বগুড়া – ভবানীপুর

বগুড়া

ভবানীপুর

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এদেশকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন–স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে গড়া এবং একথাও বলেছেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। বাংলাদেশের এক স্বপ্নাচ্ছন্ন গ্রাম হল এই সতীতীর্থ ভবানীপুর। গ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে শুনেছি যে দক্ষের পতিনিন্দায় লজ্জায় ও ক্ষোভে আত্মবিসর্জন দিলেন সতীদেবী। মহাপ্রলয় হল শুরু। সতীর নশ্বর দেহ নিয়ে নৃত্য করে স্বর্গ-মর্ত্য পৃথিবী জুড়ে তান্ডব সৃষ্টি করলেন সংহারক মহাদেব। রক্ষাকর্তা বিষ্ণুর টনক নড়ল। চক্রের আবর্তনে খন্ডিত হল সতীদেহ আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেল ধরিত্রী। একান্ন খন্ডের একখন্ড পতিত হল উত্তরবঙ্গের অখ্যাত এই ভবানীপুর গ্রামে। মা ভবানী স্কুলদেহ পরিত্যাগ করে দারুদেহের রূপ পরিগ্রহ করলেন। আমার গ্রামের ঐতিহাসিক পটভূমিকা তৈরি হল। আমার জন্মভূমি ভবানীপুর তাই পীঠস্থান। সেখানকার মাটি, সেখানকার ইতিহাস সবই আছে, কিন্তু নেই শুধু আমার বাসের অধিকার। আমার শান্তির নীড় আজ নষ্ট। খুব বেশিদিনের কথা নয়, বছর কয়েক আগেও ভাবতে পারিনি যে এমন সোনার গাঁ ছেড়ে আমাকে হীনতা দীনতার মধ্যে জীবনের শেষদিনগুলো কাটাতে হবে। আমার জন্মভূমি থাকতেও আমি পরবাসী লক্ষ্মীছাড়া হয়ে ক্লান্তপায়ে ফুটপাথে বিশ্রাম করব, বৃক্ষতলে রাত কাটাব, শিশুপুত্রের হাত ধরে ঘুরে বেড়াব অস্নাত অভুক্ত অবস্থায়। এই অশ্রুর বন্যায় মনে পড়ছে একটি কবিতার কথা,

ত্রিযুগের ব্যথা তিনভাগ জলে পূর্ণ করিল ধরা,
বাকি একভাগ ধর্মের নামে আজ অশ্রুতে ভরা।

আজ দেখছি অশ্রুই সত্যি। না হলে এমন যে স্বপ্নঘেরা গ্রাম ভবানীপুর, এমন শাঁখারীপুকুর তাকে ছেড়ে নতুন ইহুদি সেজে আমাদের অচেনা-অজানা পরিবেশে চলে আসতে হবে কেন? শান-বাঁধানো কলকাতার কোলাহলমুখর অশান্ত সন্ধ্যায় যখন মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তখনই বেশি করে মনে পড়ে সেই শ্যামল বনানী পরিবেষ্টিত আমার জন্মভূমি আর সাধের শাঁখারীপুকুরের কথা। মন মন্থন করে চলে শৈশবের সুখের দিনগুলো। মনে হয় কাক জ্যোৎস্না রাত্রে চুপচাপ বসে আছি শাঁখারীপুকুরের ধারে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অবচেতন মনের সেই পরিচিত ছবি, ‘আমি শাঁখের শাঁখারী-রাঙা শাঁখা ফিরি করি।’ সঙ্গে সঙ্গে বনমর্মর ভেদ করে কানে যেন ভেসে আসে ক্ষীণ স্বর–এই দেখো আমার শাঁখা পরা হাত!’ সংবিৎ ফিরে চমকে উঠে দেখি বাস্তবতার কঠোর পরিবেশ যেন ঠাট্টা করছে আমাকে। চোখ দুটো জলে ভরে আসে আপনা-আপনি। মনে মনে শুধু আক্ষেপের সুরে বলি,

অনাদি এ ক্রন্দনে মিশাইনু ক্রন্দন এ,
বুঝে নে মা এ প্রাণের কী দাহ!

মাঝে মাঝে ভাবি আমার গ্রামের ইতিহাস আমার ওপর এমন মর্মান্তিক প্রতিশোধ কেন নিল? আজ শত দুঃখের মধ্যেও সেরপুরের সেই ফ্যামা পাগলা আমওয়ালার কথা বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে। কোথা থেকে খুঁজে খুঁজে সিঁদুরকুটি আম নিয়ে এসে অতি আপনজনের মতোই সে যেন বলছে ‘খোকাবাবু, কনে যাও, আম খ্যাবা না?’ কই সে তো কোনোদিন বলেনি, বাবু, ‘আমাদের মোছলমানের দ্যাশ–তোমরা হেঁদুস্থানে চল্যা যাও!’

সেই কাদের মিয়া, রাজেক মাস্টার তারা তো কেউ আমার মন থেকে মুছে যায়নি। তাদের প্রতিটি কথা প্রতিটি উপদেশ আজও আমি মনে করে রেখেছি। আজও তাদের কথা চিন্তা করে আমার স্পর্শকাতর মন বেদনায় টনটন করে ওঠে। কেন?

কেন আমার প্রিয় সহপাঠী মহসিনের শেষ কথাগুলো আজও বার বার মনে পড়ছে এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও? আমাদের চলে আসার সময় সে বলেছিল– হ্যাঁরে, আমরা কী দোষ করেছি যে তোরা চলে যাচ্ছিস? এর উত্তর এ অবধি খুঁজে পাইনি আমি। ভাই মহসিন, যেখানেই থাকো তুমি, জেনো এখনও তোমাকে আমি ভুলিনি। তোমার সঙ্গে আমাকে শত্রুরা পৃথক করতে পারেনি। ভাই ভাইকে কবে কোথায় কে ভুলতে পেরেছে? তুমি যদি কোনোদিন আমাকে স্মরণ করো তাহলে নিশ্চয়ই আমি যাব। কী আর বলব, কী সমবেদনা জানাব, শুধু ভাবছি আমিও বাঙালি। বাঙালি ঘর ছাড়তেও পারে, আবার তৈরি করতেও জানে।

চোখ বুজলেই মনে পড়ে নাটমন্দিরের ধারে রক্তচন্দনের বীজ কুড়োনোর সে কী ধুম। কে কত বেশি কুড়োতে পারে তার যে প্রতিযোগিতা চলত তা ভাবতে গেলে হাসি পায় আজ। হারান পন্ডিতমশায়ের বাড়ি থেকে পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে কতদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এসব শাস্তি কিন্তু কোনোদিনই পেয়ারা চুরি থেকে আমাদের দূরে সরাতে পারেনি। পেয়ারা গাছটি কি তেমনিভাবে ফল দিয়ে চলেছে? ছোটো ছেলের দল আজও কি সেই সেখানে গিয়ে ভিড় জমায় পেয়ারা সংগ্রহের জন্যে?

পাঁজিতে প্রতিবছরই পুজো আসে, কিন্তু আমরা দেশে যেতে পারি না। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু আমরা কি স্বাধীন, আমরা যে সম্পূর্ণ অন্যের করুণার ওপর নির্ভরশীল। আগে প্রতিপুজোতেই বাড়ি গিয়েছি। সে কী আনন্দের দিন! ছোটো থেকেই দেখে আসছি অন্য সব দিনেও মা করতেন শিবপুজো। আমরা বসে থাকতাম ঠাকুরের প্রসাদ আর রক্তচন্দনের লোভে।

কালীবাড়ি আর কাছারির মালিক ছিলেন নাটোরের ছোটোতরফ। তাদের কথা ভোলবার নয়। আর ভুলতে পারব না রামনবমীর উৎসবে ব্যস্তসমস্ত নায়েব চোংদারমশায়কে। তাঁর কছে হিন্দু-মুসলমান সবাই ছিল সমান। জাতির লেবেল এঁটে তাঁর কাছে কেউ বিশেষ আদর আশা করতে পারত না। রামনবমীর দিন সমস্ত জায়গাটি গম গম করত। আজও মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনকার ছবি জীবন্ত হয়ে।

দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে সেদিনকার কথাকেও আজ রূপকথা বলে মনে হচ্ছে। আমাদের। সকালে স্নান-আহ্নিক সেরে মা সবাইকে নিয়ে বসে কুটনো কুটতেন। ঝিয়েরা রাশি রাশি বাসন ধুয়ে রকের ওপর রাখছে। সেসব বাসন আর একবার ভালো করে ধোয়া হলে তবে হেঁসেলে যাবে। বাইরে থেকে চাকর-ঠাকুররা এসে রান্না ও অন্যান্য কাজে সাহায্য করত। প্রকান্ড উঠোন–ভেতরের বাড়িতে ধানের মরাই বাঁধা সারি সারি। একপাশে চেঁকিশাল, গোয়ালে গোরু, পুকুরে মাছ। ঠাকুমা প্রতিটি গোরুর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে তবে অন্য কাজে মন দিতেন। যেখানে পশুর প্রতিও মানুষের এমন অসীম মমতা, মানুষে মানুষে প্রীতি-প্রেমের এমন শোচনীয় অভাব সেখানে ঘটে কী করে! বাইরের বাড়িতে মাঝে মাঝে কীর্তনের দল এসে মাতিয়ে তুলত মন! তার সব খুঁটিনাটি ছবি বড়ো বেশি করে আজকে পীড়িত করে তুলছে সারাঅন্তরকে। মনে করি আর ভাবব না ওসব কথা, কিন্তু মনের ওপর চোখ রাঙিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না তো! মানুষের মন কি পালটায়?

চিরদিনই ইতিহাস রচনা করেছে মানুষ। আজকের ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’কে নিয়ে জানি একদিন ঐতিহাসিকের দল গবেষণা করবেন, সাহিত্য পাবে খোরাক। কিন্তু তখন কি আর আমরা থাকব? যে সংঘবদ্ধ জীবন জাতিধর্ম নির্বিশেষে একসূত্রে সহস্রটি মনকে বেঁধেছিল সে সূত্র কে ছিঁড়ল? এক এক সময় হিসেবি মন কী পেয়েছি আর কী পাইনি তার হিসেব করতে যায়, কিন্তু তার সার্থকতা কোথায়? ছিন্নমূল জীবনে স্থিতি না এলে হিসেব তো মিলবে না। মন শুধু ক্ষুব্ধ হয়েই বলবে,

প্রলয় মন্থন ক্ষোভে
ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি
পঞ্চশয্যা হতে। লজ্জা শরম ত্যাগি
জাতি-প্রেম নাম ধরি প্রচন্ড অন্যায়
ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *