি-রোজগারের আশায়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, হিজড়াদের নিয়ে সরকারের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে সরকার অপরাপর জনগোষ্ঠীর তথ্য সংগ্রহ করেন। ২০১১ সালের আদমসুমারির রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে ২৭টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আছে। তাঁদের মোট সংখ্যা ১৫,৮৬,১৪১ এবং প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা ২০,১৬,৬১২, যা মোট জনসংখ্যার ১.৪ ভাগ। দৈনিক যুগান্তরে এ বিষয়ে রিপোর্ট করা হয়েছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে হাজারের নীচে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর হিসাব আছে, তেমনি আছে প্রতিবন্ধীদেরও আলাদা আলাদা হিসাব। তবে হিজড়াদের কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো বিভাগ সংরক্ষণ করে না। ২০০৮ সালে লিঙ্গ নির্ধারণ না করেই প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার পায়। তবে ভোটার আইডি কার্ডে লিঙ্গ-পরিচয় না-থাকায় তাঁদের বিড়ম্বনার অন্ত ছিল না। জাতীয় আদমসুমারি ২০১১ সালের মধ্যেও হিজড়াদের গণনা করা হয়নি, এমন অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের ‘বাঁধন হিজড়া সংঘ’ এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। বাংলাদেশে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আদমসুমারিতে এঁদের অধিকাংশকেই দেখানো হয় পুরুষ হিজড়া হিসাবে। ফলে এঁদের নিয়ে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কারণ এঁদেরকে টিক চিহ্ন দিতে হয় পুরুষ কিংবা নারীর ঘরে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংগঠন এই স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল।

অবশেষে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদে উত্থাপিত হিজড়াদের নারী-পুরুষের পাশাপাশি আলদা লিঙ্গ বা তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতির বিলটি পাস হয়েছে। স্বীকৃতি পরবর্তী নির্দেশ জারি করা হয় যে, সার্টিফিকেট, ভিসা, বিমা, ব্যাংক সর্বক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ণয়ে তৃতীয় লিঙ্গের অপশন রাখতে হবে এবং তাঁদের পরিচয়ে হিজড়াই লিখতে হবে, অন্য কোনো শব্দ নয়। এ স্বীকৃতি হিজড়াদের জন্যে অবশ্যই মন্দের ভালো। কিন্তু সুপারিশমালায় পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে এঁদের সংখ্যা ১০ হাজার। হিজড়াদের সংগঠন ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি সূত্রে জানা যাহ, সারা দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার দাবি, সারা দেশে ৫০ হাজার হিজড়া আছে। ডেমোগ্রাফি সূত্র অনুযায়ী শুধু ঢাকার মধ্যে হিজড়ার সংখ্যা ২৫ হাজারেরও বেশি।

হিজড়াদের মৃত্যু ও সৎকার

সাধারণ মানুষের কাছে এ এক রহস্যজনক অধ্যায়। কোনো রহস্য নেই, সবটাই উন্মোচিত। আমাদের অজ্ঞানতাই এসব জানতে পারি না। এঁদের প্রতি আমাদের চরম অবহেলা আর উদাসীনতাই রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। হিজড়াদের মৃতদেহ কেউ দেখেছে কি না এ প্রশ্ন অনেকসময় শুনতে হয়। উত্তর সবার কাছে নেই, তাই ভ্যাবাচাকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তেমন কিছু করারও নেই। বস্তুত হিজড়াদেরও মৃত্যু হয়, মৃতদেহও হয়, মৃতদেহের সৎকারও হয়। মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে হিজড়াদের শবযাত্রাও হয়। তবে তা নিঃশব্দে গভীর রাতে। শ্মশান বা গোরস্থানের কিছুটা আগে মৃতদেহকে দাঁড় করানো হয়। এরপর চতুর্দিক থেকে মৃতদেহকে ঘিরে থাকে হিজড়ারা। তারপর মৃতদেহকে কিছুক্ষণ হাঁটানো হয়। মৃতদেহকে কি হাঁটানো সম্ভব? মোট্টেও সম্ভব নয়। অগত্যা টেনে হিছড়ে নিয়ে আসা হয়। শ্মশান বা গোরস্থানে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় শুইয়ে দিয়ে মৃতদেহকে উপর্যুপরি লাথি মারা হয়। লাঠিপেটাও করা হয়। মৃতব্যক্তি যত বড়ো প্রিয় মানুষ হন না-কেন এই আচরণে অন্য হিজড়াদের একদম কাঁদা চলবে না। নিয়ম নেই। হিন্দু হলে নগ্ন করে চিতার উপর শোয়ানো হয়, মুসলমান হলে মাটি দেওয়ার আগে মৃতদেহকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে স্নান করানোর রীতি আছে। তবে পাঞ্জাবের বেশ কিছু জেলায় মৃত্যুর পর বাড়ির ছাত সরিয়ে হিজড়াদের বাইরে বের করে আনা হয়। যাতে ভোলা ছাতের মধ্য দিয়ে মৃতব্যক্তির আত্মা চিরতরে আকাশে বিলীন হয়ে যায়। মৃতব্যক্তি যদি গুরু-মা হন, তবে হিন্দুদের ক্ষেত্রে তাঁর বড় মেয়ে বা শিষ্য বা চেলা মুখাগ্নি করবে। মুসলমান হলে বড়ো মেয়ে বা শিষ্য বা চেলাই পারলৌকিক সমস্ত ক্রিয়াকর্মের সম্পাদনের মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। এরপর কোথাও দীর্ঘ এক মাস কোথাও-বা ৩৯ দিন ধরে চলে অশৌচ পর্ব। অন্য হিজড়া মহল্লার হিজড়ারও অশৌচ পালন করে, তবে সেটা চারদিনের মাত্র। হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানও, নিমন্ত্রণ রক্ষা করে হিজড়ারাই।

হিজড়া আর সমকামী কি সমার্থক?

সেই প্রশ্নটাই আবার ঘুরে ফিরে এল। হিজড়া আর সমকামী কি সমার্থক? বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আদিকাল থেকে সমকাল পর্যন্ত শিল্প-সাহিত্যেও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অভিলাষ সমকামিতার প্রতিফলন। অথচ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালতের রায়ে সহস্রাব্দ প্রাচীন সমকাম আজ ‘বিকৃত’ সমকামিতা অপরাধ। গ্রিক সভ্যতা থেকে প্রাচীন ভারত। সমকামিতার উদাহরণ যুগে যুগে। প্রাচীন নাগরিক সমাজ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা যেখানে জন্ম নিয়েছিল গ্রিসে। সেই গ্রিস, যে কখনও নাগরিকের যৌন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। সমলিঙ্গ যৌন সংসর্গের বৈধতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না সেখানে। হেরোডেটাস, প্লেটোর মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদদের লেখায় প্রায়ই পাওয়া যায় সমকামী সম্পর্কের কথা। আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিসের লেসবস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্যাফো। এই মহিলা কবির লেখার প্রতিটি পরতে পরতে নারী শরীরের বন্দনা। স্যাফোর জন্মস্থান লেসবস থেকেই তো অভিধানে জায়গা পেয়েছে লেসবিয়ান শব্দটি। পাশ্চাত্য থেকে এবার আসা যাক প্রাচ্যে। ইতিহাস বলছে, প্রাচীন পারস্যে সমকামী সম্পর্কের প্রচলন ছিল। যেমনটা ছিল, এই ভারতবর্ষেও। বহু হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্য তো সমকামেরই অভিজ্ঞান। পুরাণে বিষ্ণুর মোহিনী রূপ আর অর্ধনারীশ্বর শিব, মহাকাব্য- পুরাণের পাতায় পাতায় যেন তৃতীয় লিঙ্গের সদর্প উপস্থিতি। এমনকী, বাৎসায়নের কামসূত্রও বলছে সমকামিতা যৌন সম্পর্কেরই অন্য রূপ।

সমকামিতা বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝি পুরুষের সঙ্গে পুরুষের বা নারীর সঙ্গে নারীর যৌন সম্পর্ক। সমকামিতা কিন্তু যৌন সম্পর্কের উপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে যৌন আকর্ষণের উপরে। একটি ছেলে কোনোদিন যৌন সম্পর্ক করেনি, কিন্তু করলে সে একটি মেয়েকেই বেছে নেবে। সে মেয়েদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে বা প্রেমে পড়ে। ছেলেটি যদি ঠিক তেমন আকর্ষণ একটি ছেলের প্রতি অনুভব করে বা ছেলে হয়ে ছেলের প্রেমে পড়ে তখন সে সমকামী। যৌন সম্পর্ক হোক বা না-হোক। মোদ্দা কথা হল— সমকামিতা একটা পছন্দ, কাজ নয়। স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণ সম্পন্ন ব্যক্তিকে, অর্থাৎ একজন নারী একজন পুরুষকে অথবা একজন পুরুষ একজন নারীর প্রতি যৌন-আকর্যণ বোধ করলে, তাকে স্ট্রেইট (Straight) বলা হয়। সমকামিতা কিন্তু বিভিন্ন ধরনের ধারণা আছে। এ সংক্ষেপে শ্রেণিবিভাগগুলি আলোচনা করে নিতে পারি বোঝার জন্য। এই শ্রেণিবিভাগ করে হয়েছে একজন নিজেকে কী মনে করে ও কী পছন্দ করে তার উপর ভিত্তি করে।

(১) গে (Gay) : একজন পুরুষ নিজেকে পুরুষ মনে করে। পুরুষের পোশাক পরে এবং একজন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এই ধরনের দুইজন পুরুষ বিয়ে করলে এদের মধ্যে স্বামীকে ‘টপ’ এবং স্ত্রীকে ‘বটম’ বলে।

(২) লেসবিয়ান (Lesbian) : একজন মেয়ে নিজেকে মেয়ে মনে করে। মেয়েদের পোশাক পরে এবং একজন মেয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এই ধরনের দুইজন মেয়ে বিয়ে করলে এরা পুরুষালি পোশাকে ও আচরণে একজন স্বামীর ভুমিকা পালন করে।

(৩) ট্র্যানিঃ একজন পুরুষ সে নিজেকে মেয়ে মনে করে। অপরদিকে একজন মেয়ে, সে নিজেকে পুরুষ মনে করে। সে মনে করে সে ভুল দেহে জন্মেছে। এঁরা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পড়ে। অনেকে হরমোন প্রয়োগ ও অস্ত্রপচার করে শরীরের পরিবর্তন করে বিপরীত লিঙ্গের হওয়ার চেষ্টা করে। মোদ্দা কথা এদের শরীর এক লিঙ্গের, কিন্তু মন আর-এক লিঙ্গের। যে-কোনো লিঙ্গের প্রতি এঁদের আকর্ষণ থাকতে পারে। তবে বেশির ভাগ হিজরা এই “ট্রানি’ ক্যাটাগরিতে পড়ে।

 (৪) বাই (Bisexuality) : একটি ছেলে বা একটি মেয়ে, সে অপর কোনো ছেলে বা মেয়ে উভয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। একটি ছেলে যে মেয়েদের প্রেমেও পড়ে আবার ছেলেদের প্রেমেও পড়ে, যৌনকর্ম করতে সমর্থ। সানি লিওনও এজন বাইসেক্সচুয়াল পর্নস্টার।

সমকামিতা (Homosexuality) একটি যৌন অভিমুখিতা, যার দ্বারা সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ বোঝার। এইরূপ আকর্ষণের কারণে এক লিঙ্গের মানুষের মধ্যে যৌন-সম্পর্ক ঘটতে পারে। প্রবৃত্তি হিসাবে সমকামিতা বলতে বোঝায় মূলত সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি স্নেহ বা প্রণয়ঘটিত এক ধরনের যৌন প্রবণতা। এই ধরনের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত বা সামাজিক পরিচিতি, এই ধরনের আচরণ এবং সমজাতীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কোনো সম্প্রদায়কেও এই শব্দটি দ্বারা নির্দেশ করা হয়।

উভকামিতা ও বিপরীতকামিতার সাথে সমকামিতা বিপরীতকামী-সমকামী অনবচ্ছেদের অন্তর্গত যৌন অভিমুখিতার তিনটি প্রধান ভাগের অন্যতম বলে স্বীকৃত। ব্যক্তির মনে কেমন করে কোনো নির্দিষ্ট যৌন অভিমুখিতার সঞ্চার হয় সেই ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ নেই। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন জিনগত, হরমোনগত এবং পরিবেশগত কারণ একত্রে যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণের জন্য দায়ী। জীববিদ্যানির্ভর কারণগুলিকে বেশি সমর্থন করা হয়। এর অন্তর্গত হল জিন, জ্বণের ক্রমপরিণতি, এই দুই প্রভাবের মেলবন্ধন অথবা এই সব কিছুর সঙ্গে সামাজিক প্রভাবের মেলবন্ধন। যৌন-অভিমুখিতা নির্ধারণে যে সন্তানপালন বা শৈশবের অভিজ্ঞতার কোনো ভূমিকা আছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আচরণের প্রভাবক হিসাবে এক পরিবেশে থাকার ভূমিকা মহিলাদের ক্ষেত্রে নগণ্য এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে শূন্য। কেউ কেউ সমকামী যৌনাচরণকে অপ্রাকৃতিক মনে করলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা গেছে সমকামিতা মানব যৌনতার একটি সাধারণ ও প্রাকৃতিক প্রকার মাত্র এবং অন্য কোনো প্রভাবকের অস্তিত্ব ছাড়া এটি মনের উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতায় যৌনতার ব্যাপারে সচেতন পছন্দের কোনো ভূমিকা থাকে না। যৌন অভিমুখিতা পরিবর্তনের বিভিন্ন কর্মসূচির কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ নেই।

একজন সন্তান সে নারী হবে না পুরুষ হবে, সে মুখ্য ভূমিকা পালন করে হরমোন। শরীরের ভিতর সব কারসাজি করে টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন হরমোন। অর্থাৎ মানুষের নারী হওয়ার জন্য দায়ী ইস্ট্রোজেন হরমোন এবং পুরুষ হওয়ার জন্য দায়ী টেস্টোস্টেরন হরমোন। এবার একটু দেখে নিই এই হরমোন কীভাবে কাজ করে বা প্রতারণা করে।

টেস্টোস্টেরন : টেস্টোস্টেরন পুরুষত্বের জন্য দায়ী প্রধান স্টেরয়েড হরমোন যা এন্ড্রোজেন গ্রুপের। মানুষ সহ সকল স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ প্রাণীর শুক্রাশয়ে এটি উৎপন্ন হয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে পুরুষের শুক্রাশয় এবং নারীর ডিম্বাশয় থেকে উৎপন্ন হয়, যদিও স্বল্প পরিমাণ অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয়। এটি প্রধান পুরুষ হরমোন, যা শুক্রাশয়ের লিডিগ কোশ (Leydig Cell) থেকে উৎপন্ন হয়। পুরুষের জন্য টেস্টোস্টেরন প্রজনন অঙ্গ যেমন শুক্রাশয় (Testis) বর্ধনের পাশাপাশি গৌণ বৈশিষ্ট্য যেমন মাংসপেশি, শরীরের লোম বৃদ্ধি করে। পুরুষদের মাঝে টেস্টোস্টেরন বিপাক হার নারীদের তুলনায় ২০ গুণ বেশি। সাধারণত এন্ড্রোজেন প্রোটিন সংশ্লেষণ করে এবং এন্ড্রোজেন রিসেপ্টর সংবলিত টিস্যুর বৃদ্ধি সাধন করে। টেস্টোস্টেরনের প্রভাবকে লৈঙ্গিক (virilizing) এবং অ্যানাবলিক (Anabolic) এই দু-ভাগে ভাগ করা যায়।

মাংসপেশি বৃদ্ধি, হাড়ের ঘনত্ব (density) বৃদ্ধি, হাড়ের পূর্ণতা প্রাপ্তিতে উদ্দীপনা করা এসব অ্যানাবলিক কাজ। যৌন অঙ্গের পূর্ণতা প্রদান করা, বিশেষ করে ফিটাসের শিশ্ন এবং শুক্রথলি তৈরি এবং জন্মের পরে (বয়ঃসন্ধিকালে) কণ্ঠস্বর গাঢ় হওয়া, দাড়ি এবং বগলের চুল বৃদ্ধি এসব এন্ড্রোজেনিক কাজ। এসবের অনেক কিছুই পুরুষের সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্য। শৈশবের পরে এন্ড্রোজেন লেভেল বৃদ্ধির লক্ষণীয় প্রভাব দেখা যায় ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই। যেমন– বয়স্ক-টাইপ শরীরের গন্ধ, বগল ও শ্রোণীদেশে চুল গজায়, উচ্চতায় বৃদ্ধি, গোঁফ ও দাড়ি গজানো, পুরুষালী কণ্ঠস্বর হয়।

প্রাপ্তবয়স্ক নারীর এন্ড্রোজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হলে বয়ঃসন্ধিকালীন প্রভাব দেখা যায়। ছেলেদের এই প্রভাব সচরাচর একটু দেরিতে হয়, কিন্তু মেয়েদের রক্তে মুক্ত টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ অনেক দিন থেকে বেশি মাত্রায় থাকলে এমনটি দেখা যায়। সিবেসিয়াস গ্রন্থি বেড়ে যাওয়া। এটি ব্রণের কারণ হতে পারে। ভগাংকুর (Clitoris) বর্ধিত হওয়া। শ্রোণীদেশের চুল নিচে উরু এবং উপরে নাভী পর্যন্ত বিস্তৃত। মুখমণ্ডলে চুল (জুল্পি, গোঁফ, দাঁড়ি)। মাথার চুল কমে যাওয়া, বুকে, বৃন্তের চারপাশে, নিতম্বের চারপাশে লোম, পায়ে পশম বা লোম, বগলে চুল, মুখের উপরস্থ ফ্যাট কমে যাওয়া, পেশি বৃদ্ধি, গাঢ় কণ্ঠস্বর, পুরুষের উর্বরতা বৃদ্ধি, কাঁধ প্রসারিত, বুকের পাঁজর ফুলে যাওয়া, হাড়ের পূর্ণতা প্রাপ্তি এবং বৃদ্ধি রোহিত হওয়া।

টেস্টোস্টেরনের প্রভাব বয়স্ক নারীর তুলনায় বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে আরও পরিষ্কারভাবে প্রমাণযোগ্য, কিন্তু উভয়ের জন্যই দরকারি। টেস্টোস্টেরনের মাত্রা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের পরে হ্রাস পাওয়ায় এইসবের কিছু প্রভাব প্রত্যাখ্যান করা হতে পারে। স্বাভাবিক শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য টেস্টোস্টেরন ভুমিকা রাখে। এটি সারটলি কোশ জিনকে সক্রিয় করে। শারীরিক শক্তি নিয়ন্ত্রক। পেশি গঠন করে। টেস্টোস্টেরন মেগাক্যারিওসাইট ও অণুচক্রিকার থ্রম্বোক্সেন A2 রিসেপ্টরের উপর কাজ করে অণুচক্রিকা একত্রীকরণে ভূমিকা রাখে। টেস্টোস্টেরনের অধিক মাত্রা একই ব্যক্তির যৌন ক্রিয়ার সময়সীমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কম যৌন সক্রিয় ব্যক্তিদের জন্য বেশি। একাধিক ব্যক্তিদের সঙ্গে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত ব্যক্তি পরের দিন সকালে টেস্টোস্টেরনের অধিক মাত্রা অনুভব করে থাকেন।

যেসব পুরুষ যৌনতাপূর্ণ সিনেমা ( যেমন– পর্নোগ্রাফি ) দেখেন, তাঁদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা গড়ে ৩৫ শতাংশ বেড়ে যায়, ফিল্ম শেষ হওয়ার পর ৬০-৯০ মিনিটে চূড়ান্তে ওঠে, কিন্তু কোনো বৃদ্ধি যৌন নিরপেক্ষ ছবি দেখার পর হয় না। এছাড়াও যেসব পুরুষ যৌনতাপূর্ণ সিনেমা দেখেন, তাঁদের মানসিক অবসাদ কমে বলে জানা গেছে। আগের গবেষণা যৌন উদ্দীপনা এবং টেস্টোস্টেরনের মাত্রার মাঝে সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে। ২০০২ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায়, একজন মহিলার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের পরে পুরুষের মধ্যে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়ে। পুরুষেরা নারীদের মুগ্ধ (Impress) করার চেষ্টা করেছিল। নারীদের দেহের হরমোন চক্রের উপর পুরুষের টেস্টোস্টেরন মাত্রা এবং যৌন উদ্দীপনা বহুলাংশে জ্ঞাত।

ইস্ট্রোজেন : ইস্ট্রোজেন হল প্রাথমিক নারী লৈঙ্গিক হরমোন (primary female sex hormone)। ইস্ট্রোজেনকে বলা হয় নারী হরমোন’। নারী ও পুরুষ উভয়ের শরীরেই এই হরমোন থাকলেও নারীদের প্রজনন বয়সে এটি উচ্চমাত্রায় থাকে। নারী শরীরের সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্য বিকাশে সাহায্য করে ইস্ট্রোজেন হরমোন। নারীর বাহুমূলের পশম, স্তনের আকার বা গঠন এবং ঋতুস্রাবের মতো শারীরিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি এটি প্রজননতন্ত্র গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও ইস্ট্রোজেন পুরুষ এবং নারী উভয়ের মাঝেই থাকে, কিন্তু সচরাচর নারীদের প্রজনন বয়সে এর মাত্রা উচ্চ থাকে। এটি নারীদের সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্য যেমন স্তন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং একই সঙ্গে মাসিক চক্রের সময় এন্ডোমেট্রিয়ামের পুরুত্ব বেড়ে যায়। শুক্রাণুর পূর্ণতা প্রাপ্তিতে ইস্ট্রোজেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর পাশাপাশি ইস্ট্রোজেনের আরও কিছু কাজ আছে। যেমন— নারীদের সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্য উন্নীত করে, বিপাক হার বাড়ায়, ফ্যাট বাড়ায়, এন্ডোমেট্রিয়ামের পুরুত্ব বৃদ্ধি করে, জরায়ুর আকার বৃদ্ধি করে, যোনি পিচ্ছিল করে, জরায়ুর প্রাচীরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করে।

সাধারণত একজন মানুষ শিশুর পুরুষালি ও নারীত্ব প্রকাশ পায় না একজন শিশু ধীরে ধীরে বড়ো হয়। কেউ পুরুষ হয়ে ওঠে, কেউ নারী হয়ে ওঠে। বয়ঃসন্ধিতে পূর্ণ বিকাশ হয়। ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে একজন শিশু পুরুষ বা নারী হয়ে জন্মালেও কারোর কারোর ক্ষেত্রে হরমোনের কারসাজিতে পুরুষ শরীরে নারীত্ব প্রকট হয় এবং নারীর শরীরে পুরুষালি প্রকট হয় প্রাকৃতিকভাবেই। এঁরাই হিজড়া বা সমকামী বলে পরিচিত হয়। তৃতীয় লিঙ্গ বা থার্ড জেন্ডার হিসাবে বেঁচে থাকে বাকি জীবন। এঁরা সন্তানের জন্ম দিতে পারে না।

সমকামীদের আইনি নিরাপত্তা ও স্বীকৃতি

নানা কারণে স্বঘোষিত সমকামীর সংখ্যা এবং মোট জনসংখ্যার মধ্যে সমলৈঙ্গিক সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষের অনুপাত নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এই কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হল সমকামভীতিজনিত বৈষম্যের কারণে অনেক সমকামী প্রকাশ্যে তাঁদের যৌনতা স্বীকার না করা। অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও সমকামী আচরণের নিদর্শন নথিভুক্ত হয়েছে। অনেক সমকামী মানুষ স্থায়ী পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ আছেন, যদিও আদমশুমারির ফর্ম, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদির আনুকূল্যে তাঁদের আত্মপ্রকাশের পথ নিরাপদ হয়েছে একেবারে সাম্প্রতিক কালে। মূল মনস্তাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে এই সম্পর্কগুলি বিপরীতকামী সম্পর্কের সমান। নথিভুক্ত ইতিহাস জুড়ে সমকামী সম্পর্ক এবং কার্যকলাপের প্রশস্তি ও নিন্দা— উভয়েরই নিদর্শন মেলে, কেবল প্রকাশের ভঙ্গিমা ও সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিজনিত তারতম্য দেখা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার অন্তর্গত বিবাহ, দত্তক গ্রহণ ও সন্তানপালন, কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার, সামরিক পরিসেবা, স্বাস্থ্য পরিষেবায় সমানাধিকার এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সমকামীদের নিরাপত্তার স্বার্থে অ্যান্টি-বুলিং আইন। বর্তমানে হোমোসেক্সয়াল শব্দটি বিদ্বৎসমাজে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হলেও ‘গে’ এবং লেসবিয়ান’ শব্দদুটি অধিক জনপ্রিয়। গে’ শব্দটির দ্বারা পুরুষ সমকামীদের বোঝানো হয় এবং নারী সমকামীদেরকে বোঝানো হয় লেসবিয়ান’ শব্দটির দ্বারা। পশ্চিমে ‘গে’ শব্দটি সমকামী অর্থে প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় সম্ভবত ১৯২০ সালে। তবে সে সময় এটির ব্যবহার একেবারেই সমকামীদের নিজস্ব গোত্রভুক্ত ছিল। মুদ্রিত প্রকাশনায় শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ১৯৪৭ সালে। লিসা বেন নামে এক হলিউড সেক্রেটারি “Vice Versa: America’s Gayest Magazine” নামের একটি পত্রিকা প্রকাশের সময় সমকামিতার প্রতিশব্দ হিসেবে ‘গে’ শব্দটি ব্যবহার করেন।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সমকামী দেশ হল অস্ট্রেলিয়া। এদেশে সমকামীদের অধিকার রক্ষায় কড়া আইন আছে। এখানকার সমকামীদের কেউ কটুক্তি করলে সোজা শ্রীঘর। ইউরোপ-আমেরিকাতে সমকামিতা থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার মতো এতটা অধিকার তারা পায় না। সমগ্র পৃথিবীতে থেকে অনেক সমকামী প্রতি বছর স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় আসে। নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্যও সমকামীরা বিশেষ অগ্রাধিকার পায় এদেশে। প্রতি বছর মার্চ মাসে অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানে সমকামী অর্ধনগ্ন রেলি হয় রাস্তায়। আইনের ভয়ে সমকামিতাকে খারাপ বলার সাহস হয় না কারোর। এখানকার মা-বাবা প্রার্থনা করে যেন তাঁর সন্তান সমকামী না-হয়। অবশ্য সব দেশের বাবা-মায়েরা চান না তাঁর সমকামী বা হিজড়া সন্তান জন্ম নিক। যাই হোক, সমকামী হয়ে গেলে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এদেশের আইন তাঁদের দেয়নি। অলিম্পিকের আয়োজক দেশ যেভাবে প্রচুর টাকা আয় করে, ঠিক তেমনি অস্ট্রেলিয়া প্রতি বছর প্রায় একই পরিমাণ টাকা সমকামিতাদের সমর্থন করে আয় করে। সমকামী বার, সমকামী ক্লাব, সমকামী রেলি, প্রতি বছর কয়েক হাজার ধনী সমকামী স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য তাঁদের নিজেদের দেশের সমস্ত সম্পদ নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে চলে আসে। সমকামিতা এই দেশের সরকারের বড়ো এক আয়ের উৎস। অনেকে মনে করেন যে কয়টি দেশে সমকামিতা বৈধ, সব দেশেই ব্যাবসার জন্য সমকামিতা বৈধ করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে দামি গাড়ি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমকামীদের কাছেই দেখা যায়। উন্নত বিশ্বে ধনী লোকেরা সমকামী হওয়াতে মিডিয়া, বুদ্ধিজীবি, চিকিৎসক, বিখ্যাত ব্যক্তি এমনকি সরকারও তাঁদেরকে মানসিক রোগী’ বা ‘ফ্যান্টাসি বাতিক’ বলতে পারছে না। বরং তাঁদের এই সমকামিতাকে সমর্থন করলে বিরাট ব্যাবসায়িক লাভ আছে।

অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, ভোগবাদে সমকামিতা একটি পণ্য, অপরদিকে পশুপাখির আচরণের ধারাবাহিকতায় বিরাজমান একটি শখ! ১৩০টির মতো পাখির মধ্যে (এর মধ্যে লেইসান আলবাট্রসের ৩১ শতাংশের মধ্যে মেয়ে-মেয়ে ও গ্রেলাগ গিজের ২০ শতাংশের মধ্যে ছেলে-ছেলে) সমকামিতার প্রধান কারণ প্যারেন্টিংয়ের চাহিদা কম থাকা। পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধহীনতা বা এককথায় অসামাজিকতা সমকামিতাকে শখে পরিণত করে। যুক্তরাজ্যের এক্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভলুশনারি জেনেটিসিস্ট অ্যালান মর মানুষের সমকামিতাকেও সেভাবেই দেখেছেন। ইস্টার্ন সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে প্রকাশিত ‘Federal distortion of the homosexual footprint’-এ ড: পল ক্যামেরুন দেখিয়েছেন পুরুষ ও মেয়ের বিবাহ-সম্পর্ক আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দেয়, যেখানে সমকামীদের ক্ষেত্রে আয়ুষ্কাল ২৪ বছর কম। পল ক্যামেরুন ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল, কানাডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন জার্নাল, পোস্ট-গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল জার্নালের সম্পাদনা করে থাকেন। তাঁর নিজের ৪০টির মতো আর্টিকেল আছে সমকামিতার উপর। ১৯৯০ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ডেনমাকর্কে স্বাভাবিক যৌনাচারীর গড় আয়ু যেখানে পাওয়া গেছে ৭৪, সেখানে ৫৬১ গে পার্টনার এর গড় আয়ু পাওয়া যায় ৫১! সমকামী মহিলাদের ক্ষেত্রেও এই গড় আয়ুর হার কম, আনুমানিক ২০ বছরের কম! অপরদিকে ধুমপায়ীদের ক্ষেত্রে এই আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ার হার মাত্র ১ থেকে ৭ বছর!

১৯৭৩ সালের আগে পর্যন্ত একে ‘মানসিক অসুস্থতা’ হিসাবেই দেখা হত। পরে অবশ্য ১৯৭৩ সালে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সমকামিতাকে মানসিক অসুস্থতা থেকে অব্যহতি দেয়। অনেকে মনে করেন সমকামিতা একটি অত্যাধিক ভোগবাদিতার উপকরণ। তা ছাড়া পরিস্থিতিও এর বিকাশ ও পরিপুষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী। স্বাভাবিক যৌনসম্ভোগের উপায় না-থাকলে সমকামিতা হয়ে উঠে অপরিহার্য যৌনাচার। সেজন্যই সৈনিকদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ করার মতো। ULCA-এর আইন স্কুলের উইলিয়াম ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ ফলাফলে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে আনুমানিক ৬৬,০০০ সমকামী ও উভকামী আছে। ২০০৯ সালের গ্যালপ জরিপেও জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ৬৯ শতাংশ মানুষ সমকামীদের সেনাবাহিনীতে কাজ করাকে সমর্থন করে। ইংল্যান্ডের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী রবিন ডানবার মনে করেন, যুদ্ধ ও শিকারে সমকামিতা পুরুষ গোত্রকে সংগঠিত রাখতে সাহায্য করে। প্রাচীন গ্রিসে স্পার্টানদের এলিট সৈন্যদের মধ্যে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হত। গ্রিক স্পার্টান ছাড়াও অন্য থেবেস, এথেন্সেও সমকামিতার উদাহরণ পাওয়া যায়।

সেক্স বিষয়টি পুরোপুরি শরীরের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু জেন্ডার নির্ভরশীল সমাজের উপর। যেহেতু নারী বা পুরুষের দায়িত্ব, কাজ ও আচরণ মোটামুটি সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত হয়, তাই সমাজ পরিবর্তন বা সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জেন্ডার ধারণা বদলে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, আমরা যখন কারোকে ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ হিসাবে চিহ্নিত করি তখন সেখানে জৈবলিঙ্গ নির্দেশ করাটাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মেয়েলি’ বা ‘পুরুষালি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে জেন্ডার প্রপঞ্চকে যুক্ত করা হয় যেখানে, সেখানে নারী বা পুরুষের লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে স্বভাব-আচরণগত ইত্যাদি বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। আর এই কারণেই সেক্সকে জৈবলিঙ্গ এবং জেন্ডারকে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক লিঙ্গ বলে অনেকে অভিহিত করেন।

বিপরীতকামী-সমকামী অনবচ্ছেদ অনুসারে যৌন অভিমুখিতার প্রধান তিনটি বর্গের অন্যতম হল সমকামিতা (অপর বর্গদুটি হল উভকামিতা ও বিপরীতকামিতা)। বিভিন্ন কারণে গবেষকেরা সমকামী রূপে চিহ্নিত ব্যক্তির সংখ্যা বা সমলৈঙ্গিক যৌন সম্পর্কে অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের অনুপাত নির্ধারণ করতে সক্ষম হননি। আধুনিক পাশ্চাত্য জগতে বিভিন্ন প্রধান গবেষণার ফলে অনুমিত হয় সমকামী বা সমলৈঙ্গিক প্রণয় ও রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ। ২০০৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, জনসংখ্যার ২০ শতাংশ নাম প্রকাশ না-করে নিজেদের মধ্যে সমকামী অনুভূতির কথা স্বীকার করেছেন। যদিও এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে খুব অল্পজনই নিজেদের সরাসরি সমকামীরূপে চিহ্নিত করেন।

পথেঘাটে বা গণিকাপল্লিতে বা বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর পুরুষ যৌনকর্মীদের দেখা মেলে। এই পুরুষ যৌনকর্মীরা বেশিরভাগই হয় রূপান্তকামী, না-হয় সমকামী। এঁদের মানসিকতা কিন্তু আলাদা। যৌন-অনুভূতিও আলাদা। পুরুষের খোলস ছেড়ে যাঁদের পরিপূর্ণ নারীতে রূপান্তরিত হওয়ার বাসনা জাগে, তাঁরাই রূপান্তরকামী বা যৌন পরিবর্তনকামী ( Transsexual)। নারীরাও এই ধরনের মানসিকতার হতে পারে। অর্থাৎ নারীর খোলস ছেড়ে পরিপূর্ণ পুরুষে রূপান্তরিত হওয়ার বাসনা জাগে। এঁরা লিঙ্গ ছেদন করতে চায় না। রূপান্তরকামীদের পাশাপাশি আছে সমকামিতা বা Homosexuality। এই দুই মানসিকতার মধ্যে মিল যেমন আছে, তেমনি অমিলও প্রচুর। সব রূপান্তরকামীই সমকামী, কিন্তু সব সমকামীরাই রূপান্তরকামী নয়। সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও সমকামীরা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করে না। সমকামী সম্পর্কে আবদ্ধ দুই সম ব্যক্তি একজন পুরুষের মতো সক্রিয় (Active), অপরজন নারীদের মতো নিষ্ক্রিয় (Passive) ভূমিকা পালন করে, যৌনমিলনের ক্ষেত্রে। যদিও বিষমকামীদের ক্ষেত্রে নারীরা কখনো-সখনো যৌনমিলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে, তা সত্ত্বেও সমকামীদের যৌন-ভূমিকাটা বোঝানোর জন্য সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় প্রসঙ্গটা উঠে এসেছে। রূপান্তকামিতা এবং সমকামিতা– এই দুই ধরনের মানসিকতা যে শুধুমাত্র শৈশব ও কৈশোরেই দেখা দেবে এমন নয়, পরিণত বয়সেও ধীরে ধীরে সমকামী মানসিকতার জন্ম নিতে পারে।

পর্ন ছবিতে রূপান্তরকামীদের প্রচুর পরিমাণে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। এঁদের যেমন সতেজ এবং প্রমাণ মাপের লিঙ্গ আছে, তেমনি স্বাভাবিক নারীদের চাইতে বেশি সুডৌল-নিটোল স্তনও থাকে। এঁরা টু ইন ওয়ান। অর্থাৎ এঁরা কখনো পুরুষের ভূমিকা নিয়ে পুরুষের পায়ুপথে লিঙ্গ প্রবেশ ঘটায়, কখনোবা নারী হয়ে অন্য পুরুষের লিঙ্গ পায়ুপথে গ্রহণ করে। পর্ন ছবিতে এইসব ‘Shemale’ বা ‘Ladyboy’-দের দাপট লক্ষ করার মতো।

হিজড়াদের মধ্যে যাঁরা যৌনকর্মী তাঁদের ‘ধুরানি’ বলা হয়। হিজড়া সমাজে ‘ধুরানি’ বলতে ‘নারী যৌনকর্মীকেই বোঝায়। যাই হোক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা অনুসারে ধুরানিদের চারভাগে ভাগ করা হয়। যেমন—

 (১) খানদান ধুরানি (অত্যন্ত ধনী পরিবারের রূপান্তরকামীও সমকামী পুরুষরা খানদান ধুরানি হয়ে আছে। পুরুষের সান্নিধ্য ও যৌনসুখের আকর্ষণেই এঁরা এই পথে আসে)।

 (২) লহরি ধুরানি (এরা সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই আসে। এরা যৌন পরিবর্তনকামী পুরুষ। পুরুষ সঙ্গলাভের আশায় এরাও এই পেশা গ্রহণ করেছে।)।

 (৩) আদত ধুরানি (আদত ধুরানি হল সমকামী পুরুষ যৌনকর্মীদের একেবারে তলানি। খোলা আকাশের নীচে পলিথিন বিছিয়ে এঁরা খরিদ্দারদের তৃপ্ত করে।)।

(৪) আকুয়া ধুরানি ( স্বেচ্ছায় পুরুষাঙ্গ কর্তন করে হিজড়া সেজেছে এঁরা। এঁরা যৌন পরিবর্তনকামী।)। এঁরা সকলেই সমকাম করে। আসলে হিজড়া দলের একটা বড়ো অংশই হল হয় রূপান্তরকামী, নয় সমকামী। এঁরা পায়ুকামের (Anal Sex) মাধ্যমেই যৌনক্রিয়া করে। তবে পায়ুমৈথুন ছাড়াও মুখমেহন (Oral Sex) এবং সঙ্গীর উরুদ্বয়ে লিঙ্গস্থাপন (Irtra Crusal Sex) করেও যৌনসঙ্গম করে।

ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারায় পায়ুধর্ষণের (Anal Rape) কোনো কথা উল্লেখ নেই। কিন্তু ৩৭৭ ধারায় পায়ুকামের কথা উল্লেখ আছে। পায়ুকামকে ৩৭৭ ধারায় প্রকৃতি-বিরুদ্ধ যৌন-আচরণ (Carnal intercourse against the order of nature) হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। পায়ুকাম এবং পায়ুধর্ষণের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা টানা হয়নি। আইনে বলা হয়েছে –“In this crime question of consent has no value. Both the active and passive agents will be punished even when the act has been done with the consent of the passive agent”U. B. Mukherjee). এখানেই শেষ নয়, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার আরও একটি বিষয় হল ‘মুখমৈথুন’ (Oral Sex), এটি আইনত দণ্ডনীয়। এক্ষেত্রে সমকাম ও বিষমকাম হিসাবে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ আইনে দেওয়া হয়নি। অথচ ভাবুন তো, বর্তমান যুগে মানুষের যৌনজীবনে মুখমৈথুন করে না এমন ‘কাপল’ খুঁজে পাওয়া অতি দুর্লভ ব্যাপার। বর্তমান কেন বলছি, প্রাচীন যুগে খাজুরাহো মন্দিরে লক্ষ করুন, সেখানে মুখমৈথুনের মুর্তি দেখা মিলবে। সঙ্গী পুরুষই হোক বা নারীই হোক, শিশ্ন বা লিঙ্গ যদি তাঁর মুখে স্থাপন করা হয়, তবে তা পায়ুকামের সমান। অপরাধ বলে গণ্য করা হয় ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে। এই বিশেষ যৌনক্রিয়াকে ফেলাসিয়ো (Fellatio) বলে। আইনে ফেলাসিয়ো অপরাধ হলেও যোনিতে মুখস্থাপন বিষয়ে অবশ্য আইন একেবারে চুপ। বাৎসায়নের ‘কামশাস্ত্রম্’-এও মুখমৈথুনের উল্লেখ আছে। তাহলে কোন্ যুক্তিতে মুখমৈথুন এবং মুখমেহন দণ্ডনীয় অপরাধ হবে বোধগম্য হয় না। তবে অনিচ্ছুককে দিয়ে মুখমৈথুন করানোটা নিশ্চয় অপরাধ হওয়া উচিত।

১১ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের এক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতাকে অপরাধ বলেই গণ্য করতে বলে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানান, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী সমকামিতা দণ্ডনীয় অপরাধ। যতক্ষণ না সংসদ আইন করে এই ধারা লোপ করছে ততক্ষণ সমকামিতা আইনত অপরাধই থাকছে। এর আগে ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। ওই রায়ে বলা হয়েছিল, ভারতীয় দণ্ডবিধির এই ধারাটি বৈষম্যমূলক এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়ের সুবাদেই সমকামী এবং রূপান্তরকামীরা তাঁদের অধিকার অর্জনের পথে এগিয়েছিলেন বলে দাবি করতেন। সুপ্রিম কোর্টের এই বক্তব্য সেই এলজিবিটি আন্দোলনকারীদের পক্ষে বড়ো ধাক্কা। শীর্ষ আদালতের বেঞ্চের বক্তব্য– “৩৭৭ ধারা বাতিল নয়। ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী সমকামিতা দণ্ডনীয় অপরাধ, সাজা হতে পারে যাবজ্জীবন পর্যন্ত।”

কী আছে ৩৭৭ নম্বর ধারায়? একটু দেখে নেওয়া যাক– “Unnatural offences– whoever voluntarily has carnal intercourse against the order of nature with any man, women or animal, shall be punished with imprisonment for life, or with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine. Explanation– Penetration is sufficient to constitute the carnal intercourse necessary to the offence described in this section.”

প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোনো পুরুষ, নারী বা জন্তুর সঙ্গে, প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা যে-কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে— যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে— দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। এই ধারায় অস্বাভাবিক অপরাধের শাস্তির বিধান করা হয়েছে এবং তা অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধভাবে হতে হবে। যদিও প্রাকৃতিক নিয়ম বিরুদ্ধ যৌন সহবাসের সর্বজনীন স্বীকৃত সংজ্ঞা এখনও নির্ণীত হয়নি।

বর্তমানে বহু সমকামী সেক্সচেঞ্জ করে বিয়ে করে ঘর-সংসার করছে। আসুন, দেখে নিই দেশে দেশে সমকামী ও সমকামীদের আইনি অবস্থান :

 নেদারল্যান্ডস : ২০০১ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে নেদারল্যান্ডস্ সমকামী বিয়ে বৈধ ঘোষণা করে।

ইংল্যান্ড : ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সমকামী বিয়ে বৈধ করে আইন পাস হয়।

 ফ্রান্স : ২০১৩ সালের মে মাসে সমকামী বিয়ের বৈধতা দেওয়া হয়।

 লুক্সেমবার্গ : ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেওয়া হয়।

আয়ারল্যান্ড : বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে আয়ারল্যান্ড ২০১৫ সালের মে মাসে গণভোটের মাধ্যমে সমকামী বিয়েকে বৈধ করা হয়।

 ইউরোপের অন্যান্য দেশ : ২০০৩ সালে বেলজিয়াম, ২০০৫ সালে স্পেন, ২০০৯ সালে নরওয়ে ও সুইডেন, ২০১০ সালে পোর্তুগাল ও আইসল্যান্ড, ২০১২ সালে ডেনমার্ক, ২০১৪ সালে ফিনল্যান্ড এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রিসে সমকামী বিয়ের বৈধতা দেওয়া হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকা : আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৬ সালে থেকে সমকামী বিয়ে বৈধ।

আর্জেন্টিনা : লাতিন আমেরিকার প্রথম দেশ হিসাবে ২০১০ সাল থেকে সমকামী বিয়ে বৈধ।

ব্রাজিল : ২০১০ সাল থেকে সমকামী বিয়ে বৈধ।

যুক্তরাষ্ট্র : ২০১৫ সালের জুন মাসে গোটা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে সমকামী বিয়ে বৈধ ঘোষণা করে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।

নিউজিল্যান্ড : এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের একমাত্র দেশ নিউজিল্যান্ডে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে সমকামী বিয়ে বৈধ করা হয়।

এছাড়া মেক্সিকো (২০০৯), উরুগুয়ে (২০১৩), স্কটল্যান্ড (২০১৪), গ্রিনল্যান্ড (২০১৫), কলম্বিয়া (২০১৬), অস্ট্রেলিয়া (২০১৭), মালটা (২০১৭), অস্ট্রিয়া (২০১৭), এবং জার্মানে (২০১৭) সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়।

পরিশেষে বলব– সাধারণ মানুষের কাছে এরা প্রান্তিক, এরা হিজড়া অথবা সমকামী। তাই এদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাজনিত উৎকণ্ঠা ও উদবেগ খুব সাধারণভাবেই লক্ষ করা যায়। দ্বৈতসত্ত্বার টানাপোড়েনে খোজারা জর্জরিত। এঁদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা যেমন প্রকট, তেমনি হীনমন্যতা কুরে কুরে খায়। বেশিরভাগ খোজাই যেহেতু পরিস্থিতির চাপে লিঙ্গ কর্তন করে হিজড়া সম্প্রদায়ের বাসিন্দা হয়, তাই তাঁরা এ জীবন সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। উৎকণ্ঠা চেপে ধরে ক্রমাগত, প্রতি মুহূর্ত। হিজড়ারা মূলত সমকামী –একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সুস্থ যৌনজীবনে এঁরা অক্ষম বলেই সমকামী মানসিকতার শিকার। সেই কারণেই তথাকথিত পরিশীলিত সমাজের মানুষেরা এদের নারীর বিকল্প হিসাবে ভাবে। এই উপেক্ষিত হিজড়ারা মূলস্রোতের মানুষদের কাছ থেকে স্নেহ-ভালোবাসা-সম্মান পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। বিনিময়ে মূলস্রোতের মানুষেরা এদেরকে কৌতুকের বস্তু মনে করে, হিজড়া আর জোকার যেন সমার্থক। তার উপর এঁদের সম্বন্ধে বিপুল অজ্ঞতার কারণে দূরত্ব বেড়েই চলেছে। আর এই অজ্ঞতার ফলেই এদের নিয়ে চটুল রসিকতা। ছেলেছোকারা এঁদের দেখলেই “এই আমারটা একটু চুষে দিবি?” বলে লেগপুলিং করে। এদেরকে মানবিক আন্তরিকতা ও সহানুভূতির সঙ্গে দেখার কথা কেউ ভাবতে পারে না। নানা রকমের কটুক্তি, কু-ইঙ্গিতের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষ এদের উত্যক্ত করে, উত্তেজিত করে। সমাজের অনেকেই হিজড়াদের ‘অশুভ শক্তি ভাবে। আবার কেউ কেউ অশুভ বা অপয়া তো নয়ই, উলটে শুভ বা পয়া ভাবে। কারোর কারোর মধ্যে হিজড়াদের শ্রদ্ধা করার রেওয়াজও আছে।

সারা পৃথিবীতে (বিশেষ করে ভারতে) উভলিঙ্গ মানবদের প্রাপ্য অধিকার ও মানুষ হিসাবে পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ আইনের খুব প্রয়োজন, সনাতন লৈঙ্গিক বলয় ভাঙারও প্রয়োজন। ঘৃণা নয়, অবজ্ঞা নয়– শুধু মানুষ পাক মানুষের সম্মান। সার্বিক উন্নতির জোয়ারে প্লাবিত হলেও আমরা এখনও পুরোপুরি বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের দেশে কিছুদিন আগেও সমকামিতা নিষিদ্ধ বিধায় হিজড়াদের যৌনজীবন ছিল অপ্রতিষ্ঠিত। ভাবলে তখন অবাক লাগে যখন দেখি মানুষের যৌনজীবনে রাষ্ট্র নাক গলায়। একটা রাষ্ট্র বলে দেবে একজন মানুষ কীভাবে, কখন যৌনমিলন করবে? একটা রাষ্ট্র বলে দেবে একজন মানুষ যৌনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে কীরকম যৌনাচরণ করবে? রাষ্ট্র বলে দেবে কে মুখমৈথুন করবে, কে পায়ুমৈথুন, কে উরুমৈথুন করবে, কে স্তমৈথুন করবে, কে জননাঙ্গমৈথুন করবে? এসব কি রাষ্ট্রের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে নাকি মানুষ? রাষ্ট্র সেখানেই নাক গলাতে পারে যেখানে যৌনমিলনের নামে অত্যাচার চলে, জোরজবরদস্তি চলে। যদি যৌনসঙ্গীর কেউ একজন তেমন অভিযোগ করে যে তাঁকে দিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিশেষ যৌনাচরণে বাধ্য করাচ্ছে। তা সে সমকামীদের ক্ষেত্রেই হোক, কিংবা বিপরীতকামী। এই যে সমকামীরা লোক দেখা নেই জন দেখা নেই যাকে-তাকে সমকাম করার জন্য বিরক্ত করে মারে– এটা অবশ্যই দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়া উচিত, সাধারণ নারী-পুরুষের যৌনতা সংক্রান্ত দণ্ডবিধিতে যেমন শাস্তির বিধান আছে। তাই বলে সমকামকে স্বীকৃতি দিলে পায়ুমৈথুনকে স্বীকৃতি দিতে হবে, সেই কারণে সমকাম নিষিদ্ধ –এ যুক্তি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সমকাম এবং সমকামীদের স্বীকৃতি দিলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? স্বীকৃতি দিলে পৃথিবীর সকলে লাইন দিয়ে সমকামী হয়ে যাবে? যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই পৃথিবীর সকলে সমকামী হয়ে যাবে, তাতে কার কী এসে যাবে? সূর্য কি পশ্চিমদিক থেকে উঠতে শুরু করে দেবে? সন্তানের জন্ম? বিপরীতকামীদের মধ্যে কত হাজার হাজার দম্পতি সন্তানের জন্ম দিতে অপারগ, সে কারণে কি পৃথিবী রসাতলে চলে গেছে? খুবই অবাক লাগে মানুষের ব্যক্তিগত গণ্ডীর কামনা-বাসনা যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জালে আটকে থাকে এবং তাঁদের স্বীকৃতির অপেক্ষায় ধুকে ধুকে মরে। চিলেকোঠার খাঁচায় ডানায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে যেই পাখিটি এখনও কাতরাচ্ছে সেও স্বপ্ন বুনে আকাশে পুনরায় ডানা মেলার। তারও পূর্ণ অধিকার আছে ফিরে যাওয়ার তার জগতে। লাঞ্ছনা, বঞ্চনার জগত থেকে নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অস্তিত্বের বৈধতার সংগ্রাম করে চলছে হিজড়ারা। হাজার হাজার শিখণ্ডী চোখের দ্যুতির মাঝে স্বপ্ন লালন করে চলছে সম্মান ও সমৃদ্ধির জীবনের, একটি ঘর-সংসারের।

আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার মানবিক দাবিটাও। রূপান্তরী মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় চাকরিস্থলে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে আইডেন্টটি করেছেন। ৩৭৭ নম্বর ধারার কবলে পড়ে আমার যে সমস্ত ভাই-বোন-বন্ধুরা যৌন-অবদমিত হয়ে বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছেন আমি বিপরীতকামী হয়েও তাঁদের পাশে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তাঁদের মানসিক যন্ত্রণা আমি উপলব্ধি করি। আমি তাঁদের যৌনভাবনাকে সম্মান করি, সমর্থনও করি। কারণ আমি মনে করি ওদের যৌনচেতনা প্রাকৃতিকই। যৌন-প্যাশানে আমাদের মতো নিশ্চয় নয়, ওদের মতো তো বটেই! ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সমকামীদের দাবি অন্যায্য বলেছেন একদা। বস্তুত সুপ্রিম কোর্টের এই রায় মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপের সমতুল। মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে এ ভাবে ঢুকে পড়ার অধিকার বিচারব্যবস্থারও থাকতে পারে নাকি! প্রান্তবয়স্ক দুজন মানুষ তাঁদের যৌনজীবনে কী কী স্বাধীনতা নেবেন সে ব্যাপারে কেন মন্তব্য করবে আদালত? তাঁদের মতো করে যৌনতা করলে কেন সমকামীদের শাস্তি দেওয়া হবে? একজন পুরুষ নারীকে আদর না-করে কোনো পুরুষকে আদর করলে কিংবা একজন নারী যদি পুরুষকে আদর না করে কোনো নারীকে আদর করে, তবে তাঁদের জেল দিতে হবে? এটা কেমনতর অপরাধ! এর বিরুদ্ধে শুধু সমকামীরা নয়, প্রতিবাদ করা উচিত সমাজের সর্বস্তরের মানুষদের। আইনি বিশেষজ্ঞেরা স্পষ্টই বলছেন, সংবিধানের ১৪, ১৫ ও ২১ ধারা ব্যক্তি মানুষের যে সমানাধিকার ও স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তার পরিপন্থী। এটা তো একটা ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের বিষয়। সেই পছন্দ তো অন্য কেউ করে দিতে পারে না। তবে হ্যাঁ, শুধু সৃষ্টি অর্থাৎ সন্তানধারণই যদি হয় ভালোবাসার সংজ্ঞা হয়, তা হলে তো অনেক কিছুই অস্বাভাবিক। শীর্ষ আদালত ভারতীয় দণ্ডবিধির যে ধারাকে সাংবিধানিক বলে বহাল রেখেছে, তা কেবল মাত্র পুরুষ বা নারীর সমকামিতার কথা বলে না। সেখানে বিষমকামিতার কথাও বলা আছে। সে ক্ষেত্রে ওরাল সেক্স ও অ্যানাল সেক্সও কিন্তু অপরাধযোগ্য। কারণ তাতে সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ভালোবাসা বা প্রেমের একমাত্রিক অভিমুখের বাইরে কিন্তু দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা ভাবছেন না।

১৬৩ বছর আগে ব্রিটিশ ভারত একে অপরাধ বলে গণ্য করেছিল। তার আগে পর্যন্ত কিন্তু সমকামিতা নিয়ে ভারতীয় সমাজে সেভাবে কোনো হেলদোল ছিল না। প্রাচীন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারত যেখানে চিন্তার দিক থেকে এতটা অগ্রসর ছিল, তা হলে একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে কেন সুপ্রিম কোর্টের এহেন রায়? কেন পুরুষের সঙ্গে পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে মহিলার সম্পর্ককে এখনও ‘প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ ভাবা হচ্ছে? সুপ্রিম কোর্টের রায় বলছে— তাঁরা ভরসা করেছে ১৮৬০ সালের মেকলের ব্যাখ্যাকেই। তিনি বলেছিলেন, ‘যৌনতা সৃষ্টির জন্য, কোনো বিনোদনের জন্য নয়। এ ধরনের সম্পর্ক থেকে কোনও সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। কাজেই এই সম্পর্ক প্রাকৃতিক নয়। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার মানে সৃষ্টি হয়ে গেলে যৌনমিলন বন্ধ দেওয়া উচিত, তাই নয় কি? কন্ডোম বা অন্যান্য জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করে যৌনমিলন করার উদ্দেশ্য তো বিনোদনই। পাঠক ভালো করে লক্ষ করুন এই লাইনটি– “যৌনতা সৃষ্টির জন্য, কোনো বিনোদনের জন্য নয়। এ ধরনের সম্পর্ক থেকে কোনো সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। কাজেই এই সম্পর্ক প্রাকৃতিক নয়।” যৌনতা সৃষ্টির জন্য? কবে থেকে? বাজারে, থুড়ি আমাদের মনুষ্যসমাজে এমন একটা কথা চালু আছে বইকি। আমিও শুনেছি। হিপোক্রাসি, জাস্ট হিপোক্রাসি। ভণ্ডামি। দেখো, আমরা মানবজাতি কী মহান উদ্দেশ্যই-না যৌনক্রীড়া করি, এটা বোঝাতেই বোধহয় এই গপ্পো সমাজে ছড়িয়ে আছে। যখন বা যেদিন যে আদি মানব-মানবীটি প্রথম যৌনক্রীড়া করেছিল সেটাই তো ছিল স্রেফ যৌনতাড়না। ওরা সৃষ্টির জন্য যৌনক্রীড়া করেছে বলে কোথাও উল্লেখ পাইনি। শিবপুরাণে শিব-পার্বতীর যে দীর্ঘ সময় একটানা যৌনক্রীড়ার বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে কোনো সৃষ্টির কাহিনি বর্ণিত নেই। বরং সৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যাবে এই আতঙ্কে স্বয়ং বিষ্ণু শিব-পার্বতীর বেডরুমে শুকপাখিকে পাঠিয়ে দেয় তাঁদের যৌনক্রীড়া ঘেঁটে দেওয়ার জন্য।

বিপরীতকামীরা যদি বলেন তারা শুধুই সৃষ্টির জন্যই যৌনক্রীড়া করেন, তা করুন না। সমকামীদের যৌনতায় যদি কিছু সৃষ্টি না হয় তাতে বিপরীতকামীদের অসুবিধাটা কোথায়? ওরা তো কারোর পাকা ধানে মই দিচ্ছে না! আপনি বা আপনারা বা আদালত বা রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিন বা না-দিন তাতে তো ওদের সৃষ্টিহীন যৌনতা বন্ধ থাকবে না। পৃথিবীও রসাতলে যাবে না– স্বীকৃতি দিলেও না, স্বীকৃতি না দিলেও না। আপনার পছন্দ নয় বলে তো বিকল্প যৌনতা মিথ্যা হয়ে যাবে না। আপনার পছন্দ নয় বলে আপনি কোনো একজনের জীবনও বিপন্ন করে তুলতে পারেন না। সেই অধিকার আপনার। নেই। মনে রাখবেন, বিপরীতকামীদেরই সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যৌনতার ফলে যে হাজার হাজার সন্তান পিতৃমাতৃপরিচয়হীন হয়ে অনাথ আশ্রমগুলিতে অনাদরে অসহায় হয়ে আছে, প্রয়োজন হলে ওই সমকামী দম্পতি সেইসব সন্তান দত্তক নিয়ে বাবা-মা হওয়ার অহংকারে অহংকারী হবেন। আমিও চাই সমকামী দম্পতিরা সন্তান দত্তক নিয়ে পিতা-মাতার সাধ মেটাক।

সৃষ্টির জন্য যৌনক্রীড়া, বিনোদনের জন্য নয় –এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনো দৃষ্টান্তই আমি উপস্থাপন করতে পারছি না। মানুষ মূলত উদ্ধৃঙ্খল যৌনাচারকে শৃঙ্খলিত-বৈধতা দেওয়ার জন্যই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করেছিল। শুধু বৈধ যৌনতাই নয়, সন্তানের পিতৃ-পরিচয় নিশ্চিত করতেও বিবাহের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। মানুষ শুধুমাত্র সৃষ্টির জন্যই যৌনতা করে না, করে না-বলেই মানুষের জন্য যৌনক্রীড়ার সময় ৭ X ২৪ x ৩৬৫ দিনই। সৃষ্টির জন্য যৌনক্রীড়া করে না, তাই অনেক অবিবেচক পাষণ্ড মানুষ ঋতুচক্র চলাকালীনও মিলিত হন। সৃষ্টির জন্য যৌনক্রীড়া করে না-বলেই গর্ভবতী হয়ে পড়লেও যৌনক্রীড়া বন্ধ করে না। সৃষ্টির জন্য যৌনক্রীড়া করে না-বলেই অনেকে বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা করে থাকে। সৃষ্টির জন্য যৌনক্রীড়া করে না-বলেই অনেক নারী বা পুরুষ একাধিক পুরুষ বা নারীর সঙ্গলাভের প্রত্যাশা করে। মানুষ সৃষ্টির জন্য যৌনক্রীড়া করে না-বলেই সারা পৃথিবী জুড়ে গণিকাপল্লি বা। গণিকাবৃত্তির এত রমরমা। গণিকাপল্লিতে কেউ নিশ্চয় সৃষ্টি করতে যায় না! প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজের পাতায় যৌন কেলেঙ্কারীর খবরগুলি আমরা পাই সেগুলি নিশ্চয় সৃষ্টির জন্য বলবেন না। এত যে ধর্ষণকাণ্ড (জোরপূর্বক যৌনক্রীড়া) ঘটে যায় গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন কোথাও-না-কোথাও, তা কি সৃষ্টির জন্য? তবে প্রাচীনকালে নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে শুধুমাত্র সন্তান সষ্টির জন্যই যৌনমিলন করতে হত। এটি ছিল বিশেষ শর্তসাপেক্ষ যৌনমিলন। পাণ্ডবের পাঁচজন, কৌরবদের ১০১ জন, কর্ণ, রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-শত্রুঘ্ন প্রমুখরা তো নিয়োগ প্রথারই ফসল। এই ব্যতিক্রমী যৌনমিলনগুলি অবশ্যই শুধুমাত্র সৃষ্টির জন্য ছিল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

একটা সুস্থ মানুষ তার সমগ্র জীবনে (কমবেশি) ১০,০০০ থেকে ১১,০০০ যৌনদিবস (নিশি?) পান। তার মধ্যে মাত্র ৩০ দিন থেকে ৯০ দিন সৃষ্টির জন্য ব্যয় করেন। বাকি যৌনক্রীড়ার দীর্ঘ দিনগুলি শুধুই যৌনানন্দ বা যৌনবিনোদন বা যৌনসুখের জন্য অতিবাহিত করে থাকে। তাই পাত্র বা পাত্রী যৌনক্রীড়ায় অক্ষম হলে কোনো ক্ষমা নেই। সোজা ডিভোর্সের মামলা। সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে ডিভোর্স হয় কি না আমার জানা নেই, তবে পাত্র বা পাত্রীর যে কেউ একজন যৌনক্রীড়ায় অক্ষম হলে এক লহমায় সম্পর্ক শেষ। যে যুগে মানুষের যৌনক্রীড়া মানেই অনিবার্য সন্তানের জন্ম হত, সে যুগে মানুষ নিশ্চয় খুব অসহায় ছিল। সেই অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হল। মানুষের সেই অসহায়তা এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। সারা পৃথিবী জুড়ে রক্তপাতহীন বিপ্লব ঘটে গেল। বাজারে এখন হাজারটা জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সুলভে পাওয়া যায়, যার যার সুবিধামতো। এইসব প্রোডাক্টের বিক্রিবাটাও ব্যাপক। এমন কি স্রেফ যৌনসুখ করতে গিয়ে সন্তান যদি এসেও যায় সমূলে বিনাশ করার তারও ব্যবস্থা পর্যাপ্ত মজুত আছে। সন্তানহীন (পড়ুন সৃষ্টিহীন) যৌনসুখ পেতে মানুষ কি-না করছেন! এরপরেও কেউ যদি বলে সৃষ্টির জন্যই যৌনতা, তাহলে বলব ওসব হিপোক্রাসি ঝেড়ে ফেলে আসুন প্রান্তিক হয়ে যাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়াই। মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হই। ভারত পথ-প্রদর্শক হতে পারত, তার বদলে ভারত এখন ক্রমশ পিছন দিকে এগোতে চাইছে। একে চূড়ান্ত পশ্চাদগামী মানসিকতা’ ও ‘লজ্জা’ ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। ভুললে চলবে না— চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় থেমে থাকে না।

প্রায় ১৫০ বছর ধরে আমাদের চোখ বন্ধই ছিল। অবশেষে ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চোখ খুলল সুপ্রিমকোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়ে। সুপ্রিমকোর্ট স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন –“Gay sex is not a crime. Gay sex is legal in India now.”। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের মন্তব্য– “পুরোনো ধ্যানধারণাকে বিদায় দিয়ে সমস্ত নাগরিকদের সমান অধিকার আমাদের দিতে হবে।” বিচারপতি দীপক মিশ্রের সঙ্গে সহমত পোষণ করে একই বক্তব্য রেখেছেন অন্য চার বিচারপতিও। একই সঙ্গে তাঁরা জানিয়েছেন– “ব্যক্তিগত পছন্দ স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত। ভারতীয় সংবিধানে এলজিবিটি গোষ্ঠীর সদস্যরা বাকিদের মতো একই অধিকার পাওয়ার যোগ্য।”

এলজিবিটি সমাজে এখন উৎসবের মেজাজ। মুক্তির আনন্দ। কিন্তু এঁদের এই আনন্দ সোজা-সরল পথে আসেনি। আসুন, সেই অসম লড়াইয়ের কাহিনি জেনে নিই। ১৯৯৮ সালে ম্যাসাচুসেটসের ক্লার্কস ইউনিভার্সিটি থেকে ডাবল মেজর করে ভারতে ফিরে আসার পর আয়েশা কাপুর যোগ দিয়েছিলেন ই-কমার্স খাতে, যা তখন এ দেশে সবে মাথা তুলছে। খুব শীঘ্রই বিজনেস হেডের পদে পৌঁছোতেও কোনো অসুবিধা হয়নি তাঁর। কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই ছবিটা পাল্টে গেল –যখন তাঁর সেক্সয়াল ওরিয়েন্টেশানের কথা জানাজানি হয়ে গেল। এর ফলে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়। আয়েশার সঙ্গী ছিলেন একজন মহিলা পরে স্বাধীনভাবে ব্যাবসা করে তিনি ভারতের কর্পোরেট জগতে দারুণ সফল ঠিকই, কিন্তু নিজের সঙ্গীকে নিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে যেতে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয়।

অথচ ২০১৩ সালে ভারতেই এই সর্বোচ্চ আদালতই দিল্লি উচ্চ আদালতের একটি আদেশ খারিজ করে দিয়ে বলেছিল– ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারা (যে ধারায় সমকামিতাকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে) বাতিল করার কোনো অধিকার আদালতের নেই। কারণ সেই দায়িত্ব পার্লামেন্টের। সেই রায়ের বিরুদ্ধেই সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা দেশের পাঁচজন সেলিব্রেটি, যাঁদের অন্যতম ছিলেন আয়েশা কাপুর। তাঁদের পিটিশনে তাঁরা সুপ্রিমকোর্টেরই নিজেদের রুলিং পুনর্বিবেচনার আর্জি জানান। সেই পিটিশনে সুপ্রিম কোর্ট ৩৬০ ঘুরে গিয়ে রায় দিলেন পূর্বের মত বদলে। এই পাঁচজন তারকার আইনি লড়াইয়ে সুবাদেই যে আজ ভারতের লক্ষ লক্ষ সমকামী মানুষ তাঁদের মতো জীবনযাপন করতে পারবেন। যাপন করতে পারবেন মতো করে যৌনজীবন। কিন্তু কারা সেই পাঁচজন? তাঁদের কথা খোদিত করে না রাখলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

নভতেজ সিং জোহর : ৫৯ বছর বয়সি নভতেজ সিং জোহর ভারতের একজন প্রখ্যাত ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী। ভারতনাট্যম নৃত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কারেও ভূষিত তিনি। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যে সঙ্গীদের সঙ্গে রয়েছেন তিনি, তাঁদের সঙ্গে মিলেই সুপ্রিমকোর্টে পিটিশনটি দাখিল করেছিলেন তিনি। তাঁর যুক্তি ছিল, ভারতের সংবিধান যে জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অঙ্গীকার করে, ৩৭৭ ধারা সেই অধিকারের পরিপন্থী।

 সুনীল মেহরা : সাংবাদিক সুনীল মেহরার বয়স ৬৩। তিনি একসময় ম্যাক্সিম ম্যাগাজিনের ভারতীয় সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন। সুনীলের সঙ্গে নভতেজের সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। প্রথম দেখা হওয়ার ছয় মাস পর থেকেই তাঁরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। সেই জুটি আজ প্রায় সাতাশ বছর পরেও ভাঙেনি।

রিতু ডালমিয়া : ৪৫ বর্ষীয় রিতু ডালমিয়া ভারতের নামী সেলিব্রেটি শেফদের অন্যতম। তাঁর ‘ডি’ রেস্তোরাঁ চেইন ভারতে সেরা ইটালিয়ান খাবারের অন্যতম ঠিকানা বলে মনে করা হয়। রিতুর জন্ম কলকাতার এক রক্ষণশীল মারোয়াড়ি পরিবারে। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন লেসবিয়ান হিসাবে। তিনি যে লেসবিয়ান সে কথা নিজের পরিবারের কাছে ঘোষণা করেছিলেন একদিন ডিনারের টেবিলে বসে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বাবা-মাও বিষয়টা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি।

আমন নাথ : ৬১ বর্ষীয় আমন নাথও এই পিটিশনে যুক্ত ছিলেন। আমন নাথ ভারতের নিমরানা হোটেল চেইনসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। তবে শুধু হোটেলিয়ার হিসাবেই নয়, শিল্পরসিক ও ইতিহাসবিদ হিসাবেও তাঁর খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। শিল্পকলা, ইতিহাস, স্থাপত্য ও ফোটোগ্রাফির মতো বহু বিষয়ে তিনি অজস্র বই লিখেছেন।

আয়েশা কাপুর : আয়েশা ছিলেন সুপ্রিমকোর্টে দাখিল করা পিটিশনের পঞ্চম মুখ। ই-কমার্সের জগৎ ছেড়ে দেওয়ার পর আয়েশা এখন যুক্ত ফুড অ্যান্ড বিভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে। আর সেখানেও তিনি ভীষণ সফল। এই যে ভারতের এলজিবিটিরা ৩৭৭ ধারাকে বিলুপ্ত করে নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী জীবনযাপনের অধিকার পেলেন, তার জন্য তাঁরা অবশ্যই এই পাঁচজনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন।

সুপ্রিমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়টা সত্যিই অনেকটা এগিয়ে দিল এলজিবিটিদের। বাকি রইল সামাজিক টানাপোড়েন। সেটা আমাদেরই মেরামত করতে হবে। কিন্তু আইন কবেই-বা সমাজকে বদলাতে পেরেছে! আমরা কি পারব ওদের দেখে মুখ টিপে হাসি বন্ধ করতে? আমরা কি পারব ওদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা বন্ধ করতে? এফিমিনেট ছেলেটিকে দেখে বলব না তো ‘হাফ লেডিজ’? আমরা এলিজিবিটি মানুষদের যৌন স্বাধীনতায় কাঠি দিতে যাব না তো? এলজিবিটিদের আমরা জোর করে নারী ও পুরুষ বানাতে যাব না তো? তাঁদের মানুষের সম্মান ও মর্যাদা দেব তো?

আপাতত এলজিবিটিদের জন্য আইন তো পাশে রইলই। সেটাও কম বড়ো আত্মরক্ষার অস্ত্র নয়। তবে আইন তাঁদের পক্ষে থাকলেও বিপদ একেবারে মুক্ত হয়ে গেছে একথা বলা যায় না। ভারতীয় জনতা দলের সভাপতি (বিজেপি) রাজনাথ সিংহ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন –“We will state (at an all party meeting if it is called) that we support Section 377 because we supported.” রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে –“Homosexuality not a crime, but it’s not natural. Gay marriage and relationship are not compatible with nature and are not natural, so we do not support this kind of relationship. Traditionally, India’s society also does not recognize such relations.” অতএব চলার পথে ফুল ছড়ানো আছে মনে হলেও রক্তাক্ত হওয়ার মতো কাঁটা কিন্তু রয়েই গেছে।

———-

সাহায্যকারী তথ্যসূত্র : (১) ব্রহ্মভার্গবপুরাণ– কমল চক্রবর্তী।

(২) হলদে গোলাপ– স্বপ্নময় চক্রবর্তী।

(৩) Let us live : Social Exclusion of Hijra Community– Sibsankar Mali

(৪) অন্তহীন অন্তরীণ প্রোষিতভর্তৃকা– সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

(৫) ভারতের হিজড়ে সমাজ– অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু।

(৬) The Truth About Me— A Hijra Life Story— A. Revathi, Penguin।

(৭) দেবদাসীতীর্থ– ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়।

(৮) অপরাধ জগতে ভাষা ও শব্দকোষ– ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক।

(৯) হিজড়ে কথা : রক্তমাংসের অসংগতি এবং– পিনি দাসগুহ, উৎস মানুস।

(১০) না-পুরুষ, না-মেয়ে মহাভারতের গোপন পর্ব– রমাপ্রসাদ ঘোষাল, প্রতিদিন।

(১১) নপুংসক— অনিরুদ্ধ ধর, সানন্দা।

(১২) পুরুষ যখন যৌনকর্মী– মজুমদার ও বসু।

2 Comments
Collapse Comments

দুই ধরনের ,পুরুষ ও মেয়ে হিজড়েদের নগ্ন ছবি দেখান।

মহিলা ও পুরুষ উভয় হিজড়েদের নগ্ন জননাঙ্গের ছবি পোস্ট করলে ভালো হয় ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *