শ্রীহট্ট – পঞ্চখন্ড রামচন্দ্রপুর

শ্রীহট্ট

পঞ্চখন্ড

বাংলার পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত শ্রীভূমি। মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের পদধূলি লাঞ্ছিত, অদ্বৈতাচার্য ও দেশনায়ক বিপিন পালের জন্মস্থান পবিত্র শ্রীভূমি। তারই কোলে সদা উজ্জ্বল আমার গ্রাম পঞ্চখন্ড। বাংলার হাজার গ্রামের মধ্যে আমার গ্রাম অনন্যা। অদূরে উত্তাল প্রবহমান নদ ব্রহ্মপুত্র, তার শাখানদী কুশিয়ারা। বৈষ্ণবতীর্থ পঞ্চখন্ড, পার্শ্ববর্তী গ্রাম ঢাকা-দক্ষিণ। অতীতে বাংলা ও বাংলার বাইরে থেকে সমাগত বিদ্যার্থী পুণ্যার্থীদের চরণস্পর্শে ধন্য হয়ে যেত এই গ্রাম। যাঁরা আসতেন, তাঁরাও এ গ্রামের সান্নিধ্যে এসে নতুন প্রেরণা অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করে নিয়ে যেতেন। মহাপ্রভূর বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষায়, জ্ঞানে-গরিমায় পুণ্যব্রতা এই গ্রাম।

তার কথা বলতে গিয়ে মন চলে যায় অতীতে, অনেক দূরের অতীতে। মনের অলিতে গলিতে এলোমেলো ভাবনার ভিড়। তন্ময়তায় একেবারে ডুবে যাই। হঠাৎ যেন একটানা বাঁশির শব্দে চমকে উঠি। ওপার থেকে যাত্রী নিয়ে স্টিমার ছাড়ল। আমিনগাঁও রেল কোম্পানির বিজলি বাতি ঝিকমিক করছে এপার থেকে। নদ ব্রহ্মপুত্র। নিস্তরঙ্গ জলরাশি। একখানি শূন্য নৌকা ধীরে ধীরে ভিড়ছে পারে। কয়েক বছর আগে কুশিয়ারার তীরে বসে শেষদেখা সেই খেয়া নৌকা পারাপারের দৃশ্য মনে পড়ে গেল। কোনো মাঝি উদাস সুরে গান ধরেছে : ওরে বধূর লাইগ্যা পরান কান্দে মোর। সে গান আর শোনবার সৌভাগ্য হয় না। মনে পড়ছে গ্রামের সুধীনদাকে। গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় হৃষ্টপুষ্ট মানুষটি। সবসময় মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। আমাদের শৈশবকালে তিনি ছিলেন এক পরম বিস্ময়। এই লোকটিকে ধরতে কত পুলিশ-দারোগাকে কতবার নাজেহাল হতে হয়েছে। কত দিন মুগ্ধ বিস্ময়ে সে যুগের কীর্তি-কাহিনি শুনেছি তাঁর মুখে। রূপকথার মতো মনে হয়। বনজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি ধরে গেছে। পেছনে ঘুরছে প্রেতের মতো বিদেশি আমলের আই-বি-র দল। বোমা তৈরি আর পিস্তল চালাবার ট্রেনিং দেওয়া হয় শিয়ালকুচির জঙ্গলে। সে-যুগও চলে যায়। আসে অসহযোগ আন্দোলনের দিন। মাঠের মাঝখানে সার দিয়ে দেশকর্মীদের দাঁড় করায় অত্যাচারী দারোগা কেশব রায়। পিঠ ফুটে রক্ত বেরোয়। চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। তবুও প্রাণপণে অস্ফুটস্বরে প্রতিকণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র।

সুধীনদা আশা দিয়ে বলতেন : আর দুঃখ কী? স্বাধীনতা এল বলে। ভাবী দিনের ভাবী মানুষ তোরা, দুঃখজয়ী কিশোর তরুণের দল।… আর কথা শেষ করতে পারেন না। দু-হাত দিয়ে বুক চেপে ধরেন। অনেকদিন ধরে এই এক যন্ত্রণায় ভুগছেন সুধীনদা। সেই যে-বার পুলিশ সুপারের সঙ্গিনের আঘাতে বুকের একটি পাঁজর ভেঙে গিয়েছিল, তখন থেকেই একটানা কথা বলতে কষ্ট হত সুধীনদার। আজ কোথায় তিনি। হয়তো স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে কোনো এক উদবাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়ে তিনি প্রাণ-রক্ষার দুস্তর প্রয়াস করছেন।

গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে আমরা গড়ে তুলেছিলাম কিশোর লাইব্রেরি। করোগেটেড টিনের ছাউনি দেওয়া ছোটো ঘর। কিশোরদের জন্যে হলেও সেটা ছিল গ্রামের সকলের প্রাণ। যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সকলের অবসর বিনোদনের একমাত্র আশ্রয়কেন্দ্র। লাইব্রেরির পাশেই খেলার মাঠ। ফুটবল খেলার মরশুমে একটা-না-একটা প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত প্রতিদিন। অগণিত দর্শক। শুধু ছেলেরাই নয়–হুঁকো হাতে নিয়ে প্রৌঢ়-বৃদ্ধরাও মাঠের সামনে এসে জড়ো হতেন।

বর্ষাকালে খালে-বিলে মাঠে ধু-ধু করছে জল–সমুদ্রের বুকে যেন গ্রামটি নির্জন একটি দ্বীপ। শুরু হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। প্রতিপক্ষের চিৎকার–নৌকার দাঁড়ের শব্দ আর অসংখ্য দর্শকের উজ্জ্বল কলরব–কী ঊর্মিমুখর জীবন! মনে পড়ে ছোটো গ্রামখানার ছোটো ছোটো মানুষগুলোকে। বহির্জগতের সঙ্গে হয়তো তাদের সম্পর্ক ছিল না–নিজের গ্রাম এবং আশপাশে আত্মীয়স্বজন ছাড়া বহু মানুষের সঙ্গে হয়তো তারা মেশেনি,তবু কত সরল তাদের অন্তর কত বিষয়ে কত বাস্তব অভিজ্ঞতা! আকাশের দিকে চেয়ে ঠিক বলতে পারবে তারা, বৃষ্টি কখন হবে। সবুজ মাঠটার দিকে একবার স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি বুলিয়েই আনন্দে হয়তো মুখমন্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল একজনের। সে বললে-ফসল এবার হবে ভালো। আর ডোবার জল দেখে নির্ঘাৎ বলে দিল–প্রচুর মাছ আছে এর ভেতর। আশ্চর্য মানুষ এরা, বিচিত্র বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ এদের জীবন। নবীন মাঝি, তারক দাস, করিমুদ্দিন, শেখ সমীর এদের কি কখনো ভোলা যায়? প্রতিবার বাড়ি গেলে ঠিক এসে একবারটি খবর নেবে সমীর –ক্যামন আছ। তারপর এক কাঁদিকলা, নিজ হাতে ফলানো শাকসবজি নিয়ে এসে বাড়ি উপস্থিত–দাদাবাবুর লাইগ্যা আনলাম। পাষাণ-হৃদয় ছিল করিমুদ্দিন। একে একে তিনটি ছেলে এবং বউ একই মাসের ভেতর কলেরায় মরবার পরও লোকটাকে বিচলিত হতে দেখেনি কেউ। কিন্তু আমি জানি সেটা যে কত মিথ্যা। তার ভেতরের রূপ যে বাইরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। …একা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে গ্রাম ছাড়িয়ে কবরখানার কাছে পৌঁছেছি। সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার মিলিয়ে গেছে। সমস্ত শরীর ভয়ে শিউরে উঠল। ওই যে অল্প দূরে কী যেন নড়ছে, কে ও? স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু একী, মূর্তিটা যে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তবে যাই হোক, এ প্রেত নয়। কাছে আসতে বিস্ময়ের সীমা রইল না। আমায় সামনে দেখে হাউ হাউ করে কান্না শুরু করল করিমুদ্দিন। হঠাৎ খেয়াল হল। বহুদিনের নিরুদ্ধ আবেগ আর বাঁধ মানছে না করিমুদ্দিনের। মাথায় হাত দিয়ে রাস্তার ওপরেই বসে পড়ল আকাশের দিকে হাঁ করে চেয়ে। সান্ত্বনা দেবার মতো আমার কিছুই ছিল না, ধীরে ধীরে হাত দুটো ধরে অনেক দূর অবধি আনলাম ওকে। ওর মনের ভাষাটা তখন ঠিক রূপ নিয়েছে। যেন-’মোর জীবনের রোজ কেয়ামত, ভাবিতেছি, কতদূর!

সেদিন আর আজ। দুস্তর সমুদ্রের ব্যবধান। রাজনৈতিক পঙ্কিলতায় ডুবে আজ মানুষের মন বিষাক্ত, হিংস্রতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু চিরকালই কি এমন ছিল? হিন্দুর বহু ধর্মীয় উৎসবে যোগদান করেছে মুসলমান। আমাদের বারোয়ারি কালীপুজোয় যে শখের যাত্রা হত, তাতে বহু মুসলমানকে দেখেছি ছড়ি হাতে নিয়ে অশান্ত জনতাকে শান্ত করতে। আর প্রতিবছর মহরমের দিন গাজনতলায় যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হত, তাতে নিজ গ্রামের খেলোয়াড়দের অপূর্ব ক্রীড়ানৈপুণ্যে আমার বুকও কি গর্বে দশ হাত উঁচু হয়ে উঠেনি! সেসব তো আজ অতীতের বিস্মৃতপ্রায় স্বল্পকাহিনি!

আগে গ্রামে বিদ্যাচর্চার খুবই সুযোগসুবিধা ছিল। তর্করত্নমশাইদের চতুষ্পঠীতে বহুদূরদেশ থেকে লোক বিদ্যার্জন করতে আসত। আজ আর তার চিহ্ন নেই। ছিল ভাঙা আটচালায় গুটিকয় ছাত্র নিয়ে অপুর পাঠশালা। সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। সবই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। শুধু বাইরে নয়, অন্তরেও চিড় ধরেছিল বহুদিন থেকেই। শ্রীহট্টে গণভোটের সময় চিরশান্ত রসিদ, যাকে শ্রদ্ধা করতাম, গ্রাম্য সম্পর্কে চাচা বলে সম্বোধন করতাম তার কথাবার্তায় পর্যন্ত উন্মা ও অবর্ণনীয় ক্রোধ প্রকাশ পেয়েছে দেখে বিস্মিত হয়েছি, দুঃখ পেয়েছি। মর্মান্তিক দুঃখে বিষণ্ণ বোধ করেছি রানিদির কথা ভেবে। লক্ষ্মীর প্রতিমার মতো রূপ। স্নেহমধুর ব্যবহার। বিয়ের কিছুদিন পরই বিধবা হয়ে অবাঞ্ছিতরূপে ফিরে এসেছিলেন বাপ-ভাইয়ের সংসারে। তবু আমাদের জন্যে তাঁর স্নেহধারায় কার্পণ্য হয়নি কোনোদিন। আজ শ্রীকান্তের মতোই বলতে ইচ্ছে করে, বাংলার পথে-ঘাটে মা-বোন। সাধ্য কি এঁদের স্নেহ এড়িয়ে যাই। সেদিন কলকাতার মেসে এক রুদ্ধ কোঠায় আঝোরে অশ্রুপাত করে ডেকেছি রানিদিকে।

গ্রামের কথা বলতে বলতে গ্রামের যত সব সোনার মানুষেরই ভিড় জমে ওঠে মনে। যদি এতে ইতিহাস না থাকে, চিত্র না থাকে, আমি নিরুপায়। আমার কাছে এদের প্রত্যেকেই অপরিহার্যরূপে আজও চিরঅমলিন। আমার পঞ্চখন্ডকে আমি ফিরে পেতে চাই, ফিরে পেতে চাই আমার আপনজনকে। হয়তো পাব। ইতিহাস তো আগে থেকে কোনো কথা বলে না।

.

রামচন্দ্রপুর

‘স্বদেশ স্বদেশ করিস কেন, এদেশ তোদের নয়’–চারণ-কবির এই গান আমরা সমবেত কণ্ঠে গেয়েছি ছোটোবেলায় আমাদের সোনার গ্রামের পথে পথে। গ্রামের মেয়ে-বধূ আর শিশু-বৃদ্ধের দল সার বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছে পথের দু-ধারে, স্বেচ্ছাসেবক দলের গানে তারাও অভিভূত হয়েছে। এক এক সময় তাদের চোখে দেখেছি জল, মুখময় যেন কী বেদনা! পরদেশি শাসনের তীব্র জ্বালা। কিন্তু আজ! ব্রিটিশ শাসনমুক্ত দেশের মাটিতেও আজ আমার অধিকার নেই! পিতৃপুরুষের যে ভিটেকে মায়ের মতো ভালোবেসেছি, যে মাটিকে প্রণাম করে বিদেশি শাসকের রোষবহ্নিকে বরণ করে নিয়েছিলাম, স্বপ্নময় কৈশোরে আমার জন্মভূমি জননীকে একদিন নবারুণালোকে স্বাধীনতার স্বর্ণ সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত দেখব আশায়, সেই মাটিই যেন আজ বিরূপ! স্নেহময়ী সেই মাটির মায়ের কোথায় সেই অভয়া রূপ? তার কোল-ছাড়া ভিটে-ছাড়া হয়ে আজ ছিন্ন-ভিন্ন আমরা। কোথায় মায়ের অভয় আহ্বান? কবির গানই কি তবে সত্যি–স্বদেশ মোদের নয়, দেশের মাটিতে নেই আমাদের কোনো অধিকার? মাতৃপূজার এই কি পুরস্কার?

মনে পড়ে স্বদেশি যুগের কথা। কবিগুরুর রাখিবন্ধনের গান গেয়েই আমরা ক্ষান্ত হইনি, মনেপ্রাণে রূপায়িত করেছি কবির বাণী ও প্রেরণাকে। কে হিন্দু, কে মুসলমান এ প্রশ্ন বড়ো করে কোনোদিনই আমাদের মনে আসেনি। ভাই ভাই হয়েই আমরা কাজ করেছি পল্লি উন্নয়নে, দেশ ও দেশবাসীর সেবায়।

আমার প্রতিবেশী মুসলমান বন্ধু যেদিন গাঁয়ের মাটি ছেড়ে দূরপথের যাত্রী হল অর্থান্বেষণে সে-দিন তাকে বিদায় দিতে যে বেদনা বোধ করেছিলাম সে তো আত্মীয়-বিরহেরই ব্যথা। সেই দূরবাসী বন্ধুর পথের আশায় ডাকঘরে যেয়ে যেয়ে আমার কৈশোর-জীবনের কতদিন যে হতাশায় ভরে উঠেছে আজও মনে জাগে তার বেদনাময় স্মৃতি, আবার এক একদিন তার পত্র হাতে নিয়ে যে কত উৎফুল্ল হয়ে বাড়ি ফিরেছি সে-কথাও ভুলে যাইনি। কিন্তু কোথায় আজ সেই বন্ধু? আজ আমি যখন ছন্নছাড়া শরণার্থীর বেশে কলকাতার জনারণ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি, আমার সেই প্রাণের বন্ধু আমার কথা কি মুহূর্তের জন্যেও ভাবছে? সাতপুরুষের ভিটেমাটি পুণ্য জন্মভূমি ছেড়ে আমরা যেদিন মান-প্রাণের দায়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশ যাত্রায় সে-দিন তো বন্ধু এসে বাধা দিল না বা আর কোনো মুসলমান প্রতিবেশী এসে বারণ করল না চলে আসতে গ্রাম ছেড়ে!

টম যেন বুঝতে পেরেছিল দু-দিন আগেই যে, আমরা চলে যাচ্ছি কোথায় কোন অজানা দেশে। আসার আগের দিন সারারাত ধরে টমের সে কী কান্না! রওনা হবার দিন সকালবেলাও খোকন মুঠো মুঠো ভাত দিয়েছে টমকে, কিন্তু টম শুধু তার ল্যাজ নেড়ে খোকনের গা ঘেঁষে এসে কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে ভাতে আর মুখ দেয়নি।

মিনি বেড়ালটাও পিছু নিয়েছিল ক-দিন ধরে। বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলোর কতই না প্রিয় সে। শেষ দু-দিন দেখেছি আমাকেই আটকে দেবার জন্যে সে যেন একটা প্ল্যান করেছিল। তা na হলে কোনোদিন সে যা করেনি তা করবে কেন? চলে আসার আগের পরপর দু-রাত মিনি আমার বিছানায় ঠিক আমার পায়ের তলায় শুয়ে কাটিয়েছে। ঘুমের আবেশে তার মিনতিভরা স্পর্শও যেন অনুভব করেছি। সকাল বেলা জেগে উঠে লক্ষ করেছি তার সকরুণ বিমর্ষতা!

খোকন একবার বলেছিল, টম আর মিনিকে সঙ্গে করে নিয়ে চলো না বাবা! খোকনের মাও সায় দিয়েছিলেন তাতে। আমার মনে প্রশ্ন জাগল; ওরা কী দোষ করেছে? ওদের কেন অকারণে দেশছাড়া ভিটেছাড়া করব? রাজনীতির পঙ্কিলতায় ওরা তো মাথা গলায়নি!

কিন্তু তাতে কী? মানুষেরই প্রতিপালিত জীব ওরা, মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ওদেরও কিছুটা করতেই হবে। তাই আমাদেরই পাপে দেশবিভাগের সম্মতির পরিণামে পরিজনহীন কত টম কত মিনি যে বেদনা-বিহ্বল হয়ে দিন কাটাচ্ছে আজ, কে তার হিসেব রাখে?

আচ্ছা, আমাদের টম, আমাদের মিনি এখনও কি আমাদেরই বাড়িতে আছে? টম কি আজও শুয়ে থাকে টেকিঘরের বারান্দায় তারই গড়া গর্তটার মধ্যে? অপরিচিতের পদশব্দে আজও কি টম তেমনই গর্জে ওঠে প্রহরীর কর্তব্য পালন করতে? ইঁদুর, পোকামাকড় এমনকী সাপ দেখেও মিনি কি এখনও তেমনই তেড়ে যায়? ওরা হয়তো আজও খুঁজে বেড়ায় খোকনকে এঘরে-ওঘরে, বাড়ির উঠোনের পেছনে, আর তার সঙ্গ না পেয়ে, আমাদের কাউকে না দেখে হয়তো ডুকরে কাঁদে!

আর আমাদের মুসলমান প্রতিবেশীরা? যুগ যুগ ধরে পারস্পরিক সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে যাদের সঙ্গে পাশাপাশি বাস করেছি, তারা একটুও কি দুঃখবোধ করল না আমাদের ছেড়ে দিতে? ওরা দাদা ডেকেছে, মামা ডেকেছে, আমরাও ওদের কাউকে ডেকেছি চাচা, আবার কাউকে ডেকেছি নানা। রাজনীতির খাঁড়ার কোপে যুগ-যুগান্তের সেই আত্মীয়দের সম্পর্কে কি চিরতরে ছেদ পড়ে গেল? ওদের কারও কারও মনের মণিকোঠায় হয়তো আজও আমাদের কথা জাগে। কিন্তু ওদের সঙ্গে প্রতিবেশীরূপে আর কি কোনোদিন দেখা হবে না?

গ্রাম ছেড়ে আসার দিনই অসময়ে একটা কাক ডেকে গিয়েছিল আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে। সে-ডাকে শুনেছিলাম কান্নার সুর। কাকের কণ্ঠ মনে রাখার মতো নয়। তবু কেন পল্লিমায়ের কোল-ছাড়া হয়ে আসার একটু আগে শোনা শেষ কাক-স্বর আজও কানে বাজে!

নিতান্ত গন্ডগ্রাম হলেও শ্রীভূমি শ্রীহট্টে একটা গৌরবময় স্থান অধিকার করে রয়েছে আমার সাধের গ্রাম রামচন্দ্রপুর আর তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। ক্ষুদ্র নবদ্বীপ বলে পরিচিত যে পঞ্চখন্ড, সংস্কৃত শিক্ষার অন্যতম সেই কেন্দ্রভূমিরই একাংশ আমাদের গ্রাম। মোট আট-দশ হাজার অধিবাসীর মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয় ভারতীয় শিক্ষিতের গড়পড়তা হারের তুলনায়। তাঁরা প্রত্যেকেই গর্ব করে এসেছেন এতকাল এই বলে যে, এমন এক ঐতিহাসিক গ্রামে তাঁদের বাস যার অন্তত হাজার বছরের প্রাচীনত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে তাঁদের সামনে।

কুমার ভাস্কর বর্মার তাম্রশাসনের কথা বলছি। কামরূপের রাজা ছিলেন কুমার ভাস্কর বর্মা। থানেশ্বরের অধীশ্বর দানশীল হর্ষবর্ধন শিলাদিত্যের তিনি ছিলেন সমসাময়িক। আমাদের গ্রাম থেকে মাত্র দু-মাইল দূরে আবিষ্কৃত হয়েছে ভাস্কর বর্মার তাম্রশাসন। সেই তাম্রশাসনে বর্ণিত কুশারী নদী আজও বয়ে চলে আমাদেরই গ্রামের পাশ দিয়ে। গাঙ্গুলি ও চন্দ্রগ্রামের ইতিকথা কিছু না জানা থাকলেও তাম্রশাসনের উল্লেখ থেকে আমাদের অঞ্চলবর্তী এ দুটি গ্রামের প্রাচীনত্ব ধারণা করা যেতে পারে।

শুধু কি এই? কত স্মরণীয় কত বরণীয়ের আবির্ভাব ঘটেছে আমাদের এ অঞ্চলে। পাশের গ্রাম দিঘিরপারে জন্মেছিলেন সুবিখ্যাত নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি। ছেলেবেলায় পড়েছি রঘুনাথের ছোটোবেলার কথা। কী অপরিসীম বুদ্ধি ছিল তাঁর অতটুকু বয়সে! পরবর্তীকালে যাঁর প্রতিভার দীপ্তি সারাভারতকে প্রদীপ্ত করেছিল, তিনি ছিলেন আমারই পূর্বপুরুষের প্রতিবেশী, বন্ধুজন হয়তো–একথা ভাবতেও শিহরন অনুভব করি। সেকালে ছিল না বৈদ্যুতিক আলো, ছিল না দেশলাই। আগুন ধরানো হত চকমকির সাহায্যে। তাও গরিবের পক্ষে ছিল দুর্লভ। পাঁচ বছরের শিশু রঘুনাথকে তাঁর মা বলেছিলেন একটু আগুন নিয়ে আসতে উনুন ধরাবার জন্যে। রঘুনাথ পাশের বাড়ির গিন্নির কাছে গিয়ে চাইলেন একটু আগুন। গিন্নি জিজ্ঞেস করলেন আগুন নেবার পাত্র কোথায়? রঘুনাথ তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলেন রান্নাঘরের পাশেই এক ছাইয়ের স্তূপ। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দু-হাত ভরে ছাই তুলে নিয়ে আবার গেলেন প্রতিবেশী গিন্নিমায়ের কাছে। গিন্নিমা বিস্মিত হয়ে একবার চাইলেন তাঁর দিকে, তারপর একহাতা আগুন তুলে দিলেন হাতের ওপরকার সেই ছাইয়ের ওপর। রঘুনাথ হাসতে হাসতে এগিয়ে চললেন তাঁদের বাড়ির দিকে। সম্মুখেই টোল। পন্ডিতমশাইয়ের চোখে পড়ল এই বিস্ময়কর ব্যাপার? রঘুনাথকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করে শুনলেন সব কথা। সব দেখেশুনে তাঁর মায়েরও বিস্ময়ের অবধি রইল না। নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলে রঘুনাথ। ছেলেকে টোলে পড়াবার সাধ থাকলেও বাপ-মায়ের সে সাধ্য ছিল না। কিন্তু সেদিনকার সে-ঘটনায় বিমোহিত পন্ডিতমশাই রঘুনাথকে নিজে ডেকে নিয়ে বিনে পয়সায় তাঁর টোলে পড়াতে লাগলেন। সেই কবে পড়েছি এই গল্প, আজও ভুলিনি। ভোলা যে যায় না।

শ্রীচৈতন্যের জন্মপূত ঢাকা-দক্ষিণ সারাভারতের তীর্থক্ষেত্র। মাত্র সাত মাইলের পথ সে গ্রাম আমাদের বাড়ি থেকে। শ্ৰীমনমহাপ্রভুর বাড়িতে যথারীতি পূজার্চনা চলছে শুনে এসেছি। নিত্য কীর্তনের ব্যবস্থাও নাকি এখনও অব্যাহত আছে। চৈতন্যদেবের জ্ঞাতি বংশের লোকেরা আজও সেখানে রয়েছেন। কতদিন থাকতে পারবেন তাঁরা জানি না। তবে প্রেমময় শ্রীগৌরাঙ্গের সংকীর্তনে নবদ্বীপের পথে পথে একদিন যেমন ভক্তিরসে মেতে উঠেছিল হিন্দু মুসলমান একযোগে, ক্ষুদ্র নবদ্বীপ’ পঞ্চখন্ডে তেমন দিন দেখা দেবে সে-আশা নিতান্তই দুরাশা। এ যুগে যবন হরিদাসের আবির্ভাব একান্তই যেন অসম্ভব, ব্রাহ্মণ কালাপাহাড়েরই ছড়াছড়ি চারদিকে। তাই তো দেশেমাতৃকার দেহ-খন্ডন, তাই তো আজকের এই সর্বনাশ এই হাহাকার।

অমাবস্যার আকাশে পূর্ণচন্দ্র! এও কি সম্ভব? সম্ভব নাকি হয়েছিল এরূপ জনশ্রুতি রয়েছে। অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছিলেন আমাদেরই প্রতিবেশী ত্রিপুরা জেলার মেহের কালীবাড়ির সুপ্রসিদ্ধ সাধক সর্বানন্দ ঠাকুর আর আমাদের গুরুবংশের আদিপুরুষ ‘ত্রিশূলী’মশাই। ত্রিশূলী-র কালী’ আজও নাকি পুজো পান আমার গাঁয়ের মানুষের কাছে। কিন্তু পাপশক্তির বিনাশে মায়ের খঙ্গ তো আর নেচে ওঠে না! ‘ত্রিশূলী’-র বংশধরেরা তাই বুঝি আজ ত্রিপুরা রাজ্যে পলাতক!

ছোট্ট গ্রাম রামচন্দ্রপুরের অধিকাংশ জমির মালিকই ছোটো ছোটো জমিদার আর তালুকদার। তাঁদের মধ্যে হিন্দুও আছেন, মুসলমানও আছেন। গ্রামের মধ্যে বিশেষ করে তাঁরাই সম্পন্ন, তাঁরাই শিক্ষিত এবং তাঁদেরই অর্থে ও চেষ্টায় গড়ে উঠেছে পল্লির ছেলে মেয়েদের বিদ্যায়তন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডাকঘর, ক্লাব ইত্যাদি। তবে শিক্ষাদীক্ষায় স্থানীয়

হিন্দুরাই বেশি উন্নত এবং এগ্রামের প্রতিষ্ঠাতাও কায়স্থ ভূস্বামীরাই। আর সব জায়গার মতো আমাদের গ্রামেও ঝগড়াবিবাদ ছিল। লড়াই ও লাঠালাঠির কথা শুনেছি, দেখেছিও। কিন্তু সেসবই ছিল জমিদারির লড়াই। সেসব লড়াই আর লাঠালাঠি তালুকদারে তালুকদারে হয়েছে–হিন্দু-মুসলমানের কথা তাতে কোনোদিন ওঠেনি। হয়তো কোনো ধান খেতে একটা আল নিয়ে ঝগড়া বেধেছে একজন হিন্দু আর একজন মুসলমান তালুকদারের মধ্যে। দেখা গেল বাকি কয়জন মুসলমান তালুকদারই যোগ দিয়েছেন হিন্দু তালুকদারের পক্ষে, আবার কয়েকজন হিন্দু ভূস্বামী সাহায্য করছেন তাঁদের বিবাদমান মুসলমান প্রতিবেশীকে। এমন ঘটনা অনেকবারই নাকি ঘটেছে আমাদের গাঁয়ে এবং পাশাপাশি এলাকায়।

সাধারণ হিন্দু-মুসলমান একে অন্যকে সাহায্য করেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির বছরেও এমন ঘটনা খুঁজে বেড়াতে হত না। কিছুকাল আগের কথা। সম্ভ্রান্ত তালুকদার উজির আলি ভাগ্য বিপর্যয়ে অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। বাবার চেয়ে বয়েসে কিছু ছোটো হলেও একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে। উজির আলি সাহেবকে ডেকে পাঠালেন বাবা। তিনি এলেন এবং বন্ধুর মতোই বাবা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘উজির, শুনছি পারিবারিক মর্যাদা বজায় রেখে সংসার চালানোই নাকি তোমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তার জন্যে চিন্তা কোরো না ভাই।’ এই বলে বাবা বিনে খাজনায় ভোগস্বত্ব দিয়ে বারো বিঘের একটা ধানজমি লিখে দিলেন উজির আলি সাহেবকে।

স্বাধীনতার সংগ্রামী হিসেবে বিদেশি শাসক আর তার পদলেহীদের হাতে লাঞ্ছনা সয়েছি দীর্ঘকাল ধরে; কিন্তু মনে আনন্দের ভাটা পড়েনি তাতে কোনোদিন। বরং ওদের বাঁধান যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন ঠুটবে মোদের ততই বাঁধন টুটবে।”- মহাজনের এই মহাবাণী লক্ষ্যসাধনে আমাদের মনোবলকে চতুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শত নির্যাতনের মধ্যেও দেশবাসীর অপার স্নেহ ও প্রীতি আমাদের কৃতজ্ঞতায় ভারাক্রান্ত। সেই দেশবাসীর একাংশ বিষের বাঁশি বাজিয়ে আমাদের করল ঘরছাড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *