০২. বেদপাঠে মেয়েদের বেদদত্ত অধিকার

বেদপাঠে মেয়েদের বেদদত্ত অধিকার

ঠিক যেভাবে সবার সামনে আমার শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই আমাকে বকেছিলেন, এমনি হলে এখনও ঠিক সেইভাবেই বকতেন। সেই একটি বর্ণকে কটু অনুনাসিকতায় দীর্ঘায়িত করে বলতেন–অ্যাঁ! খুব বুলি ছুটেছে দেখছি! দু-পাতা বেদ পড়েই খুব যে বড়ো বড়ো কথা বলছ? অবশ্য এইই হয়, পরিপাক না হলে ক’খানা বেদ-মন্ত্র মুখস্থ করেই লোকে বড়ো বাগ্মী হয়ে যায়–বেদমধীত্য ত্বরিতো বক্তারো ভবন্তি। মাস্টারমশাই বেঁচে থাকলে বলা যেত–শুধু আমি কেন স্যার, এখন যে সবাই বড়ো বড়ো কথা বলছে। কেউ ধর্মের জন্য, কেউ অধর্মের জন্য, কেউ রাজনীতির জন্য, কেউ স্বার্থের জন্য, কেউ বা শুধুই আত্ম-প্রতিষ্ঠার জন্য বেদের ব্যবহার এবং অপব্যবহার–দুই-ই করছে। বেদের শুদ্ধি-রক্ষার জন্য যাঁদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, তাদের আরও একটি কারণে মাস্টারমশায়ের সুরে বকা লাগানো দরকার। কারণটা বলি।

যারা হঠাৎ বেদ-পাঠে অথবা বেদ-গানে স্ত্রীলোকের কোনো অধিকার নেই বলে ফতোয়া জারি করলেন, তাদের একবার জিজ্ঞাসা করি–যে পুরুষ-পুঙ্গবেরা বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করে অহরহ বেদের উচ্চতা স্থাপন করছেন, তাদের কি বেদ-পাঠে খুব অধিকার আছে? স্বর এবং বর্ণের উচ্চারণে যদি বিকার আসে, তো যজ্ঞকালে নানা বিপত্তি ঘটে বলে বৈদিকেরা ভয় পান। বৈয়াকরণেরাও নাকি সেই কারণে ভালো করে ব্যাকরণ পড়েন–যাতে মন্ত্রের উচ্চারণে ত্রুটি না হয়–মম্রো হীনঃ স্বরতো বর্ণতো বা। আহা, যে ব্রাহ্মণ বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে বিয়ে দেন, যিনি বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রাদ্ধ করেন, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদের স্পেশাল পেপার পড়ান এবং ভারতবর্ষের শতশত মহাবিদ্যালয়ে যারা সাম্মানিক বিষয়-সূচিতে সংস্কৃত-ক্লাসে বেদ পড়ান (মহাশয়! আমিও তাদের একজন)–তাঁদের মধ্যে ক’জন আছেন, যাঁদের উদাত্ত-অনুদাত্ত-স্বরিত স্বরে সঠিক মন্ত্র উচ্চারণের ক্ষমতা আছে! দু-চার জন ছাড়া কারও নেই। বেদের নিয়মমতো তোতাহলে সবার এখন চাকরি যাওয়া উচিত। আরও কথা হল–বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তথাকথিত ব্রাহ্মণ-শূদ্র-অন্ত্যজ নির্বিশেষে আমরা যারা এতকাল একসঙ্গে বেদ পড়ে এসেছি এবং পড়িয়ে এসেছি–শাস্ত্রের নিয়মে এখন তাদের নিশ্চয় ঘোর নরকে গরম তেলে ভাজা-ভাজা হবার কথা–অথবা বিশ্ববিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ের বৃহৎ-কাষ্ঠে দোষ নাই।

নরকের কথা থাক। আপাতত শাস্ত্রং–অভয় দিয়ে বলি, অনুস্বর ধনুঃশর নহে মহারাজ! অধিকারের নিয়ম এক রকম, অধিকার হরণের নিয়ম আরেক রকম। মূলে যাঁরা শাস্ত্র রচনা করেছিলেন তারা উদার ছিলেন। পরে যাঁরা নিজের প্রয়োজনে শাস্ত্রকে ব্যবহার করেছেন, তারা অধিকার হরণ করেছেন নিজেরই স্বার্থে, তপস্বীর করুণায় নয়। প্রথমে জেনে নেওয়া ভালোবেদের দুটো অংশ আছে। প্রথম অংশ মন্ত্রভাগ, দ্বিতীয় ব্রাহ্মণভাগ। মন্ত্রভাগের মধ্যে যেখানে শুধুই দেবতার স্তুতি, আহ্বান অথবা প্রার্থনা–সেখানে কে বেদপাঠে অধিকারী বা অনধিকারী, সেসব কথা কিছুই নেই। তবে হ্যাঁ, নানা মন্ত্রের অর্থ এবং বক্তব্য থেকে যদি এমন প্রমাণ হয় যে, পুরুষেরা বেদমন্ত্রের অধিকারী, তাহলে খোদ ঋগবেদের মন্ত্র থেকে স্পষ্ট বলে দেওয়া যাবে–স্ত্রীলোকেরাও মন্ত্রে সমান অধিকারী। বৈদিক মতে বেদের মন্ত্র কেউ লেখেনি, ঋষিরা মন্ত্রবর্ণ দর্শন করেছেন। এই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে পুরুষেরা যেমন আছেন, তেমনই মেয়েরাও আছেন। বিশ্ববারা, অপালা, কি ঘোষা-রোমশার কথা থাক, ঋগবেদের যে মন্ত্রগুলি নিয়ে আমরা দুর্গাপূজার সময় প্রতিবার মোহিত হই, সেই দেবীসূক্তটির দ্রষ্টা বা রচয়িত্রী কিন্তু একজন মহিলা। তিনি অভৃণ ঋষির কন্যা অ্যুণী। বেদান্ত-দর্শনের প্রথম আভাস যে দেবীসূক্তের মধ্যে সেই মন্ত্রবর্ণ যদি একজন আত্মজ্ঞানী মহিলা কবি চোখে দেখে থাকেন, তবে তো উত্তরাধিকারের নিয়মে সেই মন্ত্রের উচ্চারণে তাঁদেরই প্রথম অধিকার। সুখের বিষয়বহু বছর আগেই মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে এই দেবীসূক্তের–অহং রুদ্রেভিসুভিশ্চরামি অহম্‌….এই মন্ত্রগুলি সুরে-তালে একজন মহিলা গায়িকার কণ্ঠগত করে আকাশবাণীর কর্তারা বাংলাদেশের বেদ-বোধে চিরন্তনী সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।

এই প্রসঙ্গে স্মরণ করুন বিশ্ববারা নাম্নী রমণী-ঋষির কথা। তিনি ঋক্‌মন্ত্রের মধ্যে সোচ্চারে নিজের নাম ঘোষণা করে বলছেন–বিশ্ববারা পূর্বাভিমুখী হয়ে দেবতাদের স্তব উচ্চারণ করার পর যজ্ঞীয় হব্যপাত্র নিয়ে অগ্নির অভিমুখে যাচ্ছে। এখানে বিশ্ববারা শুধু অন্তত ছটি মন্ত্রের দর্শনকত্রী ঋষিই নন, এখানে তিনি ঋত্বিক অর্থাৎ ঋগবেদের পুরোহিতও বটে। একাকিনী এই সব মহিলার স্বচ্ছন্দ অধিকারের কথা বাদ দিলেও খোদ ঋগবেদের মন্ত্রভাগে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করার উদাহরণ ভূরিভূরি আছে। এমনকী প্রিয়যজ্ঞবিশিষ্ট দম্পতির মন্ত্রস্তুতি যে দেবতারা বেশি পছন্দ করেন তারও উল্লেখ আছে মন্ত্রের মধ্যেই। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে যজ্ঞের কাজ আরম্ভ করা, সোম-রস প্রস্তুত করা এবং সবার শেষে মন্ত্রোচ্চারণে দেবতার স্তব করার মন্ত্রগুলি যথাক্রমে–রিত্ব ততস্রে মিথুনা (১.১৩১.৩), যা দম্পতি স মনসা সুনুত আচ ধাবতঃ (৮.৩১.৫-৬) এবং রীতিহোত্রা কৃতদ্বসু দশস্যান্তামৃতায় কম্ (৮.৩১.৯)। এর পরেও কি রমণীয় বেদপাঠে সন্দেহ।

এরপরেও কি মেয়েদের বেদ-মন্ত্র উচ্চারণ করার অধিকার নিয়ে অর্বাচীন ধর্মধ্বজীদের বাগাড়ম্বর শোনার প্রয়োজন আছে? বেদের মন্ত্রভাগ ছেড়ে দিয়ে ব্রাহ্মণভাগে এলেও স্ত্রীলোকের এই অধিকার অব্যাহত আছে। অবশ্য এখান থেকেই মেয়েদের জ্ঞান-গম্যি এবং বিবাহের যজ্ঞীয় সংস্কারটা ধর্তব্যের মধ্যে এসে গেছে। অবশ্য অধিকার এখানে সামান্য খর্ব করা হলেও স্ত্রীলোকের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে আরণ্যক গ্রন্থগুলি। তৈত্তিরীয় আরণ্যক শুধু স্পষ্ট করে ব্রাহ্মণপত্নীদের মন্ত্র উচ্চারণ করতেই বলেনি–অনুবাকং পত্নীং বাচয়তি তাদের সমস্ত আহবনীয় হোমে উপস্থিত থাকতে বলেছে। উপরন্তু বৈষ্ণবরা যেমন কীর্তনের ধুয়ো ধরেন অথবা সম্মিলিত কণ্ঠে আমরা যেমন স্ত্রী-পুংনির্বিশেষে গান করি, ঠিক তেমনি করেই ব্রাহ্মণ-বধূদের সামগানের উচ্চারণ এবং সুর করতে বলা হয়েছে–পত্নীসহিতানাং সর্বেষাং প্রস্তোতৃনিধন ভাগোচ্চারণং বিধত্তে। হায়, এত সুর করেও রমণীর কণ্ঠে যদি সেই সুর এখন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, তবে বেদ-বিরোধী কথা বলার দায়ে ধর্ম-প্রবক্তাদের সিংহাসনটাই কেড়ে নেওয়া উচিত।

বেদের ধর্ম, যাগ-যজ্ঞ, হোম, মন্ত্রোচ্চারণ, দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের আচরণীয় কর্তব্যগুলি নিয়ে যে দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে, তার নাম পূর্বমীমাংসা দর্শন। জৈমিনীর সূত্র এবং তার ওপরে টীকা-টিপ্পনীগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে আমরা স্ত্রী-পুরুষের যজ্ঞে সমানাধিকার এবং মন্ত্রোচ্চারণের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম, কিন্তু জায়গার অভাবে তা এখানে করা গেল না। মনে রাখা দরকার–বৈদিক ক্রিয়াকর্মে এবং মন্ত্রোচ্চারণে মেয়েদের অধিকার খর্ব করা আরম্ভ হয়েছে স্মৃতিশাস্ত্রগুলি রচনার পর থেকে, বিশেষত মনু মহারাজের তাড়নায়। স্মৃতি গ্রন্থগুলি বেদমূলক হলেও, তার মধ্যে আচার-আচরণের গোঁড়ামিটাই বেশি। বস্তুত স্মৃতিশাস্ত্র যে বেদ নয়, সে কথা বহুভাবে প্রমাণ করা যায়। এর ওপরেও সেই প্রবাদ-বাক্যের মতো কথাটি আছে যে, শ্রুতি অর্থাৎ বেদ-উপনিষদের বক্তব্যের সঙ্গে স্মৃতিশাস্ত্রের বিরোধ হলে শ্রুতিকেই মানতে হবে শ্রুতি-স্মৃতি-বিরোধে তু শ্রুতিরেব গরীয়সী। অতএব স্মৃতিশাস্ত্র যতই মেয়েদের অধিকার হরণ করুক, স্বয়ং শ্রুতিই যেখানে আমাদের সহায়, সেখানে স্মার্ত পণ্ডিতের কায়দায় কে কী বিধান দিলেন তাতে কিছু আসে যায় না। স্মৃতিশাস্ত্রের মধ্যেও যেগুলি প্রাচীন স্মৃতি বা নিবন্ধ, সেগুলির কোনো কোনোটি পড়লে কিন্তু বোঝা যায় যে, মা কী ছিলেন এবং মা কী হইয়াছেন। যম-সংহিতার মতো প্রাচীন স্মৃতি মেয়েদের বেদে অধিকার-নির্ণয়ের সময় তার পূর্বর্তন সময়ের কথা স্মরণ করে বলেছে–পুরাকল্পে ছেলেদের যেমন উপনয়ন হত, কুমারী মেয়েদেরও তেমনই উপনয়ন হত, পৈতে পরতে হত। বেদ-মন্ত্র উচ্চারণ করা তো অতি সাধারণ কথা, নারীরা বেদ পড়াতেন এবং গায়ত্রী জপ করতেন–অধ্যাপনঞ্চ বেদানাং সাবিত্রীবচনং তথা। তবে হা কুমারী মেয়ে বলে কথা, গুরুকুলে পড়তে যাওয়ার তার বিপদ ছিল অনেক। ফলে স্ত্রীলোকের বেদ-অধ্যয়ন অথবা অধ্যাপনার ব্যাপারে কিছু কনসেশনও ছিল। যম-সংহিতা সেই প্রাচীন বৈদিক সমাজের সংস্কারটুকু স্মরণ করেছেন সগর্বে।

যাঁরা ভাবেন–হ্যাঁ, স্ত্রীলোকের বেদ-পাঠ-টাটের মতো একটা কিছু ছিল বটে, তবে আদুড় গায়ে কৌপীন পরে তাঁদের বেদ-পাঠ করতে হত, তাই ও সব বর্বর রীতি বন্ধ হয়ে গেছে। সবিনয়ে বলি–বৈদিক সমাজ যত খোলামেলাই হোক, তাঁদেরও কামাদি পীড়া ছিল। যম-সংহিতা বলেছে–সেকালে মেয়েরা পৈতেও পরতেন, বেদও পড়তেন–কিন্তু তাদের বেলায় অনেক রেহাই ছিল। মেয়েরা আদুড় গায়ে মৃগচর্ম অথবা কৌপীন পরে নিজের বেদাচার বজায় রাখতে চাইলে অন্যদের যে হৃৎ-কম্প সৃষ্টি হবে, সে কথা বৈদিক পুরুষেরা বিলক্ষণ জানতেন। আর জানতেন বলেই তারা বলছেন–মেয়েরা ব্রহ্মচারিণী হয়ে বেদ অধ্যয়ন করলেও, পৈতে পরলেও তারা যেন মৃগচর্ম ধারণ না করেন, কৌপীন না পরেন অথবা মাথায় যেন জটাজাল সৃষ্টি না করেন–বর্জয়ে অজিনং চীরং জটাধারণমেব চ। মেয়েদের অধ্যাপক হতেন বাবা কিংবা কাকা। ব্রহ্মচারী কুমারকে যেমন বাইরে ভিক্ষাচরণ করতে হত, মেয়েদের ভিক্ষার ব্যাপারটা সীমিত থাকত ঘরেই। অর্থাৎ বেদ-পাঠের তাগিদ থাকলেও পিতা-মাতার স্নেহচ্ছায়ার মধ্যেই তাদের লালন করা হত। কারণটা খুব স্পষ্ট এবং জৈবিক এবং বৈদিকও বটে।

অবশ্য বেদ পড়ব কি পড়ব না–সে ব্যাপারে মেয়েদের একটা স্বতন্ত্রতা ছিল। এখনকার দিনেও যেমন অনেক মেয়ের মুখে শুনি-ধূৎ! আবার কষ্ট করে অনার্স পড়া! এম.এ. পড়া! রিসার্চ করা! তার চেয়ে বিয়ে হয়ে গেলেই বেশ ভালো–গয়না পরব, শাড়ি পরব, নিত্য নতুন সাজব। বৈদিক সমাজেও যাঁদের এইরকম বিয়ে-বিয়ে মন হত, তাঁরা বেদ-পাঠ, উপনয়ন অথবা ভিক্ষাচর্যার পথে না গিয়ে বিয়েই করে বসতেন। তাদের বেদে অধিকার থাকত না, কেননা তারা জ্ঞানের পথ স্বেচ্ছায় পরিহার করেছেন। কিন্তু জ্ঞানের দিকেই যাঁদের মানসিক ঝোঁকটা ছিল, সেই সব ব্রহ্মবাদিনী মহিলাদের পৈতে নেওয়া, বেদ পড়া এবং নিজের ঘরে ভিক্ষা-চর‍্যা সবই ছিল প্রায় পুরুষদের মতোই-তত্র ব্রহ্মবাদিনীনা উপনয়ন অগ্নি-সমিন্ধনং বেদাধ্যয়নং স্বগৃহে ভিক্ষাচর‍্যা (হারীত-সংহিতা)। তার মানে, ব্রহ্মবাদিনীরা শিক্ষিতা রমণীদের একটি শ্রেণী।

বেদ কিংবা বেদ-কল্প গ্রন্থগুলির মধ্যে স্ত্রীলোকের মন্ত্রোচ্চারণ নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশই নেই। আলায়ন তার শ্রৌতসূত্রে পরিষ্কার এবং ক্যাটিগোরিকালি’ বলেছেন যে–এই মন্ত্র পত্নী পাঠ করবে, আর অমুক মন্ত্র পত্নীর হাতে বেদ দিয়ে তারপর তাকে দিয়ে বলাবে–ইমং মন্ত্রং পত্নী পঠেৎ/আবার/বেদং পত্নৈ প্রদায় বাচয়েৎ। বেদ-মন্ত্রের উচ্চারণে বা বৈদিক ক্রিয়াকলাপে মেয়েদের অধিকার ছিল কিনা তার প্রমাণ ধরে রেখেছে আদিকবির রামায়ণ। রামায়ণে দশরথের পত্নী কৌশল্যা অশ্বমেধ যজ্ঞে অংশ নিয়ে নিজে খঙ্গাঘাতে যজ্ঞীয় অশ্ব বলি দিয়েছেন। আর রামচন্দ্র যখন বনবাসের খবর দিতে এসেছেন মায়ের কাছে, তখন তিনি রীতিমতো মন্ত্রোচ্চারণ করে অগ্নিহোত্র হবন করছিলেন–অগ্নিং জুহোতি স্ম তদা মন্ত্রবৎ কৃতমঙ্গলা।

উদাহরণ দিতে পারি ভূরিভূরি। ব্রাহ্মণ, সূত্র, ব্যাকরণ এবং দর্শনের নানা উদাহরণ দিয়ে বেদে রমণীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রবন্ধ বেড়ে যাবে। তাই বিরত থাকলাম। বস্তুত মেয়েদের বেদপাঠের বা গানের অধিকার হরণ করা হয় পুরাণ এবং স্মৃতির যুগ থেকে। পুরাণ-কাহিনি সর্বসাধারণ্যে প্রচার করার কারণেই বেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হতে থাকে, এবং একই সঙ্গে আচার ব্রত উপবাসের কড়াকড়িও বাড়তে থাকে। ব্রহ্মবাদিনীর জ্ঞান আস্তে আস্তে স্ত্রী-আচারে পর্যবসিত হয়। এর জন্য দায়ী কারা জানেন? মহাভারতে যুধিষ্ঠির তাদের চিনিয়ে দিয়েছেন অন্যতর এক প্রসঙ্গে। বৈদিক যজ্ঞে আগে নাকি সুরা মৎস্য অথবা পশুমাংসের প্রচলন ছিল না, এগুলো নাকি নিজের কারণে ধূর্ত লোকেরা প্রচলন করেছে–ধূর্তৈঃ প্রবর্তিতং হ্যেতন্নৈত বেদেষু কল্পিত। অন্তত যুধিষ্ঠিরের তাই মত। বেদে, বেদপাঠে, মন্ত্রে বা গানে নারীর অধিকারের প্রসঙ্গে আমার মতটাও যুধিষ্ঠিরের অনুরূপ। বেদ বা বেদপ্রায় গ্রন্থগুলি স্ত্রীলোককে কখনও বলেনি–বেদে তোমার অধিকার নেই। অধিকার নেই বলে যারা চালিয়েছেন বা এখনও চালাচ্ছেন, তাঁদের আমি যুধিষ্ঠিরের পরিভাষাতে ধূর্ত বলি। স্বার্থান্বেষী ধূর্তরাই বলেছে–বেদে নারীর অধিকার নেই। বেদে, অন্তত বেদে, এমন কথা নেই–ধূর্তৈঃ প্রবর্তিতং হ্যেত নৈত বেদেষু কল্পিতম্।

অবশ্য এ বাবদে আমার দুঃখটা আরও একটু গভীরে। আধ্যাত্মিক প্রবক্তা, যাঁরা নিশ্চল সমাজে বিশ্বাসী, তারাও বলেন বেদে নারীর অধিকার ছিল না, আবার নব্য গবেষক, যাঁরা আধুনিকতার অভিসন্ধিতে নারীমুক্তিতে বিশ্বাসী, তারাও নানা গ্রন্থের গ্রন্থিমোচন করে দেখাতে চান–দেখ প্রাচীন সমাজ কীরকম স্ত্রী-বিদ্বেষী, বেদে নারীকে অধিকার দেয়নি। বস্তুত আধ্যাত্মিক প্রবক্তাদের থেকে নব্য গবেষকদের আমি আরও বেশি বিপজ্জনক মনে করি। কেননা আধ্যাত্মিক প্রবক্তারা অহংসর্বস্ব, তারা যা ভাবেন, তাতেই নিশ্চল। কিন্তু যারা গবেষণার বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সমাজ ধারণ করবেন, তারা যদি শুধু ইষ্টসিদ্ধির জন্য গোরুর পুরো শরীরটি না দেখিয়ে শুধু শিং দেখিয়েই বলেন–ওটা গোরুই, তাহলে বিপদ বাড়ে। আমার ধারণা–প্রাচীন সমাজে নারীর অধিকার কেমন ছিল, সে বিষয়ে সমস্ত নেতিবাচক দিকগুলির সঙ্গে ইতিবাচক দিকগুলিও সমানভাবে দেখানো দরকার। তাতে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি ন্যায়বিচার যেমন সম্ভব হবে, তেমনই সম্ভব হবে সম-আলোচনা। আমরা সম-আলোচনা চাই, শুধুই সমালোচনা নয়।

অবশ্য এর ওপরেও আরও একটা কথা আছে। আমরা মুক্তির নিশ্বাস-লিঙ্গু এক আধুনিক সমাজে বাস করি। এটা বেদের সমাজ নয়, কোনো স্মার্ত পণ্ডিতের সমাজও নয়। এই সমাজে দাঁড়িয়ে স্থান এবং কালের সঙ্গে খাপ-খাইয়ে যেখানে যে মন্ত্র পাঠ করা দরকার তাই করব; যেখানে যে গান করা দরকার, তাই করব। কোনো একজন আধ্যাত্মিক প্রবক্তার নিজস্ব ধর্মীয় শুচি-বাতিকের জন্য আমরা কেউ পূর্বপুরুষের সম্পত্তির অধিকার এক কণাও ছেড়ে দেব না। এবং এই নিরিখে, বেদ-মন্ত্র পড়ায় বা বেদ-গানে স্ত্রীলোকের অধিকার আছে কিনা, সেই আলোচনায় গিয়ে এক অকিঞ্চিৎকর ধর্মীয় নেতার ব্যক্তিমূল্য একটুও বাড়াতে চাই না। কারণ আমাদের সমাজে রমণীরা অর্ধেক আকাশ, তাদের অধিকার আকাশের মতোই স্বতঃসিদ্ধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *