বরিশাল জেলা – বাণারিপাড়া গাভা কাঁচাবালিয়া মাহিলাড়া চাঁদসী সৈওর নলচিড়া

বরিশাল জেলা

বাণারিপাড়া

পরপারের ডাক এলে মানুষকে সব কিছু ছেড়ে এ সংসার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয় মহাপ্রস্থানের পথে তা জানি, আর জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝি তার জন্যে শোক করে কোনো লাভ নেই, হয়তো তা বৃথা; কেননা আলোর অপরদিকে যেমন আঁধার, জীবনের অপরদিকে তেমনি মরণ–যে চলে যায় তাঁর স্মৃতি শুধু পড়ে থাকে, তাঁর সন্ধান মেলে না আর কোনোকালে।

শতাব্দীব্যাপী সাধনায় যে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা, সে স্বাধীনতার যজ্ঞাহুতিতে আত্মবিসর্জন দিয়েছে বহু বীর, ত্যাগ ও দুঃখ ভোগ করেছে বহু দেশকর্মী, লাঞ্ছনা ও নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে অগণিত নর-নারী। এ চরম ও পরমবস্তু লাভের জন্যে পার্থিব ক্ষয়ক্ষতিকে মাথা পেতে নিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি ভারতবাসী, বিশেষ করে বাঙালি। ত্যাগের মহিমায় প্রদীপ্ত করেছে তারা দেশকে, জননী ও জন্মভূমি তাদের চোখে এক ও অভিন্ন, জন্মদায়িনী ও দেশমাতৃকা ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ তাদের কাছে।

পরাধীনতার বন্ধনমুক্তির জন্যে ধূপের দহনের মতো নিপীড়ন সহ্য করেছে যেমন অগণিত দেশবাসী তেমনি দুঃসহ ব্যথার মধ্যে দেশমাতৃকার স্বাধীনতাকে বরণ করে নিয়েছি আমি। স্মরণীয় সেই ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা উৎসবের দিনে আনন্দে মুখরিত কলকাতা মহানগরীর রাজপথ দিয়ে মাতৃহারার ব্যথা, বুকে নিয়ে চলেছিলাম শ্মশানযাত্রায়। শ্মশানে শায়িতা সেই করুণাময়ী স্নেহময়ী মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো ভেবেছিলাম, এক মাকে হারিয়েছি আর এক মা হয়তো আমার আছে, যে মায়ের সান্নিধ্যে গিয়ে স্নেহের নীড়ে মাথা এঁজে ভুলতে পারব মনের যত ব্যথা। কিন্তু কোথায় সে সান্ত্বনা? গর্ভধারিণী মাকে হারাবার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভূমি, পিতৃপুরুষের জন্মভূমিকেও হারিয়েছি। দেশমাতৃকা দ্বিখন্ডিত হয়ে আমাদের জন্মভূমি চলে গেছে আজ অন্য রাজ্যে, পরশাসনে। শ্মশানচুল্লির ধূমায়িত পিঙ্গলাগ্নি আমার যে মায়ের দেহকে ছাই করে দিয়েছে, জানি আমি জানি, এ জীবনে তাঁর আর সন্ধান পাব না; কিন্তু রাজনীতির পাকচক্রে শ্মশানের চেয়েও ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখায় হাজার হাজার নর-নারী ও শিশুর জীবন পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে, আমাদের ঘরছাড়া, দিশেহারা হতে হবে তা ভাবতে পারিনি কোনোদিন। ঝড়ের মধ্যে নীড়হারা রাতের পাখি যেমন করে বিলাপ করে ফেরে বন থেকে বনান্তরে, আমরাও তেমনি দেশবিভাগের অভিশাপে অজানার স্রোতে ভেসে চলেছি দেশ থেকে দেশান্তরে, স্থান থেকে স্থানান্তরে; আর দৈনন্দিন জীবনে বহন করে চলেছি ছিন্নমূল উদবাস্তু জীবনের শত বিড়ম্বনা ও লাঞ্ছনা। জানি না কবে হবে এই মহানিশার অবসান!

শান্ত, স্নিগ্ধ, ছায়াসুনিবিড় আমার পল্লিগ্রাম ও সরল অনাড়ম্বর একান্ত পরিজনদের ছেড়ে এসে কোলাহলমুখর মহানগরীর লক্ষ লোকের ভিড়ের মধ্যে আজ হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে –গতানুগতিক কর্মক্লান্ত একটানা জীবন নিয়ে কোনোমতে কষ্টে-ক্লিষ্টে বেঁচে আছি। বিস্মৃতপ্রায় কবে কোন ছেলেবয়সে কবিতায় পড়েছিলাম, ‘ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে রঙিন স্বপ্ন আজ চলে গেছে, বাস্তবের অভিজ্ঞতায় আজ বুঝতে পারছি কল্পনা ও বাস্তব এক নয়, আমাদের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণ–জীবনযুদ্ধের প্রতিপদক্ষেপে রয়েছে কঠিন দ্বন্দ্ব, প্রবল প্রতিযোগিতা।

কর্মক্লান্ত জীবনের ক্ষণিক অবকাশে মাঝে মাঝে যখন আনমনে মহানগরীর ফুটপাথ দিয়ে চলি কিংবা গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি তখন আমার মা আর আমার পল্লিগ্রাম বানারিপাড়ার স্মৃতি আমার মনে জাগে। এই স্মৃতি আমার সমস্ত অস্তিত্বকে যেন আচ্ছন্ন করে দেয়। কত কথাই না মনে পড়ে তখন, আর ভাবতে ভাবতে চোখ জলে ভরে আসে।

বাল্য ও কৈশোরের সামান্য কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলাম আমার পল্লিগ্রাম বানারিপাড়ায়। বাবা থাকতেন বিদেশে, তাই বাকি সময়টা তাঁর সঙ্গে ঘুরেছি নানা জায়গায়, পড়াশুনাও করেছি নানা শিক্ষায়তনে। কিন্তু বাল্যকালের সেই পল্লিজীবনের স্মৃতি আজও অম্লান হয়ে জাগ্রত আছে আমার মানসপটে। পাগলামি স্বভাবের নিশ্চিন্ত দিনগুলোতে যে গ্রামের ধুলোমাটি গায়ে মেখে বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে একত্রে খেলা করেছি, পুকুরে স্নান করেছি, স্কুলে গেছি, সেই সাতপুরুষের ভিটের মায়া আজও যে ভুলতে পারিনি। পিতৃপিতামহের আশিসপূত তাঁদের যুগযুগান্তরের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত বাণারিপাড়ার সঙ্গে আমার অন্তরের ও নাড়ীর যোগ, এ গ্রাম আমার বাল্যের মনভোলানো মায়াপুরী, এ গ্রাম যে আমার কাছে তীর্থভূমি–এর প্রতিটি ধূলিকণা আমার কাছে পবিত্র, তাই কী করে ভুলব, কী করে ভুলতে পারব আমার ছেড়ে-আসা বানারিপাড়া গ্রামকে? সন্তান যেমন ভালোবাসে মাকে, আমি তেমনি ভালোবেসেছি বাণারিপাড়াকে।

লক্ষ গ্রামের বাংলাদেশে আমার গ্রাম বানারিপাড়া একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে শুধু বরিশাল জেলায় নয়, সমগ্র বাংলার মধ্যে বাণারিপাড়া অনন্য।

বরিশাল জেলায় যে যায়নি সে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং শস্য শ্যামলাং মাতরম’ বাংলা মায়ের এই রূপ বর্ণনা প্রত্যক্ষ করেনি। প্রকৃতি দেবীর অকুণ্ঠদানে প্রতিদিন দু-দুবার করে জোয়ার-ভাটার খেলায় বরিশালের গ্রামপ্রান্তর সুজলাং, বরিশালের মলয় শীতলাং ও বরিশালের মাটি সুফলাং শস্য-শ্যামলাং হয়েছে। রসপুষ্ট বরিশালবাসী তাই দূর-দূরান্তরে থেকেও বরিশালের মাটিকে ভুলতে পারে না। সেই বরিশালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপদ বাণারিপাড়া।

আমার গ্রামের পশ্চিমে বিস্তৃত খরস্রোতা নদী-দূর-দূরান্তরে যাবার স্টিমার পথ, আর গ্রামের মধ্য দিয়ে উত্তর ও পূর্বদিক ঘেঁষে ছোটো স্রোতস্বিনী খাল চলে গেছে–বরিশাল শহরে যাবার নৌকাপথ এটা। এই খাল ও নদীর সংযোগস্থলে খালের দু-পাশে বিরাট বন্দর। এর বিপরীত দিকে গ্রামের পূর্ব সীমানায় সপ্তাহে দু-দিন হাট বসে এবং এই হাটে হাজার হাজার মন ধান চাল কেনাবেচা হয়ে থাকে। বন্দর ও হাটকে যুক্ত করে গ্রামের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে সিমেন্ট বাঁধানো একটি রাস্তা। এই পথ ক্রমে দীর্ঘ হয়ে বরিশাল শহরে গিয়ে মিশেছে। বর্ষা-অন্তে মোটরযোগে বরিশাল শহরে যাতায়াতে এই পথই প্রশস্ত। গ্রামের কিছু দূরে উত্তরে চাখার, খলিসাঁকোটা, উজিরপুর; পূর্বে নরোত্তমপুর, গাভা, কাঁচাবালিয়া, দক্ষিণে আলতা, আটঘর, স্বরূপকাঠি ও পশ্চিমে বাইসারি, দস্তোঘাট, ইলুহার প্রভৃতি প্রসিদ্ধ গ্রামগুলো বানারিপাড়াকে মধ্যমণি করে স্ব স্ব ঐতিহ্যের বাহকরূপে দীপ্যমান রয়েছে। গ্রামের দক্ষিণাংশে বাস বিখ্যাত নট্টসম্প্রদায়ের, যাদের সুমধুর ঢোল বাজনা ও যাত্রাগান বাংলাদেশে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। গ্রামের চারদিকে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, তারা বংশপরম্পরায় হাট-বন্দরের শ্রীবৃদ্ধিসাধন করে গ্রামকে সর্বদা প্রাণচঞ্চল রেখেছে। আর সেই সুন্দর পাকা রাস্তার দু-ধারে ও গ্রামের অন্যত্র ছড়িয়ে আছে বাংলার সুপরিচিত বুদ্ধিজীবী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, যারা সংস্কৃতি ও শিক্ষায় সমাজে খ্যাতিলাভ করেছে। এদের মধ্যে গুহঠাকুরতা বংশই সংখ্যায় গরিষ্ঠ, প্রতিষ্ঠায় শ্রেষ্ঠ ও সর্বত্র সুপরিচিত।

এই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় গ্রামে নানাবিধ শিক্ষা ও সংস্কৃতিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এদেরই অনুপ্রেরণা ও স্বার্থত্যাগে প্রায় সত্তর বৎসর পূর্বে এ গ্রামে স্থাপিত হয়েছে প্রথম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। দুটি বৃহৎ দালানে অবস্থিত রয়েছে এই বিদ্যালয়টি। গ্রামান্তরের বহু ছাত্রকে দেখেছি বাণারিপাড়ার ঘরে ঘরে থেকে শিক্ষালাভ করেছেন। স্বর্গীয় বসন্তকুমার গুহঠাকুরতা ও রজনীকান্ত গুহঠাকুরতা প্রভৃতি বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবৃন্দের সাহায্যে একদিকে ক্রমশ শ্রীবৃদ্ধি হয়েছ এ বিদ্যালয়টির, অপরদিকে পরবর্তীকালে জাতীয় বিদ্যালয়, হরিজন বিদ্যালয়, মনোরঞ্জন শিল্পসদন, একটি অবৈতনিক বালিকা বিদ্যালয় ও শ্রীভবন নামে একটি উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। বাণারিপাড়ার পাবলিক লাইব্রেরিটিও স্থাপিত হয়েছে প্রায় ষাট বৎসর পূর্বে। পরে আরও একটি লাইব্রেরি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিনামূল্যে দরিদ্র জনসাধারণের চিকিৎসার জন্যে জেলাবোর্ডের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি দাঁতব্য চিকিৎসালয়, যাতায়াতের সুবিধার জন্যে খালের ওপর নির্মিত হয়েছে চার চারটে প্রকান্ড লোহার পুল। পূর্বে বাজারের কাছে যে রমণীয় দোলায়মান লোহার পুলটি ছিল তা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংগঠনমূলক কাজ এগিয়ে চলেছে একদিকে, অন্য দিকে গ্রামে আনন্দ বিতরণের জন্যে লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট অবদান কীর্তনগান, কবিগান, যাত্রা ও থিয়েটার প্রভৃতির ব্যাপক প্রচলনও হয়েছে।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলন থেকে শুরু করে অসহযোগ ও আইন অমান্যের কাল পর্যন্ত যাবতীয় রাজনৈতিক আলোড়নে বানারিপাড়া বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে এসেছে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এ গ্রামের অবদান সত্যিই বিরাট। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং-এ লেবং নামক স্থানে তদানীন্তন গভর্নর অ্যাণ্ডারসনকে হত্যা করতে গিয়ে ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য নামে ১৬ বৎসর বয়সের যে যুবক ফাঁসির মঞ্চে জীবন বিসর্জন দেয় সে-যে এই গাঁয়েরই আত্মভোলা ছেলে! আইন অমান্য, বিলিতি দ্রব্য বর্জন মাদকদ্রব্যের দোকানের সামনে পিকেটিং, ঘরে ঘরে লবণ তৈরি, সুতোকাটা প্রভৃতি বিষয়ে কেশব ব্যানার্জি, কালাচাঁদ ভট্টাচার্য, ক্ষিতীশ ঠাকুরতা, কুমুদ ঠাকুরতা, ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা, নলিনী দাশগুপ্ত ও অন্যান্য কর্মীবৃন্দ যে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সে-যুগে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা–বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বরিশাল সম্মেলনের সময় সরকারি আদেশ অগ্রাহ্য করে বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণের জন্যে পুলিশের লাঠিতে নিগৃহীত চিত্তরঞ্জন গুহঠাকুরতা তাঁরই অমরকীর্তি সন্তান। পুলিশের প্রহারে জর্জরিত-দেহ, তবু বন্দেমাতরম’ ধ্বনির বিরাম নেই। সুতীব্র প্রতিবাদে জানিয়ে দিলেন তিনি,

বেত মেরে কি মা ভুলাবে,
আমরা কি মা’র সেই ছেলে?

তাঁরই গ্রামবাসী আমরা কী করে ভুলে থাকব আমাদের গ্রাম-মাকে?

সুভাষচন্দ্র বসুর পদার্পণে ধন্য হয়েছে আমার গ্রাম। খুব ছোট্ট ছিলাম তখন, কিন্তু আজও বেশ স্পষ্ট মনে আছে–জাতীয় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বক্তৃতা দেওয়ার পর আমাদের পাশের বাড়ির দালানের বারান্দায় জ্যোৎস্না রাত্রে ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন সুভাষচন্দ্র, তাঁর আশপাশে ছিলেন আরও কয়েকজন। জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত আকাশের দিকে তাকিয়ে সুভাষচন্দ্র ক্ষীণকণ্ঠে গেয়ে উঠলেন—’এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো।‘ পাশে দাঁড়িয়ে আমার এক দাদা প্রশ্ন করলেন–কী মরণ? সুভাষচন্দ্র উত্তর দিলেন, ‘যে মরণ স্বরগ সমান।’ সুভাষচন্দ্র আজ জীবিত কি লোকান্তরিত জানি না, কিন্তু দেশমাতৃকার বন্ধনমুক্তির জন্যে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে রাত্রির আলো-আঁধারেই তিনি দেশ থেকে বহির্গত হয়েছিলেন। আজ দেশবাসীর কাছে নেতাজিরূপে বন্দিত তিনি, কিন্তু তাঁকে দেশগৌরব মুকুটমণি প্রথম পরিয়েছিলেন কলকাতা মহানগরীর এক জনসভায় আমাদেরই গ্রাম-গৌরব স্বৰ্গত চিত্তরঞ্জন গুহঠাকুরতা।

অপূর্ব শোভামন্ডিত আমার ছেড়ে-আসা গ্রামে আবির্ভাব হয়েছে বহু স্মরণীয় ও বরণীয়ের –জীবনের এক-একটি ক্ষেত্রে তাঁদের এক-একজনকে পথিকৃৎ বললেও বোধ করি অত্যুক্তি হবে না।

থানা, ডাকঘর, হাটবাজার, স্কুল ইত্যাদি নিয়ে আমার গ্রামটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। পল্লিসৌন্দর্যের এক অফুরন্ত ভান্ডার–সুখশান্তিতে নিরুপদ্রবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেছে গ্রামবাসীরা। গ্রামের আশপাশে রয়েছে বিভিন্ন আশ্রম। গ্রামের মধ্যে আছে স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন চকমিলানো বানিয়াবাড়ি। এ বাড়ি গ্রামের একটি গৌরবের বস্তু। দূর-দূরান্তরের গ্রামের লোকেরা নৌকাপথে এর সমুখ দিয়ে যাওয়ার সময় নৌকা থামিয়ে একবার অন্তত এ বাড়ির সৌন্দর্য না দেখে যেতে পারে না। যাত্রা-থিয়েটারের দ্রব্যসামগ্রী থেকে শুরু করে একটা সংসারের পক্ষে আবশ্যক যাবতীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। জেবিডি কালির আবিষ্কারক স্বনামখ্যাত জগবন্ধু দত্ত এ বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা।

দুর্গা পুজোর দু-দিন আগে থেকে লক্ষ্মী পুজোর পরদিন পর্যন্ত প্রবাসী ও অপ্রবাসী গ্রামবাসীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্যে জাহাজের মতো বিরাট একখানি করে স্টিমার খুলনা থেকে সরাসরি বানারিপাড়া পর্যন্ত চলাচল করত। বহুদূরের গ্রামবাসীরাও বাণারিপাড়া স্টেশনে নেমে নৌকো করে চলে যেত নিজ নিজ গ্রামে। পুজোর পরে শুরু হত নানারকমের সভাসমিতি, প্রীতিসম্মিলনী, বড়ো ও ছোটোদের নাট্যাভিনয় ও যাত্রাগান। এসব অনুষ্ঠানে মুসলমানেরাও যোগ দিয়েছে প্রতিবেশী ভাই হিসেবে, পুজোর প্রসাদ নিয়েছে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায়। প্রসাদের প্রধান উপকরণ ছিল নারকেলের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী। গ্রামের মেয়েদের হাতের তৈরি নারকেলের জিনিস খেয়ে সুভাষচন্দ্র পরমতৃপ্তি পেয়েছিলেন।

ছোটো-বড়ো প্রতিটি লোকের সঙ্গেই প্রত্যেকের কী মধুর সম্পর্কই না লক্ষ করেছি গ্রামে, কলকাতার জীবনে আজ তা বিশেষভাবেই অনুভব করছি। ধোপা, নাপিত, ভূমালি এরা সবাই ছিল আপনার জন। ছোটোবেলায় এক সম্পর্কীয়া পিসির বিয়ের ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বিয়ের আসরে আমাদের গাঁয়ের নাপিত এসে বিড়বিড় করে কী যে গৌরবচন বলে গেল তখন তা ঠিক বুঝতে না পারলেও পরে তার কাছ থেকে টুকে নিয়ে সবটা মুখস্থই করে ফেলেছিলাম। এখনও সে গৌরবচনের কিছুটা মনে পড়ে, ছড়া কেটে সে বলেছিল,

চন্দ্রসূর্য দেবগণ চিন্তাযুক্ত হৈল মন।
না হইলে নাপিতের কর্ম, শুদ্ধ হয় না কোনো বর্ণ।
ডাইনে শংকর বামে গৌরী,অদ্য মিলন হইল শিব-গৌরী।
আপনেরা চাঁদবদনে বলেন হরি হরি,
নাপিতের দক্ষিণা স্বর্ণ একভরি।
নাপিতস্য গড়গড়ি!

এই ‘নাপিতস্য গড়গড়ি’ কথাটি ছিল আমাদের হাসির খোরাক। কিন্তু সে যাই হোক, বর কনের মিলনকে শুদ্ধ করে দিয়ে নবদম্পতির জন্যে তার শুভ কামনার বিনিময়ে সে যে দক্ষিণস্বরূপ একভরি মাত্র স্বর্ণ প্রার্থনা করত তা কী আর এমন বেশি! বিবাহাদি ব্যাপারে এমনি নিজ নিজ কাজ করে থোপা, ভূমালি প্রভৃতি সব বৃত্তিজীবীই বিদায় পেত। তারা সব আজ কোথায়? তাদের কী করে চলে?

বাণারিপাড়া সম্মিলনীর কথা উল্লেখ না করলে এই গ্রামের বর্ণনা অসমাপ্ত থেকে যাবে। বাণারিপাড়ার বহু অধিবাসী ভাগ্যান্বেষণে আজ দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়েছেন। বাণারিপাড়ার কয়েকজন উৎসাহী কর্মী প্রবাসে থেকেও পারস্পরিক মিলনক্ষেত্র হিসেবে এবং সেবার আদর্শ নিয়ে সম্মিলনীর প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই থেকে সম্মিলনী নানাভাবে গ্রামের সেবা করে আসছে। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে আমাদের হাস্যমধুর প্রাণচঞ্চল গ্রামখানি আজ নিস্তব্ধ শ্মশান–এই শ্মশানে আবার শিবের আবির্ভাব কবে হবে কে জানে?

মনে পড়ে কতদিন ভোরে রায়ের হাটের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে মুসলমানদের দূর হতে ভেসে-আসা নামাজের সকরুণ সুর শুনেছি–সে-সুরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মিলনের আহ্বান ছিল। দিবাবসানে কত সন্ধ্যায় সর্ব উত্তরের বাড়ির পুলের ওপর দাঁড়িয়ে ঘরে ঘরে সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘণ্টা বাজনা শুনেছি, সেই আরতির তালের সঙ্গে যেন নৃত্য করেছে আমার সারাপ্রাণ। কত রাত্রে নদীর পারে বেড়াতে বেড়াতে চোখে পড়েছে, নদীর জলে ছুটে চলেছে। শত শত চাঁদের রুপালি বন্যা। শরৎকালে কত প্রভাতে, শীতের কত মধ্যাহ্নে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখেছি প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য-সারি সারি পাল তুলে চলেছে কত অজানা মাঝির নৌকা, দূরদিগন্তের শ্যামলিমা মুগ্ধ করেছে মনকে। কিন্তু সেসবই আজ স্মৃতি। তাই তো বলতে ইচ্ছে হয়—’নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’ রাজনৈতিক ঘটনা বিবর্তনে সে-গ্রাম আজ আমার কাছ থেকে দূরে-বহুদূরে, কিন্তু জীবনের শত পটপরিবর্তনেও মনের পটে আঁকা থাকবে একখানা ছবি–সে-ছবিখানি আমার ছেড়েআসা গ্রাম বানারিপাড়ার।

.

গাভা

সুখস্মৃতিকে রসিয়ে রসিয়ে রোমন্থন করা বোধহয় মনের একটা বিলাস। না হলে আজ এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও, ছন্নছাড়া অব্যবস্থিত জীবনের দুর্দিনেও কেন আমার জন্মভূমি গাভার কথা এত বেশি করে মনে পড়ছে? আমার মাটির মায়ের কাছ থেকে যে শান্তি যে সান্ত্বনা যে সুখ যে বৈভব পেয়েছিলাম একদিন, তার সঙ্গে আজকের দিনের জীবনকে তুলনা করতে কেন আমি ব্যস্ত? মন আমার অতীত-মুখর,–এই নগরজীবনের সমস্ত কিছুকে অগ্রাহ্য করে বল্গাহীন ঘোড়ার উল্কার গতি নিয়ে ছুটে চলেছে মন। তার সামনে কোনো বাধা কোনো বিপত্তিই যেন টিকবে না, মানুষের গড়া ভেদাভেদের কোনো তোয়াক্কাই করে না সে। উদ্দাম ঊর্ধ্বশ্বাসে সে পরিক্রমা করছে গাভা গ্রামটিকে কেন্দ্র করে। মনে পড়ছে, শীতের এক অপরাহ্নে কলকাতার শ্মশানের বহ্নিশিখায় এক মাকে হারিয়েছিলাম। বহুদিন পরে আর এক খন্ডপ্রলয়ে পূর্ববাংলার দিগন্তবিস্তৃত হিংসার আগুনে হারালাম আমার দেশমাতাকে। জননীর সঙ্গে সঙ্গে জন্মভূমিও গেলেন আমাদের অকূলপাথারে ভাসিয়ে। অসহায় বোধ করছি নিজেদের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে। যাঁর স্নেহাঞ্চলে বড়ো হয়েছি তাঁর প্রতি অপরিসীম আকর্ষণ থাকা বিচিত্র নয়। প্রকৃতির পরিহাস এমন নির্মমভাবে কেন আমাদের ওপর বর্ষিত হল? সংসারের অমোঘ বিধানে একদিন এই ধরাতল থেকে সকলকেই যেতে হবে–তাই জ্বলন্ত চিতাগ্নির মধ্যে গর্ভধারিণী মাকে চিরবিদায় দিয়ে এসে বিয়োগব্যথায় মুহ্যমান হলেও –সময়ের পদক্ষেপে তা ফিকে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মাটির মা–যাঁর সঙ্গে জীবনে ছাড়াছাড়ি হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই সেই মাকে হারানোর ব্যথা ভুলব কী করে? রাত্রিদিন অন্তরের অন্তস্তলে গভীর ক্ষতের অসহ্য যন্ত্রণা মনকে বিকল করে দিচ্ছে যেন। প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য-সম্পদ থেকে আমি নির্বাসিত। অপূর্ব সুষমামন্ডিত আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের চরিদিকে শুধু সবুজের প্রাণভোলানো হাতছানি। সর্বত্রই ছিল সম্ভাবনার সুর, কিন্তু আগমনির বাঁশি বাজতে-না-বাজতেই যেন তা রূপান্তরিত হয়ে গেল বিদায়ের সুরে। সুন্দর ভুবন থেকে তো আমরা কোনোদিন বিদায় চাইনি, আমরা চেয়েছিলাম মানুষের মধ্যে বাঁচতে। কবিগুরুর বাণী তাই মনে আনত প্রেরণা। শহরের রুক্ষমলিন বাঁধন কাটিয়ে যখন আমার মাটির মায়ের স্নেহস্নিগ্ধ আবেষ্টনীর মধ্যে গিয়ে হাজির হতাম, তখনই কবিগুরুর মহাবাণীর সত্যতা সম্বন্ধে উপলব্ধি ঘটত। তখনই মন পাখা তুলে নেচে উঠত, মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে যেত, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। মুহূর্তে ভুলে যেতাম শহরের সব গ্লানি, দুঃখকষ্ট, অপমান–জীবনের পুঞ্জীভূত দৈন্য অপসারিত হয়ে সেখানে বড়ো হয়ে দেখা দিত নবজীবনের গান। দু-পাশে ধানের খেতের রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি খেলা, ভরা জোয়ারের জলে পরিপূর্ণ খালের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পথের দু-পাশে ঘন সন্নিবিষ্ট নারিকেল বীথি আর সুপারিকুঞ্জের মনোরম খিলানের নীচে পল্লিমায়ের শুচিস্নিগ্ধ শান্তিনিকেতন। পল্লিমায়ের সেই মনোমুগ্ধকর ছবিখানি চোখ বুজে ধ্যান করলে আজও আমি তাকে স্পষ্ট দেখতে পাই। আজ সেই মাকে হারিয়ে নিজেকে রিক্ত ও সর্বহারা বলেই মনে হচ্ছে–জীবিকার্জনের ধাঁধায় শাহরিক যন্ত্রসভ্যতার চাপে শরীর ও মন ক্লান্ত হয়ে পড়লে আজও মাথা আপনাআপনি জন্মভূমির পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে ভক্তি-নম্রতায়। আপন মনেই ভাবি মাটির মাকে কি ভবিষ্যতে আবার তেমনি আপন করে ফিরে পাব?

আমার ছেড়ে-আসা গ্রামও আর এককালের উদবাস্তু পুনর্বাসনেরই এক গৌরবজনক ইতিহাস। মগের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে সাধকপ্রবর রামকৃষ্ণ ঘোষ একদিন জন্মভূমি ভাতশালা গ্রাম ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে অনির্দিষ্ট পথে নৌকা ভাসান এবং বসতি স্থাপনের উপযুক্ত মনে করে বরিশাল জেলার এই গাভা গ্রামেই আস্তানা পাতেন। সে আজ বহুদিনের কথা–তখন চারদিকে ধু-ধু দিগন্তবিস্তৃত বিল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ত না এখানে। তারপর ধীরে ধীরে বহুযুগ পেরিয়ে এসে এই লোকবসতি বাংলার অন্যতম বৃহত্তম গ্রামে রূপান্তরিত হল–সাধক রামকৃষ্ণ ঘোষের বংশধরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামও উঠেছিল সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে।

আমাদের পূর্বপাড়ার সঙ্গে পশ্চিমপাড়ার মিলনসেতু ছিল বড়ো পুলটা–বিলের শেষপ্রান্তে অস্তগামী সূর্য যখন অপূর্ব বর্ণচ্ছটায় যেত দিগন্তের কোণে তখন এই পুলে বসত প্রাণচঞ্চল তরুণ আর কিশোরদলের মজলিশ। সময় সময় তাদের মধ্যে অসীম সাহসী কোনো যুবক হয়তো পুলের রেলিঙের ওপর থেকে ভরা বিলের জলে পড়ত লাফিয়ে। প্রবীণদের আড্ডা বসত দারোগাবাড়ির ঘাটলায়। পড়ন্তবেলায় মাঠে মাঠে ছেলেদের খেলাধুলা ও হইচই হট্টগোলে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত সমস্ত গ্রামখানি। ভোরবেলা কিন্তু বাজারই ছিল আমাদের মহামিলন-ক্ষেত্ৰ-ছেলে-বুড়ো সবাই সেখানে এসে জুটত প্রাণের তাগিদে, গল্প করার নেশায়! ঘুম না ভাঙতেই বাজার বসত আমাদের গ্রামে–যার প্রয়োজন নেই সেও আসত সকলের সঙ্গে একজায়গায় ক্ষণিক মেলামেশার আনন্দ উপভোগ করতে। এ ছাড়া আর একটি মিলনক্ষেত্র ছিল গ্রামের পোস্ট অফিস। শহরের পোস্ট অফিসের মতো সেখানে কড়াকড়ি ছিল না–আর পোস্টমাস্টার, পিয়োন, ডাক-হরকরারা সবাই ছিল আপনজন, আত্মীয়-বিশেষ। পোস্ট অফিসের দরজায় বাংলায় ও ইংরেজিতে অবশ্য স্থায়ীভাবেই যথারীতি ‘ভিতরে প্রবেশ নিষেধ’ সংবলিত সাইনবোর্ডটি ছিল ফলাও করে টাঙানো! কিন্তু আমাদের গতি তাতে রুদ্ধ হত না কোনোদিন–চিঠি থাক বা না থাক সটান ঢুকে পড়তাম অফিসের ভেতর। সময় সময় মাস্টারমশায়ের কাজেও হাত লাগাতাম, শান্ত নিরীহ মানুষটি তাড়াতাড়িতে সব কাজ করে উঠতে হিমশিম খেয়ে যেতেন। তাঁর অবস্থার কথা চিন্তা করে আজও মনটা মুচড়ে ওঠে। কারও কোনো ভালো খবর পেলে তা নিজেই জানিয়ে আসার জন্যে অধীর হয়ে উঠতেন তিনি। জানি না আজ তিনি কোথায়, “সকলকে শুভসংবাদ দেওয়া যাঁর কাজ ছিল আজ তাঁর শুভসংবাদ দেবে কে?

গাভার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তাঁরাই জানেন দারোগাবাড়ির দৃশ্য ও তার বিরাটত্বের কথা,-পূর্ববঙ্গের বড়ো বড় জমিদারবাড়ির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার স্পর্ধা রাখে এটি। খালের ধারে প্রকান্ড সুদৃশ্য ঘাটলা, নহবত, নবরত্ন মঠ–তার ওপরে স্থাপত্যশিল্পের কুশলী নিদর্শন, পুজোমন্ডপ, বিরাট বিরাট থামওয়ালা নাটখানা, লাইব্রেরি ইত্যাদি দেখলে দর্শককে বিস্ময়াবিষ্ট হতে হয়। এর পরেই সন্তোষের মহারাজা স্বর্গীয় সার মন্মথের দাদামশায় বাবু ঈশানের দালানের কথা বলা যায়। কত বিরাট আর উঁচু হতে পারে একতলা দালান এ তারই যেন একমাত্র দৃষ্টান্ত। সে একতলা কলকাতার তিনতলার সমান।

বর্ষাকালে আমাদের দেশে এঁটেল মাটির কাদা হয় খুব। পায়ের কাদা মাথায় ওঠে এবং ছাড়তে চায় না বলেই অনেকে এই কাদাকে বলেন ‘মায়া কাদা’! সত্যিই মায়া কাদা, তা না হলে সে কাদা আজও কেন তেমনি করেই মনের চারপাশে লেপটে আছে? হাজার চেষ্টাতেও উঠছে না সে-মাটি,-সে-মাটির মায়া কত তীব্র আজ দূরে বসে বুঝতে পারছি বেশি করে! ছোটোবেলায় বর্ষাকালে রাস্তার মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা চারে (সাঁকো) পারাপার হতাম খাল। পরে গাভা সম্মিলনীর চেষ্টায় তা পাকা হয়েছে।

নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পূতচরণের স্পর্শলাভ করে আমার গ্রাম ধন্য ও পবিত্র হয়ে আছে। হিজলি বন্দিনিবাসে পুলিশের গুলিতে নিহত শহিদ তারকেশ্বর সেনের চিতাভস্ম নিয়ে নেতাজি সেবার গৈলায় আসেন এবং বরিশাল পরিদর্শন করেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। খবর পেয়ে আরও দুজন বন্ধুর সঙ্গে গৈলায় গিয়ে চেপে ধরলাম—’সুভাষদা, আপনাকে গাভা যেতেই হবে।’ সে স্নেহের দাবি এড়াতে পারেননি তিনি। গ্রামে একটি শিল্পকলা ও কৃষি-প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা হয় সেসময়। সুভাষচন্দ্র সেই প্রদর্শনী উদবোধন করেন। সেবার তিনি আমাদের গ্রামের খদ্দর বয়ন প্রতিষ্ঠানটিও পরিদর্শন করেন এবং গ্রামের মধ্যে এমন একটি প্রতিষ্ঠান দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন–এই গ্রাম ও এই প্রতিষ্ঠান দুটোই যথার্থ বড়ো, আর আমরা তাঁর এই প্রাণখোলা উৎসাহ-বাণী পেয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু আজ কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল! এক-একবার ভাবি, নেতাজি যদি এখনও ফিরে আসেন তাহলে আবার হারানো গ্রামকে, হারানো মাকে হয়তো ফিরে পেতে পারি।

ফুটবল খেলায় আমাদের গ্রাম একসময় ছিল শ্রেষ্ঠ–গাভার টিমের দাপটে বরিশাল জেলা কাঁপত ভয়ে। খেলা ছাড়াও নাম করার মতো ছিল আমাদের নিজস্ব থিয়েটার ক্লাব-পুজোর পর প্রতিবৎসরই থিয়েটার হত মহাসমারোহে। এই অভিনয়-প্রতিভাও জেলার গর্বের বিষয়। আমাদের থিয়েটার ক্লাব ছিল এমনি নামকরা। এ ক্লাবের অভিনয় দেখতে বানারিপাড়া, কুন্দহার, বাইসারি, নরোত্তমপুর, কাঁচাবালিয়া, নারায়ণপুর, ভারুকাঠি, রামচন্দ্রপুর, বীরমহল প্রভৃতি দূরাঞ্চল থেকেও বহুলোক আসত। গ্রামে যাত্রা হলে হিন্দু-মুসলমান সকলেই ভিড় করত-এক এক রাত্রে বিশ হাজার লোকের সমাবেশও দেখেছি। দেশ বিভাগের তিন-চার বৎসর আগে থেকে স্কুলবাড়ির উৎসাহী যুবক নির্মল ঘোষ পুজোর পর নিয়মিতভাবে তাঁর বাড়িতে তিন পালা করে যাত্রা ও সঙ্গে জারি গান দিতে আরম্ভ করেন এবং দেশ বিভাগের পরেও তা চলে আসছিল, কিন্তু এবারের শেষ ধাক্কায় সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শুনেছি! যাত্রার সময় দেখেছি উৎসাহ মুসলমানদেরই বেশি। কুড়ি হাজার দর্শক হলে তার মধ্যে পনেরো হাজারই থাকত মুসলমান এবং তাতে স্থানীয় মুসলমান মাতব্বর ও মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরাই শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষারও ব্যবস্থা করতেন। গান না হলে মুসলমান ভাইরাই দুঃখিত হতেন বেশি, জিজ্ঞাসাবাদ এবং অভিযোগের অন্ত থাকত না তাঁদের।

ছেলেবেলার টুকরো টুকরো কত কথাই না মনে পড়ছে আজ! স্নানের সময় পুকুরে ডোবানো, ‘নইল-নইল’ খেলা, কৃত্রিম জলযুদ্ধের মহড়া, খালে নৌকাবাইচ প্রভৃতিতে সেসব ফেলে-আসা দিনগুলো ভরপুর। আনন্দের নির্যাসে পরিপূর্ণ ছিল আমার গ্রামের দৈনন্দিন জীবন। গ্রামে পুকুরের অভাব নেই, ছোটো-বড়ো পুকুর মিলে শ-পাঁচেক তাদের সংখ্যা। এসব পুকুরে স্কুল পালিয়ে ছিপ ফেলে লুকিয়ে মাছ ধরাও ছিল মস্ত একটা আকর্ষণ। জাল দিয়ে মাছ ধরার দিনে যে হইচই চলত আজও তা মনের চোখে স্পষ্ট দেখতে পাই। দু-চারটে বড়ো দিঘিও ছিল গ্রামে, তবে তাতে জলের চেয়ে দল-দামই জমে থাকত বেশি সময়, ওপর থেকে পুকুর বলে বোঝাই যেত না। এমনি একটা দিঘিকে জঙ্গল বলে ভুল করে একবার তাড়া খাওয়া এক চোর প্রায় ডুবতেই বসেছিল! দামের নীচে প্রায় দশ-বারো হাত জল থাকত সবসময়। ভবানী ঘোষের বাড়ির দরজার দিঘির পাড়ে দিনের বেলাতেই গা ছমছম করত–দিঘির পাড়ে তাল, তেঁতুল, গাবগাছের সমাবেশ সে-স্থানটিকে করেছিল আরও ভয়ংকর। শুনেছি আগে নাকি ওই দিঘির জলে চড়কের গাছ ফেলে রাখা হত এবং আর কেউ তার কোনো সন্ধান পেত না–কিন্তু চড়ক পূজার আগের দিন দিঘির পাড়ে এসে ঢাক বাজালে চড়কগাছ নিজে থেকেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠে পড়ত। গ্রামের মুসলমান পাড়ার শেষপ্রান্তে অবস্থিত ‘গুনা চোতরা’-র দিঘি সম্পর্কেও একইরকম অলৌকিক কাহিনি শোনা যায়।

ছোটোবেলার এক উত্তেজনাকর খেলা ছিল ঘুড়ির প্যাঁচ, অর্থাৎ ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা। এ নিয়ে বহু কলহ-বিবাদ হয়ে গেছে বন্ধুদের সঙ্গে! ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে দুর্ঘটনাও কম ঘটেনি–জীবনান্ত পর্যন্ত হয়ে গেছে। আমিও একবার সাক্ষাৎ যমালয় থেকে সসম্মানে এসেছি ফিরে। মাস ছয়েক ঝোলভাতের ব্যবস্থা করে দিয়ে ডাক্তার দাদু হেসেছিলেন আমার দুরন্তপনার কথা শুনে,–বাবা-মাও কম ভর্ৎসনা করেননি সেদিন। ঘুড়ি-লাটাই সেইদিনই দূর করে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে, অসহ্য ব্যথায় আমি পিটপিট করে শুধু দেখেই গিয়েছিলাম মর্মান্তিক ঘটনাগুলো! আজ মনে পড়লে হাসি পায়, ছোটোবেলায় ঘুড়ি-লাটাইকে কী দুর্মূল্য বস্তু বলেই না মনে হত! আর তা অন্য লোককে দান করে দেওয়ায় সেদিন যে দাগ লেগেছিল তার কোনো অর্থই আজ আর ভেবে পাই না। সে মন আজ অদৃশ্য, সামান্যকে অসামান্য করে দেখা যে কত কঠিন তা আজ বুঝতে শিখেছি। সে মন কী আমাদের সম্পূর্ণ মরে গেছে? এই ঘুড়ি ওড়ানোর মতো আর একটা ডানপিটে কাজ ছিল আমাদের–সে হচ্ছে অন্ধকার রাত্রিতে মজা করে ডাব পেড়ে খাওয়া। এর জন্যেও বহুলাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে আমাদের। ডাব-সমুদ্রের দেশেও ডাব চুরি করতে গিয়ে বকুনি খেয়েছি। অবশ্য এটা ঠিক চুরির পর্যায়ে পড়ে না–এটা ছিল অ্যাডভেঞ্চার এক ধরনের। এ খেলা তারুণ্যের দুঃসাহসিকতায় ছিল ভরা, যে দুঃসাহসিকতার নেশা আজকের দিনের জীবনকেও চঞ্চল করে তোলে মধ্যে মধ্যে।

আমাদের গ্রামে ব্রত-পুজো-পার্বণ লেগেই থাকত। তার মধ্যে দুর্গাপুজোটাই ছিল বিশেষরকম উল্লেখযোগ্য। লক্ষ্মীপুজোর মতোই ঘরে ঘরে হত দুর্গাপুজোর আয়োজন। একটা গ্রামে চল্লিশটি পুজো, সে কী কম কথা! পুজোর সময় গ্রামের চেহারাই যেত বদলে, সবার মুখে আনন্দের ছাপ। মহালয়ার দিন থেকেই হাটে-বাজারে সর্বত্র ভিড়–ছিমছাম ধোপদুরস্ত জামা-কাপড়ে সজ্জিত যুবকদের দেখে নির্জন গাভাকে এক নতুন শহর বলেই ভ্রম হত! যেসব ঢাকি বাঁধা ছিল তারা তো আসতই, উপরন্তু বাণারিপাড়ার বাজার থেকে আরও ঢাকি বায়না করে আনা হত উৎসবকে বেশি সজীব করে তোলার জন্যে। এই ঢাক বাছাই করা যার-তার দ্বারা হত না, এর জন্যে প্রয়োজন হত অভিজ্ঞ লোকের তৈরি কান! বাজনার সঙ্গে চমকদার নাচ দেখিয়েও ঢাকিরা খদ্দেরদের মন আকর্ষণ করত অনেক সময়। সেই ঢাকিরা বেশির ভাগই ছিল ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া অঞ্চলের মুসলমান। এরা সাধারণত ‘নাগারচি’ বলেই পরিচিত ছিল। পুজোর আর একটি জিনিস বেশি করে মনে পড়ছে, সেটি হল আরতি-আমাদের দেশে বলে ‘আলতি’। এই আলতি বরিশাল জেলারই একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচার। পুরোহিতের আনুষ্ঠানিক আরতি শেষ হয়ে গেলে বাড়ির ও গাঁয়ের ছেলেরা এবং অনেক বাড়িতে ভাড়াটে ওস্তাদরা এই আলতি দিত। এক এক বাড়িতে রাত্রি কাবার হয়ে যেত, তবু শেষ হত না আলতি! সেরে সেরে ধুনো, গুগগুল ও ঝাঁকা ঝাঁকা নারকেল ছোবড়া পুড়ে ছাই হত। কতরকম কসরত ছিল এই অনুষ্ঠানে–একসঙ্গে দু-হাতে দুটো ধুপচি ও মাথায় একটা ধুপচি নিয়ে তান্ডবনৃত্য নাচলেও মাথার ধুপচি স্থানচ্যুত হত না দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম শৈশবে। যাঁদের বাড়িতে এসব পাট ছিল না তাঁদের ঢাকি গিয়ে যোগ দিত পাশের বাড়িতে। আলতির সময় ঢাকিদের চাঙ্গা রাখার কত প্রক্রিয়াই না ছিল–কতভাবে সিদ্ধির শরবত করে যে ওদের খাওয়ানো হত তার ইয়ত্তা নেই।

ধান-চালের দেশ বরিশাল জেলা, কাজেই সেখানে নবান্নের ঘটা যে একটু বেশি হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! ধনী-দরিদ্র সকলেই সাধ্যানুযায়ী নবান্ন করত। অগ্রহায়ণ মাস ভরেই চলত এই নবান্নের আবাহন। পুজোর মতোই এ উপলক্ষ্যে বাড়ি ফিরতেন অনেক প্রবাসী লোক। নীল পুজোও আমাদের গ্রামে কম হত না। কয়েকদিন ধরে ‘বালা’-র নাচ, হরগৌরীর বিবাহের পালা, নানা ধরনের সং আর শোভাযাত্রা এবং শেষে ভোগ সরানো। চৈত্রসংক্রান্তির দিন দারোগাবাড়িতে মেলা বসত। সেই থেকে সমস্ত বৈশাখ মাস ধরেই গ্রামে মেলা চলত। ছেলে-মেয়ে, বউ-ঝি, চাকর-দাসী সকলেই এই মেলা উপলক্ষ্যে বাড়ির কর্তাদের কাছ থেকে পার্বণী পেত। মেলার সময়কার হাসিখুশি ছবিটির কথা মনে পড়লে আজও উন্মনা হয়ে পড়ি। সেদিনকার আনন্দের দিন কি আর কখনো ফিরে আসবে না মানুষের জীবনে? অত বড়ো গ্রাম আজ একেবারে ছন্নছাড়া শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছে। শিবাদল শ্মশান জাগিয়ে শব-সাধনায় মেতেছে, এ মাতনের শেষ কোথায়?

আমাদের অঞ্চলটি সবদিক থেকেই বরিশাল জেলার একটি উন্নত এলাকা এবং আশপাশের ছোটো-বড়ো গ্রামগুলোও বাংলাদেশে কমবেশি পরিচিত। এসবের মধ্যে বাণারিপাড়ার কথাই সবিশেষ বলা যায়–গ্রাম হয়েও শহরের মর্যাদা তার। বন্দর এবং বড়ো হাট-বাজারের গঞ্জ হিসেবে তার প্রসিদ্ধি। পাশেই নরোত্তমপুরে রায়ের হাট নামকরা হাট। বাকপুর গ্রামে মাঘী সপ্তমীতে সূর্যমণির যে বিরাট মেলা বসত তার কথা সবারই জানা। আমাদের গ্রামের পাশেই মৌলবি ফজলুল হকের গ্রাম চাখারের অধুনা খুব উন্নতি হয়েছে। হক সাহেবের দৌলতে একটি কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এখানে–এ ছাড়া নতুন নতুন রাস্তা, সাব-রেজেস্ট্রি অফিস হওয়ায় গ্রামের চেহারা গেছে পালটে। আমাদের গ্রামের একদম লাগাও পূর্বদিকে ব্রাহ্মণ প্রধান বীরমহল গ্রাম, আর তা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই কাঁচাবালিয়া ও রামচন্দ্রপুর। গাভার দক্ষিণ-পশ্চিমে বিল অঞ্চলে আটঘর ও কুড়িয়ানা গ্রাম দুটি নমশূদ্র-প্রধান। এ অঞ্চলের মাটিতে সোনা ফলে বলে প্রসিদ্ধি আছে। এখানকার শাকসবজি ও ফলমূল, বিশেষ করে আখ আর পেয়ারার সত্যি তুলনা হয় না। দীর্ঘ মাপের সোনালি রঙের আখ আর কাশীর পেয়ারার চেয়েও বড়ো পেয়ারা লুব্ধ করে যেকোনো লোকের মনকে! নমশূদ্ররা গ্রাম ছাড়বে না বলেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, কিন্তু শুনলাম তারাও আটঘর ও কুড়িয়ানার মায়া ত্যাগ করে কোথায় যেন চলে গেছে।

ছুটির সময় যখন গ্রামে ফিরতাম তখনকার মানসিক অবস্থা বর্ণনা করা সম্ভবপর নয়– স্টিমার যেয়ে ভিড়বে স্টেশনে, সে পর্যন্ত দেরি সহ্য হত না প্রবাসী মনের। স্টিমার থেকেই চোখে পড়ত পল্লিমায়ের মনোমেহিনী রূপ! প্রথম সূর্যকিরণে বাসন্ডার জমিদারবাড়ির নবরত্ন মঠের চূড়া জ্বলত জ্বলজ্বল করে, খালের জলে পড়ত তার শতধা প্রতিচ্ছবি। ঘাটে বাঁধা থাকত জমিদারদের সবুজ বোট। চলার পথে একে একে উঁকি দিত বাসন্ডার স্কুল, বাউকাঠির হাট, পিপলিতার রায়ের বাড়ির দরজার মঠ, আরও কত কী! এসব অতিক্রম করলেই দেখা পেতাম গাভা স্কুলের–তখন মন বল্গাহীন, অপূর্ব হিল্লোলে হৃদয়তন্ত্রী উঠত নেচে। পটে আঁকা ছবির মতো পরিচ্ছন্ন আমার গ্রাম,-পূর্বের বাড়ির ‘রেন ট্রি’ গাছের কাছে নৌকো বেঁধে লাফিয়ে পড়তাম পল্লিমায়ের কোলে, শরীর স্নিগ্ধ হয়ে যেত তখন। তাড়াতাড়ি সোজা রাস্তায় লোকের বাড়ির মধ্য দিয়েই ছুটে যেতাম আমার কুটিরে–যেখানে জন্মভূমির সঙ্গে জননীর স্নেহের পরশ ছিল মিশে। তাঁদের দ্বৈত স্নেহে আমি ধন্য হয়েছি একদিন, কিন্তু আজ? সেসব আকর্ষণী শক্তি কোথায় গেল? নিজের গ্রামে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারি না কেন? সব কিছু হারিয়ে কেন আমরা সর্বহারা উদবাস্তু হয়েছি? স্বাধীনতার জন্যে? সে-স্বাধীনতা কোথায়? আবার কবে আমার জন্মভূমির কোলে ঠাঁই পাব, তার দিন গোনা ছাড়া উপায় দেখছি না কিছু। মনকেই প্রশ্ন করছি বারবার–মায়ের ডাকে আবার আমরা মিলব কবে? কবে মায়ের পায়ে আবার মাথা ঠেকাবার সৌভাগ্য হবে?

.

কাঁচাবালিয়া

জল–জল–জল, চতুর্দিক জলে ভরতি। মনোরম সরসতা। জল দেখে চিত্ত বিকল হয় না, আশা জাগে, মন ভেসে যায় সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পারের নারকেল-সুপারিঘেরা, সবুজ দারুচিনি দ্বীপের প্রাণমাতানো পল্লিমায়ের কাছে! শুষ্ক রুক্ষ শহরের বুকে বসে আজ বেশি করে মনে পড়ছে আমার জননী জন্মভূমির কথা, আমার সোনার বরন কাঁচাবালিয়াকে। আজ আর তার সোনার রং নেই, পুড়ে কালো বিবর্ণ হয়ে গেছে। মানুষের লোভ, মানুষের স্বার্থ, ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব তার গৌরবময় ঐতিহ্যের গায়ে কালি ছিটিয়ে দিয়েছে। আমাদের বর্বরতা, আমাদের কলঙ্ক, আমাদের বিরোধ সমস্ত কিছু সৎপ্রচেষ্টারই ঘটিয়েছে অবসান। যে দেশের বাতাস টেনে নিয়ে এত বড়োটি হয়েছি, যে দেশের ধুলোয় উঠেছে শরীর গড়ে, যে দেশের খাদ্য জুগিয়েছে শক্তি, সেই দেশকে আমরা আর নিজের জন্মভূমি বলতে পারছি না ভেবে বুক ফেটে যাচ্ছে অসহ্য ব্যথায়! আজকের এই হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর বুকে কে শান্তির বারি সিঞ্চন করবে জানি না, পৃথিবীর উত্তপ্ত বুকে কে শীতলতা বইয়ে দেবে তার সন্ধানই করছি শত দুঃখকষ্টকে অগ্রাহ্য করে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে ঘুরে। কবে দেখা পাব আমরা সেই মহামানবের, কবে বলতে পারব রবীন্দ্রনাথের মতো–’ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে?’

শরীরে শিরা-উপশিরার যেমন কাজ রক্ত চলাচলে সহযোগিতা করা, তেমনি নদীর কাজ দেশের বুকে ফসল ফলাবার। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবার কাজে নদীই প্রধানতম সহায়, তাই আমাদের গ্রামখানি ছিল এত সজীব, এত সৌন্দর্যের প্রতীক। জালের সুতোর মতো অসংখ্য খাল-বিল দিয়ে জোয়ারের জল আসত জীবনের জোয়ার নিয়ে। খালের প্লাবন ধ্বংসমুখী হয়ে কোনোদিন কাঁচাবালিয়ার বুকে দেখা দেয়নি, সেখানে নদী বর্ষাকালেও গ্রাম প্লাবিত করে যেমন মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে না, তেমনি আবার শীতকালেও জলের অভাব ঘটিয়ে মানুষকে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়ে না। উত্তর অঞ্চলের গোঁয়ার নদীর মতো দুষ্ট আমাদের গ্রামের নদী নয়, সে মানুষের মতোই মানুষের দুঃখ-কষ্ট বোঝে, মানুষের সুখদুঃখের মধ্যেই নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চায় সে গৃহস্থ বধূর মতো! আমার গ্রামবাসীরা সেদিক থেকে ছিল সত্যি ভাগ্যবান। অধ্যাপক হেম গুহ তাই মাঝে মাঝে রসিকতা করে নদীটিকে আহ্বান জানাতেন ‘ভেনিস সুন্দরী’ বলে!

যথার্থ নাম হয়েছিল এই ‘ভেনিস সুন্দরী’। ঝরঝরে, তকতকে, পুণ্যতোয়া ব্রীড়াবনতা শান্ত নদীর অন্য কোনো নাম যেন মানায়ই না। নারকেলকুঞ্জ, সুপারির বাগান, আম-কাঁঠাল কদলীগুচ্ছের ধারে ধারে বাঁশবন-ঘেরা সুদৃশ্য সব বাড়ি–কুড়ি-ত্রিশ হাত পরিসর খাল চলে গেছে এঁকে-বেঁকে সুতোর মতো সমস্ত বাড়িকে স্পর্শ করে। আবার কোথাও কোথাও পরিখার আকার ধারণ করে বেষ্টন করেছে গোটা গ্রামকে। সীমার মধ্যে অসীম হয়ে ওঠার সাধনাই যেন তার প্রধান সাধনা। এ হেন উত্তর বরিশালের মধ্যমণি ছিল আমার ছেড়ে-আসা গ্রামখানি। বঙ্গজ কায়স্থ প্রধান কাঁচাবালিয়ার সীমানা ছিল এক মাইলেরও কম, কিন্তু তাতেই সে কখন গড়ে তুলেছিল তার নিজের ঐতিহ্য। সৌন্দর্য সাধনার ক্ষেত্রে সে হয়ে উঠেছিল মহিমময়ী, মহীয়সী!

প্রবাদ আছে, সম্রাট শাজাহানের রাজত্বকালে দক্ষিণের মগ-অত্যাচারের হাত থেকে প্রাণ মান-ইজ্জত রক্ষার জন্যেই গুহ আর বসু বংশীয়েরা চলে এসে বসতি স্থাপন করেন এখানে। চন্দ্রদ্বীপের ভূঁইয়া কন্দর্পনারায়ণের আশ্রয়ে পার্শ্ববর্তী গাভা, নরোত্তমপুর, বাণারিপাড়া, উজিরপুর, খলিসাঁকোটা প্রভৃতি গ্রামে দেখতে দেখতে বিরাট সভ্য সমাজ গড়ে উঠল। ইংরেজ আমলের মাঝামাঝি এসে এঁদের অনেকেই কৌলিন্যের খোলস ত্যাগ করে ছোটো ছোটো নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন জ্ঞান ও অর্থের উৎস সন্ধানে। তাঁদের কেউ কেউ যান ঢাকায়, কেউ কেউ সরাসরি কলম্বাসের মতো পাড়ি দেন কলকাতা মহানগরীতে! সেকালে ম্যাট্রিক এবং ছাত্রবৃত্তি পাস করে অনেকে ডাক্তারি লাইনেও গিয়েছিলেন। চিকিৎসাজগতে গিয়ে সুনাম প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে কটকের জেলা অধিকর্তা মণীন্দ্র গুহের পিতা কীর্তি স্থাপন করেছেন। সে-সময় পদ্মা নদী এত বিপুলকায়া হয়ে ওঠেনি। সবে রাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশ করতে আরম্ভ করেছে। আমার পূর্বপুরুষগণ দেখেছেন সেই কীর্তিকে গ্রাস করেছে কী করে কীর্তিনাশা পদ্মা। প্রতিমার চালচিত্রের মতো ধীরে ধীরে ডুবে গেছে সেই সভ্যতা, সেই সংস্কৃতি, সেই বীর্যবান পুরুষের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। ভাবলেও শিহরন জাগে শরীরে– সেইদিনকার মতোই কি আমাদেরও কীর্তিনাশ হল না আজ? আজকের মতো অসহায়তা নিয়ে সেইদিনের বুকেও কি দুঃখের বুদবুদ ওঠেনি মানবমনে?

কিন্তু সেই শ্মশানের মধ্যে থেকেই আলো উঠেছে জ্বলে। সভ্যতার মৃত্যু নেই, সভ্যতার মধ্যেই মানুষ থাকবে বেঁচে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই আবার গড়ে উঠল রাস্তাঘাট, পুকুর, দালান, টিনের কোঠা, পাকা দালান–আবার গ্রাম শ্রীমন্ডিত হল রাজবল্লভের বংশধরদের আপ্রাণ চেষ্টায়। প্রাণের বাতি জ্বালালেন গ্রামে গ্রামে, আবার মানুষের মুখে ফুটল হাসি, গান, গল্প। মানুষ আবার মানুষ হল!

সেই হাসিগানের রেশ মেলাতে না মেলাতেই আবার নেমে এল বিপদের কালো যবনিকা, শঙ্কিত মানুষ দিশেহারা হয়ে প্রাণভয়ে ছুটল দেশ-দেশান্তরে! কেন এমন দুর্ভাগ্য নেমে আসে বারবার লাঞ্ছিত মানুষের ভাগ্যে? মগের অত্যাচার থেকে জীবন বাঁচাতে একবার আমাদের দেশত্যাগী হতে হয়েছিল–আবার দেশত্যাগে বাধ্য হলাম বিংশ শতাব্দীর হিংস্র বর্বরতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে! ইতিহাস আমাদের ভাগ্যে কী লিখেছে জানি না,–আজ শুধু তার নির্মম রসিকতাটুকুই উপভোগ করছি সর্বস্ব খুইয়ে নতুন ইহুদির পর্যায়ে নেমে এসে! ভারত-পাকিস্তানের সংখ্যালঘু মন্ত্রীদ্বয় সেদিন বানারিপাড়া গিয়ে নিশ্চয়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামের শ্মশানশ্রী দেখে! দেখবার সময় তাঁদের একবারও কি মনে হয়নি সেই কাম্বোডিয়ার সুষুপ্তা সুন্দরী বা Sleeping Beauty-র উৎসভূমির এমন বৈধব্য-মলিন চেহারা কেন হল? কোথায় গেল তার সৌন্দর্য? কোথায় গেল সেই পূর্বস্মৃতির রুপালি রূপ। শতবর্ষ আগে ভয়াবহ ওলাওঠা যা করতে পারেনি, সর্বনাশী ৭৬-এর মন্বন্তরে দেশের যে হাল হয়নি, ১৩৫০-এর নাগিনির দীর্ঘশ্বাস যে গ্রামের অঙ্গে কালির কলঙ্ক লেপে দিতে পারেনি, সেই অভাবিত সর্বনাশ কেন হল স্বাধীনতা লাভের মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। কিন্তু মানুষ কি আজ আর মানুষের পর্যায়ে আছে? মানুষ কেন মানুষকে আজ সাপের মতো ভয় করছে? জানি মানুষের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনাই আজকের যুগের প্রধানতম সংগ্রাম! সেই সংগ্রামে জয়ী হব আমরা–হে ঈশ্বর, শক্তি দাও আমাদের মনে! আমরা অমৃতের পুত্র–বিষক্রিয়া আর কতদিন কাজ করবে আমাদের ভেতর?

বাইশ-শো লোকের গ্রাম ছিল কাঁচাবালিয়া। তার বাসিন্দাদের অধিকাংশই ছিলেন ব্যবসায়ী, সুচিকিৎসক, সুবিচারক, কৃতী অধ্যাপক, নামজাদা শিল্পী এবং সংগীতজ্ঞ। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ অর্থোপার্জনের জন্যে বাইরে বাইরে কাটালেও জন্মভূমিকে তাঁরা ভোলেননি একদিনের জন্যেও। তাঁদের আন্তরিক টান গ্রামবাসীকে মুগ্ধ করত! মনে পড়ে, পুণ্যতোয়া নদী হিমালয়ের গাত্র ধৌত করে পলিমাটি সঞ্চয়ের কাজ সমাপ্ত করত যখন, তখন শুভ্র শরতের হত উদবোধন। লক্ষ করেছি সেই শারদপ্রাতে শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে ছুটে আসতেন তাঁরা এই নদীমাতৃক জন্মভূমির পায়ে হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধাভক্তির অর্ঘ্যদানের জন্যে। আজ ইচ্ছে থাকলেও মায়ের কাছে ছুটে যাওয়ার উপায় নেই আমাদের। আমরা এখন পরবাসী, অবাঞ্ছিতের দল। তা ছাড়া সেই জল, সেই হাওয়া কোথায় আজ?

মনে পড়ছে আজ বেশি করে মজিল সাহেবের কথাগুলো! আমাদের দেশ ছাড়া হতে দেখে তিনি একদিন বলেছিলেন—’আপনাদের ভয়টাই বড়ো বেশি।’ স্বীকার করতে মনে বেধেছিল তাঁর অভিযোগটি। আমরা ভীত নই, আমরা কাপুরুষ নই, আমরা দুর্বল নই। আমরা অযথা হানাহানি, রক্তপাতে অসহায় বোধ করি। এই সেদিনও আমাদের গ্রামের ছেলেরা বর্শা দিয়ে বাঘ শিকার করেছে। মাত্র ৩০ বছর আগে আমাদেরই বুটকিন সরকার একখানা খাঁড়া দিয়ে একসঙ্গে দুটো বাঘ ঘায়েল করেছিল। এগুলো গালগল্প নয়, দিনের আলোর মতোই সুস্পষ্ট। তবুও মজিল সাহেবের কথা শুনে চুপ করেই থাকতে হল। তর্ক করে গায়ের শক্তি প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে কী হবে আর? আজও তো কিছু মেয়ে-পুরুষ রয়েছে সেখানে, তাদের মনোবল প্রশংসা করার মতো। সেই শূন্যপুরীতে এখনও যে কেউ কেউ ফিরে যায় তা কি শুধু দুটো ফলের জন্যে, না, অকৃত্রিম প্রাণের টানে?

শহিদ সাহেব আসবার সময় জানিয়েছিলেন—’আপনাদের রক্ষা করলাম, আর আপনারাই আমাদের এভাবে ছেড়ে যাচ্ছেন? এসব কি ভালো করছেন মশায় আপনারা? এখান থেকে এমনভাবে দলে দলে গেলে সিকি লোক মরবেন শুধু না খেতে পেয়ে, গুণ্ডায় মারবে সিকি, আর বাকি লোক মরবেন শীত-গ্রীষ্ম-অনাহারে। এরই পিঠ পিঠ অবশ্য বলেছিলেন গম্ভীর হয়ে কেটে কেটে—’আমরা মসজিদে মোনাজাত করার সময় খোদার কাছে প্রার্থনা করেছি এই বলে,-খোদা, আমাদের প্রতিবেশীদের যেন কোনো অনিষ্ট না হয়। তারা সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক।’ শহিদ সাহেবের কথা আজও কানে বাজছে। তাঁর প্রার্থনা খোদার কানে গেছে কি না জানি না কিন্তু এমন দরদি মনের পরিচয় পেয়ে সেদিন চোখ দিয়ে আমার কৃতজ্ঞতার জল ঝরে পড়েছিল।

কিন্তু সুবিধাবাদী চ্যাংড়ার রূপ সর্বত্রই এক। ওখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। আমাদের মধ্যে যখন এই ধরনের হৃদয়াবেগের কথা হচ্ছিল ঠিক সেই সময় এসে হাজির হল আসমান। খানিকক্ষণ হাঁফ ছেড়ে সামনের চেয়ারটায় বসে দু-বার লাঠি ঠুকে অকস্মাৎ প্রশ্ন তোলে-‘কী কইছ মেয়ারা? আমাগো পাকিস্তান ছাইড়্যা মহায়রা এরকম যায় কা?’ তারপর একটা চোখ ছোটো করে আমার দিকে তাকিয়ে নিম্নকন্ঠী ষড়যন্ত্রীর মতো বলে—’হুনছি কিছু ব্যাচোনের আছে? বাড়িডা বোলে ব্যাচবেন?’ তার কথা শুনে আমরা সবাই তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। ছোকরা বলে কী, বাড়ি কেনার টাকা হল কোথা থেকে ওর?

কথাটা যাচাই করার জন্যে মজিল সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—’এই আপনার দল? এরাই আমাদের রক্ষা করবে বিপদ-আপদের মধ্যে?’ কাঁদো কাঁদো হয়ে ম্লানমুখে মজিল সাহেব শুধু জানালেন–সবই বুঝি ভাই, একটা কথা কী জানেন? এমনিভাবে হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে আমরা কাদের নিয়ে থাকব বলুন? আপনাদের সঙ্গে একত্রে এতদিন বসবাস করার পরেও যদি অনাত্মীয়ের মতো আমাদের ছেড়ে যান তাহলে তার চেয়ে বড়ো সর্বনাশের কথা আর কী হতে পারে! এরা শিশু, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করার বুদ্ধি কোথায় এদের? পাপের আপাতমধুর স্বাদেই বিভোর হয়ে রয়েছে এরা, এদের কথার তাই দাম নেই কিছু। সমস্ত হিন্দু গ্রাম ছেড়ে গেলে হিন্দুর মনে যেরকম কষ্ট লাগে, আমাদেরও সেই একইরকম কষ্ট হয়। লক্ষ করেছি কথা বলতে বলতে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল তাঁর চোখ বেয়ে। জানি না মজিল সাহেবের সাঙ্গোপাঙ্গরা তাদের হিন্দুভাইদের অভাব অনুভব করেন কি না আজও, কিন্তু আমরা দু-বেলা স্মরণ করি তাঁদের অশ্রুরুদ্ধ নয়নে। আজ তাই বারবার মনে পড়ছে মজিল সাহেব আর শহিদ সাহেবের কথা। কিন্তু গ্রাম ছাড়ার সময় তাঁরা আরও নিবিড় করে বাধা দিলেন না কেন? কেন তাঁরা প্রাচীর তুলে দিলেন একই মায়ের বুকের ওপর? এ সর্বগ্রাসী দুঃখ তো ভবিষ্যতের হিন্দু-মুসলমান মানবে না। এ যে সকলকেই নিষ্ঠুরভাবে দলন করে চূর্ণ করে দেবে! তবে দুঃখী মানুষ আজও কেন জাতিভেদের জাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে অকারণ? কেন তারা বিদেশি চক্রান্তের ক্রীড়নক হয়ে নিজের সর্বনাশ নিজে করছে আহাম্মকের মতো? এ প্রশ্ন কাকে করি? কে উত্তর দেবে? পাকিস্তান থেকে মজিল সাহেবও কি এমনি চিন্তাই করছেন আজ?

এমন সোনার দেশ কি কারও ছাড়তে ইচ্ছে হয়? প্রথম প্রথম ভীত মানুষ যখন দু-একজন করে ঘরবাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে আসতে শুরু করে তখনও প্রমদা ঠাকরুন গৃহনির্মাণ ও উদ্যানরচনায় ব্যস্ত। দেশে এমন দাবানল জ্বলে উঠবে কে চিন্তা করেছিল? ভাইয়ে ভাইয়ে কোন্দল হয়, আবার মিটেও যায়, কিন্তু সেদিনের সামান্য ফুলকিই যে দেশজোড়া তান্ডবের সৃষ্টি করবে তার হদিশও সামান্য মানুষ পায়নি! প্রমদা ঠাকরুন মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন, গ্র্যাজুয়েট পুত্রবধূ এনেছিলেন ঘরে। নিজে লেখাপড়া তেমন না জানলেও বিদ্যার প্রতি শ্রদ্ধা ছিল তাঁর আন্তরিক। সেই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি খাটতে পারতেন অসম্ভব। নিজের হাতে বেঁধে তিনি কত ভোজ নামিয়ে দিয়েছেন গাঁয়ের। জানি না তাঁর সাজানো বাগান আজ শুকিয়ে গেছে কি না!

সোনালি ভবিষ্যতের কথা তুলত মাঝে মাঝে কচি মেয়ে কল্যাণী। সে আবদার করত, আমাদের গ্রামের এই কাঠখোট্টা নামটা পালটে কাঞ্চনবালা রাখলে হয় না? হিন্দুরা যেমন সবাই লিখতে-পড়তে জানে, মুসলমানরাও সেইরকম লিখতে-পড়তে শিখবে কবে? ওরা সবাই কেন হিন্দুর মতো স্কুলে যায় না, জ্যাঠামশায়? এমনি কত অদ্ভুত অদ্ভুত কথার স্মৃতি ভিড় জমাচ্ছে আজ মনের আকাশে। আজ সে অনেক বড়ো হয়েছে, আমাকে দেখতে এসে সেদিনও বলে গেছে, এখন আর গ্রামের ক-বিঘে জমিই আমাদের বাড়ি নয় জ্যাঠামশাই, এখন আমাদের বাড়ি সমগ্র ভারত জুড়ে!’ কল্যাণী এত দুঃখেও ভেঙে পড়েনি, সে যেন বিরাটত্বের স্বাদ পেয়েছে।

অশীতিপর বৃদ্ধ সাবডেপুটি দেবেনবাবু সমস্ত কাজ ফেলে পুজোর সময় দেশে আসতেন ছুটে। তিনি না এলে মা আসবেন কী করে? তাঁর আসার পরদিন থেকেই শুরু হত আগমনি সংগীত। ভিখারি-বাউলরা সাবডেপুটি বাবুর চারপাশ ঘিরে আরম্ভ করে দিত গান,

আসছেন দুর্গা স্বর্ণরথে
কার্তিক গণেশ নিয়ে সাথে।
আসছেন কালী পুষ্পরথে
মুন্ডমালা নিয়ে গলে।।

দুর্গাপুজোর ধুমধাম যেন আজও জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। কী হইহুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে কেটে যেত দিনগুলো তা চিন্তা করেও আশ্চর্যবোধ হয় আজ। আজ একটি দিন কাটতে চায় না, দুঃখের জীবনপৃষ্ঠা ওলটাতে যে এত বিলম্ব হয় তা কে জানত আগে! কিন্তু সেদিন সারারাত জেগে রামায়ণগান শোনার উৎসাহ পেতাম কোথা থেকে! আনমনা হলেই সেইদিনকার রামায়ণগানের টুকরো টুকরো কথাগুলো বেরিয়ে পড়ে অজান্তে শত দুঃখকষ্টকে অগ্রাহ্য করে,

অযোধ্যানগরে আজ আনন্দ অপার
রাম রাজ্যেশ্বর হবে শুভ সমাচার।
পল্লব কুসুমহারে কিবা শোভা দ্বারে দ্বারে
প্রতি ঘরে সবে করে মঙ্গল আচার।
মধুর মঙ্গল গীত শুনি অতি সুললিত
বাজনা বাজিছে কত বাজে অনিবার।।

চোখের সামনে স্বচ্ছ হয়ে উঠছে আনন্দমুখর দিনগুলোর কথা। প্রতি ঘরে ঘরে যাদের আনন্দধ্বনি জাগত তাদের ঘরে আজ মর্মরধ্বনি কেন জাগছে? আলোকের ঝরনাধারায় কি এই দুঃখকষ্টকে ধুয়ে ফেলা যায় না আমাদের জীবন থেকে?

এমনি কত শত দুঃখের পাঁচালি মনটাকে করছে ক্ষতবিক্ষত। কোন দুষ্টু ছেলে আমাদের ঢিলের মতো চক্রাকারে ভারতময় ছিটিয়ে দিল? রোহিণী কবরেজমশায়ের ছোটো শিশির স্বর্ণপটপটি আজ গড়াতে গড়াতে এসেছে হাবড়ায়! সারাজীবনব্যাপী শ্রমের ফল, কত বাড়ির জনশূন্য ছবি হয়তো দেখছেন গোপাল দে মশায় বর্ধমানের ঘোলাটে আকাশে! জানকী দাসের লেকচার স্তব্ধ হয়ে গেছে শিয়ালদা প্ল্যাটফর্মের পূতিগন্ধময় পরিবেশে! অত বড়ো বাড়ির মালিক হেমন্ত গুহ সোনার পুতুলি পুত্রকন্যার হাত ধরে এসে মাথা গুঁজেছেন অন্ধকার ক্যাম্পে। তাঁর পঞ্চাশ খন্ড ইংরেজি বিশ্বকোশের পাঠক আজ কারা? কার্ভালোর দামি চকচকে পোশাকটা কী আজ ‘ভবের কোলায়’ (বড়ো মাঠে গড়াগড়ি যাচ্ছে? নরেন বসু উকিল হয়তো থিয়েটারের শখ মেটাচ্ছেন রাঁচিতে! তাঁর সিরাজ আজ চমকে চমকে উঠছে স্বপ্নের মধ্যে আগুন-রক্ত-তরবারি কিংবা বর্শা দেখে!

ভোলা যায় না, ভোলা যাবে না আমার লাঞ্ছিত জন্মভূমিকে। সেই সঙ্গে ভোলা যাবে না বিরাশি বছরের বৃদ্ধ শশী ঠাকরুনের চশমা এঁটে চিঠি পড়ার দৃশ্যকে, ভোলা যাবে না দামোদর বসুর সূক্ষ্ম হিসেব-বিলাসী মনকে, ভোলা যাবে না সাধু ভাষার ধ্বজাধারী ঈশ্বর বসুকে। তিনি সাধুভাষা প্রয়োগ করতেন স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করার সময়েও। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের টুকরো কথাগুলো মনে পড়লে আজও হাসি পায়। একবার সামান্য কলার পাতা ছেঁড়ার জন্যে ঈশ্বরবাবু স্ত্রীকে কড়া তিরস্কার করে বলেন—’এত কষ্টে আনীত, ভাদুসার হইতে কদলীবৃক্ষ, তার পত্র ছিন্ন, কে না হয় বিষণ্ণ?’ বলেই পত্নীর পিঠে সপাং সপাং করে বেত্রাঘাত!

মনে পড়ছে গ্র্যাজুয়েট বর দেখতে গিয়ে এই গ্রামেরই একজন পাত্রের হাতের লেখা চেয়েছিলেন দেখতে। এমন কত শত কাহিনি মনকে উতলা করছে কেন জানি না। যাঁরা মনের অতলে গিয়েছিলেন তলিয়ে তাঁরা সবাই উঁকি দিচ্ছেন একের পর এক। তাঁরা সবাই কোথায় আজ? মনে মনে তাঁদের স্বাস্থ্য, অর্থ, শান্তি কামনা করছি। তাঁরা সুখে থাকুন, ভালো থাকুন।

শুনেছি আমার গাঁয়ে আর পুজো হয় না, নবান্নের ধুম নেই। মানুষহীন গ্রাম শ্বাপদসংকুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার কি কোনোদিন ছেলেরা ভোরে উঠে কাক ডাকবে–’কাউয়া কোকো কো, আমাগো বাড়ি আইয়ো’ বলে? পৌষ সংক্রান্তির আগে কৃষক-মজুররা আর কি গৃহস্থের বাড়ি এসে–”রাজার বাড়ি আইলাম রে!’ বলে দাঁড়াবে? কুমির আর বাঘের পুজোর সঙ্গে রসের পিঠে, চিতে পিঠে খাওয়া হবে আর কোনোদিন?

মনুষ্যত্বের অবমাননা পৃথিবীতে এমন ভীষণভাবে আর কোনোদিন হয়নি, তবুও দুঃখকষ্ট অপমান নির্যাতনের মধ্যে মানুষ অমৃতলাভ করবেই। পাঁচশো বছর আগে তুরস্কের রাজধানী থেকে বিতাড়িত গ্রিক খ্রিস্টানরা পশ্চিম ইউরোপে জ্বেলেছিলেন প্রজ্ঞা ও শান্তির নতুন আলো। সেই আলোয় সমগ্র ইউরোপ আজ হয়ে উঠেছে আলোকিত; অত্যাচারী তুরস্কের পরাজয় হল বিতাড়িত বিধর্মীদের কাছে। মনে হয় বাংলার কাজ হবে নতুন আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে যাওয়া–সমগ্র দেশের প্রাণে নতুন জীবন যোজনা করা। জানি ভারতের জয় অবশ্যম্ভাবী। ছোট্ট জমির মালিক আর আমরা নই, এখন সারাভারতবর্ষ আমাদের মাতৃভূমি। আমাদের সাধনা এখন বিরাট হওয়ার, মহৎ হওয়া প্রাণ-গঙ্গার ঢেউ একদিন ঐরাবতের মতো সমস্ত বাধবিপত্তিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেই, নতুন পরিবেশে আবার আমরা সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াব, আবার আমরা মানুষ হব।

.

মাহিলাড়া

বরিশাল থেকে মাদারিপুর ছত্রিশ মাইল দীর্ঘ যে প্রশস্ত সরকারি রাস্তাটা চলে গেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে–তারই মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের জন্মভূমি মাহিলাড়া গ্রাম। গ্রামটি রাস্তার পুব ধারে। এরই প্রায় একমাইল দক্ষিণে রাস্তা-সংলগ্ন গ্রাম বাটাজোড়, স্বর্গীয় অশ্বিনীকুমার দত্ত মহাশয়ের পৈতৃক বাসভূমি। সরকারি রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে বয়ে চলেছে সরকারি কাটা খাল।

মায়ের কোলে যেমন শিশুর সুখের সীমা নেই, তেমনি সুখ ছিল আমাদের পল্লিমায়ের কোলে। সরকারি খাল থেকে আর একটা খাল পুব দিকে তিন ক্রোশ দূরে গিয়ে মিশেছে আড়িয়ালখাঁ নদীতে। এই খালের দুই তীরে ছবির মতো গ্রাম মাহিলাড়া। জোয়ার-ভাটায় খালের জল সদাই চঞ্চল, যেন পল্লিমায়ের বুকে দুলছে একছড়া কণ্ঠহার! ভোরে যখন সূর্য ওঠে, পূর্ণিমায় যখন নীল আকাশে চাঁদ ফোটে, তখন খালের জলে লক্ষ মানিক জ্বলে।

মাঝখানে একটা কাঠের পুল এক করে দিয়েছে এপার-ওপার। পুলের উত্তরে একটা বহুপ্রাচীন তালগাছ, আর দক্ষিণে একটা কদমগাছ। আষাঢ়ে সবুজ পাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফোটে রাশি রাশি কদম ফুল। এরা সজল চোখে হাসি ফুটিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখে। খালের দু-ধারে আরও কত গাছ–হিজল, জারুল কাঁঠাল। জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন প্রথম জোয়ারের জল ছুটে আসে কূল ছাপিয়ে, তখন তাতে ভাসে রাশি রাশি হিজল আর জারুল ফুল। হিজল ফুল লাল, আর জারুল ফুল বেগুনে। অজস্র ফুল পরস্পর মিলেমিশে রঙিন কার্পেটের মতো ভেসে আসে জোয়ারের জলে, আর পিছিয়ে যায় ভাটার টানে–নদীর দিকে।

গ্রামের উত্তরে খানিকটা দূরে শ্মশ্রুবহুল ঋষির মতো দুটো বটগাছ। বিশাল ছায়া ফেলেছে। পায়ে-চলা পথের ওপরে। কত বয়স তাদের হল কে তার হিসেব রাখে। পূর্বসীমায় গুপ্তদের দিঘির পাড়ে একটা বকুল গাছ। ফুল ঝরে পড়ে তার দিঘির জলে। দক্ষিণে সরকারের মঠ। তিন-চারশো বছরের পুরোনো দেউল। তার দেহে ঢেউ খেলানো কারুকাজ। আর একটু পশ্চিমে একটা অশ্বত্থাগাছ–বুঝি হাজার বছর বয়স হবে তার। এটি গোবিন্দ কীর্তনীয়ার গাছ বলে জনশ্রুতি। কী প্রকান্ড দশদিকে ছড়ানো এর ডালপালাগুলো। ওখানে নাকি কোনো দেবতার বাসা। কেউই চড়ে না ওই গাছে। আর একটা পুরোনো মন্দির গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে–ওই সরকারের মঠের সমবয়সি। এরও সর্বদেহে খোদাই-করা পদ্মফুল, লতাপাতা! ওই মন্দিরে দুর্গাপুজো হয় প্রতি আশ্বিনে। গ্রামের পশ্চিম সীমায় সরকারি রাস্তায় একপ্রান্তে সুদীর্ঘ আর সুবিশাল শিমুল গাছ–শালপ্রাংশু মহাকাল। ফাগুনে আগুন-বরন ফুল ফুটিয়ে চেয়ে থাকে ও আকাশের দিকে। এই চতু:সীমার বাইরে ধানের খেত–সবুজ সতেজ। অঘ্রানে বাতাসে ঢেউ লাগে ওদের বুকে। আমরা চেয়ে থাকি অপলক। কী জাদু আর কী মায়া আছে ওই ঢেউ-খেলানো সবুজ খেতে ইচ্ছে হয় সর্বাঙ্গ ভাসিয়ে কেবল সাঁতার কাটি ওই মনভোলানো শ্যামসায়রে। অশ্বথগাছের শোভাই কি কম? ওর লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পাতা সদাই মুখর, সদাই চঞ্চল প্রাণহিল্লোলে। চৈত্রে কিছুদিন ধরে পাতা ঝেড়ে ফেলে রোদের কিরণ আর হাওয়া টেনে নেয় ও সর্বদেহে। তারপরে আসে একটা চেতনা। একটু সবুজের ছোপ লাগে ডালপালায়। তারপরে ঈষৎ লোহিত। ক্রমে সবুজ রং বদলায় দিনে দিনে–গাঢ় থেকে গাঢ়তর সবুজে।

সরকারি রাস্তাটার একধারে গ্রামের উচ্চ ইংরেজি স্কুল–আর একদিকে বন্দরের মতো হাটখোলা। ওখানে কামারশালে ঢং ঢং করে শব্দ হয় রাতের বেলা। ডগডগে লাল লোহার কণা ছিটকে পড়ে হাতুড়ির ঘায়ে। চমৎকার লাগে দেখতে ওই সৃষ্টিশালা–ওরা শুধু গড়ে।

গ্রামের রাস্তাঘাট গড়েছিল প্রতাপ রায় সদলবলে মাটি কেটে, মাথায় ঝুড়ি বয়ে। তার আগে চলার পথে কোথাও ছিল এক-হাঁটু জল, কোথাও একগলা। তারপরে কতই হল। কত প্রতিষ্ঠান–ইংরেজি বিদ্যালয়, বালিকা স্কুল, ঔষধালয়, দরিদ্র ভান্ডার, লাইব্রেরি আরও কত কী! এসবও সেই প্রতাপ রায়ের গড়া। ভোরে ঘুম ভাঙিয়ে দিত প্রতাপ রায়ের ঘণ্টা তারপরে উষাকীর্তন। শীতকালে খালে জল থাকত না ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত। সদলবলে প্রতাপ রায় টেনে বার করে দিত বিপন্ন মাঝিদের নৌকোগুলো। একবার এই শুকনো খালে আটকে পড়া নৌকোয় ধুকছিল দুটি জ্বরবিকারের রোগী। না ছিল ওষুধ, না পথ্য। তাদের কাঁধে করে ধরে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের কাছারি বাড়িতে। সেবা হল দিনরাত। একটি বেঁচে গেল, আর রজনীকে পোড়ানো হল ওই সরকারি রাস্তার ধারে। গ্রামে ওষুধ-পত্তরের অভাব। প্রতাপ রায়ের চেষ্টায় যৌথ তহবিলে হল ঔষধালয়। অশ্বিনীকুমারের আদর্শ রূপায়িত করেছিলেন প্রতাপ রায়–অক্লান্ত শ্রমে। তাই তো তিনি আশীর্বাদ জানাতে আসতেন প্রতি উৎসবে। খুঁজলে আজও পাওয়া যাবে তাঁর পদরেণু।

রামচন্দ্র দাস ছিলেন প্রেমিক, কবি! ফর্সা রং–স্থূলহ্রস্ব দেহ। দুটি বড়ো বড়ো চোখ– প্রীতিরসে ঢলঢল। শুধু ভালোবেসে মানুষ গড়া যায়, তার উদাহরণ জোগালেন রামচন্দ্রবাবু। তাঁর দেহে-প্রাণে-মনে জ্যোতির ঝলক নামত ঊধ্ব থেকে অন্তরের গবাক্ষপথে। তাঁর প্রেরণা আসত যুক্তির পথে নয়, হৃদয়ের অজানিত অন্তঃপুর থেকে–শাশ্বত সত্যের চিরভাস্বর জ্যোতির মতো।

আজ প্রতাপ আর রামচন্দ্রের চিতাভস্ম মিশে আছে ওই পল্লির পথের ধুলোয়। যাঁদের কাছে এই ধুলো ছিল স্বর্ণরেণু তাঁরা ছিটকে পড়েছেন কোন দূর-দূরান্তে। কোথায় সেই নরেন্দ্রনাথ, অমৃতলাল, হরেন গুপ্ত আর রমেশচন্দ্র? তাঁদের চোখে হয়তো ধরণীর আলো হয়ে এসেছে নিষ্প্রভ।

কোথায় চলে গেল সেই অনন্তকুমার! যখন কালবৈশাখীর ঝড় উঠত-বাঁশঝাড়-গুলো ঝড়ের দোলায় নুয়ে পড়ত মাটির বুকে, তখন অনন্তকুমার আমাকে নিয়ে উঠতেন ওই উঁচু গাছের মগডালে। দেখতাম এলোকেশীর উন্মাদিনী মূর্তি। জীবনে যখন যা খাঁটি বুঝত তাই করত প্রাণ দিয়ে, জীবনের মূল সুরটি ছিল ভক্তির। সন্ধান করত তার–যে আড়ালে থাকে–ইশারায় ডাকে। লিখত সে চমৎকার, গানও গাইত অতিমধুর।

মনে পড়ে রসরঞ্জনকে। কুষ্ঠরোগীর সেবক নেই। পয়সা পাবে কোথায়-অনাহারে অনিদ্রায় পায়ে চলে নদী সাঁতরে শত শত মাইল চলল সে বৈদ্যনাথে রোগীসেবায়! এঁরা আজ কেউ নেই– কিন্তু আজও আছে ওই সুরেন। বেঁচে আছে সে আপন প্রভায়। শৈশবে ছিল সে কবি–ছবিও আঁকত চমৎকার। গৌরবর্ণ, মুখের কাঠামো মঙ্গোলিয়ান–দীর্ঘদেহ। জলের মোটা মোটা লম্বা জোঁকগুলো দেখলে আমাদের গা শিরশির করত। সুরেন ওগুলো ধরে এনে ট্যাঁকে করে ঘুরে বেড়াত–আমাদের ভয় দেখাত। সাপের ল্যাজ ধরে শূন্যে তুলে ও মজা দেখত! কল্পনা করত, কবিতা লিখত ভারত উদ্ধারের। ভারত উদ্ধারের কথা আমাদের মনে দাগ কাটত বেশি। দুর্জয়কে জয় করার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠত আমাদের মনে। আমরা তখন কিশোর। দেহের পুষ্টির সঙ্গে এই বয়সে নেমে আসে শক্তিধারা–সে শক্তিকে অচঞ্চলভাবে ধারণ করতে পারে–এত শক্তি কার আছে? বাঁশ কেটে লাঠি বানাই–তরোয়াল, বন্দুক ধনুর্বাণ। কখনো কি মনে হয়েছে এই অস্ত্রে ইংরেজকে তাড়ানো যাবে না? তারপরে এল স্বদেশি আন্দোলন। আমাদের ভেতরে প্রেরণা জাগাল আনন্দমঠ, প্রেরণা জাগাল রামচন্দ্র দাসের কবিতা, মুকুন্দ দাসের সেই প্রাণমাতানো গান,

দশ হাজার প্রাণ যদি আমি পেতাম,
মাথায় পাগড়ি বেঁধে সাধক সেজে
দেশোদ্ধারে লেগে যেতাম।

আজ সেই দেশোদ্ধারী সুরেন, কবি সুরেন, চিত্রশিল্পী সুরেন পোশাক বদলেছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোধা ডক্টর সেন এখন অবসরপ্রাপ্ত। যখন কৈশোরে বয়সের অনুপযোগী ইতিহাসের মোটা মোটা বইগুলো রাত জেগে পড়ত তখন একটি লোক তাকে উসকে দিতেন–তিনি আমাদের বরিশালের অশ্বিনী দত্ত। মনে আছে একবার সুরেন অশ্বিনীবাবুকে কবিতায় চিঠি দিল,

যাট বছরের বুড়ো তারে সবাই কেন বলে,
বুড়ো হয়ে যায় না শুধুই বয়স বেশি হলে।
সাদা হাসি আছে তাঁহার সাদা গোঁফের তলে,
বিশ বছরের যুবার মতো বুক ফুলিয়ে চলে।
আমি যদি মেয়ে হতাম, হতাম স্বয়ংবরা,
ওই বুড়োর গলে দিতাম তবে আমার মালাছড়া।

অশ্বিনীকুমারও জবাব দিয়েছিলেন তেমনি রসালো কবিতায়, সে-কবিতা আজ আর মনে নেই। ডক্টর সুরেন, ভাইস-চ্যান্সেলার সুরেন আজও তেমনি কিশোর, কিন্তু আপন জন্মভূমিতে সে অনাদৃত।

আমাদের এই খেলাঘরে জুটল এসে মনোরঞ্জন গুপ্ত! ভিন গাঁয়ের তরুণ। আজ বয়স তার যাট পেরিয়েছে, কিন্তু আজও সে কিশোর–গাছের পাতাটি ছিঁড়ে নিতে ওর দুঃখ হত, কিন্তু যখন ডাক এল গেরিলা বিপ্লবের, তখন এই বাঁধনছেঁড়া সাধকের হৃদয়-যন্ত্রে বাজল শুধু একটি তারের একতারা। দেশের মুক্তিযজ্ঞে হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে আহুতি দিল নিজের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ। সরকারের খাতায় ওর মাথায় মূল্য বেড়ে যায়, কিন্তু আইনকানুনে ওকে ধরা যায় না–রাজসাক্ষী দেয় না ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য। তবু ওকে শিকল পরতে হল। নিজের পায়ে শিকল না পরলে কি মায়ের পায়ের শৃঙ্খল খোলা যায়? কিন্তু সে-শৃঙ্খল ‘চরণ-বন্দনা করে, করে নমস্কার। আজ দেশ তো বিদেশির গ্রাস থেকে মুক্ত হয়েছে, কিন্তু মুক্ত হয়নি ভয়, মুক্ত হয়নি মানুষের মন। দেবতাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে মানুষ। এই দুর্যোগে কে দেখাবে আলো? তাই নিরন্ধ্র অন্ধকার পথে একক অভিযাত্রী ওই ষাট বছরের কিশোর। প্রতিকারের হাত নেই, আছে দরদ, আজ অস্ত্র তো অবান্তর, তাই চোখে আছে জল-’সাত সাগরের জল। এই গ্রাম মনোরঞ্জনের খেলাঘর। আজ আর খেলার মাঠে সাথিদের কোলাহল নেই, কুটিরে কুটিরে জ্বলে না দীপ। নেই বালকদের পাঠাভ্যাসের উচ্চরব। সন্ধ্যায় ঠাকুরঘরে আর শঙ্খ বাজে না, আর কেউ জোটে না নৈশ রাতে খোল-করতাল নিয়ে কীর্তনে। তবু যেন শুনি। সেই গান,

মন রে তোর পায়ে ধরি রে,
একবার আমায় নিয়ে–একবার আমায় নিয়ে–
ব্রজে চলো–দিন গেলো, দিন গেলো!

কীর্তনের কথায় মনে পড়ে প্রিয়নাথের কথা–তার ছেলে মন্মথের কথা। আজ দু-জনের কেউ বেঁচে নেই।

কী চমৎকার ওরা গাইত! প্রিয়নাথের ডাকনাম ছিল মুলাই। দু-দলে পাল্লা দিয়ে গান চলেছে। দোহার বালকদের সংযত করে মুলাই ট্যারা চোখ ঢেলা ঢেলা করে গান ধরে,

হল দেহ-তরি ডুবু ডুবু প্রায়
পড়ে অকূলে আজ অসময়

***

তরির নব ছিদ্রে বহিছে বারি-ই-ই,
তাহে পাপের বোঝা নয় রে সোজা
উপায় কী করি।

এখন একূল ওকূল দু-কূল যায়–

শেষটা বলে যখন হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে ঘুরে ঘুরে সে গাইত-শ্রোতারা হরিধ্বনি দিয়ে উঠত তখন। মুলাইর ডাগর চোখ ভিজে উঠত জলে। পাশের গ্রাম যশুরকাটির ভজরাম সেন বড়ো গায়ক। সে ছিল ওর শ্বশুর। প্রায়ই গান হত তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। শ্বশুর বলে সে রেহাই পেত না। মুলাই বলত দোহারসহ,

শোন রে ভজা শোন,
আর আর পক্ষে যেমন তেমন
তোমার পক্ষে যম।

ভজরামও জবাব দিত যোগ্য ছন্দে।

ওদের গান আজও কানে বাজে। ভুলতে পারি না গোপাল ভদ্রের সেই আকুতি,

ব্রজের পথে হায় রে নিতাই,
যদি মোর দেহ পতন হয়–
তবে কৃষ্ণ-নাম লিখো আমার গায়–
ওই তুলসী মৃত্তিকাতে কৃষ্ণ-নাম লিখো–-আমার গায়।

মনসার ভাসান রয়ানি গান হত একাদিক্রমে সাতদিন ধরে। বেহুলার দুঃখের অন্ত নেই কলার মাজুসে স্বামীর অস্থি নিয়ে গাঙের জলে ভেসে চলে বেহুলা সুন্দরী। সেই নদীতীরে গোদা বঁড়শিতে মাছ ধরে।

বুড়িয়া গোদা বঁড়শি বায় তলা বাঁশের ছিপ,
সুন্দরীরে দেইখ্যা গোদা ঘন মারে টিপ।

পেছনে সমবেত কণ্ঠে দোহাররা ধুয়া গায়, ‘বড়ো তা-আ-আপিত’।

ভিন দেশ থেকে আসত কালা বৈরাগী রামায়ণ গাইতে। বাঁকা ঠোঁট বাঁকা চোখ–গলাটা ছিল মিঠে আর ধারালো। সেই গানের কথা আজও দুঃখের দিনে সান্ত্বনা দেয়,

রাম নামের গুণে জলে ভাসে শিলে–এ-এ।

এদের কেউ আর বেঁচে নেই–ওদের গানের রেশ আজও বাজে ওই অশ্বথের পাতায় আর বাঁশবনের মর্মর শব্দে।

গ্রাম্য কবি হারাধন ছিল খোঁড়া। লাঠি হাতে একখানা পা একপাক ঘুরিয়ে স্থির হলে তবে চলত অন্য পা-খানা। কবি বাণীকণ্ঠও ছিল ট্যারা–রচনা ছিল গ্রামের ভাষায়। তারাও নেই, আর তাদের রসিক শ্রোতারাও পালিয়ে গেছে তেপান্তরের মাঠে। গ্রামের যুবকদের মধ্যে কত শত হয়েছে গ্র্যাজুয়েট, কত অধ্যাপক; পি. আর. এস. হয়েছে চারজনা, ক-জনা পি-এইচ. ডি; বিলেত থেকেও ডিগ্রি এনেছে কত সোনার ছেলে, কিন্তু পল্লিমায়ের অদৃষ্টে নেই তাদের মিলিত সেবা পাওয়া! কে. ভি. সেন এনেছিল হাফটোন ব্লকে যুগান্তর; জ্যোতি গড়েছিল আর্টস্কুল। তাঁদের শিষ্য-উপশিষ্যেরা ছড়িয়ে আছে ভারতময়। প্রত্যেক ব্লকের কারখানায় তারাই কর্ণধার। বিলেতে পাস দিয়ে অশ্বিনী সেন গড়লেন হুগলি কটন মিল, দেশের শিল্পে সুর দিলেন গোপাল সেন, দর্শনশাস্ত্রে রস জোগালেন নিবারণ দাশ, দেশবন্ধুর ভগিনী বিয়ে করলেন অনন্ত সেনকে তাঁর কৃতিত্বের আকর্ষণে। তাঁদের অর্থে সম্ভব হল দেশের শিক্ষাদীক্ষা। তারাপ্রসন্ন ব্যয় করলেন মুক্ত হাতে, কিন্তু আজ তাঁদের ঘরে আর দীপ জ্বলে না! রাস্তাঘাট আগাছায় আচ্ছন্ন!

তবু ভুলতে পারি না সেই পল্লিমাকে। বৈশাখে মেলা বসত বটতলায়, আর অশ্বতলায়। দেশি কাঠের পুতুল গড়ে আনত শিল্পী অধরচাঁদ। আর আসত মাটির পুতুল হাঁড়ি-কুড়ি। ফুটি তরমুজও মেলায় আসত রাশি রাশি। সন্ধ্যায় ঠাকুরঘরে ওই ফুটি, তরমুজ, ডাব, ফেনি বাতাসা, চিনির খেলনায় দেওয়া হত নারায়ণের ‘শীতল’। কী মজা ছিল প্রসাদ পেতে! ঘরে ঘরে জমা থাকত মুড়ি, চিঁড়ে, কলা, নারকেল, পাটালি। গাছে গাছে পাওয়া যেত আম, জাম, কাঁঠাল, গাব, ডউয়া, কামরাঙা, লিচু, জামরুল, আরও কত ফলমূল।

শ্রাবণে মনসা পুজো, ভাদ্রে বিশ্বকর্মা পুজোর বাচ, আশ্বিনে দশহরা। ভাদ্রসংক্রান্তি আর দশহরায় আসত লম্বা লম্বা ছিপ-নৌকা। সারি সারি জোয়ান বসত দু-ধারে। বাবরি দুলিয়ে মাঝি ধরত হালের বইঠা। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ছিল না এতটুকু। উৎসবে-পুজো-পার্বণে– ওরাই কর্মী, ওরাই লেঠেল–বাচ খেলে ওরাই। আমরা খালের কিনারে নৌকায় বসে বাচ দেখতাম। খালের জলে ঢেউ উঠত কূল ছাপিয়ে-দুলিয়ে দিত আমাদের নাও।

কার্তিকে রাসপূর্ণিমায় মেলা বসত বাটাজোড়ে। বাটাজোড় মেলার পরেই অঘ্রান মাসের নবান্ন। সোনার ধানে ভরে যেত গৃহস্থের আঙিনা। নবান্নে সবাইকে নেমন্তন্ন জানাতে হবে। মানুষ, পশুপাখিকেও ডাকতে হবে। মনে পড়ে বড়ো বড়ো গাছের কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বলতাম,

ও দাঁড়কাক, ও পাতিকাক
আমাদের বাড়ি শুভ-নবান্ন
তোমরা সবাই যাইয়ো,
চাল, কলা, গুড়, সন্দেশ
পেটটি ভরে খাইয়ো।

মনে পড়ে দেশপূজ্য অশ্বিনীকুমারের একখানা পুরোনো চিঠি পড়েছিলাম অনেকদিন আগে। চিঠিখানা লিখেছিলেন তিনি তাঁর স্ত্রীকে পাঞ্জাব থেকে প্রায় বছর সত্তর পূর্বে। গুরুগোবিন্দ, রণজিৎ সিং, দিলীপ সিং প্রভৃতির কীর্তিকলাপ, তাঁদের অস্ত্রাগার, সমাধিস্থল প্রভৃতি দেখে তাঁর মনে একাধারে যে আনন্দ ও বেদনার উদ্রেক হয়েছিল তাই প্রকাশ করেছিলেন তিনি ওই পত্রে। দীর্ঘ পত্রের একস্থানে তিনি লিখেছিলেন,

…ভারতলক্ষ্মী অবশেষে এই বিশাল ভারতভূমির উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাবে আশ্রয় লইয়াছিলেন, আজ সেই স্থান হইতেও দূরীভূত হইলেন। ওই অস্ত্রাগারের সম্মুখে বসিয়া শুধু মনে হয় যদি সমস্ত ভারতবাসী পরস্পরের গলা ধরিয়া দুঃখের কাহিনি গাহিয়া ক্রন্দনের রোল তুলিয়া কাঁদিতে পারিত তবে বুঝি কষ্টের কিঞ্চিৎ উপশম হইত। কিন্তু তাতেও বাধা, ‘ফুটিয়া ফুকারি কাঁদিতে না পাই’ এমনি আমাদের দূরদৃষ্ট।…একবার মনে হয় গুরুগোবিন্দের ঢালখানি নিয়া পলায়ন করি, মনে হয় ওই পতাকাগুলি, অস্ত্রগুলি কলঙ্কের নিদর্শনস্বরূপ রাভি নদীজলে বিসর্জন দেই; মনে হয় দলীপের ক্রীড়াসামগ্রী কামানটি বুকে করিয়া উচ্চতরালে কাঁদিতে থাকি–কত কী ভাব হয় কী লিখিব?

দেশনায়ক অশ্বিনীকুমার দেশের অতীত গৌরবের অবমাননা দেখে কেমন মর্মাহত হয়েছিলেন, এ চিঠি থেকেই তা বোঝা যাবে। তাঁর প্রিয় বাংলা, তাঁর প্রিয় বরিশালের আজকের রূপ যদি তাঁকে দেখতে হত কী করে তিনি তা সহ্য করতেন?

.

চাঁদসী

গ্রাম নয়। জননী। আমার পিতৃপুরুষের জন্মভূমি। তাঁদের জীবনপ্রভাতে শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল এ গ্রামের বাতাস, জীবন-সূর্যাস্তে তাঁদের চিতাবহ্নি নিবিয়েছে এ গ্রামের জলরাশি। এ গ্রামেই প্রথম সূর্যালোকের সঙ্গে আমার পরিচয়। আজ সে গ্রাম থেকে চলে এসেছি অনেক দূরে, তবু সেই নবান্নের ঋতু, পুজোর ঋতু, আকাশডাকা ঋতু আমার সমস্ত অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে দেয়। আমার চিন্তাধারার স্তরে স্তরে লেগে আছে সেই গ্রামটির প্রতি অসীম মমত্ববোধ। সে-গ্রামের পরিচয় লিখতে গিয়ে আজ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে আসছে দুটি চোখ। সে-গ্রামকে যে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। দুঃখদৈন্য নিরাশাম্লান শরণার্থী জীবনে আমার জননী, আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের স্মৃতি এখন আশার প্রদীপশিখার মতো অনাহত ও অমলিন।

কলকাতায়, শুধু কলকাতায় কেন, বাংলাদেশের সর্বত্রই চাঁদসীর ক্ষত চিকিৎসকরা খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই চাঁদসী পূর্ব বাংলার বরিশাল জেলার একটি গ্রাম, সে-গ্রামই আমার জন্মভূমি। দেশ-বদলের পালায় সে-গ্রামকে ছেড়ে এসেছি, কিন্তু শত দুঃখের দিনেও চাঁদসীর মানুষ বলে নিজে গর্ব অনুভব করি, দেশের কথা মনে হলে কেমন একটা প্রশান্তিতে ভরে যায় এই হতাশার মুহূর্তগুলো। গ্রাম তো শুধু আমার একার নয়, হাজার মানুষের গ্রাম চাঁদসী। শুধু আজকের নয়, কতকাল ধরে কত মানুষের পদচিহ্নে এ গ্রাম ধন্য। সে-ইতিহাস আজ হয়তো সকলের মনে নেই, কিন্তু সে-গ্রাম আজও রয়েছে অতীতের নীরব সাক্ষ্যের বাণী বহন করে। গ্রামের কথা লিখতে বসে সে ইতিহাসের পূর্ণ পরিচয় দেবার সামর্থ্য আমার নেই, কিন্তু আমার নিজের সঙ্গে গ্রামের যে মধুর পরিচয়টুকু জড়িয়ে আছে সে-কাহিনিই আজ জানিয়ে যাই।

অনেকদিন ছেড়ে এসেছি গ্রামকে। কিন্তু সেখানকার প্রতিটি দিনের কাহিনি আজও আমার সারামন জুড়ে রয়েছে। গরমের ছুটিতে কলেজ ছুটি হলেই গ্রামে যাওয়ার জন্যে মন ব্যাকুল হয়ে উঠত। জলের দেশ বরিশাল। স্টিমার কতক্ষণে গিয়ে পৌঁছোবে গৌরনদী স্টেশনে, সেজন্যে কী ব্যাকুলতা। ঘাটে পৌঁছেলেই সোনামদ্দি মাঝি চিরপরিচিত হাসি হেসে প্রশ্ন করত—‘কর্তা, আইলেন নাকি, চলেন, নৌকা আনছি। আপনারা যে আজি আইবেন হেই তো আমি জানতামই। আমিও আপনাগো মতো দিন গুনি কবে আপনেরা আইবেন। তা কর্তা, গায়-গতরে ভালো আছেন তো?’

এইরকম কতশত প্রশ্ন করত সোনামাঝি। সে বুঝত বাড়ি পৌঁছোবার জন্যে আমাদের আগ্রহ। তাই খুব তাড়াতাড়িই নৌকো চালাত সে, বলত, ‘ওই যে কর্তা লোহার পোল দেহা যায়।’ এই পুলটি ছিল আমাদের বিশ্রামের জায়গা। সেখানে বর্ষার দিনে দেশ-দেশান্তরের নৌকা এসে ভিড়ত পণ্য বহন করে। আর একটু এগোলেই কাঁপালীবাড়ি, আমাদের গ্রামে ঢুকবার দক্ষিণ প্রান্তের প্রবেশমুখ। আর একটু এগিয়ে যান, দেখতে পাবেন একটি কাঠের পুল, তার পাশেই ঝাঁকড়ামাথা একটা আমগাছ। খবরদার, রাত্রিবেলা অন্ধকারে সেদিকে যাবেন না। গেলেই হয়তো গাছের ডাল থেকে ঝুলে-পড়া কোনো নারীমূর্তি দেখে আপনি চমকে উঠবেন। স্বামীর অত্যাচারে এক বাজনদারের বউ ওই গাছটায় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। খুব ভয় করত বই কী সে-গাছের তলা দিয়ে যেতে। এমনি ভয় করত কালীবাড়ি ও জয়দুর্গা খোলা দিয়ে যাবার সময়ও। যাই হোক, ঝাঁকড়া আমগাছটা পেরিয়ে বাজনদার বাড়ি ছাড়িয়ে গেলেই চোখে পড়বে বিখ্যাত দিঘির ঘাট। এই দিঘির ঘাটটা ছিল আমাদের লেক। গ্রীষ্মের কত সন্ধের মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেই দিঘির পাড়ে, কাকচক্ষুর মতো স্বচ্ছ জল। তার কিছুটা দূরেই গ্রামের ডাকঘর। সেখানে প্রতিদিন সকালবেলা গ্রামের লোক সব জড়ো হত। চলত আলাপ-আলোচনা, চলত খবরের কাগজ পড়া। ওরই দক্ষিণে গুহদের বাড়ি। কত জাঁকজমক ছিল ওবাড়ির, গমগম করত দিনরাত। পুজোর সময় গ্রামের সকলেই এসে জমত এবাড়িতে। তার দক্ষিণে মজুমদার বাড়ি; আরও এগিয়ে যান। কালীবাড়ি, দশমহাবিদ্যা বাড়ি, কেদারবাবুর বাড়ি হয়ে চলে আসুন তালুকদার বাড়ি, গ্রামের একেবারে শেষসীমান্তে। পায়ের জুতো খুলে দেখুন একুটও কাদা লাগবে না, বর্ষাকালেও না। এত সুন্দর ও চমৎকার এ গ্রামের পথঘাট।

গ্রামটি ছোটো হলেও এখানে চার-চারটি থিয়েটার পার্টি ছিল। বিষহরি নাট্য সমিতি, দশমহাবিদ্যা নাট্য সমিতি, সিদ্ধেশ্বরী নাট্য সমিতি ও চাঁদসী আর্ট প্রোডিউসার্স–সংক্ষেপে সি. এ. পি.! এই শেষোক্ত পার্টিই ছিল গ্রামের মধ্যে সেরা। এদের দলেই গ্রামের শিক্ষিত যুবকবৃন্দ অংশগ্রহণ করত। পুজোর সময় থিয়েটার নিয়ে কী মাতামাতিই না হত! কত দলাদলি, ঘোঁট পাকানো, জব্দ করার ফন্দি, এসব মত্ততার মধ্য দিয়েই পুজোর কটা দিন কেটে যেত। পুজোয় দেশে যাওয়ার আনন্দই ছিল ওর মধ্যে। এই থিয়েটারে অভিনয়ে যাঁরা অংশগ্রহণ করেতেন তাঁদের মধ্যে দুই সহোদরের কথাই বিশেষ করে মনে পড়ে, হবিবর রহমান ও লুৎফর রহমান ওরফে বাদশা মিঞা। বাদশা মিঞা আজ পরলোকগত। এমন সুন্দর চেহারা, শিক্ষিত ও অমায়িক লোক খুব কমই দেখেছি। এরা দুজনে সমস্ত অভিনয়েই অংশগ্রহণ করতেন এবং তাও প্রায়ই হিন্দু-দেবতার ভূমিকায়! আজ একথা শুনলে ইসলাম ভক্তরা চোখ কপালে তুলবেন জানি, কিন্তু সেদিন এ ছিল সত্য, স্বপ্ন নয়। মধু শেখ গ্রামের সকলেরই কাছে ছিল অতিপরিচিত, আপন বন্ধুজন। তার একটি বিশেষ গুণ ছিল। সে সমস্ত পশুপাখির ডাক নকল করতে পারত আর তা শোনাবার জন্যে গ্রামের সমস্ত মেয়েমহলেও তার ডাক পড়ত। সেও আজ পরলোকগত। কত লোকের কথাই তো আজ মনে এসে ভিড় করছে কার কথা লিখব, রজনী গুহমশায়ের বাড়ির কথা কী ভোলা যায়, না ভোলা যায় তাঁর বাড়ির সকলের অমায়িক ব্যবহারের কথা? এই বাড়িতেই চলত থিয়েটারের মহড়া দিনরাত। চলত গান-বাজনা। কারণ গান-বাজনার সমজদার ছিলেন এ বাড়ির সকলেই, আর সকলেই ছিলেন সুকণ্ঠ। নিম্নশ্রেণির মধ্যে আরও অনেকের গান আমাদের মুগ্ধ করত। দিনের কর্মাবসানে এরা একত্রে মিলিত হত। রাত্রিতে অনেকের বাড়িতে ‘ত্রিনাথ’-এর মেলা বসত। খোল, করতাল, মৃদঙ্গ সহযোগে চলত ঠাকুর ত্রিনাথের ভজন। কী সুন্দর তার মূৰ্ছনা! কোনো এক আত্মভোলাকে দেখেছি জ্যোৎস্না রাতে নির্জন স্থানে বসে একটি একতারা সহযোগে অপূর্ব সুরজাল সৃষ্টি করে বাউল সংগীত গেয়ে চলেছে। সে-সংগীত শুনে ঘর ছেড়ে তার পাশটিতে এসে চুপ করে বসে থাকতে হত। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত শ্রোতা ও গায়ক উভয়েরই। সংগীত শেষ হলে মনে হত কোন স্বর্গলোক ভ্রমণ করে এলাম এতক্ষণ। সেই আত্মভোলা আর তার সংগীত কি আজও বেঁচে আছে!

সেবারের শীতকালের একটি মজার ব্যাপার বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। ডিসেম্বরের কনকনে শীত; সকলে মিলে বকুলতলার খালে মাছ ধরা হচ্ছে, এই মাছ ধরা ছিল আমাদের বড়দিনের উৎসবের একটি অঙ্গ। হঠাৎ খবর এল গ্রামে বাঘ এসেছে। দল বেঁধে চললাম সেই অকুস্থলে। চাক্ষুষ দেখার পর স্থির করলাম, তিনি একটি ক্ষুদ্র সংস্করণের নেকড়ে ছাড়া আর কিছুই নন। কিন্তু সেই ক্ষুদে নেকড়েই আমাদের গ্রামে যে নাটক অভিনয় করে গেলেন তার মধ্যে করুণ ও হাস্যরস দুই-ই ছিল, আঠারোটি লোক ঘায়েল হয়েছিল তার সঙ্গে লড়াইয়ে। মরতে মরতে বেঁচে গেছে তারা। এটাই ছিল করুণরস। হাস্যরসের কথা উল্লেখ করতে সত্যি আজ হাসি পায়। চার-পাঁচজন বীরপুঙ্গব যারা তাদের পাকা শিকারি বলে গ্রামে জাহির করত, তারা তাদের সম্মিলিত চেষ্টা দ্বারাও শেরের বাচ্চার কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারেনি, যতবারই তারা দু-তিনজন একসঙ্গে গুলি চালিয়েছে বাঘের গায়ে, ততবারই দেখা গেছে ব্যাঘ্রমশায় তার লাঙুলটি নাড়তে নাড়তে বহাল তবিয়তে অন্য ঝোপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। সারাদিন ধরে সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করা হল কিন্তু সবই ব্যর্থ, সবই বৃথা। শেষদিকে কয়জন শিকারি বাঘের হাতে সাংঘাতিকরকম জখম হয়ে বাঘ মারার বাহাদুরি নেওয়ার আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে হাসপাতালে আশ্রয় গ্রহণ করল! আর সন্ধের অন্ধকারে ব্যাঘ্র মামাও তার এ গ্রামের লীলা সাঙ্গ করে বহাল তবিয়তে অন্য গ্রামে গিয়ে লীলাখেলা আরম্ভ করলেন!

এমনি কত ঘটনা আজ মনে পড়ছে। ‘নীল খেলার মাঠে’ ফুটবল খেলা, সন্ধের অন্ধকারে ‘ধরের ভিটা’য় দল বেঁধে ডাব চুরি করতে যাওয়া, আরও কত কী! বেচারাম ধুপী চৌকিদারি করত, শাসাত। কিন্তু ডাব নিয়ে যেতে বাধা দিত না বড়ো একটা। শৈশবের এসব কাহিনি ভুলতে পারি না। মনে পড়ছে গ্রীষ্মের দুপুরে বটগাছের ডালে বসে টোটাল পাখি একটানা সুরে টুপ টুপ করে গেয়ে যাচ্ছে। ঘুঘু-ডাকা অলস দুপুর। গ্রামের ছায়া-সুনিবিড় এক-একটা বাড়ি। তেমনি নীরব নিরালা বাড়িতে বসে সে-ডাক শুনতে কী ভালোই না লাগত! আজ সেসব হারিয়ে শহরে এসে মাথা গুঁজবার ঠাঁই খুঁজছি, তাও মেলে না। এই অনাদৃতদের আবার ঘরে ডেকে নেবে কে? অসহ্য বেদনায় আজ কেবল কবি বিহারীলালের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,

সর্বদাই হুহু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন,
চারিদিকে ঝালাফালা
উঃ কী জ্বলন্ত জ্বালা!
অগ্নিকুন্ডে পতঙ্গ পতন।

এ অগ্নিকুন্ড থেকে আমাদের কি উদ্ধার নেই? পতঙ্গের মতোই কি আমরা শুধু আত্মাহুতি দিয়ে যাব? কিন্তু কোন মহত্তর কল্যাণের জন্যে এই মৃত্যুযজ্ঞ? সমগ্র দেশের ভিত যে কেঁপে উঠছে এ বীভৎসতায়!

.

সৈওর

সুগন্ধা নদী। সুদর্শন চক্রে গৌরীর খন্ডিত নাকটি এই নদীগর্ভে পড়েছিল। ভোর হয়ে আসে। দাঁড়কাকের টানা-টানা থামা-থামা ব্যথা-গম্ভীর ডাক, কোকিলের অশান্ত কাকলি। আকাশছোঁয়া টেলিগ্রাফের তার। বাঁ-দিকে ‘সুতালরি’র মাথা ভাঙা মঠ। সুতালরির পোশাকি নাম ‘সূত্রলহরি’। মাথা ভাঙা কেন? কোন সন্তান মায়ের চিতায় এই মঠ তোলা শেষ হলে বলেছিল, শোধ করলাম মাতৃঋণ, অমনি ভেঙে পড়ল মঠের মাথা। সত্যিই তো, মাতৃঋণ কী কেউ কখনো শোধ করতে পারে?

আমাদের গ্রামটি যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেখান থেকে কখনো কেউ বিলেত যায়নি, সে-গ্রামে কোনো কোঠাবাড়ি নেই, এম. বি. ডাক্তার নেই, কোনো বাড়িতে চাকর পর্যন্ত নেই, কোনো ক্লাব নেই, লাইব্রেরি নেই, পলিটিক্যাল পার্টি নেই। এমন একটি গ্রামের কথা বলতে বসেছি, যে গ্রামের লোকদের মন আজও শহর থেকে অনেক অনেক দূরে।

সামনেই নলচিটি। ছবির মতো ছোট্ট পন্টুনখানা। নদী এখানে আরও চওড়া। পাড়ে পাড়ে স্টিমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, আলো-নেভা লণ্ঠন, সড়কি-বলয় আর চিঠির ঝোলা কাঁধে ‘রাণার ছুটেছে, রাণার’। স্টেশনের ওপারে ষাটপাইকা গ্রাম। ওখানে নাকি একদা ষাটজন বিখ্যাত পাইকের বাস ছিল।

এখানে নেমেই ধরতে হয় আমাদের গ্রামের পথ। কিছুটা পথ হেঁটে অথবা বর্ষাকালে নৌকায় যেতে হয়। অন্য সময় খালগুলো কচুরিপানায় ঠাসা থাকে। যারা গ্রামে যায়নি, ফুটে থাকা কচুরি ফুলের খবর তারা জানে না। পার্ক স্ট্রিট রিফিউজি ক্যাম্পে থাকার সময়, সাহেবদের বাড়ি সাজানোর জন্যে মাঝে মাঝে কয়েকটি করে কচুরি ফুল বিক্রি হতে দেখতাম।

নৌকা গ্রামের খালে এলেই, দু-দিকের সারি সারি ধানের খেতে খেতে, দূরের আম সুপুরি-তাল-নারকেল গাছগুলোর ডগায় ডগায়, উড়ে যাওয়া কাকের বকের পাখায় পাখায়, দূর-দূরান্তব্যাপী নীল আকাশে, এককথায় পথের সর্বত্র যেন পেতাম কেমন একটা স্নেহস্পর্শ। সেখানে লজ্জা নেই, সংকোচ নেই, একেবারে খাঁটি উন্মুক্ততা। লগির খোঁচা খাওয়া নৌকায় তলাকার জলের মতোই মন তখন আনন্দে ছলছলিয়ে উঠতে থাকে।

হাঁটাপথে নলছিটির পর নরসিংহপুর, বৈচন্ডি, আখখারপাড়া, হয়বাৎপুর বা হবিৎপুর, তারপর আমাদের গ্রাম সৈওর। সৈওর গ্রামটি এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো। স্টিমারের সঙ্গে যেমন গাদাবোট থাকে, হবিৎপুরের সঙ্গে সৈওর গ্রামটিও ঠিক তেমনি। আমাদের গ্রাম বলতে আমরা বুঝি হবিৎপুরকে, বলেও থাকি তাই। হাট, বাজার, পোস্ট অফিস, হাই স্কুল, খেলার মাঠ সবই হবিৎপুর ও আখোরপাড়ার। এখানে মুসলমানেরা সংখ্যায় অনেক। আমাদের ঢোলবাদক আর কুমোররা বরিশালের মধ্যে বিখ্যাত। জামাইবাবু, পিসেমশাই ও মামারা আমাদের গ্রামকে পান্ডব বর্জিত দেশ বলতেন। অফুরন্ত মাছধরা আর গোয়ালের গোরুগুলো না থাকলে তাঁরা নাকি আমাদের ওদিকে যেতেনই না। অবশ্য কলকাতার খবরের কাগজ শহরের আগেই আমরা পেতাম। নলছিটি বরিশালের আগের স্টেশন, মাত্র ছ-ক্রোশ পথ।

এককালে কোনো শক্ত জমিদার এই কয়েকখানি গ্রাম বসবাসের জন্যে নির্দিষ্ট করেছিলেন। তাই কয়েকটি খুব বড়ো বড়ো দিঘি দেখতে পাওয়া যায়। চন্ডীদাসের দিঘি সবচেয়ে বড়ো। তার চারদিকে এখন গা-ছম ছম-করা অরণ্য আর শীতল স্তব্ধতা। দূর কুটিরের টেকিপারের ঠুকঠুক শব্দ-লাগা প্রচন্ড দুপুর ঝিমুতে ঝিমুতে কেঁপে কেঁপে ওঠে। খেজুর ফুলের গন্ধভরা নিরিবিলি পায়েচলা পথ রোদে ঝাঁঝরা শেওলাখোলার পাশ দিয়ে চন্ডীদিঘির ছায়া মেখে কোথায় যেন চলে গেছে! এ দিঘির পারে বসে শ্রান্ত পথিক তার কো-কলকেটি বের করে নিয়ে বুটুর বুটুর তামাকটানা সুর শোনায়। তারপর রাজাবাড়ির দিঘি। এখানে বড়ো বড়ো মেঘডম্বুর সাপ অনেক মারা হয়েছে। দিঘিটি জমাট ঝোপে ঢাকা। তার ওপর গোরু চরে বেড়ায়। কিন্তু পৌষসংক্রান্তির দিন থেকে এক পক্ষকালের জন্যে সব ঝোঁপ তল পড়ে। এর বৈজ্ঞানিক কারণ কী তা জানা যায়নি। তবে ঘটনাটি অনেকবার দেখা। তৃতীয়টি সম্প্রতি আঁধি। চারধারে হোগলা, ভেতরে ফণাধরা সাপ আর জলপদ্ম। পাড় খুব উঁচু, সেখানে ছেলেদের খেলবার মাঠ। সুপুরির সময় এখানে চটি পড়ে। শ-খানেক গোল গোল চকচকে বঁটি, আঙুলে ন্যাকড়া জড়িয়ে লুকা জ্বালিয়ে চটির লোকরা কাজ করে আর গান গায়। এক-একটি বড়ো বড়ো চালান শেষ হবার অবসরে গান হত ‘গুণাবিবির পালা। রাত-মাতানো হইহই আর কী বেদনা সে-কণ্ঠে,

ও নাথ, গুপ্ত হন গুপ্ত হন
পুলিশ এসেছে,
আপনার চাচা ধলু মেয়া এজাহার দিছে।
আবার গেয়েছে,
ও–গুণা, গুণা গো,
আর কেন্দো না, কেন্দো না, দেশে চলে যাও,
নয়লাখ টাকার জমিদারি বেচে বেচে খাও।

গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মুখে মুখে কিছুকাল পর্যন্ত এসব গানই চলতে থাকে। শোনা যায়, এককালে এ গ্রামের ভোজ উৎসবের সব বাসনপত্র এই দিঘির জলে ভেজানো পাওয়া যেত, ভোজশেষে তা আবার দিঘিকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবার প্রথা ছিল। কিন্তু কোনো শাশুড়ির শ্রাদ্ধের নেমন্তন্নের পর কোনো বউ নাকি দু-একটি বাসন লুকিয়ে রেখেছিল, তারপর থেকে আর কেউ কিছু পায় না। এই জলে নাকি এক-একরকম মাছ দেখা যায়, তাদের মাথায় ধূপদানি, কপালে টকটকে লাল সিঁদুর।

 কেউ কেউ বলে, এসব গ্রামে আগে নাকি গভীর অরণ্য ছিল, আর একদল ডাকাতই ছিল এখানকার আদিম বাসিন্দা। কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়। কারণ সমস্ত গ্রামটিতে দুর্গা পূজা অপেক্ষা কালীপূজারই বেশি ধুম। প্রায় বাড়িতেই, আমাদের বাড়িতেও, প্রাচীন আমলের বড়ো বড়ো ঢাল সড়কি এখনও অনেকগুলোই আছে। ঠাকুরদাদা হাঁটু ভেঙে একহাতে বড়ো বড়ো মোষ বলি দিতেন। সুগভীর রাত্রিতে ঘড়ি-ঘণ্টায় ঘুম ভেঙে পুজোমন্ডপ থেকে ঠাকুরদাদার কালীপুজোর মন্ত্র উচ্চারণ শুনতাম। ওঁ হ্রীw প্রভৃতি এক-একটি শব্দের ঝংকারে ঘরের কড়িকাঠগুলো যেন ঝন ঝন করে কেঁপে উঠত। গ্রামের নর বা ঢোলবাদকরা একত্রে এক এক বাড়ি করে বাজনা বাজায় ও আলতি হয়। যারা শোলার ফুল তৈরি করে, তাদের বলে বনমালি। বনমালি সব বাড়ি বাড়ি আলতির সময়ে ভাঙের ব্যবস্থা নিয়ে আসে। সমস্ত গ্রামের লোক একত্রে এক-এক বাড়ির প্রতিমা বিসর্জন দেয়। পুজোয় কে কত বড়ো শিংওয়ালা ছাগ বলি দিল এ ব্যাপারটি ছাড়া আর সব ব্যাপারেই সারাগ্রামের অদ্ভুত একতা। কোনো বাড়ির নেমন্তন্নর ব্যাপারে প্রত্যেক বাড়ির পুকুর থেকেই নির্বিবাদে চলত মাছ ধরার উৎসব। কোনো বাড়ির জামাই এল তো এ যেন সারাগ্রামখানারই জামাই এল, তখন গ্রামসুদ্ধ প্রত্যেক বাড়িতেই একটা সুন্দর সুলজ্জ পরিচ্ছন্নতা দেখা যেত।

গ্রামের কালীবাড়িটি গভীর অরণ্যের মধ্যে। প্রতিবছর পুজোর পাঁচ-সাত দিন আগে থেকে জঙ্গলে আগুন লাগানো হত। নির্দিষ্ট দিনে পূর্ববছরের প্রতিমা ভাসান দেওয়ার বিধি। পুজো হয় পূর্ণিমার দিন। গাঁয়ের ‘তিন মাথা লোকেরা এই পুজোর দিন ঠিক করেন। শতাধিক বছর আগের কালীমন্দির! বট-অশ্বথের শেকড় জড়ানো তার আপাদমস্তক। কালের হাওয়ায় সর্বাঙ্গের ইটচুন গেছে খসে, তাই ইদানীং সেটি একটি সুদৃশ্য শেকড়ের মন্দির-গুহার রূপ ধারণ করেছে। তার মধ্যেই আবার বেল গাছ, জবাফুল গাছ, কচি দূর্বার ছড়াছড়ি।

গ্রাম্য ব্রাহ্মণ কায়স্থ শূদ্র সবাই গোঁড়া puritan, কিন্তু এই পুজোর দিনের প্রথা অনুসারে, বাল-বৃদ্ধ পন্ডিত-মূর্খ ব্রাহ্মণ-শূদ্র সবাই একত্রে গা ছুঁইয়ে প্রসাদ খেতে বসে। মাংস দিয়ে খিচুড়ি আর পায়েস। সেদিন গ্রামের কোনো বাড়িতেই রান্না হয় না। সবাই উবু হয়ে খেতে বসে। প্রথমবারের পরিবেশন হলেই ঘোষাল একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে হাঁক দিয়ে বলে–‘ও ভাই সাধু!’ সবাই তখন সমস্ত শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে- ‘হেঁইও’, ঘোষাল বলে–’ডাইল খাইলা’, সবাই—’হেঁইও’, ঘোষাল—’তরকারি খাইলা’, সবাই—‘হেঁইও’, এইভাবে।

আরও খাইলা ভা–জি,
হেঁইও, হেঁইও, হেঁইও!
মহামায়ার,
হেঁইও!
পেরসাদ খাইয়া,
হেঁইও!
মন করিলা রাজি–
হেঁইও, হেঁইও, হেঁইও।

এই হইহুল্লোড় হাসাহাসিতে পেটেরটা হজম হয়ে যায়। তখন আবার পরিবেশন চলতে থাকে। এর কারণ, এই প্রসাদ কেউ পাতে ফেলতে পারবে না, আবার সম্পূর্ণ পেট না ভরে খেলেও চলবে না। তাতে নাকি বংশে কলেরা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, অন্তত এর পরবর্তী ছড়াটি তো তাই বলে।

গ্রামের দক্ষিণে গভীর জঙ্গল। সেখানে ছোটো-বড়ো এলোমেলো ছায়াঘন গাছের অন্ত নেই। জায়গাটিকে বলে ‘পরান শীলের বাড়ি। এখানে প্রাচীন হরীতকী গাছের তলায় মস্ত উইটিপি আর আশপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয় মস্ত মস্ত সাপ। কোন কালের সঞ্চিত ধনসম্পত্তি নাকি আছে ওই উইঢিপির মধ্যে। বর্ষাকালে এখানে বড়ো বড়ো বাঘের থাবার চিহ্ন পড়ে।

শীত আসে। শেষরাত্রে পাতায় পাতায়, টিনের চালের এখানে-ওখানে থেমে থেমে, মোটা মোটা টুপ টাপ টং টং শিশির ঝরার শব্দ শোনায়। ঘাসের শিশিরে দু-পা ভিজে যায়। নীরব সন্ধ্যায় ল্যাজঝোলা ‘শিয়ালি’ কোথায় যেন টুক টুক টুক টুক করে খেজুর গাছ কাটে! খালের স্বচ্ছ জলে গাছের সারি চুপচাপ মুখ দেখে, আর কেউ কোনো নৌকা বেয়ে গেলে তাদের ছায়াগুলো যেন খিলখিল করে হেসে ওঠে। ক্রমে রাত্রি হয়, মাঝে মাঝে ‘আওলা দানো’ বা আলেয়া ভূত নামে।

শীতের মাঝামাঝি গ্রামে বাঘ-পুজো হয়। জঙ্গলের পথে পথে সন্ধের পর মশাল জ্বেলে ছেলে-মেয়েরা বেরোয়, আর বুধাই শীলের পাঠশালার নামতা পড়ার মতো সুর করে একজন আগে বলে ও পড়ে আর সবাই—

আইলাম রে শরণে,
লক্ষ্মীদেবীর বরণে,
লক্ষ্মীদেবী দিলেন বর,
চাউল কড়ি বিস্তর।
চাউল না দিয়া দিবেন কড়ি,
ঠিক দুয়ারে সোনার লরি;
সোনার লরি রূপার মালা,
পাঁচ কাঠালে সোনার ছালা।
একটি টাকা পাই রে–
বানিয়া বাড়ি যাই রে।

এর পর তারা বারো বাঘের ছড়া বলে,
এক বাঘ রে    এক বাঘ রাইঙ্গা,
ঘর ফালাইল রে    ঘর ফালাইল ভাইঙ্গা;
আর বাঘ রে    আর বাঘ চৈতা,
বাওন মারইয়া রে     বাওনের নিল পৈতা,
আর বাঘ রে    আর বাঘ নৈচৈ

গোয়াল মারইয়ার গোয়াল মাইরা খাইল দই।–ইত্যাদি।

পুজোর দিন উঠোনে, বড়ো বড়ো বাঘা-বাঘিনি এঁকে মেয়েরা হলুদগুঁড়ো চালগুঁড়ো সরষে কালোজিরে–এসব দিয়ে বাঘের গা করত চিত্ৰবিচিত্র। সে-দিন ঘরে ঘরে আলো জ্বালা হত না। সবাই পুজোর চিড়ে পেটভরে খেয়ে রাত কাটাত।

কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন এবাড়ির ওবাড়ির মা কাকিমা বউদি বোনদের সারাদিন উপুড় হয়ে ঘরজোড়া রুচিশুভ্র আলপনা দেওয়া দেখতাম। দেশের মা দুর্গার কী টানা টানা চোখ! আমরা কুমোরদের বলি ‘গুণরাজ’। আমাদের জানকী গুণরাজ কালা। জোরে না বললে সে শোনে না, কিন্তু কথা নিজে বলে খুবই আস্তে। সে এমনি কাটা মোষের মাথা তৈরি করে উঠোনে রাখত যা দেখে শকুনি উড়ে পড়ত। নিজের হাতের কনুইয়ের কাছটা ঠোঁটে লাগিয়ে জানকী ইশারায় তামাক চাইত। পুলঘাটায় গুণরাজের মাটির নৌকো আসে। সেখানে ছেলেদের কী জমাট জমায়েত। পুলের কাছেই বোসেদের দিঘি আর হাটখোলা। দূরে দূরে কলাপাতার ঘোমটাটকা লাজুক সব কুটির। ও-পাড়ে ময়াল সাপের মতো শেকড়-জড়ানো ভ্রূকুটি-কুটিল বাদামগাছের ডালে ডালে শকুনিরা চোখ বুজে ঝিমোয়। বাড়ি আসার সময় এখানে নেমে কোনো গ্রাম্য বৃদ্ধকে দেখে প্রণাম করতে হত। এখানে নেমেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে,–মা ভিজে চুল পিঠে মেলে উনুনে ফুঁ দিচ্ছেন। কাকিমা আর বউদি টেকি পাড় দিতে দিতে হাসছেন। পিসিমা উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে সবে কোমর সোজা করে দাঁড়ালেন, সোনাভাই দাঁতহীন ঠোঁট নেড়ে পুকুরের জলে জবাফুলের পর জবাফুল ভাসিয়ে চলেছেন, কামিনী আর স্থলপদ্ম গাছের ফাঁকে ফাঁকে। আমাদের কোথাও যাত্রাকালে এই পুলঘাটা অবধি ঠাকুরদাদা মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে আসতেন–’ধেনুর্বৎস প্রযুক্তা, বৃষগজতুরগা দক্ষিণাবর্ত বহ্নি’…

চা খাওয়ার রেওয়াজ আমাদের গ্রামে নেই। কিন্তু প্রত্যেক বাড়ির বাইরের বারান্দায়, এক তাওয়া আগুন, একতাল তামাক, কয়েকটি করে কলকে আর কো–এ থাকবেই। তাওয়াটিতে চব্বিশ ঘণ্টাই আগুন থাকে। মেয়েরা গন্ধক কাঠি তৈরি করে রাখে এবং দেশলাইয়ের পরিবর্তে ওই গন্ধক কাঠির সাহায্যে তাওয়ার আগুনে আলো জ্বালানোর কাজ চলে।

অতিথিপরায়ণতা গ্রামবাসীদের মজ্জাগত। কৃচিৎ কোনো লোকের সঙ্গে দেখা হলে তার চোদ্দো-গোষ্ঠীর সংবাদ জিজ্ঞেস করা এদের স্বভাব। নেহাত অতিথি হিসেবে সে যদি নাও থাকতে চায় অন্তত একছিলিম তামাক তাকে খেতেই হবে। ভাড়ার নৌকোকে আমাদের ওদিকে বলে ‘কেরায়া নাও”। এই কেরায়া নাও-এর যাত্রীদেরও এ ব্যাপারে রেহাই নেই। এসব মনগুলো শহর কলকাতায় এসে যে কী অবস্থায় পড়ে কী রূপ পরিগ্রহ করবে, তা ভাবতে গিয়ে থেকে থেকে একটা কান্নার দমকা আমার বুক-গলা পর্যন্ত ঠেলে ওঠে, চোখ ভিজে আসে।

সেসব থেকে থেকে পাখি-ডাকা গভীর রাত্রের নীরব শিহরন আর আমাদের কানে আসবে না। ‘অক্কু’র ডাকে ডাকে রাত্রির যাম আর গুনতে হবে না। চিলের মতো এক প্রকার পাখি অকু। পুকুর পাড়ের উঁচু তালগাছে থাকে। ঝড়-ঝঞ্ঝা বাদল-বৃষ্টি যাই হোক-না-কেন সন্ধের পর থেকে প্রতি চার প্রহর পর পর এরা ডাক শোনাবেই। এদের কণ্ঠ সবার ওপরে। দিনের বেলা ছায়া মেপে সময় নির্ণয় করার প্রথা আমাদের ওদিকে বিশেষ প্রচলিত। ছায়া মেপেই ঘড়ি ঠিক রাখতে হয়।

পদেতে মাপিলে ছায়া যত পদ হবে,
দ্বিগুণ করিয়া তাহে চৌদ্দ মিশাইবে।

এর পরের লাইন দুটি মনে নেই, তাতে বিশেষ ক্ষতিও নেই। ছায়া যত পা, তাকে দুই দিয়ে গুণ করে চোদ্দো যোগ করে তাই দিয়ে ২৯২কে ভাগ দিলে দন্ড হয়, আড়াই দন্ডে এক ঘণ্টা।

সাম্প্রদায়িক গোলযোগ আমাদের গ্রামে কোনোকালেই ছিল না, আজও নেই। প্রথম দাঙ্গা আরম্ভের পর, কলকাতার খবর পেয়ে আমাদের গ্রামে গ্রাম্যভাষায় সত্যপীরের পাঁচালির সুরে ছড়া লেখা হয়েছিল। পাঁচালিটি বেশ বড়ো সুতরাং মাঝখান থেকেই একটু বলি,

তোমার ঘরে পানি নেওনা আমি যদি ছুঁই,
গো-জবাইতে বাধা দিলে কাফের কইতাম মুই।
অশিক্ষা কুশিক্ষা আলহে তোমাতে আমাতে
তমো মোরা দুইজনেই আলহাম হাতে হাতে।
রাজায় রাজত্ব হরে পেরজার চৌহে ঝরে পানি,
অধর্মেরই ছুরি খাইয়া অইলাম রে অয়রানি।

তবু সে আজ আমাদের ছেড়েআসা গ্রাম। সে-গ্রাম ছেড়ে আসতে পা কি চলতে চায়, বার বার পেছন ফিরে ঝাপসা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেছি, কেবল দেখেছি। দু-একজন মুসলমান প্রজা সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন অবধি এসেছিল। খালাসিরা সিঁড়ি ফেলল। ওপারে ধানের খেত। নৌকাগুলো ঢেউয়ের আঘাতে আছাড় খাচ্ছে, মাঝিদের কোলাহল, সন্ধে আকাশে একঝাঁক পাখি কোথায় উড়ে গেল, দিগন্তে পান্ডুর সূর্যাস্ত। কেঁপে কেঁপে স্টিমারের বিদায়ের বাঁশি বেজে ওঠে। ঘাট নোঙর ছেড়ে দেয়। দু-ফোঁটা চোখের জল, বুকভরা অশান্ত কান্না। তারপর শহর। এখানে আমরা যেন কোনো ভিন্ন জাতি, সভ্যতার একটুকু বিলাসবসনের চিহ্ন যাদের দেহে নেই, তাদের সারামুখে দেখা দেয় একটা অপমৃত্যুর বিভীষিকার ছায়া। আর সেখানে দু-শো বছরের পুরোনো বটকে যেন কেউ সমূলে উপড়ে ফেলেছে, সেখানে খাঁ খাঁ করে একটা বিরাট শূন্যতার গহর। সেখানকার সন্ধের নিশাচর বাদুড়েরা গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে আর কোনো কচি কচি গলার সুরে শোনে না,

বাদুড় ভাই, বাদুড় ভাই, তুমি আমার মিতা,
আমারে ফেলাইয়া যে ফল খাবা,
সে ফল তোমার তিতা তিতা তিতা!

সত্যি, আমার গাঁয়ের প্রিয় পশুপাখিরা কীভাবে আমাদের কথা, তারা কি আজও মনে রেখেছে আমাদের? আমরা যে কিছুতেই ভুলতে পারি না তাদের, ভুলতে পারি না আমার গাঁয়ের সে মাটি, সে জল, সে গাছপালা ও সে মিষ্টি বাতাসকে! আবার কবে ফিরে যেতে পারব তাদের মধ্যে?

.

নলচিড়া

‘মোট ক্ষতির পরিমাণ কত?’ প্রশ্ন করেছেন সরকার। উদবাস্তু শরণার্থীদের ছেড়ে-আসা ভিটেমাটিতে মোট ক্ষতির পরিমাণ কত তা জানাতে হবে সরকারকে। গণিতের হিসেবে চিরকাল আমি কাঁচা। সাহায্য নিয়েছিলুম কোনো বন্ধুর। সত্যি, কত নম্বর মৌজায়, কত নম্বর খেবটে আমার কী ধরনের স্বত্ব, সে-খবর কোনোদিন রাখিনি। আমার সম্পত্তির অবস্থান এবং আমার স্বত্ব বোঝাতে গেলে যতখানি জ্ঞানবুদ্ধি প্রয়োজন, আমার তা কোনোদিনই ছিল না। কিন্তু গোটা নলচিড়াকে এত ভালো করে চিনি যে তার সম্পর্কে কিছুমাত্র ভুল হয় না।

আড়িয়ালখাঁর দক্ষিণ তীরে সাহেবের চর থেকে আমাদের এই গ্রামের পত্তন। সদর থেকে মাইল কুড়ি উত্তরে। পড়শি গ্রামের সঙ্গে আমাদের সীমানা ছোটোখাটো নিশানা দিয়ে। আমাদের গ্রাম থেকে মাহিলাড়া পেরিয়ে অশ্বিনী দত্তের বাটাজোড় মাইল পাঁচেক হবে। অনেক উপলক্ষ্যেই যাওয়া হত সেখানে। সবচেয়ে উৎসাহ পেতাম লক্ষ্মীপুজোর দিন জলপদ্ম আনতে গিয়ে। জেলাববার্ডের সড়কে দু-মাইল এগিয়ে একটা সোতা পেতুম। পার হয়ে বলতুম, পৌঁছোলাম ভিন গাঁয়ে। এমনি সব সীমানা।

একেবারে অচিন গাঁয়ের অধিবাসী আমরা নই। তিমির তীর্থের সাহিত্যিক যে দেশের মাটিতে প্রণাম রেখেছেন, সে আমাদের সবার তীর্থভূমি। বাইরের সঙ্গে তাঁর গ্রামকে একালে তিনিই যুক্ত করে দিয়েছেন। আমাদের ইতিহাসের কথা আমরা মুখে মুখে রক্ষা করেছি। সংস্কৃতচর্চার একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল নলচিড়া। এক ভটচায্যি বাড়িতেই চোদ্দোটি টোল ছিল। নবদ্বীপে না গিয়ে অনেকে আসতেন এ গাঁয়ের দিগবিজয়ী পন্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কাছে। বিশেষ করে তাঁরই গৌরবে নলচিড়া ‘নিম্ন-নবদ্বীপ’ বলে খ্যাতি পেয়েছিল। গোটা গোটা আমলকীর লোভে আমরা যেতুম ‘নাক কাটা বাসুদেব’-এর বাড়ি। ও বাড়ির পুকুর পাড়ে একটি খন্ডিত বাসুদেব মূর্তি ছিল। শুনেছি নলচিড়ার এমন আরও কয়েকটি শিলামূর্তি এবং শিলালিপি ঢাকা মিউজিয়মে রক্ষিত হয়েছে। এসব অতীত ইতিহাস নিয়ে গৌরব করতাম। কিন্তু যে ক্ষতি সহ্য করছি তা প্রকাশের মতো ভাষা কোথায়? আমাদের সর্বাঙ্গে মাখানো থাকত গ্রাম-মায়ের স্নেহের পরশ। এখনও মাঝে মাঝে হাবার মতো কলকাতার রাজপথে তাই খুঁজে খুঁজে বেড়াই।

সদর থেকে ডিঙিনৌকা অবশ্য বাড়ির ঘাটেই পৌঁছে দিত। কিন্তু ‘গয়না’-র নৌকা দাঁড়াত শিববাড়ি ঘাটে। সমস্ত গ্রামখানার মধ্যে এই এলাকাটুকুরই একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। একটি শিবমন্দির, খানকয়েক মুদি দোকান, একটি ডাকঘর এবং একটি পাঠাগার। এর যেকোনো একটিকে উপলক্ষ্য করেই গাঁয়ের লোক এখানে জড়ো হতেন, রসিকজন বিনা উপলক্ষ্যেও আসতেন। শিবমন্দিরটির মূলকাঠামো জ্যান্ত বটগাছের না ইটপাথরের বোঝা যেত না। ছেলেদের বসবার জায়গা ছিল ওর ফলন্ত ডালগুলো আর না হয় গাছটার বাড়ন্ত শিকড়গুলো। বুড়োরা এ খালপারের তেঁতুল গাছটিকে নিষ্ফলাই বলতেন। ছেলেদের দৌরাত্মে এর ফলের মাহাত্ম্য তাঁরা টের পেতেন না। মুদি দোকানের বৈঠক কখনো ক্ষান্ত হতে দেখিনি। গ্রামের সালিশি থেকে আরম্ভ করে কীর্তনের মহড়া সবই চলত এইখানে। গ্রামের সব কথার মোহানা এই শিবতলায়। বিকেলের দিকে অনেকে বসতেন পাঠাগারের সামনে। দু-দিনের বাসি খবরের কাগজ পৌঁছোত। আর তাই নিয়েই চলত যত পঠনপাঠন সমালোচনা।

মহেন্দ্রস্মৃতি পাঠাগারের বর্তমান বয়েস বারো-চোদ্দো বছরের বেশি নয়। গ্রাম ছেড়ে আসার দিনও দেখেছি হাজার দেড়েক বই এবং আনুষঙ্গিক সব কিছু নিয়ে সার্থক হয়ে উঠেছে। পাঠাগারটি। কোনো বিশেষ একজন এ প্রতিষ্ঠান গড়ে দেননি, এটি ছিল সর্বজনের হাতে গড়া। একে কেন্দ্র করেই আমরা ছেলের দল গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখতুম, ছোটোখাটো সড়ক বাঁধতুম। ছোটোবেলা থেকেই ‘সরকারের দিঘি’-র পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে একটা ‘কঙ্কালঘর’ দেখতুম। এটাই ছিল বিবেক আশ্রম। শংকর মঠ’-এর আদর্শে ধর্মচর্চার জন্যে এর পত্তন করলেন শচীন কর। তারপরে এল শরীরচর্চা। তারপর সারাদেশের সঙ্গে সৎ ও শক্ত আশ্রমবাসীরা দীক্ষা নিলেন অগ্নিমন্ত্রে। রায়ের ভিটা’-র জঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত হল মহেন্দ্র রায়ের বোমার উৎসভূমি। এর পরের কাহিনি গল্পের মতো। শেষপর্যন্ত মহেন্দ্র রায় ধরা পড়লেন মেছোবাজার বোমার মামলায়। কারাগৃহেই তাঁর প্রাণ গেল। …একদিন হঠাৎ স্কুলের মাঠ থেকে সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে এলেন মন্তুদা ‘সরকারের দিঘি’-র পাড়ে। কাঠামোটা না ভেঙে আমরা সবসুদ্ধ আশ্রমগৃহটি মাথায় করে নিয়ে এলুম শিববাড়ি। এ দৃশ্যটি আজও মনে পড়ে। এইটেই আমাদের মহেন্দ্র পাঠাগার। বড়ো পাঠাগার আরও দুটি আছে–একটি নিম-নদিয়া গ্রন্থাগার আর একটি ইউনিয়ন বোর্ডের লাইব্রেরি।

এখন আর একটি কথা ভাবতে বুকটা ফুলে ওঠে। আমাদের চন্ডীমন্ডপে একটি খুঁটির সঙ্গে বড়ো একটা পেরেক ছিল। ন্যাশনাল স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড টাঙানো হত ওইখানে। দুর্গাঠাকুর রং করবার সময় সমস্ত রঙের সেরা রক্তচিহ্ন রেখে দিতুম ওই পেরেকটির চারদিকে একেবারে ছোটোবেলা থেকে। দশভুজার মন্ডপে ওই শক্ত মানুষগুলোকেই মানাত।

ডাকঘরের কথা বলছিলুম। আমরা ছোটোবেলা থেকে ওই ঘরটি একজনের তত্ত্বাবধানেই দেখেছি। এর ‘প্রবেশ নিষেধ’-এর সতর্কবাণীটি অনেককালই মুছে গিয়েছিল। দেখো তো মাস্টার’, বলে মনি অর্ডার প্রত্যাশী অনেকেই ঘরে ঢুকে পড়তেন। ঘরের কর্তা আপত্তি করতেন না।

শিববাড়ির কাছেই নলচিড়া স্কুল। পাশাপাশি চারটি গ্রামের ছেলেদের নিয়ে এ অঞ্চলে এই প্রথম ‘হাই স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। প্রায় চল্লিশ বছর আগে ডাক্তার সুরেন্দ্রনাথ সেন এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর অবশ্য আলাদা আলাদা স্কুল হয়েছে। আমাদের আমলে বিজ্ঞান আবশ্যিক পাঠ্য হল। উদ্ভিদ এবং প্রাণীবিদ্যার আংশিক সরঞ্জাম গ্রামেই জুটে গেল। পদার্থ রসায়নের কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তাগিদে। সারাবছর ধরে দেখলাম ওর আলমারি তালাবন্ধই থাকল চাবি খারাপ বলে। ওর একটা জিনিস নষ্ট হলে নলচিড়া স্কুলের পক্ষে যে ভারি বিপদের কথা!

‘সরকারের দিঘি’-র উত্তর-পূর্ব কোনায় জলের মধ্যে অবিরত বুদবুদ উঠত। ওই নিয়ে অনেক কাহিনি আমরা ছেলেবেলায় শুনতাম। তারপর স্কুলে নলকূপ বসাতে গিয়ে গন্ধকের সন্ধান পাওয়া গেল মাটির তলায়। নলকূপের গর্তটার মুখে ফুটো সরা বসিয়ে দেশলাই জ্বেলে দিতুম। খুব জোরে হাওয়া না দেওয়া পর্যন্ত নীল আলো জ্বলত। শাপলার ডাঁটা দিয়ে ওই আলো আমরা স্কুল অবধি নিয়ে যেতুম। অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট বিমলদা আমাদের সব পাগলামোর বুদ্ধি জোগাতেন। ভূতুড়ে ব্যাপারটির কিছু হদিশ মিলল বটে। কিন্তু খুব আতঙ্ক এল সবার মনে। গন্ধকের খনি ফেটে নলচিড়া উড়ে যাবে, নয়তো সরকার গন্ধক তুলতে গিয়ে গ্রাম উঠিয়ে দেবেন। বৃদ্ধদের পরামর্শে গর্তের মুখে মাটি চাপা দিতে হল।

আমাদের বাঁশতলার নতুন আমগাছে আষাঢ় মাসে ফল ধরল। জ্যাঠাইমা প্রথম ফলটি দিয়ে পাঠালেন কুতুব শার দরগায়। বড়ো হয়ে দেখেছি গ্রামসুদ্ধ লোক প্রথম ফসল উৎসর্গ করেন ওই দরগার কুতুব শার আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। ওই দরগায় একখানা পাথরখন্ডের তলা থেকে কুতুব শার আজান শুনতাম আমরা। কাজে-অকাজে আমাদের ডাক পড়ত। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ওই দরগায় বিরাট মেলা বসত। খেতের ফসল, গাছের ফলমূল, গাই-এর দুধ, যে-যেমন পারত নিয়ে আসত। সব মিলিয়ে জ্বাল দেওয়া হত বিরাট একটা মাটির পাত্রে। ওই প্রসাদ সবাই নিত অসংকোচে। বিজয়া এবং রাসপূর্ণিমার পরদিন ‘সন্তেশ (সন্দেশ)-কলা’ পেতে এবং রাধাকৃষ্ণের দেহাবশেষ’ কুড়োতে আসত হিন্দু-মুসলমান সব ছেলে-মেয়ে।

প্রত্যক্ষ দেবতার ঠাঁইতে পৌঁছেলেই হাতদুটো আপনার থেকেই যুক্ত হয়ে আসত। ঠাকুরের খোলা, রক্ষাচন্ডীর খোলা, হরগৌরীর ভিটে এসবের কথা মনে দাগ কেটে আছে। দেবীদাস বকসির কালীমার ভোগের ‘পাথর’ পুকুরে পড়েছিল কয়েক পুরুষ আগে। পুকুর। সংস্কার করতে গিয়ে এক এয়োতির হাতে পড়ল ওই থালা। মা স্বপ্ন দেখালেন। মানল না ও। তিনরাত না পোয়াতে পরিবারসুদ্ধ নিশ্চিহ্ন হল! প্রতিটি দেবতাকে কেন্দ্র করে এমনি সব অতীত ও চলতি কাহিনির অন্ত ছিল না। অলীক হলেও এসবে লোকের অবিশ্বাস নেই!

‘কালীসাধক মঠে’-র ঠাকরুনকে ভারি ভয় করতুম। বাড়িতে এলে মাঝ উঠোনে উনি বসতেন। বাড়িসুদ্ধ লোক পায়ে পড়ে প্রণাম করতাম। ছোটোবেলা থেকে ওঁকে একইরকম দেখেছি। মাঝে মাঝে ওঁর শিষ্যদের কাছে আমাকে দিয়ে চিঠি লেখাতেন। অরণ্যে রোদন’ কথাটি ব্যবহার করতে হত অনেকবার।

ঠাকরুনের কালীসাধনার গান শুনে ভয় লাগত। কিন্তু লক্ষ্মীকান্তের পদাবলি গান আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ওঁর চওড়া বুকখানায় অনেকগুলো পদক শোভা পেত। বাংলার জেলায় জেলায় তিনি সম্মান পেয়েছেন। গ্রামে একবার ওঁর কীর্তন হলে অনেকদিন ধরে আমাদের মুখে মুখে তার অনুসরণ চলত-শোনো বুড়িমাই, তোমাকে জানাই আমার মরম কথা। লক্ষ্মীকান্তের মৃত্যুর পরেও এই কীর্তনের দল ভেঙে যায়নি। এই সঙ্গে মনে পড়ে বৈকুণ্ঠ ঢুলিকে। কোনো এক উৎসবে মাছরঙের বিখ্যাত বাজনদাররা এসেছেন। আসর খুব জমে উঠেছে। বৈকুণ্ঠ ঢুলি হাতজোড় করে বললেন,–একটি টোকা কম পড়ছে। পরে দেখা গেল ওর বাঁ-হাতের একটি আঙুল কাটা। পরদেশি বাজনদার গুরু বলে মেনে নিল বৈকুণ্ঠকে। ভ্রমর বয়াতির জারিগান শুনতে চারপাশের গ্রাম পর্যন্ত ভেঙে পড়ত। বাঁশের সাঁকো সেদিন শিথিল হয়ে যেত।

কালী পুজোর পর দু-দিন ধরে দত্তবাড়ি এবং পালবাড়িতে যাত্রাগান হত। ভোরে উঠে আগের দিনের প্রসাদ নিয়ে হাজির হতুম। দু-বাড়ির আসর এবং সাজঘর সব আমাদের দেখা চাই। আসরের মহারানি সাজঘরে বিড়ি খাচ্ছেন, এইটে দেখার খুব আগ্রহ ছিল আমাদের। আমাদের গ্রামেও যাত্রার দল ছিল। প্রথম অভিনয়ের পরেই ওর অভিনেতাদের নতুন নামকরণ হয়ে গেল। পুজোর পর কালীপুজো অবধি পর পর থিয়েটার চলত। ওই কটা দিন গ্রাম থাকত কোলাহলমুখর! প্রবাস থেকে আসত মানুষ, মফসসলের জমিন থেকে আসত ফসল।

রাধা করাতির নীল পুজোর গান আমাদের মুখস্থ ছিল। মহাদেব-গৌরীর পেছন পেছন আমরা ছুটতুম এই বলে,–‘শঙ্খ পরিতে গৌরীর মনে হইল সাধ।’ সন্ন্যাসের দিন আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। বাস্তুপুজো উপলক্ষ্যে আমরা গান গেয়ে ভিখ নিতুম—’আইলাম লো শরণে, লক্ষ্মীদেবীর বরণে।’ ‘বারোবাঘের লেখাপড়ি’ আমরা খুশিমতো রচনা করতুম। সারাবছর যাঁদের ওপর রাগ থাকত বাঘ বানাতুম তাঁদেরই। দোলপূর্ণিমার আগের দিন ‘বুড়ির ঘর’ পোড়ানো ছিল সবচেয়ে মজার ব্যাপার। সহজদাহ্য সব কিছু লাগত আমাদের এ ‘উৎসবে’। বাগান সাফ হয়ে যেত। বুড়ির ঘরের উচ্চতার পাল্লা দেখে বৃদ্ধরা শিউরে উঠতেন, বলতেন, ‘শেষে এক কান্ড বাধিয়ে বসবি!’

চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে সপ্তাহখানেক ধরে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসত। মেলা বুঝে আমাদের ‘থৌল-খরচ’ বরাদ্দ ছিল। দক্ষিণপাড়ায় কালীতলার মেলায় মা-জ্যাঠাইমারাও যেতেন। বছরের মশলাপাতি কেনা হত ওইখানে। বছরের পয়লা আমাদের একটা বার্ষিক কর্ম ছিল। গানের বৈঠক বসত।

দেশভাগের কয়েক বছর আগে কলকাতায় নলচিড়া সম্মিলনী গ্রামের সমস্ত কল্যাণকর্মের দায়িত্ব নিল। ষোলো বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে শচীন কর সংগঠনের কাজে লেগে গেলেন। সাহেবের চরের বিশ্রামাগার, মেয়েদের হাই স্কুল, মেয়েদের কংগ্রেস, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র সব গড়ে উঠল। ভেঙেও পড়ল সব কটি বছরের মধ্যেই! রাষ্ট্রদ্রোহী’ শচীন করকে যথাকালে পালিয়ে আসতে হল। স্কুল বিল্ডিং ফাণ্ডের টাকা সেদিন ফিরিয়ে দেওয়া হল। একটি অবৈতনিক পাঠশালা গড়ে উঠেছিল। মাস কয়েক ওতে পড়িয়েছিলুম। ছুটির সময় হলে ছেলেরা বলত, ‘মাস্টারমশায়, জল খেয়ে আসি-ই।’ সে স্মৃতিটুকু সোনা হয়ে রয়েছে।

দেশভাগের পরেও অনেকদিন আদর্শ পাঠশালা, মহেন্দ্র-স্মৃতি পাঠাগার এবং রেডক্রস নিয়ে মেতেছিলুম। একদিন তাড়াহুড়ো করে সব ছেড়ে চলে আসতে হল। সন্ধেবেলা এলাম সাহেবের ঘাটে। স্টিমার এল শেষরাতে। অতক্ষণ আমি কী করেছি? সে সময়কার মনের অবস্থার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। বোধহয় ফাঁসির আগের রাতে অমন হয়।

সেদিন কলকাতায় আমাদের গ্রামের পোস্টমাস্টারমশায়ের সঙ্গে দেখা! উনি আমাদের স্কুলেরও মাস্টার ছিলেন। এক কোম্পানিতে কেরানির কাজ করছেন এখন। সেদিন ওঁর অফিসে গিয়ে দেখি পুরোনো সমস্ত কাগজপত্রে লাল কালির দাগ দিয়ে রেখেছেন, বললেন,–ইংরেজি ভুল। ডিগ্রিবিহীন এ সনাতন শিক্ষকটির স্থান কোথায়?

অগোছালো কথা এখানেই শেষ করি। …বেশি ভাড়া দিয়ে একদিন এক্সপ্রেস বাসে ওঠা গেল। প্রচন্ড বর্ষা। এমনিতেই সতর্কবাণী–বাইরে হাত দিয়ো না। সাবধানিরা জানলার কপাট তুলে দিলেন। ইচ্ছে করেই দাঁড়ালুম পা-দানির ওপর। হঠাৎ একটা স্মৃতির বিদ্যুৎ খেলে গেল মনের আকাশে ভাদ্রমাসে একটা ভরা খাল দিয়ে বাইচের নৌকা বেয়ে চলেছি। বাঁ-হাতে আর পায় ঠেকিয়ে বইঠা, ডান হাতে টেনে তুলছি কলমি শাকের ফুল। বুকটা মোচড় খেয়ে উঠল। অবাক হয়ে ভাবলুম, তাহলে আমার মোট ক্ষতির পরিমাণ কত?

3 Comments
Collapse Comments
সুব্রত রায় চৌধুরী August 17, 2022 at 8:11 am

আমার পিতামহ,মাতামহ রে স্থানে জন্মগ্ৰহণ করেছেন,বড়ো হয়েছেন সেই বরিশাল নামক স্থান কে আমার প্রণাম জানালাম।

মোঃ আবুল হোসেন February 3, 2024 at 10:41 am

আমার বাড়ী চাখার, আপনি বর্তমানে কোথায় থাকেন? বরিশালে বেড়াতে আসে না।

মোঃ আবুল হোসেন February 3, 2024 at 10:38 am

আমার বাড়ী চাখার, স্বেচ্ছায় কি ছেড়ে গেছেন না কেউ দখল করে নিয়েছে সর্বত্র সম্বলটুকু

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *