অধ্যায় ০৬: মে – জুন

অধ্যায় ৬: মে – জুন

আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ভারতের তুলনামূলক দুর্বলতা ও একাকিত্ব এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ক্ষেত্রে এর সঠিক তাৎপর্য অন্বেষণই ১২ই ও ১৩ই মে কোলকাতায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও আমার মধ্যকার প্রথম বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। এপ্রিল মাসে ঢাকায় কিছু রাজনীতি সচেতন ব্যক্তির সহযোগে এক গোপন প্রতিরোধ সংগঠন গড়ে তোলার এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং তদনুসারে ‘মুজিবনগরের উদ্দেশে স্বল্পকালের জন্য আমি ঢাকা ত্যাগ। করি। ঢাকা টেলিভিশনের তদানীন্তন মহা-ব্যবস্থাপক জামিল চৌধুরী আমার সহযাত্রী ছিলেন। ৫ই মে আগরতলা অঞ্চলে সীমান্ত অতিক্রম করার পর সপ্তাহকালের মধ্যে কোলকাতায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়। তাজউদ্দিন তার আগের দিন দিল্লী থেকে তাঁর দ্বিতীয় সফর শেষ করে ফিরেছেন। প্রায় সাত সপ্তাহের ব্যবধানে তার সাথে আমার দেখা–প্রবাসে এবং সম্পূর্ণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। কয়েকদিন ধরে কোলকাতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু অনিশ্চয়তাবোধ ও হতাশার ভাব লক্ষ্য করার পর তাজউদ্দিনকে আমি দেখতে পাই স্বাধীনতাযুদ্ধের সাফল্য সম্পর্কে অবিচল আস্থাশীল।

উল্লেখিত দুদিনে আলোচনা অধিকাংশ সময় আমাদের দুজনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে–মোট প্রায় সাত-আট ঘণ্টা ধরে। দেশের সর্বশেষ আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, প্রবাসী সরকার এবং রাজনৈতিক দলসমূহের দ্বন্দ্ব সমন্বয় প্রচেষ্টা, বিদ্রোহী সেনাদের অস্ত্র, মনোবল ও প্রস্তুতির সমস্যা, মুক্তিসংগ্রামের প্রশ্নে ভারতীয় রাজনৈতিক দলসমূহের ভূমিকা ও মনোভাব, ভারত সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সাহায্য ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিকল্প পদক্ষেপ, অমীমাংসিত পাক-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা–এই সমুদয় বিষয় নিয়েই কমবেশী আলোচনা হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে, ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে কতদূর অবধি সাহায্য করতে সম হবে, এ প্রশ্ন আমি তুলি। এর কোন প্রত্যক্ষ জবাব না দিয়ে তাজউদ্দিন কেবল জানান, মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সম্পর্কে তার কোন সন্দেহ নেই।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের সমক্ষতা সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্নকে আরও বেশী নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে দেখার প্রয়াস চলে। আমার বিবেচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতি যদি আক্ষরিক অর্থে পালিত হয়, তবে তার ফলে একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব, তেমনি অন্যদিকে তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে পাকিস্তানের পক্ষেও সংঘর্ষকে তার নিজের সীমান্তের বাইরের সম্প্রসারিত করা স্বাভাবিক। এবং সম্ভবত এক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষে চীনের প্রত্যক্ষ সামরিক সহযোগিতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সমর্থন ও সামরিক সাহায্য লাভ করা খুবই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে, সামরিক দিক থেকে ভারত মূলত নিঃসঙ্গ এবং সেই কারণে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান যদি তার গৃহযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধে পরিণত করতে চায়, তবে সেই ঝুঁকি মাথায় করে একাকী ভারতের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা বেশীদূর কি সম্ভব হবে?

বিষয়টি আর গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয় দুটি মূল প্রতিপাদ্য থেকে। প্রথমত, আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে নিজস্ব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভারতের পক্ষে অবশিষ্ট বিকল্প শক্তি তথা সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে কোন নির্দিষ্ট সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব কিনা। চীনের উত্তর সীমান্তে উসুরী নদী বরাবর এবং সিনকিয়াং প্রদেশের পশ্চিমে মোতায়েন সোভিয়েট ইউনিয়নের অন্ন চল্লিশ ডিভিশন সৈন্য চীনের ভারতবিরোধী সামরিক প্রবণতার সম্ভাব্য প্রতিবন্ধক হতে পারে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করার উদ্ভূত ঝুঁকি প্রতিবিধানের জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের তদ্রপ সমঝোতা ও সহযোগিতার আশ্বাস ভারতের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব কিনা, তা আমাদের অজানা ছিল। দ্বিতীয়ত, আমাদের আরও জানা প্রয়োজন ছিল, বহু শ্রেণীর স্বার্থ ও মতের টানাপোড়েনে গঠিত ভারতের জাতীয় সরকার এবং বিশেষত এর দক্ষিণপন্থী অংশ ভারতের? বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন মৌলিক রূপান্তর আদৌ কার্যকর হতে দেবে কিনা। এই দুই প্রশ্নের যথার্থ উত্তরের উপর ভিত্তি করে ভারতের সমতা সম্পর্কে মোটামুটি সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। ভারতের উত্তর সীমান্তের নিরাপত্তা সুদৃঢ় করে তার সামরিক ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা না বাড়ানো অবধি মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক সংখ্যা বৃদ্ধি, তথা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রায়িতকরণ, সীমান্তযুদ্ধ পরিচালন, ভারতের সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন ও সংরক্ষণ ইত্যাদি সকল ব্যাপারে অগ্রগতির সম্ভাবনা সীমিত বলে আমাদের আশঙ্কা জন্মায়। ভারতের ক্ষমতাসীন মহলে বেসরকারী আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয় দুটি সম্পর্কে যথার্থ ধারণা গঠনের উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিন আমাকে দিল্লী যেতে এবং আমার ঢাকা প্রত্যাবর্তনের কর্মসূচী পরিত্যাগ করে পলিসি পরিকল্পনায় তাকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেন।

তারপর আরো এক সপ্তাহ ধরে কোলকাতায় বিষয়টির সংশ্লিষ্ট অপরাপর দিক নিয়ে তাজউদ্দিনের সাথে আরও তিন/চার-দফা আলোচনা হয়। ফলে আমাদের প্রেক্ষিতবোধ আরও কিছুটা প্রসারিত হয়। ভারতের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েট সহযোগিতা লাভের উদ্যোগ মূলত ভারতেরই নিজস্ব ব্যাপার। তবু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই যেহেতু ভারতের এই নতুন নিরাপত্তাহীনতাবোধের মূলে, সেহেতু বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এই মুক্তিযুদ্ধকে একটা বিবেচনাযোগ্য বিষয় হিসাবে সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে উপস্থিত করার প্রয়োজন আমরা অনুভব করি। এর কিছু আগে সোভিয়েট সমর্থন লাভের জন্য আবদুস সামাদ আজাদ বুডাপেস্টে শান্তি সম্মেলনে যোগদান শেষে মস্কোতে প্রেরিত হন। বুড়াপেস্ট শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে সমাজতন্ত্রী দেশগুলির উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু মস্কোতে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি সোভিয়েট সরকার বা পার্টির কারো সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় অসমর্থ হন।৪৯ পাকিস্তানী হত্যাযজ্ঞের কঠোর সমালোচনা করে রক্তপাত বন্ধের জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট পোদগর্নি জোরাল আবেদন জানালেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা তখনও সোভিয়েট ইউনিয়নের নিকট কোন বিবেচনাযোগ্য রাজনৈতিক ইস্যু নয়। বস্তুত ১৯৭১ সালের মার্চে ভারতে ইন্দিরা গান্ধী এবং তার কিছু পূর্বে শ্রীলঙ্কায় শ্রীমাভো বন্দরনায়েক ও পাকিস্তানে শেখ মুজিব বিপুল ভোটাধিক্যে জয়যুক্ত হওয়ায় সমগ্র উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সোভিয়েট ইউনিয়নের সন্তুষ্ট বোধ করার কারণ ছিল। এই অবস্থায় রক্তাক্ত অভিযান থেকে ইয়াহিয়াকে নিবৃত্ত করে পাকিস্তানে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠাই যদি পোদগর্নির ২রা এপ্রিলের বিবৃতির প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে তাকে অযৌক্তিক মনে করার কারণ নেই।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সোভিয়েট ইউনিয়নসহ বিশ্বের অপরাপর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করার দ্ব্যর্থহীন আহ্বান জানান। পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মার্কিনী সামরিক জোট-ঘেঁষা বৈদেশিক নীতির জন্য (এবং ষাট দশকের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ জোট-নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করা সত্ত্বেও) আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহলে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যে ধারণা বিদ্যমান ছিল তা দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগ অনেকখানি সহায়ক হয়। বস্তুত আমেরিকা-ঘেঁষা দল হিসাবে আওয়ামী লীগের এই পূর্বতন পরিচিতি এবং বিশেষত আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাদের দক্ষিণপন্থী মনোভাবের দরুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে যে বেশ বেগ পেতে হবে, তা ইতিমধ্যেই তাজউদ্দিন উপলব্ধি করেছিলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষত মস্কোপন্থী হিসাবে পরিচিত দলগুলির সঙ্গে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজন এক নতুন গুরুত্ব অর্জন করে। কাজেই নীতিগতভাবে স্থির করা হয়, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের নিরাপত্তার ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য যদি সোভিয়েট সহযোগিতা ভারত সরকারের কাম্য হয়, তবে সেই প্রক্রিয়াকে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অন্তত মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্প্রসারিত করার ব্যাপারে সম্মত হতে হবে।

কাজেই মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহে আমার দিল্লী যাওয়ার আগে মোটামুটি স্থির হয়, দিল্লীতে আমার করণীয় হবে: (১) মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণমাত্রায় সাহায্য করার ক্ষেত্রে ভারতীয় সমতা পরিমাপ করার চেষ্টা করা; (২) আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে আনার প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাভাবনা সম্পর্কে ভারতের উচ্চতর ক্ষমতাসীন মহলকে আভাস-ইঙ্গিত দেওয়া; এবং (৩) সম্ভব হলে, সংশ্লিষ্ট পলিসি ও কর্মসূচী সমন্বয়ের জন্য পরবর্তী আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। একমাত্র বেসরকারী পর্যায়েই এই ধরনের নাজুক মূল্যায়ন ও আলাপ-আলোচনা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। এ ছাড়া আরো একটি কারণ ছিল। মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও আওয়ামী লীগের উপদলীয় পরিস্থিতি এমনই ছিল যে, এই চিন্তার সামান্যতম প্রকাশেও তাজউদ্দিন আরও একটি গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারতেন। তাজউদ্দিন তাই এইভাবে দলীয় ও মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সবার অগোচরে ভারতের উধ্বর্তনমহলে মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর সামরিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজন সম্পর্কে তার নিজস্ব অভিমত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন।

দিল্লীতে নদিন অবস্থানকালে ঠিক সরকারী দায়িত্বে নিযুক্ত নন, অথচ ক্ষমতাসীন মহলে অত্যন্ত প্রভাবশালী এমন কিছু ব্যক্তি থেকে শুরু করে বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি নির্ধারণের কাজে প্রত্যক্ষভাবে নিযুক্ত এমন কিছু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার সাথে আমার এক বা একাধিক বার আলোচনার সুযোগ হয়। এদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি. এন. হাকসার, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অধ্যাপক পি. এন. ধর, পররাষ্ট্র সচিব টি. এন. কল, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শদাতা হিসাবে পরিগণিত পাকিস্তান প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জি. পার্থসারথি, পরিকল্পনা মন্ত্রী সি. সুব্রামনিয়াম, ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্ট্যাডিজ এ্যান্ড এ্যানালাইসিসের’ পরিচালক কে. সুব্রামনিয়াম, এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর চীফ অব স্টাফের মিলিটারী সেক্রেটারী মেজর জেনারেল বি. এন. সরকার (যিনি দু’মাস পরেই মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্বে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের ডিরেক্টর অপারেশনস্ নিযুক্ত হন)। এ ছাড়াও আলোচনা হয় ভারতের জাতীয় সংবাদ দৈনিকের তিনজন সম্পাদক, কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকজনের সঙ্গে। এই সমুদয় আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের ক্ষমতাসীন মহলের মনোভাবের কয়েকটি ধারার সন্ধান পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি ব্যাপক সহানুভূতি সত্ত্বেও এই সংগ্রামকে সাহায্য করার পরিসর ও উপায় নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীনমহলে বিরাট মতপার্থক্য আমি লক্ষ্য করি এবং কেন্দ্রের দক্ষিন ও বামের মধ্যে কোন অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা বেশ দুরূহ বলে আমার মনে হয়। কেন্দ্রের দক্ষিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য সম্পর্কে অনেক বেশী সন্দিহান, মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের নেতৃত্ব বামপন্থীদের হাতে স্থানান্তরিত হওয়ার আশঙ্কায় চিন্তিত, পাকিস্তানের সপক্ষে চীন ও আমেরিকার সাহায্যের মুখে ভারতের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বিগ্ন এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার ফলে আমেরিকান প্রভাব বলয় থেকে আরো দূরে সরে গিয়ে রাশিয়ার উপর ভারতের নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কায় সবিশেষ ব্রিবত অথবা শঙ্কিত। এমনকি, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যে ভারতের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে নয়, তেমন মতেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এই মহলে। এই মত অনুসারে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের নিরাপত্তার প্রতি কোন বিপদ নেই, বিপদ একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই; কাজেই পশ্চিম পাকিস্তান যদি দীর্ঘদিনের জন্য পূর্বাঞ্চলের গৃহযুদ্ধ দমনের কাজে নিজের সামরিক সম্পদকে নিযুক্ত রাখতে বাধ্য হয় তবে সে অবস্থায় ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের নিরাপত্তা অপেক্ষাকৃত উন্নত হওয়া সম্ভব। কাজেই ভারতের জাতীয় স্বার্থ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই, বরং অল্পস্বল্প গোপন সাহায্যের মাধ্যমে এই বিদ্রোহকে প্রলম্বিত করাই তাদের পক্ষে বুদ্ধিসম্মত। পাশাপাশি বহুজাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও বিশ্বজনমত গঠনের মাধ্যমে আমেরিকান সরকারকে যদি পাকিস্তানের উপর উপযুক্ত চাপ প্রয়োগে সম্মত করানো যায় এবং এর ফলে পাকিস্তান সরকারকে। যদি শেখ মুজিবের সাথে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছুতে বাধ্য করা যায়, তবে ভারত একদিকে যেমন শরণার্থীর অসহ চাপ থেকে মুক্ত হবে, তেমনি অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিক্ষত দুর্বল পাকিস্তানকে মোকাবিলা করা ভারতের পক্ষে সহজ হবে। এই সমস্ত যুক্তির মর্মার্থ ছিল, শরণার্থী সমস্যা থেকে উদ্ধারের চেষ্টার অতিরিক্ত কোন আকাঙ্ক্ষা তথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভারতের জন্য অহেতুক ঝুঁকি, সমস্যা ও বিড়ম্বনা সৃষ্টি করবে। কিন্তু এদের যুক্তির সবচাইতে বড় দুর্বলতা ছিল, পাকিস্তানী শাসকদের মনোভাব পরিবর্তনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার উপর এদের সার্বিক নির্ভরশীলতা। যেন মার্কিন সরকার ইচ্ছা করলেই পাকিস্তানের কাঠামোগত স্ববিরোধিতা ও রাজনীতির মৌল বিচ্ছেদের সমাধান ঘটে যাবে।

পক্ষান্তরে, ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কেন্দ্রের বাম হিসাবে যারা পরিচিত, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ নাকচ না করেও শরণার্থী চাপ থেকে ভারতকে মুক্ত করার অন্যান্য বিকল্প পদক্ষেপ বিবেচনা করতে প্রস্তুত ছিলেন। এবং এই কারণে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থায় বা বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি কোন যুক্তিসঙ্গত পরিবর্তনের প্রয়োজন ঘটেও তবে তা গ্রহণ করতে এই অংশের কোন বড় আপত্তি ছিল না। ফলে ভারতে আগত ক্রমবর্ধমান শরণার্থীদের ফেরৎ পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই, সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ চালানো ব্যতীত অন্য উপায় নেই, এই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য ভারতের সর্বাত্মক সাহায্য প্রদান ছাড়া অন্য উপায় নেই, ভারতের সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানের আগে তার নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ভারতের অন্য কোন উপায় নেই–পরিস্থিতির এই গ্রন্থিবদ্ধ যুক্তিতে তাদের সাড়া পাওয়া যায় প্রথম আলাপেই। যেমন, দিল্লীতে পি. এন. হাকসারের সঙ্গে তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু বামপন্থী মার্কিন অর্থনীতিবিদ ডানিয়েল থর্নার আমার যে বৈঠকের আয়োজন করেন, সেখানে পরিস্থিতির এই যুক্তি উত্থাপনের পর আলোচনা চার ঘণ্টারও অধিক সময় স্থায়ী হয় এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অধ্যাপক পি. এন. ধর সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আলোচনার শেষ পর্যায়ে তাদেরকে আমি জানাই যে, আমার ভূমিকা বেসরকারী হলেও (ন্যাপের একজন সাধারণ সদস্য হিসাবেই নিজকে পরিচিত করি) পরিস্থিতির এই মূল্যায়ন ও পলিসি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং বর্তমান সংগ্রাম যাতে সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে তজ্জন্য মস্কোপন্থী হিসাবে পরিচিত দুটি দল সমেত স্বাধীনতা সমর্থক সব কটি দলের সমবায়ে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারেও তাঁর পূর্ণ সম্মতি রয়েছে।

সম্ভবত আমার এই সর্বশেষ দাবীর সারবত্তা যাচাইয়ের জন্য আমাকে দু’দিন অপেক্ষা করতে অনুরোধ করা হয়। দু’দিন পর পুনরায় যখন হাকসারের সঙ্গে মিলিত হই, তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্য গড়ে তোলার বাস্তব নানা দিক ও সম্ভাব্য সময়সূচী নিয়েই বেশীরভাগ সময় আমরা আলাপ করি। বিদায়ের আগে হাকসার জানান, ভারতস্থ সোভিয়েট রাষ্ট্রদূত বা ঐ পর্যায়ের কোন কূটনীতিকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা এবং নিয়মিত রাজনৈতিক মতবিনিময়ের চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ প্রশ্নে রাশিয়ার সাথে কোন সমঝোতায় পৌঁছাবার চেষ্টা তারা করবেন কি না, হাকসার সে সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করলেও, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সমর্থক। রাজনৈতিক দলগুলির মিলিত ফ্রন্ট গঠনে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ শুরু করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করে তিনি আমার মনে এই ধারণারই সৃষ্টি করেন। যে, আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে আনার পক্ষে আমাদের ফর্মুলা তাদের বিবেচনার অযোগ্য নয়। ঠিক সেই মুহূর্তে কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছার অসুবিধা তাদের থাকলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সম্ভাব্য সকল কিছু করার ব্যাপারে ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্রের বাম অংশের আন্তরিকতার অভাব হবে না বলে আমার ধারণা জন্মে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্রের দক্ষিণের আয়তন ও প্রভাব তুলনামূলকভাবে বড় হওয়ায় ভারত সরকারের সামগ্রিক শক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিয়োজিত হবে কি না সে সম্পর্কে বিরাট জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি কোলকাতা ফিরে আসি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে একটি কথা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করি: দক্ষিণ ও বাম, সঙ্কীর্ণ ও উদার-এই নানা উপাদানে গঠিত ভারতের ক্ষমতার যন্ত্র কোন অখণ্ড শিলা নয়; ভারতের ক্ষমতা-যন্ত্রের অভ্যন্তরে দক্ষিণ ও বামের টানাপোড়েন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বা বিপক্ষে চূড়ান্ত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম।

দক্ষিনপন্থীদের এই প্রাধান্য অনুধাবন করা সত্ত্বেও উদ্ভূত সমস্যার ‘রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে তাদের আশাবাদ যে বেশী দিন স্থায়ী হতে পারে না সে বিষয়ে আমাদের উভয়েরই কোন সন্দেহ ছিল না। কাজেই ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রে দক্ষিণ ও বামের এই টানাপোড়েনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে সোভিয়েট প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তাজউদ্দিন অনুমোদন করেন। উভয় পক্ষের মতের আদান-প্রদান যাতে অবাধে এগুতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিন আমাকে একা ও অত্যন্ত গোপনে এই যোগাযোগ শুরু করতে বলেন। এই বেসরকারী আলোচনা যে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আগ্রহের ফলেই সংঘটিত হতে চলেছে সে বিষয়ে সোভিয়েট পরে আস্থা উৎপাদন এবং বৈঠকের ব্যবস্থা সম্ভব হয় ‘প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রকাশক অরুণা আসফ আলীর সহায়তায়।

কোলকাতায় প্রথম দিনের আলোচনায় সোভিয়েট প্রতিনিধি ভি. আই. গুরগিয়ানভ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে এক নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে এই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা, বিঘোষিত লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দুর্বলতা, দীর্ঘমেয়াদী সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যে দেশের ভিতরে সংগঠন সৃষ্টির উপায় ও নেতৃত্বের সমতা, ভারতের ক্ষমতাসীন শ্রেণী-স্বার্থের সাহায্য ও সমর্থনের ভিত্তি ও মেয়াদ প্রভৃতি সব ক’টি মূল বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই অপ্রত্যাশিত স্পষ্ট ভাষণের ফলে সোভিয়েট দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনুধাবন করা আমার পক্ষে অনেকখানি সহজ হয়।

উত্তরে যা জানানো হয়, তার সার কথা ছিল: (ক) সূচনায় অধিকাংশ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনেই এমন অস্পষ্টতা ও বিশৃঙ্খলা থাকে; (খ) যদি বস্তুগত কারণে সৃষ্ট সঙ্কটের নিষ্পত্তি ঘটার সম্ভাবনা না থাকে, তবে ক্রমশ এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিকতর সংকল্পবদ্ধ ও যোগ্য। মানুষের সমাবেশ ঘটা এবং তাদের সাংগঠনিক কলা-কুশলতা উন্নত হওয়া এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া মাত্র; (গ) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পাকিস্তানের মৌলিক কাঠামোগত স্ববিরোধিতা ও একচেটিয়া পুঁজিবাদী বিকাশেরই অনিবার্য ফল এবং লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পর একে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখার নৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা যেমন বাংলাদেশের কোন নেতারই নেই, তেমনি স্বাধীনতা বা ছ’ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়ে সামরিক শাসকদের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই; এবং (ঘ) ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার মত পূর্ণ নিরাপত্তাবোধ খুঁজে পায় তবে তার ফলে ১৯৬৯ সাল থেকে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দণিপন্থীদের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার যে ধারা শুরু হয়েছে সম্ভবত তা আরও পরিপুষ্ট হবে; পক্ষান্তরে তথাকথিত ‘রাজনৈতিক সমাধানের আশায় অযথা কালপেণ করলে ক্রমবর্ধিত শরণার্থীর চাপ ইন্দিরা সরকারকে দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির কাছে পর্যুদস্ত করতে পারে।

প্রথম দিনের এই বৈঠকের পর সোভিয়েট প্রতিনিধির আগ্রহেই এক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় বৈঠকের আয়োজন হয়। তারপর আরো দুটি বৈঠক হয় এবং প্রতিবারই সাত/আট দিনের ব্যবধানে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে ছোট বড় অজস্র প্রশ্ন তোলা হয়েছে, উত্তরও দেয়া হয়েছে। তারপর এই রুশ সংলাপকারী কোলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ায় এই আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। এ সব কথাবার্তার কি ফলাফল হয়েছে, তখন তা জানার কোন উপায় ছিল না। তবে দ্বিতীয় বৈঠক থেকে শুরু করে প্রতিবারেই আলোচনান্তে এই ধারণা নিয়ে আমি ফিরে এসেছি, আমাদের কথা সম্ভবত তাদের সংশ্লিষ্ট মহলে কিছু কিছু পৌঁছাতে শুরু করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *