২৫. গণিকাগমন এবং গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডস

২৫. গণিকাগমন এবং গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডস

আগের অধ্যায়ে আলোচনা করেছি ব্রিটিশ-ভারতে অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবনে কীভাবে মানুষের মধ্যে যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় যৌনরোগের এতটাই প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যে, সকলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এই ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। ব্রিটিশ আমলের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে কি অবস্থা ছিল ওই সময়। দেবাশিস বসুর ‘কলকাতার যৌনপল্লী’ থেকে জানা যায়—১৮৫৩ সালে কলকাতা শহরে ৪০৪৯ টি গণিকালয় ছিল, যাতে বাস করছিলেন ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। ১৮৬৭ সালে ছিল ৩০,০০০ জন। ১৯১১ সালের আদশুমারি অনুযায়ী ১৪২৭১ জন। ১৯২১ সালের আদমশুমারিতে অনুযায়ী ১০,৮১৪ জন যৌনকর্মী ছিল কলকাতায়। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হবে। বিনয় ঘোষ তাঁর কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’-এ লিখেছেন—কলকাতায় খুবই রমরমা ছিল গণিকাদের জগৎ। গৃহস্থের বাড়ির পাশে গণিকা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে গণিকা, চিকিৎসালয়ের পাশে গণিকা, মন্দিরের পাশে গণিকা। বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স এগুলো ছিল গণিকাদের আখড়া। এমনকি কিছু গণিকা শহরে প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য পর্যন্ত করত। সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে আবেদন করা সত্ত্বেও এর কোনো প্রতিকার হয়নি। কারণ কলকাতায় পুলিশ ধনীদের তৈরি গণিকালয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেত না। শুধুমাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতায় একটি এলাকাতেই ৪৩টি গণিকালয়ের মালিক ছিলেন।

অবাঞ্ছিত, অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন অতিবাহিত করার ফলে যে যে যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়ছিল, সেগুলি হল–গনোরিয়া, সিফিলিস, জেনিটাল হার্পিস, এইডস, ক্লেমিডিয়া, শ্যানক্রয়েড, জিকা ভাইরাস ইত্যাদি।

গনোরিয়া : গনোরিয়া আছে এমন কারোর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হলে গনোরিয়া হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের শরীরে এই জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। পুরুষ ও নারী, বিশেষ করে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিরা গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয় বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিবারণ কেন্দ্র (সিডিসি)। গনোরিয়া হলে মূত্রত্যাগের সময় জ্বালাপোড়া ও যৌনাঙ্গ দিয়ে সাদা, হলুদ ও সবুজ স্রাব বের হতে পারে।

সিফিলিস : গনোরিয়ায় মতো সিফিলিসের জীবাণুও মা থেকে নবজাতকের দেহে ঢুকতে পারে। চিকিৎসা না করালে সিফিলিস থেকে দীর্ঘমেয়াদে জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে সিডিসি। সিফিলিসের লক্ষণ প্রাথমিক পর্যায়ে যন্ত্রণা ও চুলকানিবিহীন ক্ষত হতে পারে, দ্বিতীয় পর্যায়ে মুখ, যোনি কিংবা মলদ্বারে ব্যাশ বা ক্ষত হতে পারে। শেষ পর্যায়ে প্যারালিসিস থেকে অন্ধত্ব, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

জেনিটাল হার্পিস : যৌনকাজে সক্রিয় যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্তদের অনেকের শরীরে এই রোগের লক্ষণ দেখা যায় না। অর্থাৎ কারও শরীরে এই রোগের লক্ষণ না-থাকলেও তিনি সঙ্গীর দেহে এটি ছড়িয়ে দিতে পারেন। লক্ষণগুলো হল–যৌনাঙ্গ, মলদ্বার ও মুখে একটি বা দুটি ফোস্কা পড়তে পারে। সেগুলো ভেঙে গিয়ে ব্যথা হতে পারে। সেই ব্যথা সারতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।

এইচআইভি/এইডস : যাঁদের সিফিলিস, গনোরিয়া ও হার্পিস আছে তাঁদের ভবিষ্যতে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ রোগগুলো একইরকম যৌন আচরণের জন্য হয়ে থাকে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম দুটি কারণ হল কন্ডোম ছাড়া যৌনমিলন এবং একাধিক ও অপরিচিত কারও সঙ্গে মিলন। তবে এইচআইভিতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি বা কোনো এইডস রোগীর রক্ত আপনার শরীরে ঢুকলেও এই রোগ হয়। এইডস (Acquired Immuno Deficiency Syndrome) বা অর্জিত প্রতিরক্ষার অভাবজনিত রোগলক্ষণসমষ্টি হচ্ছে এইচ.আই.ভি. (Human Immunodeficiency Virus) তথা মানব প্রতিরক্ষা অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস’ নামক ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট একটি রোগলক্ষণসমষ্টি, যা মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা তথা অনাক্রম্যতা হ্রাস করে। এর ফলে একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যা শেষপর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারে।

এইচ.আই.ভি. সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই সর্বদা এইডস হয় না। শুরুতে ক্ষেত্রবিশেষে ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এরপর বহুদিন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। এইচ.আই.ভি. ভাইরাসের আক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র বা অনাক্রম্যতন্ত্র দুর্বল হতে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ সংক্রামক ব্যাধি যেমন যক্ষ্মায় যেমন আক্রান্ত হতে পারেন, তেমনই সুযোগসন্ধানী সংক্রামক ব্যাধি এবং অবুদ বা টিউমারের শিকার হতে পারেন, যেগুলি কেবলমাত্র সেসব লোকেরই হয়, যাঁদের দেহের অনাক্রম্যতন্ত্র (বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা) কাজ করে না। এইচ.আই.ভি. সংক্রমণের এই পর্যায়টিকেই এইডস বলা হয়। এই পর্যায়ে প্রায়শই রোগীর অনিচ্ছাকৃতভাবে ও অত্যধিক পরিমাণে ওজন হ্রাস পায়।

যেহেতু একবার সংক্রামক এইচ.আই.ভি. শরীরে ঢুকলে তাকে পুরোপুরি দূর করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, তাই এইচ.আই.ভি. সংক্রমণ হলে এইডস প্রায় অনিবার্য। তবে বিনা চিকিৎসায় এইডস পর্যায়ে পৌঁছোতে যদি লাগে গড়ে দশ বছর, তবে চিকিৎসার দ্বারা তাকে আরও কিছু বছর পিছিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ‘HAART নামে এইডসের যে সমন্বিত ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, তা অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ৩ কোটি ৬৭ লক্ষ লোক এইচ.আই.ভি দ্বারা আক্রান্ত ছিল এবং ওই বছর এইডসের কারণে ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। তবে ২০১৬ সালে ২০১৫ সালের তুলনায় নতুন এইচআইভি সংক্রমণের সংখ্যা ৩ লক্ষ কম ছিল। বেশির ভাগ এইডস আক্রান্ত রোগীই সাহারা-নিম্ন আফ্রিকাতে বাস করে ১৯৮০-র দশকের শুরুতে রোগটি চিহ্নিত করার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বব্যাপী এইডস রোগে মোট আনুমানিক ৩ কোটি ৫০ লক্ষ লোক মারা গেছে। এইডসকে বর্তমানে একটি মহামারী ব্যাধি হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বিশ্বের বিশাল এক আয়তন জুড়ে বিদ্যমান এবং যা সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এইচআইভি ভাইরাসটি সম্ভবত ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে বা বিংশ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিম-মধ্য আফ্রিকাতে উৎপত্তিলাভ করে। ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি সর্বপ্রথম রোগটি শনাক্ত করে এবং তার পরে ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকে এই রোগের কারণ হিসেবে এইচআইভি ভাইরাসকে শনাক্ত করা হয়। সিডিসির (রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র, যুক্তরাষ্ট্র সরকার) ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে এইচ.আই.ভি. আক্রান্তের ৭০ শতাংশই সমকামী এবং উভকামী পুরুষ।

ক্লেমিডিয়া : পুরুষ ও নারীর উভয়েরই এটি হতে পারে। নারীর গর্ভধারণ ক্ষমতায় স্থায়ী সমস্যা তৈরি করতে পারে ক্লেমিডিয়া। এই রোগের একবার চিকিৎসা হলেও পরবর্তীতে আবারও এটি হতে পারে। এমনটি হল নারীদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক অথবা অনিয়মিত ঋতুস্রাব, মূত্রত্যাগের সময় জ্বলাপোড়া হতে পারে। পুরুষের বেলাতেও প্রায় একই ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়।

শ্যানক্রয়েড : শ্যানক্রয়েডের ফলে যৌনাঙ্গে যন্ত্রণাদায়ক ঘা দেখা দেয়। যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি বেশি দেখা যায়। এর সঙ্গে যৌনকর্মীদের একটি সম্পর্ক রয়েছে, কারণ দেখা গেছে যাদের শ্যানক্রয়েড হয়েছে তাঁরা কোকেন ব্যবহার করেছেন কিংবা গণিকালয়ে গেছেন। উপযুক্ত চিকিৎসা না-হলে রোগাক্রান্তদের পুরুষাঙ্গের ছিদ্র সরু হয়ে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

জিকা ভাইরাস : সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এই রোগের জন্য সাধারণত মশা দায়ী। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি বলছে, যৌন মিলনের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।

নাম ছিল বুলাদি। পদবির বালাই ছিল না মাঝবয়সি মহিলার। ১০৯৭ নম্বরে ফোন করলে কথা বলতেন তিনি। এক দশক আগে টিভি থেকে শুরু করে খবরের কাগজ কিংবা রেডিয়ো অথবা হোর্ডিং—সব ধরনের গণমাধ্যমে দেখা যেত বুলাদিকে। সরকারি এই অ্যানিমেটেড চরিত্রটি এইচআইভি আর এইডস সংক্রমণ নিয়ে অবিরাম সচেতনতার বার্তা বিলিয়ে চলতেন ১৯৯৮ সাল থেকে। গণিকালয়ে পৌঁছে যদি দেখত সঙ্গে কন্ডোম নেই, তাহলে যৌনকর্মীর কাছে না-গিয়ে বলা হচ্ছিল–“চলো, এক দান লুডো খেলি”। কিন্তু গত আট বছরে আর দেখা যায়নি তাঁকে। ২০০৮ থেকে আচমকাই গায়েব হয়ে গিয়েছেন ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’-র মোড়কে পেশ করা রাজ্য এইডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সমিতির (স্যাক্স) ওই দূতকে।

ন্যাকো (ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন)-র এক কর্তার বক্তব্য, সরকারি হিসাব অনুযায়ী এ রাজ্যে ১.২৫ লক্ষ (দেশে ২১ লক্ষ) এইচআইভি পজিটিভ রোগী থাকার কথা। কিন্তু সরকারি খতিয়ান বলছে, এ যাবৎ মাত্র ৬২ হাজার রোগী চিহ্নিত হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে ৫৬ হাজারকে আনা গিয়েছে সরকারি চিকিৎসার (অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল থেরাপি বা এআরটি) আওতায়। বাদ বাকি রোগীদের চিহ্নিত করে এআরটি-র আওতায় আনাই এখন প্রধান লক্ষ্য সরকারের। ওই কর্তার কথায়—নানা ফাঁকফোকরের কারণেই সব রোগীর নাগাল এখনও পাওয়া যায়নি। সেই ফাঁকগুলো মেরামত করে রোগী চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াগুলো আরও জোরদার করতে চায় সরকার। হয়তো সেই কাজেই লাগানো হবে বুলাদিকে। স্যাক্সের প্রকল্প অধিকর্তা পৃথা জানান, ২০৩০-এর মধ্যে দুনিয়াকে এইচআইভি মুক্ত করার যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সেইমতো সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হল মা-বাবার শরীর থেকে সন্তানের রক্তে এইচআইভি সংক্রমণ ঠেকানোনা। কিন্তু নিজেরাই এইচআইভি সংক্রামিত, সেই তথ্যই যদি মা-বাবা নিজেরা না–জানেন, তা হলে সন্তানের শরীরে সংক্রমণ ঠেকানো মুশকিল। তাই যাঁদের এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তাঁরা যাতে আইসিটিসি-তে (ইন্টিগ্রেটেড টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং সেন্টার) নিজে থেকে গিয়েই রক্তপরীক্ষা করান, তার প্রচারে জোর দেওয়া হচ্ছে। অবশেষে কন্ডোমের প্রবেশ মানুষের যৌনজীবনে এনে দিল উদ্দাম বিলব। কন্ডোম (Condom) প্রধানত যৌনসঙ্গমকালে ব্যবহৃত এক প্রকার জন্মনিরোধক বস্তু। এটি মূলত গর্ভধারণ ও গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইচআইভির মতো যৌনরোগের প্রতিরোধক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি পুরুষদের উত্থিত পুরুষাঙ্গে পরানো হয়। রেতঃস্থলনের পর কন্ডোম যৌনসঙ্গীর শরীরে বীর্য প্রবেশে বাধা দেয়। এর ফলে সরাসরি যোনি ও লিঙ্গের চামড়ার সংস্পর্শ হয় না। কন্ডোমের উপাদান দুই শরীরের মাঝে সূক্ষ দেয়াল তুলে ধরে।

আধুনিক যুগে কন্ডোম মূলত তরুক্ষীর থেকে প্রস্তুত করা হয়। তবে কনডম তৈরি ক্ষেত্রে অনেক সময় পলিআরথিন, পলিইসোথ্রিন বা ল্যাম্ব ইনসেসটাইনও ব্যবহৃত হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসাবেই কন্ডোম আবিষ্কারের প্রধান উদ্দেশ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে যা ভয়ংকর যৌনরোগ প্রতিরোধের জন্য আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। কন্ডোম অত্যন্ত সুলভ, সহজে ব্যবহার্য, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত ও যৌনব্যাধি প্রতিরোধে সর্বাধিক কার্যকর।

কন্ডোম প্রায় ৪০০ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই কন্ডোম ব্যবহার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় জন্মনিরোধ পদ্ধতি। আধুনিক সমাজে কন্ডোমের ব্যবহার ব্যাপক মান্যতা লাভ করেছে। প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে কন্ডোমের ব্যবহার প্রচলিত ছিল কি না তা নিয়ে পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ যথেষ্ট। প্রাচীন মিশর, গ্রিস ও রোমে গর্ভাধান রোধ নারীর দায়িত্ব হিসাবে পরিগণিত হত। এই সব দেশ থেকে সে সমস্ত সুলিখিত প্রাচীন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিবরণীগুলি পাওয়া গেছে, সেগুলিতে মূলত নারী-নিয়ন্ত্রিত গর্ভনিরোধ বস্তুগুলিরই উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে কিছু শিশ্নাগ্র কনডমের ব্যবহারের কথা জানা যায়। এগুলি প্রধানত পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগকে ঢেকে রাখত। কন্ডোমের প্রচলন মূলত সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের মধ্যেই পরিলক্ষিত হত। চিনে শিশ্নাগ্র কন্ডোম তৈরি হত তৈলনিষিক্ত রেশমি কাগজ বা ভেড়ার অন্ত্র দিয়ে। জাপানে কন্ডোম তৈরি হত কচ্ছপের খোল বা জন্তুর শিং দিয়ে।

ষোড়শ শতাব্দীর ইতালিতে গ্যাব্রিয়েলে ফ্যালোপিও সিফিলিস রোগের উপর একখানি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেন। সেই সময়কার লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায় যে ১৪৯০-এর দশকে সিফিলিস একটি ভয়ানক রোগের আকারে প্রকট হয়েছিল। রোগাক্রান্ত হওয়ার মাস কয়েকের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটত। ফ্যালোপিওর গবেষণা গ্রন্থটি কন্ডোম ব্যবহারের প্রাচীনতম অবিতর্কিত বিবরণ। এই বর্ণনা অনুযায়ী, একটি ক্ষৌমবস্তুনির্মিত খাপকে একটি রাসায়নিক দ্রবণে ডুবিয়ে রাখা হত এবং ব্যবহারের পূর্বে সেটি শুকিয়ে নেওয়া হত। বর্ণনা অনুযায়ী এক কাপড়টি কেবলমাত্র শিশ্নাগ্রভাগকেই ঢেকে রাখত এবং একটি রিবন দিয়ে এটিকে বেঁধে রাখা হত। ফ্যালোপিও দাবি করেন, ক্ষৌমবস্ত্রাকার খাপের একটি পরীক্ষামূলক ব্যবহার ঘটিয়ে দেখেছেন যে এর মাধ্যমে সিফিলিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

এর পর থেকে সমগ্র ইউরোপে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত নানা রকম পুরুষাঙ্গ-আচ্ছাদনী রোগ প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৬০৫ সালে রচিত ‘De iustitia et iure’ (বিচার ও আইন প্রসঙ্গে) নামে একটি ধর্মীয় গ্রন্থের বক্তব্য থেকে জানা যায়, এই জাতীয় বস্তুগুলি রোগ প্রতিরোধের বদলে জন্মনিয়ন্ত্রক হিসাবেই বেশি ব্যবহৃত হত। এই গ্রন্থের লেখক ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ববিদ লেওনার্দাস লেসিয়াস এগুলিকে অনৈতিক বলে বর্ণনা করেছেন। ১৬৬৬ সালে ব্রিটিশ বার্থ রেট কমিশনের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে এই সময় কন্ডোম ব্যবহারের ফলে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ক্ষৌমবস্ত্রের পাশাপাশি রেনেসাঁর যুগে অন্ত্র ও মুত্রাশয় নির্মিত কনডমের ব্যবহারও প্রচলন লাভ করে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ওলন্দাজ বনিকেরা ভালো চামড়া’ নির্মিত কন্ডোম নিয়ে যায় জাপানে। এই অঞ্চলে পূর্বে ব্যবহৃত শিং-নির্মিত কন্ডোম শুধুমাত্র শিশ্নাগ্রভাগকেই ঢাকত। কিন্তু এই সমস্ত চামড়ার কন্ডোমে সমগ্র পুরুষাঙ্গকে ঢাকার সুবিধা পাওয়া যেত।

অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে আইনজ্ঞ, ধর্মতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকদের একটি অংশ কন্ডোম ব্যবহারের বিরোধিতা করতে থাকেন। সেসময় তাঁরা যে আপত্তিগুলি তোলেন, সেগুলির অনেকগুলি এসময় আজও তোলা হয়ে থাকে। যেমন—কন্ডোম গর্ভাধান সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়, যাকে কেউ কেউ জাতির পক্ষে অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত মনে করেন। এগুলি যৌনরোগ থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করতে অক্ষম, অথচ এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় বিশ্বাস রেখে মানুষ তাঁদের যৌন কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে থাকে। তা ছাড়া অনেকেই নানা ব্যবহায় সংক্রান্ত সমস্যা, চড়া দাম ও ব্যবহারের ফলে কামোদ্দীপনা কমে যাওয়ার জন্য কন্ডোম ব্যবহার এড়িয়ে চলেন। কিন্তু কোনো কোনো মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও কন্ডোমের বিক্রি বাড়তে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন মান ও আকারের কন্ডোম কিনতে পাওয়া যেত। এর মধ্যে যেমন রাসায়নিক মাখানো ক্ষৌমবস্ত্র নির্মিত কনডম ছিল, তেমনই ছিল ‘ত্বক’ ও (সালফার ও লাই মিশ্রিত নরম করা মুত্রাশয় বা তন্ত্র)। সমগ্র ইউরোপে ও রাশিয়ায় পাব, নাপিতের দোকান, ঔষধের দোকান, খোলাবাজার এবং নাট্যশালায় কন্ডোম বিক্রি হত। পরে এগুলি আমেরিকাতেও বিক্রি হতে শুরু করে। তবে সর্বত্রই চড়া দাম, সচেতনতা ও সঠিক যৌনশিক্ষার অভাবে কেবলমাত্র উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের মধ্যেই কন্ডোমের প্রচলন সীমাবদ্ধ থাকল

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে জন্মনিরোধক পদ্ধতিগুলির সঙ্গে সমাজের দরিদ্র শ্রেণি পরিচিত হয়। এই সময়কার জন্মনিরোধক সম্পর্কিত লেখকেরা জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতিগুলিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এযুগের নারীবাদীরা বলতেন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একান্তভাবেই নারীর হাতে থাকা উচিত। তাঁরা কন্ডোম জাতীয় সকল পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত জন্মনিরোধকের বিরোধী ছিলেন। অন্যান্য লেখকেরা লিখেছেন কন্ডোম ছিল দামী ও নির্ভরযোগ্যতাশূন্য। অভিযোগ ছিল এগুলি ছিদ্র হয়ে যেত, শরীরে বাইরে খুলে আসত বা ফেটে যেত)। তবে তাঁরা কতকগুলি ক্ষেত্রে কন্ডোমকে ভালো বিকল্প বলেছেন। যেমন রোগপ্রতিরোধের ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যবহার্য ছিল কনডম। অনেকে আবার অবাঞ্ছিত সন্তান ও যৌনরোগের ভয়ে যৌনসঙ্গম পরিত্যাগ করার পথ বেছে নিতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনীয় কন্ডোম ব্যবহারকে সমর্থন করেনি; বরং এই জাতীয় পোস্টারের মাধ্যমে সবাইকে ব্রহ্মচর্য পালনকে উৎসাহিত করত।

অনেক দেশে কনডম উৎপাদন বা গর্ভনিরোধ ব্যবস্থার প্রসার রোধ করার জন্য আইন পাস করা হয়। কিন্তু এত বাধা সত্ত্বেও ভ্রাম্যমাণ ভাষণ ও সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের কন্ডোমের কথা প্রচারিত হতে থাকে। যে সমস্ত অঞ্চলে এই জাতীয় বিজ্ঞাপন আইনত নিষিদ্ধ ছিল সেখানে শালীনভাবে কন্ডোমের কথা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ঘরে কি করে কন্ডোম তৈরি করা হয় তার নির্দেশিকা বিলি করা হত। সামাজিক ও আইনি প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কন্ডোমই হয়ে ওঠে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর পরার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যৌনরোগীর সংখ্যা অকস্মাৎ অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিকরা এর জন্য আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রভাব ও কমস্টক আইন কর্তৃক প্রচারিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলির প্রতি অজ্ঞতাকে দায়ী করেন। এই ক্রমবর্ধমান মহামারির সঙ্গে যুঝতে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে প্রথম যৌনশিক্ষা পাঠক্রম চালু করা হয়। এই পাঠক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন যৌনব্যাধি ও কেমন করে তা সংক্রমিত হয়, সেই সম্পর্কে পাঠদান দেওয়া হত। তবে যৌনব্যাধি নিয়ন্ত্রণে কন্ডোমের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হত না। কারণ সেযুগের চিকিৎসক মহল ও নৈতিকতার ধ্বজাধারীরা মনে করতেন, যৌনরোগ আসলে যৌন অসদাচারের শাস্তি। যৌনরোগে আক্রান্তদের প্রতি বিদ্বেষ এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, অনেক হাসপাতাল সিফিলিস রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে অস্বীকার করে।

এদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে জার্মান সামরিক বাহিনীতে সেনা জওয়ানদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহারকে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মার্কিন সামরিক বাহিনী কর্তৃপক্ষ একটি পরীক্ষা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে কন্ডোম ব্যবহারের ফলে সেনা জওয়ানদের যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও (কেবলমাত্র যুদ্ধের সূচনাভাগে) ব্রিটেন যুদ্ধের সেনা জওয়ানদের মধ্যে কন্ডোম সরবরাহ বা কন্ডোম ব্যবহার উৎসাহিত করেনি, যুদ্ধের অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সকল রাষ্ট্রই করেছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরও কয়েক দশক সমগ্র ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কন্ডোম ব্যবহারে সামাজিক ও আইনগত বাধা থেকেই যায়। মনস্তত্ত্ব চর্চার প্রবর্তক সিগমুন্ড ফ্রয়েড এই মর্মে সমস্ত প্রকার জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতির বিরোধিতা করেছেন যে, সেগুলির ব্যর্থতার হার ছিল সুউচ্চ। ফ্রয়েড বিশেষভাবে কন্ডোম ব্যবহারের বিরোধিতা করেন। কারণ তিনি মনে করতেন কন্ডোম যৌন উত্তেজনা প্রশমিত করে দেয়। কোনো কোনো নারীবাদীও কন্ডোম সহ সব রকমের পুরুষনিয়ন্ত্রিত জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরোধিতা করতে থাকেন। ১৯২০ সালে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ল্যামবেথ কনফারেন্সে সকল প্রকার ‘Unnatural means of conception avoidance’-এর বিরোধিতা করা হয়। লন্ডনের বিশপ আর্থার উইনিংটন-ইনগ্রাম অভিযোগ করেন যে, গলি ও উদ্যানগুলিতে বিশেষ করে সপ্তাহান্ত ও ছুটির দিনগুলিতে ব্যবহৃত কন্ডোম ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

যদিও ইউরোপীয় সামরিক বাহিনীগুলি রোগ প্রতিরোধকল্পে নিজ সদস্যদের কন্ডোম সরবরাহ করত। এমনকি যেসব দেশে সাধারণের মধ্য কন্ডোমের ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল, সেইসব দেশেও সেনাবাহিনীতে কন্ডোম ব্যবহার করা যেত। ১৯২০-এর দশকে আকর্ষক নাম ও চকচকে মোড়ক ব্যবহার কন্ডোম ও সিগারেটের মতো পণ্য বিক্রির এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়িক কৌশল হয়ে ওঠে। মানপরীক্ষাও প্রচলন লাভ করে। চাপহীনতা পরীক্ষা করার জন্য অন্যান্য সব পদ্ধতির সঙ্গে কন্ডোমে হাওয়া ভরেও পরীক্ষা করা হত। ১৯২০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী কন্ডোমের বিক্রি দ্বিগুণ হয়ে যায়।

১৯৩০ সালে অ্যাংলিকান চার্চের ল্যামবেথ কনফারেন্সে বিবাহিত দম্পতির ক্ষেত্রে জন্মনিরোধক ব্যবহারে অনুমোদন জানানো হয়। ১৯৩১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ চার্চেস একটি অনুরূপ বক্তব্য জানায়। রোমান ক্যাথলিক চার্চ এর প্রতিক্রিয়ায় ‘Casti Connubii’ নামে একটি এনসাইক্লিকাল (সমগ্র বিশ্বে রোমান ক্যাথলিক বিশপদের প্রেরিত পোপের চিঠি) জারি করে সকল প্রকার জন্মনিরোধ ব্যবহারের বিরুদ্ধে রোমান ক্যাথলিক চার্চের কড়া অবস্থানের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। এই চার্চ অদ্যাবধি এই অবস্থান থেকে সরে আসেনি। ১৯৩০-এর দশক থেকেই কন্ডোমের উপর থেকে আইনি বিধিনিষেধ শিথিল করা হতে থাকে। তবে ফ্যাসিবাদী ইতালি ও নাৎসি জার্মানিতে কন্ডোমের উপর বিধিনিষেধ বৃদ্ধি করা হয় (যদিও রোগ প্রতিরোধে কন্ডোমের ব্যবহার তখনও অনুমোদিত ছিল)। মহামন্দার সময় সৃক্সিডের কন্ডোম জনপ্রিয়তা অর্জন করে। স্ ডি সিমেন্ট-ডিপিং পদ্ধতিতে কন্ডোম প্রস্তুত করত। তরুক্ষীর কন্ডোমের তুলনায় এই জাতীয় কন্ডোমে দুটি অধিক সুবিধা পাওয়া যেত। প্রথমত, সিমেন্ট-ডিপড কন্ডোমের সঙ্গে তৈলমিশ্রিত লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা যেত এবং দ্বিতীয়ত পুরোনো রবারের কন্ডোম পুনর্ব্যবহারযোগ্য ছিল, যা সেই মন্দার বাজারে অনেকের ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে সুবিধাজনক প্রতিপন্ন হয়। ১৯৩০-এর দশকে মানের দিকটিতেও গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সেদেশে বিক্রিত কন্ডোমের মান নিয়মিত করতে শুরু করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কন্ডোম শুধুমাত্র মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেনা জওয়ানদের মধ্যে বিতরণই করা হয় না, বরং চলচ্চিত্র, পোস্টার ও লেকচারের মাধ্যমে কন্ডোমের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হতে থাকে। ইউরোপীয় ও এশীয় সকল পক্ষের সামরিক বাহিনীগুলি যুদ্ধ চলাকালীন আগাগোড়াই সেনাবাহিনীতে কন্ডোমের সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। এমনকি জার্মানিতে ১৯৪১ সালে সকল নাগরিকের কন্ডোম ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও সেনা জওয়ানদের কন্ডোম ব্যবহারে ছাড় দেওয়া হয়। অন্যদিকে কন্ডোম সহজলভ্য ছিল বলে সেনারা যৌনসঙ্গম ছাড়াও অন্যান্য কাজে কন্ডোম ব্যবহার করতে শুরু করে। এই রকম কিছু ব্যবহার অদ্যাবধি প্রচলিত রয়েছে।

যুদ্ধের পরেও কন্ডোমের বিক্রি বাড়তে থাকে। ১৯৫৫-১৯৬৫ সময়কালের মধ্যে আমেরিকার প্রজননশীল জনসংখ্যার ৪২ শতাংশই জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য কন্ডোমের উপর নির্ভর করতেন। ১৯৫০-১৯৬০ সময়কালের মধ্যে ব্রিটেনে ৬০ শতাংশ বিবাহিত দম্পতি কন্ডোম ব্যবহার করতেন। ১৯৬০ সালে বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি জন্মনিয়ন্ত্রণের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় পন্থায় পরিণত হয়। কিন্তু কন্ডোম শক্তিশালী দ্বিতীয় বিকল্প হয়ে থেকেই যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশানাল ডেভেলপমেন্ট উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা সমাধানার্থে কন্ডোম ব্যবহারের দিকে ঠেলে দিতে থাকে। ১৯৭০ সালের মধ্যে ভারতে লক্ষাধিক কন্ডোম প্রতি বছর ব্যবহৃত হতে থাকে। (সাম্প্রতিক দশকগুলিতে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে: ২০০৪ সালে ভারত সরকার পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকে বিতরণার্থে ১.৯ বিলিয়ন কন্ডোম ক্রয় করে।)

১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মানের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হয়। কন্ডোম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনি বাধাগুলিও বহুলাংশে অপসারিত হয় এই সময়। ১৯৭৮ সালে আয়ারল্যান্ডে প্রথম আইনসম্মত কন্ডোম বিক্রি হয়। অবশ্য কন্ডোমের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে আইনি বাধা কিছু থেকেই যায়। ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে আমেরিকার ন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্রডকাস্টার্স জাতীয় টেলিভিশনে কন্ডোমের বিজ্ঞাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নীতি ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল।

১৯৮০-এর দশকে জানা যায় যে, এইডস একটি যৌনব্যাধিও হতে পারে। এরপর থেকেই এইচআইভি প্রতিরোধকল্পে কন্ডোমের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হতে থাকে। কিছু রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য ব্যক্তিত্বের বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে জাতীয়স্তরে কন্ডোম ব্যবহারকে উৎসাহ দিতে প্রচারাভিযান চালানো হতে থাকে। এই সমস্ত প্রচারাভিযানের ফলে কন্ডোমের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এই মুহূর্তে কন্ডোমের বাজার তুঙ্গে। আর এটা সম্ভব হয়েছে এইডস প্যানিককে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রোপাগান্ডার ফলেই, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বৃহত্তর সামাজিক স্বীকৃতির ফলে বিভিন্ন ধরনের পাইকারে দোকানে কন্ডোম বিক্রি শুরু হয়ে যায়। এই সব দোকানের মধ্যে সুপারমার্কেট ও ওয়াল-মার্টের মতো ডিসকাউন্ট ডিপার্টমেন্ট স্টোর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কন্ডোমের ব্যবহার বাড়তে থাকে। এরপরই গণমাধ্যমগুলি এইডস রোগাক্রান্তের সংখ্যাহ্রাসের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপরই রোগ প্রতিরোধক হিসাবে কন্ডোমের ব্যবহার আকস্মিকভাবে হ্রাস পায়। এই ঘটনাকে কন্ডোম অবসাদ’ বলে উল্লেখ করা হয়। পর্যবেক্ষকরা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা উভয় অঞ্চলেই এই কন্ডোম অবসাদের ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন। এরপর থেকেই কন্ডোম উৎপাদকরা তাঁদের বিজ্ঞাপনের সুর বদলে ভয়াল বিজ্ঞাপনের বদলে মজার বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে। এরপর কন্ডোমের বাজারে বেশ কিছুটা নতুন উন্নতির ঘটনা ঘটে। ১৯৯০-এর দশকে ডুরেক্স কন্ডোমের উৎপাদক সংস্থা অবন্তী নামের ব্র্যান্ডে প্রথম পলিআরথিন কন্ডোম বাজারে ছাড়ে। ২০০৩ সালে দেফিট নামে প্রথম কাস্টম সাইজ-টু-ফিট কন্ডোম বাজারে আসে। মনে করা হচ্ছে সারা বিশ্ব কন্ডোমের ব্যবহার বাড়তেই থাকবে। একটি সমীক্ষার মতে ২০১৫ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলির ১৮.৬ বিলিয়ন কন্ডোম প্রয়োজন হবে। বর্তমানে কন্ডোম আধুনিক সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।

২০১০ সালের মার্চ মাসে সুইজারল্যান্ড সরকার ঘোষণা করেছে যে, তারা ১২-১৪ বছরের পুরুষের জন্য ছোটো আকারের কন্ডোম প্রস্তুত করবে। এই কন্ডোমের নাম রাখা হয়েছে হটশট। সেদেশের সরকারি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বারো থেকে চোদ্দো বছর বয়সি ছেলেরা যৌনসঙ্গমের সময় যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরোধক ব্যবহারের সুযোগ পায় না। একটি প্রমাণ আকারের কন্ডোমের ব্যাস ২ ইঞ্চি (৫.২ সেন্টিমিটার); কিন্তু হটশটের ব্যাস ১.৭ ইঞ্চি (৪.৫ সেন্টিমিটার)। তবে উভয় প্রকার কন্ডোমের দৈর্ঘ্য একই থাকবে–৭.৪ ইঞ্চি (১৯ সেন্টিমিটার)। একটি জার্মান সমীক্ষায় দেখা গেছে ১২,৯৭০ জন ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সিদের দলে এক-চতুর্থাংশেরই বক্তব্য প্রমাণ আকারের কন্ডোম বেশ বড়ো। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের সরকারি গবেষণা ও বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পারসোন্যালিটি সাইকোলজির গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে পরিবার পরিকল্পনা গোষ্ঠীগুলি এবং সুইস এইডস ফেডারেশন হটশট উৎপাদনের সপক্ষে প্রচার চালায়। কন্ডোম উপাদানের বিবর্তন—রবার ১৮৫৫, ল্যাটেক্স ১৯২০, পলিআরথিন ১৯৯৪, পলিআইসোপ্রিন ২০০৮। কন্ডোম বিজ্ঞানের একটা বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যা গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডসের মতো ভয়ংকর ধরনের যৌনরোগ থেকে মুক্ত পৃথিবী উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে। বাধ্যতামূলকভাবে কন্ডোমের ফলে দুটি কারণে যৌনকর্মীদের বাজার এখন নিরাপদ ও রমরমা। (১) বাধ্যতামূলক কন্ডোমের ব্যবহারে ভয়ংকর যৌনরোগের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এবং (২) গর্ভবতী হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও নেই। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)

———–

তথ্যসূত্র–(১) কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত—বিনয় ঘোষ, (২) সংবাদপত্রে সেকালের কথা—ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, (৩) রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী—অমিত মৈত্র, (৪) সুকুমারী দত্তর অপূর্ব সতী’ নাটকের ভুমিকা—ড. বিজিতকুমার দত্ত (নাট্য আকাদেমি পত্রিকা, জানুয়ারি ১৯৯২, (৫) অন্য কলকাতা—বিশ্বনাথ জোয়ারদার, (৬) কলকাতা—শ্রীপান্থ। (৭) প্রসঙ্গ দেবদাসী—আরতি গঙ্গোপাধ্যায়, (৮) Prostitution and Its Impact on Society : A Criminological Perspective–Haveripeth Prakash, (৯) New Directions in Research on Prostitution–R. Weitzer, (১০) What makes a ‘Prostitute’ a Prostitute? Mordern Definitions and Ancient Meanings–Julia Assante, (১১) Painted Love : Prostitution French Art of the Impressionist Era–Hollis Clayson, (১২) The Sociology of Prostitution : Kingsley Davis, (১৩) Sexual Exploitation and Prostitution and its impact on Gender Equality–Erika Schulza, (১৪) Prostitution, Community and Civic Regulation in Early Modern Bologna–Vanessa Gillian McCarthy, (১৫) Trafficking in Women and Prostitution in the Baltic States : Social and Legal Aspects–International Organization for Migration, (১৬) Prostitution Online–Donna M. Hughes, (১৭) Race, Class, Gender and Deviancy : The Criminalization of Prostitution–Ann M. Lucas, (১৮) Reframing Prostitution : from discourse to description, from moralization to normalization?–Gert Vermeulen, (১৯) Decades of Reform : Prostitution, Feminists, and the War on White Slavery–Jodie Masotta, (২০) The History of Prostitution–William W. Sanger (২১) জাপানে গণিকা সংস্কৃতি–প্রবীর বিকাশ সরকার, (২২) গণিকা সম্বাদ ইতিহাস ও বহমানতা–সম্পাদনা অর্ক দেব, (২৩) উৎস মানুষ, আগস্ট ২০০৫, (২৪) টপ কোয়ার্ক, ডিসেম্বর ‘০৪–আগস্ট ‘০৫, (২৫) আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ এপ্রিল, ২০০৬, (২৬) বিকেলের প্রতিদিন, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৬, (২৭) সংবাদ এখন, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, (২৮) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ নভেম্বর, ২০১৪, (২৯) যৌনতা ও সংস্কৃতি—সুধীর চক্রবর্তী, (৩০) বেশ্যাসংগীত বাইজিসংগীত–দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, (৩১) খারাপ মেয়ের কথা–দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়, (৩২) বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ গ্রন্থ–মৌ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, (৩৩) সেকাল আর একাল–রাজনারায়ণ বসু, (৩৪) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন সমাজ–শিবনাথ শাস্ত্রী, (৩৫) হুতোম প্যাঁচার নকশা–কালীপ্রসন্ন সিংহ (৩৬) বিকিয়ে যাই–মালা দত্তরায়, (৩৭) স্নায়ুরোগ–সিগমুন্ড ফ্রয়েড, (৩৮) ফিরে দেখা–ফিরদৌস আজিম, মাহবুবা মাহমুদ, সেলিনা শেলী সম্পাদিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *