অধ্যায় ২০: নভেম্বর – ডিসেম্বর

অধ্যায় ২০: নভেম্বর – ডিসেম্বর

১৯৭১ সালে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় ২৫শে মার্চের মধ্যরাত্রিতে–পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন নিরস্ত্র, অসহায়, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কোনরূপ সতর্কবাণী ছাড়াই, সম্পূর্ণ অতর্কিতে আক্রমণ করে। যুদ্ধই–কেননা আক্রমণ চলে ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টার, মেশিনগান, রাইফেল, আরও নানা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে। আক্রমণ চলতে থাকে সমগ্র স্থলভূমিতে, বিমান থেকে, জলযান থেকে। যুদ্ধই–কেননা কেউই সে আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি–ছাত্রাবাসের ছাত্র, বস্তিবাসী শ্রমিক, পল্লীবাসী কৃষক, শিক্ষক, মধ্যবিত্ত, বেকার যুবক, নারী, শিশু অথবা বৃদ্ধ। কখনো কারফিউয়ের মাঝে পেট্রোলে আগুন লাগানো বস্তিবসত থেকে ভীতসন্ত্রস্ত, পলায়নপর মানুষের উপর মেশিনগানের আক্রমণ চালানো হয়েছে, কখনো হাঁটুজলে দাঁড় করিয়ে দড়িতে বাঁধা মানুষের সারি গুলি করে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে মৃতের সাথে মুমূর্মুকে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ রেখে; তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করা হয়েছে এ দেশের কৃতি পুরুষদের, বন্দী শিবিরে অমানুষিক নির্যাতনের পর তাদের ক্ষতবিক্ষত নিস্পন্দ দেহ গোপনে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে; নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অসংখ্য মানুষকে শান্তি কমিটির ঠিকাদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তাদের প্রাণ সংহারের উদ্দেশ্যে, পথ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া যুবকদের সমস্ত রক্ত আর্মি ব্লাড ব্যাংকে সংগ্রহ করে নেবার পর তাদের প্রাণহীন দেহ ফেলে দেওয়া হয়েছে খানাখন্দকে; বসতবাটি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া অসংখ্য নিষ্পাপ কিশোরী, স্নেহশীলা তরুণীমাতা, গৃহবধূদের পাশবিক ভোগের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে মাসের পর মাস; প্রাণের ভয়ে প্রায় এক কোটির মত লোক দেশছাড়া হয়েছে; যারা দেশান্তরিত হতে পারেনি তারা ভয়ার্ত উদ্বেগে শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছে বিনিদ্র আর উৎকণ্ঠার নারকীয় যন্ত্রণার মাঝে দেশবাসীর মনে কোন শান্তি ছিল না, প্রাণের নিরাপত্তা ছিল না, সম্ভ্রম তো নয়ই। যদিও অঘোষিত, এত কিছুর পর একে যুদ্ধ ছাড়া আর কি নামে অভিহিত করা যায়?

প্রত্যেক যুদ্ধের যেমন পরিকল্পনা থাকে, প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়, তেমনি ২৫শে মার্চে পাকিস্তানের এই অঘোষিত যুদ্ধেরও পরিকল্পনা ছিল, প্রস্তুতি ছিল। এই প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয় ফেব্রুয়ারীরও আগে থেকে, যখন আকাশ পথে সৈন্য আনার কাজ শুরু হয়। এই প্রস্তুতির কথা আর যাদেরই অগোচরে থাকুক, মার্কিন সরকারের ছিল না। কিসিঞ্জার ১৬ই ফেব্রুয়ারীতে মার্কিন প্রশাসনের এক আন্তঃসংস্থা সমীক্ষা প্রণয়নের ব্যবস্থা করেন ‘পাছে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে। যে সময় কার্যত সমগ্র আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের বৈঠকে যোগদানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ ছিল, ঠিক সে সময় কিসিঞ্জারের পক্ষে ‘পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হওয়ার চেষ্টা করতে পারে’ এহেন অনুমানে প্রবৃত্ত হওয়ার চেষ্টা বিশেষ তাৎপর্যময়। যে কোন সামরিক অভিযান পরিকল্পনার জন্য সত্যিকারের বিপদ যদি নাও থাকে, তবে কল্পিত বিপদ একটি দরকারই। পাকিস্তানী জান্তা পূর্ব বাংলায় সামরিক আক্রমণ চালানোর জন্য যে কল্পিত বিপদের আশ্রয় নেয় কিসিঞ্জারের পক্ষে সেই কল্পনাকে সত্যের মর্যাদায় উন্নীত করার এই অশোভন ব্যগ্রতার পিছনে একটিই মূল কারণ থাকতে পারত–মার্কিন প্রশাসন কেবল পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতির খবরই রাখতেন না, অধিকন্তু এই আসন্ন অভিযানের পক্ষে তাদের অন্তত পরোক্ষ সমর্থন ছিল। এই কারণেই ৬ই মার্চে অর্থাৎ পাকিস্তানের গণহত্যা কার্যক্রম শুরু হওয়ার উনিশ দিন আগে হোয়াইট হাউসে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপ (SRG)-এর বৈঠকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারী এলেক্সি জনসন যখন সকল কার্যকরণ বিশেষণ করে ‘পূর্ব পাকিস্তানে শক্তি প্রয়োগ থেকে ইয়াহিয়াকে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন, তখন কিসিঞ্জার ইয়াহিয়াকে সমর্থন করার পক্ষে পেসিডেন্ট নিক্সনের অভিপ্রায়ের কথা প্রকাশ করেন। ফলে SRG এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, পাকিস্তানী জান্তার আসন্ন আক্রমণ সম্পর্কে ‘প্রকাণ্ড নিষ্ক্রিয়তার’ (massive inaction) নীতি অনুসরণই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সর্বোত্তম পন্থা। মার্কিন প্রশাসনের অন্তত পরোক্ষ অনুমোদন ছাড়া পাকিস্তানী জান্তার পক্ষে এত বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান শুরু করা আদৌ সম্ভব হত কি না, তা অত্যন্ত সন্দেহজনক। অন্যান্য কারণ ছাড়াও সম্ভবত এই ‘নৈতিক দায়িত্ব’ বোধের কারণে পাকিস্তানের অমানুষিক বর্বরতার বিরুদ্ধে নিক্সন বা কিসিঞ্জারের পক্ষে পরবর্তী ন’ মাসে কোনরূপ নিন্দা, প্রতিবাদ বা সমালোচনা একবারও উচ্চারিত হয়নি।

সামরিক জান্তার ‘বাহাত্তর ঘণ্টার’ পরিকল্পিত সার্জারী যখন মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম গণহত্যা ও শরণার্থী স্রোত শুরু করে এবং আক্রান্ত, তাড়িত, পলায়নপর মানুষের মনে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করে, তখন থেকে মার্কিন প্রশাসনের তথাকথিত ‘প্রকাণ্ড নিষ্ক্রিয়তার’ নীতি ধাপে ধাপে কিভাবে পাকিস্তানের সাহায্যার্থে সক্রিয় ও সহযোগিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা ইতিপূর্বে আলোচিত। এই সহযোগিতার চরম প্রকাশ ঘটে ২২শে নভেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে। ২৩শে নভেম্বরে ইয়াহিয়া খান চীনা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে দশ দিন বাদে স্বয়ং যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময়সূচী ঘোষণা করেছিলেন। ইয়াহিয়ার ঘোষণার দশম দিনে সূর্যাস্তের কিছু আগে পাকিস্তানী জঙ্গীবিমান প্রধানত ভারতীয় জম্মু ও কাশ্মীরের আশেপাশে একযোগে সাতটি বিমানক্ষেত্র আক্রমণ করে এবং রাত্রিতে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে। তার পরদিন পশ্চিম ও পূর্ব রণাঙ্গনে সর্বাত্মক ভারতীয় প্রত্যাঘাতের মধ্য দিয়েই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের শুরু হয়। ফলে, বাংলাদেশের মানুষ ২৫শে মার্চকেই। পাকিস্তানের যুদ্ধারম্ভের দিন বলে গণ্য করলেও, বিশ্বের চোখে ৩রা ডিসেম্বরই পাক-ভারত যুদ্ধ আরম্ভের দিন। এর আগে মূলত পূর্ব বাংলার সীমান্তে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বাহিনীর মধ্যে যেসব সশস্ত্র সংঘর্ষ চলে আসছিল, তা সীমান্ত সংঘর্ষ হিসাবেই পরিগণিত। কিন্তু কিসিঞ্জারের রায় অনুযায়ী ২১-২২শে নভেম্বর বয়রা-চৌগাছা সীমান্তে উভয়পক্ষের ট্যাঙ্ক, বিমান ও গোলন্দাজ সংঘর্ষের দিনই যুদ্ধ শুরুর দিন।

তদনুযায়ী ২২শে নভেম্বর ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কার্যনির্বাহী উপসংস্থা ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপ (WSAG)-এর বৈঠকে কিসিঞ্জার ‘যুদ্ধ আরম্ভের’ জন্য ভারতকে দোষারোপ করেন এবং অবিলম্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিসিঞ্জারের দুর্ভাগ্য যে, মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র দফতরই তার রায় এবং প্রস্তাবিত পদক্ষেপের সঙ্গে রাজী হতে পারেননি, বরং তারা আরও কিছু রাজনৈতিক দাবী-দাওয়া মেনে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের উপর। চাপ প্রয়োগের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু পাকিস্তানী জান্তাকে তার হতদ্দশা থেকে উদ্ধার করার নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই হোক, এবং/অথবা তাদের দীর্ঘমেয়াদী আঞ্চলিক স্বার্থ যে কোন প্রকারে রক্ষা করার শক্তিদর্পী সিদ্ধান্ত থেকেই হোক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সহকারী অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে একের পর এক যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তার ফলে উপমহাদেশের সঙ্কট অচিরেই দুই বৃহৎ শক্তির বিশ্ব ভূরাজনৈতিক (global geopolitical) প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাতের অন্যতম প্রধান পাদপীঠে পরিণত হয়। ২২শে নভেম্বর নিক্সন ভারতকে সমরাস্ত্র সরবরাহ করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতি সতর্কবাণী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। সম্ভবত বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বহুধাবিভক্ত করতে না পারার ব্যর্থতাজনিত জ্বালা, মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য প্রদান থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করার অক্ষমতাজনিত ক্রোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির মুখে পাকিস্তানের ভরাডুবির আশঙ্কা–এই সমস্ত কিছুর ফলে পুঞ্জীভূত মার্কিনী উত্তাপ অংশত নির্গত হয় সোভিয়েট নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। ফলে সূচনায় যা ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট, তা পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বলদর্পী বুদ্ধিভ্রংশতায় উপমহাদেশীয় সঙ্কটে পরিণত হয় এবং মার্কিন প্রশাসনের ন্যায়নীতি বিবর্জিত পৃষ্ঠপোষকতা ও ভ্রান্ত পরামর্শের ফলে এই সঙ্কটের জটিলতা ও পরিসর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মার্কিন প্রশাসনের চিরাচরিত বিশ্ব পাহারাদারীর মনোবৃত্তির প্রভাবে পাকিস্তানের আট মাস আগের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট বিশ্ব সংঘাতের রূপ ধারণ করে।

২৩শে নভেম্বর WSAG-এর বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ‘অসহযোগী ভূমিকা অপরিবর্তিত থাকে। কাজেই কিসিঞ্জার তাঁর বিশ্ব ভূরাজনৈতিক উদ্যোগ কার্যকর করার প্রথম ধাপ হিসাবে বেছে নেন জাতিসংঘে সদ্য নিযুক্ত চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়াকে এবং গোপনে নিউইয়র্কে যান হুয়াং হুয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। কিসিঞ্জারের নিজেরই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা অনুযায়ী তার এই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল, পিকিংকে মার্কিনী উদ্যোগের খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কে অবহিত রাখা, ‘সম্প্রসারণবাদ রোধকল্পে’ মার্কিনী সরকারের ‘সংকল্পের দৃঢ়তা’ ব্যাখ্যা করা এবং এক্ষেত্রে বিরাজমান ‘বাস্তব সম্ভাবনা’ সদ্ব্যবহারের অসুবিধাগুলি চিহ্নিত করা। তিনি হুয়াং হুয়াকে উপমহাদেশের বিরাজমান সামরিক পরিস্থিতির বর্ণনা দেন এবং মার্কিন সরকার পাকিস্তানের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব উত্থাপন করতে চান তার খসড়া দেখান। দুর্ভাগ্য পুনরায় কিসিঞ্জারের; হুয়াং হুয়া তাকে জানান চীন নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানকে সমর্থন করবে বটে, তবে বিষয়টি কবে নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাওয়া হবে সে ব্যাপারে চীন বরং পাকিস্তানের পরামর্শ অনুসরণ করবে। কিন্তু পাকিস্তান গণহত্যা ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের জন্য সমালোচিত ও নিন্দিত হওয়ার আশঙ্কায় তখন অবধি নিরাপত্তা পরিষদ অধিবেশনের পক্ষপাতী ছিল না।

কাজেই ২৪শে নভেম্বর কিসিঞ্জার পুনরায় WSAG-এর দ্বারস্থ হন ভারতকে আক্রমণকারী হিসাবে প্রতিপন্ন করার জন্য। ইন্দিরা গান্ধী ঐ দিনই ভারতীয় পার্লামেন্টে ব্যাখ্যা করেন, কোন পরিস্থিতিতে ভারতীয় বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে চৌগাছার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। WSAG বৈঠকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি কিসিঞ্জারের অভিযোগকে অমীমাংসিত বলে গণ্য করেন এবং রাজনৈতিক আপোসের জন্য পাকিস্তানকে চাপ দেওয়ার পক্ষে পুনরায় অভিমত প্রকাশ করেন।

নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের পক্ষে কিসিঞ্জার যখন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে সম্মত করানোর চেষ্টায় লিপ্ত, প্রায় সে সময়েই-অর্থাৎ ৩রা ডিসেম্বরের সপ্তাহাধিক কাল আগে-ভারত সরকার গোপনসূত্রে অবগত হন যে, ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন উপকূলে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় সপ্তম নৌবহরের গতিবিধির এখতিয়ার বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। হঠাৎ বঙ্গোপসাগর অবধি মার্কিন নৌবাহিনীর তৎপরতার এখতিয়ার সম্প্রসারিত হওয়ায় ভারত সরকারের সন্দেহের উদ্রেক ঘটে। কিন্তু এ সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে প্রশ্ন উত্থাপনের পরেও তাদের কাছ থেকে কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা লাভে ভারত সরকার অসমর্থ হন। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের এখতিয়ার বঙ্গোপসাগর অবধি সম্প্রসারিত করার পূর্বেই এর সম্ভাব্য তৎপরতার পরিকল্পনা যথারীতি সম্পন্ন হয়েছিল বলে অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত। বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে যাত্রার জন্য সতর্ক অবস্থা জারী করা সত্ত্বেও সপ্তম নৌবহরকে। পূর্ব বাংলার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার পথে রাজনৈতিক বাধা নিক্সন প্রশাসনের জন্য তখনও প্রবল। এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার ক্রমবর্ধিত সংঘর্ষকে ‘নগ্ন ভারতীয় আক্রমণ’ হিসাবে প্রতিপন্ন করা এবং তজ্জন্য নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তিসমূহ ও চীনের সম্মিলিত নিন্দাজ্ঞাপন অত্যাবশ্যক ছিল। একমাত্র এই উপায়েই মার্কিন ও বিশ্ব জনমতকে পরিবর্তিত করা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব ছিল এবং তার আগে সামরিক হস্তক্ষেপ রাজনৈতিক দিক থেকে দুরূহ হত। নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের ব্যাপারে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আপত্তি মার্কিন জনমতের তীব্রতাকেই প্রতিফলিত করে মাত্র। অবশ্য এই বিভাগকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া নিক্সনের জন্য দুর্লংঘ্য অসুবিধার ছিল না। অসুবিধা ছিল অন্যত্র। ২৩শে নভেম্বর কিসিঞ্জার অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের ব্যাপারে সম্মত হওয়ার জন্য চীনকে যথাসাধ্য উৎসাহিত করার পরেও হুয়াং হুয়া অনুত্তেজিত থাকায় মার্কিন প্রশাসনের অবশিষ্ট ভরসার স্থল ছিল ব্রিটেন। কেননা ইন্দিরা গান্ধীর ফ্রান্স সফরকালে ফরাসী সরকারের সহানুভূতি ভারতের পক্ষে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হওয়ার পর নিরাপত্তা পরিষদে ফ্রান্সের সহযোগিতার উপর মার্কিন ভরসা ছিল নিতান্ত কম। সোভিয়েট সহযোগিতার কোন প্রশ্নই ছিল না। কাজেই নিরাপত্তা পরিষদের অবশিষ্ট ও পঞ্চম স্থায়ী সদস্য ব্রিটেনকে পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের ব্যাপারে সম্মত করানো এতই জরুরী ছিল যে স্বয়ং নিক্সন ২৬শে নভেম্বরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী হীথ নিক্সন বর্ণিত পরিস্থিতির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েও, প্রস্তাবিত উদ্যোগ থেকে ব্রিটেনের আলাদা থাকার পক্ষে ইঙ্গিত দেন। স্পষ্টতই পাকিস্তানের পাপের ভার তখন এতই পূর্ণ যে পাশ্চাত্য ত্রিশক্তিও এই প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত। আমেরিকার শেষ ভরসার স্থল তখন পুনরায় চীন। ২৯শে নভেম্বর কিসিঞ্জার তাই পুনরায় চীনা নেতৃত্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেন; এবারে অবশ্য হুয়াং হুয়ার মাধ্যমে নয়, প্যারিসের অন্য আর এক মাধ্যমের সহায়তায়। এবারের অনুরোধের বিষয়বস্তু ও ফলাফল কিসিঞ্জার গোপন রাখেন।

এমনিভাবে বয়রা চৌরাস্তা সীমান্ত সংঘর্ষের দিন থেকে সীমান্ত অঞ্চলে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালেও এই সব ঘটনাকে ভারতীয় আক্রমণের নিদর্শন হিসাবে খাড়া করে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের আয়োজন করা এবং সেখানে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ ও চীনের সম্মিলিত ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য কিসিঞ্জারের সকল উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ফলে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে সপ্তম নৌবহরের যাত্রাও বিলম্বিত হতে থাকে। এদিকে ইয়াহিয়া ঘোষিত সময়সূচীর ‘দশ দিন’ নিঃশেষিত হতে থাকে। পূর্বাঞ্চলে ভারত বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীর সীমান্ত চাপ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে, দেশের ভিতরে নিয়াজীর তথাকথিত মজবুত ঘাঁটি’ মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ক্রমশই পরিবৃত হয়ে পড়তে থাকে, দীর্ঘ আট মাসের একটানা অভিযানে বিশেষত মুক্তিবাহিনীর আঘাতে আঘাতে পরিশ্রান্ত পাকিস্তানী সেনাদের মনোবল দ্রুত ভাঙ্গনের দিকে এগুতে থাকে এবং শীত এগিয়ে আসার ফলে উত্তরের গিরিপথগুলি বন্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়তে থাকে। অথচ তখনও সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে পাকিস্তানের দুই মিত্রই অনড়, অচল। সপ্তম নৌবহরের নোঙ্গর তোলার কোন লক্ষণ নেই। এই হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মাঝে পাকিস্তান সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধীরে ধীরে নিশ্চিত পরাজয় বরণের পরিবর্তে তার নিজের মিত্রদ্বয়কে সক্রিয় করে তোলার জন্য ৩রা ডিসেম্বরে ভারতের পশ্চিম সীমান্তবর্তী বিমানবন্দরসমূহে (একমাত্র আগ্রাই অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী শহর ছিল) বিমান আক্রমণ চালায় এবং সেই রাত্রিতেই পূর্ব পাঞ্জাব এবং জম্মু ও কাশ্মীরের বিরুদ্ধে স্থল অভিযান শুরু করে।

এই আক্রমণ শুরু করার আগের দিন পাকিস্তান পূর্বোল্লেখিত পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রথম ধারা অনুযায়ী ‘আক্রান্ত দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ দাবী করে। প্রায় এক মাস আগে প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বেঞ্জামিন ওয়েলার্ট ১৯৫৯ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশেষ দায়িত্বের কথা সর্বপ্রথম উদঘাটিত করার পর, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষে এই বিশেষ উদঘাটনের কারণ সম্ভবত ভালোভাবেই জানা ছিল; কাজেই তখন থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট একাধিক প্রকাশ্য বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এহেন দায়িত্বের কথা অস্বীকার করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অস্বীকৃতি ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও কার ভরসায় পাকিস্তান ২রা ডিসেম্বরে এই চুক্তির প্রয়োগ দাবী করে পরদিনই ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্প্রসারণে প্রবৃত্ত হয়েছিল, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ৩রা ডিসেম্বর WSAG-এর বৈঠকে কিসিঞ্জারের বক্তব্য থেকে। পাকিস্তান। পশ্চিম ভারতে বিমান আক্রমণ শুরু করার মাত্র ছ’ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ এই আক্রমণ সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীর বেতার বক্তৃতারও আগে, এই বিষয় আলোচনার জন্য হোয়াইট হাউসে WSAG-এর বৈঠক শুরু হয়। এই বৈঠকে যথাশীঘ্র নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত ছাড়াও ১৯৫৯ সালের পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে পাকিস্তানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব অন্বেষণের ব্যাপারে যোগদানকারী সদস্যদের মধ্যে একমাত্র কিসিঞ্জারই ব্যগ্রতা প্রকাশ করেন। তখন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনের প্রচেষ্টা ছিল: (১) নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েট ভেটোর আশঙ্কা সত্ত্বেও উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য জাতিসংঘকে যতদূর সম্ভব ব্যবহার করা; এবং (২) ১৯৫৯ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার অধীনে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশের উপকূলভাগের উদ্দেশে সপ্তম নৌবহরের যাত্রা শুরু করা। একমাত্র প্রথম লক্ষ্য অর্জনের পরেই দ্বিতীয় ও মূল পদক্ষেপ গ্রহণ করা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে সম্ভব ছিল। এর পরেও সপ্তম নৌবহরের কার্যকর প্রয়োগ নির্ভরশীল ছিল দু’টি সামরিক শর্তের উপর, যার মধ্যে প্রথমটি ছিল অপরিহার্য: (১) পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অন্তত ঢাকা ও উপকূলভাগে নিজ শক্তিতে পাকিস্তানী বাহিনীর কমপক্ষে তিন সপ্তাহকাল লড়াই করার ক্ষমতা; এবং (২) উত্তর সীমান্তে সীমিত আকারে হলেও চীনের যুগপৎ তৎপরতা।

মরিয়া হয়েই হোক এবং/অথবা মার্কিন হস্তক্ষেপ ত্বরান্বিত করার চিন্তাভাবনা থেকেই হোক, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে প্রবত্ত হওয়ার আগে পাকিস্তানও তার নিজস্ব সামরিক সামর্থ্য সম্পর্কে, তথা তার একক শক্তিতে অন্তত কিছু সময়ের প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করে রাখার মত ক্ষমতা সম্পর্কে, নিশ্চয়ই কিছু হিসেব-নিকেশ করে দেখেছিল। পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশের ধরন দৃষ্টে মনে হয়, পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় জম্মু ও কাশ্মীরের একাংশ দখল করে নেওয়াই তাদের রণপরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল; পূর্বাঞ্চলে কোন ভূখণ্ড যদি হারাতে হয় তবে তা পুনরুদ্ধারের কাজে লাগানো সম্ভব মনে করেই। দ্বিতীয়ত, পূর্বাঞ্চলে সীমান্তের বিভিন্ন অংশে ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য সমবেত হওয়ার খবর থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের সম্ভবত এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে নদীনালা পরিকীর্ণ ভূভাগ অতিক্রম করে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার মত পরিবহন ও ইঞ্জিনিয়ারিং উপকরণে ভারতের সীমাবদ্ধতাহেতু এবং তার বিরুদ্ধে সীমান্তের এপারের সুরক্ষিত ‘দুর্গ’ ও বাঙ্কার থেকে ভারতীয় সৈন্যের তুলনায় বহুগুণ শৌর্যের অধিকারী পাকিস্তানী জওয়ানদের’ মূলত প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সুবিধাহেতু ভারতীয় বাহিনীর অগ্রাভিযান বেশী গভীরে এগুনো সম্ভব নয়, বড় জোর কিছু এলাকা তারা দখল করে নিতে পারে। কিন্তু ৪ঠা ডিসেম্বরে পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর মিলিত প্রত্যাঘাত শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে অধিকৃত এলাকার সর্বত্র একযোগে মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত সাধারণ মানুষ পাকিস্তানী অবস্থানের বিরুদ্ধে সমুখিত হয়। এর ফলে মুক্তি অভিযান যে অসামান্য গতিবেগ অর্জন করে, তা পাকিস্তানের আশঙ্কা ও ভারতের প্রত্যাশা উভয়কেই ছাড়িয়ে যায়। প্রচলিত যুদ্ধরীতিতে অভ্যস্ত পাকিস্তান যে সমস্ত যুক্তি থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বল্প কিছু ভূখণ্ডের বেশী হারাবার কথা কল্পনা করতে পারেনি, সেই একই প্রচলিত যুদ্ধরীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের সমর পরিকল্পনাবিদগণের পক্ষেও ঢাকাকে মুক্ত করা নিশ্চিত সামরিক লক্ষ্য হিসাবে গণ্য করে ওঠা সম্ভব হয়নি। বৈপ্লবিক রাজনৈতিক উপাদান ও জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের ফলে মুক্তিযুদ্ধ যে অকল্পনীয় গতিময়তা ও শক্তি অর্জন করতে পারে, তা সম্ভবত পাকিস্তান বা ভারত কোন দেশেরই স্টাফ কলেজের পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্গত ছিল না।

1 Comment
Collapse Comments
রাজাকার পুত্র মুক্তিযোদ্ধা June 15, 2022 at 7:32 pm

অসাধারণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *