অধ্যায় ১৬: অক্টোবর

অধ্যায় ১৬: অক্টোবর

অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমন কোন নতুন উপাদানের সংযোজন ঘটেনি, যার ফলে উপমহাদেশের ঘটনাধারায় কোন দিক পরিবর্তন সম্ভব ছিল। পাকিস্তানের সামরিক কোটারী ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন আগের মতই অনিচ্ছুক। কাজেই তাদের পক্ষে রাজনৈতিক মীমাংসার কোন নতুন প্রস্তাব তোলা বা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য তৎপরতা যদি সত্যই বিপদমাত্রা অতিক্রম করে, তবে তা প্রতিরোধের সর্বশেষ উপায় হিসাবে তারা সীমিত আকারে পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটনের জন্য পশ্চিম ও পূর্ব উভয় সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ সম্পন্ন করে। কিন্তু পরিবর্তিত শক্তির ভারসাম্যে নিজেদের দুর্বলতার কথা বিবেচনা করে, যুদ্ধ অথবা কূটনীতি যে উপায়েই হোক পূর্ব বাংলার উপর দখল যাতে বজায় রাখা সম্ভব হয়, তজ্জন্য আমেরিকার উপরেই ইয়াহিয়া সরকারকে সর্বাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে দেখা যায়। আমেরিকাও ছিল মুক্তিযুদ্ধ প্রতিরোধ, তথা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় আগের মত বদ্ধপরিকর। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা রোধ করার ক্ষেত্রে তাদের সকল প্রয়াস যেমন তখন অবধি অসফল, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের প্রশ্নে ভারতকে নিবৃত্ত করার উপায়ও তাদের অজানা। পাকিস্তানের অপর মিত্র চীন সঙ্কটের প্রথম দিকে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থনসূচক অভিমত প্রকাশ করার পর বিগত কয়েক মাস যাবত রহস্যময়ভাবেই নীরব হয়ে থাকে। কিন্তু ভারত সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি এবং ২৯শে সেপ্টেম্বর ভারত-সোভিয়েট যুক্তইশতেহার প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা আরো হ্রাস পেয়েছে বলে অনুমান করা সঙ্গত ছিল। অন্যদিকে জুলাই থেকে সোভিয়েট ইউনিয়ন ক্রমশ ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির নিকটবর্তী হয়ে ওঠার পরেও শেখ মুজিবের মুক্তি ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা সম্পর্কে যেটুকু আশা সোভিয়েট কর্তৃপক্ষের ছিল, পাকিস্তানের অনমনীয়তার দরুন অক্টোবরের শেষ দিকে তা নিঃশেষিত হয় এবং ফলে সোভিয়েট ভূমিকা মৈত্রীচুক্তির নবম ধারার অধীনে কার্যকর হতে শুরু করে। আর ভারত শরণার্থী সমস্যা সমাধানের সর্বশেষ উপায় হিসাবে সামরিক পদক্ষেপ সম্পর্কে সোভিয়েট ইউনিয়নের পরোক্ষ সমর্থন আদায়ের পর এতদসংক্রান্ত অবশিষ্ট সামরিক ও কূটনৈতিক আয়োজন সম্পন্ন করার কাজে পূর্ণোদ্যমে আত্মনিয়োগ করে।

কাজেই বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে অক্টোবরের শেষে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য স্পষ্টতই ছিল দখলদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তির জন্য সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করার পূর্বে অবশিষ্ট মূল। ছিল, সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগেই এই অভিযান সফলভাবে পরিসমাপ্ত করার সম্ভাব্যতা নিয়ে।

অক্টোবরের প্রথমার্ধে পাকিস্তান তার সমর-প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। তৎসত্ত্বেও পশ্চিম, পূর্ব এবং আভ্যন্তরীণ–এই তিন রণাঙ্গনের যুদ্ধের কথা বিবেচনা করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের উপর প্রায় সর্বতোভাবেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বরের শেষে মস্কো থেকে প্রকাশিত ভারত-সোভিয়েট যুক্ত ঘোষণার মর্ম পাকিস্তানের জন্য বিশেষ দুর্বোধ্য ছিল না। তদুপরি সেপ্টেম্বর থেকে চীনের আভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ায় চীনা সশস্ত্রবাহিনীর উপর এর প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব পাকিস্তানের সম্পূর্ণ অগোচরে থাকার কথা নয়। তা ছাড়া লিন পিয়াও-এর ব্যর্থ অভ্যুত্থানেরও দু সপ্তাহ আগে সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের প্রত্যাশিত ভূমিকা সম্পর্কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত খাজা মোহাম্মদ কায়সার তাঁর ‘অনিশ্চয়তাবোধের কথা পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ খানকে জ্ঞাপন করেন।

এই ‘অনিশ্চয়তাবোধ’ পাকিস্তানের জন্য অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ সম্ভবত গভীর উৎকণ্ঠায় পরিণত হয়। মস্কো ঘোষণার মর্ম ও চীনের শুদ্ধি অভিযানের তাৎপর্য ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণের সংবাদ এবং পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তে ভারতের সৈন্য সমাবেশের আয়োজন দুষ্টে পাকিস্তান নিজস্ব নিরাপত্তার সকল জিম্মাদারী কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সমর্পণ করেন। ৭ই অক্টোবর ইয়াহিয়া উপমহাদেশে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি রোধকল্পে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগ’ কামনা করে কিসিঞ্জারকে এক জরুরী বার্তা পাঠান। কিসিঞ্জার ঐ দিনই ‘উপমহাদেশে যুদ্ধের আশঙ্কা রোধ করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের National Security Council (NSC)-এর কার্যকরী উপসংস্থা Washington Special Action Group (WSAG)-এর জরুরী বৈঠক তলব করেন। এই উপসংস্থা ক্রমবর্ধমান বিপদ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য পাক-ভারত সীমান্ত থেকে উভয়পক্ষেও সৈন্য প্রত্যাহার করার পক্ষে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে অন্যতম মূল উদ্যোগ ছিল সীমান্ত থেকে সৈন্য অপসারণ এবং বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা প্রেরণ বন্ধের ব্যাপারে ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নকে সম্মত করানো। অবশ্য সরাসরি ভারতের উপর চাপ প্রয়োগের ব্যাপারেও মার্কিন সরকারের কোন কুণ্ঠা ছিল না। ১২ই অক্টোবর দিল্লীস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্পষ্ট ভাষায় অবহিত করেন, ভারত যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য প্রদান থেকে নিবৃত্ত না হয় তবে পাকিস্তান পশ্চিম দিক থেকে ভারত আক্রমণ করবে।

বৃহৎ শক্তির পর্যায়ে উত্তেজনা হ্রাসের এক সম্ভাবনা বিরাজমান থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ভারতের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে সোভিয়েট সহযোগিতা লাভের আশা করেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে সোভিয়েট ভূমিকা ছিল ভিন্নতর। সোভিয়েট ইউনিয়ন উদ্ভূত সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পক্ষপাতী ছিল ঠিকই কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা যে ভারত-সোভিয়েট যুক্তইশতেহারে বর্ণিত রাজনৈতিক দাবীর অনুবর্তী, তা পুনর্ব্যক্ত করা হয় ১০ই অক্টোবরে প্রাভদায় প্রকাশিত পাঁচ কলাম দীর্ঘ এক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে। তারপরেও সোভিয়েট মনোভাব পরিবর্তন করার জন্য মার্কিন তৎপরতা ক্রমশই জোরদার হতে থাকে।

কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ১২ই অক্টোবর ইয়াহিয়া খানের নতুন আর এক কর্মসূচী ঘোষিত হয়। এতদিন শেখ মুজিবের মুক্তি, পূর্ববঙ্গবাসীর অবিচ্ছেদ্য অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিকে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং সম্মান ও নিরাপত্তাসহ শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনের দাবীতে সোভিয়েট সরকারী প্রচারমাধ্যমগুলি উত্তরোত্তর সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর কোন কিছুই যে পাকিস্তানী শাসকদের চিন্তাভাবনাকে সামান্যতম অর্থেও প্রভাবিত করেনি, ইয়াহিয়ার বক্তৃতা ছিল তারই প্রমাণ। ইয়াহিয়া এই বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপোস রফার কোন তোয়াক্কা না করেই অবৈধভাবে শূন্য ঘোষিত জাতীয় পরিষদের ৭৮টি আসনে ২৩শে ডিসেম্বরের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ২৭শে ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এর পাশাপাশি পাকিস্তান পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলের সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ সম্পন্ন করার ফলে এই আশঙ্কা স্পষ্টতর হয়, যে প্রকারেই হোক পূর্ব বাংলার উপর নিজেদের দখল কায়েম রাখাই পাকিস্তানের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই পটভূমিতে ‘উপমহাদেশে উত্তেজনা হ্রাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রকৃত মর্ম কি তা সোভিয়েট ইউনিয়নের পক্ষে অনুমান করা কঠিন হয়নি। অপরদিকে শরণার্থী সমস্যা ভারতের জন্য চিরস্থায়ী বোঝা হয়ে উঠতে পারে এই মর্মে ভারতের বিরোধীদলসমূহের প্রচারণায় কংগ্রেস সরকারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ যে ক্রমেই আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে এবং কংগ্রেস দলের মঙ্গল-অমঙ্গল যে বহুলাংশেই স্বচ্ছতর সোভিয়েট ভূমিকার উপর নির্ভরশীল, তাও সম্ভবত সোভিয়েট কর্তৃপক্ষের তখন আর অজানা নয়। নববর্ষে ভারতের নয়টি রাজ্যে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের মুখে বাংলাদেশ–সমস্যা নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থার জন্য দক্ষিণপন্থী দলগুলির প্রচারণা কংগ্রেস সরকার এবং ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তির বিরুদ্ধে সমভাবেই তীব্রতর হতে থাকে।

এই অবস্থায় ১৬ই অক্টোবর সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদার ‘রাজনৈতিক ভাষ্যকার’ (সম্ভবত সোভিয়েট পার্টির কোন ঊধ্বর্তন মুখপাত্র) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, উপমহাদেশে উত্তেজনার কারণ এবং এই উত্তেজনার দ্রুত বৃদ্ধির সমস্ত দোষ সর্বতোভাবেই পাকিস্তানের একার। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সোভিয়েট মনোভাব উত্তরোত্তর কঠোর হয়ে ওঠা সত্ত্বেও ১৮ই অক্টোবর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বীম মস্কোয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর কাছে পাক-ভারত সীমান্ত থেকে উভয়পক্ষেও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন-সোভিয়েট যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ সেক্রেটারী জেনারেল উ থানট অন্তত বাংলাদেশ প্রশ্নে প্রায়শ মার্কিন উদ্যোগের এক পরিপূরক। ভূমিকা গ্রহণের প্রবণতা দেখাতেন। ২০শে অক্টোবরে তিনি পাকিস্তান ও ভারতের কাছে সমগ্র সীমান্ত বরাবর জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদল নিয়োগের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব করেন। ২১শে অক্টোবর ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে ‘ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে উভয়পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার করার অনুকূলে ত্বরিত সম্মতি জানান। ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক জবাব অনেক পরে দেওয়া হলেও, অন্য সূত্র থেকে ভারতের বক্তব্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানানো হয়: ‘বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক নিষ্পত্তি এবং শরণার্থীদের সসম্মানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে পাকিস্তানের সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত ভারতের পক্ষে সৈন্য প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়; বিশেষত সীমান্ত থেকে ভারতের সৈন্য ঘাঁটিগুলি তুলনামূলকভাবে দূরে অবস্থিত হওয়ায় জরুরী অবস্থায় সৈন্য সমাবেশ যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

২২শে অক্টোবর সোভিয়েট সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন দিল্লী এসে পৌঁছান। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বীমের পাঁচ দিন আগের প্রস্তাবের জবাবে ২৩শে অক্টোবর সোভিয়েট কর্তৃপক্ষ মার্কিন সরকারকে জানিয়ে দেন যে, শেখ মুজিবের মুক্তি এবং পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত রাজনৈতিক নিষ্পত্তি সাধন’ ব্যতীত কেবল সীমান্ত অঞ্চল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুদ্ধের আশঙ্কা রোধ করা সম্ভব নয়। এদিকে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনয়নের জন্য, বিশেষত শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের সমস্যা ও ভূমিকা পশ্চিম ইউরোপের কাছে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ইন্দিরা গান্ধী ২৪শে অক্টোবরে দীর্ঘ উনিশ দিনের জন্য পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দিল্লী ত্যাগ করেন। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সব সাক্ষাৎকার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলির জন্য এত বেশী জল্পনা-কল্পনার বিষয় ছিল যে, ফিরুবিনের ভারত সফরের গুরুত্ব বিশেষ কোন প্রাধান্য লাভ করেনি। কিন্তু ২৭শে অক্টোবর ফিরুবিনের ভারত সফর শেষ হওয়ার পর দুই দেশের পক্ষ থেকে প্রচারিত এক যুক্ত ঘোষণায় বলা হয়, বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক শান্তি বিপন্ন হয়ে পড়ায় ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তির নবম ধারার অধীনে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সোভিয়েট ইউনিয়ন ভারতের সঙ্গে পূর্ণরূপে একমত যে পাকিস্তান খুব শীঘ্র আক্রমণাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে পারে।” ফিরুবিনের প্রত্যাবর্তনের তিন দিনের মধ্যে সোভিয়েট বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল কুটকভের নেতৃত্বে এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোভিয়েট সামরিক মিশন দিল্লী রওয়ানা হয়। ১লা নভেম্বর থেকে আকাশ পথে শুরু হয় ভারতের জন্য সোভিয়েট সামরিক সরবরাহ।

অক্টোবরে অধিকৃত অঞ্চলে পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যা, সন্ত্রাস ও নিপীড়নের শাসন তখনও বলবৎ। এই হত্যা ও সন্ত্রাসের উপর একটা শাসনতান্ত্রিক আবরণ লাগানোর আয়োজনই ছিল ইয়াহিয়ার ১২ই অক্টোবরের বক্তৃতার মর্মকথা। ইয়াহিয়া যাতে এই দুষ্কর্ম সমাধা করার সুযোগ পায়, এ জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহার এবং এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ছাড়া, সীমান্ত থেকে উভয় দেশের সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগের মার্কিন প্রস্তাবের পিছনে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পারাপার দুরূহ করে তোলার গূঢ় উদ্দেশ্য। কিন্তু জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগ কেবলমাত্র নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত বলেই সম্ভব। ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন সোভিয়েট ইউনিয়নকে এ ব্যাপারে সম্মত করানোর প্রয়োজন ছিল তাই সর্বাধিক। দৃশ্যত সোভিয়েট ইউনিয়ন পাকিস্তানের জন্য এই সঙ্কট থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার একটি মাত্র পথই খোলা রেখেছিল-তথা, শেখ মুজিবের মুক্তিসহ পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক বাসনা ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতে উদ্ভূত সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান এবং পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ সকল শরণার্থীর দ্রুত স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতকরণ। কিন্তু এই সব দাবী মেনে নেবার পর পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তানী রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা যে কার্যত অসম্ভব, এই উপলব্ধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও সম্ভবত পূর্ণ মাত্রাতেই ছিল। কাজেই পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তানের নগ্ন সামরিক দখল বৈধকরণ একমাত্র উপায় হিসাবে-ইয়াহিয়া ১২ই অক্টোবরের ঘোষণা অনুযায়ী–৭৮টি জাতীয় পরিষদ আসনে প্রহসনমূলক উপনির্বাচন সমাপ্ত করা, ইয়াহিয়ার ‘বিশেষজ্ঞ প্রণীত শাসনতন্ত্রের পক্ষে জাতীয় পরিষদের অনুমোদন লাভ করা এবং বেসামরিক প্রতিনিধিদের কাছে। ‘শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পন্ন করার জন্য ইয়াহিয়ার প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া এবং ইত্যবসরে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের সহায়হায় মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতীয় সহযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টাই ছিল মার্কিন কূটনৈতিক উদ্যোগের মূল কথা।

অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ এই মর্মে গৃহীত মার্কিন কূটনৈতিক উদ্যোগের ব্যর্থতা যখন স্পষ্ট হয়, তখনই অথবা তারও আগে কিসিঞ্জার পাকিস্তানের পক্ষে প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বিবেচনা করেছিলেন কি না, তা আজও অজ্ঞাত। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে মার্কিন হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। এর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুসৃত পন্থা ছিল মার্কিন নৌসেনার অবতরণ যেমন ঘটেছিল পঞ্চাশের দশকে লেবাননে, ষাটের দশকে ডোমিনিকান রিপাবলিকে। কিন্তু ষাটের দশকের প্রারম্ভে দক্ষিণ ভিয়েতনামের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ ধ্বংস ও হত্যার বিভীষিকা তুলনাহীনভাবে প্রসারিত করে। এর ফলে খোদ আমেরিকার সর্বত্র অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সামরিক হস্তক্ষেপ করার সরকারী নীতির বিরুদ্ধে এক প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে এই হস্তক্ষেপবিরোধী জনমত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য বিরাটভাবে সহায়ক হয়। বাংলাদেশ প্রশ্নেও–বিশেষত পাকিস্তানী জান্তার অমানুষিক বর্বরতা এবং এই জান্তার সমর্থনে নিক্সন প্রশাসনের সহযোগিতার নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন সিনেট, হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ, সংবাদমাধ্যম ও সাধারণ জনমত উত্তরোত্তর এমনভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে শুরু করে যে, মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধ করার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্যোগ নেওয়া রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত দুরূহ হবে বলে মনে হয়। পক্ষান্তরে দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদী মার্কিন স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে জোট-নিরপেক্ষ ভারতের প্রাধান্য ও ক্ষমতা প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা মার্কিন প্রশাসনের একটি মৌল প্রয়োজন বলে পরিগণিত হওয়ায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাকে কোন সময়েই আমাদের পক্ষে নাকচ করা সম্ভব হয়নি।

বরং ২৫শে অক্টোবরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে চীনের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব পুনর্বার উত্থাপিত হওয়ার প্রাক্কালে ‘নিক্সনের সফরসূচী চূড়ান্তকরণের জন্য পিকিং ও কিসিঞ্জারের প্রায় সপ্তাহব্যাপী আলোচনা, চীনের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে তেইশ বছর দীর্ঘ মার্কিন বিরোধিতার অবসানান্তে চীনের সদস্যপদ লাভ প্রভৃতি ঘটনার তাৎপর্য আমাদের মুক্তিসংগ্রামের জন্য কি দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে নানা জিজ্ঞাসার উদয় ঘটে। চীন ও আমেরিকার সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাকিস্তান যেটুকু সহায়তা করেছিল, তার বিনিময়ে পাকিস্তানের স্থিতাবস্থা রক্ষার জন্য এই দুই শক্তির সমঝোতা ঘটা আমাদের জন্য অচিন্তনীয় ছিল না। বরং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনা থেকে এই সব জিজ্ঞাসা নির্দিষ্ট সন্দেহে পরিণত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *