অধ্যায় ১১: আগষ্ট – সেপ্টেম্বর

অধ্যায় ১১: আগষ্ট -সেপ্টেম্বর

ভারতের বাংলাদেশ বিষয়ক কর্মসূচীর প্রধান নিয়ন্ত্রকের পদে পরিবর্তনের সংবাদ আমাদের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক ছিল না। ভারতের ক্ষমতাযন্ত্রে বাম ও দক্ষিণের নেপথ্য টানাপোড়েন তখনও আমাদের সম্যক উপলব্ধির অন্তর্গত নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের সুস্পষ্ট ইচ্ছা ব্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও ‘মুজিব বাহিনী’কে’ বাংলাদেশ কমান্ডের অধীনস্থ করার প্রশ্নে ভারতীয় প্রশাসনের এক শক্তিশালী অংশের অসহযোগিতা এই সংশয়ের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। এতদিন অবধি বাংলাদেশ-সংক্রান্ত ভারতের নীতি ও কর্মসূচীর পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতেন প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি. এন. হাকসার। তার সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার নৈকট্য প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে মাত্র। কিন্তু সমস্যার কলেবর উত্তরোত্তর বিশাল ও জটিল হয়ে ওঠায় এবং বিশেষত হাকসারের অবসর গ্রহণের মেয়াদ নিকটবর্তী হওয়ায় ভারত সরকার তাদের বাংলাদেশ বিষয়ক সমস্যার সামগ্রিক ও সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ডি. পি. ধরকে নিযুক্ত করেন। এ জন্য ইতিমধ্যেই ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদাসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘পলিসি প্লানিং কমিটির চেয়ারম্যান পদে তার নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। ৬ই সেপ্টেম্বর সামগ্রিক দায়িত্বভার গ্রহণের আগে আলোচনাধীন নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে মতবিনিময় ছাড়াও বাংলাদেশের প্রবাসী নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনৈতিক উপাদান সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা গঠন করার উদ্দেশ্যে ডি. পি. ধর ২৯শে। আগস্ট সকালে কোলকাতা আসেন। কিন্তু অন্তত কয়েকটি বিষয়ে তাঁর উদ্যোগের গতি ও ধরন থেকে আমাদের মনে হয়, ভারত সরকার অবশেষে একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে সমগ্র ঘটনাধারাকে পরিচালিত করার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ। অধিকৃত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পরিসর ও তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য যুব শিবিরের সম্প্রসারন থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সহায়তা ক্রমশ এক সুসমন্বিত সম্প্রসারণের রূপ ধারণ করতে শুরু করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষত স্বাধীনতা-সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলিকে একটি ফোরামে একত্রিত করার ব্যাপারে ডি. পি. ধরের ব্যগ্রতা আমাদের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়। এ ক’দিনের আলাপ আলোচনা সম্পর্কে আমার নোটের উদ্ধৃতিই সম্ভবত পরিস্থিতির অধিকতর নির্ভরযোগ্য বর্ণনাঃ

২৯শে আগস্ট

‘Missed the appointment a 10:30 am with DP… and arrived Hotel Hindustan at 11:45 am when he was already in session with the Acting President and the PM… I met DP at past 12:30. He wanted an overall political appreciation of the current situation. As the political leadership was still suffering from lack of cohesion and frittering its energy on matters of secondary interest, the sector war was progressively faltering and FFs facing enormous political pressure inside the country, I suggested the need/possibility of a fresh bold move to inject some efficiency in the insurgency management by inducting middle level politicos belonging to AL and non-Al streams including some civil servants, without disturbing the formal structure of the Government. This middle level task force could work under the PM and its operational structure could be the proposed national united front. But the front itself was still facing covert opposition from within the cabinet and would require GOI’s (Government or India’s) strong support to overcome the opposition.

‘DP’s reply appeared to be well-formulated: (1) cabinet’s functioning must be improved and unity strengthened and he wanted to find out its modalities; (2) multi-party alliance was a must also for the external reasons and he was keen to know the details of actual progress made so far….

‘I briefed him about the situation… DP wanted a second meeting with me in the evening after his scheduled meeting with the cabinet later in the afternoon.

‘In the evening DP told me that the proposal for the united front was supported by all the members of the cabinet except Tajuddin who remained silent. DP was puzzled, unhappy. I assured him once again about Tajuddin’s view about unity and suggested that two of them should have an exclusive meeting next day. Went to brief Tajuddin about both the sessions.”

৩০শে আগস্ট

‘Met DP briefly during the evening. He was apparently happy after having a discussion with Tajuddin but seemed a little worried about his ability to understand Bengali politicians’ mind….

৩১শে আগস্ট

‘DP met the cabinet again and requested for a specific date, modality etc. for the formation of a united forum, when they (the ministers) persisted in being vague about every thing on the ground that it would take time to remould the views of the party leaders since the move itself was unpopular with (the rank and file of) the AL. DP was nearly blunt in telling them that as the GOI was rendering all possible help to the BD Govt. since the crackdown without expecting anything in return and as India was facing a massive threat to its security due to BD problem, the time has come when the GOI must request BD Govt. to form a broad national alliance so that GOI can persuade the friendly powers to support the BD cause, even if tacitly and make them) agree to resolve India’s security problem. Otherwise the whole episode was fast becoming untenable for India, he mentioned. ‘I met Taj and DP separately during the evening. Taj said that finally it was going to work.

১লা সেপ্টেম্বর

‘Met DP at 3:45pm at his hotel and pressed for lifting the restriction against the left elements from being recruited and trained as FF. DP saw no difficulty in removing such restrictions from GOI’s side after the formation of the multi party alliance, but it would require endorsement from the BD Govt. atleast from its PM, before such recruitment was (actually) started.

‘As I mentioned the need for putting ‘Mujib Bahini? under BD command, after narrating the instances of their-disruptive activities, he agreed that these should be effectively stopped and hinted the difficulties of bringing it out of the control of the Indian agency. He suggested that Taj should sent an emissary with relevant facts to Kao and, after having this ground work done, the problem could be taken up ‘at the highest level, if required.

“In the absence of unity in outlook and common approach within in the cabinet, (DP said), he had made it known that (from then onwards) GOI would entertain only those requests which would atleast be agreed jointly be the PM and the President; and Mr. Abdus Samad Azad had been entrusted with the special responsibility for developing Taj-Nazrul relationship..

He said that he was impressed by the clarity of thought and sincerity of Tajuddin but hinted that he (Tajuddin) should try to resolve his political isolation fast.’

কোলকাতায় চারদিন অবস্থানকালে বাংলাদেশের প্রবাসী মন্ত্রিসভা, রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে ডি. পি. ঘরের আলোচনা কয়েকটি ফলদায়ক সিদ্ধান্ত ছাড়াও সামগ্রিকভাবে এমন ধারণার সৃষ্টি করে যে, অবশেষে ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তি ত্বরান্বিত করার কাজে এক গতিশীল সহায়তা কর্মসূচী গ্রহণে উদ্যোগী। এধান যে দু’টি রাজনৈতিক বিষয়ে তার আলোচনা কেন্দ্রীভূত থাকতে দেখা যায়, তার একটি বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে এবং অপরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাসমর্থক সমস্ত রাজনৈতিক দলকে একটি জাতীয় ফোরামে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে। মুক্তিযুদ্ধের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এবং রাজনৈতিক কাজকর্মে মন্ত্রিসভাকে অপেক্ষাকৃত ঐক্যবদ্ধ করার উপায় অন্বেষণের সদিচ্ছা নিয়ে শুরু করলেও ডি. পি. ধরের আলোচনা শেষ পর্যন্ত কেবল দুই সরকারের মধ্যে যোগাযোগের পদ্ধতি নিরূপণেই সক্ষম হয়। অতঃপর যে সমস্ত বিষয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী একত্রে সাব্যস্ত করবেন, ভারত সরকারের পক্ষে কেবল সে সব বিষয়েই যথাসম্ভব সহযোগিতা প্রদান করা হবে বলে তিনি জানান।

এ যাবত অধিকার ও ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার কোন কোন সদস্য নিজকে প্রধানমন্ত্রী সমকক্ষ হিসাবে জ্ঞান করায়–কি ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় (মূলত সহায়তা সংগ্রহের) প্রশ্নে, কি তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের ক্ষেত্রে–শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের প্রশ্নকে তাঁরা অনেক সময় উপেক্ষা করতেন। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রশ্ন ছাড়াও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রাজনৈতিক প্রয়োজন এবং মুক্তিযুদ্ধ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যও ছিল বিশাল। সমস্যা যদি কেবল এইটুকুই থাকতো তবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর যুগ্ম সিদ্ধান্তের পদ্ধতি গৃহীত হবার পর মন্ত্রিসভাকে ক্রমশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তোলা সম্ভব হত। কিন্তু বাস্তবে তখন উপদলীয় পরিস্থিতি গোপন বৈদেশিক হস্তক্ষেপের ফলে ছিল অত্যন্ত জটিল ও বিস্ফোরণোন্মুখ।

ডি. পি. ধরের সফরের দ্বিতীয় প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশর অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বামপন্থী দলসমূহকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল শক্তি আওয়ামী লীগের সঙ্গে এমনভাবে গ্রথিত করা, যাতে এই সংগ্রাম জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের রূপ লাভ করে এবং যার ফলে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তিকে কেবলমাত্র নিরাপত্তার বর্ম হিসাবে ব্যবহার না করে বাংলাদেশে পাকিস্তানী দখল বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান সহায়ক উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এই রণনৈতিক বিবেচনা থেকে বহত্তর ঐক্য সাধনের জন্য ডি. পি. ধর অত্যন্ত স্বল্প সময়সীমার মাঝে (অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের শেষে ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফর শুরু হবার আগে) বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার অনিচ্ছুক অংশকে ঐক্যজোট প্রস্তাবে যে পদ্ধতিতে সম্মত করান, তা সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরাগ উৎপাদন করে। তদুপরি দিল্লীর সাথে মন্ত্রীদের সরাসরি সংযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে নতুন বিধিনিষেধজনিত ক্ষোভও সম্ভবত এর সাথে যুক্ত হয়।

অন্যদিকে ডি. পি. ধর এই চারদিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং এর রাজনৈতিক উপাদান সম্পর্কে যে ধারণা গঠন করেন, তা পরবর্তী চার মাসের ঘটনাধারার বিকাশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তাঁর দিল্লী প্রত্যাবর্তনের পর পরই বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা প্রস্তাবিত জাতীয় মোর্চার নির্দিষ্ট কাঠামো ও ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু এদের কোন কোন সদস্যের অভিমতকে প্রতিধ্বনিত করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিভিন্ন স্তরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের জন্য ভারত সরকারের ‘চাপ’ এ ‘হস্তক্ষেপের’ বিরুদ্ধে ক্ষোভের গুঞ্জন শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রিসভা জাতীয় ঐক্যজোট গঠন করেন ঠিকই, তবে এই জোটকে কোন কার্যকরী সংগঠনের রূপ না দিয়ে নিছক এক উপদেষ্টা সংস্থার মর্যাদা দান করেন এবং এর অধিকার সীমিত করেন মুক্তিসংগ্রামের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দানের মধ্যে। কিন্তু এই পরামর্শ দান প্রক্রিয়া কিভাবে বা কত নিয়মিত সংঘটিত হবে, সে বিষয়টিও সর্বাংশে অস্পষ্ট থাকে। অন্য কথায়, বৃহত্তর রণনৈতিক বিবেচনা থেকে জাতীয় মোর্চা গঠনের জন্য ভারতের জোরাল অভিমতের কথা বিবেচনা করে মন্ত্রিসভা ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনে সম্মত হলেও সাংগঠনিক অর্থে এই মোর্চা একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানের রূপ লাভ করে।

কিন্তু বাংলাদেশের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে, এই বিশেষ সময়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মূল প্রয়োজনই ছিল রাজনৈতিক। ইতিপূর্বে মে-জুন মাসে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতীয় সহায়তার মাত্রা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এবং এই সহায়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্তরায়স্বরূপ পাক-চীন মিলিত আক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করার উদ্দেশ্যে, ভারত-সোভিয়েট সমঝোতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অত্যাবশ্যক বলে মনে করা হয় এবং এই লক্ষ্যে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের বিষয় উত্থাপন করা হয়। তবু মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আরো কিছু অতিরিক্ত বিবেচনা ফ্রন্ট গঠনের চিন্তার সাথে ক্রমশ যুক্ত হতে থাকে। যেমন জুলাইয়ের শেষ দিকে ‘শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের ক্রমবর্ধিত দৌরাত্মের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় রাখার জন্য দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক কর্মীদের ফেরৎ পাঠিয়ে গোপন সহায়ক সংগঠন নির্মাণ করা অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয়। এই উদ্দেশ্যে পরিষদ সদস্যদের সমবায়ে গঠিত বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিল এবং আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার উন্নতি ঘটে সামান্যই। তারও আগে অর্থাৎ মে-জুন মাসে ‘মুজিব বাহিনী’ দেশের ভিতরে গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী রাজনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হবে বলে অনুমান করা হলেও কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। দেশের ভিতরে এই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করার উদ্দেশ্যে-বিশেষত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও সংশ্লিষ্ট ন্যাপের কর্মীদের আগ্রহ ও মনোভাব বিবেচনা করে এক বহুদলীয় কেন্দ্রীয় সংগঠনের অধীনে পরীক্ষামূলকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক রাজনৈতিক সংগঠন তৈরী করার চেষ্টা তাজউদ্দিন যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন।

‘শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের দৌরাত্ম মোকাবিলা করার প্রশ্ন ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় ও সংহত করে তোলার নিজস্ব কতকগুলি সমস্যা ছিল। জুন-জুলাই থেকে তরুণ যুদ্ধ-অনভিজ্ঞ যোদ্ধাদের ছোট ছোট দল অতি স্বল্প পরিমাণ বিস্ফোরক ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এবং নামমাত্র পাথেয় সম্বল করে সীমান্ত অতিক্রম করা মাত্র প্রায়শই যে বিপদ-সঙ্কুল বা অসংগঠিত অবস্থার মাঝে নিক্ষিপ্ত হত, সেই অবস্থার মাঝে অনেক যোদ্ধাকেই নিছক উপস্থিত বুদ্ধির জোরে টিকে থাকতে হয়েছে এবং অনেকে এর ফলে লক্ষ্য-বিচ্যুতও হয়েছে। এ ছাড়া ভ্রান্ত রিক্রুটিং পদ্ধতির জন্য কিছু স্বার্থবুদ্ধিপ্রবণ তরুণেরও সমাবেশ ঘটে। তখন থেকেই দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেয়–কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্যেই নয়, তাদের সমন্বিত ও নিয়ন্ত্রিত করার স্বার্থেও। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন আঞ্চলিক কাউন্সিল থেকেও প্রায় একই মর্মে কিছু রিপোর্ট আসতে শুরু করে।

কিন্তু এ জন্য যে ধরনের কার্যকরী ক্ষমতা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হাতে ন্যস্ত করার প্রয়োজন ছিল মন্ত্রিসভা তা না করায় ফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ব্যবস্থাপনা উন্নত করার সুযোগ নষ্ট হয়। এই অবস্থার শেষ চেষ্টা হিসাবে তাজউদ্দিন মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অমান্য না করেও প্রস্তাবিত ‘উপদেষ্টা কমিটি’কে অপেক্ষাকৃত সক্রিয় সংগঠনে রূপান্তরিত করার সুযোগ উন্মুক্ত রাখার জন্য এর প্রতিনিধি সংখ্যা বৃদ্ধি করে একটি সেক্রেটারীয়েট স্থাপনে সচেষ্ট হন, যাতে অন্তত শুরু থেকেই স্বাধীনতা সমর্থক দলগুলির যোগাযোগ একটি নিয়মিত ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে। মন্ত্রিসভার গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রস্তাব তাঁর পক্ষে উত্থাপন করা অসুবিধাজনক বলে তিনি প্রস্তাবটি পেশ করার জন্য ৭ই সেপ্টেম্বর ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কাছে অনুরোধ করে পাঠান এবং তাঁকে দেখা করতে বলেন।

পরদিন ৮ই সেপ্টেম্বর সকাল দশটায় জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের জন্য পাঁচ দলের নেতৃবন্দ কোলকাতায় মিলিত হন। মন্ত্রিসভার প্রতিনিধিরা ছাড়াও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ, ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর এই বৈঠকে যোগদান করেন। একই উদ্দেশ্যে দেরাদুন থেকে এসে পৌঁছান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সংক্ষিপ্ত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ-আলোচনার পর তারা জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেন। মন্ত্রিসভার দু’জন সদস্য, তাজউদ্দিন ও খোন্দকার মোশতাক ছাড়াও আওয়ামী লীগ থেকে আরও দু’জন প্রতিনিধি এবং অন্য চারটি দল থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ। আগের দিন তাজউদ্দিনের অনুরোধ সত্ত্বেও অজ্ঞাত ব্যস্ততার দরুন মোজাফফর প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে উঠতে পারেননি এবং পরদিন তিনি উত্থাপিত প্রস্তাব সমর্থন করেন। এরপর এই ক্ষুদ্র কমিটির জন্য সর্বসম্মতিক্রমে তাজউদ্দিন আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। অতঃপর পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে অবিচল আস্থা জ্ঞাপন, শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী, ভারত সরকারের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং বাংলাদেশ সরকারের নীতির প্রতি আস্থাসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করে উপদেষ্টা কমিটির সভা শেষ হয়। এমনিভাবে জাতীয় ঐক্যজোটকে একটি সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করার যে সামান্য সম্ভাবনা ছিল তা নিঃশেষিত হয়। তবে এই ঐক্যজোট যত দুর্বলই হোক, তা বৃহত্তর রণনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক শক্তি-সম্পর্ককে বাংলাদেশের অনুকূলে আনার পক্ষে সহায়ক হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *