নোয়াখালি – দরাপনগর সন্দীপ ত্রিপুরা বায়নগর চান্দিসকরা বালিয়া কালীকচ্ছ

নোয়াখালি

দরাপনগর

পূর্ববঙ্গে প্রথম দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া নেমে আসে আমাদের নোয়াখালিতে। সাম্প্রদায়িক খঙ্গাঘাতে দ্বিখন্ডিত হয়েছি আমরা, কিন্তু তবু আমরাই একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। এই নোয়াখালির বুকের পাঁজরে পাঁজরে পড়েছিল মহাত্মার চরণচিহ্ন। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তাঁর ঐতিহাসিক পরিক্রমা সমস্ত পূর্ববাংলার বুকে একদিন এনেছিল চাঞ্চল্য। ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে এই গ্রাম সফরই যথেষ্ট। শ্রীচৈতন্যের পুণ্যস্পর্শে নবদ্বীপ যেমন ধন্য, তেমনি ধন্য হয়েছে নোয়াখালি মহাত্মাজির পুণ্য পাদস্পর্শে। বৈষ্ণবযুগের জগাই-মাধাইরা কি সব নতুন করে জন্ম নিয়েছে পূর্ববাংলার পল্লিতে পল্লিতে? ইতিহাসের পশ্চাদপসরণের অর্থই হল হানাহানি, বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তহত্যা, ভ্রাতৃবিরোধের কলঙ্কময় সমষ্টিফল। আমরা সে-কথা বুঝেছি অক্ষরে অক্ষরে, বুঝেছি আজ সর্বস্ব খুইয়ে। যাদের ভূমি যায় হারিয়ে তাদের ভূমিকা যে কী হতে পারে তাও ভাববার বিষয়!

এক দেশের অবাঞ্ছিত মানুষ অন্য দেশের ভারস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছি যেন আমরা, অমৃতবঞ্চিত পূর্ববাংলার অভিশপ্ত মানুষেরা আবার কবে এবং কী করে, স্বঐতিহ্যে, স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে তার শুভ ইঙ্গিত বা গোপনমন্ত্র কে বলে দেবে?

মনে পড়ছে ভোর পাঁচটায় হরিনারায়ণপুর থেকে যেদিন আমাদের স্টিমার ভোঁ বাজিয়ে অজানা রাজ্যের দিকে যাত্রা করল সেদিন পূর্বাকাশের উজ্জ্বল শুকতারাটি পর্যন্ত যেন লজ্জার, শঙ্কায়, অভিমানে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। হু-হুঁ শব্দে জল কেটে নিস্পৃহ যন্ত্রদানব চলছে এগিয়ে সাত-পাঁচ কোনো কথা না চিন্তা করেই–ব্যথাতুরা জননীর বুকের ভেতর গুমরে গুমরে উঠছে আর সেই হৃদয়-নিঙড়ানো ধড়ফড়ানির ঢেউ এসে লাগছে আমারও বুকে। স্নেহময়ী মাকে শেষবারের মতো দেখে নেবার জন্যে আমি দাঁড়িয়েছিলাম ডেকে–কিন্তু অশ্রুভারে সমস্ত কিছু তখন হয়ে উঠেছে অস্পষ্ট। মায়ের রূপ গেছে হারিয়ে। ইঞ্জিনের শব্দ শুনে আমার মনে হচ্ছিল দেশজননী যেন বলছেন, ফিরে আয়–ফিরে আয়–ফিরে আয় আপন ঘরে! লক্ষ করলাম চতুর্দিকে ফিরে আসার ইঙ্গিত, আমাদের না যেতে দেবার আহ্বান।

কিন্তু আমি দুর্বল মানুষ; আমার উপায় নেই থাকবার। দোটানায় পড়ে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে শুধু অক্ষমতার তপ্ত অশ্রু। সেদিন দেশজননীর কোল থেকে বিদায় নেবার পর থেকে যে অশ্রুবর্ষণ শুরু হয়েছে তার শেষ কোথায় জানি না। আজ এই বিশাল অনাত্মীয় পাষাণপুরীর এক কোনায় একখানি প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে ধুকছি, মাথা পড়েছে নুয়ে, দুর্ভাবনায় চোখের পাশে কালিমার ছাপ দেখা দিয়েছে। ছাত্রজীবনের রঙিন স্বপ্নরেশগুলি আজ কঠিন বাস্তবের আঘাতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে আসার সময় তার বুকে যে উত্তাল তরঙ্গরাশির নৃত্যরূপ দেখেছিলাম তারই মধ্যে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছি আমার সমস্ত আশা-ভরসা। উদবাস্তু স্টিমারের যাত্রী আমরা, আমাদের আশার স্বপ্ন দেখার সময় আছে? আমরা ওপারের অবাঞ্ছিত আর এপারের বোঝা হয়ে জীবন কাটাচ্ছি। সময় সময় দুঃখের আধিক্যে সজোরে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে মাটিতে, কিন্তু কোথায় আমার সেই মিষ্টি দেশের মাটি?

নোয়াখালি। বাংলামায়ের সর্বকনিষ্ঠা স্নেহ-দুলালি নোয়াখালি। মহাত্মার পাদস্পর্শে ধন্যা নোয়াখালি। সারাবাংলার অণু-পরমাণু দিয়ে গড়া সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আমার নোয়াখালি। তারই কোলে শিশু গ্রাম আমার প্রিয় দরাপনগর’। এ গ্রামের কোনো ঐতিহাসিক পটভূমিকা আছে কি না জানি না। শুধু জানি দরাপনগর নামটি মনে পড়লেই চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে আম-কাঁঠাল, সুপারি, নারকেলকুঞ্জ-ঘেরা একটি মনোরম দ্বীপপুঞ্জের প্রাণমাতানো ছবি। দু-পাশে ‘বারুই’-এর বরজ নিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে যাওয়া পল্লিপথ, আশপাশে সুসজ্জিত কুঞ্জের মতো প্রতিবেশীদের বাড়িঘর, স্নেহমমতায় ভরা মন। তারই মধ্যে দু-পাশে দুটি বিরাট পুকুর নিয়ে আমাদের বাড়ি। ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের প্রয়োজনাতিরিক্ত সাজসরঞ্জাম নিয়ে সাজানো ঘরগুলো। পুবদিকের খানিকটা বাদ দিয়ে চারপাশ ঘেরা ছিল সুপারিকুঞ্জে।

দু-বাড়ির মাঝখানে ছোট্ট একটি ‘জুরি’। জুরিটি দুই বাড়ির অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করলেও মানবিক গুণের সীমানা নির্ধারণ করেনি কখনো। তাদের প্রাণের মিল, মনের ছন্দ জুরির ওপর দেওয়া সুপারির পুলের অপেক্ষা করে না। পূর্বদিক রতনপুকুর। ওতে ডুব দিলে রতন পাওয়া যায় কি না জানি না, তবে তার কাকচক্ষু জল গ্রামের অধিকাংশ লোকই পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করত অন্য পুকুর ছেড়ে। এই রতনপুকুরের পাড় দিয়ে কচুবাড়ির দরজা দিয়ে চলে গেছে গেঁয়ো রাস্তা। কচুবাড়িতে কি শুধু কচুই হয়? শব্দ তাত্ত্বিকদের বিচার এখানে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, এরকম বহু অসামঞ্জস্যই আছে বাংলার পল্লিতে পল্লিতে। কচুবাড়ি আমাদের কাছে পরিচিত তার ফুল বাগিচার জন্যে–অতি প্রত্যূষে উঠে ফুল চুরি করতে যেতাম কচুবাড়ি! আজ বোঝাতে পারব না সেদিনকার দু-একটা ফুল চুরির মধ্যে আমাদের শিশুমনে কী উন্মাদনা জাগত।

কচুবাড়ি থেকে রাস্তা এঁকেবেঁকে ঘেরীর বিরাট দিঘির পাড় দিয়ে চলে গেছে কাবির হাটের দিকে। দিঘির পাড় এত উঁচু হয় জানতাম না, ওপর থেকে নীচে তাকালে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। তার উত্তর পাড়ের মাঝামাঝি অংশটা ভাঙা দেখে একবার কৌতূহলবশেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাবাকে তার কারণ। সেদিন বাবার কাছ থেকে যে উত্তর পেয়েছি তার বিস্ময় আজও কাটেনি, কিশোরমনে দাগ কেটে বসে গেছে। তিনি বলেছিলেন ওই ফাঁকটা দিয়েই নাকি একটি বিরাট সিন্দুক (যতখানি ভাঙা ততখানি মাপের) ক্রোশখানেক দূরে ‘কিল্লার দিঘিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাত দুপুরে। সেই বিরাট সিন্দুকে ছিল সাত রাজার সম্পদ। গ্রামবাসীরা বলে এই সিন্দুক চালাচালির ব্যাপারটি নাকি প্রায়ই নিশুতি রাত্রেই হয়ে থাকে বলে প্রবাদ আছে। বহুবার ভাঙা অংশটুকু মেরামতের চেষ্টাও হয়েছে, কিন্তু বাঁধা যায়নি কোনো-না-কোনো আশ্চর্য কারণে। শেষে ধৈর্য হারিয়ে লোকে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

মনে পড়ছে কতদিন রাত্রে রূপকথা শোনার বায়না নিয়ে মাকে বিরক্ত করেছি, ঘুমুতে দিইনি। আজও টুকরো টুকরো খেইহারা হয়ে স্মরণপথে বড়ো হয়ে দেখা দেয় সেই তেপান্তরে ছুটে-চলা দুঃসাহসিক রাজপুত্তুর, যার ঘোড়া এখনও জোর কদমে ছুটে চলেছে মনের রাজপথে ধুলো উড়িয়ে। সেই অনাদিকালের রাজপুত্তুরের পথের সাথি হলাম আজ আমরা! আমরাও ছুটে চলেছি তেপান্তরের রুক্ষ-শুষ্ক মাঠের ওপর দিয়ে সামান্য নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে। জানি না এই ছুটে চলার শেষ কোথায়? ছোটোবেলায় চাঁদের ছুটে-চলা দেখে আশ্চর্য হয়েছি। এত জোরে সাদা-কালো, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ অমন করে ছোটে কেন? আমি যেখানে যাই চাঁদও সেখানে যায় কেন ইত্যাদি প্রশ্নে মন হয়ে উঠত ভরপুর! কতদিন চাঁদকে পেছনে ফেলে যাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি ভেবে আজ হাসি পায়।

শিশুমনের বিস্ময় কাটিয়ে উঠে একদিন লক্ষ করলাম আমার জগৎটা হঠাৎ যেন বেড়ে গেছে অনেকখানি। আমি চষে বেড়াচ্ছি সারাগ্রামটা, গ্রামের প্রতি অণুপরমাণুর সঙ্গে আমার হয়ে গেছে একাত্মবোধ। আম, জাম, লিচু, জামরুল, কুল, বাতাবি গাছের ডালে ডালে ঘটেছে আমার অগ্রগতি। বর্ষার কাদাজলে চলেছে হরদম ফুটবল খেলার অনুশীলন–সেদিন সারাগাঁয়ে মায়ের যে পরশ পেয়েছি সেই পুরোনো কথা ভেবেই কাটাতে হবে বোধ হয় বাকি জীবন। সেদিনের ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ আজও লেগে রয়েছে আমার নাকে।

‘মতরী’ অর্থাৎ মিত্র বাড়ির দাওয়ায় যে দোকানঘরটি ছিল তাতেই সকাল সন্ধ্যায় বসত আচ্ছা। আশপাশের গ্রামের লোকও আসত সওদা করতে, গল্পগুজব করতে। আমাদের গ্রামটি হিন্দুপ্রধান হলেও দোকানঘরের মিলনতীর্থে দেখা মিলত সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরই চৌকিদার মুজহরলাল থেকে আরম্ভ করে চোর মরকালী, আর বুড়ো হাফেজ মিয়া থেকে আরম্ভ করে মিয়াদের বিকৃতমস্তিষ্ক বিলেত-ফেরত ছেলেটি পর্যন্ত সেখানে আসত দিনান্তে অন্তত একটিবার। পাগল ছেলেটি আপন মনে বিড়বিড় করে বকলেও ব্যবহারে কোনোরকম পাগলসুলভ হাঙ্গামা করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বেত ঘুরিয়ে গুরুমশায়ী চালে যখন সে চলে যেত আমার কিশোর মনে তখন জাগত প্রচন্ড বিস্ময়। সেদিন মানুষকে পাগল হতে দেখেছি, আজ দেখছি গোটা জাতি হয়ে উঠেছে পাগল! এমন পাগলামি করলে শান্তিতে মানুষ থাকবে কী করে সে-চিন্তা কারও মনে জাগেনি আজ পর্যন্ত? মানুষ বাঁচলে তবে তো জাতি,–তবে কেন জাতিবোধের আজ এমন প্রাধান্য মানুষের ওপর? মানুষ কী মরে গেছে? জাতের বজ্জাতি শেষ হোক এই প্রার্থনাই করছে সমস্ত সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষ!

মনে পড়ে বুড়ো তমিজুদ্দিনকে। বুড়ো ঘর ছাইত বছর বছর। সুপারির মরশুমে সুপারি দিত পেড়ে। প্রতি গাছ থেকে তার পাওনা ছিল এক গন্ডা সুপারি। সরু লম্বা একটা বাঁশের মাথায় কাস্তে বেঁধে সুপারি পাড়ত ছোকরাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। শুনেছি বয়সকালে তমিজুদ্দিন গাছে উঠত কাঠ-বেড়ালের মতো, বুড়ো বয়সে আর ভরসা করে না সরু গাছে উঠতে। মনে পড়ে বলীকেও। সে যখন জমিতে মই দিত তখন গিয়ে তার পেছনে কোমর জড়িয়ে মই-এর ওপর দাঁড়াতাম। বেঁটে বুড়ো বাধা তো দিতই না, বরং বাঁদিকের গোরুটার ল্যাজ মুচড়ে হেঁই-হেঁইও বলে আমাকে আনন্দে দেবার ব্যবস্থা করত। কিছুক্ষণ পরে নামিয়ে দেবার মতলবে প্রশ্ন করত, ‘অইল।’ ধুলোয় ধূসরিত শরীরের দিকে তাকিয়ে আমি শুধু জবাব দিতাম—’উঁহু!’

মনে পড়ছে মিত্রবাড়ির ঝুলন উৎসবের কথা। দামামার শব্দে কর্ণপটাহের অবস্থা হত সঙিন। আরতির ধূপের ধোঁয়ার আবছা পরিবেশের মধ্যে দেখতাম ঠাকুর দুলছেন, দোল খাচ্ছেন সহাস্য মুখে। পুজোর আরতিই ছিল সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। ছেলে বুড়োনির্বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে আরতি করত ভক্তিনম্র চিত্তে। বাজনার তালে তালে আরতি উঠত জমে, আগুনের ফুলকি পড়ত ছড়িয়ে এদিক-ওদিকে। ঢুলির বাজনার ছন্দ যখন চরমে, নাচতে নাচতে আরতিকরদের হাত থেকে তখন খসে পড়ত ধনুচি, আগুন ছিটকে পড়ে দু-একজনকে ঘায়েলও যে করত না তা নয়, কিন্তু সেদিকে নজর দেবার মনের অবস্থা তখন কোথায়? এইসব নিয়েই আমার গ্রাম, এইসব অনাসৃষ্টি নিয়েই পূর্ববাংলার সব গ্রাম পরিপূর্ণ। সামান্য ঝুলন উৎসবকে কেন্দ্র করেই যে বিরাট আনন্দোৎসবের ব্যবস্থা সেদিন যারা করত আজ তারা কে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে জানি না।

পুজোর সময় ধরদের বাড়িতে হত উৎসব। অভিজাত বাড়ির নোনা-ধরা দেয়ালের মতো তার সব কিছুতেই নোনা ধরলেও এই সেদিন পর্যন্তও পুজোর আনন্দটা ছিল অকৃত্রিম। ঢপ, রামায়ণ গান থেকে আরম্ভ করে যাত্রাগানের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠত সমস্ত গ্রামখানি। রামায়ণ গানের দু-চার লাইন আজও মনে আছে আমার। সেদিনকার আসর-ভরতি লোকের সামনে যখন গায়েন রামের রাজ্যাভিষেকের চিরঅভিপ্রেত সংবাদটি ঘোষণা করতেন তখন দর্শকদের মুখে ফুটে উঠত স্বস্তির হাসি। সে হাসির উৎস ছিল বিশেষ করে এই কথাটি,

ওগো কৌশল্যে, শুনে কী আনন্দ হল অযোধ্যার
রাজা হবে রঘুমণি লক্ষ্মণ হবে ছত্রধারী–
বামে সীতা সীমন্তিনী সদা নিরখি।।

এই যে সুখীসচ্ছল ভবিষ্যৎ অযোধ্যার ছবি, এ ছবি তো চিরন্তন। জীবনের ওপর সার্থকতার ছাপ পড়লে এমন নির্বিঘ্ন ছবি ফুটবে কী করে?

যাত্রার মধ্যে দীনবন্ধুর নাচই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। পুজোর সময় তাকে পাওয়া ছিল দুর্লভ সৌভাগ্যের কথা। বড়ো বড়ো যাত্রার দলে থাকত তার চাহিদা। তার ‘পূজারিনি’ নৃত্যই ছিল সবচেয়ে বিস্ময়কর। মাথায় ও দু-হাতে তিনটি ধূপদানি নিয়ে পূজারিনি তার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে দেবতাকে অর্ঘ্য নিবেদন করছে, অথচ প্রণাম করতে গিয়েও তার ধূপদানি স্থানচ্যুত হচ্ছে না। তার নৃত্যলালিত্য দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না যে শরীরে তার হাড় আছে একটাও! আমাদের গ্রামে দীনবন্ধুই ছিল প্রাচীনকালের সুরুচিসম্পন্ন নৃত্যের ধারক ও বাহক।

আজ ফেলে-আসা দিনগুলির ধূসর স্মৃতিরোমন্থনই ভালো লাগছে। আজ আমাদের অবস্থা মহাভারত বর্ণিত অভিমন্যুর মতো। তবে অভিমন্যু প্রবেশের মন্ত্র জানতেন, বের হয়ে আসার মন্ত্র সম্বন্ধে ছিলেন অজ্ঞ। আমরা বেরিয়ে আসার মন্ত্র জানি, জানি না ছেড়ে-আসা গ্রামে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের মন্ত্র, এই তফাত! মৈত্রী-সাধনার মধ্য দিয়েই পাওয়া যাবে সে-পথের সন্ধান।

.

সন্দীপ

দক্ষিণে সুন্দরবন, উত্তরে তরাই। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা এই। তবু আরও এক মৃত্যুদীপ্ত ইতিহাস ছিল এই সীমানির্ধারিত ভূখন্ডের। সে-ইতিহাস একদিনে গড়ে ওঠেনি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বুকে পলিমাটির স্তরের মতো যুগে যুগে সাত কোটি মানুষের বুকের ভালোবাসায়, অশ্রুতে, প্রতিজ্ঞায় এ ইতিহাস লিখিত হয়েছিল। আজ নিজের হতে সে ইতিহাসকে দ্বিখন্ডিত করে দিলাম। এক সীমান্তের মানুষ আর এক সীমান্তে উপনীত হল শরণার্থীর বেশে, আশ্রয়ের প্রার্থনায়। হায় আমার দেশ! যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি, এ দেশের মাটিকে, এ দেশের আকাশকে তো ভুলতে পারি না। এ দেশে যে আমি জন্মেছি, এ দেশ যে আমার জননী।

দূর থেকে একটা কালো বিন্দুর মতো মনে হয় প্রথম। সমুদ্রের বুকে বুঝি বা কোনো ভাসমান কাষ্ঠখন্ড। ঢেউয়ের ভেতর ডুবে যাচ্ছে কখনো–আবার মাথা তুলছে হঠাৎ। কর্ণফুলি নদীকে অনেক পেছনে ফেলে সমুদ্রের মোহনায় এসে পড়েছে মোটরলঞ্চ। এবার সোজা কোনাকুনি পাড়ি জমাতে হবে। ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে চলেছে লঞ্চ। যান্ত্রিক আর্তনাদ তলিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক ঢেউয়ের উত্তাল বিক্ষোভে। নির্মেঘ আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্য। রোদের স্পর্শে সফেন ঢেউগুলি হিরন্ময় দীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইগলের মতো অনুসন্ধানী চোখে তাকালেও উপকূল চোখে পড়বে না আর। শুধু অন্তহীন জল চারদিকে–ঢেউয়ের অবিশ্রান্ত গর্জন। পালতোলা নৌকার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। দেখা যায় দু-একখানা যাত্রীবাহী নৌকা। সমুদ্রের উপযোগী বিশেষ ধরনের নৌকা এইসব। দিকচিহ্নহীন সমুদ্রে নৌকারোহীদের একমাত্র সহায় মাঝির অদ্ভুত দক্ষতা আর যাত্রীর দুর্নিবার সাহস। প্রায়ই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয় এদের। তবু পরাভূত হয় না এরা, অনেক প্রাণের বিনিময়ে কঠিন অভিজ্ঞতায় শক্তিমান সবাই। তাই রুদ্রের অভিসারে অভ্যস্ত এরা প্রত্যেকে।

দুপুরের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে এক সময়। সেই কালো বিন্দুটা চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে দেখা দেয় এইবার। সুপারি, নারকেল গাছে ঘেরা একটুকরো ভূখন্ড। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে ভূখন্ডের গায়ে। যে-কোনো মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে বলে কিনারে গিয়ে ভিড়ল লঞ্চ। ঢেউয়ের দোলায় লঞ্চ তখন কাঁপছে। কোনো অবলম্বন ছাড়া লঞ্চের ওপর দাঁড়ানো যায় না। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় খালাসিরা কিন্তু সিঁড়ি ফেলে দিলে। তাদের হাত ধরে ধরে সিঁড়ি পার হয়ে উঠে এল যাত্রীদল। এখান থেকে গন্তব্যস্থল মাইল দুয়েকের পথ। কিন্তু সেখানে যাওয়া যায় কী করে? মোটর, ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা কিছুই নেই। একটা কাঁচা রাস্তা এঁকেবেঁকে ভেতর দিয়ে চলে গেছে। ছোটো ছোটো মোট কাঁধে নিয়ে যাত্রীরা কেউ কেউ সেই পথে রওনা হয়। বাকি যারা রইল তারা আশ্রয় নিল গোরুর গাড়ির। যাতায়াতের একমাত্র উপায় এই দ্বিচক্রযান।

নতুন কোনো আগন্তুক তখন হয়তো সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন–সামনে অনন্ত সমুদ্র, দিগন্ত চোখে পড়ে না। একটা ঝলসানো তাম্র পাত্রের মতো পশ্চিমের সূর্য সমুদ্রের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। নিজের অস্তিত্ব লুপ্ত করে দেবার কামনায় উদবেল বিকেলের সূর্য। আশপাশের গাছগুলোতে পাখিদের ক্লান্ত কলরব। একটা স্তব্ধ বিষণ্ণ পরিবেশ। মুহূর্তের জন্যে অবাক হয়ে যান আগন্তুক। বাংলাদেশের অংশ নাকি এটা? কিন্তু বাংলার কোনো অঞ্চল এমন দুরধিগম্য, বহির্জগৎ-বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে ভাবতে পারেননি ভদ্রলোক। একটা বিস্মিত চেতনায় কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। পাশে দাঁড়িয়ে গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান যে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছে। সেদিকে খেয়ালই নেই তাঁর।

প্রায় দেড়শো বছর আগে একদল লোক যেদিন এখানে এসে নেমেছিল সেদিন তারাও বোধহয় বিস্মিত চোখে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল তাদের নির্ধারিত। কর্তব্য ছিল সুপরিকল্পিত। সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হওয়া রূপকথার রাজকুমারের মতো তাদের চমকপ্রদ অভিযাত্ৰা তাই থেমেছিল এখানে। জাতে ছিল তারা পোর্তুগিজ। পসরা খুলতে দেরি হয়নি তাদের। অপ্রতিহত আধিপত্যে বাঁধা পড়েনি কোথাও। দেড়-শো বছর আগে বাংলার প্রত্যন্তভাগের এই দ্বীপটিও ঔপনিবেশিক আলোর সংস্পর্শ থেকে অব্যাহতি পায়নি। ইতিহাসে তবু এই দ্বীপটির কথা হয়তো দেখতে পাবেন না, কারণ বিশেষজ্ঞের গবেষণার বাইরে যে এই দ্বীপ–আমার দেশ এই সন্দীপ।

শহরের অংশটিকে বলা হয় হরিশপুর, অবশ্য ঠিক শহর নয়। একটি থানা, মুনসেফ আদালত আর সাবট্রেজারি অফিস গোটা দ্বীপটার শাসনব্যবস্থার প্রতিভূ। মাইলখানেক পরিধি শহরের। দক্ষিণদিকে দিঘিরপাড় অঞ্চল জুড়ে অধিকাংশ শহরবাসীর বাস। একটা বিরাট দিঘির চারদিকে ছোটো ছোটো ঘর। কোনোটার চালা টিনের, কোনোটার বা খড়ের। কবি নবীন সেন যখন মুনসেফ ছিলেন এখানে তখন তাঁরই উদ্যমে কাটানো হয়েছিল এই দিঘি।

দিঘিরপাড়েরই বাসিন্দা ছিলাম আমি। দিঘির জলে সাঁতার কাটা একটা অপরিহার্য আনন্দের অঙ্গ ছিল আমাদের। তা ছাড়া আরও একটা কারণে দিঘিটি আকর্ষণীয় ছিল শৈশবে। ছোটো ছোটো রঙিন মাছ দিঘির কিনারে শ্যাওলা ঝোঁপের ভেতর ঘুরে বেড়াত। পাঠশালা পালিয়ে দল বেঁধে সেই মাছ ধরতে আসতাম আমরা। বড়োদের চোখ এড়িয়ে নিষিদ্ধ কাজটা সেরে নেবার সেই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু সময় সময় ধরা পড়ে যেতাম তবু।

‘ওখানে কী করছিস তোরা?’–-একদিন একটা গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে হকচকিয়ে চেয়ে দেখি সুধেন্দুদা দাঁড়িয়ে পেছনে। পড়ি কি মরি করে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল, ধরা পড়ে গেলাম আমি।

পাঠশালা পালিয়ে এই কাজ করে বেড়াচ্ছিস? সুধেন্দুদা তখনও আমার হাতটা ধরে রেখেছেন। আমার মুখে ‘টুঁ’ শব্দটি নেই।

‘দিঘির পাহারাওলা দেখতে পেলে হাড় ভেঙে দেবে সে খেয়াল আছে?’–সুধেন্দুদা হাত ছেড়ে দিয়ে কাছে টেনে নিলেন আমাকে। নিবিড় স্নেহে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলেন। একটা প্রীতির প্রবাহ যেন এই সুধেন্দুদা। বিদেশি যুগের জেলখাটা লোক। বাড়ি মাইটভাঙা গ্রামে। শহরে ছোটো একটা বইয়ের দোকান আছে তাঁর। স্কুল-পাঠশালার বই ছাড়াও উঁচুদরের সব বই রাখতেন তিনি। ওসব বই কাউকে কিনতে দেখিনি কখনো। সুধেন্দুদা আমাদের পড়তে দিতেন বইগুলো। রাজনীতি আর সাহিত্যের আস্বাদ নিতাম আমরা সেইসব বই থেকে। ঝড়ের রাতের বিজয়ী অশ্বারোহীর মতো আজও দেখতে পাই সুধেন্দুদাকে। মাইটভাঙায় চিরাচরিত দুর্গাপুজো নিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল একবার। হিন্দু-মুসলমানের উন্মত্ত বিরোধ, দু-পক্ষই কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছে। একটা রক্তের নদী হয়তো বয়ে যাবে কিছুক্ষণ পরেই। সহসা সুধেন্দুদা কোথা থেকে এসে মাঝখানে বাজের মতো পড়লেন। বিরোধের নিষ্পত্তি হল নিমেষেই। কিন্তু আঘাতে জর্জরিত হয়ে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে চলে গেলেন সুধেন্দুদা। সেই অনির্বাণ আদর্শের দীপশিখাকে ভুলব না কোনোদিন।

রবিবার আমাদের কাছে ছিল একটা দুর্লভ দিন। দুপুরের পরেই বেরিয়ে পড়তাম আমরা। আমাদের দলের সর্দার ছিলেন দ্বিজেনদা। শহরের বুকের ওপর দিয়ে সোজা উত্তর দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেই পথে হেঁটে চারআনির বাগে চলে যেতাম আমরা। দুর্গম জঙ্গলে আচ্ছন্ন চারআনির বাগ। সরু সরু পায়ে হাঁটা পথ আছে ভেতরে ঢুকবার। কয়েকটি পুরোনো দিঘি নানানরকম জলজ গুল্মে এমনভাবে ঠেসে আছে যে সেইসব আগাছার ওপর দিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে পার হওয়া যায়। জঙ্গলের এখানে সেখানে দালানের ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে।

একটা কাহিনি প্রচলিত আছে এই চারআনির বাগ সম্বন্ধে। পোর্তুগিজদের বিলীয়মান প্রভাবের মুখে মুসলমান কৃষাণের ছেলে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল সন্দীপের। প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে নাম নিয়েছিল সে দিলাল রাজা। বাগানের এই জায়গায় ছিল তার রাজপ্রাসাদ। তারপর একদিন দিলাল রাজার ক্ষমতাও অপহৃত হল আর কালক্রমে তার প্রাসাদ পরিণত হল এই জঙ্গলাকীর্ণ বাগানে। পায়ে হাঁটা পথ থাকলেও বাগানে বড় একটা ঢোকে না কেউ। কাঠুরেরা কাঠ কাটতে আসে মাঝে মাঝে। আর আসে গ্রামাঞ্চলের নামকরা সাপুড়ে ওঝারা। সাপ ধরবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তাদের। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিষধর সাপ ধরে ফেলে–বৃহৎ অজগরও অনায়াসে আয়ত্তে নিয়ে আসে। এইসব সাপ শহরে গ্রামে দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে তারা। বাগানের একটু দূরেই চারআনির কাছারিঘর। কাছারিঘরের সামনেই খোলা মাঠে হাট বসে শনি-মঙ্গলবার। হাটের এই দুইদিন নিস্তেজ নিষ্প্রাণ চারআনি হঠাৎ জেগে ওঠে যেন। সহস্র লোকের পদাঘাতে ও পদপাতে চারআনির বুকে প্রাণ সঞ্চার হয়। শুক্রবারে চাঁদবিবির মসজিদে নামাজের জমায়েত বসে। কাছারির ডান দিকে একটা বড়ো পুকুরের পাড়ে চাঁদবিবির মসজিদ। কারুকার্য খচিত, হলদে রঙের বিরাট মসজিদ। অনেক কালের পুরোনো। ইতিহাসের চাঁদ সুলতানা এর নির্মিতা বলে সন্দেহ করে অনেকে।

পড়ন্ত রোদে ধুলো মাখা-গায়ে অন্য কোনো পথে ফিরতাম আমরা। হাঁটতে হাঁটতে বসে জিরিয়ে নিতাম পুন্নাল গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায়। অশ্বথ বটের মতো বিশালকায় গাছ। শাখাপ্রশাখায় অজস্র গুটি ফল ধরে। গ্রামের লোকেরা এই ফল থেকে একপ্রকার তেল তৈরি করে বাতি জ্বালায়। পুন্নালের ছায়া ছাড়িয়ে এসে দাঁড়াতাম হাওতালের পুলের ওপর। পুলের নীচে একটা খরস্রোতা খাল। কৃষাণের ছেলেরা মহিষের পিঠে চড়ে ওপারে গিয়ে ওঠে।

মন আজ মুখর হয়ে উঠেছে স্মৃতিতে। কালবৈশাখীর আসন্ন ঝড়ের সংকেতে সন্দীপের সমুদ্র হয়তো এখন গম্ভীর হয়ে উঠেছে। অপর পারের যাত্রীদের পক্ষে এ সময়টা ভয়ংকর, তবু এই ভয়ংকরের রুদ্র লীলার চরণতলে দোদুল্যমান সন্দীপের চরকে ভুলতে পারিনি। যদি কোনোদিন সুযোগ আসে আবার ফিরে যাব। আবার মন খুলে বঙ্গোপসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে নীলাঞ্জন আকাশের দিকে মুখ তুলে গাইব–’সার্থক জনম মাগো, জন্মেছি এই দেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *