দেবতার আংটি

দেবতার আংটি

লন্ডনের ১৪৭এ, গাওয়ার স্ট্রিটের বাসিন্দা জন ভ্যানসিটার্ট স্মিথ সহজেই বৈজ্ঞানিক হিসেবে নাম করতে পারতেন। কিন্তু তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তি তাকে কোনও একটি বিষয়ে স্থির থাকতে দেয়নি। অতএব প্রাণীবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যায় বিশারদ হতে হতে তিনি হঠাৎ রসায়ন শাস্ত্রে উৎসাহী হয়ে পড়লেন। কিন্তু তার বছরখানেক পরেই প্রাচ্যতত্ত্ব তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করল। প্রাচীন মিশরের বর্ণমালা এবং লৌকিক দেবতার সম্বন্ধে তার একটা গবেষণাপত্র প্রাচ্যতত্ত্বে উৎসাহীদের কাছে বিশেষ খ্যাতি পেল।

এরপরে স্মিথ প্রাচীন মিশরের ব্যাপারে, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও কলায় মিশরের অবদান সম্বন্ধে এতটাই উৎসাহী হয়ে পড়লেন যে, তিনি মিশর-বিশেষজ্ঞ এক মহিলাকে বিয়ে করে ফেললেন। স্মিথের স্ত্রী মিশরের ষষ্ঠ রাজবংশের ওপর গবেষণা করেছেন। এবার স্মিথও শুরু করলেন প্রাচীন মিশরের ওপর বেশ বড়সড় গবেষণার কাজ। ঘনঘন যেতে লাগলেন প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে তাঁর গবেষণার কাজে। সম্প্রতি এইরকমই একবার লুভর-এ গিয়ে তিনি এক অত্যাশ্চর্য ঘটনায় জড়িয়ে পড়লেন।

স্মিথের সেদিন একটু জ্বর জ্বর ভাব। লন্ডন থেকে প্যারিস পৌঁছে হোটেলে উঠেই শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুম এল না– ঘণ্টাদুয়েক বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পর উঠে পড়লেন। বর্ষাতি পরে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে লুভর-এ চলে গেলেন। মিউজিয়ামের যে ঘরে প্যাপিরাস সংক্রান্ত সংগ্রহ, সেই ঘরে গিয়ে তাঁর অসমাপ্ত গবেষণার কাজ শুরু করে দিলেন।

স্মিথকে কোনওভাবেই সুদর্শন বলা যাবে না। তার খাড়ার মতো নাক আর থুতনির বিচিত্র গড়ন, এবং কথা বলার সময়ে পাখির মতো মাথার নড়াচড়া-সব মিলিয়ে তার চেহারাটা অদ্ভুত। মিউজিয়ামের ঘরের আয়নায় বর্ষাতির কলার কান পর্যন্ত তুলে দেওয়া নিজের প্রতিবিম্ব দেখে স্মিথ নিজেই বুঝতে পারছিলেন তার চেহারার বিচিত্রতা। কিন্তু ইংল্যান্ডের দুটি ছাত্র তাকে অন্য দেশের লোক ভেবে তার সম্বন্ধে ইংরেজিতে বেশ কয়েকটা বাছা বাছা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করছিল, যেমন, লোকটার চেহারা কীরকম কিম্ভুত! মিশরের মমি নিয়ে কাজ করতে করতে লোকটার চেহারাই মমি-র মতো হয়ে গেছে, লোকটাকে দেখে মিশরীয় বলেই মনে হয়! ইত্যাদি।

স্মিথ চটে গিয়ে ছেলে দুটোকে ইংরেজিতে একটু কড়কে দেবেন বলে ঘুরে দাঁড়ালেন। এবং তখনই বুঝতে পারলেন যে, ছেলে দুটোর মন্তব্যের লক্ষ তিনি নন, বরং মিউজিয়ামের যে কয়েকজন কর্মচারী তখন পিতলের জিনিসগুলো পরিষ্কার করছিল, তাদের একজন।

ছাত্র দুটি একটু পরেই সেখান থেকে চলে গেল। তখন স্মিথ বিশেষ মনোযোগ দিয়ে ওই কর্মচারীকে লক্ষ করলেন। তাঁর দেখা অনেক মমি ও ছবিতে প্রাচীন মিশরীয়দের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই লোকটার চেহারার অদ্ভুত মিলকাটা কাটা মুখের গড়ন, একটু চওড়া কপাল, গোল থুতনি এবং গায়ের কালচে রং। লোকটি অবশ্যই মিশরের স্মিথ নিঃসন্দেহ হলেন।

আলাপ করবেন ভেবে লোকটির দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে স্মিথ প্রায় শিউরে উঠলেন ওকে দেখে-মুখটা যেন সাধারণ মানুষের নয়, প্রায় অতিপ্রাকৃতিক। ওর কপাল ও চোয়াল এত মসৃণ যে, সেগুলো যেন চামড়ার নয়, যেন পার্চমেন্ট কাগজে তৈরি, পালিশ করা। চামড়ার ওপর রোমকূপের কোনও চিহ্ন নেই। চামড়াতে নেই কোনও স্বাভাবিক আর্দ্রতাও। কপাল থেকে থুতনি পর্যন্ত অজস্র বলিরেখা।

–এই পিতলের জিনিসগুলো কি মেমফিস থেকে পাওয়া? কোনওরকমে আলাপ শুরু করার জন্য লোকটিকে জিগ্যেস করলেন স্মিথ।

–হ্যাঁ, অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিল লোকটা।

–আপনি কি মিশরের লোক? স্মিথের প্রশ্ন।

লোকটা এবার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল স্মিথের দিকে। তার চোখদুটো যেন কাঁচ দিয়ে তৈরি, সেইসঙ্গে একটা শুকনো চকচকে ভাব। মানুষের চোখ যে এইরকম হতে পারে তা স্মিথের ধারণার বাইরে। দৃষ্টির গভীরে যেন ভয় ও ঘৃণার যুগপৎ ছাপ।

–না, আমি ফ্রান্সেরই। বলে লোকটা নিজের কাজে মন দিল। খানিকটা বিস্ময়বিহ্বল হয়েই স্মিথ পাশের ঘরে গিয়ে একটা নিভৃত কোণে চেয়ারে বসে তার গবেষণার কাজ শুরু করলেন। কিন্তু কাজ করবেন কী? মন পড়ে আছে স্ফিংক এর মতো অদ্ভুত মুখের অধিকারী সেই লোকটার ওপর। চোখ দুটো যেন কুমির বা সাপের চোখের মতো–এমন একটা চকচকে ভাব। কিন্তু সেই চোখে শক্তি ও প্রজ্ঞার ছাপও আছে। আর যেন আছে অপরিসীম ক্লান্তি ও হতাশার অভিব্যক্তি।

এইসব ভাবতে ভাবতে স্মিথ তার গবেষণার নোটস লিখতে শুরু করলেন। কিন্তু শরীরটা কাহিল ছিল বলে খানিকক্ষণ পরে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়লেন স্মিথ। এত গভীর সেই ঘুম যে তিনি জানতেও পারলেন না কখন মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে।

ধীরে-ধীরে রাত বাড়তে লাগল। নোতর দাম গির্জার ঘড়িতে মধ্যরাতের ঘণ্টা বাজল। রাত একটার পর ঘুম ভাঙল স্মিথের। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। কাঁচের বাক্সে রাখা মমিগুলো এবং প্রাচীন মিশরের অন্য জিনিসপত্র দেখে তার মনে পড়ল যে তিনি এখন কোথায়। জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। স্মিথ এমনিতে বেশ সাহসী। আড়মোড়া ভেঙে মনে মনে একটু হেসে নিলেন। পরিস্থিতিটা বেশ মজার–গার্ডরা ভেতরটা ভালোভাবে না দেখেই মিউজিয়ামের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

বাইরে আলো ঝলমলে প্যারিস। আর এই হলঘরের নৈঃশব্দ্যে ডুবে আছে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। থিবস, লুকার, হেলিওপোলিস ও কত না প্রাচীন মন্দির ও স্মৃতিসৌধ থেকে আনা মানুষের দেহ আর তাদের ব্যবহৃত জিনিস। যেন মহাকালের সমুদ্রে জলে ভেসে আসা অতীতের স্মৃতিচিহ্ন। চাঁদের আলোয় লম্বা হলঘরে সারি দিয়ে রাখা মূর্তি ও বিভিন্ন বস্তুর দিকে তাকিয়ে প্রায় দার্শনিক চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন স্মিথ। হঠাৎ দেখতে পেলেন দূরে এক কোণায় একটু হলদে আলোর আভা।

আলোটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। একটু ভয় লাগলেও তীব্র কৌতূহলে স্মিথ চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। যার হাতে আলো তার পায়ের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। আলোটা আরও কাছে আসতে স্মিথ দেখলেন আলোর পিছনে হাওয়ায় প্রায় ভাসমান একটা মুখ। ছায়া সত্ত্বেও মুখটা চিনতে স্মিথের একটুও সময় লাগল না–সেই কাঁচের মতো চোখ, সেই মৃত মানুষের মতো চামড়া। হ্যাঁ, মিউজিয়ামের সেই কর্মী।

স্মিথ প্রথমে ঠিক করলেন লোকটির সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু ওর ভাবভঙ্গি, বিশেষত চোরের মতো পা টিপে চলা, ডানদিকে বাঁ-দিকে তাকানো ইত্যাদি দেখে স্মিথ লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে লক্ষ করাই সমীচীন মনে করলেন।

লোকটা যেন জানে ওকে কোথায় যেতে হবে। ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত প্রত্যয়ের সঙ্গে ও পোঁছোল একটা বড় কাঁচের বাক্সের কাছে। বাক্সর মধ্যে কয়েকটা মমি রাখা। পকেট থেকে একটা চাবি বের করে বাক্সের ওপরের ডালা খুলে একটা মমি নামিয়ে খুব সাবধানে সেটিকে কোলে করে নিয়ে একটু দূরে–মেঝের ওপর শুইয়ে দিল। তারপরে মমিটার পাশে বসে মমির ওপর জড়ানো ব্যান্ডেজের মতো কাপড়টা আস্তে আস্তে খুলতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে নানারকম ভেষজদ্রব্যের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।

বোঝাই যাচ্ছে এই মমিটার ব্যান্ডেজ এর আগে কখনও খোলা হয়নি। তাই অদম্য কৌতূহলের সঙ্গে স্মিথ রুদ্ধশ্বাসে পুরো ব্যাপারটা দেখতে থাকলেন। মাথার ওপর থেকে ব্যান্ডেজের শেষ অংশটা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল চার হাজার বছরের পুরোনো দেহের মাথার ওপরের লম্বা, কালো, চকচকে চুলের রাশি। ব্যান্ডেজটা আরেকটু খুলতেই দেখা গেল ফরসা ছোট কপাল আর সুন্দর বাঁকানো ভু। এর পরে চোখে পড়ল এক জোড়া উজ্জ্বল চোখ ও একটা টিকোলো নাক। সবশেষে বেরোল ঠোঁট ও সুন্দর থুতনি। পুরো মুখটা নিখুঁত সুন্দর, শুধু কপালে কফি রঙের একটা দাগ।

লোকটা এবার মমির মুখ দেখে যেন আত্মহারা হয়ে পড়ল। দু-হাত শূন্যে ছুঁড়ে, দুর্বোধ্য ভাষায় অনেক কিছু বলে সে মমিটাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরল। প্রচণ্ড আবেগে লোকটার গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে, মুখের ওপরে বলিরেখা কেঁপে কেঁপে উঠছে, কিন্তু স্মিথ অবাক হয়ে দেখলেন ওর কাঁচের মতো চোখে কোনও আর্দ্রতা নেই। বেশ কিছুক্ষণ ওই সুন্দরীর মৃতদেহের কাছে বসে, কথা বলে লোকটা হঠাৎ উঠে পড়ল।

হলঘরের মাঝখানে কাঁচের একটা গোল বাক্সে প্রাচীন মিশরের অনেক আংটি ও দামি পাথর রাখা আছে। লোকটা প্যাকেট থেকে একটা শিশি বার করল। এবার বেশ কিছু আংটি ওই বাক্স থেকে বের করে শিশিতে রাখা জলীয় পদার্থ লাগিয়ে আংটিগুলো একটা একটা করে পরীক্ষা করতে লাগল। বেশ কয়েকটা আংটি এভাবে দেখার পর একটা ক্রিস্টাল বসানো বড় আংটিতে জলীয় পদার্থ লাগিয়েই আনন্দে দু-হাত তুলে নোকটা লাফিয়ে উঠল। আর তখনই শিশিটা কাত হয়ে জলীয় পদার্থটা মেঝের ওপর পড়ে গেল। সেটা রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে ঘরের কোণের দিকে যেতেই লোকটার একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলেন ভ্যানসিটার্ট স্মিথ।

চোখে একরাশ বিদ্বেষ নিয়ে লোকটা স্মিথকে জিগ্যেস করল,আপনি এতক্ষণ আমাকে দেখছিলেন? দশ মিনিট আগে যদি আপনাকে দেখতে পেতাম, তাহলে আমার এই ছুরি আপনার বুকে বিঁধিয়ে দিতাম। এবার বলুন, আপনি কে?

স্মিথ নিজের পরিচয় দিতেই লোকটা অবজ্ঞার সঙ্গে বলল,–ও! পুরোনো মিশরের ওপর আপনার একটা লেখা আমি পড়েছি। মিশর সম্বন্ধে আপনার জ্ঞান তো প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের জীবন দর্শন সম্বন্ধে আপনারা তো কিছুই জানেন না!

স্মিথ-এর প্রতিবাদ করার আগেই হঠাৎ তার চোখ পড়ে গেল মমিটার দিকে। লোকটাও সঙ্গে সঙ্গে হাতের আলোটা মমির দিকে ফেরাল। এই দশ মিনিটে হাওয়ার সংস্পর্শে এসে মৃতদেহটির অবস্থার অবনতি হয়েছে খসে পড়েছে চামড়া, চোখ হয়ে গেছে কোটারাগত এবং ঠোঁটের মাংস কুঁচকে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে হলদে দাঁতের সারি। গভীর দুঃখে ও হতাশায় লোকটা তখন মুহ্যমান। কাঁপা গলায় সে স্মিথকে বলল, আজ রাতে যা করব ভেবেছিলাম, তা করেছি। এখন আর কিছু যায় আসে না। ওর আত্মার সঙ্গে গিয়ে মিলতে পারলেই হল। ওর এই নিষ্প্রাণ দেহের কী-ই বা মূল্য আছে?

স্মিথ, এবার প্রায় নিশ্চিত যে লোকটা বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু লোকটা হঠাৎ খুবই স্বাভাবিকভাবে স্মিথকে বলল,–আসুন, আপনাকে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দিই।

অনেকগুলো হলঘর পেরিয়ে একটা ছোট দরজা খুলে লোকটা স্মিথকে নিয়ে একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল। একটা আধখোলা দরজার কাছে গিয়ে লোকটা স্মিথকে বলল,–এই ঘরে আসুন।

স্মিথ এই রহস্যের শেষ দেখতে চান। তাই ভয়ের চেয়ে তার তখন কৌতূহলের মাত্রা অনেক বেশি। ঘরে ঢুকে দেখলেন, প্রাচীন আমলের আসবাবপত্র ও টুকিটাকি জিনিস দিয়ে ঘরটা সাজানো।

লোকটা এবার শুরু করল তার কাহিনিঃ

–আমি এখন পরলোকের চৌকাটে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে। তাই এখন আপনাকে বলে যেতে চাই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার পরিণামের এই কাহিনি।

বুঝতেই পারছেন আমি একজন মিশরীয়। আমার জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মের ষোলোশশা বছর আগে রাজা তুথমোসিসের আমলে এক সম্পন্ন পরিবারে। আমার নাম সোসরা। আমার বাবা ছিলেন নীলনদের তীরে বিখ্যাত আবারিস মন্দিরে দেবতা ওসাইরিস-এর পূজারি। ষোলো বছর বয়সেই বাবার কাছ থেকে যা কিছু শেখার সব শিখে নিয়েছিলাম। তারপর প্রকৃতির নানাবিধ রহস্য, বিশেষত জীবনের স্বরূপ নিয়ে নিজে নিজে পড়াশোনা শুরু করলাম। শরীরে রোগবালাই হলে মানুষ ওষুধের সাহায্যে তা সারায়। আমার কিন্তু মনে হল, শরীরটাকে এমনভাবে রাখতে হবে যে তাকে কোনও রোগ বা দুর্বলতা যেন ছুঁতেই না পারে। শুরু হল আমার দীর্ঘ গবেষণা। পরীক্ষা চালালাম প্রথমে জন্তুজানোয়ার, তারপর ক্রীতদাসদের শরীরের ওপর। সবশেষে আমার নিজের ওপর।

এই গবেষণার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে কোনও লাভ নেই, কেন না আপনি তার কিছুই বুঝতে পারবেন না। শুধু এটুকু বললেই হবে যে, শেষে আমি এমন একটা ওষুধ আবিষ্কার করলাম যা ইঞ্জেকশন দিয়ে একবার শরীরে রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে মানুষ অমর না হলেও কয়েক হাজার বছর নীরোগ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে। একটা বেড়ালকে ওই ওষুধের ইঞ্জেকশন দিয়েছিলাম। তারপর মারাত্মক সব বিষ দেওয়ার পরেও বেড়ালটা মরেনি। আজও ওই বেড়ালটা মিশরে আছে–জ্যান্ত।

অতি দীর্ঘকাল সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আশায় এবং যৌবনের উৎসাহে সেই অভিশপ্ত ওষুধ আমার শরীরে ঢোকালাম। তারপর ইচ্ছে হল আরও কারও উপকার করার। দেবতা থোত-এর মন্দিরে এক অল্পবয়স্ক পূজারি ছিল নাম পারমেস। আমার ওষুধের কথা ওকে বুঝিয়ে বললাম এবং ওর শরীরেও ঢোকালাম সেই ওষুধ। এখন বুঝি, আমার সমবয়স্ক কাউকে এই ওষুধটা দেওয়া ঠিক হয়নি।

এর পরে আমার পড়াশোনা ও গবেষণার কাজ অনেক কমিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পারমেস রসায়নের যন্ত্রপাতি নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকত। যদিও ওর গবেষণার বিষয়বস্তু বা তার প্রগতি নিয়ে আমায় কখনও কিছু বলত না।

একদিন পারমেসের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ একটি পরমাসুন্দরী মেয়েকে দেখতে পেলাম। কয়েকজন ক্রীতদাস মেয়েটিকে একটা ভুলিতে করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, মেয়েটি আমাদের স্থানীয় প্রশাসকের কন্যা। মেয়েটিকে দেখেই আমার এত ভালো লেগে গেল যে মনে হল এর সঙ্গে আমার বিয়ে না হলে আমার জীবনই বৃথা। আমার মনের এই কথা পারমেসকে বলতেই দেখলাম ওর মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল।

মেয়েটির নাম আত্মা। ওর সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার পরিচয় হল। আত্মাও আমাকে বেশ পছন্দ করে দেখলাম। পারমেসও আত্মাকে ভালোবাসত। কিন্তু আত্মার আকর্ষণ ছিল আমারই ওপর। হঠাৎ এই সময় আমাদের শহরে প্লেগের মহামারী শুরু হল। আমার তো কোনও রোগের ভয় নেই–তাই নির্দ্বিধায় প্লেগের রোগীদের সেবাশুশ্রূষা করতে লাগলাম। আত্মা ব্যাপারটা দেখে একটু অবাক হল। তখন একদিন ওকে আমার আবিষ্কৃত আশ্চর্য ওষুধের কথাটা বলে ফেললাম। আত্মাকে আমি অনুরোধও করলাম ওষুধটা ব্যবহার করতে যাতে আমরা দুজনে একসঙ্গে অসংখ্য যুগ বেঁচে থাকতে পারি। আত্মা কিন্তু আপত্তি করল,–এ তো ঈশ্বর ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া। পরম করুণাময় দেবতা ওসাইরিস যদি চাইতেন, তাহলে তিনিই আমাদের দীর্ঘ জীবন দিতেন।

যাই হোক, আত্মাকে বললাম ব্যাপারটা একদিন ভেবে দেখে পরের দিন সকালে আমাকে ওর সিদ্ধান্ত জানাতে।

পরের দিন সকালে মন্দিরের পুজো শেষ হওয়ার পরেই আমি আত্মাদের বাড়ি গেলাম অধীর ঔৎসুক্যে–আত্মা আমার প্রস্তাবে রাজি কি না জানতে। কিন্তু ওদের বাড়িতে যেতেই একজন দাসী আমায় জানাল, আত্মা অসুস্থ। ওর ঘরে ঢুকে দেখলাম–আত্মা বিছানায় শুয়ে! মুখ পাণ্ডুর, চোখ ছলছলে। কপালের একটা অংশে বেগুনি রঙের ছাপ। এক মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম–আত্মা প্লেগের শিকার হয়েছে, কপালে নিশ্চিত মৃত্যুর পরোয়ানা।

আত্মার এই অবস্থা দেখে আমি দুঃখে হতাশায় প্রায় পাগল হয়ে গেলাম। ওকে ছাড়া আমার এই সুদীর্ঘ যুগ-যুগ ব্যাপী জীবন আমি কী করে কাটাব? আমার এই মানসিক অবস্থার মধ্যে একদিন পারমেস জিগ্যেস করল,–তুমি আত্মাকে মরতে দিলে কেন? ওকে তত তোমার ওষুধটা দিতে পারতে!

আমি বললাম,–আমি দেরি করে ফেলেছিলাম। এখন ভগবান জানেন কত শতাব্দীর পর আমার মৃত্যু হবে আর তারপর আত্মাকে দেখতে পাব। ভাই পারমেস, তুমি এখন কী করবে? তুমিও তো আত্মাকে ভালোবাসতে!

প্রায় অপ্রকৃতিস্থ লোকের মতো হেসে পারমেস বলল, আমার এতে কিছু যায় আসে না। আত্মার দেহটাকে নানা মশলা ও সুগন্ধি দ্রব্য মাখিয়ে এতক্ষণে মমি বানানো হয়ে গেছে। ওকে রাখা হয়েছে শহরের বাইরে সমাধিক্ষেত্রের একটা কক্ষে। আমি ওর কাছে চললাম–মরতে।

–তার মানে?

পারমেস বলল,–আমি এতকাল গবেষণা করে তোমার ওষুধের একটা প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছি। সেই প্রতিষেধক এখন আমার শরীরে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমার মৃত্যু নিশ্চিত এবং তারপর আমি পরলোকে আত্মার কাছে পৌঁছে যাব।

–তাহলে আমাকেও তোমার ওই প্রতিষেধকটা দাও। আমিও মরতে চাই!

–তোমাকে প্রতিষেধক দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তুমি এই নিঃসঙ্গ জীবনের বোঝা বহু শতাব্দী ধরে বয়ে বেড়াবে।

–ঠিক আছে। তাহলে আমি নিজেই গবেষণা করে ওই প্রতিষেধক আবিষ্কার করে নেব। আমি বললাম।

পারমেস উত্তর দিল,মুখ! তোমার পক্ষে এই প্রতিষেধক তৈরি করা অসম্ভব, কেন না তার জন্যে এমন একটা দ্রব্য লাগবে যা তুমি কোথাও পাবে না। এই ওষুধ তৈরি করা আর সম্ভব নয়। কেবল দেবতা থোতের একটা আংটির মধ্যে আমার তৈরি এই ওষুধ একটু আছে।

–তাহলে আমায় বলল, দেবতা থোতের ওই আংটি কোথায় আছে?

–সেটাও তোমায় বলব না। আত্মা তোমাকে পছন্দ করলেও শেষ পর্যন্ত ওকে কে পাবে? আমি! আমি পরলোকের দিকে চললাম, তুমি থাকো তোমার অভিশপ্ত জীবন নিয়ে। এই বলে পারমেস চলে গেল। পরের দিন খবর পেলাম ওর মৃত্যু হয়েছে।

তারপর মাসের পর মাস আমি ডুবে গেলাম রাসায়নিক গবেষণায়–আমার ওষুধের প্রতিষেধকের খোঁজে। কিন্তু কোনও সফলতা পাওয়া গেল না। খুব হতাশ হয়ে পড়লে কখনও কখনও আত্মার সমাধির কাছে গিয়ে বসে থাকতাম আর ভাবতাম কবে পরলোকে ওর সঙ্গে দেখা হবে।

পারমেস বলেছিল, ওর ওষুধের খানিকটা আছে দেবতা থোতের আংটির মধ্যে। এই আংটি সম্বন্ধে আমি জানতাম। প্ল্যাটিনামের আংটি–তার সঙ্গে একটা ফাপা ক্রিস্টাল। হয়তো সেই ফাঁপা অংশে পারমেসের প্রতিষেধকটা আছে। কিন্তু কোথায় পাব সেই আংটি? পারমেসের আঙুলে ওই আংটি দেখতে পাইনি। ওর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র তন্নতন্ন করে খুঁজেও, এমনকী, পারমেসের চলা রাস্তাগুলো দেখেও, ওই আংটির কোনও হদিস পেলাম না।

এদিকে আমাদের দেশে তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাশের দেশের এক বর্বর উপজাতি আমাদের আক্রমণ করে বহু লোকের প্রাণনাশ করল। আমরা যুদ্ধে প্রায় হেরেই গেলাম। আমি বন্দি হলাম শত্রুদের হাতে।

তারপর বহু বছর সেই শত্রুর দেশে বন্দি অবস্থায় ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেষপালকের কাজ করে আমার দিন কাটতে থাকল। আমার মালিক মারা গেল, তার ছেলেও বুড়ো হয়ে গেল কিন্তু আমার মরণ নেই।

এরপর হঠাৎ একবার সুযোগ পেয়ে পালিয়ে চলে এলাম আমাদের দেশে–মিশরে। সবকিছু পালটে গেছে। সিংহাসনে বিদেশি রাজা। আমার চেনা শহরকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। মন্দিরের জায়গায় একটা কুৎসিত টিপি। সমাধিকক্ষগুলো সব তছনছ করা হয়েছে। আত্মার সমাধির কোনও চিহ্ন নেই। পারমেসের কাগজপত্র বা জিনিসের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না।

এরপর আমি প্রতিষেধকের বা দেবতা থোতের আংটি খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে জীবন কাটাতে লাগলাম। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। কত কিছুই আমার সামনে ঘটে গেল। ইলিয়মের পতন, মেমফিস-এ হেরোডোটাসের আগমন, খ্রিস্টধর্মের সূচনা। আমার বয়স কয়েকশো বছর হয়ে গেল কিন্তু দেখে কেউ বুঝবে না। আমারই আবিষ্কৃত সেই অভিশপ্ত ওষুধ আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাঁচিয়ে রেখেছে। যাক, এতদিনে আমি মৃত্যুর দোরগোড়ার কাছে এসে পৌঁছেছি।

বহু দেশ ঘুরেছি। বহু ভাষা জানি। সভ্যতার এই বিবর্তন আমার চোখের সামনে ঘটেছে। কিন্তু আত্মার প্রতি আমার আকর্ষণ এখনও অবিচল। প্রাচীন মিশরের ওপর গবেষক ও পণ্ডিতরা যা লেখেন, তা গোগ্রাসে গিলি।

প্রায় মাস আগে সানফ্রান্সিসকো গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে হঠাৎ একটা লেখা থেকে জানতে পারলাম যে আমার জন্মস্থান আবারিস-এর কাছে প্রাচীন মিশরের বেশ কিছু পুরোনো জিনিস পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আছে একটি মেয়ের মমি-সুন্দরভাবে রাখা, আগে কখনও খোলা হয়নি। মমির বাক্সের ওপর খোদাই করা লেখা থেকে জানা যায়, দেহটি রাজা তুথমোসিস-এর সময়ে আবারিস শহরের প্রশাসকের কন্যার। এবং দেহের ওপর রাখা ক্রিস্টাল বসানো প্ল্যাটিনামের একটা আংটি। এতদিনে বুঝলাম, কীরকম চালাকি করে পারমেস আংটিটা লুকিয়ে রেখেছিল। কেন না কোনও মিশরীয় কখনও মৃতদেহের বাক্স খুলবে না পাপের ভয়ে।

সেই রাতেই সানফ্রান্সিসকো থেকে রওনা হয়ে মিশরে এলাম–আমার শহর আবারিস-এ। ওখানে যেসব ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদরা কাজ করছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে জানলাম, মমি এবং আংটি চলে গেছে কায়রোর একটা মিউজিয়ামে। কায়েরোয় গিয়ে জানলাম, জিনিসগুলো চলে গেছে প্যারিস এর সুর-এ। তারপর এলাম এখানে–প্রায় চার হাজার বছর পরে। আমার প্রিয় আত্মার মরদেহ ও দেবতা থোতের আংটির কাছে।

কিন্তু কীভাবে পৌঁছোব ওই মমির কাছে? মিউজিয়ামের অধ্যক্ষের কাছে গিয়ে একটা চাকরি চাইলাম। মিশর সম্বন্ধে আমার জ্ঞান দেখে উনি বললেন যে, আমার উচিত মিশরতত্ত্বের অধ্যাপক হওয়া। যা হোক, পরে ইচ্ছে করে দু একটা ভুলভাল জবাব দিয়ে এই সাধারণ কর্মচারীর কাজটা পেলাম। আর পেলাম এই ছোট্ট ঘরটা–আমার থাকার জায়গা, আমার যৎসামান্য জিনিসপত্র নিয়ে। এটাই আমার এখানে প্রথম ও শেষ রাত।

মিঃ স্মিথ, এই হল আমার কাহিনি। আপনি বুদ্ধিমান লোক, সব বোঝেন, সবই দেখলেন। আংটিটা খুঁজে পেয়েছি আর ক্রিস্টালের মধ্যে রাখা সেই ওষুধটা এখন আমার কাছে। আমি খুব শিগগির এই অভিশপ্ত সুস্থ জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে যাব। আমার আর কিছু বলার নেই। আমি আজ ভারমুক্ত হলাম। এই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান–সোজা বড় রাস্তায় পড়বেন। শুভ রাত্রি!

স্মিথ বাইরে এসে ফিরে তাকালেন দরজার দিকে। চার হাজার বছর বয়সি মিশরীয় সসাসরার চেহারা দরজার ফ্রেমে এক মুহূর্তের জন্যে দেখা গেল। তারপর বন্ধ হয়ে গেল দরজা। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে শোনা গেল দরজায় খিল দেওয়ার আওয়াজ।

লন্ডনে ফিরে আসার পরের দিন স্মিথ টাইমস কাগজে প্যারিসের প্রতিবেদকের পাঠানো একটা ছোট খবর দেখতে পেলেন। খবরটা এইরকম :

লুভর মিউজিয়ামে রহস্যময় ঘটনা

গতকাল সকালে মিউজিয়ামের সাফাই কর্মচারীরা পূর্বদিকের একটা হলঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে দ্যাখে, মিউজিয়ামের একজন কর্মচারী একটা মমির গলা জড়িয়ে ধরে মরে পড়ে আছে। মৃত ব্যক্তি মমিটাকে এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল যে সেই বজ্ৰবন্ধন ছাড়াতে বেশ অসুবিধা হয়। যে বাক্সে অমূল্য কয়েকটি আংটি রাখা ছিল, সেই বাক্সটা কেউ খুলেছিল এবং তন্নতন্ন করে তার ভেতরটা খুঁজেছিল। কর্তৃপক্ষের অনুমান, লোকটি মমিটা চুরি করে পুরাতত্ত্বের কোনও সংগ্রহকারীকে বিক্রি করে দেওয়ার মতলবে ছিল। কিন্তু হৃদযন্ত্রের পুরোনো কোনও অসুস্থতার কারণে হঠাৎ তার মৃত্যু হয়। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায় যে, লোকটির বয়স অনিশ্চিত এবং তার ধরন-ধারণ ছিল অস্বাভাবিক। তার এই নাটকীয় এবং আকস্মিক মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার জন্য তার কোনও জীবিত আত্মীয় বা বন্ধুর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

The Ring of Thoth গল্পের অনুবাদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *