বন্ধ ঘরের রহস্য

বন্ধ ঘরের রহস্য

বলসোভার স্কোয়ারের ১০৯ নম্বর বাড়ির নিচতলার প্যাসেজের শেষ মাথার ঘরটা সব সময় বন্ধ থাকে কেন? জানার খুব ইচ্ছে এমেলিয়া জেঙ্কিনসের। কিন্তু বন্ধ ঘরের রহস্য জানার সৌভাগ্য হয়তো কোনদিনই হবে না ওর। কারণ ওর মনিবনী, মিসেস বিশপ এমন বদমেজাজী মানুষ, এমেলিয়ার কৌতূহলের কথা ঘুণাক্ষরেও টের পেয়ে গেলে ওকে পিটিয়েই মেরে ফেলবেন। দিন কয়েক আগে এমেলিয়া চুরি করে এক চামচ স্ট্রবেরী জ্যাম খেতে গিয়েছিল, ধরা পড়ে যায় ও। মিসেস বিশপ শুধু ঠাণ্ডা চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিলেন, তাতেই হার্টবিট বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল এমেলিয়ার। কঠিন গলায়, চিবিয়ে চিবিয়ে তিনি তিনি সাবধান করে দিয়েছিলেন-এমেলিয়াকে ভবিষ্যতে কোনদিন আর কিছু চুরি করে খেতে দেখলে মুখ ভেঙে দেবেন।

মহিলাকে যমের মত ডরায় এমেলিয়া। ওর যাবার কোন জায়গা নেই। নইলে ঠিক কোথাও চলে যেত। বাপ-মা মরা এতিম মেয়ে। পেকহ্যাম থেকে ওকে নিয়ে এসেছেন মিসেস বিশপ। বিধবা মহিলার বাড়িতে দিনভর খাটে। কিন্তু মহিলা ওর সাথে মোটেও ভাল ব্যবহার করে না। মহিলার স্বামী মারা গেছে কবে কে জানে, এখনও ডাঁটফাট কমেনি। সোনালি চুলগুলো সব সময় পরিপাটি করে আঁচড়ে রাখেন, কৃত্রিম আই ল্যাশ পরেন চোখে, লম্বা, ম্যানিকিওর করা নখ নিয়ে তাঁর গর্বের সীমা নেই।

মিসেস বিশপকে ভয় পায় এমেলিয়া। তারপরও মহিলা বাইরে গেলে তাঁর বেডরূমে ঢুকে সাজগোজের লোভ সামলাতে পারে না কিছুতেই। সাজ বলতে মিসেস বিশপের লাল রঙের একটা ফ্যান্সি ড্রেস পরা। ওটার হাড়ের তৈরি বোতামগুলো জ্বলজ্বল করে। দেখলেই বোঝা যায় খুব দামী। স্কার্টটা পরে আয়নার সামনে নিজেকে বারবার দেখে এমেলিয়া। তারপর আবার পোশাকটা খুলে, আগের মত ভাঁজ করে রেখে দেয় ওয়ারড্রোবে।

মিসেস বিশপ সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না এমেলিয়া। তাই দুধঅলা বা হকারের কাছে তাঁর সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করে। একদিন দুধঅলাকে সে প্রশ্ন করল, ‘মিসেস বিশপের স্বামী কি করতেন জানো কিছু?’

তরুণ এই দুধঅলাটি মনে মনে পছন্দ করে এমেলিয়াকে। প্রায়ই সে ফুল নিয়ে আসে মেয়েটির জন্যে।

‘না তেমন কিছু জানি না,’ জবাব দিল দুধঅলা। তবে শুনেছি ব্যবসা করতেন। দেশের বাইরে, ব্যবসার কাজে গিয়ে নাকি মারা গেছেন তিনি। ফ্রান্সের কোথায় যেন। ভদ্রলোকের মাথা ভর্তি সাদা চুল ছিল। মিসেস বিশপের বাবা বলে অনেকেই ভুল করত তাকে।

‘উনি স্বামীকে ভালবাসতেন কিনা সন্দেহ আছে আমার,’ বলল এমেলিয়া। ‘ভালবাসার ব্যাপারটাই বোধহয় ভদ্রমহিলার মধ্যে নেই।’

হেসে উঠল দুধঅলা। ‘আজকালকার আধুনিক মেয়েরা তাদের স্বামীদের তেমন পাত্তা-টাত্তা দিতে চায় না। মিসেস বিশপও হয়তো তাদের একজন। কেন, এখানে ভাল লাগছে না তোমার?’

করুণ মুখ করে জবাব দিল এমেলিয়া, ‘না। তবে বাইরের জগৎ এরচে ও খারাপ। তাই কোথাও যাবার সাহস পাই না।’

‘তাহলে এখানেই থেকে যাও,’ পরামর্শের সুরে বলল দুধঅলা। ‘অন্তত ভাল কোথাও চলে যাবার সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত।’

এমেলিয়ার আসলেই কোথাও যাবার জায়গা নেই। টাকা থাকলেও না হয়. কেটে পড়ার ধান্ধা করত। কিন্তু মিসেস বিশপ ওকে এত কম বেতন দেন যে নিজের টুকিটাকি জিনিস কেনার পর হাতে প্রায় কিছুই থাকে না। তারপরও এমেলিয়া সুযোগের অপেক্ষায় আছে। হাতে কিছু টাকা এলেই এখান থেকে চলে যাবে। এমেলিয়ার বিশ্বাস, মিসেস বিশপ ওই বন্ধ ঘরে টাকা-পয়সা রাখেন। একদিন সে এক অদ্ভুত স্বপ্নও দেখে ফেলল ঘরটিকে নিয়ে। দেখল মিসেস বিশপ ড্রইংরুমের ফায়ার প্লেসের ডান পাশে রাখা একটি সিন্দুক থেকে একজোড়া চাবি নিয়ে সটান ঢুকে পড়লেন সেই বন্ধ ঘরে। তার পিছু নিয়েছিল এমেলিয়া। কিন্তু সে ভেতরে যাবার আগেই দরজা বন্ধ করে দিলেন মিসেস বিশপ। দরজা বন্ধ হবার আগে সে শুধু দেখতে পেল ঘরের মাঝখানে বড় একটা পালঙ্ক। বাইরে দাঁড়িয়ে এমেলিয়া শুনতে পেল ভেতরে পয়সা গোনার টুংটাং শব্দ হচ্ছে।

‘যা ভেবেছি তাই,’ বিড়বিড় করল এমেলিয়া। ‘ও ঘরে টাকা লুকিয়ে রেখেছেন মিসেস বিশপ।’

সে ভেতরের দৃশ্য দেখার জন্যে চোখ রাখল কী হোলে। সাথে সাথে কি যেন গরম একটা ঢুকে গেল চোখে, ভয়ানক জ্বলতে লাগল। ব্যথাটা এত বাস্তব, ঘুম ভেঙে গেল এমেলিয়ার। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছে বিশ্বাস হতে চাইছে না ওর। বন্ধ ঘরের রহস্য ভেদ করার আগ্রহ বেড়ে গেল কয়েক গুণ। ‘ওখান থেকে কিছু টাকা যদি সরাতে পারি,’ নিজের মনে বলল এমেলিয়া, ‘তাহলে সাথে সাথে এখান থেকে চলে যাব। লন্ডন বিরাট শহর। লুকোবার অনেক জায়গা আছে। পুলিশ খুঁজেও পাবে না। আর ধরা পড়লেই বা কি, এই নরকের চেয়ে জেলখানা নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। সারাক্ষণ ওই মহিলার ধমকের ভয়ে সিটিয়ে থাকার চেয়ে চলে যাওয়া অনেক ভাল।’

স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটানোর চেষ্টা চালাল এমেলিয়া বারকয়েক। কিন্তু যতবার সাহস করে ড্রইংরূমের দিকে পা বাড়াল, ততবারই কোন না কোন বাধা পেল। একবার হলঘর থেকে সে ড্রইংরূমে ঢুকবে ভাবছে, হঠাৎ মনে হলো মিসেস বিশপ পিছু পিছু আসছেন ওর, ঘুরলেই তাঁর ঠাণ্ডা, নীল চোখ জোড়া দেখতে পাবে, কটমট করে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। আরেকবার মাঝরাতে সে চুপি চুপি নেমে এসেছে নিচে, পায়ের শব্দ পেল পেছনে। ঝট করে ঘুরল এমেলিয়া। নাহ্, কেউ নেই পেছনে। কিন্তু এত ভয় লেগে উঠল, দৌড়ে সে ঢুকে গেল নিজের ঘরে, নিচতলায় নামার আর সাহসই পেল না। তবে দিন কয়েক পরে এমেলিয়ার বহুল প্রত্যাশার সুযোগটি এল।

‘আমি বেরুচ্ছি, এমেলিয়া,’ মিসেস বিশপ বললেন ওকে, ‘ডিনারের আগে ফিরব না। কেউ ফোন করলে মেসেজ নিয়ে রাখবি।’

নতুন কেনা কোট আর স্কার্ট পরে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন তিনি। তাঁকে রাস্তার মোড় ঘুরতে দেখেই এক দৌড়ে তাঁর বেডরূমে ঢুকল এমেলিয়া। নতুন হ্যাট কিনেছেন মিসেস বিশপ। দামী, পার্শিয়ান হ্যাট। কালো হ্যাটটা পরার খুব লোভ এমেলিয়ার। অবশেষে সুযোগ পাওয়া গেছে। সে হ্যাটটা মাথায় চাপিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। দেখতে মন্দ নয় এমেলিয়া, কালো হ্যাটে মানিয়েও গেছে, মিসেস বিশপের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী লাগল নিজেকে। হাসিমুখে এবার মিসেস বিশপের লাল কলারের নীল রঙের স্কার্টটা পরল ও। মনিবনীর চেয়ে হালকা পাতলা বলে পোশাকটা ঢিলে হলো গায়ে, তবে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে রীতিমত মুগ্ধ এমেলিয়া। ড্রেসিং টেবিলে থরে থরে সাজানো দামী সব লিপস্টিক আর নেইল- পলিশ। ওগুলো ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারল না এমেলিয়া। মিসেস বিশপের ফরাসী হাইহিলও পায়ে গলাল। তারপর মুচকি হেসে আবার দাঁড়াল আয়নার সামনে। নিজেকে বারবার দেখেও আশ মেটে না এমেলিয়ার।

এখন এমেলিয়াকে দেখলে কে বলবে ও বাড়ির চাকরানী। মনিবনীর চেয়ে শতগুণ সুন্দর লাগছে ওকে। আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছে এমেলিয়া, এমন সময় বেজে উঠল ফোন। আতঙ্কিত হয়ে উঠল এমেলিয়া। একটানে হ্যাটটা ছুঁড়ে ফেলে, পাগলের মত জামা-কাপড় খুলতে লাগল। ওদিকে ফোন বেজেই চলেছে। এমেলিয়া আধা নগ্ন অবস্থায় গিয়ে ফোন ধরল। মেসেজ রাখার পর শান্ত হলো ও। তারপর আস্তে ধীরে পোশাকগুলো ভাঁজ করে আগের জায়গায় পরিপাটি অবস্থায় রেখে দিল। ওর বুক এখনও ধুকপুক করছে। এমেলিয়া ঠিক করল এখনই সে ড্রইংরূমে অভিযান চালাবে।

বাড়িতে কেউ নেই, তারপরও অভ্যাস মত চারপাশে চোখ বোলাল এমেলিয়া। এখনও মনে হচ্ছে কেউ ওকে গোপনে দেখছে। অথচ মিসেস বিশপকে দেখেছে সে চলে যেতে। মিসেস বিশপ চুপিচুপি আবার ফিরে আসেননি তো? সন্দেহমুক্ত হবার জন্যে এমেলিয়া বার দুই নক করল ড্রইংরুমের দরজায়। কোন সাড়া নেই। সাহস করে এবার সে দরজা খুলল, পা রাখল ভেতরে। খোলা জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছে, ঘরটা ঝকঝক করছে, এমেলিয়ার ভয় অনেকটাই কেটে গেল। দ্রুত পা চালাল সে ফায়ার প্লেসের দিকে। সিন্দুকে তালা মারা নেই। ডালা খুলতেই একটা চাবি চোখে পড়ল। স্বপ্নে দেখা সব ঘটনা বাস্তবে ঘটে যাচ্ছে। ‘ইস, ওই বন্ধ ঘরে যদি সত্যি টাকা থাকে,’ মনে মনে বলল এমেলিয়া, ‘তাহলে টাকা নিয়ে এক্ষুণি কেটে পড়ব। স্বাধীন হয়ে যাব আমি। স্বাধীন এবং ধনী।’

উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে দৌড় দিল এমেলিয়া প্যাসেজের শেষ মাথায়, বন্ধ ঘরের দিকে। দরজায় তালা মারা। চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই খুলে গেল তালা, এমেলিয়ার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো ঘরটা। ঘরের মাঝখানে, ওর স্বপ্নে দেখা পালঙ্কটা সত্যি আছে, এক কোনায় একটা আয়রন সেফ। এ ছাড়া আসবাব বলতে খান কয়েক চেয়ার এবং একটা আয়না। আয়নার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাল এমেলিয়া। আয়না ওকে সব সময় অভিভূত করে তোলে। আয়নার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে কোন ক্লান্তি নেই ওর। কল্পনায় প্রায়ই ও নিজেকে ফিল্মের নায়িকা ভাবে। ভাবে অনেক টাকা থাকলে দামী দামী ড্রেস কিনে, সাজগোজ করলে ফিল্মের নায়িকাদের চেয়ে কোন অংশে খারাপ দেখাবে না ওকে। ঘরের এই আয়নাটার দিকেও তাকিয়ে রইল এমেলিয়া। পালঙ্কের পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি পড়েছে আয়নায়। এমেলিয়া দেখল সাদা চুল, সাদা গোঁফের এক বুড়ো শুয়ে আছে বিছানায়, ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ ফায়ার প্লেসের পাশে, দেয়ালের সাথে লাগানো আলমারির দরজা ফাঁক হয়ে গেল, ওখান থেকে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা। মিসেস বিশপ। তবে বিছানায় শোয়া বুড়োর মত মিসেস বিশপেরও চারপাশে ধোঁয়াটে একটা পর্দা দেখা যাচ্ছে। মহিলার পরনে নীল সিল্কের ড্রেসিং গাউন, তাতে বড় বড় মুক্তোর বোতাম, পায়ে উলের জুতো। এক হাতে সোনার বালা, অন্য হাতের আঙুলে অনেকগুলো ঝলমলে আংটি। এমেলিয়া লক্ষ করেছে মহিলা সবসময় গহনা পরে থাকতে ভালবাসেন। তিনি পা টিপে টিপে এগোলেন বিছানার দিকে, তারপর একটা বালিশ তুলে নিলেন হাতে। তাঁর চোখে ফুটে উঠল নিষ্ঠুর, ক্রূর চাউনি যা দেখে ভয়ে জমে যায় এমেলিয়া। তিনি বালিশটা ঘুমন্ত বুড়োর মুখে চেপে ধরলেন সর্বশক্তি দিয়ে। ভয়ে চিৎকার করে উঠল এমেলিয়া, ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল। বিছানা খালি, ঘরও তাই। সে সম্পূর্ণ একা।

এত ভয় পেয়েছে এমেলিয়া সামলে উঠতে সময় লাগল। বুঝতে পারল আয়নায় ভৌতিক যে দৃশ্যটা দেখেছে বাস্তবে তাই ঘটেছে। ওই বুড়ো আর কেউ নন, মি. বিশপ স্বয়ং। মিসেস বিশপ তাঁর স্বামীকে খুন করেছেন। হয়তো স্বামীর সাথে তিনি মানিয়ে চলতে পারছিলেন না বা টাকার লোভে, যে কোন কারণেই হোক স্বামীকে মেরে ফেলেছেন মিসেস বিশপ। আসল ঘটনা কেউ জানে না। তিনি রটিয়ে দিয়েছেন মি. বিশপ বিদেশে মারা গেছেন। ভয়ঙ্কর সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল এমেলিয়া। মিসেস বিশপ তাহলে খুনী! এজন্যেই ওই বড় বড় নীল চোখের ঠাণ্ডা দৃষ্টি তার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।

এখন এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু টাকা না নিয়ে যাওয়া যাবে না। এমেলিয়া নিশ্চিত হয়ে গেছে আয়রন সেফের মধ্যে টাকা আছে। সে সেফের হাতল ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। কিন্তু খুলছে না সেফ। কোথাও গোপন বোতাম আছে কিনা ভেবে সেফের গায়ে হাত বোলাতে লাগল- এমেলিয়া। সত্যি আছে। বোতামটায় চাপ দিতেই খুলে গেল দরজা। ভেতরে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেল এমেলিয়া। সোনা! ড্রয়ারগুলো সোনার মুদ্রা, সোনার চুড়ি, আংটি, ব্রেসলেট আর নেকলেসে বোঝাই। মিসেস বিশপ কেন এ ঘরটা সবসময় বন্ধ রাখেন সে রহস্য এবার জানা গেল। তিনি শুধু খুনী নন, চোরও। স্বামীকে খুন করে তার সমস্ত সোনাদানা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এ ঘর সবসময় বন্ধ রাখেন যাতে কেউ জানতে না পারে এখানে কি আছে। ‘আমি এখান থেকে কিছু গহনা সরিয়ে ফেলব,’ বিড়বিড় করল এমেলিয়া। ‘এগুলো পরলে নিশ্চয়ই আমাকে খুব সুন্দর দেখাবে।’

উত্তেজনার চোটে ভয় চলে গেছে এমেলিয়ার। সে দ্রুত কয়েকটা চুড়ি আর ব্রেসলেট পরে নিল হাতে, গলায় পরল নেকলেস। সোনার গহনায় নিজেকে মুড়ে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়াল আয়নার সামনে। সাথে সাথে মুখ থেকে হাসি মুছে গেল, দৃষ্টিতে ফুটে উঠল নির্জলা আতঙ্ক, এমেলিয়া দেখতে পেয়েছে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছেন রক্তমাংসের মিসেস বিশপ। তাঁর হাতে লম্বা এক টুকরো তার, মুখটা কঠিন, চাউনিটা শীতল এবং ক্রূর। কিছুক্ষণ আগে অবিকল এই চেহারার ভৌতিক মিসেস বিশপকে দেখেছে সে আয়নায়।

‘বেশ,’ স্বভাবসুলভ ঠাণ্ডা, শান্ত গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন তিনি। ‘অবশেষে ধরা পড়ে গেছিস তুই। আমার গোপন ব্যাপারগুলোও দেখে ফেলেছিস। আমার গহনাও পরে আছিস দেখছি। এদিকে আয় হারামজাদী।’

নীল চোখে কি সম্মোহনী যাদু আছে কে জানে, পায়ে পায়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল এমেলিয়া। যেন সাপ সম্মোহন করে টেনে আনছে তার শিকারকে। এমেলিয়ার শরীরের সমস্ত শক্তি কেউ শুষে নিয়েছে, প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার ভাষা এবং শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে, নীরবে সে তার মনিবনীর আদেশ পালন করল। সামনে এসে দাঁড়াল মিসেস বিশপের।

‘হাঁটু গেড়ে বোস,’ আদেশ করলেন মিসেস বিশপ।

এমেলিয়া হাঁটু গেড়ে বসল, তার চোখ স্থির হয়ে আছে মিসেস বিশপের ধবধবে সাদা হাত আর টকটকে লাল ড্রেসের ওপর।

সাবধানে দরজা বন্ধ করলেন মিসেস বিশপ, তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন, হাতের তারটা দেখালেন এমেলিয়াকে।

‘চিনিস এটা কি?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

মাথা নাড়ল এমেলিয়া, কথা বলতে চাইল, কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ, একটা শব্দও বেরুল না। ‘এটা তোর গলায় বাঁধব আমি,’ বলে চললেন মিসেস বিশপ, যত্নের সাথে এমেলিয়ার ঘাড় এবং গলায় জড়ালেন তারটা। ‘তোর বাবা-মা নেই, বন্ধু বান্ধব নেই, নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও কেউ তোর খোঁজ নিতে আসবে না। কাজেই…’ লম্বা, সরু, সাদা আঙুল দিয়ে তিনি ফাঁসটাকে শক্ত করে টানতে লাগলেন….

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বন্ধ ঘরের রহস্য

বন্ধ ঘরের রহস্য

বন্ধ ঘরের রহস্য

ওকালতি আমার পেশা, কিন্তু অ্যাথলেটিক্স আমার নেশা। দশটা-পাঁচটা চার দেওয়ালের মধ্যে ব্যস্ত থাকার পর শারীরিক কসরত করার সময় পাই কেবল সন্ধেবেলায়। অফিসপাড়ার বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যখন হ্যাম্পস্টেড বা হাইগেটের দিকে একটু উঁচু জায়গায় রাতের দিকে হাঁটতে যাই, তখন মুক্ত হাওয়া সেবনে শরীর মন দুই-ই তাজা হয়ে ওঠে। এইরকমই এক সন্ধেবেলা নিরুদ্দেশ-ভ্রমণে আমার সঙ্গে ফেলিক্স স্ট্যানফোর্ডের প্রথম আলাপ হয়, আর এই আলাপ থেকেই আমার জীবনের সবচেয়ে রহস্যময় অভিজ্ঞতার আস্বাদ পাই।

মাসটা ছিল এপ্রিল বা মে, সাল ১৮৯৪। সেদিন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি লন্ডনের প্রায় উত্তরসীমানায়। রাস্তার দুদিকে গাছের সারি আর বাংলো বাড়ি। বসন্তকালের মনোরম সন্ধ্যা-আকাশ পরিষ্কার, চাঁদের আলোয় সবকিছুই সুন্দর লাগছিল। আমি তখন বহু মাইল হেঁটে ধীরেসুস্থে চারিদিক দেখতে-দেখতে ফেরা শুরু করেছি। এক মনে হাঁটছি–হঠাৎ একটা বাড়ির দিকে আমার নজর গেল।

বাড়িটা বেশ বড়–রাস্তা থেকে একটু পেছিয়ে–সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি। এমনিতে বাড়িটা আধুনিক ঢঙে বানানো কিন্তু আশপাশের বাড়ির তুলনায় জলুসহীন। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো সবই একলাইনে দাঁড়িয়ে–শুধু এই বাড়িটার সামনের জায়গাটুকু খালি থাকায় বাড়িটাকে একটু বেখাপ্পা লাগছিল। নিশ্চয়ই কোনও বড়লোক ব্যবসায়ীর বাগানবাড়ি ছিল এটা–শহর হয়তো তখনও এতদূর এসে পৌঁছয়নি। ধীরে-ধীরে লন্ডন শহরের লাল ইটের বাড়ির অক্টোপাস এই অঞ্চলটুকুকেও গ্রাস করেছে। আরও কিছুদিনে হয়তো সেই অক্টোপাস বাড়িটার সামনের ফাঁকা জমিটুকুও হজম করে নেবে, আর এখানে মাথা তুলবে বছরে আশি পাউন্ড ভাড়ার একডজন ছোট-ছোট বাড়ি। আমি যখন এইসব ভাবছি তখন হঠাৎ-ই একটি ঘটনা আমার মনকে অন্যদিকে ঘোরাল।

ঘোড়ায় টানা চারচাকার একটা নড়বড়ে গাড়ি কাঁচকোচ আওয়াজ করতে করতে দ্রুতবেগে ছুটে আসছিল, আর উলটোদিকে দেখা যাচ্ছিল একটা সাইকেলের মলিন আলো। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া এই লম্বা রাস্তায় মাত্র দুটি বাহনই চলমান অবস্থায় ছিল। কিন্তু তবুও যেমন আটলান্টিকে অনেকসময় দুটো জাহাজে ধাক্কা লাগে, ঠিক তেমনই আশ্চর্য নিপুণতায় গাড়িটার সঙ্গে সাইকেলের লাগাল ধাক্কা। দোষটা সাইকেল আরোহীরই। গাড়ির সামনে দিয়েই সে রাস্তা পার হতে গিয়েছিল, হিসেবে ভুল করে ঘোড়র ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাস্তায়। উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত খিঁচিয়ে সে তেড়ে গেল গাড়োয়ানের দিকে। তবে গাড়োয়ানও তাকে বেশ দু-চার কথা শুনিয়ে দিল। এই কথাকাটাকাটির ফাঁকে সাইকেল আরোহী ঘোড়ার গাড়ির নম্বরটা টুকে নিতে ভুলে গেল আর সেটা বুঝতে পেরেই গাড়োয়ান জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে পিঠটান গেল। সাইকেল আরোহী পড়ে থাকা সাইকেলটা তুলতে গিয়ে হঠাৎ-ই বসে পড়ল আর যন্ত্রণায় অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। আমি ছুটে ওর কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, খুব লেগেছে?

মনে হচ্ছে, গোড়ালিটা মচকে গেছে–খুব ব্যথা। আপনার হাতটা একটু বাড়ান–ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, ও বলল।

সাইকেলের ম্লান আলোয় ওকে দাঁড় করাতে গিয়ে দেখলাম ভদ্রঘরের ছেলে। বয়স বেশি নয়। ছোট কালো গোঁফ আছে। চোখদুটি বড় বাদামি রঙের, ভাঙা চোয়াল আর একটু নার্ভাস দেখতে। স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো নয়। হয় পরিশ্রম নয় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে ওর ফ্যাকাশে মুখে। আমি ওর হাত ধরে টানতেই উঠে দাঁড়াল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা পা মাটি থেকে তুলে নিল। ওই পা-টা নাড়াতে গেলেই যন্ত্রণার আওয়াজ করছিল।

পা-টা মাটিতে ফেলতে পারছি না। বলল ও।

তুমি বয়সে অনেক ছোট। তোমাকে আর আপনি বলছি না। কোথায় থাকো।

এই তো, এই বাড়িতেই, বলে মাথা নেড়ে ওই বড়, অন্ধকার বাড়িটার দিকে দেখাল।

রাস্তা পার হয়ে বাড়ির গেটে ঢোকার সময়েই হতভাগা ঘোড়ার গাড়িটা ধাক্কা মারল। আমায় একটু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন?

সহজেই তা করা গেল। প্রথমে ওর সাইকেলটা গেটের ভেতরে রাখলাম। তারপর ওকে ধরে কম্পাউন্ডের ড্রাইভ দিয়ে নিয়ে গিয়ে হলঘরের দরজার সামনে পৌঁছলাম। কোথাও একটুও আলো নেই–অন্ধকার। নৈঃশব্দের জন্য মনে হচ্ছিল, এই বাড়িতে কেউ কোনওদিন থাকেনি।

ঠিক আছে অনেক ধন্যবাদ, বলে ও দরজার তলায় চাবি লাগানোর চেষ্টা করল।

আমি বললাম, দাঁড়াও, আমি তোমাকে ঠিকমত ঘরের ভেতর পৌঁছে দিই।

ও মৃদু আপত্তি জানালেও এটা বুঝতে পারল যে, আমাকে ছাড়া ওর চলবে না।

দরজাটা খুলতেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে ঢাকা হলঘর। ও একদিকে হেলে গিয়ে এগিয়ে গেল। আমার হাত ওর বাহুতে। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে নিতে ও বলল, এই যে, ডানদিকের এই দরজাটা।

আমি দরজাটা খুললাম আর তক্ষুনি ও কোনওরকমে একটা দেশলাই জ্বালাল। টেবিলের ওপর একটা বাতি ছিল। দুজনে মিলে সেটা জ্বালালাম।

এখন আমি একদম ঠিক। আপনি যেতে পারেন। শুভরাত্রি, এই বলে ও একটা চেয়ারে বসল এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে গেল।

আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ছেলেটিকে এভাবে ছেড়ে যাই কী করে? ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, ও হয়তো মারাই গেছে। একটু পরে ওর ঠোঁটটা কেঁপে উঠল, বুকের একটু ওঠানামা দেখা গেল। কিন্তু ওর আধবোজা চোখদুটি একেবারে সাদা এবং ওর শরীর ফ্যাকাশে লাগছিল। আমার একার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন, তাই ঘণ্টা বাজানোর দড়িটায় একটা টান দিলাম আর বহুদূরে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু কেউ এল না। আস্তে-আস্তে ঘণ্টার আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে গেল, অথচ কোনও মানুষের কথা বা পায়ের শব্দ শুনলাম না। একটু অপেক্ষা করে আবার ঘণ্টা বাজালাম, কিন্তু ফলের কোনও হেরফের হল না। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কেউ আছে–এই ছেলেটি নিশ্চয়ই এত বড় বাড়িতে একা থাকে না। বাড়ির লোকদের ওর অবস্থা জানানো দরকার। তারা যদি ঘণ্টার আওয়াজে সাড়া না দেয়, আমাকেই তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমি বাতিটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে গেলাম।

যা দেখলাম, তা বিস্ময়কর। পুরো হলঘরটা খালি। সিঁড়িগুলো কার্পেটহীন ও ধুলোয় ঢাকা। দেখলাম তিনটে দরজা–তিনটে বড়-বড় ঘরে যাওয়ার। তিনটে ঘরেই কার্পেট বা পরদা নেই, ওপরে মাকড়সার জাল ও দেওয়ালে সঁাতাপড়া দাগ। নিস্তব্ধ শূন্য ঘরগুলোতে আমার পায়ের আওয়াজের প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। তারপর ভেতরের প্যাসেজ দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম–ওখানে অন্তত কাউকে পাওয়া যাবে। হয়তো আশপাশের কোনও ঘরে কেয়ারটেকারকে দেখতে পাব। কিন্তু কোথাও কেউ নেই সব খালি। হতাশ হয়ে আর-একটি দালান ধরে এগোলাম কিন্তু সেখানে অন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।

দালানটা শেষ হয়েছে একটা বড় বাদামি রঙের দরজার সামনে আর দরজার চাবির ফুটোর ওপর প্রায় পাঁচ শিলিং মুদ্রার মাপের একটা লাল মোমের সিল লাগানো। সিলটা নিশ্চয়ই বহুকাল আগের, কারণ সেটি বিবর্ণ হয়ে গেছে, তার ওপরে ধুলোর পলেস্তারা। দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবছি ঘরের ভেতর কী থাকতে পারে, এমন সময় শুনলাম কেউ ডাকছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি ছেলেটি চেয়ারে বসে আছে। ঘরে আলো না থাকাতে ও বেশ অবাক হয়ে গেছে।

আপনি ঘরের বাতিটা নিয়ে কেন চলে গেছলেন? ও জিগ্যেস করল।

আমি লোকজন খুঁজছিলাম–তোমার সাহায্যের জন্য।

আমি এই বাড়িতে একা থাকি।

তোমার শরীর খারাপ হলে তো মুশকিল হয়ে যাবে।

হঠাৎ কেমন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে আমার মায়ের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে দুর্বল হার্ট পেয়েছি। ব্যথা পেলে বা আবেগবশত এরকম হয়। মনে হয় মায়ের মতো এতেই আমার মৃত্যু হবে। আপনি কি ডাক্তার?

না, উকিল। আমার নাম ফ্রাঙ্ক অল্‌ডার।

আমি ফেলিক্স স্টানিফোর্ড। ভালোই হল আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে। আমার বন্ধু মিঃ পার্সিভাল বলছিলেন, আমাদের শিগগিরই একজন উকিল লাগবে।

বেশ তো।

সেটা অবশ্য মিঃ পার্সিভালের ওপর নির্ভর করছে। আচ্ছা, আপনি বাতি হাতে বাড়ির পুরো একতলাটা ঘুরে এলেন?

হ্যাঁ।

পুরোটা? ও বেশ জোর দিয়ে জিগ্যেস করল আর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

তাই তো মনে হল। আশা করেছিলাম কাউকে-না কাউকে পাবই।

সবকটা ঘরে ঢুকেছিলেন কি? তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন।

যে কটায় ঢুকতে পেরেছিলাম।

ও! তাহলে তো আপনি দেখেই ফেলেছেন! এই বলে ও কাধটা ঝাঁকাল, ভাবটা এমন যে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।

কী দেখে ফেলেছি?

ওই সিল করা দরজাটা।

হ্যাঁ, দেখেছি।

ভেতরে কী আছে, জানতে ইচ্ছে করেনি, আপনার?

ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লেগেছিল।

আচ্ছা, মনে করুন এই বাড়িতে আপনি বছরের-পর বছর কাটিয়ে যাচ্ছেন আর ভাবছেন ওই দরজার ওপারে কী আছে, অথচ ঢুকে দেখছেন না। পারবেন এমন করে থাকতে?

কী, বলতে চাইছ তুমি? তুমি জানো না ওই ঘরে কী আছে?

আপনি যতটা জানেন, আমিও ঠিক ততটাই জানি।

তাহলে দরজা খুলে দেখছ না কেন?

উপায় নেই, বলল ও।

ওর কথাবার্তায় একটা বিব্রত ভাব ছিল। হয়তো কোনও স্পর্শকাতর জায়গায় অজান্তে ঘা দিয়ে ফেলেছি। এমনিতে আমার সাধারণ শোকের মতো অহেতুক কৌতূহল কম, কিন্তু এখানের যা ব্যাপার, তাতে আমার কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছে। যা হোক, এ-বাড়িতে আর বেশিক্ষণ থাকার কোনও অজুহাত আপাতত নেই, কেন না ছেলেটি প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে, আমি তাই উঠে পড়লাম।

আপনার কি তাড়া আছে, ও জিগ্যেস করল।

না। আমার এখন এমন কিছু কাজ নেই।

তাহলে খানিকক্ষণ থাকুন না আমার সঙ্গে। আসলে একেবারে একা থাকি, কাজকর্মও কিছু নেই। লন্ডনে হয়তো এমন কোনও লোক পাবেন না যে আমার মতো জীবন কাটায়। কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগও তো পাই না।

আমি ছোট ঘরটির চারিদিক দেখলাম। সাজানো-গোছানো বিশেষ নয়–একটা সোফা-কাম-বেড একদিকে রাখা। মাথায় ঘুরছে এই বিশাল শূন্য বাড়িটা আর বিশেষজ্ঞ ওই সিল লাগানো রহস্যময় দরজাটা। প্রায় অপ্রাকৃত একটা পরিবেশ। ইচ্ছে করছিল, আরও একটু খোঁজখবর নিই। হয়তো আর খানিকক্ষণ থাকলেই জানতে পারব আরও কিছু। ওকে বললাম যে, আমার কিছুক্ষণ থাকতে ভালোই লাগবে।

ও বলল, “দেখুন, সাইড টেবিলে ড্রিংকসের ব্যবস্থা আছে। আমি তো হাঁটতে পারছি না, সুতরাং হেল্প ইয়োরসেলফ। আর ট্রেতে চুরুট রাখা আছে। আমিও একটু চুরুট খাব। এবার বলুন–আপনি তো উকিল। মিঃ অলডার?”

হ্যাঁ।

আর আমি কিছুই নই। পৃথিবীর চেয়ে অসহায় জীব আমি। লাখপতির সন্তান। বিশাল সম্পদ আমার আমার অধিকারে আসবে, এই আশায় বড় হয়েছি। আর দেখুন আজ আমি কী– কপর্দকহীন, সম্পূর্ণ বেকার। ভাগ্যের কী পরিহাস–আমি এই বিশাল বাড়ির মালিক, যে-বাড়ি ঠিকমতো রাখার সামর্থ্যও আমার নেই। ছোট এক চিলতে জমি গাধার বদলে ঘোড়া দিয়ে চাষ করানোর মতো হয়তো একটা কুঁড়েঘরই আমার পক্ষে যথেষ্ট।

তাহলে বাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছ না কেন?

সম্ভব নয়।

তা হলে ভাড়ায় দিয়ে দাও।

তারও উপায় নেই।

আমার অবাক ভাব দেখে ও হাসল : দাঁড়ান, আপনাকে পুরো ব্যপারটা বুঝিয়ে বলি–অবশ্য যদি আপনার শুনতে ভালো লাগে।

না-না, তুমি বলো।

আসলে আপনি আজ আমার যে-উপকারটা করলেন, তার সামান্য প্রতিদান হিসাবে অন্তত আপনার কৌতূহলটুকু তো মেটাতে পারি। আপনি হয়তো আমার বাবার নাম শুনে থাকবেন, বিখ্যাত ব্যাংকার স্ট্যানিলস স্ট্যানিফোর্ড।

ব্যাংকার স্ট্যানিফোর্ডের নাম সঙ্গে-সঙ্গে আমার মনে পড়ল।

বছরসাতেক আগে হঠাৎ করে তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে অনেক কেচ্ছা কেলেংকারি রটেছিল।

বুঝতে পারছি আমার বাবার কথা আপনার মনে পড়েছে। বাবা তার বেশ কিছু বন্ধুর টাকা ফাটকায় লাগিয়েছিলেন। সেই টাকা ডুবে যাওয়ায় বন্ধুদের এড়াতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

খুব নরমস্বভাবের সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন বাবা, বন্ধুদের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য তিনি ভীষণ বিচলিত হয়েছিলেন, আইনত তিনি কোনও অপরাধ করেননি। কিন্তু পুরো ব্যাপারটায় তিনি এত মর্মাহত হয়েছিলেন যে, নিজের পরিবারের লোকেদেরও মুখ দেখাতে চাননি। পরে তিনি বিদেশ বিভূঁইয়ে মারা যান–কোথায় মারা যান তা-ও আমরা জানি না।

তোমার বাবা মারা গেছেন!

আমার কাছে বাবার মৃত্যুর কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু ফাটকায় লগ্নী করা সেই টাকা আবার উদ্ধার হয়েছে। বেঁচে থাকলে উনি নিশ্চয়ই সসম্মানে ফিরে আসতেন। কিন্তু মনে হয় গত দু-বছরের মধ্যে কোনও একসময় তার মৃত্যু হয়েছে।

গত দু-বছরের মধ্যে কেন?

কেন-না দু-বছর আগেও তাঁর চিঠি পেয়েছি।

চিঠিতে উনি ওঁর ঠিকানা জানাননি?

চিঠিটা এসেছিল প্যারিস থেকে–কিন্তু কোনও ঠিকানা ছিল না। ওই সময়েই আমার মা মারা যান। তখনই বাবার চিঠিটা এসেছিল–আমাকে কিছু উপদেশ আর কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আর কোনও খবর নেই।

তার আগে কখনও বাবার খবর পেয়েছিলে?

হ্যাঁ এবং সিল লাগানো দরজার রহস্যের শুরু তখনই। টেবিলটা একটু আমার দিকে ঠেলে দিন।

এখানেই আমার বাবার চিঠিগুলো রাখা আছে। মিঃ পার্সিভাল ছাড়া আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই চিঠিগুলো দেখছেন।

কিছু মনে কোরো না, মিঃ পার্সিভাল কে?

উনি ছিলেন বাবার একান্ত সচিব এবং প্রথমে মায়ের ও পরে আমার বন্ধু এবং উপদেষ্টা। মিঃ পার্সিভাল না থাকলে আমাদের যে কী অবস্থা হত, তা ভাবতেও পারি না। উনি ছাড়া বাবার চিঠিগুলো আর কেউ দেখেনি। এই দেখুন প্রথম চিঠি সাত বছর আগে লেখা। দেশ ছাড়ার দিন। নিজেই পড়ে নিন। চিঠিটা ফেলিক্সের মাকে লেখা:

তোমাকে আমার ব্যাবসার ব্যাপারে কখনও কিছু বলিনি, কেন না ডঃ উইলিয়ম আমায় বলেছিলেন তোমার হার্ট খুব দুর্বল। কোনওরকম উত্তেজনা তোমার পক্ষে বিশেষ ক্ষতিকারক হবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন যে, তোমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি।

আমার ব্যাবসার অবস্থা খুব খারাপ। এই কারণে আমি কিছুদিনের জন্যে তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তবে অবশ্যই যত শীঘ্র সম্ভব চলে আসব। আমাদের এই বিচ্ছেদ অতি অল্প সময়ের জন্য। সুতরাং এ নিয়ে ভেবে তুমি শরীর খারাপ কোরো না।

আমার একটা বিশেষ অনুরোধ আছে। চেষ্টা কোরো কোনওমতেই যেন এই অনুরোধ পালনে কোনও অন্যথা না হয়। লনে যাওয়ার প্যাসেজে আমার যে ডার্করুমটা আছে, যেখানে আমার ফোটোগ্রাফির কাজ করি, সে-ঘরে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলি আমি গোপন রাখতে চাই। তবে সেগুলির সঙ্গে কিন্তু কলঙ্কজনক কিছু জড়িয়ে নেই। তা সত্ত্বেও আমি চাই তুমি বা ফেলিক্স অবশ্যই আমার এই অনুরোধ রাখবে। ফেলিক্সের বয়েস যখন একুশ বছর হবে, তখন ও ওই ঘরে ঢুকতে পারে, তা আগে নয়।

এখন তোমার কাছ থেকে বিদায় নিই। আমার এই অল্পদিনের অনুপস্থিতিতে যে কোনও ব্যাপারে পরামর্শ নিতে গেলে মিঃ পার্সিভলের সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। ওঁর ওপর আমার অগাধ আস্থা। তোমাকে আর ফেলিক্সকে এভাবে ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছে–কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি নিরুপায়।

ইতি–
তোমার স্ট্যানিসলস
৪ঠা জুন, ১৮৮৭

আমার চিঠি পরা শেষ হলে ফেলিক্স খানিকটা কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল, আমাদের এই পারিবারিক ব্যাপার আলোচনা করে হয়তো আপনার সময় নষ্ট করলাম। ধরে নিন, আপনি সবকিছু একজন ল’ইয়ার হিসেবে শুনলেন। অনেক বছর ধরে কাউকে এই কথাগুলো বলতে চাইছিলাম।

আমাকে বিশ্বাস করে এত কিছু বললে এতেই আমি খুশি। তা ছাড়া পুরো ব্যাপারটা বেশ কৌতূহল জাগায়।

জানেন, আমার বাবার সত্যের প্রতি আকর্ষণ ছিল এমনই যে, মাঝে-মাঝে সেটা প্রায় মানসিক রোগের পর্যায়ে চলে যেত। কখনও তিনি মিথ্যেকথা বলতেন না। সুতরাং তিনি যখন বলেছিলেন যে, মায়ের সঙ্গে শিগগিরই আবার দেখা করবেন এবং ডার্করুমে কোনও কলঙ্কজনক ব্যাপার নেই, বাবা নিশ্চয়ই সত্যি কথাই বলছিলেন।

তাহলে ওই ঘরে কী থাকতে পারে?

সেটা আমার বা মায়ের কল্পনার বাইরে। আমরা বাবার কথায় আমরা দরজায় সিল লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এবং সেই সিল এখনও লাগানো। বাবার অন্তর্ধানের পর মা বছরপাঁচেক বেঁচে ছিলেন। যদিও ডাক্তাররা ভেবেছিলেন যে, মা বেশিদিন বাঁচবেন না। মায়ের হার্টের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছল। বাবার যাওয়ার পর প্রথম কয়েক মাসে মাকে লেখা বাবার দুটো চিঠি এসেছিল। দুটোই প্যারিস থেকে পোস্ট করা, কিন্তু কোনও ঠিকানা নেই। দুটো চিঠিই ছিল ছোট বক্তব্য একই? চিন্তা কোরো না, শিগগির দেখা হবে। এর পরে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত আর কোনও চিঠি আসেনি। তারপরে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন তার বক্তব্য এতই ব্যক্তিগত যে, চিঠিটা আপনাকে দেখাতে পারছি না। চিঠিতে মোটামুটি বলেছিলেন, আমি যেন তাকে খারাপ মানুষ না ভাবি। আমায় অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। এ-ও বলেছিলেন যে, মায়ের মৃত্যুর পর ওই ঘরটার দরজা বন্ধ রাখার যৌক্তিকতা অনেক কমে গেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার একুশ বছর বয়েস না হওয়া অবধি ওই ঘর না খোলাই ভালো। ঘর খুললে অত্যন্ত বেদনাদায়ক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। বরং অপেক্ষা করলে সময়ের প্রভাবে ওই পরিস্থিতি সামলে নেওয়া সম্ভব হবে। আর বলেছিলেন, ওই ঘরের দায়িত্ব আমার ওপর থাকল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, চরম দারিদ্র সত্ত্বেও এই বাড়ি আমি কেন বিক্রি করিনি বা ভাড়া দিইনি।

বন্ধক তো রাখতে পারতে!

বাবা বাড়িটা আগেই বন্ধক রেখেছেন।

পুরো পরিস্থিতিটাই অদ্ভুত।

আমি আর আমার মা এতকাল আসবাবপত্র বিক্রি করে চালিয়েছি। চাকরবাকরদের একে-একে বিদায় করা হয়েছে। আপাতত, আমি এই একটা ঘরেই থাকি–আমাকে দেখাশোনা করারও কেউ নেই। তবে আর মাত্র দু-মাস অপেক্ষা করতে হবে।

তার মানে?

আমার একুশ বছর বয়স হতে আর দু-মাস বাকি। তার পরেই প্রথম কাজ ওই ঘরের দরজাটা খোলা, আর দ্বিতীয় কাজ বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া।

আচ্ছা, ফাটকায় লাগানো টাকা যখন উদ্ধার হয়েই গেছল, তখন তোমার বাবা ফিরে এলেন না কেন?

বাবা নিশ্চয়ই ততদিনে গত হয়েছিলেন।

আচ্ছা, তুমি বললে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তোমার বাবা আইনত দণ্ডনীয় কোনও অপরাধ করেননি।

হ্যাঁ।

তাহলে তোমার মাকে সঙ্গে নিয়ে যাননি কেন? জানি না।

নিজের ঠিকানা গোপন করার কারণ কী হতে পারে?

তা-ও বলা কঠিন।

মা মারা গেলেন, তাঁর শেষকৃত্যও হয়ে গেল–তবুও তোমার বাবা কেন ফিরে এলেন না?

জানি না। দ্যাখো, একজন পেশাদার উকিল হিসেবে তোমাকে এটুকু বলতে পারি যে, তোমার বাবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পেছনে অবশ্যই কোনও গুরুতর কারণ ছিল। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের প্রমাণ ছিল না। তিনি হয়তো জানতেন কোনও প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যাপারটা থানা-আদালত অবধি গড়াতে পারে। সুতরাং তিনি দেশের বাইরে চলে যাওয়াই সমীচীন মনে করেন। এ ছাড়া তো আর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাচ্ছি না।

ফেলিক্স স্বভাবতই একটু ক্ষুণ্ণ হল। আমায় ঠান্ডা গলায় বলল, আপনি আমার বাবাকে চিনতেন না। যখন আমাদের ছেড়ে যান, তখন আমি খুবই ছোট। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বাবাই আমার আদর্শ। বাবার দোষ ছিল একটাই, তিনি একটু স্পর্শকাতর মানুষ ছিলেন। আর নিজের স্বার্থ নিয়ে কখনও ভাবেননি। তার মাধ্যমে কারুর আর্থিক ক্ষতির কথা তিনি ভাবতেই পারতেন না। তাঁর আত্মসম্মানবোধও ছিল অত্যন্ত প্রখর। সুতরাং তার অন্তর্ধানের কারণ খুঁজতে গিয়ে তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ভুলে গেলে চলবে না।

কিছু মনে কোরো না আমি তো বাইরের লোক, একটা নিরপেক্ষ মত দিলাম, এই মাত্র। যাক্, এবার উঠি, অনেকটা হাঁটতে হবে এখন। সমস্ত ঘটনাটা এমনই যে, এর শেষটুকু জানার কৌতূহল থাকবে।

আপনার কার্ডটা রেখে যান, বলল ফেলিক্স।

কার্ড রেখে শুভ রাত্রি জানিয়ে রওনা দিলাম।

বেশ কিছুকাল আর কোনও খবর পেলাম না।

হঠাৎ একদিন দুপুরে আমার অফিসে বেয়ারা একটা কার্ড দিয়ে গেল–একজন মিঃ জে, এইচ, পার্সিভাল আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন তিনি–বয়েস বছর পঞ্চাশেক, ছোটখাটো চেহারা। চোখদুটো কিন্তু উজ্জ্বল।

ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ডের কাছে আমার নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন, উনি বললেন।

অবশ্যই। আমার মনে আছে, বললাম।

ফেলিক্স আপনাকে ওর বাবার অন্তর্ধান এবং একটা সিল করা ঘরের কথা বলে থাকবে।

হ্যাঁ।

তা হলে আপনি নিশ্চয় জানেন যে, ফেলিক্সের একুশ বছর বয়েস হলে ওই ঘরটা খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন ওর বাবা।

জানি।

আজই ফেলিক্সের বয়স একুশ হল।

ঘরটা খুলেছেন? উৎসাহের সঙ্গে জিগ্যেস করলাম।

এখনও খুলিনি, গম্ভীরভাবে বললেন মিঃ পার্সিভাল।

আমার মনে হয় দরজাটা ভোলা সময় একজন সাক্ষী উপস্থিত থাকা দরকার। আপনি সাক্ষী হিসাবে থাকতে রাজি?

সানন্দে।

দিনের বেলা আপনি আর আমি দুজনেই ব্যস্ত। রাত নটায় যদি আমরা ওই বাড়িতে পৌঁছই?

নিশ্চয়ই আসব।

ওই কথাই রইল। আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করব, এই বলে মিঃ পার্সিভাল বিদায় নিলেন।

রাতে পৌঁছলাম ওই বাড়িতে। ফেলিক্সের ছোট ঘরটিতে ওরা দুজনে আমার অপেক্ষায় বসেছিলেন। ফেলিক্সকে স্বাভাবিকভাবেই বেশ নার্ভাস লাগছিল। কিন্তু মিঃ পার্সিভালের বিশেষ উত্তেজিত ভাব দেখে অস্বাভাবিক লাগল, ওঁর মুখ লালচে। হাতগুলো অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছে।

ফেলিক্স আমাকে দেখে বিশেষ খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানাল। তার পরেই সে বলল পার্সিভালকে, আর দেরি করে কী লাভ? চলুন, যা হওয়ার তাড়াতাড়ি হয়ে যাক।

পার্সিভাল বাতিটা হাতে নিয়ে আগে চললেন। কিন্তু দরজাটার কাছে পৌঁছনোর আগেই প্যাসেজে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওঁর হাত এত কঁপছিল যে, বাতির আলোর ছায়া দেওয়ালে ওঠানামা করছিল।

একটু ভাঙা গলায় পার্সিভাল বললেন, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি মন শক্ত করুন। সিল ভেঙে দরজা খোলার পর যাতে কোনও মানসিক আঘাত না পান।

কী থাকতে পারে ওই ঘরে, পার্সিভাল? আপনি কি বলছেন আমি ভয় পাব?

না, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড। কিন্তু আমাদের তৈরি থাকা দরকার…মন শক্ত করা চাই..আপনার যাতে কিছু পার্সিভাল শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে অতিকষ্টে টুকরো-টুকরো কথাগুলি বলছিলেন। তখনও আমি স্পষ্ট বুঝলাম যে, পার্সিভাল জানেন ওই ঘরে কী আছে এবং যা আছে তা ভয়ানক, বীভৎস।

মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, এই নিন চাবি। কিন্তু আমার সতর্কবাণী মনে রাখবেন, বললেন পার্সিভাল।

পার্সিভালের হাত থেকে চাবির গোছাটা ফেলিক্স ছিনিয়ে নিল। তারপর বিবর্ণ সিলটির নীচে একটা ছুরি ঢুকিয়ে এক ঝটকায় সিলটি উঠিয়ে ফেলল। বাতিটা পার্সিভালের হাতে কাঁপছে, তাই আমি বাতিটা আমার হাতে নিয়ে চাবির ফুটোর ওপর আলো ফেললাম। আর ফেলিক্স একটার-পর-একটা চাবি দিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল।

হঠাৎ একটা চাবি লেগে গেল আর দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে গেল। আর তার পরেই ফেলিক্স ঘরের ভেতরে এক পা গিয়েই একটা আর্তচিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে আমাদের পায়ের কাছে পড়ে গেল।

আমিও যদি পার্সিলের সতর্কবাণী না শুনতাম বা ভয়াবহ কিছু সহ্য করার জন্য তৈরি না থাকতাম, বাতিটা হয়তো আমার হাত থেকে পড়ে যেত। ঘরটায় কোনও জানালা বা আসবাবপত্র নেই। একটা ফটোগ্রাফিক ল্যাবরেটরির মতো সাজানো-একপাশে একটা সিংক ও তাতে একটা কল লাগানো। একটা তাকে কিছু শিশি বোতল রাখা। এবং ঘরের মধ্যে তীব্র, অস্বস্তিকর একটা গন্ধ কিছুটা কেমিক্যালের, কিছুটা জান্তব। আমাদের সামনে একটা টেবিল ও চেয়ার রাখা আছে। আমাদের দিকে পেছন ফিরে একজন ওই চেয়ারে বসে কিছু যেন লিখছে। মানুষটির দেহরেখা ও ভঙ্গী একদম জীবন্ত মানুষের মতো, কিন্তু তার ওপর আলো পড়তেই আতঙ্কে আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। লোকটির ঘাড় আমার কবজির মতো সরু। ঘাড়ের চামড়া কোঁচকানো কালো। তার শরীরের ওপর ধুলোর পুরু প্রলেপ-ঘন, হলদেটে ধুলো। চুল, কাধ, হলদে কুঁচকে যাওয়া হাত–সবেতেই ধুলোর প্রলেপ। মাথাটি ঝুঁকে বুকের ওপর। তার কলমটি একটি বিবর্ণ কাগজের ওপর পড়ে আছে।

হায়! মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আমার মালিক! পার্সিভাল এই বলে কেঁদে উঠলেন এবং তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

ইনিই মিঃ স্ট্যানিস স্ট্যানিফোর্ড! আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম।

এইখানে উনি সাতবছর বসে আছেন–সাত-সাতটি বছর। কেন এমন করলেন উনি? কত অনুরোধ করেছি, পায়ে ধরেছি–তা-ও আমার কথা শোনেননি। দেখুন টেবিলে একটা চাবি পড়ে আছে। ভেতর থেকে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ওই দেখুন, কিছু লিখে রেখেছেন। ওটা দেখতে হবে।

হ্যাঁ, ওই কাগজটা নিয়ে নিন আর, ভগবানের দোহাই, এই ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন, আমি বললাম। এই ঘরের হাওয়া বিষাক্ত। আসুন, স্ট্যানিফোর্ড, বেরিয়ে আসুন! আতঙ্ক বিহ্বল ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ডের দু-হাত দুজনে ধরে ওকে কিছুটা টানতে টানতে, কিছুটা বয়ে নিয়ে আমরা ওর ঘরে চলে এলাম।

জ্ঞান ফিরে এলে ফেলিক্স বলল, উনিই আমার বাবা। মৃত অবস্থায় চেয়ারে বসে! পার্সিভাল, আপনি নিশ্চয় সবকিছু জানতেন। তাই আপনি ওই ঘরে ঢোকার আগে আমাকে সতর্ক করেছিলেন।

হ্যাঁ, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আমি জানতাম। আমি ভালো ভেবেই সবকিছু করেছি। কিন্তু আমার অবস্থাটা একটু বিবেচনা করে দেখুন–সাত বছর ধরে আমি জানি আপনার বাবা ওই ঘরে মরে পড়ে আছেন!

আপনি সবকিছু জেনেও আমাদের কিছু বলেননি!

আমার ওপর রাগ করবেন না, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড। আবার বলি, এই ঘটনায় আমার ভূমিকাই সবচেয়ে কঠিন ছিল।

আমার মাথা ঘুরছে। কিছুই বুঝতে পারছি না! এই বলে ফেলিক্স টলতে টলতে গিয়ে বোতল থেকে খানিকটা ব্র্যান্ডি খেল ও আমার মাকে ও আমাকে লেখা বাবার চিঠিগুলো কি তা হলে জাল?

না। চিঠিগুলো আপনার বাবাই লিখেছিলেন এবং আপনাদের ঠিকানাও ওঁরই হাতে লেখা। আমাকে ওগুলো দিয়েছিলেন ডাকবাক্সে ফেলার জন্য। আপনার বাবা আমার মালিক ছিলেন। এবং কর্মচারী হিসেবে তাঁর আদেশ আমি অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছি।

ততক্ষণে ব্র্যান্ডির প্রভাবে ফেলিক্স একটু সুস্থ হয়েছে। ও বলল, এবার বলুন। হয়তো এখন সহ্য করতে পারব।

মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি তো জানেন একটা সময়ে আপনার বাবা বিশেষ বিপদে পড়েন। উনি ভেবেছিলেন, অনেকের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ওঁর গাফিলতির ফলে ডুবতে বসেছে। তখন উনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি ভাবতেও পারবেন না আপনার বাবার এই সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য আমি কী না করেছি–অনুরোধ, উপরোধ, জবরদস্তি। কিন্তু তিনি মনস্থির করে ফেলেছিলেন। আমাকে শুধু বলেছিলেন যে, ওঁর মৃত্যুটা সহজ না বেদনাদায়ক হবে, সেটা নির্ভর করছে আমার ওপর। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওঁর কথার নড়চড় হবে না। শেষপর্যন্ত আমাকে মেনেই নিতে হয় ওঁর অনুরোধ, আর ওঁর কথামতো সবকিছু করতে রাজি হলাম।।

ওঁর চিন্তার কারণ ছিল একটাই। লন্ডনের ডাক্তার ওঁকে বলে দিয়েছিলেন। ওঁর স্ত্রীর হৃদযন্ত্র খুবই দুর্বল এবং সামান্য মানসিক আঘাতেই তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। স্বামী হিসাবে উনি এমন কিছু করতে চাননি যাতে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এদিকে নিজের জীবনও তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কী করে স্ত্রীর কোনওরকম ক্ষতি না করে নিজের জীবন শেষ করা যায়, এই ছিল তার লক্ষ্য।

আপনি এখন নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন উনি কী রাস্তা নিয়েছিলেন। আপনার মা যে চিঠি পান, সেটা আপনার বাবারই লেখা। চিঠিতে যা লেখা ছিল, তা সবই সত্য। উনি লিখেছিলেন যে, আপনার মায়ের সঙ্গে শিগগিরই ওঁর দেখা হবে। তার মানে উনি কয়েক মাসের মধ্যেই আপনার মায়ের মৃত্যুর সম্ভাবনার ইঙ্গিত করছিলেন। আপনার মায়ের আসন্ন মৃত্যু সম্বন্ধে উনি এত নিশ্চিত ছিলেন যে, আপনার মাকে দুটো মাত্র চিঠি লিখে যানকিছুদিনের ব্যবধান রেখে পাঠানোর জন্য। কিন্তু আপনার মা পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন আর তাকে পাঠানোর জন্য আর কোনও চিঠি ছিল না।

আপনার বাবা আর-একটা চিঠি লিখে গেছলেন, যেটা আপনার মায়ের মৃত্যুর পর আপনাকে পাঠাতে বলেছিলেন। এই তিনটে চিঠিই আমি প্যারিসে গিয়ে ডাকবাক্সে ফেলি, যাতে সকলেই নিঃসন্দেহ হয় যে, আপনার বাবা বিদেশে আছেন। উনি আমাকে বলে গেছলেন কাউকে কিছু না জানাতে, তাই আমি চুপ করে থেকেছি। আমি তার বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলাম। উনি ভেবেছিলেন, সাত বছর পরে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলে ওঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন শোকটা অনেক সহজেই সামলে নেবে। উনি সর্বদা আর সবাইয়ের সুযোগ সুবিধে ভেবে কাজ করতেন।

আমরা চুপচাপ এতক্ষণ পার্সিভালের কথা শুনছিলাম। নৈঃশব্দ ভেঙে প্রথম কথা বলল ফেলিক্স, আপনার কোনও দোষ নেই, পার্সিভাল। আপনি আমার মাকে মানসিক আঘাত থেকে রক্ষা করেছেন, এবং তাই উনি আর কটা বছর বেঁচে ছিলেন। ওই কাগজটা কী?

আপনার বাবার মৃত্যুর সময়ে এইটাই লিখছিলেন। পড়ে শোনাব?

পড়ুন।

বিষটা খেয়েছি এবং বুঝতে পারছি তা আমার শিরায়-শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। অনুভূতিটা অদ্ভুত। কিন্তু কোনও যন্ত্রণা নেই। আমার ইচ্ছা অনুযায়ী যদি সবকিছু করা হয়, তা হলে এই লেখা যখন কেউ পড়বে, ততদিনে আমার মৃত্যুর পর কয়েক বছর কেটে যাবে। আমার কাছে যারা লগ্নীর জন্য টাকা দিয়েছিল, তারা এতদিনে নিশ্চয়ই আমার প্রতি তাদের বিরুপতা ভুলে গিয়ে থাকবে। আর, ফেলিক্স, তুমিও এই পারিবারিক কলঙ্কের জন্য আমায় ক্ষমা কোরো। ঈশ্বর আমার এই ক্লান্ত আত্মাকে বিশ্রাম দিন।

আমরা তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠলাম তাই হোক।

The Sealed Room গল্পের অনুবাদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *