১৪. স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকা

১৪. স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকা

ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকাদের অংশগ্রহণ স্মরণীয়। স্বাধীন ভারত তাঁদের কথা ভুলে গেলেও এ প্রবন্ধকার ভোলেনি। ১৯০৭ সালে অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী যুবকদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল প্রচুর গণিকা নারী। ১৯০৭ সালের অক্টোবর মাসে অনুশীলন সমিতির যুবকেরা ঠিক করলেন সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে বিডন স্কোয়ারে একটা সভা করবেন। সভা শুরু হল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। আর তারপরেই শুরু হল পুলিশের লাঠিচার্জ। বিপ্লবী যুবকেরা ইট-পাথর ছুঁড়ে পাল্টা আক্রমণ চালাল। আর সেই সময় দেখা গেল চিৎপুরের বাড়ির ছাদ, বারান্দা, জানালা থেকে গণিকা নারীরা পুলিশের উপর ইট ছুঁড়ে তাঁদের তাড়িয়ে দিচ্ছে।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ সালে কলকাতার গণিকা নারীরা আন্দোলনের জন্য অর্থসংগ্রহের কাজে অংশগ্রহণ করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি সোনাগাছি অঞ্চলের গণিকাদের নিয়ে সভা করেন। এর পরের বছর বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যেও পথে নেমেছিল গণিকারা। ত্রাণের জন্য যে রিলিফ কমিটির গঠিত হল ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’, যার সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাস, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার প্রমুখ। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বেঙ্গল রিলিফ কমিটি ১ লাখ টাকার ও বেশি সংগ্রহ করতে পেরেছিল। মানদাদেবীর লেখা বই থেকে জানা যায় সেই সময় ‘পতিতা সমিতি গঠিত হয়েছিল। তাঁরা লালপাড় শাড়ি পরে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা লাগিয়ে গান গেয়ে টাকা তুলেছিলেন বন্যার্তদের জন্য মাসিক বসুমতিতে এই নিয়ে একটি রচনা লেখা হয়। সংগৃহীত অর্থ তাঁরা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের হাতে তুলে দিয়েছিল। পিতৃস্নেহে ‘এসো এসো মা লক্ষীরা’ বলে আচার্য তাঁদের আহ্বান করেন এবং তাঁরা এই অকৃত্রিম স্নেহ দেখে আপ্লুত হয়ে যান। বরিশালেও পতিতা সমিতি গড়ে ওঠে। তাঁর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গান্ধীবাদী শরকুমার ঘোষ।

১৯২৪ সালে গণিকা নারীরা তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং চিত্তরঞ্জন দাস। বাংলার ভদ্র সমাজ এই নিয়ে আবার তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। প্রবাসী’ পত্রিকা এই নিয়ে প্রতিবাদ করেন, কেন গণিকা নারীরা সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করছে। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাস প্রয়াত হলে তাঁর মরদেহ নিয়ে যে বিরাট মিছিল হয়েছিল সেই মিছিলে পা মেলান গণিকারা। ১৯৩০ মেদিনীপুরে নন্দীগ্রামে সত্যবতী নামে একা গণিকা নারী লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করে পুলিশ দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। তমলুকে ৪২-এর আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত কয়েকজন বিপ্লবীর প্রাণ বাঁচিয়েছিল এক গণিকা নারী। এক সংগ্রামী মিটিংয়ে মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট পেডি সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন। পেডি আদেশ দিলেন—“১৪৪ ধারা জারি আছে, মিটিং করা যাবে না”। বিপ্লবী জ্যোতির্ময়ী দেবী পুলিসের বাধা অগ্রাহ্য করে জনতাকে আহ্বান করে বললেন–“যারা বুকের রক্ত দিতে প্রস্তুত আছেন তারা এই সভায় এগিয়ে আসুন। যারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবেন তাঁরা ফিরে যান।” এই আহ্বান শুনে সাবিত্রী নামে তমলুকের এক সালঙ্কারা পরমাসুন্দরী ষোড়শী গণিকা নারী এগিয়ে বললেন—“আমরা বুকের রক্ত দেব। কিন্তু পৃষ্ঠপ্রদর্শন করব না।”

বঙ্গদেশে তুমুল ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলেও তথাকথিত ভদ্রঘরের মেয়েরা সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি সে সময়। মূলত পুরুষদের মধ্যেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকলেও মেয়েরা যে আসেনি তা কিন্তু নয়। যৌনপল্লির মেয়েরাই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। বিশেষ করে চিৎপুরের যৌনকর্মীরা ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে। রুখে দাঁড়িয়েছিল।

যৌনকর্মীদের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চমকে দিয়েছিল। মেয়েরা যে এভাবে এগিয়ে আসবেন তাঁরা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বিপ্লবীরা যৌনপল্লিতে আত্মগোপন করত কোনো যৌনকর্মীর ঘরে। যৌনকর্মীরাও তাঁদের শেল্টার দিতে আপত্তি করত না। শুধু শেল্টার দিত তাই নয়, তাঁদের উপার্জিত অর্থ নিজেদের স্বর্ণালংকার বিপ্লবীদের হাতে তুলে দিত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য।

‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত গ্রন্থ থেকে মানদা দেবীর বর্ণনায় জানা যায়–আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিছিলে হাঁটা, ত্রাণের টাকা তোলা বারাঙ্গনা নারীরা করতেন। তাঁরা গান গেয়ে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বিপ্লবী আন্দোলনে সামিল হতেন। প্রাণমন সঁপে দিয়ে করতেন। ১৯২৯ সালে অসহযোগ আন্দোলনেও গণিকাদের অংশগ্রহণ ছিল।

তবে ভদ্রসমাজের একটা অংশ গণিকাদের এই অংশগ্রহণ মেনে নিতে পারেনি। ব্রহ্মবাদীদের এমন আচরণ দেখা গেল যখন তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে গণিকারা অংশ নিয়েছিলেন। গণিকাদের এই অংশগ্রহণ নিয়ে সেই সময়কার পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। গণিকারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কটাক্ষ করলেন। তিনি লিখলেন–“খবরের কাগজে পড়িয়াছি তারকেশ্বরে যে সকল নারী সত্যাগ্রহ করিতেছেন পতিতা নারীরাও তাঁহাদের দলভুক্ত এবং তাহারা অবাধেই সকলের সঙ্গে মিশিতেছে। … সত্য হইলে ইহা বাঞ্ছনীয় নহে। কারণ ইহাতে সামাজিক পবিত্রতা সংরক্ষিত ও বর্ধিত না পাইয়া নষ্ট হইবার সম্ভাবনাই বেশি।” এমনকি মহাত্মা গান্ধিও গণিকাদের অংশগ্রহণ ভালো চোখে দেখেনি। সে সময় কমলকুমার মিত্র তাঁর সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় লিখলেন–“প্রকৃতপক্ষে কতকগুলি বেশ্যা, বাগদি, ডোম প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির স্ত্রীলোক দ্বারা এই দল গঠিত।  বেশ্যা ও অপর শ্রেণির স্ত্রীলোকদের ভলান্টিয়ার করা ভালো হয় নাই।” অবিনাশ নামে এক বিপ্লবী ভদ্রলোক যৌনপল্লিতে ঢুকেছিলেন যৌনকর্মীদের কাছ থেকে আন্দোলনের জন্য চাঁদা তুলতে। যৌনকর্মীরা একবাক্যে রাজি হয়ে যান চাঁদা দিতে। সেই বার্তা বিপ্লবী অশ্বিনী দত্ত ও প্রমথনাথ মিত্রকে জানানো হলে তাঁরা যৌনকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ায় আপত্তি তোলেন। এই রক্ষণশীলতার কারণে আর চাঁদা তোলা সম্ভব হয়নি।

সেই সময়কার বিমলা নামের গণিকার কথা জানা যায়, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ব্রিটিশদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। চিৎপুরের গণিকা ছিলেন বিমলা। সেই পেশা ত্যাগ করে দেশের কাজে পাকাপাকিভাবে ব্রতী হন। তিনি যেমন শিক্ষিতা ছিলেন, তেমনি ছিলেন রূপবতী। বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষাতে কথা বলাতে যথেষ্ট সাবলীল ছিলেন। যে-কোনো ভাষাতেই অসাধারণ বক্তৃতা দিতে পারতেন।

মহিলাদের এক ব্রিটিশ বিরোধী জনসভা হচ্ছিল। সেই জনসভায় বিশাল পুলিশবাহিনী উপস্থিত জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘোড়া-পুলিশের দল জমায়েতের ভিতর ঘোড়া ছুটিয়ে তাণ্ডব শুরু করে দিল। সেসময় মঞ্চে ঝাঁঝালো বক্তৃতা দিচ্ছিলেন চিৎপুরের গণিকা বিমলা দেবী। বিমলা দেবী ছুটে গিয়ে এক পুলিশ সার্জেন্টের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন এবং বলেন–“Are you not born of a woman? How do you beat your mothers and sisters?” সেদিন রণচণ্ডী বিমলার তেজ ও সাহসিকতার সামনে পুলিশ হঠে যেতে বাধ্য হয়। এ ঘটনার সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। তিনি বিমলা দেবীর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন–“সাবাস। কে বলে তুই অবজ্ঞার পাত্রী! তোর মধ্যে আজ আদ্যাশক্তি মহিষাসুরমর্দিনীর বিভূতি দেখলুম।”

আন্দোলনের একটা সময়ে এসে বিপ্লবীরা নরমপন্থী ও চরমপন্থী হিসাবে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে। আন্দোলনে অভিমুখ ক্রমশ বদলাতে থাকল। ভদ্রসমাজ গণিকা দেশপ্রেমীদের উপেক্ষা করতে থাকল। দেশের কাজ করতে গিয়ে বারবার বাধা পেতে থাকেন। অবশেষে বিমলাকে পুনরায় গণিকাজীবনে ফিরে আসতে হয়। ফিরে আসতে বাধ্য হয়। গণিকাজীবন শুরু করলেও দেশের কাজ থেকে তিনি কোনোদিন বিরত থাকতে পারেননি। শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, বিমলা কীভাবে এক বেকার কংগ্রেসকর্মীকে স্নেহ দিয়ে অর্থের জোগান দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এক বিপ্লবীর আত্মগোপন করে থাকার সময়ে সমস্ত খরচ জুগিয়েছিলেন বিমলা। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে সুমিত্রা চরিত্রটি কী বিমলারই প্রতিচ্ছবি? অনেকে তেমনটাই মনে করেন।

১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর জালালাবাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ব্রিটিশদের মধ্যে। এই যুদ্ধে শহিদ হন ৯ জন বাঙালি বিপ্লবী। এর মধ্যে একজন ছিলেন বিপ্লবী অর্ধেন্দু দস্তিদার। অর্ধেন্দু দস্তিদার ঘটনাস্থলে ভয়ানকভাবে জখম হন। সেই অবস্থায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কোনোরূপ চিকিৎসা না করে তাঁকে জেরায় জেরায় জেরবার করে তোলা হয়। অবশেষ বিপ্লবী অর্ধেন্দু মারা যান। বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মুক্তিসংগ্রামে অন্তঃপুরবাসিনী ও বারাঙ্গনাগণ’ নিবন্ধে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বয়ানে লিখলেন–“মৃতদেহ শ্মশানে রেখে তখন অর্ধেন্দুর ডাক্তারকাকা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করছেন। তখন তিনি দেখলেন শ্মশানের গেটে একটি ঘোড়ার গাড়ি থামল এবং তা থেকে নামল চারজন নারী। কাছে এগিয়ে এলে দেখা গেল তাঁরা শহরের বারাঙ্গনা। তিনি তাঁদের ওখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বলল তাঁরা দেবতা দেখতে এসেছেন। তাঁদের শাড়ির মধ্যে লুকানো দুধের বোতলগুলি আর ফুলের তোড়া বের করে তাঁরা বলে–‘এই দুধ দিয়ে ওই দেবতার মৃতদেহ আমরা স্নান করাতে চাই। তারপর ফুলগুলি দিয়ে ফিরে যাব। শহিদ অর্ধেন্দু দস্তিদারের পিতৃব্য পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁদের অনুমতি দিয়েছিলেন।

1 Comment
Collapse Comments

অজানা ইতিহাস জেনে খুব ভালো লাগছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *